প্রেম ও কলেরা – ৮

কলেরা মহামারী শুরু হবার দু’সপ্তাহ পরে ওই সমাধিস্থলে আর মৃতদেহের স্থান সঙ্কুলান হল না। গির্জাগুলিতেও আর জায়গা ছিল না, যদিও অনেক অনামভ নাগরিক বীরের ধ্বংসপ্রাপ্ত দেহাবশেষ সাধারণ অস্থিসংরক্ষণাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ক্যাথিড্রালের নিচে ভূগর্ভস্থ সমাধিস্থানগুলি ভালো করে সিলগালা দিয়ে বন্ধ না করার জন্য সেখান থেকে ভাঁপ উঠে উপরের বাতাসকে অদ্ভুত রকম হাল্কা করে দিয়েছিল আর তিন বছর অতিক্রান্ত হবার আগে ওর দরজাগুলি খোলা হয় নি। আর ওই সময়েই মধ্য রজনীর উপাসনার পর গির্জা ত্যাগ করার সময় ফারমিনা ডাজা খুব কাছ থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে প্রথম দেখতে পায়। তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ কনভেন্ট অব সেইন্ট ক্লেয়ারের ভেতরের সব জায়গা থেকে শুরু করে পপলার বৃক্ষ শোভিত রাস্তাগুলি পর্যন্ত পূর্ণ হয়ে যায়, এবং তখন একটা সমাধিক্ষেত্রের চাইতেও দ্বিগুণ বড় সর্বসাধারণের ফলের বাগানটি ব্যবহার করার দরকার পড়ে। তিন স্তরে মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য তিনটির মতো গভীর করে কবর খোঁড়া হল, দেরি না করে এবং কফিন ছাড়াই, কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে ফুলে ওঠা মাটির নিচ থেকে স্পঞ্জের মতো রক্ত কাদা উঠে আসতে দেখা গেলে ওই প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন নগরী থেকে মাইল তিনেকের কম দূরত্বে অবস্থিত দি হ্যান্ড অব গড নামক একটা গরুমহিষের খামারে মৃতদেহগুলি সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করা হয়, পরে এর নামকরণ করা হয় সর্বজনীন সমাধিক্ষেত্র।

কলেরার ঘোষণা প্রচারের পর থেকে স্থানীয় সেনা নিবাস থেকে পনেরো মিনিট পর পর, দিন-রাত, কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হতে থাকে। এর মূলে ছিল একটা স্থানীয় কুসংস্কার, বারুদ নাকি আবহাওয়াকে পরিশুদ্ধ করে। কলেরার ধ্বংসযজ্ঞ সব চাইতে বেশি ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মধ্যে, তারাই ছিল সংখ্যায় বেশি এবং দরিদ্রতরও, কিন্তু আসলে কলেরা বর্ণ কিংবা পটভূমি কোনো কিছুই বিবেচনায় আনে নি। তারপর এক সময়, যেমন হঠাৎ কলেরা শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎই তা থেমে গেল, কিন্তু এর যথার্থ ক্ষতির পরিমাণ কখনোই জানা যায় নি, তা নির্ধারণ করা অসম্ভব ছিল সে জন্য নয়, তার মূলে ছিল আমাদের অন্যতম একটি গুণ, ব্যক্তিগত দুঃখ দুর্দশার কথা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাদের সুস্পষ্ট অনিচ্ছা।

জুভেনালের বাবা ডাক্তার মার্কো অরেলিও উরবিনো ওই দুর্যোগকালে ছিলেন একজন নাগরিক বার আবার তার সব চাইতে বিখ্যাত শিকারও। সরকারি আদেশক্রমে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা পরিচালনা করেন কিন্তু প্রতিটি সামাজিক প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব উদ্যোগ এতটাই প্রবল ও প্রধান হয়ে ওঠে যে মহামারীর সর্বাপেক্ষা সঙ্কটজনক মুহূর্তগুলিতে, মনে হল, উচ্চতর কোনো কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব আর নেই। অনেক বছর পরে, ওই সময়ের কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনে নিঃসংশয়ে উপলব্ধি করলেন যে তাঁর বাবার পদ্ধতি ততটা বৈজ্ঞানিক ছিল না যতটা ছিল মমতা ও করুণাজাত এবং যুক্তির প্রতিকূল মনে হলেও, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা মহামারীর প্রকোপকে বাড়িয়েই দিয়েছিল। জীবন যে সব পুত্রদের, একটু একটু করে, পিতাদের পিতায় রূপান্তরিত করে, তাদের মমতা দিয়ে তা তিনি উপলব্ধি করলেন এবং কেন তিনি তাঁর বাবার ওই নিঃসঙ্গ ভ্রান্তির সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান নি সেজন্য গভীর দুঃখ বোধ করলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বাবার গুণাবলী উপলব্ধি করতেও ভুল করলেন না : তাঁর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম, তাঁর আত্মত্যাগ, সর্বোপরি তাঁর ব্যক্তিগত সাহস। দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার পর নগরবাসী তাঁকে বহু সম্মানে বিভূষিত করে এবং অনেক কম সম্মানজনক যুদ্ধের অনেক বীরের নামের সঙ্গে তাঁর নামও যে যোগ করা হয় তাও ছিল ন্যায়সঙ্গত।

নিজের গৌরব দেখে যাবার জন্য তিনি বেঁচে ছিলেন না। যে অমোঘ অপরিবর্তনীয় উপসর্গসমূহ তিনি অন্যদের মধ্যে দেখেছেন তা দেখে তাদের করুণা করেছেন এক সময় তিনি যখন তা তাঁর নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন তখন তিনি তার বিরুদ্ধে নিরর্থক কোনো যুদ্ধ করার চেষ্টাও করলেন না, তিনি পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন যেন অন্য কাউকে তিনি সংক্রমিত না করেন। মিসেরিকর্ডিয়া হাসপাতালের বিবিধ সামগ্রীর একটি কক্ষে তিনি নিজেকে তালাবদ্ধ করে রাখলেন, তাঁর সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের ডাকাডাকি ও মিনতিতে কর্ণপাত করলেন না, বাইরের বারান্দায় গাদাগাদি করে পড়ে থাকা মহামারীর শিকারদের মৃত্যুবরণের ভয়াবহতা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের উদ্দেশে এক আবেগঘন পত্র লিখলেন, তাঁর অস্তিত্বের জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন, জীবনকে তিনি কতোখানি এবং কী প্রবল ঔৎসুক্য ও আগ্রহের সঙ্গে ভালোবেসেছিলেন সে কথা বললেন। বিশটি হৃদয় বিদারক পাতায় এটা ছিল একটা বিদায় সম্ভাষণ এবং হাতের লেখার ক্রমাবনতি থেকে ব্যাধির অগ্রগতি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, লেখক যে তাঁর নামটি নিজের শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে লিখেছিলেন তা বুঝবার জন্য পত্রলেখকের পরিচয় জানার কোন দরকার ছিল না। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর ছাইবর্ণ ধারণ করা মরদেহ সর্বজনীন সমাধিক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে মিশে যায়, তাঁর কোনো প্রিয়জন তা দেখে নি।

তিন দিন পর ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো যখন পারীতে তাঁর বন্ধুদের নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন তখন তিনি তারবার্তাটি পান। পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শ্যাম্পেন পানের পর তিনি বলেন, ‘তিনি একজন ভালো লোক ছিলেন’ পরে পরিপক্বতার অভাবের জন্য তিনি নিজেকে তিরস্কার করেন : পাছে কেঁদে ফেলেন সেজন্য তিনি বাস্তবতাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে তিনি বাবার মরণোত্তর চিঠির একটি প্রতিলিপি পান এবং তখন তিনি সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। অকস্মাৎ, মুহূর্তের মধ্যে, অন্য কোনো মানুষকে চেনার আগে তিনি যে মানুষটিকে চিনেছিলেন, সমস্ত বিশালতা নিয়ে সে মানুষটির মূর্তি তাঁর সামনে ভেসে উঠলো, সেই মানুষটি যিনি তাঁকে বড় করেছেন, পড়ালেখা শিখিয়েছেন, যিনি বত্রিশ বছর ধরে তাঁর মায়ের শয্যাসঙ্গী হয়েছেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গম করেছেন, তবু, এই চিঠি লেখার আগে পর্যন্ত যিনি নিছক সঙ্কোচ ও ভীরুতার জন্য নিজেকে তাঁর দেহ-মন- আত্মা দিয়ে কখনো প্রকাশ করেন নি। তখন পর্যন্ত ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুকে দেখে এসেছেন একটা দুর্ভাগ্য রূপে যা অন্যদের ওপর আপতিত হয়, অন্য লোকদের বাবা আর মা, অন্য লোকদের ভাই-বোন আর স্বামী আর স্ত্রীরা মৃত্যুর শিকার হয়, তাঁদের কেউ না। ওই সব লোকের জীবন ছিল মন্থর, তারা যে বৃদ্ধ হচ্ছেন, রোগে পড়ছেন, মারা যেতে বসেছেন এটা তারা লক্ষ করতেন না, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা যথাসময়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন, রূপান্তরিত হতেন স্মৃতিতে, অন্য দিনের কুয়াশায়, তারপর তারা এক সময় ডুবে যেতেন বিস্মৃতির অতলে। দুঃসংবাদ বহনকারী তারবার্তার চাইতেও বাবার মরণোত্তর চিঠি তাঁকে মৃত্যুর অমোঘ নিশ্চয়তার মধ্যে সজোরে ছুড়ে ফেললো। অথচ তার বহুকাল আগের একটা স্মৃতি আছে, তাঁর বয়স তখন সম্ভবত নয়, কিংবা এগারো, তখন তিনি একদিন তাঁর বাবার মধ্য দিয়েই মৃত্যুর প্রথম চিহ্ন দেখতে পান। বিকাল বেলা, বৃষ্টি পড়ছে, বাড়িতে বাবার যে অফিস ঘর ছিল তারা দুজন সেখানে বসে আছেন; তিনি রঙিন চক দিয়ে টালি বাঁধানো মেঝেতে চাতক পাখি আর সূর্যমুখী ফুল আঁকছেন, আর বাবা জানালা দিয়ে আসা আলোয় কি একটা পড়ছেন, তাঁর জামার বোতাম খোলা, ইলাস্টিকের বাহুবন্ধনী শার্টের হাতার উপর নেমে এসেছে। তিনি হঠাৎ পড়া বন্ধ করে একটা কালো রঙের লম্বা পিঠচুলকানোর দণ্ড হাতে তুলে নিলেন, ওটার শেষ প্রান্তে লাগানো ছিল ছোট্ট রুপালি একটা হাত, কিন্তু যে জায়গাটা চুলকাচ্ছিল সেখানে তিনি পৌঁছুতে পারছিলেন না, তখন তিনি ছেলেকে তার নখ দিয়ে জায়গাটা চুলকে দিতে বলেছিলেন, আর ছেলেটি যখন কাজটা করছিল তখন তার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল, তার নিজের শরীরের সমস্ত বোধ যেন তখন অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বাবা বিষণ্ণ হাসি হেসে কাঁধের উপর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এখন মরে গেলে তুমি যখন আমার বয়েসী হবে তখন তুমি আমার কথা খুব সম্ভব মনেই করতে পারবে না।

আপাতবোধ্য কোনো কারণ ছাড়াই তিনি কথাটা বলেছিলেন। মৃত্যুর দেবদূত তখন এক মুহূর্তের জন্য ঠাণ্ডা ছায়াচ্ছন্ন অফিস ঘরটিতে একটা চক্কর দেয়, তারপর জানালাপথে উড়ে বেরিয়ে যায়, পেছনে ফেলে রেখে যায় কয়েকটা কম্পমান পালকের চিহ্নরেখা, কিন্তু বালকটি তা দেখতে পায় নি। তারপর বিশ বছর পার হয়ে গেছে। সেই অপরাহ্নে জুভেনাল উরবিনোর বাবার বয়স যা ছিল অল্প কিছু কালের মধ্যে তিনিও সেই বয়সে উপনীত হবেন। তিনি যে হুবহু তাঁর বাবার মতো দেখতে সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন, এখন তার সঙ্গে আরেকটা ভয়ঙ্কর সচেতনতা যুক্ত হল, তিনিও তাঁরই মতো মরণশীল।

কলেরা তাঁর দিন রাত্রির ধ্যান হয়ে উঠলো। পড়াশোনা করার সময় একটি প্রান্তীয় পাঠক্রমে তিনি এ সম্পর্কে সাধারণ ভাবে যা শিখেছিলেন তার চাইতে বেশি কিছু তিনি জানতেন না। তখন তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে মাত্র ত্রিশ বছর আগে ফ্রান্সে, পারী সহ, একশো চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ কলেরায় প্রাণ হারায়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর, যেন প্রায়শ্চিত্ত করে তাঁর স্মৃতিকে তৃপ্তি দেবার জন্য, তিনি বিভিন্ন জাতের কলেরা সম্পর্কে জ্ঞাতব্য সব কিছু জানলেন, তাঁর সমকালের সব চাইতে বিখ্যাত মহামারী বিশেষজ্ঞ, ‘কর্ডন স্যানিটেয়ারের’ স্রষ্টা, বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের বাবা, প্রফেসর অ্যাড্রিয়েন গ্রুস্তের অধীনে এ বিষয়ে পড়াশোনা করলেন। তাই তিনি যখন স্বদেশে ফিরে এলেন, সাগরের বুকে থাকতেই বাজারের পচা দুর্গন্ধ নাকে পেলেন, তারপর নর্দমাগুলির মধ্যে দেখলেন ইঁদুরের রাজত্ব আর রাস্তায় জমে যাওয়া জলকাদার মধ্যে ন্যাংটা ছেলেপেলেদের গড়াগড়ি যেতে দেখলেন, তখন ট্র্যাজেডিটা যে কেমন করে ঘটলো শুধু তাই বুঝলেন না, যে কোনো মুহূর্তে যে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে সে বিষয়েও সুনিশ্চিত হলেন।

আর ওই মুহূর্তটি আসতে বেশি সময় নিল না। বছর না পেরুতেই মিসেরিকর্ডিয়া হাসপাতালের তাঁর ছাত্ররা এক দাতব্য রোগীর চিকিৎসার বিষয়ে তাঁর সাহায্য চাইলো, রোগীর সারা শরীর একটা অদ্ভুত নীল রঙে ছেয়ে গেছে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো দরজার বাইরে থেকেই শত্রুকে চিনতে পারলেন। ভাগ্য তাঁদের পক্ষে ছিল, এই রোগী মাত্র তিন দিন আগে কুরাসাও থেকে একটি জাহাজে করে এখানে আসে, তারপর নিজে নিজেই হাসপাতালের ক্লিনিকে এসে হাজির হয়, মনে হয় না যে সে ইতিমধ্যে অন্য কাউকে সংক্রমিত করেছে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো তাঁর সহকর্মীদের সতর্ক করে দিলেন, পার্শ্ববর্তী বন্দরগুলিকে সাবধান করে দিলেন তারা যেন সংক্রমিত জাহাজটিকে খুঁজে বের করে সেটাকে কোয়ারান্টাইনে রাখে। নগরীর মিলিটারি কমান্ডার সামরিক আইন জারির কথা বললেন, পনেরো মিনিট পর পর কামান দেগে বায়ু বিশুদ্ধ করতে চাইলেন, কিন্তু ডাক্তার উরবিনো তাঁকে নিরস্ত করে সহাস্যে বললেন, ‘উদারপন্থীদের জন্য আপনার বারুদ সংরক্ষণ করুন, খামোখা খরচ করবেন না। আর, শুনুন, আমরা আর এখন মধ্যযুগে বাস করছি না।’

চার দিনের দিন রোগীটি মারা গেল। দানা দানা সাদা বমিতে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। তবে সতর্ক চোখ রাখা সত্ত্বেও পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে আর কোনো কলেরা রোগীর খবর পাওয়া যায় নি। কিন্তু এর অল্পকাল পরেই ‘বাণিজ্য দৈনিক’ পত্রিকায় একটা খবর প্রকাশিত হল, নগরীর দুটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কলেরায় দুজন শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল একজনের কলেরা নয়, সাধারণ আমাশয় হয়েছিল, তবে দ্বিতীয় জন মনে হল কলেরারই শিকার হয়। সে ছিল পাঁচ ভাই বোনের একজন, পাঁচ বছর বয়সের একটি মেয়ে। তার মা-বাবা ও তিন ভাইকে আলাদা করে পৃথক পৃথক কেয়োরানটাইনে রাখা হল এবং গোটা পাড়াটার উপর কঠোর মেডিক্যাল তত্ত্বাবধায়নের ব্যবস্থা করা হল। একটি শিশু কলেরায় আক্রান্ত হয় কিন্তু সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করে, আর বিপদ কেটে গেলে পরিবারের সবাই আবার ঘরে ফিরে আসে। পরবর্তী তিন মাসে আরো এগারোটি কেস-এর খবর পাওয়া যায়, কিন্তু পঞ্চম মাসে মনে হল বেশ ব্যাপক আকারে রোগটা ছড়িয়ে পড়ছে, তবে বছরের শেষ নাগাদ দেখা গেল যে মহামারীর বিপদ সাফল্যের সঙ্গেই এড়ানো গেছে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর সাবধান বাণীর যথার্থতার চাইতেও স্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর কঠোরতাই যে এ অলৌকিক ঘটনা সম্ভব করেছিল সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। ওই সময় থেকে বর্তমান শতাব্দির অনেক দূর পর্যন্ত শুধু এই নগরীতে নয় প্রায় সমগ্র ক্যারিবীয় উপকূল অঞ্চল জুড়ে এবং ম্যাগডালেনা উপত্যকায় মাঝেই মাঝেই কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে কিন্তু তা কখনোই মহামারীর আকার ধারণ করে নি। সঙ্কটের ফলে সরকারি কর্মকর্তারা ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর সাবধানবাণী অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে শুরু করেন। তাঁরা মেডিক্যাল স্কুলে কলেরা ও পীত জ্বরের জন্য একটি বাধ্যতামূলক চেয়ার প্রতিষ্ঠা করলেন এবং খোলা নর্দমাগুলি বন্ধ করার এবং আবর্জনার স্তূপের কাছ থেকে বেশ দূরে একটি বাজার নির্মাণের আশু প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। কিন্তু ততদিনে ডাক্তার উরবিনো তাঁর বিজয় ঘোষণা নিয়ে আর ব্যস্ত ছিলেন না, তাঁর অন্যান্য সামাজিক কর্ম তৎপরতাও তিনি আর তেমন গা দিলেন না, কারণ ওই সময় তাঁর একটি ডানা ভেঙ্গে যায়, তিনি সব ব্যাপারে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন, তাঁকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, তিনি জীবনের আর সব কিছু ভুলে যেতে চান, কারণ ওই সময়ে তিনি ফারমিনা ডাজার প্রেমে পড়েন, ভালোবাসার বিদ্যুৎ শিখায় তিনি ঝলসে যান।

আসলে ব্যাপারটা ছিল চিকিৎসা সংক্রান্ত একটা ভুল। তাঁর এক চিকিৎসক বন্ধুর মনে হয় যে এক অষ্টাদশী রোগীর মধ্যে তিনি কলেরার কিছু প্রাথমিক উপসর্গ দেখেছেন, তিনি অনুরোধ করলেন ডাক্তার উরবিনো যেন তাকে একবার দেখেন। ডাক্তার উরবিনো রীতিমত আতঙ্কিত হলেন। এতদিন কলেরার আক্রমণ ঘটেছে গরিব এলাকাগুলিতে, যার প্রায় সকল অধিবাসীই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মানুষ। এবার কি তা হলে ব্যাধিটা পুরনো শহরের সুরক্ষিত অঞ্চলেও ঢুকে পড়লো? তিনি ওই দিন অপরাহ্নেই রোগীকে দেখতে গেলেন। সেখানে তিনি ভিন্ন প্রকৃতির এবং কম অপ্রীতিকর বিস্ময়ের সম্মুখীন হলেন। বাইরে থেকে ইভানজেলস পার্কের বাদাম গাছের ছায়া ঘেরা বাড়িটিকে ঔপনিবেশিক এলাকায় আর সব বাড়িগুলির মতোই মনে হল ধ্বংসের পথে, কিন্তু ভেতরে দেখা গেল সৌন্দর্যের এমন একটা সঙ্গতি ও সুষমা, এমন একটা বিস্ময়কর দীপ্তি, যা মনে হল ভিন্ন একটি যুগের। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো একটা বর্গাকার সেভিলীয় বাঁধানো উঠান, অতি সম্প্রতি সাদা চুনের প্রলেপ লাগানো হয়েছে তার ওপর। চারপাশে কমলার গাছ, সেখানে ফল ধরতে শুরু করেছে, মেঝেতে আর দেয়ালে একই ধরনের টালি। কোথাও থেকে অদৃশ্য জলধারার শব্দ ভেসে আসছে, কার্নিশে কার্নিশে দেখা যাচ্ছে কার্নেশন ফুলের টব আর চত্বরে বিচিত্র সব পাখির খাঁচা। এর মধ্যে সব চাইতে আশ্চর্যজনক ছিল মস্ত বড় একটা খাঁচায় তিনটি কাক, তারা পাখা ঝাড়া দেয়া মাত্র প্রতি বারই সমস্ত প্রাঙ্গণ একটা অদ্ভুত অপরিচিত গন্ধে ভরে যাচ্ছিল। বাড়ির অন্য কোনো অংশে কয়েকটা কুকুর বাঁধা ছিল, অপরিচিতি মানুষের গন্ধে উত্তেজিত হয়ে ওরা চিৎকার করতে শুরু করলো, কিন্তু এক মহিলার তীব্র ধমকে ওরা তৎক্ষণাৎ চুপ হয়ে গেল, অনেকগুলি বিড়াল উঠানময় লাফালাফি করতে লাগলো কিন্তু মহিলার কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠস্বর শুনে তারা দ্রুত ফুল গাছগুলির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। আর তখন পাখিগুলির বিশৃঙ্খলা আর পাথরের উপর জল পড়ার মৃদু শব্দ সত্ত্বেও সেখানে এমন একটা স্বচ্ছ নির্মল নীরবতা নেমে এলো যে সেখান থেকে সমুদ্রের নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে বলে মনে হল। ডাক্তার উরবিনোর স্থির বিশ্বাস জন্মালো যে এই গৃহে ঈশ্বর উপস্থিত আছেন এবং এখানে ওই রকম একটা ভয়ঙ্কর ব্যাধির আক্রমণ ঘটতে পারে না। তিনি গালা প্লাসিডিয়ার পেছন পেছন খিলান শোভিত বারান্দা দিয়ে অগ্রসর হলেন, যে সেলাই ঘরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রথম ফারমিনা ডাজাকে দেখে, তখনো উঠানটা পড়ে ছিল চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায়, ডাক্তার সেই সেলাই ঘরের জানালার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মার্বেলের নতুন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে রোগীর শোবার ঘরে যাবার আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু গালা প্লাসিডিয়া ওই ঘর থেকে ফিরে এসে খবর দিল, ‘সিনোরিটা বললেন যে আপনি এখন ভেতরে যেতে পারবেন না, কারণ ওঁর বাবা বাড়িতে নেই।’

অতএব, পরিচারিকার নির্দেশমত ডাক্তার আবার প্রত্যাবর্তন করলেন বিকাল পাঁচটায়, আর তখন লোরেঞ্জো ডাজা নিজে বাইরের দরজা খুলে ডাক্তারকে তাঁর কন্যার শয়নকক্ষে নিয়ে গেলেন। তিনি সেখানে এক অন্ধকার কোণায় বুকের উপর দু’হাত জড়ো করে বসে থাকলেন, মেয়ের পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নিজের অসমসৃণ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। ডাক্তার তার নিষ্কলুষ স্পর্শ নিয়ে আর সিল্কের শেমিজ পরিহিতা রোগী তার কুমারীর শিষ্টতা নিয়ে এই দুজনের মধ্যে কে যে বেশি অস্বস্তি ও বাধাগ্রস্ত মনে করছিল বলা শক্ত, কিন্তু দুজনের কেউই একে অন্যের চোখের দিকে তাকাচ্ছিলো না। ডাক্তার নৈর্ব্যক্তিক গলায় প্রশ্ন করলেন আর ও কাঁপাকাঁপা গলায় উত্তর দিল, ছায়ার মধ্যে বসে থাকা লোকটি সম্পর্কে উভয়েই ছিল সচেতন। অবশেষে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো রোগীকে উঠে বসতে বললেন এবং গভীর যত্নের সঙ্গে তার রাতকামিজটা কোমর পর্যন্ত টেনে নামিয়ে দিলেন। শয়নকক্ষের অন্ধকারের মধ্যে শিশুর মতো স্তনাগ্রসহ তার উন্নত বিশুদ্ধ স্তনযুগল বারুদের চমকানির মতো ঝলসে উঠলো, তারপরই ও দ্রুত নিজের দু’বাহু জড়ো করে উপরে তুলে তার বুক ঢেকে ফেললো, কিন্তু অবিচলিত ডাক্তার ওর দিকে না তাকিয়ে ওর বাহু দুটি খুলে দিলেন, তারপর সরাসরি ওর গায়ে কান লাগিয়ে, প্রথমে বুকে ও পরে পিঠে, ওকে পরীক্ষা করলেন।

ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো বলতেন যে যে-রমণীর সঙ্গে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর জীবনযাপন করবেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি কোন আবেগ অনুভব করেন নি। তিনি যে ওর লেস বসানো আকাশ-নীল শেমিজ, ওর জ্বরতপ্ত দুটি চোখ, কাঁধের উপর দিয়ে নেমে আসা ওর দীর্ঘ কেশরাশি দেখেছিলেন তা তাঁর মনে আছে কিন্তু ঔপনিবেশিক জেলায় কলেরা শুরু হতে পারে ওই দুশ্চিন্তায় তিনি এতো মগ্ন ছিলেন যে ওর উদ্ভিন্ন যৌবন তাঁর চোখেই পড়লো না, তিনি শুধু লক্ষ করছিলেন ওর শরীরের কোথাও ব্যাধিটির সামান্যতম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা। ফারমিনার প্রতিক্রিয়া ছিল আরেকটু স্পষ্ট। কলেরা মহামারী প্রসঙ্গে যে তরুণ ডাক্তারের কথা সে এত শুনেছে তাকে ওর মনে হল বিদ্যাভিমানী একটি মানুষ, যিনি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে অপারগ। ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে জানালেন যে খাওয়া দাওয়ার গোলমালে ওর এই অবস্থা হয়েছে, বাড়িতে তিন দিন চিকিৎসা চললেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। মেয়ের যে কলেরা হয় নি তাতে চিন্তামুক্ত হয়ে লোরেঞ্জা ডাজা ডাক্তারকে তাঁর গাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, ভিজিট হিসাবে তাঁকে একটি স্বর্ণ মুদ্রা দিলেন, বিত্তবানদের চিকিৎসক হলেও ডাক্তারের এই ফি একটু বেশি মনে হল, তারপর লোরেঞ্জা ডাজা মাত্রাতিরিক্ত রকম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ডাক্তারকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। ডাক্তারের ঐতিহ্যবাহী পরিবারিক নামের বহর দেখে তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যে সেটা শুধু গোপন রাখেন নি তাই না, ডাক্তারের সঙ্গে আবার এর চাইতে কম আনুষ্ঠানিক পরিস্থিতিতে দেখা হবার জন্য তিনি সব কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু পরের সপ্তাহের মঙ্গলবারে, তাঁকে ডেকে পাঠানো না হলেও এবং কোনো প্রকার পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই, ডাক্তার উরবিনো অপরাহ্ণ তিনটার মতো অসময়ে ফারমিনাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। ফারমিনা ডাজা তখন সেলাই ঘরে ওর দুই বান্ধবীর সঙ্গে তৈল চিত্রাঙ্কনের পাঠ নিচ্ছিল। ওই সময়ে ডাক্তার তাঁর নিখুঁত সাদা ফ্রক কোট ও সাদা টপ হ্যাটে সজ্জিত হয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে সেদিকে এগিয়ে আসার জন্য ইঙ্গিত করলেন। ও একটা চেয়ারের উপর হাতের তুলি নামিয়ে রেখে পা টিপে টিপে জানালার কাছে এগিয়ে গেলো, ওর ঝালর দেয়া স্কার্ট যেন মাটিতে ছেঁচড়ে না যায় সেজন্য তাকে একটু উঁচু করে ধরে ও সামনে এগিয়ে এলো। ওর মাথায় ছিল একটা টায়রা, সেখান থেকে একটা দামি পাথর ওর কপালের উপর এসে ঝুলে পড়েছে। পাথরটার উজ্জ্বল আভা ছিল ওর চোখেরই মতো, তেমনি দ্যুতিমায় ও সুদূর, বস্তুতপক্ষে ওর সব কিছুর মধ্যেই ছিল একটা অচঞ্চল শীতলতার আবহ। ডাক্তার ওর সাজসজ্জা দেখে একটু বিস্মিত হলেন, বাড়িতে ছবি আঁকছে অথচ মনে হচ্ছে যেন পার্টিতে যাবার জন্য তৈরি। তিনি জানালা দিয়ে ওর নাড়ি দেখলেন, ওকে জিভ দেখাতে বললেন, অ্যালুমিনিয়ামের একটা চামচ জাতীয় জিনিস বার করে সেটা দিয়ে ওর জিভ চেপে ধরে ওর গলা পরীক্ষা করলেন, ওর চোখের নিচের পাতা টেনে ধরে ভেতরটা দেখলেন, আর প্রতিবারই সন্তোষের সঙ্গে তাঁর মাথা নাড়লেন। তিনি এখন আগের বারের চাইতে কম দমিত, কিন্তু ফারমিনা আগের চাইতে বেশি, কারণ সে এই অপ্রত্যাশিত পুনপরীক্ষার কারণটা বুঝলো না, বিশেষ করে ডাক্তার নিজেই যখন বলেছিলেন যে তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখে তাঁকে ডেকে না পাঠালে তিনি আর এখানে আসছেন না। তার চাইতেও বড় কথা : ও তাঁকে আর দ্বিতীয়বার দেখতে চায় নি। তাঁর পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার জিভ চেপে ধরার চামচটা তাঁর ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন, সেখানে নানা যন্ত্রপাতি ও ওষুধের শিশি ঠাসা, তারপর তিনি সশব্দে ব্যাগটা বন্ধ করে বললেন, ‘আপনি এখন একটি সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো।’

‘ধন্যবাদ।’

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ’, এরপর ডাক্তার সন্ত টমাসের ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, মনে রাখবেন, যা কিছু ভালো, তার উৎস যাই হোক না কেন, সেটা আসে হোলি স্পিরিটের কাছ থেকে। আপনি সঙ্গীত ভালোবাসেন?

ফারমিনা পাল্টা প্রশ্ন করলো,

‘একথা জিজ্ঞাসা করার অর্থ?’

ডাক্তার বললেন, “সঙ্গীত স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।”

তিনি সত্যিই তাই মনে করতেন, আর ফারমিনা ডাজা শিগগিরই এবং ওর সারা জীবন ধরেই, দেখবে যে যখনই কোনো বন্ধুত্বের প্রস্তাব তিনি করেছেন তখনই তিনি সঙ্গীতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, কিন্তু ওই মুহূর্তে ও ভেবেছিল যে নিছক কৌতুক করেই ডাক্তার কথাটা বলেছেন। এদিকে ফারমিনার দুই বান্ধবী ছবি আঁকার ভান করলেও ডাক্তার আর ওর কথাবার্তা শুনছিলো, তাদের তুলির আড়ালে মুখ লুকিয়ে তারা খিল খিল করে হেসে উঠলো, আর এর ফলে ফারমিনা ওর আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ক্ষিপ্ত হয়ে সশব্দে জানালাটা বন্ধ করে দিল। ডাক্তার হতবুদ্ধি হয়ে জানালার মসৃণ লেসের পর্দার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাইরে যাবার পথ খুঁজলেন কিন্তু বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে গেলেন এবং এক সময় সুরভিত তিন কাকের খাঁচার সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। কাকগুলি সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলো, ভয়ে পাখা ঝাপটালো, আর ডাক্তারের কাপড় জামাকে একটা মেয়েলি সুগন্ধে ভরে দিল। এই সময় লোরেঞ্জো ডাজার বাজখাঁই কণ্ঠস্বর শুনে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন :

‘ডাক্তার, ওইখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করুন।

দোতলা থেকে লোরেঞ্জো ডাজা সব দেখেছিলেন। রাগে তার মুখ লাল হয়ে ফুলে গেছে, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে তিনি নিচে এলেন, দিবানিদ্রা ভালো হয় নি, তাঁর গালপাট্টা এলোমেলো। ডাক্তার নিজের বিব্রত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম যে আপনার মেয়ে একটি গোলাপের মতো।’

‘ঠিকই বলেছেন, তবে বড় বেশি কাঁটা আছে।’

তিনি ডাক্তার উরবিনোকে কোনো রকম সম্ভাষণ না জানিয়ে তাঁর পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে সেলাই ঘরের জানালা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিলেন, তারপর কঠোর আদেশের গলায় বললেন, ‘এখানে এসে ডাক্তার উরবিনোর কাছে ক্ষমা চাও।’

ডাক্তার তাঁকে থামাতে চেষ্টা করলেন কিন্তু লোরেঞ্জা ডাজাকে নিরস্ত করতে পারলেন না। তাঁর নির্দেশ মানতেই হবে। তিনি কড়া গলায় বললেন, “তাড়াতাড়ি কর।’ ফারমিনা ডাজা মিনতি ভরা চোখে বান্ধবীদের দিকে তাকালো, ব্যাপারটা তারা বুঝে দেখুক, তারপর রাগে ফুলতে ফুলতে, জানালার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো, ডান পা সামনে বাড়িয়ে, হাতের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে স্কার্টটা একটু উঁচু করে ধরে, নাটকীয় ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে বললো, ‘আমি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি, স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’

ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সহাস্যে ওর অনুকরণ করলেন, তাঁর টপ হ্যাট খুলে, মাথা নুইয়ে, টুপিটা এক পাশ থেকে আরেক পাশে নিয়ে গেলেন, কিন্তু যে সহৃদয় মৃদুহাস্য আশা করেছিলেন তা লাভ করলেন না। লোরেঞ্জো ডাজা তখন সমস্ত ব্যাপারটা সুন্দর ভাবে মিটিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ডাক্তারকে তাঁর অফিস ঘরে তাঁর সঙ্গে এক পেয়ালা কফি পানের আমন্ত্রণ জানালেন এবং ডাক্তারও তা গ্রহণ করলেন, তিনিও কোনো সন্দেহের অবকাশ না রেখে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন যে ঘটনাটা নিয়ে তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ নেই।

আসলে সকালে কোন কিছু খাবার আগে এক পেয়ালা ছাড়া ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো কফি খেতেন না। তিন মদ্য পানও করতেন না, শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে খাবার সময় এক গ্লাস ওয়াইন পান করতেন, কিন্তু এখন লোরেঞ্জো ডাজার এগিয়ে দেয়া কফির পেয়ালা সম্পূর্ণ শেষ করলেন, এক গ্লাস অ্যানিসেট সুরাও গ্রহণ করলেন। তারপর আরেক পেয়ালা কফি খেলেন, আরেক গ্লাস অ্যানিসেটও। তারপর আবার, এবং আবার, যদিও তখনো তাঁর কয়েকজন রোগীর বাড়িতে যাবার কথা ছিল। প্রথম দিকে তিনি লোরেঞ্জো ডাজার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন, বাবা মেয়ের পক্ষ হয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছিলেন, বলছিলেন যে তাঁর মেয়ে বুদ্ধিমতী, অচপল, একজন রাজপুত্রের যোগ্য সঙ্গিনী, সে রাজপুত্র এখানকার হোক কিংবা অন্য কোন স্থানের, তাঁর মেয়ের শুধু একটাই দোষ, সে ভীষণ একরোখা। দ্বিতীয় গ্লাস অ্যানিসেট পান করার পর কিন্তু ডাক্তারের কানে লোরেঞ্জো ডাজার কোন কথাই যায় নি, তিনি তখন শুনছিলেন উঠানের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা ফারমিনা ডাজার কণ্ঠস্বর, তাঁর কল্পনার চোখে দেখছিলেন সে কি ভাবে রাত নেমে আসার পর বারান্দায় আলো জ্বেলে দিচ্ছে, কীটনাশক ওষুধ ছিটিয়ে শোবার ঘর পরিশুদ্ধ করছে, উনুনের উপর স্যুপের পাত্র থেকে তার ডালা সরাচ্ছে, রাতে বাবার সঙ্গে একত্রে খেতে বসেছে, দুজনে এক টেবিলে কিন্তু সে স্যুপে একটা চুমুকও দিচ্ছে না, ওদের মধ্যে বিরাজমান বিদ্বেষপূর্ণ আবহও ভাঙছে না, অবশেষে বাবা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁর অপরাহ্নের কঠোরতার জন্য তিনি তাকে বলছেন, সে যেন তাঁকে ক্ষমা করে দেয়।

মেয়েদের সম্পর্কে ডাক্তার উরবিনোর যেটুকু জ্ঞান ছিল তাতেই তিনি বুঝেছিলেন যে তিনি না চলে যাওয়া পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা অফিস ঘরের পাশ দিয়ে যাবে না, কিন্তু তবু তিনি ওখানে বসে থাকলেন, কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে তাঁর আহত মর্যাদা বোধ তাঁকে ওই অপরাহ্নের অপমানের হাত থেকে শান্তি দেবে না। ততক্ষণে লোরেঞ্জো ডাজা প্রায় মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন, ডাক্তারের অমনোযোগিতা তিনি লক্ষ করলেন না, নিজের অদম্য বাগ্মীতায় তিনি মুগ্ধ। স্রোতের মতো তাঁর মুখ থেকে কথা বেরিয়ে এলো, তিনি তাঁর আগুন না ধরানো সিগারের গোড়া চিবুতে লাগলেন, গলা পরিষ্কার করার জন্য দমকে দমকে কাশলেন, তাঁর দোলচেয়ারে একটা আরামদায়ক অবস্থানের জন্য এপাশ-ওপাশ সামনে-পেছনে নড়াচড়া করলেন আর তাঁর চেয়ারের স্প্রিংগুলি কামোন্মোত্ত পশুর মতো কঁকিয়ে উঠলো। তাঁর অতিথি যেখানে এক গ্লাস অ্যানিসেট পান করেন তিনি সেখানে পান করেন তিন গ্লাস। তিনি তখনই ক্ষান্ত দিলেন যখন তিনি দেখলেন যে তিনি আর তাঁর অতিথি দুজনের কেউই আর পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি আলো জ্বালাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন আর ওই নতুন আলোয় ডাক্তার উরবিনো দেখলেন যে লোরেঞ্জো ডাজার একটা চোখ মাছের চোখের মতো বাঁকা দেখা যাচ্ছে আর তার তাঁর কথা আর ঠোঁটের নড়াচড়ার মধ্যে কোনো সমতা নেই। তাঁর মনে হল এই দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছে অত্যধিক সুরাপানের জন্য। ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর একটা চমৎকার আশ্চর্য অনুভূতি হল, তাঁর মনে হল তিনি একটি দেহের মধ্যে আছেন যা তাঁর নিজের নয়, অন্য আরেক জনের, যে এখনো তাঁর পরিত্যক্ত চেয়ারে বসে আছে। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ডাক্তার যেন তিনি পাগল না হয়ে যান।

তিনি যখন লোরেঞ্জা ডাজার অফিস ঘর থেকে উঠলেন তখন সাতটা বেজে গেছে। লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর আগে আগে চলেছেন। আকাশ পূর্ণ চাঁদ। অ্যানিসেটের প্রভাবে আদর্শায়িত উঠানটিকে মনে হল একটা কৃত্রিম জলাধারের তলায় ভাসছে। সদ্য প্রস্ফুটিত কমলা কুঁড়ির মাতাল গন্ধের নিচে কাপড়ে ঢাকা পাখির খাঁচাগুলিকে মনে হল ঘুমন্ত প্রেতের মতো। সেলাই ঘরের জানালাটা খোলা, কাজকর্মের টেবিলের উপর একটা আলো জ্বলছে, অসমাপ্ত চিত্রকর্মগুলি ইজেলের গায়ে বসানো, যেন কোন প্রদর্শনীর জন্য। ডাক্তার উরবিনো জানালার পাশ দিয়ে যাবার সময় উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘ওগো, কোথায় তুমি যে-তুমি এখানে নেই’, কিন্তু ফারমিনা ডাজা তাঁর এই ডাক শুনতে পেল না, কারণ ও তখন ওর শোবার ঘরে রাগে-দুঃখে অস্থির হয়ে বিছানায় মাথা গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে, বাবার ওপর আজ বিকালের অপমানের প্রতিশোধ কি ভাবে নেবে তা ভাবছে। ডাক্তার ওর কাছ থেকে বিদায় নেবার আশা ত্যাগ করেন নি কিন্তু লোরেঞ্জো ডাজা সেরকম কোন প্রস্তাব করলেন না। ডাক্তারের চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলো ওর নাড়ির সারল্য, ওর মার্জারের মতো জিভ, ওর কোমল নাসারন্ধ্রের জন্য, কিন্তু ও যে আর কখনো তাঁর মুখদর্শন করতে চাইবে না, তাঁকে আর কখনো ওর কাছে আসতে দেবে না, এই চিন্তা তাঁকে অত্যন্ত নিরাশ করলো। লোরেঞ্জো ডাজা যখন তাঁকে বাড়ির প্রবেশপথের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কাপড়ে ঢাকা খাঁচার মধ্যে জেগে-ওঠা কাকগুলি তীব্র মর্মান্তিক স্বরে ডেকে উঠলো, আর ডাক্তার, ওর কথা ভাবতে ভাবতে, উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ওরা তোমার চোখ উপড়ে নেবে।’ লোরেঞ্জো ডাজা মাথা ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন ডাক্তার কি বললেন। ডাক্তার জবাব দিলেন, “আমি নই, ওটা অ্যানিসেট।’

লোরেঞ্জো ডাজা গাড়ি পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে গেলেন, দ্বিতীয় বার রোগী দেখার জন্য তাঁকে আরেকটি স্বর্ণ মুদ্রা গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করলেন কিন্তু ডাক্তার তা নিলেন না। তাঁর তখনও দুজন রোগী দেখা বাকি ছিল, তিনি কোচোয়ানকে তাদের বাড়ির নির্ভুল ঠিকানা দিলেন এবং কারো সাহায্য ছাড়াই গাড়িতে উঠে বসলেন। কিন্তু তারপর খোয়াবাঁধানো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনিতে তিনি অসুস্থ বোধ করলেন, কোচোয়ানকে তিনি তখন ভিন্ন পথে যেতে বললেন। এক মুহূর্তের জন্য গাড়ির ভেতরের আয়নায় তিনি নিজের মূর্তি দেখলেন, কিন্তু তখনো ভাবছিলেন ফারমিনা ডাজার কথা। তিনি তাঁর দু’কাঁধ ঝাঁকালেন, তাঁর মাথা তাঁর বুকের উপর নেমে এলো, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন আর স্বপ্নের মধ্যে শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলেন। প্রথমে তিনি শুনলেন ক্যাথিড্রালের ঘণ্টা, তারপর অন্য সবগুলি গির্জার, একের পর এক তারা বেজে চললো, এমনকি সেইন্ট জুলিয়ানের ফাটা ঘণ্টাও।

ঘুমের মধ্যে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাচ্ছেলে! মরাগুলো আবার মরেছে।’ তাঁর মা আর বোনেরা বিরাট খাবার ঘরের আনুষ্ঠানিক টেবিলে বসে রাতের খাবারের পর কফি আর কেক-পেস্ট্রি খাচ্ছিলেন। তাঁরা তাঁকে দরজার কাছে দেখলেন, চেহারা ক্লান্ত ও পাংশুবর্ণ, তাঁর সমস্ত শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে ওই কাকগুলির বারাঙ্গনাসুলভ সুরভি। বাড়ির বিশাল শূন্য স্থানের মধ্যে পার্শ্ববর্তী ক্যাথিড্রালের সর্ববৃহৎ ঘণ্টার শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। তাঁর মা সভয়ে প্রশ্ন করলেন, কোথাও ছিলো ও, ওরা তাকে সর্বত্র খুঁজেছে যেন ও একবার জেনারেল ইগনাশিও মারিয়াকে দেখে। জেনারেল ছিলেন মারক্যুই ডি হারাজ ডিলা ভেরার সর্বশেষ দৌহিত্র, বিকালের দিকে মস্তিষ্কের রক্তক্ষণ হয়ে তিনি মারা গেছেন। ঘণ্টাগুলি বাজছিলো তাঁর জন্য। ডাক্তার উরবিনো মায়ের কথাগুলি শুনলেন কিন্তু তার এক বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন না। তারপর তিনি সামান্য ঘুরে নিজের শয়নকক্ষের দিকে যাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু তার আগেই বমি করে নিজের বমির মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। “হা ভগবান!” তাঁর মা চিৎকার করে উঠলেন। ‘নিজের বাড়িতে ও এই অবস্থায় এসে হাজির হল! নিশ্চয়ই অত্যাশ্চার্য কিছু একটা ঘটেছে।’

তবে আশ্চর্যতম ঘটনাটি তখনো ঘটে নি। নগরবাসী জেনারেল ইগনাশিও মারিয়ার মৃত্যুশোক সামলে ওঠার পর বিখ্যাত পিয়ানোবাদক রোমিও লুসিচ কর্তৃক মোৎসার্তের কয়েকটি সোনাটা পরিবেশনের ব্যবস্থা করে। ওই বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী এক সংক্ষিপ্ত সফরে এ শহরে এসেছিলেন, ওরা এই সুযোগটা গ্রহণ করে। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে খচ্চরের গাড়িতে করে ওদের পিয়ানোটা আনাবার ব্যবস্থা করেন, তারপর বিখ্যাত পিয়ানোবাদকের সহায়তায় ফারমিনা ডাজার উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেরেনাদ নিবেদন করেন। সঙ্গীতের প্রথম সুরলহরীর ধ্বনিতেই ফারমিনা ডাজার ঘুম ভেঙে যায় এবং ওই অসাধারণ প্রেম নিবেদনের হোতা কে তা বুঝবার জন্য ওকে বারান্দার শিকের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকানোর প্রয়োজন পড়ে নি 1 রাগে-ক্ষোভে ওর একটি কারণেই দুঃখ হল। অনাকাঙ্ক্ষিত পাণিপ্রার্থীদের উত্ত্যক্তির হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনো কোনো কুমারী মেয়ে ওদের মাথার উপর নিজেদের মলমূত্রের পাত্র উপুড় করে ঢেলে দিতো, ফারমিনার কেন ওরকম করার সাহস হল না? অন্য দিকে, সেরেনাদের ধ্বনি কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর কাপড়জামা পরে ফেলেছিলেন, এখন বাদন শেষ হতেই তিনি ডাক্তার উরবিনো এবং পিয়ানোবাদককে বাড়ির ভেতরের বৈঠকখানায় ডেকে এনে সেরেনাদের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে দুজনকেই এক গ্লাস করে উৎকৃষ্ট ব্র্যান্ডি পান করতে দিলেন। পিয়ানোবাদকের পরনে তখনও ছিল আনুষ্ঠানিক কনসার্টের ধরাচূড়া।

অল্পকালের মধ্যেই ফারমিনা ডাজা বুঝলো যে বাবা ওর মন গলাবার চেষ্টা করছেন। সেরেনাদের পরদিন তিনি খুব সাধারণ ভাবে বললেন, ‘একবার শুধু কল্পনা করো, উরবিনো দ্য রা কল-পরিবারের একজন তোমার পাণি প্রার্থী, তোমার মা একথা জানতে পারলে কী রকম তাঁর মনের অবস্থা হত!’ ফারমিনা শুকনো গলায় উত্তর দিলো, ‘তিনি তাঁর কবরের মধ্যে নড়ে উঠতেন।’ ওর চিত্রকলার বান্ধবীরা ওকে খবর দিল যে ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো সোশ্যাল ক্লাবে লাঞ্চের জন্য লোরেঞ্জা ডাজাকে নিমন্ত্রণ করেছিলো এবং ক্লাবের নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য ডাক্তার কঠোরভাবে তিরস্কৃত হন। আর তখনই ফারমিনা ডাজা জানতে পারে যে ওর বাবা ইতিপূর্বে সোশ্যাল ক্লাবের সদস্যপদের জন্য কয়েকবারই আবেদন করেছিলেন এবং প্রতিবারই তাঁর বিরুদ্ধে এত বেশিসংখ্যক নেতিবাচক কালো ভোট পড়ে যে সে-ব্যাপারে আর অগ্রসর হবার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু লোরেঞ্জো ডাজার অপমান হজম করার শক্তি ছিল সীমাহীন, আর ডাক্তার উরবিনোর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবার জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করলেন, বুঝলেন না যে ডাক্তারও তাঁর সঙ্গে আকস্মিক সাক্ষাৎ লাভের জন্য অনুরূপ কৌশল অবলম্বন করে চলেছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁরা দুজন লোরেঞ্জো ডাজার অফিস ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে কাটাতেন। তখন মনে হত বাড়িটা যেন সময়ের এক প্রান্তে নিথর হয়ে ঝুলে আছে, কারণ ডাক্তার না চলে যাওয়া পর্যন্ত সংসারের সব স্বাভাবিক কাজকর্ম সে সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতো। প্যারিস ক্যাফে ছিল একটা চমৎকার মধ্যবর্তী আশ্রয় স্থল। সেখানেই লোরেঞ্জো ডাজা ডাক্তার উরবিনোকে দাবায় প্রথম হাতেখড়ি দেন, আর ডাক্তার এমনই নিষ্ঠাবান ছাত্র হয়ে ওঠেন যে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত দাবা তাঁর জন্য এক আরোগ্যাতীত নেশায় পরিণত হয়েছিল।

একক পিয়ানো বাদনের মাধ্যমে সেরেনাদের অল্পকাল পরে লোরেঞ্জো ডাজা এক রাতে তাঁর বাড়ির প্রবেশপথে একটা চিঠি আবিষ্কার করলেন, খামটা গালা-মোম দিয়ে আটকানো, সিলের গায়ে ‘জে ইউ সি’ মনোগ্রাম বসানো। ফারমিনার শোবার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি চিঠিটা দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। চিঠিটা কিভাবে ওখানে এলো ফারমিনা ভেবে পেল না, কারণ ওর বাবা যে তাঁর নিজের হাতে ওর এক পাণিপ্রার্থীর চিঠি পৌঁছে দেবার মতো এতো বদলে গেছেন তা সে কল্পনা করতে পারে নি। সে চিঠিটা টেবিলের উপর ফেলে রাখলো। আসলে চিঠিটা নিয়ে সে কি করবে তা সত্যিই ঠিক করতে পারলো না। কয়েকদিন ধরে ওই চিঠি টেবিলের উপর খামবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকলো, তারপর এক বৃষ্টিস্নাত অপরাহ্নে ফারমিনা ডাজা একটা স্বপ্ন দেখলো, ডাক্তার উরবিনো তাদের বাড়িতে ফিরে এসেছেন, মুখে চামচ দিয়ে জিভ চেপে ধরে তিনি তার গলা পরীক্ষা করবেন। তবে স্বপ্নের মধ্যে সে দেখল যে চামচটা অ্যালুমিনিয়মের নয়, একটা সুস্বাদু ধাতুর, যে-ধাতু সে তার অন্যান্য স্বপ্নে ইতিপূর্বে আস্বাদন করেছে, সে তখন ধাতুটি দুটি অসমান খণ্ডে ভেঙে ছোট খণ্ডটি ডাক্তারকে দিল।

ঘুম ভেঙে জেগে উঠে সে এবার চিঠিটা খুললো। ছোট চিঠি এবং সুশীল-সংযত। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো ওকে বলেছেন ও যেন ওর বাবার অনুমতি নিয়ে রাখে, তিনি ফারমিনার সঙ্গে দেখা করতে চান। চিঠির সরল গম্ভীর সুর ফারমিনা ডাজার ভালো লাগলো এবং যে-ক্রোধ ও এতদিন সযত্নে লালন করেছিলো তা এক মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। ও চিঠিটা ওর ট্রাঙ্কের তলায় তুলে রাখলো, কিন্তু তখনই ওর মনে পড়লো যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সুরভিত চিঠিগুলিও ও ওই খানেই তুলে রেখেছিল। তখন লজ্জার এক বিশাল ঢেউ-এ আক্রান্ত হয়ে ও অন্য একটা জায়গা খুঁজলো। তারপর তার মনে হল, সে চিঠিটা আদপেই পায় নি, ওই রকম ভাব করাই সর্বোত্তম হবে। তখন সে চিঠিটা বাতির আগুনে পুড়িয়ে ফেললো, আলোর শিখার উপরে মোমের ফোঁটাগুলি পড়ে কীভাবে নীল বুদ্বুদের আকার ধারণ করে ফেটে যাচ্ছে তা লক্ষ করলো। ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বেচারা!” আর তারপরই ওর মনে পড়লো যে মাত্র এক বছরের মধ্যে ও দ্বিতীয় বার কথাটা উচ্চারণ করলো, এক মুহূর্তের জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা ওর মনে পড়লো, তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে ওর জীবন থেকে কতো দূরে সরে গেছে তা ভেবে ও একটু অবাকও হলো! বেচারা!

অক্টোবরের শেষ বৃষ্টিপাতের সময় আরো তিনটি চিঠি এলো, প্রথম চিঠির সঙ্গে ছিল একটা ছোট বাক্সে ফ্লাভিনি মঠের নীল-লোহিত সুগন্ধী পাতা। দুটি চিঠি ডাক্তার উরবিনোর কেচোয়ান ওদের দোরগোড়ায় রেখে দেয়, ডাক্তার তাঁর গাড়ির জানালা দিয়ে গালা প্লাসিডিয়াকে সম্ভাষণ জানান, প্রথমত, চিঠিটা কার সে সম্বন্ধে যেন সন্দেহের কোন অবকাশ না থাকে, আর দ্বিতীয়ত, চিঠি ওরা পায় নি এমন কথা যেন বলতে না পারে। তার ওপর দুটি চিঠিই ছিল মোম-গালা দিয়ে তাঁর মনোগ্রামসহ সিল করা, আর ওই বিশেষ হাতের লেখার ধরন যে কোন ডাক্তারের তাও ফারমিনা ডাজার চেনা হয়ে গিয়েছিল। দুটি চিঠির বক্তব্যই ছিল প্রথম চিঠির মত, দুটিই লেখা হয়েছে বিনীত ভঙ্গিতে, কিন্তু তার আড়ালে একটা অসহিষ্ণুতার সুর ফুটে উঠবার উপক্রম করছিলো, যা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সংক্ষিপ্ত চিঠিতে কখনো দেখা যায় নি। চিঠি দুটি আসে দু’সপ্তাহের ব্যবধানে, আসার সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ডাজা তা পড়ে ফেলে, তারপর আগুনে ফেলে দেবার পূর্বক্ষণে, কেন ও জানে না, ও তার মত পরিবর্তন করে।

অক্টোবরের তৃতীয় চিঠিটা বাড়ির বাইরের দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সব দিক দিয়েই ওটা ছিল আগের দুটো চিঠির চাইতে ভিন্ন রকম। এটার হাতের লেখা ছিল এতো ছেলেমানুষের মতো যে একজন কেউ যে এটা তার বাঁ হাত দিয়ে লিখেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। চিঠিটা পড়বার আগে ফারমিনা ডাজা বোঝে নি যে ওঠা একটা বেনামী বিষাক্ত চিঠি। যেই লিখে থাকুক সে নিশ্চিত ভাবে ধরে নিয়েছিল যে প্রেমের ওষুধ খাইয়ে ফারমিনা ডাজা ডাক্তার উরবিনোকে জাদু করেছে এবং ওই ধারণা থেকে সে নানা রকম ভয়াবহ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। চিঠির শেষে একটা ভীতি প্রদর্শন করা হয় : ফারমিনা ডাজা যদি নগরীর সব চাইতে কাম্য মানুষটির মাধ্যমে তার জাগতিক উন্নতি ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পরিত্যাগ না করে তাহলে তার কুকর্মের কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়া হবে।

ফারমিনা নিজেকে মনে করলো একটা গভীর অন্যায়ের শিকার কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া বিদ্বেষমূলক হল না। পক্ষান্তরে, বেনামী চিঠির লেখককে আবিষ্কার করার ইচ্ছা হল তার, যেন সে তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারে যে পত্রলেখক ভুল করেছে, কারণ ফারমিনা সুনিশ্চিত ছিল যে সে কখনোই ডাক্তারের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেবে না। এর পর সে আরো দুটি দস্তখতহীন চিঠি পায়, আগের মতোই বিশ্রী, কিন্তু তিনটি চিঠিই একজনের লেখা বলে মনে হল না। হয় সে একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে, নয়তো এই ভালোবাসার কথা এত দূর ছড়িয়েছে যা কেউ কল্পনা করতে পারে নি। একটা কথা মনে জাগায় সে বেশ বিচলিত হল, এটা কি ডাক্তার জুভেনাল উরবিনোর কোন সরল অবিবেচনার ফসল? হয়তো তাঁকে বাইরে থেকে যেমন দেখায় তিনি তার চাইতে ভিন্ন রকম, তিনি হয়তো বাড়ি বাড়ি রোগী দেখার সময় বেশি কথা বলে ফেলেছেন, তাঁর কাল্পনিক বিজয় নিয়ে গর্ব করেছেন, তাঁর সমশ্রেণীর অনেকেই যা হরহামেশা করে থাকে। তার সম্মানে আঘাত দেবার জন্য সে ডাক্তারকে তিরস্কার করে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবলো কিন্তু তারপর সে-সিদ্ধান্ত বাতিল করলো, কারণ ডাক্তার হয়তো তাই চাইছেন। যে সব বান্ধবী তার সঙ্গে সেলাইঘরে তার সঙ্গে ছবি আঁকতো সে তাদের কাছ থেকে আরো কিছু জানার চেষ্টা করলো কিন্তু ওরা বললো যে পিয়ানো-সেরেনাদ সম্পর্কে সহৃদয় মন্তব্য ছাড়া অন্য কিছু তারা কখনো শোনে নি। তার নিজেকে মনে হল অসহায়, লাঞ্ছিত, রাগে তার সারা শরীর মন জ্বলে গেল। তার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় সে তার অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি হতে চেয়েছিল যেন তার ভুলটা সে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারে কিন্তু এখন তার ইচ্ছা হল তার বাগানের বড়ো কাঁচিটা দিয়ে তাকে ফালা ফালা করে ফেলতে। রাতের পর রাত সে না ঘুমিয়ে কাটালো, বেনামী চিঠিগুলির ছোট ছোট জিনিস ও বাক্যভঙ্গি বিশ্লেষণ করলো, চেষ্টা করলো কোথাও কোনো স্বস্তি পাওয়া যায় কিনা তা দেখতে, কিন্তু তা ছিল একটা ব্যর্থ আশা : স্বভাবগত দিক থেকেই উরবিনো ডি লা কল-পরিবারের অভ্যন্তরীণ জগতের সঙ্গে ফারমিনার কোন মিল ছিল না, সে তাদের ভালো কাজের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করতে পারতো কিন্তু তাদের খারাপ কাজের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কোনো ক্ষমতা তার ছিল না।

এর মধ্যে আরেকটি ব্যাপার ঘটলো যা তাকে ভীত করে এবং তার উপরোক্ত বিশ্বাসকে দৃঢ় ও তিক্ত করে তোলে। কোনো চিঠি ছাড়া একদিন তার কাছে একটা কালো পুতুল এসে পৌঁছলো। এটা কে পাঠাতে পারে তা অনুমান করা ফারমিনা ডাজার পক্ষে কঠিন হল না। ডাক্তার উরবিনো ছাড়া এটা আর কারো কাজ হতে পারে না। পুতুলটা কেনা হয়েছে মার্টিনেক থেকে, মূল লেবেল দেখে তা বোঝা যায়। তার পরনে অতি চমৎকার একটা লম্বা গাউন, মাথার চুল সোনালি সুতায় ঢেউ খেলানো, শুইয়ে রাখলে পুতুলটা তার দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। ওটাকে এত মনোমুগ্ধকর মনে হল যে ফারমিনা ডাজা তার সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিনের বেলায় ওটাকে তার নিজের বালিশে শুইয়ে রাখতো আর রাতে ওটাকে পাশে রেখে ঘুমাতো। কিন্তু কিছু দিন পর, একদিন ক্লান্তিকর এক স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে সে দেখলো যে পুতুলটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে, তার চমৎকার আদি পোশাকটা ছোট হয়ে তার হাঁটুর উপর উঠে এসেছে, তার পায়ের চাপে জুতা জোড়া ফেটে গেছে। ফারমিনা ডাজা আফ্রিকার জাদুর কথা শুনেছে কিন্তু এরকম ভয়াবহ কাহিনী সে আগে কখনো শোনে নি। অন্য দিকে, জুভেনাল উরবিনোর মত একজন মানুষ যে এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে পারেন তাও সে কল্পনা করতে পারলো না। এক্ষেত্রে তার অনুমান ছিল অভ্রান্ত। পুতুলটা ডাক্তারের কোচোয়ান কেনে নি, সেটা কিনে এনেছিল এক ভ্রাম্যমাণ চিংড়ি মাছের ফেরিওয়ালা, যাকে কেউ চেনে না। ফারমিনা ডাজা এই রহস্যের সমাধানকল্পে একবার এক মুহূর্তের জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা ভেবেছিল, ওর মনমরা অবস্থার কথা শুনে সে খুব দুঃখ বোধ করেছিল, কিন্তু সে যে ভুল করেছিল জীবন তাকে সে-শিক্ষা দিয়েছে। পুতুল রহস্যের সমাধান কোন দিন হয় নি এবং দীর্ঘকাল পরেও, যখন তার বিয়ে হয়ে গেছে, সে ছেলেমেয়ের মা হয়েছে, নিজেকে নিয়তির বরকন্যা বলে মনে করেছে, পৃথিবীর সব চাইতে সুখী রমণী, তখনো ওই পুতুলের কথা মনে পড়লে সে ভয়ে শিউরে উঠতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *