প্রেম ও কলেরা – ৬

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখ মড়ার মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। সে অভিভূতের মতো তাঁর সঙ্গে চললো। এই সাক্ষাতের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ফারমিনা ডাজা তাকে সতর্ক করে দেবার কোনো সুযোগ বা উপায় খুঁজে পায় নি। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই : এর আগের শনিবার প্রেজেন্টেশান অব রেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমির প্রধান, সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ, একটা সাপের চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে পৃথিবীর উৎপত্তি বিষয়ক ধারণাবলীর ক্লাসে এসে ঢোকেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করার সময় অনেকগুলো মেয়ের কাঁধের উপর দিয়ে তিনি লক্ষ করে যে ফারমিনা ডাজা তার খাতায় নোট নেবার ভান করলেও সে আসলে একটা প্রেমপত্র লিখছিল। অ্যাকাডেমির বিধি বিধান অনুযায়ী এ রকম একটি অপরাধের শাস্তি ছিল বহিষ্কার। লোরেঞ্জো ডাজা জরুরি এক আহ্বান পেয়ে রেক্টরের বাসভবনে গিয়ে হাজির হন, আর সেখানেই তিনি তাঁর লৌহ শাসন ব্যবস্থা যে ফাঁক দিয়ে গলে গলে পড়ছিল সেটা আবিষ্কার করেন। ফারমিনা ডাজা তার স্বভাবজ স্থৈর্যের সঙ্গে চিঠি লেখার অপরাধ স্বীকার করে কিন্তু তার গোপন প্রেমিকের পরিচয় জানাতে অস্বীকার করে। প্রতিষ্ঠানের বিচার সভাতেও সে যখন একই অবস্থান নেয় তখন তার বহিষ্কারাদেশ বহাল রাখা হল। তার বাবা বাড়িতে এসে ফারমিনা ডাজার ঘরে তল্লাশি চালান, এ পর্যন্ত যে ঘর একটি পুণ্যস্থান বলে বিবেচিত হয়ে এসেছিল। তল্লাশির ফলে তিনি ওর ট্রাঙ্কের নিচে কৃত্রিম গুপ্ত তাকের উপর তিন বছর ধরে লেখা চিঠির প্যাকেটগুলি আবিষ্কার করেন, যতখানি ভালবাসা দ্বারা চিঠিগুলি অনুপ্রাণিত হয়েছিল ততখানি ভালবাসার সঙ্গেই সেগুলি ওই জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। চিঠির সইয়ের মধ্যে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল না, কিন্তু লোরেঞ্জো ডাজা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তখন পারেন নি, কখনোই পারেন নি যে তাঁর মেয়ে নিজের গোপন প্রেমিক সম্পর্কে সে যে একজন টেলিগ্রাফ যন্ত্র পরিচালক এবং বেহালা বাজাতে ভালবাসে এর বেশি কিছুই জানতো না।

তাঁর বোনের অজান্তে যে এই ধরনের একটা জটিল সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না এ বিষয়ে লোরেঞ্জো ডাজার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি তাকে কোনো অজুহাত দেবার কিংবা পুনর্বিচারের কোনো সুযোগ দিলেন না। তিনি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজে তুলে সান হুয়ান ডি লা সিনেগা পাঠিয়ে দিলেন। যেদিন ফারমিনা বাড়ির দোরগোড়ায় তার পিসিকে বিদায় জানায় তার সেই যন্ত্রণাদগ্ধ স্মৃতির হাত থেকে সে কখনো মুক্তি পায় নি। বাদামি পোশাকের নিচে পিসির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল, অস্থিসর্বস্ব দেহ, রঙ ছাইয়ের মতো, ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে তিনি পার্কের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, নিজের বলতে তার জীবনে যা ছিল সব তার হাতে নিয়ে, শোবার জন্য একটা মাদুর আর রুমালে বাঁধা এক মাস চলার মতো কিছু টাকা, রুমালটা হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা। বাবার কর্তৃত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ক্যারিবীয় অঞ্চলের সবগুলি প্রদেশে তার পিসির খোঁজ নিতে আরম্ভ করে, সম্ভাব্য সকল মানুষের কাছ থেকে সে তাঁর খবর জানার চেষ্টা করে কিন্তু ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হবার আগে পর্যন্ত সে তার কোনো হদিসই পায় নি। ত্রিশ বছর পর বহু হাত ঘুরে বহু সময় নিয়ে তার কাছে একটা চিঠি এসে পৌঁছায়, সে চিঠি থেকে ফারমিনা জানতে পারে যে অনেক দিন আগেই তিনি একটা কুষ্ঠ আশ্রমে মৃত্যুবরণ করেন। তার পিসি এসকোলাস্টিকাকে অন্যায় শাস্তি দেয়ার জন্য ফারমিনার যে ওই রকম অসম্ভব তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে তা লোরেঞ্জো অনুমান করতে পারেন নি। ফারমিনা পিসিকে সর্বদা মায়ের মতো দেখেছে, মাকে সে প্রায় মনেই করতে পারতো না। সেই পিসিকে অন্যায় ভাবে শাস্তি দিতে দেখে সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে দেয়, কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, অবশেষে প্রথমে ভীতি প্রদর্শন ও পরে ছদ্ম অনুনয়-অনুরোধ- উপরোধের পর সে যখন তার ঘরের দরজা খুললো তখন তার বাবা আবিষ্কার করলেন এক আহত বাঘিনীকে, যে আর কখনো তার পনেরো বছরে ফিরে যাবে না।

সব চাটুকারিতার সাহায্যে তিনি কন্যার হৃদয় গলাবার চেষ্টা করলেন। তিনি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে তার ওই বয়সের ভালবাসা একটা মরীচিকা মাত্র, তিনি যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতে চাইলেন যে ওই চিঠিগুলি তার ফেরত দেয়া উচিত, অ্যাকাডেমিতে প্রত্যাবর্তন করে হাঁটু গেড়ে তার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত, তিনি কথা দিচ্ছেন যে সে সুখী হবে ওই রকম একটি উপযুক্ত পাত্র পাবার জন্য তিনিই সকলের আগে সাহায্য করবেন। কিন্তু এই সব কথা তিনি যেন এক মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন। অবশেষে, হেরে গিয়ে, সোমবার দুপুরে খাবার টেবিলে তিনি মেজাজের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, অপমানকর ও ধর্মমত সম্পর্কে অবজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য করা থেকে নিজেকে কোনো রকমে বিরত করে তিনি যখন বারুদের মতো ফেটে পড়তে যাচ্ছিলেন তখন তিনি মেয়েকে মাংস কাটার ছুরিটা নিজের গলার কাছে তুলে ধরতে দেখলেন, কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়া, হাত অকম্পিত, আর চোখের দৃষ্টি এতো গীতিময় যে তিনি আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। ওই সময়েই তিনি একটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, যে অভিশপ্ত মানুষটাকে তিনি কখনো দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না, যে তাঁর জীবনে একটা প্রচণ্ড দুঃখের মতো অকস্মাৎ উদিত হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য মুখোমুখি কথা বলবেন, সমানে সমানে। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় অভ্যাসের বসে তিনি তার পিস্তলটা সঙ্গে নেন, তবে সতর্কতার সঙ্গে শার্টের নিচে সেটা লুকিয়ে রাখতে ভুললেন না।

লোরেঞ্জো ভাজা যখন তার হাত ধরে ক্যাথিড্রালের খোলা চত্বর পেরিয়ে প্যারিস ক্যাফের খিলান দেয়া গ্যালারিতে নিয়ে গিয়ে তাকে বারান্দায় আসন গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানালেন তখনো সে তার হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। ওই সময়ে ক্যাফেতে আর কোনো খদ্দের ছিল না। ক্যাফের বিশাল সালোঁর রঙিন কাচের জানালাগুলি ধূলিধূসরিত, কিছু কিছু কাচের অংশ ভেঙ্গে গেছে, এক কৃষ্ণাঙ্গ রমণী মোমের টালিগুলি ঘষে পরিষ্কার করছে, চেয়ারগুলি মার্বেলের টেবিলের উপর উল্টো করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অনেক দিন লোরেঞ্জো ডাজাকে ওখানে সর্বজনীন বাজারের কিছু লোকজনের সঙ্গে জুয়া খেলতে ও সুরা পান করতে দেখেছে। তারা অন্যত্র সংঘটিত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে চিৎকার ও তর্কবিতর্ক করতো, আমাদের নিজেদের যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে তার কোনোই সম্পর্ক ছিল না। প্রেমের মারাত্মক বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতন, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, প্রায়ই ভেবেছে লোরেঞ্জো ডাজার সঙ্গে, শিগগিরই কিংবা দেরিতে, তার অনিবার্য সাক্ষাৎ কেমন হবে, যে সাক্ষাৎ আগাম প্রতিহত করার শক্তি কোনো মানুষেরই নেই, কারণ তাদের উভয়ের নিয়তির খাতায় তা লেখা হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল যে ওটা হবে এক অসম বিরোধ, ফারমিনা ডাজা তার চিঠিগুলিতে বাবার ক্রুদ্ধ প্রকৃতি সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল বলেই নয়, সে নিজেও লক্ষ করেছে যে তিনি জুয়ার টেবিলে যখন হাসেন তখনও তাঁর চোখ দুটি দেখায় অত্যন্ত রাগীরাগী। তাঁর সব কিছুই একটা অমার্জিত স্থূলতার সাক্ষ্য দিত: তাঁর কদর্য পেট, তাঁর কর্কশ জোরালো কথাবার্তা, তাঁর বন-বেড়ালের মতো গোঁফ, তাঁর অমসৃণ হাত, উপল পাথর বসানো আংটির চাপে তাঁর আঙুল। তাঁর একমাত্র প্রীতিপ্রদ জিনিস ছিল তাঁর হাঁটার ভঙ্গি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে প্রথমবারের মতো হাঁটতে দেখার সময়ই সেটা লক্ষ করেছিল। তাঁর পদচারণা ছিল তাঁর কন্যার মতোই, হরিণীর পদচারণা। কিন্তু এখন তিনি যখন চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললেন তখন লোরেঞ্জো ডাজাকে যেমন কর্কশ দেখাচ্ছিল তেমন কর্কশ বলে তার মনে হলো না, তারপর যখন তাকে এক গ্লাস আনিস্যে সুরা পানের আমন্ত্রণ জানালেন তখন সে তার সাহস অনেকখানি ফিরে পেল। এই মুহূর্তে তার ওই সাহসের প্রয়োজন ছিল বেশ জরুরি।

লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর কথা শেষ করতে যথার্থই পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেন নি, তা ছাড়া তিনি এমন একটা মনজয়করা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর কথাগুলি বলেন যা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিমূঢ় করে ফেলে। তিনি জানালেন যে স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তিনি নিজের জীবনের জন্য একটি মাত্র লক্ষ্য স্থির করেছিলেন : তাঁর কন্যাকে তিনি এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত নারীতে রূপান্তরিত করবেন। পথটা ছিল দীর্ঘ ও অনিশ্চিত। তিনি ছিলেন খচ্চরের এক নগণ্য ব্যবসায়ী, লিখতে জানেন না, পড়তে জানেন না, ঘোড়া-চোর বলে যার খ্যাতি সান হুয়ান ডি লা সিনেগা প্রদেশে যতটা ব্যাপক ছিল ততটা প্রমাণিত ছিল না। লোরেঞ্জে ডাজা একটা খচ্চর চালকের সিগার ধরিয়ে দুঃখ করে বললেন, খারাপ স্বাস্থ্যের চাইতে একটা জিনিসই নিকৃষ্টতর, সেটা হল বদনাম। তবে তাঁর সৌভাগ্যের আসল গোপন কারণ ছিল একটাই। তিনি নিজে যত কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং যতটা দৃঢ় সঙ্কল্পের সঙ্গে তাঁর কাজ করতেন সে রকম আর কেউ একটি কাজও করতো না, যুদ্ধবিগ্রহের সব চাইতে তিক্ত দিনগুলিতে যখন গাঁয়ের ঘরবাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হচ্ছিল, শষ্য ক্ষেতগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল সেই সব সময়েও। তাঁর কন্যা অবশ্য কখনোই নিজের নিয়তি সম্পর্কে পিতার পূর্ব পরিকল্পনার কথা জানতো না, তবু সে তাঁর একজন উৎসাহী সহযোগীর মতোই আচরণ করতো। সে ছিল বুদ্ধিমতী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। এ ক্ষেত্রে সে এতোটাই পারঙ্গম ছিল যে নিজে পড়ালেখা শেখার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবাকেও পড়তে শেখায়। আর মাত্র বারো বছর বয়সেই সে বাস্তবতার ওপর এতোটাই প্রভুত্ব অর্জন করে যে পিসি এসলোকাস্টিকার সাহায্য ছাড়াই সে সংসারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। তিনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সোনার ওজনের একটা খচ্চরের চাইতেও ওর মূল্য বেশি। যখন তাঁর কন্যা প্রাথমিক স্কুলের শেষ পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেল এবং গ্রাজুয়েশনের সময় যখন তার নাম বিশেষ সম্মানিতদের মধ্যে উল্লেখিত হল তখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে তাঁর স্বপ্নের তুলনায় সান হুয়ান ডি লা সিনেগা বড় বেশি সঙ্কীর্ণ একটি স্থান। তখন তিনি তাঁর সব জমিজমা ও পশু বিক্রি করে দিয়ে নতুন উদ্যম আর সত্তর হাজার স্বর্ণ পেসো সঙ্গে নিয়ে এই বিধ্বস্ত কীটদষ্ট প্রাক্তন গৌরবের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে পুরনো মূল্যবোধের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি সুন্দরী নারীর অনুকূল একটা বিয়ের মাধ্যমে এখনো পুনর্জন্ম লাভের সম্ভবনা আছে। তাঁর বহু কষ্টের পরিকল্পনার মধ্যে একটা অভাবিত বাধার মতো উদিত হয়েছে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। তাই আমি তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি, এই উক্তি করে লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর সুরার মধ্যে সিগারের প্রান্তদেশ ডুবিয়ে নিলেন কিন্তু ধূমপান করলেন না, তারপর তিনি বেদনার্ত কণ্ঠে তাঁর কথা শেষ করলেন : আমাদের পথের সামনে থেকে তুমি সরে যাও।

আনিস্যের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কথা শুনছিলো। ফারমিনা ডাজার অতীত তার সামনে উন্মোচিত হবার সময় সে ওই কাহিনী শুনছিলো এতটাই তন্ময় হয়ে যে যখন তার কথা বলার পালা আসবে তখন সে কী বলবে সে সম্পর্কে সে একটুও চিন্তাভাবনা করে নি। কিন্তু সময় যখন উপস্থিত হল তখন সে বুঝলো যে সে যাই বলুক না কেন আজ তার নিয়তির একটা মীমাংসা হয়ে যাবে।

সে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?

লোরেঞ্জো ডাজা বললেন, সেটা তোমার কোনো ব্যাপার নয়।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো, আমি প্রশ্নটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি, কারণ আমার মনে হয় এ বিষয়ে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এ সব একদম চলবে না, লোরেঞ্জো ডাজা বললেন। এটা পুরুষদের ব্যাপার, পুরুষরাই সিদ্ধান্ত নেবে।

তাঁর কণ্ঠস্বরে ভয় দেখানোর সুর লাগলো। একজন খদ্দের সবেমাত্র ক্যাফেতে ঢুকে নিকটবর্তী একটা টেবিলে বসেছিল। সে চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অত্যন্ত ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে বললো, সে যাই হোক না কেন, ও কি ভাবছে তা না জেনে আপনাকে আমি কোনো উত্তর দিতে পারবো না। দিলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে।

লোরেঞ্জো ডাজা এবার তাঁর চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন, তাঁর চোখের পাতা লাল ও ভেজা ভেজা হয়ে উঠলো, বাঁ চোখটা অক্ষিগোলকের মধ্যে ঘুরে গেল, তারপর বাঁ পাশে একটু বেঁকে গিয়ে স্থির হয়ে থাকলো। তিনি গলা নামিয়ে বললেন, তোমাকে গুলি করতে তুমি আমাকে বাধ্য করো না।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল তার পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি যেন শীতল ফেনায় ভরে যাচ্ছে, কিন্তু তার গলার স্বর একটুও কাঁপলো না, কারণ সে অনুভব করলো হোলি স্পিরিট যেন তাকে আলোকিত-উজ্জ্বল করে দিয়েছে। বুকের ওপর একটা হাত রেখে সে বললো, গুলি করুন। প্রেমের জন্য মৃত্যুবরণ করার চাইতে বেশি গৌরবের আর কিছু নেই।

লোরেঞ্জো ডাজা তার দিকে আড় চোখে তাকালেন, একটা তোতা পাখির মতো। তাঁর বাঁকানো চোখ দিয়ে তিনি ওকে লক্ষ করলেন, তারপর দুটি শব্দ পরপর এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যেন তিনি ওর দিকে থুথু নিক্ষেপ করছেন, কুত্তার বাচ্চা।

.

ওই সপ্তাহেই তিনি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, ভাবলেন যে এভাবেই ফারমিনা ফ্লোরেন্টিনোকে ভুলে যাবে। তিনি ওকে কোনো ব্যাখ্যা দিলেন না, ঝড়ের বেগে ওর শোবার ঘরে ঢুকালেন। তাঁর গোঁফ আর চিবুনো সিগার ক্রোধরঞ্জিত, তিনি ওকে তক্ষুনি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে বললেন। ও জিজ্ঞেস করলো ওরা কোথায় যাচ্ছে, আর তিনি জবাব দিলেন, আমাদের মৃত্যুর কাছে। উত্তরটা সত্যের খুব কাছাকাছি বলে ওর মনে হল। ভয় পেয়ে, কয়েক দিন আগের সাহস নিয়ে ও তাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি ততক্ষণে পেটানো তামার বকলস লাগানো তাঁর বেল্ট কোমর থেকে খুলে তাঁর হাতের মুঠির চারপাশে প্যাচাতে শুরু করেছিলেন, তারপর বেল্টটা টেবিলের ওপর এতো জোরে চালালেন যে সারা বাড়ি জুড়ে তার শব্দ একটা রাইফেলের গুলির শব্দের মতো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। তার শক্তির সীমা ফারমিনা ডাজার ভালো জানা ছিল, তাই সে দুটো খড়ের মাদুর ও একটা দড়ির দোলনা-বিছানা গোল করে বেঁধে নিল, দুটো ট্রাঙ্কে তার সব কাপড় জামা ভরলো, সে যে এই সফর থেকে আর কোনো দিন ফিরবে না সে সম্পর্কে সে ছিল নিশ্চিত। তারপর, কাপড় জামা পরার আগে, সে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টয়লেট পেপারের মোড়ক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার উপরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে ছোট একটা বিদায়ী চিঠি লিখলো। এর পর সে একটা কাঁচি দিয়ে একেবারে ঘাড়ের কাছ থেকে তার সম্পূর্ণ চুলের বেণীটা কেটে সোনালি সুতায় কাজ করা একটা মখমলের বাক্সে বেণীটা গোল করে মুড়ে চিঠির সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলো।

.

ওই ছিল এক উত্তম সফর। প্রথম পর্বে অ্যান্ডীয় খচ্চরচালকদের একটি দলের সঙ্গে খচ্চরের পিঠে চড়ে তারা সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার দীর্ঘ সরু উচ্চ রেখা ধরে এগিয়ে যায়। এটা চলে এগারো দিন ধরে। এই সময় নাঙ্গা সূর্যের উত্তপ্ত রোদে পুড়ে আর অক্টোবরের আনুভূমিক বৃষ্টিতে ভিজে তাদের স্বচ্ছ চিন্তার শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর ওপর, পর্বতচূড়াগুলি থেকে উত্থিত সারা দেহমন অবশ করে দেয়া বাষ্প তাদেরকে ভয়ে পাথর করে দিচ্ছিল। তৃতীয় দিনে ডাঁশ মাছির আক্রমণে পাগল হয়ে একটা খচ্চর তার চালককে নিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে ওটা টেনে নিয়ে যায় একই দড়িতে বাঁধা আরো সাতটা খচ্চরকে। লোকটির আর ওই পশুদের আর্ত চিৎকার দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেও পাহাড়ের চূড়ায় আর খাড়ির গর্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, আর ফারমিনা ডাজার স্মৃতিতে ওই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বছরের পর বছর। তার মালপত্র খচ্চরগুলির সঙ্গে খাদের মধ্যে তলিয়ে যায় কিন্তু তলিয়ে যাবার শতাব্দিব্যাপী মুহূর্ত থেকে শুরু করে ভয়ার্ত চিৎকারের শব্দ থেমে না যাওয়া পর্যন্ত সে ওই মৃত্যুবরণকারী হতভাগ্য খচ্চরচালক কিংবা তার ক্ষত-বিক্ষত খচ্চরগুলির কথা একবারও ভাবে নি, সে তখন তার নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবেছে, কেন তার খচ্চরটা ওই খচ্চরগুলির সঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা ছিল না!

এই প্রথমবার সে পশুর পিঠে চেপেছে। বর্তমান সফরের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট তার জন্য দুঃসহ তিক্ততায় ভরে যায় একটি কারণে, সে আর কখনো ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে দেখবে না, সে আর কখনো তার চিঠির সান্ত্বনা লাভ করবে না। সফরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সে ওর বাবার সঙ্গে একটি কথাও বলে নি আর তার বাবাও এতই হতবুদ্ধি হয়ে যান যে তিনিও খুব প্রয়োজনের মুহূর্তেও ওর সঙ্গে কথা বলেন নি, অপরিহার্য হলে কোনো একজন খচ্চর চালকের মাধ্যমে ওকে খবর দিয়েছেন। ওদের কপাল ভালো থাকলে ওরা পথিপার্শ্বের কোনো সরাইখানা পেয়ে যেত, সেখানে গ্ৰাম্য খাবার পরিবেশন করা হত যা ফারমিনা খেতে অস্বীকার করলো। সরাইমালিক ওদের বাসি ঘাম আর পেচ্ছাবের গন্ধমাখা ক্যানভাসের খাটিয়া ভাড়া দিত। তবে বেশির ভাগ সময়ে তারা রাত কাটাতো পথের পাশে নির্মিত সর্বজনীন ডরমিটরিতে, আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের বসতিতে। সেখানে সারিসারি বাঁশের দণ্ডের ওপর কটু খেজুর পাতার ছাদ টানানো, সব পথচারির-ই সকাল পর্যন্ত ওখানে রাত্রি যাপনের অধিকার ছিল। ফারমিনা ডাজা একটি রাতও ঘুমোতে পারে নি, ভয়ে তার শরীর ঘামে ভিজে যেত, রাতের অন্ধকারে সে নীরব পর্যটকদের আসা যাওয়ার শব্দ শুনতো, ওরা বাঁশের সঙ্গে তাদের পশু বেঁধে রেখেছে, যেখানে জায়গা পাচ্ছে সেখানেই তাদের দড়ির দোলনা-শয্যা ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যার সময় প্রথম পর্যটক দল যখন এসে উপস্থিত হত তখন জায়গাটা থাকতো শান্ত, কোনো ভিড় নেই, কিন্তু সকাল নাগাদ এটা রূপান্তরিত হয়ে যেত একটা মেলা প্রাঙ্গণে, এক গাদা দোলনা-বিছানা বিভিন্ন উচ্চতায় ঝুলছে, পাহাড়ি অঞ্চলের আরুয়াক ইন্ডিয়ানরা উবু হয়ে বসে ঝিমুচ্ছে, পাশেই খুঁটিতে বাঁধা তাদের ছাগলগুলি চ্যাঁচাচ্ছে, খাঁচায় আটকানো লড়াইয়ের রাতা মোরগগুলি ঝুটোপুটি করছে, আর পাহাাড়ি কুকুরগুলি নিঃশব্দে হাঁফাচ্ছে, যুদ্ধের বিপদের কারণে ওদের না ডাকতে শেখানো হয়েছে। এই সব হীনাবস্থার সঙ্গে লোরেঞ্জো ডাজার বিশেষ পরিচয় ছিল। তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেকটা এ সব জায়গা দিয়ে যাওয়া আসা করে কাটিয়েছেন, আর এখন প্রায় প্রত্যেক সকালেই এখানে তাঁর কোনো না কোনো বন্ধুর সাক্ষাৎ লাভ করছেন। কিন্তু তাঁর মেয়ের জন্য এটা ছিল এক তীব্র অন্তহীন যন্ত্রণা। লবণ দেয়া বস্তা বস্তা মাগুর মাছের তীব্র গন্ধ, শোকে কাতর, খাদ্য গ্রহণে অনীহা, এই সব মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তার খাবার ইচ্ছাটাই ধ্বংস করে দেয়। শুধু একটি কারণে সে হতাশায় ডুবে গিয়ে পাগল হয়ে যায় নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতি তাকে সর্বদা স্বস্তি দিয়েছে। তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে এটাই হচ্ছে ভুলে যাবার দেশ।

আরেকটা সার্বক্ষণিক ভয় ছিল, সেটা হল যুদ্ধের। সফরের প্রথম থেকেই তারা একটা বিপদের কথা শুনে এসেছে। নিজেদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সেনাবাহিনীর যে ছড়ানো ছিটানো পর্যবেক্ষক দল আছে তাদের সামনে পড়লেই মহাবিপদ। কিভাবে দু’পক্ষের লোকদের চেনা যাবে এবং চেনার পর তাদের সঙ্গে কি রকম আচরণ করতে হবে তা খচ্চরচালকরা ওদের শিখিয়ে দিয়েছিল। অফিসারের নেতৃত্বাধীন অশ্বারোহী সৈন্যদের সামনে ওরা প্রায়ই পড়ে। নতুন সৈন্য সংগ্রহের জন্য ওরা দড়ির ঘেরাটোপ দিয়ে লোকজন পাকড়াও করতো, কাজটা এমন ভাবে করতো যেন ওরা মানুষ নয়, গরুর পাল। অজস্র ভয়াবহ ঘটনার চাপে ফারমিনা ডাজা একটা বিপদের কথা ভুলে গিয়েছিল, যেটা তার কাছে আসন্ন মনে হয় নি বরং কাল্পনিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু একটা ঘটনায় তার ভুল ভেঙে গেল। একদিন রাতে পর্যবেক্ষণকারী সৈন্যদের একটি দল সফরকারীদের দুজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসতি থেকে মাইল দেড়েক দূরে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। ওরা কোন পক্ষের বোঝা যায় নি। লোরেঞ্জো ডাজা নিহত সফরকারীদের চিনতেন না, কিন্তু তিনি তাদের মৃতদেহ গাছ থেকে নামিয়ে খ্রিস্ট্রীয় মতে তাদের সমাহিত করেন এবং ওদের মতো একই ভাগ্য যে তাঁর হয় নি সে জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেন। ধন্যবাদ দেবার যথার্থ কারণ ছিল, কারণ এক রাতে হামলাকারীরা তাঁর পেটে রাইফেল ঠেকিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জিজ্ঞাসা করে তিনি উদারপন্থী না রক্ষণশীল। ওদের নেতার পরনে ছিল শতছিন্ন জামা, সারা মুখে কাঠ কয়লার কালি মাখানো, সে লোরেঞ্জোর মুখে আলো ফেলে ওই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেছিল। জবাবে লোরেঞ্জো ডাজা বলেছিলেন, আমি দুটোর একটাও না, আমি একজন স্প্যানিশ প্রজা।

ওই সেনাপ্রধান তখন চিৎকার করে বলে ওঠে, কী সৌভাগ্য! তারপর হাত তুলে তাঁকে অভিবাদন করে বলে, রাজা দীর্ঘজীবি হোন! বলে সে বিদায় নেয়।

দু’দিন পর ওরা এক ঝলমলে সমভূমিতে নেমে এলো। সেখানে অবস্থিত ছিল আনন্দ-উচ্ছল শহর ভালেদুপার। উঠানে উঠানে মোরগের লড়াই চলছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে গান বাজনা হচ্ছে, তেজী ঘোড়ায় চড়ে অশ্বারোহীরা ঘোড়া দাবড়াচ্ছে, আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে, ঘণ্টা বাজছে। এক জায়গায় কয়েকজন মিলে একটা আতশবাজির প্রাসাদ নির্মাণ করছে। এ উৎসবের কিছুই ফারমিনা ডাজার চোখে পড়লো না। ভালেদুপারে ওরা ওর মায়ের ভাই লিসিমাকো সাঞ্চেজের বাড়িতে উঠলো। তিনি ওদের অভ্যর্থনা করার জন্য মহাসড়কের উপরে উঠে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে একগাদা কলরবমুখর তরুণ আত্মীয়স্বজন, প্রদেশের সব চাইতে ভালো ঘোড়ার পিঠে আসীন ওরা। লোরেঞ্জো ভাজা ও ফারমিনাকে আতশবাজি বিস্ফোরিত করতে করতে ওরা শহরের রাস্তার উপর দিয়ে বাড়িতে নিয়ে চললো। বাড়িটা ছিল গ্র্যান্ড প্লাজার উপর, ঔপনিবেশিক গির্জাটার পাশে। ওই গির্জা কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে। ওটাকেই মূল বসতবাড়ি বলে মনে হচ্ছিল, বড় বড় ঘর, একটা গ্যালারি, মুখের সামনে ফলের গাছ, ফলের বাগান, চারপাশে গরম আখের রসের ঘ্রাণ।

ওরা আস্তাবলে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যর্থনা-কক্ষগুলি বিপুলসংখ্যক অচেনা আত্মীয়-স্বজনে পূর্ণ হয়ে গেল। তাদের অসহনীয় উচ্ছ্বাস ফারমিনার কাছে একটা মারাত্মক মহামারীর আক্রমণের মতো মনে হল। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কাউকে ভালবাসার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। ঘোড়ার পিঠের জিনের ঘর্ষণে তার পশ্চাদ্দেশে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল, ক্লান্তিতে সে মৃতপ্রায়, অনবরত পাতলা পায়খানা হচ্ছে, এখন সে লালায়িত শুধু একটা নির্জন নীরব স্থানের জন্য যেখানে সে প্রাণ খুলে কাঁদতে পারবে। দেখা মাত্র তার অবস্থা বুঝতে পারে মাত্র একটি প্রাণী, তার খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ, তার চাইতে দু’বছরের বড়, তারই মতো উদ্ধত অহঙ্কারী ভাবভঙ্গি। সে তার অবস্থা বুঝতে পারে কারণ সেও তার মতোই এক বেপরোয়া ভালবাসার আগুনে জ্বলছিল। রাত্রি নামতেই সে ফারমিনাকে নিয়ে তার শোবার ঘরে এলো। আগে থাকতেই সে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল, ওরা দুজন এ ঘরে একসঙ্গে থাকবে। সে যখন তার পাছায় আগুনের মতো লাল বড় বড় ফোস্কাগুলি দেখলো তখন তার বিশ্বাস হল না, কেমন করে সে এখনো বেঁচে আছে। তার মায়ের সহায়তায় সে ফারমিনা ডাজার ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করে জ্বালা করা জায়গায় আর্নিকার ঠাণ্ডা সেঁক দিয়ে তার যন্ত্রণা অনেকখানি প্রশমিত করলো। হিল্ডাব্রান্ডার মা ছিলেন ভারি মিষ্টি মহিলা, একেবারে তাঁর স্বামীর মতো দেখতে, প্রায় যমজ বলা যেতে পারতো ওদের দুজনকে। এ ঘরে যখন এসব চলছিল তখন উৎসব উপলক্ষে বারুদপ্রাসাদ থেকে ছোড়া কামানের গোলার শব্দে এ বাড়ির ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

মাঝরাতে দর্শনার্থীরা বিদায় নিল। সর্বজনীন উৎসব থিতিয়ে এসেছে। হিন্ডাব্রান্ডা ফারমিনাকে একটা রাতের পোশাক ধার দিল, তারপর তাকে মসৃণ চাদর আর নরম পালকের বালিশের শয্যায় শুয়ে পড়তে সাহায্য করলো। আর তখুনি অতর্কিত এক তাৎক্ষণিক সুখের আতঙ্ক তাকে গ্রাস করলো। তারপর শোবার ঘরে যখন ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই তখন হিল্ডাব্রান্ডা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল, আড়াআড়ি করা খিলটা লাগিয়ে দিল এবং নিজের বিছানার নিচ থেকে মোম-গালা দিয়ে সিলমোহর করা একটা ম্যানিলা খাম টেনে বের করলো, খামের গায়ে জাতীয় টেলিগ্রাফের প্রতীক চিহ্ন লাগানো, তার বোনের মুখে উদ্ভাসিত ঈর্ষার অভিব্যক্তি দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ডাজার হৃদয়ের স্মৃতিতে সাদা গার্ডেনিয়া ফুলের বিষণ্ন গন্ধ আবার জেগে উঠল। সে দাঁত দিয়ে লাল মোম-গালা সিল ছিঁড়ে ফেললো, তারপর সকাল না হওয়া পর্যন্ত এগারোটি নিষিদ্ধ টেলিগ্রাম চোখের জলে ভিজিয়ে দিলো।

তাহলে ও ঠিকই জানতে পায়। ঘটনাটা ছিল এই রকম। সফরে বেরিয়ে পড়ার আগে লোরেঞ্জো ডাজা একটা ভুল করে ফেলেন। তিনি শ্যালক লিসিমাকো সাঞ্চেজকে তাঁর আসার খবরটা দেন এবং লিসিমাকো তখন প্রদেশ জুড়ে বিভিন্ন শহর ও গাঁয়ে তাদের নিকট ও দূরের যতো আত্মীয়পরিজন আছে সবাইকে ওদের সফরের খবর জানিয়ে দেন। ফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে ওদের সমগ্র সফরসূচিই জানতে পারে তাই নয়, টেলিগ্রামকর্মীদের একটা ভ্রাতৃসংঘও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা কাবোডিলা ভেলার শেষ বসতি পর্যন্ত ফারমিনা ডাজার অগ্রযাত্রার নিখুঁত হদিস রাখে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার পক্ষে তাই ফারমিনা ডাজার সঙ্গে একটা তীব্র আবেগসমৃদ্ধ যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়, ভালেদুপারে পৌঁছার পর রিওহাচায় যখন তাদের সফর পর্ব শেষ হয় তখন লোরেঞ্জো ডাজার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে তাঁর কন্যা ফ্লোরেন্টিনোকে ভুলে গেছে। তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। কন্যার ওপর নজর রাখার ক্ষেত্রে তিনি যে কতোটা শৈথিল্য প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা তিনি অনুমান করতে পারেন নি। তাঁর মন তখন ছিল ভিন্নমুখী। এতো বছর পর তাঁর শ্বশুরকুলের লোকজন তাদের গোষ্ঠীগত সংস্কার দূরে ঠেলে দিয়ে তাঁকে সাদরে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করেছে, তাঁকে আপ্যায়িত করেছে, তাঁর সঙ্গে মধুর আচরণ করছে, তিনি এ সবের মধ্যে ডুবে ছিলেন। বস্তুতপক্ষে ফারমিনা সাঞ্চেজের পরিবার ভীষণ ভাবে এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। লোরেঞ্জো ডাজা ছিলেন একজন বহিরাগত অভিবাসী, হামবড়া হাবভাব অমার্জিত, সারাক্ষণ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে, অনায়ত্ত খচ্চর বেচাকেনা করে, ওই ব্যবসা এতো সহজ সরল যে সেটা সাধু ও সৎ ব্যবসা বলে মনে করা কঠিন। লোরেঞ্জো ডাজা চড়া দামে জুয়া খেলেছিল। তাঁর প্রিয়তমা ছিলেন ওই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী প্রতিনিধিত্বশীল পরিবারের আদরের কন্যা, যাদের মেয়েরা হত উদ্দাম বন্য প্রকৃতির, আর পুরুষরা কোমলপ্রাণ কিন্তু পরিবারের সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে উন্মাদ প্রায়। ফারমিনা সাঞ্চেজ একটা অন্ধ দৃঢ়তার সঙ্গে তার কামনার মানুষের পানে ধাবিত হচ্ছিল, ভালবাসার ক্ষেত্রে বাধা দিলে অনেক সময় অনিবার্য ভাবে যা ঘটে। তিনি এতো দ্রুততা ও গোপনীয়তার সঙ্গে লোরেঞ্জো ডাজাকে বিয়ে করলেন যে মনে হয় শুধু ভালবাসার জন্য তিনি এ রকম করেন নি, বরং ঠিক সময়ের আগেই ঘটে যাওয়া একটা ভুলের ওপর ধর্মীয় আভরণ টেনে দেবার জন্য তিনি ওরকম করেছিলেন।

লোরেঞ্জো ডাজা উপলব্ধি করেন নি যে তাঁর কন্যার ভালবাসার ক্ষেত্রে তিনি যে অনমনীয় অবস্থা গ্রহণ করেছেন তা পঁচিশ বছর আগে তাঁর নিজের অতীতেরই বিদ্বেষপূর্ণ পুনরাবৃত্তি। তাঁর শ্বশুরকুলের যে মানুষরা একদিন তাঁর বিরোধিতা করেছিল এখন তিনি তাদের কাছেই অভিযোগ জানালেন, যে মানুষগুলি সেদিন যে ভাবে নিজেদের আত্মীয়-পরিজনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল ঠিক সেই ভাবে। এ দিকে দুঃখ আর ক্ষোভ প্রকাশে তিনি যে সময় ব্যয় করলেন তাঁর মেয়ে সে সময়টায় নিজের প্রেমকে সংহত করার সুযোগ পেল। তাঁর শ্বশুরকুলের আত্মীয়দের সম্পন্ন জায়গা জমিতে তিনি বাছুরকে খোজা বানানো আর খচ্চরকে পোষ মানানোর কাজে ব্যস্ত থাকলেন, আর তাঁর কন্যা সানন্দ সময় কাটাতে লাগলো এক দঙ্গল জ্ঞাতি বোনদের সঙ্গে, যাদের নেতৃত্ব দিত হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ, ওদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী ও সবচাইতে বেশি সহানুভূতিশীল, যে কিনা একজন বিবাহিত মানুষের প্রেমে পড়েছে, তার চাইতে বয়সে বিশ বছরের বড়, ছেলেমেয়ের বাবা, আর এখন তার পানে গোপন চকিত দৃষ্টিপাত করেই হিল্ডাব্রান্ডাকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

ভালেদুপারে অনেক দিন থাকার পর এবার ওরা পর্বতমালার ঢালু পথ দিয়ে এগিয়ে গেল, অতিক্রম করলো ফুলে ছাওয়া মাঠ আর স্বপ্নের মতো চারণক্ষেত্র, আর প্রতিটি গ্রামেই তাদের অভ্যর্থনা হল প্রথম গ্রামটির মতোই : গানবাজনা, আতশবাজি, গোপন যোগসাজশে পটু জ্ঞাতি বোনের দল আর টেলিগ্রাফ অফিস থেকে যথা সময়ে আসা তারবার্তা সহযোগে। ফারমিনা ডাজা বুঝলো যে ভালেদুপারে ওরা প্রথমদিন যা দেখেছিল তা অসাধারণ বা ব্যতিক্রমী কিছু ছিল না, এই উর্বর প্রদেশে মানুষ সপ্তাহের প্রতিটি দিনই উদযাপন করত ছুটির দিনের মতো করে। দর্শনার্থীরা রাত হলে যেখানে পারতেন সেখানেই শয্যা গ্রহণ করতেন, যেখানে ক্ষুধার্ত বোধ করতেন সেখানেই খেতে বসে যেতেন, এ সব বাড়িঘরের দরজা থাকতো সর্বদাই উন্মুক্ত, সবখানেই পাওয়া যেত ঝুলন্ত দোলনা-শয্যা, আর পাছে টেলিগ্রামে খবর এসে পৌঁছবার আগেই কোনো অতিথি দল চলে আসে তাই উনুনে সারাক্ষণই রান্না হতে থাকতো গরম গরম মাংসের ঝোল, আর সত্যিই প্রায় সর্বদাই খবর পাবার আগেই অতিথিরা এসে উপস্থিত হতেন। হিন্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ সফরের বাকি গোটা সময়টাই ফারমিনা ডাজার সঙ্গী হয়, নিজের উৎফুল্ল প্রকৃতি দিয়ে সে বোনের জটপাকানো জটিল রক্তের মধ্যে দিয়ে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে, তাকে পৌঁছে দেয় একেবারে তার উৎপত্তির উৎস মূলে। ফারমিনা ডাজা নিজের সম্পর্কে অবহিত হল, এই প্রথমবার তার নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হল, তার বুক ভরে গেল স্বাধীনতার বাতাসে, তার নিজেকে মনে হল বন্ধু পরিবৃত, সে আশ্রয়হীন নয় এবং এই অনুভূতি তাকে ফিরিয়ে দিল তার মানসিক স্থৈর্য এবং বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা। তার জীবনের শেষ দিকে স্মৃতিকাতরতার যুক্তিহীন স্বচ্ছতা নিয়ে এই ভ্রমণের স্মৃতি প্রায়ই তার মনে পড়তো, মনে হত মাত্র সেদিন এটা ঘটেছে।

সে রোজ হাঁটতে বেরুতো। একদিন রাতে হাঁটার পর ঘরে ফিরে একটা জিনিস আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, মানুষ যে শুধু ভালবাসা ছাড়া সুখী হতে পারে তাই নয়, ভালবাসা স্বত্ত্বেও সে সুখী হতে পারে। আবিষ্কারটা তাকে শঙ্কিত করলো, কারণ তার এক জ্ঞাতি বোন নিজের বাবা-মাকে লোরেঞ্জো ডাজার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলাপ- আলোচনা করতে শুনে ফেলেছিল। লোরেঞ্জো ডাজা বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী ক্লিওফাস মাসকোটের সঙ্গে তার মেয়ে ফারমিনার বিয়ের সম্ভাবনার কথা নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফারমিনা ডাজা ওকে চিনতো। ঝলমলে সাজে সজ্জিত তার সুদৃশ্য ঘোড়ায় চড়ে প্লাজায় ঘুরে বেরাতে সে তাকে দেখছে, রুচিশীল, চালাক-চতুর, স্বপ্নিল চোখের পাতা, মনে হয় পাথরের বুক থেকেও তা দীর্ঘশ্বাস টেনে আনতে সক্ষম, আর তখন ফারমিনা শীর্ণ দেহ, ছোট একটা পার্কে বাদাম গাছের নিচে কোলের উপর কবিতার বই নিয়ে বসে থাকা বেচারা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতির সঙ্গে ক্লিওফাস মাসকোটের তুলনা করলো এবং তার মনে তখন সন্দেহের বিন্দু মাত্র ছায়াও রইলো না।

ওই সময় হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ এক গণকের দেখা পায়। তার ভবিষ্যদ্বাণীর দক্ষতা তাকে বিস্মিত করে। তার কথা শুনে হিল্ডাব্রান্ডার হৃদয় আশা ও আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ফারমিনা ডাজাও তার কাছে যায়। সেখানে তাসের সাক্ষ্য ও ভবিষ্যদ্বাণী তার বুকে গভীর সাহস এনে দেয় : তার বিয়ে নিঃসন্দেহে সুখের হবে, দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং ফারমিনার মনে কোনো সন্দেহ থাকলো না যে একমাত্র তার প্রেমিকের সঙ্গেই ওই রকম সৌভাগ্যজনক নিয়তি সুনিশ্চিত হতে পারবে। ওই নিঃসন্দিগ্ধতায় উজ্জীবিত হয়ে ফারমিনা ডাজা নিজের হাতে তার নিয়তির ভার নিল। এর ফলেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে পাঠানো তার টেলিগ্রামগুলি আর তার ইচ্ছার প্রকাশ ও কাল্পনিক প্রতিশ্রুতিদানের মধ্যে বাঁধা থাকলো না, সেগুলি হয়ে উঠলো নিয়মনিষ্ঠ, বাস্তবসম্মত এবং আগের চাইতেও তীব্র। সেখানে সুস্পষ্ট তারিখের কথা বলা হল,

কিভাবে সব কিছুর ব্যবস্থা হবে তার নির্দেশনা থাকলো, তাদের যখনই এর পর দেখা হবে তখনই, কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে, যেখানে এবং যেভাবে সম্ভব, তারা যে বিয়ে করবেই সে সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত হলো। ফারমিনা ডাজা তার ওই প্রতিশ্রুতিকে এতোটাই অলঙ্ঘনীয় বিবেচনা করে যে তার বাবা যখন তাকে ফোনেস্কা শহরে তার প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক নাচের আসরে যোগদানের অনুমতি দেন, তখন তার মনে হল যে তার ভাবী স্বামীর অনুমতি না নিয়ে ওখানে যাওয়া তার পক্ষে শোভন হবে না। ওই সময়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের অস্থায়ী হোটেলে তাস খেলছিল। ওখানেই ও খবর পেল যে ওর জন্য একটা জরুরি তারবার্তা অপেক্ষা করছে।

ফোনেস্কার এক টেলিগ্রাম অপারেটর খবরটা দিয়েছে। সে তাকে ধরবার জন্য সাতটা মধ্যবর্তী স্টেশনের চাবি টিপেছে, ফারমিনা ডাজা একটা নাচে যোগ দিতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনুমতি চেয়েছে সে। যখন অনুমতিটা ফারমিনা পেল তখন কিন্তু সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারে না, সত্যিই কি ফ্লোরেন্টিনো তারের ওপাশ থেকে অনুমতি দিয়েছে, নাকি অন্য কেউ। যতটা খুশি হল তার চাইতে বেশি বিস্মিত হল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। ফারমিনা ডাজা যেন সন্দেহমুক্ত হয়ে বুঝতে পারে সেজন্য সে একটা সঙ্কেতের সাহায্য নিল। সে টেলিগ্রাফ অপারেটরকে জানালো, ওকে বলো যে আমি মুকুটশোভিত দেবীর নামে শপথ করে এটা বলছি। ফারমিনা ডাজা সহজেই সঙ্কেতটি বুঝল এবং তার প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের নাচে সকাল সাতটা পর্যন্ত কাটিয়ে দিল, তারপর তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে গির্জায় সকালের প্রার্থনায় যোগ দেবার জন্য ছুটে বাড়ি ফিরলো। ইতিমধ্যে তার ট্রাঙ্কের নিচে সুরক্ষিত ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চিঠি ও টেলিগ্রামের সংখ্যা তার বাবা তার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার চাইতে অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল, আর সে একজন বিবাহিতা রমণীর মতো আচার-আচরণ আয়ত্ত করে ফেলেছিল। লোরেঞ্জো ডাজা আচার-আচরণে তার এই পরিবর্তনের মধ্যে প্রমাণ পেলেন অন্য কিছুর। তাঁর স্থির বিশ্বাস হল, দূরত্ব এবং সময় তার কন্যাকে ওর কৈশোরিক অলীক কল্পনা থেকে মুক্ত করেছে। তিনি ওর বিয়ের পরিকল্পনার কথা আর তুললেন না। এসকোলাস্টিকা পিসিকে তাড়িয়ে দেবার পর থেকে পিতা ও কন্যার মধ্যে একটা আনুষ্ঠানিক চাপা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, এখন তার মধ্যেই একটা তরলতার সৃষ্টি হল। তাদের আপাত স্বস্তিপূর্ণ কথাবার্তা চালচলন দেখে এ সম্পর্ক যে মায়া-মমতা ও স্নেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা কারোর সন্দেহ করার উপায় ছিল না।

এই সময়েই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার একটি সঙ্কল্পের কথা ফারমিনা ডাজাকে জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার জন্য নিমজ্জিত জাহাজটি থেকে ঐশ্বর্য উদ্ধার করবে। এ কথা সত্য যে এক বিকালে দৈব অনুপ্রেরণার মতো সঙ্কল্পটি তার মনে ঝলসে ওঠে। সেদিন সমুদ্র মনে হচ্ছিল অ্যালুমিনিয়মের পাতে মোড়া। মুলিন গুল্মের প্রভাবে অসংখ্য মাছ জলের ওপর ভেসে উঠেছিল। আকাশের তাবৎ পাখি এতো খাবার দেখে অসম্ভব হল্লা করতে শুরু করে। জেলেরা তাদের বৈঠা তুলে ওদের তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিষিদ্ধ করা যে অলৌকিক ঘটনা তাদের সামনে বিরাট সম্পদ এনে দিয়েছে তার ভাগ তারা পাখিদের দিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুলিন গুল্মের ব্যবহার দ্বারা মাছকে ঘুম পাড়ানো ঔপনিবেশিক যুগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আইন করে, কিন্তু গোটা ক্যারিবীয় অঞ্চলের জেলেরা সাধারণত এটা ব্যাপক হারে ব্যবহার করতো, ডিনামাইট ব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত। ফারমিনা ডাজার সফরের সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অনেকটা সময় কাটাতো জেটিতে বসে, সমুদ্রের বুকে জেলেরা তাদের বিশাল জাল নিয়ে নৌকায় করে কিভাবে ঘুমন্ত মাছগুলিকে ধরছে সেটা দেখতে দেখতে। ছোট ছোট বালকের একটা দল ওই সময় তীরে দাঁড়ানো কৌতূহলী লোকদের সমুদ্রে টাকাপয়সা ছুড়ে মারতে বলতো, তারা ডুব দিয়ে সমুদ্রের গভীরতা থেকে তা আবার ওদের তুলে এন দেবে। বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজগুলি এখানে নোঙ্গর ফেললে এই বালকরাই ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে সাঁতরে জাহাজে গিয়ে উঠতো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক পর্যটক এদের নিয়ে নানা কাহিনী রচনা করেছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এদের চেনে বহু দিন ধরে, সে প্রেমে পড়বার আগ থেকে, কিন্তু ওরাই যে একদির ডুবে যাওয়া পালের জাহাজটা থেকে ঐশ্বর্যরাশি তুলে আনতে সক্ষম হতে পারে এই সম্ভাবনা সেদিনের আগে তার মনে কখনো উদয় হয় নি। পরের রবিবার থেকে প্রায় এক বছর পরে ফারমিনা ডাজার প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত তার উন্মত্ততায় এবার আরেকটি চালিকা শক্তি যুক্ত হল।

ক্ষুদে সাঁতারুদের একজনের নাম ইউক্লিড। ফ্লোরেন্টিনোর সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলার পর সে-ও জলের নিচে অভিযানের বিষয়ে ফ্লোরেন্টিনোর মতই উত্তেজিত হয়ে উঠলো। ফ্লোরেন্টিনো অবশ্য তার অভিযানের আসল উদ্দেশ্যের সবটুকু তাকে খুলে বলে নি, তবে ডুবুরি এবং নৌ-চালক হিসেবে তার দক্ষতা সম্পর্কে সে নিজেকে নিশ্চিত করে নেয়। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো এক নিঃশ্বাসে ও জলের বিশ মিটার নিচ পর্যন্ত ডুব দিতে পারবে কিনা, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, ও একা একা ঝড়ের মধ্যে কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়া শুধু নিজের সহজাত অনুভূতি দ্বারা উন্মুক্ত সমুদ্রের বুকে নৌকা চালাতে পারবে কিনা, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, সোটাভেন্টো দ্বীপপুঞ্জের সব চাইতে বড় দ্বীপটির ষোল নৌ-মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটা নির্দিষ্ট স্থান সে খুঁজে বের করতে পারবে কিনা, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, জেলেদের মাছ ধরায় সাহায্য করার জন্য ওরা ওকে যে মজুরি দেয় সেই একই মজুরিতে সে ফ্লোরেন্টিনোর কাজটা করতে রাজি কিনা, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। তবে রবিবারের জন্য ওকে বাড়তি পাঁচ রিয়াল দিতে হবে। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে সে আত্মরক্ষা করতে পারবে কিনা, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। হাঙ্গরকে ভয় দেখাবার কিছু জাদুকরি কৌশল সে জানে। সে ওকে জিজ্ঞাসা করলো, ইক্যুজিশনের নির্যাতন কুঠুরিতে যে রকম নির্যাতন করা হয় ওর ওপর যদি সে রকম নির্যাতন চালানো হয় তাহলেও সে গোপন কথা ফাঁস করতে পারবে না, আর ইউক্লিড বললো হ্যাঁ। বস্তুতপক্ষে সে কোনো কিছুতেই না বলে নি, আর এমনই প্রত্যয়ের সঙ্গে ও হ্যাঁ বলতে জানতো যে ওকে সন্দেহ করার কোনো উপায় ছিল না। তারপর ও তার খরচের হিসাব দিল : নৌকার ভাড়া, দাঁড়-বৈঠার ভাড়া, মাছ ধরার জিনিসপত্রের ভাড়া, ওদের অভিযানের পেছনে যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই সেটা দেখাতে হবে, কেউ যেন কোনো সন্দেহ না করে। তা ছাড়া কিছু খাবার, পানীয় জল, একটা ল্যাম্প, কয়েকটা মোমবাতি এবং কোনো বিপদ ঘটলে দরকার হবে সেজন্য শিকারিদের একটা চোঙ্গও সঙ্গে নিতে হবে।

ইউক্লিডের বয়স হবে বারো বছরের মতো, ক্ষিপ্রগতি এবং বুদ্ধিমান, মুখে সারাক্ষণই খই ফুটছে, শরীরটা বান মাছের মতো, একটা ছোট ফুটো দিয়েও পিছলে গলে যেতে সক্ষম। রোদে-জলে-হাওয়ায় গায়ের রঙ এমন হয়েছে যে তার আসল রঙ কেমন ছিল তা বলা মুশকিল, আর তার ওই গাত্র বর্ণের জন্য তার বড় বড় হলুদ চোখ দুটি দেখাতো খুব উজ্জ্বল। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তখুনি ঠিক করলো যে ওই রকম বিশাল গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের জন্য এই বালকই হল সব চাইতে উপযুক্ত সঙ্গী। আর দেরি না করে তারা পরের রবিবারেই তাদের অভিযানে বেরিয়ে পড়লো।

তারা জেলে-বন্দর থেকে খুব সকালে যাত্রা করলো, সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব জিনিস নেয়া হয়েছে, মন-মেজাজ ভালো। ইউক্লিড প্রায় দিগম্বর, কোমরে একটা নেংটি প্যাচানো, ওটাই ছিল তার সার্বক্ষণিক পোশাক, আর ফ্লোরেন্টিনো আরিজার পরনে কেতাদুরস্ত ফ্রককোট, মাথায় কালো হ্যাট, পায়ে পেটেন্ট চামড়ার বুট, গলায় বো-টাই, হাতে একটা বই, উপসাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর সময়টুকুতে পড়বার জন্য। ওই প্রথম রবিবারেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা উপলব্ধি করে যে ইউক্লিড নৌকা চালনায় যেমন দক্ষ ডুবুরির কাজেও তেমন দক্ষ, সাগরের স্বভাব ও প্রকৃতি এবং উপসাগরে যে সব ধ্বংসাবশেষ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সে সম্পর্কে সে বিস্ময়কর জ্ঞানের অধিকারী। সে প্রতিটি জংধরা পরিত্যক্ত জাহাজের বিশদ খুঁটিনাটিসহ ইতিহাস বলে দিতে পারে, জলে ভেসে থাকা প্রতিটি বয়ার বয়স তার জানা, তাবৎ জঞ্জালের উৎস সম্পর্কে সব তথ্য তার নখের ডগায়, স্পেনীয়রা উপসাগরের প্রবেশমুখ বন্ধ করার জন্য যে শেকল ব্যবহার করে তার মধ্যে কটা আংটা আছে তাও সে জানে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা শঙ্কিত হল, সে কি তার অভিযানের আসল উদ্দেশ্যও জানে? সে তাকে বেশ কয়েকটা চতুর প্রশ্ন করার পর তার উত্তর শুনে বুঝলো যে, না, তার এ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য কী তা সে জানে না।

অস্থায়ী হোটেলটিতে হারিয়ে যাওয়া ঐশ্বর্যের কাহিনী শোনার পর থেকেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই সময়ে পালের জাহাজগুলির গতিপ্রকৃতি ও তাদের স্বভাব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল। প্রবালের গভীরতায় ডুবে থাকা সান হোসে-ই একমাত্র জাহাজ নয়। বস্তুতপক্ষে ওটা ছিল টেরা ফার্মা নৌবহরের পতাকাবাহী জাহাজ, পালামার বিখ্যাত পোর্টোবেলো মেলা থেকে যাত্রা করে ওই জাহাজ এখানে এসে পৌঁছয় ১৭০৮ সালের মে মাসে। পোর্টোবেলোতে জাহাজটা তুলে নেয় পেরু এবং ভোরাক্রুজের তিনশো তোরঙ্গ ভর্তি রুপা আর কোনটাডোরা দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করা একশো দশটি তোরঙ্গ ভর্তি মুক্তা। জাহাজটি এখানে অবস্থান করে এক মাস। ওই সময় দিন রাত ধরে এখানে সর্বজনীন উৎসব চলে। বাকি ঐশ্বর্য জাহাজে তোলা হয় স্পেন সাম্রাজ্যকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে : মুজো এবং সোমোনডোকো থেকে একশো ষোল ট্রাঙ্ক ভর্তি পান্না এবং ত্রিশ মিলিয়ন স্বর্ণমুদ্রা।

টেরা ফার্মা নৌবহরে ছিল বিভিন্ন আয়তনের অন্তত বারোটি সরবরাহ জাহাজ। বহরটি বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে একটি ফরাসি রণতরী ইউনিট সঙ্গে নিয়ে। তারা ছিল অস্ত্রসম্ভারে সুসজ্জিত, কিন্তু কমান্ডার চার্লস ওয়েজাবেরের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ রণতরী ইউনিটের নির্ভুল কামানের গোলার সামনে তারা নিজেদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হল। কমান্ডার ওয়েজাবের সোটাভেন্টো দ্বীপপুঞ্জের উপসাগরের প্রবেশমুখে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাই সান হোসে-ই একমাত্র ডুবিয়ে দেওয়া জাহাজ ছিল না, তবে কতোগুলি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয় আর কতোগুলি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণিক লিখিত বিবরণ নেই। যা নিশ্চিত জানা যায় তা এই যে, যে জাহাজগুলি প্রথম দিকেই ডুবে যায় পতাকাবাহী জাহাজটি ছিল তাদের একটি, আর ওই জাহাজের কমান্ডার এবং সকল নাবিক কোয়ার্টার ডেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের নিয়েই জাহাজটি জলের মধ্যে তলিয়ে যায়। আর যা নিশ্চিত ভাবে জানা যায় তা হলো এই যে, বহন করা পণ্যের সিংহভাগই ছিল ওই জাহাজে।

তদানীন্তন নৌযান চলাচলের চার্ট দেখে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা জাহাজগুলির গতিপথ সম্পর্কে অবহিত হল। তার মনে হল জাহাজটি ঠিক কোথায় ডুবেছে তা সে নির্ধারণ করতে পেরেছে। ওরা দুজন বোকাচিকার দুটি দুর্গের মধ্য দিয়ে উপসাগর দিয়ে বেরিয়ে এলো। প্রায় চার ঘণ্টা নৌকা চালাবার পর ওরা দ্বীপপুঞ্জের অভ্যন্তরীণ প্রশান্ত জলরাশিতে প্রবেশ করলো। এখানে প্রবালের গভীরতা থেকে ওরা ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে গলদা চিংড়ি তুলে আনতে পারতো। বাতাস ছিলো এতো কোমল, সাগর এতো শান্ত ও স্বচ্ছ, যে ফ্লোরেন্টিনো মনে হল সে নিজেই বুঝি জলের মধ্যে তার প্রতিবিম্ব। পশ্চাদজলরাশির একেবারে সুদূর প্রান্তে, সব চাইতে বড় দ্বীপটি থেকে দু’ঘণ্টা পথের দূরত্বে, ওরা জাহাজ ডুবির জায়গায় এসে পৌঁছল।

অসহনীয় সূর্যের তাপে তার আনুষ্ঠানিক পোশাকে হাঁসফাঁস করতে করতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ইউক্লিডকে বললো যে তাকে এখানে বিশ মিটার নিচ পর্যন্ত ডুব দিয়ে জলের তলায় যা কিছু পাবে তাই তুলে নিয়ে আসতে হবে। জল ছিল আশ্চর্য রকম স্বচ্ছ। ফ্লোরেন্টিনো জলের নিচে ইউক্লিডকে নড়াচড়া করতে স্পষ্ট দেখতে পেল, ওর সামনে দিয়ে যাতায়াত করা নীল হাঙ্গরগুলির মধ্যে ও যেন একটা তামাটে হাঙ্গর। হাঙ্গরগুলি কিন্তু ওকে স্পর্শও করলো না। এরপর ফ্লোরেন্টিনো ওকে হঠাৎ একটা প্রবালপুঞ্জের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলো, আর ঠিক যখন তার মনে হল যে ওর ফুসফুসে এখন আর একটুও বাতাস নেই ঠিক তখনই তার পেছনে সে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। ইউক্লিড দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে দাঁড়িয়ে আছে, ওর কোমর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে। এই ভাবে ওরা গভীর থেকে গভীরতর জায়গায় খুঁজে বেড়ালো, সর্বদাই অগ্রসর হতে থাকলো উত্তরের দিকে, ভীরু শামুকের মতো ছোট সামুদ্রিক প্রাণী আর গোলাপের ঝোপের ছায়ার মধ্যে দিয়ে, তারপর এক সময় ইউক্লিড ফ্লোরেন্টিনোকে উদ্দেশ করে বললো, আপনি কী খুঁজছেন তা যদি আমাকে না বলেন তা হলে আমি কেমন করে সেটা খুঁজে পাবে? আমরা এভাবে অনর্থক সময় নষ্ট করছি।

কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো ওকে কিছু বললো না। ইউক্লিড তখন প্রস্তাব করলো যে ফ্লোরেন্টিনো তার কাপড়জামা খুলে তার সঙ্গে ডুব দিক, আর কিছু না হোক পৃথিবীর নিচে যে আরেকটা আকাশ আছে সেটা দেখুক, প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ দেখুক একবার। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো যে ঈশ্বর সমুদ্র সৃষ্টি করেছেন জানালার ভেতর দিয়ে দেখার জন্য, তা ছাড়া সে কখনো সাঁতার শেখেনি। একটু পরেই অপরাহ্নের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এলো, বাতাস হয়ে উঠলো ঠাণ্ডা ও আর্দ্র। কোনো রকম আগাম জানান না দিয়েই হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল, বাতিঘরের সাহায্য নিয়ে নৌকা চালিয়ে তাদের বন্দরের অবস্থান খুঁজে পেতে হল। ওরা উপসাগরে ঢুকবার আগে সাদা রঙের একটা বিশাল ফরাসি সামুদ্রিক জাহাজ তাদের খুব কাছ ঘেঁষে চলে গেল, তার সবগুলি আলো ঝলমল করে জ্বলছিল, পেছনে রেখে গেল টগবগ করা সাদা ফেনা, সেদ্ধ ফুলকপির মতো। এভাবে ওরা আরো তিনটি রবিবার নষ্ট করলো এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যদি তার গোপন উদ্দেশ্যের কথা ইউক্লিডকে না বলতো তাহলে সময়ের ওই অপচয় চলতেই থাকতো। যাই হোক, বিষয়টা জানার পর ইউক্লিড তাদের খোঁজার প্ল্যানটা সম্পূর্ণ বদলে দিল। এবার ওরা পালের জাহাজগুলির পুরনো জলপথ ধরে অগ্রসর হল, ফ্লোরেন্টিনো আরিজার আগের ঠিক করা জায়গার অন্তত ষাট নৌমাইল পূর্ব দিক দিয়ে। প্রায় দু’মাস পরে এক বর্ষণমুখর অপরাহ্ণে ইউক্লিড জলের তলায় অনেকক্ষণ সময় কাটালো, নৌকা ততক্ষণে অনেক দূরে ভেসে চলে গেছে, ইউক্লিডকে নৌকায় পৌঁছবার জন্য প্রায় আধ ঘণ্টা সাঁতার কাটতে হয়, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা একা বৈঠা চালিয়ে নৌকাকে ওর কাছে নিয়ে আসতে পারছিলো না। তারপর ও নৌকায় উঠে এসে ওর মুখের মধ্য থেকে মেয়েদের দুটি রত্নখচিত অলঙ্কার বের করে ফ্লোরেন্টিনোকে এমন ভাবে দেখালো যেন সেগুলি তার অধ্যবসায়ের পুরস্কার।

এর পর ও যা বললো তা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে এতো মুগ্ধ ও চমৎকৃত করলো যে সে তৎক্ষণাৎ সাঁতার শেখার সিদ্ধান্ত নিল, জলের নিচে যতদূর সম্ভব সে ডুব দেবে নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখবে। ইউক্লিড তাকে জানালো যে এখানে, মাত্র আঠারো মিটার জলের নিচে, পুরনো দিনের এতো পালের জাহাজ প্রবাল পাহাড়গুলির মধ্যে আটকে আছে যে তা গুণে কুলানো যায় না, আর সেগুলি এতো বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে পড়ে আছে যে তার শেষ দেখা যায় না। সে বললো, আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই যে উপসাগরে যে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজগুলি ভাসছে তার একটাও নিমজ্জিত জাহাজগুলির মতো ভালো অবস্থায় নেই। সে ফ্লোরেন্টিনোকে বললো যে অনেকগুলি জাহাজের পাল এখনো অক্ষত আছে, ডুবে যাওয়া জাহাজগুলিকে জলের তলদেশে আরো স্পষ্ট দেখা যায়, ওদের দেখে মনে হয় তারা যেন নিজেদের স্থান ও কালকে সঙ্গে নিয়ে তলিয়ে গেছে, সেই ৯ই জুন শনিবার ডুবে যাবার সময় যে বেলা এগারোটার সূর্য তাদের আলোকিত করেছিল এখনো যেন তা তাদের আলোকিত করে রেখেছে। তার কল্পনার প্রবল তাড়নায় তার কণ্ঠস্বর আটকে যাচ্ছিল। সে বললো যে নিমজ্জিত জাহাজগুলির মধ্যে খুব সহজেই সান হোসে-কে চেনা যাচ্ছিল, জাহাজটির পেছন দিকে সোনার অক্ষরে তার নাম দেখতে পেয়েছে সে, তবে ইংরেজদের কামানের গোলায় সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে ওই জাহাজটি। ইউক্লিড বললো যে সে তার মধ্যে একটা অক্টোপাসও দেখেছে, তিন শতাব্দির বেশি বয়সের, ওর শুঁড়গুলি কামানের মুখের মধ্য দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, জাহাজের খাবার ঘরে সে এতো বিশাল আকার ধারণ করে আছে যে তাকে মুক্ত করতে জাহাজটাকে ধ্বংস করতে হবে। সে বললো, সে জাহাজের কমান্ডারের মৃতদেহও দেখেছে, যুদ্ধের পোশাক পরা, জাহাজের সামনের দিকের কৃত্রিম একটা জলাধারে আড়াআড়ি হয়ে ভাসছে। তিনি যে যাবতীয় ধনরত্ন নিয়ে জাহাজের একেবারে খোলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন নি তার একমাত্র কারণ বোধ হয় এই যে তার ফুসফুসে তখন আর পর্যাপ্ত বাতাস ছিল না। প্রমাণ হিসেবে ইউক্লিড দেখালো একটা পান্নাখচিত কানের দুল আর কুমারী মেরীর একটা মেডেল, তার শেকলটা নোনায় ক্ষয়ে গেছে।

এই সময়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ফোনেস্কাতে ফারমিনা ডাজাকে লেখা একটা চিঠিতে প্রথবারের মতো ওই ধনরত্নের কথা বলে। ফারমিনার ফিরে আসার অল্প কদিন আগে ফ্লোরেন্টিনো তাকে এই খবরটা দেয়। নিমজ্জিত জাহাজের কাহিনী ফারমিনা ডাজার ভালো করেই জানা ছিল, তার বাবার কাছ থেকে সে এ গল্প বহুবার শুনেছে। লোরেঞ্জো ডাজা একটি জার্মান ডুবুরি দলকে ওই ঐশ্বর্য উদ্ধারের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। এর পেছনে তিনি অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করেন। তিনি তাঁর প্রয়াস চালিয়ে যেতেন, যদি না ইতিহাস অ্যাকাডেমির বেশ কয়েকজন সদস্য তাঁকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়তো যে সমস্ত ব্যাপারটা একটা নিছক ধোঁকাবাজি, জনৈক ভাইসরয় রাষ্ট্রের ধনরত্ন লুট করার পর নিজের চুরি ঢাকবার জন্য এই কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। তা ছাড়া ফারমিনা ডাজা জানতো যে নিমজ্জিত জাহাজটি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার ধারণা অনুযায়ী বিশ মিটার জলের নিচে নয়, সেটা পড়ে আছে দুশো মিটার জলের গভীর অতলে। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাব্যিক অতিশয়োক্তিতে সে এতো অভ্যস্ত ছিলো যে সে তার জাহাজ অভিযানকে তার অন্যতম সফল উদ্যোগ বলে অভিহিত করলো। কিন্তু সে যখন বিস্ময়কর বিশদ বর্ণনাসহ আরো কয়েকটি চিঠি পেল এবং দেখলো যে ফ্লোরেন্টিনো তার ভালবাসার প্রতিশ্রুতিদানের মতো একই রকম গুরুত্ব দিয়ে ওই সব চিঠি লিখছে, তখন সে আর হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজের কাছে তার আশঙ্কার কথা স্বীকার না করে পারলো না, তার চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া প্রেমিক নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *