প্রেম ও কলেরা – ৫

হোটেলটা ছিল ঔপনিবেশিক যুগের একটি প্রাসাদ। এক সময় ভালো দিন ছিল সেটার। এর বিশাল আকারের মার্বেল পাথরের ঘরগুলি এখন পেস্টবোর্ড দিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট ঘরে বিভক্ত, উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার জন্য সেখানে ফুটো করা আছে। এই ছোট ঘরগুলি ভাড়া দেয়া হয়, উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার জন্য যেমন, তেমনি ভেতরের কাজকর্ম করার জন্যও। পরাধিকার চর্চা করে ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করার জন্য কাউকে কাউকে চড়া দাম দিতে হয়েছে বলে গল্প আছে। একবার সেলাইর কাঁটা ঢুকিয়ে একজনের চোখ গেলে দেয়া হয়েছিল। আরেকজন উঁকি দিয়ে দেখে যে কুকর্মে লিপ্ত রমণীটি তার স্ত্রী। বেশ সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকরাও বেশ্যাদের ছদ্মবেশ ধরে স্বল্প সময়ের জন্য জাহাজ থেকে নামা নাবিকদের সঙ্গে এখানে আসতেন, নিজেদেরকে কিছুক্ষণ নিছক ভুলে থাকার তাগিদে। আরো অজস্র গল্প শুনে ওই রকম একটি ঘরে যাবার কল্পনাতেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভয়ে শিউরে উঠলো। আর তাই, এভাবে লুকিয়ে দেখা এবং নিজেকে দেখানোর মধ্যে যে ইউরোপের রাজা-মহারাজাদের সূক্ষ্ম রুচির পরিচয় বিধৃত, লোটারিও থুগুট কখনো তা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিশ্বাস করাতে পারেন নি।

লোটারিও থুগুটের দৈহিক বিশালত্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল তার দেবশিশুর মতো গোলাপ-কুঁড়ি জননেন্দ্রিয়। এটা নিশ্চয়ই কোনো সৌভাগ্যজনক ত্রুটি ছিল, কারণ সব চাইতে বেশি পোড় খাওয়া পাখিরাও তার সঙ্গে বিছানায় যাবার অধিকার নিয়ে তর্কবিতর্ক করতো, আর তারপর তারা এমন চিৎকার করতো যেন কেউ তাদের জবাই করছে আর তাদের চিৎকারে প্রাসাদের ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠতো, সেখানে বাস করা ভূতপ্রেতগুলিও ভয়ে কাঁপতো। লোকে বলতো যে থুগুট সাপের বিষের একটা মালিশ ব্যবহার করতেন যার ফলে মেয়েদের কোমরের পশ্চাদ্ভাগ আগুনের মতো তেতে উঠতো কিন্তু তিনি শপথ করে বলেছেন যে ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের অতিরিক্ত তাঁর আর কিছু নেই। হো হো করে হাসতে হাসতে তিনি বলতেন, এ সবই হচ্ছে শুধু ভালোবাসা। সম্ভবত তার কথাই যে সত্য এটা বুঝতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনেক বছর কেটে যায়। অবশেষে তার ভাববিলাসী শিক্ষার উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে ফ্লোরেন্টিনোর যখন একটি লোকের সঙ্গে দেখা হয় তখন তার সব সন্দেহ কেটে যায়। তিনটি রমণীকে একই সময়ে শোষণ করে লোকটি রাজার হালে জীবন কাটাতো। রোজ সকালে তার পায়ের সামনে লুটিয়ে ওই তিনজন তার কাছে ওদের হিসেব বুঝিয়ে দিতো, কম মুনাফার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করতো এবং নিজেদের বাসনা পূরণের জন্য একটাই আর্জি জানতো, যে তার জন্য সব চাইতে বেশি টাকা এনেছে তার সঙ্গে সে বিছানায় যাবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হয় একমাত্র ভয়ে ওরা এই রকম গ্লানিকর আচরণ করতো কিন্তু তিন মেয়ের মধ্যে একজন ভিন্ন কথা বলে তাকে চমকে দেয়।

সে বললো, শুধু ভালোবাসার জন্যই একজন মানুষ এ সব করে।

লোটারিও থুগুট হোটেলটির অন্যতম সম্মানিত খরিদ্দার হয়ে ওঠেন রতিক্রিয়ায় তাঁর পারদর্শিতার জন্য ততটা নয় যতটা তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণীয় গুণাবলীর জন্য। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও মালিকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল তার শান্ত ও পলায়নপর স্বভাবের জন্য। তার শোকের সব চাইতে কঠিন সময়ে সে হোটেলের একটা শ্বাসরুদ্ধকর ছোট ঘরে ঢুকে তালা বন্ধ করে কবিতা আর আবেগপ্রবণ ধারাবাহিক প্রেমের গল্প পড়তো আর তার স্বপ্নকল্পনা বারান্দার কালো সোয়ালো পাখির বাসা আর চুম্বনের শব্দ ও দিবানিদ্রার সময়ের নিস্তব্ধতার মধ্যে পাখার ঝাপটানি ছড়িয়ে রাখতো। কিন্তু সন্ধ্যার পর, আবহাওয়া যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, তখন দিনের কর্ম শেষে যে সব মানুষ কিছু সান্ত্বনা পেতে এবং খানিকটা দ্রুত ভালবাসার খোঁজে এখানে আসতো তাদের কথাবার্তা না শুনে কোনো উপায় ছিল না। এর ফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বহু বিশ্বাসভঙ্গের কথা শুনলো, এমনকি কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যও সে জেনে ফেললো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু খরিদ্দার এবং স্থানীয় সরকারি কর্মচারীও তাদের স্বল্পস্থায়ী প্রেমিকাদের কাছে ওই সব কথা বলতো, চিন্তাও করতো না যে পাশের ঘরে কারো কানে এ সব কথা পৌঁছে যেতে পারে। এই ভাবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আরেকটি খবর পায়। সোটাভেন্টো দ্বীপপুঞ্জের বারো নৌমাইল উত্তরে অষ্টাদশ শতাব্দিতে একটা স্প্যানিশ পালতোলা জাহাজ পাঁচশো বিলিয়ন পেসোরও বেশি মূল্যের খাঁটি সোনা ও মহার্ঘ মণি-মুক্তার পশরা নিয়ে ডুবে যায় এবং এখনো তা সমুদ্রের তলদেশেই বিরাজ করছে। কাহিনীটি শুনে সে অবাক হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক মাস কেটে যাবার আগ পর্যন্ত সে বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবে নি। কিন্তু এক সময় তার প্রেম ওই ডুবন্ত ঐশ্বর্য উদ্ধার করার এক দুর্দম ইচ্ছা তার মনে জাগিয়ে তুললো, যেন ফারমিনা ডাজা সোনার বৃষ্টি ধারায় স্নান করতে পারে।

বহু বছর পর সে যখন কবিতার রসায়ন দ্বারা পরিশীলিত তার আদর্শায়িত মেয়েটি সত্যি সত্যি কি রকম দেখতে ছিল তা মনে করার চেষ্টা করে তখন সে দেখলো তখনকার মর্মভেদী গোধূলি থেকে তাকে আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। তার প্রথম চিঠির উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে থাকার সময় সে যখন নিজেকে দৃষ্টির আড়ালে রেখে ওকে লক্ষ করতো তখনো সে তাকে দেখেছিল বেলা দুটার ঝিকিমিকির মধ্যে বাদাম গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলের জলধারায় স্নাত। বছরের ঋতু যাই হোক না কেন ওখানে সর্বদাই বিরাজ করতো এপ্রিল মাস। লোটারিও থুগুটের সঙ্গে গির্জায় বেহালা বাজাতে যাবার পেছনে তার উৎসাহের কারণ ছিল একটাই, বাদক দলের সঙ্গে সে যে সুবিধাজনক স্থানে দাঁড়ায় সেখান থেকে সে স্তুতি গীত গাইবার সময় ফারমিনা ডাজাকে ভালো ভাবে দেখতে পেতো, তার পতপত করে ওড়া পোশাক তার চোখে পড়তো। কিন্তু তার চিত্তবিভ্রমই শেষ পর্যন্ত ওই আনন্দ উপভোগের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তার আত্মার অবস্থার তুলনায় মরমীয়া সঙ্গীতগুলি এতোই নির্বিষ মনে হলো যে সে তার মধ্যে উচ্ছল নাচের প্রেমগীতি যোগ করে সেটাকে আরেকটু উত্তেজক করার প্রয়াস পেল, আর লোরেঞ্জো থুগুট তখন বাদন দল থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হলেন। এই সময়েই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আরেকটি আকাঙ্ক্ষার কাছে আত্মসমর্পন করে। ট্রান্সিটো আরিজা তাঁর উঠানের টবে গার্ডেনিয়া ফুল ফোটাতেন। ফারমিনা ডাজার স্বাদটা জানবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো ওই ফুল খেতে শুরু করলো। এই সময়েই সে তার মায়ের তোরঙ্গে এক শিশি সুগন্ধি কোলোন আবিষ্কার করে। হামবুর্গ- মার্কিন জাহাজ কোম্পানির নাবিকরা চোরাই মাল হিসেবে এ সব বিক্রি করতো। তার প্রিয়ার অন্য স্বাদগুলি আস্বাদন করার লোভ সামলাতে না পেরে সে ওই কোলোন পান করতে শুরু করলো। সারা রাত ধরে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত, সে ওই শিশির কোলোন খেতে থাকে। শেষে সে ফারমিনা ডাজাতে মাতাল হয়ে গেল, প্রথমে কোলোন পান করে ও পরে বন্দরের সরাইখানাগুলিতে মদ গিলে, তারপর জেটিতে বসে সমুদ্রের চুলখোলা আকাশের নিচে নাবিকদের সান্ত্বনা প্রদান করা প্রেমলীলা দেখতে দেখতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। ট্রান্সিটো আরিজা সকাল ছটা পর্যন্ত ওর অপেক্ষা করলো, তার মনে হল দুশ্চিন্তায় সে মরে যাবে, ছেলেকে সে সব অসম্ভব আস্তানায় খুঁজে বেড়ালো, অবশেষে দুপুর বারোটার সামান্য আগে সে ফ্লোরেন্টিনোকে খুঁজে পেল উপসাগরের একটা খাড়িতে, যেখানে সচরাচর জলে ডোবা মড়া ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে আসতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে সেখানে সুরভিত বমির মধ্যে গড়াগড়ি করতে দেখা গেল।

তার রোগমুক্তির পর সেরে ওঠার সময়ের ছেদটুকুর সুবিধা নিলেন ফ্লোরেন্টিনোর মা। চিঠির উত্তর না পেয়ে তার নিষ্ক্রিয়তাকে তিনি তিরস্কার করলেন। তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন দুর্বলরা কখনো প্রেমের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে নি, ওই রাজ্য কঠোর এবং নির্দয় এবং মেয়েরা সাহসী ও দৃঢ়চেতা মানুষের কাছেই ধরা দেয়, কারণ জীবনের মুখোমুখি হবার জন্য যে নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় তা মেয়েদেরকে ওই রকম পুরুষরাই দেয়। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এই শিক্ষা গ্রহণ করলো, হয়তো একটু বেশি ভালো ভাবেই। ট্রান্সিটো আরিজা যখন তাকে তার কালো স্যুট, ফেল্ট হ্যাট, তার আবেগ জাগানিয়া বো-টাই এবং সেলুলয়েড কলারে সুসজ্জিত হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন তখন তিনি একটা গর্বের অনুভূতি লুকাতে পারলেন না, যার মধ্যে মাতৃসুলভতার চাইতে কামাসক্তির অংশ কম ছিল না। তিনি ওকে ঠাট্টা করে বললেন, সে কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাচ্ছে নাকি। ফ্লোরেন্টিনোর কান লাল হয়ে গেল। সে উত্তর দিল, প্রায় ওই রকমই। মা দেখলেন যে ছেলে ভয়ে প্রায় নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কিন্তু তার সঙ্কল্প ছিল অপরাজেয়। তিনি তার উদ্দেশে তাঁর শেষ সাবধান বাণী ও আশীর্বাদ উচ্চারণ করলেন, উচ্ছলভাবে হাসতে হাসতে, এবং দুজনে একসাথে। তার বিজয় উদযাপন করবার জন্য তিনি তাকে আরেক শিশি কোলোন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ও এক মাস আগে ফারমিনা ডাজাকে তার চিঠি দিয়েছিল। তারপর থেকে পার্কটিতে ফিরে না যাবার যে প্রতিশ্রুতি ও তাকে দিয়েছিল সে প্রায়ই তা ভঙ্গ করে কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে, ও যেন তাকে দেখতে না পায়। কোনো কিছুই বদলায় নি। দুটোর দিকে বাদাম গাছের নিচে পড়ালেখার পালা সাঙ্গ হত, শহর তখন সবেমাত্র দিবানিদ্রা থেকে জেগে উঠেছে। বেলা পড়ে দিন ঠাণ্ডা হয়ে উঠতে শুরু করা পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা তার পিসির সঙ্গে ওইখানে বসে সেলাই করতো। আজ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পিসি বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য সে সামরিক পদক্ষেপে রাস্তা অতিক্রম করে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, কিন্তু সে সম্বোধন করলো ফারমিনা ডাজাকে নয়, তার পিসিকে। দয়া করে আপনি ভেতরে যান, আমাকে এক মিনিটের জন্য একা এই তরুণীর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে দিন। পিসি বললেন, কী ঔদ্ধত্য! আমি শুনতে পারবো না ওকে বলার মতো এমন কিছু তোমার থাকতেই পারে না।

সে বললো, তাহলে আমি ওকে কিছু বলবোই না, কিন্তু আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি এর পরিণতির জন্য আপনি দায়ী হবেন।

এসকোলাস্টিকা ডাজা আদর্শ প্রেমিকের কাছ থেকে এ রকম আচরণ প্রত্যাশা করেন নি, কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই প্রথমবারের মতো তাঁর মনে হল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কথা বলছে স্বয়ং হোলি স্পিরিটের অনুপ্রেরণায়। তিনি তরুণ-তরুণী দুটিকে দোরগোড়ায় বাদাম গাছের নিচে একা রেখে সেলাইর কাঁটা বদলাবার জন্য বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

প্রকৃতপক্ষে, শীতের সোয়ালোর মতো তার জীবনে অকস্মাৎ উদিত তার এই মিতবাক পাণিপ্রার্থী সম্পর্কে ফারমিনা ডাজা খুব কমই জানতো। চিঠিতে ওর সই দেখেছিল বলে সে তার নামটা জানে, নইলে তাও জানতো না। সে জেনেছিল যে ও এক অবিবাহিতা মহিলার পিতৃহীন সন্তান। মহিলা পরিশ্রমী এবং অচপল স্বভাবের, কিন্তু তার যৌবনের একটি মাত্র ভুলের জন্য তিনি সমাজের সামনে কলঙ্ক হয়ে বেড়াচ্ছেন। সে এটাও জেনেছিল যে ও ডাকবিলি করে না, বরং ও একজন যোগ্যতাসম্পন্ন সহকারী, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, আর তার মনে হল সেদিন যে ও এখানে টেলিগ্রাম বিলি করতে এসেছিল সেটা ছিল তাকে দেখার একটা অজুহাত মাত্ৰ। এই ভাবনাটা তাকে নাড়া দিল। সে এটাও জেনেছিল যে ও গির্জার বাদক দলের একজন সঙ্গীত শিল্পী, যদিও প্রার্থনার সময় চোখ তুলে ওর দিকে তাকাবার সাহস সে কখনো সঞ্চয় করতে পারে নি, তবে এক রবিবার একটা বিস্ময়কর গোপন তথ্যের মতো তার সামনে একটি সত্য প্রকাশ পেল, অন্য যন্ত্রীরা যখন সবার জন্য তাদের যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করছে তখন বেহালা বাদক বাজাচ্ছে একমাত্র তার জন্য। সে নিজের জন্য এ রকম একটি মানুষ বেছে নিতো না। কিন্তু বেওয়ারিশ শিশুর চশমার মতো তার চশমা, তার পাদ্রীজনোচিত পোশাক, তার রসহ্যমণ্ডিত সঙ্গীত ফারমিনা ডাজার মনে একটা অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। সে কদাচ কল্পনা করে নি যে ভালবাসার বহু মুখোশের মধ্যে কৌতূহল হলো একটি।

সে কেনো যে ওর চিঠিটা নিল তা সে নিজের কাছেও ব্যাখা করতো পারলো না। কিন্তু সেজন্য সে নিজেকে তিরস্কার করে নি, তবে চিঠির উত্তরদানের ক্রমবর্ধমান চাপ তার জীবনকে জটিল করে তোলে। তার মনে হল তার বাবার প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি সাধারণ চাহনি, তুচ্ছতম ভাবভঙ্গি যেন তার গোপন কথাটি জানার জন্য পাতা ফাঁদ। তার ভয় এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে সে খাবার টেবিলে কথা বলাই বন্ধ করে দিল, পাছে কোনো অসতর্ক উক্তির মাধ্যমে সে তার গোপন কথাটি প্রকাশ করে ফেলে, এমনকি সে তার পিসিকেও এড়িয়ে যেতে শুরু করলো যদিও তিনি ওর অবদমিত দুশ্চিন্তাকে নিজের দুশ্চিন্তা বলেই মনে করেছিলেন। ফারমিনা সময়ে অসময়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বারবার পড়া চিঠিটা আবার পড়লো, চিঠির আটান্নটি শব্দের তিনশো চৌত্রিশটি অক্ষরের মধ্যে কোনো গোপন সঙ্কেত আছে কিনা তা আবিষ্কারের চেষ্টা করলো, সাদা অক্ষরে যা বলা হয়েছে তার বাইরেও কোনো ইঙ্গিত আছে কিনা সেটা ধরতে চেষ্টা করলো, কিন্তু প্রথম পাঠের সময় সে যা বুঝেছিল তার বেশি কিছুই সে বুঝতে পারলো না। সেদিন তার বুক তোলপাড় করে উঠেছিল, সে কোনো রকমে ছুটে বাথরুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, খামটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভেবেছিল একটা দীর্ঘ আবেগময় চিঠি সে পাবে, কিন্তু পেল শুধু ছোট একটা সুরভিত কাগজে লেখা মাত্র কয়েকটি কথা, যার সুদৃঢ় সঙ্কল্প তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।

প্রথমে সে কোনো গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাই করে নি যে তাকে এ চিঠির উত্তর দিতে হবে, কিন্তু চিঠির বক্তব্য এতো স্পষ্ট ছিলো যে উত্তর না দেয়ার কোনো উপায়ই থাকলো না। ইতিমধ্যে, তার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণার ভেতরে, স্বীকার করতে না চাইলেও সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো যে সে প্রায়ই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা ভাবছে, তার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠছে, এমনকি বিশেষ বিচলিত হয়ে সে নিজেকে প্রশ্নও করেছে কেন ও ঠিক সময়ে পার্কে উপস্থিত থাকছে না, সে নিজেই ওকে আসতে বারণ করেছে সে কথা সে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। সে ভেবেছিল যে ওই সময়টায় সে তার চিঠির উত্তর লেখায় ব্যস্ত থাকবে। আর এখন সে তার কথা সারাক্ষণ ভাবতে লাগলো, সে যে কারো কথা এভাবে ভাবতে পারে তা সে কখনো কল্পনাও করে নি। এখন তার মাঝে মাঝেই মনে হয় ওর যেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই ও বুঝি সেখানে আছে, ও যেখানে থাকতে পারে না সে চায় ও সেখানে থাকুক, তার মনে হয় সে যখন ঘুমিয়ে থাকে ও তখন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দেখছে, সে এর একটা শারীরিক অনুভূতি পর্যন্ত পায়, তাই সেদিন অপরাহে সে যখন পার্কের হলুদ পাতাগুলির উপর তার দৃঢ় পদক্ষেপের শব্দ শুনতে পায় তখন তার মনে হয়েছিল এটা হয়তো তার কল্পনারই আরেকটা চাতুরী। কিন্তু যখন ও কর্তৃত্বের সুরে, ওর সাধারণ উদাসীন ভঙ্গির চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভঙ্গিতে, তার কাছ থেকে চিঠির উত্তর দাবি করলো তখন সে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। সে বিষয়টা পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাজে অজুহাত শুনে চলে যাবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অতল গহ্বর পেরিয়ে এখানে আসে নি।

ও তাকে লক্ষ করে বললো, চিঠি যখন তুমি গ্রহণ করেছো তখন উত্তর না দিলে অসৌজন্য প্রকাশ পাবে।

গোলক ধাঁধার সমাপ্তি ঘটে ওখানেই। ফারমিনা ডাজা তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, দেরির জন্য ওর ক্ষমা ভিক্ষা করলো, কথা দিল যে ছুটি শেষ হবার আগেই ও তার চিঠির উত্তর পাবে এবং সে তা পায়ও। স্কুল খুলবার তিন দিন আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসকোলাস্টিকা পিসি একটা তথ্য জানার জন্য টেলিগ্রাফ আপিসে যান। পিয়েড্রাস ডি মোলারে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে কত খরচ পড়বে তা জানতে চান তিনি। যে সব জায়গায় টেলিগ্রাফ যায় তার তালিকাতে ওই গ্রামের নামই ছিল না। যাই হোক, তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সাহায্য নিলেন, কিন্তু ওকে যে তিনি আগে কখনো দেখেছেন সেটা বুঝতেই দিলেন না, তারপর তিনি ভুল করে টিকটিকির চামড়ায় মোড়ানো তাঁর একটা প্রার্থনা পুস্তক কাউন্টারের উপর রেখে চলে যান, ওটা ছিল নিছক ভান, আর তার মধ্যে ছিল সোনালি নকশা আঁকা সুন্দর একটি খাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বাকি বিকালটা কাটিয়ে দিল গোলাপ ফুল খেয়ে, চিঠিটা বারবার পড়ে, একটি একটি অক্ষর করে, যত বেশি পড়লো তত বেশি গোলাপ খেল, আর মাঝরাত নাগাদ এতো বার চিঠিটা পড়লো আর এতো বেশি গোলাপ ফুল খেল যে তার মা বাধ্য হলেন একটা গরুর বাচ্চার মতো তার মাথা চেপে ধরে তাকে এক ডোজ ক্যাস্টর অয়েল খাইয়ে দিতে।

ওই বছরেই তারা বিধ্বংসী প্রেমে পড়ে। দুজনের একজনও অপর জনের কথা না ভেবে, তাকে স্বপ্নে না দেখে, তার চিঠি পাওয়া এবং উত্তর দেবার জন্য সমান অধৈর্য না হয়ে থাকতে পারলো না। ওই উন্মাতাল বসন্তে, কিংবা তার পরের বছরে, ওদের কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবার কোনো সুযোগ হয় নি। অধিকন্তু, তাদের প্রথম দেখার পর থেকে অর্ধশতাব্দি পরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার সিদ্ধান্তের কথা পুনর্ব্যক্ত করার আগ পর্যন্ত তাদের একটি দিনও বাদ যায় নি যখন তারা একে অন্যকে চিঠি লেখে নি, এক সময়ে তারা দিনে দুটো করেও চিঠি লিখেছে, কিন্তু এসকোলাস্টিকা পিসি যে আগুন জ্বালাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি যখন সে আগুনের লেলিহান শিখার তীব্রতা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তখন তিনি এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেন।

পিসি প্রথম চিঠিটা টেলিগ্রাফ অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের নিয়তির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিশোধ নেবার জন্য। তারপর পথে ওরা যখন আকস্মিক দেখা হবার ভান করে তখন তিনি চিঠিপত্রের বিনিময়ে বাধা দিলেন না, তবে তিনি ওদেরকে কোনো কথাবার্তা বলার অনুমতি দেবার সাহস পেলেন না, সে কথার্বাতা যতই তুচ্ছ বা অল্প সময়ের জন্য হোক না কেন। এ সত্ত্বেও, তিন মাস পরে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তাঁর ভাইঝি তাঁর প্রথম ধারণা অনুযায়ী কোনো মেয়েলী খেয়ালের শিকার হয় নি এবং এখন তাঁর নিজের জীবনই প্রেমের আগুনের ফলে ভীষণ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আসল ঘটনা হল, তাঁর ভাই-এর দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়া এসকোলাস্টিকা ডাজার জীবন ধারণের কোনো উপায় ছিল না এবং তিনি নিশ্চিত জানতেন তাঁর অত্যাচারী প্রকৃতির ভাই তাঁর বোনের বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটা কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সময় হলে তিনি নিজে তাঁর যৌবনকাল থেকে যে প্রচণ্ড দুঃখ- যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন তাঁর ভাইঝিকে তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারলেন না, আর তখন তিনি এমন একটা কৌশলের আশ্রয় নিলেন যা তাঁকে তাঁর নির্দোষিতার মোহটুকু বজায় রাখতে সাহায্য করলো। ব্যবস্থাটা ছিল সহজ। প্রতিদিন বাড়ি থেকে অ্যাকাডেমি যাবার পথে ফারমিনা ডাজা কোনো একটা গোপন স্থানে তার চিঠিটা রেখে দিতো আর ওই চিঠিতেই সে ওকে জানিয়ে দিতো কোথায় সে এর উত্তরটা পাবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও একই কাজ করতে লাগলো। এই ভাবে, বছরের বাকি সময়টার জন্য, এসকোলাস্টিকা পিসির বিবেকের দ্বন্দ্ব স্থানান্তরিত হল গির্জার কোনো একটা জায়গায়, গাছের গর্তে, ঔপনিবেশিক আমলের কোনো দুর্গের ফাটলে। মাঝে মাঝে ওদের চিঠি বৃষ্টিতে ভিজে যেতো, কাদায় নোংরা হত, দৈবদুর্বিপাকে ছিঁড়ে যেত, আরো নানা কারণে কয়েকটা হারিয়েও যেত, কিন্তু ওরা সব সময়ই পরস্পরের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপনের একটা পথ পেয়েই যেত।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রতি রাতেই লিখতো। দোকানের পেছনের ঘরে তেলের প্রদীপের বিষাক্ত ধোঁয়া গিলতে গিলতে সে চিঠি লিখে চলতো। লাইব্রেরিতে পড়া তার প্রিয় কবিদের অনুকরণে লেখা চিঠিগুলি ক্রমান্বয়ে অসংলগ্ন ও উন্মত্ত প্রলাপের রূপ ধারণ করতে থাকে। লাইব্রেরিতে এরই মধ্যে প্রায় আশিটি গ্রন্থ সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিল। এক সময়ে তার মা তাকে নিজের যন্ত্রণা উপভোগ করার কথা বলেছিলেন, এখন তিনি তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। ভোরে মোরগের ডাক শোনার পর তিনি তার শোবার ঘর থেকে পুত্রের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতেন, এ রকম করলে তুমি তো পাগল হয়ে যাবে। কোনো মেয়ের দামই এতো হয় না। এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগের শিকার হতে তিনি ইতোপূর্বে কাউকে দেখেন নি। কিন্তু ও তাঁর কথার বিন্দুমাত্র দাম দিল না। মাঝে মাঝে সে সারা রাত না ঘুমিয়ে সকালে কাজে যেতো, প্রেমের উচ্চগুতায় তার মাথার সব চুল তখন এলোমেলা। অফিসে যাবার পথে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে সে তার চিঠিটা লুকিয়ে রাখতো যেন ফারমিনা ডাজা স্কুলে যাবার সময় সেখান থেকে তা তুলে নিতে পারে। কিন্তু ফারমিনা ডাজার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকম। বাড়িতে বাবা আর স্কুলে সিস্টারদের সতর্ক দৃষ্টির কারণে সে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কিংবা ক্লাসে নোট নেবার ছল করে তার খাতার পাতার অর্ধেকটা মাত্ৰ কোনো রকমে লিখতে পারতো। কিন্তু শুধু সময়ের স্বল্পতা বা ধরা পড়ার ভয়ে এমনটা ঘটে নি। তার নিজস্ব স্বভাব তাকে তার চিঠিতে আবেগের চোরা গর্ত এড়িয়ে শুধু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করে, ফলে তার চিঠিগুলির রূপ হয়ে দাঁড়ায় একটা জাহাজের লগ বুকের মতো। প্রকৃতপক্ষে এ সব চিঠির উদ্দেশ্য ছিল মনোযোগকে ভিন্নমুখী করা, আগুনে হাত না দিয়েও কয়লাকে জ্বলন্ত রাখা, আর অন্য দিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিঠির প্রতিটি ছত্রে নিজেকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করতে থাকতো। ফারমিনাকে নিজের উন্মত্ততা দ্বারা সংক্রামিত করার জন্য মরীয়া হয়ে ক্যামেলিয়া ফুলের পাপড়ির বুকে পিনের সরু মাথা দিয়ে অনুকবিতা লিখে ফ্লোরেন্টিনো ফারমিনাকে পাঠালো। ফারমিনা নয়, সে-ই, দুঃসাহসিকতার সঙ্গে, তার এক চিঠির মধ্যে নিজের মাথার চুল ভরে দিল। সে আশা করেছিল যে ফারমিনা হয়তো তার বেণীর একটা সম্পূর্ণ গুচ্ছ প্রতিদান হিসেবে তাকে পাঠাবে কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হল না, তবে ওকে একটা কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ফ্লোরেন্টিনো সক্ষম হয়। এর পর থেকে ফারমিনা তার চিঠির সঙ্গে পাঠাতে শুরু করে অভিধানের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখা শিরা ওঠা শুকনো গাছের পাতা, প্রজাপতির ডানা, মায়াবী পাখির পালক, আর তার জন্মদিন উপলক্ষে ও তাকে দেয় সন্ত পিটার ক্লেভিয়ারের পোশাকের এক বর্গ সেন্টিমিটারের এক টুকরা কাপড়। সে সময় ওই রকম কাপড়ের টুকরা গোপনে বিক্রি হত, একজন স্কুলছাত্রীর পক্ষে বেশ চড়া দামেই বলতে হবে। তারপর একদিন রাতে, কোনো রকম সতর্ক সঙ্কেত ছাড়াই, বেহালা বাজাবার শব্দ শুনে সে ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে, বুঝতে পারে যে তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে একজন প্রেমগীতি বাজাচ্ছে, একই নাচের সুর বাজাচ্ছে বারবার, বারবার, আর সে শিউরে উঠে শুনলো যে প্রতিটি ছড়ের টানে ধ্বনিত হচ্ছে ধন্যবাদজ্ঞাপনের সুর, তার বাগানের ফুলের পাপড়ির জন্য, ওকে চিঠি লেখার জন্য অঙ্ক কষার সময় থেকে চুরি করা মুহূর্তগুলির জন্য, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চাইতে পরীক্ষার ক্ষেত্রে ওর কথা বেশি চিন্তা করার জন্য, তার ভয়ের জন্য, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে এতো বড় অবিবেচনার কাজ করতে পারে সেটা বিশ্বাস করার সাহস তার হল না।

পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না, কারণ প্রথমত সেরেনেড তথা জানালার নিচে দাঁড়িয়ে প্রিয়ার উদ্দেশে গীতবাদনের ক্ষেত্রে একটা সুর বারবার বাজাবার অর্থ কী তা তিনি জানতেন না, দ্বিতীয়ত খুব মন দিয়ে শোনা সত্ত্বেও ঠিক কোন বাড়ির উদ্দেশে ওটা নিবেদিত হয়েছিল তা তিনি স্থির করতে পারেন নি। এই সময় এসকোলাস্টিকা পিসির কথা শুনে তাঁর ভাইঝির প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তিনি অবিচল চিত্তে বললেন যে তাঁর শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তিনি একজন নিঃসঙ্গ বেহালা বাদককে দেখেছেন, ও পার্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তিনি এও জানালেন যে একটি সুর বারংবার বাজাবার অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদের কথা জানিয়ে দেওয়া। সেদিনের চিঠিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা স্পষ্ট করে লিখলো যে গত রাতে সে-ই বেহালা বাজিয়েছে, সুরটা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে, ফারমিনা ডাজাকে সে মনে মনে যে নামে ডাকতো তার সৃষ্টির নামকরণ সে ওই নামেই করেছে : মুকুট শোভিত দেবী। সে পার্কে আর ওই সুর বাজায় নি, কিন্তু সে তার পছন্দ মতো এমন সব জায়গায় চাঁদনি রাতে ওই সুর বাজিয়েছে যেখান থেকে ফারমিনা ডাজা তার শোবার ঘরে থেকেই নিরাপদে তা শুনতে সক্ষম হয়। তার একটা বিশেষ প্রিয় স্থান ছিল নিঃশব্দের সমাধিস্থল, একটা ন্যাড়া টিলার উপর, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে অরক্ষিত, শকুনির দল ঝিমুচ্ছে সেখানে, আর ওই পরিবেশে তার সঙ্গীত একটা অপ্রাকৃতিক ধ্বনিময়তা অর্জন করতো। পরে সে বাতাসের গতি চিনতে শিখলো এবং তার সুর যে প্রয়াজনীয় জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছেছে সে সম্পর্কে সে সুনিশ্চিত হল।

অর্ধশতাব্দির বেশি কাল ধরে এই দেশ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে চলেছিল। সে বছরের আগস্ট মাসে নতুন একটা গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এবং তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, সরকার সামরিক আইনের ঘোষণা দিল এবং ক্যারিবীয় উপকূলবর্তী সব প্রদেশে সন্ধ্যা ছটা থেকে সান্ধ্য আইন প্রবর্তন করলো। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গোলমাল ঘটে গিয়েছিল, সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিশোধমূলক বেশ কিছু নির্যাতন অত্যাচারও চালিয়েছিল কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনের অবস্থা ওই সময়ে এতই বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত ছিল যে পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অনবহিত থাকলো। ফলে একদিন ঊষালগ্নে একটি সামরিক পাহারা দল তাকে আবিষ্কার করলো এক বিচিত্র পরিবেশে। সে তার প্রেমগীতি দ্বারা মৃতের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করছে। তাকে গুপ্তচর বলে অভিহিত করা হলো, সে বিশেষ একটা সুর বাজিয়ে নিকটবর্তী জলপথে উদারপন্থী দস্যুদের জাহাজে গোপন খবর পাঠাচ্ছে এই অভিযোগ আনা হল তার বিরুদ্ধে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হত, কিন্তু অলৌকিক ভাবে সে বেঁচে যায়।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বলেছিল, গুপ্তচর? কী যা তা বলছেন? আমি এক হতভাগ্য প্রেমিক ছাড়া আর কিছু নই।

তাকে স্থানীয় সেনানিবাসে বন্দি করে রাখা হয়। তিন রাত সে ঘুমায় গোড়ালিতে শেকল বাঁধা অবস্থায়। যখন মুক্তি পেল তখন তার বন্দিদশার স্বল্পকালীনতার জন্য তার মনে হল যে সে প্রবঞ্চিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে, এমনকি তার বৃদ্ধ বয়সেও, যখন আরো অনেক যুদ্ধের ঘটনা তার স্মৃতিতে তালগোল পাকিয়ে ধূসর হয়ে গেছে, তখনও সে মনে করতো যে এই শহরে, সম্ভবত এই দেশে, সেই একটি মাত্র লোক যাকে প্রেমের কারণে পাঁচ পাউন্ড লোহা পায়ে টেনে বেড়াতে হয়।

তাদের উন্মত্ত পত্রালাপ দু’বছর চলার পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মাত্র এক অনুচ্ছেদের একটি চিঠিতে ফারমিনা ডাজাকে বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। ইতিপূর্বে গত ছয় মাস ধরে সে বিভিন্ন সময়ে তাকে একটা করে সাদা ক্যামেলিয়া ফুল পাঠিয়েছিল কিন্তু পরের চিঠিতেই ফারমিনা ফুলটা ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। ফলে সে নিঃসন্দেহ হল যে ফারমিনা পত্রালাপ চালিয়ে যেতে চায় কিন্তু বাগদানের মতো গুরুতর বিষয়কে বাদ দিয়ে। আসলে, ফুলের ওই আসা যাওয়ার পালাকে ফারমিনা সর্বদা প্রেমিকের একটা খেলা বলে গ্রহণ করেছিল, এর মধ্যে যে তার নিয়তির একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় বদলের ব্যাপার ছিল সেটা বিবেচনা করার কথা তার কখনো মনেই হয় নি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটা আসার পর তার এই প্রথমবারের মতো মনে হল সে বুঝি মৃত্যুর নখরাঘাত দ্বারা আহত হল। আতঙ্কিত হয়ে সে এসকোলাস্টিকা পিসিকে জানালো এবং পিসি সাহসিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তাকে পরামর্শ দিলেন, যে সাহসিকতা তার নিজের বিশ বছরের সময়ে ছিল না এবং যখন নিজের নিয়তি সম্পর্কে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তিনি তাকে বলেন, ওকে হ্যাঁ বলে দাও, তুমি যদি ভয়ে মরেও যাও তবুও, তুমি যদি পরে দুঃখ পাও তবুও, কারণ তুমি যাই করো না কেন, যদি না বলো তাহলে বাকি জীবনভর তোমাকে এর জন্য দুঃখ পেতে হবে।

কিন্তু ফারমিনা ডাজা এমনই বিভ্রান্ত বোধ করে যে সে বিষয়টা সম্পর্কে ভাবার জন্য কিছু সময় চাইলো; তারপর তিন মাস, অবশেষে চার মাস পার হয়ে গেলেও যখন সে কোনো উত্তর দিল না তখন সে আবার একটা ক্যামেলিয়া ফুল পেল, তবে এবার খামের মধ্যে আগের মতো শুধু একটা ফুল নয়, তার সঙ্গে এলো একটা চূড়ান্ত ঘোষণাও, এবারই শেষ, হয় এখনই, নইলে আর কখনো নয়। তখন ওই অপরাহেই এবার ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মৃত্যুর মুখ দর্শন করলো। সে একটা খাম পেল, স্কুলের নোট খাতার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে ফারমিনা পেন্সিলে এক লাইনের উত্তর লিখেছে : ঠিক আছে, আমি তোমাকে বিয়ে করবো যদি তুমি কথা দাও যে তুমি আমাকে কখনো বেগুন খেতে বাধ্য করবে না।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু তার মা ছিলেন। ছ’মাস আগে সে যখন তার বিয়ের ইচ্ছার কথা মাকে বলে তখনই তিনি তাদের পুরো বাসাটা ভাড়া নেবার জন্য কথাবার্তা শুরু করেছিলেন। তখন পর্যন্ত তিনি আরো দুটি পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। দোতলা একটা বাড়ি, সপ্তদশ শতাব্দির, স্প্যানিশ শাসনামলে যখন তামাকের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল তখন এ বাড়িতেই ছিল তাদের দপ্তর। পরে মালিকরা ধ্বংস হয়ে যাবার পর ভবনের বিভিন্ন অংশকে তারা একটু একটু করে ভাড়া দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তাদের ছিল না। বাড়ির একটা অংশ ছিল রাস্তার দিকে মুখ করা, সেখানে অবস্থিত ছিল তামাকের খুচরা দোকান, পেছন দিকে অন্য একটা অংশে ছিল একটা পাকা উঠান, ওখানে অবস্থিত ছিল কারখানা আর একটা বৃহাদাকার আস্তাবল, যেখানে বর্তমানে ভাড়াটিয়ারা তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে শুকাতে দিত। বাড়ির প্রথম অংশই ছিল সব চাইতে সুবিধাজনক এবং সুসংরক্ষিত, যদিও সব চাইতে ছোটও ট্রান্সিটো আরিজা থাকতেন ওই অংশে, পুরনো তামাকের দোকানেই ছিল তাঁর টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকানঘর। রাস্তার দিকে ছিল একটা মস্ত বড় দরজা, তার এক পাশে ছিল পূর্বতন গুদামঘর, বায়ু চলাচলের জন্য সেখানে ঢালু ছাদের একপাশে ছিল ছোট্ট একচিলতা একটা জানালা। ট্রান্সিটো আরিজা ওখানেই ঘুমাতেন। সমস্ত জায়গার অর্ধেকটা জুড়ে ছিল মালপত্র মজুদ রাখার স্থান, একটা কাঠের পার্টিশান দিয়ে আলাদা করা। সেখানে ছিল একটা টেবিল আর চারটা চেয়ার, যেমন খাওয়া দাওয়ার জন্য সেগুলি ব্যবহৃত হত তেমনি লেখার জন্যও। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সকাল অবধি লেখায় ব্যস্ত না থাকলে ওখানেই একটা দড়ির দোলনা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়তো। ওদের দুজনের জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল সেখানে, কিন্তু তৃতীয় একজন এলে বেশি ছোট হয়ে যাবে। বিশেষ করে সে যদি প্রেজেন্টেশান অব দি ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমিতে পড়া কোনো তরুণী হয়, যার বাবা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িকে প্রায় নতুনের মতো পুননির্মাণ করেছেন এবং সেই সময় যখন পুরনো অভিজাত সাত খেতাবধারী পরিবারের সদস্যরা প্রতি রাতে ভয়ে ভয়ে বিছানায় যেতেন, কখন না জানি ঘুমের মধ্যে তাদের প্রাসাদের ছাদ হুড়মুড় করে তাদের মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ট্রান্সিটো আরিজা মালিকদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হলেন, ওরা তাঁকে উঠান সংলগ্ন ভবনটিও ব্যবহার করতে দেবে এবং বিনিময়ে তিনি বাড়িটাকে পাঁচ বছরের জন্য ভালো ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন।

তা করার সামর্থ্য তাঁর ছিল। টুকিটাকি জিনিসের দোকান থেকে আর ব্যান্ডেজের জন্য ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় বিক্রি করে তার যে নগদ অর্থ রোজগার হত তা তাঁর পরিমিত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর বাইরে অস্বস্তি আক্রান্ত বেশ কয়েকজন নব্য দরিদ্রকে টাকা ধার দেওয়ার মাধ্যমে তিনি তাঁর সঞ্চয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলেন। তাঁর সতর্ক বিবেচনা বোধের জন্য ওরা চড়া সুদ দিয়েও তাঁর কাছে থেকে টাকা ধার করতেন। মহিলারা, রানীর মতো হাবভাব নিয়ে, তাঁর দোকানের সামনে তাঁদের গাড়ি থেকে নামতেন, সঙ্গে কোনো চাকর বা দাসী নেই, তাঁরা হল্যান্ডের লেস এবং বিভিন্ন সৌখিন জিনিস কেনার ভান করতেন, আর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার মাঝে মাঝে তাঁদের হারানো স্বর্গের শেষ ঝলমলে অলঙ্কারগুলি বন্ধক রাখতেন। ট্রান্সিন্টো আরিজা তাঁদের বংশ গৌরবের প্রতি এতোটাই শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাঁদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন যে তাঁদের অনেকেই তাঁর কাছ থেকে ওঁরা যে সাহায্য পেয়েছেন তার চাইতেও তিনি ওদের প্রতি যে সম্মান দেখাচ্ছেন তার জন্য বেশি কৃতজ্ঞ হয়ে ওখান থেকে ফিরে যেতেন। দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি ওদের বন্ধক দেয়া, তারপর এক সময় বন্ধক ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, তারপর আবার অশ্রুসিক্ত চোখে বন্ধক দেয়া হীরা মণি মুক্তার অলঙ্কারগুলি এতোবার দেখেন যে সেগুলি তাঁর চেনা হয়ে যায়, যেন ওই অলঙ্কারগুলি তাঁর নিজেরই। ছেলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবার পর তিনি তাঁর যাবতীয় লাভ সোনায় রূপান্তরিত করে একটা মাটির ভাণ্ডে ঢুকিয়ে তাঁর খাটের নিচে রেখে দেন। তারপর তিনি তাঁর হিসেবের খাতা নিয়ে বসেন। তখন ট্রান্সিটো আরিজা দেখলেন যে তিনি যে শুধু ভাড়া করা বাড়িটা পাঁচ বছর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন তাই নয়, একটু বুদ্ধির সঙ্গে চললে, ভাগ্য একটু সাহায্য করলে, তিনি হয়তো মৃত্যুর আগেই তাঁর প্রত্যাশিত এক ডজন নাতি-নাতনির জন্য সেটা কিনেও ফেলতে পারবেন। অন্য দিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টেলিগ্রাম আপিসে প্রথম সহকারীর অস্থায়ী পদ লাভ করেছে। লোটারিও থুগুটের আশা আগামী বছর তিনি স্কুল অব টেলিগ্রাফি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখান থেকে চলে গেলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাই হবে এই আপিসের প্রধান।

বিয়ের ব্যবহারিক দিক নিয়ে তাই কোনো সমস্যা থাকলো না। তবু, ট্রান্সিটো আরিজা দুটো জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া বিচক্ষণতার কাজ বলে মনে করলেন। প্রথমটি হল লোরেঞ্জো ডাজা সত্যি সত্যি কে সেটা জানতে হবে। তাঁর বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণের ঝোঁক থেকে তিনি কোথা থেকে এসেছেন তা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় এবং তাঁর জীবিকা অর্জনের উপায় সম্পর্কে কেউ সঠিকভাবে কিছু জানে না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওদের বাগদানপর্ব দীর্ঘ দিনের হতে হবে, পাত্র- পাত্রী যেন ব্যক্তি হিসেবে পরস্পরকে ভালো ভাবে চিনতে পারে এবং তাদের ভালবাসা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত তারা যেন বিশেষ সংযম বজায় রাখে। তিনি যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে অপেক্ষা করতে বললেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিষয়টি গোপন রাখতে রাজি হল, শুধু মা যেসব যুক্তি দেখান তার জন্য নয়, তার নিজের তপস্বীসুলভ নির্জনতাপিপাসু মনের জন্যও বটে। ও দেরি করার ব্যাপারেও রাজি হল, তবে শর্তগুলি তাঁর কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়, কারণ অর্ধশতাব্দির বেশি স্বাধীনতার কালে এই দেশে একদিনের জন্যও নাগরিক শান্তি বিরাজ করে নি। ফ্লোরেন্টিনো বললো, অপেক্ষা করতে করতে আমরা বুড়ো হয়ে যাবো।

তার ধর্মপিতা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, ঘটনাক্রমে এই আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি যুদ্ধ- বিগ্রহকে কোনো প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা করলেন না। তার মতে এ সব হল জমির মালিকদের ষাঁড়ের মতো তাড়িয়ে নেয়া গরিবদের সংগ্রাম, সরকার যেমন নগ্ন পদ সৈনিকদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় ঠিক সেই রকম। আসল যুদ্ধ, তিনি বললেন, হচ্ছে পাহাড় অঞ্চলে। শহরে আমরা কখনো যুদ্ধের গুলিতে নিহত হই নি, শহর অঞ্চলে আমাদের হত্যা করা হয়েছে শাসক ও কর্তৃপক্ষের আদেশে।

যাই হোক, ওদের পরবর্তী কয়েকটি চিঠিপত্রের মাধ্যমে বাগদানের বিশেষ ব্যাপারগুলি স্থির হয়ে গেল।

এসকোলাস্টিকা পিসির পরামর্শ অনুযায়ী ফারমিনা ডাজা দুটি শর্তই মেনে নিল, বাগদানপর্ব স্থায়ী হবে দু’বছর এবং বিষয়টা ততদিন সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। ও আরো জানালো যে ওর মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হবার পর, বড় দিনের ছুটির শেষে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পাণি প্রার্থনা করলে ভালো হয়। বাগদান পর্বের আনুষ্ঠানিকতা কিভাবে সম্পাদিত হবে তা সময় হলে ওরা ঠিক করবে, ফারমিনার বাবা এটা কতখানি অনুমোদন করেন তার ওপর তা বহুলাংশে নির্ভর করবে। ইত্যবসরে, তারা পরস্পরকে আগের মতোই ঘনঘন আবেগময় চিঠি লিখতে থাকে, তবে মনের পূর্বতন বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্ত হবার ফলে তাদের চিঠিপত্রের মধ্যে একটা গার্হস্থ্যের সুর লাগে, যা ছিল অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মতো। কোনো কিছুই তাদের স্বপ্নকে বিঘ্নিত করলো না।

ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জীবন বদলে যায়। ভালবাসার প্রতিদান তাকে এমন একটা আত্মবিশ্বাস ও শক্তি দিয়েছিল যা সে ইতোপূর্বে কখনো অনুভব করে নি। নিজের কর্মক্ষেত্রে সে এতোই স্বনির্ভরতার পরিচয় দেয় যে লোটারিও থুগুট বিনা দ্বিধায় তাঁর স্থায়ী সহকারী পদের জন্য ওর নাম করেন। ততদিনে তাঁর স্কুল অব টেলিগ্রাফি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজমের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এখন তাঁর অবসর সময় যে একমাত্র কাজ তিনি যথার্থ উপভোগ করতেন সেই কাজে ব্যয় করতে লাগলেন : বন্দরে গিয়ে নাবিকদের সঙ্গে অ্যাকর্ডিয়ান বাজানো এবং বিয়ার পান করা এবং সব শেষে সাময়িক হোটেলটিতে গিয়ে কোনো রাত-পাখির সঙ্গে নিশি যাপন করা। ওই প্রমোদস্থলে লোটারিও থুগুটের প্রভাবের কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অনেক দিন পরে আবিষ্কার করে। লোটারিও থুগুট এক সময় ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক এবং রাতের পাখিদের অধিকারী উভয়ই হন। তাঁর বহু বছরের সঞ্চয় দিয়ে একটু একটু করে তিনি এটা কিনে নেন, তবে তাঁর হয়ে সব কিছু পরিচালনা করতেন একজন শীর্ণকায়, কানা, ছোটখাটো মানুষ, পালিশ করা মাথা, আর এতো সদয় প্রকৃতির যে কেমন করে তিনি একজন ভালো ম্যানেজার হলেন তা বোঝা কঠিন। কিন্তু তিনি যথার্থই তাই ছিলেন। অন্তত ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তাই মনে হয় যখন তার কোনো অনুরোধ ছাড়াই তিনি তাকে জানালেন যে এই হোটেলের একটি কক্ষ তার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্ধ থাকবে, সেখানে যখন তার ইচ্ছা হবে সে তার উদরের নিম্নাংশের চাহিদা মেটাতে পারবে। তা ছাড়াও তার পড়াশোনা ও প্রেমপত্র লেখার জন্য সে একটা শান্ত জায়গা পাবে। আর বাগদানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ হবার জন্য যখন দীর্ঘ মাসগুলি কেটে যেতে থাকে তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আপিসের চাইতে তার হোটেল কক্ষেই বেশি সময় কাটাতে শুরু করে এবং মাঝে মাঝে সে যখন পোশাক পাল্টাবার জন্য বাড়িতে আসতো শুধু তখনই তার মা তার দেখা পেতেন।

বই পড়া তার একটা চির অতৃপ্ত ব্যাধিতে পরিণত হল। তাকে পড়তে শেখাবার পর থেকেই মা তাকে স্ক্যান্ডিনেভীয় লেখকদের সচিত্র বইপত্র কিনে দিতেন। ছোটদের কাহিনী হিসেবে বিক্রি হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি ছিল যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য নির্মম ও ন্যায়ভ্রষ্ট উপাখ্যানমালা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পাঁচ বছর বয়সেই ক্লাসে এবং স্কুলের বৈকালিক সাহিত্যানুষ্ঠানে ওই সব কাহিনী স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতো কিন্তু এর ফলেও ওই সব কাহিনী তার মনে যে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলতো তা প্রশমিত হত না। পক্ষান্তরে তা আরো বৃদ্ধি পেত। এর ফলে সে যখন কবিতা পড়তে শুরু করলো তখন দুটোর তুলনা করে তার মনে হল সে যেন এখন একটা মরুদ্যানে প্রবেশ করছে। তার কৈশোরেও সে পপুলার লাইব্রেরির সব বই গিলে খেয়েছে। ট্রান্সিটো আরিজা আর্কেড অব ফ্রাইবসের বইয়ের দোকানদারদের কাছ থেকে সুবিধাজনক দামে বই কিনে আনতেন। তার মধ্যে হোমার থেকে শুরু করে নিম্নতম মানের স্থানীয় কবিদের কাব্যগ্রন্থও থাকতো, আর ফ্লোরেন্টিনো যা সামনে পেত তাই পড়তো, যেন তাই ছিল নিয়তি নির্ধারিত এবং এতো বছর এতো বই পড়ার পরও কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বিচার করার ক্ষমতা সে অর্জন করতে পারে নি। তবে একটা জিনিস সে পরিষ্কার বুঝলো; গদ্যের চাইতে কবিতা তার বেশি পছন্দ এবং কবিতার ক্ষেত্রেও তার বেশি পছন্দ প্রেমের কবিতা, আর ওই সব কবিতা দ্বিতীয় পাঠের পরই, ইচ্ছা না থাকলেও তার মুখস্থ হয়ে যেত, আর যে সব কবিতার ছন্দ ও মিলবিন্যাস যতো ভালো, তার আবেদন যত মর্মভেদী, সেসব কবিতাই সে বেশি সহজে শিখে ফেলতো।

ফারমিনা ডাজাকে লেখা তার প্রথম দিকের চিঠিগুলির আসল উৎস ছিল ওই সব কবিতা। স্প্যানিশ রোমান্টিক কবিদের কাঁচা অপরিণত প্রেম সম্ভাষণগুলি সে ওখান থেকেই তার চিঠির জন্য চয়ন করে। তার চিঠি ওই ধারাতেই চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাস্তব জীবন হৃদয়বেদনার চাইতে অধিকতর পার্থিব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিদানে তাকে বাধ্য করে। ওই সময়ে সে সমকালের অশ্রুসিক্ত ধারাবাহিক উপন্যাসগুলিও পড়তে আরম্ভ করে, আরো নিকৃষ্ট মানের লৌকিক কাহিনীও পড়তে থাকে। দুই সেন্টাভো মূল্যে স্থানীয় কবিদের কাব্য পুস্তিকা শহরের খোলা চত্বরে ও দোকানপাটের পাশের ঘেরা জায়গায় বিক্রি হত। সেই সব কবিতা মায়ের সাথে একসঙ্গে পড়ে সে চোখের জল ফেলতে শেখে। কিন্তু একই সঙ্গে সে স্বর্ণ যুগের অপরূপ সুন্দর ক্যাস্টিলীয় কাব্যও স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে পারতো। সাধারণ ভাবে, তার হাতের কাছে যা পড়তো এবং যে ক্রম অনুসারে পড়তো, তার সবই সে পাঠ করতো। তাই প্রেমে পড়ার কঠিন দিনগুলির বহু পরে, যখন সে আর তরুণ নয়, তখনো সে প্ৰথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ফেলে ইয়ং পিপলস ট্রেজারির পুরো বিশ খণ্ড, গার্নিয়ার ব্রাদার্সের ক্লাসিকস ইন ট্রান্সলেশনের সম্পূর্ণ ক্যাটালগ এবং প্রোমেটিও সংগ্রহে প্রকাশিত ডন ভিসেন্ট ব্লাস্কো ইবানেজের সব চাইতে সহজ রচনাগুলি।

যাই হোক, অস্থায়ী হোটেলে তার যৌবনকালের রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড শুধু বই পড়া আর আবেগদীপ্ত চিঠি লেখায় সীমাবদ্ধ থাকে নি, ওই সময়ে প্রেমহীন প্রেমের গোপন বিষয়াবলীতেও সে দীক্ষিত হয়ে ওঠে। ওই ভবনে জীবন শুরু হতো দুপুরের পরে, তখন তার বন্ধু পাখিরা শয্যা ছেড়ে উঠতো, জন্মগ্রহণ করার সময় যে রকম নিরাভরণ ছিল ঠিক সেই ভাবে, ফলে কাজের শেষে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন ওখানে এসে উপস্থিত হত তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করতো এক দঙ্গল নগ্ন পরী অধ্যুষিত এক প্রাসাদে। তাদের সঙ্গে যাতায়াত করা মুখ্য চরিত্রগুলির বিশ্বাসভঙ্গের কারণে তারা শহরের যাবতীয় গোপন খবর জেনে ফেলতো, ওই খবরগুলি তারা তখন, তাদের ভাষ্যসহ, একে অন্যকে চিৎকার করে বলতো। তাদের নগ্নতায় তারা তাদের অতীতের কিছু কিছু নিদর্শন তুলে ধরতো : পেটের উপর ছুরির কাটা দাগ, পিস্তল-বন্দুকের গুলির ক্ষত চিহ্ন, প্রেমের ক্ষুরের আঘাত, কসাইর হাতে সেলাই করা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের নমুনা। দিনের বেলায় তাদের কারো কারো সঙ্গে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও থাকতো, যৌবনের স্পর্ধা অথবা অসাবধানতার ফসল তারা, ওদের এখানে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মায়েরা তাদের কাপড় জামা খুলে ফেলতো, এই নগ্নতার স্বর্গে ওরা যেন নিজেদের ভিন্নরকম মনে না করে সে জন্য। সবাই নিজের নিজের রান্না করতো, আর ওরা যখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে নিমন্ত্রণ করতো তখন তার চাইতে ভালো আর কেউ খেত না, কারণ প্রত্যেকের কাছ থেকে সে তার সব চাইতে ভালো জিনিসটা তুলে নিত | প্রতিদিনের এই উৎসব সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো। সন্ধ্যা হলেই নগ্ন মেয়েগুলি গান গাইতে গাইতে, কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে, বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেত, একে অন্যের কাছ থেকে সাবান, টুথব্রাশ, কাঁচি ধার নিত, পরস্পরের চুল কেটে দিত, ধার করা পোশাক পরতো, বিষণ্ণ ভাঁড়ের মতো মুখে রঙ মাখতো, তারপর রাতের প্রথম শিকার ধরবার জন্য রাস্তায় বেরুতো। তখন ওই বাড়ি হয়ে উঠতো নৈর্ব্যক্তিক ও মানবতাবর্জিত, তখন পয়সা না দিয়ে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করা ছিল অসম্ভব।

ফারমিনা ডাজার সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আর কোনো জায়গায় এতো স্বস্তি বোধ করতো না, কারণ এই একটি জায়গাতেই তার মনে হত সে বুঝি ওর সঙ্গেই আছে। সম্ভবত ওই একই কারণে সুন্দর রুপালি চুলের এক রুচিশীল বয়স্ক মহিলাও এখানে থাকতেন। তিনি নগ্ন মেয়েদের বন্ধনমুক্ত জীবনে অংশ নিতেন না, ওই মেয়েরাও তাঁর প্রতি এক ধরনের ধর্মীয় ভাব নিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। জনৈক অপরিণত প্রেমিক তাঁর অল্প বয়সে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছিল, তাঁকে কিছুকাল উপভোগ করে, তারপর তাঁকে এখানে ফেলে রেখে উধাও হয়ে যায়। তাঁর গায়ে কলঙ্কের দাগ সত্ত্বেও তিনি বেশ ভালো একটা বিয়ে করতে সক্ষম হন। যখন তিনি বেশ বৃদ্ধ হয়ে পড়েন এবং নিঃসঙ্গ, তখন তাঁর দুই ছেলে আর তিন মেয়ের মধ্যে একটা তর্কের জন্ম হয়, কে মাকে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু তিনি তাঁর যৌবনের ভোগ-লালসার স্মৃতি বিজড়িত এই হোটেলের চাইতে ভালো কোনো বাসস্থানের কথা চিন্তা করতে পারলেন না। এখানকার স্থায়ী কক্ষটিই ছিল তাঁর বাড়ি এবং এই ব্যাপারটা তাঁর সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তাৎক্ষণিক মানসিক যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। তিনি তাকে বলেন যে ফ্লোরেন্টিনো সমগ্র পৃথিবীতে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলে পরিচিত হবে, কারণ এ রকম একটা কামোত্তেজক স্থানে বাস করেও সে গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তাঁর আত্মাকে সমৃদ্ধ করেছে। আর তার দিক থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মহিলার প্রতি এতটাই মায়া-মমতাবোধ করে যে সে তাঁকে তাঁর বাজার-সওদা করতে সাহায্য করতে শুরু করে আর প্রতি অপরাহ্ কাটাতে থাকে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায়। তাঁর কাছে নিজের কোনো গোপন কথা না বলা সত্ত্বেও তিনি তাকে তার প্রেম ঘটিত ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কিছু কথা বলেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভালবাসার অঙ্গনে তাঁকে একজন প্রাজ্ঞ মহিলা বলে মনে করতো।

ফারমিনা ডাজার ভালবাসা লাভের আগেই যদি সে এতো সুলভ প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ না করে থাকতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই এখন, ফারমিনা তার আনুষ্ঠানিক বাগদত্তা হবার পর, তার আর ওই সব প্রলোভনের শিকার হবার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই মেয়েদের সঙ্গে বাস করতে থাকে, তাদের সুখ-দুঃখে সে অংশ নেয়, কিন্তু ওই পর্যন্তই, এর চাইতে বেশি অগ্রসর হবার কথা তার কখনো মনে হয় নি, ওই মেয়েদেরও না। একটি আগাম না জানা ঘটনায় তার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে। এক বিকালে ছটার দিকে মেয়েরা যখন তাদের রাত্তিরের খদ্দেরদের অভ্যর্থনা করার জন্য সাজগোজ করছে তখন হোটেলে তার তলার ঘরগুলি যে মেয়েটি পরিষ্কার করতো সে তার ঘরে এসে ঢোকে। সে ছিল অল্প বয়সী কিন্তু চোখ মুখ বসে যাওয়া, সময়ের আগেই বুড়িয়ে গেছে, তাকে দেখে মনে হল একটা অপূর্ব নগ্নতা দ্বারা আবৃত সম্পূর্ণ ধরা চূড়া পরা কোনো অনুতাপকারী। সে ওকে প্রতিদিন দেখে, ও যে তাকে লক্ষ করছে তা সে কখনো বোঝে নি। সে তার ঝাঁটা, একটা ময়লার বালতি, মেঝে থেকে ব্যবহৃত কনডম তুলে রাখার জন্য একটা বিশেষ থলে নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। মেয়েটি তার ঘরে ঢুকে, সযত্নে, তার পড়ায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে নজর রেখে তার ঘর পরিষ্কার করতে লাগলো। তারপর ও তার বিছানার খুব কাছ দিয়ে যাবার সময় সে তার পেটের উপর, নিচের দিকে, একটা উষ্ণ কোমল হাতের স্পর্শ পেল, সে অনুভব করলো যে হাতটা তার প্যান্টের বোতাম খুলছে আর ওর নিবিড় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে তখন সারা ঘর পূর্ণ। সে তার বই পড়তে থাকার ভান করলো কিন্তু যখন আর সহ্য করা সম্ভব হলো না তখন সে তার শরীর ওর হাতের আওতার বাইরে সরিয়ে নিল।

মেয়েটি নিরাশ হল। ওকে যখন এখানে চাকরি দেয়া হয় তখনই ওকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যে সে কখনো খদ্দেরদের শয্যাসঙ্গিনী হবার চেষ্টা করবে না। ওকে এটা তাদের বলে দিতে হয় নি, কারণ ও ছিল সেই সব মেয়েদের একজন যে বেশ্যাবৃত্তি বলতে পয়সার বিনিময়ে অপরের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াকে বোঝাতো না, একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে শোয়াকেই তার বেশ্যাবৃত্তি বলে মনে হত। ওর দুটি সন্তান ছিল, দুই ভিন্ন ব্যক্তির ঔরসে তাদের জন্ম, সাময়িক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য এটা হয় নি, এর কারণ ছিল এই যে তিনবারের পর কেউ তার কাছে ফিরে এলে তাকে ভালবাসতে সে ছিল অপারগ। এর আগ পর্যন্ত ও তার জীবনে কোনো জরুরি তাগিদ অনুভব করে নি, কোনো রকম হতাশা অনুভব ছাড়া শুধু অপেক্ষা করে যাবার মতো একটা স্বভাব তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল কিন্তু ওই বাড়ির জীবনের আকর্ষণ তার সদগুণের চাইতে বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। ও কাজে আসতো বিকাল ছটায়, সারা রাত কাজ করতো একটার পর আরেকটা ঘরে, ঘর ঝাড়ু দিত, মেঝে থেকে কনডম তুলতো, বিছানার চাদর বদলাতো। প্রেমমিলনের পর পুরুষরা যে কতো রকম জিনিস ফেলে যেত তা ধারণা করাও কষ্টকর। তারা রেখে যেত বমি আর চোখের জল, এটা ওর বোধগম্য ছিল, কিন্তু তারা ঘনিষ্ঠতার আরো নানা রকম রহস্যময় বস্তু ফেলে রেখে যেত, রক্তের ডোবা, পায়খানার দাগ, কাচের চোখ, সোনার ঘড়ি, নকল দাঁত, কোঁকড়া সোনালি চুল ভর্তি লকেট, প্রেমপত্র, ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি, সমবেদনা জ্ঞাপন করা চিঠি, নানা ধরনের চিঠি। কেউ কেউ তাদের হারানো জিনিসের জন্য ফিরে আসতো, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিনিসগুলির কোনো দাবিদার খুঁজে পাওয়া যেত না। আর লোটারিও থুগুট ওই সব জিনিস তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করে রেখে দিতেন। তাঁর আশা, এই ভবন যা এক সময় সুদিন দেখেছে তা ওই সব হাজারো বিস্মৃত জিনিস নিয়ে একদা প্রেমের জাদুঘরে পরিণত হবে।

মেয়েটির কাজ ছিল শক্ত, বেতন ছিল অল্প, কিন্তু সে তার কাজ করতো সুচারু রূপে। যা সে সহ্য করতে পারতো না তা হল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা ও বিলাপের ধ্বনি, স্প্রিঙ্গের কঁকানি প্রভৃতি। এই সব তার মনে এমনই উত্তেজনা ও দুঃখ জাগিয়ে তুলতো যে সকাল নাগাদ তার মনে একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছা জেগে উঠতো, রাস্তায় প্রথম যে ভিক্ষুক বা হতভাগা মাতালকে সে দেখবে তারই শয্যাসঙ্গিনী হবে সে, কোনো রকম ভান-ভনিতা না করে এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সে যা চায় তাই তাকে দেবে। এই পরিস্থিতিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মতো একটি লোকের উপস্থিতি, তরুণ, পরিচ্ছন্ন, রমণীবিহীন, তার জন্য যেন ঈশ্বরের এক উপহার হিসেবে দেখা দিল। প্ৰথম মুহূর্তেই সে বুঝেছিল যে এই মানুষটা অবিকল তার মতো, ভালবাসা যার ভীষণ দরকার। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই মেয়ের তীব্র কামনা সম্পর্কে ছিল অসচেতন।

সে ফারমিনা ডাজার জন্য তার কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রেখেছে, এ পৃথিবীর কোনো শক্তি বা যুক্তিতর্ক নেই যা তাকে ওই সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে।

বাগদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার স্থিরিকৃত তারিখের চার মাস আগে এই ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জীবন। এই সময়ে একদিন সকাল সাতটায় লোরেঞ্জো ডাজা টেলিগ্রাফ আপিসে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার খোঁজ করে জানতে পারলেন যে সে তখনো কাজে আসে নি। লোরেঞ্জো ডাজা বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন, বড় উপল পাথর বসানো তাঁর ভারি সোনার আংটিটা এক আঙুল থেকে খুলে অন্য আঙুলে পরতে থাকলেন। আটাটা দশ মিনিটে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঘরে ঢুকতেই তিনি তাকে চিনতে পারলেন, এই সেই টেলিগ্রাম আপিসের লোক যে সেদিন তাকে টেলিগ্রাম বিলি করে এসেছিল। লোরেঞ্জো ডাজা তার বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন, চলো বাপু, তোমার সঙ্গে আমি পাঁচ মিনিট কথা বলবো, একজন পুরুষ মানুষ আরেকজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে, সমানে সমানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *