বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা

বাংলার চিত্র ঐতিহ্য : সুলতানের সাধনা

শেখ মুহম্মদ (এস. এম সুলতানের আঁকা গুরুভার নিতম্ববিশিষ্টা পীনস্তনী এসকল চমৎকার স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা লীলাচঞ্চলা নারী, স্পর্ধিত অথচ নমনীয় সর্বক্ষণ সৃজনলীলায় মত্ত, অহল্যা পৃথিবীর প্রাণ জাগানিয়া এসকল সুঠামকান্তি কিষাণ, এসকল সুন্দর সূর্যোদয়, সুন্দর সূর্যাস্ত, রাজহাঁসের পাখনার মতো নরম তুলতুলে এসকল শুভ্র শান্ত ভোর, হিঙুলবরণ মেঘ-মেঘালীর অজস্র সম্ভার, প্রসারিত উদার আকাশ, অবারিত মাঠ গগন ললাট, তালতমাল বৃক্ষরাজির সারি, দীঘল বাকের, নদীতীরের এসকল দৃষ্টি-শোভন চর, মাঠের পর মাঠে থরে থরে ঢেউ খেলানো সোনার ধান, কলাপাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকজ্বলা এমন মোহিনী অন্ধকার, আঁকাবাকা মেঠো পথের বাঁকে বাঁশ-কাঠে গড়া কিষাণের এসকল সরল আটচলা, এসকল আদী বাছুর এবং পরিণতবয়স্ক গবাদি পশু, সর্বোপরি গোটা জনজীবনে প্রসারিত উৎপাদন শৃঙ্খলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অজেয় মানুষ; তারা যেন দৈনন্দিন জীবনধারণের স্রোতে কেলিকলারসে যুগ থেকে যুগান্তর পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে, ক্যানভাসে তাদের প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ ঋজু গতিভঙ্গিমা এমনভাবে বাঁধা পড়েছে, মনে হবে সমস্ত নিসর্গ দৃশ্য ছাপিয়ে মেঘেতে ঠেকেছে তাদের মস্তক এবং পাতালে প্রবিষ্ট হয়েছে মূল, তাদের শ্রম-ঘামের ঝংকার, চেষ্টার সঙ্গীত সমস্ত প্রাকৃতিক কোলাহল ভেদ করে আকাশ গঙ্গার কিনারে কিনারে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনিতে একসঙ্গে ফেটে পড়ছে।

শহরের চৌমোহনার ইট-সিমেন্টের পুরো কঠিন আবরণ ফাটিয়ে একটা আস্ত ঝর্না যদি বন্য আদিম ভঙ্গিমায় জেগে উঠে রঙিন জলধারা হঠাৎ করে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করতে থাকত, পৃথিবীর অন্তরের এই নৃত্যপরায়ণ রসধারার প্রতি মানুষ যেমনি বিস্ময়াবিষ্ট নয়নে দৃষ্টিপাত করত; তেমনি চোখে মানুষ সুলতানের আঁকা এসকল ছবি দেখেছে। এই ছবিগুলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবে বাংলার অস্পষ্ট, ঝাঁপসা, কুয়াশাচ্ছন্ন, অবগুণ্ঠিত অতীত খুঁড়ে প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে উপরের সমস্ত নির্মোক বিদীর্ণ করে শিল্পীর পারঙ্গম তুলির মাধ্যমে আমাদের যুগ এবং আমাদের কালের ঘাটে এসে আছড়ে পড়েছে। তারপর কোনোরকম ভনিতা না করেই বাংলাদেশের চিত্র-দর্শকদের উদ্দেশ্যে অমোঘ নির্দেশবাণী উচ্চারণ করেছে: আমাদের দেখো । বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং মজেছে। রঙের পরশ দৃষ্টিপট ভেদ করে মনের পটে অক্ষয় হয়ে স্থির ইন্দ্রধনুর মতো ফুটে গেছে। গ্রাম বাংলার এই চলমান ইতিহাস প্রবাহের সঙ্গে দর্শকের তন্ময় সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। তারা নিজেদের অস্তিত্বকেও এসকল কান্তিমান, আয়ুষ্মান চিত্রের অংশ হিসেবে মনে করতে বাধ্য হয়েছে।

সকলে চিত্রকলার মর্ম বোঝে না, সূক্ষ্ম বোধ এবং উপলব্ধি অনেকের না থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষত সেই ইতিহাস গাজন-উৎসবের নটরাজের মতো অট্টরোলে যখন নেচে ওঠে। সুলতান বছর তিনেক আগে শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তার সর্বশেষ প্রদর্শনীটিতে বাংলার আবহমানকালের ইতিহাসকে নাচিয়ে দিয়েছেন। যারাই এ চিত্রগুলো দেখেছেন, তাদের উপলব্ধিতে একটি কথা ভ্রমরের মতো গুঞ্জরণ করেছে। আমাদের সভ্যতার প্রাণ কৃষি আর কিষাণ হলো সভ্যতার নাটমঞ্চের একক কুশীলব। যখন মানুষের কানে মহাকাশ আর মহাপৃথিবীর শ্যামের বেণু অপূর্ব সুরলহরী বিস্তার করে তাকে ক্রমাগত মর্তলোকের সীমানা থেকে ঊর্ধ্ব, ঊর্ধ্বতর লোকে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, তখনো এই প্রাচীন ভূখণ্ডটিতে আদলে এবং অবয়বে মানুষ সেই সনাতন মানুষই রয়ে গেছে। তাই সুলতানের আঁকা এই মানুষেরা বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ। যেখানেই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে সেখানেই আদিপিতা হলধর আদমের চেহারায় তারা উপস্থিত ছিল। তারা মিশরে ছিল, চীনে ছিল, ভারতে, ব্যবিলনে, গ্রিসে, রোমে সবখানে বন কেটে বসত গড়ার দিনে, মাটির মর্মমধু টেনে তোলার বেলায়, বনের অগ্নিকুণ্ড পরিত্যাগ করে ঘরের দাওয়ায় সান্ধ্য-প্রদীপ জ্বালবার নম্ন-মধুর ক্ষণে তারা হাজির ছিল। যেখানেই মাটি শ্রমশীল কর্মিষ্ঠ মানুষের শ্রমে যত্নে প্রসন্ন হয়ে ফুল-ফসলের বর দিয়েছে, উপহার দিয়েছে শান্ত স্নিগ্ধ গৃহকোণ, সেখানেই ইতিহাস গতিচঞ্চল পথ পরিক্রমার সূচনা করেছে। মাটি এবং মানুষের এই দ্বৈত সম্পর্ক, বিশদ করে বলতে গেলে, নিসর্গ এবং মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুলতানের আঁকা চিত্রমালায় এমন আকার পেয়েছে, এমন বরণ ধরেছে যে একান্ত নির্জীব এবং পাষণ্ড না হলে তার আবেদন অস্বীকার করা প্রায় একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলার বদলে সুলতান যদি আরব দেশে জন্ম নিতেন, মরুচারী বেদুইনদের ছবি আঁকতেন। যদি জন্মাতেন নরওয়ে, সুইডেনে তাহলে সমুদ্রচারী জেলেদের সভ্যতার পথিকৃৎ হিসেবে আঁকতেন। নেহায়েত বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন বলেই এই কৃষকদের সভ্যতার জনয়িতা ধরে নিয়ে ছবি এঁকেছেন। সুন্দর প্রকৃতিতে নয় মানুষের মনই সৌন্দর্যের নিবাসভূমি। চারদিকে দৃষ্টিরেখা যতদূর ধাবিত হয় এবং সামনে পেছনে চিন্তা-কল্পনা অনেক দূর বিহার করার পর যে অনড় বিন্দুটিতে এসে স্থির হয়, সংহত হয়, সেইখানে, কেবল সেইখানেই সৌন্দর্যের নিভৃত নিকুঞ্জ। সেজন্য একজন আরবের চোখে লু হাওয়া তাড়িত ধু-ধু মরুভূমি সুন্দর, একজন এস্কিমোর চোখে তুষার-আচ্ছাদিত ধবল তুন্দ্রা সুন্দর।

সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে, বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম, ঘাম, সংঘাতের ভেতরে সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর পথ, পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনা এবং নিরীক্ষার অনেকগুলো পর্যায়। তার ব্যক্তি জীবন এবং শিল্পীজীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তাও কম বিস্ময়কর নয়। পরে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাবে। আপন অন্তরস্থিত সৌন্দর্যবোধ, নিসর্গ, ইতিহাস এবং জীবন্ত শ্রমশীল মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে ক্যানভাসে সবকিছু মূর্ত করে তোলা-এর সবটুকু তার একক শৈল্পিক-প্রয়াসের ফল নয়। তার জন্য এই সুপ্রাচীন দেশটিকে সাম্প্রতিককালে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ঘোষণা করতে হয়েছে। একটি উদ্ভিদ-সমতুল ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে, প্রতিটি সামাজিক স্তরের মানব সাধারণের ভেতর বন্দুকের আওয়াজে, কামানের হুংকারে যে জাগরণ এসেছে, যা তাদের সম্মিলিত সৃষ্টিশক্তির তেজ উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে, তার প্রয়োজন অপরিহার্য ছিল। ইনকুয়েবেটর যন্ত্রের তাপে ডিমের খোলস ফেটে যেমন করে মুরগির বাচ্চা প্রাণ পেয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উত্তাপে শিল্পীর অন্তর চিরে এসকল ছবি বেরিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু আবেগ, সবটুকু জীবনোল্লাস, সবটুকু স্পর্ধা এবং দুঃসাহস এই ছবিগুলো ধরে রেখেছে। এরকম একটি প্রলয়ঙ্করী ঘটনা না ঘটলে সুলতানের তুলি কস্মিনকালেও এরকম আশ্চর্য ছবি প্রসব করতে সক্ষম হতো না, যত প্রতিভাই তার থাকুক, কিষাণ-জীবনের প্রতি তার অনুরাগ-মমতা যতই নিবিড় গভীর হোকনা কেন। বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রামের একেবারে অন্তঃস্থল থেকেই এসকল চিত্রের উদ্ভব। এ কারণে এ ছবিগুলো দর্শকের মনেও প্রত্যক্ষভাবে ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। হয়তো দর্শক সচেতনভাবে অনুভব করতে পারেন না, কিন্তু অন্তরালে এই বোধ ক্রিয়াশীল থাকে ঠিকই। ইতিহাসের এই জাগ্রত দেবতার প্রতি অজানিত শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দলে দলে মানুষ এ সকল ছবি দর্শন করতে এসেছে। যুদ্ধে পরাজিত, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ ভেনিসের মরমে মরে যাওয়া জনসাধারণও আজ থেকে বহুকাল পূর্বে একদা তরুণ শিল্পী মিকেলেঞ্জোলোর অপূর্ব মূর্তি ডেভিডের দিকে ভেনিসের অপরাজেয় ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক হিসেবে মমতা-মেদুর নয়নে দৃষ্টিপাত করেছিল। আমাদের দেশের চিত্রশিল্পী এবং সমালোচক এ দুজাতের দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে এই পরিপ্রেক্ষিতের অবস্থিতির দরুন তারা এ অমর চিত্রসমূহের প্রতি শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে প্রণতি জানাতে পারেননি।

.

২.

শিল্পকলার সঙ্গে সামাজিক গতিশীলতার একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল। স্থবির সমাজের শিল্পকলাও বলতে গেলে একরকম পরিবর্তনবিমুখ। পুরুষ-পুরুষানুক্রমে সেখানে একইরকম পট আঁকা হয়, একই ধরনের মাটির পাত্র তৈরি করা হয়। নতুন পুরুষের অভিজ্ঞতার ব্যঞ্জনা, অভিযাত্রার প্রাণস্পন্দন স্থবির সমাজের ঐতিহ্য নির্ভর শিল্পকর্মে কদাচিৎ সঞ্চারিত হতে পারে। পুরুষ-পরম্পরা একইরকম প্রক্রিয়ার একই বস্তু প্রথাসিদ্ধ উপায়ে প্রস্তুত করা হয়, একে নির্মাণ বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। একটি অচল সমাজ ভেতর থেকে প্রাণ পেয়ে চলতে আরম্ভ করলে তার নানামুখী শিল্প-প্রয়াসের মধ্যে এই চলার বেগ, এই গতির ছন্দ নব নব ভঙ্গি এবং নব নব দ্যোতনার জন্ম দিয়েই চলে । শিল্পকলার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন আসতে থাকে এবং ঘটতে থাকে রূপান্তর।

সামগ্রিকভাবে বাংলার শিল্প-সাহিত্য ইংরেজি তথা ইউরোপীয় শিল্প-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটা নতুন বেগ, নতুন ভঙ্গি এবং নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। অর্থাৎ এই সময়ের পূর্ববর্তী বাংলার যে চিন্ময় সৃষ্টি তা পরবর্তী সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে না। পরবর্তীকালের চিন্ময় সৃষ্টিসমূহে এমন কতিপয় নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে; পূর্ববর্তী সময়ের যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম তন্নতন্ন করে দেখলেও যার সন্ধান পাওয়া যায় না। এই পরিবর্তন শুধু একা মৃন্ময় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে আসেনি, গোটা সমাজের ধনবণ্টন থেকে শুরু করে আচার-বিচার, চিন্তা ভাবনা, রুচি-পছন্দ, পোশাক-আশাক সবকিছুর মধ্যে এমনভাবে এসেছে যে সন্ধান করলে ধরা পড়ে যাবে সম্পূর্ণ মানব সম্পর্কের ধরনটিই অল্পবিস্তর পাল্টে গেছে এবং সমাজের কাঠামো বা ছকটির মধ্যেও অনেকদূর পালাবদল ঘটে গেছে। এই সামাজিক পালাবদলের যে সুবিশাল যজ্ঞ, সাহিত্যে তার গতিপরিক্রমা মাইকেল, বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে মুখ্যত ঝাঁক বেঁধে ফুটে উঠেছে। এসময়ের প্রাথমিক সাংস্কৃতিক প্রয়াসসমূহের মধ্যে একটা দ্বিমুখী মনোভঙ্গি সবসময়ে লক্ষ্যগোচর। একদিকে ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতির স্পর্শে স্রষ্টাকুল শিউরে শিউরে জেগে উঠেছেন আর অন্যদিকে এই জাগরণের বেগ-আবেগ ঐতিহ্যের ভেতর চারিয়ে দেয়ার জন্য ঐতিহ্যের ভিতটি নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন এবং সম্প্রসারিত করে যাচ্ছেন। সাহিত্য নব্য-ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের মনীষার স্পর্শ এবং বিত্তের সমর্থনে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন কলেবর ধারণ করে। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত চিত্রকলার ভাগ্যে সে সুদিনের আগমন ঘটেনি। সমাজের সর্বসাধারণের মধ্যে চিত্রকলার প্রতি অনুরাগের অভাবই সেজন্য দায়ী। আর এক অংশ সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, ধর্ম-অর্চনা ইত্যাদির মাধ্যমে চিত্র-চর্চার যে চল ছিল তাতে ইউরোপ এবং ইউরোপীয়ানার কোনো প্রভাব সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে পড়তে পারেনি। তাছাড়া চিত্রকলার প্রসার এবং ব্যাপ্তির সঙ্গে সামগ্রিক সমাজের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্নটিও বিজড়িত ছিল। তাই অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি চিত্রকরেরা স্বেচ্ছায় ইউরোপীয় চিত্রপদ্ধতির অক্ষম অনুকরণ এবং নবিশগিরি করেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপীয় চিত্রকরেরা যা আঁকতেন বাঙালি চিত্রকরেরা হুবহু তার কার্বন কপি তৈরি করতেন। এ অবস্থাটা বেশ কিছুদিন চলেছে। এই ইউরোপ-নবিশ চিত্রকরদের কারো অঙ্কন পদ্ধতিতে সৃষ্টিশীলতার ছন্দ সঞ্চারিত হয়নি। এ পর্যায়ের চিত্রশিল্পীদের কেউ দেশবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নেয়ার কথা দূরে থাকুক, যে ইউরোপের অনুকরণ করেছেন দিবস-রজনীর প্রাণান্তকর পরিশ্রমে, তাদের সামান্য অনুমোদন পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় শিক্ষা পদ্ধতির অনুশাসন ছিন্ন করে একটা নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কারের হার্দ্য এবং মেধাবী প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। অন্ধ অনুকরণ প্রবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ রাজস্থানী, মোগল,অজন্তা, ইলোরা ইত্যাদি চিত্রকলার প্রতি সানুরাগ দৃষ্টিপাত করেন এবং এসবের মধ্যে তার অভীষ্টের সাক্ষাৎ পেয়ে যান। তাছাড়া সেসময়ে প্রখ্যাত জাপানী শিল্পী ওকাকুরা ঠাকুরবাড়িতে অবস্থান করছিলেন। প্রাচ্য শিল্পাদর্শের মহিমা। প্রচার এবং প্রাচ্যরীতির শিল্পের প্রসারকল্পে এই শিল্পী স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ওকাকুরা এবং অবনীন্দ্রনাথ দুজনে কে কাকে প্রভাবিত করেছিলেন বলা মুশকিল। মোটের উপর দুয়ের সাক্ষাতের ফলে একটা চরম অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

সেই সময়টার কথাও বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। সবেমাত্র চিত্রকলা ব্লকের মাধ্যমে মুদ্রিত করে পত্র-পত্রিকায় ছেপে সাধারণের গোচরে আনার উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে এদেশে। গোটা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লেগেছে। সর্বক্ষেত্রে জাতীয় ভাবধারার একটা দুর্বার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চাহিদা: জাতীয় সাহিত্য চাই, জাতীয় বিজ্ঞান চাই, জাতীয় শিল্প, জাতীয় বাণিজ্য চাই। ভারতের উঠতি বুর্জোয়া সর্বক্ষেত্রে নিজের অধিকার প্রসারিত করার জন্য মারি কি মরি পণ করে উঠে পড়ে লেগেছে। এই সময়ে অবনীন্দ্রনাথ চিত্রকলার একটা নিজস্ব পদ্ধতি তৈরি করলেন। তা সর্বাংশেও যেমন ভারতীয় নয়, তেমনি সর্ব অবয়বে ইউরোপের অন্ধ অনুকরণও নয়। দুয়ের সংশ্লেষে হয়ে উঠল তৃতীয় বস্তু। অসাধারণ মৌলিকত্বসম্পন্ন ও সকল চিত্রকর্ম দেশের আলোকিত অংশের মন কেড়ে নিল । বিদেশীরাও প্রশংসা করল। অবনীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয় শিল্পের জনক এবং ভারতের আত্মার অমর উদ্বোধক পুরোহিত হিসেবে আখ্যাত হলেন। কিন্তু কোন ভারত? যে ভারতে যক্ষ দয়িতার বিরহে একাকী অমোচন করে, যে ভারতে মোগল সম্রাট শাজাহানের ধ্যাননেত্রে তাজমহলের মর্মর সমাধিতলে শয়ান মমতাজ বেগমের মতো সুন্দর মৃত্যুস্বপন ঘনিয়ে আসে। অতীত ইতিহাস থেকে সন্ধান করে যে রীতি ধ্যানে, সাধনায় বের করে আনলেন; গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা অতীত রোমন্থনের মধ্যেই সীমায়িত রাখলেন। অতীত তার সামনে এমন কুহক জাল মেলে ধরেছিল যে তার গণ্ডি ভেদ করে বর্তমানের পথে পদচারণা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। চলমান জীবনের কোনো ছবি আঁকলেও অতীতের সেই সুন্দর কুয়াশা এসে বর্তমানের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মগুলো ভারতের চিত্রকলার আকাশে উজ্জ্বল অনুপম বরণবিশিষ্ট ইন্দ্রধনুর মহিমা নিয়ে জেগে থাকবে, একথা সত্যি। কিন্তু সেগুলো বাস্তবের কেউ নয়। হালকা মনোরম পুঞ্জ-পুঞ্জ রঙের প্রলেপে সৃষ্ট অর্ধেক শরীর অর্ধেক ছায়া মাত্র। শুধু অকাশে সঞ্চরণ করে, মেরুদণ্ড সোজা করে স্মৃতি স্বপ্নভারে ভারাতুর এসকল ফিগার মাটিতে দাঁড়াতে পারবে না।

তার এই সীমানা শিল্পী স্বয়ং জানতেন। জানতেন এই যে ফাঁক রয়ে গেল তা তিনি ভরাট করতে পারবেন না। এ তার সাধ্যের বাইরে। তিনিও তার আঁকা চিত্রের মতো স্বপ্ন-স্মৃতিভারে অতিশয় কাতর। অবনীন্দ্রনাথ তার বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ গ্রন্থটিতে শিল্পের তত্ত্ব হিসেবে যেসব মতামত ব্যক্ত করেছেন, তাও তার স্মৃতি স্বপ্নেরই অংশ মাত্র। তথাপি তিনি সর্বান্তঃকরণ দিয়ে কামনা করতেন, কেউ একজন আসুক যে আঁকবে নিটোল রক্তমাংসবিশিষ্ট সামাজিক মানুষের ছবি। বোধকরি সে আশায় বুক বেঁধে বেঙ্গল আর্ট স্কুলে শিক্ষকতার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এবং বাঙ্গলার ব্রত’ বইটি লিখেছিলেন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাঙ্গলার ব্রত’ বইটি বাঙালি সমাজ জীবনের আনাচ কানাচ অনুসন্ধান করে বাঙালির শিল্পের প্রাণভোমরাটিকে সূত্রাকারে উপস্থিত করেছিলেন। একটি গভীর স্বাদেশিক এবং শৈল্পিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি এ কাজটি করেছিলেন। এই সমাজের সহজ সরল কিন্তু লীলায়িত শিল্প-নিদর্শন এবং অন্তরালবর্তী মটিফ’সমূহ আত্যন্তিক যত্নে নৃবিজ্ঞানীর দক্ষতা সহকারে শুধু সংকলন করেই ক্ষান্ত থাকেননি, তার ছাত্ররা যেন নিজেদের এ সকল ঐতিহ্য-সম্পদকে নিয়মিত চর্চা এবং ক্রমাগত নিরীক্ষার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন, সেদিকে তিনি সতত সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের সে প্রত্যাশার সবটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায়ের শিল্প-সাধনার মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের সে আকাক্ষার অনেকখানিই চরিতার্থতা লাভ করেছে।

.

৩.

নন্দলাল বসুই প্রথম ব্যক্তি যাকে প্রকৃত অর্থে সার্থক বাঙালি চিত্র-শিল্পীর শিরোপা দেয়া যেতে পারে। অবনীন্দ্রনাথের কুয়াশাচ্ছন্ন স্বপ্নমণ্ডিত তন্ময় পরিবেশের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে নন্দলালের রেখাপ্রধান চিত্রসমূহ বস্তু-ঘনিষ্ঠতা লাভ করে বাস্তব জগতে মেরুদণ্ডের উপর থিতু হয়ে দাঁড়াবার জন্য যেন সংগ্রাম করছে। তাই বলে নন্দলাল বসু পৌরাণিক চিত্র আঁকেননি এমন নয়। তবে তার পৌরাণিক চিত্রগুলো দেখেও মনে একটা ধারণা জন্মাবে যে, সেগুলো পৌরাণিক জগৎ থেকে মাটির পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। তার ধ্যানী বুদ্ধ ছবিটির কথা ধরা যাক। এখানে বুদ্ধদেবের ধ্যানমগ্নতাটাই সব নয়, তার রক্ত-মাংসের অস্তিত্বটাও ধরা পড়েছে। আবার যখন তিনি রবীন্দ্রনাথ কিংবা মহাত্মা গান্ধীর ছবি আঁকেন রেখার বাঁকে বাঁকে একটুখানি পৌরাণিকতা যেন প্রাণ পেয়ে ওঠে। চলমান সাঁওতাল রমণীর চিত্রে যে ভঙ্গি ফুটে বেরিয়েছে তা অনেকটা এরকম, চিত্রটি সাঁওতাল রমণীর, কোনো সন্দেহ নেই। শরীরে যৌবন জ্বলছে, খোঁপায় দুলছে বনফুলের আভরণ, বলিষ্ঠ পায়ের গোছ, চলার ছন্দে বিজন বনভূমি ছন্দায়িত হয়ে উঠছে। এসব তো রয়েছেই। এটুকু না থাকলে শিল্প হবে কেমন করে? তবু, তবু কোথায় এ রমণীটির আদলের মধ্যে এমন কিছু আছে যেন একটুখানি ফুরসত পেলেই সে সাঁওতাল বেশভূষা পরিত্যাগ করে নারীত্বের একটা ইমেজ মাত্র হয়ে স্বপ্নলোক ধ্যানলোকের দিকে ধাওয়া করবে। নন্দলালের আঁকা বিরান মাঠের মাঝখানের তালগাছ দেখেও একইরকম ভাবনা জন্মাবে। এই তালগাছটি তালগাছ বটে, আবার তালগাছ নয়ও। সামান্য সুযোগ পেলেই অণু অণু স্বপ্ন হয়ে আকাশলোকের কোথাও মিলিয়ে যাবে । শিল্প-সাহিত্যে কেউ বাইরে থেকে ঘরে ফেরার সাধনা করে, কেউ ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার, যার যতদূর যাত্রা হয়, ততদূর সফলতা। নন্দলাল বসু এই বাইরে থেকে ঘরে আসার সাধনাই করেছিলেন। সবটা ফিরতে পারেননি। তথাপি নন্দলাল একজন বিরাট শিল্পী। বাংলার চিত্রশিল্পীকে লোকায়ত ও ধ্রুপদ, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য রীতির মিশেল ঘটিয়ে, নানা ভাঙচুরের মাধ্যমে একটি ফ্রেমের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

.

৪.

যামিনী রায় ঘরেই ছিলেন, তাকে ছবি আঁকা শিখতে হয়েছে বটে কিন্তু ঘরে ফেরার সাধনা করতে হয়নি। বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য আপনিই সেধে এসে তার তুলিতে ধরা দিয়েছে। কোনো গুরু এবং প্রতিষ্ঠানের আশীর্বাদ অর্জন করার বহু আগে কলালক্ষ্মী আদর করে এই দরিদ্র এবং অভিভূত ভক্তের হাতে গোপন অমৃত ভাণ্ডারের চাবিকাঠি তুলে দিয়েছিলেন।

যামিনী রায় সম্পর্কে পেছনের কথা বলা প্রয়োজন। তৎকালীন গ্রামীণ বা শহুরে মধ্যবিত্তদের কেউ ছিলেন না এই যামিনী রায়। চিত্রকলা কিংবা অন্যান্য বিষয়ে যে নবীন ভাবধারার জোয়ার শহর কলকাতায় খলখল ছলছল বেগে প্রবাহিত হচ্ছিল আর্ট স্কুলে আসার পূর্ব পর্যন্ত তা তাকে স্পর্শও করতে পারেনি। ভক্তিমান এবং নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব সাহিত্যরসিকের পুত্র, সুতরাং ভক্তিই তার ধ্যান এবং ভক্তিই জ্ঞান হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। দেশের যে সকল কুমোর পুরুষ-পরম্পরা ঠাকুর দেবতার মূর্তি গড়ত, পুতুল বানাতো, পট আঁকত এবং জীবিকার তাগিদে এসব যারা বাংলাদেশের হাটে হাটে মেলায় মেলায় ফেরি করে বেড়াতো তাদের কাছেই প্রথম যামিনী রায়ের হাতে খড়ি। যদি কলকাতা শহরে একটা আর্ট স্কুল জন্ম না নিত, একটা শিল্প আন্দোলন মধ্যবিত্ত সচেতন বাঙালি মানসে সুবর্ণ তরঙ্গ না তুলত কে জানে হয়তো উত্তরকালে উক্ত যামিনী রায়ও একজন দক্ষ পট আঁকিয়ে এবং পুতুল গড়িয়ে হিসেবে ধর্মপ্রাণ হিন্দু মহিলার মনে ভক্তি এবং শিশুদের মধ্যে আচমকা বিস্ময় বোধ জাগিয়ে নামহারা পটুয়াদের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন।

বৈষ্ণব সাহিত্যের ঢলঢল লাবণীস্রোতে তো সঞ্চিতই ছিল তার মানসপট। আর্টস্কুলের শিক্ষা তাতে একটা স্নিগ্ধ তরঙ্গ জাগিয়ে দিল। বাংলার কুমোরের হাতে গড়া পুতুলেরা, কালীঘাটের ভাসাভাসা পটলচেরা চোখের অচল পটেরা যামিনী রায়ের হাতের জীয়ন কাঠির ছোঁয়ায় নতুন প্রাণ পেয়ে বহু যুগ আগের ঘুম ভেঙে হঠাৎ করে জেগে উঠল যেন । যামিনী রায়ের আঁকা এ সকল ছবি দর্শক দেখামাত্রই চিনে নিল। পুলকিত বিস্ময়বোধের তাড়নায় কলারসিকের মনে একটা আশ্চর্যান্বিত জিজ্ঞাসা গুনগুনিয়ে উঠল: আরে এ তো আমাদের জিনিস, এই যে নারী তার অনুপম দেহ বল্লরী, পূর্ণিমা চাঁদের আকৃতির মুখমণ্ডল সে তো প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালে, এমন রসঘন নিবিড় গভীর চোখের দৃষ্টি, তার আলোকেই তো আমাদের সমাজ-সংসার আলোকিত। এমন নিটোল সুকুমার শোভনশালীন গড়ন ভঙ্গি, আর এত স্নিগ্ধ, এত নম্র যেন দলে দলে ব্রজবালারা কেলিকলা লীলারসের বেশভূষা ছেড়ে আমাদের সংসার-সীমান্তে কন্যা জায়া ভগিনী হয়ে আটপৌরে বসনে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যে-ই আঁকুক এ সকল ছবি; যে ঘনীভূত আবেগে বৈষ্ণব কবিরা গঠন করেছেন অতীতে পদাবলীর শরীর; সেই অচঞ্চল আবেগ, সেই অচলা ভক্তি নতুন ব্যঞ্জনায় মর্মরিত হয়ে উঠেছে এসকল ছবিতে। কে আঁকল, কে সেই আমাদের অতিশয় আপনার জন চিত্রকর।

রাতারাতি বাংলাদেশে বাংলাদেশের নিজস্ব চিত্রকর হিসেবে, বাংলার গহন সৌন্দর্যের রূপকার হিসেবে যামিনী রায় পরিচিতি লাভ করলেন। খ্যাতির ঢেউ দেশ পেরিয়ে বিদেশেও একটুখানি হাওয়া সৃজন করল। ধীমান কলাবিদ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী যামিনী রায়কে নিয়ে বিলেতের ‘টাইমস’ পত্রিকায় একটি মনস্বিতা সম্পন্ন রচনা প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানত শাহেদ সোহ্রাওয়ার্দীর দূতিয়ালীতেই যামিনী রায়ের বৈদেশিক খ্যাতি। আমাদের এ রচনার নায়ক শেখ সুলতানের শিল্পী জীবনের সূচনা সম্পর্কে আলোকপাত করার বেলায় আরো একবার আমাদেরকে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর নাম উচ্চারণ করতে হবে।

যামিনী রায় দেশীয় রীতিতে ঐতিহ্যনির্ভর মনোমুগ্ধকর অঙ্কনশৈলীর উদ্ভাবক এবং বাংলার একান্ত ঘরোয়া চিত্রশিল্পী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকে বোধকরি জানেন না, একসময়ে ক্লাসিক প্যাটার্নে অনেক ছবি তিনি এঁকেছিলেন। ইউরোপীয় চিত্রকরের আদর্শে অঙ্কিত এসকল চিত্র আজকাল কোথায় কি হালে আছে সম্ভবত কেউ বলতে পারবেন না। ছবি হিসেবে এগুলো একেবারে উৎকর্ষ বিবর্জিত ছিল একথাও বলা চলে না। তথাপি সে পথে শিল্পীর যাওয়া হয়নি। এটা শিল্পী যামিনী রায়ের জন্য ভাল হয়েছে কি খারাপ হয়েছে তা আজ অনুমান এবং বিতর্কের বিষয়। মোটকথা সে সময়ে দেশের মানুষ যামিনী রায়ের ছবির যে বিশেষ ভঙ্গিটি এবং যে বিশেষ অন্তরাবেগটির সহজ দৃষ্টিতে প্রশংসা করত, দেশীয়ানার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারত অনায়াসে, অনবরত যামিনী রায়কে সেই ছবিই এঁকে যেতে হয়েছে।

তুলির স্বচ্ছন্দ টানে টানাটানা ভাসাভাসা চোখ, চোখের ভেতর থেকে প্রকাশমান দিঘির বুকের নিথর কালো গভীর জলের অতল প্রশান্তি, মুখে মাখানো এমন একটা সহজ সারল্য, এমন একটা সহজিয়া আবেগ যে দর্শনমাত্রই মনে একটা প্রীতির ভাব ঢেউ খেলে যায়; এই সহজ গভীর ভাবের শিল্পী যামিনী রায়। একজন শিল্পী অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রকাশভঙ্গির যে একটা সহজতা, অনায়াসপনা অর্জন করে, এটা সে সহজতা নয়। এই সহজতা জলের মতো সরল, ঐতিহ্যের ভেতর থেকে সংস্কৃতির মর্মমধুর ভাণ্ডার থেকে বালক বয়সেই মুগ্ধ বিস্ময়ে তিনি তা মাতৃস্তন্যের মতো পান করেছিলেন। তারপরেও কিন্তু গভীর সাধনার আশীর্বাদ ছাড়া কেউ তা অর্জন করতে পারে না। তবে এই সাধনার ধারাটা যত বেশি সচঞ্চল মনোবৃত্তির অনবচ্ছিন্ন অন্তরাল প্রক্রিয়া বাইরে তার অভিঘাত বড় বেশি পরিদৃশ্যমান নয়। কোনো কোনো ওস্তাদ ঘরানার ছোট ছোট ছেলেরা যেমন গলা খেলিয়ে দুরূহ রাগ-রাগিনীর স্বরূপ ফুটিয়ে তুলে সকলকে তাক লাগিয়ে দেয় সে রকম আর কি। সেখানেও একটা শিক্ষার প্রশ্ন থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থী তা অজান্তে বিনাশ্রমে বিনাযত্নে পরিবেশের কাছ থেকে অর্জন করে ফেলে। যামিনী রায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যাই আঁকুন না কেন তার ছবিতে একটা বাৎসল্য রসের আভাস বড় বেশি ফুটে ওঠে। কতিপয় পরিচিত অভিব্যক্তির বাইরে, অন্য কোনো ভঙ্গিতে, অন্য কোনো রসমূর্তিতে যামিনী রায়কে বড় একটা দেখা যায় না। তার শিল্পী জীবনের কোনো বাঁক, কোনো মোড়, কোনো পরিবর্তন, কোনো রূপান্তর নেই যেন। আপনাকে আপনি অতিক্রম করে যাওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষা তাকে কোনোদিন পেয়ে বসেনি। সুন্দর নিশ্চল বস্তুঘনতার জগৎ থেকে আকাশমণ্ডল কিংবা চলমান জগৎ প্রপঞ্চ অভিমুখে অভিযাত্রা নয়, অভিসারের আকাঙ্ক্ষাও তাকে তাড়িত করেনি। সুন্দর বদন, পেলব সুকুমার শরীর এবং প্রাণ লাবণ্যের রূপকার যামিনী রায়। যামিনী রায়ের হাতে বাংলার পুতুল, কালীঘাটের পট এবং আরো নানা শিল্প ঐতিহ্য নবীন জীবন লাভ করেছে।

.

৫.

তাই বলে যামিনী রায়ের শিল্প শ্রম-ঘামের সংঘাত এবং জীবনের সংগ্রামের ক্ষেত্রে অবতরণ করতে পারেনি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল আরো একজন শিল্পীর । তেরশ পঞ্চাশের মন্বন্তরের কাকের ছবি জয়নুল আবেদীনের ললাটে শিল্প-সম্ভাবনার সোনালি রেখা এঁকে দিয়েছিল। এটা চিন্তাকে নাড়া দেওয়ার মতো একটা সংবাদ বটে। অবনীন্দ্রনাথের অলকাপুরীর দূরদূরান্তের আধেক স্পষ্ট আধেক অস্পষ্ট স্বপ্নবিজড়িত রোমাঞ্চ কল্পনা নয়, নন্দলালের ছন্দায়িত অর্ধেক বাস্তব অর্ধেক অবাস্ত বের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়া ছিমছাম সুন্দর কোনো ফিগার নয়, আর মুখে বৈষ্ণব কবিতার ঢলঢলে লাবণি মাখানো গহন নয়না কোনো কামনার ধন নারীও নয়, অমঙ্গলের বার্তাবাহক একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাক- তাও আবার মন্বন্তরের কাক শিল্পীর তুলিতে জন্মলাভ করে সকলের মনোহরণ করল। কিন্তু কেন? আর যিনি আঁকলেন তার সমাজের মধ্যে ঐতিহ্যের ভেতরে, পরিবার কিংবা পরিমণ্ডলের পরিসরে তুলির লেখনের কোনো আদর ছিল না। তথাপি এই তরুণ মুসলমান শিল্পী সৃজনশক্তির যাদুতে কাকের ছবির মধ্য দিয়ে মন্বন্তরের সমস্ত ভয়াবহতা, সমস্ত হাহাকার, সমস্ত নিষ্ঠুরতা, সমস্ত হৃদয়হীনতা এমনভাবে মূর্ত করে তুললেন, এই সংবাদটির ভেতরে অনেকগুলো বড় বড় সংবাদ আত্মগোপন করে আছে।

অবনীন্দ্রনাথ যে সমাজের নিরাপদ পাটাতনে উপবেশন করে স্নিগ্ধ রুচি এবং পূর্ণিমার মধুযামিনীর স্বপ্নচর্চা করতেন, কালের ইঁদুর সেই নিশ্চিন্ত বিলাস বাসরের কড়ি বরগা এবং খিলানে খিলানে দ্রংষ্টারেখা প্রবিষ্ট করিয়ে কেটেকুটে একাকার ছত্রখান করে ছেড়েছে। আর সেই রামধনু ঘেঁকে তোলা চমৎকার সূক্ষ্ম রুচিরেখা কালের জল সম্পূর্ণরূপে ধুয়ে নিয়ে গেছে। নন্দলালের স্বপ্ন-বাস্তব জড়াজড়ি করা ফিগারসমূহ ভয়ংকর এবং অমঙ্গলের ত্রাসিত রূপ দেখে সভয়ে পালিয়ে বিশ্বভারতীর কলাভবনে মুখ লুকিয়ে বেঁচেছে। যামিনী রায়ের চাঁদপানা মুখের রমণীরা দুর্ভিক্ষের দেশ ছেড়ে, হাভাতের হা-ঘরেদের মুলুকের সীমানা অতিক্রম করে নগদ রজতমুদ্রার বিনিময়ে গোরা সৈন্যদের বগলে চড়ে ইংল্যান্ড আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। এই দুর্ভিক্ষ এই অনাহার যন্ত্রণা, এই ধ্বংসলীলা এই অমঙ্গলের ভয়ংকর মূর্তি ধারণ করবে কোন্ শিল্পীর চেতনালোক? জয়নুল আবেদীন তার শিল্পী-জীবনের সূচনাপর্বে সরল সবল বাহু দুটি দিয়ে এই বিনষ্টি, এই বীভৎসতাকেই আলিঙ্গন করতে চেষ্টা করেছিলেন।

গোটা মুসলিম সমাজটার চিত্রকলার হাতেখড়ি হয়েছে জয়নুলের মাধ্যমে। ব্যক্তি হিসেবে জয়নুলের জন্য এটা একটা অভাবিত ঘটনা বটে। কিন্তু সমাজটার কথা চিন্তা করলে মনে প্রত্যয় জন্মায় যে ঠিক সময়েই ঠিক মানুষটি জন্ম নিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের সিংহনাদ এবং বুলবুল বচন বাংলার কাব্যলোক ও সঙ্গীতলোকে বজ্রবাণ আর পুষ্পবৃষ্টি দুই-ই বর্ষণ করেছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম নামের সিংহ-দরজা পেরিয়ে প্রাণের পতাকা উড়িয়ে বাংলার কাব্য কাননে এলেন জসীম উদ্দীন, মহুয়ার মাদকতার সঙ্গে নিধুয়া পাথারের বিরহব্যথা সুরের দীর্ঘশ্বাসে ছড়িয়ে দিয়ে সঙ্গীত জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন আব্বাসউদ্দীন। প্রায় একই সময়ে চরণে ঝংকার তুলে অপরূপ লীলালাস্য এবং গতিভঙ্গিমাসহ বুলবুল চৌধুরী গন্ধর্ব জগতে এসে উদিত হলেন। এই শিল্পী চতুষ্টয় আব্বাস-জসীম-জয়নুল-বুলবুল, ক্ষেত্র আলাদা হওয়া সত্ত্বেও, কোথায় যেন এরা একই সূত্রে বাঁধা পড়ে আছেন। ছোটখাট বৈপরীত্যসমূহ আলাদা করে নিলে দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাবে চারজনের মর্মমূলে একই ধরনের জীবনানুভূতি ক্রিয়াশীল। চারজনের ধমনীর শোণিত প্রবাহে একই আকারের লোহিত তরঙ্গ জাগছে আর ভাঙছে। একই সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে একই সমাজের ভেতর থেকে একই সৌন্দর্যের অগ্নিকাণ্ডে আত্মাহুতি দান করার জন্য এই ভক্ত চতুষ্টয় যেন সমবেত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু মধ্যবিত্তের মানসে কর্ষণে ঘর্ষণে এবং অনুশীলনে যে জীবনবোধের উন্মেষ এবং বিকাশ, এদের অবস্থান তার চাইতে অনেক দূরে। বুদ্ধির চাইতে আবেগ, চিন্তার চাইতে সংবেদনা, রীতির চাইতে স্বতঃস্ফূর্ততার দোলা, অনুশীলনের চাইতে সহজ প্রকাশের প্রবণতা এদের অনেক অনেক গুণে বেশি। এদের সকলের সাধনা এসকল গুণে গুণান্বিত এবং পাশাপাশি এ সকল অবগুণে অবগুণ্ঠিত বটে। তথাপি এ চারজন সমাজসংস্কৃতির এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত অবলীলায় প্রকাশমান করে তুলেছেন যার বোধটি পর্যন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর ছিল না, অথচ তা এদেশেরই, এ সমাজেরই কর্মজীবী মানব-গোষ্ঠীর উজ্জ্বল এক উত্তরাধিকার ।

উদাহরণস্বরূপ জসীম উদ্‌দীন যখন লিখলেন: “এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল কালো মুখে কালো ভ্রমর কিসের রঙীন ফুল”-এই বর্ণনার একটা অমোঘ আকর্ষণী শক্তি আছে। শব্দের মধ্যে সন্ধান করলে পাওয়া যাবে না, শব্দার্থের মধ্যেও নয়, কিন্তু একঝোঁকে সবটা উচ্চারণ করে গেলে একটা সুঠাম কান্তি গ্রাম্য যুবকের ছবি মনের পর্দায় ফুটে ওঠে। সেই ছবিটাই আকর্ষণ করে নিয়ে যায়। সে আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা একরকম অসম্ভব। অবচেতনে গোপন, বাঙালির দ্রাবিড় পুরুষের চেহারায় চাষার ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ালে পর সজ্ঞানে হেলাফেলা করলেও অবচেতনে খোঁজখবর নিয়ে সেবাযত্ন না করে উপায় নেই। আবার যখন জসীম উদ্দীন বলেন, “ইতল বিতল ফুলের বনে ফুল ঝুরঝুর করে: দেইখ্যা আইলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে। ধানের পরে ধানের ছড়া তার উপরে টিয়া: নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারি পাখা দিয়া”-এই চারটি পঙক্তি পাঠ করার পরে একটি কর্মিষ্ঠা কালো বরণ নমু সমাজের চঞ্চলা বালিকার ছবি যেন হাওয়া ফাঁক করে মূর্তি ধরে জেগে ওঠে। তাকে কি সুন্দরী বলা যাবে? এদেশের কাব্যে সৌন্দর্যের বাঁধা ধরা যে সংজ্ঞা প্রচলিত আছে, না সে বিচারে নমুর মেয়েকে সুন্দরী বলা যাবে না। রামায়ণ, মহাভারত, কালিদাসের কাব্য, রাধা-কৃষ্ণলীলায় এমনকি মুকুন্দরাম ভারতচন্দ্রে যে সৌন্দর্যের বর্ণনা আছে সে অর্থেও নমুকন্যা সুন্দরী নয়। ইরান তুরানের রূপকথা উপকথা অবলম্বন করে পুঁথি-সাহিত্যের যে ভাণ্ডার রচিত হয়েছে, সেখানে কাজলকাটা সুর্মা আঁকা চোখের যে সকল নায়িকাকে আদর্শ সুন্দরী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, তাদের দলেরও কেউ নয় আমাদের এই নমু ঘরের কালো বরণ বালিকাটি। তাহলে কি তাকে ‘সুন্দরী নয়’ বলব? এইখানে সমস্ত অনুভূতি পড়ে পাওয়া নান্দনিকবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে, চেতনার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে দৈব বাণীর মতো ধ্বনিত হতে থাকে: সে সুন্দরী সে সুন্দরী। কোনো ধরনের সৌন্দর্যের সঙ্গে মেলে না কিন্তু সুন্দর হয় কেমন করে। আর অসুন্দর বলতেও মন চাইছে না, আবার সে দৈববাণী ঘোষিত হয় চেতনার স্তরে: এ সৌন্দর্য বিচারের নয় বোধ করার, বাইরের নয় ভেতরের। এ তর্ক করার নয় মেনে নেয়ার। লম্বা মাথার চুল কালো বরণ চাষীর ছেলে সে সুন্দর, নমুর ঘরের কালো মেয়ে যে সর্বক্ষণ কাজ করে বেড়ায় সে সুন্দরী। এ সুন্দর এ সুন্দরীরা শুরু থেকে আমাদের ইতিহাস আলো করে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে। আমাদের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত, কোনো ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা যারা কস্মিনকালেও করেনি অথচ ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে হাজার হাজার বছর ধরে পিষ্ট হয়ে নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুন্দর পেলব বৈশিষ্ট্যসমূহকে অনাদর করতে শিক্ষা করেছে, জসীম উদ্দীনের কবিতা তার প্রথম শিল্পিত প্রতিবাদ। জসীম উদ্‌দীন কাব্যকলার সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন শ্রমনিষ্ঠ মানুষ-মানুষীর মধ্যে। এই শ্রমনিষ্ঠ মানুষের অন্তরের সুন্দর সুরে সুরে মুক্তি দিয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। এই মানুষদেরই চলার ছন্দ, জীবনস্পন্দনের হাজারোরকম বৈচিত্র্য বুলবুল চৌধুরী নাচের তালে তালে ফুটিয়ে তুলেছেন। জয়নুল আবেদীনের ছবিতে এই কর্মচঞ্চল মানুষ-মানুষীরাই নতুন প্রাণের বরে চিরদিনের জন্য আয়ুস্মান হয়ে রয়েছে। জয়নুল আবেদীনের হাত দিয়ে বাংলার চিত্রকলা নতুন একটা কক্ষপথে যাত্রা শুরু করল। জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্মে একটি সমাজের গভীর জীবনভাবনা আন্দোলিত হয়েছে, একটি সমাজের চলচ্ছবি দ্রুত ধাবমান বিজুরীরেখার গতিশীলতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অবনঠাকুর, নন্দলাল কিংবা যামিনী রায়কে জীবনের সে সংঘাতময় চলমানতা, সে গতিচ্ছন্দ তাদের শিল্পে মূর্ত করার কথা ভাবতে হয়নি। সে কারণ আংশিক সামাজিক এবং আংশিক শৈল্পিক। অবনীন্দ্রনাথ যে পরিবেশে মানুষ, যে বোধ উপলব্ধি তার শিল্পচর্চার রক্তবাহী শিরার মতো তাকে বেগ আবেগ দুই-ই যুগিয়েছে, সেই বোধ সেই উপলব্ধি তাকে ইতিহাসের অতি দূর দূরান্তরের পরিব্রাজক করে ছেড়েছে, রামধনুর কায়াহীন ছায়ার সঙ্গে আলিঙ্গন করিয়েছে। এদেশীয় চিত্রকলার নবজীবন প্রাপ্তির প্রদোষকালে অবনীন্দ্রনাথের এই ভূমিকা অতিশয় সঙ্গত এবং স্বাভাবিক ছিল। মাটির পৃথিবীতে অনুপম স্বর্গলোক সৃজনের প্রয়াস নন্দলালের পক্ষেই শোভা পায়। চাঁদপানা মুখের একই ডৌল একই ভঙ্গির প্রতিমা নির্মাণ যামিনী রায়কেই মানায় ভাল।

কিন্তু জয়নুল আবেদীন? তিনি ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন যুগের, ভিন্ন সমাজের শিল্পী। তার চেতনার স্তরে স্তরে ভিন্ন রকম জীবনবীক্ষা এবং জীবন অভিজ্ঞতা মর্মরধ্বনিতে বাংলার শ্রমশীল সমাজ, বৃহত্তর অর্থে বাংলার কৃষক সমাজের জীবন সঙ্গীত বাজিয়ে তুলছে। যোজন যোজন মাঠব্যাপী ছড়ানো উৎপাদন-শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাংলার কৃষক, বংশ-পরম্পরা কায়িক শ্রমে যাদের একমাত্র উত্তরাধিকার। এই বৃক্ষপ্রতিম অচল সমাজের মানুষেরা শিল্পীর মনের দুয়ারে দুয়ারে সবেমাত্র টোকা দিতে আরম্ভ করেছে। শ্রমে-স্বেদে সিক্ত মলিনমুখো মানুষেরা শিল্পীর কাছে আবেদন জানাতে লেগেছে: আমাদের মূর্তিমান করো, প্রকাশিত করো। অবনীন্দ্রনাথ কেমন করে সে আহ্বান শুনতে পাবেন? নন্দলাল কেমন করে স্নিগ্ধ রঙে চুবিয়ে রোদে পোড়া বৃষ্টিতে ভেজা এই মানুষদের ছবি আঁকবেন? যামিনী রায় কোন সাহসে সুন্দরীদের সঙ্গ ছেড়ে এমন নিখাদ চাঁছাছোলা জীবনসংগ্রামের রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হবেন? এই নিসর্গনির্ভর মানুষদের বার্তাবাহক একজন শিল্পী প্রয়োজন। তাই এলেন জয়নুল আবেদীন।

তেরশ পঞ্চাশের ভয়াবহ মহামারী-মন্বন্তর, মহাযুদ্ধের বীভৎসতা এবং শহর কলকাতার দুঃসহ সামাজিক বাস্তবতা একযোগে তার স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করে তাকে দিয়ে কাকের ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিল। একটি পর্যায়ে, শুধু একটি পর্যায়ে তার তুলি মানবতার বীভৎস করুণ রূপসৃষ্টির দিকে ধাবিত হয়েছিল। এটা শিল্পীর স্থায়ী পরিচয় নয়, পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠা । শিল্পী জয়নুল তার যৌবন দিনে একবার জ্বলে উঠে, এই পর্যায়ের চিত্রসমূহের মধ্যে যুগের পরিবর্তন, শিল্প রুচি এবং শিল্পাদর্শের পালাবদল এবং সমাজ আদর্শের রূপান্তর কত-কিছুর ঘোষণা রটিয়ে দিতে পেরেছিলেন । এসকল কারণেই তার এ পর্যায়ের ছবিসমূহ হানা দিয়ে চিত্রপ্রেমিকদের মনে স্থান দখল করে নিতে পেরেছে।

কিন্তু সামাজিক চিত্রাবলীর মধ্যেই শিল্পী জয়নুলের প্রকৃত এবং স্থায়ী পরিচয়। যেসকল চিত্রের মধ্যে বাংলার ইতিহাস হাজার বছরের ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, শত অবগুণ্ঠনের অন্তরাল ভেদ করে গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষের সরল জীবনযাত্রা উঁকি দিতে পেরেছে, সেখানে কেবল সেখানেই জয়নুলের সুন্দর চিত্র শরীরে কান্তিমান হয়েছে। তার পিতৃনিবাস ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের ময়মনসিংহের সে পাটক্ষেত, সে চাষা, সে মাঝি, সে নৌকা, সে ধানক্ষেত, হাল-লাঙল-বলদ, পাঁড়াগেঁয়ে বিয়ের আসর, পাল্কি চড়ে নববধূর শ্বশুর বাড়ি যাত্রা, দুধাল গাই, গুণটানা নাও, তেজী ষাড়, গাবের কষে রাঙানো জেলেদের মাছ ধরা জাল, কৃচিত কখনো একজন-দুজন বিরল সাঁওতাল রমণী, বাংলার আবহমানকালের চিরপরিচিত এসকল দৃশ্যে জয়নুল আবেদীন তার সুন্দরকে আবিষ্কার করেছিলেন। এ সুন্দর অবনীন্দ্রনাথের মায়ামরীচিৎকার সুন্দর নয়, নন্দলাল বসুর স্নিগ্ধ শোভন ধ্যান দৃষ্টির সুন্দর নয়, যামিনী রায়ের অঙ্গের সীমান্তপ্রান্তে অন্তর উদ্ভাসিত হওয়া সুন্দর নয়। এ সুন্দর রক্তমাংস চলা-অচলা, স্থূল-চিকনে মেশানো সুন্দর। জসীম উদ্দীনের কবিতার মতো তাকে হাত দিয়ে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো একটি আভাস মাত্র রচনা করে ধূপের শরীর ধরে হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায় না ।

জয়নুলের আঁকা ছবিগুলো একটার পাশে আরেকটা সাজালে গ্রামীণ মেহনতী মানুষের জীবনসংগ্রামের বিচিত্রমুখী রূপটিই প্রকটিত করে তুলবে। মনে হবে এক একটি ছবি আরেকটি বড় ছবির স্বয়ংসম্পূর্ণ অংশ। আর সে বড় ছবিটি বাংলার উৎপাদনশীল মেহনতী মানুষের সমাজ কাঠামো। এই পরিপ্রেক্ষিতটা আবিষ্কার করাই হলো চিত্রকলার ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদীনের মৌলিক অবদান।

আর্ট স্কুলের ছাত্র হিসেবে অবনঠাকুর-নন্দলাল-যামিনী রায়ের ঘরানা যে স্টাইল বা অঙ্কনশৈলী তিনি রপ্ত করেছিলেন, তার আপন বিষয়ে প্রয়োগের বেলায় দেখা গেল সে রীতি ছোট মাছধরা জালে সামুদ্রিক তিমি আটকাবার দুরাকাঙ্ক্ষার মতোই অকেজো এবং হাস্যকর। এই গ্রাম বাংলার শ্রম-ঘাম-সংগ্রামে কাতর মানুষদের চকচকে পেশী সাপের ফণার মতো রঙের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় ফুলে উঠল। কখনো বা রঙের যাদু সময় সমুদ্র মন্থন করে এমন একখানা মুখদর্পণ কোত্থেকে টেনে আনল, চোখে পড়লে হঠাৎ করে অনেক প্রকাশহীন কথা বুকে কারণহীন ব্যথায় আকুলি বিকুলি করে। এই তো জয়নুল আবেদীন! অবনীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পের যে ধারাটি রামধনুর রঙে রঙে মুক্তি দিয়েছিলেন, ইতিহাসের স্বপ্ন-কল্পনার জগতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই একই ধারাটিকে তিনি অপার মমতায় বাংলার প্রাকৃত জনগণের জীবনের সঙ্গে, জীবিকার সঙ্গে গেঁথে দিতে পেরেছেন। এ কি কম কথা! তবু এই জয়নুল আবেদীন বড় বেশি একঘেঁয়ে, বড় বেশি প্রাদেশিক । ইনস্টিঙ্ককে ছাড়িয়ে তার ছবি কোনো উচ্চতর আবেদন, সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সত্যি সত্যি অপারগ। তার ছবির নর-নারীগুলো যেন সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল এক একটা টাইপ বিষয়বস্তু। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের ছাপ বড় একটা চোখে পড়ে না। তার শিল্পী জীবনেও তেরশ পঞ্চাশের হঠাৎ জ্বলে ওঠার ক্ষণটি ছাড়া আপনাকে আপনি ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রাণধর্মী তাগিদ কিংবা প্রেরণার বড় অভাব। শেষপর্যন্ত জয়নুল আবেদীন চিত্র আঁকা শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন আর শিল্পী ছিলেন না। উনিশশ সত্তর সালের সর্বগ্রাসী বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের পর ‘মনপুরা’ শীর্ষক চিত্রে আরেকবার যৌবন দিনের মতো জ্বলে উঠবার একটা সজ্ঞান প্রচেষ্টা করেছিলেন। ভয়াবহতার প্রতীকরূপে ঢেউগুলোকে হাঙ্গরের বিরাট বিরাট হা-য়ের মতো করে এঁকেও ছিলেন। কিন্তু সে ছবি অভ্যস্ত হস্তের নির্মাণ কৌশল অতিক্রম করে সঠিক সৃজনকর্ম হতে পেরেছে বলে মনে হয় না। চিত্রকলার বোধ এবং উপলব্ধির দিক দিয়ে, নিষ্ঠা এবং সাধনার গভীরতার বিচারে জয়নুল আবেদীন, অবনীন্দ্রনাথ,নন্দলাল, যামিনী রায় এই তিনজন শিল্পীর পাশাপাশি স্থান পেতে পারে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করে দেখতে হবে। তথাপি জয়নুল আবেদীন বড়,তার হাতে আটকোটি মানুষের একটি জাতি চিত্রশিল্পের দীক্ষালাভ করেছে। বলতে গেলে তার একক প্রচেষ্টায় ঢাকা শহরে একটি চিত্রকলার পীঠস্থান রচিত হয়েছে। একসময় ভারত ভাগ না হলে হয়তো জয়নুল আবেদীনকে সে গুরুদায়িত্ব বহন করতে হতো না। এবং তিনি আরো বড় শিল্পী হতে পারতেন। কিন্তু সবকথার সারকথা হলো, ভারত বিভক্ত হয়েছিল। ছবি আঁকা বাদ দিয়ে জয়নুলকে ছবি আঁকার মাস্টার হতে হয়েছিল।

.

৬.

‘কবিকে যাবে না পাওয়া জীবন-চরিতে’-রবীন্দ্রনাথের এই ছন্দিত বাক্য কবির বেলায় সত্য হতেও পারে। কিন্তু কবিকে পাওয়া যাবে কোথায়? সহজ উত্তর: কবিতায়। কিন্তু কবিতায় যেটুকু পাওয়া যায়। অর্থাৎ কবির প্রাণ- পাতালের আলো আঁধারের ঝিকিমিকি- সেই চিন্ময় প্রাপ্তিতে মন যখন বশ মানে না, বুদ্ধি সন্তুষ্ট হতে চায় না, বাকিটুকু খুঁজতে হবে কোথায়? তারও সহজ উত্তর: জীবনে। তাহলে কথাটা দাঁড়ালো এই, কবিকে পাওয়া যাবে প্রথমে কবিতায়, তারপরে জীবন-চরিতে অবশ্য যদি হয় তেমন জীবন-চরিত।

শিল্পীকে পাওয়া যাবে শিল্পে। সেটাও এক ধরনের পাওয়া বটে। সে পাওয়া দিয়ে শিল্প উপভোগ করা যায়, তারিফ করা যায়, বাহবা দেয়া যায়, কিন্তু শিল্পের বিচার করা যায় না। রেনেসাঁস পরবর্তী যুগে অনেক কলা সমালোচক রেনেসাঁস যুগের চিত্রকর ও ভাস্করদের অঙ্কনরীতি এবং নির্মাণশৈলীর নানারকম ব্যাখ্যা-বিচার করেছেন। চিত্রকলা এবং ভাস্করদের ইতিহাসে কার কোথায় স্থান, কার প্রভাব কার উপরে কতটুকু, কার প্রাতিস্বিকতা কতদূর এসব নিয়ে বিস্তর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। ভাসারীর সেই সুবিখ্যাত গ্রন্থটির পাশে এসব তত্ত্ব এবং তথ্য বিন্যাস, নন্দনতত্ত্বের উর্ণাতন্ত্র বিস্তার বড় বেশি কাগুঁজে এবং বড় বেশি মেকী মনে। হয়। তার একটি মুখ্য কারণ, ভাসারী শিল্পের আর শিল্পীর এমন একটি সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছেন, পিতা-মাতার সঙ্গে পুত্র কন্যার সজীব ও অচ্ছেদ্য সম্পর্কের তুলনামাত্র যার সাথে করা যায়। তিনি বহু খ্যাত, কম খ্যাত এবং একেবারে অখ্যাত শিল্পী আর ভাস্করদের জীবন বৃত্তান্ত এমনভাবে সংকলন করেছেন, তাদের পছন্দ-অপছন্দ ঘরোয়া স্বভাব এবং বেপরোয়া প্রবণতাসমূহ এমনভাবে ধরেছেন, শিল্পে সেগুলোর ছায়াপাত কিভাবে ঘটেছে এমনভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন, কাঁচের আধারে শাখা-পত্রে পল্লবে-মুকুলে বর্ধিষ্ণু তরুর দীঘল শরীর যেমন দৃষ্টিগোচর; তেমনিভাবে শিল্পীদের মানস-পরিণতির ছবিটি লক্ষগোচর হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য শিল্প-সমালোচনায় এই সুবৃহৎ ও সুবিখ্যাত গ্রন্থটি এত অধিক প্রভাব বিস্তার করেছে যে আরভিং স্টোন যখন মিকেলেঞ্জেলো ও ভ্যানগগ-এর জীবন নিয়ে উপন্যাস রচনা করেন, সমারসেট মম যখন পল গঁগার জীবন কাহিনী লেখেন অথবা রমা ব্ললা উপন্যাসের পরিসরে সঙ্গীতশিল্পী বেটোফেনের মানস-জীবনের নিরন্তর ঝঞ্ঝাকে ধারণ করতে চেষ্টা করেন, তখন সকল প্রয়াসের মধ্যে ভাসারীর লাইভ অফ দ্য রেনেসাঁস পেইন্টার্স’-এর একটা জলছবি কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট, কেমন যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চায়।

এ দেশের চিত্রকলার আলোচনা-সমালোচনার ধারাটি বলতে গেলে একেবারেই অর্বাচীন এবং সেকারণেই গভীরতা বিবর্জিত। অজন্তাগুহাগাত্রের আশ্চর্য ছবিগুলো কারা এঁকেছিলেন, প্রশ্ন করলে গুহার অভ্যন্তরে সে প্রশ্ন শুধু ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রচনা করে, কোনো জবাব টেনে আনে না। তাজমহলের স্থপতি কে বা কারা? এ ব্যাপারেও একরাশ মৌনতা চারপাশ থেকে ছুটে এসে প্রশ্নকারীর কণ্ঠস্বর গ্রাস করে ফেলে- জবাব মেলে না। ভারতীয় চিত্র এবং ভাস্কর্যকলার স্রষ্টারা মা-মাকড়সার মতো। হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা সবটুকু ক্ষয় করে বাচ্চা ফুটোনোর কাজে। যখন বাচ্চা ডিম ফুটে বেরোল পেঁয়াজের খোসার মতো ফুরফুরে একখানি কঙ্কাল ছাড়া আর কোথাও মায়ের কোনো চিহ্ন নেই। ছবি আঁকা হয়ে গেলে, ভাস্কর্য গঠিত হওয়ার পরে শিল্পীর আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। তাই অজন্তাতে হোক, ইলোরাতে হোক, তাজমহলে, কুতুব মিনারে, রাজপুত চিত্রে, কানাড়া চিত্রে, মোগল চিত্রে যিনি শিল্পী তিনি গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন, তার নাম-ধাম কুল-পরিচয় কেউ জানে না।

ইউরোপীয় আদর্শে নব্য-চিত্রকলার বিকাশ ঘটলেও যথার্থ অর্থে চিত্র সমালোচনার ধারাটি এখানে অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি। এখানে এক ধরনের সমালোচনার চল আছে, তা যে একেবারে অন্ধ তাও নয়। এমন পারঙ্গম চিত্র ভাষ্যকার যথেষ্ট ছিলেন, বা এখনো আছেন যারা উৎকৃষ্ট চিত্রের মর্মোপলব্ধি করতে পারেন, শিল্পীর প্রাতিস্বিকতা অনুভব করতে পারেন রঙ-রেখার আঁকাবাঁকা বৈশিষ্ট্য প্রকাশমান করে তুলতে পারেন, বিমূর্ত চিত্রের মধ্যে অর্থের ব্যঞ্জনাও আবিষ্কার করতে পারেন। তার পরেও কিন্তু একটা ফাঁক থেকে যায়। শিল্প আর শিল্পীর মধ্যে একটা দ্বান্দ্বিক, জৈবিক এবং সক্রিয় সম্পর্কসূচক চিত্র-আলোচনার ধারা এখানে আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীকে এখনো অনেকটা বিশেষ জাতের, বিশেষ ধাচের উন্নত শ্রেণীর কারিগর হিসেবে বিচার করা হয়। শিল্প থেকে শিল্পীকে আলাদা করে দেখার সনাতন অনীহা কাটতে কাটতেও যেন কাটে না। একজন বিজ্ঞানী যে মেধাশক্তি প্রয়োগ করে একটা নতুন কিছু আবিষ্কার করেন, যে মেধার বলে পারস্পরিক যুক্তি-শৃঙ্খলার বিন্যাসে একজন দার্শনিক জীবন এবং জগতের নতুন অর্থ খুঁজে বের করেন, একজন উৎকৃষ্ট কবি যেভাবে সনিষ্ঠ মেধাশক্তির প্রয়োগে উপমা-চিত্রকলা-ছন্দ অলংকার সহযোগে আনন্দলোকের দুয়ার উন্মুক্ত করেন, চিত্রকরের দক্ষতাকে কবি-বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকের সেরকম সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়ে বরণ করার মতো মানসিক পরিপক্বতা আমাদের সমাজ অর্জন করতে পারেনি। চিত্র-শিল্পীর প্রতিভার যে কদর আমাদের সমাজে তা অনেকটা দায়ে পড়ে, ঠেকে এবং বাধ্য হয়, কদাচিৎ তা স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

সে যাহোক, শেখ মুহম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই তার জীবন আলোচনা করতে হবে। অবনীন্দ্রনাথ থেকে জয়নুল আবেদীন পর্যন্ত সমস্ত শিল্পীর যে জীবন বৃত্তান্ত আমরা জানি তার সঙ্গে সুলতানের জীবন-বৃত্তের সামান্য মিল কোথাও নেই। অন্য সকল শিল্পীর জীবন এবং তাদের কৃত শিল্পকর্ম একটা ছকে ফেলে বিচার করা যায়। শেখ সুলতানের জীবনকে যেমন তেমনি তার ছবিকেও বিচার করতে হবে অনেকগুলো ছকে ফেলে এবং তার সবগুলো আমাদের মানস-দৃষ্টির সামনে উপস্থিত নেই। সুলতানের জীবন বলতে বড়জোর যা বলতে পারে তা হলো লাল মিয়া নামে একটি শিশু যশোর জেলার একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে আজ থেকে পঞ্চান্ন কি ষাট বছর আগে জন্ম নিয়েছিল। সেই শিশুটিই এখন শেখ সুলতান নাম ধারণ করে যশোরের সেই কৃষক সমাজে ঝাঁকড়া কেশ দুলিয়ে, নমঃশূদ্র নর-নারীর আদরের গোঁসাই সেজে, অর্ধেক ছন্নছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া, অর্ধেক সন্তের বেশে সাপ-শেয়াল ইঁদুর-বেড়াল নিয়ে রঙের সংসার পেতে বসে আছেন।

আজকের দিনে সুলতান বলতে যশোরের যে ঝাকড়া কেশের আউলাঝাউলা মানুষটিকে বোঝায়, যিনি পৌঢ়ত্বের চৌকাঠে বেশকিছুদিন আগে পা রেখেছেন; পুত্র কন্যা-স্ত্রী,সংসারহীন একেবারে একাকী একজন প্রাকৃতিক মানুষ; তিনি যখন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন, উনিশশ সাতাত্তর সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনী উপলক্ষে আঁকা এসকল চিত্র-সন্তান ছাড়া তার নামের অমরতা ঘোষণা করার আর কেউ থাকবে না।

কস্তুরী হরিণের মতো আপনার গন্ধের পেছনে আপনি কক্ষচ্যুত ধূমকেতুর বেগে, প্রাণ প্রবাহের তাপে, হেথা নয় হেথা নয়’ নিরন্তর তিরিশটি বছরের ছুটে চলা ঋণ প্রবাহের তাপে খু ন হ জীবনের সমস্ত বেগ, সমস্ত আবেগ যশোরের ভাঙা মন্দিরের দ্বারে দ্বারে, জীর্ণ অট্টালিকার খিলানে-অলিন্দে, তরুলতার সংসারে, পশু-পাখির সমাজে অসহায় শিশুর মতো গৃহ সন্ধান করে চলেছে। জীবন যাকে হেঁচকা টানে গৃহ-সমাজ-সংসারের বন্ধন খসিয়ে শিল্পতীর্থের যাত্রী করেছে, শিল্পের মানস-সায়রের উপকূলেই তো তাকে গৃহ। সন্ধান করে নিতে হয়। এই গৃহের সন্ধান তিনি একবার পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন উনিশশ একাত্তর সাল। হাজার বছরের পরাধীন বাংলা, প্রাণ-পাতালের অভ্যন্তরে অপরাজেয় সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে, দর্পিত শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে, ভেতরে থেকে শিউরে শিউরে আগুন বরণ ফণা মেলে জেগে উঠেছিল। বাংলার ইতিহাসের সেই অভাবিত, সেই অচিন্তিত-পূর্ব জাগরণের অরুণ আভায় তার একখানি আশ্রয় নিকুঞ্জের ছায়া দর্শন করেছিলেন শেখ সুলতান, কামান-বন্দুকের হুংকারের মধ্যে গৃহের কল-কাকলী কান পেতে শুনেছিলেন। ইতিহাসের এই থরোথরো কম্পিত জাগরণের মধ্যে তিনি ধ্যান-দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন: সমাজের উপরতলার শ্ৰেণীগুলো, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ে যারা ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা দিতে দিতে উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কহীন পরগাছার মতো ফাঁপানো-ফোলানো জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, এই সামাজিক ভূমিকম্পে তাদের অস্তিত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সময়ের প্রখর তাপে তারা মোমের পুতুলের মতো গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই কম্পনের বেগ ধারণ করা তাদের সাধ্যের বাইরে। এই জাগরণের আগ্নেয় সংবাদ বহন করতে গিয়ে তারা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে। পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণীকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের গভীর অঙ্গীকার যারা নিরবধিকাল ধরে বহন করে চলেছে, নতুন ফুটন্ত ইতিহাসের আবেগ-উত্তাপ সবটুকু পান করে ফুটে উঠবার বীর্য এবং বিকাশমান সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে। সেই শ্রমজীবী কিষাণ জনগণকে তিনি বাংলার ইতিহাসের নবীন কুশীলব হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। এই দেখা সমাজ-বিজ্ঞানীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সামাজিক সম্পর্কের জটাজাল বিচার নয়, অর্থশাস্ত্রীর চুলচেরা শ্রেণী-বিশ্লেষণ নয়। এ দেখা শিল্পীর দেখা: বিন্দুতে সিন্ধু ঝিলমিলিয়ে ওঠে, ক্ষুদ্র তিল পরিমাণ বীজকণার অন্তরে সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে শায়িত থাকে বিশাল মহীরুহ।

তাই সুলতানের কৃষক, জয়নুল আবেদীনের কৃষক নয়। জয়নুল আবেদীনের কৃষকেরা জীবনের সংগ্রাম করে । সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন । তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশীর শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে। এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাক্ষা এবং স্বপ্ন আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে। সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয়। রামচন্দ্র যেমন অহল্যা পাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপ দান করেছিলেন, তেমনি তার মেহনতি মানুষদের পরশ লাগামাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে ভাপিয়ে উঠতে থাকে। এ মানুষগুলো পাখা থাকলে দেবদূতের মতো আকাশের অভিমুখে উড়াল দিতে পারত। কিন্তু একটি বিশেষ ব্রতে, একটি বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। সে অঙ্গীকারটি, সে ব্রতটি মাটিকে গর্ভবতী ও ফসলশালিনী করা। মাথার উপরে স্বর্গলোকের যা কিছু প্রতিশ্রুতি, যা কিছু প্রেরণা তার সবটুকু- আকাশের নীল থেকে, রামধনুর বর্ণের সুষমা থেকে হেঁকে এনে মাটির ভেতরে চারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই মানুষ-মানুষীর দল। ম্যাক্সিম গোর্কির সেই বাক্যটি কি দর্পিত, কি ব্যঞ্জনাময় এই মানুষ শব্দটি’ উচ্চারণ মাত্রই নিসর্গের অন্তরে কি ব্যাকুল সাড়া এবং কানাকানি পড়ে যায়। সুলতানের আঁকা এই কৃষকদের যিনি দেখেছেন, অবশ্যই একমত হবেন, ম্যাক্সিম গোর্কির মানুষ সম্পর্কিত মন্তব্য কত সার্থক এবং যথার্থ হয়েছে ।

ইতিহাসের অয়নান্তকালে একটি নতুন শ্রেণী সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে নতুন ঐতিহাসিক বলে বলীয়ান হয়ে, নতুন সামাজিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন জাগ্রত হয়; শিল্পকলাতে সে সমাজের ব্যক্তি-স্বরূপের অভিব্যক্তি যখন ঘটতে থাকে, তখন ব্যক্তি ব্যক্তিমাত্র থাকে না, জাগরণশীল নিখিলের অংশ হয়ে যায়। রেনেসাঁস যুগের চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের মধ্যে একবার জাগরণশীল নয়া নিখিল পুরনো চরাচরের নাগপাশ ছিন্ন করে মূর্তিমান হয়েছিল। দেবতা এবং দেবলোকের নষ্ট-অপচিত স্বপ্নের অশরীরী সৌন্দর্যের মায়াকাননের বলয় গ্রাস থেকে চিন্তা কল্পনাকে মুক্ত করে প্রাকৃতিক নিয়ম শাসিত এই পৃথিবীর দিকে এবং সমস্ত সুন্দরের নিবাসভূমি এই দেহ-দেউলের প্রতি বিস্ময়াপুত নয়ন মেলে অগ্রপথিক মানুষেরা যখন নয়া মানব বিজ্ঞানের প্রসাদে, সম্ভাবনা স্পন্দিত অন্তরে তাকাতে আরম্ভ করেছে; সেই দেখার আবেগ, প্রত্যাশাই রেনেসাঁস যুগের শিল্পীদের শিল্পকর্মে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।

শরীরী সৌন্দর্যের প্রতি এই গভীর অনুরাগ, সুন্দর এবং শক্তির এই যুগল সম্মিলন রচনার কৌশল সুলতানের রেনেসাঁস শিল্পীদের কাছে শেখা। ভাগ্যবশত রেনেসাঁস শিল্পের পীঠস্থানসমূহে পরিব্রাজকের বেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ তার হয়েছিল। পুরনো দেবতারা যেমন মরে না, পুরনো শিল্পও তেমনি অমর। গ্রিসের রঙ্গমঞ্চ যখন শুধু একটা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে, দেবী অ্যাথেনীয় মন্দির যখন একটা পাথুরে কঙ্কালমাত্র, ভাস্করের খোদাই করা রস লাবণ্যমাখানো মূর্তিসমূহ খোঁড়া-অন্ধ-বিকলাঙ্গ, কালের প্রহার অঙ্গে ধারণ করে সময়-সমুদ্রেবিলীন গরীয়ান গ্রিক সভ্যতার যৌবন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দর্শকের বুকে একটু করুণা একটা দীর্ঘশ্বাস জাগাবার জন্য দিবস-রজনী, মাস-বছর, যুগ-যুগান্ত প্রতীক্ষা করছে; সেই সময়ে খ্রিস্টধর্মের বর্বরতাঠাসা আদিম অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ‘আলো আলো’ বলে চিৎকার করছে তামাম ইউরোপ। আলো চাই, আরো আলো চাই। টলেডো, কর্ডোভা, গ্রানাডার মূর পণ্ডিতেরা অঙ্গুলি সংকেতে দিক নির্দেশ করল; যাও গ্রিসে যাও। আলো জ্বালানোর কৌশল শিখতে চাও তো গ্রিক লেখকদের লেখা পড়ো, তাদের ধ্যানের দীপ্তি, মননের ঐশ্বর্য অন্তরে ধারণ করো।

ইহজাগতিকতা বা সেকুলারিজম, যার অর্থ এই জগৎ সুন্দর, এই জীবনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, সমস্ত কর্ম, সমস্ত অভিব্যক্তি সুন্দর। প্রাচীন গ্রিস বার্ধক্যের জীর্ণতার ভারে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়লেও তার হৃদয়ে এই অবিনাশী সৌন্দর্যের প্রেরণার ঝর্নাধারা, এই ধ্বংসস্তূপের অন্তরালে, এই মৃত্যুহিম শীতলতার গভীরে এখনো উষ্ণস্রোতে প্রবহমান। ইউরোপে সে কি উৎসবের সাড়া। দলে দলে বলাকারা যেমন মানস-সরোবরের সন্ধানে যায়, ইউরোপের আলোকিত আত্মারা প্রাচীন অ্যাথেন্স নগরীর অভিমুখে মানস যাত্রা রচনা করল। রব উঠল গ্রিকদের মতো চিত্র আঁকতে হবে, ভাস্কর্য গড়তে হবে, নাটক লিখতে হবে, খ্রিস্ট ধর্ম যেসব একান্ত মানবিকবোধের মুখে পাথর চাপা দিয়েছে সে সমস্ত অর্গল টুটিয়ে দিয়ে একান্ত জৈবিক অনুভূতিসমূহও থরে থরে ফুলের মতো ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই ফোঁটার কাজ শিল্প-সাহিত্যে, চিত্রে-ভাস্কর্যে, বিজ্ঞানে-দর্শনে এমনিভাবে ঘটেছে সৃজন-ঋতুর কল্পনা করামাত্রই মন এক লাফে রোম, ভেনিস, জেনোয়া- এসকল নগরীর দিকে যাযাবর বিহঙ্গের মতো ছুটে যেতে চায়।

শেখ সুলতানের মধ্যে দ্যভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকাণ্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠতার ছাপ এত গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ, কোনোরকমের মধ্যবর্তিতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাঁস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে এই উনিশশ সাতাত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে এসে নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছবিগুলো আঁকার মতো মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য শেখ সুলতানকে সব দিতে হয়েছে। পরিবারের মায়া, বংশধারার মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবাহিত করার স্বাভাবিক জৈবিক আকাঙ্ক্ষা ভেতর থেকে ছেটে দিয়ে, এই চিত্র-সন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্রপ্রায় কাঁপালিক সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারা জীবন। শেষ পর্যন্ত অসম্ভব হয়েছে। বাংলার শিল্পীর হাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতি এবং বাংলার ইতিহাসের একেবারে ভেতর থেকে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটেছে। সুলতানের সাধনা মিথ্যা হয়ে যেত, যদি না বাংলার শিল্পীর সঙ্গে সহযোগিতা করে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ইতিহাসের জাগ্রত-দেবতা আপন স্বরূপে শিল্পীর সামনে এসে না দাঁড়াতেন।

এইখানেই সুলতানের অনন্যতা। এইখানেই বাংলার কোনো শিল্পীর সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনো শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল আবেদীন, আবদার রহমান চাঘতাই, নাগী, এসকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পাদর্শের যে ব্যাপক সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি- একমাত্র সুলতান ছাড়া । বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন যখন মহাকাব্য লিখেছেন, তার বহু আগেই ইউরোপে মহাকাব্য লেখার কাজ চুকেবুকে গেছে। কিন্তু মধুসূদন মহাকাব্য লিখলেন বাংলা ভাষায়। মধুসূদন দত্তের মহাকাব্য বাংলার সাহিত্য, গগনে সূর্য-সংকাশ দীপ্তি নিয়ে, অনন্যতার নিদর্শন হয়ে মানব কল্পনার কুতুবমিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অতিকায় কল্পনার বোঝা আরো অধিক বহন করবার জন্য তার স্বগোত্রীয় কবিকুলের মধ্যে দুচারজনের আকাঙ্ক্ষা জন্মালেও ক্ষমতা কারো যে ছিল না, তা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুলতানের এই চিত্রগুলোও অনেকটা সে গৌরবে গরীয়ান।

শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে এমন মাহেন্দ্রক্ষণের হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে যখন গোটা ইতিহাসের ধারাটাই শিল্পীর চেতনালোকে মাতম করে ওঠে। সেই বিশেষ সময়টিতে নিসর্গের স্কুল-চিকন দৃষ্টি-অগোচর কার্যকারণ সম্পর্কের সম্পূর্ণ সূত্রটাই শিল্পী-চেতনার মুকুরে এমনভাবে প্রতিফলিত হয়ে ওঠে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই গহন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় স্বভাব সম্বন্ধে শিল্পীর নিজেরও কোনো স্বচ্ছ, যুক্তিনিষ্ঠ ধারণা থাকে না। তা থাকা সম্ভবও নয়, আর শিল্পীর জন্য প্রয়োজনও নয়। এই একান্ত সংগোপন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দোলা, যার আবেশে শিল্পী সব ভুলে শিল্প-কর্মে মনোনিবেশ করে, তার সহজ নাম প্রেরণা। প্রেরণার স্পর্শ না পেলে কিছুই নির্মাণের স্তর অতিক্রম করে শিল্পকর্মের ব্যঞ্জনা লাভ করে না। আবার সব শিল্পীর প্রেরণার ধরনও এক নয়। প্রেরণা নিজের অস্তিত্বকে পুড়িয়ে অন্যরূপে রূপান্তরিত করার সুন্দর সুখকর আনন্দ-বেদনাদায়ক অনুভূতি। এই অনুভূতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙ, বিভিন্ন রসে আত্মপ্রকাশ করে। কোনো বিশেষ সময়ে স্নিগ্ধ রঙ, শান্ত রস, কোনো সময়ে উজ্জ্বল চড়া খুনখারাবীর মতো রঙ আর ভয়ংকর রস প্রাধান্য পায়। সময়ের বৈশিষ্ট্যের মতো শিল্পীর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ভেদেও একেক রঙ একেক রস মুখ্য হয়ে ওঠে। কোনো শিল্পী স্নিগ্ধ রঙের, শান্ত রসের, কোনো শিল্পী মধুর রসের আর চিত্তহারী রঙের কোনো শিল্পী হাল্কা ফুরফুরে তুলিতে হাল্কা রস বিকশিত করতে পারেন। রাগ সঙ্গীতের মতো। যেমন সব রাগ সকলের কণ্ঠে সমান খেলে না। শিল্পে যুগ-বিভাগ অর্থাৎ একেক যুগের শিল্পের প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে সাধারণ লক্ষণ ধরে নিয়ে এক যুগের শিল্পকর্মকে অন্য যুগের চাইতে আলাদা করার একটা প্রচলিত পদ্ধতি আছে, তাতে সময়ের রঙ এবং রসের ব্যাপারটিকেই নির্ণায়ক হিসেবে ধরা হয়। শিল্পীর ক্ষমতা এবং যোগ্যতায় যত আকাশ-পাতাল ফারাক থাকুক

কেন, একই সময়ের সৃষ্ট নানা শিল্পের মধ্যে একটা সাধারণ, ব্যাপ্ত লক্ষণ অবশ্যই ধরা পড়বে। প্রাক-রেনেসাঁস চিত্রের একটা সাধারণ, সহজে চেনা যায় এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে রেনেসাঁস, উত্তর-রেনেসাঁস, ইম্প্রেশানিস্ট, ইমেজিস্ট, সুররিয়ালিস্ট প্রতিটি যুগের শিল্পের আলাদা আলাদা কতেক সাধারণ ধরন।

কোনো কোনো শিল্পীর চেতনায় ইতিহাসের অন্তর্লীন সূত্রটি রক্তশিখায় জ্বলে ওঠে, মাদল ধ্বনিতে বেজে ওঠে। কেন? কেন আতশকাঁচ সূর্যের সামনে ধরলে আগুন জ্বলে, সাধারণ কাঁচ জ্বলে না কেন? সেরকম কোনো কোনো জাতের শিল্পী আছে উপযুক্ত সমিধ পেলে চেতনায় গোটা ইতিহাসের ধারাটিই জ্বালিয়ে তুলতে পারেন। এটি একটি দেবদুর্লভ ক্ষমতা। যার আসে এমনিই আসে। ইতিহাস যাকে মনোনীত করেন, অনেক দুঃখ নিয়েই যোগ্য করে তোলেন। অনেকে আবার দুঃখ সহ্য করেন বটে কিন্তু শিল্প-সৃজনলোকে নির্বাণ লাভ করতে পারেন না, এ-ও ঘটে। তুলনা করলে দেখা যাবে শিল্পতীর্থের অভিযাত্রী হাজার হাজার জনের মধ্যে কৃচিত কখনো দুয়েকটি প্রাণ সেই অমরলোকে সশরীরে হাজির হতে পেরেছে।

তান্ত্রিক সাধনার মতো শোনাবে। শিল্প-সাধনা আসলে একধরনের তান্ত্রিক সাধনারই ফলিত প্রকাশ রূপ। কথাটা শুনলে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন, কিন্তু আধুনিক মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টি প্রয়োগ করে বিষয়টি বিচার করলে সে ভুলটা অতি সহজে ঘুচে যাবে। তান্ত্রিক বাউল এমনকি সুফি সাধকেরাও বিভিন্নভাবে শরীরের গতি নিয়ন্ত্রণ করে ঊর্ধ্বায়িত করার সাধনা করেন। শিল্পীর কাজও অনেকটা সেরকম। তবে তিনি সজ্ঞানে বোধ করতে চান না যে সে সাধনাটিই তিনি করছেন। শিল্পী একটা বিশেষ ছবি আঁকতে চান, কবিতা লিখতে চান, তাতে মনের বিশেষ ভাব-অনুভাবগুলো জ্বালিয়ে তুলতে চান। এই বিশেষ ছবি আঁকতে গিয়ে, বিশেষ কবিতা লিখতে গিয়ে তাকে সর্বপ্রথম নিজের অস্তিত্বের বিপক্ষে যেতে হয়।

হয়তো অস্তিত্বের বিপক্ষে যাত্রা করেও আরেকটি অস্তিত্ব কেউ কেউ আবিষ্কার করেন। সমাজ যদি এই বৃহত্তর অস্তিত্ব অভিমুখে যাত্রার পথ করে না দেয়, শিল্পীর সংবৃদ্ধি এবং পরিবৃদ্ধির সেখানেই ইতি। শিল্পীকে সমাজের নানাকিছুর মধ্যে দিয়েই পথ কেটে বয়ে যেতে হয়। শিল্পী যা-ই কিছু সৃষ্টি করেন, তার গোটা সৃজন-ক্রিয়ার মাধ্যমে আপন অন্তর্নিহিত চেতনার সামাজিক রূপান্তর সাধন করেন। শিল্পীর আপন অন্তরকে বাইরে টেনে আনার এই যে পদ্ধতি তার স্বরূপটিও দ্বান্দ্বিক। বাছুর যেমন ডুস দিয়ে গাভীর ওলান থেকে দুধ বের করে আনে, কিছুটা তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতসমূহও শিল্পীর চেতনায় নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করে, আর শিল্পের মধ্যে তারই অভিব্যক্তি প্রকাশরূপ লাভ করে।

এইখানেই একজন শিল্পীর সঙ্গে একজন তান্ত্রিক সাধক, বাউল বা সুফি-সাধকের পার্থক্য। গোটা সমাজের দিকে পিঠ দিয়ে গহন বনে, জনতার অগম্য অরণ্যে সাধক গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন, সমাজের কথা না ভাবলেও চলে। অন্তরের মর্মরিত স্পন্দনের গভীর আবেগে সর্ব অস্তিত্ব সমর্পণ করতে পারলেই তিনি প্রকৃত সাধকের শিরোপা লাভ করেন। সাধকের চেতনা নিজের ভেতরে আবর্তিত হয়, আর শিল্পীর চেতনা সমাজকে আলোড়িত-বিলোড়িত করে। যদিও দুয়ের মধ্যে জল-অচল এরকম কোনো নিরেট পাথুরে প্রাচীরের ব্যবধান নেই। প্রায়ই বড় শিল্পী প্রকৃতিতে কিছুটা সাধক। এবং সাধকেরাও প্রকৃতিতে কিছুটা শিল্পী বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন।

চেতনার উর্ধ্বে উড্ডীন অবস্থা থেকেই শিল্পের সৃষ্টি। সমাজে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলতে গিয়ে শিল্পী নিজেও কিছুটা আউট-সাইডার হয়ে পড়েন। অর্থাৎ সমাজের কার্যকারণ সম্পর্কে সুগ্রথিত চেতনাস্তর থেকে অন্য একটি কল্পিত স্তরে নিজেকে টেনে তুলতে হয়। এই টেনে তুলতে গিয়েই শিল্পী সমাজের সঙ্গে কেজো সম্পর্কটি হারিয়ে বসেন। তখন শিল্পকলাই সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের একটা কৃত্রিম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। সমাজটির চেতনাও যদি আনুপাতিক হারে শিল্পীর চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা না করে তাহলে শিল্পীকে দুটি পরিণতির একটিকে বেছে নিতে হয়। হয়তো তাকে আত্মধ্বংসী কোনো প্রবণতাকে আমন্ত্রণ করে আনতে হয়, নতুবা তান্ত্রিক বা বাউল কিংবা অন্য কোনো সাধকের পথ ধরতে হয়। বলা বাহুল্য, এ দুটোই শিল্পীর শিল্প-সত্তার প্রেতরূপ। শিল্পীর চেতনার গতি যদি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় আর সমাজের চেতনার গতিটি যদি থাকে গাণিতিক, সেখানে শিল্পী-চেতনার সঙ্গে একটা সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। বড় শিল্পী, বড় কবি, বড় লেখকদের জীবনের চেতনার এই বিস্রস্ত অগ্রথিত সময়কে বলা হয় মানস সংকট কাল।

এমনও দেখা যায় কোনো কবি কোনো শিল্পী জীবদ্দশায় একজনও সহৃদয় হৃদয় সংবেদী পাঠক বা দর্শক পেল না। দেখা গেল মৃত্যুর পরে তার লেখা কবিতা বা আঁকা ছবি নিয়ে সমাজে বেশ মাতামাতি চলছে। উদাহরণস্বরূপ বোদলেয়ারের কথা বলা যেতে পারে। বোদলেয়ার তার জীবদ্দশায় একেবারে অনালোচিত থেকে গেছেন। জীবনানন্দ দাশ ট্রামের তলায় পড়ে মারা গিয়েছিলেন, সে সংবাদটিও ভাল করে কাগজে ছাপা হয়নি। এটা কেন ঘটে- ঘটে একারণে যে শিল্পী বা কবির চেতনা ঋদ্ধি-সমৃদ্ধি লাভ করেছে, এবং শিল্পের মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে; কিন্তু সে হারে সমাজের নাড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠেনি; তাই সমাজের বুকে কোনো সাড়া, কোনো চঞ্চলতা জাগছে না। পরে যখন সমাজ সাড়া দেয়ার শক্তি অর্জন করেছে তখন হয়তো দেখা যাবে শিল্পী বেঁচে নেই। অনাত্মীয় সমাজের দ্বারে দ্বারে হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে কত কবি শিল্পী যে জীবনের জ্বালা জুড়িয়েছেন, শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাসে তার দৃষ্টান্তের কি অভাব আছে? সুতরাং কোনো কোনো কবি, লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী দার্শনিককে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আউট সাইডারই থেকে যেতে হয়। দুই কারণেই শিল্পী আউটসাইডার হয়ে পড়েন। চেতনার প্রচণ্ড উল্লম্ফন প্রক্রিয়ার অভিঘাতে কেউ কেউ আউটসাইডার হয়ে পড়েন, আবার কেউ প্রচলিত সমাজ কাঠামোতে কোনো সহায়ক ভিত্তি না থাকার দরুন আউটসাইডার হয়ে পড়েন। শিল্পতত্ত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলো একারণে যে শেখ মুহম্মদ সুলতান তার জীবনের আদি, মধ্য, এমনকি হালের অন্তপর্বেও এই আউট সাইডারের জীবন যাপনই করে যাচ্ছেন।

কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ তাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। তাদের সকলের জন্মে জন্মান্তর ঘটে না। কোটিতে গুটি হয়তো মেলে, যারা জন্মেই জন্মান্তরের নির্বাণ লাভ করে। জীবনের দেবতা আপনি এগিয়ে এসে তাদের প্রাণের দেহলীতে সে আশ্চর্য পিদিম জ্বালিয়ে দিয়ে যান। সৌভাগ্য হোক, দুর্ভাগ্য হোক এ সকলের হয় না। শেখ মুহম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত ।

সুলতান ওরফে লালমিয়ার জন্ম যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার একটি কৃষক পরিবারে। কৃষি ছাড়াও তার বাবা বছরের অকর্মা মাসগুলোতে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য করতেন রাজমিস্ত্রির কাজ। রাজমিস্ত্রি গ্রামীণ সমাজের পেশা বিচারে একটি বিশিষ্ট কর্ম ।

সে যাক, উত্তরাধিকারসূত্রে বিচার করলে বড় জোর এটুকু বলা যেতে পারে, রাজমিস্ত্রি শিল্পী পিতার কাছ থেকেই লালমিয়ার মনে অপূর্ব বস্তু-নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু সেটাও সবার কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে, তেমন বলার উপায় নেই। সে যাহোক, শিশু লালমিয়া সুযোগ পেলেই কাঠ-কয়লা দিয়ে ছবি আঁকত, রঙ পেলে তো কথাই নেই। কিন্তু রঙ পাবে কই? তাই সে কাঁচা হলুদ আর পুঁই গাছের ফলের রস টিপে টিপে ছবি আঁকত। একদিন লালমিয়ার আঁকা এসকল ছবি স্থানীয় জমিদারের দৃষ্টিতে পড়ে। জমিদার মশায় খুবই অবাক হয়ে যান। তিনি লালকে ছবি আঁকার কিছু রঙ কিনে দেন এবং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তার পড়াশোনা কতদূর হয়েছিল, বিশদ জানা যায়নি। তবে এটুকু সত্য যে স্কুলের শেষ পরীক্ষা পাস করার আগেই লালমিয়া পালিয়ে কলকাতা চলে যায়।

কলকাতাতেই কিভাবে জানা যায়নি কলা-সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর চোখে পড়ে কিশোর লালমিয়ার ছবি। তিনি তাকে বাসায় নিয়ে খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করে দেন, জামা-কাপড় কিনে দেন এবং নির্ধারিত যযাগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সুপারিশ করে আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তার নামান্তর ঘটে যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লালমিয়ার নতুন নামকরণ করলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান। এই নামান্তর ঘটিয়েই জন্মান্তরের একটি ধাপ পার করে দিলেন। আর্ট স্কুলেও তার আঁকাবুকির পালা সাঙ্গ হবার আগে লালমিয়া ওরফে সুলতান আরো একবার নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালেন, রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের সে সুকুমার স্নিগ্ধকান্তি কিশোরটির মতো । অযাচিতভাবে পাওয়া আদর-যত্ন বিত্ত-বৈভব এবং ভাবী স্ত্রীর মায়া পরিত্যাগ করে বিয়ের দিন সে কাউকে না বলে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার গ্রামের লালমিয়া পালিয়ে শহর কলকাতায় এসেছিল। দ্বিতীয়বার শহর কলকাতা ছেড়ে কন্যা-কুমারিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত প্রসারিত গোটা ভারতবর্ষ অভিমুখে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো একজন স্নেহশীল অভিভাবকের আশ্রয়, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের গরিমা কিছুই সুলতানকে আটকে রাখতে পারেনি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। সুলতান পাঁচ-দশ টাকার বিনিময়ে গোরা সৈন্যের ছবি আঁকছে, আর ভারতের শহর থেকে শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয়-ভাবনা নেই, দায় দায়িত্ব নেই, আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ আর ছুটে চলার গতি। এ সময়ে আঁকা ছবিগুলোর কি হয়েছে, কোথা থেকে কোথায় গেছে, কেউ বলতে পারে না। ভারতবর্ষের নানা শহরে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীগুলোর বিলম্বিত সংবাদ আজ বুকে শুধু দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেবে। অনুমান করারও উপায় নেই, সে সময়ে তার অঙ্কনশৈলী কি রকম ছিল; সময়ের এবং বয়সের ব্যবধানে কতদূর বিবর্তিত এবং রূপান্তরিত হয়েছে অঙ্কনরীতি, বোধ এবং উপলব্ধি।

তারপরে ভারত তো ভাগ হলো। সুলতান এলেন পাকিস্তানে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর-করাচীতে অবস্থান করার সময় কখনো ঘর বাঁধার স্বপ্ন এ ঘরছাড়া মানুষটির মনে ঘনিয়ে এসেছিল কিনা, সে অন্তর্গত সমাচার দেয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য। সুমা-আঁকা কাজলটানা কোনো রমণীর ব্রীড়াভঙ্গি তাকে চঞ্চল এবং উতলা করেছিল কিনা, বলতে পারব না। তেমনি করতে পারব না ছবির সম্পর্কে কোনো মন্তব্য। এ সময়ে তিনি বিমূর্ত রীতিতে নাকি দেদার ছবি এঁকেছেন । পরী-কন্যার স্তনের গল্পের মতো কেবল গল্পই শুনব। কোনোদিন চোখে দেখতে পাব না। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তার অনেক প্রদর্শনী হয়েছে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি সে সকল প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছেন, সংবাদপত্রের প্রশংসা প্রশস্তির সবটুকু হারিয়ে যায়নি। নানা সাময়িকীর কল্যাণে দুয়েকটার মুদ্রিত ব্লকও হয়তো সন্ধান করলে পাওয়া যাবে। সেগুলো তো আর ছবি নয় । ছবির ছবি। সুতরাং কোনো সুচিন্তিত মন্তব্য করা অসম্ভব ।

বিলেতে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর ছবিগুলো সম্পর্কেও আমরা একইরকম অন্ধকারে থেকে গেছি। যদিও ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উষ্ণ আলোচনা থেকে অনুভব করতে পারি ছবিগুলো ভাল হয়েছিল এবং দর্শকেরা প্রাণভরে উপভোগ করছিলেন। কিন্তু আসল ছবি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে কি কোনো কথা চলে? মন্তব্যগুলো শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিলেতের পর আমেরিকা। সেখানেও সুলতান ছবি এঁকেছেন, সে ছবিগুলো কে কিনেছে, কোথায় কিভাবে আছে, অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে না হারিয়ে গেছে, কার কাছে জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবে জানি না। এখানেই নিরুদ্দেশ যাত্রার ইতি। অন্ন চল্লিশ বছরের জীবনের একটানা ছুটে চলা ঘরবিরাগী জীবনের সম্পর্কে কোনো গহন কথা আমরা যেমন উচ্চারণ করতে পারব না, তেমনি তার এ সুদীর্ঘ কালের আঁকা ছবির উপর কোনো বক্তব্য রাখতেও পারব না। তাবৎ কলা-সমালোচকের মনে সুলতানের এ-পর্যায়ে আঁকা ছবিগুলো একটা অতৃপ্ত কৌতূহল এবং একটা আফসোসের বিষয় হয়ে থাকবে। সুতরাং সুলতান বলতে যশোরের গগ্রামনিবাসী, মুসলমান চাষী এবং নমঃশূদ্র জীবনের একান্ত শরিক এই মানুষটিকেই চরম ও পরমভাবে মেনে নিতে হবে। তার জীবনের যেন কোনো সূচনা নেই, শৈশব-নেই, কৈশোর নেই, হঠাৎ করে বাংলাদেশের ইতিহাসের ভেতর থেকে একরাশ কাঁচাপাকা বাবরী চুল দুলিয়ে জেগে উঠেছেন। তার ছবির সম্পর্কেও একই কথা। এ ছবিগুলোও অতীতের একেবারে কোলঘেঁষা অন্ধকার ভেদ করে দলে দলে জগৎ-সংসারের কাছে এই মানুষ, এই সভ্যতা, এই সমাজ, এই ইতিহাস এবং এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের বার্তা প্রেরণ করবার জন্য যেন আচমকা কার মন্ত্রমুগ্ধ আহ্বানে ছুটে এসেছে।

এই যুদ্ধ এই জাগরণের একটা উল্লসিত বার্তা তো ছবিগুলোর মধ্যে আছে হাজার হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে একটা জাতি প্রাকৃতিক সত্যের মতো জেগে উঠেছে, শিল্পীর তুলিতে যখন এ জাগরণ-বৃত্তান্ত মূর্তিমান হয়, সে প্রবল প্রাণস্পন্দন ঝংকারিত না হয়ে কি পারে? কিন্তু পাশাপাশি একটা বেদনার দিক আছে। সুলতানের আঁকা একটা ছবি আছে, যা তিনি প্রদর্শনীতে হাজির করেননি। ছবিটির নাম ‘বিপ্লব’। একেক জন শক্ত-সমর্থ মানুষ আপন হাতে তার মস্তক ছিঁড়ে ফেলে ছুঁড়ে দিচ্ছে। নিজেই নিজের হাত ভেঙে ফেলছে, পা মচকে দিচ্ছে। প্রচণ্ড সামাজিক আলোড়নের ফলে যে বিপ্লবী শক্তি মুক্তি পেয়েছে, তা যে কি রকম আত্মঘাতী রূপ নিতে পারে এই ছবিটিতে তার সবটুকু বিধৃত রয়েছে। আজকের বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির আত্মঘাতী ক্রিয়াকলাপ হৃদয়ঙ্গম করার জন্য সুলতানের এ ছবিটিই যথেষ্ট। অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি কোনো বিষয়ের অবতরণার প্রয়োজন নেই।

সুলতান নিরুদ্দেশ যাত্রা অন্তে যখন দেশে ফিরলেন, তখন বোধকরি উনিশশ চুয়ান্ন কি পঞ্চান্ন সাল। ঢাকাতে জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি চিত্রপীঠ স্থাপিত হয়েছে। সেখানে সুলতানের কোনো ঠাই হলো না। কারণ অতিশয় স্পষ্ট,যে নতুন মধ্যবিত্তটি সবেমাত্র জেগে উঠছে এবং শিল্প-সাহিত্যের নানাদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পথযাত্রা শুরু করেছে, তার মানস অতিশয় সংকীর্ণ, রাজনৈতিক লক্ষ্য অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন, শিল্প-সংস্কৃতির কোনো গভীর উপলব্ধিতে রঞ্জিত হয়নি তার মানস পরিমণ্ডল । স্নিগ্ধতার বদলে উগ্রতা, উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, স্কুল আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্মর মোহ তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে কোনো বিকশিত চেতনার প্রতি প্রণত হওয়া তার ধাতের মধ্যেই স্থান পেতে পারেনি। সুলঅনের কলেজের সার্টিফিকেট নেই এটা উপলক্ষ মাত্র। এমনিভাবে এ শ্ৰেণী সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সাহিত্যের একজন দিকপালকেও দেশের বাইরে ছুঁড়ে দিতে সামান্য দ্বিধান্বিত হয়নি। মুজতবা আলীর ক্ষেত্রেও উপলক্ষের অভাব ঘটেনি। আসলে সে সময়টাই ছিল এমন: বাংলাদেশের মধ্যবিত্তটি তার ফিলিস্টিন মানসিকতার কারণে যা কিছু তার জাগতিক অধিকারবোধের বিপক্ষে যায় তার বিরোধিতা করেছে এবং প্রদর্শন করেছে অসহিষ্ণুতা।

সৈয়দ মুজতবা আলীর জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিক্টরেট ডিগ্রি ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ ছিল, আর বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক সমাজ ছিল, সর্বোপরি সমাজের উপরতলায় একটা স্থায়ী আশ্রয় ছিল। তাই তিনি নির্বিবাদে ফিরে যেতে পারলেন বিশ্বভারতীতে এবং সেখানে সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হলেন। কিন্তু সুলতান? তিনি তো আপন পরিচয়ের সূত্র আপন হাতে কেটে দিয়ে সমাজ এবং সময়ের স্রোতের ভেতর দিয়ে কেবল বয়েই গেছেন। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত কোনো সমাজেই গৃহীত হওয়ার মতো কোনো কিছুই তিনি অর্জন করেননি, না স্ত্রী না পুত্র না স্বভাব-চরিত্র আদব-কায়দা। বিত্ত-বেসাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কিছুই নেই, বুকের তলায় উজ্জ্বল আলোকিত চেতনা ছাড়া। তিনি যাবেন কোথায়? বিশ্বভুবনে এমন কে আছে তাকে গ্রহণ করে?

অগত্যা তাকে যেতে হলো সেই বহুকাল আগের ছেড়ে আসা পিতৃ-পুরুষের নিবাসে, সেই কিশোর লাল মিয়ার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে হলো। সে কি সোজা কথা- গ্রাম বাংলার লাজুক কিশোরটির সঙ্গে বিশ্ব-পরিব্রাজকের ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ দৃষ্টিবোধের অনুভবের সম্মিলন।

শেষ পর্যন্ত তাও সম্ভব হলো। তবে তার পেছনে সুলতানের সক্রিয় চেষ্টার চাইতে সময়ের ধারার ভূমিকাই অনেক বেশি। যে মধ্যশ্রেণীটি উনিশশ সাতচল্লিশ সাল থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছিল, উনিশশ একাত্তর সালে এসে তাকে চূড়ান্ত অনিচ্ছায় একটা যুদ্ধকে কাঁধে নিতে হলো। কিন্তু শ্ৰেণীটির দোদুল্যমান জাতীয়তার বোধ দিয়ে না পারল জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিকাশ ঘটাতে, না পারল অর্জন করতে যুদ্ধের ভার বইবার মতো ঋজু মেরুদণ্ড। এই শ্রেণীর শৈল্পিক প্রতিনিধি জয়নুল আবেদীন তার মনপুরা’ শীর্ষক চিত্রমালায় জানাতে বাধ্য হলেন যে বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি ক্ষমতার সবটুকু অবসিত। সত্যি সত্যি তার নতুন কিছু সৃজন করার ক্ষমতার আর অবশিষ্ট নেই।

ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে নতুন আরেকটি শ্রেণীর ডাক পড়েছে। কিন্তু বিশ্লিষ্ট হয়ে সে শ্ৰেণীটি কোনো আকার লাভ করেনি। মধ্যশ্রেণীর আকাক্ষার সঙ্গে তার আকাঙ্ক্ষা পরস্পর বিজড়িত হয়ে রয়েছে, কার লক্ষ্য কোথায় স্থির করা হয়নি। প্রথম শিল্প সাহিত্যেই তার প্রভাবটা বড় বেশি তীক্ষ্ণভাবে অনুভূত হতে থাকল। বাংলাদেশের পাঁতিবুর্জোয়া লিখতে গিয়ে বোধ করতে থাকল, এই সময়ের উপযোগী গল্প-কবিতা তার লেখনি দিয়ে আর আসছে না। অথচ অতীতের মতো লিখতেও সে পারছে না। ঘটনার অভিঘাত চঞ্চল চেতনাপ্রবাহে ভিন্ন একটা ঢেউ জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ করার ভাষা তার নেই। গায়ক অনুভব করল তার কণ্ঠের গানে সময়ের সংবেদনা বেজে উঠছে না। ছবি আঁকিয়েরা অনুভব করল সময়ের খরতরঙ্গের দোলা জাগছেনা তাদের চিত্রলেখায়। সর্বত্র একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। সকলে বুঝতে পারছেন, তাদের অন্যকিছু করা উচিত। কিন্তু সেটা কি স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না। এই লজ্জার কলঙ্ক ঢাকবার জন্য তারা কোলাহল দিয়ে সুরের অভাব, কথার পাশে কথা গেঁথে সাহিত্যের শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টায় অষ্টপ্রহর ব্যস্ত। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। প্রতারকদের সুযোগ দেবে কেন? দোদুল্যমান জাতীয়তার বোধটি আরো দুলিয়ে দিয়ে তাদের নায়ক শেখ মুজিবকে সপরিবারে নিরস্তিত্ব করে দিল সময়। কিন্তু জাতি অর্ধেক ভূমিষ্ঠ হলো, অর্ধেক রয়ে গেল ইতিহাসের জরায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে।

সুলতান শিল্পের জরায়ুর বন্ধন ছিন্ন করে জাতির ইতিহাসকে মুক্ত করে দিলেন। আগামীতে যাদের সাধনায় সংগ্রামে বাংলার ইতিহাস পাবে গতি, সেই অনাহারক্লিষ্ট, রোগগ্রস্ত, নজদেহ কিষাণ-কিষাণীকে আঁকলেন বীর করে, রেনেসাঁস পেইন্টারেরা যেমন তাদের আঁকা চিত্রে, গড়া ভাস্কর্যে মানুষ-মানুষীকে সৌন্দর্য এবং অজেয়তার প্রতীক করে নির্মাণ করেছেন, সুলতান সেই সৌন্দর্য, সেই অজেয়তা চারিয়ে দিয়েছেন বাংলার কিষাণ-কিষাণীর শরীরে। একটি সমাজের মানুষকে তার তুলি বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের উত্থানযুগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’ বলে বুর্জোয়ার প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য উল্লসিত আবেগে শিহরিত চমকিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি কি বীররসে শেষপর্যন্ত স্থিত থাকতে পেরেছেন? তাকে কি করুণরসের অগাধ সলিলে, অবগাহন করতে হয়নি? সুলতানও কি সবটুকু বীরত্বের প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছেন? তাই যদি হয়, তাহলে নায়কেরা নিজ হস্তে নিজের মস্তক কেন ছেদন করে? কেন তারা নিজের হাত-পা নিজে ভেঙে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশ করে? তা হোক, তবু মধুসূদন একজন, তেমনি সুলতান আরেকজন। সময়, পরিবেশ, সমাজ, সামাজিক আদর্শ সব আলাদা। তবু তাদের কোনো পূর্বসূরি নেই, নেই কোনো উত্তরসূরি। আচমকা জলতল থেকে সুবর্ণ স্তম্ভের মতো উত্থিত হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে রয়েছেন।

১৯৮০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *