১৩-১৫. আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর

কিছুদিন যেতে না যেতেই আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর নিরন্তর কর্মতৎপরতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালো। শুধু সন্ধ্যেবেলা নয়, ছুটির দিনে, কর্মচারিদের কর্মবিরতির দিনে কিংবা ছাত্রদের ডাকা ধর্মঘটের দিনগুলো সকালবেলাতে এ গোয়ালঘরে নানারকম বৈঠক বসা শুরু হয়ে গেল। ডোরাকাটা দলের সকলে আবার এখন আবু জুনায়েদকে সমর্থন করেন না। কিছু বেগুনি দলে চলে গেছেন, কিছু হলুদ দলে যাব যাব করছেন। আগামীতে হলুদ দলটি শক্তিশালী হয়ে উঠবে তার যাবতীয় আলামত দেখা যাচ্ছে। আবু জুনায়েদ তার নতুন সমর্থক মণ্ডলীদেরসহ ডোরাকাটা দলের অবশিষ্টাংশ নিয়ে একটি নতুন দল করবেন কি না ভেবে দেখছেন। যদি ভবিষ্যতে তেমন পরিস্থিতি আসে, তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবেন না।

এই বাদ প্রতিবাদ, এই অনবরত বাকযুদ্ধ, এই লিফলেট, পাল্টা লিফলেট বিতরণ এসবের মধ্য দিয়ে আবু জুনায়েদের গরুটির কথাই প্রচারিত হলো সর্বাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা গরুবিষয়ক অনেক খবরাখবর জেনে গেল। শ্রবণসুখকর নয় এমন সব মুখরোচক গুজবও তৈরি হতে থাকল। ছাত্রদের মধ্যেও উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত তৈরি হতে থাকল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপাচার্যের গাভী একটা চমৎকার শ্লেষাত্মক শব্দবন্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেল । যখন কোনো ছাত্র কোনো ছাত্রকে ইয়ার্কি করে তখন বলে বসে তুই বেটা উপাচার্যের গাভী । শ্লেষ প্রকাশে, অবজ্ঞা প্রকাশে নির্মল রসিকতায় উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধের ব্যাপক ব্যবহার চালু হয়ে গেল। উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তরুণ ছাত্রছাত্রীদের নানান ধরনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ালো।

উপাচার্যের গাভী শব্দবন্ধের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে দুদল ছাত্রের মধ্যে একটা জবরদস্ত মারামারি হয়ে গেল। সময়মতো পুলিশ এসে না পড়লে খুনোখুনি হয়ে যেত। ঘটনাটি ঘটেছিল এভাবে। একজন সুন্দরী ছাত্রী তার পুরুষ বন্ধুকে নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় হাত ধরাধরি করে নিরিবিলি আলাপ করছিল। আরেকজন ফাজিল মতো ছাত্র এই মধুর দৃশ্য দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে উঠল, লে হালুয়া উপাচার্যের গাভী। মন্তব্যটি সুন্দরী মেয়েটির কানে গিয়েছিল। মেয়েটি একেবারে ধনুকের টানটান ছিলার মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে প্রশ্ন করে বসল, কী বললে তুমি? ছেলেটি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। এতটুকু সে আশা করেনি। মুখরক্ষার জন্য বলল, যা বলবার তো বলে ফেলেছি। তুমি চেতছো কেন? বাদানুবাদের এই পর্যায়ে তার পুরুষ বন্ধুটি তেড়ে এসে তার মুখে খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটিও পাল্টা ঘুষি দিতে গেল। কিন্তু সে ছিল গায়ে গতরে একেবারে দুর্বল। মেয়েটির বন্ধুটি তাকে কিলঘুষি দিতে দিতে একেবারে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। ছেলেটির তিনচারজন বন্ধুবান্ধব ক্যাফেটেরিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তার করুণ অবস্থা দেখতে পেয়ে ওপক্ষের ছেলেটাকে আক্রমণ করে বসল। তারও বন্ধুবান্ধব ছিল। তারা বন্ধুকে রক্ষা করতে ছুটে এল। ব্যস দুদলে একটা খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই মারামারিটার একটা রাজনৈতিক আকার পেয়ে গেল। দুজন ছাত্ৰই দুটি প্রধান ছাত্রসংগঠনের হোমরাচোমরা। ছাত্রাবাসে ছাত্রাবাসে খবর রটে গেল। দলে দলে দুই দলের সৈনিকেরা শহীদ হওয়ার আবেগ নিয়ে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে ইট বৃষ্টি করতে লাগল। কাটা রাইফেল এল, রিভলবার এল, রামদা এল। চীনা কুড়ালের ফলায় সূর্যের আলো ঝকমক জ্বলে উঠল ।

একদিন মাঘ শেষে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। গোয়াল ঘরের আড্ডায় কোনো লোক আসেনি। আসবে কেমন করে-মাঘের শীতের চাইতে মেঘের শীত অনেক বেশি। আবু জুনায়েদ একা একা বসে গরুটার পেটের কাছে হাত দিয়ে গর্ভস্থ শিশুটির নড়াচড়া অনুভব করা যায় কি না পরখ করে দেখছিলেন। এমন সময়ে তিনি কাকের আওয়াজের মতো একটা কর্কশ গলা খাকারি শুনতে পেলেন। আবু জুনায়েদ তাকিয়ে দেখেন উত্তর দিকের শেডে একটা বেঁটেমতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। তার শরীর ওভারকোটে ঢাকা। গলায় মাফলার পেঁচানো। চট করে আবু জুনায়েদের মনে পড়ে গেল এই শহরে সুযোগ পেলে ওভারকোট পরে বেড়ায় এমন মানুষ একজন আছেন তিনি হলেন শহীদ হোসেন শিরওয়ানি। শিরওয়ানি সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য। সাম্প্রতিককালে বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিনেটের অধিবেশনের সময় একাধিকবার আবু জুনায়েদকে একরকম উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছেন। আবু জুনায়েদ শহীদ হোসেন শিরওয়ানিকে কিছু বলার আগে নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলেন, শিরওয়ানি সাহেব মাঘ মাসের এই প্রচণ্ড শীত বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কোন প্রয়োজনে তার গোয়ালঘরে আসবেন। আবু জুনায়েদ উত্তরের শেডে এসে শিরওয়ানি সাহেবের মুখমণ্ডল ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। তার মুখে রসুনের শেকড়ের মতো না কামানো পাকা দাড়ি দেখতে পেলেন। শিরওয়ানি সাহেবই প্রথম কথা বললেন, ‘জুনায়েদ ভাই’। আবু জুনায়েদের বিস্ময়বোধ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল । শিরওয়ানি সাহেবকে জীবনে এই প্রথম জুনায়েদ ভাই ডাকতে শুনলেন। তার মতলবটা কী তিনি আঁচ করতে চেষ্টা করছিলেন। যা হোক, শিরওয়ানি সাহেব বলে গেলেন,

-জুনায়েদ ভাই লোকমুখে শুনেছি আপনি একটা গাভী সংগ্রহ করেছেন এবং মিনি চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। পরিবেশচর্চায়ও নাকি মনোযোগ দিতে আরম্ভ করেছেন। শুনে ভীষণ ভালো লাগল। ভালো জিনিস কার না পছন্দ হয়? আমার আগ্রহ এত প্রবল হলো, এই শীত বৃষ্টির মধ্যেই দেখতে ছুটে চলে এলাম। কই দেখান দেখি আপনার গাভী এবং অন্যান্য জীবজন্তু। আবু জুনায়েদ প্রথমে উত্তরের শেডে পাখির খাঁচাগুলো দেখালেন। আপনা থেকেই শিরওয়ানির মুখ থেকে বেরিয়ে গেল,

-বাহ্ চমৎকার অনেক জাতের পাখি আপনি সংগ্রহ করেছেন। জুনায়েদ ভাই, ইউ আর এ মিরাকল ম্যান।

শিরওয়ানি সাহেব একটু উঁচু হয়ে আবু জুনায়েদের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,

-এইবার আপনার গাভীটি দেখব।

আবু জুনায়েদ তাকে আসুন বলে একেবারে গোয়ালঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে মশারি তুলে ফেললেন। গরুটা দেখে শিরওয়ানি সাহেবের চোখজোড়া কপালে উঠে গেল।

-জুনায়েদ ভাই কী করছেন, কোহিনূরের চাইতে দামি চীজ। এই জিনিস আপনি পেলেন কোথায়? যতই আপনাকে দেখছি অবাক হচ্ছি-আপনি বিস্মিত হচ্ছেন? তার কোনো কারণ নেই। শহীদ হোসেন শিরওয়ানি সিনেটে আপনার সমালোচনা করে। এটা তো ভাই নাগরিক কর্তব্য। আমাকে তা করতে হবে। কিন্তু সেটাই সব নয়। আমি মানুষটার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি ভালো জিনিসের তারিফ করতে পারি। সে কারণে তো আপনার এখানে এলাম।

তারা দুজনে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি বসলেন। আবু জুনায়েদ শিরওয়ানি সাহেবের জন্য কফি এবং বিস্কুট আনালেন। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শিরওয়ানি সাহেব তার পিতৃদেবের গল্প করলেন। তার পিতৃদেবও আবু জুনায়েদের মতো গরু পুষতে ভালবাসতেন। তারপর দেশের কথায় এলেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। দেশ গোল্লায় যেতে বসেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় সারা দেশের তারুণ্য অপচিত হতে যাচ্ছে। তারও দুজন তরুণ ছেলে আছে। একজন মাস্টার্স দিল আর একজন অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তার খুব ভয় কখন মারা যাবেন । ছেলেদের একেবারে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে যেতে হবে। সারা জীবন দেশের কাজ করেছেন। নিজের চিন্তা করার সময় পাননি। এখন স্ত্রী এবং ছেলেদের সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারেন না। ইচ্ছে করলে কি না করতে পারতেন। তাকে ধরে কত লোক কোটিপতি হয়ে গেল। অথচ শিরওয়ানি সাহেবের কিছুই হয়নি। তিনি যে কিছু করতে পারেননি সেই মনোবেদনাটি প্রকাশ করতে আবু জুনায়েদের কাছে আসা। কারণ, তিনি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার শেখ তবারক আলী সম্পর্কে আবু জুনায়েদের চাচা শ্বশুর হন। শিরওয়ানি সাহেব মরবার আগে ছেলেদের একটা ছাদের তলায় রেখে যেতে চান। বর্তমানে বারিধারায় একটি ডেরা বানাবার চেষ্টা করছেন। প্রিনস পর্যন্ত না উঠলে তিনি হাউজ বিল্ডিংস থেকে লোন পাবেন না। এই কাজটুকু করার জন্য তার লাখ দুয়েক ইট দরকার। জুনায়েদ ভাই তার চাচা শ্বশুর তবারক সাহেবকে ছয় মাসের করারে দুলাখ ইট যদি তার ভাটা থেকে দিতে বলেন, একটি গরিব পরিবারের বড় উপকার হয় এবং জুনায়েদ এ কাজটুকু করে দেবেন, কারণ তিনি জানেন তার মনে দয়া আছে। কালিদাস আবৃত্তি করে শোনালেন, ‘জ্ঞানীতে অনুনয় নিষ্ফল সেও ভালো ছোটোলোকে বর দিলে নিতে নেই।’ আবু জুনায়েদ সঙ্গে সঙ্গে কবুল করে ফেললেন, তিনি তবারক সাহেবকে বলে দেবেন। শিরওয়ানি সাহেব চলে গেলে অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ভাগ্যের চাকা আমার অনুকূলে ঘুরতে আরম্ভ করেছে।

ড. সাইফুল আলম বিগত উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচনে বেগুনি দলের প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের একজন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক হিসেবে ড. আলমের সুনাম রয়েছে। তিনি যদি প্রাক্তন উপাচার্য আবু সালেহ্র সঙ্গে একই প্যানেলে না দাঁড়িয়ে ডোরাকাটা দলের প্রার্থী হতেন, সবচেয়ে বেশি ভোট পেতেন একথা আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন। আবু জুনায়েদ মনে মনে ড. সাইফুল আলমকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তাকে ডোরাকাটা দল থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তিনি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আমি জানি নির্বাচনে বেগুনি দল হারবে । তবু আমি ওই দলে থেকেই নির্বাচন করব । আপনারা হয়তো বলবেন, এটা আমার জন্য একটা বোকামো হবে । সবাইকে চালাক হতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি? পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে ক্রমাগত হেরে যাওয়াই হচ্ছে যাদের কাজ। ক্রমাগত হারার ক্ষমতা অর্জন করাকেই আমি সবচেয়ে বড় বিজয় বলে মনে করি ।

ড. সাইফুল আলম একদিন সকালবেলা আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরে এসে উদয় হলেন। সেটা ছিল কোনো একটা পর্ব উপলক্ষে ছুটির দিন। আবু জুনায়েদ বাগানে মালিদের সঙ্গে নিজ হাতে কাজ করছিলেন। এই অভ্যেসটি তিনি একেবারে হালে রপ্ত করেছেন। দলের লোকেরা যখন থেকে পরিবেশ-প্রেমিক হিসেবে তার একটি নতুন পরিচয় প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছেন, তারপর থেকে আবু জুনায়েদ ফুল ফল গাছপালা এসবের প্রতি বর্ধিত অনুরাগ প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছেন। একদল ছাত্রকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাছের চারা লাগাবার জন্য বিশেষ তহবিল থেকে দশ হাজার টাকা দিয়েছেন। অবশ্য বেগুনি দলের লোকেরা আবু জুনায়েদের এই একান্ত ভালো কাজটিকেও খারাপভাবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন সরকারি দলটির মাস্তানদের হাতে রাখার জন্য বৃক্ষরোপণের নামে টাকাটা তাদের পাইয়ে দিয়েছেন।

ড. সাইফুল আলমকে আবু জুনায়েদের খোঁজ করতে হলো না। ড. আলমকে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখামাত্রই আবু জুনায়েদ এগিয়ে গিয়ে নিয়ে এলেন । তিনি বললেন,

-ভাই হাত মেলাতে পারব না, কারণ হাতে অনেক কাদা।

ড. আলম বললেন,

-আপনার এই কাদামাখা হাতের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্যই সকালবেলা ছুটে এলাম । দিন কাদামাখা হাতটা দিন, একটু মিলিয়ে নিই ।

অগত্যা আবু জুনায়েদ তার হাতখানি প্রসারিত করে দিলেন। হাত মেলানোর পালা সাঙ্গ হওয়ার পর আবু জুনায়েদ ড. সাইফুল আলমকে উপাচার্য ভবনে নিয়ে যেতে চাইলেন। ড. আলম বললেন, জুনায়েদ সাহেব এমন সুন্দর দিনে ঘরে কেবা যায়। চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকতে মন চাইছে না। আবু জুনায়েদ বললেন,

-তাহলে বারান্দায় চেয়ার পেতে দিতে বলি।

ড. সাইফুল আলম জবাবে বললেন,

-সেটিও হচ্ছে না। তার চেয়ে আপনি আপনার গরু এবং পাখিগুলো দেখান। এত শুনেছি। দুজনে পথ দিয়েছেন, মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে ড. আলম আবু জুনায়েদের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-কিন্তু ভাই একটি কথা, আপনাকে আগেই সোজাসুজি বলে ফেলতে চাই। পরে আমার বলতে খারাপ লাগবে, শুনে আপনারও মনে হতে পারে মানুষটা তোষামোদ করতে এসেছে।

আবু জুনায়েদ বললেন,

-ড. আলম আপনি আসুন। সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনার মতো স্ট্রেটফরোয়ার্ড মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।

আবু জুনায়েদ ড. সাইফুল আলমকে প্রথমে গরুটা দেখাতে নিয়ে গেলেন। গরু শুয়েছিল। আবু জুনায়েদরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আদর করার জন্য ঘাড়টা বাড়িয়ে দিল। আবু জুনায়েদ আদর করলেন। তারপর মুখের কাছে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। গরুটা লম্বা লালচে জিভ বের করে হাত চাটতে লাগল । ড. সাইফুল আলম পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে ভালো করে গরুটা দেখলেন। গো সন্দর্শন শেষ করে দুজনে উত্তরের শেডে গিয়ে বসেছেন। খাঁচা থেকে দুটি ময়নার মধ্যে একটি কথা বলে উঠল : পরিবেশ বাঁচান, গাছ লাগান। ময়নার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ড. আলম উঠে দাঁড়ালেন। তারপর প্রতিটি খাঁচার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তার মধ্যে একটা চঞ্চলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তিনি বলে উঠলেন,

-জুনায়েদ সাহেব, একটা কথা বলে ফেলি। আপনার কাছে আমি নির্বাচনে হেরেছি। জানেন তো প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি একটা ঈর্ষা, একটা শত্রুতার ভাব সব সময়ে থাকে।

আবু জুনায়েদ মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন, কী জানি আবার ড. সাইফুল আলম কী অঘটন ঘটিয়ে তোলেন। কিন্তু ড. সাইফুল আলমের মুখ থেকে কোনো অপ্রিয় বাক্য তিনি শুনতে পেলেন না।

ড. সাইফুল আলম বললেন,

-জুনায়েদ সাহেব, আপনার কাছে নির্বাচনে হেরেছি, সেজন্য মনে একটা বেদনাবোধ ছিল, এই মুহূর্তে পাখির মুখের কথা শুনে আমার মনের সমস্ত বেদনা, সমস্ত দুঃখ কোথায় চলে গেল। আমি হেরেছি বটে, কিন্তু হেরেছি একজন যোগ্য এবং ডিসেন্ট মানুষের কাছে। আসুন একটু কোলাকুলি করি।

কোলাকুলির পর দুজনে মুখোমুখি বসলেন। চা এল, সন্দেশ এল। আবু জুনায়েদ এবং ড. সাইফুল আলম দুজনকেই উঠে হাত ধুতে হলো। সন্দেশ চা খেতে খেতে ড. সাইফুল আলম তার আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করতে লেগে গেলেন,

-আমার গিন্নি আপনাকে সালাম দিয়েছেন। বস্তুত তিনিই জোর করে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনি তো জানেন আমরা সাত চল্লিশের এ-তে থাকি। বাড়িটা তিন রুমের। আমাদের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। আমরা যখন বিয়ে করেছি তখনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর কথাটা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কী করব ভাই, একবার ভুল করেছি এখন তো শোধরাবার উপায় নেই। তিন রুমের বাড়িতে সকলের স্থান সংকুলান হতে চায় না। ছেলে দুটোর বিয়ে দিয়েছি। তাদের বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে । সকলকে গাদাগাদি করে এক সঙ্গে থাকতে হয়। তাই আমার গিন্নি বললেন, মুতালিব সাহেবরা চলে যাওয়ার পর থেকে আঠার বি-র চার রুমের ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে রয়েছে। আপনি যদি ওই ফ্ল্যাটটা আমাদের দেয়া যায় কি না দেখতেন।

আবু জুনায়েদ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন,

-আপনার ক্যালিবারের একজন মানুষ চার রুমের একটি বাসা চাইছেন, সেটা এমন কী। আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। কাউকে দিয়ে দুকলম লিখে পাঠালেই কাজ হয়ে যেত। তবে আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। তবে ভাই একটি কথা, ফ্ল্যাট তো আমি বরাদ্দ করব, কিন্তু আপনার দলের লোকদের দিকটা আপনি একটু খেয়াল রাখবেন। উনারা সবসময় আমার ভালো কাজের খারাপ মানে করেন।

ড. সাইফুল আলমকে একটু অপ্রস্তুত দেখা গেল। তিনি বললেন,

-হ্যাঁ ভাই সে কথাও তো ভাবতে হবে। আমি তো একটি দল করি। আর মোটামুটি প্রিন্সিপ্যাল একটা মেনে আসছি।

আবু জুনায়েদ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,

-হ্যাঁ ভাই চার রুমের ফ্ল্যাট আপনার নামে অ্যালটমেন্ট দেয়া হবে, আগামী মাসেই পজেশন নিতে পারবেন।

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ড. সাইফুল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। উত্তরের শেড থেকে বের হওয়ার আগে বললেন,

-ভাই এই মুহূর্তে স্থির করলাম, আমিও একটি ময়না পুষবো। পাখিটিকে একটি কথাই শেখাব-ডিসেন্ট শত্রুর কাছে হারাও ভালো ।

ড. সাইফুল আলম চলে যাওয়ার পর আবু জুনায়েদ কিছুক্ষণ চেয়ারে অচল হয়ে বসে রইলেন এবং বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন,

-আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে আরম্ভ করেছে। আসবে, আরো অনেকে আসবে । অনেককেই আসতে হবে। তারপর তিনি গোয়ালঘরে গরুকে ঘাস খাওয়াতে চলে গেলেন।

বিরোধী দলীয় ছাত্রনেতা মাজহারুল করিম জুয়েল যেদিন আবু জুনায়েদের সঙ্গে গোয়ালঘরে দেখা করতে এল তার মনের ভেতর কে যেন বলে দিল এই গোয়ালঘর থেকেই তোমার নতুন ক্যারিয়ার তৈরি হতে যাচ্ছে আবু জুনায়েদ। অনেকদিন পর্যন্ত তোমার সৌভাগ্য রাশি আলো দিতে থাকবে।

সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় দুদলের মারামারির কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যখন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, ক্যাম্পাসে কোনোও ছাত্রছাত্রী থাকে না, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতারা বিপদে পড়ে যায়। এ ধরনের সময়কে তাদের জন্য আকালও বলা চলে। তাদের অনেককেই কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাতে হয়। কোনো কোনো সময় দুবেলার খাবারও জুটতে চায় না। অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতার সঙ্গে দলবল সাঙ্গপাঙ্গ না থাকলে শক্তিই বা কোথায় আর দাপটও বা আসবে কোত্থেকে। আর অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতার পেছনে জনশক্তি যদি থাকে তার মূল্য কী? একা একা দোকানে গিয়ে চাঁদা তোলার কথা দূরে থাকুক ভিক্ষেও করা যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয় একেবারে বন্ধ থাকলে অ্যাকটিবিস্ট ছাত্রনেতারা এরকম অথৈ পানিতে পড়ে যায়। ঢাকায় যাদের বাড়িঘর আছে, তাদের কথা আলাদা। যারা মফস্বল থেকে এসেছে, যাদের বাড়ি একেবারে গ্রামে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় হরিণবিহীন বনভূমিতে বন্দী ব্যাঘ মহারাজের মতো। উপস্থিত মুহূর্তে মাজহারুল করিম জুয়েলের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। সে না পারছে গ্রামে ফিরে যেতে, না পারছে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে। ছিনতাই, রাহাজানি এবং খুনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। অবশ্য খুনের মামলায় তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আসামী করা হয়েছে। জুয়েল যদি গ্রামে যায় চিল যেভাবে ছুঁ মেরে মুরগির বাচ্চা নিয়ে যায়, সেভাবে তাকেও পুলিশ উঠিয়ে নেবে। শহরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াবার উপায় নেই। জুয়েল দলের জন্য এতগুলো ঝুঁকি নিয়েছে, এতগুলো মামলার আসামী হয়েছে, আজকে যখন সে বিপদে পড়েছে দল তাকে গ্রহণ করতে চাইছে না, বের করে দেয়ার চক্রান্ত করছে। এখন মাজহারুল করিম জুয়েলের সামনে দুটি পথই খোলা আছে। প্রথমটি হলো সরকারি ছাত্র দলটিতে যোগ দেয়া। সরকারি দলে যোগ দিতে তার আপত্তি নেই, প্রধানমন্ত্রী যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সেগুলো তার ভীষণ পছন্দ। কিন্তু দুটি অসুবিধে : প্রথমটা হলো পুলিশ কেসগুলো উঠিয়ে * নিতে হবে। দ্বিতীয়টা হলো সরকারি দলের অ্যাকটিবিস্ট নেতা হান্নান মোল্লার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। হান্নান মোল্লা যদি বাধা দেয় তাহলে একটু বেকায়দায় পড়ে যাবে। তবে সে গভীর রাতে হান্নান মোল্লার বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তা বলে একটা ফয়সালা করে ফেলার আশা রাখে। যে দলেরই হোক না কেন অ্যাকটিবিস্ট ছাত্র নেতাদের একটি সাধারণ ধর্ম হলো একজন নেতা যদি আরেকজন অ্যাকটিবিস্ট নেতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে, প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কখনো কুণ্ঠিত হয় না । তার দৃঢ় বিশ্বাস সে সবগুলো বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাবে। সরকারি দলের যুবনেতা বাটুল ভায়ের সঙ্গে তার ফাইনাল কথা হয়েছে। সবকিছু সে সাইজমতো সেটেল করে এনেছে প্রায়। উপস্থিত মুহূর্তে তার কিছু নগদ টাকার প্রয়োজন, সেজন্য উপাচার্য স্যারের কাছে আসা। তিনি যদি টাকাটা ম্যানেজ করে দেন। আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন,

-কত টাকা হলে তোমার চলে?

জুয়েল বলল, বেশি নয় স্যার মাত্র পনের হাজার।

শুনে আবু জুনায়েদের বোবা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

-অত টাকা আমি পাব কোথায়? মাইনে কত পাই জানো? জুয়েল বলল, স্যার আপনাকে এক টাকাও দিতে হবে না। আমার একটা লোক আছে সে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়ার ক্যাটারার হিসেবে নিয়োগপত্র পাওয়ার আবেদন করেছে, আর্নেস্টমানি জমা দিয়েছে, উপাচার্য স্যার যদি অনুগ্রহ করে ক্যাটারিংয়ের সুযোগটা তার বন্ধু রহমতউল্লাহকে দিয়ে দেন তার কাছ থেকেই সে পনের হাজার টাকা ক্যাশ আদায় করে নেবে। জুয়েল আরো বলল, কাজটা ঠিক হচ্ছে না সে জানে, তবু উপাচার্য সাহেবের কাছে একটি কারণে তার প্রার্থনাটি জানাতে এসেছে, কারণ উপাচার্য স্যার খুব নরম দিলের মানুষ। গরু ছাগল পাখি গাছপালা সবকিছুই তার দয়া পেয়ে থাকে। সে তুলনায় জুয়েল তো মানুষের বাচ্চা। অল্প কদিন আগেও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের অ্যাকটিবিস্ট নেতা হিসেবে তার একটি সম্মানজনক অবস্থা ছিল। উপাচার্য স্যার যদি তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে দেয়, সুদূর ভবিষ্যতে সে উপাচার্য স্যারের চাকর হওয়ার আশা পোষণ করে।

মাজহারুল জুয়েলের কথাবার্তা শুনে আবু জুনায়েদ একটু উন্মনা হয়ে পড়েছিলেন, একটা তন্ময়তাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করেছিল। তিনি তন্ময়তা ভেঙে জেগে উঠে বললেন,

-একটি শর্তে তোমাকে সাহায্য করতে রাজি হব। বলো শর্তটি মানবে?

-স্যার আপনি যা বলবেন, তাতেই আমি রাজি।

-তোমাকে ভালো হয়ে যেতে হবে। কথা দিতে হবে গুণ্ডামি ষণ্ডামি এসব করবে ।

-স্যার আমি এখনই ভালো হয়ে গেছি। কথা দিচ্ছি কোনো বদ কাজ আমি করব না। বরঞ্চ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখি গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।

জুয়েল ঝুঁকে পড়ে আবু জুনায়েদের পদধূলি নিয়ে মুখে এবং কপালে মাখল।

মাজহারুল করিম জুয়েল চলে যাওয়ার পর আবু জুনায়েদের ধারণা হতে থাকল তিনি বিশেষ ধরনের কামালিয়াত হাসিল করে ফেলেছেন। যা ভাবেন তাই ঘটে যাবে। তার অগ্রযাত্রা ঠেকায় সাধ্য কার?

.

১৪.

নুরুন্নাহার বানু ভীষণ একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন। বিয়ে হওয়ার পর থেকেই তার মনে এমন একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল যে আবু জুনায়েদকে ডাইনে বললে ডাইনে, বামে বললে বামে, সামনে পেছনে যেদিকে ইচ্ছে চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন। তিনি মনে করতেন আবু জুনায়েদ হলেন একটা লক্কর-ঝক্কর গাড়ি, আর এমন গাড়ি যে পথে চলতে গেলে মাঝে-মাঝে থমকে দাঁড়ায়। দুর্ঘটনার ভয়ে মেইন রাস্তা ছেড়ে অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। আবু জুনায়েদকে ভাঙাচোড়া গাড়ির সঙ্গে তুলনা করতেন আর নিজেকে মনে করতেন রদ্দি জগদ্দলের প্লাটিনামে মোড়া চকচকে স্টিয়ারিং হুইল। নুরুন্নাহার বানুর আব্বা টাকাপয়সা দিয়েছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছেন। পেছনে তার বাবা না থাকলে আবু জুনায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া দূরে থাকুক ছাত্র হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত জুটত না। নুরুন্নাহার বানুর মতো ভাগ্যবতী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ অত সহজে বাঘা বাঘা মানুষদের পাশ কাটিয়ে উপাচার্যের চাকরিটা পেয়ে গেছেন। আবু জুনায়েদ আজকে যা হয়েছেন তার সামান্য অংশ নুরুন্নাহার বানুর বাবার তৈরি, আর বাদবাকি সবটা নিজের হাতে তিনি ঢালাই করেছেন। আবু জুনায়েদের কোনো ভূমিকা, কোনো কৃতিত্ব নেই। নুরুন্নাহার বানু অনুগ্রহ করে পেটে ধারণ করতে রাজি হয়েছিলেন বলেই আবু জুনায়েদ সন্তানের বাবা হতে পেরেছেন। নুরুন্নাহার বানু মনে করেন, পেছনে তিনি থাকলে আবু জুনায়েদকে লাফাঙ্গারের মতো ঘুরে বেড়াতে হতো। বিয়ে হওয়ার ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত নুরুন্নাহার বানুর বেঁধে দেয়া ছকের মধ্য দিয়ে আবু জুনায়েদের সংসারের যাত্রা চলছিল। সবকিছু বাঁধাধরা, কোনো অনিয়ম দুর্ঘটনার বালাই নেই। মাঝে-মাঝে ঝগড়াঝাটি, অল্পস্বল্প যে মনোমালিন্য হতো না তা নয়। কিন্তু সেগুলো নুরুন্নাহার বানুর পরিকল্পনার ভেতরের জিনিস। মেয়ে মানুষ এবং পুরুষ মানুষের একসঙ্গে দীর্ঘকাল বাস করতে হলে অল্পবিস্তর ঝগড়াঝাটি মান-অভিমান থাকা খুবই প্রয়োজন। নইলে জীবন আলুনি এবং বিস্বাদ হয়ে যায়। ঝগড়াঝাটি সময় বিশেষে সংসার রথের চাকায় ওয়েল্ডিং-এর কাজ করে। সুতরাং নুরুন্নাহার বানু যখন ফাটাফাটি ঝগড়া করতেন, সেটাও তার একটা হিসেবের ব্যাপার ছিল। সংসারের সমস্ত কিছু আপন হাতের মুঠোর ভেতর চেপে রাখতেন। এক চুল এদিক ওদিক হবার জো ছিল না। শুধু স্বামী নয়, মেয়ে থেকে চাকর-বাকর পর্যন্ত সবাই তার অনুগত ছিল। কাজের বেটি একচুল এদিক সেদিক করলে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে বাড়ির বের করে দিতেন। নিজের মেয়েটিকে পাড়ার কোনো ছেলের সঙ্গে হাসাহাসি করতে দেখলে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলতেন।

গথিক ধাঁচে তৈরি এই প্রাসাদোপম স্বপ্নপুরিতে প্রবেশ করে নুরুন্নাহার বানুর মনে হয়েছিল তিনি মহারানীর কপাল নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার ঠিকে ভুল হতে লাগল। ছোট খালে নৌকা বায় যে মাঝি, উত্তাল তরঙ্গসংকুল মহাসমুদ্রে এসে পড়লে তার যে অবস্থা হয়, নুরুন্নাহার বানুও সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে লাগলেন। কাজের লোকদের নির্দেশ দিতে গিয়েই তার কর্তৃত্বের পরিধি কতদূর সংকুচিত টের পেলেন। মালিকে সামনে তরকারির বাগান করার হুকুম দিয়েছিলেন, মালি তার মুখের উপর বলেছে এই বাড়িতে সেটা চলতে পারে না। বেয়ারাকে দুপুরবেলা বাজারে গিয়ে কিছু টক দই কিনে আনতে বলেছিলেন, বেয়ারা ঘড়ি দেখে বলেছিল,

-বেগম সাহেবা আমার পরে যে আসবে তাকে বলবেন, আমার ডিউটি শেষ। এখন আমি বাসায় যাব।

এরকম ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে টের পাচ্ছিলেন এই বাড়িতে কেউ তাকে বিশেষ মান্য করার প্রয়োজন বোধ করে না।

তার চোখের সামনে আবু জুনায়েদ কী রকম বদলে গেল। আবু জুনায়েদের গেঞ্জি এবং জাঙ্গিয়া থেকে এত দুর্গন্ধ বের হতো যে নুরুন্নাহার বানুর বমি এসে যেত। তবু সেগুলো তিনি পাল্টাতেন না। এখন আবু জুনায়েদ বাড়িতেও অর্ধেক সময় থ্রি পিস স্যুট পরে বসে থাকেন। চেপে কথা বলবেন কি করে মানুষটাকেই অচেনা অচেনা লাগে। আগে ক্লাস থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি করলে নুরুন্নাহার বানুর কাছে দশ মিনিট কৈফিয়ত দিতে হতো। এখন পুরো একবেলা এমনকি কখনো একদিন একরাত বাড়িতে না এলেও নুরুন্নাহার বানুর কাছে কথা বলাটাও প্রয়োজন বোধ করেন না। এখন আবু জুনায়েদের ব্যক্তিগত সহকারী, একান্ত সচিব, চাপরাশি কত কিছু হয়েছে। বেলে টিপ দিলেই উর্দি পরা লোক ছুটে আসে। আবু জুনায়েদের নুরুন্নাহার বানুকে কীসের প্রয়োজন।

মেয়েটাও কি নুরুন্নাহার বানুর আছে! নুরুন্নাহার বানু নিজের চোখে দেখেছেন একটা আলগা বেটাকে ঘরে বিয়ে করা বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তাকে আপন বুকে হাত দিতে দিয়েছে। নুরুন্নাহার বানু যখন শাসন করতে গেছেন আপন পেটের মেয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে কি, খবরদার গায়ে হাত দিতে আসবে না। আবেদ ভাইকে ভালো লাগে, তাই মজা করছিলাম। তুমি চিৎকার করলে আমি আবেদ ভায়ের কাছে চলে যাব। আবেদ ভাই বর্তমান বউকে নিয়ে সুখী নয়। আমিও যদি সুখী না হই সেটা আমার ব্যাপার। তুমি হৈচৈ করার কে?

যে মেয়েকে পেটে ধরেছেন, এতদিন মানুষ করেছেন, সে চোখে চোখ রেখে নুরুন্নাহার বানুকে এই সকল কথা বলতে পারে, তারপরেও নুরুন্নাহার বানু কোন মুখে আনে?

বটবৃক্ষের তলে গেলাম ছায়া পাইবার আশে
পত্র ছেদি রৌদ্র পড়ে আমার আপন কর্মদোষে
নদীর ধারে বইস্যা রইলাম নৌকা পাইবার আশে
আমারে দেখিয়া নৌকা দূরে দূরে ভাসে।

তারপরে তবারক হারামজাদা জুটিয়ে দিয়েছে এক মায়াবিনী গরু। আবু জুনায়েদের কাছে তার গরুটাই সবকিছু। গরুর সঙ্গে তার সংসার। গরু ঘরে তার অফিস কাজকর্ম সমাজ নামাজ সব। নুরুন্নাহার বানু কিছু নন। গরুটিকে সতীন মনে করবেন তেমন উপায়ও নেই। যদি তিনি সতীনের মর্যাদা পেতেন, স্বামীর অন্তত একটা অংশের উপর তার অধিকারবোধ বজায় থাকত। এই বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার বুড়ো আধবুড়ো সব বেটাছেলেরা আবু জুনায়েদের গরুকে নিয়ে এখন রঙ্গরসে মত্ত রয়েছে। এই এলাকার সমস্ত পুরুষ মানুষদের সম্পর্কে নুরুন্নাহার বানুর অত্যন্ত খারাপ একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে। একটা গরুর পেছনে যে সকল পুরুষ মানুষ এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড করে বেড়ায় কোন্ যুক্তিতে নুরুন্নাহার বানু তাদের সুস্থ মানুষ মনে করবে?

এতদিন অন্তু ছিল, রেবা ছিল, তার বর ছিল। নুরুন্নাহার বানুর সবটুকু শূন্যতাবোধ, সবটুকু রিক্ততা মেয়ে জামাই নাতি মিলে ভরিয়ে রেখেছিল। ওরা সব গত কাল চলে গেছে। রেবার বরের বদলির চাকরি। এই সপ্তাহের মধ্যে তাকে চট্টগ্রামে গিয়ে জয়েন করতে হবে। নুরুন্নাহার বানুর কোনো ছেলে নেই। তার খুব ইচ্ছে ছিল রেবার বরটিকে একটা চাকরি দিয়ে রেবা এবং অন্তুকে এখানে রেখে দেবেন। অদ্ভুটা থাকলেই নুরুন্নাহার বানুর চলে যেত। আবু জুনায়েদ তার পেয়ারের গাভীটি নিয়ে যা ইচ্ছে করুন, নুরুন্নাহার বানু মুখটিও খুলতেন না। তিনি কি তেমন বাপের মেয়ে যে, ছোটলোকের বাচ্চাদের এসকল জঘন্য কাণ্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করবেন? আবু জুনায়েদ কি তার অন্তরের করুণ হাহাকারটির কথা একবারও ভাবতে চেষ্টা করেছেন? ভাববেন কেন, তিনি কি আর মানুষের পর্যায়ে আছেন। এই পাড়ার সমস্ত নষ্ট মানুষদের নিয়ে গোয়ালঘরে সকাল-সন্ধ্যা কাটাচ্ছেন। আবু জুনায়েদ কি ইচ্ছে করলে রেবার বরকে এখানে একটা চাকরি দিয়ে রেবা এবং অন্তুকে ঢাকা শহরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারতেন না? প্রতিদিন তার হাত দিয়েই তো কত মানুষের চাকরি হচ্ছে। আপন পেটের মেয়ের জামাই, তাকে একটি চাকরি দিলে কি আবু জুনায়েদের আদরের গাই গরুর সোনার অঙ্গ খসে যেত? আবু জুনায়েদ নুরুন্নাহার বানুকে আর কত উলঙ্গ করতে পারেন? আর কত নিচে নামাতে পারেন?

নুরুন্নাহার বানু কি বিনা প্রতিবাদে আবু জুনায়েদের এই জঘন্য অন্যায় মেনে নিতে পারেন। আজকে যদি তার আব্বা বেঁচে থাকতেন, একটা গাই গরুর কাছে তার মেয়েকে এমন ছোট করা কি সহ্য করতে পারতেন? তিনি আপন হাতে রামদায়ের একটা মাত্র কোপ দিয়ে ছোটলোকের বাচ্চার মাথা ফাঁক করে ফেলতেন এবং গাই গরুটি জবাই করে জেয়াফত খাওয়াতেন, নুরুন্নাহর বানু তেমন ঝালঅলা বাপের বেটি । আবু জুনায়েদের গরু পীরিতের শেষ দেখে তিনি ছাড়বেন। গরুটিকে তিনি আপন হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করবেন। তাহলেই তার শরীরের ঝাল মেটে। ইতোমধ্যে তিনি বিষ সংগ্রহ করে ফেলেছেন। সেজন্য তাকে একটু কষ্ট করতে হয়েছে বৈকি। তার পুরনো কাজের বুয়া ছমিরনের মাকে নগদ একটি হাজার টাকা দিতে হয়েছে। পুরনো একটি শাড়িও বুড়ি মাগিটি তার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে, গরুটি ভালোভাবে মারা যাবে, সেই মারা যাওয়ার কাজটি নিরাপদে হয়ে গেলে, নুরুন্নাহার বানুকে তার সাহেবকে মানে আবু জুনায়েদকে বলে ছমিরনের স্বামীর একটি চাকরি ঠিক করে দিতে হবে। এতকিছু করার পরেই মাগি গ্রামে গিয়ে চামারের কাছ থেকে গরুর বিষ এনে দিয়েছে।

শুক্রবার দিন মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদকে নরসিংদি যেতে হলো। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে ছিল না। আজ পশু হাসপাতাল থেকে গরুটাকে দেখার জন্য ডাক্তার আসার কথা ছিল। গর্ভাবস্থার এখন ছমাস চলছে। শরীর ভারী হয়ে উঠছে। তরণীর চঞ্চলতা অনেকখানি থিতিয়ে এসেছে। ডাক্তার কী বলেন, আবু জুনায়েদের শোনার ইচ্ছে ছিল। শিক্ষা সচিব যাচ্ছেন, শিক্ষামন্ত্রী যাচ্ছেন, আবু জুনায়েদ না বলবেন কেমন করে। সরকারের অধীনে চাকরি আবু জুনায়েদের। আজ সপ্তাহব্যাপী উৎসবের সূচনা। একেবারে শেষ দিন প্রধানমন্ত্রী যাবেন। ঘর থেকে বেরোবার আগে আবু জুনায়েদ গোয়াল ঘরে গেলেন। গত দিন দেখাশোনার লোকটা চলে গেছে তার আসতে একটু বেলা হবে। কারণ তাকে বউকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। সকালে যাতে ‘তরণী’ ব্রেকফাস্ট করতে পারে সেজন্য রাতেই তার জন্য গামলাতে আতপ চালের জাউ তৈরি করে রেখে যাচ্ছে। কেউ জাউটা তরণীর সামনে ঠেলে দিলেই চলবে। তরণী জাউ শেষ করার আগেই সে বউকে বাসায় রেখেই চলে আসবে।

আবু জুনায়েদ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর নুরুন্নাহার বানুর হঠাৎ কেমন জানি ইচ্ছে হলো তিনি নিচে গিয়ে একটু হেঁটে আসবেন। আবু জুনায়েদ বাইরে টাইরে কোথাও গেলে তিনি কম্পাউন্ড পরিক্রমার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করেন। দারোয়ান মালি ঝাড়দার এ সকল তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাকে দেখে তটস্থ হয়ে ওঠে, হুকুম তামিল করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, মনে যত কষ্টই থাকুক এটা তিনি মহা আনন্দে উপভোগ করে থাকেন। আজকে তিনি নিচে নেমে দেখেন সবটা ফাঁকা। ঝাড় দেয়া শেষে ঝাড়ুদারেরা চলে গেছে। মালিরাও অনুপস্থিত। কেবল এক দারোয়ান গেটে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। নুরুন্নাহার বানুকে দেখতে পেয়ে মুখের সিগারেট ছুঁড়ে দিয়ে সালাম দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নুরুন্নাহার বানু দারোয়ানের কাছে তার অসুস্থ মেয়েটির সংবাদ জিজ্ঞেস করলেন। দারোয়ান জানালো, বেগম সাহেবের অশেষ মেহেরবাণী। আল্লাহর রহমতে তার মেয়ে সুস্থ। দুঃসময়ে বেগম টাকাটা ধার না দিলে মেয়ের চিকিৎসা করানো তার পক্ষে সম্ভব হতো না। এক তারিখ মাইনে পেলে সে ঠিক বেগম সাহেবার টাকাটা শোধ করে দেবে। বেগম সাহেব তার বড় উপকার করেছেন, সে কথা সারা জীবন মনে থাকবে। নুরুন্নাহার বানু বললেন, ঠিক আছে হাশমত ঐ টাকা কটা তোমাকে একেবারেই দিয়ে দিলাম। শোধ দিতে হবে না।

দারোয়ান করজোড়ে আবার নুরুন্নাহার বানুকে সালাম করল।

নুরুন্নাহার বানু ঘুরতে ঘুরতে গোয়ালঘরে এলেন। গরুটা দাঁড়িয়ে আছে, সুন্দর লেজটা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। তার ছলছল চোখ দুটোয় নুরুন্নাহার বানুর চোখ গেল । তিনি পেটে হাত রাখলেন, ভেতরে বাচ্চাটি নড়াচড়া করছে টের পেলেন। এমন গাভীন একটি গরুকে তিনি বিষ দিয়ে হত্যা করবেন! মনে একটা মমতা জন্মাল। গরুটা সত্যিই সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর দীর্ঘদিনের কুণ্ডুলি পাকানো সংকল্পটা জীবন পেতে শুরু করছিল। তিনি কাজটা করবেন কি না ঠিক করতে পারছেন না। গোটা কম্পাউন্ডটা আগাগোড়া দুচার চক্কর দিলেন। তার একে একে মনে পড়তে লাগল, গরুটা আসার পর থেকে কীভাবে তার উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে। স্বামী পর হয়ে গেছে, মেয়ে খানকি হওয়ার উপক্রম, তার নিজের জীবন থেকে শান্তি সুখ কীভাবে বিদায় নিয়েছে। গরুটা যদি বেঁচে থাকে নুরুন্নাহার বানুর আর কোনোই আশা নেই। নুরুন্নাহার কি স্বামী সংসার নিয়ে বেঁচে থাকতে চান, তাহলে গরুটি কোনোমতেই বেঁচে থাকতে পারে না। তার মন কঠিন হয়ে উঠল, যা করবার তাকে তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। মনের এই দৃঢ়তা কতক্ষণ রাখতে পারবেন তিনি জানেন না। নুরুন্নাহার বানু নিজের কাছে নিজে পরাজিত হতে চান না। তার চলার বেগ অত্যন্ত দ্রুত হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দ তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তাড়াতাড়ি দোতালায় উঠে প্লাস্টিকের কৌটার ভেতর থেকে পলিথিনে ঢাকা পুরিয়াটা নিয়ে নেমে এলেন এবং গুঁড়োগুলো জাউয়ের গামলার মধ্যে স্পর্শ বাঁচিয়ে ছড়িয়ে দিলেন। আপন হাতে একটি গাছের ডাল ভেঙে গুলতে লাগলেন। তারপর উপরে উঠে পরনের শাড়িটা বদলে ড্রাইভার ডেকে গাড়িতে চড়ে মীর হাজিরবাগে বোনের বাড়িতে চলে গেলেন।

.

১৫.

নরসিংদি থেকে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের ফেরার কথা ছিল বিকেলের দিকে। কিন্তু তার ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা হয়ে গেল। পথে এক জায়গায় একটা প্রাইভেট কার একজন কলেজ ছাত্রকে চাপা দিয়ে চলে গেছে এবং ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে। ক্ষিপ্ত ছাত্ররা ছাত্র হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ যত প্রাইভেট কারের দেখা পেয়েছে, ইচ্ছেমতো ভাঙচুর করেছে, কোনো কোনো আরোহীকে জোর করে নামিয়ে পিটিয়েছেও। ভয়ে ওই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি আসতে সাহস পাচ্ছিল না। আবু জুনায়েদকেও অনেক ঘুরপথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে হয়েছে। বিপদের উপর বিপদ। বড় রাস্তায় যেই উঠেছে পেছনের চাকাটা পাংচার হয়ে গেল। অতিরিক্ত কোনো চাকা সঙ্গে ছিল না। তাই দুমাইল ঠেলে গাড়িকে নিকটবর্তী গ্যারেজে আনতে হয়েছে। আবু জুনায়েদকে নিজেকেও এই ঠেলাঠেলির কাজে হাত রাখতে হয়েছে। গ্যারেজে নতুন চাকা লাগিয়ে আবার চলা শুরু করতে ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেল। তার খেয়ে ঘণ্টাখানেক আরাম করার অভ্যেস। আজকে সেটি হয়নি। তাছাড়া আরো নানারকম ধকল গেছে। শিক্ষা সপ্তাহের শুরুর দিন নরসিংদিতে দুদল ছাত্রের মধ্য মারামারি হয়েছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা শ্রান্তিতে তার চোখ বুজে আসছিল।

তিনি যখন উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে এলেন দেখেন গেট খোলা। ভেতরে মানুষজনের আনাগোনা। গোয়ালঘরে অনেক মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তিনি কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ানকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে?

দারোয়ান বলল,

-দুপুরবেলা থেকে গরুটা হড় হড় করে পাতলা পায়খানা করছে, কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না, আর মুখ দিয়ে ফেনা আসছে।

আবু জুনায়েদ জিজ্ঞেস করলেন,

-বেগম সাহেবা কোথায়?

দারোয়ান জবাব দিল,

-বেগম সাহেবেরও শরীর ভীষণ খারাপ। বড় আপার বাসায় গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। উপরে তিনি আছেন। এখন অল্প অল্প জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার দেখছেন।

আবু জুনায়েদ বেগমকে দেখতে উপরে না গিয়ে গরু দেখতে গোয়ালঘরে চলে গেলেন। গোয়ালঘরে এই এত রাতেও অনেক মানুষ। মাওলানা তাহের, জনার্দন চক্রবর্তী, ড. আনোয়ারুল আজিমসহ সান্ধ্য আসরের প্রায় সমস্ত সদস্য উপস্থিত আছেন। একপাশে শেখ তবারক আলী। তার পাশে এক ভদ্রলোক ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আবু জুনায়েদ ধরে নিলেন তিনি ডাক্তার হবেন।

গরুটার অবস্থা দেখে আবু জুনায়েদের ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। দুটো অসহায় স্বচ্ছ টলোটলে চোখ থেকে পানির দুটো ধারা গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে। মলদ্বার দিয়ে পিচকারির মতো বেগে পাতলা পায়খানা ছুটছে। আবু জুনায়েদ ভালো করে দেখার জন্য যেই পেছনের দিকে গিয়েছেন ছড় ছড় করে পায়খানা ছুটে এসে তার কোট প্যান্ট সব ভরিয়ে দিল। সে সবের পরোয়া না করে আবু জুনায়েদ মলদ্বারের গোড়া পরীক্ষা করে দেখেন, মলদ্বারের গোড়ায় ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। গরুটির মুখে ফেনা ভাঙছে তো ভাঙছেই। সমুদ্রের জোয়ার নেমে যাওয়ার পর বেলাভূমিতে যে রকম ফেনা পড়ে থাকে গোয়ালঘর জুড়ে সর্বত্র ফেনার দাগ দেখতে পেলেন। আবু জুনায়েদ কী করবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি কোটপ্যান্টসুদ্ধ হাঁটু মুড়ে গরুর পাশেই বসে পড়লেন। তারপর শিশুর মতো, বৃদ্ধের মতো, পুত্রহারা মেয়ে মানুষের মতো বুক চাপড়ে হু-হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। উপস্থিত মানুষরা তাকে কেউ কিছু বলতে পারলেন না। এক সময় কান্নার বেগও শান্ত হয়ে এল। কিন্তু গরুটি পাতলা পায়খানা করেই যাচ্ছে।

আবু জুনায়েদকে কখন থেকে পায়খানা শুরু হলো, নিতান্ত অনিচ্ছায়ও সে কথা শুনতে হলো। কাঞ্চন মানে যে মানুষটি দেখাশুনা করে থাকে হাসপাতালে বউকে দেখিয়ে বাসায় রেখে সরাসরি গোয়ালঘরে চলে এল। এসেই দেখে গরুটি পাতলা পায়খানা করছে আর বড় বড় করে কাশছে এবং কাশির সঙ্গে ফেনা আসছে। রকমসকম দেখে কাঞ্চন খুব ভয় পেয়ে যায়। বাড়িতে বেগম সাহেবাকে খবর দিতে গিয়ে দেখে বেগম সাহেবা নেই। উপায়ান্তর না দেখে তবারক সাহেবের বাড়িতে টেলিফোন করে। তার বাড়ি থেকে জানানো হয় তিনি মতিঝিলের অফিসে আছেন । কাঞ্চন তিল পরিমাণ বিলম্ব না করে তবারক সাহেবের অফিসে গিয়ে জানায় যে গরুটি পাতলা পায়খানা করছে এবং মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। তবারক সাহেব অফিসে একজন সাহেবের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে আলাপ করছিলেন। ঘটনা শুনে তবারক সাহেব বিদেশী ভদ্রলোককে সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,

এক্সকিউজ মি । ইউ হ্যাভ টু অ্যাপোলোজাইস মি। দেয়ার ইজ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট, আই হ্যাভ টু রাশ রাইট নাউ।

তারপর তবারক সাহেব পশুহাসপাতালে গিয়ে নিজের গাড়িতে ভেটেরনারী সার্জন নূরুল হুদা সাহেবকে উঠিয়ে নিয়ে উপাচার্য ভবনে চলে আসেন। ভেটেরনারি সার্জন গরুকে ট্যাবলেট খাওয়াতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু গরুটি কিছু গিলছে না। কী রোগ তিনি ধরতে পারছেন না তথাপি অনুমানের উপর নির্ভর করে দু দুটো ইঞ্জেকশন দিয়েছেন, পায়খানা বন্ধ হয়নি। শেখ তবারক আলী তারপর সাভার সরকারি ডেয়ারি ফার্মে যে সুইডিশ পশু বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক আছেন তাকে আনিয়েছেন। ড. জারনট জানালেন ট্রপিক্যাল ক্যাটেল ডিজিজ সম্বন্ধে তার যতদূর বিদ্যা এরকম কোনো রোগের নাম কখনো শোনেননি। সুতরাং তিনিও বলতে পারেন না আসল রোগটা কী। আকস্মিক কোনো বিষাক্ত বস্তু খাওয়ার কারণেই হয়তো এরকম ঘটতে পারে। স্টম্যাক এক্সরে করালে আসল কারণটা জানা যেত। কিন্তু এদেশে ক্যাটেল এক্সরে করার কোনো প্ল্যান্ট নেই। সুতরাং তিনি খুবই দুঃখিত, কিছু করতে পারবেন মনে হয় না।

আবু জুনায়েদকে ধরে ধরে উপরে উঠিয়ে দেয়া হলো। তিনি শুনলেন নুরুন্নাহার বানুকে এই সবেমাত্র ডাক্তার ঘুম পাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। তার শরীর থেকে। একরকম জোর করেই কোট প্যান্ট খুলে তাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তিনি ঘোষণা করলেন, কিছু খাবেন না। আবারও জোর করে তাকে দুধ খাওয়ানো হলো। চাপে পড়ে সামান্য ভাতও তিনি খেলেন। সকলে ধরাধরি করে তাকে শোয়ার ঘরের বাইরে একটি খাটে শুইয়ে দিল। কারণ, শোয়ার ঘরে নুরুন্নাহার বানু অচেতন হয়ে পড়ে আছেন এবং তাকে বড় বোন দেখাশোনা করছেন। আবু জুনায়েদ অসুস্থ স্ত্রী এবং গরুর কথা ভুলে পরেরদিন বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমোলেন।

মার্চ মাসের এগার তারিখ বেলা সোয়া নটার সময়ে একটি পশ্চিমা দেশের একজন রাষ্ট্রদূত আবু জুনায়েদের সঙ্গে তার অফিসে এসে দেখা করবেন, এরকম অ্যাপয়েন্টম্যান্ট করা হয়েছিল। ভদ্রলোক এদেশে নতুন এসেছেন। মাত্র দুসপ্তাহ হলো রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি মহানগরীর সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। আবু জুনায়েদ খুশি হয়েছিলেন। বিদেশীদের সঙ্গে তিনি চমৎকার বাতচিত করতে পারেন। অথচ এখানকার নাক উঁচু কালো সাহেবেরা রটিয়েছেন আবু জুনায়েদের ইংরাজি ভুল, বাংলা অশুদ্ধ।

তার ব্যক্তিগত সহকারী ফোন করে জানালেন রাষ্ট্রদূত সাহেব এসে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আবু জুনায়েদকে দাড়িটা কাটতে হলো। গত কালের স্যুটটা পরতে গিয়ে দেখলেন গরুর গোবরের ছিটা লেগে আছে সর্বত্র। আলমারি খুলে তাই নতুন স্যুট বের করে পরতে হলো। অফিসে গিয়ে দেখেন রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক অফিসে বসে বসে অপেক্ষা করছেন। আবু জুনায়েদ হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন :

-ইউর এক্সেলেন্সি আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, দেয়ার ইজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট ইন মাই হাউস।

রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন,

-সো ইউর ওয়াইফ ইজ সিক, ইজ সি?

-ইউর অ্যাক্সেলেন্সি নট এক্সাক্টলি মাই ওয়াইফ, বাট মাই কাউ।

-হোয়াট? কাউ? সো ইউ আর কিপিং এ কাউ?

-ইয়েস ইউর এক্সেলেন্সি, ভেরি গুড, ভেরি বিউটিফুল কাউ এবং ইটস মাদার ইজ এ সুইডিশ কাউ, এ কাউ অব ইউর বিউটিফুল কান্ট্রি। দ্যাট কাউ ইজ সিক। রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে গেলেন। কিছু জিনিস জানার জন্য রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোকের কৌতুকের জন্ম নিল । তিনি বললেন,

-মি: ভাইস চ্যান্সেলর আই হ্যাভ টু কুয়োরিস। দ্য ফার্স্ট ওয়ান ইজ আই হ্যাড দ্য আইডিয়া দ্যাট হিন্দুস ওঅরশিপ কাউস। বাট মুসলিমস আর বিফ ইটার নেশন লাইক আস, ইজ নট দ্যাট?

আবু জুনায়েদ বললেন,

-ইউর এক্সেলেন্সি ইজ পারফেক্টলি রাইট হিস ডু ওঅরশিপ কাউ এন্ড উই পিপল ইট বীফ। বাট ইট ইজ অলসো টু উই লাভ কাউ ভেরি মাচ।

রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক হাসি সংবরণ করে বললেন,

-নাউ মাই সেকেন্ড কুয়েরি উড বি হাউ ডু ইউ রিলেট কাউ কিপিং এন্ড য়ুনিভার্সিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন?

-ইউর এক্সেলেন্সি। আই হ্যাভ মাই ওন ইনডিভিজুয়াল মেথড টু ম্যানেজ বোথ।

রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক বললেন,

-থ্যাঙ্ক ব্যু মি: ভাইস চ্যান্সেলর, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি এন্ড গ্ল্যাড টু মিট ইউ।

তারপর একটা বিস্কুটের এককোণা দাঁতে কেটে নিয়ে চায়ে মুখ দিলেন। চা শেষ করে সুইডেনের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ক্যাডিলাকে করে চলে গেলেন।

সুইডিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর আজকের দিনের দ্বিতীয় কর্মসূচি বোটানি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর নিয়োগের ইন্টারভু। প্রফেসর নিয়োগের বেলায় উপাচার্যকে প্রিসাইড করতে হয়, এটাই নিয়ম। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডীন বোটানি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এবং এক্সটার্নেল হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির চেয়ারম্যান তিনজনই উপস্থিত আছেন। তিনজন মাত্র প্রার্থী। প্রতিটি প্রার্থীর ফাইল এবং আবেদনপত্র হাজির করা হয়েছে। আবু জুনায়েদের মুখে একটা থমথমে গাম্ভীর্য, তিনি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে বললেন প্রথম ক্যান্ডিডেট ড. আদনানকে আসতে বলো।

তিনি চেম্বারে প্রবেশ করলে আবু জুনায়েদ চেয়ার দেখিয়ে বললেন, প্লিজ টেক ইওর সিট।

ড. আদনান বসলে কাগজপত্র দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন আপনি ইউ. এস. এ. থেকে ডক্টরেট করেছেন?

ড. আদনান জবাব দিলেন,

-আমি ইউ. এস. এ’র মিশিগান য়ুনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট এবং পোস্ট ডক্টরেট করেছি। মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন,

-আচ্ছা ড. আদনান, আপনি আমাকে বলুন তো, গাভীন গরু পাতলা পায়খানা করলে কী করতে হয়?

উপাচার্য সাহেবের প্রশ্ন শুনে আদনানের হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সংযম রক্ষা করলেন এবং বললেন,

-স্যার কী করতে হবে আমার জানা নেই। আমার বিষয় অ্যানিমাল হাজব্যান্ডি নয়, বোটানি।

আবু জুনায়েদ হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের বললেন,

-আপনারা ইন্টারভিউটা চালিয়ে নিন। আমি থাকতে পারছিনে। আমার গরুটার অসুখ। তারপর তিনি অফিস রুমের বাইরে চলে এলেন।

আবু জুনায়েদের গাড়ি অফিস থেকে যখন উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে ঢুকল, জুনায়েদ দেখেন অনেক মানুষের ভিড়। ছাত্রছাত্রী, পাড়ার মহিলা, তরুণ শিক্ষকদেরও অনেককে দেখতে পেলেন। আবু জুনায়েদ চিন্তা করলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গরুটি সকলের ভালবাসার পাত্র হয়ে উঠেছিল। কী আবেগ নিয়েই না সকলে অসহায় পশুটিকে দেখতে আসছে। দলে দলে মানুষ গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছে এবং গোয়ালঘর থেকে আসছে। গরুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন্ত সত্তার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে কথা আবু জুনায়েদ জানতেন না। তার চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছিল। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ধীর মন্থর গতিতে গোয়ালঘরের দিকে গেলেন। সকলে তাকে পথ ছেড়ে দিল। তিনি নীরবে গোয়ালঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। গরুটি কাত হয়ে শুয়ে পড়েছে। তার মুখটা মাটিতে ঠেকিয়ে রেখেছে। ফেনায় গোয়ালের সবটা মেঝে ভেসে যাচ্ছে। সুন্দর চোখ দুটো বোজা। মলদ্বারের পাশে বিন্দু বিন্দু রক্ত লেগে রয়েছে। কাঞ্চন ছেলেটা গরুর গায়ে হাত দিয়ে বসে আছে। চুপচাপ। তার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আবু জুনায়েদ কাউকে কিছু না বলে উপরে গিয়ে গায়ের কাপড়চোপড়, পায়ের জুতো কিছুই না খুলে বিছানায় নিজেকে ঢেলে দিলেন।

আবু জুনায়েদ ঘুমিয়ে পরেছিলেন। ঘুমের মধ্যে তিনি একটা স্বপ্ন দেখলেন। শেখ তবারক আলী তাকে হাত ধরে গরুর মৃতদেহটার কাছে নিয়ে গেলেন। গরুটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলছেন, কী জামাই মিয়া আপনাকে কি আমি সঠিক পথ দেখাইনি। স্বপ্নটা দেখেই তিনি জেগে গিয়েছিলেন। এই রকম স্বপ্ন কেন দেখলেন, তার অর্থ কী হতে পারে! আরো কত বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কে জানে?

এই সময়ে তার ব্যক্তিগত সহকারী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে চাপাস্বরে বললেন, স্যার স্যার এডুকেশন মিনিস্টার অনেকক্ষণ পর্যন্ত লাইনে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আবু জুনায়েদকে তড়িতাহতের মতো উঠে টেলিফোনের কাছে যেতে হলো। রিসিভার কানে লাগিয়ে সালাম দিতে হলো। যত বিপদই থাকুক উপর থেকে টেলিফোন এলে কণ্ঠস্বরে বিনীত ভাব ফুটিয়ে তুলে কীভাবে জবাব দিতে হয় সেটা আবু জুনায়েদের ধাতস্ত হয়ে গেছে। রিসিভার উঠিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললেন,

-স্যার, আসোলামু আলাইকুম, আবু জুনায়েদ।

শিক্ষামন্ত্রী ওপ্রান্ত থেকে উৎসাহব্যঞ্জক কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে এবং তারপরে বাংলায় বললেন,

-মি: জুনায়েদ আই কগ্রাচুলেট ইউ অব বিহাফ অব অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার এন্ড মাই ওন বিহাফ। প্রাইম মিনিস্টার হ্যাজ আসড মি ইনফর্ম ইউ, ইউ আর দ্য মোস্ট ফেবার্ড এবং লাকি পারসন টু রিপ্রেসেন্ট বাংলাদেশ ইন ফিফটি ওয়ান আমেরিকান য়ুনিভার্সিটিস। উত্তর থেকে দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট একান্নটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির উপর পরিচয়মূলক বক্তৃতা দিতে হবে । প্রতি বক্তৃতার সময় প্রশ্নোত্তরসহ আড়াই ঘণ্টা। প্রতিটি বক্তৃতার জন্য আপনাকে চার হাজার ডলার করে সম্মানী দেবে। এটা গুরুদায়িত্ব এবং সম্মানজনক দায়িত্ব। আপনার হাতে পঁচিশ দিন মাত্র সময় আছে। এরই মধ্যে যাবতীয় ফর্মালিটিজ সারতে হবে । বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু ছকিয়ে নিতে হবে এবং ফ্যাক্টস এন্ড ফিগার যোগার করতে হবে। সুতরাং বিশেষ সময় নেই। এই মুহূর্ত থেকে কাজে লেগে যান। প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার আগের দিন আপনার অনারে একটা ডিনার দেবেন। সময়টা আমিই পরে জানাব।

এই বিরল সম্মান এবং প্রচুর অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনার সংবাদটি শোনার পর প্রথমেই আবু জুনায়েদ টেবিলের সামনে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে ক্যালকুলেটর বের করে হিসেব করতে লাগলেন। তাকে একান্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। প্রতি বক্তৃতার জন্য পেতে যাচ্ছেন চার হাজার ডলার। একান্নকে চার দিয়ে গুণ করলে কত দাঁড়ায়? এক ডলারে চল্লিশ টাকা, এক লক্ষ ডলারে চল্লিশ লক্ষ টাকা, দু লক্ষ ডলারে আশি লক্ষ টাকা। তার উপর আরো দু লক্ষ টাকার মতো। মোট বিরাশি লক্ষ টাকার হাতছানি। সে কী সামান্য ব্যাপার! একটু আগে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে এল। স্বপ্নের তাৎপর্যটা তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি ইচ্ছে করলে পাঁচশ একর, এক হাজার একর মনের মতো জমি পছন্দ করে কিনতে পারবেন। তার হালাল রুজির টাকায় কেনা । তিনি কনসালট্যান্সি করেননি। রাজনৈতিক ধান্দাবাজি করেননি । আল্লাহ সৎ পথেই তার। আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন।

আবু জুনায়েদ ভাবলেন সংবাদটা প্রথমে নুরুন্নাহার বানুকে জানানো প্রয়োজন । আবু জুনায়েদের মনে হলো তিনি শূন্যের উপর ভেসে বেড়াচ্ছেন। শোয়ার ঘরে গিয়ে দেখেন নুরুন্নাহার বানু উত্তর দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছেন। আবু জুনায়েদ তাকে আস্তে আস্তে দোলা দিয়ে ডাকতে থাকলেন এই বানু এই বানু। খুব আবেগাপ্লুত নয়নে তিনি কখনো নুরুন্নাহারকে বানু বলে ডাকেন না। আবু জুনায়েদ ডাকাডাকি করছেন, অথচ নুরুন্নাহার বানু চোখ খুলছেন না। অবশেষে অনেক ডাকাডাকির পর নুরুন্নাহার বানু ঘুম থেকে জেগে খাটের উপর বসলেন। আবু জুনায়েদের দিকে ঘোলা ঘোলা চোখে তাকালেন। মনে হলো না তিনি আবু জুনায়েদকে চিনতে পেরেছেন। খুব ক্ষীণ স্বরে, মনে হয় স্বরটা তার নয়, অন্য কোথাও থেকে ভেসে আসছে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাও?

আবু জুনায়েদ তার হাত দুটি ধরে বললেন, বানু শোনো একটা অসম্ভব সুখের সংবাদ। জানো আমেরিকার একান্নটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে একটি করে বক্তৃতা দিতে হবে। প্রতি বক্তৃতায় চার হাজার ডলার সম্মানী পাব। সব মিলিয়ে হবে দু লক্ষ চার হাজার ডলার। আমাদের টাকায় তার পরিমাণ বিরাশি লক্ষ। এত টাকা আমাদের হবে।

নুরুন্নাহার বানু পূর্বের মতো ক্ষীণ স্বরে বললেন, খুবই উত্তম সংবাদ। তুমি বিরাশি লক্ষ টাকা পাবে। এই টাকাটা তোমার দরকার হবে। গাভী প্রেমিকার কবরের উপর তুমি তো তাজমহল বানাবে। শুনে রাখো তোমার প্রেমিকাটি আজ রাতে কিংবা কাল সকালে মারা যাবে এবং আমিই ওকে খুন করেছি।

রচনাকাল : ডিসেম্বর ১৯৯৪ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *