০৭-৯. শেখ তবারক আলী

শেখ তবারক আলী এক কথার মানুষ। পরের দিন নটা বাজতেই ট্রাক এসে উপাচার্য ভবনের গেটের সামনে হর্ন দিতে থাকল। দারোয়ান গেট খুলতে রাজি ছিল না। ইট সিমেন্ট, রড বালুতে ভর্তি তিন তিনটি ট্রাকের এই সকালবেলায় আগমনের হেতু দারোয়ান জানত না। ট্রাকগুলো বারবার হর্ন দিতে থাকল। বাধ্য হয়ে দারোয়ানকে উপাচার্য সাহেবকে খবর দিতে উপরে যেতে হলো। আবু জুনায়েদ স্যুট টাই পরে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে পায়চারি করছিলেন। দারোয়ানকে উপরে উঠে আসতে দেখে তিনি রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?

-স্যার তবারক সাহেব ইটা বালু ভর্তি তিনটি ট্রাক পাঠিয়ে দিয়েছেন। ট্রাকগুলো ভেতরে ঢুকতে চাইছে, জবাব দিল দারোয়ান।

আবু জুনায়েদের মনে পড়ে গেল। আগের রাতে শেখ তবারক আলী তাকে বলেছিলেন, ঠিক নটার সময় তবারক সাহেবের লোকজন ট্রাক নিয়ে তার বাড়ির গেটে এসে হাজির হবে। সাড়ে নটার সময়ে তার একটি মিটিংয়ে বসার কথা। আজ রসায়ন বিভাগের লেকচারার নিয়োগের ইন্টার্যুর তারিখ। সাধারণত আবু জুনায়েদ প্রফেসর এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ছাড়া নিচের দিকের পোস্টগুলোর ইন্টারভুর সময়ে উপস্থিত থাকেন না। যেহেতু রসায়ন তার একেবারে নিজস্ব ডিপার্টমেন্ট, তাই তিনি আপনা থেকেই প্রস্তাব করেছিলেন, লেকচারারদের ইন্টারভ্যুর সময় তিনি স্বয়ং হাজির থাকবেন। কথা দিয়েছেন অথচ এদিকে ট্রাক এসে হাজির। তিনি যদি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জায়গা দেখিয়ে না দেন, কী রকম ঘর তৈরি করতে হবে ভালো করে বুঝিয়ে না দেন, তাহলে পরে অসুবিধেয় পড়ে যেতে হবে। ট্রাকসহ লোকজনদের আজ চলে যেতে বলবেন কি না একটুখানি চিন্তা করে দেখলেন। তিনি উপস্থিত না থাকলে বড় রকমের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তার বদলে টেলিফোনে উপ উপাচার্যকে ডেকে ইন্টারভুটা চালিয়ে নিতে বললে কাজ চলে যায়। তারপরেও একটা ব্যাপারে আবু জুনায়েদের মনের মধ্যে একটা সংশয় থেকে গেল। আবু জুনায়েদ বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছেন, আজকে যে সকল প্রার্থীর ইন্টারভু হবে, তার মধ্যে ড. করিমের একজন নিকটাত্মীয় রয়েছে। বর্তমানে ড. করিম একইসঙ্গে রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্সের ডীন। উপ-উপচার্য ড. খয়রাত হোসেন হলেন ড. করিমের বেয়াই। আবু জুনায়েদের অনুপস্থিতিতে ড. করিম এবং ড. খয়রাত হোসেন মিলে ড. করিমের আত্মীয়টিকেই বেছে নেবেন । আবু জুনায়েদ জেনেছেন ড. করিমের আত্মীয়টির চাইতে একাধিক উজ্জ্বল প্রার্থী আছে। বোর্ডে যখন বসবেন ড. করিম এবং খয়রাত হোসেন মিলে আত্মীয়টির মধ্যে এত সব প্লাস পয়েন্ট খুঁজে বের করবেন অধিকতর যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা মাঠে মারা যাবে। আরো একজন অযোগ্য প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পাবে। তা পাক, আবু জুনায়েদের কিছু করার নেই। তার চোখের সামনেই কত অন্যায় ঘটে যায়। কটা তিনি ঠেকাতে পেরেছেন। ঠিক করলেন, আজ তিনি যাবেনই না। ব্যক্তিগত সহকারীকে ফোন করে বললেন, তার নাম করে যেন উপ-উপাচার্যকে জানানো হয়, আজ তার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। দয়া করে খয়রাত সাহেব যেন রসায়ন বিভাগের লেকচারের ইন্টারভুর সময় উপস্থিত থাকেন। তিনি দারোয়ানকে ট্রাক ভেতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন বাড়ির একেবারে পেছনের ফাঁকা জায়গাটিতে ইট-সিমেন্ট, রড ওসব যেন নামানো হয়। তিনটি ট্রাক ভেতরে এল বটে, কিন্তু একটা গোলমাল বেঁধে গেল। বাড়ির পেছনদিকে যদি যেতে হয় একসারি শীতকালীন পুষ্প পিষ্ট করে ট্রাকদের যেতে হয়। হেড মালি কিছুতেই সেটি হতে দেবেন না। শেখ তবারক আলীর একজন ওভারসীয়র ট্রাক থেকে নেমে এসে মালিকে ধমক দিয়ে বললেন

-স্বয়ং উপাচার্য সাহেব পারমিশন দিয়েছেন, ট্রাক আটকাবার তুমি কে?

-আমি ওই বাগানের হেড মালি। আমার ফুলের গাছ নষ্ট করার অধিকার তোমাদের নেই। ফুল অনেক কষ্ট করে ফোঁটাতে হয়। তুমি ঠিকাদারের মানুষ রদ্দি মালের কারবারি, ফুলগাছ নষ্ট হওয়ার কষ্ট তুমি কী বুঝবে, বললেন হেড মালি।

-মালি বেটার ফুটানি কত, সরে দাঁড়াও, ট্রাক ওইদিক দিয়েই যাবে, উত্তরে বলল ওভারসীয়র। হেড মালি ওভারসীয়রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে ভীষণ তেতে উঠল।

-দেখি ওভারসীয়রের বেটা তুমি ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাও এই আমি শুয়ে পড়লাম। সত্যি সত্যি হেড মালি ফুল গাছের সারির পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল । ব্যাপারটা আরো গুরুতর রূপ নিতে পারত। শেখ তবারক আলীর জামাতা আবেদ হোসেন ঘটনাস্থলে এসে পড়ায় একটা মীমাংসা হয়ে গেল । ফুল গাছের সারি দুটো রক্ষা পেল । অনেকদূর ঘুরে ট্রাককে বাড়ির পেছনে যেতে হলো।

আজ আবু জুনায়েদের একটা বিশেষ দিন। তার জীবনের একটি প্রিয় স্বপ্ন পূর্ণ হতে চলেছে। তার বাড়িতে একটা গরু আসার উপলক্ষ দেখা দিয়েছে। এখন সেই গরুর গোয়াল তৈরি হতে যাচ্ছে। এর চাইতে প্রিয় ব্যাপার আর কী হতে পারে? তিনি শরীর থেকে স্যুট টাই অপসারণ করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠলেন। নিচে যাওয়ার জন্য স্লিপারে পা চালিয়েছেন। অমনি মনে হলো আগে সংবাদটা নুরুন্নাহার বানুকে জানানো প্রয়োজন। তিনি শোবার ঘরে গেলেন। দরজা পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করার আগেই লম্বাটে আয়নাটায় নুরুন্নাহার বানুর প্রতিফলিত চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। গেল রাতে শেখ তবারক আলীর স্ত্রী তাদের কন্যা দীলুকে যে বেনারশিখানা দিয়েছেন নুরুন্নাহার বানু সেটি পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। তার হাতে গলায় তবারক আলীর স্ত্রীর দেয়া সোনার অলঙ্কারগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আবু জুনায়েদ দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না। নতুন বেনারশি এবং অলঙ্কারের সৌষ্ঠবে নুরুন্নাহার বানুকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। আবু জুনায়েদ পা টিপে টিপে এসে নুরুন্নাহার বানুর চোখ দুটো চেপে ধরে দুই গালে চুমো খেলেন। নুরুন্নাহার বানু বেঁকে চুরে আবু জুনায়েদের নাগালের বাইরে চলে গেলেন। তারপর আবু জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। সেই পাষাণগলানো হাসি দেখে আবু জুনায়েদের কী একটা যেন ঘটে গেল। হাজার বছরের সুপ্ত পিপাসা তার সারা শরীরে জেগে উঠল। তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। দুহাতে নুরুন্নাহার বানুকে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলেন।

নুরুন্নাহার বানু এবং আবু জুনায়েদ হাত ধরাধরি করে নিচে নামলেন। বাইরে লোকজনের দঙ্গল দেখে ফেলে এই ভয়ে পরস্পরের হাত ছাড়িয়ে নিলেন। ইটের স্তূপ, রডের রাশি এবং সিমেন্টের ইতস্তত ছড়ানো বস্তাগুলো দেখে আবু জুনায়েদের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। তবারক সাহেব একেবারে ঘর বানাবার মাল সরঞ্জাম সব পাঠিয়ে দিয়েছেন। মাল এখনো নামানো হয়নি। ঝটপটে মাল নামানোর কাজ চলছে। শেখ তবারক আলীর জামাই আবেদ হোসেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাল নামানো তদারক করছেন। আবু জুনায়েদ এবং নুরুন্নাহার বানু নিকটে এলে আবেদ হোসেন তাদের সালাম দিলেন। আবু জুনায়েদ অনেকটা অনুযোগের ভঙ্গিতে বললেন,

-আবেদ তুমি ঘরে না এসে বাইরে কেন দাঁড়িয়ে রয়েছ?

-স্যার এদিকটার কাজকর্মের একটা গতি হোক আগে। জবাব দিলেন তবারক আলীর জামাতা।

-তাহলে তবারক সাহেব একেবারে গোয়াল ঘর তৈরি করেই ছাড়লেন। কথার পিঠে কথা বললেন আবু জুনায়েদ।

-স্যার, আব্বার কড়া হুকুম, সাত দিনের মধ্যে গোয়াল ঘর বানিয়ে ফেলতে হবে। এখন কথা হলো আপনি কী ধরনের ঘর পছন্দ করবেন সেটা জানার প্রয়োজন আছে। আপনি যে রকম চাইবেন মিস্ত্রিরা বানিয়ে দেবেন। আবেদ হোসেন কথার উত্তরে জানালেন-

আমার আবার পছন্দ অপছন্দ কী? একখানা গোয়ালঘর হলেই আমার চলে। যে কোনো রকমের একখানা গোয়ালঘর। আমার আব্বা পাটের বেড়া এবং খড়ের চালা দিয়ে গোয়ালঘর বানিয়েছিলেন, সেখানেই সারা জীবন গরু রেখেছেন।

আবেদ হোসেন বললেন,

-স্যার এখন কি আর পাটখড়ির যুগ আছে? তাছাড়া এই মনুমেন্টাল বিল্ডিংয়ের পেছনে যেমন তেমন একটা স্ট্রাকচার খাড়া করে দিলে তো আর চলবে না। আব্বা বলে দিয়েছেন, এমন ঘর তৈরি করতে হবে যাতে গোটা পরিবেশের সঙ্গে চমৎকারভাবে মানিয়ে যায়।

আবু জুনায়েদ বললেন,

-ভাই আবেদ, তুমি তো জানো বার বছর মাস্টারি করলে মানুষ গাধা হয়ে যায় । আমার পঁচিশ বছর চলছে। তোমাদের যা মন লয় করো, আমার কিছুই মনে আসছে না।

আবেদ জানালেন শেখ তবারক আলী সাহেব দশ বাই বার ফিট ঘরের একটা নকশা এঁকে দিয়েছেন। ঘরটা দেখতে চৌকোমতে হবে। চারপাশের দেয়াল চারফুট পর্যন্ত উঁচু হবে। সর্বসাকুল্যে উচ্চতা দাঁড়াবে দশফুট। বাকিটা কলাম করতে হবে। ছয়টা ফাঁক থাকবে। দুটো ফাঁকে দুটো দরজা বসবে। সামনের দরজাটা হবে বড়, পেছনের দরজা অপেক্ষাকৃত ছোট। কলামের ফাঁকে ফাঁকে চারটি কাঁচের জানালা হবে। ঘরে যাতে প্রচুর আলো-বাতাস খেলতে পারে, সেজন্য জানালাগুলো যাতে খোলা এবং বন্ধ করা যায় সে ব্যবস্থা থাকবে। ছাদটা হবে টিনের। কিন্তু নিচে বাঁশের বেড়া ফিট করে দিতে হবে। নইলে গরম কালে খুব গরম হবে। আর দক্ষিণ দিকে ঘরের লাগোয়া একটি টিনের শেড থাকবে। দিনের বেলা গরু এই শেডের নিচে থাকবে। এই পাশে খইল কুড়োর গামলা এবং ঘাস বিচালির ‘আড়া’ বানানো হবে। আপনারা যাতে মাঝে-মাঝে এসে গোয়ালঘরের পাশে এসে কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারেন, সেজন্য উত্তর দিকে আরো একটা শেড নির্মাণ করা হবে। সেখানে সিমেন্ট দিয়ে একটা মস্ত বড় গোল টেবিল বানানো হবে, যার চারপাশে বসার ব্যবস্থা থাকবে।

শেখ তবারক আলীর গোয়ালঘর বানানোর পরিকল্পনা শুনে আবু জুনায়েদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন,

-এই রকম একটা বাড়ি পেলে ভাই আবেদ আমিই তো বাস করতে চলে আসি।

আবেদ হোসেন আবু জুনায়েদের কথার কোনো জবাব দিলেন না। তারপর একটু ঢোক গিলে বললেন,

-গরুটার কথা তো স্যার আপনাকে চিন্তা করতে হবে। সাভার ডেয়ারি ফার্মে সুইডিশ এবং অস্ট্রেলিয়ান গরুর মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে একটা বাচ্চা জন্মানো সম্ভব হয়েছে। আব্বা ওই গরুটিই আপনার গোয়ালে পাঠাবার কথা চিন্তা করছেন।

আবু জুনায়েদ কোনো মন্তব্য করলেন না। এতক্ষণ নুরুন্নাহার বানু একটি কথাও বলেননি। তার দুটি কারণ। প্রাতঃমৈথুনের আনন্দের রেশটি তখনো কাটেনি। দ্বিতীয়ত এত কুলি-কামিনের মধ্যে মুখ খুললে তিনি মনে করেন, অনাবশ্যক নিজেকে খেলো করে তুলবেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকা নুরুন্নাহার বানুর ধাতের মধ্যে নেই। এবার তিনি কথা বলতে আরম্ভ করলেন। বিশেষত আবু জুনায়েদের সে কথাটির প্রতিবাদ করা প্রয়োজন মনে করলেন। আবু জুনায়েদ এক পর্যায়ে বলে ফেলেছেন, প্রস্তাবিত গরুর ঘরটির মতো একটা ঘর পেলে নিজে বাস করতে আসবেন। আবু জুনায়েদ ফকির মানুষের বেটা। কথায় কথায় ফকিরালি স্বভাবটি তার বেরিয়ে আসে। তবারক চাচার জামাইয়ের কাছে এই কথাটা বলা মোটেই আবু জুনায়েদের উচিত হয়নি। নুরুন্নাহার বানুর মনেও বড় একটি সুন্দর বাড়ি তৈরি করার ইচ্ছে আছে। সেই ব্যাপারটি জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন।

-আবেদ, তুমি তো আমার ছোট বোনের বর, সুতরাং তোমাকে তুমিই বলব। তুমি কি রাগ করবে?

না আপা রাগ করব কেন, অবশ্যই তুমি বলবেন। জবাব দিলেন আবেদ হোসেন।

নুরুন্নাহার বানু বললেন,

-উত্তরাতে আমাদের বার কাঠা জমি আছে। বাড়ি বানানোর সময়ে চাচাকে ধরে বলব, চাচা আপনি একটা সুন্দর নকশা এঁকে দেন। চাচা সুন্দর সুন্দর বাড়ির নকশা করতে পারেন ।

আবেদ বললেন,

-আব্বা বাড়ির প্ল্যান করতে ওস্তাদ। তার সামনে বিদেশী স্থপতি পর্যন্ত পেন্সিল ধরতে সাহস পান না।

এরই মধ্যে মাল সরঞ্জাম নামিয়ে তূপ করে রাখা হয়েছে। হেড মিস্ত্রি কোন জায়গায় ঘরটা ওঠানো হবে সীমানা নির্দেশ করতে বললেন। আবু জুনায়েদ স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে একটু গোলের মধ্যে পড়ে গেলেন। তার ইচ্ছে হলো উপাচার্য ভবনের লাগোয়া পেছন দিকটাতেই গোয়াল ঘরটা বানানো ভালো হয়। তিনি পেছনের দরজা খুলে যখন ইচ্ছে গরুটা দেখতে ছুটে আসতে পারেন। কিন্তু মুশকিল হলো, চারপাশে ফাঁকা জায়গার মাঝখানে একটা বর্বর হর্তুকি গাছ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আবু জুনায়েদ বললেন

ওই হর্তুকি গাছটা কেটে ফেলে এখানে ঘরটা তুললে ভালো হয়। তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন।

আবেদ হোসেন বললেন,

-স্যার আমার একটা কথা আছে। ঢাকা শহরে হর্তুকি বিরলপ্রজাতির বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। সুতরাং গাছটা কাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া বসতবাড়ির অত সন্নিকটে গোয়াল ঘর থাকাও উচিত নয়। গরুর গোবর, প্রস্রাবের ঘ্রাণ এসব পীড়াদায়ক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তার চাইতে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যে খালি জায়গাটি আছে, সেখানে ঘরটি তৈরি করলে সবদিকে উত্তম হয়।

-আবু জুনায়েদ বললেন,

-আবেদ জায়গাটি উত্তম, কিন্তু অসুবিধের কথা হলো কী জানো, গোটা বর্ষাকাল সারা মাঠটা প্যাক কাদায় একেবারে ফকফকে হয়ে থাকে। এই এতটা পথ গরুর দেখাশোনার জন্য গোয়াল ঘরে আসা-যাওয়া একটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

আবু জুনায়েদের আশঙ্কার জবাবে আবেদ হোসেন বললেন,

-স্যার প্যাক কাদা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। সমস্ত রাস্তাটাই আমরা কংক্রীট দিয়ে বাঁধিয়ে দেব।

ঠিক হলো আবেদ হোসেনের নির্দেশিত স্থানে গোয়ালঘর বানানো হবে।

মিস্ত্রিরা ফিতা টেনে জায়গাটা চিহ্নিত করে ফেললেন। আবেদ হোসেন শেখ তবারক আলীর স্বহস্তে আঁকা নকশাখানা ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন । সাত-আটজন মজুর একসঙ্গে দেয়াল বানাবার জন্য মাটি কাটতে লেগে গেল। মাটি কাটাকাটি করতে দেখলে আবু জুনায়েদের খুব ভালো লাগে। বালক বয়সে তারা একটি কুয়ো খনন করেছিলেন। আবু জুনায়েদ সারা দিন বসে থেকে মজুরদের মাটি তোলা দেখতেন। পৃথিবীর গভীরে আরো গভীরে কী আছে জানার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠত। বার বার আব্বাকে প্রশ্ন করতেন,

-আব্বা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে পৃথিবীর বুক ভেদ করে অপর পাড়ে যাওয়া যায় কি না। আব্বা হাসতেন। আবু জুনায়েদ বার বার জানতে চাইতেন। অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলতেন,

-দূর পাগলা এমন কথা কেউ বলে নাকি।

মাটি খোঁড়াখুড়ি করতে দেখলে আবু জুনায়েদের এসব কথা মনে পড়ে যায়।

নুরুন্নাহার বানু তার গায়ে ঠেলা দিয়ে বললেন, তুমি এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি? আবেদকে একবারও চা খেতে বলবে না নাকি?

স্ত্রীর কথা শুনে মনে হলো মস্ত অন্যায় হয়ে গেছে। শেখ তবারক আলী সাহেবের জামাইকে একবারও ঘরে যেতে বলেননি। অনেকটা মাফ চাইবার ভঙ্গিতে বললেন

-ভাই আবেদ রাগ করবে না। আগেই তো বলেছি বার বছর মাস্টারি করলে যে কোনো মানুষ গাধা হয়ে যায়। চলো ঘরে চলো। আবেদ স্মিথ হেসে বললেন,

-স্যার আজ থাক অন্যদিন আসব । এখন আমাকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে ছুটতে হবে। একখানি ড্রেজার অচল হয়ে গেছে।

মিস্ত্রিদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে অপেক্ষমাণ পাজেরোতে উঠে স্টার্ট দিল। আবেদ চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত আবু জুনায়েদ মজুরদের কাজ দেখতে থাকলেন। তার মনের মধ্যে একটা ছুটির হাওয়া দোলা দিতে থাকল। স্কুল পালানো বালকের মতো একটা নির্মল আনন্দে তার সারা মনপ্রাণ ভরে গেছে। নুরুন্নাহার বানু তার পাঞ্জাবির কোণা আকর্ষণ করে বলল, চলো ঘরে যাই। নুরুন্নাহার বানুর পেছন পেছন তিনি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। নুরুন্নাহার বানু জানতে চাইলেন

-আজ কি তোমার অফিস নেই?

-অফিস আছে, কিন্তু ও বেলা যাব। জবাব দিলেন আবু জুনায়েদ।

-ঠিক আছে গোসল সেরে একটু পাক-পরিষ্কার হয়ে নাও, তারপর দুটি খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে একেবারে বিকেল বেলা অফিসে যাবে।

নুরুন্নাহার বানুর কথার জবাবে আবু জুনায়েদ বললেন,

-আবার গোসল কেন, সকালে তো একবার করেছি।

-গোসল কেন আবার বুঝিয়ে দিতে হবে। নুরুন্নাহার বানু একটা ইঙ্গিত করলেন, নুরুন্নাহার বানু বললেন, চলো আমার সারা গা কুট কুট করছে। তোমার রাতদিন কোনো জ্ঞান নেই।

.

০৮.

দুদিনের মধ্যেই লাল ইটের দেয়াল মাটি ছাড়িয়ে উঠে গেল। সাত আটজন মিস্ত্রি কাজ করছে। সারা দিন তো কাজ করেই হ্যাজাক জ্বালিয়ে আধারাত পর্যন্ত কাজ চলতে থাকে। আবু জুনায়েদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। তার স্বপ্নের গোয়াল ঘর তৈরি হতে যাচ্ছে। ইট গাঁথা হচ্ছে, সিমেন্টে বালু মেশানো হচ্ছে, নির্মীয়মাণ গোয়ালঘরের কোণাকানচিগুলো স্পষ্ট আকার ধারণ করছে। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আবু জুনায়েদের আজন্মলালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। গোয়ালঘর তৈরি হবে এবং সেই ঘরে বাস করতে একটি গাভী আসবে। প্রচণ্ড একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আবু জুনায়েদের ফুরসৎ খুবই কম। তবু দিনে দুতিনবার গিয়ে মিস্ত্রিদের কাজ দেখে আসেন। অফিসে যাওয়ার আগে একবার দেখেন। দুপুরে খেতে এলে গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে যান। বিকেলে যেদিন কাজ থাকে না, ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়তে পড়তে মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে থাকেন। এই অল্প কদিনের মধ্যেই দেয়ালগুলোর উচ্চতা চারফুট উঠে গেছে। এখন কলাম বসবে। কলামের ফাঁকে ফাঁকে জানালা। ভেতরে ভেতরে যে উত্তেজনা তিনি অনুভব করছেন, নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পূর্বেও সে রকম অনুভূতি তার হয়নি।

নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গেও তার সম্পর্কটা এখন খুবই ভালো। কোনো দাম্পত্য কলহ নেই, পারিবারিক জীবনে কোনো খিটিমিটি নেই। দুজন যখন একান্তে আলাপ করেন তখন গরুর কথাটা আপনি এসে পড়ে। নুরুন্নাহার যখন প্রথম বাচ্চা পেটে ধরেছিলেন, ওনিয়েও দুজনের মধ্যে এমন সহমর্মিতা দেখা যায়নি। প্রথমবারের গর্ভবতী হওয়ার পর নুরুন্নাহার বানুর মেজাজ সব সময়ে খাট্টা হয়ে থাকত। একটুতেই তিনি রেগে যেতেন, কেঁদে বুক ভাসাতেন এবং আবু জুনায়েদকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন। কেননা আবু জুনায়েদই তার এই ভোগান্তির কারণ। শেখ তবারক আলীর বাড়ি থেকে ফেরার পরপরই নুরুন্নাহার বানুর মনটা নতুন করে আবু জুনায়েদের দিকে ঢলতে আরম্ভ করেছে। নুরুন্নাহার বানুর সাজ-পোশাকের বহর এখন অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন করে ভাজভাঙা শাড়ি পরেন। তবারক আলীর স্ত্রীর কাছ থেকে যে সকল অলঙ্কার উপহার পেয়েছেন, পারতপক্ষে সেগুলো শরীর থেকে নামান না। নুরুন্নাহার বানু কীভাবে রানী-রানী ভঙ্গি সৃষ্টি করা যায়, আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নুরুন্নাহার বানুর এই সার্বক্ষণিক সাজগোজের ঘটা দেখে মেয়েটা ভীষণ বিরক্ত হয়ে গেছে। তার একটা প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্য আছে। তবারক আলীর স্ত্রী দীলুকে যে বেনারশিখানা উপহার দিয়েছেন, সে কাপড়টার প্রতি নুরুন্নাহার বানুর ভীষণ লোভ। যখন তখন সেই শাড়িটাই পরে বসেন। একদিন মেয়ে বলেই বসল,

আম্মা নানি আমাকে যে শাড়িখানা দিয়েছেন সেটা তুমি যখন তখন পরে বসো কেন? ওটা তো আমার । নুরুন্নাহার বানু মেয়ের কথা গায়ে মাখেন না বিশেষ। দীলু চেঁচামেচি করলে জবাব দেন,

-তুই তো সারাক্ষণ সালোয়ার কামিজ পরে থাকিস। আমি শাড়িটা এক আধটু পরলে কি তোর শাড়ি ছিঁড়ে যাবে। তোর শাড়ি তো তোরই থাকবে।

-আম্মা ছিঁড়ে না যাক আমার কাপড় তুমি যখন তখন পরে বসবে না। তোমার যদি খুব শখ হয়, তাহলে নানিকে বলো যেন তোমাকেও একখানা কিনে দেন।

মেয়ের কথার কোনো জবাব দেন না নুরুন্নাহার বানু। ঠিক এই রঙের নয়, এই জাতীয় একখানি শাড়ি যদি চাচি তাকেও দিতেন খুব ভালো হতো। হার, ব্রেসলেট, ইয়ারিং এবং হাতের চুড়ির সঙ্গে এই শাড়িটাই মানায় চমৎকার । চাচির কাছে ওরকম আরেকখান শাড়ি চাইবেন কি না ভেবে দেখেন। না সম্ভব নয়। সেটি তিনি করতে পারবেন না। তিনি উপাচার্যের বেগম। কারু কাছ থেকে কিছু চাওয়ার মধ্যে একটা কাঙালপনা আছে। সেটি তিনি করতে পারবেন না। নুরুন্নাহার বানুর হাতে যখন কোনো কাজ-কর্ম থাকে না, দূরের আত্মীয়দের কাছে টেলিফোন করে সুসংবাদটা প্রকাশ করেন। তবারক চাচা তাকে একই সঙ্গে গরু এবং গোয়াল দুটিই উপহার দিতে চাচ্ছেন। নুরুন্নাহার বানুর বাবা যখন বেঁচেছিলেন তার বড় এবং মেজো দুবোনকেই প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর আস্ত গাইগরু উপহার দিয়েছিলেন। প্রথম বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই বাবার কাছে গাভী পাওয়ার প্রত্যাশা করে। এ প্রত্যাশা নুরুন্নাহার বানুরও ছিল। কিন্তু তিনি চাইতে পারেননি। চাইলে বাবা অবশ্যই একটা দুধের গাই দিতেন, যাতে নাতি নাতনিরা দুধ খেতে পারে। তিনি মুখ ফুটে চাইতে পারেননি। কারণ বাবা যদি বলে বসেন, বানু গাই কিনে দিলে তুমি রাখবে কোথায়। তোমার তো মোটে দুখানা ঘর। যেখানে খাওয়া সেখানে শোয়া, সেখানে রান্না। বাবা মারা গেছেন। তবারক চাচা আছেন, আল্লাহ তাকে তৌফিক দিয়েছেন। আর নুরুন্নাহার বানুদের একটা গাই পোষার ক্ষমতা হয়েছে। বাবার দায়িত্ব চাচা পালন করছেন। শেখ তবারক আলী তার বাবার আপন ভাই না হোক, তার চাইতে অনেক বেশি। নুরুন্নাহারের আপন মায়ের পেটের ভায়েরা তার জন্য কতটুকু করে? আব্বার বিষয় সম্পত্তি সব লুটে-পুটে খাচ্ছে। বোনের কথা কি তাদের খেয়াল । আছে। বউরা তাদের ভেড়য়া বানিয়ে রেখেছে। আল্লাহর কাছে হাজার শোকর, তবারক চাচার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর তিনি যে শোক পেয়েছিলেন, তবারক চাচা তার অনেকখানিই ভরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তবারক চাচাকে একখানি দিলও দিয়েছেন। ফাঁকে ফাঁকে তিনি আবু জুনায়েদের কথাও চিন্তা করেন। মানুষটা যেন কী? তবারক চাচা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করেন, অথচ আবু জুনায়েদ তার কোনো খবর জানেন না। মানুষটা যেন কী? আগে হলে বলতেন আচাবুয়া গর্দভ। এখন তার মূল্যায়নের ধারাটা একটু পাল্টেছে। এখন তিনি মনে করছেন আবু জুনায়েদ সব সময়ে ভাবের ঘোরে থাকেন। তাই ডানে বায়ে কী ঘটছে সে বিষয়ে দৃষ্টি দিতে পারেন না। হালফিল এটাকে একটা চমৎকার গুণ বলে মনে করেছেন। আবেদ হোসেন কথা দিয়েছিলেন আট দশ দিনে গোয়াল ঘর তৈরি করে ফেলবেন। কিন্তু তৈরি করতে পনের দিন লেগে গেল। তারপরেও কিছু কাজ বাকি পড়ে রইল। উত্তর দিকে যে শেডটা বানানোর কথা ছিল, এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। আবেদ হোসেন জানালেন তার ক্যালকুলেশন কখনো ফেল হয় না। এবার হয়ে গেল, কারণ একটা অঘটন ঘটে গেছে। হেড মিস্ত্রির মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করেছে। হেড মিস্ত্রির জামাই পণের টাকার দাবি নিয়ে অনেকদিন থেকেই মেয়েটার উপর অত্যাচার করছিল। শেষমেশ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করে পণের টাকার দায় থেকে আত্মরক্ষা করেছে। হেড মিস্ত্রিকে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ছুটে যেতে হয়েছিল এবং থানা পুলিশ অনেক কিছু করতে হয়েছে। উত্তর দিকের শেডটা আবেদ হোসেন খুব সুন্দরভাবে বানাতে চান। শেখ তবারক আলী তাকে সেরকমই নির্দেশ দিয়েছেন। মামুলি মিস্ত্রি দিয়ে সুন্দর জিনিস বানানো যায় না। তাই এ বিলম্ব এবং সেজন্য তিনি লজ্জিত। যা হোক, হেড মিস্ত্রি যখন ঝামেলা মিটিয়ে চলে আসতে পেরেছে, আর দুশ্চিন্তা নেই। এই দুচারদিনের মধ্যেই সব কমপ্লিট হয়ে যাবে। আবেদ হোসেনের দুচারদিন দশদিনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু বেশি সময় নিল, তারপরেও যে গোয়াল ঘর তৈরি হলো, দেখে আবু জুনায়েদের মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। আল্লাহ এতদিনে তার একটা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন।

আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো এই নতুন বানানো গোয়ালঘরটা তার কিছু বন্ধু বান্ধবকে দেখাবেন। এমনিতে আবু জুনায়েদের বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা তার দল করেন, প্রশাসনিক বিষয়ে নানা ব্যাপারে যারা তাকে সাহায্য করেন, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হলে যারা তার পক্ষ হয়ে প্রতিবাদ করেন, ইদানীং আবু জুনায়েদ তাদের মধ্যে বিশেষ কাউকে কাউকে বন্ধু মনে করতে আরম্ভ করেছেন। আবু জুনায়েদ একটি বিশেষ কারণে সদ্যনির্মিত গোয়াল ঘরখানা সকলকে দেখাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। সত্যি বটে এটি গোয়াল ঘর এবং আগামীতে এই ঘরটিতে একটি চতুস্পদ প্রাণী বসবাস করতে যাচ্ছে। কিন্তু ঘরটির নির্মাণশৈলী এত চমৎকার দেখলে চোখটা আপনা থেকেই জুড়িয়ে যায়। পাখির বাসার মতো এই এক টুকরো একখানি ঘর । ঢেউটিনের চালসহ গোটা ঘরখানি যেন মাটি খুঁড়ে আচমকা সুন্দর একটা মাশরুমের মতো ফুটে বেরিয়ে এসেছে। উপাচার্য ভবনের অসামান্য গাম্ভীর্যের পটভূমিতে এই ছোট্ট ঘরখানা একটি স্বপ্নবিন্দুর মতো ফুটে উঠেছে। আবু জুনায়েদ যখন ভাবেন মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ঘরটি সঙ্গে করে। নিয়ে যেতে পারবেন না, মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়।

আবু জুনায়েদ মনে করেন, একই সঙ্গে গরু গোয় দুটিই দেখিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেবেন। যেদিন গরুটা গোয়ালে আসবে কয়েকজনকে সন্ধ্যেবেলা চায়ের নিমন্ত্রণ করবেন। উত্তরদিকে যে শেডটা বানানো হয়েছে সেখানে চেয়ার টেবিল পেতে অতিথিদের নিয়ে বসবেন। কিন্তু গরুটা কখন আসবে? কখন আসবে? এই মহামান্য অতিথি কখন সাধের গোয়ালঘর আলো করতে আসবেন। নিষ্ঠাবান সাধক মন্দির নির্মাণের পর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন আকুলিত অন্তরে প্রতীক্ষা করতে থাকেন, আবু জুনায়েদের মনেও সে ধরনের আকুলি-বিকুলি জন্ম নিচ্ছিল। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন, গরুটা আকাশ থেকে তার গোয়ালঘরের বাসিন্দা বনে যাবে না। শেখ তবারক আলী সাহেব কথা দিয়েছেন তার ভাইঝি এবং নাতনিকে একটা গরু প্রেজেন্ট করবেন। প্রেজেন্ট করা গরু নিরাপদে বসবাস করতে পারে, সেজন্য এই গোয়ালঘর বানিয়ে দেবেন। গোয়ালঘর বানিয়ে তিনি কথা রেখেছেন, কিন্তু গরুটা কখন নিয়ে আসবেন? গরু বিহনে গোয়ালঘরটা যেন কাঁদছে, আবু জুনায়েদের এরকম মনে হলো। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন গোয়ালঘর বানানোর পেছনে শেখ তবারক অনেক টাকা ব্যয় করে ফেলেছেন। গরু কিনতে আরো টাকার প্রয়োজন। এদিকটা আবু জুনায়েদের দেখার বিষয় নয়। এসব তিনি ভ্রাতুস্পুত্রী এবং নাতনিকে গিফট করছেন। সুতরাং টাকার অঙ্কে তিনি হিসেব করবেন কেন? কিন্তু গরুটা কখন আসবে? চট করে তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। তবারক সাহেব, তার স্ত্রী, জামাই আবেদ হোসেন এবং কন্যাকে দাওয়াত করলে চমকার হয়। তাদেরকে একবার তবারক সাহেব দাওয়াত করে খাইয়েছেন, পাল্টা দাওয়াত করা তার একটি সামাজিক কর্তব্য। দাওয়াত খেতে এলে গরুটা কখন আসবে সঠিক তারিখ জানা সম্ভব হবে। আসল তারিখটা জানতে পারলে বাড়তি উৎকণ্ঠার অবসান হবে।

সেদিনই রাতে জুনায়েদ শেখ তবারক আলীকে টেলিফোন করে বসলেন । তবারক সাহেব নিজেই রিসিভ করেছিলেন। আবু জুনায়েদ আগামী শুক্রবারে আবেদ হোসেন, তার স্ত্রী এবং চাচা চাচিকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন। শেখ তবারক আলী বললেন,

-এত ঘটা করে দাওয়াত করার দরকার কী। মেয়ের বাড়ি যখন ইচ্ছে খেয়ে যাব। আবু জুনায়েদ একটু ধান্ধায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে কি তবারক সাহেব আবু জুনায়েদের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন? পরের ব্যাখ্যায় আবু জুনায়েদের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। শেখ তবারক আলী বললেন,

-শুনুন জামাই মিয়া দাওয়াত টাওয়াত ওগুলো এখন রাখেন। বানু এবং তার মেয়ে আমার এখানে যতবার ইচ্ছে যখন খুশি আসতে পারেন। এমনকি আপনি এলেও কিছু এসে যায় না। আমি বাস করি একেবারে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার এখানে কে এল কে গেল কে হিসেব রাখে। কিন্তু স্যার ভুলে যাবেন না আপনি দেশের সবচাইতে বড় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। আপনি কী করেন না করেন শত শত চোখ তাকিয়ে আছে। একটুখানি খুঁত পেলেই আপনার নিজের পেশার মানুষেরাই আপনাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে। আপনার বাড়িতে খেলাম না খেলাম এ নিয়ে উতলা হবেন না। আমাদের ভেতরের যে সম্পর্ক সেটা তো তুচ্ছ কারণে নষ্ট হওয়ার নয়। আমি আপনার কাছ থেকে একটা জিনিসই জানতে চাইব।

আবু জুনায়েদ বললেন, বলুন কী বলতে চান?

-গোয়াল ঘরটা আপনার পছন্দ হয়েছে কি না।

আবু জুনায়েদ বললেন,

-হ্যাঁ খুবই পছন্দ হয়েছে। গরুর বদলে যে কোনো রুচিবান মানুষকে এই ঘরে বাস করতে বললে খুশি হয়ে রাজি হবে। আপনার পছন্দবোধ এত উন্নতমানের।

শেখ তবারক আলী বললেন,

-আপনি পছন্দ করেছেন শুনে আমার দিলটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বানুর কেমন লেগেছে?

-আপনাদের মেয়ে তো একেবারে পাগল। লোকজনকে ডেকে দেখাবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে।

-শুনুন জামাই মিয়া, শেখ তবারক আলী বললেন,

-ওটি ঘটতে দেবেন না। এই সমস্ত জিনিস যত কম মানুষ জানে ততই উত্তম। আমি কী বলছি আপনি বুঝতে পারছেন তো?

আবু জুনায়েদ এক মিনিট থামলেন, তারপর বললেন,

-হ্যাঁ পারছি।

-আজ বৃহস্পতিবার। আগামী কাল শুক্রবার। রাত আটটার পরে আমার লোক গরুটা নিয়ে আপনার বাড়িতে যাবে। আপনাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। গরুর সঙ্গে খইল ভূষি কুড়া ঘাস সবই যাবে। যে লোক গরুর সঙ্গে যাবে সেই লোকটিই দেখাশোনার জন্য সেখানে থেকে যাবে। দক্ষিণ দিকের শেডটা সেজন্যই তৈরি করা হয়েছে। অনায়াসে বিছানা পেতে একজন মানুষ ঘুমোতে পারে। রাত সাড়ে নটা দশটার দিকে আমি এক ফাঁকে একবার দেখে আসব।

আবু জুনায়েদ অবাক হয়ে গেলেন। শেখ তবারক আলী মানুষটির বিশালতা ও সূক্ষ্ম চিন্তার পরিধি দেখে আবু জুনায়েদের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাওয়ার মতো অবস্থা। যে সকল ভাবনা-চিন্তা আবু জুনায়েদের মনে একবারও উদয় হয়নি, শেখ তবারক আলী সেগুলো থরে থরে ব্যাখ্যা করে গেলেন। শেখ তবারক আলী যে তার স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর আপন চাচার অধিক সে কথা তলিয়ে বিচার করবে কে? লোকে যখন জানবে ঠিকাদার শেখ তবারক আলী নুরুন্নাহার বানুকে জড়োয়া গয়নার সেট উপহার দিয়েছেন, মেয়েকে বেনারশি এবং সোনার ঘড়ি দিয়েছেন, আর সুন্দর একটি গোয়ালঘর বানিয়ে দিয়ে একটি মহামূল্যবান গরু পর্যন্ত সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, আবু জুনায়েদের প্রতি একান্ত সহানুভূতিশীল লোকদের মনও বিরূপ হয়ে যাবে। অলঙ্কার হোক, শাড়ি হোক, গোয়াল ঘর, গরু যাই হোক না সবকিছুর একটা নগদ অর্থমূল্য রয়েছে। কেউ যদি আপত্তি উঠিয়ে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন কাজে শেখ তবারককে অধিক সুবিধে দেয়ার জন্য আবু জুনায়েদ এসব ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় থাকবে না। কতিপয় প্রাক্তন উপাচার্যের কেলেঙ্কারির কাহিনীতে ঠিকাদারদের নাম যুক্ত হয়েছিল, আবু জুনায়েদ বিলক্ষণ সেসব অবগত আছেন। তারপরেও আবু জুনায়েদ জেনেশুনে ওই আড্ডার সঙ্গে পড়ে গেলেন। তার প্রতি লোমকূপ পর্যন্ত আঁৎকে শিউরে উঠল। লোকে শুনলে বলবে কী?

এই দুশ্চিন্তাটি মনে স্থায়ী হতে দিলেন না। শেখ তবারক আলী তাকে ঘুষ দেননি। তিনি কোনোরকম অর্থঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি করবেন একথা স্বপ্নেও তার মনে উদয় হয়নি। মানুষ যা ইচ্ছে বলুক। আবু জুনায়েদের বিবেক পরিষ্কার। শেখ তবারক আলী এ পর্যন্ত উপহার গোয়ালঘর এবং গরুর পেছনে যে অর্থ ব্যয় করেছেন, তার পেছনে ঠিকাদারি স্বার্থসিদ্ধির কোনো মতলব নেই। তার জান্নাতবাসী শ্বশুর একসময়ে শেখ তবারক আলীকে জীবনের আসল বৃত্তিটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ শেখ তবারকের পয়সাকড়ির অন্ত নেই। তার থেকে সামান্য অর্থ যদি জান্নাতবাসী অগ্রজপ্রতিম গোফরান ভাইয়ের কন্যা এবং নাতনির পেছনে ব্যয় করে উপকারের প্রতিদান দিয়ে থাকেন, কার কী বলার থাকতে পারে? তারপরেও যদি কেউ খারাপ কথা বলে তার জবাব দেয়ার ক্ষমতা মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের আছে। তার যে একেবারে শিরদাঁড়া নেই, একথা ভাবা মোটেও ঠিক হবে না। সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। আগামী শুক্রবারে রাত আটটার পরে তবারক সাহেবের লোক গরু নিয়ে আসবে সংবাদটি নুরুন্নাহার বানুকে জানানো প্রয়োজন। যাতে নুরুন্নাহার বানু কোনো মেয়েলী ভুল করে না বসেন সেজন্য আগাম সতর্ক করে দেয়ার কথাটিও মনে রাখলেন।

শুক্রবার দিন সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সেরে আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু তাদের কন্যা দীলু গরুটাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। আবু জুনায়েদ চাপা স্বভাবের মানুষ। নুরুন্নাহার বানু বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। তার সেই পুরনো কুসংস্কারটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। তার কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন হয় না। কোথাও না কোথাও থেকে একটা বিঘ্ন এসে সব ভণ্ডুল করে ফেলে। তার মনে নানারকম সন্দেহ রেখাপাত করে যাচ্ছিল। কী তবারক চাচা গরুটা কিনতে পারলেন কি না। যদিও কিনে থাকেন, গাড়ি ঘোড়ার ভিড় দেখে ভয় পেয়ে ছিঁড়ে কোথাও যদি চলে যায়। দীলু মেয়েটির উচ্ছ্বাস ধরে না। একবার আবু জুনায়েদকে জিজ্ঞেস করে। একবার নুরুন্নাহার বানুকে,

-আব্বা গরুটা আসবে তো। এই তো আটটা বেজে গেল। কখন আসবে । শুধোশুধি আমি টি. ভি. প্রোগ্রামটা মিস করলাম।

নুরুন্নাহার বানু এত বড় ধিঙ্গি মেয়ের আদেখলেপনা দেখে একটা কিল উঠিয়েছিলেন আবু জুনায়েদ তার হাতটা চেপে ধরলেন। অতএব মেয়েটি কিল খাওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে গেল । ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘরে ঠেকেছে। আবু জুনায়েদ নিজেকেই প্রশ্ন করেন, কী ব্যাপার গরু আসে না কেন? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। তবারক সাহেব এক কথার মানুষ এবং তার সময়জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, কোনো একটা অসুবিধে হয়েছে। আজ আর আসছে না।

এ সময়ে দারোয়ান এসে জানালো দুজন মানুষ একটা গরু নিয়ে এসেছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সকলের। আবু জুনায়েদ, নুরুন্নাহার বানু, মেয়ে দীলু, ছোকরা চাকর, কাজের বেটি সকলে হুড়োহুড়ি করে নিচে নেমে এলেন। গরুসহ মানুষ দুজন ভেতরে প্রবেশ করল । সত্যি সত্যি একটা গরু উপাচার্য ভবনের কমপাউন্ডের মধ্যে প্রবেশ করল। আবু জুনায়েদের কামনার ধন গরু। নতুন গরু কিনলে গোয়ালে ঢোকাবার আগে কতিপয় আচার পালন করতে হয়। আবু জুনায়েদের তার একটাও মনে নেই। তিনি এত খুশি হয়েছেন যে হঠাৎ করে তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরুচ্ছিল না। মানুষ দুজন গরুটাকে বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ছায়াছায়া অন্ধকারে পুরো চেহারাটা কারো চোখে ধরা পড়ছিল না।

.

০৯.

তিনি একটা আলো আনতে বললেন। দারোয়ান উপরে গিয়ে একটা চার্জার নিয়ে এল। এবার গরুর পুরো চেহারা সকলের নজরে এল। আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো তিনি চিৎকার করে উঠবেন। কী অপূর্ব সুন্দর গরুটি। ছিপ নৌকার মতো লম্বা শরীর। গ্রীবাটি উন্নত। কপালে দুটো শিং বেরুতে গিয়ে থেমে গেছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল লাল। মাঝে-মাঝে ডোরা কাটা দাগ। গরুটিকে পৌরাণিক বুররাকের মতো দেখাচ্ছে। যদি দুটি পাখা থাকত, তাহলে পশুটি আকাশের দিকে উড়াল দিত। ওলানটা অল্প-অল্প মধুভর্তি মৌচাকের মতো স্ফীত হওয়ার পথে। সবচেয়ে সুন্দর চোখ দুটি। একটা অসহায় ভাব দর্পণের মতো প্রতিফলিত হচ্ছে। লেজের চামড়াটা সাদা। গরুটা অসহায় এবং কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে লোকজনের দিকে তাকাচ্ছে। অল্প অল্প নড়াচড়া করছে এবং চারপাশ ভালো করে দেখে নিচ্ছে। যখনই গরুটা নড়াচড়া করে গলার ঘণ্টি থেকে টুং টুং টুং আওয়াজ বেরিয়ে আসে। শিকলটা ঝন ঝন ঝন করে বেজে ওঠে। আবু জুনায়েদের সারা জীবনের স্বপ্ন কামনা একটি গরুর আকার ধরে মূর্তিমান হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুল না । তিনি অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে গরুটি দেখছিলেন।

নুরুন্নাহার বানু শিকল ধরে দাঁড়ানো লোকটির কাছে জানতে চাইলেন,

-আচ্ছা গরুর কাছে গেলে ভূঁসাতে আসবে না তো।

লোকটি উত্তর দিল,

-এ গরু কুঁসায় না। লাথি মারে না। ডরের কিছু নাই, যান কাছে যাইয়া আদর কইরা দেহেন।

নুরুন্নাহার বানু বললেন,

-থাক বাবা আমার সাহস হয় না। জানোয়ার তো কখন কী করে বসে।

নুরুন্নাহার বানুর মেয়েটি তার চাইতে সাহসী। সে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে গরুর গলায় হাত রাখল। গরুটি একটু ঘুরে গিয়ে লম্বা জিভ বের করে তার বাহু চাটতে আরম্ভ করল। মেয়েটির কাতুকাতু লাগছিল। দুপা পিছিয়ে এসে কলকণ্ঠে বলে উঠল,

-দেখো দেখো আলু গরুটি কেমন করে আমার বাহু চাটতে ছুটে আসছে।

আবু জুনায়েদ বললেন,

-তুমি সরে এলে কেন, চাটতে দাও না। বোঝা যাচ্ছে গরুটির বেশ দয়াময়া আছে।

এবার উপাচার্য সাহেব এগিয়ে এসে গরুর পিঠে হাত রাখলেন। পশমের মতো সুন্দর কেশের স্পর্শসুখ অনুভব করলেন। গরুটি আবার আবু জুনায়েদের শরীরের অনাবৃত অংশ চাটবার জন্য জিভ বের করল। আবু জুনায়েদ পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে নিয়ে হাতটি প্রসারিত করে দিয়ে বললেন,

-বেটি চাট।

আবু জুনায়েদের ইচ্ছে হলো ওলানটা একটু ধরে দেখবেন। স্ত্রী এবং কন্যার উপস্থিতিতে সেটা করা সঙ্গত হবে না মনে হওয়ায় বিরত থাকলেন। তিনি নানা জায়গায় হাত বুলিয়ে গরুর শরীরের উত্তাপ অনুভব করছিলেন। তার স্বামী একটা গরুকে নিয়ে লোকজনের সামনে এত আদিখ্যেতা করবেন, নুরুন্নাহার বানুর সেটা সহ্য হলো না। কণ্ঠস্বরে আঁজ মিশিয়ে বললেন,

-পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করলেই চলবে নাকি! গরুকে তার জায়গায় নিয়ে যাও। খেতে দেবে কী সে কথা চিন্তা করো ।

দড়ি ধরে থাকা লোকটি বলে বসল,

-একটা মশারির প্রয়োজন হবে। এই জাতের গরু মশার কামড় সহ্য করতে পারে না।

নুরুন্নাহার বানু বললেন,

-তুমি একটু ঠাণ্ডা হও, আমি দেখি কী করা যায় ।

তারপর তিনি ডাক দিলেন,

-ওই বুয়া শুনে যা।

বুয়া এলে বললেন,

-আজ রাতের জন্যে তোমার মশারিটা গরুটাকে দিয়ে দাও। কাল সকালে অন্য ব্যবস্থা করা হবে।

বুয়া বিড়বিড় করে বলল,

-মানুষটাকে মশায় খাউক কুনু চিন্তা নাই। গরুর বাচ্চারে মশারি লাগাইয়া দাও। মাইনষের বিচার।

কিন্তু সে আট-দশ জায়গায় তালিমারা নিজের মশারিটা এনে দিল। লোকটি এক ঝলক দেখেই বলে দিল।

-ওই মশারি ত তিন হাত লম্বা দুই হাত পাশ। গরুটা কত লম্বা জানেন, পৌনে পাঁচহাত চলবে না।

আবু জুনায়েদ বললেন,

-আজকে কোনোরকমে থাকুক, কাল নতুন মশারির ব্যবস্থা করব ।

নুরুন্নাহার বানু চটে গেলেন । তিনি কোনো কথা ভেতরে রাখতে পারেন না। লোকজনের সামনেই বলে বসলেন,

-বাড়িতে পারা দিতেই নতুন মশারির দাবি। কাল সকাল হলে আরো কত কিছুর প্রয়োজন হবে। আবু জুনায়েদ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। নুরুন্নাহার বানুর কথাগুলো তবারক সাহেবের কানে গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হতে পারেন। তিনি বললেন,

-আঃ তুমি চুপ করো। আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করব। ভাই আপনি গরুটা ওই দিক দিয়ে গোয়াল ঘরে নিয়ে যান। দারোয়ান গোয়ালঘরের বাতিটি জ্বালিয়ে দাও তো।

দারোয়ান বলল,

-স্যার গোয়াল ঘরে তো আলোর বন্দোবস্ত করা হয়নি। আবু জুনায়েদ এই। প্রথম শেখ তবারক আলীর ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা ত্রুটি আবিষ্কার করলেন।

লোকটি বলল,

-স্যার এই জাতের গরু আন্ধাইরে থাকতে পারে না। আবু জুনায়েদ দিশেহারা হয়ে বললেন,–কী করব বাবা তুমিই বলে দাও। শুনলে তো গোয়াল ঘরে আলো নেই।

লোকটি বলল,

–আমি একুয়া কথা কমু আপনের মন লয় কি না চিন্তা করবেন।

আবু জুনায়েদ বললেন,

–হা বাবা বলো।

–আইজ রাইতে বড় দালানের বারান্দার একপাশে থাকুক।

আবু জুনায়েদ বললেন,

–ঠিক আছে বাবা ওই থামটার সঙ্গে বেঁধে রাখো।

নুরুন্নাহার বানু রেগে মেগে উপরে চলে গেলেন। কিন্তু মেজাজটা প্রকাশ করলেন না। মনে মনে বলতে থাকলেন, লোকটি বললে গরুটিকে নুরুন্নাহার বানুর বিছানায় শোয়াতে হবে, আবু জুনায়েদ চতুষ্পদের বাচ্চাকে তার খাটে উঠিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

গরুটা থামের সঙ্গে বেঁধে লোক দুজন চলে গেছে। আবু জুনায়েদ এই নিরিবিলি মুহূর্তটিতে সম্মুখ পাছ নানা দিক থেকে দেখছিলেন। এই সময়ে একটি কণ্ঠস্বর শুনলেন ।

-স্যার বেয়াদবি মাফ করবেন। পারমিশন না নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম ।

তিনি তাকিয়ে দেখেন সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তারই বিভাগ অর্থাৎ রসায়ন শাস্ত্রের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আধপাগলা মুস্তাফিজুর রহমান। আবু জুনায়েদ বিরক্ত হয়েছেন। যা হোক, সেটা গোপন করে বললেন,

-কী খবর মুস্তাফিজুর এত রাতে। মুস্তাফিজুর রহমান বললেন,

-স্যার প্রথমেই আপনাকে জানানোর জন্য ছুটে এসেছি। কাজটি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই শুরু করেছিলাম। এই এতদিনে প্রবলেমটার একটা সলিউশন পাওয়া গেছে। এই যে দেখুন ইউ. এস. এ-র প্রিন্সটন য়ুনিভার্সিটি থেকে ড. রবার্টসন ফ্যাক্স করে জানিয়েছেন আমার সলিউশনটা কারেক্ট । এই লাইনে ড. রবার্টসন সর্বশেষ্ঠ অথরিটি। কেমিস্ট্রির ইতিহাসে এটা বড় ঘটনা ।

মুস্তাফিজ ফ্যাক্সের কপিটা আবু জুনায়েদের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এই যে দেখুন । আবু জুনায়েদ কপিটা একবার দেখলেন বটে। কিন্তু পড়ে দেখার প্রবৃত্তি হলো না। মুস্তাফিজ সাহেবকে বললেন,

-মুস্তাফিজ আমি এখন অন্য চিন্তায় মগ্ন আছি। একটা গরু সংগ্রহ করেছি। ভালো জাতের গরু। মশার আক্রমণ থেকে গরুকে রক্ষা করার জন্য একটি বড়সড় মশারি কোথায় পাওয়া যায়, সে ব্যাপারটা নিয়ে ব্যস্ত আছি। কাল সকালে আপনার ফ্যাক্স পড়ে দেখব। ফ্যাক্সের কপিটা রেখে যেতে পারেন, না নিয়ে যান। কাগজ পত্রের ভিড়ে হারিয়ে যাবে।

মুস্তাফিজ হতাশ ভঙ্গিতে টলতে টলতে বাইরে চলে এলেন। ওই এত রাতে ভুল জায়গায় কেন এলেন? মনে ভীষণ অনুতাপ জন্মাতে লাগল ।

রাত সাড়ে দশটার সময়ে শেখ তবারক আলী উপাচার্য ভবনে এলেন। তিনি ছিপ নৌকোর মতো লম্বাটে একটি স্পোর্টস কারে চড়ে এসেছেন।

আবু জুনায়েদকে খবর দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে গরুটাকে নানাদিক থেকে দেখছিলেন। বড় সুন্দর গরু, দেখে দেখে আশ মিটে না। আবু জুনায়েদ বিস্ময়ভরা মুগ্ধতার ভেতরে এতই ডুবে ছিলেন যে শেখ তবারক আলী কখন তার পাশটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করতে পারেননি। শেখ তবারক কাঁধে হাত রাখলেন। তাকে দেখে চমকে উঠলেন। তবারক সাহেবের বদলে চাচা শব্দটি তার মুখে এসেই গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু ডাকা হলো না। মাথা ঝুঁকিয়ে কদমবুসি করার ইচ্ছেও তাকে দমন করতে হলো ।

শেখ তবারক আলী জিজ্ঞেস করলেন,

–গরু পছন্দ হয়েছে?

–বারে পছন্দ হবে না, এত সুন্দর গরু, জবাব দিলেন আবু জুনায়েদ।

–মা বানু এবং দীলুর পছন্দ হয়েছে?

–সেসব আপনি তাদের কাছ থেকে শুনবেন। চলুন উপরে যাই।

শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদের পিছে পিছে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে সলেন, গোয়াল ঘরে না নিয়ে গরুটা এখানে বেঁধে রেখেছেন কেন?

–আবু জুনায়েদ জবাব দিলেন,

আপনার লোকটা বলল এই জাতের গরু অন্ধকারে থাকতে পারে না। তাই আজ রাতটা এখানেই রেখেছি।

–সে কি গোয়াল ঘরে কারেন্ট দেয়নি? শেখ তবারক আলী হতবাক হয়ে গেলেন। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন,

–এই সমস্ত ইডিয়টদের নিয়ে কাজ করে সুখ নেই। শেখ তবারক আলী আবু জুনায়েদের সঙ্গে উপরে এলেন। দীলু নানা এসেছেন, নানা এসেছেন বলে শোরগোল শুরু করে দিল। মজা করে শেখ তবারকের মাথা থেকে টুপিটা তুলে নিয়ে নিজের মাথায় দিল । তিনি আদর করে নাতনির চুল ধরে টানলেন, নাক এবং গাল টিপে দিলেন, বললেন,

টুপিতে নাতনিকে সুন্দর মানিয়েছে।

নুরুন্নাহার বানু এসে চাচাকে সালাম করলেন। শেখ তবারক তার ভ্রাতুস্পুত্রীর মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন, জিজ্ঞেস করলেন,

-কেমন আছ মা বানু?

নুরুন্নাহার বানু রাগত স্বরে বললেন,

–চাচা আপনার সঙ্গে কথা বলব না।

শেখ তবারক অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কেন মা বানু পাগলি আমি আবার অন্যায়টা কী করলাম?

কথা বলব না তার প্রথম কারণ, আপনি আসবেন বলেছিলেন, আসেননি আর দ্বিতীয়টি থাক বলতে বলতে থেমে গেলেন।

শেখ তবারক আলী বললেন,

–এই তো মা আমি এসেছি, এখন দ্বিতীয় কারণটি বলো ।

–চাচা আপনি একটা গরু পাঠিয়ে মস্ত ফ্যাসাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন, ঘরে

আসতেই গরুর দাবি জমকালো মশারি চাই । দুদিন পর গরুর জাবনা এবং বিচালি খাওয়ার জন্য রূপোর গামলার দরকার হবে। এসব আমি যোগাব কেমন করে?

নুরুন্নাহার বানুর কথা শুনে শেখ তবারক আলী মৃদু হাসলেন।

-মা বানু, এই নতুন এসেছে, তাই ঝামেলা মনে হচ্ছে, দুদিন যাক গরুটাকে ভালো লাগতে আরম্ভ করবে। তবে এটা খুবই কুলীন জাতের গরু, যত্ন-আত্তি তো একটু করতে হবে। সকলের রাশিতে আবার গরু-ছাগল, পশুপাখি এদের বাড় বৃদ্ধি হয় না। পশুদেরও প্রাণের ভেতর থেকে ভালবাসতে হয়। অনাদর, অবহেলা, উপেক্ষা এরা মানুষের চাইতে ভালো বুঝতে পারে। পশুপাখির কথা বাদ দাও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, গাছপালাও অনাদর সহ্য করে না।

তারপর শেখ তবারক আলী গরুটার বংশবৃত্তান্ত বলতে আরম্ভ করলেন। সুইডিশ গাভী এবং অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে এই বাচ্চাটি জন্মানো হয়েছে। সরকারি লাইভস্টক বিভাগকে তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করে আসছিলেন, একটি মাত্র সফল বাচ্চা জন্মানো সম্ভব হয়েছে। আর সেই বাচ্চাটি এখন বানুদের বাড়িতে এসেছে। ছিপ নৌকোর মতো লম্বা বলেই এই প্রজাতিটির নামকরণ করা হয়েছে তরণী।

দীলু বলল, নানা ঠিক আছে আমরা নতুন গরুটির নাম রাখলাম তরণী । ওকে তরণী নামেই ডাকব।

শেখ তবারক আলী বললেন, মাশাল্লাহ আমার ওই নাতনিটার বুদ্ধি-বিবেচনা। ভারি পরিষ্কার। তারপরে শেখ তবারক আলী বলে যেতে থাকলেন, বাংলাদেশে এই প্রজাতির গরু এই একটিই আছে। বাচ্চা অবস্থা থেকে চতুষ্পদ শিশুটির প্রতি অনেকেরই নজর ছিল। গ্লোব ইন্টারন্যাশনালের মালিক নব্য ধনী খলিলুল্লাহ সাহেব নীলামের সময় পঁচাশি হাজার পর্যন্ত উঠেছিলেন। শেখ তবারক এক লাফে আরো পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে এই গো-কন্যাটিকে হস্তগত করেছেন তার মেয়ে এবং নাতনির জন্য। এই গরুটির দাম নব্বই হাজার টাকা। এই পরিমাণ টাকা নগদে শোধ করে তার ভ্রাতুস্পুত্রী এবং নাতনির জন্য গরুটা কিনেছেন। শুনে আবু জুনায়েদের মুখের হা-টা বড় হয়ে গেল। নুরুন্নাহার বানুর মুখে সহসা কোনো কথা জোগাল না। কেবল দীলু মন্তব্য করল,

–নানা আপনার দীলটা অনেক বড়।

–কত বড়, নাতনি বলো দেখি ।

–অনেক বড়, বঙ্গোপসাগরের মতো।

গরুর সেবা-যত্নের বিষয়ে কিঞ্চিৎ পরামর্শ দিলেন শেখ তবারক আলী। তিনি বললেন, গরুটিকে সব সময় না ঠাণ্ডা না গরম জায়গায় রাখতে হবে। শীতের দিনে কুসুম গরম পানি দিয়ে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে। আবার গরমের দিনে শীতল পানিতে গোসল করাতে হবে। কম্বল মশারি এসব তো অবশ্যই প্রয়োজন। দেশী ঘাসে গরুটির ভীষণ অরুচি। শেখ তবারক আলী লাইভ স্টক ডিপার্টমেন্টের খামার থেকে নিয়মিত ঘাস সরবরাহের একটা আপাত বন্দোবস্ত করেছেন। ওই জাতীয় ঘাস বাড়ির পেছনে চাষ করানো যায় কি না পরীক্ষা করিয়ে দেখবেন। গরমের দিন যখন আসবে, একটা এয়ারকুলার সেট করার ইচ্ছেও তার মাথায় আছে। আরো কতিপয় বিষয়েকঞ্চিৎ উপদেশ দিয়ে শেখ তবারক আলী উঠে দাঁড়ালেন। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও নুরুন্নাহার বানু, আবু জুনায়েদ, দীলু তাকে এক চায়ের অধিক কিছু খাওয়াতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *