১৩. অবিশ্বাস্য সংগঠক বিবেকানন্দ

অবিশ্বাস্য সংগঠক বিবেকানন্দ

তিরোধানের শতাব্দী অতিক্রম করেও স্বামীজি প্রবলভাবে বেঁচে রয়েছেন। অকালমৃত্যু তার জয়রথের গতি শ্লথ তো করতেই পারেনি, বরং নতুন শতকে যাঁদের হৃদয়সিংহাসনে তিনি রাজাধিরাজ রূপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তাদের সংখ্যা স্বদেশ এবং বিদেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

বলা অত্যুক্তি হবে না, একালের ইতিহাসে এমন বিজয়কাহিনি বিরল। কী এমন ছিল বিবেকানন্দের মধ্যে? কী এমন তিনি দিয়ে গেলেন মানুষকে, যে এমন অঘটন ঘটা সম্ভব হল? যাঁরা নতমস্তকে অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে হৃদয়ে গ্রহণ করেছেন, তারা নিজেরাও এ প্রশ্নের পূর্ণ উত্তর দিতে অক্ষম। তবে তারা বলেন স্বামীজির জীবনই যেমন তাঁর বাণী, তেমন তার বাণীও হয়ে উঠতে পারে নতুন এক ভারতবর্ষের জীবন। নিষ্ঠুর সময় আজও অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে সীমিত করতে পারেনি, বরং যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই তাঁর উপদেশ এবং আহ্বান আরও অর্থবহ এবং সময়োচিত হয়ে উঠছে। নতমস্তকে স্বীকার করে নেওয়া যাক, এ দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইদানীং আর ঘটেনি।

ইদানীং যারা বড় হয়ে উঠেছেন তারা যেন মনে না করে বসেন–স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন, দেখেছিলেন এবং মানুষকে জয় করেছিলেন। এই সেদিন কে যেন বলল, তার আবির্ভাব তো আকাশে, সেখান থেকেই বিদ্যুৎ ও বজ্রসম তিনি নেমে এলেন মাটির পৃথিবীতে, সুতরাং কে তাকে জীবনের যন্ত্রণা সম্পর্কে প্রশ্ন করবে? ব্যাপারটা অলৌকিক হলে মন্দ হত না। কিন্তু স্মরণে রাখা প্রয়োজন নিষ্ঠুর সমকাল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে অত সহজে ছেড়ে দেয়নি। আঘাতে, অপমানে, সন্দেহে এবং অবিশ্বাসে তিনি বারে বারে জর্জরিত হয়েছেন। নীলকণ্ঠের মতো সেই বিষ তিনি ধারণ করলেও, তার মনের কোথাও তা অস্বস্তিকর দাগ রেখে যায়নি, এ কথা জোর করে বলা চলে না। তার ব্যক্তিগত চিঠির কোথাও কোথাও সেই আহত এবং অপমানিত বিবেকানন্দকে আজও কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা দেখতে পাই।

কত রকমের সেই আঘাত! কখনও যে, ইস্কুলে তিনি পড়ান সেখানকার উচ্চশ্রেণীর ছাত্ররা প্রধান শিক্ষক নরেন্দ্রনাথ দত্তের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করছে তিনি পড়াতে পারছেন না, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলার আর এক মহাপুরুষ নির্দেশ দিচ্ছেন, নরেনকে আর পড়াতে না আসতে। কখনও বলা হচ্ছে, বখাটে ছোঁড়াটা গুরুজনদের তাচ্ছিল্য করে মনের সুখে তামাক খাচ্ছে, এবং নাকে নস্যি গুজছে। কখনও বলা হচ্ছে–চাকরি না পাওয়ায় বৈরাগ্য! স্বভাবসন্ন্যাসী তিনি অবশ্যই নন, সর্ব অর্থে অভাবসন্ন্যাসী। কখনও বিদেশের মাটিতে স্বদেশের মানুষ ঘরের ছেলেকে সাহায্য না করে কুৎসা প্রচার করছে বাউণ্ডুলে ভেঁপো ছোকরা, সে আবার ইংরেজি শিখল কবে?

খ্যাতির মধ্যগগনেও আপনজনদের হাতে বিবেকানন্দ-নিগ্রহ শেষ হয়নি, হিসেব চাওয়া হয়েছে, ক’বার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের নাম উচ্চারণ করেছ মার্কিন মুলুকে? প্রশ্ন করা হয়েছে, নিষিদ্ধ পানীয়, নিষিদ্ধ মাংস কি ভক্ষণ করেছ? বিস্মিত বিশ্ব সাষ্টাঙ্গে প্রণত হলেও, পেঁয়োযোগীর অগ্নিপরীক্ষা শেষ হতে চায় না। জন্মভূমি কলকাতায় যাঁরা বিবেকানন্দ অভিনন্দনসভার আয়োজন করেন তারাই লজ্জার মাথা খেয়ে খরচের বিলটা তুলে দিচ্ছেন বিশ্বজয়ীর হাতে। এই সেই দেশ, যেখানে তার মঠের বাড়ির ট্যাক্সো তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মৃত্যুর পরেও পুরসভা গড়িমসি করে বেলুড় মঠের গঙ্গাতীরে দাহকার্য সম্পন্ন করার অনুমতি দিতে।

মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার জন্য যাদের জন্ম, তাদের সব যন্ত্রণা ও লাঞ্ছনা দেহাবসানের সঙ্গে-সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না, তাই সন্ধ্যায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেও পরের দিন মহানগরীর সংবাদপত্রে স্বামী বিবেকানন্দের আকস্মিক অকালপ্রয়াণ সম্পর্কে কোনও খবর থাকে না, বিশ্ববিশ্রুত সন্তানের স্মরণসভার আয়োজন করতেও লম্বা সময় লেগে যায় এবং স্মৃতিসভায় প্রতিশ্রুতি-দেওয়া সামান্য আর্থিক দানের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত সংগৃহীত হয় না এবং আরও কত কী!

তবু কী আশ্চর্য! নিবিড় ঘন অন্ধকারে আকাশের বিদ্যুৎ ঝলকের মতন মহামানব বিবেকানন্দের বাণী আজও পৌঁছে যায় হতোদম মানুষের হৃদয়ে। নতুন করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তার অনেক বক্তব্যকে যা তার জীবিতকালে পরিপূর্ণ বোঝা যায়নি। যাঁরা খোঁজ করেন, তারা বুঝে নিয়েছেন, বিবেকানন্দকে ঠিকমতন বুঝতে আমাদের আরও এক হাজার বছর লেগে যাবে। হাজার বছরের হিসেবে হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে একজন বিবেকানন্দ এক জীবনে মানুষকে কী দিয়ে গেলেন?

কিন্তু একই সঙ্গে চলেছে উল্টোদিকের প্রবাহ! সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু কিছু সন্দেহবাদী স্বদেশবাসী নিজের দেশে বসে অথবা প্রবাসের দূরত্ব বজায় রেখে দুর্নামের ওভারটাইম খেটে চলেছেন, স্বভাবসন্ন্যাসীটি যে আসলে অভাবসন্ন্যাসী তা প্রমাণ করার জন্য। চোখে চশমা লাগিয়ে, অনেক মাথা খাঁটিয়ে, পুরনো খবরের কাগজ ঘেঁটে তারা প্রমাণ করবেনই, দুনিয়ার লোকরা একশ’ বছর ধরে মস্ত ভুল করে চলেছেন এমনভাবে বিবেকানন্দ বন্দনা চালু রেখে। এঁদের চেষ্টা, লোকের কানে কানে বলা, বিবেকানন্দ আবার মহাজ্ঞানী হলেন কবে? নরেন্দ্রনাথ ‘ইন্টেলিজেন্ট’ ছিলেন, কিন্তু কৃতী ছাত্র তো ছিলেন না, এফ এ এবং বি এ পরীক্ষায় সেকেন্ড ডিভিশন নম্বর কেন? কথামৃত মন দিয়ে পড়লেই নাকি নজর এড়ায় না যে, ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ নরেনকে বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিতেন, গান শুনে গদগদ হয়ে মন্দিরের ছোট ভাজ্যি বলে বসলেন, নরেন ধ্যানসিদ্ধ, নিত্যসিদ্ধ এবং ঈশ্বরকোটী। আরও একটি নিষ্ঠুর ইঙ্গিত, ঠাকুরের দেহাবসানের পর, বরাহনগরের যে কৃচ্ছসাধনা তার মূলে তার পারিবারিক অশান্তি এবং অর্থাভাব!

এতেও মন ভরছে না একাল ও সেকালের নিন্দুকদের। কেন বিবেকানন্দ বললেন, ভাল রাঁধতে না জানলে ভাল সাধু হওয়া যায় না? বিদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে স্বদেশে তার পরিব্রাজক জীবনটা এক ধরনের ‘হিচ হাইকিং’ ছাড়া কিছু নয়। এঁদের নিবেদন, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সম্ভ্রান্ত লোকরা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে দিতেন, সুতরাং কষ্ট কোথায়? কেন তিনি এত লঙ্কা খেতেন? উত্তর কলকাতার এই সুখী গ্র্যাজুয়েট ভদ্রলোকটি তো গরমের আতঙ্কে রাজপুতানায় আসতেই চাননি! ভক্তরা তাদের বইতে যতই তাকে মহাযোগী অ্যাখ্যা দিক, আসলে সংসারের আর্থিক হাঙ্গামা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই সন্ন্যাসীর নিশ্চিন্ত জীবনযাপন!

শুনুন আরও একটা অভিযোগ! স্বামীজি বিদেশে বললেন, ইংল্যান্ডের মাতালের সংখ্যার তুলনায় ভারতে মাতালের সংখ্যা অনেক কম! ওখানে চারশ’ জনে একজন, আর স্বদেশে দশ লাখে একজন! সঙ্গে সঙ্গে নিন্দুকদের পাল্টা আঘাত, বিবেকানন্দের সমকালীন কলকাতায় সব ‘ভদ্রলোকই তো মাতাল! ভারতীয়ত্বের যেসব গুণকীর্তন বিবেকানন্দ বিদেশে করেছেন সেসবই বাজে! বিবেকানন্দ কেন সমাজতন্ত্রের গুণগান করেছেন? এ নিয়ে বেজায় গোঁসা কিছু পণ্ডিতের! কোথাকার কোন রাশিয়ান বিবেকানন্দর এই সোশ্যালিজমকে আবছা এবং অস্পষ্ট বলায় তাঁদের বেজায় আনন্দ।

এহেন বিবেকানন্দ কী করে বিশ্ব বিজয় করলেন তা নিয়ে সন্দেহের অভাব নেই। প্রবাসে তিনি বক্তব্যের জন্য বিজয়ী হননি, সরলমনা বিদেশিনীদের মনোহরণ করেছিলেন তার শারীরিক সৌন্দর্য এবং বাচনভঙ্গি দিয়ে। তার শিকাগো বক্তৃতায় নাকি আধ্যাত্মিক নতুনত্ব একফোঁটাও ছিল না, বরং ভারত সম্বন্ধে অনেক অবান্তর এবং অবাস্তব দাবি ছিল, সেই জন্যেই শিকাগোতে হাততালি পড়েছিল, তবে একই সভায় আরও বেশি হাততালি পেয়েছিলেন কলকাতার আর এক বক্তা প্রতাপ মজুমদার! অর্থাৎ বক্তব্যের জন্য নয়, বলার স্টাইলের জন্যই শিকাগোয় শিহরন! সেইসময় বারবার এই ধরনের নানা অভিযোগে জর্জরিত হয়েছিলেন বিবেকানন্দ। নিগৃহীত হয়েছিলেন কয়েকজন স্বার্থান্ধ যাজকের হাতেও, এখন নিগৃহীত হচ্ছেন নিজের দেশের নিন্দুকদের হাতে। মৃত্যুর একশ বছর পরেও এঁদের দুঃখের শেষ হল না, কেন একজন সেকেন্ড ডিভিশন গ্র্যাজুয়েটকে নীলোৎপলনয়ন’ বাকপতি’ইত্যাদি বলা হয়েছিল?

সমকালের নিন্দুকরা কীভাবে বিবেকানন্দনিগ্রহে মেতেছিলেন পাঠক পাঠিকারা তার বিস্তারিত বিবরণ পাবেন নানা গবেষণাগ্রন্থে। মিশনারিদের দেওয়া মিথ্যা বদনামের কথা ভাবতে লজ্জা লাগে। বিবেকানন্দ নাকি দুশ্চরিত্র। সন্ন্যাসীর নিজের লেখা থেকে শুনুন : “কখনও কখনও এমন হয়েছে–আমাকে কোনও বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে দেখে কেউ আমার সম্বন্ধে মিথ্যা কুৎসা বাড়িওয়ালাকে শুনিয়ে দিয়েছে। তাই শুনে সে দোর বন্ধ করে চলে গিয়েছে, আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখি সব ভো ভো, কেউ নেই।”

প্রবীন প্রতাপ মজুমদার নিজের দেশে ফিরে এসে বলতে লাগলেন, “নরেন, সেই ছোঁড়াটা যে ভ্যাগাবন্ডের মতন পথে পথে ঘুরে বেড়াত, সে এক লম্বা জামা পরে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে চিকাগো পার্লামেন্টে ত গিয়ে হাজির।” বিদেশেও প্রতাপ মজুমদার বলতেন, “ছোকরা লেখাপড়া কিছুই জানে না। বোধহয় কোনও বিপদে পড়ে এখানে পালিয়ে এসেছে।”

দেশে ফিরেও বিবেকানন্দের কষ্ট ও অপমানের অবধি ছিল না। সুদূর আমেরিকায় সনাতন ভারতের হৃত গৌরব উদ্ধার করে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে এলেন, সেই সময় কয়েকজন ভক্তিমতী বিদেশিনী তার সঙ্গে ছিলেন। মুখে-মুখে সেই সময় তার ডাকনাম ছড়ায় বিবি কা-আনন্দ। সাধে কি আর তিনি এক চিঠিতে দুঃখ করেছেন, “এ দেশ হিংসুক নির্দয় লোকে ভর্তি–যারা আমার কাজ লণ্ডভণ্ড করে দিতে চেষ্টার কসুর করবে না।”

দেশে ফিরে এসে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ করতে গিয়ে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তার ইঙ্গিতও রয়েছে বিবেকানন্দের চিঠিতে।

উনিশ শতকে যে নিন্দাপ্রবাহের শুরু হয়েছিল একুশ শতকেও তার সম্পূর্ণ অবসান হয়েছে এমন ভাববেন না। সাধ্য থাকলে নিন্দুকেরা প্রমাণ করে দেন, যে-বিবেকানন্দ মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন তিনি তো অভিনেতা বিবেকানন্দ। তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তারা বিভিন্ন স্মৃতিকথার প্রতিটি লাইন আজও তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন!

শুধু অভিনয়ের অভিযোগ নয়, পাশ্চাত্যের ওপর তার প্রভাবে কতখানি দুধ এবং কতখানি জল তা নিয়ে মাপজোক চলেছে। কয়েকজন স্বার্থপর সায়েব সহজবোধ্য কারণে এই কাজ শুরু করেছিলেন এবং কিছু দেশবাসী সেই দায়িত্ব সানন্দে মাথায় তুলে নিয়েছেন। এঁদের নিবেদন, শিকাগোতে বিবেকানন্দের অভূতপূর্ব সাফল্যের একমাত্র কারণ তার সাদা সিল্কের পাগড়ি! বেনামে লেখা একখানা বইয়ের খোঁজও পাওয়া গিয়েছে, সেখানে বলা হচ্ছে, বিবেকানন্দের সাফল্যের অন্যতম কারণ সরল আমেরিকানদের প্রবল কৌতূহল। অভিনবত্ব দেখলেই মার্কিনরা নাকি ভীষণ আকৃষ্ট হয়, তথাকথিত সন্ন্যাসীর বেশে বিবেকানন্দই নাকি প্রথম ভারতীয়, যিনি আমেরিকায় হাজির হয়েছিলেন।

গরিবের জন্য যিনি সহস্রবার নরকে যেতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁকে বড়লোকের মোসাহেব হিসেবে আঁকবার চেষ্টাও হয়েছে। স্বামীজিকে যাঁরা কদর করেছিলেন তাঁদের অনেকেই যে ধনী তা মিশনারিরা বলেছেন। খবর দিয়েছেন, স্বামীজির অনুরাগীদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে ডেট্রয়েটের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী টমাস পামার এবং বিখ্যাত গুডইয়ার টায়ার কোম্পানির ওয়ালটার ও ফ্রস গুডইয়ার, নিউইয়র্কের ধনপতি ফ্রান্সিস লেগেট। সাহেব পাদ্রিদের, প্রচার : এইসব ধনবানদের হাতে ছিল প্রচুর সময় এবং প্রচুর অর্থ, প্রচলিত ধর্মাচরণে সাময়িকভাবে ক্লান্ত হয়ে এঁরা বিকল্প পথের সন্ধান করছিলেন।

সমস্ত তথ্য তন্নতন্ন করে খুঁজে, হন্যে হয়ে নিন্দাবিদরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেয়েছেন তা হল, প্রবাসে বিবেকানন্দর বাণীতে কোনও নতুনত্ব ছিল না, যতটুকু সাফল্য তার পিছনে রয়েছে মানুষটির ‘ক্যারিশমা’, বলবার স্টাইল এবং ভাষার ফুলঝুরি!

শক্ত মানুষ ছিলেন বিবেকানন্দ, ছিল দুর্জয় সাহস। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার লোক তিনি নন, তবু বারবার অন্যায় আঘাতে তিনি যে নীরবে কষ্ট পেয়েছেন, তার ইঙ্গিত রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। একবার বেলুড়ে বিবেকানন্দ বললেন, “ঠাকুরঘরে ঠাকুরের সামনে মার্বেল পাথরটায় জল দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে রেখে আয়, মোটে মুছবি না।” বিবেকানন্দ গিয়ে কপাট বন্ধ করে দিলেন, অনেকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বললেন, “দেখছিস না, চারদিকে কী হচ্ছে? সব শরীর জ্বলে যাচ্ছে, তাই আত্মারামের কাছে গড়াগড়ি দিচ্ছিলাম, ঠাণ্ডা হবো, সব শরীর জুড়াবো বলে।”

মৃত্যু এসে সাধারণ মানুষকে সব যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি দিয়ে থাকে। কিন্তু যাঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী, যাঁদের প্রকৃত বেঁচে থাকা শুরু হয় তিরোধানের মুহূর্ত থেকে, তারা আক্রমণের হাত থেকে কখনও মুক্তি পান না। তাদের কপালে যেমন অসংখ্য অনুরাগীর ভালবাসা ও ভক্তি জোটে, তেমনই জোটে অবিরাম, অপ্রত্যাশিত এবং অন্যায্য নিন্দা। যাঁরা শত্রু, যাঁদের তিনি জীবিত অবস্থায় আক্রমণ করতে চেয়েছেন, তাঁরা আক্রমণ করলে বিস্ময়ের বা বেদনার কিছু থাকে না, কিন্তু যাদের জন্য আত্মত্যাগ, যাদের জন্য নিজেকে তিলেতিলে বিসর্জন দেওয়া, তারা যখন অকারণে আঘাত করে তখন অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে, কেন এমন হয়? কেন আমরা বারে বারে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি?

বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর বইয়ের ফুটনোটে একজন বিদগ্ধ বিখ্যাত বাঙালির উল্লেখ করেছেন, যিনি বিবেকানন্দ স্মরণসভায় আসতে রাজি তো হননি, বরং বলেছে হিন্দু রাজত্ব হলে বিবেকানন্দের প্রাণদণ্ড হতো।

একজন দায়িত্বশীল বিচারক যদি এমন কথা বলতে পারেন, তাহলে ছোট মাপের লোকরা কেন বলবে না, সংসারে ত্যাগ নয়, সংসার থেকে তিনি পালিয়েছিলেন, পিতার মৃত্যুর পর তো তাঁর একখানা ভাঙা তক্তপোশ এবং একটা তুলো বার করা গদি ছাড়া কিছুই ছিল না।

বিবেকানন্দ জীবিত অবস্থায় অনেকের নিন্দাকে গায়ে মাখেননি। প্রকাশ্যেও কোনও মিথ্যা রটনার প্রতিবাদও তিনি পছন্দ করেননি।

সমস্ত ব্যাপারটার দিকে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ভালই হয়েছে। কারণ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর জীবন ও বাণীকে জানবার জন্য, তাঁকে অনুসরণ করবার জন্য আসমুদ্রহিমাচলে কী ব্যাকুলতা!

কেমন করে এই অসাধ্য সাধন হল? আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দের মধ্যে পাঁচটি বিবেকানন্দ উপস্থিত রয়েছে– শিক্ষক বিবেকানন্দ, নেতা বিবেকানন্দ, পরিত্রাতা বিবেকানন্দ, আধ্যাত্মিক বিবেকানন্দ ও সংগঠক বিবেকানন্দ। একইশরীরে এই পাঁচটি বিবেকানন্দের প্রকাশ ও বিকাশ কীভাবে সম্ভব হল, কেমনভাবে রোগজর্জরিত শরীরে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পাঁচটি বিবেকানন্দকে তিনি অপরূপ আলোকে উদ্ভাসিত করলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ আজও সম্পূর্ণ লিখিত হয়নি। অতি কঠিন এই কাজ এবং সেই জন্যেই বোধ হয় বিগত এক শতাব্দীতে কেউই বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার দুঃসাহসিক দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে সাহস করেননি।

যে পাঁচটি বিবেকানন্দের উল্লেখ করলাম, তার মধ্যে শেষ বিবেকানন্দটি আমার অতি প্রিয়। ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে শিক্ষক, নেতা, পরিত্রাতা এবং অধ্যাত্মবাদীদের সাক্ষাৎ পেলেও সংগঠক আমরা কমই দেখেছি। বরং ঊনিশ শতকের প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষদের অনেকেই সৃষ্টির আলোকে উদ্ভাসিত হয়েও সংগঠক হিসেবে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। মানুষ মরণশীল, তাই মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার বাসনায় মানুষ যুগে যুগে প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চেয়েছে কারণ, প্রতিষ্ঠানের মস্ত গুণ, স্থাপকের দেহাবসানের পরেও তার বিকাশ স্তব্ধ হয় না।

একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করা যায়, একই দশকের ব্যবধানে জন্মগ্রহণ করে এ দেশের চারজন মহাপুরুষ আশ্রমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাণদায়ী স্বপ্ন দেখেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীঅরবিন্দ এবং বিবেকানন্দকে আমরা প্রতিষ্ঠানিক সংগঠক হিসেবে দেখতে পাই–স্বপ্নের আশ্রমজীবনকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এঁদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। কিন্তু একশ’ বছরের মধ্যে গান্ধীর সবরমতী আশ্রম মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। পন্ডিচেরিতেও আদিযুগের সেই প্রাণবন্ত রূপ আজ বোধ হয় তেমন নেই, তার শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবন, সে তো ইতিহাসের পাতায় নিরাপদ আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুট দিয়েছে। এঁদের প্রতিষ্ঠাতারা সকলেই তাদের নিজস্ব ব্যমিহিমায় এবং সৃষ্টিমহিমায় এখনও বিশ্ববন্দিত হচ্ছেন, কিন্তু সংগঠক হিসেবে তারা কিছুটা হার মেনেছেন বললে বোধহয় সত্যের অপলাপ করা হবে না। অন্য তিনজনের তুলনায় বিবেকানন্দ তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘকে সবচেয়ে কম সময় দিতে পেরেছেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিতান্ত শৈশবকালেই তিনি ইহলীলা সংবরণ করেছেন, কিন্তু শতবর্ষের দূরত্বেও একটি প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ক্রমাগত বিস্তার অব্যাহত। আজও ভারতমাতা প্রতি বছর এই সংঘকে শতাধিক সন্ন্যাসীসন্তান উপহার দিয়ে চলেছেন।

এই আশ্চর্য ব্যাপারটি নিতান্ত দৈবিক নয়, সংগঠক বিবেকানন্দ আগামী সহস্র বৎসরের ছক কষে দিয়ে গিয়েছেন। প্রেমের সঙ্গে নিয়মের, নীতির এবং নিষ্ঠার যে মেলবন্ধনের ব্যবস্থা বিবেকানন্দ নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে করে গিয়েছেন, তা কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মতন প্রাণশক্তি দেখিয়েছে। এইখানেই সংগঠক বিবেকানন্দের অবিশ্বাস্য সাফল্য।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাংগঠনিক প্রাণশক্তির উৎস কোথায় তা আজও ম্যানেজমেন্ট বিজ্ঞানীদের নিয়মিত অনুসন্ধানের হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এ কথা সত্য যে, বিবেকানন্দ কল্পিত এবং প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ মিশনকে একটি ম্যানেজমেন্ট বিস্ময় বললে অত্যুক্তি করা হবে না। নিজের মোক্ষ, জগতের মঙ্গল এবং একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানিক নিয়মের শৃঙ্খলা–তিনটি আপাত বিপরীতধর্মী শক্তির সমন্বয় যে অসম্ভব নয়, তা সংগঠক বিবেকানন্দ দেখিয়ে গিয়েছেন।

সংগঠক বিবেকানন্দ যে তাঁর দূরদৃষ্টিতে অনাগতকালকে চোখের সামনে দেখতে পেতেন তার প্রমাণ ভূরিভূরি রয়েছে। ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে আলমবাজারে বসে তরুণ সন্ন্যাসীদের বিবেকানন্দ বলেছিলেন–”দেখ এইসব নিয়ম হচ্ছে বটে, কিন্তু প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে এগুলি করার মূল লক্ষ্য কী? আমাদের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে–সব নিয়মের বাইরে যাওয়া।” কোনও প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘদিন প্রাণবন্ত রাখার পক্ষে এটা যে কত বড় কথা তা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাংবিধানিকরা এখন ভালভাবেই জানেন।

নিয়ম লেখানো শেষ করে স্বামীজি বলেছিলেন, “দেখিস যদি কোনও নিয়মটা নেতিবাচকভাবে লেখা হয়ে থাকে, সেটাকে ইতিবাচক করে দিবি।” এটাও মস্ত কথা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংগঠকদের সাফল্যের চাবিকাঠিটা রয়েছে মহামূল্যবান এই বক্তব্যের মধ্যে।

নিয়মকানুন বিদেশিভাবে তৈরি হচ্ছে, এই অভিযোগ শুনে বিবেকানন্দ তার গুরু ভাই স্বামী যোগানন্দকে বলেছিলেন, “সম্প্রদায়পূর্ণ জগতে আর একটি নতুন সম্প্রদায় তৈরি করে যেতে আমার জন্ম হয়নি। প্রভুর পদতলে আশ্রয় পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি। ত্রিজগতের লোককে তার ভাবসমূহ দিতেই আমাদের জন্ম।”

বহুজনের হিত, বহুজনের সুখের স্বপ্ন বুকে রেখেও কত সংগঠন শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব রক্ষায় অসমর্থ হয়েছে। সংগঠক বিবেকানন্দের মনের মধ্যে বহু চিন্তা একই সঙ্গে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। একবার তিনি বলেছিলেন, “আমি তো পত্তন মাত্র করে দিচ্ছি–এরপরও আরও কত কী হবে। আমি কতক করে যাব, আর তোদের মধ্যে নানা আইডিয়া দিয়ে যাব, তোরা পরে সেসব কাজে পরিণত করবি। বড় বড় নীতি কেবল শুনলে কী হবে। সেগুলিকে কর্মক্ষেত্রে দাঁড় করাতে–প্রতিনিয়ত কাজে লাগাতে হবে।”

প্র্যাকটিক্যাল বিবেকানন্দ তার গুরুদেবের নামাঙ্কিত সংঘ পরিচালনার জন্য অনেক প্র্যাকটিক্যাল নিয়মকানুনও সুনিশ্চিত করে গিয়েছেন। অর্থই অনর্থের মূল–অতএব সন্ন্যাসীসকেও পাইপয়সার হিসেব নিষ্ঠার সঙ্গে রাখতে হবে, সেই হিসেব নিয়মিত অডিট করাতে হবে এবং শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ করা চলবে না। সেইসঙ্গে নিতান্ত সহজভাবে বিবেকানন্দ বলেছেন, “বিদ্যার অভাবে সম্প্রদায় নীচদশাপ্রাপ্ত হয়, অতএব সর্বদা বিদ্যার চর্চা থাকবে। ত্যাগ ও তপস্যার অভাবে বিলাসিতা সম্প্রদায়কে গ্রাস করে, অবএব ত্যাগ ও তপস্যার ভাব সর্বদা উজ্জ্বল রাখতে হবে।”

সংগঠক বিবেকানন্দ যে তার সমকাল থেকে বহুযোজন এগিয়েছিলেন তা বোঝা যায় তার প্রতিষ্ঠিত সংঘের আর একটি নিয়মে–”কোনও দেশেই আধ্যাত্মিক ভাব মাত্রেরই প্রয়োজন। কোনও দেশে ইহজীবনের কিঞ্চিৎ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অতীব প্রয়োজন। এই প্রকার যে জাতিতে বা যে ব্যক্তিতে যে অভাব অত্যন্ত প্রবল, তাহা পূর্ণ করিয়া সেই পথ দিয়া তাহাকে লইয়া যাইতে হবে।”

সংগঠক বিবেকানন্দ আরও বলে গেলেন, “এই সংঘই তাঁহার অঙ্গ স্বরূপ এবং এই সংঘেই তিনি সদাবিরাজিত। একীভূত সংঘ যে আদেশ করেন তাহাই প্রভুর আদেশ, সংঘকে যিনি পূজা করেন তিনি প্রভুকে পূজা করেন এবং সংঘকে যিনি অমান্য করেন তিনি প্রভুকে অমান্য করেন।”

একবার এক ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ আমাকে বলেছিলেন, “এত দুর্যোগের মধ্যেও বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠমিশন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে কীভাবে বেঁচে রইল এবং এমনভাবে বিস্তারিত হল তা অনুসন্ধান করা উচিত। ঠিক মতন খুঁজলে দেখা যাবে, একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী সংগঠকই এ দেশের শ্রেষ্ঠতম ম্যানেজমেন্ট বিশারদ। বুদ্ধ, শংকরাচার্য ও বিবেকানন্দকে না বুঝলে এ দেশে ম্যানেজমেন্ট-চর্চার কোনও মানেই হয় না।”

আমিও একসময়ে সন্ধান করেছি সেই মন্তব্যটির যা একটি বাক্যের মধ্যে বিবেকানন্দের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যকে বুঝিয়ে দেবে।

অবশেষে সেই বর্ণনাটি খুঁজে পেয়েছি ১৯৩২ সালের ইংরিজি প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকায়। “ত্যাগে বেপরোয়া, কর্মে অফুরন্ত, প্রেমে সীমাহীন, ইমোশনে উচ্ছল, আক্রমণে নির্দয়, অথচ জ্ঞানে গভীর এবং বহুমুখী, অথচ সরলতায় শিশুর মতন–এই হলেন বিবেকানন্দ।” যিনি এই বাক্যটি রচনা করেছিলেন তাঁকেও আমরা চিনি, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *