০৯. বিড়ম্বিত বিবেকানন্দ

০৯. বিড়ম্বিত বিবেকানন্দ

মহামানবের আবির্ভাব সময়ে সুরলোক থেকে জয়শঙ্খ বেজে ওঠে এমন কথা কবি শাস্ত্রকাররা সেই কবে থেকে আমাদের জানিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের ঊনচল্লিশ বছরের সীমিত জীবনকালে যে বিরামহীন বিড়ম্বনার স্রোত লক্ষ করা যায় তাতে মনে হয় আমাদের এই হতভাগ্য দেশে মানুষের পরম পূজ্যগণ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দুঃখের অবতার। দেহাবসানের পরে আমরা বিবেকানন্দকে প্রজ্বলিত সূর্যের সঙ্গে তুলনা করি, নগরে-নগরে সুসজ্জিত সভাগারে তাঁর কীর্তিকাহিনী ঘোষিত হয়, কিন্তু জীবকালে সমকালের মানুষের কাছে তিনি কি পেয়েছেন তার পূর্ণ বৃত্তান্ত একত্রিত করলে লজ্জায় অধোবদন হতে হয়।

মহাজীবনের স্মৃতিপ্রসঙ্গে মহাকাল কোনো অজ্ঞাত কারণে অনেক কিছু ভুলিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা হয়ে যায়, ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য হয়ে যাঁরা মর্তে আগমন করেন তারা বুঝি দুন্দুভি বাজিয়ে নেমে আসেন, তারা দেখেন এবং জয় করেন এবং সারা বিশ্ব নতমস্তকে তাদের বন্দনা করে ধন্য হতে চায়।

স্বামী বিবেকানন্দর ঊনচল্লিশ বছরের জীবন বড়ই যন্ত্রণাদায়ক– প্রজ্বলিত অঙ্গারের মতন তিনি তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে কেমন করে সময়ের শাসন পেরিয়ে পরবর্তীকালে ভক্তজনের হৃদয়ে প্রজ্বলিত সূর্যের রূপ গ্রহণ করলেন তার পূর্ণ ইতিহাস একদিন নিশ্চয় লিখিত হবে, কিন্তু অস্বীকার করে লাভ নেই, সেই বৃত্তান্ত আজও লিপিবদ্ধ হবার অপেক্ষায় রয়েছে।

একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলে এবং স্বামীজির জীবনের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলে বিস্মিত হতে হয়। সমকাল কতভাবে মানুষটিকে শুধু অবহেলা ও অপমানে জর্জরিত নয়, ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টাও চালিয়েছে। এই বিড়ম্বনায় বিবেকানন্দ নিজে মাঝে মাঝে বিপন্ন বোধ করলেও, প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে তিনি কীভাবে পুরুষোত্তম হয়ে উঠলেন এবং বিশ্বসংসারকে তার যা দেবার তা দিয়ে গেলেন ভাবতে বিস্ময় লাগে। অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অপমান ছাড়াও তার জীবনে রয়েছে কত রকমের কুৎসা, কত চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র, কত আঘাত যার সুপরিকল্পিত আঘাতে একজন সংবেদনশীল মানুষের তীর্থযাত্রা চিরক্ত হয়ে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক হত না।

দুর্গমপথের যাত্রী বিবেকানন্দ বিড়ম্বিত হয়েও কেন পরাজিত বিবেকানন্দ হতে রাজি হলেন না? কোন মহাশক্তিবলে উন্নতশির বিবেকানন্দ রূপেই তার মর্তজীবন সাঙ্গ করতে সক্ষম হলেন, তার অনুসন্ধান একাল ও অনাগতকালের মানুষদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়।

বিড়ম্বিত বিবেকানন্দের এই অনুসন্ধান শুরু করার আগে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলাম, এমন ভাবপ্রবণ মানুষ সারাজীবন ধরে কেমন করে এত অপবাদের আঘাত সহ্য করতে সমর্থ হলেন? এই সহ্যশক্তি তিনি কোথা থেকে আহরণ করলেন?

একমাত্র সন্ন্যাসের অধ্যাত্মশক্তি তাকে দুর্গমপথে অটল রাখতে পেরেছে বলাটা বোধ হয় সমীচীন হবেনা, কারণ অধ্যাত্মপথের যাত্রী হবার অনেক আগে থেকেই তার কপালে জুটতে আরম্ভ করেছেনানাবিধ আঘাত এবং অপমান।

বাল্যবয়সে নরেন্দ্রনাথ একবার তার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সংসারে কীভাবে চলা উচিত? পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত যে-উত্তরটি দিয়েছিলেন তা পুত্র যে সারা জীবন মনে রেখেছিলেন তার অনেক প্রমাণ ঘরে বাইরে এবং দেশে বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রিয় পুত্রকে বিশ্বনাথ বলেছিলেন, “কখনও কোনো বিষয়ে অবাক হবি না।” অনুসন্ধানীরা এই পিতৃ উপদেশের নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হয় প্রত্যাশিত এবং অপ্রত্যাশিত সূত্র থেকে আঘাত-অপমান মানুষকে আহত করতে পারে মানসিক এই হুঁশিয়ারি নরেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তাঁর পিতৃদেবের কাছ থেকে।

অতি মূল্যবান দ্বিতীয় উপদেশটি এসেছিল গর্ভধারিণী জননী ভূবনেশ্বরী দেবীর কাছ থেকে। প্রিয় নরেন্দ্রনাথকে তিনি বলেছিলেন, “খুব শান্ত হবে, কিন্তু আবশ্যক হলে হৃদয় দৃঢ় করবে।” জননী ভূবনেশ্বরী সেই সঙ্গে আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন, “আজীবন পবিত্র থাকবে, নিজের মর্যাদা রক্ষা করবে এবং কখনও অপরের মর্যাদা লঙ্ঘন করবে না।” মায়ের এই নির্দেশ যে তিনি কোনো অবস্থাতেই অমান্য করতে রাজি ছিলেন না তার নানা প্রমাণও বিড়ম্বিত বিবেকানন্দর জীবনে খুঁজে পেতে পারেন যে কেউ।

আজীবন বিড়ম্বিত হওয়ার যে দুঃখ তার শুরু নরেনের স্কুলজীবনে। এই স্কুলটি যে বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত সুকিয়া স্ট্রিটের মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন তা আজ কারও অজানা নয়। এই ইস্কুলের শিক্ষক পড়াচ্ছিলেন ভূগোল, তার হঠাৎ ধারণা হল নরেন ভুল করেছে, অতএব অবিলম্বে দৈহিক শাস্তি দিলেন। নরেন বারবার বলতে থাকেন, আমার ভুল হয়নি, আমি ঠিকই বলেছি, তাতে শিক্ষকের ক্রোধ গেল আরও বেড়ে, তিনি বালক নরেন্দ্রকে নির্দয়ভাবে বেত্রাঘাত শুরু করলেন।

“জর্জরিত দেহে নরেন্দ্রনাথ গৃহে ফিরিয়া অশ্রুলোচনে মাতার নিকট এই ঘটনা বিবৃত করিলে স্নেহময়ী ভূবনেশ্বরী…বিগলিতকণ্ঠে বলিলেন, বাছা যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে এতে কি আসে যায়? ফল যাই হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে, তাই করে যাবে। অনেক সময় হয়তো এর জন্য অন্যায় বা অপ্রীতিকর ফল সহ্য করতে হবে, কিন্তু সত্য কখনো ছাড়বে না।”

শোনা যায় এই শিক্ষক পরে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু শুনুন একই স্কুলের আরেক মাস্টারের কথা। এই রাগী শিক্ষক একজন ছাত্রকে মারতে মারতে হঠাৎ নরেনের ওপর চটে উঠলেন এবং তাকেও প্রহার করতে লাগলেন। শিক্ষক ক্রমশই প্রহারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে দু হাতে কান মলতে লাগলেন, পরে কান ধরে উঁচু করে তাঁকে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তর মূল্যবান স্মৃতি অনুযায়ী : “মাস্টার এত জোরে কান ধরিয়া টানিয়াছিল যে শিশুর কান ছিঁড়িয়া গিয়াছিল এবং রক্তে চাপকান ইজের ভিজিয়া গিয়াছিল।…নরেন্দ্রনাথ বাড়িতে ফিরিয়া আসিলে খুব একটা হৈ চৈ পড়িল। বিশ্বনাথ দত্ত ও তারকনাথ (কাকা) মাস্টারকে উকিলের চিঠি দিয়া আদালতে আনিয়া শাস্তি দিবেন…এই রূপ স্থির করিলেন। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ নিজে মধ্যস্থ হইয়া নালিশ মকদ্দমা রহিত করিল এবং পরদিন যথাসময়ে স্কুলে যাইল। এই শাস্তির কথা বিদ্যাসাগরের কানে গেলে তিনি ছেলেদের মারিবার প্রথা উঠাইয়া দিলেন।

নিজের বেলায় কোনো লড়াইয়ে না নামলেও, ভাই মহেন্দ্রনাথ একবার স্কুলে অকারণে শাস্তি পাওয়ায় নরেন্দ্রনাথ কিন্তু জ্বলে উঠেছিলেন। মহেন্দ্রনাথের কথায় : “প্রকৃতপক্ষে আমি কোন দোষ করি নাই বা দোষের কারণ জানিতাম না। বাড়িতে আসিয়া এই বিষয়ে বলায় নরেন্দ্রনাথ তখনই সুপারিন্টেন্ডেন্ট শ্রী ব্রজনাথ দে মহাশয়কে শিক্ষকের বিরুদ্ধে চিঠি লিখিয়া দিয়াছিলেন, ফলে নূতন শিক্ষকটির চাকুরি হইতে জবাব হইয়া গিয়াছিল।”

ইস্কুলে শুধু ছাত্র হিসেবে নয়, পরবর্তী জীবনে শিক্ষক হিসেবেও আমাদের বিবেকানন্দ যে চূড়ান্ত অপমানের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার কথা এখনই সেরে নেওয়া যাক।

বিশ্বনাথের আকস্মিক মৃত্যুর পরে পিতার ডুবন্ত সংসারকে রক্ষা করার জন্য নরেন্দ্রনাথ অফিস পাড়ায় চাকরি খুঁজছেন হন্যে হয়ে। সেকালের কলকাতাতেও সাধারণ চাকরির কী শোচনীয় অবস্থা তার একটি প্রমাণ উমেদার নরেন্দ্রনাথের ব্যর্থ কর্মর্সন্ধান। কত অফিসে কতবার তিনি আবেদনপত্র হাতে নিয়ে বিফল হয়ে ফিরে এসেছেন, সামান্য একজন কেরানির কাজের যোগ্যতাও যে নিয়োগকর্তারা তার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন না তা ভাবলে আমাদের নিজের কালের দুঃসহ বেকার সমস্যাকে বুঝতে কষ্ট হয় না।

অবশেষে ১৮৮৪ সালের কোনো সময়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের রচয়িতা হেডমাস্টার শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তর চেষ্টায় সুকিয়া স্ট্রিটের মেট্রোপলিটান ইস্কুলের মেন ব্রাঞ্চে নরেন্দ্রনাথের কাজ জোটে কয়েকমাসের জন্যে। পরে (জুন ১৮৮৬) চাঁপাতলায় সিদ্ধেশ্বর চন্দ্র লেনে ইস্কুলের নতুন শাখা খোলার পরে তাঁকে সেখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হল।

শুনুন পরের ঘটনা স্বামী গম্ভীরানন্দের লেখা থেকে : “তিনি ঐ কার্যে মাত্র একমাস ছিলেন, কারণ শ্ৰীম-দর্শনের মতে ঐ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাতা। তিনি চাহিতেন যে হেডমাস্টার তাহার কথামতো চলেন। কিন্তু নরেন্দ্রনাথের প্রকৃতি ছিল অন্যরূপ।”

সুতরাং উচ্চতম দুই শ্রেণীর ছাত্রদের দ্বারা বিদ্যাসাগরের নিকট লিখিত অভিযোগ গেলনতুন হেডমাস্টার পড়াতে পারেন না। তখন বিদ্যাসাগর বললেন, তাহলে নরেন্দ্রনাথকে বললা–আর না আসে।”

শ্ৰীম-দর্শন থেকেই শুনুন : “ফার্স্ট ও সেকেন্ড ক্লাশের ছেলেরা লিখল তিনি ভাল পড়াতে পারেন না। বিদ্যেসাগরমশায় আমাকে (শ্রীমকে) বললেন, তাহলে নরেন্দ্রকে বলো আর না আসে। দরকার হবে না। এই কথা শুনে আমাদের মাথা ঘুরে গেল।”

বিবরণ পড়ে আজও সারা বিশ্বে পাঠকের মাথা ঘোরে, বিশ্বসংসারকে শিক্ষা দেবার জন্য যাঁর অবিস্মরণীয় আবির্ভাব তিনি তাঁর ছাত্রদের এবং স্কুলের মালিকদের হাতে নিগৃহীত হলেন চরমতম অভিযোগে মানবজাতির শিক্ষক বিবেকানন্দ রূপে যিনি কিছুদিনের মধ্যে সারা বিশ্বের বিস্ময় হতে চলেছেন তিনি চাপাতলা স্কুলে শিক্ষকতার অযোগ্য!

কথামৃত কথাকার শ্রীম’র স্মৃতির আলোকে আরও কিছু খবর : “যদি বা বহুকষ্টে একটি কর্ম যোগাড় হল, একি বিপদ আবার উপস্থিত!নরেন্দ্রকে বললাম। এই কথা শুনে নরেন্দ্র বলেছিলেন, কেন ঐরূপ বললে ছেলেরা? আমি তো বাড়ি থেকে খুব তৈরি হয়ে গিয়ে পড়াতাম। আর কিছু বললেন না। না আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন, না অপরকে দোষারোপ করলেন। কোনও কৈফিয়ৎ দিলেন না। তাও অতি শান্তভাবে বললেন এই কথা। নোব্‌ল সোল–মহাপুরুষ।”

সেই সময়ের কলকাতার নিয়োগকর্তারা কর্মহীন বিবেকানন্দর সঙ্গে কী ব্যবহার করেছিলেন তা ভাবলে আজও মাথা নত হয়ে যায়।

শ্রীম’র স্মৃতিসঞ্চয় থেকে আরও একটু উদ্ধৃতি প্রয়োজন : “আর একবার চাকরির জন্যে সিমলের বাড়ি থেকে বৌবাজারের মোড় পর্যন্ত গেলেন একজনের পিছু পিছু, তারপর বললেন, না আপনাকে আর যেতে হবে না। নোব্‌ল সোল, উমেদারীতে যেতে রাজি নন! উপবাসী নরেন্দ্রনাথ কত রাত কলকাতার রাস্তার পাশের বাড়ির বোয়াকে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন ঐ সময়। অত সব দুঃখকষ্ট নিজের জীবনে দেখেছেন, তবেই পরবর্তীকালে সেবাশ্রমগুলি করেছেন। তাই চিরকাল দরিদ্রের উপর দয়াবান ছিলেন। আমেরিকা থেকে আসার পর প্রায়ই বলতেন, যারা দুঃখকষ্টে পড়েনি তারা যে ‘বেবি।”

পিতার দেহাবসানের পরে জীবিকাসন্ধানী নরেন্দ্রনাথের জীবন সম্বন্ধে আমাদের শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছেন স্বামী সারদানন্দ। সারদানন্দের বর্ণনা থেকে উদ্ধৃতির আগে বলে রাখি, এই বিবরণকে বিশ্বাস করতে সময় লাগতো যদি না সন্ন্যাসী গবেষক লিখতেন, “এই কালের আলোচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে বলিয়াছেন।” নরেন্দ্রনাথের এই আত্মকথায় বিড়ম্বিত মানুষটিকে ঠিক যেন চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। বহুপঠিত হলেও, এই আত্মকথার কিছু অংশ আমাদের বর্তমান অনুসন্ধানের পক্ষে অপরিহার্য।

“মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে আফিস হইতে আফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম–অন্তরঙ্গ বন্ধুগণের কেহ কেহ দুঃখের দুঃখী হইয়া কোনো দিন সঙ্গে থাকিত, কোনো দিন থাকিতে পারিত না, কিন্তু সর্বত্রই বিফলমনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত এই প্রথম পরিচয়েই বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুই দিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোনো বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে। এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া কখন কখন সংসারটা দানবের রচনা বলিয়া মনে হইত। মনে হয়, এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই-একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল, অথবা ঘটনাক্রমে ঐ স্থানে আমার সহিত মিলিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে একজন বোধ হয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল—’বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে’ ইত্যাদি।

“শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় যেন সে গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাগণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হইয়া ক্ষোভে, নিরাশায়, অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, ‘নে, নে, চুপ কর, ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব যাহাদিগকে কখন সহ্য করিতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকটে ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে, আমারও একদিন লাগিত; কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।

“আমার ঐরূপ কথায় উক্ত বন্ধু বোধ হয় নিতান্ত ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল–দারিদ্র্যের কিরূপ কঠোর পেষণে মুখ হইতে ঐ কথা নির্গত হইয়াছিল তাহা সে বুঝিবে কেমনে! প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম গৃহে সকলের প্রচুর আহার্য নাই এবং হাতে পয়সা নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে’ বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনো দিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনো দিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে, ঘরে বাহিরে কাহারও নিকটে ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না। ধনী বন্ধুগণের অনেকে পূর্বের ন্যায় আমাকে তাহাদিগের গৃহে বা উদ্যানে লইয়া যাইয়া সঙ্গীতাদি দ্বারা তাহাদিগের আনন্দবর্ধনে অনুরোধ করিত। এড়াইতে না পারিয়া মধ্যে মধ্যে তাহাদিগের সহিত গমনপূর্বক তাহাদিগের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইতাম, কিন্তু অন্তরের কথা তাহাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে প্রবৃত্তি হইত না–তাহারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয় জানিতে কখনও সচেষ্ট হয় নাই। তাহাদিগের মধ্যে বিরল দুই একজন কখনও কখনও বলিত, তোকে আজ এত বিষণ্ণ ও দুর্বল দেখিতেছি কেন, বল্ দেখি?’ একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্ৰমধ্যে মাতাকে সময়ে সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।

“যৌবনে পদার্পণপূর্বক যে-সকল বাল্যবন্ধু চরিত্রহীন হইয়া অসদুপায়ে যৎসামান্য উপার্জন করিতেছিল, তাহাদিগের কেহ কেহ আমার দারিদ্র্যের কথা জানিতে পারিয়া সময় বুঝিয়া দলে টানিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা ইতিপূর্বে আমার ন্যায় অবস্থার পরিবর্তনে সহসা পতিত হইয়া একরূপ বাধ্য হইয়াই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য হীন পথ অবলম্বন করিয়াছিল, দেখিতাম তাহারা সত্য সত্যই আমার জন্য ব্যথিত হইয়াছে। সময় বুঝিয়া অবিদ্যারূপিণী মহামায়াও এই কালে পশ্চাতে লাগিতে ছাড়েন নাই।

“এক সঙ্গতিপন্না রমণীর পূর্ব হইতে আমার উপর নজর পড়িয়াছিল। অবসর বুঝিয়া সে এখন প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল, তাহার সহিত তাহার সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া দারিদ্রদুঃখের অবসান করিতে পারি! বিষম অবজ্ঞা ও কঠোরতা প্রদর্শনে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে হইয়াছিল। অন্য এক রমণী ঐরূপ প্রলোভিত করিতে আসিলে তাহাকে বলিয়াছিলাম, বাছা, এই ছাই ভস্ম শরীরটার তৃপ্তির জন্য এতদিন কত কি তো করিলে, মৃত্যু সম্মুখে–তখনকার সম্বল কিছু করিয়াছ কি? হীন বুদ্ধি ছাড়িয়া ভগবানকে ডাক।

“যাহা হউক এত দুঃখকষ্টেও এতদিন আস্তিক্যবুদ্ধির বিলোপ অথবা ‘ঈশ্বর মঙ্গলময়’–একথায় সন্দিহান হই নাই। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে তাহাকে স্মরণ-মননপূর্বক তাহার নাম করিতে করিতে শয্যা ত্যাগ করিতাম এবং আশায় বুক বাঁধিয়া উপার্জনের উপায় অন্বেষণে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। একদিন ঐরূপে শয্যা ত্যাগ করিতেছি এমন সময়ে পার্শ্বের ঘর হইতে মাতা শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, চুপ কর ছোঁড়া, ছেলেবেলা থেকে কেবল ভগবান ভগবান-ভগবান তো সব করলেন!

“কথাগুলিতে মনে বিষম আঘাত প্রাপ্ত হইলাম। স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ভগবান কি বাস্তবিক আছেন, এবং থাকিলেও মানবের সকরুণ প্রার্থনা কি শুনিয়া থাকেন? তবে এত যে প্রার্থনা করি তাহার কোনরূপ উত্তর নাই কেন? শিবের সংসারে এত অ-শিব কোথা হইতে আসিল– মঙ্গলময়ের রাজত্বে এতপ্রকার অমঙ্গল কেন?

“বিদ্যাসাগর মহাশয় পরদুঃখে কাতর হইয়া এক সময় যাহা বলিয়াছিলেন–ভগবান যদি দয়াময় ও মঙ্গলময়, তবে দুর্ভিক্ষের করাল কবলে পতিত হইয়া লাখ লাখ লোক দুটি অন্ন না পাইয়া মরে কেন?–তাহা কঠোর ব্যঙ্গস্বরে কর্ণে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঈশ্বরের প্রতি প্রচণ্ড অভিমানে হৃদয় পূর্ণ হইল, অবসর বুঝিয়া সন্দেহ আসিয়া অন্তর অধিকার করিল।

“গোপনে কোন কার্যের অনুষ্ঠান করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। বাল্যকাল হইতে কখন ঐরূপ করা দূরে থাকুক, অন্তরের চিন্তাটি পর্যন্ত ভয়ে বা অন্য কোন কারণে কাহারও নিকটে কখনও লুকাইবার অভ্যাস করি নাই। সুতরাং ঈশ্বর নাই, অথবা যদি থাকেন তো তাঁহাকে ডাকিবার কোন সফলতা এবং প্রয়োজন নাই, একথা হাঁকিয়া-ডাকিয়া লোকের নিকটে সপ্রমাণ করিতে এখন অগ্রসর হইব, ইহাতে বিচিত্র কি?

“ফলে স্বল্প দিনেই রব উঠিল, আমি নাস্তিক হইয়াছি এবং দুশ্চরিত্র লোকের সহিত মিলিত হইয়া মদ্যপানে ও বেশ্যালয়ে পর্যন্ত গমনে কুণ্ঠিত নহি! সঙ্গে সঙ্গে আমারও আবাল্য অনাশ্রব হৃদয় অযথা নিন্দায় কঠিন হইয়া উঠিল এবং কেহ জিজ্ঞাসা না করিলেও সকলের নিকটে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, এই দুঃখ-কষ্টের সংসারে নিজ দুরদৃষ্টের কথা কিছুক্ষণ ভুলিয়া থাকিবার জন্য যদি কেহ মদ্যপান করে, অথবা বেশ্যাগৃহে গমন করিয়া আপনাকে সুখী জ্ঞান করে, তাহাতে আমার যে বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই তাহাই নহে, কিন্তু ঐরূপ করিয়া আমিও তাহাদিগের ন্যায় ক্ষণিক সুখভোগী হইতে পারি–একথা যেদিন নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিব সেদিন আমিও ঐরূপ করিব, কাহারও ভয়ে পশ্চাৎপদ হইব না।

“কথা কানে হাঁটে। আমার ঐসকল কথা নানারূপে বিকৃত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে এবং তাহার কলিকাতাস্থ ভক্তগণের কাছে পৌঁছিতে বিলম্ব হইল না। কেহ কেহ আমার স্বরূপ অবস্থা নির্ণয় করিতে দেখা করিতে আসিলেন এবং যাহা রটিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ না হইলেও কতকটা তাঁহারা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত, ইঙ্গিতে-ইশারায় জানাইলেন।

“আমাকে তাঁহারা এতদূর হীন ভাবিতে পারেন জানিয়া আমিও দারুণ অভিমানে স্ফীত হইয়া দণ্ড পাইবার ভয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস করা বিষম দুর্বলতা, একথা প্রতিপন্নপূর্বক হিউম, বেন, মিল, কোতে প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিক সকলের মতামত উদ্ধৃত করিয়া ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ নাই বলিয়া তাঁহাদিগের সহিত প্রচণ্ড তর্ক জুড়িয়া দিলাম। ফলে বুঝিতে পারিলাম আমার অধঃপতন হইয়াছে, একথায় বিশ্বাস দৃঢ়তর করিয়া তাঁহারা বিদায়গ্রহণ করিলেন বুঝিয়া আনন্দিত হইলাম এবং ভাবিলাম ঠাকুরও হয়তো ইহাদের মুখে শুনিয়া এরূপ বিশ্বাস করিবেন। ঐরূপ ভাবিবামাত্র আবার নিদারুণ অভিমানে অন্তর পূর্ণ হইল।

“স্থির করিলাম, তা করুন–মানুষের ভালমন্দ মতামতের যখন এতই অল্প মূল্য, তখন তাহাতে আসে যায় কি? পরে শুনিয়া স্তম্ভিত হইলাম, ঠাকুর তাহাদিগের মুখে ঐকথা শুনিয়া প্রথমে হাঁ, না কিছুই বলেন নাই; পরে ভবনাথ রোদন করিতে করিতে তাহাকে ঐকথা জানাইয়া যখন বলিয়াছিল, ‘মহাশয়, নরেন্দ্রের এমন হইবে একথা স্বপ্নেরও অগোচর!’–তখন বিষম উত্তেজিত হইয়া তিনি তাহাকে বলিয়াছিলেন, চুপ কর শালারা, মা বলিয়াছেন সে কখন ঐরূপ হইতে পারে না; আর কখন আমাকে ঐসব কথা বলিলে তোদের মুখ দেখিতে পারিব না!’…

“গ্রীষ্মের পর বর্ষা আসিল। এখন পূর্বের ন্যায় কর্মের অনুসন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। একদিন সমস্ত দিবস উপবাসে ও বৃষ্টিতে ভিজিয়া রাত্রে অবসন্ন পদে এবং ততোধিক অবসন্ন মনে বাটিতে ফিরিতেছি, এমন সময়ে শরীরে এত ক্লান্তি অনুভব করিলাম যে, আর এক পদও অগ্রসর হইতে না পারিয়া পার্শ্বস্থ বাটির রকে জড় পদার্থের ন্যায় পড়িয়া রহিলাম। কিছুক্ষণের জন্য চেতনার লোপ হইয়াছিল কিনা বলিতে পারি না। এটা কিন্তু স্মরণ আছে, মনে নানা রং-এর চিন্তা ও ছবি তখন আপনা হইতে পরপর উদয় ও লয় হইতেছিল এবং উহাদিগকে তাড়াইয়া কোন এক চিন্তাবিশেষে মনকে আবদ্ধ রাখি এরূপ সামর্থ্য ছিল না। সহসা উপলব্ধি করিলাম, কোন এক দৈবশক্তিপ্রভাবে একের পর অন্য এইরূপে ভিতরের অনেকগুলি পর্দা যেন উত্তোলিত হইল এবং শিবের সংসারে অ-শিব কেন, ঈশ্বরে কঠোর ন্যায়পরায়ণতা ও অপার করুণার সামঞ্জস্য প্রভৃতি সেসকল বিষয় নির্ণয় করিতে না পারিয়া মন এতদিন নানা সন্দেহে আকুল হইয়া ছিল, সেই সকল বিষয়ে স্থির মিমাংসা অন্তরের নিবিড়তম প্রদেশে দেখিতে পাইলাম। আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। অনন্তর বাটি ফিরিবার কালে দেখিলাম, শরীরে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নাই, মন অমিত বল ও শান্তিতে পূর্ণ এবং রজনী অবসান হইবার স্বল্পই বিলম্ব আছে।”

*

পরমহংসের কৃপাধন্য হলেই যে সংসারের সমালোচকরা তাদের নির্মম সমালোচনা বন্ধ করে দেবেন একথা ভাববার কোনো অবকাশ নরেন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দর জীবনে নেই। কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর বরাহনগরের এক ভাঙা বাড়িতে রামকৃষ্ণ-শিষ্যদের মধ্যে যে অধ্যাত্মসাধনার সূচনা হয়েছিল একালের ইতিহাসে তা যে অভূতপূর্ব তা পরবর্তীযুগে উচ্চকণ্ঠে স্বীকৃত হলেও, সমকালীন বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্ত হতে পারেননি নরেন্দ্রনাথ, যিনি বিবিদিষানন্দ নামে সন্ন্যাসপথের প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলেন।

বরাহনগর পর্বের তরুণ সংসারত্যাগীদের সুকঠোর জীবনযাত্রা মনকে অবশ্যই নাড়া দেয়, মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্যও মনে হয়। নরেন্দ্রনাথ তখন “অতি কঠোর তপস্যা করিতেছেন,… কি ত্যাগ, কি বৈরাগ্য! কি জপ-ধ্যান, কি অধ্যয়ন, কি তেজস্বী বাণী আর গুরুভাইদের প্রতি কি ভালবাসা!”

রামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তানদের মধ্যে তখন জ্বলন্ত বৈরাগ্য। কিন্তু সাধারণ লোকেরা তখন প্রকাশে কি বলে বেড়াচ্ছেন তার কিছু নমুনা স্বামীজির ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জন্যে রেখে গিয়েছেন।”সাধারণের ভিতরে কথা উঠিল নরেনটা পাগল হয়ে গেছে, তার মাথাটা বিগড়ে গেছে। কি বকে তার মাথামুণ্ড নাই, আবার বলে বেদান্ত অদ্বৈতবাদ…আমরা তো কোনকালে এসব কথা শুনি নাই বাপু, আর শিখেছেন কতকগুলো বচনের ঝুড়ি। কাজকর্ম করবার নাম নেই, চাকরিবাকরি করবার নামগন্ধ মুখে নেই। এর বাড়ি, ওর বাড়ি পেট ঠেসে আসে, আর কাজের মধ্যে কতকগুলো ছোঁড়া বকিয়েছে। সেগুলোকে নিয়ে কিরকম করছে সব–একটা কৰ্মনাশার দল করেছে।”

শুধু অচেনা মহলে নয়, ভক্তপরিমণ্ডলে নরেন সম্বন্ধে মন্তব্য, তিনি নাকি শ্রীরামকৃষ্ণকেই মানতেননা। প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, শ্রীরামকৃষ্ণেরও একটা ব্যঙ্গনাম জুটেছিল। পরমহংস না বলে টিটকিরি দেওয়া হত ‘গ্রেটগু’ বলে।

নরেন সম্বন্ধে গরম গুজব, তিনি রামকৃষ্ণের মুখের ওপর তর্ক করতেন, বড় হামবড়াইয়ের ভাব। পরিব্রাজক জীবনের শুরুর পরেও এইসব বিড়ম্বনার অবসানের কোনো লক্ষণ ছিল না।

লোকে বলছে, “নরেন এখন আবার গুরুগিরি ধরেছে, সে পশ্চিমে গিয়ে চেলা করছে সন্ন্যাসী করছে। ঠাকুর কি তাকে গুরুগিরি করতে বলেছিলেন? তখন তাঁকেই মানতো না, তার মুখের ওপর তর্ক করত। এখন তো দেখছি স্বয়ং গুরু হয়ে আর একটা দল পাকাচ্ছে।” এই হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মঠ বরানগর সম্বন্ধে সমকালের মন্তব্য!

এই সময়ে নরেন্দ্রনাথের মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দুর্বিষহ পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে। লোকেরা যখন উপহাস করছে, নরেন পাগলা হয়ে গেছে, কি বলে, কি কয়, কথার মাথামুণ্ডু নেই, তখন বরানগরে নরেন্দ্রনাথের জীবনে মহাকষ্ট–”অনাহার, অনিদ্রা, সকলেই বিবস্ত্র, বিকট, মলিন, পাংশুগুণ্ঠিত এবং রাত্রে শয়ন ধরণীতলে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন অন্নাভাবে কাতর ও নিরাশ্রয়। জ্ঞাতিদের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমা।”

মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার জনৈক বন্ধুর সেই সময়কার একটি উক্তি ভাবীকালকে উপহার দিয়েছেন : “তাইত হে, নরেন্দ্রনাথ পাগল হয়ে বেরিয়ে গেল। এমন গানটা মাটি করে গেল; এত বছর গানটা শিখে গলা সেধে সব মাঠে মারা গেল।”

গায়ে ধুলো কাদা মাখা, বড় বড় নখ, মাথায় ঝাঁকড়া আঁকড়া উড়ি খুড়ি চুল, তাতে কত ধুলো কাদা রয়েছে, কোনো হুঁশ নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, এই হচ্ছে তখনকার নরেন্দ্রনাথের পরিচিতমহলের ভাবমূর্তি।

শুধু মুখের নিন্দা এবং কুৎসা নয়, আমরা এখন ভালভাবেই জানি যে নরেন্দ্রনাথকে বরাহনগরে খুন করার চেষ্টাও হয়েছিল। বরাহনগরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এবং অনাহারে নরেন্দ্রনাথ প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

১৮৮৭ সালে গ্রীষ্মের প্রারম্ভে নরেনের টাইফয়েড এমনই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যে জননী ভূবনেশ্বরী তার এক ছেলেকে নিয়ে বরাহনগরের ভাড়াটে বাড়িতে ছুটে এলেন। বড্ড গায়ের জ্বালা, একসময় গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দ নাড়ির গতি খারাপ দেখে কেঁদে উঠলেন। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নরেন্দ্রনাথ বললেন, “কাদিসনি, আমি এখন মরব না, তুই ভয় করিসনি। আমাকে ঢের কাজ করতে হবে, আমি কাজগুলো যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি, আমার মরবার সময় নেই।”

কিন্তু রোগ ছাড়াও মৃত্যু তখন অন্যপথে তার অভীষ্ট সিদ্ধ করার চেষ্টায় রয়েছে। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল দশটা-সাড়ে দশটার দু’জন ভাড়া করা গুণ্ডা নিয়ে একজন লোক বরাহনগরের মঠে ঢুকলো। তার এক আত্মীয় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, তার সন্দেহ নরেন দত্ত আত্মীয়টিকে ছাড়পত্তর দিয়েছে। আগন্তুকটি বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গালমন্দ করছে। লাঠিখেলায় বিশেষ পারদর্শী নিরঞ্জন মহারাজ সেদিন বাধা না দিলে অসুস্থ নরেন্দ্রনাথের কি হত কে জানে। নিরঞ্জন মহারাজের পূর্বাশ্রমের নাম নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ।

শুধু প্রাণের আশঙ্কা নয়, মহেন্দ্রনাথ দত্ত বরাহনগর মঠের সন্ন্যাসীদের অন্য প্রলোভনের একটি মনোগ্রাহী ছবি উপহার দিয়েছে। “খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকরা খবর পেল যে বরাহনগরে কতকগুলি যুবক একটি বাড়িতে থাকে, বিবাহ করে নাই এবং বেশ ঈশ্বরানুরাগী।” যুবক সন্ন্যাসীদের নিজধর্মে টানবার জন্য প্রচারকরা স্পষ্টাস্পষ্টি বলতে লাগলো অনেক যুবতী মেম এসেছে, তাহাদের সহিত বিবাহ করাইয়া দিব, তোমরা খৃষ্টান হও, রাগে অগ্নিশর্মা তরুণ সন্ন্যাসীগণ তাদের প্রতি এতই বিরক্তি প্রকাশ করলেন যে বরাহনগর বাজারে প্রচারকরা যে আজ্ঞাটি খুলেছিল তা বন্ধ হয়ে গেল।

আমাদের আলোচনার বিষয়টি বড়ই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। রসিক চূড়ামণি বিবেকানন্দ এই সর্বদাগম্ভীর ভাব মোটেই বরদাস্ত করতেন না। পরিব্রাজক জীবনে একবার গাজীপুরে পওহারী বাবার দর্শন করতে গিয়ে স্বামীজির সঙ্গে ব্রাহ্মপ্রচারক অমৃতলাল বসুর সাক্ষাৎ হয়। অমৃতলাল সত্যিই শ্রীরামকৃষ্ণকে ভক্তি করেন কিনা জানবার জন্যে নরেন্দ্রনাথ সেবার কপট রামকৃষ্ণ নিন্দা আরম্ভ করলেন : “কি একটা লোক ছিল : পুতুল পুজো করতো আর থেকে থেকে ভিরমি যেত, তাতে আবার ছিল কি।”

ফাঁদে পা দিলেন অমৃতলাল, বেশ চটে গিয়ে বললেন, “নরেন, তোমার মুখে এমন কথা! পরমহংসমশাই তোমাকে কত সন্দেশ খাওয়াতেন, কত ভালবাসতেন, আর তুমি অবজ্ঞা করে কথা কইছো?”

সুরসিক নরেন্দ্রনাথ এবার পরমহংসের প্রতি আরও কটুক্তি করলেন, তখন অমৃতলাল রেগে গিয়ে বললেন, “যাও তোমার সঙ্গে কথা কইতে নেই,” তারপর জায়গা ছেড়ে উঠে গেলেন।

উঠে যাবার পরে নরেন্দ্রনাথের মন্তব্য “লোকটির ভিতর পরমহংস মশায়ের প্রতি যে এরকম শ্রদ্ধাভক্তি ছিল তা আমরা জানতাম না।”

অমৃতলালের রাগ অনেকদিন ছিল, অনেকদিন পরে তার ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ বসু স্বামীজির কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে, অমৃতলাল বসু বলেন, “কি হে সুরেন, গুরু কি আর খুঁজে পেলে না, শেষকালে একটি কায়েত ছোঁড়ার কাছে সন্ন্যাস নিলে।”

কায়স্থ সন্ন্যাসী এই সুবাদে স্বামীজি যে ঘরে বাইরে কতবার বিড়ম্বিত ও নিগৃহীত হয়েছেন তার কয়েকটি নমুনা এখনই দিয়ে দেওয়া বোধ হয় মন্দ হবে না। এই বিড়ম্বনা সন্ন্যাসজীবনের শুরু থেকে তার মৃত্যুর বহুবছর পরেও এমনভাবে জীবিত ছিল যে বিশ্বাস হয় না বিবেকানন্দ বিংশ শতকেও বসবাস করেছিলেন।

শিকাগো ধর্মসভায় অপ্রত্যাশিতভাবে বক্তৃতার সুযোগ পাওয়া ও সভায় অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরে স্বার্থপররা প্রচার শুরু করে যে নিজের দেশেই লোকটি ভ্যাগাবন্ড, কোথাও কোনো খুঁটি নেই। এই অবস্থায় স্বদেশের কিছু সমর্থন তার পক্ষে প্রয়োজনীয়।

স্বদেশ থেকে তিনি কোনো নিদর্শন পত্র নিয়ে আসেন নি, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করছে তাদের সামনে আমি যে জুয়াচোর নই তা কি করে প্রমাণ করবো?”

বিবেকানন্দর আশা ছিল মাদ্রাজ ও কলকাতায় কতকগুলি ভদ্রলোক জড়ো করে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সভা হবে এবং প্রস্তাবগুলি আমেরিকায় পৌঁছবে।”কিন্তু এখন দেখছি ভারতের পক্ষে এ কাজটি বড় গুরুতর ও কঠিন। এক বৎসরের ভিতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না–আর এখানে সকলে আমার বিপক্ষে।”

গুরুভাই শশীমহারাজ (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) ও কালীবেদান্তী (স্বামী অভেদানন্দ) উঠে পড়ে লাগলেন কলকাতায় কিছু একটা করবার জন্য। সভাপতি নির্বাচনের জন্য তারা মাননীয় বিচারপতি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গেলেন।

এরপর শুনুন সেই সাক্ষাতের বর্ণনা : “প্রথম হইতেই স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহহীনতা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাহার সহিত এ সম্বন্ধে বহু আলোচনা হয়। পরে তিনি বলেন যে, কোন বিশিষ্ট মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত তাহাকে বলিয়াছেন যে স্বামী বিবেকানন্দ নাম গুরুদত্ত নহে, শাস্ত্রমতে শূদ্রের সন্ন্যাস গ্রহণে অধিকার আছে কিনা এ সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে এবং সন্ন্যাসী হইয়াও ম্লেচ্ছদেশে গমনেও বিশেষ প্রত্যবায় আছে ইহাও অনেকে বলিয়া থাকেন।” যেসব কাজে সামাজিক ও ধর্ম সম্বন্ধে মতভেদ আছে সেসব কাজের ভিতর আর স্যার গুরুদাস যেতে চান না।

“নগেন্দ্রনাথ মিত্র বলিয়া উঠিলেন, আপনি যে ম্লেচ্ছদেশে যাওয়ার দোষ দিলেন কিন্তু আপনি তো শুদ্ধ আচারী ব্রাহ্মণ হইয়াও চিরকাল স্নেচ্ছের চাকরি করিলেন, এতে যে শাস্ত্রে তুষানলের ব্যবস্থা রহিয়াছে, এই বলিয়া সকলেই ক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া আসেন।”

এই দ্বন্দ্বের অবসান যে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দর মহাপ্রয়াণের পরেও শেষ হয়নি তার ইঙ্গিতও রয়েছে স্বামীজির কনিষ্ঠভ্রাতার রচনায়। “স্বামীজির স্মৃতিসভায় সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় দুইজন হাইকোর্টের বিচারপতিকে, একজন ব্রাহ্মণ এবং অপরজন কায়স্থ। এঁরা স্বামীজির প্রতি কটুক্তি বর্ষণ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ বিচারপতিটি বলেছিলেন, দেশে হিন্দু রাজার শাসন থাকলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হত। আর বিচারপতিটিও স্বামীজির তীব্র নিন্দাবাদ করেছিলেন।”

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি একসময়ে প্রস্তাব করেছিলেন যে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোন সদস্য যেন ভারতে এসে শ্বেতাঙ্গ রাজন্যবর্গের সহায়তায় নৃপতি হিসেবে দেশ শাসন করেন। এবিষয়ে কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর সংযোজন : “বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র একবার সংবাদপত্রে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। স্বামীজির মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিসভায় পৌরোহিত্য করবার জন্যে অনুরোধ করা হলে তিনি স্বামীজিকে নিন্দাবাদ ও সমালোচনা করেছিলেন।”

স্বামী অভেদানন্দ তাঁর জীবনকথায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে লিখেছেন, “প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করিয়া পূজা-জপাদি করিতেন। তাহা ছাড়া শুনিয়াছি প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ্যধর্মকে তিনি অত্যন্ত সম্মানের আসন দিতেন। সেইজন্য তথাকথিত শূদ্ৰ কুলোৎপন্ন দত্তবংশীয় নরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান করিতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করিলেন।”

আমেরিকা থেকে নরেন্দ্রনাথ লিখে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা কলিকাতায় একটি সাধারণসভার আয়োজন করিয়া আমার কার্যাবলীর সমর্থন ও সঙ্গে সঙ্গে আমি যে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি এই উল্লেখ করিয়া…একটি পত্র প্রেরণ কর।”

স্বামী অভেদানন্দ তখন আহার নিদ্রা ভুলে বিশিষ্ট নাগরিকের বাড়িতে গিয়ে সভায় যোগদানের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন। একজন বিশিষ্ট মাড়ওয়ারি নাগরিকের কাছে গেলে তিনি বললেন, “বাবুজি, হিন্দু হইয়া যাহারা বিলেত গমন করে তাহারা তো ভ্রষ্টাচারী। তাহাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ রাখা উচিত হইবে কি?”

মনোমোহনবাবু মাড়ওয়ারী ব্যবসায়ীদের সহিত বিশেষভাবে মেলামেশা করতেন, সুতরাং তাদের প্রকৃতি ভালভাবেই জানতেন। “তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন :’শেঠজি, আপকা নাম তো কমিটিমে চড় গিয়া। এই কথা শুনিবামাত্র মাড়ওয়ারী-ভদ্রলোকের মুখে আর কোনো কথা নাই।”

শেষ পর্যন্ত উত্তরপাড়ার রাজা পিয়ারীমোহন মুখোপাধ্যায় সভাপতিত্ব করতে রাজি হন, কিন্তু তিনিও “স্বামী বিবেকানন্দ কথাটিকে আপত্তি করিয়া ব্রাদার বিবেকানন্দ’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন, কারণ কায়স্থ সন্ন্যাসী হইতে পারে কিনা এবিষয়ে তখনও তাঁহার সন্দেহ ছিল।”

শিকাগোর ঐতিহাসিক ধর্মসভায় আরও একজন বিশিষ্ট বাঙালি যে উপস্থিত ছিলেন তা আজ প্রায় কারও মনে নেই। ইনি বিশিষ্ট ব্রাহ্ম ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, উত্তর কলকাতায় বসবাসকালে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন, একসময় শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বইও লিখেছিলেন, যে বইটি স্বামীজি আমেরিকায় চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রতাপ মজুমদারই যে কেন প্রবলভাবে চটে উঠে স্বামীজির নিন্দায় মেতে উঠলেন তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান হয়েছে।

আমরা কেবল মহেন্দ্রনাথ দত্তর রচনা থেকে কিছু খবর উদ্ধৃত করবো। “প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয় ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিলেন, নরেন, সেই ছোঁড়াটা, যে ভ্যাগাবন্ডের মত পথে পথে ঘুরে বেড়াত, সে এক লম্বা জামা পরে মাথায় পাগড়ি বেঁধে চিকাগো পার্লামেন্টে তো গিয়ে হাজির। সে আবার লেকচার করতে উঠলে, আবার বেদান্তর উপর কথা কয়, মায়াবাদ–সে সব অযৌক্তিক কথা, আর পৌত্তলিক ধর্ম সমর্থন করে। এসব জিনিস কি এযুগে আর চলে। যত সব বাজে জিনিস। ছোঁড়া এমনি অসভ্য রমণীদের সম্মুখে বসিয়াই চুরুট টানিতে লাগিল। আর কি লেকচার করে তার মাথামুণ্ডু কিছুই নেই, হাউড়ের মতন যত সব আবোল তাবোল বকে।”

এই নিন্দায় যে ভীষণ ক্ষতি হয়েছিল তা স্বামীজির পত্রাবলী থেকে। আমরা দেখবো। কিন্তু সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভাল দিক থাকে। বিখ্যাত ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মশায়ের নিকট কুটুম্ব নরেন্দ্রনাথ সেন রেগে উঠে মুখ ছুটিয়ে গালি দিতে লাগলেন নিজের আত্মীয়কে। মহেন্দ্রনাথ সবিস্তারে লিখেছেন সেইসব প্রতিবাদের কথা : “দেখ দেখি একটা বাঙালির ছেলে নিঃসম্বল, বিদেশ ভূমিতে গিয়ে নিজের দেশের জন্য, নিজের জাতের জন্য, নিজের ধর্মের জন্য লড়াই করছে, আর কি করে বিদেশির কাছে এদেশের একটুমাত্র সম্মান হয় তার চেষ্টা কচ্ছে, আর এই এক বুড়ো মিসে কোথা তাকে সেখানে তার হয়ে দুটো কথা বলবে না তার নিন্দাবাদ করে কিসে তার অনিষ্ট হয় তার চেষ্টা কচ্ছে।”

বিবেকানন্দের বিড়ম্বনার ক্ষেত্র প্রসারিত করার জন্য বিভিন্ন স্তরে কিরকম ষড়যন্ত্র চলেছিল তার প্রমাণ ছড়ানো রয়েছে নানা জায়গায়। অধ্যাপক এন ঘোষের বিখ্যাত ইন্ডিয়ান নেশন পত্রিকায় বিবেকানন্দকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে একটা বড় প্রবন্ধ বেরুলো। অবাক কাণ্ড। তারপর সম্পাদক স্বীকার করলেন, “মাদ্রাজ হইতে কে একটা প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাইয়া দেয়, অনবধানবশতঃ সেটা বিশেষ না পড়িয়াই সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রকাশ করা হইয়াছিল। এই ভুলের জন্য তিনি লজ্জিত ও দুঃখিত হইয়াছিলেন।”

প্রবল নিন্দার পরিবেশেও ধৈর্যশীল স্বামী বিবেকানন্দ সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করতেন। এই নীতির ফল যে সুদূরপ্রসারী তা বিবেকানন্দ অনুসন্ধানীরা পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন। কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা হচ্ছে দেখলে অনেকসময় সাধারণ মানুষের সহানুভূতি নিগৃহীত মানুষটির দিকেই চলে যায়, নিন্দুক বিন্দুমাত্র লাভবান হন না। তার কয়েকটি নিদর্শন প্রখ্যাত প্রতাপ মজুমদারের ব্যবহার ও অপপ্রচার থেকে দেওয়া যেতে পারে।

৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ আমেরিকা থেকে বিবেকানন্দ তার বন্ধু মন্মথনাথ ভট্টাচার্যকে এক দুর্ধর্ষ চিঠি লেখেন। বিবেকানন্দর নিজের ভাষাতেই শুনুন মজুমদার নিন্দার ফলাফল :”কত আগ্রহ এদের। দেশশুদ্ধ লোক আমাকে জানে, পাদ্রীরা বড়ই চটা। সকলে নয় অবশ্যি, এদের লার্নেড় পাদ্রীর মধ্যে অনেকে আমার চেলা আছে। মূর্খ-গোঁয়ারগুলো কিছু বোঝে সোঝে না হাঙ্গামা করে। তাতে আপনার পায়ে আপনি কুড়ুল মারে। মজুমদার আমায় গাল পেড়ে তার যেটুকু এদেশে পসার ছিল তার তিন ভাগ খুইয়েছেন। আমি হচ্ছি এদের পুষ্যি–আমায় গাল দিলে মেয়ে মহলে তার নামে ধিক্কার পড়ে যায়।”

এই চিঠিটায় স্বদেশের প্রিয় বন্ধুবরের কাছে অনুরোধ আছে, “চিঠিটা ফাঁস করবেন না বুঝতে পেরেছেন–আমায় এখন প্রত্যেক কথাটি হুসিয়ার হয়ে কইতে হয়–পাবলিক ম্যান–সব বেটারা ওৎ পেতে থাকে।”

নিন্দা সম্পর্কে স্বামীজির সুচিন্তিত নীতি কি তা তিনি নিজেই আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা এক চিঠিতে (২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) বিশ্লেষণ করেছেন।

“আমার বন্ধুগণকে বলবে যারা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর–একদম চুপ থাকা। আমি তাদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাদের সঙ্গে একদরের হয়ে পড়লুম। তাদের বলবে–সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। আমার বন্ধুদের এখনও ঢের শিখতে হবে, তারা তো এখনও শিশুতুল্য।..সাধারণের সঙ্গে জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুগে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।” . নিন্দায় অবিচলিত থাকার কঠিন সংকল্প গ্রহণ করলেও স্বামীজি একটি বিষয়ে বিচলিত, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার যে চারিত্রিক নিন্দা ছড়াচ্ছেন তা তার মায়ের কাছে পৌঁছলে কি হবে?

এই সময়ে বিদেশ থেকে স্বামীজির একটি করুণ চিঠি : “আমার বুড়ি মা এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সেসব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালবাসা যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছেন, সে দূরদেশে গিয়ে–কলকাতার মজুমদার যেমন রটাচ্ছে–জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাকে একেবারে শেষ করে দেবে।”

চরিত্রহননের অপচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে শিকাগো থেকে অধ্যাপক রাইটকে (২৪মে ১৮৯৪) স্বামীজি একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখেন।

“আমি যে যথার্থই সন্ন্যাসী, এ-বিষয়ে সর্বপ্রকারে আপনাকে আশ্বস্ত করতে আমি দায়বদ্ধ। কিন্তু সে কেবল আপনাকেই। বাকি নিকৃষ্ট লোকরা কি বলে না বলে, আমি তার পরোয়া করি না। ‘কেউ তোমাকে বলবে সাধু, কেউ বলবে চণ্ডাল, কেউ বলবে উন্মাদ, কেউ বলবে দানব, কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের পথ চলে যাও’–এই কথা বলেছিলেন বার্ধক্যে সন্ন্যাসগ্রহণকারী রাজা ভর্তৃহরি–ভারতের একজন প্রাচীন সম্রাট ও মহান সন্ন্যাসী।”

শিকাগোর অভাবনীয় সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মজুমদার সম্বন্ধে পাঠকের মনে যেসব কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক তার কিছুটা ভ্রাতা মহেন্দ্র নাথ দত্তের জবানিতে বলে রাখা যায়।

প্রতাপ মজুমদার কলকাতায় কেশবচন্দ্র সেনের সমাজে ও রামকৃষ্ণদেবের কাছে এসেছিলেন, তাকে চিনতেন। তার ধারণা ছিল যে স্বামীজি একটা কলকাতার গাইয়ে, ভেঁপো ছোঁড়া, পরে সন্ন্যাসী হইয়াছে, পথে-পথে ঘুরিয়া বেড়ায় ও ভিক্ষা করিয়া খায়। লেখাপড়া বা ভদ্র আচার ব্যবহার কিছুই জানে না, মোটকথা একটি ভ্যাগাবন্ড ছোঁড়া।”

মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, আমেরিকায় ধর্মসভায় এসে প্রতাপচন্দ্রের “আর্থিক অবস্থা তখন তত সচ্ছল ছিল না, তাহার উপর তিনি বৃদ্ধও হইয়াছিলেন। এই সময় এক বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দুধর্মের উপর বক্তৃতা দিবার জন্য স্বামীজিকে নির্বাচন করেন। যে চারটি বক্তৃতা দিতে হইবে, প্রত্যেক বক্তৃতার জন্য ১০০০ টাকা সম্মানমূল্যে। স্বামীজি অর্থ লইবেন না এইজন্যে নিজে এই বক্তৃতার ভার গ্রহণ না করিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের নাম উল্লেখ করিয়া দেন। প্রতাপচন্দ্র সেই চারটি বক্তৃতা দিয়া চারি হাজার টাকা পাইয়াছিলেন।”

ফল উল্টো হল, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার শুরু করলেন কুৎসা–”ছোঁড়াটা রাস্তায় ভিক্ষে করে খায়, পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, বোধ হয় কোন বিপদে পড়ে এখানে পালিয়ে এসেছে।”

প্রতাপের নিন্দা সম্বন্ধে স্বামীজি তখনও নিশ্চিন্ত–”করুকগে, আমরা রামকৃষ্ণের তনয়। করিয়াই কি করিবে? মহাশক্তির প্রভাবে তৃণবৎ সব উড়িয়া যাইবে।”

প্রবাসে গোঁড়া পাদ্রিদের বিরুদ্ধাচরণ সম্বন্ধেও স্বামীজির একই নীতি। কত কুৎসা তখনকার খবরের কাগজে প্রচার হল। স্বামীজি তার এক শিষ্যকে বলেছিলেন, “আমি কিন্তু কিছু গ্রাহ্য করতুম না।

সন্দেহ এবং বিরুদ্ধাচরণ শুধু বাইরে থেকে নয়, ঘরেও। আমেরিকায় যাবার ব্যাপারটা গোপন রাখবার জন্য স্বামীজি বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল ও স্বামী সারদানন্দকে অনুরোধ করেছিলেন।

এর কারণ নিয়ে যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছে। “কেহ কেহ প্রশ্ন তুলিলেন যে সেখানে ইংরাজিতে কথা কহিতে হয় ও ইংরাজিতে বক্তৃতা দিতে হয়, স্বামীজি তো এ সব কিছু জানেন না, তবে যাইয়া কি করিবেন। কেহ কেহ আপত্তি তুলিলেন যে সেখানে অপরের সহিত আহার করিতে হইবে, সাধু বা হিন্দুর পক্ষে কি করিয়া সম্ভব? কেহ কেহ বলিল, হিন্দুর পক্ষে সমুদ্রযাত্রা তত নিষেধ তবে স্বামীজি কি করিয়া যাইতে পারেন? একজনের এক ভীষণ আপত্তি উঠিল এবং তিনি মীমাংসা করিতে না পারিয়া ক্রমে ক্রমে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, আমেরিকা ঠাণ্ডা দেশ, সাহেবদের দেশ, সেখানে ইজের পরিতে হয়, স্বামীজি গেরুয়া পরেন, তিনি কি করিয়া ইজের পরিবেন এবং গেরুয়া কাপড় পরিত্যাগ করিয়া অন্য রঙের কাপড় কি করিয়া পরিবেন?…তখনকার কলিকাতার সমাজে এই সকল কথা অতি ভীষণ বলিয়া বোধ হইতেছিল।”

ঘরের ভিতরের কিছু কিছু খবর মহেন্দ্রনাথ ইত্যাদি কয়েকজনের স্মৃতিচারণে ধরা পড়েছে। “স্বামীজির চিকাগোর সংবাদ প্রকাশে আলমবাজার মঠে মহাগণ্ডগোল উঠিল। বলরামবাবুর (বসু) বাড়িতে সন্ধ্যার সময় যখন বক্তৃতাটি একজন পড়িতে লাগিলেন এবং অপর সকলে বসিয়া শুনিতে লাগিলেন, তখন জনকয়েক ব্যক্তি বিশেষত তাহার ভিতর একজন হস্ত প্রসারণ করিয়া নানা ভাব-ভঙ্গি করিয়া অতি বিদ্রূপ করিতে লাগিলেন। নানারকম করিয়া মাথা ঘুরাইয়া বক্তৃতা হইতে একটু একটু উদ্ধৃত করিয়া অবজ্ঞা করিয়া নানাপ্রকার ব্যঙ্গ ও কুৎসা করিতে লাগিলেন।”

আরও বিস্ময়কর প্রিয় গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দ হঠাৎ বেজায় চটে উঠলেন। পরে অবশ্য সব বুঝে ভুলের অবসান ঘটেছিল। কিন্তু আলমবাজারে গোড়ার দিককার অবস্থা উদ্বেগজনক। স্বামী প্রেমানন্দ (বাবুরাম মহারাজ) বলতে লাগলেন, “নরেনটা অহংকারে ফুলে উঠেছে, নিজের নাম জাহির করছে, নিজে নাম কিনবার জন্য মহা হুড়াহুড়ি, চেলা করে নিজে এক বড়লোক মহান্ত হবে। ওটা অহংকারে মটমট করে, এমনি অহংকার যে তার বক্তৃতায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করল না–শুধু নিজের নাম জাহির করছেন। আর প্রথম থেকেই জানা আছে ওটা তাঁকে কখনই মানতো না। মুখের ওপর তর্ক ও জবাব করতো। কেবল নিজের নাম জাহির করা আর নিজের মত প্রচার করা এইটাই হচ্ছে তার উদ্দেশ্য।”

মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি অনুযায়ী : প্রেমানন্দ “সেইসময় যেন ভূতগ্রস্ত হইয়াছিলেন। আলমবাজার মঠে এবং কলিকাতায় আসিয়া তিনি সকল ভক্তের বাড়ি যাইয়া কুৎসা, নিন্দা ও গালি দিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।…বাবুরাম মহারাজের ব্যাপার দেখিয়া গিরিশবাবু (ঘোষ) একদিন বললেন, বাবুরাম কচ্ছে কি! ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?”

স্বামীজির অন্য গুরুভাইরা ক্রমশ তাঁকে আয়ত্তে আনবার জন্য মাঝে মাঝে বকুনি দিতে শুরু করলেন। স্বামীজির সবচেয়ে বিশ্বাসের মানুষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ এই সময়ে যে রস রসিকতা করতেন তা জেনে রাখা মন্দ নয়। গালাগালি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে স্বামী প্রেমানন্দ যখন চুপ করে যেতেন তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁকে উসকে দেবার জন্য বলতেন, ‘ও বাবুরাম, শুনেছ আর এক খবর কি এসেছে। নরেন সেখানকার মেয়েদের সঙ্গে তো খাচ্ছেই আবার সে কি বলছে জান? খুব টাকাওয়ালা একটা বড় মানুষ মেমকে বে করে সেখানে সে বাস করবে আর এদেশে সে আসবে না, তোমাদের সঙ্গে সে আর দেখা করবে না।”

সাময়িক পাগলামো এতখানি গড়িয়েছিল যে বাবুরাম মহারাজ ও স্বামীজির সহপাঠী হরমোহন মিত্র একটা বিবেকানন্দ বিরোধী পুস্তিকা ছাপিয়ে বিডন উদ্যানে এবং অন্যত্র বিতরণ শুরু করেছিলেন। অপর গুরুভাই স্বামী অভেদানন্দ পুস্তিকাটি দেখে বিরক্ত হয়ে প্রেমানন্দকে বললেন, “কি বাবুরাম, নরেন বুঝি দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, তাই বুঝি টেনে টুনে খোঁটায় এনে বাঁধছ!”

শিকাগো সাফল্যের পরবর্তী পর্যায়কে যদি খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে স্বাভাবিক মনে হয় তাহলে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবেদন, অখ্যাত পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে বিবেকানন্দ যখন ভারতের এ-প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখনও তিনি অপরের অকারণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাননি।

বিদেশে যাবার আগে বিহারের কোনো অঞ্চলে ব্যাপারটি ঘটে। অতি প্রত্যুষে নিদ্রাত্যাগ করে স্বামীজি গ্র্যান্ডট্রাংক রোড ধরে হেঁটে চলেছেন, প্রত্যাশা কেউ ভিক্ষাগ্রহণের জন্য সন্ন্যাসীকে আহ্বান করবেন। এমন সময় শুনলেন, কে যেন তাকে পিছন থেকে ডাকছে। স্বামীজি “ফিরিয়া দেখিলেন অশ্বারোহী এক পুলিশ কর্মচারী তাঁহার দিকে আসিতেছেন। কর্মচারী কর্কশস্বরে তাঁহার পরিচয় চাহিলে তিনি বলিলেন, ‘দেখছেনই তো খাঁ সাহেব, আমি সাধু। সব সাধুই বদমাস, আমার সঙ্গে চলে এসো, তোমার শ্রীঘরের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত দিনের জন্য?’ মৃদুভাবে প্রশ্ন করলেন স্বামীজি। উত্তর এল, দু-সপ্তাহে হতে পারে, একমাসও হতে পারে।

স্বামীজি আরও কাছে গিয়ে অনুনয়কারে বললেন, ‘শুধু একমাস খাঁ সাহেব? ছ’মাসের ব্যবস্থা করতে পারেন না, অন্তত তিন-চার মাস?’ অদ্ভুত আবদার, কর্মচারীর মেজাজ নরম হল, তিনি বললেন, ‘এক মাসের বেশি দিন থাকতে চাও কেন?’ স্বামীজি পূর্বেরই ন্যায় ধীরভাবে বললেন, কারাজীবন এর চেয়ে অনেক সহজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই অবিরাম হাঁটার তুলনায় দিনের পরিশ্রম কিছুই নয়। ভোজনই পাই না রোজ, আর উপোস থাকতে হয় প্রায়। জেলে দু-বেলা পেটভরে খেতে পাব! আপনি যদি আমায় বেশ কয়েকমাস জেলে পুরে রাখেন তো সত্যি উপকার হয়। শুনতে শুনতে খাঁ সাহেবের মুখ নৈরাশ্য ও বিরক্তিতে ভরে উঠল, তিনি হঠাৎ স্বামীজির প্রতি আদেশ দিলেন ভাগো।

পথের বিপদ ঘরছাড়া সন্ন্যাসীকে কিন্তু ঘরে ফেরাতে পারে না। পথই তো তার ঘর। কতবার কতভাবে তিনি ট্রেনে চড়েছে অজানার সন্ধানে তার একটা নির্ভরযোগ্য বিবরণী ভারতীয় রেলপথের পরিচালকরা তৈরি করলে তা আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর জোগাতে পারতো। আমরা জানি পরিব্রাজককালেই স্বামীজি পেটের অসুখের রোগী হয়েছিলেন। এই পেটের অসুখের তাড়নাতেই তিনি আমেরিকায় যাবার সময় ডেকের যাত্রী হবার ঝুঁকি নিতে পারেন নি। ডেকের টিকিটের অর্থ সংগৃহীত হবার পরও খেতড়ির মহারাজা সমস্যাটা বুঝে তাঁকে উচ্চ শ্রেণীর টিকিট কিনে দিয়েছিলেন। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজির পেটের অবস্থা কতখানি শোচনীয় ছিল তার সমর্থন রয়েছে এস এস পেনিনসুলার জাহাজ থেকে, খেতড়ি নরেশ অজিত সিংকে লেখা চিঠি থেকে। রাজাসাহেবকে স্বামীজি লিখছেন, “আগে দিনেতে লোটা হাতে করে ২৫ বার পায়খানা যেতে হতো, কিন্তু জাহাজে আসা অবধি পেটটা বেশ ভাল হয়ে গেছে, অতবার আর পায়খানায় যেতে হয় না।”

শরীরের এই অবস্থা হলে যে কোনো যাত্রীর পক্ষে রেলের থার্ড ক্লাশ খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিষয়েও তার ভাগ্যে নিন্দা জুটেছে, সন্ন্যাসী হয়েও তিনি ভোগবিলাসী, তাই ফার্স্ট ক্লাশের যাত্রা পছন্দ করেন। এদেশে একসময় সাধু-সন্ন্যাসীরা ছিলেন বিনাটিকিটের যাত্রী, কিন্তু স্বামীজির ক্ষেত্রে সেরকম কোনো ঘটনার উল্লেখ তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পাইনি। বরং দেখা যাচ্ছে, তিনি কোনো শুভানুধ্যায়ীকে পেলে তাকে তার পরবর্তী গন্তব্যস্থানের টিকিটটা কাটতে অনুমতি দিতেন, কিন্তু তার বেশি নয়, অর্থাৎ সন্ন্যাসী কপর্দক শূন্য অবস্থায় সব সময় অজানার অনুসন্ধানে চলেছেন।

বিনা টিকিটের যাত্রী না হয়েও ভারতীয় রেলের কামরায় রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দর মতন মহামানব কিন্তু কয়েকবার নিগৃহীত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার ও পিতৃদেবের অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন পরে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, যার থেকে প্রমাণ হয় পথের অবমাননা সহজে স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। স্বামীজির ক্ষেত্রে তিনি সবসময় নীরব, সৌভাগ্যক্রমে বেশ কয়েকটি বিড়ম্বনার ঘটনা তার বিশ্বস্ত জীবনীকাররা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা দু’একটি ঘটনার দিকে তাকাতে পারি–দেখা যাবে রেলের অপমান কখনও আসে দুর্বিনীত সহযাত্রীদের কাছ থেকে এবং কোথাও সভ্যতাহীন দাম্ভিক কর্মীদের কাছ থেকে।

বিবেকানন্দ জীবনীকার স্বীকার করেছেনও ঘটনার স্থান ও কাল সঠিক জানা নেই। “রাজস্থানের মধ্যে একবার ট্রেনে যাইবার কালে তাহার কামরাতে দুইজন ইংরেজ সহযাত্রী ছিলেন। ইহারা ভাবিলেন, স্বামীজি একজন ফকির মাত্র; অতএব ইংরেজীতে অপমান করিতে করিতে তাহার প্রসঙ্গ তুলিয়া হাসিঠাট্টায় মাতিয়া গেলেন। স্বামীজি যেন কিছুই বুঝিতেছেন না এমনিভাবে নীরবে অম্লানবদনে বসিয়া রহিলেন। একটু করে ট্রেনটি একটি স্টেশনে থামিলে স্বামীজি স্টেশনমাস্টারের নিকট ইংরেজীতে একগ্লাশ জল চাহিলেন, সহযাত্রী দুইজন দেখিলেন যে স্বামীজি তাহাদের ভাষা জানেন, তখন বিশেষ লজ্জিত ও আশ্চার্যান্বিত হইয়া স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি সব বুঝিয়াও কেমন করিয়া বিন্দুমাত্র ক্রোধ না দেখাইয়া বসিয়া ছিলেন? উত্তরে স্বামীজি বলিলেন, ‘দেখুন বন্ধুগণ, আপনাদের সংস্পর্শে আসা তো আমার জীবনে এই নয়। ইহাতে সহযাত্রীদের ক্রোধ হইল নিশ্চয়, কিন্তু স্বামীজির তেজপূর্ণ সুগঠিত চেহারা দর্শনে তাহারা ক্রোধ চাপিয়া বরং ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন।”

পরের ঘটনাটি আবু স্টেশনে। যুগনায়ক বিবেকানন্দর পূজ্যপাদ লেখক স্বামী গম্ভীরানন্দ এই অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন : “স্বামীজির সহিত গাড়িতে বসিয়া স্বামীজির ভক্ত এক বাঙালি ভদ্রলোক আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় এক শ্বেতাঙ্গ টিকিট পরীক্ষক আসিয়া ভদ্রলোককে নামিয়া যাইতে বলিলেন। কিন্তু ভদ্রলোক নিজেও রেলকর্মচারী ছিলেন, তাই উহাতে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না, প্রত্যুত সাহেবের সহিত বচসায় প্রবৃত্ত হইলেন। অগত্যা স্বামীজি, উহা থামাইতে সচেষ্ট হইলে সাহেব আরও চটিয়া গিয়া রূঢ় ভাষায় বলিলেন, তুম কাহে বাত করতে হো? সামান্য সন্ন্যাসী ভাবিয়া এক ধমকে থামাইয়া দিবার উদ্দেশ্যেই সাহেব হিন্দির সাহায্য লইয়াছিলেন । কিন্তু স্বামীজি যখন ইংরেজিতে গর্জিয়া উঠিলেন, তুম তুম করছ কাকে? উচ্চ শ্রেণীর যাত্রীর সঙ্গে কি করে কথা বলতে হয় জান না? আপ বলতে পার না?

“তখন টিকিট পরীক্ষক সাহেব বেগতিক দেখিয়া বলিলেন, অন্যায় হয়েছে, আমি হিন্দি ভাষাটা ভাল জানি না। আমি শুধু ও লোকটাকে (ফেলো)–’স্বামীজির আর সহ্য হইল না। কথা শেষ করিতে না দিয়াই তিনি তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, তুমি এই বললে হিন্দি ভাষা জান না, এখন দেখছি তুমি নিজের ভাষাও জান না। লোকটা কি?’ ‘ভদ্রলোক বলতে পার না?’ ‘তোমার নাম ও নম্বর দাও, আমি উপরওয়ালাদের জানাব।ততক্ষণে চারিদিকে ভিড় জমিয়া গিয়াছে এবং সাহেবও পলাইতে পারিলে বাঁচেন। স্বামীজি তবু বলিতেছেন, এই শেষ বলছি, হয় তোমার নম্বর দাও, নতুবা লোকে দেখুক, তোমার মতন কাপুরুষ দুনিয়ায় নাই।

“সাহেব ঘাড় হেঁট করিয়া সরিয়া পড়িলেন। শ্বেতাঙ্গ চলিয়া গেলে মুনসী জগমোহনের দিকে ফিরিয়া স্বামীজি বলিলেন, “ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে গেলে আমাদের কি চাই দেখছ? এই আত্মসম্মানজ্ঞান। আমরা কে, কি দরের লোক না বুঝে ব্যবহার করাতেই লোকে আমাদের ঘাড়ে চড়তে চায়। অন্যের নিকট নিজেদের মর্যাদা বজায় রাখা চাই। তা না হলেই তারা আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও অপমান করে–এতে দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া হয়। শিক্ষা ও সভ্যতায় ভারতীয়রা জগতের কোন জাতির চেয়ে হীন নয়, কিন্তু তারা নিজেদের হীন মনে করে বলেই একটা সামান্য বিদেশীও আমাদের লাথি ঝটা মারে–আমরা চুপ করে তা হজম করি।”

রেল স্টেশনে এবং ট্রেনে অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। শেষবারের মতন হিমালয় ভ্রমণ করে স্বামীজি সেবার বেলুড়ে ফিরছেন। সময় ১৯০১ সালের শুরু। স্বামীজি পিলভিত স্টেশনে এসেছেন, সহযাত্রী চিরবিশ্বস্ত স্বামী সদানন্দ, যিনি বহুদিন আগে হাতরাস স্টেশনে কর্মী ছিলেন। পিলভিত স্টেশনের দৃশ্যটি স্বামী গম্ভীরানন্দ এইভাবে বর্ণনা করেছেন : “ট্রেন আসিলে স্বামীজি ও সদানন্দ একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রবেশ করিতে যাইবেন এমন সময় এক হাঙ্গামা উপস্থিত হইল।” একালের পাঠকপাঠিকাদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, সেকালের সেকেন্ড ক্লাস ও একালের সেকেন্ড ক্লাস এক নয়। তখন থার্ড ক্লাস ও ইন্টার ক্লাস-এর ওপরে সেকেন্ড ক্লাস।

পিলভিতের ঘটনা : “ঐ কক্ষে কর্নেলপদস্থ এক ইংরাজ সৈন্যাধ্যক্ষ ছিলেন। নেটিভদ্বয়কে তথায় প্রবেশ করিতে দেখিয়া তাহার মন বিদ্বেষপূর্ণ হইল, তখন এতগুলি নেটিভদ্রলোক সন্ন্যাসিদ্বয়কে গাড়িতে তুলিয়া দিতে আসিতেছে দেখিয়া সরাসরি বাধা দিতে সাহসে কুলাইল না। অগত্যা এই অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের অপসারণের জন্য তিনি স্টেশন মাস্টারের শরণাপন্ন হইলেন। ইংরেজ-পুঙ্গবের দাপটে হতবুদ্ধি স্টেশন মাস্টার আইন-এর মর্যাদা লঙ্ঘনপূর্বক স্বামীজির নিকট আসিয়া বিনীতভাবে তাঁহাকে কক্ষত্যাগের অনুরোধ জানাইলেন। স্বামীজি কিন্তু এভাবে নতিস্বীকার করিয়া স্বদেশ ও স্বজাতির অপমান বাড়াইতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি ঐ ব্যক্তির কথা শেষ হইতে না হইতে গর্জিয়া উঠিলেন, আপনি কি করে এ কথা আমায় বলতে সাহস করলেন? আপনার লজ্জা হলো না? বেগতিক দেখিয়া স্টেশন মাস্টার সরিয়া পড়িলেন। ইত্যবসরে স্বাভিপ্রায়ানুরূপ কার্য সমাধা হইয়া গিয়াছে এই বিশ্বাসে কর্নেল স্বস্থানে ফিরিয়া দেখেন, স্বামীজি ও সদানন্দ পূর্ববৎ সেখানেই বসিয়া আছেন। তখন তাহার পুনর্বার গাত্রদাহ আরম্ভ হওয়ায় তিনি স্টেশনের এক প্রান্ত হইতে প্ৰাস্তাত্তর পর্যন্ত উচ্চরবে ‘স্টেশন মাস্টার’, ‘স্টেশন মাস্টার’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। কিন্তু স্টেশন মাস্টার গা ঢাকা দিয়াছেন, আর এদিকে ট্রেন ছাড়িবারও বিলম্ব নাই। অতএব সাহেবের মাথায় সুবুদ্ধি আসিল, তিনি স্বীয় বোঁচকাকুঁচকি লইয়া অপর এক কামরায় চলিয়া গেলেন বীরত্ব সেখানেই সমাপ্ত হইল। স্বামীজি তাহার পাগলামি দেখিয়া হাস্যসংবরণ করিতে পারিলেন না। এমনি ছিল সমসাময়িক ভারতবর্ষের অবস্থা।”

মহাসমুদ্রের অপরপারে সুদূর মার্কিন দেশে বিজয়ী বিবেকানন্দকে আঘাতে অপমানে ক্ষতবিক্ষত করার যে বিরামহীন প্রচেষ্টা চলেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ মার্কিন গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক তার ছ’খণ্ডের ইংরিজি বইতে রেখে গিয়েছে। এমন ধৈর্যময় গবেষণার জন্য এই মার্কিনী লেখিকা আমাদের হৃদয়ের সবচেয়ে শ্রদ্ধার আসনটি দখল করে নিয়েছেন। গুরু অশোকানন্দের নির্দেশে এই গবেষিকা ১৯৪৪ সাল থেকে কয়েক যুগ ধরে স্বামীজি সম্বন্ধে নানা অজানা তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের বিস্ময়ের পাত্রী হয়েছেন।

সুদূর মার্কিন মুলুকে স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বহুজনের হৃদয়েশ্বর হয়ে উঠেছিলেন, তেমন একই সঙ্গে প্রবাসের পরিবেশে কপর্দকশূন্য সন্ন্যাসীর ভাগ্যে জুটেছে নানা ধরনের অত্যাচার ও অপমান। কখনও তিনি বিচিত্র বেশবাসের জন্য পথচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, কখনও বিতাড়িত হয়েছেন চুলছাটার সেলুন থেকে, কখনও পয়সা দিয়েও প্রবেশ করতে পারেন নি রাতের আশ্রয়স্থল কোনো হোটেলে। এই সেই সন্ন্যাসী যাঁর সম্বন্ধে মেরি লুইস বার্ক আবিষ্কার করেছেন রেল ইয়ার্ডে ওয়াগনে শুয়ে থাকার কথা।

মেরি লুইস বার্ক পাঁচহাজার পাতা ধরে মার্কিনদেশের সংবাদপত্র এবং সমসাময়িক ব্যক্তিদের যে স্মৃতিকাহিনি বিপুল নিষ্ঠার সঙ্গে পুনরুদ্ধার করেছেন এই নিবন্ধে তার প্রতি সুবিচার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মহাসমুদ্রকে হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশিতে সংক্ষেপিত করার প্রচেষ্টার কোনো অর্থ হয় না। আমরা বরং প্রথমে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার উদ্দেশ্যে খোদ বিবেকানন্দর মার্কিনদেশ থেকে লেখা কিছু চিঠিপত্রের ওপর নির্ভর করি।

২৮ ডিসেম্বর ১৮৯৩, হেল পরিবারের ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো থেকে হরিপদ মিত্রকে লেখা স্বামীজির চিঠি: “আমি এদেশে এসেছি, দেশ দেখতে নয়, তামাসা দেখতেনয়,নাম করতেনয়, এই দরিদ্রের জন্য উপায় দেখতে। সে উপায় কি, পরে জানতে পারবে, যদি ভগবান্ সহায় হন।” ২৪ জানুয়ারি ১৮৯৪, একই ঠিকানা থেকে স্বামীজি খবরের কাগজের অংশ কেটে পাঠাচ্ছেন মাদ্ৰাজী ভক্তদের কাছে। “কাগজটার অতিরিক্ত গোঁড়ামি ও আমাকে গালাগালি দিয়া একটা নাম জাহির করিবার চেষ্টা সত্ত্বেও উহাদের স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে আমি সর্বসাধারণের প্রিয় বক্তা ছিলাম।”

১৮ মার্চ ১৮৯৪ ডেট্রয়েট থেকে মিস মেরী হেলকে লেখা চিঠি :পত্রে গুরুভাইরা কলকাতা থেকে লিখেছেন, : “ম–কলকাতায় ফিরে গিয়ে রটাচ্ছে যে বিবেকানন্দ আমেরিকায় সব রকমের পাপ কাজ করছে।…এই তো তোমাদের আমেরিকার অপূর্ব আধ্যাত্মিক পুরুষ।’ ‘ম—’ বেচারীর এতোদূর অধঃপতনে আমি বিশেষ দুঃখিত। ভগবান ভদ্রলোককে ক্ষমা করুন।” বলাবাহুল্য এই ‘ম’ প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ছাড়া আর কেউ নন।

পরের দিন ১৯ মার্চ চিকাগো ডিয়ারবর্ন এভিনিউ থেকে শশীমহারাজকে কলকাতায় লেখা চিঠি : “বড় ভয় ছিল যে, আমার নাক কান খসে যাবে, কিন্তু আজিও কিছু হয় নাই। তবে রাশীকৃত গরমকাপড়, তার উপর সলোম চামড়ার কোট, জুতো, জুতোর উপর পশমের জুতো ইত্যাদি আবৃত হয়ে বাইরে যেতে হয়।…প্রভুর ইচ্ছায় মজুমদার মশায়ের সঙ্গে এখানে দেখা। প্রথমে বড়ই প্রীতি, পরে যখন চিকাগোসুদ্ধ নরনারী আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগলো তখন মজুমদার ভায়ার মনে আগুন জ্বলল!…দাদা আমি দেখেশুনে অবাক! বল বাবা, আমি কি তোর অন্নে ব্যাঘাত করেছি? তোর খাতির তো যথেষ্ট এদেশে, তবে আমার মতো তোমাদের হ’ল না, তা আমার কি দোষ?…আর মজুমদার পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নের পাদ্রীদের কাছে আমার যথেষ্ট নিন্দা করে, ও কেউ নয়, ঠক জোচ্চোর; ও তোমাদের দেশে এসে বলে–আমি ফকির ইত্যাদি বলে তাদের মন আমার উপর যথেষ্ট বিগড়ে দিলে। ব্যারোজ প্রেসিডেন্টকে এমনি বিগড়ালে যে, সে আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কয় না। তাদের পুস্তকে প্যালেটে যথাসাধ্য আমায় দাবাবার চেষ্টা; কিন্তু গুরু সহায় বাবা! মজুমদার কি বলে? সমস্ত আমেরিকান যে আমায় ভালবাসে, ভক্তি করে, টাকা দেয়, গুরুর মত মানে–মজুমদার করবে কি?…দাদা মজুমদারকে দেখে আমার আকেল এসে গেল।..ভায়া, সৰ যায়, ওই পোড়া হিংসেটা যায় না। আমাদের ভিতরও খুব আছে। আমাদের জাতের ঐটে দোষ, খালি পরনিন্দা আর পরশ্রীকাতরতা। হামবড়া, আর কেউ বড় হবে না।”

৯ এপ্রিল ১৮৯৪ নিউ ইয়র্ক থেকে প্রিয় আলাসিঙ্গা পেরুমলকে স্বামী বিবেকানন্দ : “গোঁড়াপাদ্রীরা আমার বিপক্ষে, আর তারা আমার সঙ্গে সোজা রাস্তায় সহজে পেরে উঠবেন না দেখে আমাকে গালমন্দ নিন্দাবাদ করতে আরম্ভ করেছেন, আর ‘ম–’ বাবু তাদের সাহায্য করছেন। তিনি নিশ্চয় হিংসেয় পাগল হয়ে গেছেন। তিনি তাদের বলছেন, আমি একটা ভয়ানক জোচ্চোর ও বদমাশ, আবার কলকাতায় গিয়ে সেখানকার লোকদের বলছেন, আমি ঘোর পাপে মগ্ন, বিশেষত আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছি!!! প্রভু তাকে আশীর্বাদ করুন।”

মে, ১৮৯৪, ১৭ বীকন স্ট্রিট, বস্টন থেকে অধ্যাপক রাইটকে স্বামী বিবেকানন্দ : “হে সহৃদয় বন্ধু, সর্বপ্রকারে আপনার সন্তোষ বিধান করতে ন্যায়ত আমি বাধ্য। আর বাকি পৃথিবীতে তাদের বাতচিতকে আমি গ্রাহ্য করি না। আত্মসমর্থন সন্ন্যাসীর কাজ নয়। আপনার কাছে তাই আমার প্রার্থনা…বুড়ো মিশনারীগুলোর আক্রমণকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। কিন্তু আমি দারুণ আঘাত পেয়েছি মজুমদারের ঈর্ষার জ্বালা দেখে। প্রার্থনা করি, তার যেন চৈতন্য হয়।…সাধু ও পবিত্র হবার যত চেষ্টাই কেউ করুক না কেন, মানুষ যতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছে, তার স্বভাব কিছু পরিমাণে নিম্নগামী হবেই।”

মেরি লুইস বার্ক-এর ছটি খণ্ড ধৈর্য ধরে পড়লে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেন বিবেকানন্দ এক শ্রেণীর মানুষের বিদ্বেষের কারণ হয়ে উঠেছিলেন। স্বামীজির বক্তৃতার ফলে ভারতের যথার্থ সংবাদ পেয়ে অনেকেই ভারতে ধর্মান্তরিতকরণের চাদা কমিয়ে দেন। এর ফলে চার্চ তহবিলে দানের পরিমাণ এক বছরে দশ লক্ষ পাউন্ড তখনকার হিসেবে দেড় কোটি টাকা (এবং এখনকার হিসেবে সাড়ে আট কোটি টাকা) কমে যায়। তাই কেউ কেউ পণ করলেন, “জাহান্নাম যেতে হয় তাও স্বীকার, কিন্তু নচ্ছার বিবেকানন্দর সর্বনাশ করতেই হবে।”

ডেট্রয়েটে প্রাক্তন গভর্নরের স্ত্রী শ্রীমতী জন জি ব্যাগলি ছিলেন বিবেকানন্দর গুণমুগ্ধ, তাঁর বাড়িতে স্বামীজি আতিথেয়তা নেন। ক্ষিপ্তপ্রায় শত্রুপক্ষ গুজব ছড়িয়ে দিল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের আচরণে উত্ত্যক্ত হয়ে একটি অল্পবয়স্কা ঝিকে ব্যাগলির গৃহ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অতিথিটি অসম্ভব রকম আত্মসংযমহীন।

মিথ্যা গুজবে বিরক্ত হয়ে মিসেস ব্যাগলি ২২ জুন ১৮৯৪ সালে চিঠি লিখলেন, “তিনি আমাদের বাড়িতে অতিথিরূপে তিন সপ্তাহের অধিক ছিলেন এবং তাকে আমি, আমার ছেলেরা, আমার জামাই ও গোটা পরিবার সর্বদা ভদ্রলোকরূপে পেয়েছি তার ব্যবহার অতি অমায়িক ও সৌজন্যপূর্ণ, সঙ্গী হিসেবে তিনি আনন্দময় ও অতিথিরূপে সদাবাঞ্ছিত। বহুদিন পর মেরি লুই বার্ক জানতে পারেন, মিসেস ব্যাগলির ন’বছর বয়সের নাতনীকেও এইসময় অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল, স্কুলের সহপাঠিনীরা বাড়িতে বিধর্মী রাখা হয়েছিল বলে নাতনীকে মুখ ভেঙচাত।

অমন যে অমন হেল পরিবার সেখানেও প্রবল ধাক্কা গিয়েছিল। শ্ৰীমতী হেলকে একখানা বেনামী চিঠিতে বলা হলো, স্বামীজি দুশ্চরিত্র, অতএব হেল পরিবারের কন্যাদের সঙ্গে যেন তাকে মিশতে না দেওয়া হয়।

শুধু কুৎসা রটানো নয়, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে আসে মার্কিন মুলুকে যে স্বামীজিকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হতে পারে এমন আশঙ্কাও মনে জেগেছিল। যাঁরা অলৌকিকে বিশ্বাস করেন তারা জানেন, ডেট্রয়টের এক ডিনারে স্বামীজি যখন কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে যাবেন তখন দেখলেন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলছেন, ‘খাসনি, বিষ!”

স্বদেশ থেকেও যে নিন্দার নিরন্তর প্রচার চলেছে তার মোদ্দা কথাটা বলে–স্বামীজি অধুনা বিবেকানন্দ হলেও আসলে তিনি নরেন্দ্রনাথ দত্ত, তিনি খাঁটি হিন্দু নন, তিনি ম্লেচ্ছাচারী তাম্রকূটসেবী সাগরলঙঘনকারী গায়ক ও অভিনেতা-স্বেচ্ছাচারী এবং আমোদপ্রিয়।

কাল ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮, স্থান বেলুড়, ভাড়াটিয়া মঠবাটি। স্বামীজি তাঁর প্রিয়শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়িতে বলছেন :

“অল্প বয়স থেকেই আমি ডানপিটে ছিলুম, নইলে কি নিঃসম্বলে দুনিয়া ঘুরে আসতে পারতুম রে?”

আমেরিকার কথা ওঠায় একসময় তিনি বললেন, “আমার নামে কত কুৎসা কাগজে লিখে রটনা করেছিল। কতলোক আমায় তার প্রতিবাদ করতে বললো। আমি কিন্তু গ্রাহ্য করতুম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাসচালাকি দ্বারা জগতে কোনো মহৎ কার্য হয়না। তাই ঐ সকল অশ্লীল কুৎসায় কর্ণপাত না করে ধীরে ধীরে আপনার কাজ করে যেতুম। দেখতেও পেতুম, অনেকসময় যারা আমায় অযথা গালমন্দ করত, তারাও অনুতপ্ত হয়ে আমার শরণ নিত এবং নিজেরাই কাগজে প্রতিবাদ করে ক্ষমা চাইত। কখন কখন এমনও হয়েছে আমায় কোন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে দেখে কেউ কেউ আমার নামে ঐসব মিথ্যা কুৎসা বাড়িওয়ালাকে শুনিয়ে দিয়েছে। তাই শুনে তিনি দোর বন্ধ করে কোথাও চলে গিয়েছে। আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখিসব ভো ভেঁ, কেউ নেই, আবার কিছুদিন পরে তারাই সত্য কথা জানতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে আমার চেনা হতে এসেছে।” কি জানিস বাবা,সংসার সবই দুনিয়া-দারি!ঠিক সৎসাহসী ও জ্ঞানী কি এসব দুনিয়াদারিতে ভোলে রে বাপ! জগৎ যা ইচ্ছে বলুক, আমার কর্তব্য কার্য করে চলে যাব–এই জানবি বীরের কাজ।…লোকে তোর স্তুতিই করুক বা নিন্দাই করুক, তোর প্রতি লক্ষ্মীর কৃপা হোক বা না হোক, আজ বা শতবর্ষ পরে তোর দেহপাত হোক, ন্যায় পথ থেকে যেন ভ্রষ্ট হ’সনি। কত ঝড় তুফান এড়িয়ে গেলে তবে শান্তির রাজ্যে পৌঁছানো যায়। যে যত বড় হয়েছে, তার উপর তত কঠিন পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার কষ্টিপাথরে তার জীবন ঘষে মেজে দেখে তবে তাকে জগৎ বড় বলে স্বীকার করেছে। যারা ভীরু কাপুরুষ, তারাই সমুদ্রের তরঙ্গ দেখে তীরে নৌকা ডোবায়।”

ডাঃ ব্যারোজ যে প্রথমে স্নেহপরায়ণ হয়েও ক্রমশ কানপাতলা হয়ে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বিগড়েছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ শঙ্করীপ্রসাদ বসুমহাশয় আমাদের উপহার দিয়েছে। পুরনো অনুরাগী যখননতুনশত্রুর ভূমিকা গ্রহণ করেন তখন অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায়।

ডাঃ ব্যারোজ ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন, প্রবল শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও বিবেকানন্দ তার অভ্যর্থনার জন্য যেসব ব্যবস্থা করেছিলেন তা বোধ হয় তার মনঃপূত হয় নি। পরবর্তীকালে তার একটি ছোট্ট বক্তব্য এদেশে বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্নটি ভারতীয় সমাজে গুরুতর। চিকাগো বক্তৃতার পরেই স্বামীজিকে নিয়ে ব্যারোজ নাকি একটি ভোজনালয়ে গিয়েছিলেন এবং কি খাবেন জিজ্ঞেস করায় স্বামীজি নাকি বিফের অর্ডার দিয়েছিলেন। বিলম্বে হলেও কলকাতায় সমাজে গেল-গেল রব উঠলো। অসুস্থ অবস্থায় বিবেকানন্দ তখন কলকাতা থেকে অনেক দূরে। খবর গেলো, কিন্তু খবরটা মিথ্যা হওয়া সত্ত্বেও স্বামীজি প্রকাশ্যে তর্কযুদ্ধে নামলেন না। জীবনের বড় বড় সমস্যার মোলাকাত করার সময় বিবেকানন্দ নির্বাক থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছেন, তার ফলাফল কী হলো তা নিয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি উত্তেজিত হন নি।

শুধু শত্রু নয়, স্বামীজি তার আপনজনদের হাতে যেভাবে নিগৃহীত হয়েছেন সেও এক দীর্ঘ ইতিহাস। ঠিকমতন লিখতে গেলে কেবল তার দুই সন্ন্যাসী শিষ্য লিয়োঁ ল্যান্ডসবার্গ ও মেরি লুইস সম্বন্ধে পুরো একখানা বই লিখতে হয়। স্বামীজী এঁদের সন্ন্যাস দিয়ে কৃপানন্দ ও অভয়ানন্দ নামে অভিহিত করেন। প্রবাসের কালে শিষ্য ও শিষ্যা নিয়ে স্বামীজি যে অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়েছিলেন তা বড়ই দুঃখজনক।

ল্যান্ডসবার্গ পুরো তিনবছর ছিলেন স্বামীজির অবিচ্ছেদ্য সাথী, বন্ধু, সেক্রেটারি ও সেবক। তিনি নিউইয়র্কের বিখ্যাত খবরের কাগজ নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনে কাজ করতেন। স্বামীজির সঙ্গে তিনি একই বাড়িতে (৩৩ নম্বর রাস্তা) নিউ ইয়র্কে থাকতেন এবং তার অসীম স্নেহের পাত্র হয়ে। উঠেছিলেন। প্রথমপর্বে বস্টন থেকে (১৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) স্বামীজি প্রিয় শিষ্য কৃপানন্দকে লিখছে, “তুমি নিজের ব্যবহারের জন্য কিছু বস্ত্রাদি অবশ্যই ক্রয় করবে, কারণ এগুলির অভাব এদেশে কোন কাজ করার পক্ষে তোমার প্রতিবন্ধক স্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।…আমাকে ধন্যবাদ দেবার কোন প্রয়োজন নাই, কারণ এটা আমার কর্তব্যমাত্র। হিন্দু আইন অনুসারে শিষ্যই সন্ন্যাসীর উত্তরাধিকারী, যদি সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে তার কোন পুত্র জন্মিয়াও থাকে, তবু সে উত্তরাধিকারী নয়। এ-সম্বন্ধ খাঁটি আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ–ইয়াঙ্কির অভিভাবকগিরি’ ব্যবসা নয়, বুঝতেই পারছো।”

কৃপানন্দ জাতিতে ইহুদি এবং আদিতে পোল্যান্ডবাসী ছিলেন। ব্রহ্মবাদিন পত্রিকায় কিছু পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন।

এরপর শুনুন স্বামী অভেদানন্দর ‘আমার জীবনকথা’ থেকে বর্ণনার আঙ্গিকে : “২৭ মার্চ ১৮৯৮ নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডে স্বামী বিবেকানন্দকে আক্রমণ করে এবং রাজযোগকে বিদ্রূপ করে একটি সচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে মাথায় পাগড়ি বাঁধা এক মোগলাই চেহারার কৃষ্ণকায় ব্যক্তির পদতলে এক শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার চিত্র ছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই প্রবন্ধ স্বামীজির অধঃপতিত শিষ্য কৃপানন্দ লিখেছিলেন। স্বামী অভেদানন্দ এই প্রবন্ধ সঙ্গে নিয়ে মিস্টার লেগেটকে দেখাবার জন্য তার বাড়িতে গমন করেন। তারা সেই প্রসঙ্গে কথা বলছেন এমন সময় কৃপানন্দ অকস্মাৎ লেগেটের বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। কৃপানন্দের আগমনবার্তা পেয়ে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে মিস্টার লেগেট বেরিয়ে আসলেন এবং প্রবন্ধটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন

‘তুমি কি এই প্রবন্ধ লিখেছ?’

 কৃপানন্দ বলল–হ্যাঁ।

‘কত পেয়েছ?’

‘বেশি নয়, পঞ্চাশ ডলার মাত্র।‘

‘তুমি এত নীচ, এত স্বার্থপর যে, সামান্য অর্থের জন্য তোমার আচার্যকে উপহাসাস্পদ করলে? আমার বাড়ি থেকে বের হও।’ কৃপানন্দ যেমন এসেছিলেন তেমনই বেরিয়ে গেলেন।”

এবিষয়ে পরবর্তীকালে আমরা স্বামী অভেদানন্দর মুখে আরও কিছু শুনেছি। “অভয়ানন্দ, যোগানন্দ, কৃপানন্দ–এরা শেষে সব স্বামীজির বিরুদ্ধে গেছেন। যোগানন্দ ভাল লোক ছিল, বেদান্ত বলতে পারতো না, ভান্দান্ত বলত।…১৮৯৯-১৯০১ স্বামীজি দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় যান, তখন শরীর খুব খারাপ…তিনি লেগেটের বাড়িতে ওঠেন। এক ডাক্তার (ডাক্তার গার্নসি) ওঁকে খুব ভালবাসতেন। তার এক ছেলে মারা গেল। তার মুখ নাকি স্বামীজির মতন দেখতে। তা সেই ডাক্তারের বাড়িতে তখন স্বামীজি আছেন।

একদিন স্বামীজির শরীর পরীক্ষা করছেন ডাক্তার গার্নসি। হঠাৎ কৃপানন্দ সেখানে এসে পড়েন। তাই দেখেই স্বামীজির নাড়ি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ওকে দেখেই ও রকম হলো। ডাক্তার তখন কৃপানন্দকে চলে যেতে বললেন।

আটলান্টিক পেরিয়ে ইংলন্ডে ফিরে এসেও স্বামীজি যে মানসিক শান্তি পান নি তার বিবরণও নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যারা একসময় বন্ধু থাকে তারাও ভাগ্যের পরিহাসে অনেক সময় শত্রুতে পরিণত হয়ে মহাপুরুষদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ান। দুটি চরিত্রের কথা বিশেষভাবে মনে এসে যায়–মিস্ হেনরিয়েটা মুলার, যিনি একসময় প্রবল উৎসাহী হয়ে বেলুড় মঠের জমি কেনবার জন্য বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন, আর একজন এডওয়ার্ড স্টার্ডি, একসময় স্বামীজি তাঁর ওপর বড় বেশি নির্ভর করেছিলেন।

লন্ডনে মিস্ মুলারের আতিথ্যে থাকার সময় থেকেই পরিস্থিতি যে খারাপ আকার ধারণ করছে তা বিবেকানন্দভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের ‘লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ’ বইটিতে স্বামী সারদানন্দ ও স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার গুডউইনের বিভিন্ন অস্বস্তিকর মন্তব্য থেকেই বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এডওয়ার্ড স্টার্ডির ব্যাপারটাও বিশেষ বেদনাদায়ক, এই লোকটির আচরণে স্বামীজি যে খুবই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে তার সুদীর্ঘ চিঠিতে।

একজন ভক্ত পত্রযোগে জানান, মিস্ মুলার স্বামীজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। গুরুভাই স্বামী অভেদানন্দ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি কোন কথাই বুঝবেন না, বললেন ইন্ডিয়া ইজ এ গড় ফরশেকেন কানট্রি। ইনিই স্বামীজিকে ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান বলেছিলেন।

এর আগের পর্বে প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে মিস মুলার : “একেই স্ত্রীলোক তাতে আবার বুড়ী, মেজাজ অত্যন্ত খিটখিটে, কাহারও সহিত বনিবনা হয় না।” আরও একটি বর্ণনা–”তাহার ঠোঁটে পুরুষের মতো একটু গোঁফ এবং দাড়িতে সামান্য একটু চুল হইয়াছিল।”

এই মহিলাই চিঠি লেখেন ভারততত্ত্ববিদ অধ্যাপক ম্যাক্সমুলারকে এবং পরে এঁকে এবং স্বামী সারদানন্দকে নিয়েই বিবেকানন্দ দেখা করেন ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে।

এঁর বাড়িতেই টেবিলে একটি বই দেখে স্বামীজির ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সেটি পড়বার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মহেন্দ্রনাথের বর্ণনা মিস মুলার : “বই কাহাকেও দিব না। বই লইয়া গেলে কেউ ফেরত দেয় না। স্বামীজি বললেন, না, মহিম বই ফেরত দেবে। বইটি বিরক্তভাবে মহেন্দ্রনাথকে দিয়ে মিস মুলার বললেন, “ব্যাটাছেলেকে কখনও বই পড়তে দিতে নেই, নিয়ে গেলে আর তারা কখনও ফিরত দেয় না, পুরুষদের এটা ভারি দোষ। আর মাগীদের কথা যদি বল তো নিডিলবক্স, থিম্বুল ও কঁচি দেখতে পেলেই সুবিধামতো নিয়ে সরে পড়বে।” স্বামীজি ব্যঙ্গচ্ছলে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তাদের বাড়িতে কি কাঁচি, নিডিলবক্স সব থাকে না?” মিস মুলার উত্তেজিত হয়ে বললেন, “থাকে না কেন! মাগীদের তো ঐসব রোগ, এই জন্যে মাগীরা এলে অত ভয় করে,”

খুব রাগী ছিলেন মিস মুলার, তাই স্বামী সারদানন্দ বলতেন, এই দেবীকে পুজো করবার মন্ত্র :

ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট,
তুষ্ট রুষ্ট ক্ষণে ক্ষণে।

এঁকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য ভাই ও গুরুভাইকে স্বামীজির বিশেষ উপদেশ : “খুব সাবধানে চলবি। ঘরে ঢুকলেই দাঁড়িয়ে উঠবি, কেমন আছেন জিজ্ঞেস করবি, প্যান্টালুনের পকেটে হাত রাখবি না, বুকে হাত রাখবি না। বুড়ী যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তবে বাপু তোরা বসি নি।”

স্বামীজির জীবনে উইম্বলন্ডন-নিবাসী মিস হেনরিয়েটা মুলারের ভূমিকাকে স্বামী প্রভানন্দ “যুগপৎ আনন্দের ও দুঃখের” বলে বর্ণনা করেছেন। আনন্দের হেতু তিনি অর্থদান করে মঠ-কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব জমি কিনতে সাহায্য করেছিলেন, “দুঃখের হেতু, তিনি পরে সঙ্ঘের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।”

দেখা যাচ্ছে বেলুড়ের জমি সন্ধান কালেই মিস মুলার অর্থ সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। ৩০ নভেম্বর ১৮৯৭ স্বামীজি তাঁর প্রিয় গুরুভাই স্বামী ব্ৰহ্মনন্দকে লিখছেন, “মিস মুলার যে টাকা দিবেন বলিয়াছিলেন, তাহার কতক কলকাতায় হাজির। বাকি পরে আসিবে শীঘ্রই…তুমি নিজে ও হরি পাটনায় সেই লোকটিকে ধর গিয়া–যেমন করে পারো influence কর; আর জমিটে যদি ন্যায্য দাম হয় তো কিনে লও।”

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮ শশী মহারাজকে স্বামীজি লিখলেন, “যে জমি কেনা হইয়াছে, আজ আমরা উহার দখল লইব।” ৬ মার্চ স্বামী প্রেমানন্দ লিখছেন শশী মহারাজকে “গতকল্য ঐ জায়গাটি ৩৯,০০০ টাকায় ক্রয় করা হইয়াছে।” ইঙ্গিত রয়েছে শ্বেতপাথরে মন্দির তৈরির “দেখেশুনে লোকে অবাক হয়ে যাবে।” ২৫ ফেব্রুয়ারির আর একচিঠিতে স্বামী ত্রিগুণাতীতা লিখলেন প্রমদাদাস মিত্রকে :” চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে আঠারো বিঘা উত্তম জমি গঙ্গার পশ্চিমকূলে ক্রয় করা হইয়াছে। আরও মঠের জন্য প্রায় একশত বিঘা জমি ঐ জমির চতুস্পর্শ ক্রয় করিবার মত আছে। জমিতেই প্রায় দুইলক্ষ টাকা পড়িয়া যাইবে।”

মিস মুলার সম্পর্কে আরও খবরাখবর স্বামী প্রভানন্দ দিয়েছেন। তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৮৯৭ মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। খেয়ালী ও আগ্রাসী প্রকৃতির মিস মুলারের আচরণে স্বামীজি কিরকম বিব্রত বোধ করতেন তার আন্দাজ পাওয়া যায় স্বামীজির অপ্রকাশিত একটি চিঠি থেকে। আলমোড়া থেকে ৯ জুলাই ১৮৯৭ স্বামীজি সিংহলে তার গুরুভাই স্বামী শিবানন্দকে লেখেন, “এখানে আমরা দু-তিনদিন বিনসর ডাকবাংলোয় ছিলাম–পরে আমি শ্যামধূরায় যাত্রা করায় মিস মুলার ক্ষেপিয়া আলমোড়ায় গিয়াছে। মিস মুলার বিষম ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে…। আমি বন্ধুর বাটীতে যাইতেছি। অতি খিনে মন। এই বৃহৎ বাড়ি আমাকে না বলিয়া কহিয়া ৮০ টাকা মাসে এক সিজনের জন্য ভাড়া করাইল। সকলের উপর মহারাগ, গালিম! এক্ষণে আমি অর্ধেক দিব বলায় কিঞ্চিৎ সুস্থ। বেচারীর মাথা খারাপ বোধ হয়।…এখন বলে, আমি ও বদ্রি শাহরা সকলে তাহাকে লুটিতেছি।”

স্বামীজির সহ্যশক্তিতে এই মহিলার সাময়িক পরিবর্তন হয়েছিল। স্টার থিয়েটারে সিস্টার নিবেদিতার পরে (১১ মার্চ ১৮৯৮) একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন বেলুড়ের জমির জন্য মিস মুলার কত দিয়েছিলেন। জমির দাম ৪০,০০০ টাকা এবং জমি লেভেল করার জন্য আও চার হাজার টাকা। গুডউইনের মাধ্যমে মিস মুলার দিয়েছিলেন ৩০,০০০ টাকা।

মেরি লুইস বার্ক জানাচ্ছেন প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ অবস্থায় মিস মুলার ইংলন্ডে ফেরেন ১৮৯৯-এর গোড়ার দিকে। “কিন্তু ভারত ত্যাগের পূর্বে তিনি একটি অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলেন। তাঁর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ফেটে পড়লো।” তাঁর বিষোগার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে পড়ল। তারপর ২৫ ডিসেম্বর ১৮৯৮ গোঁড়া খ্রিস্টান পত্রিকা দ্য ইন্ডিয়ান সোস্যাল রিফরমারে ঘোষণা, মিস মুলার স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁর খ্রিস্টান বিশ্বাসে ফিরে গিয়েছেন।

মিস মুলার শেষবারের মতন বেলুড় মঠে এসেছিলেন ৯ নভেম্বর ১৮৯৮।

মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, লন্ডনে নানা ভাবে বিব্রত হয়ে থেকেও স্বামীজি বিপুল বিক্রমে নিজের কাজ করে চলেছিলেন। সমস্যার কোনো শেষ নেই, তারই মধ্যে ভাই মহেন্দ্রনাথ আচমকা বিলেতে হাজির হয়েছেন, ব্যারিস্টারি পড়বার সাধ নিয়ে। আরও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে এই সময়েই আমরা প্রথম স্বামীজির হার্ট অ্যাটাকের রিপোর্ট পাচ্ছি। অনুরাগী ফক্স ও মহেন্দ্রনাথ সেই সময় উপস্থিত। মধ্যাহ্নভোজনের পর একটা চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে, হঠাৎ স্বামীজির মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল।

খানিকক্ষণ পরে তিনি শ্বাস ফেলে বললেন, “দেখ ফক্স আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন। বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল; এইটা আমাদের বংশের রোগ।”

প্রবাসে ভাইকে নিয়ে যে স্বামীজির দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না তা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। খেতড়ির মহারাজার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মহেন্দ্রনাথ বিলেতে গেলে তিনি ভাইয়ের ওপর খুব রেগে গিয়েছিলেন।

“তার পরিচিত বন্ধু প্রভৃতির কাছ থেকে কেউ টাকা নেয়–এ স্বামীজি মোটেই পছন্দ করতেন না। ভাই যখন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকায় যেতে রাজি হলেন না তখন রেগেমেগে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি এক পয়সা দেবো না। তুমি পায়ে হেঁটে ফিরে যাও।” যা সবচেয়ে আশ্চর্য, মহেন্দ্রনাথ পায়ে হেঁটেই ভারতে ফিরে এসেছিলেন। মানুষ কতখানি একগুয়ে এবং দুঃসাহসী হতে পারে তা সিমলার দত্ত পরিবারের তিন ভাইকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব। স্বদেশে বিবেকানন্দ নিজেও একবার বলেছিলেন আমেরিকা যাবার জাহাজভাড়া জোগাড় করতে না পারলে তিনিও পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়বেন।

লন্ডনের বিভিন্ন বক্তৃতার মাধ্যমে স্বামীজি যেমন বিশ্বজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, তেমন একই সঙ্গে চলেছে বিরামহীন ভোগান্তির পালা। বিশ্বসংসারের সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে একই সঙ্গে লড়াই করতে করতে রোগজীর্ণ শরীরের মানুষটি কেমন করে মানুষের জন্য এতো ভেবে গেলেন এবং করে গেলেন তা ভাবলে কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না।

লন্ডনের এক বিখ্যাত সভায় জনৈক পেনসন পাওয়া সায়েব এসে উপস্থিত ইনি বোধ হয় সারাজীবন বেঙ্গলে কাজ করেছেন। বক্তৃতার শুরুতেই সায়েবটি অত্যন্ত অসভ্য মন্তব্য শুরু করলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, স্যর মনিয়ার উইলিয়ম কোন বইতে লিখেছেন, বুদ্ধ অতি স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর লোক ছিলেন, নিজের স্ত্রীপুত্রকে ত্যাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। স্বামীজি তাঁকে তোয়াক্কা না করে বুদ্ধ সম্বন্ধে যখন বলছে, তখন সায়েবটি বললেন, “আমি জানি সাধুরা চোর, সব চোর। আমি তাদের পিছনে পুলিস লাগিয়ে দিতাম, অনেক সময় পুলিস দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতাম। চোর উঁচড় লোকরাই গেরুয়া পরে, আর তাদেরই সাধু বলে।”

সায়েব মনে করেছিল, “স্বামী বিবেকানন্দ কোন মাদ্রাজী হইবে, কারণ পূর্বে অর্শচিকিৎসার জন্য অনেক মাদ্রাজী বউবাজারে বাস করিত এবং তাহাদের লম্বা মাদ্রাজী নামের পূর্বে স্বামী কথাটি থাকিত।”

সায়েব বুঝলেন বক্তা বাঙালি। তখন বললেন, এই বেঙ্গলীবাবুদের আমরা মিউটিনির সময় বাঁচিয়ে ছিলুম। স্বামীজির অনুরাগী এক ইংরেজ চিৎকার করে উঠলেন, তার জন্যে মোটা মোটা মাইনে তো নিয়েছিলে।

সভায় প্রবল উত্তেজনা, হাতাহাতি হবার উপক্রম।

সারদানন্দ ও মহেন্দ্রবাবু প্রবাসের মাটিতে হাঙ্গামা দেখে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলেন। তখন স্বামীজি শান্তমূর্তি ত্যাগ করে অন্য এক ভীষণ মূর্তি ধারণ করলেন।… সেই ইংরেজটির দিকে মুখ করে ৩৫ মিনিট অনর্গল অগ্নিবর্ষণ করতে লাগলেন। হেনজেস্ট ও হরসার সময় হ’তে সেইদিনকার সময় পর্যন্ত ইংরেজ জাতি কোন দেশেতে কোন সময়ে, কিরূপ অত্যাচার ও অনাচার করেছে তার ইতিহাস অনর্গল বলে যেতে লাগলেন।..

স্বামীজির ইতিহাসের জ্ঞান দেখে শ্রোতারা সকলে স্তম্ভিত হয়ে রইল। অপমানিত ইংরেজটি পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁদতে লাগল এবং রুমালে নাক ঝাড়তে লাগল।

“পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে শ্রোতাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে শান্ত স্নিগ্ধভাবে স্বামীজি শুরু করলেন, ‘নাউ আই কাম টু প্রত্যাহার অ্যান্ড ধারণা।’–যেন এখানে কিছুই ঘটে যায় নি। স্থির, নিশ্চল সিদ্ধ যোগীর মতন স্বামীজি বলে যেতে লাগলেন।

“আপনি আমাদের সহ্যশক্তির শিক্ষা দিয়েছেন,” এই বলে বক্তৃতার শেষে শ্রোতারা স্বামীজিকে অভিনন্দন জানালেন। অনুগতরা বললেন, অসভ্য চোয়াড়ে লোকটাকে কোনো উচিত ছিল। স্বামীজি এতক্ষণ স্থিরভাবে বসেছিলেন। তিনি তখন বললেন, “প্রত্যেকেই নারায়ণ। এই লোকটিও নারায়ণ। তবে ওর মধ্যে দুষ্ট নারায়ণ রয়েছে।” এরপর গুডউইনকে টুপি, ক্লোক, ছড়ি নিয়ে আসতে বললেন এবং মুখে একটি সিগারেট দিয়ে বেড়াতে বেরোলেন, ফিরলেন অনেক রাতে।

স্বামীজির জীবনের নানা বিড়ম্বনার বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে মেরি লুইস বার্কের গবেষণায়।

শঙ্করীপ্রসাদ বসু স্বাধীজির বিদ্রোহিনী শিষ্যা স্বামী অভয়ানন্দ সম্বন্ধে কিছু তথ্য পরিবেশন করেছেন। যেমন, পূর্বাশ্রমে (মেরি লুই ডেভিড) অভয়ানন্দ আদতে ফরাসি। পরে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। কৃপানন্দ ২ মার্চ ১৮৯৬ ব্রহ্মবাদিন পত্রিকায় নিজেই লেখেন, তিনি ও মেরি লুই বিশেষ পীড়াপীড়ি করায় স্বামীজি অগত্যা রাজি হয়েছিলেন সন্ন্যাস দিতে। শিষ্যরূপে এঁদের দুজনকে নির্বাচন করার পিছনে ছিল স্বামীজির ধারণা–গোঁড়া খ্যাপামি বিপথগামী শক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঐ শক্তিকে যদি রূপান্তরিত করে ঊর্ধ্বতর প্রণালীতে প্রবাহিত করা যায় তাহলে তা বিরাট মঙ্গলশক্তি হয়ে উঠতে পারে। ১৮৯৫ সালেই নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সমিতি এবং কৃপানন্দের সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। এই বিরোধ দূর করবার জন্য (ডিসেম্বর ১৮৩৫) স্বামীজি মিস ওয়ালডোকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে যান কিন্তু তেমন সফল হননি। ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভয়ানন্দ ভারতে আসেন এবং ঢাকা, মৈমনসিংহ ও বরিশাল ভ্রমণ করেন। পরে বেদান্ত ত্যাগ করে গৌরাঙ্গ সমাজে যোগ দেন এবং বৈষ্ণব শক্তি চালিত অমৃতবাজার গোষ্ঠির উদার প্রশ্রয় লাভ করেন। এই সময় তার গলায় বৈষ্ণবকণ্ঠী দেখা যেতো।

৭ মে ১৯০২ সালে সংবাদ থেকে জানা যায় কাশিমবাজারের মাননীয় মহারাজার অর্থানুকূল্যে মাদাম মেরি লুই আবার ভারতে আসেন। স্বামীজির দেহত্যাগের সময় (৪ জুলাই ১৯০২) তিনি এদেশে ছিলেন এবং বিভিন্ন ধনীপরিবারে গিয়ে বক্তৃতা করেন। ৭ জুলাই ১৯০২-এর আগে স্বামীজির তিরোধান সংবাদ অমৃতবাজার পত্রিকায় বেরোয়নি–রিপোর্টের আকার সিকি কলম, কিন্তু একই দিনে অভয়ানন্দের একটা বক্তৃতার রিপোর্ট ছিল ঠাসা কয়েক কলম ভর্তি। ১৪ জুন ১৯০২ মিসেস সারা বুলকে স্বামীজি এই শিষ্যা সম্বন্ধে লেখেন, “শুনতে পাচ্ছি, জনকয়েক ধনী তাকে লুফে নিয়েছে। সে যেন এবারে প্রচুর অর্থ পায়–এই আমার আকাঙ্ক্ষা।”

“আমাকে যে যে ভাবে উপাসনা করে, আমি সেভাবেই তাকে অনুগ্রহ করি। সে টাকা চেয়েছিল। ভগবান তাকে প্রচুর টাকা দিন।”

স্বামী অভেদানন্দের স্মৃতি কথায় আরও একটি কাহিনী আছে। সেটাও জেনে রাখা মন্দ নয়। অভেদানন্দ সূত্র থেকে আরও জানা যায়, পরে আমেরিকায় অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে অতি শোচনীয় ভাবে সন্ন্যাসিনী শিষ্যা অভয়ানন্দের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯১৩ সালে শিকাগোর বাড়িতে আগুন লেগে অভয়ানন্দ সর্বস্বান্ত হন। ১৯১৫ সত্তর বছরের এই বৃদ্ধাকে কোল্ড, হাংরি ও পেনিলেস বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি দুঃখ করেন, জীবনে অনেক ভুল করেছি, এখন কর্মফল ভুগতে হবে। কিন্তু তারও আগে স্বামী অভেদানন্দের মুখে শোনা যায়, মেরি লুই ভারতে এসে বিশেষভাবে সংবর্ধিত হন এবং ঢাকায় তিনি কয়েকটি বক্তৃতা করেন। সেখান থেকে ফিরবার পরে তিনি বেলুড়ে উপস্থিত হন, তখন সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা, মিসেস ওলি বুল, মিস ম্যাকলাউড প্রভৃতি হোমাগ্নির চারপাশে ব্যাঘ্র ও মৃগচর্মাসনে বসেছিলেন। মেরি লুই আচমকা উপস্থিত হওয়ায় এবং অন্য কিছু না পাওয়ায় তাকে একখানি ছাগচর্মের আসন দেওয়া হয়। এতে তিনি ভীষণ রেগে যান এবং স্বামীজির বিরুদ্ধ-দলে যোগ দেন।

শুধু এক কোকিলে যেমন বসন্ত আসে না তখন একজন অভয়ানন্দ বা কৃপানন্দ কোনো মহামানবের জীবনে কষ্ট আনেন না। নির্দোষ বিবেকানন্দের হতভাগ্য জীবনে এঁরা অনেকেই হাজির হয়েছেন কালো মেঘের মতন।

ই টি স্টার্ডির জীবনের সঙ্গে বিবেকানন্দ ও তার আন্দোলন একসময়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। ইনি একজন স্কট ভদ্রলোক। ভাগ্যানুসন্ধানে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বছরখানেকের মধ্যে দশ হাজার পাউন্ড উপার্জন করে তিনি ইংলন্ডে ফিরে আসেন। থিওজফি তাকে ভারতে নিয়ে আসে, পরে তিনি সন্ন্যাসী হন এবং যথাসময়ে বিবেকানন্দের কয়েকজন গুরুভাইর প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। পরবর্তী সময়ে স্টার্ডি ইংলন্ডে ফেরেন এবং বিয়ে করে সংসারী হন। মহেন্দ্রনাথের ‘লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে আমরা স্টার্ডি ও তার স্ত্রীর অনেক বর্ণনা পাই। আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণ রয়েছে শ্ৰীমতী মেরি লুইস বার্কের বইতে।

অনেকের ধারণা স্টার্ডির স্ত্রীর প্রচণ্ড প্রভাব থেকেই পরবর্তী কালে অশান্তির সূত্রপাত। ১৮৯৯ সালের মাঝামাঝি তিনি স্বামীজির কাজের নিন্দা শুরু করলেন এবং বেদান্ত আন্দোলনের সঙ্গে হঠাৎ সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। ব্যাপারটা যে স্বামীজির কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়েছিল তা এখন কারও অজানা নয়।

সম্পর্ক ছিন্ন হবার আগে ই টি স্টার্ডি মিসেস ম্যাকলাউডকে জানান, স্বামীজি লন্ডনে এসে তার বাড়িতে থাকুন। কিন্তু ছ’মাস পরে স্বামীজি যখন লন্ডনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন তিনি পরিষ্কারভাবে জানালেন তার পক্ষে কোনো খরচাপাতি করা সম্ভব হবে না। ৩১ জুলাই ১৮৯৯ স্বামীজি যখন বিলেতে ফিরে এলেন তখন স্টার্ডি তাকে অভ্যর্থনা করতে বন্দরেও এলেন না।

মিস হেনরিয়েটা মুলারের বাবা ছিলেন জার্মান, চিলিতে গিয়ে কাঠের ব্যবসায় তিনি রীতিমতো ধনী হন এবং পরে ইংলন্ডে ফিরে এসে ছেলেমেয়েদের মধ্যে তার সম্পদ ভাগ করে দেন। মিস মুলার পরে দলত্যাগী হয়ে, প্রকাশ্যে অভিযোগ তুললেন, মুখে যাই বলা হোক, হিন্দুধর্মের প্রধান কথা হলো লিঙ্গপূজা। আরও গুরুতর অভিযোগ তুললেন, ভারতবর্ষে কাজের জন্য স্বামী বিবেকানন্দকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল তা তিনি নিজের পরিবারের পিছনে ঢেলেছেন।

এই ধাক্কা সাসময়ে ই টি স্টার্ডির ওপরও এল। তিনি সম্পর্ক ছাড়বার আগে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে স্বামীজির কাছে টাকা কড়ির হিসেব চাইলেন। ৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামীজি ইংলন্ডের উইম্বলডন থেকে মিসেস বুলকে হিসেব সংক্রান্ত একটা স্পষ্ট চিঠি লেখেন। “আপনি এবং অন্যরা কাজের জন্য আমাকে যে টাকা দিয়েছেন তার থেকে একটা টাকাও আমি নিইনি। আমার মাকে সাহায্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত জানিয়ে ক্যাপটেন সেভিয়ার আমাকে ৮০০০ টাকা দিয়েছিলেন আমার মাকে দেবার জন্য। সে টাকারও বারটা বেজেছে মনে হচ্ছে। এর বাইরে আমার পরিজনের জন্য অথবা

এমনকি আমার ব্যক্তিগত খরচের জন্যও আর কিছুই খরচ করা হয়নি। আমার খাইখরচের দায়িত্ব নিয়েছেন খেতড়ির রাজা, তারও প্রধান অংশ প্রতিমাসে মঠে চলে যায়। যদি না ব্রহ্মানন্দ তার থেকে কিছু অংশ আমার খুড়ির বিরুদ্ধে মামলায় খরচ করেন। যদি তিনি তা করে থাকেন তা হলে যে কোনো উপায়েই হোক আমি তা পূরণ করে দেব, যদি তা করতে বেঁচে থাকি।” এই চিঠি এখনও বাংলা বাণী ও রচনায় স্থান পায়নি।

স্টার্ডির সঙ্গে স্বামীজির পত্রবিনিময়ের কিছু অংশ এখনও রচনাবলীতে স্থান না পেলেও মেরি লুইস বার্ক কিছু অংশ উদ্ধার করে আমাদের উপহার দিয়েছে। রিজলি ম্যানর থেকে লেখা একটি চিঠির তারিখ ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৯। “আমি মিসেস সুটারের কাছ থেকে $ ৫০০ = ৭৫০০ টাকা + $ ৫০০ = ৭৫০০ টাকা পেয়েছিলাম, গুডউইনের মাধ্যমে মিস মুলারের কাছ থেকে এসেছিল ৩০০০০ টাকা, মোট ৪৫০০০ টাকা। এর থেকে জমি কেনার দাম ৪০০০০ টাকা এবং নিচু জমি ভরাট করতে আরও ৪০০০ টাকা। আমি নিজের জন্যে একটা আধলা নিই নি, আমার খরচ আসে বক্তৃতা থেকে, লেখা থেকে। কিছু এসেছে খেতড়ির রাজার কাছ থেকে, কি মিসেস সেভিয়ারের কাছ থেকে।…আমি কি তোমার কাছ থেকে কোনো টাকা চেয়েছি? আমি কারও কাছে হাত পেতেছি মনে পড়ে না, যদিও নিজে থেকে কেউ কেউ কিছু দিয়েছেন। এর পর স্বামীজি বলেছেন, মিস মুলার ইত্যাদি কেউ যদি টাকা দেওয়ার জন্য দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে একটু সময় দিন, আমি টাকা ফেরত দিয়ে দেব।

স্টার্ডিকে লেখা স্বামীজির চিঠিগুলি এখনও পূর্ণভাবে বাংলা পাঠকের কাছে আসেনি। কিছুটা ঔৎসুক্য মিটিয়েছেন মেরি লুইস বার্ক তাঁর দুঃসাহসিকতাপূর্ণ গবেষণা-পুস্তকে। এই পর্যায়ে ২১ ওয়েস্ট থার্টি ফোর স্ট্রিট, ইস্ট ইয়র্ক থেকে নভেম্বরে (১৮৯৯) লেখা স্বামীজির চিঠিটি আছে।

শঙ্করীপ্রসাদ বসু বিস্তারিত বঙ্গানুবাদ করলেও পুরো চিঠিটা অনুবাদ করেননি, সুতরাং সাধারণ পাঠককে নির্ভর করতে হবে মেরি লুইস বার্কের ওপর। আমরা শঙ্করীপ্রসাদ বসুর অনুবাদ দু’এক জায়গায় অতি সামান্য পরিবর্তন করে এখানে উপস্থিত করলাম। চিঠির আকার দীর্ঘ, কিন্তু বিপন্ন বিবেকানন্দ তার উনচল্লিশ বছরের জীবনে এমন খোলাখুলিভাবে কখনও আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেননি। সিংহবিক্রম বিবেকানন্দের রূপ ঠিকভাবে বুঝতে গেলে এই পত্রাংশ পাঠ করাটা বিশেষ প্রয়োজনীয়।

“আমার আচরণের সমর্থনের জন্য এই চিঠিনয়। যদি অন্যায় কিছু করে থাকি, কথা দিয়ে তাকে মোছা যাবে না; আর যদি কোনো সৎকাজ করে থাকি, নিন্দায় তার নিরোধ করা সম্ভব নয়।

“বিলাসিতা!–গত কয়েক মাস ধরে কথাটা বড়-বেশি শুনতে পাচ্ছি–পাশ্চাত্ত্যবাসীরা যার উপকরণ নাকি যুগিয়ে গেছে! আর আমি নাকি, ভন্ড আমি, সারাক্ষণ ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে তাকে ভোগ করেছি! এই ভোগ-বিলাসই নাকি পাশ্চাত্তে, বিশেষত ইংলন্ডে, আমার কাজের পথে মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যেন আত্মসম্মোহনের ঘোরে ভাবতে চাইলাম–তাহলে আমার ঊষর মরুজীবনের মধ্যে অন্ততঃ ক্ষুদ্র একটি মরূদ্যান আছে- সারাজীবনের নৈরাশ্যের ঘন্ধকারের মধ্যে রয়েছে আলোকিত একখণ্ড ঠাই কঠোর পরিশ্রমে ও কঠোরতর অভিশাপের জীবনের মধ্যে আছে মুহূর্তের বিশ্রাম–হোক না তা ক্ষণেকের ইন্দ্রিয়সুখের ব্যাপার!

“কী আনন্দ আমার! ঐটুকু পেতে যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদের দিনে শতবার আশীর্বাদ করেছি। কিন্তু অহহ! তোমার শেষ চিঠিটি বজ্রের মতো নেমে এল আর স্বপ্নও মিলিয়ে গেল।”

স্বপ্নভঙ্গে, বাস্তব স্মৃতি হাতড়ে, ইংলন্ডের বিলাসিতাময় জীবনের যে রূপ দেখেছেন, তাকেই এর পর স্বামীজি খুলে ধরেছেন, সেইসঙ্গে যোগ করে দিয়েছেন : “আশা করি, যদি প্রয়োজন মনে করো, এই চিঠি বন্ধুদের মধ্যে ঘুরিয়ে পড়াবে, আর যদি কিছু ভুল লিখে থাকি, সংশোধন করে দেবে।”

“রীডিং-এ তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে–যেখানে দিনে তিনবার আমাকে খেতে দেওয়া হতবাঁধাকপি-সেদ্ধ, আলু-সেদ্ধ, মসুরডাল সেদ্ধ–আর, একটু আচার দেওয়ার হিসেবের জন্য তোমার পত্নীর অবিরাম অভিশাপ। বেশি কি, কম দামের কোনো প্রকার সিগার ধূমপানের জন্য দিয়েছ বলে মনে পড়ে না। ঐ ধরনের খাবার এবং তোমার পত্নীর অভিশাপের বিষয়ে আমি কোনো অভিযোগ করেছি বলেও মনে পড়ে না, যদিও আমি কার্যতঃ চোরের মতো ভয়েভয়ে থাকতাম সর্বদা এবং খেটে যেতাম তোমাদেরই জন্য।

“দ্বিতীয় স্মৃতি সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়ির। ওখানে তোমার এবং মিস মুলারের তত্ত্বাবধান। আমার হতভাগ্য ভাই রোগে পড়ল আর তাকে মিস মুলার তাড়িয়ে দিলেন। ওখানেও স্মরণ করতে পারি না কোনো বিলাসের মধ্যে ছিলাম–খাদ্য, পানীয়, শয্যা কিংবা যে-ঘরে ছিলাম–তার দিক দিয়েও।

“পরবর্তী স্মৃতি মিস মুলারের বাড়ির। তিনি অবশ্যই দয়াবতী কিন্তু আমাকে বাদাম ও ফলের উপর জীবনধারণ করতে হয়েছিল।

“তার পরের স্মৃতি লন্ডনের একটি অন্ধকূপের [১৪ গ্রোকেট গার্ডেন যেখানে দিবারাত্র আমাকে খাটতে হয়েছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাঁচ ছ’জনের জন্য রাঁধতে হয়েছে এবং অধিকাংশ রাত্রি কাটাতে হয়েছে দু’এক কামড় রুটি-মাখন খেয়ে।

“স্মরণ হচ্ছে, মিসেস জনসন তাঁর বাড়িতে একবার ডিনার খাইয়েছিলেন, রাত্রে থাকতেও দিয়েছিলেন–তার পরদিন বুনো কালা আদমীকে নাগাড়ে গালমন্দ করে গেছেন, কেননা সে এত নোংরা যে, সারা বাড়ি ধূমপান করে বেড়িয়েছে।

“ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ারকে বাদ দিলে রুমাল-মাপের ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোও ইংলন্ডে কেউ আমাকে দিয়েছে মনে পড়ে না। অপরপক্ষে ইংলন্ডে আমার শরীর ও মনের উপরে যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল, তাতেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তোমরা–ইংরেজরা–আমায় এই তো দিয়েছ–আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছ খাঁটিয়ে-খাঁটিয়ে–এখন আবার আমার বিলাসিতার নিন্দা!! তোমাদের মধ্যে কে আমাকে একটা কোট দিয়েছ? কে দিয়েছ একটা সিগার? কে দিয়েছ মাছ বা মাংসের টুকরো? তোমাদের মধ্যে কার বলবার সাহস আছে বলবে আমি তার কাছ থেকে খাদ্য-পানীয় চেয়েছি, ধূমপানের জিনিস চেয়েছি, জামা কাপড় বা টাকাকড়ি চেয়েছি? ঈশ্বরের দোহাই, স্টার্ডি, জিজ্ঞাসা করো সেকথা, জিজ্ঞাসা করো তোমার বন্ধুদের, আর সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসা করো তোমার ‘অন্তর্যামী ঈশ্বরকে, যিনি চির জাগ্রত।

“তোমরা কাজের জন্য টাকা দিয়েছিলে, তার পাই পয়সা পর্যন্ত রয়েছে [বা কাজে লেগেছে। তোমাদের চোখের সামনে আমি [অসুস্থ] ভাইকে [অন্যত্র] সরিয়ে দিয়েছি মৃত্যুর দিকেই বোধহয়। কিন্তু যা আমার ব্যক্তিগত টাকা নয়, তার থেকে তাকে একটা পয়সাও দিই নি।”

“যাঁরা কিন্তু সত্যই সেবা করেছিলেন, তারা কিন্তু সমালোচনা করেন নি। ইংলন্ডে তেমন মানুষ ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার।

“তারা শীতের সময়ে পোষাক দিয়েছেন, অসুস্থ হলে মায়ের থেকেও স্নেহে সেবা করেছেন, ক্লান্তি ও দুঃখের দিনে সমব্যথী হয়েছেন।”–তারা কেবল আশীর্বাদই করে গেছেন।

“আমেরিকায় তেমন মানুষ মিসেস বুল, মিস ম্যাকলাউড, মিস্টার ও মিসেস লেগেট। এঁদের কেউ-কেউ ভারতে গেছেন, ভারতের মানুষকে মানুষ বলে মনে করেছেন, তাদের সুখ-দুঃখকে নিজেদের সুখ-দুঃখ বলে অনুভব করেছেন এবং সর্বদা চেয়েছেন বিবেকানন্দকে একটু আরামে রাখতে, একটু ভাল খাওয়াতে।

“আমি যখন তোমাদের দেশের মানুষদের জন্য প্রাণপাত করেছিলাম, যখন নোংরা গর্তে অনাহারের মধ্যে রেখে আমার গায়ের মাংস খাবলা করে তুলে নিচ্ছিলে এবং সঞ্চয় করে রাখছিলে বিলাসিতার অপবাদ–তখন ঐ লেগেট ও বুলদের রুটিই আমি খেয়েছি, তাদের দেওয়া পোষাকে গা ঢেকেছি, তাদের টাকাতেই ধূমপান করেছি, কয়েকবার তারাই আমার বাড়িভাড়া মিটিয়েছেন।”

এ বিলাসিতার সমালোচনা করছিল কারা? “সমালোচকদের এক এক করে ধরো–শুধু দেহজীবী তারা!–আত্মা বলে কিছু নেই সেখানে।…এইসব হৃদয়হীন স্বার্থপর লোকগুলির ইচ্ছায় আমার আচরণ ও কার্য নিয়ন্ত্রিত করতে বলো–আর বিভ্রান্ত হও তা করি না বলে?”

“আমার গুরুভাইদের আমি যা করতে বলি তারা তাই করে।…তারা আমার ভাই, আমার সন্তান আমার জন্য তারা অন্ধকূপে মরুক আমি তা চাইনি–আমি চাই নি…তারা খেটে মরবে আর তার বিনিময়ে পাবে অনাহার ও অভিশাপ।”

স্বামীজী জানালেন, পাশ্চাত্ত্যদেশে অকারণ কঠোরতা ও কৃচ্ছসাধন করে তিনি সন্ন্যাসের নিয়মভঙ্গ করেছেন। শাস্ত্রে সন্ন্যাসী বা পরমহংসের ক্ষেত্রে শরীর-নির্যাতনের বিধি নেই।

স্বামীজি লিখলেন, “প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে তুমি অনেক কথা বলেছ। স্টার্ডি, সে ভারত এখনো বেঁচে আছে কারো কারো মধ্যে, মরেনি একেবারে সেই জীবন্ত ভারত আজও ধনীর অনুগ্রহ-নিগ্রহের তোয়াক্কা না রেখে নির্ভয়ে নিজ বাণী উচ্চারণ করতে পারে। সে পরোয়া করেনা কারো–এদেশে, যেখানে তার পায়ে জড়ানো শিকল, কিংবা ওদেশে, যেখানে ঐ শিকলের প্রান্ত ধরে আছে তার শাসকেরা। সে ভারত আজও বেঁচে আছে–অমর প্রেমের ভারতবর্ষ চিরন্তন বিশ্বস্ততার ভারতবর্ষ অপরিবর্তনীয়, কেবল রীতিনীতিতে নয়, প্রেমে, বিশ্বাসে, বন্ধুত্বে। সেই ভারতের অতি নগণ্য এক সন্তান আমি, তোমাকে ভালবাসি স্টার্ডি, ভারতীয় প্রেমের ধর্মে–এবং তোমাকে এই মায়াঘোর থেকে মুক্ত হবার জন্য সাহায্য করতে সহস্রবার দেহপাত করতে পারি।”

শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে-অংশটি অনুবাদ করেননি তার কয়েকটি লাইন আমাকে মুগ্ধ করে। স্বামীজি লিখছেন, “স্টার্ডি, আমি সব বুঝি। আমার বুকটা মুচড়ে ওঠে, আমি বুঝি তুমি যাদের খপ্পরে পড়েছে তারা তোমাকে ব্যবহার করতে চায়। আমি তোমার বউয়ের কথা বলছি না, সে এতোই সরল যে ডেনজারাস হওয়া তার পক্ষে কঠিন। মাই পুওর বয়, তোমার মধ্যে মংসের গন্ধ পাচ্ছে শকুনরা।”

আমরা শুধু জানি দু’জনের পত্র বিনিময় এর পরেও বন্ধ হয়নি। ১৯০০ সালের শরৎকালে স্টার্ডিপত্নী লুসি সন্তান প্রসব কালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। স্বামীজি খবর পেয়ে ফ্রান্স থেকে এডওয়ার্ড স্টার্ডিকে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু উত্তর পাননি।

.

বিশ্ববিজয়ে বেরিয়ে বিদেশী শত্রু ও বিদেশী মিত্রদের হাতে স্বামী বিবেকানন্দ কীভাবে নিগৃহীত ও আদৃত হয়েছিলেন তার বিবরণ সংগ্রহ করতে বেরিয়ে কেউ যেন ভেবে না বসেন যে স্বদেশের মানুষদের কাছে তিনি উন্নততর ব্যবহার লাভ করেছিলেন। সেখানেও প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং সীমাহীন ভালবাসার সঙ্গে অবহেলা, অপমান, বিদ্বেষ ও বিশ্বাস ঘাতকতার অবিশ্রান্ত প্রবাহ।

এতদিনের দূরত্ব থেকে শুধু একটা প্রশ্নই মনের মধ্যে জেগে ওঠে, এই প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে এবং সারাক্ষণ সংখ্যাহীন শারীরিক ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করেও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কীভাবে এত চিন্তা করলেন এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য এত কাজ করলেন?

জীবিত কালের প্রধান অংশটা পথে পথে ঘুরে, কারও কাছে মাথা নত করে, শত শত্রুর আঘাতে আত্মসমর্পণ না করেও, জটিলতার চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে কীভাবে তিনি এতো ভালবাসলেন? সেই বিস্ময়কর প্রাণশক্তির, সেই দুর্জয় মনোবলের বিশ্লেষণ চলেছে শতাব্দীর বেশি সময় ধরে, কিন্তু এখনও পরিপূর্ণ বিবেকানন্দকে আমরা সময়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে আনতে পারিনি।

প্রায় অর্ধশতাব্দীর অনুসন্ধান চালিয়েও, মেরি লুইস বার্কের মতো গবেষিকাও স্বীকার করেছেন মানুষটির কীর্তিকাহিনী অশেষ, তার সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জেনেছি তার থেকে অনেক বেশি ঘটেছে তার জীবনে, আরও অনুসন্ধানের এই প্রচেষ্টার সবেমাত্র শুরু হয়েছে, ধৈর্য ধরে আমাদের আরও অনেক কিছু খুঁজে বার করতে হবে, ব্যাখ্যা প্রয়োজন হবে আরও অনেক কিছুর। তার পর যদি বা আমরা বলতে পারি, উনচল্লিশ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা, নর্থ ক্যালকাটার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের শরিকি বাড়িতে জন্মানো, দেরেটোনার দত্ত-পরিবারের বংশধর স্বামী বিবেকানন্দকে আমরা কিছুটা বুঝতে এবং জানতে সক্ষম হয়েছি।

হাতে বেশি সময় নেই, অকারণে লেখার আকার বৃদ্ধি করে নবযুগের পাঠক-পাঠিকাদের ধৈর্য পরীক্ষায় নেমেও লাভ নেই। আমরা দ্রুত কয়েকটি বিষয় স্পর্শ করে যাই জীবিতকালে আপনজনদের কাছ থেকে তিনি কী পেয়েছিলেন অর্থাৎ কী পাননি তার ছোট্ট একটি তালিকা।

স্বামীজির বিরুদ্ধে কত না অভিযোগ সমকালের। “কায়স্থ হওয়া সত্ত্বেও বিবেকানন্দর সন্ন্যাসী হওয়া, কালাপানির পারে যাওয়া, মাংসাহার করা ও তাকে সমর্থন করা, প্রকাশ্যে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে আহারাদি করা, ছুম্মার্গের এবং পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা” এদেশের স্বার্থপরদের হাড়ে হাড়ে বেজেছিল।

কলকাতায় স্বামীজির সংবর্ধনা সভা বানচাল করবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা হয়েছিল।

.

শূদ্রর সন্ন্যাস নেওয়ার বিষয়ে বিবেকানন্দ শুধু কলকাতার হৃদয়হীন বাঙালিদের হাতে বিড়ম্বিত হয়েছিলেন ভাবাটা ঠিক হবে না। তাঁর একই অবস্থা হয়েছিল দক্ষিণে।

“একবার কতকগুলি মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ আসিয়া স্বামীজিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, স্বামীজি আপনার কি জাতি? স্বামীজি গম্ভীর হইয়া প্রত্যুত্তর করিলেন, “যে জাত রাজা সৃষ্টি করে আমি সেই জাতের লোকসন্ন্যাসীর আদেশে রাজা সিংহাসনে বসেন, সন্ন্যাসী উপস্থিত থাকিলে রাজা সিংহাসন ত্যাগ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকেন এবং সন্ন্যাসীকে অবজ্ঞা করিলে রাজা সিংহাসনচ্যুত হন।… স্বামীজির কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণেরা নির্বাক হইয়া রহিলেন।”

কিন্তু এই স্তব্ধতা যে সাময়িক তা স্বামীজির সাহসী ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন।

“স্বামীজি আমেরিকায় যাইবেন, মাদ্রাজে এই খবর প্রচারিত হইলে ব্রাহ্মণদিগের অনেকেই বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হইলেন এবং নানাপ্রকারে আপত্তি তুলিতে লাগিলেন। একবার স্বামীজি কয়েকজন অন্তরঙ্গ লইয়া মাদ্রাজ বন্দরের উপর বসিয়া বৈকালবেলা বায়ুসেবন করিতেছিলেন, সেইসময় কতকগুলি মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ আসিয়া স্বামীজিকে অনেক কটুক্তি করিয়াছিল।”

এতকাল পরে শুধু বাঙালি এবং মাদ্রাজিদের অশোভন অন্যায়গুলির উল্লেখ করে লাভ নেই। কে না তখন সুযোগ পেয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কুৎসা রটিয়েছেন? থিওজফিস্ট কর্নেল অলকটের সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়েছিল প্রথমবার আমেরিকা যাত্রার আগে।

রোমাঁ রোলাঁর কলমে : “আমেরিকা যাত্রার অব্যবহিত পূর্বে তিনি যখন থিওজফিক্যাল সোসাইটির তদানীন্তন সভাপতি কর্নেল অলকটের নিকট আমেরিকার জন্য পরিচয় চাহিতে গিয়াছিলেন, কর্নেল অলকট তখন স্বামীজিকে সচ্চিদানন্দ নামেই জানিয়াছিলেন।… কর্নেল অলকট স্বীয় বন্ধুগণের নিকট স্বামীজিকে পরিচিত করিয়া তো দেনই নাই বরং তাহাদিগকে তাহার সম্বন্ধে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন।”

‘স্বামী-শিষ্য-সংবাদ’ থেকে এবার সামান্য উদ্ধৃতি : স্থান বেলুড় মঠ, কাল-১৯০১ “বেলুড়মঠ স্থাপিত হইবার সময় নৈষ্ঠিক হিন্দুগণের মধ্যে অনেকে মঠের আচার-ব্যবহারের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করিতেন। বিলাত প্রত্যাগত স্বামীজি কর্তৃক স্থাপিত মঠে হিন্দুর আচারনিষ্ঠা সর্বথা প্রতিপালিত হয় না এবং ভক্ষ্যভোজ্যাদির বাছ-বিচার নাই–প্রধানতঃ এই বিষয় লইয়া নানা স্থানে আলোচনা চলিত এবং ঐ কথায় বিশ্বাসী হইয়া শাস্ত্রানভিজ্ঞ হিন্দুনামধারী অনেকে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসিগণের কার্যকলাপের অযথা নিন্দাবাদ করিত।”

স্বামীজি ঐসব সমালোচনা শুনে বলতেন, “হাতী চলে বাজারমে, কুত্তা ভেঁকে হাজার। সাধুকো দুর্ভাব নহি, যব নিলে সংসার।”

শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী আরও লিখেছেন, “সমাজের তীব্র কটাক্ষ ও সমালোচনাকে স্বামীজি তাহার নবভাব-প্রচারের সহায় বলিয়া মনে করিতেন, কখনও উহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতেন না বা তাহার আশ্রিত গৃহী ও সন্ন্যাসিগণকে প্রতিবাদ করিতে দিতেন না। বরং বলতেন, “ফলাভিসন্ধিহীন হয়ে কাজ করে যা, একদিন ওর ফল নিশ্চয়ই ফলবে।”

কলকাতায় স্বামীজির সংবর্ধনা সভা বানচাল করবার জন্য বড় বড় খবরের কাগজ যে উঠে পড়ে লেগেছিল তা আজ কারও অজানা নয়। স্বামীজি এক চিঠিতে (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭) দুঃখ করেছেন, “এদেশ হিংসুক লোকে ভর্তি, যারা আমার কাজকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে কসুর করবে না।”

শুনুন সমকালের ব্যঙ্গোক্তি : “আজিকাল স্বামী হওয়ার যেরূপ হুজুক পড়িয়াছে তাহাতে বোধ হয় কালে স্ত্রী খুঁজিয়া পাওয়া ভার হইবে।…বিবেকানন্দর বক্তৃতায় নতুন কিছুই নাই।”

“নরেন্দ্রনাথ কি এতই শ্রুতিকঠোর যে উহা না বদলাইলে চলিত না?…সুরম্য অট্টালিকায় বাস, রাজভোজ ও অনেক বিষয়ে অখাদ্যভোজন ও ভদ্রসন্তানের দ্বারা পদসেবাসংসারবিরাগী, সন্ন্যাসী নামধারী ব্যক্তির পক্ষে কখনই যুক্তিসঙ্গত নয়।”

আরও বেদনাদায়ক, সারা বিশ্বে ভারতের জয়গাথা শুনিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির দর্শন করতে এসে স্বামীজি বিতাড়িত হয়েছিলেন। প্রমাণিত হয়েছে, স্বামী বিবেকানন্দ মন্দিরে ঢুকেছিলেন বলে দেবীর পুনরাভিষেকের প্রয়োজন হয়েছিল। এ বিষয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে। ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস এই প্রসঙ্গে বলেন : “যে ব্যক্তি বিদেশে যাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে হিন্দু বলিতে পারে–এমন কাহারও সহিত আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকা উচিত বলিয়া আমি বিবেচনা করি নাই।”

স্বামীজির চিহ্নিত ও এই অপমানকার ঘটনার যে উল্লেখ আছে তা পড়লেও লজ্জায় মাথা নত হয়।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে স্বামীজিকে অপমানের কলঙ্কিত অধ্যায়টি ভুলে যেতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু এ-বিষয়ে সেই সময়ের সংবাদপত্রে কিছু বাদানুবাদ হয়েছিল। চিঠিপত্রও বেরিয়েছিল। মন্দিরের খাজাঞ্চি ভোলানাথবাবু বললেন, “স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতিকে প্রত্যক্ষতঃ মন্দির হইতে তাড়াইয়া দেওয়া হয়, আর তাহার প্রভু লিখিলেন : তাড়ানো হয়েছিল ঠিকই, তবে প্রত্যক্ষতঃ নহে, পরোক্ষতঃ।”

পরবর্তীকালে এবিষয়ে স্বামীজির নিজস্ব বক্তব্য স্টার্ডিকে লেখা একটি চিঠি (১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯) থেকে পাওয়া যায়। “ভারতে অনেকে… ইউরোপীয়দিগের সঙ্গে আহার করার জন্য আপত্তি জানিয়েছেন, ইউরোপীয়দের সঙ্গে খাই বলে আমায় একটি পারিবারিক দেবালয় থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল।”

১৮৯৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবকালে দক্ষিণেশ্বরের সমস্যাটি যে আরও পাকিয়ে উঠেছিল তার স্বীকৃতি রয়েছে লাহোর থেকে ইন্দুমতি মিত্রকে লেখা স্বামীজির আর একটি চিঠিতে (১৫ নভেম্বর ১৮৯৭) “এবার মহোৎসব হওয়া পর্যন্ত অসম্ভব; কারণ রাসমণির (বাগানের) মালিক বিলাতফেরত বলিয়া আমাকে উদ্যানে যাইতে দিবেন না।”

এই চিঠির আরও অংশ : “আমার অসুখ হওয়ার জন্য জীবনের উপর ভরসা নাই। এক্ষণেও আমার উদ্দেশ্য যে, কলকাতায় একটি মঠ হয়–তাহার কিছুই করিতে পারিলাম না। অপিচ দেশের লোক বরং পূর্বে আমাদের মঠে যে সাহায্য করিত, তাহাও বন্ধ করিয়াছে। তাহাদের ধারণা যে, আমি ইংলন্ড হইতে অনেক অর্থ আনিয়াছি!!… আমার প্রথম কর্তব্য এই যে, রাজপুতানা প্রভৃতি স্থানে যে দুই-চারিটি বন্ধুবান্ধব আছেন, তাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া একটি কলকাতায় স্থান করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা। এইসকল কারণের জন্য আপাততঃ অত্যন্ত দুঃখের সহিত সিন্ধুদেশ-যাত্রা স্থগিত রাখিলাম।…কলকাতায় একটি মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখ-কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”

আপনজনদের অত্যাচার ও অবহেলার বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও অভিমানী বিবেকানন্দকে আমরা প্রায়ই খুঁজে পাই। ভগ্নশরীরে আলমোড়া (৩০মে ১৮৯৭) থেকে তিনি শেষ চিঠি লেখেন বহুদিনের পরিচিত প্রমাদাস মিত্রকে। এই চিঠিটি পড়লে হৃদয় আজও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।”শুনিলাম, গৌরচর্মবিশিষ্ট হিন্দুধর্ম-প্রচারকেরই আপনি বন্ধু, দেশী নচ্ছার কালা আদমী আপনার নিকট হেয়…আমি ম্লেচ্ছ শূদ্র ইত্যাদি, যা-তা খাই, যার-তার সঙ্গে খাই–প্রকাশ্যে সেখানে এবং এখানে।…স্মৃতি পুরাণাদি সামান্যবুদ্ধি মনুষ্যের রচনাম, প্রমাদ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তাহার যেটুকু উদার ও প্রীতিপূর্ণ, তাহাই গ্রাহ্য, অপরাংশ ত্যাজ্য।…রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীরাদিই যথার্থ অবতার, কারণ ইহাদের হৃদয় আকাশের ন্যায় অনন্ত ছিল সকলের উপর রামকৃষ্ণ; রামানুজ-শঙ্করাদি সঙ্কীর্ণ-হৃদয় পণ্ডিতজী মাত্র।… আমি পড়েশুনে দেখছি যে, ধর্মকর্ম শূদ্রের জন্য নহে; সে যদি খাওয়া-দাওয়া বিচার বা বিদেশগমনাদি করে তো তাতে কোন ফল নাই, বৃথা পরিশ্রম মাত্র। আমি শূদ্র ও ম্লেচ্ছ–আমার আর ওসব হাঙ্গামে কাজ কি?..এক কথা বুঝেছি যে পরোপকারেই ধর্ম, বাকি যাগযজ্ঞ সব পাগলামোে-নিজের মুক্তি-ইচ্ছাও অন্যায়। যে পরের জন্য সব দিয়েছে, সেই মুক্ত হয়।”

এর পরেও কয়েক কাহন বিড়ম্বনাকাহিনি লিপিবদ্ধ করা কিছু কঠিন কাজ নয়। যেমন বিশ্ববন্দিত স্বামী বিবেকানন্দের বেলুড় মঠের সঙ্গে স্থানীয় বালি মিউনিসিপ্যালিটির সম্পর্ক। মঠ হিসেবে স্বীকৃতি না জানিয়ে, এই প্রতিষ্ঠানকে নরেন দত্তর ‘প্লেজার হাউস’ হিসেবে নথিভুক্ত করে ট্যাক্সের বোঝা বাড়ানো হয়েছিল। এই বিরোধের মোকাবিলায় অপমানিত স্বামীজিকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এইমঠে সন্ন্যাসীরা শোফা ব্যবহার করেন, চা পান করেন এবং বিদেশিনীরা নিয়মিত আসেন। এসব যদি বাগানবাড়ির লক্ষণ না হয় তো কী বলা চলে? আদালতে স্বামীজির শেষপর্যন্ত জয় হয়েছিল, কিন্তু তার আগে অনেক কাঠখড় পুড়োতে হয়েছিল।

বেলুড় মঠের ব্যাপারে বিরোধীরা আরও যেসব গুজব ছড়িয়েছিল তা মঠের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

স্বামীজির দেহাবসানের পরেও বালি মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে মঠের সম্পর্ক সহজ হয়নি তারও যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। গঙ্গাতীরে মঠপ্রাঙ্গণে সন্ন্যাসীর দেহসৎকারের প্রয়োজনীয় অনুমতি দিতে মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ যে দ্বিধান্বিত’ ছিলেন এবং ৫ই জুলাই সকালে স্বামী সারদানন্দের সঙ্গে এবিষয়ে তাদের কয়েকবার পত্রবিনিময় হয়েছিল এবং প্রয়োজনীয় অনুমতি আসতে বিলম্ব হয়েছিল তার ইঙ্গিতও রয়ে গিয়েছে।

শেষপর্বে আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত, রোগযন্ত্রণায় কাতর বিবেকানন্দর ছবিটি মনকে বড় কষ্ট দেয়। মানুষের নিষ্ঠুরতা যে চিরদিনই সীমাহীন তা ভাবলে দুঃখ আরও বেড়ে যায়। আমরা জানি স্বাস্থ্যোদ্ধারে বেরিয়ে স্বামীজি শেষপর্বে শিলং শহরে বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রবল হাঁপানির প্রকোপে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হতো, সারা রাত ঘুমোতে পারতেন না। শিলং-এ তোলা স্বামীজির শেষ আলোকচিত্রটি মনে বড় দাগ কেটে যায়। কিন্তু তখনও এই কলকাতায় কেউ কেউ সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে বিবিকা-আনন্দ এই নামে ডেকে কেউ কেউ আনন্দ পাচ্ছেন।

অন্যদিকের রিপোর্ট, বিলেতে অনেকেই তার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। স্বদেশে নদীয়া ভাজনঘাটের বৈদ্য গোস্বামী বংশীয় জনৈক অতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী বিবেকানন্দর অভ্যর্থনায় চাঁদা দিয়েছিলেন বলে পরে পরিতাপগ্রস্ত হয়ে একদিন নাকি উপবাসও করেছিলেন।

মহাপণ্ডিত শঙ্খনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় বিবেকানন্দবিরোধী ছিলেন। স্বামীজি দেহাবসানের প্রায় দুই দশক পরে কাশীধাম ব্রাহ্মণসভা (১৯২৩) থেকে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লিখেছেন : “শিলং হইতে ফিরিয়া স্বামীজি গৌহাটিতে দুই চারিদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। এবার তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া বহুক্ষণ আলাপ করিয়াছিলাম। একটি রুমে’ তিনি ও আমি নির্জনে বসিয়া কথা বলিয়াছিলাম। হাঁপানিতে বড়ই কষ্ট পাইতেছেন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, স্বামীজি, শুনিয়াছি যোগীদের শ্বাসের উপর অধিকার জন্মে–এ দেখিতেছি শ্বাস আপনার উপর অধিকার করিয়া বসিয়াছে!ইহার অর্থ কি?’মনে মনে যাহা ভাবিলাম–তাহা (যখন স্বামীজিকে বলিতে সাহসী হই নাই, তখন) এস্থলে না বলাই সঙ্গত।”

বেলুড়মঠে এই রোগ-জর্জরিত বিনিদ্র বিবেকানন্দের শেষপর্বের ছবি তার প্রিয় গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দের মুখেই শোনা যাক। শেষ পর্ব শরীরের যন্ত্রণায় স্বামীজি অতিপ্রিয়জনদের মাঝে-মাঝে বকতেন। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে স্বামী ব্রহ্মানন্দ দরজা বন্ধ করে কাঁদছেন। “কিছুক্ষণ পরেই স্বামীজি দরজায় টোকা মারছে। দরজা খুল্লম। চোখে জল দেখে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দাদা, ঠাকুর তোমাকে কত আদর করতেন, ভালবাসতেন, সেই তোমাকেই আমি বকি, কত কটুকথা বলি, আমি আর তোমাদের কাছে থাকবার যোগ্য নই।”

“বলতে বলতে স্বামীজির চোখে জল ঝরছে, আমি তখন তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে, বললাম, তুমি ভালবাস বলেই বকো, বুঝতে পারি না বলে অনেক সময় কান্না পায়।

স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করবো, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়তো বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা, একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলবার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।

অবশেষে ৪ঠা জুলাই এলো সমকালের সব বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি দিতে আমাদের মহামানবকে।

সমকালের ক্ষুদ্রতা কিন্তু মহামৃত্যুকেও পথের কুকুরের মত তাড়া করে থাকে কখনও কখনও।

শুনুন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বঙ্গবাসী পত্রিকার মরণোত্তর মন্তব্য : মঠে মৃত্যু।–২৪ পরগণা দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির রামকৃষ্ণ অনেকের পরিচিত। তাহার সেই বুদ্ধিমান শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত–হাবড়া বেলুড়ের মঠে– ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। এই নরেন্দ্রনাথ অধুনা বিবেকানন্দ-স্বামী বলিয়া অনেকের নিকট পরিচিত হইয়াছিলেন। হঁহার সহিত আমাদের অনেক বিষয় মতভেদ আছে বটে। কিন্তু হঁহাকে বাহাদুর পুরুষ বলিতে কুণ্ঠিত নহি। ইনি অল্পবয়সে রামকৃষ্ণের শিষ্য হইয়া আপন মেধা ও বুদ্ধির প্রভাবে এবং বক্তৃতার মোহজালে অনেককেই আশ্চর্যপথে আকৃষ্ট করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। মার্কিন মুলুকে ইহার বাক কৃতিত্বের একটা বিজয়ঘোষণা হইয়াছিল। কোনো কোনো রমণী তাঁহারই ভাবে আকৃষ্ট হইয়া, তাহারই পথানুসরণ করিয়া, তাহাকে পথপ্রদর্শক গুরুরূপে ভাবিয়া, নূতন পথে আসিয়া, এক নূতন ভাব অবলম্বন করিয়াছেন। ইহা নিশ্চয়ই বাহাদুরীর কথা। শুনিতে পাই, নরেন্দ্রনাথের বহুমূত্রের পীড়া ছিল। গত সপ্তাহের শুক্রবার সন্ধ্যার সময় তিনি বেড়াইয়া মঠে ফিরিয়া আসেন, কিয়ৎক্ষণ পর তিনি যেন কেমন একটু অসুস্থ হন। অতঃপর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।”

বিড়ম্বনার এই ইতিবৃত্ত শেষ করার সময় বোধ হয় এসে গেল। সম্মান ও অসম্মান, প্রশস্তি ও কুৎসা, সেবা ও অবমাননা, জয়মাল্য ও অবিচার, ভালবাসা ও তীব্র অবিচার, পুস্পাঞ্জলি ও অন্যায় অবিচার, শ্রদ্ধা ও ঘৃণা, চরিত্রপূজা ও চরিত্রহননের সেই বিচিত্র ভূখণ্ডে আমাদের যুগের সবচেয়ে স্মরণীয় চরিত্রটি দাঁড়িয়ে রয়েছেন একই সঙ্গে নীলকণ্ঠ ও মহামানব রূপে। কারণে এবং অকারণে বিড়ম্বনার ইন্ধন জুগিয়েছে তার আপনজন থেকে শুরু করে অপরিচিতরা। তাঁদের মধ্যে যেমন শত্রুরাও আছেন তেমন মিত্ররাও আছেন, বিরোধীরাও আছেন মন্ত্র শিষ্যরাও আছেন, বিদেশীরাও আছেন দেশবাসীরাও আছেন, অজ্ঞরাও আছেন বিজ্ঞরাও আছেন। উদাসীন ইতিহাস বোধ হয় এইভাবেই কীর্তিমানদের মহামূল্যবান জীবন নিয়ে অকারণে খেলা করে।

মৃত্যুঞ্জয়ী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের থেকে এই নির্মম সত্য যে কেউ বেশি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি তার প্রমাণ তিনি নিজেই রেখে গিয়েছেন। দেহাবসানের দু বছর আগে আলামেডা, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে (১৮ এপ্রিল ১৯০০) মার্কিনী বান্ধবী ও অনুরাগিনী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে তিনি আশ্চর্য ভাষায় তা জানিয়ে গিয়েছিলেন :

“আমার জন্যে প্রার্থনা কর, জো, যেন চিরদিনের তরে আমার কাজ করা ঘুচে যায়।…লড়াইয়ে হার-জিত দুইই হল–এখন পুঁটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান্ মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি।…হে শিব, হে শিব, আমার তরী পারে নিয়ে যাও প্রভু।… আহা, আবার তার সেই মধুর বাণী শুনতে পাচ্ছি–সেই চিরপরিচিত কণ্ঠস্বর!যাতে আমার প্রাণের ভিতরটা পর্যন্ত কণ্টকিত করে তুলছে। বন্ধন সব খসে যাচ্ছে, মানুষের মায়া উড়ে যাচ্ছে, কাজকর্ম বিস্বাদ বোধ হচ্ছে! জীবনের প্রতি আকর্ষণও কোথায় সরে দাঁড়িয়েছে, রয়েছে কেবল তার স্থলে প্রভুর সেই মধুর গম্ভীর আহ্বান! যাই, প্রভু যাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *