০৮. গুরুর রামকৃষ্ণনমিক্‌স এবং শিষ্যের বিবেকানন্দনমি্ক্‌স

গুরুর রামকৃষ্ণনমিক্‌স এবং শিষ্যের বিবেকানন্দনমি্ক্‌স

“হিসেবের অভাবে আমি যেন জোচ্চর না বনি”–উদ্বিগ্ন স্বামী বিবেকানন্দ একবার প্রিয়জনদের বলেছিলেন।

তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণেরও অর্থ নিয়ে কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই, যখন মুখে যা এসেছে তা কারও তোয়াক্কা না করে বলেছেন। খোদ কথামৃতেই তিনি অর্থ-বিষয়ে সাঁইত্রিশবার মুখ খুলেছেন। ঠাকুর যখন বলছেন টাকা মাটি মাটি টাকা তাও সত্যি, আবার যখন বলছেন টাকা হচ্ছে গৃহস্থের রক্ত, টাকার সম্মান না থাকলে গৃহস্থ বিপন্ন, তাও সত্য। প্রেমের এই দেবতাকে আরও কঠিন কথা নিষ্ঠুরভাবে মুখে আনতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, “অর্থ যার দাস, সেই মানুষ। যারা অর্থের ব্যবহার জানে না, তারা মানুষ হয়ে মানুষ নয়।” এরপর আরও কঠিন কথা : “আকৃতি মানুষের কিন্তু পশুর ব্যবহার।”

নতুন যুগের নতুন কথা নতুন ভাষায় প্রকাশ করতে না পারলে মন ভরে না। রামকৃষ্ণ ও তার প্রধান শিষ্যের একটা অর্থনীতি আছে, আধ্যাত্মিক ব্যাপারে সারাক্ষণ ডুবে থাকার ফলে রামকৃষ্ণনমিক্স এতদিন তেমন নজরে পড়েনি, এবার পড়বে। সেখানে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতের সাঁইত্রিশটা আর্থিক মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে সাঁইত্রিশটা অধ্যায় অনায়াসেই গড়ে উঠতে পারবে।

শিষ্য বিবেকানন্দ গুরুর অর্থচিন্তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়ে, এবং দেশ বিদেশ থেকে নানা আর্থিক ধাক্কা খেয়ে তার প্রতিষ্ঠিত সংঘের জন্যে যে ইকনমিক্স সৃষ্টি করলেন তাকে ইদানীং বিবেকানন্দনমিক্স বলা হচ্ছে।’

গুরুশিষ্যের চিন্তার বিবর্তনটা কৌতূহলোদ্দীপক। প্রথম ধারণা, অর্থ। মানেই অনর্থ। দ্বিতীয় চিন্তা, অর্থ গৃহস্থের রক্ত এবং এই অর্থ দিয়েই তাঁরা সন্ন্যাসীকে সাহায্য করেন, এই সাহায্য ছাড়া সন্ন্যাসীর জীবন ধারণ হয় না। তবে অর্থের সঙ্গে সন্ন্যাসীর অত্যধিক সম্পর্ক অভিপ্রেত নয়, বিত্তের সঙ্গে সাধুর যত দূরত্ব তত ভালো।

ঠাকুরের মানসপুত্র বিবেকানন্দ একালের সন্ন্যাসীর যে স্পেসিফিকেশন নিজের হাতে রচনা করে দিয়েছেন তা বড়ই কঠিন। শুনুন তার প্রত্যাশাটা : “বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে, পুত্ৰবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে, অজ্ঞ ইতর সাধারণকে জীবন-সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ-বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্ৰষুপ্ত ব্ৰহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে জগতের সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।”

সুদীর্ঘ প্রত্যাশার লিস্টিটা যে ভয়াবহ তা স্বীকার করতেই হবে। একটা নয়, দশটা বড়-বড় দায়িত্ব নিতে সকলের প্রতি আহ্বান, তার সঙ্গে একাদশ দায়িত্ব নিজের ওপর।

উত্তর হতে পারে, দফায় দফায় কর্তব্যের বিশ্লেষণ না করে, একটি বাক্যে স্বামী বিবেকানন্দ প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন : ‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ আমাদের জন্ম।

এখানেও একটু টেকনিক্যাল অসুবিধা রয়েছে। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কেন ‘জন্ম’ কথাটা একাধিকবার ব্যবহার করলেন? কেউ তো সন্ন্যাসী হয়ে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হন না। শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসী তো অন্য সকলের মতন জন্মগ্রহণ করে কোনও এক সময় বিচিত্রতর এক জীবনযাত্রার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন আপনজনদের চোখের জল সত্ত্বেও। তারপর তো ভেবেচিন্তে নিজেকে মৃত ঘোষণা করে আত্মশ্রাদ্ধর ব্যবস্থা করে নতুন এক জীবনে প্রবেশ করা। অর্থাৎ গৃহস্থের ভাবধারায়, সন্ন্যাসী হয়ে কেউ জন্মায় না, সংসার কাউকে কাউকে সন্ন্যাসী হতে অনুপ্রেরণা জোগায় যদিও অতি কঠিন সেই জীবন এবং কঠিনতর সেই তীর্থযাত্রা।

অর্থ সম্বন্ধে গুরুর মতের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের মতের কোনও সংঘাত ছিল কি? অর্থের অনটন কাকে বলে যৌবনকালে তা বিবেকানন্দের হাড়ে-হাড়ে জানা ছিল। কোথাও কোথাও অর্থ সম্বন্ধে অভিমানও ছিল। যেমন, প্রচণ্ড অভাবে, দক্ষিণেশ্বরের মায়ের কাছ থেকে অর্থ প্রার্থনার কথা ছিল, কিন্তু, নির্ধারিত সময়ে তিনি মায়ের কাছ থেকে অত সামান্য আশীর্বাদ চাইতে পারলেন না, বিত্ত থেকে বৈরাগ্যকেই তিনি বেশি সমর্থন দিলেন। যে-বংশে তাঁর জন্ম সেখানে অল্পবয়সে বিত্তসুখের নানা অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। ত্যাগের পথ প্রস্তুত করতে ভোগের অভিজ্ঞতারও যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা উপলব্ধি করে তিনি নিজেই বলেছেন, যে জীবনে লাখ টাকার পর বসল না কখনও তার ত্যাগের চিন্তা হবে কেমন করে?

আর একটা ব্যাপারে স্বামীজির চড়া মেজাজের কথা আমরা শুনেছি। তা হলো পয়সার হিসেব। পয়সায় গুরুর বিন্দুমাত্র টান ছিল না, কিন্তু অপচয়ে ছিল প্রবল আপত্তি। দু’তিনটে দোকানে দরদাম যাচাই না করে কোনো কেনাকাটায় তিনি রাজি নন, অপরে পয়সা দিচ্ছে বলে অযথা বেশি দামি জিনিস কেনা অবিশ্যই নয়। প্রধান শিষ্যটিরও প্রথমদিকের ধারণা, অপরের টাকা হলে অবশ্যই তা খুব ভেবেচিন্তে সৎপথে খরচ করা হবে, কিন্তু তা বলে অন্যের কাছে হিসেব দাখিল করতে হবে কেন? খরচ ও হিসেব যে হরিহর-আত্মা, একটা যদি আলো হয় তাহলে অপরটি ছায়া এটা যে কিছুতেই ভোলার নয় তা কাশীপুর উদ্যানবাটিতে নরেন্দ্রনাথ দত্ত ভুলে গিয়েছিলেন। ভক্তরা চাদা তুলে অসুস্থ রামকৃষ্ণের খরচাপাতি চালাচ্ছেন, অন্যেরা পয়সা না দিলেও দিবারাত্র সেবা করছেন, তাদের জন্য খরচ হচ্ছে, সাহায্যকারী ভক্তরা খরচের লাগাম টানবার জন্যে হিসেব চাইছেন, তা শুনে নরেন্দ্রনাথ রেগেমেগে খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করবেন না। যে তাদের বিশ্বাস করতে পারে না সে লোকের টাকা নিজের হাতে নেবার প্রয়োজন নেই।

পরবর্তী পর্বে স্বামীজির মতের বিপুল পরিবর্তন হয়েছিল। হিসেবকে প্রায় পূজার বেদিতে বসাতে চেয়েছেন বিশ্বপথিক বিবেকানন্দ, তাই তাঁর সংঘের অ্যাকাউন্টিং পলিসিতে কঠিন নিয়মের শাসন, সেখানে ভ্রান্তির কোনও ক্ষমা নেই।

আমেরিকা থেকে (৩১ আগস্ট ১৮৯৪) প্রিয় শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখছেন, “তুমি তো জানো, টাকা রাখা–এমনকী টাকা ছোঁয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে বড় মুশকিল। উহা আমার পক্ষে বেজায় বিরক্তিকর, আর ওতে মনকে বড় নীচু করে দেয়। সেই কারণে কাজের দিকটা এবং টাকাকড়ি-সংক্রান্ত ব্যাপারটার বন্দোবস্ত করবার জন্য তোমাদিগকে সংঘবদ্ধ হয়ে একটা সমিতি স্থাপন করতেই হবে। …এই ভয়ানক টাকাকড়ির হাঙ্গামা থেকে রেহাই পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচব।”

একই বছরে তারিখহীন আধা ইংরিজি-আধা বাংলা চিঠিতে স্বামী শিবানন্দকে স্বামীজি লিখছেন, “আমি ইতঃপূর্বেই ভারতবর্ষে চলে যেতাম, কিন্তু ভারতবর্ষে টাকা নাই। হাজার হাজার লোক রামকৃষ্ণ পরমহংসকে মানে, কিন্তু কেউ একটি পয়সা দেবে না–এই হচ্ছে। ভারতবর্ষ। এখানে লোকের টাকা আছে, আর তারা দেয়।”

টাকা দিলেও দানের টাকার অনেক অদৃশ্য বন্ধন থাকে, তার একটি হল হিসেব। সেটা অভিজ্ঞ স্বামীজি যথাসময়ে ভালোভাবেই বুঝেছিলেন।

স্বামীজির নিজের রোজগারের টাকাও ছিল। বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে নিউইয়র্ক থেকে (৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫) লিখছেন বিবেকানন্দ : আমি বাংলাদেশ জানি, ইন্ডিয়া জানি-লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায় শূন্য।…আমি এখানে জমিদারিও কিনি নাই, বা ব্যাংকে লাখ টাকাও জমা নাই। এই ঘোর শীতে পর্বত-পাহাড়ে বরফ ঠেলে–এই ঘোর শীতে রাত্তির দুটো-একটা পর্যন্ত রাস্তা ঠেলে লেকচার করে দু-চার হাজার টাকা করেছি–মা-ঠাকুরানির জন্য জায়গা কিনলেই আমি নিশ্চিন্ত।”

বিদেশ থেকে তিনি আরেক তারিখহীন চিঠি লেখেন স্বামী ব্রহ্মানন্দকে : “যে যা করে, করতে দিও (উৎপাত ছাড়া)। টাকাখরচ বিলকুল তোমার হাতে রেখো।” অর্থাৎ সেই পুরনো সাংসারিক সাবধানতা–ঘরসংসার তোমার, চাবিকাঠিটি আমার।

১৮৯৯ সেপ্টেম্বর মাসে ফরাসি দেশের পারি নগর থেকে আলাসিঙ্গার কাছে অর্থ নিয়ে স্বামীজির দুঃখ, “আমিই তো সারাজীবন অপরকে সাহায্য করে আসছি। আমাকে সাহায্য করছে, এমন লোক তো আমি এখনও দেখতে পাইনি। বাঙালিরা তাদের দেশে যত মানুষ জন্মেছেন তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাজে সাহায্যের জন্য কটা টাকা তুলতে পারে না, এদিকে ক্রমাগত বাজে বকছে; .. জগৎ এইরূপ অকৃতজ্ঞই বটে!!”

১৮৯৫ সালে প্রবাসী বিবেকানন্দের অর্থ সম্বন্ধে চোখ খোলার সময়। রিডিং থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে চিঠি : “বাঙালিরাই আমাকে মানুষ করলে, টাকাকড়ি দিয়ে পাঠালে, এখনও আমাকে এখানে পরিপোষণ করছে–অহ হ!!! তাদের মন জুগিয়ে কথা বলতে হবে–না? বাঙালিরা কি বলে না বলে, ওসব কি গ্রাহ্যের মধ্যে নিতে হয় নাকি? …গুলোকে টাকাকড়ির কাজে একদম বিশ্বাস করবে না; অত কাঞ্চন ত্যাগ করতে হবে না। নিজের কড়িপাতির খরচ-আদায় সমস্ত করবে। মধধা–যা বলি করে যা, ওস্তাদি চালাস না আর আমার ওপর।”

টাকার কথা স্বামীজির ১৮৯৫ সালের চিঠিপত্রে বারবার উঠে আসছে। স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখছেন, “দেশের লোকের কথা কি বলো? কেউ না একটা পয়সা দিয়ে এ পর্যন্ত সহায়তা করেছে, না একজন সাহায্য করতে এগিয়েছে। এ-সংসারে সকলেই সাহায্য চায়–এবং যত কর ততই চায়। তারপর যদি আর না পারো তো তুমি চোর।”

প্রায় একই সময়ে স্বামী অখণ্ডানন্দকে লেখা (১৩ নভেম্বর ১৮৯৫) : “…এর অর্থসংগ্রহ উত্তম সঙ্কল্প বটে, কিন্তু ভায়া, এ সংসার বড়ই বিচিত্র, কাম-কাঞ্চনের হাত এড়ানো ব্রহ্মা বিষ্ণুরও দুষ্কর। টাকাকড়ির সম্বন্ধ মাত্রেই গোলমালের সম্ভাবনা।” এবার মঠের ফিনান্স সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দর স্পষ্ট নির্দেশ : “অতএব মঠের নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাহাকেও করিতে দিবে না।…আমার বা আমাদের নামে কোনও গৃহস্থ মঠ বা কোন উপলক্ষে অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন শুনিলেই সন্দেহ করিবে…।” তারপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নির্মম সত্যের উপলব্ধি : “বিশেষ দরিদ্র গৃহস্থ লোকেরা অভাব পূরণের নিমিত্ত বহুবিধ ভান করে।” সন্ন্যাসীভ্রাতা ‘গ্যাঞ্জেস’-কে উকিলবাড়ির ছেলে নরেন্দ্রনাথের সাবধানবাণী : “তুমি বালক, কাঞ্চনের মায়া বোঝ না। অবসরক্রমে মহানীতিপরায়ণ লোকও প্রতারক হয় এ হচ্ছে সংসার।”

এইখানে অবসরক্রমে’ কথাটির যথেষ্ট গুরুত্ব। প্রতারণার সুযোগ না দিতে হলে অবশ্যই হিসেবের ওপর যথেষ্ট খবরদারি প্রয়োজ! এ-বিষয়ে বিবেকানন্দের মতামত চাঁচাছোলা। আলাসিঙ্গা পেরুমলকে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় (৮ আগস্ট ১৮৯৬) তিনি লিখছেন : তোমাদের “কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজন : প্রথমত হিসাবপত্র সম্বন্ধে বিশেষ সততা অবলম্বনীয়। এই কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কোন আভাস দিচ্ছি না যে, তোমাদের মধ্যে কারও পদস্খলন হবে, পরন্তু কাজকর্মে হিন্দুদের একটা অদ্ভুত অগোছালো ভাব আছে–হিসাবপত্র রাখার বিষয়ে তাদের তেমন সুশৃঙ্খলা বা আঁট নাই; হয়তো কোনও বিশেষ ফান্ডের টাকা নিজের কাজে লাগিয়ে ফেলে এবং ভাবে শীঘ্রই তা ফিরিয়ে দেবে–ইত্যাদি।”

হিসেব সম্বন্ধে স্বামীজির মতামত ক্রমশ কঠোর হয়ে উঠেছে। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে আম্বালা থেকে (১৯ আগস্ট ১৮৯৭) মাদ্রাজ-কেন্দ্রের প্রবল অর্থাভাব সম্বন্ধে তিনি লিখছেন, “লেকচারের টাকা অভ্যর্থনায় খরচ করা অতি নীচ কার্য–তাহার বিষয় আমি কোনও কথা কাহাকেও বলিতে ইচ্ছা করি না। টাকা সম্বন্ধে আমাদের দেশীয় লোক যে কিরূপ, তাহা আমি বিলক্ষণ বুঝিয়াছি।”

দু’মাস পরে অর্থ সম্বন্ধে তার ধারণার আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা চিঠিতে (১০ অক্টোবর ১৮৯৭)। “আমি এখান হইতেই (মরী) মঠের জন্য অর্থ সংগ্রহ আরম্ভ করিলাম। যেখান হতে তোমার নামে টাকা আসুক না, তুমি মঠের ফন্ডে জমা করিবে ও দুরস্ত হিসাব রাখিবে। দুটো ফন্ড আলাদা–একটা কলকাতার মঠের জন্য, আর একটা দুর্ভিক্ষে সেবাকার্য ইত্যাদি।”

ঠিক দু’দিন পরে (১২ অক্টোবর ১৮৯৭) গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দকে হিসেবনিষ্ঠ বিবেকানন্দের কঠোর নির্দেশ : “কোন কোন বিষয়ে বিশেষ direction আবশ্যক বোধ করিতেছ।… (১) যে যে ব্যক্তি টাকা যোগাড় করিয়া পাঠাইবে…তাহার acknowledgement মঠ হইতে পাইবে। (২) Acknowledgement দুইখানা–একখানা তার, অপরখানা মঠে থাকিবে। (৩) একখানা বড় খাতায় তাদের সকলের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ থাকিবে। (৪) মঠের ফন্ডে যে টাকা আসিবে, তাহার যেন কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব থাকে এবং সারদা প্রভৃতি যাহাকে যাহা দেওয়া হচ্ছে, তাদের কাছ হতে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব লওয়া চাই। হিসাবের অভাবে…আমি যেন জোচ্চোর না বনি। ওই হিসাব পরে ছাপিয়ে বাহির করিতে হইবে।”

দেখা যাচ্ছে বিদেশের আর্থিক সংস্থায় নানা ডিসিপ্লিন দেখে স্বামী বিবেকানন্দ অপরের দেওয়া অর্থ সম্বন্ধে একটা কঠিন নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন এবং সংঘের শুরু থেকে আর্থিক সংযমকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাঁর গুরুভাইরা প্রথমে এ-বিষয়ে ততটা তৎপর না হলেও কী আশ্চর্যভাবে এই নিয়মকে সংঘজীবনের অঙ্গ করে নিয়েছিলেন তাও এক অবিশ্বাস্য গল্প। এ-বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা না করলে বোঝা মুশকিল বিবেকানন্দমিক্স-এর প্রভাবে মঠ ও মিশন কেন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সকল সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে সমর্থ হয়েছে। এদেশের বাঘা বাঘা চার্টার্ড অ্যাকাউনটেনসি প্রতিষ্ঠান ও জগৎজোড়া অডিটিং প্রতিষ্ঠানগুলি বিবেকানন্দের কাছ থেকে পথের সন্ধান লাভ করতে পারেন।

.

দরিদ্র পূজারি বাউন হলেও এককালীন অর্থসাহায্য সম্বন্ধে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণেরও ভীষণ ভয় ছিল।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ সংকলিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ’ বইতে চমৎকার এক বর্ণনা রয়েছে–

লক্ষ্মীনারায়ণ নামক একজন মাড়োয়ারি সৎসঙ্গী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে একদিন ঠাকুরকে দর্শন করতে আসেন। ঠাকুরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে বেদান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। ঠাকুরের সহিত ধর্মপ্রসঙ্গ করে ও তার বেদান্ত সম্বন্ধে আলোচনা শুনে তিনি বড়ই প্রীত হন।

পরিশেষে ঠাকুরের নিকট হতে বিদায় নেবার সময় লক্ষ্মীনারায়ণ বলেন, “আমি দশ হাজার টাকা আপনার সেবার নিমিত্ত দিতে চাই।”

ঠাকুর এই কথা শোনবামাত্র, মাথায় দারুণ আঘাত লাগলে যেরূপ হয়, মূছাগতপ্রায় হলেন। কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি প্রকাশ করে বালকের ন্যায় তাকে সম্বোধন করে বললেন, “শালা, তুম হিয়াসে আবি উঠ যাও। তুম হামকো মায়াকা প্রলোভন দেখাতা হ্যায়।”

মাড়োয়ারী ভক্ত একটু অপ্রতিভ হয়ে ঠাকুরকে বললেন, “আপ আভি থোড়া কাঁচা হ্যায়”।

উত্তরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, “ক্যায়সা হ্যায়।”

মাড়োয়ারী ভক্ত বললেন, “মহাপুরুষ লোগোকো খুব উচ্চ অবস্থা . হোনেসে ত্যাজ্য গ্রাহ্য এক সমান বরাবর হো যাতা হ্যায়, কোই কুছ দিয়া অথবা লিয়া উস্‌সে উল্টা চিত্তমে সন্তোষ বা ক্ষোভ কুছ নেই হোতা।”

ঠাকুর ঐ কথা শুনে ঈষৎ হেসে তাকে বুঝাতে লাগলেন, “দেখ, আর্শিতে কিছু অপরিষ্কার দাগ থাকলে যেমন ঠিক ঠিক মুখ দেখা যায়, তেমনি যার মন নির্মল হয়েছে, সেই নির্মল মনে কামিনী, কাঞ্চন-দাগ পড়া ঠিক নয়।”

ভক্ত মাড়োয়ারি বললেন, “বেশ কথা, তবে ভাগ্নে হৃদয়, যে আপনার সেবা করে না হয় তার কাছে আপনার সেবার জন্য টাকা থাক।”

তদুত্তরে ঠাকুর বললেন, “না, তাও হবে না। কারণ তার নিকট থাকলে যদি কোনও সময় আমি বলি যে অমুককে কিছু দাও বা অন্য কোনও বিষয়ে আমার খরচ করতে ইচ্ছা হয়, তাতে যদি সে দিতে না চায় তাতে মনে সহজেই এই অভিমান আসতে পারে যে, ও টাকা তো তোর নয়, ও আমার জন্য দিয়েছে। এও ভালো নয়।”

পরবর্তীকালে সঙ্ঘ চালানোর জন্য এই ডোনেশনভিত্তি মেনে নিতে হয়েছে রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনকে। সন্ন্যাসী অর্থ উপার্জন করেন না, শরীর রক্ষার জন্য তিনি কেবল সংসারীর কাছ থেকে যৎসামান্য দান গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দর কাছে এই অর্থের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল হিসেবনিকেশ। মঠের খরচের জন্য লাহোরের বাবু নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত চাদা আদায় করে পাঠাবেন। এই খবর পেয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে (১৫ নভেম্বর ১৮৯৭) স্বামী বিবেকানন্দ নির্দেশ দিচ্ছেন, “রীতিমত রসিদ তাকে দিও।” ঠাকুরের বাণীতে লাহোর খুব তেতেছে, চাঁদা উঠছে।

হিসেব-পত্তর অবশ্যই, তারপরে বিবেকানন্দনমিস্ দ্বিতীয় পর্ব–”টাকাকড়ি একটু হিসেব করে খরচ করো।” সন্ন্যাসীদের স্পষ্ট বলছেন, অভাবের সংসারে “তীর্থযাত্রাটা নিজের খরচে করো।”

খরচ কমাবার জন্য এবং জমিজমার দাম যাতে বেশি না হাঁকে তার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিশ্বাসভাজন গুরুভাইদের যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তা অভিজ্ঞ এটর্নি পরিবারের সন্তানের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। যেমন জমির জন্য দরদস্তুর। ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি পরামর্শ দিচ্ছেন : “অন্য লোক দিয়ে কথা পাড়লে ভালো হয়। আমাদের কেনা টের পেলে লম্বা দর হাঁকবে।”

টাকাকড়ির ব্যাপারে স্বামী ব্রহ্মানন্দই স্বামীজির প্রধান ভরসা। “দুর্ভিক্ষ ফন্ডে যে টাকা বাঁচিয়াছে তাহা একটা পার্মানেন্ট ওয়ার্ক ফন্ড করিয়া রাখিয়া দিবে। অন্য কোনও বিষয়ে তাহা খরচ করিবে না এবং সমস্ত দুর্ভিক্ষ-কার্যের হিসাব দেখাইয়া লিখিবে যে, বাকি এত আছে অন্য ভালো কাজ-এর জন্য…।”

একই চিঠিতে (৮ ডিসেম্বর ১৮৯৭) গুরুভাইকে স্বামীজির মারাত্মক সাবধানবাণী : “টাকা কড়ি সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইবে। হিসাব তন্ন তন্ন রাখিবে ও টাকার জন্য আপনার বাপকেও বিশ্বাস নাই জানিবে।” লোকশ্রুতি নয়, সন্ন্যাসীর সহস্তলিখিত পত্রে এমন কঠিন নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে।

অপরকে নির্দেশ দিয়ে নিজের খুশিমতো খরচ খরচা করাটা স্বামীজির স্বভাবে নেই। শ্রীনগর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি লিখছেন (১ আগস্ট ১৮৯৮), “ভালো কথা, কয়েকজনকে… এইভাবে টাকা দিও। এই টাকা আমি মঠ থেকে কর্জ নিচ্ছি এবং পরিশোধ করব তোমার কাছে সুদসমেত।” অর্থাৎ শুধু ধার নয়, সুদসমেত ধার। পরবর্তী সময়ে মঠের প্রতিষ্ঠাতা বিবেকানন্দকে আমরা ধার নিতে এবং সুদ দিতে দেখেছি। কোনটা নিজের টাকা আর কোনটা সঙ্ঘের টাকা সে সম্বন্ধে কোথাও কোনও সন্দেহ থাকবার অবসর নেই শ্রীরামকৃষ্ণের চেলাদের সঙ্ঘে।

এই হিসেবনিষ্ঠা এক এক সময় সন্ন্যাসীদের প্রবল কষ্টের কারণ হয়েছে, আজকের চোখে একটু পাগলামিও মনে হতে পারে। এক-আধটা ঘটনা স্মরণ করাটা অযৌক্তিক হবে না। যেমন স্বামীজির জীবিতকালে মঠ-মিশনের সন্ন্যাসীদের দুর্ভিক্ষত্রাণকর্ম। স্বামী অখণ্ডানন্দের নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদের মহুলায় রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম সুসংবদ্ধ আর্তত্রাণসেবা শুরু হয়েছিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ কলকাতার আলমবাজার মঠ থেকে দুইজন সাধুকে দেড়শ টাকা সহ মহুলায় স্বামী অখণ্ডানন্দের কাছে পাঠালেন। এই সেবাকার্যের শুরু যে ১৮মে ১৮৯৭ তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু যা তেমন প্রচারিত নয়, যারা সেবা করতে গেলেন তাদের খাওয়াদাওয়ার খরচ কি ত্রাণের ফান্ড থেকে নেওয়া হবে? বড়ই সূক্ষ্ম এই বিভাজন, এক এক সময় পাগলামোও মনে হতে পারে। কিন্তু শুনুন, স্বামীজির প্রিয়বন্ধু চিরবিশ্বস্ত সঙ্ঘনায়ক স্বামী ব্রহ্মানন্দের এবিষয়ে বক্তব্য।

স্বামী অখণ্ডানন্দকে খরচখরচা সম্বন্ধে স্বামী ব্রহ্মানন্দ নির্দেশ দিচ্ছেন ১৯মে, ১৮৯৭ : “টাকার পুনরায় আবশ্যক হইলে ১০/১২ দিন আগে লিখিবে। তোমরা যদি গ্রাম হইতে ভিক্ষা না করিতে পার তাহা হইলে ১০ টাকা ওই ফান্ড হইতে আপাতত লইয়া নিজ ব্যয়ের জন্য নির্বাহ করিবেক। এখান হইতে টাকা গেলে সেই টাকা হইতে উক্ত ফান্ডে দিবে।”

ত্রাণকার্যে গিয়েও নিজের জীবনধারণের জন্য সন্ন্যাসীদের ভিক্ষাবৃত্তি! এক আশ্চর্য ব্যাপার।

রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের কয়েকজন সাধু ব্রহ্মচারী একসময় মাদ্রাজ মঠে তীর্থযাত্রায় আসেন। কাজ নেই, শুধু ভ্রমণ স্বামী বিবেকানন্দের মোটেই পছন্দ নয়। ১৫ নভেম্বর ১৮৯৭ লাহোর থেকে স্বামীজি তার চিরবিশ্বস্ত ব্রহ্মানন্দের কাছে বিরক্তি প্রকাশ করছেন : “টাকাকড়ি একটু হিসেব করে খরচ করো; তীর্থযাত্রাটা নিজের নিজের উপর; প্রচারাদি মঠের ভার।”

৮ ডিসেম্বর ১৮৯৭ খেতড়ি থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা স্বামীজির চিঠির সুর আরও কড়া, “কাজ আমি চাই–কোন প্রতারক চাই না। যাদের কাজ করবার ইচ্ছা নেই–যাদু এই বেলা পথ দেখ।”

বিবেকানন্দর চিন্তার সূত্র ধরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ১৮ ডিসেম্বর ১৮৯৭ যে চিঠি মাদ্রাজে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লেখেন তা আজও অনেকের নজরে আসেনি। “তোমরা অনেকগুলি একসঙ্গে জমিয়াছ, দেখ, যেন তোমার কার্যের ক্ষতি না হয়। …খরচপত্র যেন বিবেচনা করিয়া করিবে। কোনওমতে বেশি না হয়। কাহারও whims শুনিয়া চলিবে না। …স্বামীজি বড় অসন্তুষ্ট হন যাহারা সাধন ভজন কিংবা work না করিয়া idle and aimlessly বেড়ায়। …তুমি কোনওরূপ চক্ষুলজ্জা করিবে না; আমি দেখিয়াছি চক্ষুলজ্জা করিয়া কাহাকেও please করা যায় না।”

এর কয়েকমাস পরে (১৭ জুলাই ১৮৯৮) স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা আর এক চিঠিতে স্বামীজির অর্থ সংক্রান্ত চিন্তাধারা আরও পরিষ্কার। “টাকাকড়ি সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি তাহাই শেষ। অতঃপর দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে তুমি যেমন বিবেচনা করিবে, তাহাই করিবে। ..আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি যে আমার পলিসি ভুল, তোমারটা ঠিক-অপরকে সাহায্য করা সম্বন্ধে, অর্থাৎ একেবারে বেশি বেশি দিলে তোক কৃতজ্ঞ না হইয়া উল্টা ঠাওরায় যে, একটা বোকা বেশ পাওয়া গেছে। দানের ফলে গ্রহীতার যে নৈতিক অবনতি হয়, সেদিকে আমার দৃষ্টি থাকে না। দ্বিতীয়তঃ ভিক্ষের পয়সা যে উদ্দেশে লোকে দেয়, তাহা একটুও এদিক-ওদিক করিবার আমাদের অধিকার নাই।”

শেষের মন্তব্যটি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা পরবর্তী সময়ে স্বামীজির আচরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বারাণসীধামে বিত্তশালী ভূম্যধ্যিকারী ভিঙ্গার রাজার সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়, সুপণ্ডিত এই রাজা কাশীতে একটা ধর্মপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তিনি যে অর্থসাহায্য করতে প্রস্তুত তা জানিয়ে দিলেন।

স্বামীজি উত্তর দিলেন, শরীর অসুস্থ, সেইজন্য প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে কোনও পাকা কথা দেওয়া তার সাধ্যায়ত্ত নয়, কলকাতায় ফিরে শরীর সুস্থ হলে ভেবে দেখবেন।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখেছেন : “পরদিবস ভিঙ্গারভবন হইতে এক ব্যক্তি আসিয়া স্বামীজিকে একখানি বদ্ধ পত্র দিল। উহা উন্মুক্ত করিলে দেখা গেল, উপঢৌকনস্বরূপ ভিঙ্গারাজ স্বামীজিকে পাঁচশত টাকার একখানি চেক পাঠাইয়াছেন এবং পত্রে উহাই উল্লিখিত আছে। অমনি স্বামীজি পার্শ্ববর্তী স্বামী শিবানন্দের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘মহাপুরুষ, আপনি এই টাকা নিয়ে কাশীতে ঠাকুরের মঠ স্থাপন করুন।’

জীবনের শেষপর্বে অপরের দেওয়া অর্থ সম্বন্ধে আজও সজাগ হয়ে উঠেছেন সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। স্বামী গম্ভীরানন্দ লিখছেন, “স্বামীজির একটি কাজ তখনও অবশিষ্ট ছিল–ভিঙ্গার রাজার প্রদত্ত অর্থে (পাঁচশত টাকায়) কাশীধামে একটি আশ্রম স্থাপন করিতে হইবে। তিনি প্রধানত স্বামী সারদানন্দকে এই কার্যভার দিতে চাহিলেন; কিন্তু সারদানন্দ সম্মত হইলেন না। তখন তিনি স্বামী শিবানন্দকে (মহাপুরুষ মহারাজকে) ওই কর্তব্য বরণ করিতে বলিলেন, স্বামী শিবানন্দ তখন স্বামীজির সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। স্বেচ্ছাবৃত এই অত্যাবশক কর্তব্য ছাড়িয়া তাহার অন্যত্র যাওয়ার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, সুতরাং তিনিও অস্বীকৃত হইলেন। স্বামীজি তবুও হাল ছাড়িলেন না।” এরপরে দানের টাকার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে স্বামীজির সেই জগদ্বিখ্যাত উক্তি : “বিরক্তি দেখাইয়া অনুযোগ ও ভৎর্সনা- মিশ্রিতস্বরে বলিলেন, টাকা নিয়ে কাজ না-করায় আপনার জন্যে আমাকে কি শেষে জোচ্চোর বনতে হবে?”

এরপরে আর ভাবনা-চিন্তার অবকাশ রইল না, এবার তড়িঘড়ি কাজ। মৃত্যুপথযাত্রী গুরুভাইকে বেলুড়ে ফেলে রেখে সন্ন্যাসী স্বামী শিবানন্দ দানের অর্থের মর্যাদা রাখতে কাশীযাত্রা করলেন।

৪ঠা জুলাই ১৯০২ বেলুড়মঠে মহাসন্ন্যাসী বিবেকানন্দ যখন মহাপ্রস্থানের পথে তখন স্বামী শিবানন্দ তার গুরুভাইয়ের ইচ্ছাপূরণের জন্য তাঁর শেষকীর্তি কাশীধামে শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রম’ স্থাপন করলেন। যুগনায়ক বিবেকানন্দের লেখক স্বামী গম্ভীরানন্দের এই ঘটনাটি সম্পর্কে মন্তব্য “কি আশ্চর্য”, কিন্তু অর্থ সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর চিন্তার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যাঁরা অবহিত তারা মোটেই বিস্মিত নন, বরং এমন না হলেই তারা আশ্চর্য হতেন।

স্বামীজির মতে অর্থে নিরাসক্তি, কিন্তু সঙ্রে অর্থে অতিমাত্রায় সাবধানতা দুটি পরস্পরবিরোধী মানসিকতা নয়। হিসেবের নাগপাশ ছাড়া এ-যুগের সন্ন্যাসী মানবসেবী হয়ে উঠতে পারেন না, এইটাই শিক্ষা।

হিসেব মানে কেবল নগদ টাকার ওপর নজর রাখা নয়। স্বামীজির উদ্ভাবিত অ্যাকাউন্টিং পলিসিতে আরও দুটি বিশেষত্ব রয়েছে। প্রথমটি এখন দেশবিখ্যাত–শাকের টাকা মাছে এবং মাছের টাকা শাকে খরচ নৈব নৈব চ।

এর আগে আমরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নীতিবিহীন প্রয়াসের ব্যর্থতার খবরই জেনেছি; কিন্তু একই খাতে সংগৃহীত অর্থ যে দাতার বিনানুমতিতে অন্য খাতে খরচ করাটা বিধিসম্মত নয় তা স্বামীজিই তার অনন্য বাচনভঙ্গিতে অবিস্মরণীয় করে গিয়েছেন। এদেশের চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্টরা আর কোনও আধ্যাত্মিক পুরুষের এমন ম্যানেজমেন্ট-বাণী কোথাও খুঁজে পাবেন না।

স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিতীয় হিসাব-চিন্তাকেও একটু প্রাধান্য না দিয়ে উপায় নেই। এই বিষয়টি হল, সম্ভাব্য খরচ অথবা এস্টিমেটকে অতিক্রম করা চলবে না। এদেশে অনুমান অথবা এস্টিমেটের কোনও পবিত্রতা বা স্যাংটিটি’ নেই–হাজার টাকার ইঙ্গিত দিয়ে কাজে নামিয়ে শেষপর্যন্ত লাখ টাকা খরচ করিয়ে দেওয়া এদেশের সরকারি এবং বেসরকারি সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধেও স্বামী বিবেকানন্দ কীরকম খঙ্গহস্ত ছিলেন জীবনের শেষ প্রান্তেও তা এইখানে নিবেদন করলে মন্দ হয় না।

এ-বিষয়ে পরের মুখে ঝাল না খেয়ে ঠাকুরের তিন সাক্ষাৎ শিষ্যের আচরণ ও স্মৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবো। এঁরা হলেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দ (পরে মঠ-মিশনের সভাপতি), স্বামী ব্রহ্মানন্দ (স্বামীজির পরম বিশ্বস্ত, মঠ-মিশনের সভাপতি) এবং স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং।

এবার আমরা স্বামী বিজ্ঞানান্দের স্মৃতিকথার ওপর নির্ভরশীল হবো। কিন্তু তার আগে যুগনায়ক বিবেকানন্দর তৃতীয় খণ্ডের একটি ছোট ফুটনোটের ওপর মুহূর্তের নজর দেবো। সেখানে স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে ছোট্ট উদ্ধৃতি। “২৯ মার্চ ১৯০২–আজ পোস্তার ভিত আরম্ভ হইল। আজ মাটিকাটা শুরু হইল। ৩০ মার্চ-নতুন পোস্তার জন্য আজ দেড়টায় আমরা পূজা করিলাম। আজ খোয়া ঢালার কাজ শুরু হইল।” সময়সীমাটা জানা থাকলে ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে।

এরপর আমাদের উদ্ধৃতিটুকু স্বামী বিজ্ঞানানন্দ থেকে। বেলুড়মঠের বারান্দায় বসে পরবর্তীকালে এই ইঞ্জিনিয়র মহারাজ তাঁর নিজের কথা বলেছিলেন। রাজা মহারাজকে স্বামী বিবেকানন্দ খুবই ভালোবাসতেন, খুব মান্যও করতেন। ঠিক গুরুবৎ গুরুপুত্রে এই ভাব। তা বলে কারো একটু দোষ বা ত্রুটি দেখলে তা সইতে পারতেন না।

“যে রাখাল মহারাজকে এত প্রাণের সহিত ভালোবাসতেন, তাকেই একবার এমন গালমন্দ করলেন যে মহারাজ তো একেবারে কেঁদে আকুল। অবশ্য সে ব্যাপারে পুরোপুরি দোষ ছিল আমারই। আমায় বাঁচাতে গিয়ে মহারাজ নিজের উপর দোষটা টেনে নিলেন।

“তখন গঙ্গার ধারে পোস্তা ও ঘাটের কাজ চলেছে। স্বামীজি আমায় বলেছিলেন–পেসন, সামনে একটা ঘাট হওয়া খুব দরকার এবং সে-সঙ্গে গঙ্গার ধারে পোস্তাও খানিকটা বাঁধতে হবে। তুই একটা প্ল্যান করে খরচের একটা আন্দাজ আমায় দিবি তো! আমি একটা প্ল্যান করে কত খরচ পড়বে তারও একটা হিসাব দেখালাম। স্বামীজির ভয়ে আমি খরচ কম ধরে তাকে প্ল্যানটা দেখিয়ে বললাম–এই হাজার তিনেক টাকা হলেই বোধ হয় সব হয়ে যাবে।

“স্বামীজিও তাতে ভারি খুশি। তখনই মহারাজকে ডেকে বলেছেন–কি বল, রাজা! এই সামনেটাতে একটা ঘাট ও পোস্তা হলে বেশ হয়। পেসন তো বলছে, তিন হাজার টাকায় হয়ে যাবে। তুমি বল তো কাজ আরম্ভ হতে পারে। মহারাজও বললেন–তা তিন হাজার টাকায় হয় তো এ টাকা জোগাড় হয়ে যাবে।

“কাজ তো আরম্ভ হল। আমিই কাজকর্ম দেখাশুনা করছি। হিসাবপত্র সব মহারাজ রাখছেন আর টাকাকড়ির জোগাড়ও করতেন তিনিই। কাজ যত এগুচ্ছে–স্বামীজিরও তত আনন্দ। মাঝে মাঝে হিসাবপত্র দেখে–টাকা পয়সা আছে কিনা খোঁজ খবর করেন।

“এদিকে কাজ যত এগুতে লাগল ততই দেখা গেল যে, তিন হাজার টাকায় কাজ শেষ হবে না। আমি বেগতিক দেখে মহারাজকে গিয়ে বললাম–দেখুন, স্বামীজিকে ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম যে তিন হাজার টাকায় কাজ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু একাজ শেষ করতে খরচ হবে ঢের বেশি। এখন উপায় কি বলুন!

“মহারাজ নেহাত ভালোমানুষ ছিলেন। আমার অবস্থা দেখে তার খুব দয়া হল। তিনি সাহস দিয়ে বললেন, তার আর কি করা যাবে? কাজে হাত যখন দেওয়া হয়েছে, তখন যে করেই হোক শেষ করতে হবে। তুমি তার জন্য ভেবো না, যাতে কাজ ভালো হয় তাই কর। আমি তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু মনে মনে ভয় আছে যে, এক সময় স্বামীজির গালাগাল খেতেই হবে।

“এমনি সময় স্বামীজি একদিন কাজের খরচপত্রের হিসাব দেখতে চাইলেন। মহারাজ হিসাব খুবই সুন্দরভাবে রাখতেন। হিসাব দেখতে গিয়ে যখন দেখলেন যে, তিন হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে অথচ কাজ শেষ হতে ঢের বাকি তখন তিনি মহারাজের উপর খুব একচোট নিলেন। মহারাজ একটি কথাও বললেন না, চুপ করে সব সয়ে গেলেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার ভারি দুঃখ হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *