২. সম্রাট-সন্ন্যাসী-সূপকার

সম্রাট-সন্ন্যাসী-সূপকার

গত দেড়শ বছরে এদেশের অভুক্তদের দুঃখ সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন কে? এই প্রশ্নের একটিই উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ। এই সেই মানুষ যিনি অসুস্থ এবং অনাহারি দেশবাসীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের মঠের জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে রাজি ছিলেন। পঞ্জাবের দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে সখারাম গণেশকে ও জনৈক পাহাড়ি ভদ্রলোককে তিনি বলেছিলেন, “দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত যতক্ষণ অভুক্ত থাকবে ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো এবং তার সেবা করা, বাকি সব অধর্ম।” আরও একবার জনৈক বেদান্তবিশারদের মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন, “পণ্ডিতজী, যারা একমুঠো অন্নের জন্য কাতরাচ্ছে প্রথমে তাদের জন্যে কিছু করুন, তারপর আমার কাছে আসুন বৈদান্তিক আলোচনার জন্যে।”

স্বামী বিবেকানন্দর নামাঙ্কিত এক ইস্কুলে আমার পড়াশোনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সুবাদে ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত স্বামীজির জীবনের একটি অল্প আলোচিত এবং অনালোকিত দিক সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ ও কিছুটা অনুসন্ধানের সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, যদিও ইস্কুলে আমার সিনিয়র পটলাদা সেই কতদিন আগে বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ও খাওয়াদাওয়া এই বিষয়টির ব্যাপ্তি ও গভীরতা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে তুলনীয়। পটলাদা তখনই সন্দেহ করেছিলেন, এই ধরনের গবেষণা একজীবনের কর্ম নয়, উনচল্লিশ বছরে খাওয়াদাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিবেকানন্দ বিশ্বভুবনকে যেভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন তার যথার্থ মূল্যায়ন হতে অন্তত আরও তিনশো নব্বই বছর লাগবে।

আমার তখন হতাশ অবস্থা, উঁচুক্লাসের ছাত্র পটলাদার কাছে করুণভাবে আবেদন করেছিলাম, “থ্রিনাইনটি স্কোর তো আমার হবে না!” পটলাদা বকুনি দিয়ে বলেছিলেন, “তাহলে অ্যাদ্দিনে বিবেকানন্দ থেকে কী শিখলি? দশহাজার মাইলের যাত্রাও সামান্য একটি পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করতে হয়। চীনা দার্শনিকের উক্তি, কিন্তু স্বামীজি তো ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছে, চীনারাই একদিন সারা বিশ্বকে আলোকিত করবে, পীতযুগ আর সুদূর নয়।”

পটলাদা আরও বলেছিলেন, “স্বামীজি অ্যান্ড খাওয়াদাওয়া স্টাডিটা তোর মতন পুরুত বংশের সন্তানই শুরু করতে সাহস পাবে, কারণ এর জন্য প্রয়োজন কখনও অনাহার, কখনও অর্ধাহার ও কখনও ভূরিভোজনের। থ্রি-ইন-ওয়ান অভিজ্ঞতা।”

এতোদিন পরে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা চেপে রেখে লাভ নেই, আমাদের ইস্কুলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর স্মৃতিবিজড়িত কোনো অনুষ্ঠান হলেই ছাত্রদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ আকর্ষণ-বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ও সমর্থিত ‘দাঁড়া প্রসাদ’, যার অর্থ ভক্তদের বসিয়ে না খাইয়ে তাদের হাতে সরা অথবা মোড়ক বিতরণ করা। এইসব বিতরণকার্যে পটলাদার সবিশেষ ভূমিকা থাকতো। বিভিন্ন প্রসাদের প্রতি পটলাদার যে একটু বাড়তি দুর্বলতা ছিল তা পটলাদা কখনও চেপে রাখতেন না। কিন্তু বারবার বোঁদে খেয়ে পটলাদা স্বামীজি সম্বন্ধে কিছু গবেষণা চালিয়ে বেশ কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং আমাকে উসকে দিয়েছিলেন, “হেডমাস্টারমশায়কে বল, পর্যাপ্ত পরিমাণে রসগোল্লা খেতে পাবেন একমাত্র এই প্রত্যাশাতেই নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেননট বোঁদে।” পটলাদার মতে, “বোঁদেটা হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ফেবারিট।” বিয়াল্লিশ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে মিছিলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে হাওড়ায় পুলিশের খপ্পরে পড়ে পটলাদা থানায় বলেছিলেন, “বন্দেমাতরম্ কখনোই বলিনি, আমি স্লোগান দিয়েছি বোঁদে খেয়ে মাথা গরম!”

রসগোল্লার প্রসঙ্গে হেডমাস্টার সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য মহাশয় সোজা ব্যাটে খেলেছিলেন, “শোন, স্বামী বিবেকানন্দ মিষ্টি খাওয়ার লোক ছিলেন না, তিনি যা পছন্দ করতেন তার ব্যবস্থা করলে তোমাদের চোখে জল ছাড়া কিছু থাকবে না, তার নাম লঙ্কা।”

পটলাদা পরিস্থিতিটা বুঝে গেলেন। এ বড় শক্ত ঘাঁটি, এখানে লুজ বল একেবারেই দেওয়া চলবে না। এরপরেই শ্রদ্ধেয় পটলাদাকে আমি একটা নোটবই উপহার দিয়েছিলাম, মঠমিশনের ভোজনযোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ মাঝেমাঝে যাতে তিনি দুটো মলাটের মধ্যে বন্দি করতে পারেন।

তথ্য সংগ্রহে নেমে নতুন নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন পটলাদা, তার ইচ্ছে, যদি কোনোদিন ইস্কুলে ও কলেজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সন্ন্যাসী হন, তাহলে অবশ্যই নাম নেবেন স্বামী ভোজনানন্দ। তিনি খবর পেয়েছেন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ প্রয়োজন হলেও রামকৃষ্ণ মঠমিশনে ভোজনে তেমন কোনো বাধানিষেধ নেই। খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন দক্ষিণেশ্বরের বড় কর্তা এবং তার প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এবং সেই ট্রাডিশন আজও রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বত্র অব্যাহত রয়েছে। ভক্তজনদের মধ্যে অকাতরে প্রসাদ বিতরণ করে আনন্দ পান না এমন কঠিনহৃদয় সন্ন্যাসী আমি আজ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে দেখিনি।

পটলাদা তার নোট বইতে অনেক কুইজ সযত্নে সংগ্রহ করে রাখতেন। একদিন ঘোষণা করলেন, “দু’খানা প্রমাণ সাইজ জিভে-গজা পুরস্কার পাবি, যদি বলতে পারিস একমাত্র কোন্ দেশে সম্রাট, সন্ন্যাসী ও সূপকার অর্থাৎ রাঁধুনিকে একই নামে ডাকা হয়?” উত্তর দিতে পারলাম না! কনসোলেসন প্রাইজ হিসেবে একখানা জিভে-গজা আমার শ্রীহস্তে অর্পণ করে পটলাদা বললেন, “ইন্ডিয়া! শব্দটা হলো মহারাজ! একমাত্র এই পবিত্র দেশে সম্রাটও মহারাজ, সন্ন্যাসীও মহারাজ, আবার রাঁধুনিও মহারাজ। বোধহয় এই কারণেই বিবেকানন্দ ছিলেন নরেন্দ্র, সন্ন্যাসী, আবার ওয়ার্লডের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি। অনেক খোঁজখবর সংগ্রহ করতে হবে তোকে এবং আমাকে, তবে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, ওয়ার্লডের মধ্যে তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি সপ্তসাগর পেরিয়ে আমেরিকায় গিয়ে বেদান্ত ও বিরিয়ানি একসঙ্গে প্রচার করবার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।”

হাওড়া বিবেকানন্দ ইস্কুলের গণ্ডি পেরোবার পরেও পটলাদা তার নোটবই ও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষণা ত্যাগ করেননি। আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। আমি বলেছি, “খুবই কঠিন বিষয় পটলাদা। এই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনো বইতে কোনো রেফারেন্স পাচ্ছি না, তেমন কোন খাবারের দোকানের সন্ধানও পাচ্ছি না যেখানে বিবেকানন্দ নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতেন বা রেসিপি সংগ্রহ করতেন।”

পটলাদা প্রচণ্ড বকুনি লাগালেন। “তুই শুধু খেতেই শিখেছিস, গবেষণা করার ব্যাপারটা এখন তোকে শিখতে হবে, দোকান পাবি কোথায়? জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা স্বামীজি তো আমেরিকা এবং ইউরোপে তার আদরের ইন্ডিয়াকে প্রচার করলেন, আর এদেশে যখন ছিলেন তখন তার হাতে পয়সা কোথায়? হঠাৎ বাবা মারা যাবার পরে তো অনাহার অথবা অর্ধাহার। পরে যখন বিশ্ববিজয় করে স্বদেশে ফিরে এলেন তখন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শরীরটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, মণ্ডা-মিঠাই তো দূরের কথা, টানা একুশ দিন জল না খেয়ে কাটাতে হয়েছিল কবিরাজের নির্দেশে।”

“তাহলে! যে লোকের খাওয়াদাওয়াই বারণ, একখানা বরফি খেয়েছে বলে গুরুভাইরা যাঁর নামে ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করছে এই কারণেই তার অসুখ বেড়েছে, তাকে নিয়ে কীভাবে লিখবো?”

পটলাদা কেসটা জানতেন। “বাগবাজারের এই ডাক্তারের নাম শশীভূষণ ঘোষ। এঁকে আলমোড়া থেকে বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ মিঠাই বরফি সম্পর্কে কী উত্তর দিচ্ছেন তা ধৈর্য ধরে খুঁজে বার কর। দেখবি, বিবেকানন্দ তার প্রিয় শশী ডাক্তারের কাছে নিবেদন করছেন, আমি লউ-এ একটি বরফির ষোলভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম, আর যোগেনের মতে (স্বামী যোগানন্দ) ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ। যোগেন যা লিখেছে তা ভ্রূক্ষেপ না করবার জন্যে ডাক্তারের কাছে। করুণ আবেদন জানাচ্ছেন আমাদের যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ।”

আমাকে অবশ্য তেমন ঘাবড়াতে দেননি পটলাদা। বলেছিলেন, “সাহস অর্জন কর, একেবারে গোড়া থেকে শুরু কর আমার মতন, ইস্কুলেই তো পড়েছিস, মর্নিং শোজ দ্য ডে, ভোরবেলাটা দেখলেই বাকি দিনটা কেমন যাবে তা বোঝা যায়।”

“তা হলে আপনি বলছেন, ভবিষ্যতেও আমার দ্বারা কিসসু হবে না, আমি চিরকালই এইরকম বোকা-বোকা থেকে যাব?”

পটলাদা বললেন, “ওরে আমরা স্বামী বিবেকানন্দর জীবন নিয়ে আলোচনা করছি, তোর-আমার লাইফ নিয়ে নয়। আমার প্রার্থনা, তুই পরিণত বয়সে ছ’সাত ভলমের একখানা জব্বর বই লিখবি ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভোজনাদি’–দেখবি বইটা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ও গরম জিলিপির মতন বিক্রি হচ্ছে।”

“কথাটা হট কেক’!”

“রাখ তোর হট কেক, স্বামী বিবেকানন্দ পাঁউরুটিকেই সন্দেহ করতেন, তা হট কেক!”

পুরনো কথায় ফিরে এলেন পটলাদা। তিনি তখন কঁকুড়গাছির কাছে কোথায় পড়াশোনা করেন, চান্স পেলেই যোগোদ্যান, অদ্বৈত আশ্রম এবং বেলুড় মঠ ঘুরে আসেন এবং প্রবীণ সাধুদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হিসেবে গোপন রিসার্চের কিছু কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে নোটবইতে লিখে ফেলেন। বিবেকানন্দকে স্বচক্ষে দেখেছেন এমন কেউ কেউ তখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে পটলাদার যোগাযোগ হয়েছে।

পটলাদা বললেন, “বিদ্রোহী বিবেকানন্দর আগাম নমুনা আমরা কবে প্রথম দেখলাম বল তো?”

“ঠাকুর জানেন।”

“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে তখনও আশ্রয় মেলেনি, সিমুলিয়ার তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নরেন্দ্রনাথ দত্তর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। সংঘর্ষটা মায়ের সঙ্গে এবং রণস্থল খাওয়ার আসন। ডান হাতে খেতে খেতে বাঁ হাতে গ্লাস থেকে জল খাওয়া নিয়ে প্রবল মতবিরোধ! এঁটো হাতে গ্লাস ময়লা করার ইচ্ছে নেই নরেনের। কিন্তু সেযুগে বাঁ হাতে জল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না, কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে নরেন বঙ্গীয় রীতি পাল্টালেন, আর আজকাল তো ভাতখাওয়ার সময়ে এঁটো হাতে গেলাস ধরলে মায়েরাই বকুনি দিচ্ছেন। বুঝতে পারছিস একটা পাঁচবছরের ছেলের বৈপ্লবিক গুরুত্ব? তুই-আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে বলে দিতে পারতাম এ-ছেলে ক্ষুধানিবৃত্তির ব্যাপারে একদিন অবশ্যই হিসট্রি ক্রিয়েট করবে।”

আমাদের পটলাদাও একসময়ে নিঃশব্দে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, উপার্জনের জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। বিলেত যাওয়ার আগে পটলাদা আমাকে রসনারসিক বিবেকানন্দ-গবেষণা সম্পর্কে বহুবিধ পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “একটা নয়, অন্তত ১০৮টা পথ দিয়ে এই বিষয় মন্দিরে পৌঁছতে পারিস। এক : উনচল্লিশ বছরটা বেশ কয়েকটা পর্বে ভাগ করে নিতে পারিস। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বে বিবেকানন্দ এক একরকম খাবারের ওপর নির্ভর করছে এবং অপরকে খাইয়েছে। পাঁচ বছর থেকে জীবনের শেষ দিন ৪ঠা জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত রস ও রসনার কালানুপাতিক ইতিহাসটা ধাপে ধাপে উন্মোচিত হতে পারে।”

“আরও অনেক পথ আছে, যেমন আমিষ না নিরামিষ? স্বামীজির কুষ্ঠিটা একবার দেখে নিতে হবে, বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা ওঁর ভাগ্যে সবসময় লেখা রয়েছে, ওঁর বিরাটত্ব প্রমাণের এটাও মস্ত এক মাপকাঠি। আমিষ নিরামিষ পছন্দ না হলে রয়েছে তৃতীয় পথ; কোন স্কুলের রান্না তার পছন্দ? বাঙালি? না নবাবী? না সায়েবী? প্রত্যেকটির আবার বহু শাখা বর্ধমানি না ঢাকাই? লাহোর না লখনউ? আমেরিকান? না ফ্রেঞ্চ? না জার্মান? ইটালিয়ান? না স্প্যানিশ?”

পটলাদা একটুকরো কাগজ দেখতে দেখতে বলেছিলেন, “এই তো কলির সন্ধে! বাড়ির রান্না? না হৃষিকেশের ঝুপড়ির রান্না? না ফাঁইভস্টার মার্কিনী হোটেলের রান্না?”

আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি কি না তা লক্ষ্য না করে পটলাদা বললেন, “ধর্মপথেও অনুসন্ধান করা যায় হিন্দু রান্না, মুসলিম রান্না, বৌদ্ধ রান্না, জৈন রান্না, চার্চের রান্না, মন্দিরের রান্না।”

“যথেষ্ট হয়েছে পটলাদা, মাত্র থার্টি নাইন ইয়ার্সে রসনার কত বৈচিত্র্যেকেই না স্বামীজি খুঁজে বেড়িয়েছেন।”

পটলাদার আশঙ্কা, “আমি কাছে না থাকলে তুই সব ভুলে যাবি, সাবজেক্টগুলো ভালভাবে ব্রেনে ঢুকিয়ে নে, স্বামীজির মতন স্মৃতিশক্তি নিয়ে তো তুই আমি এই দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হইনি। যেমন ধর পূর্বদেশের রান্না? না ওয়েস্টার্ন রান্না? ঝাল, না বেঝাল? ফল না মূল? আইসক্রিম না কুলপি? লঙ্কা না গোলমরিচ? অ্যাসপারাগাস না ডেঙোর উঁটা? এসব নিতান্ত সাধারণ প্রশ্ন নয়! প্রত্যেকটার পিছনে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল, কোরান পর্যন্ত উঁকি মারছে।”

আমি নতমস্তকে পটলাদার বক্তব্য নিজের খাতায় নোট করে নিয়েছি। পটলাদা বললেন, “আরও দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে তিনি ভয় পেতেন না! অতিভোজন, না অনশন? কোনটি শ্রেয়? তুই নোট করে নে, মতলীলার শেষপর্বে এসে স্বামীজি পরামর্শ দিচ্ছেন, অতিভোজন অপেক্ষা অনশন শ্রেয়! পরমুহূর্তেই কঠিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন, অনশন অপেক্ষা অর্ধভোজন যে শ্রেয় তা কারুর বলার অপেক্ষা রাখে না।”

এরপরেই পটলাদা বলেছিলেন, “অনেক পথ আমাদের দুজনকে একসঙ্গে অতিক্রম করতে হবে, কারণ খেয়ে এবং খাইয়ে অনেক বড় বড় লোক হয়ত অনেক নাম করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’জন রান্নাঘরে প্রবেশ করে শত শত রান্নার রেসিপি আবিষ্কার করেছেন? এসব সম্ভব। হয়েছে এই জন্যে যে আমাদের হিরো কখনও ধনীর দুলাল, কখনও বা ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, কখনও বিশ্ববিজয়ী বক্তা। কখনও স্বামীজির সামনে। বিলাসবহুল হোটেলের শতপদের বুফে, আবার কখনও বা কচুপাতায় ছড়ানো ভাত ও ত্যালাকুচো পাতার ঝোল। কখনও বা স্রেফ অনাহার। এখন প্রশ্ন, কতদিন একটানা অনাহারে থাকতে হয়েছে এই মহামানবকে? ক্ষুধার সময় অন্ন না মেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কোথায় কোথায় তার হয়েছে? আমাদের এই কলকাতায়? না পরিব্রাজকের উত্তরাখণ্ডে? না অন্নপূর্ণার কৃপাধন্য মার্কিনদেশে?”

আমার চোখ দুটি অক্ষিগোলক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এই আশঙ্কা হওয়ামাত্রই পটলাদা বলেছিলেন, “ভয় পাসনি। যদি আবিষ্কার করতে পারিস, কোন খাবারটি বীরসন্ন্যাসীর সব চেয়ে প্রিয় ছিল, কোন জিনিসটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না এবং কোন অভিজ্ঞতার আলোকে স্বামীজি ঘোষণা করতে সাহস পেয়েছিলেন, ভাল সন্ন্যাসী হতে হলে ভাল রাঁধুনিও হওয়া দরকার, তা হলে আমরা দু’জনেও এই দুনিয়াতে একটু দাগ রেখে যাব।”

পটলাদা এরপরেই বলেছিলেন, “এই নোটবুকখানা সঙ্গে নিয়ে বিদেশে চলোম। যথাসময়ে অনেক খবরাখবর পাবি সূপকার বিবেকানন্দ সম্বন্ধে! তুই নিজেও থেমে যাসনে, বুঝিয়ে দিস সবাইকে, প্রাচীন ভারতে সূপকার মানে রাঁধুনি এবং একমাত্র এই দেশেই রাঁধুনি ও ঠাকুর সমার্থক শব্দ। তুই চালিয়ে যা, তারপর টুপাইস রোজগার করে আমিও তো ফিরে আসছি।”

.

ঘটনাচক্রে পটলাদার আর এদেশে ফিরে আসা হয়নি; বিদেশেই তিনি ঘর সংসার পেতেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দ-অনুসন্ধান কখনও ত্যাগ করেননি। বেশ কিছু চিঠিপত্র নানা খবরে বোঝাই করে বিমান ডাকে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমিও কিছু কিছু খবর বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রহ করেছি নানা সূত্র থেকে, যার মধ্যে বিবেকানন্দর নিজের লেখা, নিজের চিঠি, নিজের বক্তৃতা ছাড়াও রয়েছে নানাজনের স্মৃতিকথা। এইসব সংগৃহীত হতে মহাসমাধির পরেও এক শতাব্দী লেগে গিয়েছে। শতাব্দীর সন্ধানেও সব খবর যে এখনও সংগৃহীত হয়নি তা জোরের সঙ্গেই বলা চলে। এক রান্নার পর্ব শেষ হতে না হতেই আরেক রান্নার সময় এসে যায়, কিন্তু কোথাও তো অপেক্ষমাণ অতিথিদের জানাতে হবে, খাবার রেডি, আসুন, মহামানব বিবেকানন্দকে নতুন এক ভূমিকায় দেখুন এবং আমাদের মতন আপনিও বিস্ময়ে অভিভূত হোন।

.

মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর পিতৃকুল ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব, শুধু নিরামিষ নয় সেখানে পরিবার সদস্যদের গোবর-তুলসীও নিয়মিত গ্রহণ করার রীতি ছিল। এই প্রভাব শুরুতে সিমুলিয়ার আমিষভক্ষক দত্তপরিবারেও পড়েছিল। আমরা একটি দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি–গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে খেতে বসে বালক নরেন পাতে কিছু নিতে রাজি হচ্ছেন না, কারণ তরকারির সঙ্গে মাছের স্পর্শ ঘটেছে এবং পরিবেশিকা দিদি স্বর্ণময়ীর সঙ্গে তার বাদানুবাদ চলেছে। পিতৃদেব বিশ্বনাথ নিজেও ছিলেন একজন ভোজনরসিক ও রন্ধন-বিলাসী। বাড়িতে বাবুর্চি আনিয়ে নানা মোগলাই খাদ্যের আয়োজন তিনি প্রায়ই করতেন। ভাই-বোনের কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে স্নানের জায়গা থেকে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, “ওর চোদ্দপুরুষ গেঁড়িগুগলি খেয়ে এল, আর এখন ও সেজেছে ব্রহ্মদত্যি, মাছ খাবে না!”

ব্রহ্মদত্যিরা যে মাছ-মাংস স্পর্শ করে না তা সেই প্রথম জানলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তপরিবারে যে যথেষ্ট রুচিপরিবর্তন ঘটেছে তাও দেখা গেল তখনকার সি পি অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসের পথে। মা-বাবার সঙ্গে নরেন, ভ্রাতা মহিম ও বোনরা চলেছে রায়পুরে। ঘোড়াতালাওতে মাংস রান্না হল। দিদিমার প্রভাবে মেজভাই মহিম তখন মাছ-মাংস মুখে দেয় না। পরবর্তীকালে মহেন্দ্রনাথ লিখছেন : “আমি খাব না, বমি আসতে লাগল। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল–’খা। তারপর আর কি? বাঘ নতুন রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”

মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার আগে নরেনের সাংগঠনিক শক্তির প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছে এই রান্নার ক্ষেত্রেই। নরনারায়ণের সেবার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে এক অভাবনীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিডি ক্লাব’ সংগঠন, যার বাংলা মহেন্দ্রনাথ করেছেন ‘পেটুক সঙ্ঘ’–যার উদ্দেশ্য কেবল ভোজন নয়, সেই সঙ্গে রান্না নিয়ে রীতিমত রিসার্চ। প্রতিষ্ঠাতার দৃষ্টি সারা বিশ্বের দিকে প্রসারিত। ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেক এই সময় পুরনো বইওয়ালার কাছ থেকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত ফ্রেঞ্চ রান্নার বই কিনতে আরম্ভ করেছেন। যে ফরাসী জাত অর্ধসভ্য ইউরোপকে ভদ্রস্থভাবে রান্নাবান্না করে খেতে দেতে শিখিয়েছে, যে ফরাসীজাত ও সভ্যতার গুণগানে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন মুখর হবেন, তার আদিতে কমবয়সের ফ্রেঞ্চকুকিং এর সাধনা। ফরাসীরা বড়ই সৃষ্টিশীল, এঁদের সংস্পর্শে যাঁরাই আসেন তাঁরাও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন। আমরা তার স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছি গ্রিডি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতার গবেষণামূলক রন্ধনে। এই পর্যায়ে নরেন্দ্রনাথের সফলতম আবিষ্কার হাঁসের ডিম খুব ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে কড়াইশুটি ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি। পলোয়ার চেয়ে এই রান্না যে অনেক উপাদেয় একথা বহুবছর পরেও বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন! বাবা রাঁধাতেন কালিয়া এবং পলোয়া, আর সুযোগ্যপুত্র আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন ডিশের মাধ্যমে পূর্বপশ্চিমকে একাকার করে দিলেন।

কিন্তু শুধু হাইলেভেলের রান্না নয়, এই ক্লাবের অন্যতম সভ্য হয়েছিলেন রাখাল, যিনি পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ নামে এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে রামকৃষ্ণ মঠমিশনের প্রকৃত রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন। কুস্তিগীর রাখাল যে প্রতিদিন শরীরচর্চার পরে আধসের কচুরি ও আনুপাতিক আলুচচ্চড়ি খেতেন তা এখন আমাদের অজানা নয়। বলাবাহুল্য, তখন কচুরির সের ছ’আনা, আরও আগে নাকি তিন আনা সের ছিল, কিন্তু বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহিমবাবু সেই স্বর্ণযুগ দেখেননি!

কিন্তু কচুরি, সিঙাড়া, খিচুড়ি, পলোয়ার বাইরেও আর একটি খাদ্যের প্রতি স্বামীজির প্রবল টানের প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। পরবর্তী জীবনে জেলা জজ নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কম বয়সে নরেন তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন, “কৈলাস খাবারওয়ালা নানা রকমারি খাবার ঝুড়ি ভরে রোজ বাড়িতে আনত। সব ছেলেরা মিলে পরমানন্দে জলপান করা হত। আমাদের সব কারুর দু’পয়সা বরাদ্দ, কারুর চারপয়সা, কারুর দু’আনা।…স্বামীজির সিনিয়র গ্রেড, ন’কাকার র‍্যাঙ্কের…জিবে গজা ওঁর বড়ই প্রিয়, একদিনের কথা, ওঁর বখরায় যা পেলেন, তাতে সন্তুষ্ট নন। একখানা গজা হঠাৎ তুলে নিয়ে সব্বাইয়ের সামনে নিজের জিবে ঠেকালেন এবং অম্লান বদনে হাঁড়ির মধ্যে টপ করে ফেলে হো হো করে হেসে বললেন, ওরে তোরা কেউ গজা খাসনি–এই য্যা–সব এঁটো হয়ে গেল। হাঁড়িসুদ্ধ একাই মেরে দিলেন। কী আমোদই করতেন!”

আরও কিছু পরে কাশীপুর উদ্যানবাটী পর্বে কচুরি ইত্যাদি জলখাবারের জয়যাত্রা অব্যাহত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মেজভাই মহিমকে কাশীপুরে দেখে গুরুভাই শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) অতি আগ্রহ সহকারে ফাগুর দোকান থেকে গরম লুচি, গুটকে কচুরি ও কিছু মিষ্টি এনে নরেন ও তাকে খাওয়ালেন।

শুনুন আরেকদিনের কথা। নরেন একদিন গায়ক পুলিন মিত্রর মেস বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। কচুরি ভেজে দেওয়া হয়েছে, খাচ্ছেন, খুব ভাল লেগেছে। একটু খেয়ে পুলিনকে দিলেন। পুলিন খাচ্ছেন। তখন নরেন আবার বলছেন–”এটা থেকেই একটু দেনা! বেশ চমৎকার, কি বলিস?”

এই বিবেকানন্দ কিন্তু জগৎ চষে বেড়াবার পর বাঙালি ময়রার দোকান সম্বন্ধে মত একেবারেই পাল্টে ফেলেছিলেন। শুধু বক্তৃতায় না, লিখিতভাবে তিনি জানিয়েছেন, “এই যে ঘরে ঘরে অজীর্ণ, ও ঐ ময়রার দোকানে বাজারে খাওয়ার ফল।…ঐ যে পাড়াগেঁয়ে লোকের তত অজীর্ণদোষ…হয় না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে লুচি-কচুরি প্রভৃতি ‘বিষলড়ুকের’ অভাব।” এইখানেই ইতি টানা যুক্তিযুক্ত মনে না করে বিরক্ত বিবেকানন্দ নিজের হাতে লিখে চলেছেন, “ভাজা জিনিসগুলো আসল বিষ। ময়রার দোকান যমের বাড়ি। ঘি-তেল গরমদেশে যত অল্প খাওয়া যায়, ততই কল্যাণ। ঘিয়ের চেয়ে মাখন শীঘ্র হজম হয়। ময়দায় কিছুই নাই, দেখতেই সাদা। গমের সমস্ত ভাগ যাতে আছে, এমন আটাই সুখাদ্য।…ময়রার দোকানের খাবারের খাদ্যদ্রব্যে কিছুই নেই, একদম উল্টো আছেন বিষ-বিষ-বিষ। পূর্বে লোকে কালেভদ্রে ঐ পাপগুলো খেতো; এখন শহরের লোক, বিশেষ করে বিদেশী যারা শহরে বাস করে, তাদের নিত্যভোজন হচ্ছে ঐ।…খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও, সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।”

দীর্ঘদিনের ভ্রমকে এক ধমকে মুছে ফেলা যাবে না জেনেই সমাজসংস্কারক, জাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বিবেকানন্দ আবার গোলাবর্ষণ শুরু করেছেন : “ধনী হওয়া, আর কুড়ের বাদশা হওয়া–দেশে এককথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।…যেটা লুচির ফুলকো ছিঁড়ে যাচ্ছে, সেটা তো মরে আছে।…যার দু’পয়সা আছে আমাদের দেশে, সে ছেলেপিলেগুলোকে নিত্য কচুরি মণ্ডামেঠাই খাওয়াচ্ছেন!! ভাত-রুটি খাওয়া অপমান!! এতে ছেলেপিলেগুলো নড়ে-ভোলা পেটামোটা আসল জানোয়ার হবে না তো কি? এত বড় ষণ্ডা জাত ইংরেজ, এরা ভাজাভুজি মেঠাইমণ্ডার নামে ভয় খায়..আর আমাদের…আব্দার লুচি কচুরি মেঠাই ঘিয়ে ভাজা, তেলেভাজা। সেকেলে পাড়াগেঁয়ে জমিদার এককথায় দশ ক্রোশ হেঁটে দিত,…তাদের ছেলেপিলেগুলো কলকেতায় আসে, চশমা চোখে দেয়, লুচি কচুরি খায়, দিনরাত গাড়ি চড়ে, আর প্রস্রাবের ব্যামো হয়ে মরে; ‘কলকেত্তা’ই হওয়ার এই ফল!!”

পটলাদা একবার বিলেত থেকে তাঁর প্রিয় হাওড়ায় ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। মূল্যবান সময়টুকুতে স্বামীজির এই কচুরি সম্পর্কে সাবধানবাণী সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। পটলাদা বললেন, “কচুরিবিরোধী মানসিকতাটা স্বামীজির জীবনের শেষপর্বের ঘটনা, তার আগে ১৮৯৬ সালে লন্ডনে বিশ্ববিজয়ী স্বামীজি বাড়ির বেসমেন্টে গিয়ে নিজেই মাখন গলিয়ে ঘি করে আলুপুর দেওয়া কচুরি ও বেশ ঝাল ঝাল চচ্চড়ি করে–ওপরকার ডাইনিং রুমে ফিরে এলেন।”

“দুর্দান্ত খবর পটলাদা, মহামানবের পরস্পরবিরোধী ঘটনাবলী দু’একটা না উপস্থিত করলে আজকাল পাঠক-পাঠিকারা সন্তুষ্ট হতে চায় না।”

“সেবারে লন্ডনে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল। স্বামীজির বাড়ির কাজের মেমটির নাম মিস্ কেমিরন। কচুরি ও চচ্চড়ি খেতে খেতে স্বামী সারদানন্দ সেবার বিবেকানন্দভ্রাতা মহেন্দ্রনাথকে বললেন, “ওহে, মিস কেমিরনের জন্যে একটু তুলে রেখে দাও নইলে বিকেলে এসে ঝগড়া করবে।” পরবর্তী ঘটনা : মিস কেমিরন এলেন এবং যথারীতি জানতে চাইলেন, “তোমাদের কী রান্না রয়েছে বল। নিজেরাই সব ভাল জিনিস খাবে আর আমার জন্যে কিছু রাখবে না।” সারদানন্দকে তিনি বললেন, “ইউ কুকি সোয়ামি, তুমি কেবল খাবে, আর খেয়ে খেয়ে মোটা হবে, আর আমার জন্যে কিছু রাখবে না।” দুখানা কচুরি আর আলুচচ্চড়ি অবশিষ্ট ছিল, তাই মিস কেমিরনের হাতে গেল।

কচুরি কিভাবে খেতে হয় তা সায়েব-মেমদের অজানা। মিস কেমিরন জিজ্ঞেস করলেন, “কী দিয়ে খেতে হয়? চিনি দিয়ে না নুন দিয়ে?” মিস কেমিরন প্রথমে চিনি ট্রাই করলেন। ভাল লাগল না। সারদানন্দ পরামর্শ দিলেন, নুন দিয়ে ট্রাই করতে। এরপরে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল, চামচে দিয়ে আলুচচ্চড়ি মুখে দিয়ে মিস কেমিরন চিৎকার করে উঠলেন–”ও, কি ভয়ঙ্কর জিনিস। গোলমরিচকে লঙ্কা দিয়ে বেঁধেছে”, এই বলে দু’হাতে নিজের দু’গাল চড়াতে লাগলেন, ওহো! বিষ! বিষ! পয়জন!

আন্দাজ করছি, এরপরে ইংরেজনন্দিনী আর কখনও কচুরি ও চচ্চড়ি মুখে দেবে না। পটলাদা বললেন, “তুই নোট ক’র মানুষের প্রতি ভালবাসা, গরম চা, সুগন্ধী তামাক এবং মাথাখারাপ করে দেওয়া লঙ্কা এই চারটে ব্যাপারে বিবেকানন্দ ছিলেন সীমাহীন।”

.

ফরেনে ফিরবার আগে তাঁর আদি নোটবইখানা পটলাদা আমার কাছে রেখে গিয়েছিলেন।

পটলাদার সংগ্রহের দিকে একবার তাকিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া। শেষের শব্দটিকে অসৌজন্যপূর্ণ ভাববেন না, স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব একবার শিবনাথ শাস্ত্রীর ঈশ্বরভক্তি বোঝাতে গিয়ে অন্য শব্দ না পেয়ে বলেছিলেন, যেন রসে ফেলা ছানাবড়া।

“পটলাদা, আপনি যা যা লিপিবদ্ধ করেছেন বিভিন্ন সূত্র থেকে তার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত পেশ করতে হলে সাতশ-সাঁইত্রিশ পাতার বই লিখতে হবে।”

পটলাদা; “বিষয়টাও বিশাল, একথা ভুললে চলবে না। সেবার তোকে বলেছি, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রসনারসিক বিবেকানন্দকে দেখলে মাথা ঘুরে যায়! মনে হচ্ছে, সব দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হলে তোর আরও উনচল্লিশ বছর লেগে যাবে, তার থেকে বরং ব্যাপারটাকে কালানুক্রমিক সাজিয়ে নে, তাহলে সংক্ষিপ্তসার লিখতে

তেমন কষ্ট হবে না।”

প্রথম পর্বটাকে সুখাসনে সুখাহার পর্ব বলা যেতে পারেনরেনের বাবা যতদিন বেঁচে আছেন এবং দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয়ের আদিপর্ব কেবল শুরু হয়েছে। এই পর্বে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর তার প্রিয় শিষ্যটিকে দেখেই মাখন, মিছরি ও কতকগুলো সন্দেশ এনে স্বহস্তে খাইয়ে দিতে লাগলেন। “আমি যত বলিতে লাগিলাম আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইব। তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না।”

এই পর্বে ঠাকুর বোধ হয় নরেনকে হুঁকোও খাইয়েছিলেন। নিকটজনের সাবধানবাণী, নরেন হোটেলে খায়! পরমহংসদেবের উত্তর : “ওরে শালা তোর কি রে?…তুই শালা যদি হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি হোটেলে খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।”

নরেনের মধ্যে সত্যকে চেপে রাখার প্রবৃত্তি ছিল না। একবার হোটেলে খেয়ে এসে ঠাকুরকে বললেন, “মহাশয় আজ হোটেলে, সাধারণে যাহাকে অখাদ্য বলে, খাইয়া আসিয়াছি।” ঠাকুরের উত্তর, “তোর তাতে দোষ লাগবে না।”

বোঝা যাচ্ছে তরুণ বয়সে হোটেলে খাওয়ায় নরেনের প্রবল উৎসাহ ছিল। এই সময়েই বোধ হয় তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন : “এরপর দেখবি কলকাতা শহরে গলির মোড়ে মোড়ে, রাস্তায় রাস্তায়, পানের দোকানের মতন চপ কাটলেটের দোকান হবে!”

.

শুনুন শ্রীশ্রীমায়ের মুখে নরেনের রান্নার কথা। ঠাকুরের জন্য রান্নার কথা উঠেছে। “..আমি যখন ঠাকুরের জন্য রাঁধতুম কাশীপুরে, কঁচা জলে মাংস দিতাম। কখানা তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মতো সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম।…নরেন আমার নানারকমে মাংস রাঁধতে পারত। চিরে চিরে ভাজত, আলুচটকে কিসব রাঁধত,তাকে কি বলে?” বোধ হয় চপ-কাটলেট হবে।

বাবার অকালমৃত্যুর পর থেকে নরেন্দ্রনাথের জীবনে যে পর্বের শুরু হলো সেখানেই অনাহার ও অর্ধাহারের ছবি আমরা দেখতে পাই। এই পর্ব চলেছে বরানগর পেরিয়ে পরিব্রাজক বিবেকানন্দের সঙ্গে সঙ্গে মুমবাইয়ের জাহাজঘাটায় খেতড়ির দেওয়ান মুন্সি জগমোহনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত।

বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল তা স্বামীজির মুখেই শোনা যাক :”প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপন অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে’ বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকট ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”

দেহত্যাগের কিছুদিন আগে প্রথম পর্বের দুঃখময় দিনগুলো ভোলা স্বামীজির পক্ষেও সম্ভব হয়নি। শিষ্যকে তিনি বলছেন “কিসব দুঃখের দিন না আমাদের গেছে! একসময় না খেতে পেয়ে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির দাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম–মাথার ওপর দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তবে হুঁশ হয়েছিল। অন্য একসময়ে সারাদিন না খেয়ে একাজ সেকাজ করে বেড়িয়ে রাত্রে ১০/১১টার সময় মঠে গিয়ে তবে খেতে পেয়েছি–এমন একদিন নয়।”

মঠ বলতে আদিপর্বের বরাহনগর মঠ বলেই মনে হয়। সেখানে সন্ন্যাসী ভ্রাতাদের কষ্টের অবধি ছিল না।

এই বরানগরেই একদিন হীরানন্দ নামক ভক্ত এসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের চলে কী করে?”

নরেন্দ্র : “সকলেই মুষ্ঠিভিক্ষা করে নিয়ে আসে, তাতেই একরকম চলে যায়।”

হীরানন্দর কাছে ছয় আনা পয়সা ছিল। তিনি তা দিয়ে বললেন, “এই পয়সায় এ বেলা চলুক।”

নরেন উত্তর দিলেন, “পয়সার আবশ্যক হবে না, এবেলার মতন চাল আছে।”

ভিক্ষার কথাটা স্বামীজি কত সহজভাবে বললেন, কিন্তু প্রকৃত অবস্থার দু’একটা নমুনা সংগ্রহ করা যাক। একদিন বরানগরে চারজন গুরুভাই ভিক্ষে করতে বেরিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে এলেন, ঠাকুরের ভোগের জন্য কিছু দিতে পারলেন না। তখন সিদ্ধান্ত হলো অনাহারে থেকে সেদিন সারাক্ষণ ভজন করা হবে।

অনাহার বা অর্ধাহারটাই ছিল বরানগরের রেওয়াজ। স্বামী প্রেমানন্দের কথায় : “একবেলা ভাত কোনদিন জুটতো, কোনদিন জুটতো না। থালাবাসন তো কিছুই নেই। বাড়ির সংলগ্ন বাগানে লাউগাছ, কলাগাছ ঢের ছিল। দুটো লাউপাতা, কি একখানা কলাপাতা আনতে গেলে মালী যা তা বলে গালি দিত। শেষে মানকচুর পাতায় ভাত ঢেলে তাই খেতে হতো। তেলাকুচো পাতা সিদ্ধ আর ভাত–তা আবার মানপাতায় ঢালা। কিছু খেলেই গলা কুটকুট করতো।”

কচুপাতা এড়ানোর উপায় অবশেষে উদ্ভাবিত হলো। ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে তা একটা কাপড়ের ওপরে ঢেলে সকলে মিলে খেতে বসতেন এবং লবণ ও লঙ্কার ঝোল করে তা দিয়ে ভোজন সমাপ্ত করতেন। সকলেই একগ্রাস করে ভাত মুখে নিতেন এবং বাটিতে রাখা নুন লঙ্কার ঝোলে হাত দিয়ে তা মুখে দিতেন।

ভারত-পরিক্রমায় বেরিয়ে বরানগরের অভিজ্ঞতা যে খুব কাজে লেগে গিয়েছিল তা বিবেকানন্দ অনুরাগীদের কাছে এখন আর অস্পষ্ট নয়। পরিব্রাজক বিবেকানন্দর একটি চিঠি গুরুভাইকে লেখা : “আমি নির্লজ্জভাবে ঘুরে ঘুরে অপরের বাড়িতে আহার করছি, আর এতে বিবেকের দংশনও হচ্ছে না–ঠিক যেন একটি কাক…আর ভিক্ষে করবো না। আমাকে খাইয়ে গরীবের লাভ কী? তারা একমুঠো চাল পেলে বরং নিজের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারে।”

পরিস্থিতি অবশ্য সর্বত্র সমান নয়। শুনুন মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া ছাড়িয়ে একটা রিপোর্ট : “নিতান্ত অসভ্য ও অতিথিসকার বিমুখ, একমুঠো ভিক্ষা চাইলে দেয় না–আশ্রয় চাইলে তাড়িয়ে দেয়। কয়েক দিবস নিরস্তু উপবাস, পরে জীবনধারণোপযোগী সামান্য কিছু আহার করে শরীর রক্ষা।”

একবার বৃন্দাবন থেকে গিরিগগাবর্ধন পরিক্রমাকালে স্বামীজি সঙ্কল্প করলেন, না-চেয়ে যে ভিক্ষা মিলবে তাতেই ক্ষুধা নিবৃত্তি করবেন। তাছাড়া কারও কাছে কিছু চাইবেন না। প্রথম দিন দ্বিপ্রহরে ক্ষুধার তাড়না অসহ্য হয়ে উঠলো, আবার সেই সঙ্গে বৃষ্টি। পথশ্রমে দুর্বল সন্ন্যাসী শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাকে ডাকছেন। ক্ষুধার্ত বিবেকানন্দ প্রথমে ছুটতে লাগলেন, পিছনের লোকটিও ছোটা শুরু করেছেন এবং সন্ন্যাসীকে ধরে ফেলে তাঁকে ভোজ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন!

আরও একবার স্বামীজি স্থির করেছিলেন খাদ্যভিক্ষা করবেন না। ফলে মাঝে মাঝে উপবাসে কাটাতে হতো। একবার দুদিন অনাহারে আছেন, এমন সময় এক বড়লোকের ঘোড়ার সহিস তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “সাধুবাবা, কিছু ভোজন হয়েছে?” এরপর দয়াপরবশ হয়ে সহিস কয়েকটা রুটি ও ঝালচাটনি খেতে দিলেন। এই চাটনিতে এত ঝাল যে দু’দিন উপবাসের পর ওটা খেয়ে তিনি পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। সহিসও খুব বিপদে পড়ে গিয়েছে। এমন সময় একটা লোক মাথায় ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। স্বামীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঝুড়িতে কি আছে? লোকটি বললো, তেঁতুল। “এই তো চাই!” ঐ তেঁতুল খেয়ে স্বামীজির পেটের যন্ত্রণার নিবৃত্তি হলো।

আলমোড়ার উপকণ্ঠে ক্ষুধা ও পথশ্রমে ক্লান্ত স্বামীজিকে একবার ভূমিশয্যা নিতে হয়েছিল। সামনেই গোরস্থান। একজন ফকিরের দয়ায় সেবার স্বামীজি বেঁচে গেলেন। দয়াময় ফকিরটি একফালি শশা এনে সন্ন্যাসীর হাতে দিলেন। পরে বিবেকানন্দ স্বীকার করেছেন, “আমি আর কখনও ক্ষুধায় এতটা কাতর হইনি।”

আর সেই বিখ্যাত গল্পটি, হাতরাস স্টেশনে রেলকর্মচারী এবং ভবিষ্যৎ শিষ্য শরৎ গুপ্তর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার। সন্ন্যাসীকে দেখে সহকারী স্টেশন মাস্টারের প্রশ্ন : “স্বামীজি আপনি কি ক্ষুধার্ত?” সাধু : “হ্যাঁ।” শরৎ: “তবে দয়া করে আমার ঘরে আসুন।” সাধু : “আপনি কি খেতে দেবেন?” শরৎ একটি উর্দু কবিতা আউড়ে বললেন, “হে প্রিয়, তুমি আমার ঘরে এসেছ, আমি সুন্দর মসলাসহ আমার কলিজাটা বেঁধে আপনাকে খাওয়াব।”

পরিব্রাজক জীবনের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা স্বামীজি তুলনাহীন ভাষায় পরবর্তীকালে তাঁর ভক্তদের শুনিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। “কতবার আমি অনাহারে, বিক্ষতচরণে, ক্লান্তদেহে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি। কতবার দিনের পর দিন এক মুষ্টি অন্ন না পেয়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন অবসন্ন শরীর বৃক্ষচ্ছায়ায় লুটিয়ে পড়তো, তখন মনে হতো প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে! কথা বলতে পারতাম না, চিন্তাও অসম্ভব হয়ে পড়তো; আর অমনি মনে এই ভাব উঠতো, আমার কোনো ভয় নেই, মৃত্যুও নেই; আমার জন্ম কখনও হয়নি, মৃত্যুও হবে না; আমার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। সারা প্রকৃতির ক্ষমতা নেই আমায় পিষে মারে। প্রকৃতি তো আমার দাসী। হে দেবাদিদেব, হে পরমেশ্বর, নিজ মহিমা প্রকাশ কর, স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হও! উত্তিষ্ঠত জাগ্রত! বিরত হয়ো না। অমনি আমি পুনর্বল লাভ করে উঠে দাঁড়াতাম। তাই আমি আজও বেঁচে আছি।”

.

অনাহারের ভয় যার চলে গিয়েছে জগৎসংসার তাকে আর অন্য কোনো ভয় দেখতে পারে না। এইটাই সর্বহারা মানুষের উপরি পাওনা।

একবার উত্তরভারতে স্বামীজি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন অসৎ থানাদার তার পিছনে লাগলো, কয়েদ করবার ভয় দেখাল। পরিব্রাজক বিবেকানন্দর মন তখন অতি বিষণ্ণ, তিনি ভয়শূন্য মনে বললেন, “চলুন না। এরূপ অনিশ্চিত অনাহারে থাকার চেয়ে তবুও থানায় দু’বার খেতে পাওয়া যাবে, সেতো ভাল কথা।”

স্বামীজির দীর্ঘতম উপবাসের মেয়াদ কত? এ-প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার সোজাসুজি উত্তরের সন্ধানও পাওয়া গিয়েছে। এক-আধদিন উপবাসকে স্বামীজি সবসময় উপেক্ষা করেছেন, তবে ঈশ্বরের দয়ায় কখনও তিনদিনের বেশি উপবাস করতে হয়নি।

অনাহারের আশঙ্কা কিন্তু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮৯০ সালে ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় পরিব্রাজক বিবেকানন্দ কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে মীরাটে হাজির হলেন। মীরাট শহরের ২৫৯ নম্বর রামবাগে লালা নন্দরাম গুপ্তর বাগানবাড়িতে ক’দিন ছিলেন। আফগানিস্থানের আমীর আব্দার রহমানের জনৈক আত্মীয় সেবার সাধুদের পোলাও খাওয়ানোর জন্য কিছু টাকা দেন! স্বামীজি উৎসাহভরে পোলাও রান্নার দায়িত্ব নেন। অন্যদিনেও স্বামীজি মাঝে-মাঝে রান্নায় সাহায্য করতেন। স্বামী তূরীয়ানন্দকে খাওয়ানোর জন্য একদিন নিজে বাজার থেকে মাংস কিনে আনেন, ডিম যোগাড় করেন এবং উপাদেয় সব পদ প্রস্তুত করেন।

মীরাটে স্বামীজি তাঁর গুরুভাইদের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এবং সেইসঙ্গে পোলাও কালিয়া রান্না শেখাতেন। একদিন পোলাও বেঁধেছেন। মাংসের কিমা করিয়েছিলেন, কিছু শিক্ কাবাব করবার ইচ্ছা। কিন্তু শিক পাওয়া গেল না। তখন মাথা ঘামিয়ে স্বামীজি সামনের পিচগাছ থেকে গোটাকয়েক ছোট ডাল ছিঁড়ে নিয়ে তাতেই কিমা জড়িয়ে দিয়ে কাবাব করলেন। সবাইকে খাওয়ালেন, নিজে কিন্তু খেলেন না। বললেন, “তোমাদের খাইয়ে আমার বড় সুখ হচ্ছে।”

তবে স্বদেশের অনশন অপেক্ষা বিদেশের অনশন-আশঙ্কা যে অনেক বেশি আতঙ্কজনক তা বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। মেরি লুইস বার্ক-এর বিখ্যাত বইতে মার্কিনপ্রবাসী বিবেকানন্দের একটি মর্মস্পর্শী টেলিগ্রামের উল্লেখ আছে। বোস্ট থেকে বিবেকানন্দ এটি পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন মাদ্রাজে প্রিয় শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে : না খেয়ে রয়েছি! সমস্ত টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। অন্তত দেশে ফিরে যাবার মতন কিছু টাকা পাঠাও। Starving. All money spent. Send money to return at least.

দু’দিন পরে শিকাগোতে যিনি ঝড় তুলবেন এবং বিশ্ববিজয়ী হবেন, তিনি প্রবাসে অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি। বড় ভীষণ জায়গা এই মার্কিন দেশ। এখানে ভিক্ষা করা অপরাধ, ভিক্ষা চাইলে জেলবাস অনিবার্য!

স্বামীজি অবশেষে খ্যাতি, সম্মান ও শ্রদ্ধার মুকুট পরিধান করেছেন। কিন্তু প্রবাসে অর্থসমস্যার সমাধান সব সময় হয়নি। তাঁর সহযোগী আমেরিকান সাধক কৃপানন্দ একসময় নিউইয়র্ক থেকে গোপনে মিসেস ওলি বুলকে জানাচ্ছেন : “স্বামীজি নিজেই ঘরভাড়া, বিজ্ঞাপন দেওয়া, ছাপানো ইত্যাদি খরচ বহন করছেন। এই সব খরচ বহন করতে গিয়ে অনেক সময় না খেয়ে থাকেন–হি স্টার্ভ হিমসেলফ। কিন্তু তিনি দৈত্যের মত খাটেন।”

অনাহার কাকে বলে তা জানতেন বলেই পৃথিবীর অনাহারী অর্ধ-আহারী মানুষের দুঃখের কথা বিবেকানন্দ এমনভাবে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন।

দুমুঠো অন্ন সবার মুখে তুলে দেবার জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সে কি ব্যাকুলতা। শেষজীবনে শত শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্রকে অন্নসত্ৰ খোলার কথা বলেছেন। “যখন টাকা আসবে তখন একটা মস্ত কিচেন করতে হবে। অন্নসত্রে কেবল ‘দীয়তাং নীয়তাং ভুজ্যতাম’ এই রব উঠবে, ভাতের ফেন গঙ্গায় গড়িয়ে পড়ে গঙ্গার জল সাদা হয়ে যাবে। এই রকম অন্নসত্র হয়েছে দেখব তবে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে।”

.

পটলাদা সেবার বলেছিলেন, “ওরে সন্ন্যাসীর অনাহারের পরিপ্রেক্ষিতে যদি সম্রাট বিবেকানন্দকে ফেলতে পারিস তা হলে ব্যাপারটা জমে ওঠে। কখনও এই বিবেকানন্দর পদসেবা করতে উন্মুখ এদেশের রাজা মহারাজারা এবং বিদেশের ধনপতিরা। আবার কখনও তার খাওয়া জুটছে না। যে লোক আজ অর্ধাহারে পথের প্রান্তে পড়ে আছেন, পরের দিন তাকেই আমরা দেখতে পাই তাঁর সামনে রাজপ্রাসাদের রাজভোগ সাজিয়ে রাজাধিরাজ স্বয়ং হাওয়া করছে। তার এক ভক্ত জুটেছিল পরিব্রাজক কালে। এই ভক্তটির ধারণা, সাধু-সন্ন্যাসীর স্থূলকায় হওয়া অসম্ভব। স্বামীজি তাকে বলেছিলেন, এটাই আমার ফেমিন-ইনসিওরেন্স ফান্ড যদি পাঁচদিন খেতে না পাই তবু আমার চর্বি আমাকে জীবিত রাখবে।”

মার্কিন দেশে এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপে স্বামীজি খাওয়ার ব্যাপারে কষ্ট এবং সুখ দুই-ই প্রবলভাবে পেয়েছেন। কখনও রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন, কখনও অনুরাগীদের স্নেহাশ্রয়ে তাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় উঠছেন, কখনও অতি সস্তা হোটেলে, কখনও বা ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে, আবার কখনও পাঁচতারা হোটেলের লাক্সারি সুইটে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। অর্থাভাবে কখনও স্রেফ পাঁউরুটি ভরসা, আবার কখনও ব্যাংকোয়েট ভোজন।মুগ্ধবিবেকানন্দপ্রবাসের সংগ্রামের সময়নৰ্থক্যালকাটারগুরুভাইদের কাছেমাঝে-মাঝে বাংলায় যে সব বিবরণ দিয়েছেন তা বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। স্বামীজি লিখছে, “কলাকৌশলে এরা অদ্বিতীয়, ভোগে বিলাসে এরা অদ্বিতীয়, পয়সা রোজগারে অদ্বিতীয়, খরচে অদ্বিতীয়।”

একটা লেকচারে “আমি ৫০০ ডলার পর্যন্ত পাইয়াছি।” তখন ডলারের দাম তিনটাকার মতন। “আমার এখানে এখন পোয়াবারো। এরা আমায় ভালবাসে, হাজার হাজার লোক আমার কথা শুনতে আসে।”

১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে মার্কিন দেশ থেকে কলকাতায় গুরুভাইদের লিখছেন : “এখানে হোটেলের কথা কি বলিব! নিউ ইয়র্কে এক হোটেলে আছি, যেখানে ৫০০০ পর্যন্ত রোজ ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া।…এরা হ’ল পৃথিবীর মধ্যে ধনী দেশ-টাকা খোলামকুচির মতন খরচ হয়ে যায়। আমি কদাচ হোটেলে থাকি, আমি প্রায়ই এদের বড় বড় লোকের অতিথি।”

.

বিদেশে এলাহি ডিনার কীরকম হয় তার বর্ণনা স্বামীজি নিজেই লিখে গিয়েছেন। “ডিনারটাই প্রধান খাদ্যধনী হলে তার ফরাসি রাঁধুনি এবং ফরাসি চাল। প্রথমে একটু আধটু নোনা মাছ বা মাছের ডিম, বা কোন চাটনি বা সবজি। এটা হচ্ছে ক্ষুধাবৃদ্ধি, তারপর স্যুপ, তারপর আজকাল ফ্যাশন–একটা ফল, তারপর মাছ, তারপর মাংসের একটা তরকারি, তারপর থান-মাংস শূল্য, সঙ্গে কাঁচা সবজি, তারপর আরণ্য মাংস মৃগপক্ষাদি, তারপর মিষ্টান্ন, শেষ কুলপি–মধুরেণ সমাপয়েৎ…থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কাটা-চামচ সব বদলাচ্ছে; আহারান্তে কফি বিনা-দুগ্ধ।”

যাঁরা মদ্যপান করেন তাদের জন্য খাদ্যের তালে তালে পানীয়–থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে মদ বদলাচ্ছে–শেরি, ক্ল্যারেট, শ্যামপা ইত্যাদি এবং মধ্যে মধ্যে মদের কুলপি একটু আধটু। স্বামীজি লিখছেন, “খাওয়ার রকমারি, সঙ্গে মদের রকমারি দেখাতে পারলে তবে বিড়োমানুষি’ চাল বলবে। একটা খাওয়ায় আমাদের দেশের একটা মধ্যবিত্ত লোক সর্বস্বান্ত হতে পারে, এমন খাওয়ার ধুম এরা করে।”

উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৃথিবীর কোন জাত কখন কী খায়, কত বার খায় এবং তাদের সুখাসনটি কীরকম সে বিষয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের থেকে বেশি খোঁজখবর কোনো ভারতীয় কস্মিনকালেও করেছেন বলে মনে হয় না।

একটু নমুনা চেখে দেখা মন্দ নয়। “ফরাসী চাল–সকালবেলা কফি এবং এক-আধটুকরো রুটি-মাখন; দুপুরবেলা মাছ-মাংস ইত্যাদি মধ্যবিৎ; রাত্রে লম্বা খাওয়া। ইতালি, স্পেন প্রভৃতি জাতিদের ঐ একরকম; জার্মানরা ক্রমাগতই খাচ্ছে–পাঁচবার, ছ বার, প্রত্যেকবারেই অল্পবিস্তর মাংস। ইংরেজরা তিনবার সকালে অল্প, কিন্তু মধ্যে মধ্যে কফি-যোগ, চা-যোগ আছে। আমেরিকানদের তিনবার–উত্তম ভোজন, মাংস প্রচুর।”

বিবেকানন্দ তুলনামূলকভাবে লক্ষ্য করেছেন, গরিব অবস্থায় সকল দেশের খাওয়াই ধান্যবিশেষ। বাংলায় তার সঙ্গে ডাল তরকারি, কখন কখন মাছমাংস চাটনিবৎ।

“ইউরোপের অবস্থাপন্ন লোকের এবং আমেরিকার আবালবৃদ্ধবনিতার। খাওয়া আর এক রকম–অর্থাৎ রুটি ভাত প্রভৃতি, চাটনি এবং মাছ-মাংসই হচ্ছে খাওয়া। আমেরিকায় রুটি খাওয়া নাই বললেই হয়। মাছ মাছই এল, মাংস মাংসই এল, তাকে এমনি খেতে হবে, ভাত-রুটির সংযোগ নয়।”

কোন জাত কীভাবে বসে খায় তাও বিবেকানন্দ মন দিয়ে অনুসন্ধান করেছেন : “আর্যরা একটা পীঠে বসত, একটা পীঠে ঠেসান দিত এবং জলচৌকির উপর থালা রেখে এক থালাতেই সকল খাওয়া খেত।” পাঞ্জাব, রাজপুতানা, মহারাষ্ট্র ও গুর্জর দেশে একই স্টাইল। বাঙালিরা “মাটিতেই সাপড়ান। মহীশূরে মহারাজও মাটিতে আঙট পেতে ডালভাত খান।…চীনেরা টেবিলে খায়…রোমান ও গ্রীকরা কোচে শুয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাত দিয়ে খেত। ইউরোপীয়রা টেবিলের ওপর হ’তে কেদারায় বসে–হাত দিয়ে পূর্বে খেত, এখন নানাপ্রকার কাঁটা চামচ।”

পটলাদা সেবার আমাকে বলেছিলেন, “দেখলি লোকটার প্রতিভা। তুলির কয়েকটা টানে পৃথিবীর ভোজনসভ্যতাটা এঁকে ফেললেন। পড়লেই বোঝা যায়, টুকলিফাইং ব্যাপার নয়, নিজের চোখে দেখে, বইপত্তর কনসাল্ট করে, বাড়তি জলটুকু বার করে দিয়ে ক্ষীরটুকু আমাদের জন্যে রেখে যাওয়া। ধর্টর্ম না করেও স্রেফ রসনার রহস্যভেদে মন দিলেও চিরকাল নাম থেকে যেতো মানুষটার। মহাজনরা এরকমই হন, যা কিছু স্পর্শ করেন তাই সোনা হয়ে যায়।”

“এবার বিবেকানন্দকে পরের পর কয়েকটা পর্বে ভাগ করে নেওয়া যাকবাড়ির বিবেকানন্দ, বরানগরের বিবেকানন্দ, পথের বিবেকানন্দ, পাশ্চাত্যের বিবেকানন্দ, বিলেতের বিবেকানন্দ, বিশ্ববিজয় করে দেশে ফেরা বিবেকানন্দ এবং মহাপ্রস্থানের পথে বিবেকানন্দ। এবার তার রান্নাবান্না। খাওয়া এবং না-খাওয়া বিবেকানন্দকে প্রথমপর্বের ম্যাপটার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাক, তবে বুঝতে পারা যাবে একটা মানুষ কত সহ্য করতে পারে এবং এতো সহ্য করেও সমস্ত মানুষের মঙ্গল ও মুক্তির জন্যে স্বামীজি কেমন করে এতো ভাবতে পারলেন?

.

পটলাদাকে সেবার প্রশ্ন করেছিলাম, “মানুষটা যেভাবে বনবন করে ঘুরেছে, শরীর স্বাস্থ্য এবং সামর্থ্যের তোয়াক্কা না করে, তাতে কেমনভাবে খোঁজ পাবো স্বামীজির খাওয়াদাওয়ার?”

পটলাদা বললেন, “নিরুৎসাহ হবি না, ওটা হলো ডিসপেপটিক জাতির লক্ষণ, পেটের রোগে আজন্ম ভুগলে মাঝে মাঝে অমন দিশাহারা ভাব হয়।”

স্বামীজির পাশ্চাত্যপর্বটা ইদানীং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে। আমরা যখন বিবেকানন্দ ইস্কুলে পড়তাম তখন স্বামীজির কয়েকশ চিঠিপত্তর আর খানকয়েক বক্তৃতা ছাড়া আমাদের হাতে তেমন কিছুই ছিল না। তারপর মার্কিনী-গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক আসরে নেমে পড়ে কাগজপত্তর, চিঠিপত্তর এবং অসংখ্য পরিবারের স্মৃতিসঞ্চয় মন্থন করে ইংরিজি ভাষায় এমন আশ্চর্য কাজ করেছেন যে মাথা ঘুরে যায়। পড়তে পড়তে যেখানে ছিটেফোঁটা যা যা পাওয়া গিয়েছে নোটবইতে টুকে নিয়েছি।”

“স্বদেশীপর্বটা ব্যাকগিয়ারে পরে বিবেচনা করা যাবে। আগে আমেরিকা ও ইউরোপ-পর্বের খোঁজখবর নেওয়া যাক।

কেশব সেনের ভাগ্নে বি এল গুপ্ত তখন লন্ডনে থাকতেন। মিসেস গুপ্তের বাড়িতে প্রায়ই যে বিবেকানন্দর পদধূলি পড়তো তার প্রমাণ রয়েছে। মিসেস গুপ্ত খোদ লন্ডনে বসে ছানা কাটিয়ে পান্তুয়া তৈরি করতেন এবং অভ্যাগতদের খাওয়াতেন। আজকের কথা নয়, খোদ ১৮৯৬ সালের রিপোর্ট! ভেজিটারিয়ান মিস হেনরিয়েটা মুলারের বাড়িতে সান্ধ্য আহার–দুধ দিয়ে মোটা ম্যাকারনি স্যুপ। তাতে নুন দেওয়া ছিল–অদ্ভুত এই ইংরেজ জাত, দুধে নুন মেশাতে ভয় করে না। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই নবাগত স্বামী সারদানন্দকে শেখালেন, কেমন করে চামচ ধরতে হয় এবং কীভাবে স্যুপ খেতে হয়। একবার টেবিলের তলায় সারদানন্দের পা চেপে ধরে ইঙ্গিত দিলেন নাইফ সবসময় ডান হাতে ধরতে হয়, কখনই বাঁ হাতে নয়।

সারদানন্দকে স্বামীজি বললেন, “বাঁ হাতে কাটা দিয়ে মুখে তুলতে হয় অত বড় বড় গরস করে না, ছোট ছোট গরস করবি। খাবার সময় দাঁত জিভ বার করতে নেই, কখনও কাশবি না, ধীরে ধীরে চিবুবি। খাবার সময় বিষম খাওয়া বড় দূষণীয়; আর নাক ফোঁস ফোঁস কখনও করবি না।”

আর একদিন ভ্রাতা মহেন্দ্রকে বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কী খেয়েছিস?” তারপর পরামর্শ দিলেন, “রোজ একঘেয়ে খেলে অরুচি হয়, বাড়ির মাগীটাকে বলিস, মাঝে মাঝে যেন পোট এগ বা অমলেট করে দেয়, তা হলে মুখ বদলানো হবে।”

আর একদিন স্বামীজির নিরামিষ লাঞ্চের মেনু, ভাত ও ওলন্দা কড়ায়ের মটর ডাল। ডালেতে একটু কারি পাউডার ও নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খানিকটা মাখন দেওয়া ছিল। খেতে বসে স্বামী সারদানন্দের দুঃখ, “হায় কপাল! এখানেও মটর ডাল সিদ্ধ।”

আর একদিন দেড়টার সময় স্বামীজি তাঁর অনুরাগী মিস্টার ফক্সকে বললেন, “দূর, রোজ রোজ একঘেয়ে খাওয়া যায় না। চল দু’জনে গিয়ে একটা হোটেলে খেয়ে আসি।”

আর একদিন সন্ধ্যার আহারে মাছ দিয়ে কপির তরকারি রান্না হয়েছে, সঙ্গে ছিলেন অনুরাগী এবং বক্তৃতার ক্ষিপ্রগতি লেখক গুডউইন। গুডউইন খেলো না, জিজ্ঞেস করলো, “মাছ খেলেন কেন?”

স্বামীজি হাসতে হাসতে বললেন, “আরে বুড়ি ঝিটা মাছ এনেছে, সেটা না খেলে নদৰ্মতে ফেলতো, ওটা না হয় পেটে ফেলেছি।”

লন্ডনে জনৈকা মিসেস টার্নার একটি ছোট্ট ঘরোয়া ভোজনাগার চালাতেন। তিনি ইন্ডিয়ানদের পছন্দমতন কিছু রান্না শিখেছিলেন, সেইজন্য ভারতীয়রা মাঝে মাঝে তার বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতো।

একদিন বিবেকানন্দ তার ভাই মহেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কোথায় গিয়েছিলি? ভাই উত্তর দিলেন, “মিসেস টার্নারের বাড়িতে খেতে গিয়েছিলাম।” স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন “কি বেঁধেছিল।” উত্তর : “চাপাটি রুটি, মাংসের একটা তরকারি, আরও দুটো তরকারি, পুদিনার চাটনি, আর চালের পায়েস।”

স্বামীজি : “একদিন সে এখানে এসে বেঁধে যায় না? তা হলে একটু খেয়ে বাঁচি, একটু মুখ তরাই।”

মহেন্দ্রনাথ জানালেন, “তা বোধহয় সম্ভব নয়। গৃহস্থ মহিলা, ঝি চাকরানি নন, অপরের বাড়িতে রাঁধতে আসবেন কেন?”

স্বামীজি তখন মিসেস টার্নারের বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তা শেষপর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

পত্রাবলীতে দেখছি, ৩০ মে ১৮৯৬ সালে স্বামীজি লন্ডনে বসে নিজেই এলাহি রান্না করেছিলেন। সারদানন্দ বোধ হয় স্বদেশ থেকে নানারকম মশলা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজির জন্য। পরের দিন সেন্ট জর্জেস রোড থেকে স্বামীজি হেলভগ্নি মেরিকে মুখরোচক কারি তৈরির বিবরণ দিচ্ছেন। সেই কারিতে কি না মিশিয়েছিলেন। জাফরান, ল্যাভেন্ডার, জৈত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, ক্রিম, লেবুর রস, পিঁয়াজ, কিসমিস, অ্যামন্ড, লঙ্কা এবং চাল! এতো মিশিয়েও মনের সাধ পূর্ণ হয়নি, দুঃখ করেছেন, আর একটি মশলার অভাব, যার ইংরিজি নামটা অদ্ভুত এবং আমার অজানা–অ্যাসাফিটিডা। এটা থাকলে নাকি খাবার আরও সুবিধে হতো।

অভিধানে দেখা যাচ্ছে ওটা হিং-এর ইংরিজি নাম! যার গন্ধ পেলে অমন পরমভক্ত গুডউইন সায়েবের বমি হয়ে যেতো! ওই চিঠিতেই স্বামীজি রসিকতা করছেন, “রান্নার ফলাফল এমনই হয়েছিল যে স্বয়ং রাঁধুনিও তা গলা দিয়ে নামাতে সমর্থ হলেন না!”

রাঁধা এক জিনিস আর খাওয়া আর এক জিনিসারাঁধুনি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আমরা আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করবো। এখন শুধু বলা যায় মিসেস টার্নার অজানা মহিলা, তাই তাকে বাড়ি এসে বেঁধে দিতে অনুরোধ করতে সাহস পেলেন না বিবেকানন্দ। কিন্তু আমেরিকায় বিখ্যাত সব মহিলারা স্বামীজিকে বেঁধে খাইয়ে ধন্য হয়েছেন। তিনিও কখনও কখনও প্রচণ্ড বিদুষীদের অনুরোধ করেছেন, এখানে খাবার-দাবার বড্ড নোংরা, আমার জন্যে একটু রান্না করতে পারো? এমন এক ভাগ্যবতী মহিলার নাম মিস্ ওয়ালডো। দুর্লভ সুযোগ পেয়ে মিস্ ওয়ালডো ধন্য। নিউইয়র্কে এই বিদুষীকে সস্নেহে নতুন নাম দিয়েছিলেন স্বামীজি—’হরিদাসী’।এই মহিলা প্রকৃত অর্থেইদশভুজা– সম্পাদিকা, প্রুফ রিডার, স্টেনোগ্রাফার, ভক্তিময়ী এবং দার্শনিক।

.

আমেরিকায় বিভিন্ন সময়ে স্বামীজির কখন কি খাবার জুটেছে, কি তার পছন্দ হয়েছে এবং কি অপছন্দ হয়েছে, তা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পটলাদা বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে আমাকে টুকলিফাইং-এর সুযোগ দিলেন।

নিউ ইয়র্কের চিঠি। মিসেস ওলি বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন : মিস্ হ্যামলিন দয়াপরবশ হয়ে একটা গ্যাস স্টোভ পাঠিয়েছেন–বেড রুমেই রাঁধতে হবে। আমাদের বাড়ির নিচে একটা সার্বজনীন রান্নাঘরেরও ইঙ্গিত রয়েছে।

সেখানেও স্বপাক অন্নের জন্য বিবেকানন্দ পিছপা হননি। বিশেষত্ব এই যে তিনি কখনও সব নিজে খেতেন না, জানা-অজানা সবাইকে দেদার খাওয়ানোটা তার আজন্ম দুর্বলতা।

স্টোভ পাওয়ার কয়েকদিন পরেই স্বামীজির আর এক চিঠি : কৃপানন্দ ও তিনি মিলে “কিছু ডাল ও বার্লি ফুটিয়ে নিচ্ছি…আমেরিকায় এমন সন্ন্যাসকঠোর জীবন আগে কাটাইনি।”

কলকাতায় এর কিছুদিন আগে গুরুভাইদের বিবেকানন্দ জানিয়েছেন, “কলায়ের দাল কি, কোনও দাল নেই, এরা জানেও না। একরকম শাক আছে, স্পিনাচ–যা রাঁধলে আমাদের নটে শাকের মত লাগে, আর যেগুলোকে এরা এস্পারেগাস বলে, তা ঠিক যেন কচি ডেঙ্গোর ভঁটা, তবে গোপালের মার চচ্চড়ি নেই বাবা।”

আরও খবর : “এখানে ইলিস মাছ অপর্যাপ্ত আজকাল। ভরপেট খাও, সব হজম। ফল অনেককলা, নেবু, পেয়ারা, আপেল, বাদাম, কিসমিস, আঙ্গুর যথেষ্ট, আরও অনেক ফল ক্যালিফোর্নিয়া হতে আসে। আনারস ঢের, তবে আম, লিচু ইত্যাদি নাই!”

নিউইয়র্ক নিবাসে এক বিখ্যাত হোটেলে বিবেকানন্দর সান্ধ্য নিমন্ত্রণ–এসব নিমন্ত্রণ করে যাঁরা ধন্য হতেন সেইসব ধনীদের জন্য তাঁর তৈরি বিশেষ ইংরিজি শব্দ ‘লং পকেট’ বা লম্বা পকেট। প্রায়শই স্বামীজির গন্তব্যস্থান জগদ্বিখ্যাত এসটোরিয়া হোটেল, কিংবা শোয়েল, কিংবা ডালমনিকো! যিনি তিনদিন পর্যন্ত পথের ধারে অনাহারে কাটিয়েছেন তাকেই যেতে হচ্ছে অন্তহীন ডিনার পার্টিতে যা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে ভোর দুটোর আগে কিছুতেই শেষ হতে চায় না। এইসব বিখ্যাত রেস্তোরাঁকে প্রায়শই প্রাধান্য দিলে শরীর অসুস্থ হবার আশঙ্কা যথেষ্ট, তাই একসময় স্বামীজি “নিঃশব্দে” ভেজিটারিয়ানে রূপান্তরিত হয়েছেন এবং নেমন্তন্ন এড়িয়ে চলেছেন। ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে স্বামীজি লিখছেন, “আজ একটা ডিনারে যাচ্ছি, এইটাই শেষ।”

এর পরের চিত্র–থাউজেন্ড আইল্যান্ড পার্কে বিবেকানন্দ একেবারে নিরামিষাশী, ঘন ঘন উপবাসও চলেছে। জায়গাটা ছাড়বার আগে তিনি তিরিশ-চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমাবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

নিউইয়র্কপর্ব সম্পর্কে আরও খবর আছে। মিস ওয়ালডো যেমন বহু দূরত্ব পেরিয়ে মূল শহরে এসে স্বামীজিকে বেঁধে দিতেন, তেমন সুযোগ পেলেই বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে স্বয়ং বিবেকানন্দ চলে যেতেন মিস ওয়ালডোর বাড়িতে, সেখানে তিনি সোজা উঠে যেতেন টঙে এবং শুরু করতেন রান্না।

অর্ডিনারি রাঁধুনি নন বিবেকানন্দ, গবেষক রাঁধুনি, তাই চলতো নব নব পদের পরীক্ষা এবং আবিষ্কার এবং কিভাবে পশ্চিমী মশলা ইত্যাদি দিয়ে পূর্বদেশের রান্নার কাছাকাছি পৌঁছনো যায় তার বিরতিহীন প্রচেষ্টা। শিশুর মতন এঘর থেকে ওঘরে স্বামীজি ছোটাছুটি করতেন। হরিদাসীর অন্য একটা নামও তিনি দিয়েছিলেন–যতী-মাতা’ সন্ন্যাসীদের মাতা।

বিদেশে থাকার সময় বিবেকানন্দ শুধু মোটাসোটা বেদ-উপনিষদ দেশ থেকে আনাচ্ছেন তাই নয়, সেই সঙ্গে নিউ ইয়র্কে কি পৌঁছচ্ছে ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে তা তার চিঠিতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কলকাতায় গুরুভ্রাতাকে স্বামীজি লিখছেন “যোগেনভায়া, অড়হর ডাল, মুগের ডাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে।…এক্ষণে যদি ইংলন্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়…ঐ প্রকার ডাল ও কিঞ্চিৎ আমলে পাঠাও তো আমি ইংলন্ডে পৌঁছিলেই পাইব। ভাজা মুগডাল পাঠাইবার আবশ্যক নাই। ভাজা মুগডাল কিছু অধিকদিন থাকিলে বোধ হয় খারাপ হইয়া যায়।”

এই সব মশলাপাতিতে সমৃদ্ধ হয়ে স্বামীজি মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহর দাপিয়ে বেড়ালেন! :

ডেট্রয়েট ১৮ মার্চ ১৮৯৬–এক ভক্তের বাড়িতে গিয়ে স্বামীজি রান্না করার অনুমতি চাইলেন। পকেট থেকে কয়েক ডজন গুঁড়ো মশলা ও ফোড়ন, আচার চাটনি ইত্যাদি ঝটপট বেরিয়ে এল। এসব ইন্ডিয়া থেকে সযত্নে পাঠানো। স্বামীজি যেখানেই যেতেন নানারকম মশলাপাতি সঙ্গে নিতেন। সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এক বোতল চাটনি যা এক ভদ্রলোক মাদ্রাজ থেকে পাঠিয়েছেন। ভীষণ ঝাল থাকতো রান্নায়, সময়ও লেগে যেতো অনেক। কোন কোন ভক্তের ধারণা, এসব রান্না তার লিভারের পক্ষে ভাল নয়। কিন্তু তিনি ওসব বিশ্বাস করতেন না।

বিদেশে যতই শ্রদ্ধা ভালবাসা ও আদর যত্ন পান না কেন স্বামীজির ভারতীয়ত্ব যে শতকরা একশো ভাগ অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং ভারতীয় রান্নার প্রচার যে তিনি নির্বিবাদে করে বেড়াচ্ছেন তা নিউ ইয়র্ক থেকে (১৪ এপ্রিল ১৮৯৬) স্বদেশে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।..”মুগের ডাল তৈয়ার হয় নাই মানে কি? ভাজা মুগের ডাল পাঠাইতে আমি পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি। ছোলার ডাল ও কাঁচা মুগের ডাল পাঠাইতে বলি। ভাজা মুগ এতদূর আসিতে খারাপ ও বিস্বাদ হইয়া যায়, সিদ্ধ হয় না। যদি এবারও ভাজা মুগ হয়, টেমসের জলে যাইবে ও তোমাদের পণ্ডশ্রম। আমার চিঠি না পড়িয়াই কাজ কেন কর? চিঠি হারাও বা কেন? যখন চিঠি লিখিবে, পূর্বের পত্র সম্মুখে রাখিয়া লিখিবে। তোমাদের একটু বিজনেস বুদ্ধি আবশ্যক।”

সন্ন্যাসী শুধু আটলান্টিকের ওপারে বেদান্ত ও বিরিয়ানি প্রচার করেননি, এক্সপোর্ট প্রমোশনের কর্তাব্যক্তিরা জেনে রাখুন সেই ১৮৯৬ সালে স্বামীজি নিউইয়র্কে বসে ভারতীয় মশলার রপ্তানি সম্ভাবনা সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা করেছেন। গুরুভাই ত্রিগুণাতীতানন্দকে ১৭ জানুয়ারি ১৮৯৬ নিউইয়র্ক থেকে স্বামীজি কি লিখেছিলেন তা শুনুন।

“…দয়ালবাবুকে বলবে, যে মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলন্ডে ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলতে পারে। ডাল-সুপ উইল হ্যাভ এ গগা ইফ প্রপারলি ইনট্রোডিউণ্ড। (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের ফুষের বেশ কদর হবে।) যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার ডিরেকশন দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো যায়–আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠানো যায়, তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই–ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা কোম্পানি ফর্ম করে ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলন্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়।”

বুঝতেই পারা যাচ্ছে, বেদান্তর সঙ্গে ভারতীয় রান্নার বিশ্বব্যাপি প্রচারকে স্বামীজি কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন।

প্রবাসের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে। বিবেকানন্দকে। একেবারে গোড়া থেকে ধরা যাক। শিকাগো বক্তৃতার কালে এক দয়াময়ীর আশ্রয়ে ছিলেন বিবেকানন্দ। তার নাতনি অনেক বছর পরে তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, “দিদিমা ট্যাবাসকো সস দিয়ে স্যালাড ড্রেসিং করতেন। প্রচণ্ড ঝাল এই টবাসকো সসের শিশিটি দিদিমা স্বামীজির হাতে দিলেন কয়েক ফোঁটা নেবার জন্য–স্বামীজিকে হুড়মুড় করে খাবারে টবাসকো সস ছড়াতে দেখে দিদিমা আঁতকে উঠলেন, ‘কোরো না, ভীষণ ঝাল। হেসে বিবেকানন্দ এমনভাবে ঝাল উপভোগ করতে লাগলেন যে এরপরে দিদিমা পুরো শিশিটাই স্বামীজির পাশে রেখে দিতেন!”

ভোজনরসিক বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আরেকটি নিবেদন পারিবারিক ভ্রমণে বেরিয়ে আদিম পদ্ধতিতে স্বামীজির ক্ল্যাম বা ঝিনুক ভক্ষণ। গরম ঝিনুক থেকে আঙুল দিয়ে মাংস বার করে নিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, কিন্তু গেঁড়িগুগলির দেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে এসব শিখে নিতে স্বামীজির একটুও সময় লাগেনি। তবে সেবার একটি দুর্ঘটনায় স্বামীজির প্রাণ সংশয় হতে চলেছিল, ব্যাপারটা তেমন প্রচারিত নয়।

নৌকো চালাতে গিয়ে স্বামীজি হঠাৎ জলে পড়ে গিয়েছিলেন। ব্যাগলে পরিবারের একজন সভ্য তৎক্ষণাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার না করলে অঘটন ঘটতে পারতো।

.

মার্কিন মুলুকে দ্বিতীয়বার গিয়ে স্বামীজি কীভাবে খাওয়াদাওয়া সারতেন তার বিবরণও মার্কিনী গবেষকরা অনুগ্রহ করে সংগ্রহ করেছেন। প্যাসাডেনায় (দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়) যাঁদের বাড়িতে স্বামীজি থাকতেন তাঁদের ব্রেকফাস্ট টেবিলের রিপোর্ট; দেখা যাচ্ছে স্বামীজির পছন্দ-ফল, ডবল ডিমের পোচ, দু পিস টোস্ট, চিনি ও ক্রিম সহ দু’কাপ কফি। গৃহবধূ মিসেস হ্যাঁনসবরো অতিথিকে জিজ্ঞেস করতেন, তৃতীয় কাপ চলবে কি না?

দেখা যাচ্ছে এই পর্যায়ে স্বামীজি চুরুট খাওয়া হয় বর্জন করেছেন, না হয় কমিয়ে দিয়েছেন। ওই পরিবারেই স্বামীজির মধ্যাহ্নভোজনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ : মাটন (বীফ কখনই নয়) এবং নানারকমের শাকসবজি। ওঁর বিশেষ প্রিয় কড়াইশুটি। এই পর্যায়ে ডেসার্ট হিসেবে মিষ্টির পরিবর্তে ফল, বিশেষ করে আঙুর।

“আর একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যাঁদের বাড়িতেই স্বামীজি আতিথ্য নিতেন, তাঁদের এক-আধটা পদ রান্না করে তিনি খাওয়াতে চাইতেন। আমাদের মতন নুলো জগন্নাথ হয়ে অতিথিসেবা উপভোগ তার ধাতে সইতো না! একজন মার্কিন মহিলা মিসেস উইকফ জানাচ্ছেন, স্বামীজি তাঁকে শুধু ডিনার তৈরিতে সাহায্য করতেন না, মাবে’ মাঝে পরিবারের সব কটা পদই তিনি বেঁধে ফেলতেন।

আর একজন মহিলার মন্তব্য; “নিক্রন পার্কে আমাদের বাড়িতে যখন থাকতেন তখন একটা মিল তিনি রাঁধবেনই।” আরেক মহিলা (মিসেস হ্যাঁনসবরো) জানাচ্ছেন, “তিনি চাপাটি ও কারি রাঁধতে উৎসাহী হয়ে উঠতেন, অনেক মশলা তাকে গুড়োতে হতো, তার জন্যে মেঝেতে বসে পড়া পছন্দ করতেন।” মশলা গুঁড়ো করে, মাখনে ভেজে, ফোড়ন দেবার সময় রান্নাঘর থেকে এমন ধোঁয়া উঠতো যে উপস্থিত মহিলাদের চোখে জল এসে যেতো। সমস্ত পরিবারের জন্যে রাঁধতে হলে তার আনন্দের সীমা থাকতো না। স্বামীজির এই রান্না সম্বন্ধে মার্কিনি গৃহবধূ পরম বিস্ময়ে বলেছেন–ইলাবোরেট ও অ্যালার্মিং-এলাহি এবং বিপজ্জনক!

একবার খাওয়াদাওয়ার শেষে বিবেকানন্দ জানতে চাইলেন, “পদটি ভাল লেগেছে তো?” মিসেস ওয়াইকফ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ”। স্বামীজির প্রশ্ন : “সত্যি কথা? না স্রেফ বন্ধুত্ব রাখার জন্য বলছো?” মিসেস উইকফের মধুর স্বীকারোক্তি : “বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য বলেছি!”

আর একটা পারিবারিক ডিনারের বিবরণ আমাদের কাছে রয়েছে। সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। মিড় পরিবারে মোক্ষম ডিনার-স্যুপ, মাছ অথবা মাংস, সবজি এবং মিষ্টি বলতে আমেরিকান পাই। তবে সেখানে প্রায়ই স্বামীজির সংযোজন চাপাটি ও কারি! আমরা দেখছি, স্বামীজি ডিনারে কফি এড়িয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছে, এই পর্বে রাত্রে কফি পান তার মোটেই সহ্য হচ্ছে না।

বলা যেতে পারে, উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার রান্নাঘরে শেফ বিবেকানন্দ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য রাঁধতে রাঁধতে স্বামীজি দর্শন আলোচনা করছেন, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন! যারা সেসব শুনতে পেরেছে তারা সারাজীবন সেই সৌভাগ্যকে মনে রেখেছে।

.

সাধারণত পাবলিক বক্তৃতার আগে বিবেকানন্দ কিছু খেতে চাইতেন না। ভরাপেটে বোধ হয় চিন্তাস্রোতে বাধা আসে। তবে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হতে বাধ্য। একবার সন্ধ্যায় স্বামীজিকে বক্তৃতার আগে মিসেস স্টিলের বাড়িতে ডিনার সেরে নিতে হলো। সেদিন ডিনারের শেষপদে ছিল খেজুর। খুব ভাল লাগলো তার। তারপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক স্মরণীয় প্রাণকাঁপানো বক্তৃতা। ফেরার পথে অভিভূত মিসেস স্টিল স্বামীজিকে অভিনন্দন জানালেন। বিবেকানন্দর মুখে হাসি!তার সহাস্য উত্তর :”ম্যাডাম, সবই আপনার খেজুরের মাহাত্ম্য!”

ঈশ্বরসন্ধান, বেদ-উপনিষদেরবাণীপ্রচার,মানবজীবনের গভীরতমঅনুভূতি ও প্রশ্নগুলির অসামান্য বিশ্লেষণ এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রান্নার রেসিপি সম্বন্ধে সিরিয়াস চিন্তা বিশ্বসংসারে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া কে করতে পেরেছেন?

লস অ্যাঞ্জেলিসে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের সঙ্গে বাড়ি ফিরছেন বিবেকানন্দ। গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন বিবেকানন্দ, মিস ম্যাকলাউড ভাবলেন নিশ্চয় কোনো জটিল দার্শনিক চিন্তা? এখন কথা বলাটা ঠিক হবে না। এমন সময় বিবেকানন্দ সরব হলেন। মনে হলো, অবশেষে জটিল কোনো রহস্যের সমাধানে সমর্থ হয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ: “এবার বুঝেছি, ওটা কীভাবে হয়।” ম্যাকলাউড অতি সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলেন, “কীসের কথা বলছেন?” এবার সত্যিই অবাক হবার পালা। বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “মুলিগাটানি স্যুপটা কীভাবে রান্না করা উচিত! আমি বুঝেছি, পাতাগুলো আগে দিতে নেই, ওগুলো পরে দিতে হয়, তবে অমন সুগন্ধ হয়।”

দক্ষিণী রান্না সম্পর্কে এবং একই সঙ্গে দক্ষিণীসভ্যতা সম্পর্কে স্বামীজির দীর্ঘদিনের দুর্বলতা! রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল সম্পর্কে তাঁর বিরামহীন রসিকতা, সেই সঙ্গে বোষ্টমদের নিয়ে নানারকম মজা।সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া এক গোঁসাই দেখে এক মাতাল তাকে চিতাবাঘ ঠাওরেছিল। স্বামীজি লিখছেন, “এ মাদ্রাজী তিলক দেখে চিতে বাঘ গাছে চড়ে! আর সে তামিল তেলুগু মালয়ালম্ বুলি–যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার জো নেই, যাতে দুনিয়ার রকমারি লকার ও ডকারের কারখানা; আর সেই মুড়তন্নির রসম’ সহিত ভাত সাপড়ানো–যার এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে মিঠে নিমের পাতা, ছোলার ডাল, মুগের ডাল, ফোড়ন, দুধ্যম্ল ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা,–এ না হলে কি আর দক্ষিণমুলুক হয়?”

কথাটা তাহলে মুলগাথানি নয়! মুড়গ্‌তন্নি!

এবিষয়ে ভুল হবার কোনও চান্স নেই। স্বয়ং স্বামীজি তাঁর লেখায় ফুটনোট জুগিয়েছেন “অতিরিক্ত ঝাল-তেঁতুল-সংযুক্ত অড়হর ডালের ঝোল বিশেষ। মুড়গ’ অর্থে কালো মরিচ ও তন্নি’ অর্থে দাল।”

প্রবাসে শুধু ঝাল কারি এবং বিলিতি চপ কাটলেট নয়, আরও কয়েকটি খানার ব্যাপারে গবেষকদের সংগ্রহে প্রচুর তথ্য রয়েছে। স্বামীজির কাছে ফলের ব্যাপারটাও যে মজার তা বারবার দেখা যাচ্ছে।

আমেরিকায় আসবার আগেই পরিব্রাজককালে এক যাদুকরের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎ হয়েছিল। হাতদুটো কম্বলের মধ্যে রেখে তাঁবুতে বসা জাদুকর জানালেন, তুমি যা খাবার চাইবে তা দিয়ে দেব। স্বামীজিও ছাড়বার পাত্র নন, জাদুকরকে ফাঁপরে ফেলবার জন্য এতো জিনিস থাকতে খেতে চাইলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর। বোঝা যাচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া আঙুরের প্রবল ভক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু যা আশ্চর্য, যাদুকর সত্যিই কম্বল থেকে হাত বার করে ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এবং বিস্মিত স্বামীজি সেই গল্প মার্কিন দেশের অনুরাগিণীদের কাছে নিজেই করেছিলেন।

আঙুরের প্রবল প্রশস্তি স্বামীজি ইংলন্ডে বসেও করেছেন। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে তখন গ্রীষ্মকাল। ভাই মহেন্দ্র দেখা করতে এসেছেন। স্বামীজি বললেন, “কাঁচের পাত্রে কালো আঙুর রয়েছে, এটা নতুন উঠেছে, খা, খুব গোটাকতক খা। আঙুর খেলে গায়ের রক্ত পরিষ্কার হয়।”

লন্ডনে থাকাকালীন মিস হেনরিয়েটা মুলারের কাছে কয়েকটি আম এল, ভারতবর্ষ থেকে কেউ উপহার পাঠিয়েছে। জাহাজে আসতে মাসাবধি লেগেছে। স্বামীজি একজন বিশেষজ্ঞের মতন আমের পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থায় নেমে পড়লেন।

ভক্ত গুডউইনকে তিনি বললেন, “খানিকটা বরফ এনে আমগুলোকে ভিজিয়ে দাও, তা হলে আমের কিছুটা স্বাদ হবে।” আর একজন বেদান্ত সন্ধানী যুবক মিস্টার জন পিয়ার ফক্স আমেরিকা থেকে এসেছে। তরুণ ফক্স কখনও আম দেখেনি। ছুরি কাঁটা দিয়ে আম খাওয়ায় সুবিধে করতে পারছিল না। স্বামীজি প্রথমে ফক্সকে বললেন, “ফক্স, চামচে দিয়ে কুরে কুরে খাও।” তারপর তিনি ভারতের আমের গল্প বলতে লাগলেন।

স্বামীজির নিজের জীবনেও কি আমের গল্প শেষ আছে? বেশ কয়েক জায়গায় আমকে তিনি ‘আঁব’ বলেছে। ভেবেছিলাম কলকেত্তিয়া উচ্চারণ, কিন্তু পরে ভাষাতত্ত্ববিদদের কাছে জেনেছি, আঁবটাই সঠিক উচ্চারণ।

একবার বেনারসের জগদ্বিখ্যাত ইম্পিরিয়াল ব্যাংকের ল্যাংড়া আম সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল খোদ বেনারসে বসেই। এই আমের বর্তমান নাম স্টেট ব্যাংকের ল্যাংড়া, স্বামীজির সময়ে নাম ছিল ইমপিরিয়াল ব্যাংকের ল্যাংড়া। তখন শীতকাল, গাছে আম থাকার কথা নয়, কিন্তু একজন ভক্ত বাগানে ঢুকে দেখলেন গাছে দুটি ভুবনমোহন ল্যাংড়া আম অসময়ে শোভা পাচ্ছে। অতএব জয় স্বামীজিকি জয়!

আরেকবার আমকে কেন্দ্র করে গিরিশ ঘোষ ভারসাস নরেনের বাকযুদ্ধ হয়েছিল। বলরামবাবুর উত্তর কলকাতার বাড়িতে গিরিশ নরেন দু’জনে পাশাপাশি বসে খাচ্ছেন। গিরিশের ভাষায়; “যত আম আমার পাতে দিচ্ছে। সবগুলো মিষ্টি, আর নরেনকে যত দিচ্ছে সব টক হচ্ছে। এইতে নরেন চটে গিয়ে আমাকে বললে, শালা জিসি তোর পাতে যত মিষ্টি আম, আর আমার পাতে যত টক! নিশ্চয়ই তুই শালা বাড়ির ভিতর গিয়ে বন্দোবস্ত করে এসেছিস।আমি বললাম, “আমরা গৃহী সংসারী, আমরাই মজা মারবো, তুই শালা সন্ন্যাসী-ফকির হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবি, তোদের কপালে তো শুটকো টোকো জুটবে।” জিসি ওরফে গিরিশ এবং স্বামীজি দেখা হলেই নকল কথা কাটাকাটি করতেন, দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো শ্রীম সেসবের বর্ণনা রেখে যাননি।

.

লন্ডনে স্বামীজির ফল নিয়ে কিন্তু এক রহস্যময় ব্যাপার ঘটেছিল। ১৮৯৬ সালে স্বামীজি যখন লন্ডনে এসেছেন তখন ওখানকার বিখ্যাত ফলের দোকানের নাম উইলিয়ম হোয়াইটলি। কোনো এক ভক্ত রহস্যজনকভাবে এই দোকানে নিজের পরিচয় গোপন করে বেশ কিছু টাকা জমা রেখে গিয়েছিলেন, প্রত্যেকদিন স্বামীজির বাড়িতে সেরা ফল হোম ডেলিভারির জন্য।

বেলা এগারোটার সময় প্রত্যেকদিন হোয়াইটলির দোকান থেকে একজন কর্মচারি এসে কাগজে মোড়া বেশ কিছু ফল স্বামীজির বাসস্থানে দিয়ে যেতো। বাজারে ফল উঠবার তিন সপ্তাহ আগেই বিভিন্ন ধরনের টাটকা ফল স্বামীজির টেবিলে পৌঁছে যেতো। আনারস তখন লন্ডনে দুপ্রাপ্য, দাম প্রায় একগিনি।যখনকার যে ফলটি পাওয়া যেতো,যতই দাম হোক, হোয়াইটলির লোকটি তাই স্বামীজিকে দিয়ে যেতো।

কার আদেশে এই ফল আসতো সে রহস্য আজও পরিষ্কার হয়নি, তবে সন্দেহের তীর রয়েছে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের দিকে। কারণ তিনি লন্ডনে আসার পর থেকেই অঘটন ঘটতে আরম্ভ করে।

চোখের সামনে দুষ্প্রাপ্য আনারস দেখে স্বামীজির খুবই আনন্দ। কিন্তু সেবক গুডউইন তা ছাড়াতে পারছেনা। আনারস ছাড়ানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। গুডউইনের অবস্থা দেখে তখন স্বামীজি নিজেই ছুরি হাতে আসরে নামলেন। টুকরো টুকরো করে, গুঁড়ো চিনি দিয়ে সবাইকে দেওয়া হলো। মহেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় এসবের মনমাতানো উল্লেখ আছে।

মনে রাখতে হবে, নিত্য ফল সরবরাহের রহস্যজনক সম্পর্ক গড়ে ওঠার একটু আগে থেকেই উইলিয়ম হোয়াইটলির দোকানে বিবেকানন্দপ্রেমীদের যাতায়াত শুরু হয়েছিল। সেবার লন্ডনে হঠাৎ কাঁচা লঙ্কা খাবার সাধ হলো স্বামীজির। খুঁজতে খুঁজতে অনেক সন্ধানের পর কৃষ্ণ মেনন তিনটি খুব কঁচা লঙ্কা হোয়াইটলি থেকে সংগ্রহকরলেন।দাম শুনলেচক্ষুচড়কগাছ–তখনকার দিনে তিনটি কঁচা লঙ্কা তিন শিলিং, ঝাল নেই, তবে গন্ধ আছে। ব্রেকফাস্টে বসে লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজি একের পর এক লঙ্কাগুলো খেয়ে নিলেন।

লঙ্কার কথা আরও দীর্ঘনাহলে স্বামীজির জীবনের প্রতি যে অবিচার করা হয় এবিষয়ে মতানৈক্য নেই।

লঙ্কাকাণ্ডটা শুরুর আগে ফলের কথাটা গুটিয়ে আনাও প্রয়োজন। আমরা জানি স্বামীজি ফল ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের কর্মেও যেমন অধিকার, গাছের ফলেও তেমন অধিকার! স্বামী অদ্বৈতানন্দকে (গোপালচন্দ্র ঘোষ) তিনি বলেছিলেন, “ফল দুধ বরাবর খেয়ে কেউ যদি জীবন কাটায় তাহলে হাড়ে জং ধরে না!”

এবার প্রশ্ন হলো, কোন কোন ফল স্বামীজির ভালো লাগতো? আমরা দেখেছি, কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কথামৃতকার মাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে স্বামীজি তরমুজ খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। আমরা দেখেছি, নেয়াপাতি ডাবের মধ্যে বরফ এবং চিনি ঢেলে ঠাণ্ডা অবস্থায় খেতে খুব ভালবাসতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বামীজিকে আমরা ফ্রিজের সুখ দিতে পারিনি। আমরা দেখেছি, তিনি একাধিক ভক্তকে দীক্ষান্তে গুরুকে লিচুর গুরুদক্ষিণা দেবার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার আমরা দেখছি, বেলুড় মঠে যে বিশাল সাইজের কাঁঠাল ফলেছে তার প্রশস্তি গেয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিদেশিনী শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে তিনি চিঠি লিখছেন। ইংরিজিতে কাঁঠালমাহাত্ম্য সুললিতভাবে বর্ণনা করা অত সহজ কর্ম নয়।

শেষপর্বে আমরা দেখছি, ডায়াবিটিসে কাতর স্বামীজি বড় জাগুলিয়ায় তার বোনের বাড়ি থেকে সেরা জাম নিয়ে বেলুড় মঠে ফিরছেন। সেবার বেলুড়ে কালোজামের রসকে বোতলবন্দি করে ছিপি এঁটে পাঁচ-সাতদিন রোদ্দুর খাইয়ে রান্নাঘরের পাশে দড়ি বেঁধে রাখা হলো। ফারমেন্ট হয়ে রস তেজি হওয়ায় বেলুড়ের সেই বোতল যখন দুম করে ফাটলো, তখন উৎফুল্ল বিবেকানন্দ অনুগতদের কাছে সগর্বে ঘোষণা করলেন, “এই সিরকা ভারি হজমি–এতোদিনে ঠিক তৈরি হয়েছে, তোরা রোজ একটু একটু খাবি।”

স্বামীজির সাধক জীবনের শুরুতে আমরা এক আজব ডাক্তারের পরিচয় পাচ্ছি, যিনি খালি হাতে রোগীর কাছে যেতেন না। নরেন্দ্রনাথের একবার পাথুরি হয়েছিল, ডাক্তার রাজেন দত্ত রোগী দেখবার সময় এনেছিলেন নতুন বাজার থেকে কেনা মস্ত এক বেল। সেই বেল নরেন্দ্রনাথ মুখে দিতে পারেননি, এমন কোনো রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে বিলেদের বেল অপছন্দ করার পথ থাকে না!

কিন্তু যতবড় ফলাহারি মহাপুরুষ হোন, দুনিয়ার সব ফল কারও ভাল লাগতে পারেনা। অনেক খোঁজখবর নিয়ে দেখা যাচ্ছে একমাত্র একটি ফলের বিরুদ্ধে স্বামীজি আকারে ইঙ্গিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। বারুইপুরের পেয়ারাবাগানের মালিকদের পক্ষে দুঃসংবাদ, স্বামীজি একবার বলেছিলেন, যদি কখনও দেবতাকে ফলদান করে সেই ফলটি থেকে সারাজীবন তাকে দূরে থাকতে হয় তাহলে সেটি হবে পেয়ারা! মার্কিনী মহিলা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, স্বামীজি পেয়ারা অপছন্দ করেন। জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করার জন্য আলমোড়ায় উপস্থিত হয়ে স্বামীজি তাঁর পরমপ্রিয় গুরুভাই রাখালকে লিখছেন, “রাত্রির খাওয়াটা মনে করছি খুব লাইট করব…রাত্রে দুধ ফল ইত্যাদি।তাই তোওৎ পেতে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!” সুরসিক তো এঁকেই বলে!

সত্যিই, মানুষটার কি রসিকতাবোধ! বিশ্বসংসারে শতযন্ত্রণার মধ্যেও কৌতুকবোধ এবং মানুষের প্রতি ভালবাসা হারাতে রাজি হননি বলেই আজও স্বামীজি এদেশের এতো মানুষের হৃদয়েশ্বর হয়ে আছেন।

স্বামীজির ভোজনবিলাস সম্পর্কে আমাদের দুঃসাহসী অনুসন্ধানপর্বের শেষ এইখানে নয়। সোজাসুজি বলে রাখি, সবে তো কলির সন্ধে! স্বয়ং স্বামীজিকে এইভাবে অর্ধসমাপ্ত রেখে রণে ভঙ্গ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না।

রাঁধুনি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে এখনও প্রাণখুলে আলোচনার সুযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা শুধু সবিনয়ে উল্লেখ করেছি, বিবেকানন্দই একমাত্র ভারতীয় যিনি বেদান্ত ও বিরিয়ানিকে একই সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে প্রচারের দূরদর্শিতা অথবা দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। এতোদিন পরে তার দুটো স্বপ্নই সাফল্যের পথে। ইয়োগা বলতে সায়েবদের উৎসাহ এখন আমাদের থেকে শতগুণ বেশি, আর অতি সম্প্রতি আমাদের প্রাক্তন শাসক ইংরেজ নতমস্তকে এবং বিষণ্ণবদনে স্বীকার করেছে যে খোদ ইংলন্ডে চিকেনকারি শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় খাদ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অর্থাৎ দাসের খাদ্য কারির কপালেই অবশেষেজুটেছেবহু আকাঙ্ক্ষিতরাজমুকুট। কিন্তু ইতিহাসে আমরা বিবেকানন্দ ছাড়া এক জনকেও পাচ্ছি না যিনি পশ্চিমের রান্নাঘরের দরজা প্রাচ্যের জন্য খুলে দেবার দুর্লভ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ সর্বত্যাগী, কোনোরকম খ্যাতি বা স্বীকৃতির পিছনে ছোটা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ, তিনি যা করেছেন তা করেছেন ভবিষ্যদ্রষ্টা হিসেবে, তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন প্রাচ্যের প্রধান বাণীগুলো পাশ্চাত্যের রান্নাঘর দিয়েও পশ্চিমী মানুষের হৃদয়ে পৌঁছবে একদিন।

একটা মুখ দিয়ে স্বামীজির কত কথা আর বলা যায়! মন দিয়ে খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি এটসেটা সম্বন্ধে স্বামীজির কাজকর্মটুকু খতিয়ে দেখা যাক। কী তার দূরদৃষ্টি, কি তার উদ্ভাবনী শক্তি, কি তার প্রচার ক্ষমতা!

এরপরে একের পর এক ছবি নোট বইতে তুলে রেখেছেন পটলাদা! “নরেন ও তাহার আলাপীরা সকলে একদিন ভুনি খিচুড়ি রাঁধিয়াছিল। কড়াইশুটি ও আলু ভাজিয়া রাখিল,চাউলগুলি একটু চমকাইয়া তাহাতেনানা প্রকার মশলা মাখাইয়া, হাঁসের ডিম ফাটাইয়া তাহাতে মাখিল এবং জলে সিদ্ধ করিয়া ঘিনুন দিল।”বলাবাহুল্য অভিনব ঝরঝরে ভুনি খিচুড়ি হয়েছিল। “অন্য পোলোয়ার চেয়ে এই রকম রন্ধন অনেক শ্রেষ্ঠ, এখবর দিয়েছেন মেজভাই মহিম।

ঠাকুরের দেহাবসানের পর দক্ষিণেশ্বরে তাঁর জন্মোৎসবে যে রান্নার মেনু নরেন্দ্রনাথ নির্ধারণ করেছিলেন, সেখানেও ব্যবস্থা হয়েছিল মুগের ডালের ভুনি খিচুড়ি–সেই সঙ্গে আলুকপির দম, দই, বোঁদে ইত্যাদি!

এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে স্বামী বিবেকানন্দই সাম্প্রতিক কালে জোরের সঙ্গে প্রমাণ করলেন পোলাটা খাঁটি ভারতীয়, বাইরে থেকে আমদানি করা মোগলাই খানা নয়। বোধ হয় এই প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ওপর জোর দেওয়ার জন্যেই স্বামীজি মাঝে মাঝে পোলাও রাঁধবার জন্যে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠতেন।

প্রথমবার বিদেশ থেকে ফেরবার পরে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ শীতের এক সন্ধ্যায় বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়িতে বসে আছেন। স্বামীজি বলছেন, বাংলা দেশে যেমন তরকারি ব্যবস্থা এমন কোথাও নেই, তবে রাজপুতানায় বেশ আহারের ব্যবস্থা আছে।

মহিষাদলের রাজার ম্যানেজার ভক্ত শচীনবসু মন্তব্য করলেন,”মহারাজ, ওরা কি খেতে জানে? সব তরকারিতে টক দেয়।”

স্বামীজি: ”তুমি বালকের মতো কথা কইছো যে!… সিভিলাইজেশন তো ওদের দেশেই ছিল–বেঙ্গলে কোন কালে ছিল? ওদের দেশে বড় লোকের বাড়ি যাও, তোমার ভ্রম ঘুচে যাবে।…আর তোমার পোলাওটা কি? লং বিফোর ‘পাক রাজ্যেশ্বর’ গ্ৰন্থে পলান্নের উল্লেখ আছে; মুসলমানরা আমাদের নকল করেছে। আকবরের আইনি-আকবরীতে কি করে হিন্দুর পলান্ন প্রভৃতি রাঁধতে হয় তার রীতিমত বর্ণনা আছে।”

এর আগে লন্ডনেও স্বামীজি পোলাও প্রসঙ্গ নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন। ”পেঁয়াজকেপলাণ্ডু বলে–পল মানে মাংস। পেঁয়াজ ভেজে খেলে দুষ্পচ্য, পেটের ব্যানো হয়, সিদ্ধ করে খেলে উপকার করে এবং মাংসের যে কস্টিভনেস’ থাকে সেটা নাশ করে।”

পিঁয়াজ সম্পর্কে স্বামীজি কি শেষ পর্যন্ত তার মত পরিবর্তন করেছিলেন? মেরি লুইস বার্ক-এর ঐতিহাসিক বইতে দেখা যাচ্ছে, একজন ছাত্র স্যানফ্রানসিসকোতে প্রশ্ন করছে, পিঁয়াজ সম্বন্ধে আপনার মত? স্বামীজির উত্তর : “আধ্যাত্মপথের যাত্রীদের পক্ষে পিঁয়াজ অবশ্যই সেরা খাদ্য নয়।” সেই সঙ্গে স্বামীজির সরল স্বীকারোক্তি, “ছোটবেলায় আমি কী ভীষণ ভালবাসতাম। পিঁয়াজ খেয়ে মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে খোলা হাওয়ায় অনেকক্ষণ হাঁটা চলা করতাম।”

পোলাও পর্বের যেন শেষ নেই। প্রথমবার আমেরিকা যাবার আগে স্বামীজি বোম্বাইতে রয়েছেন, হঠাৎ ইচ্ছে হলো স্বহস্তে সকলকে পোলাও বেঁধে খাওয়াবেন। মাংস, চাল, খোয়া-ক্ষির ইত্যাদি সকল প্রকার উপকরণ জোগাড় হল। এদিকে আখনির জল তৈরি হতে লাগল, স্বামীজি আখনির জল থেকে সামান্য কিছু মাংস তুলে খেলেন। পোলাও তৈরি হলো। স্বামীজি ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘরে গিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। আহারের সময় সকলে বারবার তাকে খেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বললেন, আমার খেতে কোনো ইচ্ছে নেই, তোমাদের একটা বেঁধে খাওয়ানো উদ্দেশ্য ছিল, সেজন্য ১৪ টাকা খরচ করে এক হাঁড়ি পোলাও বেঁধেছি-খাওগে যাও।” স্বামীজি আবার ধ্যানে বসলেন।

প্রবাসে কোথায় কোথায় কতবার তিনি পোলাও/খিচুড়ি বেঁধেছেন তার পুরো হিসেব সংগ্রহ করা এখনও সম্ভব হয়নি। আধ্যাত্মিক চর্চার জন্যে শহর থেকে বহু দূরে শান্ত পরিবেশে তাঁবু খাঁটিয়ে সাধনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রান্না।

আমেরিকার মাটিতে বসেহামানদিস্তা দিয়ে স্বামীজিমশলাগুঁডোকরলেন। তিনি রান্নায় ঝাল বেশি তত দিতেনই, তার সঙ্গে লাল লঙ্কা চিবিয়ে খেতেন। ভক্তিমতী আইডা অ্যানসেলকে বললেন, “খেয়ে দেখো, এতে তোমার ভাল হবে।” আইডা পরে বলেছিলেন, “স্বামীজি বিষ দিলেও খেতাম। তাই খেলাম, কিন্তু ফল হলোঅতীব যন্ত্রণাদায়ক।” মেমসায়েবদের কি অতোলঙ্কা সহ্য হয়! যদিও লঙ্কাটা এসেছে বলিভিয়া থেকে।

খিচুড়ি অথবা পোলাওতে ঝাল কম হবার যে উপায় নেই তা আমরা স্বামীজির পরিব্রাজক জীবন থেকেই দেখতে পাচ্ছি। হৃষিকেশে সেবার স্বামীজির কঠিন অসুখ হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে খেতে চাইলেন স্বামীজি। নিবিড় জঙ্গলে চাল-ডাল জোগাড় করা কঠিন। প্রিয় গুরুভাই রাখাল এক ডেলা মিছরি সেবার খিচুড়িতে দেয়। ঝালখোর স্বামীজির খিচুড়ির আস্বাদ মোটেই ভাল লাগছে না। এমন সময় খিচুড়ির মধ্যে একটা লম্বা সুতো বেরুলো। অভিজ্ঞরা জানেন, তখনকার দিনে মিছরির মধ্যে এক আধটা সুতো থাকতো।সদ্য রোগ থেকে ওঠা স্বামীজির তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, খিচুড়িতে সুতো কেন? সকলে বললো, এক ডেলা মিছরি ফেলেছেরাখাল। মহাবিরক্ত স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করলেন গুরুভাইকে। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস।দুঃ শালা। খিচুড়িতে কখনও মিষ্টি দেয় রে? তোর একটা আক্কেল নেই!”

আর একবার পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজি মীরাটে হাজির হয়েছেন। জনৈক আমীরসায়েব সন্ন্যাসীকে রাজোচিত সিধা পাঠিয়েছিলেন। আর কথা নেই, ঈশ্বরপ্রেরিত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে পোলাও রাঁধার উদ্যোগ করলেন।

মীরাটে অবস্থান সম্বন্ধে স্বামী তুরীয়ানন্দর এক চিঠিতে (১৯ ডিসেম্বর ১৯১৫) মজার বর্ণনা আছে। “স্বামীজি আমাদের জুতা সেলাই হতে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সব শিক্ষা সেই সময় দিতেন। এদিকে বেদান্ত, উপনিষদ, সংস্কৃত নাটক সকল পাঠ ও ব্যাখ্যা করিতেন, ওদিকে রান্না শিখাইতেন।…একদিন পোলাও প্রভৃতি রান্না করিয়াছেন…সে যে কি উপাদেয়। হলো আর কি বলব? আমরা ভাল হয়েছে বলায় সব আমাদের খাইয়ে দিলেন, নিজে দাঁতে কাটলেন না। আমরা বলায় বলিলেন, “আমি ওসব ঢের খেয়েছি–তোদের খাইয়ে আমার বড় সুখ হচ্ছে, সব খেয়ে ফেল।”

“স্বামীজির রান্নায় সবসময় এতো ঝাল কেন?” এই প্রশ্ন উঠতে পারে। এটাই তো রাঁধুনি, ডাক্তার, মনস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিকদের যৌথ গবেষণার বিষয় হতে পারে। লঙ্কা দেখলেই স্বামীজির ব্রেক ফেল করতো! পরিব্রাজক জীবনে তিনি তো একবার লঙ্কাভক্ষণ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন। খেতে বসেছেন গোবিন্দ বসুর বাড়িতে, আর একজন অতিথি (সাধু অমূল্য) স্বামীজিকে দেখিয়ে মনের আনন্দে একটা শুকনো লঙ্কা খেলেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দুটি লঙ্কা খেলেন, অমূল্য তিনটি খেলেন, স্বামীজি চারটে খেলেন, এইভাবে প্রতিযোগিতা বেড়েই চললো, শেষ পর্যন্ত সাধু অমূল্যকে পরাজয় মানতে হলো।

আর একবার আলোয়ারে বৈষ্ণব সাধু রামসানাইয়ার সঙ্গে স্বামীজির অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছিল। এই সাধুও ঝাল ভালবাসতেন। মাধুকরী করে আটা এনে তাতে নুন ও লঙ্কা মেখে ধুনি জ্বালিয়ে টিক্কর বানাতেন। স্বামীজিও স্রেফ এই ঝাল টিক্কর ও জল খেয়ে দিন কাটাতেন,দু’জনে প্রায়ই মনের আনন্দে ঘটি বাজিয়ে ভজন গাইতেন।

পরবর্তীকালে কোন সময়ে স্বামীজিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি এতো লঙ্কা খান কেন?”

স্বামীজির উত্তরটি স্মরণীয় : “চিরজীবনটা পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি আর বুড়ো আঙুলে টাকা দিয়ে ভাত খেয়েছি। লঙ্কাই তো একমাত্র সম্বল ছিল। ঐ লঙ্কাই তো আমার পুরনো বন্ধু ও মিত্র। আজকাল না হয় দু’চারটে জিনিস খেতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু চিরটাকাল তো উপোস করে মরেছি।”

রান্নার ওপর স্বামীজি কতটা গুরুত্ব দিতেন তারও ইঙ্গিত নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। স্বামীজি বলতেন,”যে কাজই হউক, খুব মনোযোগের সহিত করা চাই।…যে রান্নাটাও ভাল করতে পারে না, সে কখনও পাকা সাধু হতে পারে না, শুদ্ধ মনে এক চিত্তে না রাঁধলে খাদ্যদ্রব্য সাত্ত্বিক হয় না।”

পরের দায়িত্ব সম্বন্ধে তো বললেন, কিন্তু তিনি নিজে কী? শাস্ত্রই বলছে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাইবে।

এবিষয়ে একজন গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দ (হরি মহারাজ) যা বলবার তা বলে গিয়েছেন।”দেখ নরেনের সব কাজ কি চটপট, পাগড়ী বাঁধবে তাও কি চটপট করে…অন্য লোক এক ঘণ্টায় যে কাজ করছে নরেন দুই মিনিটে সে কাজ করে ফেলে এবং এক সঙ্গে পাঁচছয়টা কাজ করে যায়।…এমন লোক জগতে খুব কম আছে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, কুটনো কোটা দেখ, পাঁচ মিনিটে সব কুটনো কুটে ফেললে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, আলুকে আঙুল দিয়ে ধরলে বঁটির গায়ে ছুঁয়াতে লাগল আর ঠিক খোসাটি উঠে গেল। আলুটা কোন জায়গায় বেধে গেল না বা চোকলা উঠে গেল না। কি আশ্চর্য তার কাজকর্ম! সব বিষয় যেন চনমন করছে, এই কুটনো কুটছে, এই হাসি তামাসা করছে, এই দর্শনের কথা বলছে, কোনটাই যেন তার পক্ষে কিছুই নয়।”

অনেকদিন পরে এই হরি মহারাজের সঙ্গে হরিদ্বারে এক প্রবীন সাধুর দেখা হয়। সাধুটি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে তাকে বলেন,”এত সাধুর সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু ওঁর মতন সাধু কখনও দেখিনি। হাসাতে হাসতে পেটে ব্যথা করে দিত, আর হাসির সঙ্গে এমন কথা বলত যে একেবারে বৈরাগ্য যেন আবার জেগে উঠত। অমন ইয়ার সাধু জীবনে কখন আর দেখিনি।”

শেষ কথাটি শুনে মনে একটু ভরসা জাগছে ইয়ারকির জন্য বাজারে আমার খুব বদনাম হয়ে গিয়েছে।

ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে, যে স্রেফ নিজের ব্রেন খাঁটিয়ে রসনারসিক বিবেকানন্দকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়, মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবারের হিসট্রি জিওগ্রাফি কেমিস্ট্রি সব তিনি জেনে বসেছিলেন। নিজে প্রায়ই কিছুমুখে দিতেন না, সেই সঙ্গে ছিল হাজাররকম ডাক্তারি বাধা নিষেধ, তবু অপরকে খাইয়ে অপার আনন্দ পেতেন। চেনা-অচেনা যারাই খেতে পাচ্ছে না তাদের জন্যে ছিল সীমাহীন উদ্বেগ–এই হচ্ছেন আমাদের বিবেকানন্দ ইন এ নাটশেল অথবা একনজরে স্বামীজি।

আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয় খাদ্য ও অখাদ্যর পদবিচার। স্বামীজি যে এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন তার প্রমাণ রয়েছে নিজের লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে। এবিষয়ে লিখিত মতামত দেওয়ার পরেও স্বামীজি বেলুড়ে বসে শিষ্য শরচ্চন্দ্রের সঙ্গে দ্বিতীয়বার আলোচনা করেছেন যা স্বামী-শিষ্য-সংবাদ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

স্বামী-শিষ্য-সংবাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য দলিল যে এই বইটিকে বাংলা বিবেকানন্দ রচনাবলীতে নির্দ্বিধায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

শঙ্করশিষ্য রামানুজের মতে খাদ্যে ত্রিবিধ দোষ : (১) জাতিদোষ অর্থাৎ যে দোষ ভোজ্যদ্রব্যের জাতিগত; যেমন পাজলশুন ইত্যাদি উত্তেজক দ্রব্য খেলে মনে অস্থিরতা আসে অর্থাৎবুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়।(২) আশ্রয় দোষ অর্থাৎ যে দোষ ব্যক্তিবিশেষের স্পর্শ থেকে আসে–দুষ্ট লোকের অন্ন খেলেইদুষ্টবুদ্ধি আসবেই এবং (৩) নিমিত্ত দোষ অর্থাৎ ময়লা কদর্য কীট-কেশাদি-দুষ্ট অন্ন খেলেও মন অপবিত্র হবে।…নিমিত্ত দোষ সম্বন্ধে বর্তমানকালে বড়ই ভয়ানক অবস্থা দাঁড়িয়েছে; ময়রার দোকান, বাজারে খাওয়া, এসব মহা অপবিত্র দেখতেই পাচ্ছ, কিরূপ নিমিত্তদোষে দুষ্টময়লা আবর্জনা পচা পক্কড় সবওতে আছেন–এর ফল হচ্ছে তাই।

অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীজি বলেছেন, খাদ্যের আশ্রয় দোষ থেকে বাঁচা সকলের পক্ষে সহজ নয়।

মঠ থেকে বেরিয়ে পরিব্রাজক অবস্থায় এবং সাগরপারে স্বামীজি নিজে কীভাব আশ্রয়দোষের মোকাবিলা করেছেন তার এক-একটা উদাহরণ বিদেশিনীরাও সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন। এবিষয়ে তার বোধ হয় তৃতীয় নয়ন ছিল।

একবার খ্যাতনামা শিল্পী চার্লস নেলসন স্বামীজিকে স্যানফ্রানসিসকোর চায়নাটাউনে এক বিখ্যাত চাইনীজ রেস্তোরাঁয় ডিনারে নেমন্তন্ন করেছিলেন। দোকানের মালিক শিল্পী নেলসনের পরিচিত। তাই বিশিষ্ট অতিথিকে স্পেশাল খাতির করতে শেফ স্বয়ং ওঁদের টেবিলে দেখা করতে এলেন।সময় বাঁচাবার জন্য নেলসন অবশ্য আগে থেকেই খাবারের মেনু ঠিক করে দিয়েছিলেন। স্বামীজি কিন্তু চাইনিজ শেফকে একবার দেখেই সব বুঝে ফেললেন। একেই বলে তৃতীয় নয়ন। কিচেন থেকে লোভনীয় সব খাবার এলো, কিন্তু আশ্রয়দোষ আছে বুঝে স্বামীজি খাবার মুখে তুললেন না। নেলসন একটু লজ্জায় পড়লেন, কিন্তু কিছু করা গেল না।

স্বামীজি পরে বলেছিলেন, শেফের চরিত্র ভাল নয় বুঝেই তার পক্ষে খাদ্য স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি।

আর একবার স্বামীজি আমেরিকায় এক ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। সেখানে চিংড়িমাছ মুখে দিয়ে, বাড়িতে এসেই তিনি বমি করতে আরম্ভ করলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা স্মরণ করে পরে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার রকমসকমও বুড়োর মতো হয়ে যাচ্ছে। কোনো অপবিত্র লোকের স্পর্শ করা খাদ্য বা পানীয় তার শরীর গ্রহণ করতে পারতো না।”

এর আগে ডেট্রয়েটে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল। কিছু মিশনারী তখন স্বামীজির সর্বনাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এক ডিনার পার্টি অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। শেষপর্বেকফিএলো। গুরুভাই স্বামী বিজ্ঞানানন্দকে অনেক বছর পরে স্বামীজি বলেছিলেন, “ঠাকুর চোখের সামনে ভেসে উঠলেন, বললেন, ‘খাস না! বিষ আছে।গুরু আমার সঙ্গে সব সময় আছেন, কে কি করতে পারে আমার?”

.

খাদ্যের জাতিদোষ সম্বন্ধে স্বামীজি যে কত জায়গায় কত মূল্যবান কথা বলেছেন তার হিসেব নেই। সেসব উপদেশ এখনও মানুষকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেওয়া মন্দ নয়। স্বামীজি বলতেন, “খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খাবার ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাওসস্তাও হবে, কিছুখাওয়াও হবে।”

ডাল সম্বন্ধে তার যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল, বিশেষ করে কলায়ের ডাল হলে তো কথাই নেই। বহুবার প্রিয়জনদের কাছে তিনি আব্দার করেছেন, কলায়ের দাল কর। তবে বলে রাখা ভাল, তার গুরুভাই অভেদানন্দ আবার কলায়ের ডাল একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। বোধ হয় এলার্জি ছিল, ওই ডাল দেখলেই কালী বেদান্তীর সর্দি হতো, হাঁচতে শুরু করতেন।

সঙ্ঘজননী শ্ৰীসারদামণির কাছে গরম ছোলার ডাল দিয়ে রুটি খাবার লোভও ছিল নরেন্দ্রনাথের।

ডাল ভালবাসলেও এ সম্পর্কে স্বামীজির পরামর্শ : খুব সাবধানে “ডাল দক্ষিণীদের মতন খাওয়া উচিত, অর্থাৎ ডালের ঝোলমাত্র, বাকিটা গরুকে দিও…ডাল অতি পুষ্টিকর খাদ্য, তবে বড়ই দুষ্পচ্য। কচি কলাইশুটির ডাল অতি সুপাচ্য এবং সুস্বাদু।… কচি কলাইশুটি খুব সিদ্ধ করে, তাকে পিষে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেল। তারপর একটা দুধ ছাঁকনির মতো তারের ছাকনিতে ছাঁকলেই খেলাগুলো বেরিয়ে আসবে। তখন হলুদ, ধনে, জিরে, মরিচ, লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাওউত্তম সুস্বাদু সুপাচ্য ডাল হল।” এই হচ্ছে শখের শেফ স্বামীজির স্পেশাল রেসিপি।

বোঝা যাচ্ছে, রান্না শেখাতে এবং উদ্ভাবন করতে স্বামীজি ছিলেন তুলনাহীন।

একবার তিনি বোধগয়ায় রয়েছেন, জনৈক বাঙালি ভক্ত প্রতিদিন সকালে এক কলসি তালের রস এবং এক কলসি খেজুর রস স্বামীজি অ্যান্ড পার্টিকে পাঠিয়ে দিতেন। খেজুর রস নষ্ট করতে প্রাণ চায় না। অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীজি ভাতের হাঁড়িতে জলের বদলে রস দিয়ে তাতে চাল ফেলে দিয়ে ভাত রাঁধতেবললেন! বোধহয় ওয়ার্লডের প্রথমও শেষ খেজুরেভাত!অনুসন্ধিৎসুরা শীতকালে স্বামীজি উদ্ভাবিত খেজুর রসের এই পদটি আর একবার বেঁধে দেখতে পারেন।

বিদ্রোহী বিবেকানন্দের উপস্থিতি আমরা তার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও খুঁজে পেতে পারি। শাস্ত্রে বলে দুধ ও মাংস একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়, কিন্তু স্বামীজি বেপরোয়া, তাই দুধ-মাংসের বিপরীত আহারে তিনি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

ঠেসে ভাত খাওয়ার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন আমাদের বিবেকানন্দ। একবার বেলুড়ে আহার করতে করতে বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহকে বললেন, “দেখ সিঙ্গি, কনসেনট্রেটেড়’ ফুড খাওয়া চাই। কতকগুলো ভাত ঠেসে খাওয়া কেবল কুঁড়েমির গোড়া।…আমাদের যে দু’বার আহার কুঁচকিকণ্ঠা ঠেসে। একগাদা ভাত হজম করতে সব এনার্জি চলে যায়।”

.

দুধ সম্বন্ধেও তার সাবধানবাণী সংগৃহীত হয়েছে। “দুধ–যেমন শিশুতে মাতৃদুগ্ধ পান করে, তেমনি ঢোকে ঢেকে খেলে তবেশীঘ্র হজম হয়, নতুবা অনেক দেরি লাগে।”

দুধ থেকেই পরবর্তী প্রশ্নটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। এবার আমাদের স্বাভাবিক প্রশ্ন, “আইসক্রিমের বাংলা কি?”

ওটা বহুকাল বাংলা হয়ে গিয়েছে বলেও অনুসন্ধিৎসুদের কাছ থেকে মুক্তি নেই।

অনুরাগীরা বলবেন, “বাহাদুর বাংলা লেখক! টপ করে আইসক্রিমকে কুলপি বলতে শুরু করেছিলেন স্বামীজি। কারণও ছিল। কলকাতায় যখন প্রথম বরফ এলো তখন ওই দুর্লভ বস্তুটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিমলের দত্তবাড়িতে হাজির হয়েছিল। প্রাক-রেফ্রিজারেটর যুগ, তখন বরফের বাক্সে খাবার, ফল, দুধ রাখার রেওয়াজ হয়েছিল। আমরা দেখেছি, নেয়াপাতি ডাবের ভিতর চিনি দিয়ে সেই ডাবের খোলে বরফ দিয়ে খেতে খুব ভালবাসতেন স্বামীজি। বারবার বিদেশে গেলে কিছু একটার ওপর টান তো ধরবে, আমেরিকা স্বামীজির ক্ষেত্রে সেটি অবশ্যই আইসক্রিম। খাদ্যরসিকরা এখন জানেন, মার্কিন মুলুকে তিনি চকোলেট আইসক্রিমের প্রবল ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।”

একদিন মার্কিনদেশে তার সঙ্গিনীরা স্ট্রবেরি খাচ্ছিলেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “স্বামীজি আপনি কি স্ট্রবেরি পছন্দ করেন?”

স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করলেন, “কখনও তো চেখে দেখিনি!”

“কখনও খাননি! সে কি? রোজই তো খাচ্ছেন!”

এবার স্বামীজির জোরালো উত্তর : “তোমরা তো সেগুলো ক্রিম দিয়ে ঢেকে দাও, ক্রিম মাখানো পাথরের নুড়িও ভাল লাগতে বাধ্য!”

লেগেট পরিবারে থাকার সময় ধূমপানের লোভে স্বামীজি সান্ধ্য-আহারের পর ঝটপট ডিনার টেবিল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন। ডিনার টেবিলে স্বামীজিকে আটকে রাখার সহজতম উপায়টি স্নেহময়ী মিসেস লেগেট আবিষ্কার করেছিলেন। টেবিল ছেড়ে স্বামীজির উঠে যাবার একটু আগেই তিনি ঘোষণা করতেন, “আইসক্রিম আছে।” অমনি ছোটছেলের মতন স্বামীজিনিজের সীটেবসেথাকতেন এবং তৃপ্তিসহকারে আইসক্রিম খেতেন।

একদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় তার সান্ধ্য বক্তৃতায় নরক সম্বন্ধে স্বামীজি অনেক কথা বললেন। বক্তৃতার শেষে সবাই মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে বেরোলেন। বাইরে তখন হাড়কাঁপানো শীত, কাঁপতে কাঁপতে স্বামীজি সঙ্গি নীদের বললেন, “এ যদি নরক না হয় তাহলে নরক কাকে বলে জানি না।”

রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে ঐ ঠাণ্ডাতেও স্বামীজি কিন্তু খেতে চাইলেন আইসক্রিম। দোকানের মালিক একটু দেরি করতে পারেন তা আশঙ্কা করে স্বামীজি বললেন, “দয়া করে দেরি করবেন না, তাহলে ফিরে এসে এখানেই দেখবেন একতাল চকোলেট আইসক্রিম।” অর্থাৎ বাইরে থেকে আসা অতিথিরাই ঠাণ্ডায় জমে আইসক্রিম হয়ে গিয়েছেন।

আইসক্রিম নিয়ে ভ্রান্তিবিলাসও হয়েছে! একবার লেকচারের শেষে আটজনকে স্বামীজি আইসক্রিম খেতে নেমন্তন্ন করলেন।

স্যানফ্রানসিসকোর পাওয়েল স্ট্রীট ধরে হাঁটছেন তাঁরা। দোকানের সেলস গার্লটি বোধ হয় নতুন, অর্ডার নেবার তেমন অভিজ্ঞতা তার নেই। কি নেবেন জিজ্ঞেস করায় স্বামীজি নির্দ্বিধায় অর্ডার দিলেন আইসক্রিম। মেয়েটি ভুল বুঝে একটু পরে সবার জন্য যা নিয়ে এল তা আইসক্রিম নয়, আইসক্রিম সোডা। বোতলগুলো খোলা হয়ে গিয়েছে। তবু ফেরত দেওয়া হল। কারণ তারা আইসক্রিম সোডা চাননি, চেয়েছেন আইসক্রিম। দোকানের ম্যানেজার ব্যাপারটা জেনে মেয়েটিকে প্রবল বকাবকি করতে লাগলেন। মেয়েটির এই অবস্থা দেখে স্বামীজির মন একেবারে গলে গেল, ম্যানেজারকে ডেকে তিনি বললেন, “প্লিজ, ওকে বোকো না। তুমি যদি ওকে আর কিছু বলো, তা হলে আমি কিন্তু একাই এই আইসক্রিম সোডার বোতলগুলো শেষ করে ফেলবো।”

আর একবার স্বামীজিআইসক্রিম আস্বাদন করেউচ্ছ্বসিত হয়েবলেছিলেন, “ম্যাডাম, ফুড ফর গড়। আহা সত্যি স্বর্গীয়।”

আইসক্রিমের প্রতি এই অস্বাভাবিক টান দেশে ফিরে এসেও অব্যাহত ছিল। এক আধবার নিবেদিতার কাছে আইসক্রিম খাওয়ার আব্দার করেছেন স্বামীজি। বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন নিবেদিতা, কারণ স্বামীজি তখন ডায়াবিটিসের রোগী।

অঢেল ঠাণ্ডা খাবার সম্বন্ধে স্বামীজি স্বদেশে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন গুরু ভাই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে। “দুধ আছে, দই কদাচ, ঘোল অপর্যাপ্ত।”

ক্রিমের চমৎকার বাংলা করেছেন স্বামীজি–মাঠা, “মাঠা সর্বদাই ব্যবহার চায়ে, কফিতে, সকল তাতেই মাঠা ব্যবহার–সর না, দুধের মাঠা। মাখন তো আছেন–আর বরফ জল–এন্তের বরফ জল…আর কুলফি এন্তের নানা আকারের।”

দুধের কথা যখন উঠলো তখন বেলুড়ে কবিরাজি নির্দেশে দুধ চিকিৎসার কথাও ভোলা যাক। তখন স্বামীজির পা ফুলেছে, সমস্ত শরীরে যেন জলসঞ্চার হয়েছে। কবিরাজের নির্দেশে একুশ দিন জল ও নুন না খেয়ে থাকতে হবে, খাবার মধ্যে সামান্য একটু দুধ।

শিষ্য শরচ্চন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, এই দারুণ গ্রীষ্মকাল! তাহাতে আবার আপনি ঘণ্টায় ৪/৫ বার করিয়া জলপান করেন, এ সময়ে। জল বন্ধ করিয়া ঔষধ খাওয়া আপনার অসহ্য হইবে।”

স্বামীজির অবিস্মরণীয় উত্তর : “তুই কি বলছিস? ঔষধ খাওয়ার দিন প্রাতে আর জলপান করব না’ বলে দৃঢ় সংকল্প করব, তারপর সাধ্য কি জল আর কণ্ঠের নীচে নাবেন! তখন একুশ দিন জল আর নীচে নাবতে পারছেন না। শরীরটা তো মনেরই খোলস। মন যা বলবে, সেইমত তো ওকে চলতে হবে, তবে আরও কি? নিরঞ্জনের অনুরোধে আমাকে এটা করতে হ’ল, ওদের (গুরুভ্রাতাদের অনুরোধ তো আর উপেক্ষা করতে পারিনে।”

স্বদেশ ফিরেও বিবেকানন্দর আইসক্রিমের প্রতি আকর্ষণ কমছে না। সেবার মায়াবতীতে প্রচণ্ড শীত–স্বামী বিরজানন্দকে স্বামীজি বললেন, “জীবনের শেষভাগে সব কাজ ছেড়ে এখানে আসা, বই লিখব আর গান করব।” ইতিমধ্যে হ্রদে বরফ জমেছে। সেই বরফ সংগ্রহ করে প্রকাণ্ড একতাল আইসক্রিম তৈরি করলেন স্বামী বিরজানন্দ। স্বামীজিকে সন্তুষ্ট করার সহজতর পথ আর কি থাকতে পারে?

এবার একটি ছোটখাট বোমা ফাটাতে চাই। কিছুদিন আগে প্রকাশিত নিবেদিতার পত্রাবলী তো এদেশের মানুষ মন দিয়ে পড়লো না। সংবাদের সোনারখনি বলতে যা বোঝায় তাই এই পত্রাবলী। বাগবাজার থেকে ১৮৯৯ সালের মে মাসে নিবেদিতা আমেরিকায় মিস ম্যাকলাউডকে যা লিখছেন তাতেও ইঙ্গিত রয়েছে আইসক্রিমের। “আগামীকাল এস (সদানন্দ?) এবং আমি ওঁর আইসক্রিমের জন্য পাঁচটাকা খরচ করবোবেজায় বড়লোকি, কিন্তু উনি চাইছেন!” তন্নতন্ন করে খুঁজেও স্বামীজিকে কিন্তু কোথাও আইসক্রিম তৈরি করতে দেখছি না। বোধহয় কিছু যন্ত্রপাতির দরকার ছিল এবং তখনও বেলুড়ে বিদ্যুৎ আসেনি।

সময় বেশ কমে আসছে। কিন্তু এখনও দুটো-তিনটে বিষয় আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে। রাঁধিয়ে হিসেবে স্বামীজির ভূমিকা এবং আইসক্রিম ছাড়া কোন্ কোন্ দিশি খাবার তাঁর প্রিয় ছিল? দুটোই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন।

ভক্তদের ব্যাখ্যা, “অন্নদানকেই তিনি তাঁর সঙ্ঘের একনম্বর কাজ হবে বলে মনস্থ করেছিলেন। রান্নার ওপর সম্পূর্ণ কনট্রোল না থাকলে এতো বড় দায়িত্ব কাঁধে নেবার কথা কে ভাবতে পারে? যায় না। রাঁধিয়ে হিসেবে আমরা দেখছিও অন্তিমপর্বে তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ও শিষ্যাদের আনন্দবর্ধন করতে চাইছেন, তবে সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে তাদের সেবাও করতে চাইছেন।

শিষ্য শরচ্চন্দ্রের কথাই ধরা যাক, পূর্ববঙ্গের ছেলে, স্বামীজির আদেশ, “গুরুকে নিজের হাতে বেঁধে খাওয়াতে হবে।”

মাছ, তরকারি ও রন্ধনের উপযোগী অন্যান্য দ্রব্য নিয়ে বেলা আটটা আন্দাজ শিষ্য শরচ্চন্দ্র বলরামবাবুর বাড়িতে উপস্থিত। তাকে দেখেই স্বামীজি নির্দেশ দিলেন, “তোদের দেশের মতন রান্না করতে হবে।…”

শিষ্য এবার বাড়ির ভেতর রন্ধনশালায় গিয়ে রান্না আরম্ভ করল। স্বামীজি মধ্যে মধ্যে ভেতরে এসে তাকে উৎসাহ দিতে লাগলেন, আবার কখনও বা “দেখিস মাছের ‘জুল’ যেন ঠিক বাঙালদিশি ধরনে হয়” বলে রঙ্গ করতে লাগলেন।

শিষ্যের মুখেই শোনা যাক পরবর্তী ঘটনা। “ভাত, মুগের ডাল, কই মাছের ঝোল, মাছের টক ও মাছের সুক্তনি রান্না প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় স্বামীজি স্নান করে এসে নিজেই পাতা করিয়া খাইতে বসিলেন। এখনও রান্নার কিছু বাকি আছে বলিলেও শুনিলেন না, আবদেরে ছেলের মতন বলিলেন, যা হয়েছে শীগগির নিয়ে আয়, আমি আর বসতে পাচ্ছিনে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।…শিষ্য কোনকালেই রন্ধনে পটু ছিল না; কিন্তু স্বামীজি আজ তাহার রন্ধনের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কলকাতার তোক মাছের সুজুনির নামে খুব ঠাট্টা তামাশা করে, কিন্তু তিনি সেই সুতুনি খাইয়া খুশি হইয়া বলিলেন, ‘এমন কখনও খাই নাই। কিন্তু মাছের জুল’টা যেমন ঝাল হয়েছে, এমন আর কোনটাই হয় নাই। টকের মাছ খাইয়া স্বামীজি বলিলেন, এটা ঠিক যেন বর্ধমানী ধরনের হয়েছে।”

এইবারেই স্বামীজি তাঁর শিষ্যকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছিলেন, “যে ভাল রাঁধতে পারে না সে ভাল সাধু হতে পারে না।”

এই শিষ্যকেই কয়েক বছর পরে মহাসমাধির কয়েক মাস আগে স্বামীজি কীভাবে বেঁধে খাইয়েছিলেন তা জেনে রাখা মন্দ নয়।

তখন স্বামীজির কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। জলখাওয়া বন্ধ, শুধু দুধ পান করে পাঁচসাতদিন চলছে। এই সেই মানুষ যিনি ঘন্টায় পাঁচ-ছ বার জল পান করতেন।

শিষ্য মঠে একটি রুইমাছ ঠাকুরের ভোগের জন্য এনেছে। “মাছ কাটা হলে ঠাকুরের ভোগের জন্য অগ্রভাগ রাখিয়া দিয়া স্বামীজি ইংরেজি ধরনে রাঁধিবেন বলিয়া কতকটা মাছ নিজে চাহিয়া লইলেন। আগুনের তাতে পিপাসার বৃদ্ধি হইবে বলিয়া মঠের সকলে তাহাকে রাঁধিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলেও কোন কথা না শুনিয়া দুধ, ভারমিসেলি, দধি প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ প্রকারে ওই মাছ রাঁধিয়া ফেলিলেন। …কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি জিজ্ঞেস করিলেন, “কেমন হয়েছে? শিষ্য বলিল, এমন কখনও খাই নাই।…ভারমিসেলি শিষ্য ইহজন্মে খায় নাই। ইহা কি পদার্থ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজি রসিকতা করিলেন, “ওগুলি বিলিতি কেঁচো। আমি লন্ডন থেকে শুকিয়ে এনেছি।”

.

এই শিষ্যই আরও পরে স্বামীজির মহাসমাধির অতি সামান্য আগে আহিরিটোলার ঘাটে গঙ্গাতীরে গুরুকে আবার দেখেছিল। স্বামীজির বাঁ হাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতো খেতে খেতে আনন্দে পথ ধরে এগোচ্ছেন।

স্বামীজি বললেন, “চারটি চানাচুর ভাজা খা না? বেশ নুন-ঝাল আছে।” শিষ্য হাসতে হাসতে প্রসাদ গ্রহণ করলেন।

অন্তিম পর্বেই আমরা জানতে পারি, ছোটবেলার স্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীজি একদিন বেলুড়ের মঠে বসে প্রকাশ্যে পাড়ার ফুলুরিওয়ালা হতে চাইলেন। উনুন জ্বললো, কড়া বসলো, তেল ঢালা হলো। ফাটানো বেসন গরম তেলে ছেড়ে, পিঁড়িতে বসে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন ফুলুরিওয়ালা নরেন। ছোটবেলায় সিমলা পাড়ায় যেমন দেখেছেন ফুলুরিওয়ালাকে। বেলুড়ের মাঠে হাঁক ছেড়ে খদ্দের ডেকে স্বামীজি মহানন্দ পেতে লাগলেন।

এসব দৃশ্য কিন্তু স্বদেশ কিংবা কলকাতায় সীমাবদ্ধ নয়। সেবার ট্রেনে যেতে যেতে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালাকে ফার্স্ট ক্লাসের সামনে ছোলা সেদ্ধ হাঁকতে দেখে সেবককে স্বামীজি বললেন, “ছোলা সেদ্ধ খেলে বেশ হয়, বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস”.. ছোলাওয়ালাকে একটা সিকি দেওয়ায় স্বামীজি তার সেবককে বললেন, “ওরে ওতে ওর কি হবে? দে একটা টাকা দে।” স্বামীজি ছোলা কিনলেন, কিন্তু খেলেন না। মনে হয় ফেরিওয়ালাটিকে কিছু দেবার জন্যেই এই ছোলা কেনা।

কিন্তু বিদেশে পরিস্থিতি অন্য। লস এঞ্জেলেসে তিনি তখন একের পর এক জগৎ-কাঁপানো বক্তৃতা করে চলেছেন। সারা শহরে বেশ আলোড়ন। আয়োজকদের একজন কিছু আলোচনার জন্য স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে দেখলেন, তিনি আপনমনে চিনেবাদাম ভাজা চিবোচ্ছেন। মানুষটির সরলতা দেখে সায়েবটি মুগ্ধ।

শুধু সাধারণ মানুষের নয়, শিষ্য ও শিষ্যাদের সর্ববিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যাপারে স্বামীজি যে তুলনাহীন ছিলেন একথা তাঁর কনিষ্ঠেরা পরবর্তীকালে বারবার স্মরণ করেছেন। এই শিক্ষার সিলেবাসে রান্না কখনও তার গুরুত্ব হারায়নি।

স্বামী বিরজানন্দসহ দলবল নিয়ে মায়াবতী থেকে বেরিয়ে পড়েছেন স্বামীজি। প্রথমে চম্পাবত, সেখান থেকে ডিউরির ডাক বাংলো।

রান্নার দায়িত্বে রয়েছেন স্বামী বিরজানন্দ। হাঁড়ির আকারের তুলনায় চাল বেশি হওয়ায়, ভাত আধসিদ্ধ হয়ে উথলে পড়ছে, আর ক্ষিদে পাওয়ায় স্বামীজি লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছেন, রান্নার কত দেরি।

বিরজানন্দ ভাবছেন, খানিকটা ভাত নামিয়ে নিয়ে বাকি ভাত আরও জল দিয়ে ফুটোবেন। এমন সময় স্বামীজি রান্নার জায়গায় ঢুকে অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে বললেন, “ওরে ওসব কিছু করতে হবে না। আমার কথা শোন–ভাতে খানিকটা ঘি ঢেলে দে, আর হাঁড়ির মুখের সরাখানা উলটে দে, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর খেতেও খুব ভাল হবে।”

রন্ধনবিদ গুরুর কথা শোনায় ফল খুব ভাল হল, সেদিনকার এমার্জেন্সি ঘি ভাত সবার খুব ভাল লেগেছিল।

অনেকের সবিনয় অনুসন্ধান, “খাওয়ার জন্যে অযথা দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হলে স্বামী বিবেকানন্দ কি একটু অধৈর্য হয়ে উঠতেন?”

সেইটাই তো স্বাভাবিক। মা বাবা কত আদর করে মানুষ করেছিলেন, অথচ বড় কাজের আহ্বানে চব্বিশ বছরে সন্ন্যাসী হয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাকি জীবনটা পথে পথে কেটে গেল। পরের দিনের অন্ন কোথা থেকে কীভাবে আসবে তা সন্ন্যাসীর জানা নেই। শরীর যখন রোগ জর্জরিত, যখন দু’একজন স্নেহের মানুষ তার কাছাকাছি রয়েছে তখন মানুষের একটু-আধটু অভিমান আসতে পারে। তাছাড়া রয়েছে সময়ানুবর্তিতার প্রতি স্বামীজির প্রবল আকর্ষণ–শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য।

সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে (১৮৯৫) স্বামীজি নির্দেশ দিচ্ছেন : “ভোগের নামে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না।”

আর এক চিঠিতে স্বামীজি সাবধান করে দিচ্ছেন, ঠাকুরের জন্মোৎসবে যেন খাওয়াতে খাওয়াতে দিন চলে না যায়। কী ধরনের আয়োজন করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে থাকতে পারে যখন ভাবছেন, তখন তিনি নিজের কথা ভাবছেন না। তবে স্বামীজির ছেলেমানুষী সরলতা ছিল আপনজনদের মধ্যে। অনুরাগীরা, গুরুভ্রাতারা এবং শিষ্যরা জানতেন রাগ হলে স্বামীজি খাবার ফিরিয়ে দিতে পারেন।

স্বামীজির প্রিয় শিষ্য হাতরাস স্টেশনের প্রাক্তন সহকারী স্টেশনমাস্টার গুপ্ত মহারাজের গল্পটা অনেকের জানা। স্বামী সদানন্দর ভাষায় : “শেষের দিকে কয়েকদিন ওঁর রুচিমতো রান্না করি। তার শরীর তখন ভাঙনের পথে। একদিন চটে লাল হয়ে নিজের ঘরে বসে। মেজাজ অত্যন্ত গরম, কার সাধ্যি কাছে এগোয়। খানা তৈরি করে বাবুর্চির কায়দায় কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে খাবার নিয়ে সাধাসাধি, মহারাজ নরম হোন, গুস্সা ছোড় দিজিয়ে। টেমপারেচার তবু নামে না–”মেহেরবানি করুন, সব কসুর মাফ কিজিয়ে। যাঃ শালা, দূর হ, খাব না। তখন আমি দাঁত দেখালাম, তুমভি মিলিটারি হাম ভি মিলিটারি’, আমি রেগে নেমে এলাম: যাঃ শালা! ভুখা রহো, হামারা ক্যা পরোয়া!”

এর পরে কী হয়েছিল তা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু জোর করে বলা যায়, স্বামীজির রাগ নিশ্চয় সঙ্গে সঙ্গে কমে গিয়েছিল এবং স্বামীজি শেষপর্যন্ত খেয়েছিলেন। স্বামীজি অভুক্ত থাকবেন আর মঠের অন্য সবাই অনুগ্রহণ করবেন এটা অসম্ভব ব্যাপার। ওই কালচার বা মানসিকতা থাকলে সেদিনের রামকৃষ্ণ মিশন কিছুতেই আজকের রামকৃষ্ণ মিশন হতে পারতো না।

উৎসাহীদের পরবর্তী প্রশ্ন : “বিবেকানন্দ তোবুঝতে পারছি, দুনিয়ার সর্বত্র শত শত রান্নার মাধ্যমে বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু তার ম্যাগনাম ওপাস কোষ্টা? ওঁর কোন্ রান্নাকে বিশেষজ্ঞরা এক নম্বরে ফেলবেন?”

খুবই কঠিন প্রশ্ন। তবে মানসকন্যা নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা ঘোষালকে এক রবিবারে তিনি যে লাঞ্চ খাইয়েছিলেন তার বোধ হয় তুলনা নেই। একটা লাঞ্চের মধ্যে সারাবিশ্বের ছায়া নামিয়ে এনেছিলেন বিশ্বপথিক বিবেকানন্দ।

সময় মার্চ ১৮৯৯, স্থান বেলুড় মঠ। এই লাঞ্চের মাত্র কয়েকদিন আগে বিনা নোটিসে সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি সাপার খাইয়েছিলেন বেলুড়ে। তার মেনু : কফি, কোল্ড মাটন, ব্রেড অ্যান্ড বাটার। স্বয়ং স্বামীজি পরম স্নেহে পাশে বসে খাইয়ে নিবেদিতাকে বোটে করে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আর রবিবারের সেই অবিস্মরণীয় লাঞ্চের ধারাবিবরণী নিবেদিতা রেখে গিয়েছেন মিস ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে। “সে। এক অসাধারণ সাফল্য! তুমি যদি সেখানে থাকতে!” স্বয়ং স্বামীজি রান্না করেছেন, পরিবেশনও তিনি নিজে করলেন। “আমরা দোতলায় একটা টেবিলে বসেছি। সরলা পুবমুখো হয়ে বসেছিল যাতে গঙ্গা দেখতে পায়।”

এই ভোজনের নাম নিবেদিতা দিয়েছিলেন ‘ভৌগোলিক’ লাঞ্চ, কারণ সারা বিশ্বের রান্না একটি টেবিলে জমায়েত হতে শুরু করেছে। সব বেঁধেছেন স্বামীজি। রাঁধতে রাঁধতে তিনি একবার নিবেদিতাকে তামাক সাজতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনুন সেই অবিস্মরণীয় মেনুর কথা।

১। আমেরিকান অথবা ইয়াঙ্কি–ফিস্ চাউডার।

২। নরওয়েজিয়ান ফিস বল বা মাছের বড়া–”এটি আমাকে শিখিয়েছেন ম্যাডাম অগনেশন”–স্বামীজির রসিকতা।

“এই ম্যাডামটি কে স্বামীজি? তিনি কি করেন? মনে হচ্ছে আমিও যেন ওঁর নাম শুনেছি!” উত্তর : “আরও কিছু করেন, তবে সেই সঙ্গে রাঁধেন ফিস্ বল।”

৩। ইংলিশ না ইয়াঙ্কি? –ববার্ডিং হাউস হ্যাঁশ। স্বামীজি আশ্বাস দিলেন ঠিকমতন রান্না করা হয়েছে এবং পেরেক মেশানো হয়েছে। “কিন্তু পেরেক? তার বদলে আমরা পেলাম লবঙ্গ!–আহা পেরেক না থাকায় আমাদের খুব দুঃখ হতে লাগলো।”

৪। কাশ্মিরী মিনল্ড পাই আ লা কাশ্মির। (বাদাম ও কিসমিস সহ মাংসের কিমা!)

৫। বেঙ্গলি রসগোল্লা ও ফল। রান্নার বিবরণ শুনলে বিস্মিত হবারই কথা। মানুষটা কত রকমভাবে বিশ্বকে বোঝবার ও জানবার চেষ্টা করেছেন!

সোজা কথাটা হলো, রান্নার বিবেকানন্দকে না জানলে ঈশ্বরকোটি বিবেকানন্দকে জানা যায় না, প্রেমের সাগর বিবেকানন্দকে বোঝা যায় না।

ভক্তিমতি নিবেদিতাকে মহাপ্রস্থানের ঠিক আগে নেমন্তন্ন করে বিবেকানন্দ যে রান্না খাইয়েছিলেন তাতে ছিল কাঁঠালবিচি সেদ্ধ। আরও যা সব খাইয়েছিলেন তার বিবরণ যথাস্থানে লিপিবদ্ধ রয়েছে, একটু কষ্ট করলেই পাঠক-পাঠিকারা জানতে পারবেন, সব কোশ্চেনের উত্তর একসঙ্গে না লিখে দেওয়াই ভাল।

স্বামী বিবেকানন্দ কি মহাপ্রয়াণের কিছু আগে পাঁউরুটি নিয়েও প্রচণ্ড গবেষণা শুরু করেছিলেন?”

উত্তর : ইয়েস। একসময় তিনি লুচি কচুরির সঙ্গে পাঁউরুটিকেও প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি নিজের হাতে লিখেছেন : “ঐ যে পাঁউরুটি উনিও বিষ, ওঁকে ছুঁয়ো না একদম। খাম্বীর (ইস্ট) মেশালেই ময়দা এক থেকে আর হয়ে দাঁড়ান। …যদি একান্ত পাঁউরুটি খেতে হয়

তো তাকে পুনর্বার খুব আগুনে সেঁকে খেও।”

স্বামীজির মধ্যে ছিল বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধিৎসা ও খোলা মন, নিশ্চয় কিছু মাথায় ছিল, তাই বেলুড় মঠে তৈরি পাঁউরুটির নমুনা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নিবেদিতার বাগবাজারের ঠিকানায় দেহাবসানের ঠিক আগে।

৪ঠা জুলাই ১৯০২ শুক্রবার শেষ মধ্যাহ্নভোজনে স্বামীজি কি গ্রহণ করেছিলেন?

অবশ্যই ইলিশ মাছ। জুলাই মাস, সামনেই গঙ্গা, ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কিছু রান্না হলেই তো পৃথিবী বলতো মানুষটা বেরসিক! আসন্ন বিয়োগান্ত নাটকের পরিণতির কথা কেউ জানেনা ৪ঠা জুলাই-য়ের সকালবেলায়। স্বামী প্রেমানন্দর বর্ণনাটা পড়বার মতন:”গঙ্গার একটি ইলিশ মাছ এ বৎসরে প্রথম কেনা হল, তার দাম নিয়ে আমার সঙ্গে কত রহস্য হতে লাগল। একজন বাঙাল ছেলে ছিল তাকে বললেন-”তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর।…আহারের সময় অতি তৃপ্তির সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোলঅম্বলভাজা দিয়ে ভোজনকরলেন।বললেন–একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।”

আরও প্রশ্ন আছে। বিবেকানন্দর সৃজনী প্রতিভা রান্নাঘরেও কীভাবে বহুমুখী হয়েছিল তা তো জানা গেল, কিন্তু তিনি নিজে সব চেয়ে কী খেতে ভালবাসতেন?

উত্তরটা অত সহজ নয়। দিশি খাবারের মধ্যে প্রবল দাবিদার রয়েছে, বিলিতিতেও দাবিদার রয়েছে। আমিষে দাবিদার রয়েছে, নিরামিষে দাবিদার রয়েছে; ঝাল-ঝোল চচ্চড়িতে দাবিদার রয়েছে, আবার শেষপাতের মিষ্টিতেও দাবিদার রয়েছে।

যাঁদের ধারণা নিরামিষ আহারে স্বামীজির অরুচি ছিল তারা বিবেকানন্দের কিছুই জানেন না। বিশেষ করে খিচুড়ি যাতে বেলুড় মঠের সন্ধের খিচুড়ি মিস না হয়ে যায় তার জন্যে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য থেকে ফিরে স্বামীজির বেলুড়ের পাঁচিল টপকে খাবার জায়গায় চলে এসেছিলেন।

নিরামিষ ঝোল, যাকে অনেকে ঝালের ঝোল বলেন, তা স্বামীজি খুব ভালবাসতেন এবং সে নিয়ে নানা সময়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। জগদ্বিখ্যাত হওয়ার পরেও দলবল নিয়ে মা-দিদিমার কাছে চলে আসতেন শুকতো এবং মোচার ডানলা খাবার জন্যে। মায়ের এঁটো নিরিমিষ খেতে একদিন এমন সময় এলেন যখন মায়ের পাতে খাড়া ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই আনন্দ করে খেলেন, যদিও স্নেহময়ী মা বললেন, একটু আগে আসতে হয়।

সুযোগ পেলে স্বামীজি বাগবাজারে এসে যোগীন-মায়ের কাছে আসতেন পুঁইশাক চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতে। যোগীন মা যখন কাশীতে ছিলেন তখনও স্বামীজি তার বাড়িতে হাজির হয়ে বলতেন, “যোগীন-মা, এই তোমার বিশ্বনাথ এলোগা!” আবার কোনোদিন গিয়ে বলতেন, “আজ আমার জন্মতিথি গো! আমায় ভাল করে খাওয়াও। পায়েস করো।”

আরও পছন্দের জিনিস ছিল–কই মাছ। সিমলের দত্তবাড়ির বিখ্যাত রসিকতা কই দুরকমের, শিখ কই, গুখ কই–প্রথমটি লম্বা, দ্বিতীয়টি বেঁটে কিন্তু প্রচুর শাঁস।

প্রথমবার আমেরিকায় যাবার জন্যে বোম্বাইতে জাহাজে চড়বার আগে স্বামীজির হঠাৎ কই মাছ খাবার ইচ্ছে হলো। বম্বেতে তখন কই মাছ পাওয়া কঠিন ব্যাপার। ভক্ত কালিপদ ঘোষ ট্রেনে লোক পাঠিয়ে অনেক কষ্টে বিবেকানন্দকে কই মাছ খাওয়ানোর দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করলেন। কোনো কোনো ভক্তের বাড়িতে গিয়ে তিনি নিজেই মেনু ঠিক করে দিতেন। কুসুমকুমারী দেবী বলে গিয়েছেন, “আমার বাড়িতে এসে কলায়ের ডাল ও কই মাছের ঝাল পছন্দ করেছিলেন।” . কিন্তু পুঁইশাক ও ইলিশ এক মহাপরাক্রান্ত জুটি, যাকে বলে কিনা ডেডলি কম্বিনেশন! আমেরিকান বা জার্মান স্কলার হলে পুরো একটা ডক্টরেট থিসিস হয়ে যেতো, তারপর ভক্তরা গিয়ে সেই বইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেন, সায়েবদের লেখা সম্বন্ধে, ভারতীয়দের যা দুর্বলতা!

স্বামীজির পছন্দ অপছেন্দর ক্ষেত্রে কলায়ের ডাল ও কই মাছের দুর্দান্ত প্রতিযোগী অবশ্যই ইলিশ ও পুইশাক। মহাসমাধির অনেকদিন পরেও এক স্নেহময়ীর অনুশোচনা, “পুইশাক দিয়ে চিংড়ি মাছ হলেই নরেনের কথা মনে পড়ে যায়।”

যেমন চাবি আর তালা, হাঁড়ি আর সরা, হর আর পার্বতী তেমনি এই ইলিশ আর পুইশাক স্বামীজির জীবনে। কান টানলেই যেমন মাথা আসবে, তেমন ইলিশ এলেই পুইশাকের খোঁজ করবেন স্বামীজি। শুনুন এলাহাবাদের সরকারি কর্মচারী মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা।

একবার স্বামীজি স্টিমারে গোয়ালন্দ যাচ্ছেন; একটা নৌকোয় জেলেরা ইলিশ মাছ জালে তুলছে। হঠাৎ বললেন, ‘বেশ ভাজা ইলিশ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সারেঙ বুঝে গিয়েছে সব খালাসিদের খাওয়ানোর ইচ্ছে স্বামীজির। দর করে জানাল, এক আনায় একটি তিনটি-চারটিই যথেষ্ট। স্বামীজি বললেন, তবে এক টাকার কেন। বড় বড় ইলিশ ষোলটি, তার সঙ্গে দুচারটি ফাউ।

স্টীমার এক জায়গায় থামানো হলো। স্বামীজি অমনি বললেন, ‘পুঁইশাক হলে বেশ হতো, আর গরম ভাত। কাছেই গ্রাম। একটি দোকানে চাল পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে বাজার বসে না, কোথায় পুঁই? এমন সময় এক ভদ্রলোক বললেন, ‘চলুন, পুইশাক আমার বাড়ির বাগানে আছে। তবে একটি শর্ত। স্বামীজিকে একটিবার দর্শন করাতে হবে।

ভেবেচিন্তে দেখলে স্বামীজির প্রিয় খাদ্যতালিকায় শেষপর্যন্ত ফাঁইনাল রাউন্ডটা শুকতো-মোচার ডানলা ভারসাস ইলিশ-পুইশাক। আইসক্রিমটা সেমি-ফাইনালে হেরে গেল এই কারণে যে শেষপর্ব স্বামীজির রক্তে সুগার, আইসক্রিম খাওয়া নিশ্চয় নিষিদ্ধ।

স্বর্ণপদকটা ইলিশ-পুঁইশাকই পাবে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা দেখছি গোয়ালন্দের পথে স্টিমারে পুইশাক সরবরাহ করায় স্বামীজি এমনই খুশি হয়েছিলেন যে সেই দিনই ফিরবার পথে পুঁইবাগানের মালিককে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্যবান ভক্তটি বলেছেন, আমাকে কৃপা করবেন বলেই স্বামীজির মাছ ও পুঁইশাক খাবার কথা মনে উঠেছিল।

পুঁইশাকের বদলে দীক্ষা! মস্ত কথা, এই পদটিরই গোল্ডমেডাল পাওয়া উচিত। কিন্তু মা-দিদিমার কাছে শুকতো-মোচার ডানলা খেয়ে স্বামীজি যে মারাত্মক কথা বলেছিলেন তা গবেষকদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। নিরামিষ খেয়ে স্বামীজি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “বাংলা দেশের এই দুটোর জন্যে আবার কিন্তু জন্ম নেওয়া যায়।” গোল্ডমেডালটা ওখানেই দেওয়া ছাড়া পথ নেই, কারণ পুনর্জন্ম নিয়ে ক্ষণজন্মা পুরুষরা কখনও রসিকতা করবেন না।”

শেষমুহূর্তে আর একটা সারপ্রাইজ দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। শুকতো মোচাই বলুন, কই মাছই বলুন, ইলিশ পুঁইশাকই বলুন, আইসক্রিমই বলুন, স্বামীজির কাছে সব থেকে মূল্যবান এবং বোধ হয় সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি এতোক্ষণ আমাদের নজরের আড়ালে থেকে গিয়েছে।

সাধক সন্ন্যাসী, জগতের হিতের জন্য তার সংসারে আসা এবং জীবনধারণ। একটি ছোট্ট জিনিস তিনি সবসময় নিজের কাছে রাখতেন, প্রবাসের মাটিতে তাকে একটি ছোট্ট শিশি থেকে কিছু পান করতে দেখা গিয়াছে। স্বদেশে এবং প্রবাসে নিত্যসাথী এই দুর্লভ বস্তুটি সম্বন্ধে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর একান্ত স্বীকারোক্তি : কখন প্রয়োজন হবে ঠিক নেই, তাই সবসময় সঙ্গে, যখনই সুযোগ পেয়েছি তার সদ্ব্যবহার করেছি। অগণিত মানুষের জনস্রোতে, সভ্যতার বিস্ফোরণের কছে দাঁড়িয়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুরন্ত পদক্ষেপে নিষ্পেষিত হবার সম্ভাবনাময় মুহূর্তে আমি শান্ত হয়ে গিয়েছি, আমি স্থির হতে পেরেছি, দু’একটি ফোঁটায়।

“কী সে জিনিস?”

বুঝতে পারলেন না? গঙ্গাজল! একটা ছোট্ট শিশিতে ভরা গঙ্গাজলই ছিল বিশ্বপথিক বিবেকানন্দর চিরসাথী, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি!

অতএব এইটা দিয়েই শেষ করা যাক রসনারসিক বিবেকানন্দের এই পর্বের কথা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *