১৩-১৪. হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম

মাঝখানে তিনদিন হাসপাতালে যেতে পারিনি। ভেতর বাইরের চাপে এক রকম হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। চারদিনের দিন হাসপাতালে যেয়ে যা শুনলাম তাতে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এই তিনদিনে তায়েবার অসুখ বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে গিয়েছিলো। পরশুদিন তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নিয়ে যেতে হয়েছে। ডাক্তারেরা কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না। হাসপাতালের সামনে সেই মহানিম গাছের চারপাশের বাঁধানো গোলাকার চক্রটিতে সবাই বসে আছে। জাহিদুল, ডোরা, দোলা, হেনা ভাই আরো দুচারজন আত্মীয়স্বজন। দূরে একাকী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন তায়েবার মা। এই বর্ষীয়সী মহিলাকে এইভাবে ভিড় থেকে দূরে একেবারে একাকী বজ্রাহত তরুর মতো বসে থাকতে দেখে আমার বুকটা আশংকায় ধুকপুক করে উঠলো। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মহিলা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখের কোণায় অক্ষরেখা। আঁচলে মুছে নিয়ে বললেন, এই তিনদিনে তুমি একবারও হাসপাতালে আসোনি। তোমার কি জ্বরজারি কিছু একটা হয়েছিলো? আমি না বলতে যেয়েও পারলাম না। আমার অসুখ বিসুখ হয়নি। অথচ আমি আসিনি, জানলে মহিলা ব্যথিত হবেন। তাই বললাম, আমার জ্বর হয়েছিলো। মহিলা কিছু বললেন না। আমি তার পায়ের কাছে ঘাসের ওপর বসলাম।

একটু একটু শীত করছিলো। হাসপাতালের লোকজন কমে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যেবেলা আলো জ্বলে উঠেছে। আমরা বাইরে বসে আছি, কি করবো জানিনে। সমস্ত পরিবেশটাই কেমন ভূতুরে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তায়েবাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে। সকলেই জেনে গেছে তার আর বেশি সময় নেই। আমি দু’হাতে মাথা ঢেকে তায়েবার এই পরিণতির জন্য কে দায়ী চিন্তা করতে চেষ্টা করলাম। তায়েবার এই অকাল মৃত্যুর জন্য আমি জাহিদুলকে মনে মনে দায়ী করলাম। পরক্ষণে ভাবলাম, জাহিদুল দায়ী হতে যাবেন কেন? জাহিদুলের দোষ কি? জাহিদুল ডোরাকে বিয়ে করেছেন বলে তায়েবাকে মরতে হবে এটা কেমন করে হয়। তাহলে ভোরাই কি দায়ী? বিচার করে দেখলাম, ডোরারই বা কসুর কি? সে তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতোই। জাহিদুলকে বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেন? হেনা বিয়ে করে অন্যায়টা কি করেছে। তার ফলে তায়েবা মরতে যাবে কেনো? হেনা ভাই তায়েবার খোঁজ খবর না নিয়ে নিজে একটা বিয়ে করেছেন বলেই কি তায়েবা মরতে বসেছে? হেনা ভাই বিয়েটা না করলে বেঁচে থাকতো তার নিশ্চয়তা কি? তাহলে তায়েবার মা-ই তার মৃত্যুর কারণ? খুব খুঁটিয়ে চিন্তা করার পর একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, মহিলা তায়েবার ঘাড়ে অত্যধিক দায়িত্বের বোঝা চাপিয়েছিলেন, তাই বলে কি তায়েবাকে মরতে হবে? তাহলে দায়ী কে? তায়েবা কোলকাতা এসেছিলো, তাই কি তাকে মরতে হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু না হলে তাকে কোলকাতা আসতে হতো না। এই স্বাধীনতা সংগ্রামই কি তায়েবার মৃত্যু ঘটাতে যাচ্ছে। আমি স্বাধীনতা সংগ্রামকেও বা কেমন করে দায়ী করি। তাহলে তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? তায়েবার মৃত্যু জন্য কেউ না কেউ একজন তো দায়ী হবে। কাউকে দায়ী না করে আমার মন শান্তি পাচ্ছিলো না। তখনই মনে পড়ে গেলো তায়েবা নিজের মুখে। বলেছে, সে আমাকে ভালোবাসে, তাহলে কি আমিই কি তায়েবার মৃত্যুর জন্য দায়ী?

হাসপাতালের সামনের রাস্তায় হঠাৎ আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে তাকালাম। চারজন মানুষ একখানি খাঁটিয়ায় করে একটা সাদা চাঁদরে ঢাকা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলে একসঙ্গে হরিবোল বলে চিৎকার করছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার মধ্যে একটা দার্শনিক নির্লিপ্ততা জন্ম নিলো। মানুষের জন্ম মৃত্যুর রহস্যটা আমার চোখে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। মৃত্যু সর্বব্যাপী ওঁত পেতে রয়েছে। কেউ কারো জন্য দায়ী নয়। আমি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলাম, হেনা ভাই এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর ডাকলেন, দানিয়েল এদিকে এসো। তিনি আমাকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসালেন। বললেন, চা খাও। কাপে যেই চুমুক দিয়েছি, হেনা ভাই বললেন, দেখি তোমার একটা চারমিনার দাও। সিগারেটটা ধরিয়ে বললেন, শোনো দানিয়েল আজ তোমাকে একটা কথা বলবো। আমি বললাম, বলুন। তিনি বললেন, শোনো তিনদিন তুমি হাসপাতালে আসোনি। এই তিনদিন তায়েবার কি কষ্ট হয়েছে সে আমি বলতে পারবো না। গত পরশুদিন রাতে সে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছিলো। প্রতিবারই জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে তোমার কথা জিগগেস করেছে। তুমি বোধ হয় এরই মধ্যে জেনে গেছো আমার বোনটি বাঁচবে না। তোমাকে যে কথাটি আমি বলার জন্য ডেকেছি, তিনি একটুখানি ইতস্তত করলেন। হাতের পোড়া সিগারেটটি ফেলে দিয়ে আমার কাছ থেকে আরেকটি সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন। তারপর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কোনো গোপন কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে ফিস ফিস করে বললেন, আমার বোনটি তোমাকে খুবই ভালোবাসে। আমার কাঁধে হাত রাখলেন, ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। সে আর বাঁচবে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রু চিক চিক করে উঠলো। আমি কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

আমরা হাসপাতালে ফিরে এলাম। এসে দেখি সে মহানিম গাছটির গোড়ায় কেউ নেই। আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, ওরা সব গেলো কোথায়। এই যে দানিয়েল সাহেব এইদিকে আসুন। লাল কংক্রিট বিছানো পথ বেয়ে উঃ মাইতি হাসপাতালের গেটের দিকে যাচ্ছেন। আমি পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, চলুন, আপনাকে খুঁজছিলাম। আমি ডঃ মাইতির পেছন পেছন তাঁর কোয়াটারে গেলাম। তিনি ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর স্টেথিসকোপ রাখলেন। তারপর বললেন, দানিয়েল সাহেব বসুন, আজকে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি। তিন চারদিন থেকে আপনার দেখা নেই। আমি তাঁর উল্টোদিকের সোফায় গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, দিন দেখি আপনার একটা চারমিনার। আপনার সঙ্গে দেখা হলেই আমার সিগারেটের নেশা চেপে যায়। আমি প্যাকেটটা বের করে দিলাম। তিনি একটা ধরিয়ে খকখক কাশলেন এবং গলগল করে ধোয়া ছাড়লেন। তারপর, বলুন আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ। সহসা ডঃ মাইতির কথার কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তাই ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, আপনাদের যুদ্ধের সংবাদ আমার কাছ থেকে শুনুন। আপনারা খুব শিগগির দেশে চলে যাবেন এবং আপনাদের দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এখন বলুন, আপনার আনন্দ হচ্ছে কিনা। আমি বললাম, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে এবং আমরা দেশে ফিরে যাবো। তিনি বললেন, এটাই তো আপনারা চেয়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছিলো, ডঃ মাইতি অন্য কিছু একটা বলতে চান, যুদ্ধ সংক্রান্ত কথাগুলো ভনিতা মাত্র। আমার মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত দুঃখের কোনো কিছু হয়তো বলবেন। আমার বর্তমান যা মানসিক অবস্থা কেউ যদি বলে আগামীকাল সূর্য নিভে যাবে বোধ হয় কোনো ভাবান্তর ঘটবে না। আমি মনে মনে বিরক্তি অনুভব করছিলাম। ডঃ মাইতি আমাকে আসল কথাটি না বলে ধানাই পানাই করেন কেন। আমি জিগগেস করলাম, আপনি তায়েবার ব্যাপারে কিছু বলবেন? ইনটেনসিভ কেয়ারে সে কেমন আছে? ডঃ মাইতি টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটি উঠিয়ে নিয়ে ঘুরাতে থাকলেন এবং প্রায় পাঁচ মিনিট তাই করে গেলেন। তারপর টেবিলের ওপর রেখে সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, কোনো মূল্যবান জিনিস পেতে হলে দাম দিতে হয়, একথা আপনি বিশ্বাস করেন? আমি বললাম, অবশ্যই বিশ্বাস করি। সুতরাং আপনাকেও দাম দিতে হবে, মনে মনে প্রস্তুত হোন। আমি বললাম, একটু বুঝিয়ে বলুন, আমি এমন কি মূল্যবান বস্তু পেতে যাচ্ছি, যার জন্য দাম দিতে আগেভাগে প্রস্তুত হতে হবে। ডঃ মাইতি বললেন, ওই যে বললাম, আপনারা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছেন। আমি জবাব দিলাম, আমরা কি দাম দেইনি? তিনি বললেন, আপনার দেশের মানুষ দাম দিয়েছে, আপনি এখনো কোনো দাম দেননি। শুধু কোলকাতা এসেছেন। আপনার কোনো পার্সোনাল কন্ট্রিবিউশনের কোটা শূণ্য। এইবার ঈশ্বর আপনাকে সে লজ্জা, সে অপমান থেকে উদ্ধার করতে যাচ্ছেন।

ডঃ মাইতির কথায় আমি চমকে উঠলাম। না না ডঃ মাইতি অমন করে বলবেন । আপনি অনুগ্রহ করে তায়েবা কেমন আছে সেটা বলুন। অতো উতলা হচ্ছেন কেন? আপনাকে তায়েবার কথা বলার জন্যই তো ডেকে এনেছি। একটু আগে ওয়ার্ডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেই ব্রিদিং ট্রাবলটা এখন অনেক কন্ট্রোলড কিন্তু এটা স্থায়ী হবে না। এ্যাট এ্যনি মোমেন্ট শি ক্যান গেট ব্যাক টু হার প্রিভিয়াস পজিশন। ইউ আর এ সিরিয়াস পার্সন এ্যৎ আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ সিরিয়াসলি । বাট উই প্রে টু লর্ড সো দ্যাট হি গ্রান্টস হার লংজিবিটি টিল দ্যা ফ্রিডম অব বাংলাদেশ ইজ এ্যাচিবড। ডঃ মাইতি উঠে দাঁড়ালেন। আপনাকে চা দিতে বলি। আমি কাপড় ছাড়ি। আমি বললাম, ডঃ মাইতি এখন চায়ের ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি যাই। অলরাইট আসুন, কিন্তু তিনি সাবধান করে দিলেন, বাট ইউ শুড নট ভিজিট হার টু ফ্রিকোয়েন্টলি। আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খুব ইমোশনাল। শি নীডস কমপ্লিট রেস্ট এ্যণ্ড ফুল ট্রাঙ্কুয়িলিটি। সো টেক কেয়ার। এট দিজ স্টেজ ইউ আর এ লায়াবলিটি টু হার।

ডঃ মাইতির কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে, আসার সময় আমি এরই মধ্যে নিজে কতোটুকু বদলে যাচ্ছি সে কথা চিন্তা করে দেখলাম। তার মুখে তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে সে সংবাদটি শুনেছি। এতো বড়ো একটা দুসংবাদ শোনার পরও আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছি। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু সামাল দিতে পারছি। আমার মানসিক ধৈর্য দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই যুদ্ধ তলায় তলায় আমাকে কতোটুকু বদলে দিয়েছে। সেই নিভৃত পথটুকু অতিক্রম করার সময় আমার চেতনায় ঘন্টা ধ্বনির মতো বাজতে থাকলো, তায়েবার মৃত্যদণ্ড তো ঘোষণা হয়ে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত ঘটনাটি কখন ঘটবে সেই তারিখটা জানায়নি। আমার মন বললো, ওয়েল ইট ক্যান হ্যাপেন এ্যট এ্যনি মোমেন্ট। নিশীথে পাওয়া মানুষের মতো আমি সেই নির্জন পারিবারিক রাস্তাটুকু অতিক্রম করে কখন বড়ো রাস্তায় এসে পড়েছি খেয়াল করতে পারিনি। আমার পেছনে হঠাৎ ঘটাং করে একখানা গাড়ি ব্রেক করলো। ট্যাক্সি থেকে শিখ ড্রাইভার নেমে এসে দু’টি সবল লোমশ হাতে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে বলতে গেলে একেবারে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে দিলো। তারপর গালাগালি দিতে থাকলো, শালে লোক মরনেকা আওর কুয়ি মওকা নেহি মিলা। আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। বড়ো বড়ো চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সর্দারজি তার হাতের একটা প্রবল থাবা আমার কাঁধে বসিয়ে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমার চেতনা হলো, আমি এই গাড়ির তলায় চাপা পড়তে যাচ্ছিলাম। সর্দারজির কৃপায় এযাত্রা বেঁচে গেছি। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এড়িয়ে আসার পরও আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারলাম না।

আমি রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে থাকলাম, এখন আমার কি করা উচিত। এই অবস্থায় আমি কি করবো, কোথায় যেতে পারি। সমস্ত ভাবনা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। সমস্ত চেতনায় ঘন্টারোলে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। আজ তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু কখন কার্যকর হবে তারিখটি আমি জানিনে। একজন মহিলা এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আধো আধো অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারলাম না কে হতে পারে। গলার আওয়াজ শুনে বুঝলাম অর্চনা। তাকে কোনো জবাব দেবার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, অর্চনা এখানে কেনো? সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো এবং বললো, দানিয়েল, তোমার হয়েছে কি? একটু আগে তুমি গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। আর তায়েবাদির এখানেও তুমি তিনদিন আসোনি। তোমাকে এমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে কেনো? আমি স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, অর্চনা, তায়েবার মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে, আমরা কোনদিন কার্যকর হবে তারিখটি জানিনে। কি সব অলক্ষুণে কথা বলছো? তোমার মাথার কোনো ঠিক নেই। আমি বললাম, জানো অর্চনা, আমাকে ডঃ মাইতি বাড়িতে ডেকে নিয়ে সব বলেছেন। কি বলেছেন? বলেছেন কোনো আশা নেই। এখন শুধু খাঁচা ছেড়ে পাখির উড়াল দেয়া বাকি। অর্চনা বললো, দানিয়েল, এই সময়ে তোমার মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুবই প্রয়োজন। তায়েবাদির মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার তো ভয় হচ্ছে মহিলা কেমন জানি হয়ে গেছেন। যেখানে বসেন বসে থাকেন, ওঠার কথা ভুলে যান। কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। এই তিনদিন জল ছাড়া কিছুই মুখে দেননি। আমি জিগ্‌গেস করলাম, এসব তুমি জানলে কেমন করে? দানিয়েল, তুমি বোকার মতো কথা বলছে। এই তিনদিন আমি দু’বেলা তায়েবাদিকে দেখতে এসেছি। যখন বাড়াবাড়িটা শুরু হলো সকলে তো ভয়েই অস্থির। ভাগ্যিস মনীষদা কোলকাতায় ছিলেন। পিজি-র ডিরেক্টর। তিনি দাদার বন্ধু এবং এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। তাকে ধরে কোনো রকমে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাবার সুযোগটা পাওয়া গিয়েছিলো। আপাততঃ তায়েবাদি বিপদমুক্ত। কিন্তু এটা স্থায়ী কিছু না। লুকোছাপা করে তো লাভ নেই। ক্যান্সারের রোগীর শেষ পরিণতি তোমারও তো অজানা থাকার কথা নয়। আরেকটা দরকারি কথা বলি মনে রাখবে। সবাইকে বলতে শুনলাম, তোমাকে দেখলে তায়েবাদি ভয়ঙ্কর আপসেট হয়ে পড়েন। সুতরাং তুমি হুট করে কেবিনে ঢুকে পড়ার আগে একটু খোঁজ খবর নিয়ো।

অর্চনার কথা শুনে হাজার দুঃখের মধ্যেও আমার কৌতুকবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। আমি যে ভাবতে চেষ্টা করেছিলাম, তায়েবার এই মৃত্যুর জন্য আমি একাই দায়ী। সকলে এই কথাটি বুঝে গিয়ে আমাকে সঠিক শনাক্ত করে ফেলেছে। আমি হো হো করে হেসে উঠতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। অর্চনা বললো, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমি বললাম, পাগল হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। আর রাখো তোমার যত্তোসব…। আমি বললাম, অর্চনা এটা একটা চমৎকার নাটক, আমরা সকলে মিলে ঘটিয়ে তুলেছি। এখন শেষ অঙ্কে কি ঘটে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত আগ্রহে সকলে প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু আমি তোমাকে একটা সহজ কথা জিগগেস করবো। জবাব দেবে? বলো তোমার সহজ কথাটা, যদি জানা থাকে জবাব দেবো। আমি বললাম, আমি দেখতে পাচ্ছি এই নাটকে তুমিও একটা চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি করে সম্ভব হলো আমাকে বুঝিয়ে বলবে? দানিয়েল, আসলে তুমি একটা সিনিক। সব ব্যাপারে ঠাট্টা করার স্বভাবটি তোমার মজ্জাগত। ঠিক বলেছো অর্চনা, ওই সিনিসিজমটা এখনো আমার মধ্যে আছে বলেই হাঁটাচলা করতে পারছি। কিন্তু সেটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তখন অর্চনা বললো, তুমি সত্যি একটা অদ্ভুত মানুষ। তবু তোমার একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি আছে, সেকথা আমি অস্বীকার করবো না। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কের একটি ইন্টারেস্টিং দিক আছে। সেটাই আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছিলো গোড়ার দিকে। তুমি যখন কোনো কিছু গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকো, কখন জানো না নিজেই সে জিনিসটির অংশ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা অল্প বিস্তর আমার ক্ষেত্রেও ঘটে যাচ্ছে। এমনিতে আমি রোগী টোগী দেখতে পারিনে। কিন্তু তায়েবাদির মধ্যে আমি অন্যরকম একটা কিছু দেখেছিলাম, যা সচরাচর দেখা যায় না। সেটাই আমাকে টেনেছিলো। তুমি যাই। বলো দানিয়েল, তায়েবাদি একটা অসাধারণ মেয়ে। এমন আশ্চর্য হৃদয়ের মহিলা জীবনে আর একটিও দেখিনি। তায়েবাদিকে দেখলে ভালোবাসতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়। আমি বললাম, অর্চনা সেসব কথা থাকুক। আমি এসব আর সহ্য করতে পারছিনে, তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে? সে এক মুহূর্ত কি চিন্তা করলো। তারপর ঘড়ি দেখলো। তুমি একথা বলে খুবই ভালো করেছে। আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে মহানগর নারী সংঘ রবীন্দ্রসদনে তোমাদের ঢাকার বীরাঙ্গনা শহীদ রওশন আরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রওশনআরা রজনী উদযাপন করছে। আমার মেজদি মহানগর নারী সংঘের একজন নেত্রী। তিনি আমাকে দু’খানা টিকেট দিয়েছিলেন। সেগুলো ব্যাগের মধ্যেই পড়ে আছে। এখন মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই সাড়ে দশটা পর্যন্ত চলবে। চলো ওইতো রবীন্দ্রসদন। বড়োজোর পাঁচ মিনিট। আমি ক্লান্ত ছিলাম, কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। অর্চনার পেছন পেছন রবীন্দ্রসদনে এসে হাজির হলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে দশ পনেরো মিনিটি আগে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের (নামটা মনে আসছে না) উদ্বোধনী ভাষণটি শোনা হয়নি। আমরা যখন প্রবেশ করলাম রওশন আরা স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কোলকাতার একজন গুণী শিল্পী একটি গান পরিবেশন করছিলেন। গানের কথাগুলো ভারী সুন্দর। ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে গাইছিলেন।

শহীদ লক্ষ ভাই ভগিনী শহীদ রোশেনারা
তোমরা তো সব প্রাণের আগুন চোখের ধ্রুবতারা
রোশেনারা বোনটি আমার কোন্ গাঁয়ে যে ছিলো তোমার ঘর
সেথায় কি আজ বুটের তলে আকাশ বাতাস রৌদ্রজলে
ধু ধু করে পদ্মা নদীর চর।

শিল্পীর কণ্ঠে গানটি যেই শেষ হলো, এই বীরাঙ্গনা তরুণীর স্মৃতির প্রতি অপার সমবেদনায় উপস্থিত দর্শকদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। এই কল্পকন্যাটির প্রতি মমতায় আমার মনটাও মেদুর হয়ে উঠলো। গানের পর কোলকাতার সবচেয়ে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার বিখ্যাত কবি এবং সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর সুললিত ছন্দে লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা আবৃতি করলেন। তারপরে একজন মাঝ বয়েসী মহিলা মঞ্চে এলেন। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে রওশন আরা সম্পর্কিত এ পর্যন্ত যে সব সংবাদ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, তার একটা লিখিত বিবরণ পাঠ করলেন। রওশন আরার বাড়ি রাজশাহী জেলার নাটোর। তার বাবা পেশায় একজন পুলিশ অফিসার এবং সম্পর্কে সে ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মীয়া। পড়াশোনা করতে ঢাকার ইডেন কলেজে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পঁচিশে মার্চ তারিখে ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো, সে তখন নাটোরেই ছিলো। তারপর উত্তর বঙ্গে যখন প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়, রওশন আরা একক প্রচেষ্টায় একটি মহিলা ব্রিগেড গঠন করে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি কাজ করতে থাকে। এক রাতে ঘর্ঘর বিকট আওয়াজ শুনে রওশন আরার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তার গুপ্ত আস্তানার মহিলা কর্মীদের জাগিয়ে তোলে। সর্বনাশ, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। এখন যদি কোনো রকম বাধা না দেয়া যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রতিরোধ সংগ্রাম তছনছ হয়ে যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা একজন মুক্তিসেনাকেও জীবিত থাকতে দেবে না। ট্যাঙ্কের গতি কিভাবে রোধ করা যায়। মহিলা ব্রিগেডের কর্মীরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। তারপর রওশন আরা এগিয়ে এসে সাথী মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললো, পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের গতি কি করে থামিয়ে দিতে হয়, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। মাথার ওড়নাটা খুলে নিয়ে ভালো করে বুকের সঙ্গে তিনটা মাইন শক্ত করে বেঁধে নিলো। সাথী মহিলারা অবাকদৃষ্টিতে রওশন আরার কার্যকলাপ দেখতে থাকে। কারো মুখে একটিও শব্দ নেই। প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলে, তার প্রাণের বান্ধবি শিরিনকে জড়িয়ে ধরে বললো, শিরিন আমার মাকে বলিস। মুহূর্তের জন্য তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিলো। পরক্ষণেই সামনে গিয়ে এক মিনিট চুপ করে কি যেনো ভেবেছিলো। তারপর প্রাণপণ চিঙ্কারে জয়বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে সারা শরীর ট্যাঙ্কের তলায় ছুঁড়ে দিয়েছিলো।

এটুকু পর্যন্ত পাঠ করার পর হলের মধ্যে আহা উঁহু আফশোস ধ্বনি শোনা যেতে থাকলো। কোনো কোনো মহিলা উচ্চৈস্বরে রোদন করে উঠলেন। শোকের মাতম থিতিয়ে আসতে কমসেকম পাঁচ মিনিট সময় লেগে গেলো। যিনি পাঠ করছিলেন, ধৈর্য ধরে সে সময়টুকু অপেক্ষা করলেন। ধীরে ধীরে হল শান্ত হয়ে এলে মহিলা জানালেন, সে রাত্রে রওশন আরা একটি ট্যাঙ্ক পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিলো। ট্যাঙ্কে যে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য ছিলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তাদের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেদন পাঠিকা ভদ্রমহিলা একেবারে শেষ পর্যায়ে জানালেন, রওশন আরার ছিন্নবিছিন্ন শালোয়ার কামিজের রক্তরঞ্জিত অংশগুলো উদ্ধার করে মহিলা ব্রিগ্রেড তাদের পতাকা বানিয়েছে। বিদায় নেয়ার আগে মহিলা ডান হাতের মুঠি উর্ধে তুলে উচ্চারণ করলেন, জয়বাংলা। সমবেত শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে জয়বাংলা, জয়বাংলা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো।

তারপর এলেন আরেক মহিলা। তিনি এপর্যন্ত ভারতবর্ষের নারী সমাজ রওশন আরার আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে কি কি কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, তার একটা আনুষ্ঠানিক বিবরণ দাখিল করলেন। দিল্লীতে শ্রীমতি অরুণা আসফ আলির নেতৃত্বে একটি রওশন আরা ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। তাঁরা পায়ে হেঁটে আগ্রা অবধি মার্চ করে গেছেন এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা সগ্রহ করেছেন। পাটনায় রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীরা নিজের হাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আড়াই হাজার উলের সুয়েটার বুনে দিয়েছে। এইভাবে এলাহবাদ, বেনারস, জলন্ধর, অমৃতসর, মাদ্রাজ, দিল্লী রওশন আরা ব্রিগেডের কর্মীদের বিস্তারিত কর্মসূচীর বর্ণনা দিলেন। খোদ কোলকাতা শহরে রওশন আরার নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বুঝলাম, রওশন আরা নামটি সমগ্র ভারতে, বিশেষ করে ভারতীয় নারী সমাজে উদ্দীপনার একটি শিখা হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছে। যে মেয়ে নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিয়ে দুনিয়ার নারী সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তার নামে কিছু করতে পারাটা নারী জন্মের এক বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার, একথা কে অস্বীকার করবে।

তারপর যখন ঘোষিকা জানালেন, এখন কোলকাতার একটি নামকরা নাট্য প্রতিষ্ঠান রওশন আরার আত্মদানের ঘটনাটি অবলম্বনে রচিত একটি একাঙ্কিকা পরিবেশন করবে। আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেলো। আমি পাশে বসা অর্চনাকে কানে কানে জানালাম, আমাকে এবার যেতে হবে। অর্চনা বললো, চলে যাবে? আমি বললাম, ভীষণ খারাপ লাগছে। সে বললো, যাও, আমি মেজদির সঙ্গে যাবো।

যখন রবীন্দ্রসদন থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রায় দশটা বেজে গেছে। ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও একা একা হাঁটতে থাকলাম। সমগ্র ভারতে রওশন আরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রাম থেকে এই রকম রওশন আরার মতো বীর কন্যা যদি সত্যি সত্যি জন্ম নিতো, তাহলে আমাদের সংগ্রামের অবস্থা কি দাঁড়াতো মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম। আমার বন্ধু আগরতলার অধ্যাপক বিজন চৌধুরীর ছোটো ভাই বিকচ চৌধুরীর তেজোদ্দীপ্ত চেহারাটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বিকচের প্রকাণ্ড কল্পনা করার ক্ষমতা সঠিক খাতে প্রবাহিত হলেও উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলে কি অঘটনই না ঘটিয়ে তুলতে পারতো। আগরতলা এম বি. বি কলেজের গ্রাজুয়েট বিকচ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ভৌমিক চৌধুরীর জেন্টস পকেট রুমালের মতো দৈনিক পত্রিকাটিতে উর্বরা কল্পনা শক্তি প্রসুত নতুন নতুন কল্পকাহিনীর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এখনো।

আমার এখনো সে সন্ধ্যাটির কথা মনে আছে। সারাদিন খুব বিষ্টি ছিলো। বিকচ প্রতিদিন সীমান্তে যেয়ে এটা সেটা সংবাদ এনে পেছনের চারটি কলাম ভরাট করতো। বিকচের মতো মানুষেরও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য আগরতলা সীমান্তে যেতে হতো। এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ বিকচ নিউজপ্রিন্টের প্যাড নিয়ে বসলেই গানবোট ডুবতো, কনভয়ের পর কনভয় সৈন্য ধ্বংস হয়ে যেতো; ট্রেন লাইন উড়ে যেতো। তথাপি বিকচ সাইকেলটাতে প্যাডেল ঘুরিয়ে সীমান্ত অবধি যেতো। কারণ প্রতিদিন যেতে যেতে ওটা তার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিলো। বিকচ তার ছোট্টো পত্রিকার পাতায় এতো সৈন্য মেরেছে, এতো ট্যাঙ্ক ছারখার করেছে, এতে কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার বন্দী করেছে, আগরতলার মানুষ তার মারণ ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পাকিস্তানী সৈন্যদের যম টাইটেল দিয়েছে। এপ্রিলের শেষের বিষ্টিমুখর দিনটিতে, আধভেজা অবস্থায় অফিসে এসে দেয়ালে সাইকেলটি ঠেকিয়েই ঘোষণা দিয়ে বললো, এ বিষ্টিতে কোথাও যেতে টেতে পারবো না। ধ্যাননেত্রে আগে একটু দেখে নেই। বাংলাদেশে আবার নতুন কি ঘটলো। হাতের সিগারেটটি আমাকে দিয়ে বললো, ততোক্ষণে তুমি এটা টানতে থাকো। আমি একটু চোখ বুঝে দেখি সত্যি সত্যি কয়েক মিনিট চোখ বুজে রইলো। চোখ খুলে আমাকে জিগ্‌গেস করলো, সিগারেট কি সত্যি সত্যি শেষ করে ফেলেছে। আমি বললাম, তুমি সবটা পুড়িয়েই আমাকে দিয়েছিলে, একটান দিতেই সব শেষ। যাও দিপুকে দিয়ে মনার দোকান থেকে আমার নাম করে পাঁচটা চারমিনার আনতে বলো। সিগারেট এলে একটাতে অগ্নি সংযোগ করে লম্বা লম্বা কটা টান মেরে নিউজপ্রিন্টের প্যাডে পুরো খবরটা সে রচনা করেছিলো। বয়ান এ রকম : ফুলজান নামের এক যুবতী বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানী সৈন্যের একটা আস্ত ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে বললো, দেখতে খবরটা কেমন হয়েছে। আমি বললাম, দ্যা আইডিয়া ইজ এ্যাণ্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরকম একটা বীরকন্যা জন্মাতে পারলে খুব ভালো হয়। বিকচ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, আমরা যদি না লিখি তাহলে জন্মাবে কেমন করে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। সে বাঁ চোখটা টিপে একটু হেসেছিলো। আমি বললাম, এ ক্ষেত্রে একটা সেকেণ্ড থট দিতে হবে।

যে কোনো সংবাদ কি, কেনো, কোথায়, কখন, কিভাবে এই এতোগুলো কেনোর জবাব দিতে না পারলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তোমার গল্প সেই শর্তগুলো পূরণ করেনি। ধরো নাম নির্বাচনের বিষয়টি, তুমি বলেছো ফুলজান। এই নামটি একেবারেই চলতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের নাম সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। তাই ফুলজান শব্দটি তোমার কলমের মুখে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ফুলজান যাদের নাম, তারা বড়োজোর হাঁড়ি পাতিল ঘষে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতি দিতে পারে না। সুতরাং একটা যুৎসই নাম দাও, যাতে শুনলে মানুষের মনে একটা সম্ভ্রমের ভাব জাগবে। রওশন আরা নামটি মন্দ কি। বঙ্কিম এই নামটি বেছে নিয়েছিলেন। নামের তো একটি মাহাত্ম আছেই। রওশান আরা নাম যে মেয়ের, সে যেমন হৃদয়াবেগের আহবানে সাড়া দিয়ে জয়সিংদের ভালোবাসতে পারে; তেমনি দেশ জননীর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্যাঙ্কের তলায় আত্মাহুতিও দিতে পারে। নামটা মনে ধরেছিলো বিকচের। তারপর গল্পের নিয়মেই বাকি ব্যাপারগুলো বেরিয়ে এসেছিলো। তার বাড়ি নাটোর। তার বাবা পুলিশ অফিসার। সে ইডেনে পড়তো এবং শেখ মুজিবের আত্মীয়া ইত্যাদি। বিকচ যদি রওশন আরার বাবার মর্যাদা পায়, আমাকে কাকা টাকা কিছু একটা বলতেই হবে। সংবাদটি সামনের পাতায় বক্স করে ছাপা হয়েছিলো। আগরতলার মানুষ এটাকেও আরেকটা বিকীয় উদ্ভাবন ধরে নিয়েছিলেন। কেউ হ্যাঁচ্ছোটিও করেননি।

মাসখানেক বাদে আমি যখন কোলকাতায় এলাম অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই কোলকাতা শহরের বিকচের কল্পকন্যাটির নব জন্ম ঘটে গেছে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বাবুর কল্যাণে রওশন আরার পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রওশন আরার আত্মীয়স্বজনরা রেডিওতে সাজানো সাক্ষাতকার দিতে আরম্ভ করেছেন।

তারপর থেকে ভারতের পত্র পত্রিকাসমূহ রওশন আরাকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। আনন্দ বাজার যদি হেডলাইন করে, যুগান্তর ছাপাচ্ছে জীবনবৃত্তান্ত। অমৃত বাজার উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করছে। মিতভাষী বলে স্টেটসম্যানের সুনাম আছে।

এই সম্ভ্রান্ত সংবাদপত্রটি সম্পাদকীয় কলামে রওশন আরার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন। করেছিলো। পত্র পত্রিকার প্রচার একটু থিতিয়ে এলেই রওশন আরাকে নিয়ে কবিমশায়রা কবিতা লিখতে এলেন। শিল্পীরা গান গাইতে থাকলেন। নাট্যদল নাটক করতে এগিয়ে এলেন। প্রথম প্রথম ওসব দেখে আমার ভীষণ মজা লাগতো। যুদ্ধের প্রথম বলিইতো সত্য। কিন্তু আমি বা বিকচ ইচ্ছে করলেই রওশন আরাকে আবার নিরস্তিত্ব করতে পারিনে। আমরা যদি হলপ করেও বলি, না ঘটনাটি সত্য নয় রওশন আরা বলতে কেউ নেই। সবটাই আমাদের কল্পনা। লোকজন আমাদের পাকিস্তানী স্পাই আখ্যা দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য ছুটে আসবে। এই সময়ের মধ্যে রওশন আরার ভীষণ বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। সিপিআই যদি করে রওশন আরা দিবস, কংগ্রেস পালন করছে রওশন আরা রজনী। আমাদের কি ক্ষমতা রওশন আরার অস্তিত্ব ধ্বংস করি।

আজকে ওই রওশন আরার ওপর অনুষ্ঠানটি দেখার পর আমার মনে একটা চোট লাগলো। তায়েবা ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় আসাদ হত্যার দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পত্রপত্রিকায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলো। সবগুলো কাগজে পুরো পৃষ্ঠা ছবি ছাপা হয়েছিলো। আজ সে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে নিঃশব্দে মৃত্যুর প্রহর গুণছে, আর অলীক রওশন আরার ভাবমূর্তি ভারতীয় জনমনের অক্ষয় আসন দখল করে আছে। হায়রে তায়েবা তোমার জন্য অশ্রু। হায়রে বাংলাদেশ তোমার জন্য বেদনা। কেনো এরকম ভাবলাম বলতে পারবো না। হয়তো ভাবলাম, এ কারণে যে যার অস্তিত্ব কস্মিনকালেও ছিলো না, সেই রওশন আরার ভাবমূর্তি আকাশপ্রমাণ উঁচু হয়ে উঠেছে। আর তায়েবা এক সময়ে যে বাংলাদেশে সংগ্রামের উষ্ণ নিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলো, আজ কোলকাতার হাসপাতালে সকলের অগোচরে মারা যাচ্ছে।

.

১৪.

তায়েবার কথা প্রায় শেষ। একটি নারী দিনে দিনে নীরবে নিভৃতে কোলকাতার পিজি হাসপাতালে একটি কেবিনে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরা জানতাম সে মারা যাবেই। মারা যাবার জন্যই সে কোলকাতা এসেছে। যুদ্ধ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী, আর তায়েবাকে এখানে রেখে যেতে হবে। তায়েবা অত্যন্ত শান্তভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলো। স্বাভাবিক মানুষ যেমন করে জীবনের কর্তব্যগুলো পালন করার জন্য নিতান্ত সহজভাবে সংকল্প গ্রহণ করে, সেও তেমন আসন্ন মৃত্যুর কাছে মন প্রাণ সবকিছু সমর্পন করে প্রতীক্ষা করছিলো।

তায়েবার প্রাক মৃত্যুকালীন আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ একজন ক্যান্সার রোগীকে শেষ মুহূর্তে যে ধরনের চিকিৎসা করা হয়, ডাক্তারেরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁরা তায়েবাকে একজন সাধারণ রোগীর চাইতে অধিক ভালোবাসতেন। তাই সকলে মিলে চেষ্টা করছিলেন, তার কষ্টটা যেনো কম হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা হাজার চেষ্টা করেও তায়েবার কষ্ট কমাতে পারেনি। মৃত্যুর তিনদিন আগেই তাকে শুনতে হয়েছে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চাচার বাড়িতেই তার মা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে আছেন। উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। যে বাড়ির মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে যৌবন ছিনে প্রাণপণ প্রয়াসে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আজ প্রায় দুযুগেরও বেশি পরে সেই একই বাড়িতে তিনি একখণ্ড জড় পদার্থের মতো পড়ে আছেন।

ডিসেম্বরের চার তারিখ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওই দিন সন্ধ্যে থেকে সকাল পর্যন্ত গোটা কোলকাতা শহরে বিমান হামলার ভয়ে কোনো আলো জ্বলেনি। সেই ব্ল্যাক আউটের রাতে তায়েবার কাছে কোনো ডাক্তার আসতে পারেনি। কোনো আত্মীয়স্বজন পাশে ছিলো না। ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের কারণে যে অন্ধকার কোলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই অন্ধকারের মধ্যে তায়েবা আত্মবিসর্জন করলো।

#

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *