০৯-১০. আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ

সেদিনটি ছিলো আগস্ট মাসের চৌদ্দ তারিখ। চারদিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালনের তোড়জোর চলছে। সকাল বেলা ঢাকা রেডিও ধরেছিলাম। গোটা বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর শুনলাম। জঙ্গীলাট পাকিস্তানের দু’অংশের ঐক্য কেয়ামতের দিন পর্যন্ত অটুট থাকবে, এ ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করে ঘোষণা করছেন, কোনো দুশমন পাকিস্তানের এক ইঞ্চি মাটি একজন পাকিস্তানী বেঁচে থাকতেও দখল করতে পারবে না। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ শব্দটি উচ্চারণ করে ইয়াহিয়া খান তার উর্দু বক্তৃতা শেষ করলেন। পর পর ইংরেজি এবং বাংলায় তাঁর বক্তৃতা অনুবাদ করে শোনানো হলো। ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতার পরে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের একজন অধ্যাপক পাকিস্তানকে সমর্থন করে এমন জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, শুনে আমার শিরার সমস্ত রক্ত চট করে মাথায় এসে জমা হলো। এই ভদ্রলোকটির কাছ থেকে আমরা দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। হয়তো অধ্যাপক শখ করে পাকিস্তানকে সমর্থন করার জন্য রেডিওতে বক্তৃতা দিতে আসেননি। সৈন্যরা বন্দুক দেখিয়ে বাড়ি থেকে টেনে বের করে রেডিওর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবু আমার ভীষণ খারাপ লাগতে আরম্ভ করলো। আগস্ট মাসের এই সকালটি অত্যন্ত সুন্দর। শিশুসূর্যের প্রাণপূর্ণ উত্তাপে প্রাসাদ নগরী কোলকাতা যেনো ভেতর থেকে জেগে উঠেছিলো। মনটা অকারণে খুশিতে ছেয়ে গিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের সে গানটির কলি মনের ভেতর আসা যাওয়া করছিলো। “আজি প্রভাত স্বপনে শরত তপনে, কি জানি পরান কিযে চায় গো, শেফালীর শাখে কি বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কি যে গায় গো”। ঢাকা রেডিও শুনে সব কিছু অশ্লীল মনে হতে লাগলো। বন্ধ করে দিলাম। এই কান্তিমান দিনের সমস্ত আলো, উত্তাপ প্রতিশ্রুতি আমার কাছে একেবারে অর্থহীন হয়ে দাঁড়ালো। আজ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। আগামীকাল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আর আমরাও একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আকাশে বাতাসে সর্বত্র শাড়ির আঁচলের মতো স্বাধীনতা যেনো দুলে দুলে খেলা করছে। হায়রে স্বাধীনতা!

আমার মনে কৃষ্ণবর্ণ পুষ্পের মতো একটা বিশ্রী অনুভূতি জন্ম নিয়েছিলো, বিষয়টা আরো বেড়ে গেলো। ঘরের বন্ধুদের কারো কাছে এ অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারিনে। এমন কি নরেশদাকেও না। কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না। কণ্ঠনালী দিয়ে একটার পর একটা তেতো ঢেকুর উঠে আসতে চাইছিলো। সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি। রুমে একটা তুমুল বিতর্ক চলছে। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের ব্যাপারে সিরিয়ািস কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রীমতি গান্ধী যা ইচ্ছে করুন। আমি প্যান্ট শার্ট পরে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু গেটের কাছে এসে চিন্তা করলাম, কোথায় যাওয়া যায়। সত্যি সত্যি কোলকাতা শহরে যাওয়ার মতো জায়গা খুবই অল্প আছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো এ্যান্টনী বাগান লেনে মজহারুল ইসলামের বাড়িতে গেলে মন্দ হয় না! সকালের নাস্তাটাও ওখানে খেয়ে নেয়া যাবে। আর ইসলামের কাজকর্মের একটু ফাঁক থাকলে তাকে নিয়ে অর্চনার ফ্রান্স থেকে আগত দাদার কাছে গিয়ে আলাপ করা যাবে।

আমি যখন এ্যান্টনী বাগান এসে পৌঁছলাম, ইসলামেরা সবেমাত্র নাস্তার টেবিলের চারপাশে এসে বসেছেন। এখনো কেউ খেতে আরম্ভ করেননি। আমাদের দেখে ইসলাম হাসতে হাসতে বললেন, আরে মশায় আপনার উৎপাতে দেখছি সকাল বেলাটাও নিরাপদে কাটানো যাবে না। বলেন কোন্ মহাপ্রয়োজনে এই সকাল বেলা বাড়িতে এসেছেন। আমি বললাম, কাজ না থাকলে কি আর আসি। আপনারা বাংলাদেশের মানুষেরা বেশ আছেন, গোটা কোলকাতা শহরে একেকজন ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একেক মহাপুরুষের সুকীর্তির কাহিনী শুনতে শুনতে কানে পঁচন ধরে গেছে। আপনারা তো ইন্দিরা সরকারের অতিথি হিসেবে দিব্যি আছেন। এদিকে ইন্দিরাজী আমাদের কোন্ হাল করেছেন, সেটার কি খোঁজখবর রাখেন? গতোকাল এই পাড়ায় আমাদের পার্টির যতো কর্মী ছিলো সবাইকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। আমি বাসায় ছিলাম না। তাই আপনার সঙ্গে দেখা হলো। মজহারুল ইসলাম সিপিআইএম-এর ডেডিকেটেড ওয়ার্কার। এখন পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকরের কংগ্রেস সরকারের সমস্ত রোষ সিপিআইএম-এর বিরুদ্ধে। কেনোনা জ্যোতিবসু এবং প্রমোদ দাস গুপ্তের নেতৃত্বাধীন সিপিআইএম-ই হলো কংগ্রেসের পয়লা নম্বরের দুশমন। প্রতিদিন কর্মীদের দলে দলে গ্রেফতার করছে। কেউ নিজের বাড়িতে থাকতে পারছে না। মজবুত ঘাঁটিগুলো একে একে কংগ্রেসের হাতে গিয়ে পড়ছে। বাইরে থেকে ঠিক বোঝার উপায় নেই। এখনো কংগ্রেস সরকার একটি ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।

মজহার সুযোগ পেলেই আমাদের খোঁচা দিতে ছাড়েন না। তাঁর অভিযোগটির মর্মবস্তু অনেকটা এরকম, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কৌশলে ফঁপিয়ে ফুলিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুটি অস্বাভাবিক বড়ো করে জনমত সেদিকে আকর্ষণ করে রাখতে চাইছেন। আর সে সুযোগটি পুরোপুরি নিয়ে বিরোধী দলের অস্তিত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য অবিরাম হামলা করে চলেছেন। তিনি এবং তাঁর মতো অনেকেই মনে করেন আমরা এখানে এসে শ্রীমতী গান্ধীর হাতে একটি মারাত্মক অস্ত্র তুলে দিয়েছি। তথাপি সিপিআইএম-এর লোকদের আমাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি আছে। নকশাল ছেলেরা তো সরাসরি মনে করে আমরা জনগণের বিপ্লবের জানী দুশমন। আর ভারতীয় গোঁড়া মুসলমানেরা বাংলাদেশের মানুষদের হিন্দুদের খেলার পুতুল ছাড়া কিছু মনে করেন না। সে যাক, আমি মজহারকে বললাম, আপনাকে মশায় আমার সঙ্গে যেতে হবে।

মজহার প্রথমে যেতে চাননি। একাজ সেকাজের অছিলা করে পিছলে যেতে চেষ্টা করছিলো। আমি যখন চাপাচাপি করতে থাকলাম, শেষ পর্যন্ত রাজী না হয়ে উপায় ছিলো না। নাস্তা করার পর দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। আমি ভাবলাম গরিয়াহাটা অবধি বাসে যাবো। কিন্তু মজহার রাজী হলেন না। তিনি বললেন, মশায় এখন ট্রামে যাওয়া চলবে না। গতোরাতে পাড়া থেকে আমাদের পার্টির সমস্ত ওয়ার্কারকে তুলে নিয়ে গেছে। আপনার সাধ হয়েছে আমায় কিছু পয়সা খরচ করাবেন। তা আর কি করা যাবে। অপেক্ষা করুন ট্যাক্সি আসুক।

ট্যাক্সি এলে দু’জনে উঠে বসলাম। ডানদিকে বেরিয়ে শিয়ালদার মোড়ে এসে জানজটের মধ্যে আটকে গেলো ট্যাক্সি। মজহার বললেন, আপনি মশায় মানুষটাই অপয়া… দিন একখান চারমিনার। আর তো কিছু করার উপায় নেই! বসে বসে ধোয়া ছাড়ি। আমি সিগারেট বের করে দিলাম। তিনি দেয়ালে সাঁটা পোষ্টারের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, দেখুন, ইন্দিরা গান্ধীকে কেমন চিতা বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছে না? আমার কিন্তু তেমন মনে হলো না। ইন্দিরা গান্ধীকে ইন্দিরা গান্ধীর মতোই মনে হচ্ছিলো। বোধ হয় চিতা বাঘিনীর ছাপটি মজহারের মনে আছে। তাঁকে তুষ্ট করার জন্য বললাম তা দেখাচ্ছে বটে, আপনাদের পোষ্টার? হ্যাঁ, ছবিটা কে এঁকেছে জানেন? ছবিটা হলো গিয়ে দেব্রত দাশ গুপ্তের। বদিক থেকে তাকিয়ে দেখুন একেবারে অবিকল চিতা বাঘিনী। তাকিয়ে দেখার পর আমারও কেমন চিতা বাঘিনী মনে হলো। এই সময়ে জানজট হালকা হয়ে এলো।

গোলপার্কে এসে ট্যাক্সি থেকে নামলাম দু’জনে। দরজায় বেল টিপতেই অর্চনা নিজে এসে দোর খুলে দিলো। অর্চনা স্নান করেছে, পিঠের ওপর আধভেজা চুলের বোঝ ছড়িয়ে আছে। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। চশমা না পরলে তাকে সত্যি সত্যি সুন্দর দেখা যায়। মজহারকে সামনে ঠেলে দিয়ে বললাম, তোমার প্যারিস ফেরত দাদার সঙ্গে পরিচয় করে দেবার জন্য এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসেছি। মাথা নীচু করে আদাব জানিয়ে জিগগেস করলো, আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? মজহার বললেন, না, আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলায়। তবে দু’পুরুষ ধরে কোলকাতা স্থায়ীভাবে বসবাস করছি এবং কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই।

আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসি। প্রমোদদা ততোক্ষণে এসে পড়বেন। আমি জানতে চাইলাম তিনি কি এখন বাড়িতে নেই? অর্চনা বললেন, খুব সকাল বেলা উঠে তিনি একাকি বেরিয়ে পড়েন। ঘুরে ঘুরে পুরোনো আড্ডার জায়গাগুলো দেখেন। রোদটা তেঁতে উঠলেই চলে আসেন বাসায়। আসার সময় প্রায় হয়ে এলো। চায়ে মুখ দিয়েছি, এমন সময় বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামার শব্দ শোনা গেলো। অর্চনা উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললো, এই বুঝি দাদা এলেন।

লম্বা চাওড়া ফর্সা চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করলেন। দেখতে ঠিক বাঙালি মনে হয় না। এখন বেলা অধিক হয়নি। তবু ভদ্রলোকের শরীর ঘেমে এক রকম ভিজে গেছে। অর্চনা তাড়াতাড়ি একটা তোয়ালে এনে দিলো এবং ফ্যানটা অন করে স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্‌গেস করলো, দাদা আপনার প্রাতকালীন তীর্থদর্শন আর কতোদিন চলবে? সারা জীবন দেখলেও মনে হচ্ছে শেষ হবে না। ভদ্রলোকের অনভ্যস্থ জিহ্বায় বাংলা ভাষাটা ঠিকমতো আসতে চায় না। হঠাৎ করে বয়স্ক মানুষের মুখে শিশুর মতো বাংলা ভাষা শুনলে কানটা আচমকা খুব খুশি হয়ে ওঠে। তিনি বললেন, বিদেশে এ কোলকাতা শহরের অনেক অপবাদ শুনেছি। কোলকাতা নোংরা, ঘিঞ্জি আর দুর্গন্ধময় এসব আর কি। ঘুরে ঘুরে দেখতে কিন্তু আমার বেশ লাগে।

শেয়ালদার মোড়ে নোংরা জঞ্জাল আর আবর্জনার স্তূপ দেখে অর্চনা আমার কি মনে হলো জানিস? যেনো আবার নতুন করে জন্মাচ্ছি। কি জানি দাদা আপনি দার্শনিক মানুষ। আপনার দেখার ধরনটাই আলাদা। আমরা কিন্তু নোংরা আবর্জনাকে আবর্জনাই দেখি। প্রমোদবাবু হেসে উঠলেন হো হো করে। এসবের সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তোকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। আহ্ কতদিন পরে আবার কোলকাতা দেখছি। নিজের মাটি, নিজের মানুষ কি জিনিস যদি বুঝতে চাস তো একটানা কয়েক বছর দেশের বাইরে কাটিয়ে আয়, তারপর বুঝতে পারবি। এ মাটি মানুষ ছেড়ে বিদেশে আপনি তো একটানা দু’যুগেরও অধিক সময় কাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, মাঝে মাঝে আমি নিজেও অবাক হয়ে ভাবি এতোটা সময় কি করে কাটিয়ে দিলাম। কোনো সন্ধ্যেবেলা অথবা রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভাবতাম, আর, ঢের হয়েছে। এবার সব ছেড়ে ছুঁড়ে দেশে ফিরে গিয়ে ছোটো নাগপুরের ওদিকে একটা কুটির তৈরি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আর হলো কৈ? দেশে আসতে চাইলেও আসতে দিচ্ছে কে? আমি ফ্রেঞ্চ সিটিজেন হয়ে গেছি। তাছাড়া তোমার বৌদি আছে, ছেলেমেয়েরা আছে। তারা সকলে ওদেশটার জীবনধারায় অভ্যস্থ। সব কটাকে এখানে নিয়ে এলে ডাঙ্গার মাছের মতো অবস্থা হবে। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানুষের সব সাধ কি পূর্ণ হয়? তবু ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বাংলাদেশের ফ্রিডম ওয়ারটা শুরু হলো। আর নিজেকে আটকে রাখা গেলো না। ছুটে চলে এলাম। অর্চনা বললো, অন্তত একটা সাধ তো আপনার মিটলো। পুরনো দিনের কারো সঙ্গে দেখা হলো? প্রমোদ বাবু বললেন, দেখো, তোকে আসল খবরটাই বলা হয়নি। আমার সঙ্গে গেলো পরশুদিন অনুকূলদার দেখা হয়েছে। তিনি পূর্বের মতো শক্ত সমর্থ আছেন। শুধু মাথার চুলটাতেই একটু পাক ধরেছে। এ ধরনের চিরতরুণ মানুষকে দেখলে ঈর্ষা হয়। এখনো তিনি সমাজের কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা মোল আঠারো বছর বয়সে যেভাবে তার কাছে ঝাঁক বেঁধে যেতাম, তেমনি এখনো তার ঘরে ষোল আঠারো বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। দেখলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। জানিস অর্চনা, অনুকূলদা পুরোনো বিপ্লবীদের জড়ো করে বেঙ্গল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স পার্টি গড়েছেন। তাঁর দলের ছেলেরা কোলকাতা শহরের সব জায়গায় বড়ো বড়ো করে লিখেছে, দু’বাংলার চেক পোস্ট উড়িয়ে দাও-দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। অনুকূলদাদের বিএনভিপি ফান্ডে তিনশো ডলার ডোনেট করলাম।

প্রমোদবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা আপনি এতোদিন বাদে দেশে এসে আবার বিএনভিপি-র পাল্লায় পড়েছেন? ছি, কি কেলেঙ্কারীর কথা। কেনো, বিএনভিপি কি দোষটা করলো? ওরা ভাঙা বাংলাকে আবার জোড়া লাগাতে বলছে। একি চাট্টিখানি কথা। জানো, এই বাংলা বিভাগ সহ্য করতে না পেরে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। অর্চনা বললো, আপনি যেনো একটা কি দাদা। এই বিএনভিপি-র মতো প্রতিক্রিয়াশীল দল গোটা পশ্চিমবাংলায় আর একটিও নেই। আপনি চেনেন না বটে। ওদের আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার এমন চমৎকার ডিপো আর একটাও খুঁজে পাবেন না। আপনি গিয়ে তাদের খপ্পরে পড়লেন? একদিক দিয়ে হিসেব করলে আপনি বিশেষ ভুল করেননি। মানুষের বাচ্চা বয়সে চোট লাগলে বুড়ো বয়সে সেটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে? আপনার কৈশোর এবং যৌবনকাল কেটেছে অনুশীলন দলের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে। মাঝখানে পঁচিশ তিরিশ বছরের মতো বিদেশে কাটিয়েছেন। কিন্তু আপনার মন ওই জায়গাটিতেই এখনো আটকে রয়েছে। মাঝখানের দু’দুটি যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। সমাজের কতো পরিবর্তন ঘটে গেছে, রাজনীতির ধরনধারণ কতো পাল্টে গেছে। আপনার অগ্নি যুগের বিপ্লবীদের স্মৃতি এখন অতীত যুগের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। অর্চনা অধিক কথা না বাড়িয়ে বললো, যাকগে, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আমার এক বাংলাদেশের বন্ধুকে ডেকে এনেছি। ওর নাম দানিয়েল। আপনাকে ঢাকার সমস্ত খবরাখবর বলতে পারবে। প্রমোদবাবু নমস্কারের ভঙ্গিতে জোড়হাত করলেন। তারপর জিগ্‌গেস করলেন, আপনি ঢাকায় থাকেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, উয়ারি চেনেন? বললাম, ঢাকায় থাকি উয়ারি চেনবো না কেন? আচ্ছা আপনি জানেন উয়ারিতে একটা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। আমাকে বলতে হলো, হ্যাঁ, উয়ারিতে একটা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট আছে। ওই র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ছোটোবেলায় আমি থেকেছি। জিগেস করলাম, ওটা কি আপনাদের বাড়ি ছিলো? জবাবে প্রমোদবাবু বললেন, ঠিক আমাদের বাড়ি নয়। আমি জন্মেছি গ্রামে। ঢাকা শহর থেকে বেশি দূরে নয়। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে শুভাড্যায়। র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের বাড়িটি ছিলো আমার দাদামশায় রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন জমিদার। অসাধারণ প্রতাপশালী মানুষ। আপনি কি কখনো রায় বাহাদুর নলিনাক্ষ চৌধুরীর নাম শুনেছেন? আমাকে বলতেই হলো, এরকম কোনো নাম শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি একটুখানি নিরাশ হলেন মনে হলো। তারপর জানতে চাইলেন, আচ্ছা র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটের ৩২ নম্বর বাড়িটি আপনি দেখেছেন? আমি বললাম, র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীটটি চিনি বটে, কিন্তু কোন্ বাড়িটির কথা বলছেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে। প্রয়োদ বাবু বললেন, বাড়িটি দোতলা। সামনে একটা লোহার গেট। গেটের কাছে একটি বেল গাছ। বাড়ির পেছন দিকে একসার নারকেল গাছ। এবার চিনতে পারলেন? এতো বিশদ করে বলার পরও বাড়িটি আমার চেনার বাইরে থেকে গেলো। ভদ্রতার খাতিরে বলতে হলো, আমি থাকি র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট থেকে অনেক দূরে। সে কারণে বাড়িটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে উঠতে পারেনি। ভদ্রলোক একটু দমে গেলেন। পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি ফের জানতে চাইলেন। আপনি কি ফরাশগঞ্জের সত্যানন্দ সিংহের নাম শুনেছেন, এক সময়ে যিনি ঢাকার অনুশীলন সমিতির সর্বেসর্বা ছিলেন। এবারেও আমাকে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলো।

প্রমোদবাবু সিগারেটের ছাই ঝেড়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, আপনি ঢাকায় থাকেন অথচ সত্যানন্দ সিংহের নাম শোনেননি। আমাদের সময়ে সত্যানন্দ সিংহকে সকলে এক ডাকে চিনতো। বৃটিশ সরকার তার মাথার ওপর দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করছেন, অথচ অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম পর্যন্ত জানেন না, এটা কেমন করে হয়। আমি মনে মনে রেগে গেলাম। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম জানার কোনো সম্পর্ক আছে কি? তিনি বললেন, বারে, সম্পর্ক থাকবে না কেনো? সব ব্যাপারে একটা ধারাবাহিকতা থাকা তো প্রয়োজন।

উত্তরে আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। অর্চনা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো। সে প্রমোদবাবুকে জিগ্‌গেস করলো, আচ্ছা দাদা বলুন দেখি, আপনি দেশ ছেড়েছেন কতোদিন। প্রমোদবাবু মাথা চুলকে বললেন, তা হবে সাতাশ আটাশ বছর। অর্চনা ফের জানতে চাইলে অগ্নিযুগের যেসকল বিপ্লবীকে চিনতেন দেশ ছাড়ার সময়ে সকলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিলো? প্রমোদবাবু বললেন, তা ছিলো না- কে কোথায় ছিটকে পড়েছিলেন তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? কেবল অনুকূলদার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলো। আপনি প্রায় তিরিশ বছর পূর্বে যোগাযোগ রাখতে পারেননি। এই বেচারি যদি আপনার চেনাজানা মানুষদের চিনতে না পারে তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? মধ্যিখানে কতো কিছু ঘটে গেলো। দেশ বিভক্ত হলো। জন্ম নিলো হিন্দুস্থান, পাকিস্তান। আবার সেই পাকিস্তানও এখন ভেঙ্গে যেতে লেগেছে। আপনার দশা হয়েছে রিপভ্যান উইঙ্কলের মতো। আপনি যে ঢাকার কথা বলছেন, সে হলো আপনার স্মৃতি এবং স্বপ্নের ঢাকা শহর। এখনকার ঢাকা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শুনেছি রাস্তাগুলো প্রশস্ত চওড়া। লেখাপড়া শিক্ষা সংস্কৃতিতে ঢাকা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। কোনো কোনো দিক দিয়ে কোলকাতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

হঠাৎ প্রমোদবাবু আমার চোখে চোখ রেখে জিগগেস করলেন, আচ্ছা এখনো কি ঢাকা শহরে পঙ্খিরাজ গাড়ি আছে? কথা শুনে আমার হাসি পাওয়ার দশা। বললাম, এখন কি আর পঙ্খিরাজের যুগ আছে? আমার কথায় তিনি বোধ করি খানিকটে আহত হলেন। সে কি আপনারা এমন সুন্দর জিনিসটি উঠিয়ে দিলেন? জবাবে বললাম, কেউ উঠিয়ে দেয়নি, কালের প্রভাবে আপনা আপনিই উঠে গেছে। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের মুক্তিসংগ্রামের সংবাদ বলুন। ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনে প্রায় প্রতিদিনই খবর থাকতো। মনে করেছিলাম, বাংলাদেশে একটি বড়ো ঘটনা ঘটছে? অনেকদিন থেকেই দেশে আসবো আসবো ভাবছিলাম, তবে ইনারশিয়া কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। টিভিতে বাংলাদেশের সংবাদ শুনে শুনে নিজের মধ্যে এমন একটা হ্যাচকা টান অনুভব করছিলাম আর স্থির থাকতে পারলাম না, চলে এলাম।

এরই মধ্যে চা-বিস্কুট এসে গেছে। ভদ্রলোক একটা বিস্কুটের কোণায় কামড় দিয়ে এক চুমুক চা পান করলেন। সেই সময়ে তাঁর দৃষ্টি মজহারুল ইসলাম সাহেবের ওপর পড়লো। লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে আপনার সঙ্গে তো কথাই বলা হয়নি। আপনিও কি বাংলাদেশের। ইসলাম বললেন, না আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। তবে আমরা দু’পুরুষ ধরে কোলকাতায় বসবাস করছি। আপনি কি করেন? ইসলাম বললেন, আমি এখানে কলেজ স্ট্রীটে একখানা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চালাই। আপনার নাম? ইসলাম বললেন, মজহারুল ইসলাম। আপনি মুসলমান? ইসলাম জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মুসলমান। প্রমোদবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। অর্চনা বুদ্ধিমতী মহিলা। কথার খেই ধরে জিগগেস করলো, আপনার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামটি কিন্তু এখনো জানা হয়নি। ইসলাম বললেন, নব জাগৃতি’। কেমন চলছে আপনার ব্যবসা? অর্চনার কৌতূহল মেটাবার জন্য বললেন, বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। আমরা তো মার্কসিস্ট বইপত্র ছেপে থাকি। শ্রীমতী গান্ধীর সরকার বর্তমানে মার্কসিস্ট সবকিছুর ওপর অত্যন্ত খাপ্পা হয়ে আছেন। কোনো কোনো সপ্তাহে দোকান খোলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। আমার তো আবার ডবল রিক্স। নামে মুসলমান, তার ওপর মার্কসীয় বইপত্রের প্রকাশক। অর্চনা সোজা হয়ে বসেছিলো। একটুখানি ঝুঁকে পড়ে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিলো। তার চোখেমুখে সহানুভূতি মিশ্রিত লজ্জার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। আপনি মুসলিম বলে ব্যবসাপত্র করতে অসুবিধে হয় কি? ইসলাম বললেন, সব সময়ে নয়, মাঝে মাঝে বেশ বিপদে পড়তে হয়। এই দেখুন না, আমার দোকানটা ছিলো পুরবী সিনেমার কাছে। গেলো রায়টের সময় গোটা দোকানটাই জ্বালিয়ে দেয়া হয়, একটি পৃষ্ঠাও বাঁচাতে পারিনি। শুনে সহসা অর্চনার মুখে কোনো কথা যোগালো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, এটা ভারী লজ্জা এবং দুঃখের। ভারতের নেতৃবৃন্দ যারা প্রকাশ্য জনসভায় বড়ো বড়ো কথা বলেন, তাঁদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত। ইসলাম বললেন, আমাদের দেশে খারাপ লোকের সংখ্যা নেহায়েতই মুষ্টিমেয়। তারা ক্ষমতাসীনদের সহায়তাতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ খুবই ভালো। এই ভালো মানুষেরা আছে বলেই এখনো পর্যন্ত টিকে আছি। আমি ধরে নিয়েছি, ওটা একটা এ্যাকসিডেন্ট। তাই আমার কোনো রকম নালিশ বা অনুযোগ নেই।

প্রমোদবাবু হাতের পেয়ালাটা নামিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন, অর্চনা, বোধ করি তোর কথা সত্যি। এরই মধ্যে এতোসব পরিবর্তন হয়ে গেছে আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানিনে। আমার মন সে সাতচল্লিশ আটচল্লিশে থিতু হয়ে আছে। এখানে এসে দেখতে পাচ্ছি প্রচণ্ড রকমের ওলোট পালোট হয়ে গেছে। এই উপমহাদেশটি কোন্ দিকে যাচ্ছে? একবার দেশ ভাগ হয়ে হিন্দুস্থান পাকিস্তান হলো। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ যদি সফল হয় পাকিস্তান আরার খণ্ড হবে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে। গোটা ভারত উপমহাদেশে বাংলার স্থান কোথায়? বৃটিশ তাড়ানোর সংগ্রামে বাংলা দিয়েছে সব চাইতে বেশি, পেয়েছে সব চাইতে কম। বাঙালির ভাগ্য কি হবে বলতে পারেন? আমি চুপ করে রইলাম। অর্চনা বললো, দাদা, আমার ক্ষমতা থাকলে রাজনৈতিক কুষ্ঠি তৈরি করতাম। আপাতত যখন সে ক্ষমতা নেই, সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়াই উস্কৃষ্ট কর্ম মনে করি। অতো ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন কি? যা ঘটবার তাতো ঘটবেই। তিনি অর্চনার কথা কানে না নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলেন, আপনাদের শেখ মুজিবুর রহমানটি কেমন মানুষ আমার জানতে খুব ইচ্ছে হয়। মুক্তিযুদ্ধ যদি জয়যুক্ত হয় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জানেন এটা বিরাট ব্যাপার। বাংলার ইতিহাসে আমি যতোদূর জানি, এই ভূখণ্ডে বিক্ষোভ বিদ্রোহের অন্ত নেই। কিন্তু বাঙালি আপন প্রতিভা বলে নিজেদের মেরুদণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করেছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পারে তাহলে একটা অভিনব ব্যাপার হবে। কোলকাতায় খোঁজখবর নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তা থেকে স্থির কোনো ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন মুজিব একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় সোহরাওয়ার্দীর চ্যালা ছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি মহাত্মাজীর মন্ত্রশিষ্য। অহিংস অসহযোগনীতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এই বিরাট গণসংগ্রাম রচনা করেছেন। দু’চারজন কমিউনিস্ট বন্ধুর কাছে জিগগেস করে যা জেনেছি তাতে সংশয়টা আরো বেড়ে গেলো। মুজিব নাকি ঘোরতরো কমিউনিস্ট বিরোধী। মুজিব লোকটা কেমন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কি সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। আমার কাছে সবটা ধোঁয়া ধোয়া ছায়া ছায়া মনে হয়। কিন্তু একটা বিষয় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষটার ভেতর নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। নইলে তাঁর ডাকে এতোগুলো মানুষ বেরিয়ে এলো কেমন করে। আমি টিভিতে মুজিবের অনেকগুলো জনসভার ছবি দেখেছি। দেখার সময় শরীরের পশম সোজা হয়ে গিয়েছিলো। এ রকম মারমুখি মানুষের ঢল আমি কোথাও দেখেছি মনে পড়ে না। মনে মনে কল্পনা করতাম অনুশীলন, যুগান্তর এ সকল বিপ্লবী পার্টির প্রভাবে এই গণসংগ্রাম জন্ম নিয়েছে। এখন বুঝতে পারছি, আমার মধ্যে যথেষ্ট ইনফর্মেশন গ্যাপ ছিলো। ফ্রান্সে আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে। তাঁর ছোটো ভাই ওয়েস্ট বেঙ্গল কংগ্রেসের এক হোমড়াচোমড়া ব্যক্তি। বেলেঘাটার দিকে বাড়ি। গত পরশুদিন তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে এবং পাকিস্তান আর টিকে থাকতে পারছে না। আমি তাঁর সরল বিশ্বাসের কোনো প্রতিবাদ করিনি। রকম সকম দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সামান্য অধিকার আমার আছে, তা দিয়েই বলতে পারি ভারতবর্ষের ব্যাপারে এক জাতিতত্ত্ব এবং দ্বি-জাতিতত্ত্ব কোনোটাই খাটে না। আসলে ভারতবর্ষ বহু জাতি এবং বহু ভাষার একটি মহাদেশ। উনিশশো সাতচল্লিশে ধর্মের প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে অন্য সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিয়েছিলো। আরো একটা কথা, নানা অনগ্রসর পশ্চাৎপদ জাতি এবং অঞ্চলের জনগণ তাদের প্রকৃত দাবি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলো বলেই আপাত সমাধান হিসেবে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্র দু’টির জন্ম হয়েছিলো। পরিস্থিতি যে রকম দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিতে যাচ্ছে। একথা যদি বলি আশা করি অন্যায় হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তারপরে ভারতকে একই সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আঞ্চলিক, জাতিগত, ধর্ম এবং ভাষাগত বিচ্ছিন্নতার দায় মেটাতে গিয়ে ভারতবর্ষের কর্তাব্যক্তিদের হিমসিম খেতে হবে। এমনকি ভারতের ঐক্যও বিপন্ন হতে পারে।

মনে মনে আমি ভীষণ অস্বস্থি বোধ করছিলাম। এই কোলকাতা শহরে ক্ষুধা তৃষ্ণার অধীন আমি একজন বিপন্ন ব্যক্তি মাত্র। আপন অন্তর্গত বেদনার ভারে সর্বক্ষণ কুঁজো হয়ে আছি, আপন হৃদয়ের উত্তাপে সর্বক্ষণ জ্বলছি। কোথাও পালিয়ে গিয়ে দুঃখগুলো নাড়াচাড়া করবো সে রকম কোনো ঠায় নেই। কেউ আমাকে নিছক আমি হিসেবে দেখতে রাজী নয়। যেখানেই যাই ভারত পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এসব এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এ এমন জটাজাল, ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারিনে। হাম কমলি কো ছোড়নে মাংতা, মগর কমলি হামকো নেহি ছোড়। আমি যেখানেই যাই বাংলাদেশের যুদ্ধের কথা ওঠে। বাংলাদেশের কথা উঠলেই চীন, রাশিয়া, বৃটেন, আমেরিকার কথা আপনিই এসে পড়ে। বাংলাদেশের এক কোটির মতো মানুষ ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তার জন্য যেনো আমি দায়ী। চীনা অস্ত্রে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করছে, সেজন্যও আমি ছাড়া দায়ী কে? বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের এই দুঃখের দিনে কোনো রকমের সাড়া দিচ্ছে না, তার জন্যও আমাকে ছাড়া কাকে দায়ী করবো? আমি হলাম গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সমস্যা সঙ্কটের অঙ্কুর। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার যদি জন্ম না হতো।

তায়েবা হাসপাতালে পড়ে আছে। তার সাংঘাতিক ক্যান্সার, ডাক্তার বলছে সে বাঁচবে না। এই বেদনার ভার আমি কি করে হালকা করি। যতোই চেষ্টা করি না কেনো আমার ভেতরের সঙ্গে বাইরের কিছুতেই মেলাতে পারিনে। পৃথিবী চলছে তার আপন নিয়মে। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে রক্ত আসতে চায়। কি করবো স্থির করতে পারিনে। ঘটনা স্রোত আমার সমগ্র অস্তিত্বকে এমন একটা গহ্বরের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে, সারাজীবন চেষ্টা করলেও বোধ করি বেরিয়ে আসতে পারবো না। সময় তার জটাজাল প্রসারিত করে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।

এরই মধ্যে সুনীলদা বাজার সেরে এসে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। মজহার, সুনীলদা, অর্চনা, প্রমোদবাবু উনারা কথা বলে যাচ্ছিলেন। আমার কিছু বলতে প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। ইচ্ছে হচ্ছিলো উঠে একদৌড়ে কোথাও পালিয়ে যাই। কিন্তু যাবো কোথায়? প্রায় অর্ধেক কোলকাতা শহর ঘুরে একটুখানি সান্ত্বনার প্রত্যাশায় তো এ বাড়িতে এলাম। অর্চনার আজকের রকম সকম দেখে মনে মনে ভীষণ ব্যথিত হলাম। আমি জানি তায়েবা মারা যাচ্ছে। কারো করার কিছু নেই। আমারও না, অর্চনারও না। তবু অর্চনা যখন আগ্রহী হয়ে তায়েবার অসুখের কথা জিগগেস করে, আমাকে মিথ্যে আশ্বাসে আশ্বস্থ করে, আমি মনে মনে শান্তি পাই। আমি শান্তি পেলে কি তায়েবা বাঁচবে? না বাঁচবে না। সে মারা যাবে, তাকে মারা যেতেই হবে। মারা যাবার জন্যই সে অতি কষ্টে সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতা শহরে এসেছে। আসলে সংকট আমার ভেতরে। তায়েবাকে উপলক্ষ করে একটা আবরণ তৈরি করে নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সুনীলদা এক পর্যায়ে সমস্ত আলোচনাটা তাঁর সেই সুবিখ্যাত শান্তির থিয়োরর দিকে টেনে নিলেন। জানেন প্রমোদদা, ভেতরের ট্যানশনই হলো দুনিয়ার সমস্ত অশান্তির উৎস। যুদ্ধ, বিভীষিকা, মানুষে মানুষে সংঘাত এসব হলো ভেতরের ট্যানশনের বাহ্যিক প্রকাশ মাত্র। এগুলো থেকে মুক্তি না পেলে পৃথিবীর অসুখ কখনো সারবে না, আর মানুষও কোনোদিন শান্তি পাবে না। ক্ষণিক ঘটনার দিকে না তাকিয়ে সমস্যার মূলটাই আমাদের দেখা উচিত।

প্রমোদবাবু ফস করে জিগগেস করে বসলেন, কি রকম। এই যে ধরুন মানুষের রিপুগুলো আছে না তারাই তো মানুষকে সংঘাতের শান্তিনাশা পথে টেনে নিয়ে যায়। সুতরাং মানুষের প্রথম লক্ষ হওয়া উচিত এই সব রিপু থেকে মুক্ত হওয়া। প্রমোদবাবু বললেন, তার কোনো পথ আছে কি? আছে, আছে প্রমোদ দা। তা হলে তো মানুষ থাকবে না, সব দেবতা হয়ে যাবে। প্রমোদদা মানুষ তো আসলে দেবতাই, জ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে জগতকে বার করতে পারে না বলেই সে পশু হয়ে যায়। প্রমোদবাবু বললেন, সুনীল তোমার কথাগুলো অত্যন্ত চমৎকার। আমি অনেক বছর ইউরোপে থেকেছি। সুতরাং আস্থা স্থাপন করতে পারবো না। অর্চনা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, দাদা তুমি প্রমোদদার সঙ্গে চুটিয়ে শান্তি চর্চা করতে থাকো। রান্না হওয়ার দেরী আছে। আমি দানিয়েলকে নিয়ে গেলাম। বেচারী কষ্ট পাচ্ছে। তারপর ইসলামের দিকে তাকিয়ে বললেন, দয়া করে আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি একটু দানিয়েলকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছি।

অৰ্চনা আমাকে ভেতরের ঘরে বসিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, দানিয়েল, তোমার খবর বলো। কোনো দুঃসংবাদ নেই তো। কেমন আছেন তায়েবাদি? আমি বললাম, যেমন দেখেছিলে সে রকমই আছে। তা তোমার মুখ চোখ অমন শুকনো কেনো? এই সময়ে তোমাকে তো শক্ত হতে হবে। আমি বললাম, শক্তই তো আছি যতোটুকু থাকা যায়। অর্চনা ভু কুঁচকে বললো, তোমার চোখ মুখ কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। বললাম, আমার পক্ষে কোথাও স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চারদিক থেকে এমন একটা চাপ এসে আমার ওপর পড়ছে আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনে। অর্চনা আমার কাঁধে হাত দিয়ে কণ্ঠস্বরটা খুবই নামিয়ে অনেকটা ফিসফিস করে জিগগেস করলো, দানিয়েল, তুমি তায়েবাদিকে খুবই ভালোবাসো, তাই না? তার কথার জবাব দিতে গিয়ে আমার মুখে কথা আটকে গেলো। সহসা কোনো কিছু বলতে পারলাম না। অর্চনা আমার মানসিক অবস্থাটা আঁচ করে বললো, দানিয়েল, তুমি বরং আরেক কাপ চা খাও এবং একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি একটু ভেতর থেকে আসি। বড়ো জোর দশ মিনিট। তার বেশি নয়।

শোভা মেয়েটি চা দিয়ে গেলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হলো বাইরের গরম ভেতরের গরমকে অনেকখানি কাবু করে ফেলেছে। আমার ভাবাবেগ অনেকখানি প্রশমিত হয়ে এসেছে। আমি সমস্ত বিষয় অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করতে পারছি। বাইরের ঘরের টুকরো টুকরো আলাপ কানে আসছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, হিন্দু, মুসলমান, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, বাঙালি, অবাঙালি, শেখ মুজিব, ভাসানী, ইন্দিরা গান্ধী, নকশাল, কংগ্রেস, সিপিএম এসকল বিষয় আলোচনায় বার বার ঘুরে ঘুরে আসছে। আমি যেখানেই যাই সেখানেই মাটি খুঁড়ে একটি বিতর্ক জেগে ওঠে। আমার জন্মই যেনো একটা মস্ত বড়ো বিতর্কের বিষয়। আমি যদি জন্ম না নিতাম, এতোগুলো মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আসতো না, তায়েবার অসুখ হতো না, যে সকল সংকটু সমস্যা পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছে, তার কিছুই ঘটতো না। দুনিয়াতে যেখানে যা কিছু ঘটছে তার জন্য যেনো আমিই দায়ী। আমাকে নিন্দা করতে হয়, পক্ষ নিতে হয়। মনে হচ্ছে আমি দুনিয়া জোড়া প্রসারিত একটা শক্ত মাকড়সার জালের মধ্যে পড়ে গেছি। হাজার চেষ্টা করেও তার নাগপাশ ছিন্ন করতে পারবো না।

অর্চনা ভেতরের ঘর থেকে এসে জিগগেস করলো, চা খেয়েছো? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। সে আমার দিকে কবার চোরা চোখে তাকালো এবং তারপর বললো, তায়েবাদির অসুখটা বেশ জটিল। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন তো মনে হয় না। তুমি কি মনে করো? জবাব দিলাম, তায়েবা আর অসুখ। থেকে কোনোদিনই সুস্থ হয়ে উঠবে না এবং এটাই তার শেষ অসুখ। সে আমি বিলক্ষণ জানি, তায়েবা জানে এবং তার মা বোন আত্মীয়স্বজন সকলেই জানে। কোন দিনটিতে সে মারা যাবে সে সংবাদটি আমরা কেউ জানিনে। সেটাই হয়েছে চূড়ান্ত সমস্যার বিষয়। অর্চনা আমার চোখে চোখ রেখে বললো। দানিয়েল, তুমি সময় বিশেষে ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারো। আমি বললাম, তুমি এর মধ্যে নিষ্ঠুরতার কি পেলে? যে কথাটি সকলে জানে শুধু সঙ্কোচবশে প্রকাশ করছে না, সে কথাটিই আমি বলেছি। আচ্ছা দানিয়েল, তোমাকে একটা কথা জিগ্‌গেস করবো। আমি বললাম, হ্যাঁ করো। ধরো যদি তায়েবাদির কিছু একটা ঘটে যায় তুমি কি খুব কষ্ট পাবে? একথা কেননা জানতে চাইছো। তোমার আর তায়েবাদির সম্পর্কটা ভারী অদ্ভুত। আমার কি মনে হয় জানো, হঠাৎ করে তায়েবাদি যদি এ অসুখটাতে না পড়তেন, তোমরা যে একে অন্যকে ভালোবাসো, সেটা এমন করে অনুভব করতে পারতে না। অর্চনার কথা শুনে সহসা আমার মুখে কোনো কথা জোগালো না। আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি ধরণের। সেকি আমাকে ভালোবাসে? আমিও কি তাকে ভালোবাসি? তার সঙ্গে আমার পরিচয় চার বছরেরও অধিক। কখনো এমন করে আমাদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে হয়নি। আজকে অর্চনার কথা শোনার পর আমাকে নিজের ভেতর ডুবে যেতে হলো। তায়েবার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে আমাদের মধ্যে যা যা ঘটেছে একে একে মনের মধ্যে খেলে যেতে থাকলো। খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকলো। আমি স্পষ্টই অনুভব করলাম, সব সময়ই আমার মন তায়েবার দিকে বলগাহারা অশ্বের মতো ছুটে গিয়েছে, কিন্তু যখনই কাছাকাছি গিয়েছি, থমকে দাঁড়াতে হয়েছে, হৃদয় মন রক্তাক্ত করে ফিরে আসতে হয়েছে। তার সমস্ত অস্তিত্ব তার পার্টির ভেতর প্রোথিত। বারবার মনে হয়েছে সে যেনো সপ্তরথী পরিবেষ্টিত একটা মানবদুর্গের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী এক নারী। এই দুর্গ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার কথা সে যেমন চিন্তা করতে পারে না। আমিও তার ভেতর প্রবেশ করবো কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমরা পরস্পরের প্রতি যতদূর আকর্ষণ অনুভব করেছি, ঠিক সমান পরিমাণ বিকর্ষণ আমাদেরকে আলাদা করে রেখেছে। তারপরও তায়েবা যখন ডেকেছে ছুটে গেছি, হৃদপিণ্ডটা ছিঁড়ে নিয়ে তার পায়ে অঞ্জলি দেবো ভেবেছি। কিন্তু পরক্ষণেই এমন কিছু ঘটেছে, আমাকে ক্ষুব্ধ ব্যথিত হয়ে বুকের ভেতর একটা জখম নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে অর্চনা জিগগেস করলো, দানিয়েল কি ভাবছো? আমি বললাম, আর ভাবাভাবির কি আছে, যা ঘটবার ঘটে যাবে। শোনো দানিয়েল, একটা কথা তোমাকে বলি। তায়েবাদির হাসপাতালে তোমার আরো বেশি সময় থাকা উচিত। তুমি থাকলে উনি খুবই হাসিখুশি থাকেন। আমি বললাম, তার কাছাকাছি থাকতে পারলে ভালো লাগে। কিন্তু তার পার্টির মানুষেরা আমার দিকে এমন চোখে তাকায়, আমি খুবই বিব্রত বোধ করি। উনারা চোখেমুখে এমন একটা ভঙ্গি করেন যেনো আমি তায়েবাকে দেখতে এসে মস্ত একটা অপরাধ করে ফেলেছি। আর তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা হলেই একটা না একটা খোটাখুটি লেগে যায়। শেষে তায়েবার ওপর সব কিছুর চাপটা গিয়ে পড়ে। তার রোগের যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। এটা এমন একটা জটিল এবং বিদ্ঘুটে ব্যাপার তোমাকে সবটা খুলে বোঝাতে পারবো না। অর্চনা বললো, কিছু কিছু বুঝতে পারি। তবু একটা কথা বলবো, তুমি ভয়ানক একরোখা এবং জেদী, নিজের দিকটা ছাড়া আর কিছু দেখো না। বিশেষ বিশেষ সময়ে মানুষকে নমনীয় হতে হয়। আমি বললাম, তুমি আমাকে আমি যা নই তা হতে বলছো, সে তো সম্ভব নয়। দূর দানিয়েল, আমি কি বলতে চাইছি তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি। যাক্, এখন তুমি কি করতে চাও, সেটা বলো। আমি তোমার কাছে একটা বিশেষ অনুরোধ করবো বলে এসেছি। অর্চনা বললো, বলে ফেলো। তায়েবা তোমার খুব তারিফ করেছে। তার কথা শুনে মনে হয়েছে, সে মনের ভেতর থেকে তোমাকে খুবই পছন্দ করে। যে সমস্ত মানুষজন ওখানে আসে তার বেশিরভাগই তাকে একভাবে না একভাবে জখম না করে ছাড়ে না। অথচ সে কাউকে কিছু বলতে পারে না। সমস্ত পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোথাও থেকে একটি সান্ত্বনার বাক্য শোনার সুযোগ নেই। তার যারা একেবারে কাছের মানুষ, তাদের দেখলে সে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। তুমি যদি এক আধটু সময় করে হাসপাতালে যাও, এটা ওটা বলে তার মনটা একটু হালকা রাখতে চেষ্টা করো, ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।

অর্চনা বললো, দানিয়েল, তোমার বলার প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো এমনিতেই তায়েবাদিকে দেখতে প্রতিদিন যাচ্ছি। তাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। একেবারে খড়খড়ে মহিলা। কোথাও কোনো স্যাঁতস্যাঁতে নেই। কিন্তু তুমি যে বললে আমি এটা ওটা বলে তার মনটা হালকা করতে পারবো, এটা বোধ করি সত্যি নয়। আমি জিগেস করলাম, তুমি একথা বললে কেন? অর্চনা বললো, আজ দুপুরে আমাদের এখানে খেয়ে যাও। আমি বললাম, না অর্চনা, তা হয় না। আমাকে বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গেই খেতে হবে। আর তাছাড়া ইসলাম সাহেবের কাছে প্রমোদবাবু তাঁর কৈশোর-যৌবনের স্মৃতিচারণ করছেন। এই ফ্রান্স প্রত্যাগত ভদ্রলোকটিকে আমার মনে ধরেছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে হয়তো কোনো ব্যাপারে আমার মতের মিল হবে না। কিন্তু তাঁর চরিত্রের একটি দিক আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। প্রমোদবাবু এখনো মনে করেন, জাতি হিসেবে বাঙালির একটি স্বাধীন অবস্থান সৃষ্টি হবে। এটা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি বড়ো ঘটনা। যদিও নানা পরস্পর বিরোধী মতামতের দ্বন্দ্ব দেখে তাঁর মনে নানা রকম সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুবই খুশি হলাম। আরেকদিন সময় করে এসে গল্প করে যাবো। প্রমোদবাবু বললেন, কাল আমি আপনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প দেখতে সীমান্ত এলাকায় যাবো। হয়তো দু’চারদিন থেকে যেতে হবে। আমি বাড়িতে আছি কিনা খবর নিয়ে আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করার ইচ্ছে। আমি বললাম, আপনি একা একা সীমান্ত এলাকায় যাবেন কোনো অসুবিধে হবে না। তিনি জবাবে বললেন, ত্রিগুনা সেন হলেন তার এক বন্ধুর মামা। ত্রিগুনাবাবু তাঁকে বিএসএফ-এর এক কর্ণেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। কর্ণেল সাহেবই তাঁকে নিয়ে যাবেন।

অর্চনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ার পর মজহারুল ইসলাম সাহেব বললেন, মশায় আপনাদের নিয়ে আর পারা গেলো না। একবার ইসলামের ধুয়ো তুলে দেশ ভাগ করলেন। আবার এখন বাঙালিত্বের ধুয়ো তুলে কি সমস্ত বিষাক্ত মতামত এখানে ওখানে ছড়াচ্ছেন। দুনিয়াতে পাগলের সংখ্যা তো অল্প নয়, বস্তাপচা বাঙালি জাতীয়তার কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষও দেখি পাওয়া যায় ভূড়ি ভূড়ি। আমি বললাম, পাওয়া যাবেনা কেন? মশায় দেখছি আপনারা আমাদের অনেক জ্বালাবেন। আমি বললাম, আল্লাহ, আমাদের জ্বালাবার ক্ষমতাটুকুই শুধু দিয়েছেন। তিনি একটা চারমিনার ধরিয়ে বললেন, রাখেন আপনার আল্লাহ, আজকের গোটা দিনটিই নষ্ট হলো।

.

১০.

দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস চলে এসেছে। হাসপাতালে যাওয়া আমার নিত্যিদিনের অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে। অন্য কোনো কাজকর্ম না থাকলে দিনে দু’বারও যাই। রোজই দেখতে পাচ্ছি তায়েবার প্রাণশক্তি আস্তে আস্তে থিতিয়ে আসছে। এখন সে নিজের শক্তিতে বিছানা থেকে উঠতে পারে না, তাকে তুলে বসাতে হয়। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। কোলকাতায় আমাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে উঠেছে। তায়েবার মা, দু’বোন, বড়ো ভাই সকলেই কোলকাতায় আছেন। তার পার্টির কর্মীরাও নিয়মিত আসে, দেখাশোনা করে। কিন্তু তায়েবা শুয়ে থাকে। বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে সব কিছু দেখে। খুব কমই কথা বলে। আগে যে তায়েবাকে দেখেছে, এ অবস্থায় দেখলে মনে হবে এই মধ্যে আগের তায়েবার কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে যখন শুয়ে থাকে, দেখলে আমার মরা নদীর মতো মনে হয়। গতি নেই, স্পন্দন নেই। আমার বুকটা ধক করে উঠে। কি যে বেদনার স্রোত বয়ে যায় সে আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। এখনো জাহিদুল আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। ডোরা দেখলে অপ্রস্তুত বোধ করে। এমন একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন ফুটিয়ে তোলে, তার অর্থ দাঁড়ায় তুমি এখানে কেন?

কারো কোনো মন্তব্য আমি আর গায়ে মাখিনে। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলুক, না বলুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি যখন তার কেবিনে ঢুকি, দেখামাত্রই তায়েবার ঠোঁটে একটা ক্লান্ত সুন্দর হাসির রেখা জেগে উঠে। তার এই হাসিটাই আমাকে সবকিছু অগ্রাহ্য করতে শিখিয়েছে। আমার ইচ্ছে করে তার হাত পায়ে হাত বুলিয়ে দিই। মাথার উড়ো উড়ো রুক্ষ চুলগুলো ঠিক করে রাখি। খসে পড়া সাপের খোলসের মতো এলোমেলো শাড়িটা গুছিয়ে ঠিক করে পরিয়ে দেই। কিছুই করতে পারিনে আমি। সব সময় ঘরভর্তি মানুষ তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। আমাকে মনের বেদনা মনের ভেতর চেপে রাখতে হয়।

আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা সগ্রাম। পরের বেলার ভাত কিভাবে জোটাবো সে জন্য অনেক ফন্দিফিকির করতে হয়। ভাগ্যগুণে একটা থাকার জায়গা পেয়েছি। সেখানে যারা থাকে সকলের অবস্থাই আমার মতো। যেখান থেকে যে পয়সা সংগ্রহ করে আনি, ও দিয়ে সকলে মিলে ভাত খাওয়া সম্ভব হয় না। প্রায় সময় আমাদের মাদ্রাজি দোকানে দোসা খেয়ে কাটাতে হয়। তার ওপর আমার আবার সিগারেট খাওয়ার নেশা। রোজ তায়েবার পেছনে কম করে পাঁচটি টাকা সংগ্রহ করতে কি পরিমাণ বেগ পেতে হয় বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এখানে সেখানে লেখালেখি করে অল্পস্বল্প অর্থ আমি আয় করেছি। তার পরিমাণ খুবই সামান্য। বাংলাদেশের নানা চেনাজানা মানুষ কিছু টাকা পয়সা দিয়েছে। অস্বীকার করবো না, প্রিন্সেপ স্ট্রীটে অস্থায়ী সরকারের অফিস থেকেও নানা সময়ে কিছু টাকা আমাকে দেয়া হয়েছে। কোলকাতার মানুষেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষক সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী অল্পস্বল্প কাজ করিয়ে নিয়ে সে তুলনায় অনেক বেশি টাকা আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু টাকার এমন ধর্ম, পকেটে পড়ার সাথে সাথে উধাও হয়ে যায়। যেদিকেই তাকাই প্রয়োজন গিলে খাওয়ার জন্য হাঁ করে ছুটে আসে।

আমি কিছু কাজ করতে চেয়েছিলাম। বেশি নয়, অন্ততঃ দিনে পাঁচটা টাকা জোটাবার জন্য আমি কিছু কাজ করতে চাই। তিন ঘণ্টা কুলিগিরি করেও যদি পাঁচটি টাকা পাই আমি করতে রাজি। ওই টাকাটি না পেলে আমার পক্ষে তায়েবার হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর ইদানিং একটা সঙ্কোচবোধ আমাকে ভয়ানক আড়ষ্ট করে ফেলেছে। তায়েবার অসুখের কথা বলে চাইলে ওই টাকাটা হয়তো আমি কারো না কারো কাছ থেকে আদায় করতে পারি। আমার চেনাজানা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত অল্প নয়। নানা সময়ে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাদের কাছে হাত পেতে চেয়ে নিতে কোনো রকমের কুণ্ঠা বোধ করিনি। তায়েবার অসুখের নাম করে কারো কাছে টাকা চাওয়া গেলেও আমার পক্ষে সম্ভবত নেয়া হবে না। দু’তিন দিন আগে অর্চনা হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রেস্টুরেন্টে চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলো। ওখানেই সে আমার হাতে পাঁচশো টাকার একটি নোট দিয়ে বলেছিলো, দানিয়েল, টাকাটা রাখো। এ সময়টাতে তোমার বোধ হয় খুবই টানাটানি চলছে। আমি হাতে স্বর্গ পেয়ে গিয়েছিলাম। এই সময়ে পাঁচশো টাকা অনেক টাকা। তথাপি অর্চনার টাকাটি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলাম, টাকাগুলো তোমার কাছে থাকুক, আমার যখন খুব প্রয়োজন পড়বে চেয়ে নেবো। অর্চনা বললো, তুমি বরাবর একগুয়ে। আর তাছাড়া…। তাছাড়া কি? তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো না। আমি বললাম, অর্চনা আমি তোমাকে ঠিকই বন্ধু মনে করি, এই কোলকাতা শহরে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই যার কাছে আমার মনের বোঝা হালকা করতে পারি। তুমি না থাকলে নিঃসন্দেহে আমার কষ্ট অনেকগুণে বেড়ে যেতো। আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন, তথাপি তোমার টাকাটি গ্রহণ করতে পারবো না। দয়া করে কিছু মনে করো না লক্ষ্মীটি। অর্চনা টাকা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললো, বক্তৃতাটি কি একটু দীর্ঘ হয়ে গেলো না? আমি কোনো কথা না বলে গড়িয়াহাটার ট্রামে না ওঠা পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দিলাম।

আমি যে কিছু কাজ করতে চাই একথা বন্ধুবান্ধব অনেককেই বলেছি। সেদিন সন্ধ্যেবেলা হাসপাতাল থেকে বৌ বাজারের হোস্টেলে ফেরার পর নরেশদা জানালেন। সৌগতবাবু একটা কাজের খবর দিয়ে গেছেন। শুনে আমিতো অবাক হয়ে গেলাম। সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় লোকটিকে আমি কখনো পছন্দ করিনি। তাই তাঁর সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলাপ পর্যন্ত করা হয়নি। আজ তিনি আমার চূড়ান্ত বিপদের সময় এতো বড়ো একটা উপকার করলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করার চেষ্টা করলাম। নরেশদা এক টুকরো কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন। দেখলাম, লেখা রয়েছে অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক সাপ্তাহিক নতুন খবর, ৯১ নম্বর মঠলেন, কোলকাতা-৯১। নরেশদাকে জিগ্‌গেস করলাম, নতুন খবর নামে কোলকাতায় একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে তাতো জানতাম না। আমাকে কি ধরনের কাজ করতে হবে কিছু বলেছেন নাকি। তিনি জবাবে বললেন, না সেসব কিছু বলেননি। শুধু তোমাকে আগামীকাল সাড়ে ন’টার সময় তৈরি থাকতে বলেছেন, তিনি এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন। সেদিনও বাংলাদেশের ছেলেরা কেউ হোস্টেলে ছিলো না। সকলে মিলে হাওড়াতে একটা অনুষ্ঠান করতে গেছে। ঘর ফাঁকা। আমার ঠিক কি হয়েছে খুলে বলতে পারবো না। যখন অধিক লোকজন থাকে একটুখানি নির্জনতার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে। আর যখন লোকজন থাকে না নির্জনতা বোঝার মতো বুকের ওপর চেপে বসে। নরেশদার ভেতর কি ঘটছে অনেকদিন জিগগেস করা হয়নি। অঞ্জলি কোলকাতা আসতে চায় কিনা। তার বাবা মা এখন রাজার মঠে বড়ো ভায়ের বাসায় কি অবস্থায় আছেন, ভদ্রতার খাতিরে হলেও এসকল সংবাদ জিগ্‌গেস করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমার কোনো কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না। তিনি জিগগেস করলেন, এখন কি করবি? আমি বললাম, ঘুমোবো। কাল সৌগতবাবুর সঙ্গে যাবি? হ্যাঁ বলে মশারিটা নামিয়ে দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম।

পরের দিন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটার সময় সৌগতবাবু এসে হাজির। বললেন, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিন। অনিমেষদা আবার সময়নিষ্ঠ মানুষ। তাঁকে কথা দিয়েছি ঠিক দশটার সময় আমরা আসবো। অধিক কথা না বাড়িয়ে জামা কাপড় পরে সৌগতবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। বাসের জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো। আমরা যখন মঠলেনে এসে নামলাম দশটা প্রায় বাজে। প্রচণ্ড ভিড়ে ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছি। নতুন খবরের অফিসে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিলো না। মঠলেন বড়ো ঘিঞ্জি জায়গা, আমাদেরকে প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে একটি সেকেলে লাল ইট বের হওয়া দালানের তিন তলায় উঠতে হলো। সিঁড়ির বাঁদিকে ছোটো একটি নেমপ্লেট লাগানো। দরোজা ভোলাই ছিলো। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। অফিস কামরাটি খুব বড়ো নয়। একপাশে দেখলাম দু’জন কম্পোজিটর কম্পোজ করছে। টাইপের খাঁচার পাশ ঘেঁষে একটা চেকন লম্বা টেবিল পাতা। একজন অল্পবয়েসী মানুষ বসে বসে পুফ কাটছে। মাঝখানটিতে সম্পাদক অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেবিল। একটা ছোটো সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। ভদ্রলোকের খুব ধারালো চেহারা। নাকটি তীক্ষ্ণ এবং বাঁকানো। গোঁফজোড়া ছুঁচোলো করে ছাটা। পরনে ধুতি এবং মটকার পাঞ্জাবি। ভদ্রলোকের চোখজোড়া ভীষণ উজ্জ্বল। বয়েস কতো হবে বলা মুশকিল। পঁয়তাল্লিশ হতে পারে, আবার পঞ্চাশও হতে পারে। কিছু মানুষ আছে যাদের চেহারা দেখে বয়েস আন্দাজ করা যায় না।

সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় নমস্কার করে বললেন, এই যে অনিমেষদা, দেখলেন তো কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এসে হাজির হয়েছি। অনিমেষবাবু তাঁর রিভলভিং চেয়ারে একটুখানি নড়ে চড়ে বসলেন। টেবিল থেকে পেপার ওয়েটটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বললেন, বসো বসো সৌগত, একটা কাজের মতো কাজ করে বসে আছো দেখছি। জীবনে তোমাকে এই প্রথম সময় রক্ষা করতে দেখলাম। তারপর তোমার পকেট বিপ্লবী দলের সংবাদ কি। এই বুঝি তোমার নতুন কমরেড।

সৌগত অনিমেষবাবুর অন্যসব কথার জবাব না দিয়ে বললেন, আপনি একজন অনুবাদক চেয়েছিলেন। আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে এসে ভীষণ অসুবিধেয় পড়ে গেছেন। তার এক নিকট আত্মীয়ার ভীষণ অসুখ। আপনি যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন। এবার তিনি আপাদমস্তক আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনি বংলাদেশ থেকে এসেছেন? আমি মাথা নাড়লাম। ভদ্রলোক বললেন, বাংলাদেশ মানেই তো অসুবিধে। ওই মুসলমানের দেশে এতোদিন পড়েছিলেন, আগে চলে আসেননি কেনো? ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি একরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। কি বলতে হবে খুঁজে না পেয়ে সৌগতবাবুর দিকে তাকালাম। দেখি তিনিও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তিনি আমার চাইতে কম অবাক হননি।

সৌগতবাবু আমতা আমতা করে বলতে চেষ্টা করলেন, আপনি অনুবাদ করার লোক চেয়েছিলেন, আমার ধারণা ইনি ভালো অনুবাদ করবেন, আপনি টেস্ট করে দেখতে পারেন। আরে রাখো তোমার টেস্ট, আগে কথাবার্তা বলতে দাও। তারপর অনিমেষবাবু আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, কি মশায়, চুপ করে আছেন, আগে চলে আসেননি কেন? আমি মৃদুকণ্ঠে বললাম, আগে চলে আসবো কেমন করে? তিনি ফের জিগগেস করলেন, এখন কি করে চলে আসতে পারলেন? আমি বললাম, পাকিস্তানী মিলিটারি আক্রমণ করে বসলো, তাই বাধ্য হয়ে…। আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগে ভদ্রলোক কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বললেন, মুসলমানদের লাথি আঁটা এতোদিন খুব মধুর লেগেছিলো তাই না, এখন মুসলমানে মুসলমানে লাঠালাঠি লেগেছে, আপনারা সকলে একসঙ্গে হুড়মুড় করে আমাদের ওপর চড়ে বসেছেন। অগত্যা আমাকে। বলতে হলো আমিও মুসলমান। তাঁর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। হলেনই বা মুসলমান। তাতে এমন কি এসে গেলো। আমি মশায় সাফ কথার মানুষ। হিন্দু মুসলমানের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, হিন্দুদের সে দেশ থেকে অনেক আগেই চলে আসা উচিত ছিলো। দেড় কোটিরও বেশি হিন্দু পূর্বপাকিস্তানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জন্য দশ কোটি মুসলমানকে আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে। দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরা ভারতবর্ষে চলে এলে আমরা মুসলমানদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করতাম। সব সমস্যার সাফ সাফ সমাধান হয়ে যেতো। ওই হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্যই ভারতকে মুসলমানে মুসলমানে মারামারি কাটাকাটিতে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। ভারতের কি আর কোনো সমস্যা নেই? সে কথাও থাকুক। ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ বলেই না হয় হিন্দুরা ভারতবর্ষে এসেছে। কিন্তু আপনারা কোন্ মুখে দলে দলে চলে এলেন? আমি অনিমেষ বাবুর কথায় রাগ করতে পারলাম না। আমার লেগেছে একথা সত্যি। তারপরেও মনে মনে ভদ্রলোকের প্রশংসা না করে পারলাম না। তার মধ্যে আর যাই হোক কপটতার বালাই নেই।

আমি মনে করলাম, আর বসে থেকে লাভ কি? অন্ততঃ একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো হলো। আমি স্যাণ্ডেলে পা গলিয়ে বললাম, তাহলে আমি আসি। সৌগতবাবুকে আমার সঙ্গে আসতে বলবো কিনা ভাবনায় পড়ে গেলাম। অনিমেষবাবু বললেন, আপনার খারাপ লেগেছে বুঝতে পারি। কিন্তু আমি মশায় যা ভাবি বলে ফেলি। আমার ভেতর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিছু পাবেন না। বসুন, চা খান। চলে যাবেন কেন, আপনি তো কিছু কাজ চেয়েছিলেন। আমার তো একজন অনুবাদক প্রয়োজন। তারপর তিনি কম্পোজিটরদের একজনকে ডেকে বললেন, ভূপতি যাও নিচে থেকে, চা এবং সিঙ্গারা নিয়ে এসো। উঠি উঠি করেও উঠতে পারলাম না। সৌগতবাবু বললেন, অনিমেষদা, চা আনতে তো কিছু সময় লাগবে, ততোক্ষণে আপনি দানিয়েল সাহেবকে টেস্ট করে দেখেন, অনুবাদে হাত আছে কিনা। অনিমেষবাবু ধমক দিয়ে বললেন, সৌগত নড়াচড়া করবে না। ঠিক হয়ে বসো। আমি তোমাদের শখের কমিউনিস্টদের মতো হিপোক্র্যাট নই। আমার অনুবাদের মানুষ দরকার, উনি যদি ভালোভাবে করতে পারেন, অবশ্যই কাজ দেবো। সহজ কথাটা সহজভাবে বলি বলে মনে করো না, আমার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই।

এবার অনিমেষবাবু অপেক্ষাকৃত সহজ ভঙ্গিতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানতে চাইলেন আমার বাড়ি কোথায়। আমি বললাম, চট্টগ্রাম। তিনি বললেন, আমাদের বাড়িও একসময় ওদিকে ছিলো। পঞ্চাশের রায়টের পর সবকিছু বেচেকিনে চলে এসেছি। আমি তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম কোথায় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, না চট্টগ্রাম নয়, তবে সীমান্তের অপর পাড়েই তাঁদের বাড়ি। যশোর জেলার নড়াইল মহকুমায়। এরই মধ্যে চা এলো, সিঙ্গারা এলো। আমার দিকে প্লেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, খান। চা খাওয়া শেষ হলে একটা সিগারেট খাওয়া যাবে কিনা অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, ফিল ফ্রি। সংবাদপত্রের অফিসে আবার কেউ সিগারেট খাওয়ার অনুমতি চায় নাকি। তারপর তিনি আমাকে ইংরেজি টাইপ করা একটি প্রবন্ধ দিয়ে বললেন, একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করে দেখান, দেখি আপনার হাত কেমন। আমি একটু সরে বসে অনুবাদ করতে লেগে গেলাম। প্রবন্ধটির শিরোনাম হলো আর্যদের আদি নিবাস। স্বামীজী বিরূপাক্ষ হলেন লেখক। তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা আর্যদের বহিরাগত প্রমাণ করে যে সকল বইপুস্তক লিখেছেন, সেগুলো একেবারেই প্রমাণসিদ্ধ নয়। আর্যদের আদি নিবাস হলো ভারতবর্ষে। এই ভারতবর্ষ থেকেই আর্যরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার একটা পৃষ্ঠা অনুবাদ করতে আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগলো। তারপর আমি অনুবাদ করা অংশটি নিয়ে অনিমেষবাবুর টেবিলে রাখলাম। তিনি চশমা খুলে পড়ে দেখলেন। বললেন, আপনি তো মোটামুটি ভালোই অনুবাদ করেন। শুধু একটি শব্দ আমি পাল্টাচ্ছি। যেখানে সিন্ধুনদের পানি বলেছেন,আমি পানি কেটে জল শব্দটি বসাচ্ছি। আমি বললাম, জল পানিতে আমার কিছু আসবে যাবে না।

সৌগতবাবু বললেন, দেখি অনিমেষদা। তারপর মূলপ্রবন্ধ এবং অনূদিত অংশ টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। অনুবাদের অংশটি পড়া শেষ করে বললেন, তাহলে এখন থেকে আপনি আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই ধরনের প্রবন্ধের পাঠক এখনো পশ্চিমবঙ্গে আছে নাকি। আপনার কাগজ কেউ পড়ে? সৌগত, তুমি একটা আস্ত আহামক। শখের কমিউনিস্টগিরি করে বেড়াও বলে দেখতে পাওনি। দশ বছর থেকেই প্রতি সপ্তাহে আট হাজার কাগজ ছেপে আসছি। বাজারে দেয়ার প্রয়োজন হয় না, গ্রাহকদের বাড়িতে আমি কাগজ পাঠিয়ে দেই। তারা আমাকে ডাকে চাঁদা পাঠান। তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়, তোমার মতো পশ্চিম বাংলায় সকলে বিটকেলে জাতখোয়ানো বামুন নয়। কিছু খাঁটি এবং সৎ ব্রাহ্মণ এখনো আছেন। সৎ হিন্দুও অনেক আছেন। তারা অনেকদিন থেকেই আমার কাগজ নিয়মিত পাঠ করে আসছেন। তুমি যদি দেখতে চাও আমি গ্রাহক লিস্ট দেখাতে পারি। অনিমেষবাবুর খোঁচা খেয়ে সৌগত একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, বুঝলাম, সৎ হিন্দুরা আপনার কাগজ পড়েন। কিন্তু আপনি কাগজে কি লিখেন? কেননা আমি হিন্দুদের কথা লিখি। হিন্দুদের মহান ঐতিহ্যের কথা লিখি। স্বার্থের কথা লিখি। হিন্দুরা যে মহান জাতি সে কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেই। অনিমেষবাবুর কথার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। যে কেউ তাঁর কথা শুনলে বুঝতে পারবেন, তার মন এবং মুখের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। অনিমেষবাবু বললেন, সৌগত, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার বাংলাদেশের কমরেডের সঙ্গে কথাবার্তাটা আগে ফয়সালা করে নেই। প্রতি হাজার শব্দে আমি পঁচিশ টাকা করে দিয়ে থাকি। আমাদের যিনি অনুবাদ করতেন, তিন চার মাস যাবত অসুস্থ। বাঁচবেন কিনা সন্দেহ। তোমার বন্ধু যদি রাজি থাকেন, তাঁকে কাজটা দিতে আমি প্রস্তুত। সৌগত বাবু বললেন, কিন্তু দাদা আমার একটা খটকা থেকে গেলো। আপনার কাগজ হিন্দুদের কাগজ। একজন মুসলিম যদি অনুবাদ করে আর সে লেখা যদি আপনি ছাপেন, তাতে কোনো দোষ হবে না? অনিমেষবাবু স্পষ্টভাবে বললেন, না কোনো দোষ হবে না। কেন দোষ হবে? যদি হিন্দু সংস্কৃতি, হিন্দু সভ্যতা সম্বন্ধে তোমার কোনো ধারণা থাকতো, তুমিও বুঝতে পারতে এতে দোষের কিছু নেই। আমি একজন সৎ এবং নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হিসেবে অনুভব করি সঠিক বিষয়টি চিন্তা করা ছাড়া আমার আর কোনো কর্তব্য নেই। যুগে যুগে ব্রাহ্মণেরা তাই করে এসেছে। ক্ষত্রিয়েরা যুদ্ধ করেছে, বৈশ্যরা ব্যবসা করেছে, শূদ্ররা পরিশ্রম করেছে। আর ব্রাহ্মণ সব সময়ে বিধান দিয়েছে। কেউ না কেউ ব্রাহ্মণের কাজ করে দিয়েছে। একজন গুণবান পণ্ডিত ব্রাহ্মণের লেখা একজন মুসলমান দিয়ে অনুবাদ করালে এবং সে লেখা হিন্দুদের পড়তে দিলে এতে দোষের কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করিনে। সৌগতবাবু এবং অনিমেষবাবুর বিতর্কটি শুনে আমি তো দিশেহারা। ভাবনায় পড়ে গেলাম। কাজটা নেবো কিনা। আমার যে অবস্থা রাস্তায় কুলিগিরি হলেও আপত্তি ছিলো না। আমার দৈনিক মাত্র পাঁচ ছয়টি টাকার প্রয়োজন। কুলিগিরিতে শারীরিক পরিশ্রম লাগে কিন্তু মানসিক নির্যাতন নেই। এই কাজটি গ্রহণ করলে তার চাইতে ঢের কম শ্রমে আরো বেশি আমি পেতে পারি। আমার অন্তরাত্মা বলছে, এই কাজের ভেতরে এমন কিছু আছে, গ্রহণ করলে আমি নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাবো। কিন্তু তায়েবার কথা মনে হওয়ায় বুকটা হু হু করে উঠলো। কথা দিলাম, অনুবাদের কাজটা আমি করবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *