০১-২. হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম

অলাতচক্র (মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস) – আহমদ ছফা
উৎসর্গ – আমার জার্মান বন্ধু পিটার জেভিৎসকে

আমি যখন হাসপাতাল এসে পৌঁছলাম, সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে। মনুমেন্টের ছায়া দীর্ঘতরো হয়ে নামছে। রবীন্দ্রসদনের এদিকটাতে মানুষজন গাড়ি ঘোড়র উৎপাত অধিক নয়। মহানগর কোলকাতা এই বিশেষ স্থানটি অপেক্ষাকৃত শান্ত নিরিবিলি। বিশেষ করে এই ক্ষণটিতে যখন গোধুলির সঙ্গে বিদ্যুতের আলোর দৃষ্টি বিনিময় হয়।

ঝাকড়া গাছগুলোর ছায়া রাস্তার ওপর বাঁকা হয়ে পড়েছে। এখানে সেখানে নগর কাকের কয়েকটি জলসা চোখে পড়লো। পরিবেশের প্রভাব বলতে হবে। বায়স কলের সমবেত কাংস্যধ্বনিও মোলায়েম কর্কশতা বর্জিত মনে হয়। ট্রাফিকের মোড়টা বায়ে রেখে পিজি হাসপাতালে ঢোকার পর মনে হলো, লাল ইটের তৈরি কমপ্লেক্স বিল্ডিং আমাকে আস্ত গিলে খাওয়ার জন্য যেনো উদ্যত হয়ে রয়েছে।

হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ারের সময় শেষ হয়ে আসছে। মানুষজন চলে যেতে শুরু করেছে। আমার কর্তব্য কি ঠিক করতে না পেরে কম্পাউণ্ডের প্রাচীর ঘেঁষা নিম গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে একটা চারমিনার জ্বালালাম। আমি একজনের খোঁজ করতে এসেছি। কিন্তু জানিনে কোন্ ওয়ার্ডে কতো নম্বর বেডে আছে। তার ওপর নতুন জায়গা এবং আমি পরিশ্রান্ত। সুতরাং সিগারেট খেয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে হলো।

এই যে দাদা আগুনটা দেবেন? একজন মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললো। গায়ে হাসপাতালের ইউনিফরম। আমার যা অবস্থা মনে হলো অকূলে কূল পেয়ে গেলাম। মানুষটা লম্বাটে, বাঁ চোখটা একটু ট্যারা। দারোয়ান হতে পারে, ওয়ার্ডবয় হতে পারে, আবার মেল নার্স হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি ম্যাচ জ্বালতে যাচ্ছিলাম। বাধা দিলো লোকটি। আহা শুধু শুধু একটা কাঠি নষ্ট করবেন কেন? দিন না সিগারেটটা। আমার হাত থেকে আধপোড়া সিগারেটটি নিয়ে লোকটি নিজের সিগারেট জ্বালালো।

ভাগ্যটা যে ফর্সা একথা মানতেই হবে। না চাইতে হাসপাতালের একজন খাস মানুষ পেয়ে যাওয়ায় মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আমি জিগগেস করলাম, আচ্ছা দাদা, আপনি কি এই হাসপাতালের লোক? নাকে মুখে প্রচুর ধূম্ররাশি উদ্গীরণ করে জানালো, আমি চৌদ্দ নম্বর ফিমেল ওয়ার্ডে আছি। তারপর আমার দিকে একটা তেরছা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আপাদস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে বললো, আপনি বুঝি জয়বাংলার মানুষ? আমার জবাব দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না। কাপড়চোপড় মুখ ভর্তি দাড়ি এসব পরিচয়পত্রের কাজ করলো। লোকটা এরই মধ্যে হাতের সিগারেটটি শেষ করে একটুখানি আমার কাছে ঘেঁষে এলো। তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকলো, মশায় আজ সারাদিন কি হ্যাঙ্গামাটাই না পোহাতে হলো। তিন তিন বেটা এ্যাবসেন্ট। ডবল ডিউটি করতে হচ্ছে। দিন আপনার একখানি চারমিনার। এখুনি আবার ডাক পড়বে। এমন একটা মোক্ষম মওকা পেয়ে কৃতার্থ হয়ে গেলাম। পারলে গোটা প্যাকেটটাই দিয়ে দিতাম। আপাতত সেরকম কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হওয়ায় একটি শলাকাতেই আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। লোকটার সিগারেট টানার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। অসন্তুষ্ট বিরক্ত শিশু যেমন মাতৃবুকে মুখ লাগিয়ে গিসগিসিয়ে টান মারে সেরকম একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হতে চায়। কপালের বলিরেখাগুলো জেগে ওঠে, চোখের মণি দুটো বেরিয়ে আসতে চায়। বোধহয় আমাকে খুশি করার জন্যই বললো, জানেন দাদা, আমাদের ওয়ার্ডে আপনাদের জয়বাংলার একটি পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। লোকটা এপর্যন্ত দু’ দু’বার ‘জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। কোলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানীং জয়বাংলা শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা কেমন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যাণ্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যাণ্ডেল। এক সপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা-ছাতা, কতো জিনিস বাজারে ছেড়েছে কোলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিছুদিন আগে যে চোখওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো, কোলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিলো জয়বাংলা। এই সকল কারণে খুব দ্র অর্থেও কেউ যখন আমাকে জয়বাংলার মানুষ বলে চিহ্নিত করে অল্পস্বল্প বিব্রত না হয়ে উপায় থাকে না।

সে যাকগে। আমি জিগগেস করলাম, আপনার ওয়ার্ডে বাংলাদেশের পেশেন্টটির কি নাম জানেন নামধাম জানিনে। উনি আছেন উনত্রিশ নম্বর বেডে। বললাম, আমি এসেছি একজন রোগিনীর খোঁজে। কি অসুখ, কোথায় ভর্তি হয়েছে কিছুই বলতে পারবো না। আপনি কি এ ব্যাপারে কোনো উপকার করতে পারেন? চারমিনারের অবশিষ্ট সিগারেটগুলো তার হাতে তুলে দিলাম। লোকটি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলুন না চৌদ্দ নম্বর ওয়ার্ডে, উনত্রিশের পেশেন্টটি যদি হয়ে যায়, তাহলে তো পেয়েই গেলেন। উনত্রিশের পেশেন্ট জয়বাংলার। অন্য কোনো পেসেন্ট থাকলে তার খবরও বলতে পারবে।

ছিপছিপে এল টাইপের একতলা বিল্ডিংটির লনের কাছে এলাম। লোকটি বললো, একটু দাঁড়ান, জিগগেস করে দেখি। চার পাঁচজন মহিলা লনে পায়চারি করছে সেদিকে লক্ষ করেই হাঁক দিলো, এই যে জয়বাংলার দিদিমণি। আপনাদের দেশের এক ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্টের খোঁজ করছে। দেখুন তো সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমি তাকিয়ে দেখলাম, কপালের দিকে সরে আসা চুলের গোছাটি সরাতে সরাতে তায়েবা সুরকি বিছানো পথের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে ডাকছো নাকি গোবিন্দদা! আজ্ঞে দিদিমণি, আপনাদের জয়বাংলার একজন ভদ্দরলোক একজন ফিমেল পেশেন্ট তালাশ করছেন। আপনি একটু কথা বলে দেখুন তো।

এতোক্ষণে জানা গেলো লোকটির নাম গোবিন্দ। তায়েবা এরই মধ্যে তার পুরোনো সম্পর্ক পাতানোর ব্যাপারটি চালু করে ফেলেছে দেখছি। আমার চোখে চোখ পড়তে তায়েবা আনন্দে চকমক করে উঠলো। পিঠের ওপর ঢলের মতো নেমে আসা ছড়ানো চুলের রাশিতে একটা কাঁপন জাগিয়ে বললো, একে কোথায় পেলে গোবিন্দদা। দিদিমণি আপনার অতোসব জবাব দিতে পারবো না, আমি চলোম। ডঃ মাইতি আমাকে ওয়ার্ডে না পেলে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। ডঃ মাইতির কাঁচা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য গোবিন্দ চলে গেলো।

তায়েবাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এই ক’মাসে তার চেহারায় একটা বাড়তি লাবণ্য ফুটে উঠেছে। তার পিঠ ঝাপা অবাধ্য চুলের রাশি। চোখে না দেখলে চিনে নিতে কয়েক মিনিট সময় নিতো। তায়েবার এমন সুন্দর, সুগঠিত শরীরে কোথায় রোগ ঢুকে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে জিগগেস করলো, দানিয়েল ভাই, এতোদিন আসেননি কেন? কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন যে? যান আপনার সাথে কোন কথা নাই। যান চলে যান। পরক্ষণে হাততালি দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো। এই যে আরতিদি, শিপ্রা, মঞ্জুলিকা, উৎপলা দেখে যাও কে এসেছে। তায়েবাকে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টাও ছেড়ে দিয়েছি। পায়ে পায়ে চারজন নারীমূর্তি এগিয়ে এলো এবং আমার মনে একটা খারাপ চিন্তা জন্ম নিলো। এ সমস্ত মহিলা রোগ সারাতে হাসপাতালে এসেছে, না বিউটি কম্পিটিশন করতে এসেছে। তায়েবা বললো, আসুন আরতিদি, পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন দানিয়েল ভাই, ভীষণ প্রতিভাবান মানুষ। এসএসসি হতে এমএ পর্যন্ত সবগুলো পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছেন। স্কলারশীপ নিয়ে বিলেত যাবার ব্যবস্থাও পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিলো, মাঝখানে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলো, তাই..। আর আরতিদির বাড়ি ছিলো আপনাদের চাঁটগায়ে। আমার পাশের কেবিনে থাকেন। এ হচ্ছে শিপ্রাগুহ ঠাকুরতা। বরিশালের বানরীপাড়ার মেয়ে। আর যে মঞ্জুলাকে দেখছেন তারও আসল বাড়ি বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলায়। পোড়ামুখী তিন বছর ধরে এই হাসপাতালে ডেরা পেতে আছে। অবশেষে উৎপলার হাত ধরে বললো, এর পরিচয় আপনি জানতে পারবেন না। ওর সাতপুরুষের কেউ কস্মিনকালেও পদ্মার হেপাড়ে যায়নি। একেবারে জাত ঘটি, তার ওপর আবার ব্রাহ্মণকন্যা। এখন ঠেকায় পড়ে এই মেলেচ্ছনির সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হচ্ছে। ‘রাত্রিবাস’ শব্দটি এমন এক বিশেষ ভঙ্গি সহকারে উচ্চারণ করলো সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। এই ঘটা করে পরিচয় করানোটা যে আমার ভালো লাগেনি তায়েবার অজানা থাকার কথা নয়। তুচ্ছ জিনিসকে বড়ো করে দেখানোর ব্যাপারে তার জুড়ি নেই। কিন্তু আজকের বাড়াবাড়িটা সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। জীবনে আমি ফার্স্ট সেকেণ্ড কোনোদিনই হতে পারিনি। একবার উত্তীর্ণ ছাত্রমণ্ডলীর তালিকায় ওপরের দিক থেকে লাস্ট এবং শেষের দিক থেকে ফার্স্ট হয়েছিলাম। গোটা ছাত্রজীবনে সাফল্যের সেই ধারাটিই আমি মোটামুটিভাবে রক্ষা করে আসছি। এজন্য আফসোসও নেই। বরঞ্চ পরীক্ষায় যারা ভালোটালো করে তাদের প্রতি রয়েছে আমার মুদ্রাগত আক্রোশ। মুখে সাত আট দিনের না-কামানো দাড়ি। পায়ে জয়বাংলা চপ্পল, জামা-কাপড়ও তেমনি। অনাহার, অর্ধাহার, অনিদ্রার ছাপ মুখে ধারণ করে আমি জয়বাংলার মূর্তিমান শিলাস্তম্ভে পরিণত হয়েছি। এটাই আমার বর্তমান, এটাই আমার অস্তিত্ব। এই কোলকাতা শহরে অনেক মানুষ আমাদের সমাদর করেছে আশাতীত দয়া-দাক্ষিণ্য দেখিয়েছে, অনেকে হেলাফেলাও করেছে। ভালো লাগুক, খারাপ লাগুক সব নির্বিচারে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তায়েবার আজকের আচরণ আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা বলে মনে হলো। তার ঠিকানা সংগ্রহ করে হাসপাতাল অবধি আসতে আমাকে কি কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে! পারলে মুখে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে সোজা পা ঘুরিয়ে ফেরত চলে যেতাম। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল ছিলো না। তাছাড়া শরীরে মনে এতোদূর ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত ছিলাম যে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় আনকোরা একটি অভাবিত নাটক জমিয়ে তোলা সম্ভব ছিলো না।

তায়েবা আমাকে তার কেবিনে নিয়ে গেলো। দুটো মাত্র খাট, পানির বোতল, গ্লাস ইত্যাদি রাখার একটা কাঠের স্ট্যাণ্ড, স্টীলের একটা মিটসেফ জাতীয় বাক্স, যেখানে প্রয়োজন মতো কাপড় চোপড় রাখা যায় এবং ভিজিটরদের জন্য একটি টুল… এই হলো আসবাবপত্তর। তায়েবা বিছানায় উঠে বালিসটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে আমাকে টুলটা দেখিয়ে বললো, বসুন। জানেন তো ভিজিটরদের রোগীর বিছানায় বসতে নেই। তাছাড়া আপনার পায়ে সব সময়ে রাজ্যের ময়লা থাকে, কোনো সুস্থ মানুষও যদি আপনাকে বিছানায় বসতে দেয়, পরে পস্তাতে হয়। কথাটা সত্যি। আমি ওদের বাসায় গেলে আগেভাগে আরেকটি চাদর বিছিয়ে দিতো। তারপর আমি বসতাম। এভাবে খাটজোড়া ধবধবে সাদা চাঁদরের অকলঙ্ক শুভ্রতা রক্ষা করা হতো।’

এই সময়ে হাসপাতালের শেষ ঘণ্টা বেজে উঠলো। না চাইতেই একটা সুযোগ আমার হাত এসে গেলো। আমতা আমতা করে বললাম, জায়গাটি তো চেনা হলো, আরেকদিন না হয় আসা যাবে। আজ চলি। যতোই মৃদুভাবে বলি না কেন, আমার কথাগুলোতে রাগ ছিলো, ঝাঁঝ ছিলো। এটুকু না বুঝতে পারার মতো বোকা নিশ্চয়ই তায়েবা নয়। সে শশব্যস্তে বললো, সেকি কতোদিন পরে এলেন, এখুনি চলে যাবেন?। বসুন দু’চারটা কথাবার্তা বলি। আমি বললাম, শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে, এখন যাওয়াই উত্তম। তায়েবা শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বললো, সেজন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি মাইতিদাকে বলে সব ম্যানেজ করে নেবো। আমি স্পষ্টতই অনুভব করলাম, আমার বুকের ভেতরে ঈর্ষার একটা কুটিল রেখা। জানতে চাইলাম, মাইতিদাটি কে? জবাবে বললো, মাইতিদা হচ্ছে ডঃ মাইতি। অসম্ভব ভালো মানুষ। কিন্তু বাইরে ভদ্রলোক ভীষণ কড়া। একটু পরেই আসবেন, আলাপ করলেই বুঝতে পারবেন কি সুন্দর মন। তার কথায় আমি স্প্রীংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলাম। দোহাই তায়েবা উদ্ধার করো। দিদিমণিদের সামনে তুমি আগে একটা সার্কাস দেখিয়ে ফেলেছে। আরো একটা সার্কাস তুমি তোমার মাইতিদার সামনে দেখাবে বলে যদি মনস্থ করে থাকো। আমি তাতে রাজী হতে পারবো না। তারচে বরং আমি চলি। সুন্দর মনের মানুষদের নিয়ে তুমি থাকো। তোমার সুন্দর মনের মানুষদের গুণপনা এই সময়ে গোটা কোলকাতা জেনে ফেলেছে।

তায়েবা হঠাৎ সাপের মতো ফোঁস করে উঠলো। আপনি আমার অসুখের সংবাদ নিতে এসেছেন, নাকি যে সব কথা শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে, সেগুলো পাঁচ কাহন করে বলতে এসেছেন। চলে যান, আপনি এখুনি চলে যান। একখানা লাউড স্পীকার ভাড়া করে আমার লোকদের কথা কোলকাতা শহরে ঘটা করে প্রচার করুন। ভাড়ার টাকা আমি দেবো। এই আচমকা বিস্ফোরণে আমি দমে গেলাম। টুলটা নেড়ে বিছানার কাছে এসে বসতে বসতে বললাম, তুমি এই মহিলাদের সামনে আমাকে এমনভাবে অপমানটা করলে কেন? কই অপমান করলাম, কোথায় অপমান করলাম? মনটা আপনার অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই যে বললে প্রতি বছরে আমি ফার্স্ট হয়ে আসছি। বারে, অন্যায় কি করেছি। আপনি তো অনেক কাজ করে পড়াশোনা করেন। সব ছেড়ে ছুঁড়ে একটুখানি মন লাগালে আপনিও অনায়াসে ফাস্টটাস্ট কিছু একটা হতেন। আর যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তারা আপনার চাইতে ভালো কিসে? নিজের তারিফ শুনতে কার না ভালো লাগে। মনের উষ্মর ভাবটি কেটে গেলো। আমি হাসি মুখে বললাম, আর বিলেত যাওয়ার ব্যাপারটি। আরে দূর দূর ওটা একটা ব্যাপার নাকি, আজকাল কুকুর বেড়ালেরাও হরদম বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে। আপনি চাইলে অবশ্যই যেতে পারেন। তাছাড়া…। আমি বললাম, তা ছাড়া আর কি। তাছাড়া আপনি একটা গেঁয়োভূত। একেবারে মাঠ থেকে সদ্য আসা একটি মিষ্টি কুমোড়। আমি বললাম, আমি যে মিষ্টি কুমোড় সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কুকুর বেড়ালও বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে একথা সত্যি। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো টিকিট করে ওসব দেশে যেতে হয়। আপনি সব কথার কুষ্ঠিনামা বের করতে চান। চাল বোঝেন, চাল? ঐ মেয়েরা প্রতিদিন কথায় কথায় আমার সঙ্গে চাল মারে। আজ না হয় আমিও একটা চাল মারলাম। আপনি এটুকুও বোঝেন না? তুমি তো পরিচয় করিয়ে দিলে, তোমার দিদি, তোমার সই, তোমার বান্ধবী, এখন বলছে সব চালবাজ। আমার দিদি, আমার সই, আমার বান্ধবী ঠিক আছে, কিন্তু চাল মারতে অসুবিধেটা কোথায়? আপনি মেয়েদের সম্পর্কে জানেন কচু। সে বুড়ো আঙুলটি উঠিয়ে দেখালো।

শুনুন দানিয়েল ভাই, তায়েবা ঝলমল করে উঠলো। সেদিন হাসপাতালে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। এখানকার ধনী ঘরের এক মহিলা সেদিন বিউটি পারলারে গিয়ে ছাতার মতো এক মস্ত খোঁপা তৈরি করিয়ে আনে। বাড়ি আসার পরে কি হলো জানেন, মহিলার মনে হলো তার মগজের ভেতর কিছু একটা নড়ছে, লাফ দিচ্ছে। এরকম একটা আজগুবী অসুখের কথা কেউ কখনো শোনেনি। সকলের খুব দুশ্চিন্তা। অনেক ডাক্তার দেখানো হলো। কেউ বিশেষ কিছু করতে পারলো না। মহিলাকে নাকি স্যার নীলরতন হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। সেখানে ডাক্তারেরা কিছু করতে পারেনি। অবশেষে তাকে এক রকম ফেন্ট অবস্থায় এ হাসপাতালে আনা হয়। ডাক্তারেরা স্থির করেন, মহিলার খোঁপাটি খুলে যন্ত্রপাতি দিয়ে দেখতে হবে মগজের ঘটনাটি কী। সত্যি সত্যি নার্সরা যখন মাথার খোঁপাটি খুলতে লেগে গেলো, মহিলা ফেন্ট অবস্থায়ও দু’হাত দিয়ে খোঁপা খুলতে বাধা দিচ্ছে। পরে যখন খোঁপা খোলা হলো অমনি এক টিকটিকি বাহাদুর লেজ দুলিয়ে লাফ দিলো। খোঁপা বাঁধার কোন ফাঁকে আটকা পড়ে গেছে টের পায়নি। সেই থেকে টিকটিকিটি যতোই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, মহিলার মনে হয়েছে, মাথার মগজ খুলি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যি ঘটনা, বুঝলেন মেয়েরা কেমন হয়? আমি বললাম, যতোদূর জানি, তুমিও তো একজন মেয়ে, তোমার বিষয়েই বা অন্যরকম হবে কেমন করে। তায়েবা কৃত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, আপনি এখনো মিষ্টি কুমোড়ই থেকে গেছেন। কিছু শিখতে পারেননি।

এই সময়ে ডান হাতে স্টেথিসকোপ দোলাতে দোলাতে এক ভদ্রলোক কেবিনে প্রবেশ করলেন। বয়স খুব বেশি হবে না। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশের কোঠায়। চোখের দৃষ্টি অসম্ভব ধারালো। চেকন করে কাটা একজোড়া শাণিত গোঁফ। ধারালো চিবুক। একহারা গড়নের চেহারাখানা ব্যক্তিত্বের দীপ্তিতে খোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে। সন্ধ্যের এ আলো আঁধারিতেও আমার দৃষ্টি এড়ালো না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই যে এদিকে আসুন তো। আমি এগিয়ে গেলে তিনি অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে জিগগেস করলেন, কি বেল বাজলো আওয়াজ শুনতে পাননি? আমি মৃদুস্বরে বললাম, পেয়েছি। পেয়েছেন তো হাসপাতালে বসে আছেন কেন? আপনাদের ঘাড় ধরে বের করে না দিলে শিক্ষা হবে না দেখছি। এই যে মাইতিদা থামুন, থামুন। আমাদের দুজনের মাঝখানে তায়েবা এসে দাঁড়িয়েছে। আপাততঃ আপনার চোখা চোখা কথাগুলো তুলে টুলে রাখুন। আমি কতো বলে কয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়ার জন্য দানিয়েল ভাইকে সেই বিকেল থেকে আটকে রেখেছি। এদিকে আপনি তাকে ঘাড় ধরে বের করে দিচ্ছেন। ডঃ মাইতি স্মিত হেসে বললেন, এই তোমার দানিয়েল ভাই, যিনি ফার্স্ট ছাড়া কিছুই হন না। মশায় আপনার অসাধারণ কীর্তিকাহিনী শুনতে শুনতে তো পাগল হবার উপক্রম। অধীর আগ্রহে দিন গুণছি, কখন এসে দর্শনটা দেবেন। শুনেছি মশায়ের কোলকাতা আগমনও ঘটেছে তায়েবার অনেক আগে। যাক ভাগ্যে ছিলো, তাই দেখা হলো। তিনি আমার সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করলেন। তারপর বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ওয়ার্ডে। একটা রাউন্ড দিয়ে আসি।

উৎপলা এখনো বাইরে থেকে ফেরেনি। কেবিনে আমরা দু’জন। এই ফাঁকে আমি জিগ্‌গেস করলাম, তায়েবা, তোমার শরীর কেমন? কেমন আছো? রোগের অবস্থা কি? তায়েবা মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বললো, ওসব কথা থাকুক। আমার শরীর ভালো, আমি ভালো আছি। আমি বললাম, আগরতলা আসার সময় তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা। তোমরা তো আমার সঙ্গে এলে না, কোলকাতা এসে খবর পেলাম, তোমরাও আগরতলা এসে একটা ক্যাম্পে উঠেছে। কোলকাতায় নানাজনের কাছ থেকে নানাভাবে তোমার খবর পেয়েছি। একজন বললো, তোমাকে তিনদিন পার্ক সার্কাসের কাছে রাস্তা পার হতে দেখেছে। আরেকজন বললো, তুমি সকাল বিকেল তিনটি করে টিউশনি করছে। শেষ পর্যন্ত নির্মল একদিন এসে জানালো, তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। কোন্ হাসপাতাল, কি রোগ কিছুই জানাতে পারলো না। তোমার ঠিকানা যোগাড় করতে যেয়ে প্রায় একটা খুনখারাবী বাধিয়ে বসেছিলাম। তায়েবা বললো, সেসব কথা থাকুক। আপনার খবর বলুন, কোথায় আছেন, কখন এসেছেন? দু’বেলা চলছে কেমন করে বাড়ি ঘরের খবর পেয়েছেন? আপনার মা বোন এবং ভায়ের ছেলেরা কেমন আছে?

আমার তো বলবার মতো কোনো খবর নেই। তায়েবাকে জানাবো কি? কোলকাতা শহরে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে দিন কাটাচ্ছি, বিশেষ করে মুসলমান ছেলেরা। আমাদের সঙ্গে মা বোন বা পরিবারের কেউ আসেনি। সে কারণে শরণার্থী শিবিরে আমাদের ঠাই হয়নি। আমরাও শিবিরের মানুষদের প্রাণান্তকর কষ্ট দেখে মানে মানে শহরের দিকে ছিটকে পড়েছি এবং কোলকাতা শহরে গুলতানি মেরে সময় যাপন করছি। একজন আরেক জনকে ল্যাং মারছি। বাংলাদেশের ফর্সা কাপড়চোপড় পরা অধিকাংশ মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন বেকার জীবনযাপনের ক্লেদ কোলকাতার হাওয়া দুষিত করে তুলছে। আমরা সে হাওয়াতে শ্বাস টানছি। সীমান্তে একটা যুদ্ধ হচ্ছে। দেশের ভেতরেও একটা যুদ্ধ চলছে। অবস্থানগত কারণে আমরা সে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি ভুলে থাকতে চাই। কিন্তু পারি কই? যুদ্ধে চলে গেলে ভালো হতো। দেশের স্বাধীনতার জন্য কতোটুকু করতে পারতাম জানিনে। তবে বেঁচে থাকবার একটা উদ্দেশ্য চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। আমার যুদ্ধে যাওয়া হয়নি। যুদ্ধকে ভয় করি বলে নয়। আমাদের দেশের যে সকল মানুষের হাতে যুদ্ধের দায় দায়িত্ব, তারা আমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবার যথেষ্ট উপযুক্ত বিবেচনা করতে পারেননি। আমি তিন তিনবার চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই মহাপুরুষদের দৃষ্টি আমার ওপর পড়েছে। অবশ্য আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি যুদ্ধে যাবেন কেন? আপনার মতো ক্রিয়েটিভ মানুষের ইউজফুল কতো কিছু করবার আছে। যান কোলকাতা যান। সেই থেকে কোলকাতায় আছি। হাঁটতে, বসতে, চলতে, ফিরতে মনে হয় আমি শূণ্যের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছি। এ সব কথা তায়েবাকে জানিয়ে লাভ কী? কোন্ বাস্তব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাকে এই হাসপাতাল অবধি আসতে হয়েছে। সবটা না হলেও অনেকটা আমি জানি। তাকে খুশি করার জন্য বললাম, আমরা বাংলাদেশের বারো চৌদ্দজন ছেলে বৌবাজারের একটা হোস্টেলে খুব ভালোভাবে আছি। তুমি তো দাড়িঅলা নরেশদাকে চিনতে। এই হোস্টেলে তাঁর তিন ভাই আগে থেকে থাকতো। আমাদের অসুবিধে দেখে তারা দু’টো আস্ত রুম ছেড়ে দিয়েছে। রান্নাবান্না বাজার সব কিছু নিজেরাই করি। আমি এখানকার একটা সাপ্তাহিকে কলাম লিখছি। শীগগীর নরেশদা একটা কলেজে চাকরি পেতে যাচ্ছেন। এখানে বাংলাদেশের লক্ষ্মীছাড়া ছন্নছাড়াদের নিয়ে একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলেছি। আর শুনেছি বাড়িতে সবাই বেঁচেবর্তে আছে। তায়েবা আমার হাতে হাত রেখে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনি একটা পথ করে নেবেন, এ কথা আমি নিশ্চিত জানতাম।

এরই মধ্যে জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। তায়েবা অবলীলায় বলে দিলো ওই যে মাইতিদা আসছেন। সত্যি সত্যি ডঃ মাইতি এসে কেবিনে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, দানিয়েল সাহেব, আমি রসকষ হীন মানুষ। রোগী ঠেঙিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করি। শুনেছি আপনি একজন জিনিয়স, আপনার সাথে কি নিয়ে আলাপ করা যায় ভেবে স্থির করে একদিন জানাবো। আজ ভয়ানক ব্যস্ত; ক্ষমা করতে হবে। এখন আমি উঠবো।

তায়েবা বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে ডঃ মাইতির ঝোলানো স্টেথেসকোপটা নিজের হাতে নিয়ে বললো, মাইতিদা আপনাকে দু’মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, কালও কি আপনি হাসপাতালে আসবেন? আমি মাথা নাড়লাম। তাহলে আমার জন্য অল্প ক’টা ভাত আর সামান্য ছোট মাছের তরকারি রান্না করে নিয়ে আসবেন। মরিচ দেবেন না, কেবল জিরে আর হলুদ। ছোট্ট মেয়েটির মতো আবদেরে গলায় বললো, মাইতিদা, আমাকে আগামীকাল ভাত খেতে না দিলে আপনাদের কথামতো আমি ইনজেকশন দেবো না, ক্যাপসুল খাবো না, হেন টেস্ট তেন টেস্ট কিছুই করতে দেবো না। ডঃ মাইতির হাত ধরে বললো, আপনি হ্যাঁ বলুন মাইতিদা। ডঃ মাইতি বেশ শান্ত কণ্ঠে বললেন, বেশতো দানিয়েল সাহেব, কালকে ভাত মাছ রান্না করে নিয়ে আসুন। কিন্তু আমি ভাবছি, পুরুষ মানুষের হাতের রান্না তোমার মুখে রুচবে কিনা? তায়েবা বললো, রুচবে, খুব রুচবে। দানিয়েল ভাই ট্যাংরা মাছ পান কিনা দেখবেন। ডঃ মাইতি ঘড়ি দেখে বললেন, এবার আমি উঠবো। দানিয়েল সাহেব, আপনিও কেটে পড়ুন। এমনিতে অনেক কনসেসন দেয়া হয়েছে।

তায়েবার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে পেছন ফিরে একবার হাসপাতাল কমপ্লেক্সটির দিকে তাকালাম। ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে বিরাট বাড়িটাকে নিস্তব্ধতার প্রতিমূর্তির মতো দেখাচ্ছে। মৃত্যু এবং জীবনের সহাবস্থান বাড়িটার শরীরে এক পোচ অতিরিক্ত গাম্ভীর্য মাখিয়ে দিয়েছে মনে হলো। হাসপাতাল কম্পাউণ্ড থেকে বেরিয়ে এসপ্ল্যানেডের পথ ধরলাম। পনেরো নম্বর ট্রাম ধরে আমাকে বৌবাজারে নামতে হবে। উল্টোপাল্টা কতো রকমের চিন্তা মনের ভেতর ঢেউ তুলছিলো। তায়েবার অসুখটা কি খুব সিরিয়াস? তার মা কি দিনাজপুর থেকে কোলকাতা আসতে পেরেছে? ডোরা শেষ পর্যন্ত পিলে চমকানো এমন একটা দুর্ঘটনার সৃষ্টি করলো। এতো বড়ো একটা কাণ্ড ঘটাবার পরেও জাহিদ নামের মাঝ বয়েসী মানুষটি কি করে, কোন্ সাহসে হুলোবেড়ালের মতো গোঁফ জোড়া বাগিয়ে তায়েবাকে হাসপাতাল দর্শন দিতে আসে। আমি তো ভেবে পাইনে। ট্রাম দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে চড়তে যাচ্ছি, এমন সময় পেছনে ঘাড়ের কাছে কার করস্পর্শ অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি ডঃ মাইতি। তিনি বললেন, দানিয়েল সাহেব, একটা কথা বলতে এলাম। মাছ রান্না করার সময় একেবারে লবণ ছোঁয়াবেন না। আমি বললাম, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন গেণ্ডারিয়ার বাসাতেও তায়েবা কখনো লবণ খেতো না। তিনি জানতে চাইলেন, আপনি কতোদিন তায়েবাকে চেনেন। আমি বললাম, তা বছর চারেক তো হবেই। তিনি আমাকে জেরা করার ভঙ্গিতে বললেন, তার কী রোগ আপনি জানেন? বললাম, জানিনে, মাঝে মাঝে দেখতাম নিঃসার হয়ে পড়ে আছে। কিছুদিনের জন্য হাসপাতাল যেতো। আবার ভালো হয়ে চলে আসতো। শুধু এটুকু জানি সে লবণ খেতো না। আর চা টা ঠাণ্ডা করে খেতো। তিনি বললেন, এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? বললাম, বারে জানবো কি করে। মহিলাদের রোগের কি কোনো সীমা সংখ্যা আছে? তাছাড়া তায়েবা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, আসলে তার অসুখটা কী? তিনি বললেন, উচিত কাজ করেছে, এসব আপনাকে পোষাবে না। আপনি অন্যরকমের মানুষ। আর শুনুন ভাত তরকারি আনার সময় লুকিয়ে আনবেন। ডঃ ভট্টাচার্য জানতে পেলে ওকে হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। এটুকু কষ্ট করে মনে রাখবেন। তারপর নিজে নিজে বিড় বিড় করে বললেন, মেয়েটি তো ফুরিয়েই যাচ্ছে। যা খেতে চায় খেয়ে নিক। ডঃ মাইতি একটা চাপা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমার বুকটা ভয়ে আশঙ্কায় গুড় গুড় করে উঠলো। ডঃ মাইতি বললেন, আপনার ট্রাম, আমি চলি।

.

০২.

বৌ বাজারের স্টপেজে ট্রাম থামতেই লোডশেডিং শুরু হয়ে গেলো। সেই কোলকাতার বিখ্যাত লোডশেডিং। এটা এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে এখনো আমাদের ঠিক গা সওয়া হয়ে উঠেনি। অনেক কষ্টে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দেখি দারোয়ান পাঁড়েজী কেরোসিনের কুপী জ্বালিয়ে কম্বলের ওপর দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। বিরাট উদরটা আস্ত একখানি ছোট্টো টিলার মতো নিশ্বাসের সাথে সাথে ওঠানামা করছে। নাক দিয়ে মেঘ ডাকার মতো শব্দ হচ্ছে। সকালবেলা বেরুবার সময় পাঁড়েজীকে টিকিতে একটা লাল জবা ফুল খুঁজে কপালে চন্দন মেখে সুর করে হিন্দিতে তুলসীদাসের রামায়ণ পড়তে দেখেছি। তাঁর যে এতোবড়ো একটা প্রকাণ্ড ভূঁড়ি আছে, তখন কল্পনাও করতে পারিনি। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে পাঁড়েজী ধড়মড় করে জেগে হাঁক দিলো, কৌন? আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালে চোখ রগড়াতে রগড়াতে একটুখানি হেসে বললো, আমি তো ভাবলাম কৌন না কৌন আপনি তো জয়বাংলার বাবু আছেন, যাইয়ে।

দোতলায় পা দিতে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। এ লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনে বচসা ঝগড়া এসব আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। আমার শরীরটা আজ ক্লান্ত। মনটা ততোধিক। ভেবেছিলাম, কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবো। কিছু সময় একা একা থাকা আমার বড়ো প্রয়োজন। বাইরে কোথাও পার্কে টার্কে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসবো কিনা ভাবাগোণা করছি, এ সময়ে আলো জ্বলে উঠলো। সুতরাং ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, মেঝের ওপর পাতা আমাদের ঢালাও বিছানার ওপর নরেশদা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর বিপরীত দিকে দু’জন অচেনা তরুণ, দু’জনেরই গায়ে মোটা কাপড়ের জামা। একজনের হাতা কনুই অবধি গুটানো। জামার রঙ বাদামী ধরনের, তবে ঠিক বাদামী নয়। বুঝলাম, এরা কোনো ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসে থাকবে। হাত গুটানো তরুণের গায়ের রঙ হয়তো এক সময়ে উজ্জ্বল ফর্সা ছিলো, এখন তামাটে হয়ে গেছে। আরেকজন একেবারে কুচকুচে কালো। নরেশদা বললেন, এসো দানিয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ফর্সা তরুণটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এর নাম হচ্ছে আজহার, আমার ছাত্র। আর ও হচ্ছে তার বন্ধু হিরন্ময়। দু’জনেই জলাঙ্গী ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এসেছে। আজ রাত সাড়ে বারোটার সময় ট্রেনিং নেয়ার জন্য অন্যান্যদের সঙ্গে দেরাদুন চলে যাচ্ছে। নরেশদা জিগগেস করলেন, আজহার, তোমরা কিছু খাবে? না স্যার, হোটেলে খেয়েই তো আপনার কাছে এলাম। নরেশদা বললেন, তারপর খবর টবর বলো। এখানে এসে কি দেখলে, আর কি শুনলে? আজহার বললো, দেখলাম স্যার ঘুরে ঘুরে প্রিন্সেপ স্ট্রীট, থিয়েটর রোডের সাহেবরা খেয়ে দেয়ে তোফা আরামে আছেন। অনেককে তো চেনাই যায় না। চেহারায় চেকনাই লেগেছে। আমাদের ক্যাম্পগুলোর অবস্থা যদি দেখতেন স্যার। কি বলবো, খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার তরুণ রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে। কারো অসুখবিসুখ হলে কি করুণ অবস্থা দাঁড়ায় নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না স্যার। আমরা কোলকাতা এসেছি চারদিন হলো। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। একেকজন লোক ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে এখানে জামাই আদরে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি করা, কোনো কিছুর অভাব নেই। আরেক দল বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সোনা লুট করে কোলকাতা এসে ডেরা পেতেছে। আবার অনেকে এসেছে বিহারীদের পুঁজিপাট্টা হাতিয়ে নিয়ে। আপনি এই কোলকাতা শহরের সবগুলো বার, নাইট ক্লাবে খোঁজ করে দেখুন। দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশের মানুষ দু’হাতে পয়সা ওড়াচ্ছে। এদের সঙ্গে থিয়েটার রোডের কর্তাব্যক্তিদের কোনো যোগাযোগ নেই বলতে পারেন? কথায় কথায় আজহার ভীষণ রেগে উঠলো। আগে আমরা ফিরে আসি, দেখবেন এই সমস্ত হারামজাদাদের কি কঠিন শিক্ষাটা দেই। স্যার, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটা সিগারেট খেতে পারি? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমারই অফার করা উচিত ছিলো। কিন্তু মাস্টার ছিলাম তো সংস্কার কাটতে কাটতেও কাটে না। আজহার একটা সিগারেট ধরালো।

এই ফাঁকে হিরন্ময় মুখ খুললো। স্যার, আমি একটা গল্প শুনেছি। তবে গল্পটা খুব ভালো নয়। যদি বেয়াদবি না ধরেন বলতে পারি। বেয়াদবি ধরার কি আছে, বলে যাও। এই যুদ্ধ মান অপমান, ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় সবকিছু বানের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে সকল মানুষকে দেশে থাকতে শ্রদ্ধা করতাম, কোলকাতায় তাদের অনেকের আচরণ দেখে সরল বাংলায় যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়- তাই হতে হচ্ছে। এখনো তোমরা স্যার ডাকছো, তার বদলে শালা বললেও অবাক হবার কিছু ছিলো না। অতএব বিনা সঙ্কোচে বলে যেতে পারো তোমার গল্প। ঠিক গল্প নয় স্যার। এখানকার একটা মন্ত্রী নাকি সোনাগাছিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। চেনেন তো স্যার, সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত। নরেশদা দাড়িতে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, এই নিরীহ মাস্টার অন্য কিছু বলতে না পারলেও সোনাগাছি কি জন্য বিখ্যাত সে কথা অবশ্যই বলতে পারে। কেননা না কোলকাতা আসার অনেক আগেই তাকে প্রেমেন্দ্র মিত্তিরের অনেকগুলো ছোটো গল্প পাঠ করতে হয়েছিলো। এবার তোমার গল্পটা শুরু করতে পারো। হিরন্ময়ও একটা সিগারেট জ্বালালো। তারপর একমুখ ধোয়া ছেড়ে বললো, পুলিশ অফিসারের জেরার মুখে ভদ্রলোককে কবুল করতে হলো, তিনি ভারতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী। পুলিশ অফিসার তখন বললেন, তাহলে স্যারের গুডনেমটা বলতে হয়। মন্ত্রী বাহাদুর নিজের নাম প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ টেলিফোন করে দেখে যে বক্তব্য সঠিক। পুলিশ অফিসারটি দাঁতে জিব কেটে বললেন, স্যার, কেননা মিছিমিছি সোনাগাছির মতো খারাপ জায়গায় গিয়ে না হক ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। আর ভারত সরকারের আতিথেয়তার নিন্দে করবেন। আগে ভাগে আমাদের স্মরণ করলেই পারতেন, আমরা আপনাকে ভিআইপি-র উপযুক্ত জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম।

নরেশদা বললেন, চারদিকে কতো কিছু ঘটছে নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছি। তবে এ কথাও মিথ্যে নয় যে এসব একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আমরা তো সবাই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এসেছি। নিজের প্রাণ ছাড়া আর কিছু যেখানে বাঁচাবার নেই, সেখানে এ ধরনের বিকৃতিগুলো আসবে, আসতে বাধ্য। চিন্তা করে দেখো জানুয়ারি থেকে পঁচিশে মার্চের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের দিনগুলোর কথা। আর মানুষদের কথা চিন্তা করো। প্রাণপাতালের তাপে জেগে ওঠা সেই মানুষগুলো। একেকটা ব্যক্তি যেনো একেকটা ঝরোণা। আর আজ দেখো সেই মানুষদের অবস্থা। এই তোমার আসার একটু আগেই আমি বনগাঁ থেকে ফিরলাম। বাংলাদেশের মানুষ কি অবস্থার মধ্যে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে, নিজের চোখেই তো দেখে এলাম। ওপরের দিকে কিছু মানুষ কি করছে না করছে, সেটা এখন আমার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়। শরণার্থী শিবিরগুলোতে কি অবর্ণনীয় কষ্ট এই বিজুলীর আলো জ্বলা কোলকাতা শহরে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। প্রতিটি ক্যাম্পে প্রতিদিন বেশিরভাগ মারা যাচ্ছে শিশু এবং বৃদ্ধ। সকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বনগাঁ থেকে শেয়ালদা প্রতিটি স্টেশনে তুমি দেখতে পাবে বাংলাদেশের মানুষ। খোলা প্লাটফর্মের তলায় কি চমৎকার সংসারই না পেতেছে তারা। পুরুষেরা সব বসে আছে নির্বিকার। তাদের চোখের দৃষ্টি মরে গেছে। চিন্তা করবার, ভাবনা করবার, স্বপ্ন দেখবার কিছু নেই। সকলেরই একমাত্র চিন্তা আজকের দিনটি কেমন করে কাটে। তাও কি সকলের কাটে। মরণ যখন কাউকে করুণা করে পরিবারের লোক ছাড়া অন্য কারো মনে রেখাপাত পর্যন্ত করে না। মৃতদেহ প্লাটফর্মের পাশে পড়ে থাকে, অথচ দেখতে পাবে পাশের পরিবারটি এলুমিনিয়ামের থালায় মরিচ দিয়ে বাসী ভাত খাচ্ছে। এমন অনুভূতিহীন মানুষের কথা আগে তুমি কল্পনা করতে পেরেছো? মেয়েগুলোকে দেখো। সকলের পরনে একেকখানি তেনা। চুলে জট বেঁধেছে। পুষ্টির অভাবে সারা শরীর কাঠি হয়ে গেছে। এদের মধ্যে এমনও অনেক আছে, জীবনে রেলগাড়ি দেখেছে কীনা সন্দেহ। এখন সাধ মিটিয়ে রেলগাড়ি চলাচলের পথের ধারে তাদের অচল জীবন কাটাচ্ছে। এ অবস্থা কেননা হলো? সবাই বলছে একটা সংগ্রাম চলছে। আমিও মেনে নেই। হ্যাঁ সংগ্রাম চলছে। কিন্তু আমার কথা হলো সংগ্রাম চলছে অথচ আমি বসে আছি। আমি তো দেশকে কম ভালবাসিনি। দেশের জন্য মরতে আমি ভয় পাইনে। কিন্তু লড়াই করে মরে যাওয়ার সুযোগটা নেই কেন? গলদটা কোথায় জানো আজহার, এই মানুষগুলো লড়াইর ময়দানে থাকলে সকলেরই করবার মতো কিছু না কিছু কাজ পাওয়া যেতো। দেশ যুদ্ধ করছে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান না দেখেই এদের দেশত্যাগ করতে হয়েছে। অচল জীবন্ত মানুষ এখানে এসে জড়পদার্থে পরিণত হচ্ছে। সেখানেই দুঃখ। নেতা এবং দল এসব মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাক্ষার সৃষ্টি করলো। কিন্তু তাদের সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করতে ব্যর্থ হলো। নেতা গেলো পাকিস্তানের কারাগারে। আর আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে চলে এলাম। সেখানেই আফসোস। নানা হতাশা এবং বেদনার মধ্যেও স্বীকার করি একটা যুদ্ধ হচ্ছে। একদিন না একদিন আমাদের মাটি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের চলে যেতেই হবে। কিন্তু আমার তো বাবা এ তক্তপোষের ওপর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পিঠে বাত ধরে গেলো। নরেশদা এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন। কিছু মনে করো না বাবা, মাস্টার মানুষ। একবার বলতে আরম্ভ করলে আর থামতে পারিনে।

হিরন্ময় জানতে চাইলো, স্যার, বনগাঁ কেনো গিয়েছিলেন? নরেশদা জবাবে বললেন, আমার বুড়ো মা এবং বাবা কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনসহ আজকে বনগাঁ শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর কথা। বনগাঁর আশেপাশে যে কটা শরণার্থী শিবির আছে, সবগুলোতেই তালাশ করলাম। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। কিন্তু মা বাবাকে পাওয়া গেলো না। হয়তো এসে পড়বেন দু’চারদিনের মধ্যে। নইলে…, নরেশদা চুপ করে গেলেন। কথাটার অশুভ ইঙ্গিত সকলকেই স্পর্শ করলো। আমি অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। হাতের আধ পোড়া সিগারেটটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো আজহার। স্যার, আপনার এই মানসিক অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য অত্যন্ত লজ্জিত এবং দুঃখিত। আসলে প্রথমেই আপনার মা বাবা আত্মীয়-স্বজনের সংবাদ নেয়াই উচিত ছিলো। আমাদের মুসলমান ছেলেদের বেশিরভাগই একা একা এসেছি কীনা, তাই পরিবারের কথাটা মনে থাকে না। সেজন্য এমনটি ঘটেছে। আশা করছি, অবশ্যই তারা দু’চারদিনের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনি চিন্তাভাবনা করবেন না স্যার। আমি দেরাদুনে পৌঁছেই আপনাকে চিঠি দেবো। আপনি অবশ্যই জানাবেন, তারা পৌঁছুলেন কিনা। আজহার ঘড়ি দেখে প্রায় এক রকম লাফিয়ে উঠলো। স্যার, এবার আমাদের উঠতে হয়। মেজর হরদয়াল সিংয়ের কাছে হাওড়া স্টেশনে হাজিরা দিতে হবে। তার আগে অনেকগুলো ফর্মালিটি পালন করতে হবে। কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় রিপোর্ট করতে হবে। আজহার এবং হিরন্ময় উঠে দাঁড়ালো। তাদের পিছু পিছু আমি এবং নরেশদা বিদায় জানাতে নিচ তলার গেট পর্যন্ত এলাম। আজহার নত হয়ে নরেশদার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললো। নরেশদা মমতা মেশানো কণ্ঠে বললো, ছি বাবা, কাঁদতে নেই। আজহার কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, আমার দু’ভাই পাকিস্তানের মারীতে আটকা পড়ে আছে। এক বোন এবং ভগ্নিপতি লাহোরে। এতোদিন মনেই পড়েনি। আপনার মা বাবার কথা শুনে তাদের কথা মনে পড়লো। রাস্তার ফুটপাত ধরে দু’জন হন হন করে চলে গেলো। আমরা দুজন কিছুক্ষণ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের সকলেরই একেকটা করুণকাহিনী রয়েছে।

নরেশদা জানতে চাইলেন। দানিয়েল তুমি খেয়েছো? আমি মাথা নাড়লাম। চল ওপরে যেয়ে কাজ নেই, একেবারে খেয়েই আসি। বললাম, চলুন তিনি জিগগেস করলেন, কোথায় যাবে? আমার অতো বেশি খাওয়ার ইচ্ছে নেই, যেখানেই হোক চলুন। নরেশদা বললেন, এতো দুঃখ, এতো মৃত্যু, এসবের যেনো শেষ নেই। যাই হোক, চলো আজ মাছ ভাত খাই। আজ আমার একটুখানি নেশা করতে ইচ্ছে করছে। নরেশদা এমনিতে হাসিখুশি ভোজনবিলাসী মানুষ। কিন্তু পয়সার অভাবে তাঁকেও আমাদের সঙ্গে দু’বেলা মাদ্রাজী দোকানে দোসা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। বাঙালি দোকানে সামান্য পরিমাণ মাছ, ডাল এবং ভাত খেতে কম করে হলেও ছয় টাকা লেগে যায়; সেখানে মাদ্রাজী দোকানে দেড় দু’টাকায় চমৎকার আহারপর্ব সমাধা করা যায়।

ভীমনাগের মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে আমি রাস্তা পার হলাম। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ছবিটিতে কড়া আলো পড়েছে। স্যার আশুতোষ ভীমনাগের মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন, বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার করার জন্য ভীমনাগ স্যার আশুতোষের পোর্ট্রেটটা ঝুলিয়েছে। কিন্তু পোর্ট্রেটটি দেখে এরকম ধারণা হওয়াও একান্ত স্বাভাবিক যে ভীমনাগের মিষ্টির গুণেই স্যার আশুতোষ এতো বৃহদায়তন ভূঁড়ির অধিকারী হতে পেরেছেন। অতএব, যাঁরা ভূঁড়ির আয়তন বড়ো করতে চান, পত্রপাঠ ভীমনাগের দোকানে চলে আসুন।

আমরা দু’জন সামান্য একটু ডাইনে হেঁটে বঙ্গলক্ষ্মী হোটেলে ঢুকলাম। খদ্দেরের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। একটা টেবিলের দু’পাশে বসলাম। নরেশদা বললেন, চলো আজ মাংস খাওয়া যাক। আমি জিগগেস করলাম, পয়সা আছে? তিনি টেবিলের ওপর টোকা দিয়ে বললেন, হ্যাঁ আজ কিছু পয়সা পাওয়া গেছে। এটাতো আশ্চর্য ব্যাপার। রাস্তায় কুড়িয়ে পেলেন নাকি? রাস্তায় কি আর টাকা পয়সা কুড়িয়ে পাওয়া যায়? মাদারীপুরের এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে শ’তিনেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। আজকে বনগাঁ স্টেশনের কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা। অবশ্য তিনি জীপে চড়ে রিফিউজি ক্যাম্পে দর্শন দিতে এসেছিলেন। তাঁর হাতে অনেক টাকা, অনেক প্রতাপ। মাদারীপুর ব্যাংকের লুট করা টাকাও নাকি তাঁর হাত দিয়ে বিলিবণ্টন হয়েছে। ভাবলাম, এই সময়ে পাওনা টাকাটা দাবি না করাই হবে বোকামো। আমি জীপের সামনে দাঁড়াতেই তিনি ঝট করে জীপ থেকে নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কতো কি জিগগেস করলেন। কিন্তু আমি আমার উদ্দেশ্যটা ভুলে যাইনি। আমাদের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে শুনে পকেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোটের তোড়া অন্য কেউ দেখতে না পায় মতো বের করে, সেখান থেকে একখানি নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তো বিপদেই পড়ে গেলাম। খুচরো কোথায় পাই! তাই বললাম, আপনি বরং তিনশোই দিন। আমার তো খুচরো করার কোনো উপায় নেই। তিনি বললেন, রাখুন প্রফেসর বাবু, আপনার খুচরো সে পরে দেখা যাবে। জীপে স্টার্ট দিয়ে দলবলসহ বারাসত রিফিউজি ক্যাম্প ভিজিট করতে চলে গেলেন। বেয়ারা এলে তিনি পাঁঠার মাংস, ভাত, ডাল দিতে বললেন।

খেতে খেতে জিগগেস করলাম, মা বাবার কোনো খোঁজ পেলেন? খবর তো পাচ্ছি রোজ পথে আছেন, পথে আছেন কিন্তু কোন্ পথ সেটাতো ভেবে স্থির করতে পারছিনে। আজই তো এসে যাওয়ার কথা ছিলো। গোটা দিন অপেক্ষা করলাম, কিন্তু অপেক্ষাই সার। হঠাৎ করে নরেশদার হিক্কা উঠলো। প্রাণপণ সংযমে হিক্কার বেগ দমন করে আবার খেতে লেগে গেলেন। আমি ফের জানতে চাইলাম, কল্যাণীরও কোনো খবর পাওয়া গেলো না। হ্যাঁ, তার একটা খবর আছে বটে। তবে সত্যি মিথ্যে বলতে পারবো না। সে নাকি কিভাবে পশ্চিম দিনাজপুরে তার এক আত্মীয়বাড়ি এসে উঠেছে। ঠিকানা পেয়েছেন? নরেশদা জবাবে বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তবে দু’য়েকদিনের মধ্যে নিজে গিয়ে দেখে আসুন, অথবা ক্ষীতিশকে পাঠিয়ে দিন। নরেশদা আমাকে ধমক মারলেন। আরে রাখো তোমার পশ্চিম দিনাজপুর। যাওয়া আসার খরচ কতো জানো? এই কল্যাণীর সঙ্গে নরেশদার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। তারিখটা ছিলো একুশে এপ্রিল। এরই মধ্যে পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্র্যাক ডাউন করে বসলো। খরচ যতোই হোক ম্যানেজ করা যাবে। আপনি ঘুরে আসুন। সে কথা এখন রাখো। তোমার খবর বলো। সকাল থেকে কোথায় কোথায় গেলে এবং কি করলে?

গোটা দিনের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে একদম ভুলেই ছিলাম। নরেশদার কথায় সমস্ত দিনের ঘটনারাজি একটার পর একটা বায়োস্কোপের ছবির মতো প্রাণবান হয়ে উঠলো। আমি বললাম, সকাল দশটার দিকে তো গেলাম লেনিন সরণিতে। তিনি জানতে চাইলেন, লেনিন সরণিতে কেনো? বললাম, জাহিদুলের কাছে তায়েবার ঠিকানা চাইতে। জাহিদুল তোমাকে তায়েবার ঠিকানা দিলেন? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন। দিতে কি চায়, শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা হলো। কি করে? তিনি জানতে চাইলেন। জবাবে বললাম, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখি একেবারে সিঁড়ির গোড়ার রুমটিতে জাহিদুল মটকার পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি ফরাশের একপাশে। রিহার্সেল জাতীয় কিছু একটা হয়ে গেছে অথবা হবে। জাহিদুলের সঙ্গে আরো চার পাঁচজন মানুষ। একজন বাংলাদেশের। বাকিরা কোলকাতার। আপনি তো জানেন, মওকা পেলেই জাহিদুল ন্যাকা ন্যাকা ভাষায় চমৎকার গল্প জমাতে পারে। সেরকম কিছু একটা বোধ হয় করছিলো। সেখানে আরো তিনজন মহিলার মধ্যে ডোরাকেও দেখলাম। আমাকে দেখেই দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে আরম্ভ করেছে। তার মুখের শিশুর মতো অম্লান সরলতা তেমনি আছে। কোনো দুশ্চিন্তার রেখা, কোনো ভাবান্তর নেই। গেন্ডারিয়ার বাসায় যেমন সেজেগুজে থাকতো অবিকল তেমনি। যেনো সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কিছু ঘটেনি। জানেন তো ডোরাটা বরাবরই বোকা এবং পরনির্ভরশীল। নিশ্চয়ই এই সময়ের মধ্যে সে জাহিদুলের মধ্যে একটা নির্ভর করার মতো ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। জাহিদুল সে সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে মেয়েটিকে একেবারে নিকে করে ফেলেছে। জাহিদুলের বিরুদ্ধে আমার অনেক নালিশ আছে, তবু তার সৎ সাহসের তারিফ করি। বিয়ে না করে অন্যভাবেও মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে পারতো। জানেন তো জাহিদুলের আসল বউয়ের সংবাদ? শশীভূষণ তার মেয়েটির ট্যুইশনি করতো না, জাহিদুলকে একটা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে শশীকে বগলদাবা করে শান্তিনিকেতন চলে গেছে। এক্কেবারে ক্ষুরের মতো ধারালো মহিলা। যেদিকে যায়, ফাঁক করে যায়। তুমি কোন্ শশীর কথা বলছো? আমাদের জগন্নাথ হলের ছোট্টোমতো সুন্দর ছেলেটি নয়তো! সে তো অত্যন্ত সুশীল ছেলে। সে কেনো যাবে রাশেদা খাতুনের সঙ্গে? খাতুনেরও তো প্রচুর সুনাম শুনেছি, তিনিও বা এ রকম বাজে কাজ করতে যাবেন কেনো? এসব ব্যাপারে নরেশদার মাথাটা আস্তে আস্তে কাজ করে। তাই বিরক্ত না হয়েই বললাম, যুদ্ধ স্রোতে ভেসে যায় ধনমান জীবন যৌবন। আমি আর আপনি করলে যা অপকর্ম হয়, মহাপুরুষেরা করলেই সে সব লীলা হয়ে দাঁড়ায়। নরেশদা বললেন, ওসব কথা রাখো, তোমার খবর বলো। আমি বললাম, রাশেদা খাতুন যখন শশীকে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর পুরে তীর্থযাত্রা করলো, ওদিকে জাহিদুল ভেবে দেখলো, সে কিছু একটা করে যদি না বসে, তাহলে লোকে তাকে মরদ বলবে না। তাই কোনোও কালবিলম্ব না করে ডোরাকে নিকে করে বসলো। তাতে তার কোনো বেগই পেতে হয়নি। সে ওদেরই তো অভিভাবক ছিলো। সুতরাং ‘আপনা উদ্যান ফল, তাতে কিবা বলাবল’ স্বামী স্ত্রীর দ্বৈত সংগ্রামে ডোরাকে বলি হতে হয়েছে। আঘাতটা সবচেয়ে বেশি লেগেছে তায়েবার। সে ছোটো বোনটাকে প্রাণের চাইতে ভালোবাসাতো আর জাহিদুলকে বাবারও অধিক শ্রদ্ধা করতো। তায়েবার সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মানসিক আশ্রয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয় ওটাই তার অসুখ গুরুতর হয়ে ওঠার মূল কারণ। নরেশদা কিছুক্ষণের জন্য মুখের ভেতর পুরে দেয়া গ্রাসটা চিবুতে পারলেন না। দু’মিনিটের মতো ঝিম মেরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার ঠিকানা সংগ্রহের বৃত্তান্তটা বলো।

আমি শুরু করলাম। জাহিদুল আমাকে দেখার পর ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। জানেন, নরেশদা ওঁকে এখন বেশ স্লীম দেখায়। ভূড়িটাও কোথায় যেনো আত্মগোপন করেছে। গোঁফজোড়া এমন কায়দা করে ছেটেছেন, কাছে থেকে না দেখলে পাকনা অংশ চোখেই পড়ে না। নরেশদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি আবার আজেবাজে কথা বলছো। কি ঘটেছে সেটাই বলো। সুতরাং আরম্ভ করলাম। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। মুখ খুলতেই পারিনি। কি জানি কেউ যদি কিছু মনে করে। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললাম, আপনি কি একটু বাইরে আসবেন? জাহিদুল উঠে এলে আমি তাকে সিঁড়ির গোড়ায় ডেকে নিয়ে বললাম, আপনার কাছ থেকে আমি তায়েবার ঠিকানাটি সংগ্রহ করতে এসেছি। জাহিদুল অত্যন্ত উন্মা এবং ঝঝের সঙ্গে বললেন, আমি কি পকেটে পকেটে তায়েবার ঠিকানা বয়ে বেড়াই নাকি? আমি তার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানালাম। আপনার কাছে আমি তায়েবার ঠিকানা নিতে এসেছি এবং আপনি জানেন তার ঠিকানা। ভালোয় ভালোয় যদি না দেন চিৎকার করবো, চেঁচামেচি করবো। একেবারে বিফল হলে অন্যকিছু করবো। আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে লম্বা চ্যাপ্টা জিনিসটির অস্তিত্ব তাকে বুঝিয়ে দিলাম। ধমকের সুরে আমাকে বললো, এক মিনিট দাঁড়াও। আমি তো ভয়ে অস্থির এই বুঝি পুলিশের কাছে টেলিফোন করে বলবেন, পাকিস্তানী গুপ্তচর পকেটে ছুরি নিয়ে বাংলাদেশের একজন সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করতে এসেছে। কিন্তু সে ওসব কিছুই করলেন না, সিঁড়ি থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে ভেতরের কাগজটা বের করে নিলেন এবং সেটা দেয়ালে ঠেকিয়ে তায়েবার হাসপাতালের নাম, ওয়ার্ড এবং বেড নম্বর লিখে আমাকে দিলেন। আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিলো? দেশ থেকে আসার পর এই প্রথম একটা কাজের মতো কাজ করলাম। করুণার ওপর বাঁচতে বাঁচতে নিজের অস্তিত্বের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমরা যখন নিচে নামলাম, তখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। কোলকাতা শহরের যন্ত্রযানের চলাচল একেবারে কমে এসেছে। তথাপি একথা বলা যাবে না কোলকাতা শহর বিশ্রাম নিচ্ছে। নোঙরা ঘেয়ো রাস্তা মান্ধাতার আমলের পাতা ট্রামলাইন, উন্মুক্ত ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষজনের গাদাগাদি ঠেসাঠেসি ভিড় দেখলে একথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এই নগরী বিশ্রাম কাকে বলে জানে না, শুধু যন্ত্রণায় কঁকায়। আচমকা ছুটে চলা নৈশ ট্যাক্সিগুলোর আওয়াজ শুনলে একথাই মনে হয়। ডানদিকের উঁচু বিল্ডিংটার ফাঁকে একখানি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রাস্তার গর্তের জমা পানিতে চাঁদের ছায়া পড়েছে। আহা তাহলে কোলকাতা শহরেও চাঁদ ওঠে। নরেশদা পানের দোকান থেকে পান এবং সিগারেট কিনলেন। পকেটে পয়সা থাকলে দুনিয়ার ভালো জিনিস যতো আছে কিনতে তার জুড়ি নেই। আমার হাতে একটা তবক দেয়া পানের খিলি তুলে দিয়ে বললেন, নাও খাও। কাল আবার পয়সা নাও থাকতে পারে। তারপর আবৃত্তি করলেন, নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও।

হোস্টেলের গেটে এসে দেখলাম, দারোয়ান গেটের তালায় চাবি লাগাচ্ছে। সেই আগের দারোয়ানটিই। বললো, বাবুজী আওর একটু হোলে গেট বন্ধ হোয়ে যেতো। তখন তো খুব অসুবিধে হোয়ে যেতো। আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ওপরে এলাম। আজ হোস্টেল একেবারে ফাঁকা। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ছেলেরা থাকে, সবাই বারাসত রিফিউজি ক্যাম্পে নাটক করতে গেছে। নরেশদার ভাই দু’জনও বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গে গেছে। অঢেল জায়গা, ইচ্ছে করলে আমরা দুজন দু’রুমে কাটাতে পারি। অন্যদিন যে প্রাইভেসির অভাবে অন্তরে অন্তরে গুমরাতে থাকি আজ সেই প্রাইভেসিটাই বড়ো রকমের একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ালো। আমরা দু’জন পরস্পরকে এতো ভালোভাবে চিনি যে হা করলে একে অপরের আলজিভ পর্যন্ত দেখে ফেলি।

নরেশদা বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ে পুরোনো কথার খেই ধরে জিগেস করলেন, তায়েবাকে কোন্ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে? জবাব দিলাম, পিজিতে। তা ভালোই মনে হলো সকলের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে। আগের মতোই আছে, জেদী, বেপরোয়া। কিন্তু ডাক্তার যা বললেন, তাতে মনে হলো অসুখটা খুব একটা সাংঘাতিক। আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে। নরেশদা জিগগেশ করলেন, ডাক্তার কী রোগ বললেন। উল্টো ডাক্তার আমাকে জিগগেস করলেন, কী রোগ। আমরা কেমন করে বলবো। তায়েবা কখনো তার রোগের কথা আমাকে বলেছে নাকি! এটা তার প্রাইভেট ব্যাপার। নরেশদা বললেন, আমি তো কোনো কারণ খুঁজে পাইনে কেনো তোমার কাছে তায়েবার রোগের বিষয়ে জানতে চাইবেন। আমি বললাম, রহস্য টহস্য কিছু নেই। তাহলে গোটা ব্যাপারটা আপনাকে খুলেই বলি।

তায়েবা বলেছে, আগামীকাল যদি হাসপাতালে যাই তার জন্য কিছু ভাত এবং ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু জিরে আর হলুদ দিয়ে যেনো রান্না করে নিয়ে যাই। তাকে নাকি এক মাস থেকে ভাতই খেতে দেয়া হয়নি। আমি ভাত বেঁধে নিয়ে গেলে সেটা সে খাবে। এ ব্যাপারে ডঃ মাইতির কাছে আবদার ধরেছিলো। ডঃ মাইতি এক শর্তে রাজি হয়েছেন। ডঃ ভট্টাচার্যি যেনো জানতে না পারেন। তিনি জানতে পারলে তায়েবাকে নাকি হাসপাতালে থাকতে দেবেন না। তিনি ট্রাম স্টপেজের গোড়ায় এসে এ কথা আমাকে জানিয়েছেন। আরো বলেছেন, রান্না করার সময় কিছুতেই যেনো লবণ না দেই। পরে অবশ্য তাঁকে আপন মনে বিড়বিড় করতে শুনেছি, মেয়েটা তো শেষই হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যা খেতে চায় খেয়ে নিক না । এই শেষের কথাটি শুনে আমার ভয় ধরে গেছে। তায়েবার যদি ভয়ানক কিছু ঘটে, সে যদি আর না বাঁচে।

নরেশদা সিগারেট ধরিয়ে আরেকটা ধমক দিলেন। কি সব আবোল তাবোল বকছো। বাঁচবে না কেনো, চুপ করো। মরণ কি খেলা নাকি! পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এতদূর যখন আসতে পেরেছে, দেখবে নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবে। হয়তো একটু সময় নেবে এই ভাত মাছ রান্নার ব্যাপারটি নিয়ে কিছু ভেবেছো কী?। না এখনো ভেবে ঠিক করতে পারিনি। আপনি বনগাঁ থেকে ফেরার পর আমি এলাম। সারাক্ষণ হাসপাতালেই তো কাটিয়ে এলাম। সত্যিই রান্না করাটাও দেখছি একটা অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা নরেশদা একটা কাজ করলে হয় না। আমার বান্ধবী অর্চনা আছে না। গোলপার্কের কাছে যার বাসা। সে বাসায় তো আপনিও গিয়েছেন। তাকে গিয়ে সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে বলবো, ভাবছি কাল সকালে তার বাসায় যাবো। অবশ্যই অর্চনা কোনো একটা উপায় বের করবে। নরেশদা বললেন, তিনি তো সকালবেলা কলেজে যান। দেখা করবে কেমন করে। আর কলেজে থেকে যদি সোজা বান্ধবীর বাসা বা অন্য কোথাও চলে যান, তখন কি করবে? একেবারে ফাঁকার উপর লাফ দেয়া যায় নাকি? আমার বোপোদয় হলো। সত্যিই তো এরকম ঘটতে পারে। আমি মাথা চুলকে বললাম, আরো একটি ভালো আইডিয়া এসেছে। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে কাকাবাবু মুজফফর আহমদের কাছে যাবো। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তাঁর কাছে সব খুলে টুলে বললে একটা উপায় অবশ্যই বের করে দেবেন। তোমার মাথায় যতো সব উদ্ভট জিনিস জট পাকিয়ে রয়েছে। নিজে বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারেন না তার কাছে যাবে ভাত আর ছোটো মাছের আবদার করতে। তোমার বয়েস বাড়ছে না কমছে। আমি তো কোনো পথ দেখছিনে। কি করবো আপনি না হয় বলুন।

একটু অপেক্ষা করো। হোস্টেলের রান্নাঘরে গিয়ে নরেশদা কয়েকবার চিত্ত চিত্ত করে ডাকলেন। চিত্ত জবাব দিলো, যাই বাবু, অতো চিৎকার করবেন না। রাত বাজে বারোটা, এখনো রান্নাঘর ধোয়া শেষ করতে পারিনি। নরেশদা বললেন, বাবা কোনো কাজ নয়, এই তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। রান্নাঘর থেকে কালিঝুলি মাখা অবস্থায় চিত্ত আমাদের রুমে এসে বললো, আজ্ঞে বাবু বলেন। নরেশদা বললেন, বাবা কাল তিনটের মধ্যে একপোয়া সরু চাল এবং কিছু ছোটো মাছ মরিচ না দিয়ে শুধু হলুদ জিরে দিয়ে রান্না করে দিতে পারবে? একটা রোগীর জন্য। তুমি না পারলে অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখবো। তা বাবু হয়তো পারা যাবে। কিন্তু বাজারটা আমি করবো না আপনারা করবেন? সেটাও বাবা তোমাকে করতে হবে। ট্যাংরা মাছ পাওয়া যায় কিনা দেখবে। এই নাও, নরেশদা আস্ত একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট চিত্তের হাতে তুলে দিলেন। চিত্তের মুখমণ্ডলে একটা প্রফুল্লতার ছোঁয়া দেখা গেলো।

নরেশদা বললেন, ঘুমোবে? বললাম, ঘুম যে আসতে চাইছে না। চোখ বন্ধ করে থাকো, এক সময় আসবে। তিনি বাতি নিভিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরে নাক ডাকতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু আমি চোখের পাতা জোড়া লাগাতে পারছিলাম না। কোথায় একটা মস্তবড়ো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। তায়েবা, ডোরা, জাহিদুল, আমি, নরেশদা- আমাদের সকলেরই জীবন অন্যরকম ছিলো এবং অন্যরকম হতে পারতো। মাঝখানে একটা যুদ্ধ এসে সবকিছু ওলোটপালোট করে। দিয়ে গেলো। যতোই চিন্তা করতে চেষ্টা করিনে কেনো একটা সূত্রের মধ্যে বাঁধতে পারিনে। সব কিছুই এলোমেলো ছাড়া ছাড়া হয়ে যায়। এই দু-আড়াই মাস সময়, এরই মধ্যে কি রকম হয়ে গেলো আমাদের জীবন। সাতই মার্চের শেখ মুজিবের সে প্রকাণ্ড জনসভার কথা মনে পড়লো। লক্ষ লক্ষ মানুষ, কি তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা! চোখে কি দীপ্তি! কণ্ঠস্বরে কি প্রত্যয়! আন্দোলনের সে উত্তাল উত্তুঙ্গ জোয়ার, সব এখন এই কোলকাতায় রাতে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অথচ এখনো দু-আড়াই মাসও পার হয়নি! সে পঁচিশে মার্চের রাতটি, আহা সেই চৈত্র রজনী। সেই বাংলাদেশের চৈত্র মাসের তারাজ্বলা, চাঁদজ্বলা আকাশ। বাংলাদেশের জনগণের বর্ধিত আকাক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আরো প্রসারিত, আরো উদার হওয়া আকাশ। মানুষের ঘ্রাণশক্তি কি তীক্ষ্ণ! কিছু একটা ঘটবে সকলের মনের ভেতর একটি খবর রটে গেছে। দলে দলে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আপনাআপনি তৈরি হয়ে উঠছে ব্যারিকেড। জনগণের সৃজনী শক্তির সে কি প্রকাশ। রাত এগারোটা না বাজতেই রাস্তায় নামলো ট্যাঙ্ক। কামান, বন্দুক, মেশিনগানের শব্দে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। ভারী ট্যাঙ্কের ঘড় ঘড় ঘটাং ঘটাং শব্দে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো সরে যাচ্ছে ব্যারিকেডের বাধা। সেই চৈত্র রজনীর চাঁদের আলোতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের রাজপথের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যের ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্কের ওপর দাঁড়ানো দু’জন সৈন্যের বাদামী উর্দির কথা আমি ভুলতে পারছিনে। ভুলতে পারছিনে তাদের ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল, আর কটমটে চোখের দীপ্তি।

তারপর কি ঘটলো? তারপর? একটা ঘটনার পাশে আরেকটা ঘটনা সাজিয়ে সঙ্গতি রক্ষা করে চিন্তা করতে পারিনে। আগামীকাল কি ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আঁচটুকুও করতে পারিনে। তায়েবা যদি মারা যায়, কি করবো জানিনে। আমার মা, বোন, ভাইয়ের ছেলেরা বেঁচে আছে কিনা জানিনে। যেদিক থেকেই চিন্তা করিনে কে্নো, একটা বিরাট ‘না’-এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সব ব্যাপারে এতোগুলো ‘না’ নিয়ে মানুষ বাঁচে কেমন করে? সাবধানে উঠে বাতি না জ্বালিয়ে কুঁজো থেকে এক গ্লাস পানি গড়িয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। একটা ট্যাক্সি ঘটাং ঘটাং করে শিয়ালদার দিকে ছুটে গেলো। আমি সন্তর্পণে দরোজা খুলে ব্যালকনিতে চলে এলাম। কোলকাতায় একসঙ্গে আকাশ দেখা যায় না। ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে থাকা নক্ষত্ররাজি, এদের কি আমি আগে কখনো দেখিনি। ছায়াপথে ফুটে থাকা অজস্র তারকারাজির মধ্যে আমার প্রিয় এবং পরিচিত তারকারাজি কোথায়? চোখের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *