০৩-৪. একটি উত্তেজনাময় সন্ধ্যা

০৩. একটি উত্তেজনাময় সন্ধ্যা

পশ্চিমের লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক আপনমনে সিগারেট টানছিলেন। বিজু আর রামু দুজন একসঙ্গে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, জাফলং-এ আপনার পরিচিত কেউ আছেন?

ভদ্রলোক আকাশের ওপর চোখ রেখে শুধু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন। রামু আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ওঁকে আমাদের বাসায় থাকতে বলবি?

আমি চাপা গলায় বললাম, লুকিয়ে রাখতে হবে যে। বড় জেঠু জানতে পারলে হুলস্থুল কাণ্ড বাধাবে।

রামু তেমনি ফিসফিস করে বললো, এক রাত আমাদের সঙ্গে চিলেকোঠার ঘরেই থাকতে পারেন।

আমি মাথা নেড়ে সায় জানলাম। ভদ্রলোককে বললাম, আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন।

এইবার তিনি আমাদের দিকে তাকালেন। মিষ্টি হেসে বললেন এক রাতের ব্যাপার তো। তোমরা যদি আমার কথা কাউকে না বললো তাহলে এই পাহাড়েই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো। গাছতলায় ঘুমোনোর অভ্যেস আছে আমার।

আমি বললাম, এখানকার শীত সম্পর্কে আপনার তাহলে কোনো ধারণাই নেই। বাতির আগুন না জ্বেলে আপনি থাকতেই পারবেন না। আর বাগানে আগুন দেখলেই পাহারাদার এসে ধরবে।

আমাকে বাসায় নিয়ে কী বলবে? ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলেন।

কাউকে কিছু বলতে হবে না। আপনাকে চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে রাখবো।

তোমরা আমার জন্যে কেন এতটা করবে? পুলিসেরা টের পেলে তোমাদের সবারই বিপদ হবে!

তার কথার কী জবাব দেবো কিছুক্ষণ ভেবে পেলাম না। তারপর তাকে যে কথাটা বললাম সে কথা আমরা অচেনা কাউকে বলি না। আমি রীতিমতো গম্ভীর হয়ে বললাম, আমাদের বড়দাও একজন বিপ্লবী। তিনবছর ধরে তিনি জেলে আছেন। আপনাকে দেখে বড়দার কথা পড়লো বলেই আপনার জন্যে আমাদের ভাবতে হচ্ছে।

বড়দা বড় জেঠুর ছেলে, আমাদের বংশের সবার বড়। বড়দা বহুদিন গোপন ছিলেন। সেবার জেঠিমা মারা যাবার খবর শুনে যখন দেখতে এলেন, তখনই পুলিস এসে তাকে ধরে নিয়ে গেলো। আমরা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বড়দাকে আমরা কখনো কাছে না পেলেও তার জন্য আমাদের তিনজনের মনের ভেতর নরম একটা জায়গা ছিলো। বাড়িতে কেউ কখনো বড়দার কথা বলে না। বড়দার কথা শুনলেই বড় জেঠু বলেন, এ বাড়িতে ওর নাম কেউ উচ্চারণ করবে না। ও আমার ছেলে নয়। জেল থেকে মাঝে মাঝে দিদা আর জেঠুর কাছে বড়দার চিঠি আসে। জেঠু কখনো বড়দার চিঠির জবাব দেন না। তবে মা জেঠুকে একদিন সেই চিঠি পড়ে কাঁদতে দেখেছেন।

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আপনমনে বললেন, আমি জানি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিপ্লবীরা আছে। তাদের ভাইবোনেরা আছে। একজন বিপ্লবীর এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর কী হতে পারে!

রামু খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, আপনি তাহলে সত্যি আমাদের সঙ্গে থাকছেন?

ভদ্রলোক হেসে রামুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই। আমিও তোমাদের ভাই।

আমি হেসে বললাম, তাহলে আপনাকে আমরা কী ডাকবো বলে দিন।

তিনি একটু ভেবে মৃদু হেসে বললেন, ছোটবেলায় আমাকে বাড়িতে দুলাল ডাকতো। এ-নামে এখন আমাকে কেউ চেনে না! ডাকার মতো কেউ আর বেঁচেও নেই। তোমরা আমাকে দুলালদা ডাকতে পারো।

রামু আর বিজু প্রায় একসঙ্গে বললো, কী সুন্দর নাম দুলালদা। কেউ না ডাকুক আমরা ডাকবো।

দুলালদাকে আমাদের প্রথম থেকেই ভালো লেগে গিয়েছিলো। সেজদা, ঝন্টুদা, ছোটদারা সবাই দল বেঁধে নাটক করেন, আমাদের কাছেও ঘেষতে দেন না। বলেন, বড়দের এখানে ঘুরঘুর করিস কেন? দুলালদা কী চমৎকার বন্ধুর মতো কথা বলেন। মনেই হয় না যে তিনি আমাদের চেয়ে ছসাত বছরের বড়।

রামু বললো, অন্ধকার হয়ে এলো। চল্ বাড়ি যাই।

কখন যে আমাদের চারপাশে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে টেরও পাই নি। জেঠিমা নির্ঘাত একচোট বকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিজু বললো, দুলালদাকে নিয়ে বাসায় ঢুকবি কীভাবে?

আমি বললাম, তোরা আগে চলে যা। পেছনের খিড়কি দরজাটা খুলে রাখিস। আমি দুলালদাকে নিয়ে একটু পরে আসছি। জেঠিমা জিজ্ঞেস করলে বলিস আমি প্যাট্রিকদের বাসায় গেছি।

রামু আর বিজু উঠে চলে গেলো। দুলালদা আমাদের বাড়ির সব কথা শুনলেন। রামুর বাবা নেই শুনে দুঃখ পেলেন। মেজ জেঠু রোড এ্যাকসিডেন্টে কীভাবে মারা গেলেন, জেঠিমা আর রামু কীরকম আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছিল, সবই দুলালদাকে বললাম। এমনকি সোনিয়ার কথাও বাদ গেলো না। তবে একটু বাড়িয়ে বললাম, সোনিয়া আমার বন্ধু। দুলালদা বললেন, আমার কথা তোমাদেরকে রাতে বলবো। অবশ্য তোমরা যদি শুনতে চাও।

আমি বললাম, আপনার সব কথা না শুনলে রাতে আমাদের ঘুম হবে না দুলাল দা।

দুলালদাকে নিয়ে যখন বাড়িতে এলাম তখন রীতিমতো রাত হয়ে গেছে। উঠোনে ছোড়দারা হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটিয়ে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মহড়া দিচ্ছেন। আমরা সদর দরজা দিয়ে না ঢুকে পাচিলের গা ঘেঁষে খিড়কি দরজার দিকে গেলাম। নানারকম ময়লা আবর্জনা মাড়িয়ে যখন লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাবো তখন অন্ধকার কুঁড়ে রামু বেরিয়ে এলো। ফিসফিস করে বললো, এত দেরি করলি কেন? কখন থেকে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি! সোজা উঠে যা। আমি ছাদে যাবার বড় দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।

অন্ধকারে ভূতের মতো রামুকে দেখে আমি দারুণ চমকে উঠেছিলাম। রীতিমতো ভয়ই পেয়েছিলাম। কাঁধের ওপর দুলালদা হাত রাখতেই সব ভয় কর্পূরের মতো উবে গেলো। আমরা দুজন পা টিপে টিপে ছাদে উঠে এলাম। পুরোনো লোহার সিঁড়ি বেয়ে জোরে উঠতে গেলেই বিচিত্র সব শব্দ হয়।

ছাদের ওপর চন্দনের গুড়োর মতো মোলায়েম জ্যোৎস্না এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিলো। চারপাশে কালো কালো পাহাড়ের সারি। মনে হয় সাদা কুয়াশার আকাশের নিচে জমাট বাধা উত্তাল কালো সমুদ্র। দূরের পাহাড়গুলো ঘন সাদা কুয়াশার চাঁদরের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। দুলালরা বললেন, কী চমৎকার রাত।

এরকম চমৎকার রাত আমরা রোজই দেখি। তবে এমন উত্তেজনা আগে কখনো বোধ করি নি। পুলিস হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন একজন বিপ্লবীকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাঁর ভালো-মন্দের ভার সবটুকু আমাদের ওপর–এর চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কী হতে পারে। অথচ সাত ঘন্টা আগেও আমরা তিনজন ভাবছিলাম, উত্তেজনার অভাবে আমাদের জীবনটা কীরকম ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।

দুলালদা চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। রামু এসে বললো, কার্নিশের ধারে যাবেন না দুলালদা।

দুলালদা একটু অবাক হয়ে বললেন, কেন রামু, পড়ে যাব নাকি!

রামু হেসে বলল, তা কেন! কার্নিশের ধারে আপনার মতো লম্বা কেউ হাঁটলে, দোতালার বারান্দা থেকে দেখা যাবে যে।

রামুর কথা শুনে দুলালদা হেসে ফেললেন–তাই বলো। ঠিক আছে রামু, আমি ছাদের মাঝখানেই থাকবো। এই বলে দুলালদা কী যেন ভাবলেন, আপনমনে মৃদু হাসলেন–যেন একটা মজার কথা মনে পড়েছে। তারপর বললেন, আমাদের বাড়িতে এরকম বিশাল এক ছাদ ছিলো। এরকম বিশাল এক ছাদ ছিলো। ছোটবেলায় ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতাম, আর মা সবসময় বলতেন, কার্নিশের ধারে যাসনে দুলাল! তোমার কথা শুনে সেই ঘুড়ি ওড়ানোর দিনগুলোর কাছে ফিরে গিয়েছিলাম।

কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে আমি বললাম, ঘরে চলুন দুলালদা, কুয়াশা পড়ছে।

দুলালদা চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে বললেন, সত্যিই তোমাদের এখানে শীতটা বেশি।

আমাদের চিলেকোঠার ঘরটা খুব ছোট না হলেও নানারকম অকেজো জিনিসপত্রে সবসময় বোঝাই থাকে। এইসব অকেজো জিনিসের কিছু বাড়ির আর বেশিরভাগই আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি। ঘরের চারভাগের একভাগ জায়গা দখল করে রেখেছে, দাদু আর দিদার বিয়ের সময়কার প্রকাণ্ড মেহগিনি কাঠের পালঙ্কটা। আমাদের মতো পাঁচজন শুতে পারে সেখানে। বাকি জায়গাটুকুর পাঁচভাগের একভাগ জায়গা দখল করেছে দিদার মায়ের দেয়া বর্মীসেগুন কাঠের একটা সিন্দুক। সিন্দুকের পায়ে আঙুরলতার নকশা-কাটা রয়েছে। সিন্দুকের ভেতরের জিনিসপত্র অবশ্য সবই আমাদের তিনজনের। এ ছাড়া দুটো ছোট্ট টেবিল আর একটা রঙচটা ডিভানে ঘরের প্রায় পুরোটাই ভরে আছে।

দেয়ালে ক্যালেন্ডার-কাটা ছবি, ময়ূরের পালক, হরিণের শিং, রঙচঙে ঢাউস ঘুড়ি, রঙিন পেন্সিল দিয়ে বিজুর আঁকা অভিনব প্রাকৃতিক দৃশ্য–সবকিছু দেখে দুলালদা বললেন, বাহ চমৎকার ঘর তো তোমাদের! ছোটবেলায় দেয়ালে ছবি সাঁটার জন্যে কতদিন যে বাবার বকুনি খেয়েছি আমি। তোমরা বারবার আমাকে ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছো।

আমাদের ঘরটা সবসময় ভীষণ নোংরা থাকে। ভাগ্যিস রামু আর বিজু আগে এসে বুদ্ধি করে ঘরটা পরিষ্কার করে রেখেছিলো। নইলে ভারি লজ্জা পেতাম। বিজু এসে বললো, তোরা খেতে যাবি না? মা বলছে কতক্ষণ তোদের জন্য বসে থাকবে?

রামু বললো, তুই খেয়ে নিয়েছিস তো?

বিজু জামার হাতায় মুখ মুছে ঘাড় কাত করে সায় জানালো। আমি বললাম, তুই তাহলে দুলালদার কাছে থাক। আমি আর রামু এক্ষুনি আসছি।

আমরা সবসময় রান্নাঘরে বসে খাই। খাবারঘর বড়দের জন্যে। দুবছর ধরে ছোড়দা খাবারঘরে যাচ্ছে। নইলে আগে পাটি পেতে বসে আমাদের সঙ্গেই খেত। রান্নাঘরে খেতে অবশ্য কোনো অসুবিধে হয় না। পচার মা দুবেলা ঘষেমেজে সবকিছু তকতকে করে রাখে। ও নাকি নোংরা একটুও সহ্য করতে পারে না। পচা যখন ছোট ছিল তখন ওকে কোলে নিতো না, পাছে ও কাপড় নোংরা করে দেয় সেই ভয়ে। মা বলেন, এটা এক ধরনের বাতিক।

আমরা রান্নাঘরে ঢুকতেই সেজ কাকিমা বললেন, তোদের হল কী বল তো, কখন থেকে তোদের ডাকছি, এদিকে জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। তা কতক্ষণ বসে থাকি বল ।!

রামু বললো, সেকি কাকিমা, ছোড়দা তোমাকে ওষুধ এনে দেয় নি?

আর দিয়েছে! সেজ কাকিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার ওষুধ আনতে গেলে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে নাটকের মহড়া দেবে কে! ওদের চাচানিতে আমার মাথা ধরা আরো বেড়ে গেছে।

ছোড়দা আর ঝন্টুদার গলার প্রশংসা না করে পারা যায় না। রান্নাঘরর থেকেও ওদের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, আমি তোমায় ভুলি নি জনাব ইত্যাদি শোনা যাচ্ছিল। ছোড়দারা সামাজিক নাটক করেন না। বলেন, ওসব নাটকে নাকি গলা খুলে সংলাপ বলা যায় না। তাই তাঁরা সবসময় সিরাজউদ্দৌলা, টিপু সুলতান, শাহজাহান, মেবার পতন-এসব নাটক করবেন।

রামু সমবেদনার সুরে সেজ কাকিমাকে বললো তুমি গিয়ে শুয়ে থাকো গে কাকিমা। খাবার আমরা আমাদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। খেয়ে উঠেই তোমার ওষুধ এনে দেবো।

সেজ কাকিমা রেহাই পেয়ে খুশি হয়ে বললেন, তোদের সব বেড়ে রেখেছি। দরকার হলে জালের আলমারি থেকে নিস। মা পায়েস না খেয়ে তোদের জন্যে রেখে দিয়েছেন।

আমরা মাঝে মাঝে আমাদের খাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে খাই। সেজ কাকিমা চলে যাওয়ার পর আমরা এলমুনিয়ামের গামলায় আরো কিছু ভাত বেড়ে নিলাম। বাটিতে যতটুকু তরকারি ছিলো তাতে তিনজন অনায়াসে খেতে পারবো। তরকারি বাড়ার সময় দিদা নির্ঘাত সামনে ছিলেন না।

রামু প্লেট আর তরকারির বাটি দুটো নিলো। আমি ভাতের গামলা, পানির জগ আর দুটো গ্লাস নিয়ে বেশ কসরত করেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলাম। দোতালায় উঠতেই বড় জেঠুর সামনে পড়ে গেলাম। বড় জেঠু আমাদের দেখে চোখ পিটপিট করে বললেন, বাড়িতে কেউ এসেছে নাকি। খাবার নিচ্ছিস কার জন্যে?

আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ আরম্ভ হলো। তাকিয়ে দেখি রামুর মুখটা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমি ঢোক গিলে বললাম, সেজ কাকিমার ভীষণ জ্বর এসেছে। আমাদের দেরি হবে শুনে কাকিমা বললেন খাবার ওপরে নিয়ে যেতে।

বড় জেঠু ভুরু কুঁচকে বললেন, খেতে দেরি হবে কেন, বিকেলে বুঝি বাজারে গিয়ে তেলেভাজা খেয়েছিস?

রামু বলল, কে বলেছে আমরা তেরেভাজা খেয়েছি! আবুর খিদে পায় নি বলেই তো কাকিমা বললেন। আমার সেই কখন ক্ষিদে পেয়েছে।

বড় জেঠুকে দেখে কেউ ভয় পাচ্ছে এটা বুঝতে পারলে তিনি খুব খুশি হন। আমাদের ভাবখানা ছিল ভয়ে যেন আত্মাপাখি খাঁচা-ছাড়া হয়ে গেছে। হঠাৎ জেঠুর খেয়াল হলো সেজ কাকিমার অসুখ। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, সেজ বৌয়ের অসুখ, হাঁদা ওষুধ এনে দেয় নি।?

আমি বললাম, খেয়ে উঠে রামু আর আমি যাবো।

বড় জেঠুর মেজাজ তক্ষুনি সপ্তমে চড়ে গেল। তোরা কী ওষুধ আনবি? হাঁদা বুঝি এখনো উঠোনে বসে চ্যাঁচাচ্ছে? দাঁড়া, ওর পিঠে আমি আস্ত খড়ম ভাঙবো। পরীক্ষায় ফেল করে ওর চর্বি বেড়েছে। এই বলে বড় জেটু খড়ম পায়ে খটাশ খটাশ শব্দ তুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

দুলালদাকে খাওয়াতে গিয়ে বড়দার কথা মনে পড়ে গেলো। দিদা মাঝে মাঝে আপনমনে বলেন, ছোঁড়াটা না-খেয়ে না-দেয়ে বনে-বাদাড়ে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। বড়দার কথা ভাবলে দিদার মন খারাপ হয়ে যায়। বড়দার সঙ্গে কখনো যদি দেখা হয় তখন দুলালদার কথা তাঁকে বলবো! বড়দা যে তখন আমাদের আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরবেন এ কথা হলপ করে বলতে পারি। আবার ভাবলাম, আহা বড়দা যদি এসময়ে বাড়িতে থাকতেন! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো বড়দা এখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ছোট্ট একটা সেলে বন্দি হয়ে আছেন। কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো।

খাবার দেখে দুলালদার মুখটা খুশিতে চকচক করে উঠলো। বুঝলাম সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। ছাদে গিয়ে দুলালদা জগের পানিতে মুখহাত ধুয়ে নিলেন। তারপর আমাদের ময়লা তোয়ালেতে মুখ মুছে খেতে বসলেন। বলেন,

কতদিন পর যে ভাত খাচ্ছি মনে নেই।

রামু দুলালদাকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো। আর দুলালদা–এত সুন্দর ভাত আমি জীবনেও খাই নি; কী চমৎকার রান্না। এসব কথা বলছিলেন।

আমি খেতে খেতে দুলালদাকে বললাম, আজ রাতে ঘুমোনো চলবে না। আমরা আপনার গল্প শুনবো।

উত্তেজনা, উদ্বেগ আর আনন্দে আমার খিদে বহু আগেই উবে গিয়েছিলো। শুধু ভদ্রতা করার জন্যেই বসা। দুলালদা অবশ্য খেতে বসে মেয়েদের মতো লজ্জা করেন নি।

বিজুর মতো সারাক্ষণ খাইখাই স্বভাব অবশ্য আমার নয়। তবে খেতে বসে কেন লজ্জা করবো এটা আমি কখনো বুঝে উঠতে পারি নি। বড়দা আর দুলালদাদের কথা অবশ্য আলাদা। ওঁদের না-খেয়ে থাকার অভ্যেস করতে হয়।

.

০৪. একজন বিপ্লবীর গল্প

খেয়ে উঠে হাত ধুয়ে আবার নোংরা তোয়ালেতে মুখ মুছে দুলালদা একটা চার্মিনার সিগারেট ধরালেন। বাইরে তখন হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই বুঝি বরফ-ঢাকা হিমালয় দেখা যাবে। একটু জোরে বাতাস বইলে ঝাউবনে শনশন শব্দ হয়। কত রাতে লেপের তলায় শুয়ে সেই শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছি। কদিন পরে হাড় কাপিয়ে যে শীত নামবে, শুধু লেপ গায়ে দিয়ে সেই শীত তাড়ানো যাবে না। তখন পচার মা মাটির আঙটায় করে ঘরে আগুন রেখে যায়। শীতের সময় ভোর রাতের দিকে মনে হয়, আমাদের লেপের ওপর বুঝি কেউ ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। গরম মুজোর ভেতর হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কোনো রাতে যদি মুখে গ্লিসারিন মাখতে ভুলে যাই, পরদিন মুখ ধোবার সময় ঠোঁট দুটো ভীষণ জ্বলতে থাকে। ঠাণ্ডা শুকনো বাতাসে ঠোঁট-মুখ ফেটে গিয়ে চড়চড় করে।

জানালা দিয়ে একঝলক ঠাণ্ডা ভেজা-বাতাস হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। রামু উঠে বন্ধ করে দিলো জানালাটা। আমরা তিনজন লেপ মুড়ি দিয়ে খাটের ওপর বসেছিলাম। দুলালদা কিছুতেই খাটে শুতে চাইলেন না। বললেন, ডিভানের ওপর চমৎকার রাত কাটিয়ে দেয়া যাবে। কতক্ষণই বা ঘুমোব!

বিজু ওর লেপটা দুলালকে দিয়ে নিজে এসে রামুর লেপের তলায় ঢুকেছে। দুলালদার সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বার কয়েক জোরে টেনে এক বুক ধোঁয়া ছেড়ে ডিভানের ওপর লেপ মুড়ি দিয়ে বসে বললেন, বলো কী শুনতে চাও। আমার ছোটবেলার গল্প, না এখন কী করি সে-সব গল্প।

বিজু বললো, ছোটবেলার গল্প।

আমি বললাম, এখনকার গল্প।

দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, একসঙ্গে দুটো কী করে বলি!

রামু বললো, আগে ছোটবেলার গল্প বলুন। তারপর এখনকার গল্প।

দুলালদা হেসে ফেললেন, তুমি খুব হিসেবি ছেলে রামু। অঙ্কে কত পেয়েছো?

রামু নির্লিপ্ত গলায় বললো, একশো। বিজু সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিস তো?

বিজু ঘাড় নেড়ে সায় জানালো, আমরা তিনজন গভীর আগ্রহ নিয়ে দুলালদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, দুলালদার মতো আমার যদি একটা বন্ধু থাকতো, যার কাছ থেকে দারুণ রোমাঞ্চকর সব গল্প শোনা যেত আর তার উত্তেজনাময় অভিযানের সঙ্গী হওয়া যেতো, তাহলে বেশ হতো।

আমাদের আগ্রহভরা তিনটি মুখের দিকে তাকিয়ে দুলালদা মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, আমি কিন্তু ভালো বলতে পারি না। আর বলার মতো সে-রকম সাংঘাতিক কিছু নেইও। ছোটবেলাটা তোমাদের মতোই ক্লাস করে, ঘুড়ি উড়িয়ে, দল বেঁধে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি। বাবা-মার একমাত্র ছেলে ছিলাম আমি। আমার বাবা এককালে কমিউনিষ্ট পার্টি করতেন। পরে পার্টি ছেড়ে বিরাট ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। কোলকাতার আলীপুরে আমাদের নিজেদের বাড়ি ছিলো।

বিজু বললো, ছিলো বলছেন কেন, এখন নেই?

দুলালদা বললেন, হয়তো এখনো আছে। আমি জানি না। ছবছর ধরে বাড়ির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

বিজু আবার বললো, আপনার বাবা-মা নিশ্চয়ই এখনো সেই বাড়িতে থাকেন?

দুলালদা ম্লান হেসে বললেন, আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলাম তখন আমার মা মারা যান। বাবাকে ছবছর আগে বাড়িতে দেখে এসেছি। হয়তো তিনি এখনো বেঁচে আছেন। হয়তো-বা নেই। ছবছর আগে, বাড়ি-ঘর বাবা-মা সব কিছু ছেড়েই পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম।

বিজু বললো, প্রথম থেকে বলুন দুলালদা। আপনার মায়ের কথা বলুন।

দুলালদা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলেন। তারপর স্নান হাসলেন–ছোটবেলার কথা আজকাল একেবারেই মনে করতে পারি না। আমার মাও রাজনীতি করতেন। বাবার চেয়ে মা অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। খুব সাদামাটা থাকতেন। আলীপুরের বাড়িটা বাবা নিজের পছন্দমতো সাজিয়েছিলেন। মা বিলাসিতা ভালোবাসতেন না। আলীপুরের সেই ঝকঝকে বাড়িতে মাকে মনে হত অন্য বাড়ির কেউ। মা আমাকে বলতেন সৎপথে থেকে কেউ ধনী হতে পারে না। বড়লোক হতে গেলেই গরিব আর ভালো লোকদের ঠকাতে হয়। মা বাবাকে বলতেন, তুমি আমার বিশ্বাস, আমার আদর্শ সবকিছু ভেঙে দিয়েছে। তোমার সঙ্গে থাকাও অন্যায়। বাবা মার কথা শুনে শুধু হাসতেন। কখনো মাকে বলতেন, দুলালকে আমি আমার চেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। মা বলতেন, তুমি না একসময় কমিউনিষ্ট পার্টি করতে! আমার ছেলেকে আমি নষ্ট হতে দেব না। কমিউনিষ্ট সম্পর্কে আমার একটা ধারণা ছোটবেলা থেকেই ছিলো। তখন আমি মাকে মনে করতাম কমিউনিস্ট। মা আমাকে বলতেন, তোর বাবা নিজেকে তো নষ্ট করেছে, আমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে। দুলাল তুই বড় হয়ে গ্রামে চলে যাবি। গ্রামে গিয়ে মানুষের দুঃখ দূর করার জন্যে কাজ করবি। একদিন স্কুলে থেকে বাড়ি ফিরে শুনি মা নাকি হার্টফেল করে মারা গেছেন। বাড়িতে অনেক লোক। সবাই বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি মাকে একবার দেখেই ছুটে ছাদে চলে গিয়েছিলাম। বহুক্ষণ ছাদে বসে কেঁদেছিলাম। তারপর এক মহিলা এসে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দুলাল তোর মা হার্টফেল করে মারা যান নি। তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

এইটুকু বলে দুলালদা থামলেন। তারপর যেন আপন মনে বললেন, আমার মার নাম ছিল রুনু।

কিছুক্ষণের জন্যে দুলালদা অতীতের এক দুঃখময় সময়ের গভীরে হারিয়ে গেলেন। তার হাতে-ধরা চারমিনার সিগারেটের মাথায় ছাই জমতে লাগলো। ঘরের ভেতরটা তের বছর বয়সের একটি মা-হারা ছেলের দুঃখে ভারী হয়ে গেলো। আমার বুকের ভেতর আমাদের বয়সী একজন দুলালের দুঃখ কান্নার ঢেউ তুললো। বিজু আস্তে আস্তে বললো, তারপর কী হল দুলালদা?

দুলালদা হাতের শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ম্লান হেসে বললেন, মা মারা যাবার পর থেকে বাবাকে আমি কখনো পছন্দ করতে পারি নি। অথচ আমার যাতে এতটুকু অযত্ন না হয় সেদিকে বাবা কড়া নজর রাখতেন। একদিন বাবাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাবা মা কেন মরে গেলেন? বাবা হেসে বললেন, তোর মা আসলে খুব বোকা ছিলো। জীবন সম্পর্কে আজকাল কেউ তোর মার মতো ওভাবে ভাবে না। বাবার কথাগুলো আমার একটুও ভালো লাগে নি। তখনই ঠিক করলাম, আর কেউ মার মতো না ভাবুক, আমি ভাববো। মার আলমারিতে অনেক বই ছিলো। বাবা ওসব বই দেখে হাসতেন। মা বলতেন, দুলাল বড় হয়ে পড়বে। আমি সেসব বই পড়া শুরু করলাম। লেখাপড়ায় আমি তোমাদের মতোই ছিলাম। ক্লাশে সবসময় ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। ম্যাট্রিকে প্লেসও ছিল। কলেজে যাবার আগেই আমি মার আলমারির সব বই পড়ে ফেলেছিলাম। প্রায় সবই ছিল রাজনীতি, অর্থনীতি আর ইতিহাসের বই। গোর্কির মাদার, ফুরমানভের চাপায়েভ, অস্ত্রয়ভস্কির হাউ দা স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড-এর মতো বিপ্লবী সাহিত্যও মার আলমারিতে কম ছিলো না। তোমরা নিশ্চয়ই সেসব বই এখনো পড়ো নি?

বিজু আর রামু একসঙ্গে আমার দিকে তাকালো। লজ্জায় আধখানা হয়ে বললাম, আমি শুধু গোর্কির মা পড়েছি। অন্যগুলোর নামও শুনি নি।

দুলালদা বললেন, কলেজে আমার বন্ধু ছিল দীপা। আমরা পড়তাম প্রেসিডেন্সী কলেজে। দীপার সঙ্গে মাঝে মাঝে রাজনীতির বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। কলেজে প্রথম দুবছর কোনো পার্টিতে যোগ দিই নি। তখন আমাদের ওখানে সিপিএম-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ। অথচ ওদের কাজ পুরোপুরি সমর্থন করতে পারতাম না। ওরা এম-এলদের বলত প্রতিক্রিয়াশীল। এটাও আমি বুঝতাম না–গ্রামে গিয়ে যারা বিপ্লবের জন্য কাজ করছে তাদের কেন প্রতিক্রিয়াশীল বলা হবে।

বিজু বললো, প্রতিক্রিয়াশীল মানে কী দুলালদা?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, খুব বাজে লোককে বলে প্রতিক্রিয়াশীল।

দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, যারা প্রগতির শত্রু, যারা মানুষের ভালো চায় না তারাই প্রতিক্রিয়াশীল। আমি ভাবলাম ভুল করে কোথায় গিয়ে ঢুকবো, আর সবাই বলবে প্রতিক্রিয়াশীল এটা তো হতে পারে না। তবে ভোট দিয়ে আর পার্লামেন্টের কথা বলে যে আমাদের দেশে বিপ্লব হবে না এটা তখন আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি তখন বিএসসিতে ভর্তি হয়েছি, একদিন দীপা এসে আমাকে কিছু লিফলেট আর পত্রিকা এনে দিলো। চারু মজুমদারের লেখা আমি তখনই প্রথম পড়লাম। পড়তে পড়তে দারুণ উত্তেজিত হয়ে গেলাম। পরদিন দীপাকে এসে বললাম, এটাই আমাদের পথ দীপা। আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। দীপা শুধু বললো, আমি জানতাম তোমাকে আমরা পাবো।

তারপর একদিন কলেজ ছাড়ার ডাক এল। সবকিছু ছেড়ে সেদিন ঠিকই বেরিয়ে এসেছিলাম। দীপা ছিলো আমার সঙ্গে। তখন আমার মনে হয়েছিলো কিছুই আমার সাধ্যের বাইরে নয়। দুবছরের মধ্যেই দেশকে মুক্ত করে ফেলবো। বিভিন্ন জায়গায় তখন আমাদের জোর লড়াই চলছে। আমি নিজেও বহু এ্যাকশনে গিয়েছি। কখনো পুলিসের সঙ্গে লড়াই করেছি। কখনো গ্রামের জোতদার মেরেছি। এরকম এক এ্যাকশানে গিয়ে একদিন দীপাকে হারালাম। চারু মজুমদার তখন আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। বলেছিলেন, এটা আত্মত্যাগের যুগ, আত্মরক্ষার নয়। জীবন দেয়ার অগ্রাধিকার পেয়েছি বলেই তো আমরা কমিউনিষ্ট।

রামু বলল, চারু মজুমদারকে আপনি কখনো দেখেছেন দুলালদা?

দুলালদা মাথা নাড়লেন, না দেখি নি। তবে তিনি আমাকে চিনতেন। আমরা সবসময় তাঁর সই করা সার্কুলার পেতাম। দীপা মারা যাবার পর তাঁর চিঠি পেয়ে আমি আরো বেশি সক্রিয় হয়ে উঠলাম। প্রত্যেকটা খতম-এ্যাকশনে আমি নিজে যেতাম। তখন আমাদের বলা হয়েছিলো, শ্রেণীশত্রুর রক্তে হাত না রাঙাতে পারলে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। নিজ হাতে কম করে হলেও তিরিশটা শ্রেণীশত্রু আমি খতম করেছি। পরে অবশ্য তদন্ত করে দেখা গেছে সবগুলো খতম সঠিক ছিলো না।

এরপর শুরু হলো বিপর্যয়। প্রথমে কীভাবে বিপর্যয় শুরু হলো টেরও পাইনি। টের পেলাম তখন, যখন আমরা সিআরপি আর মিলিটারির তাড়া খেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও এতটুকু আশ্রয় পাচ্ছি না। এমনকি যে কৃষকদের মুক্তির জন্যে আমরা লড়াই করেছিলাম তারাও ভয়ে আমাদের আশ্রয় দিতে চাইলো না। আমাদের নিজেদের মুক্ত এলাকাগুলো একের পর এক হাতছাড়া হয়ে গেলো। খবর পেলাম কোলকাতায় আমাদের কমরেডদের পাড়া ঘেরাও করে ধরে এনে, মাথা কেটে নিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। সনাক্ত করার জন্য শুধু মাথাটি রেখে দিতো। একাত্তর সালে কোলকাতায় একরাতে ওরা আমাদের সত্ত্বরজন কমরেডকে এভাবে হত্যা করেছিলো। আমরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। নেতাদের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে আমি আর দুজন কমরেড জব্বলপুরে পালিয়ে গেলাম। সেখানে পাহাড়ে লুকিয়েছিলাম কিছুদিন। আমাদের দেশটা খুবই বড়। অনেক মানুষও সেখানে। তবু লুকিয়ে থাকার মতো যথেষ্ট জায়গা কিন্তু সেখানে নেই। আমি বাঙালি; উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম যেদিকেই যাই মানুষের চোখে ধুলো দিতে পারি না। আমাদের উদ্দেশ্যহীন পথ চলাটাকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখতো, কাজ করতে চাইতাম, কাজ পেতাম না। জব্বলপুরে কতদিন শুধু ঝর্নার পানি খেয়ে কাটিয়েছি। এ-সময়ে শুধু একটা কাজই ঠিকমতো করেছি, সেটা হচ্ছে। পড়াশোনা। পার্টিতে ঢোকার পর যে-কাজটি একেবারেই হতো না। তবে নিজেদের কাজের সঙ্গে তত্ত্বকে মেলাতে না পেরে তখন আরো হতাশ হচ্ছিলাম। নিজেদের পুরো কাজের তদন্ত করে দেখলাম এতদিন আমরা শুধু একটার পর একটা ভুলই করে এসেছি। ভুল যখন করেছি তার মাশুল তো দিতেই হবে। যখন খবর পেতাম আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী বন্ধুকে ওরা বর্বরের মতো হত্যা করেছে তখন নিজেজেই শেষ করে ফেলার ইচ্ছে হতো। কখনো ভাবতাম একটা পিস্তল নিয়ে বেরিয়ে পড়বো, যে বাধা দেবে তাকেই গুলি করবো। আমার রক্তের ভেতর তখন হত্যা করার এক দারুণ নেশা সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরতো। আসলে তখন আমি পুরোপুরি একটা পশুতে পরিণত হয়েছিলাম।

কথা বলতে বলতে দুলালদার মুখে যন্ত্রণায় নীল ছায়া ঘনিয়ে এলো। আমি বুঝলাম এসব কথা বলতে দুলালদার খুব কষ্ট হচ্ছে। রামু আর বিজু অসহায়ের মতো দুলালদার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি বললাম, এখন থাক দুলালদা। পরে কখনো শুনবো।

দুলালদা ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন, এখন আর আমার কষ্ট হয় না। তখন হতো। এমন অনেক কথা আছে যা তোমাদের বলা যাবে না, অথচ কী ভয়ংকর যন্ত্রণায় স্মৃতি! আমাকে সারাক্ষণ রক্তাক্ত করতো। একজন মানুষের যন্ত্রণা কতখানি চরমে যেতে পারে সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে।

রামু বললো, এখন আপনাদের অবস্থা কী রকম দুলালদা?

দুলালদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার ছবি আছে পুলিশের কাছে। কলেজে থাকতে আমার দাড়ি ছিলো। এখন দাড়ি কেটে ফেললেও বেশিক্ষণ নিজেকে এক জায়গায় লুকিয়ে রাখা যায় না। চেরাপুঞ্জি ছিলাম দিন দশেক। পুলিশ টের পেয়ে গেলো। আজ রাতেই আমাকে ধরবার প্ল্যান করেছিল। তাই ভোর না হতেই সেখান থেকে পালিয়েছি। পার্টির যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও ঠিক আমার মতো। কোনও যোগাযোগ নেই। পার্টি ভেঙে কয়েকটা গ্রুপ হয়েছে। সবাই পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। লেনিনের একটা কথা এতদিনে উপলব্ধি করছি–বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লব হয় না।

বিজু বলল, আচ্ছা দুলালদা, পুলিস কি আপনাকে ধরার জন্যে এখানে আসতে পারে?

দুলালদা মৃদু হেসে বললেন, পারে। তবে ওখানকার পুলিস নয়। এখানকার পুলিস পেলেও আমাকে হাজতে পুরে দেবে। আমাদের পুলিস যদি সন্দেহ করে আমি এদিকে এসেছি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এখানকার পুলিসকে খবর দেবে। আমাদের পুলিসের চেয়ে তোমাদের পুলিসরা বিপ্লবীদের জন্য এতটুকু ভালো নয়, এ খবর আমার জানা আছে।

আমি ভাবছিলাম চেরাপুঞ্জির কথা। পুলিস এতক্ষণে নিশ্চয়ই তন্নতন্ন করে দুলালকে খুঁজেছে। দুলালদা যদি টের না পেতেন তাহলে ঠিকই তিনি ধরা পড়ে যেতেন। ধরার পর দুলালদাকে নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতো। আজ রাতে আমরা ওঁকে আমাদের ঘরে না আনলেও ধরা পড়তে পারতেন। আজকাল মাঝেমাঝে রক্ষীবাহিনী আর বিডিআরেরা জাফলং ঘুরে যায়। তা ছাড়া পাহারাদার তো আছেই। কদিন আগে ওরা এক স্মাগলারকে ধরেছিলো। দুলালদাকে ওরা স্মাগলার সন্দেহ করেই ধরতো।

বাইরে মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বইছিলো। পুরোপুরি শীত নামার আগে এখানে ঝড় হয়। ঝাউবনে বাতাসের শনশন শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ঝড় আসার আগে এরকম এলোমেলা দমকা বাতাস বয়। জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে বুনো কুকুরের করুণ ডাক ভেসে আসছিলো। শীতের ঠিক আগে পাহাড়ি কুকুর দল বেঁধে করুণ গলায় ডাকতে থাকে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তোলে সেই ডাক। বহু দূর পর্যন্ত শোনা যায়। কখনো ফেউয়ের ডাকও শোনা যায়। আমাদের খাসিয়া মালি দারুভূই বলে জয়ন্তিয়া পাহাড়ে নাকি বাঘও আছে।

রামু বলল, দুলালদা আপনি আমাদের এখানে থেকে যান। আমরা আপনাকে লুকিয়ে রাখবো।

বুঝলাম আমার মতো রামুর মনটাও দুলালদার জন্যে খুব নরম হয়ে পড়েছে। ঠিক এই কথাটা আমিও বলতে চেয়েছিলাম।

দুলালদা হেসে বললেন, তাই কি কখনো হয়! আমাকে কাজ করতে হবে না?

আমি বললাম, আপনি কোথায় কাজ করবেন?

দুলালদা একটু ভেবে বললেন, আমি খাসিয়াদের ভেতর কাজ করতে চাই। পাঁচ বছর আগে আমি খাসিয়াদের গ্রামে কিছুদিন কাজ করেছিলাম।

রামু বললো, তাহলে তো আপনাকে এখানে থাকতেই হচ্ছে। খাসিয়াদের ভেতর কাজ করার জন্যে এটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা।

দুলালদা বললেন, কাজ শুরু হলে আমি গ্রামে গিয়েই থাকবো। তবে গ্রামে যাবার আগে হয়তো আরো দুএকরাত এখানে থাকতে পারি; যদি তোমরা আমাকে আশ্রয় দাও।

রামু খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বললো, দু-তিনরাত কেন, দু-তিনমাস থাকুন! আমরাও আপনার সঙ্গে কাজ করবো।

দুলালদা হেসে বললেন, এখানে থেকে কাজ করলে তোমাদের সহযোগিতা আমার সব সময় দরকার হবে। এবার তোমরা শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হলো। আমি ভোর হবার আগেই উঠতে চাই।

শোবার কথা শুনে বিজু হাই তুললো। এত রাত অব্দি জেগে থাকার অভ্যেস নেই ওর। রামু শুতে শুতে বললো, আপনার ঘুম ভাঙলে আমাকেও উঠিয়ে দেবেন।

লাইট নিভিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমি অনেক রাত অব্দি টের পেয়েছিলাম, দুলালদা ডিভানে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আমি ভাবছিলাম কী অদ্ভুত মানুষ এই দুলালদা। তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে মাত্র সাতঘন্টা আগে। এরই ভেতর তিনি আমাদের চিন্তাভাবনা সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছেন। আমার মনে হলো, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা আমাদের দুলালদাই দিতে পারবেন।