হেল কমাণ্ডো – মেজর আনোয়ার হোসেন
অনুলিখন – এ. এইচ. রনজু
দুটি কথা
চিরবিদায় নেয়ার আগে ভাগ্নে রনজুকে বলেছিলেন মেজর আনোয়ার, তুমি সেবা প্রকাশনীর কাজী সাহেবকে গিয়ে বলবে, লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে মেজর আনোয়ার হোসেনের একান্ত অনুরোধ: বইটি যেন তিনি প্রকাশ করেন।
সে অনুরোধ আমি রক্ষা করলাম।
কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, অমানুষিক পরিশ্রম ও অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন সহ্য করার পর তৈরি হয় একজন কমাণ্ডো। বাঙালী এক যুবক কখনও নেমেছে উত্তাল সাগরের অতল গভীরে, কখনও অসীম নীলাকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিচে, কখনও তুষারাবৃত পর্বত-শৃঙ্গে লড়েছে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। নিজের চামড়া পোড়ার গন্ধে সে চমকে উঠেছে, কখনও কুলকুচি করেছে বিষ্ঠাময় পানি দিয়ে, ক্ষুধার তাড়নায় খেয়েছে কুকুরের মাংস। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
আসুন, পাঠক, অবগাহন করুন।
কাজী আনোয়ার হোসেন
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়ানের ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন দুঃসাহসী চৌকস অফিসার। হেল কমাণ্ডো বইটি মূলত তার সৈনিক জীবনের কাহিনি নিয়েই রচিত।
অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে তিনি মুখে বলে গেছেন, আমি সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখেছি। কমাণ্ডো ট্রেনিং সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তিনিই সরবরাহ করেছেন, তবে অন্যান্য কিছু তথ্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকেই সংগ্রহ করে নিতে হয়েছে।
এ-বইটি লেখার কঠিন কাজে অনেকেই আমাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের মধ্যে স্মৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যতার জন্য রইল আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা।
যাঁরা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে বইটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে সাহায্য করেছেন তারা হলেন মেজর এনামুল হক খান (অব.), প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ; ক্যাপ্টেন ওকবা (অব.) জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ বিমান; মরহুম লে. কর্নেল সাইদুর রহমান, লে. কর্নেল কামরুল হাসান মুরাদ, লে. কর্নেল জাকির হোসেন, ব্রিগে. এ. কে. এম. শাহাজান ও ব্রিগে. আবদুল্লাহ আহমেদ মুসা।
আমি এঁদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞ।
এ. এইচ. রনজু।
.
০১.
গভীর রাত। আকাশে চাঁদের লুকোচুরি। চারদিকে মৃদু বাতাস। ঠিক এমনি এক মায়াময় পরিবেশে দূর কোন্ অরণ্যের মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া ছোট্ট একটি স্নিগ্ধ নদী। একটা স্পীডবোট–সেই নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে কোন দূর অজানায়। আর সেই স্পীডবোটের ওপর তন্ময় হয়ে বসে আছে একজন যুবক।
আনোয়ারের ঠিক এমনি একটি স্বপ্ন ছিল। এমনি এক মধুর জীবনের রঙিন কল্পনায় কার না সাধ জাগে। সাধ ছিল ছোট্ট একটি জীবনের। যেখানে সুখ আছে, দুঃখ আছে, প্রাচুর্য আছে, দৈন্যও আছে। আর আছে এগুলোকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়ার মত একজন প্রিয় সঙ্গী, যাকে নিয়ে সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে অস্তাচলগামী সূর্যকে বিদায় সম্ভাষণ জানানো যায়, যাকে নিয়ে সেই স্নিগ্ধ নদীর বুক বেয়ে দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়া যায়, যাকে নিয়ে জীবনের সবটুকু পথ অতি সহজেই অতিক্রম করা যায়।
এই রকম একটি জীবন আনোয়ারের জন্য অতিরিক্ত কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকেই কালো রঙের লম্বা গড়নের এই ছেলেটি ছিল খুব মেধাবী। দুচোখের দৃষ্টি ছিল প্রখর। তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির জন্য যে-কোন জটিল জিনিসকে সহজেই আয়ত্তে রাখাটা আনোয়ারের কাছে তেমন কোন কঠিন কাজ ছিল না। সেজন্য পড়াশোনায় ওর বেশ সুনাম ছিল। শিক্ষকরা ওর প্রতি খুবই আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু কি অদ্ভুত পরিহাস! যে আনোয়ার রাতকে ভয় করত–সেই ওকেই কিনা প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে রাতের আঁধারে। কারণ কমান্ডোদের প্রতি নির্দেশই হলো: রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের মত চমক লাগিয়ে তোমার কমাণ্ডো-নাইফ দিয়ে শত্রুর ওপর হামলা করো।
ছুরি নামক বস্তুটাকে সে কতই না ভয় করত। অথচ ছুরিই হলো ওর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী। একে সঙ্গে নিয়ে ও জীবনে বহু বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করেছে। বহু বিপজ্জনক যাত্রার সঙ্গী হয়েছে এই কমাণ্ডো-নাইফ। আনোয়ারের স্বপ্ন ছিল রাতের গভীরে শান্ত সমুদ্রে প্রিয় সঙ্গীকে পাশে বসিয়ে স্পীডবোট নিয়ে কোন অনাবিষ্কৃত দ্বীপের উদ্দেশে ছুটে চলা। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। ও শুধু সাগরের বুক চিরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটেই চলেনি, সাগরের অতল গভীরে ডুবও দিয়েছে। তখন ওর সঙ্গী রয়েছে ডুবুরি পোশাক, অ্যাকুয়ালাং স্পিয়ার-গান ও প্রিয় নাইফ। আর ও যে সাগরে ছুটে বেড়িয়েছে, সে সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের পরিবর্তে ছিল বিভিন্ন সাইজের ভয়ঙ্কর-দর্শন বোল্ডার, আর সঙ্গী হয়েছে কাঁধের ওপর স্ট্র্যাপ দিয়ে লাগানো ভারী ওজনের প্যাক, সাব মেশিনগান ও কমাণ্ডো-নাইফ।
অদ্ভুত পরিহাস এজন্যই বলছি, যে আনোয়ার পড়াশোনায় ভাল বলে সবাই ধরেই নিয়েছিল, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বেশ কয়েকটা লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ তো হবেই সেই সঙ্গে স্ট্যাণ্ডও করবে। হতও তাই। কিন্তু সবার সে ধারণা আনোয়ারের জীবনে সফল হয়নি। পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর অথবা এই বিভাগের বেশি জোটেনি। ফলে ছাত্র জীবন থেকেই শুরু হয়েছিল সব নাটকীয় পরিবর্তন।
তদানীন্তন পাক-বাহিনীতে আনোয়ার ছিল একটি পরিচিত নাম । আনোয়ার মানেই প্রাণোচ্ছল, কোমলে-কঠোরে মেশানো একটি মন; যে মন অন্যকে সহজেই আপন করে নিত। ও তখন ক্যাপ্টেন। পাক সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমাণ্ডো-ব্যাটালিয়নের একজন অফিসার। তার ছয় ফুট লম্বা, ১৮২ পাউণ্ড ওজনের পেশীবহুল শরীর পাক সেনাবাহিনীর অফিসারদের মুগ্ধতার কারণ ছিল। আদর করে অনেকেই ওকে হেল কমাণ্ডো বলে ডাকত। কেউ কেউ ডাকত লুমুম্বা বলে। তবে সবচেয়ে পরিচিত নাম ছিল কিলু বিলু। যে নামে ও বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহু অফিসারের কাছে পরিচিত। কমাণ্ডো বাহিনীকে যে-কোন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অভিজাত গ্রুপ বলে গণ্য করা হয়। কারণ, যুদ্ধের সময় কমাপ্তোদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভীষণ বিপজ্জনক ও ঝুঁকিতে ভরা।
ছোটবেলায় এই ধরনের বিপজ্জনক ও গুরুত্বপূর্ণ চাকরি ছিল আনোয়ারের স্বপ্নেরও অগোচরে। কারণ কমাণ্ডো হতে হলে চাই বলিষ্ঠ দেহ, যথেষ্ট শক্তি ও প্রচণ্ড মানসিক ক্ষমতা। কিন্তু এগুলোর কোনটাই ছোটবেলায় ওর ছিল না। ১৯৫৯ সালে আনোয়ার দশম শ্রেণীর ছাত্র। ক্যারম খেলা নিয়ে একজনের সঙ্গে তার সামান্য বিরোধ হয়। সেজন্য প্রতিপক্ষ দুষ্ট ছেলেটা ওকে ভীষণ মারপিট করে। ওর ঠোঁট কেটে, নাক ফেটে রক্ত গড়াচ্ছিল। ওর এই দুরবস্থা দেখে বরকতউল্লাহ নামে ওর এক সহপাঠী বলল, তুই ফি সারা জীবন মারই খাবি? প্রয়োজনে মারকে ঠেকাতেও পারবি না? চল, আজ থেকে তোকে আমার সঙ্গে ব্যায়াম করতে হবে। সহপাঠীর পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হলো। আনোয়ার দুর্বল শরীর নিয়ে নতুন ওস্তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলল ব্যায়াম-আখড়ার দিকে।
শুরু হলো রীতিমত শরীর চর্চা। ৩৫ দিন অক্লান্ত প্রচেষ্টার পর জীবনের প্রথম একটি সফল বুক ডন দিল ও। তারপর শুরু হলো অগ্রযাত্রা। দুবছর কঠোর অনুশীলনের পর তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল ক্যারম খেলার সেই সহপাঠীর সঙ্গে যার হাতে সে একদিন প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের মনে পড়ে গেল বিগত দিনের সেই স্মৃতি। ধীরে ধীরে সেই সহপাঠীর দিকে এগিয়ে গেল সে। ওকে দেখেই সেই ছেলেটা চমকে উঠল। কারণ এখন আনোয়ারকে দেখেই বোঝা যায়, সে বেশ দৈহিক শক্তির অধিকারী। মৃদু হেসে সেই সহপাঠীকে সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, ভাল তো? সহপাঠী চমকে উঠে জড়ানো গলায় বলল, হ্য, জ্বি, ভাল আছি। মানে…আপনি কেমন আছেন?
তোমার একটা পাওনা আছে আমার কাছে। সেটা সুদসহ তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার পর আশা করি ভাল থাকব।
সেই সহপাঠী অবাক হয়ে পাওনাটা কিসের জিজ্ঞেস করতেই প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাতে ছিটকে পড়ল। তারপর শুরু হলো আনোয়ারের দেনা পরিশোধের পালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ছেলেটির নাক মুখ বেয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো। তখন আনোয়ার ওকে দাঁড় করিয়ে কলার ধরে বলল, বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিলিয়ে দেখো, ঠিক আছে কিনা। নাউ ইউ গেট লস্ট।
এই সহপাঠী আনোয়ারের জীবনে দুটো জিনিসের পরিসমাপ্তি ঘটাল। তা হলো মার খাওয়া এবং মার দেয়া। এরপর ও আর জীবনে কোনদিন মারামারি করেনি এবং তার দরকারও পড়েনি। পরবর্তী জীবনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সেই প্রহারকারী এবং শুভানুধ্যায়ী বরকতউল্লাহ, দুজনের কাছেই ও হয় সমানভাবে কৃতজ্ঞ। এরপর আনোয়ার চিটাগাং গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা ভার্সিটিতে পরিসংখ্যানে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হলো। মনে মনে ইচ্ছা ছিল লণ্ডন স্কুল অভ ইকোনোমিক্স থেকে পি. এইচ. ডি. করা অথবা লণ্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারী ডিগ্রী নেয়ার। কিন্তু তখনও কি সে জানত, জীবনের মোড়টা এভাবে ঘুরে যাবে? : একদিন আকাশে একটা ফাইটার-প্লেন নানারকম ওলট-পালট করে কসরত দেখাচ্ছিল। তা দেখে আনোয়ারেরও শখ চাপল, সেও পাইলট হবে। সুযোগ বুঝে একবার ইন্টারভিউও দিল। কুইস্ট টেস্ট থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সে আশাতিরিক্ত ভাল করল। কিন্তু নিয়তির সেই অদ্ভুত পরিহাস। অল্পের জন্য চোখের ডাক্তারী পরীক্ষায় ও আটকে গেল। ৬/৬ দৃষ্টিশক্তি প্রয়োজন; কিন্তু ওর হলো ৬/৯, অর্থাৎ ঠিক এক ধাপ নিচে। ডাক্তার ওর অন্যান্য পরীক্ষায় এত খুশি হয়েছিলেন যে, পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত তিনিও ওর জন্যে চেষ্টা করেন। তবুও আনোয়ার, পাইলট আনোয়ার হতে পারেনি। হবে কি করে? বিধিই বাম!. ..
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম ব্যাচে যোগদানের চেষ্টা করল আনোয়ার। তখন প্রথম ব্যাচে ভর্তি হতে লাগত অভিভাবকের ছাড়পত্র। এ ছাড়া ভর্তি করা হত না। ছাড়পত্রের জন্যে আনোয়ার চিঠি লিখল তার বাবাকে। বাবা পত্রের উত্তরে জানালেন, তোমার অনার্স ডিগ্রী নেয়ার আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। তারপর তুমি যেখানে যাও না কেন আমি নিষেধ করব না। কিন্তু এখন অনার্স ডিগ্রী নিতেই হবে। এই কথায় হয়তো সেদিন বিধাতাও সবার অলক্ষে হেসেছিলেন। কারণ পরবর্তীতে ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী নেয়া আর সম্ভব হয়নি। আবার বাবার কাছ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যোগদান করাও সম্ভব হলো না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ৩০৬ নং কক্ষে আনোয়ার থাকত। রূমে ওকে পাওয়া যেত রাত এগারোটার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে পড়াশোনায় ওর তেমন কোন মনোযোগ ছিল না। কারণ ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে ওকে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখাপড়ার প্রতি ওর চরম অনীহা প্রকাশ পেতে থাকল। ক্লাসের সময় ওকে প্রায়ই দেখা যেত কমনরূম, আর্টস বিল্ডিং, ক্যাফেটেরিয়া অথবা কোন সিনেমা হলে।
অনার্স পরীক্ষার আগে আনোয়ার পরীক্ষার ফিস জমা দিতে গিয়ে চমকে উঠল। ক্লাসের হাজিরা রেজিস্টারে ও ডিসকলেজিয়েট। নিয়ম ছিল, শতকরা ষাট ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেয়া যেত। কিন্তু শতকরা চল্লিশ ভাগের নিচে হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়েও পরীক্ষা দেয়া যেত না। কোন উপায় না দেখে এক বন্ধুর পরামর্শে আনোয়ার গিয়ে হাজির হলো বিভাগীয় প্রধানের বাসায়। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন একজন অবাঙালী-নাম ডক্টর আতিকুল্লাহ ডি. এস. সি. । আচার আচরণ ও কথাবার্তায় এমন একটা ভাব ছিল যে তার আশপাশে কোন ছাত্র ভিড়ত না। সেক্ষেত্রে ড. আতিকুল্লাহর বাসায় যাওয়াটা ছিল যে-কোন ছাত্রের জন্য কোন বাঘের গুহায় ঢোকার সামিল। যদিও আনোয়ার তার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। সেও এক স্মরণীয় ঘটনা।
মাঝে মাঝেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে গলা ছেড়ে গান গাইত আনোয়ার। ড. আতিকুল্লাহ একেক দিন ওর পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতেন। গান শেষ হলে মাথায় টোকা মেরে ইংরেজিতে বলতেন, হোয়াই ডিড ইউ স্টপ? কাম অন, ক্যারি অন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ড. আতিকুল্লাহ যে বিষয় পড়াতেন সে বিষয়ে আনোয়ার ছিল রীতিমত মাস্টার। কারণ পরিসংখ্যানে তাঁর সাবজেক্ট নিউমেরিক্যাল ম্যাথমেটিকসে সে কখনও ৯০% এর নিচে নম্বর পেত না। তবুও ড. আতিকুল্লাহ পুরোপুরি খুশি হতে পারতেন না। তিনি মনে করতেন, আনোয়ারের ১০০% নম্বর না পেলেও ৯৯% নম্বর পাওয়া অবশ্যই উচিত। এ ধরনের পূর্ব পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তার ড্রয়িংরূমে বসে, আনোয়ারের শরীর দিয়ে ঘাম বেরুনোর উপক্রম হলো। কিছুক্ষণ পর তিনি ড্রইংরূমে প্রবেশ করলে ও ঢোক গিলতে গিলতে তাঁকে ওর ডিসকলেজিয়েট হবার কথা বলল। সব শুনে তিনি হেসে বললেন, সি মি ইন দ্য ডিপার্টমেন্ট।
এরপর ওকে সঙ্গে করে তিনি নাশতা করলেন এবং নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে ডিপার্টমেন্টে নামিয়ে দিলেন। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে সহপাঠীরা মন্তব্য করল, আনোয়রের ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট ঠেকায় কে? ফার্স্ট ও ঠিকই হয়েছিল, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় নয় হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে নীরস পার্বত্য-অঞ্চলে কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতায়, হয়েছিল পঞ্চাশজন অফিসারের মধ্যে আমেরিকায় পাথফাইণ্ডার, রেঞ্জার ও কমাণ্ডো কোর্সে সিলেক্ট হবার পরীক্ষায়।
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। সবেমাত্র আনোয়ার তিন পেপার পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা খুব একটা ভাল হয়নি। হিসেব করে সে দেখল, গড়ে ৩০% নম্বর আশা করা যেতে পারে। চতুর্থ দিন পরীক্ষা দিয়ে দেখল, একই অবস্থা। সে তখন সামনে সীটে বসা ঘনিষ্ঠ বন্ধু আহসানকে বলল, দোস্ত, আমি আর পরীক্ষা দেব না।
পরীক্ষা তোকে দিতেই হবে। হেড অভ দ্য ডিপার্টমেন্ট থাকতে তোর চিন্তা কি? তাছাড়া তোর ছক্কা মার্কা সাবজেক্টের পরীক্ষা তো এখনও হয়নি, আহসান বলল।
কিন্তু আনোয়ার প্রথম ঘণ্টা যাবার পর খাতায় পরীক্ষা দেব। না এই জাতীয় একটা মন্তব্য লিখে বাথরূমে যাওয়ার নাম করে হল থেকে বের হয়ে এল। ও জানত পরীক্ষা না দিয়ে হলে থাকলে হেড ওকে ঘাড়ে ধরে পরীক্ষার হলে নিয়ে যাবে। তাই মোহাম্মদপুরে এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিল।
এদিকে ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে পরীক্ষার হলে না পেয়ে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। আনোয়ারের সমস্ত সহপাঠী এমন কি ডিপার্টমেন্টের বেয়ারা সুরেশ ও নিয়ামতউল্লাহকেও তিনি আদেশ দিলেন, যেভাবেই হোক আনোয়ারকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু অত বড় ঢাকা শহরে আনোয়ারকে খুঁজে বের করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বেশ কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর সে পরাজিত সৈনিকের মত বাড়ি ফিরে এল। বাবা সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে ভীষণ দুঃখ পেলেন। তবে পরবর্তীতে অনার্স পরীক্ষায় ভালমত পাস করতে পারলে তার আর কোন দুঃখ থাকবে না–একথাও আনোয়ারকে জানিয়ে দিলেন।
১৯৬৫ সাল। আনোয়ার তখন বাড়িতে বসে আছে। এই সময় পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীতে অফিসার পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হলো। ও কাউকে না জানিয়ে দরখাস্ত করল। বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে যথারীতি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে জেন্টেলম্যান ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হলো।
কিছুদিন পরের ঘটনা। আনোয়ার তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। সবার সঙ্গে দেখা করে ও গেল ডিপার্টমেন্টের হেড ড. আতিকুল্লাহর সাথে দেখা করতে। ড. আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে দেখে খুশি হলেন। আরও খুশি হলেন, যখন জানতে পারলেন, ও এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি খুশিতে বলেই ফেললেন, ওয়েল ডান, আনোয়ার, ওয়েল ডান।
এরপর তিনি ওকে কফি অফার করলেন। ঢোক গিলতে গিলতে ও কোনমতে কফি পান করল। এরপর আরেক চমক! তিনি বললেন, আনোয়ার, আই থিংক ইউ স্মোক, এই বলে তিনি ওকে সিগারেট অফার করলেন। ওর তো তখন ভিরমি খাবার জোগাড়। অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি আবার বললেন, ডোন্ট বি শাই, আনোয়ার। নাউ, ইউ আর অ্যান অফিসার। কাম অন।
আনোয়ার হেডের বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে আস্তে করে একটি ফিল্টার টিপড় উঠিয়ে নীরবে ধূমপান করতে লাগল। ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে ড. আতিকুল্লাহ মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ওকে দেখছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, তুম্ জবর দোস্ত স্মার্ট হোগিয়া। এই ধরনের কথোপকথন ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য ওর সহপাঠীরা (তারা তখন এম. এ., এম. এস.সি. ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র হেডের পেছনের জানালা দিয়ে চোখ ছানাবড়া করে দেখছিল।
আনোয়ার অসমাপ্ত তিন পেপার পরীক্ষার নম্বর দেখতে চাইলে হেড-মার্কশীট আনালেন। মার্কশীট দেখে ও তৃতীয় বারের মত চমকে উঠল। নীরবে মার্কশীটের দিকে চেয়ে থাকল সে। একি অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ওর হিসেবে এত গরমিল? পরীক্ষার সময় ওর সব বন্ধুরা হল থেকে বের হয়ে হিসেব করেছিল, কেউ ৬০% নম্বর পাবে, কেউ ৭০% নম্বর পাবে। আনোয়ার হিসেব করেছিল সে পাবে ৩৫% নম্বর। সেজন্যেই পুরো পরীক্ষা দেয়নি সে। কিন্তু তখন কি আনোয়ার জানত যে হিসাবে কত বিরাট ভুল হচ্ছে? ওর আবাল্য অভ্যাস ছিল প্রাপ্ত নম্বর থেকে অনেক কম আশা করা। তার প্রমাণ বেশ ভাল করেই পেল এই মার্কশীট দেখে। তিন পেপারে ও পেয়েছে গড়ে ৫৮%। ড, আতিকুল্লাহ আনোয়ারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ডোন্ট থিংক। আই অ্যাম উইথ ইউ। টুমি আবার পরীক্ষা ডিবে।
বিদায় নেয়ার সময় ড. আতিকুল্লাহ হ্যাণ্ডশেক করে বলেছিলেন, আই উইশ ইওর ব্রাইট লাইফ ফুল অভ জাসটিস মাই বয়।
এরপর ড, আতিকুল্লাহর চেম্বার থেকে বের হয়ে এলে বন্ধুরা ওকে বলেছিল, দোস্ত, তুই-ই দেখালি।
ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখ, ১৯৬৫। ঢাকা বিমান বন্দর। সন্ধ্যা। চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত। আনোয়ার চলেছে অফিসার হবার জন্য পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলের উদ্দেশে। সেদিন ঢাকা বিমান বন্দরে ওর প্রিয় বন্ধু আহসান, সাজেদ, আহসান উল্লাহ, নাজমুল, আহসান আহমেদ সহ অনেকেই উপস্থিত ছিল। তখনও কি আনোয়ার ভেবেছিল, ওকে উত্তাল সাগরের অতল গভীরে নামতে হবে? ছুটতে হবে রাতের আঁধার পেরিয়ে প্লেন নিয়ে অজানার দিকে? লাফ দিতে হবে অসীম অনন্ত মহাশূন্যে? পেরিয়ে যেতে হবে মালাকান হিলস-এর দুর্লজ্জ প্রাচীর? ওকে হারিয়ে যেতে হবে অসীম বিস্তার মরু প্রান্তরে? দুর্যোগের রাত্রে তুষার-ঝড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হবে বরফের দেশে? দুবছরের ব্যবধানে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে হবে দুহাজার মাইল দুর্গম পথ? প্রতিটি পদে অজানা রহস্য। অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। কুত্তার মাংস ভক্ষণ। চারদিকে শুধু হিম শীতল মৃত্যুর হাতছানি!
একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল আনোয়ার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল প্লেনের গ্যাংওয়ের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে শেষবারের মত সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। প্রিয় বন্ধুরা বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল অপসৃয়মান প্লেনের দিকে। প্লেন তখন চল্লিশ হাজার ফুট উপরে। ৬৫-এর যুদ্ধের কারণে শ্রীলংকার ওপর দিয়ে ওভার-ফ্লাই করে ঘণ্টায় ছশো মাইল বেগে সে এগিয়ে চলেছে করাচী বিমান বন্দরের দিকে।
.
০২.
দুই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুল। বিরাট এলাকা জুড়ে চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। সুদৃশ্য লোহার গেটে একাডেমীর উজ্জ্বল নাম ফলক। সদা সতর্ক সশস্ত্র সেন্ট্রি গেট পাহারা দিচ্ছে। এবোটাবাদ থেকে মসৃণ পীচের রাস্তা সোজা এসে গেট দিয়ে ঢুকে গেছে একাডেমীর ভিতরে। ভিতরকার এই মসৃণ রাস্তাটুকু ছাড়া বাকি সব এলাকা উঁচু-নিচু ও এবড়োখেবড়ো। তবুও ভিতরটা একেবারে নীরস নয়। মাঝে মাঝে সারি বাঁধা পাইন গাছ লম্বা হয়ে দূর আকাশের দিকে উঠে গেছে। বাইরের এলাকাটা নিষ্প্রাণ ও ধূসর। চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু পাথুরে পাহাড়।
২৮ ডিসেম্বর সকাল নয়টায় এবোটাবাদ থেকে অন্যান্য নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে আনোয়ারও পৌঁছে গেল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী, কাকুলে। বড় হল-ঘরের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ও তাকিয়ে দেখল, সামনে উজ্জ্বল ফলকে লেখা রয়েছে ক্যাডেটস্ মেস। মেসের অদূরে সুইমিং পুল। সামনে বিরাট ঝকঝকে লন। আনোয়ারের হাতে পশমী দস্তানা, মাথায় কান ঢাকা ফারের টুপি, পরনে কমপ্লিট সুট, চোখে সানগ্লাস। গোল্ড লীফের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আনমনে ধূমপান করছিল ও।
ফেলে আসা অতীত ও নতুন ভবিষ্যতের রঙিন কল্পনায় ওর মন ভরপুর। কল্পনাগুলো যখন দ্রুত দানা বেঁধে উঠছিল, ঠিক তখনই আনোয়ার শুনতে পেল জীবনে শোনা সবচেয়ে কর্কশ কণ্ঠ, ইউ ব্লাডি ফুলস, হোয়াই আর ইউ পাউচিং হিয়ার, অল অভ ইউ নিউ ইন টেকস? সবাই চমকে তাকাল। সামনে তিন-চারজন তাগড়া জোয়ান দাঁড়িয়ে। ওদের সবার গায়ের রং ফর্সা। প্রত্যেকের পরনে ওভারল (প্যান্ট শার্ট এক সঙ্গে সেলাই করা)। ওদের কালো ওভারলে ধুলোবালির ছাপ। পায়ের বুট জুতোও নোংরা। দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে বুটগুলো সকালবেলায় রীতিমত পরিষ্কার ছিল। দেখতে অনেকটা কুলি বা শ্রমিকের মত মনে হচ্ছিল। সবাই পূর্বের মত যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। আনোয়ার হাত পকেটে ঢোকানো অবস্থায় সিগারেট টানছে।
হঠাৎ করে ওদের একজন আনোয়ারের সামনে এগিয়ে এল। ওভারল পরিহিত যুবকের চেহারায় ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছিল। আনোয়ারকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে সে বলে উঠল, ইউ ফুলস, ইউ থিংক দ্যাট দিস ইজ শাহনুর স্টুডিও অভ লাহোর অর হলিউড? টেক ইওর হ্যাণ্ডস আউট অভ দ্য পকেট। আনোয়ার সহ সকলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পকেট থেকে হাত বের করল। ওদের হাতে হ্যাণ্ড-গ্লাভস্ দেখে ওভারল পরিহিত আবার চিৎকার করে উঠল, টেক অফ দ্য ব্লাডি গ্লাভস। বাইরে প্রচণ্ড হাড় কাঁপানো শীত।
আনোয়ার হাত থেকে দস্তানা না খুলে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল, যেন কোন কথাই শুনতে পায়নি। আর একজন ওভারলধারী এগিয়ে এসে গর্জন ছাড়ল, ইউ ব্লাডি শিট, ইফ ইউ ডোন্ট লিসেন টু দ্য বি.এস.এম., লাইফ ইজ গোয়িং টু বি হেল ফর ইউ ইন পি.এম.এ.। পি.এম.এ. কথাটার মানে (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী) বুঝতে পারলেও সে বি.এস.এম. কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না। যাই হোক, অগত্যা সবাই যার যার হ্যাণ্ড-গ্লাভস খুলে পকেটে ভরল। এরপরই তীব্র কণ্ঠে নির্দেশ এল, টেক অফ দি ডার্টি হেড-গিয়ারস অ্যান্ড দ্য স্টুপিড সান গ্লাসেস। সবাই বিনা বাক্যে এই আদেশও পালন করল। এরপর হুকুম মত সবাই হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিল। যারা এক পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়েছিল, তাদেরকে দাঁড় করানো হলো দুই পায়ের ওপর। বি. এস,এম, কথাটার মানে আনোয়ার তখন বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে জানতে পেরেছিল। বি.এস.এম. অর্থাৎ ব্যাটেলিয়ন সার্জেন্ট মেজর। বি.এস.এম.-রা প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটদের নিয়ম শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। নতুন ক্যাডেটরা বাঘের মত ভয় করে এদেরকে।
এবার এক বি.এস.এম. সাহেব এগিয়ে এল আনোয়ারের দিকে। অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি। হঠাৎ চমকে দেবার মত গর্জন করে বলল হোয়াই ডোন্ট ইউ উইশ? সঙ্গে সঙ্গে ও উত্তর দিল, উইশ ইউ গুড লাক। (উইশ মানে যে স্লামালেকুম বলতে হয় সেটা তখনও আনোয়ার জানে না)। সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় গর্জন, আই সে হোয়াই ডোন্ট ইউ উইশ?
ও পুনরায় বলল: উইশ ইউ গুড লাক।
আবার গর্জন: সে স্লামালেকুম স্যার।
ও পুনরায় বলল, স্লামালেকুম।
এবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বি.এস.এম. ফেটে পড়লেন, সে স্লামালেকুম, স্যার।
ও বুঝতে পারল যে স্যার কথাটার ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে।
আনোয়ার সাধারণ ভাবে বলল, স্লামালেকুম, স্যার। আবার বি.এস.এম.-এর হুঙ্কার, লাউডার। ও আরও একটু জোরে বলল। আবার বি.এস.এম.-এর তীব্র কণ্ঠ লাউডার। গলার স্বর বাড়িয়ে দিল সে এক ধাপ। বি.এস.এম. আবারও বলল, লাউডার। এইভাবে আনোয়ার দশ বারোবার গলার স্বর বাড়িয়ে শেষে চিৎকার করে বলতে শুরু করল, স্লামালেকুম, স্যার।
এরপর বি.এস.এম. খুব দৃঢ় অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, হুইচ প্লেস ডু ইউ ডিসগ্রেস? বুঝতে না পেরে আনোয়ার বি. এস. এম.-এর মুখের দিকে বোকার মত তাকাল। আবার বি.এস.এম.-এর প্রচণ্ড কান-ফাটানো গর্জন, হোয়্যার দ্য হেল ডু ইউ কাম ফ্রম? আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ইস্ট, পাকিস্তান। ওহ্ ওহ্, বাংগালী বাবু-বলে বি.এস.এম, একটু অন্য দিকে তাকাতেই নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো, আনোয়ারের। জনৈক মনীষীর উক্তি মনে পড়ে গেল তার, দোজ হু জয়েন দি আর্মি, নাইন আউট অভ টেন আর ফুলস, অ্যাণ্ড রিমেইনিং ওয়ান ইজ ম্যাড।
ইতোমধ্যে বহু সিনিয়র ক্যাডেটের আগমন ঘটেছে। নতুন ক্যাডেটদের এই অসহায় অবস্থা দেখে ওরা বেশ কৌতুক উপভোগ করছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে সিনিয়রদের প্রচণ্ড তর্জন গর্জন। সিনিয়র ক্যাডেটদের মধ্যে আনোয়ার হঠাৎ করে তার পূর্ব-পরিচিত ঢাকার একজনকে দেখতে পেল। তার দিকে তাকিয়ে হাসতেই বি.এস.এম. স্বভাবসুলভ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, ডোন্ট গ্রিন। গ্রিন শরে মানে বুঝতে না পেরে ও আবার হাসল। বি.এস.এম. আবার ধমকে উঠলেন, আই সে, ডোন্ট গ্রিন। এবারেও ও বুঝতে পারল না। বি.এস.এম.-এর কণ্ঠ আবার শোনা গেল, আই সে ডোন্ট শো ইওর ডার্টি টিথ। ডু ইউ আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ইউ ব্লাডি শিট অব এ মিউল?
এবারে আনোয়ার পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারল, বি.এস.এম. কি বলতে চাইছে। সে বলল, সরি, স্যার, নাউ আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ইউ। আনোয়ারের পূর্ব-পরিচিত সেই সিনিয়র ক্যাডেটের নাম আবদুল্লাহ আহমেদ মুসা (বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার)। অবস্থা বুঝতে পেরে সে আনোয়ারের দিকে এগিয়ে এসে বলল, মিস্টার, নো সরি ইন পি.এম.এ। আনোয়ার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বি.এস.এম. মুসাকে বললেন, মোজেস, ইউ বেটার টিউন আপ দিস চ্যাপ। মুসা আনোয়ারকে ফিসফিস করে বলল, তোমার জন্য কোন রূম বরাদ্দ করা হয়েছে .. ইতোমধ্যেই ওর জন্য রূম বরাদ্দ করা হয়েছিল। মুসা কাছেই একজন পোর্টারকে ডেকে আনোয়ারের মালপত্র তার মাথায় চাপিয়ে কাঠের তৈরি একটি ব্যারাকের দিকে এগোতে এগোতে বলল, চলো কেটে পড়ি। ওর জন্য বরাদ্দকৃত দশ নম্বর রূমে ঢুকে মুসা দরজা বন্ধ করে দিল। দুজনে সিগারেট ধরিয়ে শুরু করল নানা রকম গল্প। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। মুসা, কাম ইন, প্লীজ, বলে দরজা খুলে দিল। এক সিনিয়র ক্যাডেট ঘরে প্রবেশ করল। আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। সালামের উত্তরে সিনিয়র ক্যাডেট কঠিন কণ্ঠে বললেন, ডোন্ট ডিসগ্রেস ইওর সিনিয়র, হু ইজ স্ট্যাণ্ডিং উইথ ইউ। এই বলে সিনিয়র ক্যাডেট বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
আনোয়ার অবাক হয়ে চাইল মুসার দিকে। ব্যাপার কি? মুসা ওকে বুঝিয়ে বলল, কোন সিনিয়র-ক্যাডেটের সঙ্গে থাকা অবস্থায় অন্য কোন সিনিয়রকে সালাম দেয়া অপরাধ। কারণ তখন সবকিছুর দায়িত্ব সঙ্গের সিনিয়র ক্যাডেটের ওপর থাকে। এরপর মুসা ওকে পি,এম.এ.-র কিছু কিছু নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিয়ে বলল, প্রথমত রাস্তা দিয়ে চলার সময় খুব জোরে হাঁটতে হবে, অথবা দৌড়াতে হবে। এটা অবশ্য নবাগত ক্যাডেটদের বেলায়ই প্রযোজ্য। কোন সিনিয়রকে এক মাইল দূর থেকে দেখলেও আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে হবে স্লামালেকুম, স্যার। ইউনিফরম ছাড়া ট্রাউজার্সের দুই পাশের পকেটগুলো সেলাই করে রাখা উচিত। কারণ তা না হলে কেউ ভুলবশত পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোথাও দাঁড়িয়ে থ্রাকতে পারে। এটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। সময় সম্পর্কে ভীষণভাবে সচেতন থাকতে হবে। কেউ দরজায় কড়া নাড়লে কাম ইন, প্লীজ বলতে হবে। পি.এম. এ.-র এই ধরনের বেশ কিছু নিয়ম শিখিয়ে চলে গেল মুসা।
পি.এম.এ.-তে ছিল ক্যাডেটদের একটা ব্যাটেলিয়ন। এই ব্যাটেলিয়নের চারটি কোম্পানী-কাশেম কোম্পানী, তারেক কোম্পানী, সালাহউদ্দিন কোম্পানী ও টিপু কোম্পানী। কিন্তু জরুরী অবস্থার জন্য এই সময় আরও এক ব্যাটেলিয়ন বাড়ানো হয়েছিল। এই দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে ছিল–বাবর কোম্পানী, গজনভী কোম্পানী, আওরঙ্গজেব কোম্পানী এবং কায়েদ কোম্পানী। আনোয়ারকে আওরঙ্গজেব কোম্পানীর পাঁচ নম্বর প্লাটুনে পাঠানো হলো। একটা কোম্পানী যখন কমিশন পায়, তখন পরের ব্যাচ সিনিয়র হয়ে যায়। পাস আউট হয়ে যাওয়া কোম্পানীতে নবাগত ক্যাডেটরা সর্বাপেক্ষা জুনিয়র বলে বিবেচিত। এই সময় আওরঙ্গজেব কোম্পানী ছিল সর্বাপেক্ষা জুনিয়র। সুদৃশ্য বিল্ডিংগুলোতে কাশেম ও তারেক কোম্পানীর সিনিয়র ক্যাডেটরা থাকে। বাকি সবাই থাকে কাঠের তৈরি লম্বা ব্যারাক বা ডরমেটরীতে।
আনোয়ার রূমে বসে চুপচাপ একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছে। মালপত্র সব মেঝেতে ছড়ানো ছিটানো। ওর রূমমেট তখনও ঘরে আসেনি। হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার করে কে যেন বলল, অল নিউ ইনটেকস স্ট্যাণ্ড ইনফ্রণ্ট অভ ইওর রূম অন দ্য করিডর। বাইরে প্রচণ্ড শীত। সব নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে আনোয়ারও ঘরের বাইরে, বারান্দার ওপর এসে দাঁড়াল। একজন হাবিলদার এসে সবাইকে ক্যাডেট অফিসের সামনে নিয়ে গেল, ওদেরকে দাঁড় করানো হলো সারিবদ্ধভাবে। সাধারণত ক্যাডেট অফিসকে জি.সি. অফিস বলা হয়। কারণ নতুন ক্যাডেটরা সবাই জি.সি. অর্থাৎ জেন্টেলম্যান ক্যাডেট বলে পরিচিত। জি.সি, অফিস থেকে বি.এস.এম. স্বভাবসুলভ বেপরোয়া ভাব নিয়ে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ালেন। আরও পাঁচজন সিনিয়র ক্যাডেট এসে বি.এস.এম.-এর পাশে দাঁড়াল। এরপর বি.এস.এম. ব্লাডি ফুল, শিট, ইডিয়ট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে নতুন ক্যাডেটদের উদ্দেশে যা বললেন তার মর্মার্থ এই:
আমার নাম করম খান রাজপুত। আমি পি.এম.এ.-র বি.. এস.এম.। বি.এস.এম, কি জিনিস সেটা তোমরা হাড়ে হাড়ে টের পাবে অন্তত যতদিন আমি এখানে বি.এস.এম. হিসাবে আছি। আমার সঙ্গের পাঁচজন তোমাদের পাঁচ প্লাটুনের সার্জেন্ট। সবাই যার যার সার্জেন্টকে চিনে রাখো। এই বলে বি.এস.এম. পাঁচজন সার্জেন্টকে নতুন ক্যাডেটদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর তিনি পি.এম.এ.-র নিয়মকানুন সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দিলেন:
(১) কঠোর সময়ানুবর্তী হতে হবে। কোন জায়গায় নির্দিষ্ট সময় হাজির হবার কথা থাকলে পাঁচ মিনিট আগে সেখানে পৌঁছতে হবে। কেউ চার মিনিট আগে হাজির হলেও তাকে এক মিনিট লেট হিসেবে গণ্য করা হবে।
(২) এক পায়ের ওপর ভর করে বা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো দণ্ডনীয় অপরাধ।
(৩) প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রাখা চলবে না।
(৪) কোন সিনিয়রকে যতদূর থেকে বা যে অবস্থায় বা যেদিক থেকে দেখা যাক না কেন, স্লামালেকুম, স্যার বলতে হবে।
(৫) কোন খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটা অবস্থায় ধূমপান নিষেধ।
(৬) ভোরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় এবং সন্ধ্যায় জাতীয় পতাকা নামানোর সময় বিউগলের আওয়াজ শোনা মাত্র যে যে অবস্থায় বাইরে থাকবে, বিউগল বাজানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যাটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
(৭) সপ্তাহে একবার করে বাধ্যতামূলকভাবে চুল কাটাতে হবে।
(৮) ইউনিফর্ম কড়া ইস্ত্রি এবং বুট বেল্ট চকচকে রাখার দায়িত্ব আদালীর হলেও বাইরে বেরুনোর সময় প্রত্যেক ক্যাডেটকে তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। আরও খেয়াল রাখতে হবে, কাপড়ের বোতাম ও সেলাই যেন নিখুঁত থাকে এবং বুটের ফিতা যেন প্যাঁচ খেয়ে না থাকে।
(৯) অনুমতি ছাড়া নতুন ক্যাডেটরা পি.এম.এ.-র ক্যাফেটেরিয়াতে যেতে পারবে না।, (১০) ছুটির দিন ছাড়া প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে পড়ার টেবিলে পড়াশোনা করতে হবে। এমনকি পড়ার সময় বাথরূমে যাওয়াও চলবে না। বাথরূমের কাজ তার আগেই সারতে হবে।
(১১) পি,এম.এ.-তে সব সময় সুন্দর ছায়াছবি দেখানো হয়। কিন্তু সপ্তাহে একদিন ছায়াছবি দেখার ব্যাপারে নতুন ক্যাডেটদের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
(১২) নাস্তার সময় সকাল সাড়ে সাতটা। লাঞ্চের সময়– বেলা দেড়টা এবং ডিনারের সময় রাত নয়টা। এছাড়াও ভোর সাড়ে চারটায় বেড টি ও বিকেল চারটায় আফটারনুন টি ঘরেই পরিবেশিত হবে। খাওয়ার সময় ছুরি, কাঁটা, চামচের ব্যবহার একটু পরেই শিখিয়ে দেয়া হবে।
(১৩) সপ্তাহে একদিন করে ডিনার নাইট।
(১৪) স্যালুটিং টেস্ট পাস না করা পর্যন্ত কেউ পি.এম.এ.-র মেইন গেটের বাইরে যেতে পারবে না।
(১৫) কোন অবস্থাতেই পি.এম.এ.-র ভিতরে কোন লন মাড়ানো যাবে না। সোজা কথা নো শর্ট কাট ইন পি.এম.এ.।
এছাড়া ভবিষ্যতে আরও নির্দেশ পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। সেই সঙ্গে বি.এস.এম. এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, রিমেম্বার, গড ইজ অলমাইটি ইন স্কাই লাইন, অ্যাণ্ড মাইটি সিনিয়রস ইন পি.এম.এ.।
এর কিছুক্ষণ পর বেলা প্রায় বারোটার দিকে সব নবাগত ক্যাডেটদের স্টোরের সামনে জমায়েত হবার নির্দেশ দেয়া হলো। স্টোর থেকে বুট, মোজা, গরম ফুল আণ্ডারওয়ার, পশমী গেঞ্জি, বেল্ট, ব্যারেট ক্যাপ, ফিল্ড সার্ভিস মার্চিং অর্ডার (একটা বড় প্যাক, দুটো অ্যামুনিশন পাউচ, একটা পানির বোতল), বাঙালী ক্যাডেটদের জন্য ছয়টা করে কম্বল, পশ্চিমা ক্যাডেটদের জন্য তিনটা করে কম্বল, খাকি পুলওভার, মাঙ্কি ক্যাপ, তিনটে সাদা বিছানার চাদর, দুটো বাথ টাওয়েল, দুটো হ্যাণ্ড টাওয়েল প্রভৃতি প্রত্যেক নবাগত ক্যাডেটদের জন্য ইস্যু করা হলো।
ইতোমধ্যে লাঞ্চের সময় হয়ে এল। কয়েকজন সিনিয়র ক্যাডেট চিৎকার করে নির্দেশ দিল প্রত্যেককে ডাইনিং রূমের পাশে অ্যান্টি রূমে প্রবেশ করতে। কিছুক্ষণ পর বি.এস.এম. এসে কঠোর কণ্ঠে আবার নির্দেশ দিলেন, অ্যান্টি রূমে ঢোকার আগে প্রত্যেককে বাথরূমে গিয়ে হাত-মুখ পরিষ্কার করে ধুয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়াতে হবে। বেল্ট ও ক্যাপ খুলে বাইরে স্ট্যাণ্ডে রাখতে হবে। অ্যান্টি রূমের দেয়ালে প্রেসিডেন্ট এবং বিভিন্ন নেতৃবর্গের ছবি টাঙানো আছে। সেজন্যে এ-ঘরে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কেউ ইচ্ছে করলে এখানে খবরের কাগজ, দেশী-বিদেশী ম্যাগাজিন পড়তে পারবে এবং রেডিও বা স্টেরিওগ্রামে গান শুনতে পারবে।
অ্যান্টি রূম হয়ে ডাইনিং রূমে ঢুকতে হবে। চেয়ার টানার কোনরকম আওয়াজ না করে টেবিলে বসতে হবে। (বাথরূম ছাড়া সব কামরাগুলো কার্পেটে মোড়া)। খাবার সময় ছুরি, কাঁটা, চামচ দিয়ে প্লেটের সঙ্গে কোনরকম টুং টাং আওয়াজ করা চলবে না । মাংসের হাড্ডি চিবানো নিষেধ। খাবার চিবানোর সময় কোনরকম চপ চপ আওয়াজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ । প্লেট থেকে চামচ দিয়ে সুপ উঠানোর সময় প্লেটের কাছের কোনা উঠিয়ে কাত করে সুপ ওঠাতে হবে। যাতে সামনে বসা কোন ক্যাডেট প্লেটের তলা দেখতে না পায়। কোনরকম হাঁচি বা ঢেকুর উঠলে পাশের জনকে হেল কমাণ্ডো এক্সকিউজ মি বলতে হবে। লবণ বা সস চাইতে হলে মে আই হ্যাভ দ্য সল্ট অর সস বলতে, হবে। ওয়েটার বাদিকে দাঁড়ালে খাবার নিতে হবে।
প্রথমে ভাত বা পোলাও এবং পরে মাংস, রোস্ট ইত্যাদি। রুটি থাকলে একটার পর একটা নিতে হবে। তরকারি নিতে হবে পরে খাওয়া শেষ হলে কাটা, চামচ, ছুরি প্লেটের ওপর রাখতে হবে সমান্তরালভাবে। খাওয়া শেষ না হলে ওগুলো প্লেটের ওপর রাখতে হবে ক্রস করে। তাহলে ওয়েটার পুনরায় খাবার পরিবেশন করবে। ডাইনিং রূমে কোনরকম জোরে আওয়াজ করা চলবে না। ওয়েটারদের ডাকতে হবে ইশারায়। কেউ কিছু চাইলে ওহ্ শিওর বা প্লীজ বলে এগিয়ে দিতে হবে।
ইতোমধ্যে সব নবাগত ক্যাডেটদের ফুল প্লেট, হাফ প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট কাঁটা, ছুরি, চামচ, পানির গ্লাস, ন্যাপক্লিন ইত্যাদির ব্যবহার শিখিয়ে দেয়া হলো। লাঞ্চ শেষে এক কাপ কাওয়া বা সবুজ চা পান করে আনোয়ার ছুটল বিশ্রাম নেবার জন্য ওর রূমের দিকে।
রূমে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়াল সে। ভিতরে বাঘের মত একজন সিনিয়র দাঁড়ানো। সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ও চিৎকার করে উঠল স্নামালেকুম, স্যার। ঘরের ভিতর ভাল করে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেল, ওর রূম-মেটকে বিরাট আলমারির মাথার ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। সিনিয়র সালামের জবাবে বলে উঠলেন, দেয়ার কামস অ্যানাদার জনি। কাম ইন, কাম ইন অ্যাণ্ড উড ইউ মাইণ্ড টু গেট ইনসাইড দি আলমীরা? বিনা বাক্যে আলমারির ভিতরে প্রবেশ করল আনোয়ার। আলমারির মাথার ওপর বসিয়ে রাখা আনোয়ারের রূম-মেটকে সিনিয়র বলল, ইউ আর অ্যানাউন্সার অব রেডিও পাকিস্তান কাকুল, অ্যাণ্ড দি ইডিয়ট ইনসাইড ইজ রেডিও সিঙ্গার। নাউ স্টার্ট রেডিও প্রোগ্রাম। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের রূম-মেট শুরু করল, দিস ইজ রেডিও পাকিস্তান, কাকুল। ওয়েস্ট পাকিস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম ২-৩০ পি.এম.। আওয়ার স্পেশাল প্রোগ্রাম স্টার্টস। লিসেন টু আওয়ার ফেমাস সিঙ্গার আনোয়ার। শুরু হলো আনোয়ারের বাংলায় অকথ্য গালাগালি (যা জীবনে উচ্চারণও করেনি ইতোপূর্বে) মিশিয়ে গর্দভ রাগিণী । মাঝে মাঝে আলমারির দরজা ফাঁক করে সে দেখছে, বাঘ-বাবাজী দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেট টানছেন।
হঠাৎ দরজায় নক হলো। সিনিয়র কাম ইন প্লীজ বললেন। ঘরে প্রবেশ করল আরও দুজন যমদূত। ওরা বেশ কিছুক্ষণ আনোয়ারের গর্দভ রাগিণী শ্রবণ করার পর আলমারির ভিতর থেকে ওকে বের করে আনল। তারপর ওকে ফায়ার প্লেসের ওপর দুপা শূন্যে উঠিয়ে দুহাতে মেঝেতে ভর করতে বলা হলো। এবং ওই অবস্থায় শুরু হলো ইন্টারভিউ । নিজের নাম কি, বাপের নাম কি, বাড়ি কোথায়, বিয়ে করেছে কিনা, মেয়ে বন্ধু আছে কিনা, থাকলে সে দেখতে কেমন ইত্যাদি হাজারো রকম আবোল তাবোল প্রশ্ন। ইতোমধ্যে আনোয়ারের দুহাতের পেশী ব্যথায় ও চাপে ফুলে উঠেছে। শরীরের সমস্ত রক্ত মনে হচ্ছে নিচের দিকে নেমে আসছে দ্রুত। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল ওর। মাথার ভেতর দপ দপ করছে। আগুন ধরে গেছে যেন।
হঠাৎ দুহাত ভয়ানকভাবে থর থর করে কাঁপা শুরু করল । সেদিকে সিনিয়র যমদূতদের কোন খেয়াল নেই। ওরা সবাই খোশগল্পে মগ্ন। আনোয়ার নিজের রূম থেকেই বুঝতে পারল, এ ধরনের রগড় অন্যান্য ক্যাডেটদের নিয়েও চলছে। হঠাৎ তিন যমদূতের একজনের মনে বোধহয় সামান্য করুণার উদ্রেক হলো। সে এগিয়ে এসে বলল, গেট ডাউন অ্যাণ্ড স্ট্যাণ্ড অন ইওর ফিট। যাক, এযাত্রা রেহাই পাওয়া গেল। আনোয়ার তাড়াতাড়ি উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, থ্যাংক ইউ, স্যার। সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো ধমক, নো থ্যাংকস ইন পি.এম.এ.।
এরপর আনোয়ার এবং ওর রূমমেটকে দাঁড় করানো হলো, মুখোমুখি। একে অপরের টাই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে পরস্পর পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে ওঠা বসা করার হুকুম হলো। শুরু হলো এক বিচিত্র ভঙ্গিতে ওঠা-বসা। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে ওঠ বোস করার পর ঘরে প্রবেশ করল আরও এক ইবলিস। ঘরে। ঢুকেই সে বলে উঠল এহ্ এহ্ রিলাকসিং? টেক দেম আউট। বাইরে প্রচণ্ড কনকনে শীত। ঠাণ্ডায় পানি জমে বরফ হয়ে আছে। তার ওপর হচ্ছে তুষারপাত। রূমমেট ও আনোয়ারকে বাইরে এনে দাঁড় করানো হলো বরফের ওপর। শুরু হলো স্পিনিং (সামনে ঝুঁকে পড়ে দুই হাত পায়ের পাতার সঙ্গে ঠেকিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোরা), ডিগবাজি ও ক্রলিং। রাস্তায় মাঝে মাঝে বরফ গলে কাদা হয়ে আছে। এই তীব্র কনকনে শীতের মধ্যে কাদা, পানি ও বরফে সমস্ত শরীর একাকার হয়ে গেল। আনোয়ারের চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিকেলের গেমসের সময় হয়ে এলে ওদের নিষ্কৃতি দিয়ে তিন যমদূত মাঠের দিকে চলে গেল।
ঘরে ফিরে এল আনোয়ার। শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি । ভিজে কাপড়চোপড় বদলে গরম প্যান্ট, শার্ট ও পুলোভার পরে নিল সে। ফায়ার প্লেসের আরামদায়ক উষ্ণতায় প্রচণ্ড শীতে জমে যাওয়া শরীরটা গরম হয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু এ সুখ বেশিক্ষণ সইল, না। আবার ফিরে এল সিনিয়ররা। শুরু হলো নিষ্ঠুর অমানুষিক কৌতুক । সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পরিত্রাণ পেল ওরা। নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো আনোয়ারের । ও যেন সিনিয়রদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। পি,এম.এ. তো, অদ্ভুত জায়গা।
রাত প্রায় নয়টা। ডিনার টাইম, আসন্ন। আনোয়ার পুনরায় প্যান্ট, শার্ট, টাইয়ের সঙ্গে খাকি পুলোভার জার্সি পরে ডিনারের জন্য ডাইনিংয়ে গেল। ডিনার শেষে হঠাৎ একজন সিনিয়র ক্যাডেট ঘোষণা করলেন, ডিনার শেষে প্রত্যেক ক্যাডেটকে, জি.সি, অফিসের সামনে হাজির হতে হবে। ডিনার শেষ হলো । আনোয়ার দ্রুত এক কাপ গ্রীন টি ও একটা সিগারেট শেষ করে অন্যান্য ক্যাডেটদের সঙ্গে ছুটল জি. সি. অফিসের দিকে। চারদিকে তুষারপাত হচ্ছে। দূরের সব জিনিস অস্পষ্ট, ঝাঁপসা। বি, সি, অফিসের সামনে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরু বরফের আস্তরণ। প্লাটুন সার্জেন্টের নির্দেশে সব ক্যাডেটরা লাইনবন্দী হয়ে ফল নি হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জি. সি. অফিসের ভিতর থেকে, বি.এস,এম, বেরিয়ে এসে সব নবাগত ক্যাডেটদের উদ্দেশে সুমধুর কন্ঠে ভাষণ দিলেন :
ব্লাডি ইডিয়টস, ইউ হ্যাভ কাম টু পি.এম.এ. নট টু বিকাম সফট ফিল্ম হিরোজ। অল অভ ইউ উইল বি অফিসার্স ইন পাকিস্তান আর্মি। বাট আই হ্যাভ নোটিসশ্ থ্রু আউট দ্য ডে দ্যাট ইউ শিটস হ্যাড বিন স্নাউচিং। নাউ অল অফ ইউ উইল রাশ টু ইওর রূমস অ্যাণ্ড কাম ব্যাক উইদিন টুয়েনটি মিনিটস অ্যাজ আই টেল ইউ নাউ। ড্রেস: হাফ শার্ট উইদাউট ভেস্ট। শর্টস উইদাউট আণ্ডারওয়্যার। পিটি সুজ উইদাউট স্টকিং। ইকুইপমেন্টস স্টীলমেড বাথ টাব ফুল অভ ওয়াটার অন হেড। নাউ বাজ অফ।
আনোয়ারের রূমমেট বলে উঠল, দোস্ত, এই পোশাকে ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় শীত লাগছে। বাইরে তুষারপাতের মধ্যে মাথায় ঠাণ্ডা পানির টাব নিয়ে দাঁড়ালে না জানি আমাদের প্রত্যেকের অবস্থা কি হবে। মানসিক অবস্থা আনোয়ারের এমনিতেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর রূমমেটের এই কথায় মন আরও দমে গেল। যথাসময়ে আনোয়ার নির্দেশিত পোশাকে এবং ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়া পানি ভর্তি টাব মাথায় ছুটল জি.সি. অফিসের সামনে। রূমের বাইরে আসতেই দাঁতে দাঁত বাড়ি খেতে লাগল। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। তার ওপর ঠাণ্ডা টাব মাথার ওপর ধরে রাখার জন্য দুটো হাত প্রায় অনুভূতি শূন্য হতে চলেছে। তবুও কোনমতে টলতে টলতে জি.সি. অফিসের সামনে পৌঁছাল সে। প্রত্যেক ক্যাডেট মনে মনে বি.এস.এম. এ-র গুষ্টি উদ্ধার করছে। আর বি.এস.এম. গরম পোশাকে সাথীদের নিয়ে ফায়ার প্লেসে শরীর গরম করছেন আর বাইরে এসে এই প্রাণান্তকর দৃশ্য বেশ কৌতুকের সঙ্গে উপভোগ করছেন। ক্ষণিকের মধ্যেই সমস্ত ক্যাডেটদের হাল শোচনীয় হয়ে পড়ল। এর কিছুক্ষণ পর শুরু হলো সত্যিকার করুণ ও বীভৎস অবস্থা।
ঝুরঝুর করে তুষার ঝরছে আকাশ থেকে। ঠাণ্ডা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রত্যেক ক্যাডেটের শরীর প্রায় অনুভূতিশূন্য। অনেকের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। শুরু হলো ঠাণ্ডা পানি ভর্তি টাব মাথায় নিয়ে একের পর এক পতন। সবাই যেন একে একে মৃত্যুর দিকে নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য আনোয়ারের হৃৎপিণ্ডটাকে হঠাৎ করে চমকে দিল। ওর চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে সে। কিন্তু শরীরটা ভয়ানকভাবে বিরোধিতা শুরু করল। অসাড়, অবসন্ন, প্রচণ্ড নির্যাতনে ক্লান্ত শরীরটা নরম তুষারের ওপর শুয়ে পড়তে চাইছে। মাথাটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলে উঠল ভীষণভাবে। কাটা কলাগাছের মত আনোয়ার নরম তুষারের ওপর আছড়ে পড়ল। সেই সঙ্গে টাবের পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেল তার সারা শরীর। বোধশক্তি প্রায় অবলুপ্ত ।
ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার ছদ্মবেশে মৃত্যু যেন অতি সন্নিকটে। আনোয়ারের মনে হলো, বি.এস.এম. এগিয়ে এসে ওর বুকের দুপাশে পা রেখে দাঁড়ালেন। বাঘের মত দুই চোখ ধক ধক করে জ্বলছে। বি. এস. এম.-এর সত্যিকার সুদর্শন চেহারাটা কুৎসিত কদাকার হয়ে দেখা দিল ওর চোখে। হাতের আঙুলগুলো সাড়াশির মত বাঁকা করে বি. এস. এম. ধীরে ধীরে ঝুঁকছেন ওর হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে নেবার ভঙ্গিতে। শেষ সময় উপস্থিত। নিঃশ্বাস ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছে। আব্বা, আম্মা ও প্রিয়জনদের মনে মনে বিদায় জানিয়ে অজানা মৃত্যুর কোলে নিজেকে সঁপে দেবার জন্য তৈরি হলো আনোয়ার।
প্রচণ্ড ধমকে ছিন্ন হয়ে গেল চিন্তাটা। গেট আপ-বলে চিৎকার করে উঠলেন বি.এস.এম.। আনোয়ারের মনে হলো, বহুদূর থেকে কে যেন ডাকছে। বি.এস.এম.-এর কর্কশ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ওর অসাড় শ্রবণশক্তিতে মৃদু আঘাত করল। স্লো-মোশন ছায়াছবির মত পৃথিবীটা আবার সচল হয়ে উঠল ওর কাছে। সভয়ে চোখ খুলল। তারপর শুরু হলো উঠে দাঁড়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। শেষে বহু কষ্টে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেতসপত্রের মত কাঁপতে শুরু করল সে। সবাই উঠে দাঁড়ালে বি.এস.এম. সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন:
ব্লাডি সফটিজ, ইউ কান্ট স্ট্যাণ্ড দিজ। হাউ উইল ইউ ফেস বুলেটস ইন দ্য ফিল্ড। অল অভ ইউ উইল বি সীটিং গ্রীন। নাউ ড্যাশ অফ টু ইওর রূম অ্যান্ড বি হিয়ার অ্যাট ফাইভ মিনিটস বিফোর সিক্স ইন দ্য মর্নিং।
রাত তখন প্রায় দশটা। বহু কষ্টে বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে সবাই যে যার ঘরে ফিরে গেল । আনোয়ার এবং ওর রূমমেট ঘরে ঢুকে টাবটা বাথরূমে রেখে ভিজে কাপড় বদলে স্লিপিং সুট পরে নিল। ঘরে অপেক্ষা করছিল আদালী। তাড়াতাড়ি গরম চা এনে দিল। পরম তৃপ্তিতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজন ফায়ার প্লেসের আগুনে গরম করতে শুরু করল ঠাণ্ডা শরীর। এরপর শুরু হলো কথোপকথন। প্রথমেই ওরা বি.এস.এম. ও সিনিয়র ক্যাডেটদের বাপ-মা তুলে কষে গালাগালি দিল। বেশ কিছুক্ষণ গল্পের পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আনোয়ারের রূমমেট বলল, পার্টনার নাউ লেটস গো টু বেড, অ্যাজ উই হ্যাভ টু গেট আপ আর্লি ইন দ্য মর্নিং। লেট আস রিল্যাক্স অ্যাজ মাচ অ্যাজ পসিবল অ্যাণ্ড গেট প্রিপেয়ার্ড ফর টুমরোজ বাগারী!
ঘরের মেইন লাইট নেভাননা। শুধু টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। ঠাণ্ডা বিছানা আস্তে আস্তে গরম হয়ে এল। সারাদিনের ভৌতিক অবস্থার কথা ওরা যেন ভুলে গেল। দুজনে গরম বিছানায় শুয়ে তৃপ্তির সঙ্গে রাতের শেষ সিগারেট টানছে। হঠাৎ ওদের মনে হলো পি.এম.এ.-তে কষ্ট যতই থাক না কেন, আরামেরও যথেষ্ট সুবন্দোবস্ত আছে। সিগারেট শেষ হয়ে এলে অ্যাশট্রেতে গুঁজে আনোয়ার হাত বাড়াল টেবিল ল্যাম্পের সুইচের দিকে। কিন্তু হাত টেবিল ল্যাম্পের সুইচ পর্যন্ত পৌঁছাল না। তার আগেই দরজায় টোকা পড়ল–টক, টক, টক, টক। দুজন একই সঙ্গে অফিসার সুলভ মনোভাব নিয়ে কাম ইন প্লীজ বলে উঠল । দরজা ঠেলে প্রবেশ করল দুজন সিনিয়র। ওদের দেখেই আনোয়ার ও রূমমেট দুজনের কণ্ঠচিরে বেরিয়ে এল চিৎকার স্লামালেকুম, স্যার শুরু হলো আবার সেই নিষ্ঠুর কৌতুক। প্রচণ্ড শীতের মাঝেও ওদের সমস্ত শরীর ঘামে চুপসে গেল । অমানুষিক অত্যাচার। অসহ্য। এহেন পশুসুলভ আচরণে ক্রমশই ওদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে নিষ্কৃতি পেল ওরা।
তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দুজন টাওয়েল দিয়ে শরীরের ঘাম মুছে ফেলে, আবার বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রচণ্ড ক্লান্তি ও অবসাদ থাকা সত্ত্বেও ওদের ঘুম এল না। কারণ বাইরে থেকে ভারী বুটের মচ মচ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কখন যে ওদের চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে এল, খেয়াল নেই। একটি দুঃস্বপ্নের রাতের কোলে মাথা রেখে নিজেদের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল ওরা দুজন।
এই যে এত সব ব্যাপার-স্যাপার–তা সেটা প্রাথমিক অভ্যর্থনাই হোক বা উঠতে বসতে শুতে হাঁটতে প্রতিপদে আইন কানুন, নিয়ম-বিধি-বিধানের কড়চাই হোক সবকিছুর পেছনেই । একটা উদ্দেশ্য আছে, যদিও প্রাথমিক দৃষ্টিতে নির্মমতা ও কৌতুক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
একবার এক স্পেশাল গ্যাদারিং-এর সহজ পরিবেশে এক জুনিয়র ক্যাডেট একজন সিনিয়রকে প্রশ্ন রেখেছিল, স্যার, অপরাধ করে শাস্তি পেলাম, সেটা ক্লিয়ার; কিন্তু কথা হচ্ছে অযথা বা বিনা কারণে শাস্তি পেলে সেটা কেমন হলো? এর জবাবে সিনিয়র মহোদয় যা বলেছিলেন তা মোটামুটিভাবে এই: অযথা বা বিনা কারণে তোমাদেরকে শাস্তি দেয়া হয় না। অন্য কোন কারণ না থাকলেও একটা কারণ সব সময়ই রয়েছে, তা হচ্ছে, তোমরা জুনিয়র। এটা কেমন যেন একটা গায়ের জোরে মার্কা অযৌক্তিক কথা মনে হয়। আসলেই কি তাই? জুনিয়ররা বলবে, অবশ্যই। অথচ সিনিয়ররা বলবে, নেভার। এর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা অনেকটা নিম্নরূপ:
সাধারণ নাগরিক জীবন ও সামরিক জীবনের মধ্যে ঢের পার্থক্য বিদ্যমান। একজন নতুন ক্যাডেট (জুনিয়র ক্যাডেট) যখন প্রথম এই পার্থক্যের বিপাকে পড়ে, তখন তাকে খাবি খেতে হয়, বৈ কি? এরই নাম ডিসিপ্লিনারি ট্রেনিং-যার তাৎক্ষণিক বা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক: যেমন সারাদেহে বেদনানুভূতি, মেজাজ খিঁচড়ে যাওয়া, ওজন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি; কিন্তু চূড়ান্ত ফল ইতিবাচক–যখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুনভাবে আত্মনির্ভরশীলতা, নিজের ওপর আস্থা, যে-কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করার ক্ষমতা, জীবনে চলার পথে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাব ইত্যাদি যার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
নিয়ম শৃঙ্খলা-সময়ানুবর্তিতা, ঊর্ধ্বতন কমাণ্ডোর আদেশ নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলা ইত্যাদি শুরুতেই শক্তহাতে শেখানোর চেষ্টা করা হয়, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন ক্যাডেটের সুপ্ত নিষ্ক্রিয় শক্তি-ক্ষমতা ও উদ্যমকে জোর করে জাগিয়ে তোলা। প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও পরে সে বুঝতে পারে এর সুফল সাধারণ নাগরিক জীবন যাপনকালে মানুষের পক্ষে অসম্ভব বলে যতগুলো ব্যাপার থাকে, সামরিক-প্রশিক্ষণ শেষে সেগুলোর সংখ্যা বহুলাংশে কমে আসে। আবেগের ফুলঝুরি চূর্ণ করে পুরোপুরি নিষ্ঠুর বাস্তবের কাছাকাছি সে পৌঁছে যায়।
কোনকিছুকে চট করে সে অসম্ভব ভাবতে পারে না। মাতৃভূমি রক্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ এদের রক্তে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সাধারণ মানুষের চেয়ে এদেরকে অনেক বেশি কর্মক্ষম করে। গড়ে তোলার জন্যই যাবতীয় পদ্ধতি, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন, ডিফেন্স, অ্যাটাক, ওয়্যার ট্যাকটিক্স ক্লোজ কোয়ার্টার ব্যাটল ইত্যাদির পাশাপাশি ইতিহাস, ভূগোল এমনকি অর্থনীতি বিষয়েও এদেরকে পাঠ নিতে হয়। এছাড়া খেলাধুলা-শরীরচর্চাও বাধ্যতামূলক নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে হয় বলে গড়পড়তা যে-কোন সাধারণ মানুষের চেয়ে এদের গড়পড়তা রেটিং অনেক উন্নত। মোদ্দা কথা হচ্ছে এহেন বহুমুখী ও অক্লান্ত চেষ্টার মাধ্যমে যেন এক একটা মূল্যবান প্রতিভা সৃষ্টি করা হয়-যারা প্রয়োজনে জুতো সেলাই থেকে মানুষ খুন সবই অবলীলাক্রমে করতে পারবে।
আর এই শেখা, জানা ও পারার ব্যাপারটা এত ব্যাপক যে প্রথম থেকে শক্ত পাল্লায় না পড়লে সারাজীবন ধরেও বোধহয় তা আয়ত্ত হবে না। যার জন্য প্রথম পর্যায়ে করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এই বোধ জাগানোর প্রচেষ্টা করা হয়। সেখানে কেন জাতীয় কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। পরবর্তীতে চলে অনুশীলন, এবং বাস্তব ও ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রশিক্ষণ, অনুশীলন বা প্রয়োগ কোন ক্ষেত্রেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে বলা হয় মা–দুঃসাধ্যকে সাধন করতে বলা হয়। আর তাতে নির্দ্বিধায় প্রবৃত্ত হওয়ার প্রশিক্ষণও ইতোপূর্বেই তারা পেয়ে থাকে। এখানেই একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের পার্থক্য।
আর সবার সঙ্গে আনোয়ারের সময়গুলোও একই ধারায় বইছিল।
০৩.
সাব ওঠো, সাব ওঠো ডাকে আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখল, মাথার কাছে বুড়ো আদালী দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মেইন লাইট ও টেবিল ল্যাম্প দুটোই জ্বালানো। ফায়ারপ্লেসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ফ্লাস্ক থেকে দুকাপ গরম বেড টি খেয়ে, একটা সিগারেট ধরাল ও। আদালী শেভিং-মগে গরম পানি এনে ছোট্ট টিপয়টার ওপর রাখল। সেই সঙ্গে শেভ করার সমস্ত সরঞ্জাম এগিয়ে দিল। গরম পানি দিয়ে শেভ করে মুখ টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতে বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। বাথরূম থেকে ফিরে এসে ঘড়ি দেখল–সাড়ে পাঁচটা। সর্বনাশ! আর মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই ঘর থেকে বেরুতে হবে। ভোরের গাঢ় তুষারাচ্ছন্ন অন্ধকার তখনও কাটেনি। প্রকৃতি তখনও সুপ্তির কোলে আধো ঘুমন্ত।
এখন পর্যন্ত নতুন ক্যাডেটদের কাছে ইউনিফরম পৌঁছেনি। চেস্ট অভ ড্রয়ার খুলে ফায়ার প্লেসের সামনে আনোয়ার কাপড়চোপড় পরে নিল। দরজা খুলতেই কনকনে ঠাণ্ডা ঝাঁপটা মারল মুখে। দুহাতের তালু ঘষে গরম রাখতে হচ্ছে। গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে আনোয়ার ছুটে চলল জি.সি. অফিসের দিকে।
নির্ধারিত সময়ের আগে সবাই জি.সি. অফিসের সামনে সমবেত হলো। প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে লাফাচ্ছে এবং দুহাতে তালু ঘষে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছে। হঠাৎ বাজখাই গলায় আদেশ হলো, ফল ইন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াল ওরা। ইতোমধ্যে আনোয়ারদের কোম্পানীর জন্য একজন সিনিয়র ক্যাডেটকে কোম্পানী সার্জেন্ট মেজর বা সি.এস.এম. বানানো হয়েছে। প্রথমে প্রত্যেক প্লাটুন সার্জেন্টরা প্যারেড টেস্ট বা উপস্থিত রিপোর্ট হস্তান্তর করল সি.এস.এম.-এর কাছে। অতঃপর সি.এস.এম.-রা হাবিলদার স্টাফের কাছে প্যারেড হস্তান্তর করল। এরপর শুরু হলো হাবিলদারের নির্দেশে বিভিন্ন প্লাটুনের ডবল মার্চ। দৌড়ে দৌড়ে নতুন ক্যাডেটদের মিলিটারি একাডেমীর বিভিন্ন জায়গা দেখানো শুরু হলো । আনোয়ারদের প্লাটুনকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো কোথ বা অস্ত্রাগারে। এরপর পিটি গ্রাউণ্ড, ড্রিল গ্রাউণ্ড, হলস অভ স্টাডিজ পেরিয়ে ওদের নিয়ে আসা হলো এঙ্গেল হল নামে একটা লেকচার গ্যালারিতে। সেটা দেখার পর শর্ট ফায়ারিং রেঞ্জ, সিনেমা হল, লাইব্রেরী হয়ে ওরা এল ডাইনিং রূমে ব্রেকফাস্টের জন্য।
ব্রেকফাস্ট রেডি। টেবিলের ওপর প্রত্যেকের জন্য একটা করে বড় প্লেট, দুধ ভর্তি পট, চিনির পট, এক গ্লাস করে পানি ও কয়েকটা কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট রাখা। আনোয়ার কোয়ার্টার প্লেট থেকে ন্যাপকিন নিয়ে কোলের ওপর বিছিয়ে দুধ চিনি মিশিয়ে কর্মক্ষের খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষ না হতেই ওয়েটার এসে পুটো করে এগ ফ্রাই ও চাহিদা মত ওমলেট দিয়ে গেল । সেইসঙ্গে কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট উঠিয়ে নেয়া হলো এবং শুরু হলো নাস্তা ।
প্রত্যেকের সামনে রাইস প্লেট। প্রচুর স্লাইস করা পাউরুটির সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে মাখন, জ্যাম, জেলী স্থূপীকৃত ভাবে সাজানো টেবিলের ওপর। শেষে লবণ ও গোল মরিচের পাত্র দিয়ে গেল ওয়েটার নাস্তা শেষে পর পর দুকাপ চা খেয়ে হল রূম থেকে বেরিয়ে এল আনোয়ার। একটু নিভৃত জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে টান দিল সে।
আবার প্রত্যেকে জি.সি, অফিসের সামনে জড়ো হলো এবং শুরু হলো স্থান পরিদর্শন। বিভিন্ন জায়গা দেখিয়ে শেষে ওদের নিয়ে আসা হলো পি.এম.এ.-র লাইব্রেরীর সামনে। লাইব্রেরী থেকে সবার জন্য পাঠ্য বই ও পি.এম.এ.-র মনোগ্রাম অঙ্কিত খাতা ইস্যু করা হলো। এর আগে প্রত্যেকের জন্য খাকি কাপড়ের তৈরি কাঁধ থেকে ঝুলন্ত লম্বা ফিতে দিয়ে জড়ানো ব্যাগ (যাতে বইপত্র নেয়া হয়) বা স্যাচেল ইস্যু করা হয়েছিল। এরপর ওদের আবার জি.সি. অফিসের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। এবার শুরু হলো কুচকাওয়াজের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ। একই জিনিস বারবার দেখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও নবাগত ক্যাডেটদের ভুল হতে থাকল। কিন্তু হাবিলদার ইন্সট্রাকটর ধৈর্য সহকারে একই জিনিস বারবার দেখিয়ে দিল ওদের। কুচকাওয়াজের মান মোটামুটি ভাল না হওয়া পর্যন্ত নবাগতদের ড্রিল গ্রাউন্ডে নেয়া হবে না। কারণ ড্রিল গ্রাউণ্ডে পূর্ণ সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করা হয়, এবং একজন অ্যাডজুটেন্ট পদধারী অফিসার সালাম গ্রহণ করেন। বেলা প্রায় এগারোটার দিকে নবাগত ক্যাডেটদের জন্য টি ব্রেক হলো ।
টি ব্রেক শেষে সবাই নোটিশ বোর্ডে গিয়ে লিখে নিল ট্রেনিং প্রোগ্রাম। সেইসঙ্গে সেদিনের মত ছুটি হলো ওদের। আনোয়ার ও রূমমেট ঘরে ফিরে এল। ঘরের আসবাব বলতে দুটো সিঙ্গেল খাট, দুটো সিঙ্গেল সোফা, একটা পড়ার টেবিল, দুটো চেয়ার, একটা বড় কাঠের আলমারি ও দুটো চেস্ট অভ ড্রয়ার। চেস্ট অভ ড্রয়ারের সবচেয়ে ওপরের তাকে দুটো হাফ ড্রয়ার। যার প্রত্যেকটিতে রাখতে হবে ইস্ত্রি করা রুমাল, মোজা, আণ্ডারওয়্যার, গেঞ্জি এবং খেলার পোশাক। দ্বিতীয় তাকের ফুল ড্রয়ারে রাখতে হবে ইস্ত্রি করা ইউনিফরম। তৃতীয় তাকের ফুল ড্রয়ারে রাখতে হবে বেসামরিক কাপড় এবং সবচেয়ে নিচের তাকে রাখতে হবে ব্যবহৃত ময়লা কাপড়চোপড়। বিরাট আলমারির হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে আগামীতে ব্যবহারের জন্য ইউনিফরম অথবা বেসামরিক শার্ট, প্যান্ট বা ওভারকোট। ফিল্ড সার্ভিস মার্চিং অর্ডার রাখতে হবে আলমারির ওপরের দিকে বানানো একটা তাকে। চকচকে বুট ও অন্য জুতা রাখতে হবে আলমারির নিচের তাকে।
চেস্ট অভ ড্রয়ারের ওপর কাপড়ের আচ্ছাদন বিছিয়ে রাখতে হবে শেভিং কিট। মাথা আঁচড়ে চিরুনি পরিষ্কার করে ব্রাশের সঙ্গে ভালভাবে আটকে রাখতে হবে। বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতে হবে, ব্যবহৃত শেভিং ক্রীমের টিউব যেন টোল খেয়ে না থাকে। চিরুনির সঁতের ফাঁকে যেন ময়লা অথবা চুল না থাকে। কারণ এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিকেলে প্লাটুন সার্জেন্ট এলেন চেস্ট অভ ড্রয়ার পরীক্ষা করতে। তিনি যেভাবে চিরুনি আলোর সামনে ধরে এক চোখ বন্ধ করে পরীক্ষা করলেন, তাতে আনোয়ারের মনে হলো, চিরুনি পরিষ্কার করার মত কঠিন কাজ দুনিয়ায় আর নেই। শেভিং কিটের বেলাতেও একই অবস্থা। শেভিং কিট এবং চিরুনি, এ দুটোর কোনটার অবস্থাই প্লাটুন সার্জেন্টের মনঃপূত হলো না। এর পরে শেভিং কিট এবং চিরুনির অবস্থা এরকম থাকলে শাস্তি দেয়া হবে বলে প্লাটুন সার্জেন্ট পরীক্ষা শেষ করলেন। শেভিং কিট এবং চিরুনি এর চাইতে পরিষ্কার রাখা আনোয়ারের পক্ষে অসম্ভব।
কি করা যায়–চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় একটা সুন্দর বুদ্ধি খেলে গেল ওর। আর এরপর থেকে প্লাটুন সার্জেন্ট ওর চেস্ট অভ ড্রয়ারে সবসময় ঝকঝকে শেভিং কিট ও চিরুনি ব্রাশ দেখতে পেতেন, যা কখনই ওর শাস্তির কারণ হয়নি। এর পশ্চাতে যে রহস্য লুকিয়ে ছিল তা হলো, এমন একসেট শেভিং কিট ও চিরুনি প্লাটুন সার্জেন্ট পরীক্ষার সময় দেখতে পেতেন, যেগুলো ও কখনই ব্যবহার করত না। ব্যবহৃত শেভিং কিট ও চিরুনি ব্রাশ আনোয়ার চেস্ট অভ ড্রয়ারের ময়লা কাপড়-এর মধ্যে লুকিয়ে রাখত। আর প্রদর্শনী স্বরূপ সাজিয়ে রাখত সদা-নতুন সরঞ্জামগুলো।
পড়ার টেবিলও নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখতে হত। ব্যবহারের সময় ছাড়া অ্যাশট্রের মধ্যে কোন সিগারেটের টুকরো বা ছাই পাওয়া গেলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। বাথরূম পরিষ্কারের দায়িত্ব সুইপারের হলেও তা পরীক্ষা করার দায়িত্ব ক্যাডেট বা তার আদালীর। টুথব্রাশ, পেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, টয়লেট পেপার, তোয়ালে ইত্যাদি পরিষ্কার অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। বেলা প্রায় দেড়টার দিকে ঘর গোছানো শেষ করে আনোয়ার বের হলো মেসের উদ্দেশে।
খাওয়া শেষ করে ঘরে আসার সময় ঘটল বিপদ। দূরে বিল্ডিংয়ের জানালায় দাঁড়ানো এক সিনিয়র ক্যাডেটের হাতে ধরা পড়ে গেল আনোয়ার। কাঁচের জানালা খুলে সিনিয়র চিৎকার করে বলে উঠল, ইউ ইডিয়ট, হোয়াই ডিড নট ইউ উইশ? ও সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সালাম দিয়ে বলল, স্যার, আমি আপনাকে দেখতে ইনি। সিনিয়র আবার চিৎকার করে উঠলেন, দ্যাখোনিটা কেন? যাও ওই গাছটাকে এক লক্ষবার সালাম দাও। সামনে ছিল একটি গাছ। গাছটিকে সম্মুখে রেখে আনোয়ার জপে যেতে লাগল, স্লামালেকুম, স্যার, স্লামালেকুম, স্যার, স্লামা… আবার সিনিয়র ক্যাডেটের চিৎকার শোনা গেল, লাউডার। ওর গলার স্বর এক পর্দা বেড়ে গেল। সিনিয়র সাহেব এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি পূর্ববৎ চিৎকার করলেন, আই সে লাউডার, ইউ ব্লাডি ইডিয়ট। এবারে ও গগনবিদারী কণ্ঠে বৃক্ষ মহারাজকে সালাম জানাতে শুরু করল। মনে মনে বলল, হে অজানা অচেনা বৃক্ষ, তোমার জীবনই সার্থক।
বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ওর কাঁধে ও মাথায় তুষার জমতে লাগল। মাঝে মাঝে আনোয়ার কাঁধ ও মাথা ঝাঁকিয়ে জমে থাকা তুষারকণা ফেলে দিচ্ছে। এটা সিনিয়র সাহেব দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ডোন্ট মুভ, ইউ শিট। ঠায় দাঁড়িয়ে গাছটাকে সালাম জানাচ্ছে সে। কোনরকম নড়াচড়া নেই। ফলে ক্রমেই তুষার জমে কাঁধ ও মাথা ভারী হতে লাগল। এইভাবে ঘণ্টা দুই অতিবাহিত হবার পর সিনিয়র মহোদয় চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, কেটে পড়ো এবার। এখন থেকে চোখ-কান খোলা রাখবে। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার রূমের উদ্দেশে ভোঁ দৌড়।
সে-রাতে ঘটল আরও একটা মজার ঘটনা। আনোয়ার ও রূমমেট একসঙ্গে ডিনার খেতে মেসে গিয়েছিল। ডিনার শেষে ওরা রূমে ফিরে আসছে। তুষারপাতের জন্য দূরের কোন জিনিস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। এই ঝাঁপসা অন্ধকারে ওরা দেখতে পেল কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন চিৎকার করে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। কাছে গিয়ে দেখে, সে আর কেউ নয়, ওদেরই বুড়ো আদালী। সিনিয়ররা প্রতিদিন যখন তখন রূমে এসে ওদের নিয়ে মর্মান্তিক কৌতুক শুরু করে দেয়। এই পাঁচ ছয়শো ক্যাডেটের মধ্যে কে সিনিয়র আর কে জুনিয়র তা প্রথমে বুঝে ওঠা সত্যিই মুশকিল। কিন্তু পদে পদে কঠিন শাস্তি আনোয়ারকে কে কি তা সহজেই বুঝিয়ে দিল। ঘরে বাইরে এই প্রচণ্ড শাস্তি একেবারে অসহ্য। ওরা যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোন রাজ্যের বাসিন্দা, যেখানে নির্মমতা কৌতুক বলে গণ্য।
পরদিন রাতে ডিনার খেয়ে আনোয়ার ঘরে ফিরে আসতেই দেখতে পেল দরজার সামনে একজন সিনিয়র ক্যাডেট দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি কান ফাটানো কণ্ঠে ও বলে উঠল, স্লামালেকুম, স্যার। সিনিয়র সাহেব বললেন, ওপেন দ্য ডোর। রূমে ঢুকে তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, আজ রাতে প্রত্যেক নতুন ক্যাডেটকে ভীষণ শাস্তি দেয়া হবে। তুমি আমার রুমে চলো। তাহলে শাস্তি থেকে খানিকটা রেহাই পাবে। ও তাড়াতাড়ি সিনিয়র ক্যাডেটকে অনুসরণ করল। রূমে ঢুকে সিনিয়র সাহেব আনোয়ারকে গান গাইতে অনুরোধ জানালেন। অনেকদিন পর ও প্রাণ খুলে গান গাইল। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্যাডেট এসে ঘুরে গেল। কিন্তু অন্য একজন সিনিয়রের সঙ্গে থাকায় আনোয়ার শাস্তি পেল না। ওদের মধ্যে কেউ কেউ আনোয়ারকে জিজ্ঞেস করল সে হাত দেখতে জানে কিনা, ও না সূচক জবাব দিল। কিন্তু এ ব্যাপারে সিনিয়রদের প্রচণ্ড আগ্রহ ওর নজর এড়াল না।
সেদিন বাঙালী সিনিয়র ক্যাডেটের সাহায্যে রক্ষা পেলেও পরবর্তী শাস্তির ভয় আনোয়ারকে আতঙ্কিত করে রাখল। সে চিন্তা করতে লাগল, কিভাবে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এরপর থেকে আনোয়ারের রূমে সব সময় তালা ঝুলতে দেখা যেত। রূমের, গরাদবিহীন পেছনের জানালাটাই সে ব্যবহার করে। আর সিনিয়ররা শাস্তি দিতে এসে রূম তালাবদ্ধ দেখে ফিরে যায়। ভাবে আনোয়ার হয়তো বাইরে কোথাও শাস্তি পাচ্ছে। অথচ তখন হয়তো সে রূমের ভেতরেই দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এই পদ্ধতি ওর শাস্তির মাত্রা বেশ কিছুটা কমিয়ে দিল।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনোয়ার চিন্তা করতে লাগল, শাস্তি থেকে আর কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। রাত গম্ভীর হয়ে এল, তবু ও চিন্তা করেই চলেছে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল। হাত দেখার ভান করলে কেমন হয়? ব্যাপারটা বিপজ্জনক হলেও ভালভাবে অভিনয় করতে পারলে উতরে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি দেখা দিল। এবার ও হবে হস্তরেখাবিদ।
পরদিন লাঞ্চের পর গতরাতে পরিচিত বাঙালী সিনিয়র ক্যাডেটের রূমের উদ্দেশে রওনা হলো আনোয়ার। পথে বেশ কয়েকজন সিনিয়রের হাতে ধরা পড়ল । কিন্তু অমুক সিনিয়র ক্যাডেট ডেকেছেন বলাতে ওকে সবাই ছেড়ে ছিল। শেষে এক সিনিয়রের হাতে আটকা পড়ল সে। তিনি মহা নাছোড়বান্দা! জানতে চাইলেন অমুক সিনিয়র কেন ডেকেছেন? জবাবটা ওর মুখ থেকে ফস্ করে বেরিয়ে এল, ওঁর হাত দেখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র সাহেব আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, ইউ নো পামিস্ট্রি? ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সিনিয়র সাহেব আবার বললেন, তা আমার হাত দেখছ কখন? একটু বিজ্ঞের মত চিন্তা করে আনোয়ার বলল, আফটার ডিনার, স্যার। পাঠক! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, সেদিন নিজের সুন্দর অভিনয়ের জন্য সে নিজেই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। শুরু হলো ওর হাত দেখার পালা।
দলে দলে সিনিয়র ক্যাডেটরা আনোয়ারের কাছে ভিড় জমায়। আর সে পাকা গণকের মত প্রত্যেকের হাতের তালু টিপে উল্টেপাল্টে, বিভিন্ন কাল্পনিক রেখা টেনে হাত দেখে। তাতে কেউ হলো ব্রিগেডিয়ার, কেউ হলো মেজর জেনারেল, কেউ হলো লে. জেনারেল, কেউ যুদ্ধে পদক প্রাপ্ত, আবার কেউবা হলো বিদেশী কোর্সে মনোনীত। প্রত্যেককে শেষে অবশ্য একথাও বলে দিল যে বর্তমান হস্তরেখাতে তাদের এই চিহ্ন রয়েছে। ভবিষ্যতের গ্রহ নক্ষত্রের স্থান পরিবর্তনের ফলে এবং কর্মফলের কারণেও তাদের এইসব ভাগ্য রেখার পরিবর্তন ঘটতে পারে।
আনোয়ার একজন গায়ক, আনোয়ার একজন হস্তরেখাবিদ। সর্বোপরি সে ভীষণ কৌতুকপ্রিয়। এখন পি.এম.এ.-তে আনোয়ার একটি জনপ্রিয় নাম। আনন্দের আতিশয্যে একদিন তো সে পি.এম.এ.-র কঠিন নিয়ম-কানুনও ভুলতে বসেছিল। সেদিন ও খেলার মাঠ থেকে সোজা একদৌড়ে ক্যাফেটেরিয়ায় হাজির। অথচ প্রথম দুই মাস নতুন ক্যাডেটদের জন্যে ক্যাফেটেরিয়াতে যাওয়া নিষেধ। ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকেই দেখা হয়ে গেল সেই সিনিয়র বাঙালী ক্যাডেটের সঙ্গে। আনোয়ারকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন। কাছে ডেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কেন এসেছ? চুপসে গিয়ে আনোয়ার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি আবার বললেন, এসেই যখন পড়েছ, তখন চুপচাপ আমার পাশে বসে পড়ো।
একটু পরেই পেছন থেকে চাপা গর্জন শোনা গেল, হোয়াই আর ইউ হিয়ার? ঘাড় না ফিরিয়েই আনোয়ার বুঝতে পারল বি.এস.এম. স্বয়ং। ভয়ে জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর। নিজের বোকামির জন্য চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। ভয়ঙ্কর শাস্তি আসন্ন। ওর সঙ্গের সিনিয়র ক্যাডেট দ্রুত বলে উঠলেন, স্যার, আই হ্যাভ ব্রট হিম হিয়ার। বি.এস.এম. তখন কিছু না বলে ঘুরতে ঘুরতে ক্যাফেটেরিয়ার অন্য প্রান্তে চলে গেলেন। ক্যাফেটেরিয়ায় খুব ভীড়। খালি চেয়ার না পেয়ে বি.এস.এম. আবার ফিরে এলেন। একমাত্র আনোয়ারের পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। বি.এস.এম. অনুমতি নিয়ে খালি চেয়ারটায় বসে ওকে লক্ষ করে বললেন, খাবারের অর্ডার দিয়েছ? আনোয়ার বলল, না, স্যার। বি.এস.এম. ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য কিছু অর্ডার দিলেন এবং আনোয়ারকে বললেন, যা খাবে ওয়েটারকে বলো, আমি বিল পে করব। জেনে রেখো, পি.এম.এ.-তে সব সময় সিনিয়ররা বিল পে করে থাকে। ওর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল । মনে মনে বলল, দাঁড়াও বি.এস.এম. বাবাজী, বহুদিন পর সুযোগ পেয়েছি। ওয়েটারকে বড় দুই প্লেট শিক কাবাব, চিকেন টিক্কা আর বেশ কিছু মিষ্টি দিতে বলল। অর্ডার দেয়ার ধরন দেখে বি.এস.এম. আড়চোখে কটমট করে তাকালেন আনোয়ারের দিকে। খাওয়া শেষে ও পর পর দুকাপ কফি শেষ করে বি.এস.এম.-কে বলল, স্যার, আমি কি উঠতে পারি-স্টাডি পিরিয়ডের সময় হয়ে এসেছে। বি.এস.এম.-এর সংক্ষিপ্ত উত্তর: পুশ অফ। আনোয়ার ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে একদৌড়ে কামরায় হাজির।
এরপর থেকে পি.এম.এ.-তে পুরোমাত্রায় ট্রেনিং ও ক্লাস শুরু হলো। তোর ছয়টা থেকে পরবর্তী চল্লিশ মিনিট পিটি। তারপর ব্রেকফাস্টের বিরতি। সাড়ে সাতটা থেকে আবার ড্রিল। প্রত্যেকটা পিরিয়ড চল্লিশ মিনিটের জন্য। প্রতি পিরিয়ডের মাঝে আবার দশ মিনিট বিরতি। ক্লাসে প্রথম দিন ইন্সট্রাকটর এসে বিভিন্ন সাবজেক্ট যেমন–ট্যাকটিকস, অ্যাডমিনিসট্রেশনের লজিস্টিকস, অর্গানাইজেশন অভ আর্মি, অ্যাকাউন্টিং প্রভৃতি বিষয়ে প্রেসিজ সরবরাহ করলেন। বেলা এগারোটার সময় টি ব্রেক।
কিছুদিন পর নবাগত ক্যাডেটদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য পি.এম.এ.-র বাইরে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। ইতোমধ্যে তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শেষে শুরু হলো অস্ত্র প্রশিক্ষণ। এই দায়িত্বে ছিলেন তদানীন্তন বাঙালী ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ (পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হন এবং ১৯৭৫ সালে সিপাহী বিপ্লবে নিহত হন)। কিন্তু গুলি চালনায় আনোয়ার মোটেও ভাল করতে পারছে না। একদিন খালেদ মোশাররফ ওকে কাছে ডেকে চাপা গলায় বেশ বকাবকি করলেন। তারপর থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে গুলি চালানোতে ওর দক্ষতা বেড়ে গেল। চাকুরি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ও ছিল একজন দক্ষ মার্কসম্যান। একটা চাইনিজ সাব-মেশিনগান ও প্রয়োজন মত গুলি থাকলে যে-কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা ওর জন্য অত্যন্ত সহজ ছিল। মাঝেমাঝে সাব-মেশিনগানটাকে আদর করে চুমু খেয়ে ও বলত, শাবাশ দোস্ত, কাজের সময় যেন বিগড়ে না যাস।
পি.এম.এ.-তে সবচেয়ে ভীতিকর ছিল ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট ফায়ারিং। কাঁধের ওপর রকেট লঞ্চার রেখে লক্ষ্যস্থির করতে হত। ল্যঞ্চারের ওপর গাল ঠেকিয়ে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজ কানে বাড়ি খেত। তারপর দীর্ঘদিন কানের ভিতর ভোঁ-ও-ও-ও-ও, ভোঁ-ও-ও-ও-ও আওয়াজ হত । মহড়ার সময় সবচেয়ে দুর্লভ ছিল বিশ্রাম । দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আশ্রয় নেবার জন্য বিভুয়োক বা দুইজনের শোবার উপযোগী মাটি থেকে ফুট তিনেক উঁচু ছোট তাঁবু সরবরাহ করা হত। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে বিভুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। পাহাড়ী ঢালে বিভুয়োকে অবস্থানকালীন রাতে বৃষ্টি এলে সবাই ভিজে চুপচুপে হয়ে যেত। তখন সবাই শীতে কাঁপতে কাঁপতে, বৃষ্টিকে অকথ্য গালি গালাজ করতে করতে পার করে দিত বাকি রাতটুকু।
পি.এম.এ.-তে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণের নাম কেয়াদৎ। এই প্রশিক্ষণ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ধরে চলত। ক্রমাগত সাতদিন প্রত্যেককে প্রায় সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হত পায়ের ওপর। তাই নবাগত ক্যাডেটরা প্রশিক্ষণ শেষে এই মহড়ার নাম দিল কেয়ামত। এই কেয়াদৎ বা কেয়ামতের সময় ব্রেকফাস্ট, হ্যাঁভারস্যাক লাঞ্চ, ডিনার ইত্যাদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেত ওরা। পানির অভাবে মাঝে মাঝে গর্তে জমে থাকা পানির মধ্যকার ব্যাঙ সরিয়ে সেই পানি খেতে হত ওদের। কেয়াদৎ নামধারী কেয়ামত, থেকে পি.এম.এ.-তে ফেরৎ আসার পর শুরু হলো চূড়ান্ত ভাবে লিখিত, শারীরিক, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি চালনার পরীক্ষা । প্রতিটি পরীক্ষাতে আনোয়ার ভাল করল এবং সেইসঙ্গে পি.এম.এ.-কে বিদায় জানানোর সময় এগিয়ে এল।
শুরু হলো পাসিং আউট প্যারেড রিহার্সেল। এই পাসিং আউট প্যারেডের স্যালুট গ্রহণ করে থাকেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে স্যালুট গ্রহণ করেন প্রধান সেনাপতি। এই পাসিং আউট প্যারেডের জন্য প্রত্যেক ক্যাডেটকে কঠোরভাবে অনুশীলন নিতে হয়। ক্রমাগত কয়েকদিন কঠোর অনুশীলনের পর এগিয়ে এল আনোয়ারের সৈনিক জীবনের স্মরণীয় দিন; যেদিনটি প্রতিটি সামরিক অফিসার যে-কোন অবস্থাতে অতি সহজেই স্মরণ করতে পারে।
১৯৬৬ সালের পহেলা জুলাই। পাসিং আউট প্যারেড। পি.এম.এ. নববধূর সাজে সজ্জিতা। বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ প্যাণ্ডেলের নিচে বহু বিদেশী কূটনীতিক, সাংবাদিক, উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ও তাদের পত্নী, বহু যুবতী ও কয়েক হাজার অভ্যাগতের ভীড়। প্যারেড শুরু হলো। নবাগত ক্যাডেটরা ব্যাণ্ডের তালে তালে সারিবদ্ধ ভাবে প্যারেড করতে করতে প্রবেশ করল ড্রিল গ্রাউণ্ডে। প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুসা দাঁড়ালেন ডায়াসে। জেনারেল মুসাকে জেনারেল স্যালুট দিল ক্যাডেটরা। এরপর শুরু হলো নবাগত ক্যাডেটদের শপথ গ্রহণ। শপথ গ্রহণের পালা শেষ হবার পর পি.এম.এ. কালার প্রদান করা হলো। ড্রিল গ্রাউণ্ডের এক প্রান্ত গ্যালারির মত উঁচু হয়ে আবার ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এবার ব্যাণ্ডের তালে তালে সবাই এগিয়ে গেল সেই গ্যালারির দিকে। ক্রমশ উঁচু হয়ে যাওয়া গ্যালারি বেয়ে ওরা নিচের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই একদৃষ্টে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটা উপভোগ করল। সেইসঙ্গে শেষ হলো আনোয়ারের ক্যাডেট জীবন। বহু সুখ ও দুঃখের স্মৃতিতে ভরা পি.এম.এ.-কে ও সত্যিই ভালবেসে ফেলেছিল।
.
০৪.
খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্ট। আনোয়ারকে একজন কমিশনড অফিসার হিসেবে এখানে বদলি করা হয়েছে। ও এখন সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট। ১৯৬৬ সালের জুলাই মাসে বিশ দিনের ছুটি নিয়ে দেশে এল আনোয়ার। দেশে ছুটিটা বেশ ফুর্তির সঙ্গে কাটিয়ে আবার প্লেনে করে লাহোর। লাহোর থেকে খারিয়াঁ স্টেশন পর্যন্ত এনে রিজার্ভেশন করল। জীবনে প্রথম চাকুরিস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করল আনোয়ার। খারিয়াঁ নামটা বিগড়ে দিল ওর মনকে। নামটা কেমন যেন বিদঘুঁটে মনে হচ্ছে। লাহোর স্টেশন থেকে কারিয়ার মোটামুটি অবস্থান জানা গেল। এসময়ে খারিয়াঁতে ভীষণ গরম পড়ে। ট্রেনে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিল সে। বিকেল তিনটার দিকে ট্রেন খারিয়াঁ স্টেশনে পৌঁছাল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে বের হয়ে এল আনোয়ার।
ছোট্ট স্টেশন খারিয়াঁ। স্টেশনে পা রাখতেই গরমের ঝাঁপটা এল লাগল যেন চোখে-মুখে। ক্ষণিকের মধ্যেই সারা শরীর ঘেমে উঠল ওর। কিন্তু তবুও পি.এম.এ.-র নিয়মানুযায়ী টাই পরে থাকতে হলো। স্টেশনের চারদিকে তাকিয়ে মনটা আরও বিগড়ে গেল। এ কোথায় বদলি হয়েছে সে? চারদিকে ধু-ধু প্রান্তর। মাঝে মাঝে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঝোঁপঝাড়। সূর্যের প্রখরতায় ধূসর প্রান্তরের ঝিকিমিঝি চোখকে কেমন যেন ধাধিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে, আলোর বিকিরণে যেন উজ্জ্বল পাথর থেকে দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। এই বৃক্ষহীন বিশাল মরু প্রান্তর ঘেঁষে সর্পিল রেল লাইন এগিয়ে গেছে। তারই একধারে স্টেশন খারিয়াঁ। স্টেশন বলতে ছোট্ট একটা বিল্ডিং। কয়েকটা স্টাফ কোয়ার্টার আর জলের অভাবে অযত্নে লালিত কিছু ঝোঁপঝাড়। স্টেশন থেকে উষর মরুর বুক চিরে এঁকেবেঁকে কোথায় হারিয়ে গেছে একটি অমসৃণ পায়ে চলা গ্রাম্য পথ ।
সেনাবাহিনীর কোন গাড়ি না দেখে একটি ঘোড়ায় টানা টাঙ্গায় মালপত্র চাপাল আনোয়ার। টাঙ্গা এগিয়ে চলল খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে। মাইলখানেক চলার পর টাঙ্গা পাকা রাস্তায় উঠল। এটাই উপমহাদেশের ইতিহাস-খ্যাত সেই গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক বা জি.টি. রোড। এই সড়কে বেশ কিছুদূর চলার পর টাঙ্গা বাঁক নিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
খারিয়াঁ!–কোন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের এরকম নাম হলে বুঝি মানাত ভাল । অথবা বহুদিনের পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়ির অথবা রাতের গভীরে অশরীরীদের ছোঁয়ায় হঠাৎ করে জেগে ওঠা কোন ভূতুড়ে মন্দিরের। কিন্তু আশ্চর্য! নামের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের চেহারার কোন মিল নেই। খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অত্যাধুনিক ক্যান্টনমেন্টটি আমেরিকানদের হাতে তৈরি। একই ধরনের সমস্ত বিল্ডিং-দোতলা। প্রতিটি বিল্ডিং-এর সামনে কেয়ারী করা লন। ফুলে ফুলে ভরা। সুদৃশ্য অফিসার্স মেসগুলো একতলা । বিরাট ক্যান্টনমেন্টের মাঝখানে দুই মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া নিখুঁত চতুষ্কোণ মাঠ। মাঠের চারপাশ দিয়ে চলে গেছে চওড়া মসৃণ পীচ ঢালা পথ। পথের দুধারে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাইট এবং একপাশে একের পর এক লম্বা হয়ে যাওয়া পাকা বেঞ্চের গ্যালারি। পথের দুপাশে সুশ্রী গাছের সারি।
ক্যান্টনমেন্টের পরিবেশ দেখে আনোয়ারের মনটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠল। বিভিন্ন জায়গায় জিজ্ঞেস করে অবশেষে টাঙ্গা পৌঁছল ওর নতুন ইউনিট নাইনথ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়নে। ওর পরিচয় পেয়ে একজন হাবিলদার স্যালুট (জীবনের প্রথম) করে তাড়াতাড়ি টাঙ্গাটা আবাসিক ভবনের সামনে নিয়ে এল। ও টাঙ্গা থেকে নামতেই একটা গাড়ি এসে থামল পাশে। পরিচয় পেয়ে একজন পাঠান সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট গাড়ি থেকে নেমে বলল, আই অ্যাম ভেরী সরি, আই ওয়েন্ট টু রিসিভ ইউ টু দ্য স্টেশন, পাইটলি লেট অ্যাণ্ড কামিং ব্যাক জাস্ট নাউ । প্লীজ, ডোন্ট মাইণ্ড। আনোয়ার বলল, নট অ্যাট অল। আই অ্যাম আনোয়ার হোসেন।
তাইমুর শাহ্, পাঠান সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট নিজের পরিচয় দিল ।
কালবিলম্ব না করে তাইমুর শাহ্ কয়েকজন আর্দালীকে ডেকে মালপত্র আনোয়ারের নির্দিষ্ট রূমে পৌঁছে দিল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য তাইমুর শাহ্ অনতিদূরে অফিসার্স মেস দেখিয়ে দিল ওকে। শেষে ওকে গোসল করে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেল তাইমুর শাহ্।
দোতলার নিচতলার একটা কামরা আনোয়ারের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিপাটি করে সাজানো-গুছানো ডিসটেমপার করা ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করে একটি সিগারেট ধরাল সে। ইতোমধ্যে মেস থেকে ঠাণ্ডা পানি, চা ও সিগারেট এল। মিনিট পনেরো পর নতুন আদালী এসে সমস্ত জিনিসপত্র পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলল। আনোয়ার বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডা জলে ভিজল ও। ক্রমেই দূর হয়ে গেল পথের ক্লান্তি।
ইউনিটে আনোয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটা নতুন ধরনের জিনিস। নাইনথ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটেলিয়নের প্রত্যেকের ইউনিফরমের কলারে নীল রঙের পাইপিন। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে জানতে পারল, ১৮৫৭ সালে এই ইউনিট বৃটিশ রাজের পক্ষ হয়ে সিপাহী বিদ্রোহ দমনে বিশেষ কৃতিত্ব সহকারে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে নিহত জনৈক সুবেদার মেজরের স্মৃতি ও অন্তিম অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকল্পে বৃটিশ রাজের নির্দেশে তখন থেকে এই ইউনিট ইউনিফরমের কলারে নীল রংয়ের পাইপিন ব্যবহার করে আসছে। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর জন্য ব্যাপারটা একটু অন্য রকম মনে হলেও পুরানো সেই ঐতিহ্য তখনও বর্তমান। কাজেই আনোয়ারের ইউনিফরমের কলারেও নীল রংয়ের পাইপিন লাগানো হলো।
সন্ধ্যার সময় তাইমুর শাহ্ এল আনোয়ারকে বিভিন্ন ব্যাচেলর অফিসারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। পরিচয় পর্বটা বেশ হাস্যকৌতুক ও উপভোগ্য পরিবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হলো । কারণ প্রত্যেকটা অফিসার নিজের পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনামে পরিচিত হলো ওর সঙ্গে। ফলে প্রথম দিন থেকেই ওদের মধ্যে গড়ে উঠল এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
সন্ধ্যার পর আনোয়ার ও তাইমুর শাহ্ অফিসার্স মেসে গেল। তখনও কেউ সেখানে এসে পৌঁছেনি। চারদিকে গুমোট ভাব। বেশ কয়েকটা প্যাডেস্টাল ফ্যান গুমোট ভাবটাকে দূর করার জন্য বনবন করে ঘুরছে। ওরা লনে বসে কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার দিল। কোল্ড ড্রিংকস শেষে ওরা গেল মেস বিল্ডিংয়ের ভেতরে। মেসে ঢুকলেই একপাশে বাথরুম, একপাশে বার ও এন্ট্রি রূম। বার এবং এন্ট্রি রূমের সঙ্গে লাগানো ডাইনিং রুম। দামী আসবাবপত্রে সুসজ্জিত মেস বিল্ডিং। চারদিকে আভিজাত্যের জৌলুস। এন্ট্রি রূমে ইরানী কার্পেট বিছানো কার্পেটের ওপর দেয়ালের পাশ দিয়ে সারা ঘর জুড়ে বড় বড় সাইজের দুপ্রাপ্য চামড়ায় মোড়া সোফাসেট। ডাইনিং রূম এবং এন্ট্রি রূমে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন ধরনের রুপোর তৈরি ভাস্কর্য। অপূর্ব সুন্দর। এন্ট্রি রূমের একদিকে ফায়ারপ্লেস, তার দুপাশে বড় সাইজের স্টেরিওগ্রাম ও টেলিভিশন। প্রতিটি ঘর মখমলের ভারী পর্দা দিয়ে ঘেরা। ১৮৯০ সালের মূল্য অনুযায়ী এন্ট্রি রূমে পাতা কার্পেটটার দাম ৩,২০০০০ টাকা। ডাইনিং রূমের বিশাল টেবিলটার দাম ২,৬০০.০০ টাকা এবং রুপোর তৈরি ভাস্কর্যগুলোর মূল্য ৩,৫০,০০০.০০ টাকা। পরিদর্শন শেষে ওরা আবার বেরিয়ে এল। লনে। লনে বসে কয়েকজন ব্যাচেলর অফিসার গল্প করছে। ওদের সঙ্গে নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আনোয়ার ইউনিটের ইতিহাস জেনে নিল।
১৮৪৭ সালে বৃটিশ লেফটেন্যান্ট (পরবর্তীকালে লে. জেনারেল) ওয়াইল্ড এই ইউনিটের পত্তন করেন। এর তৎকালীন মাম ছিল পাঞ্জাম ইরেগুলার ফ্রন্টিয়ার ফোর্স বা পি.আই.এফ.এফ.। পি.আই.এফ. এফ-এর সদস্যদের বলা হত শিকার। তখন থেকে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের অফিসাররা পিফার বলে পরিচিত। প্রত্যেক অফিসারকে তাই বলে দেয়া হয় ওয়ান্স পিফার, অলয়েজ এ পিফার। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের পর এই ইউনিটের বর্তমান নাম নাইনথ ব্যাটেলিয়ান (ওয়াইল্ডস), দ্য ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টবা, সংক্ষেপে নাইন এফ. এফ. বা ওয়াইল্ডস ব্যাটেলিয়ন। রাত নটায় ডিনার সেরে আনোয়ার মেস থেকে ঘরে ফিরে এল ।
পরদিন জীবনের প্রথম অফিসারের ইউনিফরম পরে ইউনিটে গেল সে। ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত কম্যাণ্ডিং অফিসার মেজর আকবর হুসাইনের সঙ্গে ইন্টারভিউ হলো। তিনি আনোয়ারকে বি কোম্পানীতে অফিসারের স্বল্পতা হেতু সরাসরি কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে নিয়োগ করলেন। প্রায় পৌনে দুইশ সৈনিকের কমাণ্ডার হয়ে গেল আনোয়ার। বেলা প্রায় এগারোটার দিকে কোম্পানী অফিসে বিপাকে পড়ল সে। জনৈক প্লাটুন কমাণ্ডার (একজন জে.সি.ও.) তার অধীনস্থ একজন সিপাহীকে আনোয়ারের সম্মুখে হাজির করে তার বিরুদ্ধে আদেশ লংঘনের অভিযোগ করল । চাকুরি জীবনে অফিসের প্রথম দিন। তাই বেশ বিব্রত বোধ করল আনোয়ার। যদিও পি.এম.এ.-তে ল সম্বন্ধে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নেয়া হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের অবস্থার সম্মুখীন এই প্রথম। প্লাটুন কমাণ্ডারকে ঘণ্টাখানেক পর আসার নির্দেশ দিয়ে অ্যাডজুটেন্টের কাছে গেল আনোয়ার। সব শুনে অ্যাডজুটেন্ট বললেন, এ ধরনের অপরাধে চার্জশীট বানিয়ে কমাণ্ডিং আদালতে তার বিচার হওয়া উচিত। তবে প্রথম দিন বলে তুমি শাস্তি থেকে তাকে কিছুটা অব্যাহতি দিতে পারো।
অফিসে ফিরে এসে অভিযুক্ত সিপাহীকে সাত দিনের প্যাক ড্রিলের শাস্তি ও এ ধরনের অপরাধ আর না করার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করে ছেড়ে দিল সে। বেলা প্রায় দুটো পর্যন্ত বিভিন্ন অফিশিয়াল চিঠিপত্র দেখে বাবুর্চিখানায় গিয়ে সৈনিকদের খাবার পরীক্ষা করে, সৈনিকদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট হলঘরগুলো পরিদর্শন করে শেষে কোম্পানী স্টোর পরীক্ষা করে মেসে ফিরে এল আনোয়ার। লাঞ্চের পর ঘণ্টাখানেক ঘুম। ঘুম থেকে উঠে বিকেলের চা। তারপর খেলার মাঠ। সন্ধ্যার পর আবার মেস । এই ছিল খারিয়াঁতে ওর প্রাত্যহিক জীবন।
তবে এর খানিকটা ব্যতিক্রমও ছিল বৈকি! সপ্তাহে দুদিন ডিনার নাইট, একদিন ক্লাব নাইট ও মাসে একদিন গেস্ট নাইট। এছাড়াও ছিল সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নাইট ট্রেনিং। এই বিশেষ নাইটগুলো ছিল দারুণ জাঁকজমকপূর্ণ । খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্ট-জীবনে যথেষ্ট বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠত আনোয়ার। তখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে জি.টি. রোডের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। পিণ্ডি ও লাহোরগামী বাসে যাতায়াতকারী, বেসামরিক যাত্রীদের তাকিয়ে দেখত সে। মনটা তখন হঠাৎ করে কেমন যেন আনমনা হয়ে যেত। মনে পড়ত দেশের কথা, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, আরও কত কি। সুশৃঙ্খল সৈনিক জীবনে কঠোরতম ব্যস্ত তার মাঝে কত কথাই না ভুলে থাকতে হত। এই ক্ষণিকের অবসরে দেশে রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো ভারাক্রান্ত করে তুলত ওর মনটাকে। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার স্মৃতি মনটাকে সবচেয়ে বেশি চঞ্চল করে তুলত।
খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া শুরু হলো ওদের। ফায়ারিং রেঞ্জে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের যেমন পিস্তল, স্টেনগান, মিডিয়াম মেশিনগান, হেভী মেশিনগান, অটোমেটিক রাইফেলস রিকয়েললেস রাইফেল প্রভৃতির গুলি চালনার অনুশীলন শুরু হলো। রিকয়েললেস রাইফেল নামক এই ট্যাংক বিধ্বংসী গোলা নিক্ষেপকারী রাইফেলের ফায়ারিং অনুশীলন ছিল বেশ বিপজ্জনক। এই লম্বা ব্যারেলের রাইফেলগুলো জীপে হুক দিয়ে আটকানো থাকে। জীপে এবং মাটিতে রেখে এই রাইফেলগুলো ফায়ার করা যায়। রিকয়েলিং (পেছন দিকে ধাক্কা মারা) করে না বলে এর নাম রিকয়েললেস রাইফেল। রিকয়েলিং-এর পরিবর্তে ব্যারেলের বিশেষ ভাবে কাটা ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড আগুনের হলকা বাইরে বেরিয়ে আসে। ফায়ারিং-এর সময় এই রাইফেলের পেছনের প্রায় ৫০ গজের মধ্যে যে-কোন জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে এবং ১০০ গজের মধ্যে মানুষ বা কোন জীবন্ত প্রাণী। থাকলে মারাত্মকভাবে আহত হতে পারে। যে-কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রিকয়েললেস রাইফেলের ফায়ারিং এর সময় পেছনের দিকে প্রায় দেড়শো গজ জায়গা পরিষ্কার রাখা হয়।
আনোয়ার ফায়ার অর্ডার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গর্জে উঠত রাইফেলগুলো। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের দাঁতে দাঁত বাড়ি খেয়ে লাফিয়ে উঠত হৃৎপিণ্ড। শ্রবণশক্তিও সাংঘাতিকভাবে কমে যেত ওদের। কিন্তু শীতকালীন কালেকটিভ ট্রেনিং ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। একবার এই ট্রেনিং-এর জন্য ঠিক করা হলো চাকোয়াল বলে একটা জায়গা। ওদের সিক্সথ আরমার্ড ডিভিশন বিশাল কনভয় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল চাকোয়ালের উদ্দেশে। এক একটা আরমার্ড ডিভিশনের কনভয়ের মিছিলে বহু জীপ, একটনী ট্রাক, আড়াইটনী (দশ চাকার) ট্রাক, রিকয়েললেস রাইফেলবাহী জীপ, ট্রাকটরের পেছনে টানা কামান, ট্যাংকট্রান্সপোর্টারের ওপরে ওঠানো ট্যাংক, অ্যাম্বুলেন্স প্রভৃতি থাকে। কনভয়ের মিছিল চলল তিন দিন তিন রাত ধরে। এই কালেকটিভ ট্রেনিংয়ে প্রত্যেক অফিসারের জন্য সুন্দরভাবে খাটানো তাঁবুর বাসস্থান থাকত। এমন কি সঙ্গে থাকত সংলগ্ন বাথরূম পর্যন্ত। সব মিলিয়ে যাকে বলে জঙ্গল মে মঙ্গল।
ক্যান্টনমেন্টের একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে বাইরের বৈচিত্র্যময় জীবন বেশ ভালই লাগত ওদের। এই ট্রেনিং শেষ হবার কিছুদিন পর ডিভিশন হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এল প্রতিটি ইউনিটে একটি করে কমাণ্ডো প্লাটুন গড়ে তুলতে হবে। প্লাটুন কমাণ্ডার হবে একজন, জুনিয়র অফিসার। তার অধীনে থাকবে জুনিয়র কমিশণ্ড অফিসার (জেসিও), নন কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) এবং সিপাহী সহ চল্লিশ জনের একটি দল। এই কমাণ্ডো দলকে কঠিন ট্রেনিং নিতে হবে। কারণ ট্রেনিং শেষে প্রতিটি পদাতিক ইউনিটের কমাণ্ডো প্লাটুনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। এই প্রতিযোগিতা তৎকালীন জি.ও.সি. মেজর জেনারেল জাঞ্জুয়া নিজে পর্যবেক্ষণ করবেন। শুরু হলো অফিসার বাছাইয়ের পালা। গুলি চালনা, দৌড় প্রভৃতি পরীক্ষায় প্রথম হলো আনোয়ার। তারপর শুরু হলো সৈনিক বাছাইয়ের পালা। প্রায় পৌনে আটশো সৈনিকের মধ্যে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, আটজন নন কমিশন্ড অফিসার ও বাকি সিপাহী নিয়ে ৪০ জনের একটি দল তৈরি করা হলো। এই দলের অধিনায়ক হলো আনোয়ারসেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট।
শুরু হলো কঠিন অনুশীলন। আনোয়ার নিজের জন্য বেশকিছু বইপত্র ও প্রেসীজ জোগাড় করে শুরু করল পড়াশোনা। প্রতিদিন, সকালে আটদশ মাইল দৌড়, তিরিশ গজ দূর থেকে এক ফুট বাই এক ফুট টার্গেটে গুলি চালনা, পিঠে যুদ্ধকালীন সময়ের ভারী প্যাক নিয়ে দৌড়, শারীরিক দক্ষতা প্রভৃতি বিষয়ে ওর দল বেশ। সাফল্য দেখাল। তারপর শুরু হলো চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। গুলি চালনায় দক্ষতা দেখাল আনোয়ার। তিরিশ গজ দূরত্বের টার্গেটে পর পর পাঁচবার লক্ষ্যভেদ করল সে একই পয়েন্টে। এ ব্যাপারে ও ছিল একজন সফল আত্মবিশ্বাসী মার্কসম্যান। অন্যান্য প্রতিটি বিষয়ে ওর দল অধিকার করল প্রথম স্থান। ফলে আনোয়ারের এই কমাণ্ডো বাহিনী জি.ও.সি. মেজর জেনারেল জাঞ্জুয়ার ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করল। বলতে গেলে এখান থেকেই শুরু হলো ওর কমাণ্ডো জীবনের হাতেখড়ি। শুরু হলো রোমাঞ্চকর গেরিলা জীবন।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে সমাপ্তি ঘটল কালেকটিভ ট্রেনিং-এর। ঠিক এই সময় আনোয়ার হঠাৎ করে নির্দেশ পেল, অফিসার্স ওয়েপনস অ্যাণ্ড জুনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্সে তিন মাসের জন্য কোয়েটা যেতে হবে। প্রি-কোর্স বা এ ধরনের কোন প্রস্তুতি নেয়ার সময় নেই। কারণ এক সপ্তাহের মধ্যেই যেতে হবে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে আনোয়ার রওনা হলো কোয়েটার পথে । তখন সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে বাস-ধর্মঘট চলছিল। ট্রেনে প্রচণ্ড ভীড়, রিজার্ভেশন পাওয়া গেল না। খারিয়াঁর মত ছোট্ট স্টেশনে ট্রেনের স্টপেজ মাত্র কয়েক মিনিট। লট বহর নিয়ে অত অল্প সময়ে ট্রেনে চড়া প্রায় অসম্ভব। তাই সে লাহোর স্টেশনে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু যাবে কিভাবে? বাস তো নেই। হঠাৎ করে একটা সুযোগ মিলে গেল। তখন লাহোরে চলছিল বিখ্যাত বার্ষিক জাতীয় গবাদি পশু প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিল ওদের ইউনিটের বাদক দল। ব্যাপার্টি নিয়ে আসার জন্য একটা ট্রাক লাহোর যাচ্ছে। মালপত্র সমেত রাইফেল হাতে ট্রাকে করে আনোয়ার লাহোর স্টেশনে পৌঁছাল।
কিন্তু এ কি? চারদিকে অজস্র মানুষের ভীড়! বিশাল স্টেশনে তিল ধারণের জায়গা নেই। ট্রেন এলে একজন কুলির সহায়তায় কোনমতে দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ল আনোয়ার। এতে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট কুপে। একটা ছোট কুপে কয়েকজন এয়ারফোর্স অফিসারের নামে রিজার্ভেশন করা। আনোয়ারের পরিচয় পেতেই ওরা সাদরে জায়গা করে দিল। প্রচণ্ড ভীড়ের দরুন এবং সময়ের অভাবে ওরাও আনোয়ারের মত। এয়ারকণ্ডিশনে রিজার্ভেশন করতে পারেনি। সারা রাস্তা সবাই তাস খেলে কাটিয়ে দিল। রাত প্রায় বারোটার দিকে ওকাড়া নামক স্টেশনে পৌঁছল ট্রেন। আনোয়ার ওকাড়া স্টেশনে নেমে কোয়েটাগামী ট্রেনে চাপল। রাত তখন সাড়ে বারোটা। এ ট্রেনেও কোন এ.সি. রিজার্ভেশন পাওয়া গেল না। অগত্যা প্রথম শ্রেণীর একটা বার্থ রিজার্ভেশন করল সে। ট্রেন ছাড়তেই দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে কম্বলের তলায় ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার।
পরদিন সকালের দিকে ট্রেন জেকোকাবাদ স্টেশনে পৌঁছল । জেকোকাবাদ এক সময় ছিল পৃথিবীর উষ্ণতম স্থান। তাই জেকোকাবাদ স্টেশন বাঙালীদের জন্য একটা আতঙ্ক বিশেষ। কিন্তু ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল আনোয়ার। চারদিকে গাঢ় সবুজ গাছপালা। প্রাণবন্ত পরিবেশ। অপূর্ব! পরে সে জেনেছিল, সরকারী প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় জলসেচ করে প্রচুর গাছপালা লাগানোর পর জেকোকাবাদের উষ্ণতা পূর্বের তুলনায় অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। ট্রেন জেকোকাবাদ স্টেশন পার হবার পর শুরু হলো বেলুচিস্তানের দিগন্ত বিস্তৃত উষর পাথুরে প্রান্তর। মাঝে মাঝে দুএকটা আকাশচুম্বী পাহাড় চোখে পড়ে। জনমানবহীন এই বিশাল পাহাড়ী অঞ্চলে ছোট ছোট স্টেশনগুলো ঠিক যেন মরুদ্যানের মত। এই কঠোর প্রাকৃতিক অঞ্চলের অধিবাসীরা যে কঠোর স্বভাবের, ওদের চেহারা দেখেই তা বোঝা যায়।
সিবি নামের একটা স্টেশনে পৌঁছার পর ট্রেনের পেছনে আরও একটা ইঞ্জিন লাগানো হলো। এখান থেকে শুরু হয়েছে চড়াই। উঁচু উঁচু পাহাড় কেটে টানেল করে রেলপথ বসানো হয়েছে। টানেলগুলোর ভিতরে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। তাই দিনের বেলাতেও ট্রেনের প্রতিটি কামরায় লাইট জ্বালানো থাকে। এই বিশাল টানেলগুলোর কোন কোনটা লম্বায় প্রায় এক মাইলের মত। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার টানেলগুলো যেন এক একটা অন্ধকূপ। টানেলে ট্রেন প্রবেশ করলেই প্রত্যেকটা যাত্রীর শরীর কেমন যেন শিউরে ওঠে। কারণ টানেলের মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে রিলিফের কাজ প্রায় অসম্ভব।
সন্ধ্যার একটু আগে ট্রেন পৌঁছল কোয়েটা। ওখানে তখন প্রচণ্ড শীত। গরম পোশাকের ওপর ওভার কোট পরে ট্রেন থেকে নেমে এল আনোয়ার। মুটের মাথায় রোল করা বেডিং হোল্ডার। বাইরে অভ্যর্থনার জন্য টুপ বাস অপেক্ষা করছিল। তাতে চড়ে সোজা ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে অফিসার্স মেস। তারপর অফিসার্স কোয়ার্টার-হান্না রোড অফিসার্স কোয়ার্টারগুলো প্রায় একই ধরনের। রাস্তা থেকে অনতিদূরে ছোট ছোট বাংলো আকারের অ্যাপার্টমেন্ট। প্রতিটায় চারটে বড় বড় ঘর। ঘরগুলোর সামনে লম্বা রেলিং ঘেরা করিডোর। প্রতিটা ঘরের পেছন দিকে একটা করে স্টোর-কাম-ড্রেসিং রূম ও অ্যাটাচ বাথ। প্রতিটা ঘর দুজন করে ট্রেইনী অফিসার থাকার মত আসবাবপত্রে সাজানো।
তেরো সপ্তাহের প্রশিক্ষণের মধ্যে প্রথম চার সপ্তাহ বিভিন্ন রকম হালকা ও ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। বাকি নয় সপ্তাহ যুদ্ধকালীন কলা-কৌশলের প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণকালে একটা মজার ঘটনা ঘটল। প্রশিক্ষণার্থী অফিসারদের মধ্যে অনেকেই ছিল ধনীর দুলাল। কেউ হয়তো কোন করদ রাজ্যের রাজপুত্র, কেউ বিরাট শিল্পপতির পুত্র, কেউ হয়তো মস্ত ব্যবসাদারের ব্যাটা আবার কেউ বা গ্রাম্য জোতদারের ছেলে। এরা প্রত্যেকে প্রচুর টাকা ওড়ত। প্রতিমাসে এদের জন্য নিয়মিত টাকা আসত বাড়ি থেকে। প্রশিক্ষণ চলাকালীন এমনি এক গ্রাম্য জোতদারের ছেলের (কমিশন্ড অফিসার) টাকার প্রয়োজন পড়ায় সে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠাল: আব্বা, অস্ত্র-প্রশিক্ষণের জন্য মর্টার ও মেশিনগান কিনিতে হইবে। পনেরো হাজার টাকার দরকার। টেলিগ্রাম মানি অর্ডারে টাকাটা পাঠাইয়া দিবেন। সেই অশিক্ষিত ধনী জোতদার ছেলেকে মেশিনগান ও মর্টার কেনার জন্য টাকাটা ঠিকই পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনাটা জানার পর অন্যান্য অফিসারদের । মধ্যে সাংঘাতিক হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল।
কোয়েটার ঠাণ্ডার তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে এল। চারদিকে গাছপালায় রঙিন ফুলের সমারোহ। গরম পোশাক ছেড়ে যুবক যুবতীরা হালকা পোশাকে রাস্তায় বের হয়ে এল। রাস্তার দুধারের আইল্যাণ্ডগুলোতে ফুটন্ত ফুল। গাছের নরম কচি কচি পাতাগুলো সবাইকে হাতছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু রঙিন ফুল আর অপরূপ নীল সবুজের ছড়াছড়ি। মসৃণ পিচঢালা পথগুলো কোথাও ঢালু হয়ে নিচে নেমে গিয়েছে, আবার কোথাও শুরু হয়েছে চড়াই। সব মিলিয়ে কোয়েটা এখন ভ্রমণকারীদের স্বর্গ ।
বিকেলে খেলাধুলোর পর আনোয়ার প্রায় প্রতিদিন শহর দেখতে বের হয়। প্রথমে যায় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট অথবা ফারাহ্ ক্যাফেতে। হালকা পানীয় নাস্তার পর ঘুরে ঘুরে দেখে শহর। ট্রেইনী অফিসারদের কাছে অভিজাত বিপনী কেন্দ্রগুলোর চাইতে লিয়াকত মার্কেটের আকর্ষণ ছিল বেশি। লিয়াকত মার্কেট শহরের প্রাণকেন্দ্র। বিদেশী স্মাগলড পণ্যের খোলা বাজার। যে কোন বিদেশী জিনিস কম দামে পাওয়া যেত সেখানে।
কোয়েটা শহর ঘুরে ঘুরে দেখার সময় এক ওয়ালীর দুই ছেলের সঙ্গে আনোয়ারের পরিচয় হলো। ওয়ালী পুত্রদ্বয়কে সব সময় একই রকমের দুটো মোটর সাইকেলে দেখা যেত। মোটর সাইকেল দুটোর সারা গায়ে তিরিশ চল্লিশটা করে রং-বেরং-এর বাল্ব জ্বলত । ওরা শহরের ব্যস্ততম এলাকা দিয়ে ঘণ্টায় সত্তর, আশি মাইল বেগে চালাত মোটর সাইকেল। কোয়েটাতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক মোটর সাইকেল প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিত ওরা।
একবার আনোয়ার ওদের একজনের মোটর সাইকেলের পেছনে চড়ে বসে। শহরের ব্যস্ততম এলাকা দিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটে চলল রঙিন আলোয় সজ্জিত মোটর সাইকেল। বিভিন্ন গোলচত্বর ঘণ্টায় প্রায় ষাট মাইল বেগে অতিক্রম করছে ওরা। তখন নিজের অজান্তে আনোয়ার চালককে খামচে ধরেছিল। প্রতি মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছিল, এই বুঝি রাস্তার সঙ্গে হাঁটু ঘষা খেলো। ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকিয়ে সে দেখতে পাচ্ছিল, মোটর সাইকেলের ডান দিকের ক্র্যাস গার্ড রাস্তার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘষা খাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে ছিটকে উঠছে আগুনের ফুলকি। এই বিপজ্জনক চালকের পেছনে আনোয়ার আর কোনদিন মোটর সাইকেলে চড়েনি। ইতোমধ্যে কোয়েটার প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গেল। আনোয়ার আবার ফিরে এল খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টে। শুরু হলো কমাঙ্গে প্লাটুন নিয়ে প্রশিক্ষণ।
০৫.
এবোটাবাদ।
শুরু হলো পিফার-এর বার্ষিক রিইউনিয়ন। এই অভিজাত অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য নির্দেশ এল আনোয়ারের প্রতি। এ সময়ে সে আবার পুরানো অভ্যাস মত মাথা ন্যাড়া করেছে। যথাসময়ে সে এবোটাবাদ পৌঁছল। দুতিনদিন কেটে গেল বেশ হৈ-চৈ-এর মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠানের শেষ দিনে ডিনার পার্টি। গ্রীষ্মকালীন ডিনার-ইউনিফরম পরে পার্টিতে যোগ দিল আনোয়ার। এই ভোজ সভায় আগমন ঘটল বহু উচচপদস্থ সামরিক অফিসারের। তৎকালীন ১নং কোর-কমাণ্ডার (কয়েকটা ডিভিশন নিয়ে একটু কোর হয়) লে. জেনারেল আতিকুর রহমানও এলেন। এই জেনারেল সম্বন্ধে অনেক ভীতিকর কথা প্রচলিত ছিল। সামান্য ভুলত্রুটির জন্য তিনি নাকি ব্রিগেডিয়ারদের পিঠেও বেত দিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলতেন। তাই সমস্ত অফিসাররা এই জেনারেলের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত।
তাছাড়া আর্মিতে তো একটা প্রবাদই আছে, ডোন্ট গো ইনফ্রন্ট অভদি জেনারেলস অ্যাণ্ড বিহাইও দি ডাংকিজ। অর্থাৎ গাধার পেছনে গেলে গাধা লাথি মারে, আর জেনারেলদের সামনে ৫-হেল কমাণ্ডো গেলে দোষত্রুটি ধরা পড়ে।
আনোয়ার কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। হঠাৎ একজন বেয়ারা এসে ওকে জানাল, জেনারেল সাহেব ডাকছেন। ও বেয়ারাকে বলল, তুমি হয়তো ভুল করছ, তিনি তো আমাকে চেনেন না। তিনি নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ডেকেছেন। বেয়ারা আবার বলল, না স্যার, আমি ভুল করিনি। তিনি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন, লম্বা ন্যাড়া মাথা অফিসারকে ডেকে নিয়ে এসো। ন্যাড়া মাথার কথা শুনতেই আনোয়ার চমকে উঠল। মাথা ন্যাড়া করার জন্য নিজেকে অভিসম্পাত দিতে দিতে দূরে দাঁড়ানো জেনারেলের দিকে তাকাতেই জেনারেল অঙ্গুলি ইশারায় ডাক দিলেন। দ্রুত জেনারেলের সামনে গিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল সে। জেনারেল আতিক মৃদু হেসে বললেন, রিল্যাক্স।
বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর জেনারেল আতিক বললেন, তোমার ডিনার ইউনিফরমের কলারডগ দুটো মনে হচ্ছে উল্টাপাল্টা হয়ে আছে। এই সেরেছে রে! জেনারেল আতিক বোধহয় তার স্বভাবসিদ্ধ পরীক্ষা শুরু করলেন। এবোটাবাদের মনোরম পরিবেশে অফিসার্স মেসের বৈদ্যুতিক পাখার নিচে দাঁড়িয়ে ঘামতে শুরু করল আনোয়ার। হাত-পা অল্প অল্প কাঁপছে তার। জেনারেল সাহেব কিন্তু বলেই চলেছেন, বোধহয় এই ক্ষুদ্র জিনিস দুটো তোমার আর্দালি ভুল করে বাম কলারেরটা ডান কলারে এবং ডানেরটা বাম কলারে লাগিয়েছে। তুমিও নিশ্চয় তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলে, তাই আর্দালির এই ত্রুটি খেয়াল করোনি। ওহো, আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি ভীষণ ঘামছ। নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে গেছ? যাই হোক, তুমি চট করে বাথরূমে গিয়ে তোমার কলারডগ দুটো ঠিক করে এসো। মুখের ঘামও মুছে আসবে। বাথরূমের কাজ সেরে তুমি কিন্তু আমার কাছে ফেরত আসবে। কারণ তুমি এখন আমার মেহমান।
তিনি সারাক্ষণ মুখে স্মিত হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। আনোয়ার তাড়াতাড়ি বাথরূম সেরে আবার জেনারেল সাহেবের কাছে ফিরে এল। উনি আনোয়ারের পিঠে হাত দিয়ে হলঘরের এক কোণায় বসানো বার-কাউন্টারে এলেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জেনারেল আতিককে সবাই সভয়ে জায়গা করে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছে। সকলের স্তম্ভিত দৃষ্টি। জেনারেল আতিক আনোয়ারের পিঠে হাত রেখে কথা বলছেন। বারম্যানকে নিজের জন্য হুইস্কি এবং আনোয়ারের পছন্দমত ড্রিংকস দেবার নির্দেশ দিয়ে বার কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল। একগ্লাস সেভেন-আপ হাতে নিয়ে জেনারেলের মুখোমুখি দাঁড়াল আনোয়ার। কোন কথা শুরু হবার আগেই তিনি বারম্যানকে বললেন, এই লেফটেন্যান্ট সাহেব আমার মেহমান, তিনি আজ রাতে যে-কোন ধরনের ড্রিংকস যত পরিমাণেই খান না কেন, সব বিল আমার নামে লিখবে।
আনোয়ারের পরিবার, শিক্ষা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানা কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছেন জেনারেল। কখনও বা নিজেই সকৌতুকে হো হো করে হেসে উঠছেন। ব্যাপার কি? আনোয়ারের মনে সন্দেহ! জেনারেলের মনে কোন দূরভিসন্ধি নেই তো? সেভেন আপের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে সে থ হয়ে গেল। হলের সমস্ত অফিসারদের দৃষ্টি ওদের দিকে। আনোয়ারের কমাণ্ডিং অফিসার চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছেন। জেনারেল সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হঠাৎ বলে উঠলেন, ওই দেখো, তোমার এ কমাণ্ডো কমাণ্ডিং অফিসার তোমাকে আমার সঙ্গে গল্প করতে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কথা বলা শেষ করে ফেরত গেলে তোমাকে তিনি হাজারো প্রশ্ন করবেন। তুমি কি জবাব দেবে তার প্রস্তুতি এখন থেকে নিয়ে নাও। অবশ্য এই কথা তুমি কাউকে বলবে না যে, আমি তোমার বন্ধু। জেনারেলের শেষের কথায় ও প্রতিবাদ করে বলল, স্যার, সিংহের সঙ্গে ইঁদুরের বন্ধুত্ব কিভাবে সম্ভব? সঙ্গে সঙ্গে তিনি কপট রাগে বললেন, তুমি একটা গাধা। কেন, ছোটবেলায় এই গল্পটা বইতে পড়োনি? একটা ইঁদুর কেমন করে জাল কেটে একটা সিংহকে মুক্ত করায় দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব। হয়েছিল? আর তুমি তো পদের দিক থেকে ইঁদুরের মত হলেও আকারে একটা ধেড়ে ইঁদুর। বুঝতে পেরেছ? আনোয়ার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ইয়েস, স্যার।
ইতোমধ্যে ডিনারের সময় হয়ে এলে জেনারেল আতিক আনোয়ারকে ছেড়ে দিলেন। আর সে ফিরে আসতেই শুরু হলো সবার কৌতূহলী প্রশ্ন। নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে কমাণ্ডিং অফিসার আগা আকবর শাহের কাছ থেকে ডাক এল। ওর ন্যাড়া মাথাই জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ, এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কমাণ্ডিং অফিসার বললেন, ব্লাডি চ্যাপ, জেনারেল কি তোমার ন্যাড়া মাথার জন্য রাগ করেছেন? ও সবিনয়ে জানাল, জেনারেল সাহেব রাগ করেননি, বরং খুশিই হয়েছেন। ডিনার টেবিলে বসার শেষ ঘণ্টা ধ্বনি হয়ে গেল। সবাই দেশের প্রেসিডেন্ট ও সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শুরু করল ডিনার। বিলাসবহুল ডিনার শেষে সবাই বাইরে এসে দাঁড়াল। সেখানে সামরিক ব্যাণ্ডে বিভিন্ন ইংরেজি গানের সুর বাজছে।
জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে আনোয়ার ব্যাণ্ডের তালে তালে লনের এক প্রান্তে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ড্যান্স করছে। নাচ তো নয় এলোপাতাড়ি হাত পা ছোঁড়াছুড়ি। সব অতিথিরা বাইরে এসে এই উদ্দাম নৃত্য উপভোগ করছে। সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যানুযায়ী এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদানকারী সর্বোচ্চ পদধারী অফিসারকে জলি গুড ফেলো বানানো হয়। জলি গুড ফেলোর অর্থ হলো, ব্যাণ্ডে একটা ইংরেজি সুর, হি ওয়াজ এ জলি গুড ফেলো বাজবে। আর সেইসঙ্গে জুনিয়র অফিসাররা প্রধান অতিথিকে কাঁধে তুলে নিয়ে ড্যান্স করবে। ওরা সবাই নাচতে নাচতে এক সময় ব্যাণ্ডমাস্টারকে ইঙ্গিত করল জলি গুড় ফেলল বাজানোর জন্য। ব্যাণ্ডে বেজে উঠল, হি ওয়াজ••ফেলল। নৃত্যরত জুনিয়র অফিসাররা উদ্ধৃঙ্খল জনতার মত ছুটে এসে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কাঁধে তুলে নিল জেনারেল আতিককে। জেনারেল আতিক জুনিয়রদের কাঁধের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। উদ্দাম নাচের সঙ্গে শুরু হলো নিচ থেকে সুড়সুড়ি দেয়া।
এই সুড়সুড়ির প্রধান লক্ষ্য হলো জেনারেলের আপত্তিকর জায়গায় হস্তক্ষেপ। তিনি লিভ মী, লিভ মী বলে চিৎকার শুরু করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেনারেল আতিককে জলি গুড় ফেলো করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ল সবাই। কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয়ার পর কাছেই দাঁড়ানো পদস্থ অফিসারদের হাঁপাতে হাঁপাতে বিশালদেহী জেনারেল, বললেন, ইউ সি, দিজ বয়েজ আর ভেরী নটি। দে হ্যাড বিন ফিঙ্গারিং মি। অর্থাৎ জানেন–এরা বড় পাজি। আমার পোঁদে আঙুল দিচ্ছিল।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘটল অট্টহাসির বিস্ফোরণ । এই ভাবেই শেষ হলো পিফার-এর রিইউনিয়ন।
খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আনোয়ারকে ব্রিগেড কমাণ্ডো ট্রেনিং-এ অংশ নিতে হলো। এই ট্রেনিং এর সময়সীমা ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। ব্রিগেড কমাণ্ডো ট্রেনিং শেষ হবার পর শুরু হলো ডিভিশন কমাণ্ডো ট্রেনিং। এটার পর শুরু হলো উইণ্টার কালেকটিভ ট্রেনিং। ক্যান্টনমেন্টের বাঁধাধরা জীবনের বাইরে এ ট্রেনিংটা ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। কিন্তু এই কালেকটিভ ট্রেনিং আনোয়ারের স্মৃতিতে একটা দুর্ঘটনার চিহ্ন স্বরূপ।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। পুরো ডিভিশনের বিশাল কনভয় খুব ভোরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো। বিশাল কনভয় নির্ধারিত সময়ে অতিক্রম করল স্টার্টিং পয়েন্ট। পনেরো থেকে বিশ মাইল বেগে এগিয়ে চলেছে কনভয়। বেলা প্রায় নটার দিকে ঝিলাম শহর অতিক্রম করল ওরা।
আনোয়ারের জীপ চলছে কনভয়ের মাঝামাঝি অবস্থানে। হঠাৎ থেমে গেল কনভয়। তাড়াতাড়ি ও ওয়্যারলেসের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু ওয়্যারলেসে বিভিন্ন স্টেশনের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারল পুরো কনভয় থামেনি। কোম্পানী-কমাণ্ডার মেজর মোখতার শাহের সঙ্গে সে যোগাযোগ করল। মেজর মোখতার শাহ জানালেন, কনভয় ঠিকই এগিয়ে চলেছে। তবে তার ও আনোয়ারের মাঝামাঝি অবস্থানে কোন গাড়ি হয় বিকল হয়েছে, নতুবা কোন অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেছে। মেজর শাহ ওকে নির্দেশ দিলেন ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে। আনোয়ার জীপ নিয়ে কনভয়ের লাইন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
আধমাইল মত যাওয়ার পর দেখতে পেল, ওর কোম্পানীর একটা বিশাল ট্রাকের নিচে একটি চকচকে নতুন কারের প্রায় অর্ধেক চাপা পড়ে আছে। সৈনিকরা ট্রাকটাকে ঠেলে পেছনের দিকে সরানোর চেষ্টা করছে। আনোয়ার জীপ থেকে নেমে দৌড় দিল দুর্ঘটনাস্থলের দিকে। ওকে দেখে কার-মালিক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। তিনি জড়ানো গলায় একহাত নেড়ে ওকে কিছু বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু কোন কথাই বোঝা গেল না। লোকটির মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল আনোয়ার। সারা মুখ ক্ষতবিক্ষত বীভৎস আকার ধারণ করেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত। কথা বলার সময় রক্তের সঙ্গে থোকা থোকা ভাঙা দাঁত বেরিয়ে আসছে। কারের ড্রাইভার অচেতন অবস্থায় অনতিদূরে ঘাসের ওপর শায়িত। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা চারদিকের পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
সবাই মিলে ট্রাক ঠেলে খানিকটা পেছনের দিকে সরাল। সঙ্গে সঙ্গে সবার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল আর্ত চিৎকার। বিশাল ট্রাকের চাপে সালোয়ার-কামিজ পরিহিতার সম্পূর্ণ ডান পা-টা চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চামড়া ফেটে নরম হাড় মাংস রক্তের সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একটা হাতও ভাঙা । হাতের সাদা হাড় নরম মাংস ভেদ করে বেরিয়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে আনোয়ার লক্ষ করল, সালোয়ার-কামিজ পরিহিতার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে খোলা। সামান্য উদাস দৃষ্টি মেলে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। তাড়াতাড়ি সব আহতদের একটা রেকুয়িজিশন করা মাইক্রোবাসে করে নিকটবর্তী ঝিলাম সি.এম.এইচ.-এ পৌঁছল আনোয়ার। সেখানে সবাইকে ভর্তি করে আবার সে ফিরে এল কনভয়ে।
মে-জুন-জুলাই। শুরু হলো সামার কালেকটিভ ট্রেনিং। আনোয়ারদের ইউনিট ক্যাম্প করল দৌলত নগরে। ওরা প্রায়ই জীপে করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক্সারসাইজ এলাকা পরিদর্শনে বের হয়। এই এলাকায় বেশ কয়েকটা শুকনো নদী আছে। এই নদীগুলো এসেছে ভারতের দিক থেকে। ভারতীয় এলাকায় বৃষ্টি হলে এদিককার শুকনো নদীগুলো ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানিতে অল্প সময়ে খরস্রোতা নদীতে পরিণত হয়। এধরনের একটা মরা নদীর পাড় ঘেঁষে ওদের ইউনিটের ক্যাম্প। এই শুকনো নদীটি প্রায় পৌনে এক মাইল চওড়া। একদিন সকালে মেজর খটক, লেফটেন্যান্ট আসিফ শাহ ও লেফটেন্যান্ট আনোয়ার বের হলো এক্সারসাইজ এলাকা পরিদর্শনে। জীপে ড্রাইভার সহ সঙ্গে রয়েছে একজন ওয়্যারলেস (পি আর সি-১০) অপারেটর ও ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার। বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনের পর বেলা ১১টার দিকে আকাশ মেঘলা হয়ে এল। মেজর খটক তাড়াতাড়ি জীপ চালিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছবার নির্দেশ দিলেন।
জীপ অতি দ্রুত এগিয়ে চলল ক্যাম্পের দিকে। দুটো শুকনো নদী পার হবার পর চমকে উঠল ওরা। সামনে ভারতীয় অঞ্চলে শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টি। তৃতীয় নদীটার সম্মুখে এসে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানি ইতোমধ্যেই এসে পড়েছে। ক্রমেই তীব্র হচ্ছে স্রোত। ওরা ভাবল, এটা পার হওয়া গেলেও সামনে চওড়া নদীটা কোনক্রমেই পেরুনো যাবে না। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, পেছনে ফেলে আসা শুকনো নদীগুলো পার হয়ে জি.টি, রোড ধরে ক্যান্টনমেন্ট হয়ে ক্যাম্পে পৌঁছুতে হবে। জীপ ফিরে চলল পেছনের দিকে। প্রথম নদীটার সম্মুখে এসে ওরা আবার থমকে দাঁড়াল। নদীটা ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানিতে সংহার মূর্তি ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে পাক খাচ্ছে পানি। দেখে কোনক্রমেই বোঝার উপায় নেই, একটু আগেই জায়গাটা শুকনো খটখটে ছিল। কিন্তু এখন জীপ নিয়ে পার হওয়া অসম্ভব। আবার ফিরে চলল জীপ সামনে। তৃতীয় নদীটা তখনও ভয়াল রূপ ধারণ করেনি। পানির ভিতর দিয়ে জীপ চালিয়ে ওরা পার হয়ে গেল নদীটা।
কিন্তু ক্যাম্প সংলগ্ন নদীটার পাড়ে এসে সবাই দেখতে পেল ফ্ল্যাশ ফ্লাডের তাণ্ডব । ভীষণ আওয়াজে প্রচণ্ডবেগে পানি ছুটে । চলেছে। মাঝে মাঝে পানি ঘুরপাক খাচ্ছে। ওরা আটকে গেছে ফ্ল্যাশ ফ্লাডে। সবাই জীপ থেকে নেমে নদীর পাড়ে দাঁড়াল। মেজর খটক ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করলেন ক্যাম্পের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর নদীর অপর পাড়ে গাছের নিচে কর্নেল আকরাম রাজা, অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন তাইমুর শাহ ও আরও কয়েকজন অফিসারকে দেখা গেল। উভয় পক্ষই হাত নাড়ানাড়ি করল । আবার শুরু হলো ওয়্যারলেসে কথোপকথন। ওপার থেকে ওয়্যারলেসে অ্যাডজুটেন্ট কৌতুক করে বললেন সেনাবাহিনী থেকে ইঞ্জিনিয়াররা রওনা হয়ে গেছে ব্রিজ তৈরি করার জন্য। আর পিণ্ডি থেকে, কপ্টার রওনা হয়ে গেছে খাবার পৌঁছে দেবার জন্য। একে প্রচণ্ড ক্ষিধে, তার ওপর এধরনের কৌতুক, বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হলো ওদের। কৌতুকপ্রিয় মেজর খটক রেগেমেগে বললেন, ওকে, নাউ ইউ সি, হাউ ইনফ্যান্ট্রি ক্রসেস দ্য অবস্ট্যাকল।
জীপ পাহারার জন্য ড্রাইভার ও ওয়্যারলেস অপারেটরকে রেখে ওরা এগিয়ে গেল নদীর কিনারায় । পানির গভীরতা কোমরের চেয়ে সামান্য ওপরে। মেজর খটক, আনোয়ার ও ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার তিনজনই দক্ষ সাঁতারু। কিন্তু আসিফ শাহ। সাঁতারের ব্যাপারে একেবারে আনাড়ি। তাই নিরাপত্তার জন্য ওকে। সবচেয়ে উজানের দিকে রাখা হলো। ভাটির দিকে রইল মেজর খটক, আনোয়ার ও হাবিলদার। হাবিলদারের পরনে শুধু শর্টস।
কিন্তু ওরা তিনজন ইউনিফরম পরেই নামল পানিতে। প্রত্যেকের মাঝে দূরত্ব প্রায় দশ হাত । লাইনবন্দী হয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে। নদীর তিনভাগের একভাগ পার হবার পর শুরু হলো প্রচণ্ড স্রোত। স্রোতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বুটের তলা থেকে বালি সরে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পিছলে যেতে চাইছে পা। প্যান্টের পকেটে ও শার্টের ভিতরে পানি ঢুকে শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে। ইউনিফরম পরে বোকার মত পানিতে নামার জন্য ওরা নিজেদেরকে ধিক্কার দিল।
স্রোত ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মাঝে মাঝে পাক খাচ্ছে পানি। পানির দিকে তাকালে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড বেগে ওরা উজানের দিকে চলেছে। মাথা পর্যন্ত ঘুরে উঠতে চায়। সবাই দূরে গাছপালার দিকে তাকিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আর মাত্র পাঁচ ছয়শো গজ বাকি। হঠাৎ করে বেড়ে গেল গভীরতা। পানি যেন রুদ্র মূর্তি ধারণ করে প্রলয় নৃত্যরত। ওরা স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। এই অবস্থায় একবার পা পিছলে গেলে আর রক্ষা নেই। দক্ষ সাতারুর পক্ষেও পুনরায় ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব।
ঠিক এই সময়ই ঘটল বিপদটা! মেজর খটকের হাত থেকে ফসকে গেল প্লাস্টিকের কাভারে মোড়া ম্যাপ। খটক ক্যাচ দি ম্যাপ বলে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়লেন পানিতে। তারপর তৃণখণ্ডের মত তীব্রবেগে আনোয়ারের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আনোয়ার দ্রুত অকাল আসিফ শাহের দিকে। শাহেরও পা পিছলে গেছে। সে-ও তীব্রবেগে স্রোতের টানে এগিয়ে আসছে। আনোয়ার আন্দাজ করল, শাহ ওর পাঁচ ছয় হাত দূর দিয়ে ভেসে যাবে। প্রাণপণে স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সামনের দিকে এগুলো সে। আস্তে আস্তে দূরত্ব কমছে। ওদিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে শাই। আর মাত্র হাত দেড়েক। তাহলেই ওকে ধরে ফেলবে আনোয়ার। কিন্তু হাতখানেক বাকি থাকতেই তীব্র গতিতে শাহ ভেসে গেল। হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে যাবার সময় র চোখেমুখে পরিষ্কার মৃত্যু ভয়ের ছাপ দেখতে পেল আনোয়ার। আসিফ শাহকে ধরার জন্য ও নিজেও লাফ দিল। কিন্তু কার ধরা কে ধরে? প্রবল স্রোতের টানে ওরা ভেসে চলল এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
ইতোমধ্যে ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সতর্ক হয়ে গেছে। শুধু শর্টস পরিহিত হাবিলদারের দ্রুত এগিয়ে চলতে তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছে না। মেজর খটকের হাত থেকে প্লাস্টিকের কাভারে মোড়া ম্যাপটা সামনে দিয়ে ভেসে যাবার সময় হাবিলদার ধরে ফেলল। আনোয়ার চিৎকার করে উঠল, আমাদের জন্য কোন চিন্তা কোরো না। তুমি শাহকে ধরো। ও সাঁতার জানে না। কিছুদূর ভেসে যাবার পর পেছন ফিরে চাইতেই সে দেখতে পেল, হাবিলদার শাহকে ধরে এগিয়ে চলেছে পাড়ের দিকে।
আনোয়ারের থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে রয়েছে মেজর খটক। স্রোতের তীব্রতা বেড়ে চলেছে ক্রমশই। সেইসঙ্গে ওদের ভেসে যাবার গতিও বাড়ছে। ওরা দুজনে অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে বেলেমাটিতে পা ঠেকিয়ে দাঁড়ানোর জন্য। কিন্তু প্রবল স্রোতে মাটিতে পা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। চিৎ হয়ে ভাসছে ওরা। মাঝে মাঝে নাকে মুখে পানি ঢুকে যাচ্ছে। এই প্রবল স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিনারায় পৌঁছানো অসম্ভব। তাই ওরা মাটিতে পা ঠেকিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য রীতিমত মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু ব্যর্থ হলো ওদের সমস্ত চেষ্টা। তীব্র স্রোতের বিপরীতে পা সোজা করাই সম্ভব হচ্ছে না। প্রাণান্ত পরিশ্রমের ফলে দুজনের শরীর ক্রমেই দুর্বল হয়ে এল। এইভাবে মাইল দেড়েক ভেসে যাবার পর স্রোতের গতিমুখের কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেল। এদিকে স্রোত অনেকটা কিনারাভিমুখী। মেজর খটক, ও আনোয়ার তীরের অনতিদূর দিয়ে ভেসে চলেছে-বড় অসহায়ের মত। হঠাৎ দুজন দেখতে পেল, নদীর ধার দিয়ে ওদের ইউনিটের একটি জীপ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের অতিক্রম করে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল জীপটি। জীপ থেকে নামল কয়েকজন দক্ষ সাঁতারু। সাঁতারুদল দ্রুত পানিতে নেমে পথ আগলে দাঁড়াল ওদের। ওরা ভেসে কাছে আসতেই সাঁতারুরা ওদের ধরে কিনারায় ওঠাল। ওরা কোনমতে সাঁতারুদের পিঠে হাত দিয়ে জীপে চড়ে বসল। জীপ এগিয়ে চলল ক্যাম্প অভিমুখে।
সন্ধ্যায় মেসে এই অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী নিয়ে শুরু হলো তুমুল হৈ-চৈ। মেজর খটকের সেই উক্তি-নাউ ইউ সি, হাউ ইনফ্যান্ট্রি ক্রসেস দি অবস্ট্যাকল। এই কথায় হাসির রোল উঠল চারদিকে। সবশেষে কর্নেল বললেন, মাই ডিয়ার ইনফ্রাস্ট্রিমেন, প্লীজ হ্যাভ সাম পেশেন্স। ফর গডস সেক, ট্রাই টু এভাললায়েট দ্য অবস্ট্যাকল বিফোর ক্রসিং ইট। আবারও উঠল হাসির রোল। ডিনার শেষে তাঁবুতে ফিরে এল আনোয়ার। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়ল সে।
.
০৬.
স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ হেডকোয়ার্টার, চেরাট। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাস। আনোয়ার আর্মি কমাভো লীডার কোর্সের জন্য এখানে এল। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ হেডকোয়ার্টারকে সংক্ষেপে এইচ.কিউ.এস.এস.জি. বলা হয়। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট থেকে প্রায় ৩০ জন অফিসার এই ট্রেনিং-এর জন্য চেরাট উপস্থিত হয়েছেন। চেরাট ক্যান্টনমেন্ট একটা অদ্ভুত জায়গা। পেশওয়ারের কাছাকাছি সমতল ভূমির মাঝখানে হঠাৎ করে জেগে ওঠা চরের মত পাঁচ হাজার ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর ক্যান্টনমেন্টটি। এটা আমেরিকানদের দ্বারা তৈরি। প্রধান ফটক ছাড়া অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। প্রধান ফটক থেকে আড়াই হাজার ফুট নিচে একটি চেকপোস্ট।
কাছাকাছি একটা পাহাড়ী গ্রামের নাম অনুসারে এই চেক পোস্টের নাম ছাপড়ি । ক্যান্টনমেন্টের প্রধান ফটকে আরও একটি চেকপোস্ট আছে। কঠোর সংরক্ষণের জন্য এই বাড়তি সতর্কতা। ভিতরে পাহাড়ের গা কেটে বানানো মসৃণ পিচঢালা পথ। পথগুলোর একপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। অপর পাশটা ঢালু হয়ে । নিচে নেমে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে অফিস, ঘরবাড়ি, খেলার মাঠ। পাহাড়ের বিভিন্ন চূড়ায়ও ঘরবাড়ি রয়েছে। পুরো ক্যান্টনমেন্টে লোকসংখ্যা প্রায় আট নয়শো। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে একটা রাস্তা থেকে পাঁচ ছয়শো ফুট নিচে একটা সমতল জায়গা। সেখানে একটি ছোট্ট বাজার। বাজার বলতে গোটা চারেক দোকান, একটা ব্যাংক ও একটা পুলিশ ফাঁড়ি। এই রাস্তার ঠিক অপর পার্শ্বে পাঁচশো ফুট উঁচু খাড়া চূড়ায় ট্রেইনী অফিসারদের আখড়া। রাস্তাটি থেকে আরও একটা পাথুরে রাস্তা বের হয়ে পাহাড় বেয়ে ওপরে আখড়ার দিকে উঠে গেছে। ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে গোটা পাঁচেক গির্জা-যেগুলো এখন উপাসনালয়ের পরিবর্তে জিমন্যাসিয়াম, লাইব্রেরী, কিণ্ডারগার্টেন স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আনোয়ার পাকা রাস্তা অতিক্রম করে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়া পাথরের রাস্তা ধরে পৌঁছল অফিসার্স কোয়ার্টারে। বুঝতে পারল, এ পথে চলাচল করাটা এক সময় যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সন্ধ্যার আগে অফিসার্স মেসে এল সে। চা পানরত, অবস্থায় শুনতে পেল ওদের জন্য নবনিযুক্ত ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন এজাজ আকরামের নির্দেশাবলী:
(১) কোন ট্রেইনী সড়ক দিয়ে গমনাগমনের সময় হাঁটতে পারবে না। তাকে অবশ্যই দৌড়তে হবে।
(২) ট্রেনিং পিরিয়ডগুলো পরিবর্তনের সময় এক ট্রেনিং এলাকা থেকে অন্য ট্রেনিং এলাকায় হেঁটে যাওয়া চলবে না।
(৩) যে কেউ–গেট টেন বলা মাত্রই বিনা দ্বিধায় তার সামনে দশটা বুকডন দিতে হবে।
(৪) ট্রেনিং চলাকালীন কোন ট্রেইনী অফিসার পদের প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করতে পারবে না। অর্থাৎ সবাইকে সিপাহীদের মত থাকতে হবে।
(৫) সপ্তাহে দুদিন করে চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা হবে। পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে অকৃতকার্যরা ছুটির দিনে বাইরে যেতে পারবে না।
(৬) কেউ এই ট্রেনিংগুলোর কোনরকম ত্রুটি করলে তাকে ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে পঁচিশশো ফুট নিচে ছাপড়ি চেকপোস্টে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। এই শাস্তিগুলো অবসর সময়ে দেয়া হবে।
চেরাট ক্যান্টনমেন্টের পিটি গ্রাউণ্ড। ট্রাউজারস, স্পোর্টস ভেস্ট ও বুট পরে পিটি গ্রাউণ্ডে এল আনোয়ার। শুরু হবে এয়ারবোর্ন পিটি। এই পিটি পৃথিবীর কঠিনতম পিটির একটি। অত্যাধুনিক কায়দায় শুরু হলো এয়ারবোর্ন পিটি। ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরে ঘাম গড়িয়ে পড়া শুরু হলো। প্রত্যেকের দেহের সমস্ত কাপড়-চোপড় ভিজে গেল। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলল এই পিটি। পিটি পিরিয়ড শেষ হবার পর মাইলখানেক দৌড়ে, পাঁচশো ফুট চড়াই অতিক্রম করে কামরায় পৌঁছতে হলো সবাইকে। কামরায় পৌঁছে তাড়াতাড়ি বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল আনোয়ার। শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলে দূর হয়ে গেল শরীরের ক্লান্তি। ইউনিফরম পরে সে আবার হাজির হলো মেসে। ব্রেকফাস্ট করতে করতে পুনরায় শুনতে পেল ক্যাপ্টেন এজাজের নির্দেশ–ব্রেকফাস্টের পর ট্রেইনীদের মেসের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
শুরু হলো ক্যাপ্টেন এজাজের সঙ্গে ওদের ট্রেনিং এলাকা ঘুরে দেখার পালা। প্রত্যেক ট্রেনিং এলাকার মাঝে দূরত্ব এক থেকে দেড় মাইল। কমাপ্তোদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ওদের এই দূরত্ব দশ মিনিটের মধ্যে দৌড়ে অতিক্রম করতে হলো। বেলা এগারোটায় টি-ব্রেক। টি-ব্রেকের পর ট্রেইনীদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো চীফ ট্রেইনার মেজর রউফের সঙ্গে। টকটকে ফর্সা, সুন্দর চেহারা ও স্মার্ট ফিগারের অধিকারী রউফকে দেখে প্রথম দর্শনে সবার ভাল লেগে গেল। তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে সুন্দর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কখনও রাগেন না। সব সময়ই একটা মিষ্টি হাসি তাঁর মুখে লেগে থাকে।– চিরকুমার চীফ ট্রেইনারের বক্তব্যে সমস্ত প্রশিক্ষণার্থী কমাণ্ডোরা বুঝল প্রকৃত কমাণ্ডা হতে হলে দৈহিক শক্তির চাইতে অনেক বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তির। রিয়েল কমান্ডোরা পৃথিবীর যে-কোন কঠিনতম অবস্থা হাসি মুখে মেনে নিতে পারে। প্রয়োজনে ওরা আলোর গতিতে ছুটবে। উলকার মত আঘাত হানবে লক্ষ্যবস্তুর ওপর। শেষ পর্যন্ত কমান্ডোরা মানবরূপী দানবে পরিণত হবে। পরিণত হবে রোবটে- যে শুধু কমাণ্ড ফলো করতে জানে। হৃদয় যাদের কাছে মৃত-অনুভূতির কোঠা শূন্য। জীবন যাদের কাছে তুচ্ছ।
বিকেলে সমস্ত ট্রেইনীরা খেলার মাঠে গেল। কুচি কুচি পাথরে ভরা মাঠ। মাঠের চতুর্দিকে অ্যাসল্ট কোর্সের জন্য বিভিন্ন ধরনের আঠারোটা অবস্ট্যাকল। খেলা শেষে ক্লান্ত শরীরে যে যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আনোয়ারসহ কয়েকজন ট্রেইনী পাকা রাস্তা অতিক্রম করার সময় না দৌড়ে একটু হাঁটা শুরু করল। পাথরের আড়াল থেকে হাবিলদার ইন্ট্রাকটর বলে উঠল-স্যার, আপনারা পাকা রাস্তা অতিক্রম করার সময় হেঁটেছেন, সন্ধ্যা ছয়টায় ছাপড়ি যাওয়ার জন্য মেইন গেটে হাজির হবেন। সারাদিনের ক্লান্তির পর সবাই যেখানে একটু বিশ্রাম করবে, সেখানে কিনা ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে চড়াই-উত্রাই অতিক্রম করে যেতে হবে ছাপড়ি। কথাটা ভাবতেই প্রত্যেকের মন বিষিয়ে উঠল।
কিন্তু ওরা তো এখন কমাণ্ডো হতে চলেছে-কমাণ্ড ওদের ফলো করতেই হবে। আনোয়ার তাড়াতাড়ি কামরায় এসে শরীরের ঘাম তোয়ালে দিয়ে মুছে ষাট পাউণ্ডের প্যাক পিঠে নিয়ে আবার ছুটল মেইন গেটের দিকে। কামরা থেকে মেইন গেটের দূরত্ব প্রায় এক মাইল। পাঁচশো ফুট উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় ওর কামরা। নির্ধারিত সময়ে মেইন গেটে পৌঁছে দেখল, অন্যান্য শাস্তিপ্রাপ্ত অফিসাররাও হাজির। প্রত্যেকেই প্রায় এক মাইল চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এসেছে। সবাই দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। একটা বিতৃষ্ণার ছাপ সবার চেহারায় স্পষ্ট।
ইট্রাকটর গোলাম আযম ওদের প্যাক কাঁটা দিয়ে ওজন করে দেখল। যাদের ওজন কম ছিল, তাদের প্যাকে পাথর ভরে ওজন ঠিক করে দেয়া হলো। হাবিলদার ওদের ছাপড়ি যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে দিল। ওরা প্যাক পিঠে. নিয়ে ছাপড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। গেট পার হবার পর হাবিলদারের চিৎকার শোনা গেল, হু আর ইউ? প্রত্যুত্তরে ওরা সমস্বরে বলে উঠল, কমাণ্ডো। হাবিলদারের আবার চিৎকার, লাউডার, হু আর ইউ? তীব্র চিৎকারে উত্তর ভেসে এল ক-মা-ণ্ডো।
হাবিলদার ইস্ট্রাকটর ওদের ধোঁকা দিয়েছে। পুরো রাস্তা দুর্গম। কোথাও কোথাও রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে শত শত ফুট উঁচুতে উঠে গেছে। আবার কোথাও সরু হয়ে নিচে নেমে এসেছে। কোথাও রাস্তার একপাশে উঁচু পাহাড়। অপর পাশে গভীর খাদ। একটু অসতর্কতার কারণে এ রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সবাই সতর্কতার সঙ্গে ছাপড়ির উদ্দেশে এগিয়ে চলল। রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে এই বিপদসংকুল দুর্গম পথ অতিক্রম করে ওরা পরিশ্রান্ত অবস্থায় ফিরে এল। আনোয়ার শাওয়ারের নিচে যাওয়ার আগে আর্দালিকে ঘরেই ডিনার সার্ভ করতে বলল।
সেনাবাহিনীতে কারও রূমে খাবার সার্ভ করা হয় না। খাবারের নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট পোশাক পরে মেসে উপস্থিত। হতে হয়। ডিনারে প্রত্যেক ঋতুতেই টাই পরার নিয়ম। কিন্তু কমাণ্ডোদের বেলায় এই সব নিয়মের বেশ কিছুটা শিথিলতা। আছে। কারণ কমান্ডোরা শারীরিক ভাবে ভীষণ পরিশ্রান্ত থাকে। তাই ওদের কিছুটা সুবিধা দেয়া হয়।
ব্রেকফাস্টের পর সকালে মাইলখানেক দৌড়ে ১নং প্রশিক্ষণ এলাকায় উপস্থিত হলো আনোয়ার। পাহাড়ের গা কেটে সুন্দর করে বানানো গ্যালারিতে বসে কিছুক্ষণ লেকচার শোনার পর শুরু হলো প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং। কমাণ্ডো ট্যাকটিক্স, বিভিন্ন রকম বিস্ফোরকের ব্যবহার, অপারেশনের সময় কমাপ্তোদের শত্রু এলাকায় অতর্কিত হামলার পথ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হলো ওদের। শেষে বলা হলো, কমাণ্ডোরা শত্রু এলাকায় হামলার সময় সবচেয়ে দুর্গম পথ ব্যবহার করবে। দুর্যোগপূর্ণ গভীর অন্ধকার রাত অপারেশনের জন্য কমাণ্ডোদের উপযুক্ত সময়। অপারেশনের সময় কমাপ্তোদের হামলা হবে অতর্কিত, গতি হবে ক্ষিপ্র।
এই কঠিন ট্রেনিং কিছুদিন চলার পর শুরু হলো কমাণ্ডোদের কারাতে ট্রেনিং। সাধারণ কারাতে ট্রেনিং-এর মত এটা নয়। এটাও কমাণ্ডো ট্রেনিংয়ের একটা অংশবিশেষ। এতকিছুর মাঝেও সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ষাট পাউণ্ড ওজনের প্যাক পিঠে নিয়ে ছাপড়ি ভ্রমণ আনোয়ারের জন্য ডালভাত হয়ে উঠল। ওর মনে হত, এটাও বুঝি কমাণ্ডো ট্রেনিং-এর একটা অংশ। সেজন্য ও ষাট পাউণ্ড ওজন ভরে একটা প্যাক সব সময় ঘরে তৈরি করে রাখত। হাবিলদার ইন্সট্রাকটরের মুখ থেকে ছাপড়ি শব্দটা বেরুতেই প্যাকের স্ট্র্যাপের ভিতর দুই হাত গলিয়ে ছুটে যেত আনোয়ার ছাপড়ির দিকে। কোনরকম অজুহাত নেই, শরীর খারাপের কোন বালাই নেই, ও যেন যন্ত্রচালিত এক যন্ত্রদানব। শরীরের সমস্ত পেশীতে পাক ধরেছে। সামান্যতম মেদও রইল না। চেহারাতে ফুটে উঠল কাঠিন্য। দেহের প্রতিটি অঙ্গের গতি হলো ক্ষিপ্রতর।
শুরু হলো চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা। এই দৌড়ের সময় বুট পায়ে, রাইফেল হাতে, পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে, দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করে আবার ফেরত আসতে হবে। আড়াই হাজার ফুট ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পথ। রওনা দেয়ার পর থেকে ফিরে আসার সময় মাত্র চল্লিশ মিনিট। প্রথম দিন সবাই অকৃতকার্য হলো। আনোয়ারের দেড় মিনিট সময় বেশি লাগল। দৌড় শেষে প্রত্যেকের জিভ বের হয়ে এল। কিন্তু তবুও কমাণ্ডো গতিতে এগিয়ে চলল প্রশিক্ষণ। শেষে ও এই দুর্গম পথ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অতিক্রম করতে সক্ষম হলো।
এরপর শুরু হলো ইভনিং ট্রেনিং। এই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় নৈশ ট্রেনিং ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে খুবই সতর্ক রাখতে হত। তা না হলে যেকোন সময়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে; যা ইতোপূর্বে বহুবার ঘটেছে। নৈশ ট্রেনিং-এ যাবার সময় সবাই ব্রাশ দিয়ে জুতোর কালো কালি মুখে ও গলায় লাগিয়ে নেয়। সারা শরীর নেট দিয়ে জড়ানো ওদের। নেটের ফাঁকে ফাঁকে জংলীদের মত পাখির পালকের পরিবর্তে ছোট ছোট ডালপালা লাগিয়ে আনোয়ার যখন আয়নার সামনে দাঁড়াত, তখন নিজেকে কিম্ভুতকিমাকার দেখাত। কালো পালিশ লাগানো অবস্থায় চোখের সাদা অংশ ও মুখের সাদা দাঁত বের করে হাসলে চেহারাটা ভীতিকর হয়ে ওঠে। কালো মুখের ওপর সাদা দাঁতগুলো শানানো ছুরির মত ঝিকমিক করে। এধরনের ভীতিকর চেহারা নিয়ে নৈশ ট্রেনিং-এ বের হত আনোয়ার।
একদিনের কথা ওর আজও মনে পড়ে। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষের রাত। অন্ধকার রাতে রাস্তার ধারে কিম্ভুত ছিরি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। সেনাবাহিনীর দুজন সিপাহী রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। ওকে কাছ থেকে দেখেও মানুষ হিসেবে চেনার উপায় নেই। আস্ত একটা গাছ যেন দাঁড়িয়ে আছে । সিপাহী দুজন কাছে আসতেই আনোয়ার হিঃ হিঃ হিঃ করে হেসে উঠল। সেইসঙ্গে একটু নড়ে ওদের দিকে এগুতে শুরু করল। সিপাহী দুজন সচল গাছের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ ওদের সংবিৎ ফিরে আসতেই ওরে বাপ বলে পড়িমরি করে প্রাণের ভয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। তখন আনোয়ারের পক্ষেও হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
পরদিন আর্দালির কাছে সে শুনল, এই অভিশপ্ত পাহাড়ী অঞ্চলে একটা ভৌতিক দানবের মাঝে মাঝে আগমন ঘটে। সেই দানবটাকে গত রাতে দুজন সিপাহী দেখতে পেয়েছে। আর্দালি ওকে নৈশ ট্রেনিংয়ের সময় সাবধান থাকতে বলল। সেই দানবের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য আর্দালি নানারকম দোয়া-কালামও শিখিয়ে দিল। এই ট্রেনিংয়ের সময় সবচেয়ে বিপদে পড়ত ম্যারেড অফিসাররা । ট্রেনিং শেষে যখন তারা সেই অদ্ভুত চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরত, তখন তাদের গৃহিণীরা কিছুতেই দরজা খুলত । কারণ সেই চেহারা দেখে তাদের জ্ঞান হারানোটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ট্রেইনী অফিসারের স্ত্রীরা দরজার ফুটো দিয়ে দেখেও দরজা খুলত না। মনে মনে ভাবত, দৈত্য দানবেরা গলার স্বরও নকল করতে পারে। তখন ম্যারেড অফিসাররা ব্যাচেলরদের কামরায় এসে চেহারা পাল্টে, সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরত। . কিছুদিন পর কম্পাস-মার্চ ট্রেনিং-এর জন্য আনোয়ারকে পেশওয়ার থেকে ষোলো মাইল দূরে জানলাযাই নামক এক রেস্ট হাউজে যেতে হলো। একশো পাউণ্ডেরও বেশি ওজনের ভারী প্যাক পিঠে নিয়ে যখন সে হেঁটে জালোযাই রেস্ট হাউজে পৌঁছল, তখন মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল। এরই নাম রেস্ট হাউজ? চারদিকে মাটির দেয়াল ঘেরা আঙ্গিনা। ভিতরে মান্ধাতা আমলের একটা মাটির তৈরি ডরমেটরী-ব্যারাকের মত লম্বা ঘর। দরজা জানালাবিহীন ডরমেটরীর মেঝে ধুলোয় ভর্তি। সামনে সমতল জায়গাটায় বড় বড় গাছ। সেখানে একটা চাপাকল। এই হলো ম্যাপে নির্দেশিত তথাকথিত জালোযাই রেস্ট হাউজ।
কম্পাস মার্চে ওদের প্রতিদিন সকালে বা সন্ধ্যায় ম্যাপ দেখে দিক নির্দেশক ডিগ্রী, দূরত্ব ও গন্তব্যস্থলের বিবরণ দিয়ে দেয়া হয়। সন্ধ্যার পর কম্পাসে নির্ধারিত ডিগ্রী সেট করে রওনা হয় ওরা। সকালের মধ্যেই আবার ঘুরে আসতে হবে রেস্ট হাউজে। কম্পাস মার্চে প্রথমে নির্ধারিত দূরত্ব অতিক্রমের পর কোন পাথরের নিচে চাপা দেয়া কাগজ খুঁজে বের করতে হত। রাতে এই কাগজ খুঁজে বের করাটা ছিল বেশ কঠিন। সেই কাগজে লেখা থাকত পরবর্তী নির্দেশ। কখনও লেখা থাকে, এখানে অপেক্ষা করো। আবার কখনও লেখা থাকে, সম্মুখের রাস্তায় মাইল-স্টোনের কাছে অপেক্ষা করো। ওখান থেকে গাড়ি তোমাদের উঠিয়ে নেবে। আবার কখনও অন্য গন্তব্যস্থলের বিবরণ, ডিগ্রী ও দূরত্ব দেয়া থাকে। তখন শুরু হয় পুনরায় পথ চলা। মাঝে মাঝে এভাবে পায়ে চলা বেশ কয়েকদিন ধরে চলে। কম্পাস মার্চে সব সময় দুজন করে ট্রেইনীকে পাঠানো হয়। আগুপিছু করে ওরা অ্যাডভান্স করে। সামনের জনের কাজ হলো অন্ধকার রাতে কম্পাসের সাহায্যে আকাশের কোন তারাকে দিক নির্দেশক হিসেবে অনধিক পনেরো মিনিটের জন্য স্থির করে নিয়ে সেই তারার দিকে দৃষ্টি রেখে চলা।
পেছনের জনের কাজ হলো প্রতি একশো বিশ কদমে একশো গজ হিসাব ধরে নিয়ে দূরত্ব মাপা। এই প্রশিক্ষণে প্রতিবার চলার জন্য প্রায় তিরিশ চল্লিশ হাজার গজ অতিক্রমের নির্দেশ থাকে। এই দূরত্ব অতিক্রমকালে কম্পাসের ডিগ্রী সামান্যতম এদিক ওদিক হলে বা আকাশে স্থির করা তারা সামান্যতম সরে গেলে গন্তব্যস্থল হারিয়ে যায় । তখন গন্তব্যস্থল খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুঁচ খুঁজে বের করার সামিল হত। কিন্তু কমাণ্ডোদের কোন কাজকে কঠিন মনে করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ কোন কাজকে কঠিন মনে করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেয়া হয় । কুইট–অর্থাৎ কমাণ্ডো কোর্স থেকে বিদায়।
কম্পাস, মার্চে বাঙালী সিনিয়র ক্যাপ্টেন রেজাউর রহমান (যিনি কমাণ্ডো মহলে বাড়ি বলে পরিচিত) ছিলেন আনোয়ারের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একদিন আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন রেজা বের হলো নৈশ-কম্পাস মার্চে।
অন্ধকার রাত। রেজা গাইড হিসেবে আগে আগে চলেছে। জালোযাই রেস্ট হাউজের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলগুলোতে সিয়ার ফল আছে। সিয়ার ফল হলো একধরনের গর্ত, যেগুলো ভরা জ্যোৎস্নাতেও চোখে পড়ে না। কোন কোন সিয়ার ফলের গভীরতা সত্তর আশি ফুট পর্যন্ত। একবার চেরাট এলাকায় নৈশ কম্পাস মার্চ প্রশিক্ষণের সময় এয়ারফোর্সের একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ও একজন সার্জেন্ট এইরকম একটা সিয়ার ফলে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এমনই দুর্গম জায়গায় পড়েছিলেন যে, তাঁদের লাশ খুঁজে বের করাও প্রথমত সম্ভব হয়নি। পরে জায়গাটার ওপর শকুন উড়তে দেখে সেই লাশ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিল, উদ্ধারকারীরা।
এই ঘটনা মনে পড়তেই ওদের সতর্কতা আরও বেড়ে গেল। রেজা ছড়ির সাহায্যে সামনের পথ পরীক্ষা করে করে এগুচ্ছে। ঘন অন্ধকারের জন্য দুই তিন কদম দূরে রেজা মাঝে মাঝেই আনোয়ারের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর রেজাকে মৃদুস্বরে ডেকে সাড়া নিচ্ছে, আর এগুচ্ছে আনোয়ার। এভাবে কিছুদূর চলার পর রেজার হঠাৎ কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ট্রেনিং-এর সময়, এই এলাকা শত্রুপক্ষীয় এলাকা হিসেবে বিবেচিত। সেজন্য ওর পক্ষে জোরে ডাকা কিংবা আলো জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়লে কল্পনাতীত নির্যাতন ভোগ করতে হবে।
ভয়ে ভয়ে, খুব সতর্কতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন রেজাকে একটু জোরে ডেকে উঠল আনোয়ার। বেশ নিচের দিক থেকে রেজার গলা শোনা গেল, সাবধান! আমি একটা গর্তে পড়ে গেছি। তাড়াতাড়ি কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে পেন-টর্চ জ্বালাল আনোয়ার । টর্চের আলোয় সামনে আট দশ ফুট নিচু একটা খাদ দেখা গেল । খাদের ভিতরে প্রায় হাঁটু সমান কাদাপানি। ক্যাপ্টেন কাদাপানির ভিতর চিৎ হয়ে পড়ে প্রায় ডুবে আছে। রেজার এই অবস্থা দেখে আনোয়ারের বেশ হাসি পেল। ও রেজাকে খাদ থেকে উঠিয়ে নিয়ে এল ওপরে। সেদিন সারারাত নোংরা কাদা পানিতে ভেজা পোশাকে রেজাকে কাটাতে হলো। এই ধরনের ছোটখাট দুর্ঘটনা কম্পাস, মার্চে প্রায়ই ঘটে। জালোই এলাকায় কম্পাস-মার্চ প্রশিক্ষণ শেষ করে আনোয়ার আবার ফিরে এল চেরাট ।
শুরু হলো বিস্ফোরকের ওপর প্রশিক্ষণ। বিস্ফোরকের সঙ্গে ডেটোনেটর, ফিউজ, প্রাইমার, মাইমাকর্ড লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো থেকে শুরু করে বাস্টিং মেশিন দিয়ে বিস্ফোরণ, বুবি ট্র্যাপ (বিস্ফোরকের ফাঁদ), ডাইরেকশনাল গ্রেনেড, গ্রেনেড় অ্যামবুশ, রকেট দিয়ে বুবি ট্র্যাপ, রাইফেলের বুলেট দিয়ে ডেটোনেটর বানানো, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে ট্রেনিং নিল সে। বিস্ফোরকের ওপর এই ধরনের ট্রেনিং পেয়ে আনোয়ার ধীরে ধীরে একজন বিপজ্জনক মানুষে রূপান্তরিত হলো।
চেরাট ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়া শুরু হলো কমাণ্ডো ট্রেইনীদের। বিভিন্ন কলাকৌশলের ওপর মহড়া দিতে হবে সবাইকে। এই মহড়া চলাকালীন এক একজন কমাণ্ডোকে কমপক্ষে দেড়শো মাইল পায়ে হাঁটতে হবে। প্রত্যেকের পিঠে একশো বিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক। প্যাকে খাদ্যসামগ্রী, রান্নার সরঞ্জাম, অতিরিক্ত কাপড়চোপড় ও প্রশিক্ষণের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে প্রত্যেকের সাব-মেশিনগান । হেভী মেশিনগান, মর্টার ও রকেট-লঞ্চার সবাইকে পালা করে বইতে হয়। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো পানির বোতল ও আনোয়ারের অতি প্রিয় সঙ্গী কমাণ্ডো নাইফ।
এই ট্রেনিং পিরিয়ডে বহুসংখ্যক ট্রেইড-কমাণ্ডো ওদের শত্রু হিসেবে কাজ করে। ট্রেইও কমাণ্ডোরা গাড়ি ব্যবহার করে প্রশিক্ষণার্থী কমাণ্ডোদের খুঁজে বেড়ায়। ওদের হাতে ধরা পড়া আর কেয়ামত নাজেল হওয়া সমান। ট্রেইনী কমান্ডোরা সবচেয়ে দুর্গম পথ ব্যবহার করে। মাঝে মাঝেই ট্রেইনড কমাণ্ডোরা হামলা করে এদের সমস্ত খাবার নষ্ট করে দেয়। তখন সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এদেরকে বেঁচে থাকতে হয় । এইভাবে, এদের সারভাইভাল-ট্রেনিং বা বাঁচার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ট্রেনিংও হয়ে যায় ।
এই ট্রেনিং-এর সময় মরুভূমি এলাকায় পানির বড় অভাব দেখা দিত। রাতের কোন বালির ঢিবির আড়ালে ঘুমোনোর আগে আনোয়ার গায়ের ঘামে ভেজা দুর্গন্ধযুক্ত জামা-গেঞ্জি খুলে বালির ওপর বিছিয়ে দিত। সকালে উঠে শিশিরে ভেজা সেই জামা-গেঞ্জি নিংড়ে ঘাম মিশ্রিত শিশির বোতলে পুরত। এই দিয়েই জলের অভাব দূর করত সে। বিভিন্ন গাছের শিকড় কিংবা লতাগুল্ম চিবিয়েও এই অভাব কিছুটা দূর হত। মাঝে মাঝে মাটির রসও চুষে খেত ও। সারভাইভাল ট্রেনিং-এর পর প্রতিটা কমাণ্ডোর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেল। খাদ্যাভাবের দরুন দুনিয়ার সব মানুষ যদি মারা পড়ে, তবে কমাণ্ডোরা মরবে সব শেষে। কারণ ওরা জানে, কিভাবে প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। প্রয়োজনে ওরা সাপ, ব্যাঙ, কুকুর বা যে-কোন প্রাণী, এমনকি নরমাংস ভক্ষণ করতে প্রস্তুত। অখাদ্য কোন জিনিস পৃথিবীতে আছে বলে ওদের জানা নেই।
একবার এ ধরনের ট্রেনিং-এর সময় ট্রেইণ্ড কমান্ডোদের হামলায় ওদের সমস্ত খাবার ধ্বংস হয়ে গেল। প্রয়োজনীয় সঙ্কেতের অভাবে প্লেনও ড্রপ-জোনে কোন খাবার ড্রপ করল না । প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বেশ কয়েকদিন কাটল ওদের। আনোয়ার ও জনৈক পাঞ্জাবী কমাণ্ডো জঙ্গল এলাকা ছেড়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল খাবার সংগ্রহের আশায়। ট্রেনিং চলাকালীন কোন লোকালয় থেকে খাবার সংগ্রহ করা ভীষণ অপরাধ। তাই ওরা চোরের মত গা ঢাকা দিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে চলল গ্রামের দিকে।
গ্রামে ঢুকেই একটি বাড়ির দরজায় ওরা কড়া নাড়ল। একজন সুন্দরী যুবতী দরজা খুলে পশতুতে জিজ্ঞেস করল, কি চাই? ওরা উর্দুতে বলল, আমরা ক্ষুধার্ত। ডিম কিনতে চাই। মেয়েটি কোন কথা বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এই এলাকার লোকেরা পশতু ভাষী হলেও কিছু কিছু উর্দু বোঝে। ওরা মেয়েটিকে পশতুতে জিজ্ঞেস করল, পখতু পোয়ে অর্থাৎ পশতু জানো? মেয়েটি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। ওরা আবার বলল, উর্দু পেয়ো? মেয়েটি ঘাড় নেড়ে না বলল। ওরাও পশতু জানে না। যা দুই একটা কথা জানে তা দিয়ে কোনমতেই মেয়েটিকে বোঝানো সম্ভব হবে না যে ওদের ডিম প্রয়োজন। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে, সময়ও কম। যে-কোন মুহূর্তে শত্রু দেখে ফেলতে পারে।
ওরা বুঝল কপালে কষ্ট আছে। আনোয়ার মেয়েটিকে হাত নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। মেয়েটি বোঝে না। মাটিতে ডিমের ছবি এঁকে ধারণা দেবার চেষ্টা করল ওরা, মেয়েটি তাও বোঝে না। আহ্ মরণ! আনোয়ার মেয়েটিকে বাংলায় কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বসল। মেয়েটি হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। এবারে ওরা শেষ চেষ্টা করল। আনোয়ার মাটিতে বসে দুই হাত মুরগীর পাখা ঝাঁপটা দেয়ার মত করে কুক-কুরু-কুকরে ডেকে উঠল। পেছন দিক থেকে সদ্য পাড়া মুরগীর ডিম ধরে ফেলার ভঙ্গি করল আনোয়ারে সঙ্গী। এই দৃশ্য দেখে মেয়েটি খিল খিল করে হেসে লুটোপুটি খাওয়া শুরু করল। ওরা অধৈর্য হয়ে আকারে ইঙ্গিতে জানতে চাইল, বুঝতে পেরেছ কিনা? মেয়েটি বলল, এগগায়া এসতা? ওরা বুঝল, পশতুতে ডিমকে এগগায়া বলে। ওরা দ্রুত মাথা নেড়ে মেয়েটিকে এগগায়া আনতে ইঙ্গিত করল। পরক্ষণে মেয়েটি বাড়ির ভিতর থেকে ডিম এনে দিল। ডিম নিয়ে রাস্তায় চলতে চলতে ওরা বলাবলি শুরু করল, হায়রে, একজন কমাণ্ডোকে কতরকম পশুসুলভ গুণের অধিকারী হতে হয়। বাঘের মত হিংস্র, চিতার মত ক্ষিপ্র, গাধার মত ভারবাহী, ঘোড়ার মত ধাবন্ত, ঈগলের মত লক্ষ্য ভেদী দৃষ্টি, লেজ গোটানো কুত্তার মত ভীতু আবার প্রয়োজনে ডিমপাড়া মুরগী। কিন্তু ওরা তখনও জানে না, প্রয়োজনে ওদের আরও কতরকম হিংস্র পশুতে পরিণত হতে হবে।
হঠাৎ একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট এল। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বারো মাইল দৌড়ের একটি পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী দুই ঘণ্টা চার মিনিটে, এই দূরত্ব অতিক্রম করেছে– পিঠে সত্তর পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। আনোয়ারদের ওপর নির্দেশ এল, এই রেকর্ড ব্রেক করার জন্য। ওরা এর আগে কখনও এতদূর পথ এমন গুরুভার প্যাক পিঠে নিয়ে পাড়ি দেয়নি। চার মাইল এবং ছত্রিশ মাইল দৌড় দিয়েছে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। সেখানে একেবারে সত্তর পাউণ্ড! ওদের কাছে ব্যাপারটা নিষ্ঠুর কৌতুক বলে মনে হলো। সবাই একটু প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতেই কড়া নির্দেশ দেয়া হলো, যে করেই হোক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর রেকর্ড ভাঙতেই হবে। অবশ্য ওরাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই রেকর্ড ওরা ভাঙবেই।
দৌড়ের পরীক্ষা শুরু হলো। ওদের প্যাকে সত্তর পাউণ্ড ওজনের পাথর ভরা। প্রত্যেকে স্ট্র্যাপ দিয়ে প্যাক পিঠের সঙ্গে আটকে নিল। সবাই দৌড়চ্ছে সামনে একটু কুঁজো হয়ে। স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো প্যাকের ফিতা পিঠের চামড়ার সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে। ইউনিফরম কিছুটা ওদের বাঁচাচ্ছে, চামড়া ছিলে উঠে যাওয়ার হাত থেকে। সুদীর্ঘ বারো মাইল পথ এই ভারী ওজন নিয়ে অতিক্রম করতে হবে; ভাবতেও ওদের মাথা গুলিয়ে উঠছে। কিন্তু প্রত্যেকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবিরাম দৌড়াচ্ছে ভারতীয় সেনাদের রেকর্ড ব্রেক করার জন্য। আস্তে আস্তে ভারী প্যাকের ফিতার সঙ্গে ওদের চামড়ার ঘষা বাড়ছে। দৌড়ের তালে তালে সেই ফিতা থেকে থেকেই কাঁধের মাংস ছিলে দিচ্ছে। এক সময় ঘষা খাওয়া জায়গাগুলোতে প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হলো। তবুও ওদের ক্লান্তি নেই। প্রত্যেকের ভাবলেশহীন চেহারা। শান্ত, হিংস্রতার ভাব। ওরা নীরবে পৃথিবীর কঠোরতম যন্ত্রণা সইতে পারে, এমন একটা ভঙ্গি সবার চোখে মুখে ।
ইউনিফরমও শেষ রক্ষা করতে পারল না। চেপে বসা, স্ট্র্যাপের ঘষায় ওদের প্রত্যেকের কাঁধের চামড়া উঠে গেল। দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো সবার। তবুও ওরা দৌড়চ্ছে। বিশাল বুকের ছাতি ওদের উঠা নামা করছে অবিরাম। ইউনিফরম রক্তে লাল হয়ে গেল। শার্ট রক্তে ভিজল–সেইসঙ্গে প্যান্টও। শেষে পায়ের মোজাতে প্রবেশ করল রক্ত। তবুও ওরা দৌড়চ্ছে। ওরা যে কমাণ্ডো! যন্ত্রণা কি তা ওদের জানতে নেই, অসম্ভব বলে কিছু ওদের মানতে নেই। এক সময় বারো মাইলের শেষ সীমা এগিয়ে এল।
অবশেষে ভারতীয় সেনাদের রেকর্ড ব্রেক করল ওরা। প্রথম স্থান অধিকার করল গুলফরাজ নামে এক সিপাহী। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তার সময় লাগে এক ঘণ্টা বিয়াল্লিশ মিনিট। আনোয়ারের লাগে এক ঘণ্টা ছেচল্লিশ মিনিট। কয়েকদিন পর গোয়েন্দা রিপোর্টের সংশোধনী এল। ভারতীয় সৈনিকরা সত্তর পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে দৌড়ায়নি; ওরা দৌড়েছে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক নিয়ে। সংশোধিত রিপোর্ট পড়ে ওদের প্রত্যেকের মেজাজ খিঁচড়ে উঠল। কিন্তু আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
০৭.
হু আর ইউ?
এয়ার বোর্ন। মেজর ভর্দৰ্গ পুনরায় ধমকে উঠলেন, মাই ব্লাডি ফুট। লাউডার। ওরা এয়ার বোর্ন এয়ার বোর্ন চিৎকার করছে, আর দৌড়চ্ছে। পেছনে মেজর ভদগ। ওদের চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূরে। চেরাটে আবার শুরু হলো অফিসার্স অ্যাডভান্সড কমাণ্ডো কোর্স। কিছুদিন পূর্বে আনোয়ার এখান থেকেই আর্মি কমাণ্ডো লীডার্স কোর্স শেষ করেছে। সেই কোর্স থেকে একমাত্র ওকেই এ ট্রেনিং-এর জন্য মনোনীত করা হলো।
মোট ট্রেইনী অফিসারের সংখ্যা ছিল ২৪ জন। এদের মধ্যে রয়েছে ক্যাপ্টেন আদিল–আনোয়ারের রূমমেট, ক্যাপ্টেন জিয়া আনোয়ারের কম্পাস মার্চের সহচর, ফ্লাইং অফিসার মঞ্জুরুল হক বিখ্যাত হার্ডল দৌড়বিদ, ফ্লাইং অফিসার তোফায়েল বাজোয়া– শর্টপুট নিক্ষেপে পাকিস্তান নাম্বার ওয়ান এবং এশিয়ান নাম্বার থ্রী। বিশাল আকৃতির বাজোয়াকে অন্ধকার রাতে কোন শত্রু সৈন্য আচমকা দেখলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে, এমনকি হার্টফেলও বিচিত্র নয়।
এই চারজনই ভীষণ অমায়িক । এই ট্রেনিং-এর সময় আনোয়ারের সঙ্গে দেখা হলো ওর প্রাক্তন চীফ ট্রেইনার মেজর রউফের। আনোয়ার চেরাটে কমাণ্ডো কোর্স করতে এসেছে দেখে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। কারণ দ্বিতীয়বার স্বেচ্ছায় কমাণ্ডো কোর্স করাটা প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তাই তিনি সবাইকে বলে দিলেন, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ওকে যেন অব্যাহতি দেয়া হয়।
মেজর ভর্দগ সবাইকে প্রথম দিনের উদ্বোধনী ভাষণে বললেন, আমি যখন আমেরিকায় ফ্রগম্যান ট্রেনিং-এর জন্য যাই, আমেরিকান ইন্সট্রাকটররা নিজেদেরকে মীন বাস্টার্ড বলে পরিচয় দিয়েছিল। আমার পরিচয় হচ্ছে, আমি একজন স্যাডিস্ট। এ-ট্রেনিং শেষে তোমরা প্যারা কমাণ্ডো বা এয়ার বোর্ন কমাণ্ডো বলে পরিচিত হবে, যেটা কোন কৌতুকের ব্যাপার নয়। সিনেমায় প্রদর্শিত কোন সস্তা দৃশ্যের মত নয় এ ট্রেনিং। অতএব কারও বেরিয়ে যাবার ইচ্ছা থাকলে এখনি যাও; নইলে আমি এমন অবস্থা করব, যাতে, যারা বেরিয়ে যাবার তারা যেতে বাধ্য হবে। এখানে যারা থাকবে, তাদেরকে হতে হবে মেশিনে পেষাই করা ময়দার মত।
পরদিন থেকে পুরোদমে ট্রেনিং শুরু হলো। প্রথমে মাইল দুয়েক দৌড়ে শরীর গরম করে বুকডন দেয়া আরম্ভ হয়। ক্রমাগত বুকডন দিতে দিতে বাজোয়ার মত দৈত্যও মাটিতে শুয়ে পড়ত। তারপর শুরু হত এয়ারবোর্ন পিটি। এই পিটি সবার শেষ শক্তিটুকুও নিংড়ে নিত। পিটি শেষে এক মাইল চড়াই অতিক্রম করে ওদের ফিরতে হত ঘরে । এরপর এল চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা। ট্রেইনী কমাণ্ডোদের পরনে কমপ্লিট ব্যাটল ড্রেস। পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক। হাতে রাইফেল। দুর্গম পাথুরে পথ দুই হাজার ফুট ঢালু। ওদের এই ঢাল বেয়ে নেমে যেতে হবে দুই মাইল। আবার উত্রাই ভেঙে ফিরে আসতে হবে, সময় মাত্র চল্লিশ মিনিট।
আনোয়ার প্রথম দিন পঁয়ত্রিশ মিনিটে এই দূরত্ব অতিক্রম করল। এক্ষেত্রে এস.এস.জি.-র সর্বোচ্চ রেকর্ড ছাব্বিশ মিনিট। এই রেকর্ডধারী হলেন প্যারাস্কুলের ভারপ্রাপ্ত বিখ্যাত অফিসার তারেক মাহমুদ, যিনি টি.এম. বা টক্কর মার নামে খ্যাত। অ্যাসল্ট কোর্সেও আনোয়ার বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলো। এরপর শুরু হলো ইভনিং ট্রেনিং। এ-ট্রেনিংয়ে ভয়ানক দুর্গম পথ ব্যবহার করতে হয়। রাতের অন্ধকারে ওদের তিন-চারটি উঁচু উঁচু চূড়া অতিক্রম করতে হবে। এগুলোর কোন কোনটা এক হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু। অন্ধকার রাত বলেই এ-ধরনের দুর্গম চূড়া অতিক্রম করা সম্ভব। কেননা অন্ধকারে কোন দুর্গমতা চোখে পড়ে
এরপর পূর্বের জালোযাই রেস্ট হাউজ এলাকায় শুরু হলো কম্পাসমার্চ। অন্ধকার রাত। আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন জিয়া কম্পাস মার্চে বেরিয়েছে। ওদের পিঠে প্রায় একশো পাউণ্ডের বোঝা, হাতে স্টিক। শত্রুর জীপ ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। জীপগুলো হেড লাইট নিভিয়ে লুকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দপ করে আলো জ্বালে। তেমনি জ্বলে ওঠা আলোর সম্মুখে হঠাৎ করে পড়ে গেল ওরা দুজন। শত্রুর জীপ দ্রুত তেড়ে এল। ওরা প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। জীপ প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে আসছে। ওরাও শত্রুর দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য তীরবেগে ছুটে পালাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। হঠাৎ আনোয়ারের বুক ধড়াস করে উঠল। পায়ের তলায় মাটি নেই। সে দ্রুতবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনাটা। দড়াম করে আছড়ে পড়ল সে অন্ধকারে। খাদটা তিরিশ ফুট গভীর।
অনেক দিনের পুরানো বালি জমে পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে। আনোয়ারের ভারী শরীরের প্রচণ্ড আঘাতে জমে থাকা শক্ত বালি চুর্ণ হয়ে গেল। একই সঙ্গে মাথাটাও হাঁটুর সঙ্গে জোরে ঠুকে গেল। জ্ঞান হারাল ও। ওর অচেতন দেহটা জমাট বাঁধা বালির ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে। হাতের ছড়িটা ছিটকে গেছে দূরে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানা নেই। হঠাৎ জিয়ার গলা শুনতে পেল আনোয়ার। জিয়া ধীরে ধীরে ওর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। এই সময় খাদের পাড়ে শত্রুর গলার আওয়াজ শোনা গেল। জিয়া কালবিলম্ব না করে শক্রদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলে উঠল, এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাড়াতাড়ি সাহায্য পাঠাও।– আনোয়ারের জ্ঞান ফিরে আসছে। ওর কপালে ভীষণ ব্যথা। মাথাটাও দপ দপ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর ভর্দগ দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হলেন। আনোয়ারকে খাদ থেকে ওপরে ওঠানো হলো। ভগ জীপ চালিয়ে ওকে নিয়ে পৌঁছলেন নওশেরা সি.এম.এইচ.-এ। দুই-তিন দিন পর হঠাৎ আনোয়ার লক্ষ করল, ওর কেবিনে কোন সিস্টার আসছে না। অথচ পাশের কেবিনে সিস্টারদের রীতিমত যাতায়াত। ব্যাপার কি? আনোয়ার ঘটনাটা জনৈক মেডিক্যাল অফিসার (মেজর)-কে জানাল। ওর কথা শুনে মেডিক্যাল অফিসার একটু অবাক হলেন। এমন তো হবার কথা নয়। তিনি ব্যাপারটা দেখবেন বলে জানালেন।
পরদিন মেডিক্যাল অফিসার এসে আনোয়ারকে বললেন, কিছু মনে করবেন না, এরা জানতে পেরেছে, আপনি একজন গেরিলা অফিসার। তাছাড়া আপনার চেহারার এখন যে হাল তাতে সিস্টাররা আপনার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে। আনোয়ার কোথায় র্যাকুয়েল ওয়েলকে গার্লফ্রেণ্ড বানানোর স্বপ্ন দেখে, এখন সামান্য সিস্টাররা ওর কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে? হায়রে মেডিক্যাল সিস্টার! চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ল সে। হাসপাতালে সাত-আটদিন কাটাবার পর হাঁপিয়ে উঠেছিল। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করল ছেড়ে দিতে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাছোড়বান্দা। এক থেকে দেড় মাস বিশ্রাম নিতেই হবে। মনে মনে হাসপাতাল থেকে পালানোর বুদ্ধি আঁটল আনোয়ার।
একদিন। রাত সাড়ে দশটার দিকে বেড়ানোর নাম করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল সে। জি.টি, রোডে উঠে একটা টাঙ্গা ভাড়া করল। নওশেরা থেকে প্রায় আট-দশ মাইল দূরে পাব্বি পৌঁছে টাঙ্গা ছেড়ে দিল আনোয়ার। পাব্বি হলো জি. টি. রোড ও চেরাট রোডের সংযোগস্থল-সংক্ষেপে পাব্বিটি জংশন। জংশনে পৌঁছে ওর মনে পড়ল, সর্বনাশ! এত রাতে চেরাট যাওয়ার তো কোন গাড়ি পাওয়া যাবে না! চেরাটগামী শেষ বাস রাত আটটার সময় ছেড়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকাল আনোয়ার। রাত বেশ গম্ভীর হয়েছে। অনতিদূরে ছোট্ট একটা বাজার। সেখানে কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে দেখা গেল। একটা ট্রাকের ঘুমন্ত ড্রাইভারকে জাগিয়ে চেরাট পর্যন্ত ভাড়া যাবার কথা বলতেই ড্রাইভার অবাক! চোখ রগড়ে ওর দিকে ভাল করে চাইল-বলে কি! ব্যাটা পাগল নাকি! একা একটা ট্রাক ভাড়া করে যাবে! তখন আনোয়ার নিজের পরিচয় সহ ড্রাইভারকে সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলল। এবারে চট করে রাজি হলো ড্রাইভার। রাত প্রায় দুটোয় পৌঁছল সে চেরাট ক্যান্টনমেন্টে।
কয়েকদিন পর শুরু হলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নতুন অনুশীলন। এক একটা অনুশীলন এলাকার দূরত্ব ক্যান্টনমেন্ট থেকে কমপক্ষে একশো পঞ্চাশ মাইল। রেইড ও অ্যামবুশ, অনুশীলন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অন্ধকার রাতে বড় বড় রেলওয়ে ব্রিজগুলো রেইড করতে হত ওদের। সন্তর্পণে ব্রিজের সুপার স্ট্রাকচার বেয়ে ওপরে উঠে এক্সপ্লোসিভ ফিট করতে হত। তাতে প্রাইমাকর্ড দিয়ে সংযোগ ঘটানোটা ছিল বিপজ্জনক। এই কাজের জন্য অ্যাকশন পার্টিকে সময় দেয়া হত মাত্র আট মিনিট। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ সারতে না পারলে পুনরায় অ্যাকশনে যেতে হত ওদের।
রেইড ও অ্যামবুশের পর শুরু হলো রেলওয়ে টানেল হামলা। টানেল হামলা অনুশীলনও ছিল রীতিমত ভয়ানক। যে-কোন সময়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা। ট্রেইনী কমাণ্ডোদের রাতের অন্ধকারে সেন্ট্রিদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে টানেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হত। রেল লাইনের নিচে এক্সপ্লোসিভ, প্রাইমাকর্ড ও প্রেসার সুইচ লাগাতে হত। প্রেসার সুইচ থেকে প্রাইমাকর্ডের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখত ওরা। যাতে সত্যিকারের বিস্ফোরণ না ঘটে। তারপর ওরা চুপি চুপি টানেল থেকে বেরিয়ে আসত। রেপেলিংটাও কম বিপজ্জনক ছিল না। প্রায় একশো বিশ ফুট খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, দড়ির সাহায্যে নেমে আসতে হত ওদের। রেপেলিংয়ের সাহায্যে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগত মাত্র পাঁচ-ছয় সেকেণ্ড ।
এরপর শুরু হলো হাত বাঁধা বন্দী অবস্থায় চলন্ত জীপ-ট্রাক বা চলন্ত ট্রেন থেকে পালানোর অনুশীলন। ট্রাক বা জীপ যখন কোন ব্রিজ অতিক্রম করছে, ঠিক তখন আচমকা পানিতে লাফিয়ে পালাতে হত । অথবা কোন কাঁটা ঝোঁপ বা জঙ্গল অতিক্রমের সময় পালাত ওরা। এভাবে বিভিন্ন বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অনুশীলন একে একে শেষ করল ওরা। সময়ের তালে তালে আনোয়ার এগিয়ে চলল এক রোমাঞ্চকর জীবনের দিকে; যে জীবন মৃত্যুর শীতল স্পর্শ দিয়ে গড়া, পদে পদে নতুন শিহরণ, নতুন অভিজ্ঞতা।
এবারে দি লোন রেঞ্জার-একলা চলরে। ক্যাম্পবেলপুর থেকে শুরু হয়েছে বিস্তৃত মরু প্রান্তর। এই খটখটে শুকনো প্রান্তরে পদে পদে মৃত্যুর সম্ভাবনা। সারা প্রান্তর জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় খানা-খন্দক। আর রয়েছে মৃত্যু ফাঁদ-চোরাবালি, যার খপ্পরে পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। এই বালি মানুষকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়, চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় সে রহস্যময় চোরাবালির অভ্যন্তরে। এই এলাকার শুরুতেই ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম। রাতের অন্ধকারে গ্রামগুলো পাহারা দেয় কতগুলো ব্লাড হাউণ্ড, বুল টেরীয়ার। মানুষকে নিমেষে টুকরো টুকরো করে ফেলতে এদের জুড়ি নেই। রহস্যঘেরা বিপদ-সংকুল প্রান্তরের পাশ দিয়ে গ্রামগুলোর গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে জি.টি. রোড। একদিন সন্ধ্যায় আনোয়ার ও আরও কয়েকজন লোন রেঞ্জারকে জি.টি. রোডের এই এলাকায় নিয়ে আসা হলো। ওরা সবাই নিরস্ত্র। প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছে একটা করে পানির বোতল, কিছু শুকনো ফলমূল ও সিগারেট-দেশলাই। আর রয়েছে মরুপ্রান্তরে চলার জন্য কম্পাস ও দিক নির্দেশক ডিগ্রী।
জি.টি. রোডের একটা অজানা মাইল স্টোন। এখান থেকে আনোয়ারকে ছেড়ে দেয়া হলো। ওকে অতিক্রম করতে হবে পঁয়তাল্লিশ হাজার গজপ্রায় ছাব্বিশ মাইল। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই এই দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে ওকে। নির্দিষ্ট সময় দূরত্ব অতিক্রম করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে না পারলে পানিশমেন্ট। শাস্তিস্বরূপ ওকে পুনরায় অজানা পথে চলতে হবে দশ মাইল। এই দুরত্বের জন্যও নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে। সঠিক দূরত্ব অতিক্রম করতে না পারলে আবারও খেসারত। এভাবে ক্রমাগত এগিয়ে যেতে হবে লোন রেঞ্জারকে অজানা গন্তব্যের দিকে।
সম্মুখে ধু-ধু প্রান্তর। গাছপালাহীন, নীরস, জনশূন্য পরিবেশ। হিমেল হাওয়া বইছে। মিটি মিটি তারাজ্বলা আকাশ। চাঁদ ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কম্পাসে ডিগ্রী সেট করে লোন রেঞ্জার আনোয়ার এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যস্থলের দিকে। প্রতিটা পদক্ষেপ গুণতে হচ্ছে সঠিক দূরত্ব নির্ধারণের জন্য। মাঝে মাঝে দিক নির্দেশক তারাটাকে দেখে নিতে হচ্ছে। কিছুদূর অতিক্রম করার পর ঘন হয়ে এল কুয়াশা-খাটো হয়ে গেল দৃষ্টিসীমা। দূরে কোন কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। রাত গম্ভীর হয়ে এল। এই পরিবেশে হঠাৎ আনোয়ারের মনে হলো, সে যেন এক অশরীরী আত্মাতেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে অদৃশ্য ডাকিনীর ডাকে।
আনোয়ারের গা-টা একটু ছমছম করে উঠছিল। সঙ্গে সঙ্গে এই ভৌতিক চিন্তাটা সে মন থেকে দূর করে দিল। সে লোন রেঞ্জার; যে-কোন পরিস্থিতিতে তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে; যে কোনরকম ভয়কে জয় করতে হবে। সেজন্যই তো এই পরীক্ষা। সন্ধ্যা থেকে চলা শুরু হয়েছে। রাত এখন প্রায় পৌনে এগারোটা। বালির ওপর বসে পড়ল ও। কোমরের বেল্ট থেকে পানির বোতলটা খুলে পাশে রাখল। জ্যাকেটের পকেট থেকে শুকনো ফলমূল বের করে চিবাল কিছুক্ষণ। বোতলের কর্ক খুলে ঢক ঢক করে কয়েক চুমুক পানি খেয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল। তারপর এগিয়ে চলল মরু প্রান্তরের বুক চিরে অজানা গন্তব্যস্থলের দিকে ।
রাতের মরু প্রান্তর বেশ ঠাণ্ডা। তার ওপর হিমেল বাতাস। কুয়াশার সঙ্গে চাঁদের আলোর রহস্যময় লুকোচুরি। চারদিকে চাইল আনোয়ার। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু অখণ্ড নীরবতা। জীবন্ত প্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। সমস্ত পৃথিবী তন্দ্রাচ্ছন্ন। শুধু একটি জীবন্ত অস্তিত্ব হাঁটছে তো হাঁটছেই–লোন রেঞ্জার আনোয়ার।
মাঝে মাঝে ছোটখাট হোঁচট খাচ্ছে সে। বালিমাটি-~দ্রুত এগুনো যাচ্ছে না। তবুও অবিরাম চলতে হচ্ছে ওকে–সময়সীমা নির্দিষ্ট। রাত প্রায় একটার দিকে দূরে আনোয়ারের নজরে পড়ল কম্পাস নির্দেশিত পথে জমাট বাঁধা অন্ধকার। ঘন কুয়াশার জন্য পরিষ্কার করে বোঝা গেল না, পাহাড় না গাছপালা। কাছে যেতেই জমাট অন্ধকারটা মাঝারি আকারের একটা জঙ্গলে পরিণত হলো। ভিতরে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আনোয়ার অতি সন্তর্পণে অন্ধকার জঙ্গলে প্রবেশ করল। শত্রুর ভয়ে হাতের ছোট্ট পেন টর্চ জ্বালতে পারছে না। ট্রেই কমান্ডোরা ঘুরে বেড়াচ্ছে মরু প্রান্তরের মাঝে। ওরা শত্রুর ভূমিকা পালন করছে। ওদের হাতে ধরা পড়ার কথা মনে হলেই ভয়ে গা-টা শিউরে ওঠে।
গাছের ফাঁক দিয়ে আবছা আবছা মরুভূমি দেখা যাচ্ছে সম্মুখে । আনোয়ার পা টিপে টিপে এগুচ্ছে কোনরকম শব্দ না করে। বলা যায় না, শত্রু এখানেও লুকিয়ে থাকতে পারে। পায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে লতানো গাছ পেঁচিয়ে যাচ্ছে। তাই ও অতি ধীরে ধীরে চলছে। অন্ধকার জায়গার প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে পৌঁছেছে আনোয়ার। হঠাৎ চমকে উঠল–পায়ের নিচে মাটি নেই। দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে সে। সঙ্গে সঙ্গে জালোযাই এলাকার কথা মনে পড়ল। তিরিশ ফুট গভীর খাদে পড়েছিল সেবার। এ যাত্রা এই প্রথম ভয়ে শরীর শিউরে উঠল ওর। সঙ্গীবিহীন গভীর রাতে নির্জন মরুপ্রান্তরে উদ্ধারের কোন আশা নেই। অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু না, এবারের মত মনে হয় বেঁচে গেল ও। তিন চার ফুট পতনের পর পায়ের তলায় ঠেকল শক্ত মাটি। আনোয়ার গর্তের মাঝে দাঁড়িয়ে পেন টর্চ জ্বালল। টর্চের আলোয়, ওর চক্ষু স্থির। গর্তের ভিতর একটা নর-কঙ্কাল চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। কঙ্কালের মাথার খুলিটা ওর দিকে দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে যেন। আনোয়ারের অনধিকার প্রবেশ ওর যেন সহ্য হচ্ছে না। গর্তের ভিতরে দাঁড়িয়ে আশপাশে ভাল করে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, এটা একটা পুরানো পরিত্যক্ত গোরস্থান। এলাকাটা প্রায় পাথুরে। ও পড়েছে একটা পুরানো কবরের ভিতর।
কবরের ভিতরটা বেশ গরম মনে হলো ওর। মাথার ওপর, গাছপালার ছাউনি। জায়গাটা বিশ্রামের জন্য বেশ আরামদায়ক। কঙ্কালের হাড়গোড়গুলো একদিকে সরিয়ে রাখল আনোয়ার। তারপর কবরের এক কোনায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর শুকনো ফলমূল খেয়ে বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলল। তারপর একটা সিগারেটে তৃপ্তির সঙ্গে টান দিল। বাইরে হিমেল বাতাস। কবরটা কিন্তু বেশ গরম। একটু ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগছে। কিন্তু সেদিকে আনোয়ারের খেয়াল নেই। দীর্ঘ পথ হেঁটেছে সে-যার-পর-নাই ক্লান্ত শরীর। একসময় নিজের অজান্তেই পশ্চিম পাকিস্তানের ধু-ধু মরু প্রান্তরের বুকে এক পরিত্যক্ত কবরের অভ্যন্তরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল এই অকুতোভয় বাঙালী যুবক।
বেশ কিছুক্ষণ পর আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে চেয়ে চমকে উঠল সে। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। মনে পড়ল ইস্ট্রাকটরদের ভাবলেশহীন নিষ্ঠুর চেহারা । নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছুতে না পারলেই…। তাড়াতাড়ি আনোয়ার জীর্ণ কবর থেকে মাথা বের করল, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। আশপাশটা ভাল করে দেখছে। মরু প্রান্তরের দিকে চোখ ফেরাতেই অবাক! শক খাওয়ার মত সারা শরীর চমকে উঠল ওর। একি! আশপাশে তো পনেরো বিশ মাইলের মধ্যে কোন লোকালয় থাকার কথা নয়। তবে? নিশ্চয়ই চোখের ভুল। চোখ রগড়ে নিল আনোয়ার। নাহ্, ঠিকই আছে। শরীরে জ্বলন্ত সিগারেট ঠেকাল, স্বপ্ন নয়। কিন্তু বাস্তব বলে ব্যাপারটা চিন্তাও করা যায় না। অথচ চোখের সামনে প্রান্তরের মাঝে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে সম্পূর্ণ নগ্ন এক সুন্দরী যুবতী। আকর্ষণীয় ফিগার। মাথা নিচু করে কি যেন খুঁজছে।
আনোয়ার ঢোক গিলে গলা ঝেড়ে নিল। চিৎকার করল যুবতীর উদ্দেশে, কোন হ্যায়? নিঃশব্দ খোলা প্রান্তরে ওর চিৎকার বহুদূরে হারিয়ে গেল। যুবতী আগের মতই নিঃশব্দে মাথা নিচু করে কি যেন খুঁজে চলেছে। আনোয়ার তিন-চারবার যুবতীর উদ্দেশে চিৎকার করল । নিশাচর যুবতী নিরুত্তর। উত্তর না পেয়ে ও একটা পাথর ছুঁড়ল সেই যুবতীর উদ্দেশে। সঙ্গে সঙ্গে ওর চারপাশে কুচি কুচি পাথর উড়ে এল। কয়েকটা ওর গায়েও পড়ল। তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে কবরের মধ্যে বসে পড়ল আনোয়ার।
হঠাৎ মনে হলো ওর, কবরবাসী কঙ্কালটাই জীবন্ত হয়ে যুবতীর ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে না তো? চিন্তাটা মাথায় আসতেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। দাঁতে দাঁত চাপল আনোয়ার। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল কঙ্কালের দিকে। জড়ো করা হাড়গোড়ের ভিতর থেকে কঙ্কালের মাথাটা উঁকি দিচ্ছে। মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে আছে আনোয়ারের দিকে। বাইরে নগ্ন যুবতী, সম্মুখে জীবন্ত কঙ্কালের হাড়গোেড়। ও বুঝতে পারল, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। না হলে যে-কোন মুহূর্তে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা। ও দ্রুত মাথাটা ঝাঁকি দিল। ক্ষণিকের জন্য ভৌতিক চিন্তাগুলো মাথা থেকে চলে গেল; সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় জেগে উঠল ইট্রাকটরদের ভাবলেশহীন নিষ্ঠুর চেহারা। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে না পারলেই… 1 প্রচণ্ড রাগ হলো আনোয়ারের নিশাচর যুবতীর ওপর। রাগের মাথায় একটা সিগারেট ধরাল সে। ভাবছে, কোন অবস্থাতেই ভয় পেলে চলবে না। যুবতীর ভয়ে আর বসে থাকা যায় না। কমান্ডো স্টাইলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ও। সম্মুখে তাকিয়ে দেখতে পেল, নিশাচরী উধাও। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজল-নেই-কোথাও নেই। রহস্যময়ীর দেখা পাওয়া গেল না। আর।
ভাঙা কবর থেকে বেরিয়ে এল আনোয়ার। আবার এগিয়ে চলল, মরু-প্রান্তরের বুক চিরে কম্পাস নির্দেশিত পথে। নিশাচর যুবতী যেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, সেখানে পৌঁছে অবাক হলো সে। পেন-টর্চ জ্বেলে দেখল, বালির ওপর কোন পদচিহ্ন নেই। এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। ও দ্রুত এগুলো সম্মুখে । ১৯২১ সালের ম্যাপে ওর গন্তব্যস্থল দেখানো হয়েছে–চারদিকে গাছপালা বেষ্টিত উঁচু পাড়ওয়ালা একটা পুকুর। পথে আর কোন বিশ্রাম নিল না। এখন কিছুটা পুষিয়ে নিতে হবে। ও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল সামনের দিকে একটু বাঁকা হয়ে, দুহাতে বাতাস কেটে; অনেকটা ভারবাহী কমাপ্তোদের মত।
কুয়াশা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। মাথার ওপর তারাজ্বলা আকাশ। চাঁদ অনেক আগেই ডুবে গেছে। কয়েকটা অচেনা পাখি উড়ে গেল। পাখিগুলোর ক্ষীণ রব কানে ভেসে এল ওর। চলতে চলতে ও সামনে দেখতে পেল গাছপালা ঘেরা একটা উঁচু জায়গা। পদক্ষেপ গণনা, কম্পাস ও তারার দিক নির্দেশে মনে ২চ্ছে, ওটাই ওর গন্তব্যস্থল।
হঠাৎ বাঁ দিক থেকে ওর কানে ভেসে এল হিংস্র কুকুরের চাপা গর্জন। ওর চলার গতি দ্রুততর হলো। গন্তব্যস্থল প্রায় সন্নিকটে। ওখানে কয়েকজন লোক থাকার কথা। হঠাৎ মনে হলো যদি ও ভুল পথে এসে থাকে তাহলে? যদি ওখানে পৌঁছে দেখে কোন লোক নেই; তখন? ঠিক এই সময় ডানপাশ থেকেও শুরু হলো কুকুরের প্রচণ্ড গর্জন। কুকুরগুলো দ্রুত এগিয়ে আসছে আনোয়ারের দিকে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগেই কুকুরগুলো পৌঁছে যাবে ওর কাছে। চোখের পলকে ওর দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে হিংস্র জানোয়ারগুলো। আত্মরক্ষার কোন উপায় নেই। ও একাকী। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। হঠাৎ অসহায়ের মত মনে হলো নিজেকে। ওদিকে হিংস্র কুকুরগুলো তীক্ষ্ণ দাঁত বের করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। কালবিলম্ব না করে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল উঁচু জায়গাটার দিকে।
কুকুরগুলো দুপাশ থেকে এগিয়ে আসছে, চোখে মারাত্মক চাহনি। তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। আর মাত্র মিনিটখানেক। তাহলেই লোন-রেঞ্জারের নাগাল পাবে হিংস্র জানোয়ারগুলো। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সে দৌড়চ্ছে। হঠাৎ করে বাঁচার প্রচণ্ড তাগিদ অনুভব করল সে। এধরনের মৃত্যু ও কোনমতেই মেনে নিতে পারবে না। ওর দেহ কুকুরের পেটে যাবে? নাহ্ কিছুতেই না। দৌড়াতে দৌড়াতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল আনোয়ার। সামনে কাঁটাভর্তি একটা বাবলা গাছ। কুকুরগুলো আর মাত্র কয়েক গজ দূরে। আনোয়ার বুট পায়ে তরতর করে ওঠা শুরু করল বাবলা গাছে। অথচ গাছে চড়ায় সে একেবারেই অনভিজ্ঞ। কুকুরগুলো গাছের নিচে পৌঁছে গেল। কয়েকটা লাফ দিল ওকে ধরার জন্য।
কিন্তু ততক্ষণে সে কুকুরগুলোর নাগালের বাইরে চলে এসেছে। ফুট দশেক উঠে একটা মোটা ডালে চেপে বসল আনোয়ার। নিচে তাকাতেই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। প্রায় পনেরো বিশটা ব্লাড হাউণ্ড, বুল টেরীয়ার দাঁড়িয়ে আছে। আধো আঁধারে ওদের চোখগুলো জ্বলছে। ভাবখানা এই, একবার নিচে নেমে এসো বাছাধন, লোন-রেঞ্জার হবার মজা দেখাচ্ছি। লোন রেঞ্জার বাবাজী তখন বাবলা গাছের উঁচু ডালে চুপচাপ বসে আছে। মাঝে মাঝে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করছে।
এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই আনোয়ার গাছের ওপর থেকে দেখতে পেল কাছেই ছোট্ট একটা গ্রাম। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য কয়েকজন গ্রামবাসী মাঠে নেমেছে। ওদের হাতে পানি ভর্তি বদনা। গাছের নিচে এতগুলো কুকুর দেখে লোকগুলো কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল। আনোয়ারকে গাছের ওপর দেখে ওরা থতমত খেয়ে গেল। আনোয়ার লোকগুলোকে নিজের পরিচয় দিল। ওরা জানাল, সামনে গাছপালার ভিতর সেনাবাহিনীর আরও লোক অপেক্ষা করছে। আনোয়ার বুঝল ওটাই ওর গন্তব্যস্থল। যাক বাঁচা গেল রাস্তা ভুল হয়নি তাহলে। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা কুকুরগুলো সরিয়ে নিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে এল সে।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেখতে পেল, উঁচু পাড় বেষ্টিত একটা খটখটে শুকনো নিচু জায়গা। দেখে মনে হয় না, কোনকালে এখানে পানি ছিল। অথচ ম্যাপে এটাকে পুকুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে পানি থাকার কথা, সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা উজ। গাড়ির পাশে ছোট একটা তাবু টাঙানো। পাঁচজন ইন্সট্রাকটর এবং তাদের কয়েকজন সহযোগী তাঁবুর নিচে শুয়ে রয়েছে। আনোয়ার বুট খুলে ওদের পাতা বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন আফজাল ও দানব সদৃশ ফ্লাইং অফিসার বাজোয়াও এসে পৌঁছাল। ওদের সবারই গন্তব্যস্থল একই ছিল। ওরা শুয়ে শুয়েই নাস্তা খেলো।
সূর্য ওঠার আগেই সবাই রওনা হলো চেরাটের উদ্দেশে। গভীর শ্রান্তিতে আনোয়ারের চোখ প্রায় বুজে আছে। এই সময় ও শুনতে পেল, ক্যাপ্টেন আফজালকে সারা রাস্তা কে যেন পাথরের কুচি ছুঁড়ে মেরেছে; রাস্তায় এক জায়গায় বাজোয়া শূন্যে একটা খাঁটিয়া নাচতে দেখেছে। এই ভয়াল অভিজ্ঞতা এখনও ওর কাছে রহস্যাবৃত। এগিয়ে চলেছে ডজ।
.
০৮.
মালাকান পাহাড়ী অঞ্চল।
চারদিকে পাথরের উঁচু উঁচু চূড়া। চূড়াগুলোর সানুদেশে উত্রাই। উত্রাইগুলোর মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে পায়ে চলা পাহাড়ী পথ। অকুতোভয় পাহাড়ীরা এই পথ ব্যবহার করে। ওদের পরিশ্রমী খচরগুলোও এপথে চলাচল করে। সারাটা এলাকা জুড়ে কেমন একটা রুক্ষ নিষ্ঠুর ভাব।
ধূসর প্রকৃতিতে প্রাণের কোন ছোঁয়া নেই। ছড়ানো ছিটানো অজস্র বোল্ডার জায়গাটাকে আরও নিষ্প্রাণ করে তুলেছে। পাহাড়ের উচ্চতার জন্য দূরে দৃষ্টি যায় না। চতুর্দিকে পাহাড়ের প্রাচীর। তাই দূরের খোলা আকাশও নজরে পড়ে না। কোথাও কোথাও পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে গভীর খরস্রোতা নালা। মালাকান-রিসালপুর-নওশেরা প্রধান সড়কগুলো এইসব পাহাড়ের গা কেটে তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় সড়কগুলোর একপাশে উঁচু পাহাড়। অপর পাশে গভীর গিরিখাদ।
ওরা ছুটে চলেছে মালাকান হিলসের এই দুর্গম এলাকায়। এবারও প্রত্যেকের পিঠে গুরুভার প্যাক। স্ট্র্যাপগুলো এবারও ওদের কাঁধের মাংস চিরে ঢুকে যেতে চাইছে। ওদের কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝুলছে পানির বোতল ও প্রিয় কমাণ্ডো নাইফ। প্রত্যেকের হাতে সাব-মেশিনগান। মর্টার হেভী মেশিনগান ও ওয়্যারলেসের ভারী জেনারেটরগুলো ওরা যথারীতি পালা করে বইছে। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। ওরা সাতদিন একনাগাড়ে ছুটছে। পেছনে দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাড়া করে আসছে শত্রুরূপী ট্রেইণ্ড কমাণ্ডোরা। শত্রুরা কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও গাড়িতে করে এগিয়ে আসছে। ওদের হাতে কোনক্রমেই ধরা পড়া চলবে না। ধরা পড়লেই অমানুষিক নির্যাতন। জ্বলন্ত সিগারেট ধীরে ধীরে নাকের ভিতর দিয়ে গলিয়ে দেবে। পোড়া মাংসের কটু গন্ধেও শত্রুদের ভাবলেশহীন নিষ্ঠুর চেহারার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওদেরকে পৌঁছুতে হবে আরও একশো বিশ মাইল দূরে আটক দুর্গে। তবেই ওরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে।
মালাকান অঞ্চলের রাত। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। আনোয়াররা পাহাড়ী পথ ব্যবহার করছে না। তাতে শক্রর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। পাহাড়ী নালার ভিতর দিয়ে এগুচ্ছে ওরা। বেশ, কিছুদূর চলার পর ম্যাপ দেখল সবাই। ম্যাপ অনুযায়ী নালা বেয়ে ওপরে উঠলেই মালাকান অঞ্চলের প্রধান সড়ক। সড়কের পাশ ঘেঁষে শুরু হয়েছে উঁচু পাহাড়। হঠাৎ ওরা বুঝতে পারল, শক্ররা খুব কাছেই। মুহূর্তে ওরা সতর্ক হয়ে গেল। শুরু হলো মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে পাথরের চাইয়ের আড়ালে লুকোচ্ছে। আবার এগিয়ে যাচ্ছে।
এইভাবে চলতে চলতে রাত প্রায় দশটার দিকে মালাকান সড়কের পাদদেশে পৌঁছুল দলটা। সবাই স্থির করল, সামনের পাহাড় ডিঙাতে হবে। নইলে শক্রর চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। ওরা নালার গা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করল। ওপরে উঠেই টের পেল, শক্ররা নিচে চেঁচামেচি করছে। কারণ শুক্ররা ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছে। এই সময় হঠাৎ ওদের টহলদার জীপের আওয়াজ শোনা গেল। ওরা দ্রুত পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। টহলদার জীপ ওদের পাশ কেটে সোজা চলে গেল। ফিরে আসতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। এই সময়ের মধ্যে পাহাড়ে চড়ার একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে হবে। ওরা দ্রুত পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে ওঠার পথ খোঁজা শুরু করল সবাই।
বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও তেমন কোন সুবিধাজনক জায়গা পাওয়া গেল না। সব জায়গাই খাড়া প্রাচীরের মত। ওরা পাগলের মত একটু ঢালু জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখা গেল। দ্রুত এগিয়ে আসছে গাড়ি। তখনও ওরা পাহাড়ে ওঠার মত জায়গা খুঁজে পায়নি। টীম লীডার ক্যাপ্টেন জানজুয়ার নির্দেশ এল, স্টার্ট ক্লাইম্বিং। শুরু হলো খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠা। ওরা একটা সরু পথ বেয়ে ওপরে উঠছে। পথটা ফুট খানেক চওড়া। কোথাও কোথাও তারও কম। গাড়ি এগিয়ে আসতেই সবাই পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেল। একে একে টহলদার। গাড়িগুলো নিচের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। শুরু হলো বিরামহীন গতিতে ওদের পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা।
রাতের গভীরতা ক্রমেই বাড়ছে। খাঁ খাঁ করছে চারদিকের নিস্তব্ধ পাথুরে প্রকৃতি। ঘন কুয়াশায় পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। ক্যাপ্টেন জানজুয়া বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে আনোয়ারের থেকে। আনোয়ার চার হাত-পা ব্যবহার করছে ওপরে ওঠার জন্য। এক হাতে পাথুরে পথ পরীক্ষা করতে হচ্ছে। আলগা পাথরের ওপর শরীরের চাপ পড়লে পা ফসকে যেতে পারে। পাহাড়ের গা ছুঁড়ে বেরিয়ে রয়েছে ছোট বড় নানা সাইজের পাথরের কোণা । নিচে ছড়ানো রয়েছে তীক্ষ্ণ ভোঁতা নানা আকারের বোল্ডার। পা কিংবা হাত ফস্কালে মৃত্যু অনিবার্য।
আনোয়ারের হাতের নখগুলো ব্যথা করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাথরের চোখা কোণা নখের নরম মাংসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে সে। শরীরের সমস্ত পেশী ফুলে ফুলে উঠছে। সারা শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়া শুরু হলো। গত কয়েকদিন ধরে একনাগাড়ে উপবাস। তার ওপর অমানুষিক পরিশ্রম। ওদের প্রত্যেকের শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখের পাতা নিজেদের অজান্তেই ভারী হয়ে আসছে।– হঠাৎ হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল আনোয়ারের। বাঁ পা-টা ফকে গেছে। ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না শরীরের। প্রচণ্ড চাপ পড়ায় বাম হাতও ফসকে গেল। বাঁ দিকটা সম্পূর্ণ শূন্যের ওপর ভেসে আছে। ডান হাতের জন্য শরীরটা এখনও পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। ডান পায়ে তেমন শক্তি পাচ্ছে না ও। দেহের প্রচণ্ড চাপ এখন ডান হাতের ওপর। ধীরে ধীরে ডান হাতের কব্জিও শিথিল হয়ে আসছে।
আনোয়ারের চোখে-মুখে তীব্র কাঠিন্য ফুটে উঠল। ওপরে ফুরফুর করে বাতাস বইছে। দীর্ঘ শ্বাস নিল সে। বাঁ পা দিয়ে শক্ত অবস্থান খুঁজছে। কিন্তু পা-টা তেমন কোন অবস্থান খুঁজে পাচ্ছে না। ওর মাথার শিরাগুলো দপ দপ করে লাফাতে শুরু করল। এই বুঝি শুরু হলো পতন। ডান হাতটা থরথর করে কাঁপছে। কব্জি খুলে যেতে শুরু করল। আনোয়ার ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎ ওর বাঁ হাতের নিচে শক্ত একটা পাথরের কোণা হেল পড়ল। ও দ্রুত চেপে ধরল সেটা। ডান হাতের কব্জিতে আবার কিছুটা শক্তি ফিরে এল। সেই সঙ্গে ডান পায়েও শরীরের চাপ পড়ল। বাঁ পা দিয়ে আবার খোঁজা শুরু হলো নিরাপদ কোন সাপোর্ট। কিছুক্ষণ খোঁজার পর খানিকটা ওপরের দিকে পাহাড়ের গা ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা একটা শক্ত কোণা পাওয়া গেল। আনোয়ার আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ওর বুকের ছাতি দ্রুত ওঠানামা করছে। সবার অলক্ষ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা।
এই সময়ে সবাই ক্যাপ্টেন জানজুয়াকে বিশ্রামের কথা বলল। একটু ওপর থেকে টীম লীডারের নির্দেশ ভেসে এল, এই বিপদসংকুল খাড়া জায়গায় কোনমতেই বিশ্রাম করা যাবে না। শুরু হলো আবার বিরামহীন গতিতে ওপরে ওঠা। ক্ষুধা পীড়িত শরীরে ওদের চলার গতি ক্রমশই মন্থর হয়ে আসছে। হাত পায়ের পেশীগুলো ব্যথায় টনটন করছে। শরীর যেন আর নড়তে চাইছে না। সারা শরীরের স্নায়ুগুলো বিরোধিতা শুরু করল। রাত প্রায় একটা । জানজুয়ার গলা ভেসে এল, হল্ট। ওদের বিশ্রামের নির্দেশ দেয়া হলো। জায়গাটা ফুট খানেক গর্ত ও দুই তিন ফুট চওড়া একটা নালার মত।
কেউ ছোট্ট একটু বসার জায়গা পেল। কেউবা পাহাড়ের গায়ে, হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে লাগল। আনোয়ার সাব মেশিনগানটা পিঠ থেকে নামিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল। নিজেও দাঁড়াল হেলান দিয়ে। সঙ্গে পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলো। প্যান্টের পকেট হাতড়ে একটা চকোলেট পেল ও। সেটা মুখের ভিতর চালান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। পরম তৃপ্তির সঙ্গে সিগারেটটা শেষ করল ও। তারপর শুরু হলো বিশ্রাম। ওদের মনে হচ্ছে, এরচেয়ে বড় সুখ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। বিশ্রাম নিতে নিতে এক সময় ক্লান্ত দেহে পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।
মালাকান পাহাড়ের বিপজ্জনক একটি রাত বিদায় নিল। পুব আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি মারছে। পাহাড়ের গুহাবাসী পাখিগুলো ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে আহারের সন্ধানে। এই সময় ট্রেইনী কমাণ্ডোদের ঘুম ভেঙে গেল । তখনও আনোয়ার ঘুমোচ্ছে । পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে-পরম নিশ্চিন্তে। ভয়ার্ত হল্লায় ওর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই প্রচণ্ড বিস্ময়! অবিশ্বাস্য দৃশ্য! শীতল শিরশিরে একটা ভাব বিদ্যুতের মত সারা শরীরে সংক্রামিত হলো। মনে হলো দৃশ্যটা পৃথিবীর প্রসিদ্ধতম কাল্পনিক গল্প লেখকের ধারণারও বাইরে।
মালাকান পাহাড়ের খাড়া প্রাচীরের কোলে ওরা দাঁড়িয়ে আছে–মাটি থেকে প্রায় ছয় সাতশো ফুট ওপরে। খাড়া প্রাচীর। তাকালেই কলজে হিম হয়ে আসে। সুউচ্চ প্রাচীরের শেষ সীমা নজরে পড়ে না। বসন্ত রোগীর মুখের মত ছোট বড় নানা আকারের অসংখ্য পাথর। প্রচণ্ড রোদে দগ্ধ পাথরগুলো তামাটে, বর্ণের। মহাকালের বিভীষিকার মত দাঁড়িয়ে আছে মালাকান পাহাড়। এই বিভীষিকার কোলে বন্দী ওরা–ষোলোজন ট্রেইনী কমাণ্ডো অফিসার, যার মধ্যে মাত্র একজন বাঙালী-আনোয়ার ।
দিনের আলো ফুটে উঠল। সবারই এক প্রশ্ন। কিভাবে ওরা এখানে উঠল? রাতের অন্ধকারে কিছু চোখে পড়েনি। তাই ওরা অন্ধের মত এই বিপদ-সংকুল খাড়া পাহাড়ে চড়তে পেরেছে। কিন্তু দিনের আলোয়…! এই মরণপথে কেউ পা বাড়াতে রাজি হবে কি? ওপরের দিকে চাইলে মাথা ঘুরে ওঠে। খাড়া প্রাচীরের শেষ সীমানা দেখা যাচ্ছে না। নিচের দিকে চাইলেও শিউরে উঠতে হয়। নামা অসম্ভব। প্রত্যেকে বুঝল, মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। আনোয়ারের শরীরের প্রতিটি পেশী শক্ত হয়ে উঠল। মন থেকে, সমস্ত ভীতির চিহ্ন মুছে গেল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে মানুষ বোধ হয় সমস্ত আতঙ্ক ভুলে এইরকম স্থির হয়ে যায়। ওর তাই মনে হলো।
ওপর থেকে টীম লীডার জানজুয়ার দৃঢ়কণ্ঠ ভেসে এল, উই উইল ক্লাইম্ব। সবাইকে বলা হলো অন্ধের মত ওপরে উঠতে হবে, রাতে যেভাবে উঠেছে। সেই সঙ্গে হুশিয়ার করে দেয়া হলো, কেউ যেন পাহাড়ের চূড়ার দিকে না তাকায়। আশপাশেও তাকানো চলবে না। চোখের দৃষ্টি সামনে চলার পথের ওপর নিবদ্ধ রাখতে হবে। মনে যেন কোন রকম নৈরাশ্য ছায়া ফেলতে না পারে। ওরা টিকটিকির মত ওপরে উঠতে লাগল মালাকান পাহাড়ের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের গা বেয়ে।
নানা রকম কথাবার্তা বলছে আর এগুচ্ছে সবাই। এই ভয়ঙ্কর পরিবেশটা হালকা করার এটা একটা কৌশল ওদের। প্রত্যেকের শরীর গড়িয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। পথ যেন আর ফুরায় না । ওদের মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে এভাবে চলতে হবে। মাঝে মাঝে মনের মধ্যে নৈরাশ্যের ছায়াপাত যে ঘটছে না, তেমন নয়। কিন্তু ওদের প্রচণ্ড সহ্যশক্তি ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের কাছে নৈরাশ্য বারবার মাথা নত করছে। ওরা আজ অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার সম্ভাবনা শতকরা প্রায় একশো ভাগ। কিন্তু চলার গতির সঙ্গে বাঁচার ক্ষীণ আশা ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ওরা জানে প্রতিটি পথের শেষ আছে। এ চলাও এক সময়ে শেষ হবেই। কিন্তু তারপর? তারপর ওদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?
বহুক্ষণ চলার পর ওপর থেকে টীম লীডার জানজুয়ার কণ্ঠ শোনা গেল, এখান থেকে পাহাড়ের খাড়া ঢাল অনেকটা কমে গেছে। আমি চূড়ার প্রায় কাছাকাছি। শাবাশ, সবাই ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসো। এই কথায় সবার মাঝে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সবাই ওপরের দিকে উঠছে। ক্রমশ খাড়া পাহাড়ের চূড়া এগিয়ে এল-ষোলোজন মৃত্যু পথযাত্রী কমাণ্ডো অফিসারের প্রত্যাশিত গন্তব্যস্থল। এক সময়ে এই কঠিনতম পথের অবসান ঘটল। সবাই নিরাপদে পৌঁছল চূড়ায়। সেখানে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক অবিশ্বাস্য চমক!
চূড়াটা সমতল। মখমলের মত সবুজ ঘাসের গালিচার আচ্ছাদনে ঢাকা। ঘন সবুজ কোমল ঘাসগুলো। কয়েকটা আপেল গাছ, পাকা পাকা সোনালী আপেলে ভর্তি। বড় বড় কয়েকটা অচেনা গাছও ওদের চোখে পড়ল। গাছগুলোর নিচে বহুদিনের শুকনো পাতা ও ডালপালা স্থূপীকৃত হয়ে রয়েছে। সোনালী : আপেল গাছগুলোর অনতিদূরে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। ওরা যেন বিভীষিকার রাজ্য পেরিয়ে রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করেছে। কিছুক্ষণ আগেও ওরা ছিল মৃত্যু-ভয়ে ভীত। এখন ওরা প্রাণ প্রাচুর্যে উজ্জ্বল। ওরা কেউ কেউ নিজেকে পৃথিবীর সম্রাট বলে ঘোষণা করল। আবার কেউ কেউ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে ঘোষণা করল।
ওদের মধ্যে কয়েকজন লেগে গেল রান্নার কাজে। কয়েকজন ছুটল জ্বালানি কাঠ আনতে। বাকি কয়েকজন গেল আপেল সংগ্রহ করতে। সবাই আপেল গাছের ডাল ভেঙে দাঁতন বানাল। এদিকে চুলো দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা কফি তৈরি হয়ে গেল। সবাই জ্বলন্ত চুলার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল। কেউ চা, কেউ কফি পান করে ছুটল ফোয়ারার উদ্দেশে। ফোয়ারার স্বচ্ছ পানি নিয়ে সবাই চঞ্চল। বালকের মত মাতামাতি শুরু করে দিল। দীর্ঘদিন কারও গোসল নেই। পরম তৃপ্তিতে ওরা সাবান দিয়ে গোসল শুরু করল। গোসল তো নয় যেন সোয়ানবাথ।
গোসল শেষে ফিরে এসে দেখল, ওদের খাবার তৈরি। প্রত্যেকে গরম গরম পরোটা, ডিম ওমলেট ও ভাজা হান্টার-বীফ পেট পুরে খেলো। শেষে সরবরাহ করা হলো গাছ থেকে পাড়া, প্রচুর আপেল। প্যাক থেকে প্রত্যেকে কাপড়চোপড় বের করে নরম ঘাসের ওপর বিছানা পাতল। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মোলোজন ক্লান্ত কমাণ্ডো সৈনিক।
ঘুম যখন ভাঙল তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। চারদিকে বেশ ঠাণ্ডা। সান্ধ্যকালীন চা-পর্ব শেষ করে কয়েকজন নৈশভোজের আয়োজন শুরু করে দিল। আনোয়ারসহ বাকি কয়েকজন একটা বড় আগুনের কুণ্ডলীর পাশে তাস নিয়ে বসে গেল। রাত আটটার দিকে ঘোষণা করা হলো, ডিনার প্রস্তুত। সবাই ছুটল ডিনারের জন্য। গরম পরোটা, ডিম ওমলেট, ভাজা হান্টার বীফ, আচার, পেঁয়াজের সালাদ সহযোগে ডিনার শেষ। হলো ওদের। আবার শুরু হলো তাস খেলা। খেলার ফাঁকে ফাঁকে চা ও কফি চলতে থাকল। রাত প্রায় এগারোটার দিকে খেলা শেষে সবাই নরম ঘাসের ওপর পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
ঘন পল্লবিত গাছের নিচে ওরা শুয়ে আছে। মাথার ওপরে। সামিয়ানার মত করে পঞ্চ টাঙানো। ওরা লোকালয় থেকে বহু দূরে। যেখানে শক্রর কোন ভয় নেই। তাই ওরা পরম নিশ্চিন্তে নিদ্রারত। অথচ আনোয়ারের দুচোখে ঘুম নেই। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল সে। তারপর এগিয়ে গেল সোনালী আপেল । ভর্তি গাছের নিচে। অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু অসংখ্য তারার ঝিকিমিকি সারা আকাশ জুড়ে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ দূর । আকাশে হারিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সম্মুখে অসীম প্রান্তর ঘন কুয়াশায় ঢাকা। নিচে মালাকান সড়ক। নীরব, নিথর,
স্পন্দনহীন। দূরে পাহাড়ী নালাগুলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। চূড়ায় ফিরে এল আনোয়ার। চিরসবুজ ঘাসগুলোও যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। সোনালী আপেলের ভারে গাছের ডালগুলো নুয়ে আছে। স্বচ্ছ পাহাড়ী ফোয়ারার প্রস্রবন থেকে কুল কুল শব্দ ভেসে আসছে। গভীর মমতা মাখানো পরিবেশ। কি অপূর্ব!
ও যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গেল। কত সুন্দর এই পৃথিবী, কি বিচিত্র তার রূপ! অথচ ওর মনের মাঝে এক বিষাক্ত দুঃস্বপ্ন ওকে মাঝে মাঝে তাড়া করে। সে জানে না, এই বিপজ্জনক কমাণ্ডো জীবনের পরিসমাপ্তি কোথায়? এক সময় আনোয়ার ধীরে ধীরে বিছানার দিকে ফিরে এল। তারপর ঘন পল্লবিত গাছের নিচে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল। হারিয়ে গেল গভীর ঘুমের রাজ্যে।
মালাকান পাহাড়ে কাটল দ্বিতীয় রাত । সকালে নাস্তা সেরে শুরু হলো পোকার খেলা। সারাটা দিন তাস হাসি তামাসা ও গল্প গুজবের মধ্য দিয়ে কেটে গেল একসময় আবার অন্ধকার হয়ে এল। আকাশে জ্বলে উঠল অসংখ্য তারার বাতি। ওরা আগুনের কুণ্ডলী জ্বালল শুকনো তালপাতা দিয়ে। দাউ দাউ করে কুণ্ডলী জ্বলছে। আগুনের চারপাশে ঘিরে বসে রাতের আহার সারল সবাই। আবার ঘুমিয়ে পড়ল ওরা মালাকান পাহাড়ের চূড়ায়।
মালাকানে তৃতীয় রাত পার হলো। সবাই স্থির করল আগামীকাল সকালে আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। ময়লা কাপড়চোপড় ফোয়ারার পানিতে কেচে নিল ওরা। একদিনের চলার উপযোগী খাবারও তৈরি করা হলো। বিকেলের দিকে চূড়া থেকে নামার রাস্তা খোঁজা শুরু হলো। খুঁজতে খুঁজতে ওরা চূড়ার পেছনের দিকে ঢালু একটা পথ পেয়ে গেল। ব্যস, ওদের সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে গেল। আবার মালাকান পাহাড়ে নেমে এল রাত । ওরাও ঘুমিয়ে পড়ল চূড়ায় কোমল ঘাসের ওপর পাতা বিছানায়।
মালাকান পাহাড়ে চতুর্থ রাত পার হলো। সকালে উঠে সবাই তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। যাত্রার আয়োজন প্রায় শেষ। সবাই ছুটল সোনালী আপেল গাছের দিকে। প্রত্যেকে পকেট ভর্তি করল আপেল দিয়ে। তারপর সেই স্বপ্নরাজ্য ছেড়ে ওরা আবার এগিয়ে চলা শুরু করল আটক দুর্গের উদ্দেশে। যেতে যেতে হঠাৎ আনোয়ার পেছন ফিরে চাইল, মায়াবিনী রূপসী মালাকান চূড়া ওকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। মনে মনে বলল, বিদায় রূপসী নন্দিনী। হয়তো আর কোনদিন তোমার কাছে ফিরে আসা হবে না। বাকি পথ সবাই নিরাপদে অতিক্রম করে পৌঁছে গেল আটক দুর্গে।
০৯.
থ্রা। এক সেকেণ্ড, দুই সেকেণ্ড, তিন সেকেণ্ড; আবার কমাণ্ড, ডাউন। নিরাপদ আড়ালে মাথা নিচু করল আনোয়ার। সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো আওয়াজ দ্রিম। শুরু হলো বিস্ফোরকের ওপর অনুশীলন।
সময় মাত্র চার সেকেণ্ড। এই সময়ের মধ্যে এক্সপ্লোসিভ ফিউজ লাগিয়ে লক্ষ্যস্থলে নিক্ষেপ করতে হবে। ভীষণ বিপজ্জনক এই অনুশীলন। সময়ের একটু এদিক ওদিক হলেই মুসিবত! প্রাণনাশ নতুবা মারাত্মক দুর্ঘটনা। প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজনাপূর্ণ। তবুও এই অনুশীলন ঘিরে একটা ছেলেমানুষী আনন্দের ভাব আছে। এখানে শেখানো হলো, ঘরে বসে বিস্ফোরক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র বানানোর কৌশল। হাতের কাছে গ্রেনেড নেই; সে অবস্থায় বিস্ফোরক দিয়ে গ্রেনেড় বানিয়ে ফেলতে পারে কমাণ্ডোরা। দশ-বারোজন শত্রুর দলকে একা অ্যামবুশ করতে হবে; বানিয়ে ফেলল ডাইরেকশনাল গ্রেনেড। শক্রর ট্যাংক বা গাড়ি উড়িয়ে দিতে হবে, সেজন্য নিজ হাতে প্রস্তুত স্বয়ংক্রিয় রকেটই যথেষ্ট। তাছাড়াও শেখানো হলো, বুবি ট্র্যাপের সাহায্যে কিভাবে শত্রু খতম করতে হবে। কিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় (যেমন চিনি) জিনিস দিয়ে মারণাস্ত্র বানাতে হবে।
টানেল অ্যামবুশ প্রশিক্ষণও ঝুঁকিপূর্ণ। পাহারারত সেন্ট্রিদের পরাজিত করে কিংবা ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে টানেলে প্রবেশ করতে হত। ছুটে গিয়ে টানেলের মাঝামাঝি জায়গায় ট্রেন লাইনের নিচে বিস্ফোরক লাগায় কমাণ্ডোরা। বিভিন্ন বিস্ফোরকে প্রাইমাকর্ড লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য ওরা কর্ডের দুদিকেই সুইচ লাগাত। যে-কোন দিক থেকে ট্রেন এলেই যাতে বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রেন টানেলে প্রবেশ করার পূর্বেই ওদের অ্যাকশন শেষ করতে হত। কারণ প্রচণ্ড গতিতে টানেলে প্রবেশ করত ট্রেনগুলো। ট্রেন বেরিয়ে যাবার পর টানেলের বাতাসও তীব্রগতিতে ট্রেনের পিছু ধাওয়া করে। ফলে টানেলের ভিতর পার্শিয়াল ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি হয়। এই প্রচণ্ড বাতাসের টান বেশ ভারী বস্তুকেও টানেলের ভিতর থেকে ছিটকে নিয়ে যেতে পারে। তাই কমাণ্ডোদের ট্রেনের সময়সূচী সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। যদিও টানেল রক্ষণাবেক্ষণকারীদের নিরাপত্তার জন্য টানেলের গা কেটে ছোট ছোট ফোকর বানানো থাকে, কিন্তু এই ফোকরগুলো অ্যাকশন-পার্টির কমান্ডোদের সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। টানেলে ট্রেন প্রবেশ করার পর কেউ যদি নিরাপদ স্থান খুঁজে না পায়, তবে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
পিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি একটা টানেল অ্যামবুশ করতে বলা হলো ওদেরকে। ঝুঁকিপূর্ণ মিশন। একটু অসতর্কতার ফলে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। চোখের পলকে ঘটে যাবে ঘটনা। তাই আনোয়ারদের ছোট কমাণ্ডো দলটি সতর্ক। রাত একটায় এইচ আওয়ার (হামলার সময়)। সোয়া একটার মধ্যে অ্যাকশন পার্টি কাজ শেষ করল। রাত দেড়টার সময় খাইবার মেল টানেলে প্রবেশ করবে। ওরা কাজ শেষে টানেলের বাইরে অপেক্ষা করছে। এই সময় অপারেশন পরীক্ষার জন্য টানেলে প্রবেশ করলেন মেজর ভর্দগ। এর পরের কাহিনি মেজর ভর্দগের মুখ থেকেই শোনা যাক:
আমি মেজর ভর্দগ বলছি। একাদশতম অ্যাডভান্সড় কমাণ্ডেী কোর্সের ট্রেইনী অফিসারদের নিয়ে টানেল হামলায় গেছি। টানেলটি রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি। কাবুল ও সিন্ধু নদীর সঙ্গমস্থলের পাশেই এক পাহাড়ী অঞ্চলে। চীফ ট্রেইনার হিসেবে প্রত্যেক অপারেশনের ছোটখাট দোষ-ত্রুটি শুধরে দেয়া আমার দায়িত্ব। এধরনের অপারেশনে যে কোন অপারেশনের মতই কৌশল প্রয়োগ করতে হয়। শুধু অ্যাকশন-পার্টির কাজ একটু অন্য ধরনের। রাত একটায় এইচ আওয়ার দেয়া হয়েছে। দেড়টায় খাইবার মেল টানেলে প্রবেশ করবে। আমি অ্যাকশন পার্টিকে সোয়া একটার মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছি। সেন্ট্রিদের ওপর হামলা করার পর যখন অ্যাকশন-পার্টি এক্সপ্লোসিভসহ টানেলের ভিতর ঢুকল, তখন আমি বাইরে হামলাকারী বিভিন্ন গ্রুপের অবস্থান ও কার্যক্রম পরিদর্শন করছিলাম।
রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি টানেলে ঢুকলাম, বিস্ফোরক কি ভাবে লাগানো হয়েছে তা পরীক্ষার জন্য। একটা, ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে দেয়া হত। বিস্ফোরকের সংযোগকারী প্রাইমাকর্ড যেন কোনমতেই সুইচের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকে। প্রাইমাকর্ড সুইচের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে সত্যিকারের বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। সেইসঙ্গে এও বলে দিলাম প্রকৃত যুদ্ধের সময় শত্রু এলাকায় যেন এর উল্টোটি না হয়। তাহলে সমস্ত প্রাণান্ত চেষ্টা তামাশায় পরিণত হবে।– অ্যাকশন-পার্টি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সেরে টানেলের বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি যখন টানেলে প্রবেশ করি তখন দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমার সঙ্গে রয়েছে দুজন হাবিলদার ইস্ট্রাকটর। টর্চ জ্বেলে এক্সপ্লোসিভ ও প্রাইমাকর্ডের সংযোগগুলো পরীক্ষা শুরু করলাম। এই সময় ট্রেন টানেলে প্রবেশ করল। আমি হাবিলদারদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলে নিজেও টানেলের গা কেটে বানানো ছোট্ট একটি গর্তে ঢুকে পড়লাম। সারা টানেল জুড়ে শুধু গুম গুম শব্দ হচ্ছে। ঘণ্টায় সত্তর মাইল বেগে ছুটে আসছে খাইবার মেল। আর মাত্র পনেরো বিশ গজ, তারপরেই ট্রেন সুইচের ওপর দিয়ে চলে যাবে। সেইসঙ্গে পয়েন্ট টু টু ক্যাপ টুস টুস করে আওয়াজ তুলবে। তাহলেই বুঝতে হবে অপারেশন সাকসেসফুল।
আমি তখনও টর্চ জ্বেলে এক্সপ্লোসিভ ও প্রাইমাকর্ডের সংযোগ পরীক্ষা করছি। সুইচ থেকে ট্রেনের ব্যবধান আর মাত্র কয়েক ফুট। আমার টর্চের আলো পড়ল সুইচের ওপর। শরীরের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। হঠাৎ করে মুখ থেকে তীব্র আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল, ইউ বাস্টার্ড, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান? চোখের সম্মুখে টানেলটা মৃত্যুকূপে পরিণত হলো। বিরাট একটা বিস্ফোরণ, হাজারো কণ্ঠের আর্তচিৎকার, সেইসঙ্গে আমারও শেষ আর্তচিৎকার চাপা পড়বে কংক্রীটের চাইয়ের নিচে। কারণ প্রাইমাকর্ডের সঙ্গে সুইচের সত্যিকারের সংযোগ ঘটানো রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। চোখ বন্ধ করে মুখ লুকালাম টানেলের গায়ে ছোট গর্তের মধ্যে। শেষবারের মত স্মরণ করলাম সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ।
মৃত্যু-ফাঁদ অতিক্রম করল খাইবার মেল । কিন্তু একি? আমি এখনও বেঁচে আছি কিভাবে? বিস্ফোরণ ঘটল না কেন? নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সংবিৎ ফিরে আসতেই কোনমতে সুইচের কাছ গেলাম। তখনও আমি থর থর করে কাঁপছি। সুইচের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কোন এক উল্লুক অফিসার যেমন ভুল করে বিপজ্জনক সংযোগ ঘটিয়েছে, ঠিক তেমনি আরেক উল্লুক ভুল করে প্রাইমাকর্ড রেল লাইনের ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে। ফলে প্রাইমাকর্ড গাড়ির চাকার নিচে পড়ে কেটে যাওয়ায় বিস্ফোরণ ঘটতে পারেনি। টানেল থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে যা-তা বলে গালাগালি দিলাম। পরে হেডকোয়ার্টারে এসে রিপোর্ট করে বলেছিলাম, দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সত্যিকারের এক্সপ্লোসিভের জায়গায় মাটি দিয়ে এক্সপ্লোসিভ বানিয়ে পরবর্তী ট্রেনিং-এ ব্যবহার করতে হবে।
এরপর শুরু হলো ১৮ দিনের চূড়ান্ত মহড়া। মহড়ায় অংশ নিল মোট ষোলোজন ট্রেইনী কমাণ্ডো-ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল, ক্যাপ্টেন আফজাল, ক্যাপ্টেন ডা. আজম, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ, ক্যাপ্টেন মালেক, ক্যাপ্টেন আফজাল জানজুয়া, ক্যাপ্টেন মো. নূর, ক্যাপ্টেন জায়েদী, ক্যাপ্টেন চিমা, ক্যাপ্টেন জামসেদ, ক্যাপ্টেন মঞ্জুরুল হক আওয়ান, ক্যাপ্টেন নাজির, ফ্লাইং অফিসার ততাফায়েল বাজোয়া, ফ্লাইং অফিসার আশরাফ খান ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার।
ম্যাপে এই মহড়ার দূরত্ব নির্ধারণ করে দেয়া হলো। লাহোরের মাইল দশেক দূর থেকে চেরাটু পর্যন্ত তিনশো ষাট মাইল। সময় দেয়া হলো আঠারো দিন। এই সময়ের মধ্যে দূরত্ব অতিক্রম করে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। পথে ট্রেইণ্ড কমান্ডোরা শত্রুপক্ষ হিসেবে কাজ করবে। ওদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কৌশলের মহড়া করতে করতে এগিয়ে যেতে হবে । ওদের সঙ্গে মাত্র একদিনের রেশন দেয়া হলো। কারণ দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হবে সারভাইভাল ট্রেনিং। সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বাকি সতেরো দিন বেঁচে থাকতে হবে ওদের।
রাতের অন্ধকার নামার পর পরই ওরা সবাই বেরিয়ে পড়ল। ভোরের দিকে লাহোর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ছাঙ্গাবাঙ্গা ফরেস্টে পৌঁছল সবাই। এখানে দিনের বেলায় ওদের লুকিয়ে থাকতে হবে। সকালবেলা কয়েকজন ইন্সট্রাকটর ওদের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আটক করলে সবাই সিদ্ধান্ত নিল, জঙ্গল থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস ও খাবার যতদূর পারা যায় সংগ্রহ করতে হবে। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হলো, ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলের ভেতর। ক্যাপ্টেন আজম ও ক্যাপ্টেন আফজাল গেল পাখি শিকারের উদ্দেশে। বাজোয়া ও আওয়ান সহ চারজন গেল বিভিন্ন লতাগুল্মের সন্ধানে। এরা চারজনই কৃষি বিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রী। ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল ও ক্যাপ্টেন মালেককে দূরবীনের পাওয়ার গ্লাস খুলে আগুন জ্বালানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। কয়েকজন জঙ্গলের মধ্যে ফলমূলের সন্ধানে বের হলো। আনোয়ার খালিহাতে গেল মাছ ধরবার জন্য ছাঙ্গাবাঙ্গার লেকে।
লেকের পাড়ে গিয়ে চিন্তা করতে লাগল সে। খালিহাতে কিভাবে মাছ ধরা যায়। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে বেশ শক্ত একটা শুকনো লতা ছিঁড়ে নিয়ে এল আনোয়ার। লতা দিয়ে তৈরি হলো ছিপের সুতো। সঙ্গের সেফটি পিন হলো বড়শী। ফাতনা হিসেবে একটা সরু শুকনো গাছের ডাল ব্যবহার করল ও। ড্যাগার দিয়ে লেকের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল কেঁচো। কেঁচো দিয়ে বানানো হলো মাছের টোপ। তারপর বড়শী পানিতে ফেলে ও চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল, শিকারের আশায়। অনেকক্ষণ কেটে গেল; কিন্তু মাছের আঁশও মিলল না। শেষে বিরক্ত হয়ে লতাটার মাঝখানে গোল করে একটি লুপ বানিয়ে তার ভিতরে হাত ভরে লেকের পাড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতে টান পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল। আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল-মনে হয় সাত-আট সের ওজনের একটা মাছ আটকেছে বড়শীতে। আস্তে আস্তে লতা টানতে শুরু করল ও। কিছুক্ষণ টানার পর শিকারের মাথা পানির ওপর ভেসে উঠল। মাছ নয়–একটা বিরাট আকারের কাছিম। পেটে প্রচণ্ড খিদে। শিকার দেখে মোটেও নিরাশ হলো না সে। কাছিমের মাংস বেশ নরম ও সুস্বাদু। একবেলা পেটপুরে ভালোমত খাওয়া যাবে।
লতা ধরে ধীরে ধীরে টানছে আনোয়ার। কাছে যেয়ে শিকারের গলা চেপে ধরবে–কিন্তু সেয়ানা কাছিম। বিপদের গুরুত্ব টের পেয়ে হাঁচকা টান দিল। সোজা হয়ে গেল পিন। পালিয়ে গেল শিকার। নিরাশ হয়ে ফিরে এল আনোয়ার। এসে দেখল ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল ও মালেক পাওয়ার গ্লাসের সাহায্যে বহু কষ্টে আগুন জ্বালিয়েছে। উনুনের ওপর খালি পানি সেদ্ধ হচ্ছে। আগুন জিইয়ে রাখার জন্য আনোয়ার শুকনো ঘাস ও লতা দিয়ে লম্বা একটা দড়ি বানাল। আগুন ধরিয়ে একটা গাছের সঙ্গে টাঙিয়ে রাখল দড়িটা।
বেলা প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে উদ্ভিদ সংগ্রহকারী দল ফিরে এল। এরা নিয়ে এল প্রচুর পরিমাণে একজাতীয় গুল্ম লতা। লতাগুলো তেতো। দ্বিতীয়বার সেদ্ধ করার পর পানিতে লবণ (ওদের শুধুমাত্র লবণ ও পানিতে মেশানো ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে) দিয়ে সুপ তৈরি করল। লবণ মিশ্রিত লতাগুল্মের সুপ সবাই খেলো পেট পুরে। ফেরৎ এল আরেক দল। এরা নিয়ে এল অচেনা গাছের সুগন্ধি পাতা ও ছাল । এগুলো দিয়ে তৈরি হলো হালকা পানীয়। এটা সবুজ চায়ের সুন্দর বিকল্প। শুধু চিনির অভাব ওদের নিরাশ করল। কিন্তু ছাল সংগ্রহকারীর একজন আশ্বাস দিল জঙ্গলের মধ্যে একটা বড় মৌচাক রয়েছে। মৌচাক ভেঙে সে নিজেই মধু সংগ্রহ করে আনবে।
মৌচাক সংগ্রহকারী অফিসারের সঙ্গে দুজন গেল গ্রাউণ্ড-শীট নিয়ে চাক সংগ্রহ করে আনার জন্য। প্রায় ঘন্টাখানেক পর গ্রাউণ্ড শীটে করে বয়ে আনা হলো একটা বিরাট মৌচাক। সেইসঙ্গে মৌচাক ভাঙায় দক্ষ অফিসারকেও বয়ে আনতে হলো। গ্রাউণ্ড-শীট ও ডাল দিয়ে বানানো স্ট্রেচারের ওপর শায়িত আহত অফিসার। মৌমাছির দংশনে অফিসারের সমস্ত শরীর ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে। মৌমাছির হুলে আক্রান্ত অফিসারকে দেখে মানুষ বলে চেনার জো নেই। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ওরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, পৃথিবীর যে কোন কঠিনতম হামলায় ওরা প্রস্তুত। কিন্তু মৌচাক হামলায় নয়। আহত অফিসারকে ইন্ট্রাকটরদের জীপ এসে লাহোের সি.এম.এইচ, এ নিয়ে গেল। সারভাইভাল ট্রেনিং-এ সবাই যেভাবেই হোক বেঁচে থাকবে। কিন্তু মৌমাছি দ্বারা আক্রান্ত ট্রেইনী অফিসার বাঁচবে কিনা, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। প্রত্যেকে দুটো করে পানির বোতল মধুতে ভরে নিল। ওরা আরও সংগ্রহ করল আগামী দশ-বারো দিন চলার উপযোগী গাছের ছাল ।
সন্ধ্যার একটু আগে ফেরৎ এল পাখি শিকারীর দল। ওরা নিয়ে এল চড়ুই পাখির মত ছোট ছোট ষোলোটা পাখি। প্রত্যেকের ভাগে একটা করে পাখি পড়ল। নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। পাখিগুলো আধপোড়া হওয়ার আগেই ওরা নিভিয়ে ফেলল আগুন। গুল্মের সুপ, সেদ্ধ ভেজিটেবল ও সবুজ চা খেয়েছে সবাই। খাদ্যগুলো প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা। আগুনে আধ ঝলসানো পাখিটাকে কাগজে মুড়ে পকেটে পুরল আনোয়ার। ওটা দিয়ে রাতের ডিনার হবে। সিগারেটখোরদের খুব অসুবিধা হচ্ছে। কেউ কেউ শুকনো পাতা বিড়ির মত পেঁচিয়ে টানছে। শুকনো পাতার বিড়ি টানার সঙ্গে সঙ্গে সবাই শুরু করল কাশতে। রাগের চোটে পাতার বিড়ি ফেলে দিল আনোয়ার।
ওরা এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের মাঝে লুকোচুরি খেলতে । খেলতে। ট্রেই কমান্ডোরা পিছু ধেয়ে আসছে। ট্রেইনী দল সতর্ক। সারভাইভাল ট্রেনিং-এ ওদের চুরি করার অনুমতি আছে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর পথে পড়ল একটা মুলার খেত। খেত কিছুটা খিদে মিটাল ওদের। মধ্যরাতে একটা অ্যামবুশ পয়েন্টে পৌঁছল ট্রেইনীরা। মিশন শেষে সবাই প্রাণপণে দিল ভো দৌড়।
মিশন সাকসেসফুল। শত্রুরা সজাগ হয়ে গেছে। ওরা দৌড়চ্ছে প্রাণপণে। ভোর হয়ে এল। লুকিয়ে থাকার মত জায়গা খোঁজা শুরু করল সবাই। চারদিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন জঙ্গল নেই, নেই কোন পাহাড়। নিরাপদে লুকিয়ে থাকার মত তেমন কোন সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল না। এলাকাটা বসতিপূর্ণ, সমতল। এধরনের জায়গা ট্রেইনীদের জন্য বিপজ্জনক। যে-কোন মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা।
ফক্স-হোল বা শিয়ালের গর্ত এখন লুকানোর একমাত্র উপায়। সবাই সিদ্ধান্ত নিল ফক্স-হোল বানানোর। একটা কাঁটা ঝোপে । আচ্ছাদিত জায়গায় আটটি ফক্স-হোল তৈরি করল ওরা। গর্তগুলোর মাটি বহুদূরে লুকিয়ে রাখা হলো; যাতে কারও দৃষ্টিগোচর না হয়। প্রতিটি গর্তের মুখ বন্ধ করার জন্য মাপ মত একটা করে মাটির চাপড়া কাটা হলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য গর্তগুলোর ওপরে ছোট ছোট ছিদ্র রাখা হলো। গর্তে ঢোকার আগে প্রাতঃকৃত্য সেরে, সঙ্গে ক্যানভাসের ছাগল ভরে পানি নিয়ে গর্তে ঢুকল সবাই। প্রতিটি গর্তের মুখে মাটির চাপড়া দিয়ে বন্ধ করে ওরা দুজন করে আশ্রয় নিল এক একটি গর্তে। শীতের দিন বলে ফক্স-হোলগুলো আরামদায়ক। ভিতরটা বেশ গরম। সারাটা দিন ওদের শুয়ে বসে কেটে গেল। আহারস্বরূপ জুটল রাতে খেত থেকে চুরি করা মুলা। পেটে প্রচণ্ড খিদে ঢুঁ মারছে।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ফক্স-হোল থেকে বের হয়ে এল ওরা। আবার শুরু হলো অন্ধকারে পথ চলা। কিছুক্ষণ চলার পর সামনে পড়ল একটা পল্লী। পল্লীবাসীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকটা অবস্থাপন্ন কৃষকের বাড়ি খুঁজে ওরা চুরির মিশন চালাল। সৌভাগ্যক্রমে কৃষকদের রান্নাঘর থেকে রুটি ও রান্না করা তরকারি পাওয়া গেল। চুরি করা মুলার সালাদ, রুটি ও তরকারিসহযোগে ওরা রাতের আহার সারল।
আহার শেষে আবার শুরু হলো পথ চলা। অন্ধকার ওদের কাছে অনেকটা স্বস্তির কারণ-শত্রুরা সহজে খুঁজে পাবে না। চলতে চলতে ওরা বুঝতে পারল, সামনে ঘন গাছপালা। মনে হচ্ছে বড়-সড় একটা বাগান। জায়গাটা সমতল এবং নিচু। বাগানে প্রবেশ করার পর প্রত্যেকের মাথাই শক্ত গোলাকৃতি জিনিসের সঙ্গে ঠুকে যেতে লাগল। হাত দিয়ে ধরে বুঝল ওরা, গোল গোল ফলগাছ থেকে ঝুলছে। ছিঁড়ে মুখে দিয়ে স্বাদ নিতেই বোঝা গেল নাশপাতি। প্রত্যেকের প্যাক পকেট ইত্যাদি আর খালি রইল না। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ওরা আবার লুকিয়ে পড়ল, জনবসতি থেকে অনতিদূরে একটি ঝোঁপের ভিতর ।
সবাই ঝোঁপের ভিতর নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। ঝোঁপের আশপাশ দিয়ে লোক চলাচল করছে। সারাদিন সামান্য পরিমাণে বেঁচে যাওয়া রুটি ও নাশপাতি খেয়ে কেটে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসতেই ওরা বেরিয়ে এল ঝোঁপের ভেতর থেকে। আবার শুরু হলো যাত্রা। প্রতি রাতে ওরা একটা করে অপারেশন চালাচ্ছে। সেইসঙ্গে কিছু না কিছু খাদ্য সামগ্রীও চুরি করছে। দিনের বেলায় ফক্স-হোলে লুকিয়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে, এইভাবে এগিয়ে চলেছে ওরা।
একদিন ফক্স-হোলে বিপর্যয় ঘটল। তখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি। গর্তে ঢোকার আগে সবাই কাছাকাছি একটা নালা থেকে ছাগাল ভরে পানি নিল। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ওদেরকে ট্যাবলেট সরবরাহ করা হত। প্রথম দিকে ওরা পানিতে ট্যাবলেট মেশালেও শেষের দিকে আর মেশাত না। রাতের অন্ধকারের জন্য কেউ বুঝতে পারেনি। পানির স্বাদ স্বাভাবিক হলেও তা ছিল ভীষণ নোংরা ও কালো রঙের। তার ওপর ট্যাবলেট মেশানো হয়নি। বেলা ১২টা থেকে শুরু হলো বিপত্তি। নোংরা পানির ক্রিয়ায় প্রত্যেকের পেটে গোলমাল দেখা দিল। শেষে আনোয়ার বাধ্য হয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে দেখতে পেল, ওর মত অন্যান্য অফিসারও এদিক ওদিক ছুটছে। প্রত্যেকের পাতলা পায়খানা দেখা দিয়েছে। চূড়ান্ত এক্সারসাইজে এধরনের অঘটনের জন্য ইন্ট্রাকটররা ভীষণ বকাবকি করলেন। শেষে সাবধান করে দিলেন, বনজঙ্গল এলাকায় কেউ যেন পানিতে বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মেশাতে না ভুলে।
চূড়ান্ত এক্সারসাইজ বলে শত্রুর দল ভীষণ সতর্ক। শত্রুরা প্রায়ই অতর্কিতে হামলা করছে। এরাও প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে। কোনমতেই শক্রর হাতে ধরা দিচ্ছে না। শত্রুর তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে ওদের খাদ্য সংগ্রহের অভিযান স্তিমিত হয়ে গেল। ফলে মাঝেমধ্যে সবাইকে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। কখনও ফক্স-হোলে, কখনও গভীর জঙ্গলে আবার কখনও বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিচ্ছে ওরা। একে অভুক্ত অবস্থা তার ওপর প্রচণ্ড উত্তেজনা ও দৈহিক পরিশ্রম-প্রত্যেকের শরীর ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, এ চলার যেন কোন শেষ নেই; দিন বুঝি আর ফুরাবে না। এইভাবে সারভাইভাল ট্রেনিংয়ের দশটা দিন পার হয়ে গেল। এখনও আটদিন বাকি।
এগারো দিনের মাথায় কমাণ্ডোদের জন্য একটি ছোট প্লেন গোপনীয় জায়গায় রেশন ড্রপ করল। কিন্তু শক্ররা অতর্কিতে হামলা করে সমস্ত রেশন নষ্ট করে দিল। ছয়-সাত দিন হলো সবাই প্রায় অভুক্ত। কখনও রাতের আঁধারে পায়ের নিচে সরদা (এক প্রকারের তরমুজ) ও মুলার খেত পড়েছে। এই কয়দিন খেত থেকে চুরি করা মুলা ও সরদা আহার হিসেবে জুটেছে। ক্ষুধার তাড়নায় ওরা প্রায় অস্থির। শত্রুর হামলায় সমস্ত রেশন নষ্ট হয়ে গেল। আবার প্লেন থেকে তিন-চার দিন পর রেশন ড্রপ করা হতে পারে। সে রেশনও শত্রুর হামলা থেকে রক্ষা পাবে কিনা জানা নেই। অসহ্য ক্ষুধা ও মানসিক উত্তেজনা ওদেরকে রীতিমত হিংস্র করে তুলল।
প্রত্যেকের শরীর থেকে চর্বি উধাও হয়েছে। নিতম্বের হাড় চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ভরে গেছে সকার গাল। চোয়ালের হাড়গুলোও রীতিমত উঁচু উঁচু হয়ে আছে। মাথায় এলোমেলো রুক্ষ চুল। প্রত্যেকের শীতল দৃষ্টি কেমন যেন হিংস্রতা মাখানো। তবুও ওরা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলেছে বহুদূরে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে।
পাঞ্জাবের গাছপালা ভর্তি সমতলভূমি অতিক্রম করল ওরা। শুরু হলো পাথুরে মরুভূমি এলাকা। চারদিকে ধু-ধু বালি, পাথর ও ছড়ানো ছিটানো কাটা গাছ। লুকিয়ে থাকার তেমন কোন জায়গা নেই। পানীয় জলের তীব্র অভাব। ওরা একটু থমকে দাঁড়াল। কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিষ্প্রাণ মরুভূমির দিকে। একে প্রচণ্ড পরিশ্রম, তার ওপর ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে উপবাস। সম্মুখে বিস্তীর্ণ মরুভূমি, যেখানে খাদ্যের বিন্দুমাত্র আশা নেই। নিষ্ঠুর দৃষ্টি মেলে ওদের দিকে চেয়ে আছে মরুভূমি–যেন সবাইকে গ্রাস করে নেবে। ওদের সমস্ত অনুভূতি যেন অবলুপ্ত হতে চলেছে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত এগোচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সতর্ক–সাপ, ব্যাঙ বা অন্য যে-কোন ধরনের প্রাণী যেন নজর এড়িয়ে না যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন প্রাণীই ওদের নজরে পড়ল না। পড়লে হয়তো সাপ, ব্যাঙের মাংস দিয়ে কিছুটা ক্ষুধা নিবৃত্তি হত ওদের।
এক এক করে চোদ্দদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। সারাদিন ওরা কাঁটা ঝোঁপ অথবা কোন পাথরের গুহায় লুকিয়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে। পানীয় জলের অভাব ওদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলল। কাঁটা গাছের রসাল শিকড় চিবিয়ে পানীয় জলের অভাব কিছুটা দূর করছে ওরা। একদিন ওরা একটা পাথুরে গুহায় নির্জীবের মত লুকিয়ে আছে। হঠাৎ গুহার বাইরে ছাগলের ভা ভঁা, আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ শোনামাত্র কয়েকজন লাফিয়ে উঠল। এইসব মরু এলাকায় পাহাড়ী অধিবাসীরা মাঝে মাঝে গরু ছাগল চরাতে আসে। এরা দুর্দান্ত সাহসী ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির । পাহাড়ের গায়ে কিছু কিছু গুল্ম লতা ও শ্যাওলা জাতীয় ঘাস জন্মে। এইগুলো ছাগলের প্রিয় খাদ্য। এধরনের কোন পাহাড়ী মনিবের একপাল ছাগল চরতে চরতে ক্ষুধার্ত কমাণ্ডোদের গুহার সম্মুখে হাজির হয়েছে। হেল কমাখো
ওরা কয়েকজন মিলে দ্রুত একটা সাদা রঙের বড় ছাগল কম্বলে পেঁচিয়ে গুহার মধ্যে নিয়ে এল। ছাগল সবার মাঝে কিছুটা যেন স্বস্তি এনে দিল। ঝলসানো ছাগলের মাংস অন্তত একবেলা পেট পুরে খাওয়া যাবে। কয়েকজন ছুটল জ্বালানি কাঠের সন্ধানে। একজন প্যাক থেকে জুতোর কালি বের করল। ব্রাশ দিয়ে সাদা ছাগলের রং কালো করে ফেলা হলো, যাতে মালিক চামড়া দেখলেও বুঝতে না পারে যে এটা তার ছাগল। সবাই জ্বালানি কাঠের জন্য অপেক্ষা করছে। এই সময় গুহামুখে পশতুতে অকথ্য গালিগালাজ শোনা গেল। একজন বন্দুকধারী পাঠান তার হারানো ছাগল খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে পাঠানটা গুহামুখে এসে দাঁড়াল। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, গুহাতে ওরা কারা। পরনে সেনাবাহিনীর পোশাক অথচ নোংরা, গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ।. চোখ-মুখ বসে গিয়েছে। সবাই নির্জীব, সঙ্গে প্রত্যেকের মেশিনগান ও সাব-মেশিনগান।
বন্দুকধারী পাঠান কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রুক্ষ কণ্ঠে বলল, আমি গুহার ভেতরটা দেখতে চাই। কমাণ্ডোদের একজন জিজ্ঞেস করল, কেন দেখতে চাও? আমার একটা সাদা রঙের ছাগল হারিয়ে গেছে–পাঠান পূর্বের কণ্ঠেই জবাব দিল। তৎক্ষণাৎ কমাােদের একজন বলে উঠল, আমাদের সঙ্গে একটা কালো রঙের ছাগল আছে। এটা আমরা বহুদূর থেকে নিয়ে এসেছি। এখানে কোন সাদা ছাগল নেই। তবুও আমি দেখব বলে বন্দুক বাগিয়ে পাঠান ঢুকল গুহার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে প্রভুভক্ত ছাগল মনিবকে দেখে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে উঠল। ব্যস, গোমর ফাঁক। ছাগল বেহাত।
ছাগল হাতছাড়া হওয়াতে ওদের চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। চূড়ান্ত এক্সারসাইজ বলে ওরা এ-ধরনের অবস্থা চুপচাপ মেনে নিল। নইলে পাঠানের রক্তপান করতেও ওরা দ্বিধাবোধ করত না। কিছুক্ষণ পর জ্বালানি সংগ্রহকারী দল জ্বালানি নিয়ে ফিরে এল। শিকার হাত ছাড়া হওয়ার কথা শুনে মিনিটখানেক নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল ওরা। শেষে ইটস অল রাইট বলে পয়েন্ট টু টু রাইফেল নিয়ে কয়েকজন বের হলো পুনরায় শিকারের উদ্দেশে।
প্রায় আধ ঘণ্টা পর শিকারী দল ফেরৎ এল। সঙ্গে নিয়ে এল রাইফেলের গুলিতে আহত করে জবাই করা নাদুসনুদুস একটা কুত্তা। সবাই জবাই করা কুত্তার চামড়া ছাড়াচ্ছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। কিন্তু প্রত্যেকের চেহারা দ্বিধাহীন। পেটে খিদের প্রচণ্ড দাবানল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চামড়া ছাড়ানো শেষ হলো। কুত্তার মাংস চর্বিযুক্ত। মাংসগুলো খণ্ড খণ্ড করে আগুনে ঝলসে রোস্ট তৈরি করল ওরা। সন্ধ্যাবেলা রান্না শেষে খেতে বসল সবাই। কুত্তার মাংসের রোস্ট, সেইসঙ্গে চা। বেশ কদিন পর সবাই একটু সুস্থবোধ করল। কুত্তার মাংস ভক্ষণ–এটা ওদের কাছে এমন কোন ব্যাপারই নয়। প্রয়োজনে ওরা যে-কোন প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করতে পারে।
এখন পেটে প্রচণ্ড খিদে আর নেই। শরীর আগের চেয়ে অনেক ঝরঝরে। বহুদিন পর একটি রাত ওদের পার হলো আরামে। পরদিন বিকেলে প্লেন থেকে ড্রপ জোনে কিছু রেশন ড্রপ করা হলো। সৌভাগ্যক্রমে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে রেশন সংগ্রহ করল ওরা। রেশন পেয়ে সবাই চাঙা হয়ে উঠল আবার। চলার গতিও বেড়ে গেল ওদের। চেরাট আর বেশি দূরে নয়। সময়ও, প্রায় শেষ, সতেরো দিন পার হয়ে গেল। সবাই দ্রুত এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে। আঠারোতম দিনে ওরা সবাই পৌঁছে গেল চেরাটে। পৌঁছে হিসেব করে দেখা গেল, তিনশো ষাট মাইলের জায়গায় শত্রুর তাড়া খেয়ে প্রায় চারশো মাইল অতিক্রম করতে হয়েছে ওদের। এভাবে শেষ হলো ফাইনাল এক্সারসাইজ।
.
১০.
রাওয়ালপিণ্ডির অভিজাত চাইনিজ রেস্তোরাঁ ডিম-সাম। সন্ধ্যার পর এখানে শহরের অন্যতম ধনীরা আসর জমায়। জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতীরাও আসে। সবাই দুহাতে প্রচুর পয়সা উড়িয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে যায়। রেস্তোরাঁটার ওপর যুবকদের দুর্বলতাই বেশি। মালিক এক বোম্বাইয়া মহিলা। তার সুন্দরী দুই কন্যা এটার দেখাশোনা করে। সন্ধ্যার পর অনেক সুবেশি তরুণদের আগমন ঘটে এখানে। সুন্দরী দুজন সবাইকে মিষ্টি হেসে স্বাগত জানায়।
ফাইনাল এক্সারসাইজ শেষ হওয়ার পর দুদিন ছুটি পেল আনোয়ার। ছুটি কাটানোর জন্য সে বেরিয়ে পড়ল পিণ্ডির উদ্দেশে। পরনে ঢোলা ট্রাউজার, পায়ে স্পোর্টস ভেস্ট ও তার ওপর ফিল্ড জ্যাকেট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ওর চেহারা এখনও রীতিমত এলোমেলো, রুক্ষ, অনেকটা আমেরিকান কাউবয়দের মত। পিণ্ডি পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিল আগে ডিম-সামে উদরপূর্তি করতে হবে। ওর শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু এখনও ক্ষুধাপীড়িত।
রেস্তোরাঁর ভারী কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল আনোয়ার। কাউন্টারে বোম্বাইয়া মহিলা ও তার সুন্দরী কন্যাদ্বয়। তিনজনই ওর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। তারপর মুখ নামিয়ে ফিসফিস শুরু করল। আনোয়ার বুঝতে পারল, অভিজাত রেস্তোরাঁয় ওর চেহারা এখন বেমানান। কিন্তু কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ও সোজা ভিতরে গিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে পড়ল। উর্দিপরা ওয়েটার এসে মেন্যু এগিয়ে দিলে খাবারের অর্ডার দিয়ে বলল, অ্যাণ্ড নাউ টু কোক্স প্লীজ। পুরো রেস্তোরাঁ এয়ারকণ্ডিশণ্ড। আনোয়ার গায়ের, জ্যাকেট খুলে রাখল চেয়ারের পিঠে। দ্রুত দুবোতল কোক শেষ হলো, তবুও তৃষ্ণা যেন মেটে না।
ইতোমধ্যে অন্যান্য টেবিলগুলো লোকজনে ভর্তি হয়ে গেছে। হঠাৎ ওয়েটার এসে ওকে ফ্যামিলি রূমের মাঝে বড় একটা টেবিল দেখিয়ে বসতে অনুরোধ জানাল। এর কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। বাক্যব্যয় না করে আনোয়ার সোজা ওয়েটারের দেখিয়ে দেয়া টেবিলে গিয়ে বসল। এখন শুধু চাই খাবার। ফ্যামিলি রূমের প্রতি কেবিন তরুণ-তরুণীদের দখলে। বিরাট সাইজের একটা ওভালশেপড টেবিল দখল করে আনোয়ার বসে আছে–একা। সবাই ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। খাবার দিতে দেরি দেখে কারণ জিজ্ঞেস করতেই ওয়েটার সবিনয়ে জানাল, স্যার, আপনার অন্যান্য সাথীদের আগমনের অপেক্ষা করছি। অবাক হয়ে আনোয়ার বলল, আমি একসঙ্গে কোন সাথী নেই। জদি খাবার সার্ভ করো।
শুরু হলো খাবার পরিবেশন। ওয়েটার প্রথমে নিয়ে এল দুবাউল চিকেন কর্ন সুপ ও দুই প্লেট এগ ফ্রায়েড রাইস । তারপর পরিবেশিত হলো ডবল বীফ উইথ চিলিস, দুপ্লেট সুইট অ্যাণ্ড সাওয়ার প্রন, দুটো বীফ উইথ ভেজিটেবল, এক প্লেট নুড়ল, এক প্লেট চপ সুয়ে, সিঙ্গল ফ্রায়েড চিকেন। সেইসঙ্গে চারটে কোকাকোলা। আনোয়ার গিলছে গোগ্রাসে। ।
খাওয়ার মাঝে এক সুবেশি বাঙালী ভদ্রলোক উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মাফ করবেন। আপনি কি বাঙালী? ও হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে বলল, কেন, কোন সন্দেহ আছে কি?
না মানে, আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভদ্রলোক ওকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ফিরে গেল। খেতে খেতে হঠাৎ আনোয়ার বুঝতে পারল, কাঁচের জানালার ওপাশে কে যেন তাকিয়ে রয়েছে। দৃষ্টি ফেলতেই দেখল রেস্তোরাঁর মালিক স্বয়ং চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে। আশপাশেও চেয়ে দেখল, অনেকেরই ত্যারছা দৃষ্টি ওর দিকে। এতক্ষণে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো। এই বিশাল খাবারের বহরই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের কারণ।
এবার কাঁচের জানালার ওপাশে মালিকের পরিবর্তে তার সুন্দরী কন্যাদ্বয়কে দেখা গেল। ওরা আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আনোয়ারও জবাবে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিল এক টুকরো মুচকি হাসি। অনেকদিন এধরনের উপাদেয় খাদ্য পেটে পড়েনি। খাওয়া শেষে তৃপ্তির সঙ্গে একটা সিগারেট ধরিয়ে কাউন্টারে এল সে। বিল পে করে ডিম-সাম হোটেল থেকে বেরিয়ে এল দৃঢ় পদক্ষেপে।
চেরাট ক্যান্টনমেন্ট। পিণ্ডিতে দুদিন ছুটি কাটিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসেছে আনোয়ার। ওর মনটা প্রফুল্লতায় ভরে আছে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে। ওকে জানানো হলো, পরদিন শুরু হবে ছত্রিশ মাইল দৌড়ের পরীক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায়, পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক, হাতে রাইফেল ও ব্যাটল ড্রেস। মেজর রউফ ওকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, দৌড়ে তোমাকে, প্রথম স্থান অধিকার করতেই হবে আনোয়ার। নইলে মেজর ভর্দগের থোতা মুখ ভোতা হবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আনোয়ার, ওকে।
সবাই প্রস্তুত। শুরু হলো দৌড়। উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথ। কমাণ্ডোদের ভারী বুটের চাপে ছোট ছোট পাথর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। : ওদের পদক্ষেপ একপ্রকার বেসুরো আওয়াজ তুলল। সকলের দৃষ্টি পথের ওপর। এখনও সম্মুখে অনেক পথ । ওরা দৌড়ে চলেছে। দশ মাইল পার হলো–আরও ছাব্বিশ মাইল। প্রত্যেকের জুলফি বেয়ে কুলকুল করে ঘাম গড়াচ্ছে। পুরো ইউনিফরম ঘামে ভেজা। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ওদের বুকের ছাতি দ্রুত ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ পর মুখে আর পোশাকের এখানে ওখানে লবণ জমতে শুরু করল। কিন্তু কোনদিকে কারও খেয়াল নেই। সর্বাগ্রে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। এখনও অনেকটা পথ।
বিশ মাইল পার হয়ে গেল–আরও ষোলো মাইল। প্রত্যেকের পায়ের পেশীগুলো প্রচণ্ড পরিশ্রমে স্ফীত। পিঠের চল্লিশ পাউণ্ড পঞ্চাশ পাউণ্ড হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একে একে রাইফেল, হাত বদল করা শুরু করল সবাই। প্রত্যেকের মুখমণ্ডল লবণে প্রায় সাদা। শরীর যেন আর চলে না। ক্লান্তি ও অবসাদ সবাইকে ঘিরে ধরেছে। পাহাড়ী উঁচু-নিচু পথ আরও দুর্গম হয়ে এল ওদের কাছে। তবুও সবাই ছুটে চলেছে। ছত্রিশ মাইলকে জয় করতেই হবে। অতিক্রান্ত হলো, ত্রিশ মাইল–আর মাত্র ছমাইল। মন্ত্রমুগ্ধের মত দৌড়চ্ছে আনোয়ার। আ-র-ও এক মাইল। তাহলেই শেষ হবে দৌড়। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল গন্তব্যস্থল। সবাই শরীরের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করছে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেবার জন্য। আনোয়ার দেখতে পেল দূরে মেজর রউফ দাঁড়িয়ে আছেন। ওকে হাত নেড়ে উৎসাহ দিচ্ছেন।
আনোয়ার সবার আগে। গন্তব্যস্থল প্রায় সন্নিকটে। বিপুল সংখ্যক দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। ওদের মাঝে দারুণ উত্তেজনাকে প্রথম হয়? সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখল, আনোয়ার সকলের আগে এগিয়ে আসছে। দর্শকদের কণ্ঠে ফুটে উঠল আনন্দ-সূচক ধ্বনি, আনোয়ার, আনোয়ার, আনোয়ার। মেজর রউফ আনন্দে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
পেশওয়ার। প্যারা ট্রেনিং স্কুল। চেরাট থেকে পুরো ফোর্সকে ট্রান্সফার করা হলো এখানে। ক্যান্টনমেন্ট-এর মল রোডের ওপর দ্বিতল অফিসার্স মেস, রোডের উল্টো দিকে পেশওয়ারের ডিভিশনাল কমিশনারের বাসভবন। অফিসার্স মেসের ওপরতলায় ট্রেইনী কমান্ডোদের থাকার ব্যবস্থা। নিচতলায় এন্ট্রিরূম, ডাইনিং হল, গেস্ট রূম এবং প্যারা স্কুলের অফিসার-ইন-চার্জ তারেক মাহমুদ (সেতারা-ই-জুরাত) এর কামরা। ইংরেজিতে তাঁর নামের আদ্যক্ষর টি.এম. হলেও স্পেশাল সার্ভিসে টি.এম. অর্থ টক্কর মার। তারেক মাহমুদ-এর টক্কর মার নামে খ্যাত হওয়ার পেছনে একটা ঘটনা আছে। দুর্ধর্ষ, অকুতোভয় ও প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী তিনি অথচ দারুণ হাসিখুশি।
চেরাটে একবার দলবল নিয়ে তিনি খাড়া পাহাড়ের আঁকা বাঁকা গা বেয়ে নিচে নামছিলেন। সবার আগে তারেক মাহমুদ। দলবল তাঁকে অনুসরণ করছে। পাহাড়ের ঢালে বালু জুমে শক্ত: পাথরের মত হয়ে আছে। কঠিন শিলার মত চাঁইগুলোর কোন কোনটার ওজন ৪/৫ মণেরও বেশি। মাহমুদ পাহাড়ের প্রায় পাদদেশে পৌঁছেছেন। ঠিক এই সময় পেছনে একজনের পায়ের চাপে মণ দুয়েক ওজনের একটা চাই পাহাড়ের গা থেকে খসে যায়, আর সেটা সোজা গিয়ে পড়ে সেতারা-ই-জুরাত-এর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে টক্কর মারের মুখ থেকেও বেরিয়ে আসে বাপ।
মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে ভেবে সবাই নিচে নেমে এল। তারেক মাহমুদ দুপা সামনের দিকে ছড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। তিনি ডানে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়তে পারছেন না। অথচ সামনের দিকে, তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছেন। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো সি.এম.এইচ.-এ। দেখা গেল তিনি ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন এবং মাথার চামড়া খানিকটা কেটে গেছে। তাছাড়া অন্য কোন ক্ষতি হয়নি। এরপর থেকে তিনি এস.এস.জি-তে টি.এম, অর্থাৎ টক্কর মার নামে খ্যাত হয়েছিলেন।
তারেক মাহমুদের অধীনে প্যারা স্কুলে শুরু হলো ট্রেনিং। স্কুলের প্রবেশ মুখে একটি ফলকগেট টেন, আদারওয়াইজ অর্থাৎ দশটা বুকডন দাও, নইলে…। এখানে প্রত্যেককে দশটা করে বুকডন দিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয়। এছাড়াও স্কুলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশ সম্বলিত ফলক। কোনটার গায়ে লেখা আছে বিশবার ওঠাবসা করো, নইলে… আবার কোনটার গায়ে লেখা আছে দৌড়াও, নইলে… সবাই প্রথমে মাইলখানেক দৌড়ে শরীর গরম করে নেয়। তারপর শুরু হয় প্যারা পিটি। পিটি শেষে ওদের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও থাকে না। অথচ তারেক মাহমুদ পিঠের ওপর ২০/২৫ সের ওজন নিয়ে অনায়াসে একশো বুকডন দিতেন।
এবার শুরু হলো অ্যাপারেটাস-এর সঙ্গে পরিচয়পর্ব ও অনুশীলন। পি.এল.এফ. বা প্যারা ল্যাণ্ডিং ফল-জায়গাটা দুফিট বাই চার ফিট বেদীর মত। প্যারাট্রুপার দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য আকাশ থেকে পড়ে কিছুটা গড়িয়ে যাওয়ার ট্রেনিং নেয় এখানে। শূন্য থেকে প্যারাট্রুপার সেকেণ্ডে আঠারো থেকে বাইশ ফিট গতিতে নিচের দিকে নামতে থাকে। প্যারাল্যাণ্ডিং-এর কৌশল জানা না থাকলে প্যারাট্রুপার যে-কোন সময় মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে।
এস.এল.এফ.টি-সুইং ল্যাণ্ডিং ফল ট্রেনিং। বাতাসের বেগ যদি বেশি থাকে, তখন প্যারাট্রুপার দোল খেতে খেতে কিভাবে ল্যাণ্ড করবে তার জন্য এ-ট্রেনিং।
টাওয়ার-উচ্চতা ৩৭ ফিট। টাওয়ারের ওপর থেকে হার্নেস বেঁধে লাফ দিয়ে স্টীলের কেবল-এর ওপর দিয়ে গড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে হয়। এয়ারক্রাফট-এর দরজা থেকে জাম্প দেয়ার পর শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখা, সময় গণনা করা, শূন্যে প্যারাশুট খুলে যাওয়ার পর ওপরে তাকিয়ে সেটা পরীক্ষা করা এবং ডানে-বাঁয়ে অন্যান্য প্যারাট্রুপারের অবস্থান লক্ষ্য করার জন্য এই ট্রেনিং।
ড্রাগ–এটা একটা ভীতিকর: প্রশিক্ষণ। বাতাসের গতি তীব্র থাকাকালীন অবস্থায় যদি প্যারাট্রুপার ল্যাণ্ড করে তখন বাতাসের বেগ প্যারাশুটসহ প্যারাট্রুপারকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। সেই অবস্থায় প্যারাট্রুপার কিভাবে হার্নেস মুক্ত হয়ে নিজেকে রক্ষা করবে তার জন্য এই ট্রেনিং। হার্নেস মুক্ত করতে না পারলে তার মৃত্যু অনিবার্য। কয়েক বছর পূর্বে জনৈক বাঙালী হাবিলদার নুরুল ইসলাম এয়ারক্রাফট থেকে জাম্প করে। তখন নিচে তীব্র বাতাস বইছিল। নুরুল ইসলামের ড্রাগ অনুশীলন আয়ত্তে ছিল না। প্যারাশুটসহ বাতাসের বেগ তাকে প্রায় মাইল তিনেক টেনে নিয়ে যায়। পরিণতি করুণ মৃত্যু।
রিগিং-প্যারাশুট ভাঁজ করার কৌশল। রিগিং শেডে সর্বদাই লেখা থাকে: রিমেম্বার, দ্য লাইফ অভ এ ম্যান ডিপেণ্ডস অন ইচ প্যারাশুট ইউ প্যাক। অর্থাৎ মনে রেখো তোমার ভাঁজ করা প্যারাশুটের ওপর একটা মানুষের জীবন নির্ভরশীল।
সাসপেনডেড হার্নেস। এখানে শেখানো হলো, প্যারাশুট খুলে যাওয়ার পর শূন্যে কি কি করতে হবে, প্যারাশুট ডানে বামে বা সামনে পেছনে নিতে হলে হার্নেসের চারটা মেইন স্ট্রাপ কিভাবে ব্যবহার করতে হবে; কোন গাছ ইলেকট্রিক পোল বা কোন মারাত্মক অবস্থানে যদি প্যারাশুট ল্যাণ্ড করতে যায়; তখন কিভাবে ইমারজেন্সি ল্যাণ্ডিং করতে হবে; নদী অথবা সাগরে ল্যাণ্ড করার আগে শূন্যে কিভাবে সমস্ত স্ট্র্যাপ, স্টীল হেলমেট প্যাক অস্ত্র ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বগলের নিচে চেপে রাখা স্ট্রাপ ছেড়ে দিয়ে পানিতে ঝুপ করে পড়তে হবে ইত্যাদি।
সাসপেনডেড হার্নেসের এতগুলো বিষয় একসঙ্গে শেখার জন্য ওদেরকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হার্নেসের ভিতর ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে হয়। হার্নেসের দুটো স্ট্র্যাপ পেছন দিক থেকে এসে সামনে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে তলপেটটাকে এত জোরে চেপে রাখে যে জায়গাটা প্রায় অবশ হয়ে যায়। তাই ওরা এটার নাম দিয়েছিল ফ্যামিলি প্ল্যানার।
টাওয়ার জাম্প শুরু হলো। এয়ারক্রাফট থেকে প্যারাশুটসহ জাম্প করার পূর্ব-যোগ্যতা হিসেবে প্রত্যেককে ছয়টা করে সন্তোষজনক টাওয়ার জাম্প দিতে হয়। ছয়টা স্যাটিসফ্যাক্টরি জাম্প দিতে প্রত্যেককে অন্তত ৩০/৪০ বার চেষ্টা করতে হয়। যদি কেউ ৫০/৬০ বার জাম্প দিয়ে একটা জাম্পও স্যাটিসফ্যাক্টরি দেখাতে না পারে তখন তাকে এয়ারবোর্ন কোর্স থেকে বাদ দেয়া হয়। জাম্প শুরু হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আনোয়ারকে যেতে হলো খারিয়াঁ ক্যান্টনমেন্টে। ওকে ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশনের জন্য পরীক্ষা দিতে হবে।
পরীক্ষা শেষে প্যারা স্কুলে ফিরে এলে টি.এম. তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কটমট করে বললেন, দুদিন খুব ফাঁকি দিয়েছ। আজ তোমাকে টাওয়ার থেকে এমন লাফ দেয়া যে, হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না। টি.এম.-এর নির্দেশ মত আনোয়ার সোজা গিয়ে টাওয়ারে চড়ল। হার্নেস পরে রেডি হলো জাম্পের জন্য। নিচ থেকে স্পীকারে নির্দেশ এল গো।
লাফ দিল আনোয়ার। ও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। টাওয়ারের সামনে টাঙানো কেব্ল বেয়ে। হঠাৎ নিচ থেকে টি, এম-এর গলা ভেসে এল ওয়াণ্ডারফুল! ওয়েলডান! ফাস্ট জাম্প, স্যাটিসফ্যাক্টরি। কথাটা শুনে শিউরে উঠল ও। তবে কি টাওয়ার জাম্পে কোন রেকর্ড সৃষ্টি হলো? কারণ আমেরিকানরা এই প্যারা স্কুল তৈরি করার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রথম জাম্প সন্তোষজনক হওয়ার মত কোন ঘটনার রেকর্ড নেই। জাম্প শেষে হার্নেস থেকে বেরিয়ে টি.এম. এর কাছে ফিরে এল আনোয়ার। হঠাৎ তিনি হুকুম দিলেন গেট ফিফটি। আনোয়ার অবাক! বলে কি? কোথায় ও রেকর্ড সৃষ্টি করার চিন্তা করছে আর সেখানে কিনা পঞ্চাশটা বুকডন? দ্রুত মন থেকে দূর হয়ে গেল স্বপ্নিল চিন্তাটা। ৫০টা বুকডন দেয়া শেষ হতেই টি. এম. ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
স্পীকারে ঘোষণা করলেন, আনোয়ার প্রথম জাম্প। স্যাটিসফ্যাক্টরি করে টাওয়ার জাম্পে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পরের জাম্পও স্যাটিসফ্যাক্টরি হলো। টি.এম. পুনরায় স্পীকারে ঘোষণা করলেন, আনোয়ারকে আর জাম্প দিতে হবে না। টাওয়ার জাম্পে ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়াও প্রথম জাম্প স্যাটিসফ্যাক্টরি করে আনোয়ারের সঙ্গী হলো। অনেকে টাওয়ার জাম্পে ভাল ফল দেখাতে না পেরে কোর্স থেকে বাদ পড়ল।
শুরু হলো ভীতিকর ড্রাগ ট্রেনিং। জীপের পেছনে দশ-বারো ফুট লম্বা দুটো স্ট্র্যাপ লাগানো। স্ট্র্যাপের মাথায় সংযুক্ত দুটো হার্নেস। আনোয়ারের পিঠে রবারের প্যাড। হার্নেস পরে দুপা ভঁজ করে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ও। মাথায় স্টীল হেলমেট। জীপ ঘণ্টায় বিশ-পঁচিশ মাইল বেগে এগিয়ে চলেছে মসৃণ পাথরের রাস্তা ধরে। আনোয়ার ব্যাক সমার সল্ট করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জীপের পেছনে কয়েক ধাপ দৌড়াতে পারলেই ড্রাগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। ও ব্যাক সমার সল্ট করে। ঠিকই উঠে দাঁড়াল, কিন্তু পরক্ষণে জীপের প্রচণ্ড ঝটকায় পাথুরে মাটিতে আছড়ে পড়ল। ডান হাতের কনুই প্রচণ্ড বেগে বাড়ি খেলো উঁচু হয়ে বেরিয়ে থাকা একটা পাথরের সঙ্গে-ব্যথায় হাতটা অবশ হয়ে গেল।
মাথাটা বোঁ করে উঠল–স্টীল হেলমেট থাকায় এযাত্রায় কিছুটা রক্ষা। উঁচু নিচু পাথুরে রাস্তা। জীপের গতির সঙ্গে মাথাটা ঝাঁকি খাচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে চেপে রেখেছে সে। মনে হচ্ছে দেহ থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে। শরীরের কোন অংশই অক্ষত রইল না। রাস্তার ঘষায় হাত ও পায়ের মাংস চিরে গেল, গড়িয়ে পড়া শুরু হলো রক্ত। আনোয়ার অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল, স্প, স্প। কিন্তু কে শোনে কার কথা? টি.এম. নিজে জীপের স্টিয়ারিং ধরে আছেন। সুতরাং নির্ধারিত কোয়ার্টার মাইল জীপের পেছনে হেঁচড়ে যেতেই হলো।
নির্ধারিত দূরত্বে পৌঁছানোর পর আনোয়ারকে হার্নেস মুক্ত করে দেয়া হলো। কোনমতে টলতে টলতে একটা গাছের নিচে বসে পড়ল ধপাস করে। শরীরের দিকে তাকানো যায় না। প্রতিটি জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে, এখানে-ওখানে থেঁতলে গেছে। ঘাড় স্বাভাবিক ভাবে নড়ানো যাচ্ছে না। প্রচণ্ড ব্যথা। তবুও মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। কারণ প্যারাশুট জাম্পের চারদিন বাকি। আছে। এর মধ্যে শরীরকে জাম্পের উপযোগী করে নিতে হবে।
.
পেশওয়ার বিমান বন্দর। বিরাট আকারের একটা সি-১৩০ কার্গো দাঁড়িয়ে আছে। কার্গোর পেছনের দিকে প্ল্যাটফরম উন্মুক্ত অবস্থায় মাটির সঙ্গে ঠেকানো। অনতিদূরে প্যাক করা প্যারাশুটের বিরাট একটা স্থূপ। নির্দিষ্ট দিনে আনোয়ারসহ ১৪৮ জন অফিসার হাজির হলো পেশওয়ার বিমান বন্দরে। ওদেরকে প্যারাশুট জাম্প করতে হবে। ওদের সঙ্গে জাম্পে অংশ নিল অ্যাডভেঞ্চার কোর্স এবং অ্যানুয়্যাল জাম্প রিয়ালের জন্য এস.এস.জি-র একটা ট্রেইণ্ড কমাণ্ডো দল।
।সবাই প্যারাশুটের হার্নেস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। হার্নেস শক্ত করে বাঁধার জন্য ওদের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বাঁকা হয়ে আসতে চাইছে। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। কার্গো চারটা ট্রিপ দেবে। প্রতি ট্রিপে ৭২ জন। ড্রপজোন পনেরো মিনিটের পথ। প্রতি ট্রিপে সময় লাগবে প্রায় আধ ঘণ্টা। আনোয়ার দ্বিতীয় ব্যাচে। ব্রিফিংয়ের পর প্লেন উড়ল আকাশে। ট্রেইও কমান্ডোরা প্রথমে জাম্প করবে। প্রথম ট্রিপের পর ফাঁকা কার্গো ফিরে এল। ইঞ্জিন চালু অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল প্লেন-বৃহৎ আকারের চারটি প্রপেলার প্রচণ্ড গতিতে ঘুরছে। আনোয়ার এগিয়ে চলল কার্গোর দিকে। সবাই চিৎকার করছে, এয়ারবোর্ন, এয়ারবোর্ন বলে। ওর মনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
সি-১৩০ কার্গো একটানা বে-ও-ও আওয়াজ করে ছুটে চলেছে ড্রপজোনের দিকে তেরোশো ফুট ওপর দিয়ে ঘণ্টায় দুশো মাইল বেগে। প্লেনের ফিউজিলাজের দিকে দাঁড়ানো জাম্প মাস্টার টিম.এম.-এর সশব্দ হাততালি শোনা গেল। সেই সঙ্গে টি.এম. গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেন, টেন মিনিটস। অর্থাৎ আর দশ মিনিট পরে শুরু হবে জাম্প। আবার শোনা গেল, সিক্স মিনিটস। প্লেনের দরজা খুলে টি. এম. বাইরে ভাল করে দেখে নিলেন। আবার চিৎকার করলেন, স্ট্যাণ্ড আপ। সবাই পেছনের দরজায় লাইন বন্দী হয়ে দাঁড়াল। আবার নির্দেশ এল, হুক আপ। প্যারাশুটের স্ট্যাটিক লাইনের হুকগুলো প্লেনের অ্যাংকর লাইনের সঙ্গে আটকে অধিকতর নিরাপত্তার জন্য সবাই পিন লাগিয়ে নিল। এরপর নির্দেশ এল–চেক আপ। স্ট্যাটিক লাইন চেক করে সকলে ওয়ান ওকে টু ওকে এবং অল ওকে বলে ওকে রিপোর্ট করল। স্ট্যাণ্ড ইন দি ডোর। নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের প্রথমজন দুপা শাফলিং করে প্লেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। আনোয়ার লাইনের দ্বিতীয়জন। কার্গোর দরজায় লাল লাইট জ্বলছে। প্রথমজন বা স্টিক লীডার নির্দেশ অনুযায়ী দরজার দুপাশের হ্যাঁণ্ডেল ধরে প্লেনের বাইরে চারপাশ দেখে নিয়ে দরজার কিনারে দাঁড়াল জাম্পের ভঙ্গিতে। লাল আলো নিভে গিয়ে দপ করে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। স্টিক লীডারের পশ্চাদদেশে টি.এম. প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন, গো। মুহূর্তে হারিয়ে গেল স্টিক লীডার কার্গোর বাইরে।
দরজায় আবার লাল আলো জ্বলে উঠল। আনোয়ার নির্দেশ অনুযায়ী এগোল দরজার দিকে। প্রপেলারের ঠেলে দেয়া বাতাস প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে পেছনে। এই বাতাসের ভিতর লাফ দিতে হবে ভেবে ওর মনে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। ঠিক ভয় বলতে যা বোঝায় তা নয়। একটা অচেনা অনুভূতি মনকে দোলা দিচ্ছে। নিচে মাটিতে বিছানো ইংরেজি টি অক্ষরটা দেখা গেল। টি-র মাথায় প্লেন পৌঁছলে লাফ দিতে হবে। টি.এম. ওকে নিয়ে নিষ্ঠুর কৌতুক শুরু করলেন। তিনি কখনও বলছেন, তোমার প্যারাশুট তো খুলবে না। আবার কখনও বলছেন, তোমাকে যে প্যারাশুটটা দেয়া হয়েছে, সেটা ঠিকমত প্যাক করা হয়নি! অতএব বুঝতেই পারছ। আনোয়ারও উল্টো বলছে, আমার প্যারাশুট যদি না-ই খোলে তাহলে আমি কিন্তু এয়ারক্রাফটে ফিরে আসব। কার্গোটি টি অক্ষরের মাথায়। দপ করে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। টি.এম, ওর পশ্চাদদেশে চপেটাঘাত করে নির্দেশ দিলেন গো।
পিঠের ওপর প্যাক করা মেইন প্যারাশুট এবং পেটের কাছে রিজার্ভড প্যারাষ্ট ওর একমাত্র সঙ্গী। ও ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে। হু হু করে ছুটে যাচ্ছে প্রপেলারের ঠেলে দেয়া বাতাস। বাতাসের গতিবেগ ওকে বেশ কিছুটা পেছনের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। তারপর শুরু হলো নিচের দিকে পতন। আনোয়ারের দুহাত, রিজার্ভড প্যারাশুটের প্যাকের দুপাশে ডান হাত রিপ কর্ডের ওপর। মেইন প্যারাশুট কাজ না করলে রিপ কর্ডের হ্যাঁণ্ডেল টেনে যাতে রিজার্ভড প্যারাশুট ওপেন করা যায়। ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ওয়ান থাউজে, টু থাউজেণ্ড–চার সেকেণ্ড গণনার হিসাব। এই সময়ের মধ্যে খুলে যাবে মেইন প্যারাশুট। স্ট্যাটিক লাইন থেকে প্যারাশুট খুলে গেছে। সামান্য একটু ঝুঁকি খেয়ে নিচে পতনের গতি কিছুটা হ্রাস পেতেই ও ওপরের দিকে চাইল।
বিশাল ব্যাঙের ছাতার মত বাতাসে ফুলে রয়েছে প্যারাশুটটা। নিচের দিকে চাইতেই একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল । একি! পৃথিবীটা দুলছে কেন? ভাল করে খেয়াল করতেই ব্যাপারটা বোঝা গেল–পৃথিবী নয়, ও নিজেই প্যারাশুটের নিচে দুলছে। বহুদূর দৃষ্টি যাচ্ছে শূন্যে ভাসমান অবস্থায়। ওপরে বিশাল আকাশ-মেঘমুক্ত। নিচে শ্যামল প্রান্তর। যারা কোনদিন প্যারাশুট জাম্প করেনি অথবা করবে না তাদের জন্য আনোয়ারের মনে করুণার উদ্রেক হলো। প্যারাট্রুপার আনোয়ার সেকেণ্ডে আঠারো থেকে বাইশ ফুট গতিতে নিচে নামছে। ও সুন্দর ভঙ্গিতে পি.এল.এফ. করে মাটিতে পড়ল। তারপর প্যারাস্যুট গুটিয়ে নিয়ে ড্রপজোনের অদরে অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে এগুলো ।
পরদিন সকাল। সবাই ব্রেকফাস্ট খেয়ে রওনা হলো পুনরায় বিমান বন্দরের দিকে। আজ ওদেরকে লাইনবন্দী হয়ে পর পর জাম্প করতে হবে। ওরা কার্গোর অভ্যন্তরে ৩৬ জন করে পাশের দরজায় দণ্ডায়মান। জাম্প মাস্টারের গো নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল শূন্যে। প্লেন থেকে বেরুতে ওদের সময় লাগল পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড। টি.এম. বললেন, হোপলেস্। সময় আরও কমাতে হবে। দ্বিতীয়বার জাম্পে ওরা পাঁচ সেকেণ্ড সময় কমিয়ে চল্লিশ সেকেণ্ডে আনল।
সেদিনের মত জাম্প শেষ হলো। পরদিন আবার শুরু হলো জাম্প । দুটো করে অ্যাডমিনিসট্রেটিভ জাম্প শেষে অ্যাডভেঞ্চার কোর্সের অফিসারদের বুকে পরিয়ে দেয়া হবে বহু প্রতীক্ষিত প্যারাউইং, আর এস.এস.জি ট্রেইনীদের রাতে আরও একটা ট্যাকটিক্যাল জাম্প শেষে ডান বুকে পরিয়ে দেয়া হবে দুর্লভ কমাণ্ডো উইং।
রাত আটটার দিকে আনোয়ারসহ এস.এস.জি-র ট্রেইনী অফিসাররা বের হলো পেশওয়ার বিমান বন্দরের উদ্দেশে।
রাত সাড়ে আটটা। পেশওয়ার বিমান বন্দর। বিশাল রানওয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। স্থির, শান্ত। চারদিকে খোলামেলা পরিবেশ।
ব্রিফিং শেষ হলো। আনোয়ারসহ সমস্ত এস.এস.জি-র ট্রেইনী অফিসাররা এগিয়ে গেল, সি-১৩০ কার্গোর দিকে।
সি-১৩০ উড়ছে মাত্র আটশো ফুট উপর দিয়ে। প্লেন থেকে প্যারাশুট জাম্প করার জন্য স্বল্প উচ্চতা বিপজ্জনক। প্যারা ল্যাণ্ডিং ফলের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। প্যারাট্রুপার সেকেণ্ডে বিশ থেকে বাইশ ফুট গতিতে নিচের দিকে, ধাবিত হয়। প্যারাট্রুপার যদি পি.এল, এফ-এর প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়, তবে-মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। সেজন্য উচ্চতা বেশি হলে প্যারাট্রুপার পি.এল.এফ-এর জন্য বেশ কয়েক সেকেণ্ড সময় পায়।
ড্রপ জোন আর বেশি দূরে নয়। আনোয়ারের মনটা রোমাঞ্চিত। এটাই হবে জীবনের প্রথম রাত্রিকালীন জাম্প। ও ভারছে ছেলেবেলার কথা। আক্লাশে প্লেন উড়ত। দ্রুত সেগুলো হারিয়ে যেত দৃষ্টিসীমার আড়ালে। মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে খেলা দেখাত প্লেনগুলো । ও তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। কি অদ্ভুত সৃষ্টি এই প্লেন! আকাশের বুকে উড়ে বেড়ায়! আশ্চর্য! বড়দের কাছ থেকে গল্প শুনত। ছত্রীসেনারা প্যারাশুটে করে প্লেন থেকে ঝাঁপ দেয়। ওর বিশ্বাসই হত না। দূর, অত উঁচু থেকে কেউ কখনও লাফ দিতে পারে? একদিন সিনেমায় দেখল-প্লেন থেকে ছত্রীসেনা লাফ দিচ্ছে। ওর ছোট্ট হৃদয়টা অবাক বিস্ময়ে ভরে উঠেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল ছত্রীসেনারা কি অপূর্ব! কি অদ্ভুত ওদের জীবন! না জানি ওরা কত বড়! নিজেকে ছত্রী হিসেবে কল্পনা করতে খু-উ-ব ভাল লাগত আনোয়ারের।
প্লেনের দরজায় দপ করে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। ছোটবেলার চিন্তাটা উবে গেল নিমেষেই। জাম্প মাস্টারের চিৎকার ধ্বনি ভেসে এল, গো। একজন ট্রেইনী প্যারাট্রুপার লাফিয়ে পড়ল বাইরে। এবার আনোয়ার এগুলো প্লেনের দরজার দিকে। দরজায় লাল আলো জ্বলছে। কানে ভেসে আসছে প্লেনের একটানা গর্জন। অদূরে ড্রপজোন। ও প্লেনের দরজা গলিয়ে শরীরটা বাইরে এনে চারপাশটা ভাল করে দেখে নিচ্ছে।
মিষ্টি রাত। আকাশে প্রস্ফুটিত চাঁদের আলো। কোমল। জ্যোত্সামাখা প্রকৃতি। স্বপ্নিল। ছুটে যাওয়া ঠাণ্ডা বাতাস। তন্দ্রালু। ও দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জাম্পের ভঙ্গিতে দাঁড়াল। দরজায় সবুজ আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ এল গো। এক ঝলক কোমল বাতাস আনোয়ারের চোখে-মুখে ঝাঁপটা দিল। মেইন প্যারাশুট খুলে গিয়েছে। দ্রুত ক্যানোপি, সাসপেনডেড লাইন, হার্নের্স পরীক্ষা করে নিল সে। তারপর রূকস্যাক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সামনের বেল্টের দুটো ফিতা টান মারতেই। কোমরের বেল্টের সঙ্গে বাঁধা একটা দড়ির সঙ্গে ঝুলছে রূকস্যাকটা।
প্যাক খুলে যাওয়ার কয়েক সেকেণ্ড পর নিচের দিকে তাকাল আনোয়ার। সারা শরীর আড়ষ্ট হলো ভয়ে। প্যারাশুট একেবারে মাটির সন্নিকটে। পি.এল.এফ-এর জন্য সময় নেই। মুহূর্তের মধ্যেই প্যারাট্রুপার আনোয়ারের সারা শরীর বাড়ি খেলো মাটিতে। স্টীল হেলমেট সমেত মাথাটাও ঠুকে গেল। মারাত্মক আঘাত না পেলেও বোঁ করে উঠল মাথাটা। কোনরকমে নিজেকে হার্নেসমুক্ত করে, প্যারাশুট রোল করে মাটিতে বসে বিশ্রাম নিল সে। ভাবল, ভবিষ্যতে সব রকম মহড়ায় ওদের মাত্র আটশো ফুট উচ্চতা থেকে এই বিপজ্জনক ট্যাকটিক্যাল জাম্প দিতে হবে। এবারে তো কোনরকমে প্রাণ রক্ষা হলো। ভবিষ্যতে এর চেয়েও মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে?
বিশ্রামের পর প্যাক ও প্যারাশুট ঘাড়ে নিয়ে অপেক্ষারত গাড়ির দিকে এগুলো আনোয়ার। সেদিন মেসে দারুণ হৈ-চৈ হলো। পরদিন সকালে ওদের পরিয়ে দেয়া হবে কমাণ্ডো উইং। সৈনিকদের সেরা গ্রুপ-কমাণ্ডো। দুর্লভ প্রতীক–কমাণ্ডো উইং একজন কমাণ্ডো, মানুষরূপী, ভয়ঙ্কর যান্ত্রিক রোবট বিশেষ। বিভিন্নরকম বিপজ্জনক ট্রেনিংয়ে দক্ষ ওরা। প্যারাশুট জাম্প মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পার হলো। বিছানায় শুয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাল আনোয়ার।
পরদিন সকাল। ঘুম থেকে উঠে বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। টয়লেট, শেভ সেরে শাওয়ারের ট্যাপ খুলে দিল। কোমরে শুধু তোয়ালে জড়ানো। আয়নাতে চেয়ে দেখল, এই বুকের ডান ধারেই শোভা পাবে দুর্লভ কুমাণ্ডে উইং। ঝরঝরে মন নিয়ে বেরিয়ে এল বাথরূম থেকে আনোয়ার। একটা প্রফুল্লতা ওকে ঘিরে রেখেছে। চকচকে ইউনিফরম পরে স্মার্ট অথচ বেপরোয়া একটা ভাব নিয়ে প্যারা স্কুলে পৌঁছল সে।
সেখানে বিরাট আয়োজন। সকাল নয়টার দিকে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের গ্রুপ কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার শেরউল্লাহ বেগ এলেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিটি অফিসারের বুকে পরিয়ে দিলেন কমাণ্ডো উইং। আনোয়ারের বুকটা ভরে উঠল এক অনাবিল আনন্দে। এটা অগ্নি পরীক্ষার দুপ্রাপ্য পুরস্কার। ওর মনে পড়ল মেজর ভর্দগের সেই কথা, মাই ডিয়ার মাম্মি, আমি এখন একজন কমাণ্ডো হয়ে গেছি। ওর ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি ফুটে উঠল, আমি কিন্তু তা নই, এখন আমি একজন হেল কমাণ্ডো। বিকেলে ওরা রওনা হলো চেরাট ক্যান্টনমেন্টের পথে।
শুরু হলো এস.এস.জি-র পাসিং আউট প্যারেড। এই প্যারেড সেনাবাহিনী-পাসিং আউট প্যারেডের মত নয়। ওদের প্রত্যেকের পরনে কমপ্লিট ব্যাটল ড্রেস-মাথায় স্টীল হেলমেট, ফুলপ্যান্টের নিচের প্রান্ত প্যারা-জাম্পের লং-বুটের ভিতর গোঁজা, পিঠে রূকস্যাক, রাইফেল বুকের সামনে আড়াআড়িভাবে ধরা। ব্যাণ্ড দ্রুত তালে বাজছে। হাঁটু ভাঁজ করে পা বুক সমান উঠিয়ে ওরা মার্চ-পাস্ট করল। শেষে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো একটা পাহাড়ের ধারে। পাহাড়ের গা কেটে বানানো হয়েছে বিশাল আকৃতির কমান্ড্রো উইংয়ের প্রতিকৃতি।
শুরু হলো কমাণ্ডোদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সাব মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ে ওদের শপথ করানো হলো। সেদিন রাতে এস.এস.জি-র ঐতিহ্য অনুয়ায়ী ওদেরকে অফিসার্স মেসের ডাইনিং মেম্বার বানানো হবে। সে এক অদ্ভুত কায়দা। অ্যান্টি রূমের ফলস্ সিলিং খুলে ফেলা হলো। মাটি থেকে তেরো-চোদ্দ ফুট উঁচু একটা লোহার বিম দেখা যাচ্ছে। চার-পাঁচজন পুরানো অফিসার মিলে এক একজন নবীন অফিসারকে হাতের ওপর শোয়াল। তারপর ওয়ান, টু, থ্রী বলে নবীন অফিসারকে ছুঁড়ে দিল ওপরে। নবীন অফিসার ওপরে লোহার বিম ধরে ফেলল। দশবার চিন আপ (শরীরকে দুই হাতের জোরে কনুই ভেঙে ওপরে তুলে, বিমের সঙ্গে থুতনি ঠেকানো ও আবার হাত সোজা করে ঝোলা) . ও নিখুঁত ভঙ্গিতে পি.এল.এফ. করে নিচে নেমে এল নবীন অফিসার। তারপর বিশটা বুকডন। এস.এস.জি-র ঐতিহ্য অনুযায়ী নবীন অফিসার অফিসার্স মেসের ডাইনিং মেম্বার হয়ে গেল তখন থেকে। তিনদিন ছুটি পেল ওরা। যাদের বাড়ি কাছে তারা চলে গেল ছুটি কাটাতে। ছুটির তিনটা দিন আনোয়ার সানরূমে তাস খেলে, টিভি দেখে কাটিয়ে দিল। ছুটি শেষে ওকে বদলি করা হলো চেরাট থেকে ৬৩ মাইল দূরে রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশওয়ারের মাঝামাঝি টু কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান, আটক ফোর্টে।
১১.
আটক দুর্গ। শেরশাহের তৈরি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ঠিক ওপরে মোঘল সম্রাট আকবর এই দুর্গ তৈরি করেন। দুৰ্গটার নির্মাণ কৌশল অপূর্ব। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের জন্য দুর্গটার অবস্থান বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আটক দুর্গের চারপাশ ঘিরে কয়েক মাইল ফাঁকা জায়গা। দুর্গে অবস্থানকারী সৈন্যেরা সহজেই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে পারে। গভীর পাথুরে খাদ ঘিরে রেখেছে দুর্গের চারপাশ। পাথুরে খাদের কিনারা ঘেঁষে দুর্গের আকাশচুম্বি দুর্ভেদ্য দেয়াল। কোন কোন জায়গায় দেয়ালের উচ্চতা ১৩০ ফুট। দুর্গের সম্মুখের দেয়ালের ওপর দিয়ে দুটো ট্রাক অনায়াসে চলতে পারে। ফটকের নির্মাণশৈলীও অপূর্ব! প্রধান সড়ক সোজা দুর্গে প্রবেশ করেনি।
ইংরেজি এস অক্ষরের মত বাঁক ঘুরে প্রবেশ করেছে। যাতে শক্তিশালী পালোয়ানরা বড় বড় গাছের গুঁড়ি কাঁধে নিয়ে দৌড়ে দরজা ধাক্কা মেরে ভাঙতে না পারে। প্রধান ফটক বিশাল। পেটানো লোহা দিয়ে তৈরি ভীষণ মজবুত। কোন হাতি দিয়েও ফটক ভাঙার উপায় নেই। এছাড়া বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রয়েছে। বিশাল পাল্লার বাইরের দিকে অসংখ্য সঁচালো লোহার স্পাইক লাগানো। এছাড়াও রয়েছে, সম্মুখবর্তী দেয়ালের ওপরের অংশে নানা আকারের ছিদ্র। ছিদ্রগুলো দিয়ে সৈনিকরা ফটক আক্রমণকারী শত্রুদের ওপর গরম পানি, বোল্ডার প্রভৃতি নিক্ষেপ করতে পারে।
দুর্গের বাইরে একটা উঁচু কংক্রিটের প্ল্যাটফরম, যেখান থেকে দৃষ্টি যায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের দিকে। এক সময় প্ল্যাটফরমের ওপর একটা বিশাল আকৃতির কামান বসানো ছিল। কংক্রিটের দেয়ালের ওপর চেইন দিয়ে কামান আটকে রাখার জন্য লাগানো বিশাল লোহার বালাগুলো এখনও অটুট। এসত্ত্বেও দুর্গ ছেড়ে পালানোর জন্য একটা নিরাপদ গুপ্তপথ আছে। এই সুড়ঙ্গটির দৈর্ঘ্য প্রায় এক মাইল। সিন্ধু ও কাবুল নদের সঙ্গমস্থলের তল দিয়ে চলে গেছে সুড়ঙ্গ পথটি। নদীর অপর পাড়ে সুড়ঙ্গ থেকে বেরুনোর মুখ। দুর্গের ভিতর রয়েছে বহু গোপন ও ভূগর্ভস্থ কক্ষ। মজবুত এই কক্ষগুলো এখনও অটুট। এইগুলো এখন টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের গোলা-বারুদ রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দুর্গ থেকে প্রায় কোয়ার্টার মাইল দূরে বেগম-কি-সরাই। সরাই-এর সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সিন্ধু নদ। পাশ ঘেঁষে চলে গেছে জি.টি. রোড। জি.টি. রোডের খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে সামনে সিন্ধু-অববাহিকা। এই অববাহিকা অঞ্চলের এক মনোরম স্থানে বেগম-কি-সরাই বা রাণীর পান্থশালা। বেগম-কি-সরাই থেকে পিণ্ডিগামী জি.টি, রোড ধরে কয়েকশো গজ গেলে সামনে পড়ে একটা উঁচু টিলা। এই টিলার পাদদেশে রাণী ও তার সহচরীদের জলকেলি করার এক অভিনব স্থান।
সরাই থেকে খাড়া ঢাল বেয়ে নেমে নিচে জি.টি. রোড। রোডের ধার ঘেঁষে আর একটি চড়াই প্রায় ৭০-৮০ ফুট ওপরে উঠে গেছে। এই ঢালের ওপরেই টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের অফিসার্স মেস। বেগম-কি-সরাই-এর দেয়াল ঘেরা মনোরম মাঠ টু কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নের শরীরচর্চার জন্য ব্যবহৃত হয়।
অফিসার্স মেস থেকে শুরু হয়েছে মসৃণ পীচঢালা পথ। পথের একধারে ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার। এখান থেকে পীচঢালা পথ বাঁক ঘুরে গিয়েছে ম্যারিড অফিসার্স কোয়ার্টারের দিকে। এই এলাকাটা জুড়ে পাথুরে পাহাড়। চারদিকে খটখটে নিণ। বহু পরিশ্রম করে সযত্নে বেশ কিছু ফুলগাছ লাগানো হয়েছে মেস বিল্ডিং-এর আশপাশে এবং ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার-এর সামনে। অফিসার্স মেসের উঁচু পিলারের ওপরে রেলিং ঘেরা বিরাট পার্লার। এখানে বসে নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাবুল ও সিন্ধুর সঙ্গমস্থলের সুন্দর দৃশ্যাবলী উপভোগ করা যায়।
কামরায় পৌঁছেই আনোয়ার দেখল, ওর কামরা সাজানো গোছানো। এরমধ্যেই আর্দালিরা সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে। কামরার এককোণে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে ফায়ারপ্লেসে। তিরিশ ফুট বাই পঁচিশ ফুট বিশাল আকৃতির কামরা। ড্রেসিং কাম স্টোর রূমও বিশাল-বিশ ফুট বাই পনেরো ফুট। সেই সঙ্গে প্রমাণ সাইজের বাথরূম-পনেরো ফুট বাই দশ ফুট। কামরার সামনে দশ ফুট চওড়া বারান্দা। বারান্দার নিচে ফুট তিনেক চওড়া ফুল গাছের কেয়ারি করা লন।
আনোয়ার ইউনিটে যোগদানের পর ওদের ইউনিটে কমাণ্ডিং অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন লে. কর্নেল সোলেমান খান এবং মেজর আবু তাহের (বাংলাদেশে কর্নেল ঈহের নামে পরিচিত) । লে. কর্নেল সোলেমান সদালাপী, হাসিখুশি। খুবই অভিজ্ঞ ও বহু উচচতর ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তিনি কয়েকদিনের মধ্যে ইউনিটের সবার মন জয় করে নিলেন। আনোয়ারকে জাংজু কোম্পানীতে পোস্টিং করা হলো। একটা কোম্পানীতে কোম্পানী কমাণ্ডার একজন মেজর ও প্ল্যাটুন কমাণ্ডার তিনজন ক্যাপ্টেনসহ মোট চারজন অফিসার থাকার কথা। কিন্তু জাংজু কোম্পানীতে আনোয়ার ছাড়া আর কোন অফিসার নেই।
জাংজু কোম্পানী, হেলি এয়ারবোর্ন। হেলিকপ্টার ও প্যারাশুট দ্বারা মিশন পরিচালনা করার দায়িত্ব এই কোম্পানীর। অবশ্য অন্যান্য কোম্পানীকেও একই দায়িত্ব পালন করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। এই কোম্পানীর মিশন সাধারণত সমতল ভূমিতে পরিচালিত হয়। মেজর তাহের যোগ দিলেন কায়েদ কোম্পানীতে। এই কোম্পানীর দায়িত্ব মরুভূমি এলাকায় মিশন পরিচালনা করা। পাশে গজনভী কোম্পানী । এই কোম্পানীর দায়িত্ব পার্বত্য অঞ্চল ও তুষার এলাকায় কাজ করা।
কিছুদিন পর মেজর তাহের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকা পাড়ি দিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার আগে তিনি বিয়ে করেন এবং লণ্ডনে চাকুরিরত স্ত্রীর বড় ভাই ড. রফিকের কাছে স্ত্রীকে রেখে যান।
ইউনিটের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর আকরাম খটক। বিশালদেহী মেজর খটক জাতে পাঠান, বেশ কৌতুকপ্রিয়। প্রচুর অর্থশালী হলেও তিনি টাকা পয়সার ব্যাপারে কৃপণ। তবুও তিনি সকলের প্রিয়পাত্র। তাঁর চার হাজার টাকায় কেনা শেয়ারের দাম বেড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়েছে। এই গল্পটা তিনি প্রায়ই শুনিয়ে তৃপ্তি পান। একদিন আনোয়ার বলল, স্যার, আপনার এই সৌভাগ্যটাকে আজ আমরা সেলিব্রেট করব। চলুন, মেসে যাই।
আনোয়ার, এ তুমি কি বলছ? তারচেয়ে চলল খোলা মাঠে যাই।
খোলা মাঠে? সকলের অবাক কণ্ঠ।
আরে ইয়ার, খোলা মাঠের মুক্ত বাতাস স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ উপকারী।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল মেজর খটকের কথা শুনে। তারপর খটককে টানতে টানতে মেসে হাজির হলো সবাই। কয়েক বোতল সেভেন আপ, কোক, স্যাণ্ডউইচের সামান্য বিল দিতে হলো মেজর খটককে। বার কাউন্টারে বিলে সিগনেচার করার সময় তিনি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমলোক মেরা কাবাড়া কার দিয়া। আওর মেসমে নেহী আয়েগা।
তবুও ওরা মাঝে মাঝেই খটকের ওপর হামলা চালাত।
ইউনিটে বিবাহিত অফিসাররা হলেন, লে. কর্নেল সাৈলেমান, মেজর আকরাম খটক, মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশারফ এবং ক্যাপ্টেন (ড.) মহম্মদ হোসেন। অবিবাহিত অফিসাররা হলেন, ক্যাপ্টেন সরদার হুমায়ুন খান (অ্যাডজুটেন্ট), ক্যাপ্টেন সাইদ আহমদ (কোয়ার্টার মাস্টার), ক্যাপ্টেন খালেদ, ক্যাপ্টেন জায়েদী এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার। কিছুদিন পর ওদের সঙ্গে যোগ দিলেন মেজর আজম, ক্যাপ্টেন সিকান্দার, ক্যাপ্টেন রিফাজ, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন গোলাম কাদের।
প্রতিদিন সকালে ওরা দৌড়ে বেগম-কি-সরাই পর্যন্ত যায়। দূরত্ব প্রায় এক মাইল। শরীর গরম হওয়ার পর শুরু হয় প্যারা পিটি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে চলে এই কঠিনতম শরীর চর্চা। এটা ওদের প্রাত্যহিক কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত। এরই মাঝে সপ্তাহে একদিন ভোরে চার মাইল দৌড়ের পরীক্ষা হয়। সকালে দৌড় ও পিটি শেষে ওরা রওনা হয় দুর্গের উদ্দেশে। প্রত্যেকের নিজ নিজ অফিসে ফায়ারপ্লেসের আরামদায়ক উষ্ণতায় অফিস-আওয়ার কেটে যায়।
বেলা এগারোটায় টি-ব্রেক। গরম মুরগীর রোস্ট, স্যাণ্ডউইচ ও কফি সহযোগে টি-ব্রেক সারে ওরা। তারপর বেলা দুটোয় লাঞ্চ। লাঞ্চের পর অনেকেই রূমে ফিরে যায়। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশারফ, ক্যাপ্টেন সাইদ ও আনোয়ার তাস নিয়ে বসে এয়ার কণ্ডিশশু বারে। বিকেলে গেমস পিরিয়ডের আগে ওরা ওখানেই পোশাক বদলে নেয়। গেমসে যাওয়ার আগে বেয়ারা ঘড়ি দেখে ওদের চা পরিবেশন করে। চা ও সিগারেট শেষ করে ওরা বেরিয়ে পড়ে গেমসের জন্য দুর্গের উদ্দেশে।
দুর্গে ঢুকে সোজা বাস্কেটবল বাউণ্ডে চলে যায় আনোয়ার। বাস্কেটবল সে নিয়মিত খেলে। ঘণ্টাখানেক বাস্কেটবল খেলার পর ও আবার স্কোয়াশ গ্রাউণ্ডে হাজির হয়। কিছুক্ষণ কর্নেলের সঙ্গে স্কোয়াশ, খেলার পর রূমে ফেরে সে। রূমের পেছনের দিকে একটা খোলা জায়গা। সেখানে বারবেল দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে আনোয়ার। মাঝে মাঝে সঙ্গী পেলে জুডো কারাতের প্র্যাকটিসও করে। সবকিছুর পর আর্দালি ভাল মত শরীর মেসেজ করে দেয়। অরপর শুরু হয় গরম পানির শাওয়ার বাথ। ঝরঝরে শরীর নিয়ে ফায়ারপ্লেসের ধারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও কফি পান। রাত নয়টার সময় ডিনারের জন্য আবার মেস। ডিনার শেষে ঘণ্টাখানেক টেলিভিশন দেখে ঘরে ফেরে ও। আর্দালিকে চিঠির জবাব লেখার নির্দেশ দিয়ে বিছানায় যায় আনোয়ার। এই হলো। আটক দুর্গে ওর দৈনন্দিন কর্মসূচী।
শীতকালে আটকের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। ধীরে ধীরে শীত ফুরিয়ে গেল। শুরু হলো গরম। প্রথম প্রথম গরমের তীব্রতা আনোয়ার বুঝতে পারেনি। গরমকালের মাঝামাঝি সময় আটকের আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে উঠল। একশো উনিশ থেকে একশো বাইশ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠানামা শুরু করল। অসহ্য হয়ে উঠল আনোয়ারের কাছে আটক দুর্গের ভিতর সমস্ত বিল্ডিংগুলোর দেয়াল ভীষণ পুরু। সেজন্য কিছুটা রক্ষা তবে আউটডোের ট্রেনিং-এর সময় সকাল থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত এই প্রচণ্ড তাপমাত্রায় কাজ করতে হয় ওদের। এসময় ওদের পোশাক হাফহাতা সুতির গেঞ্জি। গেঞ্জির বুকের ওপর নাম ও পদবী ছাপা। পরনে খাকি ট্রাউজার্স ও বুট। মাথায় ব্যেরেট ক্যাপের পরিবর্তে কটন জকি ক্যাপ।
তীব্র রোদে শরীরের চামড়া ঝলসে যাওয়া শুরু হলো আনোয়ারের। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় খুললে রোদে পোড়া অংশ এবং কাপড়ে আবৃত অংশের পার্থক্য প্রকট হয়ে চোখে পড়ে। দুর্গের ভিতরে রয়েছে, একটা সুন্দর সুইমিংপুল। কর্নেলের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে অফিস শেষে ওরা সবাই সুইমিংপুলে ছুটে যায়। কাবুল নদীর বরফ গলা জলে পুল ভর্তি। একবার পুলে নামলে আর উঠতে ইচ্ছে করত না আনোয়ারের। সুইমিংপুলে কোক, স্যাণ্ডউইচ, কফি খেত সে। মাঝেমধ্যে পুলে গোসলরত অবস্থায় অফিসের কাগজপত্রও দেখত।
জুলাই-এর এক সন্ধ্যা। আনোয়ারসহ কয়েকজন অফিসার মাটক দুর্গের খোলা মাঠে বসে গল্প করছে। হঠাৎ সস্ত্রীক মেজর তাহের উপস্থিত হলেন। আনোয়ারকে দেখে তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, হাই আনোয়ার, কেমন আছ?
তারপর আনোয়ারকে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। মিসেস তাহের খুব খুশি হলেন আনোয়ারকে বাংলায় কথা বলতে দেখে। স্বাভাবিকভাবে মেহমানদারী করার দায়িত্ব ওর ওপরেই পড়ল। কোল্ড ড্রিঙ্কস, স্ন্যাক্স শেষে মেস-হাবিলদারকে নিয়ে ওরা গেল গেস্টরূমে। আপাতত সেখানেই মেজর তাহের ও মিসেস তাহেরের থাকার ব্যবস্থা হলো। গেস্টরুমে বসে আনোয়ারের সঙ্গে নেকক্ষণ আলাপ করলেন দুজন। শেষে মেজর তাহের বললেন, এখন থেকে দুপুর আর রাতে তুমি আমাদের এখানে খাবে। এই বাংলাভাষী বিবর্জিত এলাকায় তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমার ভাবী নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবেন।
কিছুদিন পর দুর্গের সবচেয়ে কাছে একজন বিবাহিত অফিসারের বাসস্থান খালি হলো। মেজর তাহের সেখানে চলে গেলেন। নতুন করে সংসার গোছানো তাহেরের পক্ষে কষ্টকর। এসব ব্যাপারে তিনি একেবারে আনাড়ী। সংসারের ছোটখাট জিনিসপত্র কেনায় তাঁর ভীষণ বিরক্তি। তার ওপর ধারে কাছে কোন বাজার নেই। আটক দুর্গ থেকে বাজার প্রায় বাইশ মাইল দূরে। মেস-হাবিলদার প্রায়ই গাড়ি নিয়ে বাজার করতে যায়।
একদিন তাহেরের নতুন বাসায় গেল আনোয়ার। গিয়ে দেখে মিসেস তাহের পাঞ্জাবী মেস-হাবিলদারকে কি যেন বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মেস-হাবিলদার বাংলার কিছুই বোঝে না এবং কিছু না বুঝেই সে ঘাড় নাড়াচ্ছে। আনোয়ারকে দেখে মিসেস তাহেরের মুখটা করুণ হয়ে উঠল, দেখুন তো ভাই, আমি হাবিলদারের একটা কথাও বুঝতে পারছি না। আর হাবিলদারও আমাকে বুঝতে পারছে না। অথচ জিনিসগুলো দরকার। আপনার স্যার তো এসবের কথা শুনতেই পারেন না।
আপনি চিন্তা করবেন না। বলুন আপনার কি কি দরকার?
আনোয়ারকে নিয়ে মিসেস তাহের ঘরের ভেতরে গেলেন। তিনি বাংলায় একটা ফর্দ লিখে ওর হাতে দিলেন। ও পাঞ্জাবী মেসূ-হাবিলদারকে সবকিছু বুঝিয়ে বলল । হাবিলদার গাড়ি নিয়ে চলে গেল বাজারে।
যাক আপনি বাঁচালেন। কি বিপদেই না পড়েছিলাম। মিসেস তাহের বললেন।
এখন থেকে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার কোন কিছুর প্রয়োজন হলে দয়া করে আমাকে বলবেন। আমি মেস হাবিলদারকৈ সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেব।
সত্যি বলছেন?
অবশ্যই। এতে মিথ্যে বলার কি আছে?
না, আপনারা নানা ঝামেলায় ব্যস্ত থাকেন তো।
এখানে আরামেই তো আছি। তেমন কোন ঝামেলা নেই। বরং আপনার এই কাজটুকু করতে পারলে আমি খুশিই হব।
যাক, তাহলে আমার দুশ্চিন্তা অনেকখানি কেটে গেল। মিসেস তাহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কয়েকদিন পর মিসেস তাহেরের সুবিধার্থে পাঞ্জাবী মেস-হাবিলদারের পরিবর্তে একজন বাঙালী মেস-হাবিলদার নিয়োগ করা হলো। মিসেস তাহেরের সমস্ত সমস্যার সমাধান হলেও খাওয়ার সময় প্রায়ই আনোয়ারকে হাজিরা দিতে হত মেজর তাহেরের বাসায়।
মেজর তাহের একটা অদ্ভুত মানুষ। খাটো শক্ত কাঠামোর অধিকারী এ মানুষটির চোখে মুখে কঠিন আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। এক কঠিন ব্যক্তিত্বের দুর্ভেদ্য দেয়ালে ঘেরা মেজর তাহের। তিনি যেমন স্পষ্টভাষী, নির্ভীক, তেমনি একগুঁয়ে। ঈশ্বরবাদে তাঁর বিন্দুমাত্র বিশ্বাসও নেই। তাহের অতিমাত্রায় নাস্তিক। এই কঠিন স্বভাবের অদ্ভুত মানুষটি কিন্তু আনোয়ারকে ভীষণভাবে স্নেহ। করেন।
প্রথম পরিচয়ের কথা আজও মনে পড়ে আনোয়ারের। তুমি কি বাঙালী কমাণ্ডো? তাহেরের স্মার্ট কণ্ঠস্বর শুনেই আনোয়ার বুঝেছিল, ইনি সাংঘাতিক মানুষ। ও তাড়াতাড়ি জবাব দিয়েছিল, ইয়েস, স্যার।
কয়েকটা কথার পরেই মেজর তাহের দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, কমাতে যোগ দিয়েছ দেখে আমি বেশ খুশি হয়েছি। কিন্তু মনে রেখো, দেশ স্বাধীন করতে হবে। বাংলায় কথা হচ্ছিল। আনোয়ার তো অবাক! মানুষটা বলে কি?
স্যার, পাকিস্তান তো একটা স্বাধীন দেশ। তবে কোন্ দেশ আমাদের স্বাধীন করতে হবে? সঙ্গে সঙ্গে মেজর তাহেরের প্রচণ্ড ধমক, গোল্লায় যাক পাকিস্তান। মনে রেখো, তুমি একজন বাঙালী। এখন বুঝতে পেরেছ, কোন দেশ স্বাধীন করতে হবে?
ব্যাপারটা ১৯৬৭ সালের। তখন বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের মুখেও দেশ স্বাধীন করার কথা শোনা যেত না। অথচ একজন সৈনিক হয়ে তাহের এই কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। প্রথমে আনোয়ারের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে কথাগুলো বাস্তবে রূপ নিতে দেখে ওর শ্রদ্ধা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছিল তাহেরের ওপর। একটা ব্যাপারে ওর সঙ্গে মেজর তাহেরের বিরাট পার্থক্য ছিল। তাহেরের ঈশ্বরবাদে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। অথচ আনোয়ার ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। তাহের মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করেন। আনোয়ার মদ নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি করেনি কোনদিন।
একদিন মিসেস তাহের আনোয়ারকে বললেন, মদের মাত্রা কিছুটা কমানোর জন্য তাহেরকে অনুরোধ করতে। বারে বসে, মেজর তাহেরকে ও ঢোক গিলতে গিলতে বলল, স্যার, ড্রিঙ্কটা একটু কম করলে মনে হয় ভাল হত। বলেই ঘামতে শুরু করল আনোয়ার। এই বুঝি শুরু হলো বজ্রপাত। কিন্তু না, তাহের শান্ত ভাবে ওর দিকে তাকালেন।
তুমি দিনে দশ কাপ চা খাও কেন? তাহেরের প্রশ্ন।
সতেজ অনুভূতির জন্য। আনোয়ারের ভীত কণ্ঠ।
তৎক্ষণাৎ তাহেরের উত্তর, আমি সতেজ হবার জন্য মদ খাই। আমি তো মদ খেয়ে মাতলামি করি না, কিংবা বউকে মারপিটও করি না। তাছাড়া মদ আমাকে খায় না, আমিই মদকে খাই। বুঝলে, ইডিয়ট?
রাইট, স্যার। ও তাড়াতাড়ি তাহেরের কথায় সম্মতি জানাল। কিছুক্ষণ পর তিনি পুনরায় বললেন, নিশ্চয়ই আমাকে এ-কথা বলার জন্য তোমার ভাবী তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। নাহ্, আমার বউটা ভেতো বাঙালীই রয়ে গেল। ঠিক আছে, সে যখন অতিরিক্ত ড্রিঙ্কস পছন্দ করে না, আমি কিছুটা কমানোর। চেষ্টা করব। তবে একেবারে ছাড়তে পারব না। কথাগুলো বলেই তাহের আনোয়ারকে নিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি প্রামাণ্য চিত্র টিভিতে দেখছেন তাহের। চিত্রটা দেখার পর থেকেই তাঁর মাথায় চাপল অদ্ভুত খেয়াল। ছবিতে আমেরিকান সৈনিকেরা একটা উঁচু দেয়াল বাঁশের সাহায্যে বিশেষ কায়দায় পার হলো। তাহের ফিসফিস করে পাশে বসা আনোয়ারকে বললেন, দৃশ্যটা বেশ সুন্দর। তাই না?
সুন্দর। তবে রিস্কি।
মাই ব্লাডি ফুট। রিস্কি, এই শব্দটা কমাণ্ডোদের অভিধানে আছে? তাহেরের কণ্ঠস্বরে রীতিমত তাচ্ছিল্য । আনোয়ার, মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। তিনি আবার বললেন, আগামী রোববার আটক দুর্গের দেয়ালে রেপেলিং করার জায়গায় এই প্রচেষ্টা চালানো হবে। কথাটা শুনে চমকে উঠল আনোয়ার। এবার বুঝি মানুষটার মাথা সত্যিই খারাপ হলো। কোথায় আমেরিকান সৈনি বিশ ফুট উঁচু দেয়াল পার হলো, আর সেখানে কিনা মেজর তাহের একশো বিশ ফুট উঁচু দেয়াল পার হবেন। এটা একটা পাগলামি ছাড়া আর কি হতে পারে। আনোয়ার একটু চিন্তা করে বলল, স্যার, আপনি কি ঠাট্টা করছেন?
শাট আপ, এটা ঠাট্টা নয়। ধমক খেয়ে ও নীরব হয়ে রইল।
পরদিন। ইউনিটে টি-ব্রেকের সময় এই আলোচনা উঠল। এটা নিছক পাগলামি-সমস্ত অফিসারদের মন্তব্য। কিন্তু তাহের তাঁর সিদ্ধান্তে আটক দুর্গের কঠিন শিলার মত স্থির, অনড়, অবিচল। তাঁর অনমনীয় মনোভাব দেখে কর্নেল সোলেমান বাধ্য হলেন নির্দেশ দিতে। সমস্ত অফিসারদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন। কর্নেল সবাইকে আটক দুর্গের রেপলিং করার জায়গায় উপস্থিত থাকতে বললেন। অর্থাৎ ছুটির পুরো দিনটাই মাটি।
অফিসে ফিরে আনোয়ার তাহেরকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, অত উঁচু বাঁশ কোথায় পাবেন?
কেন? ছোট ছোট বাঁশের টুকরো জোড়া দিয়ে?
কিন্তু স্যার, জোড়া দেয়া জিনিস কি গোটা বাঁশের মত শক্ত হবে? ওর কণ্ঠস্বরে সন্দেহ।
সে আমি ম্যানেজ করে নেব।
আনোয়ার আর কিছু না বলে তাহেরের অফিস থেকে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এল।
রোববার সকাল দশটা। সমস্ত অফিসাররা হাজির আটক দুর্গের রেপেলিং করার স্থানে। দুর্গের দেয়ালের এই অংশটা একটু বাঁক খেয়ে খাড়া কোনাকুনি গোলাকার হয়ে ওপরে উঠে গেছে । একশো বিশ ফুট লম্বা জোড়া লাগানো একটা বাঁশের দণ্ড! মেজর তাহের দুই হাতে দণ্ডটার অগ্রভাগ ধরলেন। দশজন শক্ত সমর্থ জোয়ান দণ্ডটাকে খাড়া কোনাকুনি অংশ বরাবর ঠেলে ওপরের দিকে ওঠাতে শুরু করল। তাহের দুই পা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে অনেকটা হাঁটার ভঙ্গিতে দেয়াল বেয়ে উঠছেন। পঞ্চাশ ষাট ফুট ওঠার পর সমস্ত অফিসারদের হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করতে থাকল। দণ্ডটা দুপাশে ভীষণভাবে দুলছে। যে-কোন মুহূর্তে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে। এই ভীতিকর অবস্থা দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল অফিসারদের মাঝে। কিন্তু তাহের ওপর থেকে অনবরত বলে যাচ্ছেন, দ্যাটস্ রাইট, ক্যারি অন। লগিটাকে এইভাবে ওপরের দিকে ঠেলতে থাকো।
নিচে আতঙ্কিত নীরবতা। সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টির সম্মুখে তাহের আটক দুর্গের একশো বিশ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর কর্নেল সোলেমানের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, স্যার, এটা কঠিন কিছু না। আর একজন অফিসারকে এবার পাঠান। কর্নেল চারদিকে তাকালেন। প্রত্যেকের দৃষ্টিতে নীরব অসম্মতি।
তাহের যদি এটা করতে পারে, তাহলে তোমাদেরও পারা উচিত। কর্নেলের কথা শুনেও সবাই নিরুত্তর। এবার কর্নেল বলে উঠলেন, একজন বাঙালী অফিসার যখন এটা করতে পেরেছে, অতএব আর একজন বাঙালী অফিসারও পারবে। আমি আশা করি, এবারে আনোয়ার একটু চেষ্টা করে দেখবে।
আনোয়ার কোন বাক্যব্যয় না করে সোজা গিয়ে দণ্ডটার অগ্রভাগ ধরল। জোড়া লাগানো দণ্ডটা একবার ব্যবহারের পর পূর্বের তুলনায় আরও বেশি লচপচে হয়ে গেছে। তার ওপর ওর ওজন তাহেরের চেয়ে প্রায় তিরিশ পাউণ্ড বেশি। কিছুদূর ওঠার পর শুরু হলো দুলুনি। কাঁচ কাঁচ শব্দ উঠছে দণ্ডটার প্রতিটা জোড়া থেকে। যে-কোন মুহূর্তে দণ্ডটার যে-কোন অংশ ভেঙে যেতে পারে। সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে ও প্রায় আশি ফুট পর্যন্ত উঠল। তারপর হঠাৎ করে দুলুনিটা বেড়ে গেল প্রচণ্ডভাবে। ওদিকে তাহের ওপর থেকে চিৎকার করছেন, ব্র্যাভো, ব্র্যাভো। আর একটু বাকি। উঠে এসো, কুইক।
কিন্তু কর্নেল বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি আনোয়ারকে নিচে নামিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। তাহের নিচে নেমে এসে ওকে বললেন, ব্লাডি হেল কমান্ডো, তোমার মত একটা ভীতু অপদার্থের কমাণ্ডোতে যোগ দেয়া উচিত হয়নি। নাউ পুশ অফ। প্রচণ্ড ধমক খেয়ে আনোয়ার মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল। তাহের পেছন থেকে ওকে ডাক দিলেন, তুমি কিছু মনে করোনি তো, আনোয়ার? তার কণ্ঠে স্নেহ।
না স্যার, একটুও না। আনোয়ার তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
তোমার বিপদের গুরুত্ব আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওকে, ইটস অল রাইট। চলো বারে যাই।
আর একটা ঘটনা।
গ্রীষ্মকাল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণকালীন মেজর তাহের সমুদ্রে সারফিং করতেন। সার্ফ বোট একটু লম্বাকৃতি কাঠের তৈরি। বোটের কোণগুলো সামান্য বাঁকা হয়ে ওপরের দিকে ওঠানো। উত্তাল ঢেউয়ের মাথায় ভেসে চলাটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। তাহেরের মাথায় আবারও ভূত চাপল। আগামী রোববার তিনি সারফিং করবেন। তাহের কাবুল নদীর একটা বরফ গলা জলভর্তি চ্যানেল পাড়ি দেবেন। চ্যানেলটা মেসের অদূর দিয়ে প্রবাহিত। গ্রীষ্মকাল হলেও এই চ্যানেলে পড়ে গেলে কারও রক্ষা নেই। শরীরের সমস্ত রক্ত নিমেষেই জমে যাবে। চ্যানেলটা পাহাড়ী এলাকা ভেদ করে গিয়েছে। সারফিং-এর জন্য চাই উত্তাল ঢেউ। নেই। পরিবর্তে আছে বরফ গলা হিম স্রোত। চাই সারফিং বোট। তাও নেই। তার পরিবর্তে আছে একটা লম্বা কাঠের তক্তা। তাহেরের একগুঁয়েমির কাছে আবার কর্নেল হার মানলেন। সারফিং-এর নির্দেশ পেয়ে গেলেন তাহের।
পরদিন রোববার বেলা দশটা। ওরা সকলেই কাবুল নদীর পারে উপস্থিত। এখান থেকে চ্যানেলটা এঁকে বেঁকে বেরিয়ে গেছে। প্রত্যেকের পরনে সাঁতারের পোশাক। একটা দশফুট বাই দেড় ফুট কাঠের তক্তা । এটা দিয়ে তাঁহের সারফিং করে চ্যানেল পার হবেন। পানিতে নামার আগে কর্নেলসহ ওরা সবাই তাহেরকে অনুরোধ করল নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার জন্য কোমরে একটা রশি বাঁধতে। তাহের রাজি হলেন। কোমরে বাঁধা দড়ির অপর প্রান্ত কিনারায় অপেক্ষমাণ ওদের কাছে রইল।
তাহের তক্তাসহ পানিতে নামলেন। তক্তার ওপর শরীরের। চাপ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তক্তা পানিতে প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। তক্তার যেদিকে ডুবতে শুরু করে, তাহের তার উল্টোদিকে পা রাখেন। এইভাবে এক অভিনব কায়দায় তাহের সারফিং শুরু করলেন। চ্যানেলটি তিরিশ ফুট চওড়া। আশ্চর্যজনকভাবে তাহের তার সাহায্যে চ্যানেল পার হলেন। তারপর স্বাভাবিকভাবেই আনোয়ারের পালা। কোমরে দড়ি বেঁধে আনোয়ার তক্তার দিকে এগুলো । এ-ব্যাপারে ও একেবারে নতুন। সারফিং কাকে বলে সে। জানে না। তবুও তাহেরের জন্য চেষ্টা করতে হলো। দুই-তিন ফুট যাওয়ার পরই ঝপাং করে পানিতে পড়ল আনোয়ার। তলিয়ে গেল বরফগলা জলে। কোমরে বাধা দড়ির সাহায্যে ওকে দ্রুত টেনে তোলা হলো ওপরে। মুহূর্তের মধ্যেই আনোয়ারের হাত-পা ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর যেন অনুভূতিহীন। এরপর কর্নেল সোলেমান সারফিং বন্ধের নির্দেশ দিলেন।
আজও আনোয়ারের কাছে মেজর তাহের একটি জীবন্ত স্মৃতি। তাহের দুর্লভ। তাহের দুর্ধর্ষ। তাহের দেশপ্রেমিক! অদ্ভুত গুণাবলীর সংমিশ্রণে তৈরি মানুষটি। আনোয়ারকে কত বকুনি দিয়েছেন তিনি। তারপর আবার প্রশান্ত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার মুখ । হাই আনোয়ার, হাই কমাণ্ডো, কিছু মনে করোনি তো? সস্নেহে বলতেন তাহের। নো স্যার, নট অ্যাট অল। এই ছিল আনোয়ারের জবাব। তাহেরের কথা মনে হলে ও যেন কেমন আনমনা হয়ে যায়। তখনি মনে পড়ে, ফিট টু সার্ভ উইথ এনি আর্মি আণ্ডার এনি কণ্ডিশন ইন দ্য ওয়ার্লড়। আমেরিকায় আন্তর্জাতিক ট্রেনিং শেষে তাহেরের সার্টিফিকেটে এই মন্তব্যই লেখা ছিল, পৃথিবীর যে-কোন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যে কোন অবস্থায় কাজ করতে সক্ষম।
ব্যাটল ইনোকুলেশন, কাকুল। এটা একটা মারাত্মক প্রশিক্ষণ। সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্র। একটা নির্দিষ্ট টার্গেট রয়েছে। শত্রুপক্ষের ব্যুহ ভেদ করে টার্গেটের দিকে ছুটে যেতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে আনোয়রিসহ সকল প্রস্তুত। ওদের পরনে ব্যাটল ড্রেস।
অস্ত্র বাগিয়ে ওরা এগুলো টার্গেটের দিকে। শুরু হলো, শত্রুপক্ষের অবিরাম গুলিবর্ষণ। দুই পাশ থেকে বৃষ্টির মত গুলি ছুটে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন বুলেটগুলো বাতাসে হিসহিস শব্দ তুলছে। ওরা সবাই মাথা নিচু করে ক্রলিং করে এগুচ্ছে। মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট-একটু এদিক ওদিক হলেই ঠুস করে ঢুকে পড়বে মগজের মধ্যে।
ট্যাট…ট্যাট…ঠাঠাঠা…অটোমেটিক অস্ত্রগুলো গজরাচ্ছে। মাঝে মাঝে রকেট-ফায়ারের কান ফাটানো আওয়াজ। প্রচণ্ড ধোঁয়া
ও বারুদের গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ওরা ক্রল করে কাঁটাতারের নিচ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে হেভী মেশিনগানের প্রচণ্ড গতির অসংখ্য বুলেট। টার্গেট এলাকায় চলছে মর্টার ও কামানের অবিরাম গোলাবর্ষণ। ঘন কালো ধোঁয়া টার্গেট এলাকা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বারুদ পোড়া গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের। প্রতিটি মুহূর্ত ওরা সজাগ। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সতর্ক। অতি সাবধানে ওরা টার্গেট এলাকার দুশো গজের মধ্যে প্রবেশ করল। হঠাৎ থেমে গেল মর্টার ও কামানের গোলাবর্ষণ। ওরা রক্ত হিম করা রণহুঙ্কার দিয়ে ছুটল টার্গেটের দিকে। এইভাবে শেষ হলো ব্যাটল ইনোকুলেশন, কাকুল।
.
কেবল ট্রেনিং। একটা উঁচু চূড়া থেকে স্টীলের কেবল জলাশয়ের ওপর দিয়ে গিয়েছে। উঁচু চূড়া থেকে কেবটা ক্রমশই ঢালু হয়ে জলাশয়ের অপর প্রান্ত পর্যন্ত পৌচেছে। চূড়ার কাছে স্টার্টিং পয়েন্ট। ওখানে একটা পুলি। পুলির সাহায্যে সহজে কেবলের ওপর দিয়ে রোল করে যাওয়া যায়। জলাশয়ের মাঝামাঝি কেবলের সঙ্গে একটা স্পর রয়েছে। পুলির হ্যাঁণ্ডেল ধরে ট্রেইনীরা লাফ দেয় চূড়া থেকে। তারপর প্রচণ্ড বেগে ঝুলন্ত অবস্থায় গিয়ে বাড়ি খায় স্পরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে শরীরের সামনের দিকটা ওপরের দিকে উঠে যায়। ট্রেইনীকে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল জড়িয়ে ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। শরীরের ভারসাম্য রক্ষার পর ঝুপ করে পানিতে লাফিয়ে পড়লেই কেব ট্রেনিংয়ের সমাপ্তি।
কাকুলে ব্যাটল ইনোকুলেশনের পর শুরু হলো এই কেবল ট্রেনিং। এই ট্রেনিংয়েও-যে-কোন মুহূর্তে বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে হাত ফসকে গেলে, কিংবা কেবল ছিড়ে গেলে হাড়গোড় চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। চূড়ার উচ্চতা মাটি থেকে অনেক ওপরে। তারপর প্রচণ্ড গতি। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে জলাশয়ে পৌঁছানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ট্রেইনী অফিসারের মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা থাকে। এই দূরত্বের মধ্যে পতন ঘটলে নিচে কঠিন মাটির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটবে শরীরের। স্টার্টিং পয়েন্ট। চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার। সে চারপাশ দেখে নিল। সম্মুখে কেবলটা ক্রমশই ঢালু হয়ে গিয়েছে। ওর শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি। বেশ দূরে, নিচে স্পর দেখা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে হ্যাঁণ্ডেলটা বাড়ি খাবে, শরীরের সামনের দিকটা উঠে যাবে শূন্যে, জড়িয়ে ধরতে হবে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল্। লাফ দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে স্টীলের কেবলটা ওর কাছে বেশ সরু মনে হলো। ওর বিশাল শরীরের ওজন বইতে পারবে তো কেবলটা? দ্রুত মন থেকে সমস্ত খুঁতখুঁতে অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে দিল আনোয়ার।
তারপর এগিয়ে গেল পুলির দিকে। পুলির হাতল শক্ত করে ধরল। তারপর লাফ দিল। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে ও। সারা শরীর রোমাঞ্চিত। সমস্ত মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে আছে। বিশাল শরীর বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে। ঝুলন্ত অবস্থায় পেছনে চাইল ও। নিচে মাটি সরে যাচ্ছে অতি দ্রুত। মনে হচ্ছে ওকে ঢিল মেরে কেউ সামনে ছুঁড়ে ফেলেছে। নিমেষের মধ্যেই স্পরের কাছে পৌঁছে গেল আনোয়ার । পুলিটা প্রচণ্ড গতিতে বাড়ি খেলো স্পরের সঙ্গে। শরীরের সামনের অংশ শূন্যে ওঠার আগেই হঠাৎ ওর হাত ফসকে গেল পুলির হাতল থেকে। ঝপাং করে পানিতে পড়ল বেকায়দা ভঙ্গিতে। বেশ ব্যথা পেল সে।
সাঁতার কেটে জলাশয়ের কিনারায় পৌঁছে আবার এগিয়ে গেল স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে। এবারে হাত থেকে পুলির হাতল ফসকাল না। সুন্দর ভঙ্গিতে শরীরের সামনের অংশ উঠে গেল ওপরে। সেই সঙ্গে দুপা দিয়ে স্টীলের কেবল জড়িয়ে ধরল আনোয়ার। তারপর ঝুপ করে পানিতে লাফিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে কেবল ট্রেনিংটা ওর কাছে ছেলেখেলার মত হয়ে গেল।
.
১২.
মনসেরা। এটা কাকুলের কাছাকাছি একটা পাহাড়ী এলাকা। খটখটে পাথুরে পাহাড় সারা এলাকা জুড়ে । মাঝে মাঝে হলদে রংয়ের মাটি নজরে পড়ে। গভীর অগভীর পাহাড়ী খাদও রয়েছে এই এলাকায়। একটা পাকা রাস্তা পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে কাকুল থেকে চলে এসেছে মনম্রেরা পর্যন্ত। একবার ট্রেনিংয়ের জন্য আনোয়ারদের যেতে হলো মনসেরাতে ।
অন্ধকার রাত। এলাকাটা একেবারে অচেনা। তার ওপর শত্রুরা আশপাশে ওঁৎ পেতে রয়েছে। যে-কোন মুহূর্তে ওরা হামলা, করে বসতে পারে। তাই সতর্ক ট্রেইনীদল। কোনরকম আলো না জ্বেলে ট্রেইনীরা অন্ধকারে পথ চলছে পাকা রাস্তার পাশ ঘেঁষে। আশপাশে কোন জনবসতি নেই। নীরব পরিবেশ। ওরা নিরাপদেই এগিয়ে চলেছে। সাবধান, হঠাৎ সামনের স্কাউট ইংগিত করল, শত্রু। মুহূর্তের মধ্যে রাইফেলের বোল্ড কক করার শব্দ ভেসে এল সম্মুখ হতে । আনোয়ার একলাফে রাস্তার একপাশে সরে গেল। সামনে একটা উঁচু ঢিবি। ও লাফিয়ে পড়ল ঢিবির ওপাশে। ঢিবির ঢালে শুয়ে পজিশন নিল। তাড়াহুড়োর জন্য প্রথমে বুঝতে পারেনি। পজিশন নেবার পর ও বুঝতে পারল, কোমর থেকে শরীরের নিম্নাংশ শূন্যে ঝুলছে। কী সর্বনাশ! আনোয়ার ভাবল পায়ের নিচে হয়তো ছোটখাট একটা গর্ত রয়েছে। আস্তে আস্তে শরীর নিচে নামিয়ে দিতে শুরু করল সে। গর্তের ভিতর দাঁড়িয়ে ভালভাবে পজিশন নেয়া যাবে। দেহের প্রায় পেট পর্যন্ত নিচে নেমে গিয়েছে। তবুও মাটির কোন রকম নাগাল পেল না সে। এদিকে শরীরের অর্ধেকের বেশি শূন্যে ঝুলছে। স্বাভাবিকভাবেই শরীরের ওপরের অংশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আনোয়ার ভাবল, এই বোধহয় গর্ত শেষ, মাটির নাগাল পাওয়া যাবে। এবারে সে পা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করল। তবুও মাটির নাগাল মিলল না। এদিকে শরীরের নিম্নমুখী পতন ক্রমশই বাড়ছে।
সন্দেহে দুলে উঠল ওর মন। পিছনে ভাল করে চাইতেই চক্ষুস্থির। খাদটির গভীর তলদেশ নজরে পড়ে না। আকাশে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোটা ঘন কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। পাহাড়ী খাদটার মাঝেও ঘন কুয়াশার আস্তরণ। সেজন্য প্রথমে নজরে পড়েনি। ও গভীর পাহাড়ী খাদের ঢালে ঝুলছে। শরীরের অধিকাংশ অংশই শূন্যে ভাসমান।
আনোয়ারের কণ্ঠ চিরে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু শক্রর, ভয়ে চিৎকার দেয়া থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করল ও। আত্মরক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল আনোয়ার। খাদে পড়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। হাতে শক্ত কোন কিছু পড়ল না। পায়ের নিচে মসৃণ ঢাল। ঢিবি থেকে ঢাল শুরু হয়ে পাহাড়ী খাদের কিনারায় মিশেছে। ঢিবির ঢালও মসৃণ। কোন শক্ত উদ্ভিদ বা গুল্মলতাও নেই। আত্মরক্ষার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো ওর।
প্রতি সেকেণ্ডে শরীর নিচে নেমে যাচ্ছে। পতন রোধের কোন উপায় নেই। আর মাত্র মিনিট খানেক। শরীর হঠাৎ করে সোজা হয়ে যাবে। ঢিবির ঢালের গা থেকে খসে যাবে হাত। প্রচণ্ড গতিতে ও আছড়ে পড়বে গভীর পাথুরে খাদের তলদেশে।
আনোয়ারের পাশে রয়েছে ক্যাপ্টেন আফজাল। ফিসফিস করে ওকে বলল, আফজাল, নিচে গভীর পাথুরে খাদ, আমি কিনারায় ঝুলছি। বাঁচাও। আফজাল দ্রুত এগুলো ওর দিকে। আনোয়ার পুনরায় চাপাস্বরে বলল, কুইক। ওর প্রায় সম্পূর্ণ শরীর শূন্যে ঝুলছে। শুধু মাত্র হাত দুটো মসৃণ ঢালে এখনও আটকে আছে। আর কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধান। তারপর পুতন।
আফজাল ক্রল করে এগিয়ে চলেছে ওর দিকে। ও শেষ ঝুঁকি নিল। পতন অনিবার্য দেখে ঢিবির ঢাল ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠল শূন্যে। শূন্যে লাফিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিল আফজালের দিকে। আফজাল ওর একহাত ধরে ফেলল। হাত ধরে সে-ও তখন খাদের কিনারায় ঝুলছে। ক্যাপ্টেন আফজাল বুঝতে পারল–ওর পক্ষে একা আনোয়ারের ভারী শরীর টেনে ওঠানো সম্ভব নয়। পাশে পজিশনরত একজন সৈনিককে সে ডাক দিল। তারপর ওরা দুজনে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করল আনোয়ারকে।
.
অ্যাসল্ট কোর্স, চেরাট। এই কোর্সের ব্যাপ্তি বিশাল। অথচ সময় মাত্র আট মিনিট। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ট্রেইনী, অফিসারকে বহু বাধা অতিক্রম করতে হবে। আনোয়ারসহ সমস্ত ট্রেইনী অফিসার পিঠে চল্লিশ পাউণ্ড ওজনের প্যাক, হাতে রাইফেল, পায়ে বুট পরা অবস্থায় এই কোর্সে অংশ নিল ।
টারজান-সুইং করে দড়ির সাহায্যে বিরাট গর্ত পার হওয়া, পনেরো ফুট উঁচুতে মাত্র ছয় ইঞ্চি চওড়া, বিশ ফুট লম্বা ব্রিজ পার হওয়া, দশ ফুট উঁচু দেয়াল ডিঙানো, মাটির ওপর বানানো তিরিশ ফুট লম্বা আঁকাবাঁকা টানেল ক্রল করে অতিক্রম করা এবং এই ধরনের অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে ওদের-মাত্র আট মিনিট সময়ের মধ্যে। এই বাধাগুলো একটার পর একটা সাজানো, দৈর্ঘ্যে প্রায় নয়শো গজ-আধ মাইলেরও ওপরে।
প্রথম দিকে ওরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে পারল না। কিন্তু ক্রমাগত অনুশীলনের পর আনোয়ার মাত্র ছয় মিনিটে এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে শুরু করল। অন্যান্য অফিসাররাও এই কোর্সে যথেষ্ট ভাল ফল দেখাচ্ছে। ওদের অ্যাসল্ট কোর্সে ভাল ফল দেখানোটা বোধহয় মেজর ভর্দগের সহ্য হলো না। তিনি মনে মনে ফন্দি আঁটলেন, কিভাবে ওদের বিপদের মাত্রা আরও বাড়ানো যায়।
একদিন সকালবেলা। কোর্স শুরু হয়েছে। আনোয়ার দড়ির সাহায্যে টারজান-সুইং করবে। ঠিক সেই মুহূর্তে কাছেই প্রচণ্ড আওয়াজে গর্জে উঠল টি.এন.টি.। হঠাৎ করে হাত থেকে দড়ি ফসকে দেয়াটাই ছিল এক্সপ্লোসিভ ফাটানোর উদ্দেশ্য। আনোয়ারের হাত থেকে দড়ি ফসকে গেলে হাসপাতালে যাওয়াটা ছিল অবধারিত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত হাতটা দড়ি থেকে ফসকে গেল না। টারজান-সুইং করে গর্ত পার হয়ে গেল ও; প্রবেশ করল টানেলে।
টানেলের ভিতর উল্টো দিক থেকে বাতাস বইছে। হঠাৎ গর্জে উঠল স্মোক গ্রেনেড। বাতাসের টানে দ্রুত আচ্ছন্ন হলো গোটা টানেল। শ্বাস নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণভাবে কাশতে শুরু করল আনোয়ার। অতি কষ্টে ক্রল করে টানেল পার হলো সে।
সামনে কাঁটাতারের নেট। জালের নিচ দিয়ে ক্রল করে এগুচ্ছে আনোয়ার। গর্জে উঠল মেশিনগান, খুব কাছে। মাথার ওপর বুলেট বৃষ্টি। চমকে উঠল সে। ক্ৰলরত অবস্থায় মুখটা বাড়ি খেলো পাথুরে মাটিতে। দ্রুত নিজের অজান্তেই মাথাটা ওপরের দিকে উঠে গেল আবার। মাথার পেছনের অংশ জোরে ধাক্কা খেলো কাঁটাতারের নেটে। নেটের সংঘর্ষে মাথার পেছনের চামড়া চিরে গেল। এদিকে ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। তবুও সে এগিয়ে চলল। পার হলো কাঁটাতার। শেষে মেজর ভগ সবার সামনে বললেন, জেন্টলম্যান, আমি নিঃসন্দেহে একটা দুষ্ট কাঁটা, তোমার ট্রেনিং দুঃসাধ্য করার জন্যই এসব করেছি। তবে জব্বর দেখিয়েছ তুমি। এভাবেই শেষ হলো চেরাটের অ্যাসল্ট কোর্স।
.
রাওয়ালপিণ্ডি । আর্মি এভিয়েশন বেজ। হেলিকপ্টার রেপেলিং অনুশীলনের জন্য কমাণ্ডোদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আনোয়ার ও মেজর আজমসহ পঁয়ত্রিশজন কমান্ডো সৈনিক এতে অংশ নিল। আর্মি এভিয়েশন বেজ থেকে হেলিকপ্টার উড়ল আকাশে। মাত্র নব্বই ফুট উচ্চতায় উড়ছে কপ্টার। ওরা কয়েক সেকেণ্ড রেপেলিং করে মাটিতে নামল। মাটিতে নামা মাত্র পজিশন নিল সবাই। এরপর অন্য একটা কপ্টার থেকে পঁয়ত্রিশ পাউণ্ড ওজনের শেল নিক্ষেপকারী একটা ফিল্ডগান ওদের সুরক্ষিত পজিশনের মাঝামাঝি জায়গায় নামিয়ে দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পর উড়ে এল আরও একটা যান্ত্রিক ফড়িং। নব্বই ফুট উচ্চতায় উড়তে থাকল এটা। শত্রুদের ধোঁকা দেয়ার জন্য ফড়িংটি উড়ছে আকাশে। এটা দেখে শক্ররা যেন মনে করে, বড় বড় গাছপালা বা এই জাতীয় কোন বাধার জন্য ল্যাণ্ড করতে অসুবিধা হচ্ছে কপ্টারের।
হেলিকপ্টার থেকে অতি সন্তর্পণে দড়ির মই নিচে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ওরা দড়ির মই বেয়ে দ্রুত উঠতে থাকল উপরে। ইতোমধ্যে আরও একটি কপ্টার উড়ে এলে ফিল্ডগানসহ ক্রুরা উঠে গেল তাতে।
উড়ন্ত কপ্টারে রেপেলিং করে চড়া সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। বড় বড় কপ্টারগুলোর ওজন বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে রোটর ব্লেডগুলো মাটির দিকে একটা বাতাসের কুশন তৈরি করে। ফলে বাতাসে নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি হয়। সেজন্য সহজেই কপ্টারের ভারী ওজন বাতাসে ভেসে থাকে। রেপেলিং করে ওপরে ওঠার সময় ওদের এই প্রচণ্ড নিম্নমুখী বাতাসের চাপ ভেদ করে উঠতে হয়। প্রবল বাতাসের চাপ ওদের গতিরোধ করে। একে বাতাসের তীব্র চাপ, তার ওপর পিঠে ভারী ওজনের রূকস্যাক। ওদের শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওরা সবাই কপ্টারে চড়ল। শেষে কপ্টার থেকে কেবলযুক্ত একটা আসন নামিয়ে দেয়া হলো নিচে। যুদ্ধে আহত সৈনিকদের উঠিয়ে নেয়ার জন্য। এইভাবে কয়েকদিন প্রচণ্ড অনুশীলন করল ওরা। তারপর শুরু হলো চূড়ান্ত প্রদর্শনী।
ইন্টারন্যাশনাল শো আঠারোটি বিদেশী রাষ্ট্রের কূটনীতিবিদ ও অভ্যাগতদের ভীড়। সম্মানিত অভ্যাগত ও দর্শকদের মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মহিলাও। রাওয়ালপিণ্ডি আর্মি এভিয়েশন বেজ জমজমাট। অভ্যাগতদের সঙ্গে রয়েছে বহু গাড়ি। যুবক, যুবতী, অভ্যাগত প্রত্যেকের পোশাক পরিচ্ছদে আভিজাত্যের ছাপ। সবাই হেলিকপ্টার রেপেলিং দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। তৎকালীন পাক সেনাবাহিনীতে এই ধরনের শো এটাই প্রথম। সেজন্য কপ্টার রেপেলিংটা দর্শকদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।
আনোয়ার ও মেজর আজম পঁয়ত্রিশজন কমাণ্ডো সোলজার নিয়ে প্রস্তুত। বিশাল এয়ারফিল্ডের এক প্রান্তে ওদের কপ্টার অপেক্ষারত। কিছুক্ষণ পর ওয়্যারলেসে মেসেজ এল কপ্টার উড্ডয়নের। ওরা দ্রুত কপ্টারে চড়ে উড়ল আকাশে। দর্শকদের সামনে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে একই জায়গায় স্থির হয়ে উড়ছে যান্ত্রিক ফড়িংটা।
মেজর আজম ককপিটে। অলটিমিটারে নব্বই ফুট উচ্চতা মেইনটেইন করার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। আনোয়ার দ্রুত দর্শকদের দিকের দরজা খুলে ফেলল। দরজার দুই কোনা শক্ত করে ধরে শরীর বাইরে ঝুলিয়ে দেখে নিল চারপাশ। প্রায় একশো ফুট লম্বা একটা নাইলনের দড়ি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে কপ্টার থেকে। দড়ির ওপরের মাথা কপ্টারের সঙ্গে মজবুত করে বাঁধা।
আনোয়ার সৈনিকদের রেপেলিং করে নিচে নামার নির্দেশ দিল। রেপেলিং করে চারজন সৈনিকের নিচে অবতরণের পর ও পেটের সঙ্গে আটকানো ডি-রিংয়ের (ডি আকৃতির) ভিতর বিশেষ কায়দায় নাইলনের দড়িটা গলিয়ে দিল। তারপর তৈরি হলো রেপেলিং-এর জন্য। ওর হাতে স্কিন গ্লাভস্। দ্রুত এগিয়ে গেল। আনোয়ার দরজার দিকে।
মুহূর্তে অদৃশ্য হলো ওর ভারী শরীরটা কপ্টারের বাইরে। মাটিতে অপেক্ষা করছে চারজন কমাণ্ডো সৈনিক। আনোয়ার নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল, ওদের দ্রুত পজিশন নেয়ার জন্য। সৈনিকরা বৃত্তাকারে পজিশন নিল। এদিকে একের পর এক অবশিষ্ট সৈনিকরা রেপেলিং করে নিচে নেমে এল কপ্টার থেকে। মেজর আজম ওপর থেকে সৈনিকদের পজিশন পর্যবেক্ষণ করে ওকে রিপোর্ট পাঠালেন।
ওকে রিপোর্ট পাঠানোর পরপরই আকাশে উড়ে এল দ্বিতীয় যান্ত্রিক যান। ওদের পজিশন এলাকার মাঝামাঝি অবস্থানে ভাসছে যানটি। এটার পেটের সঙ্গে স্টীলের কেবল সংযুক্ত একটি ঝুলন্ত ফিল্ডগান। ধীরে ধীরে নামতে থাকল গানটি। মাটি স্পর্শ করতেই কপ্টার থেকে স্টীলের কেবল খুলে নেয়া হলো।
সৈনিকরা ফিল্ডগানটি বসাল ফায়ারিং পয়েন্টে। শুরু হলো ফায়ারিং। প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে উঠল রণাঙ্গন। পঁচিশ পাউণ্ড ওজনের শেল নিক্ষেপকারী ফিল্ডগান গজরাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু গোলা বেরুচ্ছে না। এটা ব্ল্যাংক ফায়ার। আনোয়ার স্বস্থানে তৈরি প্রতিপক্ষের হামলা মোকাবেলার জন্য। এলোপাতাড়ি ফায়ারিং করে ওরা একটা সুন্দর কাল্পনিক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে ফেলল। হঠাৎ করে থেমে গেল ফায়ারিংয়ের আওয়াজ । চারদিকে নেমে এল শীতল নীরবতা।
একশো ফুট উচ্চতায় প্রথম কপ্টারটি শূন্যে ভাসছে। দ্বিতীয় কপ্টারটি নেমে এল ফিল্ডগানের কাছে। ইঞ্জিন বন্ধ হলো না এটার। স্টীলের কেবল দিয়ে ফিল্ডগান আটকানো হলো কপ্টারের সঙ্গে। ফিল্ডগানের ক্রুরা উঠে গেল ওপরে। গানসমেত দ্রুত আকাশে ভাসল যান্ত্রিক ফড়িংটি।
প্রথম কপ্টারের দরজায় মেজর আজম ও কয়েকজন কমাণ্ডো সৈনিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কপ্টারের নিচে একটা নাইলনের দড়ি ঝোলানো। রেপেলিং করে নিচ থেকে সৈনিকরা উঠে যাচ্ছে ওপরে। ওদের কভার দিচ্ছেন মেজর আজম ও কয়েকজন কমাণ্ডো সৈনিক। হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান। একে একে সমস্ত সৈনিকরা চড়ল কপ্টারে। তখনও আনোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে। একাকী। সে একজন যুদ্ধাহত সৈনিককে পাহারা দিচ্ছে। উড়ন্ত কপ্টার থেকে কেবলযুক্ত একটা আসন নিচে নেমে এল। আহত সৈনিককে আসনে চড়িয়ে দিল আনোয়ার। যুদ্ধাহত সৈনিকসহ যন্ত্রচালিত আসন উঠে গেল ওপরে। এরপর আনোয়ার রেপেলিং করে কপ্টারে চড়ছে ধীরে ধীরে। পরক্ষণে কপ্টারসহ হারিয়ে গেল দূর আকাশে। পুরো দৃশ্যটা চিত্রায়িত হলে টিভি ক্যামেরায়। অফিসার্স মেসে বসে টেলিভিশনে দৃশ্যটা দেখল আনোয়ার।
১৩.
জুলাই মাস। একটা অনুশীলন চলছে। আনোয়ারসই ষোলোজন অফিসার আটক দুর্গের বাইরে। ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে শত্রুর হাতে তাড়া খাচ্ছে ওরা। কৌশলে ওরা শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিচ্ছে। বেশ কয়েকদিন হলো পেটে কিছু পড়েনি। ওদের দুর্বল শরীর, তার ওপর অমানুষিক পরিশ্রম। একদিন হাঁটল সারা রাত। শেষ রাতে ওরা নিরাপদে পৌঁছল আটক দুর্গের অভ্যন্তরে। বাকি রাতটুকু সকলে অফিসার্স মেসের চত্বরে কাটিয়ে দিল।
সকাল। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় সবাই প্রবেশ করল ডাইনিংয়ে। বিশাল ডাইনিং টেবিলে থরে থরে ব্রেকফাস্ট সাজানো। বেশ কয়েকদিন পর রাজকীয় আয়োজন দেখে ওদের জিভ গড়িয়ে পানি ঝরার উপক্রম। গোগ্রাসে খেতে শুরু করল ষোলোজন ক্ষুধার্ত ট্রেইনী কমাণ্ডো।
হঠাৎ ডাইনিংয়ের দরজায় সাব-মেশিনগান লোড করার আওয়াজে ওরা চমকে ফিরে তাকাল। সবেমাত্র কয়েক গ্রাস পেটে গিয়েছে। ফলে খিদেটা ভয়ানকভাবে চাগিয়ে উঠেছে। প্রত্যেক দরজায় শত্রু-হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান। লোডেড। শত্রুদের ভাবলেশহীন চেহারা, যেন পাষাণমূর্তি। ওদের স্থির দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা ঝিকমিক করছে।
কঠিন কণ্ঠে নির্দেশ এল, হ্যাণ্ডস আপ। কলজে হিম করা কণ্ঠস্বর। ট্রেইনীরা বুঝতে পারল, সিরিয়াস কোন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও ওদের মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব। এটা সিরিয়াস কোন কৌতুক নয়তো? শত্রুপক্ষ আবার নির্দেশ দিল, সবাই মেঝেতে বুক ডনের পজিশন নাও। পজিশন নিতে দুজন অফিসারের একটু বিলম্ব হওয়াতে পিঠে সাব-মেশিনগানের প্রচণ্ড গুতো খেয়ে ওরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আনোয়ার মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল। এটা কোন কৌতুক নয়। মারাত্মক কোন ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু কি সেটা, বোঝ যাচ্ছে না। চিন্তা করার তেমন কোন অবকাশও দিচ্ছে না শত্রুপক্ষ। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আদেশ মানতে কোনরকম ত্রুটি করাটা আপাতত উচিত হবে না। কৌশলে এদেরকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে হবে। নইলে নির্ঘাত প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন। তারপরও কি অবস্থায় নিস্তার মিলবে জানা নেই। সাব-মেশিনগানধারীরা ট্রেইনীদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে নিল। শুধু আণ্ডারওয়্যার রইল ওদের পরনে। তারপর প্রত্যেকের হাত-পা, চোখ এঁটে বাঁধল ওরা।
আনোয়ার এই অবস্থায় একজনকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কি? সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল, সুসরাল যায়েগা। অর্থাৎ শ্বশুর বাড়ি যাবে। ওদের পা দড়ি দিয়ে বাঁধলেও একটু ফাঁক রাখা হয়েছে, যাতে ধীরে ধীরে হাঁটা যায়। প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। হুকুম হলো উঠে দাঁড়াবার। এ অবস্থায় শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে উঠে দাঁড়ানো সহজ নয়। ট্রেইনী কমাণ্ডোরা উঠে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একটু বিলম্ব হওয়াতে শুরু হলো বৃষ্টির মত কিল, ঘুসি, লাথি। লাথির চোটে অনেকেই ককিয়ে উঠল। লাথি, ঘুসি খেতে খেতে কোনমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার। তারপর ওদের ডাইনিং থেকে ঠেলে বের করে নিয়ে আসা হলো বাইরে। এদিকে প্রচণ্ড এলোপাতাড়ি মার অবিরাম চলছে। আনোয়ার ঠোঁটের কোণে নোনা স্বাদ পেল। জিভ দিয়ে চেটে বুঝতে পারল, রক্ত গড়াচ্ছে। ঘুসি ও থাবড়ার চোটে চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে।
শুরু হলো নগ্নপায়ে পথ চলা। ওদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ওদের চলার পথে তীক্ষ্ণ কাঁটাঝোঁপ শুরু হলো। তীক্ষ্ণ কাটা পায়ের নরম তালুতে ফুটে ভিতরে ভেঙে যাচ্ছে। চারদিক ভরে গেল আর্তচিৎকারে। আনোয়ারের চোয়ালের মাংসপেশী কঠিন হয়ে উঠল। ওর মুখ দিয়ে কোন রকম বেদনার্ত ধ্বনি বেরুচ্ছে না। নীরবে সইছে সমস্ত ব্যথা। আর্তচিৎকারকারী অফিসারদের ঘুসি, লাথি ও বেতের বাড়ি উপরি পাওনা হিসেবে জুটছে। এক সময় শেষ হলো কাঁটাওয়ালা পথ। প্রত্যেকের পা ক্ষতবিক্ষত। আনোয়ারের মনে হলো, ওর পায়ের তলায় শত শত কাঁটা ফুটে ভেঙে রয়েছে।
মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ ওদের কানে ভেসে আসছে। জি.টি. রোডের পাশ ঘেঁষে চলেছে ওরা। আনোয়ার দৌড়ে পালানোর চিন্তা ছেড়ে দিল। এখন সমস্ত বাঁধন খুলে দিলেও দৌড়ে পালানোর উপায় নেই, পায়ের তালুতে ফুটে থাকা কাঁটাগুলো বের না করা পর্যন্ত। অতি কষ্টে হেঁটে চলেছে ওরা।
বহু বেসামরিক গাড়ি ওদের পাশে ব্রেক করে থেমে যাচ্ছে। ব্যাপার কি? আরোহীদের কৌতূহলী. প্রশ্ন। শত্রুপক্ষের কেউ কেউ জবাব দিচ্ছে, ফরেন স্পাইস। গাড়ির আরোহীরা চিৎকার করে বলছে, শালাদের পিটিয়ে মেরে ফেলো। দুই একজন অতি উৎসাহী আরোহী পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় কষে চপেটাঘাত আর লাথিও এনাম দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আনোয়ারের মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই। কারণ কমাণ্ডো জীবন ওকে সবরকম ঘটনা সহ্য করার জন্য তৈরি করে ফেলেছে।
ঢালু রাস্তা বেয়ে নামছে ওরা। আচমকা লাথির চোটে কেউ কেউ গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। আবার কেউ হোঁচট খেয়েও গড়াচ্ছে। আনোয়ার সাবধানের সঙ্গে নামছে ঢালু পথ বেয়ে। হঠাৎ পিঠে প্রচণ্ড বুটের লাথি। ছিটকে গড়িয়ে পড়ল সে। পাথুরে রাস্তা। অমসৃণ। ছোট বড় পাথরের ডগা বেরিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ ডগার আঘাতে ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গার চামড়া চিরে গেল। গড়াতে গড়াতে একটা শক্ত পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেলো ওর ভারী শরীর।
অতিকষ্টে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার। আবার শুরু হলো পথ চলা। কিছুক্ষণ চলার পর ওরা পৌঁছাল একটা হলরূমে। বিশাল আকৃতির হলরূম। একেকজন প্রবল ধাক্কায় ছিটকে পড়ল কঠিন মেঝের ওপর। আনোয়ার বুঝল এটা বেগম-কি-সরাই। সরাইয়ের চারদিকে শুরু হয়েছে বাবাগো, মাগো বিভিন্ন ধরনের কাতরানি। কারও কারও মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে চাপা গোঙানি। এ যেন এক নারকীয় পরিবেশ।
আনোয়ার পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় ডান কাতে শুয়ে আছে। হঠাৎ একটা বুট পরিহিত ভারী পা পড়ল ওর গালের ওপর। ভারী বুটের চাপ ক্রমশই বাড়ছে। নিচে অমসৃণ পাথুরে মেঝে। গালের নরম মাংস থেঁতলে যাচ্ছে বুটের চাপে। তীব্র ঘষায় গালের চামড়া ছিঁড়ে গেল। বাম পাশে ফিরতেই চটচট করে উঠল গাল। ওর সারা গালে রক্ত। পাশ ফিরতেই শুরু হলো তীব্র জ্বলুনি।
বুট দিয়ে দলাই মলাই করাতে ওর প্রায় সারা মুখের চামড়া উঠে গেছে। দগদগে ক্ষতস্থানগুলো থেকে রক্ত ও কস বের হচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে। এবারে অচেনা বুটওয়ালা ওকে পেছন দিক থেকে ধাক্কা মেরে উপুড় করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে নাকটা ঠুকে গেল মেঝেতে। থেঁতলে গেল নাকের নরম হাড়। প্রচণ্ড ব্যথা ও জ্বলুনি নীরবে সহ্য করতে না পেরে এই প্রথমবারের মত আনোয়ারের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল ইস্। তারপর নিশ্চুপ । কোনরকম নড়াচড়া নেই।
কিছুক্ষণ অমানুষিক অত্যাচারের পর ওকে শোয়ানো হলো। ওর মুখমণ্ডলের অংশটা প্রায় অবশ। হঠাৎ ও টের পেল, ওর মুখে তুলো দিয়ে কি যেন চেপে ধরা হচ্ছে। মুখের নরম ক্ষতস্থানগুলো জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। টিংচার আয়োডিন! সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। টিংচার আয়োডিনের সংস্পর্শে ক্ষতস্থানগুলোর জ্বালা লক্ষগুণ বেড়ে গেল নিমেষেই। অসহ্য। ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল আর্তচিৎকার, স্প ইট। পিঠের ওপর দ্রুত পড়ল, ভারী ওজনের লাথি। কেউ একজন বলে উঠল, ওহো এটার এখনও তেজ কমেনি।
শুরু হলো সজোরে লাথি দিয়ে গড়ানো। আনোয়ারের ভারী শরীরটা গড়িয়ে চলেছে। কখনও শরীরের নিচে তীক্ষ্ণ পাথর পড়ছে, কখনও কাঠির খোঁচা লাগছে, আবার কখনও কাঁটাঝোঁপের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শরীর। ওর শরীরের প্রতিটি বোন জয়েন্ট বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হলো। তবুও নিস্তার নেই। অত্যাচারের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
বাইরের তাপমাত্রা একশো বাইশ ডিগ্রী ফারেনহাইট। আনোয়ারের শরীর দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে দরদর করে। পিপাসায় ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত। মুখের ভিতরটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কাঁটাবিদ্ধ পায়ের তলায় তীব্র ব্যথা। গড়িয়ে চলা হঠাৎ করে বন্ধু হলো এক সময়।
তারপর ওর পা ধরে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলল বুটধারীদের একজন। পিঠের নিচে উত্তপ্ত বালি। বালি তো নয়, যেন গনগনে আগুন। পুড়ে গেল পিঠের চামড়া–আর ঘষা খেয়ে সেগুলো আরও দগদগে ঘায়ে পরিণত হতে লাগল। কিছুদূর টেনে হেঁচড়ে চলার পর ওকে ফেলে রাখা হলো বালির ওপর।
আনোয়ারের এখনও ক্ষীণ চৈতন্য আছে। আর সবার অবস্থা কেমন কে জানে। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবী থেকে বহুদূরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আবার পৃথিবীটা সচল হয়ে উঠছে। পুনরায় হারিয়ে যাচ্ছে সে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো। সারা শরীর ঘিরে ক্লান্তি, অবসাদ। এখন শুধু চাই বিশ্রাম, অফুরন্ত বিশ্রাম। একসময় উত্তপ্ত বালির ওপর ক্লান্ত আনোয়ার ঘুমিয়ে পড়ল অসহায়ের মত।
হঠাৎ তন্দ্রার ভাবটা ছিন্ন হয়ে গেল ওর। ওরে বাবারে, ওরে মারে তীব্র আর্তচিৎকার। চিৎকারগুলো ওর কানে অস্পষ্ট। শ্রবণশক্তিও প্রায় অকেজো। ও শুধু ভাবছে, যন্ত্রণাকাতর দেহটা কখন চেতনাশূন্য হবে। দুই বগলের নিচে এবং আণ্ডারওয়্যারের তলে দপ করে জ্বলে উঠল। কে যেন গনগনে পাথরের কুচি ঢুকিয়ে দিয়েছে। এরপর অবিশ্বাস্য ভাবে বিশাল আকারের একটা পাথর চাপিয়ে দেয়া হলো মৃতবৎ শায়িত, আনোয়ারের বুকের ওপর। বাঁচার ক্ষীণ আশাটুকুও দূর হয়ে গেল। গরম পাথরের কুচি আণ্ডারওয়্যারের নিচে আটকে রয়েছে। ভিতরটা ধীরে ধীরে পুড়ছে। বগলের নিচের চামড়াও পুড়িয়ে দিচ্ছে উত্তপ্ত পাথর। বুকের ওপর বিশাল ভারী পাথরের জন্য শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সাহায্যের বিন্দুমাত্র আশা নেই। মৃত্যু আসন্ন। অথচ ইচ্ছে করলেই এধরনের মৃত্যুকে এড়ানো যায়। আনোয়ারের মনটা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠল। কিন্তু বড় দেরিতে। এখন সে অসহায়। পায়ের তালু কাঁটাবিদ্ধ। সারা শরীর পাথরের আঘাতে ও লাথির চোটে ক্ষতবিক্ষত। পাথরের কুচি শরীরের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে–নিচে উত্তপ্ত বালি। তার ওপর অসহ্য তাপমাত্রা–তৃষ্ণায় কণ্ঠতালু শুষ্ক।
শত্রুরা ঠাণ্ডা পানীয় পান করছে অদূরে। গ্লাসে ঠোকাঠুকি ও বরফ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল আনোয়ার। কয়েকটা বরফের ছোট ছোট টুকরো ছিটকে পড়ল শরীরে। এগুলো ইচ্ছাকৃত তা বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। তবুও মুখ হাঁ করে রইল আনোয়ার। যদি ছিটকে দুই একটা বরফের টুকরো মুখের ভিতর পড়ে। হাঁ করা মুখটা সত্যিই ভরে গেল; কিন্তু বরফে নয়। গনগনে বালিতে। প্রায় গলার নিচ পর্যন্ত পৌঁছে গেল বালি। বুকের ওপর ভারী পাথরের জন্য অতিকষ্টে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ওর। মুখের ভিতর বালি দেয়ার জন্য নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল । দমবন্ধ করে অতিকষ্টে বালিগুলো মুখ থেকে ফেলে দিল সে। অবশিষ্টটুকু গিলে ফেলল। আবার শুরু হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেল।
বুটধারীদের একজন বলে উঠল, কে কে পানি খাবে? কেউ কোন উত্তর দিল না। আরেকজন বলল; সত্যি বলছি। আমরা ঠাট্টা করছি না। শুধু একটু হাঁ করো। ঠাণ্ডা পানি দিচ্ছি। সবাই নিশ্চুপ। মুখ বন্ধ করে আছে ওরা। কারণ হাঁ করলেই মুখে বালি
অথবা ওই জাতীয় কিছু দেয়া হবে।
আনোয়ারের কাছে একজন এসে ফিসফিস করে উঠল, পানি খাবে?
হ্যাঁ, দুর্বল কণ্ঠ আনোয়ারের।
তাহলে একটু হাঁ করো। কিন্তু সে মুখ খুলল না কিছুতেই। বরফগলা ঠাণ্ডা পানির গ্লাসের ছোঁয়া পেল গালে।
তোমাকে পুরো এক গ্লাস পানি দেব। শুধু একটু হাঁ করো।
তবুও মুখ খুলল না। গালে ঠাণ্ডা পানির পরশে ভিতরটা ছটফট করছে ওর। কিন্তু মুখ খুললেই পড়বে ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে গরম বালি। অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করল আনোয়ার।
মুখ যখন খুলবেই না, তবুও তোমাকে পানিটা দিয়ে যেতেই হবে। বলেই লোকটা ওর মুখের ওপর পানির গ্লাসটা উল্টে দিয়ে চলে গেল। ক্ষণিকের জন্য শীতল পানির পরশ দারুণ আরাম দিল। তারপর ক্ষতস্থানগুলো জ্বলে উঠল তীব্রভাবে। জিভ দিয়ে চেটে যতদূর পারা যায় পানির স্বাদ নিল আনোয়ার। এইভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা অতিবাহিত হলো।
ওর বুক থেকে পাথরটা সরে গেল হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো দুর্গের ভিতর । দুর্গের এক প্রান্তে সবাই ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছে। প্রত্যেকের শরীরে অমানুষিক অত্যাচারের চিহ্ন পরিস্ফুট। শত্রুরা লাঞ্চ করছে অদূরে বসে। গন্ধে বোঝা যাচ্ছে সুস্বাদু খাবার। গন্ধ দিয়ে ক্ষুধা বাড়িয়ে তুলতে চাইছে শত্রুরা। মাঝে মাঝে কৌতুক করে দুই একটা হাড্ডিও ছুঁড়ে মারছে ওরা ওদের দিকে।
শেষ হলো লাঞ্চ। হঠাৎ দুলে উঠল আনোয়ারের শরীর। শত শত বৃশ্চিক যেন কামড়ে দিল। কিন্তু মুহূর্তে ভুল ভাঙল ওর। অসংখ্য সুচবিদ্ধ একটা ব্রাশ দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে ওর শরীরে। চারদিকে ইস্, উহ্, আহ্ যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি। ঘাড় থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত এবং দুই হাতের প্রতিটি ইঞ্চি সুচবিদ্ধ হলো। কাতরাতে কাতরাতে এক সময়ে আর সে শক্তিও রইল না। ইতোমধ্যে ওর সমস্ত অনুভূতিশক্তি প্রায় ফুরিয়ে গেছে। দ্বিতীয় দফা সুচ ফোঁটানোর পর বন্ধ হলো সুচওয়ালা ব্রাশের আঘাত।
এবারে শুরু হলো জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে পোড়ানো। আনোয়ারের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরা হচ্ছে। তাজা মাংসের পোড়া গন্ধে চারদিকের বাতাস ভরপুর। ওর শরীর দুএকবার কেঁপে কেঁপে থেমে গিয়েছে। হঠাৎ শক খাওয়ার মত চমকে উঠল আনোয়ার। একটি জ্বলন্ত সিগারেট ধীরে ধীরে নাকের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ভিতরে। তীব্র কণ্ঠে অকথ্য গালি দিয়ে উঠল সে, ইউ মীন বাস্টার্ড। স্প- ইট। নাকের ভিতর জ্বলন্ত সিগারেট গলিয়ে দিতে দিতে অচেনা লোকটি বলে উঠল, সত্যি আমি একটা মীন বাস্টার্ড। তবে এই দাওয়াই তোমাকে নিতে নাকের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছল সিগারেট। জ্বলন্ত সিগারেটের ঘর্ষণে নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তক্ষরণে একসময় সিগারেটটি নিভে গেল। আনোয়ারের মনে অনিশ্চিত আতঙ্ক, না জানি এরপর আবার কি বিপদ আসে। সামনে কি ধরনের যন্ত্রণা-আল্লাহই জানেন।
নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। শুরু হলো আবার হাঁচড়েপাঁচড়ে চলা। ওদের ক্রমশই ওপরের দিকে উঠতে হচ্ছে। আনোয়ার আন্দাজ করল মেইন অফিসের দিকে চলেছে ওরা। মেইন অফিস প্রায় দুশো ফুট উঁচুতে। চড়াই অতিক্রম করে এই পথটুকু পৌঁছতে ওদের প্রায় একঘণ্টা সময় লেগে গেল।
ঘড়ঘড় শব্দে খুলে গেল, একটি লোহার গরাদ। কামরাটি আয়তনে বেশ বড়। একটাই মাত্র দরজা । কোন জানালা নেই। উঁচু দেয়াল-এর ওপরে ছোট ছোট কয়েকটি ভেন্টিলেটর। এই দেয়ালঘেরা কামরায় বন্দী করা হলো ট্রেইনী কমাণ্ডোদের। সেই সঙ্গে প্রত্যেকের চোখের বাঁধন খুলে দিল শত্রুপক্ষ। বাধন খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তীব্র আলো জ্বলছে বন্দীশালায়। আলোর দিকে চাইলে চোখ অন্ধ হওয়ার উপক্রম। কেউ ওপরের দিকে তাকাতে পারছে না। একমাত্র লোহার গরাদটিও বন্ধ হয়ে গেল ঘটাং করে। সবাই নির্বিকার। কারও দিকে তাকানোর উপায় নেই। ঠোঁট, নাক, মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, সমস্ত শরীর আঘাতে জর্জরিত। প্রত্যেকের মাথার চুলে বালি ও মাটি-রক্তের সঙ্গে চাপ ধরে আছে।
এভাবে নির্যাতন আর সহ্য করা যায় না। কিছু একটা করা উচিত। কিন্তু কি করা উচিত, এ সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারল না। বন্দীশালায় চাপাস্বরে আলোচনা চলছে। আনোয়ার ধীরে ধীরে বলল, আগে আমাদের দেখতে হবে ঘরটা মজবুত কেমন। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুরু হলো ঘর পরীক্ষার পালা। বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি দেয়ালগুলো উঁচু। দ্বিতীয় কোন দরজা নেই। নিরস্ত্র অবস্থায় দেয়াল ভেঙে পালানো কোনমতেই সম্ভব নয়। বাতিল হয়ে গেল দেয়াল ভেঙে পালানোর প্ল্যান।
সামনে লোহার গেটে সশস্ত্র সেন্ট্রি সর্বক্ষণ পাহারারত। এখন পালানোর একটাই মাত্র পথ। পরাস্ত করতে হবে সশস্ত্র শত্রুদের তারপর পালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওদের শরীরের যে অবস্থা, তাতে সশস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ঝুঁকির ব্যাপার। তবুও ট্রেইনীরা সিদ্ধান্ত নিল, সুযোগ এলেই ওদের কাবু করে পালাতে হবে। শেষে ওরা চোখ বন্ধ করে নেতিয়ে পড়ল বিশ্রামের কোলে। যাতে দুর্বল শরীর কিছুটা লড়াইয়ের উপযোগী হয়।
হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই–কর্কশ বাজনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল বন্দীশালা। ধাতব পাতের সংঘর্ষ, পাথরের ঘর্ষণ, রক্তহিম করা আর্তচিৎকার, হিসহিস, খলখল, হাঃ হাঃ হাঃ, হাসির আওয়াজ, পাগলের প্রলাপ, বিস্ফোরকের আওয়াজ প্রভৃতিতে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো ঘর। বন্দীশালার উঁচু ছাদে বিশাল আকৃতির চারটে লাউড স্পীকার। শক্ররা, কোথাও স্টেরিওগ্রাম অন্ করেছে। সেই শব্দ লাউড স্পীকারে ভেসে আসছে। ভীষণ অস্বস্তি শুরু হলো বন্দীদের মাঝে।
কানে আঙুল দিয়েও কেউ রেহাই পাচ্ছে না। একনাগাড়ে বেজে চলেছে বিশ্রী বাজনা। মুহূর্তের মধ্যেই সৃষ্টি হলো এক ভৌতিক পরিবেশ। বন্দীদের মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে বৃহৎ আকারের চারটে লাউড স্পীকারের পচা বমি। ওদের মাথায় শুরু হলো অসহ্য যন্ত্রণা। কানের পাতলা পর্দা যে-কোন মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে।
আনোয়ারসহ কয়েকজন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে বীভৎস অত্যাচার। কিন্তু সবাই সহ্য করতে পারল না। কয়েকজনের শরীরে শুরু হলো ভীতিকর খিচুনি। আনোয়ার দ্রুত গড়িয়ে অসুস্থদের কাছে গেল। ওদের কানের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কেমন বোধ করছ? কিন্তু কোন উত্তর দিল না অসুস্থরা। ভয়ানকভাবে পাথুরে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সারা শরীরে প্রচণ্ড খিচুনি। মুখ দিয়ে গোঙানির সঙ্গে লালা গড়াচ্ছে। যে-কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারে। নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় আক্রান্ত বন্দীরা।
রাগে অন্ধ হয়ে গেল আনোয়ার। দৌড়ে গেল লোহার গরাদের কাছে। চিৎকার করে উঠল শক্রদের উদ্দেশে, আমরা যে-কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারি। তোমরা বন্ধ করো এই বিশ্রী বাজনা। প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। একেবারে নিশ্চুপ। এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা পার হলো। হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল লোহার গরাদ। ঘরের মাঝে প্রবেশ করল কয়েকজন যমদূত। ওদের হাতে লিকলিকে বেতের চাবুক। ওরা এদের পেটাতে শুরু করল বেধড়ক। চাবুক মারা শেষে ইবলিসগুলো দ্রুত বের হয়ে গেল বন্দীশালা ছেড়ে। গরাদও বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর লাউড স্পীকারের অত্যাচারও মিলিয়ে গেল। হলঘরে, নেমে এল প্রশান্তি। ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রাত কত হয়েছে বোঝা মুশকিল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পেটের নাড়িভুড়ি জ্বলে যাচ্ছে। ওদের ঢুলু ঢুলু চোখ। নিদ্রার ভাব থাকা সত্ত্বেও কেউ ঘুমাতে পারছে না। সবাই নির্জীবের মত পড়ে আছে মেঝের ওপর। কারও কোন সাড়া নেই।
আবার ঘটাং করে উঠল লোহার গরাদ। খুলে গেল দরজা। প্রবেশ করল একজন জালেম! দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র সেন্ট্রি। বন্দীরা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ইবলিসের হাতে পানির পাত্র, গ্লাস ও একঝুড়ি রুটি। ক্ষণিকের জন্য ওরা ভুলে গেল সমস্ত যন্ত্রণা। দুশমনটা, ওদের সবাইকে একটা লুচি আকারের শুকনো রুটি ও আধ গ্লাস করে পানি দিল খেতে। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল রুটি ও পানির ওপর। নির্জীব শরীরে সামান্য কিছুটা শক্তি ফিরে এল ট্রেইনীদের।
ইবলিসটা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্ধ হলো লোহার দরজা। এবং আবার শুরু হলো পৈশাচিক বাজনা। ওরা আবার হারিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণার সাগরে। অসহ্য যন্ত্রণায় কয়েকজন পাগলের মত লম্পঝম্প শুরু করে দিল। মিনিট দশেক পর পুনরায় থেমে গেল শব্দত্রাস। বন্দীদের মাঝে আবারও নেমে এল প্রশান্তি। কিন্তু সবাই আতঙ্কিত হয়ে রইল, যে-কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে পৃথিবীর জঘন্যতম কর্কশ সুরলয়হীন বাজনার খিচুড়ি।
সময় যেন স্থির হয়ে গেছে ওদের জন্য। শম্বুকগতিতে গড়িয়ে চলেছে প্রহর। আনোয়ার ধীরে ধীরে মাথা তুলল মেঝে থেকে। সবার দিকে চাইল সে। ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়া, ক্যাপ্টেন চিমা, ক্যাপ্টেন মালেক নূর ওর দিকে তাকিয়ে আছে করুণ দৃষ্টি মেলে। অন্যরা পড়ে রয়েছে স্থির হয়ে। আনোয়ার হেঁচড়ে এগিয়ে যেতে লাগল ওদের দিকে। সেই মুহূর্তে খুলে গেল লোহার গরাদ। প্রবেশ করল একদল অস্ত্রধারী। শুরু হলো এলোপাতাড়ি মার। মুহূর্তে বদলে গেল হলঘরের চেহারা। ওদের দেহ থেকে পাথুরে মেঝেতে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে। ক্যাপ্টেন চিমা উহ্ মাগো বলে চিৎকার করে উঠল। চিমার বাম হাত বেকায়দা ভঙ্গিতে মুচড়ে ধরেছে এক ভয়ঙ্কর দুশমন। সারা বন্দীশালা জুড়ে আর্তচিৎকার। আনোয়ারের কপালটা বেপভাবে ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণ চিরে রক্ত ঝরছে। ঘুসির চোটে বাম চোখ দিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছে না ও। ফোলা মাংসের আড়ালে চোখটা ঢাকা পড়ে আছে। সারারাত ধরে চলল এই নারকীয় নির্যাতন।
পরদিন সকাল । ওদেরকে বের করে আনা হলো হলরুম থেকে। এবার শুরু হলো নতুন কায়দায় নির্যাতন। ক্যাপ্টেন আহমেদ জিয়াকে উল্টো করে ঝোলানো হলো। প্রচণ্ড ঝটকায় চিপের একগোছা চুল উঠে গেল জিয়ার। ওর কণ্ঠচিরে মরণ আর্তনাদ বেরুচ্ছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে একই ধরনের চিৎকার। ক্যাপ্টেন জানজুয়াকেও টাঙানো হলো উল্টো করে। এক বালতি পায়খানা ও প্রস্রাবের মধ্যে চুবানো হলো ওর মাথা। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল বেচারা।
আনোয়ার চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বিচিত্র কায়দায় নির্যাতন চলছে ওর ওপর। ভয়ানকভাবে হাঁপাচ্ছে সে। একজন শত্রু এগিয়ে গেল ওর দিকে। হাতে চকচকে ধারাল ব্লেড। ফস করে ব্লেড দিয়ে কয়েকটা পোচ দিল আনোয়ারের নিতম্বের ওপর। দুফাঁক হয়ে গেল নিতম্বের মাংস। প্রথমে সাদা, তারপর লাল হয়ে উঠল পোঁচ দেয়া অংশগুলো। সামান্য দুলে উঠল ওর শরীরটা। মুখটা হাঁ হয়ে আছে ওর। পানি-আনোয়ারের কণ্ঠস্বর। একজন শত্ৰু এগিয়ে এসে ওর মুখে প্রস্রাব করে দিল। ও প্রথমে বুঝতে পারল না–কি খাচ্ছে। পানি নাপ্রস্রাব? ভীষণ নোনতা ও বিস্বাদ বলে মনে হলো তরল পদার্থটাকে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল পদার্থটা কি, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। প্রায় সবটুকু তরল পদার্থ গলাধঃকরণ করেছে আনোয়ার। বাকিটুকু মুখ কাত করে ফেলে দিল।
উহ্-আবার চিৎকার। আনোয়ারের ক্ষতস্থানগুলোতে লবণ চেপে ধরা হচ্ছে। শরীরের প্রতিটি শিরা দপ দপ করছে অসহ্য যন্ত্রণায়। ও জড়ানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, মেরে ফেলল আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিয়ো না। প্রতিটি ক্ষতস্থান লবণে পরিপূর্ণ। সদ্য জবাই করা মুরগির মত ছটফট করছে ওর দেহটা। ধীরে ধীরে শরীরটা নিথর হয়ে গেল আনোয়ারের; যেন প্রাণহীন, নিস্পন্দ।
ছোট একটি খাদ। থিকথিকে। বহুদিনের পুরানো পায়খানা, প্রস্রাব জমে রয়েছে। খাদটি দুর্গের একপ্রান্তে। শুধু পায়খানা, প্রস্রাবই নয়–দুর্গের যাবতীয় ময়লা ফেলা হয় এখানে। নোংরা ও দুর্গন্ধে ভরা। সবাইকে এলোপাতাড়িভাবে মারতে মারতে শত্রুরা নিয়ে চলল সেদিকে। তারপর বন্দীদের চোবানো হলো সেই নোংরা কাদার মধ্যে।
পুরো দিনটা ওদের কেটে গেল পায়খানা প্রস্রাব ভরা খাদের মধ্যে। বিকেলের দিকে ওরা এক অপ্রস্তুত অবস্থার সম্মুখীন হলো। পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল তরুণী এসেছে, ঐতিহাসিক আটক দুর্গ পরিদর্শনে। যুবতীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দুর্গের চওড়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দুর্গ দেখছে। ভ্রমণরত একদল যুবতী খাদের পাশ ঘেঁষে দেয়ালের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। নিচে তাকিয়ে ওরা অস্ফুটস্বরে চিৎকার করে উঠল, হায় আল্লা, ইয়ে লোগো কো ইয়ে হালাত কিঁউ হ্যায়? ইয়ে লোগ কেয়া কালপ্রিট হ্যায়? চোর, ইয়া ডাকু? যুবতীদের সঙ্গে শত্রুপক্ষের একজন গাইড হিসেবে ছিল। সে ইংরেজিতে বলল, নো, দে আর ফরেন স্পাইস। বিদেশী গুপ্তচর। তৎক্ষণাৎ একজন যুবতী বলে উঠল, দেন, কিল দেম। হোয়াই ডোন্ট ইউ ডু সো?
গাইড আশ্বাস দিল; ওদেরকে মেরে ফেলা হবে। গাইডের কথায় যুবতীরা সন্তুষ্ট হলো। ওরা দেয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে আর আড়চোখে নিচে তাকাচ্ছে। নিচে ওদের পরনে আণ্ডারওয়্যার ছাড়া কিছুই নেই। যুবতীদের কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল ওরা। এক সময় যুবতীরা ওদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেল। ক্রমেই সন্ধ্যার অন্ধকার ঘিরে ফেলল চারপাশ। ওদেরকে আবার নিয়ে যাওয়া হলো গতরাতের সেই বন্দীশালায়।
অবিরাম বেজে চলেছে সেই পৈশাচিক অর্কেস্ট্রা। বন্ধ হল ঘরের কঠিন পাথুরে দেয়ালে লাউড স্পীকারে কর্কশ চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বন্দীদের কয়েকজনের শরীরে আবার শুরু হলো ভীতিকর খিচুনি। সারারাতের মধ্যে ছিটেফোঁটা খাবারও ওদের কপালে জুটল না। এবং মাঝে মাঝেই শত্রুরা দমকা হাওয়ার মত হলে ঢুকছে, আর পিটাচ্ছে বেধড়ক। ওদের কাউকে আর মানুষ হিসেবে চেনার উপায় নেই। রক্তাক্ত শরীর-ছোটবড় ক্ষতে ভর্তি। পরনে শতচ্ছিন্ন আণ্ডারওয়্যার, নেই বললেই চলে। ওদের চেহারার দিকে চাইলে শরীর শিউরে ওঠে। দফায় দফায় বেতের লিকলিকে ছড়ি, ঘুসি, লাথি ও বেসুরো অর্কেস্ট্রার মধ্য দিয়ে রাত কেটে গেল বন্দীদের।
ভোর । পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। তার তীক্ষ্ণ রেখা দুর্গের মাথার ওপর। ওদেরকে বের করা হলো বন্দীশালা থেকে। তারপর ওদের একে অপরের থেকে আলাদা করা হলো। আনোয়ারকে ঢোকানো হলো ছোট্ট একটা সেলে। ওকে পিছমোড়া করে চিকন নাইলনের রশি দিয়ে দুহাতের কব্জির ঠিক সংযোগের স্থানে বাঁধল শত্রুরা। চিকন রশির অপর প্রান্ত দরজার চৌকাঠের একটা ফুটো দিয়ে বাইরে ঝুলছে।
বাঁধনটা পানি দিয়ে ভেজানো হলো। হাতের মাংস ভেদ করে রুশি ক্রমেই চেপে বসছে। সেইসাথে রশিতে শুরু হলো টান। আনোয়ারের দুহাত ওপরের দিকে উঠছে টানের সঙ্গে সঙ্গে। তীব্র ব্যথায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাতের রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ। আঙুলগুলো নীলবর্ণ ধারণ করেছে। ওর শরীর ক্রমেই বাঁকা হচ্ছে সামনের দিকে। এক সময় দুপায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল সে। রশির টান বেড়েই চলেছে। হাত ও কাঁধের প্রতিটি শিরা-উপশিরা সহ্য সীমার শেষপ্রান্তে। যে-কোন মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে ওগুলো। তবু ও নির্বিকার। ওর সহ্যশক্তি এখনও পরাজয় বরণ করেনি।
আবার ভেজানো হলো বাঁধন। চেপে বসল নাইলনের রশি। যে-কোন মুহূর্তে এখন হাত দুটো কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। আনোয়ারের চেতনাশক্তি শূন্য হতে চলেছে। শুরু হলো চাপা গোঙানি। এক সময় গোঙানি বীভৎস আর্তনাদে রূপ নিল। রশির বাধন একটু ঢিল হলো। ওর গোঙানিও কমে এল একটু। আবার শক্ত হলো বাঁধন। আবার বাড়ল আর্তনাদ। এইভাবে চলল সারাদিন। সন্ধ্যার দিকে এই অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেল সে। বাঁধন খুলতেই কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল, আনোয়ারের ভারী দেহটা। চেতনাশূন্য অবস্থায় ও পড়ে রইল মাটির ওপর। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একজন বুটধারী ওকে টেনে নিয়ে চলল সামনের দিকে। একটা ঘরে পৌঁছে ওর চোখের বাঁধন খুলে দিল লোকটি। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে ঘরটা।
সারাদিন চোখবাঁধা অবস্থায় থাকার ফলে আলোর দিকে ভালভাবে তাকাতে পারছে না ও। ওকে একটা চেয়ার দেয়া হলো বসার জন্য। সামনের চেয়ারে সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা একজন অফিসার বসে আছেন। তিনি আনোয়ারকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। নাম কি? র্যাংক কি? কোন ইউনিটের অফিসার? বাড়ি কোথায়? ইত্যকার প্রশ্ন। প্রশ্ন শেষে ওকে আবার নিয়ে যাওয়া হলো বন্দীশালায়।
ও শুয়ে আছে নিঃসাড়, নিস্পন্দ, যেন মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত। চারদিকে অখণ্ড নীরবতা। বাতাসে ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ। গভীর রাতে হঠাৎ লোহার গরাদ খোলার আওয়াজ কানে ভেসে এল আনোয়ারের। একজন বুটধারী এগিয়ে এসে ওকে ফিসফিস করে বলল, পালাতে চাও?
হ্যাঁ। নির্জীব কণ্ঠে উত্তর দিল আনোয়ার।
তবে এসো আমার সঙ্গে। ও দ্রুত অনুসরণ করুল বুটধারীকে। সামনে একটা ভোলা মাঠ। বুটধারী বলল, দৌড় দাও, কুইক। ও প্রাণপণে দৌড়ানো শুরু করল সম্মুখের দিকে। মুক্তির আনন্দ ওর শরীরে সতেজ অনুভূতি এনে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর সামনে পড়ল সিন্ধু। সিন্ধুর তীরে নরম বালির ওপর আছড়ে পড়ল ওর দেহ। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল সে।
সূর্য তার প্রখর তেজ ওর চোখেমুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এল আনোয়ারের। চোখ মেলে চাইতেই নজরে পড়ল সিন্ধু। পাশে একটা বিশাল পাথর। কোনমতে উঠে বসল সে বালির ওপর। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সিন্ধুর দিকে। আঁজলা ভরে পানি পান করল। হাত মুখ ভাল করে ধুয়ে ফিরে এল পাথরের কিনারায় । ভাল করে আশপাশটা দেখতেই জায়গাটা চিনতে পারল আনোয়ার। তারপর টলতে টলতে এগিয়ে চলল । আটক দুর্গে পৌঁছতেই ওকে জানানো হলো, ইন্টারোগেশন ট্রেনিং শেষ।
তোর ট্রেনিং-এর নিকুচি করি–বিড়বিড় করল আনোয়ার।
.
১৪.
ফ্রগম্যান ট্রেনিং। বাংলায় এটাকে বলা হয় ডুবুরী প্রশিক্ষণ । এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক ট্রেনিংগুলোর অন্যতম। একজন কমাণ্ডো ফ্রগম্যানকে অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে সাগরের তলায় নানারকম বিপজ্জনক কাজ করতে হয়। যেমন, কোন জাহাজের তলায় লিমপেট মাইন লাগানো, কোন ড্যাম বা ব্রিজের পিলারের গোড়ায় এক্সপ্লোসিভ সেট করা, শত্রু এলাকায় প্লেন থেকে প্যারাশুটে করে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দেয়া, পানির তলায় যে কোন রকম অনুসন্ধানের কাজ করা, যে-কোন রকম বিস্ফোরণ ঘটানো ইত্যাদি।
নভেম্বর। হেডকোয়ার্টার থেকে এস,এস,জি, অফিসার্স অ্যাডভান্সড ফ্রগম্যান কোর্সের জন্য তিনজন অফিসারের নামের তালিকা প্রকাশ করা হলো। ক্যাপ্টেন জানজুয়া, ক্যাপ্টেন জিয়া ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার। ওদের নির্দেশ দেয়া হলো মঙলা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে মুসা কোম্পানীতে যোগদানের জন্য। MUSA কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়–মেরিন আণ্ডার ওয়াটার সারফেস এয়ারবোর্ন। অর্থাৎ মুসা কোম্পানীর একজন সৈনিককে পানির ওপরে, নিচে, মাটিতে ও শূন্যে যে-কোন ধরনের কাজ করার জন্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুদক্ষ হতে হবে।
মঙলা ক্যান্টনমেন্ট মঙলা ড্যাম তৈরির সময় আমেরিকানরা বানিয়েছিল। তখন এটি আমেরিকানদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। অত্যাধুনিক কায়দায় নির্মিত ক্যান্টনমেন্টটি। আমেরিকানরা ড্যাম ও পাওয়ার হাউজ তৈরি করে ফেরত যাবার পর পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। এই ক্যান্টনমেন্টে ব্যাচেলরস কোয়ার্টার ও ম্যারিডদের জন্য চার-পাঁচ বেডের অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। প্রতিটি বাড়ি অত্যন্ত দামী আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। রান্নাঘরগুলোয় রয়েছে ওভেন, ফ্রীজ, ডিস-ওয়াশার, ওয়াটার বেসিন, গ্যাস ইত্যাদি। বাথরুমগুলোতে আছে গরম পানির গীশার ও কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন। প্রতিটি ঘরে ফ্লোরেসেন্ট আলোর ব্যবস্থা ও দামী দামী বিদেশী অয়েল পেন্টিং। পুরো বাড়ি এয়ারকণ্ডিশনড। পুরু ও কোমল কার্পেটে মোড়া ঘরগুলোর মেঝে । প্রথমদিন, জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার মঙলা ক্যান্টনমেন্টের অত্যাধুনিক ক্লাব, সিনেমা হল, মার্কেট, বোলিং অ্যালে প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে দেখল। বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিল সুইমিংপুলের উষ্ণ পানিতে।
দুদিন আরামে অতিবাহিত হয়েছে। তৃতীয় দিন। তখনও ভোরের অন্ধকার কাটেনি। ওরা তিনজন নির্দেশমত সুইমিং কস্টিউম পরে খালি গায়ে, খালি পায়ে রূম থেকে বেরিয়ে এল। মঙলা লেকের পাড় পাথরময়। উঁচু নিচু। শুরু হলো দৌড়। চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। কনকনে শীত। নগ্ন পায়ে পাথুরে পথে ওরা প্রায় আট মাইল দৌড়াল। চোখা চোখা পাথরের আঘাতে ওদের প্রত্যেকের পায়ের তালুতে রক্ত জমে নীল হয়ে গেল। দৌড়ের পর শুরু হলো ক্যালিসথেনিক পিটি। এটা অত্যন্ত কঠিন পিটি বলে পৃথিবী খ্যাত। পৌনে এক ঘণ্টা ধরে চলল ক্যালিসথেনিকস।
পৌনে আটটায় শুরু হলো থিওরিটিক্যাল ক্লাস। একজন জেসিও ক্লাস নিচ্ছে। পানির তলার জগতের ওপর লেকচার দিচ্ছে জেসিও। সর্দি লাগা অবস্থায় কোন ফ্রগম্যানের পানির নিচে যাওয়া। উচিত নয়। কারণ এ অবস্থায় কপালে সাইনাস বন্ধ থাকে। পানির তলদেশে একজন ফ্রগম্যানের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এই প্রচণ্ড পানির চাপে ফ্রগম্যানের সাইনাস ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সাইনাস ফেটে রক্ত বেরুলে হাঙ্গরের মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হতে পারে ফ্রগম্যান। একই কারণে শরীরে কোন ক্ষত নিয়েও পানির নিচে যাওয়া নিষেধ।
পানির নিচে কোন কাজ তাড়াহুড়ো করে করা উচিত নয়। বিশেষ করে দ্রুত ওপরে উঠে আসাটা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নিচে পানির অধিক চাপকে মোকাবেলা করার জন্য অক্সিজেন ট্যাঙ্ক থেকে সমান অনুপাতের প্রেশারাইজড বাতাস শরীরে প্রবেশ করে। তাড়াহুড়ো করে ওপরে উঠলে হঠাৎ করে পানির চাপ কমে যায়। ফলে শরীরের ভিতর প্রেশারাইজড় (ঘনীভূত) বাতাস পাতলা হয়ে দ্রুত আয়তনে বাড়তে থাকে। এই বাতাসের চাপ বেড়ে যাওয়াটা সাংঘাতিক তীব্র হয়। ঘন ঘন শ্বাস ফেলেও ফুসফুস খালি করা যায় না। পরিণামে বাতাসের চাপে লাং ফেটে যায়। এই বিপদের নাম এয়ারএমবোলিজম বা লাং বাস্ট।
দ্রুত ওপরে ওঠার আরও একটা বিপদ আছে। পানির নিচে অক্সিজেন ট্যাংক থেকে যে প্রেশারাইজড বাতাস ফ্রগম্যান নেয়, তার তিন চতুর্থাংশ নাইট্রোজেন। এই নাইট্রোজেন ফুসফুস থেকে সরাসরি রক্তে মেশে। রক্তের সঙ্গে একাকার হতে নাইট্রোজেনের কিছুটা সময় লাগে। দ্রুত ওপরে উঠলে নাইট্রোজেনের যে অংশটা রক্তের সঙ্গে মিশতে পারে না, বাইরে পানির চাপ কমে আসায় সেটা রক্তের ভিতর বুদুদের সৃষ্টি করে। ফ্রগম্যান যতই দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে বুদ্বুদের আয়তন রক্তের ভিতর ততই বাড়তে থাকে। ফলে বুদ্বুদগুলো শরীরের প্রতিটি সংযোগস্থলে আটকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রগম্যানের শরীরের প্রতিটি সংযোগস্থল বিকৃত হয়ে যায়। এতে একজন ফ্রগম্যান তৎক্ষণাৎ মারা যায় না। তবে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। এর কোন ডাক্তারী চিকিৎসা নেই। এই বিপদের নাম বে।
বেণ্ডে আক্রান্ত ফ্রগম্যানকে পানির নিচে পূর্বের গভীরতায় নিয়ে যেতে হয়। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে পরিমিত পানির চাপে রক্তের ভিতর নাইট্রোজেনের বুদ্বুদগুলো পূর্বের স্বাভাবিক, অবস্থায় ফিরে আসে। তারপর ফ্রগম্যানকে ধীরে ধীরে ওপরে উঠিয়ে আনতে হয়। এয়ার এমবোলিজম বা বেণ্ড থেকে বাঁচতে হলে একজন ফ্রগম্যানকে একটা নির্দিষ্ট গতিতে ওপরে উঠতে হবে। তা হলো, নিশ্বাস ছাড়ার সময় পানিতে যে বুদ্বুদ সৃষ্টি হয় সেই বুদ্বুদের ওপরে উঠে আসার গতির সঙ্গে ফ্রগম্যানকে ওপরে উঠে আসতে হবে। প্রতি তিরিশ ফুট অন্তর অন্তর ফ্রগম্যান কয়েক মিনিটের জন্য স্থির হয়ে বিশ্রাম নেবে। পানির নিচের জগতে মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা। সেজন্য পানির নিচে ফ্রগম্যান একা নয়- জোড়ায় জোড়ায় যাবে।
গ্যাস পয়জনিং। এটা পানির নিচে ফ্রগম্যানের জন্য মারাত্মক বিপদ বয়ে আনতে পারে। গ্যাস পয়জনিংয়ে আক্রান্ত ফ্রগম্যানের মৃত্যুর সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। কার্বন মনো অক্সাইড পয়জনিং, কার্বন ডাই অক্সাইড পয়জনিং, অক্সিজেন পয়জনিং এবং নাইট্রোজেন নারকোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেজন্য গ্যাস পয়জনিংয়ের ব্যাপারে ফ্রগম্যানকে সাংঘাতিক সতর্ক থাকতে হয়। গ্যাস পয়জনিং থেকে বাঁচতে হলে ফ্রগম্যানকে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত তাল মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হবে। একে বলে পেণ্ডুলাম ব্রিদিং।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর জলজ প্রাণীর আক্রমণ। সাগরের নিচে মোরে-ঈল ভয়ঙ্করতম প্রাণী। এই প্রাণী বারো থেকে তেরো ফুট পর্যন্ত লম্বা। বিশাল আকৃতির। এই হিংস্র মাংসাশী জলজ প্রাণীর ধারাল দাঁতের আঘাতে নিমেষেই একজন ফ্রগম্যান টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। এছাড়া আছে শার্ক বা হাঙর। এগুলো বিভিন্ন জাতের হয়। কোন কোনটার আকৃতি বিশাল। এদের চোয়ালের দুপাশে তীক্ষ্ণ ধারাল দাঁত রয়েছে। রক্তের গন্ধ এদেরকে উন্মাদ করে তোলে। শার্ক অতীব হিংস্র এবং মাংসাশী। ব্যারাকুডার প্রকৃতিও প্রায় শার্কের মত। ব্লু বটল এবং পোর্টগীজ ম্যান অভ ওয়ার একজাতীয় বিষাক্ত মাছ। এগুলো দৈর্ঘ্যে প্রায় ইঞ্চি ছয়েক হয়। অত্যন্ত ভয়ানক এদের বিষ। এই বিষ আক্রান্ত ফ্রগম্যানকে নিমেষেই মৃত্যু-যন্ত্রণা এনে দেয়। জেলী ফিশ এক ধরনের পর্দার মত। পানির ওপর ভেসে বেড়ায়। দেখে এদের জীবন্ত বলে মনে হয় না। এগুলো শরীরের উন্মুক্ত জায়গায় আঠার মত লেগে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে সৃষ্টি হয় তীব্র যন্ত্রণা।
সাগরের তলদেশে রঙিন গাছপালা, ফুল প্রভৃতি দেখতে পাওয়া যায়। সাবধান! এগুলো যেন কোন ফ্রগম্যান স্পর্শ না করে। কারণ এগুলোর অধিকাংশই জীবন্ত প্রবাল কীটের তৈরি। কোটা আসল গাছপালা আর কোটা প্রবাল কীটের তৈরি কৃত্রিম গাছপালা-তা চেনা মুশকিল। প্রবাল কীটের তৈরি কোন রঙিন ফুল বা গাছ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কীট নিমেষেই হাতে জড়িয়ে যায়। মাংসাশী এই কীটগুলো মুহূর্তের মধ্যেই আক্রান্ত স্থানের হাড় বের করে ফেলে।
শত্রুপক্ষ থেকেও পানির নিচে বিপদ আসতে পারে। পানির তলায় বিস্ফোরণের সময় ফ্রগম্যানকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এক্সপ্লোশনের ফলে পানির নিচে একটা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে চাপের সৃষ্টি হয়। এই চাপের আওতায় পড়লে ফ্রগম্যানের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। প্রতি এক পাউণ্ড টি.এন.টি. এক্সপ্লোশনে ফ্রগম্যানকে এক হাজার গজ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে। সেদিনের ক্লাস শেষ হলো।
পরদিন। ট্যাকটিক্যাল সুইমিং ট্রেনিং শুরু হলো। সাঁতারের পূর্বে জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ারকে সতর্ক করে দেয়া হলো। পানিতে নামা ও ওঠার সময় যেন কোন প্রকার শব্দ না হয়। শব্দ হওয়া শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ওদের পরনে সুইমিং কস্টিউম। গায়ে লাইফ জ্যাকেট। কোনরকম ইমারজেন্সী হলে জ্যাকেটের সঙ্গে লাগানো কর্ড টান দিলে মুহূর্তে জ্যাকেটটি বাতাসে ফুলে ওঠে। তাছাড়া জ্যাকেট থেকে বেরিয়ে থাকা একটা টিউব দিয়েও বাতাস ভরা যায়। ওদের সঙ্গে রয়েছে হাবিলদার ইট্রাক্টর রমজান। নিষ্ঠুর প্রকৃতির রমজানের বিশাল পেশীবহুল শরীর। ভয় কাকে বলে জানে না। প্রথম দিন ওরা মঙলা লেকের চকচকে পানিতে বেলা দশটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সাঁতার কাটল।
বিকেল চারটায় শুরু হলো প্যাডেলিং ক্লাস। ওদের তিনজনকে একটা রাবারের ডিঙি নৌকা দিয়ে নির্দেশ দেয়া হলো, কম্পাসের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে মাইল পাঁচেক দূরে একটা জায়গায় গিয়ে, ফিরে আসতে হবে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর ওদের প্যাডেলিং ক্লাস শেষ হলো। এরপর সেদিনের মত ছুটি।
আবার শুরু হলো থিওরিটিক্যাল ক্লাস। আজকের আলোচ্য বিষয় ডাইভিং। SCUBA (স্কুবা) সেট সম্পর্কে প্রথমে বলা হচ্ছে ওদের। স্কুবা অর্থ সেলফ কনটেইন আণ্ডার ওয়াটার ব্রিদিং অ্যাপারেটাস। একটি আমেরিকান কোম্পানী স্কুবা সেটটির প্রস্তুতকারক। মলিবডেনাম নামক শক্ত ধাতুতে প্রস্তুত প্রতি সিলিণ্ডারের সঙ্গে লাগানো রয়েছে একটি ডিমাণ্ড ভালভ, ও একটি গোলাকৃতি হোস পাইপ। প্রেশারাইজড বাতাস সিলিণ্ডারে ভরা হয়। প্রয়োজনীয় বাতাস ভরা হলো কিনা সেটা মিটার দিয়ে চেক আপ করতে হয়। একটা সরু তারের মত রড সিলিণ্ডারের মাথা থেকে সংযুক্ত হয়ে সিলিণ্ডারের বাইরের দিকে, তলায় গিয়েছে। ডাইভার (ফ্রগম্যান) বেখেয়ালী হওয়ায় হঠাৎ যদি টের পায় ট্যাংক বাতাসশূন্য হয়েছে, তখন সরু রডটা নিচের দিকে টান দিলে ট্যাংকের রিজার্ভড বাতাস ব্যবহার করা যায়। রিজার্ভড বাতাস ব্যবহারের সময়সীমা মাত্র পাঁচ মিনিট। সিলিণ্ডারের মাথায় একটা ডিমাণ্ড ভাল্ভ লাগানো থাকে। এই ডিমাণ্ড ভালভের কাজ ডাইভার পানির যত গভীরে যাবে, পানির চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাল্ভ ট্যাংক থেকে আনুপাতিক হারে প্রেশারাইজড বাতাস সাপ্লাই করবে। ডাইভার পানির যত নিচে যায়, চারদিক থেকে পানির চাপও ততই বাড়তে থাকে। সেই চাপকে মোকাবেলার জন্য ট্যাংক থেকে এই বাতাস সাপ্লাই করা হয়।
ডিমাণ্ড ভালভ থেকে একটি গোলাকৃতি হোস পাইপ বেরিয়ে কানের দুই পাশ দিয়ে মুখের সামনে মাউথ পীসে সংযুক্ত হয়েছে। এই পাইপের একটি টিউব দিয়ে ডাইভারকে ট্যাংক থেকে বাতাস নিতে হয়। অপর টিউব দিয়ে ব্যবহৃত বাতাস বুদ্বুদ আকারে বেরিয়ে যায়। এই ধরনের স্কুবা সেট ট্যাকটিক্যাল কাজে ব্যবহার করা যায় না। কারণ টিউব থেকে বেরিয়ে যাওয়া বুদ্বুদ ডাইভারের অবস্থানকে শক্রর কাছে ফাঁস করে দেয়। সেজন্য অপারেশনের সময় ক্লোজ সার্কিটসেট ব্যবহার করতে হয় ডাইভারকে। এই ধরনের স্কুবা সেটে হোস পাইপে শ্বাস ছাড়ার পর ব্যবহৃত বাতাস একটা কনটেইনারের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই কনটেইনারে বাতাস পরিশোধনকারী কেমিক্যাল থাকে। পরিশোধিত বাতাস পুনরায় এয়ার ট্যাংকে ফিরে যায়। ফলে কোন বুদ্বুদের সৃষ্টি হয়
এই স্কুবা সেটের ব্যবহার ঠিকমত জানা না থাকলে ডাইভার মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবে। ক্লান্ত বা উত্তেজিত অবস্থায় ডাইভার যদি ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, তাহলে ব্যবহৃত বাতাস কেমিক্যাল কনটেইনারে সম্পূর্ণরূপে পরিশোধিত না হয়েই পুনরায় এয়ার ট্যাংকে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় চললে ট্যাংক অপরিশোধিত বাতাসে পূর্ণ হয়ে যায়। ফলে পরিশোধিত বাতাসের অভাবে ডাইভার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এছাড়াও, অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য গ্যাস পয়জনিং ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমস্ত দুর্ঘটনা এড়াতে হলে ডাইভারকে পানির নিচে উত্তেজিত বা ক্লান্ত হওয়া চলবে না। তাকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বা পেণ্ডুলাম ব্রিদিং চালাতে হবে।
এরপর শুরু হলো রাবার সুটের ওপর আলোচনা। পাতলা মজবুত রাবারের তৈরি এই সুটের বুকের সামনে একটা বড় রাবারের চোঙ আছে। এই চোঙের ভেতর দিয়ে শরীর গলিয়ে ডাইভার বা ফ্রগম্যানকে রাবার সুটে প্রবেশ করতে হয়। রাবার সুট পরিহিত অবস্থায় ফ্রগম্যানের সমস্ত শরীরের মধ্যে মুখমল ও হাতের কব্জি থেকে অগ্রভাগ শুধু অনাবৃত থাকে। বুকের সামনে রাবারের চোঙ ভালভাবে শক্ত করে রাবারের ব্যাণ্ড দিয়ে বাঁধতে হয়। রাবার সুটের ভেতর সামান্য বাতাস থাকলেও ফ্রগম্যান সহজে পানির নিচে যেতে পারে না। একটা বিশেষ কৌশলে সুটের ভেতর থেকে সামান্যতম বাতাসও বের করে দিতে হয়। কৌশলটা হলো, রাবার সুটের থুতনির কাছের অংশটা টেনে নিয়ে শুধুমাত্র মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে শ্বাস নিতে হবে। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে বাইরে। এই প্রক্রিয়ায় রাবার সুট সম্পূর্ণরূপে বাতাসশূন্য হয়ে গায়ের সঙ্গে চেপে বসে।
পানির নিচে যে-কোন গভীরতায় সহজেই যে-কোন পজিশনে অথবা যে-কোন অবস্থায় থাকার জন্য একজন ফ্রগম্যানের বয়ানসি (BOUYANCY) বা, ভেসে থাকার ক্ষমতাশূন্য হতে হবে। একে বলা হয়, জিরো বয়ানসি। সেজন্য ডাইভিংয়ের সময় প্রত্যেক ফ্রগম্যানের বয়ানসি পরীক্ষা করা হয়। যাদের বয়ানসি পজেটিভ অর্থাৎ বুক ভরা শ্বাস নেয়া অবস্থায় পানিতে ভাসে, তাদের রাবার সুটের ওপরে কোমরে একটা ওয়েট বেল্ট পরে নিতে হয়। বয়ানসি জিরো না হওয়া পর্যন্ত একটার পর একটা ওয়েট আটকে নিতে হয় বেল্টে। আর নেগেটিভ বয়ানসির বেলায় ওয়েট বেল্ট তো নয়ই, বরং তাকে খানিকটা বাতাস পুরে নিতে হবে, রাবার সুটের ভিতর, যতক্ষণ না বয়ানসি জিরো হয়।
এরপর এল ফিন, ডেপথ গেজ, আণ্ডার-ওয়াটার ক্যামেরা ও কম্পাস। পানির নিচে দ্রুত চলাচলের জন্য ফ্রগম্যান পায়ে ফিন ব্যবহার করে। ফিন পরা অবস্থায় ফ্রগম্যান হাত ব্যবহার ছাড়াই দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। ডেপথ গেজ অনেকটা ঘড়ির মত দেখতে। এটা একটা বেল্টের সাহায্যে ফ্রগম্যানের হাতের কব্জিতে আটকে থাকে। ডেপথ গেজের সাহায্যে ফ্রগম্যান পানির নিচে নিজের অবস্থানের গভীরতা সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য পায়। আণ্ডার ওয়াটার কম্পাসের সাহায্যে পানির নিচে সঠিক দিক নির্ণয় করে চলা যায়। আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরার সাহায্যে পানির নিচে যে
কোন বস্তুর পরিষ্কার ছবি তোলা যায়। … এরপর এল ফেস মাস্ক ও এয়ার কমপ্রেশার বা জেনারেটর। ফেসমাস্ক রাবার জাতীয় জিনিসের তৈরি। এটার সামনের দিকটা স্বচ্ছ কাঁচের মত। ইলাস্টিক জাতীয় ব্যাণ্ড দ্বারা এটা ভোলা মুখের সঙ্গে আটকে থাকে। যদি ফেস মাস্কের ভেতর পানি ঢুকে দৃষ্টিশক্তির কোন বাধা সৃষ্টি করে, তখন নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ব্লো করতে হয়। নিঃশ্বাস ব্লো করার সঙ্গে সঙ্গে ফেস মাস্কের স্বচ্ছ কাঁচ পরিষ্কার হয়ে যায়। জেনারেটর বা এয়ার কমপ্রেশারের সাহায্যে ধাতব সিলিণ্ডারগুলোতে কমপ্রেশড এয়ার ভরা হয়। কমপ্রেশারের সাহায্যে প্রেশারাইজড এয়ার প্রায় তিন হাজার পি.এস.আই. (PS) পর্যন্ত সিলিণ্ডারে ভরা যায়। বাতাস ভর্তি অবস্থায় এক একটা সিলিণ্ডারের ওজন হয় প্রায় ঊনচল্লিশ পাউণ্ড।
পানির নিচে চাপ বা ওয়াটার প্রেশার প্রতি তেত্রিশ ফুট গভীরতায় ওয়ান অ্যাটমোসফিয়ারিক প্রেশার বা সংক্ষেপে ওয়ান অ্যাটমোস (সী লেভেলে যা প্রতি বর্গইঞ্চিতে ১৪.৭ পাউণ্ড)। তেত্রিশ ফুট গভীরতায় একজন ফ্রগম্যানের শরীরের ওপর পানির চাপের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ২৯.৪ পাউণ্ড। এভাবে প্রতি তেত্রিশ ফুট গভীরতায় শরীরের প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৪.৭ পাউণ্ড করে চাপ বৃদ্ধি পায়। অ্যাডভান্সড ফ্রগম্যান ট্রেনিংয়ে প্রতি ফ্রগম্যানকে ১৮০ (একশত আশি) ফুট গভীরতায় যেতে হবে। এই গভীরতায় একজন ফ্রগম্যানের শরীরের ওপর শত শত টন পানির চাপ পড়বে।
মজার ব্যাপার হলো, এই প্রচণ্ড চাপ আসে চারদিক থেকে এবং এই প্রেশারকে মোকাবেলা করে একমাত্র শরীরের মধ্যকার প্রেশারাইজড বাতাস, যা এয়ার সিলিণ্ডার থেকে ডিমাণ্ড ভাভের সাহায্যে গভীরতা অনুযায়ী ঘনীভূত হয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায়। পানির গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটার প্রেশার যেমন, বাড়ে, ঠিক তেমনি আনুপাতিক হারে প্রেশারাইজড বাতাসও নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরের ভিতরের চাপ বৃদ্ধি করে। ফলে দুদিকে চাপ সমান হওয়ার জন্য ফ্রগম্যানের পানির তলায় চলাফেরা করতে কোন অসুবিধা হয় না। এই উভয় দিকের চাপের যদি কোন তারতম্য ঘটে তাহলে ফ্রগম্যানের বিপদাশঙ্কা করা হয়।
.
মঙলা লেক। চকচকে রূপালি পানি। পানির নিচে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। লেকের তলদেশে অসংখ্য নুড়ি পাথর ও তুষারশুভ্র বালি। থিওরিটিক্যাল ক্লাস শেষে ওরা তিনজন ডাইভিং শুরু করল মঙলা লেকের তলদেশে। দশ থেকে বারো ফুট গভীরতা পর্যন্ত ওরা পৌঁছাল। লেকের তলদেশে যে-কোন বস্তুকে প্রকৃত আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি বড় দেখায়। এই ব্যাপারটা যারা জানে না, তাদের নিক্ষিপ্ত সুচ ওরা অনায়াসেই লেকের তলদেশ থেকে তুলে এনে দিত। ব্যাপারটা ওদের কাছে সহজ হলেও যারা জানে না, তাদের কাছে সাংঘাতিক আশ্চর্যের ছিল। এইভাবে ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে চলল ডাইভিং, সাঁতার ও রাবার র্যাফট চালানোর অনুশীলন।
এই সময় ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলো। কারণ একজন ফ্রগম্যানকে হতে হবে যে কোন জলজ প্রাণীর মত। পানিতে তার চলাফেরা হবে স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও নিঃশব্দ। ছোটখাট যে ত্রুটিগুলো কাটানো মুশকিল–সে ধরনের ত্রুটির জন্য ওদেরকে পেতে হলে কঠিন শাস্তি। দুই হাতের কব্জিতে দুটো বড় বড় তোয়ালে বেঁধে ওদের বহুদূর পর্যন্ত ফ্রি-স্টাইলে সাঁতার কাটতে হলো। পিঠের ওপর ৭৮ পাউণ্ড ওজনের এয়ার সিলিণ্ডার নিয়েও সুইমিং করতে হলো এবং শাস্তি স্বরূপ ৩৬ মাইল রাবারের র্যাফটও চালাতে হলো। শাস্তির চোটে ওরা ধীরে ধীরে জলজ প্রাণীর মত আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠল।
১৫.
খেসকি লেক। রিসালপুর। কয়েকশো বছরের পুরানো এই লেকটি। নোনা মাটির এলাকা। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় কাঁটাঝোঁপ। লেকটি ঠিক তার মাঝখানে। পচা পানি, শ্যাওলা ও দামে ভর্তি। লেকের চেহারা দেখে ওদের মঙলা লেকের ডাইভিংয়ের সুখানুভূতি নিমেষেই উবে গেল। তবুও ওদেরকে এই পচা লেকেই ডাইভিং করতে হবে। লেকের অদূরে খাটানো একটা বড় তাবু ওদের তিনজনের বাসস্থান। তাঁবুর প্রায় মাইলখানেক দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বরফ গলা পানির খরস্রোতা কাবুল নদী। চারপাশে জনশূন্য পরিবেশ। একটা আদিমতার পরশ সর্বত্র। জানজুয়া অভিমত প্রকাশ করল, খেসকি লেক আমার জীবনে একটা অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে। জিয়ার অভিমত, খেসকি লেক আমাকে সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আনোয়ার বলল, আদিমতার পরশ জড়ানো খেসকি লেক। তুমি আমাকে পৃথিবীর আদি অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে। জানজুয়া ও জিয়া একসঙ্গে বলে উঠল, খাসা বলেছ!
ওদের সঙ্গে কোন আর্দালি নেই। ট্রেনিংয়ের কদিন রিসালপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওদেরকে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা হবে। রাতের অন্ধকারে এই এলাকায় নেকড়েরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। একটা ছোট হারিকেনের মৃদু আলোয় ভেতরটা আলোকিত। ওদের পরনে সুইমিং কস্টিউম। খালি গা। প্রস্তুত ওরা ইন্ট্রাক্টরের ডাকে যখন তখন যেন সাড়া দিতে পারে। বিকেলে আর্দালি ফ্লাস্ক ভরে চা দিয়ে গেছে। চা-সিগারেট শেষ করে, গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল তিনজন ট্রেইনী ফ্রগম্যান।
তখনও চারদিকে অন্ধকার। কুয়াশা ভেজা প্রকৃতি। তাঁবুর বাইরে জীপের হর্নের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তিন ফ্রগম্যানের। মেজর ডেভিড চিৎকার করছেন, হারিআপ। কনকনে শীতের মাঝে ওরা নগ্ন পায়ে, নগ্ন গায়ে, শুধু সুইমিং কস্টিউম পরা অবস্থায় বেরিয়ে এল। শরীর গরম রাখার জন্য তিনজন লাফাচ্ছে অনবরত। ডেভিডের সারা শরীর মোটা গরম কাপড়ে আবৃত। তিনি জীপের পাশে দাঁড়িয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সিগারেট টানছেন। হঠাৎ তিনি নির্দেশ দিলেন, তিনজন তিনটে তোয়ালে নাও। চমকে উঠল তিন ট্রেইনী ফ্রগম্যান! নগ্ন শরীরে এই কনকনে শীতের মধ্যে পানিতে চুবানি খেতে হবে নিশ্চয়ই! ডেভিডের সুদর্শন চেহারাটা মুহূর্তের ব্যবধানে ওদের কাছে বীভৎস বলে মনে হলো। লোকটা কি মানুষ? না পিশাচ? না অন্য কিছু? তোয়ালে নিয়ে ওরা আবার বেরিয়ে এল বাইরে।
দৌড়াও। কাবুল নদীর দিকে। মেজর ডেভিডের নির্দেশে ওরা তিনজন শুরু করল দৌড়।
নোনা মাটি। উঁচু নিচু পথ বরফের মত ঠাণ্ডা। তিনজনের নগ্ন পা যেন আর কিছুতেই উঠতে চাইছে না। তবুও ওরা প্রাণপণে দৌড়চ্ছে। কাবুল নদীর পেট চিরে বেরিয়ে গেছে একটা নাতিপ্রশস্ত চ্যানেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন চ্যানেলের পাড়ে উপনীত হলো। বরফ গলা জল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ওরা আন্দাজ করল, এই পানির তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির ওপরে নয়। নির্দেশ মত তিনজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল বরফ গলা জলে। ওরা পাগলের মত ধস্তাধস্তি করছে, যাতে শরীরে রক্ত জমে না যায়। যে-কোন মুহূর্তে শরীরের রক্ত জমে যেতে পারে। মিনিট তিনেক পর তিনজনের গলা থেকে বেরুতে শুরু করল ভৌতিক চিৎকার। অপরিচিত কেউ ওদের দেখলে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবে। প্রায় পনেরো মিনিট পর এই অবস্থা থেকে ওদের মুক্তি দিলেন মেজর ডেভিড।
এরপর শুরু হলো ফ্রগম্যান বা অ্যামফিবিয়ান পিটি। এই কঠিন পিটি ওদের ঠাণ্ডায় জড়ানো শরীরকে গরম করে তুলল। মিনিট বিশেক পর প্রত্যেকের শরীর চুঁইয়ে পড়া শুরু হলো ঘাম। একঘণ্টা ধরে চলল এই পিটি। পিটি শেষে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে আনোয়ার ভাবল, জয় পরাজয় মূলত ইচ্ছার ওপরেই নির্ভরশীল।
আকাশে সূর্য উঠেছে। সূর্যের আলোয় স্নাত ঝলমলে প্রকৃতি। ঠাণ্ডার তীব্রতা কমেছে কিছুটা। রিসালপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে জীপ এল, ব্রেকফাস্ট, একুয়ালাং সিলিণ্ডার, ক্যাম্প স্টুল, ফ্লিপার ও ওয়েট জ্যাকেট নিয়ে। ক্যাম্পস্টুলে বসে মেজর ডেভিডসহ নাস্তা সারল ওরা। তারপর ওদেরকে বলা হলো ডাইভিংয়ের জন্য তৈরি হতে। ঠাণ্ডার তীব্রতা থেকে কিছুটা রক্ষা পাবার জন্য ওয়েট জ্যাকেট পরল তিনজন। মোটা পুরু স্পঞ্জের তৈরি ওয়েট জ্যাকেটগুলো ফুল হাতা, সামনে বুক খোলা; কবুজি থেকে বুকের খোলা অংশ চেইনে বন্ধ করা যায়। পানিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেটগুলোর পুরু স্পঞ্জের কোষে কোষে পানি ঢুকে আটকে থাকে। শরীরের উত্তাপে ধীরে ধীরে পানি গরম হয়ে ওঠে। ফলে ফ্রগম্যান ঠাণ্ডার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পায়।
ঠিক হলো, ক্যাপ্টেন জানজুয়া ও জিয়া এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার আনোয়ার জোড়া বেঁধে ডাইভিং করবে। মেজর ডেভিড রাবারের ডিঙি নৌকায় পানির ওপরে থাকবেন। ওরা খেসকি লেকের পিচ্ছিল পাড় বেয়ে নামা শুরু করল। ওদের নগ্ন পায়ের তলা ঠাণ্ডায় অবশ। কিছুদূর নামার পর ঘটল বিপত্তি। পিচ্ছিল পাড় বেয়ে নামার সময় তিনজন পড়ে গেল। ওপর থেকে মেজর ডেভিড বললেন, টু আওয়ার্স এক্সট্রা সারফেস সুইমিং আফটার লাঞ্চ উইথ ডবল বটল। অর্থাৎ দুপুরে খাবার পর পিঠের ওপর অতিরিক্ত ৭৮ পাউণ্ড ওজনের সিলিণ্ডার বেঁধে দুঘণ্টা সাঁতার কাটতে হবে।
ডাইভ দেবার আগে ওরা একে অন্যের সঙ্গে রশি দিয়ে কব্জি বেঁধে নিল, যাতে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। ওদের সঙ্গে রয়েছে। আণ্ডারওয়াটার ওয়াচ, ডেপথ গেজ এবং আণ্ডার ওয়াটার কম্পাস। পচা পানির দুর্গন্ধ নাকে ঝাঁপটা দিচ্ছে। ফেস-মাস্ক ঠিক করে নিয়ে চারজন ডুব দিল জোড়ায় জোড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কয়েকটা দীর্ঘাকৃতি সাপের ছোঁয়া পেল ও। কোনটাই ওকে কামড় দিল না। সাপগুলোর পিচ্ছিল শরীর ওর গা ঘেঁষে চলে গেল। প্রতি মুহূর্তে নগ্ন পায়ে লম্বা পিচ্ছিল শ্যাওলা জড়িয়ে যাচ্ছে। কোটা শ্যাওলা, আর কোটা সাপ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চারদিকে গা ঘিন ঘিন করা অনুভূতি। কিছুক্ষণ পর ওরা টের পেল, ওয়েট জ্যাকেটের ভিতর পানি গরম হয়ে শরীরের স্থানীয় তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।
তলদেশের পানি অতিরিক্ত ঘোলা–যেন নরম কাদার আস্ত রণ; নানা আগাছায় পরিপূর্ণ। দৃষ্টিসীমা কয়েক ইঞ্চির ভিতরে সীমিত ওদের। আনোয়ার সুবেদারের কোন ইঙ্গিত বুঝতে পারছে না।শেষে সুবেদার ওকে নিয়ে পানির ওপরে ভেসে উঠল। স্থির হলো, আঙুলের ইশারা একেবারে মুখের সামনে এনে দেখানো হবে। তাতেও কাজ না হলে ওর রশিতে বিভিন্ন ধরনের টান দিয়ে সংকেত দেয়া হবে। আবার ওরা ডুব দিল। বিশ ফুট গভীরতায় যাওয়ার পর আর নিচে যাওয়া সম্ভব হলো না। নিচে ঘন শৈবাল ও দাম। শুরু হলো সম্মুখে এগিয়ে চলা। কম্পাস ওদের পথ নির্দেশক। মুখের পাশ ঘেঁষে বিভিন্ন পিচ্ছিল জলজ প্রাণীর আনাগোনা টের পাচ্ছে চার ফ্রগম্যান। প্রায় একঘণ্টা চলল ওরা কম্পাস ধরে। এরপর টান পড়ল ট্যাংকের বাতাসে। রিজার্ভ ট্যাংকের কর্ড টান দিয়ে চারজন ভেসে উঠল জোড়ায় জোড়ায়।
ফিনিশড-কানের কাছে ওরা মেজর ডেভিডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তিনি রাবারের র্যাফট নিয়ে বুদ্বুদ লক্ষ্য করে এগিয়ে এসেছেন। ওরা দ্রুত সাঁতার কেটে কিনারায় পৌঁছল। তারপর তাঁবুতে ফিরে এল সবাই। তাঁবুর সামনে ঘাসের ওপর বসে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ আনোয়ারের নজর পড়ল নগ্ন পায়ের ওপর। প্রায় গোটা বিশেক জেঁক। ওগুলো রক্ত খেয়ে বেশ মোটা তাজা হয়েছে। ওর সমস্ত শরীর কিলবিল করে উঠল ঘৃণায়। সুবেদার আনোয়ার সিগারেটের আগুন দিয়ে একটা একটা করে সবগুলো জোক খুলে ফেলল ওর শরীর থেকে।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার ওদেরকে যেতে হলো খেসকি লেকে। আবার দিতে হলো ডুব। বেলা এগারোটা পর্যন্ত চলল ডাইভিং। ডাইভিং শেষে কাবুল নদীর বরফ গলা পানিতে শরীর ভাল মত পরিষ্কার করে রোদে বসে ওরা দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিল। লাঞ্চের পর বেলা চারটে পর্যন্ত চলল পানিশমেন্ট-সুইমিং। সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমে এলে শেষ হলো ওদের ইভনিং ট্রেনিং।
তাবুর বাইরে আর্দালিরা আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়েছে। ওরা তাঁবুর ভিতরে বসে অফিসার্স মেস থেকে আনা স্ন্যাকস, চা সহযোগে হালকা নাশতা সারল। তাঁবুর বাইরে অন্ধকার। কুণ্ডলীর পাশে বসে আর্দালিরা চাপাস্বরে ফিসফাস করছে। মেজর ডেভিডসহ ওরা তিনজন তাঁবুর ভিতর খোশগল্পে মগ্ন। রাত সাড়ে আটটার দিকে ডেভিড বলে উঠলেন, চলো, ওঠা যাক। ব্যাপার কি? তিনজনের চোখে-মুখে বিস্ময়! ডেভিড ধীরে সুস্থে জানালেন, নাইট ডাইভিং। ওরা নির্বোধের মত একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। লোকটা মানুষ না পিশাচ? সেঁক, সাপ, শৈবাল, দামে ভরা লেকে যেখানে দিনের বেলায় ডাইভিং করাটাই রীতিমত বিপজ্জনক, সেখানে কিনা এই রাতে ডাইভিং করতে হবে।
জানজুয়া বলল, স্যার, তার চেয়ে আমরা কাবুল নদীতে পনেরো মিনিট গোসল করে আসি। কি কঠিন অবস্থায় পড়লে এই তীব্র শীতের রাতে কাবুল নদীর বরফগলা পানিতে গোসলের প্রস্তাব করা যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মেজর ডেভিড দাঁত বের করে হেসে জানালেন, হবে, হবে সেটাও হবে। সর্বনাশ! এ যেন পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বারণ করার অবস্থা। জানজুয়া ও জিয়া ফিসফিস করে ডেভিডের উদ্দেশ্যে খিস্তি করছে। আনোয়ার পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, শালা, অমানুষ একটা।
ভয় নেই আনোয়ার। তোমার মৃত্যু-সংবাদ আমার মেয়েকে দেব না। তুমি মরে গেলে আমার মেয়ে চিরকুমারীই রইবে। এবারে চলল, রূপালী লেকে একটু জলকেলী করা যাক। কথাগুলো ইংরেজিতে বললেন ডেভিড।
ডাইভিং গীয়ার পরা অবস্থায় সবাই চলল খেসকি লেকের উদ্দেশে। ঘুটঘুঁটে জমাট বাঁধা অন্ধকার। তীব্র ঠাণ্ডা। চাপ চাপ অন্ধকারের নীরব কোলে সারা পৃথিবী বিশ্রামরত। মাঝে মাঝে অন্ধকারের বুক চিরে দূর থেকে ভেসে আসছে নিশাচর পাখির ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ। মুহূর্তের জন্য প্রকৃতি সচকিত হয়ে উঠছে। আবার তলিয়ে যাচ্ছে গভীর নিদ্রায়। ঠিক আধো-ভৌতিক পরিবেশ। দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে এলোমলো কিছু ক্ষীণ তারা। খেসকি লেকের পাড়ে সবাই থমকে দাঁড়াল। প্রেতাত্মাদের পরিত্যক্ত রহস্যময় দীঘি বলে মনে হচ্ছে লেকটাকে।
আণ্ডার ওয়াটার টর্চ ওদের ইচ্ছে করে দেয়া হলো না। লেকের কিনারায় একটা রাবারের র্যাফট। র্যাফটের ওপর মেজর ডেভিড ও সুবেদার আনোয়ার। জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার ভেলাটার কোণা ধরে পানিতে ভাসছে। শ্যাওলা, দাম ও আগাছার পাশ ঘেঁষে র্যাফট এগিয়ে চলল। লেকের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে থেমে গেল ভেলা। প্রত্যেকের হাতে রশি বাঁধা। ওদের বলা হলো ডাইভিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে। ডেভিড র্যাফট-এর ওপর বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, দড়িতে এক টান অর্থ, নিচে যেতে হবে। দুই টান, দাঁড়াও। তিন টানে ডানে এবং চার টানে বামে। পাঁচ টান ওপরে উঠে আসার সিগন্যাল। ঘন ঘন টান ইমারজেন্সী।
ওরা ডুব দিল খেসকি লেকে। নিচে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ শূন্য। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আনোয়ার নিজেকে হারিয়ে ফেলল অন্ধকারে। শরীরের কোন অংশই নজরে পড়ে না। অসহ্য ঠাণ্ডা। শ্যাওলা ও জলজ প্রাণীর পিচ্ছিল অনুভূতি নগ্ন শরীরে। রেডিয়াম সংযুক্ত বলে আণ্ডার ওয়াটার ঘড়ির ডায়াল ও ডেপথ গেজ শুধু নজরে পড়ছে। ডেপথ গেজ অনুযায়ী বিশ ফুট গভীরে পৌঁছল সবাই। প্রচুর শ্যাওলা ওর শরীর পেঁচিয়ে ধরছে। এই পিচ্ছিল শ্যাওলার মাঝে। প্রায় তিরিশ মিনিট কেটে গেল । আনোয়ার হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সমস্ত শরীরের রক্ত ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো জমে যাওয়ার ভয়ে অনেকক্ষণ ধরে মুঠ পাকাচ্ছিল আর খুলছিল যাতে রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত থাকে।
কিন্তু এখন আর মুঠো পাকানো যাচ্ছে না। হাতের আঙুলগুলো অনুভূতিশূন্য। স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করানো যাচ্ছে না ওগুলো। কব্জিতে বাঁধা রশিও হাত দিয়ে ধরা গেল না। বাধ্য হয়ে হাত ঝাঁকি দিয়ে রশিতে ইমারজেন্সী সিগন্যাল দিল আনোয়ার। ইমারজেন্সী সিগন্যাল পেয়ে ওকে দ্রুত টেনে তোলা হলো ওপরে। অন্যদেরকেও একই কায়দায় ওপরে ওঠানো হলো। তারপর সবাই ফিরে এল তাঁবুতে। ডাইভিং গীয়ার খুলে ওরা তাড়াতাড়ি ঢুকল পিপিং ব্যাগে। পরপর কয়েক বাউল গরম সুপ খেলো সবাই। ধীরে ধীরে পিপিং ব্যাগের আরামদায়ক উষ্ণতা ও গরম সুপ ওদের শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরিয়ে দিল কিছুটা । ডিনার শেষে মেজর ডেভিড আর্দালিসহ বিদায় নিলেন।
আগেই বলা হয়েছে জায়গাটার নোনা মাটির ওপর ছোট ছোট কাঁটাঝোঁপ। সেখানেই একটা বাবলা গাছের নিচে ওদের তাঁবু। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দলবদ্ধ নেকড়ের চাপা গর্জন। পরম নিশ্চিন্তে তিনজন ফ্রগম্যান ঘুমিয়ে পড়ল পিপিং ব্যাগে, তাঁবুর ভিতর। অথচ ওদের নিরাপত্তার কোন বালাই নেই।
রাত তিনটা। মুহুর্মুহু জীপের হর্নের আওয়াজ শোনা গেল তাঁবুর বাইরে। ঘুম ভেঙে গেল তিনজনের। হারিআপ, কাম আউট মেজর ডেভিডের গলা ফাটানো চিৎকার শুনতে পেল ওরা। মীন বাস্টার্ড, স্যাডিস্ট প্রভৃতি গালি দিতে দিতে তিনজন শুধু সুইমিং কস্টিউম পরা অবস্থায় পিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল। মেজর ডেভিড় বললেন, লেটস গো ফর এ লেট-নাইট, ডীপ। অর্থাৎ গভীর রাতের ডাইভিং। নির্দেশমত সবাই দৌড়ানো শুরু করল কাবুল নদীর সেই বরফগলা জল ভর্তি চ্যানেলের দিকে। ডেভিড চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, ডাউন। তিনজন ফ্রগম্যান ঝাঁপিয়ে পড়ল বরফগলা জলে। শুরু হলো প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি। এটা শরীর গরম রাখার একটা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ওদের। দীর্ঘ আধ ঘণ্টা পর পরিত্রাণ মিলল তিনজনের।
সকালে দেখা হবে, ডেভিড দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। তাঁর গমন পথের দিকে চেয়ে আনোয়ার বলে উঠল, বানচোত । আবার তিনজন ফিরে এল তাঁবুতে-ঘুমিয়ে পড়ল পিপিং ব্যাগের আরামদায়ক উষ্ণতার মাঝে।
এরপর থেকে প্রতিদিন অনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী, একই ধরনের ট্রেনিং চলতে থাকল। দিনরাত মিলে প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা ওদের খেসকি লেকের পচা পানির তলদেশে ডাইভিং করতে হচ্ছে। বিশ্রামের সময়গুলোর বেশ কিছু অংশ শরীর থেকে জোক ছাড়াতে কেটে যায়। তিনদিন পর থেকে শুরু হলো ক্যাপ্টেন জিয়ার নাক থেকে হলুদ পানি গড়ানো। মেজর ডেভিড ওদের রাবার সুট ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। রাবার সুট তিনজনকে জোঁক আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি দিল।
দিনের বেলা। তিনজনে ডাইভিং করছে খেসকি লেকে। আনোয়ার ডেপথ গেজ দেখে বুঝতে পারল সে বিশ ফুট গভীরে– রয়েছে। আজ আরও গভীরে যাবে ও। ডেপথ গেজে বিশ ফুট অতিক্রান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ সে টের পেল ফেস-মাস্কের ভিতর দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘন অন্ধকার চারদিকে। ব্যাপারটা হঠাৎই ঘটে গেল। আনোয়ার হারিয়ে গেছে খেসকি লেকের তলদেশে। বিশ ফুট পর থেকে শুরু হয়েছে একটা নরম কাদার স্তর। কাদার মাঝে দাম ও শৈবাল। সে আটকা পড়েছে নরম কাদার এই স্তরে। সঙ্গী সুবেদার দ্রুত ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। সুবেদারের আপ্রাণ চেষ্টায় আনোয়ার বহু কষ্টে কাদার স্তর ভেদ করে উঠে এল ওপরে। একটা মারাত্মক অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেল সে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর। দিনের বেলায় ওরা পুনরায় ডাইভিং করছে খেসকি লেকে। আনোয়ার বিশ ফুট গভীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ট্যাংকের বাতাস প্রায় শূন্য। এই সময় ও হঠাৎ আটকে গেল শৈবাল ও দামের ভিতর। বহু চেষ্টার পরও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। এবারও সঙ্গী সুবেদারের প্রচেষ্টায় সে বিপদমুক্ত হলো। সুবেদার দ্রুত ওপরে গিয়ে তাঁবু থেকে ছুরি নিয়ে নেমে এল নিচে। ছুরি দিয়ে দাম কেটে ওকে মুক্ত করল। এ যাত্রায়ও আনোয়ার নির্ঘাত প্রাণে বেঁচে গেল। এরপর থেকে পানির তলদেশে ওদের সঙ্গী হত ডাইভিং-নাইফ।
এভাবে অতিক্রান্ত হলো পনেরো দিন। ওদেরকে পুনরায় নিয়ে আসা হলো মঙলা লেকে। মঙলা লেকের জল স্ফটিক স্বচ্ছ–ঈষৎ নীল। তিরিশ গজ পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। কোথাও বা তারচেয়েও বেশি। মঙলা লেকে ডাইভিং আনন্দপূর্ণ। বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও বিচিত্র মাছে ভরা লেক। ওরা হারিয়ে যেতে চায় লেকের তলদেশে । এই স্ফটিকস্বচ্ছ ঈষৎ নীল পানি, রঙিন নুড়ি, বিচিত্র জলজ প্রাণী আনোয়ারের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে-বড় আনন্দপূর্ণ ও তৃপ্তিময়। ও ভুলে যায় পৃথিবীকে হারিয়ে যায় বহুদূরে। ওরা তিনজন ওপরে উঠে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে বৃহৎ আকারের একটা করে মাছ। মাছগুলো স্পিয়ারগান দিয়ে শিকার করা। সুস্বাদু চপ, কাটলেট প্রভৃতি চমৎকার খাবার তৈরি হয় শিকার করা মাছ দিয়ে। ক্রমেই ওরা ভুলে গেল খেসকি লেকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
ডাইভিংয়ের গভীরতা বেড়েই চলল। সেই সঙ্গে পানির নিচে চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও বাড়ছে। ৭০ ফুট গভীরতায় পৌঁছল তিনজন। বেলা এগারোটার আগে পানি থেকে ওঠা নিষেধ। আনোয়ার ভাবছে, এগারোটা কেন? সে চিরদিনের জন্য মঙলা লেকের তলদেশে থাকতে রাজি। মঙলার ফুটফুটে তলদেশ অপূর্ব। কিন্তু গভীর পানিতে বেশিক্ষণ ডাইভিং বিপজ্জনক। বেলা এগারোটার পর টি-ব্রেক । ওরা তখন উঠে আসতে বাধ্য হয় লেক থেকে।
স্কি-ইং (SKI-ING)। মুসা কোম্পানীতে ৩৫টি স্পীড বোট রয়েছে। এগুলোর শক্তি ৩৩ থেকে ১৫০টি হর্স পাওয়ার। স্কি-ইং তুলনাহীন আনন্দদায়ক। অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। তিনজনের মাঝে একজন স্পীড বোট চালায়। একজন স্কি-ইং করে। একজন বোটে বসে থাকে। বোট তীব্রগতিতে এগিয়ে চলে লেকের বুকে। বোটের পেছনে বাঁধা একটা রশির প্রান্ত স্কি-ম্যান ধরে রাখে। পায়ে থাকে তার স্কি। লেকের খোলা বাতাসে ওদের চুল এলোমেলো হয়ে যায়। তিনজন পালাক্রমে সর্পিল গতিতে ছুটে বেড়ায় লেকের বুকে।
পি.এন.এস. ইকবাল, করাচী। আরব সাগরের খাড়ির প্রান্তে প্রায় পানির ওপর নির্মিত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল পি.এন.এস. ইকবালের দোতলায় বিশাল আকারের তিনটা কামরা ওদের তিনজনের জন্য বরাদ্দ করা হলো। প্রথম কামরায় ক্যাপ্টেন জানজুয়া, তারপর ক্যাপ্টেন জিয়া ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার। প্রতিটি কামরায় অ্যাটাচড় বাথরূম। অত্যাধুনিক বাথরূমগুলোতে ঠাণ্ডা ও গরম পানির সুব্যবস্থা। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই আরব সাগরের কালোজল চোখে পড়ে। প্লেনে করে তিনজন পৌঁছল পি. এন.এস. ইকবাল, করাচীতে।
কমপ্রেশন টেস্ট। গভীর পানিতে যাওয়ার উপযুক্ততার পরীক্ষা। কমপ্রেশন টেস্টের জন্য একটা নির্দিষ্ট চেম্বার রয়েছে। চেম্বারটি মিশ্র ধাতুর তৈরি। ভীষণ মজবুত। সম্পূর্ণরূপে এয়ারটাইট। কঠিন কাঁচে আবৃত কয়েকটা ফোকর রয়েছে চেম্বারের গায়ে। পরীক্ষকরা এই ফোকর দিয়ে পরীক্ষার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। বাইরে যোগাযোগের জন্য চেম্বারের ভিতরে কয়েকটা টেলিফোন রয়েছে। চেম্বারটি প্রায় গোলাকৃতি। ফুট দুয়েক ব্যাসের গোলাকার দরজাটা মজবুত স্টীলের তৈরি। ভিতরে ধূমপান নিষেধ। সাবধান! কোন ধারাল জিনিস ভিতরে নিয়ে যাওয়া চলবে না। ইস্পাতের সঙ্গে ধারাল জিনিসের ঘষায় যে-কোন মুহূর্তে চেম্বারের ভেতর আগুন ধরে যেতে পারে। কারণ ভেতরে প্রেশারাইজড় বাতাসের চাপ রয়েছে। বাতাসের অতিরিক্ত চাপে কোন পরীক্ষার্থীর অবস্থা মারাত্মক হয়ে উঠলে সুইচে চাপ দিলে বাইরে ঘণ্টা বেজে ওঠে।
যথাসময়ে তিনজনের শুরু হলো কমপ্রেশন টেস্ট। ওরা চেম্বারে আবদ্ধ। হিসহিস শব্দে ভেতরে প্রেশারাইজড বাতাস ঢুকছে। ডেথ গেজে টের পাওয়া যাচ্ছে গভীরতা। শরীর এবং কানের ঝিল্লির ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। একজন ফ্রগম্যান পানির নিচে যে অবস্থার সম্মুখীন হয়, চেম্বারের মাঝে ওদের কৃত্রিম উপায়ে সেই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ অনুযায়ী ওরা মাঝে মাঝে নিশ্বাস বন্ধ অবস্থায় ব্লো করছে। ফলে শরীরের ওপর নিউট্রালাইজ হয়ে যাচ্ছে বাইরের চাপ। একশো ফুট গভীরে যাওয়ার পর জিয়ার সাইনাস ও কানের পর্দায় ব্যথা শুরু হলো। ওরা দ্রুত সংকেত পাঠাল বাইরে। জিয়া টেলিফোনে। কথা বলা শুরু করল বাইরে অপেক্ষমাণ ডাক্তারের সঙ্গে। জিয়ার কথা অনুযায়ী ওদের কিছুক্ষণ স্থির করে রাখা হলো, একশো ফুট গভীরতায়। আবার ধীরে ধীরে বাড়ল চাপ। এইভাবে ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো দুশো ফুট গভীরে। আর কারও কোন অসুবিধা হলো না। তিনজনই উত্তীর্ণ হলো কমপ্রেশন টেস্টে।
এরপর শুরু হলো ডিকমপ্রেশন। কমপ্রেশন টেস্টে চাপ বাড়ানো হয়। কিন্তু ডিকমপ্রেশন টেস্টে চাপ কমানো হয়। চাপ বাড়ানোর চাইতে কমানোর প্রক্রিয়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ডিকমপ্রেশন টেস্টে একজন ফ্রগম্যান বেণ্ড, লাং বাস্ট বা এয়ার এমবোলিজমের শিকার হতে পারে। ধীরে ধীরে প্রেশার চেম্বারে বাতাসের চাপ কমছে। ডেপথ গেজে দেখা যাচ্ছে ওরা একশো ফুট গভীরে। পুনরায় জিয়া অসুবিধার সম্মুখীন হলো। বাইরে সংকেত পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হলো চাপ কমানো। একশো ফুট গভীরতা জিয়ার জন্য ক্রিটিক্যাল ডেপথ। এই গভীরতায় জিয়াকে একটু বিশ্রাম নিয়ে চাপ সয়ে নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর প্রেশার চেম্বারে শুরু হলো ডিকমপ্রেশন। এই টেস্টেও ওরা তিনজন সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলো।
আরব সাগরের বেলাভূমি। কুচকুচে কালো জল। বিশাল সাগর শত রহস্য বুকে নিয়ে স্থির, অবিচল। করাচী শহর তখনও তন্দ্রার কোলে আচ্ছন্ন। ঘন কুয়াশায় আবৃত চারদিক। বাইরে যেন জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা। এই ঠাণ্ডা ভেদ করে ছুটে চলেছে–জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার। সঙ্গে রয়েছে নিষ্ঠুর প্রকৃতির হাবিলদার রমজান। আরব সাগরের কোল চিরে বেরিয়ে যাওয়া একটা খাড়ির পাড়ে তিনজনে হাজির হলো। অদূরে চকচকে বেলাভূমি, ঘন কুয়াশার সাদা চাঁদরে আবৃতা। দিনের বেলায় শত শত বিদেশী টুরিস্ট নরনারীর চঞ্চল পদক্ষেপে মুখরিত হয়ে ওঠে এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বেলাভূমি। এটাই ওদের ট্রেনিং এলাকা। কিন্তু ওদের অভিজ্ঞতা টুরিস্টদের ঠিক উল্টো।
খাঁড়ির পাড়ের ওপর দিয়ে সবাই দৌড়চ্ছে। মাইল দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর থামতে বলল হাবিলদার রমজান। সম্মুখে একটা বিশাল আকৃতির মোটা পাইপ। করাচী শহরের মলমূত্র ও যাবতীয় আবর্জনা সাগর বক্ষে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এই পাইপ দিয়ে । সাগরের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে মলমূত্ৰ চাপ চাপ হয়ে আসছে। এগুলো মাছের উপাদেয় খাদ্য। ওরা দেখতে পেল, বিভিন্ন আকারের মাছ হুটোপুটি খেলছে নোংরা জায়গাটায়।
হঠাৎ রমজানের উচ্চম্বরের নির্দেশ শোনা গেল, স্যার, আপনারা এই পানি দিয়ে কুলকুচো করুন। ভাল করে হাত মুখ পরিষ্কার করুন। সেই সঙ্গে গোসলও করতে হবে। ফ্রগম্যান তিনজন বৈদ্যুতিক-শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। ব্যাটা বলে কি? চারদিকে তাজা, পুরানো মলের চাই। তার ওপর অন্যান্য আবর্জনা তো আছেই। একবার দেখলেই সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। হাবিলদারের দিকে তিনজনে তাকাল করুণ দৃষ্টিতে। কিন্তু রমজান নির্বিকার। নির্দেশ পালন না করলে কোর্স থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নির্দেশ পালন করা ছাড়া পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। ফ্রগম্যান ট্রেনিংয়ের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে তিনজন এগোল মলভর্তি ঘনকালো নোংরা পানির দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুর্গন্ধময় পানিতে।
দেহ সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে মলের চাঁইগুলো খুঁড়িয়ে গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তারপর। আনোয়ার আঁজলা ভরে পানি নিল কুলি করার জন্য। আঁজলার পানিতে ক্ষুদ্র একটা মলের দলা দেখতে পেল সে। শরীরটা ঘিন ঘিন করে উঠল। উদগ্র বমি বহুকষ্টে সংবরণ করল আনোয়ার। দুর্গন্ধে মাথাটা গুলিয়ে উঠেছে। পড়ে গেল আঁজলার পানি নিষ্ঠুর রমজান একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। ভীষণ রাগ, ক্ষোভ ও অসহনীয় কষ্টে মনটা বিষিয়ে উঠল। হাত দিয়ে মলের চাঁইগুলো সরানো যাচ্ছে না। সরাতে গেলেই ওগুলো গুঁড়িয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে পানিতে। কিছু কিছু মলের চাই গুঁড়িয়ে যাওয়ায় পানির ঘনত্বও বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে আবার আঁজলা ভরে পানি তুলল আনোয়ার।
আনোয়ার দ্রুত মুখে দিল পানি। জিভ জড়িয়ে গেল ঘন পানির পরশে। পানি তো নয়–যেন নরকের বিষ। অনেকক্ষণ ধরে মুখ হাত পরিষ্কার করতে হলো পানি দিয়ে। দাঁতের ফাঁকে ময়লা আটকে গেল। সারা শরীরে ওদের একটা পাতলা স্তর পড়েছে। পিচ্ছিল শ্যাওলার মত। কটুগন্ধে ওদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নীরব দর্শকের মত অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রমজান। ও যেন পাষাণ মূর্তি। স্নেহ, মমতা ও মানবীয় গুণের ঊর্ধ্বে এক নরপিশাচ। ওরা ঘন ঘন তাকাচ্ছে রমজানের দিকে। ঠাণ্ডায় ওদের দাঁতে দাঁত বাড়ি খেয়ে সৃষ্টি হলো এক অদ্ভুত বেসুরো আওয়াজ। হঠাৎ রমজান চিৎকার করে উঠল, স্যার, আপনারা উঠে আসুন। আনোয়ারের মনে হলো, এটাই রমজানের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর বাণী। তিনজন তীরে উঠেই ছুট লাগাল পি.এন.এস. ইকবালের দিকে।
রূমে এসে সোজা বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। গরম পানির শাওয়ার ছেড়ে দিল। শরীর গরম হয়ে এলে ঠাণ্ডা ও গরম পানি অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভিজল সে। কয়েকবার পেস্ট লাগাল দাঁতে। শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে শেষে ডেটল দিয়ে গোসল সেরে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল ও। গরম চিকেন সুপসহ নাস্তা সেরে আবার তিনজন ছুটল আরব সাগরের দিকে। শুরু হবে রহস্যময় সাগরের হলদেশে ডাইভিং।
উজ্জ্বল রোদ ঝিলমিল করছে। রোদে বীচের বালি থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ ধাঁধানো দ্যুতি। ফুরফুরে বাতাসে আন্দোলিত সাগরবক্ষ। দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দুএকটা জাহাজ। সাগরের কিনারায় একটা বোট অপেক্ষমাণ। মেজর ডেভিড বসে রয়েছেন বোটের ওপর। বোটে করে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো প্রায় আধ মাইল দূরে। রাবারসুটবিহীন অবস্থায় ডাইভিং করতে হবে। সবাই ভাবছে প্রচণ্ড শীতে হয়তো শরীরের রক্ত জমে যাবে। বেশিক্ষণ ডাইভিং করা সম্ভব হবে না। ডেভিড নির্দেশ দিলেন, ডাউন। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল আরব সাগরের কুচকুচে কালো পানিতে হারিয়ে গেল গভীর পানির অন্তরালে।
আরামদায়ক উষ্ণ পানি। ওদের ভয় কেটে গেল। নিচে পানিও পরিষ্কার। বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে ওদের। এখানে পানির গভীরতা চল্লিশ ফুট। আনোয়ার পৌঁছে গেল তলদেশে। বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। দুই তিন ইঞ্চি থেকে শুরু করে প্রায় চোদ্দ পনেরো ফুট লম্বা মাছগুলো। কোন কোনটা ওর মুখের সামনে এসে বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওরা আগন্তুকদের। হঠাৎ আনোয়ারের দৃষ্টি আটকে গেল-তলদেশে অসংখ্য রঙিন পাথর।
কমলা, পীত, তামাটে, কালো, ধূসর বিভিন্ন রঙের পাথর। তবে কালো রঙের পাথর বেশি। কোন কোনটার আকৃতি বিরাট। এইসব পাথরের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন নুড়ি পাথরও দেখতে পেল সে। নুড়ি পাথরগুলো মুক্তার মত টলটলে। কতকগুলো পাথরের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ। বিশাল আকৃতির কয়েকটা পাথরের গায়ে ফাটল। ফাটলগুলোর মাঝে গভীর অন্ধকার। হাঁ করা ফাটলগুলোর মুখে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণ। নানা বর্ণের মাছ, সাপ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও অচেনা সামুদ্রিক প্রাণী আনাগোনা করছে ওখানে।
রূপালী ফুলের রাজ্য আনোয়ারের দৃষ্টি কেড়ে নিল। লাল, সবুজ, গোলাপী, হলুদ নানা বর্ণের, অজস্র ফুলের সমারোহ। ফুলের উজ্জ্বল আলোয় তলদেশের বেশ কিছুটা অংশ আলোকিত। পানির তলায় প্রস্ফুটিত ফুলগুলোকে আকারে বেশ বড় দেখাচ্ছে। কি অপরূপ! কত সুন্দর! ওর মনটা নির্মল আনন্দে ভরে উঠল। অদ্ভুত ধরনের কিছু ফুল লক্ষ করল সে। এগুলো থেকে উজ্জ্বল নীলাভ আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। ফুলের দেশে কতকগুলো মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে এঁকেবেঁকে। ওরা যেন রূপালী দেশের রাজপুত্র।
ওর মুগ্ধ দৃষ্টি আবারও হরণ করল–তুষারশুভ্র বালির প্রান্ত । স্বচ্ছ পানিতে নিটোলভাবে ফুটে রয়েছে। যেন এইমাত্র কোন নিপুণ শিল্পী এঁকে গেল। এই নীরব, স্পন্দনহীন, তুষারশুভ্রতার মাঝে ও দুষ্ট বালকের মত ছুটোছুটি করছে। সারাদেহে এক অনাবিল আনন্দের পুলক। ওর চারপাশে প্রকৃতির অপূর্ব বিস্ময় অপার সৌন্দর্য। মাঝে মাঝে চঞ্চল বালকের মত কোমল বালি নিয়ে খেলা করছে আনোয়ার। সময় জ্ঞান হারিয়ে নিটোল বালির প্রান্তরে ও যেন হারিয়ে গেল । হঠাৎ টান পড়ল ট্যাংকের বাতাসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওপরে আসতে হলো ওকে।
পরদিন। শীতের সকাল। জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার আবার উপস্থিত হলো সাগরের পাড়ে। চারদিকে কাঁচামোনা রোদ। দশজন যাত্রী বহন করার উপযোগী একটা কাঠের তৈরি মজবুত নৌকা পড়ে রয়েছে সাগরের পাড়ে। মেজর ডেভিড ওদের নৌকাটি ঘাড়ে করে দৌড়ানোর নির্দেশ দিলেন। সমুদ্র সৈকতের ওপর দিয়ে ওরা দৌড়চ্ছে। প্রত্যেকের জুলফি বেয়ে কুলকুল করে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। একটা উঁচু মাটির টিলার প্রান্তে পৌঁছুতেই ওপর থেকে কে যেন লাফিয়ে পড়ল নৌকার ওপর। তিনজন, তাকিয়ে দেখতে পেল মেজর ডেভিডকে। তিনি নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসছেন। মাঝে মাঝে দুপা এপাশ ওপাশ করে নৌকা দোলাচ্ছেন। ওদের দৌড়ের গতি শ্লথ। একে মজবুত কাঠের নৌকা, তার ওপর ডেভিডের ভারী শরীর। তিনজনের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম। ওরা ইশারায় ঠিক করল ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা।
হঠাৎ কাত হয়ে গেল নৌকা। ডেভিড লাফিয়ে পড়লেন মাটিতে। ওদের দৌড়ের গতি আবার দ্রুত হলো। প্রায় দুই মাইল অতিক্রম করার পর ডেভিড থামতে নির্দেশ দিলেন। আনোয়ার, জানজুয়া, জিয়া, তোমরা টায়ার্ড। সামনে পরিষ্কার পানি। হাতমুখ ধুয়ে ভাল করে গোসল করে এসো। যাও। মেজর ডেভিডের কথা শুনে ওদের মেজাজ গেল বিগড়ে। সামনে মলের চাই ছড়ানো সেই নারকীয় পানি। আনোয়ারের তীব্র দৃষ্টি ডেভিডের দিকে। ডেভিড শিশুর মত ফিক করে হেসে আবার বললেন, যাও বেটা, নাহাকে আও।
ব্ল্যাক হোল টেস্ট। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ভয়ঙ্করতম পরীক্ষা এটা। আনোয়ারকে জানানো হলো, সাগরের তলায় কোন এক জায়গায় ওকে একাকী তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট বসে থাকতে হবে। ওর সঙ্গে রমজান। দুজন ডুব দিল আরব সাগরে। প্রায় সত্তর ফুট তলিয়ে গেল ওরা। সম্মুখে একটা বিশাল কালো ডুবন্ত পাহাড়। গায়ে একটা ফাটল। ভয়ঙ্করভাবে হাঁ করে আছে ফাটলটি। আবার সেই কৃষ্ণমূর্তি অন্ধকার। আনোয়ারের মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল একটা ঠাণ্ডা স্রোত। ওর মনে হলো ফাটলটা মোরে-ঈলের উপযুক্ত বাসস্থান। হাবিলদার ও আনোয়ার এগিয়ে চলল ফাটলের দিকে। অন্ধকার যে এত নিকষ কালো হতে পারে তা ওর জানা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার যেন এই গহ্বরের মাঝে লুক্কায়িত। এটা যেন সমস্ত রহস্যের আধার-এক ভয়াল অন্ধকূপ। দুজনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল অন্ধকূপের অভ্যন্তরে।
আগে চলেছে রমজান। পেছনে আনোয়ার। রমজান মাঝে মাঝে আণ্ডার ওয়াটার টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে। ফাটলের অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত গেল ওরা। হাবিলদার রমজান হঠাৎ হারিয়ে গেল । আনোয়ার বুঝতে পারল, ওকে একা রেখে চলে গেল রমজান। ওকে এখন একাকী অবস্থান করতে হবে তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। ভৌতিক গহ্বর। বর্ণনাতীত অন্ধকার। ভয়ঙ্কর গভীরতা। রহস্যময় পরিবেশ। নিজের অজান্তেই আনোয়ার চমকে উঠল। একটা পিচ্ছিল জলজ প্রাণী ওর গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ও মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল, কোন রকম ভয় পাওয়া চলবে না। ভয় পেলে মৃত্যু অনিবার্য। ওর মাঝে শুরু হলো বেঁচে থাকার জন্য অদ্ভুত প্রক্রিয়া, যা শুধু অনুভব করা যায়, কাউকে বোঝানো যায় না। ও এখন এমন এক পরিবেশে অবস্থান করছে, যা পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের কাছে কল্পনাতীত বিস্ময় ও ভীতিকর।
নিজের হার্টবিটের শব্দ সে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে শব্দ। যে-কোন মুহূর্তে শরীরের রক্ত জমে যেতে পারে। অনবরত হাত-পায়ের আঙুল নড়াচ্ছে–যেন ঠাণ্ডায় ওগুলো জমে না যায়। হঠাৎ একটা পিচ্ছিল জলজ প্রাণী ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রাণীটার নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই। শেষে আনোয়ার ওটাকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। ও ভাবছে এই গহ্বর থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে তো? যদি পথ হারিয়ে ফেলে? যদি ট্যাংকের বাতাস ফুরিয়ে যায়? দুশ্চিন্তাগুলো দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল ও। ৩৫ মিনিট পার হওয়ার পর সে এগুতে শুরু করল ফাটলের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর নিরাপদেই বেরিয়ে এল ব্ল্যাক হোল থেকে।
চাঁদ নেই। মুক্তোর মত অগণিত তারা দূর নীলিমায়। রাত এগারোটা। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বইছে নির্জন সৈকত জুড়ে। মৃদু গর্জন তুলে বোট ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। জানজুয়া, আনোয়ার, জিয়া ও হাবিলদার রমজান ডাইভিং গীয়ার পরা অবস্থায় বোটের ওপর। মেজর ডেভিডের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। পেছনে করাচী শহরের আলোগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার । হিম বাতাস ভেদ করে ছুটে চলেছে বোট। শুরু হবে নাইট ডাইভিং–এই প্রথম।
জানজুয়া। ডাকলেন মেজর ডেভিড।
ইয়েস, স্যার।
আল্লাহর সঙ্গে প্রেম করেছ?
সঠিক উত্তর আমার জানা নেই।
উঁহু, তাহলে তুমি প্রেম করোনি। তবে চেষ্টা করেছ বহুবার। তাই না?
রাইট, স্যার।
মেজর ডেভিড এবার জিয়াকে বললেন, তোমার কোন গার্লফ্রেণ্ড আছে? থাকলে তাকে স্মরণ করো।
এর কারণ তো বুঝতে পারলাম না, স্যার।
যদি ফিরে না আসো।
ও এই ব্যাপার! আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি স্যার, ডাইভিং শেষে নিরাপদেই ফিরে আসব।
সাবাস, বেটা। ডেভিড এবার তাকালেন আনোয়ারের দিকে। প্রশ্ন করলেন, আনোয়ার, তুমি কি সুস্থ?
ইয়েস, স্যার। ওর দৃঢ় কণ্ঠ।
তুমি সত্যি বলছ, তার প্রমাণ কি?
রাইট, স্যার। সাগরতলে আমি মৎস্যকুমারীদের সঙ্গে নাচব, গাইব, আপনি টেলিফোন করবেন। আমি আণ্ডার ওয়াটার টেলিফোনে একটা সুন্দর গান শুনিয়ে দেব আপনাকে।
আনোয়ারের বলার ধরন দেখে ডেভিড হেসে উঠলেন হো হো করে।
বোট প্রায় সাগরের মাঝামাঝি। ওদের ডিগ্রী, আণ্ডার ওয়াটার কম্পাস, দূরত্ব প্রভৃতি দেয়া হলো। চল্লিশ ফুট গভীরতা দিয়ে ওদের ডাইভিং করে পৌঁছতে হবে তীরে। মেজর ডেভিড পুনরায় ফিসফিসিয়ে উঠলেন, তোমার অনাগত বৌকে স্মরণ করো, আনোয়ার। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সে চোখের জল ফেলছে।
বাড়িতে যেয়ে আপনার মেয়েকে সান্ত্বনা দেবেন, স্যার। ওকে… আনোয়ারের কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল। ডেভিড বুঝে ফেলেছেন, এরপর ও কি বলবে। তিনি দ্রুত নির্দেশ দিলেন, ডাউন। ওরা চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।
লাফ দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে চকিতে চেয়েছিল আনোয়ার ডেভিডের মুখের দিকে। ডেভিড দেখলেন, আনোয়ারের মুখ স্মিত হাস্যে উজ্জ্বল। সেখানে ভয় চিন্তার কোন চিহ্ন নেই। কি অদ্ভুত জীবন! একটু আগেও ওরা ছিল চঞ্চল, উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। যার পরশ এখনও বোট ঘিরে। মেজর ডেভিডের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন বোটের ওপর।
চারজন ডাইভিং করছে সাগরতলে নিচে উষ্ণ পানি আরামদায়ক। ওরা পৌঁছে গেল তলদেশে। অসংখ্য ফসফরাসের টুকরো ভাসমান । ওগুলো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল আলো। ফসফরাসের উজ্জ্বল আলোয় তলদেশ জ্যোৎস্নাস্নাত রাতের মত উজ্জ্বল। নিজের চোখে না দেখলে এই সৌন্দর্য অবিশ্বাস্য! সামুদ্রিক মাছ ও জলজ প্রাণী সাবলীল ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে ওদের। কম্পাস নির্দেশিত পথ ধরে ওরা এগিয়ে চলল। রাত কত গভীর নিচে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তলদেশের পরিবেশ প্রায় একই রকম। রূপালী ফুলের রাজ্যের প্রান্ত ঘেঁষে তুষারশুভ্র বালুকাবেলার ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ ওদের দৃষ্টি চমকে উঠল!
একটা বিশাল দানব হাঁ করে রয়েছে। লাল রঙা জিভ। ঝিকমিকে তীক্ষ্ণ দাঁত। নাকে যৈন দুটো বড় বড় গহ্বর। চোখ দুটো ভাঁটার মত জ্বলছে। রমজান ওদের তিনজনকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে গেল । দানবটাকে ও ভাল করে দেখতে চায়। এধরনের অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্য যেন ওর জন্ম। রমজানের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে ইঙ্গিতে জানাল, ওটা সত্যিকারের দানব নয়। একটা ডুবন্ত পাথরের ঢিবি। ঢিবিটার গায়ে অসংখ্য রঙিন পাথর ও জ্বলন্ত ফসফরাসের টুকরো আটকে রয়েছে। সেজন্যে ওটাকে দূর থেকে দানবের মত মনে হচ্ছিল। ডুবন্ত পাথরের ঢিবি পেরিয়ে চারজন ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল কিনারার দিকে। পথে পড়ল এধরনের আরও অনেকগুলো দানবসদৃশ ঢিবি। এক সময় ওরা পৌঁছে গেল কিনারায় । নিরাপদেই ফিরে এল চারজন ফ্রগম্যান মুক্ত পৃথিবীতে।
আণ্ডার ওয়াটার ডিমোলিশনও একটা ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট। সাগরের তলদেশে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ক্যাপ্টেন জানজুয়া, জিয়া, আনোয়ার আবার প্রস্তুত। ওদের দেয়া হলো পাঁচ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ও মেকানিক্যাল ডিভাইস। বোট থেকে পানিতে নামার আগে ডেভিড বললেন, আই প্রে টু গড ফর ইওর সাকসেস।
সাগরের তলদেশে একটা বড় সাইজের পাথর ওরা. বেছে নিল। পাথরটা গোলাকার। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ সেট করল ওরা পাথরটার তলদেশে। মেকানিক্যাল সুইচে টান দিয়ে সবাই দ্রুত উঠে এল ওপরে। আর তিরিশ মিনিট-তারপর ঘটবে বিস্ফোরণ।
পানির ওপর সবাইকে মৃদু হেসে স্বাগত জানালেন ডেভিড। সরাই বোটে করে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। তিরিশ মিনিট হতে আর কয়েক মিনিট বাকি। মেজর ডেভিড বললেন, আজ ডিনারে তোমরা প্রচুর মাছ খেতে পারবে।
স্যার, এরপর কি আমাদের মাছ শিকার করতে হবে? জানজুয়া প্রশ্ন করল ডেভিডকে।
ডোন্ট বি স্টুপিড। তোমরা মাছ অলরেডি শিকার করেছ। এখন শুধু ওগুলো ধরতে হবে।
কিন্তু কেমন করে, স্যার?
জিয়ার কথায় ডেভিড ধীরে ধীরে বললেন, যদি বিস্ফোরণ ঘটে।
আনোয়ার বোটের গলুইয়ের ওপর বসেছিল। দৃঢ় অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে সে বলে উঠল, বিস্ফোরণ ঘটবেই।
আনোয়ার, তুমি একটু বেশিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী।
মেজর ডেভিডের কথা শেষ হতে না হতেই ওদের কানে এল চাপা গর্জন। ঘটল বিস্ফোরণ। ছিটকে উঠল সাগরের জল।
পরক্ষণে পানির ওপর ভেসে উঠতে শুরু করল মাছ, সাপ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও নানারকম সামুদ্রিক প্রাণী। সাগরের কালো পানি রক্তে হয়ে উঠল রঙিন। ওরা বোট নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিক। কয়েকটা দীর্ঘাকৃতির সামুদ্রিক সাপ দেখতে পেল ওরা । সাপগুলোর শরীর ছিন্নভিন্ন। তেঁতলানো মাংসের মাঝে মেরুদণ্ডের ভাঙা কাঁটা দেখা যাচ্ছে। কচ্ছপ এবং কাঁকড়াগুলোও র্থেতলে গেছে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আঘাতে। কয়েকটা বড় বড় মাছের মাথাও সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গেছে। ওরা বেছে বেছে কয়েকটা বড় বড় মাছ বোটে তুলে নিল। বোট এগিয়ে চলল তীরের উদ্দেশে।
এরপরও ওরা ডাইভিং করতে থাকল। ওদেরকে ১৮০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত যেতে হবে। ওদের আণ্ডার ওয়াটার ক্যামেরায় ধরা পড়ল, সেই তুষারশুভ্র বালির প্রান্তর, রূপালী ফুলের রাজ্য, রঙিন পাথর, জ্বলন্ত ফসফরাস খণ্ড, ডুবন্ত দানবসদৃশ পাথরের ঢিবি, কোরাল রীফ, ব্ল্যাক-হোল, বিশাল শার্ক, ব্যারাকুড়া প্রভৃতি দুপ্রাপ্য চিত্র। একসময় ওরা ১২০ ফুট তলদেশে পৌঁছাল। ঠিক এই সময় জরুরী নির্দেশ এল চেরাট ক্যান্টনমেন্ট থেকে। ওরা ডাইভিং অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে পড়ল ক্যান্টনমেন্টের পথে।
.
১৬.
স্লোয়ারফেয়ার। তুষারের দেশে শুরু হবে যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার জীপ নিয়ে চলেছে কালাম উপত্যকায়। এবারে লোক সংখ্যা দেড়শো । সঙ্গে রয়েছে দুমাসের উপযোগী রেশন। প্রথমে নওশেরা, তারপর রিসালপুর অতিক্রম করল ওদের ছোট্ট কনভয়। মালাকান থেকে শুরু হলো চড়াই উত্রাই।
কোথাও মসৃণ পীচঢালা পথ ঢালু হয়ে গভীরে নেমে গেছে। আবার কোথাও উঁচু তুষারাবৃত পাহাড় অতিক্রম করে গেছে। রাস্তার একপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। ঢালে সবুজ ফার ও পাইন গাছ বরফ আচ্ছাদিত, শুভ্র। অপরপাশে পাহাড়ী স্রোতস্বিনী। তিরিশ-চল্লিশ ফুট চওড়া, অগভীর। রূপালী চকচকে পাঁনি। স্রোতস্বিনীর প্রান্ত ঘেঁষে সবুজ খেত। খেতের কোল জুড়ে বিশাল উঁচু পর্বত-তুষারময়। অধিকাংশ জায়গায় স্রোতস্বিনীর জল ও রাস্তার উচ্চতা প্রায় সমান। এই সমতা অদ্ভুত বৈচিত্র্যময়। মনে হচ্ছে ওদের কনভয় স্রোতস্বিনীর জলের ওপর দিয়ে ভেসে, চলেছে।
সোয়াত। শু্যটিং স্পট। বহু পাকিস্তানী ছায়াছবির বহিদৃশ্যাবলী এখান থেকে গৃহীত হয়। বরফাচ্ছাদিত উঁচু পর্বত, মসৃণ পীচঢালা পথ, অগভীর পাহাড়ী নালা, সবুজ খেত–অপূর্ব! এখানেও পর্বতের ঢালে ফার ও পাইন গাছ কোমল বরফে জড়ানো। সারা প্রকৃতি জুড়ে এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসি। আনোয়ার মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দুচোখ ভরে দেখছে সোয়াতের অপরূপ সৌন্দর্য। এখান থেকে শুরু হলো স্রোতস্বিনীর ওপর চমৎকার সব কংক্রিটের ব্রিজ একের পর এক। রাস্তা বাঁক ঘুরে ব্রিজের ওপর দিয়ে ওপারে গিয়েছে। আবার সম্মুখের ব্রিজ ঘুরে এপারে এসেছে।
ওদের কনভয় এঁকেবেঁকে সোয়াত অতিক্রম করল। সোয়াত পার হয়ে ওদের প্রতিটি গাড়ির চাকার সঙ্গে অ্যান্টি স্কিড চেইন লাগানো হলো, যাতে কোন গাড়ির চাকা স্কিড় করে গভীর খাদে পড়ে না যায়। ওদের কনভয় অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। ভীষণ পিচ্ছিল রাস্তা, দুর্গম। রাস্তার একপাশে গভীর খাদ। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ। ছোট্ট কনভয়টি পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে।
কালাম উপত্যকা। গ্রীষ্মকালীন নিবাস। সী-লেভেল থেকে আট হাজার ফুট উঁচুতে। চারদিকে বরফাচ্ছাদিত পর্বত। পনেরো ষোলো হাজার ফুট উঁচু। পাইন গাছের লম্বা সারি এই পর্বতের ঢাল জুড়ে। গাছগুলোর সবুজ দেহ কোমল তুষারে জড়ানো। ছোট ছোট দুই-একটা মাটির বাংলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে। উপত্যকার একপ্রান্ত তিরিশ-চল্লিশ ফুট ঢালু। এই ঢালু প্রান্তের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে একটা খরস্রোতা পাহাড়ী নালা। স্বচ্ছ জলের নালাটি পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু রূপালী ট্রাউট মাছে ভর্তি । উপত্যকার ওপর তিনটে রেস্ট হাউজ, ইউরোপীয়ান ফিটিংস-এ সাজানো। প্রতিটি ঘরের ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন। সৈনিকরা রেস্ট হাউজের, অদূরে একটি স্কুল বিল্ডিংয়ে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করল। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার রইল রেস্ট হাউজে।
পরদিন সকাল । আরজুমান্দ মালেক ও আনোয়ার বেড়াতে বের হলো। ওদের পরনে গরম পোশাক, ও, পায়ে স্নো বুট। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ফার ও পাইন গাছে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে। সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুষ্ট ছেলের মত কৌন হ্যায়, কৌন হ্যায়, করে চিৎকার করতেই দরজা খুলে গেল। সেখানে দাঁড়ানো একটি যুবতী। পরিচ্ছন্ন সালোয়ার কামিজ পরিহিতা। অপূর্ব সুন্দরী। চমকে উঠল-মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে ওরা! ভাল করে দেখতেই ওদের ভুল ভেঙে গেল। লিজ টেলর নয়। তবে লিজের হুবহু প্রতিকৃতি। মেয়েটির মুখে স্মিত হাসি।
ওরা দুজন এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। ইঙ্গিতে ঘর সংলগ্ন মাটির বারান্দায় বসতে চাইলে মেয়েটি মৃদু হেসে বসতে আহ্বান জানাল ওদের। যুবতী ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, পশতু কিছুই বোঝে না। ওদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। বিরল পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে এরা। তবে পশতুর সঙ্গে অতি সামান্য মিল রয়েছে।
ইশারায় ভাব বিনিময় শুরু হলো সালোয়ার কামিজ পরিহিতার সাথে। মেয়েটি ইঙ্গিতে জানাল সে বাড়িতে এখন একা। বাড়ির– অন্যান্য লোকেরা কাজের জন্য শহরে গিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। আনোয়ার ও মালেক সেনাবাহিনীর লোক, তাও মেয়েটি বুঝে নিল। আনোয়ার দুএকটা পাহাড়ী শব্দ জানত। সে বলল, ওর উস্কা (পানি খাব)। যুবতী কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দুর্বোধ্য, পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে উঠল । কিন্তু আনোয়ার তার কিছুই বুঝতে পারল না। ও ইঙ্গিতে জানাল, সে দুএকটার বেশি পাহাড়ী শব্দ জানে না। যুবতী বরফ গলিয়ে পানি এনে দিল ওদের। পানি খেয়ে সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল।
রেস্ট হাউজ থেকে স্কুল বিল্ডিং মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। অথচ ওদের এই পথটুকু অতিক্রম করতে অনেক সময় লাগে। প্রায় গোলাকৃতি মাঠটি পুরু বরফে ঢাকা। আনোয়ার স্কি চালানো শিখছে, উঁচু পর্বতবেষ্টিত এই ক্ষুদ্র মাঠে। ওর পরনে অলিভ-গ্রীন ঢোলা ট্রাউজার্স, গায়ে গরম ফুল হাতা ভেস্ট, তার ওপর ফুল হাতা মোটা উলেন সার্জের দামী শার্ট, শার্টের ওপর ফুল হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা। গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ, পায়ে নাইলনের স্টকিং, তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কানাকা ফারের টুপি। বেশ কয়েকদিন অনুশীলনের পর ও একজন স্কিম্যান হয়ে গেল।
ক্রেভিজ ক্রসিং। দুপাশে উঁচু পর্বত। মাঝে গভীর গিরিখাদ। বিশেষ কায়দায় এই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার নাম ক্রেভিজ ক্রসিং। শুরু হলো অনুশীলন। একটা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী রকেট নিল ওরা। বের করে নিল ফিউজ। নিউট্রালাইজড হয়ে গেল রকেট। কোন বিস্ফোরণ ঘটবে না। অ্যাংকর আকৃতির তিনটা হুক ওয়েলডিং করে লাগানো হলো রকেটের বডিতে। রকেটের লেজের সঙ্গেও শক্ত একটা নাইলনের লম্বা কর্ড বাঁধা। শেলটাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো ওপাশের পর্বত লক্ষ্য করে। তারপর টেনে দেখে নিল ওরা ঠিকমত আটকেছে কিনা। একে একে ওরা পার হয়ে গেল নাইলনের রশির সাহায্যে গভীর ফাটল । শেষ হলো অনুশীলন ক্রেভিজ ক্রসিং।
ক্লিফ ক্লাইম্বিং। খাড়া পর্বতের চূড়ায় আরোহণ। নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বত। অ্যালুমিনিয়ামের পিটন (পেরেক) ওরা বিঁধিয়ে দিচ্ছে পর্বত গাত্রে। পিটন ধরে একে একে সবাই উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। ওদের প্রত্যেকের পিঠে ভারী ওজনের প্যাক। সারা শরীর বরফের দেশের উপযোগী পোশাকে আবৃত। পায়ে স্নো বুট। হাতে আইসঅ্যাক্স বা বরফ কাটা গাঁইতি। অমানুষিক পরিশ্রম শেষে ওরা পৌঁছল নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বতের চূড়ায়। শেষ হলো, ক্লিফ ক্লাইম্বিং।
স্কি-ইং। বরফের ওপর স্কি-ইং দারুণ রোমাঞ্চকর। আনোয়ার শুরু করল অনুশীলন। ওর পায়ে চামড়ার তৈরি স্কি-ইং বুট, স্টীলের মত মজবুত। মাথায় কান ঢাকা পারকা। পরনে ট্রাউজার্স ও পারকা-জ্যাকেট। প্রতি হাতে দুটো করে গ্লাভস । ওপরেরটাকে বলা হয় মিটন শেল। ভিতরেরটাকে বলা হয় মিটন ইনার । দুহাতে দুটো স্কি-ইং স্টিক। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ওর স্কি-ইং ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য প্রায় এক মাইল। সাঁ সাঁ করে সে এগিয়ে চলল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল গতিতে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে। ঠিক যেন একটা ছুটন্ত তুষার মানব।
ইনিশিয়ার ক্লাইম্বিং। পুরো দশ দিনের প্রোগ্রাম। এবার ওদের বহুদূর যেতে হবে বরফের মাঝে। চল্লিশজনের দল। এদের মাঝে একমাত্র অফিসার আনোয়ার-কমাণ্ডার। এই সৈনিকদের বলা হয়, আদার র্যাংকস। প্রত্যেকের পরনে অলিভ গ্রীন ট্রাউজার্স। গায়ে ফুলহাতা উলেন ভেস্ট, সার্জের মোটা শার্ট, ফুল-হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা; গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ। পায়ে নাইলন স্টকিং ও তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কান ঢাকা ফারের টুপি।
একশো পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের ভারী রূকস্যাক প্রত্যেকের পিঠে। রূকস্যাকে দশদিনের পুরো রেশন, গোলা বারুদ, বাড়তি কাপড়-চোপড়, স্কি বুট, চকোলেট, সিগারেট, স্নো বুট প্রভৃতি। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো হোলস্টারে পিস্তল, কম্পাস, পানির বোতল, মেডিসিন কীট ও কমাণ্ডো নাইফ। গলায় ঝোলানো বিনকিউলার। ডান কাঁধে ঝোলানো সাব-মেশিনগান। বাম কাঁধে একজোড়া স্কি-ও স্কি-ইং স্টিক ও ডান হাতে আইস অ্যাক্স; বরফ কেটে রাস্তা তৈরির জন্য ।
আদার র্যাংকসদের এগুলো ছাড়াও বাড়তি জিনিসপত্র বহন করতে হচ্ছে। গরু ও দুম্বার বড় বড় ঠ্যাং ও গ্যাসোলিনের ক্যান ওদের কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো। এছাড়াও রয়েছে স্টোভ, নব্বই পাউণ্ড ওজনের ওয়্যারলেস সেট, জেনারেটর, দুই ইঞ্চি মর্টার ও ছয়টা হেভী মেশিনগান। এগিয়ে চলেছে অভিযাত্রী দল। আগে চলেছে দুজন পাহাড়ী স্কাউট । তারপর কমাণ্ডার আনোয়ার, জেসিও নায়েক সুবেদার কবীর, আদার র্যাংকস জানস খান, আদার র্যাংকস আসলাম খান, মালেক নূর, শেরদিল ও জুলফেকার। পেছনে অন্যান্য সবাই। এদের মাঝে একমাত্র বাঙালী আনোয়ার। সকাল নয়টায় শুরু হয়েছে যাত্রা। দুর্গম পথ। কোথাও রাস্তা অত্যন্ত সরু, মাত্র ছয় ইঞ্চি চওড়া। পাশে গভীর গিরি খাদ। কোথাও রাস্তা আঁকাবাঁকা। পর্বতের ঢালে অসংখ্য পাইন গাছ। গাছের ডালপাতায় তুষার জমে আছে। বেলা বারোটায় কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্য। আনোয়ার ডাকল, জানস খান।
জ্বী, স্যার। বিশালদেহী জানস খানের গম্ভীর গলা শোনা গেল।
সবাইকে হুঁশিয়ার করে দাও। এখন বরফ গলে রাস্তা আরও পিচ্ছিল হয়ে যাবে।
অভিযাত্রী দল কালাম উপত্যকা থেকে এক হাজার ফুট উঁচুতে। ক্রমশ বাড়ছে সূর্যের তাপ। বরফ গলে রাস্তা ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে গেল। সবার চোখে প্রটেকটেড সানগ্লাস। সানগ্লাসবিহীন অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে স্নো ব্লাইনেসে আক্রান্ত হতে পারে ওরা। ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেন কমে আসছে। প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর পাঁচ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা। বিশ্রামের সময় গ্যাসোলিনের স্টোভে বরফ গলিয়ে প্রচুর জলপান করছে সবাই শরীরের ডিহাইড্রেশন পূরণ করার জন্য। দুপুর দেড়টার দিকে সবাই থামল। তাজা হান্টার বীফ, পরোটা, গরম মাংসের কাবাব ও কফি সহযোগে লাঞ্চ সারল ওরা।
আবার শুরু হলো ক্লাইম্বিং। রাস্তা ক্রমশই উঁচু হয়ে গিয়েছে। সম্মুখে সুউচ্চ পর্বতের চূড়া। অভিযাত্রীদল সতর্ক। বরফে পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। রাস্তার পাশে খাদের তলদেশ নজরে পড়ে না। সূর্য আস্তে আস্তে হেলে পড়ল পশ্চিমাকাশে। তাপমাত্রাও কমে এল সেইসঙ্গে। অভিযাত্রীদের চলার গতি বাড়ল কিছুটা । বরফ গলছে না, ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। দুহাজার ফুট অতিক্রান্ত হলো। সবাই পরিশ্রান্ত। বেলা চারটায় আনোয়ার নির্দেশ দিল, হল্ট।
জেসিও কবীর, শেরদিল, আসলাম খান রান্নার আয়োজন শুরু করল। জানস খান ও জুলফেকার স্নো-টেণ্ট খাঁটিয়ে দিল কমাণ্ডারের। স্নো-টেন্টগুলো একপিস কাপড়ের তৈরি। টেন্টের দুই মুখে দুটো চোঙ-টেন্টের প্রবেশ পথ। চোঙের গোড়ার দিকে নাইলনের নেট ঝোলানো। টেন্টগুলো সাত ফুট বাই চার ফুট। ভিতরে ছয় ইঞ্চি মোটা এয়ার ম্যাটরেস, ডবল পিপিং ব্যাগ ও একটা এয়ার পিলো। দ্রুত নেমে এল অন্ধকার। মৃত্যুশীতল নীরবতায় ছেয়ে গেল বরফের রাজ্য। প্রাণের কোন ছোঁয়া নেই। পর্বতচূড়াগুলো অস্পষ্ট। কিছুই আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আকাশ জুড়ে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ডিনার শেষে আনোয়ার ঢুকল টেন্টে। জেসিও কবীর ও জানস খান এসে শুভরাত্রি জানিয়ে গেল ওকে।
বরফের দেশে রাত-আনোয়ারের জীবনে এই প্রথম। ডবল পিপিং ব্যাগের ভিতরে এখন সে। চোখে তন্দ্রালু ভাব। রাত এলেই ওর মনটা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। ওর মনের গভীরে জেগে ওঠে এক টুকরো স্মৃতি। রাত ওর প্রিয়। ও যেন নিশাচর। শরীরের পেশীগুলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার, লোকালয় থেকে বহুদূরে বরফের দেশে।
পরদিনও একই ভাবে ক্লাইম্বিং করল অভিযাত্রী দল। পাঁচ দিন কেটে গেল ওদের বরফের রাজ্যে। কখনও পর্বতের ঢাল ঘেঁষে, পিচ্ছিল পথ বেয়ে, গভীর খাদের প্রান্ত ছুঁয়ে এগিয়েছে ওরা। ষষ্ঠ দিন, বিকেলবেলা। আবহাওয়া চমৎকার। ওরা যাত্রাবিরতি করল। জায়গাটা সমতল। সামনের দিকটা একটু ঢালু। কয়েকটা ঘন পল্লবিত পাইন গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রি-লাইন। তারপর কোন গাছপালা নেই। শুধু সীমাহীন বরফ। আনোয়ার সবাইকে স্নো-টেন্ট টাঙানো ও রান্নার আয়োজনের নির্দেশ দিল। ও আজ স্কি-ইংয়ে বেরুবে।
নায়েক সুবেদার কবীর বলল, স্যার, এখনি সন্ধ্যার অন্ধকার নামবে। পথে কোন বিপদ ঘটতে পারে, আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।
কবীর, বিপদ যদি ঘটেই, তবে সেটা মোকাবেলা করার মত ক্ষমতা আমার আছে। ভয় পেয়ো না। আমি নিরাপদেই ফিরে আসব। শেরদিল, আসলাম খান, সরফরাজ কেউ ওদের প্রিয় কমাণ্ডারকে একা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু কারও কথা শুনছে না সে। একাই যাবে স্কি-ইং করতে।
স্যার, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
কে? জানস খান। আনোয়ার ঘুরে তাকাল।
জ্বি, স্যার।
তোমরা অযথা ভয় পাচ্ছ। কিছুই হবে না–আমাকে একাই যেতে দাও। কমাণ্ডার যেন অনুমতি চাইল আদার র্যাংকস জানস খানের কাছে। কোমরের বেল্ট থেকে কমাণ্ডো-নাইফ খুলে এগিয়ে এল জানস খান। বাড়িয়ে ধরল আনোয়ারের দিকে। বলল, স্যার, এটা বুকে বিঁধিয়ে দিন। তাহলে আমি আপনার পথরোধ করে দাঁড়াব না। এই সুযোগে সবাই ওকে সঙ্গে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানাল। অগত্যা অনুরোধের চেঁকি গিলতে হলো কমাণ্ডারকে।
আগে আনোয়ার, পেছনে জানস খান। ঘণ্টায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল বেগে এগুচ্ছে দুজন। কয়েক মিনিট চলার পর সম্মুখে পড়ল একটা ঢাল। ঢালটি বেশ গভীর। তারপর আবার সমতল বরফ। আনোয়ার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেল। ওদের চলার গতি এখন ঘণ্টায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল। আনোয়ার ইশারা করতেই জানস খান দ্রুত পাশে চলে এল ওর। এগিয়ে চলল দুই তুষার-মানব পরম নিশ্চিন্তে।
ক্যাম্প এলাকায় সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। কেউ গ্যাসোলিনের চুলায় বরফ গলাচ্ছে। কেউ তৈরি করছে মাংসের কাবাব, কেউ পাইন গাছের শুকনো ডালপালা ভাঙছে। সেগুলো একটা বড় পাইনের নিচে স্থূপীকৃত। গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতেই শুকনো ডালপালা জ্বলে উঠল । কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওরা আগুনের পরশ নিচ্ছে শরীরে। সূর্য প্রায় অস্তমিত। তবুও আনোয়ার আর জানস খানের ফিরে আসার নাম নেই। হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল। ঝড় আসছে–তুষার ঝড়। দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্প এলাকায়। ওদের প্রিয় কমাণ্ডার ও সঙ্গী জানস খান তুষার ঝড়ের কবলে। যেভাবেই হোক ওদের উদ্ধার করতে হবে । আসলাম খান, শেরদিল, সরফরাজ সহ দশজন শক্তিশালী আদার র্যাংকসকে নিয়ে পরামর্শ করতে বসল জেসিও কবীর।
আনোয়ার ও জানস খান ফিরে আসছে ক্যাম্প অভিমুখে। হঠাৎ পেছনে শোঁ শোঁ আওয়াজ। থমকে দাঁড়াল দুজন। পেছনে তাকিয়ে খান বলে উঠল, স্যার, তুষার-ঝড়।
কুল ডাউন, জানস খান । মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আনোয়ার দ্রুত পকেট থেকে ম্যাপ বের করল। ক্যাম্পের দূরত্ব আর মাত্র দুমাইল । সম্মুখে তিরিশ গজের মধ্যে রয়েছে সেই ঢালটি ।
জানস খান।
স্যার।
তুষার ঝড় আসার আগেই আমাদের ঢালটি অতিক্রম করতে হবে। গেট অ্যাহেড। ওরা দুজন দ্রুত এগিয়ে চলল। পেছনে ধেয়ে আসছে ঝড় ।
ওরা ঢালের প্রান্তে। ঠিক সেই সময় এসে পড়ল ঝড়। চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ভারী বাতাস। বুলেটের মত বরফের কুচি ছুটছে।
জানস খান, ঢাল পার হও, কুইক। চিৎকার করে উঠল আনোয়ার। ওরা ঢলের প্রায় মাঝামাঝি। পেছন থেকে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় ওদের গতি দ্রুততর হলো । ঢালের নিচু জায়গা। এক্ষুণি ভরে যাবে কোমল বরফে । দ্রুত পার হতে না পারলে ওরা চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। প্রায় ষাট ডিগ্রী খাড়া চড়াই বেয়ে স্কি-ইং করে ওরা উঠে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক গজ। তারপর শুরু হয়েছে সমতল বরফ। আনোয়ার পার হয়ে গেল বরফের চড়াই । শেষপ্রান্তে সমতল বরফে আছড়ে পড়ল ওর ভারী শরীর। সঙ্গে সঙ্গে ছেয়ে গেল সারা শরীর বরফে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় ওর কানে এল একটা ক্ষীণ আর্তনাদ বাঁচাও। পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল আনোয়ার–জানস খান নেই। খান বলে চিৎকার করে ও লাফিয়ে পড়ল ঢালের প্রান্তে।
ঢালের প্রান্তদেশে শুয়ে পড়েছে সে। দেখছে নিচে-বরফের প্রচণ্ড মাতামাতি। কোমর বরফে ঢেকে যাচ্ছে ঢালের তলদেশ। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠল আনোয়ারের মন। ওর জন্যই জানস খান চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। মনে হয় আর বাঁচানো গেল না ওকে। আনোয়ার আবার চিৎকার করে উঠল, জানস খান! ডানদিক থেকে শোনা গেল জানস খানের দুর্বল আওয়াজ, স্যার। আনোয়ার দ্রুত এগিয়ে গেল। নিচে দেখা গেল খানকে। প্রায় চার ফুট গভীরে তখন সে। কোমল বরফরূপী মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধরত। ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে জানস খানের ভারী শরীর।
আনোয়ার দ্রুত স্কি-ইং স্টিক পুঁতল ঢালের প্রান্তে। জানস খান, তুমি আমার পা ধরো। বলে আনোয়ার শরীর নামিয়ে দিল নিচে। ও দুহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে স্কি-ইং স্টিক। জানস খান জড়িয়ে ধরল ওর ঝুলিয়ে দেয়া পা। ধীরে ধীরে উঠে আসা শুরু করল খান। আনোয়ার বুঝতে পারছে স্কি-ইং স্টিক বেঁকে যাচ্ছে ক্রমেই। যে-কোন মুহূর্তে উপড়ে যেতে পারে।
আনোয়ার শুধু বলল, একটু তাড়াতাড়ি, খান। ঠিক এই সময় ঢালের প্রান্তে হাজির হলো জেসিও কবীর। সঙ্গে দুজন আদার র্যাংকস ও দুজন স্কাউট। আনোয়ার ওদের দেখতে পেয়ে। দ্রুত ডাক দিল, কবীর, আমরা এদিকে। দ্রুত এগিয়ে এল উদ্ধারকারী দল। ঢালের প্রান্তে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করল জেসিও কবীর। তারপর তুষার ঝড়ের মধ্য দিয়ে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।
পরদিন সকাল। আবহাওয়া অপরিচ্ছন্ন, তুষারপাত হচ্ছে। সারাদিন ধরে চলল তুষারপাত । সারাটা দিন স্নো টেন্টের মাঝে কেটে গেল ওদের। অষ্টম দিনে আবহাওয়া মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। শুরু হলো অনুশীলন। বরফের ওপর ভারী অস্ত্রের ফায়ারিং এবং কাল্পনিক শত্রু এলাকা আক্রমণ। রাতে শুরু হলো নাইট রেইড। তারপর ফিরে আসার পালা। পর্বত বেয়ে ওঠার চেয়ে নামাটা আরও বিপজ্জনক, যে পথ ওদের অতিক্রম করতে সময় লেগেছিল আটদিন, সেই পথ ওরা নেমে এল সাত আট ঘণ্টার মধ্যে। কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়াই ফিরে এল অভিযাত্রী দল নিচে রেস্ট হাউজে।
রেস্ট হাউজের আরামদায়ক পরিবেশে ওরা বিশ্রাম নিল পুরো একদিন। বিশ্রামের জন্য হাতে এখনও দুদিন সময়। পরদিন সকাল। ঝলমলে রোদ উঠল আকাশে। চকচক করছে তুষার। অলস দিন। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বের হলো নির্জন পর্বতের ঢালের সেই যুবতীর উদ্দেশে। ঘরের সামনে গিয়ে ওরা চিৎকার করল, কৌন হ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই যুবতী। নীরবে স্বাগত জানাল ওদের।
কাছে যেতেই যুবতী বলল, কেনা (অর্থাৎ বসো। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বসে পড়ল মাটির বারান্দায়। আনোয়ারও মেয়েটিকে বলল, কেনা। যুবতী না বসে মিটিমিটি হাসতে লাগল। হঠাৎ সে কথা বলে উঠল। কিন্তু ওরা কিছুই বুঝল না। তারপর ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল ওদের উদ্দেশে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা বুঝতে পারল, মেয়েটি জানতে চাইছে, এতদিন ওরা কোথায় ছিল। এবারে ইঙ্গিতে ওরাও বুঝিয়ে দিল–ওই দূরে, উঁচু বরফের চূড়ায় গিয়েছিল ওরা। আনোয়ার বলল, এগগায়া এস্তা? দ্রুত এস্তা বলে ঘরের ভিতরে গেল মেয়েটি ডিম আনার জন্য। আরজুমান্দ মালেক বলল, শালা, খুব তত জমিয়েছিস! এবার নামটা জিজ্ঞেস কর।
কিন্তু কি করে?
যেভাবে ডিম আনতে বললি।
দ্যুৎ শালা। তারচে বরং তুই ইশারাতে নামটা জিজ্ঞেস কর।
মালেকের চোখ কপালে উঠল, আরে বিয়ে করবি তুই, আর নাম জিজ্ঞেস করব আমি?
মালেক, আমি বাঙালী মেয়েকেই বিয়ে করব। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আনোয়ারকে সিরিয়াস মনে হলো ।
নে, নে, তুই শালা বাঙালী প্রেমেই মত্ত থাক। এটাকে আমিই নিই।
বারান্দায় বসে ওরা আশপাশে ভাল করে দেখল। পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটা মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুজন ভাবছে, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কি অদ্ভুত জীবন! এই নির্জন বরফের রাজ্যে সুন্দরী যুবতাঁকে একা রেখে সবাই চলে গেছে শহরে। কাজ শেষে কবে ফিরবে কে জানে?
ঘর থেকে বেরিয়ে এল যুবতী। হাতে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের পরিষ্কার পাত্র। তাতে কাঁচা ডিম ভেঙে এনেছে। ওরা গপাগপ খেয়ে নিল। আরজুমান্দ মালেক ইশারায় জানতে চাইল যুবতীর নাম । বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করল মালেক। যুবতী কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত চেয়ে রইল। আনোয়ার উঠে দাঁড়িয়ে মালেককে বলল, আমি তোর নাম জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিবি। আনোয়ার বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার নিজের নাম উচ্চারণ করল। তারপর ফিরল মালেকের দিকে। ডাকল, আরজুমান্দ মালেক। মালেক দ্রুত উত্তর দিল। আনোয়ার ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নাম। তবুও যুবতী নিরুত্তর। এবার শুরু হলো প্রচেষ্টা। মালেক ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার উত্তর দিচ্ছে, আনোয়ার নাম জিজ্ঞেস করলে মালেকও দিচ্ছে জবাব। এরই মাঝে আনোয়ার চট করে ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিত করল–ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ নূরী।
আনোয়ার ও মালেক একসঙ্গে জানতে চাইল নূরী? যুবতী ঘাড় হেলিয়ে জানাল-ঠিক! আনোয়ার ইংরেজিতে বলল,
মালেক, তোর বৌয়ের নাম তো বেশ সুন্দর।
বেশ সুন্দর নয় খু-উ-ব সুন্দর। তোরই ভাবী তো? . শালা, আগে দেখ, তোর বৌ হতে ও রাজি আছে কিনা। আনোয়ারের কণ্ঠে রীতিমত কৌতুক।
বলিস কি! ও তো আমার বৌ হয়ে বসে আছে। দাঁড়া ওকেই জিজ্ঞেস করছি। মালেক নূরীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই নূরী, তোর স্বামী কে? আমি না?
নূরী একবিন্দুও বুঝতে পারল না ওদের কথা।
চল, আজ অনেক হয়েছে। আর একদিন আসা যাবে। মালেককে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার । ওরা বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ওদের ইঙ্গিতে আবার আসতে বলল। ওরা হাঁটা শুরু করল রেস্ট হাউজ অভিমুখে। মাটির বারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নূরী ওদের গমন পথের দিকে। কে জানে, পর্বতবাসিনী নূরী ওদের নিয়ে কি ভাবছে?
একটি গ্লেসিয়ার। বিশ হাজার ফুট উঁচুতে ম্যাপে নির্দেশিত এই গ্লেসিয়ারের চূড়ায় আরোহণ করতে হবে এবার অভিযাত্রী দলকে। ভিন্ন পথে এগিয়ে চলল ওরা। আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। সূর্য ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। সামনের পথ বেশ সরু হয়ে বেঁকে গেছে। পাশে গভীর খাদ। খাদের পাশ ঘেঁষে সরু পথ অতিক্রম করছে ওরা। সবাই সতর্ক। হঠাৎ শেরদিল চিৎকার করে উঠল, স্যার, সরফরাজ নিচে পড়ে গেছে।
আনোয়ার দ্রুত নায়েক সুবেদার কবীরকে নির্দেশ দিল, জলদি নিচে যাও এবং অবস্থা সম্পর্কে আমাকে ইনফর্ম করা, কুইক।
কবীর দ্রুত নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ওয়্যারলেসে শোনা গেল কবীরের কণ্ঠ। আনোয়ার সেট অন করে রেখেছে। স্যার, সরফরাজ ভাল আছে। তেমন কোন মারাত্মক আঘাত পায়নি। শুধু জেনারেটরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। ওভার।
ও কত ফুট গভীরে পড়েছে? ওভার। আনোয়ারের প্রশ্ন।
আবার ভেসে এল কবীরের কণ্ঠ, প্রায় বারোশো ফুট নিচে, স্যার।
ঠিক আছে, তুমি ওকে রেস্ট হাউজে রেখে ফিরে এসো । আমরা এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ওভার অ্যাণ্ড আউট। কেটে গেল যোগাযোগ।
সাতদিনের মাথায় আবহাওয়া ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । চারদিকে শোঁ শোঁ আওয়াজ। বাতাসে বরফের কুচি ছুটে বেড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের । আনোয়ার ক্যাম্প করতে নির্দেশ দিল । সবাই আশ্রয় নিল স্নো টেন্টের অভ্যন্তরে। একদিন একরাত পর আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এল। ওরা আবার শুরু করল যাত্রা। দশদিন পর অভিযাত্রী দল পৌঁছল ম্যাপ নির্দেশিত গ্লেসিয়ারের পাদদেশে।
বিশাল গ্লেসিয়ার। এটির আয়তন কত, তা অনুমান করা মুশকিল। চারদিক শুধু সীমাহীন বরফ। তারই মাঝে গ্লেসিয়ারটি গম্বুজের মত দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টিতে বিস্ময়। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মসৃণ বরফের দেয়াল-একেবারে খাড়া প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। শুরু হলো পিটনের সাহায্যে ক্লাইম্বিং। আট-নয় ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওরা পৌঁছল গ্লেসিয়ারের চূড়ায়। সুন্দর সমতল চূড়া। পিচ্ছিল বরফের আস্তরণ, অতি মসৃণ। এইসব গ্লেসিয়ারের চূড়া প্রায় সারা বছরই তুষার ঝড়ের মোকাবেলা করে। কখনও হালকা মাঝারি ধরনের, আবার কখনও বা প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হয় তুষার ঝড়। ওরা যখন চূড়ায় পৌঁছল, তখন মাঝারি আকারের ঝড় হচ্ছে সেখানে। * পায়ে সবাই ক্র্যাম্প-অন পরে নিল । ক্র্যাম্প-অনের নিচে ধারাল স্পাইক লাগানো। হাঁটার সময় স্পাইকগুলো বরফের ভিতর ঢুকে যায়। ফলে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে সহজেই চলাফেরা করা যায়।
অভিযাত্রী দল পরিশ্রান্ত। চটপট স্নো টেণ্ট খাটাল ওরা। জানস খান, শেরদিল, জুলফেকার ও জেসিও কবীর তৈরি করল একটি সুন্দর ইগলু। এটাই আনোয়ারের আবাস। ইগলুর দিকে চেয়ে আনোয়ার বলল, এক্সেলেন্ট! এবার তোমরা যে যার টেন্টে ঢুকে পড়ো। এরকম আবহাওয়ায় ফ্রস্ট-বাইটের আশঙ্কা পুরোমাত্রায়।
আবহাওয়া ভাল হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। আকাশ ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে তুষার ঝড় ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আবার স্তিমিত হয়ে আসছে। সেটা ক্ষণিকের জন্য। আট দশ দিন ওরা কেউ সূর্যের মুখ দেখেনি। ইগলুর অভ্যন্তরে কেটে গেল আনোয়ারের দুই দিন। তৃতীয় দিন ক্র্যাম্প-অন পায়ে ও বেরিয়ে এল ইগলুর বাইরে। চারদিক ভাল করে লক্ষ করল । আবহাওয়া কখন পরিষ্কার হবে বলা মুশকিল । এদিকে রেশনও প্রায় শেষ। আনোয়ার সবাইকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার অভিযাত্রী দল যাত্রা শুরু করল রেস্ট হাউজের উদ্দেশে। নিরাপদেই পৌঁছল ওরা।
পনেরো দিনের মাথায় প্রকৃতি ওদের একটি সুন্দর মিষ্টি সকাল উপহার দিল। পুব আকাশে রক্তিম সূর্য। প্রত্যুষের নতুন আলোয় হেসে উঠল বরফের রাজ্য। চারদিকে ঝলমল করছে মুক্তোর মত কোমল রূপালী বরফ। আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। গতকাল আরজুমান্দ মালেক দলবল নিয়ে ক্লাইম্বিং শেষে ফিরে এসেছে। ফিরেই আনোয়ারকে বলেছে, আজ নূরীকে দেখতে যেতে হবে।
আনোয়ার জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সম্মুখে দিগন্ত বিস্তৃত বরফ, উদীয়মান সূর্য-শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর চিন্তায়। হঠাৎ দরজায় নক হলো। ছেদ পড়ল আনোয়ারের চিন্তায়। ডাক দিল সে। কাম ইন প্লীজ।
হাই আনোয়ার, গুড মর্নিং। রূমে প্রবেশ করল আরজুমান্দ মালেক।
মর্নিং আনোয়ার ওকে একটি সোফা দেখিয়ে বসতে বলল ।
সোফায় বসে একটি সিগারেট ধরাল মালেক। লম্বা টান দিয়ে বলল, আনোয়ার, তুই আজকাল কি ভাবিস বল তো?
এমন কিছু নারে। আনোয়ার একটু অন্যমনস্ক।
দোস্ত, তুই আমার কাছে লুকোতে চাইছিস? প্লীজ, বল না । মাঝে মাঝে তোকে অন্যমনস্ক মনে হয় কেন? মালেকের কণ্ঠে অনুনয়।
ভাবছিলাম, শেষ জীবনটা কিভাবে কাটবে? আনোয়ারের ভাবলেশহীন কণ্ঠ।
আনোয়ার, ওটা তো তোর জন্য নির্ধারিত ব্যাপার। তোর মরণ হবে হয় বুলেটে-বেয়োনেটে, নয়তো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। আর যদি ভালভাবে কাটে তবে আমেরিকার কোন ফাইভস্টার হোটেল। পাশে…
নে, চুপ কর। পৃথিবীতে মৃত্যু অতি নিশ্চিত। আর মৃত্যুর সময়টা অতি অনিশ্চিত, একটু থেমে আনোয়ার আবার বলল, নূরীকে দেখতে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। এবারে কেটে পড়। টয়লেট আমাকে ডাকছে।
আমাকেও রেডি হতে হবে। নাস্তা সেরে তুই তাড়াতাড়ি আয়। রূম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল মালেক।
ও শিওর। বলল আনোয়ার।
পরিচ্ছন্ন সকালে দুজন আবার উপস্থিত হলো পাইন ঘেরা সেই পর্বতের ঢালে। আসার সময় মালেক চা, কফি ও চকোলেট সঙ্গে নিয়েছে নূরীর জন্যে। সারা রাস্তায় এই নিয়ে আনোয়ার ওকে খেপাল। মাটির বারান্দার সামনে গিয়ে ওরা নির্দিষ্ট সংকেত দিল, কৌন হ্যায়? পরিচিত গলা শুনে মেয়েটি খুলে দিল দরজা। একগোছা তাজা ফুলের মতই দাঁড়িয়ে রয়েছে নূরী। মুখে অতি পরিচিত মৃদু হাসি। নূরী ডাকল, দালতারাসা। (অর্থাৎ এখানে এসো) আনোয়ার জানত দালতারাসার অর্থ। মালেককে নিয়ে সে এগিয়ে গেল। নূরীর সামনে গিয়ে বলল চায়ে উস্কা(অর্থাৎ চা খাব)। নূরী ইশারায় বুঝিয়ে দিল ঘরে চা নেই। মালেক পকেট থেকে চা, কফি ও চকোলেট বের করে নূরীর দিকে এগিয়ে দিল। আনোয়ার ইশারা করল নূরীকে চকোলেট খাবার জন্য। চকোলেটগুলো বেশ সুস্বাদু। একটা মুখে পুরে ওদের দুজনের দিকে দুটো চকোলেট এগিয়ে দিল নূরী। ইশারায় ওদেরকেও খেতে বলল। আজ ওরা প্রথম নূরীর সঙ্গে ঘরের ভিতরে গেল। মাটির তাকে বিভিন্ন জিনিস সুন্দর করে সাজানো। টাঙানো দুটি দড়িতে কাপড়-চোপড়। একটিতে পুরুষের কাপড়, অপরটিতে মেয়েদের। পুরুষের কাপড়গুলো ভীষণ নোংরা, কিন্তু নূরীরগুলো পরিষ্কার ।
মাটির দেয়াল কেটে ছোট্ট একটি দরজা। আনোয়ার অনুমান করল, ওটাই নূরীর কিচেনে যাওয়ার পথ। নূরীকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো। তারপর দুজন নূরীকে নিয়ে কিচেন রূমে ঢুকল। ছোট্ট ঘরটি মাটির দেয়াল ঘেরা। কাঠ ও মাটির তৈরি ছাদ। দেয়ালে কয়েকটি খাঁজ-জিনিসপত্র রাখার জায়গা। ঘরের মাঝখানে ছোট উনুন। এককোণে শুকনো ডালপালা জড়ো করা। ওরা নূরীকে চা ও কফি বানানো শেখাল, নূরী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখল, কিভাবে চা, কফি বানাতে হয়। কফি তৈরি শেষে সামনের ঘরে ফিরে এল ওরা তিনজন। প্রত্যেকের হাতেই পট ভর্তি গরম কফি। আনোয়ার ও মালেক কফি পান শুরু করল। নূরী তাকিয়ে দেখছে ওদের। মালেকের ইশারায় নূরীও কফি নিল। কফি পান শেষে পুনরায় কিচেনে ঢুকল সে। দুটো পট হাতে ফিরে এল ও। পটভর্তি কাঁচা ডিম। ইশারায় ওদের খেতে বলল নূরী। আনোয়ার ও মালেক নূরীকে বোঝাচ্ছে, কফির পর এগুলো খাওয়া ঠিক নয়–কিন্তু ও অবুঝ। ভীষণ পীড়াপীড়ি শুরু করল । শেষে ওরা বাধ্য হয়ে খেয়ে ফেলল কাঁচা, ডিম। তারপর বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ইশারায় আবার ওদের আসতে বলল । কিছুদূর আসার পর পেছন ফিরতেই ওরা দেখতে পেল নূরীকে–দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দার ওপর। মালেক ও আনোয়ার দুজনেই হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে। নূরীও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল। বরফ ভেঙে ওরা এগিয়ে চলল রেস্ট হাউজের দিকে। একসময় ওরা হারিয়ে গেল নূরীর দৃষ্টি সীমার আড়ালে।
১৭.
ফালাক শের। তেইশ হাজার ফুট উঁচু একটি বরফের চূড়া অভিযাত্রী দলের এবারের গন্তব্যস্থল। ম্যাপ অনুযায়ী উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রিলাইন। তারপর কোন গাছপালা নেই। শুরু হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত বরফ। কমাণ্ডার আনোয়ারের নেতৃত্বে এগিয়ে চলল অভিযাত্রী দল। আবহাওয়া পরিষ্কার নয়। যে-কোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। মাঝারি আকারের তুষার ঝড় বইছে। ওরা এগিয়ে চলল ঝড় উপেক্ষা করে। সারাদিন ধরে চলল ক্লাইম্বিং। বিকেলের দিকে কমাণ্ডারের নজরে পড়ল ঘন পল্লবিত ফার গাছের নিচে একটি মাটির ঘর । আনোয়ার নির্দেশ দিল, হল্ট।
পর্বতবাসী স্কাউটরা জানাল, এধরনের মাটির ঘর ট্রিলাইন অর্থাৎ উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত পাওয়া যাবে। এর আগে যারা ক্লাইম্বিং করেছে এপথে, ঘরগুলো তাদেরই পরিত্যক্ত। ওরা আরও জানাল, স্নো টেন্টের চাইতে মাটির ঘর অনেক বেশি আরামদায়ক। আনোয়ার স্থির করল সে আজ এই ঘরে ঘুমাবে।
ওপরে তুষারে ছাওয়া গাছের ছাউনি। দরজার একপাশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনতিদূরে জে.সি.ও. কবির, জানস খান, শেরদিল ও আসলাম খানের স্নো টেন্ট। কবির জানাল, স্যার, ডিনার রেডি। একটা পাইন গাছের নিচে বিশাল আগুনের কুণ্ডলী জ্বেলেছে ওরা শুকনো ডালপালা দিয়ে। জ্বলন্ত, কুণ্ডলীর চারপাশ ঘিরে বসল সবাই। দুম্বার মাংসের রোস্ট, গরম পরোটা, সঙ্গে স্কচ্ হুইস্কি, ফলের রস ও কফি। শেষ হলো ডিনার সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে কমাণ্ডার প্রবেশ করল মাটির ঘরে ।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। অবিরাম স্নো ফল হচ্ছে। আনোয়ারের মনে হলো, এই পরিবেশে মাটির ঘর পৃথিবীর যে কোন বিলাসবহুল প্রথম শ্রেণীর হোটেলের কামরার সমান। ভিতরে সুন্দর আরামদায়ক উষ্ণতা। ডবল পিপিং ব্যাগের নরম বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল কমাণ্ডার।
পাঁচদিন অতিক্রান্ত হলো। ষোলো হাজার ফুট উচ্চতায় ওরা। তুষার ঝড় লেগেই আছে–কখনও আবার তীব্র আকার ধারণ করছে। সামনের পথ আরও দুর্গম। প্রতি রাতে আনোয়ার পরম আবেশে ঘুমায় মাটির তৈরি ঘরে। একদিন রাতে স্নো-বেয়ারের চাপা গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল ওর। সারা ক্যাম্প এলাকায় শুরু হয়েছে হৈ চৈ। সবাই জেগে উঠেছে তুষার ভল্লুকের ক্রুদ্ধ গর্জনে।
স্যার কি জেগে আছেন? দরজার পাশে জানস খানের গলা শুনতে পেল আনোয়ার।
কিসের যেন গর্জন শুনতে পেলাম, খান?
তুষার ভল্লুক, স্যার।
আনোয়ার দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে। জানস খান দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান-লোডেড। সেদিন বাকি রাতটুকু ওরা জেগেই কাটিয়ে দিল। পরদিন সকালে আবার শুরু হলো যাত্রা।
ট্রি-লাইন পার হয়ে গেল। এখনও চার হাজার ফুট দূরে ফালাক শের। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। নেই কোন গাছপালা, নেই কোন জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব। এগিয়ে চলেছে চল্লিশজন অভিযাত্রী। প্রত্যেকেই সুঠামদেহী অকুতোভয়। তেইশ হাজার ফুট অতিক্রম করার পর কমাণ্ডার পুনরায় নির্দেশ দিল, হল্ট।
গভীর রাত। স্নো টেন্টের মাঝে সবাই নিদ্রায় মগ্ন। আনোয়ার ঘুমাচ্ছে একটি ইগলুতে। ঠিক এই সময় ঘুম ভেঙে গেল ওর। বাইরে নারী কণ্ঠের উচ্চস্বরের হাসি। নিশুতি প্রকৃতি জেগে উঠল যেন–একটানা শোনা যাচ্ছে হাসি। আনোয়ার দেখতে চাইল, কে এই নারী? কেন হাসছে গভীর রাতে এই দুর্গম এলাকায়? ও বেরিয়ে এল বাইরে। আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। কোমল আলোয় মুক্তোর মত টলটল করছে তুষার। ফুরফুরে বাতাসে সারা তুষাররাজ্য আন্দোলিত। বহুদূর দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। থেমে গেছে হাসি। কিন্তু কোথায় সেই নারী? কিছুই নজরে পড়ল না। কমাণ্ডার সম্মোহিতের মত চেয়ে আছে। স্থির অবিচল। ধীরে ধীরে ওর মনের প্রান্তে জেগে উঠল বহু দিনের পুরানো সেই স্মৃতি। মনে পড়ল সেই কথা, যা ও মনের নিভৃতে লালন করেছে সবার গোচরে।
আনোয়ার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারাদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার। মিছিল, মীটিং লেগেই আছে। দি ব্যালাড অফ এ সোলজার ছবিটি চলছিল ঢাকার একটি প্রেক্ষাগৃহে। ছবি শেষে বাইরে বের হতেই ও হতবাক! সারা ঢাকা শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের।ওরা হল ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। সারা শহর থমথমে। আর মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি। তারপর বাইরে থাকা চলবে না।
উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে চলেছে আনোয়ার একটি আশ্রয়ের সন্ধানে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সাতটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। তীব্র হুইসেল বাজিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি। আনোয়ার সম্মুখে একটি বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে পড়ল। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলল একটি মেয়ে।
বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই? প্রশ্ন করল সে মেয়েটিকে।
জ্বি-না!
আনোয়ারের মুখটা করুণ হয়ে উঠল। আর কিছু না বলে ও আবার ফিরে চলল রাস্তার দিকে।
শুনুন! পেছন থেকে মেয়েটির ডাক শুনতে পেল সে। কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করল মেয়েটি, কি ব্যাপার? আপনি তো কিছু বললেন না।
না, মানে পুরুষ মানুষ যখন নেই…
তাতে কি। বলুন।
আনোয়ার নিশ্চুপ।
মেয়েটি আবার বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সারা শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
হ্যাঁ–সেজন্যই তো… আনোয়ার বলতে বলতে থেমে গেল। বাড়িতে পুরুষ কেউ নেই। ও কি করে বলবে, আমাকে রাতটা এখানে থাকতে দিন।
আপনি ভিতরে আসুন।
মেয়েটি আনোয়ারকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল ।
আপনি মনে হয় কারফিউয়ের জন্য বিপদে পড়েছেন। তাই না? পুনরায় জানতে চাইল মেয়েটি । আনোয়ার প্রকৃত ঘটনা খুলে বলল তখন। সব শুনে মেয়েটি বলল, আপনি তো আচ্ছা লোক। এত বড় বিপদে কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলেন?
না মানে… আনোয়ারের দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠ ।
আর মানে মানে করতে হবে না। আজ রাতটা এখানেই থাকবেন।
আনোয়ার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ।
আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি। বলে মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আনোয়ার চিন্তা করছে হলের অবস্থা। ওর যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে রূমে। ক্যাম্পাস এলাকায় নাকি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কে জানে, এখন ক্যাম্পাস এলাকার প্রকৃত অবস্থা কি? তাছাড়া আহসান, সাজেদ, নাজমুল সবাই হলে ছিল। ওরা কোন বিপদে পড়েনি তো? মেয়েটি প্লেটে কিছু ফলমূল ও মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকল, সবাই দেশের বাড়িতে বেড়াতে গেছে । বাড়িতে শুধু আমি, ছোট বোন ও চাকরাণী। আর কেউ নেই। নিন শুরু করুন-ততক্ষণ আমি রান্নাটা দেখি গিয়ে।
ঠিক আছে।
সরি। আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি। মেয়েটি ফিরে এল দরজার কাছ থেকে।
আনোয়ার।
ওয়াহিদা। বেরিয়ে গেল ও।
পরদিন সকাল। আনোয়ার বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল। ওয়াহিদা রেখে দিল আনোয়ারের ঠিকানা। তারপর প্রায়ই দেখা হত ওদের দুজনের। কত ঘটনা, কত স্মৃতি-আজও মনে পড়ে ওর। কাকুলে আসার আগের দিন আনোয়ার বিদায় নিতে গিয়েছিল ওয়াহিদার কাছে। সেদিন প্রায় সারারাত ওকে আটকে রেখেছিল ওয়াহিদা। ভোরের দিকে আনোয়ার ডাকল, ওয়াহিদা।
উঁ।
এবারে যেতে দাও।
আর একটু থাকো।
নেমে এল দুজনের মাঝে নীরবতা। একে অপরের দিকে চেয়ে রইল মুগ্ধ দৃষ্টিতে। কি মধুর স্বপ্নই না ছিল, সেদিনের সেই দৃষ্টিতে। আনোয়ার তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের একজন অফিসার। এবার অনেকদিন পর দেখা হলো ওদের। দুজনের মাঝে গভীর প্রণয়-ঘর বাঁধার স্বপ্ন।
তুমি আমাকে প্রেম শেখালে, ওয়াহিদা। আনোয়ার বলল।
সেটা কি আমার অন্যায় হয়েছে? চোখ তুলে জানতে চাইল ও।
না, তা বলছি না। তবে…
কি তবে?
আমি একজন সৈনিক।
হ্যাঁ।
তাই বলছিলাম–আমার কাছে নারীর প্রেমের চেয়ে দেশপ্রেম অনেক বেশি বড়।
মানে… কি বলতে চাও তুমি? ওয়াহিদার বিচলিত কণ্ঠ।
ভয় পেয়ো না। এবার ফিরে এসেই…
কি?
তোমাকে বিয়ে করব। রাজি?
রাজি।
তারপর হেসে উঠল দুজন একসঙ্গে। বিদায়ের দিন। ঢাকা বিমান বন্দরের লাউঞ্জে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ
ওয়াহিদা প্রশ্ন করল, প্রেম জীবনকে কি দেয়?
প্রেম জীবনকে মহৎ করে। প্রেম জীবনে পূর্ণতা এনে দেয়। প্রেম জীবনকে আত্মকেন্দ্রিকও করে তোলে।
দেশপ্রেম?
দেশপ্রেম মানুষকে ত্যাগের আনন্দ জোগায়। উৎসর্গের প্রেরণা দেয়। ঘোষক মাইকে অনুরোধ জানাল, প্রত্যেক যাত্রীকে বিমানে আসন গ্রহণের জন্য। আনোয়ার বলল, আমি এস, এস, জি.-তে যোগ দিয়েছি।
এস. এস. জি.?
আমাকে কমাণ্ডো কোর্স করতে হবে।
কমাণ্ডো?
ভয়ের কিছু নেই। এটা তুমি কারও কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে। আনোয়ার ওর মুখের দিকে চেয়ে শেষে বলল, তুমি ভাল থেকো, ওয়াহিদা।
তুমিও।
খোদা হাফেজ।
খোদা হাফেজ। আনোয়ার এগিয়ে গেল প্লেনের গ্যাংওয়ের দিকে। গ্যাংওয়েতে দাঁড়িয়ে ও শেষবারের মত ওয়াহিদাকে বিদায় জানাল হাত নেড়ে। প্লেন হারিয়ে গেল দূর আকাশে। কিছুদিন পর একটি চিঠি পেল আনোয়ার। চিঠিতে লেখা…,
দি রিয়েল সোলজার,
এটাই আমার শেষ পত্র। দেশপ্রেম সত্যিই যদি তোমাকে ত্যাগের আনন্দ জুগিয়ে থাকে, উৎসর্গের প্রেরণা দিয়ে থাকে, তবে তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো। মনে কোরো, আমিও তোমাকে ভুলে গেছি। ক্ষমা করে দিয়ো।
ইতি–
ওয়াহিদা।
এর কিছুদিন পর আনোয়ার শুনতে পেল, ওয়াহিদার বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখন অন্যের ঘরণী। কথাটা মনে হলে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে গোপন একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস।
অল রাইট ওয়াহিদা। তোমাকে ভুলতে পারব কিনা জানি না। তবে আমি কমাণ্ডো কোর্স করবই।
আনোয়ার ধীরে ধীরে প্রবেশ করল ইগলুতে। পরদিন আর ক্লাইম্বিং করা গেল না। সামনে তুষার অত্যন্ত নরম। ওদের কারও কারও প্রায় গলা পর্যন্ত পুঁতে গেল তুষারের মধ্যে। অদূরে ফালাকশের দেখা যাচ্ছে। আনোয়ার নির্দেশ দিল, গো ব্যাক টু দি প্যাভেলিয়ন। অভিযাত্রীদল আবার ফিরে এল তেইশ হাজার ফুট নিচে, রেস্ট হাউজে।
.
স্নো ওয়ারফয়ার প্রায় শেষ। হঠাৎ করে নির্দেশ এল চেরাট ক্যান্টনমেন্ট থেকে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সবাইকে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছুতে হবে। কালাম উপত্যকায় ব্যস্ততার সাড়া পড়ে গেল। অ্যান্টি স্কিড চেইন সংযুক্ত কনভয় এগিয়ে চলল চেরাট অভিমুখে । সোয়াতের মাঝামাঝি পৌঁছনোর পর আনোয়ারের মনে পড়ল নূরীকে। ওকে বলা হয়নি। হয়তো আর কোনদিন দেখাও হবে না পর্বতবাসিনী নূরীর সঙ্গে। চারদিকে সোয়াতের অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, সূর্যের সোনালী কিরণ। ফার ও পাইনের সারি । পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শ্যামল প্রান্তর। ধবল স্রোতস্বিনীর বুকে মলয় তুলেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ। ওখানেই যেন চঞ্চল নূরী হারিয়ে গেছে। আনমনা আনোয়ার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মালাকান পাহাড়ের পাদদেশ ছুঁয়ে এগিয়ে চলল কনভয়।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। রাওয়ালপিণ্ডির একটা প্রেক্ষাগৃহে দুজন অফিসারসহ আনোয়ার ছবি দেখছে। হঠাৎ ছবি দেখানো বন্ধ হয়ে গেল। লাউডস্পীকারে ধ্বনিত হলো, স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ-এর মেজর আনোয়ার যদি হলের অভ্যন্তরে থাকেন, তবে তাঁকে দয়া করে চেরাট ক্যান্টনমেন্টে কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে অবিলম্বে রিপোর্ট করতে বলা হচ্ছে। সেদিন এধরনের ঘটনা পিণ্ডির প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে ঘটেছিল। ছবি দেখা বাদ দিয়ে আনোয়ার ছুটল ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে।
ড্রয়িংরূমে ঢুকতেই আনোয়ার দেখতে পেল, কমাণ্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আগা আকরাম রাজা পায়চারি করছেন। চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব। নাইট গাউনের ফিতা খোলা; অবিন্যস্ত চুল। টেবিলের ওপর কনিয়াকের বোতল। মৃদুস্বরে বললেন সি.ও. সিট ডাউন, আনোয়ার। ড্রয়িংরূমে পিন পতন নিস্তব্ধতা। দুজন বসে রয়েছে মুখোমুখি। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন আগা আকরাম রাজা, ব্যাপারটা টপ সিক্রেট। এইটুকু বলেই থেমে গেলেন তিনি। কি ব্যাপার? এ ধরনের ভূমিকা করে কখনও তো কথা বলেননি কমাণ্ডিং অফিসার। সন্দেহে দুলে উঠল আনোয়ারের মন ।
পুনরায় শোনা গেল সি.ও.-র কণ্ঠ, আমি একটা অর্ডার দেব । সেটা তোমার কাছে অন্যায় মনে হতে পারে। অ্যাণ্ড ইফ সো, তাহলে কি তুমি সেটা ক্যারি আউট করবে?
স্যার, আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, হোয়াট হ্যাজ টু বী ডান। কণ্ঠস্বরে মনে হলো আনোয়ার যেন বাণবিদ্ধ বাঘ। গমগম করে উঠল ড্রয়িংরূম। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন রাজা, আমাকে ভুল বুঝো না। এটা হাই অফিশিয়াল অর্ডার। ওকে, লেট মি থিংক এ কাপল অফ ডেজ মোর। আজ থাক, দুদিন পরেই তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করব । এসো, আনোয়ার।
ড্রয়িংরূম ছেড়ে বেরিয়ে এল আনোয়ার। সে বুঝে ফেলেছে হাই অফিশিয়াল অর্ডার। ওরা ওকে বাংলাদেশে পাঠাতে চায়– বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। আনোয়ার সিদ্ধান্ত নিল, পালাতে হবে, যে করেই হোক। এরপর অনেক বাঙালী অফিসারদের (তাদের অনেকেই এখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত) সঙ্গে পালানোর ব্যাপারে সে গোপনে পরামর্শ শুরু করে। কিন্তু মিশন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগেই ওদেরকে বন্দী করা হলো। বন্দী অবস্থা থেকেও অনেক বাঙালী অফিসার পালিয়ে গেল ভারতে। ফলে কড়াকড়ি আরও বেড়ে গেল। বন্দীদের একজায়গায় বেশিদিন রাখা হত না। চেরাট, আটক, সাগাই, কোহাট, হরপপ্তা, ঘাজুরি প্রভৃতি ফোর্টে ওদেরকে বিছিন্ন অবস্থায় কড়া প্রহরাধীন রাখা শুরু হলো। তবুও আনোয়ার, সস্ত্রীক মেজর আবু তাহের (নিহত কর্নেল তাহের), মেজর মঞ্জুর (নিহত মেজর জেনারেল), ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীসহ বেশ কয়েকজন অফিসার সিদ্ধান্ত নিলেন পালানোর। দুর্ভাগ্যবশত আনোয়ার শেষ মুহূর্তে মূল দলে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়। পালিয়ে গেলেন মেজর মঞ্জুর ও তাহেরসহ দলের অন্যান্য সবাই। হতাশায় ছেয়ে গেল আনোয়ারের মন। মেজর তাহের ও মেজর মঞ্জুর দুজনেই ছিলেন পাক সেনাবাহিনীর জন্য ভীতির কারণ। পশ্চিমা কর্তৃপক্ষের সতর্কতা বেড়ে গেল চতুগুণ। আনোয়ারের জন্য সশস্ত্র সেন্ট্রির সংখ্যা বাড়ানো হলো। কিছুদিন পর একটি চিঠি পেল আনোয়ার। ইনিশিয়াল দেখেই চিনতে পারল মেজর তাহেরের লেখা। পালানোর ইংগিত অত্যন্ত কৌশলে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও পালানোর সুযোগ মেলেনি আনোয়ারের। শেষ হলো নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। জন্ম নিল বাঙালীদের বহু আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ । অবসান ঘটল শতাব্দীর কান্না বিজড়িত ইতিহাসের।
১৯৭৪ সাল। করাচী পোর্ট। একটি রুশ জাহাজে বাঙালী বন্দীদের শেষ ব্যাচটি উঠল। আনোয়ারের মনে মিশ্র অনুভূতি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারায় নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা । আনোয়ার জাহাজের খোেলা ডেকে বসে রয়েছে। বিশাল বঙ্গোপসাগরের বুকে ছোট্ট খেলনার মত এগিয়ে চলেছে জাহাজখানা। মেঘমুক্ত নীলাকাশ। কূল নজরে পড়ে না। এলোমেলো বাতাস অতীতস্মৃতি রোমন্থন করতে মনকে নীরবে দোলা দিচ্ছে। মনে পড়ল লে. কর্নেল জাকির হোসেনের সেই উক্তি, আনোয়ার, তুমি জীবন নিয়ে এত রসিকতা করো কেন? জীবনটাই যদি শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে একটা বিরাট রসিকতা করে যায়? এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আনোয়ারের ঠোঁটে। এ হাসির যে কি অর্থ, তা মনে হয় একমাত্র ঈশ্বর-ই জানেন। পেন্সিল পিয়ে সাদা পৃষ্ঠায় কয়েকটা আঁচড় দিতেই হঠাৎ ওয়াহিদাকে মনে পড়ল। তারপর একটা চিঠি লেখা শুরু করল আনোয়ার।
ওয়াহিদা,
এটা আমারও শেষ পত্র। এই কথাগুলো তোমাকে বলা প্রয়োজন। আমাদের অতীত বিশ্লেষণে তুমি যদি কারও কাছে ঘৃণ্য হও, সেটা আমার জন্য দুঃখজনক। মিথ্যে বলে নিজের অহমিকা প্রকাশ করতে আমি চাইনে। আজ আমার অখণ্ড অবসর। আজ আমি সত্যিই লোন রেঞ্জার, নিঃসঙ্গ। আমি ভুলতে পারি না আমার অতীতকে। ওকে আমি ভীষণভাবে ভালবাসি। কখনও সুখে, কখনও দুঃখে। কারণ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন তার প্রথম প্রণয় ভুলতে পারেনি।
মানুষ জন্মগতসূত্রে শান্তিবাদী। কেউ শান্তি চায় রাইফেলের ব্যারেলের মাধ্যমে, কেউ চায় তার অঢেল সম্পদ রক্ষার্থে, কেউ শান্তির জন্য রাজনৈতিক কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে, কেউ শান্তি চায় অর্থের বিনিময়ে, আর কেউ কাউকে পরিত্যাগ করে। তুমি শান্তির অন্বেষায় চলেছ আমাকে পরিত্যাগ করে। আমার প্রার্থনা, তুমি সুখী হও।
জানো ওয়াহিদা, আমিও শান্তি চাই। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আত্মিক, নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নয়ন আমারও কাম্য। আমার এ চাওয়া ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের শৃংখলমুক্ত। এভাবে ভাবতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। কারণ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে আমরা সবাই সমান ।
ওয়াহিদা, তুমি আর আমি কখনও হেঁটে যাব না স্বপ্নের সেই নীল বালুচরে। আর বিদায় জানানো হবে না অস্তগামী সূর্যকে। আর দেখা হবে না সাগর সৈকতের নরম বালিতে ভেঙে পড়া কোমল ঢেউগুলো। তোমার আর আমার মাঝে আজ কি দুস্তর ব্যবধান! এমনতো কথা ছিল না।
তুমি নও; তোমার দেয়া টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো আমার অনুপ্রেরণার উৎস। ওগুলো আমাকে পরম আনন্দে উৎফুল্ল করে, আবার কখনও অতি দুঃখে অশ্রু ঝরায়। বিদায়।
ইতি–
আনোয়ার।
আনোয়ার জাহাজের খোলা ডেকে বসে লিখল পত্রটি। তারপর ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে, ভাসিয়ে দিল বঙ্গোপসাগরের জলে। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ছিন্নপত্র হারিয়ে গেল গভীর জলের অন্তরালে। ক্রমেই চিটাগাং পোর্টের আলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আনোয়ার তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশির দিকে। ওখানেই যেন লুকিয়ে আছে ওর সুদূর অতীতের একটুকরো, মাতাল স্মৃতি।
***
Leave a Reply