১০-১২. ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর

দুপুর বারোটা। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। দোকানিরা খাবার সাজাচ্ছে ক্যামাক স্ট্রিটের ফুটপাথে। বিরিয়ানি থেকে ঝালমুড়ি, কী আছে আর কী নেই! অফিসবাবুদের টিফিন। গাড়ি চালাতে চালাতে পার্থর সেদিকেই নজর। লোভী-লোভী গলায় বলল, এখন নিশ্চয়ই আমাদের লাঞ্চব্রেক?

হ্যাঁ স্যার। পেট পুরে খেয়ে নাও। তোমাদের এখন টানা পাঁচ ঘন্টা ছুটি।

কেন? কেন? কেন?

অবনীদা এস এম এস পাঠিয়েছেন। মিস্টার দস্তুরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে বিকেল ছটায়। ময়দানে, পারসি ক্লাবে। ততক্ষণ তোমরা খাও আর চরকি কাটো। আমি কয়েকটা কাজ সেরে আসি।

টুপুর, পার্থকে কোনও প্রশ্নের সুযোগই দিল না মিতিন। তাড়া লাগিয়ে নামিয়ে দিল কাছের শপিং মলটায়। নিজে ড্রাইভিং সিট দখল করে বলল, বাইই, ঠিক সময়ে তোমাদের ডেকে নেব।

নিমেষে লাল মারুতি হাওয়া। পার্থ হাত উলটে বলল, আর কী, চল আমরা আমাদের প্রোগ্রামটা ছকি। পাঁচ ঘণ্টা তো মেলা সময়, কী করে যে কাটবে!

আমরা আইনক্সে একটা পিকচার দেখতে পারি।

গ্র্যান্ড আইডিয়া। তার আগে কিছু সাঁটাই চল।

ফুডকোর্টটি বাজারের চার তলায়। চিনা, জাপানি, কন্টিনেন্টাল, মোগলাই, হরেক খানার ছড়াছড়ি। দুখানা পুরুষ্টু পিৎজা আর ব্রাউনি নিয়ে গুছিয়ে বসল পার্থ। পিৎজা থেকে খানিকটা চিজ চেঁচে নিয়ে মুখে পুরে বলল, তোর মাসিটা গেল কোথায় বল তো?

টুপুরও আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। উঁহু, মগজ খেলছে না। ঠোঁট উলটে বলল, কে জানে?

ফালতু ছুটে মরছে। ওই তারককে আর-একটু কড়কালেই সব হুড়হুড় বেরিয়ে পড়ত।

কাজটা তা হলে তারকেরই বলছ?

সন্দেহ আছে কোনও? চশমার দোকানটা তো ওর অ্যালিবাই। ব্যাটা জেনেশুনেই দেরিতে গিয়েছে। যাতে রনি নির্বিবাদে লোপাট না হয়।

অর্থাৎ তারকের একটা গ্যাং আছে।

অথবা তারক গ্যাং-এ আছে। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, রনির আইডি কার্ডটা তারকই সাপ্লাই দিয়েছে। কার্যসিদ্ধি হতেই কার্ডটা ফের ব্যাক টু তারক।

কীভাবে?

গোটা ঘটনাটা আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। রনিকে গাড়িতে তুলে ক্লোরোফর্ম শোঁকানো হল। ব্যস, রনি অজ্ঞান। তারপর নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি নিয়ে একটু অপেক্ষা। ওদিকে তারকও সময় মেপে বেরোল চশমার দোকান থেকে এবং পথে আই-ডি কার্ডটা কালেক্ট করে নিল। তারকের এগেনস্টে আর কোনও প্রমাণ রইল না।

কিন্তু চেনা লোকটি কে? যাকে দেখে রনি অবলীলায় উঠে পড়ল গাড়িতে?

পুলিশের রুলের গুঁতো খেলে ওটাও উগরে দেবে তারক। তোর মাসি কেন যে এক্ষুনি ব্যাটাকে গারদে ঢোকাল না!

আমারও খুব অবাক লাগল, জানো৷ তারককে কেমন হেলায় ছেড়ে দিল মিতিনমাসি।

কোনও একটা প্ল্যান নিশ্চয়ই ভাঁজছে।

গবেষণার মাঝেই উঠে গিয়ে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে এল পার্থ। আহারপর্ব সেরে দৌড়োল সিনেমা হলে। বেছেবুছে একটা ইংরেজি সিনেমায় ঢুকল। দারুণ মজার ছবি। একের পর এক উদ্ভট কাণ্ড ঘটছে, হো হো, হি হি হাসছে পার্থ-টুপুর। হাসির জোয়ারে অপহরণ কাণ্ডটি প্রায় মাথা থেকে উধাও।

শো ভাঙল সাড়ে তিনটেয়। এবার কী করে?ঘুরে-ঘুরে খানিকক্ষণ উইন্ডো শপিং করল দুজনে। তারপর ঢুকল বইয়ের দোকানে। পার্থ পছন্দ করল দাবা খেলার একটি বই, টুপুর নিল দুখানা আগাথা ক্রিস্টি। কাউন্টারে বিল মেটাচ্ছে পার্থ, তখনই মিতিনের মিসড কল।

দুদ্দাড়িয়ে শপিং মলের গেটে এসে টুপুর থ। গাড়িতে মিতিনমাসির পাশে বাবা!

মিতিন মুচকি হেসে বলল, অবনীদাকে তুলে আনলাম, বুঝলি। পারসি বন্ধু আছে অবনীদার, অথচ ময়দানে পারসি ক্লাবটা কখনও দেখেননি!

কোনও উপলক্ষ ঘটেনি যে। হাই মাইনাস পাওয়ার চশমার ওপারে অবনীর চোখ চকচক, আমি কিন্তু আজ দারুণ থ্রিলড। এই প্রথম কোনও কেসে তোমার কাজে লাগছি।

দয়া করে মিস্টার দস্তুরের সামনে উচ্ছ্বাসটা প্রকাশ করবেন না। আমার পরিচয় নিয়েও আড়ম্বরের কোনও প্রয়োজন নেই।

কিন্তু আমি যে বলে ফেলেছি তুমি গোয়েন্দা?

তাতে ক্ষতি নেই। শুধু কী কেস করছি না জানলেই ভাল।

কেসটা যে কী, আমাকেও তো খুলে বলোনি মিতিন।

আপাতত নয়, রহস্যজালেই মোড়া থাক।

যা তোমার অভিরুচি। তুমি তো বরাবরই রহস্যময়ী।

শ্যালিকা-জামাইবাবুর রঙ্গরসিকতার মাঝেই স্টার্ট দিল গাড়ি। মিতিনই স্টিয়ারিং-এ। জওহরলাল নেহরু রোড় বেয়ে পেরোল পার্ক স্ট্রিটের মোড়। বাঁয়ে মেয়ে রোড ধরল। খানিক এগিয়ে পাশাপাশি দুখানা ক্লাবের তাবু। মাঝখানটা চিরে সরু পথ, পারসি ক্লাবে পৌঁছোনোর রাস্তা।

টেন্টের গেটে থামল গাড়ি। নেমেই মনটা যেন ভরে গেল টুপুরের। চারপাশ কী সবুজ। কংক্রিটের এই শহরে ময়দানটা যেন সত্যিই মরূদ্যান। নাগরিক কোলাহল নেই, পাখির ডাক শোনা যায়, নরম হাওয়ায় জুড়িয়ে আসে শরীর। অদূরে রেড রোড ধরে হু হু গাড়ি ছুটছে, অথচ তাদের যান্ত্রিক শব্দ পৌঁছোচ্ছে না এখানে। প্রশস্ত রাজপথের দুধারে কৃষ্ণচুড়া-রাধাচুড়া-গুলমোহরের মিছিল। লাল হলুদ-বেগুনি ফুলে ছেয়ে আছে গাছগুলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় কী অপরূপ যে লাগছে।

ক্লাবের অন্দরেও প্রচুর গাছগাছালি। আম, জাম, পামট্রি। বেড়ার ধারে গন্ধরাজ গাছটা তো ফুলে-ফুলে সাদা হয়ে আছে। আঃ, কী মিষ্টি গন্ধ!

গাড়ির আওয়াজ পেয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন প্রোফেসর রতন দস্তুর। অবনীরই মতো মধ্যবয়সি। গায়ের রং টকটকে লাল, খাড়া নাক, ব্যাকব্রাশ চুল, লম্বা-চওড়া মানুষটার দেহে জিন্স-টি-শার্ট। ভারী আন্তরিক ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরলেন অবনীকে। ঝড়ের গতিতে সেরে ফেললেন আলাপ-পরিচয় পর্ব। লতানো গাছের তোরণ পেরিয়ে সবাইকে এনে বসালেন লনটায়।

জনাকয়েক পারসি মহিলা-পুরুষ রয়েছেন সবুজ লনে ইতিউতি ছড়ানো চেয়ার-টেবিলে। তাবুর পিছনে, ঘেরা মাঠে ফুটবল খেলছে কচিকাঁচারা। সম্ভবত বাবা-মার সঙ্গে এসেছে। তাদের সরু গলায় উল্লাস শুনতে বেশ লাগছে।

টুপুরের মতো মিতিন-পার্থও চারদিকটা দেখছিল। প্রশংসার সুরে পার্থ বলল, জায়গাটা ভারী সুন্দর তো! কতটা স্পেস! বাস্কেট বলের কোর্ট রয়েছে, ক্রিকেট পিচ।

শুধু খেলার লোকই যা কমে গিয়েছে। রতন দস্তুর আলতো হাসলেন, একসময় ক্লাবটা কী জমজমাট ছিল, ভাবতে পারবেন না। আমাদের ছেলেবেলায় তো বিকেলে লনটা গিজগিজ করত। এখন আর কজনই বা আসে।

পার্থ তাবুটার দিকে আঙুল দেখাল, আপনাদের টেন্টটাও কিন্তু বেশ পুরনো হয়ে গিয়েছে।

ওটাকে বলে অ্যান্টিক লুক। রতন চোখ টিপলেন, উনিশশো আটে তৈরি হয়েছিল ক্লাব। গোটা পূর্ব ভারতে এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে খানদানি আড্ডা। সেঞ্চুরি পেরিয়েছে তো, তাই এখন প্রাচীনত্বের গরিমা ঠিকরে বেরোচ্ছে।

সারালে কিন্তু বেশ ঝকঝকে লাগবে।

দরকার কী, দিব্যি তো চলছে, রতনের হাসি চওড়া হল, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? আমরা পারসিরা, একটু রক্ষণশীল। দুমদাম কিছু বদলে ফেলা আমাদের ধাতে নেই। এই তো দেখুন না, সেই কত বছর আগে পারস্যদেশ ছেড়েছি। অথচ সেখানকার অজস্র রীতিনীতি আজও আঁকড়ে ধরে বসে আছি। আমাদের অগ্নিমন্দিরে এখনও পারসি ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। পারসি সম্প্রদায়ের বাইরে আমাদের বিয়ে-থার চল নেই বিশেষ। যদি বা হয়, পারসি সমাজ মোটেই সেটাকে ভাল চোখে দেখে না।

আজকালকার দিনেও অত মানামানি চলে?

চলছে তো, চলে আসছে। এভাবেই তো আমরা বেশ টিকে আছি। বলেই হাতের ইশারায় ক্লাবের বেয়ারাটিকে ডাকলেন রতন। কফি আর চিকেন পকোড়ার অর্ডার দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। মিতিনকে বললেন, ইয়েস ম্যাডাম, আর আপনাকে বোর করব না। এবার কাজের কথাটা শুনি।

মিতিন হেসে বলল, অবনীদা বললেন, আপনি নাকি টানা আট বছর পারসি ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন? তা হলে তো নিশ্চয়ই অনেককেই চেনেন?

বলতে পারেন। ক্লাবের শতকরা পঁচানব্বই জনকে তো বটেই। তবে ক্লাবের সেক্রেটারি হওয়ার সূত্রে নয়। আমার একটা অন্য পরিচয়ও আছে।

কীরকম?

আমরা, দস্তুররা হলাম পুরোহিতের বংশ। পারসি সমাজে পুরোহিতের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। তবু নানান কাজেকর্মে আমাদের ডাক তো পড়েই। যেমন ধরুন, বিয়ে-শাদি দেওয়া…!

অবনী বলে উঠলেন, তুমি বিয়ে দাও নাকি?

না না, আমি ওসবে নেই। তবে আমার দাদা এখন কলকাতার একমাত্র মোবেদ। শুধু বিয়ে দিতে নয়, দাদাকে সব আচার-অনুষ্ঠানেই যেতে হয়। দাদার সুবাদে আমারও সবার সঙ্গে জানাশোনা।

ও? মিতিন একটু দম নিয়ে বলল, আমি কলকাতার একজন বিশিষ্ট পারসি ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

কে বলুন তো?

শেঠ রুস্তমজি জরিওয়ালা।

রাস্টি, রাস্টি? রতন দস্তুর বেজায় অবাক, তার আবার কী হল?

কিছু মনে করবেন না মিস্টার দস্তুর, আমার তদন্তের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়। শুধু এটুকু বলতে পারি, রুস্তমজির অসম্মান হতে পারে এমন কিছু আমি খুঁজছি না।

ও, তা কী জানতে চান?

রুস্তমজি মানুষটি কেমন?

এক কথায় বললে, এক্সেলেন্ট। আমাদের কলকাতার পারসি সমাজের গর্ব। প্রাণে দয়ামায়া আছে, প্রচুর দান-ধ্যান করে, অফিসেও মালিক হিসেবে খুব সুনাম। বাড়ির যে-কোনও অনুষ্ঠানে অফিসের বেয়ারাটিকে পর্যন্ত নেমন্তন্ন করে। তবে একটু মাথা গরম টাইপ। বিশেষত, কেউ বেইমানি করলে রাস্টি ছেড়ে কথা বলে না। শুধু এই কারণেই মুম্বইয়ের তিন-তিনটে রইস ডিলারকে ছাঁটাই করেছে। তারা নাকি লুকিয়ে অন্য কোম্পানির জিনিস বেচছিল। এই তো, মাস চারেক আগে অফিসেও একজনের চাকরি নট করল। লোকটা নাকি ভাউচার জাল করে টাকা তুলত। শুনেছি, লোকটা ওর খুব রিলায়েবল স্টাফের রিলেটিভ। সে নাকি রাস্টির হাতে পায়েও ধরেছিল, তবু তাকে ক্ষমা করেনি। শুধু তাই নয়, রাস্টি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর কোনও অফিস-স্টাফের আত্মীয়কে চাকরি দেবে না।

অবনী বললেন, ওরে বাবা, তুমি দেখছি ভদ্রলোকের নাড়িনক্ষত্র জানো!

আমি তো ওকে প্রায় জন্ম থেকেই চিনি। ওর বিয়েটাও তো দিয়েছে আমার দাদা। রাস্টির বউ লীলাও আমার খুব চেনা। আমার ছোট বোনের বান্ধবী।

মিতিন বলল, তা হলে তো আপনি মিস্টার জরিওয়ালার আত্মীয়স্বজনের গল্পও বলতে পারবেন!

আত্মীয় আর রাস্টির কে আছে তেমন! ছিলেন এক পিসি, তিনি তো বহু বছর যাবৎ অস্ট্রেলিয়ায় সেটেলড। তাঁর ছেলেমেয়েরা কস্মিনকালে কলকাতায় আসে না। রাস্টির আপন বলতে তো এখন বাবা, মা আর ভাই। ওই ভাইয়ের সঙ্গে অবশ্য রাস্টির একটু খিটিমিটি বেধেছে।

কী নিয়ে?

ব্যবসাপত্তর। জিমিই ঝঞ্ঝাট পাকাচ্ছে। তার জাহাজের ব্যবসায় নাকি মন্দা চলছে ইদানীং। তাই দাদার কার্পেটের বিজনেসে ঢুকতে চায়। রাস্টির বাবাও নাকি জিমির দলে। তাই নিয়ে খানিক মন কষাকষি চলছে শুনেছি।

তার মানে ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ? পার্থর কপালে ভাঁজ পড়ল, আচ্ছা মিস্টার দস্তুর, রুস্তমজির ভাই কি খুব হার্মফুল? আই মিন, প্রতিশোধপরায়ণ?

এটা তো বলতে পারব না। জিমি তো আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট, নেচারটা তাই খুব ভাল জানা নেই।

ও! তা মিস্টার জিমি কি কলকাতায় আসা-যাওয়া করেন?

আসে বোধহয়। কলকাতায় তো ওর একটা ফ্ল্যাটও আছে।

কোথায়?

এলিয়ট রোডে।

ওনারশিপ?

তাই তো শুনেছি। সম্ভবত সেকেন্ড হ্যান্ড। রতন দস্তুর এতক্ষণে যেন থমকালেন, এত সংবাদ জানতে চাইছেন কেন? জিমি কি কিছু ঘটিয়েছে?

না না। মিতিন জোরে-জোরে মাথা নাড়ল, রুস্তমজি একটা বাজে বিপদে পড়েছেন। আমি জাস্ট তার কারণটা বের করতে চাইছি। যাক গে, আবার একটু পারসি সমাজের গল্প বলুন। আপনাদের একটা নিউজ পেপার বেরোয় না কলকাতা থেকে?

উঁহু, হাউস জার্নাল। দুখানা। গাবাসনি, আর আওয়ার ভেঞ্চার। কলকাতার পারসিদেরই নানান সমাচার থাকে জার্নালে।

খাবার এসে গেল। চলছে হাত-মুখ, সঙ্গে কথাও। পারসিদের ধর্মগ্রন্থ আভেস্তা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিলেন রতন দস্তুর। শোনালেন জরথুস্ত্রের বাণী। একটি উপদেশ তো ভারী পছন্দ হল টুপুরের। দারিদ্র্য আর ভিক্ষে করাকে নাকি পারসিধর্মে খুব নিন্দনীয় বলে ধরা হয়।

গল্পগাছা সাঙ্গ হল প্রায় সন্ধে সাড়ে সাতটায়। অবনী উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করছিলেন, গাড়িতে উঠেই জিজ্ঞেস করলেন, কী মিতিন, কাজ কিছু হল?

মিতিন বলল, আমি তো কাজে যাইনি। কাটাকুটি খেলতে গিয়েছিলাম।

বুঝলাম না।

এক্ষুনি বোঝার দরকার কী অবনীদা? মেট্রো স্টেশনে নেমে সোজা বাড়ি চলে যান। শুধু দিদিকে গিয়ে বলবেন, আপনার দৌলতেই কেস সলভ হতে চলেছে।

অবনী ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন, এটাও বুঝলাম না।

 মিতিন আর কথায় গেল না, গাড়ি চালাচ্ছে চুপচাপ। বাড়ি ফিরে সোজা ঢুকে গেল নিজের স্টাডিতে। খাওয়ার আগে আর বেরোলই না। ডাইনিং টেবিলেও বড় অন্যমনস্ক। রুটি ছিঁড়ছে, মুখে পুরছে, চিবোচ্ছে, তবু কোনও ক্রিয়াতেই যেন মন নেই।

আহার সেরে মিতিন সবে আঁচাচ্ছিল, তখনই বেজে উঠল মোবাইল। যেন এই ফোনটারই প্রতীক্ষায় ছিল এভাবে দৌড়ে গিয়ে তুলল। কানে চেপে শুনল প্রথমটা, তারপর অস্ফুটে বলল কী যেন। তারপর ফোন অফ করে দাঁড়িয়ে রইল নিথর।

টুপুর ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কার ফোন ছিল গো, রুস্তমজির?

হুঁ! মিতিনের ঠোঁট নড়ল, ক্রিমিনালরা টাকা দেওয়ার সময়টা এগিয়ে এনেছে। কাল ভোর পাঁচটায় কিটসব্যাগে ভরে পৌঁছে দিতে হবে মুক্তিপণ এবং রুস্তমজিকে যেতে হবে একা। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে।

কোথায়?

বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। সঠিক লোকেশন কাল ভোরে বলবে।

ও। আমরা তা হলে এখন কী করব?

ওরা চলে ডালে-ডালে, মিতিন চলে পাতায়-পাতায়। যা, তোরা শুয়ে পড়। ঠিক রাত তিনটেয় ডাকব। বিদ্যুদবেগে মিতিন ফের স্টাডিতে, মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

.

১১.

ভোরের আলো ফুটছে সবে। পৃথিবীতে এখন এক তরল আবছায়া, পশ্চিম আকাশে ঝুলে আছে ফ্যাকাশে চাঁদ। পাখিরা আড়মোড়া ভাঙছে, এখনও তারা বাসা ছাড়েনি।

শুনশান ভি আই পি রোড ধরে ছুটছিল লাল মারুতি। কাঁটায় কাঁটায় সত্তর কিলোমিটার বেগে। গাড়ি চালাচ্ছে পার্থ, পিছনে মিতিন, টুপুর। একটু আগেও মিতিন সামনে ছিল, উলটোডাঙার মোড়ে জায়গা বদল করল। ফাঁকা রাস্তায় সামনের সিটের লোককে নাকি মানুষ আগে নজর করে।

রাত থাকতে উঠেছে টুপুর, কিন্তু চোখে তার ঘুমের লেশমাত্র নেই। কেসের অন্তিম মুহূর্ত প্রায় এসে গেল, উত্তেজনায় সে টানটান। তাকাচ্ছে ইতিউতি।

পার্থর দৃষ্টি ঘোরাফেরা করছিল রেয়ারভিউ মিররে। বেশ সংশয়ের সুরে বলল, ব্যাপারটা কী হল? পিছনে রুস্তমজির গাড়ি তো দেখা যাচ্ছে না?

উনি উলটোডাঙা থেকে পাঁচ মিনিট পরে রওনা দিয়েছেন। একই স্পিডে চালাচ্ছেন গাড়ি।

এমন নির্দেশ কেন?

বুদ্ধিটা সামান্য খাটাও, বুঝে যাবে।

দুটো গাড়ির মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রাখতে চাও, তাই তো?

প্লাস, গন্তব্যস্থলটি রুস্তমজির মিনিট পাঁচেক আগে আমাদের পেরোতে হবে। কারণ, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যত্রতত্র গাড়ি ঘোরানো যায় না। ডিভাইডারের নেক্সট কাটিং পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি টার্ন করাতে একটু সময় লাগে। ওই টাইমটুকু হাতে রাখা দরকার।

অ!

ভি আই পি ছেড়ে গাড়ি এবার যশোর রোডে। ডাইনে বিমানবন্দর। বিকট শব্দ তুলে একটা ভোরের প্লেন আকাশে উড়ল। ভেসে চলেছে পশ্চিম পানে। এরোপ্লেনটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই এসে পড়ল বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে।

পার্থ ফ্লাইওভারে উঠছিল। মিতিন বলল, লোকেশনটা খেয়াল আছে তো?

ইয়েস ম্যাম। বাঁয়ে লাল সাইনবোর্ড। টায়ারের বিজ্ঞাপন।

ঠিকঠাক চালিয়ো। ওখানে যেন স্পিড কমিয়ো না।

দাঁড়াও। আগে দ্যাখো, ওখানে আদৌ কেউ আছে কিনা। এখনই হয়তো রুস্তমজিকে ফোন করে বলবে, আমরা বালি ব্রিজে থাকব!

উঁহু। ওরা আর ঝুঁকি নেবে না। নার্ভাস হয়েছে, এখন কোনওমতে টাকাটা হাতাতে পারলে বাঁচে। নইলে সময়টা দুম করে এগিয়ে আনত না।

টুপুর ঘড়ি দেখল, পাঁচটা বাজতে সাত। আমরা আগে চলে এলাম না তো? বলতে গিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, না না, ওই তো… ওই তো কালো হন্ডা সিটি।

দেখেছি! মিতিন ঈষৎ উত্তেজিত স্বরে বলল, চটপট মাথাটা নামিয়ে নে।

তেমন মনঃপূত না হলেও বাধ্য সৈনিকের মতো আদেশ পালন করল টুপুর। মিনিটখানেক পর ঘাড় উঁচিয়ে বলল, ধুস, কোনও মানে হয়? গাড়িটায় কে আছে দেখাই তো হল না!

অধৈর্য হোস না টুপুর। কিচ্ছু পালাবে না। আমরা এক্ষুনি ওখানে ফিরছি।

কিন্তু পথবিভাজিকার পরবর্তী ছেদ এল প্রায় চার কিলোমিটার গিয়ে এবং এমনই কপাল, সেখানে গাড়ি ঘোরাতেই সামনে একটি ট্রাক। হর্ন দিলেও পথ ছাড়ছে না। চলেছে গজেন্দ্রগমনে। অসহায় ক্ষোভে মাথা ঝাঁকাল পার্থ। মিতিনের মুখ থমথমে। চোয়াল শক্ত হচ্ছে ক্রমশ।

বেশ খানিকটা দূর থেকে ফের নজরে পড়ল কালো হন্ডা সিটি। ঠিক তার পিছনেই রুস্তমজির গাড়ি। এবং রুস্তমজি কেমন উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে।

ঘ্যাচাং ব্রেক কষে মারুতি থামাল পার্থ। সঙ্গে-সঙ্গে নেমেও পড়ল সকলে। রাস্তা টপকে ছুটল ওপারে।

রুস্তমজির সামনে গিয়ে মিতিন বলল, কী হল কেসটা? গাড়ি রয়েছে, অথচ…!

বিহ্বল মুখে রুস্তমজি বললেন, গাড়িটা ফেলে রেখে গেল।

মানে?

পালিয়েছে।

কজন ছিল?

প্রথমে একজনই। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা। গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগ চাইল, দিয়ে দিলাম। অমনি পিছন থেকে একটা মোটরবাইক। ব্যাগ নিয়ে মোটরবাইকে ব্যাক করে গেল দুজনে।

টুপুর চেঁচিয়ে উঠল, আর রনি?

জানি না। রনিকে তো দিল না।

গাড়িটা দেখেছেন?

হ্যাঁ। রনি নেই। সামনের সিট, পিছনের সিট, দুটোই তো ফাঁকা।

পার্থ কালো গাড়ির জানলায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। নীলচে কাচের ওপারে কিছু ঠাহর করা কঠিন। কী ভেবে দরজার হ্যান্ডেলটা টানল। খুলে গেল দরজা।

এবং কী কাণ্ড! আছে, আছে, রনি আছে। পিছনের সিটের তলায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে রনি।

রুস্তমজি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তুললেন ছেলেকে। কোলে নিয়ে ডাকলেন, রনি, রনি, বেটা…!

মিতিন ঠান্ডা গলায় বলল, রনি এখন জাগবে না রুস্তমজি। ওকে হেভি ডোজে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। আপনি বরং ওকে নিয়ে গাড়িতে বসুন।

রুস্তমজি তবু দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে কোলে। রীতিমতো অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, কিন্তু শয়তানদের তো ধরা গেল না? আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন…!

তারা আমার হাতের মধ্যেই আছে, মিস্টার জরিওয়ালা। আপাতত গাড়িটাকে একবার সরেজমিন করছি। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, গাড়িতে আর-একজন আছে।

বলেই কালো গাড়ির ডিকি খুলল মিতিন। কীমাশ্চর্যম! সত্যিই সেখানে একটা লোক। দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা এবং রনির মতোই অচেতন।

রুস্তমজি হতবাক মুখে বললেন, এটি কে?

ওই হন্ডা সিটির ড্রাইভার। শয়তানরা একেও আটকে রেখেছিল। রনির সঙ্গে ড্রাইভার আর ভাড়া করা গাড়ি, দুইই খালাস করে দিয়েছে।

ভাড়ার গাড়ি? 

হ্যাঁ, অবিকল আপনার হন্ডা সিটির মতো দেখতে তো, তাই এই গাড়িটাই ওরা ইউজ করেছিল। ধোঁকা দিয়ে রনিকে কিডন্যাপ করার জন্য।

ও মাই গড!

মিতিন ঘুরে পার্থকে বলল, অ্যাই এসো, ধরাধরি করে লোকটাকে বের করি। দড়িদড়াগুলো খোলো! এখানে তো ফেলে রাখা যায় না, ও আমাদের সঙ্গেই চলুক। সজ্ঞানে এলে ওকে অনেক পুলিশি জেরা সামলাতে হবে।

আর গাড়িখানার কী গতি?

থাকুক পড়ে। লক করে অনিশ্চয়দাকে জানিয়ে দিচ্ছি, লোকাল থানা এসে নিয়ে যাবে। তারপর গাড়ি ছাড়ানো দ্বিজেন হালদারের দায়।

দ্বিজেন হালদার? রুস্তমজির চোখ বড় বড়। নামটা খুব চেনা-চেনা লাগছে!

ওয়েট করুন, এবার অনেক কিছুই চেনা লাগবে।

একটা অর্থপূর্ণ হাসি ছুড়ে দিয়ে মিতিন নেমে পড়ল কাজে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমন্ত ড্রাইভার চালান হল মারুতিতে। পার্থ তাকে নিয়ে পিছনে বসল। টুপুর আর মিতিন সামনে।

সিটবেল্ট বাঁধতে-বাঁধতে মিতিন রুস্তমজিকে বলল, এবার আপনি আমাদের ফলো করুন।

রনিকে গাড়ির সিটে শুইয়ে লীলাকে ফোন করছিলেন রুস্তমজি। মোবাইলটা মুখ থেকে সরিয়ে বললেন, কোথায় যাব? লীলা তো শুনেই ছটফট করছে! এক্ষুনি রনিকে দেখতে চায়।

আর-একটু অপেক্ষা করতে বলুন। জানিয়ে দিন, কালপ্রিটদের গারদে পাঠিয়ে আপনি বাড়ি ফিরছেন।

কালপ্রিটদের আর কোথায় পাবেন?

বললাম যে, এখনও মুঠোয় আছে। চলুন, এবার এগোই।

মিতিনের বলার ভঙ্গি এত দৃঢ় যে, রুস্তমজি আর কথা বাড়ালেন না। দ্রুত ফোনালাপ সেরে উঠলেন গাড়িতে। লাল মারুতিকে অনুসরণ করছে বি এম ডব্লিউ। ফের যশোর রোড। ফের ভি আই পি রোড। তারপর রাজারহাট নিউটাউনে ঢুকল গাড়ি। ক্রমশ সল্টলেকের দিকে এগোচ্ছে। অবশেষে এ-বি ব্লকের একটি পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকে নেমে রুস্তমজি হাঁ, এ কী! এ তো অশোকবাবুর বাড়ি!

হ্যাঁ। আপনার বিশ্বস্ত প্রাইভেট সেক্রেটারি! মিতিনের ঠোঁটে তির্যক হাসি। কেটে কেটে বলল, বিস্ময়টা ঝেড়ে ফেলুন মিস্টার জরিওয়ালা। এখন শুধু আপনার নীরবে দেখে যাওয়ার পালা। আসুন।

কিন্তু রনি একা গাড়িতে…।

ভয় নেই। প্রোটেকশনের ব্যবস্থা আছে।

বলেই মিতিন হনহনিয়ে অশোক মজুমদারের দরজায়। পাশেই বাড়ির গ্যারাজ, শাটার নামানো। সেদিকে দেখল তাকিয়ে-তাকিয়ে। আঙুল রাখল ডোরবেলে।

পাল্লা খুললেন অশোক মজুমদার স্বয়ং। আগন্তুকদের দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকালেন। তোতলানো স্বরে বললেন, আ…আ…আপনারা?

আপনার স্যারের সঙ্গে চলে এলাম। ভিতরে ঢুকতে বলবেন না?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। অশোক মজুমদার সন্ত্রস্ত চোখে একবার দেখলেন গাড়ি দুটোকে। ঢোক গিলে বললেন, প্লিজ কাম।

অন্দরে পা রেখে মিতিন সরাসরি বলল, আপনার ভাইটি কোথায়?

কোন ভাই?

সুজয়। সুজয় মজুমদার। যিনি মিস্টার জরিওয়ালার অফিস থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন টাকা চুরির অপরাধে?

সে আলাদা থাকে, দোতলায়। আমার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

তাই বুঝি? মিতিনের স্বরে ব্যঙ্গ, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ নাকি? ডাকতেও পারবেন না?

আমি ওর সঙ্গে কথা বলি না। ও একেবারেই উচ্ছন্নে গিয়েছে।

জানি। এখন সে বাচ্চা কিডন্যাপিং-এর ব্যবসায় নেমেছে। আপনার মালিকের একমাত্র পুত্রটিকে অপহরণের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি।

কী বলছেন ম্যাডাম? অশোক মজুমদার যেন আকাশ থেকে পড়লেন, রনি কিডন্যাপড হয়েছিল নাকি? সুজয় করেছিল?

বাচ্চাটা এই বাড়িতে আড়াই দিন আটক রইল, এখান থেকে ভোরে বের করা হল তাকে… অথচ আপনি কিছুই টের পাননি, তাই না?

বিশ্বাস করুন, আমি এই কুকাজের বিন্দুবিসর্গ…! ভাবতেই পারছি না, ভাবতেই পারছি না। রনি এখন কোথায়?

জবাব দিতে হল না মিতিনকে, তার আগেই বাইরে হালকা শোরগোল। প্রায় তৎক্ষণাৎ দুটো লোককে কলার ধরে টানতে টানতে ঘরে ঢোকালেন এক পুলিশ অফিসার। সঙ্গে তাঁর চার বন্দুকধারী।

অমনি প্রায় লাফিয়ে উঠলেন রুস্তমজি, এই তো, এই তো সুজয়।

খানিক আগে মুখে কালো কাপড় জড়িয়ে ইনি এক কোটি টাকা হাতিয়ে ছিলেন, মিস্টার জরিওয়ালা।

চোয়াড়ে চেহারার অন্য লোকটির দিকে আঙুল দেখাল মিতিন, এঁকে চিনতে পারছেন? ইনিই মোটরবাইকে সুজয়কে উঠিয়েছিলেন।

ঠিকই তো। এই হলুদ টি শার্ট, নীল জিন্স…!

দুজনেই পাঁচিল টপকে পালাচ্ছিল ম্যাডাম। ভুড়িওয়ালা পুলিশ অফিসারটির গলা গমগম করে উঠল। তৃপ্ত মুখে বললেন, নিয়ে গিয়ে ভ্যানে তুলি?

কোথায় রেখেছেন আপনাদের গাড়ি?

যেমনটি আই জি সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন। পরের রাস্তাটায়।

একটু দাঁড়ান। এই লোকটির কোমরেও দড়ি পরাতে হবে।

মিতিন অশোক মজুমদারের দিকে এগোল, ইনিই হলেন নাটের গুরু। অপহরণকাণ্ডের মূল মস্তিষ্ক। মিস্টার জরিওয়ালার টাকা এখন এঁরই জিম্মায়।

কাঁপা কাঁপা গলায় অশোক মজুমদার বললেন, আমায় টানছেন কেন? আমি কী জানি?

খুলে বলতে হবে? রনিকে অপহরণের দিন বেলা আড়াইটেয় তারককে পাঠালেন রনির স্কুলে। হাতে ধরিয়ে দিলেন চশমার বিলখানা। ভাল মতোই জানতেন, তিনটের আগে চশমা ডেলিভারি হবে না এবং সেটি নিয়ে তারকের পক্ষে সাড়ে তিনটের আগে সেন্ট পিটার্স স্কুলে পৌঁছোনো সম্ভব নয়। আগেই আপনার গুণধর ভাইকে দিয়ে ফোন করিয়েছিলেন দ্বিজেন হালদারকে, মিস্টার জরিওয়ালার কোম্পানির নাম করে। আপনাদের অর্ডারমাফিক কালো হন্ডা সিটি চলে গেল বেলেঘাটার টাওয়ার অফ সাইলেন্সে। তারপর সুজয় আর ওই বজ্জাতটি তিনটের আগে সেন্ট পিটার্সের গেটে হাজির। নকল আই-ডি কার্ড আগেই বানানো ছিল। মিস্টার জরিওয়ালার বাড়িতে যাওয়া-আসার সুবাদে সুজয়ও রনির পরিচিত, সুতরাং নির্বিবাদে বাচ্চাটিকে গাড়িতে তুলতে কোনও অসুবিধেই নেই। ছক কষে বউ ছেলেমেয়েকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন শিলিগুড়িতে। অতএব রনি এবং হন্ডা সিটির ড্রাইভারটিকে নির্বিঘ্নে বাড়িতে বন্দি রাখলেন। নিজস্ব সানত্রো গাড়িটিকে টুকিটাকি সারাইয়ের অজুহাতে চালান করলেন কারখানায়। তার জায়গায় আপনার গ্যারাজে লুকোনো রইল কালো হন্ডা সিটি। কী, ঠিক বলছি তো?

একেবারেই না। এসব আজেবাজে গল্প ফাঁদার কোনও মানেই হয় না। অশোক মজুমদার এবার রীতিমতো ক্ষিপ্ত, দেখুন না গ্যারাজ খুলে, হন্ডা সিটি আছে কি না!

থাকার তো কথা নয়। এখন তো ওখানে শোভা পাচ্ছে একটি মোটরবাইক আর সাইকেল।

মিতিন বাঁকা হাসল, সাইকেল চেপে টেলিফোন বুথে যাওয়ার বুদ্ধিটা কিন্তু অভিনব। মনে হবে, আরোহীরা আশপাশেরই বাসিন্দা। অথচ আদতে তারা আসছে সল্টলেক থেকে, ফুটব্রিজ ব্যবহার করে। তবে আপনার চালাকিটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল না, মিস্টার মজুমদার। প্রথমবার ফোনে রনির কান্নার টেপ শোনানোর আইডিয়াটাও বেশ কাঁচা। আপনার মতো ধুরন্ধর মানুষের কাছে এটা আশা করা যায় না।

আপনি কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ম্যাডাম। একজন ভদ্রলোককে আপনি অপমান করছেন।

ভদ্রলোকের মুখোশ পরে থাকলেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না, মিস্টার মজুমদার।

খুবই আপত্তিকর কমেন্ট, অশোক মজুমদারের নাকের পাটা ফুলল। দাঁতে দাঁত ঘষে রুস্তমজিকে বললেন, এই মহিলাকে সংযত হতে বলুন স্যার। ভাই অপরাধ করলে দাদাকেও দোষী ধরা হবে, এ কেমন কথা? উনি যে অভিযোগ আনছেন, প্রমাণ করতে পারবেন?

প্রমাণ না রাখার চেষ্টা অবশ্য আপনি চালিয়েছেন আগাগোড়া। সম্ভবত রনি কিংবা ড্রাইভারটিকেও আপনি দর্শন দেননি। বেমালুম ঠান্ডা মাথায় অফিস যাচ্ছেন, কাজকর্ম করছেন। আপনাকে সন্দেহের অবকাশই বা কোথায়? মিতিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কিন্তু অপরাধীরা যে একটা মোক্ষম ভুল করেছে মিস্টার মজুমদার!

কী? কী করেছি?

আপনি নয়, ভুলটা আপনার ভাইয়ের। শাগরেদকে দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করানোর পর-পরই উৎসাহের আতিশয্যে সে একটি কল করেছিল আপনার মোবাইলে। বাঙ্গুর অ্যাভেনিউয়ের বুথ থেকে। সেটি কিন্তু আমার রেকর্ডে আছে। পুলিশেরও। ওই বুথ থেকে ছটা পঁয়ত্রিশে কেন আপনাকে ফোন করা হয়েছিল, তার কারণ দর্শাতে পারবেন তো?

জোঁকের মুখে বুঝি নুন পড়ল। অশোক মজুমদারের সমস্ত জারিজুরি খতম। কাটা কলাগাছের মতো আছড়ে পড়লেন সহসা। জড়িয়ে ধরলেন রুস্তমজির পা। কপাল ঠুকছেন আর বলছেন, অন্যায় করেছি স্যার। পাপ করেছি স্যার। ক্ষমা করে দিন স্যার। মাথার ঠিক রাখতে পারিনি স্যার।

একটি শব্দও ফুটল না রুস্তমজির গলায়। না ক্ষোভ, না রাগ, না বিরক্তি। এক পা, এক পা করে সরে এলেন। বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। ধীর পায়ে।

.

১২.

নৈশাহারটি মন্দ হল না আজ। বিপুল আয়োজন করেছিলেন রুস্তমজি। কাবাব, ফ্রাই, রোস্ট, তন্দুর, সঙ্গে অঢেল পরোটা, নান। স্বহস্তে সিমুইয়ের মিষ্টি বানিয়েছিলেন লীলা। খাব না, খাব না করেও অনেকটা খেয়ে ফেলল টুপুর। আর পার্থর তো আজ পোয়াবারো। মুখ তার চলছে তো চলছেই। মিতিন না থামালে তাকে বোধহয় ক্রেন দিয়ে চেয়ার থেকে তুলতে হত।

রনি এখনও স্বাভাবিক হয়নি পুরোপুরি। কথাবার্তা বলছে বটে, তবে মাঝে-মাঝেই চমকে-চমকে উঠছে। টুপুর আর বুমবুম অবশ্য তার সঙ্গে কম্পিউটার গেমস খেলল কিছুক্ষণ। বুমবুমের হইহল্লাতেই যা রনির সাড় ফিরছিল খানিকটা। বাচ্চারাই তো বাচ্চাদের মন ভাল করার সবচেয়ে বড় ওষুধ।

 বিদায় নেওয়ার সময় রুস্তমজি টুপুরদের সঙ্গে এলেন নীচে। মিতিনকে একটা রঙিন খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখুন। আমার আর লীলার তরফ থেকে একটা সামান্য উপহার।

মিতিন খামটা দেখল। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কভারে এটা কী লেখা আছে, মিস্টার জরিওয়ালা? আফজুড… আফজুন… আফজায়াদ…!

ওটা পারসি ভাষায় কুশল প্রার্থনা। উপহার দেওয়ার সময় আমরা প্রাপকের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করি।

থ্যাঙ্ক ইউ। অনেক-অনেক ধন্যবাদ।

গাড়িতে উঠে টুপুরের আর তর সইছিল না। হ্যানোভার কোর্টের গেট পেরিয়েই খুলল খামটা। উল্লসিত স্বরে বলল, ওয়াও! এ যে পাঁচ-পাঁচ লাখ টাকার চেক গো!

মিতিন খুশি-খুশি মুখে বলল, এত দিয়েছেন?

পার্থ গিয়ার বদলাতে-বদলাতে টুকুস মন্তব্য ছুড়ল, বেশি কোথায়? ভদ্রলোক তো নিট পঁচানব্বই লাখ মুনাফা করলেন।

মানে?

এক কোটি তে গিয়েইছিল, তার থেকে ফাইভ পারসেন্ট ছাড়লেন। এনিওয়ে, টাকাটার উপযুক্ত ব্যবহার তো হতেই পারে।

কীভাবে?

চলো, পুজোয় এবার কন্টিনেন্ট টুর মেরে আসি। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইতালি। চাইলে লন্ডনটাও ছুঁয়ে আসতে পারি।

সে দেখা যাবেখন। বুমবুম ঢুলছে, তার মাথা কোলে টেনে মিতিন বলল, আগে একটা সলিড ঘুম দেব। পরপর দুটো রাত যা টেনশনে কেটেছে।

টেনশনের ছিলটা কী? কেস তো প্রায় জোড়াতালি দিয়ে সলভ করলে। পার্থ টিপ্পনী ভাসাল, যে ব্রহ্মাস্ত্রে অশোক মজুমদারকে শেষমেশ বধ করলে, সেটা তো স্রেফ আন্দাজ।

আজ্ঞে না স্যার। প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি প্রমাণ ছাড়া কাজ করে না। কাল দুপুরে আমি বেড়াতে যাইনি। অশোক মজুমদারের মোবাইলের কললিস্ট জোগাড় করছিলাম। ওটা ঘাঁটতেই তো ফোন বুথের নাম্বারটা বেরিয়ে এল।

টুপুরের ভুরু জড়ো হল, তুমি অশোক মজুমদারের মোবাইল নাম্বার পেলে কোত্থেকে?

গেস কর।

রুস্তমজি?

উঁহু।

তা হলে তারক…?

হল না।

আর কে হতে পারে? টুপুর মাথা চুলকোচ্ছে।

পারলি না তো? মিতিন ঝটাকসে ব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করল, দিস ইজ দ্য সোর্স মাই ডিয়ার। কাল অশোক মজুমদার যখন আমার স্লিপ দিতে রুস্তমজির ঘরে ঢুকেছিলেন, তখন তাঁর এই কার্ডটি আমি গায়েব করেছিলাম।

তুমি কি তখনই অশোক মজুমদারকে সন্দেহ করেছিলে?

অনেকটাই। কারণ, স্কুলে গাড়ি পাঠানোটা ওঁর দায়িত্ব। অতএব দেরিতে যদি গাড়ি পৌঁছোয়, দুজন প্রধান সাসপেক্ট থাকে। একজন তারক, অন্যজন অশোক। ঠিক কি না?

তা তারককে বাদ দিলে কী হিসেবে?

স্টেটমেন্টে ফাঁক খুঁজে পাইনি, তাই। যদি তারক দলে থাকতেন, তা হলে চশমার দোকানের গল্পটা বলতেন কি? ট্রাফিক জ্যামের অজুহাত দেওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। এবং মোবাইলে অশোক মজুমদার যে তাঁকে কল করেছিলেন, সেটাও চেপে যেতেন। অশোক মজুমদারকে তোর-আমার গল্পটাও তারক শুনিয়েছেন বটে, তবে তা হয়তো নিজের অজান্তেই। অশোক মজুমদারই কৌশলে কথাটা বের করে নিয়েছিলেন।

একটা কথা বলব মিতিনমাসি? কললিস্ট চেক করে অশোক মজুমদারকে যখন ধরেই ফেললে, ফালতু-ফালতু বিকেলে আর পারসি ক্লাবে গেলে কেন?

প্রয়োজন ছিল রে। একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে চাইছিলাম। অশোকবাবুই কুকীর্তির নায়ক, নাকি পিছনে কোনও মেঘনাদ আছে?

জিমির খবর নিতে চাইছিলে?

যে-কোনও জ্ঞাতিশত্রুর কথাই ভাবনায় ছিল। হয়তো বা জিমিও। তবে জিমি মুম্বই থেকে এসে ভাইপোকে ইলোপ করবে, তাও মাত্র এক কোটি টাকার জন্য, এটা একেবারেই অবাস্তব চিন্তা।

দুনিয়ায় সবই ঘটে, বুঝলে! পার্থ মাথা দোলাল, এই অশোক মজুমদারকেই ধরো না। কতদিনের বিশ্বাসী কর্মচারী। চাকরিটা যথেষ্ট ভাল। নিজস্ব বাড়ি-গাড়ি আছে, মাস গেলে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা মাইনে। লোভে পড়ে তাঁরও মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল তো! সোনার ডিমের জন্য আস্ত হাঁসটাকেই জবাই করতে যাচ্ছিলেন।

শুধু লোভ নয় মেসো, এখানে প্রতিশোধস্পৃহাও একটা ফ্যাক্টর। টুপুর ফুট কাটল, ভাই যে দোষই করুক, তার বরখাস্ত হওয়াটা নিশ্চয়ই অশোকবাবু মানতে পারেননি। অপমানে ধিকিধিকি জ্বলছিলেন। সুজয় হয়তো সেই আগুনে ঘি ঢেলেছিল।

না রে টুপুর, রক্তে অপরাধ প্রবণতা থাকলে তবেই এ ধরনের কুকাজ করা সম্ভব। চেহারায়, আচার-আচরণে, যতই সভ্যভব্য হোক, সময়-সুযোগ পেলে এদের আসল রূপটা ফুটে বেরোবেই। না হলে ভাব তুই, এত সুন্দর প্ল্যান করে, হিসেব কষে, ওইটুকু একটা বাচ্চাকে কেউ গুম করতে পারে?

মিতিনমাসি ঠিকই বলছে। টুপুরের একটা শ্বাস পড়ল। সত্যি, মানুষকে চেনা বড় কঠিন!