১-২. ভারী ফুরফুরে একটা মেজাজ

গুপ্তধনের গুজব – মিতিনমাসি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

ভারী ফুরফুরে একটা মেজাজ নিয়ে ঘুম ভাঙল টুপুরের। কাল সন্ধেবেলা সে এসেছে মিতিনমাসির বাড়ি। আজ রবিবার, আগামীকাল জন্মাষ্টমী, পরশু পনেরোই অগস্ট, বুধবার স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবস, এখন কদিন ছুটিই ছুটি। আর এইরকম মিনি ভেকেশানে মাসির বাড়ি ঘাঁটি গাড়ার মজাই আলাদা। অবিরাম আড্ডা, হইহই, এদিক-সেদিক বেড়ানো, বুমবুমের সঙ্গে খুনসুটি…! কী আনন্দে যে কাটে দিনগুলো। এর সঙ্গে মাসির কোনও কেস চললে তো কথাই নেই। বিপুল উৎসাহে টুপুর ছুটতে পারে তার পিছন-পিছন। উত্তেজনার আগুন পোহানের সঙ্গে-সঙ্গে মস্তিষ্কে খানিক শান দিয়ে নেওয়া যায়।

বিছানা ছাড়ার আগে টুপুর ছোট্ট একটা আড়মোড়া ভাঙল। সাড়ে সাতটা বাজে, বুমবুম এখনও অকাতরে ঘুমাচ্ছে। ভাইয়ের গালে আলতো টোকা দিয়ে পায়ে-পায়ে ঘরের বাইরে এল টুপুর।

লিভিংরুমে উঁকি মারতেই পার্থমেসোর প্রশ্নবাণ উড়ে এল, অ্যাই মেয়ে, বৃত্ৰাসুরের আগের জন্মের নাম কী ছিল? … চার অক্ষর।

টুপুর থতমত মুখে বলল, কে বৃত্ৰাসুর?

এক অসুর। যাকে মারার জন্য দধীচিমুনির পাঁজরার হাড় দিয়ে ইন্দ্রের বজ্র তৈরি হয়েছিল।

ও হ্যাঁ, জানি তো। কী যেন? কী যেন? চিত্রসেন?

নো। চিত্রকেতু। এবার চশমার একটা প্রতিশব্দ বল দেখি? তিন অক্ষরের?

টুপুর প্রমাদ গুনল। পার্থমেসো এখন শব্দজব্দের নেশায় রয়েছে, প্রশ্নে-প্ৰশ্নে টুপুরকে পাগল করে দেবে। একটা হাই তুলে টুপুর বলল, জানি না।

জেনে রাখ। উপাক্ষ।

ও।

কতবার বলেছি, ভোরবেলা উঠে শব্দছক কবি, স্মৃতিশক্তি প্রখর হবে। এবার বল তো, জটাসুরের ছেলে…চার অক্ষর…!

ঘ্যাঁঘাসুর?

তোমার মাথা। অলম্বুষ। ঠিক আছে, এবার একটা সোজা জিজ্ঞেস করছি। আলতার প্রতিশব্দ কী? তিন অক্ষরের?

অলক্ত?

উঁহু। য দিয়ে।

টুপুর মাথা চুলকোল, পারব না।

যাবক। পাৰ্থ দু দিকে মাথা নাড়ল, নাঃ, মাসির পোঁ ধরেধরে তোর ব্ৰেনে পলি জমে যাচ্ছে। দাঁড়া, তোকে আরও সোজা একটা…।

পরবর্তী আক্রমণের অবশ্য সুযোগ পেল না পার্থ। টুপুরকে রক্ষা করতেই বুঝি বেজে উঠল ডোরবেল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল টুপুর।

অমনি চমক। অনিশ্চয় মজুমদার। পরনে ট্র্যাকসুট, পায়ে স্নিকার, হাতে কায়দার ছড়ি।

পার্থ প্রায় লাফিয়ে উঠল, স্বয়ং আই জি সাহেব যে! সক্কালসক্কাল হঠাৎ গরিবের ডেরায়?

ছুটির দিনের ব্রেকফার্স্টটা এখানেই সারতে এলাম। আজ আপনাদের মেনু কী?

ফুলকো লুচি আর সাদা আলুচচ্চড়ি। উইথ কাঁচালঙ্কা।

গ্র্যান্ড! সিকার খুলে অনিশ্চয় সোফায় বসলেন। এদিকওদিক তাকিয়ে বললেন, তা গৃহকর্ত্রী

কে দেখছি না কেন? তিনি কোথায়?

শরীরচর্চা চলছে। ডাকব?

ডাকাডাকির প্রয়োজন হল না। অনিশ্চয় মজুমদারের বজ্ৰকণ্ঠ শুনে মিতিন নিজেই বেরিয়ে এল। আই জি সাহেবকে দেখল ঝলক। দোপাট্টায় ঘাম মুছতে-মুছতে বলল, আপনি কি আজকাল মর্নিংওয়াকেও রিভলবার নিয়ে বেরোচ্ছেন?

অনিশ্চয় তাড়াতাড়ি কোমরে হাত রাখলেন, কী কাণ্ড, বোঝা যাচ্ছে নাকি?

মিতিন মুচকি হাসল, এটুকুও না নজরে পড়লে গোয়েন্দাগিরি তো ছেড়ে দিতে হয় দাদা। তা এত সতর্কতা কীসের জন্যে? কোনও গুন্ডা বদমাশ প্রাণহানির হুমকি দিয়েছে নাকি?

ওদের আমি থোড়াই পরোয়া করি। তবে আজকাল উগ্ৰপন্থীদের যা উৎপাত বেড়েছে…! কাকে কখন টার্গেট করে তার ঠিকঠিকানা কী?

একদম খাঁটি কথা। সাবধানে থাকাই তো ভাল। পার্থ সায় দিল, এত রকম অস্ত্র ওদের হাতে। বোমা, রিভলবার, অটোমেটিক রাইফেল, হাজারও ধরনের বিস্ফোরক, এমনকী, রকেট লঞ্চারও…

টুপুর ফস করে বলে উঠল, কিন্তু ওরা এসব পাচ্ছে কোত্থেকে?

দেশের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে চোরাগোপ্তা। আর বাইরে থেকে তো আসছেই।

যারা পাঠাচ্ছে তাদের ধরা যাচ্ছে না?

 চেষ্টার কি কসুর রাখছি রে ভাই। তবে বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি ঠেকানো বড় মুশকিল। অন্তত আমাদের এই রাজ্যে। এত লম্বা বর্ডার, স্থলপথ, জলপথ জঙ্গল, পাহাড়… কোন দিক দিয়ে যে কীভাবে এন্ট্রি নেয়! এই তো, মাসখানেক আগে আমাদের গোয়েন্দা দপ্তরে খবর ছিল, সুন্দরবন দিয়ে নাকি বেশ কিছু জিনিস ঢুকছে। তা সে এমন নদীনালার জায়গা, কিছু ট্ৰেসই করা গেল না। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন অনিশ্চয়, একটাই সান্ত্বনা, শুধু আমরাই যে এঁটে উঠতে পারছি না, তা নয়, আমরা নই, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ সর্বত্রই এক হাল।

হু, গভীর সমস্যা। পাৰ্থর বিজ্ঞ রায়, আর্মস আসা রুখতে না পারলে উগ্ৰপন্থী-দমন খুব কঠিন কাজ।

কথার মাঝে রান্নাঘরে গিয়েছিল মিতিন। আরতিকে জলখাবারের নির্দেশ দিয়ে সোফায় এসে গুছিয়ে বসল, হাসি-হাসি মুখে অনিশ্চয় মজুমদারকে বলল, আপনার আগমনের হেতুটা কিন্তু এখনও ভাঙেননি দাদা।

বা রে, বললাম যে লুচি খেতে এসেছি।

ওটা তো একটা মামুলি উপলক্ষ। আই ওয়াশ। আসল উদ্দেশ্যটা এবার শুনি?

ওঃ, আপনাকে নিয়ে পারা যাবে না। অনিশ্চয় হো হো হাসলেন। ক্ষণেই সামান্য গম্ভীর, হ্যাঁ, কারণ একটা আছে বটে। তবে সাংঘাতিক সিরিয়াস কিছু নয়।

কীরকম?

আপনার কি মনে আছে, হপ্তাতিনেক আগে ডায়মন্ডহারবারের কাছে নুরপুরে একটা ইন্সিডেন্ট ঘটেছিল? মিডিয়ায় বেশ শোরগোলও পড়েছিল ঘটনাটা নিয়ে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কী এক গুপ্তধন-টুপ্তধন সংক্রান্ত ব্যাপার ছিল। একটা পুরনো বাড়িতে মাটিটাটি খুঁড়তে গিয়ে দুটো ছেলে ধরা পড়ে। তারপর থেকে বাড়িটায় রাশি-রাশি লোক গিয়ে ভিড় করছিল…। এখন বোধ হয় কানাডা ফেরত এক ভদ্রলোক থাকেন বাড়িটায়। ভদ্রলোক তো টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউও দিয়েছিলেন। তার মতে গুপ্তধনের অস্তিত্ব নাকি নেহাতই রটনা। লোকজনের ভিড়ে তিনি উদ্বিগ্ন, বিরক্ত। তিনি চাইছিলেন ওইসব হল্লাগুল্লা বন্ধ হোক।

আপনার স্মরণশক্তি তো দারুণ! অনিশ্চয়ের চোখে-মুখে তারিফ। স্মিত মুখে বললেন, ঘটনাটা তা হলে আর-একটু ডিটেলে আপনাকে জানিয়ে দিই। ওই ছেলে দুটোকে পুলিশ যথেষ্ট জেরা করেছিল, কিন্তু কিছুই তেমন পাওয়া যায়নি। ওদের বক্তব্য, ওই বাড়ির কুলপুরোহিতের মুখে তারা গুপ্তধনের গল্পটা শুনেছে। আর তাই লোভে পড়ে…!

তা কুলপুরোহিতকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি?

হুঁ, তাও করেছিল। তবে বুড়োটা একেবারেই ফালতু, বড্ড টল টক করে। ও নাকি ওর বাপ-ঠাকুরদার মুখে শুনেছে…। লোকাল পুলিশের মতে সবটাই বুড়োর বানানো গল্প।

ছেলে দুটো এখন কোথায়? নিশ্চয়ই এখনও পুলিশ কাস্টডিতে নেই?

ওদের তো পরদিনই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তেমন ক্রাইম তো কিছু করেনি, স্রেফ অন্যের বাড়িতে অনুপ্রবেশ…। তা ছাড়া ভদ্রলোকও কোনও কেসটেস করতে চাননি।

আরতি চা রেখে গেল। সঙ্গে বিস্কুট। পেয়ালাটা অনিশ্চয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে মিতিন বলল, তা আমাকে এখন কী করতে হবে? গুপ্তধনের অনুসন্ধান?

ঠিক তা নয়। আবার অনেকটা সেরকমও বটে।

মানে?

ব্যাপারটা তা হলে আপনাকে আর-একটু বিশদে বলি। কানাডা ফেরত ওই ভদ্রলোক, অর্থাৎ বাড়িটির মালিক, আমার খানিকটা পরিচিত। আমার দাদার সহপাঠী ছিলেন। অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ। বিদেশে অধ্যাপনা করতেন, এখানে এসেও লেখাপড়া নিয়েই থাকেন। গত পরশু উনি হঠাৎ আমার কাছে হাজির। একান্তই ব্যক্তিগত কারণে। ওঁর বক্তব্য, গুপ্তধন নিয়ে লোকজনের কৌতূহল কমে গিয়েছে বটে, তবে অন্য এক অশান্তি আরম্ভ হয়েছে। প্রায় রাত্তিরেই নানারকম ভৌতিক কাণ্ডকারখানা নাকি চলছে বাড়িতে। হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যেমন একজোড়া সাহেব মেমের ঝগড়া, মেয়েলি গলার কান্না, কুকুরের ডাক…।

তার মানে বাড়িটায় ভূত আছে? পাৰ্থর চোখ গোল-গোল, ভদ্রলোক সেখানে একা-একা বাস করছেন?

ভূত নিয়ে ভদ্রলোককে খুব একটা ভাবিত তো দেখাল না। ওঁর ধারণা, ওসব মনের ভুলও হতে পারে। উনি চিন্তিত অন্য একটা কারণে। কদিন আগে আবার উনি দুটো লোককে মাটি খুঁড়তে দেখেছেন। মাঝরাত্তিরে। পাকড়াও করার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তারা পালিয়ে যায়। এখন ভদ্রলোক ভাবতে শুরু করেছেন, হয়তো কোনও গুপ্তধন থাকলেও থাকতে পারে। উনি তাই ব্যাপারটা প্রাইভেটলি ইনভেস্টিগেট করিয়ে দেখতে চান।

বুঝলাম। মিতিন মাথা দোলাল, কেসটা তাই আপনি আমায় দিতে চাইছেন?

কাজের চাপ বেশি না থাকলে যান না। গুপ্তধন উদ্ধার করাটা তো আপনার ভালই আসে। হয়তো কোনও চিরকুট-ফিরকুট পেয়ে গেলেন। কিংবা জটিল ধাঁধা। সেটাকে সমাধান করে…। অনিশ্চয়ের মোটা গোঁফের ফাঁকে একফালি হাসি, ভদ্রলোকের ভালই টাকাকড়ি আছে, আপনার প্রাপ্তিযোগ মন্দ হবে না। তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোক বিষয়টা নিয়ে পাবলিসিটি চাইছেন না একদম। পুলিশ কিংবা মিডিয়ার হাঙ্গামাও তাঁর ঘোরতর অপছন্দ।

অর্থাৎ যা করব একেবারে নিঃসাড়ে। তাই তো?

কারেক্ট। প্রয়োজনে আমি তো আছিই।

লুচি-তরকারি এসে গেল। আহারে ভারী মনোযোগী হয়ে পড়লেন অনিশ্চয়। টোকা দিয়ে দিয়ে ফুটো করছেন ফুলকো লুচি, আলু পুরে সাপটে নিয়ে আস্ত লুচি সোজা চালান করে দিচ্ছেন মুখগহ্বরে। খানপনেরো লুচি উদস্থ করে মহাতৃপ্তির একটি ঢেকুর তুললেন। থালা শেষ হতে না-হতেই গরমাগরম কফি পৌঁছে গেল হাতে।

বড়সড় কফিমগটায় চুমুক দিয়ে অনিশ্চয় ফের কথায় ফিরলেন, আপনি তা হলে ভদ্রলোককে কবে মিট করছেন ম্যাডাম?

আজই যেতে পারি। দুপুর বিকেলে।

গুড। আমি তা হলে ভদ্রলোককে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনিও ওঁর নাম আর মোবাইল নাম্বার নোট করে নিন।

টুপুর অমনি ছুট্টে মিতিনমাসির মোবাইল ফোনটা নিয়ে এল। ভদ্রলোকের পুরো নামটা শুনে তার চক্ষু চড়কগাছ। মীনধ্বজ মৰ্মরবক্ষ বাগচী! অস্ফুটে বলেই ফেলল, এরকম নাম আবার হয় নাকি?

ওঁদের পরিবারের সকলের নামই একটু অভিনব। মীনধ্বজ মৰ্মরবক্ষর বাবার নাম ছিল কপিধ্বজ কপাটবক্ষ বাগচী। তার বাবা, বজ্ৰধ্বজ বিরাটবক্ষ বাগচী। তার বাবা ছিলেন সিংহধ্বজ সমুদ্রবক্ষ বাগচী।

ব্যস, ব্যস, আর এগোবেন না। পার্থ দুহাত তুলে থামাল, রোববারের সকালের পক্ষে ওই সিংহধ্বজ পর্যন্তই যথেষ্ট।

.

০২.

খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরোতে-বেরোতে দুপুর দুটো। কাজেকর্মে ঘোরাঘুরির জন্য সম্প্রতি একটা গাড়ি কিনে ফেলেছে মিতিন। লাল টুকটুকে চার-চাকাখানা সাধারণত নিজেই চালায়। আজ সারথির আসনে পার্থ। সবে মাসদেড়েক হল পার্থ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে, এখনও তার হাত তেমন সড়গড় নয়। আস্তে-আস্তে চালাচ্ছে গাড়ি, অতি সাবধানে। ঠাকুরপুকুরের পর ডায়মন্ডহারবার রোড বেশ সরু, উলটো দিক থেকে বাস-লরি ধেয়ে আসে ক্ৰমাগত। সাইকেল, অটো, ভ্যানরিকশারও কমতি নেই। সবদিক সামলেসুমলে রীতিমতো কসরত করে এগোতে হচ্ছে পার্থকে। সরিষা-আমতলার মতো ঘিঞ্জি এলাকায় গাড়ির গতি তো প্ৰায় রুদ্ধ হওয়ার জোগাড়। ডায়মন্ডহারবারের খানিক আগে, ডাইনে বাঁক নিয়ে, টুপুররা যখন নুরপুর পৌঁছল, শেষ শ্রাবণের সূর্য অনেকটাই পশ্চিমে হেলে পড়েছে।

জনপদটি নেহাতই ছোট। একেবারেই গঙ্গার ধারে। সবুজ গাছগাছালিতে ছাওয়া। নদীর পাশ বরাবর উঁচু বাঁধের রাস্তা। একদিকটা চলে গিয়েছে লঞ্চঘাটায়, অন্যদিকে নদী আর বাঁধের মাঝখানে একের পর এক ইটভাঁটা। গোটাতিনেক ইটভাঁটা পেরোতেই চোখে পড়ল লোহার ফটক। থামের ফলকে এখনও অস্পষ্টভাবে টিকে আছে বাড়ির নাম নিনহো।

টুপুর ভুরু কুঁচকে বলল, ভারী অদ্ভুত নাম তো! নিনহো মানে কী?

পার্থ পথশ্রমে বেজায় ক্লান্ত। তার সংক্ষিপ্ত চালকজীবনে এতখানি লম্বা পাড়ি এই প্রথম। নয়-নয় করেও টানা পঞ্চাশ কিলোমিটার স্টিয়ারিংয়ে বসে প্রায় ধুঁকছে এখন। তার মধ্যেও ফুট কাটল, নিনহো মনে হয় ধ্বজাধারীদের কারও ডাকনাম।

আজ্ঞে, না স্যার। ওটা একটা পর্তুগিজ শব্দ। মানে পাখির বাসা। মিতিন গাড়ি থেকে নামল। গেটের উপর চোখ চালিয়ে বলল, হর্নটা একটু বাজাও তো।

আওয়াজ দিতেই কাজ হল। প্রাচীন বাড়িখানা থেকে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে এলেন বিশালকায় এক ভদ্রলোক। ছ ফুটের উপর লম্বা, চওড়া কাঁধ, টকটকে ফরসা রং, মাথাজোড়া টাক, ফোলাফোলা গোল মুখে খোঁচা-খোঁচা পাকা দাড়ি, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। দশাসই বপুটি মীনধ্বজ মর্মরবক্ষ নামের সঙ্গে যেন খাপেখাপে মিলে যায়।

মিতিন নমস্কার জানিয়ে বলল, আমি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। অনিশ্চয় মজুমদার আমায় পাঠিয়েছেন।

ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বছর পয়ষট্টির মীনধ্বজ গেট খুলে দিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভেল্টু আমায় ফোন করেছিল। আসুন, গাড়িটা ভিতরে এনে রাখুন।

পাৰ্থর আর গাড়ি নাড়ানোর ইচ্ছে নেই। বেজার গলায় বলল, এখানেই থাক না।

ভরসা পাচ্ছি না ভাই। যা সব কাণ্ডকারখানা ঘটছে।

অগত্যা গাড়ি অন্দরে এল। টুপুর লক্ষ করল, পাঁচিল ঘেঁষে অ্যাসবেস্টসের ছাউনির নীচে আর-একখানা গাড়ি শোভা পাচ্ছে। বেশ বড়সড়, হালফ্যাশানের। যথেষ্ট দামিও। সম্ভবত মীনধ্বজের।

নুড়ি বিছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মীনধ্বজের বাড়িখানাও দেখছিল টুপুর। তাকিয়ে থাকার মতোই বাড়ি বটে। পাঁচিলঘেরা বিঘেপাঁচেক জমির মধ্যিখানে খাঁটি বিদেশি স্থাপত্য। বয়স দেড়শো বছর তো হবেই, তবে তেমন জরাজীর্ণ নয়। জমকালো চেহারার অনেকটাই এখনও অটুট। সবচেয়ে লক্ষণীয়, হঠাৎ দেখে একতলা মনে হলেও বাড়িটি আদতে দোতলা। সাদা পাথর বসানো প্রশস্ত বারান্দা থেকে মোটা-মোটা ডোরিক থাম উঠে গিয়েছে। স্যান্ডকাস্টিংয়ের রেলিং দেওয়া ছাদ পর্যন্ত। ওই থামগুলোর আড়ালে দোতলা প্রায় ঢাকা পড়ে থাকে। বারান্দাটাও বেশ উঁচুতে, পাক্কা দশ-দশখানা সিঁড়ি পেরোতে হয়। বারান্দার ওপারে ঘর। কী লম্বা-লম্বা দরজা-জানলা, বাপস! দরজা-জানলার মাথায় রংবেরঙি শার্সিতে নকশাও রীতিমতো নজরকাড়া।

বারান্দা টপকে টুপুর আরও বিমোহিত। কী প্রকাণ্ড হলঘর রে বাবা! সিলিং একদম টঙে, ছাদের লেভেলে। হলের দুপাশ দিয়ে জবরদস্ত দুখানা কাঠের সিঁড়ি, দোতলায় যাওয়ার জন্যে। দোতলার চারদিকে টানা বারান্দা, যেমন পুরনো দিনের হিন্দি ফিল্মে দেখা যায়।

পলকের জন্য টুপুরের মনে হল, এমন ডাকসাইটে বাড়িতে গুপ্তধন থাকতেই পারে।

সুসজ্জিত হলঘরে অজস্র অয়েলপেন্টিং, মাঝখানে পুরু কার্পেটের উপর সোফাসেট। পুরনো হয়েছে সোফাগুলো, তবে ঘরের সঙ্গে মোটেই বেমানান নয়। শ্বেতপাথরের টেবিলও আছে এদিক-ওদিকে, কারুকাজ করা ফুলদানি আর ছোটখাটো ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো।

টুপুরদের সোফায় বসিয়ে মীনধ্বজ বললেন, চা-কফি চলবে তো? নাকি শরবত?

পার্থ বলল, আমি আগে একগ্লাস জল খাব।

শশব্যস্ত পায়ে ভিতরে ছুটলেন মীনধ্বজ। ফিরলেন এক বছর আটাশ-তিরিশের বিবাহিত মহিলাকে নিয়ে। তার হাতের ট্রেতে তিনগ্লাস জল। একাই সব কটা গ্লাস শেষ করে থামল পার্থ।

মহিলাকে কফি বানাতে বলে মীনধ্বজ এবার বসলেন সোফায়। সামান্য গলা নামিয়ে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই ভেল্টুর মুখে সব শুনেছেন?

মিতিন মাথা নাড়ল, মোটামুটি। তবে ডিটেলটা তো আপনি বলবেন।

কোত্থেকে শুরু করব? মীনধ্বজকে ঈষৎ উত্তেজিত দেখাল, সেই প্রথমবার ছেলে দুটোকে যখন ধরলাম…?

আহা, আপনি টেনশন করবেন না। আমি আস্তে আস্তে সব জেনে নেব। মিতিন সোফায় হেলান দিল, আপনি কি এখন এ বাড়িতে একাই থাকেন?

হ্যাঁ, একাই তো! মাঝে-মাঝে অবশ্য সন্দীপনও রাতে থেকে যায়।

তিনি কে?

এ বাড়ির কেয়ারটেকার। ভেরি নাইস চ্যাপ। ও না থাকলে এ বাড়ি থোড়াই এমন বাসযোগ্য থাকত। আমি পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরছি জেনে গোটা বাড়িটাকে ও টিপটপ করে রেখেছিল।

আপনারই অ্যাপয়েন্ট করা লোক?

না না, তিন পুরুষ ধরে ওরা এ বাড়ির দেখাশোনা করছে। এখন তো প্রায় ফ্যামিলি মেম্বারের মতো হয়ে গিয়েছে।

তিনি এখন কোথায়? আছেন বাড়িতে?

না ও তো দুপুরে নিজের বাড়িতে গেল। সন্ধেবেলা আবার আসবে। বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন মীনধ্বজ, ডাকব সন্দীপনকে? কথা বলবেন?

থাক, তাড়া নেই। সন্দীপনবাবুর বাড়ি কোথায়?

কাছেই। ডায়মন্ডহারবার রোডের মুখটায়। ফোন পেলেই মোটরবাইক নিয়ে চলে আসবে।

উনি চব্বিশ ঘণ্টা এখানে থাকেন না কেন? পাৰ্থ ফস করে প্রশ্ন জুড়ল, আপনি বয়স্ক মানুষ, যে-কোনও সময় আপনার তাঁকে প্রয়োজন হতে পারে?

এতে ওর কোনও দোষ নেই। প্রথম কথা, আমি নিজেকে এজেড ভাবি না। আই অ্যাম ওনলি সিক্সটি সিক্স। অ্যাবসলিউটলি ফিট অ্যান্ড স্ট্রং। সেকেন্ডলি, আমার একটা বাজে অভ্যোস আছে। দীর্ঘদিন বিদেশবাসের কুফল আর কী। বাড়িতে সারাক্ষণ পরিবারের বাইরের কেউ ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে, এ আমার মোটেই পছন্দ নয়। মীনধ্বজ আলতো হাসলেন, সন্দীপন তো আগে এখানেই থাকত। আমিই ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন তার কাজ রোজ একবার করে দর্শন দেওয়া, আর আমি হাঁক মারলেই তুরন্ত হাজির হওয়া। চটপট আসতে যেতে যেন অসুবিধে না হয়, তাই মোটরবাইকও কিনে দিয়েছি ছেলেটাকে।

ভালই করেছেন। মিতিন গলা ঝাড়ল, আপনার কাজের মেয়েটিও নিশ্চয়ই রাতে এখানে থাকে না?

প্রশ্নই নেই। করুণা রান্নাবান্না সেরে সন্ধে নাগাদ চলে যায়।

তারপর থেকে সারাক্ষণ আপনি একা?

হ্যাঁ। যদি না কোনওদিন সন্দীপনকে আটকে রাখি।

আপনি আটকান? কেন?

আরে, আমি কি একেবারেই অসামাজিক মানুষ? মীনধ্বজ হো হো হেসে উঠলেন, এক-আধদিনও কি মানুষের সঙ্গ ভাল লাগতে নেই?

মিতিনও হেসে ফেলল। আবার কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, করুণাকে দেখে থেমে গেল। কফি আনল করুণা, সঙ্গে তিনটে প্লেটে অমলেট, চানাচুর, সন্দেশ।

খাদ্যবস্তু দেখেই পাৰ্থর চোখ চকচক। টুপুরেরও অল্প-অল্প খিদে পাচ্ছিল। যা খারাপ রাস্তা দিয়ে এসেছে, ঝাঁকুনিতেই দুপুরের ভাত কখন হজম। মেসোর দেখাদেখি হাতে প্লেট তুলে নিল। অমলেট কাটল চামচে।

মীনধ্বজেরও হাতে কফিমগ। মিতিনও চুমুক দিচ্ছে উষ্ণ পানীয়ে। করুণা দৃষ্টির আড়াল হতে মিতিন থমকে যাওয়া প্রশ্নটায় ফিরল, আচ্ছা মিস্টার বাগচী, প্রথম দিন ঠিক কোন সময়ে দুটো ছেলে মাটি খোঁড়াখুড়ি করতে গিয়ে ধরা পড়ে?

রাত্তিরেই। অ্যারাউন্ড এগারোটা।

 সেই রাত্তিরে কি সন্দীপনবাবু এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ, ছিল বলেই তো সেবার ছেলে দুটোকে ধরা গেল। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে আমি দোতলায় নিজের কাজকর্ম নিয়ে বসে ছিলাম। একটা জটিল সমীকরণ মিলছিল না কিছুতেই! ফ্রেশ এয়ার নিতে ছাদে গেলাম। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ল, আমাদের ব্যাকইয়ার্ডটায় কারা যেন…. সঙ্গে-সঙ্গে একতলায় নেমে সন্দীপনকে ডাকলাম।

উনি তখন কী করছিলেন?

টিভি দেখছিল। নিজের ঘরে… আই মিন, ওর জন্য অ্যালট করা ঘরে বসে। আমার মুখে শুনে ও চেঁচামেচি করতে বারণ করল। তারপর দুজনে পা টিপেটিপে ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে… ছেলে দুটো এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, পালানোর চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারেনি। তারপর ওদের আটকে রেখে সন্দীপনই তো পুলিশে ফোনটোন করে…।

হুম। মিতিন কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, আর লাস্ট যেদিন মাটি খুঁড়তে দেখলেন, সেদিন সন্দীপনবাবু কি…?

সন্দীপন থাকলে কি লোক দুটো পালাতে পারে? আমিও এমন হাঁকডাক করে ফেললাম…! ওরা হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে সোজা গঙ্গায় নেমে গেল।

পার্থ তেরচা চোখে বলল, মাঝেও তো কদিন কী সব শব্দটব্দ শুনেছেন?

রাতের দিকে মনে হয় কিছু-কিছু আওয়াজ কানে আসে, তবে আমি ঠিক সার্টেন নই। আবার উড়িয়ে দিতে পারছি না। ঘুম ভেঙে একদিন যেন শুনলাম, একজন পুরুষ আর-একজন মহিলা জোর ঝগড়া করছে। ইংরেজিতে। দরজা খুলে বাইরে আসতেই ভোঁ ভাঁ। আর-একদিন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে এল। চুপচাপ শুয়ে থাকতে-থাকতে সুরটা একসময় থেমেও গেল। পরে চিন্তা করে দেখলাম, ওটা বোধ হয় বিড়াল-টিড়ালের ঝগড়া…। গত সপ্তাহে একদিন অবশ্য খুবই ধুপধাপ হচ্ছিল। ঘর থেকে বেরনোর পরও বেশ খানিকক্ষণ শুনেছি শব্দটা।

কোন দিক থেকে আসে আওয়াজগুলো?

বাড়ির ভিতর থেকেই। যদিও আমি একতলা, দোতলায় হন্যে হয়ে খুঁজেও কোনও সোর্স পাইনি। এক হতে পারে, গঙ্গার ধারে বাড়ি, হয়তো রাত্তিরে উলটোপালটা হাওয়া জানলা-টানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে এখানে-ওখানে ধাক্কা খায়, আর আবোল-তাবোল শব্দ তৈরি করে। কাঠের বাড়িতে তো এরকম হয়ই। আমি বিদেশে দেখেছি।

তা হলে আপনি এত আপসেট হচ্ছেন কেন?

কারণ, আমার একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও একটা গড়বড় আছে। অ্যাদ্দিন কোথাও কিছু ছিল না, হঠাৎ আমি আসার পরেই কোত্থেকে এক গুপ্তধনের গুজব ভেসে উঠল! পাবলিকলি ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদ জানানোর পরও রিউমারটা থামল না, তারপরেও লোক আসছে! আর এটাই আমার খুব ফিশি লাগছে।

মিতিন একটুক্ষণ স্থির চোখে মীনধ্বজকে দেখে নিয়ে বলল, অর্থাৎ আপনিও এখন গুপ্তধনের রটনাটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন?

ঠিক তা-ও নয়। এখনও অবিশ্বাসই করছি। কিন্তু…। মীনধ্বজের কপালে মোটা ভাঁজ, বোধ হয় আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। ইভেন্টগুলোকে যদি কার্যকারণের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত!

হুম। মিতিন নড়ে বসল, তা ঠিক কোন রহস্যটার আপনি সমাধান চান? গুপ্তধন আদৌ আছে কি না যাচাই করতে হবে? নাকি গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে? নাকি ভৌতিক শব্দগুলোর উৎস জানা গেলেই আপনি সন্তুষ্ট?

ধরুন, তিনটেই। মীনধ্বজকে অস্থির দেখাল। জোরে-জোরে মাথা নাড়ছেন, জানেন তো, যত ভাবছি, ততই কেমন পাগলপাগল লাগছে। ব্যাপারটা স্পষ্ট না হলে আমার মানসিক অশান্তিটা কিছুতেই যাবে না। এর একটা বিহিতের জন্যে আমি যে-কোনও অঙ্কের টাকা খরচ করতে রাজি।

টাকা জিনিসটা আমার কাছে খুবই মূল্যবান মিস্টার বাগচী। তবে একটা জটিল রহস্যভেদ করার আনন্দ তার চেয়েও দামি। মিতিনের ঠোঁটে চিলতে হাসি, আর এই রহস্যটা আমার মোটেই সরল মনে হচ্ছে না।

তা হলে সেটা নিচ্ছেন?

অবশ্যই। আমি আজ থেকেই কাজে নামতে চাই। এক্ষুনি। মিতিন সোজা হল, চলুন, আগে আপনার গুপ্তধনের স্পটটা দেখে আসা যাক।