৩৬-৪১. মজিলপুরে বদলি

মজিলপুরে বদলি হইয়া আসার পর আবদুল কাদের আয় বাড়াইয়াছিল কিন্তু রসুলপুর ও মাদারগঞ্জের বন্ধকের দরুন মাসিক ৬০ টাকা পরিশোধ করিয়া যে টাকা অবশিষ্ট থাকিত। তাহাতে সংসার চালানো বেশ কঠিন। কয়েকটি ছেলেমেয়ে লইয়া আবদুল কাদের খুব কষ্ট করিয়া যথাসাধ্য মিতব্যয়ীভাবে সংসার চালাইয়া আসিতেছিল। কিন্তু আপিসের খাটুনি খাঁটিয়া এবং সাধারণের উপকারের জন্য নানারূপভাবে তাহাকে পরিশ্রম করিতে হয়। যেমন খাটুনি তেমন আহার জোটে না। পিতৃঋণ পরিশোধ না করিলেও চলে না। তা ছাড়া মাঝে মাঝে গরিব দুই-এক জন আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য করিতেও হয়। একশত বা শওয়া শত টাকার মধ্যে ৬০ টাকা গেলে আর কতই-বা থাকে! হালিমা দেখিল আবদুল কাদেরের শরীর দিন দিন খারাপ হইয়া চলিয়াছে। অন্যান্য নাশতা যোগাড় করা দুঃসাধ্য, তাই হালিমা তাহাকে সকাল-বিকাল একটু দুধ খাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিলে আবদুল কাদের বলিত, ছেলেমেয়েদেরই দুধ জুটাতে পারি না আর আমি বুড়ো মানুষ দুধ খাব!

এইভাবে দিন কাটিতেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদেরের স্বাস্থ্যও অসম্ভবরূপে ভাঙিয়া পড়িতেছিল। মাঝে মাঝে জ্বর হইতে লাগিল; কুইনাইন খাইয়া জ্বর বন্ধ করা হয়, কিন্তু জ্বরটা কী জ্বর এবং তার ঔষধ কী এ সম্বন্ধে প্রথমটা কেহই মাথা ঘামাইল না। যাহাদের অর্থের অভাব তাহাদের দেহদুর্গের মধ্যে কোনো শত্রু প্রবেশ করিলেও তাহাদের বিশেষ হুঁশ হয় না। অবশেষে এমন হইয়া আসিল যে, জ্বর আর ছাড়ে না। তখন ডাক্তারের ডাক পড়িল। মজিলপুরে যে ডাক্তার ছিল, সে পরামর্শ দিল রক্ত পরীক্ষা করিতে হইবে। তদনুসারে বরিহাটী রক্ত পাঠানো হইল। পরীক্ষা করিয়া জানা গেল রক্তের মধ্যে কালজ্বরের বীজাণু ঢুকিয়াছে। আবদুল কাদের মনে মনে হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু উপায় নাই। হালিমা ব্যাকুল হইয়া উঠিল। সকলে পরামর্শ দিল বরিহাটী গিয়া চিকিৎসা করা দরকার। আবদুল কাদের মনে মনে টাকার অভাব অনুভব করিল। পিতা বিমুখ; আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমন কে-ই বা । আছে যে টাকা দিয়া সাহায্য করিবে! কিছু টাকা কর্জ করিতে পারিলে চিকিৎসার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা এখন যেরূপ তাহাতে কে-ই বা কর্জ দেয়!

মানসিক উদ্বেগ ও অশান্তির মধ্যে অসুস্থদেহে কয়েকদিন আপিসের কাজ চলিল বটে কিন্তু তাহা আর বেশিদিন চলিল না। অবশেষে যখন আবদুল কাদের একেবারে শয্যাগ্রহণ করিতে বাধ্য হইল তখন ছুটির দরখাস্ত করা হইল।

কিস্তির টাকা দেওয়া হইবে না, হালিমার কী উপায় হইবে, ছেলেমেয়েদের কী দশা। হইবে; পিতার যেরূপ মতিগতি তাতে পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে তাও রক্ষা হইবে না। আর যদিই-বা রক্ষা হয় তাহা ভাগ হইয়া গেলে থাকিবেই-বা কী ইত্যাদি দুশ্চিন্তা আবদুল কাদেরকে একেবারে অধীর করিয়া ফেলিল।

সংবাদ পাইয়া আবদুল্লাহ্ কয়েকদিনের casual leave লইয়া আবদুল কাদেরকে দেখিতে আসিল। আবদুল কাদের আর সে আবদুল কাদের নাই। একেবারে অস্থিচর্মসার, তাহার কঙ্কালের প্রতি তাকাইয়া আবদুল্লাহর চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আবদুল কাদেরের কাঁদিবার শক্তি ছিল না, দুই হাত বাড়াইয়া ইশারা করিয়া তাহাকে বসাইয়া দিতে বলিল। অতি সন্তর্পণে সকলে মিলি ধরিয়া তাহাকে পিছনে দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়া বসাইয়া দিল। তাহার চক্ষু ছলছল করিতেছিল। আবদুল্লাহকে কাছে ডাকাইয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, ভাই, গোনা-খাতা মাফ্ কর। তাহার পর হালিমাকে দেখাইয়া অস্পষ্টস্বরে কী একটা কথা বলিল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার ণণ্ড বাহিয়া দুই ফোট তপ্ত অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। আবদুল্লাহ্ নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করিয়া নানারূপ আশ্বাসবাণী দিয়া আবদুল কাদেরকে সান্ত্বনা দিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিল। আবদুল কাদের আর বসিতে পারিতেছিল না। সকলে মিলিয়া অতি সন্তর্পণে তাহাকে শোয়াইয়া দিল ।

একবালপুরে সংবাদ পৌঁছিল। সৈয়দ সাহেব বলিলেন, আর কী হবে–আমার ওসব জানাই আছে। সবই খোদার মরজি, নইলে এমন হবে কেন?

আবদুল মালেক কহিল, তা আব্বাজান, ধরুনগে আপনার আবদুল কাদের তো ছেলেমানুষ, আপনি ওকে মাফ করে দিন; আর আমি না হয় একবার ওকে দেখে আসি।

সৈয়দ সাহেবেরও শারীরিক অবস্থা দিন দিন কাহিল হইয়া আসিতেছিল। নিজের যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ বাবা, আমিও তাই মনে করছি, তুমি গিয়ে দেখে এস। আমার নড়াচড়ার হাঙ্গামা সইবে না।

অবশেষে সৈয়দ সাহেবের আদেশমতো আবদুল মালেক মজিলপুর আসিয়া উপস্থিত হইল। আবদুল মালেক আসিয়া যাহা দেখিল তাহাতে সে একেবারে বসিয়া পড়িল। সে আবদুল্লাহকে কহিল, তা দুলাহ্ মিঞা, ধরগে’ তোমার বরিহাটীতে নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না? হালিমার ব্যারাম তো ধরগে’ তোমার ওই বরিহাটীর ডাক্তার বাবুই ধরগে’ তোমার আরাম করে দিয়েছিলেন।

আবদুল্লাহ্ কহিল, কী আর নিয়ে যাব! দেখছেন তো হাড় কখানা। ও নিয়ে যেতে গেলে পথেই গুড়া হয়ে যাবে। নেবার মতো অবস্থা থাকলে কি আর বসে আছি! কিছুই নেই। এখন যে আর। কোনো আশাই নেই ভাইজান–বলিয়া আবদুল্লাহর চক্ষু দিয়া অশ্রু বাহির হইল। ঠিক সেই সময়েই হালিমার উচ্চ ক্রন্দন-রোল উভয়ের চমক ভাঙাইয়া দিল, উভয়ে ব্যতিব্যস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া কলেমা পড়িতে লাগিল। হালিমার হাত-পা তখন থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। আবদুল্লাহ্ তাহাকে একপাশে সরাইয়া তাহার হাত হইতে চামচটি লইয়া একবার মুখে পানি দিল।

হালিমা কহিল, ভাইজান আর পানি দেবেন না। আবদুল মালেক কলেমা পড়িতে পড়িতে পা দুটি সোজা করিয়া দিল। সকলেই সমস্বরে পড়িতে লাগিল, লা-এলাহা-ইল্লাল্লাহ্ মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্।

যথাসময়ে কাফন-দাফন সমাধা করিয়া, লাখ কলেমা পড়াইয়া এবং কয়েকজন ফকির-মিসকিনকে খাওয়াইয়া হালিমা ও তাহার সন্তান কয়েকটিকে লইয়া আবদুল্লাহ্ ও আবদুল মালেক একবালপুরে ফিরিয়া আসিল। আসার সময় ফজলু মিঞা হালিমাকে কয়েকদিন তাহাদের বাড়ি রাখিয়া পরে একটু সুস্থ হইলে লইয়া গেলে হইবে এইরূপ পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার স্বামীর অসুস্থ অবস্থায় যে ফজলু মিঞা একদিনও দেখিতে আসিলেন না, তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে হালিমা আদৌ রাজি হইল না। হালিমা আরো জানিত যে, ফজলু মিঞা তাঁর দীনী এলেমের প্রতি উৎকট নেশায় বশীভূত থাকায় আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে নানারূপ সমালোচনা করিয়াছে এবং তদ্দরুন আবদুল কাদেরকে অনেক যন্ত্রণাও পোহাইতে হইয়াছে। মাদ্রাসায় কতকগুলি ছেলেকে ইংরেজি, বাংলা ও অঙ্ক শিখাইতে চেষ্টা করায় ফজলু মিঞা আবদুল কাদেরের বিরুদ্ধে একবার কাফেরের ফতোয়ার কথাও ভাবিয়াছিলেন। সে বাড়িতে হালিমা কিছুতেই যাইতে রাজি হয় নাই।

বিধবার বেশে হালিমা যখন রসুলপুরে পৌঁছিল, তখন তাকে দেখিয়া তাহার মা একেবারে উন্মাদের ন্যায় কাঁদিয়াউঠিলেন। আবদুল্লাহ্ অশ্রুসজলচক্ষে মাকে শান্ত করিবার জন্য বলিল, সবর করুন আম্মা, সবর করুন! ওতে গোনাহ্ হয় আম্মা, তা তো জানেন। পরে আবদুল কাদেরের বড় ছেলেটিকে তাহার মায়ের কোলে দিয়া বলিল, দোয়া করুন। এরা বেঁচে থাকুক, মানুষ হোক।–কে কার কথা শোনে, ছেলেটিকে ধরিয়া মা ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। হালিমা কাদিতে দিতে অশ্রু নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়াছিল। সে আর কাঁদিতে পারিল না। তাহার কোলের ছেলেটি ক্ষুধায় অস্থির হইয়াছিল। আবদুল্লাহ্ মাকে বলিল, আম্মা, দুধ থাকে তো ওকে একটু দুধ দিন। যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করিয়া শিশুটিকে কোলে লইয়া তাহাকে দুধ খাওয়াইবার জন্য জননী উঠিয়া গেলেন।

আবদুল্লাহ্ হালিমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল যে আবদুল কাদেরের life insure-এর দরুন ৫০০০ টাকা পাওয়া যাইবে। এই টাকা দ্বারা ছেলেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে মানুষ হইতে পারে এই ভরসা দিয়া সে হালিমাকে অনেকখানি আশ্বস্ত করিয়া ছুটিশেষে রসুলপুর রওয়ানা হইল।

আবদুল কাদের যে life insure করিয়াছিল, এ কথা সকলেই জানিত। এখন অনটনের মধ্যে পড়িয়া সেই টাকাগুলির ন্যায্য অংশ হস্তগত করিবার জন্য সৈয়দ সাহেব উপায় উদ্ভাবন করিতে লাগিলেন, দুই-এক জনকে ডাকাইয়া সলাপরামর্শও করিলেন। শেষে স্থির করিলেন আবদুল্লাহর দ্বারাই টাকাটা উঠাইয়া লইতে হইবে, কারণ সে ভিন্ন হালিমাকে রাজি করা সম্ভব হইবে না এবং এত হাঙ্গামা হুজ্জৎ অন্য কেহও পোহাইতে পারিবেন না।

স্থিরসঙ্কল্প হইয়া সৈয়দ সাহেব আবদুল মালেককে রসুলপুরে পাঠাইয়া দিলেন। আবদুল মালেক রসুলপুরে পৌঁছিয়া সাংসারিক অভাব-অনটনের কথা যাহা কিছু বলিবার সমস্তই আবদুল্লাহকে বলিল এবং শীঘ্রই যাহাতে life insure-এর টাকাটার ন্যায্য প্রাপ্যটা পাওয়া যায় তাহার যথাবিহিত চেষ্টা করিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইল।

আবদুল্লাহ আপত্তির কোনো কারণ দেখিতে পাইল না। কাজেই যত শীঘ্র সম্ভব সে একটা ব্যবস্থা করিয়া ফেলিবে–এই প্রতিশ্রুতি দিয়া আবদুল মালেককে একবালপুরে পাঠাইয়া দিল।

.

৩৭.

বাস্তবিকই সৈয়দ সাহেবের শরীর অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। পুত্র আবদুল কাদেরের মৃত্যু-সংবাদে তিনি আরো বেশি কাহিল হইয়া পড়িলেন। তার ওপর দুশ্চিন্তার বোঝাও ক্রমে বাড়িয়া উঠিয়াছে। আবদুল কাদেরের মৃত্যুতে কিস্তি খেলাপ হওয়ায় ভোলানাথবাবুরাও কিছু চাঞ্চল্য দেখাইতেছেন। টাকাটা শোধ না দিলে ভালো ভালো দুটা তালুক বেহাত হইয়া যাইবার সম্ভাবনায় আবদুল মালেকও অনেকটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। আবদুল মালেক সেদিন আসরের নামায বাদ সৈয়দ সাহেবের সম্মুখীন হইয়া বলিল, আহ্বা, মনে মনে ভাবছি আবদুল কাদেরের লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দরুন যে টাকাটা পাওয়া যাবে তা ধরুনগে তাতে তো আপনারও হক আছে; সৈয়দ সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন, তা আছে, তাতে তুমি কী বলছ?

আবদুল মালেক, বলব আর কী, ধরুনগে আপনার মাদারগঞ্জ আর রসুলপুর ওই দুটাই। তো হল ভালো তালুক; ও দুটা গেলে ধরুনগে আপনার আর রইল কী?

সৈয়দ সাহেব একটু উষ্ণ হইয়া বলিলেন, তা তুমি কী বলছ খোলসা করে সোজা বল না। ওসব ঘোরপ্যাঁচ কেন?

আবদুল মালেক, আমি বলছি যে আপনার যখন শরা-মতো হক আছে তখন ধরুনগে আপনার যে টাকাটা আপনি পাবেন…।

সৈয়দ সাহেব, হ্যাঁ, পাব, তাতে কী? তুমি বলছ সেই টাকাটা ভোলানাথবাবুকে দিয়ে ঋণটা শোধ দেওয়া যাবে!

আবদুল মালেক, তা যাবে বৈকি! আবদুল কাদের মরহুম তো প্রায় হাজার দেড়েক টাকা শোধ দিয়ে গেছে।

সৈয়দ সাহেব, হাজার দেড়েক না, তবে কাছাকাছি, অনেকটা টাকা তো সুদের বাবদ গেছে কিনা? তা যা হোক, লাইফ ইস্যুরেন্সের কত টাকা?

পাঁচ হাজার; তা তার দুই আনা হল কত ছয় শত সাড়ে ছয় শত হবে। তাতে কি আর ঋণ শোধ হবে? তা যা হোক, তুমি আবদুল্লাহকে চিঠি লিখে দাও। বড় টানাটানি চলছে।

যথাসময়ে ওই মর্মে আবদুল্লাহর নিকট পত্র প্রেরিত হইল এবং আবদুল্লাহ্ যথাসময়ে শরা-মতো সৈয়দ সাহেবের দাবি গ্রাহ্য করিয়া ৬৩৩।৩ টাকা পাঠাইয়া দিল।

টাকা হস্তগত হওয়ায় সৈয়দ সাহেবের সওয়াব হাসিল করার আবার একটি বিশেষ সুযোগ উপস্থিত হইল। পীর সাহেবের পুত্রের শাদি-মোবারকের দাওয়াদ পৌঁছিয়াছিল এবং যত্র আয় তত্র ব্যয়। সমস্ত টাকাই পীরসাহেবের ছেলের বিবাহের নজর ইত্যাদিতে খরচ হইয়া গেল।

অভাব অভিযোগের ইয়ত্তা ছিল না, শরীরও ভাঙিয়া গিয়াছিল। সৈয়দ সাহেব শীঘ্রই নিতান্ত অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর ডাক পড়িল। তিনি জান্নাতবাসী হইলেন।

.

৩৮.

তখনকার দিনে ডিপুটিগিরি চাকরি সুপারিশের ওপর নির্ভর করিত। সুপারিশ যোগাড় করিতে হইলে বিস্তর টাকা-পয়সা খরচ হইত। যার টাকা-পয়সার অভাব সে যথেষ্ট কৃতবিদ্য হইলেও চাকরি তার জুটিত না। আলতাফের ওকালতি ব্যবসায় পছন্দ না হওয়ায় শেষে বাদশা মিঞার ইচ্ছানুসারে ডিপুটিগিরির চেষ্টার কথা মীর সাহেবের নিকট উপস্থিত করিল। মীর সাহেবের শরীর দিন দিন ভাঙিয়া পড়িতেছিল। আলতাফের ওকালতি ব্যবসায় ভালো লাগে না। সুতরাং মীর সাহেব কোনো আপত্তি করিলেন না এবং যথাসাধ্য সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। বাদশা মিঞাও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া লালমিঞার দ্বারা মালেকার সহিত আলতাফের বিবাহের প্রস্তাব রিয়া পাঠাইলেন। লালমিঞা আলতাফকে ডিপুটি করার কথা পাকা করিয়া লইলেন। মীর সাহেব যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া দেখিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং কয়েকদিন পরেই আলতাফকে সঙ্গে লইয়া সদরে গিয়া পৌঁছিলেন।

সদরে গিয়া প্রথমে তিনি হরনাথবাবুর সহিত দেখা করিলেন। হরনাথবাবু সদরেই ওকালতি করিতেছিলেন এবং সেখানে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বেশ অর্জন করিয়াছিলেন। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি মেজাজ। লেখাপড়ায় যেমন, আইনের জ্ঞান ততোধিক। এদিকে টেনিস খেলায় তিনি সদরের চ্যাম্পিয়নরূপে পরিগণিত। জজ সাহেব, পুলিশ সাহেব ও কালেক্টর সাহেব প্রায় প্রতিদিন তাহার সহিত খেলা করেন। কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে খেলার সূত্রে তার সহিত বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া উঠিয়াছিল। মীর সাহেব এ সমস্ত খবর জানিয়াই হরনাথবাবুর নিকট গিয়া সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলেন। হরনাথবাবু প্রথমটা বলিলেন, তা ওকালতিই তো ভালো। এখানে Scope বড় বেশি; আর আজকাল, ডিপুটিগিরি পাওয়াটা লটারি বৈ আর কিছু নয়। উনি এখন ওকালতি করছেন, চাকরির চেষ্টা করতে গেলে এখানে ওখানে দৌড়-ঝাঁপ করে বেড়াতে হবেখন; মক্কেল দু-চারটা যা আছে তারা সব বেহাত হয়ে যাবে। শেষে ধরুন। যদি চাকরি নাই মিলল, তবে তো সেই আবার কেঁচে গণ্ডুষ। আলতাফ একটুখানি বিনয়ের হাসি হাসিয়া কহিল, আমার মক্কেল আদৌ নাই, যা ২/১ জন কখনো কখনো আসে তারা। পরামর্শ নিয়ে শেষকালটা ভেঙ্গে পড়ে। দুই-এক জন এমনও আছে যে কাগজপত্র সব রেখে। গেল, বলে গেল নিশ্চয়ই আমাকে উকিল দেবে; কিন্তু পরদিন অথবা এমনকি দিনের দিন বললে আমি নূতন উকিল বলে ভরসা হয় না। এমন করে আর কী করে চলে! বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। বাড়িতে বৃদ্ধ পিতাও আমি একটু সাহায্য করব বলে অনেকদিন আশা করে রয়েছেন, এখন ওকালতিতে যা দেখছি তাতে আমার আর কোনো ভরসা হচ্ছে না।

হরনাথবাবু সমস্ত শুনিয়া অবশেষে মীর সাহেবকে বলিলেন, আচ্ছা, আপনার অনুরোধ আমি কখনো ভুলব না এবং যথাসাধ্য আলতাফকে সাহায্য করব। আজই সন্ধ্যায় কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা। তখনই আমি কথাটা পাড়ব। কাল সকালেই একবার আলতাফ ভায়াকে পাঠিয়ে দেবেন আমার এখানে, যা কথা হয় জানাব। যদি কালেক্টর সাহেবকে সম্মত করতে পারি তা হলে দাদা আছেন এখন কমিশনারের পার্সন্যাল এসিসটেন্ট, তারও কাছে একটা চিঠি দিয়ে আলতাফকে পাঠিয়ে দেব। যতদূর যা পারি আমি নিশ্চয়ই করব, আর কিছুর জন্য না হয় শুধু আপনার খাতিরে।

পরদিন প্রত্যুষে আলতাফ হরনাথবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়া জানিল যে কালেক্টর সাহেব বলিয়াছেন যে, কয়েকজন খুব ভালো ভালো প্রার্থী আছে; তিনি কোনোরূপ প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না, তবে আলতাফকে একবার দেখিতে চান।

সেইদিনই হরনাথবাবুর একখানা পত্র লইয়া আলতাফ যথাসময়ে কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করিল। কালেক্টর সাহেব বলিলেন, আলতাফের আরো কিছু পূর্বে দেখা করা উচিত ছিল, কারণ তিনি পূর্বেই একজনকে একরূপ কথাই দিয়াছিলেন। এখন ডিপুটিগিরির জন্য প্রথম নাম (first nomination) তিনি দিতে অক্ষম তবে সবুডিপুটির জন্য প্রথম নাম এবং ডিপুটিগিরির জন্য দ্বিতীয় নাম দিতে চেষ্টা করিবেন বলিয়া আলতাফকে জানাইলেন।

মীর সাহেব সমস্ত কথা শুনিলেন এবং রসুলপুর ফিরিয়া আসিয়া বাদশা মিঞার সহিত পাকাপাকি কথা ঠিক করিয়া দিন স্থির করার প্রস্তাব করায় বাদশা মিঞা নানারূপ অজুহাত দেখাইয়া সময় লইতে চাহিলেন। বাদশা মিঞার মনের অভিসন্ধি যে, আলতাফের চাকরির চেষ্টার ফলাফল জানার পূর্বেই যদি সম্বন্ধ স্থির হইয়া যায় তবে হয়তো মীরের পো সরিয়া পড়িবেন এবং আলতাফের চাকরির তদ্বিরের দরুন আর্থিক সাহায্য শেষ পর্যন্ত নাও করিতে পারেন! মীর সাহেব যে এতদিন কোনো বিশেষ মতলবেই আলতাফের খরচ যোগাইতেছিলেন এইরূপ সন্দেহ আর যে যাই বলুক বাদশা মিঞার মনে বরাবরই ছিল। কোনো সমাজ যখন অধঃপাতে যায় তখন সেই সমাজে যে দুই-একটি ভালো লোক নিঃস্বার্থভাবে পরের উপকার করে তাদের মনের কথা বিচার করিবার সময় অধঃপতিত জন নিজের মনের প্রতিবিম্ব ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পায় না। কৃতজ্ঞতা জিনিসটির অধঃপতিত সমাজে কোনো স্থান নাই। মীর সাহেবের অবশ্য কৃতজ্ঞতার দিকে তত লোভ ছিল না। তিনি সমাজকে ভালো করিয়াই চিনিয়াছিলেন। বাদশা মিঞা কেন যে দিন স্থির করিতে নারাজ তাহা তিনি হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিলেন। অবশেষে যখন বাদশা মিয়া একটু দূরে অর্থাৎ ডিপুটিগিরির চেষ্টার ফলাফল প্রকাশিত হইবার পর বিবাহের দিন স্থির করিলেন মীর সাহেব তাহাতেই রাজি হইলেন।

.

৩৯.

যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশিত হইল এবং আলতাফ সব্‌ডিপুটির নিয়োগপত্র পাইল। বাদশা মিঞা একেবারে চটিয়া লাল। তিনি আরো শুনিয়াছিলেন যে, মালেকাকে মীর সাহেব ৫০০০ টাকা দিয়াছেন সে কথাও মিথ্যা। বাদশা মিঞা চটিয়া বলিলেন, সব জুরি–ডিপুটি করে দেবে বলেছিল, হল কিনা সবুডিপুটি–টাকার বেলাতেও ফাঁকি–সব চালাকি! কিন্তু তিনি মীর সাহেবকে মনের কথা কিছু জানাইলেন না। ভিতরে ভিতরে কূট মতলব করিয়া বসিলেন, আলতাফের বিবাহের সময় এই জুজুরির সমুচিত প্রতিশোধ দিবেন। তাহাকে লোকচক্ষে এমনভাবে অপদস্থ করিবেন, যাহাতে জীবনে কখনো আর লোকের কাছে মুখ দেখাইতে না পারেন।

এদিকে আলতাফকে বরিহাটীতে কার্যে যোগদান করিতে হইবে। অথচ বিবাহের দিন নিকটবর্তী। রসুলপুরে বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছে। সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক। লোকজনকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে। গত রাত্র হইতে নিমন্ত্রিতদের খানার যথারীতি আয়োজন চলিয়াছে। ২০/২৫ জন লোক যাদের ওপর পাকের ভার ছিল তারা সারারাত্রি জাগিয়া পাকের আয়োজন করিয়াছে। পোলাও, মাংস ইত্যাদি কতক কতক পাক হইয়া গিয়াছে। মীর সাহেব অসুস্থ শরীরে প্রায় রাত্রি দুটা পর্যন্ত জাগিয়া সকলের অনুরোধে একটু ঘুমাইয়া আবার ফজরে উঠিয়া নামায সমাধা করিয়া কাজকর্ম দেখিতেছেন। ক্রমে বেলা উঠিল। বরের আসিবার সময় সন্নিকট। দু-দশজন নিমন্ত্রিতরা আসিতে আরম্ভও করিয়াছে। মীর সাহেব হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা করিতেছেন। এমন সময় ডাকপিয়ন আসিয়া একখানা চিঠি হাতে দিল। মীর সাহেব ক্ষিপ্রহস্তে চিঠিখানা লইয়া পড়িয়া একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। সকলে অবাক! ব্যাপার কী জানিবার জন্য মীর সাহেবের চারিদিকে ভিড় জমাইল। ছলছল-চক্ষু বৃদ্ধ মীর সাহেব বুকে পাষাণ বাধিয়া সকলকে জানাইলেন, বাদশা মিঞা চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে এ বিবাহ হতে পারে না, কারণ আমি নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে আলতাফকে ডিপুটি করে দেব কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আমি তাকে সব্‌ডিপুটি মাত্র করেছি। হা কপাল, ডিপুটিগিরি কেন, যদি তার বড় কিছু আমার হাতে থাকত আমি আলতাফকে তাও দিতে পারলে কি ছাড়তাম? আলতাফ, তোমার হাতে আমার এই শাস্তি, এ তো আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নি! আমার পুত্র পরিবার কেউ নাই। তোমরাই আমার সব! কবে কোনদিন আলতাফকে কী দিতে আমি কুণ্ঠিত হয়েছি তা খোদাতালা ছাড়া আর কেউ জানেন না। বৃদ্ধের গণ্ড বাহিয়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরিল।

বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন উপলক্ষে রাত্রি জাগরণ, তার ওপর মানসিক অশাস্তি ও উদ্বেগ ভগ্নস্বাস্থ্য মীর সাহেব সহ্য করিতে পারিলেন না। সেইদিন দ্বিপ্রহরে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হইলেন। একটু সর্দিকাশি পূর্বেও দেখা দিয়াছিল। রাত্রে বুকে-পিঠে বেদনা অনুভব করিলেন। মীর সাহেব ভাবিলেন আর সময় নাই। নানারূপ ভাবিয়া পরদিন বাদশা মিঞাকে এই মর্মে একখানা চিঠি লিখিয়া পাঠাইলেন যে, টাকাটা লোন-আপিসেই ছিল কিন্তু সে টাকা লোন আপিস হইতে উঠাইয়া তদ্বারা মালেকার নামেই একটি খুব লাভবান সম্পত্তি খরিদ করা হইয়াছে।

.

৪০.

বিবাহ উপলক্ষে আবদুল খালেক সপরিবারে রসুলপুরে উপস্থিত ছিল। আবদুল্লাহ্ ও আবদুল খালেক উভয়েই উপযুক্ত ডাক্তারকে ডাকিয়া মীর সাহেবের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করিল। এদিকে মালেকা ও রাবিয়ার প্রাণপণ সেবা-শুশ্রূষাও চলিতে লাগিল। খোদার মরজিতে অল্পদিনের মধ্যেই মীর সাহেব আরোগ্য লাভ করিয়া উঠিলেন।

মীর সাহেব অসুস্থ থাকাকালীন আবদুল্লাহ্ তাহার বাড়িতে অনবরত আসা-যাওয়া করিত। মালেকার সেবা-শুশ্রূষার নিপুণতার বহু পরিচয় আবদুল্লাহ্ পাইয়াছিল এবং মালেকার প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মানে তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। বুদ্ধিমতী রাবিয়াও ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল। সে মনে মনে উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধ স্থির করিবার সঙ্কল্প করিল।

মীর সাহেব আরোগ্য লাভ করায় সকলেই অত্যন্ত সুখী হইয়াছিল। কয়েকদিন পর একটু আয়োজন করিয়াই সবাই মিলিয়া একসঙ্গে খাবার বন্দোবস্ত করিল। এদিকে মীর সাহেব মালেকার চিন্তায় আকুল হইয়া উঠিয়াছিল।

সেদিন আহারাদির পর রাবিয়া আবদুল্লাহ্কে ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল। সেদিন সকলেরই মন বেশ প্রফুল্ল ছিল। রাবিয়া আবদুল্লাহর সম্মুখে সাজা পানভরা পানের বাটা রাখিয়া দিতেই আবদুল্লাহ্ কহিল, ভাবীসাহেবা, আমি পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

রাবিয়া বলিল, কেন, এত বৈরাগ্য কিসের জন্য?

বৈরাগ্য আর কী, ভালো লাগে না, তা ছাড়া পান খেলে অপকার হয়–আবার মাস্টারি করি কিনা, ছেলেপুলের সামনে পান খাওয়াটা ভালো নয়; তাই আজকাল ওটা ছেড়েই দিয়েছি!

আচ্ছা, পান খাওয়া না হয় ছেড়েই দিলেন, তাই বলে সব ছাড়তে পারবেন না। সত্যিই খোনুকার সাহেব, বলুন দেখি এমনভাবে আর কতদিন কাটবে!

আপনার কথাটা বুঝতে পারলাম না।

কথাটা কি এতই শক্ত যে বুঝা কঠিন! তবে সোজা করে বলি। আপনি আপনার লোক, কিন্তু কেন জানি না, আপনাকে আরো কাছে টেনে নিতে বড় ইচ্ছা হয়। যদি সত্যি সত্যি আমার মনটা বার করে আপনাকে দেখাতে পারতাম তা হলে আপনি বুঝতে পারতেন…

আবদুল খালেক পাশের ঘরে সমস্ত কথাই শুনিতেছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, বাঃ, বেশ তামাশা হচ্ছে, আর আমি যে এ ঘরে ওত পেতে রয়েছি তার খোঁজ আছে?

রাবিয়া ঘোমটা একটু টানিয়া দিয়া বলিল, তামাশা নয়; সত্যি কথা। তাহার চক্ষু ছলছল করিতেছিল। বলিল, খোকার সাহেবকে মামুজান এত স্নেহ করেন দেখে আমার বড় ইচ্ছা হয়…।

আবদুল খালেক, কী ইচ্ছা, মালেকাকে ঘাড়ে চাপাতে চাও, না! আমি বলে দিলাম মনের কথাটা।

রাবিয়া, চাই, চাব না কেন? আপনার লোকের বোঝা আপনার লোকের উপর চাপাতে পারলে কে ছাড়ে? কিন্তু চেলেই যদি পারতাম তা হলে আর বিলম্ব করতাম না। তা সে আমাদের কি আর সেই কপাল হবে!

আবদুল্লাহ্ একটু যেন লজ্জিত হইল। আবদুল খালেক তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিল, কী। হে খোকার? মনটা কি নরমে উঠেছে? তা আমি তো বলি কাজটা করলে মন্দ হয় না।

আবদুল্লাহ্ এবার গম্ভীর হইয়া উঠিল। তার জীবনের অনেক কথা তার মনে দ্রুত খেলিয়া যাইতে লাগিল। সেদিন স্কুলে একটি ইংরেজি কবিতা পড়াইতে ছিল, … Life is real Life is earnest সে কথাও মনে হইল। চন্দ্রশেখর বাবুর কথা, জলধর সেনের কথা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ সমর্থনের কথা, নূরজাহান, তাজমহল, কত কথাই তাহার মনে হইল।

মীর সাহেব ব্যাপার কিছু কিছু শুনিলেন। অবশেষে আবদুল্লাহ্ মীর সাহেবের নিকট নিজেই জানাইল যে, যদি তিনি মুরব্বিস্বরূপ আবদুল্লাহকে পরামর্শ দেন এবং যদি তিনি সুখী হন তাহা হইলে আবদুল্লাহ্ এই বিবাহে রাজি।

কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবদুল্লাহর মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে মীর সাহেব হঠাৎ তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া কাছে বসাইয়া পিঠে মাথায় হাত বুলাইয়া অজস্র আশীর্বাদে তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিলেন।

বিনা আড়ম্বরে শুভদিনে শুভক্ষণে আবদুল্লাহর সহিত মালেকার বিবাহ হইয়া গেল।

মীর সাহেব যেন তার শেষ কর্তব্যটি সম্পন্ন করার জন্য এতদিন মনের কথা মনেই রাখিয়া দিয়াছিলেন। সুদখোর মীর সাহেব যে মনে মনে এতখানি কল্পনা করিয়াছিলেন তাহা কেহ পূর্বে ভাবে নাই। বাদশা মিঞার সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া কলিকাতা হাইকোর্ট হইতে একজন উকিল আনাইয়া সুদখোর মীরসাহেব তার সমস্ত সম্পত্তির ওয়াকফনামা লিখিয়া রেজিস্ট্রি আপিসে গিয়া রেজিষ্ট্রি করিয়া দিলেন। তার পরিত্যক্ত যাবতীয় সম্পত্তি lo আনা সাধারণ শিক্ষার জন্য, ॥O আনা শিল্পশিক্ষার জন্য, l0 আনা আতুর-সেবার জন্য, l0 আনা একটি পান্থশালার ব্যয়ের জন্য, বাকি l0 আনার জন্য l0 আনা মোতওয়াল্লীর মোশাহেরা দরুন এবং 0 আনা অন্যান্য কর্মচারীর বেতনের দরুন ব্যয় হইবে। আয়-ব্যয় হিসাব করিয়া দেখা গেল l0 আনা সম্পত্তির বার্ষিক আয় প্রায় ৪০০০ টাকা হয় অর্থাৎ সম্পত্তির মোট আয় ৬৪০০০ টাকা ছিল। আবদুল্লাহ্ আপাতত মোতওয়াল্লীর পদে নিযুক্ত হইল।

.

৪১.

সৈয়দ সাহেবের মৃত্যুর পর হইতে পাওনাদারদের তাগাদা অগ্রাহ্য করিয়া তার উভয় পক্ষের নাবালক সন্তানসন্ততিকে অসহায় অবস্থায় ফেলিয়া আবদুল মালেক সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি শরীফাবাদে গিয়া নিশ্চিন্ত মনে বহাল তবিয়তে কালাতিপাত করিতেছেন। অবশ্য ইহার যে কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না, তাহা নহে। অভাব এত বেশি হইয়া উঠিয়াছিল যে বাড়িতে আদৌ মান-সম্ভম বজায় রাখিয়া চলিবার কোনো উপায় ছিল না। তার ওপর ছেলেপুলের অসুখবিসুখ, তাহাদের চিকিৎসাপত্র হইবে কেমন করিয়া? সেবা-শুশ্রূষারও একান্ত অভাব, কারণ দাসী-বাদী যাহারা ছিল, নিয়মিত ভরণপোষণ না পাইয়া যে যাহার পথ দেখিয়া লইয়াছে, কাজেই শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ ভিন্ন তাহার গত্যন্তর ছিল না।

এখন বাড়ির কর্তা হইয়াছিল খোদা নেওয়াজ। বেচারা একাধারে চাকর ও কর্তা। বাঁদী-পুত্র বলিয়া লেখাপড়া শিখিবার সুযোগ পায় নাই। কাজেই একজন গোমস্তার ওপর আদায়পত্রের ভার ছিল। সে যাহা দয়া করিয়া দেয় তাহারই ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা ছাড়া তাহার গতি ছিল না। সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে যে তাহাকে যথেষ্ট ঠকানো হইতেছে। কিন্তু উপায় ছিল না।

এদিকে ভোলানাথবাবুর শরীরও ইদানীং ভালো ছিল না। তিনি সেই মাদারগঞ্জ ও রসুলপুর এই দুইটি তালুকের একটা ব্যবস্থা করিয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। এবং মাঝে মাঝে কড়া তাগিদও পাঠাইতেছিলেন। খোদা নেওয়াজ দুঃখ করিয়া বলিত, আর কি ও ঋণ পরিশোধ হবার যো আছে! ও আপনাদেরই হয়ে গেল।

মধ্যে কয়েক মাস আদৌ আর কোনো তাগিদ আসিল না। খোদা নেওয়াজের মনের ভিতর একটা সন্দেহ জাগিয়া উঠিল; কাহাকেও জিজ্ঞাসা করিতেও পারে না আবার না করিলেও স্থির থাকিতে পারে না। অবশেষে একদিন সকল রহস্য প্রকাশ হইয়া পড়িল, আদালতের এক কর্মচারীর মুখে। ভোলানাথবাবুর পুত্র হরনাথবাবু ঋণের টাকার জন্য নালিশ রুজু করিয়াছেন এবং শীঘ্রই সুদে-আসলে সমস্ত টাকার ডিক্রি হইয়া যাইবে। সংবাদ শুনিয়া খোদা নেওয়াজ মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।

হইলও তাই। যথাসময়ে হরনাথবাবু আদালত হইতে খরচসমেত সুদে-আসলে সমস্ত টাকার ডিক্রি পাইলেন। সংবাদ যখন একবালপুরে পৌঁছিল, তখন সকলের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। ছোট বিবি জ্বরগায়ে কাঁপিতে কাঁপিতে ঘর ঝাঁট দিতেছিলেন। কন্যাটি ঘরের মেঝেয় বসিয়া বাসি তরকারি দিয়া গরম ভাত খাইতেছিল। বড়বিবি বলিলেন, ওমা, ওর গায় দেখি জ্বর, ওকে বাসি তরকারি দিয়ে ভাত খেতে দিলে কী বলে! ছোটবিবি ধীর শান্তভাবে বলিলেন, বেলা দুপুর হয়ে গেল, কাল থেকে কিছু খায় নি, কী করি! বললাম নুন দিয়ে খা, তা কি শোনে!

কেন একটু মিছরি দিয়ে দিলে না?

পেট ভরা পিলে, খালি পেটে মিষ্টি খাওয়া কি ভালো, তাই দিনি। আর মিছরি তাও কি ঘরে আছে; থাকলে তো দেব!

এমন সময় খোদা নেওয়াজ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া বলিল, আম্মাজান, কাল নাকি তালুক দুটা নিলামে চড়বে। ছোটবিবি শুনিয়াও শুনিলেন না, কাঁপিতে কাঁপিতে ঘর ঝট দিয়াই চলিলেন। বড়বিবি যেন তাহার বিশেষ কিছু আসে যায় না এমনিভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, কে বল্লে, তুই কোত্থেকে শুনে এলি? চিঠি দেখে নাকি?

খোদা নেওয়াজ কিন্তু কী করিবে ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিতেছিল না। অবশেষে সে স্নানাহার মুলতুবি রাখিয়া মধ্যাহ্ন মার্তণ্ডের প্রখর রৌদ্র অগ্রাহ্য করিয়া এক কাপড়েই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িল এবং বেলা ডুবুডুবু সময়ে রসুলপুর গিয়া উপস্থিত হইল।

আবদুল্লাহ্ সব শুনিয়া ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝিয়া রাত্রিতেই একবালপুর পৌঁছিল এবং আবদুল খালেককে সঙ্গে লইয়া পরদিন প্রত্যুষেই বরিহাটী যাত্রা করিল।

হরনাথবাবুর এখন অসীম প্রসার-প্রতিপত্তি, কিন্তু তাই বলিয়া এতগুলি টাকা ছাড়িয়া দেওয়ার কথা তাকে বলা অন্যায় হইবে ভাবিয়া আবদুল্লাহ্ কিছুদিন সময় প্রার্থনা করিল।

হরনাথবাবু বলিলেন, আর কতদিন অপেক্ষা করা যায়! একেবারে টাকাগুলা মারা যায়, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে এ-কাজ করতে হয়েছে। তা যদি বড় মিয়া সাহেব (আবদুল মালেক বাড়ি থেকে নিজে দেখেশুনে) আদায়-পত্র করতেন এবং কিছু কিছু করে টাকাটা আদায় হত তা হলে আর ভাবনা কী ছিল! তা তিনি তো শুনেছি শ্বশুরবাড়িতেই আজকাল আছেন। এখন আপনারাই বলুন, কী ভরসায় আমি বসে থাকি?

আবদুল্লাহ্ কহিল, আপনারা বড়লোক। সৈয়দ সাহেবদের অবস্থা তো জানেনই। একটি বিশেষ সম্ভ্রান্ত পরিবার পথের কাঙাল হবে! দয়া করলে একটা উপায় হতেই পারে।

হরনাথবাবুর করুণ হৃদয় মথিত হইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস নির্গত হইল, তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, সৈয়দ সাহেবকে আমি দেখেছি। এমন উদারচেতা লোক আজকাল অতি বিরল। একবার বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কত খাতির করলেন বাবাকে ও আমাকে! তার গোমস্তা ৮০০ টাকা তহবিল তসরুফ করেছিল, বাবার অনুরোধে এক কথায় তিনি মা লিখে দিলেন। ভগবান এমন একটি উদারচেতা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সন্তানসন্ততির ভাগ্যে এত দুঃখ কেন লিখলেন বুঝি না। তা যা হোক আপনারা এসেছেন; আমি না হয় সুদটা ছেড়ে দিতে পারি; কিন্তু আসল টাকাটা–

আবদুল খালেক একটু নড়িয়া বসিল এবং চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া হরনাথবাবুর দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল।

আবদুল্লাহ্ বলিল, এরূপ মহৎ-হৃদয় না হলে ভগবান আপনাদের এত উন্নতি দিয়েছেন? যার যেমন মন তার তেমন ভাগ্য!

আবদুল খালেক আনন্দে অধীর হইয়া বলিয়া উঠিল, সোবহান আল্লাহ্!

আবদুল্লাহ্ সজল চক্ষে হরনাথবাবুকে বলিল, মহাশয়, আপনি যদি সুদ ছেড়ে দেন তবে ও আসল টাকাটা আমিই দিয়ে দিব।

হরনাথবাবু আবদুল্লাহর প্রতি সৈয়দ সাহেব যে ব্যবহার করিয়াছিলেন সে সংবাদ জানিতেন। ইত্যাকার ব্যবহার সত্ত্বেও আবদুল্লাহর এই উদারতায় তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হইলেন।

আবদুল্লাহ দৃঢ় এবং শান্তভাবে বলিল, তা দেখুন, আমার শ্বশুর আমার সঙ্গে কিছু দুর্ব্যবহার করেছিলেন সত্য, কিন্তু তার ইদানীং যা অবস্থা পঁড়িয়েছিল তাতে ওরূপ ব্যবহারে আমি খুব দুঃখিত হই নি। লোকজনকে দান-খয়রাত করা ও পেট-ভরে লোককে খাওয়ানো, তার একটা নেশা ছিল; আমিই-বা কি কম খেয়েছি! আমার স্ত্রীকে তিনি যা যত্ন করতেন আর ভালবাসতেন তেমন বাৎসল্য পুস্তকে ভিন্ন দেখা যায় না।

হরনাথবাবু সমস্তই শুনিলেন। এই মহৎ উদার যুবকের প্রতি তাঁহার মন আপনা হইতে নত হইয়া পড়িল। শ্রদ্ধায়, প্রীতিতে তাঁহার সমগ্র অন্তর্দেশ ভরিয়া উঠিল। তিনি উঠিয়া আবদুল্লাহকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, ভাই, তোমার মহত্ত্বের কাছে আজ আমি নতশিরে পরাজয় স্বীকার করছি। আজ হতে সত্যিই তুমি আমার ভাই। এ-ঋণ তোমার পরিশোধ করতে হবে না। আমি এখনই তার ব্যবস্থা করছি। এই বলিয়া হরনাথবাবু সম্মুখস্থ দেরাজ টানিয়া ডিক্রিখানি বাহির করিয়া তাহাদের সম্মুখেই টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। আবদুল্লাহ্ বা আবদুল খালেকের মুখে একটিও কথা ফুটিল না, শুধু নির্বাক বিস্ময়ে তাহারা হরনাথবাবুর মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ November 1, 2022 at 2:33 am

মুসলিম সমাজের তৎকালীন কূপমন্ডুকতা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *