১৬-২০. বড় দুইটি পুত্র

বড় দুইটি পুত্রের মধ্যে আবদুল কাদেরকেই একটু মানুষের মতো দেখা গিয়াছিল বলিয়া সৈয়দ সাহেব তাহার ওপর অনেক ভরসা করিয়া বসিয়া ছিলেন। আবদুল মালেক তো বাল্যকাল হইতেই বুদ্ধি-বিবেচনা বিষয়ে অভ্রান্ত স্থূলতা দেখাইয়া আসিতেছিল; তাই তাহার দ্বারা কাজের মতো কাজ কিছু একটা হইবার সম্ভাবনা না দেখিয়া তিনি পশ্চিম হইতে এক জন কারী (সুষ্ঠুভাবে কোরআন শরীফ পাঠে দক্ষ ব্যক্তি) আনাইয়া তাহাকে কোরআন মজিদ হেফজ (মুখস্থ) করিতে দিয়াছিলেন। তাহার পর মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর দিবারাত্র ঢুলিয়া ঢুলিয়া নানা সুরে নানা ভঙ্গিতে আয়েত (শ্লোক)-গুলি শতবার সহস্রবার আওড়াইয়া অবশেষে যখন আবদুল মালেক হাফেজ (আদ্যন্ত কোরআন মজিদ যাহার কণ্ঠস্থ) হইয়া উঠিল, তখন সৈয়দ সাহেব মনে করিলেন, যা হোক ছোঁড়াটার ইহকালের কিছু হোক না-হোক, পরকালের একটা গতি হইয়া গেল। এক্ষণে আবদুল কাদেরকে দিয়া কতদূর কী করানো যায়, তাহার দিকে মনোনিবেশ করিলেন।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। আবদুল কাদের মাদ্রাসা পাস করিয়া পশ্চিমে যাইবে; সেখানকার বড় বড় আলেমগণের নিকট হাদিস, তফসির প্রভৃতি পড়িয়া দীনী এল এর (ধর্মবিষয়ক শিক্ষা) একেবারে চরম পর্যন্ত হাসেল (আয়ত্ত) করিয়া আসিবে, সৈয়দ সাহেব বহুকাল হইতে এই আশা হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছিলেন। কিন্তু সে যখন তাঁহাকে এমন করিয়া দাগা দিয়া এলমে-দীনের পরিবর্তে এলমে-দুনিয়ার উপর ঝুঁকিয়া পড়িল, তখন তিনি ভয়ানক চটিয়া গেলেন এবং তাহার পড়াশুনা বন্ধ করিয়া দিয়া বাড়িতে আনাইয়া বসাইয়া রাখিলেন। রাগের মাথায় স্পষ্ট করিয়া মুখে কিছু না বলিলেও, ব্যবহারে। তাহার ঘোর বিরক্তি ও দারুণ অসন্তোষ পদে পদে প্রকাশ পাইতে লাগিল। এইরূপে বৎসরাধিক কাল কাটিয়া গেল।

আবদুল কাদেরের প্রকৃতি যে ধাতুতে গড়া তাহাতে অকর্মা হইয়া বসিয়া থাকা তাহার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর। প্রথম প্রথম কিছুদিন সে কর্মচারীদিগের সেরেস্তায় গিয়া বসিয়া জমিদারির কাজকর্ম দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিল। আমলারা দেখিল মেজ মিয়া সাহেব যেরূপ উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছেন, তাহাতে বেচারাদের চাকরি বজায় রাখা দায় হইয়া উঠিয়াছে। অবশেষে তাহারা একদিন খোদ্ কর্তাকে গিয়া ধরিয়া পড়িল; কর্তা আবদুল কাদেরকে ডাকিয়া ধমকাইয়া দিলেন এবং বুঝাইয়া দিলেন যে, আমলা-ফামলার কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করিতে যাওয়া জমিদার-পুত্রের পক্ষে সম্মানজনক নহে। পক্ষান্তরে ও-সকল কাজের ভিতর গিয়া ডুবিয়া পড়িলে দীনদারী বজায় রাখা অসম্ভব হয়; নহিলে কি তিনি নিজেই সব দেখাশুনা করিতে পারিতেন না! ওইসব দুনিয়াদারীর ব্যাপার আমলাদের উপর ছাড়িয়া দিতে পারিয়াছেন বলিয়াই তো তিনি নিশ্চিন্ত মনে খোদার নাম লইতে পারিতেছেন!

আবার বেকার বসিয়া বসিয়া কিছুকাল কাটিয়া গেল। অবশেষে একদিন আবদুল কাদের পিতার নিকট গিয়া প্রস্তাব করিল যে, সে কোনো একটা চাকরির সন্ধানে বিদেশে যাইতে চাহে। শুনিয়া সৈয়দ সাহেব একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন। জমিদারের ছেলে চাকরি করিবে–বিশেষ সৈয়দজাদা হইয়া! নাঃ, ছেলের আখেরাতের বিষয় আর উদাসীন হইয়া থাকিলে চলিতেছে না! অতঃপর সৈয়দ সাহেব প্রত্যহ দুবেলা তাহাকে কাছে বসাইয়া দীনী এলম্-এর ফজিলাত (গুণ) বয়ান (বর্ণনা) করিয়া, পুনরায় মাদ্রাসায় পড়ার আবশ্যকতা বুঝাইবার জন্য নানাপ্রকার নসিহৎ (উপদেশ) করিতে আরম্ভ করিলেন।

আল্লাহতালা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন পরীক্ষা করিবার জন্য, কে কতদূর দুনিয়াদারির লোভ সামলাইয়া দীনদারীতে কায়েম থাকিতে পারে এবং তাহাকে ইয়াদ (স্মরণ করিতে পারে। যে গরিব, লাচার, তাহাকে অবশ্য সংসার চালাইবার জন্য খাটিতে হয়, খোদাকে ইয়াদ করিবার সময় বেশি পায় না, তাহার পক্ষে দিন-রাত এবাদত না করিতে পারিলেও মাফ আছে। কিন্তু আল্লাহতালা যাহাকে ধন-সম্পত্তি দিয়াছেন, সংসার চালাইবার ভাবনা ভাবিতে দেন নাই, তাহার পক্ষে পরীক্ষাটা আরো কঠিন করিয়াছেন। সে যদি দিন-রাত এবাদতে মশগুল না থাকে, তবে তাহার আর মাফ নাই। আর তেমন লোক যদি আবার দুনিয়াদারিতে মজিয়া পড়ে, তো সে নিশ্চয়ই জাহান্নামে যাইবে। অতএব যখন। আবদুল কাদেরের সংসারের ভাবনা আল্লাহতালা নিজেই ভাবিয়া রাখিয়া দিয়াছেন, তখন তাহার উচিত দীনের ভাবনা ভাবা, দীনী এল হাসেল করিয়া আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু এত নসিহতেও কোনো ফল হইল না। আকবত-এর ভয় দেখাইয়াও সৈয়দ সাহেব পুত্রের মন ফিরাইতে পারিলেন না। সে আর মাদ্রাসায় পড়িতে চাহিল না। যদি পড়িতেই হয়, তবে সে ইংরেজি পড়িবে, আর যদি তাহা পড়িতে নাও দেন, তাহা হইলে যে-টুকু সে শিখিয়াছে, তাহাতেই করিয়া খাইতে পারিবে। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া সৈয়দ সাহেব সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিবার ভয় দেখাইতে বাধ্য হইলেন। এইটিই তাহার হাতের শেষ মহাস্ত্র ছিল এবং মনে করিয়াছিলেন, এ মারাত্মক অস্ত্র ব্যর্থ হইবে না।

আবদুল কাদের নিতান্ত নির্বোধ ছিল না। সে বুঝিতে পারিয়াছিল যে, পিতার সম্পত্তি ভ্রাতা-ভগ্নীগণের মধ্যে বিভাগ হইয়া গেলে আর পায়ের উপর পা দিয়া বড়-মানুষি করা চলিবে না; বিশেষত পিতা যেরূপ অবিবেচনার সহিত খরচ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তালুক বিক্রয় করিয়া মসজিদ দিতেছেন, তাহাতে শেষ পর্যন্ত সম্পত্তির যে কতটুকু থাকিয়া যাইবে, তাহা এখন বলা যায় না। এরূপ অবস্থায় পিতা তাহাকে যেটুকু সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিবার ভয় দেখাইতেছেন, সেটুকু থাকিলেও বড় লাভ নাই, গেলেও বড় লোকসান নাই। সুতরাং পিতার মহাস্ত্রের ভয়েও সে টলিল না, বরং জেদ করিতে লাগিল, তাহাকে এন্ট্রান্সটা পাস করিতে দেওয়া হউক, নতুবা সে নিজের পথ দেখিবার জন্য গৃহত্যাগ করিয়া যাইবে।

সৈয়দ সাহেব অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া কহিলেন, তবে তুই দূর হয়ে যা–তোর সঙ্গে আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

আবদুল কাদের খুশি হইয়া ভাবিল, –সে তো তাহাই চাহে। মুখে কহিল, জি, আচ্ছা, তাই যাচ্ছি।

তাহার পর সত্য সত্যই সে একদিন বাটী হইতে বাহির হইয়া গেল।

.

১৭.

গৃহত্যাগ করিয়া আবদুল কাদের বরিহাটীর সদরে আসিয়া তাহার সহপাঠী ওয়াহেদ আলীর বাটীতে আশ্রয় লইল। ওয়াহেদ আলী তখন বাটীতে ছিল না; কিছুদিন পূর্বে সে পুলিশের সব্‌-ইনস্পেক্টারি চাকরি পাইয়া ট্রেনিঙের জন্য ভাগলপুরে চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পিতা আকবর আলী আবদুল কাদেরের পরিচয় পাইয়া সযত্নে তাহাকে নিজ বাটীতে স্থান দিলেন এবং চাকরি সম্বন্ধেও তাহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।

বরিহাটী জেলায় মোটের উপর মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যা অধিক হইলেও শহরে মুসলমান বাসিন্দা বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। মুসলমান জমিদারগণের ভগ্নাবশেষ যে দুই-চারি ঘর এখনো টিকিয়া আছেন, সদরে বাড়ি করিয়া থাকিবার আবশ্যকতাও তাঁহাদের নাই, আর ক্ষমতাও নাই বলিলে চলে। তাহাদের বিষয়-সংক্রান্ত কাজকর্ম নায়েব গোমস্তা ও উকিলবাবুরাই করিয়া থাকেন, কৃচিৎ স্বয়ং হাজির হইবার দরকার পড়িলে নৌকায় আসেন এবং নৌকাতে থাকেন। তাই বলিয়া মুসলমান বাসিন্দা যে একেবারে নাই, তাহা নহে। শহরের এক প্রান্তে কয়েক ঘর পেয়াদা ও চাপরাসী শ্রেণীর লোক বাস করে; সেইটাই এখানকার মুসলমান পাড়া! আকবর আলী কালেক্টারির একজন প্রধান আমলা ছিলেন; চাকরি উপলক্ষে তাহাকে এখানে অনেক দিন হইতে বাস করিতে হইতেছে। কিন্তু অন্য কোথাও স্থান না পাইয়া তিনি এই মুসলমান পাড়াতেই বাসের উপযুক্ত খানকয়েক ঘর বাঁধিয়া লইয়াছেন।

যাহা হউক মুসলমানদিগের মধ্যে হিন্দু মহলে যা কিছু খাতির তা একশ্চন্দ্ৰস্তমো হন্তি গোছ আকবর আলীই পাইয়া থাকেন। কিন্তু সে খাতিরটুকুর মূলে, তাহার কার্যদক্ষতার গুণে সাহেব-সুবার সুনজর ব্যতীত আর কিছু ছিল কি না, তাহা সঠিক বলা যায় না।

বিদেশে অপরিচিত স্থানে একাধারে এহেন আশ্রয় ও সহায় পাইয়া আবদুল কাদের কতকটা আশ্বস্ত হইল বটে কিন্তু চাকরি কবে জুটিবে, ততদিন কেমন করিয়া নিজের খরচ চালাইবে, আর কতদিনই-বা বসিয়া পরের অন্ন ধ্বংস করিবে, ইহাই ভাবিয়া সে উতলা হইয়া উঠিল। সে আকবর আলীকে কহিল যে, যতদিন তাহার চাকরি না হয়, ততদিনের জন্য তাহাকে একটা প্রাইভেট টুইশন যোগাড় করিয়া দিলে বড় উপকৃত হইবে।

আকবর আলী তাহাকে বুঝাইয়া কহিলেন, –যদিও বরিহাটীতে অনেক শিক্ষিত লোকের বাস আছে, কিন্তু সকলেই হিন্দু; তাহাদের বাড়িতে টুইশন পাওয়া অসম্ভব, কেননা, একে তো তাহারা স্বজাতীয় লোক পাইতে অপরকে ও-কাজ দিতে রাজি হইবেন না, তাহার উপর আবার হিন্দু গ্রাজুয়েট, আণ্ডার-গ্রাজুয়েটের অভাব নাই, সুতরাং মাত্র এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়া মুসলমানের পক্ষে এ শহরে টুইশনের প্রত্যাশা করা ধৃষ্টতা বৈ আর কিছু নহে। তবে নিতান্ত যদি আবদুল কাদের বেকার থাকিতে অনিচ্ছুক হন, তবে আকবর আলী সাহেবের পুত্রটিকে মাঝে মাঝে লইয়া বসিলে তিনি বড়ই উপকৃত হইবেন।

এ প্রস্তাবে আবদুল কাদের সানন্দে সম্মত হইল এবং আকবর আলী সাহেবকে বহু। ধন্যবাদ দিয়া সেই দিন হইতেই তাহার পুত্রের শিক্ষকতায় লাগিয়া গেল। তাহার আগ্রহ এবং তৎপরতা দেখিয়া আকবর আলী মনে মনে সন্তুষ্ট হইলেন এবং যাহাতে সত্বর বেচারার একটা চাকরির যোগাড় করিয়া দিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

সৌভাগ্যক্রমে মাস দুইয়ের মধ্যেই একটি এপ্রেন্টিস্ সব্‌রেজিস্ট্রারের পদ খালি হইতেছে বলিয়া সংবাদ পাওয়া গেল। আকবর আলী অবিলম্বে আবদুল কাদেরকে লইয়া ম্যাজিস্ট্রেট করবেট সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলেন। করবেট সাহেব লোকটি বড় ভালো, যেমন কার্যদক্ষ, তেমনি খোশমেজাজ। অধীনস্থ কর্মচারীগণের ওপর তাহার মেহেরবানির সীমা নাই। দরিদ্র প্রজার সুখ-দুঃখও তাহার দৃষ্টি এড়াইতে পারে না এবং তাহাদের কিঞ্চিৎ উপকারের সুযোগ পাইলে তিনি তাহার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিয়া থাকেন।

আকবর আলী তাহার সম্মুখে নীত হইয়া যথারীতি সালাম করিলে সাহেব বলিয়া উঠিলেন, –গুডমর্নিং, মুন্সী, খবর কী?

আকবর আলী কহিলেন, থ্যাংক ইউ সার, খবর ভালোই। আজ একটা দরবার নিয়ে হুজুরে হাজির হয়েছি…।

বলা বাহুল্য, কথাবার্তা ইংরেজিতেই হইতেছিল।

সাহেব কহিলেন, –কেন, আপনার ছেলের চাকরি তো সেদিন হয়ে গেল, আবার কিসের দরবার?

আপনার দয়াতেই আমার ছেলের চাকরি জুটেছে, সেজন্য কী বলে আমি আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাব, তা ভেবে পাই নে…

না না, মুন্সী, দয়াটয়া কিছু নয়, তবে উপযুক্ত লোক পেলে আমি অবশ্যই চাকরি দিয়ে থাকি…।

সেই ভরসাতেই আজ একজন দুস্থ মুসলমান উমেদারকে সঙ্গে করে এনেছি, স্যার! যদি হুকুম হয়…

আচ্ছা, তাকে আসতে বল, দেখি।

আকবর আলী তৎক্ষণাৎ বাহিরে গিয়া আবদুল কাদেরকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। আবদুল কাদের সালাম করিয়া দাঁড়াইলেন, করবেট সাহেব তাহার নাম, যোগ্যতা প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, –ওয়েল মুন্সী, এ তো এনট্রান্স পাস করে নাই। পাস না হলে আজ-কাল তো গভর্নমেন্ট আপিসে চাকরি হওয়া কঠিন–তবে বিশেষ ক্ষেত্রের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র।

আকবর আলী কহিলেন, –ইনি আপিসে কোনো চাকরি চান না স্যার; সব্‌রেজিস্ট্রারির জন্যে এপ্রেন্টিসী প্রার্থনা করেন…

সাহেব কহিলেন, –সে তো আরো কঠিন কথা! আজকাল যেসব গ্রাজুয়েট, আন্ডার গ্রাজুয়েট এসে সব্‌রেজিস্ট্রারির জন্যে উমেদার হচ্ছে…।

এন্ট্রান্স ফেলও তো আপনার কৃপায় পেয়ে যাচ্ছে, স্যার!

সাহেব একটু হাসিয়া বলিয়া উঠিলেন, –ও! আপনি উমাশঙ্কর বাবুর ছেলের কথা বলছেন? সে যে খুব সম্ভ্রান্ত বংশের লোক…

ইনিও কম সম্ভ্রান্ত বংশের লোক নন, স্যার! একবালপুরের জমিদারেরা যে কেমন পুরাতন ঘর তা স্যারের জানা আছে…

সাহেব কহিলেন, –ওঃ আপনি একবালপুরের সৈয়দ বংশের লোক বটে?–আপনার সঙ্গে আজ পরিচয় হওয়ায় বড়ই সুখী হলাম! তা আপনাদের মতো বড় ঘরের ছেলের চাকরির দরকার কী?

আবদুল কাদের কহিল, –আমাদের ঘরের অবস্থা আর আজ-কাল তেমন ভালো নেই, স্যার। এখন অন্য উপায়ে উপার্জন না কত্তে পাল্লে সংসারই চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। আপনি একটু দয়া কল্লে, স্যার, আমার কষ্ট দূর হতে পারে।

সাহেব একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, –মুসলমান জমিদার ঘরের ছেলে হয়ে আপনি এমন কথা বলছেন! আমি দেখেছি, আপনাদের শ্রেণীর মধ্যে এমন লোকও আছে যে, ক্রমে দুরবস্থায় পড়েও গুমোর ছাড়ে না। লেখাপড়া শেখা, কি কোনো ব্যবসায় করা, ছোটলোকের কাজ বলে মনে করে–শেষটা তাদের বংশাবলীর ভাগ্যে হয় ভিক্ষা, না হয় জাল-জুয়াচুরি ছাড়া আর কিছুই থাকে না।

আকবর আলী কহিলেন, –আমাদের ভিতরকার অবস্থা সম্বন্ধে আপনার চমৎকার বহুদর্শিতা আছে, স্যার।

হ্যাঁ, আমি অনেক ঘুরে ঘুরে দেখেছি বটে। দেখেশুনে সত্যই আমার মনে বড় দুঃখ হয় এদের জন্যে। কিন্তু যতদিন এরা লেখাপড়ার দিকে মন না দিচ্ছে, ততদিন কিছুতেই কিছু হতে পারবে না। দেখ, হিন্দুরা লেখাপড়া শিখে কেমন উন্নতি করে ফেলেছে– আপিসে আদালতে কি ব্যবসায়-বাণিজ্যে, যেখানে যেখানে দেশীয় লোক দেখতে পাই, কেবলই হিন্দু–ক্বচিৎ কালে-ভদ্রে একজন মুসলমান নজরে পড়ে। ক্রমে ওরাই দেশের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবে, দেখতে পাবেন, আপনারা কেবল কাঠ কাটবার জন্যে পড়ে থাকবেন।

আকবর আলী কহিলেন, –আজ কাল দুই-একজন করে লেখাপড়া শিখতে আরম্ভ করেছে, স্যার, এই তো একজন আপনার কাছে হাজির করেছি…

ওঃ, এক-আধ জন একটু শিখলে তাতে তো ফল হয় না, আর ইনি তো পাসও কত্তে পারেন নি…

প্রথম অবস্থায় এইটুকুতেই একটু উৎসাহ না পেলে লেখাপড়ার দিকে লোকের উৎসাহ বাড়বে কেন, স্যার? প্রথম প্রথম তো আমরা হিন্দুদের সঙ্গে সমান সমান হয়ে প্রতিযোগিতা কত্তে পারব না, কাজেই গভর্নমেন্টের একটু বিশেষ নজর এ গরিবদের উপর থাকবে বলে ভরসা করি।

সাহেব কহিলেন, –কিন্তু এ কথা মনে রাখবেন, মুন্সী সাহেব, চিরদিন যদি আপনারা ওই বিশেষ নজরের ওপর নির্ভর করে থাকেন, তবে কখনই উন্নতি করে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সমকক্ষ হতে পারবেন না।

সে কথা খুবই ঠিক, স্যার। তবে বর্তমানে লেখাপড়ায় একটু কম থাকলেও, স্যার বোধহয় দেখেছেন, মুসলমান কর্মচারীরা কাজকর্মে নিতান্ত মন্দ দাঁড়ায় না…  

তা দেখেছি বটে। আবার অনেক সময় বি-এ পাস হিন্দু দেখে লোক নিযুক্ত করে আমাকে ঠকতে হয়েছে। অবশ্য কেবল পাস হলেই যে লোক যোগ্য হল তা নয়, তবু গভর্নমেন্টের পক্ষে বাছাই করবার ওটা একটা সহজ উপায় বটে। সেইজন্যেই পাসটা আমাদের দেখতে হয়।

তবু স্যার, এর বেলায় আপনি একটু বিশেষ দয়া না করলে ভদ্রলোকের মারা পড়বার দশা। লেখাপড়া শিখবার এর খুবই আগ্রহ ছিল, কিন্তু এদিকে বয়সও বেড়ে চলল, অবস্থাতেও আর কুলাল না, কাজেই চাকরির চেষ্টা কত্তে হচ্ছে। গরিবের ওপর আপনার যেমন মেহেরবানি, তাতেই একে আজ আনতে সাহস করেছি…।

সাহেব কহিলেন, –আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দেবেন–এপ্রেন্টিসী খালি হলে আপনার বিষয় বিবেচনা করা যাবে। আর, মুন্সী, আপনি একটু নজর রাখবেন, সময়মতো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবেন।

আকবর আলী কহিলেন, –সম্প্রতি একটা এপ্রেন্টিসী খালি হবার কথা শুনছি, স্যার। যদি হুকুম হয়, তবে আজই দরখাস্ত পেশ করি…

আচ্ছা, করতে পারেন, আমি আপিসে সন্ধান নিয়ে দেখব, খালি হচ্ছে কি না। যদি খালি হয়, তবে হয়তো পেতেও পারেন, কিন্তু আমি কোনো অঙ্গীকার কত্তে পারি নে, মুন্সী।

আপনি আশা দিলেন স্যার, তার জন্যেই আমরা কৃতজ্ঞ।

অল রাইট, মুন্সী, গুডমর্নিং! বলিয়া কিঞ্চিৎ ঘাড় নাড়িয়া তাহাদিগকে সাহেব বিদায়সূচক সম্ভাষণ করিলেন। তাঁহারাও থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, স্যার, গুডমর্নিং! বলিয়া এক সেলাম করিয়া বিদায় লইলেন।

বাহিরে বারান্দায় কয়েকজন ডেপুটি বাবু, পেশকার, উমেদার প্রভৃতি সাহেবের সহিত সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় বসিয়া ছিলেন। আকবর আলী তাহাদিগকে স্মিতমুখে সালাম করিলেন; কেহ কেহ সে সালাম গ্রহণ করিলেন, কেহ কেহ করিলেন না। তাহারা চলিয়া গেলে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন–এ আর এক ব্যাটা নেড়ে এল কোত্থেকে হে?

পেশকার বাবু কহিলেন, সব মুন্সী কোত্থেকে জোটাচ্ছে, কে জানে! এক নেড়ে যখন ঢুকেছে, তখন নেড়েয় নেড়েয় মক্কা হয়ে যাবে দেখতে পাবেন;–আর আজকাল মুন্সীর তো পোয়াবারো! সাহেবের ভারি সুনজর! এই দেখুন না, কারু সঙ্গে সাহেব দুই-তিন মিনিটের বেশি আলাপ করেন না, আর মুন্সী প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সাহেবের সঙ্গে খোশআলাপ করে এল! অপর এক বাবু কহিলেন, –তা হবে না? আজকাল যে ওরা গভর্নমেন্টের পুষ্যি পুত্তুর হয়ে উঠেছে। তাহার পর তিনি চক্ষু দুইটি ঘুরাইয়া কহিলেন, –সার্কুলার বেরুচ্ছে চাকরি খালি হলে এখন নেড়েরাই পাবে। নেড়ে এ্যাঁপয়েন্ট না করতে পারলে আবার কৈফিয়তও দিতে হবে!…

এমন সময় বাবুটির তলব হইল; তিনি তাড়াতাড়ি চেয়ার হইতে লাফাইয়া উঠিয়া পকেট হাতড়াইয়া রুমাল বাহির করিয়া এক হাতে মুখ মুছিতে মুছিতে এবং আর এক হাতে চাপকানের দাম পাট করিতে করিতে দরজার চৌকাঠে ছোটখাটো একটা হোঁচট খাইয়া সেটা সামলাইতে সামলাইতে সাহেবের কামরায় গিয়া প্রবেশ করিলেন।

.

১৮.

হালিমাকে সঙ্গে লইয়া আবদুল্লাহ্ যখন গৃহে ফিরিল, তখন মাতা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাইলেন। বহুদিন তিনি কন্যাকে দেখেন নাই; ইতোমধ্যে তাহার একটি পুত্রও হইয়াছে। স্বামীর মৃত্যুতে তিনিও দারুণ শোক পাইয়াছেন, এক্ষণে শোকের ও আনন্দের যুগপৎ উচ্ছ্বাসে অধীর হইয়া কন্যাকে কোলে টানিয়া লইয়া কাদিতে লাগিলেন, আবার পরক্ষণেই তাহার পুত্রটিকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া অশ্রুসিক্ত মুখে হাসিয়া ফেলিলেন। কিন্তু সে যখন তাহার অজস্র চুম্বনে অস্থির হইয়া কাঁদিয়া ফেলিল, তখন তিনি তাহাকে ভুলাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন; তাহাকে কোলের উপর নাচাইয়া কাক, বিড়াল, মুরগি, যাহা যেখানে ছিল, সব ডাকিয়া, এটা ওটা সেটা দেখাইয়া তাহাকে হাসাইয়া দিলেন।

কিন্তু এ আনন্দের মধ্যেও তাহার মনের কোণে দুইটি কারণে দুঃখের কুশাঙ্কুর বিধিয়া রহিল, –বউ আসে নাই, সে এক কারণ, আর আবদুল্লাহর পড়ার কোনো বন্দোবস্ত হইল না, সেই আর এক কারণ। আবদুল্লাহর শ্বশুর তো সাহায্য করিতে রাজি হইলেন না; মীর সাহেব যদিও সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছেন বলিয়া আবদুল্লাহর মুখে শুনিলেন, কিন্তু সে সাহায্য গ্রহণ করা ভালো বিবেচনা করিলেন না। সুতরাং আর কোনো উপায় নাই; আবদুল্লাহ্কে চাকরির সন্ধানেই বাহির হইতে হইবে। আবার বাহির হইতে হইলে কিছু খরচপত্র চাই, তাহারও যোগাড় করা দরকার; এই সকল কথা ভাবিয়া মাতা বড়ই অস্থির হইয়া উঠিলেন।

কয়েকদিন ধরিয়া ভাবিয়া ভাবিয়া টাকা সংগ্রহের কোনো উপায় স্থির করিতে না পারিয়া শেষে পুত্রকে ডাকিয়া কহিলেন, –বিদেশে যাবি বাবা, কিছু টাকা তো হাতে রাখতে হয়! তা আমার যা দুই একখানা গয়না আছে সেগুলো বেচে ফেল্!

আবদুল্লাহ্ কহিল, –কীই বা এমন আছে, আম্মা, ওগুলো না হয় ঘর বলে থাক। আমি যোগাড় করে নেবখন…।

কোথা থেকে যোগাড় করবি, বাবা?

হালিমা কহিল, –আমার হাতে কিছু আছে, ভাইজান, আমি দিচ্ছি।

আবদুল্লাহ্ কহিল, –না, না, ও টাকা থাক, সময়-অসময়ে কাজে লাগবে…

হালিমা বাধা দিয়া কহিল, –তা বেশ তো, আপনার অসময় পড়েছে, ভাইজান, তাই তো কাজে লাগাতে চাচ্ছি। কেন মিছিমিছি ধার-কর্জ কত্তে যাবেন; এই টাকাই নেন, তারপর খোদা যদি দিন দেন, তখন না হয় আবার আমাকে দেবেন।

মাতাও হালিমার এই প্রস্তাবে মত দিলেন। অগত্যা তাহাকে ভগ্নীর নিকট হইতেই টাকা লইতে রাজি হইতে হইল।

স্থির হইল, সে প্রথম কলিকাতায় গিয়া তাহাদের পুরাতন মেসে বাসা লইবে এবং চাকরির সন্ধান করিবে। আবদুল্লাহ্ আশা করিয়াছিল, কলিকাতায় গেলে নিশ্চয়ই একটা কিনারা করিতে পারিবে। সে বিশাল নগরীতে শত-সহস্র লোক উপার্জন করিতেছে, চেষ্টা করিলে তাহারও কি একটা উপায় হইবে না! আশায়, উৎসাহে সে কলিকাতায় যাইবার আয়োজন করিতে লাগিল।

এমন সময় বরিহাটী হইতে আবদুল কাদেরের এক পত্র আসিল। অনেক দিন পরে তাহার পত্র পাইয়া আবদুল্লাহ্ ক্ষিপ্রহস্তে খুলিয়া এক নিশ্বাসে পড়িয়া ফেলিয়া, আম্মা, আম্মা, হালিমা, হালিমা বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে বাড়ির ভিতর ছুটিয়া আসিল। তাহার ব্যস্ততা দেখিয়া মাতা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, –কী, কী, আবদুল্লাহ্, কী হয়েছে?

আবদুল কাদেরের চাকরি হয়েছে, আম্মা!

আলহামদো লিল্লাহ্! কী চাকরি পেয়েছে, বাবা?

সব্‌রেজিস্ট্রার হয়েছে–এখন উমেদারি কচ্ছে, তাতেও মাসে কুড়ি টাকা করে পাবে, এর পরে পাকা চাকরি পেলে মাসে এক শ কি দেড় শও পেতে পারে।

শুনিয়া মাতা খোদার কাছে হাজার হাজার শোকর করিতে লাগিলেন। হালিমা তাহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল; আনন্দে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। শ্বশুরালয়ে একেবারেই তাহার মন টিকিত না; এইবার খোদার ফজলে স্বামীর যখন চাকরি হইয়াছে, তখন নিজের সংসার গুছাইয়া পাতিয়া লইয়া পছন্দমতো থাকিতে পারিবে, ইহাই মনে করিয়া সে মনে মনে একটা সোয়াস্তি অনুভব করিল।

মাতা একটু ভাবিয়া কহিলেন–তা তুইও ওই চাকরির চেষ্টা কর না বাবা!

আবদুল্লাহ্ কহিল, সেও তো তাই লিখেছে, আর আমাকে বরিহাটীতে যেতেও বলেছে। কিন্তু ওদিকে গেলে যে আর পড়াশুনা করা যাবে না। আমার ইচ্ছে, মাস্টারি করে বি-এ পাস করি। বিএ পাস কত্তে পাল্লে ও সবরেজিস্ট্রারির চাইতে ঢের ভালো চাকরি পাওয়া যাবে–আর না হলে ওকালতিও তো করা যাবে।

সংসারের উপস্থিত টানাটানির কথা ভাবিয়া মাতা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন; কিন্তু পুত্রের সঙ্কল্পের কোনো প্রতিবাদ করিলেন না। কহিলেন, –আচ্ছা, বাবা, যা ভালো বোঝ, তাই কর। খোদা এক রকম করে চালিয়ে দেবেন।

এদিকে আবদুল্লাহর রওয়ানা হইবার সময় নিকট হইয়া আসিয়াছে। সে তাড়াতাড়ি আবদুল কাদেরের পত্রের জবাব লিখিয়া ফেলিল। তাহাতে পিতার মৃত্যু সংবাদ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার শ্বশুরবাড়ির ঘটনা এবং চাকরির সন্ধানে কলিকাতায় যাওয়ার বন্দোবস্তের কথা পর্যন্ত মোটামুটি লিখিয়া দিল এবং কলিকাতায় গিয়া কোথায় থাকিবে, কী করিবে, না করিবে সে সকল বিষয় সেখানে গিয়া পরে জানাইবে, তাহাও বলিয়া রাখিল।

যাত্রাকালে মাতা কহিলেন, –একটা খোশ-খবর নিয়ে যাত্রা করলি বাবা, খোদা বোধহয় ভালো করবেন। বিসমিল্লাহ বলিয়া আশায় বুক বাঁধিয়া আবদুল্লাহ রওয়ানা হইয়া গেল।

কিন্তু যে আশা ও উৎসাহ লইয়া আবদুল্লাহ্ কলিকাতায় আসিল, দুদিনেই তাহা ভঙ্গ হইয়া গেল। কোনো স্কুলেই মাস্টারি জুটিল না। কলিকাতায় এক মাদ্রাসা ভিন্ন তখন আর মুসলমান স্কুল ছিল না; সেখানে একটা চাকরি খালি পাইয়াও, আর একজন বিহারবাসী উমেদারের বিপুল সুপারিশের আয়োজনের সম্মুখে সে তিষ্ঠিতে পারিল না।

এইরূপে কয়েক মাস বেকার কাটিয়া গেল। হালিমা যে কয়টি টাকা দিয়াছিল, তাহাও প্রায় ফুরাইয়া আসিল, অথচ উপার্জনের কোনোই কিনারা হইল না। এদিকে আবদুল্লাহ কাহারো বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজও খুঁজিতেছিল। কিন্তু মুসলমানগণের ঘরে বড়জোর পাঁচ টাকায় আপারা এবং উর্দু পড়াইবার কাজ মিলিতে পারে; তাও আবার ইংরেজি-পড়া লোক দেখিলে লোকে আমল দিতে চায় না। যাহা হউক অনেক অনুসন্ধানের পর অবশেষে মীর্জাপুরের জনৈক ধনী চামড়াওয়ালার বাড়িতে আহার ও বাসস্থানসহ পনর টাকা বেতনে দুইটি বালকের শিক্ষকতা পাইয়া আবদুল্লাহ্ আপাতত হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল।

কিন্তু গৃহশিক্ষকের কাজ করিয়া বি-এ পাস করিবার সুযোগ পাওয়া যাইবে না। প্রাইভেট দিতে হইলে কোনো স্কুলে মাস্টারি করা চাই; আর কলেজে পড়িতে গেলে এ সামান্য বেতনে চলা কঠিন, তবে যদি ফ্রি স্টুডেন্ট হইতে পারে, তাহা হইলে ওই পনরটি টাকা হইতে অন্তত বারটি করিয়া টাকা মাসে মাসে মাকে পাঠাইতে পারিবে। কিন্তু এ বৎসর আর সময় নাই; এখন এইভাবেই চলুক; আগামী গ্রীষ্মের বন্ধের পর কোনো কলেজে ফ্রি পড়িবার জন্য চেষ্টা করা যাইবে। আর ইতোমধ্যে যদি একটা মাস্টারি কোনো স্কুলে জুটিয়া যায়, তবে তো কথাই নাই; নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে পারিবে।

সৌভাগ্যক্রমে চাকরির জন্য আবদুল্লাহকে অধিক দিন বসিয়া থাকিতে হইল না। কলিকাতায় আসার পর সে আবদুল কাদেরের সহিত রীতিমতো পত্র ব্যবহার করিতেছিল। ইতোমধ্যে তাহার নিকট হইতে সংবাদ পাইল যে বরিহাটীর গভর্নমেন্ট স্কুলে একজন মুসলমান আন্ডারগ্রাজুয়েট চাই, বেতন চল্লিশ টাকা। বিলম্বে ফসকাইয়া যাইতে পারে, সুতরাং আবদুল্লাহ্ যেন পত্রপাঠ চলিয়া আসে।

আবার আবদুল্লাহর মন আশার আনন্দে নাচিয়া উঠিল। সেইদিন রাত্রের মেলে রওয়ানা হইয়া পর দিন বরিহাটীতে গিয়া উপস্থিত হইল। আবদুল কাদের তাহাকে দেখিয়া এত খুশি হইল যে, সে আবদুল্লাহূকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া কহিল, –ভাই, খোদার মরজিতে যদি তুমি এ চাকরিটা পাও, তবে আমরা দুজনে এক জায়গাতেই থাকতে পারব।

আবদুল্লাহ কহিল, –দাঁড়াও ভাই, আগে পেয়েই তো নিই। তুমি যে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল গোছ কচ্ছ।

আরে না না, শুনলাম এবার নাকি ডিরেক্টার আপিস থেকে চিঠি এসেছে, একজন মুসলমান নিতেই হবে। আর ক্যান্ডিডেট কোথায়? থাকলেও ভয় নেই খোদার ফজলে। আমাদের মুন্সী সাহেবের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের খুব খাতির–আর তিনিই স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট কিনা। ও এ্যাপয়েন্টমেন্ট তারই হাতে। মুন্সী সাহেবকে সঙ্গে দিয়ে তোমাকে কালই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, দাঁড়াও।

আবদুল কাদেরের আশাপূর্ণ কথায় আবদুল্লাহ্ মনে মনে অনেকটা বল পাইল। সে ভাবিল, –চল্লিশ টাকা তাহার জন্য এখন খুবই যথেষ্ট হইবে; বাসা খরচ পনর টাকা করিয়া লাগিলেও পঁচিশ টাকা সে মাকে পাঠাইতে পারিবে–আর আবদুল কাদেরও হালিমাকে মাসে মাসে পাঁচটি করিয়া টাকা পাঠাইতেছে। ওঃ, খোদা চাহে তো সংসারের আর কোনোই ভাবনা থাকিবে না।

এইরূপ কল্পনা-জল্পনা করিতে করিতে আবদুল্লাহ আহারাদি করিয়া একখানি দরখাস্ত লিখিয়া হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করিতে চলিল। স্কুলে উপস্থিত হইয়া জনৈক ভৃত্যকে হেডমাস্টারের কামরা কোথায় জিজ্ঞাসা করিল। সে একবার আবদুল্লাহর আপাদমস্তক ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া কহিল, –একখানা কাগজে নাম এবং কী জন্য দেখা করিতে চাহেন তাহা লিখিয়া দিতে হইবে। আবদুল্লাহ্ তাহাই লিখিয়া দিল। কিছুক্ষণ পরে ভৃত্যটি আসিয়া তাহাকে হেডমাস্টারের কামরায় লইয়া গেল।

আবদুল্লাহ্ কামরায় প্রবেশ করিতেই হেডমাস্টার চেয়ার হইতে উঠিয়া সবেগে তাহার সহিত করমর্দন করিলেন এবং হাতমুখ নাড়িয়া অদ্ভুত বিকৃত উচ্চারণে বলিয়া ফেলিলেন, আইয়ে জনাব, বয়ঠিয়ে, আপ কাঁহা সে আসতে হ্যাঁয়?

আবদুল্লাহ্ বিনয়ের সহিত কহিল, –স্যার, আমি বাঙালি, আমার সঙ্গে বালাতে কথা বলতে পারেন।

হেডমাস্টার একটু ঘাড় নিচু করিয়া তাহার নাসিকার মধ্যস্থিত চশমাটির উপর হইতে আবদুল্লাহর দিকে নেত্রপাত করিয়া কহিলেন, –ওঃ হো! আপনি বাঙালি? বেশ, বেশ, আপনার পোশাক দেখে আমি ঠাউরেছিলাম যে, আপনি দিল্লি কিংবা লাহোর না হোক, অন্তত ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে এসেছেন; সেখানকার নবাব ফ্যামিলির লোকেরা এই রকমই পোশাক পরেন কিনা!

আবদুল্লাহ্ একটুখানি হাসিয়া কহিল, –কেন, মুসলমানেরা সব জায়গাতেই তো এই রকম আচকান আর পায়জামা পরে…।

কই মশায়, আমি তো দেখতে পাই এখানে কেউ টুপিটা পর্যন্ত পরে না। তা এরা সব—এই–ছোটলোক কিনা, চাষাভুষো; এসব পোশাক ওরা কোত্থেকে পাবে!

আবদুল্লাহ কহিল, হ্যাঁ, তা সম্ভান্ত লোকমাত্রেই এইরকম পোশাক ব্যবহার করেন…

তা বৈকি! তবে আপনাদের মতো সম্ভ্রান্ত লোক এ অঞ্চলে কটিই বা আছেন!

আবদুল্লাহ্ একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, –মশায়ের কাছে একটা দরবার নিয়ে এসেছিলাম…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি বুঝি এই পোস্টটার জন্যে স্ট্যান্ড কত্তে চান? তবে কি জানেন, এতে মাইনে অতি সামান্য, প্রসপেক্টও কিছু নেই, আপনাদের মতো লোকের কি আর এসব চাকরি পোষাবে? আমি তাই ভাবছি।

আমাদের অবস্থা নিতান্ত মন্দ স্যার। বি-এ পড়ছিলাম, হঠাৎ আমার ফাদার মারা গেলেন, কাজেই আর পড়াশুনো হল না, আর এখন চাকরি ছাড়া সংসার চালাবার উপায় নেই…

ওঃ বটে? তবে তো বড়ই দুঃখের বিষয়! তা আপনি একটু চেষ্টা কল্লে খুব ভালো চাকরিই পেতে পারেন। ডিপুটি না হোক, সব্‌ডিপুটি তো চট করে হয়ে যাবেন। কেন মিছিমিছি এই সামান্য মাইনের চাকরি করবেন, এতে না আছে পয়সা, না আছে ইজ্জত…

আমার তেমন মুরব্বি নেই স্যার, আর ডিপুটি সবুডিপুটি ওসব বি-এ পাস না হলে হয় না…

কে বলেছে আপনাকে? আপনাদের বেলায় ও-সব কিছুই লাগে না। একবার গিয়ে দাঁড়ালেই হল। আজকাল যে সব গভর্নমেন্ট সার্কুলার বেরুচ্ছে, মুসলমান হলেই সে চাকরি পাবে, তা কি আপনি জানেন না?

শুনেছি বটে, কিন্তু মুসলমান হলেই তো হয় না; উপযুক্ত যোগ্যতা থাকা চাই, আবার যোগ্য লোকদের মধ্যেও কমপিটিশন আছে। যার ভালো সুপারিশ নেই, তার পক্ষে যোগ্য হলেও ওসব বড় চাকরির আশা করা বিড়ম্বনা।

হেডমাস্টার বামপার্শ্বস্থ জানালার বাহিরে দৃষ্টিস্থাপন করিয়া টেবিলের উপর অঙ্গুলির আঘাত করিতে করিতে কহিলেন, –ভুল ভুল! এমনি করেই আপনারা নিজেদের প্রসপেক্ট মাটি করেন।

তাহার পর আবদুল্লাহর দিকে চাহিয়া কহিলেন, –আমি আপনার ভালোর জন্যেই পরামর্শ দিচ্ছিলাম, একটু চেষ্টা কল্লেই আপনি এর চেয়ে ভালো চাকরি পেতেন। সরেজিস্ট্রারিও তো মাস্টারির চাইতে অনেক ভালো। এই তো সেদিন আপনাদেরই জাতের একজন সব্‌রেজিস্ট্রারি পেয়ে গেল, সে তো ফোর্থ ক্লাস পর্যন্তও পড়ে নি। এক কলম ইংরেজি লিখতে পারে না, কওয়া তো দূরের কথা। হাতের লেখাও একেবারে ছেলে মানুষের মতো, তবু সাহেব কেবল মুসলমান দেখেই তাকে চাকরি দিয়েছেন।

আপনি কি আবদুল কাদেরের কথা বলছেন, –এই মাস তিন চার হল এপ্রেন্টিস্ হয়েছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তারই কথা বলছি–আপনি তাকে জানেন তা হলে?

জানি একটু একটু।

তবে দেখুন দেখি, সে এই বিদ্যে নিয়ে চাকরিটা পেলে, আর আপনি বি-এ পর্যন্ত পড়ে ডিপুটি হতে পারবেন না!

তার সম্বন্ধে বোধহয় আপনি ঠিক খবর পান নি, স্যার। সে এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়েছে, আর এন্ট্রান্স পর্যন্ত পড়া অনেক হিন্দুই যখন সরেজিস্ট্রার হতে পেরেছেন, তখন সে হিসেবে আবদুল কাদেরকে তো অযোগ্য বলা যায় না। আর এদিকে সে ইংরেজিও খুব ভালোই জানে, হাতের লেখাও চমৎকার। এই দেখুন, তার একখানা চিঠি আমার পকেটে ছিল, পড়ে দেখতে পারেন।

হেডমাস্টার চিঠিখানি পরম আগ্রহের সহিত হাত বাড়াইয়া লইলেন এবং ঘাড় উঁচু করিয়া দূর হইতে চশমার ভিতর দিয়া গভীর মনোযোগের সহিত চিঠিখানি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিলেন। পরে চশমার উপর দিয়া আবদুল্লাহর দিকে তাকাইয়া কহিলেন, বটে? এ তো দেখছি বেশ লেখা! আর ইংরেজিও খাসা; কে বলতে পারে এন্ট্রান্স পড়া লোকের লেখা! একেবারে বি-এ পাসের মতো বলেই বোধ হচ্ছে! আমি নিশ্চয়ই আর কারুর কথা শুনেছিলাম। কী জানেন, আপনাদের নামগুলো সকল সময় মনে থাকে না, তাই কার কথা। শুনি আর কাকে মনে করি। তা যাক, আপনি তা হলে এই পোস্টের জন্যেই এ্যাঁপ্লাই করবেন, স্থির করেছেন?

হ্যাঁ, সার এ্যাপ্লিকেশন ও সঙ্গে এনেছি। বলিয়া আবদুল্লাহ দরখাস্তখানি পেশ করিল। হেডমাস্টার সেখানি এক নজর দেখিয়া লইয়া টেবিলের উপর চাপা দিয়া রাখিলেন এবং কহিলেন–বেশ, এখন রইল আপনার এ্যাপ্লিকেশন । এখনো এ্যাপয়েন্টমেন্টের দেরি আছে। সময়মতো খবর পাবেন।

আবদুল্লাহ্ কহিল, –তবে এখন উঠি, স্যার। দয়া করে মনে রাখবেন, এটা পেলে আমার বড় উপকার হবে।

তা নিশ্চয়ই আপনাকে আর ও সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে না, আমার যতদূর সাধ্য আপনার জন্যে চেষ্টা করব।

আবদুল্লাহ্ তাহাকে ধন্যবাদ দিয়া বিদায় হইল। সেদিন সন্ধ্যার পর আকবর আলীর বৈঠকখানায় আবদুল্লাহর উমেদারির প্রথম অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আলোচনা চলিতেছিল। হেডমাস্টারের সঙ্গে তাহার যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল তাহা সবিস্তারে শুনিয়া আকবর আলী কহিলেন, — আপনি খুব টিকে গিয়েছেন, যা হোক।

আবদুল্লাহ কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, — টিকে গেলাম কেমন?

লোকটার চেষ্টা ছিল, আপনাকে খুব আমড়াগাছী করে ও ছোট চাকরি যাতে আপনি নিতে না চান তাই করা। দেখুন না, প্রথমেই আপনাকে নবাব ফ্যামিলির সঙ্গে তুলনা করে দিল–তারপরে বললে, মুসলমান হলেই বড় চাকরি পায়, পাসটাসের দরকার হয় না–

এইসব শুনেটুনে হয়তো আপনার মাথা ঘুরে যেত…।

তা আমাকে ভোগা দিয়ে ওঁর কী লাভ? এ পোস্টে তো মুসলমানই নেবে বলে এ্যাঁভার্টাইজ করেছে…

তা করুক। যদি মুসলমান ক্যান্ডিডেট কেউ এ্যাঁপ্লাই করে, তা হলে তো শেষটা হিন্দুই ওটা পাবে।

আবদুল্লাহ্ এতটা তলাইয়া দেখে নাই। এক্ষণে আকবর আলী সাহেবের নিকট গূঢ়ার্থ অবগত হইয়া সে একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। রাত্রে শুইয়া শুইয়া সে অনেকক্ষণ ভাবিল, পরস্পর সহৃদয়তার এমন অভাব যেখানে সেখানে মানুষ শান্তিতে বসবাস করে কেমন করিয়া? আর যদি সে এ চাকরি পায়, তাহা হইলে এরূপ লোকের অধীনে কাজ করিয়া তো সুখ পাইবে না! যা হোক, খোদা যা করেন, ভালোই করিবেন, এই বলিয়া সে আপাতত মনকে প্রবোধ দিল।

পরদিন আকবর আলী তাহাকে সঙ্গে লইয়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেলেন। সাহেব কোনো অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইতে পারিলেন না, তবে যদি যোগ্যতর লোক না পাওয়া যায়, তাহা হইলে আবদুল্লাহর বিষয়ে বিবেচনা করিবেন বলিয়া ভরসা দিলেন। আবদুল্লাহ্ সেই রাত্রেই কলিকাতায় ফিরিয়া গেল।

যথাসময়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কুঠিতে কমিটির অধিবেশন হইল। ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং প্রেসিডেন্ট, হেডমাস্টার সেক্রেটারি এবং একজন ডিপুটি, একজন উকিল ও একজন স্থানীয় জমিদার, এই তিনজন বাকি মেম্বর। আবদুল্লাহ্ ব্যতীত আর একজন মাত্র মুসলমান দরখাস্ত দিয়াছে; সে লোকটি এফ-এ পাস এবং কিছুদিন অন্যত্র মাস্টারিও করিয়াছে। হেডমাস্টার তাহাকেই উপযুক্ত বলিয়া পছন্দ করিলেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আবদুল্লাহকেই অধিক যোগ্য বলিয়া মত দিলেন। হেডমাস্টার কহিলেন–উহার শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু ইহার নাই। সাহেব কহিলেন, এ ব্যক্তি বি-এ পর্যন্ত পড়িয়াছে, সুতরাং ও ব্যক্তি অপেক্ষা কিছু বিদ্বান, এবং ইহার হাতের লেখাও সুন্দর, দেখিলে লোকটিকে বেশ দক্ষ বলিয়া ধারণা হয়। তাহার পর তিনি মেম্বরগণের মতামত জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন যে, তাহার মতের অপেক্ষা না করিয়া মেম্বরগণ স্বাধীনভাবে মত দিতে পারেন। অবশ্য যাহার পক্ষে ভোট অধিক হইবে, সেই চাকরি পাইবে, তা সাহেব নিজে যাহাকেই পছন্দ করুন না কেন! ফলে কিন্তু মেম্বরত্রয় সাহেবের মতেই মত দিয়া ফেলিলেন। আবদুল্লাহ্ চাকরি পাইল।

কুঠি হইতে বাহিরে আসিয়া পথে চলিতে চলিতে জমিদার বাবুটি হেডমাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি সাহেবের বিরুদ্ধে ও লোকটার জন্যে এত উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন কেন। হেডমাস্টার কহিলেন, –আরে মশায়, আপনারা কেউ আমার দিকে ভোট দিলেন না, তা আর কী করব! আমারই ভুল হয়ে গেল। আর সাহেব যে ওর দিকে ঝুঁকে পড়বেন, তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আগে থেকে আপনাদের যদি একটু বলে রাখি, তা হলে আজ ভোটে ঠিক মেরে দিয়েছিলাম মশায়। সাহেব লোক ভালো, মেম্বরদের মত দেখলে তিনি কখনই জেদ কত্তেন না।

উকিল বাবুটি জিজ্ঞাসা করিলেন, –তা ও দু ব্যাটাই তো নেড়ে, ওর আবার ভালো মন্দ কী? একটা হলেই হল।

হেডমাস্টার কহিলেন–আরে না মশায়, এর ভেতর কথা আছে। এ-লোকটা পি-এল লেকচার কমপ্লিট করেছে, এখন একজামিন দিয়ে পাস কল্লেই চাকরি ছেড়ে দেবে, আমি সঠিক খবর জানি। ছেড়ে দিলে একটা প্লি হত, নেড়েগুলো স্টিক করে না তাতে কাজের বড় ডিসলোকেশন হয়। তারপর নিজেদের একটা লোক নেওয়া যেত।

উকিল বাবুটি একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, –আপনি একটু আগে কেন বলেন নি? আমরা তো এর কিছুই জানি নে। জানলে নিশ্চয়ই এর জন্যে ভোট দিতাম। বলা উচিত ছিল আপনার আগে।

হেডমাস্টার কহিলেন, কে জানে মশায়, এত গণ্ডগোল হবে! ভেবেছিলাম, আমি যাকে ফিট বলে দেব, সাহেব তাতেই রাজি হবে। যাক, ওর বরাতে আছে, আমি কী করব!

.

১৯.

একবালপুরে সৈয়দ-বাড়িতে আজ মহা ধুম পড়িয়া গিয়াছে। আবদুল মালেকের শ্বশুর শরীফাবাদের হাজী বরকতউল্লাহ সম্প্রতি মক্কা শরীফ হইতে ফিরিয়া বৈবাহিকের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন।

হাজী সাহেব বড় যে-সে লোক নহেন; কি ভূসম্পত্তিতে, কি বংশমর্যাদায়, বরিহাটী জেলায় আশরাফ সমাজে তাহার সমকক্ষ আর কেহ নাই। এমনকি, আমাদের সৈয়দ আবদুল কুদ্দুসও তাহার সহিত কুটুম্বিতা করিতে পারিয়া আপনাকে ধন্য মনে করিয়াছিলেন। করিবারই কথা; কেননা হাজী সাহেবের পিতা শরীয়তুল্লাহ্ মাত্র পনের দিনের দারোগাগিরির দৌলতে যখন এক বিপুল সম্পত্তি খরিদ করিয়া দেশের মধ্যে একজন গণ্যমান্য লোক হইয়া উঠিয়াছিলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তাহার শরাফতের দরজাও অতিমাত্রায় বাড়িয়া গিয়াছিল, এবং যদিও লোকে বলে যে, পঞ্চদশ দিবসে ভোরবেলায় ওযু করিবার সময় এক মস্ত বড় ডাকাতি-ব্যবসায়ী জমিদার সদ্য-খুন-করা লাশ সমেত তাহার নিকট ধরা পড়িয়া হাজার। টাকা ঘুষ কবুল করিয়াছিল এবং টাকার তোড়া আনিবার জন্য যে লোকটিকে সে বাড়িতে পাঠাইয়াছিল, সে দিশাহারা হইয়া টাকার পরিবর্তে মোহরের তোড়া আনিয়া নূতন দারোগা সাহেবকে দিয়া ফেলিয়াছিল এবং তাহারই বলে শরীয়তুল্লাহ পঞ্চদশ দিনের চাকরিতে ইস্তফা দিয়া হঠাৎ জমিদারি ক্রয় করিয়া বসিয়াছিলেন, তথাপি তাহার সাহেবজাদা বরকল্লাহ্র পক্ষে বরিহাটী জেলায়, এমনকি বঙ্গদেশের মধ্যে একেবারে অতি-আদি শরীফতম ঘর বলিয়া পরিচিত হইতে কোনোই বাধা-বিঘ্ন ঘটে নাই!

সুতরাং একে তো বরকতউল্লাহ্ মস্ত বড় মানী লোক, তাহার উপর আবার এক্ষণে হাজী হইয়া সমাজে তাঁহার সম্ভ্রম আরো বাড়িয়া গিয়াছে; কাজেই তাহার শুভাগমনে সৈয়দ-বাড়ি আজ পবিত্র হইয়াছে এবং মনিব-চাকর, ছোট-বড় সকলেই তাহার উপযুক্ত খাতির-তোয়াজ করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গিয়াছে।

বেলা প্রায় তিন প্রহরের সময় আহারাদি শেষ করিয়া সৈয়দ সাহেব বৈবাহিকের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শুনিতে বসিলেন। হাজী সাহেব মক্কা মওয়াজ্জমা, মদিনা মনুওয়ারা, দামেস্ক, বাগদাদ প্রভৃতি আরবের বহু পবিত্র স্থান দর্শন করিয়া আসিয়াছিলেন, একে একে সে সকলের বর্ণনা করিয়া তিনি সৈয়দ সাহেবকে চমকৃত ও ঈর্ষান্বিত করিয়া তুলিলেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে দান করিয়া তাহাদের জীবন ধন্য করিবার জন্য হাজী সাহেব পুণ্যভূমি হইতে নানা প্রকার পবিত্র বস্তু সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন। বৈবাহিক তাহা হইতে বঞ্চিত হইলেন না; হাজী সাহেব তোরঙ্গ খুলিয়া তাহাকে কিঞ্চিৎ শুনা উটের গোশত, একটুখানি জমজমের পানি এবং কাবার গেলাফের এক টুকরা বাহির করিয়া দিলেন। সৈয়দ সাহেব এই সকল পবিত্র বস্তু পাইয়া যে কী অপার আনন্দ লাভ করিলেন, তাহা আর বলিয়া শেষ করিতে। পারিলেন না। তিনি কহিতে লাগিলেন, –ভাই সাহেব, আপনি এ গরিবের কথা মনে করে। যে কষ্ট করে এ-সব পাক চিজ বয়ে এনেছেন, তাতে আমি বড়ই সরফরাজ হলাম। কী বলে আর দোয়া করব ভাইজান, খোদা আপনার নসিব কোশাদা করুন! খাস করে এই যে গেলাফ-পাকের কাপড়টুকু আপনি দিলেন, এতে আমাদের ঘর আজ পাক হয়ে গেল! এ চিজ যার ঘরে থাকে তার যত মুসিবত সব কেটে যায়। এমন চিজ কি আর দুনিয়াতে আছে? আহা, চ বলিয়া তিনি কাপড়ের টুকরাটিতে বহুত তাজিমের সঙ্গে বোসা (চুম্বন) দিলেন, এবং উহা দুই চক্ষে, কপালে এবং বক্ষে ঠেকাইয়া অতি যত্নে তুলিয়া রাখিলেন।

তাহার পর জমজমের পানি একটুখানি শিশি হইতে ঢালিয়া লইয়া পান করিলেন এবং দেহে ও মনে পরম তৃপ্তি ও এক অভিনব পবিত্রতা অনুভব করিয়া আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিলেন।

কিন্তু এক্ষণে উটের গোশতটুকু লইয়া কী করা যায়? উহা তো শুকাইয়া একেবারে হাড় হইয়া গিয়াছে; খাওয়া যাইবে না। হাজী সাহেব কহিলেন, –ইহা কোরবানির গোশত; খাস মক্কা মওয়াজ্জমাতেই কোরবানি হয়েছিল, এর বরকতই আলাদা। এটুকু ঘরে রাখাই ভালো, কারুর ব্যারাম-পীড়ার সময় কাজে লাগবে।

সৈয়দ সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, –কী করতে হয়?

হাজী সাহেব কহিলেন–কিছু না, একটুখানি ঘষে বিসমিল্লাহ্ বলে খাইয়ে দিলেই হল।

সৈয়দ সাহেব শুকনা মাংসখণ্ডটিও সযত্নে তুলিয়া রাখিলেন।

কথায়-বার্তায় ক্রমে আসর-এর আযান পড়িয়া গেল। উভয়ে ওযু করিয়া মসজিদের দিকে চলিলেন। মসজিদটি এখনো অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়িয়া আছে দেখিয়া হাজী সাহেব একটু আশ্চর্যান্বিত হইয়া কহিলেন, –এ কী! আপনি এ কাজ এতদিন ফেলে রেখে দিয়েছেন?

সৈয়দ সাহেব একটু বিষাদের সুরে কহিলেন, –না, ভাই সাহেব, ফেলে রেখে দিই নি, পেরে উঠছি নে।

বাঃ, আপনার মতো লোকের না পেরে ওঠার তো কথাই নয়। এতে যে আপনার গোনাহ্ হচ্ছে তা কি বুঝতে পাচ্ছেন না! খোদার কাজে হাত দিয়ে এমন করে ফেলে রাখা এতে যে হেকারত করা হচ্ছে।

তা তো বুঝি ভাই সাহেব; আজ প্রায় তিন বৎসর হল কাজে হাত দিইছি, বছরখানেক কাজ চালিয়ে এই পর্যন্ত করে তুলেছি। কিন্তু গেল দুই বছর থেকে আমার যে কী দশা ধরেছে, কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পাচ্ছি নে। কী বলব ভাই সাহেব, এর জন্যে আমার রাত্রে ঘুম হয় না। এ দিকে ব্যারাম-পীড়ায় কাতর হয়ে পড়েছি, কেবল ভয় হয়, কোন দিন দম বেরিয়ে যাবে, এ-কাজটা খোদা আমার দ্বারা বুঝি আর করাতে দেবেন না–কী যে কেসমতে আছে, তা সেই পরওয়ারদেগারই জানেন!

হাজী সাহেব গম্ভীর হইয়া কহিলেন, –আপনার মুখে এমন কথা শোভা পায় না, ভাই সাহেব। খোদা আপনাকে যা দিয়েছেন, তা যদি খোদার কাজে না লাগালেন, তবে আখেরাতে কী জবাব দেবেন? বিষয়-সম্পত্তিই বলুন, আর ধন-দৌলতই বলুন, কিছুই তো আর সঙ্গে যাবে না। ও-সব খোদার কাজেই লাগানো উচিত।

সৈয়দ সাহেব গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, –ঠিক বলেছেন ভাই সাহেব, এত দিন আমি বড়ই গাফেলী করেছি–আল্লাহ্ মাফ কবৃনেওয়ালা–আমি আর দেরি করব না, যেমন করে পারি, কাজটা শেষ করে ফেলব।

আসরের নামায বাদ হাজী সাহেব মসজিদের ভিতরে দাঁড়াইয়া উহার কোথায় কিরূপ কাজ হইয়াছে, তাহার সমালোচনা করিতে লাগিলেন! তিনি আরবের কোথায় কোন্ মসজিদে কবে নামায পড়িয়াছিলেন, তাহার কোন্ জায়গাটিতে কিরূপ ধরনের কারুকার্যের বাহার দেখিয়াছেন, সে সকল তন্নতন্ন করিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন এবং সৈয়দ সাহেব একাগ্রমনে শুনিতে শুনিতে সেই সকলের চিত্র মনের মধ্যে আঁকিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার পর বাহিরে আসিয়া বারান্দাটি কত বড় হওয়া উচিত, তাহার ছাদ কিরূপ হইবে এবং কয়টি থাম দিলে মানাইবে; বারান্দার সম্মুখে বেশ কোশাদা রকম একটা রোয়াক দিলে ভালো হয়–এই রকমই তিনি অনেক ভালো ভালো জায়গার মসজিদে দেখিয়া আসিয়াছেন– এইরূপ নানাপ্রকার মত প্রকাশ করিলেন।

বৈবাহিকের সহিত এই সকল বিষয়ের আলোচনার পর হইতে এই মসজিদটিই সৈয়দ সাহেবের একমাত্র চিন্তনীয় বিষয় হইয়া উঠিল। পরদিন হাজী সাহেব রওয়ানী হইয়া গেলে পরই তিনি আবদুল মালেককে ডাকিয়া কহিলেন, বাবা, মসজিদটা তো আর ফেলে রাখা। যায় না।

আবদুল মালেক কহিল, –তা কী করবেন, এরাদা করেছেন?

আরো গোটা দুই তালুক বেচা ছাড়া তো আর উপায় দেখছি নে। ওই রসুলপুরের তোমার আম্মার দরুন তালুকটা আর মাদারগঞ্জেরটা বেচব মনে কচ্ছি।

আবদুল মালেক মনে মনে ভারি চটিয়া গেল। পিতা আর কিছুদিন বাঁচিয়া থাকিলে তালুক-মুলুক সবই ছারেখারে যাইবে, তাহাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকিবে না। সে একটু হতাশভাবে কহিল, –তা হলে ধরুন গে আপনার থাকবে কী?

পিতা একটু বিরক্ত হইয়া কহিলেন, –কেন? যা থাকবে, তা বুঝেসুঝে চালাতে পাল্লে তোমাদের আর ভাবনা কী? আর কদ্দিন! এ কাজটা আমি শেষ করেই যাব, বাকি খোদার মরজি।

আবদুল মালেক আবার কহিল, –যা আছে, তাই ধরুন গে আপনার ভাগ হয়ে গেলে আমরা কীই-বা পাব, তার ওপর আবার…

পিতা অসহিষ্ণুভাবে বাধা দিয়া কহিলেন, তোমরা খোদার ওপর তওয়াক্কল রাখতে একেবারেই ভুলে যাও। সেই জন্যেই তোমাদের মন থেকে ভাবনা ঘোচে না। তোমার ভাবনা কী বাবা? তোমার শ্বশুরের বিষয়-আশয়ের খবর রাখ কি? খোদা চাহে তো বড় বউমার যেটা পাওয়া যাবে, তাতেই তো খোশ-হালে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আর তোমার বোনেরা তো একরকম পার হয়ে গিয়েছে–ছোট যে দুটো আছে, আমি যদি বিয়ে দিয়ে না যেতে পারি, তবে তোমরাই দেখেশুনে দিও। তেমন ঘরে পলে হয়তো তোমাদের সম্পত্তিতে হাত নাও পড়তে পারে–একটু বুঝেসুঝে সংসার কত্তে হয়, বাবা! আর তোমার ভাইদের–আবদুল কাদেরের কথা ছেড়ে দাও, সে তো সবুরেজিস্ট্রার হয়েছে, তার এক রকম চলে যাবে। আর ওই ছোট ছেলেগুলো রয়েছে, তোমরা দেখেশুনে ওদের বিয়ে দিও, তা হলে আর কারুর কোনো ভাবনা থাকবে না, বাকি খোদার মরজি।

পুত্রকে এইরূপে বুঝাইয়া, খোদার উপর তওয়াক্কল রাখিয়া সংসার চালাইবার কৌশল শিখাইয়া দিয়া সৈয়দ সাহেব দুইটি তালুক বিক্রয়ের বন্দোবস্তে লাগিয়া গেলেন। এবার যাহাতে বিক্রয়ের পূর্বে জানাজানি হয়, সেইজন্যে তিনি ভোলানাথ সরকারকে গোপনে ডাকিয়া তাহার হস্তে তালুক দুইটি ন্যস্ত করিবেন, স্থির করিলেন। তিনি মনে মনে আশা করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, তালুক দুইটির মূল্য যে দশ হাজার টাকা হইবে, তাহাতে আর ভুল নাই। কিন্তু সরকার মহাশয় আসিয়া কাগজপত্র দেখিয়া সাত হাজার পর্যন্ত দিতে রাজি হইলেন। সৈয়দ সাহেব অনেক ঝুলাঝুলি করিলেন, কিন্তু ভোলানাথ সেই সাত হাজারই তাহার শেষ কথা বলিয়া উঠিয়া গেলেন।

সৈয়দ সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, আর কোনো খরিদ্দারের সন্ধান করা কর্তব্য কি না। তালুক দুটি নিতান্ত মন্দ নহে; বৎসরে প্রায় চার-পাঁচ শত টাকা আয় আছে; এত সস্তায় উহা ছাড়িয়া দিতে তাহার মন সরিতেছিল না। কিন্তু অন্যত্র খরিদ্দার দেখিতে গেলে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সহজেই জানাজানি হইয়া পড়িবে; পাছে তাহাদের মধ্য হইতে কেহ কৌশলে খরিদ করিয়া বসে, তাহা হইলে আর সৈয়দ সাহেবের মুখ দেখাইবার যো থাকিবে না। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া অবশেষে তিন তিনটি হাজার টাকার লোভ তাহাকে সংবরণ করিতেই হইল এবং সাত হাজারেই সম্মত হইয়া দলিল রেজিস্টারি করিবার জন্য তিনি ভোলানাথ সরকারকে সঙ্গে লইয়া স্বয়ং বরিহাটী রওয়ানা হইলেন।

সদরে সম্প্রতি একটি জয়েন্ট আপিস খোলা হইয়াছে, সেইখানেই তাহাদিগকে দলিল রেজিস্টারি করিতে হইবে। যেদিন প্রাতে তাহাদের নৌকা বরিহাটীর ঘাটে আসিয়া ভিড়িল, সেই দিনই বেলা সাড়ে দশটার সময় তাহারা দলিলাদি লইয়া জয়েন্ট আপিসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আপিসের আমলাগণ তাহাদিগকে চিনিল; সুতরাং তাহারা এজলাসের এক পার্শ্বে দুইখানি চেয়ার আনাইয়া যত্ন করিয়া তাহাদিগকে বসাইল। সবুরেজিস্ট্রার তখনো আসেন নাই; আসিবার বড় বিলম্বও নাই।

একটু পরেই সব্‌রেজিস্ট্রার আসিলেন। এজলাসে উঠিয়াই চেয়ারে উপবিষ্ট মূর্তি দুইটি দেখিয়া তিনি একটুখানি থমকাইয়া দাঁড়াইলেন; পরক্ষণেই অগ্রসর হইয়া তিনি সৈয়দ সাহেবকে কদমবুসি করিয়া ফেলিলেন!

কে কে! আবদুল কাদের? তুমি? তুমি এখানে? অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া সৈয়দ সাহেব এই কথা কয়টি বলিয়া উঠিলেন।

ভোলানাথ সরকার কহিলেন, বাঃ আপনি এখানে এসেছেন, তা তো আমরা কেউই জানি নে! কর্তাও তো জানেন না দেখতে পাচ্ছি!

আবদুল কাদের কহিল, –আমি আজ মাত্র তিন দিন হল বদলি হয়ে এসেছি। আপনার তবিয়ত ভালো তো, আব্বা? কিন্তু আবার মনে এতক্ষণে একটা তুমুল আন্দোলন উঠিয়া পড়িয়াছে। আজ প্রায় তিন বৎসর পরে পিতা-পুত্রের সাক্ষাৎ হইয়াছে; কুশল-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দূরে থাকুক, তিনি ভয়েই অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। আবদুল কাদের ছেলেটি যেরূপ বেতরো গোছের, তাহাতে হয়তো সে বিষয়-বিক্রয় লইয়া একটা গণ্ডগোল উপস্থিত করিবে এবং তাহাতে অনর্থক একটা জানাজানি কেলেঙ্কারি ব্যাপার দাঁড়াইবে, এই ভাবিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, আমাদের একটা কাজ ছিল; কিন্তু কথাটা তোমাকে একটু নিরালা বলতে চাই আগে…

আবদুল কাদের কহিল, –কাজটা কী আব্বা? কোনো দলিলটলিল রেজিস্টারি কত্তে হবে কি?

হ্যাঁ, তাই বটে, তবে…

তা হলে আমার বাসাতেই চলুন…

ভোলানাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, –কোথায় বাসা?

এই কাছেই বোর্ডিঙে আবদুল্লাহর ওখানে এখন আপাতত আছি, এখনো বাসা পাই নি।

আচ্ছা আমি কর্তার সঙ্গে একটু পরামর্শ করে পরে যাচ্ছি, এই বলিয়া ভোলানাথ সৈয়দ সাহেবকে বারান্দার এক প্রান্তে লইয়া গেলেন।

আবদুল কাদেরের সন্দেহ হইল, ইহার ভিতর এমন কোনো কথা আছে, যাহা ইহারা তাহার নিকট প্রকাশ করিতে ইতস্তত করিতেছেন। দলিল রেজিস্টারি করিতে গেলে তো সব কথাই জানা যাইবে; কিন্তু যদি ইহারা অতিরিক্ত ফী দিয়া অন্যত্র রেজিস্টারি করিতে যান? সরকার মহাশয় বুঝি আব্বার সঙ্গে সেই পরামর্শই করিতে গেলেন। আবদুল কাদের এইরূপ চিন্তা করিতেছে, এমন সময় ভোলানাথ আসিয়া কহিলেন, দেখুন মেজ মিঞা, কর্তার মত বদলে গিয়েছে। তিনি একখানা দলিল রেজিস্টারি কত্তে এসেছিলেন বটে কিন্তু সেটা আর করবেন না।

কেন?

এর ভেতরে অনেক কথা আছে, তা অন্য সময় বলব। এখন আমাকে নৌকায় ফিরে। যেতে হচ্ছে–কর্তা চলে গিয়েছেন, তিনি আমাকে বলে গেলেন, এখনই নৌকা খুলতে হবে।

বাঃ এসেই অমনি চলে যাবেন। সে কেমন কথা!

বাড়িতে অনেক জরুরি কাজ ফেলে এইছি–দলিলখানা রেজিস্টারি হলেই আমরা নৌকা খুলতাম। এখন যখন রেজিস্টারি হলই না, তখন আর দেরি করে ফল নেই; যত শিগগির বাড়ি পৌঁছুতে পারি, ততই ভালো!

আচ্ছা, তা যেন হল; কিন্তু হঠাৎ দলিল রেজিস্টারি করতে আসা আবার হঠাৎ মত ফিরিয়ে চলে যাওয়া, এর মানে তো কিছু বুঝতে পাচ্ছি নে; বোধহয় আমাকে দেখেই আপনারা মত ফিরিয়ে ফেললেন…

সরকার মশায় তাড়াতাড়ি কহিলেন, –আপনাকে দেখে কেন মত ফেরাব? তবে কি জানেন, কর্তার মতের ঠিক নেই…।

আবদুল কাদের বাধা দিয়া কহিল, –না, নিশ্চয়ই এর ভেতর এমন কোনো কথা আছে, যা আমাকে আপনারা লুকুচ্ছেন–কোনো বিষয় বিক্রি টিক্রি নয় তো?

এই কথায় ভোলানাথ একটু হাসিয়া উঠিলেন; কিন্তু সে হাসির একান্ত শুষ্কতা উপলব্ধি করিয়া আবদুল কাদেরের মনে সন্দেহ বদ্ধমূল হইয়া গেল। ভোলানাথ কহিলেন, –আপনি মিছে সন্দেহ কচ্ছেন, মেজ মিঞা…।

না না, মিছে নয়। সেবার কয়েকটা তালুক বিক্রি করবার সময় আমি আবার সঙ্গে খুব একচোট চটাচটি করেছিলাম কিনা, তাই বোধহয় এবার আমার কাছ থেকে কথাটা লুকুচ্ছেন। নইলে বেশ ভালো মানুষটির মতো দলিল রেজিস্টারি করবার জন্য আপিসে এসে বসে রয়েছেন, আর আমাকে দেখবামাত্রই যেন কেমন একরকম হয়ে গেলেন, আর মতও বদলে গেল! আমি এখানে বদলি হয়ে এসেছি জানলে, আপনারা কখনো এখানে আসতেন না! কেমন কি না, বলুন।

সরকার মহাশয় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া আমতা আমতা করিতে লাগিলেন। চক্রী ব্যবসায়ী ভোলানাথের সত্য গোপনের চেষ্টা আবদুল কাদেরের নির্ভীক সরল স্পষ্টবাদিতার সম্মুখে ব্যর্থ হইয়া গেল। তবু একবার শেষ চেষ্টা করিবার জন্য তিনি কহিলেন, –আচ্ছা, আমার কথা আপনার বিশ্বাস না হয়, কর্তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখবেন।

আবদুল কাদের তৎক্ষণাৎ কহিল, –তাই চলুন।

ভোলানাথ কহিলেন, –আপনি এগোন, আমি আসছি! নৌকা থানার ঘাটে আছে।

সৈয়দ সাহেব আবদুল কাদেরকে এড়াইয়া সরিয়া পড়িতে চাহিয়াছিলেন। তাই আগে আগে নৌকায় আসিয়া উৎকণ্ঠিতচিত্তে প্রতি মুহূর্তে ভোলানাথের আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তাহার মনে মনে ভয়ও হইতেছিল, পাছে-বা সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদেরও আসিয়া পড়ে। পরে ভোলানাথের পরিবর্তে তাহাকেই নৌকায় উঠিতে দেখিয়া তাহার মন এমন বিক্ষুব্ধ হইয়া পড়িল যে, যখন আবদুল কাদের সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল– আব্বা, আপনি বুঝি আবার তালুক বিক্রি কচ্ছেন?–তখন তিনি কী বলিবেন ঠিক করিতে নাপারিয়া, কেবল না, হাঁ, তা কি জান ইত্যাদি অসংলগ্ন দুই-চারিটি শব্দ উচ্চারণ করিলেন।

আবদুল কাদের কহিতে লাগিলেন, –আব্বা, আপনাকে একটা কথা বলি। সেবারে তালুক বিক্রি করবার সময় আমি অনেক আপত্তি করেছিলাম, তাতে আপনি আমার ওপর। নারাজ হয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমার বাধা দেবার কোনো ক্ষমতা ছিল না–আপনার টাকার দরকার পড়েছিল, আমার যদি তখন সে টাকা দেবার উপায় থাকত, তবে কিছুতেই বিক্রি কত্তে দিতাম না। আর আপনারও বিক্রি করবার দরকার হত না। এখন খোদার ফজলে আমি কিছু কিছু রোজগার কচ্ছি–আমার যতদূর সাধ্য আপনাকে সাহায্য করব, আপনি আর তালুক বিক্রি করবেন না…

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –কী করি বাপ, ওই মসজিদটা পড়ে রয়েছে, খোদার কাজ একবার আরম্ভ করে যদি শেষ না করে মরি, তবে আখেরাতে খোদার কাছে কী জবাব দেব?

সে মসজিদ এখনো শেষ হয় নি?

কই আর হল! তিন বছরের বেশি হল তুমি বাড়িছাড়া, সংসারের খবর তো আর রাখ না–টাকা-পয়সা কোথে কে আসবে যে কাজ শেষ করব? তালুক বিক্রি ছাড়া আর উপায়। কী?

মসজিদ শেষ কত্তে আর কত টাকা লাগবে?

এখনো তো ঢের বাকি–বারান্দা আর সামনের একটা রোয়াক, বাইরের আস্তর, উপরকার মিনারা…

তা কোন তালুকটা বিক্রি কচ্ছেন?

এই দেখ বাবা, দলিলটাই দেখ, তোমার কাছে আর লুকিয়ে কী হবে!

দলিল দেখিয়া আবদুল কাদের আশ্চর্য হইয়া কহিল, –এই দুটো ভালো ভালো মহাল মাত্র সাত হাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন আবা? আর ও দুটো গেলে থাকবেই-বা কী!

তা কী করি, ভোলানাথ বাবু ওর বেশি আর দিতে চাইলেন না…

সাত হাজার টাকাই কি মসজিদে লাগবে?

তা লাগবে বৈকি! মেজেতে সঙ্গে মমর দেবার ইচ্ছে আছে, ভেতরেও কিছু পাথরের কাজ, উপরে মিনারা, বারান্দায় থাম, পাথরের কাজ দিতে হবে, তাতে করে অনেক টাকা। পড়ে যাবে।

এত না কল্লেও তো চলে আব্বা…

না, না, তাও কি হয় বাবা! নিয়ত যা করিছি খোদার নামে, তা আদায় না কল্লে যে খোদার কাছে বেইমানি হবে।

আমার মনে হয়, আহ্বা, নিয়ত, কল্লেই যে সেটা সম্পূর্ণ আদায় কত্তে হবে, তার কোনো মানে নেই। যদি এখন সাধ্যে না কুলোয়, তবে? যতটা পারা যায়, তাই কল্লেই খোদা রাজি থাকেন। এখন আমি যদি নিয়ত, করে বসি যে, পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মসজিদ। দেব, তা কি কখনো আদায় করা আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে? মসজিদ দেওয়া আপনার নিয়ত; এখন সাধ্যে যতদূর কুলোয়, তাই খরচ করে ওটা শেষ করে ফেলুন। আমি বলি, রসুলপুরের ওটা থাক্‌, মাদারগঞ্জেরটা বরং বন্ধক রেখে হাজার দুই টাকা নেন; ও টাকা খোদা চাহে তো আমিই পরিশোধ করব। আপনার কিছু ভাবতে হবে না; খোদার ফজলে বিষয়েও আঁচ লাগবে না, আপনার মসজিদও শেষ হয়ে যাবে।

সৈয়দ সাহেব একটু ভাবিয়া কহিলেন, দু হাজার টাকায় কি হবে বাবা?

যাতে হয়, তাই করুন; বেশি আড়ম্বর করে কাজ নেই, আব্বা। এই যে সরকার মহাশয়ও এসে পড়েছেন…

সরকার মহাশয় উঠিতে উঠিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, –নৌকা এখন খোলা হবে না?

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –আবদুল কাদেরকে সব কথা খুলে বললাম, ও তো বিক্রি কত্তে দিতে চায় না–আর আমার বড় ছেলেরও মত নয় যে বিক্রি করি। এখন ছেলেরা সব লায়েক হয়েছে, ওদের অমতে কাজটা করা ভালো দেখায় না, সরকার মশায়…।

ভোলানাথ কহিলেন, –তা বেশ তো। বিক্রি নাই-বা কল্লেন। আমি তো আর জোর করে কিনতে চাই নি…

নারাজ হবেন না, সরকার মশায়…

না, না, আপনার সম্পত্তি আপনি ইচ্ছে হয় বিক্রি করুন, ইচ্ছে হয় না করুন, তাতে আমি নারাজ হব কেন, সৈয়দ সাহেব!

কিন্তু আমার টাকার দরকার যে! আপনি মেহেরবানি করে যদি বন্ধক রাখেন…

ওই সাত হাজার টাকায়! সে কি হয়?

আবদুল কাদের কহিল, –না, না, সাত হাজার টাকা কেন! আমরা কেবল মাদারগঞ্জের তালুকটা বন্ধক রাখব; আপনি মেহেরবানি করে কেবল ওইটা রেখেই যদি দু হাজার টাকা দেন…

সৈয়দ সাহেব কহিলেন, –না না, দু হাজারে আমার চলবে না তো! নিদেনপক্ষে তিন হাজার চাই যে।

ভোলানাথ একটু ভাবিয়া কহিলেন, –বন্ধক রেখে তিন হাজার দিতে গেলেও দুটো তালুক চাই; তা নইলে তিন হাজার দিতে পারব না।

আবদুল কাদের অনেক আপত্তি করিল; কিন্তু সৈয়দ সাহেব দু হাজারে সন্তুষ্ট হইতে চাহিলেন না, এবং ভোলানাথও দুইটি সম্পত্তি না হইলে তিন হাজার দিতে রাজি হইলেন না। অবশেষে ভোলানাথেরই জয় হইল।

সেই দিনই দলিল লেখাপড়া হইয়া গেল। সুদের হার লইয়া আবদুল কাদেরকে অনেক লড়ালড়ি করিতে হইয়াছিল; অবশেষে ভোলানাথ বার্ষিক শতকরা ১২ টাকাতেই রাজি হইয়া গেলেন। বন্দোবস্ত হইল যে, আবদুল কাদের প্রতি মাসে সুদে-আসলে ৬০ টাকা করিয়া ভোলানাথকে পাঠাইতে থাকিবে। ইহাতে প্রায় ছয় বৎসরে সমস্ত টাকা পরিশোধ হইতে পারিবে। কিন্তু ভোলানাথ আরো শর্ত করিয়া লইলেন যে, কিস্তি কোনো সময়ে খেলাফ হইলে, সুদের হার শতকর ২৫ টাকায় দাঁড়াইবে, এবং খেলাফকালীন সুদ আসলে পরিণত হইয়া চক্রবৃদ্ধি হারে গণ্য হইবে।

সদর আপিসেই দলিল রেজিস্টারি করা হইল। আবদুল্লাহ্ও তাহাতে একজন সাক্ষী হইয়া রহিল। সৈয়দ সাহেব ও ভোলানাথ সেইদিনই সন্ধ্যার পর নৌকা খুলিলেন।

.

২০.

বরিহাটী জেলাস্কুলে এতদিন মুসলমান ছাত্রদের কোনো বোর্ডিং ছিল না; আবদুল্লাহ্ এখানে মাস্টার হওয়ার পর অনেক চেষ্টা-চরিত্র করিয়া একটি মুসলমান বোর্ডিং স্থাপন করিতে সক্ষম হইয়াছে এবং নিজেই তাহার সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হইয়া সেইখানেই বাস করিতেছে। আবদুল কাদের বরিহাটীর জয়েন্ট আপিসে বদলি হইয়া আসা অবধি আবদুল্লাহর ওখানেই রহিয়াছে; এখনো বাসা পায় নাই; কিন্তু স্বতন্ত্র বাসা না করিলে তো চলিবে না। বোর্ডিঙে বাহিরের লোক অধিক দিন রাখা যায় না; সুতরাং আবদুল্লাহ্ এবং আবদুল কাদের উভয়েই বাসা খুঁজিতে লাগিয়া গেল।

বরিহাটীতে মুসলমানপাড়ায় চাপরাসী ও পেয়াদা শ্রেণীর লোকদের কয়েকখানি খড়ো ঘর ছাড়া মুসলমানের আর কোনো বাড়ি ছিল না। সম্প্রতি নাদের আলী বলিয়া একজন সিভিল কোর্টের পেয়াদা নদীর ধারে একটুখানি জমি খরিদ করিয়া ছোটখাটো একটি পাকা বাড়ি তৈয়ার করিতেছিল। নাদের আবদুল্লাহর পিতার মুরীদ ছিল; সুতরাং তাহাকে বলিলে সে নিশ্চয়ই আর কাহাকেও ভাড়া দিবে না। এই মনে করিয়া আবদুল্লাহ নাদের আলীর বাড়িতে গিয়া তাহাকে বিশেষ করিয়া অনুরাধ করিল, যেন বাড়িখানি আর কাহাকেও ভাড়া দেওয়া না হয় এবং কিছু অগ্রিমও দিতে চাহিল।

নাদের আলী কহিল, –না, না হুজুর, আগাম নেব ক্যা? আপনারা ভাড়া নিবেন, তার আবার কথা? বাড়ি আপনাগোরই থাকল; শ্যাষ হতি আরো মাসখানেক লাগবে; আল্লায় করলি ত্যাখন আপনাগোরই ভাড়া দেব।

আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, –তা ভাড়া কত করে নেবে, নাদের আলী?

নাদের কহিল, –আগে শ্যাষ করেই তো নিই, হুজুর, ভাড়ার কথা পাছে।

না, না, আগে থেকেই ওটা ঠিক করে রাখা ভালো। তোমার বাড়ি প্রায় হয়েই রয়েছে; তিন কামরা আর এক বারান্দা–এই তো! তবে ভাড়া ঠিক করতে আর অসুবিধে কী?

নাদের একটুখানি হাসিয়া কহিল, –তা আপনারা যা দেবেন হুজুর, আমি তাই নেব। আপনাগোর সাতে কি আর দর-দস্তুর কত্তি পারি?

তবু তোমার কত হলে পোষাবে, মনে কর!

বাড়ি ভাড়া তো দেখতিইছেন হুজুর–বাবুরা সব বাড়ির জন্যি খাই খাই করে বেড়ায়। ড্যাড়া ড্যাড়া ভাড়া দ্যেও বাড়ি পায় না। তা আপনাগোর কাছে আর বেশি নেব না হুজুর, কুড়ি টাকা করে দেবেন।

নাদের নিতান্ত অন্যায় ভাড়া চাহে নাই বুঝিয়া আবদুল কাদের তাহাতেই রাজি হইয়া গেল। ঠিক হইল যে বাড়ি শেষ হইলে যেদিন আকামত হইবে সেইদিনই আবদুল কাদের বাড়ি দখল করিবেন।

বিদায়ের পূর্বে নাদের আবদুল্লাহকে কহিল, –হুজুর, আকামতের দিন এট্টু মৌলুদ শরীফ পড়াতি চাই, তা আপনি এট্টু দয়া কত্তি হবে…

আবদুল্লাহ কহিল, –কী করতে হবে!

আপনিই এট্টু পড়বেন–আপনাগোর মুখির পড়ায় খোদায় বরকত দেবে।

আবদুল্লাহ্ হাসিয়া কহিল, –আচ্ছা আচ্ছা, পড়া যাবে।

যাহা হউক, একটা বাসার বন্দোবস্ত হইয়া গেল মনে করিয়া আবদুল কাদের নিশ্চিন্ত হইল। কিন্তু নাদেরের বাড়িখানি শেষ হইতে এখনো এক মাসের বেশি লাগিবে। এতদিন বোর্ডিঙে থাকা উচিত হইবে না। তাই দুই জনে পরামর্শ করিয়া স্থির করিল, যতদিন বাড়ি প্রস্তুত না হয়, ততদিন আবদুল কাদের আকবর আলী সাহেবের ওখানেই থাকিবে, খাওয়াদাওয়ার স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত করিয়া লইবে।

আকবর আলী আবদুল কাদেরকে পুনরায় সাদরে নিজে বাটীতে স্থান দিলেন; কিন্তু তাহার স্বতন্ত্র আহারের বন্দোবস্তে বিশেষ রকম আপত্তি করিতে লাগিলেন। আবদুল কাদের কিছুতেই শুনিল না; সে এখন খোদার ফজলে যথেষ্ট উপায় করিতেছে, এক্ষেত্রে নিজের একটা বন্দোবস্ত করিয়া লওয়া ভালো দেখাইবে না বলিয়া সে জেদ করিতে লাগিল। অগত্যা আকবর আলীকে সম্মত হইতে হইল। তিনি বৈঠকখানা ঘরের বারান্দায় একধারে ঘিরিয়া উপস্থিত রান্নার কাজ চালাইবার মতো একটু স্থান করিয়া দিলেন।

কিন্তু রাঁধিবার আর লোক পাওয়া গেল না। অবশেষে আবদুল কাদেরের চাপরাসী নিজেই কেবল খোরাক পাইয়া রাধিয়া দিতে রাজি হইল। কিন্তু তাহাকে বেশি রাঁধিতে হইত না। আকবর আলীর অন্দর হইতে প্রায়ই ডালটা, তরকারিটা আসিত, এবং সপ্তাহের মধ্যে অন্তত তিন সন্ধ্যা আবদুল কাদেরকে বোর্ডিঙের সুপারিন্টেন্ডেন্টের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইতে হইত।

এইরূপে প্রায় এক মাস কাটিয়া গেল। একদিন সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় বসিয়া আবদুল কাদের আবদুল্লাহর সহিত পরামর্শ করিতেছিল, বাড়ি প্রস্তুত হইয়া গেলে হালিমাকে আনা যাইবে কি না। তাহার মাসিক আয় গড়ে এক শত টাকারও উপর। তাহা হইতে পিতার দেনা পরিশোধ বাবদ ৬০ টাকা করিয়া দিলে তাহার ৫০ টাকা আন্দাজ থাকিবে। তাহাতে জেলার ওপর সপরিবারে খরচ চালানো যায় কি না, দুই জনে তাহারই একটা হিসাব করিতেছিল, এমন সময় নাদের আলী সেখানে উপস্থিত হইয়া আভূমি মাথা নোয়াইয়া আদাব করিয়া দাঁড়াইল।

আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, –কী নাদের আলী, খবর কী? তোমার বাড়ির আকামতের মৌলুদ পড়তে হবে কবে?

নাদের আলী মুখে একটু বিষণ্ণতার ভাব আনিয়া কহিল, –হুজুর, বড় এট্টা মুশকিলি পড়লাম, তাই এখন কী করি ভাবতিছি।

কেন, কেন, কী হয়েছে?

আমাগোর মোন্সব বাবুর এক সুমুন্দি সব্‌ডিপুটি হয়ে আইছেন; তা মোন্সব বাবু আস্যে আমারে ধরে পড়লেন; আগাম টাকা নিতি চালাম না, তাও জোর করে দশটা টাকা হাতে গুঁজে দ্যে গেলেন ও বাড়ি তানার সুমুন্দিরে দিতেই হবে। আপনাগোরে আগে কথা দিছি, সে কথা কত করে কলাম, তা তারা মোটেই শোনলেন না। কী করি এখন…

আবদুল্লাহ্ উষ্ণ হইয়া উঠিয়া কহিল, –বাঃ আমাদের কথা দিয়ে রেখেছ আজ এক মাস হল, এর ওপরেও আবার কী করবে ভাবছ? তোমার কথার ওপর নির্ভর করে আমি এদ্দিন বসে আছি, পরিবার আনবার বন্দোবস্ত কচ্ছি; আর আজ কিনা তুমি ফস্ করে আর একজনকে বাড়ি দিয়ে ফেলে? আমরা আগাম দিতে চাইলাম, তা নিলে না; আর তোমার মুন্সেফ বাবু যেই এসে টাকা দিলেন, অমনি নিয়ে ফেল্লে! ছিঃ নাদের, তোমার একটু লজ্জাও হল না আমাদের সুমুখে আসতে?

নাদের মিনতি করিয়া কহিল, –তা কী করি হুজুর, তানারা মুনিব, নাগোর কথা তো ঠেলতি পারি নে। তা আমি আপনাগোর আর এট্টা বাড়ি দেখে দেব, আপনাগোর কোনো কষ্ট হবে না…

আর কষ্ট হবে না। নাদের, তুমি তোমার নিজের বাড়ির সম্বন্ধেই যখন কথা রাখতে পাল্লে না, তখন আর তুমি পরের বাড়ি দেখে দিয়েছ! আর তো বাড়িই নেই, তা তুমি দেবে কোথে কে? হিন্দু-বাড়ি কি আর আমাদের দেবে?

কেন দেবে না হুজুর? ওই ওদিকে বাবুর একখানা বাড়ি খালি আছে, তবে তার ভাড়াডা কিছু বেশি, তিরিশ টাকা…

আবদুল কাদের কহিল, –অত টাকা আমি দেব কোত্থেকে নাদের? কুড়ি টাকার মধ্যেই চাই।

নাদের একটু ভাবিয়া কহিল, –শোশি বাবুগোর একখান বাড়ি আছে দুই কামরা, ১৫ টাকা। সে খালি হবার কথা শুনিছি। ওবোশিয়ের বাবু ছেলেন সে বাড়িতি, তিনি বদলি হয়ে গ্যালেন। সেইডেই দেখি যদি হয়।

আবদুল্লাহ্ হতাশভাবে কহিল, –তা দেখ। কিন্তু হবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

তা য্যামন করে পারি আপনাগোরে এট্টা বাড়ি করে দেবই, আপনারা ভাবনা করবেন না। এইরূপ আশ্বাস দিয়া নাদের চলিয়া গেল।

একটু পরেই আকবর আলী অন্দর হইতে বাহিরে আসিলে আবদুল কাদের নাদেরের বাড়ি সম্বন্ধে সকল কথা খুলিয়া বলিল। আকবর আলী একটু চিন্তিতভাবে কহিলেন… তবেই তো! ও বাড়ি যখন হাতছাড়া হয়ে গেল, তখন যে আপনি এখানে আর বাড়ি পাবেন, এমন বোধ হয় না। কোনো হিন্দুই মুসলমানকে বাড়ি দেবে না।

আবদুল কাদের একটু প্রতিবাদের সুরে কহিল, নাদের যেমন নিশ্চিত রকম ভরসা দিয়ে গেল, তাতে বোধহয় বাড়ি পাওয়া যেতে পারে। যদি কেউই না দিত, তবে নাদের অমন জোর করে বলতে পারত না যে, সে বাড়ি করে দেবেই। যার বাড়ির কথা বল্লে সে লোকটা হয়তো মুসলমানকে দিতে আপত্তি নাও কত্তে পারে বলে নাদের জেনে থাকবে…

কার বাড়ির কথা বল্লে সে?

আবদুল্লাহ্ কহিল, –শশীবাবু, বোধহয় উকিল শশীবাবু হবেন…

আকবর আলী অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া কহিলেন, –ওঃ শশীকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর বাড়ি যদি আপনি পান তবে আমি কী বলেছি… ।

আবদুল কাদের কহিল, –আচ্ছা দেখাই যাক না, নাদের কদ্দূর কী কত্তে পারে। আর আমার বোধহয় এখন হিন্দুতে যখন মুসলমানের বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে, তখন ওরা মুসলমানকে বাড়ি দিতে আর আপত্তি নাও কত্তে পারে।

আকবর আলী কহিলেন, –আপনি ক্ষেপেছেন? মুসলমানের বাড়ি হিন্দুতে ভাড়া নিচ্ছে বলেই যে হিন্দুর বাড়ি মুসলমানকে দেবে, এর কোনো মানে নাই। আমি যখন নবাবশাহীতে প্রথম চাকরি পাই, তখনকার এক ঘটনা শুনুন। একজন মুসলমান রইস্ মারা গেলেন; তাদের। পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। ছেলেরা পুরোনো বাড়িটা বেচে ফেল্লে। বাড়িখানা মন্দ ছিল না। এক হিন্দু ডাক্তার সেটা কিনেছিল; সে একটু মেরামত সেরামত করে ভাড়া খাটাতে লাগল। কিছুদিন পরে একজন মুসলমান ডিপুটি নবাবশাহীতে বদলি হয়ে এলেন। তখন ও বাড়িটা খালি ছিল; তিনি এত ঝুলোঝুলি কল্লেন, ভাড়া অনেক বেশি দিতে চাইলেন, কিছুতেই সে ডাক্তার দিলে না। সাফ বলেই দিলে, মুসলমানকে দেবে না।

আবদুল কাদের কহিল, –বাঃ, বেশ তো! ওরা আমাদেরটা নেবে, আর আমাদের দরকার হলে ওদেরটা পাব না? মুসলমানের বাড়ি হিন্দুর কাছে বেচাও উচিত নয়, আর ভাড়া দেওয়াও উচিত নয়।

আবদুল্লাহ্ কহিল, ভাই রে, বেচা উচিত নয় বলছ, কিন্তু মুসলমান খদ্দের পাবে কটা? আর ভাড়া না দিয়েই বা যাবে কোথা? কজন মুসলমান চাকুরে আছে যে, সকল সময় ভাড়া পাবে? তা ছাড়া ওরাই তো যত আপিস-আদালতের হর্তাকর্তা, ওদের সঙ্গে আড়াআড়ি করে কি আমাদের চলে? এই দেখ না, নাদের বেচারা যদি মুনসেফ বাবুর সম্বন্ধীকে বাড়িটা না দিত, তবে ওর চাকরি নিয়েই পরে টানাটানি পড়ত। যেমন আমাদের সমাজের অবস্থা, তাতে এসব সয়েই থাকতে হবে। অনর্থক চটলে কোনো ফল নেই।

আবদুল কাদের হতাশভাবে কহিল, তবে কি আমি বাড়ি পাব না?

আকবর আলী কহিলেন, –সেই রকমই তো বোধ হচ্ছে। নিদেনপক্ষে এই পাড়াতে, একটু জায়গা নিয়ে ঘর বেঁধে থাকবেন, আমি যেমন আছি। আর তো কোনো উপায় দেখছি নে।

এইরূপ কথাবার্তায় রাত্রি অধিক হইয়া উঠিল দেখিয়া আবদুল্লাহ্ বিদায় লইয়া বোর্ডিঙে চলিয়া গেল। আবদুল কাদের রাত্রে শুইয়া আকবর আলী সাহেবের কথামতো বাসা-বাটী নির্মাণের কল্পনা করিতে লাগিল।

পরদিন বৈকালের দিকে নাদের আলী আবদুল কাদেরের আপিসে আসিয়া কহিল, শশীবাবু তাহার বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হইয়াছেন, কিন্তু ভাড়া পাঁচ টাকা বৃদ্ধি করিয়া কুড়ি টাকা চাহিয়াছেন; আবদুল কাদের বাড়ি ভাড়া পাইবার আশা ছাড়িয়া দিয়াছিল; এক্ষণে নাদেরের কথায় তাহার আবার ভরসা হইল–সে কুড়ি টাকাই দিতে রাজি হইয়া গেল।

নাদের কহিল–তবে চলেন হুজুর, শশীবাবুর সাথে একবার মোকাবিলা করে ঠিকঠাক করে আসি গে। আমি তানারে কয়ে আইছি, আজই আপনারে লয়ে যাব। তানি সঁজ বাদ যাতি কইছেন।

বেশ তো, সন্ধ্যার পরই যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যেও। আপিসেই থাকবখন–আজ কাজ অনেক।

সন্ধ্যার পর নাদের আসিয়া আবদুল কাদেরকে শশীবাবুর বাড়িতে লইয়া গেল। শশীবাবু তাকে পরম সমাদরে ঘরের ভিতর লইয়া গিয়া একখানি চেয়ারে বসাইলেন এবং পান, তামাক প্রভৃতির ফরমাইশ করিলেন। তৎক্ষণাৎ পান আসিল, তামাক আসিলে শশীবাবু কিঞ্চিৎ সেবন করিয়া কলিকাটি নাদেরের হস্তে তুলিয়া দিয়া কহিলেন, –দেও তো মিঞা,

একটা কাগজের ঠোঙ্গা করে সবুরেজিস্ট্রার সাহেবকে তামাক খাওয়াও।

অনভ্যস্ত বলিয়া আবদুল কাদের কাগজের ঠোঙ্গায় তামাক খাইয়া জুত পাইল না। তবু ভদ্রতার খাতিরে দুই-এক টান দিল এবং কাশিতে কাশিতে কলিকাটি ফিরাইয়া দিল।

শশীবাবু উপস্থিত আর একটি ভদ্রলোকের দিকে কাটি বাড়াইয়া দিয়া কহিলেন, নাদের আলী বলছিল, আমার ওই নদীর ধারের বাড়িটা আপনি ভাড়া নিতে চান।

আবদুল কাদের কহিল, –হ্যাঁ মশায়, যদি দয়া করে দেন, তবে বড় উপকার হয়, বাড়ি পাচ্ছি নে।

তা বেশ তো; আমার বাড়ি নেবেন তাতে আর কথা কী! তবে ভাড়াটা সম্বন্ধে একটু কথা ছিল, নাদের আলী বলে নি আপনাকে?

হ্যাঁ, তা বলেছে। আপনি কুড়ি টাকা চান তো? আমি তাতেই রাজি আছি।

তা হলে আপনি আসচে মাসের পয়লা থেকেই নেবেন। এর মধ্যে আমি চুনকাম টুনকাম করিয়ে ফেলি। একটু-আধটু মেরামত কত্তে হবে। এ কটা দিন দেরি হলে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না তো?

না, না, অসুবিধে কিছুই হবে না। আমি কটা দিন সবুর কত্তে রাজি আছি! তবে আপনি কিছু অগ্রিম নিলে আমি পাওয়া সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।

আবদুল কাদেরের এই প্রস্তাবে শশীবাবুর প্রতিই তাহার অবিশ্বাসের ভাব প্রকাশ পাইলেও আবদুল কাদের যেন নিজেকেই তাহার নিকট বিশ্বাস প্রতিপন্ন করিবার জন্য অগ্রিম দিতে চাহিতেছে এইরূপ ভাব দেখাইয়া শশীবাবু কহিলেন, –সে কী মশায়! অগ্রিমটগ্রিম আবার কেন? আপনার মতো ভদ্রলোকের মুখের কথাই কি আমার কাছে যথেষ্ট নয়?

ইহার উপর আর কথা চলে না। কাজেই আবদুল কাদেরকে কেবল মুখের কথার উপর নির্ভর করিয়াই বিদায় লইতে হইল।

আবদুল্লাহ্ আবদুল কাদেরের প্রতীক্ষায় আকবর আলীর বৈঠকখানায় বসিয়া তাহার সহিত বসিয়া গল্প করিতেছিল। এক্ষণে তাহাকে আসিতে দেখিয়া সে কহিল, –কী হে, এত রাত্তির হল যে?

গিয়েছিলাম শশীবাবুর ওখানে…

শশীবাবুর ওখানে? কেন–বাড়ি ঠিক করতে? পেলে?

আবদুল কাদের একটু বিজয়োল্লাসের সহিত কহিল, –হ্যাঁ হ্যাঁঃ! তোমরা বল, হিন্দুর বাড়ি মুসলমানে ভাড়া পায় না। ও একটা কথার কথা! এই তো আমি ভাড়া ঠিক করে এলাম। কুড়ি টাকা করে, ও-মাসের পয়লা থেকে নেব; শশীবাবু এর মধ্যে মেরামত টেরামত করে ফেলবেন।

আকবর আলী এবং আবদুল্লাহ্ উভয়েই এই কথা শুনিয়া একটু আশ্চর্য বোধ করিলেন। আবদুল্লাহ্ কহিল, যদি বাস্তবিক দ্যায়, তো সে খুব ভালো কথা। এতেই পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব বাড়বে; নইলে পরস্পরের ব্যবহারে কেবল রেষারেষি, তাচ্ছিল্য, ঘৃণা, এ সব থাকলে কি আর দেশের কল্যাণ হতে পারে?

বাসা একরূপ স্থির হইয়াছে বলিয়া আবদুল কাদের নির্ভাবনায় আপিস করিতেছে, এমন সময় একদিন শশীবাবু স্বয়ং আসিয়া দেখা দিলেন। আবদুল কাদের উঠিয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিল এবং চেয়ার আনাইয়া বসিতে দিল। যথারীতি কুশল প্রশ্নাদির পর শশীবাবু কহিলেন, দেখুন সবুরেজিস্ট্রার সাহেব, আপনার কাছে এক বিষয়ে আমাকে বড়ই লজ্জিত হতে হচ্চে, অথচ উপায় নেই। আশা করি, কিছু মনে করবেন না…

আবদুল কাদেরের বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল, –বুঝি বাড়িটা ফসকাইয়া যায়! সে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়া কহিল, –কেন, কেন?

শশীবাবু গভীর দুঃখব্যঞ্জক সুরে কহিতে লাগিলেন, –কী করব, মৌলবী সাহেব, বাড়িটা তো আপনাকে দেব বলেই ঠিক করেছিলাম, কিন্তু ও-দিকে এক বিষম বাগড়া পড়ে গেল…

ঔৎসুক্যে অধীর হইয়া আবদুল কাদের জিজ্ঞাসা করিল, –কী রকম?

আমাদের বারের প্রেসিডেন্ট অতুল বাবু ওই পাড়াতেই থাকেন কিনা তা তিনি এবং আরো পাঁচজনে বলেছেন, ও-পাড়ায় ভদ্দরলোকের বাস, ওখানে মুসলমানকে বাড়ি দিলে সকলকারই অসুবিধে হবে, তাই ভাবছি–আবার এদিকে…।

ভদ্দরলোকের পাড়ায় মুসলমানকে থাকিতে না দেওয়ার ইঙ্গিতে আবদুল কাদের বড়ই রুষ্ট হইয়া কহিল, –তা ও-পাড়া যে ভদ্রলোকের পাড়া তা তো আপনার জানা ছিল, তবে আমার মতো অভদ্র অর্থাৎ মুসলমানকে কেন কথা দিয়েছিলেন মশায়?

না, না, মশায় কিছু মনে করবেন না আপনাকে কেন অভদ্র বলে মনে কত্তে যাব…

ভদ্রলোকের পাড়ায় যাকে থাকতে দেওয়া উচিত হয় না, সে অভদ্র নয় তো কী?

না, না, মৌলবী সাহেব, –ওটা একটা কথার কথা বৈ তো নয়–যেমন ধরুন না, বাঙালি বললে আপনারা বাঙালি হিন্দুকেই বোঝেন…

কই, তা তো বুঝি নে–আমরাও তো বাঙালি…

আমি অনেক মুসলমানকে বলতে শুনিছি, –মুসলমানেরা আজকাল ধুতি পরে বাঙালি সাজে। এর মানে কী?

এর মানে এই যে, অনেক মুসলমান ভিন্ন দেশ থেকে এসে এখানে বাস কচ্ছে কিনা তাই তারা এদেশের আসল বাসিন্দাদের বাঙালি বলে; কিন্তু তাই বলে আপনারা হিন্দু বলেই যে ভদ্র নামের একমাত্র অধিকারী, আর কেউ ভদ্রলোক নয়, এমন মনে করা কি ঠিক?

কি জানেন মৌলবী সাহেব, ওটা কথার কথায় দাঁড়িয়ে গেছে তা আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি আপত্তি মানতাম না; আসল কথা হচ্ছে কী জানেন, ও বাড়িখানি ঠিক আমার নয় কিনা? ওটা হচ্ছে আমার এক পিসিমার–তিনি বিধবা মানুষ জানেনই তো আমাদের বিধবারা কেমন গোঁড়া। তা তিনি কিছুতেই দিতে রাজি হলেন না। বললেন ওইটুকুই তার সম্বল আছে, ওতে অনাচার হলে তার অকল্যাণ হবে। এমন কথা বললে তো আর পীড়াপীড়ি করা যায় না। এখন কী করি, এ-দিকে আপনাকেও কথা দিয়ে রেখেছি, ও-দিকে পিসিমাকেও রাজি কত্তে পাচ্ছি নে, আমি মহা মুশকিলে পড়ে গিইছি…

আবদুল কাদের বিরক্তির সহিত কহিল, –বাড়ি যখন আপনার নিজের নয়, তখন তাকে না জিজ্ঞেস করে আপনার কথা দেওয়া উচিত হয় নি…।

আমি তখন এতটা ভাবি নি মশায় তিনি যে আপত্তি কত্তে পারেন এ-কথা আমার। মনেই হয় নি। নইলে কি আর আপনাকে এমন করে হয়রান করি? তা আপনি কিছু মনে করবেন না মশায়। তবে এখন উঠি, সেলাম।

সন্ধ্যার পর আকবর আলী এবং আবদুল্লাহ্ তাহার মেঘাচ্ছন্ন মুখ দেখিয়া বুঝিলেন যে, একটা কিছু ঘটিয়াছে। আবদুল কাদের নিষ্ফল ক্রোধে ও ঘৃণায় উত্তেজিত হইয়া শশীবাবুর ব্যবহারের উল্লেখ করিয়া কহিল, –দেখুন তো, লোকটার আচরণ! এমন করে আশা দিয়ে নিরাশ কল্লে! এ কি মানুষের কাজ? আকবর আলী কহিলেন, –তা আর কী করবেন বলুন! ব্যাপারটা কী হয়েছে, তা আমি বুঝতে পেরেছি। ওর বাড়িখানার ভাড়া বাড়াবার দরকার ছিল, সুযোগ পেয়ে আপনাকে দিয়ে বাড়িয়ে নিলে। ২০ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন, এই বলে সে কারুর কাছ থেকে অন্তত ১৮ টাকা তো আদায় করবেই। যখন আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হয়, তখন হয়তো সে লোককেও সেখানে হাজির রেখেছিল; আপনার মুখ থেকেই তাকে শুনিয়ে দিয়েছে যে, ভাড়া বেশি দিতে চেয়েছেন। আমি অনেক দিন থেকে ওদের সঙ্গে মেলামেশা কচ্ছি কিনা, ওদের কলাকৌশল আমার কিছু কিছু জানা আছে। দেখে নেবেন কদিন পরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *