০১-০৫. বি. এ. পরীক্ষা

আবদুল্লাহ – উপন্যাস – কাজী ইমদাদুল হক

বি. এ. পরীক্ষার আর কয়েক মাস মাত্র বাকি আছে, এমন সময় হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় আবদুল্লাহর পড়াশুনা বন্ধ হইয়া গেল।

পিতা ওলিউল্লাহর সাংসারিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না। পৈতৃক সম্পত্তি যাহা ছিল, তাহা অতি সামান্য; শুধু তাহার উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হইলে সংসার চলিত না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি পৈতৃক খোন্দকারী ব্যবসায়েরও উত্তরাধিকার পাইয়াছিলেন বলিয়া নিতান্ত অন্ন-বস্ত্রের জন্য তাহাকে বড় একটা ভাবিতে হয় নাই।

ওলিউল্লাহ্ পীরগঞ্জের পীর-বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। পূর্বে পরিগঞ্জের চতুষ্পার্শ্বে বহু গ্রামে ইহাদের মুরীদান ছিল বলিয়া পূর্বপুরুষগণ নবাবি হালে জীবন কাটাইয়া গিয়াছেন। কিন্তু কালক্রমে মুরীদানের সংখ্যা কমিয়া কমিয়া এক্ষণে সামান্য কয়েক ঘর মাত্র অবশিষ্ট থাকায় ইহাদের নিদারুণ অবস্থা বিপর্যয় ঘটিয়াছে। সে প্রতিপত্তিও আর নাই, বার্ষিক সালামীরও সে প্রতুলতা নাই; কাজেই ওলিউল্লাহকে নিতান্ত দৈন্যদশায় দিন কাটাইতে হইয়াছে। তথাপি যে দুই-চারি ঘর মুরীদান তিনি পাইয়াছিলেন, তাহাদের নিকট প্রাপ্য বার্ষিক সালামীর উপর নির্ভর করিয়াই তিনি একমাত্র পুত্রকে কলিকাতায় রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইতেছিলেন। সুতরাং তাহার অকালমৃত্যুতে আবদুল্লাহর আর খরচ চালাইবার কোনো উপায়ই রহিল না; বরং এক্ষণে কী উপায়ে সংসার চালাইবে, সেই ভাবনায় সে আকুল হইয়া উঠিল।

আবদুল্লাহর বিবাহ অনেক দিন পূর্বে হইয়া গিয়াছিল। তাহার শ্বশুরালয় একবালপুরে; শ্বশুর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস তাহার পিতার আপন খালাতো এবং মাতার আপন ফুফাতো ভাই ছিলেন। আবার সেই ঘরেই তাহার এক শ্যালক আবদুল কাদেরের সহিত, আবদুল্লাহর একমাত্র ভগ্নী হালিমারও বিবাহ হইয়াছিল। এই বদল-বিবাহ আবদুল্লাহর পিতামহীর জীবদ্দশায় তাঁহারই আগ্রহে সম্পন্ন হয়।

সৈয়দ আবদুল কুদ্‌সের মাতা আবদুল্লাহ্ পিতামহীর সহোদরা ছিলেন। এই দুই ভগ্নীর মধ্যে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল; এবং তাহারা পরস্পরের নাতি-নাতিনীর বিবাহ দিবার জন্য বড়ই আগ্রহান্বিত ছিলেন। কিন্তু তাহাদের এ সম্প্রীতি সন্তানদিগের মধ্যে প্রসারিত হয় নাই; কেননা সৈয়দরা সম্পন্ন গৃহস্থ, এবং খোন্দকারেরা এক সময়ে যথেষ্ট ঐশ্বর্য ও সম্ভ্রমের অধিকারী থাকিলেও, আজ নিতান্ত দরিদ্র, ধরিতে গেলে একরূপ ভিক্ষোপজীবী। তাই আবদুল কুদ্দুস প্রথমে ওলিউল্লাহর সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনে নারাজ ছিলেন; কিন্তু অবশেষে মাতার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তাহাকে এই বদল-বিবাহে সম্মত হইতে হইয়াছিল।

বিবাহের পর হইতে হালিমা বৎসরের অধিকাংশ কালই শ্বশুরালয়ে থাকিত; কিন্তু আবদুল্লাহর শ্বশুর কন্যাকে অধিক দিন পীরগঞ্জে রাখিতেন না। তাই বলিয়া আবদুল্লাহর পিতামাতার মনে যে বিশেষ ক্ষোভ ছিল, এমত নহে। তাহারা বড় ঘরে একমাত্র পুত্রের বিবাহ দিয়া এবং না-খাইয়া না-পরিয়া তাহাকে লেখাপড়া শিখিতে দিয়া, এই ভরসায় মনে মনে সুখী হইতেন যে, খোদা যদি দিন দেন, তবে পুত্র কৃতবিদ্য হইয়া যখন প্রচুর অর্থ উপার্জন করিবে, তখন বউ আনিয়া সাধ-আহ্লাদে মনের বাসনা পূর্ণ করিবেন। এখন সে। বড়লোকের মেয়েকে আনিয়া কেবল খাওয়া-পরার কষ্ট দেওয়া বৈ তো নয়!

কিন্তু আবদুল্লাহর পিতার সে সাধ আর পূর্ণ হইল না; এমনকি মৃত্যুকালেও তিনি পুত্রবধূর মুখ দেখিতে পাইলেন না। আবদুল্লাহ্ বাটী আসিয়াই পিতার কঠিন রোগের সংবাদ শ্বশুরালয়ে পাঠাইয়াছিল এবং হালিমাকে ও তাহার স্ত্রীকে সত্বর পাঠাইয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা সে অনুরোধ রক্ষা করেন নাই।

আবদুল্লাহর সংসারে এখন এক মাতা এবং তাহার পিতামহের বাঁদী-পুত্রের বিধবা স্ত্রী করিমন ভিন্ন অন্য কোনো পরিজন নাই। করিমন বাঁদী হইলেও আপনার জনের মতোই এই সংসারে জীবন কাটাইয়া বুড়া হইয়াছে। সে গৃহকর্মে আবদুল্লাহর মাতার সাহায্য করে, এবং আবশ্যকমতো বাজারবেসাতিও করিয়া আনে।

এই ক্ষুদ্র সংসারটির খরচপত্র ওলিউল্লাহ্ যে ব্যবসায়ের আয় হইতে কষ্টেসৃষ্টে নির্বাহ করিতেন, আবদুল্লাহর সে ব্যবসায় অবলম্বনে একেবারেই প্রবৃত্তি ছিল না। সে ভাবিতেছিল, চাকরি করিতে হইবে। যদিও সে বি. এ.-টা পাস করিতে পারিল না, তথাপি উপস্থিত ক্ষেত্রে সামান্য যে কোনো চাকরি তাহার পক্ষে প্রাপ্য হইতে পারে, তাহারই দ্বারা সে সংসারের অসচ্ছলতা দূর করিতে সমর্থ হইবে।

এইরূপ স্থির করিয়া আবদুল্লাহ তাহার মাতাকে গিয়া কহিল যে, সে আর পড়াশুনা করিবে না, কলিকাতায় গিয়া যাহা হোক একটা চাকরির চেষ্টা করিবে।

হঠাৎ পুত্রের এইরূপ সঙ্কল্পের কথা শুনিয়া মাতার মন বড়ই দমিয়া গেল। বি. এ. পাস করিয়া বড় চাকরি করিবে কিংবা জজের উকিল হইবে–ইহাই আবদুল্লাহ্ চিরদিনের আশা; কী গভীর দুঃখে যে সে আজ সেই চিরদিনের আশা ত্যাগ করিয়া চাকরির সন্ধানে বাহির হইবার প্রস্তাব করিতেছে, মাতা তাহা বুঝিতে পারিলেন। তাই নিতান্ত ব্যাকুল-কাতর দৃষ্টিতে পুত্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, কোনো কথা কহিতে পারিলেন না।

আবদুল্লাহ্ তাহার মাতার কাতর দৃষ্টি সহিতে পারিত না। এক্ষণে কী বলিয়া তাহাকে সান্ত্বনা দিবে ঠিক করিতে না পারিয়া কহিতে লাগিল, তা আর কী করব আম্মা, এখন সংসার-খরচই চলবে কেমন করে তাই ভেবে দিশে পাচ্ছি নে। যদি সুবিধেমতো একটা চাকরি পাই, তা হলে সংসারটাও চলে যাবে, ঘরে বসে পড়ে পাস করাও যাবে…

মাতার বুক ফাটিয়া একটা গভীর নিশ্বাস পড়িল। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন, যা ভালো বোঝ, কর বাবা। সবই খোদার মরজি।

এই বলিয়া তিনি চুপ করিলেন। আবদুল্লাহ মনে মনে কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির করিয়া কথা কী করিয়া পড়িবে, তাহাই ভাবিতেছে, এমন সময় মাতা আবার কথা কহিলেন,

একটা কাজ কল্লে হয় না, বাবা?

আবদুল্লাহ্ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, কী কাজ আম্মা?

একবার মুরীদানে গেলে হয় না? তারা কি কিছু সাহায্য করবে না তোর পড়াশুনার জন্যে?

মাতা জানিতেন, আবদুল্লাহ্ খোন্দকারী ব্যবসায়ের ওপর অত্যন্ত নারাজ; তবু যদি এই দুঃসময়ে তাহার মন একটু নরম হয়, এই মনে করিয়া তিনি একটু ভয়ে ভয়েই মুরীদানে যাইবার কথা তুলিলেন, কিন্তু তিনি যাহা ভয় করিয়াছিলেন, তাহাই হইল; আবদুল্লাহ্ একটু চঞ্চল হইয়া বলিয়া উঠিল, না আম্মা সে আমাকে দিয়ে হবে না!

মাতা নীরব হইলেন। আবদুল্লাহ্ দেখিল, সে তাহার মাতার মনে বেশ একটু আঘাত দিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু সে যখন নিজের বিশ্বাস ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিতে প্রস্তুত নহে, তখন তাহার মতের সমর্থন করিয়া মাতাকে একটু বুঝাইবার জন্য কহিতে লাগিল, আব্বাও ও-কাজটা বড় পছন্দ করতেন না; তবে আর উপায় ছিল না বলেই তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় মুরীদানে যেতেন। সেই জন্যই তো আমাকে তিনি ইংরেজি পড়তে দিয়েছিলেন, যাতে ও ভিক্ষের ব্যবসায়টা আর আমাকে না করতে হয়।

পুত্র যখন তর্ক উঠাইল, তখন মাতাও আর ছাড়িতে চাহিলেন না। তিনি তাহার যুক্তি খাইবার জন্য কহিলেন, তাই বুঝি? তোকে না তিনি মাদ্রাসায় দিয়েছিলেন! তারপর তুই-ই তো নিজে ইচ্ছে করে মাদ্রাসা ছেড়ে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলি।

আবদুল্লাহ্ কহিল, তা হয়েছিলাম বটে, কিন্তু তাতে কোনো দিনই আবার অমত ছিল না। তিনি বরাবর বলতেন, মাদ্রাসা পাস করে বেরুলে আমাকে ইংরেজি পড়তে দেবেন। ইংরেজি না পড়লে আজকাল–

মাতা বাধা দিয়া কহিলেন, তার ইচ্ছে ছিল, তুই মৌলবী হবি, তারপরে একটু ইংরেজি শিখবি; তা না, ফস্ করে মাদ্রাসা ছেড়ে ইংরেজি পড়া শুরু করে দিলি। এ-দিকও হল না, ও-দিকও হল না। আজ যদি তুই মৌলবী হতিস তবে আর ভাবনা ছিল কী! এখন কি আর মুরীদানরা তোকে মানবে?

আবদুল্লাহ্ অবজ্ঞাভরে কহিল, তা নাই-বা মানল; আমি তো আর তাদের দুয়ারে ভিখ মাগতে যাচ্ছি নে!

মাতা অনুযোগ করিয়া কহিলেন, ছি বাবা, অমন কথা বলতে নেই। মুরুব্বিরা সকলেই তো ঐ কাজ করে গেছেন। যারা অবুঝ, তাদের হেদায়েত করার মতো সওয়াবের কাজ কি আর আছে বাবা!

হ্যাঁ, হেদায়েত করা সওয়াবের কাজ বটে, কিন্তু তাতে পয়সা নেওয়াটা কোনোমতেই সওয়াব হতে পারে না। বরং তার উল্টো।

তারা খুশি হয়ে সালামী দেয়, ওতে দোষ নেই বাবা! সব দেশে, সকল জাতেই এ রকম দস্তুর আছে;–কেন, হিন্দুদের মধ্যে কি নেই!

তা থাকলই-বা; তাদের আছে বলেই যে আমাদের সেটা থাকতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই, আম্মা! আর এই পীর-মুরীদি ব্যবসায়টা হিন্দুদের পুরুতগিরির দেখাদেখিই শেখা, নইলে হযরত তো নিজেই মানা করে গেছেন, কেউ যেন ধর্ম সম্বন্ধে হেদায়েত করে পয়সা না নেয়।

আবদুল্লাহর এই বক্তৃতায় মাতা একটু অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়া কহিলেন, ওই তো ইংরেজি পড়ার দোষ, কেবল বাজে তর্ক করতে শেখে; শরীয়ত মানতে চায় না। তুই যে পীরগোষ্ঠীর নাম-কাম বজায় রাখতে পারবি নে, তা আমি সেই কালেই বুঝেছিলাম। সে যাকগে, যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন কী করবি, তাই ঠিক কর।

আবদুল্লাহ একটু চিন্তা করিয়া কহিল, পরীক্ষেটা যদি পাস করতে পারতাম, তবে একটা ভালো চাকরি জুটত। এখন চেষ্টা কল্লে বড়জোড় ত্রিশ কি চল্লিশ টাকা মাইনে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তার জন্যেও মুরুব্বি চাই যে, আম্মা! কাকে যে ধরব তাই ভাবছি।

যদিও ওলিউল্লাহ পুত্রকে প্রথমে মাদ্রাসায় দিয়াছিলেন, তথাপি তাহাকে ইংরেজি পড়াইবার ইচ্ছা তাহার খুবই ছিল। ইংরেজি না শিখিলে দুরবস্থা ঘুচিবে না, তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এদিকে ইংরেজি শিখিয়া লোকের আকিদা খারাপ হইয়া যাইতেছে, তাহাও তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন; কাজেই প্রথমে মাদ্রাসায় পড়াইয়া পুত্রের আকিদা পাকা করিয়া লইয়া তাহাকে ইংরেজি পড়িতে দিবেন মনে মনে তাহার এইরূপ সঙ্কল্প ছিল। কিন্তু জমাতে চাহরম পড়িয়াই যখন আবদুল্লাহ্ মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগে গিয়া ভর্তি হইল, তখন তিনি আর বাধা দেন নাই। তাহার পর ক্রমে এন্ট্রান্স ও এফ. এ. পাস করিয়া যখন সে বি. এ. পড়িতে লাগিল, তখন পুত্র হয় খুব দরের চাকরি পাইবে, না হয় উকিল হইয়া জেব ভরিয়া টাকা উপায় করিয়া আনিবে, এই আশা আবদুল্লাহর পিতামাতার অন্তরে জাগিয়া উঠিয়াছিল। তাহারা এই বলিয়া মনকে প্রবোধ দিলেন যে, ইংরেজি পড়িয়া সচরাচর ছেলেরা যেমন বিগড়াইয়া যায়, আবদুল্লাহ তেমন বিগড়ায় নাই। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রোজা রাখে; পাকা মুসল্লির মতো সকল বিষয়েই বেশ পরহেজ করিয়া চলে। এক্ষেত্রে ইংরেজি পড়িয়া পুত্র যদি বড়লোক হইতে পারে, তাহাতে বাধা দিবেন কেন? খোদা উহাকে যেদিকে চালাইয়াছেন, ভালোর জন্যেই চালাইয়াছেন।

এক্ষণে স্বামীর অকালমৃত্যুতে পুত্রের বি. এ. পাসের এবং বড়লোক হওয়ার আশা ভঙ্গ হইল; তাই আবদুল্লাহর জননীর মন বড়ই দমিয়া গিয়াছিল। যে হাকিম হইতে অথবা অন্তত জেলার একজন বড় উকিল হইতে পারিত, তাহার পক্ষে এখন সামান্য চাকরিও মিলা দুষ্কর হইয়া পড়িয়াছে, ইহাই মনে করিয়া তাহার অশ্রু ঝরিয়া পড়িল। অঞ্চলে চক্ষু মুছিতে মুছিতে তিনি কহিলেন, বাবা একটা কাজ কল্লে হয় না?

মাতার অনিরুদ্ধ কণ্ঠ আবদুল্লাহকে বিচলিত করিয়া তুলিল। সে যেন মাতার আদেশ তৎক্ষণাৎ পালন করিবার জন্যে প্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী কাজ আম্মা।

মাতা কহিলেন, আমাদের এখন যেমন অবস্থা, তাতে তো আর অভিমান করে থাকলে চলবে না, বাবা! তোর শ্বশুরের কাছে গিয়ে কথাটা একবার পেড়ে দেখ, –তিনি বড়লোক, ইচ্ছে কল্লে অনায়াসে এই কটা মাস তোর পড়ার খরচটা চালিয়ে দিতে পারেন।

এই প্রস্তাবে আবদুল্লাহর মন দমিয়া গেল। সে কী উত্তর দিবে ঠিক করিতে না পারিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, পরের কাছে হাত পাততে ইচ্ছে করে না, আম্মা।

মাতা আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, পর কী রে! তার সঙ্গে যে তোর কেবল শ্বশুর-জামাই সম্পর্ক, এমত তো আর নয়।

আবদুল্লাহ্ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। মাতা আবার কহিলেন, কী বলিস?

আবদুল্লাহ্ কহিল, বলব আর কী, আম্মা; তিনি যে সাহায্য করবেন, এমন তো আমার মনে হয় না।

তিনি সাহায্য করবেন না, আগে থেকেই তুই ঠিক করে রাখলি কী করে? একবার বলেই দ্যাখ না?

আবদুল্লাহ্ কহিল, তিনি নিজের ছেলের সঙ্গে সে-বার কেমন ব্যবহার করেছিলেন, তা কি আপনি জানেন না আম্মা? আবদুল কাদের আর আমি যখন মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হই, তখন আব্বাকে আমি জানিয়েছিলাম, কিন্তু সে তার বাপের কাছে গোপন রেখেছিল। সে খুবই জানত যে, তার বাবা একবার জানতে পারলে আর কিছুতেই পড়ার খরচ দেবেন না; কেননা তিনি ইংরেজি শেখার উপর ভারি নারাজ। ফলে ঘটলও তাই; কয়েক বৎসর কথাটা গোপন ছিল, তারপর যখন আমরা ফার্স্ট ক্লাসে উঠলাম, তখন কেমন করে যেন আমার শ্বশুর সে কথা জানতে পারলেন, আর অমনি বেচারার পড়া বন্ধ করে দিলেন! আর আমি ইংরেজি পড়ি বলে আমার উপরও তিনি সেই অবধি নারাজ হয়ে আছেন। হয়তো-বা মনে করেন যে, আমিই কুপরামর্শ দিয়ে তার ছেলেকে খারাপ করে ফেলেছি।

মাতা কহিলেন, তা তিনি দীনদার পহেজগার মানুষ, তার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে আরবি পড়িয়ে মৌলবী করেন। ছেলে যখন বাপের অবাধ্য হল, আবার কথাটা এদ্দিন গোপন রাখল, তখন তো তার রাগ হবারই কথা! তুই তো আর বাপের অমতে ইংরেজি পড়তে যাস নি, তোর উপর তিনি কেন নারাজ হতে যাবেন?

আবদুল্লাহ্ কহিল, কিন্তু আমার মনে হয় আম্মা, তিনি আমাকে বড় ভালো চোখে দেখেন না। দেখুন, আব্বার ব্যারামের সময় নিজে তো কোনো খবর নিলেনই না, আবার হালিমাকে কি আপনাদের বউকে, –কাউকে পাঠালেন না…

মাতা বাধা দিয়া কহিলেন, সে তো তার দোষ নয়, বাবা! তিনি যে তখন বাড়ি ছিলেন না। তারপর যদিই-বা বাড়ি এলেন, নিজেই শয্যাগত হয়ে পড়লেন, নইলে কি আর তিনি আসতেন না!

বড় আদরের একমাত্র মেয়ে-পুত্রবধূকে স্বামী মৃত্যুকালে দেখিতে চাহিয়াও দেখিতে পান নাই, এই কথা মনে করিয়া আবদুল্লাহ্-জননীর শোক আবার উথলিয়া উঠিল। তিনি ভগ্নকণ্ঠে কহিতে লাগিলেন, যাক সেসব কথা–বরাতে যা ছিল হয়ে গেছে, তা নিয়ে এখন মন ভার করে থেকে আর কী হবে! দোষ কারুরই নয় বাবা, সবই খোদার মরজি। তুই অনর্থক অভিমান করে থাকিস নে। আর তোর শ্বশুর যে আমাদের নিতান্ত আপনার জন। তার সঙ্গে আর অভিমান কী বাবা!

আবদুল্লাহর শ্বশুর যে বাস্তবিকই একজন বড়লোক ছিলেন, তাহা নহে। কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ হইয়াও তাহার মনে বড়লোকের আত্মম্ভরিতাটুকু পুরামাত্রায় বিরাজ করিত। তার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ হীনাবস্থার লোককেই তিনি কৃপার চক্ষে দেখিতেন। এরূপ চরিত্রের লোক পিতার খালাতো এবং মাতার ফুফাতো ভাই হলেও তাহাকে নিতান্ত আপনার জন বলিয়া মনে করিয়া লইতে আবদুল্লাহর প্রবৃত্তি ছিল না। কিন্তু সে তাহার স্নেহপরায়ণা মাতার বড়ই অনুগত ছিল; তাহার নিজের ফুফাতো ভাইয়ের প্রতি সনির্বন্ধ বিরাগ দেখাইলে পাছে তাহার মনে কষ্ট হয়, এই ভাবিয়া সে অবশেষে কহিল, তা আপনি যখন বলছেন আম্মা, তখন একবার তার কাছে গিয়েই দেখি।

মাতা প্রীত হইয়া কহিলেন, হ্যাঁ বাবা তাই যা, আর দেরি করিস নে। আমি বলি কাল ভোরেই বিসমিল্লাহ্ বলে রওয়ানা হও।

.

০২.

পরদিন রাত্রি শেষ না হইতেই আবদুল্লাহর মাতা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিলেন এবং তাড়াতাড়ি চারিটি ভাত রাঁধিয়া যখন আবদুল্লাহকে ডাকিতে গেলেন, তখনো আকাশ পরিষ্কার হয় নাই। মাতার আহ্বানে আবদুল্লাহ্ শয্যার উপর উঠিয়া চোখ কচলাইতে কচলাইতে কহিল, এত রাত থাকতে!

বাঃ রাত আর কোথায় রে? কাক-কোকিল সব ডেকে উঠল যে? নে ওঠ, নামাযটা পড়ে চাট্টি খেয়ে বেরিয়ে পড়।

এত ভোরে আবার খাব কী আম্মা?

চাট্টি ভাত বেঁধে রেখেছি বাবা–

আপনি বুঝি রাত্রে আর ঘুমোন নি, বসে বসে ভাত বেঁধেছেন?

মাতা একটু হাসিয়া কহিলেন, দেখ, হাবা ছেলে বলে কী শোন। চাট্টি ভাত রাঁধতে বুঝি সারা রাত জাগতে হয়? আমি তো এই একটু আগেই উঠলাম। এতটা পথ যাবি, চাট্টি খেয়ে না গেলে পথে ক্ষিধেয় কষ্ট পাবি যে, বাবা।

আবদুল্লাহ আলস্য ত্যাগ করিতে করিতে কহিল, তা খাওয়াটা একটু বেলা উঠলেও তো হতে পারত।

বেলা উঠে গেলে রোদে কষ্ট পাবি। নে, এখন ওঠ; আর আলিস্যি করিস নে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, রোদে কষ্ট পাব কেন, আম্মা, আমি তো আর একটানে অতটা পথ হাঁটব না, পথে জিরিয়ে যাব ঠিক করেছি।

কোথায় জিরুবি?

কেন, শাহপাড়ায় গোলদারদের বাড়ি? তারা লোক বড় ভালো, আমাকে খুব খাতির করে।

মাতা মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তারা যে তোদের মুরীদান, তাদের বাড়ি যাবি? শেষকালে যদি…

আবদুল্লাহ্ বাধা দিয়া কহিল, ওঃ, আমি বুঝি সেখানে খোনকারী করতে যাব! এমনি যাব মেহমানের মতো। একবেলা একটু জিরিয়ে আবার বেলা পড়লে বেরিয়ে পড়ব!

যদি তারা সালামী টালামী দেয়?

দিলেই অমনি নিয়ে নিলুম আর কি!

তারা যে তা হলে বড্ড বেজার হবে, বাবা।

তা হলে আর কী করব, আম্মা। যতদূর পারি তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে।

এমন সহজলভ্য উপজীবিকা যাহাদের চিরদিনের অভ্যাস, অতি সামান্য হলেও তাহাদের পক্ষে উহার আশা পরিত্যাগ করা কঠিন, তাই মাতা মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হইলেন। এখনো যদি আবদুল্লাহ একবার মুরীদানে গিয়া ঘুরিয়া আসে, তাহা হইলে তাহার পড়ার ভাবনা থাকে। না। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হইবে না; অগত্যা তিনি ভাবিলেন, থাক, যে কাজে উহার মন যায় না সে কাজের জন্য পীড়াপীড়ি করা ভালো নহে। খোদা অবশ্যই একটা কিনারা করিয়া দেবেন। আবদুল্লাহর ইচ্ছা ছিল একটু বেলা হইলে ধীরেসুস্থে বাটী হতে বাহির হইবে; কিন্তু মাতার পীড়াপীড়িতে ফজরের নামায বাদেই তাহাকে দুটি খাইয়া রওয়ানা হইতে হইল।

একবালপুর তাহাদের বাটী হইতে আট ক্রোশ। পিতা বাঁচিয়া থাকিতে আবদুল্লাহকে কখনো এতটা পথ হাঁটিয়া যাইতে হয় নাই; গরুর গাড়ি অথবা কোনো কোনো সময়ে পালকি করিয়া সে শ্বশুরালয়ে যাতায়াত করিয়াছে। কিন্তু এক্ষণে টানাটানির সংসারে মিতব্যয়িতার নিতান্ত দরকার বুঝিয়া সে হাঁটিয়াই চলিয়াছে। মাতা অনেক পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন; দুই-এক টাকা গাড়ি ভাড়া দিলে কতই-বা টানাটানি বাড়িত! কিন্তু সে কিছুতেই গাড়ি লইতে রাজি হয় নাই।

গ্রামখানি পার হইয়াই আবদুল্লাহ্ এক বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে আসিয়া পড়িল। তখন শরৎকাল প্রায় হইয়া আসিয়াছে। মাঠগুলি ধান্যে পরিপূর্ণ; মৃদুমন্দ বায়ু হিল্লোলে তাহাদের শ্যামল হাস্য ক্ষণে ক্ষণে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিতেছে। এই অপূর্ব নয়নতৃপ্তিকর দৃশ্য দেখিতে এবং শারদীয় প্রভাতের সুখ-শীতল সমীরণের মধুর স্পর্শ অনুভব করিতে করিতে আবদুল্লাহ্ মাঠের পর মাঠ এবং গ্রামের পর গ্রাম পার হইয়া চলিতে লাগিল।

ক্রমে বেলা বাড়িয়া উঠিল, এবং ক্লান্ত পথিকের পক্ষে হৈমন্তিক রৌদ্রও অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। সুতরাং তিন-চারি ক্রোশ পথ আঁটিবার পর শ্রান্তি দূর করিবার জন্য আবুদল্লাহ্ এক মাঠের প্রান্তে বৃক্ষতলে বসিয়া পড়িল।

কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর যখন তাহার মন বেশ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, তখন নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নানা কথা মনে উঠিতে লাগিল। এতদিন সে যে উচ্চ আশা হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছিল, তাহা সফল হইবার সম্ভাবনা না থাকিলেও, ক্লান্তদেহে আজ বটবৃক্ষতলে বসিয়া সে মনে মনে ভবিষ্যতের যে চিত্রটি আঁকিতেছিল, তাহা নিতান্ত উজ্জ্বলতাহীন নহে। সে ভাবিতেছিল চাকরি তাহাকে করিতেই হইবে, আর কোনো উপায় নাই। সরকারি চাকরি তো পাওয়া কঠিন, মুরব্বি না ধরিতে পারিলে সামান্য কেরানীগিরিও জুটিবে না। কিন্তু মুরব্বি কোথায় পাইবে? কাহাকে ধরিবে? সোজাসুজি গিয়া সাহেব সুবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাইতে পারে। কিন্তু কী চাকরির জন্য চেষ্টা করিবে? পুলিশের? –নাঃ, ও চাকরিটা ভালো নয়। সবরেজিস্ট্রারি?–ওটা পাওয়া বড় কঠিন না হইতে পারে; কত এট্রেন্স ফেল সবরেজিস্ট্রার হইতেছে, কিন্তু অনেক দিন এপ্রেন্টিসি করিতে হয়; ততদিন চলিবে কিসে? একটা মাস্টারি পাইলে মন্দ হয় না; ত্রিশ কি চল্লিশ টাকা মাহিনা পাওয়া যাইতে পারে, চাই কি একটা টুইশন যোগাড় করিতে পারিলে আরো দশ-বিশ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আরো বিশেষ সুবিধা এই যে, মাস্টারি করিতে করিতে বি. এ. পরীক্ষাটার জন্য প্রস্তুত হওয়া যাইবে। এটা মস্ত লাভ। আর কোনো চাকরিতে এই সুবিধাটা হইবে না। শ্বশুর তো সাহায্য করিবেনই না, তাহা জানা আছে; কেবল আম্মাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য। একবার তাহার কাছে যাওয়া। তা তিনি সাহায্য না-ই করিলেন, পরের সাহায্য গ্রহণ না করিতে হইলেই ভালো। আবদুল্লাহ মাস্টারি করিবে; বি. এ. পাস করিয়া তাহার চিরদিনের ঐকান্তিক বাসনা পূর্ণ করিয়া জীবন সফল করিবে। হাতে কিছু টাকা জমাইয়া আবার। কলিকাতায় দুই বৎসর আইন পড়িবে–এখানেও একটি টুইশন যোগাড় করিয়া লইবে। পাস করিয়া যখন সে ওকালতি আরম্ভ করিবে তখন আর ভাবনা কী?–চাই কি, তখন দেশের কাজে, সমাজের কাজে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাইবে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রবর্তন প্রভৃতি ব্যাপারে সে জীবন উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইবে। এই সকল সংস্কার সুসম্পন্ন না হইলে, বিশেষত যতদিন স্ত্রী-শিক্ষা সমাজে প্রচলিত করা না যাইতেছে, ততদিন মুসলমানদের কুসংস্কারের আবর্জনা দূর হইবে না; এবং তাহা না হইলে সমাজের উন্নতি একেবারেই অসম্ভব। আবদুল্লাহ্ মনে মনে স্থির করিয়া ফেলিল যে, খোদা যদি দিন দেন, তবে স্ত্রী-শিক্ষার জন্য তাহার যথাসর্বস্ব পণ করিয়া ফেলিবে!

এইরূপ সুমহৎ সঙ্কল্প করতে করিতে হঠাৎ আবদুল্লাহর চৈতন্য হইল যে, বেলা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। শাহপাড়ায় পৌঁছিতে এখনো এক ক্রোশ পথ বাকি, কাজেই তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহাকে আবার পথ লইতে হইল।

.

০৩.

আবদুল্লাহ্ যখন শাহপাড়ার গোলদার-বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল, তখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। সংবাদ পাইয়া গৃহস্বামী কাসেম গোলদার ব্যস্ত–সমস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল এবং তাহার দীর্ঘ শুভ্র শ্মশ্রুরাজি ভূলুণ্ঠিত করিয়া আবদুল্লাহর কদমবুসি করিতে উদ্যত হইল! এ ধরনের অভিনন্দনের জন্য আবদুল্লাহ্ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। পথে হঠাৎ সাপ দেখিলে মানুষ যেমন এক লম্ফে হটিয়া দাঁড়ায়, সেও তেমনি হাটিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, আহা, করেন কী, করেন কী, গোলদার সাহেব!

কাসেম গোলদার বড়ই সরলপ্রাণ, ধর্মপরায়ণ, পীরভক্ত লোক। আবদুল্লাহর পিতা তাহার পীর ছিলেন; এক্ষণে তাহার মৃত্যুতে আবদুল্লাহ্ তাহার স্থলাভিষিক্ত বলিয়া মনে করিয়া লইয়া সে আবদুল্লাহর কদমবুসি কবিরার জন্য নত মস্তকে হাত বাড়াইয়াছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ্ পা টানিয়া লওয়ায় সে উহা স্পর্শ করিতে পাইল না; তাহার মনে হইল, বেহেশতের দুয়ারের চাবি তাহার হাতের কাছ দিয়া সরিয়া গেল! বড়ই মর্মপীড়া পাইয়া রুদ্ধকণ্ঠে কাসেম কহিতে লাগিল, আমাদের কি পায়ে ঠেললেন, হুজুর? আমরা আপনাদের কত পুরুষের মুরীদ! আপনার কেবলা সাহেব তার এই গোলামের উপর বড়ই মেহেরবান ছিলেন; আপনি আমাদের পায়ে না রাখিলে কী উপায় হবে হুজুর!

কাসেমের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করিয়া আবদুল্লাহ বড়ই অপ্রস্তুত হইয়া গেল। চিরদিনের সংস্কার-বশে যে ব্যক্তি তাহাকে পূর্ব হইতেই পীরের পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিয়াছে, এবং আজ সরল বিশ্বাসে প্রাণের ঐকান্তিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা অঞ্জলি ভরিয়া নিবেদন করিবার জন্য উন্মুখ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, আবদুল্লাহর এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যান যে সে ব্যক্তির প্রাণে গুরুতর আঘাত দিবে ইহা আর বিচিত্র কী! কিন্তু উপায় নাই। এ আঘাত অনেককেই দিতে হইবে, এবং অনেকবার তাহাকে এইরূপ অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হইতে হইবে।

আবদুল্লাহ্ কহিল, অমন কথা বলবেন না, গোলদার সাহেব। আমার বাপ-দাদা সকলেই পীর ছিলেন মানি, কিন্তু আমি তো তাদের মতো পীর হবার যোগ্য হই নি। ও কাজটা আমার দ্বারা কোনোমতেই হবে না। তা ছাড়া আপনি বৃদ্ধ, সুতরাং আমার মুরব্বি; এক্ষেত্রে আমারই উচিত আপনার কদমবুসি করা।

কাসেম শিহরিয়া উঠিয়া দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, আরে বাপরে বাপ! এমন কথা বলে আমাকে গোনাহগার করবেন না, হুজুর! যে বংশে খোদা আপনাকে পয়দা করেছেন, তার এক বিন্দু রক্ত যার গায়ে আছে, তিনিই আমাদের পীর, আমাদের মাথার মণি! আপনাদের পায়ের একটুখানি ধুলো পেলেই আমাদের আখেরাতের পথ খোলাসা হয়ে যায়, হুজুর!

আবদুল্লাহ্ একটুখানি হাসিয়া কহিল, খোদা না করুন যেন আখেরাতের পথ খোলাসা করবার জন্যে কাউকে আমার মতো লোকের পায়ের ধুলো নিতে হয়! তা যাকগে, এখন আমি যে এতটা পথ হেঁটে হয়রান হয়ে এলাম, আমাকে একটু বিশ্রাম করতে দিতে হবে, সে কথা কি ভুলে গেলেন গোলদার সাহেব?

কাসেমের চৈতন্য হইল। তাই তো! এতক্ষণ সে কথাটা যে তাহার খেয়ালেই আসে। নাই। তখনই, ওরে বিছানাটা পেতে দে, পানি আন, তেল আন, গোসলের যোগাড় কর ইত্যাকার শোরগোল পড়িয়া গেল।

আবদুল্লাহ যখন মুরশিদের প্রাপ্য ভক্তি-নিদর্শনগুলি গ্রহণ করিয়া কাসেমের মনের বাসনা পূর্ণ করিতে অস্বীকার করিল, তখন সে অন্তত মেহমানদারি বাবদে সে ত্রুটি ষোল আনা সংশোধন করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। সময়াভাবে এ-বেলা কেবল মোরগের গোশত এবং মুগের ডাল প্রভৃতির দ্বারা কোনো প্রকারে মেহমানের মান-রক্ষা হইল বটে, কিন্তু রাতের জন্যে বড় এক জোড়া খাসির এবং সেই উপলক্ষে গ্রামের প্রধান ব্যক্তিগণকেও দাওয়াদ করিবার বন্দোবস্ত হইয়া গেল।

এদিকে বেলা প্রায় তিন প্রহরের সময় আহারাদি সম্পন্ন করিয়া যখন আবদুল্লাহ্ কাসেম গোলদারকে ডাকিয়া কহিল যে, আর বিলম্ব করিলে চলিবে না, তাহাকে এখনই রওয়ানা হইতে হইবে, নহিলে সন্ধ্যার পূর্বে একবালপুরে পৌঁছিতে পারিবে না, তখন কাসেমের মাথায় যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। সে হাত দুটি জোড় করিয়া এমনই কাতর মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি তাঁহার মুখের উপর স্থাপন করিল যে, বেচারা বুড়া মানুষের মনে দ্বিতীয়বার দুঃখ দিতে আবদুল্লাহর মন সরিল না। সুতরাং সে সেখানেই সেদিনকার মতো রাত্রিবাস করিতে রাজি হইয়া গেল। আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া কাসেম তৎক্ষণাৎ কোমর বাঁধিয়া যথারীতি আয়োজনে লাগিয়া পড়িল।

সারাটা বৈকাল এবং রাত্রি এক প্রহর ধরিয়া লোকজনের আনাগোনা, চিৎকার, বালক বালিকাগণের গণ্ডগোল এবং ডেকচি, কাফগীরের ঘনসংঘাতে গোলদার-বাড়ি মুখরিত হইতে লাগিল। এই বিরাট ব্যাপার দেখিয়া আবদুল্লাহ ভাবিতে লাগিল, মুসলমান সমাজে পীর মুরশিদের সম্ভ্রম ও মর্যাদা কত উচ্চ! গোলদারেরা না হয় সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ; ইহাদের পক্ষে মুরশিদের অভ্যর্থনার জন্য অম্লান বদনে অর্থ ব্যয় করা অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু নিতান্ত দরিদ্র যে, সে-ও তাহার বহু যত্নপালিত খাসি-মুরগির মায়া গৃহাগত মুরশিদের সেবায় উৎসর্গ করিয়া এবং মহাজনের নিকট হইতে উচ্চ হারের সুদে গৃহীত ঋণের শেষ টাকাটি সালামী স্বরূপ তাহার চরণপ্রান্তে ফেলিয়া দিয়া বেহেশতের পাথেয় সঞ্চয় হইল ভাবিয়া আপনাকে ধন্য মনে করে।

রাত্রে আহারাদির পর কাসেম কয়েকজন মাতব্বর লোক লইয়া এক মজলিস বসাইল এবং তাহাদের এই একমাত্র পীরবংশধর যে পৈতৃক ব্যবসায় পরিত্যাগ করিয়া হতভাগ্য মুরীদগণের পারত্রিক কল্যাণ সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন হইয়া পড়িয়াছেন ইহাই লইয়া নানা ছন্দোবন্ধে দুঃখ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। এই পীরগোষ্ঠী যে কত বড় কেরামতকুশল, সমাগত লোকদিগকে তাহা বুঝাইবার জন্য সে আবদল্লাহর পূর্বপুরুষগণের বিষয়ে অনেক গল্প বলিতে লাগিল।

প্রথম যিনি আরব হইতে পীরগঞ্জে আসেন–সে কত কালের কথা, তাহার ঠিকানা নাই;–তিনি প্রকাও এক মাছে চড়িয়া সাগর পার হইয়াছিলেন; তাই তাহাকে সকলে মাহী সওয়ার বলিত। তিনি কত বড় পীর ছিলেন, তাঁহার দস্ত মোবারকের স্পর্শমাত্রেই কেমন করিয়া মরণাপন্ন রোগীও বাঁচিয়া উঠিত, ঘরে বসিয়াই তিনি কেমন করিয়া বহু ক্রোশ দূরবর্তী নদীবক্ষে মজ্জমান নৌকা টানিয়া তুলিয়া ফেলিতেন এবং সেই ব্যাপারে কিরূপে তাঁহার আস্তিন ভিজিয়া যাইত, আকাশে হাত তুলিয়া আও আও বলিয়া ডাকিতেই কোথা হইতে হাজার হাজার কবুতর আসিয়া জুটিত এবং তিনি হাত নাড়িয়া কী প্রকারে আস্তিনের ভিতর হইতে রাশি রাশি ধান, ছোলা, মটর প্রভৃতি বাহির করিয়া তাহাদিগকে খাওয়াইতেন, সে সকল ঘটনা সালঙ্কারে বর্ণনা করিয়া কাসেম সকলকে স্তম্ভিত ও চমৎকৃত করিয়া দিল। আবার শুধু তিনিই যে একলা পীর ছিলেন, এমত নহে, তাহার বংশেও অনেক বড় বড় পীর জন্মিয়া গিয়াছেন; এমনকি, কেহ কেহ শিশুকালেই এমন আশ্চর্য কেরামত দেখাইয়াছেন যে তাহা ভাবিলেও অবাক হইতে হয়। মাহী সওয়ার পীর সাহেবের পৌত্র কিংবা প্রপৌত্রের একটি বড় আদরের কাঁঠাল গাছ ছিল। একবার তাহাতে একটিমাত্র কাঁঠাল ফলিয়াছিল, সেটা তিনি নিজে খাইবেন বলিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার অনুপস্থিতকালে তাহার এক বালক-পুত্র ঐ কাঁঠালটি পাড়িয়া খাইয়া ফেলেন। বাটী আসিয়া পীর সাহেব যখন দেখিলেন যে গাছে কাঁঠাল নাই, তখন তিনি বড়ই রাগান্বিত হইয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, কে উহা খাইয়াছে। সকলেই জানিত, কিন্তু ভয়ে কেহ বলিল না। অবশেষে তিনি পুত্রের বিমাতার নিকট জানিতে পারিলেন কাহার এই কাজ। তখন পুত্রের তলব হইল; কিন্তু তিনি অস্বীকার করিলেন এবং কহিলেন, কেন, বাপজান, কেহ তো সে কাঁঠাল খায় নাই, গাছের কাঁঠাল গাছেই আছে!

তাহার পর পীর সাহেব গিয়া দেখেন, সত্য সত্যই গাছের কাঁঠাল গাছেই ঝুলিতেছে! দেখিয়া তো তিনি অবাক হইয়া গেলেন, কিন্তু ব্যাপার কী, তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন তাহার বড় গোস্বা হইল; তিনি বলিলেন, কেয়া এক ঘরমে দো পীর। যাও বাচ্চা, সো রহো। সেই যে বাচ্চা গিয়া শুইয়া রহিলেন, আর উঠিলেন না!

আবদুল্লাহ্ নিতান্ত নিরুপায় হইয়া বসিয়া বসিয়া কাসেমের এই সরল বিশ্বাসের উচ্ছ্বাস-রঞ্জিত উপাখ্যানগুলি জীর্ণ করিতেছিল। ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া চলিল দেখিয়া

অবশেষে মজলিস ভঙ্গ করিয়া সকলে উঠিয়া গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ্ শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল, পুত্রের পীরত্বে পিতার হৃদয়ে এরূপ সাংঘাতিক হিংসার উদ্রেক আরোপ করিয়া ইহারা পীর মাহাত্ম্যের কী অদ্ভুত আদর্শই মনে মনে গড়িয়া তুলিয়াছে!

.

০৪.

বহু কষ্টে বৃদ্ধ কাসেম গোলদারের সরল ভক্তিজাল ছিন্ন করিয়া পরদিন বৈকালে আবদুল্লাহ্ একবালপুরে পৌঁছিল।

আবদুল্লাহর বড় সম্বন্ধী আবদুল মালেক এইমাত্র নিদ্রা হইতে উঠিয়া বৈঠকখানার বারান্দার এক প্রান্তে জলচৌকির উপর বসিয়া ওযু করিতেছিলেন। লোকটি হাফেজ এবং উকট পরহেজগার; ওযুর সময় কথা বলিলে গোনাহ্ হইবে বলিয়া, কেবল একটুখানি মুচকি হাসিয়া তিনি আপাতত ভগ্নীপতির অভ্যর্থনার কাজ সারিয়া লইলেন এবং পুনরায় সযত্নে ওযু ক্রিয়ায় মনোনিবেশ করিলেন। ওযু শেষে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তারপর দুলা মিঞা ধরগে’ তোমার কী মনে করে? খবর ভালো তো?

আবদুল্লাহ্ তাহার কদমবুসি করিয়া কহিল, জি হাঁ, ভালোই। আপনি কেমন আছেন?

আমি ভালো। একটু বোস ভাই, আমি আসরের নামায পড়ে নিই। এই বলিয়া আবদুল মালেক নামায পড়িতে গেল।

এদিকে চাকর মহলে দুলা মিঞা এয়েছেন, দুলা মিঞা এয়েছেন বলিয়া একটা কলরব উঠিল এবং দেখিতে দেখিতে উহা অন্দরমহল পর্যন্ত সংক্রামিত হইয়া পড়িল। কয়েকটা বাঁদী দরজার প্রান্তদেশ হইতে মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোন্ দুলা মিঞা রে? চাকরেরা জবাব দিল, পীরগঞ্জের দুলা মিঞা।

বাঁদীরা সেই সংবাদ লইয়া অন্দরের দিকে দৌড়িয়া গেল।

দুলা মিঞার আগমন-সংবাদে, অন্দর হইতে একদল ঘোট ঘোট শ্যালক ছুটিয়া আসিল, –কেহ কেহ আবদুল্লাহর নিকটে আসিয়া কদমবুসি করিল, এবং নিতান্ত ছোটগুলি একটু তফাতে দাঁড়াইয়া মুখে আঙুল দিয়া চাহিয়া রহিল।

আবদুল্লাহ্ ইহাদিগের সহিত একটু মিষ্টালাপ করিতেছে, এমন সময় আবদুল মালেক নামায পড়িয়া উঠিয়া একজন চাকরকে ডাকিয়া কহিলেন, ওরে, দুলা মিঞার ওযুর পানি দে।

আবদুল্লাহ্ ওযু করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিল, আবদুল কাদের কোথায়?

আবদুল মালেক কহিল, ওঃ, সে আজ ধরগে’ তোমার মাস তিনেক হল বাড়ি ছাড়া।

কেন কোথায় গেছে?

খোদা জানে, কোথায় গেছে! আব্বার সঙ্গে ধরগে’ তোমার একরকম ঝগড়া করেই চলে গেছে।

আবদুল্লাহ্ একটু শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কেন, কী নিয়ে ঝগড়া কল্লে?

আবদুল্লাহ্ পায়ের ধুলা-মাটি ভালো করিয়া ধুইয়া ফেলিবার জন্য একজন চাকরকে আর এক বদনা পানির জন্য ইশারা করিল। ছোকরার দলের মধ্যে একজন খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বিরক্ত হইয়া আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিলেন, হাসছিস কেন রে?

একজন কহিল, ঐ দেখুন, ভাইজান, দুলাভাই নাঙ্গল চষে এয়েছেন, তাই এক হাঁটু ধুলো-কাদা লেগে রয়েছে!

আবদুল মালেক এক ধমক দিয়া কহিলেন, যা–যাঃ! ছেঁড়াগুলো ধরগে’ তোমার ভারি বেতমিজ হয়ে উঠেছে! যা-না তোরা, ওযু করে আয় গে, নামাযের ওক্ত হয়ে গেছে, এখনো ধরগে’ তোমার দাঁত বার করে হাসছে আর ফাজলামি কচ্ছে! যাঃ

ছেলের দল তাড়া খাইয়া চলিয়া গেলে আবদুল মালেক কহিলেন, সত্যি, দুলা মিঞা, এমন করে হেঁটে আসাটা ধরগে’ তোমার ভালো হয় নি। নিদেনপক্ষে একখানা গরুর গাড়ি করে তোমার আসা উচিত ছিল।

আবদুল্লাহ্ কহিল, আমার মতো গরিবের পক্ষে অতটা আমীরি পোষায় না, ভাই সাহেব!

আরে না, না; এ ধরগে’ তোমার আমীরির কথা হচ্ছে না। লোকের মান-অপমান আছে তো। এতে ধরগে’ তোমার লোকে বলবে কী?

লোকে কী বলে না বলে, তা হিসেব করে সকল সময় কি চলা যায়? লোকে কেবল বলতেই জানে, কিন্তু গরিবের মান বাঁচাবার পয়সা যে কোত্থেকে আসবে তা বলে দেয় না!

একখানা গরুর গাড়ি করে আসতে ধরগে’ তোমার কতই-বা খরচ হত?

তা যতই হোক, গরিবের পক্ষে সেটা মস্ত খরচ বৈকি!

তবু, ধরগে’ তোমার খোদা যে ইজ্জতটুকু দিয়াছেন, সেটুকু ধরগে’ তোমার বজায় রাখতে তো হবে!

যে ইজ্জতের সঙ্গে খোদা পয়সা দেন নি, সেটা ইজ্জতই নয় ভাই সাহেব! বরং তার উল্টো। সেটাকে যে হতভাগা জোর করে ইজ্জত বলে চালাতে চায়, তার কেসমতে অনেক দুঃখ লেখা থাকে।

কথাটা আবদুল মালেকের ঠিক বোধগম্য হইল না; সুতরাং কী জবাব দিবেন স্থির করিতে না পারিয়া তর্কটা ঘুরাইয়া দিবার জন্য কহিলেন, তোমরা ভাই দু পাতা ইংরেজি পড়ে কেবল ধরগে’ তোমার তর্ক করতেই শেখ; তোমাদের সঙ্গে তো আর কথায় পারা যাবে না! ধরগে’ তো–

আবদুল্লাহ বাধা দিয়া কহিল, যাকগে, ও সব বাজে তর্কে কাজ নেই। আমি নামাযটা পড়ে নিই। নামায শেষে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি যে বলছিলেন, আবদুল কাদের বাড়ি থেকে ঝগড়া করে বেরিয়েছে…

আবদুল মালেক কহিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে গোঁ ধরেছে, চাকরি করবে। আব্বা বলেন, না, আবার মাদ্রাসায় পড়;–তা তিনি ধরগে’ তোমার ভালো কথাই বলেন; দু-তিন বছর ঘরে বসে বসে নষ্ট কল্লে, পড়াশুনা কিচ্ছু কল্লে না–তদ্দিনে সে ধরগে’ তোমার পাস-করা মৌলবী হতে পারত–দীনী এলম হাসেল করত। তা সেদিকে তো তার মন নেই; বলে চাকরি করবে।

তা বেশ তো চাকরি কল্লেই বা তাতে ক্ষেতিটা কী হত?

আবদুল মালেক বিরক্ত হইয়া কহিলেন, হ্যাঁঃ, চাকরি করবে। আমাদের খান্দানে ধরগে’ তোমার কেউ কোনো কালে চাকরি কল্লে না। আর আজ সে যাবে চাকরি কত্তে? তা যদি ধরগে’ তোমার তেমন বড় চাকরি টাকরি হত, না হয় দোষ ছিল না;-উনি যে কটর মটর একটু ইংরেজি শিখেছেন, তাতে ধরগে’ তোমার ছোট চাকরি ছাড়া আর কী জুটবে? তাতে মান থাকবে? তাতে বাপ-দাদার নাম ধরগে’ তোমার–

সে গেছে কোথায়, ভাই সাহেব?

গেছে সদরে, আর যাবে কোথায়? মোল্লার দৌড় ধরগে’ তোমার মসজিদ পর্যন্ত কিনা! বলিয়া আবদুল মালেক একটু হাসিয়া দিলেন।

আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, সেখানে বসে কী কচ্ছে, তার কোনো খবর পেয়েছেন?

করবে আর কী? সেখানে আকবর আলী বলে একজন আমলা আছে তার বাপ ধরগে’ তোমার প্যাদাগিরি কত্ত–তারই ছেলে পড়ায় আর সে চাট্টি খেতে দেয়। সে নাকি বলেছে। ওকে সব্‌রেজিস্ট্রার করে দেবে!

আবদুল্লাহ কহিল, বেশ তো, যদি সব্‌রেজিস্ট্রার হতে পারে তো মন্দ কী?

আবদুল মালেক নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কহিলেন, হ্যাঃ, সব্‌রেজিস্ট্রার চাকরি ধরগে’ তোমার অনি মুখের কথা আর কি! তাতে আবার প্যাদারপোকে মুরব্বি ধরেছেন, দুনিয়ায় আর লোক পান নি!

এই প্যাদার পো’টি কে, জানিবার জন্য আবদুল্লাহ্ বড়ই উৎসুক হইল, কিন্তু তাহার প্রতি আবদুল মালেকের যেরূপ অবজ্ঞা দেখা গেল তাহাতে তাহার নিকট হইতে সঠিক খবর পাওয়া যাইবে, এরূপ বোধ হইল না। পরে এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিলেই জানা যাইবে মনে করিয়া আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল।

কিছুক্ষণ পরে আবদুল্লাহ্ কহিল, আমি তাকে বাড়ির ঠিকানায় একখানা পত্র লিখেছিলাম, তার কোনো জবাব পেলাম না। বোধহয় সে চিঠি সে পায় নি।

আবদুল মালেক জিজ্ঞাসা করিলেন, কবে লিখেছিলে?

আব্বার ব্যারামের সময়।

আবদুল মালেক যেন একটু বিচলিত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, তা–তা–তা ধরগে’ তোমার ঠিক বলতে পারিনে।

আবদুল্লাহ্ আবার কিছুক্ষণ ভাবিয়া পরে জিজ্ঞাসা করিল, শ্বশুর সাহেব এখন ভালো আছেন তো?

আবদুল মালেক কহিলেন, নাঃ, ভালো আর কোথায়! তিনি ব্যারামে পড়েছেন এই ধরগে’ তোমার প্রায় মাসাবধি হল–

ব্যারামটা কী? এখন কেমন আছেন?

এই জ্বর আর কি! এখন ধরগে’ তোমার একটু ভালোই আছেন।

আবদুল্লাহ্ কহিল, ও জ্বর তো আপনাদের বাড়িতে লেগেই আছে! দুদিন ভালো থাকেন তো পাঁচ দিন জ্বরে ভোগেন। কাউকে তো বাদ পড়তে দেখিন…

না, না, এবার আবা বড় শক্ত ব্যারামে পড়েছিলেন। জ্বরটা ধরগে’ তোমার দশ-বার দিন ছিল। বড় কাহিল হয়ে গেছেন। একেবারে ধরগে’ তোমার বাচবারই আশা ছিল না। চাচাজানের ফাতেহার সময় ধরগে’ তোমার সে হাঙ্গামেই আমরা কেউ যেতে পারি নি। ধরগে’ তোমা–

তা ফাতেহার সময় যেন যেতে পারেন নি, কিন্তু আবার ব্যারামের সময় যখন আমি খবর পাঠাই, তখন আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত পাঠালেন না, হালিমাকেও না। মরণকালে তিনি ওদের একবার দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনাদের মেহেরবানিতে তার ভাগ্যে আর সেটা ঘটল না।

আবদুল মালেক একটু উষ্ণ হইয়া উঠিয়া কহিল, বাঃ, কেমন করে পাঠাই? আবদুল কাদের তখন বাড়িতে ছিল না, আব্বাও ছিলেন না, কার হুকুমে ধরগে’ তোমার পাঠাই!

আবদুল্লাহ একটু শ্লেষের সহিত কহিল, আঁ, বাপ মরে, এমন সময় তো হুকুম ছাড়া পাঠানো যেতেই পারে না! তা হালিমা আপনাদের বউ তাকে না হয় আটকে রাখলেন, কিন্তু আমার স্ত্রীকে কেন পাঠালেন না। তার বেলায় তো আর কারুর হুকুমের দরকার ছিল না।

কার সঙ্গে পাঠাব? বাড়িতে আর কেউ ছিল না, আমি তো আর ধরগে’ তোমার বাড়ি ফেলে যেতে পারি নে!

কেন, আবদুল খালেকের সঙ্গে পাঠালেই তো হত।

আবদুল মালেক যেন একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। বলিল, সে কী! তার সঙ্গে? সে হল ধরগে’ তোমার গায়ের মহরুম…

আবদুল্লাহ্ একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, আবদুল খালেক গায়ের মরুম হয়ে গেল!

বাঃ, হবে না? সে হল ধরগে’ তোমার খালাতো ভাই বৈ তো নয়।

কেন, কেবল কি সে খালাতো ভাই? চাচাতো ভাইও তো বটে–বাপের আপন মামাতো ভাইয়ের ছেলে–আবার ধরতে গেলে একই বংশ…

তা হলই-বা, তবু শরীয়তমতো সে ধরগে’ তোমা….

এমন নিকট জ্ঞাতি যে, তার বেলাতেও আপনারা শরীয়তের পোকা বেছে মহরুম, গায়ের মহরুমের বিচার করতে বসবেন, বিশেষ আমার এমন বিপদের সময়, এতটা আমার বুদ্ধিতে জুয়ায় নি।

তা জুয়াবে কেন? তোমরা ধরগে’ তোমার ইংরেজি পড়েছ, শরা-শরীয়ত তো মান না, সে জন্যে ধরগে’ তোমার…

অত শরীয়তের ধার ধারি নে ভাই সাহেব; এইটুকু বুঝি যে মানুষের সুখ-সুবিধারই জন্য শরা-শরীয়ত জারি হয়েছে; বে-ফায়দা কালে-অকালে কড়াকড়ি করে মানুষকে দুঃখ দেবার জন্যে হয় নি। যাক গে যাক, আপনার সঙ্গে আর সেসব কথা নিয়ে মিছে তর্ক করে কোনো ফল নেই। আযানও পড়ে গেল, চলুন নামায পড়া যাক।

বহির্বাটীর এক কোণে ইহাদের বৃহৎ নূতন পারিবারিক মসজিদ নির্মিত হইতেছিল। উহার গম্বজগুলির কাজ শেষ হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু মেঝে, বারান্দা, কপাট, এসকল বাকি থাকিলেও কিছুদিন হইতে উহাতে রীতিমতো নামায আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। আবদুল কুদ্দুস সাহেবের বাঁদী-পুত্র খোদা নেওয়াজ এই নূতন মসজিদের খাদেম। সে-ই আযান দিতেছিল। আযান শুনিয়া আবদুল মালেক আবদুল্লাহূকে লইয়া তাড়াতাড়ি মসজিদের দিকে চলিলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাহার ছোট ছোট কয়েকটি বৈমাত্রেয় ভাই, দুই-এক জন গোমস্তা এবং চাকরদের মধ্যে কেহ কেহ মসজিদে গিয়া উঠিল। প্রতিবেশীরাও অনেকে মগরেবের সময় এইখানে আসিতে আরম্ভ করিয়াছিল; সুতরাং জামাত মন্দ হইল না। আবদুল মালেক ভিড় ঠেলিয়া পেশনামাজের উপর গিয়া খাড়া হইলেন এবং কৃচ্ছ্বসাধ্য কেরাত ও বহুবিধ শিরশ্চালনার সহিত সুরা ফাতেহার আবৃত্তি আরম্ভ করিলেন।

নামায শেষে আবদুল্লাহ্ বাহিরে আসিয়া মসজিদটি দেখিতে লাগিল। একটু পরেই আবদুল মালেক বাহিরে আসিলে কহিল, এখনো তো মসজিদের ঢের কাজ বাকি আছে, দেখছি।

আবদুল মালেক কহিল, হ্যাঁ, এখনো ধরগে’ তোমার অর্ধেক কাজই বাকি।

উভয়ে বৈঠকখানার দিকে অগ্রসর হইল। আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কত খরচ পড়ল?

ওঃ, সে ঢের। ধরগে’ তোমার প্রায় হাজার আষ্টেক খরচ হয়ে গেছে।

মসজিদটি নির্মাণ করিতে সৈয়দ সাহেবকে যথেষ্ট বেগ পাইতে হইয়াছে। হাতে নগদ। টাকা কিছুই ছিল না; সুতরাং কয়েকটি তালুক বিক্রয় করা ভিন্ন তিনি টাকা সংগ্রহের কোনো উপায় খুঁজিয়া পান নাই। আবদুল মালেক কিন্তু এই বিক্রয় ব্যাপারে মনে মনে পিতার ওপর চটিয়া গিয়াছিল। সে ভাবিতেছিল, পিতা নিজের আখেরাতের জন্য পুত্রদিগকে তাহাদের হক হইতে বঞ্চিত করিতেছেন। তাই মসজিদের খরচের কথায় সে তাহার মনের বিরক্তিটুকু চাপিয়া রাখিতে পারিল না। সে বলিয়া ফেলিল, খান কয়েক তালুকও ধরগে’ তোমার এই বাবদে উড়ে গেছে।

কী রকম?

বিক্রি হয়ে গেছে।

শেষটা তালুক বেচতে হল! কেন, বন্ধক রেখে টাকা ধার নিলেও তো হত।

না; তাতে ধরগে’ তোমার সুদ লাগে যে!

কিন্তু তালুক বিক্রয় করিয়া মসজিদ নির্মাণের কথায় আবদুল্লাহ্ বড়ই আশ্চর্য বোধ করিল। সে কহিল, নিকটেই যখন আবদুল খালেকদের একটা মসজিদ রয়েছে, তখন এত টাকা নষ্ট করে আর মসজিদ দেওয়ার কী দরকার ছিল, তা তো আমি বুঝি নে!

আবদুল মালেক ছোটখাটো একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, যার আখেরাতের কাজ সেই করে রে ভাই; ও মসজিদ যিনি দিয়ে গেছেন, তাঁর কাজ তিনিই করে গেছেন; তাতে করে ধরগে’ তোমার আর কারুর আকবতের কাজ হবে না।

আবদুল্লাহ্ কহিল, এক মসজিদের আযান যত দূর যায়, তার মধ্যে আর একটা মসজিদ দেওয়া নিতান্তই ফজুল। এতে আকবতের কোনো কাজ হল বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। তার ওপর এমন করে তালুক বেচে মসজিদ দেওয়া, এ যে খামাখা টাকা নষ্ট করা।

নষ্ট ঠিক না; আবার কাজ আব্বা করে গেলেন, কিন্তু আমাদের ধরগে’ তোমার.. একরকম ভাসিয়ে দিলেন। তালুক কটা কিনেছে কে, জান?

না, কে কিনেছে?

আবদুল খালেকের বেনামীতে মামুজান কিনেছেন।

কোন্ মামুজান?

রসুলপুরের মামুজান–তিনি ছাড়া ধরগে’ তোমার আবদুল খালেকের, বেনামীতে আবার কে কিনবে?

আবদুল্লাহর খেয়াল হইল রসুলপুরের মামুজান আবদুল খালেকদেরই আপন মাতুল, আবদুল মালেকদিগের বৈমাত্রেয় মাতুল। কিন্তু সে বুঝিতে পারিল না, নিজের নামে না কিনিয়া ভাগিনেয়ের নামে বেনামী কেন করিলেন। সুতরাং ঐ কথা আবদুল মালেককে জিজ্ঞাসা করিল।

আবদুল মালেক কহিল, কী জানি! হয়তো ধরগে’ তোমার কোনো মতলব টতলব আছে।

তা হবে বলিয়া আবদুল্লাহ্ চুপ করিয়া রহিল। এমন সময় অন্দর হইতে তাহার তলব হইল।

.

০৫.

অন্দরে প্রবেশ করিয়া আবদুল্লাহ্ তাহার শাশুড়িদ্বয় এবং অপরাপর মুরব্বিগণের নিকট সালাম আদাব বলিয়া পাঠাইল। তাহার পর হালিমার কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইতেই হালিমা তাহার শিশুপুত্রটি ক্রোড়ে লইয়া কাঁদিতে কাদিতে আসিয়া ভ্রাতার কদমবুসি করিল। পিতার মৃত্যু-সংবাদ পাওয়া অবধি সে অনেক কাদিয়াছে। তাহার স্বামী বিদেশে; এ বাটীতে তাহাকে প্রবোধ দিবার আর কেহ নাই, সুতরাং সে নির্জনে বসিয়া নীরবে কাদিয়াই মনের ভার কিঞ্চিৎ লঘু করিয়া লইয়াছে। কিন্তু আজ ভ্রাতার আগমনে তাহার রুদ্ধ শোক আবার উথলিয়া উঠিল; সে আবদুল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।

উচ্ছ্বসিত শোকাবেগে আবদুল্লাহরও হৃদয় তখন মথিত হইতেছিল; তাই অন্যমনস্ক হইবার জন্য সে হালিমার ক্রোড় হইতে শিশুটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার মুখচুম্বন করিল এবং ধীরে ধীরে দোল দিতে দিতে কহিল, আর মিছে কেঁদে কী হবে বোন! যা হবার হয়ে গেছে, সবই খোদার মরজি।

এদিকে হালিমার পুত্রটি অপরিচিত ব্যক্তির অযাচিত আদরে বিরক্ত হইয়া খুঁতখুঁত করিতে লাগিল দেখিয়া হালিমা তাহাকে ক্রোড় হইতে ফিরাইয়া লইল এবং অনিরুদ্ধ কণ্ঠে কহিতে লাগিল, মরণকালে আব্বা আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এমন কেসমত নিয়ে এসেছিলাম যে, সে সময়ে তার একটু খেদমত কত্তেও পেলাম না–এ কষ্ট কি আর জীবনে ভুলতে পারব, ভাইজান!

আবদুল্লাহ্ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিল, তা আর কী করবে বোন! তখন তোমার স্বামী, শ্বশুর, কেউ বাড়ি ছিলেন না…

কেন, বড় মিঞা তো ছিলেন?

তিনি বললেন যে, বাড়িতে তিনি তখন একলা, কী করে সব ফেলে যাবেন! আর তা ছাড়া তোমার স্বামীর কি শ্বশুরের বিনা হুকুমে…

হ্যাঁ! গরিবের বেলাতেই যত হুকুমের দরকার। কেন?–সেবার আমার বড় জার মার ব্যারামের সময় তো কেউই বাড়ি ছিলেন না, আর উনি তো তখন কলকেতায় পড়েন। বুবুর এক ভাই হঠাৎ একদিন এসে তাকে নিয়ে চলে গেলেন, আমার শাশুড়ি-টাশুড়ি কেউ তো টু শব্দটি কল্লেন না! তারা বড়লোক কিনা তাই আর কারো হুকুম নেবার দরকার হল না…

হয়তো তারা আগে থেকে হুকুম নিয়ে রেখেছিলেন…

না–তা হবে কেন? ওঁরা যেদিন চলে গেলেন, তার এক দিন বাদেই তো আমার শ্বশুর বাড়ি এলেন। বাড়ি এসে তবে সব কথা শুনে চুপ করে থাকলেন।

আবদুল্লাহ্ দুঃখিত চিত্তে কহিতে লাগিল, তা আর কী হবে বোন! বড়লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা কল্লে এ-রকম অবিচার সইতেই হয়। দেখ, তোমার বেলা না হয় দুলা মিঞার হুকুমের দরকার ছিল, কিন্তু আমি তো তোমার ভাবীকে পাঠাতে লিখেছিলাম, তাও তো পাঠালেন না! আবদুল খালেকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে পাঠাতে পাত্তেন, কিন্তু ভাই সাহেব বললেন, সে গায়ের মহরুম কাজেই তার সঙ্গে পাঠানো যায় না…

হালিমা বাধা দিয়া কহিল, কিসের গায়ের মহরুম? ও-সব আমার জানা আছে। কেবল না পাঠাবার একটা বাহানা! কেন? মজিলপুরের ফজলু মিঞাকে তো এঁরা সকলেই দেখা দেন, তিনিও তো খালাতো ভাই!

আবদুল্লাহ কহিল, ফজলু হল গিয়ে মায়ের আপন বোনের ছেলে, আর আবদুল খালেক সতাত বোনের ছেলে…

তা হলই-বা সতাত বোনের ছেলে; ইনি যদি গায়ের মরুম হন তবে উনিও হবেন। ওসব কোনো কথা নয়, ভাইজান, আসল কথা, ফজলু মিঞারা বড়লোক আর এ বেচারা গরিব।

আবদুল্লাহ্ গম্ভীর-বিষণভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, তা সত্য! গরিবকে এরা বড়ই হেকারত করেন–তা সে এগানাই হোক, আর বেগানাই হোক।

হালিমা একটু ভাবিয়া আবার কহিল, আচ্ছা, ওঁর সঙ্গে যেন না পাঠালেন; কিন্তু বড় মিঞা তো নিজেও নিয়ে যেতে পাত্তেন…

তিনি বাড়ি ফেলে যেতে পাল্লেন না যে!

ওঃ। ভারি তো তিনি বাড়ি আগলে বসে রয়েছেন কিনা! তিনি তো আজকাল বাইরেই থাকেন, অন্দরের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

কেন, কেন! কী হয়েছে?

কথাবার্তা নিম্ন স্বরেই চলিতেছিল; কিন্তু এক্ষণে হালিমা আরো গলা নামাইয়া কহিল, হবে আর কী? ওই গোলাপী ছুঁড়িটেকে উনি নিকে করেছেন কিনা তাই।

এই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ করিবার জন্য আবদুল্লাহ্ কহিল, যাক্ গে যাক। ওসব কথায় আর কাজ নেই। তোমার ভাবী কোথায়?

তিনি আম্মার ঘরে নামায পড়ছেন।

তখন এশার ওক্ত ভালো করিয়া হয় নাই; সুতরাং আবদুল্লাহ্ ভাবিল, বুঝি এখনো মগরেবের জের চলিতেছে। তাই জিজ্ঞাসা করিল, এত লম্বা নামায যে?

হালিমা কহিল ওঃ! তা বুঝি আপনি জানেন না! এবার আমার শ্বশুরের ব্যারামের সময় পীর সাহেব এসেছিলেন কিনা, তাই তখন ভাবী তার কাছে মুরীদ হয়েছেন। সেই ইস্ত আমার শ্বশুরের মতো সেই মগরেবের সময় জায়নামাজে বসেন, আর এশার নামায শেষ করে তবে ওঠেন।

আবদুল্লাহ্ সকৌতুকে তাহার স্ত্রীর আচার-নিষ্ঠার বিবরণ শুনিতেছিল। শুনিয়া সে কহিল, বটে নাকি? তা হলে তোমার ভাবী তো দেখছি এই বয়েসেই বেহেশতের সিঁড়ি গাঁথতে লেগে গেছেন…।

হালিমা কহিল, না না, ঠাট্টা নয়; ভাবী আমার বড়ই দীনদার মানুষ। তার পর আবার পীর সাহেবের কাছে সেদিন মুরীদ হয়েছেন…

তা তুমিও সেইসঙ্গে মুরীদ হলে না কেন?

হালিমা হঠাৎ বিষাদ-গম্ভীর হইয়া ধীরে ধীরে কহিল, আমি যে আব্বার কাছেই আর বছর মুরীদ হয়েছিলাম, ভাইজান!

এই কথায় উভয়ের মনে পিতার স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। উভয়ে কিয়ৎকাল নীরব হইয়া রহিল।

আবদুল্লাহ্ হাত বাড়াইয়া কহিল, খোকাকে দেও তো আর একবার আমার কাছে…

ইতিমধ্যে খোকা মাতার স্কন্ধে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। হালিমা তাহাকে দুই বাহুর উপর নামাইয়া কহিল, এখন থাক, আবার জেগে উঠে চেঁচাবে। শুইয়ে দিই।

আবদুল্লাহ কহিল, আচ্ছা হালিমা, ও-বেচারার বুকের ওপর একটা আধমনি পাথর চাপিয়ে রেখেছ কেন?

হালিমা পুত্রকে শোয়াইতে শোয়াইতে জিজ্ঞাসা করিল, আধমনি পাথর আবার কোথায়?

ঐ যে মস্ত বড় একটা তাবিজ।

ওঃ! ও একখানা হেমায়েল-শরিফ তাবিজ করে দেওয়া হয়েছে।

আবদুল্লাহ্ চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিল, এ্যাঁ! একেবারে আস্ত কোরান!

হালিমা কহিল, কী করব ভাইজান, সকলে মিলে ওর দু হাতে, গলায় একরাশ তাবিজ বেঁধে দিয়েছিলেন। তার কতক রুপোর, কতক সোনার–সেগুলোর জন্যে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু কাপড়ের মোড়ক করে যেগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোতে তেল-ময়লা জড়িয়ে এমন বিশ্রী গন্ধ হয়ে উঠেছিল যে, উনি একদিন রাগ করে সব খুলে ফেলে দিয়েছিলেন। আম্মা, বুবু, এঁরা সব ভারি রাগারাগি কত্তে লাগলেন। তাইতে উনি বললেন যে, একখানা কোরান-মজিদই তাবিজ করে দিচ্ছি–তার চাইতে বড় আর কিছুই নেই! তাই একটা আসী কোরান দেওয়া হয়েছে।

এমন সময় একটা বাঁদী নাশতার খাঞ্চা লইয়া আসিল, এবং শাশুড়ি প্রভৃতি মুরব্বিগণের দোয়া আবদুল্লাহকে জানাইল। আবদুল্লাহ্ কহিল, এখন নাশতা কেন?

হালিমা কহিল, এখন না তো কখন আবার নাশতা হবে?

একেবারে ভাত খেলেই হত।

ওঃ, এ-বাড়ির ভাতের কথা ভুলে গেছেন ভাইজান? রাত দুপুরের তো এদিকে না, ওদিকে বরং যতটা পারে।

তা বটে! তবে নাশতা একটু করেই নেওয়া যাক। এই বলিয়া আবদুল্লাহ দস্তরখানে গিয়া বসিল। একটা বাঁদী সেলাচী লইয়া হাত ধোয়াইতে আসিল। তাহার পরিধানে একখানি মোটা ছেঁড়া কাপড়, তাহাতে এত ময়লা জমিয়া আছে যে, বোধহয় কাপড়খানি ক্রয় করা অবধি কখনো ক্ষারের মুখ দেখে নাই! উহার দেহটিও এমন অপরিষ্কার যে, তাহার মূল বর্ণ কী ছিল, কাহার সাধ্য তাহা ঠাহর করে!

আবদুল্লাহ্ অত্যন্ত বিরক্তির সহিত কহিল, আচ্ছা হালিমা, তোমরা এই ছুঁড়িগুলোকে একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পার না? ওদের দেখলে যে বমি আসে। আর এই ময়লা গা হাত নিয়ে ওরা খাবার জিনিসপত্র নাড়ে-চাড়ে, ছেলে-পিলে কোলে করে, তাদের খাওয়ায় দাওয়ায়, এতে শরীর ভালো থাকবে কেন?

ঘরে জন দুই বাঁদী ছিল; আবদুল্লাহর এই কথায় উহারা ফিক্‌ ফিক্‌ করিয়া হাসিতে হাসিতে মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া গেল–যেন দুলা মিঞা তাহাদের লইয়া ভারি একটা রসিকতা করিতেছেন।

হালিমা কহিল, কী করব ভাইজান, এ বাড়ির ঐ রকমই কাণ্ডকারখানা। প্রথম প্রথম আমারও বড়ড় ঘেন্না করত, কিন্তু কী করব, এখন সয়ে গেছে! অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু হারামজাদীগুলোর সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠি নি। চিরকেলের অভ্যেস, তাই পরিষ্কার থাকাটা ওদের ধাতেই সয় না।

একখানি পরোটার এক প্রান্ত ভাঙিতে ভাঙিতে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, কাপড় ওদের কখানা করে আছে?

ও, তা বড় বেশি না; কারুর ঐ একখানা, কারুর-বা দেড়খানা—

দেড়খানা কেমন?

একখানা গামছা কারুর কারুর আছে, কালেভদ্দরে সেইখানা পরে তালাবে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আসে।

চামচে করিয়া এক টুকরা গোশত ও একটুখানি লোআব তুলিয়া লইয়া আবদুল্লাহ্ কহিল, তা বেচারাদের খানকয়েক করে কাপড় না দিলে কেমন করেই-বা পরিষ্কার রাখে, এতে ওদেরই-বা এমন দোষ কী!

আর খানকয়েক করে কাপড়! আপনিও যেমন বলেন! ও শুয়োরের পালগুলোকে অত কাপড় দিতে গেলে এঁরা যে ফতুর হয়ে যাবেন দুদিনে!

তবু এতগুলো বাঁদী রাখতেই হবে!

হালিমা কহিল, তা না হলে আর বড়মানুষি হল কিসে ভাইজান!–ও কী? হাত তুলে বসলেন যে? কই, কিছুই তো খেলেন না!…

নাশতা আর কত খাব?

না, না, সে হবে না; নিদেন এই কয়খানা মোরব্বা আর এই হালুয়াটুকু খান। এই বলিয়া হালিমা মিষ্টান্নের তশতরিগুলি ভ্রাতার সম্মুখে বাড়াইয়া দিল। অগত্যা আরো কিছু খাইতে হইল।

নাশতা শেষ করিয়া হাত ধুইতে ধুইতে আবদুল্লাহ্ জিজ্ঞাসা করিল, আবদুল কাদেরের কোনো চিঠিপত্র পেয়েছ এর মধ্যে?

হালিমা মাথা নিচু করিয়া আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াইতে জড়াইতে কহিল, আমার কাছে চিঠি লেখা তো উনি অনেকদিন থেকে বন্ধ করেছেন।

আবদুল্লাহ্ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

হালিমা কহিল, এ বাড়ির কেউ ওসব পছন্দ করেন না। বলেন–জানানাদের পক্ষে লেখাটেখা হারাম। তাতেও বাধত না–উনি ওসব কথা গ্রাহ্য কত্তেন না; কিন্তু চিঠি হাতে পেলেই বড় মিঞা সব খুলে খুলে পড়েন, তাই উনি চিঠিপত্র লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।

এ বাটীর মহিলাগণ চিঠিপত্রের ধার বড় একটা ধারিতেন না। পড়াশুনার মধ্যে কোরান শরীফ, তাহার উপর বড়জোর উর্দু মেহুল জেন্নত পর্যন্ত; ইহার অধিক বিদ্যা তাহাদিগের পক্ষে নিষিদ্ধ ফল। লেখা–তা সে উর্দুই হোক আর বাঙলাই হোক, আর বাঙলা পড়া, এ সকল তো একেবারেই হারাম। হালিমা যদিও পিত্রালয়ে থাকিতে এই হারামগুলি কিঞ্চিৎ আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিল এবং বিবাহের পর স্বামীর উৎসাহে প্রথম প্রথম উহাদের চর্চাও কিছু কিছু রাখিয়াছিল, কিন্তু অল্পকালমধ্যেই শ্বশুরালয়ের কুশাসনে তাহার এই কু-অভ্যাসগুলি দূরীভূত হইয়া গিয়াছিল। আবদুল্লাহ্ হালিমাকে পত্র লিখিলে, সে অপরাপর অন্দরবাসিনীদের ন্যায় বাটীর কোনো বালককে দিয়া অথবা বাহিরের কোনো গোমস্তার নিকট বাঁদীদের মারফত খবর দেওয়াইয়া জবানী-পত্র লিখাইয়া লইত। এইরূপ জবানীপত্র পাইলে আবদুল্লাহ্ ভগ্নীকে লেখাপড়ার চর্চা ছাড়িয়া দিয়াছে বলিয়া ভর্ৎসনা করিয়া পত্র লিখিত এবং সাক্ষাৎ হইলে হালিমা সময় পায় না ইত্যাদি বলিয়া কাটাইয়া দিত। এতদিন সে আসল কথাটি অনাবশ্যক বোধে ভ্রাতাকে বলে নাই, কিন্তু সম্প্রতি তাহার মন এ বাটীর সকলের উপর তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়া সে কথায় কথায় অনেক কিছু বলিয়া ফেলিয়াছে। আবদুল্লাহও আজ বুঝিতে পারিল, হালিমা কেন স্বহস্তে পত্রাদি লেখে না। মনে মনে তাহার রাগটা পড়িল গিয়া আবদুল মালেকের ওপর। তিনি কেন পরের চিঠি খুলিয়া পড়েন–তাহার কি একটুও আক্কেল নাই? ছোট ভাই তাহার স্ত্রীর নিকট পত্র লিখিবে, তাহাও খুলিয়া পড়িবেন? কী আশ্চর্য!

এই কথাটি মনে মনে আলোচনা করিতে করিতে আবদুল্লাহর সন্দেহ হইল, বোধহয় সে কলিকাতা হইতে আসিবার সময় পিতার রোগের সংবাদ দিয়া আবদুল কাদেরকে যে পত্র লিখিয়াছিল, তাহাও আবদুল মালেকের কবলে পড়িয়া মারা গিয়াছে। তাহার এই সন্দেহের কথা সে হালিমাকে খুলিয়া বলিল। হালিমা জিজ্ঞাসা করিল, সেটা কি ইংরেজিতে লেখা ছিল?

আবদুল্লাহ্ কহিল, হ্যাঁ ইংরেজিতে। অনেক দিন আবদুল কাদের আমাকে পত্র লেখে নি; আমিও জানতাম না যে, সে চাকরির সন্ধানে বরিহাটে গেছে। তাই বাড়ির ঠিকানাতেই লিখেছিলাম।

হালিমা একটু ভাবিয়া কহিল, একদিন বড় মিঞার ছেলে জানু ইংরেজি চিঠির মতো কী একটা কাগজ নিয়ে খেলা করছিল। আমি মনে করলাম, এ ইংরেজি লেখা কাগজ ওনার ছাড়া আর কারুর হবে না; কোনো কাজের কাগজ হতে পারে বলে আমি সেটা জানুর হাত থেকে নিয়ে তুলে রেখেছিলাম।

আবদুল্লাহ্ আগ্রহের সহিত কহিল, কোথায় রেখেছিলে আন তো দেখি।

তার খানিকটা নেই, জানু ছিঁড়ে ফেলেছিল। আনছি এখনই– এই বলিয়া হালিমা সেই ছেঁড়া কাগজখানি বাক্স খুলিয়া বাহির করিল।

কাগজের টুকরাটি দেখিয়াই আবদুল্লাহ্ বলিয়া উঠিল, বাঃ, এ তো দেখছি আমারই সেই চিঠি।

হালিমা কহিল, তবে নিশ্চয়ই বড় মিঞা ওটা খুলেছিলেন, তারপর ইংরেজি লেখা দেখে ফেলে দিয়েছিলেন।

একটু আগেই যখন আবদুল্লাহ আবদুল মালেককে সেই চিঠির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল তখন হঠাৎ তাহার চোখে-মুখে একটু বিচলিত ভাব দেখা গিয়াছিল। সেটুকু আবদুল্লাহর দৃষ্টি না এড়াইলেও তাহার নিগূঢ় কারণটুকু বুঝিতে না পারিয়া তখন সে সেদিকে ততটা মন দেয় নাই। এক্ষণে উহার অর্থ বেশ পরিষ্কার হইয়া গেল, তাই সে বড়ই আফসোস করিয়া কহিতে লাগিল, দেখ তো কী অন্যায়! চিঠিখানা না খুলে যদি উনি ঠিকানা ঘুরিয়ে দিতেন, তবে সে নিশ্চয়ই পেত। ইংরেজি চিঠি দেখেও সেটা খুলে যে তার কী লাভ হল, তা খোদাই জানেন! আবদুল কাদের আমার চিঠির জবাবও দিলে না, একবার এলও না; তাই ভেবে আমি তার ওপর চটেই গিয়েছিলাম। ফাতেহার সময় হয়ে গেছে! সে হয়তো এদ্দিন আব্বার এন্তেকালের কথা শুনেছে; আর আমি তাকে একটা খবর দিলাম না মনে করে সে হয়তো ভারি বেজার হয়ে আছে…

হালিমা কহিল না, না ভাইজান, বেজার হবেন কেন? এই চিঠির টুকরাই তো আপনার সাক্ষী! বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, কার জন্যে এটা ঘটেছে। আপনি তাকে একখানা লিখে দিন না।

আবদুল্লাহ্ কহিল, হ্যাঁ কালই লিখতে হবে।

এমন সময় একজন বাঁদী পানের বাটা লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। হালিমা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, পান কে দিল রে বেলা?

ছোট বুবুজী দিয়েছেন।

তাঁর নামায হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, নামায পড়ে উঠেই পান তয়ের কল্লেন।

হালিমা ভ্রাতাকে কহিল, তবে এখন একবার ও-ঘরে যান। রাতও হয়েছে, দেখি গে ভাতের কদ্দূর হল।

দুয়ারের নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হালিমা জিজ্ঞাসা করিল, এবার কদিন থাকবেন, ভাইজান?

কেন বল দেখি?

যাবার সময় আমাকে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু।

আমার তো তাই ইচ্ছে আছে; এখন দেখি কর্তারা কী বলেন। যদি তারা দুলা মিঞার হুকুম চেয়ে বসেন, তবেই তো মুশকিল হবে…

না, এবার না গিয়ে কিছুতেই ছাড়ব না, তা বলে রাখচি।

আচ্ছা, আচ্ছা দেখি তো একবার বলে কয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *