১০. নাসরিনকে কলকাতার একটি ক্লিনিকে ভর্তি

নাসরিনকে কলকাতার একটি ক্লিনিকে ভর্তি করে দেয়া হল। বর্ডার ক্রশ করেই আমি ও মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা আট নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে ইমামের সাথে যোগাযোগ করি। ভাগ্য ভালো যে তাকে সেখানেই পেয়ে যাই এবং হরিপুর চেক পোষ্টের কাছে একটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিই। তিনি সেদিন সন্ধ্যায় একজন ডাক্তার ও একজন নার্সসহ একটি এ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস পাঠিয়ে দিলে আমরা গভীর রাতে কলকাতায় পৌঁছি। ডাক্তার ও নার্সগণ মুহূর্তের মধ্যে নাসরিনকে ক্লিনিকের জরুরি বিভাগে তুলে নেয়। আমি বুঝলাম ইমাম সাহেব সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন। সম্ভবত এ ধরনের গুরুতর ঘটনা মোকাবেলা করতে করতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমি নাসরিনকে নিয়ে একাই এসেছি। মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা নাসরিনকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আমার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে যায়।

পার্ক স্ট্রীটের একটা দুতলা বাড়িতে ক্লিনিকটা। নাম রোজ ক্লিনিক। ক্লিনিকের লোজন নাসরিনের সাদা কাপড় ঢাকা দেহটাকে এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরকার স্ট্রেচারসহ সরাসরি বয়ে এনে লিফটে ঢুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি সে মুহূর্তে রোগীর সাথে না গিয়ে একটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বারান্দায় পায়চারী করছিলাম। এ সময় একজন মহিলা ডাক্তার এসে আমাকে বলল, ওপরে চলুন। জয়বাংলা সরকারের একজন সেক্রেটারি আমাদের অফিস কামরায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমি হাতের সিগ্রেটটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বললাম, চলুন।

ওপরে এসে দেখি ক্লিনিকের ডাইরেক্টরের অফিস রুমে ইমাম ও পারুল আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি ঢোকামাত্রই উভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম জানাল। পারুল বলল, ভাই আপনি অক্ষত আছেন দেখে আল্লার শোকর আদায় করছি।

আমি হেসে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, দেহের বাইরেটা অক্ষত আছে বোন তবে ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধটা কী এবং কোথায় চলছে আমি জানতে চেয়েছিলাম। এখন আমি তা জানি।

যুদ্ধটা আপনার কাজ নয় ভাই। লেখালেখিটাই আপনার কাজ। আশা করি আপনি এখন তা বুঝতে পারছেন। আমি দেশ থেকে আপনাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লেখার জন্যই এনেছিলাম। কিন্তু আপনি ও নন্দিনী দিদি জিদ ধরে দেশের ভেতরে চলে গেলেন। এখন অন্তত আপনার যুদ্ধের সাধ মিটেছে।

বলল ইমাম।

আমি জবাব না দিয়ে চুপচাপ কতক্ষণ বসে থাকলাম। এরা আমার শুভার্থী এবং নিকট আত্মীয়। সরাসরি দেশের ভেতরে গিয়ে আমি বা আমার স্ত্রী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি এটা এরা প্রথম থেকেই চায় নি। ইমামের ইচ্ছে ছিল আমি কলকাতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কবিতা গল্প প্রবন্ধ লিখে মটিভেশনের কাজটা চালিয়ে যাই। এতে পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে কলকাতার লেখকদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ও বিনিময় বাড়বে। কিন্তু যুদ্ধের সময় পরিকল্পনা মোতাবেক কোনোকিছুই ঘটে না। কে জানতো আমার স্ত্রী তার ব্যক্তিগত শুভাশুতের চিন্তা না করে যুদ্ধের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে। অথচ সে ইচ্ছে করলে নিরাপদে কলকাতায় বসে থেকে যুদ্ধের দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারত। আর নন্দিনী? দুর্ভাগ্যই কী নন্দিনীকে আমার কাছে এনে দিয়েছে না আমিই কর্তব্যবোধের চেয়েও অন্যবিধ কোনো মানবিক তাড়নায় নন্দিনীকে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমি পারুলের দিকে মুখ তুলে মিতুর কথা জিজ্ঞেস করলাম, তোরা মিতুকে আনিস নি কেন? মিতু কেমন?

মিতুকে এখানে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। ভালোই। জবাব দিল পারুল।

ইমাম বলল, আপনি যে রোগিনীকে নিয়ে এসেছেন তাকে দেখতে গেছেন ডাঃ অজয় রায়। এই ক্লিনিকের পরিচালক। এক সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। আমার সাথে আগে থেকেই পরিচয়। পরিচিত বলে এখানেই ব্যবস্থা করেছি।

খুব ভাল করেছেন।

ডাক্তার এখনই এসে অবস্থা জানাবেন। এখনও সম্ভবত জ্ঞান ফেরে নি।

জ্ঞান ফিরেছে।

ইমামের কথা শেষ হবার আগেই ডাক্তার রায় এসে ঘরে ঢুকলেন। চেয়ারে বসে ইমামের দিকে ফিরে আমায় বললেন, দৈহিক পীড়ন যেমন মারাত্মক তেমনি মানসিক ভীতিও মারাত্মকভাবে চেপে বসেছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে দুসপ্তাহ সময় লেগে যাবে মনে হচ্ছে। আপনারা সাত নং কেবিনে গিয়ে দেখে আসুন। এর নিকট আত্মীয় কেউ এখানে আছেন কি?

আমি বললাম, আমি আছি।

এর মা বাবা কেউ নেই?

ওর মা বাবা এখনও কিছু জানে না সম্ভবত। তবে পরিস্থিতি তেমন হলে তাদের না হয় খবর দিয়ে আনানো যাবে।

বললাম আমি।

ডাক্তার আমার দিকে ঔৎসুক্য নিয়ে তাকালে পারুল বলল, ইনি আমার ভাই কবি হাদী মীর। দেশের ভেতরে একটা অপারেশন থেকে ফিরলেন।

ডাক্তার রায় আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, দরকার হবে না। সুস্থ হয়ে উঠলেই বরং গার্জিয়ানদের খবর দেবেন। তবে দিন পনেরো মিসেস ইমাম বিকেলের দিকে এসে রোগীকে সঙ্গ দেবেন। আর আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী আপনার কাছে পরে একদিন শোনা যাবে। এখন আপনারা গিয়ে রোগিনীকে দেখে আসুন।

সাত নং কেবিনে এসে দেখি একজন নার্স নাসরিনকে হাসপাতালের সাদা জামাপায়জামা পরিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে দিচ্ছে। এখন তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না দীর্ঘ সময় অজ্ঞান হয়েছিল। আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে সে খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বললাম, নাসরিন আমি হাদী। এখন কেমন আছ?

নাসরিন কোনো জবাব দিল না। তার বেডের অপর দিক থেকে একজন নার্স বলল, এখন একে কোনো প্রশ্ন না করাই ভালো। মাত্র বিশ মিনিট আগে জ্ঞান ফিরেছে। ব্যথা বেদনা কমানোর ইনজেকশনের ফলে চোখ মেলে তাকিয়েছে। এখন একটানা চারঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠলে গা গতর নাড়াতে পারবে। আপনারা কথা বলে রোগীর টেনশন বাড়াবেন না।

আমার নার্সের কথায় চুপ করলে সে সেলাইনের টিউব ইত্যাদি ঠিক করতে করতে আমার দিকে ফিরে বলল, আপনাদের মধ্যে রেজা কে?

আমি বললাম, তিনি এখানে নেই।

তাকে বলবেন একবার রোগীকে দেখে যেতে। সেন্স ফেরার সাথে সাথে তার নাম বলছিল।

আমি বললাম, কমরেড আলী রেজা রোগিনীর গার্জিয়ান এবং রাজনৈতিক শিক্ষক। একজন মুক্তিযোদ্ধা। সময় পেলে তিনি নিশ্চয়ই একবার নাসরিনকে দেখে যাবেন। আমরা তাহলে আসি।

আসুন। কোনো চিন্তা করবেন না। দিন পনেরোর মধ্যে রোগী সেরে উঠবে।

আমরা ডাক্তার রায়ের চেম্বারে গিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইমামের গাড়িতে এসে উঠলাম।

গাড়ি পার্ক সার্কাসের দিকে মোড় নেয়া মাত্র ইমাম আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনার জন্য আরও একটি দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে বলে দুঃখিত কবি ভাই।

আমি হতভম্ব হয়ে ইমামের দিকে ফিরে দুঃসংবাদটি জানতে চাইলাম।

হামিদা ভাবি ঢাকায় গুরুতর আহত হয়ে একটা গোপন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাকে সীমান্ত পার করে আনা এখন এই মুহূর্তে অসম্ভব। আবার দেশের ভেতরে অর্থাৎ রাজধানী ঢাকাতেই তিনি এখন যে অবস্থায় যেখানে আছেন যে কোনো মুহূর্তেই ধরা পড়ে যেতে পারেন। আমি মাত্র গতকালই আমাদের সোর্স থেকে এ খবর পেয়েছি। আপনার বোন বা ভাগ্নিকেও এখবর জানাতে পারি নি কারণ এদের উৎকণ্ঠা বাড়বে।

হামিদা কী গুলিবিদ্ধ হয়েছে?

না। সিদ্ধিরগঞ্জের কাছে একটা পাওয়ার গ্রীড কাটতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে উরুর হাড় ভেঙ্গে গেছে। তাকে দ্রুত সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তার সাথের বিশজনের মধ্যে নজনই স্পট ডেড। বাকি এগারজনের একজন ভাবি যিনি গুরুতরভাবে আহত। বাকি দশজনের গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগে নি। এ সংবাদ আপনাকে এ সময় না জানানোই ভালো ছিল। তবে তাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে আসার ব্যাপারে আপনি একটা পথ বাৎলাতে পারেন ভেবে আপনাকে বলা। অপারেশনের নেতৃত্বে দুজন ছিলেন। একজন পোলের ওপর ইলেক্টিফায়েড হয়ে শহীদ হয়েছেন। অন্যজন ভাবি, পোলের গোড়ায় সমস্ত দল নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন। গোড়ায় যে মাইন পাতা থাকতে পারে চিন্তা করেন নি। হঠাৎ বিস্ফোরণ। আশেপাশের গাঁও গেরামের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সাহায্যের জন্য এগিয়ে না এলে ভাবিসহ পুরো দলটাই ধরা পড়া যেত। এরা ব্যাপারটা হঠাৎ আন্দাজ করতে পেরে অত্যন্ত বিপদের মধ্যে রাত তিনটায় রাস্তাঘাটে এ্যাম্বুশ করে পাঞ্জাবিদের ঠেকিয়ে দ্যায় এবং ভাবিসহ অন্যরা নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে পারে।

ইমামের কথায় হতবুদ্ধি হয়ে আমি ও পারুল গাড়ির ভেতর বসে পরপর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। ইমাম এমন একটা মারাত্মক সংবাদ আমার বোনকেও জানায় নি। পারুলের মুখ দেখে বোঝা যায় ইমামের এই চেপে রাখার ব্যাপারে সে অসন্তুষ্ট হয়েছে। ইমাম আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, আপনার বোনের কাছে বিষয়টা বললে সে অযথাই উদ্বিগ্ন হয়ে কান্নাকাটি করত। এখান থেকে ভাবিকে সাহায্য করার আমি যে সামান্য চেষ্টাচরিত্র করছি তাতে বাধা পড়ত। এখন আপনি কিছু একটা করবেন ভেবেই বললাম। আমার অপরাধ নেবেন না।

আপনি বলুন কলকাতায় বসে আমি এর এখন কী বিহিত করতে পারি? আমার মাথায় তো কোনো উপায় খেলছে না।

আপনি এই মুহূর্তে কিছু করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। তবে আমার একথা বলার কারণ যে কোনো মুহূর্তে আপনাকে ঢাকায় রওনা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতিতে রাখা।

আমি বললাম, আমি এই মুহূর্তে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আপনি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে আমি এখনই রওনা দেব।

আমার কথায় পারুল ও ইমাম উভয়ই খুশি হয়েছে বলে মনে হল। আমি নন্দিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পের কথা নাসরিনকে আনার সময় টেলিফোনে ইমামকে জানিয়েছিলাম। পারুল বলল, দিদিকে সম্ভব হলে খবরটা পাঠানো উচিত।

আমি বললাম, নন্দিনী দুএকদিনের মধ্যে কলকাতায় আসবে। আমার গ্রুপ কমান্ডার আলী রেজা এতক্ষণে নিশ্চয়ই নন্দিনীকে নাসরিনের বিষয় জানিয়ে আমি যে কলকাতায় এসেছি একথা জানিয়েছেন। খবর পেলে সে আর দেরি করবে না। গাড়ি ইমামের বাসার সামনে এসে দাঁড়াল।

.

পরের দিন বেশ দেরিতে আমার ঘুম ভাঙল। বেলা নটায় মিতুর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল, মামা উঠুন, এক ভদ্রলোক সকাল থেকে আপনার জাগার জন্যে বসে আছেন।

কোথায়?

ড্রইংরুমে।

নাম জিজ্ঞেস করিস নি?

মিঃ আলী রেজা।

মিতুর কথায় আমি লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। দ্রুত বেসিনে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখি রেজাভাই মাথা নিচু করে চিন্তিত মুখে চুপচাপ বসে আছেন। আমি সালাম বলেই রেজা ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, রেজাভাই আপনি এসছেন?

আগে নাসরিনের কথা বলুন।

তাকে আমার ভগ্নিপতি একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তির ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গতকালই তার জ্ঞান ফিরেছে। শুধু রাতের খবরটা আমি নিতে পারি নি। আমিও খুব বিপদগ্রস্ত রেজাভাই। খুব ক্লান্ত।

আমাদের কোলাকুলির মধ্যে মিতু ও পারুল এসে ঢুকল।

সকালে ইমাম রোজ ক্লিনিকে টেলিফোনে জেনেছে মেয়েটি আজ সকাল থেকেই উঠে বসতে পারছে। তার পরিপূর্ণ সেন্স ফিরে এসেছে এবং আপনার আর আলী রেজা সাহেবের খোঁজ করছে। তাকে ডাঃ রায় সব খুলে বলেছেন। এখন মোটামুটি ভালো আছে, চিন্তার কিছুই নেই। ভাই আপনি মেহমানকে নিয়ে খাওয়ার টেবিলে চলে আসুন। নাস্তা আর কফি দেয়া হয়েছে। আপনাদের জামাই অফিসে গেছেন। আসুন নাস্তা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

বলল পারুল।

আমি বললাম, এ আমার বোন পারুল, এটা মিতু, ভাগ্নি। আর ইনি আমার গ্রুপ কমান্ডার কমরেড আলী রেজা। আর নাসরিন এর ছাত্রী। আমরা দর্শনায় এর নেতৃত্বেই একটা অপারেশনে সফল হয়েছি। চলুন রেজাভাই ভেতরে গিয়ে নাস্তা খেতে খেতে এদের সাথে আলাপ করবেন।

আমরা এসে নাস্তার টেবিলে বসলাম। কলা, ডিম, আপেল আর পাউরুটি সাজানো খাবার টেবিলে। আলী রেজা দেখেই খুশি হয়ে বললেন, এত নাস্তা বেশ কিছুকাল আমার কপালে জোটে নি কবি সাহেব। আগে কিছু খেয়ে নিই তারপর কথা বলব। নাসরিনের ভালো ব্যবস্থা করেছেন আপনার বোন আর ভগ্নিপতি এতেই এ পরিবারের কাছে আমার কৃতজ্ঞতায় সীমা নেই।

পারুল হেসে বলল, এটা আপনি কী বলছেন রেজা ভাই, আপনারা দেশের ভেতরে লড়ছেন, প্রাণ দিচ্ছেন, এটা তো আমাদের কর্তব্য।

তোমাকে বোন আমি ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। তোমরা যে মেয়েটিকে ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেছ সে আমার কন্যা তুল্য। তার ভালোমন্দের সাথে আমার বিবেক জড়িত। তার চিকিৎসার সমস্ত টাকা আমি দিতে এসেছি।

নাসরিনের চিকিৎসার খরচ আপনাকে বহন করতে হবে না রেজাভাই। যে ক্লিনিকে তাকে আমরা ভর্তি করেছি সে ক্লিনিকের ডাঃ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আহত একজন যোদ্ধার চিকিৎসার ব্যয় ক্লিনিকই বহন করবে বলে জানিয়েছেন। তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেবেন না। নিলে বাংলাদেশের সরকারই তা বহন করত। আপনি কেন দেবেন?

পারুল রেজা ভাইয়ের কাপে কফি ঢেলে দিতে গেলে তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি বলছিলেন আপনি খুব বিপদগ্রস্ত। কী ব্যাপার বলুন তো?

ঢাকার কাছে একটা অপারেশন আমার স্ত্রী মাইনের আঘাতে পঙ্গু হয়ে ঢাকায় আটকা পড়েছে। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে আনতে না পারলে বিপদ হতে পারে। চিকিৎসাও হচ্ছে না।

রেজা ভাইকে সংক্ষেপে হামিদার বিপদের কথা জানালে তিনিও স্তম্ভিত হয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন, কী সাংঘাতিক! এতক্ষণ এখবরটা আমাকে বলেন নি কেন? আমাদের কয়েকটা শক্তিশালী ইউনিট ঢাকায় কাজ করছে। এ ব্যাপারে তারা খুবই সাহায্য করতে পারবে। তাছাড়া আমাদের যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হল সেটা পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটিকে রিপোর্ট করতে হলেও ঢাকার কাছাকাছি এক জায়গায় আমাকে গিয়ে পৌঁছুতে হবে। আর আপনি তো জানেন আমাদের একজন কমরেড গৌহাটিতে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের হাতে আটকা পড়ে আছে। তাকে ছাড়াতে হলেও আমাকে ঢাকা হয়ে আসামে ঢুকতে হবে। আপনার স্ত্রীর অবস্থানের খবর আমাকে জানালে তার চিকিৎসার ভার আমাদের ইউনিটগুলো নিতে পারবে বলে ধারণা করি।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ রেজা ভাই। আমার ভগ্নিপতি এখনও আমার স্ত্রীর অবস্থানের কথা আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। শুধু বলেছেন তিনি শাজাহানপুরে একটি বাড়িতে আপাতত আশ্রয় পেয়েছেন। আশ্রয়টি খুব নিরাপদ নয়। সেখান থেকে তাকে অবিলম্বে সরিয়ে আনতে হবে।

এ ব্যাপারে আমাদের লোকেরা সাধ্যমতো সাহায্য করবে। আমাদের একটা মেডিক্যাল ইউনিট আছে তারা চিকিৎসার ব্যবস্থাও করবে।

আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন রেজাভাই। কফি পান শেষ হলে আমি বললাম, রোজ ক্লিনিকটা কাছেই। চলুন নাসরিনকে দেখে আসি।

রেজাভাই বললেন, এখন সাড়ে দশটা বাজে আর একটু অপেক্ষা করে গেলে সম্ভবত আপনার বান্ধবী নন্দিনীকে সাথে নিয়ে যেতে পারবেন। আমি বাদুড়িয়া থেকে সরাসরি কলকাতায় এসেছি। তাকে গত রাতেই আপনার এখানে আসা, নাসরিনের ঘটনা সব জানিয়েছি। তিনি পারমিশন নিয়ে বেলা বারটার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। আমি ম্যাসেজ পৌঁছে দিয়ে রাতেই রওয়ানা হই। নন্দিনী ভালোই আছেন। তবে আপনার জন্যে দেখলাম খুবই চিন্তিত।

পারুল রেজা ভাইয়ের কথায় চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

কবি ভাইকে আরো এক কাপ কফি দেব?

দে।

পারুল আরো এককাপ কফি আমার কাপে ঢেলে দিয়ে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দিয়ে বলল, দিদি যখন বারটায় বাসায় এসে পৌঁছুবেন তখন একটু অপেক্ষা করেই বেরুন।

আমি কোনো কথা না বলে পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে পারুলের কৌতূহলী চাওনি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইলাম। আমার বোনও সম্ভবত আমার হৃদয়ের এক দোদুল্যমান অন্তরালকে উদ্ঘাটনের চেয়ে নীরব থাকাই বেহতের ভেবে রেজা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা অন্য কামরায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন। দিদি যদি বারটায় আসেন তবে নাওয়া-খাওয়া করেই ক্লিনিকের দিকে বেরুলে ভালো হবে। আমি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলব। মিতুর আব্বাও এর মধ্যেই আশা করি ফিরবেন।

রেজা বললেন, সেটাই ঠিক হবে।

কফি শেষ করে আমরা উঠে গেলাম।

রেজা ভাই আমার কামরায় এসে সোজা জুতোসহ আমার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, গত কয়েক রাত ঘুমোতে পারি নি, আমি এখানে ঘন্টাখানেক গড়িয়ে নিতে চাই কবি।

আমি বললাম, ঘুমোন।

ঠিক ঘুম নয়, একটু শুয়ে গড়িয়ে আপনার সাথে কথা বলব। আচ্ছা, আপনার আর নন্দিনীর ব্যাপারটা কী বলুন তো? নিছক বন্ধুত্ব?

না নিছক বন্ধুত্ব নয় রেজা ভাই। আমি নন্দিনীকে ভালবেসে ফেলেছি বলেই মনে হচ্ছে। সম্পর্কটা আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এদিকে আমার স্ত্রী রয়েছে যিনি মুক্তিযোদ্ধা, মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন। তার প্রতিও রয়েছে আমার গভীর ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ ও প্রেম। এ রকম কেন হয় রেজা ভাই আমি জানি না। আমি নিজেও আমার এ ধরনের আচরণের ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আপনারা, সমাজ, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ আমার এই দ্বিমুখী প্রেমের কোনো স্বীকৃতি দেবেন না জানি, কিন্তু আমি কাউকেই নিজে থেকে পরিত্যাগ করতে পারব না। অদৃষ্টে আমার যাই ঘটুক।

আমি অত্যন্ত আগ্রহভরে জবাব দিলাম।

আমার কথা শুনে রেজা ভাই হঠাৎ বিছানায় উঠে বসে গেলেন।

আপনি খুব জটিল অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এর পরিণাম কী হবে বলা খুব মুস্কিল।

আমি একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নন্দিনীর সাথে আমার পরিচয়ের পূর্বাপর সব ঘটনা কমরেড রেজাকে বলে গেলাম। তিনি গম্ভীর হয়ে সব শুনে আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট তুলে নিয়ে ধরালেন।

আপনার সমস্যার কোনো সমাধান আমার জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে আপনার যে কর্তব্য রয়েছে তা আপনার স্ত্রীকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা। এ ব্যাপারে আমি ও আমার সহকর্মীরা যে যেখানে আছেন সাহায্য করবেন। আপনার সব কথা শুনে আপনার স্ত্রীর প্রতি আমি এ ধরনের নৈতিক দায়িত্ব বোধ করছি। আপনার ভগ্নিপতি যদি আমাকে পলিটিক্যাল রিকগনাইজ করেন এবং ঢাকা পৌঁছুতে সাহায্য করেন তবে আপনাকে সাথে নিয়ে আমি ঢাকার পথে রওনা হতে পারি।

রিকগনাইজের প্রশ্ন আসে কেন?

আমি অবাক হলাম।

আসে। এই স্বাধীনতা লড়াইয়ের প্রকৃতি এবং আদর্শগত দিকগুলো নিয়ে আমাদের সাথে আওয়ামী লীগের গুরুতর মতো পার্থক্য রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার মুহূর্তকাল পূর্ব পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের অস্তিত্ব, ছ’দফা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মতো পার্থক্য ছিল কম। কিন্তু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা শেখ সাহেবের নেই। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে আটক আছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষমতা এখন কার হাতে তা আমাদের জানা নেই। আপনার ভগ্নিপতি আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকারেরই সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তি। তিনি আমাকে পছন্দ নাও করতে পারেন।

বললেন রেজাভাই। তার চেহারায় রাজনৈতিক কূট আদর্শবাদের তীর্যক রেখা ফুটল। আমি বললাম, আপনি আমার ভগ্নিপতিকে জানলে একথা বলতেন না রেজাভাই। তিনি একজন নিষ্ঠাবান, সৎ সরকারি কর্মকর্তা, তার প্রকৃতপক্ষে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত থাকতে পারে না।

আমার কথায় হাসলেন কমরেড রেজা।

ইমাম সাহেবকে তার বর্তমান দায়িত্ব ও অতীত কর্তব্যনিষ্ঠা ইত্যাদিসহ আমরা বিচার-বিবেচনা করেছি কবি সাহেব। তা না হলে আহত নাসরিনকে আপনার সাথে তার সাহায্যের আশায় এখানে পাঠাতাম না। আমি পূর্বাপর অনেক বিবেচনা করেই এখানে, আপনার বোনের বাসায় এসেছি। ইমাম সাহেব রাজনৈতিকভাবে বিচার না করে মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোকে একটু সহায়তার হাত বাড়ালে আমরা অর্থাৎ আমি আমার ইউনিট নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারি। আপনি তো জানেন আমাদের কী মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এই যুদ্ধের মধ্যে আমার বিচ্ছিন্ন কমরেডদের পুনর্গঠনের একটু সুযোগ পেলে আমি কুষ্টিয়া জেলায় একাই পাক বাহিনীর দৌরাত্ম্য ঠেকিয়ে রাখতে পারব। সম্ভবত ইমাম সাহেবও তা জানেন। মেজর জলিল যেমন তার এলাকায় একটা মারাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নিয়েছেন, তেমনি আমিও পারব। মেজর জলিলের সাথে যেমন আওয়ামী লীগের মৌলিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও সহযোগিতা ও সমর্থন বন্ধ নেই তেমনি আমরাও এটুকু সহযোগিতা চাই। আমরা জানি আপনার ভগ্নিপতিই এই যুদ্ধকালীন জরুরি সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করেছেন। আমি এসব বিষয় নিয়েই তার সাথে আলোচনা করতে এসেছি। শুধু নাসরিনকে দেখতেই আসি নি। আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানে, আমি এখন এখানে আছি।

আমি অবাক হয়ে আলী রেজার মুখের দিকে তাকালাম।

তিনি হেসে আমার প্যাকেট থেকে আরও একটা সিগ্রেট তুলে নিয়ে তার মুখটা আমার কানের কাছে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললেন, এমনকি এতক্ষণে সম্ভবত আপনার বোনজামাই মহোদয়ও জেনে গেছেন কুষ্টিয়ায় কমরেড রেজা এখন তার বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। এখানকার ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক খুব কড়া। তাছাড়া আমি বর্ডার ক্রশ করেই ভারতীয় কতৃপক্ষের কাছে আমার প্রেজেন্স রিপোর্ট করেছি। আপনি কবি মানুষ, দেশের ভেতরের এবং বাইরের রাজনৈতিক সংঘর্ষের খবর কিছুই জানেন না। আমি বাংলাদেশের ভেতর থেকে পাক বাহিনীর আক্রমণ অত্যাচারের মধ্যে যতটা নিরাপদ কলকাতায় ততটা নই কবি সাহেব।

আমি মুহূর্তের মধ্যে কমরেড রেজার রাজনৈতিক গুরুত্ব যেন উপলব্ধি করলাম।

আমি বললাম, রেজাভাই আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন। আমি ও আমার বোন ইমাম সাহেবকে আপনার সহযোগিতার প্রস্তাবে সম্মত করাব। অন্তত আপ্রাণ চেষ্টা করব।

রেজাভাই আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে চোখ মুদে সিগ্রেট টানতে লাগলেন। আমি কামরা থেকে বেরিয়ে এসে দুয়ারটা ভেজিয়ে দিলাম।

ঘন্টাখানেক পরে পারুল কিচেন থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মিতুর ঘরে ঢুকল। আমি তখন ভাগ্নির সাথে তার স্কুল সম্বন্ধে এবং নতুন বান্ধবীদের সাথে মেলামেশার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপ করছিলাম। পারুল বলল, আপনার অতিথি কমরেড রেজার সাথে ইমাম কথা বলতে চায়। অফিস থেকে টেলিফোন। ইমাম ধরে আছে।

আমি লাফ দিয়ে উঠলাম এবং রেজা ভাইয়ের তন্দ্রা ছুটিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার টেলিফোন। ইমাম ধরে আছেন।

রেজাভাই হাসলেন, চলুন।

আমি তাকে পারুলদের বেডরুমে এনে টেবিলে রাখা রিসিভারটা দেখিয়ে দিলে তিনি রিসিভারে হাত রেখে বললেন, আপনি একটু বাইরে যান। আর দুয়ারটা ভেজিয়ে দিন।

আমি বাইরে এসে দুয়ার ভেজিয়ে দিলাম।

পনেরো মিনিট পর কমরেড রেজা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে আমাকে ও পারুলকে অপেক্ষমান দেখে বললেন, আপনারা রান্নাটা বোধ আর খাওয়া হয়ে উঠল না। ইমাম সাহেব আট নম্বর থিয়েটার রোডে এক্ষুনি ডেকে পাঠিয়েছেন। তাজউদ্দিন সাহেব এই মুহূর্তে আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। আমি তাহলে আসি কবি সাহেব। আপনার বোনকে একটু অনুরোধ করছি নাসরিনের একটু খোঁজ খবর নিতে। আসি ধন্যবাদ।

আমি ও পারুল আমরা উভয়েই কমরেড রেজাকে অনুসরণ করে বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে একটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন।

আমরা হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালাম। তিনি মুখ ফিরিয়ে একটু হাসলেন মাত্র। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে আমরা যখন ওপরে ওঠার সিঁড়িতে পা দিতে যাব তখন কে যেন পারুলের নাম ধরে পেছনের রাস্তা থেকে ডাকল। আমরা ফিরে দেখি খাকি প্যান্টশার্ট পরা নন্দিনী অন্য একটা ট্যাক্সি থেকে নামছে। প্রথম দৃষ্টিতে নন্দিনীকে চেনার কথা নয়। শাড়ির বদলে প্যান্টশার্ট শুধু নয়। নন্দিনী তার দীর্ঘ বেণীর বদলে চুল কেটে বব করে এসেছে। শুধু তার হাসিটাই অপরিবর্তিত। এগিয়ে এসে পারুলের হাত ধরে বলল, কেমন আছ পারুল, ইমাম সাহেব, মিতু এরা কেমন?

আমরা সবাই ভালো দিদি। বরং আপনার খবর বলুন, ট্রেনিং কেমন লাগছে?

খুব কষ্টকর। মানুষ সেখানে খুব নোংরা, লোভী। ম্লান মুখে জবাব দিল নন্দিনী।

আমি তার হাত আমার হাতে তুলে নিয়ে বললাম, আর কুশল জানার দরকার নেই, চলো ওপরে যাই।

নন্দিনী ওপরে এসেই পারুলকে বলল, তোমার একটা শাড়ি দাও তো পারুল। এই জবড়জং পোশাকগুলো খুলে একটু হালকা হই।

পারুল বলল, আসুন আমার কামরায়। শাড়ি ব্লাউজ দিচ্ছি। ইচ্ছে করলে গোসলও দিতে পারেন।

নন্দিনী খুশীতে লাফিয়ে উঠল, এ বাসায় বুঝি প্রচুর জল পাচ্ছ। দ্যাখো, যেখানে ছিলাম সেখানে লাইন বেঁধে জলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আমি বরং আজ একটু প্রাণভরে গায়ে জল ঢেলেই আসি।

পারুল শাড়ি ব্লাউজ দেবার জন্য নন্দিনীকে তার কামরায় নিয়ে গেলে আমি এসে আমার বিছানায় বসলাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না ইমাম কমরেড রেজাকে কী বিষয় আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। তবে এটা বুঝলাম তাজউদ্দিনের সাথে আলাপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে রেজা ভাই খুশি মনেই বেরিয়ে গেছেন। ইমাম যদি দুপুরে খাওয়ার জন্যে বাসায় আসত তবে সবকিছুই জানা যেত। মনে হয় না ইমাম আজ লাঞ্চ খেতে বাসায় ফিরবে।

নন্দিনীর টয়লেট থেকে বেরুবার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমার চোখ দুটিতে তন্দ্রাভাব এসে যাওয়াতে আমি একটা বালিশ ঠেলে শুয়ে পড়লাম।

ঘুম ভাঙলে দেখি নন্দিনী আমার পাশে একটা চেয়ারে বসে আনন্দ বাজার পত্রিকা পড়ছে। সদ্য স্নান সেরে আসার পরিচ্ছন্নতা তার চোখেমুখে। সে পারুলের একটা লালপেড়ে গরদ ও লাল ব্লাউজ পরেছে। চমৎকার লাগছে নন্দিনীকে। তবে তার বিশাল বেণী না থাকায় বব করা চুল ফ্যানের বাতাসে মুখে এসে পড়ায় পোশাকের সাথে চেহারাকে খাপছাড়া লাগছে।

আমি বললাম, চুল কেটে ফেলাটা কী ট্রেনিংয়ের জন্য বাধ্যতামূলক?

না।

তবে এমন ন্যাড়া হওয়ার কী দরকার ছিল?

তখন যদি জানতাম আমার চুলগুলো তোমার চোখে খারাপ লাগত না তাহলে ন্যাড়া হতাম না।

কপালের ওপর থেকে একগুচ্ছ চুলকে আঙুল দিয়ে সরিয়ে জবাব দিল নন্দিনী।

আমি বললাম, ভালো লাগত কিনা জানি না। তবে লম্বা বেণীর বদলে তোমার বব দেখে মনে হচ্ছে বেণীঅলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তোমাকে মানাত ভালো।

এখন একেবারেই ভালো লাগছে না বুঝি?

এত উপেক্ষা করার ক্ষমতা কী আমার আছে?

মিথ্যা কথায় আমাকে ভুলিও না তো।

আনন্দ বাজার পত্রিকাটা পাশে সরিয়ে রেখে জবাব দিল নন্দিনী। আমি বিষয়টা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার আশায় বললাম, আবার কখন বাদুড়িয়ায় ফিরে যাচ্ছ?

আর যাচ্ছি না।

নন্দিনীর কথায় আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

আমি আর ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি না কবি।

কেন? সব কথা আমাকে খুলে বলল নন্দিনী।

নিজেকে বাঁচিয়ে সেখানে অবস্থান করা অন্তত আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সেখানে ভালো লোক নেই একথা আমি বলছি না। তবে এমন লোকও আছে যারা মনে করে ওদের লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হল মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ।

বলো কী নন্দিনী?

সর্বত্র কী ঘটছে আমি জানি না। তবে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। এ যুদ্ধ আলী রেজাদের মতো দেশের ভেতর থেকে পরীক্ষিত লোকদের নিয়ে চালাতে হবে। ভারতের সাহায্যে নয়।

বলল নন্দিনী। বুঝলাম অল্পকালের মধ্যেই নন্দিনীর মনে নিদারুণ বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। এ সময় তাকে ঘাটানো উচিত হবে না ভেবে আমি অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইলাম। বললাম, ঢাকা থেকে খুব খারাপ খবর এসেছে। দুঃসংবাদ।

দারুণ ঔৎসুক্য নিয়ে নন্দিনী আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল।

আমার স্ত্রী গুরুতর আহত হয়ে ঢাকায় আটকা পড়েছে। সম্ভবত দুচার দিনের মধ্যে আমি ও রেজাভাই ঢাকা যাচ্ছি।

আমার মুখে হামিদার দুর্ঘটনার সংবাদ এমন আবেগহীনভাবে উচ্চারিত হতে শুনে নন্দিনী নিস্পলকভাবে আমার মুখের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, বৌদির কী হয়েছে?

একটা অপারেশনে গিয়ে মাইনের আঘাতে উরুর হাড় ভেঙে গেছে বলে খবর এসেছে। সে যেখানে আছে জায়গাটাও নিরাপদ নয় যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে।

তোমরা কখন যাচ্ছ?

এখনও স্থির হয় নি। ইমাম যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করবেন। আজই হয়তো ব্যাপারটা জানা যাবে। রেজা ভাই থিয়েটার রোডে গেছেন। যদি ইমাম লাঞ্চের জন্য বাসায় আসেন সব জানা যাবে।

আমি যদি যেতে চাই?

তোমাকে নিয়ে রওনা হওয়াটা ঠিক হবে না।

কেন?

বোঝো না, ঢাকা পর্যন্ত এসময় পৌঁছাটা আমাদের পক্ষেই কতটা বিপজ্জনক? কমরেড রেজাই সম্ভবত রাজি হবেন না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রতিজ্ঞা যখন নিয়েছ তখন ট্রেনিং শেষ করা কর্তব্য। তোমার ক্যাম্প সম্বন্ধে যেসব অভিযোগ আছে তা ইমামকে জানাও। তিনি সম্ভবত তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন।

আমি ইমাম সাহেবকে কিছু বলব না। আর ঐ নরকেও ফিরে যাব না। যদি কিছু বলতে হয় তবে দেশের সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা আলী রেজাকেই বলব। এখন চল নাসরিনকে দেখে আসি।

নন্দিনী চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালে আমি বললাম, বস। নাসরিন ভালোই আছে। আমরা লাঞ্চের পর সকলেই ক্লিনিকে যাব।

নন্দিনী বলল।

এর মধ্যে একটা ট্রে হাতে করে নন্দিনীর জন্য কিছু খাবার ও দুকাপ চা নিয়ে পারুল এসে ঘরে ঢুকল।

আপনাদের দুকাপ চা দিতে এলাম। একটু আগে ইমাম আবার টেলিফোন করেছিল। সুখবর। কমরেড রেজার সাথে আমাদের সরকারের আলাপ হয়েছে। ইমাম একটা ফয়সালা করে দিয়েছেন। ইমাম বলল, রেজা সাহেব খুব খুশি। দুপুরে আমাদের সাথে খেতে আসছেন। যাই আমি গিয়ে রান্নাটা সেরে ফেলি।

পারুলও রেজার প্রতি তার গভীর সহানুভূতির ইঙ্গিত দিল এবং ট্রেটা নন্দিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসল। নন্দিনী ট্রে বিছানার ওপর নামিয়ে রেখে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তুমি যাও আমিও তোমাকে একটু সাহায্য করতে আসছি।

কোনো দরকার নেই দিদি। আমি একাই সব পারব। আপনারা বরং যুদ্ধের গল্প করুন। গতরাতে ইমাম বলেছে আমাদের ছেলেরা ঢাকায় নাকি খুব চোরা মার লাগাচ্ছে। একদম ভয় খেয়ে গেছে সবাই।

পারুলের মুখে বিজয়ের হাসি দেখে আমার খুব ভালো লাগল।

বেলা আড়াইটার দিকে রেজাভাইসহ ইমাম এসে বাসায় ঢুকেই বলল, তাড়াতাড়ি খানা লাগাও। খুব খিদে পেয়েছে।

আমরা সবাই এসে নিঃশব্দে খাওয়ার টেবিলে বসলাম। আমি মিতু ও নন্দিনী একদিকে। অন্যদিকে রেজাভাই ও ইমাম। পারুলের চেয়ারটা খালি রইল কারণ সে সবাইকে পরিবেশন করে তবে বসবে। খেতে বসেই রেজাভাই বললেন, কবি সাহেব আমাকে সাপোর্ট দিতে তাজউদ্দিন সাহেব রাজি হয়েছেন। আমরা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হব।

আমি বুঝলাম খুব খুশির কথা রেজাভাই।

খুব বেশি খুশির কথা নয়। কারণ দেশের ভেতর এখন প্রতিরোধ যুদ্ধ মারাত্মকভাবে সাহস দেখাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি তৈরি হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতীয় বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধজয়ের কৃতিত্বটা মুক্তিযোদ্ধাদের দেবে বলে মনে হয় না। আমার সন্দেহ ডিসেম্বরেই তারা হস্তক্ষেপ করবে।

আমরা কোনো জবাব দিলাম না। আমি ভেবেছিলাম ইমাম এর প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সেও কোনো জবাব দিল না। শুধু নন্দিনী বলল, রেজাভাই আমি কী আপনাদের সাথে ঢাকা যেতে পারব?

আপনি যেতে চাইলে নিয়ে যাব। আমি ভেবেছিলাম নাসরিনের ভার আপনার হাতে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে দেশের ভেতর ঢুকব। আপনি যে আর ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরবেন না তা আমি বাদুড়িয়ায় আপনার চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম। এসব নিয়ে দুঃখ করে, নালিশ করে কোনো লাভ নেই বোন। এটা হল একটা আনঅর্গানাইজড ওয়ারফেয়ার। এ সুযোগে অনেক বাজে লোক এখানে ঢুকে পড়েছে। এদের উদ্দেশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। এদের আচরণে বিরক্ত হয়ে পুরো আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধটাকেই অর্থহীন ভাববেন না।

বেশ ধীরে সুস্থে কথাগুলো বলে রেজাভাই লোকমা তুলল। ইমাম আমার দিকে ফিরে বলল, দিদিকে আপনাদের সাথে নিন ভাই। নাসরিন না হয় আমাদের সাথে থাকবে।

তাহলে তো আমি খুবই নিশ্চিন্ত হয়ে রওনা দিতে পারি।

বললেন আলী রেজা।

পারুল আমার পাতে কোর্মার ঝোল তুলে দিতে দিতে বলল, দিদির এখন, এই মুহূর্তে ঢাকায় যাওয়া কী ঠিক হবে? যেখানে ভাবিকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে আপনাদেরই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হতে পারে?

তুমি আর না বল না পারুল। আমি আসলে বৌদির কাছেই যেতে চাইছি। আমি তার কাছে থাকব। তার সেবাযত্ন করব। আমাকে পেয়ে বৌদি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবেন। আমি না গেলে তার উদ্বেগ দূর হবে না। এটা আমি জানি।

বেশ দৃঢ়তার সাথে কথা বলছে নন্দিনী।

ইমাম বলল, মন্দ বলেন নি। আমি আপনাদের ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে দেয়ার মোটামুটি নিরাপদ একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। কয়েকজন সশস্ত্র লোক আপনাদের সাথে দিতে পারি।

না, এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু করতে হবে না। বরং ভেতরে এখনও আমার কয়েকটা ঘাঁটি আছে। ঢাকা পর্যন্ত এদের নিয়ে যেতে আমার কোনো অসুবিধেই হবে না। আমরা এক ঘাঁটি থেকে অন্য ঘাঁটিতে বিশ্রাম নিয়ে এগোব। ভাগ্য ভালো থাকলে যানবাহনও পেয়ে যেতে পারি।

ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে ইমামের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন আলী রেজা। সম্ভবত এর কোনো একটা রাজনৈতিক দিক থাকতে পারে ভেবে আমিও আর কথা বাড়ালাম না। শুধু মিতু ছেলে মানুষের মতো আমাকে জিজ্ঞেস করল, মামা, আমরা আর কতদিন পরে ঢাকায় ফিরতে পারব?

রেজাভাই হেসে বললেন, কেন মা কলকাতা তোমার ভালো লাগছে না?

না চাচা। একদম না।

তোমার মতো আমারও। সে জন্যেই তো একটু আগে চলে যেতে চাই। কিছুদিন অপেক্ষা কর, আব্বা আম্মাকে সাথে নিয়ে তুমিও চলে আসবে।

মিতুকে এমনভাবে আশ্বাস দিলেন রেজাভাই মনে হল তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত।

.

খাওয়ার পর বিশ্রাম না নিয়েই আমরা রোজ ক্লিনিকের দিকে রওনা হলাম। বাসায় থাকল ইমাম আর মিতু। ক্লিনিকে পৌঁছেই ডাঃ রায়ের ঘরে গেলে তিনি সাদরে আমাদের বসতে বলে বেল টিপলেন। একজন নার্স মুহূর্তের মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়ালে তিনি বললেন, সাত নং কেবিনের রোগিনীর চার্টটা দেখে আসুন।

একটু আগে দেখেছি স্যার। চমৎকার রিকভারি। গত রাতে খুব ভাল ঘুম হয়েছে। দুস্বপ্ন দেখে কেঁদে ওঠে নি। আমার তো মনে হয় দুদিন এভাবে গেলে রিলিজ করে দেয়া যাবে।

গুড। নাসরিনের গার্জিয়ানরা এসেছেন। এদের ওর কেবিনে নিয়ে যান।

খুশি হয়ে পারুলের দিকে তাকালেন ডাঃ অজয় রায়। আমি ও পারুল তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রেজা ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ডাক্তার রায় নিজেই তার চেম্বার থেকে আমাদের কেবিনে নিয়ে চললেন। আমরা সাত নম্বরে পৌঁছে দেখি নাসরিন তার বেড ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে বেডের ওপর পা মেলে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। আমাদের দিকে ফিরেই রেজাভাইকে দেখতে পেয়ে একলাফে তার গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে ফুঁপিয়ে উঠল যে-আমি, পারুল, ডাক্তার ও নার্স দৃশ্যটির মর্ম বুঝে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

রেজাভাই ভেজা গলায় বললেন, শান্ত হও মা। এদের ধন্যবাদ দাও। এবার এদের দয়ায় বেঁচে গেলে। ইনি কবি সাহেবের বোন পারুল আর ডাঃ অজয় রায়।

বেশ কিছুক্ষণ নাসরিন কমরেড রেজার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদল। একটু শান্ত হলে আমি বললাম, নাসরিন আমরা আবার দেশের ভেতরে যাচ্ছি। তুমি সুস্থ হলে আমার এই বোনটি এসে তোমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। রেজাভাই না ফেরা পর্যন্ত তোমাকে কলকাতায় থাকতে হবে। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না এবং চিন্তারও কোনো কারণ নেই।

নাসরিন তখনও রেজাভাইয়ের হাত ধরেছিল। আমার কথায় একটু অবাক হয়ে বলল, আপনারা আমাকে এখানে রেখে কেন ভেতর যাবেন? আমি আপনাদের সাথে যেতে পারি না?

তোমার শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক হতে আরও বেশ কতদিন লেগে যাবে। আমার ধারণা এই যুদ্ধ বড় জোর আর দিন বিশেক চলবে। আমার এখন ঢাকায় যাওয়া নানা কারণেই দরকার মা। জানতো আমাদের বহু মানুষ এই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা শহীদ হয়েছে তাদের কথা আমি বলছি না। যারা নানা জায়গায় বাংলাদেশের ভেতরে বাইরে বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে তাদের রক্ষা করতে হবে। পার্টিকে আবার সংগঠিত করতে হবে। তুমি তো আমাদের সব ব্যাপারই জান নাসরিন। তুমি এখানে যাদের সাথে থাকবে তারা খুব ভালো মানুষ। তারা তোমাকে আমার মতোই দেখাশোনা করবে। তাছাড়া কবি সাহেবের স্ত্রী ঢাকার কাছে একটা অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন। তার সেখানে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।

আমার স্ত্রী মারাত্মক আহত হয়ে ঢাকায় পড়ে আছেন সম্ভবত রেজা ভাইয়ের একথাটা নাসরিন ঠিকমতো বুঝতে না পেরে নন্দিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে থাকল। সে জানতো নন্দিনীকে দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে আমি আমার স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিলাম এবং এক বা একাধিক রাত আমরা একসাথে ছিলাম। নাসরিনের মনোভাব বুঝতে পেরে নন্দিনী এগিয়ে এসে তার হাত ধরে মুচকি হাসল, আমাকে ভুল বোঝে না যেন। এ যুদ্ধে জেতার জন্য তোমাকে, আমাকে সবাইকে নানা পরিচয়ে নানাভাবে থাকতে হয়েছে, হবে। এখন ওসব নিয়ে দুর্ভাবনার দরকার নেই। আমিও এদের সাথে ঢাকা যাচ্ছি। আবার আমাদের একদিন নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ হবে। তখন আমাকে সব কথা বুঝিয়ে বলব।

নাসরিন আমার দিকে ফিরে একটু হাসার চেষ্টা করল। আমিও। রেজা ভাই নাসরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার আব্বা আম্মার খবর নিতে পারি নি। তবে আমাদের লোক কোনো না কোনোভাবে তাদের একথা জানিয়ে দেবে তুমি বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে আমার সাথে কলকাতায় নিরপদেই আছ।

নাসরিন খুব বাধ্য মেয়ের মতো কমরেড রেজার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। পারুল এগিয়ে গিয়ে নাসরিনের হাত হাতে তুলে নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল, আমি সকাল সন্ধ্যায় তোমাকে দেখে যাব। রিলিজ হলে আমার কাছে নিয়ে যাব। কোনো টেনশনের মধ্যে থেক না।

না কিছু ভাবব না।

বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল নাসরিন। বুঝলাম নাসরিন সবকিছু কাটিয়ে উঠে আবার দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে প্রথম দেখা মেয়েটির মতোই সাহসী হয়ে উঠেছে। আমি ডাক্তার অজয় রায়ের দিকে ফিরে বললাম, আপনি অসাধ্য সাধন করেছেন ডাক্তার। আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ডাক্তার হাসলেন, চলুন আমার কামরায় গিয়ে একটু চা খাবেন সবাই।

আমরা ক্লিনিক থেকে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে কমরেড আলী রেজা পারুলকে বলল, আমি এখন আর বাসায় ফিরছি না। আজ রাতেও সম্ভবত ফেরা হবে না।

পারুল বলল, আমাদের বাসায় কিন্তু আপনার থাকার কোনো অসুবিধে হবে না রেজা ভাই।

আমি সেটা জানি বোন। তবে দেশের ভিতরে যাওয়ার আগে স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটু আলাপ করে যেতে চাই। আমার ধারণা এ যুদ্ধ আর বেশি দূর এগোবে না। এর আগেই, এই দুচার দিনের মধ্যেই মিসেস গান্ধী বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চেয়েও মারাত্মক এক দখলদার বাহিনী নামিয়ে দেবে। আর তোমাদের যুদ্ধের ইতি এখানেই। তোমাদের বিজয় মিছিল যখন পথে বেরুবে তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে অন্য একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ফিরে যাবে। এটাই ঘটবে। তোমার কাছে অনুরোধ তুমি শুধু আমাদের নাসরিনটাকে একটু নিজের আশ্রয়ে রেখ।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, আপনার ধারণাতো ঠিক নাও হতে পারে রেজা ভাই। সারা পৃথিবী আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে। পাকিস্তানের বদলে ভারত দখলদার সাজবে বিশ্বের মানুষ তা মানবে না। আমরাও অস্ত্র ত্যাগ করব না।

এটা কবির মতো কথা বটে। দেখা যাক, আপনার ধারণাই সত্য হোক। তবে আমি তো কবি নই হাদী সাহেব। গত চৌদ্দ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ ও সম্প্রসারণবাদের সাথে লড়াই করে চলেছি। মুখ কোনটা মুখোশ কোনটা তা এখন ধরতে পারি। আচ্ছা আপনারা বাসায় যান। আমি অন্য পথে যাব।

আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে একটু সাবধান থাকবেন রেজা ভাই।

আমার কথায় রেজা ভাই একটু হাসলেন। তারপর সোজা আমরা যেদিক থেকে আসছিলাম আবার সেদিকেই দ্রুত হন হন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি, নন্দিনী ও পারুল কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *