০৯. দর্শনা হল্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়

রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমরা দর্শনা হল্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললাম। আমরা সর্বমোট একাত্তর জন মুক্তিযোদ্ধা। আমি ছাড়া সকলেই ট্রেনিং প্রাপ্ত। সকলের হাতেই আধুনিক অস্ত্র। মুজিববাদী গ্রুপের প্রায় সবার হাতেই স্টেনগান। দুএকটা এল, এম, জিও আছে। মোজাফফর গ্রুপও চাইনিজ রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড এবং একটা সাব মেশিনগান সঙ্গে করে এনেছে। কমরেড রেজার গ্রুপ অর্থাৎ আমাদের দলও সর্বাধুনিক চাইনিজ অস্ত্রে সজ্জিত। প্রত্যেকের বেল্টে বাঁধা গ্রেনেড। শুধু রেজা ভাই আরও চারজনের সাহায্যে একটা ভারী ব্যারেল এবং ব্যারেলের সাথে সংযুক্ত করার ব্যাটারী, স্ট্যান্ড, ইত্যাদি বহন করে এনে স্কুলের সামনের মাঠটার শেষপ্রান্তে একটা নালার উঁচু পাড়ে থামতে বললেন। আমাকেও একটা পিস্তল দেওয়া হয়েছে। যদিও আমি এ পর্যন্ত অস্ত্রটা চালাতে শিখি নি। তবুও দেওয়ার সময় আলী রেজা খুব তাড়াতাড়ির মধ্যে এর গুলীর পার্টসটা খুলে এবং লাগিয়ে আমাকে বিষয়টা মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং একবার মাত্র বুলেট খুলে অস্ত্রটার ট্রিগার টানার কায়দাটা দেখিয়ে দিয়ে বলেছেন, নিন এবার এই বুলেটের কেসটা চেম্বারে লাগান ত দেখি।

মনে হয় পারব।

বলেই আমি পিস্তলটার বাটের দিকে বুলেটের কেসটা ঠেলে ক্লিক শব্দে ঢুকিয়ে ফেললাম। আলী রেজা বললেন, সাবাস। যখন তাক করবেন তখন দুহাতে পেছন দিকটা শক্ত করে ধরে তাক করবেন। হঠাৎ এক হাতে ধরতে গেলে হাত কাঁপবে। তাছাড়া আপনার আঙুল ও কবজি খুব নরম। তাক ফসকে যাবে।

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অস্ত্রটা কোমরে গুঁজে আলী রেজার পেছনে পেছনে এ পর্যন্ত এসেছি। রওনা হওয়ার সময়ই অপারেশনের প্ল্যানটা সবগুলো গ্রুপের কাছেই আলী রেজা ব্যাখ্যা করেছেন। সবাই একমত হয়ে বিভিন্ন পথ ধরে এখানে রওনা হয়ে এসেছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা না গেলেও মাঠের ওপারে একটা লম্বা টিনের চাল আন্দাজ করা যায়। পশ্চিম দিকে একটা দেয়ালের পাশে দুটি ছাদঅলা মাঝারি সাইজের বড় সামরিক জিপ দাঁড়ানো। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল হানাদারদের একটা পঁয়ত্রিশ জনের পুরো গ্রুপ এখানে থাকলেও স্কুলের বারান্দায় কোনো আলোর ব্যবস্থা রাখা হয় নি। বারান্দায়, মাঠ কিংবা জিপ দুটোর আশে পাশে কোনো সেন্ট্রির চলাফেরা দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় সবাই স্কুল ঘরটার বিভিন্ন কামরায় ওঁৎ পেতে আছে। এদের সংখ্যাটা আলী রেজাই যোগাড় করেছেন।

নালাটার পাড় থেমেই আলী রেজা ও তার চার সঙ্গী প্রায় আড়াই হাত লম্বা ব্যারেলটা স্কুলের মাঠে রাখা গাড়ি দুটোর দিকে তাক করে ফিট করে ফেললেন। একটা ঝোলার ভেতর থেকে চকচকে ছোটো শেল বের করেই ব্যারেলের নিচের দিকে নিঃশব্দে বসিয়ে দিলেন। খুবই অনুচ্চ, প্রায় ফিসফিসানির মতো আনন্দ ধ্বনি বের হল সবার মুখ থেকেই। আমি বুঝলাম অন্ধকারে এই ক্ষুদ্র কামান বসানোর সাফল্যে এরা উল্লসিত। হঠাৎ রেজা আমার দিকে মুখ এগিয়ে এনে বললেন, আর দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যাবে। আমাদের সহযোদ্ধারা আমার নির্দেশমত ঠিক ঠিক জায়গায় অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। এখানে আমার এই চারজনের ইউনিটের সাথে আপনি চুপচাপ বসে থাকবেন। ফায়ারের সময় কানে আঙুল দিয়ে থাকবেন। ভয় পাবেন না।

আমি বললাম, আপনি?

আমি প্রত্যেকটা গ্রুপের পজিশন চেক করে সিগন্যাল দেব। কীভাবে দেব তা আপনি বুঝবেন না। যারা এ্যাকশন শুরু করবে তাদের বলা আছে তারা বুঝে যাবে। আমার এই গোলন্দাজ ইউনিট না নড়া পর্যন্ত আপনিও এখান থেকে নড়বেন না। মনে রাখবেন এটা হল অপারেশন কমান্ডারের হুকুম। একদম স্থির থাকবেন।

বলেই আলী রেজা কামানটার দুপাশে উবুড় হয়ে দুজন করে বসে থাকা সঙ্গীকে হাত দিয়ে একটা ইশারা করেই অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে মিলিয়ে গেলেন।

আমি ও আমার সঙ্গীরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকলাম। হঠাৎ কামানটার বাঁ পাশ থেকে একজন খুব নিচু স্বরে বলল, সিগন্যাল।

আমি কিছুই বুঝতে না পেরে অন্ধকার মাঠটার দিকে তাকলাম। না কোনো ইঙ্গিত বুঝতে পারছি না। শুধু ব্যারেলটা একটু উঁচু হয়ে উঠল বলে মনে হল। এদিকে আমার চারজন সঙ্গীর মধ্যে দুজন মাঠের দিকে মাথা একটু উঁচু রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কে একজন আমার কোমরের বেল্ট ধরে টান দিল, আমাদের মতো করে পজিশন নিন।

আমিও নিঃশব্দে কনুইয়ের ওপর ভার রেখে দুটি পা পেছন দিকে মেলে দিলাম। আমরা সকলেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছি মাঠ আর ওপাশের ফুলটার দিকে। স্কুললটার ওপর পাতলা চাঁদ হঠাৎ মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় একটা হালকা আলো যেন অন্ধকারকে ঈষৎ ফিকে করে দিল। এখন গাড়ি দুটির অবস্থান অস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। স্কুলের বারান্দাটাও অস্পষ্টভাবে নজরে আসছে। কিন্তু শত্রুদের কোনো চলাফেরা দেখছি না। আমি ফিসফিস করে আমার পাশে শুয়ে পড়া সঙ্গীকে বললাম, দুশমনদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না কেন কিছু বুঝছি না।

তারা ঠিকমতোই পজিশন নিয়ে আছে। একটু পরেই বুঝতে পারবেন।

তার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই নারী কণ্ঠের আর্ত চীৎকার শুনতে পেলাম। আর সাথে সাথেই স্কুলঘরের একটা দরজায় আলো জ্বলে উঠল। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল পাঁচ ছজন শত্রু সেনা। এদের প্রত্যেকেই অস্ত্র উঁচিয়ে খোলা দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেলো। মুহূর্তমাত্র। এরপরই ক্লাস রুমের ভেতর থেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ একটি মেয়েকে চুলের মুঠি এবং দুদিকে হাতপা ধরে কয়েকজন হানাদার ঝুলন্ত অবস্থায় বের করে আনল। এদের পেছনে একজন সার্চ লাইট উঁচু করে ধরে আছে। দৃশ্যটা দেখামাত্রই আমি বুঝতে পারলাম নাসরিনের ওপর পাশবিক অত্যাচারের পর তার অচৈতন্য দেহটাকে পশুরা বাইরে নিয়ে এসেছে। রাগে, ঘৃণায় ও স্নায়বিক উত্তেজনায় আমি থর থর করে এমন। প্রবলভাবে কাঁপছিলাম যেন এই মুহূর্তে সারা দেহ কাঁপিয়ে আমাকে ম্যালেরিয়া আক্রমণ করেছে। সম্ভবত আমার সঙ্গীদের একজন কেউ অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার পিঠে হাত দিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল, একটু ধৈর্য ধরুন। একটু পরেই আমাদের মেয়েটি রিলিজ হবে। প্লিজ কাঁপবেন না।

আমি একথায় গুঁড়ি মেরে লোকটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কমরেড এ্যাকশন শুরু হচ্ছে না কেন? আপনারা কামান দাগছেন না কেন?

এ্যাকশনতো শুরু হয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা এদের সব পজিশনে হুকুমের অপেক্ষায় ওৎ পেতে আছে। ঐযে গাড়ি দুটি দেখছেন এখন ও দুটোতে আমাদের ছেলেরা পজিশন নিয়ে রেখেছে। কামান দাগলে মেয়েটি মারা পড়বে। আমাদের কমান্ডারের ওপর ভরসা রাখুন। আর কথা বলবেন না। চুপ।

আমি চুপ করে এক দৃষ্টিতে স্কুলের বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাসরিনকে এরা এখন বারান্দার ওপর ছুঁড়ে ফেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে মনে হল হাসতে হাসতে একটা সিগ্রেট ধরাল। কেউ আবার উবুড় হয়ে নাসরিনের নিরাবরণ অচৈতন্য শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়ে পরখ করে সঙ্গীদের কী যেন বলছে। আর পেছন থেকে ক্লাসরুমের অন্ধকার গহ্বর থেকে একটা লোক প্যান্টের বোতাম বা চেইন টানতে টানতে বেরিয়ে এল। তার গায়ে গেঞ্জি। দূর থেকেও তার ফর্সা গায়ের রং বোঝা যায়। সম্ভবত এ লোকটাই এদের অধিনায়ক। সে বেরিয়ে এসেই কী যেন বলল। লোকগুলো আবার নাসরিনের নগ্ন দেহটাকে চ্যাঙদোলার মতো দুলিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। যারা নাসরিনকে বহন করে মাঠে নামল তাদের পেছন পেছন বেশ কয়েকজন হানাদার লাইন বেঁধে মার্চ করে মাঠে নেমে পড়ল। গেঞ্জি পরা লোকটা এবং আরও কয়েকজন তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

আমার পাশের কমরেড হঠাৎ তার সঙ্গীদের বলল, টার্গেট।

সাথে সাথেই ব্যারেলটা একটু সরে বারান্দার মধ্যমণি লোকটাকে তাক করল। ততক্ষণে নাসরিনের দেহটাকে মধ্য মাঠে টেনে এনে নর পশুরা যে দৃশ্যের অবতারণা করল তা না দেখার জন্য আমি আমার মাথা ঘাসের ভেতর নামিয়ে এনে ধরিত্রীর বুকে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম।

আমার পিঠে কে যেন হাত রেখে মোলায়েম কণ্ঠে উচ্চারণ করল, আমরা সিগন্যাল পাচ্ছি। কানে আঙুল। ফায়ার।

প্রচন্ড শব্দে ব্যাটারী কার্যকর হয়ে উঠলে আমি আচমকা মাটি থেকে মাথা ওপরে তুললাম। কোথায় সে সার্চ লাইট আর কোথায় সেই স্কুল ঘর কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু মাঠটার চারদিক থেকে আচমকা শুরু হয়েছে ধারাবাহিক এল, এম, জির ফটাফট শব্দ। এর মধ্যে কামান একটু বিরাম দেওয়া মাত্রই শুনতে পেলাম স্থান বদলের ইঙ্গিত। দ্রুত হাতে কমরেডের কামানটাকে কয়েক ভাগে আলাদা করে ফেলে নালাটার, নিচে নেমে গেল। আমিও তাদের সাথে নামলাম। এর মধ্যে কে একজন ওপর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের ওপর এসে পড়েই হুকুম করলেন, তিরিশ গজ ডানে।

বুঝলাম রেজা ভাইয়ের গলা। আমরা দ্রুত তিরিশ গজ আন্দাজ ডানে ছুটে এসে মাথা মাটিতে লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। এবার মাঠের মধ্য থেকে এক ঝাঁক গুলী আমাদের দেহের ওপর দিকে শিস্ তুলে চলে গেল। আমার পাশে মাটিতে চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থাতেই রেজা ভাই ও তার সঙ্গীরা ব্যারেলটা যুৎসই করে মাঠের দিকে তাক করল। কিন্তু এখন কারো উঠে বসার উপায় নেই কারণ মাঠের চারদিক থেকেই লাইট মেশিনগান ও চাইনিজ রাইফেলের গুলীর শব্দ উঠছে। এর মধ্যেই আলী রেজা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, এনিমি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শুধু স্কুল ঘরটার ভেতর দুতিনজন পজিশন নিয়ে আছে। ভয়ে এলোপাথাড়ি গুলী চালিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই স্কুলটা আমাদের দখলে চলে আসবে।

আমি বললাম, নাসরিন?

মাঠের মধ্যে পড়ে আছে সম্ভবত এখনও বেঁচে আছে। তবে অজ্ঞান।

মাঠের মধ্যে অনেকগুলো হানাদার ছিল?

খতম। ঐ জিপগুলোর ভেতর আমাদের লোকেরা অন্ধকারে পজিশন নিয়ে ছিল। আমাদের গান থেকে প্রথম হিট করার সাথে সাথেই তারা মাঠে লাফিয়ে পড়ে সবাইকে খতম করে দিয়েছে। আমাদের এ্যাটাকে বারান্দার সেই গেঞ্জিপরা বদমাইশ মেজরটারও খুলি উড়ে গেছে।

আমাদের কারো কিছু হয় নি তো?

ছজন ডেড।

মাঠের অপারেশন নাসরিনের গায়ে গুলী লাগে নি তো?

আমার উৎকণ্ঠার কোনো জবাব না দিয়ে আলী রেজা হঠাৎ উঠে বসলেন। তার দেখাদেখি আমিও উঠে বসতে চেষ্টা করতে গেলে রেজাভাই আমার কাঁধে সজোরে চাপ দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিলেন।

মাথা তুলবেন না। স্কুলঘরের ভেতরে হারামজাদাদের হাতে একটা রকেট লঞ্চার আছে আমাদের ভারী অস্ত্রটা এরা খুঁজছে। একটু আভাস পেলেই কামান শুদ্ধ আমাদের উড়িয়ে দেবে।

আমি এবার অবস্থাটা ঠিকমতো আন্দাজ করতে পেরে মাটির ওপর কপাল রেখে আস্তে বললাম, আল্লাহ দয়া কর। আমাদের বিজয় দাও।

আলী রেজা কতক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে মাঠের ওপর গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমি বললাম, রেজাভাই আপনার গায়ে গুলী লাগতে পারে। আমার পাশে শুয়ে পড়ুন।

আমি এবার ক্রল করে নাসরিনের কাছে পৌঁছুতে পারি কিনা দেখি। আপনার পিস্তলটা কোথায়?

এইত আমার হাতেই আছে।

আমি আলী রেজার দিকে পিস্তলটা বাড়িয়ে দিলাম।

তিনি পিস্তলটা হাতে নিয়েই একজন সঙ্গীর দিকে নিচু হয়ে কী যেন বললেন। এই লোকটিই কামান থেকে প্রথম গোলা বর্ষণ করে স্কুলের বারান্দায় গেঞ্জিপরা মেজরটাকে খতম করেছিল। আলী রেজার ইঙ্গিতে সে কয়েক হাত গড়িয়ে গিয়ে ব্যারেলের পেছনে ব্যাটারির ওপর হাত রেখে পজিশন নিল। আলী রেজা এবার সরে এলেন আমার দিকে।

আমার পেছনে বুকে হেঁটে আসতে পারবেন?

আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই বললাম, পারব।

দ্যান ফলো মি।

আলী রেজা বুক ঘাসের ওপর হেঁচড়িয়ে কনুই দিয়ে চলতে শুরু করলেন। আমিও তাকে যথাযথ অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। উত্তেজনায় আমি ঘাসের ওপর কনুই ছোঁয়াবার কষ্টটা টেরই পেলাম না। শুধু হাঁটুর দিকে প্যান্টের ভেতরে একটা ঘসটানির জ্বলুনি অনুভব করলেও বেপরোয়া রেজাভাইকে অনুসরণ করতে লাগলাম। আমরা পনেরো গজের মতো এগোতেই আমাদের পেছন থেকে বিপুল শব্দে গোলাবর্ষণ শুরু হল। রেজাভাই এগোনো বন্ধ করে ঘাসের ওপর মাথা রেখে স্তব্ধ হয়ে থাকলেন। আমিও তার মতোই ঘাসে মাথা রেখে কানে আঙুল দিলাম। ব্যারেল থেকে শেল ছিটকে বেরুবার আলোর ঝলক এসে পড়ছে আমাদের ওপর। গন্ধকের গন্ধের মতো এক ধরনের ঝাঁঝাল গন্ধ এসে লাগল নাকে। আবার মাঠটার চারদিক থেকে এবং স্কুল ঘরের একটা জানালা থেকে প্রবল শব্দে গুলী বিনিময় চলতে লাগল। আলী রেজা ঘাসের ওপর মুখ চেপে রেখেই আস্তে বললেন, নার্ভাস লাগছে?

মোটেই না।

তাহলে এগোন।

আমরা আবার কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে কয়েক গজ এগিয়েই থেমে পড়লাম। কারণ স্কুললটার ভেতর থেকে শিসের মতো এমন একটা শব্দ উঠেই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে বিশ গজ পেছন তীব্র গর্জনে ফেটে পড়ল। মনে হল আমি বুঝি কালা হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু ভাববার আগেই আমাদের ব্যাটারী থেকে দুম দুম আওয়াজ তুলে আগুন ছিটকে যেতে লাগল। একটা ধোঁয়ার আস্তরণের ভেতর আমি ও রেজা ভাই তলিয়ে গেলাম। বিস্ফোরণের তীব্র গন্ধে চোখ জ্বলছে। এর মধ্যেই পিস্তলের বাট দিয়ে রেজা ভাই আমার পিঠে চাপ দিলেন।

স্টার্ট।

আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।

একটু এগিয়েই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অনেকগুলো মৃতদেহের পাশে চলে এলাম। রেজা ভাই থামতে ইঙ্গিত করলে আমি থামলাম। আমার সামনেই ইউনিফর্ম পরিহিত একজন পাকিস্তানী জোয়ানের হাতের অস্ত্রটি ছিটকে গিয়ে পড়ে আছে কয়েক হাত দূরে। রেজা ভাই বললেন, দেখুন ত মড়াটার বেল্টে একটা রিভলবার আছে মনে হচ্ছে।

আমি দেখলাম আছে। বললাম, খুলে নেব?

আপনি আমার হাতের পিস্তলটা ধরুন।

রেজা আমাকে আমার পিস্তলটা ফিরিয়ে দিয়ে লাশের খাপ থেকে রিভলবার বের করে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সেফটি পিন নামিয়ে বলে উঠলেন, খুব ভালো জিনিস। চাইনিজ মেড।

এসময় লাশগুলোর মাঝে একটা গোঙানি শুনতে পেয়ে আমরা উভয়েই হাতের অস্ত্র তাক করে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রেজা ভাই বললেন, নাসরিন বেঁচে আছে। জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে।

আমি তার কাছে এগিয়ে যাব?

লাশটির ওপর দিয়ে আস্তে পার হয়ে যান।

আমি মৃত জোয়ানের শরীরের ওপর নিজের বুকটা তুলে দিলাম। তারপর আস্তে করে গড়িয়ে নাসরিনের একটা হাত ধরে ফেললাম। এবার তার গোঙানি ও এলোমলো কথা কানে এল।

যতখুশি মারো আমি বলব না। মাগো।

আমি বললাম, নাসরিন। শুনতে পাচ্ছ? আমরা এসে গেছি। হানাদাররা খতম।

নাসরিনের হাতে আমি মৃদু ঝাঁকুনি দিলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সম্ভবত নাসরিন আবার চেতনা হারিয়েছে। এ সময় রেজা ভাই গুঁড়ি মেরে আমার পাশে চলে এলেন।

আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। এখন কী করব রেজাভাই?

আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। যদি আবার জ্ঞান ফিরে ওকে উঠে বসতে দেবেন না। যে দুতিনজন এখনও স্কুলের ভেতর আছে এরা এখনই সারেন্ডার করতে বাধ্য হবে। মনে হয় রসদ ফুরিয়ে এসেছে। এখন আমাদের লোকেরা স্কুলল ঘরটায় আগুন লাগিয়ে দেবে। বাছাধনরা যদি জান বাঁচাবার জন্য মাঠে লাফিয়ে পড়ে কিংবা এদিকে এগিয়ে আসে তবে সোজাসুজি পিস্তল থেকে ফায়ার করবেন। দুহাতে পিস্তলের বাট ধরবেন, হাত কাঁপবে না। আমি অন্য পজিশনের দিকে যাচ্ছি। একটু পরেই সকালের আলো ফুটবে। এর আগেই আমাদের সব খতম করতে হবে।

রেজাভাই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছেন শুনে আমি একটু ভয়ই পেলাম। বললাম, আপনারা এসময় এখানে থাকলেই ভালো হত। নাসরিন এখানে রয়েছে।

আমি না যাওয়া পর্যন্ত স্কুলঘরটায় এরা আগুন দেবে না। নাসরিনের জ্ঞান ফিরলে কী করতে হবে তা তো বলেছি। বুকে সাহস রাখুন। শেষ মুহূর্তে কোনো অঘটন যাতে না ঘটে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। বুঝতে পারছেন না মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটাই হল মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। যদি ওদের রকেট লঞ্চারটা হাতাতে পারতাম তা হলে খুব ভালো হত। মনে হয় সে সুযোগ হবে না। সবকিছু আগুনে ছাই হয়ে যাবে। আর এ অপারেশনের পরই আমাদের সীমান্তের ওপারে পালাতে হবে। এরা এর মধ্যেই যশোর ক্যান্টনমেন্টে অয়্যারলেসে সম্ভবত বিপদের কথা জানিয়ে সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে ভোরের আগে সেখান থেকে সাহায্য এসে পৌঁছুতে পারবে না। এর আগেই সব খতম করে আমরা পালাব।

কথা শেষ করেই রেজাভাই ক্রল করতে শুরু করলেন। আবার প্রচন্ড গুলীর শব্দ মাঠটার চারদিক থেকে এসে স্কুল ঘরের একটি বিশেষ ক্লাসরুমে আঘাত হানতে লাগল। মনে হচ্ছে শত শত রাউন্ড গুলীর আঘাতে ঘরটার টিনের বেড়া, দরজা-জানালা ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। এবার আমাদের পক্ষ থেকে গুলী বর্ষণের তোড় এমন বাড়ল যে, কুল থেকে মাঝে মধ্যে যে জবাব দেয়া হচ্ছিল তাও তলিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমাদের পেছনের ব্যাটারি থেকে কোনো শব্দ পাচ্ছি না কেন? রকেটের বিস্ফোরণে এরা কী তবে শেষ হয়ে গেছে? নাকি আমাদের কামানটাই বিকল হয়েছে?

ভয় ও এসব এলোমেলো চিন্তাভাবনার মধ্যেই নাসরিন আবার কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। তার একটা হাঁটু একটু উঁচু হয়েই পড়ে গেল। আমি তার হাতটা মুঠোর মধ্যে রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিলাম।

নাসরিন, আমি হাদী মীর।

বুঝতে পারলাম না নাসরিন আমার উপস্থিতি টের পেল কী না। তার নগ্নদেহটা একবার পাশ ফিরতে গিয়েও পারল না। আবার সে সটান হয়ে ফোঁপাতে শুরু করল। আমি আবার নাসরিনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম।

নাসরিন, শুনতে পাচ্ছ?

পানি খাব। একটু পানি।

নাসরিন সম্বিৎ ফিরে পাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, নাসরিন, আমি হাদী ভাই। চিনতে পারছ?

পানি।

নাসরিন আবার অস্ফুট গোঙানিতে পানি চাইল। আমি পিস্তলটা কোমরে খুঁজে দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি স্কুল ঘরটার চতুর্দিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। রেজা ভাই আগুন ধরিয়ে দেয়ার হুকুম ঠিকমতো দিতে পেরেছেন বুঝলাম। নাসরিন ক্রমাগত ভাঙা আওয়াজে তার তৃষ্ণা ব্যক্ত করতে লাগল, পা-নি।

আমি মুহূর্তমাত্র হতভম্ব অবস্থায় থেকে পাকিস্তানী জোয়ানদের লাশগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেললাম। ভাবলাম যদি এদের বেল্টে কিংবা ইউনিফর্মের সাথে বাঁধা পানির বোতল থাকে? গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম সামনের দেহটার কাছে। একটু হাতড়েই পেয়ে গেলাম পানির বোতল। অনায়াসেই তুলে নিয়ে ছুটে গেলাম নাসরিনের কাছে। কর্ক খুলে ঢেলে দিলাম মুখে। আমার হাত ঠক ঠক করে কাঁপছিল। পানি ছড়িয়ে গেল নাসরিনের চোখে মুখে গলায়। এবার মনে হল নাসরিন সম্পূর্ণ সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। আমি বললাম, নাসরিন আমি হাদী, হাদী মীর। তোমার কোনো ভয় নেই। হানাদাররা প্রায় সবই খতম। দ্যাখো রেজাভাই স্কুলটায় এ্যাটাক করেছে। এখন যুদ্ধ শেষ হবে। আমাদের জিত হচ্ছে। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ নাসরিন?

আমি পানির খালি বোতল পাশে রেখে নাসরিনের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে প্রশ্ন করলাম।

আমি এখন কোথায় হাদী ভাই?

স্কুলের মাঠে। আমাদের ছেলেরা স্কুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ভেতরে দুতিন জন এতক্ষণ প্রতিরোধ দিচ্ছিল। এবার বেরুবে কিংবা পুড়ে মরবে। দেখতে পাচ্ছ?

আমার কোমরটা নাড়াতে পারছি না। ওরা আমাকে কয়েকজন মিলে…

কথা বল না নাসরিন, আমি সব জানি। তুমি ওঠার চেষ্টা করো না। এটা রেজাভাইয়ের হুকুম। রেজাভাই অচেতন অবস্থায় তোমাকে এখানে দেখে গেছেন। আমাকে তোমার পাহারায় রেখে গেছেন। তোমার কোনো ভয় নেই।

আমাকে ওরা শেষ করে দিয়েছে হাদী ভাই। আমি উঠে দাঁড়াতে পারব না।

বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল নাসরিন।

আমি বললাম, সবই ঠিক হয়ে যাবে বোন। নিজেকে একটু শক্ত কর।

আমার কাছ থেকে এরা একটি কথাও বের করতে না পেরে দশ বারো জন মিলে…

আমি বললাম, আমরা সব জানি নাসরিন, একটু ধৈর্য ধর।

স্কুলে এনেই টেনে আমার কামিজ ছিঁড়ে, সেলোয়ার জোর করে খুলে নিয়ে…

একটু ধৈর্য, নাসরিন একটু অপেক্ষা। আমি তোমাকে ঢাকার ব্যবস্থা করছি।

আমি আমার শার্টটা দ্রুত হাতে খুলে নাসরিনের হাতে দেওয়া মাত্র সে তার নগ্নতা ঢাকার চেষ্টা করল। শার্টটায় তার উদোম নাভি ও নিম্নাংশ ঢাকা পড়ল বলে মনে হল। স্কুলের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় মাঠটা ফর্সা। আমি নাসরিনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া মাত্রই মাঠটার চারদিক থেকে হই চই করে আমাদের সশস্ত্র গেরিলারা স্কুলের দিকে এ্যাডভান্স করতে লাগল। আর তক্ষুণি জ্বলন্ত স্কুলের জানালা থেকে তিনটি সশস্ত্র জোয়ান লাফিয়ে পড়ল স্কুলের বারান্দায়। সঙ্গে সঙ্গেই গুলীর ঝাঁক ছুটে গেল সেদিকে। আমিও আমার পিতল বারান্দার দিকে তাক করে দুহাতে বাগিয়ে ধরলাম। আমার হাত ও শরীর উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে।

এক ঝলক গুলীর বাতাস কাটা শব্দ আমার ও নাসরিনের ওপর দিকে পার হয়ে গেল। নাসরিন আবার পাশ ফিরতে কাঁধ ও কোমর ফেরাবার চেষ্টা করছে। পারল না। ব্যথায় কঁকিয়ে কাঁদল, পারি না, হাদী ভাই। আমায় একটু ঘুরিয়ে দিন। আহ, ও মাগো।

আমি পিস্তল নামালাম।

পিঠে একটু ঠেলা দিন।

আমি পিস্তলটা রেখে নাসরিনের পিঠে আস্তে আস্তে ঠেলতে লাগলাম। এবার উপুড় হয়ে পড়ল সে। আমি বললাম, এই তো পেরেছ।

নাসরিনের পেছন দিকটা আবার উদোম হয়ে যাওয়াতে আমি শার্টটা টেনে ঢাকলাম। এখন শীতের প্রারম্ভকাল। বাতাসে একটু শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। আমার গেঞ্জি পরা থাকলেও বেশ শীত লাগছে। কিন্তু নাসরিনের পিঠে ঠেলা দেবার সময় বুঝেছিলাম সে দর দর করে ঘামছে। আকাশে চাঁদের ফালিটা এখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। রাতের পাখিরা আগুনের শিখায় ও গুলীর শব্দের মধ্যেও কোথাও ডেকে চলেছে। খুব দূরের কোনো ঝোপঝাড় থেকে কোকিল ডেকে চলেছে। সম্ভবত রাতজাগা প্রাণিকুলদের মধ্যে চতুর্থ প্রহরের অতিক্রান্তি প্রাকৃতিক ইঙ্গিতের মতো ঘোষিত হল। বারুদের ঝঝে ভারী বাতাসেও জোনাকিরা জ্বলছে। ঝিঁঝির শব্দ উঠছে পেছনে ফেলে আসা নালাটার পাড় থেকে। এতক্ষণে সারা স্কুলটাই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। অথচ অনতিদূরে মানুষের বসতিতে এর কোনো প্রতিক্রিয়া আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গুলীর শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ বা কলরব এতক্ষণ শুনি নি। হানাদারদের জুলুম-অত্যাচারের ভয়ে সারা দেশের নিরুপায় সাধারণ মানুষ যেন বোবা হয়ে আছে। এর ওপর আছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপবাদ ও নির্মম পীড়ণ। গাঁয়ের মেয়েদের ওপর হানাদাররা যে পৈশাচিক আচরণ ও ধর্ষণলীলা চালাচ্ছে তাতে নাৎসীরাও লজ্জা পেত। অথচ এরা নিজেদের মুসলমান বলে সারা দুনিয়ার কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। আজ হোক কিংবা কাল এরা পরাজিত হবেই। নীতিবোধহীন সেনাশক্তি আধুনিক মারণাত্রের জোরে ক্ষণকালের জন্য বিজয়ী হলেও পরাজয়ই এদের শেষ ভাগ্যলিপি। ইসলামের এমন অবমানকারীদের আল্লাহ নিশ্চয়ই শাস্তি দেবেন। অমর্যাদাই এদের ললাট লেখন। এইতো এরা এখন বাংলাদেশের সর্বত্র মুক্তিযোদ্ধাদের চোরগুপ্তা আক্রমণের মুখে দিশেহারা। এখানে আমাদের ষাট সত্তরজন আনাড়ি গেরিলার কাছে পরাজিত।

নাসরিন এতক্ষণ উপুড় হয়ে শোয়ার আরামটা পেয়ে চুপ করেছিল। এখন আবার গোঙানির শব্দ পাচ্ছি। আর ফুঁপিয়ে কান্না। আমি বললাম, খুব কষ্ট হচ্ছে?

কোমরের পেছনের হাড়ে খুব ব্যথা হচ্ছে। নাঈয়ের নিচেও হুল ফুটানোর ব্যথা। আহ।

ভালো লক্ষণ। এতক্ষণ তো তোমার সারা শরীরই অসাড় ছিল। ব্যথাবেদনা বোঝার বোধশক্তি ছিল না। এখন অন্তত ব্যথার অনুভূতিটা ফিরে আসছে। তুমি ভালো হয়ে যাবে নাসরিন।

ওরা আমাকে একদম শেষ করে দিয়েছে। আমি আর বোধহয় হাঁটাচলা করতে পারব না।

এবার বেশ জোরে বিলাপ করতে লাগল নাসরিন। আমি তাকে এখন সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু আরও কিছুক্ষণ তাকে সহ্যের মধ্যে রাখতে পারলে হত। বললাম, আর সামান্য সময় মুখ বুজে পড়ে থাক বোন। তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে। স্কুলের বারান্দায় এখনও দুতিন জন হানাদার পজিশন নিয়ে আছে। গুলী ছুঁড়ছে। এখানে মানুষের আওয়াজ পেলেই আমাদের নিশানা বানাবে। একটু চুপ করে থাক।

আমার কথায় নাসরিন ঘাসের ওপর ব্যথায় মুখ ঘসটাতে থাকল। এখন বিলাপ বন্ধ। মাঠের মাঝে যারা একটু আগে জয় বাংলা বলে হই চই তুলে অস্ত্র উঁচিয়ে স্কুলটা ঘিরে ফেলতে যাচ্ছিল তারা সবাই মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে। বারান্দায় লাফিয়ে পড়া শত্রুদের এদের সবাই সম্ভবত দেখে সাবধান হয়েছে। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে বলেও মনে হল না। স্কুলের আগুনটা এতক্ষণে প্রায় মিইয়ে এসেছে। জ্বলন্ত চালা, কড়িকাঠ ইত্যাদি হঠাৎ কাঠামোসহ ভেঙে পড়ল মাটিতে। দৃশ্যটা দেখেই আমাদের পক্ষের গুলীর শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আগুনটা নিচে নেমে আসাতে মাঠের বুকে যে আবছা আলো ছিল তা এখন অন্ধকারে ডুবে গেল। বারান্দার দিকটাও নিস্তব্ধ। দুশমনরা আর জবাব দিচ্ছে না। এসময় হঠাৎ রেজাভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম। তিনি স্কুলের মাত্র বিশ ত্রিশ গজ দূরে থেকে উর্দুতে শত্রুদের উদ্দেশ্যে কী যেন বললেন। আমি শুধু হাতিয়ার শব্দটাই বুঝতে পারলাম। পাকিস্তানীরা কোনো জবাব দিল না। তবে পাল্টা গুলীও না করাতে বোঝা গেল তারা সারেন্ডারের ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছে না। এবার সারা মাঠ থেকেই আমাদের ছেলেরা সারেন্ডার সারেন্ডার বলে চীৎকার করে উঠল। তারপরই শুরু হল বেপরোয়া গুলীর ঝড়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত একতরফাভাবে গুলীর তুফান বইতে লাগল। মনে হল সারেন্ডার করার জন্য বারান্দার নিচে আর কেউ বেঁচে নেই। পাল্টা একটাও গুলীর শব্দ না থাকাতে আলী রেজা মাঠের একদিক থেকে এ্যাডভান্স বলে কমান্ড দিলেন। গুলীর শব্দ জ্বলন্ত ভিটেটার দিকে এগোতে লাগল। আমি অবশ্যম্ভাবী পরিণামের জন্য উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। নাসরিন তার নাভির তীব্র ব্যথায় আমার একটা পা চেপে ধরেছে।

আমাকে গুলী করে মেরে ফেলুন আমি আর সইতে পারছি না ওমা, মাগো।

নাসরিন আর কয়েক মিনিট, আমরা জিতে গেছি বোন। একটু পরেই তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।

আমি তাকে পিঠের ওপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। সে আবার একটা বাচ্চা মেয়ের মতো বিলাপ করতে লাগল। ব্যথা নিশ্চয়ই খুব তীব্র যা নাসরিনের বিকৃত ও ভেঙে যাওয়া কণ্ঠস্বর থেকে আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, নাসরিন আল্লার নাম বল। বল আল্লাহ আল্লাহ আমাকে পানাহ দাও।

আমার কথামতো নাসরিন ভাঙা বিকৃত গলায় আল্লাহ, আল্লাহ বলে কাঁদতে লাগল। আমি নাসরিনের মাথায় হাত রেখে স্কুলের জ্বলন্ত ভিটে বাড়ির ওপর নজর রাখলাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মাঠের বাঁ পাশে দাঁড়ান একটা জিপের হেড লাইটের আলো জ্বলে উঠল। জিপটার স্টার্টের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাড়িটা তীব্র বেগে এগিয়ে এসেই বাঁক ঘুরে রাস্তায় নেমে গেল। এর আগেই আমাদের ছেলেরা জিপটার দিকে গুলীবর্ষণ করলেও জিপটা বেপরোয়া রাস্তায় নেমে পালিয়ে গেল। অন্য জিপটার দিকে কারা যেন হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গ্রেনেড ফাটার বিকট শব্দ এলাকাটাকে কাঁপিয়ে দিলেও আমাদের বুঝতে বাকি রইল না দুশমনদের দুতিন জন আমাদের ফাঁকি দিয়ে চোখের সামনে পালিয়ে গেছে। গুলীর শব্দ থেমে গেলে আমি উঠে বসলাম। এক ধরনের হতাশা ও হতভম্বের মাঝে আমাদের বিজয় শেষ হল। একটু পরেই দূরের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এল। মনে হল গত রাতের এই প্রচন্ড গুলীর শব্দ, কামান এবং লাইট মেশিন গানের শব্দের মধ্যেও যেন এলাকাবাসী নির্বিকার। প্রাত্যহিক নিয়মেই যেন মোয়াজ্জিন আজান হাঁকলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। এখান থেকে গ্রামগুলো খুব দূরে নয়, আশেপাশেই ছড়ান। রাতের এই প্রচন্ড যুদ্ধের ভয়াবহতা তারা না বুঝলেও নিশ্চয়ই গোলাগুলির শব্দে ঘুমোতে পারে নি। অথচ কেউ দল বেঁধে গ্রাম থেকে এদিকে এগোল না। জানতে চাইল না এখানটায় গতরাতে কী ঘটেছে? নাকি সব ভয়ে উদাসিনতার ভান করে দূরে সরে থাকতে চাইছে?

মাঠটার এদিক ওদিক থেকে নানা গ্রুপের মুক্তিরা টর্চের আলো ফেলে পরস্পরকে বিজয়সূচক অভিবাদন ও আনন্দ প্রকাশ করছে। এবার মাঠের মধ্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ সিগ্রেট ধরাচ্ছে বুঝতে পেরে আমিও পকেট থেকে প্যাকেট খুলে একটা ধরালাম। এখন নাসরিনের কাতরানি একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে। সম্ভবত নাসরিন আবার ঘুমিয়ে পড়েছে কিংবা অচৈতন্য হয়ে আছে। প্রতিহিংসামূলক ধর্ষণ যে কী ভয়াবহ ব্যাপার সে অভিজ্ঞতা তো আমার আগেই খানিকটা হয়েছে। নাসরিনের ব্যাপারটা একেবারেই আমার কাছে অসহনীয়। ঘৃণায় আমি আবার পাশে পড়ে থাকা নর পশুদের দিকে একবার দৃষ্টি ফেরালাম। নিষ্প্রাণভাবে কুঁকড়ে পড়ে আছে সব। হয়ত এদের নিজের দেশে এদের স্ত্রী পুত্র কন্যা আত্মীয়স্বজন প্রেম ভালবাসা সামাজিকতা সবই আছে। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই পশুদের হুকুম তামিল করতে এসে নিজেরাই পশুর অধম আচরণ করে মানুষের ধর্ম ও মানবিক বিবেক পরিত্যাগ করে একদম পশু হয়ে গিয়ে প্রাণ হারাল।

আমার তন্ময়তার মধ্যে আলী রেজা এসে কখন যেন নাসরিনের পাশে বসলেন। হঠাৎ চমকে আমি মুখ তুলে তাকালাম। পূর্ব দিগন্ত তখন ফর্সা হয়ে গেছে। যদিও সূর্যের লাল আভা তখনও দেখা দেয় নি। আমি বললাম, রেজা ভাই?

আমাদের এখন আর কথা বলার সময় নেই কবি সাহেব। আমাদের এখনই স্থান ত্যাগ করতে হবে। শত্রুরা অচিরেই এখানে এসে পড়বে।

আমি বললাম, নাসরিনের অবস্থানে তো সুবিধের নয়। সে হেঁটে যেতে পারবে না। এতক্ষণ জ্ঞান ছিল। আমার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে। সে আপনাদের কোনো গোপনীয়তাই শত্রুর কাছে ফাঁস করে নি। সে কারণেই বেশি জুলুম চলেছে তার ওপর। এখন মনে হয় ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছে।

নাসরিনকে আমি ট্রেনিং দিয়েছি কবি সাহেব, আমি জানি সে কিছু বলে নি। এখন তাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যেতে হবে। আমাদের লোক একজন বোকামি করে শত্রুদের ফেলে যাওয়া গাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তা না হলে এগাড়িতেই সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া যেত।

এখন তাহলে কী ব্যবস্থা করবেন?

এ মেয়েটার জন্য আপনার সাহায্য দরকার। আপনার ভগ্নিপতি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন হোমরাচোমরা। আপনি নাসরিনকে এক্ষুণি নিয়ে কলকাতায় রওনা হোন। সেখানে কোনো ক্লিনিকে রেখে তার চিকিৎসা করাতে হবে। খরচ আমরা দেব।

বললেন কমরেড আলী রেজা। তার গলায় পিতৃসুলভ মমতা ও আমার প্রতি গভীর বিশ্বাস ব্যক্ত হল। আমি বললাম, আমি তৈরি রেজা ভাই। আমি নাসরিনের জন্য সবকিছু করব। এখনি বলুন তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া যায় কী উপায়ে?

সে ব্যবস্থা হচ্ছে। মোজাফফর গ্রুপের লোকেরা একটা ইউনিটসহ স্ট্রেচারে রোগীকে নিয়ে আপনাদের সীমান্ত পার করে প্রাইভেট কারে তুলে দেবে। কথা হয়েছে। আমরা লতিফকে বাঁচিয়েছি। তারা এর প্রতিদান দিতে চায়। আমরাও এ সাহায্য নিতে বাধ্য। এমনিতে তাদের সাথে আমাদের আদর্শগত সংঘাত আছে। তবে এসময় সহযোগিতা।

কেমন যেন হতাশ গলায় আশার সংবাদ বললেন আলী রেজা। আমি বললাম, আপনার গলা কাঁপছে কেন রেজা ভাই? আপনার অপারেশন প্ল্যান কী সফল হয় নি?

হ্যাঁ হয়েছেই বলা যায়। তবে আমাদের ক্ষতিটা মারাত্মক। আমার ছজন সঙ্গীই মেশিনগানের গুলীতে শহীদ হয়েছে। কামানটার ব্যারেল ব্যাটারি সব লন্ডভন্ড। অস্ত্রের ক্ষতিটা আমি পুষিয়ে নিতে পারব। আপনাদের ফেরত দেয়া টাকায় অস্ত্র কেনা যাবে। কিন্তু যাদের আজ এই যুদ্ধে হারালাম তারা ছিল আমার আজীবনের আদর্শগত সাথী। উচ্চশিক্ষিত তাত্ত্বিক। বিপ্লবী ভ্রাতা। এদের ছাড়া আমাদের সমগ্র পার্টিটাই স্থবির হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি। যাক আর দেরি করা উচিত হবে না। ঐ যে কমরেড মোজাফফরের লোকেরা স্ট্রেচার নিয়ে আসছে।

বললেন কমরেড আলী রেজা। গলা বিষাদে আক্রান্ত। দৃষ্টি উদাসীন। চারজন লোক একটা স্ট্রেচার এনে নাসরিনের পাশে রেখেই নাসরিনকে স্ট্রেচারে তুলে নিলো।

স্টেচারের মধ্যেই একটা সাদা চাদর ছিল। চাদরে তার দেহটা আবৃত করে দিলেন রেজা ভাই। নাসরিনের মুখ থেকে কোনো আহা উঁহু শব্দ নেই। ব্যথার কাতরানি নেই। সে সম্পূর্ণ অচৈতন্য।

আমি রেজা ভাইয়ের দিকে বিদায়ের জন্য মুখ তুললাম।

যান।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেলে রেজা বললেন, আমি বাদুড়িয়া ক্যাম্পে আপনার সঙ্গিনীকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেব। তিনি কলকাতায় গিয়ে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। সব ব্যবস্থা আমরা করব। আমরা কয়েকদিনের জন্য ইছামতীর ওপারে অবস্থান নেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *