০৭. অনেক চিন্তা-ভাবনার পর

দুদিন অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আমি ও নন্দিনী স্থির করলাম টাকাটা আমরা প্রকৃত মালিক অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গার ঠিকানায় পৌঁছে দেব। ব্যাগের ভেতর টাকার প্যাকেট এবং কাগজ পত্রের সাথে কাষ্টম কলোনীর যে মেয়েটির কথা চিঠিতে লেখা আছে সেখানে। যেভাবেই হোক ব্যাগটা পৌঁছে দিলে বিপ্লবীরা তাদের যুদ্ধকালীন কৃচ্ছতায় খানিকটা সচ্ছলতা অনুভব করবেন। তারা হয়তো ব্যাগটা খোয়া যাওয়াতে দারুণ অসুবিধায় আছেন। তাছাড়া গৌহাটি বিমানবন্দরে যে ভদ্রলোক ব্যাগটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন তার অবস্থাটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি ছাড়া না পেয়ে থাকেন তবে তার গ্রেপ্তারের খবরটাও তার সঙ্গীসাথীদের পৌঁছানোর নৈতিক একটা দায়িত্ব আমাদের ওপরই বর্তেছে।

টাকাটা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবে আমি প্রথম সম্মত হতে দ্বিধা করলেও নন্দিনীর নির্লোভ চেহারা ও বার বার মিনতিতে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তাছাড়া হঠাৎ পথে দৈবভাবে পাওয়া এই বিপুল অর্থে আমাদের যে বৈধ কোনো অধিকার নেই এই অনুশোচনাও আমাদের উভয়েরই মনে সম্ভবত অতিশয় গোপন ছাইচাপা আগুনের মতো জ্বলছিল। আর হামিদার হোটেলে আগমন এবং সব কিছু জেনেশুনেও ব্যক্তিগত সমস্ত স্বার্থ, সামাজিকতা, স্বামী ও পারিবারিক আশা আকাঙ্খা পরিত্যাগ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতিজ্ঞায় নন্দিনীর মনে পরাজিতের বেদনা সৃষ্টি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এই যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সে। তার বোন হানাদার বাহিনীর গুলী বর্ষণে পথে প্রাণ হারিয়েছে। তারও নারীত্ব লুষ্ঠিত হয়েছে হানাদারদেরই সহযোগিদের হাতে। তার পক্ষে আকস্মিক স্বাচ্ছন্দ্য, কারো প্রেমময় সঙ্গ কিংবা পথে পাওয়া টাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকা যে অসম্ভব তা আমি উপলব্ধি করেই টাকাটা ফেরত দেয়ার উদ্যোগে রাজি হয়ে গেলাম।

একদিন দুপুরের খাওয়ার পর নন্দিনী আমার ঘরে এসে দুয়ার ভেজিয়ে দিয়ে আমার বিছানায় এসে বসল।

আমি বললাম, আমাকে কিছু বলবে?

আমাদের বোধহয় আর দেরি না করে স্যুটকেসটা চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।

গম্ভীর হয়ে বলল নন্দিনী।

আমি বললাম, আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের চেষ্টায় কোনো কিছু সাব্যস্ত করার আগেই ইমামকে সবকিছু খুলে বললে কী করা যায় এর পরামর্শ চাইলে ভালো হয়।

এতে যদি ইমাম সাহেব ও পারুল রাজি না হয়? এখন তো যুদ্ধ। এ বিপদের সময় এরা যদি আমাদের এত টাকাকড়ি নিয়ে দেশের ভেতরে যেতে বারণ করেন?

ঘটানাটা ফাঁস করার ব্যাপারে নন্দিনীকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হল।

আমি বললাম, এরা কেন রাজি হবেন না? টাকাটা যেহেতু দেশের ভেতরকার একটা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের। নীতিগতভাবে ইমাম এতে রাজি হবেনই। তবে তিনি এ প্রস্তাব দিতে পারেন টাকাটা আমাদের বদলে এখান থেকে অপারেশনে যারা নিত্য যাওয়া আসা করছেন তাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার।

আমি এতে রাজি হতে পারি না।

দৃঢ়তার সাথে অস্বীকৃতি জানাল নন্দিনী।

আমি বললাম, কেন?

এতে ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হবে। আমরা যদি টাকাটা ফেরত না দিই এরা কোনোদিন আমাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য খুঁজে বেড়াবে না। তারা আমাদের চেনে না। নাম ঠিকানাও তাদের অজানা। আমরা যদি অন্যের হাতে টাকাটা পাঠিয়ে এদের গোপনীয় অবস্থানকে অন্যের কাছে উন্মুক্ত করে দিই তবে এদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। আমি তা করতে পারব না কবি। টাকা কেবল তুমি আর আমিই পৌঁছে দেব। পৌঁছে দিয়ে আমরা ক্ষমা চেয়ে এদের আশ্রয় প্রার্থনা করে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সামিল করে নিতে বলব। আমার ধারণা এরা আমাদের অবিশ্বাস করবে না।

নন্দিনীর কথায় আমি একটু চমকে গেলাম।

তোমার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। তোমার বেশ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে নন্দিনী। আমি তো অত কথা ভাবতেও পারি নি। বিষয়টা মন্দ নয়। কিন্তু ইমামদের কিছুই না জানানো কী ঠিক হবে? আমরা বাংলাদেশের ভেতরে যেতে চাইলে ইমামের সহায়তা ছাড়া সেটা কীভাবে সম্ভব?

বললাম আমি।

নন্দিনী বলল, ইমাম ও পারুলকে সব কথা জানিয়েই আমরা যাব। তবে কারো হাতে টাকা ও গন্তব্যের ঠিকানা না দিয়ে ইমাম সাহেবের সহায়তায় অপারেশনে যাওয়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপই তো আমাদের বাংলাদেশের ভেতরে পৌঁছে দিতে পারে। চাইকি তারা আমাদের দর্শনা কাষ্টম কলোনীতেও ছেড়ে আসতে পারে। পারে না কি?

আমি হাসলাম।

নন্দিনী বলল, তাহলে আজ রাতেই এদের কাছে টাকা পাওয়ার ইতিহাস এবং আমাদের যাওয়ার প্রস্তাবটা তুলতে হবে।

কে তুলবে?

তোমার দ্বিধা থাকলে আমিই তুলব।

সেটাই বরং ভালো হবে। আমি সব কথা তোমার মতো গুছিয়ে বলতেও পারব না।

তবে যাওয়ার ব্যাপারে তোমারও খানিকটা দৃঢ়তা দেখাতে হবে। নইলে তোমার বোন তোমাকে জেনেশুনে বিপদের ভিতর যেতে দেব কেন?

অর্থবহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল নন্দিনী।

আমি বললাম, পারুল তোমাকেও যেতে দিতে সম্মত হয় কিনা সেটাই আগে দেখো।

হাসল নন্দিনী। বালিশের ওপর নখ খুটতে খুটতে বলল, তুমি হলে ভাই। যাকে তারা দেশ থেকে ডেকে নিয়ে এসেছেন বিপদ আপদ থেকে দূরে রাখার জন্য। আর আমি কে? আমি হলাম একটা বাড়তি বোঝা। যার আগমনে এই পরিবার, তোমার নিজের সংসারেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। পারুল নির্বোধ মেয়ে নন। সবই তিনি বুঝতে পারছেন।

আমি একথার কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করেই থাকলাম। নন্দিনীর ধারণাটা অবাস্তব নয়। পারুল স্বভাবতই তার আচরণে এ ধরনের পক্ষপাত এতদিন গোপন রাখে নি। শুধু ইমামের নির্লিপ্ততার জন্যেই সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।

.

রাতে খাওয়ার টেবিলে ইমামের ডান পাশের চেয়ারে নন্দিনী গিয়ে বসল। বাঁ পাশে পারুল। উল্টো দিকে বসলাম আমি আর মিতু। সাধারণত প্রায় প্রত্যেক দিনই নন্দিনী, আমি আর মিতু একদিকে বসি। আজ ইমামের সাথে কথা বলতে হবে বলেই নন্দিনী ইমামের ডানদিকে বসেছে। পারুল আবার সামান্যতম অস্বস্তিবোধ করে এ জন্যই সম্ভবত নন্দিনী আসন গ্রহণ করেই আগেভাগে বলতে শুরু করল, ইমাম সাহেবের সাথে আমার কিছু কথা আছে বলেই একটু কাছাকাছি বসলাম। আশা করি মিসেস ইমাম কিছু মনে করবেন না।

পারুল প্রথমে একটু হতভম্ব। পরে হেসে বলল, কী আশ্চর্য! আমি কিছু মনে করব কেন? আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন না। গোপনীয় বিষয় হলে বলুন আমি বরং কিছুক্ষণের জন্য উঠে যাই!

না আমার কথাগুলো আপনাকেও শুনতে হবে। উঠে গেলে চলবে না।

গলায় একটু গুরুগম্ভীর ভাব আনার চেষ্টা করছে নন্দিনী।

আমি কারো দিকে না তাকিয়ে প্লেটে ভাত তরকারি তুলে নিতে লাগলাম।

নন্দিনীর ভাবসাব দেখে ইমাম একটু অবাক হলেও মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে অপ্রত্যাশিত কিছু শোনার জন্য যেন তৈরি করে নিল। হেসে মুখ ফিরিয়ে বলল, বিষয়টা কী খুবই সিরিয়াস মিস নন্দিনী?

ইমামের প্রশ্ন এবার নন্দিনীর কপট গাম্ভীর্যের দেয়াল তার উচ্চকিত খিল খিল হাসিতে ভেঙে ছড়িয়ে গেল। সকলেই, এমন কী আমিও অকারণে হাসতে লাগলাম।

হাসি থামিয়ে নন্দিনী বলল, ইমাম ভাই, আমার আর কবির ওপর একটা গুরুতর দায়িত্ব বর্তেছে। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার দায়িত্ব। আপনার আর পারুলের অনুমতি ও সহায়তা পেলে আমরাও এই লড়াইয়ে কিছু করতে পারি।

পারুল আর ইমাম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে আমার দিকে দেখল। আমি আর দ্বিধা না করে বললাম, আমরা একটা খুব জরুরি মিশনে দেশের মাটিতে ফিরতে চাই।

ইমাম কিছু আঁচ করার আগেই পারুল ত্রস্ত হয়ে বলল, বলেন কী ভাই? এই যুদ্ধের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে চান?

আমি বললাম, না বোন আমার বিজয়ী না হয়ে কী করে ঢাকায় যাব? আমরা বরং বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে একটা শহরে যাব।

সীমান্তের কোনো শহরই এখন নিরাপদ নয়। তবে আপনারা কোথায় যেতে চান জানলে অবশ্য আপনাদের যাওয়া উচিত হবে কিনা সেটা বলতে পারব।

কৌতূহলী চোখ তুলে নন্দিনীর দিকে তাকাল ইমাম।

নন্দিনী বলল, আমরা দর্শনা কাষ্টম কলোনীতে যেতে চাই। সেখানে একটা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপকে কিছু অর্থ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে আমার আর কবির ওপর। আমরা স্থির করেছি আমরা সেখানে যাবই। রাস্তাঘাট আমাদের অচেনা বলে আপনার সাহায্য চাই। ওদিকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা আসা-যাওয়া করছেন আপনি কী তাদের কোনো দলের সাথে আমাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন না?

খুব পারি। তার আগে জানা দরকার আপনার ও কবি ভাইয়ের ওপর টাকা-পয়সা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটা দিল কে?

ভাতের প্লেটে লোকমা বাঁধতে বাঁধতে জবাব দিল ইমাম। বেশ একটু উদ্বেগ নিয়ে আমার দিকেও তাকাল। নন্দিনী কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ভাই আমরা আপনার কাছে কিছুই লুকোতে চাই না। এ দায়িত্ব কেউ আমাদের ওপর চাপায় নি। দৈবভাবে এ দায়িত্ব আমাদের ওপর এসে এসে পড়েছে। আমরা গৌহাটি থেকে কলকাতার প্লেনে ওঠার আগে ওয়েটিং রুমে এক ভদ্রলোক অনেক মাল-সামান নিয়ে নন্দিনীর পাশের সীটের এসে বসে। প্লেনে ওঠার ডাক পড়লে একটা হ্যান্ড ব্যাগ একটু কষ্ট স্বীকার করে প্লেন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য ভদ্রলোক নন্দিনীকে মিনতি করতে থাকলে ভদ্রতার খাতিরে নন্দিনী ব্যাগটা নিয়ে প্লেনে উঠে যায়। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা ভদ্রলোককে সিঁড়ির কাছে আটকায় এবং টানতে টানতে তাকে টার্মিনালের দিকে নিয়ে যায়। আমি ও নন্দিনী ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে থাকি। হোটেলে এসে ব্যাগটা খুলে আমরা এতে তিন লাখ টাকা, একটা গোপনীয় চিঠি ও কিছু কাগজপত্র পাই। চিঠি থেকে জানতে পারি এই টাকা মিঃ আলী নামক এক ভদ্রলোককে অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনার জন্য পাঠানো হচ্ছিল। হ্যান্ডব্যাগটা দর্শনা কাষ্টম কলোনীর বি-৩ নং হাউসের নাসরিন নামক দশম শ্রেণীর একটি ছাত্রীকে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। এই হল কাহিনী। ঘটনাটা আগেই আপনাকে এবং আমার বোনকে আমার জানান উচিত ছিল। জানাতে পারি নি কারণ টাকাটার প্রতি আমার ও নন্দিনীর লোভ জেগে উঠেছিল। আমরা ভেবেছিলাম এই টাকায় আমি ও নন্দিনী যুদ্ধের সময়টা কলকাতায় সুখে কাটাতে পারব।

ঠিকই তো ভেবেছিলেন। এখন হঠাৎ আবার মতো পাল্টাতে যাচ্ছেন কেন? যখন অজ্ঞাত বিপ্লবীদের বোঁচকা পৌঁছে দেয়ার ভার আপনাদের ওপর কেউ চাপায় নি। তা ছাড়া এতে যে বিপদ আছে সেটাও ভাবতে হবে।

আমার কাহিনী শুনে মুহূর্তের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল ইমাম। পারুল তো সব শুনে খাওয়া রেখে হা করে ইমামের কথা শুনতে লাগল।

মিতু শুধু ছেলে মানুষের মতো বলে উঠল, বাবা তিন লাখ টাকা ফেরত দেবেন মামা। আমাকেই দিয়ে দিন না।

ফাজলামা করো না মিতু। বড়দের সব কথা শুনতে চাই। খেয়ে চুপচাপ ঘরে যাও।

মিতুকে ধমক দিল পারুল।

ইমাম একবার চোখ তুলে নন্দিনীর দিকে তাকাল, টাকাটা দর্শনায় নিজেরাই নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব বোধহয় আপনার?

প্রস্তাব নয়, প্রতিজ্ঞা।

সেখানে গিয়ে যদি কোনো বিপদে পড়েন?

সে রকম সম্ভাবনা তো আছেই।

আপনার সাহস আছে।

গম্ভীর হয়ে বলল ইমাম।

আমি বললাম, সাহসের কথা নয় ভাই। তার চেয়ে বড় কথা হল গ্লানিবোধ। টাকাটা একদল মুক্তিযোদ্ধার। যারা দেশের ভেতরে লড়ছে। একটা দুর্ঘটনায় আমাদের হাতে এসে পড়েছে। এখন আপনিই বিবেচনা করুন এ টাকা আমরা নিয়ে বসে থাকতে পারি কিনা। এ টাকা আমাকে ও নন্দিনীকে শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছে না।

বেশ, আমি আপনাদের দর্শনা হল্টে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব। তবে সেখানে পৌঁছার পর আপনাদের দায়দায়িত্ব আপনারাই বহন করবেন। আমাদের লোকেরা রাতের অন্ধকারে আপনাদের দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে।

খাওয়া সেরে উঠে দাঁড়াল ইমাম।

নন্দিনী বলল, আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না। আমরা দেশের ভেতরে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর সাথে মিশে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখানে বসে থাকতে চাই না।

খাওয়া সেরে আপনারা বরং আমাদের কামরায় আসুন। বিষয়টা নিয়ে আরও আলোচনা করতে চাই। বিপদ-আপদের ভয় থাকলেও আপনাদের মনোভাবকে আমি সম্মান না করে পারছি না। যাচ্ছেন যখন বুকে সাহস নিয়েই যান। দেশের ভেতর কোটি কোটি মানুষ বিপদ মাথায় নিয়ে বেঁচে আছে না? তারাই আপনাদের আশ্রয় দেবে সাহায্য করবে।

অপ্রত্যাশিত আশ্বাসের কথা শুনিয়ে ইমাম তার কামরার দিকে চলে গেলে পারুল নিঃশব্দে খেতে লাগল।

আমি বললাম, পারুল বোধহয় একটু চিন্তায় পড়ে গেছে।

আপনারা জেনেশুনে বিপদের মধ্যে যাচ্ছেন।

ভয়ের কিছু নেই বোন।

আচ্ছা এমন হয় না যাদের টাকা তাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে আপনারা আমাদের ছেলেদের সাথে আবার এখানে ফিরে চলে এলেন।

পারুল সত্যি ভাবনায় পড়ে গেছে।

নন্দিনী বলল, আমরা তো বোন দেশের মধ্যেই থাকতে যাচ্ছি। সেখানে থাকার আর কাজ করার সুযোগ পেলে এখানে কেন ফিরে এসে তোমাদের বোঝা হয়ে থাকব? তোমার হামিদা বৌদিকে তো আটকাতে পার নি। তার জন্যে তোমার ভাবনা হয় না?

সে কথা আর বলবেন না দিদি। ভাবির কথা ভাবলে আমার রাতে দুর্ভাবনায় ঘুম কেটে যায়। গত রাতটাও আমি ভাবির কথা ভেবে বিছানায় জেগে বসেছিলাম। এখন আবার আপনারা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন।

খাওয়া শেষ করে পারুল মিতুকে নিয়ে উঠে গেল।

.

অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পারুলদের কামরায় ইমামের সাথে পরামর্শ করে ফিরে এলাম। স্থির হল তিনজন মুক্তিযোদ্ধা থিয়েটার রোডের অফিস বাড়ি থেকে আমাদের সীমান্তের কাছে একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আমরা কয়েকদিন সেখানেই থাকব। দেশের ভেতর থেকেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাদের ভেতর নিয়ে যাবে। শর্ত হল আমি ও নন্দিনী কোনো ব্যাপারেই কোনো কৌতূহল প্রদর্শন করতে পারব না। নিজেদের পরিচয় দিতে হবে স্বামী-স্ত্রী বলে এবং গ্রুপ কমাণ্ডারের আদেশ বিনা ওজরে মেনে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছব। কাষ্টম কলোনীর গেটে পৌঁছার পর এদের আর কোনো দায়দায়িত্ব থাকবে না। ইমাম এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের যাওয়ার আয়োজন। করবে। মোটামুটি এই ভাবে সব ঠিক হলে আমি ও নন্দিনী আমার কামরায় এসে বসলাম। নন্দিনী বলল, আজ একটু শান্তিতে ঘুমোব। আমি এবার উঠি, বেশ রাত হয়েছে।

আমি হেসে বললাম, রাতটা আজ এখানে কাটালেও পার, ভবিষ্যতে যখন স্ত্রীর ভূমিকায় গ্রামেগঞ্জে যেখানে সেখানে রাত কাটাতে হতে পারে।

ব্যাপার কী হঠাৎ এত দয়া?

ভবিষ্যৎ অজানা বলে লোভ জেগে উঠেছে।

হ্যাংলামো করে কত গা ঘেষাঘেষি করলাম। একবার যে ফিরেও তাকাল না তার মনে লোভ? বিশ্বেস হয় না কবি। এবার আমি ঘরে যাই।

নন্দিনী গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়াল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে দুয়ার মেলে দিলাম।

.

ইমামের ব্যবস্থামত এক সপ্তাহের পর আমরা সীমান্ত পার হয়ে কুষ্টিয়ায় একটি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখান থেকে দর্শনা হল্ট মাত্র পাঁচ মাইল। আমরা পাঁচজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সাথে ভোর রাতের দিকে নিমতা গাঁয়ের এক স্কুল শিক্ষকের বাড়ির গোয়াল ঘরে পূর্ব ব্যবস্থামত আশ্রয় নিলাম। সন্ধ্যার একটু আগে একটা খালের পাড় ধরে পাঁচ মাইল এগিয়ে গিয়ে দর্শনা হল্ট থেকে একটি রিকশা নিয়ে কলোনীতে পৌঁছতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূর মোহাম্মদ গোয়ালের খড় বিছানো একটা গাদার কাছে আমাকে ও নন্দিনীকে বসিয়ে দিয়ে এখানেই সারাদিন বিশ্রাম নিতে হবে বলে জানাল।

দিনটা আপনাদের দুজনকে এখানে থাকতে হবে। এখান থেকে মুহূর্তের জন্যও বেরুনো চলবে না।

নন্দিনী বলল, আপনারাও আমাদের সাথে থাকবেন তো?

না সিস্টার, আমাদের ডিউটি এখানে নয়। অন্যত্র আমরা অপারেশনে যাব। সেটা অনেকদূর। আপনাদের জন্য লোকেরা এসে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। ভয় পাবেন না। আমরা এখনই রওনা হচ্ছি। আপনাদের যা যা দরকার খাওয়া-থাকা সব এখানে বসেই যথাসময়ে পাবেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। অন্য ভাইয়েরা এসে ইঙ্গিত দিলেই বিনা দ্বিধায় তাদের সাথে রওনা হবেন। আচ্ছা আমি আসি।

বলে কমান্ডার নূর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে থ্যাঙ্কস্ বলে তার হাতটা চেপে ধরলাম। নূর নিঃশব্দে তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বেরিয়ে গেলে স্কুল শিক্ষক আহমদ আলী একটি কিশোরীকে নিয়ে আমাদের খড়ের গাদার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনাদের চা-নাস্তা এখুনি এ মেয়েটি এনে দেবে। এর নাম সালেহা। আপনারা যতক্ষণ থাকবেন সালেহা আপনাদের দেখশোনা করবে। হাতমুখ ধোয়ার দরকার হলে খড়ের ওপরই পানি ঢেলে সেরে নেবেন। এমন কী বাথরুমের কাজও। খবরদার বাইরে উঁকিঝুঁকি মারবেন না। আমি আসি।

আহমদ আলী সালেহাকে নিয়ে চলে গেলে আমি নন্দিনীকে বললাম, আসল মুক্তিযোদ্ধার জীবন বোধহয় আমাদের শুরু হল।

তোমার ভয় লাগছে?

সঠিক বললে বলতে হয় উৎকণ্ঠায় ভুগছি।

আমার কিন্তু একটুও ভয় লাগছে না বরং একটা কিছু করতে পারব ভেবে আনন্দই লাগছে।

বলল নন্দিনী।

এর মধ্যে সালেহা নামক কিশোরীটা এসে গোয়ালের স্বল্প সংখ্যক কয়েকটি গরু বাছুরের দড়ি খুলে বাইরে নিয়ে গেল। গোবর আর গরুর চেনার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এলেও আমরা খড়ের গাদার পাশে বিছানা খড়ের ওপর পরস্পরের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলাম। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নন্দিনী বলল, বাংলাদেশে আমাদের প্রবেশের এই প্রথম প্রভাত বেলায় আমাকে একটা আদরের চুমু খাও না কবি। নাও ঠোঁট দুটি এগিয়ে দিচ্ছি।

তুমি সত্যি পাগল নন্দিনী। বুঝতে পারছ না আমরা এখানে একটুও নিরাপদ নই। মাষ্টার সাহেবের সতর্ক করে দেয়ার পরও যদি এমন ছেলেমানুষী করো তবে আমাদের কোনো উদ্দেশ্যেই সিদ্ধ হবে না।

আমার কথায় নন্দিনী হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল, আমি প্রকৃতপক্ষে কবির উৎকণ্ঠা তাড়াতে চাই। যারা জীবন বাজি ধরে এখানে এসেছে তাদের আবার প্রাণের জন্য এত মায়া?

আমরা একটা মিশনে এসেছি ধরা পড়লে বা মরে গেলে মিশনটি বিফল হবে। তোমার মুখে এখন হাসি তামাশা মানায় না নন্দিনী।

তামাশা নয়, প্রেম।

প্রেমের চেয়ে বড় বিষয় হল ধরা না পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেবা করা। টাকাটা পৌঁছে দিয়ে দেশের ভেতরে একটা কর্তব্য স্থির করা।

বললাম আমি। আমার কথা ফুরোবামাত্র খড়ের গাদার ওপাশ থেকে সালেহা টিনের একটা বড় থালায় চায়ের কাপ, চিতোই পিঠা, ডিম ভাজি ইত্যাদি এনে আমাদের সামনে রাখল। অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, আপনারা খান। আমি পানির জগ আর গেলাস এনে দিই।

আমরা কোনোরূপ আওয়াজ না করেই গরম চিতোই পিঠা আর ডিমভাজিতে কামড় লাগালাম। হঠাৎ এমন প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তা উদ্বেগে থাকার দরুণ বুঝতে পারি নি। নন্দিনী খুশি এবং ব্যঙ্গ মেশানো স্বরে বলে উঠল, এযে দেখছি প্রেমিক পুরুষের চুম্বনের চেয়েও মিষ্টি।

আমি হাসলাম কিন্তু নন্দিনীর বিদ্রুপের কোনো জবাব দিলাম না। নাস্তার পর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে নন্দিনীর টাকার হ্যাণ্ডব্যাগটিতে মাথা রেখে খড়বিচালীর ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। শোয়া মাত্র ঘুমে দুচোখ বুজে এল। আমি নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমে ডুবে যেতে যেতে আমার সঙ্গিনীর হাসি-মস্করা শুনতে পেলাম। শুনতে শুনতেই স্বপ্নের উপত্যকায় একটি প্রচণ্ড গুলীবর্ষণের চিত্র দেখে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। আর ঠিক তখনই আমার বিপরীত দিক থেকে কে একজন প্যান্ট আর পুলওভার পরা নারীযোদ্ধাকে দেখলাম হাতে একটি পিনখোলা হ্যাণ্ডগ্রেনেড হাতের তালুতে মুঠো করে ধরে আমার দিকে সক্রোধে ছুঁড়ে মারল। বোমাটা আমার মাথার কাছে প্রচণ্ড শব্দে বিদীর্ণ হলে আমি চিৎকার করে খড়ের গাদার ওপর ঘুম ভেঙে বসে পড়লাম।

কি ব্যাপার, ঘুমিয়েই দুঃস্বপ্ন দেখলে নাকি?

নন্দিনীর গলা শুনে আমি চমকে তার দিকে চেয়েই বললাম, পানি খাব।

সে জগ থেকে পানি গড়িয়ে আমার মুখে ধরলে আমি পরম তৃষ্ণায় কাঁপতে কাঁপতে গেলাসের সবটুকু পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম।

.

বেলা পাঁচটায় সালেহা একজন তরুণকে নিয়ে গোয়ালে এসে ঢুকল। আমি ও নন্দিনী দুপুরের খাওয়ার পর একটা দীর্ঘ দিবানিদ্ৰা শেষ করে সবে জেগেছি। তরুণটি নন্দিনীর সামনে এসে বলল, আমার নাম কুদ্দুস। আপনাদের নিয়ে যেতে এসেছি। আর দেরি না করে এখনই চলুন।

আমি বললাম, তুমি কী একাই আমাদের নিয়ে যাবে?

আমি নিয়ে যাব না। যারা নিয়ে যাবেন তাদের হাতে ছেড়ে আসব।

নন্দিনী বলল, আমরা যাত্রার জন্য রেডি।

তাহলে আল্লার নাম নিয়ে আমার পেছনে আসুন।

মুহূর্তের মধ্যে নন্দিনী হ্যাণ্ডব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটিকে বলল, চলুন।

আমরা গোয়ালটার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বেলা তখন লাল হয়ে পশ্চিম দিকে ঢলে গেছে। নিমতা গাঁটাকে অতিশয় দরিদ্র কৃষকদের একটি ছোটো গাঁ বলে মনে হল। ভোররাতের দিকে আমরা যখন গাঁয়ে প্রবেশ করি তখন আধো-অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারি নি। এখন চারিদিকে গোলপাতা কিংবা ছনের চালার নিচু কুঁড়ের ব্যাপকতা দেখে গ্রামটার দারিদ্র্য আন্দাজ করলাম। আমরা যখন বের হয়ে আসি সালেহাকে দেখলাম ঘরের ভেতরেই থেকে গেল। বাইরে এসে ছেলেটির মুখের দিকে তাকালাম। একেবারেই কচি বয়েস। ষোল-সতেরোর বেশি হবে না। ফর্সা গোলগাল চেহারা। গায়ে একটা সবুজ শার্ট ও খাকি রংয়ের প্যান্ট। পায়ে রবারের সেন্ডেল। আমি তার গা ঘেষে চলতে চলতে বললাম, এ গাঁয়ে হানাদারের হামলার ভয় আছে নাকি?

আছে। গত রাতে আমাদের পাশের গাঁয়ের হাটে পাকবাহিনী তিনজন চাল বেপারীকে শুধু শুধু গুলী করে মেরে ফেলেছে। আসলে তারা আমাদের মাষ্টার সাহেবের বাড়ির ঠিকানা খুঁজছে। যার বাড়িতে আপনারা এতক্ষণ কাটিয়ে এলেন।

আহমদ আলী সাহেব এ খবর জানেন?

জানেন।

খুব নিচুস্বরে জবাব দিল ছেলেটি।

এ অবস্থায় আমরা নিরাপদে দর্শনায় পৌঁছুতে পারব বলে ভাববো?

জানি না। আমার ওপর হুকুম আপনাদের নিয়ে গিয়ে গাঁয়ের শেষ মাথায় তালগাছের নিচের প্রাইমারী স্কুলের বারান্দায় পৌঁছে দেওয়া। তারা সেখান থেকে আপনাদের নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, কুদ্দুস, আজ যখন বিপদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তখন আরও একটা দিন আশেপাশের কোনো আশ্রয়ে অপেক্ষা করে গেলে হয় না?

ছেলেটি হাসল, যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানকার গ্রুপ লীডারকে একথা বলবেন। আমাদের এলাকায় তো প্রতিদিনই লড়াই চলছে। পাল্টা মারও লাগান হচ্ছে। যারা আপনাদের নিয়ে যাবে তারা আজ সকালে খালের ভেতর একটা নাওয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাঁচজন পাকসেনাকে খতম করেছে। তারা খুব সাহসী দল। ঘাবড়াবেন না।

আর কোনো কথা না বলে আমরা কুদ্দুসের পাশাপাশি চলতে লাগলাম। গাঁয়ের ভেতরের ঘরবাড়িতে মানুষের সাড়াশব্দ পেলাম। একটা ছোটো পুকুরের ঘাটে দেখলাম মেয়েরা বাসন মাজছে। আমাদের দিকে দৃষ্টি পড়ায় কেউ কেউ মাথা তুলে অবাক হয়ে নন্দিনীকে দেখতে লাগল। দুএকটি নেংটা ছোটো ছেলেমেয়ে আমাদের পিছু নিয়েছে দেখে কুদ্দুস তাদের ধমক দিয়ে হাঁকিয়ে দিল।

কুদ্দুসের সাথে আমরা গাঁয়ের পশ্চিম প্রান্তের একটা স্কুলের বারান্দায় এসে উঠলাম। স্কুল বাড়িটা বেশ লম্বা। বারান্দাটায় ইটবাঁধানো। সামনে একটা ফাঁকা জায়গা। সম্ভবত ছাত্রছাত্রীদের এটাই খেলার মাঠ। মাঠের পূর্বপ্রান্তে তালগাছের সারি। কুদ্দুস বারান্দায় উঠেই ইশারায় আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে তালবনের দিকে রওনা দিল। সূর্য এর মধ্যেই অনেকখানি নেমে ঢলে পড়েছে। গ্রামের দিকে তাকালে মনে হয় এটা একটা নিষ্প্রাণ লোকালয় মাত্র। গোধূলিবেলা হওয়া সত্ত্বেও কোনো গরুবাছুর চোখে পড়ছে না। শুধু বহুদূরে মধ্যগ্রাম থেকে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ অস্পষ্ট ভাবে কানে আসছে। আর এদিকে তালগাছের চূড়ায় বেলুনের মতো ঝুলে থাকা বাবুইয়ের বাসাগুলো ঘিরে হল্লা ও তর্কপ্রবণ অসংখ্য পাখির চিৎকারে জায়গাটা মুখর। আমার নিজের গ্রামের কথা অকস্মাৎ মনে পড়ায় আমি নন্দিনীকে বললাম, বাংলাদেশের গ্রাম-লোকালয়ের চেহারা আর জীবনযাপন সর্বত্রই এক।

এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও এসব খুঁটিয়ে দেখার সময় আছে দেখছি? বাংলাদেশের কবিদের উদাসীনতা ও শহর-গ্রামে একই রকম। মাছের চোখের মতো পলকহীন।

নন্দিনীর কথায় আমি হেসে ফেললাম। চমৎকার উপমা তো! মাছের চোখের মতো পলকহীন। তোমার লেখালেখির অভ্যেস থাকলে মন্দ হত না।

কবি হওয়ার চেয়ে কবিকে দখল করে নেয়ার চেষ্টাটাই এমন কী আর মন্দ। তোমার অবর্তমানে তোমার কাব্যের সমালোচনা আমার দখলদারির জন্য না হয় একটু মন্দ বলবে। কিন্তু আমার সংস্পর্শে তোমার রচনা রসাতলে তলিয়ে গেছে একথা কেউ বলবে না আশাকরি। তুমি কী বল?

ঘাড় কাৎ করে একটা বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে হাসল নন্দিনী। আমিও হাসলাম। এতক্ষণে বেলা গ্রামসীমান্তের বৃক্ষসীমার ওপর একদম তেজ হারানো আলোর বলের মতো লুটিয়ে পড়তে চাইছে। একবার তালবনের দিকে তাকালাম। কুদ্দুস আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে বলে এদিকে হেঁটে গেছে। নন্দিনী বলল, কুদ্দুস বোধহয় কাউকে ডেকে আনতে গেছে। আমরা এই স্কুলের বারান্দাটায় একটু বসলেও পারি।

আমি বুঝলাম নন্দিনী অনিশ্চয়তার ধুকপুকানিতে কাঁপছে। তার কথায় আমি নিজেই বারান্দায় ধুলোবালি ফুঁ দিয়ে সরিয়ে বসে পড়লাম। হ্যান্ড ব্যাগটার ওপর কনুই রেখে বললাম, বস।

নন্দিনীও বসল। ততক্ষণে বেলা পশ্চিমের মাঠের প্রান্তসীমার গাছের ছায়ার ভেতর অকস্মাৎ ডুবে গেল। যদিও পরিপূর্ণ অন্ধকারে এখনও নেমে আসে নি। তবুও ছায়ায় একটা আবরণের মধ্যে স্কুল বাড়িটা ও সামনের ফাঁকা মাঠটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল। বাবুই পাখিদের কিচিরমিচির হঠাৎ যেন শান্ত হয়ে গেছে। তালপাতার ঝুলন্ত বাসাগুলোকে মনে হচ্ছে ডাইনীদের শুকনো স্তনের মত। হঠাৎ ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

আমি বললাম, কুদ্দুস মনে হয় একটু দেরি করছে।

দেরি আর কই দেখলে, এই মাত্রতো ছেলেটা গেল। তুমি বরং একটা সিগ্রেট খাও টেনশন কেটে যাবে। আমাদের যারা নিয়ে যাবে তাদের দেখা পেলে তো ছেলেটা ফিরবে।

নন্দিনীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই বারান্দায় দুটি মানুষের দীর্ঘ ছায়া দেখা গেল। তালবনের দিকে থেকে ছায়াদুটি স্কুলের বারান্দায় এসে উঠল। দুজনের কাঁধেই অস্ত্রের নল উঁচু হয়ে আছে। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। নন্দিনী অন্ধকারে আমার হাত চেপে ধরেছে।

মানুষ দুটি এগিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। একজন বলল, সিগ্রেটটা নিভিয়ে ফেলুন।

আমি মুহূর্তের মধ্যে সিগ্রেটটা জুতোর নিচে চেপে ধরলাম। বললাম, কুদ্দুস কোথায়?

কুদ্দুসের আর দরকার হবে না। আপনারা এখন আমাদের সাথে যাবেন। এখান থেকে দর্শনা হল্ট সাড়ে তিন মাইল পথ। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।

বলল একজন।

আমি আর নন্দিনী বিনাবাক্যে উঠে দাঁড়ালাম। হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, চলুন, আমরা রেডি।

রওনা হওয়ার আগে আপনাদের একটু সতর্ক করার আছে। প্রথম কথা হল পথ চলতে চলতে আমাদের কোনো প্রশ্ন করবেন না। চতুর্দিকে রাজাকার বাহিনী পাহারা বসিয়েছে। নিজেদের মধ্যে কোনো আলাপ আলোচনা চলবে না। পথে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে আপনারা কোনো জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না। যা বলতে হয় আমরা বলব। তেমন অবস্থায় পড়লে আপনারা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করবেন। আমরা এখন যেদিকে হাঁটা দেব ঠিক সেদিকে নাক বরাবর হেঁটে গেলে আপনারা দর্শনা হল্ট স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। কাউকে কোনো প্রশ্ন করার দরকার নেই। ভয় নেই, পথে কোনো চ্যালেঞ্জে না পড়লে আমরাই আপনাদের দর্শনার কাষ্টম কলোনীতে পৌঁছে দেব। পথে কোনো বিপদ ঘটলে কী করতে হবে তাই শুধু জানালাম। আমার নাম মোজাফফর। আমি এখানকার মুক্তিবাহিনীর ফ্রুপ লীডার। আর আমার সঙ্গীর নাম লতিফ, ট্রেইন্ড ফাইটার।

আসসালামু আলাইকুম।

লতিফ আমার সাথে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। আমিও সালামের জবাব দিয়ে বললাম, আমরা বোধহয় আপনাদের ওপর বাড়তি বোঝার মতো চেপে গেছি।

মোজাফফর হেসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে বলল, বোঝা কেন হবেন। আপনারাও যতদূর জানি দেশের জন্যই বিপদ মাথায় নিয়ে দেশের ভেতর চলাফেরা করছেন। হরহামেশাই আমরা লোকদের চলাফেরায় সাধ্যমত সাহায্য করছি। আজ দুদিন ধরে শত্রুরা এই অঞ্চলে খুব সতর্ক হয়ে উঠেছে। এখানকার কয়েকটি অপারেশন পাক বাহিনী মার খেয়ে পাগলের মতো যাকে তাকে খুন করছে। রাজাকাররাও খুব এ্যালার্ট। এ অবস্থায় আপনাদের দায়িত্ব এসে পড়ায় একটু সাবধান থাকা দরকার। আচ্ছা আপনাদের কেউ হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে জানেন?

আমি বললাম, না আমাদের কারো গ্রেনেড ছোঁড়ার কোনো ট্রেনিং নেই। তবে শিখিয়ে দিলে পারব।

না, মুখের কথায় মুহূর্তের মধ্যে শিখিয়ে দিলে পারবেন না। নিজের অস্ত্রে নিজেরাই মারা পড়বেন। জানা থাকলে দুটি গ্রেনেডও দুজনের হাতে দিতাম। এখন কথা নয়, চলুন।

বললেন মোজাফফর।

আমরা তার কথামতো তার পেছন চলতে শুরু করলাম। তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। চতুর্দিকে ঝিঁঝি পোকার শব্দ গ্রাম্য পথঘাট মুখর। আমরা যাদের অনুসরণ করে হাঁটছি তাদের নাম জানলেও স্পষ্ট ভাবে মুখ দেখতে পাই নি। এখনও মোজাফফর ও লতিফ আমাদের কাছে দীর্ঘতর ছায়া মাত্র। সন্ধ্যার অন্ধকারে তাদের মুখাবয়ব কেমন তা বোঝা যায় নি। পথে নেমে এরা এমন নিঃশব্দে আঁটছে যে এদের সতর্কতার প্রভাব আমাকে ও নন্দিনীকেও নিশ্চুপ করে দিয়েছে। আমরা শুধু হেঁটে যাচ্ছি। গ্রামের পথ, জমির আইল আর কখনও কখনও কোনো গৃহস্থের উঠোন ডিঙিয়ে এবং পুকুরের পাড় মাড়িয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। কী এক ধরনের উদ্যম যেন আমাদের সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। নন্দিনী আমার বাঁ হাতটা আঁকড়ে ধরে হাঁটছে। সে চলতে চলতে নিজেই শাড়ির আঁচল শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে নিয়েছে। তার চলা দেখলে মনে হবে সারারাত হাঁটলেও সে ক্লান্ত হবে না। মাঝে মাঝে আমার ডান হাতটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য হ্যান্ড ব্যাগটা আমার হাত থেকে নিঃশব্দে কেড়ে নিয়ে হাঁটছে। আবার নিজের হাতকে বিশ্রাম দেবার জন্য আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সবি চলছে মুখে একটিও শব্দ উচ্চারণ না করেই।

মাঝরাতে আমরা একটা বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। রাস্তায় পা দিয়েই মোজাফফর বললেন, এবার আমরা একটু কথা বলে নিতে পারি। আপনি ইচ্ছে করলে একটা সিগ্রেটও খেয়ে নিতে পারেন। এখান থেকে কলোনীটা খুবই কাছে। একটু এগোলেই বাতি চোখে পড়বে।

নন্দিনী বলল, তাহলে ও একটা সিগ্রেট খেয়ে নিক আর আমি একটু পথের উপর বসি। পা দুটো একটু ভারী লাগছে।

মোজাফফর মনে হল একটু লজ্জিত হয়ে হাসলেন।

হ্যাঁ, আপনার কথা এতক্ষণ একটুও বিবেচনার মধ্যেই আনা হয় নি। একটানা বহুদূর হেঁটে এসেছেন। আপনার একটু বিশ্রাম দরকার। আপনি একটু বসে বিশ্রাম নিন। আমরা বরং তিনজন তিনটা সিগ্রেট ধরাই।

বললেন মোজাফফর। আমি তার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমার পকেট থেকে প্যাকেট খুলে এদের দুজনকে সিগ্রেট অফার করলাম।

মোজাফফর ও লতিফ একটু সংকোচের সাথে আমার কাছে থেকে সিগ্রেট নিলেন। লতিফ হেসে বললেন, এতক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে সিগ্রেট ধরাতে দিই নি বলে খুব শরম লাগছে।

আমি হাসলাম। মোজাফফর বললেন, কাজ শেষ হলে কী এ পথেই ফিরবেন?

নন্দিনী বলল, একথা তো এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না ভাই। আদৌ ফিরব কিনা সেটাই জানি না।

যদি ফেরেন কিংবা ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময় দিতে পারেন তবে বলুন আমাদের স্থানীয় কর্মীরা এগিয়ে এসে নিয়ে যাবে।

আমি বললাম, তেমন সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সময় আমরা এই মুহূর্তে দিতে পারছি না। যদি ফিরি তবে যাদের কাজে যাচ্ছি তারাই আশা করি ফেরার ব্যবস্থা করবে।

ঠিক আছে। এবার চলুন হাঁটি।

বললেন মোজাফফর।

আমি সিগ্রেট ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। নন্দিনী বলল, এবার ব্যাগটা বরং আমাকে দাও আমি নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটি। কলোনীর গেটে পৌঁছে তোমায় হাওলা করে দেব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দর্শনা কাষ্টমস্ কোয়ার্টারগুলোর গেটে এসে উপস্থিত হলাম। মোজাফফর বলল, যদি আপনারা কিছু মনে না করেন তবে এখান থেকেই আমরা বিদায় নেব। আমাদের ওপর ভার ছিল আপনাদের এ পর্যন্তই পৌঁছে দেয়ার। আমার মনে হচ্ছে কলোনীর ভেতর আপনাদের কোনো বিপদ নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, রাত দুটোর গাড়িতে যশোর থেকে এসেছেন। আপনারা যাদের কাছে এসেছেন তাদের নাম বললেই কোয়ার্টার দেখিয়ে দেবে।

মোজাফফর ও লতিফ আমার সাথে করমর্দন করে ও নন্দিনীকে সালাম জানিয়ে বিদায় দিল। আমরাও দেরি না করে কলোনীর গেটে এসে ঢুকলাম। ঢুকেই একজন পাহারাদারের সামনে পড়ে গেলাম। নন্দিনী এ অবস্থায় একটু অপ্রতিভ না হয়ে সোজাসুজি পাহারাদারের সামনে এগিয়ে গেল, আমরা রাতের গাড়িতে যশোর থেকে এসেছি। এখানে নাসরিনদের কোয়ার্টারটা কোনো দিকে একটু দেখিয়ে দেবেন?

সশস্ত্র পাহারাদারটা সম্ভবত একটু উদাসীন। সে নন্দিনীর দিকে ভাল করে না তাকিয়েই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, গেটে আপনাদের রিকশা থাকলে ভেতরে নিয়ে যান। দক্ষিণ সারির প্রথম বাড়িটাই নাসরিনের আম্মার। আপনারা কী রিকসা ছেড়ে দিয়েছেন?

আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, রিকশাঅলা গেটের ভেতরে যেতে চায় না। বলে রাতে ভেতরে ঢোকা নাকি বারণ। এজন্যই তো রিকশা ছেড়ে দিলাম। এখন কী করি বলুন তো।

এখন কী আর করবেন। সোজা হেঁটে চয়ে যান। ঐযে লাইট পোস্টটা দেখা যাচ্ছে এর নিচের টিনের শেডগুলোই নাসরিনের মায়ের কোয়ার্টার। আপনারা তার কী হন?

আমি তার বোন। আর ইনি আমার স্বামী।

বলল নন্দিনী।

আপনারা যশোর থেকে এসেছেন। যশোরের খবর কী? শুনলাম সেখানে মুক্তিবাহিনী খুব মার লাগাচ্ছে?

আমি বললাম, শুনেছি তো সারাদেশেই এরা সুবিধা মতো মার লাগাচ্ছে। তবে চোখে তো দেখি নি, তাই বলতে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করি কী করে? সব জায়গা থেকেই তো খানসেনাদের দাপটের কথা শুনছি। ঘরবাড়ি পোড়াচ্ছে, গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এইসব।

আরে রাখুন সাহেব। হারামজাদা এখন মুক্তিবাহিনীর ভয়ে কাঁপছে। বেটারা নির্ঘাত হারবে। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছেন তো। স্কুল কলেজের ছেলেদের মার খেয়েই খান সাবরা চোখে সর্ষেফুল দেখছে। সারা দেশে একটা মানুষও এদের পক্ষে নেই। এ অবস্থায় যুদ্ধ করবে কী?

বলল পাহারাদার। বেশ খুশি খুশি ভাব। বুঝলাম এ লোক আমাদের কোনো অনিষ্ট করবে না। মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্বে এ আনন্দিত। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নাসরিনদের কোয়ার্টারের দিকে হাঁটা ধরলাম।

কোয়ার্টারের সামনে এসে নন্দিনী বলল, কবি আমার বুক কাঁপছে।

আমি বললাম, এখানে এই লাইট পোষ্টটার নিচে একটু দাঁড়াও। আগেই ঠিক করে নিই কেউ দরজা খুলে দিলে কী বলবে।

যা বলতে হয় আমিই বলব। যার ব্যাগ আমরা যেহেতু তার নামটাও জানি না, শুধু একটা চিঠি পড়ে জানি টাকাটা ও কাগজপত্র এই কলোনীতে নাসরিন নামের একটি স্কুলছাত্রীকে পৌঁছে দেয়ার ইঙ্গিত আছে, এর বেশিকিছু আমরা করতে বা বলতে যাব না। এরা যদি বেশি প্রশ্ন করে তখন বলব আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর ভরসা করেই টাকাটা নিয়ে এখানে এসেছি। এরা যদি সন্দেহ করে এদের বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, করতে পারে, আমরা কোনো জবাব দেব না।

বলল নন্দিনী।

আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। লাইট পোষ্টের আলো এসে দরাজায় পড়ায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কপাটের একদিকে আলকাতরা দিয়ে ইংরেজি সেভেন সংখ্যাটি লেখা। সম্ভবত এটাই কোয়ার্টারের নাম্বার। আশেপাশের কোয়ার্টারগুলো খুব বেশি দূরে নয় পনের বিশ গজ দূরে দূরে এক একটা বাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির সামনে এক চিলতে বাগান। গাদাফুলের ঝোপ থেকে এক ধরনের বন্য গন্ধ নাকে এসে লাগছে। কড়া নাড়ার পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না দেখে আমি আবার একটু জোরে দরজার পাটে আঘাত করলাম। এবার ভেতর থেকে খুব ক্ষীণকণ্ঠে কে যেন জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি জবাব দিলাম, দরজাটা খুলুন, আমরা আপনাদের মেহমান।

ভেতর থেকে বেশ ক্ষীণ কণ্ঠে কে যেন বলল, এতরাতে কে আপনারা? আম্মা তো বাড়িতে নেই, বেনাপোল গেছেন। দরকার থাকলে কাল সকালে আসবেন। এতরাতে আমি দুয়ার খুলব না। বাসায় আমি একা আছি। আপনারা সকালে আসবেন।

সতর্ক মেয়েলী গলা। এবার নন্দিনী এগিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়াল। এবং বেশ পরিষ্কার উচ্চারণে ভেতরের মেয়েটিকে ডাক দিল, শোন নাসরিন। তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

শুনতে পাচ্ছি। কী বলছেন বলুন। আপনি কে?

আমাকে তুমি চিনবে না নাসরিন।

আমি চিনবো না, তবে আমার নাম জানলেন কী করে?

কীভাবে তোমার নাম জানলাম এটা বলতেই তো নানা বিপদের মধ্যে এতো দূর এসেছি। নাসরিন, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার বা তোমাদের শত্রু নই। বরং বন্ধু। তোমাদের সাহায্য করতেই এসেছি। খুব বিপদ মাথায় নিয়ে এসেছি। আমাদের এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলে তোমাদেরই ক্ষতি হবে। আমরা তোমাকে একটা ম্যাসেজ পৌঁছে দিতে এসেছি।

খুবই অনুচ্চকণ্ঠে, বেশ আবেগ মিশিয়ে নন্দিনী কথাগুলো বলল । কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাসরিনের আর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। মনে হল নাসরিন বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে কী করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না।

এবার আমি ডাকলাম, নাসরিন।

না, আমি এভাবে এতরাতে আপনাদের জন্য দুয়ার খুলে দেব না। আপনারা এখন চলে যান। সকালে আসবেন। তাছাড়া আপনারা কে আমি তো চিনতেই পারছি না। কোনো ম্যাসেজ থাকলে বাইরে থেকেই তো বলতে পারেন।

বেশ জেদের সাথে নাসরিন আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এবার মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করতে নন্দিনী মুখ বাড়িয়ে নাসরিনকে ডাকল, শোন নাসরিন, যদি আমাদের সন্দেহ করে দুয়ার খুলতে ভয় পাও তবে ঐ পাশের জানালাটা খুলে আমাদের সাথে একটু কথা বল। আমরা বহুদূর থেকে তোমার কাছে এসেছি। তোমাদের সাহায্য করতেই এসেছি। এখানে থাকার আমাদের কোনো পরিচিত জায়গা নেই। আমরা এখন কোথায় যাব বলতো? তুমি আশ্রয় না দিলে আমরা নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব।

এবারকার অনুরোধে মনে হয় একটু কাজ হল। নাসরিন বলল, বাঁ দিকের জানালার কাছে সরে আসুন।

আমরা দ্রুত দরজা ছেড়ে বাঁদিকের অন্ধকার জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম। এখানে একটা কচুবনের ওপর সম্ভবত কোয়ার্টারের একটা জানালা আছে। আমরা এদিকটায় সরে এসে দাঁড়াতেই অন্ধকার দেয়ালের মধ্যে একটা জানালা খোলার শব্দ পেলাম। কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পেলাম না। একটা টর্চের আলো এসে নন্দিনীকে ও আমাকে মুহূর্তের মধ্যে উদ্ভাসিত করেই নিবে গেল। আকস্মিক আলোর কম্পিত বিনিময়ের ভেতর জানালায় মেয়েটিকে স্পষ্ট না বুঝলেও তার হাতে একটা উদ্যত পিস্তলের আভাস পেলাম। মেয়েটি অর্থাৎ নাসরিন বলল, আপনারা এতরাতে কোত্থেকে এসেছেন?

আমি কিছু বলার আগেই নন্দিনী বলল, কলকাতা থেকে।

আপনারা কে?

জবাবে আমি বললাম, আমার নাম সৈয়দ হাদী মীর। আর ইনি নন্দিনী চক্রবর্তী।

আপনারা স্বামী স্ত্রী?

নন্দিনী বলল, হ্যাঁ।

কোন গ্রুপের নোক আপনারা?

আমার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি জোগালে আমি নির্দ্বিধায় জবাব দিলাম, আমরা নিমতার মোজাফফর গ্রুপের লোক। এই ব্যাগটায় তোমার জন্য জরুরি ম্যাসেজ আছে বলেই আমরা সুদূর কলকাতা থেকে নিমতার সালাম মাস্টারের বাড়ি হয়ে এখানে এসেছি। তুমি যদি এক্ষুনি দুয়ার খুলে না দাও আমরা বাধ্য হয় তোমার জন্যে আনা ব্যাগটা ফিরিয়ে নিয়ে চলে যেতে। যা করবার তাড়াতাড়ি কর।

অনেকক্ষণ পর্যন্ত জানালাটা অন্ধকার হয়ে থাকল। নাসরিন কোনো জবাব দিচ্ছে ।

আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করে নন্দিনী কোমল গলায় ডাকল, নাসরিন।

বলুন।

এই ব্যাগটায় তোমার জন্য একটা চিঠি আছে। বাতিটা জ্বালো আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটা তোমাকে দিচ্ছি। নাসরিন একথার কোনো জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর কী ভেবে হঠাৎ বলল, ওদিকে আসুন দুয়ার মেলে দিচ্ছি।

আমরা আবার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা শব্দ করে দরজা খুলে গেলে ভেতর থেকে পিস্তল হাতে একলাফে নাসরিন লাইটপোস্টের আলোয় মধ্যে বেরিয়ে এল। আমাদের দিকে পিস্তলের তাক রেখে বলল, আপনাদের সাথে কোনো হাতিয়ার থাকরে মাটিতে রেখে দিন। তাড়াতাড়ি করুন।

নাসরিনের এই আকস্মিক মুক্তিযোদ্ধাসুলভ দক্ষতায় মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও আমি পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় বললাম, আমাদের কাছে কোনো হাতিয়ার নেই নাসরিন। তুমি চেক করতে পার।

ঠিক আছে যে ব্যাগটা আমাদের দিতে এনেছেন তা মাটিতে নামিয়ে রাখুন।

ব্যাগটা তখন নন্দিনীর হাতে থাকায় সে নাসরিনের কথা অনুযায়ী কাজ করল। ব্যাগটা মাটিতে রাখা মাত্র নাসরিন সেটা ছোঁ মেরে নিজের হাতে তুলে নিল।

আপনারা এবার ঘরের ভেতরে যান।

আমরা তার কথামত কপাট পেরিয়ে অন্ধকার কামরার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। নাসরিন বাইরে থেকে অকস্মাৎ দরজার দুটি পাট টেনে এনে সম্ভবত তালা মেরে দিল। টিপ তলার বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। সবটা ঘটনা এমন মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল যে আমি ও নন্দিনী উভয়েই হতভম্ব। কিন্তু নাসরিনককে আমি বা নন্দিনী স্পষ্ট ভাবে কেউ একবারও দেখতে পারি নি। শুধু বুঝতে পেরেছি মেয়েটা বয়েসে কিশোরী হলেও বেশ লম্বা এবং শারীরিক শক্তির অধিকারিণী। হয়তো বা যুবতীই হবে। শুধু তার চেহারাটাই কোনো আলোর ঝলকের মধ্যে একবারও স্পষ্ট দেখার সুযোগ ঘটে নি। তবে গলায় আওয়াজটা খুব মিষ্টি।

নন্দিনী তার হতভম্ব ভাব কাটিয়ে অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠল, আমাদের কী আটক করলে নাসরিন?

কিছু মনে করবেন না, আপনাদের সকাল পর্যন্ত এভাবেই এখানে থাকতে হবে। আমি আমার পার্টির লোকদের কাছে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা যদি সত্যি কোনো ক্ষতি করতে না এসে থাকেন তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনারা যদি শুয়ে বিশ্রাম নিতে চান তবে ঘরের ভেতর বিছানা পাতা আছে শুয়ে পড়ুন। আলো জ্বালার দরকার হলে কপাটের পাশেই সুইচ বোর্ড আছে দেশলাই জ্বেলে দেখে নিন। বেশি হই চই করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন না। এ কলোনীতে কয়েক ঘর পাকিস্তানী আছে আবার তাদের সাপোর্টারও কয়েকজন আছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে, বুঝলেন?

নন্দিনী বলল, আমরা সবই বুঝতে পারছি নাসরিন। তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। পালাবার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমরাও তোমাদের সাথেই থাকতে চাই। তোমাদের সাথে থেকে লড়তে চাই। আর একটা কথা, যে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্চো ওতে লাখ তিনেক রূপীর ভারতীয় কারেন্সী আছে। টাকাটা তোমাদের। ব্যাগটা সাবধানে নিয়ে যেও।

ঠিক আছে, এখন চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। আমি আমাদের লোকজনের কাছেই যাচ্ছি।

বলল নাসরিন।

আমি পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করে বললাম, আলো জ্বালছি তুমি সুইচটা কোথায় দেখে নিয়ে বাতি জ্বালো।

বাতির কী দরকার? তোমার দেশলাই থেকে আর একটা কাঠি জ্বেলে বিছানাটা কোথায় পাতা আছে দেখে নিলেই তো হয়। আমি আর দাঁড়াতে পারছি না কবি।

নন্দিনীর কথায় আমি আর একটা কাঠি জ্বালালাম। বসার ঘর ছেড়ে আমরা একটু ভেতরে গেলেই একটু সুসজ্জিত কামরা দেখতে পেলাম। এখানেই একটা বিছানা পাতা। নন্দিনী সোজা গিয়ে বিছানায় পড়ল। কাঠিটা নিবে গেলে আমিও গিয়ে বিছানায় বসলাম।

যাক আমাদের ওপর থেকে একটা গুরুভার নেমে গেল। হ্যান্ডব্যাগটা বুকের ভেতর পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এখন যাদের টাকা তাদের হাতে পৌঁছে যাবে।

বলল নন্দিনী।

আমি বললাম, আমি কিন্তু তোমার মতো নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আমরা এখন যাদের আওতায় এসেছি তারা স্বাভাবিক মুক্তিযোদ্ধা নয়। এরা আন্ডারগ্রাইভে থেকে বহুদিন আগে থেকে স্থানীয় শোষক-পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সম্প্রসারণবাদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সাম্প্রতিক মুক্তির লড়াই এদের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে মাত্র। এরা যে আমাদের বন্ধুভাবে নেবে তা আগে থেকেই আন্দাজ করে বসে থেকো না। এরা সহজে আমাদের বিশ্বাস করবে না।

এখন ভাগ্যের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর উপায় কী?

আমার খুব খিদে পেয়েছে নন্দিনী।

তবে তো বাতিটা জ্বালতে হয়। খুঁজলে নিশ্চয়ই কিছু খাবার জুটে যাবে। দেশলাইটা দাও আমি সুইচ বোর্ডটা কোনদিকে দেখি।

নন্দিনীর কথামত আমি দেশলাই তার হাতে নিলাম। বুঝতে পারলাম নন্দিনীও খিদেয় কাতর। সে কাঠি জ্বেলে দরজার পাশে সুইচবোর্ড খুঁজে পেয়ে বাতি জ্বালাল। বেশ পরিপাটি করে সাজানো একটা মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীর কোয়ার্টার বলেই ধারণা হল। আলনায় পরিপাটি করে সাজানো রংবেরঙের শাড়ি ব্লাউজ জুতো। একটা বুক সেলুফে বেশকিছু বইপত্র। ড্রেসিং টেবিলের পাশে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। ছবিতে একজন মধ্যবয়ক শুল্ক বিভাগে কর্মরত মহিলার সাথে একটা চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী দাঁড়ানো। ছবি দেখে মনে হয় উভয়েই বেশ ফর্সা। কিশোরীটির মুখমণ্ডল চিবুকের দিকে একটু লম্বমান। বেশ সুন্দর চেহারা। সম্ভবত এই মেয়েটি নাসরিন। পাশের মহিলাকে কাস্টমস-এর পোশাকে বেশ স্মার্ট বলেই মনে হল। মহিলা খুব দীর্ঘাঙ্গীই হবেন। মেয়েটিকে সামনে রেখে দুই কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। মা মেয়ে দুজনেই হাসিমুখ।

নন্দিনী ততক্ষণে খাবার আলমারিটা তন্ন তন্ন করে দেখছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিছু পেলে?

ভাতের ডেগ ধোয়ামোছা। তবে প্রচুর ডাল পড়ে আছে। আর একটা সরায় গোটা চারের মুরগির ডিম। একটা ব্যাগে চাউলও আছে। চুলাটা খুঁজে পেলে ভাত চাপিয়ে দিতে পারতাম।

হেসে বলল নন্দিনী।

আমি হেসে বললাম, তাড়াতাড়ি রান্নাঘর খুঁজে বের করে। তোমার কথা শুনে খিদে আরও বেড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এদিকে কেরোসিনের চুলোয় রাঁধা হয়। রান্না ঘরটা খুঁজে পেলে সব পাবে। জান তো কাল সকালে যাদের পাল্লায় পড়ব তারা কেমন আচরণ করবে তা এখনই আঁচ করা যাচ্ছে না। হয়ত কয়েকদিন খেতেই দেবে না।

আমি কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছি না। যারা নিঃস্বার্থভাবে একটা অর্থের ভাণ্ডার অপরিচিত লোকদের হাতে তুলে দেয় তাদের প্রতি জামাই আদর না করলেও প্রাণে মারবে না বলেই ভরসা করি।

ঘরের সবগুলো বাতি স্যুইচ টিপে জ্বালিয়ে দিতে দিতে জবাব দিল নন্দিনী। রান্নাঘর খুঁজতে ঘরটার পেছনে কপাট মেলে দিয়ে বলল, এই তো পেয়েছি।

রান্নাঘর?

তাই তো মনে হচ্ছে।

দাঁড়াও আমিও আসছি।

বলে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার ওপর নাসরিনের টর্চটাও পাওয়া গেল। আমি টর্চটা হাতে নিয়ে নন্দিনীকে সাহায্য করতে এগোলাম। নন্দিনী অল্পক্ষণের মধ্যেই রান্নাঘরের চুলা চাক্কি বের করে ফেলে হেসে বলল, এখানে রান্নাবান্নার সবকিছুই মজুত আছে কবি। আমাকে আর তেমন সাহায্য করতে হবে না। তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও আমি দুজনের খাওয়ার মতো সামান্য চাল ফুটিয়ে আনি। আসলে আমারও পেট চো চো করছে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই নন্দিনীর ভাত রান্না ও ডিম ভাজি হয়ে গেল। নন্দিনী বাসি ডালটাও গরম করে ডেগ শুদ্ধ টেবিলে এনে রাখল। ঘরের পাশের টিপ কল থেকে জগ ভর্তি পানিও নিয়ে এসে বলল, এসো শুরু করা যাক।

আমি টেবিলে বসতে গিয়ে হেসে বললাম, এই বোধহয় তোমার আমার প্রথম ঘরকন্না। হোক ডিমভাজি আর ডাল, অমৃত সমান লাগবে।

আমার রান্না নিয়ে আজ অন্তত ঠাট্টা করো না কবি, ভগবানের দোহাই। আমি অল্পসল্প রান্নাটা জানি। আজ এই মুহূর্তে এর পরীক্ষা নিতে চেও না। খিদেয় বুক জ্বলছে। একটু নুন মাখিয়ে হলেও চারটি ভাত পেটে পড়ুক।

নন্দিনীর কথায় আমিও লজ্জা পেয়ে হাসলাম, সত্যি অন্যায় হয়ে গেছে। এসো শুরু করা যাক। আমি গরম সসপেনে পাশাপাশি সাজিয়ে আনা দুটি ডিমভাজির একটা ভাতের প্রেটে তুলে নিলাম। নন্দিনী ধোয়া-ওড়া গরম ভাত একটা পিতলের চামচে তুলে আমার পাত ভর্তি করে দিয়েছে।

আমি নিমকদান থেকে একটু নুন তুলে নিয়ে পাতে রেখে ভাত মাখাতে লাগলাম। প্রথম লোকমা তোলার সাথে সাথেই কোয়ার্টারের প্রবেশ দরোজায় তালা খোলার শব্দ পেলাম। নন্দিনীও উৎকণ্ঠিত হয়ে শব্দটা শুনল।

দুয়ার খুলে বেশ কয়েকজন লোক ঘরে প্রবেশ করছে অনুভব করা মাত্রই কয়েকজন সশস্ত্র স্টেনগান উঁচিয়ে আমাদের খাওয়ার টেবিলটা ঘিরে দাঁড়াল। এদের পেছনে নাসরিনকেও দেখে নন্দিনী প্লেটের ওপর ভাতের গ্রাস রেখে বলল, নাসরিন এরা আমাদের কাছে কী কিছু জানতে চায়?

নাসরিন কিছু বলার আগেই একজন সশন্ত্র ব্যক্তি নন্দিনীর দিকে অস্ত্রের তাক রেখে বলল, সত্যি করে বলুন আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?

কলকাতা থেকে।

আমি জবাব দিলাম।

এ ব্যাগটা কে আপনাদের দিয়েছে?

গোহাটি এয়ারপোর্টে এক ভদ্রলোক অনেকগুলো ব্যাগ স্যুটকেস নিয়ে কলকাতার প্লেনে উঠতে গিয়ে আমার স্ত্রীকে এই ব্যাগটা একটু ধরতে বলে তার হাতে গছিয়ে দেন। প্লেনে ওঠার সময় তিনি লাইনের পেছনে পড়ে যান। আমরা ঠিকমতোই প্লেনে উঠতে পারলেও সে ভদ্রলোক চেকিং এর মধ্যে পড়ে যান। তাকে গার্ডরা টেনে লাইনের বাইরে এয়ারপোর্টের ভেতরে নিয়ে যায়। আমরা নিরুপায় হয়ে ব্যাগটা নিয়ে কলকাতায় চলে আসি। আমার ভগ্নিপতি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের একজন বড়কর্তা বলে এবং আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়ে আসার ফলে চেকিংয়ের ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারায় ব্যাগটা বেঁচে যায়। আমরা জানতাম না ব্যাগের মধ্যে কী আছে। বাসায় এনে খুলে দেখি এতে অনেক টাকা ও কাগজপত্র রয়েছে। এ টাকা যে একদল মুক্তিযোদ্ধার সম্পত্তি এটা একটা চিঠি থেকে জানতে পেরে বিবেকের তাড়নায় প্রাণ বাজি রেখে আমরা ব্যাগটা আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে এসেছি।

সম্পূর্ণ ঘটনাটা আমি সংক্ষেপে বললাম।

যিনি ব্যাগটা আপনাদের কাছে দিয়েছিলেন তার কী হল?

সশস্ত্র ব্যক্তিদের অন্য একজন পাশ থেকে আমাকে প্রশ্ন করল। আমি মুখ তুলে এবার এদের সবার দিকে তাকালাম। এরা নাসরিনসহ পাঁচজন। মেয়েটি ছাড়া সবার পরনেই খাকি পোশাক ও মাথায় মাংকি ক্যাপ। সকলেরই বয়েস ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মতো। এদের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ ব্যক্তির দাড়িগোঁফ আছে। মনে হল ইনিই লীডার।

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা প্লেনের জানালা দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছি। সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে ঠেলে এয়ারপোর্টের ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে দেখেছি। তারপর আমরা আর তার সম্বন্ধে কিছু জানি না।

আমার জবাব শুনে এরা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। নন্দিনী এ অবস্থায় খাওয়া আর সম্ভব নয় ভেবে গেলাস তুলে হাত ধুয়ে ফেলার উপক্রম করতে দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, আপনারা খাওয়া শেষ করুন। পরে আলাপ করব। ভয় পাবেন না।

তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমরা আবার খাওয়া শুরু করলাম। নাসরিন এগিয়ে এসে আমাদের পাতে ভাত বেড়ে দিতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *