০৪. যাবার দিন সকালে

যাবার দিন সকালে ভারতীয় এয়ারফোর্সের সামরিক পরিবহণ বিমানে আমরা আগরতলা থেকে গোহাটি এসে নামলাম। এখান থেকে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের বিমানে আমাদের কলকাতা যাওয়ার কথা। আসার সময় গাদাগাদি করে এক রকম দাঁড়িয়েই আমরা এখানে এসে পৌঁছাই। সর্বক্ষণ নন্দিনী আমার কাঁধ ধরে ছিল। তার শারীরিক দুর্বলতা এখনও কাটে নি। তবু মানসিক সাহসেই সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

গোহাটি এয়ারপোর্টে আমরা পারুলদের বাক্স প্যাটরার ওপর বসলাম। বিমান বন্দরে খুব ভিড়। মনে হল সকলেই কলকাতার যাত্রী। আমাদের টিকেট অবশ্য আগরতলা থেকেই ওকে করে দেওয়া ছিল। তবুও ইমাম টিকেট ইত্যাদি নিয়ে কাউন্টারের বিশাল লাইনের মধ্যে দাঁড়াল লাইনের মধ্যে দাঁড়াল। কিন্তু বেশি সময় তাকে কষ্ট করতে হল না। সামরিক পোশাক পরা একজন অফিসার কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসে ইমামকে কী যেন বলল। ইমাম তার হাতে আমাদের পাঁচজনের টিকেট ও দরকারি কাগজপত্র তুলে দিলে ভদ্রলোক দ্রুত সেসব নিয়ে কাউন্টারের পেছনের কামরায় গিয়ে ঢুকল।

ইমাম ফিরে এলে আমি তাকে ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করলাম। ইমাম জানাল, আমি যে যাচ্ছি এ ব্যাপারে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অবহিত আছেন।

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

কিছুক্ষণ পরেই সামরিক পোশাক-পরা ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, প্লেন রেডি। আপনারা পেছনে আসুন। মালপত্র টানতে হবে না। ওগুলো আমাদের লোকজন প্লেনে তুলে দেবে। এই নিন আপনাদের টিকেট ও বোর্ডিং কার্ড।

ইমাম টিকেটগুলো নিয়ে পকেটে রাখল। আর বোর্ডিং কার্ডগুলো এক এক করে আমাদের ধরিয়ে দিল।

আমি দেখলাম বোর্ডিং কার্ডের মাঝামাঝি জায়গায় হলুদ রংয়ের এক একটি ক্লিপ স্টেপলার দিয়ে আঁটা। স্লিপের ওপর রবার স্ট্যাম্পের ছাপ এবং ছাপের ওপর কার যেন একটা ইংরেজি স্বাক্ষর। সম্ভবত এটাই আমাদের পরিচিতজ্ঞাপক ছাড়পত্র।

ভদ্রলোকের পেছন পেছন আমরা সিকিউরিটি বেষ্টনী পার হয়ে সর্বশেষ ওয়েটিং রুমে চলে এলাম। এখানকার সবগুলো সোফাই শূন্য। কারণ এখনও যাত্রীদের কেউ প্রবেশাধিকার পায় নি। আমরা এসে কামরার ভেতর দাঁড়াতেই অফিসারটি ইমামের সাথে সেকহ্যান্ড করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, যাত্রা শুভ হোক। আমার নাম অমরনাথ। আমিও একদা ঢাকারই লোক ছিলাম। এনাউন্স হলেই প্লেনে গিয়ে উঠবেন। আপনাদের আর কোনো চেকিং হবে না। আমি এখানকার সিকিউরিটি অফিসার। আপনাদের আসার ব্যাপারে আগেই আমাদের এলার্ট করা আছে। দমদমেও আপনাদের জন্য লোক থাকবে। তারাই যথাস্থানে পৌঁছে দেবে। আর কোনো অসুবিধে নেই। নমস্কার।

.

আমরাও তাকে হাত তুলে সালাম বললাম। স্মিত হেসে ভদ্রলোক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলে আমরা সোফার ওপর আরাম করে বসলাম। নন্দিনী আমার পাশে। এখন তার মুখখানা উজ্জ্বল। আমার বোন ও ভাগ্নিটাও খুশি। কলকাতার বিমান আমাদের জন্য রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই উড়াল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কামরাটা যাত্রী নারীপুরুষে ভর্তি হয়ে গেল। কালো মতো মোটা এক ভদ্রলোকে সুটাটাইপরা, হাতে দুটি বিশাল ব্যাগ নিয়ে নন্দিনীর গা ঘেঁষে বসে পড়ল। হ্যান্ড ব্যাগ দুটি একটু অস্বাভাবিকভাবে আমার পায়ের কাছে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনারা কী জয়বাংলার লোক?

আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও জবাব দিলাম আমি।

আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি।

কোথায় যাবেন?

আপাতত কলকাতায়।

আপনার হ্যান্ডব্যাগগুলো খুব ভারী মনে হচ্ছে। আপনি তো হাঁপাচ্ছেন।

আর বলবেন না ভাই। ব্যবসার কাগজপত্রের বোঝা। পাটের ব্যবসা করি কিনা।

আমি আর কিছু না বলে ইমাম ও পারুলের দিকে তাকালাম। এরা আমাদের সোফা থেকে একটু দূরে এদের বারো বছরের মেয়ে মিতুর নানা কৌতূহলী প্রশ্নে জবাব দিতে ব্যস্ত। মিতু একবার হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, এই যে কবি মামা, একটু পরেই কলকাতা।

মিতুর মুখে আনন্দ উছলে পড়ছে দেখে আমি ও নন্দিনী হাসলাম। নন্দিনীর হাসিটা খুব ভালো লাগল।

একটু পরেই প্লেনে ওঠার ঘোষণা শুনে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ইমাম পারুল ও মিতুকে নিয়ে যাত্রীদের লাইনের ভেতর দাঁড়িয়ে আমার ও নন্দিনীর দিকে হাতের ইশারা করল। আমরা লাইনের দিকে যেতে উদ্যত হলে পাশের সেই ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরে হঠাৎ মিনতি করল, আমাকে একটু সাহায্য করুন, এই ব্যাগটা একটু প্লেন পর্যন্ত পৌঁছে দিন না।

এ অবস্থায় আমি যখন দ্বিধান্বিত নন্দিনী হাত বাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে দিন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

আমি কিছু বলার আগেই নন্দিনী ব্যাগটা হাতে তুলে বলল, খুব ভারী তো।

আমি বললাম, দাও আমাকে।

লাগবে না, এসো।

নন্দিনী আমার আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। তার পেছনে আরও দুজনের পর আমি ও নারায়নগঞ্জের ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ঠাঁই পেলাম।

যাত্রীরা লাইন বেঁধে হেঁটেই বিমানের সিঁড়ির কাছে বিশাল লাইনে থেকে চেকিং করিয়ে বিমানে উঠছে। এদিকে একজন চেকিং অফিসার নন্দিনী পর্যন্ত ওপরে উঠতে অনুমতি দিয়ে বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে লাইনটাকে থামাল। নন্দিনী তর তর ওপরে উঠে গেলে ভদ্রলোক আমার বোর্ডি কার্ডের হলুদ শ্লিপটা নেড়ে চেড়ে দেখল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাতের ওয়াকিটকিতে কী যেন কথা বেজে উঠতেই সে আমার পেছনের ব্যবসায়ীটির দিকে ফিরে বলল, আপ লাইনসে নিকাল আইয়েজি।

বলেই ভদ্রলোক আমার বোর্ডিং কার্ডটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আপ যাইয়ে, জলদি।

আমি দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে এলাম। যাত্রীরা এখনও সবাই সঠিক সীট খোঁজাখুজি করছে। আমি উন্মুখ হয়ে নন্দিনীকে খুঁজতে গেলে দেখলাম সে প্লেনের সম্মুখভাগে একটি জানালার পাশে বসে হাতের ইঙ্গিতে আমাকে ডাকছে।

আমি সামনের দিকে এগোতে গিয়ে দূরেই পারুলদের দেখলাম। কিন্তু একবার পেছন ফিরেও দেখলাম না ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটি এখনও ভেতর আসতে পারল কিনা। নন্দিনীর পাশের সীটে বসেই বললাম হ্যান্ড ব্যাগওয়ালা লোকটাকে সিঁড়ির কাছে আটকে দিয়েছে।

বলো কী, এখন কী হবে?

এক্ষুণি হয়ত ছেড়ে দেবে।

আমার কথায় নন্দিনী জানালার দিকে মুখ ফেরাল।

সর্বনাশ লোকটাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখন কী হবে?

তার কথায় আমিও নিচের দিকে দেখার চেষ্টা করলাম। দুজন পুলিশ লোকটাকে তার অবশিষ্ট হ্যান্ডব্যাগসহ ঠেলতে ঠেলতে ওয়েটিং লাউঞ্জের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমরা নিরুপায়ের মতো পরস্পরের দিকে তাকালাম। নন্দিনী ধরা গলায় ফিসফিস করে আমাকে বলল, ভগবান জানেন এ ব্যাগটায় কী আছে?

নন্দিনী পায়ের কাছে সীটের ফাঁকে ব্যাগটা খাড়া করে রাখা। আমি বললাম, চুপ করে থাক। যাই থাক ব্যাগটা এখন তোমার আমার কাছে। এর ভেতরকার সবকিছুর জন্য দায়দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তাবে। আর এ নিয়ে কথা বলো না।

নন্দিনী একদম চুপ হয়ে গেল। তার মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে। আমি বললাম, একটুতেই ভয় পাও কেন?

একটু পরেই বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি নন্দিনীর সীট বেলট বেঁধে দিয়ে নিজেরটা বাঁধলাম। একজন এয়ারহোস্টেস আমাদের পাশের গলিপথ দিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে দেখতে দেখতে হেঁটে চলে গেলে বিমানেরও রানওয়ের ওপর দিয়ে চলা শুরু হল।

একটু পরেই বিমানটি মেঘলা আকাশের ভেতর ঢুকে পড়লে আমি ও নন্দিনী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নন্দিনী অনুচ্চ স্বরে আমাকে বলে, হ্যান্ডব্যাগটা ওপরে তুলে রাখলে হয় না?

এত বড় ব্যাগ ওঠাতে গেলে এয়ার হোস্টেসরা আপত্তি করবে। আর তাছাড়া এখন এটা নাড়াচাড়া করতে গেলে সকলের চোখে পড়বে। পায়ের নিচে আছে, ওখানেই থাক।

নন্দিনীর কানে কানে বললাম।

আমার সতর্কতায় নন্দিনী মনে হয় একটু ঘাবড়ে গেল, হা ঈশ্বর, এর মধ্যে বোমা না থাকলেই হল।

নন্দিনীর কথায় আমিও একটু ভয় পেলাম। কিন্তু কথা না বলে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে আকাশের নীলের ওপর জমে থাকা পুঞ্জিভূত মেঘের বিশ্রাম দেখতে লাগলাম। আমাকে বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে নন্দিনী বলল, নিচে হিমালয়?

না। হিমালয় সম্ভবত আরও উত্তরে। আমরা মনে হয় হিমালয়ের দক্ষিণের সমতলের ওপর দিয়ে যাচ্ছি।

নন্দিনী বেশীক্ষণ বিমানের বাইরে প্রাকৃতিক শোভার দিকে দৃষ্টি রাখতে পারছে না। তার মন হ্যান্ডব্যাগটার ভিতরে কী আছে, এ নিয়ে উসখুস করছে। আমরা কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আমার ভীষণ ভয় লাগছে।

লাগারই কথা। অপরিচিত ঐ লোকটার আব্দার না রাখলেই হত।

আমি পারি না।

এখন তো মনে হয় এর চেয়েও কঠিন কাজ পারতে হবে।

কী কঠিন কাজ?

চকিত হয়ে নন্দিনী আমার হাত চেপে ধরল। ঠিক ঐ সময় একজন বিমানবালা একটি ট্রেতে করে জেলি মাখানো বিস্কুট আর কফি নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল, টি অর কফি?

আমরা দুজন এক সাথেই বলে উঠলাম, টি।

মহিলাটি সীটের সাথে সংযুক্ত টেবিল ঠেলে দিয়ে চা ঢেলে দিতে দিতে বলল, আর কোনো অসুবিধা?

সম্ভবত নন্দিনীর চেহারায় একটা ভয় চকিত উৎকণ্ঠার আভাস পেয়ে এই প্রশ্ন। মেয়েটি তবে বাঙালি। আমি বললাম, না কোনো অসুবিধা নেই।

আমার জবাব শুনে ভদ্রমহিলা কিন্তু নিরাশ হল না। বরং গলা বাড়িয়ে আমরা যে ব্যাগটা লুকোতে ব্যস্ত সেটার দিকে তাকাল এবং পর মুহূর্তেই নন্দিনীর পায়ের তলা থেকে ব্যাগটা মুহূর্তের মধ্যে নন্দিনীর দিকে টেনে এনে বলল, ব্যাগটা সামনের ফাঁকা জায়গায় রেখে দিচ্ছি। নামার সময় স্মরণ করে নিয়ে যাবেন।

মহিলা ব্যাগ নিয়ে প্যাসেঞ্জারদের সারিগুলা পেরিয়ে একেবারে সামনের ফাঁকা জায়গায় ডান দিকে রেখে পেছন ফিরে নন্দিনীকে ইশারায় জানিয়ে দিয়ে সামনের পর্দার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নন্দিনী বলল, নামার সময় ঐটা এখানেই ফেলে গেলে কী হয়?

আমি বললাম, তোমার প্রস্তাবটা মন্দ নয়।

কিন্তু লোকটা যদি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমাদের পেয়ে আমাদের খুঁজে বের করে তার গচ্ছিত ব্যাগটা ফেরত চায়?

এ কথার আমার কাছে কোনো জবাব নেই।

এমনও তো হতে পারে ব্যাগের মধ্যে ভদ্রলোকের দরকারি কাগজপত্রই আছে খারাপ কিছু নেই।

আমি হাসলাম, এ নিয়ে আর অস্বস্তির মধ্যে থেকে লাভ নেই নন্দিনী। আমরা ব্যাগটা নিয়েই বরং নেমে যাব। কপালে যা থাক।

দমদমে আমাদের কোনো অসুবিধেই হল না। এখানেও আমাদের জন্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার অপেক্ষা করছিলেন। আমরা সন্দেহজনক ব্যাগটা নিয়েই নামলাম। আমাদের মালপত্র, বাক্স প্যাটরার ওপর কোনো চেকিংই হল না। বরং সবকিছু অতিসাবধানে একটা মাইক্রোবাসে তুলে দেয়া হল। পূর্বের ব্যবস্থা মতো আমরা এসে উডস্ট্রীটের একটা হোটেলে উঠলাম। খুব বড় হোটেল না হলেও আধুনিক সমস্ত আরাম আয়েসের ব্যবস্থা আছে। মোট তিনটি কামরা আমরা পেলাম। মিতু ও নন্দিনীর জন্য একটি দুই সীটের কামরা, পারুলরাও দুজন দুসীটের একটি কামরা নিল। আর আমার জন্য পেলাম সিঙ্গেল সীটের একটি ছোট কামরা। ইমাম দম্পত্তির সমস্ত লটবহর আমার কামরায় রাখা হল।

হোটেলে ওঠার সময় ইমাম আমাকে জানিয়েছিল, এখানে আমাদের এক সপ্তাহ থাকতে হতে পারে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের এ্যাকজাইল গভর্ণমেন্টের ব্যবস্থায় আমরা অন্যত্র উঠে যাব।

সন্ধ্যায় আমি যখন আমার কামরায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, দেখলাম অন্যান্য মালামালের সাথে হ্যান্ড ব্যাগটাও এঘরেই আছে। ব্যাগটার দুপ্রান্তে দুটো ছোট চাইনিজ তালা। কৌতূহল আমাকে আর খাটে শুয়ে থাকতে দিল না। আমি উঠে ভারী ব্যাগটাকে বিশাল বিশাল বাক্স প্যাটরার স্তূপ থেকে টেনে বের করে আমার বিছানার ওপর রাখলাম। তালাগুলোতে হাত বুলিয়ে বুঝলাম তেমন মজবুত না হলেও মুচড়ে খোলা যাবে না। তালা দুটো আদৌ খোলা উচিত হবে কিনা, আমি যখন এসব ভাবছিলাম তখন মিতু এসে দরজায় বেল টিপল।

মামা, আব্বা-আম্মা চা নিয়ে বসে আছে।

আমি উঠে দরজা খুলে দিলাম।

মিতু হেসে বলল, চায়ের পর নিউমার্কেট।

নিউমার্কেট?

আপনার আর নন্দিনী খালাম্মার জন্য কাপড়জামা কিনতে আব্বা-আম্মা এখনই বাজারে যাবেন। আপনাদের তো আর বাড়তি কাপড়ই নেই। আপনাদের সাথে আমিও যাব।

খুশিতে মিতু হাসতে লাগল। হঠাৎ আমার খাটের ওপর চোখ পড়ায় বলল, ও মামা এই ব্যাগ পেলেন কোথায়?

আমি তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, এটা তোমার নন্দিনী খালার। কোনো রকমে নিয়ে এসেছে। এরও আবার চাবি হারিয়ে গেছে কিনা, খোলা যাচ্ছে না।

ভেঙে ফেলুন না।

না খুলতে পারলে তো ভাঙতেই হবে।

দাঁড়ান আমাদের ব্যাগের চাবিগুলো এনে দিই। মিতু তাদের চাবি আনতে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম, দাঁড়াও মিতু। আগে তো চা নাস্তা খেয়ে নিই পরে না হয় তোমাদের চাবিগুলো নিয়ে খোলার চেষ্টা করব। তোমার আব্বা-আম্মার ঘরে যাই।

মিতুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি আমার কামরার দরজা ভেজিয়ে বাইরে এলাম। মিতু আমাকে হাত ধরে নিয়ে বলল, মামা আপনি কী এর আগেও কলকাতায় এসেছেন?

অনেকদিন আগে দুতিন বার এসেছি বৈকি।

হগ সাহেবের মার্কেট দেখেছেন?

তাও দেখেছি।

ঢাকার নিউ মার্কেটের চেয়েও সুন্দর?

সুন্দর কিনা জানি না তবে অনেক বড়, অনেক দোকানপাট।

আমার কথায় কিশোরীসুলভ আনন্দে মিতু এক রকম নেচে উঠল, একটু পরেই যাচ্ছি।

আমরা এসে পারুলদের কামরায় ঢুকলাম। মিতুর আনন্দের হাসিমুখ দেখে পারুল বলল, কী ব্যাপার, মামাভাগ্নির মনে হচ্ছে কলকাতায় এসে খুশির সীমা নেই।

আমি বললাম, মিতু মা সাথে থাকলে মনে হয় কলকাতায় আমাদের খুব একটা খারাপ যাবে না।

ওতো এখনও ঢাকাতেই আছে।

পারুল গম্ভীর হয়ে একবার মিতুর দিকে মুহূর্তমাত্র তাকাল। মিতু ততক্ষণে চুপসে গেছে। আমি বললাম, ওকে আর আমাদের দুঃখে, যুদ্ধের কথায় কিংবা পরিণাম চিন্তায় হাসিটা ভুলিয়ে দিয়ে লাভ কী? থাকুক ও খুশিবাসি।

না ভাই, মেয়ে আমার যত ছোটোই হোক, আমরা যে পরিস্থিতিতে নিজেদের দেশ ও ঘরবাড়ি ছেলে এলাম সে ব্যাপারে তার সচেতন থাকতে হবে।

আমি বললাম, এটা জরুরি হতে পারে পারুল, তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান এবং আমাদের মুক্তি যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি বোঝার মতো বয়েস মিতুর এখনও হয় নি। ওকে খুশি থাকতে দাও।

আমার কথা ফুরোবার আগেই নন্দিনী এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

ইমাম ডাকল, আসুন চা খাবেন। চা খেয়ে চলুন একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি। আপনারা তো দুজনই এক কাপড়ে ভারতে ঢুকেছেন। আপনাদের জন্যে এখন ঢাকার মতো নিউ মার্কেট থেকে সস্তা কয়েকটা কাপড় কিনব।

আমার জন্যে দুটোর বেশি শাড়ি লাগবে না। কম দামের ছাপার কাপড় হলেই চলবে।

জবাব দিল নন্দিনী।

পারুল বলল, আপনার জন্য এত চিন্তা করছি না। আপনার পরার মতো সায়া, ব্লাউজ, শাড়ি ইত্যাদি আমার সুটকেসে যথেষ্ট আছে। অসুবিধা হচ্ছে কবি ভাইয়ের। মিতুর আব্বার জামা তার গায়ে লাগবে না। কবি ভাইয়ের জন্য কয়েকটা শার্ট প্যান্ট আর লুঙ্গি হলেই আপাতত চলে যাবে।

আমি কোনো আপত্তি না করে সাইড টেবিল থেকে জ্যাম লাগানো একজোড়া বিস্কুট তুলে নিলাম। পারুল চা ঢেলে দিলে নন্দিনী আমাকে ও ইমামকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ইমাম বলল, আপনিও চলুন। দেখে শুনে দরকারি আরও কিছু জিনিষপত্র কেনা যাবে।

নন্দিনী বলল, পারুল দিদি যখন যাচ্ছেন আমার আর যেতে হবে না। তাছাড়া বাজার করার মতো শারীরিক অবস্থা আমার নেই। শরীরটা খুবই দুর্বল। আমি একটু শুয়ে থাকব। আপনারা কিছু মনে করবেন না তো?

এ-কথার ওপর আর কথা চলে না। আমি বুঝলাম নন্দিনী কেন যেতে চাইছে না। একেতো তার শরীরটা এখনও সম্পূর্ণ সেরে ওঠে নি। তার ওপর বাড়তি বোঝার মতো হ্যান্ডব্যাগটা তার মনে চেপে বসেছে। আমি বললাম, ঠিক আছে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বরং তোমার কামরায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। এত মালামাল যখন রয়েছে তখন হোটেলেওতো কারো থাকা দরকার।

আমার কথায় পারুলও সায় দিল। দিদির যখন যেতে ইচ্ছে করছে না তখন উনি বরং এখানেই থাকুন।

পারুলের কথায় আমি চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। আমি তা হলে একটু তৈরি হয়ে আসি।

আমি আমার কামরায় এসে ঢাকামাত্র নন্দিনীও আমার পেছনে কামরায় এসে ঢুকল।

আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

আমি জানি।

তোমরা চলে গেলে ব্যাগটা একটু দেখব?

কি করে দেখবে, তালা আছে না?

হোটেলের দারোয়ান ডেকে যাহোক একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। আমি ঠিক পারব।

কৌতূহল আর আত্মবিশ্বাসে ভরা গলা নন্দিনীর। আমি বললাম, যাই করো দারোয়ান টারোয়ানের সামনে ব্যাগটা খুলো না। কে জানে এর মধ্যে কী আছে?

কেন, মানুষের কাটা মাথা বেরিয়ে পড়বে নাকি?

হেসে একথা বললেও আমি বুঝলাম নন্দিনীর ভেতর দারুণ ভয়ের তোলপাড় চলছে। সন্দেহের দোলা থেকে নন্দিনীকে রেহাই দেয়ার জন্য আমি হেসে বললাম, শেষপর্যন্ত দেখো এর ভেতর থেকে পাট ব্যবসায়ের নথিপত্র ছাড়া আর কিছুই বেরুবে না। লোকটাকে আমরা অযথাই মিথ্যেবাদী ভাবছি কেন। লোকটাকে হয়ত অন্য কোনো কারণে সন্দেহবশত গোহাটির পুলিশ আটক করেছে। ছাড়া পেয়ে একদিন এসে তার মূল্যবান কাগজপত্রের ব্যাগটা হয়ত আমাদের কাছে দাবি করবে।

আমাদের পাবে কোথায়?

ঠিকই পেয়ে যাবে। যদি সত্যি এতে কোনো মূল্যবান কিছু থেকে থাকে।

নন্দিনীকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম আমি।

তুমি বলছ ব্যাগটা খোলা আমাদের অনুচিত হবে?

আরে না, তা কেন বলব। মালিকহীন বোঝায় প্রকৃত বিষয় কী আছে অবশ্যই আমাদের পরখ করে দেখতে হবে। বোঝাটা যখন আমরা বইছি তখন অবশ্যই বোঝার ভেতরটা একবার দেখা দরকার। এখন আসল প্রশ্ন হল তালা খুলবে কীভাবে?

আমি ঠিক খুলতে পারব। কেউ যখন থাকবে না তখন আর চিন্তা কি। তোমার বোনের গাট্টি বোচকায় নিশ্চয়ই তালা খোলার মতো জিনিসপত্র আছে। দেখো, ঠিক আমি খুঁজে বের করব।

অদম্য কৌতূহল আর সাহসী গলা নন্দিনীর।

আমি বললাম, আল্লাহ তোমার সহায়ক হোন। আমি তাহলে বাজার থেকে ঘুরে আসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *