• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০০৭. পৃথিবী কি দাড়ি কামায়

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০০৭. পৃথিবী কি দাড়ি কামায়

পৃথিবী কি দাড়ি কামায় বাবা?

না না, পৃথিবী মোটেই তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি কামাতে চায় না। কিন্তু মানুষ বারবার জোর করে তার খেউরি করে দিচ্ছে। পৃথিবীর দাড়ি হল সবুজ। যদি আকাশের অনেক ওপরে কোনও স্যাটেলাইটে বসে দেখ, তাহলে দেখবে ওই সবুজ কত সুন্দর! গ্লোরিয়াস গ্রিন। আর কোনও গ্রহই এত সুন্দর নয়।

তুমি কি করে দেখতে পাও বাবা?

আমি চোখ বুঝে ভিসুয়ালাইজ করি। আমাদের মোটে দুটো চোখ, তা দিয়ে তো অত দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু কল্পনাশক্তিও আর একরকম চোখ। তা দিয়েও দেখা যায়। কিরকম জানো? কালো মিশমিশে আকাশে সবুজ আর নীলে মেশানো একটা স্নিগ্ধ মুখ। মাথায় বরফের সাদা চুল, গলায় বরফের সাদা একটা বো।

চোখ বুজলে আমিও দেখতে পাবো?

নিশ্চয়ই পাবে। তুমি তো ছোটো, তোমার ইমাজিনেশন আরও ভাল। তুমি সহজেই পারবে।

কিন্তু পৃথিবীর দাড়ি কামানোর কথাটা বললেনা!

পৃথিবীর দাড়ি হল তার গাছপালা, শস্যক্ষেত্র। একমাত্র পৃথিবী ছাড়া দৃশ্যমান কোনও গ্রহে প্রাণের লেশমাত্র নেই। তাই পৃথিবী তুলনাহীন। প্রাণহীন নিথর সৌরমণ্ডলে শুধু এই একটা গ্রহেই গাছ জন্মায়, জীবজন্তু ঘুরে বেড়ায়, মানুষ কথা বলে। কিন্তু এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীটিই সবচেয়ে বেশী বোকা। সে পৃথিবীর সবুজ দাড়ি কামিয়ে দিতে চাইছে। আর ডেকে আনছে সর্বনাশ। সে ব্রাজিলের রেন ফরেস্ট থেকে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল সব জায়গা থেকেই কেটে নিচ্ছে গাছ। গাছ কেটে বসতি বানাচ্ছে, কলকারখানা সাচ্ছে, কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বলছে, কাঠ দিয়ে আসবাব আর ঘরবাড়ি বানাচ্ছে। গাছ কাটছে, কিন্তু সেই পরিমাণে গাছ বসাচ্ছে না। এইভাবে চলতে থাকলে একদিন স্যাটেলাইট থেকে দেখা যাবে, কালো আকাশে যে সুন্দর ঢলঢ়লে নীলচে সবুজ হাসি-হাসি মুখখানা ভেসে থাকত সেটা একেবারে পশুটে হয়ে গেছে। বুঝতে পারলে?

কেন এরকম হবে বাবা?

তুমি সব ঠিকঠাক বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখো, গাছ কাটা খুব খারাপ। জঙ্গল উড়িয়ে দেওয়া খুব খারাপ। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখছে গাছপালা। পৃথিবীর গাল থেকে ওই সবুজ দাড়ি কখনও কামিয়ে ফেলা উচিত নয়। যখন বড় হবে তখন তোমার যেন কথাটা মনে থাকে।

কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে তার ছোট ছেলে দোলনের খুব ভাব। এতটা ভাব কৃষ্ণজীবনের সঙ্গে আর কারও নয়। দোলনের মধ্যে সে নানা ভাবে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে। তার মত, তার চিন্তা, তার যত জ্ঞান। বারো বছরের দোলনের অত বুঝবার ক্ষমতাই নেই। তবু সে বাবাকে গ্রহণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। দোলন বোধহয় টের পায় সে ছাড়া কৃষ্ণজীবনের আর কোনও বন্ধু নেই।

কথাটা ঠিক। কৃষ্ণজীবনের তেমন কোনও বন্ধু নেই, যাকে সে সব কথা উজাড় করে বলতে পারে। তা বলে কৃষ্ণজীবনের যে অনেক কথা বলার আছে তাও নয়। তার মুখে যেমন কথা খুব কম, তার ভিতরেও তেমনি কথা খুব কম। তার মন ও মস্তিষ্ক দুটোই কিছুটা বোবা।

সাত তলার ওপর একটি সুন্দর ফ্ল্যাটে কৃষ্ণজীবন থাকে। এ তার নিজস্ব ফ্ল্যাট। সে ও তার স্ত্রী রিয়া এই ফ্ল্যাটের যুগ্ম মালিক। অথচ কেন কখনও এই ফ্ল্যাটটা তার নিজস্ব বলে মনে হয় না? কেন নিজস্ব বলে মনে হয় না তার আর দুটি সন্তান ও স্ত্রীকে?

এক অজ পাড়াগাঁয়ের উদ্বাস্তু বসতির ভাঙা ঘর থেকে এতদূর এসেছে সে। কিন্তু নিজের সবটুকুকে আনতে পারা গেছে কি? সবটুকু কৃষ্ণজীবন কি আনতে পারল? না বোধহয়। টেনে হিচড়ে আনতে গিয়ে কৃষ্ণজীবনের খানিকটা পড়ে রইল সেই ভাঙাচোরা মেটে বাড়ির আশেপাশে, খানিক পড়ে রইল পথে-বিপথে, খানিকটা কৃষ্ণজীবন এল। কিন্তু পুরোপুরি হল না এই আসা।

যার নাম কৃষ্ণজীবন, যার বাপের নাম বিষ্ণুপদ, তার বউয়ের নাম কি করে হয় রিয়া? কৃষ্ণজীবন আর রিয়া—এ যেন এক বিষম অসবর্ণ জোড়। না, বর্ণে তাদের অমিল নেই। তারা দুজনেই কায়স্থ। কিন্তু শুধু বর্ণে মিললেই কি হয়! কত যে অমিল! রিয়া তাকে এক সময়ে বলেছিল, আজকাল কত লোক তো এফিডেভিট করে নাম বদলায়। তুমিও বদলে ফেল না।

ভারী আশ্চর্য হয়েছিল কৃষ্ণজীবন। বলেছিল, কেন?

শোনো, রাগ কোরো না। পুরোপুরি বদলাতে বলছি না।শুধু জীবনটা ঘেঁটে দাও। কৃষ্ণ নামটা চলবে।

কৃষ্ণজীবন গম্ভীর হয়ে বলেছিল, এটা যে খুব অপমানজনক রিয়া।

তার মাথা ছিল পরিষ্কার। লেখাপড়ায় ধুরন্ধর। আর চেহারাখানা বেশ লম্বা চওড়া, সুদৰ্শন। এ দুটি জিনিস তাকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। যদিও যে ততদূর বিষয়বুদ্ধির অধিকারী নয় যাতে নিজে থেকেই এ দুটি মূলধনকে কাজে লাগাবে। সে ততদূর খারাপ ও ধান্দাবাজও নয়। কিন্তু চেহারা আর মেধা আপনা থেকেই রচনা করে গেছে তার পরিবর্তনশীল পারিপার্শ্বিককে। উত্তর চব্বিশ পরগণা থেকে কলকাতা। ওই মেধা ও চেহারার মৃগয়ায় একদিন শিকার হয়ে গেল রিয়াও।

কিংবা ঠিক তাও নয়। কে করে শিকার তা কে বলবে?

আজ সাততলার এই ফ্ল্যাটবাড়িতে তার অবিশ্বাস্য অধিষ্ঠান। সে থাকে, রিয়া থাকে, তার দুই ছেলে আর মেয়ে থাকে। থাকে, তবু কিছুতেই থাকাটাকে তার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কেবলই মনে হয়, এ সবই স্বপ্ন। একদিন ভেঙে যাবে। হঠাৎ গুম ভেঙে জেগে উঠে দেখবে, সবু ফব্ধিকারি।

এত দুঃসহ ছিল তাদের দারিদ্র্য যে, যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকেই তাকে টিউশনি করতে হত। জনপ্রতি দশটাকা করে রেট ছিল। তিনটে বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছোটো ক্লাসের ছেলেদের পড়াত সে। সেই বয়সের তীব্র খিদের কথা কৃষ্ণজীবন কখনও ভুলতে পারে না। কখনও নেমন্তন্ন-বাড়ির ডাক পেলে কী যে আনন্দ হত! ওই খিদেই তাকে জাগিয়ে রাখত রাতে। সে পড়ত। ওই খিদেই শান দিত তার মেধায়। সে বরাবর ফার্স্ট হত। ওই খিদেই তাকে চনমনে, উচাটন রাখত সবসময়। তাই সে সাহস করে পড়তে আসত কলকাতায়। কত দূরে রেল স্টেশন। কতক্ষণ ধরে ট্রেনের ধকল। তারপরও অনেকটা হেঁটে কলেজ। গাড়িভাড়া নেই, টিকিট নেই, বইপত্র নেই, খাতা-কলমেরও অভাব। ট্রেনে টিকিট কাটত না। কতবার ধরা পড়ে নাকাল হয়েছে। তিন চারবার হাজতে নিয়ে গেছে তাকে। সুন্দর চেহারা দেখে এবং অতিশয় দরিদ্র এবং ছাত্র বলে ছেড়ে দিয়েছে শেষ অবধি। মেয়াদ হয়নি।

আজ খিদেটা নেই। আজ তার ভিতরটা মৃত।

তার বাবা এক বোকা মানুষ, তার মা এক বোকা মানুষ। তাদের বোকাসোকা সব ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে এই একজন হঠাৎ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল তা দেখে সবাই ভয় খেল, অবাক হল। কলেজ ইউনিভার্সিটি সে টপকাল হরিণের মতো লঘু পায়ে। কোথাও আটকাল না। বরাবর দারুণ ভাল রেজাল্ট। বড় আশায় বুক বেঁধেছিল বোকা বাবা আর মা। ভাইবোেনরা ঝকমক করত দাদার অহংকারে। ক্লান্ত দিনশেষে যখন গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেত তখন জোনাকি পোকা, অন্ধকার আর আপনজনেরা ঘিরে ধরত তাকে। সেও কত স্বপ্ন দেখত।

চাকরি বাধাই ছিল তার। পড়াশুনো শেষ করতে না করতেই সে অধ্যাপনায় বহাল হল। প্রথমে কলেজে। রিয়া তার অধ্যাপকজীবনের প্রথম বছরের ছাত্রী। সেও এক অধ্যাপকের মেয়ে। একটু ফাজিল, ফচকে ধরনের মেয়ে। নবাগত অধ্যাপকটির সঙ্গে খুনসুটি করতে গিয়েই বোধহয় বিপদে পড়ল। বিয়ে হতে দেরী হয়নি।

যৌবনের উন্মাদনা ছাড়া আর কি! উন্মাদনা মানেই পাগলামি। হিসেব-নিকেশহীন কিছু ঘটিয়ে ফেলা। সেই উন্মাদনা ছিল না বলেই রিয়ার বাবা তাদের গায়ের বাড়ি ও পরিবারের অবস্থা দেখে এসে বিয়েতে অমত করলেন। রিয়া উল্টে গো ধরল।

বিয়েটা শেষ অবধি হল বটে, কিন্তু বয়ে আনল নানা উপসৰ্গ আর জটিলতা। গায়ের ওই বাড়িতে গিয়েই বিবর্ণ হয়ে গেল রিয়া। এই বাড়ি? এইসব অতি নিম্নমানের মা-বাবা-ভাইবোন? বোকা, আহাম্মক, হিংসুটে, লোভী! প্রত্যেক রাতে প্রেমের বদলে তাদের ঝগড়া হতে লাগল। প্রতি রাতে কাঁদত রিয়া। আর প্রতিদিন সকাল থেকে কৃষ্ণজীবনের ভাইবোনদের সঙ্গে মন কষাকষি শুরু হত রিয়ার। এই সাঙ্ঘাতিক অবস্থায় বড় কাহিল আর অসহায় আর একা হয়ে পড়ছিল কৃষ্ণজীবন।

দুমাসের মধ্যে তাকে চলে আসতে হল কলকাতার ভাড়া বাসায়। বড় কষ্ট হয়েছিল কৃষ্ণজীবনের। কারণ সে ফাটলটা দেখতে পেয়েছিল। সে জানত, নিজের আপনজনদের সঙ্গে এই যে বাঁধন কাটল আর কিছুতেই তা গিঁট বাঁধা যাবে না। গাদাবোটকে টেনে নিয়ে যাবে একটি লঞ্চ—এরকমই আশা ছিল সকলের। কিন্তু লঞ্চ শিকল কেটে তফাত হল। সংসারের গাদাবোট যেখানে ছিল পড়ে রইল। উত্তর চব্বিশ পরগনার ওই অজ পাড়াগাঁয়ে আজও তার স্তিমিত পরিবারটি অভাবে, অশিক্ষার অন্ধকারে পড়ে আছে। অভাবের সংসারে ঝগড়া-কাজিয়া-অশান্তি আর নানা পঙ্কিলতার মধ্যে।

কৃষ্ণজীবন পারত। পারল না।

কে কার শিকার তা বুঝে ওঠা মুশকিল। আজ তো কৃষ্ণজীবনের মনে হয়, এক লোলুপ বাঘের থাবার নিচে লম্বমান পড়ে আছে তার মৃতদেহ। ধীরে ধীরে বাঘটা তাকে খেয়ে ফেলছে। তার কিছু করার নেই।

না, রিয়াকে সেই বাঘ ভাবে না কৃষ্ণজীবন। গোটা পরিস্থিতিটাই সেই বাঘ। রিয়া তার একটি থাবা মাত্র।

মাইনে কম ছিল তখন। তবু কষ্টেসৃষ্টে টাকা পাঠাত কৃষ্ণজীবন। প্রতি শনিবারে রবিবারে যেত গায়ের বাড়িতে। আর তখন তাকে চোখা চোখা কথা শোনাতো ভাইবোনেরা। বিশেষ করে বোনেরা। বউয়ের চাকর, ব্যক্তিত্বহীন ভেড়া, স্ত্রৈণ। এতকাল কৃষ্ণজীবনের মুখের ওপর কথা বলার সাহসই কারও ছিল না। এই গরিব, গৌরবহীন পরিবারে কৃষ্ণজীবন ছিল প্রায় গৃহদেবতার মতো সম্মানের আসনে। সবাই তাকে তোয়াজ করত, ভয় পেত। কিন্তু বিয়ের পর সব ভাঙচুর হয়ে গেল। একদিন তার বোন বীণাপাণি বলেছিল, তুই তো লেখাপড়া শিখে ভদ্ৰলোক হয়ে গেছি, আমরা সেই ছোটলোকই আছি, আমাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখার দরকার কি তোর?

সবচেয়ে বেশী লেগেছিল ভাই রামজীবনের সঙ্গে। আগে কুব বশংবদ ছিল রামজীবন। কি কারণে কে জানে, সেই রামজীবনই তার ওপর ক্ষেপে গেল সবচেয়ে বেশী। এক শনিবার বিকেলে সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিজের পরিবারের জন্য নিয়ে গিয়ে গায়ের বাড়িতে হাজির হয়েছিল সে। তার পদার্পণমাত্র বাড়ির আবহাওয়া থমথমে করে উঠল। ভিতরে ভিতরে একটা আক্ৰোশ পাকিয়ে ছিল আগে থেকেই। সন্ধের পর রামজীবন মদ খেয়ে ফিরল। মাতাল নয়, তবে বেশ টং। ফিরেই তাকে দেখে বাবার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল, এই ততা আপনার লেখাপড়া জানা ছেলে এসে গেছে। শালা মেলা লেখাপড়া করেছে। মেলা বই পড়েছে। মেলা ভাল ভাল কথা জানে। কিন্তু শালা নিজের পরিবার, নিজের ভাইবোনের জন্য এক ফেঁটা বিদ্যে খরচ করেনি। করেছে বাবা? আপনিই বলুন, আমাদের কোনওদিন ডেকে বলেছে, আয় তোকে এটা বুঝিয়ে দিই বা সেটা শিখিয়ে দিই? কোনওদিন জিজ্ঞেস করেছে যে, আমরা কে কোন ক্লাসে পড়ি? আপনার বিদ্যাধর ছেলে শুধু নিজেরটা গুছিয়ে নিয়েছে। আর আমরা শালাকে তেল দিয়ে গেছি। বলুন সত্যি কিনা! আপনার গুণধর ছেলে এখন কলেজে পড়ায়, ছেলেদের ভাল ভাল জ্ঞানের কথা শেখায়। কী শেখাবে ও বলুন তো! ওর চরিত্র আছে, না মায়াদয়া আছে? ও জানে, মা-বাবা ভাই-বোনকে কেমন করে শ্রদ্ধাভক্তি করতে হয়, ভালবাসতে হয়? লেখাপড়া জানা বউকে দিয়ে আমাদের কম অপমান করে গেল? সব শেখানো ছিল আগে থেকে।

রামজীবন যে মদ খায় তা জানত না কৃষ্ণজীবন। হয়তো আগে যেত না। সম্প্রতি ধরেছে। মদ পয়সার জিনিস। এ বাড়িতে চাল কেনার পয়সা জোটে না তো মদ কেনার পয়সা আসবে কোথেকে? কৃষ্ণজীবন জীবনে খুবই কম আত্মবিস্তৃত হয়েছে। সেদিন হল। ওই মাতাল অবস্থায় রামজীবনের চেঁচামেচি তার সহ্য হয়নি। তার ওপর রামজীবন তাকে গুয়োরের বাচ্চা ও বেজন্ম বলে গাল দিয়েছিল। মায়ের পেটের ভাই হয়েও দিয়েছিল। সে উঠে তেড়ে গিয়েছিল রামজীবনের দিকে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!

রামজীবন একা নয়, সঙ্গে সঙ্গে তার সব ভাইবোন যেন এককাট্টা হয়ে উষ্টে তেড়ে এল তার দিকে বিস্তর চেঁচামেচি হয়েছিল। তার মধ্যে রামজীবনের একটা কথা খুব কানে বাজে আজও, তোর টাকায় আমরা পেচ্ছাপ করি। তোর লেখাপড়া জানার মুখে পেচ্ছাপ করি।

রামজীবনকে খুন করতে পারলে সেদিন তার জ্বালা জুড়োতো। কিন্তু আজ আর সেই রাগটা তার নেই। কৃষ্ণজীবন আজ বুঝতে পারে তাকে বড় বেশী ভালবাসত তার পরিবার, অনেক নির্ভর করত তার ওপর, তাকে ঘিরেই ছিল ওদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে তো সে নিজেই।

সেই রাতেই ফিরে এল কৃষ্ণজীবন। সে কি মারতে গিয়েছিল রামজীবনকে? সে কি আত্মবিস্তৃত হয়েছিল। তার সঙ্গে কি ওদের আর সম্পর্ক থাকবে না? কী হল! সে কিছুতেই এইসব ঘটনার জট খুলতে পারল না। শুধু টের পেল, তাকে ঘিরে একটা অদৃশ্য পোকা একটা গুটি বুনে যাচ্ছে। তাকে বন্ধ করে দিতে চাইছে নিজস্ব খোলর মধ্যে।

কলকাতার বাসাই বা কোন কোল পেতে বসে ছিল তার জন্য? অভাবী সংসার থেকে মেধা দিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল সে, কিন্তু গা থেকে গায়ের গন্ধ মোছেনি, মুছে যায়নি তার নিম্নবিত্ত, প্ৰায় অশিক্ষিত পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড। সে নিজেও টের পায়, পুরোপুরি ভদ্ৰলোক নয়, খানিকটা গেঁয়ো, খানিকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। রিয়া ঝকঝকে আধুনিক, ছলেবলে, আর্ট। অসবর্ণের সেই শুরু।

তার বাবা বিষ্ণুপদর স্বভাব হল, সংসারের কোনও ব্যাপারেই জোরালো মতামত নেই। বিষ্ণুপদ ছেলেপুলেদের শাসন-টাসন করত না। তার চোখের সামনে কোনও অন্যায় অবিচার দেখলেও বিষ্ণুপদ রা কাড়ত না। ওটাও একরকম মূক বধিরতা। বাবার কাছ থেকে ওই স্বভাবটি পেয়েছিল কৃষ্ণজীবনও। ভিতরটা যতই টগবগ করুক বাইরেটা শান্ত। সে কখনোই চেষ্টা করেনি রিয়াকে কিছু বোঝাতে বা শাসন করতে। চেষ্টা করলেও হয়তো পারত না। রিয়া বড্ড বেশী প্রখর, বড় বেশী মুখর।

কৃষ্ণজীবনের ওই আংশিক মূক-বধিরতা তার আর রিয়ার মধ্যে কোনও সেতুবন্ধন রচনা করতে দেয়নি। এক ঘরে থেকেও তারা পরস্পরের অচেনা থেকে গেছে। আর রিয়া তার ওপর ক্ষেপে উঠত সেইজন্যই। রাগ বাধা না পেলে অনেক সময়ে স্তিমিত হয়ে যায়। কিন্তু অনেক সময় উল্টোটাও হতে পারে। মানুষের চরিত্র ততা নানা বৈচিত্র্যে ভরা। রিয়া হয়তো চাইত, কৃষ্ণজীবন তার প্রতিবাদ করুক। তাতে বোধহয় রিয়ার ধার বাড়ত। যত সে চুপ করে থেকেছে ততই রাগ বেড়েছে। রিয়ার। বাড়তে বাড়তে আজ কৃষ্ণজীবনকে প্রায় পাপোশ বানিয়ে ছেড়েছে রিয়া।

রাগের কারণ অনেক। প্রথম কারণ, কৃষ্ণজীবনের নিম্নবিত্ত, নিম্নরুচি ও নিচু কালচারের পরিবার। অর্থাৎ কৃষ্ণজীবনের স্নান পটভূমি। আর দ্বিতীয় কারণ, কৃষ্ণজীবনের নিরীহ অনুত্তেজক ব্যক্তিত্ব। বা ব্যক্তিত্বের অভাব। তৃতীয়, চতুৰ্থ, পঞ্চম আরও নানা দাম্পত্য কারণ তো আছেই। সব সময়ে যথেষ্ট কারণেরও দরকার হয় না।

রাগ! রাগই রিয়াকে চালায়। রাগই তার চালিকাশক্তি। তার রাগের চোটে ঝি থাকে না। বাড়িওলার সঙ্গে খিটিমিটি বাধে, ছেলেমেয়েরা জড়োসড়ো হয়ে থাকে। তাদের সংসারে আনন্দের লেশমাত্র নেই।

তাকে উসকে তোলার জন্য, দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ করার জন্যই কি বিয়ের দুবছরের মধ্যেই একদিন, বাচ্চার জন্য কৌটোর দুধ আনতে ভুলে গিয়েছিল বলে, রাত বারোটা নাগাদ কৃষ্ণজীবনের হাতের বোটানির ভারী বইটা কেড়ে নিয়ে সেটা দিয়েই তার মাথায় মেরেছিল রিয়া? সরাসরি হাত তোলেনি, শুধু বইটা দিয়ে মেরেছিল।

ভারী বই। খুব সজোরে এসে মাথায় লাগতেই ঢলে পড়ে গিয়েছিল সে। মাথা অন্ধকার। আঘাতটা বড় কথা নয়। মানুষ মাঝে মাঝে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। সে ওভাবে পড়ে যাওয়ায়, নিজের কৃতকর্মে অনুশোচনায় পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেছিল রিয়া। কৃষ্ণজীবন মাথার সাময়িক অন্ধকার কাটিয়ে উঠে রিয়াকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। কান্না থামিয়েছিল। বলেছিল, কিছু নি। আমার একটুও লাগেনি।

আমি যে তোমাকে মারলাম? এ কী করলাম আমি?

মার! একে কি মারা বলে? তুমি বইটা রাগ করে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েছিলে। আমিই তে এগিয়ে যেতে গিয়েঠিক গুছিয়ে মিথ্যেটা সাজাতে পারল না কৃষ্ণজীবন। সেই দক্ষতা তার নেই। তবে কাজ হল। রিয়া শান্ত হল।

কিন্তু অনেকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, তুমি খুব অদ্ভুত।

এ কথাটা কৃষ্ণজীবনের বিশ্বাস হয়। সে কিছু অদ্ভুত। রিয়া মিথ্যে বলেনি।

তার নিজের চারদিকে একটা গুটিপোকার খোলস আছে। প্রকৃত কৃষ্ণজীবন বাস করে সেই খোলর মধ্যে। সেখানে শক্ত হয়ে থাকে সে। বাইরের কারও সঙ্গেই তার সম্পর্ক রচিত হতে চায় না সহজে।

সম্পর্ক রচনা হল না তার বড় দুই সন্তানের সঙ্গেও। ব্যস্ততা বা সময়ের অভাব নয়, আগ্রহের অভাব নয়। অভাব পড়ল বাক্যের। অভাব পড়ল ভাব প্রকাশের। যখন ছোটো শিশু ছিল তখন একরকম। যখন বড় হল, বুঝতে শিখল, মতামত হতে লাগল, তখন অন্যরকম।

আজ সাতলার ফ্ল্যাটে তার সংসার। রিয়া আর সে দুজনেই অধ্যাপনা করে। মিলিত রোজগার আর ধার মিলিয়ে। কষ্ট করে কেনা। ধার এখনও অনেক শোধ হওয়ার বাকি। কিন্তু কোনওদিন এই ফ্ল্যাটটার সঙ্গেও কেন একটা আপন-আপ ভাব রচনা করা হল না কৃষ্ণজীবনের পক্ষে? কেন কেলই মনে হয় এ পরের বাড়ি?

এইসব কারণেই কৃষ্ণজীবনের কেবল মনে হয়, তার সবটুকুকে সে জড়ো করতে পারেনি আজও। এখানে ওখানে তার টুকরো টাকরা পড়ে আছে আজও। অনেকটাই পড়ে আছে ওই অজ পাড়াগাঁয়ে। মেটে ঘর, দারিদ্র্যের ক্লিষ্ট ছাপ চারদিকে, প্রতি পদক্ষেপে এক পয়সা দুপয়সার হিসেব রাখতে হয় মাথায়। নুন আনতে সত্যিই পান্তা ফুরোয়। তবু সেইখানে তার অনেকটা পড়ে আছে।

কৃষ্ণজীবন একবার একটা পেপার পড়তে আমেরিকা গিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। রিয়ার ইচ্ছেতেই বিশেষ করে। স্বামী একবার বিদেশ ঘুরে এলে তার মুখ কিছু উজ্জ্বল হয়। ফলে একটা আলগা আমন্ত্রণপত্র যা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামেশাই আসে, ব্যক্তিবিশেষকে নয়, সেই নৈর্ব্যক্তিক একটি আমন্ত্রণলিপিকে অবলম্বন করে, বিস্তর চিঠি চালাচালির পর সে রাহাখরচ ও অন্যান্য ক্ষতি স্বীকার করে গিয়েছিল। সেখানে সেই ঝা-চকচকে, উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সভ্যতার দেশে পা দিয়েও তার মনে হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার সেই অজ পাড়াগাঁ তার সঙ্গেই এসেছে। ধুলোটে পা, চোখে অসহায় আত্মবিশ্বাসহীন দৃষ্টি, ভিতরে কেবলই বিস্ময়ের পর বিস্ময়।

খুবই বিস্ময়ের কথা, পৃথিবীর বাতাবরণের ওপর তার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটি সেখানে বিস্তর কদর পেল। শুধু হাততালি দিয়ে কদর জানানো নয়। সাহেবরা যার মূল্য বুঝতে পারে সেটাকে বাস্তবসম্মত ভাবেই কদর দেয়। একটা ফাউন্ডেশন তার যাবতীয় রাহাখরচ আর হোটেলের ব্যয় মিটিয়ে দিল। সঙ্গে দিল কিছু দক্ষিণাও। এক আশাতীত পুরস্কার। আজকাল মাঝে মাঝে তাকে আমেরিকা যেতে হয়। নিজের উদ্যোগে আর নয়, পুরোপুরি আমন্ত্রণ পেয়েই সে যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে একটা দুশ্চিন্তা আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে ক্রমে। ওজোন হোল, গ্লোব ওয়ার্মিং, সমুদ্রের জলস্তরে স্ফীতি। দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি ইতিমধ্যেই চারদিকে করুণ আবেদন জানাতে শুরু করেছে—কিছু একটা করো, নইলে অচিরে আমাদের প্রিয় ভূখণ্ড তলিয়ে যাবে সমুদ্রে।

খুবই বিস্ময়ের কথা, এই পৃথিবীকে প্রগাঢ় ভালবাসে কৃষ্ণজীবন। অন্য কারও সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক রচিত হয় না বটে। কিন্তু এই অদ্ভুত প্রাণময় গ্রহটির প্রতি হয়।

দোলন তার সরু গলায় খুব সাবধানে ডাকল, বাবা।

উঁ! গভীর আনমনা কৃষ্ণজীবন জবাব দিল।

কী ভাবছো বাবা?

কৃষ্ণজীবন মাথাটা সামান্য নত করে বলে, আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন আমাদের গায়ে অনেক গাছপালা ছিল।

তুমি কেন শুধু গাছপালার কথা ভাবছো বাবা?

কেন ভাবছি! তোমাকে যে এই পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে আমাকে। মানুষ যে কেন তার সন্তানের কথা ভাবে না।

আমি গাছ কাটব না বাবা। আমি কখনও পৃথিবীর দাড়ি কামিয়ে দেবো না।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০০৬. নপাড়ার ছেলেরা
পরবর্তী:
০০৮. মেঘলা দিনের কালো আলো »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑