০১. অন্ধকারে হঠাৎ গুলীর শব্দ

উপমহাদেশ – উপন্যাস – আল মাহমুদ
উৎসর্গ – মিলন ইসলাম

এ বইয়ের সকল চরিত্রই কাল্পনিক। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন কবি সাহিত্যিক, আমলা, বুদ্ধিজীবীর নাম উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ততাকে সম্মানিত করতে। তারা সর্বস্ব ত্যাগ করে এই সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন বলেই। প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের কাহিনীর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। উপন্যাস তো উপন্যাসই।

–লেখক

০১.

অন্ধকারে হঠাৎ গুলীর শব্দে নৌকাটা দুলে উঠল। যাত্রীরা উবুড় হয়ে পড়ল এ-ওর গায়ের ওপর। নৌকার পেটের ভেতর থেকে ময়লা পানির ঝাপটা এসে আমার মুখটা সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিল। সার্ট ও গেঞ্জির ভেতর ছলছলানো পানি ঢুকে ঝুলতে লাগল। আর ফোঁটা ফোঁটা চুঁইয়ে পড়তে লাগল পাটাতনে। ততক্ষণে বুড়ো মাঝি ও তার ছোটো ছেলেটা বৈঠা গুটিয়ে নিয়ে পাটাতনে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। কে একজন ছিটকে এসে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে। কান্না ও শরীরের ছোঁয়াতেই আমার বুঝতে বাকি রইল না, একটা মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাচ্ছে। আমার অস্তিত্বের সমর্থন পেয়েই কিনা জানি না, মেয়েটার কান্না আরও শব্দ করে একটু রোদন বা বিলাপের মতো হয়ে উঠল। আর সাথে সাথেই আখাউড়ার দিক থেকে সারিবাঁধা পটকা ফাটানোর মতো গর্জন করে বইতে লাগল গুলীর শব্দ। সীসার বাতাস কেটে চলে যাওয়ার শিস উঠছে। এর মধ্যেই আমাদের গাইড আনিসের বাজখাই গলা শোনা গেল, কে কাঁদছে? এই হারামজাদি একদম চুপ করে থাক।

ধমক খেয়ে মেয়েটার ফোঁপানি বিকৃত হয়ে অবরুদ্ধ গোঙানির মতো হয়ে উঠল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করব। মেয়েটা আমার পিঠের ওপর উবুড় হয়ে আমাকে দুহাতে জাপটে ধরে কাঁদছে।

আনিসের গলা যে এতটা রুঢ় ও দয়ামায়াহীন হয়ে উঠতে পারে একটু আগেও এই নৌকার কেউ আমরা আন্দাজ করতে পারি নি। যদিও আমার সাথে পরিচয় হওয়ার সময়ই আমি আনিসকে সশস্ত্র দেখেছি। দেখেছি চাদরের ভেতরে উঁচু হয়ে আছে এস, এল, আর-এর ঝাফরিকাটা ছোট নল। তার কোমরের বেল্টে সাবধানে ঝুলিয়ে রাখা দুটি হ্যাণ্ড গ্রেনেডও হঠাৎ দেখে ফেলেছিলাম। যেন দুটি বারুদের পাকা ফল নিয়ে আনিস হাঁটছে। কিন্তু আমার কাছে যখন নিজের পরিচয় দিয়ে চাটগাঁ থেকে আগরতলায় পালিয়ে যাওয়া আমার বোন ও ভগ্নীপতির লেখা একটি চিঠি হস্তান্তর করে বলল, আপনাকে আমিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো। আগামীকাল ভোরে, রাত থাকতেই রওনা হব। তৈরি হয়ে থাকবেন। কোনো ভারী বোঝা নেবেন না। আসি তাহলে।

আমি এমুহূর্তে দেশ ছেড়ে পালাব কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই ছেলেটা কথাগুলো বলে খামটা আমার হাতে তুলে দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। তার দাড়িভরা মুখের আকৃতিটা ঠাহর করতে না পারলেও, হাসির মধ্যে এক ধরনের বিশ্বস্ততা দেখে আমি আর কথা বলতে পারি নি।

এখন এই আনিসের কাছ থেকেই এমন একটা রূঢ় ধমকানি বেজে উঠবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি ফিসফিস করে বললাম, দাঁড়াও, আমি সামলাচ্ছি। আমরা কি ধরা পড়ে যাবো?

ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমরা ঘাটের কাছে এসে পড়েছি। ওরা সম্ভবত নৌকাটিকে আঁচ করে ফেলেছে। এখন নৌকার মধ্যে কান্নাকাটি আর হুটোপুটি শুরু হলে নাওটা ডুবে যাবে। তাছাড়া শত্রুরাও টহল বোট নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। তখন আমরা পালিয়ে বাঁচলেও মেয়েরা আর বাচ্চাগুলো গুলী খেয়ে মরবে।

অনুচ্চকণ্ঠে আনিস পরিস্থিতিটা আমাকে বুঝিয়ে দিল। আমি বুঝলাম, আনিস আমার খুব কাছেই উবুড় হয়ে আছে। যদিও অন্ধকারে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু একটু নড়াচড়ার মুহূর্তে তার ধাতব অস্ত্রের নল আমার মাথায় ঠুকে যাওয়াতে বুঝলাম সে নদীর দিকে এসএল, আরটা বাগিয়ে পজিশন নিয়ে আছে। আমি অন্ধকারেই আমার কপালে একবার হাত বুলিয়ে নিলাম। আনিসের গলার স্বর নেমে এল, লাগল?

না।

মেয়েটাকে ফোঁপাতে মানা করুন। এ অবস্থায় কান্নাটা খুব খারাপ। একবার অযথা ভয় ধরে গেলে নৌকার সবগুলো মেয়েছেলে আর বাচ্চা চিৎকার করে কাঁদতে থাকবে। বাঁচবার জন্য হুটোপুটি করে নাও টলিয়ে দেবে। আপনার কথাতেই তো এতগুলো মেয়ে যাত্রীকে নৌকায় তুললাম।

আনিস আমার বিরুদ্ধে একটু অনুযোগ করল। কারণ নারায়ণপুর বাজার থেকে গতকাল শেষরাতে নাও ভাসাবার সময় ভৈরবের এক শিক্ষয়িত্রী ও তার বোনকে আমাদের সঙ্গে নিতে আমি আনিসকে পীড়াপীড়ি করেছিলাম। মেয়ে দুটি সত্যি অসহায় হয়ে পড়েছিল। শিক্ষয়িত্রীর স্বামী ২৩শে মার্চ ঢাকায় গিয়ে আর ফেরে নি। এদিকে ভৈরব ও আশুগঞ্জে যখন পাক হানাদার এসে ঢুকল তখন অন্যান্য পলায়নপর মুসলিম। পরিবারের সাথে এরাও নারায়ণপুর বাজারে পালিয়ে এসে প্রাণ বাঁচায়।

আমাদের নৌকা শেষ রাতে যখন ঘাট ছেড়ে ভাসানোর তোড়জোর চলছে তখন খালের পার ধরে মেয়ে দুটি দৌড়ে এসে আনিসের হাত চেপে ধরে, আমাদের নিন। আমরাও আর সকলের মতো ভাড়া দেব। শুধু বর্ডারটা পার হতে পারলেই হল।

আনিস বলল, আমাদের এ নৌকায় তিরিশ জনের বেশি যাত্রী ধরে না। এর মধ্যেই বত্রিশ জন উঠে বসেছে। বাচ্চাগুলোকে তো গুণতিতেই ধরি নি। আমি আর রিস্ক নিতে পারি না। আপনারা পরের কোনো নৌকায় আসুন। আর না হলে আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করুন। আমরা দরকারি কাজে আবার এদিকে আসবো। তখন আমাদের সাথে যাবেন।

আনিস না বলাতে মেয়ে দুটি একসাথে আর্তনাদ করে উঠেছিল। না, তাদের নিতেই হবে। তাদের যুক্তি হল তাদের কোনো আশ্রয় নেই। নারায়ণপুর বাজারে একটা খোলা চালার নিচে তারা দেড়টা মাস কাটিয়েছে। এখানকার হিন্দুরা অনেক আগেই অর্থাৎ ঢাকায় ২৫শে মার্চের ঘটনার পর দিন থেকেই বর্ডার পার হবার জন্য সীমান্তের দিকে ছুটছে। শিক্ষয়িত্রী সীমা ও নন্দিনী শুধু যেতে পারে নি। কারণ তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভরসা রেখেছিল যে অজয় ঢাকা থেকে নিরাপদে ফিরে আসবে। কিন্তু ভৈরবের তরুণ ব্যবসায়ী ও আড়তদার অজয় চক্রবর্তী যখন মে মাসের সাত তারিখেও ফিরল না, তখন সীমা ও নন্দিনী আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। এদিকে ভৈরব থেকে ক্রমাগত উদ্বেগজনক খবর আসছিল যে হানাদাররা নারায়ণপুর বাজারেও হানা দিতে পারে। আর সীমাদের চেনাশোনা যুবকগণ যারা ভৈরবের আশপাশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো থেকে এই নিরাপদ অঞ্চলে এসে জুটেছিল তারাও একে একে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে কিংবা অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে আগরতলা পাড়ি জমাতে লাগল। এ অবস্থায় হতোদ্যম একজন মেয়ে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ও তার কলেজে পড়া বোন আর কতদিন এখানে স্বামী ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারে?

আমি মেয়ে দুটোর কাতরতা দেখে বিব্রত হয়ে আনিসকে বললাম, ভাই, এদের নাও। আমি বরং পরের সপ্তাহে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আমি তো মোটামুটি নিরাপদ আশ্রয়েই আছি। আর স্থানীয় ছাত্ররাই আমাকে দেখাশোনা করছে। আমি বরং আমার স্ত্রীর জন্য আর কয়েকটা দিন এখানেই অপেক্ষা করি। তারও তো কোনো খবর পাচ্ছি না। অথচ সে আমার এখানে এসে পৌঁছার দুদিন আগেই আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছে। হানাদার বাহিনী ভৈরব দখলের অন্তত দুদিন আগেই আমার স্ত্রী হামিদার ভৈরব বাজারে আমার ছোটো বোনের বাসায় এসে পৌঁছার কথা। যদিও আমার স্ত্রীর একান্ত ইচ্ছে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বাড়িতে এসেই থাকবে। সেও শিক্ষিকা। চিন্তাভাবনাও সাদামাটা। তার ধারণাটা ছিল পঁচিশে মার্চের ঘটনাটা একটু বাড়াবাড়ি হলেও, সাময়িক। শেখ মুজিবের সাথে ইয়াহিয়া খানের শেষ পর্যন্ত সমঝোতার ব্যাপারে হামিদার তেমন সন্দহ ছিল না। যেমন ছিল না আমারও। কিন্তু সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল যখন বাঙালিরা তাদের জাতীয় চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে পা বাড়াল। অর্থাৎ পাকিস্তানী সামরিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজেরাও সামরিক সিন্ধান্ত নিয়ে বসল।

হামিদা একদিন আগে রওনা হয়েও ভৈরব বা পরিচিত আত্মীয় স্বজনের বাসায় যখন এসে পৌঁছাল না তখন স্বভাবতই আমার মনে উৎকণ্ঠার তুফান বইতে লাগল। এর মধ্যে একবার একটা উড়ো খবর পেলাম। একজন তরুণ গায়ক এসে বললো, স্যার, আমি আর্টস কাউন্সিলের স্টাফ আর্টিষ্ট। আপনার ভাই ও স্ত্রীর খবর আমি জানি। তারা ইণ্ডিয়ায় চলে গেছে। ঢাকা থেকে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছিল। কিন্তু শহরটা পাকিস্তানীদের দখলে চলে যাওয়ায় তারা ভৈরবে আসতে চেয়েছিল। যখন জানল যে, ভৈরব ও আশুগঞ্জের পতন হয়েছে তখন একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের সাথে আপনার স্ত্রী সীমান্ত পার হয়ে গেছে।

ছেলেটিকে আমি আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে মাঝে মধ্যে দেখেছি এতক্ষণে মনে পড়ল। আমি বললাম, তুমি জানলে কি করে আমার স্ত্রী ইণ্ডিয়ায় পালাতে পেরেছে? তুমি কি আমার স্ত্রীকে চেনো?

ছেলেটি বলল, বারে, আপনি আমাদের লাইব্রেরিয়ান। আমি প্রায়ই সঙ্গীত বিষয়ক বইপত্রের জন্য আপনাকে বিরক্ত করে থাকি। সেখানে আপনার কাছে আপনার ম্যাডামকে আসতে দেখি না বুঝি? আপনি এখন সম্ভবত আমাকে ঠিকমত রিকগনাইজ করতে পারছেন না। তাছাড়া আপনার ভাই আরিফও তো আমার ক্লাসফ্রেণ্ড। আমরা অন্নদা স্কুলের ছাত্র। আমিও তো কাজীপাড়ারই ছেলে।

এবার ছেলেটিকে আমি খানিকটা চিনতে পারলাম। সেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে বলেই তার বক্তব্যে আমার উদ্বেগ কেটে গেল। তাছাড়া আমি আর্টস কাউন্সিলের গ্রন্থাগারিক আর সে সেখানকার স্টাফ আর্টিষ্ট। প্রায়শই হয়তো দেখা সাক্ষাৎ ঘটে। তবে আমার পেশাগত অন্যমনস্কতার দরুণ আমি বোধহয় ছেলেটির প্রতি তেমন মনযোগী ছিলাম না। এখন তার দিকে ভাল করে তাকালাম, তুমি কি ভাল করে জানো, আমার স্ত্রী বর্ডার ক্রস করেছে?

হ্যাঁ জানি। রামরাইলের ব্রীজে মুক্তিযোদ্ধারা শেষ প্রতিরোধ বাঁধিয়েছিল। কিন্ত টেকেনি। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সব শহরবাসী ইণ্ডিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ঐ পালানো লোকদের মধ্যে আমি ও ভাবি ছিলাম। আমরা সিঙ্গারবিলের দিক দিয়ে বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা দুজনের গ্রুপ করে করে হানাদারদের চোখ এড়িয়ে একটা পাহাড়ের টিলায় উঠে যাচ্ছিলাম। টিলার ওপাশেই ভারত। প্রথম গ্রুপেই ছিলেন আপনার স্ত্রী। তখন আমার ভাই আরিফকে আর দেখি নি। এরা টিলায় উঠে নিরাপত্তা সংকেতও পাঠিয়েছিল। এরপর এরা অদৃশ্য হয়ে যায়। অর্থাৎ ভারত বর্ডারের ভেতরে চলে গেলে আমরা আরও দুইজন যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি তখুনি শুরু হল হানাদারদের গুলী। আমি হলপ করে বলতে পারি আপনার স্ত্রী নিরাপদে ভারতের মাটিতে পা দিয়েছেন। তবে তিনি এখনও সেখানে আছেন কিনা, না আবার দেশের ভেতর ফিরে এসেছে, তা আমি জানি না। ছাত্র ও শিক্ষকেরা তো আবার দেশের ভেতর ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি কাজ শুরু করেছে। আপনি এদের জন্য আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করে দেখুন। যারাই আগরতলা থেকে দেশের ভেতরে এ্যাকশানে আসছে তাদের সকলেই তো নারায়ণপুর, রায়পুর ইত্যাদি এলাকায় এসে জমা হচ্ছে। এখানেই ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা রাজনৈতিক ক্যাডাররা বেশি জমা হয়েছে। আপনার ভাইও আসবেন।

এই ঘটনার পর আমিও আরও কয়েকটা দিন নারায়ণপুর আমার আশ্রয়দাতাদের বাড়িতে অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার বোন ও ভগ্নীপতির কাছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মারফত আমার অবস্থানের খবর জানিয়ে আগতলায় চিঠি পাঠালে তারা আনিসের মারফত অবিলম্বে আগরতলায় চলে যেতে চিঠি দেয়। সেই চিঠিই আনিস আমাকে পৌঁছে দিয়ে এখন আমাকে এনে নৌকায় তুলেছে।

এসময় মেয়ে দুজন এসে আমার হাত ও কাঁধ জড়িয়ে ধরলো, না, আপনি কেন আমাদের জন্য নেমে যাবেন। আমরা দুটি মাত্র প্রাণী উঠলে আর এতবড় লম্বা নাও ডুবে যাবে না। আমাদের নিতে হবে। অবলা মেয়েমানুষকে আপনারা এখন কোথায় ফেলে যাবেন? অগত্যা আনিসকে রাজি হতে হল। এখন আনিস আমাকে সেই খোটাই দিচ্ছে।

আমি মেয়েটার, আমাকে জড়িয়ে ধরে, এই ফোঁপানি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। নৌকায় ওঠা অবধি দুবোনকে সামনে গলুইয়ের কাছে পাটাতনে দুটি ত্রস্ত চড়ুইয়ের মত কাঁপতে দেখছিলাম। কোনো কথা হয় নি। নৌকোর বত্রিশজন যাত্রীর মধ্যে আমি ও আনিস ছাড়া আর সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সকলের চোখ মুখই ফ্যাকাশে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঠের মতো নিষ্ক্রিয়, অসাড়। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। একবার আমি ভয়ে নিশ্চল মেয়ে দুটিকে তাদের পরিচয় ও নামধাম জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম তাদের সমস্যাও আমার মতোই। তারাও তাদের অভিভাবককে হারিয়ে খুঁজছে। তার নাম অজয় আড়তদার। অনেক টাকা নিয়ে সে ঢাকায় মাল কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। সেও কি ঘটনাচক্রে বা দৈবক্রমে ভারতেই পালিয়েছে? আমি একবার এদের পরিচয় জানতে গিয়ে এদের কার কী নাম তা জিজ্ঞেস করতেই ছোটো বোনটি আগে জবাব দিল, আমি নন্দিনী। আর ইনি আমার বোন সীমা। ভৈরব রেলওয়ে স্কুলের হেড মিসট্রেস। ২৩শে মার্চ আমার জামাই বাবু ঢাকা গিয়ে আর ফেরেন নি। আমরা এখন কোথায় যাবো, কি করব বুঝছি না। আমাদের বাঁচান।

শেষ বাক্যটা এমন মর্মান্তিকভাবে উচ্চারিত হল যে আমি পর্যন্ত ভয় পেলাম। নন্দিনীর চোখ ভয়ে বিস্ফারিত। দেখতে মেয়েটি গৌর বর্ণের হলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্য তার দিকে চোখ রাখা যায় না। ছিপছিপে দোহারা গড়ন। পরনে একটি ভারতীয় ছাপা শাড়ি। হলদেটে কালো ব্লাউজ। শাড়ির আঁচলে বাহু দুটি ঢাকা থাকায় স্বাস্থ্যের দীপ্তিটা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। তবে নৌকায় বসার ধরন ও নাওয়ের দুলুনিতে অভ্যস্ত থাকার লক্ষণ সহজেই ধরা পড়ে। তার বিশাল বেণী যেন নদীতে একটা সাপ নেমে যাওয়ার কসরৎ করছে।

সীমা দীর্ঘাঙ্গী ও একটু আলুথালু। শাড়ির আঁচল অসাবধানে বুক থেকে সরে যাওয়াতে তার পূর্ণ নারীরূপ আমি একবার দেখে ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। তার বর্ণও গৌর। নাক টিকলো। চোখে শিক্ষিকার অপরিহার্য চশমা। সম্ভবত চোখ তেমন খারাপ নয়। ভ্রূরেখা স্পষ্ট। চুল খোঁপায় শক্ত করে টেনে বাঁধায় দৃষ্টি একটু উদভ্রান্ত হলেও চিবুকের গড়নটা দৃঢ়চেতা মহিলার মতো।

হঠাৎ গুলীর শব্দ খুব কাছে চলে এল বলে মনে হল। প্রচণ্ড শব্দ। এতক্ষণ আমাদের দক্ষিণ পাশ থেকে অর্থাৎ আখাউড়ার দিক থেকে আসছিল। এখন মনে হয় নদীর ভেতর থেকে শব্দটা আসছে। হানাদাররা কী তবে আমাদের বোট নিয়ে তাড়া করছে। এবার সত্যি আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার পিঠের ওপর সওয়ার হওয়া মেয়েটা ভয়ে চুপ হয়ে গেল। তবে তার ভেতরে আতংকিত অসহায় অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছিলাম। তার ফোঁপানি ও কান্নার উথলানো ধকলটা তার ভেতরেই গুমরে মরছিল। আমি একটা ভয়ার্ত দেহের কম্পন আমার ঘাড় ও পিঠের ওপর বহন করছিলাম। কিন্তু অবস্থাটা আমার কাছে অসহনীয় মনে হওয়ায় আমি পিঠের ওপর থেকে তাকে গায়ের জোরে একপাশে নামিয়ে এনে নৌকার পাটাতনে আতে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম। আনিসকে উদ্দেশ করে বললাম, এখন উপায়?

আনিস আমার কথার জবাব না দিয়ে নৌকার সকল যাত্রীর দিকে গম্ভীর গলায় বলল, পাঞ্জাবিরা বোট নিয়ে এদিকে আসছে। সাবধানে কেউ একটু টুঁ শব্দ করবেন না। নৌকায় যারা জোয়ান পুরুষ আছেন সকলেই পানিতে নেমে পড়ুন। বুক পানির বেশি হবে না। ঐ নদীর পার এদিকেই হবে বোঝা যাচ্ছে। এই মাঝি, তুমিও নামো। নাও ঠেলে দ্রুত কিনারায় নিয়ে যেতে হবে। মেয়েরা আর বাচ্চারা নৌকায় থাকবে। সাবধান, হুটোপুটি করে সবাইকে ধরিয়ে দেবেন না।

আনিসের কথায় আমি নিঃশব্দে পানিতে নেমে গেলাম। তার আন্দাজ ঠিকই। এখানে বুক পানির মধ্যে পা মাটিতে ঠেকলো। আমরা দ্রুত নৌকাটাকে বাঁদিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলাম। চতুর্দিকে মিশমিশে অমাবস্যার অন্ধকার থাকলেও নদীর তীরটা ঠাহর করা যাচ্ছে।

আনিসের ধমকে এবং গুলীর ক্ষণ-বিরতির ফাঁকে নৌকার সমস্ত আরোহীরাই ভয়ে পাথর হয়ে আছে। কারো কোনো সাড়া বা নড়াচড়া নেই। আমি পানির ভেতর দিয়ে সর্বশক্তিতে নৌকাটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আনিস বলল, সামনেই ঘাট। আমাদের লোকজন থাকার কথা। থাকলে রক্ষা, না থাকলে আন্দাজে চলতে হবে।

অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা নৌকা টেনে পাড়ে এনে ভিড়ালাম। না, এখানে কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষায় নেই। নাওটা পাড়ে এসে লাগামাত্র সকলেই অন্ধকারে একসাথে তীরের দিকে লাফিয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই নদীর তীরে ঝোপ জঙ্গল থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল আমার ও আনিসের মুখের ওপর। একটা লোক টর্চের আলোর ভেতর একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল আমাদের দিকে তাক করে এগিয়ে এল, খবরদার কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। আমরা নৌকাটা সার্চ করবো। কারো কাছে হাতিয়ার থাকলে আমাকে দিয়ে দাও। আমরা কারো ক্ষতি করবো না।

আমাদের কারো বুঝতে বাকি রইল না যে আমরা কাদের হাতে পড়েছি। আনিস মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে পানির নিচ দিয়ে পা বাড়িয়ে আমাকে ইশারা করলো। আমি অন্ধকারের দিকে ফেরা মাত্রই সে তার এস. এল. আরটা কাঁধ থেকে ডান হাতে নিয়ে খুব আস্তে করে নৌকার তলায় ডুব দিল। আনিসের সাহস দেখে আমি হতভম্ব হয়ে নৌকা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এ সময় টর্চঅলা লোকটা, যার মুখ আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছিলাম না, আমার দিকে আলো ফেলে হেঁকে উঠল, এই তোমার পাশের মানুষটা কোথায়? ডুব দিয়ে পালিয়েছে নাকি? আমি ত্বরিৎ সাহসে বলে উঠলাম, না বোধ হয়। সে ভয় পেয়ে বেহুঁশ হয়ে ডুবে গেছে। তাকে দয়া করে পানিতে নেমে তাড়াতাড়ি খুঁজে বার করুন। তা না হলে মরে যাবে।

মরে যাবে না, জাহান্নামে যাবে।

আমার মুখ থেকে টর্চের আলো সরিয়ে লোকটা বিদ্রূপ করে উঠল। ততক্ষণে তার টর্চের আলো এসে পড়েছে নদীর পাড়ে লাফিয়ে পড়া যাত্রীদের ওপর।

খবরদার কেউ নড়বে না।

সব অসহায় নারী পুরুষ তখন ভয়ে স্তন্ধ। লোকটা টর্চের আলো ফেলল সীমার ওপর। সে তখন নৌকা থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়েছে। লোকটা অনেকক্ষণ তার ওপর টর্চ জ্বেলে রাখল। নন্দিনী তখনও নৌকায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আমি একটু আগে অন্ধকারে বুঝতেই পারি নি কে আমার কাঁধ জড়িয়ে ফোঁপাচ্ছিল। এখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে নন্দিনীই গুলীর শব্দে ভয় পেয়ে শেষ অবলম্বনের মত আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।

লোকটা আবার আলো নৌকার ওপর ফেলল। আলোটা নৌকার ওপর পড়া মাত্রই আমি বললাম, এখানে আরও একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে।

কিন্তু আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই নন্দিনী উপুড় হয়ে থাকা অবস্থায় থেকে মাথা তুললে টর্চের আলোর বৃত্তটা নন্দিনীর মুখের ওপর এসে স্থির হল। লোকটা অনেকক্ষণ অসভ্যের মতো আলোটা নন্দিনীর মুখের ওপর স্থির করে রাখায় নন্দিনী আর চোখ ফেলতে পারছিল না। এই অসভ্যতা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আলোটা সরান। দেখছেন না চোখ মেলতে পারছে না?

টর্চটা নিভে গেল।

সবাই ওপরে উঠে এসো।

লোকটা আদেশ করল। টর্চের অপর্যাপ্ত আলোয় আন্দাজ করলাম এরা সংখ্যায় মাত্র চার-পাঁচজনের বেশি হবে না। সবার হাতেই থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রত্যেকটা অস্ত্রের মুখই আমাদের দিকে ফেরানো। আমি নৌকার গলুইটা যাতে নদীর পারের মাটিতে ঠেকে সে কারণে নৌকাটি ধাক্কা দিলাম। নন্দিনী যাতে শাড়ি না ভিজিয়ে ডাঙায় নামতে পারে সে জন্যই অবশ্য নৌকাটাকে ঠেলে দিলাম। লোকটা হাত বাড়িয়ে নাওয়ের মাথাটা ধরলো। আর এক লাফে নৌকায় উঠে এসে নন্দিনীর চুলের খোঁপা মুঠো করে ধরে টান দিল, নেমে আয় মাগী, নেমে আয়। বেহুঁশ হওয়ার পরে অনেক মওকা পাবি।

চুলের মুঠো ধরে টেনে লোকটা নন্দিনীকে নৌকা থেকে পাড়ে নামিয়ে আনল।

আমি তখন পানি থেকে ভেজা কাপড় নিয়ে ডাঙার দিকে পা বাড়ালাম। লোকটির অন্যান্য সঙ্গীরা একটুও কথা বলছে না বা আনন্দ প্রকাশ করছে না। এখন অন্তত চার পাঁচটা টর্চ এক সঙ্গে জ্বলে উঠল নৌকা আর ডাঙায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের ওপর। নারী-শিশু ও বৃদ্ধ মিলিয়ে প্রায় ৩৪টি প্রাণী। সবাই ভয়ে কাঁপছে। এমন কি শিশুরাও বুঝতে পেরেছে আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গেছি। আমাদের আর রেহাই নেই।

আমি ডাঙায় উঠে দাঁড়ানো মাত্রই একজন বন্দুকধারী লোক টর্চের আলো আমার মুখের কাছে এনে বলল, এই মেয়েটা তোমার বোন?

আমি চট করে মিথ্যা কথা বললাম, না, আমার বৌ।

ও।

আমি বললাম, আমরা আগরতলা যাবো। আমাদের কেন আটকেছেন? আমাদের ছেড়ে দিন, তা না হলে আপনাদের বিপদ হবে। কারণ আমাদের নিয়ে যেতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এখানেই থাকার কথা। সম্ভবত তারা আশেপাশেই আছে। আমাদের ছেড়ে দিলে আমরা আপনাদের ক্ষতি করতে দেব না।

কথাগুলো বলে আমি নদীর পানির দিকে তাকালাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। তবে আবছায়ার মত দূরে দূরে কচুরিপানার ঝোপগুলো বোঝা যায়। আমি আনিসের ডুব দিয়ে পালানোর পর কোথায় গিয়ে ভেসে উঠতে পারে তা মনে মনে আন্দাজ করছিলাম। সম্ভবত সে এসব কচুরিপানার ঝোপের মধ্যেই চুপচাপ মাথা জাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা ডাঙায় উঠে পালিয়েছে।

আমার কথায় লোকটা প্রথমে কোনো জবাব দিল না। পরে সামনে এগিয়ে এসে বললো, তোমরা হারামির বাচ্চা। ভারতের দালাল। দেশটাকে হিন্দুদের কাছে বেচে দিতে যাচ্ছো। সবকয়টাকে কুত্তার মত গুলী করে মারবো। যাও, সবগুলো একঠাঁই জমা হয়ে দাঁড়াও।

লোকটা আমার কাঁধে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে একটা ধাক্কা মারল। আমি অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে ছিটকে পড়লাম। মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে হাত বাড়িয়ে কে যেন আমাকে ধরলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, কে?

আমি সীমা।

আমি বললাম, আপনার বোন কোথায়, নন্দিনী? অনুচ্চকণ্ঠে আমার প্রশ্ন শুনে পাশ থেকে নন্দিনী জবাব দিল, এই তো আমি। এরা কি আমাদের গুলী করবে?

আমি কোনো জবাব দিলাম না। কীই বা বলবার আছে? লোকগুলো যে আশপাশ এলাকার মাস্তান ধরনের লোক তা বুঝতে পারলাম। এটা যে মুকুন্দপুর স্টেশনের কাছাকাছি কোনো এলাকা আমি তা আন্দাজ করেছিলাম। কাছেই হয়ত কোথাও বামুটিয়া বাজার। এখন অন্ধকারে কোনো কিছু বুঝতে পারছি না। নন্দিনী ও সীমা আমার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে যেন একটু নির্ভরতা নিয়ে দাঁড়াল। আমি ফিসফিস করে নন্দিনী ও সীমাকে বললাম, জায়গাটা আমার চেনা লাগছে। কাছেই খাটিঙ্গা নামের একটা গাঁয়ে আমার জ্ঞাতিকুটুম্বদের বাড়ি। ভাবছি আত্মীয়দের পরিচয় দেব কিনা। এলাকাটা সম্ভবত আমার দাদার মুরীদদের এলাকা।

নন্দিনীরা কোনো জবাব দিতে পারল না। একটা হতভম্ব ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমাদের ঘিরে নারীশিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধসহ পুরো দলটা। রাইফেলধারী লোকগুলো আমাদের থেকে চারপাঁচ হাত দূরে। অন্ধকারে অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে এরা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। যে লোকটা একটু আগে আমাদের গুলী করার ভয় দেখাচ্ছিল সে একটা সিগ্রেট রাতে দেশলাই জ্বালালে আমি তার মুখটা এক ঝলক দেখতে পেলাম। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ফর্সাই মনে হল। বয়েসও আমার মতই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। সিগ্রেট ধরিয়েই সে আমার দিকে এগিয়ে এল, বৌয়ের সাথে ফিসফিস করে কি বলছিলে? কোন্ গায়ে তোমার আত্মীয় আছে?

খাটিঙ্গা আবু সর্দারের বাড়ি। নাসির মাষ্টার আমার চাচাতো ভাই।

মুহূর্তে আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। লোকটা টর্চ আমার মুখের ওপর ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে আলোর গোলটাকে নামিয়ে আনল পায়ের ওপর। আলোটা এখন আমার নগ্ন পায়ের পাতায় স্থির হয়ে আছে। নৌকা থেকে পানিতে নামার সময় জুতো খুলে ফেলেছিলাম। পায়ের পাতা দুটি এখনো শুকোয় নি।

তোমরা কোথা থেকে এসেছো?

নারায়ণপুর বাজার থেকে।

সেটা আবার কোথায়?

ভৈরব বাজারের কয়েক মাইল পেছনে। ঢাকা জেলার রায়পুরা থানা এলাকা।

আমি জবাব দিলাম। লোকটা সিগ্রেটে পরপর কয়েকটা সুখটান মেরে বলল, তুমি কোথাকার লোক, কি নাম, কি কর?

আমি বললাম আমার নাম হাদী। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমি কবিতা-গল্প লিখি। ঢাকায় পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান।

সরকারি চাকুরি?

বললাম, হ্যাঁ।

কবি সাহিত্যিক মানুষ সরকারি চাকুরি ফেলে কেন আগরতলা যাচ্চো? মালোয়ানের গোলামি করতে চাও?

আমি চুপ করে রইলাম।

বি. এস. এফ ক্যাম্পের ট্রেনিংয়ে দু’একটা ব্রাস ফায়ার আর হাতবোমা মেরে ভেবেছো পাকিস্তান ভেঙে ফেলবে? পারবে না।

লোকটা সিগ্রেট ফেলে দিল। আবার অস্পষ্ট অন্ধকারে তার মুখ ঢেকে গেল।

পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করবো আমরা। সর্বহারা পার্টি। সিরাজ শিকদারের নাম শুনেছো?

আমি বললাম, তার নাম সবাই জানে।

ভবিষ্যতে আরও জানবে। তিনিও কবি।

বেশ দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো উচ্চারণ করল লোকটা। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক আমরা রাজাকার বা আলবদরের হাতে পড়ি নি। কেন যেন মনে হল এরা আর যাই করুক আমাদের জানে মারবে না কিংবা মেয়েদের বেইজ্জত করবে না। আমি মনে মনে ইন্নু কুনতু মিনাযজলেমিন পড়তে লাগলাম। লোকটা ততক্ষণে তার ক্ষুদ্র সশন্ত্র গ্রুপটির কাছে এগিয়ে গিয়ে কি যেন পরামর্শ করল। তারপর ফিরে এসে বলল, তোমাদের গুলী করে মারাই উচিত ছিল। কিন্তু তুমি খাটিঙ্গার যে বাড়িতে আত্মীয়তার দাবি করলে তারা তোমার আত্মীয় হলেও হারামির বাচ্চা নয়। নাসির আমার বন্ধু। তার ভাই আর বৌয়ের ওপর গুলী চালাতে চাই না। আমাদের সামনে থেকে এক্ষুণি পালাও। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়।

লোকটার কথার মধ্যে এমন শ্লেষ ছিল আমরা যেন চাবুক খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না কোনদিকে যাব। এখনও অন্ধকার কাটে নি। ঝিঁঝি পোকার তীক্ষ্ণ শব্দে রাতের গভীরতা বোঝা যায়। কোনোদিকে পায়ে চলার কোনো পথ ঠাহর করতে পারছি না। আমি বুকে সাহস এনে লোকটাকে বললাম, আমরা তো পথঘাট চিনি না। কোন দিকে যাব অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না। বর্ডারে যাওয়ার পথটা একটু দেখিয়ে দিয়ে গেলে ভালো হয়।

আমার কথায় লোকটা আবার টর্চের আলো ফেলল আমাদের ওপর। আলোটা প্রথম সীমার মুখ থেকে নন্দিনীর মুখে। তারপর সরে এল আমার মুখে।

একটু আগে যে মুক্তিদের ভয় দেখাচ্ছিলে তারা কোথায়?

লোকটা একটু এগিয়ে এল আমার দিকে। আলোটা এখনও আমার মুখের ওপরই আছে। চোখ মেলতে পারছি না।

আমি বললাম, তারাইতো আমাদের নদীর পাড় থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। এখানে থাকার কথা।

আনিসের কথা বলতে গিয়েও বললাম না। কি জানি একজন সশন্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথেই ছিল একথা বলে আবার কোন বিপাকে পড়ি। লোকটা হঠাৎ আলো নিভিয়ে অন্ধকারের মধ্যে বলে উঠল, জাহান্নামে যাও। আমরা তোমাদের হিন্দুস্তানের পথ দেখিয়ে দিতে পারি না।

কথাগুলো বলে তার রাইফেলধারী গ্রুপ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর তক্ষুণি আকাশে গুড়গুড় শব্দে বিদ্যুতের কয়েকটি চমক হেনে ঝমঝম শব্দে নেমে এল বৃষ্টি। আমরা সকলেই সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। এতক্ষণ পরে আমাদের দলের দুএকটা বাচ্চা কেঁদে উঠল। নৌকায় থাকতে আনিসের ভয়ে এতক্ষণ সবাই চুপ মেরে ছিল। পরে ধরা পড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড আতংক সকলকেই প্রায় বোবা করে রেখেছিল। এখন সেই নৈশব্দে ফাটল ধরেছে। সীমা আমার হাত ধরে বলল, চলুন আমরা সকলেই হাত ধরাধরি করে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করি। দেখা না গেলেও পথ তো একটা আছে?

আমি বললাম, সেটা মন্দ নয়, তবে এতগুলো বুড়ো মানুষ আর বাচ্চাকাচ্চা লাইন বেঁধে ঠিক মতো ঠিক ডিরেকশনে চলতে পারবে তো?

ডিরেকশন আবার কি, আমরা সামনের দিকে সমানে হাঁটতে থাকব। সামনে থাকবেন আপনি। আমরা একে অন্যের কাপড়ের খুঁট ধরে হাঁটতে থাকবো সকাল হওয়া পর্যন্ত কোথাও না কোথাও গিয়ে তো পৌঁছুব?

এ হল নন্দিনীর কথা যদিও তার মুখে দেখা যাচ্ছে না তবুও তার মরিয়া-ভাবটা পাশে থেকে আমি টের পেলাম। তার প্রস্তাব শেষ হওয়া মাত্র আমাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলে উঠল, সাব আমার ভাড়াটা দিন। আনিস সাবেরে এখন কই পামু। তার সাথে কথা হইছিল জনপ্রতি সত্ত্বর টাকা। বাচ্চা কাচ্চার কোনো পয়সা লাগবে না। ভাড়া পাইলে আমি পোলাডারে লইয়া নাও ভাসাই। আল্লাই জানে আন্দাইর নদীতে আমাগো কপালে কী আছে। হুনলেন তো পাঞ্জাবিরা বোড ভাসাইয়া গুলী চালাইতেছে। আমরা তো আর নাও চালাইয়া ইণ্ডিয়া যাইতে পারুম না।

মাঝির দাবি সকলেরই কানে ঢুকলেও কেউ কিছু বলছে না। বলবেই বা কি, সকলেই প্রবল বর্ষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাউয়ার মতো ভিজছে। টাকাটা অবশ্য দিনের বেলায় নদীতে থাকতেই শোধ করে দেওয়া উচিত ছিল। এখন বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গাট্টিবোস্কা খোলার যেন কারো কোনো শক্তি বা বা প্রবৃত্তি নেই।

আমি বললাম, আপনারা একটু কষ্ট স্বীকার করে মাঝির টাকাটা দিয়ে দিন। বেচারা গরিব। আমাদের জন্য যথেষ্ট রিস্ক নিয়েছে। আপনারা ভাড়ার ব্যাপারে যে যেই কথাবার্তা বলে এনেছেন এখন তা শোধ করে দিন। আমরা এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সামনে এগোব।

আমার কথায় কাজ হল। বৃষ্টির তোড় ও মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যেও অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিগুলোর একটু নড়ে ওঠার আভাস পেলাম। যেন এই আতংকের মুহূর্তে তারা কারো আদেশেরই অপেক্ষা করছিল। মানুষ সর্ব অবস্থায়ই সম্ভবত একটা নেতৃত্ব কামনা করে। একটা কণ্ঠস্বর শুনতে চায় যা অপেক্ষাকৃত প্রবল এবং নির্ভরশীল।

আন্দাজে একে একে সকলেই ভাড়ার টাকা হাতড়ে হাতড়ে আমার হাতে খুঁজে দিতে লাগল। আমি অভিভূত হয়ে অন্ধকার আর বৃষ্টির ঝরঝরানির মধ্যে এইসব বিপদগ্রস্ত ও মৃত্যু তাড়িত মানুষের সততায় মুগ্ধ হয়ে থাকলাম। আমার হাতের ভেতর টাকাগুলো ভিজতে লাগল। নন্দিনী আমার বাঁ দিক থেকে বলে উঠল, এই নিন। এখানে দুশোর দুটি নোট আছে। ভাংতি খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝিকে দিন।

আমি এগিয়ে গিয়ে মাঝির হাতে টাকাগুলো তুলে দিলাম। নিজের পকেট থেকেও একশোর একটি নোট।

আশাকরি এখানে যা আছে তাতে হিসেবে কম পড়বে না। যদি কিছু কম হয় আমাদের মাফ করে দিও।

আল্লাহ আপনেগো সহিসালামতে পৌঁছাক। আমরা গিয়া নাও ভাসাই। আয়রে বাজান।

মাঝি তার ছেলেটিকে হাতড়ে খুঁজে পেয়ে পাড়ের ঢালুতে নেমে গেল। আমরা অন্ধকারে বৈঠার শব্দ শুনতে পেলাম।

আমরা লাইন বেঁধে এক জনের পেছনে একজন এভাবে হাঁটছিলাম। যদিও ভোর হয় নি তবে বৃষ্টিটা ধরেছে। মনে হয় এখন ইলশেগুঁড়ির মত ঝরছে। আমাদের সবার চোখও অন্ধকারের মধ্যে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। পথ দেখতে না পেলেও গাছপালা বা ঝোপজঙ্গলের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হচ্ছে না। আমি সবার আগে। আকাশের পাখির ঝাঁকের সর্দার পাখিটির মতো। আমার পেছনে সীমা আমার বেল্ট ধরে। তারপর নন্দিনী বোনের শাড়ির খুঁট আঙুলে জড়িয়ে হাঁটছে। এভাবেই পুরো দলটা একের কাপড় ধরে অন্যে।

এটাই পথ কিনা জানি না, তবে পায়ের তলার মাটি, কাদা ও পানিতে ভয়ানক পিচ্ছিল। এখানকার লালমাটি বৃষ্টিবাদলে ভিজলে এমনিতেই হাঁটা মুস্কিল। আর চলছি পায়ে হাঁটা পথের হদিস হারিয়ে। আমি পা টিপে ভর রেখে এগোতে পারলেও সীমা পা পিছলে বার বার পড়ে যাচ্ছিল। সাথে নন্দিনীও। কোমরের বেল্টে হেঁচকা টান পড়লেই আমি বুঝতে পারতাম সীমা হুমড়ি খেয়েছে। বেল্টটা ছুটে গেলে আমি আবার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিই।

এভাবে ঘন্টাখানেক চলার পর হঠাৎ একটা মাঠের মতো ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। মনে হল ছেলেদের খেলার মাঠ। মাঠে ঢোকার আগে আমি একটু দাঁড়ালাম। পোশাকআশাক বৃষ্টির পানিতে এখনও সপসপ করছে। মাঠের ভেতর থেকে বাতাসের ঝাপটা এসে আমার গায়ে লাগাতে হঠাৎ শীত করতে লাগল। আমি পেছন ফিরে বললাম, আমরা যদি ঠিকমতো এসে থাকি তবে বর্ডারের খুব কাছাকছি এসে গেছি। আপনারা কেউ হল্লাচিল্লা করবেন না। আমরা সামনের এই ফাঁকা জায়গাটায় ভোর না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেব। মনে হচ্ছে এটা কোনো গাঁয়ের খেলার মাঠ। সামনে যে গাছপালার মতো দেখা যাচ্ছে এর আড়ালে নিশ্চয়ই মানুষের বাড়িঘর আছে। এসব এলাকার লোকজন ভালো নয় বলে জানি। আমরা ইণ্ডিয়ায় যাচ্ছি শুনলে লুটতরাজ করে সব কেড়ে নেবে। ধরিয়েও দিতে পারে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আকাশ একটু খুললেই গাঁটা পেরিয়ে যাব। মানুষজন জাগার আগেই। আপনারা আমার পেছনে কথাবার্তা না বলে এগোন।

সীমা বলল, দাদা, যদি গাঁয়ের মানুষ বদলোক হয়ে থাকে তবে তো ভয়ের কথা। চলুন না কষ্টেসৃষ্টে গাঁটা পার হয়ে যাই।

আমি বললাম, এই গাঁ পেরুলেই যে ইণ্ডিয়ান বর্ডার পাব এটাতো জানি না। একটু ফর্সা হলে এলাকাটা সম্বন্ধে আমরা একটা ধারণা পাব। হয়তো আমরা বর্ডারের খুব কাছেই আছি। কিংবা এর মধ্যেই বর্ডার পেরিয়ে ত্রিপুরার ভেতরে চলে এসেছি। একটু সকাল না হলে আর এগোনো ঠিক হবে না।

আমার কথা শুনে পেছন থেকে সকলে একবাক্যে সীমার কথার প্রতিবাদ করল, না আমরা মাঠে একটু জিরাবো। আর চলতে পারছি না বাবা।

আমি দলটাকে নিয়ে মাঠের মাঝামাঝি চলে আসা মাত্র সামনের গাছপালার ভেতর থেকে আচমকা একটানা গুলীর শব্দ ফেটে পড়ল। আমি মুহূর্তমাত্র হতভম্ব না থেকে চীৎকার করে বললাম, শুয়ে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন। আপনারা শুয়ে পড়ুন। নন্দিনী, সীমা–

আমার মাটিতে লুটিয়ে পড়া শরীরের ওপর মেয়ে দু’জন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সীমা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, দাদা, আমাদের বাঁচান। আমাদের ফেলে রেখে চলে যাবেন না।

আমি সীমার কানের কাছে মুখ রেখে বললাম, ভয় নেই, আপনাদের ফেলে পালাব না।

আমার কথা নন্দিনীরও কানে গেল সে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, আমাদের ফেলে পালালে ভগবানের কাছে দায়ি থাকবেন। নদীর ঘাটে আমি আপনার কে হই যেন বলেছিলেন, মনে রাখবেন। আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছিলাম, আপনি কবি সৈয়দ হাদী মীর। আপনার সব বই আমার কাছে আছে, জানেন? আমিও লিখি।

গুলীর শব্দ হঠাৎ থেমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *