কানা বেড়াল

ভলিউম ০০৯ – কানা বেড়াল – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল ১৯৯০

০১.

কাজে ব্যস্ত কিশোর পাশা আর মুসা আমান, এই সময় বড় বড় দুটো কাঠের গামলা নিয়ে তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপে ঢুকলেন রাশেদ পাশা। ছেলেদের সামনে এনে মাটিতে রাখলেন ওগুলো। কোমরে হাত দিয়ে বললেন, কাজ নিয়ে এলাম। রঙ করতে হবে। লাল, নীল আর সাদা ডোরা।

ওই গামলায় রঙ? অবাক হলো মুসা।

এখন? হাতের স্ক্রু-ড্রাইভার নেড়ে বললো কিশোর।

তিন গোয়েন্দার জন্য একটা কি-জানি-যন্ত্র বানাচ্ছে কিশোর, ওয়ার্কবেঞ্চে রাখা ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো দেখিয়ে বললো মুসা।

নতুন আবিষ্কার? আগ্রহী হলেন রাশেদ পাশা, ক্ষণিকের জন্যে ভুলে গেলেন গামলার কথা।

কি জানি? হাত নাড়লো মুসা। আমাকে কিছু বলে নাকি? আমি তো শুধু ওর ফাইফরমাশ খাটছি।

পরে করলে হয় না, চাচা? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

না, আজ রাতেই দরকার। ঠিক আছে, তোমরা না পারলে বোরিস আর রোভারকে গিয়ে বলি, মিটিমিটি হাসি রাশেদ পাশার চোখের তারায়। কিন্তু তাহলে গামলাগুলো ডেলিভারিও দেবে ওরাই।

সতর্ক হয়ে উঠলো কিশোর। মানে?

রাশেদচাচার সারা মুখে হাসি ছড়ালো। ধরো, ওই গামলাগুলোকে সিংহের আসন বানানো হলো। কেমন হবে?

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো মুসা, সিংহেরা শুধু এই তালেই আছে। কখন লাল-নীল চেয়ারে বসবে।

কিশোর হাসছে না। চোখ উজ্জ্বল। ঠিক বলেছো, চাচা, খুব ভালো হয়। উপুড় করে বসালে চমৎকার সীট হবে সিংহের…তবে অবশ্যই সার্কাসে!

খাইছে! সার্কাস! হাসি মুছে গেল মুসার মুখ থেকে। গামলা-ডেলিভারি দিতে গেলে সার্কাসের ভেতরটা ঘুরিয়ে দেখাবে আমাদেরকে?

ঠিক সার্কাস নয়, হাসিমুখে খবর জানালেন রাশেদ পাশা। কারনিভল। আমাদের দেশের মেলা আরকি। নানা রকমের খেলা, আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা আছে। কাল রাতে এসে আস্তানা গেড়েছে রকি বীচে। সিংহ বসার বেদীগুলো নাকি পুড়ে গেছে। মুশকিলে পড়েছে বেচারা লায়ন ট্রেনার। কিসে বসিয়ে সিংহের খেলা দেখায়? অনেক খুঁজেও ওরকম বেদী কোনোখানে পেলো না, শেষে আমাদের ফোন করলো, পুরনো বেদী-টেদী যদি থাকে। নেই, বলেছি। শেষে আমিই পরামর্শ দিয়েছি, গামলা দিয়ে আসন বানানো সম্ভব, কথা থামিয়ে বিশাল গোঁফের কোণ ধরে টানলেন তিনি। ওগুলো পেলে খুব উপকার হবে ওদের। হয়তো ঘুরিয়ে দেখাতেও পারে।

কিশোর! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তাহলে আর দেরি করছি কেন আমরা? রঙ আনো। আমি স্প্রে গান রেডি করছি।

আধ ঘন্টার মধ্যেই রঙ হয়ে গেল। শুকাতে সময় লাগবে। এই সুযোগে সাইকেল নিয়ে রবিনকে খবর দিতে চললো মুসা, রকি বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে, যেখানে পার্টটাইম চাকরি করে রবিন মিলফোর্ড। শুনে, রবিনও উত্তেজিত। সময় আর কাটে না, কখন অফিস ছুটি হবে। ছুটির পর আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। সাইকেল নিয়ে ছুটলো স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

 তাড়াতাড়ি মুখে কিছু গুঁজে রাতের খাওয়া শেষ করলো তিন গোয়েন্দা। সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লো। গামলা দুটো বেঁধেছে কিশোর আর মুসার সাইকেলের ক্যারিয়ারে।

দূর থেকেই চোখে পড়লো কারনিভলের আলো। একটা পরিত্যক্ত পার্কের পাশে অসংখ্য তাঁবু আর কাঠের ছোট ছোট খুপড়ি। সাময়িক তারের বেড়া, যাওয়ার সময় আবার তুলে নিয়ে চলে যাবে। জোরে জোরে বাজনা বাজছে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্যে। ঘুরছে শূন্য নাগরদোলা। একটা পথের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন ভাঁড়।

লায়ন ট্রেনারের তাঁবু খুঁজে বের করতে অসুবিধে হলো না। লাল কাপড়ে সাদা অক্ষরে লিখে বিজ্ঞাপন টানানো হয়েছেঃ কিং–দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান সিংহ। তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একজন লোক, পরনে গাঢ় নীল পোশাক, পায়ে চকচকে বুট; ওদের দেখে এগিয়ে এলো। গোঁফে তা দিয়ে বললো, এসে গেছো! দেখি? ভালো হয়েছে তো?

পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড কখনও বাজে মাল সাপ্লাই দেয় না, কিশোর বললো।

বাহ, হেসে উঠলো লোকটা। একেবারে বারকারদের মতো কথা বলছে, ইয়াং ম্যান।

বারকার কি, স্যার? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

আন্দাজ করো তো, মিটিমিটি হাসছে লোকটা।

বাজি রেখে বলতে পারি, আমাদের কিশোর জানে, ঘোষণা করলো রবিন।

তাকে নিরাশ করলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বারকার হলো, যে সার্কাস কিং কারনিভলের বাইরে দাঁড়িয়ে দর্শকদের জানায়, ভেতরে কি মজার মজার ব্যাপার। হচ্ছে। এটা এক ধরনের বিজ্ঞাপন, পুরনো।

জানো তাহলে, লোকটা বললো। আরও নাম আছে ওদের। কেউ বলে স্পাইলার, কেউ পিচম্যান। যতোই বোঝাও বারকারদের, লাভ হবে না, বাড়িয়ে বলবেই। আসলে ওটাই ওদের কাজ। তবে খুব ভালো আর অভিজ্ঞ বারকারের। মিথ্যে বলার প্রয়োজন পড়ে না, সত্যি কথা বলেই দর্শক আকৃষ্ট করতে পারে। এই আমাদের বারকারের কথাই ধরো না, কিঙের কথা এক বর্ণ বাড়িয়ে বলবে না সে। অথচ যা বলবে তাতেই লোকে দেখার জন্যে পাগল হয়ে উঠবে। সিংহকে ট্র্যাপিজের খেল দেখাতে দেখেছো কখনও?

খাইছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। সিংহ আবার ট্র্যাপিজে উঠতে পারে নাকি?

আমাদেরটা পারে। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখেই দেখবে। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফার্স্ট শো শুরু হবে। এসো, তোমরা আমার মেহমান। টিকেট লাগবে না।…ও, আমি মারকাস। মারকাস দ্য হারকিউলিস।

বাইরে চেঁচিয়ে চলেছে বারকার। ইতিমধ্যেই দর্শক জমেছে কয়েকজন।

নাগরদোলায় চড়লো তিন গোয়েন্দা। কয়েক চক্কর ঘুরে নেমে এলো। ব্রাস রিঙের কাছে এসে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। রবিন আর কিশোর ব্যর্থ হলো, মুসা। পারলো একবার। ভাড়ের ভাড়ামি দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর চললো গেম বুদের। দিকে, যেখানে ডার্ট ছেঁড়া, রিং নিক্ষেপ আর রাইফেল শুটিঙের প্রতিযোগিতা হয়। ই আমার মনে হয় ফাঁকিবাজি আছে, খানিকক্ষণ দেখে বললো রবিন। দেখছো

কি সহজেই জায়গামতো লাগিয়ে দিচ্ছে।

না, মাথা নাড়লো কিশোর। মারতে মারতে ওস্তাদ হয়ে গেছে ওরা। হিসেব করে, মারে…

তার কথা শেষ হলো না। চিৎকার শোনা গেল, ফাঁকিবাজ! দাও, দাও ওটা! আমি পুরস্কার পেয়েছি!

 চেঁচাচ্ছে লম্বা এক প্রৌঢ়, মাথায় ব্লাউচ হ্যাট। পুরু গোঁফ। চোখে কালো কাঁচের চশমা। অন্ধকার হয়ে আসছে, এ-সময় সাধারণত ওরকম চশমা পরে না। লোকে। শুটিং গ্যালারির দায়িত্বে এক সোনালি চুল কিশোর, তাকেই গালিগালাজ করছে লোকটা। ছেলেটার হাতে একটা স্টাফ করা জানোয়ার। হঠাৎ ওটা কেড়ে নিয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে দৌড়ে এলো প্রৌঢ়।

চেঁচিয়ে উঠলো সোনালি চুল ছেলেটা, ধরো, ধরো ওকে! চোর, চোর!

.

০২.

ছেলেটার চিৎকারে পেছনে তাকাতে গিয়ে সোজা এসে কিশোরের গায়ের ওপর পড়লো লোকটা। তাল সামলাতে না পেরে তাকে নিয়ে পড়লো মাটিতে।

আঁউউ করে উঠলো কিশোর।

ছুটাছুটি শুরু করলো কয়েকজন দর্শক। দৌড়ে এলো প্রহরী।

এই, এই, থামো! কালো চশমাওয়ালাকে বললো এক প্রহরী।

উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। জানোয়ারটা বগলের তলায় চেপে রেখে কিশোরকে ধরলো। আরেক হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা লম্বা ছুরি। কর্কশ কন্ঠে হুমকি দিলো, খবরদার, কাছে আসবে না! কিশোরকে টেনে নিয়ে চললো গেটের দিকে।

বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিন আর মুসা। চোরটাকে ধরার জন্যে এগোলো দুই প্রহরী। ওদেরকে দেখে ফেললো সে। ক্ষণিকের জন্যে অসতর্ক হলো, মুহূর্তটার সদ্ব্যবহার করলো কিশোর। ঝাড়া দিয়ে লোকটার হাত থেকে ছুটে দিলো দৌড়। গাল দিয়ে উঠে তাকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালো সে, ধরতে পারলো না। কিশোরের কাঁধে বাড়ি লেগে হাত থেকে ছুটে গেল ছুরিটা। উড়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে।

 তোলার সময় নেই বুঝে সে-চেষ্টা করলো না চোরটা। বগলের জানোয়ার টাকে হাতে নিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলো গেটের দিকে।

প্রহরীরা পিছু নিলো। ছেলেরাও ছুটলো ওদের পেছনে। ঘুরে সাগরের ধার দিয়ে দৌড়াতে লাগলো লোকটা। উঁচু কাঠের বেড়ার এক ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল পরিত্যক্ত পার্কের ভেতরে।

পিস্তল বের করলো দুই প্রহরী। ইশারায় ছেলেদেরকে আসতে বারণ করে নিজেরা সাবধানে ঢুকলো পার্কের ভেতরে। আর ফেরার নাম নেই। অধৈর্য হয়ে উঠলো কিশোর। বললো, নিশ্চয় কিছু হয়েছে। চলো তো দেখি!

বেড়ার ধার ঘুরেই থেমে গেল আবার। প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। চোরটা নেই।

ঘাসে ঢাকা ছোট্ট একটুকরো খোলা জায়গা। ডানে উঁচু বেড়া, বাঁয়ে মহাসাগর। পানিতে গিয়ে নেমেছে বেড়ার একমাথা। বেড়ার ওই অংশ কাঠের বদলে চোখা শিকের তৈরি। ওরা যেদিক দিয়ে ঢুকেছে, একমাত্র সেদিকটাই খোলা।

গেল কোনখান দিয়ে! বিড়বিড় করলো এক প্রহরী।

সাঁতরে যায়নি তো? রবিন বললো।

না। তাহলে দেখে ফেলতাম।

কিন্তু এখানেই তো ঢুকতে দেখলাম, ভোঁতা গলায় কিশোর বললো।

চারপাশে দেখতে দেখতে আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। দেখো! এগিয়ে। গিয়ে কি একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলো। সবাই দেখলো, সেই স্টাফ করা জানোয়ারটা, যেটা নিয়ে পালাচ্ছিলো চোর। তারমানে ব্যাটা এখানে এসেছিলো।

নিয়ে পালাতে অসুবিধে হচ্ছিলো বোধহয়, রবিন মন্তব্য করলো। ফেলে। গেছে। কিন্তু পালালো কিভাবে?

নিশ্চয় বেড়ায় কোনো ফাঁকফোকর আছে, বললো আরেক প্রহরী।

কিংবা দরজা, বললো দ্বিতীয় প্রহরী।

বেড়ার নিচে সুড়ঙ্গও থাকতে পারে, মুসার অনুমান। বেড়ার একমাথা থেকে আরেকমাথা ভালোমতো খুঁজে দেখলো ওরা। মানুষ পালাতে পারে, এরকম কোনো গুপ্তপথই দেখলো না।

নাহ, কিচ্ছু নেই, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর।

ব্যাটার নিশ্চয় পাখা গজিয়েছে, এক প্রহরী বললো। উড়ে যাওয়া ছাড়া তো আর কোনো পথ দেখি না।

তাই তো, বললো দ্বিতীয় প্রহরী। বারো ফটু উঁচু বেড়া। ওড়া ছাড়া উপায় কী?

 চিন্তিত ভঙ্গিতে বেড়ার ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। সাঁতরে যায়নি বলছেন। বেড়ার নিচে সুড়ঙ্গ নেই। মানুষের পাখা গজানোও সম্ভব নয়। বেড়া পেরোনোর একটাই পথ, ডিঙিয়ে যাওয়া।

মাথা খারাপ! বললো প্রথম প্রহরী। ওই বেড়া ডিঙাবে কি করে?

কিশোর, মুসাও বললো। কিভাবে? বেয়ে ওঠা অসম্ভব।

আমিও তাই বলি, একমত হলো রবিন।

যাওয়ার আর যখন কোনো পথ নেই, অসম্ভবকেই কোনোভাবে সম্ভব করেছে, কিশোর বললো। এছাড়া বিশ্বাস যোগ্য আর কি ব্যাখ্যা আছে?

আর কোনো ব্যাখ্যা দিতে না পেরে এক প্রহরী বললো, চলে যখন গেছে, ওটা নিয়ে ভেবে আর লাভ নেই। আমাদের জিনিস তো ফেলে গেছে। চলো, যাই। জানোয়ারটার জন্যে মুসার দিকে হাত বাড়ালো সে।

বেড়ার দিকে তখন তাকিয়ে আছে কিশোর। প্রহরীর দিকে ফিলো। গ্যালারিতেই যাচ্ছি। আমরাই নিয়ে যাই।

তাহলে তো ভালোই হয়। আমাদের সময় বাঁচে। নিয়ে যাও। আমরা থানায় যাচ্ছি ডায়েরী করাতে।

প্রহরীরা চলে গেল।

গ্যালারির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মুসা বললো, গ্যালারিতে কেন আবার? শুটিং। করে পুরস্কার নিতে?

চেষ্টা করতে দোষ কি? তবে সেজন্যে যাচ্ছি না। যাচ্ছি, সোনালি চুল ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে, জিনিসটা কেন ছিনিয়ে নিচ্ছিলো চোর, মুসার হাতের জানোয়াটার দিকে ইঙ্গিত করলো কিশোর।

এই প্রথম ওটাকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলো তিন গোয়েন্দা। স্টাফ করা একটা বেড়াল, লাল-কালো ডোরা। পা-গুলো বিচিত্র ভঙ্গিতে বাঁকানো, শরীরটাও। হা করা মুখে সাদা ধারালো দাঁত। এক কান খাড়া, আরেক কনি নিচে নামানো। একটা মাত্র চোখ, লাল, আরেকটা কানা। গলায় পাথর বসানো লাল। কলার। এরকম অদ্ভুত বেড়াল জীবনে এই প্রথম দেখছে ওরা।

এই জিনিস চাইছিলো কেন লোকটা? কিশোরের প্রশ্ন। দেখে তো দামি কিছু মনে হয় না।

হয়তো স্টাফ করা জানোয়ার সংগ্রহের বাতিক আছে, রবিন বললো। পছন্দের জিনিস জোগাড়ের জন্যে চুরি করতেও দ্বিধা করে না অনেকে।

 কিন্তু তাই বলে স্টাফ করা বেড়াল? মুসা মানতে পারলো না। তা-ও আবার কারনিভলের শুটিং গ্যালারি থেকে? কতো আর দাম ওটার, বলো?

দামের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না ওরা, কিশোর বললো। কোটিপতি লোকও চুরি করে। কিন্তু আমাদের এই চোরটাকে সেরকম, কেউ মনে হলো না। কে জানে, হয়তো হেরে গিয়ে জেদের বশেই করেছে কাজটা।

হেরে গেলেও অবশ্য আমি করতাম না। তবে, আমাকে ঠকানোর চেষ্টা করলে অন্য কথা…..

 শুটিং গ্যালারিতে ঢুকলো ওরা। কাউন্টারের ওপাশ থেকে হেসে সাগত জানালো ওদেরকে সোনালি-চুল ছেলেটা। কি সাংঘাতিক! চোরটাকে ধরেছে? জিজ্ঞেস করলো সে।

পালিয়েছে, হাতের বেড়ালটা দেখালো মুসা। এটা ফেলে। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিলো সে।

যাবে কোথায়? পুলিশ ধরে ফেলবে, বলতে বলতে রেগে গেল ছেলেটা। পাঁচটা হাঁসের মাত্র তিনটা ফেলেছে, অথচ বলে কিনা আমি ঠকিয়েছি, আবার.. হাসলো সে। আমি রবি কনর। এই বুঁদ আমার। তোমরা কি এ-লাইনের?

চোখ মিটমিট করলো রবিন। মানে?

ও বলতে চাইছে, কিশোর বুঝিয়ে দিলো, আমরাও ওর মতো কারনিভল কিংবা সার্কাসের লোক কিনা।…না, রবি, আমরা অন্য কাজ করি। রকি বীচেই থাকি। আমি কিশোর পাশা…ও মুসা, আমান…আর ও হলো রবিন মিলফোর্ড। তিনজনে একই ইস্কুলে একই ক্লাসে পড়ি, বন্ধু।

খুব খুশি হলাম, তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে যোগ করলো সোনালি-চুল, আমি কিন্তু এ-লাইনের ফুল অপারেটর। পাঙ্ক কিংবা রাফনেক নই।

কি বললো ও? কিশোরের দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো মুসা। ভিনগ্রহের ভাষা?

না, এই গ্রহেরই। পাঙ্ক হলো কারনিভলের শিক্ষানবিস, আর রাফনেক শ্রমিক গগাছের লোক। রবি, তোমার বয়েসে ফুল অপারেটর হওয়া একটু অস্বাভাবিক না?

এই কারনিভলের মালিক আমার বাবা তো, বলেই বুঝলো বোকামি হয়ে গেছে, কথা ঘুরিয়ে ফেললো রবি। বাবা বলে, যেকোনো কারনিভলে ফুল অপারেটরের কাজ চালাতে পারবো আমি। তা তোমরা খেলবে নাকি? পুরস্কার জিততে চাও?

ওই কানা বেড়ালটা জিততে চাই আমি, মুসা বললো।

 বাহ্, ভালো নাম দিয়ে ফেলেছো তো! কানা বেড়াল…হাহ্ হাহ্!

যাও না, দেখো চেষ্টা করে, কিশোর বললো মুসাকে। রবি, বেড়ালটা পুরস্কারের জন্যে তো?

হাসলো রবি। নিশ্চয়। তবে পাঁচ গুলিতে পাঁচটা হসিই ফেলতে হবে। আমি নাম দিয়েছিলাম বাকা বেড়াল, কিন্তু কানা বেড়াল শুনতে ভাল্লাগছে। ঠিক আছে, কানা বেড়ালই সই। ওটা ফার্স্ট প্রাইজ। জেতা কঠিন। তা-ও জিতে নিয়ে গেছে লোকে, চারটে। আর মাত্র একটাই আছে।

বেশ, পঞ্চমটা আমি জিতবো, সদম্ভে ঘোষণা করলো মুসা। এগিয়ে গিয়ে কাউন্টারের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা রাইফেলটা তুলে নিলো।

দাঁড়াও, দাঁড়াও! হাত নাড়লো রবি। প্রায় লাফ দিয়ে এসে দাঁড়ালো কাছে।

.

০৩.

কী? সচকিত হলো মুসা।

পয়সা, হেসে, খাঁটি পেশাদারি ভঙ্গিতে হাত বাড়ালো রবি। আগে পয়সাটা দিয়ে নাও।

এরকম করেই কথা বলো নাকি তুমি? রবিনও অবাক হয়েছে।

পকেট থেকে পয়সা বের করে দিলো মুসা। সেটা হাতে নিয়ে রবি বললো, বাবা বলে, আমার রক্তেই রয়েছে কারনিভল। জাত কারমিভল-ম্যান।

রাইফেল কাঁধে ঠেকিয়ে নিশানা করলো মুসা। সাবধানে টিপলো ট্রিগার পড়ে গেল একটা খেলনা হাঁস। পর পর গুলি করে আরও দুটো ফেলে দিলো।

বাহ, ভালো হাত তো তোমার, হাততালি দিলো রবি। সাবধান। এখনও দুটো বাকি।

আবার গুলি করলো মুসা। ফেলে দিলো চতুর্থটা।

আরি! মুসাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্যে বললো রবি, ঘাবড়ে দিয়ে তার হাত কাপিয়ে দিতে চায়। সত্যি জাত কারনিভল-ম্যান, ভুল বলে না তার বাবা। সাংঘাতিক তো! তবে শেষটা ফেলা খুব কঠিন। ভালো মতো সই করো।

রবির উদ্দেশ্য বুঝে কিশোর বললো, কাকে কি বলছো, রবি? আফ্রিকায়। সিংহ শিকারে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ও, উড়ন্ত ঘুঘু ফেলে দেয়, আর এ-তো। কিছুই না। মারো, মুসা, ফেলে দাও। বেড়ালটা আমাদের দরকার।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে রবি। বুঝতে পারছে, বিফল হয়েছে সে। স্থির। হয়ে আছে মুসার হাত, রাইফেল ধরা আঙুলগুলো নিথর। ট্রিগারে আলতো চাপ।

পড়ে গেল পঞ্চম হাঁসটাও।

জিতেছি! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। গলা কাঁপছে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত, গুলি করার সময় অনেক কষ্টে চেপে রেখেছিলো।

দারুণ দেখিয়েছো, মুসা, গোয়েন্দা-সহকারীর পিঠ চাপড়ে দিলো রবি। চমৎকার নিশানা। বেড়ালটা তার হাতে দিতে দিতে বললো, এই নাও, ফার্স্ট প্রাইজ শেষ। নতুন কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যানটিক কয়েকটা ছুরি আছে, ওয়েস্টান কাউবয়রা ব্যবহার করতো।

চোখ চকচক করে উঠলো কিশোরের। ছুরি তার খুব পছন্দ। ওয়েস্টান কাউবয়দের জিনিস শুনে লোভ সামলাতে পারলো না। তাড়াতাড়ি পয়সা বের করে দিলো রবির হাতে। রাইফেল তুলে নিলো।

পাঁচটা ফেলতে হবে কিন্তু, মনে করিয়ে দিলো রবি।

পর পর দুটো হাঁস ফেললো কিশোর। পরের তিনটে মিস করলো। একবারের বেশি সুযোগ দেয়ার নিয়ম নেই, মুখ কালো করে সরে দাঁড়ালো সে।

আমি দেখি তো, রবিন এগিয়ে এলো। পয়সা দিয়ে রাইফেল তুলে নিলো। ছুরিটা পেলে কিশোরকে উপহার দেবে।

সে-ও দুটোর বেশি ফেলতে পারলো না।

ইতিমধ্যে জমে উঠছে কারনিভল, ভিড় বাড়ছে। শুটিং গ্যালারিতেও বেশ লোক জমেছে।

তিন গোয়েন্দাকে অনুরোধ করলো রবি, তোমরা একটু থাকবে এখানে? আমি চট করে গিয়ে ছুরিগুলো নিয়ে আসি। এই কাছেই আছে।

তিনজনকেই থাকতে হবে? মুসা বললো।

কেন, আসতে চাও? বেশ, এসো। ইচ্ছে করলে আরও একজন আসতে পারো। এখানে একজন থাকলেই চলবে।

রবিন, তুমি যাও, কিশোর বললো। আমি থাকি।

গ্যালারির পেছনে দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে এলো রবি। কারনিভলের মূল এলাকার চেয়ে আলো এখানে কম। ছোট একটা ব্যাগেজ ট্রেলার দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।

কাছেই রাখি, কারণ জানালো রবি, চোরের ভয়ে। সুযোগ পেলেই এটা ওটা। নিয়ে চলে যায়। তাই চোখে চোখে রাখতে হয়।

ঢাকনা খুলে ভেতর থেকে একটা পোটলা বের করলো রবি। সেটা থেকে ছুরির বাক্স বের করে রবিনের হাতে দিলো, ধরো, আমি ঢাকনা, হঠাৎ থেমে গেল সে। মুসার পেছনে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড়। কি সাংঘাতিক! একদম চুপ! নড়বে না কেউ! ফিসফিসিয়ে বললো।

ভ্রূকুটি করলো রবিন। বোকা বানানোর চেষ্টা কোরো না, রবি। ওসব। কারনিভলের কায়দা…

চুপ! রবির কণ্ঠে, ভয় মেশানো উত্তেজনা। আস্তে, খুব আস্তে ঘোরো। কিং!

স্থির হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। ঢোক গিললো মুসা। ধীরে ধীরে ঘুরলো দুজনেই। শুটিং গ্যালারির পরে আরেকটা বুদ, কোনো ধরনের খেলা দেখামোর জায়গা। কারনিভলে ঢোকার মূল গলিপথ থেকে দেখা যায় না ওই বুদের পেছনটা। মাঝে ঘাসে ঢাকা একটুকরো ভোলা জায়গা। সেখানে, ছেলেদের কাছ থেকে বড় জোর বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কালো কেশরওয়ালা এক মস্ত সিংহ।

.

০৪.

শুটিং গ্যালারির দিকে পিছিয়ে যাও, নিচু গলায় বললো রবি। তাড়াহুড়ো করবে না। বুনো নয় কিং, পোষা, ট্রেনিং পাওয়া। কিন্তু চমকে গেলে বিপদ বাধাবে। বুদে ঢুকতে পারলেই আমরা নিরাপদ। ফোন আছে ওখানে, সাহায্য চাইতে পারবো।

ছেলেরা ছাড়া আর কারও চোখে পড়েনি এখনও সিংহটা। জুলজুলে হলুদ চোখ। হা করে বিকট হলদে দাঁত দেখালো। ঝাঁকি দিলো রোমশ কালো লেজের ডগা।

 না, রবি, মুসার কণ্ঠ কাঁপছে। রাস্তার দিকে চলে যেতে পারে সিংহটা।

কিন্তু আর কি করবো? মারকাস ছাড়া সামলাতে পারবে না ওকে।

সিংহের চোখে চোখ রাখলো মুসা। ফিসফিসিয়ে বললো, তুমি রবিনকে নিয়ে। চলে যাও। জানোয়ার সামলানোর অভিজ্ঞতা আছে আমার, দেখি চেষ্টা করে। তুমি গিয়ে মারকাসকে পাঠাও।

মুসাআ! বন্ধুকে বিপদে ফেলে যেতে চাইছে না রবিন।

তার কণ্ঠ শুনে মৃদু গর্জন করে উঠলো সিংহটা।

জলদি যাও! ফিসফিসিয়ে জরুরী কণ্ঠে বললো মুসা। তাকিয়ে আছে সিংহের দিকে।

পিছাতে শুরু করলো রবিন আর রবি। ওদের দিকে চেয়ে এক কদম আগে বাড়লো সিংহ। খাঁচা থেকে বেরিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে, অস্বস্তিতেও বোধহয়। শান্ত, দৃঢ়কণ্ঠে আদেশ দিলো মুসা, থামো, কিং। শোও…শুয়ে পড়ো।

চট করে ফিরে তাকালো সিংহ। পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল। হলুদ চোখে সতর্কতা।

এই তো, লক্ষী ছেলে, লক্ষ্মী কিং।

 ধীরে ধীরে লেজ দোলাচ্ছে সিংহ। অচেনা একটা ছেলের মুখে নিজের নাম আর আদেশ শুনে অবাক হয়েছে যেন। কোনো দিকেই তাকালো না মুসা। ক্ষণিকের জন্যেও চোখ সরালো না সিংহের, চোখ থেকে। আবার বললো, শোও…শুয়ে পড়ো, কিং।

এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে গলা সামান্য চড়িয়ে শেষবার আদেশ দিলো, শোও, কিং! কথা শোনো!

চাবুকের মতো লেজ আছড়ালো সিংহ। আশোঁপাশে তাকিয়ে কী যেন বোঝার চেষ্টা করলো, তারপর ধপ করে গড়িয়ে পড়লো ঘাসের ওপর। বিশাল মাথা তুলে বেড়ালের মতো তাকালো মুসার দিকে, ঘড়ঘড় শুরু করবে বুঝি এখুনি।

গুড, কিং।

হঠাৎ পেছনে কথা সোনা গেল। লম্বা পায়ে মুসার পাশ দিয়ে সিংহের দিকে। এগিয়ে গেল মারকাস। হাতে একটা বেত আর একটা শেকল। মোলায়েম গলায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, খানিক আগে মুসা যেরকম করে বলেছিলো। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে কেশরে ঢাকা মোটা গলাটায় শেকল পরিয়ে দিলো। তারপর টানতে টানতে নিয়ে চললো খাঁচার দিকে। সিংহটাও প্রতিবাদ করলো না, শান্ত সুবোধ প্রভুভক্ত কুকুরের মতো চলেছে পিছে পিছে।

ঢোক গিললো মুসা। উত্তেজনা প্রশমিত হতেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখ। বিড়বিড় করলো, খাইছে!

পাশে এসে দাঁড়ালো রবিন, কিশোর আর রবি।

 দারুণ দেখিয়েছো! রবি বললো।

সত্যিই দারুণ, সেকেণ্ড! এভাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সাধারণত করে না গোয়েন্দাপ্রধান, লোকের দোষই বেশি দেখে। আর খুঁতখুঁত করে। কিং যে ছুটেছে, কেউ জানে না। একটা দুর্ঘটনা বাঁচিয়েছো।

এতো প্রশংসায় লজ্জা পেলো মুসা। জবাব দেয়ার আগেই দেখলো ফিরে আসছে মারকাস দ্য হারকিউলিস। কাছে এসে শক্ত করে চেপে ধরলো মুসার কাধ। খুব, খুবই সাহসী তুমি, ইয়াং ম্যান। বলা যায় দুঃসাহসই দেখিয়ে ফেলেছে। এমনিতে কিং শান্ত, কিন্তু লোকে ভয় পেয়ে হৈ-চৈ শুরু করলে ঘাবড়ে যেতো সে। বিপদ ঘটতো।

আরও অস্বস্তিতে পড়লো মুসা, কোনোমতে হাসলো। আমি জানতাম, স্যার, ও পোষা। নইলে কখন, ভাগতাম।

তবু আমি বলবো দুঃসাহস দেখিয়েছো। খাঁচার ভেতর সিংহ দেখেই কতোজনে ভয় পেয়ে যায়। তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে চোখ নাচালো লায়ন। ট্রেনার। কিঙের খেলা দেখবে?

দেখাবেন? উৎসাহে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। কখন?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খেলা শুরু হবে।

নিজের তাঁবুতে ফিরে চললো মারকাস। এখানে আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে, রবি ফিরে গেল তার নিজের বুদে। শুটিং গ্যালারিতে তখন রীতিমতো ভিড় জমেছে।

সিংহের খেলা যে তাঁবুতে দেখানো হবে সেদিকে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। পথে দেখা গেল, দর্শক জমিয়ে ফেলেছে দুই ভাড়। একজন বেঁটে, মোটা। আরেকজন লম্বা, পাতলা নাক, বিষণ্ণ চেহারা, সাদা রঙ মেখে আরও বিষণ্ণ করে ফেলেছে। ভবঘুরে সেজেছে সে। ঢোলা প্যান্টের পায়ের কাছটা বেঁধেছে দড়ি দিয়ে। তার সঙ্গী হাসিখুশি। নানারকম শারীরিক কসরত দেখাচ্ছে, ডিমে তা-দেয়া। মুরগীর মতো বিচিত্র শব্দ করছে গলা দিয়ে।

বিষণ্ণ চোখে সঙ্গীর খেলা দেখছে লম্বা ভড়, তাকে অনুসরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। করুণ করে ফেলছে চেহারা। আবার চেষ্টা করছে, আবার বিফল হচ্ছে। বিষণা থেকে বিষণ্ণতর হয়ে যাচ্ছে চেহারা। তার এই কাণ্ড দেখে দর্শকরা হেসে অস্থির। শেষে, কঠিন একটা খেলা দেখাতে গিয়ে ইচ্ছে করেই ব্যর্থ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়লো বেঁটে ভাড়। অবশেষে হাসি ফুটলো লম্বার মুখে।

 চমৎকার অভিনয়, কিশোর বললো। সে নিজে ভালো অভিনেতা, তিন বছর বয়েসেই অভিনয় করেছে টেলিভিশনে। ফলে কারও ভালো অভিনয় দেখলে ভালো লাগে তার।

সিংহের তাঁবুর দিকে চললো আবার ওরা। তাঁবুর এধারে পর্দা দিয়ে আলাদা। করা। এপাশে দর্শকদের দাঁড়ানোর জায়গা। বড় একটা খাঁচা, মাঝে শিকের আলগা বেড়া দিয়ে আলাদা করা। ভেতরে সেই গামলা: দুটো, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে রঙ করে আনা হয়েছে যেগুলো। খাঁচার ছাত থেকে ঝুলছে একটা ট্রাপিজ।

ছেলেরা তাঁবুতে ঢোকার পর পরই পর্দার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো। মারকাস। দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাউ করে গিয়ে খাঁচায় ঢুকলো। মাঝের বেড়াটা সরিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে ডাকলো। ভয়ঙ্কর বুনো গর্জন করতে করতে খাঁচার এধারে চলে এলো কিং। চক্কর দিতে লাগলো খাঁচার স্বল্প পরিসরে, চোখমুখ পাকিয়ে এসে থাবা মেরে মারকাসকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো।

হাসলো ছেলেরা। বুঝতে পারছে, সিংহটাও অভিনয় করছে ট্রেনারের সঙ্গে। লাফালো, গড়াগড়ি দিলো, নাচের ভঙ্গিতে পা ফেললো, ডিগবাজি খেলো, সব শেষে লাফিয়ে উঠলো ঝুলন্ত ট্র্যাপিজে। চোখ কপালে তুলে দিলো দর্শকদের।

আরিব্বাপরে! মুসা বললো। কতো কি করছে! আমি তো শুধু ওকে শুইয়েছি।

খুব ভালো খেলা দেখাচ্ছে, তাই না, কিশোর? বলে, পাশে দাঁড়ানো কিশোরকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারতে গেল রবিন, কাত হয়ে গেল একপাশে। কারো গায়ে লাগলো না তার কনুই। কিশোর নেই ওখানে।

গেল কই? খোঁজ, খেজ। গোয়েন্দাপ্রধানের দেখা মিললো সিংহের খাঁচার পেছনে, কখন গেছে ওখানে খেয়ালই করেনি দুই সহকারী।

এখানে কি, কিশোর? জানতে চাইলো রবিন।

মুখে কিছু না বলে আঙুল তুলে ট্রেলারটা দেখালো কিশোর, তাঁবুর ভেতরেই থাকে ওটা, পর্দার অন্যপাশে। সিংহের ঘর। খেলা দেখানোর সময় খাঁচায় ঢেকে সিংহটা, অন্য সময় থাকে ট্রেলারটাতে ট্রেলার আর খাঁচা একসঙ্গে যুক্ত, মাঝে শিকের বেড়া। বেড়া সরিয়ে দিলেই ট্রেলার থেকে খাঁচায় চলে আসতে পারে ওটা, বাইরে দিয়ে আসার দরকার হয় না। ট্রেলারের দরজায় বড় তালা লাগানো থাকে। কড়া দেখালো কিশোর। ভালো করে দেখো, বুঝবে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো সে। জোর করে খোলা হয়েছে। ইচ্ছে করেই কেউ ছেড়ে দিয়েছিলো কিংকে।

.

০৫.

তখন থেকেই ভাবছিলাম, বেরোলো কি করে সিংহটা? বললো কিশোর। তাঁবুতে ঢুকে মনে হলো, যাই, দেখিই না। দেখলাম। কিন্তু কথা হলো, মারকাসের অগোচরে কে ছাড়লো কিংকে? তালাটা তুলে দেখালো সে। এই দেখো, চাবির ফুটোর চারধারে আঁচড়ের দাগ, নতুন। বেশিক্ষণ হয়নি খুলেছে।

তুমি শিওর, কিশোর? বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু কিশোরের কথা অবিশ্বাসও করতে পারছে না রবিন।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

কে করলো কাজটা? মুসার প্রশ্ন।

তিনজনেই ভাবছে, এই সময় পর্দার ওপাশে জোর হাততালি শোনা গেল। খেলা শেষ। লাফাতে লাফাতে এসে ট্রেলারে ঢুকলো কিং।

উন্মাদের কাজ, রবিন বললো।

সিংহটার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে কিশোর। উন্মাদ? আমার তা মনে হয় না। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।

যেমন? মুসা জানতে চাইলো।

হতে পারে, দর্শককে ভয় দেখিয়ে কারনিভল করা কিংবা সিংহ পাকড়াও করে হিরো সাজার ইচ্ছে। কিংবা লোকের নজর আরেকদিকে সরিয়ে দিয়ে ফাঁকতালে কোনো জরুরী কাজ সেরে ফেলা।

কিন্তু তেমন তো কিছু ঘটেনি, মুসা বললো।

হিরো সাজতেও আসেনি কেউ, বললো রবিন।

আসার সময়ই হয়তো দেয়নি মুসা। অথবা যে কাজটা সারতে চেয়েছিলো। সেই লোক, সেটার সুযোগ দেয়নি। থামিয়ে দিয়েছে সিংহটাকে।

কারনিভল বন্ধ করতে চাইবে কেন কেউ? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো রবিন। লোকের মারাত্মক ক্ষতি করে? সিংহ ছেড়ে দেয়া ছাড়া কি আর উপায় ছিলো না?

জানি না, বিড়বিড় করলো কিশোর।

 কে করেছে ভাবছো? কারনিভলের কেউ?

মনে হয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো, ট্রেলারের কাছ থেকে বেশ দূরে চলে গিয়েছিলো? যেন, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাকে সেখানে।

মারকাস? জবাবটা নিজেই দিয়ে দিলো মুসা, না, সে নয়। তালা জোর করে খোলার দরকার হতো না তার। নিশ্চয় চাবি আছে।

ধোঁকা দেয়ার জন্যে করতে পারে। রবি গিয়ে বলার পর তবে তার টনক, নড়লো। আরও আগে খোঁজ করলো না কেন সিংহটার? বিশেষ করে, কয়েক মিনিট পরেই যখন খেলা দেখানোর কথা?

জবাব খুঁজে পেলো না দুই সহকারী।

ভ্রূকুটি করে কিশোর বললো আবার, সমস্যাটা হলো, প্রায় কিছুই জানি না আমরা এখনও। কে, কেন করেছে আন্দাজই করতে পারছি না। তবে…

তবে কী? বাধা দিয়ে বললো মুসা। রহস্য মনে করছো নাকি এটাকে? তদন্ত করার কথা ভাবছো?

হ্যাঁ, ভাবছি…, শুরু করেই থেমে গেল সে। ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করলো। বুড়ো আঙুল নেড়ে দেখালো তাঁবুর পেছন দিকে।

বিশাল একজন মানুষের ছায়া পড়েছে তাঁবুর দেয়ালে। চওড়া কাঁধ। কেমন হেলে রয়েছে মাথাটা, তাঁবুর গায়ে কান ঠেকিয়ে ভেতরের কথা শুনছে যেন। ছায়া দেখে মনে হয় না গায়ে কাপড় আছে।

জলদি বেরোও, ফিসফিস করে বললো কিশোর।

তাঁবুর পেছন দিয়ে পথ নেই। সামনে দিয়েই বেরোলো ওরা। ঘুরে তাড়াতাড়ি চলে এলো তাঁবুর এক কোণে, পেছনে কে আছে দেখার জন্যে।

কেউ নেই।

 পালিয়েছে, রবিন বললো।

এই সময় পেছনে শোনা গেল পায়ের শব্দ। এই যে, কানের কাছে গমগম করে উঠলো ভারি কণ্ঠ, তোমরা এখানে কি করছো?

চমকে উঠলো তিনজনেই। ঢোক গিললো মুসা। ফিরে তাকিয়ে দেখলো বিশালদেহী একজন মানুষ। কালো চোখ। কাঁধে ফেলা লম্বা, ভারি একটা হাতুড়ি।

আ-আ-আমরা…, তোতলাতে শুরু করলো মুসা।

রবি এসে দাঁড়ালো মানুষটার পেছনে। তিন গোয়েন্দাকে দেখে উজ্জ্বল হলো: চোখ। বাবা খুঁজে পেলো তাহলে তোমাদের।

তোমার বাবা? আবার ঢোক গিললো মুসা।

হ্যাঁ, খোকা, হাসি ফুটলো তার মুখে, হাতুড়িটা নামিয়ে রাখলেন মাটিতে, হাতল ধরে রেখেছেন। ধন্যবাদ জানানোর জন্যে খুঁজছিলাম তোমাদের। কিংকে সামলে মহা-অঘটন থেকে বাঁচিয়েছো। রাফনেকদের সাহায্য করছিলাম, তাই তখন আমাকে খুঁজে পায়নি রবি।

তোমাদেরকে পুরস্কার দিতে চায় বাবা, রবি বললো।

পুরস্কারের কথায় কানা বেড়ালটার কথা মনে পড়লো মুসার। খাইছে! আমার। বেড়াল! দ্রুত চারপাশে তাকালো সে, বেড়ালটা খুঁজলো। নেই।

বেড়াল? অবাক হলেন মিস্টার কনর।

শুটিং গ্যালারিতে পুরস্কার পেয়েছিলো, বাবা, রবি জানালো। ফার্স্ট প্রাইজ।

সিংহের তাঁবুতে ফেলে এসেছে হয়তো, মুসাকে বললো রবিন।

কিন্তু তাঁবুতে তন্নতন্ন করে খুঁজেও বেড়ালটা পাওয়া গেল না। শুটিং . গ্যালারিতে চললো সবাই। সেখানেও নেই ওটা। এমনকি মুসা যেখানে কিংকে শুইয়েছে সেখানেও নেই।

ছিলো তো, কোথায় রেখেছে, মনে করতে পারছে না মুসা, আমার হাতেই ছিলো। সিংহটাকে যখন দেখলাম, তখনও ছিলো। ভয়ে হয়তো হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছি, কেউ তুলে নিয়ে গেছে।

নীরবে ভাবছিলো কিশোর। কড়ে আঙুল কামড়াচ্ছিল। দাঁতের ফাঁক থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো, মনে করতে পারছো না?

আস্তে মাথা নাড়লো মুসা।

এতো মন খারাপ করছো কেন? মিস্টার কনর বললেন। আরেকটা পুরস্কার দেবো। বেড়ালের চেয়ে ভালো কিছু।

আর চেপে রাখতে পারলো না কিশোর। বলে ফেললো, মিস্টার কনর, আপনার কারনিভলে কোনো গোলমাল চলছে?

গোলমাল? কালো চোখের তারা স্থির নিবদ্ধ হলো কিশোরের ওপর। কেন, একথা কেন?

 এই সিংহের তাঁবুতে আমরা কথা বলছিলাম। এই সময় তার পেছনে একটা লোকের ছায়া দেখলাম, মনে হলো আমাদের কথা আড়িপেতে শুনছে সে।

তোমাদের কথা আড়িপেতে শুনেছে? ভুরু কোঁচকালেন তিনি। তারপর, হেসে উঠলেন। ভুল করেছো। কিং তোমাদের ঘাবড়ে দিয়েছে। ভয় পেলে হয় ওরকম। উল্টোপাল্টা দেখে লোকে, শোনে

জানি, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের কল্পনা নয়। তিনজনেই দেখেছি। আর কিংও নিজে থেকে ছাড়া পায়নি, ট্রেলারের দরজা খুলে। দেয়া হয়েছিলো।

কি যেন ভাবলেন মিস্টার কারসন। এসো, আমার ট্রেলারে। শো দেখানোর জায়গা থেকে খানিক দূরে মাঠের মধ্যে পার্ক করা রয়েছে কারনিভলের লোকদের ট্রাক, ট্রেলার, কার। একটা ট্রাকের পেছনে লাগানো ট্রেলারে থাকে বাপ-ছেলে, মিস্টার কনর- আর রবি। ট্রেলারের ভেতরে দুটো বাংক, কয়েকটা চেয়ার, একটা ডেস্ক–তাতে কাগজপত্র ছড়ানো, ছোট একটা আলমারি, বড় ঝুড়িতে নানারকম বাতিল জিনিস ছেঁড়া স্টাফ করা একটা কুকুর, একটা বেড়াল, কিছু ভাঙা পুতুল।

বাতিল মাল কিনে সারিয়ে নিই আমি, গর্বের সঙ্গে বললো রবি। পরে পুরস্কার দিই।

বসো, ছেলেদের বললেন কনর। সব খুলে বলো আমাকে।

বলার তেমন কিছু নেই, স্যার, কিশোর বললো। তবে কিংকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এটা ঠিক। জোর করে তালা খোলার চিহ্ন আছে।

এমনভাবে কথা বলছে, যেন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, হাসলেন মিস্টার কনর।

গোয়েন্দাই, স্যার, পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিলো কিশোর। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছি আমরা।

কার্ডটা পড়ে মাথা দোলালেন কনর। ভালো। মজার হবি…

ঠিক হবি নয়, স্যার, আমরা সিরিয়াস। বলে পকেট থেকে বের করে দিলো আরেকটা কাগজ, পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেট।

 সেটাও পড়লেন কনর। হু, আসল গোয়েন্দা বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশ তো আর মিছে কথা বলবে না। সে যাই হোক, ইয়াং ম্যান, এখানে কোনো কেস নেই। তোমাদের জন্যে। কোনো রহস্য নেই। তুমি ভুল করেছে।

কিশোর পাশা ভুল করে না, স্যার, ঘোষণা করলো রবিন।

ওরকম জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না, হেসে বললেন কনর। বলতে পারো, সাধারণত ভুল করে না। একেবারেই ভুল করে না, এটা হতে পারে না। মানুষ মাত্রেই ভুল করে।

কিন্তু, বাবা…, বলতে গিয়ে বাধা পেলো রবি।

কনর বললেন, থামো, রবি, অনেক হয়েছে। ওসব কথা আর শুনতে চাই না, উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিশোর ভুল করেছে। তবে আমাদের অনেক উপকার করেছে ওরা, পুরস্কার একটা অবশ্যই দিতে হয়। কারনিভলের তিনটে ফ্রি পাস। তিনটে কার্ড বের করে দিলেন তিন গোয়েন্দার হাতে। কী, খুশি হয়েছে তো?

নিশ্চয়, বললো বটে, হাসি দেখা গেল না গোয়েন্দাপ্রধানের মুখে।

আরি! দরজার দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন।

সবাই তাকালো। পেছনের দরজার পর্দায় মস্ত ছায়া পড়েছে। লম্বা এলোমেলো চুল, চাপ দাড়ি, পেশীবহুল চওড়া কাঁধ।

ওই যে ছায়া! দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস শব্দ বেরোলো মুসার।

ডাকলেন কনর।

ঘরে ঢুকলো একজন লোক। হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেরা। স্বাভাবিক উচ্চতা, কিন্তু দেখার মতো মাংসপেশী। ঠেলে ফুলে উঠেছে নগ্ন কাঁধের। পেশী। পরনে কালো-সোনালি রঙের আটো পাজামা, গায়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে। পায়ে চকচকে বুট। কালো অগোছালো চুল-দাড়ি কেমন যেন বন্য করে তুলেছে। চেহারাটাকে।

ও আমাদের স্ট্রং ম্যান, পরিচয় করিয়ে দিলেন কনর, ওয়ালশ কোহেন। একটা রহস্যের তাহলে সমাধান হয়ে গেল, বয়েজ। কারনিভলে, একজন মানুষ। নানারকম কাজ করে, কোহেনও ব্যতিক্রম নয়। সে আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জ। তোমাদের ঘোরাফেরা দেখে নিশ্চয় সন্দেহ হয়েছিল তার, চুপ করে গিয়ে। দেখে এসেছে কি করছো।

ঠিকই বলেছেন, স্বীকার করলো কোহেন। মোটা, ভারি গলা।

মাথা ঝোকালেন কনর। তো, ছেলেরা, কোহেনের সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে। রবিরও শুটিং গ্যালারিতে যাওয়া দরকার। তোমরা ঘোরো গিয়ে, যা ইচ্ছে দেখো। ফ্রি পাস আছে, কোথাও পয়সা দিতে হবে না।

থ্যাংক ইউ, স্যার, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। ইশারায় রবিন আর মুসাকে। আসতে বলে পা বাড়ালো দরজার দিকে। বাইরে বেরিয়ে সোজা চলে এলো। ট্রেলারের পেছনে।

কি করছো? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

আমি শিওর, কিছু একটা ঘটছে এখানে, নিচু গলায় বললো কিশোর। কোহেনকে সন্দেহ হচ্ছে আমার। প্রহরীর মতো লাগে না। এমনভাবে তাঁবুর কাছে আড়ি পেতে ছিলো, যেন চোর। আর রবিও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার বাবা থামিয়ে দিয়েছেন। কাজেই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে শুনবো কি হচ্ছে।

সরো! বলতে বলতেই দুজনকে ঠেলে আড়ালে নিয়ে এলো মুসা।

ট্রেলার থেকে নেমে দ্রুত গ্যালারির দিকে চলে গেল রবি, কোনোদিকে তাকালো না। পা টিপে টিপে, জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো ছেলেরা।

কোহেনের ভারি গলা শোনা গেল, কিংও. ছুটলো। এরপর কি ঘটবে, কনর? হয়তো শেষ পর্যন্ত বেতনই দিতে পারবেন না আমাদের।

আগামী হপ্তায়ই বেতন পাবে। এতো চিন্তা করো না।

আপনাকে আর কি বলবো? জানেনই কারনিভলের লোকেরা কুসংস্কারে। বিশ্বাসী। আজকের শো তেমন জমছে না। আরও অঘটন ঘটবে।

কোহেন, শোনো। তুমি…।

ভেতরে পায়ের শব্দ। ছেলেদের মাথার ওপরে বন্ধ হয়ে গেল জানালা। আর কথা শোনা গেল না। দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। সরে চলে এলো তিন গোয়েন্দা।

সত্যিই গণ্ডগোল, বলে উঠলো মুসা। কিন্তু আমরা কি করতে পারি? মিস্টার। কনর আমাদের পাত্তাই দিলেন না।

কিশোর চিন্তিত। রবিকেও কিছু বলতে দিলো না। যাকগে, পাস আছে। আমাদের। নজর রাখতে পারবো। রবিন, কাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পত্রিকা ঘাটবে। দেখবে, অন্যান্য শহরে কারনির্ভুলটা কেমন জমিয়ে এসেছে। গত কয়েক দিনের কাগজ দেখলেই চলবে। কাল ভাৰবো, কি করা যায়।

.

০৬.

সেরাতে ভালো ঘুম হলো না মুসার। মনে ভাবনা। তিন গোয়েন্দাকে তদন্ত করতে দেয়ার জন্যে কিভাবে রাজি করানো যায় মিস্টার কনরকে? সকাল পর্যন্ত ভেবেও কোনো উপায় বের করতে পারলো না। শেষে চেষ্টা ক্ষান্ত দিলো। রবিন কিংবা কিশোর উপায় বের করে ফেলবে। নাস্তার টেবিলে এসে দেখলো খাওয়ার শেষ পর্যায়ে রয়েছেন মিস্টার আমান।

বাবা, এতো তাড়াতাড়ি উঠেছে আজ? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, ডেভিস ক্রিস্টোফার ডেকেছেন। নতুন একটা ছবি করবেন। জরুরী কাজ নাকি আছে, কফির কাপে লম্বা চুমুক দিলেন। কিন্তু এদিকে যে একটা গোলমাল হয়ে গেল।

কী?

 তোমার মাকে কাল রাতে কথা দিয়েছি, আজ বাগান সাফ করে দেবো। তোমার তো স্কুল ছুটি, কাজও নেই। দাও না আমার কাজটা করে।

মনে মনে গুঙিয়ে উঠলো মুসা। মুখে বললো,.বেশ, দেবো।

লাঞ্চের আগে বেরোতে পারলো না। বাগান সাফ করে, দুপুরের খাওয়া খেয়ে, সাইকেল নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে চললো মুসা। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দেখলো, কিশোর ডেস্কেই রয়েছে।

কোনো উপায় বের করতে পারলে? ভূমিকা নেই, সরাসরি জিজ্ঞাসা।

নাহ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো মুসা। তুমি?

 আমিও না, মুখ গোমড়া করে রেখেছে কিশোর। দেখি, রবিন কি জেনে আসে। তার জন্যেই বসে আছি।

বাইরে আওয়াজ শুনে গিয়ে সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো কিশোর। পেরিস্কোপটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা বিশেষ অবস্থানে আনতেই ইয়ার্ডের অনেকখানি দেখা গেল।

ওই, এসে গেছে।

একটু পরেই ট্র্যাপডোরে টোকা পড়লো। ঢাকনা তুলে উঠে এলো রবিন। হাতে নোটবুক, ভীষণ উত্তেজিত।

রবিনের মুখ দেখেই আন্দাজ করা গেল, খবর আছে।

সারাটা সকাল খরচ হয়েছে আমার, রবিন, বললো। কারনিভলে গুরুত্ব নেই, ফলে খবর থাকলেও কাগজের চিপায়-চাপায় থাকে। একগাদা কাগজ ওল্টাতে হয়েছে আমার।

কি জানলে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

নোটবুক খুললো রবিন। তিন হপ্তা আগে ভেনচুরায় পনি রাইড হারিয়েছে কারনিভল। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে ওদের তিনটে খেলুড়ে পনি ঘোড়া। তারপর, তিন দিন আগে স্যান মেটিওর উত্তরে একটা জায়গায় থাকার সময় আগুন লেগেছে। তিনটে তাঁবু পুড়েছে আগুনখেকোর তাঁবু, সিংহের তাঁবু, আর শুটিং গ্যালারির খানিকটা নেহাত কপালগুণে সময়মতো নেভাতে পেরেছে।

সিংহের তাঁবু? কপাল কুচকে গেছে মুসার। একখানে দুবার অঘটন?

কাকতালীয় ব্যাপারও হতে পারে, কিশোর বললো। ঝট করে সিদ্ধান্তে চলে আসা ঠিক নয়। তবে ইন্টারেসটিং মনে হচ্ছে। যদি পনি রাইডও ওই একই কারনিভলের হয়।

কোন কারনিভল, পেপারে কিছু লেখেনি, রবিন বললো।

কাল রাতে আমি ও কিছু বইপত্র ঘেঁটেছি, সার্কাসের ওপর লেখা, বললো। কিশোর। চাচার বই। জানোই তো সার্কাসে কি-রকম আগ্রহ তার। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে একবার সার্কাসের দলে ভর্তিও হয়েছিলো। একটা বইতে পেলাম, অনেক কুসংস্কার আছে সার্কাসের লোকের। পুরনো প্রবাদ আছেঃ কোনো সার্কাসে দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করলে পর পর তিনবার ঘটবে। ঘটবেই। সুতরাং, কিঙের বেরিয়ে যাওয়াটা তৃতীয় দুর্ঘটনা বলা যায়।

তুমি বিশ্বাস করো এসব? রীতিমতো অবাক হলো মুসা।

আমার করা না করায় কিছু এসে যায় না, সেকেণ্ড। সার্কাসের লোকে করে। আরও কিছু বইয়ের লিস্ট দিয়েছে চাচা, তার কাছে ওগুলো নেই। ফলে সকালে লস অ্যাঞ্জেলেসে যেতে হলো, লাইব্রেরিতে। অনেক বই ঘেটেছি। জেনেছি, সার্কাসে কি। কি খেলা থাকে, কোন পদে কি রকম লোক থাকে। আশ্চর্য কি জানো, কোথাও স্ট্রং ম্যানের উল্লেখ নেই।

তাহলে কোহেন? প্রশ্ন তুললো মুসা।

কি জানি। হতে পারে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে। কিংবা তার দেশের সার্কাসে। ওরকম, পদ আছে। লোকটা বিদেশী। আরেকটা ব্যাপার সহজেই চোখে পড়ে, তার। আচার-আচরণ সন্দেহজনক। ঝিক করে উঠলো কিশোরের চোখের তারা। তুড়ি বাজালো। পেয়েছি।

কি পেয়েছো?? একসঙ্গে প্রশ্ন করলো দুই সহকারী।

কারনিভলে তদন্ত করার উপায়। জড়িয়ে নিতে হবে।

কিভাবে? রবিন জানতে চাইলো

বলছি, মন দিয়ে শোনো…

.

কয়েক মিনিট পর সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো মুসা। হঠাৎ বললো, আসছে! আমি যাই।

 তিন গোয়েন্দার ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপের বাইরে রবির সঙ্গে দেখা করলো মুসা। ফোন করে তাকে আসতে বলেছে কিশোর।

কি ব্যাপার, মুসা? হাসলো সোনালি-চুল ছেলেটা। জরুরী তলব?

ভাবলাম, আমাদের গোপন হেডকোয়ার্টার দেখাই। হাজার হোক, তিনটে ফ্রি পাস পেয়েছি তোমাদের কাছে। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে। কি করে কাজ করি আমরা, দেখবে এসো।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে রবিকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এলো মুসা।

কি সাংঘাতিক! কি জায়গা বানিয়ে রেখেছো জঞ্জালের তলায়!

চোখ বড় বড় করে দেখলো রবিঃ মাইক্রোস্কোপ, টেলিফোন, পেরিস্কোপ, ওয়াকি-টকি, ফাঁইলিং কেবিনেট, মেটাল ডিটেকটর, তাক বোঝাই বই আর ট্রফি, আর আরও নানা রকম জিনিস যেগুলোর নামই জানে না সে। রবিন আর কিশোর কাজে ব্যস্ত, ঘরে যে লোক ঢুকেছে টেরই পায়নি যেন। একজনও চোখ তুললো না। আতশ কাঁচ দিয়ে একটা তালা পরীক্ষা করছে কিশোর। আলোকিত কাঁচের তলায় রেখে কি যেন দেখছে রবিন।

ওদের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিচু গলায় বললো মুসা, রবি, তোমাদের কারনিভলে গোলমাল হচ্ছে। সেটারই তদন্ত করছি।

কি করে জানলে? অসম্ভব!

তোমার কাছে কঠিন লাগছে, রবি, ভারিক্কি চালে বললো মুসা। আমাদের কাছে কিছু না। বিজ্ঞান আর আমাদের অভিজ্ঞতাই সেটা সম্ভব করেছে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো কিশোর। বুঝলাম। কিংকে ছেড়ে দেয়েছিলো একজন। পেশাদার অপরাধী, রবি যে আছে ঘরে দেখতেই পায়নি যেন। কোনো সন্দেহ নেই। তালাটার বাইরের প্যাটার্ন দেখলাম, টাইপ-সেভেন পিক-লক। সিংহের খাঁচায়ও একই তালা। নিশ্চয় গোলমাল পাকানোর জন্যেই খুলে দেয়া হয়েছিলো।

বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে রবি, অর্ধেক কথা বুঝতে পারছে না। আরও তাজ্জব হওয়া বাকি আছে তার। কিশোর থামতেই রবিন শুরু করলো, হুঁ, বোঝাই যাচ্ছে, তিন হপ্তা আগে তিনটে ঘোড়া মরে যাওয়াতেই পনি রাইড খেলাটা বন্ধ। করতে হয়েছে। তারপর পুড়লো তবু, শুটিং গ্যালারির ক্ষতি হলো। নতুন তবু কিনতে, গ্যালারি মেরামত করতে অবশ্যই টাকা নষ্ট হয়েছে। বেকায়দায় পড়ে গেছেন মিস্টার কনর। বেতন দিতে পারছেন না।

রবিকে না দেখার অভিনয় চালিয়ে গেল কিশোর। মাথা ঝাঁকিয়ে রবিনের কথার সমর্থন জানালো। জিজ্ঞেস করলো, কর্মীদের কথা কি কি জানলে?

স্ট্রং ম্যান কোহেন কারনিভলে আগে কখনও কাজ করেনি, রেকর্ড নেই। আমার বিশ্বাস, লোকটা ভণ্ড।

ভাব দেখে মনে হলো, বাজ পড়েছে রবির মাথায়। ঝুলে গেছে নিচের : চোয়াল। আর চুপ থাকতে পারলো না। এসব কথা কে বলেছে তোমাদের?

ফিরে তাকালো কিশোর আর রবিন। রবিকে দেখে যেন অবাক হয়েছে।

আরে, রবি, কখন এলে? কিশোর বললো।

নিশ্চয় কেউ বলেছে তোমাদেরকে এসব কথা! প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গরম হয়ে বললো রবি।

না, রবি, মাথা নাড়লো কিশোর। আমরা গোয়েন্দা। তদন্ত করে জেনেছি। তারমানে, সত্যি জেনেছি?

মাথা ঝোঁকালো রবি। হ্যাঁ, প্রত্যেকটা বর্ণ। এমনকি কোহেনের কথাও। ছদ্মনামে ঢুকেছে। টাকার দরকার, তাই একটা পদ তৈরি করে নিয়ে কারনিভলে কাজ করতে এসেছে। সার্কাসের চেয়ে কারনিভলের আয় কম, বেতনও কম, তারপরেও এসেছে। আমাদের এখানে যে কাজ করছে, পরিচিত কাউকে জানতে দিতে চায় না। আমরাও ওর আসল নাম জানি না। তবে স্ট্রং ম্যান হিসেবে খুব ভালো, একথা বলা যায়।

তা হতে পারে। কিন্তু, রবি, তোমাদের কারনিভলে যে গোলমাল করছে। কেউ, এটা তো ঠিক? কে করছে, সেটা বের করতে চাই আমরা। যদি তোমার। বাবা অনুমতি দেন।

এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকালো রবি। আগে বলো, কি করে জানলে? যাদু বিশ্বাস করি না আমি।

ভূতে বলেছে, রহস্যময় হাসি হাসলো কিশোর। খুলে বললো, কিভাবে জেনেছে।

 রবিন আর মুসার মুখেও হাসি.। রবিকে তাজ্জব করে দিতে পারার আনন্দে।..

দারুণ হে! সত্যি তোমরা জাতগোয়েন্দা! না বলে পারলো না রবি। কারনিভলের গণ্ডগোলের হোতা কে, বের করতে পারবে তোমরা। কিন্তু বাবাকে। নিয়েই মুশকিল। বাইরের সাহায্য নিতে রাজি হবে না।

তাহলে খুব শীঘ্রি কারনিভল খোয়াতে হবে তাকে, কিশোর বললো।

বুঝি, বিমর্ষ হলো রবি। আগামী হপ্তায় বেতন দিতে না পারলে…,.থেমে গেল সে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। বেশ, বাবা না নিলে না নিক, আমি নেবো তোমাদের সাহায্য। আমি জানি কি কারণে বাবাকে কারনিভল খোয়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমার জন্যে!

.

০৭.

আমার নানী, রবি বললো। বাবাকে দেখতে পারে না, বিষণ্ণ হয়ে গেল। খুব ছোটবেলায় মা মরেছে আমার। অ্যাকসিডেন্ট। মায়ের স্নেহ পাওয়ারও সুযোগ। হয়নি আমার… গলা ধরে এলো তার।

 দুঃখ করো না, রবি, সান্তনা দিলো কিশোর। তোমার বাবা আছে, আমার তো তা-ও নেই। দুজনেই মারা গেছে মোটর দুর্ঘটনায়।

এক মুহূর্ত অস্বস্তিকর নীরবতার পর রবি বললো, নানী বাবাকে দেখতে পারতো না, তার কারনিভলও পছন্দ করতো না। মা বাবাকে বিয়ে করুক, এটাও চায়নি। তাই বাবাকে দূষতে লাগলো নানী। বাবার জন্যেই নাকি মারা গেছে তার মেয়ে। বললো, কারনিভলে থাকা হতে পারে না আমার। মা মারা যাওয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিলো বাবা, কাজকর্ম ঠিকমতো করতো না, ফলে কারনিভলের অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। নানী চাইলো আমি তার কাছে থাকি। মোটামুটি ধনীই বলা যায় তাকে। তা ছাড়া বাবা এক জায়গায় থাকতে পারে না, ব্যবসার খাতিরে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে হয়। ছায়া নামলো রবির চেহারায়। যতোই বড় হলাম, নানীর ওপর বিতৃষ্ণা বাড়লো আমার। খারাপ নয় মহিলা, আমাকে অনেক আদর করে, কিন্তু আমি দেখতে পারি না। একটাই কারণ, দুনিয়ার সব কিছুতেই তার ভয়, আমাকে বাইরে বেরোতে দিতো না, কিছু করতে দিতো না। আমার ইচ্ছে বাবার কাছে কারনিভলে চলে যাই। নানী যেতে দেয় না। শেষে এ-বছরের গোড়ার দিকে পালিয়ে চলে এলাম বাবার কাছে। কি সাংঘাতিক, পাগলের মতো ছুটে এলো নানী। বাবাকে ভয় দেখালো, কেস করে দেবে। বাবা বললোঃ ঠিক আছে, রবি যদি যেতে চায়, আমার কোনো আপত্তি নেই, নিয়ে যান। আমি যেতে চাইলাম না। আইনত নানীও কিছু করতে না পেরে ফিরে গেল।

শাসিয়ে-টাসিয়ে গেছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হ্যাঁ। বাবাকে বলে গেছে, আমাকে কিছুতেই কারনিভলে থাকতে দেবে না। মায়ের মতো মরতে দেবে না আমাকে। কোর্টে গিয়ে নালিশ করবে, আমার খাওয়া-পরা জোটানোর সাধ্য নেই বাবার। নানীর ভয়েই অনেকটা পালিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এসেছে বাবা। প্রাণপণে খাটছে টাকা রোজগারের জন্যে, যাতে আদালতে নানীর নালিশ না টেকে। কিন্তু যে-হারে অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, কারনিভলই খোয়াতে হবে বাবাকে!

তুমি সত্যি বিশ্বাস করো, তোমার নানী এসব করাচ্ছেন।

 জানি না, কিশোর, ধীরে ধীরে বললো রবি, নানী করাচ্ছে ভাবতেও খারাপ লাগে আমার। বাবাকে দেখতে পারে না, কিন্তু আমাকে তো ভীষণ আদর করে। নানী ছাড়া বাবার শত্রু আর কে থাকবে, বলো?

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, তোমার ক্ষতি চান না তোমার নানী। কিশোর যুক্তি দেখালো, দুর্ঘটনায় তোমারও ক্ষতি হতে পারতো। তিনিই যদি করাবেন, এসব কথা কি তিনি ভাবেননি? নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটলো সে। রবি, আমার বিশ্বাস, এরকম কিছু তিনি করাতে পারেন না। হয়তো অন্য শত্রু আছে তোমার বাবার, যার কথা তুমি জানো না। কার্নিভল ধ্বংস করার পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে।

কে করছে জানি না, কিশোর। তবে একথা ঠিক, শীঘ্রি তাকে ঠেকাতে না পারলে বাবাকে শেষ করে দেবে। ঐ তৃতীয় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে আছে কারনিভলের সবাই।

ততীয়টা তো ঘটেই গেছে? অবাক হলো কিশোর।

মাথা নাড়লো রবি। না, কিরে বেরিয়ে যাওয়াটাকে দুর্ঘটনা ধরছে না ওরা। কারণ তাতে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি নাহলে দুর্ঘটনা ধরা হয় না। কাজেই তৃতীয়টার অপেক্ষায় আছে।

খুব খারাপ কথা, রবিন বললো। সর্বনাশ হয়ে যাবে তো। আতঙ্ক নার্ভাস করে ফেলে মানুষকে, আর নার্ভাস হলে দুর্ঘটনা বেশি ঘটায় মানুষ।

একমত হলো কিশোর। এবং এসবের মূলে সার্কাসের লোকের কুসংস্কার। লোকে যেটার ভয় বেশি করবে, সেটাই বেশি ঘটবে।

কিন্তু রবিদের কারনিভলে তো অন্য ব্যাপার ঘটছে, মুসা মনে করিয়ে দিলো। আপনা-আপনি ঘটছে না। ঘটানো হচ্ছে।

সেটাই শিওর হওয়া দরকার, সেকেণ্ড, কিশোর বললো। একটা ব্যাপার মনে খচখচ করছে, কিঙের ছাড়া পাওয়াটা অন্য দুটো দুর্ঘটনার মতো নয়। প্যাটার্ন মিলছে না। ওদুটো ঘটার সময় কারনিভল খোলা ছিলো না। দর্শকদের ক্ষতি হওয়ার ভয় ছিলো না।

তাহলে এটা হয়তো আসলেই দুর্ঘটনা?

না। ছেড়েই দেয়া হয়েছে, জোর দিয়ে বললো গোয়েন্দাপ্রধান। কারনিভলে। যাওয়া দরকার রবি; এখন তো বন্ধ, আমরা ঢুকতে পারবো?

নিশ্চয় পারবে। আমি সবাইকে বলবো, রিহারস্যাল দেখতে এসেছে। তোমাদের কথা সবাই জানে এখন। বিশেষ করে মুসার কথা। কোনো অসুবিধে হবে না।

কি খুঁজবো আমরা, কিশোর? মুসার প্রশ্ন।

বলতে পারবো না। কড়া নজর রাখার চেষ্টা করবো, যাতে আরেকটা দুর্ঘটনা। ঠেকানো যায়। সাবধান থাকতে হবে আমাদের…, থেমে গেল হঠাৎ।

মেরিচাচী ডাকছেন। দ্রুত গিয়ে সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো মুসা।

রবিন, আবার ডাকলেন তিনি, জলদি বেরিয়ে এসো। তোমার মা ফোন করেছেন। ডাক্তারের কাছে নাকি যাবার কথা?

হায়, হায়, ডেন্টিস্ট। গুঙিয়ে উঠলো রবিন। ভুলেই গিয়েছিলাম!

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। কাজে বাধা পড়লে রাগ লাগে তার। মেনে নিতে পারে না। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বললো, কি আর করবে, নথি, যাও। তোমার জন্যে আমাদের বসে থাকা উচিত হবে না। আমি আর মুসা যাচ্ছি। সময়। নষ্ট হলে কখন কি করে বসে…ও হ্যাঁ, একটা দিনিজসপ্রে নিয়ে যাও। যোগাযোগ রাখতে পারবে আমাদের সঙ্গে।

কী সপ্রে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

দিনিজসপ্রে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। দিক-নির্দেশক ও জরুরী-সংকেত প্রেরক, সংক্ষেপে বাংলায় দিনিজসপ্রে, গর্বের হাসি হাসলো সে। কাল যেটা বানানো শুরু করেছিলাম তোমাকে নিয়ে, মাঝপথে তো চাচা এসে গামলা রঙ করতে দিলো। আজ সকালে বানিয়ে ফেলেছি। তবে মাত্র দুটো। আপাতত তাতেই চলবে। একটা রবিন নিয়ে যাক, আরেকটা আমরা নেবো। সুবিধে হবে। ওয়াকি টকি দেখলেই লোকে চিনে ফেলে। এটা দেখবেও না, আর দেখলেও সহজে চিনবে না।

ওই যন্ত্র দিয়ে কি হয়, কিশোর? জানতে চাইলো রবি।

ওটা? একধরনের হোমার বলতে পারো। নিজস্ব কিছু আবিষ্কার ঢুকিয়েছি ওটাতে। হোমার আমরা আগেও বানিয়েছি, ব্যবহার করেছি, তবে এখনকারটা আরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধে বেশি। প্রথমেই ধরো, সিগন্যাল পাঠাবে এটা। শব্দ করবে। আরেকটা হোমার নিয়ে যতোই কাছে যাবে, বাড়বে শব্দ। একটা ডায়াল আছে, তাতে দিক-নির্দেশক কাটা আছে, যেদিক থেকে শব্দ আসবে সেদিকে ঘুরে যাকে কাটাটা। প্রতিটি দিনিজসপ্রেতে গ্রাহক আর প্রেরক, দুধরনের যন্ত্রই আছে। জরুরী অবস্থার জন্যে ছোট্ট একটা লাল আলোর ব্যবস্থা আছে এতে। সুইচ টেপার ঝামেলা নেই, ভয়েস অপারেটেড মুখে বললেই কাজ শুরু করবে। ধরো, আমাদের মধ্যে কেউ বিপদে পড়লো। আর কিছু করার দরকার নেই, শুধু বলতে হবে সাহায্য। ব্যস, অমনি অন্যদের দিনিজসপ্রের লাল আলো জ্বলতে নিভতে শুরু করবে, এক মুহূর্ত থেমে দম নিলো কিশোর। সব চেয়ে বড় সুবিধে, খুদে এই হোমারটা পকেটেই জায়গা হয়ে যাবে।

বিস্ময় চাপা দিতে পারলো না রবি। চেঁচিয়ে উঠলো, কি সাংঘাতিক, খুব কঠিন করে কথা বলো তুমি, কিশোর! …আর…আর, দুনিয়ার সব কিছুই করতে পারো, তাই না? সব কিছুতেই বিশেষজ্ঞ।

ইয়ে, রবি…, প্রশংসায় খুশি হয় কিশোর। কিন্তু এতো বেশি প্রশংসা করেছে রবি, কিশোর পাশাকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছে, সব কিছু পারা তো একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কিছুই করার চেষ্টা করি আরকি। গোয়েন্দাগিরিতে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমাদের হোমারের সঙ্কেত শুধু আমাদের হোমারই ধরতে পারবে, অন্য কোনো যন্ত্র নয়। রেঞ্জ তিন মাইল।

ডাক পড়লো আবার।এই, রবিন, কোথায়? বেরোচ্ছো না? মেরিচাচী অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তুমি এসো। আমি অফিসে যাচ্ছি।

দাও, কোথায় তোমার দিনিজসপ্রে, কিশোরকে বললো রবিন। যতো তাড়াতাড়ি পারি ডাক্তার দেখিয়েই কারনিভলে চলে যাবো আমি।

বাইরে বেরিয়ে, অফিসে মেরিচাচীকে বলে সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল রবিন। মুসা আর কিশোরও সাইকেল বের করলো। রবি সাইকেল নিয়েই এসেছে। তিনজনে চললো কারনিভলে।

খানিক আগেও রোদ ছিলো, এখন মেঘলা বাতাস। বাতাস বাড়ছে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় না হলে এই সেপ্টেম্বরের গোড়াতেই বৃষ্টি আশা করা যেতো। এখানে এখন বৃষ্টির সম্ভাবনা কম, কিন্তু সূর্যের মুখ ঢেকে দিয়েছে মেঘ। মন খারাপ-করা আলো।

কারনিভলের কাছে পৌঁছে সাইকেল থেকে নামলো কিশোর। অন্য দুজন। থামতে বললো, রবি, তুমি আগে যাও, আমাদের সাথে গেলে সন্দেহ করতে পারে। শুটিং গ্যালারির আশোঁপাশে কড়া নুজব রাখবে। মুসা মাঠের ওদিকে গিয়ে কর্মীদের রিহারস্যাল দেখবে, ওপাশটায় চোখ রাখবে। আমি টহল দেবো বুঁদ আর তাঁবু গুলোর কাছে। সন্দেহজনক সামান্যতম ব্যাপারও যেন চোখ না এড়ায়। ঠিক আছে?

রবি আর মুসা, দুজনেই মাথা ঝাঁকালো।

.

ডেন্টিস্টের ওখানে পৌঁছে দেখলো রবিন, রোগীর লাইন। তার ডাক চলে গেছে। কাজেই অপেক্ষা করতে হলো। অযথা বসে থাকা স্বভাব নয় তার। সামনের টেবিলে রাখা পত্র-পত্রিকা ঘাটতে লাগলো।

ম্যাগাজিন ওল্টানো শেষ করে দৈনিক পত্রিকা ধরলো। স্থানীয় পত্রিকা। রকি বীচ থেকে বেরোয়। কিং-এর ছাড়া পাওয়ার খবর আছে কিনা খুঁজলো। কোনোটাতে নেই। তবে কারনিভল সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন লিখেছে একটা পত্রিকা। বলা যায় এক ধরনের বিজ্ঞাপনঃ কারনিভলটা কতো ভালো, কতো কিছু দেখার আছে এতে, কতো মজা পাওয়া যাবে, এসব। এতো ছোট আর সাধারণ খবর নিয়ে এই বাড়াবাড়ি কেবল ছোট পত্র-পত্রিকাতেই সম্ভব। বিরক্ত হয়ে পত্রিকাটা রেখে দিয়ে আরেকটা তুলে নিলো সে। ওল্টাতেই ছোট বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়লো। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনঃ

কানা বেড়াল আবশ্যক
বাচ্চাদের খেলাঘরের জন্য স্টাফ করা বেড়াল চাই।
লাল-কালো ডোরাকাটা হতে হবে, শরীরটা কিম্ভুত রকমের বাঁকা,
 এক চোখো, গলায় লাল কলার। ওরকম প্রতিটি বেড়ালের জন্যে
১০০ (একশো) ডলার দেয়া হবে।
অতি-সত্বর যোগাযোগ করুনঃ
রকি বীচ, ৫-১২৩৪।

 নাড়ির গতি বেড়ে গেল রবিনের। ঠিক এরকম একটা বেড়াল নিয়েই কারনিভলে গোলমাল করেছিলো চোর, পুরস্কার পেয়েও হারিয়েছে মুসা। বিজ্ঞাপন ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে সোজা ডেন্টিস্টের চেম্বারে ঢুকলো রবিন। চেঁচিয়ে বললো, ডাক্তার সাহেব, আজ আমার দাঁত দেখানোর দরকার নেই! আরেকদিন! বলেই

বেরিয়ে এলো হতভম্ব ডেন্টিস্টের ঘর থেকে। সাইকেলের দিকে দৌড় দিলো।

.

০৮.

মেঘাচ্ছন্ন ধূসর বিকেল একদম ভালো লাগে না মুসার। উত্তেজনা আছে বলেই তেমন খেয়াল করছে না এখন। একটা ঘন্টা যে কোন দিক দিয়ে কেটে গেছে, বলতেই পারবে না। মাঠের এখানে ওখানে ঘুরছে। রিহারস্যাল দেখছে কর্মীদের।

নতুন একটা ভাঁড়ামি প্র্যাকটিস করছে দুই ভাঁড়। বেঁটে লোকটার হাতে একটা খাটো ঝাড়ু, লম্বার হাতে একটা ছোট বালতি। বেঁটে ভাড় ঝাড়ু দিয়ে ময়লা তুলে বালতিতে রাখছে, সেটা তুলে নিয়ে তার পেছন পেছন যাচ্ছে লম্বা। কিছু ময়লা জমলেই তার ভারে বালতির তলা খসে যাচ্ছে। বিশেষ কায়দায় আবার তলাটা লাগিয়ে ময়লাগুলো কুড়িয়ে রাখছে লম্বা। তোলার চেষ্টা করলেই আবার। খসে পড়ছে। ক্রমেই বিষণ্ণ হচ্ছে তার চেহারা, আর বেঁটে লোকটা হাসছে। লম্বার দুর্গতি দেখে যেন খুব মজা পাচ্ছে বেঁটে।

তলোয়ারের মাথায় আটকানো তুলোর দলায় আগুন লাগিয়ে নির্দ্বিধায় মুখে পুড়ছে আগুনখেকো। চোখ বড় বড় করে দিচ্ছে মুসার। প্রতিবারেই সে ভাবছে, এইবার লোকটার মুখ পুড়বেই। কিন্তু পোড়ে না।

ভার উত্তোলন, আর মোটা বই টেনে ছেঁড়ার প্র্যাকটিস করছে স্ট্রং ম্যান কোহেন। তাকে সন্দেহ, তাই তার কাছেই বেশি সময় ব্যয় করছে মুসা। সন্দেহজনক কিছুই করছে না লোকটা।

সিংহের খাঁচায় কিংকে নতুন একটা খেলা শেখাচ্ছে মারকাস দ্য হারকিউলিস।

এই দুটো উঁচু খুঁটিতে বাঁধা তারের ওপর ভারসাম্য বজায়ের রোমাঞ্চকর খেলা খেলছে দুজন দড়াবাজ।

সবই দেখছে মুসা। এমন ভাব করছে, যেন শুধু ওসব দেখার জন্যেই এসেছে সে।

কিছুই ঘটলো না মাঠে।

বুদ আর তাঁবুগুলোতে ঘোরাঘুরি করছে কিশোর। রাফনেক আর বুঁদ অপারেটররা রাতের জন্যে সেট সাজাচ্ছে, নষ্ট জিনিস মেরামত করছে। কোনো বুদ। কিংবা তাঁবুই বাদ দিলো না সে, কোনো কোনোটাতে কয়েকবার করে ঢুকলো। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো না। ঘূর্ণমান নাগরদোলা দেখার জন্যে থেমেছে, এই সময় সেখানে এলো রবি। শুটিং গ্যালারিতে কাজ শেষ করে এসেছে।

নাগরদোলাটা টেস্ট করবে না, রবি? স্তব্ধ বিশাল চাকাটা দেখালো কিশোর, কাঠের ঘোড়াগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে ক্যানভাস দিয়ে।

চালাতে অনেক খরচ। কারনিভল খোলার আগে চালু করি, একটা মাত্র টেস্ট রান দিয়েই চড়ার জন্যে ছেড়ে দিই।

ওটার জন্যে নিশ্চয় মেকানিক আছে? কিংবা অপারেটর?

আছে। বাবা নিজেই।

চিন্তিত দেখালো কিশোরকে। বিড়বিড় করে কি বললো সে-ই বুঝলো।

কিশোর, রবি বললো। রবিন এসে পড়েছে।

সাইকেল চালিয়ে মুসার কাছে গেল প্রথমে রবিন, তারপর দুজনে মিলে এলো কিশোরদের কাছে। এসেই বললো রবিন, কিশোর, কানা বেড়ালটা চাইছে!

কোনটা? আমরা যেটা হারিয়েছি? রবিনের মতোই চেঁচিয়ে বললো মুসা।

 আমার মনে হয় না ওটা হারিয়েছে, গলা আরও চড়ালো রবিন। পকেট থেকে ছেঁড়া বিজ্ঞাপনটা বের করলো। চুরি হয়েছে! কিশোর, দেখো।

গোয়েন্দাপ্রধানকে ঘিরে দাঁড়ালো সবাই। পড়তে পড়তে চোখ উজ্জ্বল হলো। কিশোরের। নিশ্চয় মুসার কানাটার মতো। রবি, ওরকম বেড়াল মোট কটা পেয়েছিলে?

পাঁচটা। রকি বীচেই ছেড়েছি ওগুলো। মুসাকে দিয়েছিলাম শেষটা।

হুমম্, মাথা দোলালো কিশোর, প্রথমবারে চেষ্টা করেছিলো, নিতে পারেনি। দ্বিতীয়বারে সফল হয়েছে। হুঁ, মিলতে শুরু করেছে।

কী? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

কানা বেড়ালটা কারও দরকার, নথি। হয়তো পাঁচটাই দরকার। কিংকে ছেড়ে দেয়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে।

কি কারণ? মুসা জানতে চাইলো।

আমাদের নজর অন্যদিকে সরানোর জন্যে। প্রথমবার বেড়ালটা নিতে না পেরে পালিয়ে গিয়েছিলো লোকটা, সেই গোঁফ আর কালো চশমাঅলা। তারপর। ঘুরে এসে আবার ঢুকেছে শুটিং গ্যালারিতে, মুসাকে পুরস্কার জিততে দেখেছে। বুদ্ধি করে ফেলেছে তখনই। গিয়ে কিংকে বের করেছে। তোমরা বেরোতেই ওকে নিয়ে গিয়ে ঠেলে দিয়েছে তোমাদের সামনে। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে তার। দুজন গেছে মারকাসকে খবর দিতে। মুসা বেড়াল ফেলে সিংহ সামলাতে ব্যস্ত। সেই সুযোগে ওটা তুলে নিয়ে চলে গেছে চোরটা।

খাইছে, কিশোর, নিশ্চয় দামি কিছু আছে বেড়ালটার ভেতর।

থাকার সম্ভাবনা বেশি, একমত হলো কিশোর। রবি, বেড়ালটার কোনো বিশেষত্ব আছে?

জানি না।

নিচের ঠোঁটে দুবার চিমটি কাটলো কিশোর। ভাবছে। অধীর হয়ে আছে অন্যেরা। ঠোঁট কামড়ালো একবার, সে, বললো, হতে পারে কোনো খেপাটে, সংগ্রহ করে রাখতে চাইছে তার সংগ্রহশালার জন্যে, বিজ্ঞাপন সে-ই দিয়েছে। : কিংবা হয়তো বিশেষ কিছু রয়েছে ওই বেড়ালগুলোর মধ্যে…

কাকাতুয়াগুলোর যেমন ছিলো? বলে উঠলো রবিন। ওই যে, তোতলা কাকাতুয়া…

হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। দামি কিছু থাকতে পারে।…রবি, কারনিভল নিয়ে মেকসিকোতে গিয়েছিলে তোমরা? কিংবা সীমান্তের কাছে?

না, কিশোর। শুধু ক্যালিফোর্নিয়া।

মেকসিকোতে গেলে কি হতো? রবিন জানতে চাইলো।

স্মাগলিঙের কথা ভাবছি আমি, নথি। ওরকম জিনিসের ভেতর মাল লুকায়। চোরাচালানীরা, পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্যে। রবি, বেড়ালগুলো কোত্থেকে কিনেছো?

শিকাগো। এক প্রাইজ সাপ্লাইয়ারের কাছ থেকে কিনেছে বাবা।

গাল চুলকালো কিশোর। যা-ই হোক; বেড়ালগুলোর বিশেষত্ব আছে। রবি, কাল রকি বীচে তোমাদের তৃতীয় দিন ছিলো, না? .

হ্যাঁ। মাত্র দুটো শো দিয়েছি। স্যান মেটিওতে দুই শো দেখিয়ে রাতারাতিই চলে এসেছি এখানে।

বেড়ালগুলো কবে থেকে দিতে শুরু করেছো?

এখানে এসে, পয়লা শো থেকেই। শেষটা দিয়েছি কাল রাতে, মুসাকে। সেটা পঞ্চম বেড়াল।

প্রথম রাতেই চারটে দিয়ে দিলে কেন? চারজনেই ফার্স্ট হলো?

কড়াকড়ি কম করেছিলাম সেরাতে। চারটে হাঁস ফেলতে পারলেই ফার্স্ট ধরেছিলাম। বিজ্ঞাপনের জন্যে করেছিলাম এটা। লোকে বাড়ি গিয়ে বলাবলি করবে, প্রাইজ দেখাবে। তাতে আরও বেশি লোক আসবে পরের শো-তে।

ফার্স্ট প্রাইজ কি শুধু বেড়ালই দিয়েছো?

এখানে এসে প্রথম শো-তে বেড়াল।

কাল দেখলাম, একটা ট্রেলারে রাখো প্রাইজগুলো। নিরাপদ?

সব সময় তালা দিয়ে রাখি। শো যখন বন্ধ থাকে, ট্রেলারটা এনে আমাদের, ট্রাকের সঙ্গে আটকে রাখি। বার্গলার অ্যালার্ম আছে, চুরির চেষ্টা হলেই বেজে, ওঠে। কতোবার যে ওটা চুরি ঠেকিয়েছে। বেশির ভাগই ছোট ছেলেমেয়ে। ট্রাকের কাছে এসে ঘুরঘুর করে, পুরস্কারের জিনিসগুলো খুব লোভনীয় ওদের কাছে। শো যখন চলে, ট্রেলারটা এনে বুদের পেছনে রাখি, তখনও তালা লাগিয়ে।

 বোঝা যাচ্ছে, তোমাদের চোখ এড়িয়ে ট্রেলার থেকে বেড়াল চুরি করা খুব কঠিন।

হ্যাঁ। তালা ভাঙ্গা সহজ, কিন্তু জিনিস নিয়ে পালানো কঠিন। তালা ভেঙে জিনিস বের করে নিয়ে দৌড় দিতে দিতে দেখে ফেলবো।

হ্যাঁ, বললো গোয়েন্দাপ্রধান। দুই সহকারী যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তীব্র গতিতে ঘুরছে তার মগজের বুদ্ধির চাকাগুলো। তাহলে, পাঁচটা কানা বেড়াল নিয়ে, স্যান মেটিও থেকে রওনা হয়েছিলে। সোজা এসেছে এখানে। স্যান মেটিও আর রকি বীচের মাঝে বেড়ালগুলো চুরি করা কঠিন ছিলো। এখানে এসেও ট্রেলার থেকে চুরি করতে পারেনি, কারণ, সেটাও কঠিন। চোখে পড়ার ভয়। এখানে শো করে প্রথমেই চারটে বেড়াল দিয়ে দিলে। বাকি থাকলো একটা। সেটা ছিনিয়ে নিতে চাইলো গোঁফওয়ালা, কালো চশমা পরা বুড়ো। ব্যর্থ হলো। মুসা পেয়ে গেল। বেড়ালটা। কিং ছাড়া পেলো, মুসা বেড়াল হারালো। এখন পেপারে বিজ্ঞাপনঃ ওরকম বেড়াল চায়।

সবই বুঝলাম। কিন্তু কেন চায়? কি মানে এসবের?

গোয়েন্দাপ্রধানের চোখে অদ্ভুত চাহনি। কিশোর পাশার এই চাহনির অর্থ। জানা আছে তার দুই সহকারীর-রহস্যের সমাধান করে ফেলেছে সে, কিংবা জরুরী কোনো তথ্য আবিষ্কার করেছে।  তর্জনী নাচালো কিশোর। কাল রাতের আগে বেড়ালগুলো ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়নি। দুটো সম্ভাবনা, স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাতে। চকচক করছে তার চোখ। হঠাৎ করে দামি হয়েছে ওগুলো। আর যার কাছে দামি, সে এই কারনিভলেরই কেউ।

.

০৯.

 কিন্তু, কিশোর, প্রতিবাদ জানালো রবি, ওরকম চেহারার কেউ নেই কারনিভলে।

ছদ্মবেশ নেয়া সহজ ব্যাপার। পুরু গোঁফ, হ্যাট টেনে দিয়েছে, যাতে চেহারাটা ভালোমতো দেখা না যায়। তার ওপর কালো চশমা। আবছা আলোয়। আসল চেহারা বোঝা মুশকিল।

কারনিভলের লোক হলে ওভাবে নিতে আসবে কেন? প্রশ্ন তুললো মুসা। ট্রেলার থেকেই তো নিয়ে নিতে পারতো।

হ্যাঁ, তাই তো, রবিনও মুসার সঙ্গে সুর মেলালো। এতো চালাকির দরকার কি. ছিলো তার? কোনো এক ফাঁকে ট্রেলার থেকেই নিয়ে নিতে পারত। রবি খেয়ালই করতো না।

ট্রেলার থেকে নেয়ার চেষ্টা করেনি বলেই আমার সন্দেহ বেড়েছে, কিশোর জবাব দিলো। বাইরের কেউ হলে সে-চেষ্টাই কুরতো প্রথমে। কঠিন বুঝলেও করতো। আর চিনে ফেলবে, এই ভয়ও করতো না।

তাহলে?

ওই যে বললাম, কারনিভলেরই কেউ। তার জানা আছে, ট্রেলার থেকে নেয়া। প্রায় অসম্ভব। দেখে ফেললে মুশকিলে পড়বে, জবাবদিহি করতে হবে রবির বাবার। কাছে। সব চেয়ে বড় কথা, ওই বেড়ালসহ ধরা পড়লে অনেকেরই সন্দেহ হবে। ওগুলোতে দামি কিছু আছে।

ঠিক তাই। কানা বেড়ালের ওপর কারো নজর পড়ুক এটাই চায়নি সে। ভেতরের লোক নিলে স্পষ্ট হবে, জিনিসটা দামি। বাইরের কেউ নিলে, কাল। যেভাবে ছিনিয়ে নিতে চাইলো, মনে হবে লোকটা পাগল। কিংবা খেপাটে, সংগ্রহকারী। আর যা-ই ভাবুক, চোর ভাববে না কেউ।

কি সাংঘাতিক! ঊরুতে চাপড় মারলো রবি। হয়তো ঠিকই বলেছো। সন্দেহ যাচ্ছে না তার। মেনে নিতে পারছে না।

আমি জানি আমি ঠিক বলছি, ঠোঁটের এক কোণ কুঁচকালো কিশোর। শিওর হচ্ছি লোকটার অপেক্ষার ধরন দেখে। কাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে সে, চুরি। করার জন্যে। কারনিভলের লোক বলেই সাবধান হতে হয়েছে তাকে, আর কারনিভলের লোক বলেই সময় নষ্ট করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে। ঠিক সময়টা বেছে নিয়েছে, যখন বেড়াল করলে কারও সন্দেহ পড়বে না তার ওপর। কারনিভলের কারও পক্ষেই শুধু রবির ওপর সারাক্ষণ চোখ রাখা সম্ভব, ঝোপ বুঝে কোপ মারা সম্ভব। তবে কোপ মারতে বেশি দেরি করে ফেলেছে।

এই না বললে ঠিক সময়? মুসা ধরলো কথাটা।

কাজটা করেছে ঠিক সময়ই, তবে বেশি দেরি করেছে আরকি।

বুঝলাম না।

বুঝলে না? রকি বীচে আসার আগে বেড়ালগুলোকে ফার্স্ট প্রাইজ হিসেবে চালানোর কথা ভাবেনি রবি। আর কিছু না পেয়েই ওগুলোকে চালিয়েছে। পয়লা রাতেই পার করে দিয়েছে চারটে। তাতে চমকে গেছে চোরটা। সে ভাবেওনি এরকম কিছু একটা করে বসবে রবি। চারটে চলে যাওয়ার পর আর ঝুঁকি নিতে চায়নি চোর, তাড়াহুড়ো করেছে, যাতে পঞ্চমটাও হাতছাড়া না হয়ে যায়। দেরি করে করেছে বললাম এই জন্যে, আগের দিন চেষ্টা করলে চারটে না হোক, অন্তত আরও দুএকটা বেড়াল সে হাতাতে পারতো। পঞ্চমটাও ছুটে যাচ্ছে দেখে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে, সিংহ ছাড়তেও দ্বিধা করেনি।

মুসার কাছে কিংকে নিয়ে যেতে হয়েছে, রবি বললো। যদি সত্যিই নিয়ে গিয়ে থাকে। আর তা করতে হলে করেছে এমন কেউ, যাকে কিং চেনে।

মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছে, সন্দেহ নেই, কিশোর বললো। তবে সফল হয়েছে। একটা বেড়াল অন্তত নিতে পেরেছে। এখন বিজ্ঞাপন দিয়েছে বাকিগুলোর জন্যে। হয় মুসার বেড়ালটা সঠিক বেড়াল নয়, যেটা সে খুঁজছে, নয়তো সবগুলোই তার দরকার।

মাথা দোলালো রবিন। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। হঠাৎ করে। বেড়ালগুলো দামি হয়ে উঠেছে, একথা বললে কেন?

কারণ, স্যান মেটিওতে আগুন লাগার আগে ওগুলো নেয়ার চেষ্টা করা হয়নি। হতে পারে, আগুন লাগানোই হয়েছে বেড়ালগুলো নেয়ার জন্যে। পারেনি। রবি, স্যান মেটিওতে শুটিঙের সময় বের করেছিলে ওগুলো?

কয়েকটা। এমনি লোককে দেখানোর জন্যে। শো-কেসে সাজিয়ে রেখে ছিলাম। প্রাইজ দেয়ার ইচ্ছে ছিলো না।

কিশোর, রবিন বললো। তুমি বললে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো চোর। স্যান মেটিওতেই যদি নেয়ার চেষ্টা করে থাকে, তোমার যুক্তি গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না?

মোটেই না। আমি বলেছি, ঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো সে। হয়তো স্যান মেটিওতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আরেকটা ভালো সুযোগের জন্যে বসেছিলো। তবে। আগুন লাগার অন্য কারণও থাকতে পারে। সেই কারণটাই জানার চেষ্টা করবো। জানতে হবে, কেন, কে চায় কানা বেড়ালগুলো?

কি করে সেটা জানবো? মুসার প্রশ্ন।

ভাবলো কিশোর। তুমি থাকবে। এমন কোথাও, যেখানে বসে কারনিভল থেকে কে কে বেরোয় সব দেখতে পাবে। তোমাকে যেন না দেখে।

আমার ওপরই এই গুরুদায়িত্ব?

আবারও বলছি, চোর এই কারনিভলেরই লোক, মুসার কথা কানে তুললো কিশোর। একশো ডলার কম না, লোকে সাড়া দেবেই। বেড়াল আনার জন্যে বেরোতেই হবে চোরকে। অবশ্য তার কোনো সহকারী না থাকলে। নেই বলেই মনে হয় আমার। একাই করছে যা করার। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়তে পারে। তোমার। রবিন, দিনিজসপ্রেটা দিয়ে দাও ওকে। আমারটা আমার কাছেই থাক।

যাচ্ছো নাকি কোথাও? রবি জিজ্ঞেস করলো। আমি আসবো?

তা আসতে পারো। জলদি জলদি করতে হবে আমাদের।

কোথায় যাচ্ছো তোমরা? আমাকে একা ফেলে? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না কেউ। ছুটতে শুরু করেছে। সাইকেলের দিকে। করুণ চোখে ওদের যাওয়া দেখলো মুসা। তারপর ঘুরলো। শেষ বিকেল। আরও মলিন হয়েছে ধূসর আলো। লুকানোর জায়গা খুঁজতে শুরু করলো সে। পরিত্যক্ত পার্কের একটা উঁচু বেড়ার ওপর চোখ পড়লো, কারনিভলের প্রবেশপথ থেকে বিশ গজমতো দূরে।

বেড়ার জায়গায় জায়গায় এখানে ফুটো, ফোকর। পুরনো, বিশাল নাগরদোলার ভারি স্তম্ভগুলোর মাথা বেড়া ছাড়িয়ে উঠে গেছে। ওখানে লুকানোই সব চেয়ে সুবিধেজনক মনে হলো মুসার। চট করে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। কেউ তাকিয়ে নেই তার দিকে, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আস্তে আস্তে বেড়ার কাছে সরে এলো সে।

কেউ দেখছে না তাকে, আরেকবার চেয়ে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বেড়ার একটা। ফোকরে মাথা ঢুকিয়ে দিলো সে। অন্যপাশে চলে এলো। নাগরদোলার স্তম্ভের মাঝের ফ্রেম বেয়ে উঠতে শুরু করলো। এমন একখানে এসে থামলো, যেখান থেকে কারনিভলের প্রবেশ পথ পরিষ্কার দেখা যায়।

মোটা একটা লোহার ডাণ্ডার ওপর পা ঝুলিয়ে বসলো সে। গা ছমছমে অনুভূতি। চারপাশের বিষণ্ণতা যেন হা করে গিলতে আসছে তাকে। ঠাণ্ডা বাতাসে বিচিত্র ক্যাচকোচ আওয়াজ করছে ভাঙা, পুরনো কাঠের কাঠামো, নীরব শূন্যতা সইতে না পেরে যেন গুঙিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে, সেই সঙ্গে মিলিত হচ্ছে জোর বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। মুসার মনে হলো, উঁচু ওই বেড়াটা ওপাশের জীবন্ত পৃথিবী থেকে আলাদা করে দিয়েছে তাকে।

মাথার অনেক ওপরে উঠে গেছে স্তম্ভগুলো, কালচে ধূসর আকাশ ছুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে যেন। স্তম্ভ আর বেড়ার মাঝের পোড়ো ফান হাউসটাকে কেমন ভূতুড়ে লাগছে। ওটার প্রবেশ পথ দেখে মনে হয়, মস্ত দৈত্যের হাঁ করা মুখে রঙ মাখিয়ে দিয়েছে। কেউ হাসছে নীরব হাসি। ডানে, সাগরের ধারে লাশ হয়ে পড়ে আছে বুঝি টানেল অভ লাভ। মানুষের তৈরি ওই সুড়ঙ্গের দেয়ালে অসংখ্য ফোকর। সরু মুখের কাছে গড়িয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ, একসময় ওখানে বাধা থাকতো অনেক নৌকা, টিকেট কেটে লোকে চড়তো ওগুলোতে, ঘুরে আসতো সাগর থেকে।

 বড় একা লাগছে মুসার। সতর্ক হয়ে উঠলো হঠাৎ। কারনিভলের গেট দিয়ে। লম্বা লম্বা পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একজন। রকি বীচের বাণিজ্যিক এলাকার দিকে চলে গেল লোকটা। চেনা চেনা লাগলো তাকে। পরনে ধোপদুরস্ত শহুরে পোশাক, দূর থেকে ম্লান আলোয় চিনতে পারলো না লোকটাকে মুসা।

কোহেন না তো? চওড়া কাঁধই তো, নাকি? দাড়িও আছে না মুখে? তবে এলোমেলো লম্বা চুল দেখা গেল না, হ্যাঁটের জন্যেই বোধহয়। পরনে কালো সোনালি পাজামাও নেই, কাজেই শিওর হতে পারলো না মুসা।

খানিক পরেই আরেকজনকে বেরোতে দেখা গেল। লম্বা। ওকেও চেনা চেনা লাগলো, কিন্তু চিনতে পারলো না মুসা। সান্ধ্য পোশাক পরে মারকাস দ্য হারকিউলিস গেল না তো?

দমে গেল মুসা। পঞ্চাশ-ষাট গজ অনেক দূর। এতো দূরে বসা উচিত হয়নি। পোশাক বদলে বেরোলে এখান থেকে দেখে কারনিভলের একজন কর্মীকেও চিনতে পারবে না সে। স্থান নির্বাচন যে ভুল হয়ে গেছে, নিশ্চিত হলো আরও দুজন বেরোনোর পর। তৃতীয়জনও লম্বা, মনে হলো বয়স্ক, ধূসর চুল। চতুর্থজনকে চিনতে পারলো শুধু মাথার টাকের জন্যে, আগুন খেকো। তবে চতুর্থ লোকটার ব্যাপারেও কিছুটা সন্দেহ রয়ে গেল। টাকমাথা আর কি কেউ থাকতে পারে না?

নেমে, জায়গা বদল করে বসবে কিনা ভাবতে ভাবতেই আরও অনেকে। বেরিয়ে গেল। নিশ্চয় রিহারস্যালের সময় শেষ। বাইরে বেরোচ্ছে তাই কারনিভলের লোকেরা। ওদেরকে চিনতে পারলেও খুব একটা লাভ হতো না, বুঝতে পারলো মুসা। অনেকেই তো বেরোচ্ছে। কজনকে সন্দেহ করবে?

অবশেষে সত্যি সত্যি একজনকে চিনতে পারলো। মিস্টার কনর। দ্রুত হেঁটে গিয়ে একটা ছোট গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

নড়েচড়ে বসলো মুসা। ভাবছে। নামবে? গিয়ে খুঁজে বের করবে বন্ধুদের? নাকি যেখানে আছে, বসে থাকবে আরও কিছুক্ষণ?

সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

বাতাস বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পুরনো নাগরদোলার ক্যাঁচকোঁচ আর গোঙানি।

.

১০.

আগে আগে চলেছে কিশোর। দুই সঙ্গীকে নিয়ে যাচ্ছে স্যালভিজ ইয়ার্ডে।

ইয়ার্ডে ঢুকে, ওদেরকে দাঁড়াতে বলে সাইকেল রেখে গিয়ে জঞ্জালের গাদায়। ঢুকলো সে।

সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জঞ্জালের ভেতর জিনিসপত্র ঘাঁটা আর ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে লাগলো ররিন আর রবি।

করছেটা কি? রবি বুঝতে পারছে না।

জানি না, রবিনও পারছে না। আগে থেকে কিছু বলতে চায় না কিশোর, স্বভাব। কাজ শেষ করে তারপর বলে। কি করছে সে-ই জানে।

দুড়ুম-দাডুম আওয়াজ হচ্ছে জঞ্জালের গাদায়। রেগে গিয়ে সব যেন ছুঁড়ে ফেলছে কিশোর। অবশেষে শোনা গেল উল্লসিত চিৎকার, হাসিমুখে বেরিয়ে এলো সে-। হাতে একটা অদ্ভুত জিনিস। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললো, জানতাম পাবো। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে সব মেলে।

কিশোর কাছে এলে জিনিসটা চিনতে পারলো অন্য দুজন। স্টাফ করা একটা বেড়াল। সাদার ওপর কালো ফোঁটা। তিনটে পা ছিঁড়ে ঝুলছে, একটা নেই-ই। একটা চোখ খসে পড়েছে। চামড়া ফেটে ভেতরের তুলা-ছোবড়া সব বেরিয়ে পড়েছে।

এটা দিয়ে কি হবে? রবি জিজ্ঞেস করলো!

বিজ্ঞাপনের জবাব দেবো, হাসি-চওড়া হলো কিশোরের।

কিন্তু ওটা তো কানা বেড়ালের মতো না! হাত নাড়লো রবিন।

না তো কি হয়েছে? হয়ে যাবে। এসো।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো ওরা। ছোট একটা ওয়ার্কবেঞ্চে বসলো কিশোর। ফিরে চেয়ে বললো, রবিন, ফোন করে জিজ্ঞেস করো তো, কোথায় যেতে হবে।

রবিন রিসিভার তোলার আগেই কাজে হাত দিলো কিশোর। রঙ, ব্রাশ, সুই সুতো, কাপড়, তুলা, তার, আর দ্রুত রঙ শুকানোর কেমিক্যাল বের করলো। তিনটে পা মেরামত করে সেলাই করলো জায়গামতো, নতুন আরেকটা পা বানিয়ে লাগালো, শরীরের ছেঁড়া জায়গা সেলাই করলো। টিপে, চেপে বাঁকা করলো বেড়ালটাকে। পা-গুলো বকিয়ে দিলো। তারপর রঙ করতে শুরু করলো।

ফোন শেষ করে ফিরে এলো রবিন।

কি বললো? মুখ তুললো না কিশোর, বেড়ালের গায়ে ব্রাশ ঘষছে।

একটা আনসারিং সার্ভিসের নাম্বার ওটা, রবিন জানালো। তেত্রিশ স্যান। রোকুইওয়েতে যেতে বললো। এখান থেকে মাত্র দশ বুক দূরে।

গুড। অনেক সময় আছে। অ্যানসারিং সার্ভিসের সাহায্য নিয়েছে, তার কারণ, বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় লোকটার কোনো ঠিকানা ছিলো না।

আধ ঘন্টা পর সন্তুষ্ট হয়ে ব্রাশ রাখলো কিশোর। একটা কলারে লাল রঙ করে পরিয়ে দিলো বেড়ালের গলায়। ব্যস, হয়েছে, লাল-কালো ডোরাকাটা কানা। বেড়াল। পা ঠিকমতো বাকা হয়েছে তো? হয়েছে। তবু, চোখ থাকলে চিনে। ফেলবে। কাজ চালানো যাবে আশা করি।

আমার কাছেও রবির বেড়ালের মতো লাগছে না, রবিন বললো।

না লাগুক। গিয়ে অন্তত দেখাতে পারবো, বেড়াল এনেছি।

পনেরো মিনিট পর, ৩৩ স্যান রোকুই ওয়ে-র সীমানায় পাম গাছের একটা জটলায় ঢুকলো তিন কিশোর। ইটের তৈরি ছোট একটা বাড়ি, রাস্তা থেকে দূরে। রঙচটা একটা সাইনবোর্ড বুঝিয়ে দিলো, একসময় ওটা এক ঘড়ি মেরামতকারীর অফিস-কাম-বাড়ি ছিলো। মেঘলা বিকেলে অস্বাভাবিক নির্জন লাগছে বাড়িটা। জানালায় পর্দা নেই, ভেতরে আলো জ্বলছে না।

তবে রাস্তা নির্জন নয়। দলে দলে আসছে ছেলেমেয়েরা। হাতে, বগলের তলায় স্টাফ করা বেড়াল। নানা জাতের, নানা রঙের, নানা ধরনের। যার কাছে যা আছে, নিয়ে এসেছে, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিলুক না মিলুক। একশো ডলার অনেক টাকা, বিক্রির জন্যে সবাই উদ্বিগ্ন।

বেশির ভাগই তো মেলে না, রবিন বললো। তবু এনেছে।

লোকে কিছু না দিয়েই টাকা নিতে চায়, তিক্তকণ্ঠে বললো রবি। শুটিং গ্যালারি চালাই তো, লোকের স্বভাব-চরিত্র আমার জানা।

ওরা ভাবছে, কিশোর বললো। ওদেরটা পছন্দ হয়ে যেতেও পারে। হলেই কড়কড়া একশো ডলার। একটার দামও দশের বেশি হবে না, নব্বই ডলারই লাভ।

এই সময় নীল একটা গাড়ি ঢুকলো বাড়ির আঙিনায়, ঘুরে চলে গেল ওপাশে। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো একজন লোক। দূর। থেকে তার চেহারা ভালোমতো দেখলো না ছেলেরা, চিনতে পারলো না।

দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো লোকটা। হুড়মুড় করে ঢুকতে শুরু করলো। ছেলেমেয়ের দল।

গাছের আড়ালে হুমড়ি খেয়ে থাকতে থাকতে উত্তেজিত হলো রবি। আমরা কি করবো, কিশোর?

নীল গাড়িটা চিনেছো? জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলো কিশোর।

আরেকবার তীক্ষ্ণ চোখে দেখলো রবি। না। আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কারনিভলের সবার গাড়িই এরচে বড়, ট্রেলার টানতে হয় তো!

বেশ, মাথা কাত করলো কিশোর। আমরা দুজন এখানে থাকছি। বেড়াল নিয়ে রবিন যাক। কয়েক মিনিট পর আমরা একজন গিয়ে কাছে থেকে দেখবো গাড়িটা। হুশিয়ার থাকতে হবে আমাদের, যাতে দেখে না ফেলে। চোরটা যাতে বুঝতে না পারে কেউ তাকে সন্দেহ করেছে, পিছু নিয়েছে। কারনিভলের লোক, হলে তোমাকে চিনবেই।

আমি গিয়ে কি কি করবো? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

বেড়াল বিক্রির চেষ্টা করবে। হয়তো কিনবে না সে। না কিনুক। তোমার। আসল কাজ হবে, তার চেহারা দেখে আসা। জেনে আসা, বেড়াল নিয়ে কি করে সে।

বেশ, যাচ্ছি, আবার সাইকেলে চাপলো রবিন।

বেড়ালটা বগলে চেপে, সাইকেল চালিয়ে এসে বাড়ির দরজায় থামলো সে। সাইকেল স্ট্যাণ্ডে তুলে মিশে গেল ছেলেমেয়েদের স্রোতে। = বড় একটা হলঘরে ঢুকলো। বাচ্চারা গিজগিজ করছে ওখানে। আসবাব। বলতে কয়েকটা কাঠের চেয়ার, আর একটা লম্বা টেবিল। টেবিলের ওপাশে বসে আছে একজন মানুষ, চেয়ার-টেবিলের বেড়ার ওপাশে আত্মগোপন করতে চাইছে। যেন। এক এক করে বেড়াল নিয়ে পরীক্ষা করছে। ও

দুঃখিত, বললো সে। এই তিনটে চলবে না। খসখসে কণ্ঠস্বর। বিজ্ঞাপনেই বলেছি কেমন বেড়াল চাই।…না, তোমার ওটাও চলবে না, সরি।

আরেকটা বেড়াল নিয়ে এগিয়ে গেল একটা ছেলে। হাত বাড়িয়ে বেড়ালটা প্রায় কেড়ে নিলো লোকটা। ওরকম জিনিসই পুরস্কার জিতে আবার হারিয়েছে মুসা। লোকটার বাহুতে একটা টাট্টু আঁকা দেখলো রবিন, পালতোলা একটা জাহাজের ছবি, স্পষ্ট।

গুড, লোকটা বললো। এই জিনিসই চাই। এই নাও তোমার একশো ডলার।

রবিনের কানে ঢুকছে না যেন কথা। ভাবছে, ওই লোকটা কি কারনিভলের কেউ?, তাহলে নিশ্চয় চিনতে পারবে রবি। ওই টাট্ট তার চোখে না পড়ার কথা নয়। বাদামী চামড়ার লোক, সোজা তাকালো রবিনের দিকে। এই, এই ছেলে, তুমি। দেখি এদিকে এসো, তো।

চমকে গেল রবিন। তাকে কি সন্দেহ করলো লোকটা? দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গিয়ে বেড়ালটা রাখলো টেবিলে। ওটার দিকে একবার চেয়েই হাসলো লোকটা। হু, মেরামত করা হয়েছে। মন্দ না। আমার বাচ্চারা পছন্দ করবে। এই নাও, তোমার টাকা।

থ হয়ে গেল রবিন। হাত বাড়িয়ে নিলো একশো ডলার, বিশ্বাস করতে পারছে না। চেয়ে আছে লোকটার দিকে। কিন্তু লোকটা গুরুত্ব দিলো না তাকে। আরেকটা ছেলের দিকে তাকালো।

টেবিলের কাছ থেকে সরে এলো রবিন। দেখলো, টেবিলের ধারে মেঝেতে বেড়ালের স্তূপ। তারটা সরিয়ে রাখা হয়েছে একপাশে। ওটার সঙ্গে ওরকম আরও একটা। খানিক দূরে রাখা আরও দুটো, মুসা যেটা পুরস্কার পেয়েছিলো অবিকল সেরকম।

ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে ভিড়। অস্বস্তি লাগছে রবিনের। বেরিয়ে যাবে, না থাকবে?- কিছুই তো জানা হলো না এখনও, যায় কি করে? আবার থাকলেও যদি সন্দেহ করে লোকটা? ঝুঁকি নেয়াই ঠিক করলো সে। থাকবে আরও কিছুক্ষণ।

দেখো, খোকা, ওরকম বেড়াল চাইনি আমি, নাছোড়বান্দা একটা ছেলেকে বোঝাচ্ছে লোকটা। দেখতে পাচ্ছি তোমারটা ভালো, কিন্তু আমি অন্য জিনিস চাই। বাচ্চাকে বড়দিনের উপহার দেবো। আমার পছন্দ না হলে দিই কি করে, তুমিই বলো? ছেলেটাকে চওড়া হাসি উপহার দিলো সে। হাত নাড়তে আবার পাল-তোলা-জাহাজটা চোখে পড়লো রবিনের।

কি জিনিস চান, বুঝতে পারছি, ছেলেটা বললো। ওই দুটোর মতো তো? একটার খবর আপনাকে দিতে পারি। আমার বন্ধু ডিক ট্যানারের কাছে আছে। কারনিভলে পুরস্কার পেয়েছে।

তাই? ভুরু কুঁচকে গেল লোকটার, ঠোঁট সামান্য ফাঁক। নিশ্চয় আমার বিজ্ঞাপন দেখেনি। আমার হাতেও আর সময় নেই, শুধু আজকের দিনটাই।

গিয়ে তাহলে কথা বলুন ওর সাথে, ছেলেটা বললো। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে। টোয়েন্টি ফোর কেলহ্যাম স্ট্রীট।

এহহে, দেরি হয়ে গেল, হঠাৎ যেন তাড়াহুড়া বেড়ে গেল লোকটার। ক্ষণিকের জন্যে তাকালো রবিনের দিকে। জ্বলে উঠলো না? নাকি চোখের ভুল? ঠিক বুঝতে পারলো না রবিন। অল্প কয়েকটা ছেলে রয়েছে আর ঘরে। ওরা যতোক্ষণ থাকে, সে-ও থাকবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

 আরেকটা ছেলের কাছে একটা লাল-কালো ডোরাকাটা কানা বেড়াল কিনলো লোকটা। আর কারও কাছে নেই ওরকম বেড়াল। হাত নেড়ে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বললো লোকটা। বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসতে হলো রবিনকে। সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি চললো পাম গাছগুলোর কাছে।

অনেকক্ষণ থাকলে, রবি বললো।

জানার চেষ্টা করলাম, হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো রবিন। লোকটা লম্বা, বাদামী চামড়া, বাহুতে একটা পাল-তোলা-জাহাজের টাট্টু। কারনিভলের কেউ?

পাল-তোলা-জাহাজ? চিবুক ডললো রবি। না, ওরকম কেউ তো নেই। কয়েকজন রাফনেকের হাতে টাট্টু আছে, তবে জাহাজ নয়। আর চেহারাও…নাহ, মেলে না কারও সাথে।

চিন্তিত লাগছে কিশোরকে। কারনিভলে হয়তো লুকিয়ে রাখে, বললো সে। আর মেকআপ নিয়ে মুখের রঙ বদলানোও কিছু না। রবিন, রবি গিয়ে ওর গাড়িটা দেখে এসেছে। কোনো সূত্র পায়নি। লাইসেন্দ্র নম্বর লিখে নিয়েছি।

আসল কথাটাই বলিনি এখনও, কিশোর। ও আমাদের বেড়াল কিনেছে।

বাড়ি পড়লো যেন কিশোরের মাথায়। কিনেছে! নকলটা!

পকেট থেকে একশো ডলার বের করে দেখালো রবিন। এই যে, টাকা। ওরকম দেখতে আরও চারটে কিনেছে। তারমধ্যে তিনটে আসল মনে হলো।

তোমাকে চিনেছে?

কি করে? আগে কখনও দেখা হয়নি তো।

কাল রাতের চোরটাই না তো? নিজেকেই করলো প্রশ্নটা। যদি সে হয়, আর তোমাকে চিনে থাকে, তাহলে আমাদের বোকা বানানোর জন্যেই কিনেছে বেড়ালটা।

আসল তাহলে তিনটে পেয়েছে? রবি বললো।

আরও একটার খোঁজ দিলো একটা ছেলে। কারনিভলে নাকি পুরস্কার পেয়েছে। থাকে চব্বিশ নম্বর কেলহ্যাম স্ট্রীটে। নাম ডিক ট্যানার।

এটাই আসল খবর, রবিন! চুটকি বাজালো কিশোর। তিনটে কিনেছে, আমার ধারণা, চার নম্বরটাও কিনতে যাবে। আমরাও যাবো ডিকের বাড়িতে। তার আগে দেখি বেড়াল তিনটে নিয়ে লোকটা কি করে…

কিশোর, বলে উঠলো রবি। শেষে যে ছেলেটা ঢুকেছিলো, সে-ও বেরোচ্ছে।

ছেলেটার বগলে একটা সাদা বেড়াল। বিক্রি করতে পারেনি। লোকটাকেও দেখা গেল দরজায়। আর কেউ আসছে কিনা বোধহয় দেখতে বেরিয়েছে। নির্জন। পথে চোখ বোলালো, তারপর ঢুকে গেল আবার ভেতরে।

এসো, বলে, উঠে দাঁড়ালো কিশোর।

কালচে হয়ে আসছে ধূসর গোধূলি। পা টিপে টিপে বাড়িটার কাছে চলে এলো ওরা। সাবধানে মাথা তুলে লিভিং রুমের জানালা দিয়ে সাবধানে ভেতরে তাকালো।

আগের জায়গাতেই বসা লোকটা। সামনে টেবিলে রেখেছে এখন তিনটে কানা বেড়াল, যেগুলো মুসারটার মতো দেখতে। একটা বেড়াল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে শুরু করলো।

হ্যাঁ, ওগুলোই পুরস্কার দিয়েছি, ফিসফিসিয়ে বললো রবি।

ওই যে, দুটো ফেলে রেখেছে, কিশোর বললো। কোণের দিকে দেখো৷

রবি আর রবিনও দেখলো। দুটোই নকল। তার একটা রবিন নিয়ে গিয়েছিল।

ফেলে দিয়েছে, আবার বললো কিশোর। তারমানে তোমারগুলোই চায়, রবি।

শশশ! হুঁশিয়ার করলো রবিন।

তৃতীয় বেড়ালটাও দেখা শেষ করেছে লোকটা। রেখে দিয়েছে টেবিলে। হাতে বেরিয়ে এসেছে ইয়া বড় এক ছুরি।

.

১১.

নড়তে ভুলে গেছে যেন ছেলেরা। ছুরিহাতে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। আচমকা, একটা বেড়াল টেনে নিয়ে পোঁচ মারলো। চিরে ফেললো পেট। দ্বিতীয়টার চিরলো। তৃতীয়টারও। তারপর টেনে টেনে বের করতে লাগলো ভেতরের তুলা, ছোবরা, কাঠের গুঁড়ো। সমস্ত কিছু ছড়াতে লাগলো টেবিলে। ছোবড়া আর তুলার। ভেতর খুঁজতে লাগলো কি যেন।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। ছুরিটা টেবিলে ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়লো চেয়ারে। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেঁড়া বেড়ালগুলোর দিকে, পারলে চোখের আগুনেই ভস্ম করে ফেলে।

পায়নি, ফিসফিস করে বললো রবিন।

না, কিশোর বললো। ডিকেরটার ভেতরে থাকতে পারে। চলো, চলো, ও বেরোবে! কুইক!

লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। হাত বাড়ালো চেয়ারে রাখা হ্যাঁটের দিকে।

 কাছেই হিবিসকাসের গোটা তিনেক ঘন ঝোপ। ওগুলোর ভেতরে এসে প্রায়। হুমড়ি খেয়ে পড়লো তিনজনে। বেরিয়ে, দরজা লাগিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। লোকটা। ঝোপের দিকে চোখ তুলে তাকালো না। লম্বা পা ফেলে হারিয়ে গেলে বাড়ির আড়ালে। গাড়ির দরজা বন্ধ করার শব্দ হলো। স্টার্ট নিলো, ইঞ্জিন। শা করে ছুটে বেরিয়ে গেল নীল গাড়িটা।

বেড়াল নিতে যাচ্ছে! রবিন বললো।

 চলো, আমরাও যাই, বললো রবি।

আমাদের সাইকেল, ওর গাড়ি। আর কেলহ্যাম স্ট্রীট এখান থেকে পাঁচ মাইল। তোমাদের কারনিভলের কাছাকাছি।

হতাশ দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালো ওরা।

কিছুই করতে পারছি না আমরা! গুঙিয়ে উঠলো রবিন। কিশোর, কিছু একটা করো!

কি করবো? ঝোপ থেকে বেরোলো কিশোর। থমথমে চেহারা। বাড়িটার দিকে চেয়ে হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পারবো হয়তো! দেখো দেখো, টেলিফোনের তার! বলতে বলতেই দৌড় দিলো সে। দরজা দিয়ে ঢুকতে পারলো না। তালা লাগানো।

জানালা! চেঁচিয়ে উঠলো রবি।

লিভিং রুমের জানালার পাল্লায় ঠেলা দিতেই খুলে গেল। এক এক করে। চৌকাঠে উঠে টপাটপ ভেতরে লাফিয়ে পড়লো তিনজনে।

ফোনটা কোথায় দেখো! তাগাদা দিলো কিশোর। সবখানে খোজো!

ওই যে, কিশোর, হাত তুলে দেখালো রবি। ওই যে, ঘরের কোণে মেঝেতে রেখে দিয়েছে।

ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো কিশোর। ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো। আস্তে করে আবার ক্রেডলে রেখে দিয়ে মাথা নাড়লো। নষ্টহ্! ফেস করে ছাড়লো ফুসফুঁসে চেপে রাখা বাতাস।

হলো না তাহলে? রবিন বললো।

জানি না, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। সাইকেল নিয়ে যেতে পারি-লাভ হবে বলে মনে হয় না। বাড়িতে লোক না থাকলে অবশ্য…

না থাকলে কি বসে থাকবে মনে করেছো? তালা ভেঙে ঢুকে নিয়ে যাবে।

 কাছেপিঠে পাবলিক টেলিফোন নেই? রবি জিজ্ঞেস করলো।

গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। তাই তো! আমার মগজ ভোঁতা…, কথা শেষ না করেই থেমে গেল।

বাইরে পায়ের শব্দ, এগিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলো রবিন। ঝট করে মাথা নুইয়ে ফেললো আবার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসে জানালো, লোকটা ফিরে এসেছে!

চলো বেরিয়ে যাই, উদ্বিগ্ন হয়ে বললো রবি।

সময় নেই, মৃদু কাঁপছে রবিনের কণ্ঠ।

আঙুল তুলে দরজা দেখালো কিশোর, পেছনের ঘরে ঢোকার। দৌড়ে গিয়ে ঢোকার সময় ধাক্কাধাক্কি লাগিয়ে দিলো ওরা। আগে ঢুকলো রবি, পেছনে রবিন, সবার শেষে কিশোর। ছোট ঘর। আসবাবপত্র কিছু নেই। জানালায় খড়খডির। জন্যে আলো আসতে পারছে না। তাড়াতাড়ি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ওটা ঘেঁষে। দাঁড়ালো ওরা।

লিভিং রুমের দরজা খোলার শব্দ হলো, বন্ধ হলো।

দীর্ঘ নীরবতা।

তারপর ছেলেদের চমকে দিয়ে খলখল করে হেসে উঠলো লোকটা। খসখসে গলায় বললো, খুব চালাক, না? অতি চালাকের গলায় দড়ি, ভুলে গেছো!

একে অন্যের দিকে তাকালো ওরা।

আবার শোনা গেল হাসি। তিন-তিনটে মাথা জানালায়, ভেবেছো দেখিনি? আরও সাবধানে উঁকি দেয়া উচিত ছিলো। তোমাদের অনেক আগে দুনিয়ায়। এসেছি, বাছারা, চোখ পেকেছে, কান পেকেছে। তিন বুদু, বোকামির শাস্তি পাবে এখন।

দরজায় তালা লাগানোর শব্দ হলো। তারপর আরেকটা ভারি ধাতব শব্দ, লোহার দণ্ড আড়াআড়ি ফেলে পাল্লা আটকানো হয়েছে, যাতে তালা ভাঙলেও দরজা খুলতে না পারে। নাও, থাকো এখন, বললো খসখসে কণ্ঠ। একটা কথা মনে রেখো। আর আমার ধারেকাছে আসবে না। হাসলো না আর। দূরে সরে গেল পদশব্দ। দড়াম করে বন্ধ হলো সামনের দরজা। ভারি নীরবতা যেন চেপে বসলো ছোট্ট বাড়িটার ওপর।

জানালা, বললো কিশোর। গিয়ে খড়খড়ি তুলেই থমকে গেল। শিক লাগানো। বিড়বিড় করলো, নিশ্চয় এটা ঘড়ি মেকারের স্টোররুম ছিলো!

জানালা খুলে চেঁচাই, রবিন বললো।

গলা ফাটিয়ে চেঁচালো ওরা। কেউ শুনলো না। কেউ এলো না। রাস্তা অনেক দূরে, বাড়িঘর আরও দূরে। ওদের চিৎকার কারও কানে গেল না। কয়েক মিনিট পর পা ছড়িয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো রবি। জানালা খোলায় ঘরে আলো এসেছে। এই প্রথম. চোখে পড়লো আরেকটা দরজা।

ছুটে গেল কিশোর। লাভ হলো না। ওটাও শক্ত করে আটকানো, তালা দেয়া।

আমাদের দৌড় এখানেই শেষ, হতাশ কণ্ঠে বললো রবি। বেড়ালটা নিয়ে যাবে সে। আটকাতে পারবে না।

এখনও আশা আছে, বলে উঠলো কিশোর। দিনিজসপ্রে! মুসা আমাদের বিপদ সঙ্কেত পাবে।

পকেট থেকে খুদে হোমারটা বের করলো গোয়েন্দাপ্রধান। মুখের কাছে এনে জোরে জোরে বললো, সাহায্য! সাহায্য!

খুব মৃদু গুঞ্জন শুরু করলো যন্ত্রটা।

লাল আলো জ্বলবে এখন মুসার হোমারে, বললো কিশোর। সত্যিই শুনবে তো–তিনজনে একই কথা ভাবছে। সাহায্য করতে আসবে ওদেরকে?

.

ডাণ্ডার ওপরই বসে আছে মুসা। পর্বত থেকে আসা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস সুচের মতো বিধছে চামড়ায়। কাপ তুলে দিচ্ছে গায়ে। আকাশ মেঘলা থাকায় সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নামছে। প্রবেশ পথের লোকজন এখন শুধু ছায়া।

যারা যারা বেরিয়েছে, তাদের একজনকেও ফিরতে দেখেনি। অথচ কারনিভলে শো শুরু হতে আর মাত্র ঘন্টাখানেক বাকি। গেল কোথায় সবাই? কিশোর, রবিন আর রবিই বা কোথায় গেল? কারনিভল খোলার আগেই তো রবির ফেরার কথা। কিশোর বা রবিনেরও এতো দেরি করার কথা নয়, অন্তত একটা মেসেজ তো পাঠানো উচিত ছিলো।

উদ্বিগ্ন হলো মুসা।

মাঝে মাঝে কিশোর এমন আচরণ করে, না, রাগ লাগে তার। কোথায় যাচ্ছে, বলে গেলে কি ক্ষতি হতো বাবা? না, সব কাজ শেষ করে, সফল হয়ে এসে তারপর বলা! যত্তোসব! তার এসব নাটকীয়তার কারণে আগে অনেকবার বিপদে পড়েছে তিন গোয়েন্দা, তা-ও স্বভাব বদলাতে পারে না। গিয়ে খোঁজ করবে?

করাই উচিত। মাটিতে নামলো মুসা। ফান হাউসের বিশাল মুখটা তার দিকে চেয়ে যেন ব্যঙ্গ করে হাসছে এই ভর সন্ধেবেলা। দ্রুত ওটার পাশ কাটিয়ে এসে মাথা গলিয়ে দিলো বেড়ার ফোকরে।

কারনিভলে নাগরদোলার ঘোড়াগুলোর ক্যানভাস সরানো হয়েছে। বাজনা বাজছে। বুদে পাওয়া গেল না রবিকে। ঠোঁট কামড়ালো মুসা। কোথায় গেছে? কানা বেড়াল কেনার বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে, তার বাড়িতে দুজনকে নিয়ে যায়নি তো কিশোর? কিন্তু তাহলেও কি এতো দেরি করার কথা?

হয়তো জরুরী কোনো কাজে আটকে গেছে, মনকে বোঝালো মুসা। আসবে। কারনিভল খোলার আগেই চলে আসবে। আর এসেই প্রথমে মুসাকে খুঁজবে, তার রিপোর্ট শুনতে চাইবে। তাকে না পেলে চিন্তা করবে…

এই সময় মনে পড়লো হোমারটার কথা। পকেটেই তো রয়েছে। বিপদে পড়লে জরুরী সঙ্কেত পাঠাবে কিশোর।

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করলো মুসা। নাহ, নীরব। লাল আলোও জ্বলছে না।

.

১২.

মেঝেতে বসে মুখ তুলে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকালো রবি। সিগন্যাল কতদূর। যাবে, কিশোর?

তিন মাইল, বলেই আরেকবার গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। উঁহুহু, কারনিভল এখান থেকে পাঁচ মাইল। মুসা আমাদের সঙ্কেত পাবে না।

আবার একে অন্যের দিকে তাকালো ওরা।

 আবার চেঁচালে কেমন হয়? রবিন পরামর্শ দিলো। কেউ না কেউ, একসময় না একসময় আমাদের চিৎকার শুনতে পাবেই।

যদি ততোক্ষণ গলায় জোর থাকে আমাদের, বললো কিশোর। শোনো, বেরোনোর উপায় আমাদেরকেই করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমন কোনো ঘর নেই, চেষ্টা করলে যেটা থেকে বেরোনো যায় না। কোথাও না কোথাও দুর্বলতা, থাকেই। সেটা পাই কিনা, খুঁজে দেখি।

কিন্তু কোথায় খুঁজবো? রবি বললো।

হয়তো কিছু একটা মিস করেছি আমরা। রবিন, দেয়ালগুলো দেখো তুমি। পাইপ গেছে যেখান দিয়ে, সেসব জায়গা ভালোমতো দেখবে। আমি জানালাগুলো দেখছি। রবি, তুমি দরজা দেখো। কোণের আলমারিটাও বাদ দেবে না।

নতুন উদ্যমে কাজে লাগলো ওরা।

কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আবার দমে গেল রবি। দরজাগুলো আগের মতোই লাগলো তার কাছে, কোথাও দুর্বলতা পেলো না। দেয়ালে কিছু পেলো না রবিন।

থামলে কেন? চালিয়ে যাও, উৎসাহ দিলো কিশোর। চালিয়ে যাও। কিছু না। কিছু পাওয়া যাবেই।

জানালার প্রতিটি ইঞ্চি পরখ করছে গোয়েন্দাপ্রধান। চার হাতপায়ে ভর দিয়ে এখন দেয়ালের নিচের অংশ দেখছে রবিন।

আলমারির ভেতরে খুঁজছে রবি। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, দেখে যাও! দেখে যাও! হাতে একপাতা টাইপ করা কাগজ, আলমারিতে পেয়েছে। কারভিলের ইটিনর্যারি। কোথায় কোথায় যাবে, কোনখান থেকে কোনখানে, সেই তালিকা। আমাদেরটার। ক্যালিফোর্নিয়ার পুরো শিডিউল রয়েছে।

তাহলে এই লোকটা তোমাদের কারনিভলেই কেউ, নিজের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ পেয়ে খুশি হলো কিশোর।

কিংবা ওদের কারনিভলকে অনুসরণ করছে, অন্য যুক্তি দেখালো রবিন।

রবি, জিজ্ঞেস করলো কিশোর। লোকটার গলা চিনেছো? কথা যে বললো, চেনা চেনা লাগলো?

না কখনও শুনিনি।

মিনিটখানেক চুপ করে রইলো কিশোর, ভাবলো। গলাও হয়তো নকল। করেছে। খসখসে ভাবটা কেমন যেন মেকি।

রবি আর রবিন দুজনেই গিয়ে আলমারিতে খুঁজতে লাগলো আবার। কয়েকটা তাকে মলাটের বাক্স আর পুরনো হার্ডবোর্ড বোঝাই। এক তাকে অদ্ভুত একটা পোশাক পেয়ে টেনে বের করলো রবিন। দেখো তো, এটা কি? আমি চিনতে পারলাম না।

 কালো কাপড়ে তৈরি, আলখেল্লার মতো একটা পোশাক, তবে ঢোলা নয়, আঁটো। কাঁধের সঙ্গে জোড়া দেয়া হুড–তাতে মাথা, কান, গাল সব ঢেকে যায়, শুধু মুখের সামনের দিকটা খোলা থাকে।

ভুরু কোঁচকালো কিশোর। কারনিভলের পোশাক-টোশাক না তো? রবি?

অবাক হয়ে পোশাকটা দেখছে রবি। নীরবে-এগিয়ে এসে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। ইতিমধ্যে তাক থেকে একজোড়া জুতো বের করলো। রবিন। ওগুলো অদ্ভুত। কালো ক্যানূভাসে তৈরি, রবারের সোল। তলাটা বিচিত্র, অনেকটা সাকশন কাপের মতো দেখতে।

দেখে আরও অবাক হলো রবি।

কি, চিনেছো? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

মাথা নাড়লো রবি। আমাদের কারনিভলে কেউ পরে না, কিন্তু, আবার মাথা নাড়লো সে। বলতে দ্বিধা করছে। ঠিক শিওর না, তবে যদূর মনে পড়ে, মাছিমানব টিটানভ পরতো ওরকম পোশাক।

কী মানব? রবিন অবাক।

মাছিমানব। আমি তখন ছোট, নানীর কাছে থাকি। শিকাগোর এক ছোট সার্কাসে পার্টটাইম কাজ করতো বাবা। টিটানভ শো দেখাতো তখন ওই সার্কাসে। তার শো আমি দেখেছি। বেশিদিন থাকতে পারেনি ওখানে। চুরির দায়ে চাকরি যায়। পরে শুনেছি, জেলে গেছে। হয়তো আবারও চুরি করে ধরা পড়েছিলো পুলিশের হাতে।

জেল! কিশোর বললো। টাট্টু আঁকা লোকটার সঙ্গে তার চেহারার মিল আছে?

চেহারা মনে নেই। তবে বয়েসের মিল আছে। মাছিমানবের পোশাক ছাড়া দেখিনি তো কখনও..,

এই পোশাকটা কি ঠিক ওরকম?

হ্যাঁ। জুতোগুলোও। এরকম জুতো ছাড়া খেলা দেখাতে পারে না। মাছিমানবেরা। তলায় সাকশন কাপ দেখছে না, উঁচু দেয়াল বেয়ে উঠতে কাজে লাগে। প্রায় যে-কোনো দেয়াল…

কিন্তু রবির কথাই কানে ঢুকছে না কিশোরের। আনমনে বিড়বিড় করলো, সেদিনের সেই বুড়ো চোর…পার্ক থেকে গায়েব হয়ে গেল…উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে… তুড়ি বাজালো। ঠিক! মাছিমানবের পক্ষেই সম্ভব!

জন্তুজানোয়ারও সামলাতে পারতো টিটানভ, আরেকটা জরুরী তথ্য জানালো রবি। সিংহও।

জলদি বেরোতে হবে এখান থেকে! মাথা ঝাড়া দিলো কিশোর। নইলে বেড়ালটা হাতিয়ে নিয়ে যাবে চলে। আর ধরা যাবে না। চেঁচাও, চেঁচাও! ফাটিয়ে ফেলো গলা!

জানালার কাছে সমবেত হয়ে আবার চিৎকার শুরু করলো ওরা।

.

ইস, এখনও আসছে না কেন কিশোররা? উৎকণ্ঠা বাড়ছে মুসার। শেষে আর থাকতে না পেরে মনস্থির করে ফেললো, খুঁজতেই বেরোবে।

আধঘন্টা পর সাইকেল চালিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকলো সে। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। বোরিসকে দেখা গেল, ছোট ট্রাকটা থেকে মাল নামাচ্ছে। নামানো প্রায়। শেষ।

সাইকেল থেকে না নেমেই জিজ্ঞেস করলো মুসা, বোরিসভাই, কিশোর আর রবিনকে দেখেছেন?

না তো! সারাদিনই দেখিনি। কিছু হয়েছে?

বুঝতে পারছি না। আমি…

মুসা, হাত তুললো বোরিস। কিসের আওয়াজ? ভোমরা ঢুকেছে নাকি তোমার পকেটে?

উত্তেজিত না থাকলে আগেই খেয়াল করতো মুসা। বোলতায় কামড়ালো যেন তাকে। ঝট করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো যন্ত্রটা। সিগন্যাল! চেঁচিয়ে উঠলো সে, বোরিসভাই, বিপদে পড়েছে ওরা! জলদি চলুন।

একটাও প্রশ্ন করলো না আর বোরিস। প্রায় লাফিয়ে গিয়ে উঠলো ট্রাকের ড্রাইভিং সীটে। সাইকেল রেখে মুসা গিয়ে বসলো তার পাশে। ইয়ার্ডের গেট দিয়ে। ছুটে বেরোলো ট্রাক।

মুসার হাতে হোমার। দিকনির্দেশ করছে কাঁটা। পথ বাতলে দিতে লাগলো বোরিসকে, বায়ে, বোরিসভাই…আবার বায়ে…এবার সোজা…

পথের ওপর বোরিসের দৃষ্টি, মুসার নজর যন্ত্রের ডায়ালে। উড়ে যেতে পারলে যন্ত্রের কাটা একদিকেই নির্দেশ করতো। যেহেতু মাটি দিয়ে যেতে হচ্ছে, পথ সরাসরি যায়নি, ঘোরাঘুরি হচ্ছে, ফলে কাটাও একবার ডানে, একবার বায়ে সরছে।

বলে যাচ্ছে মুসা, ডানে, বোরিসভাই–বাঁয়ে…আবার বায়ে…এবার ডানে!

ধীরে ধীরে বাড়ছে যন্ত্রের শব্দ।

এখানেই! মুসা বললো। কাছাকাছিই হবে কোথাও!

নির্জন একটা পথে এসে পড়েছে ট্রাক। এই সন্ধেবেলা একটা লোককেও দেখা গেল না রাস্তায়। ধীরে চালাচ্ছে এখন বোরিস। মুসার নজর পথের দুপাশে। কাউকে দেখলো না, কোনো নড়াচড়া নেই। আবার তাকালো কাঁটার দিকে।

ডানে, বোরিসভাই। এখানেই আছে কোথাও।

কিছু তো দেখছি না, মুসা! উদ্বেগে ভরা বোরিসের কণ্ঠ।

দাঁড়ান, দাঁড়ান! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। পিছে, পেছনে যান! বেশি এগিয়ে। গেছি!

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো বোরিস। ট্রাকটা পুরোপুরি নিশ্চল হওয়ার আগেই ব্যাক-গীয়ার দিলো। বিকট শব্দে প্রতিবাদ জানালো ইঞ্জিন, পিছাতে শুরু করলো গাড়ি।

পথ থেকে দূরে ছোট হঁটের বাড়িটা দেখালো মুসা। বোরিসভাই, আমার মনে হয় ওখানে।

গাড়ি পার্ক করে লাফ দিয়ে নামলো বোরিস। মুসাও নামলো। বাড়িটার দিকে দৌড় দিলো দুজনে।

.

কয়েক মিনিট পর, হাসিমুখে বেরিয়ে এলো কিশোর, রবিন আর রবি। দরজা ভেঙে ফেলেছে বোরিস আর মুসা মিলে।

খাইছে! হেসে বললো মুসা। কিশোর, তোমার দিনি…দিনি…

দিনিজসপ্রে।

হ্যাঁ। দিনি…দিনি… বাংলা শব্দটা কিছুতেই উচ্চারণ করতে না পেরে রেগে গেল মুসা।

ধ্যাত্তোর, নিকুচি করি দিনিফিনির! সহজ নাম রাখো।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, হোমারটা সত্যি কাজে লাগলো। এতো তাড়াতাড়ি…

এই, কে তোমরা! ধমকের সুরে বলে উঠলো কেউ।

ফিরে তাকালো ওরা। রাস্তার দিক থেকে আসছে ছোটখাটো একজন মানুষ। কাছে এসে আবার ধমক দিলো, এখানে কি? হায় হায়রে,আমার দরজা-টরজা সব ভেঙে ফেলেছে! আদালতে পাঠাবো আমি তোমাদেরকে! জেলের ভাত খাওয়াবো!

লোকটার মুখোমুখি হলো কিশোর। শান্তকণ্ঠে বললো, সরি স্যার, ইচ্ছে করে ভাঙিনি। একটা বাজে লোক আমাদের এখানে এনে বন্দি করেছিলো। বাইরে থেকে। তালা লাগিয়ে চলে গেল। বহুত চিল্লাচিল্লি করেছি, কেউ শোনেনি। লোকটার হাতে টাট্টু আঁকা, পাল-তোলা-জাহাজের ছবি, কালো চামড়া। কোন দেশী, বলতে পারবো না। চেনেন? আপনার ভাড়াটে?

আটকে রেখেছে? টাট্টু? কি বলছো তুমি, ছেলে? বৃদ্ধ বললো। আজ সকালে এক ভদ্রলোককে ভাড়া দিয়েছি। দেখে তো সহজ-সরল মানী লোক মনে হলো। বুড়ো মানুষ। কোথায় নাকি সেলসম্যানের চাকরি করে। টাট্ট তো দেখিনি! যা-ই হোক, ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে। পুলিশে রিপোর্ট করবো আমি।

হ্যাঁ, তাই করুন, স্যার। পুলিশকেই জানানো দরকার। দেরি না করে এখুনি। যান, প্লীজ।

মাথা ঝাঁকালো লোকটা। দ্বিধা করলো, ঘুরে আবার ফিরে চাইলো, তারপর আবার ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো রাস্তার দিকে।

লোকটা কিছুদূর এগিয়ে গেলে কিশোর বললো, চলো, আমরাও যাই। তাড়াতাড়ি করলে এখনও হয়তো ধরা যায় ব্যাটাকে। বোরিসভাই, চব্বিশ নম্বর। কেলহ্যাম স্ট্রীট। কুইক!

.

১৩.

সাগরের ধারে পুরনো, বড় বড় সব বাড়ি। পথের দুধারে গাছপালা, কড়া রোদেও নিশ্চয় ছায়া থাকে। নীল গাড়িটা দেখলো না ছেলেরা।

জানতাম, ব্যাটাকে ধরা যাবে না, নিরাশ কণ্ঠে বললো মুসা।

হ্যাঁ, অনেক দেরি করিয়ে দিলো, সুর মেলালো মুসা।

কোনো কারণে ওর দেরি হলেই বাঁচি, আশা করলো, কিশোর। পথের। মাথায়, ওই বাড়িটাই বোধহয় চব্বিশ নম্বর। ইস, অন্ধকারও হয়ে যাচ্ছে। যান। এগোন।

তিনতলা সাদা একটা বাড়ি। চারপাশে বড় বড় গাছ। বাগানে ফুলের বেড। ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি, সেই নীল গাড়িটা নয়। মোড় নিয়ে সেদিকে চললো। বোরিস, এই সময় আলো জ্বললো বাড়ির ভেতরে।

এইমাত্র এলো? কিশোর তাকিয়ে আছে সেদিকে, লোকজন কে আছে দেখতে চায়। এর

বাড়ির সামনে এনে গাড়ি রাখলো বোরিস।

 মহিলাকণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল বাড়ির ভেতর থেকে, চোর! চোর। ধরো! ধরো!

এক ঝটকায় ট্রাকের দরজা খুলে লাফিয়ে নামলো বোরিস।

ছেলেরাও নামলো হুড়াহুড়ি করে। মুসা চেঁচিয়ে বললো, নিশ্চয় টাট্টুওলা!

 দৌড় দিয়েছে বোরিস.। পেছনে ছেলেরা ছুটলো।

 একনাগাড়ে চেঁচিয়ে চলেছেন মহিলা।

দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল মুসা। হাত তুলে দেখালো বাড়ির একপাশে। আবছা অন্ধকারে সবাই দেখলো, খাড়া দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে। একজন মানুষ। কি ধরে নামছে, সে-ই জানে। কয়েক ফুট বাকি থাকতে লাফিয়ে পড়লো মাটিতে, জানালা দিয়ে আসা আলোর মাঝে। কোনো ভুল নেই, সেই লোকটা। বগলে লাল-কালো ডোরাকাটা কানা বেড়াল।

ও-ব্যাটাই! চেঁচালো রবিন। বেড়ালটা পেয়ে গেছে।

ধরো, ধরো চোরটাকে! রাগে চিৎকার করে উঠলো রবি।

রবির গলা শুনে ফিরে তাকালো লোকটা। ছেলেদের দেখলো, বোরিসকে দেখলো, তারপর ঘুরে দিলো দৌড়। একদৌড়ে গিয়ে ঢুকে গেল বাড়ির পেছনে গাছপালার ভেতরে।

খেপা ষাঁড়ের মতো গোঁ গোঁ করতে করতে পিছু নিলো বোরিস। কিন্তু বিশালদেহী ব্যাভারিয়ানের তুলনায় লোকটা অনেক দ্রুতগতি। বোরিস আর ছেলেরা গাছের জটলার ভেতরে থাকতেই রাস্তায় উঠে গেল সে।

বোরিসকে ছাড়িয়ে গেল মুসা, রাস্তায় উঠলো। পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে অন্যেরা। সবাই দেখলো, রাস্তার পাশে রাখা নীল গাড়িটাতে উঠলো চোর। ইঞ্জিন স্টার্ট নিলো, শাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়ি।

নাহ, পারলাম না! দাঁড়িয়ে পড়লো মুসা।

গেল! পাশে এসে দাঁড়ালো রবি।

যাবে কোথায়? আশা ছাড়তে পারছে না রবিন। লাইসেন্স নম্বর আছে, পুলিশ খুঁজে বের করে ফেলবে।

তাতে সময় লাগবে, নথি, গোয়েন্দাপ্রধানের কণ্ঠে হতাশার সুর। তবে তাড়াতাড়িতে কোনো সূত্র ফেলে গিয়ে থাকতে পারে। চলো, বাড়ির ভেতরে চলো। দেখি খুঁজে। ৩

বাড়ির কাছে এসে দেখলো, সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সুন্দরী মহিলা, পেছনে একটা ছেলে। দলটাকে দেখে সতর্ক হলেন তিনি, চোখে সন্দেহ। চোরটাকে চেনো তোমরা?

চিনি, ম্যাডাম, কিশোর বললো। পাজী লোক। এ-বাড়িতে আসবে, জানতাম। তাই পিছে পিছে এসেছি। দেরি না হলে…

তোমরা চোর ধরতে এসেছো? বিশ্বাস করতে পারছেন না মহিলা। ওরকম। একটা ক্রিমিন্যালকে? তোমরা তো ছেলেমানুষ।

কালো হয়ে গেল কিশোরের চেহারা। এই ছেলেমানুষ কথাটা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। বয়েস কম হলেই যেন বুদ্ধিশুদ্ধি থাকতে নেই, ক্ষমতা থাকতে পারে না, অবহেলার যোগ্য। আমরা ছেলেমানুষ সন্দেহ নেই, ম্যাডাম, ইচ্ছে থাকলেও কণ্ঠের ঝাঁঝ পুরোপুরি চাপতে পারলো না সে। কিন্তু অনেক বুড়ো মানুষের চেয়ে আমরা অভিজ্ঞ, অন্তত চোর ধরার ব্যাপারে। শুধু চোর নয়, ঝানু। ঝানু ডাকাত, ধরেছি। …আপনি নিশ্চয় মিসেস ট্যানার?

তুমি কি করে নাম জানলে? মহিলা অবাক।

 চোরটা যে এখানেই আসবে, জানতাম, মহিলার প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না কিশোর। তার কপাল ভালো, আটকে ফেলেছিলো আমাদেরকে। এখানে এসে ওকে পাবো, তা-ই আশা করিনি। তা আপনি বোধহয়। এই এলেন?

হ্যাঁ, ডিককে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলাম। কয়েক মিনিট আগে এসেছি। এসেই ওপরে চলে গেল সে। গিয়েই চিৎকার শুরু করলো।

দশ-এগারোর বেশি না ছেলেটার বয়েস। বললো, চিৎকার করবো না তো কি। সিঁড়িতে দেখি চোরটা, ঘাপটি মেরে ছিলো। আমাকে দেখেই নেমে এসে আমার হাত থেকে বেড়ালটা কেড়ে নিলো!

ওটা নিয়েই বেরিয়েছিলে নাকি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হ্যাঁ। পুরস্কার পেয়েছি তো, বন্ধুদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।

এই জন্যেই। বোঝা গেল, মাথা দোলালো কিশোর। এজন্যেই এতো দেরি করেছে। খুঁজেছে, বেড়ালটা পায়নি। বসেছিলো। যেই তোমার হাতে দেখেছে, খাবলা মেরে নিয়ে পালিয়েছে।

ডিকের হাত থেকে নিয়ে নামছিলো, আমাকে দেখে আবার উঠে গেছে, মিসেস ট্যানার বললেন। বোধহয় দোতলার জানালা দিয়ে বেরিয়েছে।

বেরিয়ে দেয়াল বেয়ে নেমেছে, মুসা বললো।

মাছিমানবের মতো, যোগ করলো রবিন।

ডিক, জিজ্ঞেস করলো কিশোর। বেড়ালটার ভেতরে কিছু পেয়েছো? ছিলো?

কি করে জানবো? আমি কি খুলেছি নাকি?

কথাটা ঠিক। কেন খুলতে যাবে ডিক?

যা দরকার, নিয়ে পালিয়েছে, আফসোস করলো রবিন। আর শয়তানটাকে খুঁজে পাবো না।

লাইসেন্স নম্বর তো আছে, মুসা বললো। পাবো না কেন?

পেতে সময় লাগবে, মুসা,একই কথা আরেকবার বললো কিশোর। এখন…

এখন আর আমাদের কিছু করার নেই, বাধা দিয়ে বললো বোরিস। পুলিশকে ফোন করো।

পুলিশকে? কিশোরের ইচ্ছে নেই। কিন্তু বোরিসভাই…

কোনো কিন্তু নয়। এখুনি যাও, ফোন করো। লোকটা আস্ত বদমাশ। কখন যে কি করে বসে ঠিক নেই। পুলিশকে অবশ্যই জানানো দরকার।

রবিনও বোরিসের সঙ্গে একমত হয়ে বললো, ঠিকই, কিশোর, এখন আর। আমাদের কিছু করার নেই।

করো না, মুসাও বললো। মিস্টার ফ্লেচারকেই ফোন করে সব কথা বলো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিশোর। ঝুলে পড়লো কাধ। বেশ, হাতের তালু চুলকালো সে। মিসেস ট্যানার, আপনার ফোনটা ব্যবহার করা যাবে?

নিশ্চয়। করো।

দল বেঁধে ঘরে ঢুকলো সবাই। কিশোরই ফোন করলো থানায়। পুলিশ চীফ, ইয়ান ফ্লেচারকে পাওয়া গেল। শুনে বললেন, আসছেন। লাইন কেটে রিসিভার হাতে রেখেই রবিনকে বললো কিশোর, এক কাজ করো না। তোমার বাবাকে, ফোন করে জিজ্ঞেস করো, কারনিভলের কোনো কর্মচারী অনুপস্থিত কিনা।

অনুপস্থিত? কি সাংঘাতিক, কিশোর, তোমাকে আগেই বলেছি, ওরকম টাই ওলা কেউ নেই আমাদের কারনিভলে।

ছদ্মবেশ নেয়া কঠিন কিছু না। হাতের টাট্টু ঢেকে রাখাও সহজ।

হু। ঠিক আছে, করছি। বাবাকে পাওয়া মুশকিল হবে। শো-এর সময় এখন, নিশ্চয় খুব ব্যস্ত। তবু, দেখি।

হ্যাঁ, দেখো, রবিন বললো।

 ডায়াল করে রিসিভার কানে ধরে রইলো রবি। ওপাশে রিঙ হয়েই চলেছে, ধরছে না কেউ। বললাম না পাওয়া যাবে না। অফিসে নেই। বক্স অফিসে বলে দেখি, ডেকে আনতে পারে কিনা।

পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। রিসিভার তখনও কানেই ঠেকিয়ে রেখেছে। রবি। বাড়ির বাইরে এসে থামলো গাড়ি। কয়েকজন পুলিশ নিয়ে ঢুকলেন ইয়ান ফ্লেচার।

সংক্ষেপে তাকে সব জানালো ছেলেরা।

যাক, নম্বর রেখে কাজের কাজ করেছে, চীফ বললেন। পাওয়া যাবে। তা, বেড়ালগুলো কেন চায়, বুঝেছো?

না, স্যার, রবিন বললো।

ভেতরে দামি কিছু থাকতে পারে, বললো মুসা। কিশোরের ধারণা, স্মাগলিং কেস।

মাথা ঝোঁকালেন চীফ। অসম্ভব না। ঠিক আছে, সীমান্ত রক্ষীদের হুশিয়ার করে দিচ্ছি, নীল গাড়িটা আর কানা বেড়াল দেখলেই যেন আটকায়, বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।

তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রবি।

কিশোর চুপ করে আছে। বেড়ালের ভেতর কি আছে, জানার আগেই পুলিশ ডাকতে হলো বলে তার মন খারাপ। পুলিশকে সব জানিয়ে চমকে দেয়া আর হলো না। এতো দেরি লাগছে? …রেখো না, চেষ্টা করো।

আবার ডায়াল করলো রবি।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন ফ্লেচার। আগের চেয়ে গম্ভীর। কিসে হাত দিয়েছো, জানো না তোমরা। খবর নিতে গিয়ে জানলাম, ওরকম একটা লোক, হাতে টাট্টু আঁকা, গত হপ্তায় ব্যাংক ডাকাতি করে পালিয়েছে। সাত লাখ ডলার। নিয়ে গেছে।

নিশ্চয় স্যান মেটিওতে, তাই না, স্যার? ইয়ান ফ্লেচার বলার আগেই বলে। ফেললো কিশোর।

তুমি কি করে জানলে? কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন চীফ।

কারনিভলে আগুন, স্যার। স্যান মেটিওতে লেগেছিলো। আমার স্থির বিশ্বাস, ওই বেড়াল-চোর রবিদের কারনিভলের কেউ। ডাকাতির পর আগুন লাগার জন্যে সে-ই দায়ী।

তুমি শিওর?

শিওর। কাকতালীয় ঘটনা এতো বেশি ঘটতে পারে না। আপনি কারনিভলে গিয়ে…

পেয়েছি, কিশোর, বলে উঠলো রবি। বাবাকে পেয়েছি।

বাবার সঙ্গে কথা বলছে রবি, চুপ করে শুনছে সবাই। কি জবাব আসে শোনার জন্যে অধীর। একজন পুলিশ এসে ডাকতে আবার বেরিয়ে গেলেন চীফ।

হ্যাঁ, বাবা, কি সাংঘাতিক, রবি বলছে। আমি দুঃখিত, বাবা। সবাই আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার রেখে দিয়ে কিশোরের দিকে ফিরলো সে। বাবা বলছে আমি ছাড়া সবাই আছে এখন। শো শুরু হয়েছে। এক্ষুণি যেতে হচ্ছে আমাকে। গিয়ে খাওয়ার সময়ও পাবো না, গ্যালারিতে ঢুকতে হবে।

 খাওয়ার কথায় চমকে উঠলো মুসা। খাইছে রে খাইছে! এতোক্ষণ না খেয়ে আছি! মনেই ছিলো না। হায় হায় হায়, নাড়ি তো সব হজম।

কিশোর ছাড়া সবাই হাসলো। সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।

ফিরে এলেন চীফ। জানালেন, গাড়িটা পাওয়া গেছে। এখান থেকে মাত্র চার ব্লক দূরে, রাস্তার পাশে বেড়ালটাও ছিলো গাড়িতে। পেট কাটা, ভেতরে কিছু নেই। ঘাসের ওপর চাকার দাগ। হয় চোরটা আরেকটা গাড়ি রেখে এসেছিলো ওখানে, নয়তো অন্য কোনো গাড়ি এসে নিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, যা দরকার, পেয়ে গেছে। যতো তাড়াতাড়ি পারে রকি বীচ থেকে পালানোর চেষ্টা করবে এখন। তবে পুলিশও সতর্ক, পালাতে দেবে না। ধরা পড়বেই। সময় লাগবে আরকি, কিশোরের দিকে তাকালেন। তোমাদের আর কিছু করার নেই। বাড়ি চলে যাও।

.

১৪.

পরদিন রবিন বা মুসা, দুজনের কেউই বেরোতে পারলো না। বাড়িতে জরুরী কাজ, ব্যস্ত থাকতে হলো। কাজ করলো বটে, কিন্তু মন পড়ে রইলো ইয়ার্ডে। চোরটাকে ধরতে পারেনি, সেটা একটা ব্যাপার। তার ওপর কয়েকবার ফোন করেও কিশোরকে পায়নি। সে নেই।

ডিনারের সময় অন্যমনস্ক হয়ে রইলো রবিন।

হেসে বললেন তার বাবা, চীফের কাছে শুনলাম, একটা ডাকাতকে ধরতে ধরতেও নাকি ধরতে পারোনি।

জানতামই না যে ও ডাকাত, বাবা। কারনিভলের একটা ছেলেকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। কেঁচো খুঁড়তে বেরোলো সাপ।

পারলে মানুষকে সাহায্য করা উচিত। ঠিকই করেছ।

ডাকাতটার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে, বাবা? চীফ কিছু বললেন?

ধরতে পারেনি এখনও। পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

এই খবরে খুশি হতে পারলো না রবিন। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লো, ইয়ার্ডে যাবে। ভাবছে, এই প্রথম একটা কেসে সফল হতে পারলো না তিন গোয়েন্দা।

হেডকোয়ার্টারে পাওয়া গেল কিশোরকে। সামনে একগাদা খবরের কাগজ, পড়ছে, মাঝে মাঝে নোট নিচ্ছে।

কি করছো? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান, বোঝালো এখন কথা বলতে চায় না। কিছুটা বিরক্ত হয়েই কয়েকটা শামুক আর ঝিনুক দেখতে লাগলো রবিন, স্কিন ডাইভিঙের। সময় ওগুলো তুলে এনেছে ওরাই। সময় কাটে না। শেষে গিয়ে চোখ রাখলো সর্ব দর্শনে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডটাই দেখতে শুরু করলো। রোদেলা দিন ছিলো, গোধূলি তাই যেতে দেরি করছে এখনও।

ট্রাক বোঝাই করে মাল এনেছেন রাশেদ আঙ্কেল, রবিন জানালো।

আনমনে ঘোঁৎ করলো একবার কিশোর। পড়া বাদ দিয়ে চোখ বন্ধ করে। ভাবনায় ডুবে গেল।

আবার সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো রবিন। কিছুক্ষণ পর বললো, মুসা আসছে।

 এবার ঘোঁৎও করলো না কিশোর।

ট্রাপডোর দিয়ে উঠে এসে দীর্ঘ এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলো মুসা। রবিনের দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো, কি করছে?

আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? দেখছো না?

এতো খবরের কাগজ কেন? আবারও রবিনকেই জিজ্ঞেস করলো মুসা। টাট্টুওলার জন্যে বিজ্ঞাপন দেবে নাকি পেপারে?একটা টুলে বসলো।

চোখ মেললো কিশোর, হাসলো। তার আর দরকার হবে না, সেকেণ্ড। লোকটা কোথায় আছে, জানি।

জানো? চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। কোথায়?

যেখানে ছিলো, সেখানেই। রকি বীচে। কারনিভলে।

বাবা বললো, লোকটাকে নাকি ছয় জায়গায় দেখা গেছে? চীফ নাকি বলেছেন তাকে।

আসলে সাত জায়গায় হবে।

আরমানে তুমি ভুল করছে। এখানে নেই সে।

পত্রিকাগুলো ভালোমতো দেখে, তবেই বলছি। সাতজন লোক সাত জায়গায় দেখেছে লোকটাকে, দুশো মাইলের ব্যবধানে। সে-কারণেই বলা যায়, কেউই দেখেনি তাকে। ওরা মিথ্যে বলেছে।

মাথা আঁকিয়ে রবিন বললো, তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু সে যে এখানেই আছে, এ-ব্যাপারে শিওর হলে কি করে?

উঠে ছোট ঘরটায় পায়চারি শুরু করলো কিশোর। ওই ব্যাংক ডাকাতির ওপর লেখা যতোগুলো খবর বেরিয়েছে, সব পড়লাম। তিনটে কাগজে লিখেছে, স্যান মেটিওর দুটোয়, আর লস অ্যাঞ্জেলেসের একটাতে। আজ সকালে স্যান মেটিওতে গিয়েছিলাম।

কোথায় গিয়েছিলে? লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা।

স্যান মেটিওতে, হাসলো কিশোর। তোমরা তখন ব্যস্ত। একজন ঘর পরিষ্কার করছিলে, আরেকজন বাগান সাফ…আমারটাও কাজই, তবে অন্যরকম। পুরনো মাল কিনতে পাঠালো চাচা, বোরিস আর রোভারকে সঙ্গে দিয়ে…

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুসা। ধপ করে বসে পড়লো আবার টুলে। কিছু মানুষের। কপালই থাকে ভালো। কাজের মাঝেও আনন্দ। আর আমি শালার কপালপোড়া, সেদিন করলাম বাগান সাফ, আজ করতে হলো ঘরবাড়ি পরিষ্কার, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে ক্ষোভ প্রকাশ করলো সে। ওই করে করেই মরবো।

ডাকাতির ব্যাপারে কি জানলে, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

অনেক কিছু। কারনিভলে শুক্রবার রাতে আগুন লেগেছে। সেদিন, স্যান। মেটিওতে ব্যাংক খোলা ছিলো বিকেল ছটা পর্যন্ত। আর যেহেতু উইকএণ্ড, কারনিভল শুরু হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। তাছাড়া সেদিন ওখানে কারনিভলের শেষ দিন। রাতেই স্যান মেটিও ছাড়ার কথা, রকি বীচে এসে খোলার কথা শনিবারে।

খাইছে! ডাকাতটা কারনিভলের লোক হলে মহা সুযোগ।

হ্যাঁ, সুযোগটা নিয়েছিলো সে। আগাগোড়া কালো পোশাক, মাথায় কালো হুড, পায়ে কালো টেনিস শু পরে ডাকাতি করতে গিয়েছিলো।

মাছিমানব টিটানভ! রবিন বললো।

মাথা নেড়ে সায় জানালো কিশোর। অনেকেই তার হাত দেখতে পেয়েছে। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুইর ওপর তুলে রেখেছিলো।

নিশ্চয় টাট্টুও দেখেছে লোকে।

হ্যাঁ। ছটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে ব্যাংকে ঢুকলো সে। একজন গার্ডকে ধরে নিয়ে ভল্টে ঢুকলো। ওকে জিম্মি করেই বেরিয়ে এলো টাকা নিয়ে। তারপর মাথায় বাড়ি মেরে লোকটাকে বেহুশ করে ব্যাংকের পেছনের গলি দিয়ে দিলো দৌড়। সে দৌড় দিতেই ব্যাংকের ঘন্টি বাজিয়ে দেয়া হলো। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেল পুলিশ।

ডাকাতটাকে নিশ্চয় ধরতে পারেনি? মুসা বললো।

না, পারেনি। কি করে যে পালালো, সেটাই বুঝতে পারেনি কেউ। গলিটায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে পুলিশ। অন্ধগলি ওটা, একদিক খোলা। তিনদিকে তিনটা বিরাট উঁচু বাড়ি, সব জানালা বন্ধ। গলি থেকে যে বাড়িতে ঢুকবে সে উপায়ও ছিলো না। ভোলা মুখ দিয়ে ঢুকেছে পুলিশ। সেদিক দিয়েও যেতে পারেনি। ডাকাতটা। অথচ, গায়েব।

পার্ক থেকে যেভাবে গায়েব হয়েছিলো, বিড়বিড় করলো রবিন।

দেয়াল বেয়ে উঠেছে, বললো মুসা। মাছিমানব।

আমার তাই ধারণা, নিচের ঠোঁটে টান দিয়ে ছেড়ে দিলো কিশোর। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়লো খবর। কারনিভলের বাইরে তখন পাহারায় ছিলো একজন। পুলিশ। ডাকাতির খবর সে-ও শুনেছে। কারনিভলে ঢোকার জন্যে হুড়োহুড়ি করছে লোকে, ওদেরকে শান্ত করার জন্যে এগিয়ে গেল সে। লোকের ধাক্কায় পড়ে গেল একজুন, কোট গেল উল্টে। তার কালো শার্ট দেখে ফেললো পুলিশ। সন্দেহ হলো। গিয়ে লোকটার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে কোটের হাতা নামিয়ে দিলো। দেখে ফেললো টাট্টু…

কাকতালীয় হয়ে গেল না? মুসা বললো। লোকটার পড়ে যাওয়া। আর পড়বি তো পড় একেবারে পুলিশের সামনে।

হ্যাঁ, হয়েছে। তবে এটা নতুন কিছু না। অনেক বড় বড় রহস্য সমাধান। হয়েছে এরকম কাকতালীয় ঘটনা থেকে। বলা যায়, অপরাধীদের দুর্ভাগ্যই এসব। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়, প্রবাদটা তো আর খামোকা হয়নি। যাই হোক, ভিড়ের মধ্যে লোকটাকে আটকাতে পারলো না পুলিশ। এক ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিলো। কাছেই আরেকজন পুলিশ ছিলো, চেঁচিয়ে সাহায্যের জন্যে তাকে ডাকলো প্ৰথমজন। খবর পেয়ে আরও পুলিশ ছুটে এলো। ঘিরে ফেলা। হলো পুরো এলাকা। নিশ্চিত হলো, ডাকাতটাকে ধরে ফেলবেই। কিন্তু

আগুন লেগে গেল! বলে উঠলো রবিন।

হ্যাঁ। ডাকাত ধরার চেয়ে আগুন নেভাননা জরুরী। সেদিকে নজর দিলো পুলিশ। আগুন নেভার পর আবার ডাকাত খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেলো না। না। ডাকাত, না টাকা।

কোথায় গেল? রবিনের প্রশ্ন।

যাবে আবার কোথায়? কারনিভলেই ছিলো। ভালো করেই জানে সে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্যে ওটাই সব চেয়ে নিরাপদ জায়গা। স্যান মেটিও থেকে বেরিয়ে আসার জন্যেও। সেসব বুঝে, ভেবেচিন্তেই প্ল্যান করেছে সে। কখন। ডাকাতি করবে, কোনদিক দিয়ে পালিয়ে এসে কোথায় লুকোবে, সবু। সহজ, নিরাপদ পরিকল্পনা।

 কিন্তু পুলিশ দেখে ফেলায়, বললো রবিন। অসুবিধায় পড়লো ডাকাতটা। আগুন লাগিয়ে দিলো, সবার নজর সেদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্যে। এই সুযোগে ছদ্মবেশ খুলে বেরিয়ে এলো সে।

তারমানে, মুসা বললো। আমরাও সেদিন ওকে ছদ্মবেশেই দেখেছি?

তাই তো মনে হয়, বললো কিশোর। মুখে রঙ লাগিয়েছিলো, কিংবা প্লাস্টিকের মুখোশ। চুলেও রঙ করেছিলো নিশ্চয়। হয়তো নাকটাও আলগা। হাতে নকল টাট্ট।

হু, মাথা দোলালো মুসা। ওরকম একটা ছবি সবার চোখেই পড়ে।

সবাইকে দেখানোর জন্যেই লাগিয়েছে। আসল হলে কিছুতেই দেখাতো না, বরং লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতো। আমার বিশ্বাস, লোকটার বয়েস বেশি না, টাট্টুও নেই। নিশ্চয় মাছিমানব টিটানভ। কারনিভলের অভিজ্ঞ কর্মী বলেই মিস্টার কনরকে বোকা বানাতে পেরেছে।

কিন্তু মাছিমানবের খেলা তো দেখায় না।

অন্য খেলা দেখাচ্ছে।

কিন্তু তাকে চিনতে পারছেন না কেন, মিস্টার কনর?

হয়তো কাছে থেকে দেখেননি আগে। তাছাড়া অনেক দিন জেলে ছিলো টিটানভ। এতোদিনেও চেহারা বদলায়নি, এটা জোর করে বলা যায় না। তার ওপর হয়তো এমন কোনো সাজ নিয়েছে, যাতে চেহারার আরও পরিবর্তন হয়। এসব করতে কোনো অসুবিধে হয় না তার। কারনিভলে প্রত্যেক কর্মীরই আলাদা। ট্রেলার আছে।

বুঝলাম, হাত তুললো মুসা। আচ্ছা, বেড়ালগুলো কেন দরকার তার? ভেতরে টাকা রেখেছিলো?

সেটা তো সম্ভবই না। এতো টাকা, জায়গাই হবে না। তবে, টাকাগুলো কোথায় লুকিয়েছে, সেই নির্দেশ রয়েছে হয়তো। কিংবা লকার-টকারের চাবি।

হু, রবিন বললো। তা-ই করেছে। আগুন লাগানোর পরই কাজটা করেছে। যাতে তাকে সার্চ করা হলেও পুলিশ কিছু না পায়।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, একমত হলো মুসা।

বেড়াল নিয়ে তো যথেষ্ট হাঙ্গামা করলো। টাকাগুলো বের করবে কখন? এখনি বের করে নিয়ে পালাবে, নাকি আরও কিছুদিন থাকবে কারনিভলে?

থাকাটাই তো স্বাভাবিক, কিশোর বললো। ওখানেই নিরাপদ। আমি হলে তা-ই ভাবতাম–যদি বুঝতাম আমার চেহারা চিনছে না কেউ, আমাকে ডাকাত বলে সন্দেহ করছে না। পুলিশ কড়া নজর রেখেছে। হুট করে কেউ এখন কারনিভল ছাড়লেই তাকে সন্দেহ কররে। নাহ, সে বেরোবে না। রকি বীচে থাকতে কিছুতেই নয়।

তো, আমাদের এখন কি করা? মুসা জিজ্ঞেস করলো। কারনিভলে আর যাবো-টাবো?

হ্যাঁ, যাবো। চলো।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরোলো ওরা। সাইকেল নিয়ে রওনা হলো কারনিভলে। সাঁঝ হয়েছে তখন। পর্বতের দিক থেকে আসা বাতাসের বেগ বাড়ছে।

কারনিভলের কাছে এসে গেটের বাইরে সাইকেল পার্ক করলো তিন গোয়েন্দা। লোক ঢুকতে আরম্ভ করেছে। তাদের সঙ্গে মিশে গেল ওরাও।

হঠাৎ শোনা গেল চিৎকার। এদিক ওদিক দৌড় দিলো কেউ, কেউ ছুটে গেল সামনে।

কারনিভলে কিছু হয়েছে! চেঁচিয়ে বললো মুসা।

 অ্যাকসিডেন্ট! বলে উঠলো রবিন।

 দৌড়াতে শুরু করেছে ততোক্ষণে কিশোর।

.

১৫.

ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে নাগরদোলাটা। চেঁচিয়ে রাফনেকদের আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন মিস্টার কনর।

রবিকেও পাওয়া গেল সেখানে।

কি হয়েছে, রবি? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

জানি না, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললো রবি। ঘুরছিলো। সওয়ারি নিতে তৈরি, হঠাৎ ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো। কাত হয়ে পড়ে গেল দোলাটা। তিনটে ঘোড়া ভেঙেছে, দেখো।

নাগরদোলাটা আবার খাড়া করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে রাফনেকরা। ভাঙা ঘোড়াগুলো মেরামতে ব্যস্ত কয়েকজন। ইঞ্জিন পরীক্ষা করছেন মিস্টার কনর।

কয়েকজন কর্মী এসে ঘিরে দাঁড়ালো তাঁকে। উঠে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম। মুছলেন তিনি।

আর কতো অ্যাকসিডেন্ট দেখবো, কনর? কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো কোহেন।

আপনার যন্ত্রপাতিই খারাপ হয়ে গেছে, বললো মারকাস দ্য হারকিউলিস। আমরা ভয় পেতে শুরু করেছি।

যন্ত্রপাতি যে খারাপ হয়নি, কনর বললেন। ভালো করেই জানো।

নাগরদোলা অতো সহজে ভাঙে না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো সদাবিষঃ লম্বা ভড়। এটা আগাম হুঁশিয়ারি! আনলাকি শো। অবশ্যই বন্ধ করে দেয়া উচিত।

হ্যাঁ, আনলাকি শো! আগুনখেকোও একমত। হয়তো কিঙের ছাড়া পাওয়াটাও দুর্ঘটনাই ছিলো। তাহলে আরও তিনটে দুর্ঘটনার শুরু হলো।

গুঞ্জন উঠলো কর্মীদের মাঝে। কেউ মাথা ঝাঁকালো, কেউ দোলালো।

বন্ধই করে দেয়া উচিত, মিস্টার কনর, বললো এক দড়াবাজ।

বড় জোর আজকের রাতটা চালাতে পারেন, লম্বা ভাড় বললো। তারপর আর একটা শো-ও নয়।

চালাবেন কি করে? কোহেন জানতে চাইলো। নাগরদোলা না চললে তো আমাদের বেতনই দিতে পারবেন না…

অসহায় ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন কনর। কাজ করতে করতে উঠে এসে জরুরী গলায় তাকে কি বললো একজন রাফনেক। কনরের উদ্বিগ্ন চেহারায় হাসি ফুটলো। আধঘন্টার মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে নাগরদোলা। একটা বিয়ারিং ভেঙেছে, আর কিছু না। যাও, যার যার কাজে যাও।

আরও খারাপ অ্যাকসিডেন্ট হবে, আমি জানি, বিড়বিড় করলো লম্বা ভাঁড়।.

তবে বেশির ভাগ কর্মীর মুখেই হাসি ফুটলো আবার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল যার যার বুদের দিকে, কোহেন ছাড়া।

শো দেখানো বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, কনর, বললো স্ট্রংম্যান। এতো অ্যাকসিডেন্ট! শো বন্ধ করে দেয়া উচিত, বলে আর দাঁড়ালো না।

চেয়ে রইলেন কনর। চোখ ফেরালেন ছেলেদের দিকে। উৎকণ্ঠা ঢাকতে পারছেন না, ঢাকার চেষ্টাও করলেন না। তার ভবিষ্যৎ, তাঁর ছেলের ভবিষ্যৎ, সব নির্ভর করছে এই কারনিভলের ওপর।

কাজ করবে ওরা, বাবা? রবি জিজ্ঞেস করলো।

করবে। বেশি আশা করে না কারনিভলের লোকে। গণ্ডগোলের কথা সহজে। ভুলে যায়। আর কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেই হলো।

নাগরদোলাটা ঠিক হবে?

হবে, গম্ভীর হয়ে গেলেন। সে-জন্যে ভাবি না আমি। ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে। মেকানিক বললো, বিয়ারিঙে শক্ত কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কয়েকটা বন্টু আলগা করে দিয়েছিলো। ঘোরার সময় বিয়ারিঙ আটকে যাওয়ায় প্রচণ্ড চাপে ছিঁড়ে গেছে বল্টুগুলো।

স্যাবোটাজ! রবিন বলে উঠলো।

হ্যাঁ। ঠিকই আন্দাজ করেছিলে তোমরা, গোলমাল চলছে এই কারনিভলে। কেউ ধ্বংস করে দিতে চাইছে।

না, স্যার, কিশোর বললো। কারনিভলের ক্ষতি করার জন্যে করছে না ডাকাতটা।

ডাকাত? মানে ব্যাংক ডাকাত? কিশোরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কনর। স্যান মেটিওতে যে ডাকাতি হয়েছিলো?

হ্যাঁ। আপনার কারনিভলেরই লোক সে।

জ্বলে উঠলেন মিস্টার কনর। বুঝে শুনে কথা বলো, ছেলে! পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, পায়নি।

আপনার কারনিভলের লোক বলেই তো পায়নি। আগুন লাগিয়ে সবার নজর অন্যদিকে সরিয়ে দিয়েছে। পুলিশকে তো ফাঁকি দিয়েছেই, সেই সুযোগে ছদ্মবেশ খুলেছে, কানা বেড়ালের ভেতরেও কিছু লুকিয়েছে।

তুমি ভুল করছো, কিশোর। ওই চেহারার কেউ নেই এখানে। ওরকম টাট্ট কারও হাতে নেই।

কি করে বুঝবেন? বলে ফেললো মুসা। ছদ্মবেশে থাকে। হাতের টাট্টাও নকল।

নীরবে তিন গোয়েন্দার ওপর চোখ বোলালেন কনর। হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। কিন্তু কে…।

আমি জানি, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। আমি শিওর, ডাকাতটা মাছিমানব টিটানভ।

টিটানভ? কি বলছো!

ঠিকই বলছি। ওর পালানোর ধরন, আলমারিতে পাওয়া কাপড়, সবই প্রমাণ করে লোকটা ওই মাছিমানব…

না, কিশোর, হাত তুলে তাকে থামালেন কনর। টিটানভ নয়। তোমার কথায় যুক্তি আছে, স্বীকার করছি। কিন্তু পুলিশ্নের মুখে সব শোনার পর আমার প্রথমেই মনে হয়েছিলো ওর কথা। আমিও ভেবেছি, এই কারনিভলে লুকিয়ে আছে। সে, আমি চিনতে পারছি না। কারনিভলের পোশাক পরা থাকলে, সাজ ধরে থাকলে চেনা কঠিন। তাই সবাইকে পোশাক ছাড়া দেখেছি। টিটানভের মতো। লাগেনি কাউকে।

দে-দেখেছেন…, তোতলাতে শুরু করলো কিশোর।

দেখেছি। বেশির ভাগই ওরা বয়স্ক। আরেকটা কথা, কারনিভলে ডাকাত থাকলে আগুন লাগা আর কিঙের ছাড়া পাওয়ার ব্যাপারটা নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু পনি রাইডের কথা কি বলবে? আর এখন এই নাগরদোলা নষ্ট করা? 

দমে গেছে কিশোর। মনে তো হচ্ছে গোলমাল পাকানোর জন্যে।

ঠিক তাই। গোলমাল পাকিয়ে কারনিভলের সর্বনাশ করে দিতে চায়, বলতে দ্বিধা করছেন কনর। শেষে বলেই ফেললেন, হয়তো এর মূলে রবির নানী। ডাকাতটাই কানা বেড়ালের পেছনে লেগেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সে বাইরের লোক। যা চাইছিলো, পেয়ে গেছে, আর এখানে আসার দরকার নেই তার। নাগরদোলা নষ্ট করায় তার হাত নেই।

হতে পারে, মুসা বললো।

তবু, চোখ খোলা রাখতে বলবো তোমাদের। আর কোনো দুর্ঘটনা যাতে ঘটাতে না পারে কেউ। আমার কাজ আছে। যাও, তোমরা গিয়ে কারনিভল দেখো, নজরও রাখো। খুব সাবধানে থাকবে।

থাকবো, কথা দিলো রবি।

হাসলেন কনর।

সরে এলো ছেলেরা। নিচের ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। বললো, আমি এখনও বিশ্বাস করি, আমার অনুমানই ঠিক। .

কিন্তু মিস্টার কনরের কথায়ও যুক্তি আছে, রবিন বললো। নাগরদোলা নষ্ট করার কোনো কারণই নেই ডাকাতটার।

এতোক্ষণে হয়তো বহুদূরে পালিয়েছে সে, বললো রবি।

আমার মনে হয় না, জোর দিয়ে বললো কিশোর। এখানেই আছে এখনও। কারনিভল বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে অন্য কর্মীদের ভিড়ে মিশে যেতে পারে সে, যাওয়ার সময় কারো সন্দেহ না হয়।

পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করবে না? প্রশ্ন তুললো রবি।

হয়তো করবে। আচ্ছা, ঠিক করে বলো তো পাঁচটাই বেড়াল ছিলো তো? না আরও বেশি?

পাঁচটাই।

বুঝতে পারছি না…, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। বেড়ালের ভেতর থেকে পড়ে-উড়ে যায়নি তো? হয়তো বেড়ালের ভেতরে পায়নি। তাহলে নিশ্চয় গিয়ে ট্রেলারটায় খুঁজবে, যেটাতে বেড়ালগুলো রাখা ছিলো! রবি, কোথায় ট্রেলারটা?

 যেখানে এখন থাকার কথা। শুটিং গ্যালারির কাছে। সারাক্ষণ যাতে চোখ রাখতে পারি।

কিন্তু এখন রাখছ না! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। রাখতে পারোনি, কারণ, নাগরদোলাটা পড়ে যাওয়ায় দেখতে চলে এসেছে!

 খাইছে! চমকে উঠলো মুসা। আরেকবার!

কেন নয়? এরকম করে দুবার সফল হয়েছে আগে। দোলাটার ক্ষতি সামান্য। কারনিভল বন্ধের চেষ্টায় থাকলে ওটা একেবারে বিকল করে দিতো। জলদি, শুটিং গ্যালারিতে। কুইক! বলতে বলতেই দৌড় দিলো সে।

দর্শকের ভিড় বেড়েছে।

তাদের পাশ কাটিয়ে গ্যালারির পেছনে চলে এলো ছেলেরা। আলো এখানে কম, ছায়া বেশি। কিন্তু দেখতে অসুবিধে হলোনা, মাটিতে ছড়িয়ে আছে পুতুল, খেলনা, পুরস্কারের নানা জিনিস।

আরি, ভেঙে ফেলেছে? আঁতকে উঠলো রবি।

দেখো দেখো! হাত তুললো রবিন।

চারজনেই দেখলো, ট্রেলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মূর্তি। দৌড় দিলো অন্ধকারের দিকে। খোলা জায়গার পরে একসারি তাঁবু পেরিয়ে, বেড়ার ফোকর গলে পার্কে ঢুকে যাওয়ার ইচ্ছে।

ধরো ব্যাটাকে! বলেই পেছনে ছুটলো মুসা।

.

১৬.

বেড়ার ওপাশে চলে গেল চোরটা।

এক এক করে ফোকর গলে ছেলেরাও চলে এলো। ছায়ায় ঢাকা নীরব পার্ক। চাঁদ উঠছে। পর্বতের দিক থেকে আসা বাতাসের জোর বেড়েছে আরও। ঝুঁকি দিয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে পুরনো, নড়বড়ে নাগরদোলার স্তম্ভগুলোকে, ক্যাঁচকোঁচ করছে ওগুলো, নিষ্প্রাণ গোঙানি।

কই? নিচু কণ্ঠে বললো রবিন। গেল কই!

চুপ, ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। শোনো।

বেড়ার ছায়ায় গা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মেরামত করা নাগরদোলার শব্দ হচ্ছে ভীষণ, বহুদূর থেকে শোনা যাবে। পার্কের অন্ধকার ছায়া থেকে কাউকে বেরোতে দেখা গেল না, কেউ নড়লো না। বায়ে, টানেল অভ লাভ-এ ছলাত-ছল করে আছড়ে পড়ছে পানি। মাঝে সাঝে মৃদু হুটোপুটির শব্দ, নিশ্চয় ইঁদুর। এছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।

বেশিদূর যেতে পারেনি, কিশোর বললো। ভাগ হয়ে খুঁজবো আমরা। নাগরদোলা ঘুরে আমি আর মুসা যাবো ডানে। রবিন, তুমি আর রবি যাও বুয়ে।

এই লোকটাই ডাকাত? রবি প্রশ্ন করলো।

মনে হয়। বেড়ালের ভেতর পায়নি, তাই ট্রেলারে খুঁজছিলো। পেয়ে গিয়ে থাকলে ও এখন মহাবিপজ্জনক। সাবধান, ধরার চেষ্টা করবে না। পিছে পিছে গিয়ে শুধু দেখবে, কোথায় যায়।

বাঁয়ে সুড়ঙ্গের দিকে চলে গেল রবি আর রবিন। মুসা আর কিশোর এগোলো ফান হাউসের হাসিমুখের দিকে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল মুসা। কিশোর, শব্দ শুনলাম!

স্তম্ভগুলোর নিচে অন্ধকার। সেখান থেকেই এলো শব্দটা। আবার। কাঠের ওপর ভারি জুতোরঘষা লাগার মতো। তারপর, দ্রুত দূরে সরে গেল চাপা পদশব্দ।

দেখেছি, ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। ফান হাউসে ঢুকলো।

কে, চিনেছো?

না।

জলদি চলো। বেরোনোর আরও পথ থাকতে পারে।

মুসা দেখেছে, ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে গিয়ে ঢুকছে লোকটা। ওরা যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে ফান হাউসের মুখ পর্যন্ত একটুকরো খোলা জায়গা, চাঁদের আলোয় আলোকিত। একছুটে জায়গাটা পেরোলো ওরা। ভেতরে ঢুকে কান পাতলো। সরু বারান্দার মতো একটা জায়গা। ছাতের ফুটো দিয়ে আলো আসছে, অন্ধকার কাটেনি তাতে।

সামনে ছাড়া পথ নেই, কিশোর।

মুসার কথার সমর্থনেই যেন মচমচ শোনা গেল। তার পরেই ধুপ, সবশেষে তীক্ষ্ণ চিৎকার। গড়িয়ে পড়ে কাঠের দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে যেন ময়দার বস্তা। আবার শোনা গেল মচমচ, আবার ধুপ, তারপর নীরবতা।

অস্বস্তিতে পড়েছে দুই গোয়েন্দা। পা টিপে টিপে এগোলো আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে। একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।

 সাবধানে খুলবে, কথা শেষ করতে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। মচমচ করে সামনে ঝুঁকে গেল বারান্দাটা। কাত হয়ে গেছে মেঝে। চিত হয়ে পড়লো দুজনে, গড়াতে শুরু করলো।

পাগলের মতো হাত বাড়াচ্ছে ওরা, ধরার মতো যদি কিছু মেলে। কিছুই নেই।

ধুপ করে কাঠের দেয়ালে বাড়ি খেলো মুসা। আঁউক করে উঠলো। পরক্ষণেই তার গায়ের ওপর এসে পড়লো কিশোর।

হাত-পা ছুঁড়ে কোনোমতে উঠে বসলো দুজনেই। হতবাক হয়ে দেখলো, কাত হয়ে যাওয়া মেঝে উঠে যাচ্ছে আবার। জায়গামতো লেগে ছাত হয়ে গেল। মাথার ওপর।

পুরো মেঝেটা কাত হয়ে গিয়েছিলো! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। নিশ্চয় কোনো কিছুর ওপর ব্যালান্স করা। একটা বিশেষ জায়গায় এসে কেউ দাঁড়ালেই কাত হয়ে যায়।

হ্যাঁ, অনেকটা টেকির মতো। ফান হাউসের মজার কৌশল। ডাকাতটাও নিশ্চয় আমাদের মতোই পড়েছে। গেল কোথায়?

পথ একটাই।

ঘরের দেয়ালে একটা বড় ফোকর দেখা যাচ্ছে। পাইপের মুখের মতো।

হামাগুড়ি দিয়ে ওটার দিকে এগোলো মুসা।

খেয়াল রেখো, পেছন থেকে কিশোর বললো। ওর মধ্যেও কৌশল থাকতে পারে।

ছোট সুড়ঙ্গ। আরেকটা ঘরে বেরিয়ে এলো ওরা। ছাতের ফাটল দিয়ে আলো আসছে।

ছাতই তো! নাকি মেঝে? অবাক হয়ে ভাবলো মুসা। কিশোওওওর! কেঁপে উঠলো গলা।

আবছা আলোয় মনে হলো ওদের, একটা উল্টে থাকা ঘরে রয়েছে। ছাত নিচে, মেঝে ওপরে। মেঝেতে রাখা চেয়ার, টেবিল, কার্পেট, সব উল্টো হয়ে আছে মাথার ওপরে। ওদের পায়ের কাছ থেকে সামান্য দূরে উল্টো হয়ে রয়েছে। একটা ঝাড়বাতি, বাহু নেই। দেয়ালে ঝুলছে ছবি, উল্টো।

ফিসফিস করলো বিস্মিত কিশোর, আরেকটা কৌশল, মুসা। আলো থাকলে আরও ভালোমতো দেখা যেতো।

আমরা সত্যি উল্টো হয়ে নেই তো? মুসার সন্দেহ যাচ্ছে না।

না।…ওই যে, আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ। এসো।

প্রথমটার চেয়ে এটা লম্বা। নড়েচড়ে, দোল খায়। ওরা বুঝলো, একসময় ওটাকে ঘোরানোর ব্যবস্থা ছিলো। এখন ঘোরে না যদিও, স্থিরও থাকে না। একজায়গায়। আরেক মাথায় বেরিয়ে, নামার সময় আরেকটু হলেই পড়ে। গিয়েছিলো কিশোর। সোজা হয়েই বললো, শুনছো?

সামনে কোনোখান থেকে আসছে শব্দটা, হালকা পা ফেলছে কেউ। ওদিকে! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা, পর মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠলো, ওরিবাবারে…!

লম্বা-চওড়ায় আগেরটার চেয়ে বড় এই ঘর। ছাতে অসংখ্য গর্ত, ফাটল, বেশ ভালো আলো আসছে। মুসার মনে হলো গভীর সব ছায়া নড়ছে। কিন্তু ছায়ার। কারণে ভয় পায়নি সে। যা দেখালো, সেটা দেখে কিশোরও ঢোক গিললো।

ডানে দেয়ালের কাছে নড়ছে একটা অদ্ভুত মূর্তি। সোজা তাকিয়ে আছে ছেলেদের দিকে। লম্বা, পাকাটির মতো:শরীর, তার ওপর বিশাল এক মাথা। হাত দুটো সরু সরু, যেন মাকড়সার শুড়। কিভূত এক মানব-সর্প যেন, ভাসছে রুপালি চাঁদের আলোয়।

কী-কী ওটা, কি-কিশোর! কাছে ঘেঁষে এলো মুসা। ভূউত না তো?

আরেকবার ঢোক গিললো কিশোর। আ-আমি জানি নাঃ..আমি…, হঠাৎ হাসতে শুরু করলো সে। মুসা, ও কিছু না। আয়না। আয়না ঘরে ঢুকেছি আমরা। বিভিন্ন ভঙ্গিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাকা আয়নাগুলো।

আয়না? তাহলে পায়ের আওয়াজ শুনলাম কেন?

আমি…. শুরু করেই বাধা পেলো কিশোর।

 ও-ওটাও কি আয়না? জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে মুসা

নাক বরাবর সামনে, আয়না থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি। কান। পেতে রয়েছে যেন। চওড়া কাধ কোমর পর্যন্ত নগ্ন, লম্বা অগোছালো কালো চুল, কালো দাড়ি, চাঁদের আলোয় বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কোহেন! যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখতে পারলো না মুসা। শুনে ফেললো কোহেন। পাঁই করে ঘুরলো। এই, এই, বেরিয়ে এসো।

মুসার বাহু আঁকড়ে ধরলো কিশোর। ফিসফিস করে বললো, কথা বলবে না। আমাদের দেখেনি।

গর্জে উঠলো আবার কোহেন। এই, কথা শুনছি। বেরোও। বেরিয়ে এসো।

ওই যে, দরজা! দেখালো মুসা।

অনেকগুলো আয়নার মাঝে দরজাটা। কিশোরের হাত ধরে ওটা দিয়ে ঢুকে পড়লো মুসা। সরু একটা গলিপথে ঢুকলো ওরা, ছাত নেই। দশ কদম মতে গিয়ে দুভাগ হয়ে গেছে পথ। পেছনে কোহেনের কণ্ঠ আর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল, দরজাটা দেখে ফেলেছে সে।

বাঁয়েরটা দিয়ে, কিশোর, তাড়া দিলো মুসা। জলদি!

আগে আগে চলেছে গোয়েন্দা-সহকারী। প্রতি দশ কদম পর পরই দুভাগ হয়ে যাচ্ছে পথ। প্রতিবারেই বাঁয়ের পথ ধরছে সে। পেছনে লেগে রয়েছে কোহেন, পায়ের শব্দেই বোঝা যায়।

অবশেষে আরেকটা দরজা পাওয়া গেল। ধাক্কা দিয়ে পাল্লা খুলে একটা ঘরে ঢুকলো ছেলেরা। তাজ্জব হয়ে গেল। আবার সেই আয়না ঘরে ফিরে এসেছে।

মরীচিকা! বিমূঢ়ের মতো বললো কিশোর। ফান হাউসের আরেক মজা! ছাগল বানিয়ে ছেড়েছে আমাদের, গলায় রশি দিয়ে একই জায়গায় ঘুরিয়েছে!

কোহেনও তো এসে পড়লো! গুঙিয়ে উঠলো মুসা।

ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। উপায় একটা নিশ্চয় আছে। আবার ওই দরজা দিয়ে ঢুকবো। এবার আর বয়ে যাবো না। ডানে।

আয়নাগুলোর মাঝের দরজা দিয়ে আবার সরু গলিতে ঢুকলো দুজনে। দশ কদম এগিয়ে সরে গেল ডানের পথটায়। পদশব্দ এখনও অনুসরণ করছে ওদের। পেছনে তাকানোর সময় নেই। ছুটছে তো ছুটছেই ওরা। ধীরে ধীরে কমে এলো পেছনের আওয়াজ, মিলিয়ে গেল একসময়। সামনে দেখা গেল একটা ডাবল ডোর। দ্বিধার সময় নেই। ঠেলে পাল্লা খুলে ফেললো মুসা।

দরজার অন্যপাশে বেরিয়ে এলো দুজনে। খোলা আকাশের নিচে ব্রেরিয়ে। এসেছে। একপাশে ফান হাউস, আরেক পাশে টানেল অভ লাভ-এর প্রবেশ পথ।

আহ, বাঁচলাম! জোরে নিঃশ্বাস ফেললো মুসা।

হ্যাঁ, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো কিশোর। কাজও হয়েছে। লোকটাকে চিনতে পেরেছি। গিয়ে এখন মিস্টার কনরকে বলতে পারবো, কোহেন…

মড়মড় করে ভেঙে গেল পুরনো পচা কাঠ। ফান হাউসের দেয়াল ফুড়ে বেরোলো ব্যায়ামপুষ্ট শক্তিশালী বলিষ্ঠ দেহটা। চাঁদের আলোয় বন্য হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া, জ্বলছে। কোহেন!

.

১৭.

ছায়ার ভেতরে হুমড়ি খেয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। শ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছে। তাকিয়ে আছে কোহেনের দিকে।

এখনও দেখেনি, কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বললো কিশোর। তবে দেখে ফেলবে।

বেড়ার কাছেও যেতে পারবো না, মুসা বললো। পথ আগলে রয়েছে। কিন্তু যেতে না পারলে…

টানেল অভ লাভ। চলো।

কি হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো ওরা। ছায়ার অভাব নেই। লম্বা হয়ে পড়েছে। নাগরদোলার স্তম্ভগুলোর ছায়া। ওগুলোর মধ্যে রইলো ওরা, কোনো অবস্থাতেই আলোয় বেরোলো না। কোহেনের অলক্ষ্যে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো।

আর আসছে না, মুসা বললো।

আসবে। ও জানে, আমরা ওকে দেখে ফেলেছি। আমাদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবেই। টানেল থেকে বেরোনোর আরেকটা পথ বের করতে হবে আমাদের।

সরু খাল কেটে সুড়ঙ্গের ভেতরে পানি ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তরল সীসার মতো লাগছে ওই পানিকে। কিনার দিয়ে গেছে পথ। সেই পথ ধরে হেঁটে চললো দুজনে। অনেকখানি ভেতরে ঢুকে সরু একটা কাঠের পুল পাওয়া গেল। শেষ মাথায় কাঠের জেটি। একসময় অনেক নৌকা থাকতো ওখানে, এখন আছে শুধু একটা পুরনো দাঁড়টানা নৌকা।

কিশোর, মুখে বাতাস লাগছে।

লাগবেই। সামনে বোধহয় ভোলা। নিশ্চয় সাগর।

কাঠের ওপর চাপ পড়ার মচমচ শব্দ হলো। নরম সোলের জুতো পরা পায়ের চাপ। কেউ আসছে।

নড়ড়া মা! হুঁশিয়ার করলো কিশোর। একদম চুপ।

সরু পুলের ওপর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে। অনেক ওপরে ছাতের একটা ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে আসছে চাঁদের আলো, নড়াচড়া ওখানেই দেখা গেল।

উল্টোদিক দিয়ে নেমে আসবে! মুসা বললো।

 ফিরে যাবো? নিজেকেই প্রশ্ন করলো কিশোর।

ওপরে ছায়ামূর্তিটাকে নড়তে দেখা গেল। পিস্তল কক করার নির্ভুল শব্দ কানে এলো দুজনের। আস্তে কিশোরের কাঁধে হাত রাখলো মুসা।

ফিরে গিয়ে বাঁচতে পারবো না, কিশোর বললো। যেদিক দিয়েই বেরোই, চাঁদের আলোয় দেখে ফেলবেই।

ওদের কাছাকাছিই রয়েছে নৌকাটা, জেটির সঙ্গে বাঁধা। সামনের দিকে ছড়িয়ে ফেলে রাখা হয়েছে মোটা ক্যানভাস। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগোলো ওরা। নৌকায় উঠলো। গায়ের ওপর টেনে দিলো ক্যানভাসটা। অন্ধকারে পড়ে রইলো চুপচাপ, নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয়।

সময় যাচ্ছে। মিনিটের পর মিনিট।

পুলে হালকা পায়ের আওয়াজ হলো। কাঠের সঙ্গে ধাতব কিছুর ঘসা লাগলো যেন, দেয়ালে লেগেছে বোধহয় লোকটার হাতের পিস্তল।

তারপর অনেক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই।

পূর্ণ নীরবতা।

খালের পানিতে দুলছে নৌকা। ঘষা খাচ্ছে জেটির সঙ্গে।

আবার নড়লো লোকটা। ছেলেদের প্রায় মাথার ওপর চলে এলো জুতোর চাপা শব্দ। জোরে জোরে কয়েকবার নাড়া খেলো নৌকা, যেন ধরে কঁকিয়ে দেয়া হচ্ছে। থেমে গেল একসময়। তারপর শুধুই দুলুনি।

ক্যানভাসের  নিচে গুটিসুটি হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আরও কয়েক মিনিট পেরোলো। নৌকার গায়ে ঢেউয়ের ছলাত-ছল ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

চলে গেছে! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা।

জবাব দিলো না কিশোর।

আরও কিছুক্ষণ পর আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, মুসা, জলদি কারনিভলে ফিরে যেতে হবে। রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে!

কোহেন?

হ্যাঁ, সে তাড়া করাতেই..ডাকাতটা কি খুঁজেছে, এবং সেটা কোথায় আছে, জানি এখন।

ও পায়নি?

না, সবাই আমরা ভুল জায়গায়…

ভীষণ দুলে উঠলো নৌকা। ধার খামচে ধরলো কিশোর। ক্যানভাসের  তলায় ঝট করে উঠে বসলো মুসা। কান পেতে শুনছে। বললো, কিশোর, বড় বেশি দুলছে না? ঘষার শব্দও পাচ্ছি না আর। কি হয়েছে? ক্যানভাস তোলো তো।

দুজনে ঠেলে সরালো ক্যানভাসের  চাদর। মুখে আঘাত হানলো বাতাস। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে চিত হয়ে পড়লো কিশোর, নৌকার দুলুনিতে।

খোলা সাগরে চলে এসেছি! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। চারপাশে দেখছে।

পরিত্যক্ত পার্কের কালো ছায়াগুলো এখন অনেক পেছনে, ছোট হয়ে আসছে, কারনিভলের আলোকসজ্জা।

নৌকা বাঁধার দড়িটা দেখলো কিশোর। কেটে দিয়েছে! পুলে উঠে দড়ি কেটে দিয়ে চলে গেছে ব্যাটা।

এখন ভাটা, পানির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। স্রোতে পড়েছে নৌকা। দেখছো, কি জোরে ভেসে যাচ্ছি?

জলদি ফেরাও, মুসা!

কি করে? দাঁড় নেই, মোটর নেই। সাঁতরে যে যাবো, তারও উপায় নেই। যা স্রোত আর ঢেউ, সাহস হচ্ছে না।

হুঁ। তুমি না পারলে আমি পারবো? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। এক কাজ করা যায়। সিগন্যাল।

পকেট থেকে হোমারটা বের করলো কিশোর। কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। নৌকার তলায় পানি জমে আছে, তাতে ভিজে গেছে পকেট, পকেটে রাখা যন্ত্রটা। হবে না, হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিশোর। নষ্ট হয়ে গেছে।

সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করলো দুজনে। কিন্তু বাতাসের শব্দে হারিয়ে গেল চিৎকার। তীর থেকে অনেক সরে এসেছে। চারপাশে থৈ থৈ করছে সাগরের কালো পানি। একটা নৌকা চোখে পড়লো না। তীরের আলো এখন দূরে। বড় বড় ঢেউ ভাঙছে নৌকার গায়ে, কিনার দিয়ে ভেতরে ঢুকছে, ছিটে লেগে ভিজছে শরীর।

নৌকার তলায় ঝনঝন করছে দুটো টিনের পাত্র, গায়ে গায়ে বাড়ি লেগে। পানি সেঁচার জন্যে রাখা হয়েছে ওগুলো। একটা তুলে নিলো মুসা। আরেকটা কিশোরকে নিতে বলে সেঁচতে শুরু করলো নৌকায় জমা পানি।

যে ভাবেই হোক, কিশোরকে বললো। ফিরে যেতেই হবে আমাদের।

পারবো না। যা স্রোত। বাতাস অবশ্য বিপরীত দিক থেকে বইছে, অনেক খানি ঠেকিয়ে রাখছে নৌকাটাকে। স্রোতের টানে নইলে এতোক্ষণে আরও দূরে। ভেসে যেতো। বার দুই পাত্র বোঝাই করে ছপাত ছপাত করে পানি ফেললো। মুসা। দাঁড় ছাড়া হবে না, থেমে গেল সে। কিশোরের দিকে তাকালো।

মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে গোয়েন্দাপ্রধান। মুসা! ওটা।

ঝট করে ঘুরে চাইলো মুসা।

সামনে বিশাল এক কালো ছায়া। সাগরের নিচ থেকে উঠছে যেন, মাথা তুলেছে ওদের মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে।

.

১৮.

ঘুরে, যেখান থেকে শুরু করেছিলো, সেখানে এসে দাঁড়ালো আবার রবি আর রবিন। কিশোর বা মুসাকে দেখলো না।

রবি, কিছু হয়েছে, চারপাশে দেখতে দেখতে বললো রবিন। এখানেই তো ওদের আসার কথা।

দেখো! ফান হাউসের দেয়ালে বড় একটা ফোকর দেখালো রবি। নতুন হয়েছে গর্তটা। আমি শিওর।

জ্যোৎস্নায় আরও বিষণ্ণ লাগছে পরিত্যক্ত পার্কটা।

চেঁচিয়ে ডাকলো রবিন, কিশোওর! মুসাআ!

কে জানি আসছে! বলে উঠলো রবি।

ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ এসে থামলো বেড়ার ওপাশে, ফোকর গলে ভেতরে ঢুকলো দুজন লোক।

তোমার বাবা, রবি।

 কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার কনর, কি ব্যাপার?

আমাদের কিছু হয়নি, বাবা, আমরা ঠিকই আছি। মুসা আর কিশোরকে পাচ্ছি না। আমার ট্রেলারে কি জানি খুঁজছিলো একটা লোক। তাকে তাড়া করে এলাম এখানে। দুভাগ হয়ে খুঁজতে গেলাম। আমি আর রবিন একদিকে, কিশোর আর মুসা আরেকদিকে। তারপর আর ওদের খবর নেই।

কোহেন তাহলে ঠিকই বলেছে!

মিস্টার কনরের পেছনে এসে দাঁড়ালো দাড়িওয়ালা স্ট্রংম্যান। চাঁদের আলোয় চকচক করছে তার ঘামে ভেজা নয় কাধ, আর কালো বুট। বললো, আমিও দেখেছি, রবির ট্রেলারে খুঁজছে। পিছে পিছে ছুটে এলাম এখানে। ফান হাউসে ঢুকে গায়েব হয়ে গেল ব্যাটা।

মুসা আর কিশোরকে দেখেননি? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

না তো।

রবি, কনর বললেন। দৌড়ে যাও তো। বাতি নিয়ে এসো। কয়েকজন রাফনেককে আসতে বলবে।

ছুটে চলে গেল রবি।

রবিন আর কোহেনকে নিয়ে পরিত্যক্ত পার্কে খুঁজতে শুরু করলেন কনর। মুসা আর কিশোরকে পাওয়া গেল না।

বাতি আর রাফনেকদের নিয়ে এলো রবি। শক্তিশালী বৈদ্যুতিক লণ্ঠন নিয়ে খুঁজতে বেরোলেন কনর। কোহেন আর রাফনেকদের সঙ্গে নিলেন। ফান হাউসের বাইরে দাঁড়াতে বলে গেলেন রবিন আর রবিকে।

রবি, রবিন বললো। কোহেনও নাকি ট্রেলারের কাছে লোকটাকে দেখেছে। আমরা তাহলে দুজনকে না দেখে একজনকে দেখলাম কেন?

বুঝতে পারছি না, রবিন। দেখা তো উচিত ছিলো।

আমার মনে হয় না দুজন। কোহেনকেই তাড়া করেছি।

কোহেনই ডাকাত?

মাথা আঁকালো রবিন। প্রথম থেকেই ওকে কিশোরের সন্দেহ। তোমরা ওর আসল নাম জানো না। আড়িপাতা স্বভাব। আমাদের ওপর চোখ রাখে। কারনিভল। বন্ধ করার জন্যে বোঝায় তোমার বাবাকে। কিশোর আর মুসাকে সে-ই আটকে রেখে এখন ধোকা দিতে চাইছে, আমাদের। চলো, দেখি তোমার বাবা কি করছে?

দ্রুত ফান হাউসের দিকে চললো ওরা। ফাঁকফোকর দিয়ে বেরোচ্ছে লণ্ঠনের আলো। ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল কনরের সঙ্গে, বেরিয়ে আসছেন।

নাহ, কোনো চিহ্নই নেই, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন তিনি। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে!

কোহেন আমাদের বোকা বানিয়েছে, স্যার, আঁঝালো কণ্ঠে বললো রবিন। ও-ই ডাকাত। মুসা আর কিশোর কোথায়, জানে।

কোহেন? কি বলছো? কী প্রমাণ আছে?

আমি শিওর, রবির ট্রেলারের কাছে সে একাই ছিলো। তাকেই তাড়া করেছিলাম আমরা।

দ্বিধা করলেন কনর। এটা তো প্রমাণ হলো না। ভুলে যেও না, কোহেন আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জ। সবখানে চোখ রাখা তার দায়িত্ব। কিন্তু তোমাকেও অবিশ্বাস করতে পারছি না। দাঁড়াও, কোহেনকে জিজ্ঞেস করি।

আবার গিয়ে ফান হাউসে ঢুকলেন তিনি।

বাইরে অপেক্ষা করছে ছেলেরা। অস্বস্তি বোধ করছে। এক এক করে দশ মিনিট পেরোলো। অন্ধকারে পায়চারি শুরু করলো রবিন। সে কি ভুল করেছে?

ফিরে এলেন কনর। থমথমে চেহারা। ফান হাউসে নেই কোহেন! রাফনেকদের নাকি বলে গেছে, কারনিভলে যাচ্ছে। কই, আমাকে তো বললো না! বলতে পারতো। চলো, দেখি।

তাড়াতাড়ি কারনিভলে ফিরে এলো ওরা। কোহেনকে তার তাঁবুতে পাওয়া গেল না, ট্রেলারেও নেই। কেউ তাকে দেখেনি। মুসা আর কিশোরকেও না।

এবার তো আর পুলিশের কাছে না গিয়ে উপায় নেই, শঙ্কিত হয়ে বললেন মিস্টার কনর।

.

কালো ছায়াটার দিকে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা, কিশোর, ওটা অ্যানাপামু আইল্যাণ্ড! আশোঁপাশের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ। তীর থেকে মাইলখানেকও হবে না। ওটাতে উঠতে পারলেও হয়।

পারবো। ওদিকেই তো ভেসে যাচ্ছি।

নৌকার ধার খামচে ধরে বসে রইলো দুজনে। কাছে আসছে দ্বীপটা। খাড়া পাড়, গাছপালা আর পাথর চোখে পড়ছে এখন। পাড়ের নিচে সাদা ফেনার রেখা।

ওইই, ওখানে সৈকত, বাঁয়ে দেখালো মুসা। মনে হয়…, কথা শেষ না করেই ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়লো সে। নৌকার পেছনে ধরে ঠেলে, সাঁতরে নিয়ে চললো তীরের দিকে। অসংখ্য ছোট-বড় পাথর মাথা তুলে রেখেছে এখানে। সেখানে। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে নৌকাটাকে ঠেলে নিয়ে এলো তীরের কাছে।

অল্প পানিতে নেমে পড়লো কিশোর। দুজনে মিলে টেনেহিঁচড়ে এনে শুকনোয় তুললো নৌকা।

যাক, বাঁচলাম! বালিতে বসে পড়লো মুসা।

কিশোর বসলো তার পাশে। বাঁচলাম আর কই? দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছে আমাদের। মুসা, এখুনি ফিরে যেতে হবে, নইলে ডাকাতটাকে আটকাতে পারবো না।

বেশি বড় না, দেখছো? কিশোরের কথায় কান নেই মুসার, দ্বীপ দেখছে। ছোট। মানুষজন কিছু নেই। খালি গাছ আর পাথর। কালকের আগে যেতে পারবো না এই দ্বীপ থেকে, তা-ও কপাল ভালো হলে। যদি ধার দিয়ে কোনো নৌকা-টৌকা যায়।

কাল অনেক দেরি হয়ে যাবে। এখানকার প্রায় সব দ্বীপেই ইমারজেন্সি শেল্টার আছে শুনেছি। এটাতেও থাকতে পারে। চলো তো দেখি, কোথায়?  

আগে আগে চললো মুসা। বেশি খুঁজতে হলো না। ছোট একটা কেবিন পাওয়া গেল। ভেতরে একটা কাঠের টেবিল, কয়েকটা চেয়ার আর বাঙ্ক। একটা স্টোভ আর টিনজাত কিছু খাবারও সংরক্ষিত আছে। কেবিনের পেছনে একটা ছাউনি। তাতে রয়েছে দুটো ছোট নৌকার মাস্তুল, হাতলশুদ্ধ একটা ছোট হাল, দড়ির বাণ্ডিল, বোর্ড, আর নৌকার জন্যে দরকার আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। হাতুড়ি আর পেরেকও আছে।

রেডিও নিই, কিশোর, মুসা বললো। যে-আশায় এসেছে। কাল সকাল পর্যন্ত থাকতেই হচ্ছে আমাদের। যদি তার আগে কেউ উদ্ধার না করে।

জবাব দিলো না কিশোর। ছাউনির জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে।

মুসা, হঠাৎ বললো সে। পাল হলে তো আমাদের নৌকাটাকে চালানো যায়, তাই না?

যায়। পাল আর হাল থাকলে।

মাস্তুল আর হাল তো এখানেই আছে। নৌকায় আছে ক্যানভাস। পাল তৈরি করা যায়।

বেশি বড় মাস্তুল, বিশেষ ভরসা করতে পারছে না মুসা। স্টেপিং থাকলেও লাগানো যাবে কিনা সন্দেহ।

স্টেপিং? 

কিশোর পাশাও তাহলে অনেক কিছু জানে না, হাসলো মুসা। বিদ্যে ঝাড়ার দুর্লভ একটা সুযোগ পেলো। সকেট আর সাপোর্টিং ফ্রেমে মাস্তুল আটকানোর ব্যবস্থাকে নাবিকরা বলে স্টেপিং। মাস্তুলের গোড়া তো কোথাও আটকাতে হয়, নাকি?

এখানে দুটো বুম দেখতে পাচ্ছি। ওগুলোর একটা দিয়ে স্টেপ বানানো যায় না?

নাক চুলকালো মুসা। হয়তো যায়। সীটের মধ্যে গর্ত করে ঢুকিয়ে দিতে পারলে বোর্ড তো আছেই। টুলবক্সে করাত আর বাটালি থাকলে বানিয়ে ফেলা। যাবে। না না, কিশোর, হবে না, ভুলে গিয়েছিলাম!

কেন হবে না?

কীলই নেই নৌকাটার, তিক্তকণ্ঠে বললো মুসা। সেন্টারবোর্ড, সাইডবোর্ড, কিছু নেই। পালে বাতাস ধাক্কা দিলেই নৌকা উল্টে যাবে। আর যদি নেহায়েত কপালগুণে না-ও ওল্টায়, চালানো যাবে না। কিছুতেই সোজা চালানো যাবে না নৌকা।

ধপ করে বসে পড়লো কিশোর। আঙুল কামড়াতে শুরু করলো। তাকিয়ে আছে মাস্তুল আর বুমগুলোর দিকে। খানিক পরে বললো, মুসা, মাস্তুলগুলো ভাসবে?

ভাসতে পারে। কেন, মাস্তুলে চড়ে বাড়ি যাবার কথা ভাবছো নাকি?

মুসার রসিকতায় কান দিলো না কিশোর। মাস্তুলের সঙ্গে যদি পেরেক মেরে বোর্ড লাগিয়ে দিই? বোর্ডের আরেক ধারে পেরেক মেরে লাগিয়ে দিই নৌকার সঙ্গে, তাহলে…

খাইছে, কিশোর, খাইছে! চটাস করে নিজের উরুতে চাটি মারলো মুসা। বাজিমাত করে ফেলেছো! হবে, কাজ হবে এতে! আর যেতে তো হবে মাত্র এক মাইল। বাতাসের গতি ঠিক থাকলে ভারসাম্য বজায় থাকবে নৌকার। চমৎকার!

তাহলে আর দেরি কেন? উঠে পড়লো কিশোর। এসো, চটপট সেরে ফেলি।

.

১৯.

চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে সব কথা যে বলেছে রবিন, সে-ও প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে। খুজতে বেরিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এখনও কিশোর, মুসা কিংবা কোহেনের হদিস করতে পারেনি। কারনিভলের ভেতরে-বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন চীফ। শো চলছে। উপভোগ করছে দর্শকরা। বুঝতেই পারছে না, সাংঘাতিক ব্যাপার। ঘটে গেছে ভেতরে ভেতরে। উক্তষ্ঠিত হয়ে আছেন মিস্টার কনর, রবি আর রবিন।

তোমার ধারণা কোহেনই ব্যাংক ডাকাত? আরেকবার রবিনকে জিজ্ঞেস করলেন চীফ।

হ্যাঁ।

রকি বীচ থেকে পালালো কিনা বুঝতে পারছি না। অনেকেই দেখেছে বলেছে, অথচ কেউ দেখেনি।

কিশোরও তাই মনে করে।

ওর মনে করার যথেষ্ট কারণ নিশ্চয় আছে। ফালতু কথা বলে না কিশোর।

ওর অনুমান, ডাকাতটা এখনও তার জিনিস খুঁজে পায়নি। আর আমা অনুমান, কোহেনই রবির ট্রেলার ঘেঁটেছে তখন। তারমানে সে-ই ডাকাত লুকানো জিনিস খুঁজছিলো।

হ্যাঁ, হতে পারে।

লোকটা অদ্ভুত, মিস্টার কনর বললেন। সব সময় আলাদা আলাদা থেকেছে আমাদের কাছ থেকে। কারও সঙ্গে মিশতে পারেনি।

হুঁ, চোয়াল শক্ত করে ফেললেন চীফ। খুঁজে বের করবোই তাকে।

 দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে পুলিশ, আর কনরের রাফনেকরা। চষে ফেলছে পুরো এলাকা। খোলা অঞ্চল, কারনিভলের তাঁবু, বুদ, ট্রেলার, ট্রাক, কিছু বাদ রাখছে না। সব কটা গাড়ি আর ট্রাক যথাস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটা নিখোঁজ হয়নি।

কয়েকবার করে পরিত্যক্ত পার্কটায় খুঁজতে গেল ওরা, সাগরের ধারে খুঁজলো। এমনকি কারনিভলের কাছাকাছি পথ, অলি-গুলি-ঘুপচি, বাড়িঘরেও খুঁজে দেখলো।

পেরোলো আরও এক ঘন্টা। তিনজনের একজনকেও পাওয়া গেল না।

এবার সত্যি চিন্তা লাগছে! চীফ বললেন। গেল কোথায়? ওই পার্কটাতেই সূত্র মিলবে। আমিও একবার গিয়ে দেখি।

রাফনেকদের নিয়ে কয়েকজন পুলিশ তখনও পার্কে খুঁজছে। চীফ কাছে যেতে যেতেই চিৎকার শোনা গেল।

ওই যে, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ফ্লেচার। নিশ্চয় কিছু পেয়েছে। বেড়ার ফোকর গলে দ্রুত পার্কে ঢুকলেন তিনি। পেছনে ঢুকলেন কনর আর দুই কিশোর। পানির কিনারে জটলা করছে পুলিশ আর রাফনেকরা। কাকে যেন ধরেছে।

ছুটে গেলেন চীফ। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেদের পাওয়া গেছে?

না, চীফ, একজন পুলিশ বললো। একে পেয়েছি।

ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে এলো কোহেন। আমাকে এভাবে ধরেছে কেন, জিজ্ঞেস করুন তো? আমি কি চোর নাকি?

আগে বলো তুমি এখানে কি করছো? কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কনর।

সেটা আমার ব্যাপার।

আর চুপ থাকতে পারলো না রবিন। ও-ই ডাকাত! ওকে জিজ্ঞেস করুন, মুসা আর কিশোরকে কি করেছে!

ডাকাত? গর্জে উঠলো কোহেন। আমি ডাকাত নই, গাধা কোথাকার। ডাকাতটাকে তাড়া করেছিলাম। বলেছিই তো।

গত তিন ঘন্টা তাহলে কি করছিলেন? প্রশ্ন করলেন চীফ। আমরা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। কোথায় ছিলেন?

ডাকাতটাকে খুঁজতে এসেছি। আমার সন্দেহ…

মিথ্যে বলছে ও! রাগে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। ওর দাড়িও নকল।

কোহেন সরে যাওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে তার দাড়ি চেপে ধরলেন চীফ। হ্যাঁচকা টান দিতেই খুলে চলে এলো আলগা দাড়ি। সবাই তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে।

বেশ, কোহেন বললো। নাহয় নকলই হলো। তাতে কি? নিজে নিজেই টেনে খুলে ফেলতে লাগলো আলগা চুল, গালের জডুল। বেরিয়ে এলো খাটো করে ছাটা চুল, চেহারার বুনো ভাব দূর হয়ে গেল, ভদ্র চেহারার এক তরুণে পরিণত হলো স্ট্রংম্যান। কারনিভলে সবাই চোখে পড়ার মতো পোশাক পরে। মেকাপ নেয়। চুল-দাড়ি আর জড়ুল ছাড়া স্ট্রংম্যানকে লোকে পছন্দ করবে কেন!

কিন্তু আমাকেও তুমি ধোকা দিয়েছে, কোহেন, কনর বললেন। ওসব পরেই চাকরি নিতে এসেছিলে। বুঝিয়েছে, ওগুলো আসল।

মস্ত থাবা নাড়লো স্ট্রংম্যান। আগে সার্কাসে কাজ করেছি, বলেছি আপনাকে। সার্কাস থেকে কারনিভলে আসে না কেউ। কারনিভল থেকেই সার্কাসে যায়, ভালো করেই জানেন। সম্মান খোয়াতে চায় কে? তাই চেহারা লুকিয়ে রেখেছি।

ও স্ট্রংম্যানই নয়, বলে উঠলো রবি। তাই না, বাবা? নিশ্চয় মাছিমানব টিটানভ।

না, ও টিটানভ নয়।

কিন্তু মিথ্যে বলছে, সন্দেহ নেই! রবিন বললো।

কাঁধ ঝাঁকালো স্ট্রংম্যান, ফুলে উঠলো কাঁধের পেশী। তাই নাকি, খোকা? তাহলে… সাগরের দিকে চোখ পড়তে থেমে গেল সে। আরে…?

চীফ, দেখুন, দেখুন, চিৎকার করে বললো একজন পুলিশ।

সাগরের দিকে তাকালো সবাই। কালো পানি চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়। এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো ওরা বিচিত্র একটা নৌকা এগিয়ে আসছে পাল তুলে। একপাশে কাত হয়ে আছে নৌকাটা, চ্যাপ্টা কি যেন একটা আটকে রয়েছে একধারে, বোঝা যায় না। আরও কাছে এলে চেনা গেল আরোহীদের, মুসা আর কিশোর।

ওরাই! বলে দৌড় দিলো রবিন।

কিশোওর! মুসাআ! চেঁচিয়ে উঠে রবিও দৌড়ালো।

নৌকা তীরে ভিড়তেই লাফিয়ে নেমে ছুটে এলো দুই গোয়েন্দা। কয়েক মিনিটেই অন্যদের জানা হয়ে গেল, দুজনের সাগর-অভিযানের কাহিনী।

ওটায় চড়ে এসেছো? বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন চীফ।

দেখলেনই তো, হেসে বললো কিশোর। মুসা খুব বড় নাবিক। চলুন, কারনিভলে। ডাকাতটা কি খুঁজছিলো, জানি। আমার ধারণা, এখনও পায়নি ওটা।

আর পাবেও না, রবিন বললো। ডাকাতটা ধরা পড়েছে। কোহেনকে দেখালো সে।

না, কোহেন ডাকাত নয়।

গোঁ গোঁ করে বললো কোহেন, সেকথাই তো বলছি ওদের এতোক্ষণ। বিশ্বাসই করে না।

ছদ্মবেশে ঢুকেছে ও, কিশোর, কনর বললেন। রবির ট্রেলার ঘাটতে দেখেছো ওকেই।

না, স্যার, শান্ত, দৃঢ়কণ্ঠে বললো, গোয়েন্দাপ্রধান। নৌকার ক্যানভাসের  নিচে লুকিয়ে থাকার সময় বুঝেছি লোক একজন নয়, দুজন। ডাকাতকে তাড়া করেছে কোহেন। ফান হাউসে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমরা, মনে করেছে আমরাই বুঝি ডাকাত।

কি করে বুঝলে? চীফ জিজ্ঞেস করলেন।

আমাদের দেখেছে বলে চিৎকার করছিলো। যে তাড়া করে সে-ই ওভাবে। চেঁচায়, যাকে তাড়া করা হয়, সে নয়। আসল ডাকাতটা বরং লুকিয়েই থেকেছে আমাদের কাছ থেকে।

হ্যাঁ, যুক্তি আছে। কিন্তু…

তাছাড়া, চীফকে কথা শেষ করতে দিলো না কিশোর, কোহেনের কোমর পর্যন্ত নগ্ন, কোনো কাপড় ছিলো না। শুধু আঁটো পাজামা। হাত খালি। পিস্তল আর ছুরি লুকিয়ে রাখার জায়গাই নেই। অথচ, নৌকার দড়ি কেটে আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছিলো, যে লোকটা, তার কাছে ছুরিও ছিলো, পিস্তলও।

ছেলেটা আপনাদের চেয়ে অনেক চালাক, আন্তরিক প্রশংসা করলো স্ট্রংম্যান।

আরও একটা ব্যাপার, কিশোর বললো। রকম পায়ের আওয়াজ শুনেছি। ভারি বুট আর রাবার সোল নরম জুতো। কোহেনের পায়ে বুট, তারমানে ডাকাতটার নরম জুতো ছিলো।

 হেসে উঠলো কোহেন। নিন, এবার হলো তো। আমি যে ডাকাত নই, দিলো। প্রমাণ করে।

তবে আপনিও দুধে ধোয়া নন, মিস্টার কোহেন, তাকে ধরলো এবার কিশোর। ছদ্মবেশে ছিলেন, এটা তো ঠিক। কিছু একটা গোপন করে রেখেছেন সবার কাছ থেকে। নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকেছেন কারনিভলে। আশা করি, চীফের কাছে বলবেন কারণটা। স্ট্রংম্যানের দিকে চেয়ে ঠাণ্ডা হাসি হাসলো সে।

ভুরু কুঁচকে কোহেনের দিকে তাকালেন চীফ।

জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করলো কোহেন। তুমি সাংঘাতিক চালাক, কিশোর পাশা। দেখে কিন্তু মনেই হয় না। ধরা যখন পড়েছি, না বলে আর উপায় কি? সত্যিই স্ট্রংম্যান ছিলাম আমি, সার্কাসে, কয়েক বছর আগে ছেড়ে দিয়েছি। গোয়েন্দাগিরিতে বেজায় শখ, তাই শখের গোয়েন্দা হয়েছি চাকরি ছাড়ার পর। আমার আসল নাম ডেনমার বোলার। রবির নানী ভাড়া করেছে আমাকে নাতির ওপর চোখ রাখার জন্যে। মহিলা জানতে চান, কারনিভল সত্যি সত্যি পছন্দ করে কিনা রবি। আর তার কাজে বিপদের সম্ভাবনা কতটা।

দুর্ঘটনাগুলো তাহলে তুমি ঘটাওনি? কঠোর হয়ে উঠেছে কনরের দৃষ্টি।

না। তবে ঘটাতে উদ্বিগ্ন হয়েছি। আপনাকে বার বার কারনিভল বন্ধ করতে অনুরোধ করেছি সেজন্যেই। রবির জন্যে ভয় হচ্ছিলো। ওর কোনো ক্ষতি হলে। ওর নানী আমাকে আস্ত রাখতো না। তাছাড়া, এটাও বুঝতে চাইছিলাম. ওগুলো আসলেই দুর্ঘটনা কিনা?

রবিকে নিরাপদে রাখতে চাইছিলে?

হ্যাঁ, কনর। সেই দায়িত্বই দেয়া হয়েছে আমাকে।

ভ্রূকুটি করলো কিশোর। চমৎকার, মিস্টার কোহেন। নাকি, মিস্টার বোলার? যা-ই হোক, সব কথা বলেননি। আরও কিছু আছে। রবিকে দেখা আপনার দায়িত্ব, তার ট্রেলার দেখা নয়। ওখানে গিয়েছিলেন কেন? নিশ্চয় সন্দেহ করেছিলেন, ডাকাতটা ওখানে খুঁজতে যাবে। ডাকাতের পেছনে কেন লেগেছেন?

দীর্ঘ এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো কোহেন, ওরফে বোলার। তারপর মাথা ঝাঁকালো। নাহ, তোমাকে ফাঁকি দেয়া মুশকিল। ঠিকই ধরেছো, স্যান মেটিওতেই বুঝেছি, ডাকাতটা কারনিভলেরই লোক। আমি গোয়েন্দা। পেশাদারী একটা মনোভাব রয়েছে। আশা করেছি, ডাকাতটাকে ধরতে পারলে আমার সুনাম বেড়ে যাবে রাতারাতি। কাজেই তদন্ত শুরু করলাম। কিন্তু অনেক খুঁজেও পেলাম না, ডাকাতটার চেহারার সঙ্গে কারনিভলের কারও চেহারা মেলে না। তারপর কানা বেড়াল চুরি গেল। বুঝলাম, ওগুলোর ভেতরেই জরুরী কিছু লুকিয়েছে ডাকাতটা। থেমে হাত নাড়লো সে। কিন্তু বেড়ালের ভেতরে সে নিজেই খুঁজে পেলো না।

কি সাংঘাতিক! বলে উঠলো রবি। নিশ্চয় ভেতর থেকে পড়ে গেছে।

তার কথায় সায় জানাতে পারলো না কিশোর। আমার তা মনে হয় না, বললো সে। বেড়ালের ভেতরেই রয়েছে এখনও।

.

২০.

কিন্তু কিশোর, প্রতিবাদ করলো রবি। আমার পাঁচটা বেড়ালই ছিলো। ডাকাতটা সবগুলো নিয়ে গেছে।

না, রবি, তুমিও ভুল করছো। আসলে বেড়াল ছিলো ছটা। আমরা দেখেছি।

দেখেছি? হাঁ হয়ে গেছে মুসা। কোথায়?

কোথায়, কিশোর? রবিন জানতে চাইলো।

ধরতে গেলে আমাদের নাকের নিচে। সেজন্যেই দেখেও দেখিনি। রবিদের ট্রেলারে উঠেছিলাম, মনে আছে? ভাঙা, নষ্ট…

পুরস্কার! চেঁচিয়ে উঠলো রবি। মেরামত করার জন্যে রেখেছি ঝুড়িতে। আরেকটা কানা বেড়াল আছে ওখানে! স্যান মেটিওয় পুড়ে গিয়েছিলো।

তারমানে আগুন লাগার সময় শুটিং গ্যালারিতে ছিলো ওটা, বললো কিশোর। ওটাতেই জিনিসটা লুকিয়েছিলো ডাকাত। আগুনে বেড়ালটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রবি নিয়ে গিয়ে ঝুড়িতে ফেলে রেখেছে। সেকথা ভাবেইনি ডাকাতটা, তার নিশ্চয় জানা ছিলো না, বেড়াল ছটা আছে। নৌকায় সময় পেয়েছি ভাবার। আমাদের ভাসিয়ে দেয়াটা একটা কথাই প্রমাণ করে, যা খুঁজছে তখনও পায়নি সে। আমরা তার কাজে বাগড়া দেবো বলেই সরিয়ে দিতে চেয়েছে। অনেক ভাবলাম, কোথায় থাকতে পারে জরুরী জিনিস? হঠাৎ মনে পড়লো, ঝুড়িতে ফেলে রাখা বেড়ালটার কথা।

খাইছে! কিশোর, একবারও ভাবিনি আমরা।

আমিও না, তিক্তকণ্ঠে বললো রবি। অথচ আমার হাতের কাছেই রয়েছে।

ডাকাতটাও ভাবেনি, হেসে বললেন চীফ। খুব ভালো কাজ দেখিয়েছো, কিশোর। তোমাকে আমার জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে পেলে খুশিই হবো। করবে চাকরিটা? অনারারি পোস্ট।

মৃদু হেসে প্রশ্ন এড়িয়ে গেল কিশোর। বললো, যখন বুঝলাম…! থেমে গেল সে। সতর্ক হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি চারপাশে দেখলো। চীফ! কে যেন গেল?

অন্ধকার ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। আমিও শুনলাম!

কে গেল? এদিক ওদিক তাকালেন চীফ।

কি জানি, স্যার! বললো একজন পুলিশ। আমরা তো সবাই আছি।

কে যেন দাঁড়িয়েছিলো আমার পেছনে, একজন রাফকে বললো, মনে করতে পারছি না।

চেঁচিয়ে উঠলো রবিন, কোহেন কোথায়?

আশেপাশে কোথাও নেই কোহেন।

জলদি চলুন, কিশোর বললো। কুইক। ছয় নম্বর বেড়ালটার কথা জেনে গেছে!

ছুটতে ছুটতে বেড়ার কাছে চলে এলো সবাই। ফোকর গলে ঢুকলো। কারনিভলের সীমানায়। কিছু দর্শক রয়েছে এখনও। কৌতূহলী হয়ে তাকালো ওরা ছুটন্ত দলটার দিকে।

ছুটে ট্রেলারে ঢুকলো রবি। পরক্ষণেই বেরিয়ে এসে হাত ঝাড়া দিলো। নেই! বেড়ালটা নেই!

সব পথ বন্ধ করে দাও! আদেশ দিলেন চীফ।

 খোঁজো, খোঁজো! কনর বললেন। সমস্ত কারনিভল চষে ফেলো!

 তাড়াহুড়া করে চলে গেল পুলিশ আর রাফনেকরা।

আর পালাতে পারবে না, চীফ বললেন।

চীফ, কোহেনই নিয়েছে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

বুঝতে পারছি না। একের পর এক মিথ্যে বলে যাচ্ছিলো!

নানী গোয়েন্দা ভাড়া করেনি, রবি বললো। করেছে একটা ডাকাতকে।

অনেক শখের গোয়েন্দাকেই নষ্ট হতে দেখেছি আমি, চীফ বললেন। ক্রিমিনালদের সঙ্গে মেশার সুযোগ বেশি ওদের। খারাপ হতে সময় লাগে না। হতে পারে, ডাকাতটার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কোহেনও।

কোহেন না হলে আর কে, স্যার? মুসার প্রশ্ন। তাকে তো আমরা চিনি না। ধরবো কিভাবে? বেড়ালটা জাস্ট লুকিয়ে ফেলবে। ব্যস, আর চেনা যাবে না। তাকে।

বেড়ালটা নিয়ে প্রমাণ করে দিলো, সে আছে। পালাতে আর দেবো না। যেভাবেই হোক, ধরবোই। কিশোর…আরে, কিশোর গেল কোথায়?

কোন ফাঁকে চলে গেছে কিশোর, কেউ খেয়াল করেনি।

কিশোর? মুসা ডাকলো।

 কিশোর? কোথায় তুমি? জোরে ডাকলেন চীফ।

 জবাব নেই।

 আমাদের সঙ্গে কি এসেছিলো এখানে? মনে করতে পারছে না রবিন।

পার্ক থেকে বেরোনোর আগে পর্যন্ত ছিলো, কনর বললেন।

বেশিদূরে যেতে পারেনি, চীফ বললেন। কাছাকাছিই থাকবে।

যদি ডাকাতটার পিছু নেয়? মুসার গলা কাঁপছে।

শান্ত হও, মুসা, কনর বললেন। চলো, খুঁজি।

এক এক করে সমস্ত ট্রাক আর ট্রেলার খুঁজলো ওরা। তারপর চলে এলো যেখানে শো চলছে সেখানে। পনেরো মিনিট খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে এলো শুটিং গ্যালারির পাশের চওড়া পথটায়। সেখানেও নেই কিশোর।

শো শেষ, কনর বললেন। দেখি ওদেরকে জিজ্ঞেস করে, কিশোরকে দেখেছে কিনা।

বেরোনোর সব পথ বন্ধ, চীফ বললেন। বেড়ার কাছেও লোক আছে। ওদের ফাঁকি দিয়ে পার্কে ঢুকতে পারবে না। ভেতরেই আছে কিশোর।

মারকাস দ্য হারকিউলিসের তাঁবুর কাছে কর্মীদের ডেকে জড়ো করালেন কনর। পুলিশ দেখে অস্বস্তি বোধ করছে অনেকেই। কিশোরকে দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলো।

আমি দেখিনি, অস্বস্তিতে নাক কুঁচকালো লায়ন ট্রেনার।

আগুনখেকো আর দড়াবাজরা মাথা নাড়লো। বিচিত্র ভঙ্গিতে দুই লাফ দিলো খাটো ভাড়, এখনও অভিনয় করছে। হাত তুলে দেখালো বিষণ্ণ লম্বা ভাঁড়কে। ভাঙা ঝাড়ু দিয়ে তলাহীন বালতিতে ময়লা তোলার অভিনয় করলো লম্বা। কিন্তু হাসাতে পারলো না কাউকে। হাসার সময় নয় এটা।

মনে হয় আমি দেখেছি, কেঁদে ফেলবে যেন লম্বা। তাঁবুর পেছনে।

 দেখেছো? কাটা কাটা শোনালো চীফের কথা। কার সঙ্গে? কোন তাঁবুর। পেছনে?

জানি না, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো লম্বা। মনে করতে না পারায় বড় দুঃখ পেয়েছে যেন।

হাতে ভর দিয়ে উল্টো হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পড়ে গেল বেঁটে। তিড়িং তিড়িং করে আবার দুই লাফ দিলো লম্বাকে ঘিরে।

গুঙিয়ে উঠলো রবিন। কিশোরকে ধরে নিয়ে গেছে! আমি জানি!

হ্যাঁ, মুসাও প্রায় ককিয়ে উঠলো। জিম্মি করার অভ্যেস তো আছেই। ডাকাতটার!

শান্ত হও, শান্ত হও, বললেন বটে, কিন্তু চীফ নিজের উদ্বেগই ঢাকতে পারলেন না। যাবে কোথায়? ধূরে নিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারবে না।

ধরেই যদি নিয়ে থাকে, প্রশ্ন তুললো রবি। এখনও বেরিয়ে আসছে না। কেন? জিম্মি তো আছেই।

তা-ও তো কথা। বুঝতে পারছি না কিছু।

লম্বা ভাঁড় বলে উঠলো, জিম্মি? মনে পড়েছে। লোকটা পার্কের বেড়ার দিকে দৌড়াচ্ছিলো, ছেলেটাও। ধরে নিলো কিনা বুঝলাম না।

সাগরের দিকে? অবাক হলেন চীফ।

নিশ্চয় সাঁতরে পালানোর চেষ্টা করবে, বললেন কনর। পাহারা পরে বসিয়েছি আমরা, তার আগেই নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে দৌড় দিয়েছে মুসা আর রবি। চীফ আর কনরও পিছু নিলেন। কিন্তু রবিন নড়লো না। মাটির দিকে চেয়ে আছে। চীফ! ডাকলো সে। দেখে যান।

ফিরে এলো চারজনেই। আঙুল তুলে দেখালো রবিন। মাটিতে মস্ত এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা।

খাটো ভাঁড় তখনও লম্বাকে ঘিরে নাচছে। বুড়ো আঙুল নেড়ে বার বার দেখাচ্ছে লম্বা ভাঁড়কে।

.

২১.

আমাদের সাঙ্কেতিক চিহ্ন! বিড়বিড় করলো মুসা। দুই ভাড়ের দিকে তাকালো একবার।

নিশ্চয় কিশোর, বললো রবিন। আমাদের…, বলতে বলতে থেমে গেল। সে। খাটো ভাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। চীফ…!

এবারেও রবিনের কথা শেষ হলো না। হঠাৎ ঢোলা জামার পকেট থেকে লম্বা ভঁড়ের হাতে বেরিয়ে এলো একটা পিস্তল। সেটা তাক করে কোনো কথা না বলে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে শুরু করলো প্রধান প্রবেশ পথের দিকে। রঙ করা ফ্যাকাসে-সাদা চেহারায় ধকধক করে জ্বলছে কালো চোখের তারা।

খবরদার, কেউ নড়বে না! সতর্ক করলেন চীফ। যেতে দাও।

অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেরা, চীফ নিজে, এবং মিস্টার কনর। চলে যাচ্ছে লোকটা। গেটের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে, হঠাৎ একটা বুদের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো আরেকজন। লম্বা ভড় কিছু করার আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

কোহেন। পিস্তল ঘোরানোর চেষ্টা করলো লম্বা, পারলো না। লোহার মতো কঠিন আঙুল কব্জি চেপে ধরলো তার। সেই আঙুল ছাড়ানোর সাধ্য হলো না তার, হাত থেকে খসে পড়লো পিস্তল। স্ট্রংম্যানের কবলে পড়ে একেবারে অসহায় হয়ে গেল লম্বা।

যাক, ব্যাটাকে ধরলাম শেষ পর্যন্ত। খুশি হয়ে বললো কোহেন।

নিজের লোকদের ডাকলেন চীফ। ছুটে এলো তারা। শো শেষ হলেও দর্শকরা সব বেরিয়ে যায়নি, ভিড় জমাতে লাগলো। দুজন পুলিশ গেল ভাঁড়কে ধরতে, অন্যেরা লোক সরানোয় ব্যস্ত হলো।

হেসে বললো, কোহেন, গিয়ে ঘাপটি মেরে ছিলাম। জানতাম, আজ বেরোবেই ব্যাটা। কিন্তু ভাঁড়ের ভেতর থেকে যে বেরোবে, কল্পনাও করিনি।

লাফালাফি থামিয়ে দিয়েছে খাটো ভড়। চুল, মুখোশ সব টেনে টেনে খুললো। হাসিমুখে বললো কিশোর, ভাড় সাজার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের।

কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ হয়ে রইলেন চীফ। তারপর কথা ফুটলো মুখে, খুলে বলো সব। কি করে বুঝলে, লম্বুই ডাকাত? আর ভাড় সাজতেই বা গেলে কেন?

বলছি, শুরু করলো কিশোর। লোকটা আমাদের অলক্ষ্যে পার্ক থেকে সরে আসার পরই বুঝেছি, ছয় নম্বর বেড়ালটা নিতে গেছে। আমরা পৌঁছার আগেই বের করে নিয়ে লুকিয়ে ফেলবে। তারপর তাকে চেনা খুব মুশকিল হয়ে যাবে। তাই আপনাদের সঙ্গে না গিয়ে অন্যদিকে গেলাম। বুঝেছি, বেড়ালটা নিয়েই মিশে যাবে লোকের ভিড়ে। যেখানে তাকে চেনা সহজ হবে না।

ওরকম জায়গা কোনটা? দড়াবাজদের তাঁবু। ওরা তখনও খেলা দেখাচ্ছে। ওদিকে পা বাড়াতে যাবো, দেখি ট্রেলারের দিক থেকে একটা লোক দৌড়ে আসছে। চিনলাম। লম্বা ভাঁড়। দৌড়াতে দৌড়াতেই জিনিসটা ঢুকিয়ে ফেললো ঢোলা পাজামার ভেতরে। আমাকে ওখানে ওই অবস্থায় দেখে ফেললে নিশ্চয় চিনে। ফেলতো। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লাম কাছের তাঁবুটাতে। ঢুকেই চমকে গেলাম। ঢুকেছি ভাঁড়দের তাঁবুতেই।

খাইছে! আঁতকে উঠলো মুসা। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত… একেবারে বাঘের ঘরে ঢুকে গিয়েছিলে!

মাথা ঝোঁকালো কিশোর। ভয় পেয়েছি খুব। দ্রুত ভাবছি, কি করা যায়। শো দেখানোর অন্যান্য তাঁবুর মতোই ওটারও দুটো অংশ। পেছনের অংশে থাকে অভিনেতাদের মেকাপের সরঞ্জাম, যারা ট্রেলারে মেকাপ নেয় না তাদের জন্যে, জানোই। সোজা ঢুকে পড়লাম সেখানে। বাইরে তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তখন। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। পেছনে ঢুকবে কিনা, জানি না। ঢুকতেও পারে… 

কি সাংঘাতিক! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবির। ভালো ফাঁদে পড়েছিলে! ছুরি-টুরি মেরে বসতে পারতো।

পারতো, সায় জানালো কিশোর। ভয় তো পেয়েছি সেকারণেই। দেখি, খাটো ভাঁড়ের সাজপোশাক পড়ে আছে। খেলা শেষ। সাজপোশাক খুলে রেখে গেছে সে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে পরে ফেললাম। ভাগ্যিস, গায়ে লেগেছে। মুখোশ পরাও শেষ করলাম, এই সময় লম্বু ঢুকলো। আমাকে চিনতে পারলো না। অনুরোধ করতে লাগলো, দড়াবাজদের তাঁবুতে গিয়ে আরেকবার যেন খেলা। দেখাই। খেলা দেখানোর নেশায় নাকি পেয়েছে তাকে। আমি তো বিশ্বাস করিইনি, খাটো ভাড়ও করতো কিনা কে জানে। আসলে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। লম্বু মিয়া। পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। বেড়ালটা নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগের জন্যে। প্রথমে চেয়েছিলো, বেড়ালের ভেতর যে সে জিনিস। লুকিয়েছে, এটা কেউ না জানুক। পরে দেখলো, সবাই জেনেই গেছে। আর চালাকি করে লাভ নেই। কোনোমতে বেড়ালটা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলেই তখন হাঁপ ছাড়ে।–

হু, বুঝলাম, বললেন চীফ। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে, আমাদের কাছে এসে কেন বললে না, লম্বুই ডাকাত? ভাঁড়ামির কি দরকার ছিলো?

আমি জানতাম, স্যার, ওর কাছে পিস্তল আছে। আমার ভয় ছিলো, সরাসরি আপনাকে বললে বেপরোয়া হয়ে উঠবে সে। পিস্তল বের করে যথেচ্ছা গুলি চালাতে শুরু করলেও অবাক হতাম না। তাতে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারতো। তাই চাইছিলাম, ওকে না জানিয়ে কোনোভাবে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। বোঝাতে চাইছিলাম, আমি আসলে খাটো ভাড় নই। তা-ও যখন বুঝলেন না, মাটিতে প্রশ্নবোধক আঁকলাম। রবিনের চোখে পড়েছিলো বলেই…।

হ্যাঁ, আরেকটু হলেই দিয়েছিলাম কাচিয়ে, স্বীকার করলেন চীফ। যাক, ভালোয় ভালোয় সব শেষ হলো। বেড়ালটা কোথায়?

ওর পাজামার ভেতরে, লম্বা ভাঁড়কে দেখালো কিশোর।

অস্বাভাবিক ঢোলা পাজামার ভেতর থেকে বের করা হলো বেড়ালটা। ওটার। ভেতর থেকে বেরোলো ছোট একটুকরো কার্ডবোর্ড।

লেফট-লাগেজ টিকেট! টুকরোটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করলেন চীফ। টাকাগুলো নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে ওখানে। আরেকটা রহস্যের সমাধান। হলো। এখন দেখা যাক, ভঁড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছেন কোন মহাজন।

ভাঁড়ের পরচুলা আর উইগ নিজের হাতে খুললেন চীফ। পিছিয়ে গেলেন এক পা। বোকা হয়ে গেছেন যেন।

ভাঁড়ের মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সাদা-চুল এক বৃদ্ধ। বয়েস পঁয়ষট্টির কম নয়।

ও…ও ডাকাত নয়! মাথা নাড়ছেন চীফ। ও নয়!

আমিও তাই বলতে চাইছিলাম, কনর বললেন। ডাকাতি করার বয়েসই নেই। আর যা-ই করুক, বয়েস কেউ লুকাতে পারে না। আর দেয়াল বেয়ে ওঠাও তার কর্ম নয়।

আমি ডাকাত নই, দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভাড়, গোবেচারা চেহারা। দশ হাজার ডলারের লোভ দেখিয়ে আমাকে দিয়ে ট্রেলার থেকে বেড়ালটা চুরি করিয়েছে। পিস্তলটা ও-ই দিয়েছে। কি করে ব্যবহার করতে হয়, তাই জানি না। আপনাদের ভয় দেখিয়ে খুব অন্যায় করেছি। আ-আমাকে…আমাকে মাপ করে দিন।

কে ভাড়া করেছে? চীফ জিজ্ঞেস করলেন।

আড়চোখে কোহেনের দিকে তাকালো ভড়। বললো, কোহেন। আমাকে দশ হাজার ডলার দেবে বলেছে।

লাল হয়ে গেল স্ট্রংম্যান। চেঁচিয়ে উঠলো, মিথ্যে কথা? ব্যাটা মিথ্যুক! আমি…আমি…

আমি সত্যি বলছি, জোর গলায় বললো ভাঁড়। আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ও এখন স্বীকার করতে চাইছে না।

কোনো কথা বলছে না কিশোর। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে ভাঁড়ের হাতের দিকে। হাসি ফুটলো মুখে। আমাদের বুড়ো ভাঁড়ই মিথ্যে কথা বলছে, চীফ।

কি করে বুঝলে?

ও মোটেও বুড়ো না।

 অ্যাঁ? কি বলছো? বিশ্বাস হচ্ছে না মুসার।

হ্যাঁ, সেকেণ্ড। আমরা ভেবেছি, ছদ্মবেশ পরে গিয়ে ডাকাতি করেছে বাদামী চামড়ার লোকটা। আসলে পরে গিয়ে নয়, খুলে গিয়ে করেছে। প্রথম দিন বেড়াল চুরি করার সময় অবশ্য আরেকটা ছদ্মবেশ পরেছিলো। তবে কারনিভলে সব সময়ই ছিলো বুড়ো মানুষের ছদ্মবেশে।

ছাড়া পাওয়ার জন্যে জোরাজুরি শুরু করলো ভাড়, কিন্তু দুজন পুলিশ তাকে দুদিক থেকে চেপে ধরে রাখলো। চুল ধরে টানলেন চীফ, মুখোশ খোলার চেষ্টা করলেন। চুলও খুললো না, মুখের ভাঁজ পড়া চামড়াও আগের মতো রইলো।

ভালো করে দেখলেন আবার চীফ। লোকটার গলার কাছে সূক্ষ্ম একটা দাগ দেখতে পেলেন। নখ দিয়ে খুটে বুঝলেন আলগা। আঙুল ঢুকিয়ে জোরে ওপর দিকে টানতেই খুলে চলে এলো প্লাস্টিকের মুখোশ গলা, মুখ, চুল, সব একটাতে। আলগা কিছু নয়।

বেরিয়ে পড়লো আরেক চেহারা। বাদামী চামড়া।

টিটানভ! সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন কনর। মাছিমানব থেকে ব্যাংক ডাকাত!

টাট্টু কোথায়, দেখুন তো? মুসা বললো।

পাওয়া যাবে না, বললো কিশোর। ওটা আলগা। সময়মতো লাগিয়ে নিতো।

জাহান্নামে যাও; বিচ্ছু কোথাকার! হিসিয়ে উঠলো টিটানভ। হাঁদা ছেলে!

বিচ্ছু ঠিকই, টিটানভ, কঠিন হাসি ফুটলো চীফের ঠোঁটে। তবে হাঁদা বলতে পারবে না। তোমাকেই বরং হাঁদা, গাধা, সব বানিয়ে ছেড়েছে। কিশোরের দিকে ফিরলেন। অনেক প্রশ্নের জবাবই তো দিলে, কিশোর। আর একটা প্রশ্ন। কি করে বুঝলে, ওর মুখে মুখোশ? টেনেও তো কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না।

অতি-ধূর্ত অপরাধীও কিছু না কিছু ভুল করেই ফেলে, স্যার। আপনি খুব ভালো করেই জানেন। এই লোকও হাত ঢাকতে ভুলে গিয়েছিলো। বোধহয় তাড়াহুড়োয়। সবসময় তো দস্তানা পরেই থাকতো, দেখেছি। কোথায় খুলে রেখেছিলেন, টিটানভ? পার্কে? আমাদের নৌকার দড়িকাটার সময়? নাকি বেড়ালটা চুরির সময়? . জবাব দিলো না মাছিমানব। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো আরেকদিকে। তার হাতের দিকে এখন সবার চোখ। বাদামী চামড়া সবাই দেখতে পাচ্ছে।

হাঁদা আমাকে বলতে পারো, টিটানভ, বিরক্ত কণ্ঠে বললেন চীফ। চোখ ভোঁতা হয়ে গেছে আমার। নইলে এটা দেখলাম না!

হাসলো কিশোর। নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, সহজ ব্যাপারগুলোই সহজে, চোখ এড়িয়ে যায়।

.

 পরদিন, কেসের রিপোর্ট ফাইল নিয়ে বিখ্যাত পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা।

মন দিয়ে ফাইলটা পড়লেন পরিচালক। মুখ তুলে বললেন, চমৎকার কাহিনী। ভালো ছবি হবে।…এখন, কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। কারনিভলে ঢুকলো কেন টিটানভ? ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা আগেই ছিলো?

ওহিওতে ডাকাতির অপরাধে খুঁজছিলো তাকে পুলিশ, রবিন জানালো। কারনিভলে ঢুকে তাই লুকিয়ে থাকতে চেয়েছে।

 আরও একটা কারণ আছে, বললো কিশোর। সে শুনেছে, কারনিভল নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় আসবেন মিস্টার কনর। দলে ঢুকতে পারলে পুলিশের চোখ এড়িয়ে সহজে বেড়িয়ে আসতে পারবে টিটানভ। ভাঁড়ের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছে। কারনিভলে কাজের অভিজ্ঞতা তার আগে থেকেই ছিলো। ভাঁড়ের অভিনয় করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। স্যান মেটিওতে আসার পর ব্যাংক ডাকাতির চিন্তা ঢুকলো মাথায়।

বুদ্ধিমান ডাকাত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন পরিচালক। ডাকাতি করে টাকা নিয়ে গিয়ে লেফট-লাগেজে রাখলো। ভাঁড়ের ছদ্মবেশে আরেকবার ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেল পুলিশকে।

রকি বীচ থেকেও বেরিয়ে যেতো। শুধু যদি জানতো, বেড়াল পাঁচটা নয়, ছটা।

হু। চুপ করে ভাবলেন কিছুক্ষণ পরিচালক। জিজ্ঞেস করলেন, রবি কি বাবার কাছেই থাকবে ঠিক করেছে? নাকি নানীর কাছে চলে যাবে?

বাবার কাছেই থাকবে, মুসা বললো। কোহেন, মানে বোলার রিপোর্ট করেছে তার নানীর কাছে, কারনিভলে ভয়ের কিছু নেই। নিরাপদেই থাকবে রবি। তাছাড়া কাজটা সে পছন্দ করে।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়েছেন মহিলা, যোগ করলো কিশোর। ছেলে বাবার কাছে থাকলেই ভালো।

বোলার কি চলে গেছে?

না, রবিন বললো। কারনিভলেই রয়ে গেছে, সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে। গোয়েন্দাগিরি করেছে বটে কিছুদিন, কাজটী তার ভালো লাগেনি।

হুঁ। সব কাজ সবার জন্যে নয়। ঘড়ি দেখলেন পরিচালক, মুখে না বলেও বুঝিয়ে দিলেন হাতে সময় কম। আর একটা প্রশ্ন, তারপরেই তোমাদের ছেড়ে দেবো। ওই পনি রাইডের ব্যাপারটা কি? কে বিষ খাওয়ালো ঘোড়াগুলোকে?

ওটা সত্যিই দুর্ঘটনা। খাবারে বিষক্রিয়া।

ও। মিস্টার কনরের ভাগ্য খারাপ। ভালো ঘোড়াগুলো মরে গেল। ভড়ও কমে গেল একজন। আরেকটা বড় আকর্ষণ গেল তাঁর কারনিভলের।

রকি বীচে যতোদিন থাকবেন উনি, ভাঁড়ের অসুবিধে হবে না তার, হেসে বললো মুসা। কিশোর কথা দিয়েছে, ভাঁড়ের অভিনয় সে-ই করবে। কাল যা দেখিয়েছে না, স্যার, কি বলবো। অন্য সময় হলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেতো আমার।

তাই নাকি, তাই নাকি? আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন সদাগম্ভীর পরিচালক। সময় করতে পারলে যাবো দেখতে। দেখি, কিছুক্ষণ হেসে মনটা হালকা করে আসতে পারি কিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *