১৫. সামাজিক জীবন (১৫তম খণ্ড)

১৫তম খণ্ড – সামাজিক জীবন

সামাজিক জীবনে ইসলাম

 জন্মগতভাবে মানুষ সামাজিক জীব। বিচ্ছিন্ন মানব জীবনের কল্পনাও করা যায় না। সমাজ হীন মানুষ কখনো চলতে পারে না। বস্তুত সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপন মানুষের স্বভাবগত ও প্রকৃতিগত ব্যাপার।

পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে বেহেশতে একা থাকতে দেয়া হয়নি। বরং মা হাওয়া (আঃ)-কেও সৃষ্টি করে তার সাথে একত্রে বসবাস করতে দেয়া হয়েছিল। হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ পাক আদম (আঃ)-কে বলেছিলেন?

يادم اسكن أنت وزوجك الجثة

হে আদম! তুমি তোমার জোড়সহ বেহেশতে বসবাস কর।–(সূরা বাকারা ৩৫)

মানব ইতিহাসের শুরুতেই সমাজের মূলভিত্তি পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে দেখা যায়, যখন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়নি, তখনো মানুষ পরিবারবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে বাস করতো। পরবর্তী পর্যায়ে এই পারিবারিক এককসমূহ গোত্রে এবং গোত্রসমূহ সমাজে পরিণত হয়। মানব জাতির আরবি প্রতিশব্দ L3 আর এর মূলধাতু ] এর অর্থ অন্তরের টান। ঝোঁক-প্রবণতা, ভালবাসা, মেলামেশা। অর্থাৎ মানুষের স্বভাব হলো অন্যের সাথে মিলেমিশে সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপন করা। এর কারণ দু’টো। এক, স্বজাতির প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ। দুই. জীবন ধারণের জন্য অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন।

স্বজতির প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণের অর্থ মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বজাতির প্রতি বিশেষ অনুরাগের অধিকারী। স্বজাতির সঙ্গসুখে সে আত্মিক ও মানসিক শান্তি লাভ করে। পক্ষান্তরে, যদি স্বজাতির সাথে পূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তবে তার মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আর নিরবচ্ছিন্ন ও দীর্ঘকালীন নির্জনতা তাকে আতংকগ্রস্ত করে তোলে।

জীবন ধারণের জন্য অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন, এর মানে হচ্ছে মানুষের একক ব্যক্তিগত শক্তি একেবারে সীমাবদ্ধ। অথচ সে তুলনায় তার পার্থিব প্রয়োজন বিপুল ও ব্যাপক। সুতরাং তার প্রযোজন পূরণের জন্য তার ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থ্য যথেষ্ট নয়। সেজন্য তাকে অন্য মানুষের সহযোগিতা নিতে হয়। সে মুহূর্তের জন্যও অন্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারে না

নিজের, নিজ পরিবার-পরিজনের, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা ও কল্যাণ সাধন প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। ইসলামে অপরের প্রতি কর্তব্য পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বস্ততার সাথে হুকুকুল ইবাদ’ আদায় করা ইসলামী সমাজ জীবন যাপনের অপরিহার্য শর্তবিশেষ। শুধু নিজের বা নিজ পরিবারের আরাম আয়েশ করার অধিকার কোন মুসলিমকে দেয়া হয়নি; বরং তার আনন্দ-বেদনা, সুখানুভূতি ও সম্পদে রয়েছে তার প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-দুঃখী মানুষের অংশ ও অধিকার। আল্লাহ্ তা’আলার বাণী।

وجعل بينكم مودة ورحمه

তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া পয়দা করেছেন। (সূরা রূম : ২১)

এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে মানুষকে মূলত সামাজিক জীব হিসাবে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সমাজবদ্ধতা মানব-প্রক্বতির এমন একটি চাহিদা যা থেকে শুধু এই পার্থিব জীবনেই নয়; বরং পরকালের জীবনেও সে পৃথক থাকতে পারে না। বেহেশতেও মানুষ কেবল তখনই মানসিক স্বস্তি ও পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করবে, যখন সে স্বজাতীয় ব্যক্তিবর্গের সাহচর্য লাভ করবে।

মানব জীবনের বহুমুখী কার্যক্রম সম্পাদনে প্রয়োজন সমাজের সাথে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক ও বহুবিধ সম্পৃক্ততা। নিজ নিজ প্রয়োজন পুরণ ছাড়াও তাদের মাঝে বিরাজ করে এক প্রকার মধুর সম্পর্ক। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা তাই স্বাভাবিক, আবার ধর্মেরও দাবী। অধিকন্তু, পরকালের সাফল্যতার জন্যও আবশ্যক দুনিয়ার জীবনে সুন্দর-সুষ্ঠু সমাজিক বন্ধনের।

পবিত্র কোরআনের বিধানসমূহ মানব কল্যাণের জন্য এবং মানব সমাজকে লক্ষ্য করেই নাযিল হয়েছে। এমন কি কোরআনের যে সব আয়াতে ব্যক্তি গঠন ও সশোধন বিষয়াদির উল্লেখ রয়েছে সেগুলোও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়; বরং সমাজের সাথে তা সম্পৃক্ত।

নামায, যাকাত ও হজ্জসহ যাবতীয় মৌলিক এবাদত যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য সমাজ-জীবনই প্রকৃত ক্ষেত্র। নামায ইসলামের পঞ্চ বেনার অন্যতম। ঈমানের পরেই নামাযের স্থান। ইসলামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক এবাদত যাকাত, যা সমাজের ধনীদের থেকে সংগ্রহ করে গরীব, অসহায়দের মাঝে বন্টনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামের আরেকটি বেনা হজ্জ আদায় করা এবং হজ্জের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করা একা কোন ব্যক্তির পক্ষে অকল্পনীয় ব্যাপার।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত ও

لا تدخلوا الجنة حتى تؤتوا ولا تؤمنوا حتی تحابوا أولا أدلكم

على شئ إذا فعتموا تحاببتم أفشوا السلام بينكم

রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার পরস্পরকে ভালবাসতে না পারা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের খবর দেব না করলে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসতে সক্ষম হবে? (তা হলো) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন করবে।–(মুসলিম শরীফ)

এ হাদীসে দেখা যায় জান্নাতী হওয়ার জন্য ঈমানদার হওয়া শর্ত, আবার ঈমানদার হওয়ার জন্য সামাজিক সৌহার্দ্য থাকা অপরিহার্য। আল্লামা ইবন খালদুন (রঃ) বলেন, এক সাথে মিলেমিশে থাকা মানুষের জন্য অপরিহার্য। এ সত্যটিকেই পণ্ডিতব্যক্তি ও জ্ঞানীগণ এভাবে বিবৃত করে থাকেন যে, জন্মগতভাবেই মানুষ সামাজিক জীব।–(মুকদ্দমায়ে ইব্‌ন খালদূন)।

দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, মানুস প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক জীব। যে লোক সমাজ-সভ্য নয়, সে হয়ত দেবতা নয়ত পশু। কথাটি সর্বজন স্বীক্বত।

.

সামাজিক বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা

ইসলামে সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত ইসলাম যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সেহেতু এতে মানুষের যথার্থ কল্যাণের সার্বিক বিধানাবলী বিবৃত হয়েছে। সমাজত্যাগী জীবন মূলত ইসলামী জীবন নয়। আল-কোরআন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছে:

ورهبانيين ابتدعوها ما كتبنا عليهم

আর বৈরাগ্যবাদ তো তাদেরই আবিষ্কৃত, আমি তো তাদের এ বিধান দেইনি! –(সূরা হাদীদ ও ২৭)

হাদীস শরীফে কথাটি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :

لا رهبانية في الإسلام

ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই।

ইসলাম নিঃসন্দেহে ব্যক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক ও মূলবাণী ব্যক্তির উদ্দেশ্যেই। ব্যক্তি এই দুনিয়ায় জন্ম নিয়েছে। আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবন যাপন করা ব্যক্তিরই দায়িত্ব। আর দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় কর্মের হিসাব-নিকাশ তাকেই দিতে হবে। কিন্তু ইসলাম এ কথাও ঘোষণা করেছে যে, মানুষ যে পথে চললে জীবনের সফলতা লাভ করতে পারে, তা সমাজকে পাশ কাটিয়ে নয়; বরং একট সুসংগঠিত, সুষ্ঠু সমাজ জীবন-যাপনের মাধ্যমেই তাকে সাফল্যের চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছতে হবে। আল-কোরআনের ঘোষণা :

واعتصموا بحبل الله جميعا و لاتفرقوا

তোমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহর রঞ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। –(সূরা আলে ইমরান ও ১০২)

ইসলাম একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে মানুষকে সমাজবদ্ধ জীবন যাপনের উদ্বুদ্ধ করে। এরশাদ হয়েছে।

وكذالك جعلناكم أمة وسطا تكونوا على الناس ۔

এভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে গড়েছি, যাতে করে তোমরা লোকদের জন্য সাক্ষ্যদানকারী হতে পার।–(সূরা বাকারা : ১৪৩)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

ثم خير أمة أخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن

المنکر۔

তোমরা উত্তম জাতি, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে।–(সূরা আলে ইমরান : ১১০)

দুনিয়ার মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা, মানুষের মঙ্গলের জন্যে ভাল কাজের প্রতিষ্ঠা ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করা, সত্যের সাক্ষ্য দেয়া আর দুনিয়াতে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে মানব জাতির সত্যিকার কল্যাণ সাধন করাই ইসলামী সমাজের উদ্দেশ্য। ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হয় না। তাছাড়া সল্কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকা ও বিরত রাখা একটি ইসলামী সমাজেরই বৈশিষ্ট্য। ইসলামী সমাজে মানুষের মর্যদার মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ামূলক কাজে পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হওয়া ও পরস্পরের সাহায্য-সহানুভূতি থাকা সে সমাজের আর একটি বৈশিষ্ট্য।

.

ইয়াতীম, দুঃস্থ ও মাযলুমের প্রতি কর্তব্য

 মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজুরাত : ১০) রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেনঃ

إنما المؤمنون إخوة

مسلم اخوة

প্রত্যেক মুসলিম একে অন্যের ভাই। তিনি আরও বলেছেন :

الخلق عيال الله فأحب الخلق الى الله من أحسن إلى عياله

সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি হলো যে তার সৃষ্টির প্রতি সদয় আচারণ করে।

ইসলাম সকল মানুষের সাথে সদাচারের শিক্ষা দেয়। বিশেষ করে সমাজের ইয়াতীম, দুস্থ, অসহায় ও মযলুমকে সহায়তা দানের প্রতি ইসলাম অধিক গুরুত্ব আরোপ করে।

আল্লাহ্ তা’আলা আল-কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সমাজের সকল মানুষকে ইয়াতীম, দুস্থ ও মযলুম মানুষের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন নির্দেশ দিয়েছেন। ইয়াতীমের হক আদায় না করা ও মিসকীনদের খাবার না দেয়ার প্রতি ভৎর্সনা করে কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

اريت الذي يكب باليرين فذلك الذي يدفع اليتيم ولا يحض علي

طعام المسكين

তুমি কি (এমন লোককে) দেখেছ, যে দীনকে মিথ্যা মনে করে? সে তো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয়, আর সে মিসকীনদের খাবার দানে মানুষকে উৎসাহিত করে না। –(সূরা মাউন : ১-৩)

আল-কোরআন ইয়াতীমদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

كلا بل تكرمون اليتيم ولا ممشون على طعام المشين

কখনও নয়; বরং তোমরা ইয়াতীমের সম্মান কর না, আর মিসকীনদের খাদ্যদানে উৎসাহিত কর না।–(সূরা ফাজর : ১৭-১৮)

ইয়াতীমদের সম্মান না করার অর্থ তাদের পাওনা আদায় না করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন না করা।

যারা দুনিয়ার জীবনে ইয়াতীম, মিসকীন ও বন্দিদের উপকার করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে পরকালে বেহেশত ও বেহেশতের বহু নিয়ামত দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। ইয়াতীম ও মিসকীনদের প্রতি সহায়তা দান বেহেশতী মানুষের স্বভাব। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে।

ويطعمون الطعام على حبه مشينا ويتيما واسيرا

তারা দুনিয়ার জীবনে খাদ্যদ্রব্যের প্রতি নিজেদের প্রয়োজন আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও কয়েদীদের আহার দেয়।–(সূরা দাহর : ৮)

ইসলাম অসহায় ও দুস্থ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। প্রত্যেক মানুষকে ইসলাম শিক্ষা দেয় পরস্পরকে ভালবাসতে। কেউ যেন কাউকে কোনভাবে কষ্ট না দেয় এবং কারো প্রতি যুলুম-অত্যাচার না করে, সেই মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তোলে। আল-কোরআন আজকের মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ্য করে বলেছে?

كنتم خير أم أخرجت للناس

তোমরা উত্তম জাতি! তোমাদের আগমন ঘটেছে মানুষের কল্যাণের জন্য। (সূরা আলে-ইমরান : ১১০)

মুসলমানদের আগমন ঘটেছে সকল মানুষের সঠিক ও প্রকৃত কল্যাণ সাধনের জন্য। এ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক দায়িত্ব। আর প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিগত পর্যায়েও মানুষের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করবে। কমপক্ষে কেউ যেন কষ্ট না পায়; অথবা কারো প্রতি যেন কোন যুলুম না হয়, তার প্রতি সচেতন থাকা মুসলমান মাত্রেরই কর্তব্য।

মযলুমকে সাহায্য করা এবং যালিমকে বাধা দেয়া ঈমানী দায়িত্ব। কোন মুসলমান যদি এর বিপরীত করে অর্থাৎ মযলুমকে যালিমের হাত থেকে হেফাযতের চেষ্টা না করে, অথবা যালিমকে বাধা না দেয়; তবে সে ব্যক্তি ইসলামের অবারিত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। হযরত আউস ইবন শুরাবলী (রাঃ) থেকে এক হাদীস বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেন:

من حشى مع ظالم ليقويه وهو يعلم أنه ظالم فقد خرج من

الإشلام

যে ব্যক্তি যালিমের সাথে থেকে তার শক্তি যোগায় অথচ সে জানে যে, লোকটি যালিম; তবে সে ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিয হয়ে যাবে।

নবী করীম (ছঃ) বলেন :। jL1 315)

তুমি তোমার মু’মিন ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে যালিম হোক অথবা তোক মযলুম।

উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম যালিকে কিভাবে সাহায্য করবে জিজ্ঞাসা করলে, নবী করীম (ছঃ) বলেন, যালিমকে যুলুম থেকে বিরত রাখাই তাকে সাহায্য করা।

বস্তুত ইসলাম মানব সমাজে যুলুম-অত্যাচার বন্ধ করার কার্যকর বিধান দিয়েছে। এর অনুকরণ আমাদের সকলের একান্ত কর্তব্য।

সমাজের প্রবীণদের কাছে নবীনদের জানার ও শেখার অনেক কিছু থাকে। প্রবণীদের কাছ থেকে তারা ঈমান-আমলসহ জাতীয় পরিচিতি, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। পক্ষান্তরে, প্রবীণরা নবীনদেব প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানে ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাই ছোটদের উচিত বড়দের সম্মান করা ও তাদের কথা মেনে চলা। জাতির ভবিষ্যত বংশধরদের সার্বিক উন্নতির জন্য ছোটদের প্রতি স্নেহ ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অপরিহার্য।

 রব্বুল আলামীন সন্তান-সন্ততির শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-কায়দা শিক্ষাদানে ও চরিত্র গঠনে পিতামাতা ও অভিভাকদের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। ছোটরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বড়দের থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা হাসিল করে থাকে। একটি সমাজ সুন্দর-সুখী হয়ে গড়ে উঠার জন্য প্রয়োজন ঐ সমাজের ছোটদের প্রতি বড়দের মায়া-মমতা ও স্নেহ-ভালবাসা রাখা এবং ছোটদেরও বড়দের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মান করা। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেনঃ

ليس منا من لم يرحم صغيرنا ولم يؤقر کبیر

যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না আর আমাদের বড়দের শ্রদ্ধা করে না, সে আমাদের দলভূক্ত নয়।-(মেশকাত পৃঃ ৪২৩)।

কোমলমতি বালক-বালিকারা অনুকরণ প্রিয়। বড়দেরকে তারা যে কাজ করতে দেখে নিজেরাও তা করতে অভ্যস্ত হয়, কাজেই ছোটদের উন্নত চরিত্র ও সুষ্ঠু মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা এবং তাদের সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করার ব্যাপারে বড়দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পক্ষান্তরে, বড়দের আদেশ-উপদেশ মেনে নিয়ে জীবন পরিচালনা করা ও তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা ছোটদের কর্তব্য। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা, তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শোনা এবং প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা উচিত। পক্ষান্তরে বড়দের দায়িত্ব হল ছোটদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা, আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়া এবং আন্তরিকতার সাথে তাদের চরিত্র গঠনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।

.

মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আচরণ

ইসলাম সকল মানুষের সাথে সুসম্পর্ক ও সদ্ব্যবহার শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়ঃ

إنما المؤنون إخوة

মু’মিনরা সকলে পরস্পর ভাই ভাই। (সূরা হুজুরাত : ১০)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেছেনঃ

حقر اخاه

المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يخذله ولا يقره القوى ههنا ويشير إلي صدره ثلك مرات بحسب امرأ من الشوان يحقر أخاه المشيم المشلم على المملم رام دمه وماله وعرضه

মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না। তিনি বুকের দিকে ইশারা করে তিনবার বললেন, তাকওয়া এখানে। নিজ মুসলমান ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা করা অন্যায়। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান সবই হারাম।

কোন মুসলমান ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট ও সংকট নিরসনে এগিয়ে গেলে আল্লাহ্ তার বিপদ সংকটে সাহায্য করেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন :

من نفس عن مؤمن كربة من كرب الاشياء نفس الله عنه كربة من کرب يوم القيامة ومن يشره على معسرير الله عليه في الدنيا

والأخرة ومن ستر مسلما ستره الله في الدنيا والآخرة والله عون العب مادام العبد في عون أخيه

যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ্ কিয়ামতের দুঃখ-কষ্ট তার দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার যাবতীয় সংকট নিরসন করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমনের দোষ-ক্রটি গোপন রাখে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ক্রটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ্ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।

এক মু’মিন সে তার নিজের জন্যে যা পসন্দ করে অন্যের জন্যও তা-ই পসন্দ করবে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন:

لا يؤمن عبد حتى يحب لأخيه مايحب لنفسه

কেউই মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পসন্দ করবে যা তার নিজের জন্য পসন্দ করে।

তিন দিনের বেশি মুসলমান ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন রাখা দুরুস্ত নেই। নবী করীম (ছঃ) বলেছেন :

يحل لمسلم أن يهجر مؤمنا فوق ثلث أيا

কোন মুসলিমের জন্য জায়েয নেই যে, সে তার কোন মু’মিন ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন অবস্থায় থাকে।

কোন কারণে মুসলমানদের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটলেও তা যেন তিন দিনের বেশি স্থায়ী না হয়। এমন অবস্থায় যে প্রথমে ক্রোধ প্রশমিত করে মিলনের হাত বাড়াবে রাসূলুল্লাহ (ছ.) তাকে উত্তম লোক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

.

প্রতিবেশীর সাথে মুমিনের আচরণ

প্রতিবেশীরা আত্মীয়-স্বজনের চেয়েও অধিক কাজে আসে। আত্মী-স্বজন তো সবাই নিকটে অবস্থান করে না। প্রতিবেশীরাই বিপদে-আপদে, দুঃখ-দুর্দশায় প্রথমে এগিয়ে আসে। বিপদের সময় প্রতিবেশীরা খোঁজখবর নেয় ও সেবাযত্ন করে থাকে। বিয়ে-শাদী এবং অনুরূপ সামাজিক কাজকর্মে প্রতিবেশীর ভূমিকা থাকে উল্লেখযোগ্য। কোরআন সকল প্রকার প্রতিবেশীর সাথে সদচারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

والجاري القربى والجار الجب والشاب بالجثتي

নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী এবং সাথী-সঙ্গীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। –(সূরা নিসা : ৩৬)

হাদীস শরীফে হক বা অধিকার অনুসারে প্রতিবেশীকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।

 ১. এক হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী–যারা আত্মীয় নয়, মুসলিমও নয়।

২. দু’ হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী–যারা আত্মীয় নয়, কিন্তু মুসলমান।

৩. তিন হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী–যারা আত্মীয় ও মুসলমান।

প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে থাকা, তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করা প্রতিটি মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব।

নবী করীম.) বলেছেনঃ

حتى ظننت انه سيورثه

إل جبريل يوصيني بالجار

জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে (এত বেশি) তাকিদ দিচ্ছিলেন যে, আমার মনে হচ্ছিল তিনি তাদেরকে আমার ওয়ারিস বানিয়ে দেবেন।

প্রতিবেশী যে কোন ধর্মের, যে কোন বর্ণের এবং যে কোন আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার প্রতি ইসলাম প্রত্যেক মু’মিনকে উদ্বুদ্ধ করে। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবীয় আচরণ প্রদর্শন ইসলামেরই শিক্ষা। আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সকল প্রতিবেশীর সাথে ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ ঈমানদারদের ঈমানের দাবী।

.

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা

দুনিয়ার মানুষ জন্মসূত্রে ও বৈবাহিক সূত্রে পরস্পরের আত্মীয়। মাবাবার হক আদায় করার পর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখা ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। ইসলামী জীবন বিধানে আত্মীয়তার হক আদায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে :

 আত্মীয়দের হক আদায় কর।–(সূরা বনী ইসরাঈল ও ২৬)

আল্লাহ্ তা’আলা মুত্তাকীদের সম্পর্কে বলেন :।

وأتى المال على حتی توی القربی

তারা ধনসম্পদের প্রতি নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজনদের দান করে। –(সূরা বাকারা : ১৭৭)

আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখা ঈমানদারের ঈমানের দাবী। আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা মুসলিম সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

يحل لمسلم أن يهجر أخاه فوق لين فمن هجر فوق ثلث فمات

কোন মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের সাক্ষাৎ পরিত্যাগ করে থাকা বৈধ নয়। কেউ যদি তিন দিনের বেশি ভাইয়ের সাক্ষাত ত্যাগ করে থাকা অবস্থায় মারা যায় তবে সে দোযখে যাবে।

ভাই বলতে সহোদর, বৈমাত্রেয়, বৈপিত্রেয় এবং মুসলিম ভাই সবাইকে বুঝায়। তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন অবস্থায় থাকা জায়েয নয়। কখনো কোন কারণে মনোমালিন্য হলে সর্বোচ্চ তিন দিন পর্যন্ত রাগ থাকতে পারে। তিন দিনের মধ্যে মু’মিনরা পরস্পরের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নেবে। সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের কী চমৎকার ব্যবস্থা!

.

নারীর অধিকার

 ইসলামই নারীদের অধিকার সত্যিকারভাবে নিশ্চিত করেছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণতা দানকারী আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)-এর পূর্ব পর্যন্ত নারীকে তুচ্ছ মনে করা হতো। এমন কী নারীদের আত্মা আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা হতো। আজকের দুনিয়াতে এখনও কোন কোন সমাজে নারীর উত্তরাধিকারিত্বের স্বীকৃতি নেই।

জাহেলী যুগের সমাজিক চিত্র অবলোকন করলে ইসলামী সমাজ ও ইসলাম বহির্ভূত সমাজে নারীর অধিকার সম্পর্কিত পার্থক্য ধরা পড়ে। কন্যা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবরে ওদের মনমানসিকতা হয়ে যেতো ভারাক্রান্ত, চেহারা হয়ে পড়তো বিবর্ণ। আল-কোরআনে সে চিত্রের বর্ণনা রয়েছে এভাবে?

وإذا بشر أحدهم بالأنثى ظل وجهه مسودا وهو كظيم

যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ দেয়া হতো, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যেতো, আর সে ক্লিষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে পড়তো। (সূরা নাহূল : ৫৮)।

কন্যা সন্তানের বাঁচার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, এমন কী সার্বিক মানবিক অধিকার ইসলামই প্রতিষ্ঠিত করেছে। একটি কন্যা সন্তানের বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত তার যাবতীয় ভারণপোষণের দায়িত্ব পিতার উপর অর্পিত থাকে। বিয়ের সাথে সাথে সে দায়িত্ব অর্পিত হয় স্বামীর উপর। অধিকন্তু মোহরানাস্বরূপ প্রাপ্ত সম্পদের তো প্রথম দিনেই সে মালিক হয়ে যায়। এ সম্পদে স্বামী বা অন্য কারো মালিকানা নেই। আবার স্ত্রীর আয় উপার্জনের সমস্ত অর্থ তার নিজের, তাতে স্বামীর অংশিদারিত্ব থাকবে না। অন্যদিকে নারীরা ওয়ারিসসূত্রে পিতা, মাতা, স্বামী, ভাই সবাইর সম্পত্তির অংশ পেয়ে থাকে। এভাবে ইসলামে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত।

নারীদের সার্বিক অধিকার সম্পর্কে আল-কোরআনের নির্দেশ হলো

وله مثل الي عليهن بالمعروف

তাদেরও তেমনই অধিকার আছে, যেমন তোমাদের আছে তাদের উপর। –(সূরা বাকারা : ২২৮)

অধিকার ও মর্যাদার ব্যাপারে ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছে। অবশ্য সৃষ্টিগত পার্থক্যের কারণে উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যে রয়েছে তারতম্য। এ তারতম্য নিরূপিত হয়েছে আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল ও দুনিয়ার জীবনের শৃংখলা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে। কর্তৃত্বের এতটুকু পার্থক্য না থাকলে বিশ্বশান্তি ব্যাহত হতো আর দুনিয়ার শৃংখলা লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়তো। কোরআনে সেই তারতম্যের কথা বলা হয়েছে এভাবে?

وللرجال عليهن درجة

আর পুরুষদের জন্য নারীদের উপর মর্যাদা রয়েছে (সূরা বাকারা : ২২৮)

এ হচ্ছে কর্তৃত্বের পার্থক্য বা সার্বিক কর্মপরিচালনার তারতম্য ভিত্তিক মর্যাদা।

তাপরও কতিপয় বিশেষ পর্যায়ে ইসলামী শরীয়াত নারীর মর্যাদার ঘোষণা করেছে। নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

১২:২ তোমাদের মধ্যে উত্তম তারা, যারা নিজেদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম।-(মেশকাত, পৃঃ ২৮১)

৫৪১ স্ত্রীদের সাথে সদাচারণ ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়ে আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

وعاشروهن بالمعروف

তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে জীবন যাপন করবে। (সূরা নিসা : ১৯)

.

অধীনস্থদের সাথে আচরণ

দুনিয়াতে কোন মানুষ তার সকল কাজ একা সম্পন্ন করতে পারে না, বিশেষত এ জটিল শিল্পায়নের যুগে জীবন ধারণের জন্য প্রত্যেক মানুষকেই অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। বিভিন্ন স্তরে এক ব্যক্তির অধীনে একাধিক লোক কাজকর্মের আঞ্জাম দিয়ে থাকে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় সকল দায়িত্বশীল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন প্রত্যেকই নিজ নিজ অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তাদের উপর কোন প্রকার যুলুম না হয়।

ইসলামী জীবন বিধানে মর্যাদার পার্থক্য হয় শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতে। তাই উধ্বর্তন কোন কর্মকর্তা নিম্ন পদস্থদের প্রতি কোন প্রকার যুলুম ও অবিচার করতে পারবে না।

আজকের সমাজে ক্রীতদাস প্রথা নেই সত্য, তবে অধীনস্থদের প্রতি যুলুম-অত্যাচার চলতে থাকে বিভিন্নভাবে। তাই নবী করীম (ছঃ)-এর নির্দেশ এ যুগের সকল প্রকার শ্রমিক ও অধীনস্থদের বেলায়ও একইভাবে প্রযোজ্য হবে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে একটি হাদীসে বর্নিত আছে। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন :

هم ا لكم جعل الله تحت ايديكم فمن جعل الله أخاه تحت يده فليطعمه وماياكل وليلبسه مما يلبس ولا يكلفه من العمل ما بغلبه فإن كلفه ما يغلبه فليون عليه

অর্থ : তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ্ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ্ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার উচিত তাকে তাই খাওয়ানো যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরানো যা সে নিজে পরে। আর তাকে এমন কর্মভার দেবে না, যা তার সাধ্যাতিত। যদি কখনো তার উপর অধিক কর্মর্ভর চাপানো হয় তবে যেন তাকে সাহায্য করে।–(বুখারী, মুসলিম)

এ প্রসঙ্গে নবী করীম (ছঃ)-এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, আমি দীর্ঘ দশ বছর নবী করীম (ছঃ)-এর খেদমত করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে কখনো উহ্’ শব্দটি বলেননি এবং কোন দিন বলেন, এটা কারো নি কেন? ওটা কুরো নি কেন? আমার বহু কাজ তিনি নিজে করে দিতেন।-(মিশকাত)

হযরত ওমর (রা.) জেরুজালেম সফরে উটে চড়া ও উট টেনে নেয়ার ব্যাপারে সাম্য ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের ও ভৃত্যের মধ্যে পালাক্রম ঠিক করে। এর নযীর ইতিহাসে বিরল।

একজন ভৃত্যকে দিনে কতবার ক্ষমা করা যেতে পারে? বিদায় হজ্জে এ প্রশ্নের জবাবে নবী করীম (ছঃ) ঘোষণা করেছিলেন : ১১০ ১ es –প্রতিদিন সত্তর বার।

.

পারস্পরিক সম্পর্ক

সমাজে বসবাসকারী মানুষের সাথে সহাবস্থান করে পরস্পর সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সকলের সাথে সমঝোতা ও সুসম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন কোরআনুল করীমে এরশাদ করেন।

الأخير في كثير ممن نجؤهم إلا من أمر بقو او معروف او إصلاح بين الناس ومن يفعل ذلك ابتا، مژضات اللوقوف تؤييم

তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই, তবে মঙ্গল আছে যে নির্দেশ দেয় দান খয়রাত, সকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহা পুরস্কার দেব। (সূরা নিসা : ১১৪)।

এ আয়াতে তিনটি উত্তম কাজের কথা বলা হয়েছে, ১. দান খয়রাত, ২. সৎ কাজ, ৩. পারস্পরিক শান্তি স্থাপন। শেষোক্তটি আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের সাথে ভাল সম্পর্ক না থাকলে সমাজে শান্তিতে বসবাস করা যায় না। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শান্তি স্থাপনের বিষয়টি আমর বিল্ মারূফ’-এর অন্তর্ভূক্ত হলেও গুরুত্ব বুঝাবার জন্য একে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য যারা চেষ্টা তদ্বীর করবে তাদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট রয়েছে বিরাট পুরস্কার।

এ প্রসঙ্গে নবী করীম (ছ.) বলেন : তোমরা মুসলিমদেরকে পারস্পরিক মহব্বত, হৃদ্যতা ও দয়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি গেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের কোন অঙ্গ পীড়িত হলে অপর অঙ্গগুলোও জ্বর ও নিদ্রাহীনতা সহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে।

এরূপ সম্পর্ক মুসলিম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর যে কোন স্থানের ও যে কোন বর্ণের মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও একাত্মবোধ বিরাজমান থাকা উচিত মুসলমান বিচ্ছিন্ন থাকলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং শক্র তাদের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। মোটকথা পারস্পরিক দৃঢ় সম্পর্ক ও একাত্ববোধের মধ্যে মুসলমানদের শক্তি নিহিত রয়েছে।

.

পারিবারিক সহাবস্থান

 সহাবস্থান ও সম্প্রীতি শুরু হয় পরিবার থেকে। যে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবান ও সহানুভূতিশীল সেই পরিবারে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকে। বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী মিলিত হয়ে একটি পরিবার গঠন করে। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য এদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহিষ্ণুতা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে স্বামী ও স্ত্রীর সহাবস্থান সম্ভব হবে না এবং তাদের মধ্যে সম্প্রীতিও গড়ে উঠবে না।

মানুষ হিসাবে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মধ্যে কিছু দোষত্রুটি থাকতে পারে। আল্লাহ্ তা’আলা দু’জনকে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে সম্ভাবে জীবন যাপনের হুকুম দিয়েছেন:

هوا شيئا

رههتموهن فعسی ا

وعاشروه يجعل الله فيهم خيرا كثيرا

তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপসন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপসন্দ করছ।–(সূরা নিসা : ১৯)।

পারস্পরিক সহাবস্থানের জন্য আল-কোরআনের এ আয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একে অন্যের ছোট-খাট দোষত্রুটি উপেক্ষা করাই কল্যাণকর।

একজন নারী স্বামীগৃহে এসে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখতে পান। নিজের পিতামাতা ও ভাইবোনকে ছেড়ে এসে তাকে এখানে নতুন করে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদের সাথে সম্পর্ক গড়তে হয়। এ অপরিচিত মানুষগুলোর মেজাজ-মর্জি তাকে জানতে ও বুঝতে হয়। অপর পক্ষে পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদেরকে ভিন্ন পরিবেশ থেকে আগত নতুন সদস্যকে সাদরে গ্রহন করতে হয়। পারিবারিক সমঝোতার খাতিরে আগন্তুকের ছোট-খাট ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখতে হয়। উভয় পক্ষ থেকে যদি কিছু ছাড় দেয়া না হয়, তবে ভবিষ্যতে পারিবারিক শান্তি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি ছেলেমেয়েরা কেমন ব্যবহার করবে আল-কোরআন তা শিক্ষা দেয়। অক্ষম অবস্থায় পিতামাতাকে পরিবারের বোঝা মনে না করে তাদের সাথে সদয় ও সম্মানজনক ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন।

وقضى ربك ألا تعبدوا إلا إياه وابالوالدين إحسانا إما يبلغن عثتك الكبر أحدهما أو كلهما فلا تقل لهما أف ولا تنهرهما وقل لهما قولا كريما واخفض لهما جناح التي من الرحمة وقل رب ارحمهما كما ربيني صغيرا

তোমার রব আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া কারো ইবাদত না করতে ও পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে; তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকেউহ্’ বলবে না এবং তাদেরকে ধমকও দেবে না। তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে। তাদের প্রতি সদয় বাহু অবনত করবে এবং বলবে হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুণ যেভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।–(সূরা বনী ইসরাইল : ২৩-২৪)

.

প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক

সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিবেশীর সঙেগ সদ্ভাব বজায় রেখে সহাবস্থান করা একান্ত কর্তব্য। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ হতে থাকলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। একটি আদর্শ সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানকার লোকেরা প্রতিবেশীর প্রতি পরস্পর সহানুভূতিশীল হবে, পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে, আপদে বিপদে পরস্পর সাহায্য করবে এবং সুখ-দুঃখের ভাগী হবে। পাশাপাশি বসবাস করতে গেলে অনেক সময় প্রতিবেশীর সাথে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। কিন্তু এগুলোকে স্থায়ীভাবে মনে না রেখে প্রতিবেশীর ছোট-খাট ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে তার সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে।

আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন।

واعبدوا الله ولا تشركوا به شيئا وبالوالدين إحسانا وپدی القربى واليمى والمكينوالجاري القربى والجار الجنب والشاب بالجثتي وابني الشبيلي وما ملكت أيمانكم إن الله يحب من كان مختالا فورا

তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পসন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে। (সূরা নিসা, ৪ ঃ ৩৬)।

উল্লিখিত আয়াতে পিতামাতাসহ আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করতে হুকুম দেয়া হয়েছে। নিজেকে বড় ও প্রতিবেশীকে ছোট মনে করলে এবং প্রতিবেশীর স্বার্থ অপেক্ষা নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব রাখ অসম্ভব। এ জন্য দাম্ভিবকতা ও অহংকার পরিত্যাগ করে প্রতিবেশীর সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে বলা হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম, সে মু’মিন নয়, আল্লাহর কসম, সে মু’মিন নয়, আল্লাহর কসম সে মু’মিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কে সে ব্যক্তি? নবী করীম (ছঃ) বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।-(মেশকাত, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২২)।

.

সামাজিক সহাবস্থান

 মুসলিম সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে পরস্পরের সাথে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতে হবে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে যালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ্ তা’আলা তার অভাব পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কোন বিপদ দূর করবে, আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের মধ্য থেকে কোন বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।–(বুখারী)

এ হাদীসে মুসলিম সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এক মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের সম্পর্ক হবে এক ভাইয়ের সাথে অন্য ভাইয়ের সম্পর্কের মত। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের প্রয়োজন পূরণ করবে। বিপদে আপদে সাহায্য করবে এবং কেউ করো প্রতি যুলুম নির্যাতন করবে না। এভাবে মুলমানকে অন্য মুসলমানের সাথে সম্প্রীতি স্থাপন করে সহাবস্থান করার জন্য নবী করীম (ছঃ) নির্দেশ দিয়েছেন।

.

অমুসলিমদের সাথে সহাবস্থান

ইসলামী রাষ্ট্রে যে সব অমুসলিম বাস করে তাদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। মুসলমানদের ন্যায় তারাও নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। তাদের সম্পর্কে নবী করীম (ছঃ) বলেন, মনে রেখ কোন ব্যক্তি কোন মুহিদ (চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) নাগরিকের প্রতি যদি অত্যাচার করে, তাকে কষ্ট দেয়, তার সম্মানহানি করে অথবা তার কোন সম্পদ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তবে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করবো।’–(কিতাবুল খারাজ, পৃঃ ৮২)

এ হাদীস থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহর নবী অমুসলিম নাগরিকদের উপর অত্যাচার করা এবং ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়াকে কত কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন। অমুসলিমদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় কোন হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে।

.

আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের গুরুত্ব

আদর্শ সমাজ গঠনে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতীয় ঐক্যের উপর ইসলাম প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন বলেন :

و الله جميعا ولا تفرقوا

واعتصموا بد

তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।

এ আয়াতে ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং সাথে সাথে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে নিবৃত্ত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :

بروا ان الله مع

افتفشلوا وتذهب ريحد

الصبرين

তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি নষ্ট হবে। আর তোমরা ধৈর্যাবলম্বন করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছে।–(সূরা আনফাল : ৪৬)

এ আয়াতের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে বিবাদ পরিহার করে ঐক্যবদ্ধভাবে ধৈর্যধারণ করে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা আদর্শ সমাজ সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য।

.

আদর্শ সমাজ

 আদর্শ সমাজ বলতে এমন সমাজকে বুঝায়, যেখানে সকল নাগরিক আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় ঈমান এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সকাজে উদ্যোগী হয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকে। এরূপ সমাজে দ্বন্দব-কলহ, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুনখারাবী, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, অভাব অভিযোগ ও অপসংস্কৃতি থাকবে না। মানুষ পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসবে। একে অন্যের বিপদ-মসীবতে সাহায্য সহযোগিতা করবে এবং সুখ-দুঃখে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করবে, সব মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে। আদর্শ সমাজে উল্লিখিত নেতিবাচক দিকগুলো সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে এবং ইতিবাচক দিকগুলো সর্বোচ্চস্তরে পৌঁছে যাবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এমন এক সমাজ কায়েম হয়েছিল যেখানে চুরি, ডাকাতি, রাহাজিন সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছিল এবং মুসলমানদের মানবীয় গুণাবলী পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছিল। এরূপ সমাজ গড়তে হলে সমাজের সদস্যবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের রশিকে মজবুতভাবে ধরে রাখতে হবে অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার দেয়া দীন বা জীবন ব্যবস্থা পুরোপুরি মেনে চলতে হবে।

.

ঐক্যের ভিত্তি

ঐক্যের ভিত্তি হিসাবে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকে। সাধারণত বংশ, ভাষা, অঞ্চল ইত্যাদিকে ঐক্যের ভিত্তি মনে করে থাকে।

কিন্তু ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হিসাবে নিম্নেক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে

ক. এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য,

খ. আল্লাহর রাসূলের পরিপূর্ণ অনুসরণ,

গ. কোরআন ও সুন্নাহকে জীবন পথের একমাত্র দিশারী হিসাবে গ্রহণ।

মুসলমান যে ভাষায় কথা বলুক, বংশ বা বর্ণে যতই পার্থক্য থাকুক, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করুক, আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তার একমাত্র ইলাহ্। কোন অবস্থাতেই সে এ বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয় না। এ বিশ্বাস বা ঈমান সকল মুসলমানের ঐক্যের প্রথম ভিত্তি।

মুসলমানের ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি হলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ)-এর আদর্শের অনুকরণ। তিনি আল্লাহর বাণী আমারে কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, ঝগড়া-বিবাদের ও একটা জাতিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন, মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক আল্লাহর দাসে পরিণত করেছেন। সমগ্র মানব জাতির জন্য তিনিই একমাত্র পরিপূর্ণ আদর্শ। অতএব আল্লাহর রাসূল (ছ.)-কে ঐক্যের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা সব মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।

একতার আরেকটি ভিত্তি হলো কোরআন ও সুন্নাহ্। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যার বিশ্বাস রয়েছে তাকে অবশ্যই কোরআন ও সুন্নাহকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নিতে হবে। আল-কোরআন আল্লাহ্ তা’আলার বাণী এবং নবী করীম (ছঃ)-এর মাধ্যমেই আমরা তা পেয়েছি। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মূলনীতি হিসাবে কোরআন শরীফে ঘোষণা করা হয়েছে :

إنما المؤمنون إخوة

অর্থ : মু’মিনরা একে অন্যের ভাই। (সূরা হুজুরাত : ১০)।

সুতরাং বর্ণ, ভাষা বা অঞ্চল মানুষের মৌলিক পার্থক্য নির্ণয় করে না। পার্থক্যের একমাত্র মাপকাঠি হলো আদর্শ। যেহেতু সব মুসলমান এক আদর্শে বিশ্বাসী, এক আল্লাহর অনুগত, এক রাসূল (ছঃ) এবং এক কোরআনের অনুসারী, সেহেতু তারা পরস্পর ভাই ভাই এবং এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনই তাদের ঐক্যের ভিত্তি।

.

সংজ্ঞবদ্ধ হওয়ার উপায়

পারিবারিক হিংসা, বিদ্বেষ, কুৎসা রটনা ও শত্রুতামূলক আচরণ ইত্যাদি ঐক্য বিনষ্টকারী দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হয়ে কথায় ও ব্যবহারে সম্প্রীতিমূলক আচরণ করতে হবে, তবে সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এরপর ঐক্য সৃষ্টির জন্য আরো কিছু কাজ করতে হবে। যেমন : সংঘবদ্ধ হওয়া–ইসলাম সংঘবদ্ধ জীবন-যাপনের উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, তিন ব্যক্তি যদি সফরে থাকে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর-নেতা বানিয়ে নেয়।-(মেশকাত শরীফ)

ইসলাম দৈনিক পাঁচবার জামায়াতে নামায ও শুক্রবারে জুমু’আর নামায জামায়াতে আদায়ের বিধান দিয়েছে। হজ্জের মাধ্যমে বাৎসরিক বিশ্ব জামায়াতের ব্যবস্থা রেখেছে। এর দ্বারা বোঝা যায় মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে হবে।

পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করা–এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে বিপদে-আপদে সাহায্য করবে। এ সাহায্য যে কোন ধরনের দীনি ও দুনিয়াবী বৈধ প্রয়োজন পুরণ করার ক্ষেত্রে হতে পারে। নবী করীম (ছঃ) বলেন, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার সাহায্য করে থাকেন যতক্ষন পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।-(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২)।

পরস্পর সদুপদেশ দান–প্রত্যেক মুসলমান নিজে নেক আমল করার সাথে সাথে অপর মুসলমান ভাইয়ের কাজকর্মের প্রতি নযর রাখবে এবং তাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে উপদেশ দিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে নবী করীম (ছঃ) বলেন, এক মু’মিন অন্য মু’মিনের আয়নাস্বরূপ এবং এক মু’মিন অন্য মুমিনের ভাই। সে তার ভাইকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এবং পেছন থেকে তাকে রক্ষা করে।-(মেশকাত, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২৪)

এরূপ উপদেশ দানের মধ্যে মঙ্গল কামনা, সহানুভূতি ও ভালবাসার মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়। যাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে সে যেন মানসিকভাবে আহত না হয়।

.

সালাম আদান-প্রদান ও দোয়া করা

সালাম আদান-প্রদানের রীতি মানুষের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক উত্তম উপায়। এর দ্বারা পরস্পর পরস্পরের জন্য দোয়া করে এবং মনের মিল হয়। নবী করীম (ছঃ) বলেন, যখন তোমাদের কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করে তখন সে যেন তাকে সালাম দেয়। তবে সালামের মধ্যে অপর ভাইয়ের শান্তির জন্য দোয়া ও শুভাকাঙ্ক্ষার মনোভাব থাকতে হবে।

.

আপোস মীমাংসা

কোন কারণবশত দু’জন বা দু’দল মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ দেখা দিলে তা মীমাংসা করে দেয়া উচিত। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই মু’মিনরা একে অন্যের ভাই, অতএব তোমরা ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।’ (সূরা হুজুরাত, ৪৯ ও ১০)

এমনকি এ ব্যাপারে সীমা অতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে দ্বন্দ্ব-কলহ মিটিয়ে সমাজে ঐক্য স্থাপন করার জন্য বারবার তাকীদ দেয়া হয়েছে।

.

আল্লাহ তা’আলার নিকট সাহায্য চাওয়া

সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের নিকট দোয়া করতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর অনুগ্রহে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য সৃষ্টি করে দিতে পারেন।

আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছেঃ তিনি তাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্তাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের মনে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ্ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ –(সূরা আনফাল, ৮ ঃ ৬৩)

রাসূলুল্লাহ (ছঃ) মানুষের নৈতিক গুণাবলী বিকাশের মাধ্যমে তদানিন্তন সমাজের চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন। দ্বন্দ্ব-কলহ ছিল যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী, সামান্য কারণে যারা যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকতো তাদের তিনি একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি আদর্শ সমাজ গঠন করেছিলেন। এ অসাধারণ কাজের জন্য তিনি যে উপায় অবলম্বন করেছিলেন তা ছিল মানুষের মনের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি অবিচল আস্থা সৃষ্টি এবং কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী চরিত্র গঠন।

অতএব একটি সুসংবদ্ধ আদর্শ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কোরআন ও সুন্নাহ্ নির্দেশিত পথ অবলম্বন করা একান্ত আবশ্যক।

.

হাদিয়া দেয়া নেয়া

 ভালবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্যদের যে উপহার ও উপঢৌকন দেয়া নেয়া হয় তাকে হাদিয়া’ বলা হয়। রাসূল (ছঃ) বলেন, একে অন্যকে হাদিয়া দেবে, হাদিয়া হৃদয়ের কলুষ দূর করে। এক পড়শি অপর পড়শিকে হাদিয়া দিতে যেন অবহেলা না করে এবং কেউ যেন সামান্য মনে না করে যদিও তা এক টুকরা বকরীর ক্ষুরও হয়। নবী করীম (ছঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে হাদিয়া দিতেন এবং সাহাবীরাও নবী (ছঃ)-কে হাদিয়া দিতেন।

কেউ হাদিয়া দিলে তার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক মধুর হয়। হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেন নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, যাকে দান করা হয়েছে তার সামর্থ থাকলে সে যেন এর প্রতিদান দেয়, আর যার সামর্থ নেই, সে যেন প্রশংসা করে। কেননা, যে প্রশংসা করল সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, আর যে তা গোপন করে সে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’–(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৬১)।

হাদিয়া প্রতিদানে সমপরিমাণের জিনিস হতে হবে এমন কোন কথা নেই, বরং নিজ ক্ষমতা সুনযায়ী প্রতিদান দিতে চেষ্টা করা উচিত। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মধ্যে হাদিয়া আদান প্রদান করবে। নবী করীম (ছ) তাঁর সহধর্মিনীদেরকে হাদিয়া দিতেন। প্রকৃতপক্ষে হাদিয়া দাম্পত্য জীবনে আন্তরিকতা বৃদ্ধির এক মূল্যবান উপাদান। এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয় এবং মনের গ্লানি দূর হয়ে যায়।

কেউ হাদিয়া দিলে তা ফিরিয়ে দেয়া ঠিক নয়, কেননা, তাতে হাদিয়াদাতার মনে কষ্ট হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, যাকে সুগন্ধি দান করা হয়, সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কেননা, এটি হাল্কা জিনিস অথচ সুগন্ধযুক্ত।’-(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৬০)।

হাদিয়া সামান্য হলেও তা ফিরিয়ে না দিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা উচিত। তদ্রুপ হাদিয়া দেয়ার পর তা ফিরিয়ে নেয়া শোভনীয় নয়। হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, যে দান করে তা প্রত্যাহার করে নেয় তার দৃষ্টান্তএমন কুকুরের মত যে বমি করে পুনরায় তা গলাধঃকরণ করে নেয়।’–(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৬০)।

রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর জীবন থেকে হাদিয়ার ব্যাপারে যে দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় তা হলো

ক. হাদিয়া নিজ সামর্থ্যানুযায়ী দেয়া উচিত।

খ. হাদিয়া যাই হোক না কেন তা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করা উচিত।

গ. হাদিয়ার পরিবর্তে হাদিয়া দেয়ার চেষ্টা করা উচিত।

 ঘ. হাদিয়ার ক্ষেত্রে নবী করীম (ছঃ)-এর পসন্দীয় বস্তুর মধ্যে খুশবু ছিল অন্যতম।

ঙ. হাদিয়া দেয়ার পর তা ফিরিয়ে নেয়া অশোভনীয়।

.

হাদিয়া ও ঘুষ

হাদিয়া আর ঘুষ এক নয়, হাদিয়া ও ঘুষের মধ্যে পার্থক্য বিরাট। হাদিয়া দেয়ার নিয়্যতের মধ্যে পারস্পরিক মহব্বত ছাড়া পার্থিব কোন স্বার্থ রক্ষা বা কোনরূপ সাহায্য পাওয়ার আশা থাকে না। অপরপক্ষে ঘুষ দেয়ার উদ্দেশ্য হয় কোন স্বার্থ রক্ষা করা বা সাহায্য পাওয়া। সাধারণত কর্তব্যরত কোন ব্যক্তির নিকট থেকে কাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে কিছু দেয়া ঘুষের পর্যায়ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) আয়দ গোত্রের এক ব্যক্তিকে সাদকা আদায়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করেন। তার নাম ছিল ইবন লুতবিয়্যা। তিনি ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেয়া হয়েছে। একথা শুনে। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহর মাহাত্ম ও প্রশংসা বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা পালনের জন্য আমি তোমাদের মধ্য থেকে কোন কোন লোককে নিয়োজিত করি। তাদের মধ্য থেকে কেউ এসে বলে, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেয়া হয়েছে। সে তার পিতা বা মাতার ঘরে বসে থাকেনি কেন, তখন দেখতে পেত, তাকে হাদিয়া দেয়া হয় কি না? সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, এ ক্ষেত্রে কেউ যদি কিছু গ্রহণ করে, তবে সে তা তার ঘাড়ে বহন করে কিয়ামাতের ময়দানে উপস্থিত হবে।-(মেশকাত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৫৬)

ঘুষকে হাদিয়া বা অন্য কোন নামে আখ্যায়িত করলেও তা ঘুষই। হাদিয়া দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে আন্তরিকতা ও ভালবাসা বৃদ্ধি পায়, সুতরাং পরস্পর হাদিয়া দেয়া-নেয়ার একটি উত্তম রীতি। তবে এর মাধ্যমে দুনিয়ার কোন স্বার্থ লাভের আশা না করা। কেবলমাত্র পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য হাদিয়া আদান-প্রদান বাঞ্ছনীয়।

.

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ

মানুষকে সঠিক পথে চালানোর জন্য সমাজে এমন কিছু লোক থাকা উচিত যারা সকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেন :

كنتم خير أمة أخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن

المنكر وتؤمنون بالله

তোমরাই উত্তম জাতি, মানব জাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব ঘটেছে; তোমরা সৎকাজের আদেশ কর, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর।–(সূরা আলে ইমরান : ১১০)

আল-কোরআনের এ নির্দেশের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হল। পথভ্রষ্ট মানুষকে সৎ ও ন্যায়ের পথ দেখানো। হযরত হুযায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেন, যার হাতে আমার প্রাণ, তার কসম, তোমরা অবশ্য অবশ্যই ন্যায়ের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। অন্যথায় আল্লাহ্ তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর অবশ্যই আযাব নাযিল করবেন। এরপর তোমরা আল্লাহকে ডাকবে, কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়া হবে না।’-(মেশকাত শরীফ)

অন্য এক হাদীসে আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে শরীয়াত বিরোধী কাজ হতে দেখলে সে তা শক্তি দ্বারা পরিবর্তন করবে। যদি সে এর শক্তি না রাখে তবে মুখ দ্বারা, আর যদি এর শক্তিও না রাখে তবে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। আর এটাই হল ঈমানের দূর্বলতম স্তর।–(মেশকাত শরীফ)

নবী-রাসূলদের দায়িত্ব ছিল আল্লাহর দীন কায়েম করা। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদেরকে ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (ছঃ) পর্যন্ত লক্ষাধিক নবী ও রাসূল এ কাজ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) সুদীর্ঘ ২৩ বছর যাবত কঠোর পরিশ্রম দ্বারা একটি পথভ্রষ্ট জাতিকে তদানীন্তন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতিতে পরিণত করেন। তারপরে আর কোন নবী পৃথিবীতে আসবে না। এ অবস্থায় কারা এ দায়িত্ব পালন করবেন। সে প্রসঙ্গে আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

ولكن يرثكم أمة يدعون إلى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون عن

المنكر وأولئك هم المفلحون

আর তোমাদের মধ্যে এমন একদল থাকবে যারা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে, তারাই সফলকাম–(সূরা আলে ইমরান : ১০৪)

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় মুসলিম জাতির অন্ততপক্ষে একদলকে সৎকাজের আদেশ অসৎকাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালন অত্যন্ত কঠিন। যেই এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে তাকে অমানুষিক নির্যাতন ও উৎপীড়ণের শিকার হতে হয়। এ কাজ করতে গিয়ে বিশ্বনবী (ছ.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-কে চরম কোরবানী দিতে হয়েছে। বিরোধীদের নির্যাতন ও অত্যাচারে তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যুগে যুগে যারাই সঙ্কজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন তাদেরকে অপরিসীম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

সৎকাজের আদেশ নিজ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। পবিত্র কোরআন এরশাদ হয়েছেঃহে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি থেকে।’–(সূরা তাহরীম : ৬)।

নবী করীম (ছঃ) প্রথমে নিজ পরিবারের হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) হযরত আলী (রা.) এবং হযরত যায়িদ ইবন হারীসা (রাঃ)-কে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং তাঁরা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

সৎকাজের আদেশ দাতাকে সকাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন : তোমরা মানুষকে সকাজের নির্দেশ দাও, আর নিজেদেরকে বিস্মৃত হও!’–(সূরা বাকারা : ৮৪)

হযরত শুয়াইব (আঃ) নিজ সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি তাবিরুদ্ধাচরণ কর আমি তা করতে ইচ্ছা করি না। –(সূরা হূদ ৮৮)

উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আহবানকারীকে সঙ্কাজের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে নিজেও সঙ্কৰ্মশীল হবে।

কোন পদ্ধতিতে ভাল কাজের উপদেশ দিতে হবে সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ আল-কোরআনে এরশাদ করেন :

، ع إلى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجارتهم بالتي

هي احسن

তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে তর্ক কর উত্তমভাবে। (সূরা নাহল : ১২৫)

এখানে আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান করার জন্য তিনটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা : হিকমত, সদুপদেশ ও সদ্ভাবে বিতর্ক করা।

সাধারণভাবে এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে সঙ্কজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে। পরিবারের কর্তা পরিবারস্থ অন্যান্য সদস্যদের আমল সংশোধনের জন্য দায়ী থাকবেন। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সমাজের অন্যান্য লোকদের সৎকাজের আদেশ দেবেন ও তাদেরকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। আলিম সমাজ বিশেষভাবে এ দায়িত্ব। পালন করবেন। সর্বেপরি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ভাল কাজ করতে ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকতে আদেশ দেবে, এটাই ইসলামের বিধান।

.

উপহাস, দোষারোপ, মন্দ নামে ডাকা ও অহেতুক ধারণা করা

কোন ব্যক্তিকে উপহাস করা, তিরস্কার করা কিংবা মন্দ নামে ডাকা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের জন্য মুসলমানকে অবশ্যই এসব মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ্ রাব্দুল আলামীন এরশাদ করেন :

نوا خيرا

و ابزوا بالألقاب ب کن بکن خیرا تو

منهم و لا نساء من نسا

ايها الذين أموا لايشقم من قوم عسى أن يكونوا خيرا

انفسكم ولا تنابزوا بالألقاب بئس الإسم الفسوق بعد الإيمان ومن ثم يب قولك هم الظلمون

يتب فک

হে মু’মিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী যেন অপর নারীকেও উপহাস না করে। কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে উত্তম। হতে পারে। তোমরা একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে। মন্দনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দনামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা তওবা না করে তারা। যালিম।–(সূরা হুজুরাত ১১)

এ আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়কে তিনটি কাজ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। যথা : ১ কোন মুসলমানকে বিদ্রূপ বা উপহাস করা, ২. কারো প্রতি দোষারোপ করা এবং ৩. কাউকে অবমাননাকর বা মন্দনামে ডাকা।

.

উপহাস

কোন মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে তার কোন দোষ এমনভাবে উল্লেখ করা, যাতে শ্রোতাদের হাসির উদ্রেক হয়। একে বলে উপহাস। এ কাজ কথাবার্তায়, আচার ব্যবহারে, ভাবভঙ্গিতে বা আকার ইঙ্গিতে হতে পারে। এরূপ কাজে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ ও অন্যকে অপমান, লাঞ্ছনা ও হেয় প্রতিপন্ন করার মনোভাব বিদ্যমান থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি নিঃসন্দেহে ঘৃণিত অপরাধ। এরূপ কাজের মাধ্যমে অন্যের মনে আঘাত দেয়া হয়। ফলে সমাজে বিপর্যয় ঘটে। এ জন্য আল-কোরআনে কাজটিকে হারাম বলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এ আয়াতের সারমর্ম হলো, কোন ব্যক্তির দেহে, আক্বতিতে বা আচার-আচরণে কোন দোষত্রুটি দৃষ্টিগোচর হলে তা নিয়ে উপহাস বা বিদ্রূপ করা উচিত নয়। কেননা, সে ব্যক্তি সততা, আন্তরিকতা ইত্যাদি বিষয়ে উপহাসকারীর তুলনায় আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। কারো বাহ্যিক অস্থা দেখে তাকে নিশ্চিতরূপে ভাল বা মন্দ বলা যায় না। কারণ, যার বাহ্যিক কাজকর্মকে আমরা ভাল মনে করছি, আল্লাহ্ তা’আলার দৃষ্টিতে সে নিন্দনীয় হতে পারে। যে ব্যক্তির বাহ্যিক কাজকর্ম মন্দ তার কাজ ঘূণ্য ও অপসন্দনীয় হলেও তাকে হেয় মনে করা যায়। না। কেননা, তওবার মাধ্যমে তার অপরাধ কাফফারা হয়ে যেতে পারে। কাজেই এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে উপহাস বা বিদ্রূপ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে।

.

মন্দনামে ডাকা

কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মন্দনামে ডাকা ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। হযরত আবু যুবায়র আনসারী (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছঃ) যখন মদীনায় আসেন, তখন আমাদের অনেকের একাধিক নাম ছিল। এর মধ্যে কোন কোন নাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে লোকেরা ব্যবহার করত। নবী করীম (ছঃ)-এর তা জানা ছিল না। সে জন্য কখনও কখনও তিনি ঐ মন্দ নাম ধরে সম্বোধন করতেন। তখন সাহাবীরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছঃ)! ঐ ব্যক্তি এ নাম শুনলে অসন্তুষ্ট হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে JaL 25, আয়াত নাযিল হয়।-(প্রাগুক্ত)।

হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর মতে, এ আয়াতের অর্থ হলো, কেউ কোন মন্দ কাজ করে তওবা করার পরও তাকে সেই মন্দ কাজের নামে সম্বোধন করা। যেমন কাউকে চোর, ব্যভিচারী অথবা শরাবী বলে ডাকা। কোন ব্যক্তি চুরি যিনা, শরাব ইত্যাদি থেকে তওবা করার পর তাকে অতীতের মন্দ কাজের দ্বারা লজ্জা দেয়া ও হেয় করা হারাম। নবী করীম (ছ.) বলেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে এমন গুনাহ্ দ্বারা লজ্জা দেয়, যা থেকে সে তওবা করেছে, তাকে সে গুনাহে লিপ্ত করে ইহকাল ও পরকালে লাঞ্ছিত করবেন।

তবে যদি কোন লোকের এমন নাম প্রচলিত হয়ে যায়, যা আসলে মন্দ, কিন্তু এ নাম ছাড়া কেউ তাকে চিনে না। এরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হেয় করার উদ্দেশ্য ছাড়া সে নামে ডাকা যায়। যেমন কোন কোন মুহাদ্দিসের নামের সাথে . 014 (খোঁড়া, ট্যারা) ইত্যাদি যুক্ত আছে। নবী করীম (ছঃ) লম্বা হাত বিশিষ্ট জনৈক সাহাবীকে ১is নামে ডেকেছেন এবং আবৃহুরায়রা (রাঃ)-কে আবু হুরায়রা নামে অভিহিত করেছেন। এরূপ নামে স্নেহ ও ভালবাসার ইশারা রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিজেরাও তা অপসন্দ করেননি।

মানুষকে তার ভাল নামে ডাকা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ্ (ছঃ) বলেন, মু’মিনের হক অপর মু’মিনের উপর হল, তাকে অধিক পসন্দনীয় নাম ও পদবী সহকারে ডাকবে। নবী করীম (ছঃ)-এর যুগে আরব দেশে ডাক নামের প্রচলন ছিল। তিনি কোন কোন সাহাবীকে কিছু পদবী দিয়েছিলেন। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে আতীক’, হযরত উমর (রাঃ)-কে  ফারূক, হযরত খালিদ ইব্‌ন ওয়ালীদ (রাঃ)-কে সাইফুল্লাহ্’ এবং হযরত হামযা (রাঃ)-কে আসাদুল্লাহ্ ইত্যাদি।–(প্রাগুক্ত)।

.

অহেতুক ধারণা করা

 প্রমাণ ব্যতীত কোন মুসলমানের প্রতি কু-ধারণা বা অহেতুক খারাপ ধারণা পোষণ করা হারাম। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে :

ايها الذين آمنوا اجتنبوا كثيرا من الظن إن بعض الظن إثم

হে মু’মিনগণ! তোমরা অধিকাংশ (অহেতুক) ধারণা হতে দূরে থাক। কেননা, (অহেতুক) ধারণা কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ। (সূরা হুজুরাত : ১২)।

নবী করীম (ছঃ) বলেছেনঃ

وإياكم والظن فإن الظن أكذب الحديث

অর্থ : তোমরা অহেতুক অনুমান থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, অহেতুক অনুমান জঘন্যতম মিথ্যা।

.

গীবত (পরনিন্দা), অপবাদ ও ছিদ্রান্বেষণ

গীবত (পরনিন্দা), অপবাদ ও ছিদ্রান্বেষণ করা কবীরা গুনাহ্। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই এগুলো পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

كل لحم

سوا ولا يغتب بعضکم بعضا ایجب احدکم

ولا تجسسوا ولا يغتب بعضکم با

م زه

الله تواب رحيم

اخيه ميتا فكرهتموه واتقوا

আর তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় খোঁজ করো না এবং একে অপরের পেছনে গীবত করো না। তোমরা কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ্ তওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু। –(সূরা হুজরাত : ১২)

.

গীবত

গীবত আরবি শব্দ। বাংলায় একে পরনিন্দা বলা যায়। কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায়, তাকে বলা হয় গীবত। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, গীবত কী, তা কি তোমরা জান? লোকেরা উত্তরে বললো, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। নবী করীম (ছঃ) বলেন, গীবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে তোমার এমন কথা বলা যা সে অপসন্দ করে। জিজ্ঞাসা করা হল, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, এটাও কি গীবত হবে? নবী করীম (ছঃ) বললেন, তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তবে সেটাই হবে গীবত। আর তুমি যা বল তা যদি তার মধ্যে না থাকে, সে ক্ষেত্রে সেটা হবে বুহ্তান’ বা অপবাদ।

অবশ্য শুভাকাক্ষীর দৃষ্টি নিয়ে কোন মুসলমানকে তার দোষত্রুটির কথা বললে স্বভাবত একে সে খারাপ মনে করে না। কারণ, এরূপ বলার উদ্দেশ্য থাকে সংশোধন। কিন্তু যদি কাউকে সমাজের নিকট হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার অনুপস্থিতিতে তার দোষত্রুটি বর্ণনা করা হয়, তবে এটা হবে তার মনোকষ্টের কারণ। তাই কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষচর্চা করা না জায়েয। এ থেকে এ কথা ধারণা করা ঠিক হবে না যে, উপস্থিতিতে কাউকে নিন্দা বা দোষারোপ করা জায়েয আছে। কেননা, পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, অপমান করার লক্ষ্যে কাউকে কষ্টদায়ক কথা বলাকে দোষারোপ বলা হয় এবং তা না জায়েয। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :

ويل كل همزة لمزة

অর্থ : দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।–(সূরা হুমাযাঃ ১)

পরনিন্দা কোন অবস্থায় জায়েয নেই। উপস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ করার চেয়ে কারো অনুপস্থিতিতে তার গীবত করা অধিকতর দোষণীয়। কারণ, অনুপস্থিতিতে কারো দোষের কথা বললে তার জবাব দেয়ার কেউ থাকে না। ফলে যে দোষ বা ত্রুটির কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য না মিথ্যা বোঝার আর উপায় থাকে না। গীবত করা যেমন পাপ তেমন গীবত শোনাও পাপ। কোন ব্যক্তি যখন কারো গীবত করতে থাকে, তখন শ্রোতাদের উচিত গীবতকারীকে গীবত থেকে নিবৃত্ত রাখা। এ ক্ষেতে গীবতের অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিআকর্ষণ করতে হবে। তবে পরনিন্দার চর্চা সমাজ থেকে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হয়ে যাবে।

পরনিন্দা ব্যভিচার হতেও গুরুতর অপরাধ। নবী করীম (ছঃ) বলেন, গীবত বা পরনিন্দা ব্যভিচার হতেও গুরুতর অপরাধ। সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! গীবত কী ভাবে ব্যভিচার থেকে গুরুতর অপরাধ হতে পারে? নবী করীম (ছঃ) বললেন, ব্যভিচার করার পর মানুষ আল্লাহর নিকট তওবা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। কিন্তু গীবতকারী ব্যক্তিকে যে পর্যন্ত সে ব্যক্তি (যার গীবত করা হয়েছে) ক্ষমা না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাকে মাফ করবেন না।–(মেশকাত, পৃঃ ৪১৫)।

এ হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, গীবত করা কোন অবস্থাতেই জায়েয নেই। অবশ্য কারো দ্বারা এরূপ গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অর্থাৎ সে ব্যক্তি জীবিত থাকলে এবং তার নিকট থেকে মাফ করিয়ে নেয়া সম্ভব হলে ক্ষমা চেয়ে নিতে। কিন্তু যদি সে মারা গিয়ে থাকলে কিংবা দূর এলাকায় চলে যাওয়ার কারণে ক্ষমা চাওয়া সম্ভব না হলে, আল্লাহর নিকট তার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে হবে। নবী করীম (ছঃ) বলেন, নিঃসন্দেহে গীবতের একটি ক্ষতিপূরণ হলো, তমি যার গীবত বা কুৎসা রটনা করো তার জন্য এভাবে দোয়া করবে। হে আল্লাহ্! তুমি আমার ও তার গুনাহ্ মাফ করে দাও।’

মৃত ব্যক্তির কুৎসা রটনা করাও পাপ। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছঃ) বলেন, তোমরা মৃত ব্যক্তিকে গালমন্দ করো না। কারণ, তারা তাদের ক্বতকর্ম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।–(বুখারী)

আল-কোরআনে গীবত বা পরনিন্দা করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য বলা হয়েছে। গীবত কত বড় অপরাধ তা এর থেকে প্রতীয়মান হয়। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ছঃ) বলেন, যখন আমার রব আমাকে মিরাজে নিয়েছিলেন তখন আমি এমন এক শ্রেণীর লোকের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম যাদের নখগুলো ছিল পিতলের নখের মত। যা দ্বারা তারা নিজেদের চেহারা ও বক্ষ খামচাচ্ছিল। আমি তাদের সম্পর্কে জিবরীল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, এরা সেইসব বক্তি যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত খেতে এবং তাদের ইয্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতো।-(মেশকাত, পৃঃ ১৭)

এখানে মানুষের গোশত খাওয়ার অর্থ হলো অন্যের গীবত করা ও তাদের সুনাম ও খ্যাতি নষ্ট করার চেষ্টায় রত থাকা।

তবে কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত জায়েয আছে। যেমন : ১. মযম কর্তৃক যালিমের বিরুদ্ধে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট নালিশ করা, ২. মুফতীর নিকট ফতোয়া চাওয়ার সময় ঘটনার বিবরণ দিতে কারো দোষত্রুটি বলার প্রয়োজন হলে তা বলা, ৩. প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তি গোটা সমাজকে যাতে মন্দ কাজে জড়িত করতে না পারে, সে জন্য তার পাপাচারেরও কথা প্রকাশ করা, ৪. সাধারণ মানুষকে কোন অনিষ্টকর লোকের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তার সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া।

এসব ক্ষেত্র ছাড়া গীবত করা থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে বিরত থাকতে হবে।

.

অপবাদ

অপবাদ গীবতের চেয়ে মারাত্মক অপরাধ। কোন লোকের মধ্যে যে দোষ নেই, তার প্রতি সে দোষ আরোপ করাকে অপবাদ বলা হয়। আরবিতে একেবুহতান’ বলা হয়। সতী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা ভয়ানক অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা বলেন : যারা সাধ্বী, সরলমনা ও ঈমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।’ (সূরা নূর ও ২৩)

এই আয়াতে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, কোন সতী নারীর বিরুদ্ধে ব্যভিচার ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ দানকারী দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তার জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। এই দুনিয়ায় তার শাস্তি হল ৮০টি বেত্রাঘাত। আর তার সাক্ষ্য কোন সময় গ্রহণ করা হবে না। আখিরাতের জীবনেও তার জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, নবী করীম (ছ.) ৭টি কবীরা গুনাহ্ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি হলো সতী সাধ্বী রমণীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ।-(মেশকাত, পৃঃ ১৭)

.

ছিদ্রান্বেষণ

মানুষের দোষত্রুটি খুঁজে বের করাকে ছিদ্রান্বেষণ বলা হয়। এটা কবীরা গুনাহ্। দুনিয়াতে এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না, যার কোন দোষ নেই। কোন সমাজের মানুষ যদি পরস্পরের দোষত্রুটি অনুসন্ধানের কাজে লিপ্ত হয় এবং তা প্রচার করতে থাকে, তবে সেই সমাজে শান্তি থাকতে পারে না। আল-কোরআনের নির্দেশ হলো : তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না।’–(সূরা হুজুরাত : ১২)।

এ নির্দেশের তাৎপর্য হলো, পরস্পরের গোপনীয় দোষত্রুটি খুঁজে বের করা নিষিদ্ধ।

মহানবী (ছঃ) মুসলমানদেরকে পরস্পরের দোষত্রুটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন নবী করীম (ছঃ) বম্বরের উপর উপবেশন করে উচ্চস্বরে বললেন, হে লোক সকল! যারা মুখে মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছ কিন্তু এখনো অন্তর পর্যন্ত ঈমান পৌঁছায়নি, তোমরা মুসলমানদেরকে কষ্ট দিয়ে, না, তাদেরকে লজ্জা দিয়ো না এবং তাদের গোপনীয় দোষত্রুটির পেছনে লেগে থেকো। কেননা, যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের গোপনীয় দোষত্রুটি উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে পিছনে লেগে থাকে, আল্লাহ্ তার গোপনীয় দোষ প্রকাশ করে দেন। আল্লাহ্ সে ব্যক্তির দোষ প্রকাশ করে দেন, তাকে লজ্জিত ও অপমানিত করেন, যদিও সে নিজের ঘরের মধ্যে অবস্থা করে।’–(প্রাগুক্ত)

উল্লিখিত হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের দোষত্রুটি সন্ধান করা অতীব নিন্দনীয় কাজ। তবে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির কাজে সুস্পষ্ট ক্ষতিকর নিদর্শন দেখা গেলে এবং সে বা তারা কোন অপরাধজনক কাজে লিপ্ত হতে পারে এরূপ আশংকা হলে, প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে অথবা কারো সাথে যৌথ ব্যবসা করার ইচ্ছা করলে বা বিয়ের প্রস্তাব দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা পরিবারের সঠিক অবস্থা যাচাই করা যেতে পারে।

মোটকথা, কোরআন হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, প্রকৃত মুসলমান গীবত, অপবাদ ও ছিদ্রান্বেষণের মত গর্হিত কাজে লিপ্ত হতে পারে না।

.

সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ

সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপের পরিধি ব্যাপক। হত্যা, ষড়যন্ত্র, সম্পত্তি আত্মসাত, গোলমাল, নিপীড়ন, নির্যাতন ইত্যাদি সবই সন্ত্রাসী তৎপরতা। যে সমাজে এসব অবাধে চলতে থাকে সেখানে শান্তির আশা করা যায় না। মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র এমন গর্হিত কাজের প্রশ্রয় দিতে পারে না। ইসলামে এ সবের কোন অবকাশ নেই।

.

সামাজিক অপরাধ দমনে ইসলামী বিধান

প্রতিটি মানুষই সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। সমাজের কোন মানুষ যেন অপরাধ করে সামাজিক শন্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট না করে এটাই সকলের কাম্য। তবুও সমাজের কিছু মানুষ এসব অপরাধে লিপ্ত হয়। ফলে সনামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। সমাজে যাতে অপরাধ সংঘটিত না হয় সে লক্ষ্যে ইসলাম সমাজকে কলুষমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখতে চায়। সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল, যে সব পরিস্থিতিতে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভবনা থাকে তা থেকে সমাজকে মুক্ত রাখা। যেমন সম্পদের সুসম বন্টন, যাতে অভাবের তাড়নায় কাউকে চুরি, ডাকাতি করতে না হয়। প্রতিটি নাগরিক যাতে স্বীয় পরিশ্রমলব্ধ আয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয় এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে, সেরূপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নারী-পুরুষের অবাধ মিলন ও যৌন প্রবৃত্তি উদ্দীপক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার রোধ করে ব্যভিচারের পথ রুদ্ধ করা প্রয়োজন। খুনখারাবি রোধে সামাজিক দ্বন্দ্ব কলহের অবসান ঘটাতে হবে। সকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ধারা জারী রাখতে হবে। পরনিন্দা, পরচর্চা বন্ধ করার লক্ষ্যে মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন করতে হবে।

অপরপক্ষে ইসলাম ব্যক্তির মন-মানসিকতায় আল্লাহর দৃঢ় বিশ্বাস ও পরকালের জবাবদিহিতার ভয় সৃষ্টি করে। তাকে এ কথা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করার সুযোগ দেয় যে, যত সংগোপনেই সে অপরাধ করুক না কেন আল্লাহ্ তা দেখেন। পরকালে আল্লাহর নিকট এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং পরকালের শাস্তি ইহকালের শাস্তির চেয়ে অনেক কঠিন ও স্থায়ী। এই বোধ সৃষ্টির দ্বারাই কেবল অপরাধের মাত্রা ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব। একাধারে সমাজ থেকে অপরাধ সংঘটনের সকল সম্ভাবনা দূরীভূত ও ব্যক্তি চরিত্রের উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমেই অপরাধ দমন করা যেতে পারে। এতসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরও যদি কোন ব্যক্তি অপরাধ করে বসে, তবে ইসলাম তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার পক্ষপাতী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *