৩-৪. আকাশ আজ মেঘলা

সকাল থেকে আকাশ আজ মেঘলা। একফোঁটা হাওয়া নেই। চৈত্রমাসের দশ তারিখ হয়ে গেল, এখনও একটা কালবৈশাখী এল না। রোজই বেলা বাড়লে মেঘগুলো বেপাত্তা হয়ে যায়, চলতে থাকে বিচ্ছিরি চাঁদিফাটা গরম। ভ্যাপসা-ভ্যাপসা। গা জ্বালানো।

গরমের মধ্যেই টুপুরকে নিয়ে দুপুরে বেরিয়ে পড়েছিল মিতিন। ঢাকুরিয়া থেকে ট্যাক্সি ধরে সটান নিউ মার্কেট। নতুন থানাটায়। আরক্ষা বাহিনীর অফিস রীতিমতো ব্যস্ত তখন। ঘরখানা পেরিয়ে মিতিন ওসির চেম্বারে উঁকি দিয়েছে।

মধ্যবয়সি থলথলে চেহারার অফিসারটি এক কনস্টেবলকে খুব দাবড়াচ্ছিলেন। মিতিনদের দেখে তাঁর গলা দিয়ে বুলেট ছিটকে এল, ইয়েস?

মিতিন ঋজু স্বরে বলল, আমি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। আপনাকে সকালে ফোন করেছিলাম…।

অ। আপনিই তিনি? আসুন। সঙ্গে লেজুড়টি কে?

আমার বোনঝি। কেসে আমাকে হেল্পটেল্প করে।

 পড়াশুনো ফেলে চোর-জোচ্চোরদের পিছনে ঘুরছে?

টুপুর সামান্য সিটিয়ে গেল। কীরকম তেড়ে-তেড়ে কথা বলেন রে বাবা। মিতিনমাসির সঙ্গে পূর্বপরিচয় নেই, এ তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে নামটা নিশ্চয়ই জানেন।

মিতিন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়েছে বেমালুম। দেখাদেখি টুপুরও বসল আড়ষ্টভাবে। কনস্টেবলটিকে ছেড়ে দিয়ে অফিসার গলাখাকারি দিলেন, হ্যাঁ, কী যেন একটা দরকার ছিল আপনার?

এবার মিতিন বিনীত স্বরে বলল, মারকুইস স্ট্রিটের এক আর্মেনিয়ান ফ্যামিলি…।

অ। সেই হিরে চুরির কেস? ওটা তো সেকেন্ড অফিসার দেখছেন। বিশ্বনাথ মই।

আমি কি বিশ্বনাথবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

উনি কি আছেন! দাঁড়ান দেখছি।

বলেই কলিংবেলে মুষ্ট্যাঘাত। ঝং শব্দ বেজে উঠতেই হুমড়ি খেয়ে ঘরে এক উর্দিধারী। ঝটাক স্যালুট মারতেই হুকুম জারি হল, মইকো বুলাও।

হুকুমবরদার বাইরে যেতেই মিতিন কেঠো হেসে বলল, আপনার খুব দাপট আছে শুনেছি। অনিশ্চয় মজুমদার আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন।

আপনি আইজি সাহেবকে চেনেন নাকি?

কেসের সূত্রে আলাপ। এখন ফ্যামিলিফ্রেন্ডের মতো হয়ে গিয়েছেন। বাড়িতে আসেন তো মাঝেমধ্যে।

জাঁদরেল অফিসার পলকে মাখন। একগাল হেসে বললেন, হেঁ হেঁ, আগে বলবেন তো! দুটো ঠান্ডা আনাই? কী গো বোনঝি, খাবে তো কোল্ডড্রিংক?

টুপুরের বাসনায় জল ঢেলে দিল মিতিন। বলল, না না, এই গরমে ঠান্ডা খাওয়া ঠিক নয়।

তা হলে চা? কফি?

কিছু লাগবে না। আমি কাজটা করেই চলে যাব।

একটু অতিথি সৎকারেরও সুযোগ দিলেন না! হেঁ হেঁ হেঁ।

টুপুরের বেজায় হাসি পাচ্ছিল। হলফ করে বলতে পারে, অনিশ্চয় মজুমদার কস্মিনকালে মিতিনমাসিকে এই অফিসারটির কথা বলেননি। মিতিনমাসি যে এক একসময় কী অম্লান বদনে গুল মারে!

পিছনে হঠাৎ খোনা-খোনা গলা, আমায় ডাকছেন স্যার?

ঘাড় ঘুরিয়েই টুপুর বুঝল, ইনি বিশ্বনাথ মই না হয়ে যান না। পদবিটি চেহারার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে গিয়েছে। লিকলিকে রোগা চশমাপরা তালট্যাঙা মানুষটিকে দেখলে গা বেয়ে চড়চড়িয়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করবে।

বড়বাবু গলা ফের রাশভারী করে বললেন, এই ম্যাডামকে চেনেন?

দুদিকে মাথা দোলালেন বিশ্বনাথ, না তো স্যার।

নামী ডিটেকটিভ। প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। আই-জি মজুমদার সাহেবের বন্ধু। মারকুইস স্ট্রিটের হিরে চুরির ব্যাপারটায় উনি আপনার কাছে কিছু জানতে চান।

ও। চেয়ার টেনে বসলেন বিশ্বনাথ, কী জিজ্ঞাস্য আছে ম্যাডাম?

না মানে… সেটা তো আপনি ডিল করছেন। কী মনে হচ্ছে?

বেশ ভজকট। ওই হিরে উদ্ধার হওয়া খুব মুশকিল।

কেন? পাচার হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়?

লোকাল মার্কেটে বিক্রি হয়নি এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ওই সাইজের হিরে কোনও জহুরির কাছে বাঁকা পথে এলে শোরগোল পড়ে যেত। সোর্স তো আমাদের আছেই, কানে ঠিক চলে আসত খবর।

আর যদি বাইরে কোথাও চালান হয়ে গিয়ে থাকে?

সে আশঙ্কাও আমি খতিয়ে দেখিনি তা নয়। নাকের মগড়াল থেকে চশমা নেমে যাচ্ছিল, আঙুল দিয়ে তুলে বিশ্বনাথ বললেন, ভেবে দেখুন, চোর যদি হিরো কাউকে পাস করে, তার বিনিময়ে নিশ্চয়ই মোটা টাকা নেবে। এবং সেই টাকা হজম করে ঘাপটি মেরে থাকা বেশ কঠিন কাজ। ব্যাঙ্কে তো রাখতে পারবে না, সুতরাং উশখুশ করবে খরচ করার জন্যে। হয় অ্যাসেট কিনবে, নয়তো স্রেফ ওড়াবে। সন্দেহভাজন কারওর সম্পর্কেই এখনও সেরকম পিকচার পাইনি।

মিতিন ভুরু কুঁচকে বলল, কত দাম হতে পারে হিরেটার?

এটা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করে যে কিনছে তার শখ-মর্জির উপর। পাঁচ টাকার জিনিস কেউ যদি কুড়ি টাকা দিয়ে কেনে, আপনি কি আপত্তি করতে পারবেন? তবে বাজারচলতি মূল্য সম্পর্কে আমি একটা আন্দাজ দিতে পারি। বিশ্বনাথ লম্বা শরীরটাকে আরও খানিক লম্বা করলেন, মিসেস আরাকিয়েল বলছিলেন, হিরেটা নাকি গোলকুন্ডা মাইনসের। এবং এটি নাকি তিন পুরুষের সম্পত্তি। তাই যদি হয়, তবে ক্যারাট পিছু কম করে চল্লিশ লাখ।

বড়বাবু বললেন, চল্লিশ লক্ষ ইনটু পাঁচ, কত হয়? দু কোটি। কী বুঝলেন?

মিতিনের আগে বিশ্বনাথবাবু বলে উঠলেন, যে নিয়েছে, তার এখন সাপের ছুঁচো গেলা দশা। না পারছে ফেলতে, না পারছে গিলতে। আমিও তক্কে-তক্কে আছি। যেই না খোলশ ছেড়ে গাঝাড়া দেবে, অমনি ক্যাঁক।

মিতিন হেসে বলল, শুনলাম তো আপনি কষে জেরা করেছেন। কাকে-কাকে আপনার সন্দেহ হয়?

বিশ্বনাথ বুঝি সামান্য অস্বস্তি বোধ করলেন। চশমা ঠিক করতে করতে বড়বাবুর দিকে তাকাচ্ছেন। বড়বাবু ঢক করে ঘাড় নাড়লেন, বলে দিতে পারেন। উনি আই-জি সাহেবের লোক।

মিতিন তাড়াতাড়ি বলল, বিশ্বনাথবাবু, ডোন্ট মাইন্ড, আপনার লিড থেকে যদি হিরেচোরকে ধরতে পারি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন কৃতিত্বটা আমি আপনাকেই দেব।

আমার তালিকায় প্রত্যেকেই সন্দেহভাজন। বিশ্বনাথের আঙুল ফের চশমায়। গলায় খানিক রহস্য মিশিয়ে বললেন, মিসেস আরাকিয়েল নিজেই নাটকটি রচনা করতে পারেন। তারপর ধরুন, মহিলার যে ভাইঝিটি সঙ্গে থাকে… কী যেন নাম?

জেসমিন।

হ্যাঁ, জেসমিন। সে তো মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আরাকিয়েলের সবচেয়ে নিকটজন। চাবিটা অকুস্থল থেকে হাতিয়ে সে যে কুকাজটি করেনি, তাও কি নিশ্চিত করে বলা যায়? আর রাতদিনের কাজের মহিলারা যে কত কী কাণ্ড ঘটাচ্ছে, তা তো আপনারা রোজ কাগজেই দেখতে পাচ্ছেন। সুতরাং হাউসমেডটিকেও আমি ক্লিনচিট দেব না।

আর হ্যারি?

সেও তো মোটেই সাধুপুরুষ নয়। প্রিটোরিয়া স্ট্রিটে তার একটি হোটেল আছে। হোটেলটির খুব একটা সুনাম নেই। মাঝে-মাঝেই সেখানে জুয়ার আজ্ঞা বসে। হ্যারির আর্থিক অবস্থাও এখন পড়তির মুখে। এই ধরনের মানুষরা কখন কী করে বসে বলা কঠিন। আর একতলার ভাড়াটেদের মধ্যে ডিসুজা বড় চাকরি করতেন বটে, তবে তাঁর পুত্ৰটি ঘোর অপদার্থ। রোজগার প্রায় নেই বললেই চলে, সংসৰ্গও ভাল নয়। বাবার সঙ্গে সেও রাতে উপরে এসেছিল, আমি খবর পেয়েছি। বাকি রইলেন মিস্টার কুরিয়েন। তিনি একটি চিট ফান্ড চালান। তিনবার কোম্পানির নাম বদলেছেন। একবার জেলে যেতে যেতেও বেঁচে গিয়েছেন। আশা করি, এঁকে কেন সন্দেহ করছি সেটা আর ভেঙে বলার দরকার নেই। আর আছে দারোয়ান। বাহাদুর। যতই নিস্পাপ দেখাক, আমি কিন্তু এখনও তাকে ছেঁটে ফেলিনি। হ্যারির বউও বরের সঙ্গে যোগসাজশ করে…।

টুপুরের আর কানে ঢুকছিল না। মাথা ঝিমঝিম করছে। বিশ্বনাথ মই বোধ হয় এবার ডাক্তারকেও টানাটানি করবেন। কিংবা মৃত মিস্টার আরাকিয়েলকে…।

মিতিনের কিন্তু এতটুকু বিরক্তি নেই। একগাল হেসে বলল, অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাকে যে অমূল্য সাহায্যটি করলেন, তা আমার বহুকাল স্মরণে থাকবে।

এ তো আমার কর্তব্য ছিল ম্যাডাম। আই-জি সাহেবের পরিচিত আপনি… প্রয়োজন হলেই চলে আসবেন।

বড়বাবু গদগদ মুখে বললেন, সেদিন কিন্তু আপনাকে কিছু খেতেই হবে ম্যাডাম। নিদেনপক্ষে ডাবের জল…।

অবশ্যই।

 থানা থেকে বেরিয়ে ফের ট্যাক্সি। গনগনে আঁচ লেপে আছে ট্যাক্সির সর্বাঙ্গে। উনুনে বসানো চাটুর মতো গরম সিটে শরীর ছেড়ে দিয়ে টুপুর বলল, বিশ্বনাথবাবু তোমায় কিন্তু খুব হ্যারাস করলেন। ইচ্ছে করে গুলিয়ে দিলেন ব্যাপারটা।

আহা, ওভাবে ধরছিস কেন? উপরতলার সঙ্গে খাতির আছে বলেছি তো, তাই একটু মই ঘষলেন। তা ছাড়া সরকারি তদন্তের গোপন তথ্য আমার কাছে গড়গড় করে উগরে দেবেন, এতটা আশা করাও কি ঠিক?

তা হলে এসেছিলে কেন? দুপুরটা তো বেকার গেল।

না রে, জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা। নয়-নয় করে ছিটেফোঁটা তো পেয়েছি। ওগুলোই কুড়িয়ে বাড়িয়ে জড়ো করে এখন খেলাতে হবে। দেখি, একটু-একটু করে ছবিটাকে সাজাই।

বাড়ি ফিরে মিতিন ঢুকে গেল নিজের ছোট্ট স্টাডিতে। বোধ হয় ছবি সাজাতেই। মিতিনমাসি যে-কোনও কেসে কী করে এগোবে, এখনও তার থই পায় না টুপুর। দরকারই বা কী, মাসির পাশে পাশে থেকে পর্যবেক্ষণ করে যাওয়াটাই তো যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। সুতরাং, এক্ষুনি-এক্ষুনি মাসির সঙ্গে বাতচিত করে লাভ নেই। কম্পিউটারে দাবা খেলতে বসে গেল টুপুর।

হিরে চুরির প্রসঙ্গ ফের উঠল সন্ধেবেলায়। প্রেস থেকে ফিরে পার্থ উত্তেজিত মুখে বলল, তোর মাসি কাল অ্যাডভান্সটা না নিয়ে ভালই করেছে।

মিতিন টুপুরের সঙ্গে বসে টিভি দেখছিল। ভঙ্গি করে বলল, হঠাৎ এই বোধোদয়?

ভেবে দেখলাম, এই কেসে আগাম দু-পাঁচ হাজার নেওয়া মানে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা। তার চেয়ে স্ট্রেট পুরো দক্ষিণাটা হেঁকে দেবে। হিরের দামের এক পারসেন্ট।

টুপুর বলে উঠতে যাচ্ছিল, সে তো অনেক টাকা গো! তাকে থামিয়ে মিতিন সরল মুখ করে বলল, তাতে লোকশান হয়ে যাবে না তো?

কী বলছ? হিরের দাম সম্পর্কে কোনও আইডিয়া আছে?

তোমার আছে? মিতিন পালটা প্রশ্ন হানল, তুমি কি আজকাল হিরের কারবার করছ?

আরে বাবা, হিরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি তো করি। মনে রেখো, আমার প্রেসটা বউবাজারে। যেখানে সোনা, রুপপা, হিরে-জহরতের দোকান থিকথিক করছে।

বুঝেছি। আজ হিরে সম্পর্কে প্রচুর ফান্ডা নিয়ে এসেছ।

উহুঁ, আগেই ছিল। আজ আবার একবার ঝালিয়ে নিলাম। পার্থ সোফায় গ্যাট হয়ে বসেছে, দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় হিরেটার নাম জানো কি? কালিনান। ওজন পাঁচশো ক্যারাটেরও বেশি। দু নম্বরে আছে ওলফ। তিনশো ক্যারাট। আমাদের কোহিনুরের র‍্যাঙ্ক ফিফথ। কেটেকুটে তার ওয়েট এখন দাঁড়িয়েছে একশো দু ক্যারাটে। আর দশ নম্বর পজিশনটা হর্টেনসিয়ার। কুড়ি ক্যারাটের এই ডায়মন্ডটি এক সময় ফ্রান্সের রাজমুকুটে শোভা পেত। এখন অবশ্য হর্টেনসিয়ার ঠাঁই পেয়েছে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে।

মিতিন মুচকি হেসে বলল, তার মানে ওদের তুলনায় আরাকিয়েল বাড়ির হিরে নেহাতই পুঁচকে, কী বলো?

যাহ বাবা, পাঁচ ক্যারাট কি ছোট? কীরকম প্রাইস হতে পারে জানো?

কত আর! দু কোটি মতো।

তাই বা কম কী? এক পারসেন্ট পাওয়া মানেও তো দুলক্ষ। অবশ্য ওজনের হিসেবে।

কিন্তু আমার প্রাপ্য তো আরও বেশিও হতে পারে। কারণ, হিরের দাম তো শুধু ওজনে হয় না। কোন খনি থেকে সেটা পাওয়া গিয়েছিল, কতটা বিশুদ্ধ, কেমন কাটিং হয়েছে, রং, গ্লেজ, সবই ম্যাটার করে। প্লাস বিশেষ এক-একটা হিরের কত যে ইতিহাস থাকে। আমাদের কোহিনূরের কথাই ধরো না। মালবের রাজার কাছ থেকে বাবর নাকি কোহিনুর লুট করেছিলেন। মোগল সম্রাটদের হাত ঘুরে সেটি গেল নাদির শাহের কাছে। তারপর পেলেন পঞ্জাব কেশরী রঞ্জিৎ সিংহ। এবং শেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে কুইন ভিক্টোরিয়ার হাতে। এমন হিস্ট্রি আছে বলেই কোহিনুর না এত ফেমাস। এবং দামটাও সব হিসেবের বাইরে।

সে যদি বলো, ওরলফের হিস্ট্রি তো ঢের ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং। এখন যদিও মস্কোয় আছে, কিন্তু আদতে ওটা নাকি ভারতের। দক্ষিণের এক মন্দিরে ওরকম দুখানা হিরে নাকি বিষ্ণমূর্তির দুচোখে সেট করা ছিল। এক ব্যাটা ফরাসি সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর সময় ওই মন্দিরে ঢুকে পড়ে। পাথর দুটো দেখেই তো তার চোখ চকচক। কিন্তু একটা চোখ খুবলে নেওয়ার পরেই লোকটা বেজায় ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে মন্দির থেকে ধাঁ। তারপর ঘাবড়ে গিয়েই হোক, কী হিরে বলে চিনতে না পেরেই হোক, রত্নটিকে সে বেচে দিল এক ব্রিটিশ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে। মাত্র দুহাজার পাউন্ডে। তারপর ক্যাপ্টেন জাহাজ নিয়ে গেল আমস্টারডাম। সেখানে তখন থাকতেন রাশিয়ার এক কাউন্ট গ্রিগরি ওলফ। রানি ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের বিশেষ বন্ধু। নব্বই হাজার পাউন্ডে হিরেখানা কিনে ওলফ উপহার দিলেন রানিকে। আনন্দে আত্মহারা রানি রিটার্ন গিন্ট হিসেবে আস্ত একখানা প্রাসাদই দিয়ে দিলেন ওরলফকে। তিরিশ বছর পর নেপোলিয়ান হানা দিলেন মস্কোয়। পাছে নেপোলিয়ান হিরেটা নিয়ে চলে যান, ওলফকে লুকিয়ে রাখা হল এক পুরোহিতের সমাধিতে তা নেপোলিয়ানও তো ছোড়নেওয়ালা নন। খুঁজে খুঁজে ঠিক সন্ধান পেয়ে গেলেন হিরেটার। কিন্তু সমাধিস্থলে গিয়ে যেই না সৈনিকরা মাটি খুঁড়ে হিরে বের করতে যাবে, অমনি পুরোহিতের আত্মা এসে প্রচণ্ড অভিশাপ দিতে লাগল সৈনিকদের। তাদের ভয়ংকর ক্ষতি হবে… কেউ তোরা বেঁচে ফিরবি না… রাশিয়ানদের কাছে হেরে যাবি…!

পাৰ্থ গোঁফে তা দিল, কী কপাল, নেপোলিয়ান শেষ পর্যন্ত রাশিয়াতে হেরে গেলেন, ওরলফও তাঁর কবজায় এল না।

কোথা থেকে পেলে গো গল্পটা? মিতিন চোখ নাচাচ্ছে, সাজিয়ে গুছিয়ে গুল মারছ না তো?

আজ্ঞে না। কদিন আগে একটা বইয়ে পড়ছিলাম।

তা বিষ্ণুর চোখের সেকেন্ড হিরেখানা গেল কোথায়?

নিশ্চয়ই আছে কোথাও। খুঁজে দেখতে হবে। বেশি জেরায় পড়ার আগে পাৰ্থ মানে-মানে উঠে দাঁড়িয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে বলল, আমার সাজেশনটা কিন্তু খেয়াল রেখো। আরাকিয়েলরা যথেষ্ট মালদার পার্টি, দু লাখের নীচে কখনও নামবে না।

মনে থাকবে। মিতিন মুখ বেঁকাল। টুপুরকে বলল, গালগল্পগুলো আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফ্যাল। কাল থেকে আমাদের কিন্তু অভিযান শুরু।

টুপুর ঘাড় নাড়ল, জানি তো।

.

০৪.

বাড়িটা প্রাচীন, কিন্তু জরাজীর্ণ নয়। পাঁচিল ঘেরা সাহেবি ছাঁদের চেহারা। দোতলা। বেশ বড়সড় গাড়িবারান্দাওয়ালা। মজবুত পিলারে গাঁথা লোহার গেটখানা রীতিমতো সম্ভ্রম জাগায়। বাড়ি আর গেটের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। চাতালের মতো। ঈষৎ এবড়োখেবড়ো, ঘাসবিহীন। পাঁচিলের গায়ে দুখানা খুপরি-খুপরি ঘর। দরোয়ানের কোয়ার্টার।

মিতিন আর টুপুর খোলা গেট পেরোতেই এক নেপালি যুবক বেরিয়ে এসেছে, কাহা জানা হ্যায়?

উপর। জেসমিন মেমসাবকা পাস।

আইয়ে। আইয়ে।

 গাড়িবারান্দা পর্যন্ত টুপুরদের পৌছে দিল গাঁটাগোট্টা চেহারার যুবকটি। সম্ভবত জেসমিনের নির্দেশেই এই খাতিরদারি। টুপুর ভাল করে দারোয়ানটিকে দেখে নিল। এই তবে বাহাদুর। বিশ্বনাথ মইয়ের মতো মিতিনমাসিও কি একে সন্দেহের তালিকায় রাখবে?

গোটা তিনেক ধাপ টপকালে চওড়া প্যাসেজ। তিনখানা টিউবলাইট জ্বলছে প্যাসেজে। দুপাশে দুখানা লম্বা-লম্বা দরজা। নেমপ্লেট লাগানো। ডিসুজা আর কুরিয়েন। আলোকিত প্যাসেজের শেষ প্রান্তে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। বারচারেক পাক খেয়ে সিঁড়ি পৌঁছেছে উপরে। সিঁড়ির শেষে আবার একখানা লম্বা টানা প্যাসেজ। অন্দরে যাওয়ার জন্য দুপ্রান্তে দুখানা, মধ্যিখানে পাশাপাশি তিনটে, মোট পাঁচটা দরজা। সামনেরটাতেই ডোরবেল।

জেসমিন বুঝি বেল বাজার প্রতীক্ষাতেই ছিল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই খুলেছে দরজা। নরম হেসে বলল, ওয়েলকাম। আন্টি আপনাদের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন।

বর্গাকৃতি ড্রয়িংরুমে টুপুরদের বসিয়ে পিসিকে ডাকতে গেল জেসমিন। টুপুর ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখছিল ঘরটাকে, আর চমৎকৃত হচ্ছিল। আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, সর্বত্রই অ্যান্টিকের ছড়াছড়ি। দেওয়ালআলমারিতে কত যে দুষ্প্রাপ্য পুতুল। যিশুখ্রিস্ট, মা মেরি থেকে শুরু করে কিমোনো পরা জাপানি মেয়ে…। ঘরের চারকোণে রাখা চারটে অর্ধচন্দ্রাকার শ্বেতপাথরের টেবিলে সাবেকি ফুলদানি, রঙিন বাতিদান। এখানে সেখানে শোভা পাচ্ছে সুদৃশ্য মোমবাতি। নানান নকশার, নানান আকারের দেওয়ালে ছোট-বড় অয়েলপেন্টিং, রকমারি মুখোশ… অদ্ভুতদৰ্শন এক বাঁশের চোঙাও টাঙানো আছে দেওয়ালে। পাশে একজোড়া বাঁকানো কাঠের পাত, গায়ে ছবি আঁকা। একখানা গ্র্যান্ড পিয়ানোও ঘরে মজুত। কার্পেটে শুয়ে আছে পিতলের হরিণ।

তারিফের সুরে টুপুর বলে উঠল, কী গ্র্যানজার গো?

মিতিন অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, মাথার উপর ল্যাম্পশেডগুলো দ্যাখ। স্টেনড গ্লাস। ইতালিয়ান।

জগঝম্প বাঁশের ভেঁপুটা কী গো?

ডিজিরিড়ু। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের বাজনা। পাশের দুটো বুমেরাং।

সেই অস্ত্র, যা ছুড়লে টার্গেটকে হিট করে আবার হাতে ফিরে আসে?

ইয়েস। তবে ছোড়াটা সহজ নয়। কেরামতি লাগে। এটাও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাই..।

মিতিন থেমে গেল। এক বয়স্ক মহিলাকে ধরে ধরে আনছে জেসমিন। মহিলার চোখে মিলেস চশমা, চুল ছোট করে ছাঁটা, পরনে লম্বা গাউন। চেহারাটি ছোটখাটো, রোগাসোগা। গায়ের রং এককালে টকটকেই ছিল, এখন তাতে কেমন বাদামি-বাদামি ভাব। চামড়াও বেশ শিথিল। বয়সের তুলনায় যেন একটু বেশিই বুড়িয়ে গিয়েছেন মহিলা।

মিতিন আর টুপুর উঠে দাঁড়িয়েছিল। জেসমিনের পিসি ইংরেজিতে বললেন, শুভ সন্ধ্যা। আমি ইসাবেল আরাকিয়েল। প্ৰয়াত জোসেফ মেলিক আরাকিয়েলের হতভাগ্য স্ত্রী। তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোস।

আলাপ-পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হতেই মিতিন দ্রুত কাজের প্রসঙ্গে চলে এল, প্রথমে মিস্টার আরাকিয়েলের মৃত্যুর রাতটার সম্পর্কে বিশদ জানতে চাই। এবং একটু একান্তে।

ইঙ্গিত বুঝেছে জেসমিন। তাড়াতাড়ি বলল, হা হা, নিশ্চয়ই। আপনারা কথা বলুন, আমি ততক্ষণ একটু চা-কফির বন্দোবস্ত করি।

শুধু চা কিন্তু। লিকার উইদাউট সুগার। আর আমার এই অ্যাসিস্ট্যান্টের জন্য…।

কোড্রিংক, তাই তো?

দ্যাটস নাইস অফ ইউ।

মধুর হেসে চলে গেল জেসমিন। মিতিন সোফা বদলে ইসাবেলের পাশে গিয়ে বসেছে। ইসাবেল অল্প-অল্প হাঁপাচ্ছিলেন। দম নিয়ে বললেন, আমি বাংলা বুঝি, কিন্তু বলতে পারি না।

ঠিক আছে, আপনি ইংরেজিতেই বলুন।

বাইশে ডিসেম্বরের ওই অপয়া রাতটাকে আমি মনে করতে চাই না। তবু তুমি যখন শুনতে চাইছ…। সন্ধে থেকে শুরু করি?

যেভাবে আপনার সুবিধে হয়।

বিকেলবেলা রোদ্দুর পড়ে এলে জোসেফ রোজ হাঁটতে বেরোতেন। অনেক কালের অভ্যেস। সেদিন ফিরলেন সাতটা সওয়া-সাতটা নাগাদ। তখন আমি টিভি দেখছিলাম। তা উনি তো গল্ফ কিংবা কার রেস ছাড়া অন্য কোনও অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না… আমাকে ইভনিং টি দিতে বলে উনি চলে গেলেন পাশের লাইব্রেরিরুমে। চা নিয়ে গিয়ে দেখি, যথারীতি খবরের কাগজ খুলে বসেছেন। একটা পিকিউলিয়ার হবি ছিল জোসেফের। রোজ তিনটে-চারটে করে নিউজ পেপার কিনতেন, আর বসে-বসে যত ক্রসওয়ার্ড আর জাম্বল আছে, সেগুলোর সমাধান করতেন। বিশেষ-বিশেষ দিনে খবরের কাগজ বন্ধ থাকলে জোসেফ ছটফট করতেন সারাদিন। এমনই নেশা, ওই সময়ে কেউ কথা বলতে গেলেও তাঁর কী বিরক্তি। ইসাবেল একটু থামলেন। বারকয়েক চোখ পিটপিট করে বললেন, তবে সেদিন, কে জানে কেন, আমার সঙ্গে গল্প করলেন খানিক। হয়তো চিরতরে চলে যাবেন বলেই…

টুপুর ঝানু গোয়েন্দার স্বরে প্রশ্ন করল, কী কথা হয়েছিল স্মরণে আছে?

তেমন বিশেষ কিছু নয়। ইসাবেলের মুখে দুঃখী হাসি, কাকে কাকে কার্ড পাঠানো যায়, কার জন্য কী উপহার কিনতে হবে… দু সপ্তাহ পরেই ক্রিসমাস ছিল তো।

দু সপ্তাহ পরে? টুপুর অবাক, সেদিন তো ছিল ডিসেম্বরের বাইশ…?

আমরা পঁচিশে ডিসেম্বর বড়দিন পালন করি না, মাই চাইল্ড। সেদিন শুধু একটা বাতি জ্বালাই। আর্মেনিয়ানদের ক্রিসমাসের উৎসব হয় ছয় জানুয়ারি।

তাই বুঝি? ব্যাপারটায় বিশেষ একটা উৎসাহ না দেখিয়ে মিতিন ইসাবেলকে প্রসঙ্গে ফেরাল, হ্যাঁ, তারপর কী হল?

আমি আবার বেডরুমে গেলাম টিভি দেখতে। জোসেফ ক্রসওয়ার্ড পাজলে মন দিলেন। জেসমিন আসার পর তিনজনে একসঙ্গে ডিনার সারলাম।

জেসমিন এলেন কখন?

 নটা নাগাদ। কাজে বেরোলে ওর একটু রাতই হয়। … ডিনারের পর জোসেফ কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন টেরেসে। তারপর আমরা তো শুয়েই পড়লাম। ঘুমটা যখন আসছে… হঠাৎ টের পেলাম জোসেফ আমায় ঠেলছেন। আলো জ্বেলে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখি, বুকের যন্ত্রণায় উনি কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। ঘামছিলেনও ভীষণ। ভয় পেয়ে জেসমিনকে ডেকে তুললাম। আওয়াজে নির্মলাও জেগে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকাল ডাক্তারকে কল দিয়েছিল জেসমিন। তবে ডাক্তারবাবু আসার আগেই তো উনি কেমন স্থির হয়ে গেলেন। ইসাবেলের গলা ধরে এল। নাক টেনে বললেন, ডাক্তারবাবু চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। হার্ট পাম্প করলেন, মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস পাঠিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করারও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যার সময় শেষ, তাকে কি আর ধরে রাখা যায়। ইঞ্জেকশনটাও তো দেওয়া গেল না।

সরি আন্টি। মিতিন ইসাবেলের হাতে হাত রাখল, জানি আপনাকে এসব প্রশ্ন করা মোটেই সমীচীন নয়। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার যে আমায় জানতেই হবে।

কিন্তু কিন্তু করছ কেন? বলো না?

আমি তো এসেছি আপনাদের হিরে হারানোর তদন্ত করতে…। মিতিন গলা ঝাড়ল, আর হিরেটা খোওয়া গিয়েছে মিস্টার আরাকিয়েল মারা যাওয়ার পরপরই…।

মৃত্যুর ঠিক পরেই কিনা তা কিন্তু নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, পঁচিশ তারিখ সকালে যখন সিন্দুক খুললাম, তখন দেখি বাক্সটা খালি।

আপনি তো আগে কখনও সিন্দুকে হাত দেননি?

না। জীবনে ওই প্রথম। সিন্দুক থেকে কিছু বের করার দরকার হলে জোসেফ ঘর বন্ধ করে সিন্দুক খুলতেন। তখন আমারও ঘরে থাকার অনুমতি ছিল না। ইসাবেল একটা নিশ্বাস ফেললেন, সেদিন জেসমিন কিছু টাকা চাইল। সমাধি দেওয়ার দিন খরচাপাতিগুলো হ্যারি মানে আমার ভাসুরের ছেলেই তো করেছিল। ওকে টাকাটা ফেরত দেবে বলে…. ভাগ্যিস খুললাম, চুরিটা তাই তখনই ধরা পড়ল।

হঠাৎ বাক্সটাই বা দেখতে গেলেন কেন? ওটা তো খোলার প্রয়োজন ছিল না।

নিছকই কৌতূহলে। আগে কখনও সিন্দুক খুলে দেখার সুযোগ পাইনি তো।

হুম। জেসমিন তখন কোথায়?

বেরিয়েছিল কী যেন কিনতে। ফোন করে জানাতেই ও চলে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গে পুলিশকে..।

ও। মিতিন একটু থেমে থেকে বলল, আচ্ছা আন্টি, চাবিটা তো মিস্টার আরাকিয়েলের কাছেই থাকত?

বরাবর। আমি যখন বিয়ের পর এ বাড়িতে আসি, তখন থাকত শশুরমশাইয়ের হেপাজতে। তিনি গত হওয়ার পর থেকে জোসেফই… চাবিটা যেন ওঁর শরীরের একটা অংশ বনে গিয়েছিল।

তা আপনার হাতে চাবিটা এল কখন?

ওই রাত্তিরে তো চাবির কথা আমার মাথাতেই ছিল না। মগজ কাজই করছিল না কোনও। কখন যেন জেসমিনের ঘরে গিয়ে শুয়েছিলাম, তারপর সকালে ফের ও ঘরে যেতে সুজান আমাকে চাবিটা দিল।

মিস্টার হ্যারির বউ?

 তুমি তাকে চেনো?

জেসমিনের মুখে নামটা শুনেছি।

হ্যারি আর সুজান আমার উপর খুব রেগে আছে।

কেন?

পুলিশ ওদের খুব জেরা করেছে তো। ভাবছে আমি ওদের নামে নালিশ করেছি। ইসাবেল ফের একটা নিশ্বাস ফেললেন, বোঝে না, আমিও নিরুপায়। পুলিশকে তো বলতেই হবে সেদিন রাতে জোসেফের পাশে কারাকারা ছিল।

বটেই তো। রাতভর চাবি ছিল মিস্টার আরাকিয়েলের কোমরে। তখনই সিন্দুক খুলে হিরে সরানো হয়েছে কিনা পুলিশ তো খতিয়ে দেখবেই। মিতিন আড়চোখে অন্দরে যাওয়ার দরজাটা একবার দেখে নিয়ে বলল, তা সুজানের হাতে চাবি এল কীভাবে?

সুজান তো সকলের সামনেই জোসেফের কোমর থেকে খুলল।

সবাই মানে? কে কে ছিল তখন?

অনেকে। হ্যারি, মিস্টার ডিসুজা, মিসেস কুরিয়েন… এ ছাড়া জেসমিন, নির্মলারা তো ছিলই।

আপনার ভাড়াটেরা কি হিরেটার কথা জানতেন?

অজানা ছিল না। আমি কখনও সেভাবে আলোচনা করিনি বটে, তবে দু-একবার হয়তো বলেছি। ডিসুজা কুরিয়েনদের সঙ্গে জোসেফের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। জোসেফও হয়তো গল্প করে থাকতে পারেন।

এবার একটা ডেলিকেট প্রশ্ন। ভাড়াটেদের কাউকে কি আপনার সন্দেহ হয়?

ইসাবেল চুপ। প্রায় মিনিটখানেক নীরব থেকে বললেন, পিটার ডিসুজা ছিলেন জোসেফের বন্ধু। অ্যালবার্ট এই বাড়িতেই জন্মেছে। কুরিয়েনরাও আছে প্রায় তিরিশ বছর। ওদের সম্পর্কে আমি কী মন্তব্য করব বলো? সজ্ঞানে এরা আমাদের ক্ষতি করবে, এ আমি ভাবতেই পারি না। ওদের সন্দেহ করলে তো জেসমিন, নির্মলা, হ্যারিদেরও সন্দেহ করতে হয়।

নির্মলাও কি বহুদিনের পুরনো…?

হ্যাঁ। ষোল বছর বয়স থেকে আছে। আর্মেনিয়ান চার্চ কিছু বৃদ্ধাশ্ৰম আর অনাথালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ওই রকমই একটা অনাথ আশ্রম থেকে জোসেফ এনেছিলেন নির্মলাকে। এখন জেসমিনও আমার মেয়ে, নির্মলাও আমার মেয়ে। বলতে-বলতে ইসাবেল হঠাৎই চঞ্চল, কী কাণ্ড দ্যাখো… নির্মলা এখনও তো তোমায় চা দিয়ে গেল না! দাঁড়াও তো, দেখি উঠে।

ইসাবেলকে অবশ্য উঠতে হল না। নির্মলা প্রায় তখনই ট্রে সাজিয়ে ঢুকেছে। ক্ষণিকের জন্য টুপুরের মনে হল, আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিল নাকি নির্মলা? চা, কোল্ডড্রিংক নামিয়েই সে চলে গেল বটে, তবে তার আগেই টুপুর তাকে মোটামুটি জরিপ করে নিয়েছে। চেহারায় একটু যেন আদিবাসীআদিবাসী ভাব। বছর তিরিশেকের নির্মলার কালেকুলো মুখে একটা আপাত সারল্য থাকলেও খুদে-খুদে চোখের ঘূর্ণন বলে দেয়, সে মোটেই বোকা নয়। মিতিনমাসি কি নজর করল ব্যাপারটা?

চা শেষ করে মিতিন বলল, চলুন আন্টি, এবার আপনার শোওয়ার ঘরে যাই।

ইসাবেল বললেন, তা হলে জেসমিনকে ডাকি? আমাকে একটু ধরুক।

আমি হেল্প করব?

না না, তুমি কেন? ওরা তো আছে।

 আপনার প্রবলেমটা কী আন্টি? হাঁটু?

শুধু হাঁটু নয়, সর্বাঙ্গই যেন অচল হয়ে আসছে। এই কমাসে যে কী হল, পায়ে আর তেমন জোর পাই না, হাতে বল নেই, আঙুলগুলোও বড় কাঁপে…। ইসাবেলের স্বর দুলে গেল, অবশ্য আমার আর থেকেই বা কী লাভ। উনি নেই, আরাকিয়েল বংশের সৌভাগ্যের প্রতীক হিরেটাও বিদায় নিল…।

ইসাবেলের হাহাকারে টুপুরের চোখ ছলছল এবার। মিতিনের কিন্তু তেমন কোনও তাপউত্তাপ নেই। গলা উঁচিয়ে ডাকল জেসমিনকে। ভাইঝিকে ধরে কাঁপা-কাঁপা পায়ে হাঁটছেন ইসাবেল। পিছন-পিছন মাসি-বোনঝি।

ড্রয়িংরুমের ডান পাশের ঘরটি লাইব্রেরি। মোটা-মোটা আইনের বইয়ে চার দেওয়াল ঠাসা। আইনজ্ঞের টেবিলচেয়ার ছাড়াও একখানা গোল শ্বেতপাথরের টেবিল রয়েছে ঘরে। সাবেকি আরামকেদারাও। কবিরগাওয়ালা উঁচু সিলিং থেকে ঝুলছে চার ডাঁটির ফ্যান।

ঘরটা পেরোতে-পেরোতে টুপুর প্রশ্ন করল, মিস্টার আরাকিয়েল বুঝি লইয়ার ছিলেন?

উহুঁ। জেসমিন উত্তর দিল, আঙ্কলের বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। ভাল পশার ছিল।

আর আঙ্কল? বিজনেস?

অনেকটা ওই রকমই। আঙ্কলের ঘোড়দৌড়ে খুব আগ্রহ ছিল। তাঁর নিজের ঘোড়াও দৌড়ত কলকাতা আর বেঙ্গালুরুর ট্র্যাকে। পরে রেসের মাঠের রোজগার লাগিয়ে দেন বিভিন্ন কোম্পানিতে। নিয়মিত ডিভিডেন্ড পেতেন, দিব্যি চলে যেত।

কথায় কথায় পরের ঘরখানায় পা রেখেছে টুপুর। আগের দুটো ঘর বড় ছিল বটে, কিন্তু এটা যেন বিশাল। চারখানা দরজার একটা বাইরের প্যাসেজে বেরনোর, একটা পাশের ঘরে যাওয়ার, তৃতীয়টি অন্দরকে যুক্ত করেছে, চতুর্থটি দিয়ে গাড়িবারান্দার মাথার টেরেসটিতে যাওয়া যায়। লাইব্রেরি ঘরের দরজাটি ছাড়া বাকি তিনটি দরজা অবশ্য বন্ধ। লম্বা-লম্বা জানলায় ভারী-ভারী পরদা ঝুলছে।

ঘরে ঢুকেই টুপুরের চোখ গিয়েছে সিন্দুকে। গোলাকার হাতলওয়ালা দেওয়ালে গাঁথা আয়রন চেস্টা বিছানার ওপাশে, ঘরের কোনায়। প্ৰকাণ্ড খাটটি থেকে মাত্র হাত পাঁচেক দূরে। আস্তে আস্তে বাকি আসবাবেও দৃষ্টি ঘুরল টুপুরের। বিডে কারুকাজ করা ভারী চমৎকার দুটো কাঠের আলমারি, তাদের মাঝখানে একটা পুরনো অ্যাকোয়ারিয়াম, সাহেবি আমলের ড্রেসিংটেবিল, মানুষপ্রমাণ দোলআয়না, সবই বেশ ছড়িয়ে-ছড়িয়ে সাজানো। মেঝের লতাপাতার স্কার্টিং যেন আলাদা একটা মাত্ৰা এনেছে সজ্জায়। শুধু হালফ্যাশনের স্ট্যান্ডে টিভিটাই যা খাপছাড়া।

ইসাবেল খাটে বসেছেন। পাশে জেসমিন। মিতিন সোজা সিন্দুকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, একবার খোলা যাবে কি?

অবশ্যই। গাউনের পকেট থেকে একজোড়া চাবি বের করলেন ইসাবেল। জেসমিনকে বললেন, দেখিয়ে দাও।

পুরু লোহার পাল্লার ভিতরভাগে অত্যাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সঠিক চাবি ছাড়া খোলার চেষ্টা করলে যা কিনা সশব্দে বেজে ওঠে। সিন্দুকের দুটো তাকই প্রায় শূন্য। ফাঁকা ভেলভেটের বাক্স, একখানা ডায়েরি, খুচখাচ কাগজপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। নীচে বন্ধ লকার। জেসমিন বলল, ওখানে টাকাপয়সা আর শেয়ারের সার্টিফিকেট থাকে। দেখবেন কি?

থাক। মিতিন নীল ভেলভেটের আধারখানা খুলে দেখল। আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, বাক্সটা কি এখানেই ছিল? না লকারে?

ইসাবেল বললেন, আমি তো সেফেই দেখেছি।

খোলা ছিল? না বন্ধ?

বন্ধই।

আচ্ছা আন্টি, হিরেটার কোনও ইনশিওরেন্স করানো হয়নি কেন বলতে পারেন?

শুনেছি আমার শ্বশুরমশাই একবার চেষ্টা করেছিলেন। ইনশিওরেন্স কোম্পানি নাকি খুব বেশি টাকার প্রিমিয়াম হাঁকে। শর্তও দেয় অনেক। কোথায় রাখতে হবে, কীভাবে রাখতে হবে…। শ্বশুরমশাই হিরে সিন্দুক থেকে সরাতে রাজি হননি। জোসেফও আর ও ব্যাপারে গা করেননি কোনও।

ও। মিতিন কথা বলতে বলতে ডায়েরিটা দেখছিল। হালকা বিস্ময়ের সুরে বলল, এ তো অনেক পুরনো! উনিশশো বাহাত্তর সালের।

ওটিও শ্বশুরমশাইয়ের। ওই বছরে তিনি মারা যান। জোসেফ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন।

হুঁ। ডায়েরিটা রেখে মিতিন এবার পায়ে-পায়ে এগোল দেওয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে। হ্যাট কোট পরা এক সুপুরুষ সাহেবের ফোটো। ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটির নীচে ছোট্ট শ্বেতপাথরের টেবিল, কাঠের চেয়ার। টেবিলে মোমদানিতে লাল বাটি-মোমবাতি। অর্ধেক জ্বলা বাতি থেকে মোম গলে টেবিলেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ছবিতে চোখ রেখে মিতিন বলল, ইনি নিশ্চয়ই মিস্টার আরাকিয়েল?

জেসমিন সিন্দুকের ডালা বন্ধ করে ইসাবেলকে চাবি দিয়েছে। পকেটে চাবি রাখতে-রাখতে ইসাবেল ঘাড় নাড়লেন, প্ৰায় কুড়ি বছর আগের। মধ্যবয়সে উনি যেন আরও রূপবান হয়েছিলেন।

ছবির নীচে মোমবাতি কে জ্বালান? আপনি?

হ্যাঁ। শুতে যাওয়ার আগে রোজ রাতে ওঁর ধ্যান করি। ওই চেয়ারে বসে।

সুন্দর-সুন্দর মোমবাতির সাপ্লায়ার কে? নিশ্চয়ই জেসমিন?

লাজুক হেসে জেসমিন বলল, অন্য কোনও মোমবাতি আন্টি ব্যবহারই করবেন না।

আপনার কারখানাটি কোথায়?

কারখানা-টারখানা আবার কী! নীচের একটা গ্যারাজে নিজে নিজেই বানাই। হঠাৎ বেশি অর্ডার এসে গেলে নির্মলা সাহায্য করে হাতে-হাতে।

কথোপকথনের মাঝে টুপুরের দৃষ্টি হঠাৎ অ্যাকোয়ারিয়ামে। দুটো রেডসোর্ড টেল মারামারি জুড়েছে। একটা ধাড়ি অ্যাঞ্জেল ভারিক্কি ভঙ্গিতে এসে ঝগড়া থামাল। জলে ভাসমান কাচের পাত্র থেকে পুটপাট কেঁচো খেয়ে চলেছে মলির ঝাঁক। গাপ্পি গোরামিনরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে আপন মনে। আশ্চৰ্য, এত কাণ্ডকারখানা চলছে জলে, অথচ জলের তলদেশ একদম স্থির। ঈষৎ সবজেটে জলে দুলছে ঝাঁঝি, ভাসছে জলজ উদ্ভিদ, মাছেরা হঠাৎ হঠাৎ ড়ুব দিচ্ছে তলায়, সব মিলিয়ে কী অপরূপ দৃশ্য। বদলে-বদলে যাচ্ছে দৃশ্যগুলো, প্রতি মুহূর্তে। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে চোখে যেন নেশা লেগে যায়।

সত্যি, কী নিশ্চিন্ত জীবন মাছেদের। চুরিচামারির বালাই নেই। শোকতাপ নেই। বাড়ির কর্তা মারা গিয়েছেন, তাই নিয়ে কোনও বিকারও নেই। দিব্যি মজাসে আছে।

আহা রে, মানুষের জীবনও যদি এমন হত।