২. কলকাতা শহরে সাইনবোর্ড

মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কলকাতা শহরে কত লক্ষ লক্ষ সাইনবোর্ড আছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

মিঃ সোম তার ছোট্ট সাইনবোর্ড ঝোলাবার সময় স্বপ্নেও ভাবেননি, এটি এত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

সবার হাতে বইখাতা না থাকলেও ওদের দেখেই মিঃ সোম বুঝলেন ওরা সবাই ছাত্রছাত্রী। ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসার পর বিয়ে হলে তাদের বন্ধুরা একটু বেশী উৎসাহী হবেই। বিয়ের নোটিশ দেবার সময় শুধু ছেলেটি ও মেয়েটির উপস্থিতি দরকার হলেও একালে বন্ধুবান্ধব আসা অস্বাভাবিক নয়।

মিঃ সোম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি সবাই বিয়ে করবেন?

ওঁর কথায় ছেলেমেয়েরা হেসে উঠল। দু-একটি ছেলেমেয়ের দিকে ইশারা করে জানতে চায়, আমাদের কাউকে পছন্দ হয়? মেয়েরা হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলে, না।

দুটি ছেলেমেয়ে মিঃ সোমের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটি বললো, আমরা বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছি।

মুহূর্তের জন্য ওদের দিকে তাকিয়েই মিঃ সোম মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার বসুন।

ওরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে বললে, আমাদের আপনি বলবেন না। আমরা আপনার চাইতে অনেক ছোট।

মিঃ সোম একটু খুশির হাসি হেসে বললেন, আজকাল আর ছাত্র ছাত্রীদের তুমি বলা নিরাপদ নয়।

ছেলেটি চেয়ারে বসে বললে, আপনি বোধহয় ঠিকই বলছেন, তবে আমাদের তুমি বললেই…

মেয়েটি বললো, আমরা তো আপনার প্রায় ছেলেমেয়ের বয়সী হবে।

মিঃ সোম কিছু বলার আগেই একটি ছেলে বললো, এটা কিন্তু লাভ ম্যারেজ নয়; এ বিয়ে আমরা ঠিক করেছি।

মিঃ সোম অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি?

এবার সামনের ছেলেটি বললো, আমাদের বন্ধুরাই এ বিয়ের ঘটকালি করেছে।

মিঃ সোম খুশিতে ঝলমল করে ওঠেন। বলেন, ভেরী গুড।

একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে সামনে টেনে এনে বললো, এই ইন্দিরাই এ বিয়ের ঘটকালি করেছে।

ইন্দিরা হাতজোড় করে নমস্কার করল। বললো, আপনার সঙ্গে পাত্রপাত্রীর পরিচয় করিয়ে দিই।…

হ্যাঁ, হ্যাঁ।…

ইন্দিরা আলতো করে ছেলেটির কাঁধে হাত দিয়ে বললো, সুবীর মুখার্জী। মেয়েটিকে দেখিয়ে বললো, নন্দিতা ব্যানার্জী। পঞ্জিকাতে কোন আইন লঙ্ঘন না করেই এদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।

ইন্দিরার কথায় সবাই হাসেন।

আরো একটু কথাবার্তার পর সুবীর আর নন্দিতা ফর্ম ভর্তি করে, ফর্মের নীচে সই করে।

মিঃ সোম বললেন, বিয়ের দিন তোমরা সবাই আমার এখানে মিষ্টি খেয়ে যাবে।

মাসখানেক পরে এই ছেলেমেয়েরা আবার এসে হাজির। সুবীর আর নন্দিতা বর-বৌ-এর মতো সেজেছে। দুজনের কপালেই চন্দনের ফোঁটা। ইন্দিরার হাতে দুটি মালা।

মিঃ সোম ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের থার্ড সিডিউলের ২১নং ধারা অনুযায়ী পাত্রপাত্রীর ডিক্লারেশন ফর্ম বের করলেন।

আই, শ্ৰীসুবীর মুখার্জী, হিয়ারবাই ডিক্লেয়ার অ্যাজ ফলোজ—

(১) আমি বর্তমানে অবিবাহিত,

(২) আমার বাইশ বছর বয়স হয়েছে,

(৩) কুমারী নন্দিতা ব্যানার্জীর সঙ্গে আমার নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়তা নেই,

(৪) আমি জানি এই ঘোষণায় মিথ্যা তথ্য থাকলে এবং…আমার জেল ও জরিমানা হতে পারে।

এর নীচে সুবীর মুখার্জী সই করল। অনুরূপ ঘোষণা করার পর নন্দিতাও সই করল। তারপর তিনজন সাক্ষী ও মিঃ সোম সই করলেন। তারপর ওঁর নির্দেশমতো সুবীর বললো, আই শ্ৰীসুবীর মুখার্জী টেক দি নন্দিতা ব্যানার্জী অ্যাজ মাই লফুল ওয়াইফ। নন্দিতা বললো, আমি নন্দিতা ব্যানার্জী,সুবীর মুখার্জীকে আইনসঙ্গত স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলাম।

তারপর মালাবদল হলো ও সুবীর নন্দিতার সিথিতে সিঁদুর দিল। হঠাৎ একজন শাঁখ বাজিয়ে সমস্ত পরিবেশটাকে আরো আনন্দময় করে তুললো।

সাবিত্রী এসব বিয়ের সময় বাইরের ঘরে আসেন না, তবে ওদের সবার অনুরোধে আজ শুধু উপস্থিতই ছিলেন না, বরণডালা দিয়ে বরণ করে আশীর্বাদও করলেন। সুবীর আর নন্দিতা মিঃ সোম আর সাবিত্রীকে প্রণাম করল।

এর ঠিক দিনতিনেক পরের কথা। মিঃ সোমের ছাত্রজীবনের বন্ধু দীপেন চ্যাটার্জী এসে হাজির।

মিঃ সোম খুশির হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার তোমার? তিন-চারখানা চিঠি দিয়েও…

দীপেনবাবু বললেন, তোমার সব চিঠিই পেয়েছি। কিন্তু জবাব দেবার মতো অবস্থা ছিল না।

কেন? কী হলো?

তোমার কপালে চিরযৌবনা স্ত্রী জুটলেও আমার কপালে…

মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, পরে আমার স্ত্রীর প্রশংসা করো। আগে বল বৌদির কী হয়েছিল?

আরে ভাই বলো না, হঠাৎ ওর চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করল।

তারপর?

তারপর হঠাৎ চোখ দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল।

বল কী?

হ্যাঁ ভাই। সে যে কী ঝামেলার মধ্যে কটা মাস কাটিয়েছি—

এখন কেমন আছেন?

শেষ পর্যন্ত পিনাকী রায়কে দেখিয়ে চশমা নেবার পর থেকে ভালই আছে।

আমার এক মাসতুতো ভাই তো প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাকেও পিনাকী রায় ভাল করে দিয়েছেন।

নর্থ বেঙ্গলে তো দূরের কথা, সারা বাংলাদেশে অমন চোখের ডাক্তার আছেন কিনা সন্দেহ।

সাবিত্রী বাথরুম থেকে বেবিযে এসে দীপেনবাবুকে দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, এত দিন পবে আমাদের মনে পড়ল।

দীপেনবাবু তার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলার পর বললেন, ছ-মাসের চেষ্টায় আজ কলকাতা এলাম।

এই এক বছবেব মধ্যে আব কলকাতা আসেননি?

না বৌদি। কলকাতায় এসে তো আপনাদের এখানে ছাড়া আর কোথাও উঠি না।

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর দুই বন্ধুতে বাইরের ঘরে বসে গল্প করছিলেন।

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা কবলেন, তুমি কি মামলামোকদ্দমার কাজে এসেছ?

না ভাই, এবার কোন মামলামোকদ্দমার কাজে আসি নি। এবার আমার এক ভগ্নীপতির কাজে এসেছি।

কী কাজ?

হালিশহরে আমার ভগ্নীপতির কিছু সম্পত্তি আছে। সেটা বিক্রির ব্যাপারে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এসেছি।

হঠাৎ হালিশহরের সম্পত্তি বিক্রি করছেন কেন?

আমার এই ভগ্নীপতি এককালে খুবই বড়লোক ছিল কিন্তু এখন বড়ই বিপদের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। হালিশহরের সম্পত্তি বিক্রি না করে ওর পক্ষে মেযের বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, অথচ–

অথচ কী?

এই হালিশহরের বাড়িভাড়া থেকে ওর তিন মেয়ের পড়াশুনার খরচা চলছে।

তাহলে কেন বিক্রি করছেন?

ওদের এমনই ফ্যামিলির ধারা যে মেয়ের বিয়ে দিতে অন্ততপক্ষে হাজার চল্লিশেক টাকা দরকার।

চল্লিশ হাজার?

হ্যাঁ ভাই। এর কমে ঐ ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হয় না।

হালিশহরের বাড়ি বিক্রি করে কত টাকা হবে?

বড় জোর পঞ্চাশ। দীপেনবাবু একটু থেমে বললেন, আমার দিদির তিনটি মেয়েই লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল। বড় মেয়েটি কলকাতায় এম. এ. পড়ছে, আর দুটি মেয়ে গৌহাটিতে পড়ছে। হালিশহরের বাড়ি বিক্রি হবার পর হয়ত ছোট মেয়ে দুটোর পড়াশুনোই বন্ধ হয়ে যাবে।

মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার ঠিকঠিকানা নেই।

হালিশহরের বাড়ি বিক্রি করে আমার এই বড় ভাগ্নীর বিয়ে হলে এই ফ্যামিলিটাও ধ্বংস হয়ে যাবে।

তবু ফ্যামিলি ট্রাডিশন রাখতে হবে?

হ্যাঁ ভাই। তা না রেখে বুঝি ওদের উপায় নেই।

একটু পরে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বড় ভাগ্নীর বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে?

না, ঠিক হয়নি, তবে সে ব্যাপারেও আমাকে একটা ছেলে দেখতে হবে।

ছেলে কি কলকাতায় থাকে?

হ্যাঁ, বেহালায় ওদের নিজেদের বাড়ি আছে।–

ছেলেটি কি করে?

একটা বড় প্রাইভেট কনসার্নে অ্যাসিসট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট। তবে নগদ চায় দশ হাজার।

দশ হাজার।

হ্যাঁ ভাই। যদি হাজার পাঁচেকে রাজী করাতে পারি, তাহলে বোধহয় এখানেই ভাগ্নীর বিয়ে ঠিক করে ফিরব।

কিন্তু এই ছেলের জন্য দশ হাজার?

ওঁরা বলছেন, গৌহাটিতে গিয়ে বিয়ে দিতে হলে অনেক খরচ—

ওঁদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে?

দীপেনবাবু তাড়াতাড়ি সুটকেশ থেকে একটা ফটো বের করে বললেন, তুমিই বলো, এ মেয়েকে কেউ অপছন্দ করবে?

ফটোটা দেখেই মিঃ সোম চমকে উঠলেন। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এইসব শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েরা যদি আমাদের মত ম্যারেজ অফিসারের কাছে এসে বিয়ে করে

তাহলে তো ফ্যামিলিটা রক্ষা পেতো, কিন্তু নন্দিতা সে ধরনের মেয়ে নয়।

মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর মিঃ সোম বললেন, একটা কথা বলব তোমাকে?

নিশ্চয়ই বলবে।

তুমি তোমার ভগ্নীপতির হালিশহরের সম্পত্তি বিক্রি করো না, বেহালাতেও যেতে হবে না।

কেন?

আমি কথা দিচ্ছি, এ মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা আমি করে দেব।

কিন্তু–

আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। এ মেয়েকে সৎ পাত্রের হাতে দেবার দায়িত্ব আমার।

কিন্তু যদি তুমি ফেল করো–

মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, চিন্তা করো না। এত বড় কলকাতা শহরে একটা ভদ্র শিক্ষিত ছেলে ঠিকই খুঁজে বের করব। একটু থেমে উনি বেশ জোরের সঙ্গে বলেন, এবং তুমি জেনে রাখো এমন ছেলের সঙ্গে তোমার ভাগ্নীর বিয়ে দেব, যে তোমার ভগ্নীপতির হাজার টাকাও খরচ করাবে না।

তুমি যদি তা পারো তাহলে সত্যি বড় উপকার হবে।

এর মধ্যে কোন যদি নেই, এ কাজ আমি করবই। মিঃ সোম একটু থেমে বললেন, তোমার ভগ্নীপতি ও ভাগ্নীর সব ডিটেলস আমাকে লিখে দিয়ে যাবে। আর তোমার ভাগ্নীকে আমার বিষয়ে কিছু বলল না, শুধু বলে যেও তোমার এক বন্ধু যোগাযোগ করতে পারে।

তোমার নামও বলব না?

না। হাজার হোক বিয়ের ব্যাপারে আগের থেকে কাউকেই সব কিছু না জানানোই ভাল।

তা ঠিক।

কলকাতার অন্যান্য কাজকর্ম সেরে দিন দুই পরে দীপেনবাবু কুচবিহার ফিরে গেলেন। তার পরের দিনই মি, সোম ম্যারেজ নোটিশ বুক থেকে সুবীরের ঠিকানা দেখে চিঠি দিলেন-তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে। একদিন সময় করে এসো। খুব খুশী হবে।

তিন-চারদিন পরেই সুবীরের জবাব এলো–আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভাল লাগল। ইতিমধ্যে আপনাদের সঙ্গে দেখা করা উচিত ছিল, কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম বলে যোগাযোগ করতে পারি নি। সেজন্য ক্ষমা করবেন। যাই হোক, রবিবার দুপুরে দুজনেই আসছি। মাসীমাকে বলবেন, দুপুরে দুজন খাবে।

.

রোজ ঠিকে ঝি মানদাই বাজার করে দেয়, কিন্তু রবিবার সকালে উঠেই মিঃ সোম নিজে বাজার গেলেন। শাকসবজি মাছভর্তিথলে রান্না ঘরের সামনে রেখে সাবিত্রীকে বললেন, হ্যাঁগো, আলুবখরা এনেছি।

খুব ভাল করেছ। তুমি বেরিয়ে যাবার পরই আমার মনে পড়ল।

খানিকটা পরে দুটি ছেলেমেয়ে এসে বিয়ের নোটিশ দিয়ে গেল। ওরা চলে যাবার দশ-পনের মিনিট পরেই সুবীর আর নন্দিতা এসে হাজির।…

বহুদিন পরে ছেলে আর পুত্রবধু এলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক সেই কম আনন্দে ঝলমল করে উঠলেন মিঃ সোম আর সাবিত্রী।

বাইরের ঘরের চেয়রে-টেবিলে না, ভিতরের ঘরে বিছানার উপর বসেই চা খেতে খেতে চারজনে মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেন। তারপর সাবিত্রী বললেন, তোমরা বাইরের ঘরে গিয়ে গল্প করে। আমি আর নন্দিতা রান্না সেরে নিই।

বাইরের ঘরে এসে ওঁরা দুজনে পাশাপাশি বসলেন। মিঃ সোম বললেন, একটু জরুরী কথাবার্তা বলার জন্যই তোমাকে ডেকে এনেছি।

সুবীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে ওর দিকে তাকাতেই উনি হেসে বললেন, না, না, চিন্তার কিছু নেই।

এবার সুবীর নিশ্চিন্ত হয়ে একটু হাসে। মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের বিয়েটা কিভাবে হলো?

সুবীর বলে, এককালে আসামের তিন-চারটে চায়ের বাগানের মালিক ছিলেন নন্দিতার বাবা-কাকারা। তারপর পারিবারিক শত্রুতার জন্য একে একে সব বাগান মারোয়াড়ীদের কাছে বিক্রি হয়ে গেল। এখন ওর বাবার অবস্থা সত্যি খুব খারাপ। সুবীর একটু হেসে বললো, আমাদের দেশে বা সমাজে অর্থ না থাকলেও ঐতিহ্য থাকে। এখন পারিবারিক মর্যাদা মত নন্দিতার বিয়ে দিতে হলে ওর বাবাকে সর্বস্ব খোয়াতে হতো।

তোমাদের এবিষয়ে সম্বন্ধ করলো কে?

ইন্দিরা গাঙ্গুলী। সুবীর একটু হেসে বললো, আমার ছোড়দির নাম ইন্দিরা। তাই ও আমার সঙ্গে পড়লেও ওকে আমি ছোড়দি বলি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ছোড়দি আর নন্দিতা হস্টেলের একই ঘরে থাকে।

তোমার বাবা কী করেন?

আমার বাবা মারা গিয়েছেন।……

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

বাড়ীতে আর কে কে আছেন?

দিদি ও ছোড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাড়ীতে আমি আর মা আছি।

তোমাদের সংসার কে চালান?

আমাদের বাড়ীটা নিজেদের। একতলার দুটি ফ্যামিলি ছাড়াও চারটি দোকানঘর আছে…

তাহলে ত ভাড়ার টাকাতেই সংসার চলে যায়।

আপনাদের আশীর্বাদে ভালভাবেই চলে যায়। এই বাড়ীভাড়া ছাড়াও বড় বড় কোম্পানির কিছু শেয়ার আছে।

তোমার বিয়ের কথা মা জানেন?

না, তবে মা জানেন, নন্দিতাকে বিয়ে করব।

মার মত আছে?

সুবীর হসে বললো, নন্দিতাকে মার খুব পছন্দ।

নন্দিতার বাবা-মাও নিশ্চয়ই বিয়ের কথা জানেন না?

না। আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার পর সবাইকে জানান হবে। সুবীর মুখ নীচু করে বললো, আমাদের বিয়ে হলেও আমরা আগের মতই আছি।

মিঃ সোম সুবীরের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, তুমি যে খাঁটি সোনা তা তোমাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম। একটু থেমে বললেন, তাহলে তোমার রেজাল্ট বেরুবার পর আনুষ্ঠানিক ভাবেই বিয়ে করো।

হ্যাঁ তাই করব।

সাবিত্রী আর নন্দিতা বাইরের ঘরে আসতেই মিঃ সোম বললেন, বসো। তারপর হাসতে হাসতে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেহালার একটি ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করার জন্য দীপেন কলকাতায় এসেছিল।……

নন্দিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ছোটমামার আসার খবর আপনি জানলেন কী করে?

সাবিত্রী হাসতে হাসতে বললেন, দীপেন ঠাকুরপো ওর ক্লাশ ফ্রেণ্ড। উনি কলকাতায় এলে সব সময় আমাদের এখানেই থাকেন।

নন্দিতা প্রায় চিৎকার করে উঠল, তাই নাকি?

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, দীপেন কী কী কাজে কলকাতা এসেছিল জানো?

নন্দিতা মাথা নেড়ে বললো, না।

তোমার বিয়ের জন্য তোমাদের হালিশহরের বাড়ী বিক্রি করতে আর বেহালার ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে পাকা করতে।

এতক্ষণ শোনার পর সুবীর জিজ্ঞাসা করল, উনি যে নন্দিতার মামা তা জানলেন কেমন করে?

দীপেনের কাছে নন্দিতার ফটো দেখেই……….

নন্দিতা বললো, ছবিটা না দেখলেই কেলেঙ্কারি হতো।

সাবিত্রী হাসতে হাসতে বললেন, দীপেন ঠাকুরপোকে উনি কথা দিয়েছেন তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।

সুবীর একটু হেসে নন্দিতাকে বললো, ভগবান আমাদের ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছেন।

.

প্রবীরবাবু আর সুমিত্রা ভি. আই. পি. রোডে থাকলেও মাঝে মাঝে আসেন। না এসে পারেন না।

সুমিত্রার হাতে মিষ্টির প্যাকেট দেখেই মিঃ সোম বলেন, দিদি, রোজ রোজ মিষ্টি নিয়ে আসা কী ঠিক হচ্ছে?

সুমিত্রা একটু কপট গাম্ভীর্য এনে বলেন, একশ-বার ঠিক হচ্ছে। মিষ্টি আনি বলে কি আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন?

না দিদি, সে সাহস নেই।

সাবিত্রী বলেন, জানো সুমিত্রা, তোমার দাদা এখন সব নেমন্তন্ন বাড়ীতেই তোমার ভাইফেঁটায় দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যাবেন আর সবাইকে বলবেন……….

সুমিত্রা কপালে হাত দিয়ে বলেন, হা ভগবান! ঐ ধুতি-পাঞ্জাবির কথা আবার সবাইকে বলেন?

মিঃ সোম বলেন, তুমি যেমন একশবার মিষ্টি আনবে, আমিও সেইরকম ধুতি-পাঞ্জাবির কথা একশবার সবাইকে বলব।

সুমিত্রা বললো, ঠিক আছে। সামনের বার আন্ডারওয়ার-গেঞ্জি দেব। দেখি, কি করে বলে বেড়ান।

তুমি দিতে পারলে আমিও বলতে পারব।

দেখতে দেখতে মিঃ সোমের এখানে কয়েক শ ছেলেমেয়ের বিয়ে হলো; কিন্তু এ ধরনের মধুর সম্পর্ক দু-চারজনের সঙ্গেই গড়ে উঠেছে।

বিয়ের পর সুমিত্রা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সাবিত্রীকে বলে, যখন নিঃসঙ্গ ছিলাম তখন বাধ্য হয়ে চাকরি করেছি। কিন্তু এখন আর টাকার লোভে চাকরি করতে ইচ্ছে করে না।

সাবিত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমর্থন জানান, ঠিক করেছ।

সুমিত্রা বলে, এর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সংসার করি নি।

সাবিত্রী ওর কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারেন না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুমিত্রার দিকে তাকাতেই ও বলে, যে মহাপুরুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, সে একদিনের জন্যও আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয় নি। তাছাড়া এত বেশী নেশা করতো যে, যখন ঘরে আসতো তখন তার কোন জ্ঞানই থাকত না।

সাবিত্রী বললেন, মাঝখান থেকে শুধু শুধু তোমার জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গেল।

তাছাড়া বাবার সারা জীবনের সঞ্চয় নষ্ট হলো। সুমিত্রা এবার একটু হেসে বললো, যাই বলল বৌদি। এখন আর আমার কোন দুঃখ নেই। প্রবীরকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়েছে।

সত্যি ঠাকুরপোর মত ছেলে হয় না।

আমি জানতাম, প্রবীর ভাল কিন্তু সতের বছর পর ওকে আবার নতুন করে পেয়ে বুঝলাম, ও অসাধারণ।

তা না হলে কেউ সতের বছর ধরে এইভাবে জীবন কাটাতে পারে?

সুমিত্রা একটু আনমনা হয়। উদাস দৃষ্টি দূরের, বহুদূরের আকাশের কোলে ঘোরাঘুরি করে। সাবিত্রী ওর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারে, সুমিত্রা কাছে বসেও দূরে চলে গেছে। ফেলে আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছে। কখনও খুশির হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল ভাস্বর হয়ে উঠছে; কখনও আবার ব্যথা-বেদনায় ম্লান হচ্ছে ঐ উজ্জ্বল সুন্দর মুখখানা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সাবিত্রী জিজ্ঞাসা করল, কী ভাবছ?

ভাবছি তোমার ঠাকুরপোর কথা। তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে যে বিয়ের পর তোমার ঠাকুরপোর ঘর করতে গিয়ে কী দেখলাম জানো?

কী?

দেখলাম, আলমারির মধ্যে সতেরটা শাড়ী রয়েছে।…

আচ্ছা।

ঐ শাড়ীগুলো কিসের জানো? কিসের?

আগে ও আমার জন্মদিনে প্রতি বছর একটা শাড়ী দিতো। যে সতের বছর আমাকে কাছে পায় নি, সেই সতের বছরেও আমার জন্মদিনে ও প্রতি বছর শাড়ী কিনেছে।

কী আশ্চর্য!

সুমিত্রা একটু হেসে বললো, আগে আগে আমরা দুজনে খুব থিয়েটার দেখতাম। তোমার ঠাকুরপো আমাকে কাছে পায় নি বলে একলা একলা একটাও থিয়েটার দেখে নি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ বৌদি। এই লোকটা আমার জন্য যে কী আত্মত্যাগ করেছে তা ভাবলেও অবাক লাগে।

এই আত্মত্যাগ করেছে বলেই তো ঠাকুরপো তোমাকে হারিয়েও আবার পেয়েছে।

আবার একটু চুপচাপ। আবার সুমিত্রা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।…

জানো বৌদি, মাঝে মাঝে হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি, তোমার ঠাকুরপো বসে আছে।

.

কী হলো? বসে আছো কেন?

প্রবীর একটু হেসে বললো, ঘুম আসছে না।

কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

না, না, শরীর খারাপ লাগছে না।

তবে?

তোমাকে দেখছি।

সুমিত্রা তাবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তার মানে?

প্রবীর সুমিত্রার মুখের সামনে মুখ নিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে একবার ওকে দেখে। তারপর বলে, হ্যাঁ মিত্রা, তোমাকে দেখতে এত ভাল লাগে যে কিছুতেই ঘুম আসে না।

তাই বলে রাত জেগে আমাকে দেখবে? হ্যাঁ। দেখে দেখে আশা মেটে না?

হ্যাঁ।

কেন?

দিনে আমরা সবাই দায়িত্ব-কর্তব্যের দাস। তাই তখন আমাদের আসল রূপটা দেখা যায় না। রাত্তিরেই মানুষের সৌন্দর্য।

সুমিত্রা হাসতে হাসতে বলে, তাই বলে এত রাত্রে আর আমার মত বুড়ীর সৌন্দর্য দেখতে হবে না। তাছাড়া এভাবে ক রাত্তির আমার সৌন্দর্য দেখলে তোমাকে আর সুস্থ থাকতে হচ্ছে না।

প্রবীর বলে, অসুস্থ হলে তো তোমাকে সব সময় কাছে পাবো।

.

সব শোনার পর সাবিত্রী বললেন, সত্যি ঠাকুরপো একটা আস্ত পাগল।

সুমিত্রা একটু আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বললো, তোমার ঠাকুরপো সত্যিই পাগল! একটু থেমে, একটু এদিক-ওদিক দেখে, একটু চাপা গলায় বললো, সারা রাত ঠিক বাচ্চা ছেলের মত আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকবে। সকালবেলায় ঘুম ভাঙ্গার পর ওকে ঐভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ মায়া হয়।

সাবিত্রী বলেন, ঠাকুরপো সম্পর্কে তোমার দাদাও ঠিক ঐ কথাই বলেন।

দাদা কি বলেন?

বলেন, প্রবীরের চোখ দুটো দেখলেই ভীষণ মায়া হয়।…

আর কি বলেন?

বলেন, প্রবীরের বয়স হয়েছে, কিন্তু তবু ওকে ছোট ছেলের মত আদর করতে ইচ্ছে করে।

দাদাকে ও দারুণ শ্রদ্ধা করে।

সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

অফিসের কাজের জন্য প্রবীরবাবু বেশী দিন আসতে না পারলে সুমিত্রা একলাই চলে আসে। বিকেলের দিকে অফিসছুটির পর প্রবীরবাবু এখান থেকে সুমিত্রাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

সুমিত্রা এলে সারা দুপুর সাবিত্রীর সঙ্গে গল্প হবেই।

জানো বৌদি, যে মেয়েয়া কোনদিন কাউকে ভালবাসেনি বা কারুর ভালবাসা পায়নি তারা যে কোন পুরুষের কাছে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমার মত মেয়েরা তা পারে না।

সাবিত্রী বলেন, প্রবীরবাবু সত্যি অপূর্ব মানুষ।

আমি তো ভগবানের চাইতেও ওকে বেশী ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি।

নিশ্চয়ই করবে।

সুমিত্রা একটু হেসে বলে, আমি ওকে কি বলি জানো?

কি?

বলি, রামচন্দ্র চোদ্দ বছর বনবাসে গিয়েছিলেন বলেই যদি রামায়ণ লেখা যায়, তাহলে তুমি আমার জন্য কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছ বলে রামায়ণের চাইতে বড় কিছু লেখা যায়।

সাবিত্রী একটু হেসে জিজ্ঞাসা করেন, প্রবীরবাবু কী বলেন?

সুমিত্রাও হাসে। বলে, ও বলে, সে মহারামায়ণ আমাকেই লিখতে হবে, আমাকেই পড়তে হবে।

এবার সাবিত্রী একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমার মত মেয়েকে ভালবেসেছিলেন বলেই উনি কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছিলেন।

তার মানে?

এই বয়সেও তোমার রূপ দেখে অনেক পুরুষেরই মাথা ঘুরে যাবে।

সুমিত্রা একটু লজ্জিত বোধ করে। বলে, তা তো বটেই।

সাবিত্রী ওর গাল টিপে বলেন, এমন সর্বনাশা রূপসীর প্রেমে পড়লে কি কোন পুরুষের বাঁচার উপায় থাকে?

.

সুমিত্রা এলে সাবিত্রীর আর কাজে মন লাগে না। কোন মতে কাজকর্ম করেই গল্প করবে। সুমিত্রার সঙ্গে গল্প করতে ওর এতই ভাল লাগে যে রমেনবাবু একটু বেশী বাজার করলেই উনি বলেন, আচ্ছা, তুমি কী ভেবেছ বল তো?

রমেনবাবু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, আমি আবার কী করলাম?

আমাকে না বলেই এত মাছ আনলে কেন?

এবার রমেনবাবু হেসে বলেন, রোজ রোজ তো এসব মাছ পাওয়া যায় না। তাছাড় দিদি এসেছে…

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সাবিত্রী স্বগতোক্তি করেন, কোথায় একটু গল্পগুজব করব। তা না! এখন আমাকে সারাদিন এই রান্নাঘরের মধ্যে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে।

রমেনবাবু তখনও হাসেন। বলেন, তুমি একলা একলা রাঁধবে কেন? দিদিও নিশ্চয়ই কিছু রাঁধবে।

তোমার দিদি যদি রান্নাঘরে থাকে, তাহলে কী আমি চেয়ার টেবিলের সঙ্গে গল্প করব?

দিদি যখন রান্নাঘরে কাজ করবে, তখন তুমি আমার সঙ্গে গল্প করবে।

সুমিত্রা বাথরুম থেকে স্নান করে বেরিয়েই বলে, হ্যাঁ বৌদি, তুমি দাদার সঙ্গে গল্প করো। আমি রান্না করে দেব।

সাবিত্রী হেসে বলে, তোমার দাদার ন্যাকামির কথা বাদ দাও। মাঝে মাঝে তোমার দাদা এমন ঢং দেখায় যে…….

সাবিত্রীর কথা শুনে সুমিত্রা হাসে। রমেনবাবু সুমিত্রার সামনে এইসব কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করেন, লজ্জিত হন। তাই বলেন, বলছিলাম, অনেক দিন তত দিদির হাতের রান্না খাই না, তাই…

সুমিত্রা বলে, তুমি যাই বলল বৌদি, আজ আমি তোমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না।

সুমিত্রা-প্রবীরবাবুর বিয়ের পর শুধু ওদের জীবনেই নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় নি; ওদের বিয়ের পর ম্যারেজ রেজিস্ট্রার রমেন সোম ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীর জীবনেও আনন্দের জোয়ার এসেছে।

.

এখন রমেন সোমের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। জীবনে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পরই উনি ম্যারেজ অফিসার হন, কিন্তু এই নতুন ভূমিকায় স্বল্পকালীন সময়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তা বহু মানুষ সারা জীবনেও সঞ্চয় করতে পারে না।

এক দল ছেলেকে সঙ্গে এনে যেদিন দিলীপ আর মায়া বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছিল, সেদিনই ওর একটু খটকা লেগেছিল। তবে আইন অনুসারে যে কোন আঠারো বছরের মেয়ে আর একুশ বছরের ছেলে নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করতে পারে বলে উনি কিছু বলেননি। নোটিশ দেবার ঠিক এক মাস পরে যেদিন ওরা বিয়ে করল, সেদিনও মিঃ সোম কোন আগ্রহ দেখান নি। আইনমত কর্তব্য সম্পাদন করে সার্টিফিকেট দিয়েছেন, আমি রমেন্দ্রনাথ সোম এতদ্বারা নিশ্চিতভাবে জানাইতেছি যে……শ্রীদিলীপ ঘোষ ও শ্ৰীমতী মায়া ঘোষ (বসু) আমার সামনে হাজির হন এবং নীচে স্বাক্ষরিত তিনজন সাক্ষী সমক্ষে ১১নং ধারা অনুযায়ী ঘোষণা করিবার পর আইনানুসারে আমার সামনে উহাদের বিবাহ সম্পাদিত হয়।

এই বিয়ে হবার কয়েক দিন পরে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে হাজির।

আমার নাম নিবারণ ঘোষ। একটু বিপদে পড়েই আপনার কাছে এসেছি।

মিঃ সোম বললেন, বলুন, আমি কি করতে পারি।

আপনি রেজিস্ট্রি বিয়ে দেন?

মিঃ সোম শুধু মাথা নাড়লেন।

ইদানীংকালে শিবনাথ ঘোষ নামে কোন ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?

মিঃ সোম রেজিস্ট্রার দেখে বললেন, না, ঐ নামের কোন ছেলের বিয়ে আমি দিইনি।

নিবারণবাবু বেশ মুষড়ে পড়লেন। বললেন, দেননি। কিন্তু পাড়ায় রটেছে…….

কী রটেছে?

আপনার এখানেই সমার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে।

মিঃ সোম আবার ভাল করে রেজিস্ট্রার দেখে বললেন, রমা নামের কোন মেয়ের বিয়েও তো আমার এখানে হয়নি।

নিবারণবাবু মাথা নীচু করে কি যেন ভাবেন।

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিন আগে ওদের বিয়ে হয়েছে বলতে পারেন?

কবে বিয়ে হয়েছে তা তো বলতে পারব না, তবে কবে পালিয়েছে তা বলতে পারি।

কবে পালিয়েছে?

গত রবিবার ভোরে।

মিঃ সোম রেজিস্ট্রার খুলে বললেন, গত শুক্রবার ওই মে আমার এখানে দিলীপ ঘোষের সঙ্গে মায়া বসুর বিয়ে হয়েছে।…….

দিলীপ ঘোষ? মেয়েটির নাম কী বললেন?

মায়া বসু।

না, না, ও না।

শিবনাথ কাকে নিয়ে পালিয়েছে?

সম্পর্কে আমার এক জ্ঞাতি বোন রমা মিত্তিরকে নিয়ে পালিয়েছে। নিবারণবাবু একটু থেমে বললেন, সব চাইতে বড় কথা সামনের জ্যৈষ্ঠে রমার বিয়ের ঠিক হয়েছে।

হঠাৎ রেজিস্ট্রারের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মিঃ সোম বললেন, আচ্ছা সাক্ষীদের নাম বলছি। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা। জ্যোতি চক্রবর্তী, নন্দদুলাল দে আর কমল রায়।

নিবারণবাবু ঠোঁট উল্টে বললেন, না, ওদের কাউকেই চিনতে পারলাম না।

এবার মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি শিবনাথ আর রমার হাতের লেখা চিনতে পারবেন?

শিবনাথের হাতের লেখা চিনতে পারব, কিন্তু রমার হাতের লেখা তো চিনতে পারব না।

মিঃ সোম বিয়ের নোটিশ দেবার ফর্মের বাণ্ডিলটা বের করে দিলীপ ঘোষের এ্যাপ্লিকেশনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা।

নিবারণবার পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে দিয়ে একটু ঝুঁকে পড়েই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ত শিবুর হাতের লেখা।

এবার মিঃ সোম হেসে বললেন, তাহলে আপনার ছেলে সবকিছু মিথ্যা বলে ঐ রমাকেই বিয়ে করেছে।

তাহলে উপায়?

পুলিশে রিপোর্ট করুন। বিচারে ওদের দুজনেরই জেল হবে।

কিন্তু……

কিন্তু কী?

তাতে তো আমি বাঁচতে পারব না। ঐ মেয়েটার বাবা-মাকে আমি কি বলব? নিবারণবাবু খুব জোরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপন মনেই বললেন, অত গহনাগাটি কোথা থেকে আমি পাবো?

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা কী অনেক গহনা-টহনা নিয়ে গেছে।

আর বলবেন না। হারামজাদা আমাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এবার মুখ তুলে মিঃ সোমের দিকে তাকিয়ে বললেন, রমার মার পঁচিশ-তিরিশ ভরি গহনা আমার স্ত্রীর কাছে ছিল। তার একটাও ওরা রেখে যায়নি।

আপনি কি পুলিশে রিপোর্ট করতে চান না?

পুলিশে রিপোর্ট করে আর কি হবে? যে কেলেঙ্কারি, যে সর্বনাশ হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন উপরে থুথু ফেললে তো নিজের গায়ে এসেই পড়বে।

তা ঠিক।

নিবারণবাবুকে দেখলেই মনে হয়, অত্যন্ত সৎ ও সহজ সরল মানুষ। গলায় তুলসীর মালা প্রমাণ করছে, ভদ্রলোক বৈষ্ণব। ধার্মিক। চোখমুখের চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, ছেলের কাণ্ড কারখানায় উনি হতবাক হয়ে গেছেন। মিঃ সোম ওকে যত দেখেন, তত বিষণ্ণ হন মনে মনে। কিন্তু ওকে সাহায্য করতে না পেরে আরো বেশী বিষণ্ণ, আরো বেশী অসহায় বোধ করেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নিবারণবাবু কোন কথা না বলে চোরের মত মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আইন বড় নির্দয়। আইনের নির্দেশমত কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মনের মধ্যে আরো অনেকবার কালবৈশাখীর মাতলামি হয়েছে, কিন্তু কিছু করতে পারেননি। মুখ বুজে কর্তব্য পালন করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *