২.১৬-১৯ উঠে দাঁড়ালো এণ্ড্রি

২.১৬

এরপরই উঠে দাঁড়ালো এণ্ড্রি। জজের দিকে চেয়ে বললো, আত্মপক্ষ-সমর্থনকারী ভদ্রলোকগণ…

জনৈক জজ বেগে চেঁচিয়ে বললেন, তোমার সামনে আদালত, আত্মপক্ষ-সমর্থনকারী ভদ্রলোকগণ নয়।

এণ্ড্রি মাথা দুলিয়ে বললো, তাই নাকি? আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। আমি দেখছি, আপনারা বিচারক নন, বিবাদী মাত্র।

বাজে না ব’কে মামলার কথা বল!

মামলার কথা? বহুৎ আচ্ছা। আমি জোর ক’রে মনে ক’রে নিলুম যে আপনারা সত্যি-সত্যি জজ, সাধু স্বাধীনচেতা পুরুষ…

আদালত তোমার এসব সার্টিফিকেট চায় না।

এসব চায় না? আচ্ছা, আমি বলে যাচ্ছি। আপনারা হচ্ছেন স্বাধীন মানুষ—আত্ম-পর ভেদ নেই। এখন, আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছে দু’পক্ষ : একদল নালিশ জানাচ্ছে, ও আমাব যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন কয়ে নিয়েছে, আমার সর্বনাশ করেছে। আর একদল জবাব দিচ্ছে, আমার লুঠন করার এবং সর্বনাশ করার অধিকার আছে; কারণ আমি সশস্ত্র…

দয়া করে গালগল্প রাখো।

সে কি! আমি তো শুনেছি বুড়োর গালগল্পের বড্ডো ভক্ত।

তোমার মুখ বন্ধ করে দেব। মামলার কথা বলো…রসরঙ্গ না করে।

মামলার কথা! কিন্তু বেশি কি আর বলবো। যা বলবার তা তো আমার কমরেডরাই বলেছে। বাকি যা তা বলবারও দিন আসছে। তা বলা হবে…দিন আসছে যখন…

আমি তোমাকে কথা বলতে নিষেধ করছি। ভ্যাসিলি শ্যাময়লভ…

শ্যাময়লভ উঠে তার কোকড়া চুল নেড়ে বললো, সরকারি উকিল আমাদের সঙ্গীদের বলেছেন, অসভ্য, সভ্যতার শত্রু…আমি জিগ্যেস করি, আপনাদের এই সভ্যতা চিজটা কেমন?

তোমার সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি আমরা। কাজের কথা বল।

শ্যাময়লভ সে কথা কানে না তুলে বলতে লাগলো, আপনারা গোয়েন্দা পোষেন, মা-বোনদের পথভ্রষ্ট করেন। মানুষকে এমন অবস্থায় ফেলেন যে, সে চুরি করতে, খুন করতে বাধ্য হয়। তাকে আপনারা নষ্ট করেন মদ দিয়ে…আন্তর্জাতিক হত্যা-ব্যবসায় দিয়ে, বিশ্বব্যাপী মিথ্যা, হীনতা এবং বর্বরতা দিয়ে এই তো আপনাদের সভ্যতা… হাঁ, আমরা শত্রু…এ-সভ্যতার শত্রু।…

জজ উচ্চকণ্ঠে তাকে নিষেধ করলো, কিন্তু শ্যাময়লভ যেন আরো জ্বলে উঠলো, কিন্তু আমরা শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি আর একটা সভ্যতাকে, যার স্রষ্টাদের আপনারা নির্যাতিত কবেছেন, জেলে পচিয়ে মেরেছেন, পাগল করে দিয়েছেন,…

জজ তাকে বসিয়ে দিলেন।

কিছুক্ষণ পরে বিচার সাঙ্গ হলো। দণ্ড হলো—সাইবেরিয়ায় নির্বাসন সকলের। চোখের জলের মধ্য দিয়ে আত্মীয়-বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আসামীরা রক্ষীদের সঙ্গে আদালত হতে বেরিয়ে গেলো।

.

মাও ধীরে ধীবে আদালতের বাইরে এলেন। তখন রাত হয়ে গেছে। দলে দলে নরনারী এসে তাকে অভিনন্দিত কবলো। শশেংকা এসে পেভেলের কথা জিগ্যেস করলো। মা সকল প্রশ্নের জবাব দিলেন ধীরে, স্থিরভাবে। তিনি ভাবছিলেন, পেভেল, গেলে এই বার আমার পালা। আমারও এমনি বিচার হবে, নির্বাসন হবে। আমি তখন শুধু একটি আবেদন করবো, সে হচ্ছে পেভেল যেখানে থাকবে, আমায় যেন সেইখানে নির্বাসিত করে।

.

২.১৭

বাড়িতে এসে মা এবং শশা দু’জনে বসে বুনছে ভবিষ্যতের স্বপ্নজাল। পেভেলের শশার বিয়ে হবে ছেলে হবে…মা নাতিকে আদর করবেন…পেভেল বাঁধা পড়তে চাইবে না…কাজের তাগিদে দূরে চলে যেতে চাইবে শশা বাধা দেবে না…সে হবে যোগ্যা সঙ্গিনী…স্বামীর সহায় … বাধা নয়… এমনি আরো কত কি!

হঠাৎ আইভানোভিচ এসে ঘরে ঢুকলো। বললো, তোমরা এখান থেকে পালাও…নইলে ধরা পড়বে। গোয়েন্দা যেমন ভাবে আমার পিছু নিয়েছে তাতে খুব সম্ভব আমি শীগগিরই গ্রেপ্তার হবো। এই পেভেলের বক্তৃতা…ছাপানো দরকার…নিয়ে লুকিয়ে রাখো…আইভানকে দিয়ো…বলে একখানা কাগজ মার হাতে দিলো।

মা বললেন, আমায় ধরবে?

নিশ্চয় এবং তাতে অনেক কাজের ব্যাঘাত হবে। তুমি বরং লিউদমিলার কাছে যাও।…কাল ভোরে একটা ছেলে পাঠিয়ে খবব নিয়ো, আমি আছি কি নেই।

মা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পথে। শশা অনেক দূর তার সঙ্গে গেলো, বললো, চমৎকার এই আইভানোভিচ। মরণ যখন ডাক দেবে, তখনো ও চলবে এমনি সহজ শান্তভাবে। চশমাটা ঠিক করতে করতে শুধু বলবে, তোফা, তারপর মরবে।

মা, বললেন, আমি ওকে বড় ভালোবাসি।

শশা বললো, আমি অবাক হই। ভালোবাসা? না,–আমি ওকে শ্রদ্ধা করি। কাটখোট্টা সাদা-সিধে বাইরের অভ্যন্তরে একখানি কোমল অন্তঃকরণ…

তারপর হঠাৎ সে প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলে উঠলো, মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে। যাই, মা…গোয়েন্দা পিছু নিয়েছে বুঝলে লিউদমিলার ঘরে ঢুকো না।…

শশা চলে গেলো!

মা লিউদমিলার কাছে এসে কাগজটা তার হাতে দিলেন। তারপর আইভানোভিচের কাহিনী বললেন খুলে…কেমন করে সে গ্রেপ্তারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

লিউদমিলার চোখে-মুথে এসে পড়েছে অগ্নির রক্তিমাভা। স্থির কণ্ঠে সে বললো, কিন্তু আমার কাছে যখন তারা আসবে, আমি গুলি করবো। ধরা দোবনা। অত্যাচার হতে আত্মরক্ষা করার অধিকার আমার আছে। অন্যকে যখন যুদ্ধে উত্তেজিত করছি, তখন আমিও যুদ্ধ করবে। শান্তির অর্থ আমি বুঝিনে…শান্তি আমি চাইনে। … মা ধীরে ধীরে বলেন, তোমার কাছে জীবন তাহলে সুখপ্রদ হবেনা, মা।

লিউদমিলা সে কথার জবাব না দিয়ে পেভেলের বক্ততাটা পড়ে গেলো, বললো, বেশ! আমি এই-ই চাই, কিন্তু এতেও দেখছি শান্তির কথা আছে। এ যেন গোরস্থানে ডঙ্কা-নিনাদ–যদিও ডঙ্কাবাদক শক্তিমান।

তারপর পেভেলের কথা তুলে বললো, চমৎকার লোক, মহাপ্রাণ কিন্তু এমন ছেলে পাওয়া যেমনই গৌরবের তেমনি ভয়ের।

মা বলেন, গৌরবেরই, মা। ভয় আর কিছু নেই।

.

২.১৮

পরদিন জানা গেল, আইভানোভিচ ধরা পড়েছে। ডাক্তার আইভানও এসে পড়লো কিছুকালের মধ্যে। বললো, মা, তুমি এখানে? তোমাকেও খুঁজছিল। আইভানোভিচ আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলো।

তাতে বিপদ কাটানো যাবেনা, মা। সে যাক। জনকয়েক ছেলে কাল পেভেলের বক্তৃতাটা হেকটোগ্রাফে পাঁচশ কপি ছাপিয়েছে…শহরে ছড়াতে চেয়েছিল। আমি তার বিরুদ্ধে–ছাপানো কপি শহরে ছড়ানো ভালো…এগুলো অন্যত্র পাঠানো যাবে।

মা সোৎসাহে বললেন, আমায় দাও, আমি ন্যাটাশাকে দিয়ে আসছি।

ডাক্তার বললেন, এখন তোমার একাজ করতে যাওয়া ভালো হবে কিনা জানিনে। এখন বারোটা, দুটো পাঁচে গাড়ি। পৌঁছাবে পাঁচটা পনেরোয়—সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছুবে, দেরি তেমন হবে না। কিন্তু কথা তা নয়।

কথাটা কি? কাজটা ভালোভাবে হাঁসিল করা, এই তো! তা আমি পারবো।

লিউদমিলা বলো, কিন্তু তোমার পক্ষে এ বিপজ্জনক।

কেন?

ডাক্তার বললেন, কারণ হচ্ছে এই—আইভানোভিচ ধরা পড়ার এক ঘণ্টা আগে তুমি উধাও হয়েছো; তারপর মিলে তুমিও গেলে আর ইস্তাহারের আবির্ভাব হলে।…

মা জেদ করে বললেন, না আমি যাবো। ফিরে এলে যখন ধরতে আসবে, তখন একটা-কিছু বলে তাদের ফেরাতে পারব।

ডাক্তার বলেন, বেশ তাই হক। স্টেশনে বসে ইস্তাহার পাবে। ডাক্তার চলে যেতে লিউদমিলা বললেন, চমৎকার তুমি, মা। আমারও এক ছেলে আছে…তেরো বছর তার বয়স, কিন্তু সে আজ থেকেও নেই। তার বাপ… আমার স্বামী সহকারী সরকারি উকিল। হয়তো এদ্দিনে সবকাবী উকিল হয়ে গেছেন। ছেলে তার সঙ্গে। ছেলে কেমন হবে সময় সময় ভাবি।… যাদের আমি সেরা মানুষ বলে মনে কবি তাদের শত্রু যে, তার হাতে পড়েছে আমার ছেলে। আমার কাছে থাকতে পারছে না। আমি আছি এক ছদ্মনামে। আট বছর তাকে দেখিনা, আট বছর…

ধীরে ধীবে জানালার কাছে যেয়ে বাইরে ম্লান আকাশের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, সে যদি আমার সঙ্গে থাকতো, কত জোর পেতাম আমি। বুকে সর্বক্ষণ এই ব্যথাটা লেগে থাকতোনা।…এর চেয়ে যদি মরতোও সে, আমার পক্ষে তাও সওয়া ববঞ্চ সহজ হতো। জানতাম সে মৃত, কিন্তু শত্রু নয়। মাতৃস্নেহের চাইতেও যা মহৎ, যা প্রিয়ত, যা বেশি দরকার সেই ব্ৰতের শত্রু নয়।

আহা মা…বলে মা লিউদমিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

লিউদমিল তেমনি তদগতভাবে বললো, হাঁ, তুমি সুখী, মা তুমি সুখী। কী মহান দৃশ্য–মা আর ছেলে একসাথে, পাশাপাশি এ খুব কম মেলে।

মা যেন নিজের অজ্ঞাতে বলে ফেললেন, হাঁ, মা, এত সুন্দর…অভিনব…এ যেন এক নবীন জীবন। তোমরা সবাই সত্যপথের যাত্রীদল পাশাপাশি চলেছো…যাদের আগে দেখিনি, তারা হঠাৎ যেন পরম আত্মীয় হয়ে গেছে। সব কথা আমি বুঝি না, কিন্তু এটা বুঝি, মা…বুঝি ছেলেরা দুনিয়ার পথ বেয়ে এগোচ্ছে সকলে একটি লক্ষ্যের দিকে সমস্ত অন্যায়কে পায়ে দলে, সমস্ত অন্ধকারকে দূরীভূত করে, সমস্ত তত্ত্বকে আয়ত্ত করে, সমস্ত মানুষের পক্ষ নিয়ে তারা এগিয়ে চলেছে। তরুণ তারা, শক্তিমান তাব, তাদের অদম্য শক্তি নিয়োজিত হচ্ছে, এক উদ্দেশ্য সাধনে, সে হচ্ছে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। মানুষের সকল দুঃখকে তারা জয় করতে চলেছে। পৃথিবীর বুক হতে দুঃখকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য তারা অস্ত্রধারণ করছে, যা-কিছু বীভৎস তা দমন করতে বেরিয়েছে তারা, দমন করবে। একজন বলেছিল আমায়, আমরা এক নতুন সূর্য প্রজালিত কববোহ, তারা তা করবে। সমস্ত জীবনকে এক প্রাণে গাথবে তারা, সমস্ত ছিন্ন হৃদয়কে একত্র সম্মিলিত করবে তারা। জীবনকে শুদ্ধ, পবিত্র, উজ্জ্বল করবে তারা। …

ভাবে তন্ময় হয়ে মা আকাশের দিয়ে আঙুল তুলে বললেন, ঐ সেই সূর্য-গৌববময় স্বর্ণ-সুষমাদীপ্ত মানুষের সুখ-সূর্য। সমস্ত ভুবনকে চিরকালের জন্য উজ্জ্বল করে রাখবে এ…পৃথিবীর সবাই, সমস্তখানি দীপ্ত হবে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমে, বিশ্বের সমস্ত কিছুর ওপর মানুষের প্রীতিতে।…এই সত্য এবং যুক্তি-পন্থীরা সকলের কাছে ব’য়ে নিয়ে যাবে প্রেমের আলোক। সমগ্র দুনিয়াকে ছেয়ে ফেলবে তারা এক নতুন মাশমানে, সমস্ত কিছুকে ভাস্বর কবে তুলবে তারা অন্তরের অনির্বাণ জ্যোতিতে, নবযাত্রীদের এই বিশ্বপ্রেম হতে, উদ্ভুত হবে এক নবজীবন। কে নির্বাণ করবে এ শক্তিকে? কোন্ শক্তি এর চাইতে মহত্তর? কে দমিত করবে এ শক্তিকে? পৃথিবী এর জন্ম দিয়েছে, সমস্ত মানুষ এর জয়-কামনা করেছে! রক্তের নদীশুধু তা কেন, সমুদ্র বইয়ে দাও, এ নিভবে না।…

লিউদমিলার হাত ধরে তিনি বললেন, মা, মানুষের কাঙ্ক্ষিত আলোক যে তার নিজের মধ্যেই আছে, একথা জানা যে কতো হিতকর তা তোমায় কি করে বলবো! এমন দিন আসবে যখন মানুষ এটা বুঝবে, মানুষের প্রাণ সে আলোকে মণ্ডিত হবে। এব অনির্বাণ শিখায় সকলের প্রাণ জ্বলে উঠবে। পৃথিবীতে আজ জন্ম নিয়েছে এক নব দেবতা–সে দেবতা মানুষ…সমস্তের জন্য সমস্ত-কিছু, সমস্ত-কিছুর জন্য সমস্ত, প্রত্যেকের জন্য ষোলো-আনা জীবন, ষোলো-আনা জীবনের জন্য প্রত্যেকে… এমনিভাবে আমি তোমাদের সবাইকে বুঝেছি। এই দুনিয়ায় তোমাদের আবির্ভাব এরি জন্য। সত্যি-সত্যিইতোমরা সবাই কমরেড, আত্মীয়, সাথী, কারণ তোমরা সবাই সত্যের সন্তান…সত্য তোমাদের জনম দিয়েছে—সত্যের দৌলতে তোমরা বেঁচে আছছা যখনই নিজের মনে উচ্চারণ করি, কমরেড, তখনই যেন প্রাণ দিয়ে শুনি,তোমর যাত্রা করেছে: সর্বস্থান হতে… দলেদলে …একই কার্যের সঙ্কল্প নিয়ে। কানে যেন ভেসে আসে মত্ত হর্ষধ্বনি। দুনিয়ার সমস্ত মন্দিরের সব কটা ঘন্টা যেন একসঙ্গে বেজে উঠেছে অপূর্ব এক উৎসব-সমাববাহে।

লিউদমিলা আশ্চর্য হয়ে মার মুখের দিকে চেয়ে বললো, অপূর্ব, এ যেন উচ্চগিরিশিরে সূর্যোদয়।

.

২.১৯

সময় মত মা স্টেশনে গিয়ে হাজির হলেন। একটি যুবক ইস্তাহার, ভরা একটা হলদে ব্যাগ দিয়ে গেলো তার কাছে। মা একটা বেঞ্চিতে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

গোয়েন্দারাও নিশ্চিন্ত ছিলোনা। তারা মার চারদিকে এসে জড়ো হ’ল, এক বুড়ো তার দিকে চাইলো ক্রোধ-রক্তিম দৃষ্টিতে। মা তার দিকে চেয়ে সংযতকণ্ঠে বললেন, কি চাও তুমি?

কিছু না।

একজন বলে উঠলো…বুড়ি—চোর কোথাকার।

আমি চোর নই, মা গর্জন কবে উঠলেন।

দেখতে দেখতে চারপাশে বেশ একটা ভিড় জমে গেলো।

কি, কি, ব্যাপার কি?

একটা গোয়েন্দা।

চোর…

কে, ঐ বুড়ি?

চোর হলে কখনো চেঁচায়?

মা জোর গলায় বলেন, আমি চোর নই। কাল ওরা রাজনৈতিক আসামীদের বিচার করেছে। তাদের মধ্যে একজন…পেভেল একটা বক্তৃতা দিয়েছিলো…এই সেই বক্তৃতা… আমি লোকদের কাছে তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যাতে তারা এ পড়ে সত্য চিন্তা করে। এই বলে কাগজ বের করে উঁচুতে দুলিয়ে ভিড়ের মধ্যে ফেলে দিলেন।

একজন বলে উঠলো, এতে বখশিস যা মিলবে তা বিশেষ লোভনীয় নয়।

হাঁ।

মা দেখলেন, সবাই কাগজ হাতাহাতি করে নিয়ে পকেটে, বুকে গুঁজে রাখতে লাগলো। উৎসাহিত হয়ে আরো কাগজ ছড়াতে ছড়াতে বললেন, এর জন্য, মানুষের কাছে এই পবিত্র সত্য প্রচার করার জন্য, আমার ছেলে এবং তার কমরেডরা নির্বাসিত হয়েছে।

বিস্মিত, মুগ্ধ শ্রোতৃমণ্ডলী আরো চেপে দাঁড়ালে মার দিকে। ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। মা বলতে লাগলেন, দারিদ্র্য, অনশন, ব্যাধি… শ্রম করে গরীবের লাভ হয় এই। সমাজের এই ব্যবস্থা আমাদের ঠেলে দেয় চুরির দিকে, অন্যায়ের দিকে। আর আমাদের মাথার ওপর বসে আছে ধনীরা শান্তিতে এবং তৃপ্তিতে। যাতে আমরা তাদের বাধ্য থাকি তাই তাদেরই হাতে পুলিস, সরকার সৈন্য-সামন্ত সব-কিছু! সবাই আমাদের বিরুদ্ধে, সব-কিছু আমাদের প্রতিকূলে। আমাদের জীবন আমরা নষ্ট করে চলেছি দিনের পর দিন শ্রমে…নোঙরামীতে…প্রবঞ্চনায়। আর ওর মজা লুঠছে, রাজভোগ ওড়াচ্ছে আমাদের শ্রমের সুবিধা নিয়ে। কুকুরের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছে আমাদের অজ্ঞানের অন্ধকারে। আমরা কিছু জানি না, আতঙ্কে আমরা সবকিছুকেই ভয়ের চোখে দেখি। আমাদের জীবন এক অমাবস্যার অন্ধকার। ঘেরা রাত্রি—এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। মনের বিষে আচ্ছন্ন করে রেখে ওরা আমাদেব রক্তপান করছে। ওরা অতিভোজনে ভুড়ি বাগাচ্ছে, বমি করছে,ওরা লোভ-শয়তানের চেলা…তাই নয় কি?

তাই-ই।

মা দেখতে পেলেন, ভিড়ের পিছনে দু’জন পুলিস এবং সেই গোয়েন্দা। অমনি তাড়াতাড়ি কাগজগুলো ছড়াতে গেলেন, কিন্তু কার যেন একখানা অপরিচ্ছন্ন হাত এসে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে পলকে অদৃশ্য করে ফেললো—তারপর প্রশ্ন হল, কাকে বলবো? কাকে খবর দেবো?

মা তাতে কান না দিয়ে বলতে লাগলেন… এই জীবনযাত্রাপ্রণালীকে বদলাতে, সকল মানুষকে মুক্তি দিতে, আমার মত তাদের জীবন্ত কবর হ’তে তুলে নবজীবন, দিতে এগিয়ে এসেছে কতিপয় যুবক…যারা তাদের গোপন প্রাণে পেয়েছে সত্যের দর্শন…গোপনে…কারণ, তোমরা জানো আজ যা সত্য, মানুষ তা খোলাখোলি বলতে পারেনা। ওর। তাহলে গুলি করবে, টুটি টিপে ধরবে, জিভ কেটে ফেলবে। ধন একটা শক্তি কিন্তু তা সত্যের সুহৃদ নয়। সত্য ধনীর চির-শক্ত, মরণ-শত্রু। আমাদের ছেলেরা দুনিয়ায় এই সত্যের বার্তা প্রচারে বেরিয়েছে। তারা পবিত্র, তার জ্যোতির্ময়। সংখ্যা তাদের অল্প, শক্তি তাদের কম, কিন্তু দলে বাড়ছে তারা। তরুণ প্রাণ সমর্পণ করছে তারা স্বাধীন সত্যের ব্রতে, সত্যকে পরিণত করছে তারা সর্বজয়ী শক্তিতে। তাদের প্রাণের পথ দিয়ে সেই সত্য এসে ঢুকবে আমাদের কঠোর জীবনে!—আমাদের উদ্দীপিত করে তুলবে, সঞ্জীবিত করে তুলবে; আত্ম-বিক্রয়ী যারা, ধনী যারা, তাদের অত্যাচার থেকে টেনে তুলে বাঁচাবে। তোমরা বিশ্বাস কর একথা।

ভাগো এখান থেকে–পুলিসেরা ভিড় ঠেলতে ঠেলতে চেঁচাতে লাগলো।

বেঞ্চির ওপর উঠে নাও।

দরকার নেই—এখনই গ্রেপ্তার হবো।

তাড়াতাড়ি বলে যাও। এসে পড়লো বলে।

মা বলেন, সেই সত্য-প্রচারকদের, সর্বরিক্ত-দরিদ্রের বান্ধবদের পাশে গিয়ে দাঁড়াও… আপোস করোনা, বন্ধুগণ, আপোস করোনা। শক্তি-গর্বীদের কাছে মাথা নুয়িয়োনা। ওঠো, জাগো মজুর ভাইসব, এ জীবনের নিয়ন্তা তোমরা, তোমাদের শ্রমের দৌলতে সবাই বেঁচে আছে, অথচ তোমরাই বন্দী। হাত তোমাদের খোলা। শুধু কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য। চেয়ে দেখো, তোমাদের চারিদিকে বন্ধন। ওরা তোমাদের খুন করছে, তোমাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করছে।…আজ মন-প্রাণ একীভূত করে একশক্তিতে উঠে দাঁড়াও। সমস্ত বাধা পরাভূত হবে। তোমরা ছাড়া তোমাদের আর বন্ধু কেউ নেই—এই কথাই মজুরদের বন্ধুরা তাদের বলতে চেয়েছে এবং বলতে গিয়ে কারাগারে, নির্বাসনে পলে পলে প্রাণ দিয়েছে। অসৎ লোকেরা কি এমনিভাবে কথা বলে? প্রতারকরা কি এমনিভাবে প্রাণ দেয়?

পুলিসরা ‘ভাগে ভাগো’ বলে উপর্যুপরি ঠেলতে লাগলো লোকগুলোকে। মার প্রাণ যেন কথার ভারে, আবেগে উচ্ছ্বাসে ঝংকৃত হ’তে লাগলো গানের মতো! কম্পিত ভগ্নকণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, আমার ছেলের এই বাণী এক ন্যায়নিষ্ঠ শ্রমিকের বাণী…আত্মবিক্রয় যে করেনি তার বাণী। এর সত্যতা তোমরা বুঝতে পারবে এর স্পষ্ট তেজোদৃপ্ত ভাষা হতে, নির্ভীক এ ভাষা। হে আমার মজুর বন্ধুগণ, এই নির্ভীক, নিত্য জ্ঞানদীপ্ত বাণী আজ তোমাদের কাছে উপস্থিত। প্রাণ খুলে একে গ্রহণ কর…এ দিয়ে প্রাণকে পুষ্ট কর। তোমাদের শক্তিলাভ হবে, সব আপদ হ’তে আত্মরক্ষা করার, সত্যের পরিপন্থী যুক্তির প্রতিকূল সবকিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। এ বাণী গ্রহণ কর, বিশ্বাস কর,একে পাথেয় করে বিশ্বমানবের সুখের পথে যাত্রা কর, পরম আনন্দভরে এক নবজীবনের অভিমুখে অগ্রসর হও!…

মায়ের বুকে এক প্রচণ্ড ঘুষি এসে পড়লো। মা ট’লে বেঞ্চির ওপর পড়ে গেলেন। জনতার ওপরও অবিশ্রাম প্রহার চলতে লাগলো।

মা একটু পরেই শেষ শক্তি প্রয়োগ করে চেঁচিয়ে উঠলেন, ভাইসব, তোমাদের বিচ্ছিন্ন শক্তি একত্র করে এক মহাশক্তির সৃষ্টি কর…

একজন বৃহদাকার পুলিস তার কলার ধরে ধমকে উঠলো, চুপ রও। জনতাকে ভয় দেখিয়ে বলতে লাগলো, ভাগো।

মা বললেন, কোনো কিছুতেই ভয় পেয়ো না। ওরা কি যন্ত্রণা দেবে? এর চাইতে ঢের-ঢের বেশি যন্ত্রণা জীবন-ভোর সইছো তোমরা।…

চুপ কর বলছি, ব’লে একজন পুলিস তার একহাত ধরলো, তারপর অন্যদিক থেকে আর একজন অন্য হাতটা ধরে লম্বা পা ফেলে মাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চললো। … মা বলতে লাগলেন, এর চেয়ে ঢের ঢের বেশি নির্যাতন অহর্নিশ গোপন-কাটার মতো তোমাদের অন্তর-বিদ্ধ করে তুলছে, তোমাদের শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে।…

গোয়েন্দা গর্জন করে উঠলো, এই বুড়ি, থাম।

মা বেপরোয়া হয়ে বলতে লাগলেন,-এই নব-উদ্বুদ্ধ আত্মাকে হত্যা করে কার সাধ্য?

একটা গাল দিয়ে গোয়েন্দাটা মার মুখের ওপর এক চড় লাগালো। একমূহূর্তের জন্য মা চোখে অন্ধকার দেখলেন। রক্তের নোনা স্বাদে তার মুখ ভরে এলো। কানে এলো ক্ষিপ্ত জনতার চীৎকার, খর্বদার, ওঁকে মেরো না।–শয়তান কোথাকার—দোব এক ঘা বসিয়ে–

মা উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগলেন—রক্তে ওরা যুক্তিকে ডুবিয়ে দিতে পারবে না, সত্যের শিখাকে নিভিয়ে দিতে পারবে না তারা।

মার মাথায় পিঠে ঘাড়ে ঘা পড়তে লাগলো। চারদিকের সব কিছু যেন ঘুরতে আরম্ভ করলো। চারদিকে চীৎকার, তর্জন-গর্জন, হুমকি-কানে যেন তালা লাগছে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পা নুয়ে পড়ছে, শরীর কাঁপছে, জ্বলছে, টলে পড়ছে কিন্তু চোখ বন্ধ হয়নি। মা দেখলেন, জনতার চোখে এক অপূর্ব উত্তেজনা।

তাকে ঠেলে এক দোরের ভিতর দিয়ে ঢোকানো হ’ল। পুলিসের কবল থেকে হাত ছিনিয়ে দরজার কাঠ ধরে মা বলে উঠলেন—রক্তের সমুদ্র বহালেও সত্যকে ডুবিয়ে মারতে পারবে না ওরা।

পুলিসের মার হাতের ওপর ঘা লাগালো।

–বোকা ওরা, নিজেদের ওপর জমিয়ে তুলছে বিদ্বেষের স্তূপ। এক দিন তারই তলে চাপা পড়বে ওরা…

কেউ যেন গলা টিপে কণ্ঠরোধ করলো—মার গলা থেকে মোটা সুরে বেরিয়ে এলো : নির্বোধ হতভাগ্য ওরা, ওদের জন্য দুঃখ হয়…

-সমাপ্ত-

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *