প্রথম প্রেম

প্রথম প্রেম

কখনো উত্তরে বাতাস, কখনো আবার দক্ষিণে বাতাস; কখনো গ্রীষ্মের দাহ, কখনো মাঘের হিম; কখনো পাতা ঝরে যায়, কখনো নতুন পাতার মহা সমারোহ। এক এক ঋতুতে এক এক রকম। কখনো পদ্মার চরে চাষীরা চাষ করে, শিশুরা খেলা করে; আবার বর্ষায় সেই পদ্মার বিভীষিকা ওদেরই রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।

মানুষের মনও ঠিক একই রকম। মানুষের মনেও জোয়ার-ভাটা খেলে। শত বাধা-বিপত্তির উজান ঠেলে এগিয়ে যায়; আবার কখনো অতীত স্মৃতির ভাটার টানে ভাসতে ভাসতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। আজ ছবির বোধহয় এমনই একটা দিন।

অফিসের কাজে শিশিরকে এত বেশি ট্যুর করতে হয় যে একলা থাকা ছবির কাছে নতুন নয়। প্রথম প্রথম সত্যি কষ্ট হতো। খুব কষ্ট হতো। কতদিন মনের দুঃখে চোখের জল ফেলেছে। কখনো কখনো রাগে-দুঃখে কাগজ-কলম নিয়ে মাকে চিঠি লিখতে বসত তোমরা তো সব সময় বলল, শিশিরের মত ছেলে হয় না কিন্তু আমি যে কি দুঃখে দিন কাটাই, তা তোমরা ভাবতে পারবে না। প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুদিনও এখানে থাকে না। কোন কোন সময় পাঁচ-সাত দিনও বাইরে থাকে। দিনরাত্তির বোবা হয়ে থাকি। যে বুড়ী আমার ঘর সংসারের সব কাজ করে, তার সঙ্গে আর কত গল্প করা যায়? দু একটি বাঙালী পরিবারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু তাদের তো সংসার আছে। আমার স্বামী হরদম বাইরে যান বলে তো তারা সব কাজকর্ম ফেলে আমাকে সঙ্গ দিতে পারে না।

আরো কত কি লিখত! কখনো আবার লিখত–আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার জন্য তোমরা যে কেন পাগল হয়ে উঠেছিলে, তা ভেবে পাই না। আমি আরো কিছুদিন লেখাপড়া করলে বা গান শিখলে কী তোমাদের কোন ক্ষতি হতো? বাবার ধারণা ছিল, বিয়ের পর আমি আবার পড়াশুনা করতে পারব কিন্তু কটা মেয়ে বিয়ের পর লেখাপড়া করার সুযোগ পায়? আর এই দিল্লী শহরে যে গান শিখব, তারও কোন উপায় নেই। কত গল্প-উপন্যাস পড়া যায়? এখানে রেডিওতে কালে-ভদ্রে বাংলা গান হয়। সুতরাং রেডিওর গান শুনে যে কিছু সময় কাটাব, তারও কোন উপায় নেই।

সবশেষে ও লিখত, এক কথায় আমি চিড়িয়াখানার এক বন্দিনীয় জীবন কাটাচ্ছি!

এসব অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। এখন শিশিরের বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নেই। স্বামী এখনো টুরে যায়। আগে মীরাট, ডেরাডুন, এলাহাবাদ, লক্ষ্মী বা জয়পুর, উদয়পুর যেতে হতো। এখন কখনো বোম্বে, কখনো মাদ্রাজ বা কলকাতা। বছরে দুএকবার বিদেশেও একলা একলা থাকতে হয়। একলা একলা মানে অবশ্য ছেলেমেয়ে কাছে থাকলেও স্বামীর সান্নিধ্য লাভ না করা। তবে ছেলেমেয়েকেই বা কতক্ষণ কাছে পায়! ওরা দুজনেই সাতসকালে স্কুলে যায়। বেলা গড়িয়ে পড়ার পর ফিরে আসে। বিকেলে একটু খেলাধুলা, সন্ধের পর পড়াশুনা। নটা বাজতে না বাজতেই ঘুমে ঢুলে পড়ে। ছবির বকুনির জোরে আরো কিছু সময় বইপত্তর নিয়ে পড়ে থাকে কিন্তু সে যাই হোক, সাড়ে নটা-দশটার মধ্যেই দুজনে বিছানায়। এখন অবশ্য ওরা দুজনেই বেড়াতে গেছে। ছেলের স্কুল থেকে ওদের ক্লাসের সবাইকে মানালী নিয়ে গেছে। মেয়েকে ভাশুর কলকাতা নিয়ে গেছেন। আর শিশির এক সেমিনারের জন্য ওটি গেছে।

ছেলেমেয়ে স্কুলে বা শিশির দিল্লীর বাইরে গেলে এখন ছবি সেই পুরনো দিনের মত নিঃসঙ্গতার জ্বালা বোধ করে না। দিল্লীতে এখন ওর কত বন্ধু। সীতা ওর বাবার হার্ট-অ্যাটাক হবার খবর পেয়েই কলকাতা চলে গেছে। তা নয়ত এইরকম সকাল সাড়ে নটা-দশটার সময়ই ও প্রায় প্রত্যেক দিন নাচতে নাচতে এসে হাজির হয়েই বলবে, সারাদিনের মধ্যে সকালবেলার এই দুএক ঘণ্টাই শুধু আমার নিজের। এই সময়টা যে আমার কি ভাল লাগে!

ছবি ওকে খুব ভাল করে চেনে। তাই ওর কথা শুনে ও শুধু হাসে। ছায়াদি এই পাড়াতেই থাকেন কিন্তু ছবির মত ঘনিষ্ঠ নয় বলেই সেদিন সীতার কথা শুনেই বলেন, এই দুএক ঘণ্টা সময় ছাড়া আর কোন সময়ই তোমার ভাল লাগে না?

সীতা বলে, ভাল লাগে না মানে এই সময়টুকুর মালিক আমি নিজে। এখন আমি হাসতে পারি, কাঁদতে পারি, নাচতে পারি। ও একটু থেমে ছবির দিকে তাকিয়ে একটু মুখ টিপে হেসে বলে, ইচ্ছে করলে এখন আমি প্রেমও করতে পারি কিন্তু স্বামী জানতেও পারবে না, ধরতেও পারবে না। তাই এই সময়টা..

ছায়াদি ওর কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন না বলেই আবার বলেন, অন্য সময় কি তুমি ক্রীতদাসী যে তোমাকে স্বামীর কথামত উঠতে-বসতে হবে?

-হ্যাঁ, ছায়াদি, অন্য সময় সত্যি ক্রীতদাসী।

তার মানে?

 সীতা এবার কাজের ফিরিস্তি দেয়, সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠাকুর দেবতার নাম করি আর নাই করি চায়ের কাপ নিয়ে স্বামী দেবতার নিদ্রাভঙ্গের সাধনা করতেই হবে।

ওর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।

–তারপর স্বামী ও পুত্ররা যতক্ষণ না বেরুচ্ছে ততক্ষণ তাদের তদবির-তদারক ভজন-পূজন করতে হবে। ছেলেরা স্কুল থেকে ফিরে এলে, তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে এটা চাই, সেটা চাই-এর ঝামেলা ভোগ করো।

এবার সীতা একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, ডিরেক্টর জেনারেল ম্যানেজারের কাছে পানি খেয়ে স্বামী যখন বাড়ি ফিরবেন, তখন তাকে বিশ্বজয়ী আলেকজাণ্ডারের মত সংবর্ধনা জানাবার দায়িত্বও এই সীতাদেবীর।

ওর কথা শুনে ছায়াদি সত্যি মজা পান। তাই বলেন, তারপর?

সীতা হেসে বলে, আরো শুনতে চাও?

-হ্যাঁ, শুনতে চাই।

ও বলে যায়, শরদিন্দু বাঁড়ুজ্যের গল্প শোনার মত মন দিয়ে স্বামীর কাছে তার অফিসের গল্প শুনতে হবে। দরকার হলে বলতে হবে, এই চোপড়া আর বোস–দুটো লোকই হারামজাদা এবং বারো আনা কাজ তো তোমাকেই করতে হয় কিন্তু তবু কেন যে জি এম বা ডিরেক্টররা তোমার মুখের দিকে তাকান না, তা ভেবেই পাই না।

এবার ছায়াদি হাসতে হাসতে বলেন, মিঃ সেন খেয়ে-দেয়ে শুতে যাওয়া পর্যন্ত বুঝি তোমাকে ডিউটি দিতে হয়?

এবার সীতা মুখ টিপে না, একটু জোরেই হাসে। বলে, শুয়ে পড়ার পর প্রায়ই উনি আবিষ্কার করেন, আমার চাইতে সুন্দরী মেয়ে নাকি ভূ-ভারতে উনি দেখেননি। ব্যস! যেদিনই ঐ প্রশংসা শুনি, সেদিনই আমার সর্বনাশ!

ওর কথা শুনে শুধু ছবি না, ছায়াদিও হাসি চাপতে পারেন না।

সীতা কিন্তু ঐটুকু বলেই থামে না। বলে যায়, শুনি স্বামীদেরই সারাদিন অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয় কিন্তু অত পরিশ্রম করার পরও যে ওরা মাঝ রাত্তিরে কি করে সার্কাস দেখায়, তা ভেবে পাই না!

এবার ছায়াদি ওকে সমর্থন না জানিয়ে পারেন না। হাসতে হাসতে বলেন, ঠিক বলেছ সীতা।

যাই হোক, এই সীতা থাকলে ছবির সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায়, তা ও নিজেই টের পায় না। গতকাল রেখা ফোন করে বলেছিল, কাল-পরশুর মধ্যে আসব। ছবির দুই বন্ধু দিল্লীতে আছে। শ্ৰীলার স্বামী হিন্দু কলেজের লেকচারার। ওরা মডেল টাউনে থাকে। অত দূরে থাকে বলে শ্রীলা বিশেষ আসতে পারে না কিন্তু রেখা আসে এবং এলেই সারাদিন কাটিয়ে যায়। আজ এতক্ষণ যখন এলো না, মনে হয়, কালই আসবে। তাই ছবি কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার পর নিজের আলমারিটা ঠিকমত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গোছগাছ করতে বসল।

এই বাড়িতে, এই সংসারে কত কি আছে! খাট-বিছানা সোফা গার্ডেন চেয়ার থেকে শুরু করে রেডিও-টি ভি-মিউজিক সিস্টেম। কত ভাল ভাল ছবি ও বই আছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ছবি সবকিছুই ব্যবহার করে, উপভোগ করে কিন্তু ঐ সবকিছুর সঙ্গেই যেন ওর প্রাণের টান নেই। ওগুলো সবার কিন্তু এই আলমারিটা শুধু ওর নিজের। একান্তই নিজের।

বিয়ের পর ছবি যখন দিল্লীতে প্রথম সংসার করতে আসে, তখন ওদের একটা আলমারিতেই স্বামী স্ত্রীর জামাকাপড় বা টাকা-পয়সা থাকত। চাকরিতে শিশিরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওর জামাকাপড়ের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে। তখন একদিন ছবি একটু অভিমান করেই বলে, তোমার জামাকাপড়ের ঠেলায় এ আলমারিতে আর আমার জামাকাপড় রাখা অসম্ভব। এতদিন বলার পরও যখন আমাকে একটা আলমারি কিনে দিলে না, তখন না হয় আমাকে মা-দিদিমার আমলের একটা স্টীলের ট্রাঙ্কই কিনে দাও কিন্তু এভাবে আর চলে না।

শিশির হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, পর পর তিন দিন আদর করলেই তোমাকে আলমারি কিনে দেব।

ছবি গম্ভীর হয়ে বলে, যে তিনশ দিন আদর খেয়েছ সে হিসেবটা বুঝি এখন মনে পড়ছে না?

শিশির ওর মুখের পাশে মুখ নিয়ে বলে, তিনশ তিন দিন হলেই আলমারি এসে যাবে।

ছবি প্রায় জোর করেই নিজেকে মুক্ত করে বলে, আমি আলমারিও চাই না, তোমাকে আদর করতেও পারব না।

পরের শনিবারই শিশির ওকে এই আলমারিটা কিনে দেয়।

আলমারিটা যেমন সুন্দর, তেমনই বড়। ছবি নেহাৎ বেঁটে না। ৰাধারণ বাঙালী মেয়েদের তুলনায় ও একটু লম্বাই কিন্তু তবু নিচে দাঁড়িয়ে ও আলমারির উপরের তাকে হাত পায় না। একটা ট্রল বা চেয়ারের উপর দাঁড়াতে হয়। প্রথম যখন আলমারিটা কেনা হয়, তখন অর্ধেকই খালি পড়ে থাকত কিন্তু এখন শুধু ভর্তি নয়, ঠাসাঠাসি করে কাপড়চোপড় জিনিসপত্র আছে। তাই তো এই আলমারির জিনিসপত্র গোছগাছ করতে বসলেই ছবির সারাদিন লেগে যায় কিন্তু সব সময় ইচ্ছে করে না বা হাতে অত সময় থাকে না বলেই নমাসে ছমাসে ছবি এই আলমারি পরিষ্কার করে।

এই আলমারিতে কী নেই? জামাকাপড়, কিছু গহনা, দুতিনটে ঘড়ি, বাবা-মা-আত্মীয়-বন্ধুদের অসংখ্য চিঠি ও ছবি, পুরনো দিনের কিছু খাতাপত্র-ডায়েরী। লকারের একপাশে সংসারের খরচপত্রের টাকাকড়ি ছাড়াও ব্যাঙ্কের পাসবই-চেকবই। তাছাড়া কতজনের দেওয়া কত রকমের প্রেজেনটেশন। আরো কত কি!

ছবি মনে মনে ঠিক করেছিল, আগে কাপড়চোপড় না গুছিয়ে অন্য কিছুতে হাত দেবে না। এই তো কদিন আগে শিশিরের সঙ্গে একটা পার্টিতে যাবার সময় একটা টাঙ্গাইল সিল্কের শাড়ি বের করল কিন্তু ঐ শাড়ির সঙ্গে পরবার মত ব্লাউজটাই পেল না। খুব ইচ্ছা ছিল ঐ শাড়িটা পরার কিন্তু হলো না। অথচ তার পরের দিন সকালেই একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ি টানতেই ঐ ব্লাউজটা বেরিয়ে এলো। এ প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।

যাই হোক, ও মেঝেতে বসে সব চাইতে নিচের তাক থেকে পুরনো সায়া আর কয়েকটি নতুন ব্লাউজ পিস টান দিতেই একটা খাতা প্রায় কোলের উপর এসে পড়ল। খাতার মলাট ওল্টাতেই ছবি আপন মনেই একটু হাসে। প্রথম পাতায় মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে ডায়েরী। মাস্টারমশায়েরই হাতের লেখা। খাতাটাও উনিই দিয়েছিলেন।

কবেকার কথা?

ছবি মনে মনে একটু হিসেব-নিকেশ করে নেয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেকেণ্ড স্ট্যাণ্ড করে ক্লাস ফাইভে উঠতেই একদিন সন্ধেবেলায় মাস্টারমশাই পড়াতে এসে এই খাতাটা দিয়ে বললেন, ছবি, এই খাতায় তুমি রোজ ডায়েরী লিখবে। যাদের ডায়েরী লেখার অভ্যাস থাকে, তারা সবকিছু ভাল লিখতে পারে।

তখন ছবির কত বয়স? বড় জোর নদশ। না, না, দশও হয়নি। সবে ন বছরে পা দিয়েছে। ডায়েরী সম্পর্কে ওর কোন ধারণাই ছিল না। তাই তো ও মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করে, ডায়েরীতে কি লিখব?

বৃদ্ধ সন্তোষবাবু একটু হেসে বললেন, তোমার যা ইচ্ছে তাই লিখবে।

ছবি অবাক হয়ে বলে, যা ইচ্ছে?

–হ্যাঁ, যা ইচ্ছে। এবার উনি একটু থেমে বলেন, তুমি সারাদিনে যা করবে তাই লিখে রেখো।

সারাদিনে যা যা করব সব লিখে রাখব?

 –তাহলে তো খুব ভাল হয়।

 ছবি একটু ভেবে আবার প্রশ্ন করে, কখন লিখব স্যার?

–ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেও লিখতে পারে, আবার রাত্রে শুতে যাবার আগেও লিখতে পারে। সন্তোষবাবু এক টিপ নস্যি নিয়ে বলেন, তোমার যেমন সুবিধে হবে, তেমন লিখবে। তবে একটা সময় ঠিক থাকলেই ভাল।

ছবি খাতাটা নিয়ে নাড়াচড়া করে। মাস্টারমশাই এবার বললেন, ডায়েরী লেখার সময় তারিখ লিখে রাখবে।

-কেন স্যার?

মাস্টারমশাই একটু হেসে বলেন, পরে বুঝতে পারবে কবে কি ঘটেছে।

ছবির স্পষ্ট মনে পড়ছে সেদিন মাস্টারমশাই চলে যাবার পরই ও ডায়েরী লিখতে বসল। আজ এত বছর পর সেই সেদিনের কচি মনের ডায়েরী পড়তে গিয়ে ছবি নিজেই হাসে। অদ্য সকাল ছটা আট মিনিটে শয্যা ত্যাগ করিলাম। হাত-জোড় করিয়া মা-কালীর ফুটোয় প্রণাম করিবার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়িয়া বাথরুমে গেলাম…

ছবি ঐ দুলাইন পড়েই মনে মনে বলে, এ রাম!

একসঙ্গে কয়েক পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ে–কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মকথা কবিতাটি মুখস্থ বলিতে পারায় আমাদের বাংলার দিদিমণি খুব আনন্দিত হইলেন। উনি বলিলেন, ছবি, নববর্ষ উৎসবে তোমাকে একটি কবিতা আবৃত্তি করিতে হইবে। দিদিমণির কথা শুনিয়া আমি খুব গৌরববোধ করিলাম।

ছবি হাসতে হাসতেই পাতা উল্টে যায় আর সেই সব দিনের কথা ভাবে। মোক্ষদা স্কুলের সব দিদিমণিরাই ভাল ছিলেন কিন্তু ওর সব চাইতে প্রিয় ছিলেন ঐ বাংলার টিচার চৈতালীদি। কী সুন্দর দেখতে ছিল চৈতালীদিকে! উনি খুব ফর্সা ছিলেন না কিন্তু অমন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ রঙেই যেন ওঁকে আরো বেশ ভাল লাগত। চোখ দুটো কী সুন্দর ছিল! মনে হতো সব সময় হাসছেন। নাকটা সামান্য একটু চাপা ছিল কিন্তু মুখখানা এত সুন্দর ছিল যে ওটা চোখেই পড়ত না। তাছাড়া যেমন গড়ন, তেমন মাথায় চুল। উনি রোজই সাদা বা হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি পরে আসতেন কিন্তু তবু মনে হতো ওঁর পাশে কোন ফিল্ম স্টারও দাঁড়াতে পারবে না। বোধহয় ওঁকে খুশি করার জন্যই ছবি খুব বেশী মন দিয়ে বাংলা পড়ত।

আনমনে ঐ ডায়েরীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই ওর আরো কত কি মনে পড়ে।

তখন বোধহয় সেভেন বা এইটে পড়ে। কী বা এমন বয়স! কিন্তু ঐ বয়সেই লিপি কি ফাজিল ছিল! রোজ টিফিনের সময় ওরা এক দল স্কুলের পিছন দিকে কোন এক গাছের ছায়ায় বসে টিফিন খেত। আর ঐ টিফিন খেতে খেতেই লিপি এক একদিন এক একজন টিচারের নানা খবর বলত।

সেদিন টিফিনের কৌটো খুলতে খুলতেই লিপি বলল, আজ চৈতালীদিকে দেখে আমারই মনে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে একটা কিস করি।

ওর কথায় অনেকেই লজ্জা পায় কিন্তু উপভোগ না করে পারে না। রেখা বলল, চৈতালীদিকে রোজই দারুণ দেখতে লাগে। উষা বলল, যত দিন যাচ্ছে উনি যেন তত বেশী সুন্দরী হচ্ছেন। ছবি বলল, চৈতালীদিকে দেখতেও যেমন ভাল তেমনি সুন্দর ওঁর ফিগার।

লিপি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঠিক বলেছিস ছবি। ওঁর বুক যেমন ডেভলপড, থাই-টাইগুলোও দারুণ; অথচ কোমর কত সরু। ও রসগোল্লার রসে টান দেবার মত আওয়াজ করে বলল, শৈবাল ডাক্তারের কী ভাগ্য!

দুতিনজন মেয়ে প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করে, তার মানে?

 লিপি রেখার কাছ থেকে একটু আচার নিয়ে মুখে দিয়েই বলল, কী আবার ব্যাপার! চৈতালীদি শৈবালকে ভালবাসে তাও তোরা জানিস না?

হাজার হোক চৈতালীর ব্যাপারে ছবির আগ্রহ সব চাইতে বেশী। তাই ও জিজ্ঞেস করে, সত্যি নাকি রে?

–তবে কি আমি মিথ্যে বলছি? ও প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বলে যায়, এই তো পূজার ছুটি আসছে। তখন দেখিস, যেদিন ছুটি হবে সেইদিনই আপার ইণ্ডিয়ায় চৈতালীদি শান্তিনিকেতন যাবেন আর…

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই কে যেন অবাক হয়ে বলে, শান্তিনিকেতন?

-আজ্ঞে হ্যাঁ, ওখানে চৈতালীদির মাসী থাকেন। লিপি মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলে, উনি চলে যাবার দুএকদিন পরই শৈবাল ডাক্তার কলকাতা ঘুরে শান্তিনিকেতন হাজির হবে।

লিপি কোথা থেকে কেমন করে এসব খবর জানতে পারে, তা জিজ্ঞেস করার কথাও ওদের মনে আসত না। ওরা সবাই মনে করত, লিপি সত্যি কথাই বলছে কিন্তু ঐ বয়সে যে এইসব বলতে ভাল লাগে, শুনতেও ভাল লাগে, সে কথাও ওদের কারুর মনে আসত না।

হঠাৎ দুর্গাদি এক কাপ চা ছবির পাশে রেখেই বলল, তাই বলি, আজ বৌদি কেন চায়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছে না!

দুর্গাদির কথা শুনেই যেন ছবি সংবিৎ ফিরে পায়। হঠাৎ আবিষ্কার করে ঐ ডায়েরীর খাতাখানা হাতে নিয়েই অনেকক্ষণ বসে আছে। না, না, আর না। খাতাটা তাড়াতাড়ি সরিয়ে রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই নতুন ব্লাউজ পিসগুলো গুছিয়ে একপাশে রাখে।

এবার ছবি ঐ তাক থেকে সবকিছু বের করে মেঝেয় রাখে। ঠিক করে, আজেবাজে সবকিছু ফেলে দেবে। ছেঁড়া-ফাটা সায়াগুলো একে-ওকে দিয়ে দেবে। সত্যি বেশ কিছু আজেবাজে জিনিস বেরুল। কয়েকটা ছেঁড়া সায়া দূরে সরিয়ে রাখতে গিয়েই ওর ভিতর থেকেই কয়েকটা চিঠি মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল। ছবি একবার ভাবে চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেবে। কী হবে পুরনো চিঠিপত্র জমিয়ে? তাছাড়া কত চিঠি রাখবে?

ছবির এই আলমারিতে কয়েক শ চিঠি আছে। যখনই আলমারি গোছগাছ করতে হাত দেয় তখনই ভাবে সব চিঠিপত্র ফেলে দেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন চিঠিই ফেলতে পারে না। সব চিঠির সঙ্গেই কিছু সুখ-দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেইসব স্মৃতির কথা মনে করে আবার চিঠিগুলো আলমারির মধ্যে রেখে দেয়। আজ সত্যি সত্যি চিঠিগুলো ছিড়বে বলে প্রথমে দুটো খামের চিঠি তুলে নেয় কিন্তু ছিঁড়তে চেষ্টা করেও পারল না। বড় শক্ত কিছু ভিতরে আছে মনে হলো। খামের ভিতর থেকে চিঠি বের করতে গিয়েই ছবি অবাক। আরে! এর মধ্যে সেই ভাগলপুরের মোক্ষদা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ফটো আছে! ইস! ছিঁড়ে ফেললে কী সর্বনাশ হতো? ক্লাস নাইন থেকে টেন-এ ওঠার পরই ওরা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলে এই ছবি তুলেছিল। এই ফটো তোলার জন্য ওরা প্রত্যেকে তিন টাকা করে চাঁদা দিয়েছিল, তাও ছবির স্পষ্ট মনে আছে। এবার ছবি ফটোটার দিকে তাকাতে গিয়েই যেন ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। যে লিপি সব সময় হাসত, সবাইকে হাসিয়ে মাতিয়ে রাখত, ভগবান তার মুখের হাসিই চিরকালের জন্য কেড়ে নিলেন? ইস্! ছবি যেন শিউরে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে ওর হাত-পা যেন অবশ হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টিও যেন কেমন ঝাপসা হয়ে ওঠে। মনে পড়ে কত কথা! সেই মোক্ষদা স্কুলের কথা, টিফিনের সময় চৈতালীদির রূপ যৌবনের গল্প, সুন্দরবনে পিকনিক, ক্লাস নাইনে উঠেই চৈতালীদি আর সুমিত্রাদির সঙ্গে সারা ক্লাসের মেয়েরা মিলে মান্দার হিল যাওয়া, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে চিত্রাঙ্গদায় অভিনয় করা ও গান গাওয়া এবং আরো কত কি মনে পড়ে।

ছবি মোক্ষদা স্কুল থেকে পাস করার পর কলকাতায় বেথুনে ভর্তি হয়। নানা কারণে ওর আর ভাগলপুর যাওয়া হতো না কিন্তু লিপির বিয়েতে গিয়েছিল। মার অমত না থাকলেও বাবার বিন্দুমাত্র মত ছিল না কিন্তু ছবির কান্নাকাটি দেখে উনি শেষ পর্যন্ত মত দিয়েছিলেন। ওর বিয়ের সময় মুঙ্গের, পাটনা, কলকাতা থেকে প্রায় সব পুরনো বন্ধুরাই ভাগলপুর হাজির হয়েছিল। হাজার হোক, লিপির বিয়ে! তার উপর লাভম্যারেজ! বন্ধুবান্ধবরা না গিয়ে পারে?

সেই অবিস্মরণীয় রাত্রির কথা ছবি কোনদিন ভুলবে না। বিয়ের পর বাসরে আসতেই লিপিকে ওরা বলল, সত্যিই তাহলে সব্যসাচীকে বিয়ে করলি?

লিপি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, এতদিন বাবা-মার চোখে ধুলো দিয়ে সব্যসাচীর সঙ্গে প্রেম করার পর কি তোরা ভেবেছিলি অন্য কাউকে বিয়ে করব?

ও একটু থেমে আবার বলে, আমি তো তোদের মত ভীতু না।

সেদিন কত হাসি, কত ঠাট্টা, কত গান হয়েছিল, তা আজ আবার নতুন করে ছবির মনে পড়ছে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লিপির জীবন থেকে সব হাসি সব গান চিরদিনের মত চিরকালের জন্য কেন হারিয়ে গেল, তা ও ভেবে পায় না।

সর্বনাশ হবার কয়েক মাস পরে লিপি ছবিকে লিখেছিল, তোরা আমার জন্য দুঃখ করিস না। এ কথা ঠিক ভগবান আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপনেরও সুযোগ দিলেন না। তবু আমি জানি লক্ষ লক্ষ মেয়ে সারা জীবনে যে প্রেম, যে ভালবাসা, যে দরদ মমত্ব স্বামীর কাছ থেকে পায় না, ঐ কটি মাসের মধ্যে আমি তার চাইতে অনেক অনেক বেশী পেয়েছি। দৈনন্দিন জীবনের আঘাতে-সংঘাতে আমাদের দ্বৈত জীবন কলুষিত কর্দমাক্ত হতে পারেনি। ভালবাসার স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণেই আমাদের খেলা শেষ হয়েছে, এইটুকুই সান্ত্বনা, এইটুকুই তৃপ্তি।

সব্যসাচীর মৃত্যুর বছর খানেক পর লিপির দাদারা ওর আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। যেদিন ওরা লিপিকে ওদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন, সেদিন লিপি পাগলের মত ক্ষেপে উঠেছিল।

বলেছিল, তোমরা কী ভেবেছ আমি বেশ্যা, যে এই দেহটা যে কোন পুরুষকে বিলিয়ে দিতে পারি?

সত্যি, বিচিত্র মেয়ে এই লিপি!

দুর্গাদি আবার এক কাপ চা দিয়ে যায়। ছবি সযত্নে ঐ ছবিটা আর লিপির চিঠিখানা লকারের মধ্যে রেখে চা খেতে খেতেই নিচের তাক গুছিয়ে ফেলে। অন্য তাক থেকে কাপড়-চোপড়গুলো টান দিতেই বড় অ্যালবামটা ওর কোলের উপর এসে পড়ল। বিয়ের অ্যালবাম! সেই আশীর্বাদের দিন থেকে বিয়ে বৌভাত-ফুলশয্যার ছবি দিয়ে অ্যালবাম ভর্তি। ছবি ফটোগুলো না দেখে পারে না। শিশির সত্যি খুব হ্যাণ্ডসাম। ছবি আপনমনেই একটু হাসে। একটু ভাবে। সত্যি, অত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। ভেবেছিল আরো পড়বে। ভাল করে গান শিখবে। কিন্তু তবু বিয়ের কথা শুনে মনের মধ্যে কেমন একটা চাপা আনন্দ, রোমাঞ্চ অনুভব করেছিল। ঠাকুমা বলতেন, বিয়ের কথায় কাঠের পুতুলও নাচে! কথাটা বোধহয় ঠিক।

ছবি অ্যালবামের পাতা উল্টে যায়। শিশিরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ে ওকে দেখেই ওর ভাল লেগেছিল। যেমন সুপুরুষ দেখতে, তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ! বিয়ের পর বন্ধুবান্ধবরা বলেছিল, হ্যাঁরে ছবি, তুই কি ফ্যাশন প্যারেড করে বর পছন্দ করেছিস?

মনের খুশি চেপে রেখে ছবি গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ওর কী এমন রূপ দেখলি রে?

জয়শ্রী বলল, থাক, আর ন্যাকামি করিস না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে আয় স্বামীর গর্বে তোর মুখের চেহারা কত বদলে গেছে!

এই অ্যালবামখানা নাড়াচাড়া করতে করতেই ছবির কত কথা মনে পড়ল।…

হাসিমুখে গিয়ে শিশির ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, শুনছিলাম তোমার নাকি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না।

–বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না, তা ঠিক নয়। ভেবেছিলাম, আরো পড়াশুনা করব, গান শিখব। তারপর বিয়ে করব।

-এখন কী মনে হচ্ছে?

 –ঠিক কী জানতে চাইছ?

শিশির বলে, এখন কি মনে হচ্ছে, বিয়ে হয়ে ভালই হয়েছে, নাকি বিয়ে না হলেই ভাল হতো?

ছবি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে। মুখে কিছু বলে না।

রাত্রে শোবার পর ছবি ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল, তোমাকে দেখার পর সত্যি মত বদলে গেল। মনে হলো, বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে ঠিক কাজই করেছেন।

ফটোগুলো দেখা শেষ হলে ছবি আঁচল দিয়ে অ্যালবামটা পরিষ্কার করে আলমারিতে তুলে রাখে। এবার ছবির হঠাৎ খেয়াল হয়, বেলা হয়ে যাচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে দুটো তাক পরিষ্কার করে কাপড়চোপড় সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। কতজনের কত পুরনো চিঠি হাতে পড়ে কিন্তু ওগুলো পড়তে গেলে সারাদিন কেটে যাবে ভেবে আর খুলে দেখে না। শুধু গুছিয়ে-গাছিয়ে এক তাকের কোণায় রেখে দেয়।

দুর্গাদি চায়ের কাপ-ডিশ নিতে এসে বলে, বৌদি, তোমার একটা পুরনো সায়া আমার জন্য রেখে দিও।

-কেন? নতুন সায়া তো এই সেদিন কেনা হলো।

 দুর্গাদি হেসে বলে, ও দুটো তুলে রেখেছি।

-তাই বল।

হাতের কাছেই দুতিনটে পুরনো সায়া ছিল। ছবি সেগুলো দুর্গাদিকে দিয়ে বলল, এই নাও।

লক্ষ্ণৌ চিকনের সায়া দেখে দুর্গাদি একটু হেসে বলে, এ সায়া পরলে লোকে ঠাট্টা করবে না তো?

ছবি একটু হেসে বলে, তুমি শাড়ির নিচে কি সায়া পরেছ, তা লোকে জানবে কী করে?

–তবুও..

 দুর্গাদি কাপ-ডিশ আর সায়াগুলো নিয়ে চলে যায়।

হ্যাঙার থেকে ময়লা শাড়িগুলো কাঁচতে দেবার জন্য আলাদা করে রাখতে রাখতেই টেলিফোনের বেল বাজল। ছবি তাড়াতাড়ি গিয়ে রিসিভার তুলেই বলে, হ্যালো! কে-রেখা? শ্রীলা তোর ওখানে এসেছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে নিয়ে বিকেলে আসিস। না, না, আমি কোথাও বেরুব না।  যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আসিস। আমি? আমি কি করছি? তুই এলি না বলে আমি আলমারি গোছাতে বসেছি। কী বললি? স্বামী আমাকে প্রেমপত্র লিখেছে কিনা? ও জীবনে আমাকে চিঠি লিখেছে? বড়জোর একবার টেলিফোন করে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছেলের একটা পিকচার পোস্টকার্ড পেয়েছি। মেয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। কবে ফিরবে? ভাশুরের কাছে গেলে মেয়ে আর ফিরতেই চায় না। না, না, আমি কিছু বলি না। তাছাড়া ঐ মেয়েকে নিয়ে বেড়াবেন বলে ভাশুরও তো ছুটি নিয়েছেন। আচ্ছা, ছাড়ছি। তাড়াতাড়ি আসিস।

বেশি বেলা হয়ে যাবার ভয়ে ছবি আর উপরের তাকে হাত দেয় না। ঠিক করে, শুধু লকার দুটো পরিষ্কার করেই স্নান করতে যাবে। ডান দিকের লকারটা গোছাতে বিশেষ সময় লাগল না। ওর মধ্যে সংসার খরচের টাকাকড়ি, ওর একটা গলার চেন, দুটো ঘড়ি আর টুকটাক কয়েকটা জিনিসপত্র ছিল। অন্য লকারে অসংখ্য পুরনো চিঠিপত্র, কিছু প্রেজেনটেশন পাওয়া জিনিসপত্র ছাড়াও আরো কত কি আজেবাজে জিনিস আছে। বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজনদের বেশ কিছু ফটোও আছে ওর মধ্যে। এই লকারটা পরিষ্কার করতে গিয়েই মুশকিল হলো। দশটা পুরনো চিঠি না পড়ে একটা বাজে কাগজ ফেলতে পারে না। একটা ফটো হাতে পড়লে আরো পাঁচটা ফটোর কথা মনে পড়ে। সেগুলো খুঁজতে গিয়ে আরো দশ-বিশটা ফটো দেখতে হয়। দেখতে ভালই লাগে। এইসব ফটো ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই ছবি অমিতের সঙ্গে ওর একটা ফটো দেখে আপনমনেই একটু খুশির হাসি হাসে। কত কথা, কত মিষ্টিমধুর স্মৃতি মনে আসে।…

সেদিন বিকেলে বাবা বাড়ি ফিরেই মাকে বললেন, হ্যাঁগো, ভাগলপুর টি. এন. জে. কলেজে ভাইস প্রিন্সিপ্যালের অফার এসেছে।

মা জিজ্ঞেস করলেন, অফার এসেছে মানে?

-আমার কলেজ জীবনের অধ্যাপক ত্রিদিববাবু তো এখন ওখানে প্রিন্সিপ্যাল। উনি খুব ধরেছেন…

বাবাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মা বললেন, উনি ত আমার ছোট কাকার খুড়শ্বশুর হন। আমাকেও উনি খুব স্নেহ করেন।

–সব জানি। আমাকেও উনি এত ভালবাসেন যে ওঁকে না বলা মুশকিল।

মা বললেন, না বলবে কেন? ওখানে ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল হয়ে কয়েক বছর কাটালে বরং তুমি কলকাতার কোন বড় কলেজে প্রিন্সিপ্যাল হতে পারবে।

-হ্যাঁ, তাও হতে পারে।

ব্যস! কয়েক মাস পরই ওরা পাটনা থেকে ভাগলপুর চলে গেলেন।

ছবির মনে আছে একদিন ওরা পাটনা ছেড়ে ভাগলপুর চলে গেল কিন্তু কেন গেল, তা জানা বা বুঝার বয়স ওর তখন হয়নি। একটু বড় হবার পর ও মার কাছে সব শোনে।

 ত্রিদিববাবু যেমন পণ্ডিত তেমন স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন। ছবির বাবা-মা দুজনকেই উনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ত্রিদিববাবুর মেয়েরাই বড় এবং বহুদিন আগেই তাদের বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র পুত্র নেহাতই শিশু। এমন কি ছবির চাইতেও ঠিক দুবছরের ছোট। নাম অমিতাভ। কেউ ডাকে আমি বলে, কেউ ডাকে অমিত বলে। স্বামী কলেজ আর লেখাপড়া নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকেন বলে ত্রিদিববাবুর স্ত্রী মহিলা সমিতি, হরিসভা, রামকৃষ্ণ আশ্রম বা সাহিত্য পরিষদ নিয়ে মহাব্যস্ত থাকেন। অমিত স্কুল থেকে এসে বাড়ির মধ্যেই আপন মনে পড়াশুনা বা খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকে বলে ওর আরো সুবিধে হয়েছে।

ত্রিদিববাবুর স্ত্রীর পাল্লায় পড়ে ছবির মাকেও মহিলা সমিতি, হরিসভা ইত্যাদিতে ভিড়তে হয়েছে। স্বামীর মত উনিও ছবির বাবা মাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। সংসারের প্রতিটি ব্যাপারে উনি হাসিমুখে সাহায্য করেন বলে ওঁর অনুরোধ এড়ান সম্ভব নয়।

ছবির বাবা মাঝে মাঝে স্ত্রীকে ঠাট্টা করে বলতেন, তুমি তো কাকিমার প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়ে গেছ।

কি করব বল? উনি এত স্নেহ করেন যে ওঁকে না বলতে পারি না। একটু থেমে বলেন, তাছাড়া বাড়িতে বসে বসেই বা করব কী? কাকিমার সঙ্গে পাঁচটা কাজে বেশ সময়টা কেটে যায়।

–ছবিকে দেখছি না তো?

–এই তো ঘণ্টাখানেক আগে কাকাবাবু কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওকে নিয়ে গেলেন। আর যাবার সময় বললেন, বৌমা, ছবিয়াকে একেবারে সোমবার স্কুলে পৌঁছে দেব।

ছবির বাবা একটু হেসে বলেন, কাকাবাবু ছবিকে একদিন না দেখে থাকতে পারেন না। উনি একটু থেমে বলেন, কাকাবাবুর কাছে থাকলে ছবি অনেক কিছু শিখতে পারবে। তাছাড়া বেচারী এখানে একলা একলা কী করবে? ওখানে তবু অমিতের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে।

–তা তো বটেই!

ছবি অমিতের ঐ ফটোটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, খঞ্জনপুরে ওদের ঐ বাড়িতে কী আনন্দেই দিনগুলো কাটত। পিছনের বাগানের ঐ লিচুতলায় দুজনে পাশাপাশি বসে গল্প করা, আমগাছের ডালে দোলনা ঝুলিয়ে দোল খাওয়া, দুজনে একসঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করা, সন্ধ্যের পর লাইব্রেরি ঘরে বসে পড়াশুনা করা, দুজনে এক রিকশায় চেপে স্কুলে যাওয়া-আসা, আরো কত কি!

বড় ঘরের ঐ বিরাট খাটের একধারে শুতেন দিদি-ত্রিদিববাবুর স্ত্রী আর অন্য ধারে শুভ ছবি; মাঝখানে অমিত। দিদি শোবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়লেও ওদের দুজনের চোখে ঘুম আসত না। দুজনে গলা জড়াজড়ি করে কত কথা, কত গল্প।

–আচ্ছা ছবি, তুই কাঠবেড়ালী ধরতে পারবি?

–কেন? তুই পুষবি?

–হ্যাঁ।

 ছবি সঙ্গে সঙ্গে বলে, ঠিক আছে, একটা কাঠবেড়ালী ধরে দেব। এই কথা বলেই ও প্রশ্ন করে, কিন্তু কাঠবেড়ালীকে কি খেতে দিবি?

সাত বছরের শিশু অমিত বলে, ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস…

নবছরের পাকা গিন্নী ছবি বলে, তুই একেবারেই বাচ্চা! কিছু জানিস না। ওরা তো রামচন্দ্রের ভক্ত। মাছ-মাংস খায় না।

-ভাত, ডাল, তরকারি তো খাবে?

 ছবি স্পষ্ট জবাব দেয়, না, ওরা শুধু দুধ আর ফল খায়।

-আমিও দুধ ফল খেতে দেব।

-তাহলে ঠিক আছে। কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে থাকে। তারপর ছবি ওকে জিজ্ঞেস করে, কাঠবেড়ালীকে কোথায় শুতে দিবি?

–আমাদের দুজনের মাঝখানে ওকে শুতে দেব।

-না, না, আমরা দুজনে এইভাবেই শোব। কাঠবেড়ালীকে একটা নতুন বিছানা করে দেব।

-ও একলা একলা শুতে ভয় পাবে না?

–ভয় পাবে কেন? ওরা তো বনের মধ্যে একলা একলাই থাকে।

একটু ভেবে অমিত জিজ্ঞেস করে, কাঠবেড়ালীদের বাবা-মা থাকে?

-কেন থাকবে না?

-ওরা কোথায় থাকে?

-ওরাও আলাদা আলাদা থাকে।

ঐ কাঠবেড়ালী নিয়ে কথা বলতে বলতেই রাত গম্ভীর হয়। পিছনের বাগানে কি একটা পাখি বিকট চিৎকার করতেই অমিত ভয়ে ছবিকে আঁকড়ে ধরে। ছবিও ওকে আরো কাছে টেনে নেয়। বলে, ভয় কী? আমি তো আছি!

এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটে। বছরও পার হয়। নতুন ক্যালেণ্ডার আবার পুরনো হয়।

সাতসকালে ত্রিদিববাবু সামনের দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে হাঁক দেন, ছবিয়া, এই ছবিয়া!

শুধু ছবি না, ওর বাবা-মাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসেন। ..

কী ব্যাপার কাকাবাবু, এই ভোরবেলায় ছবির খোঁজে এসেছেন? স্বামী-স্ত্রী প্রায় একই সঙ্গে জানতে চান।

ত্রিদিববাবু ঘরের মধ্যে পা দিয়েই হাসতে হাসতে বলেন, ছবিয়াকে আমার হাজার কাজে দরকার। এবার উনি ছবিকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, দ্যাখ ছবিয়া, সাহিত্য পরিষদের বাৎসরিক উৎসবে তোকে রবি ঠাকুরের পৃথিবী কবিতাটা আবৃত্তি করতে হবে।

ছবি একটু হেসে বলে, ওটা খুব বড় কবিতা, তাই না দাদু?

-কবিতাটা বড় ঠিকই কিন্তু তুই তো বড় হয়েছিস। ত্রিদিববাবু ওর মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, এখন তুই আর কচি খুকী না, ক্লাস সিক্স-এ পড়িস। আরো কত বড় বড় কবিতা তোকে আবৃত্তি করতে হবে।

ছবি শুধু হাসে। কোন কথা বলে না।

ত্রিদিববাবুই আবার বলেন, বুঝলি ছবিয়া, রবি ঠাকুর তো শুধু কবি ছিলেন না, তিনি বৈজ্ঞানিক ছিলেন, ঐতিহাসিক ছিলেন, দার্শনিক ছিলেন। উনি একটু থেমে হঠাৎ গলা চড়িয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথ সবকিছু ছিলেন। এই পৃথিবী কবিতাটা ভাল করে বুঝলে লক্ষ কোটি বছরের ইতিহাস জানাও হবে, বিজ্ঞান জানাও হবে।

চা-টা খেতে খেতে ছবির বাবা-মার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলার পর বিদায় নেবার আগে ত্রিদিববাবু বলেন, ছবিয়া আজ স্কুল থেকে সোজা আমাদের ওখানে চলে যাবে আর কয়েক দিন ওখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত করবে।

পড়াশুনা খেলাধুলার মাঝখানে একটু একটু করে পৃথিবী কবিতা আবৃত্তি ও সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করার কাজ এগিয়ে চলে। ছবি হঠাৎ প্রশ্ন করে, আচ্ছা দাদু, অমিত কোন কবিতা আবৃত্তি করবে না?

ত্রিদিববাবু মাথা নেড়ে বলেন, অমির দ্বারা এসব হবে না। এখনও খুবই ছোট, তবু মনে হয়, ও অঙ্কে ভাল হবে।

–কিন্তু অনেক কবিতা তো ও মুখস্থ বলে।

-তা বলে কিন্তু কবিতা-টবিতার চাইতে অঙ্ক করেই ও বেশি আনন্দ পায় বলে মনে হয়।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই অমিত ডাক দেয়, এই ছবি, শোন।

ছবি এগিয়ে এসে বলে, কী বলছিস?

–আগে চোখ বন্ধ কর।

চোখ বন্ধ করব কেন?

 দরকার আছে।

 ছবি চোখ বন্ধ করতেই অমিত বলে, হা কর।

ছবি কোন প্রশ্ন না করেই হাঁ করে। এবার অমিত ওর মুখের মধ্যে একটা টফি দিয়েই বলে, কেমন? ভাল না?

ছবি চোখ খুলেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, কোথায় পেলি রে?

অমিত নিজের মুখের মধ্যে একটা টফি দিয়ে বলে, পরশু এক বন্ধু দিয়েছিল।

ছবি অবাক হয়ে বলে, পরশু দিয়েছিল?

-হ্যাঁ।

পরশু দিয়েছিল আর আজ খাচ্ছিস?

 -তোকে না দিয়ে আমি কিছু খাই?

 ছবি অমিতকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই আমাকে খুব ভালবাসিস, তাই না?

অমিত মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ। এবার ও প্রশ্ন করে, তুই আমাকে ভালবাসিস?

ছবি ওকে খুব জোরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে, হ্যাঁ, আমিও তোকে খুব ভালবাসি।

কত দিন আগেকার কথা কিন্তু সবকিছু দিনের আলোর মত স্পষ্ট মনের পর্দায় ভেসে উঠছে ছবির। কোন কিছু ভোলেনি। ভুলতে পারে না। অসম্ভব। 

ছবি অমিতের ফটোটা তখনও হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ একটু হাসে।

–তুই কি বড় হয়েছিস যে শাড়ি পরতে শুরু করলি?

 ছবি বলে, আমাদের স্কুলের নিয়ম ক্লাস সেভেন থেকে শাড়ি পরতে হবে।

ও একবার অমিতের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, তাছাড়া আমি বুঝি বড় হচ্ছি না?

দশ বছরের অমিত একটু চিন্তা ভাবনা করে বলে, স্কুলে না হয় শাড়ি পরে গিয়েছিস কিন্তু এখন শাড়ি পরে শুয়েছিস কেন?

-কাল তো আমি এই শাড়ি পরে স্কুলে যাব না। ছবি ওর মুখের পর একটা হাত রেখে বলে, তাছাড়া আমার শাড়ি পরতে ভালই লাগে।

অমিত একটু হেসে বলে, তুই শাড়ি পরলে খুব সুন্দর দেখতে লাগে।

–সত্যি বলছিস?

-এই তোকে ছুঁয়ে বলছি। অমিত ওর বুকে একবার হাত দিয়েই বলে।

এত বছর পর সেসব রাত্রির কথা ভাবতে গিয়েও যেন ছবি একটু লজ্জা পায়। পাবেই তো! এখন যে এ দেহে কামনা-বাসনা-লালসা পাকাপাকি আসন বিছিয়ে বসেছে কিন্তু তখন কিশোরী মন-এ তো ওরা ঠাঁই পায়নি। আগের মতই ছবি ওকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, মনের কথা বলে, শোনে।

-আচ্ছা অমিত, তুই বড় হয়ে কী হবি?

 -আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো।

 তোর ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে না?

 -না।

-কেন?

–হাসপাতালের চাইতে কলকারখানা ল্যাবরেটরি আমার অনেক ভাল লাগে।

ছবি ওর মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তুই খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি, বুঝলি?

-আমি বড় ইঞ্জিনিয়ার হলে তোর ভাল লাগবে?

-হ্যাঁ, খুব ভাল লাগবে।

অমিত একটু ভেবে প্রশ্ন করে, তখনও তুই আমার কাছে শুয়ে শুয়ে এই রকম গল্প করবি?

–দূর বোকা! তখন তো আমার বিয়ে হয়ে যাবে।

-তখন তুই বরের কাছে শুবি?

 -হ্যাঁ।

-রোজ বরের কাছে শুবি? একদিনও আমার কাছে শুবি না?

–বিয়ের পর বর আমাকে তোর কাছে শুতে দেবে কেন?

–তোর বর বুঝি রাগী লোক হবে?

ছবি ঠোঁট উল্টে বলে, ভগবান জানেন! একটু পরই ও বলে, ততদিন তো তোরও বিয়ে হবে।

-সত্যি?

বড় হলে তো সবারই বিয়ে হয়।

–আমার বউ আমার কাছে শোবে?

তোর কাছেই তো শোবে। অমিত আবার একটু ভাবে। তারপর বলে, তোর মত গলা জড়িয়ে শোবে?

-তুই বললেই শোবে।

–আমি কি তোকে গলা জড়িয়ে শুতে বলি?

–আমার ভাল লাগে বলেই আমি তোকে জড়িয়ে শুই। কেন, তোর কি ভাল লাগে না?

-তোকে জড়িয়ে শুতে আমারও ভাল লাগে।  

গ্রীষ্ম-বর্ষা শরৎ-হেমন্ত শীত-বসন্তর চাকা ঘুরে চলে। অমিতের শৈশব বিদায় নেয়, শূন্য আসন পূর্ণ করে কৈশোরের ক্ষুদে রাজা। ছবিও এগিয়ে চলে। বসন্তরাজ যৌবন-এর আগমনী বার্তা অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। তা হোক। দুটি মন, দুটি আত্মা সেই একই সুরে বাঁধা থাকে।

এই ছবি, ছবি! টিফিনের সময় দূর থেকে চিৎকার করে শ্রীলা ডাকে।

ছবি ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে শ্রীলাকে দেখে ওর কাছে যায়। জিজ্ঞেস করে, ডাকছিস কেন?

–অমিত কতক্ষণ গেটের কাছে তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

তাই নাকি?

-হ্যাঁ।

ছবি তাড়াতাড়ি মেন গেটের কাছে গিয়ে দেখে সাইকেলে হেলান দিয়ে অমিত দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই অমিত বলল, তোকে ডেকে দেবার জন্য কতজনকে বলেছি।

তুই অনেকক্ষণ এসেছিস?

টিফিনের ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সাইকেলে চেপেছি।

–ইস্! তোকে কত কষ্ট দিলাম!

অমিত একটা ক্যাডবেরি চকোলেট ওর হাতে দিয়ে বলল, এই নে। আমি চলি।

ছবি একটু এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে খুব চাপা গলায় বলে, তুই খুব ভাল ছেলে!

অমিত ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। ও আর দেরি করে না। সাইকেলে উঠেই খুব জোরে প্যাডেল করে।

ছবি বিমুগ্ধ মনে ঐখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অমিতকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে।

অমিতের সি-এম-এস স্কুল থেকে ছবির মোক্ষদা স্কুল বেশ খানিকটা দূরে। ওটা আদমপুরে, এটা মসাকচকে। তবু ভাল-মন্দ কিছু পেলেই অমিত টিফিনের সময় ছুটে আসে। বরাবর। ছবিরও মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে টিফিনের সময় ওকে কিছু দিতে কিন্তু যাবে কি করে? টিফিনের সময় তো বেরুবার নিয়ম নেই। নিয়ম থাকলেও যেতে পারত না। ও তো সাইকেল চালাতে জানে না! হেঁটে সি-এম-এস স্কুল যাতায়াত করতে না করতেই তো টিফিনের ঘণ্টা পড়ে যাবে। তবে টিফিনের সময় স্কুলে গিয়ে কিছু দিতে না পারলেও ছবি মাঝে মাঝে ওকে কিছু না দিয়ে পারে না। দিতে ইচ্ছে করে; দিলে ভাল লাগে।

-এই অমিত, একটু লিচুতলায় চল।

-কেন রে?

-চল না! একটু দরকার আছে।

ছবির পিছন পিছন অমিত লিচুগাছের পাশে গিয়েই বলে, বল, কি দরকার?

ছবি আঁচলের আড়াল থেকে একটা সরু লম্বা প্যাকেট বের করে ওকে দিয়ে বলল, এই নে।

–এটা কী?

 –খুলেই দ্যাখ।

অমিত খুলে দেখে একটা ফাউন্টেন পেন। ও একটু অবাক হয়েই বলে, হঠাৎ ফাউন্টেন পেন দিচ্ছিস কেন?

-আমার বুঝি দিতে ইচ্ছে করে না?

তাই বলে এত ভাল পেন দিবি?

 ছবি স্পষ্ট জবাব দেয়, আমার অনেক টাকা থাকলে আরো অনেক দামী পেন দিতাম।

হঠাৎ দুর্গাদি ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে বলল, কিগো বৌদি, তুমি কি বাথরুমে যাবে না? নাকি খাওয়া-দাওয়া করবে না?

ছবি বিভোর হয়ে যে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করছিল, সেখান থেকে বাধ্য হয়ে মাটির পৃথিবীতে নামতেই হয়। বলে, হ্যাঁ, এখনি উঠছি।

প্রায় সবকিছু আগের মতই লকারের মধ্যে ভরে দেয়, শুধু অমিতের ফটোটা ব্যাঙ্কের পাস বইয়ের মধ্যে আলাদা করে রাখে। এবার ছবি তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করে বাথরুমে ঢোকে।

খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে নিতেও ছবি শুধু অমিতের কথা ভাবে। না ভেবে পারে না। অন্য কিছু ভাবতে মন চাইছে না।

.

ভাগলপুর থেকে চলে আসার আগের দুচারটে দিনের কথা ভাবতে গেলে এখনো ছবির চোখে জল এসে যায়। ত্রিদিববাবু ওর মাথায় হাত দিতে দিতে বললেন, তোর বাবা যখন কলকাতায় ভাল চান্স পেয়েছে, তখন তোক তো যেতেই হবে। তাছাড়া তুইও ওখানে গিয়ে ব্ৰেবোর্ন বা বেথুনে পড়তে পারবি কিন্তু তোকে ছাড়তে ঠিক মন চায় না।

ছবি পাথরের মত মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশেই অমিত দাঁড়িয়ে।

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বুঝলি ছবিয়া, তুই যদি একটু ছোট হতিস বা অমি যদি একটু বড় হতো, তাহলে বড় ভাল হতো।

ছবি আর পারে না। দুচোখ জলে ভরে যায়। কয়েক মুহূর্ত কারুর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোয় না। তারপর হঠাৎ ছবি পাগলের মত এক দৌড়ে লিচুতলায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে দুহাঁটুর উপর মাথা রেখে চোখের জল ফেলে।

একটু পরেই অমিত এসে ওর মাথায় হাত দিতে দিতে বলে, এই ছবি, কাঁদছিস কেন? দুবছর পর আমিও তো কলকাতার কলেজে পড়ব। তাছাড়া এর মধ্যে তুইও এখানে আসবি, আমিও ছুটিতে তোর কাছে যাব।

ছবি কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ তুলে বলে, সত্যি তুই আসবি?

নিশ্চয়ই আসব।

–ঠিক বলছিস ত?

-আমি কি কোনদিন তোকে মিথ্যে কথা বলেছি?

ছবি মাথা নেড়ে বলে, না।

তবে?

–তুই পুরো ছুটিটা আমাদের কাছে থাকবি তো?

–পড়াশুনার ক্ষতি না হলে নিশ্চয়ই থাকব। অমিত জোর করেই নিজের মুখে একটু হাসি ফোটায়। বলে, একবার তুই আসবি, অনেকবার আমি যাব।

ছবি যা যা খেতে ভালবাসে, ত্রিদিববাবু আজ বাজার থেকে সেই সবই এনেছেন। স্ত্রীকে বলেছেন, খুব ভাল করে রান্না করবে। আমার ছবিয়াকে আবার কবে খাওয়াতে পারব তার তো ঠিক নেই।

বৃদ্ধা একটু মুচকি হেসে বললেন, তুমি এমন একটা ভাব দেখাচ্ছ যেন ছবিকে শুধু তুমিই ভালবাস, আর কেউ ভালবাসে না।

-না, না, তা ভাবব কেন?

সেদিন রাত্রে এই বুড়ো-বুড়ীর পাল্লায় পড়ে কত কি ও কত বেশি খেতে হলো। তারপর কতক্ষণ ধরে সবাই মিলে গল্প হলো। দুতিনবার হাই তোলার পরই ত্রিদিববাবু বললেন, ছবিয়া, বড্ড ঘুম পেয়েছে, শুতে যাচ্ছি। আবার কাল গল্প হবে।

একটু পরে ওঁর স্ত্রী বললেন, আমারও বড্ড ঘুম পেয়েছে। তোরাও আর দেরি করিস না।

অমিত বলল, তুমি শোও। আমরাও একটু পরে আসছি। হ্যাঁ, একটু পরে ওরাও শুতে আসে। সেই আগের মতই বড় খাটে তিনজনের বিছানা। আগের মতই অমিত আর ছবি পাশাপাশি মুখোমুখি শুয়ে গল্প করে কিন্তু এখন আর আগের মত দুজনে দুজনকে জড়িয়ে শোয় না। বোধহয় দুজনেরই লজ্জা করে। হাজার হোক, ছবির ত বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। অমিতেরও গোঁফের রেখা বেরিয়েছে, হাফপ্যান্ট পরা বছর দুই আগেই ছেড়ে দিয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনই মানুষের পায়ে অনুশাসনের শিকল পরিয়ে দেয়।

অনেক কথার পর ছবি জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা অমিত, তুই আমাকে ভুলে যাবি না?

কোনদিন না।

–যখন খুব বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি, তখনও ভুলবি না?

 –না।

ছবি একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, যখন তোর বিয়ে হবে, খুব সুন্দর বউ আসবে, তখনও ভুলবি না?

অমিত স্পষ্ট জবাব দেয়, না।

একটু থেমে ও প্রশ্ন করে, তুই কি বর পেয়ে আমাকে ভুলে যাবি?

মেয়েরা অত সহজে কোন কিছুই ভোলে না।

কথায় কথায় রাত গড়িয়ে যায় তারপর এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।

ভোরবেলায় ছবির ঘুম ভেঙে যায়। অমিত ওর গায়ের উপর একটা পা তুলে আর হাত বুকের উপর দিয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ যেন ছবি লজ্জায় দ্বিধায় কুকড়ে যায়। না, দিদিও ঘুমুচ্ছেন। লজ্জা কেটে যায় কিন্তু শিহরণ অনুভব করে সারা শরীরে, মনে। ছবি অমিতকে দেখে, প্রাণভরে দেখে, মুগ্ধ হয়ে দেখে। কী একটা চাপা ইচ্ছা আত্মপ্রকাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু অজানা অজ্ঞাত অনুশাসনের জন্য সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। পারে না। সঙ্কোচ হয়। একটু যেন ভয় ভয় করে। ছবি ওর বুকের উপর থেকে অমিতের হাত সরিয়ে দিতে গিয়েও সরিয়ে দেয় না। পারে না। মায়া হয়। নাকি এক অনাস্বাদিত আনন্দের স্বাদ পেয়ে ওর বসন্তোৎসবের উদ্বোধন হয়?

এত বছর স্বামীর উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগের পর আজ সেই ফেলে আসা দিনের এক টুকরো স্মৃতির কথা মনে করে ছবি যেন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কিন্তু অমিত? ও কি সেই আনন্দ-স্মৃতির কথা জানে?

ছবির বিয়েতে অমিত আসতে পারেনি। বছর দুয়েক পর এক আত্মীয়ার বিয়েতে হঠাৎ দুজনের দেখা। তাও সিড়িতে ওঠা-নামার সময়। দুজনেই থমকে দাঁড়ায়। দুজনেই দুজনকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর দুজনেই হঠাৎ একসঙ্গে হাসে। দুজনেই বোধহয় একসঙ্গে প্রশ্ন করেছিল, কেমন আছ?

এ প্রশ্নের জবাব কেউই দেয়নি। দুজনেই শুধু একটু হেসেছিল।

-তোমার বরের সঙ্গে আলাপ হলো। অমিত ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।

-তাই নাকি?

 -হ্যাঁ।

কেমন লাগল।

অমিত একটু হেসে বলল, তোমার মত সুন্দরী ও শিক্ষিত মেয়ের উপযুক্তই বটে।

ছবি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে, আমি এখন দিল্লী থাকি, তা জানো?

-জানি।

 –একবার এসো না!

–সত্যি আসব?

তবে কি ঠাট্টা বলছি?

–কোন অসুবিধে হবে না?

–বিন্দুমাত্র না, বরং অত্যন্ত খুশি হব।

অমিত একটু মুচকি হেসে প্রশ্ন করল, সত্যি খুশি হবে?

–একশ বার খুশি হবো। ছবি একটু হেসে বলে তোমার মত আমিও মিথ্যে কথা বলি না।

জানি।

একে বিয়েবাড়ি, তার উপর সিঁড়িতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পাশ দিয়ে লোকজনের যাতায়াতের বিরাম নেই। তবু এরই মধ্যে একটু সুযোগ বুঝে ছবি বলে, তুমি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছ জেনে খুব খুশি হয়েছি।

অমিত একটু হেসে বলে, কী করব বলো? ঐ লিচুতলায় বসে বা আমগাছের দোলনায় দোল খেতে খেতে এমন একজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে কিছুতেই পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে পারি না।

কথাটা শুনেই ছবি মুখ নিচু করে। কৃতজ্ঞতায় ওর সারা মন ভরে যায়। নাকি গর্ব হয়? ঠিক বুঝতে পারে না। তবে এ কথাও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে, এ সংসারে ভালবাসার আদুরে গোলাপ-চারা সব মানুষের মনেই জন্ম নেয় কিন্তু সংসারের শত নির্মমতার মধ্যেও পুরুষ তাকে মন-প্রাণের সাং-জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। রাখবেই। আর মেয়েরা? নতুন জীবনের উন্মাদনার ঘোরে সে প্রথম জীবনের ঐ ভালবাসার গোলাপ-চার কথা ভুলে যায়। মুছে ফেলে সে স্মৃতি।

ছবি মনে মনে একটু অস্বস্তিবোধ করলেও নিজেকে সামলে নেয়। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, ফাঁকি দিলেই হলো? বকুনি খাবার ভয় নেই বুঝি?

অমিত হাসতে হাসতে উপরে উঠে যায়।

ছবি ভাঁটার টানে ভাসতে ভাসতে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলে। কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি, কিছু কথা, কিছু হাসি বার বার মনে পড়ে। কিন্তু তিল দিয়েই তাল, খণ্ড দিয়েই তো অখণ্ড। সব মিলিয়ে একটা সুন্দর ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

ঐ বিয়েবাড়িতে দেখা হবার বহুকাল পর মাদ্রাজে আবার ওদের দেখা হয়। শিশির অফিসের কাজেই গিয়েছিল। মাদ্রাজ দেখেনি বলে ছবিও ওর সঙ্গে গিয়েছিল। ভেবেছিল অমিতকে আগেই চিঠি লিখে জানাবে কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। ওখানে গিয়েই শিশির ফোন করল-মে আই টক টু প্রফেসর ডক্টর ব্যানার্জী?

জাষ্ট এ মিনিট স্যার।

কয়েক মুহূর্ত পরই ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি বললেন, স্পীক অন স্যার।

-অমিতাভ ব্যানার্জী!

 –আমি শিশির। ছবি আর আমি কাল রাত্রে এসেছি।

 অমিত হাসতে হাসতেই বলে, রিয়েলি?

তবে কি আমি দিল্লী থেকে ফোন করছি?

-না, না, তা বলছি না। অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের ধাক্কা সামলাতে একটু কষ্ট হয় তো! এবার অমিত এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা জিজ্ঞেস করে, কোথায় উঠেছেন, কদিন থাকবেন, এখানে কাজে বেড়াতে এসেছেন, ছেলেমেয়েকে এনেছেন কিনা, আরো কত কি!

শিশির একটু হেসে বলে, সবার আগে তোমার সৌভাগ্যের ধাক্কা সামলাবার জবাব দিই।

হ্যাঁ, দিন।

-তুমি তো ভাই জীবনে বহু সৌভাগ্য লাভ করেছ; সুতরাং তোমার তো এই সামান্য খবরে–

ওকে পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অমিত বলল, বিলেত আমেরিকার ইউনিভার্সিটি থেকে দুএকটা ডক্টরেট পাওয়া কোন ব্যাপারই না। ও বহুজনে পায় কিন্তু

-তা তো বটেই!

–কিন্তু এই মাদ্রাজ শহরে হঠাৎ আপনাদের দুজনকে পাওয়া সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার!

যাই হোক, শিশির এবার বলে, আমি অফিসের কাজেই এসেছি। থাকব শুক্রবার পর্যন্ত। তবে ছবি মাদ্রাজ দেখেনি বলে প্রায় জোর করেই এলো।

জোর করে এলো মানে?

–আমি তো কনফারেন্স নিয়েই ব্যস্ত থাকব। তাই ওকে বলেছিলাম, আমি তো তোমাকে নিয়ে বেড়াবার সময় পাব না।

-তারপর?

–ছবি বলল, অমিত তো আছে। দরকার হলে ওকে দুদিন ছুটি নিতে বলব।

অমিত বলল, দ্যাটস নো প্রবলেম কিন্তু আপনি কনফারেন্স শেষ করেই পালাতে পারবেন না।

-কিন্তু..

-আই টেল ইউ শিশিরদা, কোন কিন্তু বিজনেস চলবে না।

-আচ্ছা সে দেখা যাবে। ইন এনি কেস, ইউ রিং আপ কনিমারা রুম নাম্বার ফোর-ফোর-টু। আই উইল ট্রাই টু সী ইউ লেট ইভনিং।

শিশির বেরুবার সময় বলে গেল, অফিসে গিয়েই অমিতের সঙ্গে যোগাযোগ করে হোটেলে ফোন করতে বলবে। এতক্ষণ ফোন না আসায় ছবি যেন একটু আশাহত হয়। একটু অবাকও হয়। শিশির কি অমিতকে পায়নি? ও আবার বিলেত আমেরিকায় কোন বক্তৃতা দিতে গিয়েছে নাকি? অথবা

মন ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না কিন্তু তবু একবার মুহূর্তের জন্য ভয় হয়, অমিত বদলে যায়নি তো? জীবনে এত উন্নতি করার পরও সেই লিচুতলার স্মৃতি ..

দরজার ওপাশ থেকে বোধহয় রুম-বেয়ারা বেল বাজাল। ছবি একটু বিরক্ত হয়েই বলল, কাম ইন।

দরজা খুলে অমিতকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ছবি যেন ভূত দেখার মত অবাক হয়ে বলে, তুমি!

অমিত দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে দুএক পা এগিয়েই বলল, তুমি কি ভেবেছিলে? রুম-বেয়ারা নাকি…।

-সত্যি তাই ভেবেছিলাম। আনন্দে খুশিতে ছবির সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি তুমি এভাবে এখুনি এসে হাজির হবে, বরং

অমিত বড় সোফার একপাশে বসতে বসতে বলে, বরং কি?

ছবি ঐ সোফারই অন্য দিকে ওর মুখোমুখি বসে বলে, সত্যি ভয় হচ্ছিল, হয়ত তুমি বদলে গেছ, হয়ত পুরনো দিনের কোন কিছুই এখন মনে করতে চাও না বা ..

অমিতের মুখের হাসি দেখে ছবি থামে।

অমিত বলে, থামলে কেন? বলে যাও। শুনতে বেশ লাগছে।

ছবি দুচোখ ভরে ওকে দেখতে দেখতে বলে, যাক, বলল, কেমন আছ?

অমিত কষ্ট করেও হাসি চাপতে পারে না। বলে, কনিমারা হোটেলের রুম নাম্বার ফোর-ফোর-টুতে ছবির সামনে বসে খুব ভাল আছি।

বাঃ! বেশ কথা বলো তো আজকাল! ছবি একটু থেমে বলে, হরদম বিলেত-আমেরিকায় গিয়ে মেমসাহেবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতেই বোধহয়

-খুব অধঃপাতে গিয়েছ, তাই তো?

–ছি, ছি, ওকথা বলো না। সবাই তোমার জন্য কত গর্ব অনুভব করে।

–তুমি?

ছবি দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, না, আমি গর্ব অনুভব করি না কিন্তু ..

অমিত একটু অবাক হয়ে জানতে চায়, তুমি গর্ব অনুভব করো না?

-না। চাঁপাগাছে চাঁপাফুলই ফুটবে বা ল্যাংড়াগাছে ল্যাংড়াআমই হবে। তুমি যে ভাল হবে, বড় হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

ওর কথা শুনে আনন্দে খুশিতে অমিতের মনপ্রাণ ভরে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কেউই কোন কথা বলে না। মাঝে মাঝে দুজনের দৃষ্টি মাঝ পথে বিনিময় হয়। অকারণে দুজনেই একটু হাসে।

–ভাগলপুর যাও?

বছরে একবার ছুটি নিয়েই যাই। তাছাড়া সেমিনার কনফারেন্সে কলকাতা-পাটনা-গৌহাটি গেলেও অনেক সময় একটা চক্কর দিয়ে আসি।

–দাদু-দিদি তো ওখানেই থাকেন?

বছরের অর্ধেক সময় ওখানেই থাকেন। বাকি সময় কখনো আমাদের কাছে, কখনো দিদিদের কাছে কাটান।

ছবি আবার জানতে চায়, সব আগের মতই আছে?

অমিত মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।

–সেই লিচুগাছ, আম-পেয়ারার গাছগুলোও আছে?

ও একটু হেসে বলে, হ্যাঁ।

আবার ক্ষণিকের নীরবতা। মাঝে মাঝে দৃষ্টি বিনিময়। সলজ্জ হাসি।

অমিত জিজ্ঞেস করে, তোমার ভাগলপুর যেতে ইচ্ছে করে না?

ছবি আপনমনে কি যেন ভাবে। বোধহয় ওর কথা শুনতে পায়। জিজ্ঞেস করে, দোলনাটা এখনও আছে?

অমিত হেসে বলে, আমি তো এখনও গিয়ে দোলনায় চড়ি।

ইস্! তোমার কি মজা! ছবি দৃষ্টিটা একবার দূরের মুক্ত আকাশের দিকে ছড়িয়ে দিয়েই প্রশ্ন করে, বাগানে এখনও কাঠবেড়ালীগুলো দৌড়াদৌড়ি করে?

হঠাৎ খুব জোরে বেল বাজাতেই ছবি প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। দরজা খুলতেই রেখা আর শ্রীলা প্রায় একসঙ্গে হাসতে হাসতে বলে, এতক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছি, শুনতেই পাসনি?

ছবি হেসে বলে, সত্যি শুনতে পাইনি।

রেখা ড্রইংরুমে পা দিয়েই হাসতে হাসতে বলে, জেগে জেগে কি স্বামীকে স্বপ্ন দেখছিলি?

–এত বছর বিয়ের পর কি কেউ স্বামীকে স্বপ্ন দেখে?

 শ্রীলা বলে, তবে কি প্রথম প্রেমের স্মৃতি রোমন্থন করছিলি?

ছবি হোহো করে হাসতে হাসতে বলে, ঠিক ধরেছিস!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *