২.৩ হতাশা-কাণ্ড

হতাশা-কাণ্ড

সাগিয়ার পুনরাবির্ভাব

সরকার মানে ফৌজ। সেই ফৌজের বুকের পাটা বেড়েছে। আগে ফৌজদের ক্যাম্পগুলো থাকত গাঁয়ের বাইরে, অনেক দূর পর্যন্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। এখন তারা থাকে গাঁয়ের ইস্কুলের ঘরগুলোতে। বেলুজী ফৌজের দল যখন-তখন ঘোড়ার চড়ে গাঁয়ে গায়ে টহল দিয়ে বেড়ায়। গিধর মণ্ডল রাতে কানী মুসহরনীকে ফৌজী অফসরের তাঁবুতে পাঠায়। আর দিনে তাকে নিয়ে খা-সাহেব ইনসান আলির বাড়িতে বসে পাইকারী জরিমানার লিস্ট তয়ের করে। চৌকিদার দিহাত-এর পুলিন্দাগুলো আর ক্রান্তিদলকে দেয় না, বিক্রি করে দেয় বাবুসাহেবের বাড়ির কন্ট্রোল-এর দোকানে ঠোঙা তয়ের করবার জন্য। লাডলীবাবু আর ইনসান আলি মিলে চাল কাপড়ের আড়ত খোলে নেপালে; এখান থেকে নিয়ে যায় রাতে। বাবুসাহেবের দস্তখতে লোকে কাপড় পায়। একদিন ক্ষেতে কাজ করিয়ে নিয়ে তারপর দস্তখত দেন তিনি।

আগে রামায়ণজী শুনত কোশীজী থেকে আরম্ভ করে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পাক্কী। এখন এতদূর পাক্কী সে দেখেছে কিন্তু এর আদি অন্ত পায়নি। শুনেছে পুবে পাক্কী চলে গিয়েছে চীনের দেশে কামাক্ষ্যামাই হয়ে। পচ্ছিমেও কোথায় কোথায় যেন গিয়েছে নাম মনে আসছে না। এই রকমই হয়! রামায়ণ পড়তে শিখলেও দিহাত [৫৫৮]-এর পাতা পড়া যায় না। শেষ নেই কিছুর।

 দলের যত লোক ধরা পড়ে, তত নতুন লোক ভর্তি হয় না। আসে মধ্যে মধ্যে দুএকটা ইস্কুলিয়া এখনও, রহস্য আর রোমাঞ্চের টানে।

 দল ছোট হয়ে এলে কী হবে, দলের মধ্যের গোলমালটা দিন দিনই বাড়ছে। এটা বেশিদূর গড়িয়েছে কিছুদিন থেকে। গান্ধী গিয়েছিল জিরানিয়ায় ভাল লোহার ব্যবস্থা করতে। সেখানকার ফৌজী হাওয়াগাড়ি মেরামতের কারখানার সর্বণ মিস্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে দলের। জামালপুরের লোহাটা বড় খারাপ দিচ্ছিল। সে লোহার তৈরি পিস্তলের নিশানা বড় তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ইদানীং। জিরানিয়া থেকে গান্ধী এর জন্যে টাকা চেয়ে পাঠায়। প্যাটেল গঞ্জের বাজারের নৌরঙ্গীলাল গোলাদারের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে গান্ধীকে টাকা পাঠায়। চাঁদাটা অবশ্য তোলা হয়েছিল সাবেক ক্রান্তিদলের ধরনে, একটু জিরিয়ে নেবার অছিলায় রিভলভার সুদ্ধ কোমরের বেল্টটা খুলে সমুখের খাটিয়ায় রেখে। পুরনো থিতোনো মনোমালিন্য হঠাৎ নাড়া পেয়ে উপরে উঠে আসে। প্যাটেল বলে, বিলাকে [৫৫৯] আমার বাবাও যদি লাখ টাকা রোজগার করত তাহলে আমি তাকেও ছাড়তাম না। এই ঝগড়াটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে দলের মধ্যে। একজনের সমর্থকদের হাতে বেশি বন্দুক গেলে অন্যের সমর্থকরা ভরসা পায় না। রাতের পাহারায় দু-দলের দু-জনের এক এক সঙ্গে ডিউটি পড়ে।

দল থেকে ঠিক হয়েছে যে, যেসব লোক বিয়াল্লিশ সালে জেলে গিয়েছিল এখন ফিরে আসবে, তাদের দলে টানবার চেষ্টা করতে হবে। না হলে আনাড়ী রংরুটদের দিয়ে বেশি কিছু কাজ হবে না। জেলফেরতদের দলে আনতে পারলে লোকের চোখে দলের সম্মানটা বাড়ে আর টাকা-পয়সা-সংক্রান্ত দুর্নামটা একটু কমে। দলে যদি সে নাও আসতে চায়, বাইরে থেকেও তো সাহায্য করতে পারে। সরকার একবার যখন ছেড়েছে তখন আর চট কর ধরবে না তাদের। তাই কে কবে ছাড়া পাচ্ছে সব খবর দলের লোকের নখাগ্রে।

বিসকান্ধার বিল্টা আর বড়কামাঝি ছাড়া পেয়েছে দিনকয়েক আগে। তাই প্যাটেল রামায়ণজীর উপর ডিউটি দেয় তাদের সঙ্গে দেখা করবার। যাওয়ার সময় হঠাৎ প্যাটেল বলে, না রামায়ণজী, আমি ভেবে দেখলাম যে, বড়কামাঝির সঙ্গে দেখা করে আর দরকার নেই। ওর বুদ্ধিটা বড় মোটা। চুপচাপ কোনো কাজ ওকে দিয়ে করান যাবে না। কেবল বিল্টার সঙ্গেই কথাবার্তা বলবেন। আর কিছু না করুক দলের লোকগুলোর মোকদ্দমার তদবিরটাও যদি করতে পারে ঠিক করে কাছারীতে তাহলেও অনেক কাজ হয়। তিনগুণ করে টাকা নেবে বিজন উকিল বলেছে; তারিখের আগে তাকে মনে পড়িয়ে দেওয়ার জন্যও তো একজন লোকের দরকার। আপনার দোস্ত সে, আপনি বললে শুনবে।

বিজন উকিলের দেবার টাকাটা আসবে কোথা থেকে?

রামায়ণজী বিশেষ কিছু ভেবে বলেনি কথাটা। সকলে এর মানে নেয় উল্টো। দলের টাকা যোগাড় করবার ধরনের উপর ইঙ্গিত বলে ধরে নেয় সকলে এটাকে। আরও একটা প্রচ্ছন্ন মনের ভাব আছে রামায়ণজীর কথার পেছনে, নিজেকে দলের অন্য সকলের চাইতে ভাল ভাবা। এটা ক্রান্তিদলের লোকেরা বরদাস্ত করতে পারে না। এতগুলো উদগ্র স্নায়ুর বারুদে দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে।

গান্ধী কম্বল চাপড়ে বলে, যেমন করে হোক জোটাতেই হবে এর টাকা আর সর্বণ মিস্ত্রির টাকা। কে একজন বলে, রামায়ণগিরি ফলাতে আসো, আর নিজের ইমানদারির দিকে তাকিয়েও দেখ না?

মুখ সামলে কথা বলবি বলছি। তার ইমানদারি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এরা। এরা তাৎমাটুলির পঞ্চ না, যে ঢোঁড়াইয়ের চোখ রাঙানো দেখে ভয় খেয়ে যাবে। সার্চ করা হোক রাময়ণজীর বটুয়া। কেঁপে ওঠে রামায়ণজীর বুক। এতক্ষণে সে বোঝে এরা কী বলতে চায়। তার ঘুমোনোর সময় এরা বোধ হয় বটুয়াটা খুলে দেখে থাকবে।

 না, না, বিশ্বাস করো গান্ধী; সর্দার তুমি অবিশ্বাস কোরো না। এ রাহাজানির জিনিস নয়। ভুল ভোবো না। এই রামায়ণ হাতে করে বলছি। আমার ইমানদারিটুকুতেও যদি সন্দেহ কর তাহলে আমার আর থাকল কী?

নানা রকম জেরা করে সকলে। তার বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষও জমানো ছিল এ লোকগুলোর। এটা তার মরা ছেলের গলার মালা, এ কথা কেউ বিশ্বাস করল কিনা কে জানে। বলেনি কেন সে এ কথা আগে নিজে থেকে। তার কথাটা বিশ্বাস করলেও হয়তো সবাই তাকে স্বার্থপর ভাবছে; দলের এত দরকারের সময়ও নিজে জিনিসটা দলকে দেয়নি বলে। প্যাটেল আর গান্ধী দুজনেই তাকে নিজের দলে টানতে চায়। যে কোনো একটা দলে গেলে তার সমর্থন পাওয়া যেত এখন। শেষ পর্যন্ত সকলকে ঠাণ্ডা করে গান্ধী। প্যাটেল রামায়ণজীর পিঠ চাপড়ে কথাটা ভুলে যেতে বলে। দলের অন্য সকলে হাসি তামাশা আরম্ভ করে অন্য একটা বিষয় নিয়ে। এসব ভাব-আড়ির খেলা তাদের অষ্টপ্রহর। একটা জিনিস নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামানো আজকাল আর তাদের ধাতস্থ হয় না। মুহূর্তে মুহূর্তে এদের মন বদলায়। আমাদের শোনাতে এসেছিলে কথা, তোমাকেও শুনিয়ে দিয়েছি, দলের আর দশ জনের চইতে তুমি এক চুলও ভাল না- এই হচ্ছে সকলের মনের ভাব।

আগুন ঝলসানো ছোলার গাছগুলো নিয়ে ততক্ষণে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছে দলের মধ্যে। একজন রাময়ণজীকেও কতকগুলো দিয়ে গেল।

মনের উপর একটি দুশ্চিন্তার বোঝা নিয়ে রামায়ণজী বিসকান্ধার পথে বেরোয়। যাত্রাটা প্রথমেই খারাপ হয়ে গিয়েছে আজ; বরাতে কী আছে কে জানে। বটুয়াটা বাইরে থেকে টিপে টিপে দেখে। এইটাকে নিয়েই তো যত গণ্ডগোল হল আজকে। অথচ যার দেওয়া, সে একটা খবরও রাখে না; সে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল তার মাকে দেখতে। রাখতে পেরেছে কি তার কথা।

রামায়ণজী যখন বিসকান্ধায় পৌঁছুল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ভজন শেষ হওয়ার পর বিল্টা বাড়ি ফিরলে, তখন গিয়ে চুপচাপ দেখা করবে তার সঙ্গে। ততক্ষণ এই শীতের মধ্যে কোথায় বাইরে বসে রাত কাটাবে, তার চাইতে টোলার বাইরে মোসম্মতের বাড়িতে যাওয়াই ভাল। তা ছাড়া সাগিয়ার যাওয়ার সময়ের কথাটাও রাখা হবে। আজকের আসবার আগের ঘটনাটির জন্যই বোধহয় সাগিয়ার যাওয়ার সময়ের কথাটাও রাখা হবে। আজকের আসবার আগের ঘটনাটির জন্যই বোধহয় সাগিয়ার কথাটা বার বার মনে পড়ছে।

এদিকটায় কোনো ভয় নেই। ফৌজের ক্যাম্প কুশীর ধারে, গুটিপোকার ঘরের পাশে। মাঘ মাসে জলা জমিটার জল শুকিয়েছে। মানুষসমান একরকম ঘাসের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলার পথ। দূরে বাবুসাহেবের বাড়ির দিকে, আর কোয়েরীটোলার গিধর মণ্ডলের বাড়ির দিকে, শীতের ধোঁয়ার মধ্য দিয়েও অস্পষ্ট আলো দেখা যাচ্ছে। বাকি গাঁখানা অন্ধকার।

মোসম্মতের বাড়ির মধ্যে যেন কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ও বুড়ির চিরকাল আপন মনে বকা অভ্যাস। যাক, বুড়ি তাহলে ভালই আছে। উঠোনের ঝাঁপ বন্ধ ভেতর থেকে, এই সাঁঝ রাতেই গাঁয়ে মিলিটারি ক্যাম্প হয়েছে বলে বোধ হয়। রামাণজী দরজায় জুতো খুলে রাখে। এই জুতো পরা আর চা খাওয়ার কথাটা লোকে ব্যবহার করে ক্রান্তিদলের বিরুদ্ধে, ডাকাতি অভিযোগের প্রমাণ। গাঁয়ের সাধারণ লোক যে সৎপথে থাকলে তাদের শ্রেণীর কারও পক্ষে এই বিলাসিতা ও ব্যসনের খরচ জোটানো সম্ভব নয়। তাই জুতো পরে সাগিয়ার মায়ের সম্মুখে যেতে লজ্জা করে।

মোসম্মত! ও মোসম্মত! বাড়ি আছ নাকি মোসম্মত?

কে?

কথার স্বরটা কী রকম যেন একটা লাগে। মনটা এখনও সুস্থির হয়নি, সেই জন্য বোধ হয় এমন মনে হচ্ছে।

 মেহমান [৫৬০]।

বোধ হয় ভরসা পাচ্ছে না বুড়ি। পাশের গোয়ালঘরে একটা গোরু ডাকছে। অনেক দিন মোসম্মতের গোয়ালঘরে কাটাতে হয়েছে তাকে। গোরুটা কি তার গলার স্বর চিনতে পারল নাকি? সে গোরুটা কি আর এতদিন বেঁচে আছে?

বেড়ার ফাঁকের ভেতর দিয়ে একটা মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। গোবর লাগানো পাটকাঠির আলোটা কাছে আসছে।

 কে?

 ঢোঁড়াই!

ঢোঁড়াই!

সাগিয়া!

অজস্র প্রশ্ন ভিড় করে আসে ঢোঁড়াইরে মনে। ঝাঁপখানাকে ধরে দাঁড়াতে হয়।

ও মা, দেখে যাও কে এসেছে। সকালে দেখি এই বেড়ার উপর একটা কাক আর একটা কাকের মুখে খাবার খুঁজে দিচ্ছে। তখনই আমি মাকে বলেছি ঘরে অতিথি আসবে। আমরা মায়ে বেটিতে ভেবে মরছিলাম যে না আছে ভাতারপুত না আছে। সাতগুষ্টিতে আপনার বলতে একটা কেউ! ভয়ে মরি। অতিথি বলতে চোরডাকাত, না-হয় ফৌজী ক্যাম্পের সেপাই।

এতক্ষণে ঢোঁড়াইরের কথা বেরোয়। কবে এলে? অনেক দূর থেকে যেন এল স্বরটা।

এই তো কিছুদিন আগে। এসেই সব শুনেছি তোমাদের কথা মার কাছ থেকে। দেখি একবার মেহমানের চেহারাখানা ভাল করে।

সাগিয়া পাটকাঠিটা তুলে ধরে ঢোঁড়াইয়ের দিকে। ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে, সাগিয়া বোধ হয় আগের চেয়ে একটু প্রগলভা হয়েছে।

একি ছাই চেহারা হয়েছে ঘুরে ঘুরে। কিছু খাও-দাও, না উপোস করেই থাক? আবার ফৌজের উর্দি চড়েছে গায়ে! ও উর্দি আজকাল পচে গিয়েছে। না, সাগিয়া বদলায়নি। দরদভরা বকুনিগুলো শুনেই ঢোঁড়াই বুঝতে পারে। একটু কালো হয়েছে আগের চেয়ে, আর কথাবার্তার আত্মপ্রত্যয় অনেক বেড়েছে। বোধ হয় প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছেছে বলে, কিম্বা হয়তো পৃথিবীর সঙ্গে এই কয়বছরের যাযাবরী পরিচয়ের ফলে। ঢোঁড়াই লক্ষ্য করতে চেষ্টা করে যে সাগিয়ার চোখদুটো তার চোখের মধ্যে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে কি না, সেই আগেকার মতো। না প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় পেয়ে গিয়েছে সে। হয়তো তার আর জবাবের দরকার নেই। কিন্তু সেই সাগিয়া ঠিক তেমনই আছে। নইলে তার বকুনিটাকে কি কখনও আদর বলে মনে হয়? বুড়ি এসে ঢোঁড়াইকে জড়িয়ে ধরে। আর তো আমাদের ভুলেই গিয়েছিল তুই, বড়লোক হয়ে। তবু যে মনে পড়েছে আজ, সে আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যি।

মোসাম্মতের কথায় প্রতিবাদ করে না ঢোঁড়াই। বুড়ো মানুষ! ভাল মনে বলছে। ভাগ্যে সে জুতোজোড়া বাইরে রেখে এসেছে।

কী করবে সগিয়া ভেবে পায় না। খাটিয়াখানায় উপর কম্বল বিছিয়ে দেয়, ঘটিতে জল এনে দেয় পা ধোয়ার জন্যে, নারকেলতেলের শিশিটা পেড়ে নিয়ে গরম করতে বসে পাটকাঠি জ্বেলে। [৫৬১]

ওমা, দ্যাখ আমার আক্কেল! মার সঙ্গে গল্প করো ততক্ষণ। তেলের শিশিটা ঢোঁড়াই য়ের হাতে দিয়েই সাগিয়া ছোটে গোয়ালঘরের দিকে।

মিছে দৌড়চ্ছিস সাগিয়া। বাছুর খুলে দেওয়া হয়েছে কখন। এখন কি আর পাবি এক আঁজলাও?

মোসম্মতের কাছ থেকেই ঢোঁড়াই সব জানতে পারে। যেমন হঠাৎ চলে গিয়েছিল, তেমনি অপ্রত্যাশিতভাবেই ফিরে এসেছে। মাঝের জীবনের খুঁটিনাটিগুলো ঢোঁড়াই শুনতে চায় না। সাগিয়া ফিরে এসেছে সেইটাই সবচেয়ে বড় কথা। কী রকম যেন সাগিয়ার মাটা। সব খবর সে ঢোঁড়াইকে শোনাবে। বিদেশিয়ার দলেই সেই ফো হারামজাদাটা, কী একটি ফৌজে কাজ পেয়েছে। জায়গায় জায়গায় গিয়ে নাকি ফৌজদের গানবাজনা শুনিয়ে বেড়াতে হবে। যেমন সরকার তার তেমনি ফৌজ! সাগিয়াকে ছেড়েই দিয়েছে না-কি? সে তারপরেই চলে এসেছে। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি তাকে। সে নিজে থেকেই যা কিছু বলেছে। যেদিন আসে সেদিন শুধু বলেছিল যে, বয়স দুকুড়ি পেরোনোর পর লোকে কিছু বললে গায়ে লাগে না।

তারপর ফিসফিস করে ঢোঁড়াইয়ের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, টোলার লোকও নরম হয়েছে আমাদের উপর এখন। হবে না? সেই তুই যখন পালালি না, সেই সময় টমিরা কার বাড়িতে কী করেছিল সে তো সবার চোখে দেখা। বাড়িসুদ্ধ লোকে জানত যে টমিরা ভুট্টাক্ষেতে ঢোকে না। তাই গাঁয়ের মেয়েদের রাখা হয়েছিল ভুট্টাক্ষেতে। ঢোকে আবার না। যেতে দে সে সব কথা। আর গিধর কোয়েরী পুরনো কাসুন্দি ঘটাতে যায়?…

কী বকতেই পারে বুড়িটা। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে সাগিয়া কী যেন উনুনে চড়িয়েছে। মুখের একদিকে আগুনের আলোটা পড়েছে। সে চলে যাওয়ার দিনও হাটে তার এই রূপই দেখেছিল। মাথার কাপড়টার সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর কাঠিন্যের মুখোশটা খসে পড়েছে। এই কাজেই তাকে মানায় ভাল। কতদিন আগের দেখা কোথাকার একটি লোকের একটু তৃপ্তির জন্যে নয়; নিজের তৃপ্তির জন্যে! এর বদলে সে কিছু চায় না নতুন করে।

 তার জন্য রাঁধা…দুধ দোয়ানো…ন্যাতা দিয়ে নিকিয়ে তার উপর পিড়ি পাতা…খাওয়ার সময় একটার পর একটা করে পাটকাঠি জ্বালানো,…তার একার জন্য…আর কারও জন্যে নয়…ভাবতেও বেশ লাগে ঢোঁড়াইয়ের।

 কীর্তনের মাতন কানে আসছে দূর থেকে। এইবার বোধ হয় শেষ হবে। আঙিনায় বেড়ার উপর দিয়ে দেখা যায় ঘন কুয়াশার মধ্যে জোনাকিপোকা জ্বলছে মিটমিট করে…

মোসাম্মত বলে, হাতে জল ঢেলে দে সাগিয়া। [৫৬২]

সাগিয়া হেসে ওঠে, ঢোঁড়াই আবার মেহমান-তার আবার হাতে জল ঢেলে দিতে হবে!

বলে, কিন্তু জল ঢেলে দেয় ঠিকই।

এই যে গো সিরি পঞ্চমীর মেহমান [৫৬৩], তোমার শোবার খাটিয়া।

আজ সিরি পঞ্চমী নাকি? আর কি আমাদের দিনক্ষণের হিসেব আছে।

ঢোঁড়াই য়ের ইচ্ছা করে দুটো ক্রান্তিদলের কথা বলে সাগিয়ার কাছে একটু বাহাদুরি দেখাতে, আরও একটু আদর কাড়তে। সে সুবিধে সাগিয়া দেয় না। একটা ভাঙা কড়াতে করে উনুন থেকে আগুন নিয়ে আসে। নাও, হাত-পা গরম করে নাও। সিরি পঞ্চমীর ফাগ একটু কপালে দিয়ে দেয়। সদ্যমাখা নারকেল তেলের উপর দাগটা নেপটে বসে। কম্বলের নিচে এই কাঁথাখানা দিয়ে নাও আরাম হবে।

খেরোর বালিশটার বহুদিনের সঞ্চিত নারকেল তেলের [৫৬৪] পচা গন্ধটা, খারাপ লাগে না। মনের মধ্যে এই গন্ধের পরিচয় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে; ধূপকাঠি নিভাবার অনেকক্ষণ পরের ফিকে সুবাসের মতো; নিরাপত্তা আর স্নিগ্ধ আরামের আবেশ মেশানো। ঢোলক খঞ্জনীর শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। শোনা গেলে বেশ হত। বিল্টা তাহলে এবার বোধ হয় বাড়ি ফিরেছে। শীতের মধ্যে খাওয়াদাওয়ার পর একবার কম্বলের মধ্যে ঢুকলে আর বেরুতে ইচ্ছা করে না।

উঠোনের দুয়ারের বাইরে একটা আলো দেখা যায়। ঢোঁড়াই উঠে কপাটের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্রান্তিদলের লোকের জীবনে এসব বহুবার ঘটে গিয়েছে। কারা যেন কথা বলছে বাইরে! অন্ধকারের ভেতর সাগিয়া সাগিয়ার মার কারও মুখ চোখ দেখা যাচ্ছে না।

 সাগিয়া কোনো কথা না বলে ঢোঁড়াইয়ের হাতটা ধরে তাকে টেনে এনে বিছানায় শোয়ায়! তারপর কম্বল আর কাঁথাটা দিয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। ছি! ছি! কী ভুলই করে ফেলেছে সাগিয়া। ভেতরের থেকে দরজার ঝাঁপটা বেঁধে দিলেই খানিকটা সময় পাওয়া যেত! কে আবার এল এই রাতে! সাগিয়ার দেখাদেখি মোসম্মতও উঠোনে নামে। হাতে লণ্ঠন। কেরোসিন তেল জ্বালানো বাড়ির লোক দেখছি। কে, কারা?

কোথায় গো মোসম্মত।

 কে? গিধরের বৌ। আয় আয়। এত রাত্তিরে টোলার বার তো মনের বার।

মনের বার হলে কি আর এসেছি। আজ টোলার সিরি পঞ্চমীর ভজন আমাদের দুয়োরেই হল কিনা। তাই ভাবলাম বচ্ছরকার দিনের প্রসাদ আর ফাগ দিয়ে আসি দিদিকে। তোমার ছেলে বলল, তা দিয়ে এস না কেন। দূরও তো কম নয়। তার উপর যা দিনকাল। একা পথে চলতে দিনেই সাহস হয় না তার আবার রাতে; ঐ মুখপোড়াগুলোর জ্বালায় অতি কষ্টে গনৌজীর ছেলেটাকে সঙ্গে করে এসেছি।

 আজকাল পাইকারী জরিমানার ফৌজী হাকিম গিধর মণ্ডলের হাতের মধ্যে। তাই কেউই আর এখন গিধরকে চটাতে রাজী নয়। সেও এই হিড়িকে জাতের মণ্ডলের হৃত- সম্ভম ফিরিয়ে পাবার চেষ্টা করছে। তাই তার বাড়িতে সে সিরি পঞ্চমীর ভজনের আয়োজন করেছিল। আর সাগিয়ার কাছে গিধরের বৌ কৃতজ্ঞ। সেইজন্যেই বোধহয় আজ এই প্রসাদ আর ফাগ নিয়ে এসেছে।

গিধরের বৌ আর গনৌরীর ছেলেটা অন্ধকার শোবার ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। ঢোঁড়াইকে দেখতে পাচ্ছে না তো? এদের উঠে বসতে বলবে নাকি বারান্দায়? আগুনের কড়াখানা আনবে নাকি? সাগিয়া বলে, মা, প্রসাদ আর ফাগ নাও। শীতের মধ্যে ওরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে এমন করে?

না না, আমি আর বসব না। বাড়ির ছিষ্টি কাজ ফেলে এসেছি। গিধরের বৌকে আগিয়ে দেবার জন্য সাগিয়া আর মোসম্মত উঠোন থেকে বার হয়। দরজার বাইরে গিয়েই গিধরের বৌ বলে, জুতো দেখছি। হাতের ফুলুরিটা অতর্কিতে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে- যেমন ব্যাপারটা ঠিক ভাল করে বোঝাই যায় না, তেমনি অবস্থা হয় মোসম্মত আর সাগিয়ার। কী আক্কেল ঢোঁড়াইয়ের। এই কথাই তাহলে ওরা বাড়িতে ঢোকবার আগে বলাবলি করছিল। সাগিয়া বলে, ও-ও-ও-মা। নিশ্চয়ই ফেলে গিয়েছে সেই বৈদটা [৫৬৫]। সাদা বলদটা খাচ্ছেও না দাচ্ছেও না, দিন দিন হাড়পাঁজরা বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা বৈদ যাচ্ছিল হেঁকে। তাকেই মা ডাকল। সে বলে যে এ কিছু না। গায়ে পোকা হয়েছে তাই। একটু হলুদ খাওয়াও। কেরোসিন তেলে ছাই ভিজিয়ে তাই দিয়ে পা ডলে দাও, একদিনে সেরে যাবে। পোড়া কপালে রামজী ছাই দিয়েছেন, ছাই না-হয় জুটল; কিন্তু আজকালকার দিনে কেরোসিন তেল জোটাই কী করে;…

বিদেশিয়ার দলের সঙ্গে এতকাল সাগিয়া বৃথায় কাটায়নি। গিধরের বৌ এ কথায় ভুলল কিনা বোঝা যায় না। গনৌরীর ছেলেটা বলে, ফৌজী জুতো!

কোনো ফৌজের লোকের কাছ থেকে কিনে থাকবে বৈদটা।

গিধরের বৌয়ের কানে কথার সুরটা একটা অযাচিত কৈফয়িতের মতো ঠেকে। তারা দূরে চলে গেলে সাগিয়া মাকে বলে যে, এসব কথা আর ঢোঁড়াইয়ের কাছে তুলে দরকার নেই। একদিন একটু আরামে ঘুমোক।

আজকের মতো দিনে, তাদের বাড়িতে সে ঢোঁড়াইয়ের দুর্বহ জীবনকে অযথা ভারাকান্ত করতে চায় না।

মোসম্মত গম্ভীর হয়ে তামাক খেতে বসে। তার মনের মধ্যে কুয়াশা জমে আসে। তার মেয়ে বুঝি মেহমানকে বাঁচাতে গিয়ে, আবার নতুন করে একটা কলঙ্কের টিকা নিল কপালে। এ ব্যাপারে এখন থামলে হয়।

প্রসাদ খাওয়ার পর, ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে, এইবার যাওয়া উচিত বিল্টার সঙ্গে দেখা করতে। নইলে বিল্টা ঘুমিয়ে পড়বার পর গেলে অসুবিধে। তাছাড়া ক্রান্তিদলের নির্দেশে যে, যার বাড়িতে খাবে তার ওখানে শুয়ো না। অনেক অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই নির্দেশ। কথা না মেনে কে কোথায় কবে ধরা পড়েছে সব ঢোঁড়াইয়ের জানা। তাই আর এই ঢালা আদেশকে অহেতুক মনে হয় না ঢোঁড়াই য়ের। সে একরকম জোর করেই বিছানা থেকে উঠে পড়ে। অবাক হয়ে যায় সাগিয়া।

আমার যেতে হবে এখনি কাজ আছে।

এই রাত্তিরে!

রাত্তিরে না তো কী? সিঁদ কি দিনে কাটে নাকি লোকে? হেসে ঢোঁড়াই হালকা করে দিতে চায় মনের উপরের বোঝাটাকে। তাকে যেতেই হবে।

হ্যাঁ, তোমরা হলে কাজের মানুষ-

ঢোঁড়াই  বুঝতে চেষ্টা করে সাগিয়া কী ভেবে কথাটা বলল। ঠাট্টা করল না তো? ঠিক বোঝা যায় না। মোসম্মত দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্ছিল। একটু ফাগ চুঁইয়ে প্রণাম করে তাকে ঢোঁড়াই। বড়ডো ভালো লেগেছে তার আজকে মোসম্মতকে। বুড়িও হুঁকোটো ঢোঁড়াইয়ের মাথায় ঠেকিয়ে বচ্ছরকারদিনে আশীর্বাদ করে, রামজী করুন যেন তাদের সুমতি হয়। কেবল টাকা কামাচ্ছিস, এবারে বিয়ে-থা করে সংসারী হ। প্রসাদের থালা থেকে চিনিটুকু সাগিয়া একখান নেকড়ায় বেঁধে ঢোঁড়াইয়ের উর্দির পকেটে দিয়ে দেয়।

বুড়ি বলে, ঐ গিধর মণ্ডল বলেই চিনিটা যোগাড় করতে পেরেছিল। নইলে আজকাল কি আর পূজাপার্বণ করবার জো আছে।

 বলে সে নিজেই বোঝে যে তার কথাটা সময়োপযোগী হয়নি। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলে, এ আসবার দরকার কী ছিল?

…ঢোঁড়াই কতক্ষণই বা ছিল। মাত্র তিন-চার ঘণ্টা হবে। তবু সে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা খালি খালি লাগে। শীতের রাতের ঝিঁঝির ডাকে নিঃসঙ্গতা আরও বেশি বলে মনে হয়। ঢোঁড়াইয়ের কথা মনে করে, আগুনের কড়াইখানা কোলের কাছে টেনে নিতে সংকোচ লাগে। আকাশ-পাতাল ভেবে নিঝঝুম ঠাণ্ডা মনটাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় আনবার চেষ্টা করতে হয়। মোসম্মতের তবু তো হুঁকোটা আছে।

বাড়ির কাছেই শিয়াল ডেকে ওঠে। রাত দুপুর হয়ে গেল নাকি এরই মধ্যে? তারপর ভাকে একটা কুকুর। কুকুরের স্বরটা একটু ভাঙা ভাঙা গোছের। মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে, তার আবার কুকুর। গাঁয়ের কুকুর এতদূর এসেছে শিয়ালের পেছনে? সত্যিই ঢোঁড়াই টার কী আক্কেল! কুকুর শিয়ালেও তো জুতোটা বাইরে থেকে টেনে নিয় যেতে পারত।…মিয়াও। মিয়াও।…মা মেয়ে দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকায়। আর ভুল না হয় কারও। এতক্ষণ প্রায় বুঝেও মনকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছিল।

তখনই আমি বলেছি সাগিয়া।

মিয়াও।

কে?

 তোর পিসেমশাই।

ঝাঁপ ঠেলে টোলার ছেলের দল উঠোনে। গনৌরীর ছেলেটা ফিরে গিয়ে পাড়ায় বন্ধুদের খবর দিয়েছিল। ফৌজের লোক! ফৌজী জুতো! গাঁয়ের বাইরে করে দিলে কী হবে? জাতে তো কোয়েরী। এ কি কানী মুসহরনী পেয়েছে? এখানে এসে দেখে যে ফৌজ ফেরার। জুতো জোড়া নেই। সকলে গনৌরীর ছেলেটাকে দোষ দেয়। জুতো জোড়া তার নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। হাকিমের কাছে দাখিল করবার জন্যে। তারপর সব রাগ গিয়ে পড়ে সাগিয়ার উপর। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে; স্বভাব যাবে কোথায়। ফের যে-কে-সেই। ফৌজের লোক না হলে আর মানায় না আজকাল।

সাগিয়া কোন কথা বলে না। এইসব ছোট ছোট পাড়ার ছেলেরা। তার পেটের ছেলে বেঁচে থাকলে এদের থেকে কত বড় হত আজ। এদের কাছে নিজের চরিত্রের সাফাই দিতেও ঘেন্না করে। আর ঢোঁড়াই  এখনও কাছাকাছিই আছে।..

আগে একবার টোলা-ছাড়া করেছিলাম, এবার দেশছাড়া করাব। ভাবিস না যে ঐ ফৌজের বাপও তোদের বাঁচাতে পারবে।

হাসি-টিটকারি গালির তোড়ে, আর আসন্ন বিপদর আশঙ্কায় মোসম্মত আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এই ঢোঁড়াইটাই হয়েছে তার মেয়ের কাল।

শোন গো বাছারা।

তারপর মোসম্মত সব কথা বলে ছেলেদের। একটা কথাও লুকোয় না। ফৌজের লোক ঘরে আনবার দুর্নামের চেয়ে ঢোঁড়াইকে ঘরে আশ্রয় দেবার দুর্নাম অনেক ভাল। রামায়ণজী! চুপ! আস্তে।

 কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও এত হট্টগোল চুপিচুপি সেরে ফেলা যায় না। টোলার লোকেও তখন লাঠি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে চেঁচামেচি করতে। গনৌরীর ছেলের কাছ থেকে খবরটা জানবার পর বড়রা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে সলা-পরামর্শ করছিল। জমাট কুয়াশা চিরে ফৌজী ক্যাম্পের হুইসল বেজে ওঠে। গুটিপোকার ঘরের দিক থেকে অনেকগুলো টর্চের আলোর ঝাঁটা দেখা যাচ্ছে অন্ধকারের মধ্যে। সিটি মেরেছে রে! পালা পালা। এই এসে পড়ল বলে। থাকে কেবল, যারা যেতে পারে না। লচুয়া চৌকিদার, মোসম্মত আর সাগিয়া।

…ফৌজ যেন আগে এখানেই আসে রামজী। তাহলে ঢোঁড়াইটা খানিকটা সময় পায় দূরে চলে যাবার।

[৫৫৮. বিহার গভর্নমেন্টের যুদ্ধকালীন প্রচারপত্রের নাম ছিল দিহাত! ৫৫৯. ব্ল্যাকমার্কেটে। ৫৬০. অতিথি। ৫৬১. এ দেশে মাথায় তেল মাখার সঙ্গে স্নানের কোনো সম্বন্ধ নেই। ৫৬২. অতিথি নিজে হাতে জল ঢেলে নিলে গৃহস্থের পক্ষে তা অসম্মানসূচক। ৫৬৩. শ্রীপঞ্চমীর দিন থেকে ফাগের খেলা আরম্ভ হয়। ৫৬৪. নারকেল তেল কেবল শৌখিন মেয়েরা মাখে। ৫৬৫. গোবদ্যি।]

.

রামায়ণজীর ক্ষোভ ও আশা

মাস্টারসাহেবদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। মাস্টারসাহেব বেরিয়েই ছাপা ইস্তাহার বার করেছেন। প্যাটেল পড়ে শোনাল।

কংগ্রেসের লোক যারা আজও ফেরারী আছেন, মহাৎমাজীর আদেশ অনুযায়ী, তাঁরা যেন সরকারের সম্মুখে অবিলম্বে নির্ভীক চিত্তে হাজির হয়ে যান। মহাৎমাজীর এই আদেশের পর কারও আত্মগোপন করে থাকবার অর্থ হয় না। সর্বসাধারণকেও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, এই মাসের পর কোনো ফেরারী ব্যক্তিকে, তাঁরা যেন কংগ্রেসের লোক বলে ভুল না করেন। ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের নির্দেশ অনুযায়ী যাঁরা কাজ করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত সেই সময়ের মোকদ্দমাগুলির সম্পূর্ণ ব্যয়ভার আমরা বহন করব।

দলের মধ্যে হট্টগোল পড়ে যায়। ছাগলের দুধ খেতে খেতে মাস্টারসাহেবের বুদ্ধিতেও বোটকা গন্ধ হয়ে গিয়েছে; যাদের ফাঁসি সাজা হতে পারে তাদের বলে কিনা সারেণ্ডার করতে? এর পর আর কেউ চাঁদা দেবে ক্রান্তিদলকে? ধরিয়ে দেবে। নিজেরা তো জেলের মধ্যে বসে মজা উড়িয়েছিল এতদিন। যারা প্রাণ হাতে করে কাজ করল এতদিন বাইরে থেকে, তাদের মোকদ্দমা পর্যন্ত তদবির করবে না। দলের কে কী মনে করে মাস্টারসাহেবের ইস্তাহারে, তা ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু দেখা যায় যে, প্যাটেল হাকিমের কাছে সলণ্ডর করে দিনকয়েক পরে। আজাদ একটা কাজে নেপালে গিয়ে আর ফিরে আসে না, শুধু রিভলবার নয়, দলের দুহাজার টাকাও তার কাছে ছিল।

রামায়ণজীর দুঃখ যে, মোসম্মত আর সাগিয়াকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরে ক্রান্তিদল লেজটা পর্যন্ত নাড়ায়নি। মুখ ফুটে অবশ্য এ কথা সে বলেনি দলের লোকের কাছে। বললে তারা মিথ্যাবাদী রামায়ণজীর সঙ্গে তখনই ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিত। লেজটা পর্যন্ত নাড়ায়নি। বললেই হল। কত সওয়াল কত বহস হয়েছিল বলে! নতুন প্রস্তাব পাশ হয়েছিল, কোনো কাজে কারও বাড়ি গেলে কেউ যেন জুতো খুলে না রাখে।

কথাটা মিথ্যে নয়। তবে রামায়ণজী বলতে চায় অন্য কথা। মেয়েদের স্বীকারোক্তি নেবার সময় তাদের চোখে লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া হয়েছিল বলে যে কথাটা রটেছিল, সেটাকে নিয়ে ক্রান্তিদল মাথা ঘামায়নি। একটু খোঁজও তো নিতে পারত। নাকের সামনে যে জুলুম করছে, তাকে সাজা দেবার সাহস যদি চলে গিয়ে থাকে, আজ তবে দরকার কি এত কার্তুজ আর পিস্তল তয়ের করে। তার মনের মধ্যে দলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো জড় হয়েছে, তার সঙ্গে এটাকে সে গেঁথে রেখে দিয়েছে। সব ভাল না-লাগাগুলো জমে জমে দানা বেঁধে বেঁধে অভিযোগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেখানে।

প্রথম প্রথম যেমন দলটাকে আপন মনে হত, এখন আর তা হয় না। তা না হলে যে। নিজের কাজেই নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হত।

তবু দরকার প্রাণ বাঁচানোর। তাছাড়া আর এখন কাজই বা কী? দুদিন উপরোউপরি এক জায়গায় থাকবার উপায় নেই। চৌকিদারগুলোকে পর্যন্ত দেখলে আজকাল লুকোতে হয়। মায়া বসাবার মতো কোনো জিনিস মনের কোণায় পাওয়া যায় না। কাল মাথা গুঁজবার মতো জায়গা পাওয়া যাবে কিনা, এ কথা ভেবে মন খারাপ করতেও ভয় করে। রাতে কুকুরের ডাক শুনলে ধড়মড় করে উঠে বসতে হয়। বাতার ঘুণধরা বাঁশের কুটকুট শব্দকেও ঘোড়ার খুরের শব্দ বলে ভুল হয়। রাতের আঁধারে পথ চলতে হয়। মাঠের গোরু মোষ আর অন্য জানোয়ারগুলো বর্ষাকালে জায়গা দেখে দেখে দাঁড়ায়। তাই রাতে জলকাদার মধ্যে পথ চলবার সময় পথ ঠিক করতে হয়, কোথায় তাদের চোখ জ্বলছে তাই দেখে। রাতটা তো তবু একরকম করে কাটে, দিন আর কাটতে চায় না। ঘোড়সওয়ার ফৌজদের টহল দেওয়ার নিয়ম রাতে। কিন্তু রাতে তারা কাজে ফাঁকি মেরে ঘুমোয়, আর দিনে ঘোড়ায় চড়ে হাটে যায়, ডিউটি আর সস্তায় জিনিস কেনা একসঙ্গে সারবে বলে। তাছাড়া আছে টোলায় টোলায় সরকারের খুফিয়া [৫৬৬]। দিনের বেলা এদের নজর এড়িয়ে চলা শক্ত।

শক্ত করে ধরবার মতো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না মনের কাছে। এর পর কী তা কেউ জানে না। এত কথা, এত তর্ক, কিন্তু রামায়ণজীর মনে পড়ে না কেউ একদিনও রামরাজ্য স্থাপনের কথা বলেছে দলের মধ্যে।

এই প্রাণ বাঁচানোর চাইতেও দলের বেশি দরকার টাকার। এতগুলো লোকের খাওয়াপরা চালাতেই হবে। অনিশ্চিত এবং প্রায় অজ্ঞাত কোনো উদ্দেশ্যের জন্যে কার্তুজ আর পিস্তল তৈরির কাজ চালিয়েই যেতে হবে। ক্রান্তিদলের মোকদ্দমায় বিজন উকিল তিনগুণ ফি নেয়। সে খরচ যেমন করে থোক জোটাতেই হবে। একজন দুজন করে এক এক গেরস্তর বাড়ি গেলে তবু খেতে পাবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তাতে ভয় আছে, গেরস্ত দুষ্ট হলে। তাছাড়া লোকদের বন্দুক নিয়ে একা ছাড়তেও ভয়-ভয় করে। কত লোক যে বন্দুক নিয়ে পালিয়েছে, তার ঠিকানা নেই।

এ সাবধানতা সত্ত্বেও রোজ কানাঘুষো শোনা যায়, দলের অধিকাংশ লোকের বিরুদ্ধে। এ কেবল বাবুসাহেবের মতো কিষাণের বক্রোক্তির মধ্যে দিয়ে নয়। আজকাল অভিযোগ আনে ঘোড়ায়-চড়া গরিব হাটুরে, পাটের গাড়ির গাড়োয়ান, পরিষ্কার ভাষায়; ক্রান্তিদলের লোকের বন্দুক দেখিয়ে পাঁচ টাকা দশ টাকা নেওয়ার অভিযোগ। সব বুঝেও গান্ধী বলে, ক্রান্তিদলের নাম করে কোনো বদমাশ রাহাজানি করে বেড়াচ্ছে। একবার ধরতে পারলে হয় শালাকে।

রাঙাআলু তোলা ক্ষেতের মধ্যে খুঁটে খুঁটে, খুঁজে খুঁজে যখন আর একটা কড়ে আঙুলের মতো মোটা শেকড়ও পাওয়া যায় না, তখন যদি দলের দুজন নতুন লোক বলে যে দেখি কিছু মুড়ি-চিড়ের যোগাড় করতে পারা যায় কিনা গাঁয়ে, কে আর জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছে তাদের কাছে পয়সা আছে কিনা। কথা বাড়িয়ে লাভ কী।

এই অস্থির-অনিশ্চিত জীবনে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো ক্রমে ভোঁতা হয়ে আসে, ভাববার ধারা চলে অপ্রত্যাশিত খাতে, এস্ত চঞ্চল চোখের চাউনিতে সকলের সন্দেহের ছায়া পড়ে। কেউ কাউকে বিশ্বাস পায় না। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া বেধে ওঠে। উৎসাহের ফেনা মরে এসেছে। শক্ত অবলম্বন চায় মন। মন্থনদণ্ডের গায়ে ফেনাটা লেগে থাকলে বাঁচতে পারে। তাই রামায়ণজী দিন দিন নিজেকে বেশি করে গুটিয়ে নেয়, রামায়ণ খানার মধ্যে।

[৫৬৬. গুপ্তচর।]

.

দৈবানুগ্রহে এন্টনির সাক্ষাৎ লাভ

রামায়ণের আড়ালে গিয়েও মনের অস্থিরতা কাটে না রামায়ণজীর; ওর মধ্যে ডুবে থেকেও মনে বল পায় না। স্বাদ পাওয়া যায় না কিছুতে। একটা সর্বগ্রাসী উদাসীনতার ছায়া পড়েছে মনের উপর। হয়তো রামায়ণজীর মতো দলের আরও অনেকের মনের ভাব এই রকম। কে আর জানতে পারছে! আজকাল দলের লোকেরা যা ভাবে তা বলে না, যা বলে তা করে না। সর্দারেরও সকাল সন্ধ্যার পুজোটা বেড়েছে।

আবার বলতে আসে যে, সাগিয়াদের গ্রেপ্তারের সময়- লেজ নাড়ায়নি সে কথা ভুল! দল কই, দলের লেজটুকুই তো আছে। সেইটুকুই তিড়িং-মিড়িং করে লাফায় টিকটিকির খসা লেজের মতো; প্রাণটুকু বাঁচানোর উদ্দীপনায় লাফায়; না ভাবার লোকসানটা পুরিয় নেবার জন্য লাফায়। মূল শেকড় কেটে গিয়েছে। এখন বাঁচাতে হলে ছোট ছোট বিধিনিষেধ, আর বড় বড় কথার মধ্যেই বাঁচতে হবে। প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টার একঘেয়েমিটুকুকেই ভালবাসতে হবে; প্রাত্যহিক মিটিনের বিরামহীন তুচ্ছতাগুলোতে আনন্দ পেতে হবে।

নইলে হবে এই রামায়ণজীর হাল। সে সমান তালে পা ফেলে চলেছে দলের সঙ্গে; কিন্তু হোঁচট খেতে খেতে ছুটেছে একঘেয়েমি থেকে উদাসীনতার পথে, তারপর উদাসীনতা থেকে বিতৃষ্ণার দিকে। পথ ফুরিয়ে এসেছে।

তাই আজকাল মিটিনের সময়ও সে বহু দূরে বসে থাকে রামায়ণ খুলে। কেউ কিছু বলে না। দলের যে ঝাঁঝ মরেছে। সকলেই জানে যে, পড়তি পরিবার যখন আর চাল মেরামতের পয়সা জোটাতে পারে না, তখন দেওয়ালের হাতি ঘোড়ার রঙ্গেলি গুলোতে [৫৬৭] ভাল করে রঙ দেয়।

সেই জন্য আজকাল হয়েছে মিটিন আর মিটিন, আর মিটিন। সুযোগ আসছে, তৈরি হও, তৈরি কর, এ কথা গত আড়াই বছর ধরে প্রতি মিটিনে তারা শুনেছে।

আজকের মিটিনে মনোহর কা বলেই ফেলল। আবার কবে আসবে? আর এসেছে সুযোগ।

 গান্ধী চটে ওঠে, সেদিনের ছোকরা ইস্কুল পালিয়ে ক্রান্তিদলে এসেছে। শালিখের রোয়ার মতো গোঁফ। আজ দরকার পড়লে যে গোঁফদাড়ি গজিয়ে চেহারা বদলাতে পারবে, সেটুকুসুষ্ঠু হয়ে উঠবে না তোমার দ্বারা। আর কেবল বড় বড় কথা। তুমি হচ্ছ ভাদ্রের শিয়াল, বোঝো তো? একটা শিয়াল ভাদ্র মাসে জন্মেছিল। আষাঢ় শ্রাবণ দেখেইনি। জন্মেই বলে, এত বৃষ্টি তো কখনো দেখিনি। তোমার হয়েছে তাই।…

সকলের মনের কথা বলেছে ইস্কুলিয়াটা। কিন্তু কেউ তার পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে সাহস করে না। তাহলেই সে হয়ে যাবে হয় কাপুরুষ, না হয় গুপ্তচর। কেবল এই ভয়টার জন্যেই কেউ কিছু বলল না তা নয়। ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্ত্বর বিজা সিং হওয়ার স্বপ্ন এদের বহুদিন আগেই ভেঙেছে। সকলে মনে মনে বোঝে যে, এ দানের খেলায় তারা হেরে গিয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ফেরবার পথটা পর্যন্ত বন্ধ করে এসেছে। একটা কিছু হয়তো এখনও ঘটে যেতে পারে, এই মিথ্যে সান্ত্বনাটুকুও যদি নিজের মনকে না দিতে পারে, তাহলে এরা কী নিয়ে বাঁচে। সেটাও বন্ধ করে দিতে চলেছিল আজকের মনোহর ঝা, খোলাখুলিভাবে আলোচনা করে। ঠিক জবাব দিয়েছে গান্ধী।

কিন্তু আজকের মিটিনটা আর এরপর জমবে না। ইস্কুলিয়াদের দল এরই মধ্যে বিড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি আরম্ভ করে দিয়েছে। এখনই নিশ্চয় তুমল ঝগড়া শুরু হয়ে যাবে। রামায়ণজীর রামায়ণ যেমন-কে-তেমন সম্মুখে খোলা পড়ে রয়েছে। অন্যমনস্কভাবে একটা ঘাসের শিষ ছিঁড়ে নিয়ে সে দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে সম্মুখে; কিন্তু দেখছে না; মন উড়ে গিয়েছে কোথায়।

নতুন একটা ছোকরা এল এখনই। চুপ! চুপ! কে আবার এল! কোনো খবর ছিল নাকি আসবার, গান্ধী? সকলের হাত চলে গিয়েছে কোমরে। কাঁধে একটা থলে! মোচ ওঠেনি এখনও ভাল করে! তাহলে নিশ্চয়ই ইস্কুলিয়া! কামিজ আর হাফপ্যান্ট দেখেই বোঝা গিয়েছে। এরকম তো হরহামেশা যায় আসে, ক্রান্তিদলের আজকের এই দুর্দিনেও! একজন বড় বড় গোঁফদাড়িওয়ালা লোক ঠাট্টা করে, গান্ধী, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে নিও, মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে কিনা। না হলে আবার হরেসোয়ারের মতো রাতে কান্নাকাটি করবে ভূতের ভয়ে।

এই হাসির অভ্যর্থনায় ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সকলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তবু খানিকটা সময় কাটবে। ভিড়ের মধ্যে থেকে গান্ধীর গলার আওয়াজ শোনা যায়।

সর্বণ মিস্ত্রি এত কম লোহা দিল কেন? এটুকুতে কী কী হবে?

বলেছে বারে বারে নিয়ে আসতে। এক সঙ্গে বেশি আনা ঠিক নয়।

বাড়ি কোথায়?

জিরানিয়ায়।

রামায়ণজীর কান খাড়া হয়ে ওঠে। সে সোজা হয়ে বসে। ছি! রামায়ণ পড়তে পড়তে হাত ঠো করেছে। হাতের ঘাসের শিষটা ফেলে সে হাতধোয়ার জলের জন্য ওঠে।

নাম?

এন্টনি।

আসল নাম বলুন। আমাদের কাছে লুকোনোর দরকার নেই।

 ওই এন্টনিই আমার আসল নাম। আমরা কিরিস্তান যে।

 কিরিস্তান! কিরিস্তান এসেছে ক্রান্তিদলে! সকলে এই অদ্ভুত জীবটিকে ঘেঁষে দাঁড়ায়। সরকারের চর নয় তা? কিরিস্তান, মুসলমান, এরা কখনও ক্রান্তিদলে আসে? পাইকারী জরিমানার লিস্টে নাম চড়ে না এদের।

সর্দার।

সর্দারকে কী একটা ইঙ্গিত করে মুখে-বিড়ি দুটো ইস্কুলিয়া হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ল।

 সর্দার কনৌজী ব্রাহ্মণ। ক্রান্তিদলে এসেছে বলে জাত দিতে পারে না। গত বছর একজন মুসলমান নাচগান শেখাবার জন্য দিন পনের দলের সঙ্গে ছিল। তখন খাওয়ার সময় সর্দার অন্য লাইনে বসত। তাই নিয়েই এই ঠাট্টা। আবার এক কিরিস্তান এল। এইবার জমবে সর্দারের!

সর্দার কটমট করে ছেলেদুটোর দিকে তাকায়। ফাজিল কোথাকার! গান্ধীর জেরা এখনও শেষ হয়নি।

আপনার পিতাজীর নাম?

আমার পিতাজীর নাম ছিল সামুয়র।

 বিয়ে করেছেন?

না।

বাড়ি জিরানিয়ার কোথায়?

 শহরে না। ধাঙড়টুলি জানেন? ঐ পার্কীর ধারে যেদিকে ফৌজী হাওয়াগাড়ির কারখানা আর টমি অফিসারদের ঘর হয়েছে, সেই দিকে ছিল আমাদের বাড়ি! ধাঙড়টুলির সকলকে উঠে যেতে হয়েছিল সেই সময়। টোলাসুদ্ধ সকলে চলে গিয়েছে মোরঙ্গে [৫৬৮] চাষবাস করতে। লোকজন বেশি হলে তার মধ্যে ধাঙড়রা থাকে না। কেবল কিরিস্তানরা যায়নি। কলস্টর সাহেব নিজে এসে তাৎমাটুলিতে সব কিরিস্তানের থাকবার জায়গা করে দিয়েছে। তাই আমরা এখন থাকি তাৎমাটুলিতে।

আমরা মানে?

 আমি আর আমার মা।

 তোমাদের চলে কিসে?

জিরানিয়ায় সাতজন ফৌজী অফিসার থাকে, টমি। ঘাসের অফিসার, চাষের অফিসার, ঘোড়া গোরু অফিসার, মোটর- মেরামতির কারখানার অফিসার, সব মিলিয়ে। তাদের খাওয়া-দাওয়ার দেখাশুনা করে বেটিসসাহেবের বিধবা মেম। আর তাকেই সাহায্য করে আমার মা। ফাদার টুডু পাদরিসাহেব আছে না, সেই করিয়ে দিয়েছিল কাজটা।

থাক, সর্বন মিস্ত্রি বিশ্বাসী লোক। সে যখন পাঠিয়েছে তখন আর ভাববার দরকার নেই। এত খুঁটিনাটি কেউ বানিয়ে বলতে পারে না। গান্ধী প্রশ্ন করা বন্ধ করে।

কিছু মনে কোরো না। নতুন লোককে এসব জিজ্ঞাসা করা আমাদের নিয়ম। রামায়ণজী এঁটো-হাতটা ধুয়ে ঘটিটা মাটিতে রাখতে ভুলে গিয়েছিল। প্রথমটায় মাথার মধ্যেটা মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ নিভে যায়। তারপর ঠাণ্ডা ঝিমঝিম মাথাতে, একটা অজ্ঞাত, অপ্রত্যাশিত উত্তেজনার ঢেউ লাগে। সম্বিতের সঙ্গে সঙ্গে এটা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে আর মনে।

…যা ভয় করছে যদি তাই হয়! চারিদিক থেকে সকলে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ছেলেটাকে। সরবার কোন লক্ষণ নেই। কেবল কতকগুলো মাথা, উর্দি আর পায়ের মেলা। অথচ নিজে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার চেহারাটা ভাল করে দেখবার সাহস নেই রামায়ণজীর।

কৌতূহলের চাইতে আশঙ্কা বেশি তার মনে। অথচ এই সত্যি কথাটা সে স্বীকার করতে চাইছ না। তবু তাকে দেখতেই হবে। যতক্ষণ না দেখছে নিস্তার নেই তার! ওদিকে আগিয়ে যাবার সময় তার বুক দুর দুর করে। শেষ মুহূর্তে মনে হয় যে, সে মিছে এতদিন নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে এসেছে। ছেলেটার রঙ নিশ্চয়ই সাহেবদের মতো, চুল কটা, চোখ বিড়ালের মতো। দেউলে যদি হতেই হয়, তবে কিনে নে হাতি, এমনি একটা বেপরোয়া তাচ্ছিল্যের ভান করে সে ভিড় ঠেলে ঢোকে। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা আছে যে, খারাপটা, ভেবে নিলে ভালটা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

জয় হে রামচন্দ্রজী! ধন্য তোমার করুণা! ছেলেটার রঙটা ঘষা কালো। চোখ, চুল সব কালো, বয়সের আন্দাজে বেশ জোয়ান চেহারা। কতই আর বয়স হয়েছে! এই তো পনর বছর এখনও পোরেনি।…

 তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদ থেকে আজ রামায়ণজী বেঁচে গিয়েছে।

 এ যে না হয়েই পারে না। এখনও যে চন্দ্র সূর্য মুছে যায়নি আকাশ থেকে। সবাই মিলে একে পর করে দিয়েছে। কিরিস্তান করে দিয়েছে। হয়তো অখাদ্য কুখাদ্যও খাইয়ে থাকবে। কিন্তু তাহলেই কি আপন রক্ত হয়ে যায় নাকি? গঙ্গাজীতে ময়লা পড়লে কি জল খারাপ হয়। ছেলে যে সোনা। গলালে পোড়ালেই যে সোনার আসল রূপ খোলে। গায়ের আঁচিলটা বলে খুঁটে ফেলা যায় না, আর এ তো হল ছেলে। আপন বলতে তো তার এই একটা জিনিসই আছে।

গান্ধী পরিচয় করিয়ে দেয়, ইনিই রামায়ণজী।

রামায়ণজী।

এঁর নাম শুনেছে এন্টনি ক্রান্তিদল-ফেরত স্কুলের একজন বন্ধুর কাছে।

ছেলেটি রামায়ণজীকে নমস্কার করে। নম্র অথচ বেশ সপ্রতিভ ছেলেটি। কতদূর হেঁটে এসেছে! একেবারে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো! এখনও মুখ চোখে জল দেবার সময় পায়নি।

এই ইস্কুলিয়ারা। তোমরা কি কেবল গল্পই করবে। অন্তত প্রথম দিনটাতেও একটু খাওয়া-দাওয়া যোগাড় করে দাও এন্টনির জন্যে। উর্দির পকেটের নেকড়া বাঁধা চিনিটুকু রামায়ণজী সকলের অলক্ষ্যে ঘটির মধ্যে গোলে, এই শান্ত ছেলেটাকে একটু শরবত খাওয়ানোর জন্যে।

[৫৬৭- রঙিন আলপনা! ৫৬৮. নেপালের একটি জেলা।]

.

হতাশার রাজ্যে নূতন নাগপাশ

রামজীর কৃপায় রামায়ণজী তার হারানো ধন ফিরে পেয়েছে। নেড়েচড়ে উলটে পালটে কতরকম করে দেখে। আদেখলের তৃপ্তি আর হয় না, রোজ রোজ দেখেও। মনের আলগা শেকড়গুলো আবার খানিক রসাল মাটির সন্ধান পেয়েছে। পরিবেশের একটানা রুক্ষতায় তার প্রাণ আর হাঁফিয়ে ওঠে না। আকঁড়ে ধরবার মতো জিনিস পেয়েছে সে হাতের কাছে। দুনিয়া আজ তার প্রতি অনুকূল। মনের উপরের গাদ মরেছে, নিচের থিতুনো তলানি সরেছে। একটা অনাবিল ক্ষমাশীলতায় তার মনপ্রাণ ভরে আছে।

 …সব ভাল, সবই ভাল। উপর থেকে শুধু খারাপটুকুনি দেখা যায় বলে লোকে ভুল ভাবে। দলের লোকেরা যে ছোট ছোট তুচ্ছতার মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে রাখে, তা তাদের মন ছোট বলে নয়; রামরাজ্য না আনতে পারবার দুঃখ ভুলতে চায় বলে। আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচতে চায় বলে। তাৎমাটুলির সমাজও তাকে ন্যায্য শাস্তিই দিয়েছিল। ছেলে হয়ে সে বাওয়ায় মনে দুঃখ দিয়েছিল। অভিমানে বাওয়াকে দেশত্যাগী হতে হয়। জাতের দেবতা পঞ্চের মুখ দিয়ে সেই অভিমান শাপ হয়ে বেরিয়েছিল, মনের কাছ থেকে প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নেবার ব্যথা কেমন হয়, সেইটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে। চোখের জলে বুক ভেসেছিল বাওয়ার, আর তার মন কেঁদেছে। এতদিন গুমরে গুমরে। বাওয়া ছিল পুণ্যাত্মা লোক, তাই সে ঘুরে বেড়াতে পেরেছে রামজীর মন্দিরের দুয়োরে দুয়োরে। আর রামায়ণজী পাপী মানুষ, তাই তাকে ঘুরে মরতে হচ্ছে মঘাই ডোমের [৫৬৯] মতো। রামিয়ার উপরও সে অন্যায় করেছিল, অবিচার করেছিল। সীতাজীর চাইতেও বেশি দুঃখ তাকে সইতে হয়েছে। পশ্চিমের তরিবৎ আর উঁচু সংস্কার ভুলতে হয়েছে। যে লোকটার আশ্রয় নিয়েছিল সেটা সুদ্ধ মরেছে আসামের চা-বাগানে। এখন পাদরির পা চেটে, আর টমিদের পাত চেটে দু-দুটো পেট চালাতে হচ্ছে। এন্টনির কাছ থেকেই সকলে শুনেছে এসব কথা। নিজের থেকেই যা বলে, নইলে রামায়ণজী কি জিরানিয়ার কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে ছেলেটার কাছে। রামায়ণজীর সবচেয়ে জানতে ইচ্ছা করে যে, সামুয়র হিন্দু হয়ে গিয়েছিল বলেই সবাই জানত। আবার কিরিস্তান হল কী করে? ঐ পাদরিটার জন্যেই তাহলে রামিয়ার জাতিধর্ম সব গিয়েছে। কত কী হয়তো খেতে হয়েছে। তা হোক, তবু পাদরিসাহেব লোক ভাল। এন্টনিই বলেছে গান্ধীর কাছে যে, সে জিরানিয়ার জেলা ইস্কুলে পড়ে। ইস্কুলে পড়বার খরচ দেয় পাদরিসাহেব। বড়লোকদের ইস্কুল সেটা, লাডলীবাবুর ছেলে পড়ে, রাজপারভাঙার ছেলে পড়ে। এই পাদরিসাহেবকে কি সে খারাপ লোক ভাবতে পারে?

 যেদিন থেকে এন্টনি এসেছে, ঢোঁড়াই তাকে চোখে চোখে রেখেছে। ক্রান্তিদলের মেম্বর হওয়ার গৌরবের আমেজ, তার মন থেকে এখনও কাটেনি। এইটাকেই রামায়ণজী ভয় করে। আর দুদিন যেতে দে, তারপর বুঝবি। এখন নতুন নতুন তেঁতুলের বীচি। এখনও কেন যে মরতে আসে ছেলেরা এই দলে তা রামায়ণজীর মাথায় ঢোকে না। দলে নিত্যি নতুন কাণ্ড লেগেই আছে। হতাশার আঁধারের মধ্যে ছুটতে ছুটতে দলের অনেকে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কবে একটা কী করে ফেলবে, তখন আর এন্টনির ফিরে যাওয়ারও পথ থাকবে না। ইস্কুলে কী পড়ায় ছেলেদের? ইস্কুলিয়াগুলোর আজকের দিনেও মোহ কাটছে না। ক্রান্তিদলের নামের! এন্টনিটা এখন সোবাসবাবু [৫৭০] কবে যেন রেডিওতে কী বলেছিলেন, সেই কথাই বলে। তিনি আর এসেছেন। এক এই নিরর্থকতার গণ্ডি থেকে বাঁচাতেই হবে। ঐ অবুঝ ছেলেটার ভবিষ্যৎ সে নষ্ট হতে দিতে পারে না। ক্রান্তিদলকে সাহায্য করতে ইচ্ছা হলে, জিরানিয়াতে থেকেও করা যায়। দরকার পড়লে সর্বণ মিস্ত্রির কাছ থেকে জিনিসপত্র পৌঁছে দেবার কাজ করতে পারে। একবার ভালভাবে জড়িয়ে পড়বার বাঁধনটা বড় শক্ত। এখনও ছেলেটার মনে পেঁচ ঢোকেনি। সেদিন ও জিজ্ঞাসা করছিল আচ্ছা রামণজী, ইস্কুলে যে শুনেছিলাম, একদিন ফৌজের গুলি লেগেছিল তোমার গায়ে। সেটা পকেটের রামায়ণখানায় লাগাতে তুমি বেঁচে গিয়েছিলে। নিশ্চয়ই ছিটেভরা কার্তুজ ছিল! তাই নয়?

 দূর বোকা কোথাকার। এসবও তোরা বিশ্বাস করিস মেয়েদের মতো! ইস্কুলে পড়িস কেন বুঝতে পারি না।

ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল।

 সেদিন হুল্লোড় করে সবাই স্নান করছে কুয়োর ধারে। এন্টনিটা মাথায় জল ঢালছে। জলটা মাথা দিয়ে পিঠ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু ঘাড়ের কাছের খানিকটা জায়গা, ঠিক যেমনকে-তেমন শুখনোই থেকে যাচ্ছে। গায়ে জলটা পর্যন্ত নিজে নিজে ঠিক করে ঢালতে শেখেনি ছেলেটা। দেখে দেখে আর রামায়ণজী থাকতে পারে না। দে তো দেখি বালতিটা বলে কুয়োতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। এই এমনি এমনি করে ভিজো ঐ জায়গাটা! অন্য সব ইস্কুলিয়াগুলো হেসে ওঠে। রামায়ণজীর এই ছেলেটাকে নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি সকলেই লক্ষ্য করেছে। রামায়ণজী এ হাসি গায়ে মাখে না। সে তখন নিজের ভাবেই বিভোর- ছেলেটার মাথায় যদি একটি টিকি থাকত, তাহলে কী সুন্দর মানাত! সবচেয়ে আনন্দের কথা, ছেলেটাও রামায়ণজীকে পছন্দ করে। এমন বেআক্কিলে ছেলে যে বাড়ি থেকে, একখানা কম্বল পর্যন্ত আনেনি সঙ্গে।..

 রামায়াণজী চুপিচুপি বলেছিল, সেগুলো মিলিটারি অফিসারদের কম্বল কিনা। কোনো দিকে ইংরেজি হরফে লেখা। দেখলেই সবাই বুঝবে যে, কোথা থেকে পেয়েছে তাই আনিনি সঙ্কোচে।

লজ্জাটা কিসের শুনি? ক্রান্তিদলের কি মিলিটারি রিভলবার নেই?

 বলে বটে রামায়ণজী। তবু মিলিটারি অফিসারগুলোর উপরে কৃতজ্ঞতার বদলে কেন যেন আক্রোশ জমে ওঠে।

লজ্জা কী, আমার কম্বলেই শো। আমি বলছি শো।

 সবাই ঘুমোলে, ঘুমন্ত ছেলেটার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অন্ধকারে ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে কার সঙ্গে যেন একটা সাদৃশ্যর কথা মনে ভাবতে চেষ্টা করে। নিজে হাওয়া খাওয়ার ছেলে একখানা পুরনো খবরের কাগজ দিয়ে ছেলেটার গায়ের থেকে মশা তাড়ায়। আহা, পিঠটা ঘেমে উঠেছে। মাটি থেকে এখনও গরম ভাপ উঠছে কিনা! নিদ্রাহীন চোখের সমুখে তাৎমাটুলির মধুর স্মৃতির ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে… একটা পচ্ছিমা ছবি…পিদিম দিতে এসেছে গোঁসাইথানে।…

রামায়ণজী বুঝতে পারেনি, কখন সে গুনগুন করে কটা রাময়ণের চোপই গাইতে আরম্ভ করেছে, ছোটবেলায় বাওয়ার সঙ্গে ভিক্ষা করতে যাবার সময় যেমন গাইত।…হঠাৎ এই কথাটা তার খেয়াল হয়। পাগলামি না! গত এক বছরের মধ্যে দলের কেউ গান গেয়েছে বলে মনে পড়ে না। সেন্ট্রিডিউটিতে ছিল একজন ইস্কুলিয়া। সে ঘুমেভরা স্বরে চেঁচায়, রস জেগেছে কার এই রাতদুপুরে? দলসুদ্ধ সকলকে ধরাবে নাকি? যাক! রামায়ণজী আগেই সাবধান হয়ে গিয়েছে। নতুন ইস্কুলিয়াদের মধ্যে কেউ জানেও না যে, রামায়ণজী আগেই সাবধান হয়ে গিয়েছে। নতুন ইস্কুলিয়াদের মধ্যে কেউ জানেও না যে, রামায়ণজী আবার গাইতে জানে।

 ঘুমন্ত ইস্কুলিয়াদের মধ্যে থেকে একজন গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠে। তারপর একে একে সব ইস্কুলিয়াদের গলা খাঁকানোর শব্দ রামায়ণজীর কানে আসে। সব কটা তাহলে মটকা মেরে পড়ে ছিল এতক্ষণ! এখন খিকখিক করে হাসা হচ্ছে। অতি বদ এই ছেলেগুলো! একটা বলছে, রামায়ণ পড়া ছেড়ে দিয়েছে আজকাল রামায়ণজী কিছুদিন থেকে, দেখেছিস? পছন্দ না করলেও রামায়ণজী মনে মনে স্বীকার করে যে, কথাটা মিথ্যে নয়। তবে হ্যাঁ ছেড়ে দিতে যাবে কেন রামায়ণ পড়া। এমনিই পড়ে না; মানে এই-হয়ে হয়ে ওঠে না- আর কি।…

[৫৬৯. বেদেদের মতো একটি যাযাবর জাত। এরা Criminal Tribes-এর অন্তর্গত। ৫৭০. সুভাষবাবু।]

.

হৃদয় অন্বেষণের ফল

সেদিন পামারসাহেবের ভাঙা নীলকুঠিটাতে ছিল ক্রান্তিদল। এই পামারসাহেবেরা বাপদাদার আমলে নোট ছাপত। এখন এদিকটায় এত ঘন জঙ্গল যে, লোকজন কেউ আসে না। লোকে বলে বাঘ থাকে।

 দিনের লু বাতাসটা থেমেছে অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু গরম কমেনি তখনও। এন্টনি অনেকক্ষণ ধরে কম্বলের উপর এপাশ-ওপাশ করছে। দুবার ঘটি থেকে জল খেল। রামায়ণজী আর থাকতে পারে না।

কী রে, কী হয়েছে এন্টনি? উঃ আঃ করছিস কেন? ঘুম আসছে না? জবাব দিস না কেন? দম আটকানি ধুলোতে হাঁসফাঁস লাগছে? এ ছেলে কিছু কি বলবে? গায়ে হাত দিয়ে দেখে গাটা গরম আগুন।

সেই রাতেই আরম্ভ হয়ে যায়, এন্টনির সুলবাই[৫৭১]। পশ্চিমে ধুলোর ঝড়ে বোশেখ মাসে প্রতি বছর এর বিষ ছড়িয়ে দেয় মুল্লুক, জুড়ে, এ কথা জিরানিয়া জেলার প্রত্যেকে জানে। ছোট ছেলেপিলের এ রোগ হলে আর নিস্তার নেই; বড়দের মধ্যে তবু অনেকে বাঁচে। তাই বছরের মধ্যে ধুলোর ঝড়ের সময় এলে মায়েরা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে। অন্য রোগে তবু ঝাড়ফুক তন্তরমন্তর চলে; কিন্তু এর দেবও নেই, দানোও নেই। বেহুঁশ জ্বরে আরম্ভ, তারপর বাস! চারদিনের মধ্যেই খতম। যেটা বাঁচে লোকে বলে বাগভেরেণ্ডার রস বাতাসার মধ্যে দিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল বলেই বেঁচেছে। আর যেটা মরে সেটার বেলায় বুকচাপড়ানি কান্নার মধ্যে বাগভেরেণ্ডার রস কেন কাজে লাগল না, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামানোর সময় পায় না।

এর পরের কয়দিন রামায়ণজী লড়েছে যমের সঙ্গে একা হাতে।

ভাগ্যে নীলকুঠিটার কাছে তারা তখন ছিল, তাই ছেলেটা মাথা গুঁজবার একটা জায়গা পেয়েছিল। জরুরী মিটিন বসে। দলের সকলের এক জায়গায় বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। তার উপর রোগটাও ছোঁয়াচে। সারলেও গায়ের জোর ফিরে পেতে অনেক সময় নেবে। রামায়ণজীকে এন্টনির সেবার জন্য অনেকদিন থেকে যেতে হবে, সেটা দলের লোকেরা এত ভালভাবে জানে যে, সে সম্বন্ধে প্রস্তাব পাস করতেও তারা ভুলে যায়। কেবল ঠিক হয় যে, কান্তলাল বলে একজন রামায়ণজীকে সাহায্য করবার জন্য এখানে থাকবে। লোকটা বেশ চালাক চতুর।

 যাবার সময় গান্ধী রামায়ণজীকে আশ্বাস দিয়ে যায়। এ রোগে বড়দের ভয় কম। এন্টনি জোয়ান ছেলে। ওষুধের চেয়ে দরকার সেবার আর পথ্যির।…

 তারপর কদিন আর ঢোঁড়াই সেখান থেকে নড়েনি। কান্তলালকে রুগীর কাছেও আসতে দেয়নি। বলেছে তুমি খালি রোজ সকালে একখান বাতাসায় সাদা বাগভেরেণ্ডার রস নিয়ে আসবে, তাহলেই হবে।..

সবজান্তা কান্তলাল বলে, এখানকার মাটতে অভ্র আছে! লোকে যা ইচ্ছে হয় বলুক, আমার ধারণা ধুলোর সঙ্গে অভের গুঁড়ো পেটে গিয়ে এই রোগ হয়। অভ্র গলাতে বার্লিস [৫৭২]-এর মতো আর কিছু নেই। অভ্র এমনিতে আগুনে পোড়ে না। ফেলো তো তার উপর এক ফোঁটা বার্লিস; ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে আমি বলে রাখলাম।

আচ্ছা তুমি বাগভেরেণ্ডার রস নিয়ে তো এস। রামায়ণজী চায় যে লোকটা দূরে দূরে থাকুক! ছেলেটা যন্ত্রণায় অধীর হয়ে যখন মাইগে [৫৭৩] বলে কাতরায় তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না।

কী হয়েছে বেটা! বলবি তো! নাইয়ের চারিধারটা আস্তে আস্তে একটু টিপে দি? এইবার আরাম লাগছে একটু? একটু সেরে ওঠ বেটা; তারপর তোকে নিয়ে যাব, তোর মার কাছে। মায়ের কাছে যাবার জন্য বড়ডো মন কেমন করছে? তাই নয়। রোগ হলে তাই হয়। মায়ে যেমন করে রুগীর দেখাশুনো করতে পারে, তেমন করে কি আর কেউ পারে?

পনের বছরের ছেলেটাকে রামায়ণজীর মনে হয় এতটুকুনি বাচ্চা! নিজের অক্ষমতার কথা রামায়ণজী নিজে যতটা জানে, ততটা আর কেউ না!

কেউ না সে এন্টনির কেউ না। সরকারী কানুনের মোহর পড়ে গিয়েছে তার উপর। না হোক সে এন্টনির কেউ। থাকুক ছেলেটা একা তার মায়ের। রামিয়ার যে আর কেউ নেই দুনিয়ায়। বাঁচিয়ে দাও রামচন্দ্রজী ছেলেটাকে। এ গেলে সে কী নিয়ে থাকবে দুনিয়াতে। কিরিস্তান বলে ঠেলো না।

ছেলেটার একটু তন্দ্রা এলে তার অলক্ষ্যে রামায়ণখানা বার করে তার মাথায় ঠেকিয়ে দেয়। হোক কিরিস্তান। রামচন্দ্রজীর আবার জাতবিচার আছে নাকি। গুহক চণ্ডালকে তিনি কোলে টেনে নিয়েছিলেন। আহা দেখা হয়নি; রামায়ণখানার পাশের দিকে এরকম পোকায় বাসা করেছে, ঠিক ধুনোর মত চটচটে একটা জিনিস দিয়ে। একেবারে এঁটে গিয়েছে পাতাগুলো। খোলা যায় না। একখান একখান করে খুলতে অনেক সময় লাগবে। থাক এখন।….

ভগবান রামায়ণজীর ডাকে মুখ তুলে চেয়েছিলেন।

এখন ছেলেটার বিপদ কেটে গিয়েছে। একটু ভালর দিকে। সেবার ত্রুটি রামায়ণজী হতে দেয়নি একটুও। এরই মধ্যে একটু খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছে। ..ছেলে কি একা মায়েরই নাকি? তবু মায়েরা জাদু করে রাখে ছেলেকে। বাপ যে পর সেই পরই থেকে যায়।..এর রোগে দরকার সেবার আর পথ্যির। বলে তো গেল গান্ধী যাবার সময়। কিন্তু ব্যবস্থা কী করে গেল তার। পথ্যি আসবে কোথা থেকে। বার্লিস বললেই হয় না। তাতেও পয়সা লাগে। আর আজকাল যা আগুন দাম। যেমন দল তার তেমনি ব্যবস্থা। এ কয়দিনের মধ্যে খবরটা পর্যন্ত নেওয়া দরকার মনে করল। না, গান্ধী টাকা-পয়সা দেবে কোথা থেকে? দলের পয়সা কোথায়? কান্তলালকে বললেই সে এখনি কোনো রকমে কিছু যোগাড় করে নিয়ে আসবেই।…সে রামায়ণজী হতে দেবে না কিছুতেই …অংরেজ বাদশার চাইতেও বড়লোক ছিল এক সময় পামারসাহেব। তাই না তার নামের নোট চলত এক যুগে। তারই ভাঙা কুঠিতে বসে দ্যাখো রামায়ণজী রামায়ণপড়া হাতে রোগা ছেলের মুখে বার্লিস দিতে পাচ্ছে না।

…কোমরের বটুয়ার থেকে রামচন্দ্ৰজী আকা আর ফারসি লেখা সিক্কার মালাটা সে বার করে দেয় কান্তলালের হাতে। লোকটা দরকারের চাইতেও বেশি চটপটে।

কান্তলাল অবাক হয়ে রামায়ণজীর মুখের দিকে তাকায়। এই জিনিসটাকে নিয়ে দলের মধ্যে কত বদনাম হয়েছিল তার। থাক রামায়ণজী। এটা তোমার মরা ছেলের জিনিস। আমি যেমন করে হোক সব জিনিস যোগাড় করে আনছি।

কান্তলালের যোগাড় করার নাড়ীনক্ষত্র রামায়ণজী জানে।

না না! কান্তলালের হাতে মালাটা খুঁজে দেবার সময় রামায়ণজী সেদিকে তাকাতে পারে না। যায় যদি যাক, দুটো বানভাসি মনের মাঝের একমাত্র সেতু। পিছনের ও পথে রামায়ণজী আর কখনও ফিরবে না। পারলে মনের উপর থেকে স্মৃতির সেই খোসাটা সে আলগোছে ছাড়িয়ে ফেলে দেবে।…হয়তো আপনা থেকেই খসে পড়বে। এখন কোনো রকমে, এ যার ছেলে তাকে ভালয় ভালয় ফিরিয়ে দিতে পারলে সে বাঁচে। তারপর…তার পরের কথাগুলোও ছেলে ভাল হবার মুখে এলে আস্তে আস্তে ভাবতে আরম্ভ করে রামায়ণজী। অনেকদিন আগের মনের নিচের চাপা-পড়া কথাগুলো উপরে ভেসে ওঠে। সেই পচ্ছিমা আওরতের কথাটা তার সমস্ত মনখানাকে জুড়ে বসে। এতকাল সে নিজের মনকে ফাঁকি দিয়ে এসেছে। মনটাকে আড়াল করবার জন্য কত রকমের পলকা পাঁচিল তোলবার চেষ্টা করেছে। জলের উপর কুমিরের দেহের কতটুকুই বা দেখা যায়।

বেশিটাই তো থাকে নিচে। জাতিস্মর জানতে পেরেছে যে এক যুগ আগের সেই স্মৃতিটুকুই আসল। বাকি সব সেই শাসটুকুর উপরের খোসা। পেঁয়াজের খোসার মতো পরতের পর পরত সাজানো, কোনোটা পুরু।…সামুয়রটা মরে গিয়েছে চা বাগানে…

[৫৭১- ব্যাসিলারী আমাশয়ের লক্ষণযুক্ত রোগে প্রতি বৎসর এই সময় জিরানিয়া জেলায় বহু লোক মারা যায়! সুলবাই এর সাধারণ অর্থ আমাশয়। ৫৭২. বার্লি। ৫৭৩. মাগো।]

.

স্বর্ণসীতা

রাতে কোনো গাড়োয়ান গাড়ি চালাতে রাজী নয়, মিলিটারির ভয়ে। অতি কষ্টে একখানা গাড়ি যোগার করে কান্তলাল। ঘোড়সওয়ারগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আট আনা করে পয়সা দিতে হয়। সেটা যে গাড়ি ভাড়া নিচ্ছে সেই দেবে, এই শর্তে গাড়োয়ান রাজী হয়। সাঁঝ-রাতেই টহল দেয় ফৌজগুলো; তাই অর্ধেক রাতে রওনা হয় ঢোঁড়াইয়া গাড়িতে।

নমস্তে কান্তলালজ! বলে নিও গান্ধী আর সর্দারকে যে, আমি গিয়েছি এন্টনিকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে।

কান্তলালের সঙ্গে, ক্রান্তিদলের সঙ্গের শেষ সম্বন্ধটুকুও মনের আড়াল হয়ে যায়। ঘর পালানো ঢোঁড়াই। আবার সেই ঘর-জ্বালানী আওরতটার কাছে ফিরে যাচ্ছে, রামায়ণজী না ঢোঁড়াই। আড়াই বছরের রামায়ণজীকে ফেলে এসেছে পিছনে, ক্রান্তিদলের দৈনন্দিন তুচ্ছতা আর বিধি-নিষেধগুলো সঙ্গে। ঢোঁড়াইয়ের মনে হচ্ছে। যে, সে এতদিনে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। এতদিনকার গুপ্ত জীবনের ঝিমিয়ে-পড়া মনটা জীয়নকাঠির পরশ পেয়ে চোখ তাকিয়েছে।

ছেলেটা এখনও গায়ে জোর পায় না। রামায়ণের ঝোলাটা কম্বল দিয়ে জড়িয়ে তার হেলান দেবার তাকিয়া করে দিয়েছে ঢোঁড়াই। রুগ্ন ছেলে, ঘুমতে পেলে ভাল হত; কিন্তু তার কি উপায় রেখেছে ফৌজে। পাক্কী দিয়ে গোরুর গাড়ি যেতে দেবে না। খানা-ডোবার পথে কি গাড়িতে ঘুমোন যায়! রোগের পর একেবারে ছোটটো আবদারে ছেলের মতো হয়ে গিয়েছে এন্টনি। রাগ অভিমান, কথা গল্পের মধ্যে দিয়ে, খুব কাছে এসে গিয়েছে সে ঢোঁড়াইয়ের। এন্টনির গল্প আর ফুরোয় না…

ধাঙড়টুলির লোকদের কলস্টরসাহেব জমি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ফৌজদের কাছাকাছি থাকতে তারা কিছুতেই রাজী হল না।…যাবার আগে বুড়ো এতোয়ারী মায় কাছে এসে বলে গেল, ধাঙড়টুলির ভাত আমাদের কপালে নেই, তার আর ভেবে কী করবে এন্টনির মা। মা যত বোঝায় যে টমিদের যত খারাপ লোক মন করছে, তত খারাপ নয় তারা। তাতে এতায়ারী বলে কী জান? বলে যে তারা কিরিস্তানদের জন্য ভাল হতে পারে, হিন্দুদের জন্য নয়। টাকা যখন কিছু দিচ্ছে। সরকার, তখন জমি নিয়ে চাষবাসই করব নেপালে।…

…ধাঙড়টুলির শুক্রা, এতোয়ারী, বড়কা বুছু, ছোটকা বুদ্ধ, কর্মাধর নাচ, শনিচরা মাদল বাজাচ্ছে…। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে বলেই বোধ হয় এত সেখানকার গল্প করছে ছেলেটা।

টমিদের সকলেই খারাপ লোক নয়। একটা খোঁড়া পাগলী মেয়ে আছে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে চলে, গোঁসাইথানের কাছে মিউনিসিপালিটির টিউবওয়েলটার পাশে থাকে, সেটা টমি দেখলেই বলে সাহেব ওটা কি! বন্দুক! একটা ছুঁড়োশিয়াল মেরে দিয়ে তো আমাকে বন্দুক দিয়ে। সাহেবরা বলে কাল দেব। আর রোজ তাকে সিগারেট দেয়, পয়সা দেয়। এক-আধটা পয়সা না, দু-আনা, চার আনা করে পয়সা। সে পাগলীটা তো আর কিরিস্তান নয়। …ও ফুলঝরিয়া, অশ্বথের পাতার আচার একটু ঢোঁড়াইকে দিয়ে যা। …স্পষ্ট মোড়ল গিন্নির গলা মনে হচ্ছে শুনতে পাচ্ছে ঢোঁড়াই। রতিয়া ছড়িদার বলে একটা বুড়ো আছে তাৎমাটুলিতে, সে ফৌজী সহিসদের নিমের দাঁতন দেবার ঠিকে কেমন করে পেয়েছিল জানতো রামায়ণজী। এক ডালা মূলো ভেট নিয়ে একেবারে বড়োসাহেবের অফিসে হাজির। সাহেব হেসেই খুন। পাছে। লোকটা দুঃখিত হয় ভেবে একটা মূলো অফিসে বসেই খেল সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে রতিয়া ছড়িদারকে দাঁতনের ঠিকেদারি দিয়ে দিল। রতিয়া ছড়িদার কি কিরিস্তান? কিরিস্তান হওয়ার যে কী দুঃখ, সে যে কিরিস্তান নয় সে বুঝবে না। তাৎমাটুলিতে কি আমরা সাধ করে এসেছি। অথচ কেউ সেখানে দেখতে পারে না আমাদের। বাড়িটা কিন্তু বেশ। উঠোনে কুয়ো আছে। নইলে মিউনিসিপ্যালিটির টিউবওয়েলে যা ভিড়! বাড়িটা ছিল বাবুলাল চাপরাসীর ছেলে দুঃখিয়ার। বাবুলাল এবার পেনসন নিয়েছে বলে দুখিয়ার চাকরি হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের দারোয়ানগিরির। সেখানেই কোয়ার্টার দিয়েছে দুখিয়াকে। খালি ঘরখানাতে বাবুলাল পেনসনের পর চায়ের দোকান দেবে ঠিক করেছিল। এখন ভাল চলতে পারে দোকান ওখানে। জায়গাটা ভাল। তার জন্যই তো বাবুলালের রাগ আমার উপর।

চায়ের দোকান! ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে যে তাকেও একদিন বাওয়া দোকান খুলতে বলেছিল। কত জল্পনা তাই নিয়ে। তবে সেটা চায়ের দোকান নয়।

 তা এন্টনি, তোমরাই ওখানে একটা দোকান খোল না কেন?

 ছেলেটা চুপ করল কেন! ও তাই বল! ঢুলুনি এসে গিয়েছে! দুর্বল শরীর! ভাল করে শুয়ে পড় এন্টনি। এই ঝকানির মধ্যে ঘুমুবি কী করে? ধুলোর ঝড়টাও আরম্ভ হয়ে গেল বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে। তাৎমাটুলির গল্প শুনে ঢোঁড়াইয়ের তৃপ্তি আর হয় না। খানিক পরই নিজের চোখে এইসব জিনিস দেখবে। তবু তীর্থযাত্রীর ব্যাকুলতা-ভরা মন মানে না। অবধ তঁহা উঁহ রাম নিবাসু [৫৭৪]; যেখানে রাম থাকেন সেইখানেই অযোধ্যা। অবধ তঁহা উঁহ রামিয়া নিবাসু; যেখানে রামিয়া থাকে সেইখানেই অযোধ্যা। বেশ লাগে কথাটা। বারকয়েক মনে মনে লাইনটা আওড়ায়। ঢোঁড়াই তাৎমাটুলির আজকালকার ছবি কল্পনা করতে চেষ্টা করে; কিন্তু পনের বছর আগের, তারও আগের ছবিগুলোই শুধু তার মনে মূর্ত হয়ে ওঠে। সে যুগের তার পরিচিত দুনিয়াটুকুর ক্লেদগ্লানি আবর্জনাগুলো, সারের মাটি হয়ে তার মনের গহীনের খানাডোবাগুলোকে ভরাট করে তুলেছে। ছেলেটার মাথায় রোদ্দুর লাগছে। ঢোঁড়াই একটু সূর্যের দিকে আড়াল করে বসে।…কিরিস্তান হওয়ার যে কী দুঃখ, তা যে কিরিস্তান নয় সে বুঝবে না।

এককালের বন্ধ্যা প্রতীক্ষা হঠাৎ নূতন সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাচ্ছে।

পনের বছর আগেও তাৎমাটুলির পঞ্চায়ত যা করেছিল, টাকা খরচ করতে পারলে আজও হয়তো তা সম্ভব হবে। করবে আবার না! টাকা পেলেই করবে। গোঁসাইথানে জোড়া ভেড়া কবলালেই করবে! যে পঞ্চায়েতের মোড়ল গাড়ি হাঁকায়, ছড়িদার দাঁতনর ঠিকেদারি করে, মোড়লের ছেলে রাজমিস্ত্রি, সে পঞ্চায়েতের বিষদাঁত কি আর আছে।

 দূরে পাক্কীর গাছের সারি, এত ধুলোর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, ধোঁয়ার মতো! ঘুঘুগুলো

একটানা ডেকে মরছে। ধাঙড়টুলির লোকগুলো কি চালাকি করেই ঘুঘু ধরত সেকালে। আগে একটা ঘুঘু ধরে, তারপর ঘুঘুর ডাকের নকল করত। এ ডাক সে ঘুঘু শুনেছে তার আর নিস্তার নেই। সাথী পাবার দুর্বার আকর্ষণ তাকে সেখানে টেনে নিয়ে যাবেই। বেলাবাড়ার পাখি [৫৭৫] ছক ছক করে ডাকছে। বোধ হয় তার সাথী খুঁজছে। .

..তোমার আজ নাওয়া-খাওয়া নেই নাকি? বেলাবাড়া পাখি কখন থেকে ডাকছে। কী আদেখলে বলদই হয়েছে! বলদের গায়ে এটুলি ওবেলা ছাড়ালেও চলবে।…মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা। দূরটা কাছে এসে গিয়েছে। বকুনিটুকুও কত মিষ্টি ছিল। হবে না? পচ্ছিমের মেয়ে।

 গাড়োয়ান গাড়ি থামায়। এই পর্যন্ত যেতে দেয় গোরুর গাড়ি! ধুলোর গন্ধটা বদলে গিয়েছে। আগেকার চেনা ধুলোর গন্ধটা ঢোঁড়াই চোখবাঁধা হলেও বলে দিতে পারত। যেখানে সেকালে রেবণগুণীর বাড়ি ছিল, সেখানে এখন কেবল তার লিচুগাছ দুটো আছে। গাছের নিচের মাচায় কজন ফৌজের উর্দিপরা লোক জটলা করছে। মেয়েলোকও আছে সেখানে; বোধ হয় লিচুগাছ জমা নিয়েছে।

কোথাও একটাও কুল, ময়নাকাঁটা কামিনী কিংবা শিমুল গাছের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রোদে ঝলসানো মাঠে গোবর কুড়োচ্ছে। তার মধ্যে দুটো আবার হাফপ্যান্ট পরেছে! তাৎমা বলেই মনে হচ্ছে ওদের দলের মেয়েগুলোকে! ছোটবেলায় ঢোঁড়াই রা এই রোদে ঝলসানো মাঠে আগুন লাগাত। আজকালকার ছেলেরা বোধ হয় মিলিটারির ভয়ে পারে না…বকরহাট্টার মাঠটা কিন্তু সবুজ হয়ে রয়েছে। এন্টনি দেখায় ঐগুলো ঘাসের ক্ষেত। ঐ দিকটা হাতিঘাস। হাতিঘাস ঘোড়ায় খায় না, গোরুতে খায়। জুটি কেটে খাওয়াতে হয়। ঐ দিকটা গোলোভার [৫৭৬] ঘাস। ঘোড়াদের জন্য বাক্স করে প্যাক করা ঘাস আসে রেলগাড়িতে।

যা রোদ্দুর। আকাশে গোঁসাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তিন পহর বেলা হবার আর দেরি নাই। ছেলেটার মুখটা গরমে লাল হয়ে উঠেছে। নিজের জামাটা খুলে এন্টনির মাথায় জড়িয়ে দেয়; ঢোঁড়াইয়ের এক কাঁধে কম্বল জড়ানো রামায়ণের ঝুলিটা। ছেলেটা তার কাঁধে ভর দিয়ে চলেছে। এখনও পায়ে জোর পায় না। তাকে সূর্যের দিকে তাকাতে দেখে এন্টনি বলে, দুটো বাজল এখন। ঐ যে তাৎমাটুলির লোকের সার চলেছে হাতিঘাসে জল দিতে। একটা থেকে দুটো খাবার ছুটি।

 মরণাধারে কাঠের পুলটা সেই রকমই আছে। পুলের গায়ে সে ছোটবেলায় ছুরি দিয়ে কেটে যে তারাটা এঁকেছিল, সেটা অস্পষ্ট হয়ে এলেও এখনও বোঝা যায়। পুলের নিচে বড় বড় চৌবাচ্চা করেছে।

এন্টনি বলে এগুলোতে বারমাস জল থাকে। ঐ পাশের বাটিগুলো দেখছ না, গোরুতে যেই ঐ বাটিতে মুখ দেবে আর অমনি ওগুলো ভরে যাবে জলে; যেই মুখ তুলে নেবে অমনি আর জল থাকবে না।

তার গর্ব মেশানো কথার সুরটুকু ঢোঁড়াই য়ের কান এড়ায় না। গর্বেরই তো কথা! আগে এইখানে পথের উপর ঢোঁড়াই দের কল্কে ফুলের বীচি দিয়ে খেলার গর্ত থাকত। আজকাল ছেলেরা সে খেলা খেলে না নাকি?

একটু বসবি নাকি এন্টনি গাছটার তলায়?

না, একেবারে বাড়ি গিয়ে বসা যাবে। বসলে একটু সময় পাওয়া যেত। তার কাঁধে হাত দিয়ে রয়েছে এন্টনি। তার বুকের হঠাৎ ধড়ফড়ানিটা বুঝতে পারছে নাকি? মনটা দুর্বল-দুর্বল লাগছে শেষ মুহূর্তে। তার একক্ষণকার আত্মপ্রত্যয় হঠাৎ সে হারিয়েছে। হয়তো এই দাড়ি গোঁফওয়ালা ফেরার ঢোঁড়াইকে চিনতে পারবে না রামিয়া। রামিয়ার মন এখন কী চায়, সে কথা তো ঢোঁড়াই জানে না।

…সারা দুনিয়ার দুয়োরে মাথা কুটে-কুটে ফিরে এসেছে ঢোঁড়াই তোমার কাছে। তোমার টানে, তোমার দুঃখের কথা মনে করে। তারই জন্য রামচন্দ্রজী তোমায় সৃষ্টি করেছিলেন তারই সঙ্গে তোমার জীবন বাঁধা। ঢোঁড়াই অপমানের কথা ভুলেছে, কোনো অভিমান নেই তার আজ। বিনা শর্তে সে নিজেকে ফিরিয়ে দেবার জন্য ফিরে এসেছে। তুমিও ভুলে যাও মাঝের যুগের এই সব কথা। জীবনের রাময়ণকানার মাঝের অধ্যায় ধুনোর মতো পোকার আঠা দিয়ে আঁটা থাক। খোলবার দরকার নেই সে পাতাগুলো। তোমার দুঃখ ঢোঁড়াই যদি না বোঝে তবে আর কে বুঝবে।…

রামচন্দ্রজী ছাড়া এখন ঢোঁড়াইয়ের মনে বল আনবার আর কোনো সম্বল নেই। তাই। কম্বলের বোঝাটাকে সে শক্ত করে চেপে ধরেছে। এন্টনি যে বাড়িটায় নিয়ে যায়, সেটা ঢোঁড়াইয়ের নিজের বাড়ি। এটাকে তাহলে সে চলে যাওয়ার পর দুখিয়ার মা দুখিয়াকে দিয়েছিল। বানভাসি চড়ায় ঠেকার সময়ের মুহূর্তের আঘাতের মধ্যেও এক অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিত দেখতে পায়।

…বলদের নাদা দুটো নেই। সেখানে মাটির ঢিবি উঁচু হয়ে রয়েছে।…হাকিম এই বাড়ি পাইয়ে দিয়েছিলেন এন্টনির মাকে। এন্টনির মা কথাটা শুনতে ভাল লাগছে না রামিয়াকে। ঐ মনে হয় হাকিম করেছেন! কিন্তু হাকিমের হাত দিয়ে দুনিয়াতে কে করাচ্ছেন এসব, তার খবর রাখে কজন!

 মা নিশ্চয়ই বাড়ি এসেছে। দুটোর সময় অফিসারদের খাওয়া হলে, তারপর মা খাবার নিয়ে আসে বাড়িতে।

এন্টনি ডাকে, মা কোথায়?

উঠোনে ঢুকেই ঢোঁড়াই  কম্বলের পুঁটলিটা দাওয়ার খুঁটির পাশে রাখে। তারপর সেইখানেই বসে, মনের উত্তেজনাটা একটু কমাবার জন্য। এই খুঁটিতে হেলান দিয়েই, ঢোঁড়াই গাঁ ছাড়বার দিন, রামিয়া ছটপরবের জিনিস পাহারা দিচ্ছিল। নেড়া তুলসীতলার মাটির বেদীটার উপর আমসি শুকোচ্ছে।

ঘরের ভেতর থেকে গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে। রামিয়ার গলাটা…একটু বদলেছে মনে হচ্ছে। নিজের বদল নিজে বোঝা যায় না। কম দিনের কথা হল না তো!

 কে রে-তাই বল! এ কী চেহারা হয়েছে। রোজ মনে করি এন্টনির চিঠি আসছে, চিঠি আসছে। সে চিঠি আজও আসছে, কালও আসছে। থাকতে না পেরে কাল তালঝড়ির মিশনে চিঠি লেখালাম। ঠিক বুঝেছি। অসুখ করেছিল। কী অসুখ? দাঁড়া একমিনিট, বিছানা পাতি। না গেলেই চলছিল না তালঝড়ির পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। কী জ্বালানোই যে জ্বালাস তুই আমাকে। মা যদি হতিস তাহলে বুঝতিস!মরদে বোঝে না সে কথা। আমার কপাইল যে পোড়া। আর কার ঝাড় দেখতে হবে তো। সেই বাপেরই তো ছেলে।

এন্টনি মায়ের স্বভাব জানে। এসব কথা একবার আরম্ভ হলে তার মুখ মা শিগগির থামবে না, সে তা জানে। তাই মাকে চুপ করাবার জন্যেই বোধ হয় বারান্দায় ঢোঁড়াইকে দেখিয়ে বলে, উনি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।

এখানে বসে কেন? ছেলে বলছে তুমি করেছ খুব ওর অসুখের সময়। একে তুমি আমার হাঁটুর বয়সী, তার উপর তালঝড়ি মিশনের লোক। তোমাকে কিন্তু বাপু আপনি বলতে পারব না, আগে থেকেই বলে রাখছি।

ঢোঁড়াইয়ের তখন সম্বিৎ নেই। খাকী রঙের শাড়ি পরা এই প্রৌঢ়া স্ত্রীলোকটিই এন্টনির মা! মুখটি অস্পষ্টভাবে চেনা-চেনা মনে হয়। কোথায় যেন দেখেছে আগে। আয়নায় আলোর ঝলকের মতো হঠাৎ মনে পড়ে। মর্লিসাহেবের বাড়ির সেই ডাকসাইটে আয়াটা, যেটাকে নিয়ে সাহেবদের বাড়ির বাবুর্চি আর আরদালী মহলে সেকালে খুব হৈ চৈ ছিল। অনেকের সঙ্গে এর আশনাই ছিল ধাঙড়টুলির পাক্কী মেরামতির দলের গল্পের একটা মস্ত খোরাক, এর সঙ্গে সামুয়ের আশনাইয়ের ব্যাপারটা। রামিয়া কি তাহলে… এন্টনির মা ততক্ষণে জমিয়ে বসেছে ঢোঁড়াইয়ের কাছে, হারানো কথার খেইটা সামলে নিয়ে। নিজের একটানা দূরদৃষ্টের কথা বলে চলেছে সে।

…এদের ঝাড়টাই এই রকম। এর বাপ বিয়ের পর যে কদিন একসঙ্গে ঘর করেছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছে আমাকে। নেশাভাঙ করে সব খুইয়ে শনিচরা ধাঙড়ের বৌটাকে নিয়ে পালিয়েছিল। মরেছে কি বেঁচে আছে দশ-বারো বছরের মধ্যে কোনো খবর নেই। মরলে পরে হাড় জুড়িয়েছে। শুধু কি বিয়ের পর জ্বালিয়েছে? বিয়ের আগেই বা কী! সে কাণ্ড যদি শোন তো বলি।…

 সেই কাণ্ডই ঢোঁড়াই শুনতে চায়। চায় কিনা তাও ঠিক করে ভাববার ক্ষমতা নেই তার এখন…রামিয়া? অতল শূন্যতার মধ্যে কতগুলো অস্পষ্ট কথার আবর্তে সে ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছে।…কুর্বাঘাটের মেলায় জুয়োর দোকানের সাদা ছকটার উপর কাঁটাটা। বনবন করে ঘুরছে। কোথায় গিয়ে ঠেকবে।

বলার কি আর কথা। ছেলে বড় হয়েছে। নিজেরও তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে, এখন আর লাজই বা কী; শরমই বা কি।

তারপর গলাটা নামিয়ে বলে, এই যে বাড়িটা দেখছ না, এটা বাবুলাল চাপরাশীর ছেলে ঢোঁড়াইয়ের। তারই বৌটাকে বিয়ে করবে বলে পঞ্চদের টাকা খাইয়ে, নিজের জাতজন্ম খুইয়েছিল। সে বৌটা তো একটা মরা ছেলে বিয়ের পর মারা যায়। সে মেয়েটার দোষ ছিল কি না-ছিল ভগবান জানের। শুনি তো যে তাকে না জানিয়েই পঞ্চরা এই কাণ্ড করেছিল। সেবারে সাহেব পাদরিরা চলে গিয়েছিল কিনা এখান থেকে, তাই এন্টনির বাপের সাহস হয়েছিল, গোঁসাইথানে ভেড়া বলি দিতে। আমার তখন এন্টনি পেটে। রাঁচিতে গিয়ে সাহেব পাদরিকে ধরি। সাহেব তো চটে আগুন, এন্টনির বাপের জাত দেবার কথা শুনে। সাহেব নিজে এসে, খোরপোষের মোকদ্দমার ধমকি দিয়ে, কোনোরকমে আমাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। …এই ছেলেটার মুখ চেয়েই বিয়ে করেছিলাম ঐ হতভাগাটাকে। নইলে আমার জন্যে আমি ভাবি না। যতদিন গতর আছে খেটে খাব। প্রভুর কাছে প্রার্থনা যখন শরীরের শক্তি যাবে, তখন যেন আর বাঁচতে না হয়। না হলে এই ছেলে আমায় রোজগার করে খাওয়াবে? তাহলেই হয়েছিল। আমি ওর ইস্কুলের খরচের জন্যে কোথায় গিয়েছি, আর কোথায় না গিয়েছি। আরে না পড়িস তো তাই বল পরিষ্কার করে। রোজগার করে খাওয়ার বয়েস হয়েছে। ফৌজের সাহেবকে ধরে একটা চাকরিই জুটিয়ে দি। অনিরুদ্ধ মোক্তারের ছেলেটা হাওয়াগাড়ি মেরামতের কারখানায় মিস্ত্রির কাজ শিখছে, আর তুই শিখতে পারিস না। না-হয় এখানেই দোকান দে। বিজন উকিলের নাতির গোঁসাইথানের চায়ের দোকান চলছে কি না? মিলিটারিগুলো থাকতে চলবে আবার না! তা নয়, ইস্কুল কামাই করে উনি চললেন তালঝরি মিশনে। এই দেখ। একদম ভুলে গিয়েছি। জল এনে দি, হাত পা ধোও। যা হোক চারটি খেয়ে-দেয়ে নাও। এন্টনির কলা খাওয়া বারণ না কি? আজ ভাল কলা এনেছি। মেস থেকে।

কথাগুলো ঢোঁড়াই শেষ পর্যন্ত বোধ হয় শোনেওনি। কয়েকটা কথার বালি পড়ে তার শরীরের আর মনের সব যন্ত্রগুলো বিকল হয়ে গিয়েছে। জুয়ার খেলায় সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে সে। অবচেতনের মতো সে উঠোন থেকে বেরিয়ে আসে! এই নিঃসীম রিক্ত জগণ্টার মধ্যে পাক্কী না কী নামের যেন একটা অপরিচিত রাস্তা দিয়ে সে চলছে। ঠিক অনুতাপ নয়। হতাশার গ্লানি তার নিঃসঙ্গতাকে আরও নিবিড়, আরও দুঃসহ করে তুলেছে। একেবারে একা সে আজ এই দুনিয়াতে। বুকের বোঝার চাপে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আশমানে দিনের চাকা ঘোরানোর গোঁসাই পশ্চিমে ঝুঁকেছেন। তাঁর কাজের কামাই নেই, নিচে গোঁসাই থানের গোঁসাই হাল ছেড়ে দিয়ে ভাটবনে উইবনে উইয়ের ঢিবি হয়ে গিয়েছেন। পশ্চিমে ধুলোর ঝড় জেদ ধরেছে না বলে। ঝাপসা চোখের মধ্যে একটা আকৃতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সর্বগ্রাসী শূন্যতার মধ্যে এই পথটা তবু পা রাখবার একটু শক্ত জমি। সিধে চলে গিয়েছে কাছারি, জেলখানা, আরও কত দূরে। আর বেশি দূরে সে যেতে চায় না। জেলে সাগিয়া আছে। চিনিও মিষ্টি, গুড়ও মিষ্টি। তবু লোকে চিনিই চায়। আর চিনি না পেলে? সব পুঁজি খোয়ানোর পর তার মনে পড়েছে বহুদিন আগের জমানো বাতায় গোঁজা পয়সার কথা। ঢোঁড়াই চলেছে। সারেন্ডার করতে, এস.ডি.ও.সাহেবের কাছে।

এক্কাওয়ালা চেঁচায়–এক সওয়ারি! কাছারি! চার-আনা! পাঞ্জাবি বাসওয়ালা চেঁচায়- কচহরি! শহর! তিন আনা! তিন আনা! কচহরি।

এস.ডি.ও. সাহেব এজলাস থেকে উঠে গেলে আজ হয়তো জেলে নিয়ে যাবে না; থানা হাজতেই রেখে দেবে রাতটা। ঢোঁড়াই বাসে চড়ে বসে। তাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে এস.ডি.ও. সাহেবের কাছে।…

এন্টনির মা হয়তো এখন বলছে- এটা কীরে কম্বল জড়ানো? লোকটা ফেলে গেল। রামায়ণ? লোকটা তাহলে কিরিস্তান নয়? তালঝড়ি মিশন থেকে এসেছিল বলে আমি ভাবলুম বুঝি কিরিস্তান। তাই এখানে না খেয়ে চলে গেল। আসবেখুনি বাজার থেকে খেয়ে এগুলো নিতে।

ক্রান্তিদলের লোকেরা বলবে, কাংগ্রিসের বড় নেতাদের সরকার ছাড়ছে বলে সুযোগ বুঝে সলভার করেছে কায়েরটা। [৫৭৭]

বুড়ো এতোয়ারী ধাঙড় থাকলে ফোকলা দাঁতে হেসে বলত, ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত। যতই খাবলাক, ছোবল মারুক, তড়পাক, এক মরলে যদি ওদের বিষদাঁত গজায়।

[৫৭৪. তুলসীদাস থেকে। ৫৭৫. এক জাতের সবুজ রঙের পাখি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের ডাকের অবিরাম ধ্বনি চরমে ওঠে। ৫৭৬. Clover। ৫৭৭ কাপুরুষ।]

2 Comments
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *