২.২ লঙ্কা কাণ্ড

লঙ্কা কাণ্ড

কোয়েরীদের নিদ্রাভঙ্গ

অনেকদিন আগে একজন মহাৎমাজীর চেলা বিসকান্ধার লোকদের ভূমিকম্পের দরুন ক্ষতির তদন্ত করতে এসেছিলেন। খুব পণ্ডিত লোক; সকলকে জিজ্ঞসা করে অনেক লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন কাগজে। লাডলীবাবুর বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। সকলেই শুনেছিল যে, তাঁর রপোর্ট-এর উপর ভূমিকম্পের রিলিফ দেওয়া হবে সকলকে।

তারপর বছর ঘুরে গেল। রিলিফ–এর আর কোনো সাড়াশব্দ পায়নি কোয়েরীটোলার লোকে। একরকম ভুলেই এসেছিল তারা এই কথাটা। হঠাৎ একদিন কী করে যেন সবাই জেনে গেল যে, বাবুসাহেবের বাড়িতে যে পাকার ইট আর সিমেন্টের বস্তা জড় করা রয়েছে সেগুলো কাংগ্রিস থেকে রিলিফ পেয়েছে। গিধর মণ্ডলও পেয়েছিল দুশখান ঢেউখেলানো টিন, শালের গুঁড়ি, চুন, সিমেন্ট আরও কত কী। তখনই বিল্টারা দল বেঁধে দৌড়ায় জিরানিয়ার মাস্টারসাহেবের আশ্রমে। অনেক কিতাব ঘেঁটে মাস্টারসাহেব বিসকান্ধার রপোটটা খুঁজে বের করেন। তাতে লেখা আছে কোয়েরীটোলায় গিধর মণ্ডল ছাড়া আর সকলেরই খড়ের ঘর। খড়ের ঘরগুলির ভূমিকম্পে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি। কেবল যে ঘরগুলির মধ্যে দিয়ে ফাটল গিয়েছিল তার বেড়াগুলো হেলে পড়েছিল। সেসব কোয়েরীরা নিজেরাই মেরামত করে নেয়। ঘরের ভিতরের ফাটলগুলিও তদারকের বহু পূর্বেই তারা ভরাট করে নিয়েছিল। গ্রামের আসল ক্ষতি হয়েছে পাকা দালানগুলির। ক্ষতির পরিমাণের ফিরিস্তি পরে দেওয়া আছে। ঐ পরিমাণে রিলিফ এদের দেওয়া উচিত। এক গিধর ওরফে গিরিধারী মণ্ডল ছাড়া বাকি সব ক্ষতিগ্রস্ত ইটের বাড়িই রাজপুতটোলার। কোয়েরীটোলার যে জমিগুলিতে বালি উঠেছিল সেগুলি তারা আগেই পরিষ্কার করে নিয়েছে। ইঁদারার বালি ছাকবার জন্যও তারা পরমুখাপেক্ষী নয়। এর জন্য তারা সত্যই প্রশংসার পাত্র। এখানকার ইঁদারাটির পাট কয়েক জায়গায় ফেটে গিয়েছে। তবে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একটি টিউবওয়েল কোয়েরীটোলার মধ্যে থাকায়, গরমের সময় লোকের অসুবিধা হয়নি। জমিগুলি থেকে বালি সরানো হলেও কিছু কিছু বালি থেকে গিয়েছে। ঐ সব জমিতে চীনাবাদাম লাগিয়ে দেখা যেতে পারে। টুর্নামেন্টে এগ্রিকালচার ফার্ম থেকে কিছু কিছু চীনার বাদামের বীজ, কোয়েরী আধিয়ারদের দেওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি। রাজপুতটোলায় একটি নতুন ইঁদারা দেওয়া উচিত। তাদের সব পাকা ইঁদারাগুলিই খারাপ হয়ে গিয়েছে। সাঁওতালটোলায় ক্ষতি কিছুই হয়নি। তারা বালিতে গর্ত খুঁড়ে যে জল বোরোয় তাই পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করে। ভূমিকম্পে রিলিফির টাকা থেকে সাঁওতালটোলার জন্য একটা ইঁদারা কিম্বা টিউবওয়েল করিয়ে দিলে ঐ টাকার অপব্যয় করা হবে না বলেই আমার ধারণা।

এর মোটামুটি মানেটা মাস্টারসাহেব বিল্টাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। যাদের যাদের বাড়িতে ক্ষীরে ছাতা ধরে তারাই পাবে রিলিফ? এরই নাম রপোট। তাই বল! যখনই লোকটা পুরি-হালুয়া খেয়েছে বাবুসাহেবের বাড়ি তখনই বোঝা উচিত ছিল। মাস্টারসাহেব নিজে যদি পোট লিখত, তবে মহাৎমাজীর কথা থাকত। মহাৎমাজী বলেছিলেন যে, কাংগ্রিস থেকে সাহায্য দেওয়া হবে গরীবদের যারা নিজেরা খরচ করতে পারে তাদের নয়। তাঁর কথা থাকল কই? সকলে গাঁয়ে ফিরে এসে ঢোঁড়াইকে দোষ দেয়। তার পাল্লায় পড়ে নিজেরা জমির বালি সরিয়ে এই ফল হল। কুয়োর বালিটা না তুললেই হত। রপোট একটা রিলিফের কথা একবার লিখতে আরম্ভ করলে হয়তো কলমের ডগায় কত রিলিফ এসে যেত। সত্যিই ঢোঁড়াই টার কথায় না পড়লেই হত। লাডলীবাবু যে বলেছিলেন, নিজের হাতে কাজ করাই মহাৎমাজী চান, তবে যারা নিজে হাতে বালি তোলেনি তারা মহাৎমাজীর রিলিফ পেল কী করে?

খালি ঢোঁড়াই কেন, কোয়েরীটোলার ছোট ছেলেটা পর্যন্ত বোঝে যে, রপোট বাবুসাহেবের পক্ষে। যতগুলো লোক রিলিফ পাচ্ছে সবাই বাবুসাহেবের দিকের। এক রইল কেবল সাঁওতালটোলার কথা। তারা কী করে কাংগ্রিসে তদবির করাল, সেটা কোয়েরীটোলার লোকেরা বুঝতে পারে না। যাকগে! গরীব মানুষ! আমাদেরই মতো পোড়াকপাল ওদের। মহাৎমাজীর নেকনজর যদি পড়ে থাকে ওদের উপর তা নিয়ে আমাদের চোখ টাটানো পাপ হবে।

এদের প্রশ্নের হঠাৎ সমাধান হয়ে যায় একদিন। নৌরঙ্গীলাল গোলাদারের ছেলে ভোপতলাল, ঐ যে, যে ছেলেটা সেবার আমনসভার মিটিনে বাগড়া দিয়েছিল, সেটা একদিন ঢোঁড়াইদের ডেকে বলে, তোরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুস নাকি? বাবুসাহেবরা সাঁওতালটোলার পাশে যে নতুন কলমা বাগান করেছে, তাতেই এনে বসিয়েছে কাংগ্রিসের দেওয়া সাঁওতালটোলার টিউবওয়েলটা! ঘুষ খাইয়েছে মহাৎমাজীর চেলাদের। গিধর মণ্ডল বলে, ও যাদের টোলার ব্যাপার তারা বুঝুক গিয়ে। আমাদের পাবলিশেরধ [৪৩৬] ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে দরকার কী?

 ভোপতলাল ছাড়বার পাত্র নয়। সে বলে যে, আমি এই ব্যাপার নিয়ে মহাৎমাজী পর্যন্ত লেখাপড়া করব। বাবুসাহেব আগে আগে হাল দিয়ে চলেছে, আর তুমি বকধার্মিক পিছনে পিছনে চলেছ খোঁড়া মাটির পোকা খাওয়ার জন্য। আশ্চর্য! গিধর মণ্ডল চটে না। আচ্ছা বাবা যাদের জিনিস তাদের জিজ্ঞাসা করলেই তো লেঠা চুকে যায়, যে তারা টিউবওয়েলটা কোথায় বসাতে চায়।

 কথাটা সকলের মনে ধরে। দল বেঁধে সবাই যায় সাঁওতালটোলায়। সাঁওতালরা বলে, থাকুক টিউবওয়েলটা বাবুসাহেবের বাগানে। আমরা ওখান থেকেই জল নিয়ে আসব।

দেখলি তো?

মিলেছে ভাল! গরুখোর গিধরটার সঙ্গে শুয়োরখোর সাঁওতালগুলোর। মুখের কইমাছ পিছলে পালিয়েছে ফুস মন্তরে। তাই গিধরটা রাগে নিজের হাত কামড়াচ্ছে।

আর এখন ওর মোসম্মতেরই বা দরকার কী, জাত বেরাদারের সঙ্গে বা সম্পর্ক কী। ঢোঁড়াই , তোকে একবার ও বলেছিল না তন্ত্রিমাকোয়েরী? এবার থেকে আমরা বলব যে, ও জাতে রাজপুত কোয়েরী। বাবুসাহেবের কাছ থেকে ও মন্থর নিয়েছে জানিস না? রপোট টাপোট সব ওরা মিলে সাজশ করে করিয়েছে। নিতে হবে না চীনেবাদামের বীজের রিলিফ, রাজপুতদের পাতকুড়ানো বকশিশ।

 পরের দিন ঢোঁড়াই মাচার নচের ছায়ায় বসে একটু আরাম করে নিচ্ছে। বিলটা কাজ করছে পুবের ক্ষেতে। একা বসে থাকলেই তার মন চলে যায় পাক্কীর দিকে। পাক্কীর উপরের গরুর গাড়ির সারকে ঠিক পিঁপড়ের সার বলে মনে হয়। ধুলো উড়িয়ে কুরসাইলার বাস চলে গেল। এখান থেকে গাড়ির ভেঁপুর শব্দ শোনা যায়। গরুর গাড়িগুলো বাস চলে যাবার পর আবার সার বেঁধেছে। দূরে গরুর গাড়ি যেতে দেখলেই সাগিয়ার কথা মনে পড়ে; এক মেলা থেকে আর এক মেলাতে হয়তো যাচ্ছে; মাথার কাপড়খানা পর্যন্ত তুলে দেয়নি।…

লাইন ভেঙে একখানা গাড়ি পাক্কী থেকে নামল এদিকে। গাড়ির উপর বস্তা বোঝাই। হবে হয়তো বাবুসাবের!..হঠাৎ ঢোঁড়াই য়ের বুকের স্পন্দন একটু দ্রুত হয়ে ওঠে।…সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। ঠিক সেই রকমই সোজা সোজা শিঙ! বাঁ দিককার বলদটার কপালের কালো দাগটা আরও কাছে এলে নজরে পড়ে। এ গাড়ি বলদে তো ঢোঁড়াইয়ের ভুল হতে পারে না; লেজের গোছার অর্ধেক চুল সাদা, ডাইনের লালিয়া বলদটার।…ক্ষেত থেকে বিল্টা জিজ্ঞাসা করে, কোথাকার গাড়ি? জিরানিয়া টুরমনের ফারমের [৪৮৮]। এটা বিসকান্ধা না? কোয়েরীটোলা? এখানকার জন্যে চীনাবাদামের বীজ পাঠিয়েছে, টুরমনের ফারম থেকে।

চেনা চেনা লাগে গাড়োয়ানের গলার স্বরটা!..যা মনে করেছিল ঠিক তাই! মোড়ল! তাদের তাৎমাটুলির মোড়ল! তার গাড়ি মোড়ল চালাচ্ছে কেন? কী ভেবে যেন ঢোঁড়াই পাশের বেড়াটার আড়ালে গিয়ে বসে। আশপাশের ক্ষেত থেকে লোক গিয়ে জমে গাড়ির চারিদিক।

ফারম থেকে বলে দিয়েছে, যাকে যেমন দেওয়া দরকার, লাডলীবাবু খাতায় লিখে লিখে সকলকে দেবে।

ঐ যে ছাত হাঁ করে রয়েছে, ঐটাই লাডলীবাবুর বাড়ি। ওখানেই নিয়ে যা গাড়ি। আর এ পথে ফিরবার দরকার নেই। ঐ হাঁ-করা বাড়িটার মুখের মধ্যে পুরে দিস এই বস্তাগুলো। বড় পেট ওদের। তারপর যদি কিছু বাঁচে বিলিয়ে দিস রাজপুতটোলায়। গাড়োয়ানটার চোখেমুখে কথা। এই মুহূর্তে সে ব্যাপারটা বুঝে নেয়।

আরে, চটে কী করবি। ভূমিকম্পে তোদের আর কী হয়েছে। আমরা করতাম ঘরামির কাজ, আর কুয়োর বালি ছাঁকার কাজ। ভূমিকম্পে ভাঙবার পর সব খোলার ঘরে টিনের ছাত উঠেছে, সব বাড়িতে টিউবওয়েল বসেছে। তিরিশ টাকায় টিউবওয়েল পাওয়া যায়, কে আর কুয়ো খোঁড়াচ্ছে! ধরতিমাইর খেয়ালই বলব একে। তাই না এই চীনেবাদামের বস্তার উপর সারারাত বসে কাটাতে হচ্ছে। আর যা পাচ্ছিস নিয়ে নে। ক্ষেতে না লাগাস খেয়ে ফেলবি। এও কি পেতিস নাকি? আশ্রমের মাস্টারসাহেব রপোর্ট দেখে এক হুড়ো দিয়েছে ফারমের উপর যে, এক বছরের উপর হল এখনও কটা চীনাবাদামের বীজ পাঠাতে পারলে না বিসকান্ধায়?

 বিল্টা ক্ষেপে ওঠে, ঢের হয়েছে, তোর রাপজুতদের তরফ থেকে বালিস্টারি করতে হবে না। জলদি বেরো আমাদের টোলা থেকে।

 রাগে গজগজ করতে করতে গাড়োয়ান বলদের লেজ মোড়ে। বাপের কেনা সড়ক তোদের। ধার অনেক তো কিনে নে ঘোড়া- তোদের হয়েছে তাই।

ঢোঁড়াই  বেড়ার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।…রাশর টান আলগা, তবু বলদ জোড়া মুখ উঁচু করে রয়েছে। বাতাস শুঁকছে নাকি? নিশ্চয়ই তার গন্ধ পাচ্ছে! ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে গায়ে একবার হাত বুলিয়ে দেয়। হাত-বুলানো দূরের কথা, এমনি কপাল করে পাঠিয়েছ রামচন্দ্রজী যে, নিজের গাড়ি বলদও বেড়ার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখতে হয়।

———–

[৪৮৮- টুর্নামেন্ট এগ্রিকালচারাল ফার্ম।

.

অভীষ্ট পূরণে বাবুসাহেবের উল্লাস

সেসরসাহেবের পায়াভারি খানদান। কিছুদিন টাল খেয়ে পড়েছিল। এতদিনে আবার মাথা উঁচু করে জমিয়ে বসেছে গাঁয়ে। লাডলীবাবুই না একটু বিপথে গিয়ে অমন পরিবারটার জলুস একটু কমিয়ে দিয়েছিল, সেই লাডলীবাবুর কল্যাণেই ছাতলাধরা বাড়িঘরদোর আবার চকচকে ঝকঝকে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দারোগা-হাকিমের চোখেও তাঁদের কলঙ্কের দাগ মুছেছে। আসলে সব হয়েছে সময়ের গুণে; কিন্তু বাবুসাহেব বাড়িতে বলেন যে, তিনি সংসারের ভ আবার হাতে নিয়েছেন বলেই সামলাতে পেরেছেন।

 বাবুসাহেব আজ সাঁঝের পর এখনও বাড়ির ভিতরে যাননি। গিধর মণ্ডলের জন্য অপেক্ষা করছেন। গিধর আজকাল প্রায় রোজই আসছে। সংসারের কাজে তালিম দেওয়ার জন্য বাবুসাহেব নাতিকে নিয়ে বসেন এই সময়টায়। আজকে গিধর সেই ব্যাপারটা একটা অন্তিম নিষ্পত্তি করে আসবে বলেছে। সব হয়েই এসেছে। গিধর করেছে এবার খুব। কাজটা করেছেও বেশ গুছিয়ে। আজকে খবরটা শুনবার পর তবে তিনি গিয়ে পূজোয় বসবেন। পূজোর উপচার সব ঠিক করাই আছে। ঘরবালী ইতিমধ্যেই দুবার ডেকেও পাঠিয়েছেন। মেয়েমানুষের কাণ্ড! বুঝবে না কিছু, কেবল রাত হয়েছে, রাত হয়েছে।

 মনের অস্থিরতা কাটাবার জন্য বাবুসাহেব অভ্যাস মতো নাতিকে উপদেশ দেওয়া আরম্ভ করেন। সে বেচারা অনেকক্ষণ থেকে বসে ঢুলছে।…অতিথি এলে দুধদই দেবেন পুরো। কিন্তু সব সময় বলবেন যে, আজকাল আর দুধ কই বাড়িতে। সব মোষ মরে হেজে গিয়েছে।…মরদের জমি বেড়ে চলে, মেয়েমানুষের জমি কমে যায়, আর হিজড়ের জমি যেমন-কে তেমন থাকে।..জমির সীমানায় তালগাছ পোঁতাটা একদম ভুল। ও হিজড়েরা পোঁতে। ঐ একটা বেঢঙ্গা লম্বা সাপ শকুনের আড্ডা। দু পুরুষে জমি বাড়ে মোটে বেড়ের অর্ধেকটা।…যেদিকে লোক চলাচল কম সেদিককার সীমানার বাঁশঝাড়ই ভাল, আর বাড়ির কাছে কলার ঝাড়। বাবুসাহেব মনে মনে ভাবেন, মেয়েমানুষের জমির ধর্মই যে কমে যাওয়া। গিধর মণ্ডল তো শুধু নিমিত্তের ভাগী।

গাঁয়ের লোকের মন না মতি। ঘুঘু গিধর মণ্ডল এই নবম জায়গাটায় ঘা দিতে পেরেছিল এতদিনে। বুড়হাদাদার পাঁচ বছরের নাতিটা রক্তবমি করে দুদিনের জ্বরে মারা গিয়েছিল। তারপর গিধর বুড়হাদাদাকে কী সব যেন বলেছিল।

ঠিক বলেছিস গিধর, এ ঐ ডাইনী মোসম্মতটারই কাজ। এ তো আমার মাথায় ঢোকেনি আগে। বুড়হাদাদার ঘোলাটে চোখ দুটোকে লেজে পা পড়া বিড়ালের চোখ বলে ভুল হয়। রাগের জ্বালায় এখনই বুঝি বেড়া আঁচড়াতে বসে। বড়হাদাদার পুত্রবধূ চিৎকার করে কাঁদছিল। তার হঠাৎ মনে পড়ে যে মোসম্মত একদিন তার কাছে আগুন নেওয়ার জন্য এসেছিল।

 লছমিনিয়ার মা-ও লক্ষ্য করেছে যে, মোসম্মতের খাওয়ার পরও তার হেঁশেলে এক থালা ভাত নিত্য ঢাকা থাকে। নিশ্চয়ই সেই যাদের নাম করতে নেই তাদের খাওয়ানোর জন্য।

সাক্ষী অভাব হয় না।

সারারাত নাকি মোসম্মত জেগে বসে থাকে। পায়ের শব্দে চমকে ওঠে।

সত্যিই তা! বিল্টাও নিযুতিরাতে ক্ষেতে পাহারা দিয়ে ফিরবার সময় মোসম্মতের তামাক খাওয়ার শব্দ শুনেছে।

সাঁঝের পর কে একজন যেন মোসম্মতকে হাটের চৌরাস্তার বটগাছটার নিচে বসে থাকতে দেখেছে। সেদিন হাটের দিন ছিল না। চারিদিকে চুপচাপ ফাঁকা, জনমানবের চিহ্ন নেই, তারই মধ্যে বুড়ি বসে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল যে, হাটের কুষ্ঠ রোগীটাকে চারটে ভাত দিতে এসেছিল। বুড়োমানুষ, থকে গিয়েছিলাম বলে, একটু জিরিয়ে নিচ্ছি।

 আরও কত রকমের প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। গাঁয়ের মধ্যে থেকে এই কাণ্ড। জাতের বুকের উপর বসে জাতের দাড়ি উপড়ানো। এর এখনই একটা জাতিয়ারী [৪৮৯] বিহিত করতে হয়।

ঠিক বলেছে গিধরটা।

বিল্টা পর্যন্ত বলে, না ঢোঁড়াই  এ আমাদের জাতের সওয়াল। তুমি এর মধ্যে নাক গলাতে এসো না। সত্যিকারের ডান কিনা সেটা না দেখেই কি আর কিছু করা হবে? তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তা তোর দরদ ঘোচে না ঐ ডানটার উপর। এই ডাইনী কিনা দেখা কথাটার মানে সকলেই জানে। পরীক্ষায় উতরে গেলে নিস্তার নেই। বিষ্ঠা গুলে খাওয়ানোর পরও সে যদি স্বাভাবিক থাকে, তখন আবার প্রশ্ন উঠবে ঐ জিনিস খাওয়া লোককে জাতে তুলবার। প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এ ব্যাপারটির গুরুত্বও কম নয়।

আচ্ছা বিল্টা, তোরা গাঁ-সুদ্ধ লোক যদি চাস যে, মোসম্মত গা ছেড়ে চলে যাক, তাহলে সে চলেই যাবে। তা বলে কোন জুলুম করিস না তার উপর। আমি তাকে মানিয়ে নেব। দেখছিস না কী ছিল আর কী মানুষ হয়ে গিয়েছে, মেয়ে চলে যাওয়ার পর। তুই বরঞ্চ একবার বলে দ্যাখ গিধর মণ্ডলকে।

অনেক সাধ্যসাধনা, কথা কাটাকাটি, সলা পরামর্শের পর ঢোঁড়াইয়ের কথা রাখে গিধর। একবার তোর কথা রাখলাম বলে, বার বার অনরোধ করতে আসিস না যেন ফিরে ফিরে।

এখান থেকে খানিক দূরে, রামনেওয়াজ মুন্সীর বাড়ির পথে একটা জলা জমি উঁচু হয়ে উঠেছিল ভূমিকম্পে। সেই জমিটা বাবুসাহেবকে বলে মোসম্মতকে পাইয়ে দিল গিধর মণ্ডল।

 …পুরনো ধরনের লোক বাবুসাহেব। কেউ গিয়ে কেঁদে পড়লে না করতে পারেন না।

খোসামোদ করে যা চাও পেতে পার তার কাছ থেকে, কিন্তু রুখে কথা বল, ঠকবে। তা ছাড়া মোসম্মতও তো আমার পর না। নগদ পয়সা বার করাই আজকালকার দিনে শক্ত। তাই নতুন জমিটার বদলে, কোয়েরীটোলার জমিটা বাবুসাহেবকে দিতে হল। তবে হ্যাঁ, সকলেরই টাকার দরকার। বাবুসাহেবকে ভাবিস সকলে ডবল মানুষ [৪৯০]। আরে মানুষও যেমন ডবল তেমনি তার খরচাও ডবল। সেসবের আন্দাজও তোরা করতে পারবি না, বুঝলি রে গনৌরী। আমি অনেকদিন মিশেছি কিনা, আমি জানি।…।

এবার গিধরটা মোসম্মতের জন্য সত্যিই করেছে খুব। এককালে যে টাকা খেয়েছে সেটা সুদে আসলে উসুল করে দিয়েছে। বাবুসাহেবকে বলে তাঁর লোকজন দিয়ে, নিজের তদারকে, সে মোসম্মতের চালা আর খুঁটিগুলো উপড়ে নতুন জমিতে বসিয়ে দিয়ে এসেছে। কদিন ধরে দিনরাত মেহনত করেছে এর পিছনে।

ঢোঁড়াই মোসম্মতের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। সেই মুখরা ডাইনী বুড়ি কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। স্বামীর ভিটে ছাড়বার সময়ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদে না। জাতের লোকদের গালাগালিটা পর্যন্ত দেয় না। তার জাতের লোকেরা তো খারাপ না। যার মেয়ে জাতকুল ভাসিয়ে, বেরিয়ে গিয়েছে, তাকে সুদ্ধ এতদিনে একঘরে করেনি। জাতের, মোড়ল, গিধর, সেও তার এই বিপদের সময় যতটুকু পেরেছে করেছে। সে তার এই দুর্ভাগ্যের মধ্যে থেকেও একটা কিছু ভাল খুঁজে বার করে, মনে স্বস্তি পেতে চায়।… গাঁয়ের বাইরে গেলে হয়তো সাগিয়াটা কোনোদিন মার কাছে আসতেও পারে।…মহাবীরজী আজ তাকে তার জাতের লোকের হাতে বেইজ্জতি থেকে বাঁচিয়েছেন।

যাবার সময় মাটির তাল বাড়ির গোঁসাইটিকে কোলে নিয়ে মোসম্মত উঠোনের তুলসীতলায় প্রণাম করে জয় মহাবীরজী।

এই খবরের প্রতীক্ষা করেছিলেন বাবুসাহেব সন্ধ্যা থেকে। গিধরের কাছে খবরটা পেয়েই, তিনি তাঁর ঠাকুরঘরে ঢোকেন। ডাকবার মতো করে ডাকতে পারলে ভক্তর কথা শুনতেই হবে তাঁকে। কৃতজ্ঞতার আতিশয্যে বিগ্রহের পায়ের কাছ থেকে তাঁর মাথা তুলতে আর ইচ্ছা করে না। নিজের জমির উপর দিয়ে তাঁর গাড়ি সদর দরজা থেকে সোজা গিয়ে পাক্কীতে উঠতে পারবে এবার থেকে।…

জয় জয় হো জানকীবল্লভ রঘুনাথজী! জয় জানকী মাঈ! জয় লছমনজী, ভরতজী, দশরথজী, কৌশল্য মাঈ, মহাবীরজী, শত্রুঘনজী, সুগ্রীব, বিভীষণ…আর কোনো নাম ছেড়ে গেল না তো? রামচন্দ্রজীর আয়ুধগুলির নাম তার মনে পড়ছে না ঠিক। বুড়ো হওয়ার নানা লেঠা। পরিত্রাণায় সাধুনাং রামোজাতঃ স্বয়ং হরি, বলে বাবুসাহেব মন্ত্র শেষ করে ওঠেন।

ও অনোখীবাবু, কোয়েরীটোলার ভজনের দলকে পাঁচসিকে চাঁদা পাঠিয়ে দেবেন কাল সকালে, মনে করে।…

——–

[৪৮৯- গিন্নী! ৪৯০. জাতের পক্ষ থেকে।]

.

রামরাজ্য আনয়নার্থে যজ্ঞ

রবিবার করলে কুষ্ঠরোগ সারে বটে, কিন্তু এক রবিবারে নয়। কথাটা মনে রাখবার মতো স্মৃতিশক্তি বাবুসাহেবের এই বুড়ো বয়সেও আছে। আজকে গাছ পোঁত, দশ বছর পরে ফল ধরবে! জমি-জিরেতের ব্যাপার। অত হড়বড় করলে কি চলে!

 তাই সত্যি করে ঘাড়ে পড়বার আগে কোয়েরীটোলার লোকরা তাদের বিপদের কল্পনাও করতে পারেনি। জানতে পারল হঠাৎ সাঁওতালটুলির লোকেরা এ জেলার লোকদের বলে বিরকু [৪৯১]। নেহাত দরকার না পড়লে তারা বিরকুদের পাড়ায় আসে না। সেইজন্য এক রাতে মঠের ময়দানে সাঁওতালের দলকে আসতে দেখে কোয়েরীটোলার লোকেরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপার কী! শিকার-টিকার থেকে ফিরছে না তো? কী রে, বড় শিকার না ছোট শিকার? খরগোস না শজারু? বোস রে ঐদিকে। খয়নি নে। আগুন নিবি?

সাঁওতালরা প্রথমটার কোন কথা বলে না। অন্ধকারের মধ্যে তাদের সাদা দাঁতগুলো দেখে বোঝা যায় যে, তারা হাসছে। তারপর পিথো মাঝি এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে যে, গেনা, গনৌরী, পরসাদী, ভবিয়া আরও কার কার যেন জমি ছেড়ে দিতে হবে সাতদিনের মধ্যে।

 ঠেসে পচই চড়িয়েছে রে শালা আজ! চেঁচামেচির মধ্যে দিয়ে আসল কথা বেরোয়, আস্তে আস্তে। বাবুসাহেব ঐ সব রায়তী জমি সেলামি নিয়ে বন্দোবস্ত দিয়েছে সাঁওতালদের কাছে। সদরে ডিগরি করিয়ে দুবছর আগেই নিলামে কিনে নিয়েছিল।

তবে যে অনিরুদ্ধ মোক্তার বলেছিল লুটিস না দিলে কিছু করতে পারবে না। হামিটা রাজপুত নাকি জাতে? না হলে নিশ্চয় টাকা খেয়েছে। নিলাম আবার কবে হল? ঢোল নেই, ঢাক নেই, গোরার বালি! চাপরাশি নেই, লুটিশ নেই, নিলাম হলেই হল আর কী!

জান কবুল!

এই দিন যে হাতাহাতিটার আরম্ভ, সেটা চলে বহুদিন। থানা-পুলিশ, মাথা ফাটাফাটি, ফৌজদারি আদালত, কিছু করেই জমিগুলো রাখা যায় নি। দারোগা হাকিম, এমনকি হাসপাতালের ডাক্তারটা পর্যন্ত সবাই বাবুসাহেবের দিকে। শেষ পর্যন্ত একদিন পুলিশের সম্মুখে সাঁওতালরা ঐ জমিগুলোর উপর মুর্গি কেটে খেল।

 এই আবহাওয়ার মধ্যে প্রথম যৌবন যেদিন বলন্টিয়ররা গান গাইতে গাইতে কোয়েরীটোলায় এল সেদিন গাঁয়ের বড়রা গান শুনবার জন্য তাদের উপর ভেঙে পড়েনি। মহাৎমাজীর চেলাদের নাম বলন্টিয়র।

 ছেলেরা তাদের বলে, এখান থেকে সিধা গেলে লাডলীবাবুদের বাড়ি পাবেন।

তারা লাডলীবাবুদের বাড়ি থেকেই এদিকে এসেছে। সেখানে উঠবে বলে গিয়েছিল। বাবুসাহেব খাসকামরায় তাদের ডেকে বলেছিলেন যে ছাপোষা মানুষ তিনি। সংসার ধর্ম করে খেতে হয়। ছেলে হচ্ছে নিজের হাত-পা। তারই একটাকে তিনি তো দানই করেছেন মহাৎমাজীকে। লাডলীবাবুর দোস্তরা তাঁর ছেলেরই মতন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের থাকতে দেওয়ার মানে রাজপারভাঙার বিরুদ্ধে যাওয়া। কোয়েরীটোলার ভাঙা মঠটা এখনও লোক থাকবার যোগ্য আছে। শীত পড়ে এসেছে, এখন আর সাপের ভয় নেই ওখানে।

তোমাদের টোলায় এলাম, আর তোমরা চলে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিচ্ছ? টোলায় আমাদের থাকতে দিলে পুলিসে ধরবে না।

 সাঁওতাল, রাজপুত, আর পুলিশের সঙ্গে বলে কত লড়লাম, এই কয় বছর ধরে, তার আবার পুলিশের ভয়! ভারী সুন্দর কথা বলে বলন্টিয়ররা।

তাসের গোলাম বড়র খেলা জান না? আমাদের মুল্লুক সেই গোলাম বড়র রাজ্য। অংরেজের মাইনে পাওয়া চাকর কলক্টর দারোগা, আর পাতের এঁটো কুড়ানোর চাকর জমিদার। লড়ে দেখেছ তো? এদের সঙ্গে লড়লে পাবলিস হেরে যায়। মহাৎমাজীর খেলায় পাবলিসের এক্কা [৪৯২] বড়।

কত মজার মজার কথা বলে বলন্টিয়ররা। বোট [৪৯৩] না কী একটা কথা তারা ঠিক ধরতে পারে না। কেবল এইটুকু বোঝে যে একদিকে মহাৎমাজী, আর এক দিকে রাজপারভাঙা। মহাৎমাজীর দিকে আছে কাংগ্রিস আর মাস্টরসাহেব। রাজপারভাঙার দিকে বাবুসাহেব, রাজপুতরা, দারোগা সাহেব, ইনসান আলি আড়গড়িয়া, গিধর মণ্ডল। বাবুসাহেবের পা-চাটা সাঁওতালগুলো কোন দিকে বোঝা যাচ্ছে না। কোন দিকে আর হবে। যে দিকে যইয়ের ক্ষেত সেই দিকেই ঐ মোষগুলো মুখ বাড়ায়।

 তোরা মানুষ না কি! পাবলিস-এর জমি হড়পাচ্ছে বাবুসাহেব। মঠের জমি। আখের চাষ আরম্ভ করেছে সেই সব জমিতে। মঠবাড়ির চৌকাঠগুলোর সুদ্ধ খুলে নিয়ে গিয়েছে।

 ঢোঁড়াই বলে, হুজুর! নিজের জমিই বলে আমরা বাঁচাতে পারলাম না জান কবুল করেও, তার আবার পাবলিসের জমি। বলন্টিয়ররা বলছে বটে কড়া কথা, কিন্তু কথাগুলো,দামী কথা। গুরুজীও তা ছাত্রদের গালাগালি দেয়, বাপও ছেলেকে মারে। না হলে আবার আপনার জন কী?

 হুজুর বললাগে তোমাদের বাবুসাহেবকে, আর দারোগা হাকিমকে। মহাৎমাজী আমাদের বলে দিয়েছেন, যে যে গাঁয়ের লোক তোমাদের হুজুর বলে সে গাঁয়ে থেকো না।

কোয়েরীরা সকলেই ঢোঁড়াইয়ের উপর চটে ওঠে, মহাৎমাজীর এই হুকুমটুকুও জানিস না ঢোঁড়াই?

ঢোঁড়াই অপ্রস্তুত হয় না। বলে, আমরা মুখ লোক, চোখ থাকতেও অন্ধ। আপনারা রামায়ণ না পড়া লোক, আপনাদের হুজুর বলতেই আমাদের বাপ-দাদা শিখিয়েছে। এ শুধু আপনাদের ইজ্জত দেখান নয়, রামায়ণকে ইজ্জত দেখান।

এই লোকটাই তাহলে ঢোঁড়াই। এরই কথা লাডলীবাবু বলে দিয়েছিল। কথার বাঁধুনি তো খুব। বলন্টিয়ররা হঠাৎ ঢোঁড়াই কে আপনি বলে কথা বলতে আরম্ভ করে। একে দিয়েই তাদের কাজ হবে। এ একটা নতুন অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে। ঠাট্টা করছে বলে তো মনে হচ্ছে না মুখ দেখে। আজকে তেল মেখেছে বলে বাবুভইয়া ভাবল না তো তোকে। কী রকম একটা অস্বস্তি লাগে মনে।

আ গয়া! এসে গেল! এসে গেল! এল আবার কী। সাদা বাক্সতে আবার কী? বোট! বোট! ভয়ের তো লক্ষণ দেখছি না বলন্টিয়রদের মুখে। মহাৎমাজীর খাদি সাদা, মহাত্মাজির বাক্স সাদা! সাদাতে মনের ময়লা কাটবে। পাকসাফ! জমিদারে রক্ত শুষে সাদা ফ্যাকাশে করে দিয়েছে আপনাদের, তাই আপনাদের বাক্স সাদা। দিতেই হবে আপনাদের। সাদা বাক্সতে।

কোনো চাঁদা কিংবা তোলা টোলা নয়তো? এ টোলায় যারা দশ আনার বেশি চৌকিদারী খাজনা দেয়, তাদেরই কেবল বোট দিতে হবে। সাঁওতালটোলায় যারা পাঁচ আনা খাজনা দেয় তারাই বোট দিতে পারবে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে বুড়হাদাদার। ভাগ্যে সে সাঁওতাল নয়। খুব বেঁচে গিয়েছে সে। তাকে চৌকিদারী খাজনা দিতে হয় সাড়ে ছয় আনা।

বিল্টার চোখ জ্বলে ওঠে। জবরদস্তি পেয়েছ! আমার বোট বসালেই হলো নাকি! সার্কিল মানিজর, জমিদার টমিদার আমি কিছু বুঝি না।

 ঢোঁড়াইয়ের সব শুনে মনে হয় যে বোটটা গঞ্জের বাজারে সাদা বাক্সতে দিতে হয় ধর্মদায়-এর মতো। নৌরঙ্গীলালের গোলার পাট, তামাক বেচতে গেলেই দাম থেকে গাড়ি পিছু চার আনা করে কেটে নেয় ধর্মদায় বলে। নৌরঙ্গীলাল সিকিটা একটা তালা দেওয়া বাক্সের ফুটোর মধ্যে ফেলবার সময় সুর করে বলবেই গৌ সেবা কি করো তৈয়ারি, প্রাণ বাঁচে গোমাতাকী।…

অদ্ভুত জিনিস এই বোট। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়ে গিয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গায়ের। তাই মানিজর সাহেবের মতো অত বড় একটা লোক একদিন বাবুসাহেবকে সঙ্গে করে কোয়েরীটোলায় এলেন। বাবুসাহেব তাঁকে বলেছিলেন যে, ঢোঁড়াইটাকে বুঝোতে পারলেই কোয়েরীটোলার কাজ হয়ে যাবে। এত বড় একটা অফসর আদমী [৪২৮] পায়খানাতেও নাকি কুর্সিতে বসে, যার আরদালি জিরানিয়া থেকে সাইকেলে রোজ পাউরুটি আর খবরের কাগজ নিয়ে আসে। এহেন সার্কিল মানিজর সাহেবও ঢোঁড়াইকে চেনেন, নাম ধরে ডাকেন, তুই না বলে তুমি বলেন। গর্বে ঢোঁড়াইয়ের মন ভরে ওঠে।

বলন্টিয়ররা বলেছে সারা মুল্লুক জুড়ে এই রকম বোট হচ্ছে। চেরমেন সাহেব যদি তাৎমাটুলিতে যান এইরকম, তবে না তাৎমাটুলীকে বলব গাঁ। বলন্টিয়াররা মঠের বটগাছে একটা সুন্দর ঝাণ্ডা বেঁধে সেইখানেই আস্তানা গেড়ে বসেছে কিছুদিন থেকে। একদিন জিরানিয়া-ফেরত একজন বলন্টিয়র ঝোলার ভিতর থেকে বার করে দিল মহাৎমাজীর চিঠি; যে যে বোট দেবে সবার নামে এক-একখান। রামায়ণের হরফের মতো লেখা মহাৎমাজীর। যারা দশ আনা চৌকিদারী খাজনা দেয় তাদের স্ত্রীদের নামেও মহাৎমাজী চিঠি দিয়েছেন। সন্ত আদমীরা সকলের নামধাম সব জানতে পারেন। তাৎমাটুলিতে ঢোঁড়াইয়েরও চৌকিদারী ট্যাক্স দেড় টাকা ধরা হয়েছিল। সেখানে থাকলে তার নামেও মহাৎমাজী চিঠি দিতেন। আরও এককান চিঠি যেত। রামপিয়ারীর জৌজে [৪২৯] ঢোঁড়াই-এর নামে। এখন হয়তো রামপিয়ারী জৌজে সামুয়র। মহাৎমাজীর স্বীকৃতির সিলমোহর পড়ে যাচ্ছে এত বড় একটা অবিচারের উপর। এই মনখারাপ করা কথাগুলো ঢোঁড়াই দূর করে ফেলতে চায় মন থেকে। মহাৎমাজী বোধ হয় সামুয়র ধাঙড় লিখবেন না, লেখা থাকবে রামপিয়ারী জৌজে সামুয়র হরিজন…কী ভাগ্যি লোকগুলোর যেগুলো মহাৎমাজীর চিঠি পায়।..

শেষ পর্যন্ত মহাৎমাজীর কাছ থেকে ঢোঁড়াইয়ের নামে একখানা চিঠি আনিয়ে দিতে রাজী হয় বলন্টিয়ররা, যদি ঢোঁড়াই তাদের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের গাঁয়ে মহাৎমাজীর গান গেয়ে বেড়ায়। আপনার গানের গলাটা বেশ ভজনের সময় শুনেছি তো। এ কথা কাউকে বলবেন না যেন। সেই বোট-এর দিন চিঠি দেব। ধন্যি ভাগ্যি তার, যে মহাৎমাজীর চেলাদের নেকনজরে পড়তে পেরেছিল। মনে মনে ভাবত যে দুনিয়ার অনেক কিছু দেখেছে সে। ছাই জানে সে! এত বড় ব্যাপার বোট যার জন্য সার্কিল মানিজর দুয়োরে মাথা কোটেন, মহাৎমাজী চিঠি দেন, তার সম্বন্ধে কিছুই জানত না সে। দৈবক্রমে সে বলন্টিয়ারদের কাছ থেকে জেনেছে, বোটের মানে সাদা ডাক বাক্সে চিঠি ফেলতে হবে, মহাৎমাজীর চিঠির জবাবে। বিনা টিকিটের চিঠিই ঠিক জায়গায় পৌঁছোয়। ঐ চিঠি পেলেই মহাৎমাজী বুঝবেন যে তোমরা রামরাজ্য চাও কিনা। প্রথমেই তিনি কানুন করবেন খাজনা কমাবার আর জমিদারকে কাবু করবার।

সাদা বাক্সের গান তো নয়, রামরাজ্য কায়েম করবার গান; রামচন্দ্রজী আর মহাৎমাজীর নামেই মহিমা প্রচারের ভজন। অষ্টপ্রহর ভজনের দিন যে-রকম মাদকতা আছে সাদা বাক্সর গানে। থামতে আর ইচ্ছে হয় না। ঠেলে নিয়ে যায়। সার্কিল মানিজর সাহেবের দিকে থেকে টাকার লোভ দেখাতে এলে, গিধর মণ্ডলকে মারতে ইচ্ছা করে। ভোটের দিন সার্কিল মানিজর তাদের কুশীঘাটের নৌকা সরিয়ে নিলে, এই নেশাটা সাঁতরে নদী পার হতে বাধ্য করে। সাঁওতালের দলকে ওদের তাঁবুতে পুরি খেতে দেখলে, মনটা পাগল হয়ে ওঠে; ঝাঁপিয়ে কেড়ে নেয় ঢোঁড়াই পাশের বলন্টিয়রের হাতের চোঙ্গাটা; গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে।

মাগনা কচুরি পাও খেয়ে নিও
মাগনা গাড়ি পাও চড়ে নিও
পয়সা পাও বটুয়াতে ভরে নিও
কিন্তু ভোটের মন্দিরে গিয়ে বদলে যেও ভাই হামারা
সাদা বাক্স মহাৎমাজীকা সাদা বাক্স!

বাবুসাহেবের পাহারাদার বজ্ৰবাঁটুল তিলকুমাঝি ছুতো করে তাঁবুর বইরে এসে ঢোঁড়াই কে ইশারা করে জানিয়ে যায় যে, তারা ঠিক আছে।

 বলন্টিয়ররা মহাৎমাজীর চেলা, সাচ্চা আদমী। তারা তাদের কথা রেখেছিল, সেদিন বেলাশেষে। সাদা ছোট এক টুকরো কাগজে ভারী সুন্দর কী যেন একটা লিখে দিয়েছেন মহাৎমাজী। হোক ছোট। দেশজোড়া লাখ লাখ লোককে লিখতে হচ্ছে। তাঁর। কত আর লিখবেন! একখানা চিঠি লিখতেই বলে মিসিরজী হিমশিম খেয়ে যায়।

বলন্টিয়র ভাঙা গলায় তাকে বলে, তোর নাম ঢোঁড়াই কোয়েরী, বাপের নাম কিরতু কোয়েরী বিসকান্ধার। হাকিম জিজ্ঞাসা করলে বলবি। মুখস্থ রাখিষ, বাপকা নাম কিরতু কোয়েরী। হাকিম আর একখানা মহাত্মজীর চিঠি দেবে। এখান নিয়ে গিধর মণ্ডলের তন্ত্রিমাকোয়েরী কথাটা ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে। এক অজ্ঞাত উত্তেজনায় তার সারা শরীর ঘেমে ওঠে; সকলে বোধ হয় তাকে দেখছে? চলবার সময় পা জড়িয়ে আসছে। সে যখন হাকিমের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল, তখন তিনি চটে আগুন হয়ে পিথা সাঁওতালকে বকছেন। চিঠি ফেলবার আগে সাদা বাক্সটায় সিঁদুর দিচ্ছিল সে। ..জেলে পুরব তোকে আমি; বাক্সর রং বদলান হচ্ছিল।…

ঢোঁড়াইকে দেখেই অসহায় পিথো অকূলে কূল পায়। দেখছিস ঢোঁড়াই হাকিমের কাণ্ড! আমি বলি হাকিম তুমিও নাও না কেন বিড়ি খাওয়ার জন্য এক আনা পয়সা। ত নয় আমাকে হাজতে পুরবে বলছে …

হাকিম ঢোঁড়াইকে কিছু না জিজ্ঞাসা করেই হাত বাড়ান, তার হাত থেকে মহাৎমাজীর চিঠিখানা নেওয়ার জন্য। ঢোঁড়াই কোয়েরী? নতুন মহাৎমাজীর চিঠিতে হাকিম ডাকঘরের মোহর মেরে দেন। যাও! হাকিমের চিৎকারে ঢোঁড়াই  চমকে ওঠে। তবু ভাল! হাকিম পিথোটাকে ছেড়ে দিল।

ঘরের মধ্যে সাদা বাক্সটাকে প্রণাম করে ঢোঁড়াই চিঠিখান তার মধ্যে ফেলে। ধন্য হে মহাৎমাজী, ধন্য হো কাংগ্রিসের বলন্টিয়ার, যাদের দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাটবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল। দুঃখে তার বুক ফেটে যায়, সে যদি লিখতে জানত তা হলে নিজে হাতে লিখে দিত মহাৎমাজীকে। এই চিঠির মধ্যে দিয়ে মুল্লুকের এক পারের লোক সেই কোথায় অন্য পারের মহাৎমাজীর কাছে পৌঁছতে পারছে, এক সঙ্গে, এক সময়। তাৎমাটুলি, জিরনিয়া, বিসকান্ধা, গঞ্জের বাজার, ঢোঁড়াই, রামপিয়ারী, পিথো সাঁওতাল, বলন্টিয়র, তিলকুমাঝি, মাস্টারসাহেবে একই জিনিস চায়। তারা সকলে একই চিঠি দিয়েছে মহাৎমাজীকে। সরকার, হাকিম পুলিশ, জমিদার, সার্কিল মানিজর, গিধর কোয়েরী, বাবুসাহেব, ইনসান আলি বোধ হয় কিরিস্তান সামুয়র, সব তাদের বিরুদ্ধে। জাতের মিল নেই, তবু কত কাছে এসে গিয়েছে তারা। রমিয়া আর তার ছেলেটা সে রকম আপন হলেও পর, তেমনি এরা সব পর অথচ আপন। মাকড়সার জলের মতো হালকা সুতোর বাঁধন, ধরতে গেলেই ছিঁড়ে যায় এমন মিহি। সব সময় বোঝাও যায় না আছে কি নেই; হাওয়াতে যখন দোলা দেয়, ভোরের শিশিরে যখন ভিজে ওঠে, হঠাৎ- রোদের যখন ঝলকানি লাগে তখন দেখা যায়; তাও খানিক খানিক। রামজীর রাজ্য জুড়ে পলকা সুতোর জাল বুনে চলেছেন তাঁরই অবতার মহাৎমাজী। সেই পশ্চিমা মেয়েটার বাঁধন, সেই সাত বছরের ছেলেটার বাঁধন, সাগিয়ার বাঁধনের মতো এ বাঁধন, সেই সাত বছরের ছেলেটার বাঁধন, সাগিয়ার বাঁধনের মতো এ বাঁধন কেটে বসে না গায়ে। ঝামা দিয়ে ঘষলেও কলজের উপর থেকে সেগুলোর দাগ তোলা যায় না, কিন্তু এটাকে কেবল আমলকী খাওয়া মুখের মতো একটা ফিকে স্বাদ রেখে যায়।

 এই করছ কী ভিতরে?

হাকিমের তাড়া খেয়ে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে।

——–

[৪৯১. বিরকু কথাটির মধ্যে খানিকটা অবজ্ঞা মেশানো! ৪৯২. এক্কা কথাটি স্থানীয় ভাষায় দ্ব্যর্থবাচক। এর একটি অর্থ একতা। অপর অর্থ তাদের টেক্কাট। ৪৯৩. ভোট। ৪৯৪. ক্ষমতাশালী লোক। ৪৯৫. রামপেয়ারী স্ত্রী ঢোঁড়াই ভোটারদের তালিকায় স্ত্রীলোকদের নাম একইভাবে লেখা হয়।]

.

লাডলীবাবুর চরু লাভ

লাডলীবাবুটা আবার আনাগোনা আরম্ভ করেছে কোয়েরীটোলায়। ও লোক ভাল, মহাৎমাজীর চেলা। দুবার হয়ে এসেছে [৪৯৬]। কিন্তু তবু বিশ্বাস নেই ওই রাজপুতদের ঝাড়কে।

বিল্টা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এই যে তিন মাস অন্তর বোট আরম্ভ হল এর শেষ আছে। কি নেই। আসল কাজের কথা কিছু নেই, কেবল নিত্যি তিরিশ দিন বোট, বোট, বোট। বোট জিনিসটা খারাপ নয়। সেদিন দারোগা সাহেব আর সার্কিল মানিজর সাহেবেরে গা ঘেঁষে তারা চলে গিয়েছিল। আদাব না করে। আরে কাংগ্রিসের লোকেরা লাটসাহেবের সঙ্গে লড়েছে, ওরা দারোগা-জমিদারকে গিলে ফেলতে পারে গলার গুলিটাকে পর্যন্ত না নাড়িয়ে। আর এই রাজপুতদের? চোখেও দেখা যাবে না; উঠের মুখে জিরে! ফুঃ!

লাডলীবাবুর সম্মুখে রাজপুতদের বিরুদ্ধে কথা বলবার সাহস তাদের হয়েছে, আগেই ভোটের পর থেকে। কাংগ্রিস থেকে আধিয়াদারদের জন্য নতুন কানুন হবে বলন্টিয়ার বলেছে। আর পরোয়া কিসের!

 বাবুসাহেবের খোশামোদ করে তো গনৌরী, ভবিয়া, পরসাদী কেউ জমি রাখতে পারেনি। ভোলাকে যেতে হয়েছে কাটিহারে কাজের জন্যে। গনৌরী, ভবিয়া আর পরসাদী গিয়েছে কুরসাইলা। সেখানে রাজপারভাঙা চিনির কল খুলেছে তিন বছর থেকে। আর চায় না তারা বাবুসাহেবের পা চাটতে। এক সময়ে অসময়ে কিছু খরচখরচার ব্যাপার। রামজীর আশীর্বাদে তারও একটা সুরাহা হয়েছে। গঞ্জের বাজারে নৌরঙ্গীলাল গোলাদার, ওই যে, ভোপতলালের বাবা, সেই দরকার হলে খরচ দেয়। যত চাও। ভালো রক্তের লোক। ধার শোধ দেবার সময় বুড়হাদাদু প্রতিবার দড়িতে যে গিট দিয়ে রাখে, সেটাকে কখনও অবিশ্বাস করেনি আজ পর্যন্ত। ঐ ত বাবুসাহেব। সব জানা আছে। এত বছর থেকে দেখছে, বাবুসাহেব আর তাঁর গোমস্তাদের। এক কথার মানুষ নৌরঙ্গীলাল গোলাদার। সাফ বলে দিয়েছে আখের চাষ আর লঙ্কার চাষ করতে হবে। না করলে তার গোলামুখো হওয়ার দরকার নেই। সে কুরসাইলা মিলে আখের যোগান দেয়, আর লঙ্কা পাঠায় পূর্বীবাঙাল। তারই গাড়ি এসে গাঁয়ে থেকে নিয়ে যায়। কোনো হুজ্জত নেই। তবে আর রাজপুতদের এত খাতিরদারি কিসের? বিপদের সময় রামচন্দ্রজী কাকের মুখ দিয়ে পথের হদিশ পাঠিয়ে দেন। তাই না নৌরঙ্গীলালের কাছ থেকে তারা এমন আখ পেয়েছে পুঁতবার জন্য, যা বাবুসাহেব পর্যন্ত জোগাড় করতে পারেননি। বুনো শুয়োরের দাঁত ভেঙে যায় সে আখ চিবুতে গেলে। পাটনাই লঙ্কার বীচি দিয়েছে, এত বড় বড়, এই আঙুলের মতো; কাঁচা লঙ্কারও যা দর, পাকা লঙ্কারও তাই দর। গোলাদারই তো শিখিয়েছে, কেন এতদিন ক্ষেত পাহারা দিবি, কাঁচাই বেচে দে। এই নৌরঙ্গীলালই প্রথম কাঁচা লঙ্কা পাঠাতে আরম্ভ করেছে রেলগাড়িতে। বাবুসাহেব চটবে তো বসে বসে নিজের গোঁফের চুল কাটবে দাঁত দিয়ে। লাডলীবাবু বলে হাঁ, পূর্বীবাঙাল-এর মতো নরম পানির দেশে কাঁচা লঙ্কা না খেলে লোকে বাঁচে না। আমি একবার গিয়েছিলাম। খালি পানি, খালি পানি। সাধে কী আর বাঙ্গালিরা এখানে এসে জমিয়ে বসে। এই মাস্টারসাহেবকে দেখ না। এবার ঠিক ডিস্টিবোডের চেরমেন হওয়ার চেষ্টা করবে। কেউ কথাটার উপর কোনো গুরুত্ব দেয় না। ঢোঁড়াইয়ের একটু আনন্দই হয়। তবে পুরনো চেরমেন সাহেবের মতো অত বড় একটা লোকের কাজ মাস্টার সাহেব চালাতে পারবে তো? বড় ভালো লোক ছিল চেরমেন সাহেবের বাড়ির বুড়ি মাইজী। সবাই জানে যে, লাডলীবাবু এবার ডিস্টিবোড়ে দাঁড়াচ্ছে কংগ্রিসের থেকে। হাতে কাটবে এবার। ডিস্টিবোডে যাওয়ার আগেই বলে খোঁয়াড়ের মালিক ইনসান আলি, গঞ্জের-বাজারের হাসপাতালের ডাক্তার, ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে ছিল। রাজপুতদের সঙ্গে জমি নিয়ে ঝগড়ার সময় কিছু বলতে গেলে বলত যে, আমি তো জমিজিরেত সম্বন্ধে কিছু জানি না; জমি দেখাশুনা করেন অনোখবাবু আর বাবুসাহেব।

 মরে যাই রে! মুখের মাছিটা তাড়াতে পারেন না। সব বুঝি রে, আমরা সব বুঝি। লাডলীবাবুও এদের হাবভাব সব বোঝে, কিন্তু তবু হাল ছাড়ে না। হঠাৎ এরই মধ্যে একদিন টোলাসুদ্ধ সকলের নেমন্তন্ন হয়ে গেল সত্যদেবের কথা শুনবার জন্য, গিধর মণ্ডলের বাড়িতে।

ব্যাপারখানা কী! হারকঞ্জুস লোকটা তো বিনা পয়সায় গায়ের ময়লাটুকুও কাউকে দিতে রাজি নয়। সে করবে দেড় টাকা খরচ বিনা মতলবে। আরে, বাবুসাহেবের দেওয়া ভজনপার্টির দরুন সেই পয়সাটা নয় তো? ঠিক, ঠিক, ঠিক! উগলে দিচ্ছে। দেবদানো পুরুত গুণীর পয়সা কি কারও পেটে থাকে? সে যত বড় গরুখোরই হোক না কেন।

ঢোঁড়াইয়ের নেমন্তন্ন হয়নি। সকলের চোখেই জিনিসটা বিসদৃশ ঠেকে। জাতিয়ারি সত্যদের কথা, এ তো জন্মে কেউ শোনেনি কোনোদিন। পূজোর পর গরভু পত্তনিদার দেখে তারা ব্যাপারটা মোটামুটি আন্দাজ করে নেয়।

পূজোর পর গরভু পত্তনিদার কাজের কথা পাড়ে।…সবাই মিলে রাজপুত আর ভূমিহার বামুনদের ঠাণ্ডা করতে হবে। নামেই মহাৎমাজীর কাংগ্রিস। রাজপুত ভূমিহারারই মহাৎমাজীকে ঠকিয়ে এটাকে হাত করেছে।…লাডলীবাবু! কোথায় ছিল লাডলীবাবু, যখন ইনসান আলির আড়গড়িয়ার খোয়াড় থেকে, একটা লাল বলদ কপূবের মতো উবে গিয়েছিল বকরঈদের আগে। সে সময় কোথায় ছিল রাজপুতগিরি? মহাবীরী ঝাণ্ডা নিয়ে যাওয়ার দিন কলস্টরকে খবর দিয়েছিল কে? হাতে কঙ্কণ, আরশির দরকার কী? অনেক চেটাং চেটাং কথা বলেছিস কাংগ্রিস মহাৎমাজীর ভোটের আগে। এখনও শুনছি কানুন তৈরি হচ্ছে। একটা কানুনও করবে না, এই বলে রেখে দিলাম।… আমাদের সাহায্যেই ভোট কাংগ্রিস জিতেছিল আগেরবার। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি কুছত্রি, কুশবাহাছত্রি, আর যদুবংশীছত্রি [৪৯৭] তিন জাত মিলে রাপজুত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। এই তিন। জাতে মিলে হয়েছে, ত্রিবেণী সঙ্ঘ।

 ভারী সুন্দর নামটা। তিরবেণী সং।

বুড়হাদাদু গরভু পত্তনিদারকে শুনিয়ে জিজ্ঞাসা করে বিল্টাকে, এত বুদ্ধির কথার সঙ্গে এর আগে মোলাকাত হয়েছে জিন্দেগীভরে?

রাজপুতি শান দেখাতে আসে। অবজ্ঞায় বাঁকানো ঠোঁটের পিচকারী থেকে, চিক চিক করে খয়নিগোলা থুতু মেঝের উপর ছোটে। গিধরটা এতক্ষণ কথা বলেনি। সকলের উঠবার সময় কেবল বলে, যে জাত ঘুমিয়ে থাকে, সে জাত বাঁচে না।

বিল্টার ছাঁত করে মনে লাগে কথাটা। এর আগেও একবার কথাটা শুনেছিল। গিধরের মুখে, কোথায় যেন। মনে করে দেখবার চেষ্টা করে বাড়ি আসতে আসতে। ডিস্টিবোড ঢোঁড়াইয়ের কাছে যেমন জীবন্ত জিনিস, এদের কাছে ততটা নয়। ছোট বেলায় সে অষ্টপ্রহর শুনেছে ডিস্টিবোডের কথা- বাবুলাল চাপরাসী, ঠিকাদারসাহেব, শনিচরার দল, তালে মহলদার, রোড পিয়ন। নিশুতি রাতে ঘুম ভেঙে ডিস্টিবোডের ঘড়িঘরের ঘড়ি বাজবার শব্দ শুনেছে।…তবু এই ডিস্টিবোডের ব্যাপারে কোয়েরীটোলার লোকেরা তাকে আমলই দিতে চায় না। ঢোঁড়াইয়ের পাক্কীর মালিক ডিস্টিবোডে কী করে যেন, কোয়েরীদের জাতিয়ারি সওয়াল [৪৯৮] হয়ে গিয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা তিরবেণী সং শুনতে শুনতে একবারে কান ঝালাপালা!…গয়লাদের মধ্যে দুটো ভাগ আছে জানিস তো? কিসনৌৎ আর বিসনৌৎ। একটা দুধে জল মেশায় আর একটা মেশায় না। ওই দুধে জল মেশানোর যমগুলোকে রাজপুতরা নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে মহাৎমাজীর নাম করে।…আরও কত কথা।

এক গাছের বাকল কি অন্য গাছে জোড়া লাগে?

 ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় যে, তাকে শুনিয়েই কথাটা বলল বুড়াহাদাদা।..

ভোটের দুদিন আগে খবর পাওয়া যায় যে, গরভু পত্তনিদার নাম তুলে নিয়েছে। বিনা ভোটে লাডলীবাবু ডিস্টিবোডে যাবে।

 জাতের মাথা গরভু পত্তনিদার; সে কিনা জাতের সঙ্গে এই নেমকহারামি করল রাজপুতদের কাছে থেকে টাকা খেয়ে! তাই জন্যই গিধরটা কদিন লাডলীবাবুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে বোধ হয়।

এর দিনকয়েক পরে কী করে যেন লাডলীবাবু ডিস্টিবোডের চেরমেন হয়ে গেল। তবে যে লাডলীবাবু বলেছিল মাস্টরসাহেব চেরমেন হবে? এবার সত্যিই হাতে কাটবে রাজপুতরা।

কোয়েরীটোলার কেউ আর সেদিন ক্ষেতে কাজ করতে যায়নি।

———–

[৪৯৬. জেল থেকে। ৪৯৭- কুর্মি, কোয়েরী, গোয়ালা। ৪৯৮- জাতের প্রশ্ন।]

.

আচম্বিতে দৈববাণী হওন

লাডলীবাবু চেরমেন হওয়ার পর থেকে, জিরানিয়ায় মাস্টারসাহেবের আশ্রমেই থাকেন। ডিস্টিবোডের ওরসিয়বাবু এসে পাক্কা থেকে বাবুসাহেবের বাড়ি পর্যন্ত নতুন রাস্তা তোয়ের করিয়ে দিয়েছেন। নতুন করসাইলা জিমানিয়া লাইনের বাসটা সেই রাস্তা দিয়ে রোজ বাবুসাহেবের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। বাবুসাহেব প্রত্যহ জিরানিয়াতে যাতায়াত করেন করেন অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছে। ঢোঁড়াইরা আবছাভাবে অনুভব করে যে, একটা বিপদ আসছে তাদের উপর। কোথা দিয়ে আসবে, কেমন করে আসবে, তা তারা জানে না। তবে বাবুসাহেব কাছারী যাচ্ছে রোজ। নিশ্চয়ই রামনেওয়াজ মুন্সি কানুনী সলা দিচ্ছে তাঁকে।

পরিষ্কার করে বলে না ঢোঁড়াই। কিন্তু তারা সবাই জানে বিপদ একদিক থেকেই আসে। আধিয়াদারদের জমির দিক থেকে। যেদিন ইচ্ছে জমি থেকে সরিয়ে দিতে পারে বাবুসাহেব। এতদিন হয়ে গেল, এখনও কাংগ্রিসের কানুন এল না। বলন্টিয়রকে জিজ্ঞাসা করলে বলে কানুন কি কমলালেবুর বীচি যে, টিপে দেবেন আর পুচ করে বেরিয়ে আসবে।

এদিকে বাবুসাহেব যে রোজ ডেকে পাঠাচ্ছে সাঁওতালটোলার আর কোয়েরীটোলার আধিয়াদারদের নতুন করে টিপসই দেওয়ানোর জন্য! সকলের যখন প্রায় অধৈর্য হয়ে পড়েছে, তখন একদিন সত্যিসত্যিই কানুন এসে গেল। বলন্টিয়রকে দিয়ে মহাৎমাজী পাঠিয়েছেন পাটনা থেকে। বলন্টিয়র বলে, কত নেবেন নেন- একটা, দুটো, তিনটে, চারটে, আরও…বিল্টা আরও একটা বলে সার্কাসের ভাঁড়ের মতো বটুয়া থেকে বিড়ি বার করে- মরদের কথা হাতির দাঁত। কাংগ্রিস কথা রেখেছে কিনা দেখুন। দুমুখ দিয়ে কথা বলে না মহাৎমাজীর চেলারা। বিনা রসিদে কোনো আধিয়াদার ফসল দেবেন না। আঠারো সের পাবে জমিদার, বাইশ সের আপনি। আধাআধি নয়। মজকুরী সেপাই আর কোনো জমিদার রাখতে পারবে না। যারা নগদ খাজনা দেয়, তাদের খাজনা কমে যাবে।

যাদের জমি নিলাম হয়ে গিয়েছে, ফেরত পাবে। তার জন্য দরখাস্ত দিতে হবে ফারমএ [৪৯৯]। আমার কাছে ফারম আছে। আমি শস্তায় ফারম দেব আপনাদের। আট আনা করে দাম। সাদা রঙের। রামনেওয়াজ মুন্সিরা বেচবে চার আনা করে কিন্তু সেগুলোর রং হলদে যাতে করে সাওজী পোস্তদানা বেচে। আমার ফারম পাটনায় ছাপা। আজকাল কাংগ্রিসের সরকার, কাংগ্রিসের হাকিম, তাই কাংগ্রিসের ফারম এই ফল ভালো হবে। খাতা খেশরা নম্বর দিতে হবে দরখাস্তে। যাদের নেই তারা আমাকে তিন টাকা করে দিলে জমিদারী সেরিস্তা থেকে আমি আনিয়ে দেব;…

 জমিতে কুয়ো খুঁড়তে পারবেন আপনারা।

এতদিন পারা যেত না নাকি। নিজের অজ্ঞানতায় ঢোঁড়াই মনে মনে লজ্জিত হয়। স্বর্গের ভাণ্ডার খুলে দিয়েছে বলন্টিয়র। সাঁওতালগুলো আবার কখন এসে জুটেছে। বোস বোস মাদলটা নিয়ে এলে পারতিস বড়কামাঝি!

 ঢোঁড়াই একরাশ রাঙ্গা আলু দেয় উনুনে।

ঘুরের ধোঁয়ায় চারিদিকের কুয়াশা আরও অন্ধকার হয়ে উঠেছে। ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো একটা একটা করে লোকের চেহারার মত হয়ে কুয়াশার মনে হয় ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো একটা একটা করে লোকের চেহারার মত হয়ে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কারও বাপ-দাদার আকৃতি নিশ্চয়। বাপ-দাদারা স্বপ্নতেও যা ভাবেনি, তাই আজ দেখিয়েছে বলন্টিয়র। চোখের সম্মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সোনালি ধানের স্তূপ, তার বাইশের দিকটা মোরঙ্গ-এর [৫০০] পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে; আর আঠারোর দিকটা যেন মেঠো ইঁদুরের গর্তের উপরের বালির ঢিপি। সেদিকটায় বসে রয়েছে বাবুসাহেবের সেপাই বটেশোয়ার সিং।

 বলন্টিয়র উঠে দাঁড়ায়। বাবুসাহেবের নতুন বৈঠকখানায় তার শোবার জায়গা রয়েছে।

সেই ভালো বলন্টিয়র, শীতের মধ্যে।

 বলন্টিয়রের বোধ হয় একটু লজ্জা লজ্জা করে। সে আগুনের মধ্যে থেকে একটা রাঙা আলু বার করে নেয়।

আমরাও কিষাণের ছেলে, কীর্তিগঞ্জের রাজার খানদানের লোক না। লাডলীবাবু আবার তাঁদের ওখানে খাইনি শনলে দুঃখিত হবেন তাই…

সকলে দল বেঁধে তাকে বাবুসাহেবের বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।

 বন্দেগী।

বলন্টিয়র বলে, নমস্তে!

ফিরবার পথে বড়কামাঝি বলে, কিতাব পড়া লোক বলন্টিয়র; দেখিস না মৈ মৈ [৫০১] বলে পচ্ছিমা বিল্লির মতো।

সকলে হেসে সমর্থন জানায় বড়কামাঝির কথাটাকে।

ঢোঁড়াইয়ের মনে হয়, এত ভাল মহাৎমাজীর বলন্টিয়র, এর কথা শুনতে ভাল লাগে, দেখলে ভক্তি হয়, তবু কোথায় যেন একটা ব্যবধান আছে। ভাল না হলে কি আর রামায়ণপড়া লোক তাদের দুয়োরে ঘুরে বেড়ায়। রামায়ণের হরফগুলো একটা পাতলা পর্দা টেনে ধরেছে তাদের আর বলন্টিয়রের মধ্যে।

———

[৪৯৯- দরখাস্তের ফরম। ৫০০. মোরঙ্গ নেপালের একটি জেলার নাম। ৫০১. যুক্তপ্রদেশের হিন্দীতে আমি অর্থে মৈ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু বিহারে ওই অর্থে হম কথাটি প্রচলিত।]

.

রসিদ প্রার্থনায় বিপত্তি

গঞ্জের বাজারের ভোপৎপাল ঢোঁড়াই কে বলে দিয়েছিল, নতুন কানুনে বারো বছরের উপর দখল থাকলে আধিয়াদারদের কিছুতেই সরাতে পারবে না বাবুসাহেব। এর কথা তো বলেনি বলন্টিয়র।

মরে মুছে যাবি তবু দখল ছাড়িস না। আঠার বাইশ ভাগের সময় আগে রসিদ নিয়ে তবে ফসল দিবি। ওই রসিদখান পরে দখলের প্রমাণ হয়ে যাবে হাকিমের সম্মুখে। বড়কামাঝিও এসেছিল সঙ্গে। সে জিজ্ঞাসা করে, আর দারোগার সম্মুখে?

সেখনেও!

সেই রসিদখানাই?

 হ্যাঁ।

অদ্ভুত! একথা ভাবতেও মনে একটা উদ্দীপনা আসে। ফসল দেওয়ার কথাটা এক টুকরো কাগজে লিখে দেবে, আর সেটা হয়ে যাবে রসিদ। দুনিয়ার গুড়ের ভাণ্ডার আখ [৫০২] যে ওই কাগজটুকুর মধ্যে, তা কি সে আগে জানত। কাঁচা ধানের দুধটা যেমন আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে চাল হয়ে ওঠে, তেমনি রসিদটা হয়ে উঠবে দখলের প্রমাণ! হদ্দ করেছে কংগ্রেসী সরকার। বেদখল করতে না পারার মানেই যে পায়ের নিচের মাটিটুকু এক রকম তারই হয়ে যাবে।

এতখানি উঁচু আল দেওয়া চারিদিকে; নিড়ানো আগাছাগুলির একটাও সে আলের বাইরে যেতে দেবে না; একটুখানি গোবরও ধুয়ে যেতে দেবে না ক্ষেতটুকুর বাইরে; ক্ষেত থেকে বেরুবার সময় পায়ের কাদামাটিটুকু আলের ধারে মুছে নেবে। ও যে নিজের। একেবারে নিজের ছেলের মতো খাওয়াবে বুড়ো বাপকে।…

সেই রাতেই কোয়েরী আর সাঁওতালরা মঠের মাঠে জড় হয়। ফসল তোয়ের ক্ষেতে। তাই দেখেই মহাৎমাজী কানুন পাঠিয়েছিলেন জলদি করে।

চেঁচামেচি হট্টগোলের মধ্যে এ বিয়য়ে বিশদ আলোচনা কিছু না। মহাৎমাজী কানুন করে দিয়েছেন। আর ভাববার কী আছে। রসিদ দখল, রসিদ জমি, রসিদ জিন্দগি, জান কবুল; মরে মুছে যাও; রসিদ দেও, ফসল লেও! রসিদ দেও, ফসল লেও! মহাবীরজীকি জয়! ভোপৎপাল লোকটা বলন্টিয়রের চাইতে ভাল; কিন্তু বলন্টিয়রের মতো আমাদের গাঁয়ে আসে কই। কেবল দোকান আর বাজার।

রসিদ চাইবার প্রথম ঝাঁপটা গেল সাঁওতালটুলির উপর দিয়ে।

ঢোঁড়াই বলে দিয়েছিল, ফসল কেটে টোলার খলিহানে [৫০৩] জড় করতে। সেখানেই ভাগ হবে। না হলে বাবুসাহেবের খলিহানে একবার গেলে কি আর রসিদ দেবে, না আঠার-বাইশ ভাগ করবে?

ক্ষেত্রে ফসল কাটছিল বড়কামাঝি, তার স্ত্রী আর পুত্রবধূ। খবর পেয়ে বাবুসাহেব গিয়েছিলেন হাতিতে; পিছনে ঘোড়ার উপর বটেশোয়ার সিং লাঠি নিয়ে। ঘোড়ার খুরের শব্দ পেলে হাতি উধ্বশ্বাসে দৌড়ায়। তাই সিপাহিজী হেঁটে না এসে ঘোড়ার পিঠেই এসেছিল। বিশেষ কিছু গোলমাল হবে বাবুসাহেব ভাবেনওনি। শুধু সাঁওতালটুলিতে একটু ভয় দেখানোর জন্যে হাওয়ায় একটা বন্দুক ছুঁড়েছিলেন। অমনি ডুমডুম-ডুমডুম করে মোষের চামড়ার কাড়া বেজে উঠেছিল। তীর, ধনুক, লাঠি, খুন্তি নিয়ে প্রতি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষ।

 সবাই এসে দাঁড়ায় বড়কামাঝির আলের উপর, এক দিকে একটুখানি পথ রেখে ক্ষেতে হাতিটাকে ঢুকতে দেবার জন্যে। ডুম-ডুম-ডুম বেজে চলেছে কাড়া একটানা। কেটে চল বড়কামাঝি, থামিস না। ওদিক পানে তাকাস না। ঘাবড়াস না, এসে পড়ল বলে কোয়েরীটোলার দল কাড়ার শব্দ শুনে। কথা হয়ে গিয়েছে কালকে এই নিয়ে। কারও মুখে বিন্দুমাত্র বৈলক্ষণ্য নেই, সকলে নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে।

 পিথো মাঝির বৌ আখ চিবুতে চিবুতে হাতির দিকে এগিয়ে গেল। অদ্ভুত সাহস! শক্ত করে চেপে ধরে হাতের লাঠি বটেশোয়ার সিং। তাই বল! সাঁওতালনীটা হাতির নাদ কুড়োচ্ছে। এমনি বড় বড় অশ্বথের চাকলা থাকে এর মধ্যে। ভাল জ্বালানি হয়। পিথোর স্ত্রী দূরদর্শী গিন্নি বলে পাড়ায় সুনাম আছে।

 চল মাহুত। বাবুসাহেব ফিরে যান।

ডিগি ডিগি ডিগি ডিগি; বিজয়ের উল্লাসে কাড়ার তাল দ্রুত হয়ে ওঠে। বড়কা মাঝি হুংকার ছাড়ে, হা, নাচতে আরম্ভ কর ক্ষেতের মধ্যে। পায়ে পায়ে সব ফসল যে ঝরে পড়ল।

কে তার কথায় কান দেয়। সকলে তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, রশিদ দাও, ফসল নাও। বাবুসাহেবকে শোনাচ্ছে।

ঢোঁড়াইকে দূর থেকে ছুটে আসতে দেখে, এতক্ষণে সাঁওতালদের খেয়াল হয় যে কোয়েরীটোলার কেউ কাড়ার ডুমডুম শব্দ শুনেও আসেনি। ঢোঁড়াই কেবল দুঃখিত নয়, অপ্রস্তুতও হয়েছে বিলক্ষণ। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ওরা কেউ এল না বড়কামাঝি। বলন্টিয়র এসেছিল এখনি, কলস্টসাহেবের কাগজ নিয়ে। তাতে লেখা আছে, বাবুসাহেব কিষাণ [৫০৪] তার আধিয়াদারদের উপর আঠার-বাইশের কানুন চলবে না। ও কানুন হচ্ছে রাজপারভাঙার আধিয়ারদের জন্য।

বলন্টিয়রের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। সেদিন বলল এক কথা, আজ বলছে আর এক কথা। কোয়েরীদের সকলে ক্ষেপে ওঠে।

মরদ! বাবুদের বাড়ির মেয়েদের শাড়ি কাঁচতে কাঁচতে শালাদের মর্দামি ঘুচে গিয়েছে।

ঢোঁড়াই  ও কথার জবাব দিতে পারেনি। মহাৎমাজীর কানুন কলস্টরসাহেব বদলে দিল। কলস্টরসাহেব কী মহাৎমাজীর থেকেও বড়?

তারপরেই চলেছিল থানা-পুলিশ। তিনজন সাঁওতালের জেল হয়েছিল। রসিদ কেউ পায়নি। হাকিম বলেছিলেন যে, এদের বুড়ো আঙুলের ছাপ দেওয়া কাগজে লেখা আছে যে, এদের জমি দেওয়া হয় এক বছরের জন্য। এরা জোর করে অন্যের ফসল নিচিছল। ঢোঁড়াইরা কি করবে ভেবে পায় না। ভোপলালের কাছে সলা নিতে যেতেও মন চায় না। ওটা বোধ হয় পণ্ডিতমশাইকে কোদো? [৫০৫] দিয়ে লেখাপড়া শিখেছিল। কানুনের হরফ পড়তে পারে না।

কার কাছে দরখাস্ত করলে সুবিচার হবে জানা নেই। ডিস্টিবোডের নতুন নিলামের তাকে ইনসান আলির জায়গায় গিধর মণ্ডলকে খোঁয়াড়টা দিয়েছে লাডলীবাবু। কাজ গুছিয়েছে গিধরটা। বাবুসাহেবেরই বেনামদার। ইনসান আলি তাই সবুজ নিশানের লিঙে [৫০৬] গিয়েছে, আর পাটনার জিন্দাবাদ-সাহেবের কাছে না কার কাছে নালিশ করেছে।

এ কথা ভোপৎপালকে একদিন গল্প করতে শুনেছিল বাজারে। ওটার পর্যন্ত দরখাস্ত করার লোক আছে রে, আমাদের নেই।

তাই ইচ্ছা না থাকলেও ছুটতে হয় ভোপৎপালের কাছে। ভোপৎপাল বলে, এদের ঠাণ্ডা করতে পারে একমাত্র কিষাণসভার স্বামীজী। তারপর কোয়েরীটোলার লোকদের টিপসই নিয়ে কী সব লেখাপড়া করে।

কোথা থেকে কী হয় তা ঢোঁড়াই জানে না; হঠাৎ একদিন একজন হাকিম এসে হাজির। তিনি বাবুসাহেবের বৈঠকখানায় কিছুতেই উঠলেন না, উঠলেন গিয়ে ইনসান আলির বাড়িতে। কলস্টরসাহেব তাঁকে পাঠিয়েছেন। কোয়েরীটোলার রসিদ দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে। হাকিম বলেন দুপক্ষ থেকে দুজন বলবে। বাবুসাহেবের দিক থেকে কাগজপত্র দেখায় রামনেওয়াজ মুন্সি; আর কোয়েরীটোলার সকলে বলছে ঢোঁড়াইকে সকলের হয়ে কথা বরবার জন্য। ঢোঁড়াই বলে পেলালকে ডাক, কিন্তু বিল্টারা কেউ বিশ্বাস পায় না ভোপলালকে; তার কানুনে বিদ্যের দৌড় আগেই দেখা গিয়েছে। বিজন উকিলকে হারায় রামনেওয়াজ মুন্সি। একেবারে কানুনের ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ঢোঁড়াইয়ের বুক টিপটিপ করে। প্রথমটায় মনে হয়েছিল বলতে পারবে না ঠিক করে। কিন্তু একবার আরম্ভ করবার পর, রসিদ আর দখলের কথা ছাড়া, দুনিয়ার সব কিছু মুছে যায় তার মন থেকে।

 রামনেওয়াজ বেশি কিছু বলে না। সাত-আট বছর আগে ধান নেওয়ার সময়কার আঙুলের ছাপগুলো কেবল দেখায় হাকিমকে। বুড়ো আঙুলের ছাপে লেখা হয়ে গিয়েছে, কেউ রসিদ পাবে না।

হাকিম রামনেওয়াজ মুন্সি আর বাবুসাহেবকে তাড়া দেন, সব বুঝি, ঘাস খাই না আমরা। তারপর অংরেজীতে চোখ গরম করা কী সব কথা যেন বলেন বাবুসাহেবের দিকে তাকিয়ে। আলবৎ বলেছে বটে ঢোঁড়াইটা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাকিমের রায় শুনে অবাক হয়ে যায় সকলে। বুড়ো আঙুলের কানুনের জোর, মহাৎমাজীর কানুনের চাইতেও বেশি।

সাহেবী টুপি না থাকলে কী হয়, লাডলীবাবুও হাকিম। নতুন হাওয়াগাড়ি কিনেছে দেখিস না চেরমেনসাহেব। সরকারি হাকিম কখনও কাংগ্রিসের হাকিমের বিরুদ্ধে যেতে পারে। জাত বেরাদার সব হাকিমে। দেখলি না বাবুসাহেবের নতুন সড়ক দিয়ে এই সরকারি হাকিমের হাওয়াগাড়ি এল। অন্য কোন লোকের গাড়ি বাবুসাহেব আসতে দেয় ওই রাস্তা দিয়ে?

———-

[৫০২. স্থানীয় বাক্যরীতি। ৫০৩. যেখানে ফসল কেটে প্রথমে জড় করা হয়। প্রতি গ্রামে এরকম একটি করে জায়গা থাকে। এ। ছাড়া খুব বড়লোকদের নিজের নিজের খলিহান থাকে। ৫০৪. রায়তী-স্বত্বাধারী লোক। ৫০৫. ধানের ক্ষেতের একরকম আগাছা। ৫০৬. জিরানিয়া জেলায় মুসলিম লীগকে সাধারণ লোকে বলে লিঙ। শব্দটি বিদ্রুপাত্মক বা বিদ্বেষপ্রসূত নয়।]

.

বলন্টিয়রের পতন

রামরূপ, গনৌরী, পরসাদি, ভবিয়া এরা তিন বছর থেকে কাজ করতে কুরসাইলা চিনির কলে। সারা বছর মিল চলে না। তাই কয়েকমাস করে গাঁয়ে থাকতেই হয়। সেই যে বলন্টিয়রের ফারমের [৫০৭] উপর টিপসই দিতে গাঁয়ে এসেছিল বাবুসাহেবের কাছ থেকে নিলাম করা জমি ফেরত পাবার জন্য, আর ফিরে যায়নি তারপর। আবার কোনদিন হাকিম জমি ফেরত দেবার জন্য এসে খোঁজ করবে তারই এন্তেজারিতে ছিল। হাকিমের ডাক, আর নিলামের ডাক। এক, দু, তিন খতম! তাই আর যেতে সাহস করেনি। খানদানের অযাগ্য ছেলে তারা, বাপ-দাদার করা জমিটাও রাখতে পারেনি। পরের জমির ধানে নবান্ন করিয়েছে বাড়ির মেয়েদের। তাদের বাপদাদার পায়ের ধুলো মিশে আছে ওই জমিতে, তাঁরা উপর থেকে দেখছেন। মহাৎমাজীর কৃপায় সে জমি ফিরে পাবার একটা সুরাহা হল, ফারম-এর জবাব এল কই? প্রত্যেক বলন্টিয়রকে সাত টাকা বারো আনা দিয়েছে; ফারমের কোণের দিকে পর্যন্ত বলন্টিয়র লিখে দিয়েছিল, তবু হাকিম সাড়া দেয় না কেন? এক বছরের উপর হয়ে গেল।

আরও কত লোকের এই অভিযোগ, নিত্য তিরিশ দিন ঢোঁড়াইয়ের কাছে। বলন্টিয়র এখন আসাও কমিয়ে দিয়েছে। একদিন ঢোঁড়াইয়ের দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। গনৌরীদের ফারম-এর কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই বলে, দেড় লাখ দরখাস্ত পড়েছে; আপনাকে ঢোঁড়াইজী আমি ওয়াকিবহাল লোক বলেই তো জানি। আপনি সুদ্ধ এ ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে কেন?

ঢোঁড়াইজী! আশ্চর্য কথাটা। গায়ের মধ্যে শিরশিরুনির ঢেউ খেলে যায়। যেদিন প্রথম আপনি শুনেছিল সেদিন লেগেছিল মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি। শুধু আপনি কথাটা দূরে ঠেলে, আপনার করে না। কিন্তু ঢোঁড়াইজী! কথাটা শুনলেই বোঝা যায় যে, বলন্টিয়র যে স্বীকৃতিটুকু দিচ্ছে ঢোঁড়াইকে সেটা অনিচ্ছায় নয়। একজন তার ন্যায্য প্রাপ্য পেয়ে যাচ্ছে মাত্র। ইজ্জত গায়ে লেখা থাকলে তবে লোকে বলে জী। বড় মিষ্টি এর অনুভূতি, একেবারে নতুন। এরপর বলন্টিয়রকে দরখাস্তের সম্বন্ধে তার কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে না সে আজ। বড় ভাল বলন্টিয়র। এবার থেকে সেও বলন্টিয়রজী বলবে।

তার নিজের এক ধুরও জমি নেই, রামায়ণও পড়তে জানে না। কিন্তু বলন্টিয়রজী আজ তাকে পনের বিঘা জমিওয়ালা লোকের ইজ্জত দিয়েছে, রামায়ণ-পড়া লোকের ইজ্জত দিয়েছে। করতে বাধছে! নমস্তে বলন্টিয়রজী।

গনৌরীর ভাল লাগে না বলন্টিয়রের হাবভাব। এ কখনও হয় কাছারিতে? কোন খোঁজ নেই খবর নেই কাছারি থেকে! জমি যাবার সময় এমনিই হয়েছিল তাদের। হঠাৎ জানতে পেরেছিল যে জমি নিলাম হয়ে গিয়েছে। টালবাহানা করিস না ঢোঁড়াই  এ ব্যাপার নিয়ে। তুই টোলার সরগনা আদমী [৫০৮] বলেই বলছি। গিধর যদি মোড়লের মতো মোড়ল হত, তাহলে কি আর আমরা তোর কাছে ছুটে আসি।

 থাকুক গিধরটা খোঁয়াড়ে আটক। বিল্টার রসিকতার উপর এসে পড়েছে, তা জিজ্ঞাসা করলে গাঁয়ের লোক কেউ বলতে পারবে না। জলের ধারা কেন নিচের দিকে গড়িয়ে এক জায়গায় জমা হয় এ প্রশ্নও তারা কোনো দিন করেনি।

এসব কাজে ঢোঁড়াই য়ের ক্লান্তি নেই। বাপ-দাদার ভিটে ছাড়ার যে কী দুঃখ তা ঢোঁড়াই বোঝে। কাজের মলম দিয়ে সে নিজের মনটাকে ঢেকে রাখতে চায়। নিজেকে সে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করে, কয়েকটা মুখের ছবি যেন তাকে অনবরত নিচের দিকে টানছে; সে যেতে চায় উপরে, বাওয়ার মুছে আসা স্মৃতি যেদিকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, পটের ছবির মহাবীরজী যে পা-দুটির দিকে তাকিয়ে তাকে পথের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেইখানে পৌঁছুবার সড়কের নির্দেশ দিচ্ছেন সেই চরণেই আশ্রিত মহাৎমাজী। এই যে সে যখন-তখন সাঁওতালটুলি, গঞ্জের বাজার, ভোপল্লাল আর বলন্টিয়রের কাছে ছুটোছুটি করছে, অন্যের কাজে, এটা হুজুগের নেশা নয়। রামচন্দ্রজীর হুকুম মানবার নেশা; আর দশজন তার কাছে ছুটে এসে যে ইজ্জত দিচ্ছে তাকে, সেইটার দাম দেওয়ার নেশা। আবার নেশাটার ফাঁকে ফাঁকে তার মনে হয়েছে যে এসব নিজের মন ভুলোনোর নোটাঙ্কী [৫০৯]। মনের নিচে, অনেক ভিতরে একটা জায়গা আছে যেখানে হুকুম খাটে না; দাম দেওয়া-নেওয়ির পালা সেখানে অচল। রামজী এক হাতে নেন, আর এক হাতে দিয়ে দেন। তাঁরই কৃপায় আজ গাঁয়ের লোকে তার কাছে ছুটে এসে দুঃখের কথা বলে মন হালকা করে যায়, টোলার লোকে সরগনা বলে, হাকিমের সম্মুখে সে রামনেওয়াজ মুন্সির সঙ্গে বহস করে, বলন্টিয়র ঢোঁড়াইজী বলে। কিন্তু রামজী যত ঢোঁড়াইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছেন তত কী আশীর্বাদের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন? ছি ছি, এ কী ভাবছে সে? এর কী হিসাবনিকাশ চলে, আখ আর কাঁচালঙ্কার দামের মতো!

আছে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো ভোপাল। অনেক খোশামোদ করে ঢোঁড়াই তাকে রাজী করায়, কাছারি থেকে দরখাস্তগুলোর কী হল জেনে আসতে। ভোপোল পাঁচ টাকা খরচ করে কাছারির সেরিস্তায় তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কোয়েরীটোলার কোনো দরখাস্ত কাছারিতে নেই।

এসে বলে যে বলন্টিয়র টাকাগুলো খেয়েছে। ওর বলন্টিয়ারী আমি ঘোচাচ্ছি মহাৎমাজীর কাছে চিঠি লিখে। তোমরা এই কাগজে টিপসই দিয়ে দাও।

টিপসই? মরে গেলে না।

সকলের মুখে কাঠিন্যের রেখা পড়ে। জীবনে একবারই লোকে ভুল করে। বাপ দাদার উপদেশ না মেনে, বুড়ো আঙুলের এক ছাপে ভিটেমাটি ছাড়া হতে চলেছে টোলা-সুদ্ধ লোকের। বাপরে বাপ না না ভোপলালজী, বাবুসাহেবই হয়তো কাছারিতে টাকা খরচ করে সরিয়ে ফেলেছে দরখাস্তগুলো।

——–

[৫০৭. দরখাস্তের ফরম। ৫০৮. গণমান্য লোক। ৫০৯. যাত্রার মতো একরকম গ্রাম্য অভিনয়।]

.

বলন্টিয়রের পুনরুত্থান

গঞ্জের বাজারে সার্কিল মানিজর সাহেবের বাংলায় একটা কল আছে না, যাতে করে মেমসাহেবরা গান শোনায় তাঁকে, সেই কলে লাটসাহেব তার কাছে খবর পাঠিয়েছে যে বিলাতে ইংরেজ-জর্মন লড়াই লেগেছে। সেখানকার হাটে ঢোঁড়াই রা কথাটা শুনেছিল। সেখানে আরও কানাঘুষা শুনেছিল যে লড়াইয়ে লংকা, তামাক খুব লাগে। দাম বাড়বে। নৌরঙ্গীলাল গোলাদার যাই বলুক, কাঁচালঙ্কা আর বেচা নয়। গাছে পাকানোই ঠিক। এর কিছুদিন পরই বলন্টিয়র একদিন গাঁয়ে এসে হাজির। এতদিন শত চেষ্টা করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এল যখন, একেবারে আসার মতো আসা। ফৌজের উর্দি পরে, খটমট খটমট করে। গাঁয়ের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে আসে, ছোট ছেলেরা বেড়ার পাশে লুকোয়, বিল্টার বুড়ী চাচী মাথার শনের নুড়োর উপর ঘোমটা টেনে দেয়। ঢোঁড়াই পর্যন্ত ভাবে, বন্দেগী হুজুর বলবে, নমস্তে করবে।

অনেক দূর দেশ থেকে আসছে বলন্টিয়র। তাজা নতুন খবর এনেছে রংরেজ-জর্মান লড়ায়ের। লড়ায়ের খবর ফৌজের লোকে জানবে না তো আর কে জানবে। সব চেয়ে জবর খবর কাংগ্রিস রংরেজ সরকারের দেওয়া পাটনার গদিতে লাথি মেরে চলে এসেছে।

 তাহলে মহাৎমাজীর হুকুমত আর নেই মুলুকে?

নেই বলেই তো ঢোঁড়াইজী এসেছি আপনাদের কাছে কাংগ্রিসের ফৌজে ভর্তি করাতে।

ফৌজে?

সকলে চেঁচামেচি আরম্ভ করে। বিল্টার চাচী চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বুড়হাদাদু বলন্টিয়ারের হাত চেপে ধরে, যেমন করে হোক দারোগাকে বলে, আমাদের ফৌজ থেকে নাম কাটিয়ে দাও বলন্টিয়ার। উখলি বাঁধা দিয়ে আমি তোমাকে খুশী করাব।

 লড়াইয়ের খবর প্রথম দিন শুনে সবার মনে হয়েছিল বিলাতে লড়াই। তাতে বিসকান্ধার কী? এ আবার কী বিপদ এসে উপস্থিত হল। চায় না তারা লঙ্কাগুলোকে গাছে পাকিয়ে বিক্রি করতে।

বলন্টিয়র তখন কাংগ্রিসের ফৌজে ভর্তির ফারম [৫১০] বার করে সকলকে বুঝায় যে, সে এতদিন ছিল রামগড়ে। সেখানে আসছে বছর মহাৎমাজীর প্রকাণ্ড জলসা হবে। সেখানেই বলন্টিয়র ফৌজী টিরেনি [৫১১]নিতে গিয়েছিল। এখন সে জিরানিয়ার সকলকে ফৌজে ভর্তি করে নিজেই টিরেনি দেবে। তারই ফারম এগুলো।…

ফারমের কথা ওঠায় এতক্ষণে গনৌরী কাজের কথা পাড়বার সুযোগ পায়। লটপট কথা ছাড়ো বলন্টিয়ার। আমাদের জমি ফিরে পাবার দরখাস্তের কী হল? একবছর থেকে হয়রান করছ তুমি আমাদের।

মহাৎমাজীর চেলা হলে কী হয়। বলন্টিয়র জানে যে, কখন রাগে জ্বলে উঠতে হয়। নেমখারামের দল কোথাকার! তারপর ঢোঁড়াইকে বলে, কোন খাস্তা খাতায় ফেলে রেখে দিয়েছে তার কি হিসেব আছে? তার উপর কাংগ্রিসের উজিররা ইস্তফা দিয়েছে; আর কি এখন সাহেবকলস্টর ঐসব দরখাস্ত পড়বে মনে করেছেন? এতদিন সেই সাহেবই ঐ হরিজন মন্ত্রীর ছেলেটাকে সফরের সময় কোলে নিয়ে, নাকের শিগনি মুছত! আরও কত কথা বলন্টিয়রজী বলে যায়। তার সিকিও ঢোঁড়াই রা বোঝে না। শোনবারও উৎসাহ নেই তাদের। বিল্টার সুদ্ধ কথা বার হয় না মুখ দিয়ে। কতদিন থেকে ভেবে রেখেছিল যে বলন্টিয়র এলে, চেপে ধরবে তাকে।

কপালটাই পোড়া কোয়েরীটোলা! রংরেজ জর্মন লড়ায়ের গরম তাজা খবরের মধ্যে কোয়েরীটোলার এতগুলো লোকের হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কোন খাস্তা খাতায় তলিয়ে যায়।

 যাবার সময় বলন্টিয়র দুঃখ করে যায়- শ্বশুররা যে যুদ্ধে হারতে জানে না। কোয়েরীটোলার গিধরেরও দুঃখ কম হয়নি। সে সবে দেড় বছর থেকে খদ্দর পরা ধরেছিল। শান্তি আর নেই কিছুতে। সব চেয়ে চিন্তার কথা যে নাইট স্কুলের নাম করে সে একটা লণ্ঠন, আর এক টিন করে মাসে কেরোসিন তেল, আরও কী কী যেন, লাডলীবাবুর সাহায্যে পেয়ে আসছে। এত দিন নিসপেট্রর সাহেব লাডলীবাবুর ভয়ে কিছু করতে সাহস করেনি। এবার নিশ্চয়ই রিপোর্ট করে দেবে যে, কোয়েরীটোলায় কোনো ইস্কুল খোলেনি গিধর মণ্ডল। সে বলে, পাবলিসের কথাটা একবারও ভাবল না কাংগ্রিস গদ্দি থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে। নে! দুবছর খুব উড়েছিস হালুয়াপুরি, এবার মজা চাখাবেন সরকার।

কিন্তু সরকার সব চেয়ে আগে মজা চাখাল কিনা গনৌরীদের।- ঢোঁড়াইয়ের মনটা খারাপ হয়ে যায়। মহাৎমাজীর লোকেরা তবু চেষ্টার ত্রুটি করেনি। সরকারের চাকর এই হাকিম দারোগা, এরাই না বাবুসাহেবের দিকে গিয়ে সব পণ্ড করে দিল। দারোগা-হাকিমদেরই বা দোষ দেওয়া যায় কী করে। যার নুন খায় তার গুণ গায়। রংরেজ বাদশা হল দুনিয়ার রাজা, কত বড়লোক। তাই না সে চাকর রাখতে পারে, কলস্টর দারোগাকে। কোথায় পাবে অত টাকা মহাৎমাজী! ঢোঁড়াই  সেবার দর্শন করতে গিয়ে দুপয়সা দিয়েছিল মহাৎমাজীর পায়ে। দুপয়সা সে, দুপয়সা সাগিয়া, দুপয়সা মোসম্মত, ছপয়সা। এই সব পয়সার রোজগার থেকে কি কলস্টর দারোগা পোষা চলে? তার জন্যে দরকার লোটের? [৫১২]।

হঠাৎ সাগিয়ার কথাটা মনে এল কেন? ভাল আছে তো?

অনেকদিন পর আজ বাড়িতে ফিরে  ঢোঁড়াই  সেই সিক্কার মালাটা বার করে দেখে, যে তেলচিটচিটে সুতোগুলো দিয়ে এগুলো গাঁথা ছিল, সেগুলো ঝুরঝুরে হয়ে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। রূপোর সিক্কাগুলো কালো হয়ে উঠেছে কলঙ্ক পড়ে। ঢোঁড়াই ছাই দিয়ে সেগুলোকে ঘষতে বসে।

সাগিয়া যেন ভাল থাকে রামচন্দ্রজী!

———-

[৫১০. ফারম। ৫১১. ট্রেনিং। ৫১২. নোট।]

.

ভূম্যধিকারীর তপস্যায় বিঘ্ন

জিরানিয়া জেলার পশ্চিমে যত নদীনালা সবগুলোর নামই কোশী। রগচটা কোশীমাই পুরুবের বাঙাল মুল্লুক থেকে বাপের বাড়ির দিকে চলেছেন হোঁচট খেতে খেতে। চোখের জলের অজস্র নদী-নালায় রেখে যাচ্ছেন তাঁর নামের, আর চলার পথের চিহ্ন। রাগটা পড়লেই তিনি আবার ফিরবেন, এ কথা জিরানিয়া জেলার প্রত্যেক লোক জানে। তার বউকাটকী শাশুড়ী, তাঁর ফেরবার পথ বন্ধ করবার জন্যে জিরানিয়া জেলা জুড়ে শিমুল, কুল, বালা আর ক্যায়া-গোলাপের কাঁটা-জঙ্গল ভরে রেখেছিলেন। আস্তে আস্তে অনেক বছর ধরে সেই জঙ্গল পরিষ্কার করে এখনও সকলে কোশীমাইয়ের প্রতীক্ষায় ঢোলক, ঘণ্টা, ঝাঁঝর, শিঙে নিয়ে বসে আছে। হোক পাগল, হোক বদমেজাজী, তবু মা না থাকলে আবার সে কি একটা সংসার। যতদিন মা না ফিরে আসে, ততদিন এইসব মরা নদীগুলোকে তারা সাবধানে আগলে বসে থাকবে। তারপর কোশীমাই ফিরে এলে আবার সমৃদ্ধির জোয়ার আসবে এই পথে। এখন তো কেবল বর্ষাকালে মাটির হাঁড়ি বোঝাই নৌকো যায়। তখন আবার বারো মাস পাকীর মোটর ট্রাকগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেবে হাজারমণী নৌকোগুলো। বিরতাহা গোলায় পাটের গাঁইট বাঁধবার পেঁচকলগুলোয় আবার রেড়ির তেল পড়বে।

 মরা কুশীকে, আর কুশীর ধারের পড়তি জমিগুলোকে গাঁয়ের লোকে কী চোখে দেখে তা বাবুসাহেব জানেন। জানেন বলেই তার এত ভাবনা।

জমিগুলোকে বহুকাল থেকে লোকে জানত রাজপারভাঙার পড়তি জমি বলে। নদীর ধারের জমির উপর বাবুসাহেবের নজরটা বেশি। নদী আর নৌকোই তাঁর পছন্দ। তার সঙ্গে কি আর রেলগাড়ির তুলনা হয়। কিসে আর কিসে! নদীর পথেই তিনি প্রথম এসেছিলেন। দূর-দূরান্তর থেকে মাটির গন্ধ যাদের টানে, কুলের গাছ শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলবার যাদের তাকত আছে, শিমুলগাছ কেটে ডোঙা তৈরি করবার নিয়ম যার জানা, বাবলা গাছ দেখলেই যার লাঙলের কাঠের কথা মনে পড়ে, বুনো শুয়োরের সঙ্গে লাঠি নিয়ে ভেড়বার হিম্মত যে রাখে, সেই আসে নদীর পথে। আর রেলের গাড়ি টানে দুধ-ঘি-খাওয়া লোকদের যারা কুলগাছ দেখলে রেশম আর লা-র কথা ভাবে, শিমুল গাছ কাটায় মাটিহারদেশাইয়ের কারখানায় ঠিকেদারের জন্যে, স্টেশনের কাছে বাবলা গাছ দেখলে দৌড়ে একগোছা দাঁতন কেটে নেয়ে এসে তখনি বাক্সে পোরে! এই রামে রাম দুয়ে-দুর দল শেষ জীবনে জ্ঞান হলে বনেদী হবার জন্যে কেনেন জমি। যে ইজ্জত প্রতিষ্ঠা চায় তাকে যে এই পথে আসতেই হবে।

 যতই কোয়েরী আর সাঁওতালগুলো জ্বালাতন করুক না কেন, জমি রাখার মধ্যে আছে একটা গভীর আত্মপ্রসাদ, অন্তহীন আকাঙ্ক্ষার তলে তলেও আছে একটা গভীর পরিতৃপ্তির ভাব কিন্তু নিশ্চিন্দি আর নেই। ঘুরেফিরে নাকের উপর মাছি বসলে ধ্যানী সন্ন্যাসীরাই বিরক্ত হয়ে ওঠেন, বাবুসাহেব তো কোনছার। কোয়েরী- সাঁওতালগুলোর সেই যে তড়পানি আরম্ভ হয়েছে, আট-দশ বছর আগে থেকে, এ কি কোনদিন থামবে না। নিত্যি নতুন ফ্যাসাদ বাধিয়েই রেখেছে। করবি আধিদারদের কাজ, তার আবার দারোগা-পুলিশের মতো মেজাজ।

কুশীর ধারের রাজপারভাঙার পড়তি জমিগুলোতে গত কবছর থেকে কলাই কুর্থি ছিটাচ্ছিলেন বাবুসাহেব। ওটা ছিল গাঁয়ের লোকের গোরু-মোষ চরাবার জায়গা। কলাই–কুর্থির দামই বা কী ছিল। গোলাতে পচত। গাঁ সুদ্ধ লোকের মোষের গায়ের খাঁজ ঢেকেছে ঐ কলাই-কুর্থির গাছ খেয়ে, বাবুসাহেব একদিনও বারণ করেননি। সেইজন্যেই রাজপারভাঙার পড়তি জমির উপর কে কোথায় কলাই ছড়িয়েছে তা নিয়ে গাঁয়ের লোকে মাথা ঘামায়নি। বাবুসাহেবের অধিকারের পলি, এই কবছর পড়বার পর, বাবুসাহেব হালে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন ঐ জমি রাজপারভাঙার কাছ থেকে। রাজপারভাঙার সুত্বে বোধ হয় কোন গোলমাল ছিল, কিংবা বোধ হয়, সার্কিল মানিজর চেরমেনসাহেবের বাবাকে নারাজ করতে চাননি, তাই নামমাত্র সেলামিতে ছেড়েছিলেন জমিগুলো। তারপরই লেগেছিল খটাখটি। সাঁওতালগুলির মোষ নদীর ধার থেকে ধরে, গিঘরের খোয়াড়ে দিয়েছিলেন খটাকটি। সাঁওতালটুলির মোষ নদীর ধঅর থেকে ধরে, গিধরের খোয়াড়ে দিয়েছিলেন বাবুসাহেব। বড়কামাঝি তখন জেল থেকে ফিরেছে! তার ছেলে বলে, এবার আমাকে হয়ে আসতে দাও। বাবুসাহেবের হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। কোয়েরীটোলার লোকেরা সাঁওতালের মোষ খোয়াড়ে দিলে মাথা ঘামাবে তা তিনি ভাবেননি। তাদের কোশীমাইকে নিয়ে ব্যাপার। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া বলে কি মায়ের বে-ইজ্জতি  পটুর পটুর? [৫১৩] দেখবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ওগুলো হল তাদের সারা গায়ের নিকাশ জমি। সকলের গোরু মোষ জল খেতে যায় ঐ পথে; মেয়েছেলেরা যায় দরকার পড়লে নদীর ধারের আবরুতে; দশবিধ করম আছে নদীর ধারে; জানোয়ার মরলে ফেলতে হবে, ছোট ছেলেটা মরলে পুঁততে হবে, ঘর নেপবার মাটি আনতে হবে সেখান থেকে খুঁড়ে; তারই নাম নিকাশ। এই নিকাশ কেড়ে নেওয়ার আবার জাত আছে নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে টোলার পঞ্চায়েৎ বসে যায় মাঠে মাঠে। দিনের বেলায় মাঠে মাঠে পঞ্চায়তি বড়হাদাদু পর্যন্ত এর আগে জীবনে দেখেনি।

এত বড় কথা! এ কী জবরদস্তি কাণ্ড বাবুসাহেবের। আর ঐ গিধরটা হাত মিলিয়েছে বাবুসাহেবের সঙ্গে। সাজস না থাকলে সে খোঁয়াড়ে মোষ নিল কেন? মোড়ল তো মোড়ল! তার হয়েছে কী? সাজিমাটির মধ্যেও ময়লা থাকে। দে গিধরটার হুক্কাপানি বন্ধ করে। জেলার জাতের বড় মাতত্বররা গিধরের হাতের লোক। গিধর গুরুজী [৫১৪] বড়ডো কানুন জানে, সেইটাই ভয়। শালা গোরুখোর, গোরু খেয়ে হাঁড়িটা ফেলবি কোন চুলোয় নিকাশ গেলে! কানী মুসহরনীটা যে দিকেই তার কানা চোখটা ফিরিয়ে রাখে, সেদিকেই তার আবরু; কাজেই মেয়েদের যে নিকাশ,-এর আবরুর দরকার, তা কি আর গিধরটা বুঝবে? ভূমিকম্পের রিলিফের দয়ায় ওর মেঝে দেয়াল পাকা হয়েছে। আর ওর নদীর ধার থেকে মাটি কেটে আনবার দরকার হয় না তো।

সব দিক ভেবে-চিন্তে ঠিক হয় যে, গিধরের হুঁকোজল বন্ধ করবার কারণগুলোর মধ্যে খোয়াড়ের ব্যাপারটার সঙ্গে কানী মুসহরনীর ব্যাপারটাও জুড়ে দেওয়া ভাল।

তারপর মহাবীরজীর জয় দিতে দিতে নিজেগের গোরু-মোষ নিয়ে সকলে পৌঁছোয় সাঁওতালটোলাতে।

আরে ভয়ের কী আছে! রাজপুতদের লাঠি আজকাল ভাঙ খুঁটবার নিমের কাঠি হয়ে গিয়েছে। আর ভালার [৫১৫] কাছে লাঠি। এখান থেকে ছুঁড়ে দেব এই-ই ফন-নন… সাঁওতালটুলির আর কোয়েরীটোলার গরু-মোষ ছেলে-বুড়োর বিরাট মিছিল গিয়ে ঢোকে কুশীর ধারের কলাই-কুর্থির ক্ষেতগুলোতে। সবচেয়ে আগে ঢোঁড়াই, আর বড়কামাঝির ছেলে।

দুদলকে একসঙ্গে চটান না বাবুসাহেব। মুহূর্তের অনবধানতার চালে ভুল করে ফেলেছেন। বাবুসাহেব দোতলা থেকে দলটাকে যেতে দেখেছিলেন। কিছুক্ষণ পর বটেসেয়ার সিং সেপাই দৌড়ে বাবুসাহেবকে খবর দিতে এসেছিল। কিন্তু সে অবাক হয়ে গিয়েছিল বাবুসাহেবের রকম-সকম দেখে। মালিক বন্দুক রাখবার দেরাজটা তো খোলেনই না, উপরন্তু নড়েচড়ে পর্যন্ত বসেন না।

ভুল করে ফেলেছেন, স্বীকার করতে দ্বিধা করলে চলবে কেন। বড়কামাঝির পরিবারের সরকারের খিচুড়ি খাওয়ার ভয়টা কেটে গিয়েছে। ভাল লক্ষণ না এটা!… আরও কবছর অপেক্ষা করা বোধ হয় উচিত ছিল।…যাক যা হবার হয়েছে। গুড় দিয়েই যদি মাছি ধরে, তবে বিষ দেওয়ার দরকার কী?

বটসোয়ার সিং অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে, কোনো জবাব না পেয়ে চলে যায়। তাই আজ ভাববেন বলেই ভাবতে বসেছেন বাবুসাহে।

————

[৫১৩. পিটপিট করে। ৫১৪. শৃগাল পণ্ডিত। ৫১৫. ভল্ল।]

.

বাবুসাহেবের অক্ষয় তুণীর লাভ

জিরানিয়ার টুরমনের ফারমের কাজ চালানোর জন্য একটা কমিটি আছে। ডিস্টিবোডের চেরমেনসাহেব তার একজন মেম্বর থাকেন। লাডলীবাবু আগের বার যখন বাড়িতে এসেছিলেন তখন বাবুসাহেব শুনেছিলেন যে টুরমনের কমিটি এবার দেহাতে আস্তে আস্তে কাজ বাড়াবে ঠিক করেছে, গাঁয়ের লোকদের ভালর জন্য। এই নিয়ে বাবুসাহেবের মাথায় একটা জিনিস খেলছে, দিন কয়েক থেকে।

লাডলীবাবুটা চেরমেন হবার পর থেকে বাড়ি আসা আস্তে আস্তে কমিয়ে দিয়েছেন। কাংগ্রেসি চেয়ারম্যান, খাটুনি বেশি। এ তো আর আগেকার ওকালতি করা রায়বাহাদুর চেয়ারম্যান নয়। তাই বোধ হয় সময় হয় না। কিছুদিন থেকে বাড়ির মেয়েমহলে বাবুসাহেব কানাঘুষো শুনছিলেন যে, লাডলীবাবু নিজে বাসা ভাড়া করবেন। মাস্টারসাহেবের আশ্রমে থাকবার ঠিক সুবিধা হচ্ছে না। কত লোকজন, সাহেবসুবো, পণ্ডিত, ঠিকেদার আসে দেখা করতে চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে… মাস্টার সাহেবকে আজকাল আর কে পৌঁছে …

আবার এক খরচের রাস্তা করছে! আজকালকার ছেলেরা পয়সা চেনে না। আর কেবল বাসা ভাড়া করলে কোনো চিন্তার কারণ ছিল না, ভালই হবে। মাস্টসাহেবের আশ্রমে গিয়ে উঠতে তাঁর মন চায় না আর। কিন্তু শোনা যাচ্ছে যে, লাডলীবাবু তাঁর স্ত্রী পুত্র নিয়ে যেতে চান সদরে। বলেছেন যে নইলে তার ছেলেদের লেখাপড়া হবে না।

প্রকাণ্ড জিলা ইস্কুল আছে সেখানে, বাবুসাহেবও দেখেছেন। রাজপারভাঙার জমিদারের ছেলে পড়ে নাকি সেই স্কুল। তাদেরই পড়ারই যুগ্যি পেল্লায় মহল, সদর কলস্টরি থেকেও বড়। হাঁ, বড় হয়েছ, চেরমেনসাহেব হয়েছ, তোমার ছেলে তো

আর তোমার মতো মজকুরি সেপাইয়ের ছেলে নয়। পড়াতে হবে বৈকি তাদের, রাজরাজড়ার ইস্কুলে। কিন্তু বই নিয়ে যাওয়া? কভভী নহী! চন্দাবৎ রাজপুতের বাড়ির বউ গিয়ে থাকবে নিজের সংসার ছেড়ে সেইখানে! লোকে থুতু দেবে না তাহলে বাবুসাহেবের গায়ে। লাডলীবাবুর মাকে যখন তিনি প্রথম আনতে চেয়েছিলেন তাঁদের দেশ থেকে তখন কি সে আসতে চেয়েছিল। সে একরকম জোর করে আনা। আর এ বোধ হয় লাডলীবাবুর বউই স্বামীর কানে মন্তর দিচ্ছে। তার মায়ের তো তাই ধারণা। আসতে দাও লাডলীবাবুকে এবার।

…জ্যোছনারাতে এখান থেকে পাক্কী পর্যন্ত আবছা দেখা যাচ্ছে। সমস্তটা এক চক হয়ে গিয়েছে কবে। নতুন রাস্তাটা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। পরিতৃপ্তির বোঝার নিচে সেটা কবে চাপা গিয়েছে। এখন মনের মধ্যের সমস্ত জায়গাটা জুড়ে আছে কুশীর ধারের জমির ফ্যাসাদটা। এক জোড়া হাওয়াগাড়ির আলো নামল পাক্কী থেকে তাঁর নিজের রাস্তাটার উপর। এত দূর থেকেও তিনি বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন আলো দুটোকে। তাঁর অত সাধের রাস্তাটা তাঁকে দেখানোর জন্যে আলো ফেলছে। কোনো হাকিম-টাকিম নাকি? বাবুসাহেব একটু তটস্থ হয়ে ওঠেন। অনোখীবাবু, ও অনোখীবাবু। ঢুলছে বোধ হয়। দেখুন তো কে এল। জানলার মধ্যে দিয়ে তার ঘরের মধ্যে আলোটা এসে পড়েছে। নীচে লাডলীবাবুর গলা শোনা যায়। তাই বলো! সঙ্গে একজন টুপি-পরা হাকিম। বাবুসাহেব নিজের মনের অস্থিরতা চাপবার জন্য কেশে সোজা হয়ে বসেন। নিচে হাঁকডাকের সাড়া পড়ে যায়।

খানিক পরেই লাডলীবাবু বাবার সঙ্গে দেখা করবার জন্য এই ঘরে আসেন। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। একজন হাকিম আছেন তাঁর সঙ্গে সফরে। তখনও বোধ হয় বাবুসাহেবের পূজো শেষ হবে না। তাই এখনই দেখা করতে এসেছেন।

এতদিন পরে এলেন, তাও যেন ধান রোপার কাজ ফেলে এসেছেন। ভাষাটা অনুযোগের হলেও কথায় সুরে বিরক্তির আভাস নেই।

আমি একা থাকলে কথা ছিল না। সঙ্গের হাকিমটি ভোরেই যাবেন কি না।

কিসের হাকিম উনি?

রেশমের হাকিম। ভাগলপুর থেকে এসেছেন।

ও! তাহলে এ- জেলার হাকিম নয়? লাডলীবাবুকে বেশিক্ষণ পাবেন না তিনি। তাই বাবুসাহেব আর দেরি করেন না। একেবারে কুশীর ধারে জমিসক্রান্ত কাজের কথাটা পাড়েন।

লাডলীবাবু বলেন, তার আর কী! এই রেশমের অফিসার এদিককার কয়েকটি গাঁয়ে গুটিপোকা চাষের সেন্টর খুলতে চান। তারই জায়গা দেখতে এসেছেন সফরে। লড়ায়ের জন্য খুব দাম হবে এভির রেশমের। গুটিপোকা খাওয়ানোর রেড়ির চাষের জন্য নদীর ধারে জমি পেলে তারা তো লুফে নেবেন। এক রকম নতুন জাতের রেড়ির বীজ বেরিয়েছে, গাছ বড় হয় না, হাত দিয়েই ফল পাড়া যায়। ওরই কাছে ঘর তুলে নেবে, পোকা রাখবার জন্য। টুরমনের ফারম থেকে আমি পাঠিয়ে দেব দুজন কামদারকে [৫১৬]। তাদের দেহাতে নতুন ধরনের চাষবাসের কাজ শেখানোই ডিউটি। বকরহাট্টার মাঠের টুরমনের ফার্ম লোকসানে চলছে। একবারে বেলে জমি, চীনেবাদাম পর্যন্ত ভাল হয় না। তাই সরকারি কমিটি ঠিক করেছে এর কাজ অন্য দিকেও বাড়াতে। ফৌজী ডিপার্টমেন্টের সঙ্গেও একটা কথাবার্তা চলছে বকরহাট্টার মাঠ নিয়ে।

লাডলীবাবু আরও কী কী সব বলে যান। সেসব কথা বাবুসাহেবের কানেও যায় না। এত তাড়াতাড়ি এত বড় একটা প্রশ্নের সুরাহা হয়ে যেতে পারে তা বাবুসাহেব ভাবতেও পারেননি। গর্বে, তৃপ্তিতে তার মন ভরে ওঠে। ধন্যি সেই আওরত যে এই চেরমেনসাহেবের মতো ছেলে পেটে ধরেছিল। তার গায়ের দুসের চাঁদির সাত্যিই যুগ্যি সে। বৃথাই এত দিন মনে হত যে সে চুরি করে গোলার ফসল বেচে পয়সা জমায়। সেটা চুরি নয়, তার আগের জন্মের জমানো পুণ্যের ওরাজগার। বহু বছর আগেকার একটা ছবি তার চোখের সম্মুখে জ্বলজ্বল করে,…তখন হরিয়ানা গোরুর চাইতেও নর চিকন তার দেহ; ফুটফুটে রঙের উপর সর্বাঙ্গে নীল উলকির মিনে করা; তার কোলে ছোটটো লাডলী; মায়ের নাক থেকে বার হওয়া তামাকের ধোয়ার কুণ্ডলীটাকে খাবলে ধরবার চেষ্টা করছে। কৌশল্যা মাইয়ের মতো দেখতে লাগে, বেশ লাগছে ভাবতে। কিন্তু লাডলীবাবুটা কী মনে করছে? তাই বলতে হয়, তোমাদের হালচাল বল, ডিস্টিবোডের।

মন্ত্রির গদি ছেড়েই কাংগ্রিস ভুল করেছে। আরও করবে যদি ডিস্টিবোড ছাড়ে। ছাড়লে তো সরকারেরই সুবিধে; সরকার ডিস্টিবোডের সব পয়সা লড়ায়ের কাজে লাগাবে। এই তো রাস্তার রোলারগুলো ডিস্টিবোড় থেকে চেয়ে পাঠিয়েছে। আমি থাকলে দু-চারমাস সে চিঠির জবাব না দিয়ে চেপে রাখতে পারি কিনা। তা তো বটেই।

তা নয়, ন এক পাই, ন এক ভাই [৫১৭] বলে জেলে চলে গেলেই অংরেজ হেরে গেল আর কী! আমি তো সাফ বলে দিয়েছি যে, চেরম্যানের পদ থেকে আমি ইস্তফা দেব না। পাবলিসের ভালর জন্য এসেছি এখানে। যতদিন পারব সাধ্যমতো পাবলিসের উপকার করে যাব।….

কথাটা শুনতে শুনতে আনন্দে আর উদ্বেগে বাবুসাহেবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। যাক, রামচন্দ্রজী সুমতি দিয়েছেন লাডলীকে। খুব মুখ রেখেছেন তার। এমন দিনকাল পড়েছে যে ছেলে চেরমেন না হলে, আজকাল জজসাহেবের সেসরকেও কেউ পোঁছে না; তার অধিয়াদাররা পর্যন্ত না; তিন টাকার কুশী থেকে মহানন্দা পর্যন্ত পাক্কীর ধারের আম কাঁঠাল জমা নেওয়া যায় না। এমন ছেলের উপর যে চটে, সে ছেলের বাপ না।

শুনুন লাডলীবাবু, বৌমাকে যদি নিয়ে যেতে চান তাহলে একটা ভাল আবরুওয়ালা বাসা ঠিক করবেন। সেসরসাহেবের মর্যাদার যোগ্য বাসা হওয়া চাই। রাজপুতদের নিয়ম যে দাঁতওয়ালা হাতির পিঠে চড়েও আঙিনা দেখা যায় না বাইরে থেকে; এত উঁচু হবে বাড়ির পাঁচিল। রেশমের সাহেবটা আবার বদমেজাজী নয়তো? চলুন একবার দেখা করে আসি তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন না এন্ডির গুটি কেটে প্রজাপতি বেরিয়ে আসাবার পর গুটিগুলোকে সিদ্ধ করতে হয়? যাক নিশ্চিন্দি! তাহলে প্রাণীহত্যা করতে হবে না। একটা জীবন তোয়ের করতে পার না, তবে জীবন নেবার কী অধিকার আছে? মরবার পর রাজ এ-কথা জিজ্ঞাসা করলে কী জবাব তিনি দিতেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামে মত্যুর থটা হঠাৎ মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় মনে হয় যে পাতালপুরীর গভীর অতলে নেমে চলেছেন।

লাডলীবাবু ইনসান আলির বাড়ি থেকে ভালমন্দ কিছু রাঁধিয়ে টাধিয়ে আনতে বলে দিয়েছেন নাকি হাকিমের জন্যে? রেশমের হাকিম বড় হাকিম।

——–

[৫১৬. এগ্রিকালচারাল ফার্মের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী। ৫১৭. ইংরেজয় যুদ্ধে একটি পয়সা বা একটি লোক দিয়েও সাহায্য করব না।]

.

সতিয়াগিরার উৎসব

আজ জমজমাট তামাসা কোয়েরীটোলার। বলন্টিয়র সতিয়াগিরা৫১৮] করবে গাঁয়ের। রামখেলিয়ার নাচ এলেও গাঁয়ে সাড়া পড়ে যায় এই রকমই। কিন্তু সতিয়াগিরা তার চাইতেও জবর জিনিস। সতিয়াগিরার মানে যে কী তা ঢোঁড়াই জানে না, তবে শোনা শোনা মনে হয় কথাটা। ভূতের গল্প শোনার আনন্দ গা ছমছমানিটুকু। সতিয়াগিরার রহস্যের সঙ্গেও সেই ভয় মেশানো;-পুলিশ, লালপাগড়ি, হাল-বলদ ক্রোক হওয়া, জেলের খিচুড়ি, হাকিম আর কত জানা-অজানা আতঙ্কের। সতিয়াগিরার সম্বন্ধে কৌতূহলের সঙ্গে মেলানো আছে মহাৎমাজীর নামের সম্মোহন; রঙ্গ-তামাসার মধ্যেও আছে বিশ ক্রোশ দূরের ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মন্দিরে মন্দিরে জল ঢেলে আসার[৫১৯] সমান পরিতৃপ্তি।

 ঢোঁড়াইয়ের সারারাত ঘুম হয়নি। এত বড় দায়িত্ব এর আগে কখনও তার মাথায় পড়েনি। আবার সামলাতে পারলে হয়। ডাবর কমঠ কি মন্দর লেহী?[৫২০] ডোবার কচ্ছপ কি মন্দার পর্বতের ভার সইতে পারে? ভিনগাঁ থেকেও কত লোক আসছে দেখতে। আশপাশের এত গাঁ থাকতে তাদের টোলাকেই বেছেছে বলন্টিয়র। এখন কোয়েরীটোলার ইজ্জত তার হাতে। যে গাঁয়ে যেত বলন্টিয়র সেই গাঁয়ের লোকেই লুফে নিত তাকে। এ কি আর নিমক তৈরির যুগের বিদেশিয়ার গান? তখন লোকে গাঁয়ের বাইরে করাতো তামাশা, থানা পুলিশের ভয়ে! বড় ভাগ্যি কোয়েরীটোলার যে বলন্টিয়র এই জায়গাটাই পছন্দ করেছে।

সে যেদিন জায়গা ঠিক করতে এসেছিল সেদিন বলেছিল যে, মহাৎমাজী ভাল ভাল লোক দেখে দেখে বেছে নিয়েছে অংরেজের বিরুদ্ধে সতিয়াগিরা করবার জন্য। বড় ভাল লোক বলন্টিয়জী; নইলে কি আর গত বছর ফৌজের উর্দি পরবার অধিকার দিয়েছিলেন তাকে মহাৎমাজী। এতকাল বাবুসাহেব বলন্টিয়রকে ভূমিকম্প রিলিফের টাকায় করা নতুন বৈঠকখানায় থাকতে দিত, সবচেয়ে কশা দড়ির খাটিয়াখানা দিত, ওয়াড় দেওয়া বালিশ দিত, পুরনো কলের গানের চাকার রেকাবি করে অঢেল ছোট এলাচ নিত। কাংগ্রিস মন্ত্রিত্ব ছাড়াতে, ছু মন্তরে ফুস বিড়াল হয়ে গিয়েছে সব। লাডলীবাবু, যে লাডলী বাবু মহাৎমাজীর মত আদরের চেলা, সে সুদ্ধ তার হুকুম মানলে না, চেরমেনগিরির রোজগারের লোভে। লোকটা যে কেবল মুখেই মালপুয়া ভাজে তা কি কেউ আগে ভাবতে পেরেছিল। আসল কাজের সময় না কে কী মেকারের লোক বোঝা যায়। ঐরু গৈরু নথু খৈথু[৫২১] শুনতে সবাই ভাল গোরুর গাড়ি চালায়। আঁধার রাতে খানাডোবায় গাড়ি উলটানোর মুখে, যে বাঁচিয়ে নিতে পারে, তাকেই না বলি ভাল গাড়ি চালিয়ে। চিরকাল হাকিম পুলিশের দিকে ওরা। দেখে আসছি তো। লড়ায়ের সময় অংরেজের পা চাটবে না তো কী? চারপেয়ে জানোয়ারগুলো যেদিকে সবুজ দেখে সেইদিকে ছোটে চরতে। এরা হচ্ছে সেই শিংওয়ালা রাজপুত।

ঢোঁড়াইয়ের কাজের অন্ত নেই। এখন বে-আক্কিলে টোলার ছেলেগুলো যে বলন্টিয়রজীর মালার জন্য, রাতে বাবুসাহেবের বাগান থেকেই ফুল চুরি করে এনেছে।

বাবুসাহেবের বাড়ির ফুলে কি মহাৎমাজীর কাজ হয়। মঠের বটগাছে বলন্টিয়রের দেওয়া মহাৎমাজীর ঝাণ্ডাটা টাঙানো হয়েছে। চারকোশ দূরের থানা থেকে দেখতে পায় তো দেখুক দারোগাসাহেব। ছানিপড়া চোখটা আঙুল দিয়ে ঘষে নিয়ে বুড়হাদাদা বলে, মহাবীর ঝাণ্ডাটা[৫২২] তুলে ভাল করলি না ঢোঁড়াই। ইনসান আলিটা আবার লিঙে খবর দিয়ে হাকিম না আনায় গাঁয়ে। বেটা আবার শাঁখ বাজানোকে আজকাল বলে কড়ি ফোঁকা।

 বিল্টা সকাল থেকে ঢোল গরম করতে বসেছিল। বুড়হাদাদার কথায় হঠাৎ কী মনে হয়, সে ঢোল ছেড়ে ওঠে, নদীর ওপারের গয়লাদের বস্তি থেকে বাজিয়ে সমেত শাঁখের যোগাড় করতে। পাড়ায় মেয়েরা রন্ধননিপুণা গনৌরীর বইয়ের বাড়িতে জটলা করছে। সেখানে আলুর তরকারি রান্না হবে। চাঁদা করে দেড় পোয়া আলু কেনা হয়েছে। বেচারা বলিন্টয়রকে আবার কতকাল জেলের খিছুড়ি খেতে হবে।

শিউজীর বেলপাতা, আর মাহাত্মাজীর খাদি। বলন্টিয়রের বসবার জায়গাটায় খাতি দিয়ে দিলে হত। গিধরটা তো দিন কতক পরছিল খাদি। না, ওর কাছে থেকে চাওয়া হবে না কোনো জিনিস, যতই এই ক্ৰটিটুকুর জন্য মন খুঁতখুঁত করুক। দারোগাসাহেবকে দেওয়ার জন্য একখানা কুর্শিরও দরকার ছিল, কিন্তু পাওয়া যাবে কোথা থেকে।

 বলন্টিয়র গাঁয়ে এসেই জিজ্ঞাসা করে এখনও দারোগসাহেব আসেননি? এখনও এলেন না কেন? গোঁসাই ঠিক মাথার উপর এলেই সতিয়াগিরা করবার কথা। পনর দিন আগে সরকারের কাছে রেজেষ্ট্রি লুটিশ পাঠিয়েছি। তবু দারোগাসাহেব এল না এখনও। শীতের দিন, ছোটবেলা। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক দুপুরে সময়টা ঠিক করেছিলাম। এখান থেকে থানা হাজতে যাতে দিনে দিনে পৌঁছে যেতে পারি।

আজব জিনিস এই সতিয়াগিরা। গঞ্জের বাজারের নাটক সার্কিল মানিজর-সাহাব না আসা পর্যন্ত আরম্ভ হয় না। সতিয়াগিরাও তেমনি দারোগাসাহেব না এলে আরম্ভ হয় না।

ঢোঁড়াই বোঝায়, আরে না না। এ একটা লড়াই। মহাৎমাজীর সঙ্গে রংরেজের লড়াই। রাম-রাবণের যুদ্ধে রামজীর অনুচররা যে রকম লড়েছিল রাবণের নাতি পুতির সঙ্গে, এ তেমনি মহাৎমাজীর চেলা বলন্টিয়র লড়বে…রংরেজের নাতি দারোগাসাহেবের সঙ্গে।

 তাই বল ঢোঁড়াই! এ হবে উঠাপটক [৫২৩] দারোগাসাহেবের সঙ্গে। তা না, সতিয়াগিরা! সতিয়াগিরা।

 বলন্টিয়র সকলের ভুল ধারণা শুধরে দেওয়ার জন্য কী সব যেন বলে, কেউ বুঝতে পারে না। থামেই না, থামেই না বলন্টিয়র। ভারি সুন্দর সুন্দর কথাগুলো। একেবারে থুতু কুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু চেষ্টা করেও কোনো মানে বোঝা যায় না। সতিয়াগিরার মনগড়া অস্পষ্ট মানেটা, আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সাধুসন্তদের কথার ধারাই এই। মধ্যে মধ্যে মাথা নেড়ে সায় দিতে হয়, বলন্টিয়রের মুখে হাসি দেখলে হাসতে হয় তার সঙ্গে হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেলে সোজা হয়ে বসতে হয়। আর কত বোঝাবে বলন্টিয়র।…

 ঢোঁড়াই তিনটি কথা বোঝে। মহাৎমাজীর চান সকলে সত্যি কথা বলুক; সকলে বৈষ্ণব[৫২৪] হয়ে থাকে; আর দারোগার সঙ্গে লড়ায়ের সময় বলন্টিয়রজী কিছুতেই চটবে না। এই তিনটি কথা। সে বাপু এরাই পারে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই লোক বেড়ে চলেছে। দারোগাসাহেবের এখনও দেখা নেই। বলন্টিয়রের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়। সে-দুজন ছোকরাকে দূর থেকে দারোগাসাহেবকে দেখবার জন্য বটগাছের মগডালে চড়ানো হয়েছিল, তারা ধৈর্য হারিয়ে নেমে আসে।

বলন্টিয়র বিরক্ত হয়ে ওঠে, নবাবপুতুরদের স্বভাব যাবে কোথায়। খেয়েদেয়ে এক ঘুম দিয়ে বোধ হয় আসবে।

 ঢোঁড়াইয়ের মতো লোকও হঠাৎ বলন্টিয়রের মুখ-চোখ দেখে আবিষ্কার করে যে, তার বিরক্তির চাইতে উদবেগই হয়েছে বেশি।

 বলন্টিয়রজী, দারোগাসাহেব ভয় পেলেন না কি?

কে জানে। সে খোঁজে আমার দরকারও নেই।

বলন্টিয়রজীর কথার ঝাঁঝ দেখে ঢোঁড়াই চুপ করে যায়। হাতের খারু দেখতে আয়নার দরকার কী? বলন্টিয়র ফৌজের উর্দি পাওয়া লোক বলে বোধ হয় দারোগাসাহেব একটু ভয় পেয়েছে। এ দারোগাটাও আবার একটু রোগা রোগা গোছের। একটানা কীর্তন শুনিয়েও এত লোকের ভিড়কে আর শান্ত রাখা যাচ্ছে না। দারোগাসাহেব বোধ হয় আর আসবে না। ঢোঁড়াই  একেবারে মুষড়ে পড়েছে। দুদিন ধরে দিনরাত মেহনত করেছে তারা। সে কি এই জন্যে। সতিয়াগিরা না হলে রাজপুতটোলার লোকেরা মুখ টিপে টিপে হাসবে। বলন্টিয়রজী তো বেশ বসে বসে চরখা কাটছে। বলন্টিয়রজী, সতিয়াগিরা কি তাহলে আর হবে না আজ?

বলন্টিয়রজী চটে কী যেন বলে। কীর্তনের কানফাটানো মাতনের মধ্যে জেঁড়াই কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারে না। তবে এটুকু বোঝে যে সতিয়াগিরা হবে। আর বোঝে যে, মহাৎমাজী চটে কী যেন বলে। কীর্তনের কানফাটানো মাতনের মধ্যে ঢোঁড়াই কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারে না। তবে একু বোঝে যে, মহাৎমাজী দারোগাসাহেবের উপর রাগ করতে বারণ করেছেন বলন্টিয়রকে, কিন্তু ঢোঁড়াই দের উপর চটে উঠতে মানা করেননি।

হবে! হবে! দারোগা না এলেও হবে। সকলের মুখে মুখে কথাটা ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে।

বলন্টিয়র হাত উঁচু করে বলে, শাস্তি! শাস্তি! কীর্তনের মাতন থামে। লোকের হট্টগোল থামে। সে দাঁড়িয়ে বলে, মহাৎমাজীর হুকুম ছিল বেশি কিছু না বলা। কিন্তু দারোগাসাহেব যখন আসেনি তখন খোলসা করেই বলি।…তারপর সে অংরেজ জর্মান লড়াই, কাংগ্রিস মহাৎমাজী কত কী বলে যায়।…অনেকক্ষণ বলবার পর শেষের দিকে ভারি ভাল কথা বলতে আরম্ভ করে। বাবুসাহেবকে বলে জুলুমকার। পাবলিস জুলুমকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বড় বড় জুলুমের অংরেজ সরকার, তাকে সাহায্য করতে এসে দাঁড়ায়। এই দেখুন কুশীর ধারের গাঁয়ের নিকাশ বাবুসাহেব হড়পে নিল। এগিয়ে দিল অংরেজ সরকারকে। পোকা থাকবার জন্য যে আটচালা তুলছে সরকার, তেমন ঘর আপনাদের টোলায় একখানও আছে? রেড়ির বীচি চলে যাবে বিলাতে লড়ায়ের কাজে, আর আপনাদের খুঁটিয়ে বাঁধা গরুগুলো জল না পেয়ে তড়পে মরবে। এন্ডির চাদর গায়ে দেবে, বাবুসাহেবের মতো জয়চন্দদের আওরতরা, আর আপনাদের বাড়িতে মা-বোনেদের আবরু-ইজ্জত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে…

আগুনের হলকা ছিটোচ্ছে বলন্টিয়রের কথাগুলো। সকলের রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। সব মনগুলো গলে তাল পাকিয়ে এক হয়ে গিয়েছে। বলন্টিয়রজী যে এরকম প্রাণের কথা বলতে পারে তা আগে কারও জানা ছিল না। দামী কথা বলেছে। জুলুমকার! বলন্টিয়র লচুয়া চৌকিদারের দিকে তাকিয়ে বলে, বলে দিও তোমার দারোগাকে আমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী বলেছি। কানুন যদি ভাঙতেই হয় তবে ঠিক করে ভাঙাই ভাল।

উত্তেজনায় সকলে উঠে দাঁড়িয়েছে। বুড়হাদাদার ছানিপড়া চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। গাল বেয়ে। সে বলে, বসে পড় সবাই। এরপর সতিয়াগিরা বাকি রয়েছে। এখনই সবাই উঠে পড়লে কেন?

কে কার কথায় কান দেয় তখন।

 বলন্টিয়র বলছে অংরেজ, আর সকলে বলে জুলুমকার।

 ঢোঁড়াই বলে বাবুসাহেব! সকলে বলে জুলুমকার! লাডলীবাবু। জয়চন্দ্র!

 কখন যেন সকলে বলন্টিয়রের সঙ্গে সঙ্গে চলতে আরম্ভ করেছে। কুশীর ধারে যেখানে গুটিপোকার ঘর হয়েছে সেখান পর্যন্ত গিয়ে সকলে প্রাণভয়ে চেঁচায়। তারপর বলন্টিয়রজী ন এক পাই, ন এক ভাই অংরেজকী লড়াইমে বলে ঊইসদিয়ারার পথ ধরে।

 মহাৎমাজীর হুকুম, যতদিন পুলিশ না ধরে গ্রামে গ্রামে এই বলে বলে ঘুরে বেড়াতে হবে। সাঁঝের আগে বোধ হয় ভঁইসদিয়ারায় পৌঁছুতে পারবে না। দেখছিস না হাওয়াই জাহাজ চলল। জিরানিয়ায় নেপালী ফৌজ ভর্তি করবার ছাউনি খুলেছে। সেখানকার ফৌজি হাকিম রোজ হাওয়াই জাহাজে কলকাত্তা থেকে আসা যাওয়া করে।

ছেলেপিলেরা বলন্টিয়রের দেওয়া মালগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। বলন্টিয়রকে আর চেনা যাচ্ছে না এতদূর থেকে। হাতে বার্নিশ করা চরখার বাক্সটার উপর রোদ্দুর পড়ে ঝকমক করে উঠল। কুশীর ধারে টিলার পিছনে গোঁসাই পাটে বসবেন এইবার।

 পরণাম মহাৎমাজী! পরণাম! পরণাম!

তারা সকলে ফিরে এসে দেখে, মঠের মাঠে বুড়হাদদা তখন মেয়েদের বসিয়ে রেখেছে, সবাই এলে সতিয়াগিরা আরম্ভ হবে বলে।

——–

[৫১৮. সত্যাগ্রহ। ৫১৯. কুশীতীরের সিংহেশ্বর থান নামে জায়গা। ৫২০. তুলসীদাস থেকে। ৫২১. রাম শ্যাম যদু মধু। ৫২২. মহাবীরী কাণ্ডার মিছিল নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ হয়! মহাবীরের নামে এই নিশান ওড়ানো হয়। ৫২৩. তুলে আছাড়। ৫২৪. জিরানিয়া জেলায় বৈষ্ণব কথাটির অর্থ নিরামিষাশী। এর সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক।]

.

হাকিম রায়বার

বেচারা বলন্টিয়রকে গ্রেপ্তার না করে দারোগাসাহেব ভারি বিপদে ফেলেছে, একবার জ্বর গায়ে কোয়েরীটোলায় এসে সেই যে ভাঙা মঠে আস্তানা নিয়েছিল, সেই থেকে রয়ে গিয়েছে সেখানেই। দু-চার দিন পর পর এ-গাঁ, সে-গাঁ, মাস্টারসাহেবের আশ্রয় ঘুরে আসে। কোয়েরীটোলার লোকের ইচ্ছে যে বলন্টিয়র তাদের গায়েই থাকে। থাকলে পর সময়ে অসময়ে একটু মনে বল পাওয়া যায়। জিরানিয়া থেকে এসেই তার খদ্দরের ঝোলার মধ্যে থেকে বলন্টিয়র প্রত্যেকবার বার করে একখানা করে মহাত্মজীর কাগজ। তার উপর মাহত্মজীর ছবি, হাঁসের পিঠে চড়ে উঠে যাচ্ছেন আকাশে। তার থেকে পড়ে পড়ে কত খবর শোনায় মুল্লুকের। এ ছাড়াও বলন্টিয়র আরও কত খবর আনে।

…অংরেজকে কাবু করছে জন। …লাভলীবার জেলা কেমি মোর্চার [৫২৫]সভাপতি হয়েছে; লোটা ভরা টাকা পাবে মাইনে, সরকারের কাছ থেকে। খুব বড় হাকিম।…পাট-তামাকের দাম বাড়ছে।..ঐ দেখ নেপালী রংটেদের হাওয়াগাড়ি চলেছে পাক্কী দিয়ে- এক, দু, তিন, চার, পাঁচ। রোজ বিশখান করে যায়। কুরসাইলা স্টেশনে এগুলো চড়বে রেলগাড়িতে। জিনিয়ার বাঙালিয়াগুলো [৫২৬] আজকাল ভারি কাবু; বাজারের সব মাছ এই নেপালী রংরুটেগুলো কিনে নেয়। খায় কী করে জানেন তো? পুড়িয়ে।..

লাডলীবাবু আরও বড় হাকিম হয়েছে- কথাটা ঢোঁড়াইয়ের ভাল লাগে না। কোয়েরী আর সাঁওতালরা বাবুসাহেবের মঠের দরুন জমিগুলোতে গোরু চরানো আরম্ভ করেছিল। তারা জানে যে, এ জমিগুলো নিয়ে বাবুসাহেব মামলা-মোকদ্দমা করতে সাহস করবে না। যে চুরি করে খায় সে কি হাকিমের কাছে যায়? লাডলীবাবু বড় হাকিম হয়ে গেলে আবার কলস্টর দিয়ে গোলমাল না করায়। কলস্টর না হোক, একদিন এস.ডি.ও. সাহেবকে নিয়ে সত্যিই লাডলীবাবু এল গাঁয়ে। খবর দিল মিটিন হবে; সকলে ভয়ে কাঠ। এই দিনই আবার বলন্টিয়রের জিরানিয়া না গেলে চলছিল না। কী যে করে সেখানে বুঝি না। লাডলীবাবু নিজে এসে সকলকে ডেকে নিয়ে গেলেন মিটিনে।

 তাজ্জব ব্যাপার! মিটিনে মঠের জমির কথা কিছু বলেন না এস.ডি.ও. সাহেব। কেবল লড়ায়ের কথা। হিটলার রাবণের মতো জুলুমকার। রাঙা আলুর চাষ করা খুব লাভের। সাড়ে সাত টাকা করে মণ উঠেছে। গাঁয়ের উচিত, চোর-ডাকাতের বিরুদ্ধে রক্ষীদল কায়েম করা গাঁয়ে গাঁয়ে।

ঢোঁড়াই হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ায়। আমাদের বাড়ি থেকে আর হুজুর কী নেবে ডাকাতে?

 হাকিম বোঝান, এ কথা বললে কী চলে? সকলকে মিলে-মিশে থাকতে হবে গাঁয়ে।

হয়ে আসা [৫২৭] বড়কামাঝি বলে, বলছ বটে ঠিক হাকিম, শুনতে লাগছে ঠিক বাপের কথার মতো। কিন্তু কুশীকিনারের নিকাশে, তোমরা আর লাডলীবাবুরা মিলে যে রেড়ির চাষ করছ, আমাদের টোলার মেয়েরা কি কুর্বাঘাটে মেলার তাঁবুর আওরত?

 এস.ডি.ও. সাহেব প্রথমে কথাটা ধরতে পারেননি। লাডলীবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি একটু আমতা আমতা করেন। বাবুসাহেব পাট-করা চাদরখানার উপর হাত বুলোতে বুলোতে কাশেন।

 দিনকাল বোঝেন না আপনারা।

হাকিমের মুখ চোখ দেখে বিল্টাটা আবার বুঝতে পারল কি না পারল, তাই পিথা মাঝি তার পায়ে খোঁচা মেরে বুঝিয়ে দেয় বকছে রে বাবুসাহেবকে। না, না, লাডলীবাবু, এদের সঙ্গে সম্বন্ধটার একটু উন্নতি হওয়া দরকার।

 লাডলীবাবু, কথাটা অস্বীকার করেন না। আজকালকার দিনে কি চাষবাসে, কি অন্য কাজে লোকবলই আসল বল। ফসলের দাম বাড়ছে। এখন এদের সঙ্গে ঝগড়া ঝটিটা জিইয়ে না রাখাই ভাল।

কথাটা বাবুসাহেবও কিছুদিন থেকে ভাবছেন; কিন্তু হাকিম একথা কটা তাদের আলাদা ডেকেও তো বলতে পারতেন।

 এস.ডি.ও. সাহেব ইনসান আলিকে সঙ্গে করে হাওয়াগাড়িতে ওঠেন। ইনসান আলির বাড়িতেই খানাপিনা করবেন আজ।

লাডলীবাবু বাড়ি ফিরবার সময় বলেন, এস.ডি.ও.টা লম্বরী লিঙি [৫২৮] তাই জন্যই ইনসান আলি আড়গড়িয়ার বাড়ি গেল।

আবার রাবণের কথা তুলেছিল বক্তৃতার মধ্যে।

লচুয়া হাড়ি বলে, হাকিম চটেছিল কেন জানিস? কৌমি মোর্চর মিটিন করবে বলে লাডলীবাবু হাকিমকে আনিয়েছিল এখানে। জেলার সব বড়লোককে, কাকে কত ওঅর-ফান্ডে দিতে হবে, কলস্টর সাহেব ঠিক করে দিয়েছে। অত দিতে চায় না লাডলীবাবু।

এখানে এনে এস.ডি.ও. সাহেবকে বলে পাঁচশ টাকা নিতে। তিনি তো শুনে চটে লাল। কলস্টর বসিয়েছে তিন হাজার টাকা। এস.ডি.ও.কি পাঁচশ টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতে পারে? তুই হলি কৌমি মোর্চার সভাপতি।…

ঢোঁড়াইদের কারও এসব কথা শুনবার উৎসাহ নেই। কী বাজে গল্প করতেই ভালবাসে এই লচুয়া চৌকিদারটা! এখন এটা গেলে বাঁচা যায়! লচুয়া হাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের কথা আরম্ভ হয়।

লাডলীবাবুটা তাহলে বেশি বড় হাকিম নয়। দেখলি না এস.ডি.ও. সাহেবের চাইতেও ছোট হাকিম।

হ্যাঁ, ডবল হাকিমের গরমই আলাদা।

যা তাড়া খেয়েছে। আর সাহস করবে না মঠের জমি নিয়ে গোলমাল করতে। বাবুসাহেবের কাছ থেকে আধি বন্দোবস্ত নেওয়া মঠের জমিগুলো ফসলের ভাগ এবার না দিয়ে দেখলে হয়। দেখাই যাক না বাবুসাহেব কী করে। মঠের পড়তি জমিতে গোরু চরালেও কিছু বলেনি, সতিয়াগিরার দিনের এত গালাগালিও হজম করে গিয়েছে। বাবুসাহেবকে না দিয়ে কিছুটা বলন্টিয়রকে দিলে কী হয়। ওরও তো বাল-বাচ্চা আছে নিজের গাঁয়ে। বড়কামাঝিরও রায় তাই। তুইও বড়হাদাদার মতো পুতুপুতু করিস না ঢোঁড়াই, এই সব ব্যাপার নিয়ে! যা হবার হবে, পরে দেখা যাবে। কাজ আজকাল দুয়োরে দুয়োরে ঘুরছে লোকের।

সে কথা ঢোঁড়াইও জানে। এই তো ইনসান আলি এসেছিল পরশু লোকের জন্য। সেই বলল, রাজপুতরা ভিস্টিবোভের খোঁয়াড় তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার সুথনী [৫২৯] করবে। লড়ায়ের জন্য সরকারবাহাদুর পাক্কী নিয়ে নিয়েছে ডিস্টিবোভের হাত থেকে। এখন পাক্কীর ধারের গাঁয়ে গাঁয়ে লোক রাখবে, রাস্তা মেরামত করবার জন্যে। তারই ঠিকেদারি পেয়েছে ইনসান আলি। ইনসান আলি আড়গড়িয়া আরও বলে গিয়েছিল, এই জন্যেই বাবুসাহেবরা পাক্কীর ধারের আমগাছ তিনটে তাড়াতাড়ি কাটিয়ে নিল। জিরানিয়ায় চালান করছে। ও রপোট করবে লাটসাহেবের কাছে। আজই হয়তো বলবে এস. ডি. ও. সাহেবের কাছে; দুজনই তো লিঙের লোক। …ডিস্টিবোডের রাস্তা মেরামতির কাজ আবার যদি ঢোঁড়াই  নেয়। ভাবতেও বেশ লাগে। কোথায় গিয়েছে সেই শনিচড়া বুছুর দল… রাস্তায় কাজ করতে করতে যদি সে কুশীনের দিন দেখে যে, গোরুর গাড়িতে করে রামিয়া আর তার ছেলে চলেছে… উদাস হয়ে ওঠে মনটা।

না, এখন পাক্কীর কাজ নিলে এরা ভাববে যে বাবুসাহেবের মুখে এদের ছেড়ে দিয়ে সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে। তা হয় না।

[৫২৫. ন্যাশনাল এয়ার ফ্রন্ট। ৫২৬. বাঙালিদের তাচ্ছিল্যে বাঙালিয়া বলা হয়। ৫২৭. জেল থেকে। ৫২৮. লিঙি-মুসলিম লীগের লোক। ৫২৯. এরকম কন্দ। কচুপোড়া করবে এই অর্থে ব্যবহৃত।]

.

জমি জাতির রাজ্যে খবরের দৌরাত্ম্য

আজকাল বছরে যত দিন তত খবর, হাটে যত লোক, তত খবর। আর সব খবর সত্যি। না পেলে মন শক শক করে; মৌতাতের জিনিস পাওয়া না গেলে যেমন হয়, তেমনি। এতকাল মঠের মাঠের খবরগুলো টিকত অনেক দিন। তার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রস নিতে হত ন-মাস ছ-মাস ধরে। এখনকার খবরগুলো আসে ভিড় করে। একটা সত্যি খবর আর একটা সত্যি খবরকে ঠেলে নিজের জায়গা করে নেয়। কালকেরটা কালকে খুব সত্যি ছিল আজকেরটা আজকে আরও সত্যি। তবে সত্যির মধ্যে কড়া ফিকে আছে।

হাটের সত্যির চাইতে গঞ্জের বাজারের সত্যি কড়া। গনৌরর কুরসালা থেকে আনা খবর আরও কড়া। বলন্টিয়রের জিরানিয়া থেকে আনা রামায়ণের হরফের খবর, তার উপর তো কথাই নেই।

কাপড়ের জাপানীরা হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এবার বাঘের খেলা, জর্মনবালা! লে লে লালা! সুরুজজী মহারাজের আর বুধভগমানের [৫২৯] পূজো করে জপৈনীরা। গোরু-টোরে গন্ডগোলের মধ্যে তারা নেই। ঠেলা বোঝাবে ইনসান আলি আড়গড়িয়াকে।

কাগজ দিয়ে ওরা হাওয়াই জাহাজ তৈরি করে, রবার নিয়ে জাহাজ। জল খাইয়ে ছাড়বে চি পল্টনকে জলের নিচ দিয়ে একেবারে কলকাতা থেকে কুসাইলা পৌঁছে যাবে।

রাজপারভাঙার তরফ থেকে রেলগাড়িভরা লোকদের যখন বিনা পয়সায় পুরিতরকারি খাওয়ান হচ্ছিল সেই সময় একদিন কোয়েরীটোলার কাঁচা লঙ্কার গাড়িগুলো ফেরত এল নৌরঙ্গীলালের গোলা থেকে। পূর্বিবাঙ্গাল লুক নাকি জপৈনীরা নিয়ে নিয়েছে। হাটে আর কত কাঁচা লঙ্কা বিক্রি করা যায়। সব বরবাদ হল। কিছুদিন পর শোনা যায় যে, নৌরঙ্গীলালের গোলায় কাঁচা লঙ্কা বিক্রি খুলে গিয়েছে? [৫৩০] আবার। যে গনৌরী আগের খবর দিয়েছিল সেই বলে যায় যে টিশন-মাস্টার সাহেব বখেভা তুলেছিল। দস্তুরের চাইতেও বেশি চাচ্ছিল পান খেতে। তাই লঙ্কা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল নোরঙ্গীলাল কিছুদিনের জন্য। জপৈনারী পূর্বি বাঙ্গাল নিয়েছে না ছাই!

আগেকার কাল হলে বিল্টারা তাকে নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করত, সে কটা মুখ দিয়ে কথা বলে? এখন কারও সে কথা খেয়াল হয় না। সাত জঙ্গলের লাকড়ি এক করে আঁটি বাঁধা; সব কি সমান জ্বলে।

তবে হ্যাঁ, বলন্টিয়রের খবরের সঙ্গে গনৌরীর খবরের তুলনা। কিতাব দেখে বলুক তো গনৌরী কবে রামনবমী! এক মাস আগে বলন্টিয়র বলে গিয়েছিল যে, পরের মাস থেকে পাক্কী দিয়ে গোরুর গাড়ি যেতে দেবে না, কাঁচা অংশটা দিয়েও নয়। পাক্কী দিয়ে চলবে খালি হাওয়াগাড়ি। ফৌজী সড়ক হয়েছে পাক্কী, একেবারে কামিখ্যামাইয়ের দেশ থেকে পালাবার রাস্তা করে রাখছে সরকার পচ্ছিমে! ঠিক বলেছিল কি না বলন্টিয়র? বর্ষায় জিরানিয়া বাজারে কেউ পাট নিয়ে যেতে পেরেছিলি? অষ্টপ্রহর ফৌজী হাওয়াগাড়ি চলছে পাক্কীতে। এত গাড়িও কি ফৌজের ছিল। বলন্টিয়র বলেছে যে জিরানিয়াতে ট্রমন ফারমের? [৫৩১] লাঙ্গলের হাওয়াগাড়ি সারাবার আর রাখবার যে ঘর ছিল না, সেইখানে হাওয়াগাড়ি মেরামতের কারখানা খুলেছে ফৌজি সরকার। একেবারে পাক্কীর পশ্চিম দিকটা ভাঙা হাওয়াগাড়িতে ভরে গিয়েছে। কত ঘর তৈরি হচ্ছে সেই দিকটায়। বিজলী বাতি বসাবে। আর পুবের দিকে টুরমনের ফারমের সিধা রেললাইনের কাছে কাঠের ইস্টিশান করেছে ফৌজের সাহবেরা। বড় বড় চালা তুলেছে সেখানে। গোরু, ঘোড়া, ছাগল, খচ্চর, ভেড়ায় ভরা। সব বেলুচি ফৌজ মুসলমান নইলে এত কসাই আর কে হবে। অথচ মুসলমানরা চটবে বলে উট আর শুয়োর রাখেনি সরকার। ফৌজ না হাতি! সহিস, সহিস! উর্দি পরেছে বলে ছাগল চরানোর রাখালকে ফৌজ বলতে পারি না। আর ফারমের কী হালত জানেন তো ঢোঁড়াইজী? বিলিতী ঘাস পোঁতা হয়েছে ঐসব জানোয়ারদের খাওয়ানোর জন্য। তার আবার যত্ন কত! মরণাধার থেকে নলের পিচকিরি দিয়ে জল দেওয়া হচ্ছে, সেই খচ্চরের খাওয়া ঘাসের জন্য।

ঢোঁড়াই জানে যে বলন্টির বাজে কথা বলে না।

আরও বলুক বলন্টিয়র পীর ধারের ঐ জায়গাগুলোর খবর। সেখানকার লোকগুলোর কথা তো কিছু বলে না। টুরমনের ফারমের উপর তার মনে মনে আক্রোশ আছে; তাদের বকরহাট্টার মাঠ নষ্ট করে দিয়েছিল চিরকালের জন্য। আবার চীনাবাদামের বিচি দিতে এসেছিল সেবারে। হাওয়াগাড়ির লাঙ্গল দিয়ে চীনে বাদাম করতে গিয়েছিলি, এবার থেকে ফলবে ছাগলের নাদি?

 তার পাক্কীও কি তাহলে বদলে গেল? ক্ষেতের রঙ বদলায়, লোকের মন বদলায়, আজকে ছোট ছেলেটা কাল জোয়ান হয়ে ওঠে, রোজার তাকত কমে, রোজগারের ধারা বদলায়, তাৎমাদের মোড়ল গোরুর গাড়ি চালায়, দুনিয়ার সব জিনিস বদলায়। বদলায় না কেবল পাক্কীও কি তাহলে বদলে গেল? ক্ষেতের রঙ বদলায়, লোকের মন বদলায়, আজকে ছোট ছেলেটা কাল জোয়ান হয়ে ওঠে, রোজার তাকত কমে, রোজগারের ধারা বদলায়, তাৎমাদের মোড়ল গোরুর গাড়ি চালায়, দুনিয়ার সব জিনিস বদলায়। বদলায় না কেবল পাক্কী আর রাময়ণ। এ দুটোর সঙ্গে যে নাড়ি বাঁধা তার। এগুলো চিরকাল একরকম। পাক্কীর বটগাছের পাতা ঝরুক শীতে; পশ্চিমবাতাসে নূতন পাতা গজাক, বর্ষায় রাস্তার মাটি ধুয়ে যাক; রাস্তা চওড়া কর না যত ইচ্ছে, কামাখ্যাজী থেকেও আগে নিয়ে যাও না যদি চাও; এসবকে সে বদলানো বলে না। কাঁচা অংশটা দিয়েও গোরুর গাড়ি যাবে না, গাড়োয়ানের গান শোনা যাবে না রাতে, লোকে ব্যবহার করতে পারবে না, ছাগল-ভেড়ার কদর হবে মানুষের চাইতে বেশি, একেই বলে বদল। শিলিগুড়ি নকসালবাড়িতে গোরাদের জন্য শুয়োরের পাল নিয়ে যাচ্ছে রোজ ডোমরা এই পথে, কিন্তু ধান নিয়ে যেতে দেবে না লোককে গোরুর গাড়িতে। অদ্ভুত! ফৌজের লোক ছাড়া আর যেন লোক নেই দুনিয়াতে।

কানে আসছে বলন্টিয়রের কথা- থেমে থেমে দম নিয়ে নিয়ে- সৌরা, সলিমপুর, বিরসোনি, বাজিতগঞ্জ, সাতকোদারিয়া…না, না। বিসকান্দা মৌজার নাম নেই ফিরিস্তিতে…

বলন্টিয়রজীর গল্প তাহলে এবার শেষ হল। বলন্টিয়র প্রতি সপ্তাহে জিরানিয়া থেকে মহাৎমাজীর কাগজ নিয়ে এলেই সকলে ঘিরে বসে থাকে। সব খবর বলা শেষ হয়ে যাবার পর, সবাই বলন্টিয়রকে বলে কাছারীর নিলামী ইস্তাহারটা দেখতে, মহাৎমাজীর কাগজখানা থেকে। বিসকান্ধার নামটা নেই তো? কিছু বিশ্বাস নেই বাবুসাহেবকে। দেখছি তো! হাজার লড়ায়ের খবর বল, মহাৎমাজীর খবর বল, আর জিরানিয়ার ফৌজী ছাইনির খবর বল, এর কাছে আর কোনো কথা কথাই না।

জমির কাছে আবার অন্য কথা! ফৌজে বকরহাট্টার মাঠের জমি নেয়, সরকার পর্যন্ত কুশীর ধারের জমি নেয়। রোজগার মানেই যে জমির ইজ্জতের সঙ্গে রোজগার, জমি। আবার রোজগারের সঙ্গে ইজ্জত চাইলে তারও দরকার জমি। চাষের জমি, গোরু চরাবার জমি, নিকাশের জমি, ধেনো জমি, তামাকের জমি, ভুট্টার জমি। যার আছে, সে আরও চায়, যার কোনোদিন ছিল না, সে-ও আজকে চায়; যাদের ছিল, গিয়েছে, তারা তো চাইবেই। বদলাক দুনিয়া। হয় যদি হোক রামায়ণের বদল। উদাস হয়ে উঠেছে ঢোঁড়াইয়ের মন একটা অজানা উৎকণ্ঠায়।

[৫২৯. সূর্যদেব ও বুদ্ধদেব। ৫৩০. আরম্ভ হয়েছে। ৫৩১. Tournament Agricultural farm.]

.

দিব্যদৃষ্টি লাভ

পাক্কী ঢোঁড়াইয়ের কাছে একটা সজীব জিনিস। তার কোনোরকম সন্দেহ নেই যে পাক্কীটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে? লোহাতে ঘুণ ধরেছে, সোনাতে মরচে পড়েছে; এ কি কলির শেষ হয়ে এল নাকি? বাবুসাহেব কাটিয়ে নিয়েছিল পাক্কীর ধারের অনেক আমগাছ। ফৌজের থেকে কাটিয়ে নিল সব সেগুন, শাল আর শিশুগাছগুলো। কুশী থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পাক্কীর গাছের মৌচাকগুলো একজন পাঞ্জাবী ঠিকাদার জমা নিয়েছে। আসামে ফৌজদের জন্যে মধু চালান যাবে। ফৌজি হাকিমরা পাক্কীর ধারের জমি কতদূর পর্যন্ত তাদের, তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই দুধারের মাটিকাটা গর্তগুলোতে বাবুসাহেব ধান লাগিয়েছে।

 দুনিয়াটা ঠিক বদলাচ্ছে না। ভেঙ্গে পড়ছে হুড়মুড় দুমদাম করে। এর খুঁটিগুলো এত পলকা তা আগে জানা ছিল না। পায়ের নিচের শক্ত মাটি, তাতে দাঁড়িয়েও যেন নিশ্চিন্দি নেই; ঐ শুনতেই রাঙাআলু সাড়ে-ন টাকা মণ! রোজার রাজ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন রাজা- সরকার বাহাদুর। এতদিন ইনরধনুর-আড়ালে ইনরজী মহারাজের [৫৩২] মতো ছিল সাত-সন্দুর তের নদীর পারের রাজা। সূর্যিঠাকুরকে সেই রূপকথার রাজা রাখতেন দারোয়ান। সে দারোয়ানের চোখের পলকটুকু পর্যন্ত ফেলবার হুকুম ছিল না। রাজপুতুর ঢলাকুমার আর বিজাসিং-এর রূপটা তবু পালাগানের সুরে আর ঢোলকের বোলে ধরা পড়ত। এ রাজাকে জানবার সে উপায়টুকু ছিল না। সেই রাজা এসে গিয়েছেন কাছে। আবছা রূপটা স্পষ্ট না দেখা গেলেও অনুভব করা যায়। পাক্কী আর পাটের দামের রাজা, কাপড় আর কেরোসিনের রাজা, মাটিতে জমিদার হাকিম দারোগা ফৌজের রাজা, আকাশে হাওয়াই-জাহাজের রাজা, বাতাসে ফৌজী হাওয়াগাড়ির গন্ধর রাজা। রামায়ণে এ রকম রাজার কথা লেখা নেই। বিলাক-এর [৫৩৩] কথা লেখা আছে? লাডলীবাবু নিজের বৈঠকখানায় দোকান মঞ্জুর করে দিয়েছিল, অনোখীবাবু, ইনসান আলি আড়গাড়িয়া আর গিধর মণ্ডল এই তিনজনকে। পনের টাকা দিয়ে নাম লেখালে তবে চিনিখোররা সেই দোকান থেকে জিনিস পেতে পারে। রামায়ণপড়া পণ্ডিতজীও জানত না যে ঐ দোকানের নাম কন্ট্রোল। এসব জিনিসের কথা রামায়ণে থাকে না, নিলামি ইস্তাহারওয়ালা মাস্টারসাহেবের কিতাবে। বলন্টিয়রজী জানে। তাই না এসব জানতে হলে বসতে হয় বলন্টিয়রজীর কাছে।

বদলায় অথচ বদলায় না। পুরনো রামায়ণ আর নতুন রামায়ণে জট পাকিয়ে যায়। ইনসান আলি পাক্কীর ঠিকেদার হওয়ার পরও তার ইনসান আলি আড়গড়িয়া [৫৩৪] নাম ঘোচে না। গিধর মোড়লের মোড়লি ঘুচল, তবু সে গিধর মোড়লই থেকে যায়। খোয়াড়ে কাজ করলেও কেউ তাকে আড়গড়িয়া বলে না। কলকাত্তায় রাঙাআলু চালান দেওয়ার ঠিকে নিলেও কেউ তাকে ঠিকাদারসাহেব বলে না। ভাঙখোর অনোখীবাবু রাত জাগতে হবে বলে আজকাল অন্য জিনিস খায়; কৌমি মোর্চার [৫৩৫] সাহায্যে কন্ট্রোলের দোকানের নাম করে কেনা নুন রোজ রাতে নৌকা বোঝাই করে চালান দেয় বাঙ্গাল মুলুকে; তবুও সে নিজেকে বলে কিষাণ। কুরসাইলার চিনির কলের আর বাস লাইনের মালিক রাজপারভাঙা; তবু সবাই বলে জমিদার।

যা শোন সব আসামের যাচ্ছে। রাজ্যিসুদ্ধ লোক ঠিকেদার হয়ে উঠছে। মন হয়ে যাচ্ছে অন্যরকম। গোরু দুইতে আরম্ভ করেছে কিষাণরা। জিরানিয়া জেলায় এত দিন। গোরু রাখা হত বাছুরের জন্য আর গোবরের জন্য কেবল। গাছের থেকে পড়া ফল যার ইচ্ছে নেওয়ার অধিকার ছিল গাঁয়ে, এখন ঠিকাদাররা কাঁচা আমই চালান করে দিচ্ছে, গাছতলায় ফল আসবে কোথা থেকে। যদিই বা দৈবাৎ কোনো বাগানে গাছে। আম পাকতে দেওয়া হয়, সেখানেও ঠিকেদাররা তলের ফল কুড়োতে দিচ্ছে না।

এতও খেতে পারে ফৌজরা!

ঢোঁড়াই  কিছুতেই বুঝতে পারে না কী করে তারা এত জিনিস নিয়ে মধু থেকে আরম্ভ করে রাঙা আলু পর্যন্ত।

বলন্টিয়র বলে, মৌকা এসেছে যে যা পারে করে নেবার। এমন সুযোগ জীবনে একবারের বেশি আসে না। কালকে এ সুবিধা নাও থাকতে পারে। সাধে কি আর মহাৎমাজী গরমেছেন! বরদাস্তের বাইরে হয়ে গিয়েছে। মহাৎমাজী বলে গিয়েছেন এই তাঁর শেষ লড়াই, দুনিয়াতে রামরাজ্য আনবার লড়াই। 

রামচন্দ্রের অবতার মহাৎমাজী। রামায়ণের লেখার সমান তাঁর কথার ওজন।

এবার আর আগের মতো নিমক তৈরীর ফিস-স-স আর সতিয়াগিরার ফুস-স-স নয়। আর সে সব খোঁড়া-নুলোর নোটাঙ্কি। এবার মরদের লড়াই রেললাইন তুলবার, তার কাটবার আরও অনেক! অনেক! মাস্টারসাহেব পাটনা থেকে খবর নিয়ে এসেছে। মাস্টার সাহেব এনেছে? পাটনা থেকে? তবে আর এ খবর অবিশ্বাস করার কিছু নেই। রেলগাড়ি দিয়ে কি আর রামরাজ্যে পৌঁছন যায়। এতে করে সব জিনিস পাঠানো যায় আসামে, কুরসাইলা থেকে আর জিয়ানিয়ার ইস্টিশান থেকে। বুড়হাদাদা বলন্টিয়রকে জিজ্ঞাসা করছে, মাতাল গোরাপল্টনরা তেল খায় নাকি? না হলে এত তেল কী হয়? বুড়হাদাদার উপর ঢোঁড়াই য়ের মন বিরূপ হয়ে ওঠে। এত বাজে কথা বলতে পারে। এইবার নিশ্চয়ই দেশলাই নুন আর কাপড়ের পুঁথি খুঁলে বসবে।…না না বলন্টিয়রজী, এসব কথা যেতে দিন। মহাৎমাজীর কথা বলুন।

ঢোঁড়াইয়ের ইচ্ছা হয় আরও শোনে, এ কথা শোনে। রামায়ণ শোনবার পুণ্যি না থাকুক এতে। তবু একথা আরম্ভ হলে বলন্টিয়রের কাছে ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে করে। রাবণের চাইতেও অংরেজ সরকারের উপর আক্রোশ আরও জীয়ন্ত হয়ে ওঠে। ধন্য তার পুণ্যের বল সে অমন মহাত্মার দর্শন করতে পেরেছিল। এই দর্শনের দিনের সঙ্গে তার জীবনের কতখানি অংশ জড়ানো। শুধু তার কেন আরও একজনের। সে এখন কোথায় কোথায় জলকাদায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বেঁচে আছে কি মরে গিয়েছে কেউ জানে না।…

অজ্ঞাতে ঢোঁড়াইয়ের হাত চলে যায় কোমরের বটুয়াটিতে। উপর থেকে টিপে টিপে দেখলে চাদির সিক্কাগুলো বোঝা যায়। ভাল লোকদের অদ্ভুত ধরন অবিচারের প্রতিবাদ জানাবার। সাগিয়া প্রতিবাদ জানায় নিজেকে কাদায় নামিয়ে; বাওয়া ঢোঁড়াইয়ের উপর প্রতিশোধ নেয়। নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মহাৎমাজী অংরেজের জুলুমের জবাব দেন জেলের খিচুরি খেয়ে; সীতাজী নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেন ধরতিমাইয়ের কোলে গিয়ে।

ও বলন্টিয়র! গোঁসাই মেঘে ঢাকা রয়েছে বলে আজ কি আর খাওয়ার সময় হবে না?

বলন্টিয়র এক-একবেলা এক-একজনের বাড়িতে খায়। গনৌরীর বৌ তাকে ডাকতে এসেছে।

আর এ গাঁয়ের দানাপানি উঠল আমার।

আবার কী হল। গনৌরীর বৌয়ের মুখ শুকিয়ে যায় ভয়ে। এত বড় একটা লোককে খাওয়ানোর আবার কিছু ত্রুটি হয়ে যায়নি তো। আর স্বামী থাকে কুরনাইলা। গাঁয়ে জমি কেনবার মতো টাকা জমলে তবে ফিরবে। তার কষ্টের সংসার থেকে, কত চেষ্টা করে বলন্টিয়রের খাওয়ার পালাটা চালাতে হয় তাকে।

না না, তা বলছি না, জেলের খিচুড়ি আবার খেতে হবে শীগগিরই-একটু আদর কাড়তে চায় বলন্টিয়র।

বাবুসাহেব?

 মেয়েমানুষের আবার কত আক্কেল হবে। বুড়হাদাদা অবাধ্য মাজাটা সোজা করে নিয়ে বসে, তারপর এই বুদ্ধিহীনা স্ত্রীলোকটিকে এক কথায় সমস্ত ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়, মহাৎমাজীর লাইন তোলা হবে।

বলন্টিয়রের খাওয়া হলে, গাঁসুদ্ধ সকলে তাকে টিপটিপুনি বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে দিতে আসে। জিরানিয়া থেকে খবর পাঠিও বলন্টিয়র।

 মজাত্মাজীর মুখ রেখো ঢোঁড়াই।

 ও বলন্টিয়র, থামো থামো। গনৌরীর বৌ ছুটে আসছে তার বিছানায় পাতবাবুর বোরাটা নিয়ে। গায়ে মাথায় দিয়ে নাও এটা, না হলে এক কোশ যেতে না যেতেই ঐ অমনি হয়ে যাবে চেহরা। গনৌরীর বৌ বাবুসাহেবের ভুট্টা ক্ষেতের কাকতাড়ুয়াটাকে দেখায়। যেদিন কলস্টরসাহেব লাডলীবাবুর সঙ্গে কন্ট্রোল খুলতে এসেছিলেন, সেদিন তাঁকে দেখানোর জন্য প্রজাপতি ছাঁটের গৌফওয়ালা হিটলার কাকতাড়ুয়াটিকে এখানে খাড়া করা হয়েছিল। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। রোদে বৃষ্টিতে সেটার রূপ গিয়েছে বদলে, এখন সেটাকে দেখিয়েই মুখখু গনৌরীর বৌটা হেসেছিল, যাতে রামায়ণপড়া বলন্টিয়রজী চটের বোরাটা নেওয়ার সময় কুণ্ঠিত হবার অবকাশ না পায়। মহাৎমাজী সাবধান করে দিয়েছেন অংরেজকে। কী করতে হবে তা বলন্টিয়র বলে যায়নি। তবে কাঠবিড়ালের কর্তব্য করতে ঢোঁড়াই পিছপা নয়।

[৫৩২. রামধনুর আড়ালে ইন্দ্রদেব। ৫৩৩. ব্ল্যাকমার্কেটিং। ৫৩৪. খোঁয়াড়রক্ষক। ৫৩৫. ন্যাশনাল ওয়ারফ্রন্ট।]

.

বিসকান্ধার অঙ্গীকার

বাবুসাহেব বহুকালের অভ্যাসমতো আজও হাটে এসেছিলেন। দুদিন থেকে তাঁর মনের উপর দিয়ে বড় অশান্তি চলেছে। তাঁর ছাব্বিশ বিঘার বাঁশঝাড় নির্মূল করে অনোখীবাবু কোশীজী গঙ্গাজী দিয়ে পাটনায় পাঠিয়েছে। এক টাকায় একখানা করে বাঁশ বলে কী সব বেচতে হবে? ছেলেদের এ হ্যাংলামি বাবুসাহেবের পছন্দ না। বললেও শোনে না। তোদের জিনিস যা ভাল বুঝিস কর। তবে তিনি শর্ত করিয়ে নিয়েছেন যে, ওর থেকে এক পয়সাও ফঙ্গবেন ঠিকেদারির কাজে খরচ করতে দেবেন না তিনি। ঐ টাকা দিয়ে গোরু, বলদ, মোষ কিনতে হবে, যত আক্ৰাই দাম পড়ুক না কেন। কম করে পাঁচশটা গোরু-মোষ না হলে সেগুলোকে নিজের রাখালের দলের সঙ্গে মোরঙ্গে [৫৩৬] পাঠান যায় না চরবার জন্য। জনকয়েকে মিলে পাঠাতে হয়। সে রকম লোকদের এ অঞ্চলে আবিজাতদের মধ্যে ধরা হয় না। যা দাম বাড়ছে। গোরু মোষের। বাঁশের দাম বাড়াটাই দেখছে অননাখীবাবু, মোষের দাম বাড়াটা আজ নজরে পড়ে না। হরে-দরে হাঁটুজল। সেই বাঁশঝাড়ের জমিটা থেকে, তিনি বাঁশের শেকড় খুঁড়ে বার করাচ্ছিলেন দিনকয়েক থেকে। মুসহরগুলোর [৫৩৭] উপর কোনো কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই! একদিন রোজগার করে দুদিন জিরোয়। তিন দিন থেকে সেই বে-আক্কেলে লোকগুলো কাজে আসছে না। বোঝে না আজকালকার দশ টাকা মণ রাঙাআলুর দিনে এক ধূর জমি অনাবাদী ফেলে রাখলে কিষাণের কত লোকসান। পোপাই মুসহরটা হাটে এসেছে ঠিকই। কিন্তু গেল কোথায়?

তাকে দেখতে পাওয়া যায় কুয়োর পাশের ভিড়টার মধ্যে। রাজপুতটোলার বাঁচিতরোয়াকেও [৫৩৮] তো দেখছি একটা কাগজ দেখে কী যেন পড়ছে। বস মুসহর আর হাড়ীগুলোর গা ঘেঁষে! মাহৎমজীর হল্লা। এসব বহু দেখেছেন তিনি সারাজীবন ধরে। দেবে সরকার বাহাদুর ভুট্টা পেটানোর মতো করে ঠেঙ্গিয়ে, অমনি টায় টায় ফিস-স [৫৩৯] হয়ে যাবে সব। প্রত্যেক কবছর পর পরই তে হয়। এবার যেন একটু তাড়াতাড়ি! তা করছিস বাপু তোরা কর। এর মধ্যে আবার মুসহর-টুসহরকে নেওয়া কেন?

এই পোপাই, শোন এদিকে।

 চেঁচামেচি করবেন না এখানে। কাল সকাল আটটায় নটায় যাব।

কেন এখানে কি রামায়ণপাঠ হচ্ছে নাকি? হাটে কথা বলতে হলেও খাজনা দিতে হবে? ফের এখানে বকবক করবে তো জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেব। বহুদর্শী বাবুসাহেব মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারেন যে, এরা যা বলছে তা করতে ইতস্তত করবে না আজ। দারোগাসাহেব পরশু ঠিকই বলেছিলেন, বাবুসাহেব, ইনসান আলি, গিধর মণ্ডল তিনজনই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সে কথা। তাঁর টোলার বাঁচিতর নামের ছোকরাটা কী সব বলছে তাঁর কানেও যায় না। চারিদিকে এত ভিড় চাপ বেঁধে গিয়েছে এই চেঁচামেচিতে যে বেরুনও শক্ত। সেখানেই বসে পড়েন তিনি। ঘড়ির টাইম ছাঁটে মুসহরের ব্যাটা! শিখল কোথা থেকে?

সরকার জুলুমকার! অংরেজ জুলুমকার! বলে বাঁচিতর সিং শেষ করল তার কথা।মহাৎমাজী গ্রেপ্তার! হো যাও তৈয়ার! হঠাৎ ঢোঁড়াই উঠে দাঁড়িয়েছে।

কেউ মহাৎমাজীর হুকুমের বিরুদ্ধে যেও না। যে খেলাপে যাবে সে পাবলিসের দুশমন। কিসকান্ধার বিশ কাঁধ এক হলে কারু দল গলবে না সেখানে। তাঁর কথা রাখবে তো সকলে?

সকলে চেঁচিয়ে জবাব দেয়, নিশ্চয়।

মরদের এক কথা!

নিশ্চয়।

দেখো, যার এক বাপ, তার এক বাত!

এত মনের মতো করে কথা কি বাঁচিতর সিং বলতে পারে? ঢোঁড়াইয়ের কথা মনে গিয়ে বেঁধে। পা ঠুকে ঠুকে আর হাত নেড়ে নেড়ে সকলে চিৎকার করে, এক বাপ! এক বাত! এক বাপ! এক বাত! এত মনের মতো কথা তারা এর আগে কখনও শোনেনি। বিল্টা একটা ঘণ্টা হাতে করে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে বাঁচিতর সিংহের হাতে দিয়ে ভিড় ঠেলে আসে বাবুসাহেবের কাছে। তার হাত ধরে তাঁকে টেনে দাঁড় করায়। চুপ করে কেন? বলো এক বাপ, এক বাত। বলো, বলো, থেমো না। কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলেন বাবুসাহেব। সকলে শ্রান্ত হয়ে থামবার পর বড়কামাঝি লচুয়া চৌকিদারের হাত পেপে ধরে। বলবি নাকি এসব কথা তোর বাপ দারোগার কাছে? সে ঘাড় নেড়ে জানায় যে সে বলবে না।

এক বাপ! এক বাত!

চৌকিদারকে ধরে এনে বাবুসাহেবের পাশে দাঁড় করান হয়।

 আবার বলো। দুজনে একসঙ্গে বলো।

 মহাৎমাজীর কাজে তারা কাঠবেড়ালির সাহায্যটুকু করতে পেরেছে, এই সন্তেষ মনে নিয়ে সেদিন সবাই বাড়ি ফেরে। ঢোঁড়াই টাকে আগে রেখে মনে ভরসা পাওয়া যায়।

ও যাঃ!

বিল্টা ঠিক করে গিয়েছিল, হাটে ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে যে আর কাউকে চৌকিদারি খাজনা দিতে হবে না। এক বাপ এক বাতের ঠেলায় যথাসময়ে সেটা ভুলে গিয়েছে। আর এখন হাট ভেঙে গিয়েছে।

[৫৩৬. নেপালের একটি জেলা। ৫৩৭. একটি স্থানীয় অনুন্নত জাতের নাম। এরা ক্ষেতমজুরের কাজ করে। ৫৩৮- বিচিত্র সিং নামের তাচ্ছিল্যসূচক উচ্চারণ। ৫৩৯. বহুবারম্ভে লঘু ক্রিয়া।]

.

তিতলি কুঠি দাহন

এর পরে কয়দিন এক রকম নেশার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। একটা যা হোক কিছু করবার নেশা। দল বেঁধে বেঁধে সকলে এখানে-ওখানে সাত জায়গায় ছুটে বেড়ায়। সবাই সব কিছু করছে মাহত্মাজীর  সেবাতে। থানাতে স্বরাজ হয়ে গেল। ঢোঁড়াই কাউকে বলে না, কিন্তু তার মনে মনে দুঃখ যে সে মহাৎমাজীর কাজ কিছু করবার সুযোগ পেল না। লোকে জানুক, দশজনে বলুক যে, সে খুব মহাৎমাজীর কাজ করছে। এই বাসনাটি প্রবল হয়ে উঠেছে আজ কয়েকদিন থেকে।

গঞ্জের বাজারের দাগী আসামী বিশুনি কেওট পর্যন্ত ভোপতলাল আর বলন্টিয়রের প্রশংসা পেয়ে গেল মহাৎমাজীর কাজ করে। থানার কাগজ জ্বালানোর দিন সে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে দারোগাসাহেবের চালাকি। তার শ্বশুরা দারোগা নাকি দাগী রেজিস্টার খান [৫৪০] লুকিয়ে রেখে বাজে কাগজগুলো জ্বালানোর জন্য দিয়েছিল। তারপর পেট্রল দিয়ে ছোট দারোগাকে সমেত থানার ব্যাপারটা সে নিজে শেষ করে। মাঝে থেকে ফাঁকি দিয়ে নাম কিনে নিল ভোপতলাল আর বাঁচিতর সিং। তবে বিশুনি কেটের মতো মহাৎমাজী কাজ করতে চায় না। বলন্টিয়রের দেখা পাওয়াই শক্ত। নইলে ঢোঁড়াই তাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করত।..

একদিন বিসকান্ধার দল কুরসাইলার কাছের একটা রেললাইনের ব্যাপার দেখে ফিরছে। কাঁধে তীর ধনুক, বড়কামাঝি তান ধরেছে। নেশায় গলা ভেঙে এসেছে। কাল রাত থেকেই পচই এর [৫৪১] স্রোত বইছে সাঁওতালটোলায়। স্বরাজ হয়ে গিয়ে বড় দারোগা ভেগেছে, সারকিল মানিজর হাকিমি টুপি খুলেজে। জুলুমকার সরকারকে এতদিন এক টাকা করে বছরে দিতে হত পচই খাওয়ার কাগজের জন্য। জয় হো মহাৎমাজী! তার রাজ্যে পচই খেতে আর কাগজ [৫৪২] নিতে হবে না। পাওয়া যেত এখন সেই পচইয়ের হাকিমটাকে, তাহলে কেড়ে নেওয়া যেত তার কুর্তা পাতলুন। নাচ শালা হাকিমি নাচ। কী করে যে স্বরাজ এসে গেল ঠিক বোঝা গেল না। মহাৎমাজীর কাজ প্রাণভরে করাও গেল না। দুঃখে তাই কান্না এসে গিয়েছে বড়কামাঝির। তাই ভাঙা গলায় সে তান ধরেছে

… রেললাইন উঠিয়ে ফেললে
তো পা ভেঙে দিলে সরকারের।
 তার কেটে দিলে।
তো কান কেটে দিলে সরকারের।
থানা জ্বালিয়ে দিলে
তো চোখ গেলে দিলে সরকারের। [৫৪৩]

নেশার ঘোরে তুই অংরেজের জন্যে কাঁদছিস নাকি রে বড়কামাঝি?

নেশার ঘোরে! পচইয়ের আবার নেশা, তা আবার ধরবে বড়কামাঝিকে! ঐ দ্যাখ কুশীর ধারে কাকচিল উড়ছে; পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। নেশা হলে কি দেখতে পেতাম। বলেই বড়কামাঝির সন্দেহ হয় নিজের উপর। একটা চিলকে অতগুলো চিল দেখছে না তো?

বিল্টা বলে, বাদলা পোকাটোকা উড়ছে মনে হয়। বড়কামাঝি নিশ্চিত হয়, যাক, তাহলে চোখের ভুল হয় না। শিকারীর অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে সে বোঝে যে কাকচিলগুলো উড়ছে গুটিপোকার ঘরের উপর। ডালা পরিষ্কার করে রোগা পোকাগুলো ফেলছে বোধ হয়।

 কাছে এসে দেখে যে ঠিক তাই। তিতলি [৫৪৪]র হাকিম কথাটার মধ্যে কেউ হাসির কিছু খুঁজে পায়নি।

ঠিক বলেছিস বড়কামাঝি। পচইয়ের হাকিমের পিসতুতো ভাই তিতলির হাকিম? চৌকিদার উর্দি ছেড়েছে, কিন্তু তিতলির সাহেব পাতলুন ছাড়েনি। গুট মোটিং। গুট মোটিং তিতলি ঢুকে পড়ে। সকলে সেইদিকে আগিয়ে যায়।

হঠাৎ ঢোঁড়াইয়ের মুখচোখে একটা জিনিস মনে পড়ার ঝলক লাগে। হাতের কাছের এমন জরুরি কাজ এতদিন মনে পড়েনি কেন তাই ভেবে সে আশ্চর্য হয়।

ঢোঁড়াই বলে, বাইরে চলে এস তিতলিসাহেব, ঘরে আগুন লাগাচ্ছি আমরা। চালের খড় সকলে টেনে বার করে এক একমুঠো।

একখানা লুঙ্গি পরে তিতলি সাহেব বেরিয়ে এসেছে।

দম বন্ধ করা ধোঁয়ার মধ্যে ঢোঁড়াই গুটিপোকার ডালাগুলোকে এক এক করে বার করে মাঠে রাখে। কিলবিলে পোকাগুলোকে দেখে গা ঘিনঘিন করে।

যত তোর উদ্ভট কাণ্ড! কার জন্য বার করছিস ওগুলো? এখনই তো কাকে চিলে খেয়ে যাবে।

তা থাক।

–মাথায় জড়ানো গামছাখানা আলগোছে খুলে নিয়ে বড়কামাছি ঢোঁড়াইয়ের পায়ের কাছে রাখে; নাটকে ঠিক যে রকম সে দেখেছে। লোহা মানছি [৫৪৫] আমি তোর ঢোঁড়াই আজ থেকে। তোর খুনে পানি নেই।

ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে সেই একদিনকার কথা ছোটবেলার, যেদিন রেবণগুলী লোহা মেনেছিল মহাৎমাজীর। আজ সাঁওতালটুলি তার লোহা মানছে। এতে আনন্দ আছে। কাল হয়তো আরও দূরের লোকেরা তার তারিফ করবে। দেখা হলে বলন্টিয়রজী পিঠ চাপড়ে দেবে তার। মহাৎমাজীর কাজ মন বদলে দেয় লোকের দেখতে দেখতে। অন্য কাজে কেবল নিজের গাঁয়ের লোকের প্রশংসা পেলেই মন ভরে ওঠে। এ কাজে শুধু। ঐটুকুতে তৃপ্তি হয় না। কিন্তু সে কদর পেতে হলে রামায়ণ পড়া লোক হতে হয়। তার সত্যিকারের তৃপ্তি হয়েছে পোকা-কটাকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে।

সত্যই ঢোঁড়াই নিজেকে বুঝতে পারে না। কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে, খুঁজে পায় না নিজেকে। দিন কয়েক আগে যেদিন পাক্কীর ধারের অশ্বত্থাগাছ কেটে রাস্তা কর হচ্ছিল সেইদিনের কথা। অত মেহনত, অত হৈ-চৈ, কিন্তু তার মধ্যে কেবল একটা কথাই তার মনে আছে। অনেকদিনের পর সেদিন মোসম্মতকে দেখেছিল সেখানে, গায়ের মেয়েদের মধ্যে। মোসম্মত তাকে একপাশে আলাদা ডেকে নিয়ে। গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল–তুই নিজে অশ্বত্থাগাছ কাটার মধ্যে থাকিস না ঢোঁড়াই। ওতে অমঙ্গল হয়।

কী ভাল যে লেগেছিল তার এই কথাটা! মহাৎমাজীর কাজের চাইতেও ভাল। কিছুক্ষণের জন্যে মহাৎমাজীর কাজ তার চোখের সমুখ থেকে মুছে গিয়েছিল সেদিন। মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছে কথা কটা। বড়কামাঝির কথা কানে আসে। …মাস্টারসাহেব কলস্টর হবে। লাডলীবাবু অংরেজের হাকিম হতে গিয়েছিল, এখন লে সুধনি [৫৪৬]। ঢোঁড়াই তুই চেষ্টা করিস দারোগা হতে, তিতলির হাকিম তো মহাৎমাজীর রাজ্যে থাকবেই না।…

[৫৪০. Village Crime Note Book. ৫৪১. ভাত থেকে তৈরী এক রকম মদ। ৫৪২. আবগারী বিভাগের লাইসেন্স। ৫৪৩- স্থানীয় গীত। ৫৪৪- তিতলি-প্রজাপতি। রেশমের গুটি কেটে প্রজাপতি বার হয়। সরকারী রেশম বিভাগের কর্মচারী। ৫৪৫. পরাজয় স্বীকার করা। ৫৪৬. খা কলা পোড়া। সুথনি এক কন্দের নাম।]

.

ঢোঁড়াইয়ের আজাদ দস্তায় প্রবেশ

যেদিন বড় দারোগাসাহেবকে সঙ্গে করে গোরারা আসে বিসকান্ধায়, সেদিন সকালেই ঢোঁড়াই পালিয়ে এসেছিল কুশী পার হয়ে, আজাদ দস্তায় [৫৪৭]। লচুয়া চৌকিদার খবর দিয়ে দিয়েছিল যে, তাকে ধরবার জন্যই টমিরা আসছে।

ভিনদেশের রঙবেরঙের পাখি লালমুখো কাকতাড়ুয়া দেখে দিশেহারা হয়ে পালাচ্ছিল। সাঁঝ পড়াতে একগাছে রাত কাটাচ্ছে। তার নাম আজাদ দস্তা। বুলিমুখস্থ তোতা আছে, নাচনদার ফিঙে আছে; পাঁকের পাখি কাঁদাখোঁচা আছে, সবজান্তা ভুশণ্ডী কাক আছে। ইস্কুলের ছেলেই বেশি। নাম জিজ্ঞাসা করলে নামের শেষে আজাদ কথাটা যোগ করে দেয়।

ভালমন্দ যেমন লোক চাও সব পাবে এখানে। কাজের লোক কি আর নেই? বলন্টিয়রজী আছে; ভোপতলাল আছে, মিলিটারি-ফেরত সর্দারজী আছে; মাস্টারসাহেবের ডান হাত বিসুন শুকলা আছে। বিসুন শুকলাকে ঘিরেই দলটা দানা বেঁধেছে।

 পুলিশের নজর এড়ানোর জন্যে দলের যোগ্য লোকেরা নতুন নাম পায়। ভোপতলালের নাম হয়েছে গান্ধী, বিশুন শুকলার নাম জওয়াহর, বলন্টিয়রজীর নাম প্যাটেল, বাঁচিতর সিংহের নাম আজাদ; মিলিটারি-ফেরত লোকটির নাম দেওয়া হয়েছে সর্দার। এই নাম পাওয়ার চাইতে বড় সম্মান দলের মধ্যে আর কিছু নেই। এ নিয়ে ঈর্ষা দ্বন্দ্বেরও অন্ত নেই।

এদিকটা বন্যার দেশ। তের মাইলের মধ্যে হাওয়াগাড়ির রাস্তা নেই; টমিরা আসতে পারবে না। তাই সবাই নিশ্চিন্দি হয়ে কী কী ভুল করে ফেলেছে, তারই বিরামহীন গল্প করবার ফুরসত পেয়েছে।

 ঢোঁড়াই যেতেই বলন্টিয়রজী সকলকে বলে দেয় যে, এ আমাদের চেনা লোক।

খুলিয়া [৫৪৮] নয়।

 বাবুসাহেব আর ইনসান আলির পাখিমারা বন্দুক দুটো যদি নিয়ে নিতিস রে ঢোঁড়াই।

বন্দুক? বন্দুক নিতে তো বলেনি বলন্টিয়রজী কখনও। আর ভোপতলালজী তুমি তো আমাদের ওদিকে যাওইনি।

সকলে একসঙ্গে হাঁ হাঁ করে ওঠে। সকলের মুখ দেখে ঢোঁড়াই বোঝে যে, সে কোথায় যেন একটা দোষ করে ফেলেছে। সে ভেবে পায় না, কী আবার বলল সে? বলন্টিয়রজী বলে দেয় যে, এখানে বলন্টিয়রজী আর ভোপতলালজী বলে ডাকা বারণ, তবে জওয়াহরকে বিসুন শুকলা বলে ডাকতেও পার। সবে নতুন এসেছে সে। সেইজন্যে তার অজ্ঞতা সেবারকার মতো দলের লোকে মাফ করে দেয়।

গান্ধী হেসেই খুন। পাখিমারা বন্দুকের কথায় আকাশ থেকে পড়িস। তোরা আবার অংরেজের সঙ্গে লড়বি।

কোনা থেকে গর্জে ওঠে প্যাটেল। ডিং হাঁকিস না?৫০ গান্ধী। এই আমাদের সকলের সমুখে বলে রাখলাম, গান্ধী যদি পাখিমারা বন্দুকেও টোটা ভরতে পারে তবে আমার নামে কুকুর পুষবেন। ফৌজের কাছ থেকে নেওয়া তিন-তিনটে রাইফেল পড়ে রয়েছে। কাউকে তো একদিনও চালাতে দেখলাম না।

চালাবে কি টোটা খরচ করবার জন্য? আমাদের ইস্কুলের পণ্ডিতজী বলতেন বৃহৎ দন্তা হি ক্কচিৎ মূখাঃ। প্যাটেলটা সেই কচিৎ-এর মধ্যে পড়ে গিয়েছে।

প্যাটেলের সমুখের দাঁতকয়টি বড়। রাগে তার সর্বশরীর জ্বলে ওঠে। একবছর ভাগলপুরে কলেজে গান্ধী পড়েছিল বলে সংস্কৃতে অপমান করবে!

দুজন হাতাহতি হবার উপক্রম। জওয়াহর সব ব্যাপারে গান্ধীর দিক টেনে কথা বলেন। আজাদ দস্তায় এসব চলবে না।

আবার একটা চেঁচামেচি আরম্ভ হয়।

একেবারে হতভম্ব হয়ে যায় ঢোঁড়াই সমস্ত দেখে।

সেই রাতেই ঢোঁড়াইয়ের পাহারা দেওয়ার ডিউটি পড়ে সম্মুখের মাঠে। দুজন দুজন করে একসঙ্গে ডিউটি দেয়। তার সঙ্গের লোকটিকে ঢোঁড়াই দেখেই চিনতে পারে, গঞ্জের বাজারের দাগী আসামী বিশুনি কেট। এইটাই থানা জ্বালানোর দিন দারোগাসাহেবের চালাকি ধরে ফেলেছিল।

সে গল্প জমায় ঢোঁড়াই য়ের সঙ্গে। দুনিয়ার বহু খবর রাখে লোকটা।

…তোর মাগ ছেলে নেই ঘরে; দুধে দম্বল দিয়ে জেলে যাবি, আর ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে সেই দই খাবি।…বিসুন শুকলাকে এরা দলের পাণ্ডা করেছে কেন জানিস? এখন কাজের মধ্যে তো চাঁদা তোলা কেবল। বিসুন শুকলা মাস্টার সাহেবের চেলা কিনা, তবু লোকে ভাববে যে টাকাটা মহাৎমাজীর কাজেই লাগবে। দেখলি না ঐ জন্যই তো দল থেকে নিয়ম করে দিয়েছে যে, ওকে বিসুন শুকলাও বলতে পার, জওয়াহরও বলতে পার। ঐ পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে আর কাউকে আসল নাম ধরে ডাকো তো! তাহলেই কালকে খাওয়া বন্ধ? পাঁচজনে আবার যাওয়া হল ভুখনাহার বালোসোয়ার যাদবের বাড়ি শোবার জন্য। সে নাকি বিশ্বাসী লোক। আরে বুঝি সব। খুব দুধ দই চালাচ্ছে সেখানে রোজ রাতে। দেখলি না কত কটা করে ভাত খেল এখানে। তোরাও মহাৎমাজীর কাজ করেছিস, আমরাও মহাৎমাজীর কাজ করেছি। তবু দুধ দইটার বেলায় শুধু তোরাই থাকবি কেন? নিজেরা গান্ধী জওয়াহর সব ভাল নাম নিয়ে নিল। ওরে আমার ভাল নাম লেনেওয়ালারে! জেলের মধ্যে কত কাণ্ডই দেখেছি। এইসব মহাৎমাজীর চেলাদের।… বিসুন শুকলা করনজাহা ইউনিয়ন বোর্ড পুড়িয়েছে। কেন জানিস তো? টাকা খেয়েছিল ইউনিয়ন বোর্ডের। তাই হিসাবের খাতাপত্তরগুলো নষ্ট করে দিল। এই আজাদ দস্তার নামে নেওয়া চাঁদার টাকাও খাবে ওই দশভূতে মিলে। এ আমি বলে রেখে দিলাম দেখে নিস। চাঁদা আর বলিস না ওকে।

নিজের তর্জনীটি বেঁকিয়ে বন্দুকের ঘোড়া টিপবার মুদ্রা দেখায়।…এই এরই ভয়ে। নইলে কেউ উপড়হস্ত করত?…দ্যাখ না, আর কয়েক দিন। রেলগাড়ি আবার চলতে আরম্ভ হয়েছে। এই টাকার থলে নিয়ে নিয়ে সব বেরুবে কাজের নাম করে।

আসল রাজনীতির এই প্রথম পাঠ নিতে নিতে ঢোঁড়াই হাই তোলে। বিসুনি কেওট বলে, খুব থকে আছিস, না ঢোঁড়াই? কাল সারাদিন সারারাত হেঁটেছিস।…গান্ধীটা সুশীলার [৫৪৯] দলের কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সুশীলা আর কামিনী দুই সতীন জানিস তো। একজন যদি বলে পুবে যাবার কথা, আর একজন বলবে পচ্ছিমে। কত বলে দেখেছি এসব জেলে। একদল যদি বলে মাংস খাব, আর একদল বলবে আণ্ডা খাব!… বুঝলি ঢোঁড়াই! ঘুমিয়েছে শ্বশুরটা…

পরদিন সকালে খোঁজ পড়লে দেখা যায় কার্তুজগুলোর একটাও নেই। বিসুনি কেটেরও কোনো পাত্তা নেই। বন্দুকগুলোর মধ্যে একটা মাত্র গিয়েছে। মহাৎমাজীর কাজের সে ক্ষতি করতে চায় না। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটা জিনিসও নেয়নি। রামরাজ্য স্থাপনের কাজে অবহেলা করবার কলঙ্ক প্রথম দিনই ঢোঁড়াইয়ের উপর পড়ে। দুদিন খাওয়া বন্ধর সাজা সে মাথা পেতে নেয়।

[৫৪৫. আজাদ-দস্তার শব্দগত অর্থ স্বাধীন দল। ৫৪৬. গুপ্তচর। ৫৪৭. বড় বড় কথা বলিস না। ৫৪৮- জিরানিয়া জেলার গ্রাম্য মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা সোস্যালিস্ট ও কমুনিস্ট দলকে সুশীলা ও কামিনী বলে বিদ্রূপ করে।]

.

স্বর্গের সোপানের সন্ধান লাভ

ঢোঁড়াইয়ের সবচেয়ে ভাল লাগে সর্দারকে। কনৌজী ব্রাহ্মণ! ভারি ঠাণ্ডা স্বভাব। পূজো করে, রামায়ণ পড়ে। সকালবেলায় দু-ঘণ্টা করে ড্রিল করায়। তারপর সারা দিন ছুটি। ছোট ছোট দলে কোথাও তাস, কোথাও দশ-পঁচিশ খেলা। প্যাটেল, গান্ধী আর জওয়াহর সফরে বাইরেই বেশি থাকেন। কে কোথায়, কেন যাচ্ছে, সেসব খবর ঢোঁড়াই রাখে না। সে খুশি যে, সর্দার বলেছে তাকে এক বছরের মধ্যে রামায়ণ পড়া শিখিয়ে দেবে। মুখস্থ তোমার যখন আছেই ঢোঁড়াইজী, তখন হয়তো এক বছরও লাগবে না।

এখন এতদিন সময় পেলে হয়।

ঢোঁড়াইয়েরও সেই ভাবনা। এরই মধ্যে একদিন জওয়াহর তাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বলেছিলেন যে, ঢোঁড়াইকে তাঁর ভারি পছন্দ। সে যদি রাজী থাকে, তাহলে তিনি তাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতে পারেন, নিজে হাতে তাকে কাজ শেখানোর জন্য। তাহলে তিনি ঢোঁড়াইকে দল থেকে একটা নাম দেওয়ানোরও ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। ইস্কুলিয়াদের [৫৪৯] মধ্যে কেউ হলে এ-প্রস্তাবে হাতে চাঁদ পেত। কিন্তু ঢোঁড়াই রাজী হয়নি। বর্ণ পরিচয়ের অক্ষর তো নয়, রামায়ণের স্বর্গে উঠবার এক-একটা সিঁড়ি।

সেই পিছল সিঁড়িতে হাত ধরে টেনে তুলছে তার মতো অযোগ্য লোককে সর্দার।

দলের প্রত্যেকেই জওয়াহরের সান্নিধ্য চায়। তাই তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, ঢোঁড়াই তার অনুরোধে প্রত্যাখ্যান করবে। সই দিন থেকে তিনি ঢোঁড়াইয়ের পিছনে লেগেছিলেন। কোথাও দূরে চিঠি পাঠাতে হলে ঢোঁড়াইয়ের উপরই সেই ডিউটি পড়ত। এটা দলের সবাই লক্ষ্য করেছিল। তবে সুবিধের মধ্যে জওয়াহর বাইরেই থাকতেন বেশি। সেই সময়টার জন্যেই ঢোঁড়াই অপেক্ষা করে থাকত। মিলিটারি ড্রিল করালে কী হবে, সর্দার ভাবপ্রবণ লোক। সে ঢোঁড়াই য়ের দরদী মনের মধ্যে এমন একটা জিনিসের সন্ধান পেয়েছিল, যা সে দলের আর কারও মধ্যে পায়নি।

ঢোঁড়াই গান্ধীকে ব্যাপারটা বলেছিল। সে বলে, খুব ভালো করেছিস, জওয়াহরের সঙ্গে না গিয়ে। ও তোকে কাপড় কাঁচানো আর বিছানা বওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। ইস্কুলিয়ারা সে কাজ করবে না বলে তাদের বলেছি। কাজ শেখাতে না ছাই। সব বেলনায় বেলা আছে আমার। জানি তো ওকে আমি। স্লোড়াইয়ের আর তর সয় না। গান্ধী, তোমরা তো প্রায়ই পাটনা-ভাগলপুর-মুঙ্গের যাও। আমার জন্য একখানা রামায়ণ কিনে এনো।

সর্দার বলে, হবে, হবে। ঠাকুরদা মরবে তবে তো বলদ ভাগ হবে! এত হড়বড় কিসের?

 বুঝলে না সর্দার, হবে তো ঠিকই। তবে কিনা আগে থেকে কেনা থাকবে…।

তার মনে হয় যে, এখনই যদি কেনা না হয়, তাহলে আর কখনও কেনা হয়ে উঠবে না।

আমার রামায়ণখান দিয়ে চলবে না?-সর্দার হেসে ঢোঁড়াইকে জড়িয়ে ধরে। গান্ধী, কাল তো জামালপুর যাচ্ছ তুমি। নিয়ে এসো একখান রামচরিত মানস কিনে ঢোঁড়াইজীর জন্য।

মনে থাকলে আনব।

সে রাতে ঢোঁড়াই ঘুমোয় না। ধন্য রামচন্দ্রজী, যিনি তাকে এই পথে নিয়ে এসে ছিলেন। চিরকাল তিনি তার উপর সদয়। আগে থেকে তার ইচ্ছেটা বোঝা যায় না, তাই লোকে ভুল করে। রামায়ণখান হবে তার একেবারে নিজের। ঠিক নিজের জমির মতো, নিজের ছেলের মতো।…দূর ভুখনাহাদিয়ারায় একটা আলো দেখা যাচ্ছে; ঠিক তারার মতো দেখাচ্ছে। চরার ক্যায়া-গোলাপের জঙ্গলের মধ্যে তিতির পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। খয়ের আর বাবলা গাছগুলোর নিচের জলের ভাপসা পচা গন্ধটাও মিষ্টি লাগছে। কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, কোনো সমাজের চাপ নেই এখানে। বামুন সর্দার এখানে তার সঙ্গে বসে ভাত খায়। সমুখে মহাৎমাজীর রামরাজ্য স্থাপন করবার কাজ নিশ্চয়ই আছে। কী, তা সে জানে না। ইস্কুলিয়ারাও জানে না। দলের মাথাদের জিজ্ঞাসা করলে বলে, হবে, হবে! আর কদিন সবুর কর না। তা নিয়ে ঢোঁড়াইয়ের বিশেষ দুশ্চিন্তাও নেই। তার উপর যা হুকুম হবে, সে তাই করবে। …ততদিনে তার রামায়ণ এসে যাবে। তার বটুয়ার মধ্যে সাগিয়ার ছেলের মালাটা ছাড়া এক টাকা তিন আনা আছে। শেষ রাতে যখন গান্ধী রওনা হবে, তখন তাকে এগিয়ে দেওয়ার ছুতো করে, খানিকটা পথ তার সঙ্গে যাবে সে। তারপর চুপিচুপি এই এক টাকা তিন আনা তাকে দেবে; রামায়ণের দাম। মহাৎমাজীর পয়সায় কেনা রামায়ণ নিলে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে না?

যেদিন গান্ধী ফিরে এল জামালপুর থেকে, সেদিন দলের কারও মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না। রাতে চৌকিদার এসে খবর দিয়ে গিয়েছিল যে, জওয়াহর পুলিশের কাছে সারেন্ডার করেছেন। তার বাবাকে জেলে ধরে নিয়ে গিয়েছিল; তাই আর তিনি থাকতে পারেননি।

গান্ধী বলে, বন্দুক-পিস্তল আসতে আরম্ভ করেছে দেখে ঘাবড়েছে। ঘরে থুথু ফেলা বারণ, এই প্রচারের কাজ যদি আজাদ দস্তা করত, তাহলে জওয়াহর থাকত এখানে। হারামী।

প্যাটেল বলে, ছুতো খুঁজছিল পালাবার। কায়ের। [৫৫০]

আজাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, জওয়াহর একটা পুলিশের খফিয়া [৫৫১]। আবার দলের সকলকে না ধরিয়ে দেয়। গোরু একবার যখন উখলিতে মুখ দিয়েছে, তখন কি আর কিছু না খেয়ে ছাড়বে?

এই আবহাওয়ার মধ্যেও ঢোঁড়াইয়ের মন পড়ে রয়েছে গান্ধীর ঝোলাটার উপর।

অনেকক্ষণ উশখুশ করবার পর সে আর থাকতে পারে না। গান্ধীর গা ঘেঁষে গিয়ে বসে, যদি তাকে দেখে রামাণের কথাটা মনে পড়ে। সর্দার গান্ধীর ঝোলাটার খুলে লাল রঙের পকেট রামায়ণ বার করে দেয় ঢোঁড়াইয়ের হাতে। কী ঠাণ্ডা রামায়ণখান। ঢোঁড়াইয়ের হাতে কাঁপুনি ধরে গিয়েছে। গান্ধী যে তার দিকে কটমট করে তাকাল, সেদিকে তার খেয়ালও নেই।

[৫৪৯- ইস্কুল কলেজের ছাত্র। ৫৫০. কাপুরুষ। ৫৫১. গুপ্তচর।]

.

ক্রান্তিদলে ঢোঁড়াইয়ের নতুন নামকরণ

আজাদ দস্তার নাম ক্রান্তিদল হয়ে গিয়েছে। না হলে ভাগলপুর মুঙ্গের জেলার দলগুলো সাহায্য পাওয়া যাচ্ছিল না। জামালপুর থেকে পিস্তল আর কার্তুজ তৈরির সরঞ্জাম এসেছে, মুঙ্গের থেকে মিস্ত্রি এসেছে। মাচার উপর পাটনা থেকে আনা ইস্তাহারগুলো ইস্কুলিয়ারা দিনরাত বসে বসে নকল করছে। প্যাটেল মন্ত্রী হয়েছে এখানকার ক্রান্তিদলের। কাছাকাছি বাবলা গাছের গুঁড়িগুলো পিস্তল ছোঁড়া অভ্যাস করবার ঠেলায় মৌমাছির চাকের মত দেখতে হয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো জায়গায় দলের কেন্দ্র হয়েছে। নিত্যি নতুন নতুন ইস্কুলিয়া আসছে দলে ভর্তি হতে। কতক বা চলে যাচ্ছে নেপালে।

 সবচেয়ে বড় কথা, ঢোঁড়াই নতুন নাম পেয়েছে। তার নাম হয়েছে রামায়ণজী। সর্দারই প্রস্তাব করে! গান্ধীর এ নামে আপত্তি ছিল। সে বলেছিল যে, এখনও অনেক লীডারের ভাল ভাল নাম বাকি রয়েছে। ক্রান্তিদলে আবার রামায়ণ-টামায়ণ আনা কেন? কিন্তু তার কথা টেকেনি।

এখন আর নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসত নেই কারও। কাজের আর কথার অন্ত নেই। গল্পের মধ্যে যেমন লোকে অজানতে চলে যায় এক কথা থেকে অন্য কথায় তেমনি এরা যায় এক কাজ থেকে অন্য কাজে।

ছোট বড় কাউকে ছেড়ে কথা বলা হয় না প্রাত্যহিক মিটিনে, মন্ত্রীকে পর্যন্ত না। সেদিন মিটিনে প্যাটেলের দল গান্ধীর দলকে হারিয়ে দিয়েছিল হাফপ্যান্ট কাচবার ব্যাপার নিয়ে। আজকাল সকলের উর্দি হয়েছে খাকির হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট। প্যাটেল বলেছিল খাকির হাফপ্যান্ট আবার কাঁচানো! ও কি ময়লা হয়! নেহাত দরকার পড়লে, মাসে একবার কাঁচলই যথেষ্ট। গান্ধীর দল বলেছিল এতবড় একটি ব্যাপারে দল থেকে নির্দেশ দেওয়া ঠিক হবে না। আজাদ গান্ধীকে সমর্থন করেছিল। কাপড়কাঁচা সাবানের খরচ কমানোর আগে, পান-জর্দার খরচ কমানোর দরকার।

ভোটে হেরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীর দলের একটা ছোকরা চেঁচিয়ে বলে, পানের খরচ যার চোখে বেঁধে, নিজের হাতের ঘড়িটা কি তার নজরে পড়ে না? আবার মিটিনে নতুন করে সাড়া পড়ে যায়। দলের পিরথিলাল পুলিশের কাছে যাতায়াত করত। তাই সেটাকে দিনকয়েক আগে খতম করে দেওয়া হয়েছিল। কুশীতে ফেলবার আগে আজাদ লাশটার হাত থেকে রিস্টওয়াচটা খুলে নেয়।

কেড়ে নেওয়া হোক ওর নামটা।

এই নিয়ে বাদানুবাদ যখন বেশ জমে এসেছে, আজাদ উঠে দাঁড়ায়। নাটকীয় ভঙ্গিতে দুহাত দিয়ে পড় পড় শার্টটা ছিঁড়ে ফেলে। আনাবৃত বুকটায় একটা চাপড় মেরে বলে, বুক চিরে যদি দেখান যেত তাহলে দেখাতাম আমার মনের মধ্যে কী ছিল….

প্যাটেলের মুকাঠিন্য নরম হয়ে এসেছে। দেখি দেখি আজাদ, বুকের সেই চিতি সাপ লাগবার জায়গাটা। ঘা হয়নি তো দেখছি।…।

সঙ্গে সঙ্গে সকলের নজর গিয়ে পড়ে সেই দিকে। দিনতিনেক আগে হামিদপুরে আজাদ যেখানে শুয়েছিল, মিলিটারি ঘেরাও করে সেই পাড়াটা। একখানা পুরনো চালা মাটিতে নামনো ছিল। আজাদ তারই নিচে উপুড় হয়ে সারারাত কাটিয়েছিল। সকালে সে নাকি দেখে যে, একটা চিতি সাপ চেপটে মরে রয়েছে তার বুকের নিচে। কে যেন বলে, খানিকটা আমের আঠা লাগিয়ে নিলি না কেন বুকে?

আমের আঠার কথাটা ওঠায় হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে বিসকান্ধার লোকে খবর দিয়ে গিয়েছে যে, ঠিকাদার দু-একদিনের মধ্যে আম চালান দেওয়া আরম্ভ করবে। বাগানে বসে ঝুড়ি বুনছে।

 ফলার খাবে রে, আসামের ফৌজে। চল চল। এখনই।

ঘোড়ায় চড়ে উর্দিপরা ক্রান্তিদল চলে। বাগানে পৌঁছুতে ঠিকেদার বলে, এখন হাতে পয়সা নেই। আর দিনকয়েক পরে আমটা বেচেই আমি হুজুরদের খুশী করব। আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব।

তার গলার টুঁটি চেপে ধরে আজাদ। শালা, পিটিয়ে তো শরীর ঢিলে করে দেব। খুশী যা করবে সে আমরা জানি। আমটা পাড়বার পরও তোমরা বসে থাকবে কিনা এখানে।

কোয়েরীটোলার আর সাঁওতালটোলার যে ছেলেকয়টি বাগান পাহারা দেবার কাজ নিয়েছে তাদের গাছে চড়িয়ে সব আম পাড়ানো হয়।

 বিলিয়ে দিও তোমাদের টোলায়।

ঠিকেদার আর চুপ করে থাকতে পারে না, হুজুররা আমার দোষ দেখছেন, আমি পচ্ছিমের লোক বলে। এই গাঁয়ের গিধর মণ্ডল যে কৌমী মোর্চার? [৫৫২] চাঁদা মাফ করিয়ে দেবে বলে, টোলা থেকে এক টাকা নিল তাকে তো কিছু বলেন না?

 গিধর মণ্ডল।

যারা আম পাড়ছিল তারা বলে কথাটা মিথ্যে নয়।

তবে আমাদের খবর দিসনি কেন?

 ওতে বার? [৫৫৩] বসায়নি আমাদের উপর। যেটা বসেছিল সেটাকে মাপ করিয়ে দিয়েছে।

তাঁকে মুখ ভেংচে ওঠে গান্ধী। আহাম্মক কোথাকার! মাপ করিয়ে দিয়েছে। এই, তোদের বলে রাখলাম, আমি বিলি করবার সময় সবাইকে আম দিবি, একে খবদ্দার দিস না।…

গিধর মণ্ডলের এই কাণ্ড। সকলের নাকের উপর।

আর এখানে সময় নষ্ট করা যায় না।

গিধরের বাড়ি যেতে যেতে মাঝপথে প্যাটেলের মনে পড়ে, যে হরিজনগুলো ঝুড়ি বুনছিল, তাদের আম দেওয়ার কথা তো ঐ গাছের ছোঁড়াদের বলা হয়নি। আবার ফিরে গিয়ে কথাটা বলে আসা হয়।

গিধর মণ্ডলের দেখা পাওয়া যায় না বাড়িতে। আঙুলে থেকে বার করা রক্ত দিয়ে একখানা কাগজে কী যেন লেখে গান্ধী। তারপর সেখানাকে আমের আঠা দিয়ে এঁটে দেওয়া হয় গিধরের বারান্দায়।

টোলার লোকেরা বলে ইনসান আলি আড়গড়িয়াকে বলেই গিধর বার মাফ করিয়েছিল। সে আজকাল সদরে থাকে কিনা। জিরানিয়া স্টেশনের কাছে ওর বেয়াইয়ের সঙ্গে মিলে বড় ঠিকাদারি কারবার খুলছে, সব হাকিমের সঙ্গে তার দোস্তি। সকলের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। হাতের কাছে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

প্যাটেল গর্জে ওঠে, এখানে থাকে না কেন ইনসান আলি?

 হুজুর, আপনার ভয়ে।

যাক! তবু মনটা একটু ঠাণ্ডা হয়।

রাজপুতটোলাতেও সাড়া পড়ে গিয়েছে। কেরন্টি। কেরান্টি। [৫৫৪] বাবুসাহেব লোটা নিয়ে বাইরে যাবার চেষ্টা করছিলেন। ধরা পড়ে যান। আসুন।

 পায়ের ধুলো পড়ল আপনাদের সকলের অনেকদিনের পর। গান্ধী কোমরের ভিতর থেকে একটা কালো রঙের রিভলবার বার করে খাটিয়ার উপর রাখে। ভাবে দেখাতে চায় যে কোমরের বেল্টটা আলগা করে দিয়ে একটু আরাম করে নিচ্ছে মাত্র। তারপর ফরমাশ করে, কাউকে কটা দাঁতন দিতে বললেন তো। ছটা নিমের, চারটে বাবলার।

এর ইঙ্গিত বাবুসাহেব বোঝেন। ও অনোখীবাবু, এরা সকাল থেকে কিছু খাননি, কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন আগে। ও আজাদ, আপনি তো ঘরের ছেলে। রান্নাঘরে ঠাকুরকে বলে আসুন না গোলমরিচ দিয়ে যেন রাঁধে; প্যাটেল আবার লঙ্কা খান না।

ক্রান্তিদলের সবাই হেসেই খুন। কোন যুগের দুনিয়ায় আছে ঐ বুড়োটা? সেই লঙ্কা খাওয়া বলন্টিয়রের জীবন কি আর ক্রান্তিদলেও চলে নাকি।

বাবুসাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকান সকলের মুখের দিকে। কিছুই তাল পাওয়া যায় না এদের কথাবার্তার। তাকে খাটিয়া থেকে উঠতে দেবে না, তার কারণটা তিনি বুঝতে পারেন…একসঙ্গে সকলে খেতে বসবে না, সেটার কারণও বোঝা যায়; তাদের পুরো বিশ্বাস পায় না, তাই দুজন পাহারায় থাকে। কিন্তু এদের হাসি, এদের রাগ, এদের চাউনি, এদের কথাবার্তা সব বদলে গিয়েছে। দলের প্রায় বেশির ভাগ লোকই তাঁদের আগেকার জানা। তারা কী করে এই কদিনে বদলে গেল। কোয়েরটোলার ঢোঁড়াইয়ের পায়ে জুতো উঠেছে, শু জুতো। লোেটা নিয়ে ময়দানে যাবে, তাও পায়ের জুতো খুলবে না।…জাতের লোক বাঁচিতর সিং,গাঁয়ের লোক ঢোঁড়াই, কত পরিচিত বলন্টিয়র, ভোপতলাল! এখন এদের সম্মুখে আসতে ভয় করে।..

পান জর্দা খাওয়ার সময় প্যাটেল কাজের কথা পাড়ে। আর সিংজী, আপনি তো লাল হয়ে গেলেন যুদ্ধের বাজারে।

কী যে বলেন আপনারা।…উদবেগে বাবুসাহেব মাড়ি দিয়ে জিবটা একবার চিবিয়ে নেন। এ কী জুলুম! এই তো কালই নিয়ে গিয়েছে তিনশ টাকা। আবার সরকারী হাকিমও এসে নিয়ে গেল চারশ টাকা কিসে যেন চাঁদা বলে, গত রবিবারে। দুদিক থেকে জুলুম পাবলিসের উপর।…

দেখুন প্যাটেলজী, আমি কি আর আপনাদের বাইরে নাকি? কালই তো বিসুনি এসে নিয়ে গিয়েছে ক্রান্তিদলের জন্য তিনশ টাকা। আপনারা বলেন তো রোজই দিতে হবে, কিন্তু…

 কোন বিসুনি? বিসুনি কেওট? কে বলল ও জাতিদলের লোক?

সকলেই তো তাই জানে। উর্দি আছে, বন্দুক আছে, জুতো আছে। কাল এখান থেকে গিয়েছিল রামনেওয়াজ মুন্সির ওখানে। এখনও হয়তো সেটা ওখানে আছে।

তাই নাকি? দশজোড়া চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। এখনো হয়তো ধরা যেতে পারে শয়তানটাকে। জলদি! দস্তা! এক কাতার। [৫৫৫]

ধুলোর ঝড় বইয়ে আপদ বিদায় হল বাবুসাহেবেদের বাড়ি থেকে। এখন কেবল সরকারের কানে না গেলে হল যে, ক্রান্তিলকে তার বাড়িতে খেতে দিয়েছেন আজকে। শান্তি আর নেই পাবলিসের।

 দৈবক্রমে বিসুনিকে রামনেওয়াজ মুন্সির বৈঠকখানাতে পাওয়া যায়। রামনেওয়াজ মুন্সির কাছে থেকেও সে তখনই দুশ টাকা নিয়েছে।

আজাদ প্রথমেই গিয়ে তার বন্দুকটা কেড়ে নেয়। একটাও কার্তুজ পাওয়া যায় না তার কাছে। সে বলে ফুরিয়ে গিয়েছে।

দস্তা। এক কাতার!

টানতে টানতে বিসুনি কেওটকে নিয়ে যাওয়া হয় গাঁয়ের বইরে, পামারসাহেবের নীলকুঠির দীঘির ধারে। একটা বাদাম গাছে বাঁধা হয় তাকে। বিসুনি চিৎকার করে কাঁদে। আর কখনও সে এমন কসুর করবে না, মহাৎমাজীর নামে ছেড়ে দাও, অনেক জমানো টাকা আছে তার, সে দেবে ক্রান্তিদলকে, দুটো নাবালক ছেলে অনাথ হবে, তোমরাও ছেলেপিলের বাবা…

ক্রান্তিদলের লোকেরা এসব অনেক শুনেছে। রামায়ণজী আর থাকতে পারে না। সে প্যাটেলের হাত চেপে ধরে।

না না, এটাকে প্রাণে মেরো না। আমার কথা রাখো। গান্ধী বিরক্ত হয়। এই জন্যই তো এসব কাজে রামায়ণজীকে আনতে বারণ করি।

এর কি ঠিক ছিল নাকি? আগে থেকে জানব কী করে?

সকলেই ভাব দেখায় যে তারা রামায়ণজীর দুর্বলতায় বিরক্ত। অথচ রামায়ণজীর কথায় তাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। তারা নিজেদের ঢাকতে চায় কঠোরতার আবরণে; নইলে দলের মধ্যে কায়ের (কাপুরুষ)। বলে দুর্নাম হয়ে যাবে। এর চেয়ে বড় দুর্নাম দলের মধ্যে নেই, এক কেবল খুফিয়া (গুপ্তচর) কথাটা ছাড়া। এরা সবাই সব সময় ক্রান্তিকারী বলে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়; যে যত নিষ্ঠুর সে তত ক্রান্তিকারী, যে যত বেপরোয়া সে তত ক্রান্তিকারী, যে যত মুখখিস্তি করতে পারে সে তত ক্রান্তিকারী, খাওয়ার সময় যে যত উদ্দণ্ডতা দেখাতে পারে সে তত ক্রান্তিকারী; আরও অনেক কাজ, হাবভাব থেকে দলের সাধারণ অশিক্ষিত সদস্যরা অন্য লোকের ক্রান্তির কাছে যোগ্যতার সম্বন্ধে বিচার করে।

দশজোড়া বিদ্রূপভরা চোখ পড়েছে রামায়ণজীর দিকে। এখনও লজ্জায় মিশে গেল না। রাময়ণজী। না না, প্যাটেল, একে অন্য কোনো সাজা দাও। তখন বাধ্য হয়ে বিসুনির উপর লঘুদণ্ডের আদেশ দেয় প্যাটেল।

ক্ষিপ্রহস্তে আজাদ হাফপ্যান্টের পকেট থেকে আম আর নখ কাটবার ছুরিটা বার করে। মানুষের নাকের মাংস যে এত শক্ত তা ক্রান্তিদলে আসবার আগে করাও জানা ছিল না। আজাদ এ-কাজে বিশেষজ্ঞ। পরিত্রাহি চিৎকার করছ বিসুনি কেওট। বলুক তাকে সকলে ভীরু। এ আর দেখা যায় না, রাহায়ণজী চোখ বুজে ফেলে।

 আবার ঘোড়ার পিঠে চড়বার সময় রামনেওয়াজ মুন্সী ছুটতে ছুটতে এসে বলে যায় যে, বিসুনির কাছ থেকে পাওয়া দুশ টাকা যেন তাঁর চাঁদা বলে লিখে নেওয়া হয়…না, না, একেবারে রজিস্টারের সত্যিকারের লেখা নয়- তারাও ছা-পোষা মানুষ… এই মনে করে রাখবেন আর কি, আমার নামে টাকাটা, প্যাটেলজী…বেলা পড়ে আসছে। রামায়ণজীর কর্মব্যস্ত জীবনে একদিনের প্রোগ্রাম শেষ হয়। এখনও হয়তো। আর একটা নতুন কিছু মনে পড়ে যেতে পারে গান্ধীর না হয় প্যাটেলের।…

শ্রান্ত দেহ আর মন নিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে পর্যন্ত ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে হয় পথের পাশেই শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঢোঁড়াইজী জানে রাতের আঁধারে চৌকিদারের দেওয়া দিহাত এর [৫৫৬] পুলিন্দাগুলো মাথায় দিয়ে সার সার যখন সকলে শুয়ে ঘুমোবার ভান করে, তখন সবাই মনের কাছে হিসাব খতিয়ে দেখে। আর সকলে অস্বীকার করুক, রামায়ণজী করবে না। সাঁইবাবলার বনে বৌকাবাওয়ার দীর্ঘনিঃশ্বাস বয়ে যায়, তারাগুলোর নিষ্পলক চাউনিতে মনে পড়ে একজনের কথা, আকাশের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া হিমে ভিজে ওঠে ধোঁয়ার দাগে ভরা বন্দুকের নলটা পর্যন্ত, তখন কি ঘুম আসতে পারে রামায়ণজীর।…আবার কাল ভোর হতে না হতেই হয়তো কত জমা করা কাজের কথা মনে পড়ে যাবে এদের। এই নিত্য নতুন পোরোগারেমের মধ্যে এত একঘেমিও কি থাকতে পারে।

 অন্ধকার গাখানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সর্দার বলে ঐ শোন শোন কী বলছে। পাশের খড়ের ঘরখানার ভিতর মা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে।

খোকন!
 এতগুলো ভাত খাবে?
কেরান্টিতে যাবে?
ওরে হাতি দাম দে
ঘোড়ার লাগাম দে।
কেরান্টিতে কাম দে। [৫৫৭]

গান্ধী বলে, দেশে আর ছাগল চরাবার লোক জুটবে না রে এর পর।

তার রসিকতায় কেউ হাসে না। একজন অপরিচিতা মায়ের ক্রান্তিদলের উদ্দেশে দেওয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি রামায়ণজীর মনের অবসাদ মুছে দেয়। তাদের অসাক্ষাতে বলা বলেই কথাটার দাম এত। তাহলে হয়তো তারা মহাৎমাজীর কাজ কিছু কিছু করছে! লোকে তাহলে তাদের অনেক উঁচুতে মনে করে- ক্রান্তিদলের জাতকে। কনৌজী ব্রাহ্মণ হলে নিশ্চয় এই রকমই মনে হয়। একবার জিজ্ঞাসা করে দেখলে হয় সর্দারকে।

[৫৫২. ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্ট। ৫৫৩. ওয়ার লোন; ৫৫৪. সাধারণ লোকে ক্রান্তিদলকে কেরান্টি বলত। ৫৫৫. দলের সকলকে লাইন বেঁধে তৈরি হবার জন্য হুকুম। ৫৫৬. বিহার গভর্নমেন্টের প্রচারপত্র। ৫৫৭. আগে ঘুমপাড়ানি ছড়া ছিল: এতগুলো ভাত খাবে-ছাগল চড়াতে যাবে?-ইত্যাদি।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *