১-২. হঠাৎ একটা বড় গাড়ি

মৌ – প্রেমের উপন্যাস – নিমাই ভট্টাচার্য

০১.

হঠাৎ একটা বড় গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামতেই মৌ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকায়। তারপর ভদ্রলোককে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই ও পিছন ফিরে চিৎকার করে, ও মা, শান্তদা এসেছে।

মৌ তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই দেখে মা দু’হাত দিয়ে শান্তদাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, এতকাল পরে তোর আমাদের কথা মনে পড়ল?

ভাল মা, তুমি শুনলে অবাক হবে ক’টা বছর কিভাবে কাটিয়েছি। কেন কী হয়েছিল?

ঘরের ভিতর থেকে বিমলবাবু গলা চড়িয়ে বলেন, অনু, কার সঙ্গে কথা বলছ?

মৌ গলা চড়িয়ে বলে, বাবা, শান্তদা এসেছে।

শান্ত এসেছে?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

শান্ত বলে, ভাল মা, চল, ভাল কাকার কাছে যাই।

হ্যাঁ, চল।

ও ঘরে ঢুকেই শান্ত বিমলবাবুকে প্রণাম করে।

বিমলবাবু দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে কপালে স্নেহ চুম্বন দিয়ে বলেন, ক’দিন ধরেই তোর আর মৌয়ের ছবিটা দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম, এতদিনে তুই কত বড় হয়েছিস, কী করছিস, কোথায় আছিস এইসব আর কি!

অনুপমা দেবী বলেন, তুই দাদার মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলি কিন্তু তোর মা কেমন আছে তা তো জানাস নি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ সব বলছি। তার আগে এক কাপ কফি তো খাই।

হ্যাঁ, বাবা, এখনই দিচ্ছি।

মৌ বলে, মা তোমরা কথা বল, আমি কফি করে আনছি।

শান্ত ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, ভাল না হলে কিন্তু তুই আমার কাছে মার খাবি।

এখনও মারামারি করার অভ্যাস যায়নি তোমার?

তোর সঙ্গে মারামারি আর ঝগড়াঝাটি করেই বড় হয়েছি। সে অভ্যাস কী কখনও যায়?

মৌ হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

মৌ চলে যেতেই শান্ত বলে, এখানে থাকতে থাকতেই আমি আই-আই-এম’ এর এনট্রান্স পরীক্ষা দেবার সপ্তাহখানেক পরই বাবা নাগপুর বদলি হলেন।

অনুপমা দেবী বলেন, তোরা ওখানে যাবার মাসখানেক পরই তো তোর মায়ের ইউট্রাস রিমুভ করা হয়, তাই না?

হ্যাঁ, ভাল মা; তবে ওই অপারেশনের পরই মা-র কিছু না কিছু প্রবলেম শুরু হল।

আমি জানি, এই অপারেশনের পর অনেকেরই অনেক সমস্যা শুরু হয়।

শান্ত বলে, ভাগ্যক্রমে আমি আই. আই. এম আমেদাবাদে জয়েন করার আগেই মা বেশ ভাল হয়ে গেল।

মৌ দু’কাপ কফি এনে বাবা আর শান্তকে দেয়।

কফির কাপে চুমুক দিয়েই শান্ত হাসতে হাসতে বলে, মৌ, তুই তো দারুণ কফি করেছিস।

আমি তো তোমার মতো অকর্মণ্য না।

বিমলবাবু একটু হেসে বলেন, ওরে মৌ, যে ছেলে আমেদাবাদ আই. আই. এম থেকে এম. বি. এ করেছে তাকে তুই অকর্মণ্য বলছিস?

ও এম. বি. এ হয়েছে তো কী হয়েছে? আমিও তো এম. এ পাস করেছি।

কী যে বলিস তুই!

শান্ত বলে, ভাল কাকা, মৌ-এর কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন।

মৌ ওকে বলে, তুমি এই ঘর থেকে বেরোও, তারপর তোমাকে দেখাচ্ছি।

মৌ ওই ঘর থেকে চলে যায়।

শান্ত, তোর মা-র কথা বল।

হ্যাঁ, ভাল মা, বলছি।

বিমলবাবু বলেন, তোর বাবা যখন মারা যান, তখনও কী তুই আই. আই. এম-এর ছাত্র?

আমি আই. আই. এম থেকে বেরুবার আগেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে একটা বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাঙ্কে চাকরি পাই।

তারপর?

ওই ব্যাঙ্কে কাজ করতে শুরু করার ঠিক তিন দিন পরই বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।

কী আশ্চর্য!

জানেন ভাল কাকা, কেন জানি না, আমার মনে হল এই ব্যাঙ্কে কাজ করলে আমার ভাল হবে না। বাবা মারা যাবার পরদিনই আমি ওই ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিলাম।

হ্যাঁ, এইরকম মনে হয় বৈকি।

অনুপমা দেবী বলেন, এবার তোর মা-র কথা বল।

হ্যাঁ, ভাল মা, বলছি।

মুহূর্তের জন্য থেমে শান্ত বলে, বাবা মারা যাবার বছর খানেক পরের কথা। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, মা শুয়ে আছে।

.

মা, তুমি শুয়ে আছো কেন?.

আমার পেটে খুব জ্বালা করছে; তাছাড়া দু’বার পটি করতে গিয়ে শুধু রক্ত বেরুলো।

সেকি?

হ্যাঁ, তাই তো ভাবছি, পেটে আলসার-টালসার হল কিনা।

তুমি চিন্তা করো না, আমি এখনই ডাঃ পাতিলকে আসতে বলছি।

অনুপমা দেবী বলেন, ডাঃ পাতিল ওকে দেখে কী বললেন?

উনি তিন দিনের ওষুধ দিয়ে বললেন, এই ওষুধে যদি পেটের জ্বালা আর ব্লিডিং বন্ধ না হয় তাহলে আমি ডাঃ কেশকারকে রেফার করব।

কোন ডাঃ কেশকারের কথা বলছেন? যিনি ক্যান্সার স্পেশালিস্ট নাকি…

হ্যাঁ, ওই ডাঃ কেশকারকেই রেফার করব।

তোর মা-র কি ক্যান্সার হয়েছিল?

হ্যাঁ, মা-র ক্যান্সারই হয়েছিল।

ইস!

তবে ভাল মা, একটা অপারেশনের পরই মা-র পেটের জ্বালা চলে যায়। মাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারত না মা সর্বনাশা রোগে ভুগছেন।

ও ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করতে পারত?

জীবনের শেষ তিন বছর মা শুধু লিকুইড খেতেন।

তারপর?

হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, মা হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর বেশ কষ্ট করে বললেন, নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আর বুকের ডান দিকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।

ডাঃ কেশকারকে খবর দিলি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করলাম।

উনি কী বললেন?

ডাঃ কেশকার খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোধহয় তোমার মা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।

শান্ত একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, জানো ভাল মা, ডাঃ কেশকারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখার পরই..

না। শান্ত কথাটা শেষ করতে পারে না।

হঠাৎ সবাই চুপচাপ; কারুর মুখেই কোন কথা নেই।

একটু পরেই মৌ ও ঘরে এসে বলে, ও মা, খেতে দেবে না? বড্ড খিদে লেগেছে।

শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাল, আমিও হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে আসি নি।

হ্যাঁ, চল। তোদের দু’জনকে খেতে দিচ্ছি।

খেতে খেতেই শান্ত বলে, হ্যাঁরে মৌ, এখন কী করছিস?

মৌ হাসতে হাসতে বলে, এম. এ. আর রিসার্চ করার পর আমি ভগবান বুদ্ধের উন্নততর বামফ্রন্টের উন্নততর বেকার।

ওর কথায় শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।

বিমলবাবু ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, ওর একটা চাকরি হলে বড়ই ভাল হত। গভর্নমেন্ট যেভাবে ইন্টারেস্ট রেট কমিয়েছে, তাতে আমার মতো রিটায়ার্ড লোকেরা সত্যি বিপদে পড়েছে।

মৌ বলে, শান্তদা, তুমি কোন হোটেলে উঠেছ?

তাজ বেঙ্গলে।

তার মানে ইউ আর রিয়েলি এ বিগ বস!

হঠাৎ আমার পিছনে লাগলি কেন?

সোজা কথা, আমাকে একটা চাকরি দাও।

সত্যি চাকরি করবি?

তবে কী তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি?

একটু চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, আমাদের চাকরিতে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হবে, তাতে কোন আপত্তি নেই তো?

বাইরে মানে?

দু’চার মাস অন্তর আমাদের বোম্বের হেড অফিসে আসতে হবে। তাছাড়া তোকে মাসে একবার করে শিলং, গুয়াহাটি, গ্যাংটক, কাঠমাণ্ডু আর থিম্পু যেতে হবে।

মৌ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, রিয়েলি?

তবে কী আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করছি?

ওইসব জায়গায় গিয়ে কোথায় থাকব?

ভাল হোটেলেই থাকবি।

মাইনে কত পাবো?

দুতিন শো’র কম হবে না।

শান্তর কথা শুনে বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী হেসে ওঠেন।

মৌ বলে, অত টাকা মাইনে পেলে আমার মাথা ঘুরে যাবে।

যাইহোক তুই কী এখন আমার সঙ্গে যাবি?

তাজ-এ লাঞ্চ খাওয়াবে?

শুধু লাঞ্চ কেন, তোকে ডিনারও খাওয়াব।

এবার মৌ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, মা, যাব?

শান্তর সঙ্গে যাবি তা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে।

মৌ হাসতে হাসতে বলে, শান্তদা একটু দাঁড়াও; একটু সেজেগুজে আসি।

প্রায় আধঘণ্টা পরে মৌ নীচে নেমে আসতেই শান্ত ওর চোখের পর চোখ রেখে বলে, মাই গড! তোকে কি দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে!

আমাকে সব সময়ই সুন্দর দেখায়।

তুই এত অহংকারী?

অহংকারের কী আছে? যা সত্যি তাই বললাম।

ভাল মা, ধন্য তোমার মেয়ে, ধন্য তার রূপ!

.

০২.

সে অনেক দিন আগেকার কথা।

পুজোর ছুটিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মতো ওরাও পুরী গিয়েছেন; উঠেছেন পুরী হোটেলেই। দুপুরে খেতে গিয়েই দেখা গেল, ওই দূরে কোনার দিকে একটা টেবিলই খালি আছে; আর সব টেবিলে আবাসিকরা খাওয়া-দাওয়া করছেন।

বিমলবাবু বললেন, অনু, চল, ওখানেই বসি।

একটা অল্পবয়সী ছেলে দুটো গেলাসে জল দিয়ে একটা জলের জাগ রেখে চলে গেল।

এখানে কী আমরা বসতে পারি?

বিমলবাবু আর অনুপমা তাকিয়ে দেখেন, প্রায় ওদের বয়সীই এক দম্পতি।

হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন।

বিমলবাবু একটু হেসেই বলেন।

ওদের দু’জনের মুখোমুখি বসেই মনিকা দেবী অনুপমা দেবীকে বলেন, আপনারা বোধহয় আমাদের পাশের ঘরেই আছেন, তাই না?

অনুপমা দেবী কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়েই একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, তাইতো। পাশের বারান্দায় আপনাদের দুজনকেই দেখি।

আমরাও তো আপনাদের দেখি।

ওরা চারজনেই না হেসে পারেন না।

আমি অপূর্ব সরকার আর আমার স্ত্রী মনিকা।

আমি বিমল চৌধুরী আর আমার স্ত্রী অনুপমা।

আমরা কলকাতায় থাকি; আপনারা কোথায় থাকেন?

আমরাও কলকাতায় থাকি।

এইভাবেই শুরু হল ওদের আলাপ পরিচয়।

খাওয়া-দাওয়ার পর ডাইনিং হল থেকে বেরিয়েই অপূর্ববাবু বলেন, মিঃ চৌধুরী, কলকাতায় আপনারা কোথায় থাকেন?

আমরা প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি? আপনারা?

প্রতাপাদিত্য রোড শুনেই চৌধুরী হাসতে শুরু করেন।

কী হল? হাসছেন কেন?

আমরাও তো প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি। তারপর?

দুটো বাড়ির নম্বর জানাজানির পর দেখা গেল, ওরা প্রায় সামনা-সামনি বাড়িতে থাকেন।

অনুপমা দেবী হাসতে হাসতে বলেন, আমরা থাকি দুটো মুখোমুখি বাড়িতে অথচ আমাদের আলাপ হল জগন্নাথ দেবের কৃপায় এই শ্রীক্ষেত্রে।

হ্যাঁ, ভাই, ঠিক বলেছেন।

মনিকা দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, জগন্নাথ দেবের কৃপায় আমাদের যোগাযোগের ফল বোধহয় ভালই হবে।

বোধহয় না, নিশ্চয়ই ভাল হবে।

.

একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া গল্পগুজব করে ওদের সময় বেশ কেটে যায়।

কখনো অপূর্ববাবুর ঘরে বসে বিমলবাবু আড্ডা দেন। আবার কখনো অন্য ঘরে অনুপমা দেবী আর মনিকা দেবী গল্প করেন।

মনিকাদি, তোমরা ক’দিন এখানে থাকবে?

দশদিন।

উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তোমরা কদিন কবে?

আমরা বারো দিন থাকব; তার মানে তোমাদের একদিন পরে কলকাতা পৌঁছব।

বারো দিনই পুরী থাকবে?

ইচ্ছা আছে দু’একদিন চিৎকার পাড়ে থাকার।

অনুপমা দেবী একটু হেসে বলেন, তোমরাও চিল্কা চল; খুব মজা হবে।

মনিকা দেবী একটু হেসে পেটের উপর হাত রেখে বলেন, সাত মাস; তাই এবার আর বিশেষ ঘুরাঘুরি করব না।

তাহলে তো তোমার ঘুরাঘুরি করা ঠিক হবে না।

সামনের বছর আমরা একসঙ্গে এসে খুব ঘুরব।

হ্যাঁ, ঠিক আছে।

অনুপমা দেবী না থেমেই বলেন, তুমি যখন যেতে পারবে না, তখন আমরাও এবার চিল্কা যাব না।

আমার জন্য তোমরা কেন যাবে না? তোমরা ঘুরে এসো।

এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে যেতে পারব না।

কিন্তু…

না, না, কোন কিন্তু না। বেশ তো গল্পগুজব করে আমাদের দিনগুলো কাটছে।

এইভাবেই শুরু হল দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা।

.

মনিকাদি, তুমি এই শাক আর টক ডাল দিয়ে ভাত খেও; তোমার ভাল লাগবে।

মনিকা একগাল হেসে বলেন, তুমি কী আজকাল আমার অবস্থা চিন্তা করেই রান্না করছ?

শুধু তোমার জন্য তো রান্না করিনি; আমরাও তো খাবো।

এ সে যাইহোক আমাকে কী রোজই তোমার কিছু না কিছু দিতে হবে?

কী আশ্চর্য! আমি কী রোজ রান্না করি না?

অনুপমা না থেমেই বলেন, তুমি অত-শত প্রশ্ন করবে না। আমি যখন যা দেব, তোমাকে তা খেতে হবে।

মনিকা হাসতে হাসতে বলেন, তুমি ভালবেসে দিচ্ছ আর আমি খাব না, তাই কখনো হয়?

দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেল।

তারপর একদিন মনিকার ছেলে হয়।

এই ছেলেকে দেখতে ওদের কত আত্মীয়স্বজন আসেন, চলেও যান।

অনুপমা সংসারের কাজকর্ম রান্নাবান্না নিয়ে সকালে বেশ ব্যস্ত থাকে কিন্তু স্বামী অফিস রওনা হলেই চলে যায় ও বাড়ি।

ছেলেটাকে আমার কাছে দে তো; ওকে একটু প্রাণভরে আদর করি।

তুই বোধহয় জলখাবার না খেয়েই এসেছিস?

এত সকাল সকাল আবার কবে খাই?

বাজে বকিস না; সওয়া ন’টা বাজে। কেউ জলখাবার কী দশটা-এগারোটায় খায়?

সে কথা অনুপমার কানেও যায় না। উনি ছেলেকে আদর করতেই ব্যস্ত।

মনিকা গলা চড়িয়ে বলেন, মালতী আমাকে আর অনুকে খেতে দিবি?

মালতী রান্নাঘর থেকেই জবাব দেয়, হ্যাঁ, মা, দিচ্ছি।

একটু পরেই ও ওদের দুজনকে জলখাবার খেতে দেয়।

নে অনু, শুরু কর।

আচ্ছা মনিকা, আমাকে কী রোজই তোর সঙ্গে খেতে হবে?

আমার সঙ্গে খেলে কী তোর জাত যাবে?

অনুপমা হাসতে হাসতে খেতে শুরু করেন।

খাওয়া শেষ হতেই অনুপমা বলেন, মনিকা ছেলের তেলটা দে তো; আমি বাবুসোনাকে ভাল করে তেল মাখিয়ে দিই।

মনিকা তেলের শিশিটা এগিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলেন, নে, প্রাণভরে তেল মাখা।

তুই কী জানিস না, বাচ্চাদের ভালভাবে মালিশ করে তেল না মাখালে ওদের শরীর ভাল হয় না?

জানব না কেন? তাই বলে তোর মতো ঘণ্টাখানেক ধরে কেউ তার বাচ্চাকে তেল মাখায় না।

.

তারপর?

চাকা ঘুরে যায়। বছর তিনেক পর অনুপমা গর্ভবতী হলেন।

ভূমিকায় অদল-বদল হল। এবার অনুপমার ভূমিকায় মনিকা, মনিকার ভূমিকায় অনুপমা।

শোন অনু, এই সুক্তো খাবি, আর এই আচার রেখে গেলাম। মাঝেমধ্যে একটু আচার খেলে ডাল-তরকারী খেতে ভালই লাগবে।

তুই আগে যে আচার দিয়েছিলি, সেটাও খুব ভাল ছিল।

মনে হয়, এটাও তোর ভাল লাগবে।

ছেলেটাকে নিয়ে এলি না কেন?

ও এখন এত ছটফটে আর দুরন্ত হয়েছে যে ও হয়তো তোর পেটে লাথি-টাথি লাগিয়ে দেবে।

বাবুসোনা কখনই লাথি-টাথি লাগাবে না; তুই এখনি মালতাঁকে দিয়ে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দে।

সত্যি পাঠাব?

একশ’বার পাঠাবি।

অনুপমা একটু হেসে বলেন, ও এলে আমার সময়টা বেশ ভাল কাটবে।

তারপর একদিন অনুপমা কন্যা সন্তানের মা হলেন।

.

এই মেয়ে যখন বছর খানেকের, তখন ওরা আবার একসঙ্গে পুরী গেলেন এক সপ্তাহের জন্য। মহানন্দে এক সপ্তাহ কাটিয়ে হাওড়া স্টেশনে ফিরেই অঘটন। মনিকা দেবী হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই স্লিপ করে পড়ে গিয়েই বেদনায় বিকট চিৎকার করেন।

তারপর সোজা উডল্যান্ডস নার্সিংহোম। অর্থপেডিক একবারূরীক্ষা করতেই তার মুখ গম্ভীর হল।

মিঃ সরকার, আমার মনে হচ্ছে ঊরুর হাড় দু’জায়গায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে অপারেশন করে স্টীলেরড ঢোকাতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।

অর্থপেডিকের সন্দেহই ঠিক ছিল।

ডাঃ ঘোষ বললেন, কাল সকালেই অপরেশন করব।

পরের দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন করার পর ও. টি থেকে বেরিয়ে ডাঃ ঘোষ বললেন, অপারেশন ঠিকই হয়েছে, তবে মিসেস সরকারকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।

তিন মাস শুয়ে থাকতে হবে?

একটা ফরেন বডি হাড়ের মধ্যে ঢুকিয়েছি।

দু’জায়গার হাড় জোড়া লাগতে ছ’ থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগবে; তাছাড়া স্টীল রড় দুটো ঠিক মতো ফিক্সড হওয়া চাই।

এর আগে ওর ভাল হবার সম্ভাবনা নেই?

ওষুধপত্তর ঠিক মতো খাওয়াবেন; গড উইলিং একটু তাড়াতাড়ি কন্ডিসন ইমপ্রুফ করতে পারে। দু’মাস পরে একবার এক্স-রে করে দেখব কি অবস্থা।

বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে অনুপমা ওর ছেলেকে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। বাবুসোনা মাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মনিকা একবার ছেলেকে বুকের উপর নিয়ে আদর করতেই নার্স বলেন, ম্যাডাম, ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। সামান্য একটু টান লাগলেই অপারেশনের জায়গার স্টিচ ছিঁড়ে যেতে পারে।

নে অনু, ছেলেকে ধর।

হ্যাঁ, অনুপমা ওর ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।

দিন দশেক পর মনিকা অনুপমাকে দেখিয়ে ছেলেকে বলেন, বাবুসোনা, এই মা কেমন?

মা ভাল, ভাল মা ভাল।

ব্যস, অনুপমা ওর সারা জীবনের জন্য ভাল মা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *