০৭-৮. ঠিক যেন এক ঘন জঙ্গল

ঠিক যেন এক ঘন জঙ্গল। ছায়া ছায়া। জঙ্গল বেয়ে চলে গিয়েছে। আঁকাবাঁকা পথ। কখনও সে পথ চড়াই ভাঙছে, কখনও উতরাই। গাছে গাছে, ঝোপেঝাড়ে অসংখ্য পাখির ডাক। এমন পরিবেশে হঠাৎ এসে পড়লে চোখে যেন কেমন ঘোর লেগে যায়।

হ্যাঁ, বার্ড পার্কের ভিতরে পৌঁছে টুপুরের সেরকমই ঘোর লাগছিল। এত বিরাট এলাকা জুড়ে, এমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুধু পাখির বাগান তৈরি করা যায়? ঢোকার মুখে পেঙ্গুইনদের আস্তানাটাই তো জোর চমক। কাচের বরফঠান্ডা খাঁচায় কত রকম যে পেঙ্গুইন সেখানে। রাজা পেঙ্গুইন, বাদশা পেঙ্গুইন, পরি পেঙ্গুইন… ছোট্ট ছানা থেকে ইয়া-ইয়া ধাড়ি। কালো-কোটপরা উকিলবাবুদের জন্য পাহাড়, গুহা, নদীটদি বানিয়ে কী তোফা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ তুলে গল্পগুজব করছে কেউ-কেউ। সাঁতার প্র্যাকটিসও চলছে জলে। কেউ বা উদাস নয়নে বসে। দুটো কিং পেঙ্গুইন তো জোর মারপিট শুরু করে দিল। দেখে বুমবুমের সে কী উল্লাস! দুই পালোয়ানের মধ্যে কে জেতে না জেনে সে নড়বে না। তাকে কোনওক্রমে টেনেটুনে সরিয়ে আনা গেল।

এখন অবশ্য বুমবুমের অন্য উত্তেজনা জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে টয়ট্রেনে যাচ্ছে যে! ছোট্ট কামরায়। শুধু চারজনে। দু ধারে, গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে খাঁচায় নানান দেশের পাখি। হর্নবিল, ম্যাকাও, কিংফিশার… বন্ধ কাচের জানালা দিয়ে বুমবুম তাদের দেখছে, আর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, ওখানে যাব। ওখানে চলো।

পিচের রাস্তা দিয়ে অনেকেই ঘুরছে পায়ে হেঁটে। সেদিকে ক্যামেরা তাক করে পার্থ বলল, ঠিক বলেছিস। আমাদের পা-গাড়ি ধরাটাই উচিত ছিল।

টুপুর বলল, তা হলে কিন্তু টয়ট্রেনের আনন্দটা মিস হত।

 তা-ও তো বটে, বলেই পার্থ মিতিনের দিকে ফিরল, কী গো, তুমি এত চুপচাপ কেন? কালকের কথাই ভেবে যাচ্ছ নাকি?

মিতিন অস্ফুটে বলল, নাঃ, আজকের কথা ভাবছি।

আজকেও কেউ ঘুরছে নাকি পিছন-পিছন?

এখনও পর্যন্ত তো মনে হচ্ছে, না।

পরেও দেখবে কেউ নেই। কালও ছিল না। সবটাই তোমার মনগড়া। কে এক অজানা অচেনা টুরিস্ট..অকারণে তাকে সন্দেহ করে নিজের ভিতর ভুলভাল টেনশন তৈরি করছ।

অকারণ হলেই ভাল। তবে আমার মন বলছে..

মনকে ঘুম পাড়িয়ে দাও, পার্থ হ্যা-হ্যা হাসল, সিঙ্গাপুরে তো আছ আর মাত্র দেড়টা দিন। টিকটিকিপনা ছেড়ে বেড়ানোটাকে ভালভাবে এনজয় করো দেখি!।

খেলনা-ট্রেন এক পুঁচকে স্টেশনে থেমেছে। লাফাতে-লাফাতে নেমে পড়ল বুমবুম। সঙ্গে টুপুর-মিতিন-পার্থও। খুদে প্ল্যাটফর্ম টপকে সোজা টিয়া, রোজেলার আড়তে। গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির। গায়ে তাদের কত রকম যে রং। মনে হয় লালনীল-হলুদ-সবুজ-কমলা, সব কটা রঙে কেউ ছাপিয়ে দিয়েছে তাদের। রবিবার বলেই বোধ হয় আজ দৰ্শক অনেক। ছোট-ছোট বাটিতে তারা দানাপানি ধরছে, অমনই পাখির ঝাঁক নেমে এসে বসছে তাদের কাঁধে, হাতে, মাথায়। ধারালো ঠোঁটে টপাটপ সাবাড় করছে খাবার। হালকা করে ঠুকরেও দিচ্ছে মাঝে-মাঝে।

টুপুর উচ্ছসিত মুখে বলল, মাৰ্ভেলাস! কলকাতায় এমন একটা পার্ক বানানো যায় না? যেখানে পাখিগুলো ছাড়া থাকবে? খোলা আকাশে উড়ে-উড়ে বেড়াবে?

এখানেও মোটেই খোলা আকাশে উড়ছে না, টুপুর। পার্থ আঙুল তুলে দেখাল, ওই দ্যাখ, উপরে সরু-সরু জাল। জালটা একটু বেশি উঁচুতে, এই যা।

তা হোক। স্বাধীনভাবে তো ওড়াওড়ি করতে পারছে। গাছে বাসা বেঁধে থাকছে..

বলতে-বলতে হঠাৎই টুপুরের কথা আটকে গেছে। সামনে এক বিচিত্র দৃশ্য। মিতিনমাসি বাটি ধরে বহুরঙা রোজেলাদের খাওয়াচ্ছিল। তাদের মধ্যেই একজন বুমবুমের মাথায় এখন। আতঙ্কে বুমবুম পাথরের মতো স্থির। আড়ষ্ট স্বর শুধু বলে চলেছে, ভাল হবে না বলছি। যা, উড়ে যা।

টুপুরের পেট গুলিয়ে হাসি উঠে এল। তাই দেখে বুমবুম আরও কাঠ, দিদি, ওকে এখনই তাড়িয়ে দে।

আহা, থাক না। কিছু তো করছে না।

করবে। এখনই মাথায় পটি করে দেবে।

লাল-ঠোঁট রোজেলা বুঝতে পারল কিনা কে জানে, বুমকুমকে রেহাই দিয়ে এক সাহেবশিশুর মাথায় গিয়ে বসেছে। সম্ভবত পটি করার জন্য কালো চুলের চেয়ে সোনালি চুল তার বেশি পছন্দ হল।

বুমবুমের পক্ষীপ্ৰেম উবে গেছে। এ তল্লাটে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজি নয়। অগত্যা রোজেলাপট্টি ফেলে শুরু হল হাঁটা। খাঁচার পাখিগুলোকে দেখে তেমন একটা আহ্লাদ হল না টুপুরের। এমন তো কলকাতায় চিড়িয়াখানাতেও দেখা যায়। এখানে শুধু সবুজের আধিক্য, এই যা।

ঘুরতে ঘুরতে শেষে এক কৃত্রিম জলপ্রপাতের সামনে। চতুর্দিকে লম্বা-লম্বা গাছপালা লাগিয়ে এমন একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া অরণ্য বানানো হয়েছে, সত্যিই রেনফরেস্ট বলে ভুল হয়। জলপ্রপাতটিকেও মনে হয় না মেকি। বেশ লাগে দেখতে।

পার্থও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারিফের সুরে বলল, আইডিয়াটা গ্র্যান্ড। কোন হাইট থেকে জল ফেলা হচ্ছে লক্ষ করেছিস?

টুপুর বলল, মিনিমাম একশো ফিট তো হবেই। আরও বেশি। এটাই মানুষের তৈরি সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত। পাৰ্কটার গ্ল্যামারই বাড়িয়ে দিয়েছে এই ওয়াটারফল।

পাখিরাও বোধ হয় এই রেনফরেস্ট এরিয়াটা বেশি পছন্দ করে।

হুম। প্রচুর কাকাতুয়া উড়ছে। জাম্বো সাইজের পায়রাও।

কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, পার্থমেসো?

কী রে?

পাখিদের রাজ্যে একটাও কাক নেই।

কাক কি তুই সিঙ্গাপুর শহরেও দেখতে পেয়েছিস?

এখনও তো নজরে পড়েনি।

পাবি না। নেই। একসময় যাও ছিল, এখন ঝড়েবংশে নির্মূল হয়ে গিয়েছে। কাক শহর নোংরা করে বলে সিঙ্গাপুরে তাদের নো এন্ট্রি।

অদ্ভুত তো! আমি তো জানতাম কাক ঝাড়ুদার পাখি। নোংরা খেয়ে সাফ করে।

সিঙ্গাপুরিরা হয়তো সেটা মানে না।

জবাবটা মনঃপুত হল না টুপুরের। এখানকার কাকদের জন্য একটু যেন মনখারাপই হল। পায়ে-পায়ে পার্থমেসোর সঙ্গে এল ছাউনি ঢাকা এক চাতালে। পার্থ তিনটে কফির অর্ডার দিল ব্ল্যাক বারে। আর বুমবুমের জন্য চিপস।

মিতিন বুমবুমকে নিয়ে টয়লেটে গিয়েছিল। ফিরে বলল, এখন কফি? চিপস? সাড়ে বারোটা বাজে, দুপুরের খাওয়া হবে কখন?

পাৰ্থ কাপে চুমুক দিয়ে বলল, লাঞ্চ করব লিটল ইন্ডিয়াতে গিয়ে। ওখানে অনেক বাংলাদেশি হোটেল দেখেছি। গরম-গরম মাছভাত খাব। কাল সুজিতবাবু বলছিলেন, ওখানে নাকি দারুণ শুটকি পাওয়া যায়।

সুজিত দত্তর নাম উঠতেই মিতিনের চোথ তেরচা, তোমার সুজিত দত্ত সকালে হঠাৎ হোটেল ছেড়ে চলে গেলেন যে বড়?

পার্থ হাত উলটে বলল, হয়তো কাজকর্ম মিটে গিয়েছে, তাই।

চলে যাবেন, এটা তোমায় কাল বলেছিলেন?

 না। সেরকম কোনও প্রসঙ্গ তো ওঠেনি। আমিও জানাইনি, আজ আমরা রুম চেঞ্জ করছি। পাৰ্থর চোখ সরু, আচ্ছা, তুমি সুজিতবাবুকে নিয়ে পড়েছ কেন বলো তো? ভদ্রলোক গায়েপড়ে আলাপ করেছিলেন বলেই তাকে বাঁকা চোখে দেখতে হবে?

আমি সোজা বাঁকা কোনও চোখেই দেখছি না। জাস্ট জানতে চাইছি।

বললেই মানব? তুমি মগজ থেকে কিছুতেই পোকাটাকে তাড়াতে পারছ না। ওই পোকাই ভোঁ-ভোঁ করে বলছে, তোমার পিছনে কেউ ফেউ লাগিয়েছে। অমুক লোক তমুক প্রশ্ন করল কেন… নারায়ণের চিঠি চাওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর মানে আছে… এমনকী একটা নৰ্মাল টেলিফোন… সুজিতবাবু থাকাকালীন সেটা আসতেই পারে… তাও তুমি সোজা মনে নিতে পারনি। অথচ সাদা চোখে দেখলে গোটা ব্যাপারটাই জলবৎ তরলং।

তাই বুঝি?

আমার সুডোকু মেলানো ব্রেন তো সেরকমই বলে … শোনো, মিস্টার নারায়ণ নেহাতই তার কোম্পানির এক জো-হুজুর কর্মচারী। যেহেতু তাকে বলা আছে অরিজিনাল আমন্ত্রণপত্র কালেক্ট করতে হবে, উনি বাধ্য দাসানুদাসের মতো ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছিলেন। ওঁকে একটা ধাতানি দেওয়ার দরকার ছিল। দিয়েছি। ফল নিজের চোখেই দেখলে। সকালে উনি আর হোটেলের ছায়া মাড়াননি। সুজিতবাবুও কাজ চুকে গেলে চলে যাবেন, এটাও একদম স্বাভাবিক। অতএব বুঝতে পারছ তো, তোমার কেতাবি সন্দেহগুলো নিছকই হাস্যকর?

মিতিন কোনও জবাব দিল না। চিলতে হাসল শুধু। ওই হাসি দেখে টুপুর বেশ আন্দাজ করতে পারল, পার্থমেসোর একটা যুক্তিও হজম করেনি মিতিনমাসি। বোঝাই যায়, এখন থট প্রসেস চলছে। শত খোঁচালেও মাসি এই মুহুর্তে রা কাড়বে না।

কিন্তু কেটা কী? রহস্যটা কোথায়?

.

বাংলাদেশি হোটেলে খ্যাটন মন্দ হল না। ভাত, ডাল, আলুভরতা, সর্ষেইলিশ, পাঁঠার মাংস। খুব চেকনাদার রেস্টুরেন্ট অবশ্য নয়, তবে রান্না দিব্যি সুস্বাদু। লিটল ইন্ডিয়ার এদিকটায় পর পর এরকম খাওয়ার জায়গা রয়েছে কয়েকটা। বাংলাদেশিদের দোকানবাজার। বাংলা ভাষা ভাসছে বাতাসে। সামনেই মুস্তাফা সেন্টার। ভারতীয় ব্যবসায়ীর তৈরি প্রকাণ্ড ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। বহুতল ওই বাড়িতে কী না পাওয়া যায়। বহুমূল্য গয়নাগাটি থেকে ব্যথাবেদনার মলম পর্যন্ত।

টুপুরের ইচ্ছে ছিল মুস্তাফায় একবার ঢুঁ মারার। পার্থর ঘোরতর আপত্তি। ভরপেট আহারের পর হোটেলে ফিরে সে একটু গড়াতে চায়। মুস্তাফা চব্বিশ ঘণ্টা খোলা, যে-কোনও সময় এলেই হবে।

বাঙালি-বাঙালি এলাকাটা থেকে কার্লটন হোটেল খুব দূরে নয়। হাঁটাপথে মিনিটপাঁচেক। হোটেলে পৌঁছে জোর ঘাবড়ে গেল টুপুর। বেজায় হল্লাগুল্লা চলছে লাউঞ্জে। এক মধ্যবয়সি গুজরাতি দম্পতি আঙুল নেড়ে-নেড়ে শাসাচ্ছেন হোটেলের কর্মচারীদের। সুটটাইপরা ম্যানেজার প্রাণপণে শান্ত করার চেষ্টা করছেন তাদের।

ব্যাপারটা কী শুনে টুপুর তো আরও থ। সকালে তারা যে ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানেই উঠেছেন এই দম্পতি। স্নানটান সেরে কাছেই লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। ফিরে দ্যাখেন, ঘরের লণ্ডভণ্ড দশা। কোনও এক বদমাইশ ব্যাগ সুটকেস খুলে যাবতীয় জিনিসপত্র ছত্রাকার করে দিয়ে গিয়েছে। কপাল ভাল, কিছু খোয়া যায়নি। সম্ভবত সময় পায়নি চোর। স্বামী-স্ত্রীর রাগ অবশ্য তাতে পড়ছে না। এই যদি কার্লটন হোটেলের নিরাপত্তার ছিরি হয়, এখানে তাঁরা দুটো দিন কাটাবেন কোন ভরসায়?

উপরে নিজেদের নতুন রুমে এসে পাৰ্থ বলল, জোর বাচা বেঁচে গিয়েছি রে টুপুর। ভাগ্যিস তোর কথামতো ঘর বদলেছিলাম। নইলে হয়তো ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার বদলে আমাদেরই এখন ওখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতে হত।

টুপুর বলল, কী আশ্চর্য কাণ্ড! সিঙ্গাপুরে এত কড়াকড়ি, এখানেও তবে চুরিবাটপাড়ি হয়?

তাই তো দেখছি। আমি তো আবার ডলারের অর্ধেকটাই সুটকেসে রেখে গিয়েছিলাম। নিৰ্ঘাত আজ হাপিশ হয়ে যেত।

মিতিন গুম হয়ে বসে ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, না। আর যাই হোক, ডলার খোয়া যেত না।

কী করে বুঝলে?

তোমাদের মাথায় কি গোবর পোরা? এ-ও বুঝলে না, চোর ডলার হাতাতে আসেনি। ঘড়ি, ক্যামেরা বা আর কিছু নয়? এসেছিল অন্য কিছুর সন্ধানে?

কী সেটা?

এমন কিছু, যা ওসবের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। এবং জিনিসটা সে খুঁজতে এসেছিল ওই গুজরাতি স্বামী-স্ত্রীর ব্যাগে নয়। আমাদেরই ব্যাগে।

একসঙ্গে পার্থ আর টুপুর বলে উঠল,মানে?

কারণ, জিনিসটা আমাদের কাছেই থাকার কথা। আমরা যে রুম পালটেছি, সেটা চোর তো আর জানত না।

ও, পার্থ থমকে গিয়েছে। খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি বলতে চাইছ, ওই চিঠিটা…?

মনে তো হচ্ছে, তাই।

তা হলে কি মিস্টার নারায়ণই..?

স্বয়ং না-ও আসতে পারেন। হয়তো কাউকে পাঠিয়ে… কিংবা। এখানকারই কোনও কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজস করে… কিংবা হয়তো সম্পূর্ণ অন্য কেউ…

টুপুর বলে উঠল, তুমি কি সুজিত দত্তর দিকে ইঙ্গিত করছ?

ইঙ্গিত করছি না। শুধু মাথায় রাখতে বলছি, রুম চেঞ্জের খবরটা তিনিও জানতেন না, মিতিন ভুরু বেঁকিয়ে পার্থকে বলল, কী, তাই তো?

পার্থ জোরে-জোরে ঘাড় নাড়ল, অবশ্যই। আমি ওঁকে মোটেই বলিনি। তা ছাড়া উনি তো কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন।

 সেটা তুমি হলপ করে বলতে পার না। উনি হোটেল ছেড়ে দিয়েছেন, এটুকুই সত্যি। মনে রেখো, সিঙ্গাপুর থেকে কলকাতা যাওয়ার ফ্লাইট একটাই। রাত নটায়। ওই প্লেনে ওঠার জন্য কেউ ভোরবেলা হোটেল ছাড়ে না।

কিন্তু সুজিত দত্তর সঙ্গে ওই চিঠির কী সম্পর্ক? বরং মিস্টার নারায়ণের ইন্টারেস্ট থাকলেও থাকতে পারে। যদিও তার পক্ষে দিনদুপুরে লাগেজ হাতড়ানো যথেষ্ট অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে।

বা রে, মিতিনমাসি তো বলছে চিঠিটা হয়তো খুব মূল্যবান, টুপুর মন্তব্য জুড়ল, তাই যদি হয়, ওটা মিস্টার নারায়ণেরই কাজ। আমি শিওর।

ধুত্তোর ছাই, পার্থ মাথা ঝাঁকাল, চিঠিটা কেন মূল্যবান, তার তো একটা যুক্তি দেখাবে। প্রত্যেক সপ্তাহেই আমার মতে কেউ না কেউ সুডোকু মিলিয়ে সিঙ্গাপুর টুর প্রাইজ পাচ্ছে। প্রত্যেকের কাছেই অবিকল এরকম চিঠি থাকে। এর মধ্যে আমাদেরটা ফর নাথিং হঠাৎ মূল্যবান হয়ে উঠবে কেন?

মিতিন থমথমে মুখে বলল, এটাই তো একটা সুডোকু।

.

০৮.

বিকেল প্রায় শেষ। চা-টা খেয়ে পার্থ তৈরি। বুমবুমকে নিয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানায়। নাইট সাফারিতে। কবজিতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে টুপুরকে বলল, কী রে, তোরা তা হলে যাচ্ছিস না? ফাইনাল?

টুপুর অসহায় মুখে মিতিনমাসিকে দেখল। সেই যে দুপুর থেকে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে মাসি, এখনও ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। কাচুমাচু মুখে টুপুর বলল, কী করব, মিতিনমাসি আমাকে থেকে যেতে বলছে যে।

তা হলে আর কী, মাসি-বোনঝি ঘরে বসে ভ্যারেল্ডা ভাজ। থুড়ি, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালা, পার্থ মুখভঙ্গি করল, অবশ্য তোর দুধের স্বাদ আমি ঘোল খাইয়ে পূর্ণ করে দেব। রাত্তিরে নাইট সাফারির ছবি দেখে নিস।

তখনই হঠাৎ মিতিনের গলা শোনা গেল, টুপুর, তোর মেসোকে বল হ্যান্ডিক্যাম যেন না নিয়ে যায়। ক্যামেরা মোবাইলটাও থাকুক।

পার্থ আকাশ থেকে পড়ল, কেন?

দরকার আছে।

তোমার এই পাগলামির কিন্তু আমি কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছি না। পার্থ বিরক্ত স্বরে বলল, শুধু শুধু তিলকে তাল করছ।

তিল যদি নিজেই তাল হতে চায়, আমি কী করতে পারি?

করো যা খুশি। সিঙ্গাপুরে বসে তালের বড়া ভেজে খাও।

বলেই বুমবুমের হাত ধরে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেছে পার্থ। টুপুর হতবুদ্ধির মতো বসেই আছে বিছানায়। নাইট সাফারিতে যাওয়া হল না বলে একটু-একটু দুঃখ হচ্ছে বটে। আবার তাকে দরকারে লাগবে বলে মিতিনমাসি আটকে রাখল ভেবে, পুলকও জাগছে অল্প-অল্প। কিন্তু মিতিনমাসি ওঠে না কেন? কতক্ষণ শুয়ে থাকবে?

পায়ে-পায়ে ব্যালকনিতে এল টুপুর। লাগোয়া ব্যালকনিখানা ছোট হলেও ভারী সুন্দর। দূরে একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে। এ শহরের অজস্র পার্কের মতোই গাঢ় সবুজ। চওড়া রাস্তাও চোখে পড়ে। দেখা যায় গাড়িঘোড়া, মানুষজন। এই অঞ্চলের বাড়িগুলো সিঙ্গাপুরের আর পাঁচটা জায়গার মতো নয়। বহুতল তো প্রায় নেইই। বেশির ভাগই একতলা, কী দোতলা। একটু যেন ঘিঞ্জি। কোথায় যেন কলকাতার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এদিককার হোটেলে উঠে একটা ব্যাপার অন্তত বোঝা গেল, সিঙ্গাপুরের সর্বাঙ্গই খুব ঝকমকে নয়।

মিতিন ডাকছে ভিতর থেকে। ঘরে ফিরে টুপুর অবাক। বিছানা ছেড়ে কখন যেন উঠে পড়েছে মিতিনমাসি। টিভিতে ক্যামেরা লাগিয়ে আবার দেখছে সেন্টোসার ক্যাসেটখানা।

টুপুর বসে পড়ল পাশে, কী খুঁজছ গো? কালকের সেই লোকটাকে?

হুম।

টুপিওয়ালা ফ্রেঞ্চকাট অনেকবারই ধরা পড়ছে পরদায়। কিন্তু কিছুতেই মুখটা জুতসইভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কখনও সাইড-ফেস। কখনও পিছন ফেরা। বাসে তো টুপি আর ম্যাপে মুখ প্রায় ঢাকা পড়ে আছে। অবশেষে ডলফিন লেগুনের ছবিটাই কাজে লাগল। ঝলকের জন্য হলেও স্পষ্ট হয়েছে মুখমণ্ডল। সঙ্গে সঙ্গে ছবিটাকে দাঁড় করিয়ে জুম টিপল মিতিন। অনেকটা বড় সঙ্গে হয়েছে ছবি। তবে সামান্য ফেটে-ফেটে গেল।

পরদায় দৃষ্টি গেঁথে মিতিন বলল, দ্যাখ তো ভাল করে, চেনাচেনা লাগে কিনা?

টিভির খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল টুপুর। চোখ পিটপিট করে বলল, নাঃ, লোকটার নাক যা প্রকাণ্ড..

নাক তো বানানো যায়। নাকটাকে ছেঁটেকেটে দ্যাখ। দাড়ি আর টুপিও বাদ দে।

উহুঁ, বুঝতে পারছি না। মিস্টার দত্তর সঙ্গে মিল আছে কি?

আরও দুচার সেকেন্ড ছবিটাকে পর্যবেক্ষণ করে ক্যামেরা অফ করল মিতিন। বিড়বিড় করে বলল, ভদ্রলোক ছদ্মবেশ ধরাতে খুব পটু। ফলো করাতেও। যদি ভদ্রলোক সুজিত দত্তই হন, আমাদের পিছন-পিছন ঘুরছিলেন কেন?

চিঠিটার জন্য কি?

অথচ একবারও তো আমাদের কাছাকাছি এলেন না? যদি ধরেও নেন বস্তুটি আমাদের সঙ্গে আছে, তা হলে তো উনি কাড়ার চেষ্টা করতেন?

তা হলে বোধ হয় উনি মিস্টার নারায়ণ।

দুর বোকা। সে লোকটাই বা হামলাটামলা না করে স্রেফ ঘুরে বেড়াবে কেন? তা ছাড়া মিস্টার নারায়ণের হোটেলে বসে থাকাটাই বলে দিচ্ছে…

উনি নিজেও যাননি। এবং কোনও লোকও পাঠাননি, টুপুর কথা মাঝপথ থেকে কেড়ে নিল। হতভম্ব মুখে বলল, তা হলে লোকটা কে?

উহুঁ। প্রশ্নটা কে নয়। প্রশ্নটা হল কেন?

 মানে?

মিতিন উত্তর দিল না। তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তিন মিতিনটে রেডি হয়ে নে। বেরোব।

কোথায় যাবে?

প্ৰশ্ন নয়। যা বলছি, কর।

নিজেও চটপট চুলে চিরুনি চালাল মিতিন। সালোয়ার-কামিজের ওপর ওড়না বিছিয়ে দ্রুত নেমে এল নীচে। রিসেপশনে গিয়ে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, ১০৪ নম্বর রুমের কেসটার কোনও ফয়সালা হল?

কাউন্টারে এখন এক মিষ্টিমুখ চিনা মেয়ে। সে ভারী লজ্জিত মুখে বলল, নো ম্যাম। তবে ঘটনাটির জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বিশ্বাস করুন, এ হোটেলে আগে কখনও এমনটা হয়নি।

আপনি কি জানেন, আমরা ওই রুমেই ছিলাম? ইনফ্যাক্ট, আজও ওখানে থাকার কথা ছিল? সকালেই আমরা রুম চেঞ্জ করে তিনতলায় গিয়েছি? ৩২২-এ?

জানি ম্যাডাম। ডিউটিতে এসে শুনেছি।

ঘটনাটায় আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বোধ করছি। আপনারা কি পুলিশকে জানিয়েছেন?

পুলিশকে এখনই জানালে হোটেলের বদনাম হয়ে যাবে, ম্যাডাম। আমাদের মালিক আর ম্যানেজার নিজেরাই থরো এনকোয়ারি করে দেখছেন। তেমন হলে নিশ্চয়ই পুলিশকে..

আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

বলুন।

একজন থার্ড পার্সন রুম খুলল কী করে?

 সেটাই তো পরিষ্কার হচ্ছে না, ম্যাডাম। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস পটেল তো চাবি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন।

চাবির ড়ুপ্লিকেট আছে না?

তা আছে।

রিসেপশনেই থাকে?

হ্যাঁ, ম্যাম, চিনা মেয়েটি অধোবদন।

অর্থাৎ আপনাদের লোকও ইচ্ছে করলে রুমে ঢুকতে পারে?

 না ম্যাডাম। নেভার। বোর্ডারের অনুমতি ছাড়া রুম আমরা খুলতে পারি না।

ও। তার মানে লক ভেঙে কেউ ঢুকেছিল?

লক ভাঙা হয়নি ম্যাডাম। আমরা চেক করেছি।

তা হলে তো সন্দেহ আপনাদের কর্মচারীদের দিকেই যায়।

সব কর্মচারীকেই ক্ৰস করা হচ্ছে। যদি কাউকে দোষী মনে হয়, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ম্যাডাম, পুলিশের হাতে পড়লে তারা পেট থেকে কথা টেনে বের করবেই।

দ্যাটস গুড..যাক গে, আপনাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত।

আমাদেরই তো দুঃখিত হওয়ার কথা ম্যাডাম। এবং এমন ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটা দেখাও আমাদের কর্তব্য।

শুনে ভাল লাগল। আর একটা-দুটো প্রশ্ন করতে পারি কি?

স্বচ্ছন্দে। বলুন?

ঘটনাটা ঠিক কখন ঘটেছিল?

সঠিক টাইম বলতে পারব না ম্যাডাম। তবে মিস্টার পটেলরা বেরিয়েছিলেন এগারোটা নাগাদ। ফিরে আসেন দেড়টার সময়…

আপনি নিশ্চয়ই তখন ডিউটিতে ছিলেন না?

না। আমার আজ ইভনিং শিফট। দুটোয় এসেছি। আজ মর্নিং ছিল রোজির। বলেই চিনা মেয়েটি যেন কেঁপে গেল, রোজি খুব ভাল মেয়ে ম্যাডাম ও সত্যিই কিছু জানে না।

রোজি কি কাউকে ১০৪-এর দিকে যেতে দেখেছিলেন?

না ম্যাডাম সেভাবে বোধ হয় বলা সম্ভবও নয়। সারাক্ষণই কাস্টমাররা আসা-যাওয়া করছেন…

রোজির কাছে কেউ ১০৪-এর বোর্ডারদের সম্পর্কে খোঁজও করেননি?

বোধ হয় না। তা হলে তো রোজি বলত।

 আচ্ছা, আর-একটা খবর দিতে পারেন? মিতিন সামান্য ঝুঁকল এবার, আমার কাছে একটা গাড়ির নম্বর আছে। গাড়ির মালিকের নাম জানতে চাই…

সিঙ্গাপুরে এটা কোন সমস্যাই নয় ম্যাডাম। ইন্টারনেটে মোটর ভেহিকলসের ওয়েবসাইটে চলে যান।

থ্যাঙ্কস। এখানে কাছাকাছি সাইবার কাফে কোথায় আছে?

এই সার্ভিসটুকু আমরাই প্রোভাইড করতে পারি। অনুগ্রহ করে আমায় যদি নম্বরটা দেন..

এস-জি-কে টু ফাইভ এইট নাইন। সাদা রঙের মিৎসুবিশি।

 দু মিনিট, ম্যাডাম।

ডেস্কের কম্পিউটারে মনোযোগী হয়েছে চিনা মেয়েটি। টকাটক কী টিপছে। দুমিনিট নয়, সময় নিল মিনিটপাঁচেক। মনিটরে চোখ রেখে বলল, এটা তো একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির গাড়ি ম্যাডাম।

মিতিন উৎসুক স্বরে বলল, এজেন্সির নাম?

ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট। ঠিকানা, ইস্ট-এ মল, গ্রাউন্ড ফ্লোর, শপ নম্বর গ্রি সি।

লোকেশনটা জানতে পারি?

 অবশ্যই। সিমেই।

ট্রাভেল এজেন্সির প্রোপ্রাইটারের নাম পাওয়া যাচ্ছে?

হ্যাঁ, ম্যাম। টি পি শঙ্করন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ, মিতিন কাউন্টার থেকে সরতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল, আচ্ছা, সিমেই যাওয়া যায় কী করে?

ট্যাক্সিতে যেতে পারেন। কিংবা এম-আর-টি। সিঙ্গাপুরের এই ট্রেন সার্ভিস কিন্তু অতুলনীয় ম্যাডাম। ট্রেনে করে শহরের যেকোনও জায়গায় চলে যেতে পারেন। তবে হ্যাঁ, লিটল ইন্ডিয়া থেকে সিমেই যেতে গেলে আউটরাম পার্ক স্টেশনে ট্রেন বদলাতে হবে। ওখান থেকে ধরবেন পূর্ব-পশ্চিম লাইনের ট্রেন। আশা করি, বোঝাতে পেরেছি?

একদম, মিতিন এবার একটা চওড়া হাসি উপহার দিল মেয়েটিকে। টুপুরকে বলল, চল, সিমেই ঘুরে আসি।

রাস্তায় বেরিয়ে টুপুর জিজ্ঞেস করল, ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে গিয়ে কী হবে মিতিনমাসি?

দেখা যাক। সূত্র কিছু তো মিলতেও পারে।

রিসেপশনের মেয়েটিকে জেরা করে কিছু লাভ হল?

 না। হওয়ার কথাও নয়।

কেন?

জানাই ছিল, রুম খোলাখুলিতে হোটেলের স্টাফ যুক্ত থাকতে পারে না।

কীভাবে শিওর হলে?

সোজা বুদ্ধিতে। ঘর বদলানো তো হোটেলের লোকদের অগোচরে হয়নি। তারা কেউ জড়িত থাকলে ১০৪-এ নয়, ৩২২-এ ঢুকত।

তা হলে ফালতুফালতু মেয়েটাকে অত জেরা করছিলে কেন?

দুটো কারণে। এক, আমাদের ৩২২ এখন থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। দুই, প্রশ্নের ধাক্কায় মেয়েটাকে নার্ভাস করে দিয়ে গাড়ি সংক্রান্ত খবরটাও বের করে নেওয়া গেল। আমার সময়ও বাঁচল, পরিশ্রমও বাঁচল…

বুঝলাম।

কথা বলতে বলতে হাঁটছে দুজনে। লিটল ইন্ডিয়ার এম-আর-টি স্টেশন টুপুর চেনে মোটামুটি। ট্যাক্সিতে যাতায়াতের সময় নজরে পড়েছে। তাদের হোটেল থেকে পঞ্চাশ-ষাট পা গেলে সেরাংগুন রোড। চওড়া রাস্তাটা টপকে বাফেলো স্ট্রিট ধরে পৌছতে হয়।

স্টেশনে নেমে টুপুর দেখল, টিকিট কাউন্টারের কোনও বালাই নেই, তার জায়গায় শোভা পাচ্ছে সার দিয়ে বসানো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। টিকিট কাটার ওই যন্ত্রের গায়ে ট্রেন রুটের ম্যাপ। গোটা শহরে টিকিট সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও ভারী সরল। যেখান থেকে যেখানে যাবে মানচিত্রে শুধু আঙুল ছুঁইয়ে দাও, পরদায় ফুটে উঠবে ভাড়া কত। সেইমতো ডলার ঢুকিয়ে দাও নির্দিষ্ট ফোকরে, তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে ফেরত খুচরোসহ একটা শক্তপোক্ত কার্ড। অনেকটা কলকাতার মেট্রোরেলের স্মার্টকার্ডের মতো।

প্ল্যাটফর্মের গেটে কার্ড ছুঁইয়ে ভিতরে ঢুকতে না-ঢুকতেই ট্রেন। থামার সঙ্গে-সঙ্গে খুলে গেল বন্ধ দরজা, যাত্রীরা উঠতেই আটকে গেল নিঃশব্দে। কামরাটি বেশ প্রশস্ত এবং সিঙ্গাপুরের আর পাঁচটা যানবাহনের মতোই দিব্যি দর্শনধারী। মোলায়েম ঠান্ডা বিরাজ করছে কামরায়। চিটপিটে গরম এই শহরটায় এ যেন বাড়তি পাওনা। আউটরাম পার্কে ট্রেন বদলাতেও সমস্যা হল না। প্ল্যাটফর্মে নিখুঁতভাবে দিক নির্দেশ করা আছে।

লিটল ইন্ডিয়া থেকে আউটরাম পার্ক আসার সময় কামরায় বেশ ভিড় ছিল। সিমেইগামী ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। ভূগর্ভ ছেড়ে মাঝেমাঝে উপরে উঠে আসছে ট্রেন, একটা-দুটো স্টেশন পরে আবার নেমে যাচ্ছে নীচে। ওঠানামার খেলাটা দেখতে বেশ মজাই লাগছিল টুপুরের। নাইট সাফারিতে না যেতে পারার আক্ষেপ যেন পুষিয়ে যাচ্ছিল। বেচারা বুমবুমটার বোধ হয় এম-আর-টি চড়া হল না।

সিমেই পৌঁছে ছোট্ট একটা ম্যাজিক দেখাল মিতিনমাসি। এসকালেটর বেয়ে নামতেই আবার স্বয়ংক্রিয় টিকিট। তার ভিতরে কার্ড ঢোকাতেই ঠং করে বেরিয়ে এল একখানা এক ডলারের কয়েন। টুপুরের কার্ডে আবার আর-একটা করেন।

টুপুর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে বলল, এটা কী করে হল গো?

 সিঙ্গাপুরকা জাদু, মিতিন ফিকফিক করে হাসছে, এখানকার এম-আর-টি ভারী মজাদার রে। যতটা নেয়, তার খানিকটা ফিরিয়ে দেয়। আমি লিটল ইন্ডিয়া স্টেশনেই ওয়াচ করেছি।

খুব ইন্টারেস্টিং কিন্তু।

মোহিত হোস না টুপুর। একটু পরে হয়তো দেখবি অন্য ধরনের কোনও ইন্টারেস্টিং আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।