০৩-৪. কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর

কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর অনেকটাই পুবে। সময়ের হিসেবে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে। অর্থাৎ কলকাতায় যখন রাত বারোটা, সিঙ্গাপুরে রাত আড়াইটে। অতএব প্রায় চার ঘণ্টা আকাশপথে পাড়ি দিয়ে প্লেন যখন সিঙ্গাপুরের চাংগি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামল, সেখানে তখন সকাল ছটা কুড়ি।

এয়ারব্রিজ থেকে বেরিয়ে, ইমিগ্রেশন কাউন্টার অবধি যেতে গিয়ে টুপুর বেজায় মুগ্ধ। ম্যাপে সিঙ্গাপুর একটা ফুটকির মতো দেশ, তার কী পেল্লাই এয়ারপোর্ট! ভিতরে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য, চলমান রাস্তা। কাচ ঘেরা অজস্র লাউঞ্জ। অগুনতি বোর্ডিং গেট। কাচের ওপারে, গুমটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের মতো সার-সার এরোপ্লেন দেখা যায়। ডিউটি ফ্রি শপের এলাকাও কী বিশাল! কত কিসিমের যে ঝলমলে দোকান সেখানে। সব মিলিয়ে কার্পেট মোড়া বিমানবন্দরের অন্দরটি রীতিমতো চোখ ধাঁধানো।

পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষার জায়গাটা নীচে। চলন্ত সিঁড়ি ধরে নামতে হয়। ছোট-ছোট লাইন পড়েছে সেখানে। কাউন্টারের কর্মীরা বেশ চটপটে, কাজ হচ্ছে দ্রুত। লাইন থেকেই টুপুর দেখতে পেল। তাদের আগে বেরিয়ে গেলেন সুজিত দত্ত। টুপুরদের দিকে সেভাবে ফিরে তাকালেন না। লাগেজ সংগ্রহের সময়ে তাকে এদিক-ওদিক খুঁজল টুপুর। চোখে পড়ল না। এবারও আগেই চলে গিয়েছেন।

টুপুর মনে-মনে হাসল একটু। প্লেনে পার্থমেসো কীভাবে জেরা করেছেন কে জানে, তারপর থেকে ভদ্রলোক আর তাদের দিকে ঘেঁষছেনই না। বুঝি টের পেয়েছেন, তার গায়েপড়ে ভাব জমানোটা টুপুরদের পছন্দ হয়নি। ভদ্রলোককে মিছিমিছি সন্দেহ করারও বোধ হয় কোনও মানে হয় না। পার্থমেসোই ঠিক। ডিটেকটিভরা দড়িকে সাপ বলে ধরে নেয়।

কাস্টমসের গণ্ডি পেরোতেও সময় লাগল না বিশেষ। ব্যাগ-সুটকেস ট্রলিতে বসিয়ে ঝাঁ-চকচকে এয়ারপোর্টটার বাইরের দিকে এল টুপুররা। পার্থমেসোর পিছু-পিছু। অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে এখানে। কারও হাতে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড, কেউ বা সন্ধানী চোখে তাকাচ্ছে ইতিউতি। কিন্তু পেঙ্গুইনের লোক কোথায়?

এতক্ষণ পাৰ্থ দারুণ সপ্রতিভ ছিল, এবার যেন ফাঁপরে পড়েছে। ঈষৎ উদভ্রান্তের মতো টুপুরকে বলল, কী রে, আমার নাম লেখা কোনও বোর্ড দেখছি না যে?

তাই তো। যদি কেউ নিতে না আসে কী হবে?

ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমরা কি জলে পড়ে গিয়েছি? বুমবুমের হাত শক্ত করে ধরে থাকা মিতিন অভয়বাক্য শোনাল, একেবারে খালি হাতে তো আসিনি। সিঙ্গাপুরের ট্যাক্সি সার্ভিসের খুব সুনাম। টুরিস্টদের সচরাচর ঠকায় না। তেমন বুঝলে ট্যাক্সি পাকড়াও করে ভাল কোনও হোটেলে চলে যাব।

তার অবশ্য দরকার হল না। হঠাৎই যেন মাটি ফুড়ে আবির্ভূত হলেন এক ভদ্রলোক। বয়স বছর পঞ্চাশ। কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। গায়ের রং আবলুশ কাঠের মতো কালো। মুখখানা যেন শুকনো লিচুর আঁটি। পরনে কালো সুট, কটকটে লাল রঙের টাই।

ব্যস্তসমস্তভাবে ভদ্ৰলোক বললেন, আই হোপ ইউ আর মিস্টার পি পি মুখার্জি? ফ্রম ক্যালকাটা?

পার্থ গম্ভীরস্বরে বলল, ইয়েস।

আয়্যাম ফ্রম পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল, ভদ্রলোক ঝুঁকলেন সামান্য দক্ষিণ ভারতীয় টানে ইংরেজিতে বললেন, অনুগ্রহ করে আমাদের সংস্থার আমন্ত্রণপত্রটি দেখাবেন কি?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, পার্থ কাঁধের ব্যাগ থেকে খাম বের করে দিল। মুখটা খুলে ভদ্রলোক আলগা চোখ বোলালেন চিঠিতে। তারপর চিঠিসুদ্ধ খাম চালান করলেন কোর্টের পকেটে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে গদগদ মুখে বললেন, ওয়েলকাম স্যার, পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে সিঙ্গাপুরে সুস্বাগতম। আমি কি আপনাদের অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি?

খুব বেশি নয়, মিনিটদশেক।

 সরি স্যার। দেরি হওয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত … আসুন, আপনাদের গাড়ি রেডি আছে।

গাড়িটা জাপানি। চেহারাটি নয়নলোভন। গাড়িতে ওঠার আগে মোবাইল ক্যামেরায় টুক করে গাড়িটার একটা ছবি তুলে নিল পার্থ। তারপর বসল সামনের সিটে। দরজা খুলে ভদ্রলোকও উঠেছেন। পাৰ্থর পাশে। চালকের আসনে। পিছনে টুপুর, মিতিন, বুমবুম। আকাশে বুমবুমের ঘুম তেমন জুতসই হয়নি, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে ওঠামাত্র সে চোখ বুজে ফেলল।

এয়ারপোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে এল গাড়ি। প্রথমটা ভদ্রলোক চুপচাপই ছিলেন, পাৰ্থর কৌতূহলের তোড়ে মুখ খুললেন ধীরেধীরে। দিব্যি জমে গেল আলাপ। ভদ্রলোক তামিল। নামটি বিশাল। কুম্ভকরম শ্রীনিবাসরাঘবন সৌম্যনারায়ণ। বারবার আউড়েও নামটা গুলিয়ে ফেলছিল পার্থ। অবশেষে ভদ্রলোকই সরল করে দিলেন। বললেন, তাকে কে এস এস বলেও ডাকা যেতে পারে। কিংবা শুধু নারায়ণ।

কথায় কথায় জানা গেল চাকরিসূত্রে ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরেছেন ভদ্রলোক। আপাতত কৰ্মসুত্রে সিঙ্গাপুরে আছেন বছরপাঁচেক। কলকাতাতেও নাকি ছিলেন কিছুদিন। সেই সূত্রেই ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। বোঝেনও মোটামুটি।

জানলার বাইরে চোখ মেলে, অচেনা শহরটাকে দেখতে দেখতে নারায়ণের কথা শুনছিল টুপুর। কী চমৎকার চওড়া-চওড়া মসৃণ রাস্তাঘাট। দু ধারে একের পর এক আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। তবে শুধু ইটকাঠের জঙ্গল নয়, মাঝে-মাঝেই ঘন সবুজেরও দর্শন মিলছে। কোথাও এতটুকু ধুলোময়লা নেই। সবে সওয়া সাতটা, এর মধ্যেই অসংখ্য গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। মাপা গতিতে ছুটছে তারা। নিঃশব্দে। হর্ন না বাজিয়ে। চমৎকার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। কোথাও কোনও পথচারী যেমন-তেমনভাবে রাস্তা পার হচ্ছে না। ফুলে ভরা বোগেনভেলিয়ার লতায় সাজানো ফুটব্রিজ রয়েছে কিছু দূর অন্তর-অন্তর, ওই সেতু ধরেই পথ পারাপার করছে মানুষ। এমন ছবির মতো শহর দেখলে মনটা এমনিই কেমন ভাল হয়ে যায়।

টুপুর আপন মনে বলে উঠল, সিঙ্গাপুর তো সত্যিই ভারী সুন্দর।

প্ৰশংসাটা নারায়ণের পছন্দ হয়েছে। খুশি খুশি মুখে বললেন, অবশ্যই সুন্দর। তবে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে এমনটি ছিল না। এখন সিঙ্গাপুর নিজ গুণে সারা দুনিয়ার নজর কেড়েছে।

সত্যি, কী ছিল সিঙ্গাপুর আর কী হয়েছে। ঘুমন্ত বুমবুমের মাথা কাঁধে টেনে নিয়ে মিতিন বলে উঠল, এক সময় তো এখানে চুরি ছিনতাই খুনখারাপি লেগেই থাকত। ঠগ জোচ্চোরের ভয়ে লোকে সিঙ্গাপুরে আসতেই চাইত না।

পার্থ বলল, আহা, অতটা বদনাম কোরো না। হাল খারাপ হয়েছিল ঠিকই, তবে সে তোদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। যখন জাপানিরা ব্রিটিশদের হারিয়ে সিঙ্গাপুরের দখল নিয়েছিল। তার আগে এই রকম ঠাটবাট না থাকলেও শহরটার কিন্তু নাম ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় বন্দরগুলোর একটা বলে কথা। সিঙ্গাপুর থেকে কোথায় না জাহাজ ছাড়ত তখন!

সে তো এখনও যায়। শুধু জাহাজ নয়, উড়োজাহাজও।

 তবে বন্দরটা আরও বড় হয়েছে ম্যাডাম, নারায়ণ মিটিমিটি হাসছেন, পৃথিবীর খুব কম মালবাহী জাহাজই বলতে পারবে, সে কখনও সিঙ্গাপুর ছোঁয়নি। প্লাস, এখানে এখন কত ইন্ডাস্ট্রি। জাহাজ তৈরির কারখানা, অয়েল রিফাইনারি, ইস্পাত… এ ছাড়া বিশালবিশাল শপিং সেন্টার… ইলেকট্রনিক গুডস তো এখানে অনেক সস্তায় পেয়ে যাবেন।

পার্থ টুপুরের দিকে ঘুরে বলল, মাইন্ড ইট, সিঙ্গাপুরের এত উন্নতি কিন্তু হয়েছে গত তিরিশ-চল্লিশ বছরেই।

ঠিক বলেছেন, নারায়ণ রায় দিলেন, জাপানিরা শহরটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। শুধু একজন মানুষ দেশটাকে নতুন করে গড়ে তুললেন।

মিতিন বলল, আপনি নিশ্চয়ই লি-কোয়ান-ইউয়ের কথা বলছেন?

ইয়েস ম্যাডাম। প্রচুর ঝড়ঝাপটা গিয়েছে সিঙ্গাপুরের উপর দিয়ে। জাপানিরা হটে যাওয়ার পর আবার এল ব্রিটিশ শাসন। তারপর বেশ কিছুদিন খিচুড়ি অবস্থা। এক সময় সিঙ্গাপুর ঢুকে গেল মালয়েশিয়ার মধ্যে। সেখান থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা এল ১৯৬৫ তে। আর তখন থেকেই লি-কোয়ান-ইউ শক্ত হাতে হাল ধরলেন সিঙ্গাপুরের। এখানকার স্থানীয় মানুষদের মুখে তো গল্প শুনি, তিনিই নাকি সিঙ্গাপুরের বাসিন্দাদের স্বভাবচরিত্র পুরো বদলে দিয়েছেন।

কী রকম? কী রকম? টুপুর কৌতূহলী হল।

বলে শেষ করা যাবে না, নারায়ণ নিপুণ হাতে গাড়ি বাঁয়ে ঘোরালেন, ছোট একটা উদাহরণ দিই। সিঙ্গাপুরে চিনারাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। প্রায় সত্তর ভাগ। তাদের একটা অভ্যেস ছিল যত্রতত্র থুতু ফেলার। এখন এই দ্বীপে একটা চিনাকেও তুমি খুঁজে বের করতে পারবে না, যে রাস্তায় থুতু ফেলছে।

জানি, মিতিন মাথা নাড়ল, এককালে নিয়ম না মানার জন্যই সিঙ্গাপুর কুখ্যাত ছিল। এখন সর্বত্রই এখানে নিয়মের শাসন। কেউ পথঘাট নোংরা করে না, ট্রাফিক আইন অমান্য করে না, কোথাও কোনও বেচালপনা নেই, রাত দুপুরেও যেখানে ইচ্ছে নিৰ্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়…

তাই নাকি? পাৰ্থ ঠাট্টা জুড়ল, সিঙ্গাপুরকে কি তা হলে স্বৰ্গরাজ্য বলতে পারি?

প্রায়। তবে এমনই এমনই হয়নি। এখানে ঠেলার নাম বাজি। এ দেশে আইন এমনই কঠোর যে, ভয়ে আইন মানে লোকে। অন্যায় করলে শাস্তি তোমায় পেতেই হবে। সে তুমি যত শাহেনশা লোকই হও না কেন, মিতিন বুমবুমের চুলে বিলি কাটছে, একটা ঘটনার কথা বলি শোনো। মাইকেল ফে নামে এক আমেরিকান ছেলে জাস্ট মজা করে একটা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির গায়ে আঁচড় কেটেছিল। এখানে রাস্তায়-রাস্তায় লুকনো ক্যামেরা থাকে, ছেলেটি ওই ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়। শাস্তি হয়, কুড়ি ঘা বেত মারা হবে তাকে। খবর রটে যেতেই চারদিকে হইহই, আমেরিকারও মাথায় হাত। একজন আমেরিকান সিঙ্গাপুরের মত এক পুঁচকে দেশের বিচারে প্রকাশ্যে বেত খাবে? স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লি-কোয়ানইউকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন, মাইকেল ফে-কে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। লি-কোয়ান-ইউয়ের সাফ জবাব, অসম্ভব। আমাদের দেশে আইন ইজ আইন। তবে হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট যখন অনুরোধ করছেন, তাঁর সম্মান রক্ষার্থে বেতটা আস্তে মারা হবে।

তুমি এই গপ্পো জানলে কোত্থেকে? পাৰ্থর ভুরুতে ভাঁজ, আগে বলোনি তো?

মন দিয়ে নিউজ পেপার পড়তে হয়, স্যার। শুধু শব্দজব্দ আর সুডোকুর জন্য তো কাগজ কেনা হয় না।

কবে বেরিয়েছিল কাগজে?

 বিল ক্লিন্টন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

 ধুৎ, গুল মারছ, পাৰ্থর তবু অবিশ্বাস যায় না, কী মিস্টার নারায়ণ, আপনি শুনেছেন গল্পটা?

মনে করতে পারছি না। তবে ম্যাডাম যখন বলছেন, হতেও পারে, নারায়ণ এবার ডান দিকে গাড়ি ঘোরালেন। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায় ঢুকেছেন। ভিড়-ভিড় এলাকা। গাড়ির গতি কমিয়ে বললেন, ম্যাডাম দেখছি খবরটবর রাখেন খুব? সাংবাদিকতার পেশায় আছেন নাকি?

না না, ও তো প্রফেশনাল…

পার্থ পরিচয়টা দেওয়ার সুযোগ পেল না, তার আগেই মিতিনের প্রশ্ন, আসল খবরটাই তো এখনও জানা হয়নি মিস্টার নারায়ণ। আমরা উঠছি কোথায়?

কার্লটন হোটেল।

 সেটা কোথায়?

লিটল ইন্ডিয়ায়, নারায়ণের স্বরে পেশাদারি ভদ্রতা, আমাদের ভারতীয় অতিথিরা লিটল ইন্ডিয়ায় থাকাই পছন্দ করেন।

অভারতীয় অতিথিও আসেন বুঝি?

অবশ্যই। সুডোকুর প্রতিযোগিতা পৃথিবীর অনেক শহরেই চলে। নিউ ইয়র্ক, সিডনি, টোকিও, লন্ডন… পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল শুধু নামেই নয় ম্যাডাম, কাজেও আন্তর্জাতিক। এই তো, আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আমি এক জাপানি দম্পতিকে রিসিভ করতে যাব।

বলতে বলতে গাড়ির গতি আরও কমিয়েছেন নারায়ণ। বাঁয়ে হোটেল কার্লটনের সাইনবোর্ড। বড়সড় কম্পাউন্ডটায় ঢুকে গাড়ি হোটেলের দোরগোড়ায় থামল। নারায়ণ নেমে নিজের হাতে দরজা খুলে ধরেছেন, আসুন আপনারা, প্লিজ।

প্ৰথম দৰ্শনেই হোটেলটা বেশ মনে ধরে গেল টুপুরের। সামনে অর্ধবৃত্তাকার লন, আর ফুলের বাগান দিব্যি শোভা এনে দিয়েছে। বহিরঙ্গে। চারতলা বিল্ডিংটাও বেশ নতুন-নতুন। শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, শ্বেত পাথরের মেঝে… নাঃ, পেঙ্গুইন ইন্টারন্যাশনাল খুব একটা আজেবাজে জায়গায় রাখছে না।

একতলার ১০৪ নম্বর রুমে টুপুরদের ঢুকিয়ে দিয়ে নারায়ণ বিদায় নিলেন। নিজের মোবাইল নম্বরও দিয়ে গেলেন যাওয়ার আগে। পরশু সন্ধে অবধি এই হোটেলই এখন টুপুরদের আস্তানা।

ঘরে এসে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে বুমবুমকে। টুপুরও পাশে গড়িয়ে পড়ল। মিতিন ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছে টয়লেট, অ্যান্টি রুম। কাঠের দেওয়াল-আলমারিতে ব্যাগ সুটকেস রেখে দিয়ে বড় করে আড়মোড়া ভাঙল পার্থ। চোখ টিপে জিজ্ঞেস করল, কী রে টুপুর, ঘরটা কেমন?

সবই ভাল। শুধু

কী শুধু?

দোতলা-তিনতলা হলে বেটার হত। ব্যালকনি পাওয়া যেত একখানা।

এই তো বিপদে ফেললি, পাৰ্থ আঙুলে চুল পাকাচ্ছে, দা^ড়া, রিসেপশনে একবার বলে দেখি। যদি পটিয়ে-পাটিয়ে ম্যানেজ করতে পারি… এক্সট্রা কিছু লাগে তো দিয়ে দেব।

বলেই পাৰ্থ দুম করে ধাঁ। ফিরল প্ৰায় মিনিট কুড়ি পর। চোখমুখে টগবগ করছে উত্তেজনা।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কী গো, ব্যবস্থা হল?

আজ নয়, কাল সকালে পেয়ে যাব। টপ ফ্লোরে। খুশি?

 ভীষণ।

এবার তার চেয়েও বড় খবরটা দিই? শুনে তোর মাসি বুদ্ধিতে শান দিতে থাকুক?

কী খবর গো?

লাগোয়া বাথরুম থেকে জল ছিটিয়ে এসে মুখ মুছছিল মিতিন। তোয়ালে কাঁধে ফেলে বলল, সুজিত দত্ত এই হোটেলে উঠেছেন, তাই তো?

হ্যাঁ, এই মাত্র চেক ইন করলেন, বলতে বলতে পার্থ তোতলাচ্ছে, তু-তু-তুমি কী করে জানলে?

মিতিন হেসে বলল, আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির নাম কী মনে আছে তো? থার্ড আই। তৃতীয় নয়ন। এটা আমার ওই তৃতীয় চক্ষুর নমুনা।

টুপুর আর পার্থ চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। নাঃ, কারওরই মাথায় টুকছে না।

.

০৪.

সাড়ে নটা বাজে। বুমবুম এখনও ঘুমে কাদা। সে না জাগা পর্যন্ত বেড়াতে বেরনোর কোনও সুযোগই নেই। অগত্যা টুপুর আর মিতিন স্নান সেরে নিল একে-একে। রাতে প্লেনে কারওরই ঠিকঠাক ঘুম হয়নি, ফলে গা-টা ম্যাজম্যাজ করছিল। শাওয়ারের ঠান্ডা জলে বেশ তরতাজা হল শরীর। এবার পার্থ ঢুকেছে বাথরুমে।

সুজিত দত্তর কেসটা এখনও টুপুরের মাথায় চেপে আছে। চুলটুল আঁচড়ে, জিল্স, টি-শার্ট পরে ঘরের বাইরে একবার পাক খেয়ে এল টুপুর। টানা লম্বা প্যাসেজ একেবারে শুনশান, দুধারে সব কটা রুমেরই দরজা বন্ধ। উহুঁ, বোঝার জো নেই সুজিত দত্ত ধারেকাছে আছে কিনা।

ঘুরে এসে টুপুর ফের মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, সুজিত দত্ত কি সত্যিই আমাদের ফলো করে এখানে এসে উঠল?

সুটকেস খুলে বুমবুমের জামাপ্যান্ট বের করছিল মিতিন। হালকা গলায় বলল, আমি তো কোনও কারণ দেখি না।

আমিও। ভদ্রলোক আমাদের অযথা ধাওয়া করবেনই বা কেন? এখানে ওঠা হয়তো নিছক কাকতলীয়।

সেরকমই কিছু ধরে নে। অনর্থক টেনশন করছিস কেন? মিতিন সুটকেসের ডালা বন্ধ করল, শুধু একটা কথাই বলব, চোখ কানটা খোলা রাখবি।

সে তো টুপুর রাখবেই। কথা না বাড়িয়ে টুপুর টিভির রিমোটখানা হাতে তুলে নিল। বিছানায় বসে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। বেশিরভাগই স্থানীয় চ্যানেল। কোথাও সিঙ্গাপুরি মেয়েদের ফ্যাশন প্যারেড চলছে, তো কোথাও ইংরেজিতে নীরস বকরবকর। মালয়ী আর চিন ভাষাতেও অনুষ্ঠান চলছে কোনও কোনও চ্যানেলে। হঠাৎ একখানা ভারতীয় চ্যানেলও এসে গেল। খবর পড়ছেন এক মহিলা। মায়ানমার থেকে ভারতে বাৰ্ড ফ্লুর ভাইরাস ঢোকা বন্ধ করতে সতর্কবার্তা জারি করেছে মণিপুর সরকার … শুটিংয়ের জন্য ঐশ্বর্য রাইয়ের সঙ্গে অভিষেক বচ্চনের বিয়ে পিছিয়ে গেল … আগ্রায় গত কাল গ্রেপ্তার হয়েছে এক বিদেশি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে ফোটো তোলার অপরাধে…

শেষ খবরটা শুনেই টুপুর ঝট করে ঘাড় ঘোরাল, লোকটা নিশ্চয়ই স্পাই। তাই না মিতিনমাসি?

মিতিনও খবরটা শুনছিল। বলল, হতেও পারে। তবে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

কেন? লোকটা তো ক্যামেরা সমেত হাতেনাতে পাকড়াও হয়েছে?

দুর, গুপ্তচররা কি অত বোকা হয় নাকি? সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে শাটার মারবে? তা ছাড়া আজকাল আর স্পাইদের দিয়ে ফোটো তোলানোর দরকার হয় না। এখন আকাশে ছেড়ে রাখা উপগ্রহের কল্যাণে মিলিটারিদের প্রায় প্রতিটি খুঁটিনাটি খবরই জোগাড় করে ফেলা যায়। কোথায় কোন যুদ্ধজাহাজ ঘুরছে, কোন এয়ারবেসে কটা যুদ্ধবিমান রাখা আছে, অবিরাম তার ফোটো। তুলছে স্যাটেলাইটের ক্যামেরা। আর সেই ক্যামেরা এত শক্তিশালী যে, যুদ্ধজাহাজের স্ক্রুগুলো পর্যন্ত তার নজর এড়ায় না।

ও। তার মানে এখন উপগ্রহগুলোই স্পাই? মানুষ-গুপ্তচরের দিন শেষ?

পুরোপুরি নয়, তাদেরও কাজ আছে। কোথায় কোন ফ্রন্টে কত মিলিটারি পাঠানো হবে, কবে কখন কোন ব্যাটেলিয়ান কোথায় সরবে, কিংবা কোনও দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করার মতলব ভজছে কিনা… এ সব খবর তো মানুষকেই জোগাড় করতে হয়।

কীভাবে পায় খবরগুলো?

হাজারও উপায় আছে। গুপ্ত ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন বসানো থাকে কোথাও কোথাও। সৈন্যবাহিনীর মধ্যেও গোপন খবর পাচার করার লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, মিতিন মুচকি হাসল, জানিস তো, ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের যিনি দুনম্বর বড়কর্তা ছিলেন, সেই কিম ফিলবি কিন্তু আদতে ছিলেন এক রাশিয়ান গুপ্তচর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি কত খবর যে রাশিয়াকে সাপ্লাই করে গিয়েছেন…

বলো কী? কেউ ধরতে পারেনি?

ওস্তাদ স্পাইদের ধরে ফেলা খুব সহজ কাজ নয় রে। তারা খবর পাচারের নিত্যনতুন টেকনিক বের করে। হয়তো সকলের চোখের সামনে দিয়েই খবর পাঠিয়ে দেবে, কিন্তু কায়দার গুণে কেউ ঘূণাক্ষরেও টের পাবে না। কত ধরনের সাংকেতিক ব্যাপারস্যাপার যে থাকে, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই।

মাসি-বোনঝির বাক্যালাপের মাঝেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল পার্থ। দাড়িটাড়ি কামিয়ে। স্নানটান সেরে। আচমকা সেও নাক গলাল আলোচনায়। বিজ্ঞের সুরে বলল, ক্লস ফুকসের নাম শুনেছিস, টুপুর বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আবার গুপ্তচরও বটে। তিনি তো অ্যাটম বোমের আস্ত ফর্মুলাটাই আমেরিকা থেকে রাশিয়ায় চালান করে দিয়েছিলেন। কীভাবে করেছিলেন জানিস?

 সে গপ্পো পরে হবে, মিতিন বাধা দিল, এখন ছোটসাহেবকে তোলো। সারা সকাল ঘরেই কাটাব নাকি, অ্যাঁ?

বলার সঙ্গে সঙ্গে পটাং চোখ খুলে গিয়েছে বুমবুমের। ফিক করে হেসে বলল, আমি তো জেগেই আছি।

তা হলে এবার দয়া করে গাত্ৰোত্থান করো। দশ মিনিটের  মধ্যে রেডি না হলে তোমাকে রেখেই কিন্তু আমরা বেরিয়ে যাব।

আর ফাইভ মিনিটস বেশি দাও মা, প্লিজ।

পনেরো মিনিট নয়, বুমবুমের তৈরি হতে সময় লাগল পাক্কা পঁচিশ মিনিট। তার মধ্যে অবশ্য পার্থ টুকটাক কিছু কাজ সেরে নিল। হ্যান্ডিক্যামে নতুন ক্যাসেট ভরা, ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া। চাংগি এয়ারপোর্টের টুরিস্ট কাউন্টার থেকে সিঙ্গাপুরের দর্শনীয় স্থান সংক্রান্ত বেশ কিছু লিফলেট জোগাড় করেছিল, সেগুলোও পুরল পকেটে। ব্যস, এবার বেরিয়ে পড়লেই হয়।

রুমে চাবি লাগিয়ে ডাইনিং হলে এল সকলে। সামনের টেবিলটাতেই বসেছে। মেনুকার্ড দেখতে-দেখতে পার্থ জিজ্ঞেস করল, কী রে টুপুর, কী খাবি?

টুপুর কাঁধ ঝাঁকাল, এনিথিং।

হেভি? না লাইট?

মিতিন বলল, প্লেনে অনেক রাত্তিরে ডিনার হয়েছে, এখন হালকাই ভাল।

তাই হোক তবে, পার্থ মুখভঙ্গি করল, সেই সঙ্গে লাঞ্চ, ব্রেকফার্স্ট, ডিনারের ব্যাপারে একটা প্রিন্সিপলও তৈরি হয়ে যাক। এখন থেকে খাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাঁধাধরা টাইম থাকবে না। যখনই জাগিবে জঠর, তখনই আহার।

মিতিন হেসে বলল, জঠর নয়, বলো তোমার রসনা।

বটেই তো। রসনাকে তো তৃপ্ত করতেই হবে। মালয়েশিয়ান খাবার খাব, ইন্দোনেশিয়ান চাখব, থাই ফুড, চাইনিজ কোরিয়ানও টেস্ট করতে পারি..

সব হবে। তবে এখন সাহেবি ব্রেকফার্স্টটাই বলো।

সেই মতোই অর্ডার দেওয়া হল। বাটার টোস্ট, টার্কি সসেজ, স্ক্র্যাম্বল্ড এগ আর কফি। বুমবুমের জন্য মিল্কশেকও বলা হল এক গ্লাস।

বিলিতি নাস্তা টেবিলে পৌঁছনোর আগেই ছোট্ট ঝটকা। সুজিত দত্ত ঢুকছেন ডাইনিং হলে। পার্থদের দেখে পলকের জন্য থমকালেন যেন। পরক্ষণে নিজেই এগিয়ে এসেছেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, সাহেব দেখছি ক্যামেরা কাঁধে রেডি। তা চললেন কোথায়?

মিতিনকে এক ঝলক দেখে নিয়ে পার্থ বলল, এখনও ডিসাইড করিনি। শুনেছি এখানে সেন্টোসা আইল্যান্ড খুব বিখ্যাত?

অবশ্যই। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা ছোট্ট একটা দ্বীপকে কত সুন্দর করে তোলা যায়, সেন্টোসা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ওখানকার আন্ডার ওয়াটার অ্যাকোয়ারিয়াম তো রীতিমতো তাকলাগানো। এ ছাড়া আমার সাজেশন, জুরং বাৰ্ড পার্কেও একবার যাবেন। ওটা না দেখলে সিঙ্গাপুর আসাই বৃথা।

দর্শনীয় জায়গার লিস্টে তো বোটানিক্যাল গার্ডেন আর চিড়িয়াখানার নামও দেখছিলাম।

 হ্যাঁ। ওগুলোও দ্রষ্টব্য। চিড়িয়াখানায় নাইট সাফারি তো দারুণ ইন্টারেস্টিং, সুজিত দত্ত একগাল হাসলেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন? সিঙ্গাপুর সরকার পর্যটন ব্যাবসাটা খুব ভাল বোঝে। অতি সাধারণ কিছুকেও এমন মনোহারী মোড়কে আপনার সামনে পেশ করবে, আপনি চোখ ফেরাতে পারবেন না। সন্ধেবেলা সিটি সেন্টারের দিকে যান, সিঙ্গাপুর নদীর ধারে বসে থাকলেই আপনার প্ৰাণ জুড়িয়ে যাবে। চারদিকে আলো দিয়ে, ফোয়ারাটোয়ারা বসিয়ে জায়গাটা এমন ভাবে সাজিয়ে রেখেছে। ওদিকে নদীতেও নৌকোবিহারের এলাহি আয়োজন… অথচ লোকে বলে, ওটা নাকি আদতে নদীই নয়। সমুদ্র থেকে ঢুকে আসা আঁকাবাঁকা খাড়ি।

বুঝেছি। বাছাবাছির দরকার নেই। সিঙ্গাপুরে যা দেখব, তাই ভাল লাগবে।

ঠিক। একদম ঠিক। এখানকার জমকালো শপিং মলগুলোও দেখতে ভুলবেন না। চৌষট্টি তলা একটা বাড়ি জুড়ে শুধুই ঝলমলে দোকানপাট, ভাবতে পারেন? আর হ্যাঁ, পারলে পুরনো শহরটাকেও একবার দেখে আসবেন। সেই ব্রিটিশ আমলের ঘরবাড়ি, চার্চ … সেই র‍্যাফলসাহেব যেভাবে সিঙ্গাপুর শহরটার পত্তন করেছিলেন…

একটানা বকেই চলেছেন সুজিত দত্ত। এয়ারপোর্টে যে মানুষটা ফিরেও তাকালেন না, তিনি হঠাৎ আবার ওপরপড়া হয়ে এত কথা বলছেনই বা কেন? বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য আছে কি? টুপুরের কেমন যেন সন্দেহজনক ঠেকছিল। মিতিনমাসিই বা এমন মুগ্ধ শ্রোতা কেন হয়ে গেল হঠাৎ? জরিপ করতে চাইছে সুজিত দত্তকে?

টেবিলে খাবার এসে গিয়েছে। সুজিত দত্ত বোধ হয় সরেই যাচ্ছিলেন এবার, কিন্তু টুপুরকে অবাক করে দিয়ে মিতিনই সহসা বলে উঠল, বসুন না মিস্টার দত্ত। আমাদের সঙ্গেই ব্রেকফার্স্ট করুন।

থ্যাঙ্কস। আমার ব্রেকফার্স্ট হয়ে গিয়েছে।

তা হলে এক কাপ কফিই চলুক। আমরা কফি খেতে খেতে গল্প করি।

এবার আর সেভাবে না করলেন না সুজিত দত্ত। চেয়ার টেনে বসেছেন। ফিলিপিনো বেয়ারাটিকে ডেকে আর-এক কাপ কফির অর্ডার দিল মিতিন। সহজ সুরে বলল, সিঙ্গাপুর শহরটাকে আপনি দেখছি খুবই ভাল চেনেন?

মৃদু হেসে সুজিত দত্ত বললেন, বহুবার এসেছি তো, চষা হয়ে গিয়েছে।

তা হলে আপনিও আজ আমাদের সঙ্গে চলুন না! একসঙ্গে সেন্টোসা ঘুরে আসি।

এবার বুঝি একটু থতমত খেলেন সুজিত দত্ত। একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বেড়ানোর আমার উপায় নেই, ম্যাডাম। একটা বিজনেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, এখনই বেরোতে হবে।

ও। সেন্টোসা আমরা যাব কী করে যদি একটু বলে দেন…

ট্যাক্সি ধরে নিন। সেন্টোসার ভিতরে গিয়েও গাড়ি ছাড়তে পারেন। আবার রোপওয়ে স্টেশনেও নামতে পারেন। রোপওয়েতে চড়ে সেন্টোসা যাওয়াটা বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। কেবলকারগুলো যায় অনেক উঁচু দিয়ে। নীচে সমুদ্রের খাঁড়ি, সিঙ্গাপুরের কেপেল ডক, বিউটিফুল দৃশ্য।

পার্থ ফস করে বলে উঠল, কেবলকারগুলো মাউন্ট ফেবার থেকে ছাড়ে না?

মাউন্ট না আরও কিছু! সুজিতের গলায় শ্লেষ, এখানে ছোট ছোট টিলাগুলোও সব মাউন্টেন! আমার কাছে জেনে রাখুন মশাই, এই শহরের চৌহদ্দির মধ্যে ৫০০ ফিটের বেশি উঁচু কোনও পাহাড়। নেই। সিঙ্গাপুরের বহু বাড়ি ওই পাহাড়গুলোর চেয়ে উঁচু।

অর্থাৎ মাউন্ট বলাটাও সিঙ্গাপুর সরকারের প্যাকেজিংয়ের মধ্যে পড়ে? পার্থ ফিক করে হাসল।

সম্ভবত, বড়-বড় চুমুকে কফির কাপ শেষ করলেন সুজিত দত্ত। ঘড়ি দেখছেন। চোখ তুলে বললেন, আজ তবে সেন্টোসাটাই ঘুরে আসুন। পরে আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাবে। আপনাদের রুম নম্বর যেন কত?

১০৪।

আমি আছি ২১৭-এ। আসি তা হলে?

একটু যেন বেশি তাড়াহুড়ো করেই উঠে গেলেন সুজিত দত্ত। ভদ্রলোক দৃষ্টির আড়াল হতেই পার্থ বলে উঠল, তোর মাসির তো এখন মুশকিল হয়ে গেল রে টুপুর।

কেন?

সুজিত দত্তকে সন্দেহ করার আর তো কোনও উপায় রইল না রে। যে লোকটা যেচে এসে এত আড্ডা দিয়ে গেল, তাকে কি খুব পাজি বলে মনে হয়?

টুপুর বলল, খারাপ ভাল জানি না। তবে ভদ্রলোক কিন্তু বেশ অদ্ভুত রকমের। আমার তো ধারণা, কায়দা করে উনি জেনে গেলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি।

বলছিস? পাৰ্থ চোখ পিটপিট করল, আমরা কি তা হলে ডেস্টিনেশন বদলে ফেলব?

বুমবুমের মিল্কশেক শেষ। চেটোর উলটো পিঠে ঠোঁট মুছতেমুছতে সে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভাল। চলো আমরা বার্ড পার্ক যাই কিংবা চিড়িয়াখানায়।

উহুঁ, ওসব কাল হবে, শেষ সসেজটা মুখে পুরল মিতিন। মাথা দুলিয়ে বলল, আজ এ বেলা সেন্টোসা।