১৬. মাস দেড়েক চলে গিয়েছে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

তারপরে মাস দেড়েক চলে গিয়েছে। এতদিনে দুএক পশলা বৃষ্টি নেমেছে, কিন্তু এতবড়ো নদীর ধারে বর্ষাকাল এভাবে সাধারণত আসে না। ফরাসডাঙার টিলায় নতুন করে চার্চের ভিত বসেনি। দয়ালকৃষ্ণ ফরাসডাঙার লাট জমা দিয়েছে যেমন সে অনেকদিন থেকে দিয়ে আসছে। ওয়ারিশের প্রশ্ন এবারও ওঠেনি। ম্যাকফার্লান রেভেনু বোর্ডে কী লিখেছে জানা যাচ্ছে না।

রাজনগরের লোকেরা কালক্রমে যে-গল্পটাকে মেনে নেবে তা এখনই কারো কারো মুখে শোনা যাচ্ছে : কী একটা গোলমাল আছে ফরাসডাঙার স্বত্বে, সেক্ষেত্রে দখলদারী প্রমাণ করতে রাজকুমারের স্বয়ং সেখানে থাকা ভালো। রানীর শিবমন্দিরই দখল প্রমাণ করে বটে, রাজকুমার নিজে থাকলে যা হয় তেমন কী করে হবে? রাজকুমারের স্বত্বটা হয় কীসে, সে প্রশ্ন তুললে বলতে হয়, পাল্টা স্বত্ব নিয়েই বা কে এগিয়েছে?

দীঘিটা সব কাটা হয়নি। বিঘা পঁচিশেক কাটা হয়েছে উপর উপর, বৈশাখে জল আসেনি।

নায়েবমশায় ইতিমধ্যে ফরাসডাঙায় পাল্কি থামিয়ে নেমেছিলেন। পত্তনিদারদের দুজনকেই প্রথম ধাপে ডাকিয়েছিলেন। বলেছেন, দয়ালকৃষ্ণ আসবে, তোমাদের নিয়ে আমার সেরেস্তায় যাবে। ভালো দিন দেখে নজর দিয়ে এসো।

নায়েবমশায়ের গা-ঢাকা দেওয়ার গল্পটাকে কাছারির আমলারা হেসে উড়িয়ে দেয়। উনি তো বিলমহলের তসীল কাছারিতে তখন। বছরে একবার করে তো যেতেই হয়।

তবে নাকি ডেপুটির পাল্কির বেহারা বদলে গিয়েছিলো মাঝপথে? তার উত্তরে সদর আমিন বলে, তোমরাও যেমন! বেহারা বদলালে কি হয়? ডেপুটির চার বেহারার পাল্কি ধিকিধিকি করছে তখন। ওদিকে তখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বিলমহলের পথও তো সুবিধার নয়। সেজন্যই নায়েবমশায়ের আট বেহারার পাল্কিটা এগিয়ে এসেছিলো। কী? এত মশাল কেন? এই পাল্কি কেন পথে? হুজুর, রাত হয়, আপনার কষ্ট, নায়েবমশায় আপনার জন্য পাঠালেন। ডেপুটি সঙ্গের সিপাহীদের সতর্ক হয়ে আসতে বলে সেই বড় পাল্কিটায় উঠেছিলো। বেহারাদের ভুল। নায়েবমশায় কালেক্টরকে আশা করেছিলেন। ডেপুটি জানলে কি আর নিজের পাল্কি পাঠান? তো, তোমার তেলেঙ্গি সিপাহী কি বিলমহলের জঙ্গলে পথ চিনবে হাতে মশাল থাকলেই? সেদিন গোলমাল ছিলো,নায়েবমশায়ের বরকন্দাজরা ভালো মশাল জ্বালাতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মশাল নিবে গিয়েছিলো। কাজেই ডেপুটির পাল্কি আর তেলেঙ্গিরা গেল একদিকে, অন্যপথেনায়েবমশায়ের পাল্কিতে ডেপুটি। অন্ধকারে এরকম আকছার হয়ই। নায়েবমশায় যে কালেক্টরকে আশা করেছিলেন তার প্রমাণ কাহাররা বেদম ধমক খেয়েছিলো। আরে ছোঃ, এ কী? কাকে এনেছো?

সদর আমিন চিরকালই কথায় লোক হাসাতে পারে। ডেপুটি ছো শুনে একটু তেড়ে উঠেছিলো। তা বাপু তখনও সে ক্ষুঃ শোনেনি। তখন নায়েবমশায় গড়গড়ায় মুখ দিয়ে খানিকটা টানলেন। ক্ষুঃ করলেন। পরে বললেন, বুড়ো হয়েছি, বাপু, কথার দোষ নিও না। তুমি তো সেই ঘোষ ছোকরা? তা বলি কুলীন কায়েত? নাকি শ্রীকৃষ্ণের জাত?

ডেপুটি তবু মাথা নাড়া দেয়। তখন নায়েব বলেছিলেন, ছোটো হলেও জাত বটে। তাহলে তোমাকেই জামাই আদরটা দিতে হয়। এটাই গল্পের উৎপত্তি। সত্যি কি আর নায়েবমশায় তাকে কুলীন কায়েতের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কায়েত করতে চেয়েছিলেন, না, বিল মহলের খাসের তহসীল তাকে বিনা-নজরে পত্তনি দিতে চেয়েছিলেন?

(বিল মহলের খাস তহশীলের আধখানা নিয়ে এক ঘোষ পত্তনিদার বংশে কিছুদিন। আগেও ছিলো বটে। তাছাড়া ও গল্পের, যা নায়েবমশায়ের কাশীলাভের পরে কিছুটা চালু হয়েছিল, যে ঘোষ ডেপুটিকে আটন ফুট লম্বা, দু হাত চওড়া, হাত দুয়েক গভীর কালো একটা অন্ধকার খাদ নায়েবমশায়ের সামনের মেঝে থেকে গালিচা সরিয়ে দেখানো হয়েছিলো, নতুবা সেই বা কায়েত-কন্যাকে কেন শেষ পর্যন্ত বিবাহে রাজী হবে? তার কোনো প্রমাণ নেই)।

একটা ধাঁধা আছে যা কখনো কখনো, বেশ কিছুদিন ধরে, মনে হতো হরদয়ালের। দশ হাজার রানী ভিক্টোরিয়ার মোহরের থলিগুলো ধীরে ধীরে জোগাড় করতে হয় বটে। কিন্তু সে রকম কিছু কিছু থলি তোষাখানায় আছে তা সে-ই যখন জানতো, রানী কি জানতেন না? ফরাসডাঙার দখল নিতে ম্যাকফার্লানকে ডেকে আগেই থলিটা দিলে হতো। এতসব ঘটার কি দরকার ছিলো? ভরসা–এই ডেপুটি মনোহর সিং-এর বাড়ির ব্যাপারটাকেই তদন্তের বিষয় করেছে। ছেলেটি বুদ্ধিমান, তদন্তটা বিলমহলের দিকে গড়িয়ে দিয়েছে। মরেলগঞ্জ ও ফরাসডাঙার তদন্তের ভার তোকালেক্টরের নিজের হাতেই। গত মাসে ছোকরা একবার এসেছিলো, নায়েবমশায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তখনই জানা গিয়েছিলো গজার বাড়িতে মনোহরের নাবালিকা স্ত্রীকে পাওয়া গিয়েছে। নায়েবমশায় হরদয়ালকে এসব বলেছিলো। পরে নিজেই আবার বললো, গজার বিপদের কথা তাই রানীমার কানে আনা যাবে না। হরদয়াল বলেছিলো, একদিক দিয়ে ফুটে বেরোবেই, ভালো উকিল দিয়ে কিছু করা যায়?

কিন্তু আসল কথা, কেন এসব? বুদ্ধিমতী রানীর এটা আর-এক হিসাবের ভুল? সেই দশ হাজার তো দিতেই হলো।

.

রাজচন্দ্র এ বিষয়টাকে আর ভাবে না। সেই রাতেই কালেক্টর জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেই সে বলেছিলো, আপনাদের দেশে কী হয় জানি না। আমাদের দেশে নায়েব, দেওয়ান যখন যা করে রাজার হুকুমেই করে। আমার কোনো কর্মচারী কিংবা প্রজাবর্গ কোনো কিছুর জন্য দায়ী হয় না। হরদয়াল, কালেক্টরকে ইংরেজি করে বুঝিয়ে দাও। ন্যায়, অন্যায়, ভালোমন্দর। দায়িত্ব রাজবাড়ির একমাত্র সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসাবে আমারই।

তার মনে বাগচী সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা ছিলো। বাগচীকে তো নিজের চোখেই সে কালেক্টরের গুলি খেয়ে ঘুরে পড়তে দেখেছিলো। কয়েকদিন পরে যে দাসী ঘরের কাজ করে সে খুব নিচু গলায় বলছিলো, হৈমীদিদি বলেছিলেন শিবঠাকুরের পুরোহিতকে, পুরোহিত আমাকে জানালেন, বাগচীমাস্টার ক্রমশ ভালো হচ্ছেন।

তবে কিছুই আর ভাবার নেই। বাগচী কোথায় তা জেনেই-বা কী হবে? নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও সে কি ভাবছে? দিনরাত্রি মিলে বর্তমান একটা যেন স্তব্ধ তড়াগ। অতীতকে ভেবেই-বা কী লাভ? একদিন সে ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলো, অতীতকে আমরা মনে আনি ভবিষ্যতের জন্য। বর্তমানের জন্য আদৌ নয়।

একদিন তার ভৃত্য বলেছিলো, হুজুর, রূপকাকা পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার সকালে বিকালে বেড়ানো হয় কিনা। তা আমি তেলেঙ্গি দুটোকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারাও বললো, হুজুরকে তারাও বেড়াতে দেখেনি। মন্দির দিয়ে, মাঠ দিয়ে, নদীর ধার দিয়ে কতই তো বেড়ানোর জায়গা!

রাজচন্দ্র একসময়ে তার সেই নতুন ঘোটকীর কথা মনে করেছিলো। ছুটতে পারে বটে। একবার ছুটিয়ে আনলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায় সারাদিনের মতো। একদিন হঠাৎ তার পিয়ানোর কথা মনে হয়েছিলো। খুবই সত্য যে পিয়ানোর ঘাটে হাত রাখলে মন ফাঁকা থাকে না।

পিয়েত্রোর বাংলোর জানলা দিয়ে নদীর বাঁধানো পার চোখে পড়ে। সে জানে পারের পরেই শুকনো খাত, তার অনেক পরে জল। একদিন বাংলোর বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছিলো আলোতে নদীর জল কাঁপছে, মৃদু ঢেউ তুলছে। এমন যে চোখে ধাঁধা লাগে, চোখে আর দেখতে পায় না। সে কিন্তু চোখের ভুল, সেখান থেকে নদীর জল চোখে পড়ে না।

কিন্তু রাজবাড়ি থেকেই তো তার আহার ও পরিচ্ছদের উপকরণ আসে। একদিন সেখানে খবর গেলো, রাজকুমার ইদানীং অর্ধেকও খাচ্ছেন না। শরীর কি শুকিয়েছে? রাজবাড়িতে কথা হলো ঝিয়ের বদলে একজন রাঁধুনি পাঠালে হয়। নায়েবের পরামর্শ চাইলে

জানা গেলো, এক আসবে এক যাবে, তাতে তেলেঙ্গিদের আপত্তি কী?

দু-চারদিনে রাজচন্দ্র একবার খেয়াল করলো রান্নার স্বাদে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যে স্বাদের কথা তুলো আর যে পাত্রটাকে ঠেলে দিয়ে উঠে গেলো তারা এক লোক নয়। সে যখন খেতে বসে সামনে ভৃত্য থাকে, ঝি তার পিছনে। গগাড়া থেকেই তাই ব্যবস্থা। সেও কথা বলে না, তাদের সাহস কী কথা বলে? প্রথম কয়েকদিন তবু ভৃত্য এসে বলতো খেতে দেব, হুজুর? খেতে দেওয়া হয়েছে। এখন সে-ই নিয়মমতো গিয়ে বসে খাওয়ার জায়গায়।

একদিন এক মুহূর্তের জন্য অসাবধানতার ফলে রাঁধুনি ভৃত্যের আগে দাঁড়িয়েছিলো। রাজচন্দ্রর মনে হলো জাল জাল কম দামের শাড়ির পায়ের কাছে কিছু একটা চক চক করছে। সোনার মল? যে সোনার মল দেখলো, যে আহারের স্বাদ নিচ্ছে তারা যেন দুজন মানুষ।

একদিন আবার রাজচন্দ্রর মনে হলো সময় যদি স্রোত হয় তবে তার দহও থাকতে পারে। স্রোতটা বয়ে যেতে থাকলে উপর থেকে কোথায় দহ বোঝা যায় না। কিন্তু স্রোতের গতি কমলে জলটা দহে জমতে থাকে। দহের পার ছাপিয়ে আর বহতা থাকে না।

কয়েকদিন থেকেই নদীর দিকে চেয়ে থাকলে, বিশেষ দুপুর যখন শেষ হতে থাকে, ধুলো ওড়ে। বাঁধের উপরে ঝুঁকে থাকা আকাশে ধূসর রং দেখা যায় হালকা নীলের নিচে নিচে। ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে আকাশে একরকমের অদ্ভুত সজে মেঘ দেখা দিয়েছিলো। হলুদ, সবুজ, ধোঁয়ার রং মিলে একটা থমথমে ভাব। হতেই পারে। জ্যৈষ্ঠ শেষ হতে চলে, কালবৈশাখী হয়নি একঘণ্টার জন্যও।

সেদিন দুপুরের পরপরই হঠাৎ নদীর দিক থেকে কয়েকটা ধুলোর ঝাপটা এলো। কিছুক্ষণ বাদে সেদিকের আকাশে খানিকটা কালো মেঘ দেখা দিলো। সেই কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে গেলো। খানিকটা বাদে যেন বাতাস একদম বন্ধ। একদল কাক তাড়াতাড়ি ডেকে উড়ে পালালো। মিনিট দশেক গেলো না বিকেলের আকাশে সন্ধ্যা নেমে গেলো যেন। এমন যে নদীর উপরের আকাশটা বিদ্যুতে চিরছে মনে হলো।

রাঁধুনি আর ভৃত্য জানলা দিয়ে দেখছিলো। ভৃত্য বললো, আলো জ্বালাতে হবে।

ভৃত্য ঘরে ঘরে আলো জ্বালতে চলে গেলো।

রাঁধুনি দেখলো রাজকুমার বাংলোর বারান্দায় এলো। খানিকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রাজকুমার বারান্দা থেকে মাঠে নামলো। মাঠে থেকে থেকে একটা বাদামী রং পড়ছে, যেন উপর থেকে। রাজকুমার মাঠে ঘুরে ঘুরে অবশেষে মন্দিরের সেই উঁচু চত্বর, যা প্রকৃতপক্ষে ফরাসী পিয়েত্রোর হাওয়া ঘরের ভিত, তার উপর গিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে চত্বরের কিনারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যেন কৌতুকে আর কৌতূহলে কিছু দেখছে।

আর এক ঝাঁক পাখি খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে উড়ে গেল। মাঠের উপরের বাদামী রংটা ছাই-এর রং নিলো এবার।

এই দ্যাখো, নিজের মনে মন্তব্য করলো রাঁধুনি, রাজকুমার চত্বর থেকে নেমে ডানদিকে চলেছে! ওটা কি হাতিশুড়ো যা নিচে থেকে বাঁধ ছাড়িয়ে উঠলো এবার? রাজকুমার কিন্তু সেটাকে আমল দিলো না। দাঁড়িয়ে পড়ে শূন্যে দুহাত তুলছে। এত দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু আকাশে কি কিছু আছে, যার দিকে হাত তুলছে?

রাঁধুনি বারান্দায় এলো। সে দেখলো ডানদিকে বাঁধের উপরে একটা অদ্ভুত চেহারার কালো মেঘের টুকরো। সেটাই যেন রাজকুমারের লক্ষ্যে। কালো আর সাদায় মিশিয়ে তৈরী সেই মেঘ। তার জন্যই যেন হাত দুটো আকাশের দিকে তোলা।

এ তো ঝড়, এ তো ঝড়, এই বললো– রাঁধুনি। মাটির উপরে সর সর খর খর করে, দরজা-জানালার ঝাপটা শব্দ দিয়ে, বাতাসটা বারান্দাতে ধাক্কা মারলো। নদীর ধারে-কাছে বাতাসে বালি থাকবেই। নাকি সেই হাতিশুড়োটা ভেঙে পড়লো? গাছপালা নেই, এত শোঁ শোঁ শব্দ কিসের?

কিন্তু এ কী কাণ্ড! রাজকুমারকে দেখা যায়, যায়ও না। দ্যাখো, ঝড় উঠে এসেছে, ঝড়। পাক খাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেলো। রাজকুমার সেই মেঘের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে মুখটা এখনো উঁচুদিকে। হঠাৎ ভয় হলো রাঁধুনির, যেভাবে চলেছেন বাঁধের ধার থেকে নিচে পড়ে যান যদি!

রাঁধুনি বারান্দা থেকে নেমে নিজেকে বললো, দাঁড়ানো যায় না দেখি। কিছু যেন তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলো। সে কি ডাকবে রাজকুমারকে? এই শব্দে তা কি শোনা যাবে?

দাঁড়ানোই যায় না। চাদর খুলে গিয়ে পতাকার মতো উড়ছে। তার প্রান্তটাকে গুটিয়ে আনাও কঠিন, তা করতে গেলে পায়ের পাতার ওপরের শাড়ি হাঁটুর কাছে উঠে পাক খাচ্ছে। কিন্তু রাজকুমার? পড়ে গেলেন নাকি?

রাঁধুনি ডাকলো, রাজকুমার! ডাকটা এক হাত দূরে গেলো কিনা সন্দেহ। রাঁধুনি ছুটতে ছুটতে ডাকলো, রাজু! তার পায়ের মলের শব্দ দূরের কথা, তার ফোঁপানোর শব্দও শোনা গেল না।

নয়নতারা ছুটতে-ছুটতে ঘাটের মাথায় এসে দেখলো, দেখাই কি যায় চোখ মেলে, নিচে যেন তোলপাড় চলেছে, যেন বাঁধের কোলে নদীর খাত একটা প্রকাণ্ড মন্থন-ভড়। ধুলোর বাতাস ঘূর্ণি তুলে পাক খাচ্ছে। সে কি নামতে পারে? রাজকুমার হাত ধরে ধরে নামিয়েছিলো তাকে এই ভাঙাঘাটে। চুল এলো হয়েছিলো, হাত তুলে চুল জড়ো করতে গিয়ে চাদরটা গা থেকে উড়ে সিঁড়িগুলোর পাশ দিয়ে নিচে পড়ে অদৃশ্য হলো। কিন্তু রাজকুমার? তাকে তো দেখাই যাচ্ছে না!নয়নতারা চিৎকার করে ডাকলো, রাজুজু! ডাকটা বাতাসের শব্দে ডুবে গেলো না শুধু, যেন তার চাপে ফিরে এসে তার মুখে জড়িয়ে গেলো কান্নার মতো হয়ে। ঘাটের ধাপ বেয়ে নামতে নামতে, সে তো হাতে পায়েই চলা, শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে গেলো নিজের পায়ে জড়িয়ে।

শেষ ধাপটা সে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু রাজকুমার কোথায়? লাফিয়ে নামতে গিয়ে সে হামা দিয়ে পড়েছিলো। এ কী, জলও যে এখানে! এ কি বাতাসের তাড়ায় নদীর জলের উপরে উঠে আসা? উঠতে গিয়ে কাঁধের শাড়ি কোমরে নেমে পৎ-পৎ শোঁ-শোঁ করে উড়ছে। তা সত্ত্বেও সেই শব্দকে–সব শব্দকে ডুবিয়ে নয়নতারা হাহাকার করে উঠলো, রাজু, আমার রাজু।

ঝড়ের গতির বিরুদ্ধে, প্রবাদ আছে, এই গঙ্গার বুকে যখন সেই ঝড়, হাজার পাঁচ হাজার মুণি হলেও, পাল নামিয়ে না দিলে পাল ছিঁড়ে রসাতলে যায় নৌকো। মাস্তুলসমেত পাল উড়ে যায়। বাতাসের ঝাপটায় নৌকোকে চরে তুলে দেয়। ধুলোর ঝাপটায় আলোর চোখ অন্ধ করে। নয়নতারার পক্ষে শাড়ি ধরে রাখাই কি সম্ভব! শেষবার বালিয়াড়িটার মাথায় উঠতে গেলে তা কোমর থেকে নেমে একপাকে হাঁটুর কাছ জড়িয়ে ছিলো। কে আর দেখছে সেসব দিকে? সে তো বালির উপরে কপাল চাপড়ে, আমার রাজু বলে কঁদছে তখন।

আর তখন আকাশ থেকে তেরচা ধারে জলও নামছে। পায়ের তলে তখন মাঝে মাঝে অগভীর জল। বালিয়াড়িটার, তার মাথাও তো তখন ঝড়ে অনেকটাই উড়ে গিয়েছে, ওপারের গোন গায়ে প্রায়ান্ধকার সেই আলোতে নয়নতারা একটা স্তূপের মতো কিছু পড়ে থাকতে দেখলো বটে। সে কি বিশ্বাস করবে? সে ভয়ে ভয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে শেষে আতঙ্কে কেঁদে উঠে দৌড়লো আবার।

ঝড়ে কি শোনা যায়? এই একটু সুবিধা, নয়নতারা তখন দু হাতে জড়িয়ে রাজুর মুখকে নিজের বুকের উপরে তুলে নিতে পেরেছে। রাজুর কান তার ঠোঁটের কাছে। সে বললো–রাজু! রাজু!

রাজুর মন তার শরীরে ফিরলো। সে একবার জিজ্ঞাসা করলো–কে? নয়ন? নয়নতারা? কিন্তু সে-মনটা যেন অন্য কারোও। যেন ঘুমের ঘোরে সে-মন।

নয়নতারা বললো–বা, ওঠো। চলো, আমরা চলে যাই।

রাজচন্দ্র হঠাৎ সম্বিত পেয়ে উঠে বসে বললো–আরে ছি ছি, নয়নতারা, এই ঝড়ে এভাবে বার হতে হয়?

নয়নতারা চোখ মুদলো না, দু হাতের বাঁধন একটু আলগা করে দিলো, নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেরই ঠোঁট দুটিকে রাজুর কপালে ছোঁয়ালো।

দুএক পা চলে রাজচন্দ্র বললো–ওমা, এ কী?

নয়নতারা বললো–ওভাবে তাকিয়ো না, দেখো না কোথায় খসে পড়েছে। ঠাট্টা কোরো না।

রাজচন্দ্র হাসলো-চাইবো কেন? অনুভবে ধরা পড়ে।

তখন বাতাস কমেছে। বাঁকা বৃষ্টির ফলায় শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। নয়নতারার পা ঠিকমতো পড়তে চাইছেনা। রাজচন্দ্র বললো–একেবারে অন্ধকার না-হলে বাংলোয় ফিরবে কী করে?

গাঢ় অন্ধকার হলে তারা বাংলায় ফিরে থাকবে।

তখন রাত হয়েছে। বললো–আলোটা? থাকবে?

শেজের আলোতে সে ঘরের চারিদিকে চাইলো, যেন ঘরটা তার পরিচিত হওয়াতেই ভালো লাগছেনা। বলে–চলে যাবো, চলো। এখানে আসা তো সেই ফরাসডাঙাতে ফেরাই।

কিন্তু নয়নতারা শয্যায় এলো। বললো–বা, আমাকে বুঝি দেখবে না?

শেজের আলোয় নয়নতারা ঝিকমিক করে হাসলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *