১৩. সে বৎসর বসন্ত রাজনগরে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

০১.

অনুমান করি সে বৎসর বসন্ত রাজনগরে আগে এসে পড়েছিলো। বসন্ত যে তাতে ভুল নেই; করবী তা নানা রঙের, টগর তা নানা মাপের, গোলাপ যা রাজবাড়ির হাতায় পৌঁছে বসরাই, চম্পকচাপা, কৃষ্ণচূড়া, গুলমোর–এসব তো বটেই, শালে আমে সে বসন্তরই এসে পড়া। এমনকী পাখিরাও তা বুঝতে পেরে গিয়েছিলো। গম্ভীর কোনো পথচারীকে চমকে দিয়ে পথের ধারে ছোটোঝোপটা থেকে পরিষ্কার উঁচু গলায় কেউ আচমকা গান করে উঠছিলো, তারপর মানুষের গাম্ভীর্য দেখে মাথা ঠোঁট এদিক ওদিক করে যেন যা করেছে, না-দেখে করেছে এমনভাবে নিজের পোকা খোঁজায় গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো। বনে কী ফুটছে, কত ফুটছে, তার ইয়ত্তা করা যায় না।

একটা প্রাকৃতির কারণ দেখানো যায় : অঘ্রান, পৌষ, মাঘ তিনটি মাস গেলো একফোঁটা বর্ষা হয়নি;বসন্তের শুকনো ভাবটাকে, বাতাসের হালকা ভাবটাকে তা এগিয়ে আনতে পারে। অন্য কারণ বোধ হয় এই যে জঙ্গীলাটের ক্যাম্পের উজ্জ্বলতা আর বসন্তের ঘটনাগুলোর মাঝখানে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিলো তা যেন নিষ্প্রভ কুয়াশা-ঢাকা, যেন দুইপাশের উজ্জ্বলতার মাকে চোখে পড়তে চায় না।

জঙ্গীলাটের সেই ক্যাম্প নিশ্চয়ই সুদীর্ঘকাল মনে রাখার মতো ছিলো। অত যার আয়োজন, অত যার বাহুল্য, যেন চোখকে ধাঁধায়, তা মিটে যাওয়ার পরও যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখা যায়। গ্রামটাই যেন সাহেবদের হয়ে গিয়েছিলো। সেই ভোর-সকালে বিউগল বেজে উঠতে ফরাসডাঙায় কুচ। সেই তালে তালে রাজবাড়ির দিকে গিয়ে অবশেষে লাটের সামনে নাকি পতাকায় অভিবাদন করে, বিউগল বাজে। আবার সন্ধ্যায় বিউগল। আর তারপরই দপ করে যেন একসঙ্গে সব আলো জ্বলে ওঠে, ওদিকে ফরাসডাঙা এদিকে রাজবাড়ি একটানা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। রানীমার জন্মতিথির উৎসবে আলো হয়; কিন্তু সে তো রাজবাড়িতে, সে আলো এমন করে পথে পথে ছড়ায় না। তুমি বলতে পারো না, আলো জ্বলে উঠলে রাজবাড়ির হাতার মধ্যে দেওয়ানকুঠিতে কী হতো; কারণ রাজবাড়ির দরজা দিয়েই তো দেওয়ানকুঠির পথ; সেই দরজার সামনে সারাদিনই তো লালকুর্তা সিপাহী বন্দুক ঘাড়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা করছে অষ্টপ্রহর। কিছুপরে আবার এক রকম বাজতো। তাই নাকি ব্যাগপাইপ, নাকি গোরার বাদ্যি। আর তখন নাকি লাট খেতে বসেছেন।

আর এর মাঝে তো গোটা দিনটাই ব্যস্তসমস্ত সওয়াররা রাজবাড়ি থেকে ফরাসডাঙা, ফরাসডাঙা থেকে রাজবাড়ি করছে। কত ঘোড়া, কত রকমের রং। আর বেলা দশটা বাজে কি না বাজে, সারিসারি হাওদাদার হাতি বেরোল রাজবাড়ি থেকে। সব হাওদায় দু-তিনজন করে সাহেব, একটিতে কখনো কখনো মেমসাহেব, এই মেমসাহেবদের হাওদায় কখনো কখনো রাজকুমারকে দেখা যেতো। রাজকুমারের কথা যদি বলল, এক ঘোড়ার পিঠেই না তাকে কত রকম দেখা যেতো, কত রঙের পোশাকে। কত রঙের শুধু নয়; কত জাতের তা। আর ঘোড়াগুলোও। সেটা সব চাইতে ভালো দেখা যেতো সেই সময়ে যখন রাজবাড়ি থেকে একদল সাহেব, তাদের সঙ্গে রাজকুমারও, হাতে বল্লম, হৈ হৈ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যেন কোনো দুর্গা আক্রমণ করতে যেতো। ঘোড়াগুলোর পায়ে পায়ে একদল কুকুর ছুটতো। পিলপিল করে, চাপা পড়তো না আশ্চর্য।

কিন্তু তা তো চিরস্থায়ী নয়। তখন তো প্রগাঢ় শীত আর কুয়াশাও বটে। শীত কমার আগেই সেই অ্যালবেট্রসে চেপেই তারা চলে গিয়েছিলো। ভোজবাজি নয়, তার প্রমাণ পথের সেই স্ট্রিট লাইটিং কিছু কিছু থেকেই গিয়েছে। রাজবাড়ির গেটে দুটো পিতল রঙের চকচকে কামান, বিলমহলে যাওয়ার জন্য হাতিঘাস বনের পথটাকে এখনো ঘাসে ঢেকে দিতে পারেনি, একটা গাছের উপরে নাকি এক কাঠের তৈরী বাড়ি এখনো আছে।

এই ক্যাম্প কেন তা নিয়ে অবশ্যই এখনকার মতো তখনো কেউ কেউ ভেবেছিলো। একই উত্তরে সকলে পৌঁছতে অবশ্যই পারেনি। সে সময়ের কোনো খবরের কাগজে লাটের এই টুর সম্বন্ধে কিছু না লেখায় এরকম সন্দেহ থাকে, তা হয়তো প্রাইভেট কিংবা সিক্রেট ছিলো। এদিকে সব লাটই যে আত্মজীবনী কিংবা মেমোয়ার্স রেখে যাবে তাও হয় না।

রাজবাড়ির পক্ষে কি এই আয়োজন সার্থক হয়েছিলো? একটা মত এই : সন্ধ্যায় কেট, লাটের শ্যালী, লাটের মহিষী একত্র পিয়ানোর কাছে বসতেন। লাট নিজেও কি অদূরে থাকতেন না? সেই রকম এক সন্ধ্যায় রাজকুমারকে নিয়ে আলাপ হয়েছিলো। লাট-ললনা বলেছিলো, রাজার পুত্র রাজাই হয়; স্ট্রেঞ্জ, এখনো তা হয়নি! আচ্ছা, আজ ডিনারে হিজ একসেলেন্সিকে বলবো তো!

চিন্তা করার লোক রাজনগরে অবশ্যই ছিলো। হরদয়ালের চিন্তার কথা জানা যায় না। সে তো অ্যালবেট্রসের লাট-পার্টির সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলো। বাগচী, যাকে দুএকবার লাটের পার্টির সামনাসামনি হতে হয়েছে, যার সঙ্গে তার পার্টির সেই ডাক্তার মেজর চীবসের গ্রামের চিকিৎসা বন্দোবস্ত নিয়েও কিছু আলোচনা হয়েছে; সে যেন অন্য কোনোদিকে ব্যস্ত। নায়েবের চিন্তার কথা বলা যায়।

তারা চলে গেলে নায়েব একদিন যখন তার খাসকামরায়, হঠাৎ তার মনে হলো :সদরের খবর, এই ডানকানের উস্কানিতে কালেক্টর ম্যাকফার্লান অনেকবার কলকাতায় লিখেছে পিয়েত্রোর সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ থাকার কথা। সেইজন্যই কি জঙ্গীলাট তদন্ত করে গেলো? নায়েবের মুখে হাসি দেখা দিয়েছিলো। এত ভয়! এখনো? দেখছে, ঘাসের ছাই এর নিচে স্ফুলিঙ্গ আছে কিনা? কিন্তু সে গম্ভীরও হলো। সদরের এটাও খবর, ম্যাকফার্লান কালেকটরিতে খোঁজ নিচ্ছে, পিয়েত্রো দুসন আগে গত হয়েছে, তাহলে ফরাসডাঙার লাট জমা পড়লো কী করে? জমা তো পিয়েত্রোর উকিলই দিয়েছে। কিন্তু…

তাই বলে কিছুই ঘটেনি শীতের সেই শেষ কয়েকটি দিনে, এমন হয় না। যেমন বাগচী তো লাটের ক্যাম্পের কয়েকটি দিন তাদের ডিসপেনসারিতে যেতেই পারেনি। সে কিছু করছে না রোগীদের সম্বন্ধে এ রকম চাপ ছিলো মনে। উপরন্তু মেজর চীবসের সঙ্গে আলোচনায় জানতে পেরেছে যে বাংলাদেশের যশোর খুলনা জেলা জুড়ে ম্যালেরিয়া এপিডেমিকের চেহারা নিচ্ছে ক্রমশ। জ্বর হলেই এখন থেকে তাই লিভার ও সৃপ্লিনের কথা ভাবতে হবে। সুতরাং সে জঙ্গীলাট চলে যাওয়ার দুএক দিনের মধ্যেই চরণের ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলো। রোগী ছিলো না, চরণকে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–তুমি তো আমাকে কমিশনের সামনে যেতে নিষেধ করছো? তোমার কথা শুনে কি ঠিক করলাম? না হয়, যারা সাহস করে সাক্ষী দিতে পারছে না, এখানেই ডাকো তাদের, কথা বলি। লোকগুলোকে খারাপ মনে হয় না। আজ কালই তো সাক্ষ্যের দিন বোধ হয়।

চরণ বললো–সাক্ষ্য গতকাল হয়েছে। আরো দুদিন হওয়ার কথা। গোপালদার পাড়ার কেউ সাক্ষ্য দেবেইনা। কাল আমরা চারজন সাক্ষী দিয়েছি। আমি, অমর্ত্যমামা, শ্বশুরমশায়, কৃষ্ণানন্দ, আর ইসমাইল। একটু থেমে আবার সে বললো, ইসমাইলকে নিয়ে এসেছিলো ওসুলিভান। ওসুলিভান সকলের বেলাতেই দোভাষীর কাজ করেছে।

বাগচী সংবাদটার নতুনত্বের বাইরে যখন তার মূল্যটাকে ওজন করেছে, চরণ বলেছিলো, সাক্ষ্য না দেওয়া তো ছিলো ভালো। যাদের দরখাস্ত লিখে দিয়েছেন তাদের জনাকুড়ি আমাদের সামনেই এক লাইন করে হলফ নিয়ে গেলো :তারা দরখাস্তর বিষয়ে কিছু জানে না, সবই চরণদাস আর রাজনগরের বাগচীমাস্টারের কাজ।

বলো কী? বলে চমকে ওঠা যায়, তাতে কিন্তু চিন্তা শেষ হয় না। বাগচী দিন দুয়েকের মধ্যে সব ব্যাপারটা আনুপূর্বিক রাজকুমারকে বলেছিলো।

রাজকুমার কী ভাবলো বোঝা গেলো না। পরে বললো–আপনি কিন্তু এখন আর রাজনগরের হেডমাস্টার নন। আপনাকে এদিকটা দেখতে হয়। আপনার টাট্টু ভালোই। কিন্তু আজ আমার সঙ্গে আস্তাবলে যাবেন। সেখান থেকে যে ঘোড়াটা পছন্দ হয় নেবেন। আপনার সহিস ঘোড়া চিনবে না। সহিস আমি ঠিক করে দেবো। আর কথা এই, সেই সহিস কিন্তু মাথায় পাগড়ি-টাগড়ি বাঁধবে। গ্রামে ঘুরতে হলে সে তার ঘোড়ায় আপনার সঙ্গে থাকবে। একটু থেমে থেকে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করেছিলো, দিনকর রাও আর সালর জং দুজনেই নাকি সার উপাধি পেয়েছে?

এ ঘটনাটা নিশ্চয় সামান্য, কিন্তু সেই শিবচতুর্দশীর পূজা এবং তার মেলা? সে রাতে কিন্তু খুব শীতই ছিলো। আর সেই শিব তো রানীমার প্রতিষ্ঠিত। দুদিন ধরে মেলা হয়েছিলো। সেই মেলায় তো অনেকেই গিয়েছিলো। পরিচিতদের মধ্যে কেট ও বাগচীর নাম করতে হয়। বনদুর্গা আর চরণও গিয়েছিলো। চরণের তবু দ্বিধা ছিলো। বনদুর্গা তো শেষ প্রহরের পূজানা-দিয়েই ছাড়েনি। চরণ বলেছিলো, সেখানে কি আমাদের পূজা হয়, সেখানে কি যেতে আছে? বনদুর্গা হেসে বলেছিলো, মশায় কিছু জানেন না। গ্রামের সব লোক জানে, রানীমা নিজে মুখে বলেছেন, সেনাকি খেস্টানি শিব, সকলেই পূজা দিতে পারে, ছুঁতে পারে। কথাটা তো সত্যি, দ্যাখো। সে তত খেস্টানের হাওয়াঘরের ভিতেই।

মেলা খুব বড়ো নয় বটে, কিন্তু দুদিন তো চলেছিলো। দ্বিতীয় দিনে কেট ও বাগচী গিয়েছিলো। কেটই উৎসাহী। তার উৎসাহ কি এজন্য যে বাগচীর নিরুৎসাহের সময় চলেছিলো? সে বাগচীর পাশে পাশে, তার সুদৃশ্য গুলফ দেখিয়ে যেন কিছুটা নেচে নেচে, চলেছিলো। পুরুষ হলে বলা যেতো, সে যেন বলছে, লেটস টেক ইট ইন আওয়ার স্ট্রাইড। একবার পিছন ফিরে সে কিছু বিপন্ন বোধ করছিলো। তাদের দুতিন হাত পিছনে, যেন তাদের গায়েই এসে পড়বে, একজন প্রকাণ্ড চেহারার মানুষ যার ঝালরদার পাগড়িতে জরি, যার লম্বা আচকানের বোতামগুলো যেন সোনার,হাতে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ফলার লম্বা বল্লম। কেট এর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকে দেখে বাগচী বলেছিলো, তোমার বডিগার্ড আমরা আর হেডমাস্টার নই, কেমন কিনা? মেলাতেও একটা কৌতুক হয়েছিলো। কেটই দূর থেকে বলেছিলো, দ্যাখো, গাছতলাটায় কি ক্রাইস্টের মিশনারি? একদল চাষী একজন লোককে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আর সে ভাঙা বাংলায় ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। একেবারে মুখোমুখি না হয়ে, কৌতূহল মেটানো যায় তেমনভাবে ভিড়ের কাছে বাগচী এগিয়েছিলো। তার মনে দুঃখই হয়েছিলো। সুরটা মিশনারীদের, তাদের মতোই কখনো আকাশের দিকে আঙুল তুলছে, কখনো দিগন্তের দিকে হাত বিস্তার করে দিচ্ছে। কিন্তু সে ও সুলিভান এবং নিশ্চয় নেশার ঘোরে। প্যারাডাইস, স্বর্গ বোঝাতে শান্তির দ্বীপ, সুস্বাদু জল, উজ্জ্বল সূর্যালোক, ছোটো ছোটো কুটির এবং যার যত চাষ করার ক্ষমতা এমন জমির কথা কোনো বাইবেল বলে না। বাগচী শুনলো, সে বলছে : আমরা ভাসিয়া যাইবো, এই পুরাতন হইতে নতুনে, এবং আমরা শান্তির দ্বীপে পহুঁছিবো। কেটেরও ধারণা হয়েছিলো, মাতাল। বাগচী তার মনোভাব দূর করতে বললো, ও নাকি পূর্বজন্মে কবি ছিলো।

আর শিবমন্দির তো রানীমারই। ভোরের শেষ প্রহরের পূজার আগে তাঁর হাতি গলার ঘণ্টা বাজিয়ে মন্দির-চত্বরের নিচে থেমেছিলো। যারা পিয়েত্রোর বাংলোয় পূজার জন্য রাত্রিবাস করছিলো তাদের সে সংবাদে উৎসাহিত হওয়ারই কথা। তারা সকলেই বললো, দুধজল দিলে তবেই আমরা সারি বেঁধে তার পিছন পিছন এগোবো। তখন ভোরের আলো ফুটছে, পূজা শেষ হয়েছে। রানী নয়নতারাকে ডেকে হাওদায় নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। মাহুতকে বলেছিলেন নদীর খাতের দিকে যেতে। অনেকটা ঘুরে, কুতঘাটের কাছে যেখানে নতুন জেটি, সেখানে বাঁধ এড়িয়ে নদীর পার ধরা যায়। পার ধরে ক্রমশ ফরাসডাঙার কাছে। বাঁধের নিচে হাতি পৌঁছলে রানী বলেছিলেন, এই নাকি তোমার বাঁধ,নয়ন? এ নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা? কিন্তু একসময় ফাটলগুলো চোখে পড়েছিলো। তখন রানীমার মুখে হাসির পাশে পাশে চিন্তা দেখা দিয়েছিলো।

.

০২.

কিন্তু এসবকে উপেক্ষা করে, ছাপিয়ে যেন সেই দ্রুতগামী বসন্ত এসেছিলো। বনে ছায়ায় ছায়ায় কী ফুল, কত ফুল তার খবর অবশ্যই কম রাখা হয়। গ্রামের এখানে ওখানে টগর, করবী, জবা, চীনাজবা, গন্ধরাজ, গোলাপ, চাপা তো অজস্রই তখন। আমের মুকুল দেশ বিদেশের মৌমাছি ডেকে আনায় তার গুঞ্জরণও আছে। গাছের আশ্রয়ে পাখনাখালির ডাকাডাকি ঝুটোপাটি তো নিশ্চয়ই। সকালের দিকে শিশির পড়ে এখনো, তাতেই ফুলের জোর তো। কিন্তু যেখানে ফুল নয়, গাছ নয়, চাষের জমি, সেখানে সকাল ফুরোতে না ফুরোতে গরম হয়ে ওঠে বাতাস। দুপুরে খালি মাঠগুলোর দিকে, হলুদ বাদামী মাঠগুলোর দিকে চাওয়া যায় না। সকালে শিশির বরং ক্ষতিই করছে, তাকে কিছুটা ভেজে বলেই দুপুরের রোদে ফাল্গুনেই মাঠ ফেটে যাচ্ছে।

দিনের হিসাবে সেটা শিবচতুর্দশীর দু-তিন দিন পরে হতে পারে। রাজকুমার রাজচন্দ্র তার ঘরের কাছারির দিকের ঝুলবারান্দায়। নিচে যে ফেনসিং দেওয়া হয়েছিলো রাজবাড়িকে দেওয়ানকুঠি আর টমিদের তাঁবু থেকে পর্দানশীন রাখতে সেগুলো খোলা। হচ্ছে। তার মনে এই পর্দানশীন কথাটাই উঠলো, সেটাই খেলা করলে সেখানে।

কিছুক্ষণ পরে যেন অসংলগ্ন এমনভাবে তার মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে বেলা আটটা-নটার আলোতে কাছারির সামনে দিয়ে হাতিটা এগিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির কাছাকাছি বসেছিলো। হাতিতে হাওদা ছিলো, হাওদার মাথায় নকল মুক্তোর ঝালরদার রঙিন ছাতা। হাতিটা রামপিয়ারী নয়, বরং পিয়েত্রোর বেঁটে হাতিটা। এরকমটা সচরাচর দেখা যায় না। রাজচন্দ্র তখন ফিরছিলো তার ঘোড়ায় বেড়াননা শেষ করে। হাতিটা তার আগে আগে ঢুকেছে গেট দিয়ে। সে দূর থেকে দেখেছিলো একই রকম চাঁদরে জড়ানো, একই রকম অবগুণ্ঠন, দুজন হাতি থেকে নেমে রাজবাড়ির গাড়িবারান্দার দিকে চলে গেলো। এরকমটাও সচরাচর দেখা যায় না। রানীমার হাতি বাগান দিয়ে ঘুরে গিয়ে অন্দরে বসে। পিয়েত্রোর হাতি, মাহুতটিও তার। এ বাড়িতে সে নতুনই তো। রাজকুমারের পাশ দিয়ে হাতিটা যখন পিলখানার দিকে ফিরে যাচ্ছে, রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করে ফেলো–কে রে? মাহুত বলেছিলো, দুজন রানী এলেন।

রোদটা এখন আর আরামের নয়। ঝুল বারান্দা থেকে সরতে গিয়ে মনে হলো তার, নতুন মাহুত বুঝতে ভুল করেছে। জিজ্ঞাসা না করলেও চলতো। দূরে হলেও হাঁটার ভঙ্গিতে বোঝা গিয়েছিলো তারা নয়নতারা এবং রানী। রাজু নিজের মনে মনে হেসে ঝুল বারান্দা থেকে বরং ছায়ার দিকে সরলো। আজ সে সকালেই উঠেছে। কিন্তু কাল ঘুমোতে বেশ দেরি হয়েছিলো।

সে অনুভব করলো সেজন্য সে ক্লান্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বলা যায়, রাত দুটো পর্যন্ত হৈমী তার ঘরে ছিলো। পিয়ানোনা শেখার কথা হয়েছিলো একবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হৈমীর ব্যক্তিগত জীবনের কথা হয়েছিলো। এটা খুব খারাপ লাগছে। হৈমী তার আশ্রিত বলেই কি তেমন উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো তার প্রশ্নের! না, ভালো নয়। একজন মানুষের বুকের ভিতরে তেমন নির্দয়ভাবে প্রবেশ করা। এখন তো ভাবতে গিয়ে খারাপ লাগছে যে হৈমী তেমন করে বলেছিলো, সে তারই আশ্রিত।

রাজচন্দ্র তার ঘরে এলো। ঘর পার হয়ে উল্টোদিকের দরজা খুলে আবার সেদিকের ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালো। তখন তার হঠাৎ মনে হলো, এটা কি আশ্চর্য বলবে না কেউ-ই, যে রানীমার জন্মতিথির সেই রাতে তুমি তাহলে পূজার কাছে এসো বলে চলে যাওয়ার পর নয়নতারাকে আজ পর্যন্ত সে আর দেখেনি! অথচ সেদিন সেভাবে হাওদা থেকে নামায় প্রমাণ হয়, সে তো রাজবাড়িতে এসেছিলো! সে কি রানীর উজিরাইন বলে ঠাট্টা করবে?

অনেকসময় ঠাট্টা করলেও রাগ যায় না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। দোতলার অলিন্দ দিয়ে রানীমহলের দিকে চলতে লাগলো। তখন মনে মনে বললো, বলে গেলেই হতো আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না রাজু। রানীর মহলে রানী ছিলেন। কিন্তু তাকে তো বলা যায় না, তার সামনেও বলা যায় না, উজিরাইন কোথায়? দোতলা থেকে নেমে সে মন্দিরের দিকে চললো। সে ভাবলো, মনে তো হয় সে এ বাড়িতে এলেই পূজা, মন্দির ইত্যাদির কাছে থাকে আজকাল।

মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে রাজচন্দ্র দেখতে পেলো, কয়েকজন পুরস্ত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তার কি চিনতে দেরি হয়? আর এখন তো অবগুণ্ঠনও নেই। মাঝখানের সেই গজ বিশেক মাটি সে খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলো। যারা দাঁড়িয়েছিলো তারাও তো তাকে দেখেছিলো। কিন্তু তারা সরে যাওয়ার আগেই সে নয়নতারার মুখোমুখি দাঁড়ালো, এমন যে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে। সে বললো–তুমি আসবে? না, হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে?

হতচকিত নয়নতারা পিছন পিছন, কখনো পাশে, অন্দর পার হয়ে একতলার অলিন্দ দিয়ে হাঁটছে তখন, রাজু গলা তুলে বললো–রূপচাঁদকে বলো, হাওদা-হাতি আনবে।

নয়নতারা বলতে গেলো এভাবে কোথায়?

ততক্ষণে রাজচন্দ্র দরবারের হল পার হয়ে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়েছে। সে বললো–তোমার কি চাদর ছাড়া খুব অসুবিধা হবে নয়ন? কাজটা আমি হয়তো ভালো করলাম না। রূপচাঁদ তোমাকে দেখে গেলো, সে টোপর-হাওদা আনবে।

তারপর সে হাসলো, বললো–চলো না নয়ন, আজ একটু বেরিয়ে আসি।

হাতি তখন গ্রামের পথ ছাড়িয়ে বনের দিকে চলে এসেছে। রাজচন্দ্র বললো–তোমার সঙ্গে কথা না বললে আমার চলছিলোনা। নয়নতারা হাত বাড়িয়ে টোপর হাওদার ছাদ থেকে ঝোলানো পর্দাটা ফেলে মাহুত থেকে নিজেদের আলাদা করে নিলো।

রাজচন্দ্র পাশের খিলান দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিলোনয়নতারার থেকে মুখ আড়াল করে। হেসে বললো–একবার দ্যাখো নয়ন, হরদয়ালের কীর্তি, গাছের উপরে বাড়ি। কিন্তু নয়নতারা সেটাকে দেখলে কি না দেখলো, রাজচন্দ্র বললো, নয়ন, তোমার সঙ্গে দু-আড়াই মাস দেখা হয় না। আচ্ছা নয়ন, তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো? আমি আর রাজকুমার নেই বলে? তুমি কি দরজায় বসানো কামান দুটোর মতোই আমাকে জাল মনে করো?

নয়নতারাকে একটু ভাবতে হলো। চেষ্টা করে সে হাসি আনতে পারলো না। বললো, তোমার খোঁজ নিইনি বললে ঠিক বলা হয় না। তোমার বাজনা মাঝেমাঝেই শুনি। হৈমীদিদি তোমার সব ব্যাপার দেখছে তো। সে তাড়াতাড়ি নিজের কথা থেকে সরে আসতে বললো, এই হৈমীদিদি, সেই ছ-আনির কুমার, এদের কথা বেশ আশ্চর্য না?

খানিকটা দূরে গিয়ে রাজচন্দ্র বললো, হাতিটা ছেড়ে দিই। কাছে থাকো। চলো আমরা হাঁটি। এই বনে ছোটো একটা নদী আছে। তার উপরে লাটের জন্য ছোটো কিন্তু মজবুত সাঁকো হয়েছিলো। চলো দেখি গে।

হাতি থেকে নেমে তারা পায়ে হেঁটে চললো।

যখন অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করে তখনই যেন কথা বলা যায় না। সাঁকো পেরিয়ে প্রায় একশো গজ হেঁটে একটা ঘাসে ঢাকা জমি দেখে রাজচন্দ্র বললো, এসো বসি। দ্যাখো পাখি ডাকছে। তুমি একবার আমার সঙ্গে শিকারে আসবে বলেছিলে,দ্যাখো আজ তা হলো।

রাজচন্দ্র বললো, ইতিমধ্যে দুএক বিকেলে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। দু বারই শুনলাম, তুমি রাজবাড়িতে। অনুমান, রানীমহলে লুকিয়ে থাকছে।

–হুকুম করলেই আসতাম।

হুকুম, নয়ন?

নয়নতারা মুখ নামিয়েছিলো, মুখ তুলে বললো–আমাকে কিছুদিনের ছুটি দিতে হবে, রাজকুমার। মামাবাড়ি যাবো।

-তোমার মামাবাড়িও কাশী?

 –মহাভারত পড়তে গিয়ে দেখি এখনো অনেক জায়গা স্পষ্ট বুঝি না।

–গত তিন-চার বছরেও হলো না? সেবার আমি পশ্চিমে গেলে তুমিও তো কোথায় চলে গিয়েছিলে! এই তো আমি এবার কলকাতা যাওয়ার আগে থেকেই আড়াই মাস হবে দূরে দূরে ছিলে।

নয়নতারা যেন সময়টাকে আঙুলে গুনবে।

রাজচন্দ্র বললো–আমার অনুমতি দিতে ইচ্ছা নেই।

এটাই তো নয়নতারার ভয়। তবু সে সাহস করে বললো–অবুঝ হতে নেই।

রাজচন্দ্র বললো, রানীমা তোমাকে নিজের কাছে রেখে নিজের বস্ত্রালঙ্কারে সাজিয়ে-তোমরা ভালো জানো, হয়তো মেয়েদের ছেলে থাকার মতো একটি মেয়ে থাকাও দরকার মনে হয়, কিন্তু তোমাকে সকলের অপ্ৰাপণীয় করে তুলেছেন।

নয়নতারা জোড়াসনে বসে ছিলো। তার নিজের পায়ের সোনার কামদার মোটা মলজোড়ায় চোখ পড়লো।

সেই কবে পুরনো সিন্দুক সাফ করতে গিয়ে এটা বেরিয়েছিলো। নয়নতারা কৌতূহল দেখিয়েছিলো। রানী তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, পরো তুমি। ক্ষতি কী? কিন্তু সোনা যে! নয়নতারার এই দ্বিধায় রানী হেসে বলেছিলেন, আমি পরতাম, তাতে দোষ কেটে গিয়েছে।

নয়নতারা লজ্জায় পুড়ে গেলো যেন। রানী পরতে বলেছিলেন, পরে ছিলো। রানী ছাড়া কাউকে কি মানায়? কেউ যেন বললো, খুলে ফেলোনি কেন?

 সে বললো, রাজকুমার, আমার স্পর্ধা, হয়েছে, আমাকে মাপ করো।

রাজচন্দ্র বললো–দ্যাখো নয়ন, তুমি কী নির্দয়! আমার কথার ভুলকে ক্ষমা করো না। আমি কি তাই বলেছি? সে হেসে বললো, আচ্ছা নয়ন, তোমার সেই বাইচে নামে একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে?

-তুমি গল্প করেছিলে বটে। সেই পিয়ানোর গায়ে নাম তো? যার তেরো চৌদ্দ বয়সের সুঘ্রাণ ছিলো? সে বলেই ভাবলো, রাজকুমার কি কলকাতার কনে সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়? তার সম্বন্ধে কোনো অনুভূতি বা সুঘ্রাণের কিংবা তার অভাবের? তা কি বলতে দেওয়া উচিত?

কিন্তু রাজচন্দ্র বললো–জানো, চরণদাস, গ্রামের পোস্টমাস্টার, ওদের খুব দুঃসময়। খুব বিপদে পড়েছে। কাল বিকেলে তার বাড়ির চারিদিকে ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছা হলো! চরণ আমাকে দেখেনি। আমি কিন্তু দেখলাম, বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে তার ভারি মুখটা উজ্জ্বল হলো।

নয়নতারা গলাটাকে চেপে ধরার চেষ্টায় বললো–দুঃসময়ের কথা বলছিলে।

 রাজচন্দ্র বললো–একই গল্প। কাল সন্ধ্যায় দাবা খেলতে খেলতে বাগচী হা হা করে হাসছিলেন। তিনি যাদের জন্য দরখাস্ত লিখে দিয়েছিলেন তারা অনেকেই তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করেছে। হাসি দেখে আমার বলতে কষ্ট হলো, ডানকান আরো এগিয়ে গিয়েছে, তাদের নামে মিথ্যা দলিল তৈরী করার মামলা আনছে। আচ্ছা নয়ন, তা সত্ত্বেও এদের মুখে হাসি দেখে কি মনে হয় না?

-কি রাজকুমার?

–যে এদের স্ত্রী আছে?

নয়নতারা অবাক হলো। সে একবার হাসিমুখে বলতে গেলে, সেই চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই রাজচন্দ্র বললো–আচ্ছা নয়নতারা, তুমি কি কখনোই আমার হবে না?

নয়নতারার চোখে জল এসে যাচ্ছে। সে অনুভব করলো, কথা বলতে গেলে ঠোঁট দুটোকে শাসনে রাখা যাবে না। ফুঁপিয়ে উঠবে নাকি শেষে? সে সেসবের পাশ কাটিয়ে হাসিমুখে পৌঁছালো। বললো–সেই কবে থেকেই এই দ্যাখো, সেই আংটিটা আজ আবার পরেছি।

সে যেন নিজের হাতটাকে রাজচন্দ্রর চোখের সামনে ধরবে। কিন্তু রাজকুমার হাতজোড় করেছে কি? তেমনভাবে কি কিছু বলছে? সে দেখতে পেলো না, শুনতে পেলো-স্ত্রীরা যেমনভাবে পুরুষের নিজের হয়?

নয়নতারা দুএক মিনিট দম বন্ধ করে বসে রইল। নিচের দাঁত ঠোঁটে চেপে ধরে চোখের জল ঝরে না যায় এমন করে মাথাটাকে ডাইনে বাঁয়ে দোলালো।

একসময়ে রাজচন্দ্র হেসে উঠলো। চলো নয়ন, আজ আর শিকার হবে না।

.

০৩.

তারা যখন রাজবাড়ির হাতায় ঢুকছে বেলা দুটোর ঘণ্টা পড়লো। নয়নতারা বলতে গেলো, আজ সারাদিন স্নানাহার হলোনা। তখন কাছারি আবার বসেছে। কাছারির চত্বরে তো মানুষ জনের ভিড়ই। হাতিটা চলছে, তা সত্ত্বেও সেই ভিড়ের দুএকজন যেন হাতিটার দিকে এগোলো। হাতি বসলে রাজকুমার তাদের একজনকে চরণদাস বলে চিনতে পারলো। কাছারির একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে বললো, এরা সকাল থেকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এসে বসে আছে। এখন কি তাই বলে দেখা হয়?

রাজচন্দ্র বললো–এদের দরবারে বসাও।

তারা চলে গেলে নয়নতারাকে নামতে সাহায্য করলো রাজচন্দ্র। বললো–দেখেছো, এদেরও খাওয়া-দাওয়া হয়নি আজ। তুমি কি এখন বাড়িতে ফিরবে? যদি পারো থাকো না হয়, বিকেলে কথা বলবো।

নয়নতারাকে বাড়িতে যেতে হলেও তো রানীকে বলে যেতে হয়। অন্দরে যেতেই হবে। সকালের সেই দৃশ্যটার কথা কি এতক্ষণে সর্বত্র ছড়ায়নি? একরকম লজ্জায় নয়নতারার পা দুখানা যেন পড়তে চাইছে না। কিন্তু রাজচন্দ্র বললো, শোনো নয়ন, এক কাজ করো না হয়। কাউকে বলে দাও এদের কিছু খেতে দেবে।

চরণ তো রাজকুমারের পরিচিতই। তাদের বিপন্নতার কথা সে বরং তাদের চাইতেও বেশি জানে। তারা হয়তো এখনো সেই মামলার কথা শোনেনি যা রাজ বাড়ির চরেরা সংগ্রহ করেছে ইতিমধ্যে। দরবারের আসনে বসেই রাজচন্দ্র সেজন্য বললো, তোমরা কী ভেরে এসেছো? আমি তোমাদের জন্য কী করতে পারি? তোমরা কি মরেলগঞ্জের জমি ছেড়ে চলে আসতে চাইছো?

তারা কী বা বলতে পারে? তাদের সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে কোথাও? চরণ দুএকবার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। রাজচন্দ্র ভাবলো, এই সময়ে মরেলগঞ্জের বাড়ি জমি ছেড়ে আসতেই বা এদের কীরকম লাগবে? তার মনে পড়লো, নয়নতারা একদিন জমি সম্বন্ধে কীসব বলেছিলো। সে তাদের চুপ করে থাকতে দেখে বললো, আচ্ছা, এ কি সত্যি সেই জমি যার জন্য তোমাদের কষ্ট, অপমান, তা ছেড়ে আসতে কী তোমাদের খুব কষ্ট হয়? এ কি সত্যি যে সেই জমি তোমাদের আত্মীয়স্বজনের মতো আপন হয়ে যায়?

চরণ বললো–সে জমি যদি আমরা ছেড়ে দিয়ে আসি, তাতে কিন্তু ডানকানেরই সুবিধা। যে কিনবে সে তো তার কথাতেই সেই নীল চাষই করবে।

রাজচন্দ্র ভাবলো, ওটা হয়তোনয়নতারার ভাবুকতা যে জমিকে অনেক স্মৃতিতে জড়ানো জননীর মতো মনে হয়। চরণ বললো–রাজকুমার, বাপ-পিতামোর কথা মনে এসে যায়। তাদের কষ্টের, আদরের, যত্নে বাড়িয়ে তোলা জমিকে ডানকানের লোভ থেকে বাঁচাতে ইচ্ছা করে। সে জমি যদি বিক্রি করতে হয়, ইচ্ছা হয় যে তা এমন কেউ নিক যে ডানকানকে ছুঁতে দেবে না।

রাজচন্দ্র বললো–চরণ, তোমাকে একটু কষ্ট দিই, নায়েবমশায় এসে থাকবেন, তাকে এখানে একটু আসতে বলল।

চরণ নায়েবকে ডাকতে গেলে রাজচন্দ্র পরিচয় নিয়ে জানলো বাকি দুজন অমর্ত্য আর কৃষ্ণানন্দ। তাদের দুজনের এবং চরণের জমি পাশাপাশি। যোগ করলে একশো বিঘায় দাঁড়াবে। জমিগুলো সবই মরেলগঞ্জ রাজনগরের সীমা ঘেঁষে।

সে বললো, নায়েবমশায় খোঁজখবর করে বিলমহলে তোমাদের জমি দিতে পারবেন। হয়তো পাশাপাশি হবেনা, কাছাকাছি হবে, এমন করা যাবে। কিন্তু ওটা কি হয়, যে তোমাদের মরেলগঞ্জের জমি নেবে সে ডানকানকে জমি ছুঁতে দেবে না? এমন তো করা যায় না। তোমাদের মরেলগঞ্জের জমি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এ তো সত্যি মা নয় যে বুড়িকে মাথায় নিয়ে পালাবে? রাজকুমার হাসলো।

নায়েব এলে রাজচন্দ্র তাদের সমস্যার কথা বলে বললো–এদের একটা ব্যবস্থা করুন, তাই বলে ডানকানকে ধরে এনে পিটিয়ে দেওয়ার কথা ভাববেন না।

নায়েব হেসে বললো, খুব কড়কে দেওয়া যায়, বছরখানেক মুখ নিচু করে চলবে। তাতে কিন্তু রানীমার মত নিতে হবে। এদের না হয় জমি দেওয়া গেলো, কিন্তু মরেলগঞ্জের মায়া তো ছাড়তেই হবে। ছেলেমানুষি কি চলে? সে জমি যে কিনবে তাকে তো ডানকানকে মানতেই হবে। নীলের ফসল ভোলা চাই।

রাজচন্দ্র বলতে গেলে, দেখলে চরণ, দেখলে অমর্ত! কিন্তু সে কিছু ভাবলো। তার মুখের হাসিটার অর্থ ধরা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়, চিন্তাটা বিচিত্র খাতে চলেছে। সে বললো, নায়েবমশায়, এরা চাইছে জমিটা এমনভাবে বিক্রি হোক যাতে বরং পতিত থাকবে কিন্তু ডানকানের জোর খাটবে না। তোক না ওটা রাজবাড়ির নামে কিংবা আমার নামে কেনা!

নায়েব বললো– রাজকুমার, তা কি ভালো দেখায়? ডানকানরা খাজনা দেয় না, লীজে একবারে আগাম দিয়েছে। কিন্তু মরেলগঞ্জের দরুন লাট তো আমরাই দিই। প্রজার জমি খাস করা যায়, আপনার নামে কেনা যায় কি?

একজন ভৃত্য ও একজন দাসী চরণদাসদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলো। রাজকুমার বললো–তোমরা কি নয়নতারা-ঠাকরুনকে চেনো? তিনি যদি রাজবাড়িতে থাকেন, এখনই একবার তাকে দরবারে আসতে অনুরোধ করো। রাজচন্দ্রের মুখে একটা বিচিত্র হাসিই যেন। সে বললো–খাও তোমরা, চরণ। সে যেন মনে মনে এমন লোক খুঁজতে লাগলো যে এদের জমি কিনতে পারে অথচ ডানকানকে পরোয়া করবে না।

নায়েবমশায় অনুমতি নিয়ে চলে গেলো। নয়নতারা এলো। এই সময়ে রাজচন্দ্ৰ হেসে উঠেছিলো। সে বললো–বসো নয়ন, এরা সকলেই আমায় কিছু করতে বলছে। সে গলা তুলে বললো, নায়েবমশায়কে আবার ডাকো তো। নয়নতারাকে বললো, তুমি একদিন জমি নিয়ে বলেছিলে, এদেরও সেই সমস্যা। জমি আর স্ত্রী কিংবা মা কিন্তু এক নয়। জমিকে মাথায় করে পালানো যায় না।

বিব্রত নয়নতারা কী বলবে খুঁজে পেলো না।

রাজচন্দ্র মৃদু মৃদু হেসে বললো–রসো, নায়েবমশায় আসুন।

নায়েব তখনো কাছারি পৌঁছায়নি যখন তাকে ভৃত্য আবার ডেকে আনলো।

রাজচন্দ্র বললো–আসুন, আসুন। তোক খুঁজছিলেন তো মনে মনে একশো বিঘার। জমিটা আমি যদি নয়নতারার নামে কিনি?

নায়েবও কী বলবে খুঁজে পেলো না। এটা কেমন এক লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না? -লজ্জা এবং অবিবেচনার?

রাজচন্দ্র বললো, হ্যাঁ, এই ঠিক হয়েছে। তোমরা রাজী হয়ে যাও। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিটা নয়নঠাকরুনই আমাকে দিয়েছিলেন। এদের কথাও থাকছে। নয়নঠাকরুনকে ডানকান নীল বুনতে বলবে না নিশ্চয়। তাছাড়া, নয়ন, এরা যেমন চাইছে তাও নয়। জমিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। ওটা এক একশো বিঘার দীঘি হতে পারে।

নয়নতারা খুব মৃদু করে বললো, রাজকুমার! কিন্তু চাঁদরের ঘোমটা থাকায় সেই মৃদুস্বরকে যে-ভঙ্গি অর্থবহ করবে তা প্রকাশ পেলো না।

রাজকুমার বললো–এই ভালো হলো, নয়নতারা। ও জমিতে আর চাষ হতে হয় না। ও জমি আমার চাই। বুঝেছো তোমরা? বৈশাখের আগেই,নয়ন, ওই মার্টিটুকু কেটে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। একটা দীঘি, কিন্তু এমনভাবে কাটবে যেন বৈশাখে জল আসে। তারপরে লম্বার দিকটা চওড়া করে আবার কাটাব, ফের লম্বার দিকটাকে চওড়ার দিক করে দিলে তোমার একশো বিঘা ঢেকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা দীঘিই হবে। তোমরা খাও। আমি এবার উঠবো। নায়েবমশায়, আপনি এদের আগাম দিয়ে বায়নাপত্রে দস্তখত নিয়ে রাখবেন। কিংবা নগদে দাম চায়, দিয়ে দেবেন, আর তা আজই। নয়নঠাকরুনের যদি সই করতে হয়, ইনি আপাতত রাজবাড়িতে থাকবেন।

নয়ন স্তম্ভিত,নায়েবমশায় বাকরুদ্ধ। তখন বোধ হয়, চরণদাসদের মাথা ঝিমঝিম করছে।

নয়নতারা কিছু বলতেই হবে এরকম ভেবে মিনমিন করে বললো–আমাকে কি সই করতে হবে?

নায়েব কথা খুঁজে পেয়ে বললো–তা তো করতেই হবে, মাঠাকরুন।

রাজু বললো–চলো নয়নতারা, সারাদিন আজ স্নানাহার করতে দিলে না। কী পুকুর তোমার মাথায় ঢুকেছে। অবশ্য একশো বিঘার দীঘি না করে একটা ভালো বাড়ির জন্যও জমি ছেড়ে রাখা যায়। তোমার বাড়ি হলে আমিও কি যাবো না মাঝেমাঝে? চরণ, অমর্ত, কৃষ্ণানন্দ, খাও তোমরা। না খেয়ে যেয়ো না। ভয় নেই তোমাদের। নায়েবমশায় তোমাদের জমির ন্যায্য দাম দেবেন।

.

তখনকার দিনেও এমন মত ছিলো, ধনাঢ্যদের পীড়া একসময়ে প্রকাশ পাবেই। কাছারির লোকেদের যাদের ঘটনাটা সেই সন্ধ্যার আগেই টাকার অঙ্কসমেত জানা হয়েছিলো তাদের মনোভাব এ রকম হলো :সম্বন্ধটা যে কোনোভাবেই প্রকাশ পেতে পারতো। তাদের কেউ কেউ এ রকম চিন্তা করলো বরং–গোলমাল বাধার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সে গ্রামে তখন ন্যায়নীতি নিয়ে চিন্তা করার লোকও ছিলো, যাদের পক্ষে ধনাঢ্যদের পীড়া বলেই উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলো না। এরকম সংবাদ কাছারির বাইরে যেতে কিছু সময় লাগে, কিন্তু যেহেতু নরেশ, সুরেন প্রভৃতি জমি বিক্রির ব্যাপারটা চরণের সঙ্গে আলাপ করেছিলো, সংবাদটা নিয়োগীর কানে একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলো।

তাতে তো এখন অধ্যক্ষের কাজও কিছু কিছু করতে হচ্ছে, সুতরাং সেও দুএকদিন সংবাদটাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে বাধ্য হলো। কিন্তু রবিবার এসে যাওয়াতে সে সকালের দিকেই বাগচীর কুঠিতে উপস্থিত হলো। বিষম বিপদ যে, এই ঘৃণার ব্যাপারটা সেখানে কীভাবেই বা আলোচনায় আনা যায়। অন্যত্র এই এক সুবিধা থাকে যে গৃহের মহিলারা আলোচনায় যোগ দেন না, অথবা ইংরেজি বোঝেন না। এক্ষেত্রে তো ইংরেজিতে আলোচনারও সুবিধা নাই। কিন্তু কর্তব্য তোকর্তব্যই বটে। তাছাড়া ঋষিপ্রতিম ওয়ার্ডসওয়ার্থ কি কর্তব্যকে স্বয়ং ঈশ্বরের গম্ভীরা কন্যা বলেন নাই? অন্যদিকে সে-ই-বা কলকাতার সমাজে কীভাবে মুখ দেখায়? দিদি ব্ৰহ্ম-ঠাকুরানীই বা অতঃপর কী করেন? না, না, এ আমাকে বলতে হবে, অবিবাহিত একটি স্ত্রীলোককে পুকুরসমেত বাগানবাড়ি করে দেওয়াকে তাই বলে, ধনাঢ্যদের পীড়াই।

সর্বরঞ্জন সেদিন যত কম কথায় সম্ভব বাগচীর সঙ্গে আলোচনা করবে স্থির করে নিলো। সে প্রায় বসতে বসতেই বললো, এটা আমাদের স্কুলের বিষয় নয়, এ থেকে আমরা কানে আঙুল দিয়ে দূরে থাকতে পারতাম, কিন্তু একটি কুমারী কন্যার সর্বনাশকে তো আর নিশব্দে উপেক্ষা করা যায় না।

বাগচী ও কেট কারোপক্ষেই সরঞ্জনের বক্তব্য বুঝতে সহজ হলো না। বাগচী এমনকী কল্পনা করলো, নিয়োগী হয়তো কৈলাশ পণ্ডিতের সেই অবিবাহিতা কন্যার কথা কিছু বলছে। বাগচী বললো–এ সম্বন্ধে কি কাছারিতে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে?

সর্বরঞ্জন বললো–সেটাই তো বিপদের উৎস। আপনি কি শোনেননি? নয়নতারা নামে এক অবিবাহিতা স্ত্রীলোককে রাজকুমার বাগানবাড়ি কিনে দিচ্ছেন, তাও প্রকাশ্যে?

বাগচী প্রায় হেসে ফেলো–কেটের মুখে তো হাসি খেলা করলোই! সে খুব মৃদুস্বরে বললো, সেন্ট বটল?

সেন্ট বটলের ব্যাপারটা মাথায় না ঢুকলেও সেই সকালে নিয়োগী বাগচী এবং কেটকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিতে পেরেছিলো। সে অনেকবার শুরু করে, মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে, আবার শুরু করে, ডাইনে বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে, দু-একবার লাল হয়ে বাগচীকে বুঝিয়ে দিতে পারলোয়নতারা একজন অবিবাহিতা স্ত্রীলোক। তাকেই রাজকুমার বাগানবাড়ি তৈরী করে দিচ্ছেন, ঠিক তখনই, যখন কলকাতার এক কুসুম কোমল কুমারী কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ প্রায় স্থির। সে কী করে বা এই পাপে অংশ নিতে পারে? কেননা এখানে সত্য গোপন করা কি পাপে অংশীদার হওয়া নয়? বিশেষ সেই কন্যা যখন হিন্দুনয়,বরংনবধর্মের বিশিষ্ট সদস্য, এমনকী ইংরাজি-দক্ষা আধুনিকাও বটে।

বাগচীকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকতে হলো। তার এবং কেটের একটা আনন্দোজ্জ্বল ধারণা। যা রাজকুমারের বিবাহ সম্বন্ধে তাদের আনন্দের কারণ হয়েছিলো সেটা কি কলঙ্কিত হবে? কেটের মুখটা শুকনো দেখালো। কিন্তু বাগচী বললো, একে অন্যের কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিতে পারেনা। আমি আপনাকে এই বলতে পারি, রাজ-পরিবারে এরকম ঘটে থাকে। আপনি প্রচার করবেন কিনা আপনার বিবেচনার বিষয়।

সর্বরঞ্জন নিয়োগী নিতান্ত চিন্তাকুল মুখেই চলে গেলো।

সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কেট জিজ্ঞাসা করলো–তুমি কি এখন রাজবাড়িতে যাচ্ছো?

-হ্যাঁ, দশটা বাজে। আমি তো কাছারির নিয়মে বসি না। বাগচী রাজবাড়িতে যাওয়ার জন্য টুপি হাতে করলো। তার মুখটা অস্বাভাবিক কঠোর দেখালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *