১২. রাজকুমার কলকাতায়

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

০১.

সেবার রাজকুমার কলকাতায় পুরো একমাস ছিলো। জানুয়ারির মাঝামাঝির আগে ফেরেনি, যদিও হরদয়াল ও রানীমা কিছু আগে চলে এসেছিলেন। তাতে অসুবিধারও কিছু হয়নি। উপরতলায় হৈমী ছিলো, একতলায় রূপচাঁদ ছিলো, নরেশ ওভারসিয়ার, হরদয়ালের সেরেস্তাদার ব্রজ ছিলো, দাসদাসী বরকন্দাজেরা ছিলো। উপরন্তু বড়োদিনের পরেও যে নববর্ষের উৎসব, তখন তো হরদয়ালই ছিলো তত্ত্বাবধানে।

এরকম আন্দাজ হয়েছিলো, জঙ্গীলাট আর রাজকুমার একইসঙ্গে আসবেন। কিন্তু হরদয়াল অবশ্যই সঠিক জানতো। দুদিন দিয়ে সংবাদ আসছিলো তার, সদরে সওয়াল বহাল ছিলো যাতে টেলিগ্রাম এলেই তা নিয়ে আসে, দীর্ঘতর পত্রাদি আসছিলো ছিপ মারফত। পথে দাঁড়ি বদলে তারা আড়াই দিনে কলকাতার সঙ্গে যোগ রাখছে।

হরদয়ালের দুর্ভাবনা বরং কমে আসছিলো, এবং সংবাদটা ক্রমশ ধীরে ধীরে কাছারির এ-মুখে ও-মুখে শোনা যাচ্ছিলো। এমন তো ঘটতে দেওয়া যায় না যে রটে গেলো জঙ্গীলাট রাজনগরে তিন-চারদিনের জন্য ক্যাম্প করবেন, অথচ তিনি এলেন না। অন্যের কানে সংবাদ তখনই গেলো যখন কমিসারিয়েটের কন্ট্রাকটর জানালো জঙ্গীলাট আর তার পার্টির জন্য অ্যালবেট্রস জাহাজ চার্টার করা হয়েছে। কলকাতা থেকে নদীপথটাকে অবশ্যই দেখে নেওয়া হবে। এখনকার মতো তখনো এইসব ট্যুরের খবর তখনই প্রকাশ করা হতো যখন উদ্যোক্তারা সব আয়োজন প্রায় শেষ করে এনেছে।

কিন্তু অ্যালবেট্রস? হরদয়ালের দিন দশেক আগেকার কথা মনে পড়লো। তার মুখে হালকা একটা চিন্তা যাওয়া-আসা করলো। সেটা একটা বিশেষ দিন ছিলো। যেদিন অ্যালবেট্রসঅশ্রুতপূর্ব জলদানের মতো রাজনগরের ভোররাতেরনদীতে দেখা দিয়েছিলো। এমন নয় যে কুতঘাটে সংবাদ আনার লোক ছিলো। হরদয়াল হাসলো এবার মনে মনে। জেলেরা খবর এনেছিলো। সেদিন তাদের আবার ইলিশ ধরার সূচনা। সরস্বতীপূজা তো। সেদিন থেকেই আবার ইলিশ খাওয়া হবে। তার কুঠিতে হয় না। কিন্তু রাজবাড়ির অন্দরেও জোড়া ইলিশ, জোড়া বড়ি, ধানদুর্বা, সিঁদুর এসব দিয়ে ইলিশকে অভ্যর্থনা করা হয়। যেমন গ্রামের পথে পথে, তেমন রাজবাড়ির দিকেও জেলেরা ঝাঁকা মাথায় ছুটতে থাকে। ইলিশ তো জীবিত থাকে না অন্য মাছের মতো, কিন্তু এমন চাই যে তখনো রক্ত গড়িয়ে আসছে কানকো থেকে। দেওয়ানকুঠিতেও মাছ দিতে আসবে তারা। সেখানে দাম নয়। দুটো মাছে দশটাকা বকশিশ তো!

তারাই প্রথম অ্যালবেট্রসের কথা বলেছিলো। ভোর ভোর রাতে তখন বেড়াল গুটিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, প্রথমে আলোর ঝলকানি–যেন সূর্য উঠলো অকালে; কিন্তু দিকটা তো পুব নয়, দক্ষিণ। আর সূর্যের আলো কি জলের বুকে ঝাটায়? আর তখন বিরাট একটা ছাগলের ভ্যা ভ্যা। কিন্তু জল কাঁপছে, ঢেউ উঠছে, তাদের ডিঙিগুলো নাচছে, জাল টানতে অন্যরকম লাগছে হাতে। অবাক হতে হতে, ভয় কাটাতে কাটাতে তারা গেলো গেলো করে উঠলো। সেই দানব তো জালের উপরেই উঠে পড়তে চায়। জাল বাঁচাতে চার-পাঁচখানা ডিঙ্গি, তারাই তো সেদিকে, ঢেউ অগ্রাহ্য করে ছুটলো। জাল বাঁচলো, কিন্তু শ্ৰীমন্তর নৌকাখানা ডুবেছে। বাপবেটা মিলে তারা চারজন সাঁতরে উঠেছে বটে। তবে (জেলে দুজন হাসলো এই জায়গায়) মাছও এবার উঠেছে! বোধহয় সেই কলের নৌকাই ঝেটিয়ে এনেছে। মাছ।

এ বিষয়ে হরদয়ালের প্রথম চিন্তা আমরা শুনেছি ইতিপূর্বে–এটা একটা এগিয়ে যাওয়া, কিন্তু কিছুই আর অর্জিত রইলোনা। এ বিষয়ে সর্বরঞ্জনপ্রসাদের মনোভাবেরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। সে বাড়ির সামনে, গঞ্জে নয়, জেলে দেখে অবাক হয়েছিলো। জেলেরা যখন প্রায় জোর করেই তাকে জোড়া ইলিশ দিতে চাইলো, সে প্রথম বললো, এখানে এরকম পাওয়া যায়? কিন্তু তার মনে পড়ে গেলো, সেদিন পূজার ব্যাপার একটা আছে। তার মনে বিমুখতা দেখা দিলল। গৃহিণীর উৎসাহকে সে দৃঢ়ভাবে নিরস্ত করলো,নানা,এ কি কখনো, না না, এ হতে পারে না যে এমন কুসংস্কারকে আমরা প্রশ্রয় দেবো।

আদর্শবাদী মানুষদের চিন্তা যেন আদর্শের তাড়নাতেই দ্রুততর হয়। সর্বরঞ্জনপ্রসাদ জেলেদের প্রায় পিছন পিছন বেরিয়ে পড়েছিলো। সে তাদের প্রায় সবগুলো পথ দিয়েই ছুটতে দেখলো। কোথাও কি তাদের গতিরোধ হবে? হঠাৎ অনুপ্রেরণার মতোই তার মনে পড়ে গেলো : এদিকে চরণই একমাত্র, অন্তত একদিক দিয়ে, আধুনিক মনের পরিচয় দিয়েছে, অন্তত বিবাহে আর পুরোহিতের অসুবিধা বলে চরণের বাড়িতে পূজা নেই। সে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চরণের বাড়ির দিকে চলেছিলো। আদর্শবাদীদের মতোই আবার পরাজয় তার প্রতীক্ষা করছিলো। সে তখন চরণের বাইরের দিকের ঘরের বারান্দার কাছে। সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। দেখলো : চরণের মাথায় নতুন গামছা বাঁধা, সে খুরপি হতে বাড়ির সামনে একটা কঞ্চি-ঘেরা জায়গায় মাটি ঠিক করছে; চরণের বউ থালা হাতে বেরিয়ে এলো উলু দিতে দিতে। চরণ যে জায়গাটা খুঁড়ছিলো সেখানে থালা কাত করে যা ঢেলে দিলো তা যে রক্ত তা দূর থেকেই বোঝা যায়; আর আঁশগুলোও রোদে চকচক করে উঠলো; চরণ তার ট্র্যাক থেকে কীসের বীজ বার করে সে মাটিতে পুঁতে দিলো।

সর্বরঞ্জনপ্রসাদ গলা-খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি না জানিয়ে পারলো না। বনদুর্গা, চরণের স্ত্রী, দৌড়ে পালালো। চরণ মাথার গামছা খুলে তাড়াতাড়ি হাত মুছে সলজ্জভাবে বললো–এত সকালে যে?

সর্বরঞ্জন নিশ্চয়ই শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ। সে তো বুঝতেই পারছে এইমাত্র যা সে দেখলো, তা পৌত্তলিকতার চাইতেও অনেক পিছিয়ে থাকা–মাটি, রক্ত, বীজ নিয়ে এক ঘোরতর আদিমতা! সে কোনো কথা না বলেই পিছন ফিরে নিজের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করলো।

চরণ একটু অবাক, এমনকী একটু লজ্জিতও হয়েছিল বটে, কিন্তু তখন তাকে একটু ভাবতেই হলো। তাতেও অ্যালবেট্রস দেখা দিয়েছিলো। তা বিশেষভাবেই, সকালের ব্যাপারটাকে পূর্বাপর সাজিয়ে নিয়ে ভাবতে আগ্রহ হচ্ছে তার। বনদুর্গার দাবি মেটানোর পরে।

মরেলগঞ্জ থেকে নদীর ধারে যেতে কিংবা ফরাসডাঙর উপর দিয়ে যেতে হয়। মাছ কিনতে গোপাল দাস নদীর ধারে যাওয়ার পথে চরণদাসের বাড়িতে এসেছিলো ভোর সকালে। চরণ শুনে বলেছিলো, তোমার সুখের কমতি নেই, গোপালদা। কিন্তু চলো যাই বলে সে-ও সঙ্গী হয়েছিলো। বাছাই মাছ পেতে নদীর ধারই ভালো।

তারা একা একা যখন তখন তো ভাবেই, একত্র হলে ভাবনাটা বাড়া স্বাভাবিক।

চরণ বললো–এ মাসের শেষ থেকে তো আমাদের সাক্ষী দিতে শুরু হবে।

গোপাল নিস্পৃহভাবে বললো–বামুনাদিয়াড়া, শালুকডুবি, হিমায়েতপুর সেরে কাল নাকি সদরের দিকে গেলো। কালেক্টরও নাকি সঙ্গে আসবে তখন এখানে।

চরণ জিজ্ঞাসা করেছিলো কিছু বুঝলে সেখানে কী হলো?

কী করে জানব? কাল বিশে চাষ দিচ্ছিলো। বিশেকে তুমি চেনো না এমন নয়। তার দরখাস্ত ঠিক করতে হেডমাস্টারের একবেলা লেগেছিলো। জিজ্ঞাসা করলাম ওসব জায়গার রায়তরা কমিশনে কী বলেছে, না বলেছে। বিশে লাঙল ঘুরিয়ে নিয়ে দূরে গেলো যেন কানে শোনে না।

চরণ একবার গত সনেই ইলিশের কথা তুলেছিলো। সেখান থেকে সরে এসে আবার বললো–বামুনদিয়াড়া, শালুকডুবি সব তো রাজার জমিদারিতেই, সেখানে তো গুড় হতো।

-হতো তো। শাবাবু আর পালবাবু পত্তনিদার। ডানকানের সঙ্গে কমিশনে নীলের চাষ করায়।

খবরটা দুজনেরই জানা, আলাপে বিষয়টাকে এনে খতিয়ে দেখলো যেন।

খানিকটা গিয়ে গোপাল বলেছিলো–এসব কী শুনি, চরণ, তোমাদের গ্রামে ইংরেজি মাসেই নাকি কারা সব আসবে? তারাও সব ইংরেজ নাকি?

-তুমি হাসালে গোপালদা, জঙ্গীলাট বাঙালি হবে, না মুসলমান?

নদীর ঘাটে ইলিশ তো অবশ্যই উত্তেজনার কারণ, ক্রেতা জেলে ফড়ের ভিড়। নামানো চুবড়ি-ডালাগুলো ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়, জেলের মাথায় চুবড়ি ঘাটে আসতে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা চলেছে, কোনো কোনো জেলে না না করে অন্য গ্রামে যেতে ছুটছে। কিন্তু ভিড় যেন দো-মনা। অন্য কোথাও যেন আর এক উত্তেজনার কারণ থাকতে পারে।

চরণ বললো–এবার বেশ মাছ।

 গোপাল বললো–হুঁ।

দুজনে ভিড়ে গলে মাছ পছন্দ করছিলো। চরণ একজোড়া পছন্দ করে কিনে ফেলো। গোপাল বললো–আর একটি দেখি, দাঁড়াও। তারা দুজনে আর এক ভিড়ে ঢুকলো। তখন সেখানে মাছের চাইতে কলের নৌকোর কথা বেশি। গোপাল সেই গল্পবাজ জেলেকে বললো, রাখো, রাখো, মাছ দেখাও। জলে নাকি রেলগাড়ি চলে!

মাছ কেনা যখন শেষ তখন তাড়াতাড়ি ফেরা ভালো। চরণ বলেছিলো–ফরাসডাঙা দিয়ে চলো, তাড়াতাড়ি হবে।

খানিকটা গিয়ে চরণ বললো–গোপালদা, চুপচাপ যে?

গোপাল বললো–অমর্ত্য আর কৃষ্ণানন্দ আউসের খোঁজ করছে, তুমি কী ভাবছো, চরণ?

এখনো ভাবিনি, কমিশনটা মিটুক।

 মিটবে? যারা কমিশনে কাগজ পাঠায়নি তারা এখন যে যা পাচ্ছে দাদন নিচ্ছে। –

-নেবে তো। খাওয়ার ধান কিনতে টাকা লাগে।

–যারা দাদন পেলোনা, তারা কিন্তু রেগে কই। আমার জমিতে কিন্তু এর আগেও আউস তেমন ফলতো না।

চরণ বললো–উল্টোপাল্টা কী বলছো, গোপালদা?

দুজনেই মাথা নিচু করে পায়ের দিকে চেয়ে হাঁটছিলো। চিন্তার ভারই তো ঘাড়ে।

নদী বরাবর চলে ফরাসডাঙায় উঠতে কুতঘাট পেরোতে হয়। তারা সামনে আট-দশজন গ্রাম্যমানুষ এবং কয়েকটি উলঙ্গ বালককে জটলা করতে দেখতে পেয়েছিলো। গলা বাড়িয়ে দেখতে গিয়ে জটলার মধ্যে অভূতপূর্ব পোশাকের দুজন লালমুখোকে দেখতে না দেখতে তাদের পিছনে কুতঘাটে বাঁধা সেই চোংদার কলের নৌকোকে দেখতে পেয়েছিলো। এমনকী কপালের উপরে দুহাতে বারান্দা করে সেই জাহাজের গায়ে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অক্ষরে লেখা অ্যালবেট্রস শব্দটাকেও পড়তে পেরেছিলো চরণ।

কিন্তু সেই লালমুখোরাও তাদের দেখতে পেয়েছিলো। তাদের পোশাক জটলার লোকদের চাইতে কিছু উন্নত হওয়াতেই বোধ হয় লালমুখোদের একটা বললো–হে, ব্ল্যাকি! ডু ই নো দা ওয়ে টু প্ল্যানটেশন।

ইংরেজি-পড়া চরণ থমকে দাঁড়ালো। কিছু একটা তাকে আঘাত করেছে এই রকম অনুভূতির সঙ্গে তার রাগ চড়চড় করে উঠছিলো : ইউ ব্লাডি সোয়াইন, ইউ ফিলদি শ্বেতী, এ রকম সব কথা তার মনে আসছিলো।

কিন্তু সে দাঁড়ালো না, গোপালের হাত টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলো। জাহাজী গোরা দুটো হেই, ইউ দেয়ার, ইউ–এমন সব চিৎকার করতে লাগলো।

বেশ খানিকটা চলে এসে গোপাল জিজ্ঞাসা করলো–পালিয়ে এলে যেন,কী কইছিলো? ধমকালো যেন তোমাকে?

চরণ বললো–ডানকানের কাছে যেতে চায়। তা পথ খুঁজে নিক না।

গোপাল বললো–ওরা তো ওই কলের জাহাজ থেকেই, নয় কি? ঘাটে তো নৌকোও ছিলো, বিলিতি মনে হলো যেন।

আরো খানিকটা চলে গোপাল বলেছিলো–এই এরা, আবার জঙ্গীলাট, আবার কমিশনের তারা সবাই কিন্তু এক জাত।

চরণ ভাবছিলো। তখন গোপাল বললো–মুশকিল এই, চরণ, তোমার জমির অনেকটা মরেলগঞ্জে কিন্তু বাড়িটা রাজনগরে, ডানকানের এলাকায় নয়।

–এ কথা যে?

–ভাবছি।

তারা তখন সেখানে এসেছে যেখানে পথটার এক-শাখা মরেলগঞ্জে, অন্যটি রাজনগরের দিকে গিয়েছে। চরণ একটু দাঁড়ালো, বললো–গোপালদা, সকলকেই কিন্তু সাক্ষী দিতে একইসঙ্গে যেতে হবে। পরের পর সাক্ষী দিয়ে যাবো। প্রথমে আমরা দিলে আর সকলে জোর পাবে। হেডমাস্টারমশায়ের কাছে আবার বসতে হয় কিন্তু।

চরণ অনেকক্ষণ ধরে কথাগুলোকে মনের মধ্যে তোলাপাড়া করলো। তার একটা খটকা লাগছে মনে। গোপালদা কী বলতে চাইছে? শেষে সে ভাবলো এখনো আট-দশ দিন, দেখা যাক।

.

সর্বরঞ্জনপ্রসাদ অবশ্যই সেদিন অ্যালবেট্রসের কথা শোনেনি। সেও নিতান্ত ভারাক্রান্ত মনে নিজের বাসার দিকে ফিরে চলেছিলো। গঞ্জের উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে। তা করতে গিয়ে সে ভুলে গেলো, দুদিন আগেই প্রতিজ্ঞা করেছিলো এ পথটাকে সে ভবিষ্যতে বর্জন করবে। পরপর কয়েকটি কুমোরদের চালা। সেখানে কুমোরেরা পট ও প্রতিমা তৈরী করছিলো। বয়স্ক পুরুষ, নারী, বালক, বালিকা সকলেই কাজ করছে। বালকদের মধ্যে তার পরিচিত ছাত্ররাও কয়েকটি। অবাকই লাগে দেখতে, সাদা সরার উপরে কী অবলীলায় তুলি টানছে সেই বালকেরা এবং স্ত্রীলোকেরা। কিন্তু সেখানে কোনো ভদ্রব্যক্তিরই থাকা চলে? অধোবদনে পালাতে হয় না? কী এত অভূতপূর্ব নির্লজ্জতায় সেই কুমোরেরা নারীদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরী করছে। নিতম্বের বর্তুলতা এবং মসৃণতা, স্তনের বর্তুলতা এবং তারও মসৃণতা, এমনকী পা দুটির সন্নিহিত ভাজ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে পালিয়েছিলো সর্বরঞ্জন। তাড়াতাড়ির মাথায় এখন সেখানেই এসে পড়ে বিপদ থেকে বাঁচার জন্য চোখ তুলতেই সে দেখতে পেলো, তেমনি বড়ো বড়ো দুটো প্রতিমাকে শাড়ি পরানোর তোড়জোড় চলেছে।

হতাশ, বিপন্ন, দুঃখার্ত সর্বরঞ্জন কী ভাববে তাই ভেবে পেলো না। একবার তার মনে হলো, এই গ্রামে এমনই সব ঘটবে। কী ভয়ঙ্কর এই এক আদিম অন্ধকার।

কিন্তু সত্যকে স্বীকার না করে উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে সেদিনটা তো ভলোই ছিলো। সকাল দশটাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। গম্ভীর সর্বরঞ্জন হেসে ফেলো। এমনকী কথা বলার ছন্দে গোলমাল হয়ে গেলো। সে বললো–দেখে যাও, দেখে যাও, দিদির চিঠি।

ব্রহ্ম-ঠাকরুনের চিঠি। সে লিখেছিলো গুণাঢ্যমশায়ের কন্যাকে রানীমা পছন্দ করেছেন।

.

০২.

অ্যালবেট্রসে জঙ্গীলাটের আসার সংবাদ হরদয়ালকে অবশ্য নিশ্চিন্ত করেছিলো। জঙ্গীলাট, তার পরিবারের মহিলারা। তার দেহরক্ষী দল, তার অফিসাররা। তাদের জন্য তাঁবু ইত্যাদি, তাদের প্রভিশন, এসব নৌকো, পাসি, বোট আনা সহজ ছিলো না। এখন তো এই একটা জাহাজে সবই ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এমনকী কয়েকটা ঘোড়াও আসবে সঙ্গে। এ বুদ্ধিটা সিম্পসন সানিয়াল কম্পানি ভালোই করেছে।

কিন্তু তখন আসল সংবাদ তো রাজকুমারের ফিরে আসা।

সেই সকালে কুয়াশার গায়ে রোদ খেলা করছে তখন। কেট তাদের কুঠির সেই কিচেন গার্ডেন থেকে ভাসের জন্য ফুল সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো। সে জানতো না, সহিস মূলা লাগিয়েছিলো। সহিস কেটের কাঁচি চেয়ে নিয়ে মূলার কচিপাতা সংগ্রহ করে দিচ্ছিলো। কিছু দূর থেকে তাদের চেনা যায় না কুয়াশায়। কিন্তু কেট সম্ভবত শাকের ব্যাপারে খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছিলো, নতুবা কুয়াশার ওপারের খুরের শব্দ, চামড়ার শ্যাড়লের মৃদু কাঁচকোচ শব্দ কানে আসতো। সেজন্যই সে চমকে উঠলো যখন সে অনুভব করলো একটা ঘোড়া ঠিক তাদের কাঁধের উপরে নাক ঝাড়লো। অনুভূতিটা ঠিক নয়। সে দেখতে পেলো ফেনসিং-এর ধারে লাগানো স্থলপদ্ম ঝোপটার লম্বা লম্বা ডালের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া আর তার সওয়ারকে অস্পষ্টভাবে হলেও দেখা যাচ্ছে। এক মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে কাটিয়েই সে চিনতে পারলো। আর তখন দৌড়ে স্থলপদ্মটার গোড়ায় গিয়ে সম্ভাষণ করলো রাজকুমার!

রাজকুমার বললো–আমি ভাবছিলাম, কেট, শীত পড়েছে, একটু কফি খেলে হয়, কিন্তু তুমি তো গৃহকাজে বাঁধা।

কেট হেসে বললো–আ, ডারলিং, খুব হয়েছে। আসুন।

বাড়িটাকে ঘুরে আসতে রাজকুমারের যে সময় লাগে তার মধ্যে কুঠিতে ফিরে, হাত পা, জামা, চুল থেকে শিশির ও ভেজা কুটো সরিয়ে, বাগচীর ঘুম ভাঙিয়ে, রান্নাঘরে কফির জল চাপিয়ে, বাইরের দরজা খুলে দেওয়ার সময় করে নিতে কেটকে তো পরিশ্রম করতেই হলো। ফলে সে যখন পার্লারে রাজকুমারকে ডেকে আনছে, তার বুক মৃদু ওঠাপড়া করছে, গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পার্লারের জানলাগুলো ভোলা যায়নি, ফলে সেখানে অন্ধকার; কুশনগুলো অগোছালো, পর্দাগুলো বিপর্যস্ত। কেট রাজকুমারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সেসব দিকে ঝুঁকতেই রাজচন্দ্র বললো–অন্ধকার থাক, তুমি কফি আনো।

বাগচী ঘুম ভেঙে রাজকুমারের কথা শুনে ততটা বিস্মিত হলো না, যতটা হলো সে এই সকালেই তার কুঠিতে এসেছে শুনে। কাল দুপুরে সে রাজবাড়িতে গিয়েছিলো। জানুয়ারি থেকেই সে যাচ্ছে, কারণ নতুন চাকরিটা তো সে গ্রহণ করেছেই। আর রাজবাড়ি সম্বন্ধে যদি জানতে চাও তবে নায়েবমশায়ের চেম্বারেই তো সংবাদ। সেখানেই সে কাল শুনেছিলো : ছিপ ফিরেছে, রাজকুমারের বোট সুতরাং বিকেলের পরপরই কুতঘাটে ভিড়বে। নায়েবমশায় আলোচনা থামিয়ে তখনই ঘাটে যানবাহন রাখার বন্দোবস্ত করতে উঠে পড়েছিলো।

আলোচনাটা আর বিশেষ কী? বাগচীর মনে হয়েছিলো কমিশনের ব্যাপারে সে যেটুকু করেছে, তাতে মরেলগঞ্জের সঙ্গে অসদ্ভাব ঘটার সম্ভাবনা। এখন তো সে রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িতই। তাই অসদ্ভাবটায় রাজবাড়িও জড়িয়ে না পড়ে। আগে থেকে নায়েবমশাইকে জানিয়ে রাখা ভালো। সুতরাং সে কমিশনের কাছে দরখাস্ত নালিশ লিখে দেওয়ার কথা বলেছিলো নায়েবকে। নায়েবমশায় শুনে বললো, আমার মনে হয় এসব ব্যাপারে রায়মশায় ভালো বুঝবেন। আমার খবর এই, যারা দরখাস্ত পেশ করেছিলো চরণ তাদের খুব বোঝাচ্ছে, কিন্তু অনেকেই সাক্ষী দিতে চাচ্ছে না। দোষও দেওয়া যায় না। ডানকান জনাত্রিশেক রায়তকে তৈরী করেছে যারা ডানকানের প্রশংসা করে সাক্ষী দেবে।

প্রকৃতপক্ষে বাগচীর ঘুম তো আগেই ভেঙেছিলো, সে শুয়ে থেকে এসবই ভাবছিলো। সে অবাক হয়ে যাচ্ছিলো, আশ্চর্য, এদিকটা সে ভেবে দেখেনি। নায়েবমশায় না বললে সে আশঙ্কাই করতো না।

রাজকুমার এসেছেন শুনে সে উঠে বসলো। কোনোরকমে প্রস্তুত হয়ে সে বসবার ঘরে পৌঁছে দেখলো, সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে কেট রাজকুমারের সঙ্গে গল্প করছে।

রাজকুমারের মুখে খুশি চকচক করছে।

বাগচী বললো–ঘর অন্ধকার তো। জানলা খুললে রোদ আসতে পারে।

রাজচন্দ্র বললো–থাক মশায়। গেঁয়োমানুষ গাঁয়ে ফিরেছি। এবার যাও, কেট, শিগগির তিন কাপ কফি। ওসব জানলা দরজা খোলা-টোলা কাল থেকেই হৈ চৈ ধুন্ধুমার করে রাজবাড়িতে হচ্ছে না মনে করো? জানো, কেট, এখানে তোমার বাড়িটা যেমন এক পালানোর জায়গা তেমন কলকাতায় ছিলো না।

কেট কফি করতে গেলে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–ভালো ছিলেন কলকাতায়? ভালোই দেখাচ্ছে আপনাকে।

-তা ছিলাম। রাজচন্দ্র নিজেই একটা জানলা খুলে দিলো। খানিকটা কোমল রোদ এসে পড়লো। তার মধ্যে বসে সে আবার বললো–বোধ হয় কানে কিছু কম শুনছি, আর হজমটা কেমন হচ্ছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না।

বাগচী কি অভ্যাসের ফলে চিকিৎসার কথা ভাবতে গেলো?

রাজচন্দ্র বললো, মানুষ অত শব্দ করে কেন, বলুন তো? খেতে বসেও অত কথা? তা মশায়, ওটা আপনার অন্যায়-ওই লোকগুলোর কথা আমাকে আগে থাকতে না বলে। দেওয়া।

কাদের কথা বলছেন, রাজকুমার?

–কেন, দিনকর রাও, সালর জং, জং বাহাদুর রাণা।

–এরা?

–আমি কি জানতাম, এঁরা কত আধুনিক, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন?

কেট এলো কফি নিয়ে। রাজচন্দ্র বাঁচালে বলে কফি টেনে নিলো।

এই সময়ে কেট লক্ষ্য করলো রাজচন্দ্রের গায়ের পুলোভারের ডিজাইনটা উল্টো উল্টো লাগছে। আরো একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে সে বুঝলো সেটা উল্টো করে পরা হয়েছে। রাজচন্দ্রও বুঝলো সে কিছু ভুল করেছে, অনুমান করলো তা পোশাকেই। বললো–ও, কেট, কফিটুকু খেতে দাও, তুমিও দেখছি হৈমবতী।

কেট নিজের সঙ্কোচ কাটাতে তাড়াতাড়ি বললো–হৈমবতী কী?

কী না, কে। তোমার মতোই, আর তারও আছে একজনের পোশাকের দিকে এমন ট্যারচা করে চাইবার অভ্যাস।

-কে হৈমবতী, রাজকুমার? কেট এই বলে অনুমান করতে চেষ্টা করলো, রাজবাড়িতে এই নামের কোনো মহিলা কি এসেছেন?

রাজকুমারের পোশাকের উপরে এমন দৃষ্টি নয়নতারা ছাড়া আর কার হতে পারে?

রাজচন্দ্র বললো, তুমি হৈমীকে দ্যাখোনি বুঝি? তোমার মতোই বরফে তৈরী, চোখ দুটোতে তোমার যেমন সোনার ভাব, তার তেমন নীলের। তা, তোমার মতোই সুন্দরী বলা যায়।

কেট একটু রঙ্গভরে বললো–কিন্তু নয়নঠাকরুনের চাইতে

রাজচন্দ্র বললো–তিনি কি আছেন গ্রামে?

কফি শেষ করে রাজচন্দ্র উঠলো। হেসে বললো–আর একদিন আসবো কেট। নতুন কয়েকটা স্কোরশীট এনেছি। ভালো কথা, তুমি কি জানতে, কেট, প্রকৃতপক্ষে লাট তিনজনা? জঙ্গীলাটের এক শ্যালী আছেন, তাঁরও পিয়ানোর বাতিক। আমি তাঁকে তোমার কথা বললাম। যদি আসেন এখানে তখন দেখবো বাগচী মাস্টারমশায়ের পোশাক নিয়ে কী হেনস্তা করো তুমি!

বাগচী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলোতাঁরা কি এই গ্রামে আসবেন?

রাজচন্দ্র এই বিস্ময়ের সুযোগে দরজার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো, সেখানে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–আমাদের হরদয়াল পারেও বটে। ভাগ্যে আমাদের খানিকটা জঙ্গল আছে আর তাতে বাঘ, চিতা, হরিণ, মোষ এসব থাকতে পারে।

তারা অবশ্যই দরজা পর্যন্ত এমনকী কুঠির গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। ঘোড়াটা ল্যাজ নেড়ে দুলকি চালে চলতে আরম্ভ করলে বাগচী বললো–একটা হাওয়ার মতো, নয়?

.

০৩.

তখন জঙ্গীলাটের সপারিষদ সপরিবার রাজনগরে ক্যাম্প করা, শিকার করা ইত্যাদির সংবাদে আর সংশয় নেই। ব্রজ, নরেশ আরো কিছু সংবাদ এনেছে। হৈমীও তো তাদের সঙ্গেই পরে এসেছে, তার কাছেও কিছু সংবাদ থাকবে। রাজকুমার, হৈমী, ব্রজ ইত্যাদির গ্রামে ফেরার দিন চারেক পরে রানী হরদয়ালকে ডেকে পাঠালেন। হরদয়াল অনুমান করলো রানী অবশ্যই জঙ্গীলাটের ক্যাম্প সম্বন্ধেই বলতে চান।

হরদয়ালের কিছু দেরি হলো দরবারে যেতে। কারণ তখনই বাগচী এসে বসেছিলো। সে ইন্ডিগো কমিশন সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়। সে তত ইতিমধ্যে চরণের সঙ্গে আলাপ করেছে। নায়েবমশায়ের কাছে যা সে শুনেছিলোতা চরণকে বলে জিজ্ঞাসা করেছিলো, রোজ দেখা হচ্ছে, এসব তো বলোনি? দারুণ লজ্জায় চরণের মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিলো, একবার তো মনে হলো সে ফেঁপাচ্ছে। অবশেষে বলেছিলো, এরকমই আমরা। গোপালদারই তো সবচাইতে শক্তি, সে এখনো বলছে, ভাবছি। তার পাড়ার যারা দরখাস্ত করেছে তাদের অন্তত পনেরোজনকে অনুরোধ করেছি। মুখ ঘুরিয়ে থাকে, যেন চেনে না। বাগচী হরদয়ালকে সমস্যার কথাই বললো। হরদয়াল মিনিট পাঁচ-সাত চুপ করে থেকে বললো, আপনাকে এখনই হতাশ হতে বলি না; কিন্তু কুমীরের সঙ্গে জলে থেকে বিবাদ না করার প্রবাদটা কত দিনের ভেবে দেখুন।

বাগচী বললো–আমি ভাবছি কমিশন চলে যাওয়ার পরে কী হয়।

এই সূত্রেই বড়ো ইংরেজ এবং ছোটো ইংরেজের আলাপ উঠবে এমন হলো। তারা দুজনেই ক্লাইভ ইম্পের কথা জানতো, বার্ক শেরিডানের কথাও। বার্ক শেরিডানের বক্তৃতা তো গ্রন্থাকারেই হরদয়ালের লাইব্রেরিতে। তারা জানতে অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকায় যারা আদিবাসীদের গুলি করা আর পশু শিকার করা একই মনে করে, এবং সে রকম গুলি করে এসে লাঞ্চ বা ডিনারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, স্ত্রীদের সঙ্গে, হাসি তামাসা প্রণয় করে, বাইবেল পড়ে, যারা ধর্মের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমেরিকা গিয়ে সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করে নিজেদের মহাবীর মনে করেছিলো, যারা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে জাহাজের খোলে ভরে ক্রীতদাস চালান দেয়, আর যারা সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে, তারা একই ইংরেজ জাতি। সে জাতে হিগিন-বোথামের মতো দাস ব্যবসায়ী এবং উইলবারফোর্সের মতো ক্রীতদাস-মুক্তির আন্দোলনে সমর্পিত-প্রাণ মানুষ আছে, নীলকর ডানকান আছে, আর্চি হিল আছে, উইলিয়াম জোন্স, হেয়ার,বীটন আছে। তারা সুতরাং এদিকে আলোচনায় গেলো না।

হরদয়াল হেসে বললো–আপনি কি মনে করেন, মিস্টার বাগচী, আর্মি কমিশনে ইংল্যান্ডের রাজকীয় অফিসারদের কেউ কেউ মিথ্যা সাক্ষী দেবে না? চাইল্ড লেবার কমিশনের ফলে দেশের শিশুদের মিলের কয়েদখানায় কিংবা খনির মৃত্যু ফাঁদে যাওয়া বন্ধ হবে? ডানকানেরা যে ভালো না-ও হতে পারে এরকম প্রশ্ন তো স্বীকৃত হচ্ছে। হয়তো চরণদাসের মতো কেউ কেউ সাক্ষী দেবে।

.

হরদয়াল রাজবাড়িতে গিয়ে শুনলো, রানী খানিকক্ষণ আগে নিচের বসবার ঘর থেকে উঠে গিয়েছেন। কিন্তু সেই দাসীই বললো, আপনাকে বলতে বলেছেন, এখন সম্ভবত উপরের বসবার ঘরে থাকবেন। দোতলায় পৌঁছেও হরদয়ালকে কিছুক্ষণ বসবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে অপেক্ষা করতে হলো। সে শুনতে পেলো রানী কাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আলাপের বিষয়গুলো অনেকটাই তার কানে আসতে লাগলো। তা অবশ্যই এমন নয় যে কোনো দিক দিয়েই তাকে সঙ্কুচিত হতে হবে।

রানীর ঘরে তখন নয়নতারা আর হৈমী। নয়নতারা বোধ হয় তাকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছিল।

হরদয়াল এসেছেন–দাসী এই খবর দিলে নয়নতারা পুঁথিটাকে পাটায় জড়িয়ে বাঁধলো। কিন্তু হাসতে হাসতে বললো, রানীমা পৌত্রকে রাজা করতে হলে ভীমার্জুনের বয়স তখন কম করেও ষাট-সত্তরে দাঁড়ায়;কৃষ্ণ তাদের সখা, তারও সেরকমই বয়স হবে। ষাট-সত্তরে কি আর গাণ্ডীব টানা যায়, না সুদর্শন তোলা যায়? বেচারীরা!

হৈমী বললো–কৃষ্ণেরও মহাপ্রস্থানে যাওয়া ভালো ছিলো, তাহলে ব্যাধের হাতে প্রাণ দিতে হতো না।

তখন কী অবস্থা দেশের! একদিকে ডাকাত অন্যদিকে ব্যাধ, তাদের হাতে ক্ষত্রিয়রা যদুবীরেরা মার খাচ্ছে। তাদের স্ত্রীদের কেড়ে নিচ্ছে। এখনকার ভীলদের পূর্বপুরুষ হতে পারে। বোধ হয় পরীক্ষিত বাদশার বাদশাহীও ছিলো দিল্লী সে পালাম তক।

রানী খিলখিল করে হেসে উঠলেন-বললেন, খুব হয়েছে। হৈমী, তাহলে কলকাতায় এরকম আলোচনাও তুমি শুনেছো? কৃষ্ণ ঐতিহাসিক মানুষ একজন, বিষ্ণু নন? তোমরা আমাকে ব্রাহ্ম না করে ছাড়বে না দেখছি।

নয়নতারা বললো–আমাদের শিরোমণিমশায়

–তার আবার কী?

এক গল্প ছড়াচ্ছে আবার। আমাদের রাজবাড়ির পুরোহিতমশায় সেদিন বলছিলেন। শিরোমণিমশায় নাকি তাকে কী কথায় ধমকে দিয়েছেন, তুই তো বাপু ব্রাহ্মই। রোজই তো যা ভেবেছিস, বলেছিস, করেছিস, স্বপ্ন দেখিস সবাই তো ব্রহ্মকে সমর্পণ করিস।

রানী হেসে বললেন–সেকেলে ব্রাহ্মণদের রসিকতার তল নেই। হৈমী, এবার বাপু তুমি ওঠো। রাজুকে দেখছিলাম ময়লা পায়জামা আচকান পরতে। তুমি বাপু, কলকাতায় ওর পোশাক ভালো রাখতে, এখানেও তেমনি রাখো। ওর ঘরের আলমারিটা আজ খুলল। কে যেন বলছিলো ঘোড়ায় চড়ার, শিকারে যাওয়ার, এমনকীনাকি ঘোড়ায় চড়ে শোর মারারও আলাদা আলাদা পোশাক দরকার হয়। তা কি আছে ওর? না হয় কাউকে দিয়ে খালেক ওস্তাগরকে খবর দিও।

হৈমী উঠে দাঁড়িয়ে বললো–সিমসন তো রাজকুমারের দলের সঙ্গে অনেক কাপড় চোপড় দিয়ে গ্রাহামকে পাঠিয়েছে। সেই আর্মির টেলার। রাজকুমারের পোশাক বানাতে শুরুও করেছে।

দ্যাখো, রানী হেসে বললেন, হরদয়ালের কী রকম সবদিকে দৃষ্টি। জানো,নয়ন, এবার কলকাতায় অনেক নতুন ব্যাপার হয়েছে, তাই না, হৈমী? আমাদের রাজু এবার পীরালি হতে পেরেছে।

হরদয়ালের বাবুর্চি সোলটান আর পিয়েত্রোর বাবুর্চি বান্দার রান্নাই খুব খেয়েছে। শোর টোর কীসব খেয়ে থাকবে।

নয়নতারা বললো–অ্যা, মাগো!

হৈমী বললো–না, রানীমা, শোর একদিনও ছিলো না।

রানী বললেন–তবে যে সেই মেয়েটি, আমাদের হরদয়ালের বন্ধুপত্নী বললো, মহাভারতেই আছে–অর্জুন তো বটেই, এমনকী যাকে নিরামিষাশী বলে চালাচ্ছো সেই শিবঠাকুরও দারুণ শশারভক্ত ছিলেন। তাই মরা শোর নিয়ে নাকি যুদ্ধ, নাকি এক কাব্যও আছে।

নয়নতারা হেসে বললো–দেখলেন, ওরা কলকাতায় এখন ইংরেজদের মতো বুদ্ধিমান হয়েছে, কাব্যের মানে করতে আটকায় না আর।

রানী আবার বললেন–জানে আবার না? আমাকে সেই ভাদুড়ীবউই বলেছিলো সঙোসকিতো নামে নাকি এক ভাষা আছে, আর তাতে নাকি গোগ্নো বলে এক শব্দও আছে, যাতে প্রমাণ মুনি-ঋষিরা আকছার ভগবতী খেতেন আর তাতেই পোষ্টাই।

নয়নতারা খিলখিল করে হেসে বললো–এবার আমাদের রানীমা বেশ জ্ঞান নিয়ে ফিরেছেন। ভাগ্যে তিনি বলেননি ভগবতী খাওয়া ছেড়েই হিন্দুরা যুদ্ধে হেরেছে বারবার।

হৈমী বললো–কিন্তু রানীমা, দুবার তো ভোজ হয়েছে, দুবারই কিন্তু হরিণ, তিতির আর হাঁস শিকার করেছিলেন রাজকুমার। কলকাতার কাছেই তো জঙ্গল। হরিণ খেতে খেতেই তো এখানকার জঙ্গলে হরিণ আর নদীতে চখা শিকারের কথা উঠলো জঙ্গীলাটের।

রানী বললেন–দ্যাখো আমাদের হরদয়ালকে; দরকারে সে কেমন হরিণসমেত জঙ্গল জোগাড় করতে পারে। কিন্তু হৈমী, তোমাকে যেজন্য ডেকেছি তাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তুমি কি জঙ্গীলাটের স্ত্রী আর শ্যালীকে হার দুটো দিয়ে আসতে পেরেছিলে, তাদের হাতেই? রাজু কি সঙ্গে গিয়েছিলো? হার পছন্দ হয়েছে তো?

হৈমী বললো–ভেবেছিলাম একই প্রায় দেখতে, স্ত্রী আর শ্যালীতে গোল না বাধে। কিন্তু রানীমা, ওদের অত দামী না দিলেও হতো।

রানী হেসে বললেন–পাগল কোথাকার! লক্ষ্য করোনি ওটা একটা পুরনো সাত নহর ভেঙে তার পাঁচ নহরে দুটো বানিয়ে ওদের দেওয়া হয়েছে। আর গোল হওয়ার কথাও নয়, একটা তিন নহর, অন্যটা দু নহর ছিলো।

-কিন্তু মুক্তো তো? হৈমী বললো।

–এই দ্যাখো, তাছাড়া আমি কি দিতে পারতাম? ভালো কথা মনে করেছে। স্যাকরাকে আজই ডাকিও তো। কলকাতায় সেই হার দুটিকে গড়াতে দেবো ভেবেছিলাম। বাকি দু নহরে দুটো বানাতে দিও। তোমার কাছেই তো আছে। বাগচী মাস্টারমশায়ের স্ত্রী তো এখন প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রী হয়ে জঙ্গীলাটের পরিবার এলে মিশবে-টিশবে। তার কী আছে আমি জানি না। আমার পক্ষ হয়ে তাকে দিও একটা। আর দ্যাখো বাপু, তুমি তো সব সাদাই পরো। অন্যটাকে তুমি সবসময়ে পরবার জন্য না হয় বানিয়ে নিলে। একেবারে গলা খালি রাখো!

নয়নতারা উঠে বললো–আপনি কি এখন স্নানে যাবেন?

রানী বললেন–তোমরা এসো। হরদয়াল ও-ঘরে অপেক্ষা করছে, তার সঙ্গে কথা বলে নিই। কাউকে বলে দিও হরদয়ালকে আসতে বলে দিতে।

রানী এখন দেখা করবেন দাসীর মুখে জেনে হরদয়াল রানীর বসবার ঘরে গেলো। এ অঞ্চলটা তো সবসময়েই স্নিগ্ধভাবে নিঃশব্দ, ফলে এ ঘরের আলাপ অ্যান্টিচেম্বারে স্পষ্টই শোনা যায়। কথাগুলো হরদয়ালের মুখে একটা স্মিত হাসি হয়ে রইলো। সে এই ভাবতে ভাবতে ঢুকলো, মুক্তোর নহরের সংখ্যায় কি যারা পরবে তাদের স্তরভেদ হয়?

ততক্ষণে রানী কথা বলতে শুরু করেছেন। সুরেনকে ডেকেছিলাম। লাটের কথা বলতেই হকচকিয়ে গেলো। বললো–যত লোকই লাগানো হোক এই শীত ঋতুতেই কি তেমন একটা করা যাবে?

-তা তো নয়ই, হরদয়াল বললো। সেজন্যই কি এখন সে নরেশকে সঙ্গে নিয়ে পিয়েত্রোর বাংলোর দিকে গেলো?

-সেটাকে কিছু করা যায় কিনা তাই বোধ হয় ভাবছে। বোধ হয় ফিরে এসে তোমাকে জানানোর মতলব।

হরদয়াল বললো–এখন কিছু নতুন করে করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম একটা আন্দাজ করছি, লাট আর তার পরিবারের যে দু-তিনজন তারা আপনার দেওয়ানকুঠিতে থাকতে পারবেন। আমার অভিজ্ঞতায় তা যে কোনো শহরের সার্কিট-হাউস বা কালেক্টর বাংলোর নিচু নয়। তাঁর সঙ্গী অন্য জনাদশেক অফিসার অনায়াসে পিয়েত্রোর বাংলোয় থাকতে পারবে। দেহরক্ষী টমিরা অবশ্য লাটের কাছাকাছি থাকতে চাইবে। তাদের জন্য দেওয়ানকুঠির লনে ছোলদারি টেন্ট খাটানো যেতে পারবে। সিমসন সেই রকম উদ্যোগ করছে। তবে তোষাখানা থেকে কিছু গালিচা বার করতে হতে পারে। আপনার এ ব্যবস্থা পছন্দ হলে টমিদের ছোলদারি আর দেওয়ানকুঠি ঘিরে ফুট ছয়েক উঁচু ফেনসিং-এ রাজবাড়ি থেকে তাকে আলাদা করে দেওয়ার কথাও ভাবছি। আমি কি এ ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চিন্ত থাকতে অনুরোধ করবো?

রানী বললেন–তা যদি বলো তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু রানী হাসলেন। হরদয়াল বললো–সিমসন সানিয়াল দ্বিতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ থেকে কমিসারিয়টের কাজ করছে। সে সময়ে তো শুধু খাদ্য নয়, ঘোড়া, তবু সবই জাহাজে গুছিয়ে নেওয়ার অভ্যাস করেছিলো। এদিকে পাটনা থেকে মীরাট পর্যন্ত যে ইংরেজ সৈন্যদল ছিলো তাদের খাদ্য, তাঁবু, ঘোড়া এসবের জোগান দিয়েছে। এবার সেই সিমসনই ঘোড়া, তাঁবু, প্রভিশন ইত্যাদি পাঠাবে।

রানী খানিকটা ভাবলেন। ঈষৎ হেসে বললেন–এই সানিয়ালদের একজনই তো গুণাঢ্য লিখছে পদবী। তার কন্যা সম্বন্ধে তুমি আর কী ভাবলে?

হরদয়াল একটু ইতস্তত করে বললো–এরকম প্রচার ছিলো কনে বছর পনেরোর হয়েছে…

রানী বললেন–ঠিক নয়। তোমার বন্ধুর স্ত্রী আমাকে বলেছেন বছর তেরো হলো। ওদের সমাজে আজকাল কম বয়সের মেয়ের বিবাহ নিন্দার, সেজন্য ঘটকী বয়স বাড়িয়ে থাকবে।

হরদয়াল নিজের করতলের দিকে মুখ রেখে বললো–সেজন্যই বলছিলাম…

রানী বললেন–খোঁজ নিয়েছিলে, সংযুক্ত প্রদেশে গুণাঢ্য সত্যিই জমিদারি কিনেছে কিনা?

-হ্যাঁ, দু লাখের মতো হবে। কিন্তু একটা কথা এই, গুণাঢ্য ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু ইদানীং ব্রাহ্ম, এবং উপবীত ত্যাগ করার কথাও ভাবছেন।

রানী বললেন–খোঁজ নিয়ে দেখেছো ওটা সত্য কিনা যে গুণাঢ্যকন্যা বিলিতি মেমের কাছে লেখাপড়া শিখেছে, দরকারে ইংরেজিতে কথা বলে কিনা?

–এটাও সত্য।

উপবীতের কথা ভাবছো? রানী হাসলেন, একটু দ্বিধা করলেন, বললেন পরে, তুমি কি জানোনা, তোতাপুরী এরকম পরিচয় দিয়েছিলো নিজের? লোটা, চিমটে, হরিণ-চামড়া সম্বল। নাগাই বলতে পারো একরকম। গত বর্ষায় শিরোমণি তাকে মন্দিরের পিছনে শালবাগান দেখিয়ে দিয়েছিলো। রাজবাড়ি থেকে ধুনির কাঠ আর সিধে দেওয়া হতো। তার কিন্তু শিখা উপবীত ছিলো না। সাকার পূজাকে ব্যর্থ পুতুলপূজা বলত।

হরদয়াল অবাক হলো। সে ভাবলো, কে এই তোতাপুরী যে একসময়ে এসে রাজবাড়ির সীমার মধ্যে মন্দিরের পিছনে শালবাগানে আশ্রয় পেয়েছিলো? সেটা কৌতূহলের নয়, সে যে তেমন আশ্রয় পেয়েছিলো সেটাই কি আবার তাকে অবাক করে দেবে? সে কিন্তু এত কাছে থেকেও এই বহিরাগতের তেমন রাজবাড়ির সীমার মধ্যে আশ্রয় পাওয়ার বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি! এটা কি তেমন আর একটা বিষয় যা প্রমাণ করে রানী কাছারির এতগুলো সতর্ক দৃষ্টির ভিতরেও, যে কোনো সময়েই অভাবনীয় কিছু ঘটাতে পারেন!

হরদয়ালের এই অনুভূতি যখন তার অভিমানকে মৃদু আলোড়িত করছে, সে শুনতে পেলো রানী বলছেন–তাকেও তুমি উপবীত-ত্যাগী ব্রাহ্ম বলতে পারো, যদিও সে আকাশ মন্দির।

হরদয়াল বললো–আপনি আদেশ করলে এ বিবাহ হবে।

রানী বললেন–তাছাড়া আমি শুনেছিকনেকে তাদের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, রাজকুমার কেমন? তাতে সে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে নাকি বলেছে, খুব ভালো। ওদিকে কিন্তু যতগুলি দেখলাম এইটিই সুন্দরী হয়ে উঠবে মনে হয়।

রানীমার সামনে এসব বিষয়ে আলোচনা হয় না। হরদয়াল মুখ নিচু করে শুনলো।

রানী আবার বললেন–এখনই ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। সুরেন তোমার কাছে যাবে। সে তো বলছে রাজকুমারের বিয়ের উপযুক্ত করে আমাদের গ্রামকে সাজাতে কয়েক লাখ ইট লাগবে। আর অঘ্রান মাসের আগে তা হয়ে উঠবেনা। (রানী হাসলেন)। এক বছরেরই ধাক্কা। ও পক্ষকেও তো প্রস্তুত হতে সময় দিতে হবে!

রানী স্নানের জন্য উঠলেন।

হরদয়াল তার কুঠিতে ফিরলো। কমিরিয়টের কনট্রাকটররা অবশ্যই জানে লাটের এরকম ক্যাম্পে কী কী লাগে। তাছাড়া তারা অবশ্যই লাটের দপ্তরে যোগাযোগ রেখে চলেছে। লাটের অসুবিধা হলে তারাও কি অসন্তোষ থেকে রেহাই পায়? ব্রজনাথ ইতিমধ্যে ঝাড়, দেয়ালগিরি, লণ্ঠন, টেবল ল্যাম্প ইত্যাদির লিস্ট করে রাজবাড়ির গুদাম তোলপাড় করছে। ছোটো আকারের কার্পেটগুলোতে পিয়েত্রোর বাংলোয় চলে যাবে, কিন্তু রাজবাড়ির নতুন কার্পেটগুলো সবই কি বড়ো মাপের নয়? সেগুলো কি দেওয়ানকুঠিতে হবে? না হলে মাপ দিয়ে কলকাতায় লোক পাঠাতে হয়। ওদিকেও দ্যাখো রাজকুমারের বন্দুক, ঘোড়া, হাতি আছে, কিন্তু সেই শোর শিকারের বল্লম? আর কুকুরও লাগে বোধহয়। তাহলে কি ব্রজকেই পাঠাতে হয় কলকাতায়? পারবে ছিপে যাওয়া-আসা করে। তার চাইতে তার করা ভালো।

কিন্তু নরেশ এলো। সে আসতে হরদয়াল বললো–সুরেন বাংলো দেখছে। তুমি পথ ঘাট দ্যাখো। কুতঘাটে জেটি তৈরীর কতদূর? এদিকে বলতে ভুলেছি, দেওয়ানকুঠি আর রাজবাড়ির মধ্যে অন্তত ফুট ছয়েক উঁচু ফেনসিং খাড়া করে দাও। দেখতে খারাপ না হয়। কাঠেরই। মাপ নাও গে। আর নায়েবমশায়কে বলে যেও, আমি বুনোদের জন্য অপেক্ষা করছি।

বুনোরা এলে জেনে নিতে হবে হরিণ, বাঘ, চিতা, কোনো কোনো অঞ্চলে পাওয়া সম্ভব। সেদিকের পথঘাটের কিছু কিছু উন্নতি করা দরকার।

.

০৪.

সন্ধ্যার আগে আগে বাগচী রাজবাড়ি পৌঁছলো। পথে হরদয়ালের লাইব্রেরি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের টাইমসগুলোকে সে সংগ্রহ করেছে। তার সাড়া পেয়ে রূপচাঁদ, যে এতক্ষণ ফরাশ আর মশালচিদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সে-ই এদিকে সারবলে পথ দেখিয়ে রাজকুমারের দোতলার বসবার ঘরে নিয়ে গেলো বাগচীকে। ইতিমধ্যে সে-ঘরের পরিবর্তন হয়েছে, কি আসবাবে, কি আলোতে। চীনা লেকারের কাজকরা ছোটো টেবিলের চারিদিকে খয়েরিতে সোনার ছাপ মখমলের গদিদার ইংরেজি সোফা। টেবিলের উপরে রূপার বড়ো শ্যমাদানে জ্বলন্ত মোমকে ঘিরে ঝকঝকে কাঁচের গোলক। সেই আলোতে একটা দাবার ছকে গুটি সাজিয়ে রাজকুমার একাই দুজনের হয়ে খেলছে।

বাগচী ভাবতে ভাবতেই উঠছিলো, তার স্বীকার করতে আপত্তি নেই সে বুঝতে পারছে না কী তার কাজ, কেন তাকে বেতন দেওয়া হবে? প্রকৃতপক্ষে আজই তো সে তার নতুন কাজে যোগ দিতে এসেছে। রাজবাড়ির ধরন-ধারণ জেনে নেওয়া তো কারো কর্তব্য হতে পারে না। রাজকুমারের সঙ্গে গল্প করা? তা তো সে করতোই, এই ঘরেই; কিন্তু আজ, দ্যাখো, ঘরটারও পরিবর্তন হয়েছে। গল্প করা? কাল সন্ধ্যাতে রাজকুমারের দেখা না পেয়ে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন সদরদরজার কাছে রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তখন কী করে হঠাৎ লন্ডনের ইভানজেলিস্টদের কথা উঠে পড়েছিলো। বাগচীবলেছিলো, ব্যবসা বাণিজ্যে হাতে টাকা হওয়ার পরেও কিছু লোক দেখলো সমাজে সম্মানটা যতটা পাওয়া উচিত ততটা তারা পাচ্ছেনা। সে রকম সম্মান তখনো বিশপ ইত্যাদির; তখন সেই লোকেরা ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলো এরকম একটা মত আছে। রাজকুমার হেসে উঠেছিলো। কিছুক্ষণ পরে বলেছিলো, কলকাতাতে বেশ কিছুদিন থেকে ধর্ম নিয়েই আন্দোলন। যতদূর জানা যায় তাদের বেশির ভাগ নিতান্ত মধ্যবিত্ত, ব্যবসা বাণিজ্যে টাকা হয়েছে মনে হয় না। বাগচীতখন বলেছিলো, তারাও একরকম সম্মান পান বৈকি। নিছক একজন কেরানি কিংবা শিক্ষকের চাইতে ধর্ম-আন্দোলনে যুক্ত তেমন শিক্ষক কেরানির সমাজে কিছু বেশি মান। রাজকুমার বলেছিলো, আপনার এই মত ভালো নয়! বাগচী হেসে বলেছিলো, ঠিক আমার মত নয়, একটা প্রচলিত মত, যা হয়তো কোণঠাসা কোনো বিশপ ইভাজেলিস্টদের হীন দেখাতে তৈরী করেছে। আপনি কি বলবেন, যে ধর্ম দীর্ঘ দিন নিন্দায়, ধিক্কারে কুণ্ঠিত ছিলো তা এখন নতুন রূপে নিজের স্থান খুঁজছে?

কিন্তু এসব তো সময় কাটানোর আলাপ। তার ইংরেজিতে দক্ষতাই বা কী কাজে লাগে?

বাগচী লক্ষ্য করলো, রাজকুমারের দুটো হাত যেন দু পক্ষের হয়ে চাল দিচ্ছে। বাগচী দরজার কাছে গুড ইভনিং বলে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আমি একটা হাত নেবো কি? রাজকুমার ছক থেকে হাসিমুখ তুলো। হয়তো আধঘণ্টার চিন্তায় দু রঙের যে দুটো ব্যহ সাজিয়েছিলো ছক ধরে উল্টে দিয়ে তা ভেঙে দিয়ে, ছকটাকে একপাশে সরিয়ে রাখলো। গলা একটু তুলে বললো–কে আছো, হৈমীকে ডেকে দিও।

হৈমী দু-চার মিনিটে এলে রাজচন্দ্র বললো–ইনি হৈমী, রানীমার লোক। ইনি মিস্টার বাগচী, আমার সেক্রেটারি। তো, হৈমী কলকাতায় ব্র্যান্ডি লাঞ্চ খাইয়েছিলে। এখন একটু চাই যে। চিনিটা কমিয়ে নেবুর বদলে নারাঙ্গি দিলে কী হয় দ্যাখো।

হৈমী চলে গেলে রাজকুমার বললো, আচ্ছা, মাস্টারমশাই, আমি কী জাতি? আপনি বলেছিলেন, বিপ্লবের আগে পরে ফরাসী দেশে একটা জাতি। নেপোলিয়নের সৈন্যদল সেই জাতির হয়ে যুদ্ধ করতো। আপনি, আমি, কেট, রাজনগরওয়ালি, ডানকান হোয়াইট কি এক জাতি? দিল্লীওয়ালে মুসলমানরা মারাঠাদের বিরুদ্ধে আবদালিকে সাহায্য করেছিলো, তারা আর মারাঠীরা এক জাতি নয়। নানাসাহেব গোয়ালিয়রের বিশ হাজার সৈন্যকে টেনেছিলো সেই বর্গিরা আর রোহিলারা কি এক জাতি? ওদিকে রানীমা বড়ো রানীর এক ঘোষণাপত্রের অনুবাদ পড়তে দিয়েছেন। আমরা আর কম্পানির প্রজা নই, তাতে আমি আর ডানকান কি এক জাতি হলাম?

বাগচী বিব্রত বোধ করলো বললে কমই বলা হয়। রাজকুমারের মুখ কি আলোর জন্য রক্তাভ? রাজকুমারের দাবা খেলার সঙ্গে কি এই চিন্তার যোগ থাকতে পারে? এ কি কোনো জাতিবৈর যা রাজকুমারকে বিচলিত করছে?

বাগচী কিছু বলার আগে রাজকুমার জেব থেকে রুমাল বার করে আঙুলগুলোকে মুছে নিলো। আর তখনই ভৃত্যের হাতে রূপার ট্রেতে ব্র্যান্ডি, গরম জল, চিনি, সন্তরা, রাম দিয়ে হৈমী তার পিছন পিছন এলো। রূপার ও কাঁচের ঔজ্জ্বল্যে মনে হলো গরম জলের জাগটাতে অন্য কোনো মদ আছে।

রাজকুমার হেসে বললো–মার্সি ম্যাডামোয়াজেল। তুমি পাঞ্চটা বানাতে থাকো, আমরা দুই ছাত্র শিখে নিই। কিংবা মনে হচ্ছে মিশোনোর ব্যাপারটা পরিশ্রমসাপেক্ষ; তুমি মেপে দিতে থাকো, আমি শেকিংটা করি। পিয়েত্রোকে বুজরুকের জন্য নিজের হাতে বানিয়ে দিতে দেখেছি, তাতে অবশ্য গরম জল থাকতো না। বসো হৈমী, এটা আমার প্রাইভেট চেম্বার।

হৈমীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাজকুমার বাগচীর দিকে চাইলো। বললো, আপনার হাতে কি আখবরের রোল? টাইমস না কী যাতে মেফেয়ার, নাইটিংগেল, সার সিডনির কথা লেখে?

বাগচী বললো–এখন চীন আর মিশরের কথাই বেশি। চীনের যুদ্ধ। ওয়াং বিদ্রোহ।

রাজকুমার হেসে বললো–দ্যাখো, হৈমী তাহলে তো তুমি ঠিকই বলেছো। মুকুন্দ তো তাহলে ঠিকই যুদ্ধে গিয়েছে। কিন্তু ওয়াংটা ঠিক কী মাস্টারমশাই?

বাগচী বললো, ওয়াং একজন লোকের নিজের নেওয়া উপাধি। সে নিজেকে তিয়েন ওয়াং বলে। নিজেকে ক্রাইস্টের ছোটোভাই বলে, সে পৃথিবীতে তাইপিং অর্থাৎ স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতে চায়।

রাজকুমার হেসে উঠলো, এই চমকপ্রদ গল্পটা তার ভালো লেগে গেলো। বললো–হৈমী বলেছিলো, সে যুদ্ধে ইংরেজও একপক্ষ। কেন, সেটা কি বড়ো যিশু ছোটো যিশুর যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

বাগচী বললো–আমার কিন্তু মনে হয়, এটা মূলত মাঞ্চু আর সিং-এর লড়াই। যুদ্ধটা গড়াতে গড়াতে ইংরেজের বাণিজ্যকুঠির দিকে গেলেই তারা জড়িয়ে পড়ছে।

রাজকুমার বললো, তা জড়িয়ে পড়া ওদের কেমন একটা স্বভাব। সেখানেও কি কোনো সম্রাট তাদের দেওয়ানি দিয়েছে? তোমার কী মনে হয়, হৈমী? তুমি তো আবার যুদ্ধ সম্বন্ধে জানো।

হৈমীর পাঞ্চ-প্রস্তুতরত হাত দুখানা থামলো, তার মাৰ্বল-সাদা গাল রক্তাভ হলো।

রাজকুমার বললো–এবারে কলকাতায় শেষের কয়েকদিন হৈমী আমাকে অনেক গল্প শুনিয়েছে। একটা বিষয় আপনাকে জানাই, মাস্টারমশাই। হৈমীর স্বামী কিন্তু খুব বড়ো যোদ্ধা ছিলেন। ক্যাপটেন বিলি। দানাপুরের অ্যামিউনিশন ডিপো তার অধীনে ছিলো।

দুটো ঝকঝকে গ্লাস মিশানো মদে পূর্ণ করে তার উপরে চাকা করে কাটা সন্তরা ভাসিয়ে দিলো হৈমী। রাজচন্দ্র বললো–ক্যাপটেনের কথায় মনে পড়লো,…কিন্তু হৈমী, তোমার গ্লাস কই? কিছু নাও। কী যেন তুমি বলেছিলে কলকাতায়–রিল্যাক। মনে পড়লো লাট আসছেন শিকারে। হরদয়াল এতদিনে জেনে নিয়েছে বনমহলের কোথায় চিতা, কোথায় হরিণ, কোথায় বা বাঘ। বুনোমোষের দিকে জেনারেল না যায় তাই ভালো। ওদের লোভ দেখিয়ে বাইরে আনা কঠিন।

হৈমী একটা গ্লাসে নিজের জন্য পাঞ্চ নিলো। এই সময়ে এই এক অদ্ভুত ভাবনা হলো বাগচীর–আজই তো সে প্রথম এ ঘরে বসছে না; কিন্তু নতুন চাকরির পরে এই প্রথম। আজই দ্যাখো আবহাওয়াটা যেন কেমন বদলে গিয়েছে, যেন কতদিনের অভ্যস্ত এই ব্যাপারগুলো।

কিন্তু রাজকুমার বললো–আমি বিলির জন্য দুঃখিত। সাতদিনের বিবাহিত জীবনের পরেই তাকে প্রাণ দিতে হলো। কিন্তু হৈমীর কাছে শুনেই আমার মনে হয়েছিলো : কানোয়ারের লোকেরা তো দেশপ্রেমের আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়েছিলো। বিলি? এটা তো তার স্বদেশ নয়। কীসের জন্য প্রাণটা দিলো?

বাগচী হৈমীর দিকে চাইলো। সে মুখ নিচু করে গ্লাসটার দিকে চেয়ে আছে। বাগচী তাড়াতাড়ি করে বললো–লয়্যালটিও তো একটা আদর্শ। বাগচীর মনে হলো এই সময়ে, রাজকুমার কী নিদয়, যে এখানে এই কথাগুলো তুলছে? কিংবা একি একরকমের নিস্পৃহতা?

হৈমী বললো– রাজকুমার, আর একটু দেবো কি আপনাকে, এখনো গরম আছে।

রাজকুমারের আর দরকার হলো না। একটু থেমে সে আবার জিজ্ঞাসা করলো–মিস্টার বাগচী, আপনি তো একাধিকবার লন্ডনে গিয়ে থাকবেন, সেখানে কি দশসালার বন্দোবস্ত আছে?

বাগচী বললো–কিছু কিছু লর্ড আছেন যাঁরা পারমানেন্ট। কিন্তু সেখানে এই নতুনত্ব একটি ছেলেই বিষয় পায়।

কৌতুক বোধ করে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করলো–অন্যরা তবে?

–অনেকক্ষেত্রেই আর্মিতে নেভিতে যায়, নতুবা…আজকাল কেউ কেউ ব্যবসা করতে শুরু করেছে।

রাজচন্দ্র হো হো করে হেসে উঠে বললো, তাহলে, হৈমী, মুকুন্দ ঠিকই করেছে।

সেদিন কুঠিতে ফিরতে ফিরতে বাগচীর মনে হলো, একি অন্য রাজকুমার? কিংবা এটা কি এই সন্ধ্যারই ধরন? কিছুদিন পরে, সেদিন সে কায়েতবাড়ির বিষয়ে জেনেছে (এখন তো রানী ব্যাপারটাকে প্রকাশ্যে এনেছেন, অনেকেই জেনেছে)। বাগচীর রাজকুমারের এই আবেগশূন্য হাসিটাকে মনে পড়েছিলো।

সেই সন্ধ্যায় হরদয়াল বেশ ক্লান্ত হয়ে তার কুঠিতে ফিরেছে। এখন সে বিশ্রাম নিতে পারে। মনে মনে রাজবাড়ি, দেওয়ানকুঠি, পিয়েত্রোর বাংলো, গ্রামের কয়েকটি পথ, বনমহলের এ-অংশ সে-অংশ সে তো একজায়গাতে বসেই দেখতে পাচ্ছে।

তুলনা দিতে হলে একটা সুদৃশ্য জাল বুনে তার একপ্রান্তে সে যেন এখন অলক্ষিত ভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারে। তাহলেও শেষ কাজটার কথা না ভেবে সে পারছে না। কিছুক্ষণ আগে শুরু হয়েছে, আলো জ্বেলে অনেক রাত পর্যন্ত করবে। জাহাজ ভিড়বার জেটি কুতঘাট থেকে সরিয়ে কিছুটা নতুন পথ করতে হয়েছে বটে, কিন্তু নদীর বাঁকটায় সেখানে জল গভীর থাকায় জেটিটা লম্বায় কম হয়েছে। বিলমহলে যাওয়ার হাতিঘাসের বনের মধ্যে দুধারে ঘাস রেখে মাঝখানের দশ ফুট পথটা দেখতে বেশ লাগছিলো কিন্তু। ওটাও খুবই ভালো, গাছের উপরে সেই দু কামরার বাড়িটা; সিঁড়িটা কতকটা মই-এর মতোই হলো, কিন্তু মহিলারা পছন্দ করলে তার উপরে থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত শিকারের দলকে দেখতে পাবে। সিমসন জানিয়েছে কুকুর পার্টির সঙ্গেই যাবে, শুয়োরবল্লমের কথা কখনোই ভুল হবে না। টেলিগ্রাম সে পেয়েছে। কিন্তু সবচাইতে ভালো বুদ্ধি হয়েছে দেওয়ানকুঠি আর রাজবাড়ির মধ্যে ফেনসিংটার ব্যাপারে। ফেনসিং খাড়া হলে তাতে রং আর নকশা থাকলেও কেমন যেন কৃত্রিম আর ন্যাড়া মনে হচ্ছিলো। তারপর বুদ্ধিটা এলো। দু-তিন গাড়ি সোনালিলতা আনা হলো তো। ফেনসিং-এ লতাগুলো তুলে দিলে একটা সোনালি বাগান স্ক্রিনের মতো দেখাবে। মনে হবে লতাগুলো সেখানেই জন্মেছে। এই লতাগুলোয় সবুজ থাকে না বলে ছ-সাত দিন অবিকৃত থাকবে।

হরদয়াল ক্লান্তিটাকে খুশির মতো অনুভব করলো। তার লাইব্রেরিতে উজ্জ্বল আলো। সেদিকে যেতে যেতে তার মনে হলো–সেটা আগামীকাল। ব্রজই দেখবে ব্যাপারটা। লাট থাকার কয়েকদিন সদর গেট থেকে দেওয়ানকুঠি পর্যন্ত, ফেনসিং-এর ধারে ধারে, রাজবাড়ির বাইরের দেয়ালে, সদর দরজার বাইরে পিয়েত্রোর বাংলোর দরজা পর্যন্ত যে আলো জ্বলবে তখন সেই আলো জ্বালিয়ে দেখা হবে। দেওয়ানকুঠির বা পিয়োত্রার বাংলোর ভিতরের আলোটা মশালচিরাই পারবে। আর এই লাইব্রেরি, লাটের শ্যালী এবং স্ত্রী কি উপন্যাসই খুঁজবে শুধু? এই সময়ে তার মনে হলো রানীমাকে কি বলা যায় আপনি বেরিয়ে আলোর মহড়াটা একবার দেখুন?

কিন্তু আর একটা কাজ আছে তার। সেদিন রানী বলেছিলেন গুণাঢ্যর কন্যা সম্বন্ধে লিখতে। হরদয়াল দাঁড়িয়ে পড়লো। রানী গুণাঢ্য কন্যাকে পছন্দ করেছেন তার একটা কারণ এই: সে মেমসাহেবের কাছে পড়ে, ইংরেজি শেখে, পিয়ানো শিখছে। রানী ইংরেজি আদব কায়দার কথা উহ্য রেখেছেন। তাহলে?

হরদয়ালের মুখে আবার হাসি দেখা দিলো। যেন সে মনে মনে বলবে–এটা কেমন হচ্ছে না? সেই কেট তো এখন প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রী হিসেবে ইংরেজ এবং খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও আদরের হলো। মুক্তোর হার হচ্ছে না? তার মনের মধ্যে যে কথাটা উঠেছিলো সেটা ফুটবার আগেই তার মনের মধ্যেই কারো রুচিতে আটকালো। শেষোক্তজন যেন বললো– বারবার কেন সেই কথা? কিন্তু সে বিস্মিত হয়ে গেলো যেন। এটা তো সে ভাবেনি। এখানকার এই নায়েব-ই-রিয়াসৎ তো তখনো ছিলেন যখন তাকে ডিঙিয়ে হরদয়ালকে দেওয়ান করা হয়। সে কি তার ইংরেজি দক্ষতা এবং বরং আধুনিক চালচলনের জন্য নয়? সেই কবে তখনই তো রানী খানিকটা আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। এতদিনের হিসাবটা তবে ভুল?

অসাধারণ বুদ্ধিমতী রানী। নতুবা রাজার মৃত্যুর পরে এই বিশ বছর হতে চলে, আয় কমে দ্বিগুণে দাঁড়াতো না। কিছুই ক্ষতি হয়নি, সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। বলবে রানী ইচ্ছা প্রকাশ করে নিশ্চিন্ত, কী করে তা হবে সে চিন্তা নায়েব ও দেওয়ানের? কিন্তু ইচ্ছাটা?

কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতীর পক্ষেও ওটা একটা ঝুঁকি, বিষে বিষ দূর করার চেষ্টা হয়। যদি। হৈমীকি অসাধারণ রূপসীনয়? বলবে দুঃখিনী, আশ্রয়প্রার্থিনী, রাজবাড়িকে প্রভাবিত করতে পারে না?

সে কিন্তু এখানেই থেকে গিয়েছে। সে লাইব্রেরির বইগুলোকে দেখলো ঘুরে ঘুরে। ওটাকে স্মৃতিই বলতে হয়। প্রায় শিশু সেই রাজকুমারকে বালক ও কৈশোরে পৌঁছে দেয়া একপাশে উপস্থিত থেকে। অন্যপাশে রানী।

চিঠিটা লেখাই দরকার। সে লাইব্রেরী থেকে বসবার ঘরের ডেস্কে গেলো। সেখানেই কয়েকদিন থেকেই কাজ হচ্ছে। সেখানেই প্যাড, কলম, সিহাই।

ভাদুড়িকেই তো চিঠি, সুতরাং তার এবং তার স্ত্রীর কথা মনে পড়লো। কোনো কোনো মানুষকে দেখে মনে হয় বটে জীবন যেন নিজ বেগে উচ্ছল স্রোতমাত্র নয়, বরং যেন এক নৌকা যাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে চালনার চেষ্টা করতে হয়। এই যোগাযোগের ব্যাপারে ভাদুড়িও একজন, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর বিবাহের সে ঘোর বিরোধী। ধর্ম-বিশ্বাসে সে স্বীকার করে : সে হয়তো অজ্ঞেয়বাদী, কিন্তু বিশ্বাস করতে একমাত্র তেমন ঈশ্বরকে করা যায় যার সম্বন্ধে পুরাণে কিছু বলা হয়নি। পুরাণের দেবদেবীকে সে দুশ্চরিত্র নরনারী মাত্র মনে করে। একবার বৈষ্ণব কাব্যের কথায় রজকিনীর কথা ওঠামাত্রই সে কানে আঙুল দিয়ে নিজের বৈঠকখানা থেকে পালিয়েছিলো। থানা থেকে পালিয়েছিলো।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তার বন্ধুকে লিখলো :

ব্যাপারটা সম্ভবত ক্যাচ দেম ইয়ং। রানীমাতা গুণাঢ্য মহাশয়ের কন্যাটিকে পছন্দ করিয়াছেন। তুমি তাহার বয়স বিবেচনায় নীতিগত আপত্তি তুলিতে পারো, কিন্তু গুণাঢ্যকে সংবাদটি দিবে। সংবাদ দিবার সময় তাহাকে তোমার নীতিগত আপত্তির কথা বলিতে পারো। গুণাঢ্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। তাহার পর সে অগ্রসর হইলে তোমাতে দোষ অর্শে না। অবশ্যই তুমি এরূপ ধারণা দিবে না যে রানীমাতা নিতান্ত আগ্রহী, শেষেরটি গুণাঢ্যের তরফে প্রকাশ হওয়া চাই।
 অপর, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের কোনো সংবাদ পাইতেছি না এরূপ কিছুদিন গেলো। অবগত আছে যে রাজপরিবারের পক্ষে উক্ত সভার আমি সভ্য। এবার কলিকাতায় রাজকার্যে ব্যস্ত থাকায় যোগাযোগ করিতে পারি নাই। আমি তাহাদের ঠিকানায় পত্র দিয়াছি। কিন্তু এরূপ সন্দেহ তাহাদের ঠিকানা বদল হওয়ায় পত্র না পঁহুছিতে পারে। …

 হরদয়াল একটু ভাবলো, একটু যেন দ্বিধাও করলো। পরে আবার লিখলো :

…এই সুযোগে তোমাকে অন্য এক বিষয়েও বলিতে পারি। কলিকাতায় থাকাকালীন আমি হিন্দু হরিশ মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে কিছু সংবাদ পাইয়াছি। প্রকৃতপক্ষে তাহার চেষ্টাতেই যে ইন্ডিগো কমিশন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। সেই কমিশন বর্তমানে এই অঞ্চলে। কিন্তু যাহা শুনিয়াছি তাহা এই যে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের স্বাস্থ্য ভালো চলে, হয়তো এরূপও সত্য অর্থকৃচ্ছতা দেখা দিয়াছে। অবগত আছি, তোমাদের সমাজের একাংশে তাহার কার্যকলাপে নিরুৎসাহ আছে; অধিকন্তু সেখানে তাহার পানদোষ এবং আনুষঙ্গিক ধনাঢ্যদের পীড়া সম্বন্ধে বক্র-ইঙ্গিত শুনিয়াছি। সে বিষয়ে আমার বলিবার নাই। শুনিয়াছি সে গৃহের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করিতেছে। ইহা নিন্দার প্রচারমাত্র হইতে পারে। যাহা হউক, যদি পুস্তকাদি বিক্রয় দ্যাখো, বিশেষ পুরাতন এডিনবরা রিভুর মতো পত্রিকা, তুমি গোপনে আমার পক্ষ হইতে একটা দাম বলিবে। এক এক বৎসরের এডিনবরা রিভুর জন্য আমি এক এক হাজার দিতে প্রস্তুত জানিবে। টাকার জন্য প্রয়োজনে আমাদের নতুন স্থাপিত কলিকাতার দপ্তরে যোগাযোগ করিতে পারো। কিন্তু অবশ্যই লক্ষ্য রাখিও মুখোপাধ্যায় মহাশয় দাম শুনিয়া ক্রেতার বদান্যতা এরূপ সন্দেহ না করে, যেন মানের হানি না হয়। ..

চিঠি শেষ করে তামাকে মন দিলো হরদয়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *