০৪. হরদয়াল

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কিন্তু পরের দিনই হরদয়াল চিন্তা করার অবসর পেয়েছিলো।

এখন সন্ধ্যা হচ্ছে। হরদয়ালের কুঠির বারান্দায় কাঠের মিস্ত্রি তার সরু র‍্যাদাটা তুলে মাথায় ঘষে নিলো একবার। তাতে নাকি র‍্যাদা আরো তেলালো হয়। দুবার ঘষে ফুঁ দিয়ে র‍্যাদায় ওঠা গুঁড়ো কাঠ ঝেড়ে ফেলো মিস্ত্রি। আর তখন সুগন্ধটা পাওয়া গেলো কাঠের। আসবাবটা এমন কিছু মূল্যবান নয়, একটা বুকশেলফ। কিন্তু যত্ন দেখে মনে হচ্ছে তা হাতির দাঁতের।

সকালেও হরদয়ালের কুঠির বারান্দায় ছুতোর মিস্ত্রি কাজ করছিলো। রোদটা তখন সরে গিয়েছে, ওমটা আছে। চেয়ারে হরদয়াল। তার বাঁদিকে আলবোলা। আলবোলার সম্মুখে তেপায়ার উপরে কাগজপত্র যা লমোহরার গৌরী রেখে গিয়েছে।

সকালে গৌরী এসেছিলো মামলার কাগজপত্র দিতেই। মুখে বলেছিলো মামলাটা মরেলগঞ্জের মনোহর সিং-এর বিরুদ্ধে। ট্রেসপাস। মনোহর তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে রাস্তা তৈরি করছিলো। এটাকে বলা যায় সাধারণ দপ্তর থেকে আইন দপ্তরে ফাঁইল আসা। হরদয়াল বলেছিলো, মামলাটার কী দরকার হলো? আচ্ছা, রেখে যাও।

কিন্তু গৌরীর আসল বক্তব্য ছিলো যেন এবারে রানীমার জন্মতিথি উৎসবে কাছারির কর্মচারীরা এবং তাদের বন্ধুবান্ধব মিলে একটা নাটক করতে চায়। নায়েবমশায়কে অনুরোধ করেছে। এটা তো যাত্রা নয়,নাটক–আধুনিক ব্যাপার। কাজেই হরদয়াল নিজে একটু সমর্থন না করলে নায়েবমশায় রাজী হবেন না। হরদয়াল হাসিমুখে তাকে আশ্বাস দিয়েছিলো।

এখন হরদয়ালের গায়ে মটকার গলাবন্ধ কোট। চুনুট করা ধুতির কালো পাড়, তালতলার চটির উপরে। সে বৈকালিক ভ্রমণ শেষ করে ফিরেছে। তার চাকর জুতো নিয়ে চটি দিয়ে গিয়েছে। আলবোলা নিয়ে ফিরবে।

রানীমার জন্মতিথি? গৌরী চলে গেলে হরদয়াল চিন্তা করেছিলো। এবার কি একটু আগে? তা অসম্ভব নয়, তিথি অনুসারে চলে; কখনো এগোয় কখনো পিছিয়ে যায়।

কিন্তু গৌরীর পরেই সকালেই হরদয়াল সদর-নায়েবকে দেখেছিলো। কাছারির থেকে যে রাস্তাটা তার কুঠি দিকে তার উপরে সদরনায়েবকে দেখে সে ভৃত্যকে ডেকে চেয়ার দিতে বলেছিলো। এমন নয় যে নায়েব মাঝে-মাঝেই হরদয়ালের কুঠিতে আসেন, সুতরাং নায়েবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে হরদয়ালের কৌতূহল হয়েছিলো।

হরদয়ালকে অবাক করে নায়েবমশায়ও নাটকের কথাই তুলেছিলেন। খুব মুশকিল তার। নাটক কারে কয়? ছোকরারা খেপে উঠেছে। হরদয়াল হেসে ফেলেছিলো। আমাদের দেশে যাত্রা, অন্য দেশে নাটক হয়। এতে আর মুশকিল কী এই বলেছিলো সে হেসে। কলকাতায় হচ্ছে।

–ও বাবা, না করে থামছে না দেখছি। কিন্তু সে তো শুনি অনেক খরচ। মঞ্চ না কী একটা করবে। নরেশও এর মধ্যে আছে। নায়েব বলেছিলো।

হরদয়াল বলেছিলো–তা, দিন না মঞ্জুরি।

নায়েব উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বললেন–ভালো কথা, নরেশের কথায় মনে হলো, ও তো দেখছি ক্রমে এ কাজে ও কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কাজ শেষ হবে কবে? ওদিকে সুরেনও। আমার তো মনে হয় ওদের বাবদে একটা পৃথক হিসাব বই খোলা দরকার। আজ গেট করে তো কাল সড়ক, সড়ক ছাড়ে তো রাজবাড়ি। তা করতে আবার এক খাবোল অন্য সড়ক।

–তা মন্দ কী? নতুন কাজ পুরনো কাজ মিলে তো পরিমাণ কম নয়।

নায়েব হাসলো-মাঝে-মাঝে মনে করি একটা আলাদা বিভাগ তৈরি করে দিই। নরেশ কাজ করবে। হিসাবের জন্যও না-হয় একজনকে দেওয়া গেল। কিন্তু তারা যে ঠিকঠাক কাজ করছে তা অন্তত মাসে একবার দেখা দরকার। মাপজোখের উপরে মাপজোখ আর কি। কিন্তু দেখে কে? আমি কি সিএফটি বুঝি? যতদিন অন্য ব্যবস্থা না-হচ্ছে আপনার পক্ষে কি একটু দেখা সম্ভব হয়?

–আমাকে ভার নিতে বলছেন?

–যদি সম্ভব হয়।

 হরদয়ালও উঠে দাঁড়িয়েছিলো।

নায়েব বললেন–আপনি রাজী হলে রানীমার অনুমতি চাইবো।

হরদয়াল কী একটু চিন্তা করলো, বললো–আপনি বললেই হবে। রানীমা পর্যন্ত যেতে হবে কেন?

তারপরে নায়েব মামলার কথায় গিয়েছিলো। কাগজপত্র দেখেছেন নিশ্চয়। ওপক্ষ একেবারে চুপচাপ। যেন রাস্তা কাটার ব্যাপারটা সম্বন্ধে ওদের ভাবনা চিন্তা এখনো শেষ হয়নি।

হরদয়াল তখন বলেছিলো, গৌরী বলছিলো ট্রেসপাসের প্রমাণ গোছাচ্ছে সে।

নায়েব বলেছিলো, প্রমাণ হোক তা নয়, কিংবা সেটা মরেলগঞ্জের লীজভুক্ত জমি এবং লীজে এখানে-ওখানে রাস্তাঘাট তুলবার শর্ত ছিলো নাকি ফৌজদারিতে যেতে চাইছেন না? তাহলে ওরাই এগোবে? হরদয়াল বলেছিলো, দেখি ফাঁইলটা।

তখন আর কথা হয়নি। নায়েবমশাই তিন বিষয়ে বলেছিলেন। কোন উদ্দেশ্যে দেওয়ান কুঠি পর্যন্ত আসা তা কি বোঝা গেলো? তা কি মাঝখানে যা বলেছিলেন? এখন সন্ধ্যা হচ্ছে। মিস্ত্রি কাঠগুলোকে গুছিয়ে তুলো। উঠে দাঁড়ালো, তাতেই যেন সন্ধ্যার সূচনা হলো। কাজটাকে গুটিয়ে তুলতে-তুলতেও মিস্ত্রি তা যেন চোখের সম্মুখে মেলে দেখলো। তা থেকে হরদয়ালের মনে হলো, সৌন্দর্যসৃষ্টি নাকি? পরখ করে দেখছে? লোকটি রোজই কাজ করে, কিন্তু তার মধ্যে টাকা উপার্জনের বাড়তি কি কিছু থাকে?

রাজকুমারের ঘরের আসবাবপত্র করার জন্য লোকটিকে গত বছর আনানো হয়েছে। নরেশ চিনতো। তারপর থেকে কাজের পর কাজ চলেছে। জাতে চীনা। ইতিমধ্যে একটি স্থায়ী ঘরও জুটেছে, রাজবাড়ির মালীদের ঘরের একটি। লোকটি অভ্যাসবশে হয়তো ডিজাইন তুলে যায়, কিন্তু অন্য অনেকে তার মধ্যে সৌন্দর্য আবিষ্কার করে। মৌমাছির মতো নাকি? কয়েকদিন আগে সে এক বই-এ পড়েছিলো–মৌমাছি গান করে না। কর্মব্যস্ততায় সে উড়ে বেড়ায়, তার পাখা কাপে, মানুষ তাতে গুঞ্জরণ আবিষ্কার করে।

কিন্তু দ্যাখো, এই লোকটিকে এনেছে নরেশ, অনুরূপভাবে নরেশকে এনেছিলো সে নিজে। গত সনের সেই মেরামতির জন্য। নরেশের কাজের সুখ্যাতি হয়েছে।

সকালে গৌরী ও নায়েবমশায় চলে গেলে হরদয়াল ব্রেকফাস্টে বসেছিলো। আর তখন সে নরেশ সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলো।

হরদয়াল তাদের মতো নয় যারা ব্রেকফাস্ট না করে পৃথিবীর মুখ দেখে না। এ কি তার আহার-বিলাসের ফল? অথবা কোনো ব্যাপারেই তাড়াতাড়ি করে কী হয়–এরকম এক মনোভাব থেকে ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে ঢিলেমি? ওদিকে কিন্তু টেবল দেখলে মনে হবে ভৃত্য বাবুর্চির সংসারের পরে তার ব্রেকফাস্টের ব্যাপারটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

একটা জানলার পাল্লা খোলা। খানিকটা রোদ টেবিলে এবং সেখান থেকে রূপোলি প্লেট চামচের গায়ে মাখামাখি করছে। পাশের জানলার কাঁচ থেকে রঙীন আলো মেঝের উপরে একটা রঙীন আয়তক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে। রোদে পিঠ রেখে হরদয়াল ব্রেকফাস্টে বসেছিলো।

সে বাদামযুক্ত হালুয়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট শুরু করে ভাবতে শুরু করলো। কী যেন? ও, সে নরেশের কথা ভাবছিলো। ভদ্রলোকের নাম নরেশ পান। তিন মাসের কড়ারে আনা হয়েছিল। মিলিটারি কনট্রাক্টরের এক ফার্মে এবংকখনো কখনো ফোর্ট উইলিয়ামে সরকারি এঞ্জিনীয়ারের অধীনে কাজ করতো। এ কাজটা তোনরেশের কুলকার্য নয়। চাষবাস করতো। তারপর একসময়ে সে কী করে বা এইসব কাজে যুক্ত হয় এখন বিষয়ে কিছু লেখাপড়া না করেও সে প্রায় ওস্তাদ শ্রেণীর একজন হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নয়ই-বা বলছো কী করে, কাগজকলমে নকশা, এস্টিমেট প্রভৃতি করতে শিখেছে। রাস্তাঘাটের কাজে যদি সুরেন, বাড়িঘরের কাজে তবে নরেশ। কোথাকার বীজ কোথায় উড়ে এসে পড়ে গাছ হয় দ্যাখো। এটাও কিন্তু কৌতুকের–তুমি বলতে পারো নরেশ আছে বলেই মেরামতের কাজের বাইরে নতুন কাজ হচ্ছে, কিংবা নতুন কাজ করানো হবে বলেই তাকে রাখা হচ্ছে।

আগে প্রতি বছরেই রাজবাড়ির রং মেরামত ইত্যাদির কাজ হতো। গ্রামের গহরজান মিস্ত্রির পরিবারের পুরুষরা কাজ করতো। কখনো মুর্শিদাবাদ থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন কাজের খোঁজে এলে যেন তাদের সুবিধার জন্যই কাজ করা হতো। আজ থেকে তো মনে হচ্ছে নরেশ ও সুরেন পাকাপাকি থেকে যাচ্ছে। হয়তো কথাটা পূর্তবিভাগনা হয়ে বাস্তুবিভাগ হলে মানাতো। একটা বিভাগ যখন হয় তখন ধরে নিতে হবে অন্তত বেশ কিছুদিনের জন্য তা হলো।

এবং তার ভারটা আজ থেকে এসে গেলো যেন তার নিজের দপ্তরে। আজ থেকেই। ওটাকে হুকুমই বলতে হয়। যদি তার চারিদিকে খুবনরম কিছু থেকে থাকে তবে তানায়েবের কথা বলার কায়দা। হরদয়ালের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলা করে গেলো। অথচ তুমি কায়দাটাকে ধরতে পারো না। কিন্তু এতদিন?

তখন ব্রেকফাস্টের টেবলের পাশে দাঁড়িয়ে তার ভৃত্য, দরজার কাছে বাবুর্চি।

হরদয়ালের হাতে চামচটা দুললো। যেন সে মিষ্টিটা পছন্দ করছে। কিন্তু চামচটা রেখে সে বরং কফির পাত্রটা টেনে নিলো।

এটা কি অস্বীকার করা যায়, ভাবতে গিয়েও গলা সাফ করতে হলো, নায়েবই কিছুদিন আগে তার অধস্তন কর্মচারী ছিলো।

তাই তো, আজ যেন, আজই প্রথম যেন, প্রমাণ হয়ে গেলো নরেশের এই ব্যাপারটায়–যে নায়েব একসময়ে শুধুমাত্র নায়েবই ছিলেন, এবং তখন হরদয়াল ছিলো দেওয়ান।

ব্রেকফাস্টের কফিটা শেষ করে যে-জানলায় রৌদ্র আসছিলো তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যেন দিনটার কী রং তা দেখলে বিস্ময়টা কাটবে। নিশ্চিতই আকাশে মেঘ নেই কিংবা ঝড়ো হাওয়াও বইছেনা যে দিনটাকে গতকাল যা ছিলো তা থেকে ভিন্ন দেখাবে।

সে এ সময়ে, ব্রেকফাস্টের পরেই কাজ করে। জানলাটা থেকে সরে এসেছিলো সে। লাইব্রেরিতেই তো। সে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলো। ফাঁইলটা দিয়ে গিয়েছে গৌরী যাতে নায়েবের মন্তব্য আছে মামলা সম্বন্ধে। পাশের দরজা দিয়ে ভৃত্য গড়গড়া নিয়ে ঢুকে চেয়ারের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেও গেলো। তখন বেলা দশটা হবে।

সম্মুখে ডেস্কের দিকে চেয়েছিলো সে। সমতল অংশটার উপরে অনেককিছুই তো। একটা সুদৃশ্য ট্রের উপরে সকালের আসা ডাক তখন। চরণদাস নিজেই দিয়ে গিয়েছে। আর তখনই সে ম্যানিলা রং-এর খামটাকে এবং তার উপরের ঠিকানার হরফগুলোকে লক্ষ্য করেছিলো।

এখন এই সন্ধ্যায় সে তো আবার লাইব্রেরির সেই ডেস্কের সামনে। উজ্জ্বল টেবল ল্যাম্পের আলোয় একটু দ্বিধা করে সেই চিঠিখানাই হাতে নিলো। চিঠিখানা তার বন্ধুর। খুলবার আগেই সে ভাবলো কোনো কোনো কাজে কেমন করে যেন বাধা পড়ে যায়। বন্ধুর আগের চিঠিটার জবাব এখনো দেওয়া হয়নি। কাল রাত্রিতে একবার সে ভাবতে বসেছিলো এ বিষয়ে। কিন্তু রানী ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

চিঠিখানা খুললো সে। পুরো নোটশীট, কিন্তু বন্ধুর চিঠি সাধারণত যত বড় হয় তেমন নয়। হরদয়াল পড়লো। বন্ধু লিখেছে : তার আগের চিঠির (যার জবাব সে পায়নি) অনুসৃতিতে সে সানন্দে জানাচ্ছে পৃথক প্যাকেটে শেকসপীয়র পাঠানো যায়। এক সিভিলিআন প্রমোশন-প্রাপ্ত ও অন্যত্র স্থাপিত হওয়ায় ফার্নিচার ইত্যাদিসহ হস্তান্তর করে। সুতরাং মরোক্কো বাঁধাই হলেও রিবে মালিকের নাম ঘষে তোলা। পৌঁছনো মাত্র প্রাপ্তিসংবাদ দেবে। পুনশ্চ বলে সে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-মহলে খোঁজখবরে জানতে পারা গেলো ডান্নামে (লক্ষ্য করবে ওটা ডা) এক কবি ছিলো বটে। কিন্তু ইংরেজি ভার্সে লিখিত হলেই কবিতা হয় এমন নয়। মিলটনের পরে তো বার্নস, ব্লেক, মধ্যে আর কবি কে? লন্ডনের পাবলিশার্স ও স্টেশনার্সদের ঠিকানা পাঠালাম। ১৮৫৮ ও ১৮৫৯ প্রকাশিত দশখানি বই তোমার টাইমসের সাপ্লায়ার রোজার গুনের কাছে আছে।

চিঠিটা যত্ন করে খামে পুরলো সে আবার। একটা প্রশান্ত তৃপ্তি যেন অনুভব করলো হরদয়াল। তাই বলে সে তো ডাকঘরে খোঁজ নিতে যেতে পারে না। বই-এর প্যাকেট পৌঁছনোর একঘণ্টার মধ্যেই তার হাতে নিশ্চয় আসবে। বাঁ হাতটা উঁচু করে তার উপরে গাল রেখে সানন্দ দৃষ্টিতে বই-এর শেলফগুলোর দিকে চাইলো সে।

কিন্তু আজ সকালেও চিঠি লেখা হয়নি। অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকে সরিয়ে রাখতে হয়েছিলো, কারণ বাগচী নিজে এসেছিলো স্কুলের বিষয়ে আলাপ করতে। একটা সমস্যাই যেন। তাও এক চিঠি নিয়ে। চিঠিটা পেয়ে বাগচী বারদুয়েক পড়েছে, যাকে বলে তার উপরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু এখনো কর্তব্যটাকে সে স্পষ্ট দেখতে পায়নি। এদিককার বিদ্যালয়-পরিদর্শক এতদিনে যেন এই বিদ্যালয়ের সংবাদ পেয়েছেন। এবং তিনি বিদ্যালয়টিকে পরিদর্শন করতে বাসনা করেছেন। এটা তাঁর সরকারী কর্তব্যও বটে। তিনি বস্তুত লিখেছেন :ইহা আমার কর্তব্য বলিয়া বোধ করি যে যত শীঘ্র সম্ভব আপনার বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হয়।

বাগচী বলেছিলো উনি এসে পড়তে পারেন, তার আগেই জবাব যাওয়া দরকার। নতুবা লাঞ্চের পরে আসতাম।

হরদয়াল চিঠিখানা আদ্যোপান্ত পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাগচীর মত কী? এতে কি স্কুলের লাভক্ষতি কিছু আছে?

বাগচী বলেছিলো, কারো কারো মতে, যেমন নিয়োগীমশায়,এ সুযোগ ছাড়া উচিত হবে । স্কুল সরকারের নজরে পড়লে তার মর্যাদা বাড়ে।

-তা কি শিক্ষক অথবা পাঠক্রম নির্বাচন, অথবা সরকারী গেজেটে আসা এবং আর্থিক আনুকুল্য?

–নিয়োগী বলেন সবই হতে পারে। সব স্কুলই তাই চায়।

-এখনই শেষ কথা বলা কঠিন। যে সুবিধা দেয় তার পক্ষে নিজের মত চাপাতে চাওয়াও অসম্ভব নয়।

নিয়োগী বলেন, শিক্ষার ব্যাপারে যাঁরা কর্ণধার শিক্ষা সম্বন্ধে তাদের মতামতের নিশ্চয়ই মূল্য আছে। এবং এই শিক্ষাধারাই ইংরেজ জাতকে মহৎকরেছে, আমাদের দেশের কুসংস্কার দূর হচ্ছে।

-ঠিক তাই। হেসে বলেছিলো হরদয়াল। –এর একটাও আপনার নিজের মত নয়। আপনি হয়তো বৃহত্তর মঙ্গল চিন্তা করে নিজের মতকে কুণ্ঠিত করে রাখছেন। কিন্তু আমি জানি ঠিক এখন আপনি যা ভাবছেন তা ভাষাশিক্ষাকে অন্তত তার ব্যাকরণ ও বানানকে কম মূল্য দিতে যা কলকাতায় গ্রাহ্য হবে না। নিষেধ করে দিন।

বাগচী চলে গেলেও চিঠিটায় আর হাত দেওয়া হয়নি। এখন আবার সন্ধ্যা পার হচ্ছে। ছুতোর মিস্ত্রি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে লাইব্রেরির এই আরামকেদারায় এসে বসেছে। এখন কি সে ডায়েরি লিখবে? দু-তিন দিন তা হয় না। কিংবা বন্ধুর চিঠি দুটির উত্তর?

হরদয়াল উঠে পাশের ঘরে গেলো। প্রভিশনের আলমারি খুলে মদের বোতল এবং গ্লাস নিয়ে লাইব্রেরিতে ফিরলো। গ্লাসটা লম্বা, সরু, গায়ে কাঁচের মধ্যে সাদা রঙে একটা লতার মটিফ। হরদয়াল নিজের অজ্ঞাতেই যেন হাসলো ডেস্কের উপরে বোতল আর গ্লাস পাশাপাশি রেখে।

ডায়েরির মরোক্কো বাঁধাই মলাটের উপরে লিখবার প্যাড। প্যাড আর ডায়েরির মাঝখানে সেই অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকে পাওয়া গেলো যা সে বন্ধুকে লিখতে শুরু করেছিলো কাল।

হরদয়াল বোতল থেকে তার লম্বা গ্লাসটাকে ভরে নিলো। এবার বন্ধুর আগের চিঠিটাকেও বার করলো। হ্যাঁ, সেই চিঠিতেই বন্ধু জানিয়েছিলো সে গত একমাস মদ্য স্পর্শ করেনি। আশা প্রকাশ করেছিলো হরদয়ালও ইচ্ছামাত্র সেরকম পারবে। একেবারে নতুন নয় সংবাদ। হরদয়াল তার কলকাতার অভিজ্ঞতা থেকে জানে সেখানে মদ্যপান নিবারণ নিয়ে কথা উঠেছে বটে।

হরদয়াল চিঠিটা হাতে ধরেই গ্লাসটাকে ঠোঁটে তুলো। দ্যাখো কাণ্ড, এই বলবে যেন সে, ইচ্ছামাত্রই কি সব কাজ হয়? কিন্তু বন্ধুর চিঠির এটা জবাবনয়, বরং ডায়েরিতে লিখবার মতো কিছু।

ডায়েরি কেন লেখা হয়? এর সহজ উত্তর আছে। ডায়েরিতে দিনে কতবার মিথ্যাভাষণ হলো, কতবার লোভ থেকে ত্রাণ পাওয়া গেলো, কতবার বা ঈশ্বরের গুণগান করা হয়েছে তা লেখা থাকে। হয়তোবা একসময়ে চারিত্রিক উন্মেষের সহায়ক হিসাবেই হরদয়াল ডায়েরি রাখতে শুরু করে থাকবে। এখন? ইচ্ছামাত্রই মদ ছাড়বে এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা কি তার আছে আর। তেমন ইচ্ছাই কি হবে?

একসময়ে কলকাতার সত্যনির্ভর ইংরেজিনবিশ ছাত্রদের মতো সে হয়তো সব অবস্থাতেই সত্য বলতো। সেই যে গল্প আছে যে তেমন একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো :তুমি মদ খাও–সে বলেছিলো খাই; জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো :অসৎ স্ত্রীলোকের বাড়িতে যাওয়া-আসা করো–সে বলেছিলো, করি।

রানীমার জন্মতিথির উৎসবটাই ধরো। হঠাৎ একটা চালু হয়েছিলো কিছু একটাকে। ঢাকতে। এখন সময়ের হিসাবে দূরে এসে স্পষ্ট করেই বলা যায় সত্যকে গোপন রাখতে। বিপদমুক্তির জন্য রানী কালীপূজা করবেন। বাৎসরিক কালীপূজার কয়েকদিন পরেই। কালীপূজা। সেটা অনভিপ্রেতভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। তাই বলা হলো রানীমার জন্মতিথি। কেউ কি জানে সেটা সত্যিই কারো জন্মতিথি কিনা? সে কি বলতে পারে এটা তা নয়? এ বছরের উৎসবটা এসে পড়েছে। আমলারা সেই সুযোগে নাটক করতে চাইছে।

অন্যমনস্কের মতো গ্লাসটাকে নামিয়ে সে বন্ধুর আগের চিঠিটাকে চোখের সামনে ধরলো। আলোটাকে একটু উসকে দিলো সে।

বন্ধু আগের চিঠিতে তাকে বলেছিলো কলকাতায় যেতে। জানতে চেয়েছিলো হরদয়ালের স্কুল কেমন চলছে। নবনিযুক্ত নিয়োগী মাস্টারমশাই যে লোহার মতো খাঁটি মানুষ এ বিষয়ে আবার আশ্বাস দিয়ে জানতে চেয়েছিলো কেমন সে পড়াচ্ছে। সংবাদ দিয়েছিলো প্রায় দুমাস হয় সে মেট্রোপলিটনে অধ্যাপকের পদপ্রাপ্ত হয়েছে। ঘোষণা করেছিলো সে গত একমাস মদ্য স্পর্শ করেনি এবং আশা প্রকাশ করেছিলো হরদয়াল ইচ্ছামাত্র সেরকম পারবে। চিঠির পরের অনুচ্ছেদে সে বলেছেগ্রামের রাজসরকারের চাকরি যতই ভালো হোক হরদয়ালের মতো মানুষের পক্ষে কলকাতার বাইরে থাকা আর উচিত হয় না। কেননা দ্রুতউন্নতিশীল জীবনের পরাকাষ্ঠা রাজধানীতে, তাই রাজধানীর বাইরে জীবন কি অপচয়মাত্র নয়? বর্তমানে হাইকোর্টের বিষয়ে যেরূপ শোনা যায় তাতে ব্যবহারজীবীদের আশাতিরিক্ত উন্নতির সুযোগ আসছে। হরদয়াল কলকাতায় গেলে সে যে অনায়াসে দুচার হাজার তঙ্কা উপার্জন করবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মনে হয় শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা রামমোহনের পুত্র রামপ্রসাদ এবং আরো অনেকে কোনোনা-কোনোভাবে হাইকোর্ট স্থাপিত হওয়ামাত্র তাতে যুক্ত হবেন। নতুন জীবনে রওয়ানা হওয়ার মতো সঞ্চয় কি এখনো হরদয়ালের হয় নাই?

হরদয়াল নিজের অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকেও উপরে তুলো আবার। মেট্রোপলিটানে অধ্যাপকের পদপ্রাপ্তির জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলো সে বন্ধুকে। স্কুল ভালো চলেছে। নিয়োগী কিছু পাগলাটে বটে, বোধহয় কার্পণ্য দোষ আছে যার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন, কিন্তু পড়ান ভালোই। নিয়োগের পরে আর আলাপ হয়নি। সে জানতে চেয়েছিলো এই চার বছরে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় জনসমাজে কী কী পরিবর্তন সূচনা করেছে।

নিজের কথা সে কিছু লেখেনি। কেন সে গ্রামে থাকে অর্থাৎ দ্রুত ধাবমান কলকাতা শহরের আধুনিক সমাজের বাইরে, কী তাকে গ্রামে আকৃষ্ট করে–এসব কিছু জানায়নি সে। সে কি লিখবে গ্রামের সৌন্দর্য অথবা শান্তির কথা?

বন্ধুর চিঠিটা সযত্নে রেখে দিলো হরদয়াল। চিঠি লেখা এখন অন্তত হবে না।

কয়েকটি সত্যভাষণহলো,কয়টি মিথ্যাভাষণ হলো, ডায়েরি তার হিসাবনা-হয়েও অন্য রকমের কিছু হতে পারে। হরদয়াল চিন্তা করলো আমরা কি নিজের স্বরূপ নিজের কাছে। প্রকাশ করি ডায়েরিতে? আত্মজীবনী হতে পারে? যাতে কোনো পোজ থাকে না। হরদয়াল ভাবলো পোজ শব্দটার বাংলা কী হবে?

দেয়ালঘড়িতে মৃদু গম্ভীর শব্দ হলো। রাত হয়েছে তাহলে। আত্মজীবনীতে নিশ্চয়ই পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধেও সংবাদ থাকে। কারণ মন তো নিরালম্ব নয়।

হরদয়াল উঠলো। আবার আলমারি থেকে নতুন একটা কাঁচের গ্লাস নিয়ে এলো। একবার ব্যবহার করা গ্লাসে আবার মদ নিলে কি স্বাদে তারতম্য হয়?

ডায়েরিতে অন্যের সম্বন্ধেও মন্তব্য থাকে। আত্মজীবনীতেও অন্যের জীবনী এসে পড়ে। এই গ্রামে যদি কারো জীবনের কথা লেখা যায় তিনি নিশ্চয়ই রানী? তাই নয়? অন্যদিকে বন্ধু ভাবছে এখনো সে দেওয়ান। না সে আর দেওয়ান নয় এ কথাও বন্ধুকে জানায়নি কেন? এত বড়ো একটা সংবাদ সে দিতে পারলো না কেন? এটা কি একটা পোজ নয়? এই পোজ থেকে মুক্তি ডায়েরি লেখার যুক্তি হতে পারে?

হরদয়ালের চোখের কাছে কি বেদনার চিহ্নের মতো কিছু দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেলো। হ্যাঁ, সে আর দেওয়ান নয়। আজই কি তা আবার প্রমাণ হলো না? তার একসময়ের অধস্তন নায়েবমশায় এখন অনায়াসে সে কী কাজ করবে তার নির্দেশ দিতে পারেন। এটা কি নিদারুণ লজ্জার বিষয় বলেই ডায়েরিতে স্থান পায়নি?

ঘটনার কথা মনে আছে তার। সেদিন তখন অনেক রাত হয়েছে। হরদয়াল তার নিজের শয্যায় একখানা বই পড়ছিলো। পদশব্দে এবং বোধ করি সুগন্ধেও সে বই থেকে চোখ সরিয়েছিলো। রানী স্বয়ং, একা! রাজকুমারের বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে কলকাতার এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পরে রানীর নিজের আত্মীয়স্থানীয় এক মহিলা কিছু লিখেছিলো চিঠিতে যাতে রানী অপমানিত বোধ করেছিলেন। হয়তো কেটের মতো বিদেশিনী সুন্দরীর সাহচর্যে রাজকুমার ভ্রষ্টচরিত্র এরকম ইঙ্গিত ছিলো। কারণ রানী বাগচীমাস্টার এবং তার স্ত্রী কেটের গ্রামে থাকা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। হরদয়াল বলেছিলো তারা নিরপরাধ। সে বলেছিলো এর জন্য রাজকুমারের বিবাহ বন্ধ হতে পারে না। সে এই পাত্রীর সঙ্গেই বিবাহ ঘটিয়ে দেবে। রানী তাকে সেই রাতেই বরখাস্ত করেছিলেন। হরদয়াল শুধু বলতে পেরেছিলো আমার স্কুল? রানীতাকে সাধারণ প্রজাদের একজন হয়ে সে-বিষয়ে আবেদন করতে বলেছিলেন। অথচ সে গ্রাম ছেড়ে যায়নি।

ডায়েরিতে (তা যদি আত্মজীবনীও হয়) অন্যের চরিত্রও ফুটে ওঠে। হরদয়ালের মনশ্চক্ষে রানী যেন ফুটে উঠলেন। কেন এই পদচ্যুতি তা কি সে বুঝতে পেরেছে? রানীকে শেষ যেদিন দেখেছে সে তখন যেমন তাকে দেখিয়েছিলো তেমনটাই যেন হরদয়াল দেখতে পেলো। রানীর মতো এমন চরিত্রই-বা কার এই গ্রামে?

হরদয়ালের মনের কি এটা পলায়ন-প্রবৃত্তি? পদচ্যুতির মতো কঠিন শাস্তি, যা অপমানজনকও বটে তা থেকে সরে আসার চেষ্টা? কিংবা এটা কি এমন যে, যে-রানী সেই। শাস্তির উৎস হরদয়ালের মন তার সম্মুখে গিয়ে এখনো বিষয়টাকে বুঝতে চেষ্টা করছে?

বাগচীমাস্টার এ গ্রামে থাকায় রানীর আপত্তি শুধু সেটুকুই ছিলো নিশ্চয় যেটুকুমাত্র তাদের জীবনযাত্রার প্রভাব রাজবাড়িতে প্রবেশ করে। নতুবা তার প্রজারা কে কী ধর্ম আচরণ করে তার জন্য তাঁর চিন্তার কিছু নেই। অর্থাৎ রাজকুমারের উপরে কেটের প্রভাব পড়ছে। কেট বিদেশিনী এবং সুন্দরী। হ্যাঁ, তরুণ মনে প্রভাব রাখতে পারে এমন সৌন্দর্যই বটে তার। রাজকুমারের তরুণ মনকে রূপসীর প্রভাব মুক্ত রাখাই কি রানীর চেষ্টা? রাজকুমার কেটকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো এই জেনেই কি রানীর ক্রোধ? যার ফলে সে আর দেওয়ান নয়?

এদিকে দ্যাখো, কাল রাতে আবার অন্য ভাবনাও উপস্থিত ছিলো। দুবার অন্তত, যদিও হয়তো তা দুই রকমের সুরে, তিনি বলেছিলেন নয়নতারা রাজকুমারের সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। অথচ রানীর প্রশ্রয় ছাড়াই কি নয়নতারা রাজকুমারের সঙ্গী হতে পারতো?

রানীর মুখ কী রকম দেখিয়েছিলো সেই প্রতীক্ষার সময়ে যখন দুবার বলেছিলেন নয়নকে নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা? সেই আয়ত চোখ দুটির কোলে কি হাসি ছিলো? অথবা কি রানীর গালে কিছু টোল খেয়েছিলো? একটা আলোর মতোই রানীর মুখটা যেন স্মৃতিতে ধরা দিচ্ছে।

কেন এই প্রশ্রয় নয়নতারাকে তা ভাবতে গেলে কোনো হেতু কি খুঁজে পাওয়া যায়? রানী যা কিছু করেন তার অনেকটা রাজনৈতিক কৌশল–এরকম একটা প্রত্যয় আছে। কেটের চাইতেও নয়নতারা কি বেশি সুন্দরীনয়? হয়তো রূপ দুটি দুরকম, কিন্তু তুমি বলতে পারো না নয়নতারার চাইতে বেশি আকর্ষণীয়া কেউ হতে পারে।

তাহলে এটা কি বুদ্ধিমতী রানীর বিষের ওষুধ হিসাবে বিষ প্রয়োগ করা? এক সুন্দরীর প্রভাব কাটাতে অন্য এক রূপসীকে পাশে এনে দেয়া। বিষস্য বিষৌষধি?

হরদয়ালের মুখে একটা হাসি যেন দেখা দিলো। যেন সে ডায়েরিতে মন্তব্য করবে-কিন্তু রানী, খুব হুঁশিয়ার হয়েই এই বিষ প্রয়োগ করা উচিত হবে।

এসবে তার পদচ্যুতির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদেশী প্রভাবেই কি রানীর আপত্তি? বিদেশী প্রভাব কি আলোর ডোমগুলিতে, পর্দাগুলিতে, আসবাবপত্রের অজুহাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে না রাজবাড়িতে?

রানীর চরিত্রই যেন হরদয়ালের সম্মুখে। আজ সেটাই সবচাইতে মূল্যবান এমন অনুভব করলো সে হাসিহাসি মুখে, যেন সে একজন লেখক যে নিজেই একটা চরিত্র সৃষ্টি করে। তখন তো লেখক অন্য সবকিছু ভুলেও যায়, নিজের জীবনে ক্ষতি কিছু থাকে তাও।

অন্যদিকে ওটাও কি বিদেশী প্রভাব দূরে রাখা? কাল রাতের সেই মুন্সেফি কোর্ট দূরে রাখার অসহায় ইচ্ছাটা ভাবো। কলকাতায় হাইকোর্ট বসবে। এবং দেশের সব আদালত তার অধীনস্থ হবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত কোম্পানীর আদালতগুলি উঠে যাবে। ছোটো-ছোটো আদালত স্থাপিত হবে হাইকোর্টের এক্তিয়ারে। রানী চান না তেমন কোনো আদালত গ্রামে স্থাপিত হয়।

মুন্সেফি কোর্ট আসাটা হরদয়াল নিজেও সমর্থন করে। সে এ-ধরনের শাসন বিস্তারে শুভ দেখতে পায় বৈকি।

কিন্তু রানী কী চাইছেন? তিনি কি কল্পনাতেও নিজের আদালত স্থাপনের কথা চিন্তা করেন? করদ রাজ্য বেহার রাজ্যের আদালতের কথা বলছিলেন না? অন্য কেউ বললে এ সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে না হরদয়াল। কিন্তু রানীর লাবণ্য যত কোমল মস্তিষ্ক তেমনই তীক্ষ্ণধার নয় কি? কিন্তু তুমি চিঠি লেখো আর না-ই লেখো, ডায়েরিতে চিন্তাগুলোকে বসাও কিংবা না-ই বসাও রাত হয়ে যায়।

রাত হলো বৈকি। ইতিমধ্যে ভৃত্য একবার পর্দার ওপারে এসেছিলো। দশটা বাজে ঘড়িতে। লাইব্রেরীর এটা একটা কৌতুক যে রাতের বয়স কত হলো তা এখানে বোঝা যায় না যেন।

বন্ধু তাকে বলেছে কলকাতায় গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে। কলকাতায় কী হয় জানি না, এখানে আমাদের কিন্তু অনেকের বয়স হয়েছে। বয়স হলে তার অতীত থাকে না। অতীতকে কি বিসর্জন দেওয়া যায় সবসময়ে, কিংবা সবটুকু অতীতকে?

ভৃত্য এসে এবার বললো– টেবল পাতা হয়েছে।

 হরদয়াল উঠলো।

লাইব্রেরি থেকে খাবার ঘরে যেতে একটা সরু প্যাসেজ পার হতে হয়। তার একটা জানলা রাজবাড়ির দিকে। চলতে চলতে কানে এলো, মনে হবে যেন জানলার ওপারেই বাজছে। তা সম্ভব নয়। কারণ এটা পিয়ানো এবং রাজকুমার বাজাচ্ছেন। তাহলে বরং এটাই প্রমাণ হয় রাজকুমারের ঘর–যেখানে তিনি পিয়ানো বাজান-তা দেওয়ানকুঠির এই দিকেই।

একটু দাঁড়ালো হরদয়াল। ইতিপূর্বেও দু-একবার বাজনা কানে এসেছে তার। রাজকুমার যে বাজান তা সে ভালোভাবেই জানে। প্রতিবারেই কলকাতায় তাকে স্বরলিপি খোঁজ করতে হয়। বাঃ, ভারি সুন্দর তো! বাজনাটার বৈশিষ্ট্যই যেন জানলার কাছে নিয়ে গেলো তাকে। গম্ভীর মধুর কিছু, যেন কিছু বিষণ্ণ। যেন মানুষ যখন চাঞ্চল্যের বাইরে যায় সেই বয়সের সুর। কিন্তু তা হয় নাকি? হরদয়ালের মনে পড়লো এই গ্রামে যারা চল্লিশ হচ্ছে তাদের কথা; সে নিজে, বাগচী, রানীমা। কিন্তু এই গম্ভীর মধুর ক্লান্ত সুর কি প্রাণ থেকেই উঠে আসে না? পছন্দ-অপছন্দে মানুষের স্বরূপ ধরা পড়ে। এই সুর অন্তরে অনুভব করার মতো গম্ভীর হয়েছে নাকি রাজকুমার ইতিমধ্যে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *