২৬-২৮. অরুণ-বরুণ কিরণমালা

অরুণ-বরুণ কিরণমালা
রূপ ভোমরার ঘর।
শিশুর কালে দেখাইলা কোন
অচিন সওদাগর
হাতে তাহার মোহন বাঁশি
মাথায় শোভন তাজ
রূপ-স্বরূপের মধ্যে দেখি
মনের মহারাজ,
আসিও তুমি যাইওরে তুমি
যেমন পরান চায়
প্রাণের কথা পুরান হইলে
আমার বিষম দায়
কাদা ছানিয়া গড়োরে কুমার
সাধের সংসার
তাহার সাথী প্রাণের সাথী
এই জনমও সার ॥

দেশের প্রধানের বাড়িতে বিপুল উৎসব, আর আয়োজনও বিরাট। সমস্ত পুরীতে নানা সজ্জা, একধারে প্রশস্ত প্রাঙ্গণে বাঁধা শামিয়ানার তলে মূল অনুষ্ঠান; অন্য এক প্রাঙ্গণে শত শত অতিথিদের জন্য নানারকম দীয়তাং ভূজ্যতাং-এর ব্যবস্থা গৃহপুরীর তোরণ দ্বারে বিদেশ হইতে বায়না আনা বাদ্যদলের নৈপুণ্যে; সমস্ত দিক-দিগন্তে সেই উৎসবের রেশ ছড়াইয়া পড়িতেছিল। দায়ে পড়িয়া শিকদারকে আসিতে হইল বটে, কিন্তু সে আরও অপ্রস্তুত বোধ করিল, আরও ঘাবড়াইয়া গেল।

সকল কিছুর তদারকে ব্যস্ত মনসব সর্দার স্বয়ং। দেহে তাহার বাহারের সাজ, তেলমাখা চুলে টেরি কাটিয়া ফুলতোলা টুপি চাপাইয়াছে একধারে; হাতে মুখে, দড়িতে, বগলের লাঠিতেও নানারকম রূপ-প্রসাধন করিয়া সে সকলেরই অতি দ্রষ্টব্য হইয়া উঠিয়াছে; তাহার চোখে মাখা সুর্মার গুণে দৃষ্টি আরও উজ্জ্বল আরও তীক্ষ্ণ বলিয়াই সম্ভবত শিকদারের সসংকোচে উপস্থিতি তাহার দৃষ্টি এড়াইল না। যেমন তাহার স্বভাব সে তৎক্ষণাৎ প্রায় হুড়মুড় করিয়াই তাহার সামনে আসিয়াছিল, তারপর হাত ধরিয়া শামিয়ানার তলায় একধারে বসাইয়া দিল; তারপর কানে কানে বলিল : এইখানে কেবল গায়ক কবিয়ালদের আসন। আশে-পাশের সকলকেই বাহির হইতে আনা হইছে। তারাই শুধু করবে পয়লা। তুমি যেন কিছু মনে করিও না। আর, এই মর্দ, ঘাবড়াইও না।

শিকদারকে সে একরকম চাপিয়া বসাইয়া দিয়াই আবার অন্য কোনো দিকের তদারকিতে ছুটিয়া গেল। জোবেদার হাতে ধোওয়া সামান্য সাধারণ জামাকাপড় যথাসম্ভব বিন্যস্ত করিয়া শিকদার অন্যান্য গায়কদের সসংকোচে দেখিয়া লইতে চাহিল। তাহাদের একজনও তাহাকে লক্ষ করিতেছিল, একটু ঝুঁকিয়া জানিতে চাহিল : মনে কয় কোথায় যেন একবার দেখছিলাম আপনারে। কী ধরবেন, শারি না জারি?

শিকদার মাথা দোলাইল; কোনোটাই নয়, এখনও সে মনস্থির করিয়া উঠিতে পারে নাই, সেই এমন বিখ্যাত কেউ নয়, হয়তো সে তাহাদের মতো গুণীদের সঙ্গে একই সারিতে উপবেশনের যোগ্যতাও রাখে না।

: একলা? অন্য কোনো বাদক দোঁহারও নাই?

শিকদার আবারও মাথা নাড়িল; হাসিতে চাহিল : আপনাগো লাহান বড়ো আমি কেউ না। আমার সঙ্গী এই-বলিয়া সে নিজ দোতারাটা দেখাইল।

: সর্দার খাতির করে, সেই সুবাদে আসা।

: ও!-সেই লোকটি দৃষ্টি ফিরাইয়া অন্যদের সঙ্গে আলাপে মনোযোগ দিল।

ইতিমধ্যে সর্বত্র একটি চাঞ্চল্য দেখা গেল। কোথায় আসিয়া বসিয়াছেন দেশ-প্রধান এবং তাহার সমস্ত সভাসদগণ তা শিকদার অনেক উঁকি ঝুঁকি দিয়া দেখিতে পাইল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জারি শুরু হইয়া যাইতেছে টের পাইয়া সে সেইদিকে মনোযোগ দিবার চেষ্টা করিল। তাহারই পাশে বসা দোহার এবং মূল গায়ক যে ভঙ্গিতে এবং দৃঢ়তায় সকলের সম্মুখে দাঁড়াইল, কেবল মাত্র তাহা লক্ষ করিয়াই শিকদার অবাক হইয়া রহিল। সময় লাগিল সেই মূল গায়কের কথাগুলি উপলব্ধি করিতে। দেশে দেশে আসরে আসরে ক্রমাগত গাহিয়া গাহিয়া হয়তো তাহার কণ্ঠস্বরে আর তেমন কোনো তারুণ্য নাই, কিন্তু এমন কিছু ছিল যা সমস্ত আসরকে যেন মুহূর্তকালের মধ্যে স্তব্ধ করিয়া দিল, যেন একটা বিরাট সমুদ্র তাহার অঙ্গুলি হেলনে স্তব্ধ হইয়া গেল।

পিছন দিক হইতে তবু কে কাহাকে ফিসফিস করিয়া বলিল : গণি বয়াতী, গণি বয়াতী তার এই জারি সে সাতদিন সাতরাত্রি ধরিয়া গায়। মনে কয় এখন সে কেবল মুখ রাখার জন্য আরেক রকম করিয়া শুরু করিয়াছে।

: হিসস্।

শিকদার সেই বয়াতীর নাম-ধাম জানিয়াছে, কিন্তু এইরকম মুখোমুখি হইবার কোনো অবকাশ পায় নাই। সে লক্ষ করিল কী বিপুল শ্রম আর অধ্যবসায় করিয়া একজন গায়ক এমন করিয়া মানুষের সমস্ত মনোযোগ, তাহার হৃদয়ের সমস্ত তরঙ্গের উত্থান-পতনের উপর নিজেকে বিস্তৃত করিয়া দিতে পারে। কোথায় কোন দিগন্তের সেই ধূ ধূ মরুভূমি, গাছপালা নাই, বাতাস নাই, মাথার উপর একটা প্রচণ্ড সূর্য জ্বলিয়া জ্বলিয়া চতুর্দিক জ্বালাইয়া দিতেছে, মরুভূমির বালুকণাগুণি যতই স্থান পরিবর্তন করিতে চাহুক, সমস্ত বিশ্ব-চরাচরের নিয়ামকের আজ্ঞা ব্যতীত তাহাদের কোনো অস্তিত্ব নাই, অবয়ব নাই, ভরসা নাই। গায়কের মুন্সিয়ানা এবং প্রত্যয় দেখিয়া সে আরও ক্ষুদ্র আরও অপ্রস্তুত বোধ করিতে লাগিল। অথচ সে তাহার সেই সব বর্ণনাকেও অগ্রাহ্য করিতে পারিল না। সম্ভবত সে স্বয়ং গীত-কথা তাহার সুর লয় তাল এবং তাহার শ্রোতা-সচেতন কঠিন-কঠোর শ্রম উপলব্ধি করিতে সক্ষম বলিয়াই সে খেয়াল করিল কী নৈপুণ্যে সে এমন জনগণ মন-নন্দিত কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে পারিয়াছে। শিকদার আরও উন্মুখ হইয়া সেই কবিয়ালের বর্ণিত জগৎ, তাহার কীর্তিত সত্যের মধ্যে তাহার অনুভবের মধ্যে নিজেকে একাত্ম করিয়া লইতে চাহিল। দোহারেরা যে-প্রতিধ্বনি তুলিল, যে-ধূয়া তারস্বরে প্রচার করিতে চাহিতেছিল, তাহার যান্ত্রিকতা এবয় কপটতা খেয়াল করিয়া সে ক্ষুব্ধও হইয়া উঠিতেছিল, বেশ কয়েকবারই মন চাহিল সে স্বয়ং উঠিয়া গিয়া দোহারদের কীর্তন বন্ধ করিয়া দেয়, বলে তাহারা শ্রোতাকে মূল হইতে বিচ্যুত করিতেছে নিরাকার রূপকে সাকার করিবার প্রগলভতায় মত্ত হইয়াছে, কিন্তু সে অধোবদন হইয়া রহিল।

এক সময় মনসব সর্দার তাহাকে ডাকিয়া নিল : খাওয়া-দাওয়া করছ মর্দ? জীবনটা কেবল কারবালা কি রোজ-কেয়ামতের ডরে ভরাইলে চলে না, যিনি হায়াত দিছেন, অন্তত তার সম্মানেরও কিছু ভালো-মন্দ মুখে দিতে হয়। তুমি এখন ওইদিকে যাও, খিদমতগারদের বলা আছে, তোমার ইচ্ছামতো খাও দাও, ফুর্তি করো, আমি যতক্ষণ আছি তোমার কোনো ভাবনা নাই।

শিকদারের ইচ্ছা হইল তবু, তাহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে, যে-ব্যবস্থার উপর ভয় করিয়া সে এমন সহজ সরলভাবে সমস্ত কিছুর মধ্যে গলিত মিশ্রিত হইয়া যাইতে চাহিতেছে, তা সবই ঠিক আছে কিনা; কিন্তু একটুক্ষণ কোথায়ও থির হইয়া থাকা যেন মনসব সর্দারের ধাতে নাই, ব্যস্ত না থাকিলে সে হয়তো কোনো সুখও অনুভব করে না। সে অমন জম-জমাট আয়োজনের মধ্যে। আহারেও অভ্যস্ত ছিল না, তাহার উপর সেই সব খাদ্য এমনই উপাদেয় যে শিকদারের পক্ষে মনে হইল উপবাসে না থাকিলে তাহার অন্য সকল চৈতন্যও অবলুপ্ত হইয়া যাইবে।

জারির গায়ক তখনও বর্ণনা করিতেছিল ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের কাহিনি; কীভাবে জীবনের সমস্ত অধিকার হইতে বিপুল মানুষের গোষ্ঠীকে বঞ্চিত রাখিয়া একদল স্বার্থপর শয়তান দিক-দিগন্ত পরম আহাজারিতে ভরিয়া তুলিতেছিল। দোহারদের ধূয়া শুনিতে শুনিতে আবারও তাহার মনে হইতে লাগিল জীবনের সকল সত্য নিশ্চয়ই কোনো যৌথ উপলব্ধির বস্তু, গায়ক এবং দোহার-শ্রোতা যথার্থই একাত্ম হইতে পারিলে মানুষের সমাজেও হয়তো আর কোনো দুঃখের ঠাঁই থাকিত না।

: এই বয়াতীর এক একটি ভাব, এক একটি পদ ভালো করিয়া বুঝতে হয়, তার মধ্যে ডুব দিতে হয়। আশপাশের জনতার মধ্য হইতে কে একজন বলিল : বয়াতীরও বয়স হইছে, এখন এক গুষ্টি সাগরেদরাই তারে এখান থেকিয়া উড়াল দেওয়াইয়া আরেক খানে লইয়া যাইতে আছে। এই সমস্ত গীত-কথা কি এক দুই পহরে বুঝিয়া উঠার জিনিস। ওনার আসর সাত-দশ দিন রাত্তির ধরিয়া চলে, এক একটি পদ এক একটি ভাব প্রবলই ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বয়ান করে। মনে কয় নিজেও যেন তারে পরখ করিয়া লয়।

মুখ ঘুরাইয়া শিকদার সেই লোকটিকে দেখিতে চাহিল; কিন্তু কাছাকাছি জনতার মধ্যে সেই ব্যক্তিটিকে আর বিশিষ্ট করিয়া দেখিতে সক্ষম হইল না; আরও উৎসুক হইয়াছিল এই কারণে যে তাহার কথার মধ্যে যেন পিতামহ করমালীরই কোনো কোনো উক্তি কানে বাজিয়া উঠিল।

তিনি বলতেন : ওরে মনা,-কখনও তিনি আসল নামে, কখনও বা বে নামে ডাকিতে তাহার মন চাহিত, এক এক সময় শুধুই ডাকিতেন, কিছু বলিতেনও না, কখনও কারণ জানিতে চাহিলে হাসিয়া বলিতেন, ডাকি, এমনিই ডাকি, ডাকিয়াও একটা সুখ আছে রে। সেই পিতামহ বলিতেন : বারংবার হইবেই তো। তবে কান পাতিয়া শোন, কক্ষনো সবই এক রকম না! ওইখানেই কৃতিত্ব, যেন কোনো একটা সত্যের দিকে নানানভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তাহার পর এক সময় সত্যকে ছুঁইয়া দেওয়া। গায়ক যখন তার সেই খেলায় সম্পূর্ণ ডুবিয়া যায়, তখন তার চতুর্দিকের শ্রোতারাও যেন তারই অবয়ব হইয়া ওঠে। এমন যে সব লোকগীতি তাও বড়ো উচারকম বিষয় হইয়া যায়। কখনও মনে করবি গায়ক যেন কোনো জহুরি, মনি-মাণিক্য পরখের লাহান কতভাবে, কত দিক হইতেই না দেখে, তার সুর স্বর অন্যের চৌখেও পরীক্ষা করাইয়া লইতে চায়। এ জন্যই যেন সেইসব আসরের আর অন্ত থাকে না। আবার এমনও দেখি কোনো গায়কের কাছে সবই যেন কোনো পরম কী চরম পাওয়ার শামিল হইয়া ওঠছে। বড়ো হ, দেখবি, তোর চৌখেও ধীরে ধীরে অনেক কিছু স্পষ্ট হইয়া উঠবে।

আরও কিছু কিছু কথা মনে পড়িয়া গেল। বাড়ির কাছাকাছি ছোটো গাঙের পাড় ধরিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে একসময় স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িতেন; একটু এইদিক-সেদিক দেখিয়া হাতের লাঠি উঁচাইয়া বলিতেন : এই দেখ কেউ কয় এরেই গঙ্গা, অথচ আসল গঙ্গা কত দূর। একবার একদল ব্যাপারীর সঙ্গে উজাইয়া যাইতে শুরু করছিলাম মেঘনায়, তারপর সেইখান দিয়া ব্রহ্মপুত্রে। আমিও দেখতে চাইছিলাম কোন রাজ্য হইতে এমন শিরা-উপশিরার লাহান নামিয়া আসছে সব। যখন গীত-কথা শুনি, তখনও মনে হয় তারও একটা উৎস আছে। একবার যে প্রান্তে আসিয়া খাড়া হয়, তারে আরও গভীরে যাইতেই হয়। কিন্তু আমার লাহান অভাজনরা পারে না, পায়ের তলায় কাদা নরম, দেহ মনে আর জোর নাই, আমরা কেবলই বিহ্বল হইয়া পড়িয়া রই।

শিকদার মন হইতে দূর করিয়া দিতে চাইল সেইসব কথা। আসরের জারি তখন আরও জমিয়া উঠিয়াছে; সাত-দশদিন না হউক, অন্তত সন্ধ্যার আগে তা সমাপ্ত হইবে বলিয়া মনে হইল না। তাহার দৃষ্টি আবারও মনসব সর্দারকে তালাশ করিতে লাগিল। আবারও মনে হইল, সেই আসরে সে নিতান্তই অপ্রস্তুতভাবে উপস্থিত হইয়াছে। আরও অনুভব করিল তাহার মন স্থির নাই, চিত্ত স্থির নাই, সে যেন আর কখনও এমন কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হয় নাই।

ইতিমধ্যে জারি শেষ হইয়া গেল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থাবার মতো একটা হাত তাহার ঘাড়ে পড়িল : এই মর্দ, কোথায় তুমি এখন ঘোরাঘুরি করতে লাগছ? এখন উপাসনা আর দোয়া-দরুদের পর কিছু খানা-পিনা। তারপরই তোমার পালা।

শিকদার সরাসরি তাহার দিকে চাহিয়া কিছু বলিতে গেল; কিন্তু সে শিকদারের কাঁধে একটা চাপ দিয়া বলিল : আমারে এত্তোবড়ো এস্টাট চালাইতে হয়, তায় আইজকার কাণ্ডকারখানা তো দেহো; তুমি কিছু দুশ্চিন্তা করিও না। যাও যাও, সকলের সঙ্গে শামিল হও, একলা হইতে নাই।

চতুর্দিকে লোকজন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি করি করিয়াও যেন আর সুযোগ হইল না। মনে মনে সে নিজেকে প্রবোধ দিবার সুযোগ করিল, সেই গোপন বিষয়টি যখন মনসব সর্দার ব্যতীত অন্য কেউই জানে না, জানিবার কোনো কথাও নয়, সুতরাং সুসার মতো সবই ঠিক না থাকিলে মনসব সর্দারই তাহাকে কোনো একান্তে ডাকিয়া জানাইয়া দিত। অন্তত তখনকার মতো সে বাস্তবিকই সেই দুশ্চিন্তার কবল হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে চাহিল।

.

২৭.

শ্রীঅঙ্গ যেমন তাহার বিভূতিভূষণ
মৃদুভাষ অরণ্যের কথোপকথন
নিশা হইয়া ঢাকে সব দশ দিশা
আকুলি-ব্যাকুলি করে জীবন-অন্বেষা
আশার প্রদীপ জ্বালে গগনের তারা
পথে নামিয়া পথ খোঁজে এক দিশাহারা
দুঃখ বলে সুখ দেও, সুখ বলে আসো
জগৎ কাঁদিয়া বলে কারে ভালোবাসো?
আমি আমি করি ভরো জগৎ-সংসার
ভুবনে নামিয়া দেখো সবই নিরাকার
গৃহে আছে অন্তঃপুরা অন্তরেতে গৃহ
একে আন মিশাইয়া বিধি বানাইছে দেহ ॥

গানের আসরে শিকদার যখন উঠিয়া দাঁড়াইল, তখনও তাহার বুক কাঁপিতেছিল। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস, তাহার উপরে কোনো গীত-কথার প্রস্তুতিই যেন তাহার ছিল না। সম্মুখে স-পরিষদ দেশের প্রধান, অজস্র গুণীজন, দেশ-বিদেশ হইতে আসা অগণ্য জনতা; কেবল শামিয়ানার খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ডে-লাইটগুলির আলোই একসময় সেই চতুর্দিক নিরাবয়ব করিয়া দিল। এক সময় খুশি হইয়া দেখিল, সেই এক সময়ে পাশে-বসা দোহারদের কয়েকজন তাহার কাছে আসিয়া ফরাশের উপর বসিয়াছে। একজন একটু হাসিয়া ফিস ফিস করিল : যদি কোন ধূয়ার দরকার হয়।

মনসব সর্দারও বুক ফুলাইয়া চতুর্দিকটা দেখিয়া লইল; তারপর শিকদারের দিকে ফিরিয়া ইশারা করিল : কই, দেরি কেন মর্দ, শুরু করা।

শিকদার চক্ষু বুজিয়া দুই হাত বুকের কাছে জড় করিয়া আনিল; সমস্ত আসর তখন ক্রমে ক্রমে নিস্তব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল; শিকদার সমস্ত অন্তঃকরণ হইতে, তাহার মধ্যে কোনো ডুবুরির মতো ধীরে ধীরে অবরতণ করিয়া তাহার গীত-কথাগুলি আহরণে মন দিল।

আমার বন্দনা গ্রহণ করো, প্রভু দয়াময়
অভয়-শরণ, মাঙে বরাভয়, হইও সদয়।
তোমারই মহিমা এই বিশাল পৃথিবী
একভাবে মাটি আর অন্য তিনে বিপুল জলধি
কত জীব কত প্রাণ ইহাতে বিচরে
আশা-বাসনা যা-ই কিছু তারা বোধ করে
সেই অরূপ-স্বরূপ সব তোমা হইতে হয়
তুমিই স্বজন করো, দিতে পারো জয়
তোমারই বরাবরে প্রথম প্রার্থনা আমার
রাখিও রাখিও মান এই অধম বান্দার।

নতমস্তকে যেন অত্মগতভাবে সেই প্রার্থনা করিয়া শিকদার এক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর এক এক করিয়া চতুর্দিকের শূন্যের দিকে চাহিয়া পৃথিবীর সমুদয় তীর্থক্ষেত্র এবং নগরাদির বন্দনা গাহিয়া সে চক্ষু মেলিয়া আসরের জনতার দিকে তাকাইল :

অতঃপর বন্দনা আমার যত সভাজনে
এমন ভূষণ দিয়াছে অকিঞ্চনে।
আকাশ আছে, পঙ্খি ওড়ে, বৃক্ষ আছে ফল।
দেশ-দশা গীত কথা সুরস্বর আমারও বল!

সমস্ত আসার শিকদারের প্রতিটি কথা কান পাতিয়া শুনতে লাগিল; সে ধীরে ধীরে তাহার কণ্ঠস্বর আরও উচ্চ গ্রামে তুলিতে তুলিতে দেশ প্রধান এবং সমবেত গুণীজনেরও বন্দনা করিল; তারপর একসময় আরও উচ্চতর কণ্ঠে জানাইল :

সর্বশেষে বন্দী আমি সেই মহাজনে
আনিয়াছে এই খানে যে এত সভাজনে।
যার জন্মে এত মর্মে হুন খুশি বয়
কালে সে-ই এক মহাজন হইবে নিশ্চয়।

এই সময় শিকদার পাশে ঝুঁকিয়া দোহারদের একটা ইঙ্গিত করিয়া আরও উচ্চকণ্ঠে দুইটি পদ গাহিল:

যার সঙ্গে এত রঙ্গে সব এক সাথ
তার জন্য জগৎ ধন্য আল্লা-রাহামাত।

দোঁহারেরা শেষ দুইটি চরণের আবৃত্তি শেষ করিতে না করিতেই আসরের চতুর্দিক হইতে বাহবাধ্বনি উঠিল; এক ঝলক বাতাস, অথবা একটা সমুদ্র তরঙ্গই যেন ধাইয়া আসিল চতুর্দিক হইতে। শিকদার একটু অবাক হইয়া পড়িলেও, তাহার মুখেও একটু ক্ষীণ হাসি ফুটিয়া উঠিল যখন দেখিল বড়োমিঞাও খুশি মুখে নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়াছেন; আর মনসব সর্দারও মহা উৎসাহে আসরের ফরাশের উপর বসিয়া পড়িয়াছে, দুই হাতে বিশাল বুক বাঁধিয়া সে চতুর্দিকের সকলকে দেখিয়া লইতেছে। মুহূর্তকালের জন্য হইলেও শিকদারের মনে একটা সন্দেহ ছায়াপাত করিয়া গেল, এমন সমাদর সম্বর্ধনা তাহারই কোনো ক্রিয়াকাণ্ড নয় তো? কিন্তু আসর তখন প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে, মনে হইল তা যেন কোনো ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীর মতোই উন্মুখ ঋজু হইয়া দাঁড়াইল।

আর কোনো বিনয়-ভনিতা নয়, অতঃপর মূল গীত-কথা শুরু করিয়াছে শিকদার। বাস্তবিকই তাহার কোনো প্রস্তুতি ছিল না, তাহার সমস্ত জীবনটাই যেন একটা ধনুকের মতো টানটান হইয়া উঠিতেছিল। প্রতিদিনের জীবনাচার দেখিয়া যেই সব ভাব-ভাবনা তাহার মনে ক্রমশ একটা জীবন উপলব্ধি প্রস্তুত করিতেছিল, এইবার যেন একটা জ্যা-মুক্ত শরের মতোই তীব্র-তীক্ষ হইবার বাসনায় অধীর হইয়া উঠিল। তবুও সে সংযত হইতে প্রয়াস করিল, চক্ষু নিমীলিত করিয়া সে নিজেকে শাসন করিতে চাহিল। সমস্ত হৃদয়ের কূল উপকূল ভাসাইয়া কোনো দুর্দম নদ কিংবা নদী যেন তাহাকেও উনুল করিয়া লইয়া যাইতে চাহিতেছিল, কিন্তু শিকদার আত্মস্থ হইতে চেষ্টা করিল। ক্রমে ক্রমে যে গীত-কথা, তা অভিনব, কখনও কথকতা, কখনও গীত, কখনও কোনো জীবন দৃশ্যের খণ্ড খণ্ড চিত্র। কী সুন্দর এই পৃথিবী, কী বিচিত্র এই জগৎ-সংসার। ইহার মধ্যে নদীর মতো জীবন-প্রবাহ কখনও জোয়ারে, কখনও ভাটায় বহিয়া চলিয়াছে, সেই মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ তরঙ্গমালা নৃত্য করিতেছে, জাগিয়া উঠিতেছে, আবার ভাঙিয়া পড়িতেছে, কোথায়ও ফুলমালা কুঁড়ি স্বরূপে চক্ষু মেলিতে চাহিতেছে আবার কোথাও শুষ্ক শীর্ণ হইয়া ঝরিয়া পড়িতেছে, একই সঙ্গে জীবন ও মৃত্যু, আনন্দ ও বেদনার দোলায় দোলাইয়া জীবনকে কোন শক্তি কোন ইচ্ছা একই সঙ্গে এমন সুখের এবং এমনই দুঃখের করিয়া তুলিতেছে? যে ইচ্ছায় নদীর তরঙ্গগুলি পাড় ধরিয়া উপরে উঠতে চায়, তাহার বধূ সমস্ত জীবনকে কেবলই শৃঙ্গার-সজ্জার মতো যত্নে সাজাইয়া তুলিতে চায়। যে-ইচ্ছায় শত দুঃখ কষ্টে অভাব-অসুবিধা-অস্বাস্থ্যের মধ্যেও ফসলের ঋতু-ধর্মকে সমীহ করিয়া সম্ভ্রম দেখাইয়া জীবনাচারে ব্রতী থাকে, যে-ইচ্ছায় কিশোরী-যুবতীর বুকের মধ্যে কামনা-বাসনা প্রদীপ-শিখার মতো কাঁপে, যে-ইচ্ছায় যুবক-তরুণ সমস্ত অন্যায়, সমস্ত অত্যাচারকে নির্মূল করিবার জন্য প্রশস্ত বক্ষপট পাতিয়া দেয় হিংস্র দানবের সম্মুখে, সেই আগ্রহ, সেই ইচ্ছা, সেই ব্যাকুলতা অহরহ বিশ্ব-ভুবনের দুয়ারে দুয়ারে করাঘাত করিয়া বেড়াইতেছে। তাহার নিকট হইতে মুক্ত হইবে, না অন্য কোনো স্বার্থকতার পথ দেখাইবে না কেবল কোনো অতি পুরাতন পুরাণ-কথা শুনাইয়াই তাহাকে তুষ্ট করিতে চাহিব, কিছু চাহিব কী আদৌ চাহিব না? কেন এইভাবে দিন আসে দিন যায়, দিনও রাত্রির মতোই অন্ধকার হইয়া ওঠে, রাত্রিরও যেন আর কোনো অবসান আছে বলিয়া মনে হয় না। শিকদার কখনও শ্রুত-বিশ্রুত গীত-কথা, কখনও নিজ ধ্যান-ধারণা সৃষ্ট কথা-পূর্ণ বহাইয়া দিতে চাহিল। কখনও কখনও নিজ কথার অনুসরণ নিজ কানে শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া পড়িতেছিল। এত কথা, এত ভালোবাসা, এত আকুলতা ব্যাকুলতা কবে কখনও সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছিল তাহার মধ্যে? সে কি বাস্তবিকই কোনো রমণীদেহেরও উত্তরে অন্য কোনো জীবনানন্দে বিস্তৃত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু সে তখন যেন কোনো তরঙ্গ-সঙ্কুল সমুদ্রের উপর সওয়ার হইয়াছে, দিক-দিশা ঠিক রাখাই তখন তাহার চিত্ত-চৈতন্যে প্রধান হইয়া রহিল, সে আপন কর্তব্য ভুলিল না।

এক আসন্ন সমুদ্রযাত্রার জন্য সে নিজেকে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করিয়া লইতেছিল। কবে কোন শৈশবকালে দেখা এক সমুদ্রের কথা সে জোবেদাকেও বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছে। পিতামহ করমালীর সঙ্গে সেই মুলুক দেখিতে গিয়াছিল। দীর্ঘ যাত্রা, ভাটার টানে তর তর করিয়া নামিয়া যাইতে থাকিলেও ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল এক সময়; যখন জাগিয়া উঠিল দেখে চতুর্দিকে কুয়া, কুয়াশা, কে যেন বলিয়াছিল কূহকের মেলা। নৌকা দুলিতেছিল। মাঝি মাল্লা এবং অন্যান্য সকলে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল দিক-দিশা ঠিক রাখিতে :

‘বদর বদর বলে ভাই, কোনো ডর নাই।
উপরে সাগরমাথা, দক্ষিণে জলধি, উরসে,
আগুলিয়া আছে পরম অবধি।’

দাঁড় টানিবার তালে তালে প্রধান মাল্লার প্রতিধ্বনি তুলিয়া অন্যেরা যা কিছু আবৃত্তি করিয়াছিল শিকদার সেই কচি বয়সে সম্পূর্ণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, মনেও রাখে নাই আর। অকস্মাৎ এক সময় যেন সমস্ত কুয়াশার যবনিকা সরিয়া গেল। প্রসন্ন রৌদ্রের মধ্যে এক দীর্ঘ বেলাভূমি যেন কোনো রমণীর মতো কেশজাল ছড়াইয়া বিশ্রান্তে শয়ান, পক্ষীকূল, বৃক্ষরাজি লতা ঘন বন যেন তাহারে ফিরিয়া অন্য কোনো পুরী গড়িয়া তুলিয়াছে। কত কত নিঃসীম অসীম দূর দূরান্ত হইতে চঞ্চল তরঙ্গমালা যেন অলঙ্কার পরাইয়া দিতে আসিতেছে সর্বক্ষণ; পবন-বীজনে কলকণ্ঠ জলস্বরে যেন ধরিত্রীর দশ দিন আর অযুত-নিযুত কালে কত কথা সর্বত্র ছড়াইয়া রহিয়াছিল।

পিতামহ করমালীর সর্বাঙ্গসিক্ত দেহাবয়ব তখনও তাহার চক্ষে ভাসে। সে যেন সেই বিপুল জলধির মধ্য হইতেই জাগিয়া উঠিয়া তাহার দিকে হাত। বাড়াইয়া দিয়াছিল : দেখ মনা, এই পলি-রেণু জমিয়া জমিয়া গড়িয়া ওঠে দেশ-মহাদেশ, আবার তাহার উপর জীব-জীবন সকল আশা-বাসনা, কত ভুল-ভ্রান্তি। এই মাটি সকল সময় চোখে পড়ে না, কিন্তুক মাঝে মধ্যে আমারও মনে কয় যেন এরই শক্তি আমাগো জীবনেরও নিয়ামক হইয়া রইছে।

কিশোর শিকদার তাহার কিছু কথা বুঝিয়াছে আবার অনেক কথা বুঝিতে সক্ষম হয় নাই। ভাব-তত্ত্বে যাহাই থাকুক, বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে ক্রমশই উপলব্ধি করিতে শুরু করিয়াছিল জীবনের মৌল প্রয়োজন মাটি জল বায়ু; মানুষ তাহার ভোগ ব্যবস্থা সুসার মতো করিতে পারিলে পৃথিবীতে অনেক দুঃখ থাকিত না। যতদূর মনে পড়ে, সেই দিন সেই ধরণী ভূমি জল বৃক্ষলতা দল দাম ভরা ফুল ও ফল বড়ো ঐশ্বর্যময়ী বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল। কোথায় দুঃখ জীবন-জীবিকা কেন কেবল দুঃখভার ভরা ক্রন্দন হইয়া উঠিয়াছে? করমালী কেবলই বলিয়াছে : বড়ো হ মনা, বড়ো হ, আপনা হইতেই বুঝিতে পারিবি। শিকদার আবারও সেইরকম একটা সুযোগ, আরও গভীরতর অভিজ্ঞতার আগ্রহে উজ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছিল।

মনসব সর্দারও একটা সমাধান পাইয়া উফুল্ল বোধ করিয়াছে : হ, এইটাই ভালো হইবে। তুমি যাইবা শুনিয়া অনেক গরিব গুবারাও সাহস পাইছে। মুলুক তো সহজ না, তোমারে সঙ্গে পাইলে তার গো খাট-খাটনি তেমন কষ্টের হইবে না। যাও কবি কর্মে কাজে তাগো মাতাইয়া দেও। এই এস্টাটের শ্রীবৃদ্ধিতে দশেরও শ্রী, তুমিও এই বিষয়টা ভালো করিয়া বুঝিয়া লও।

কিন্তু জোবেদা তেমন উৎসাহ বোধ করে নাই। বিধি-ব্যবস্থা, লোক-নিন্দা প্রভৃতি বিষয়গুলি সে তলাইয়া দেখিলেও বড়ো অনিচ্ছার সঙ্গেই সে তাহার ভাই-এর বাড়িতে গেল। নৌকায় উঠিবার আগে সে কিছুক্ষণ নিথরভাবে শিকদারের দিকে চাহিয়া রহিয়াছিল; তারপর মাথার উপর আঁচল টানিয়া ধীরস্বরে জানিতে চাহিয়াছিল : আসবা তো আমারে নিতে, না তুমি আমার দায়মুক্ত হতে চাও?

শিকদার নির্ভয় দিয়াছে : কোনো দুশ্চিন্তা নাই। সব ব্যবস্থা মনসব সর্দার নিজ হাতে তুলিয়া লইছে। ভাটির মুলুকের কাজে এই সংসারেরও লাভ হইবে। শিকদার বাস্তবিকই বুঝিয়া উঠিতেছিল ক্রমাগত যে জীবনধারণের মৌল শ্রম এবং সংগ্রাম হইতে পৃথক করিয়া গীত-কথার কোনো মূল্য নাই। অথচ কী রকম হইতে পারে সেই কথামালা সে-বিষয়ে সে তখনও যেন একটা সুস্পষ্ট ধারণা করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না। কিন্তু একটা বিশেষ ধ্যান তাহাকে উদ্বুব্ধ করিতেছিল যে সেই ভাটির দেশের রূঢ় কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্যে সে সকল ধ্যান-ভাবনা কর্তব্য এবং জীবনাচারকে সুশৃঙ্খলভাবে গুছাইয়া লইবার সুযোগ পাইবে।

আসরে গীত-কথা নিবেদন করিতে সেও যেন এক সময় কোনো গম্ভীর হইতে করমালীর মতোই জাগিয়া উঠিল; জগৎ-জীবন, সৃষ্টি ও ভালোবাসার সমুদয় চিত্র এবং তাহার কাহিনি-কলকতার পল্লবে সে যেন তাহার সকল সাধ আকাঙ্ক্ষাকেই আবিষ্কার করিয়া চলিল।

সে কি তাহার বংশধারা? করমালীও তো কেমন অভিভূত হইয়া পড়িত গানে গানে, কথায় কথায়, চতুর্দিকের সমস্ত জগৎ ত্যাগ করিয়া যেন নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতে চাহিত অন্য কোনো রহস্যময় জগতে, কখনও তাহাকে মনে হইত সমস্ত বাহ্যজ্ঞান চৈতন্যরহিত। কিন্তু তাহাতে জগৎ-সংসারের জীবনের কী সার্থকতা লাভ হইয়াছে? জীবন-গড়ন-গঠনের মৌল ভিত্তিগুলি কেবলই যেন খুলিয়া খুলিয়া ভাঙিয়া ডুবিয়া যাইতে শুরু করিয়াছিল। পিতামহী সামাল দিতে চেষ্টা করিয়াও পারেন নাই। তাহার পিতৃদেব বাইজু মন দিতে চাহিল গণ্ডা-কড়ি হিসাব সওদাগরিতে। সর্বস্বান্ত হইয়া সে আর কোনোদিকে কোনো উদ্যম নিতে পারে নাই।

শিকদারের মধ্যে সেই বহুকালের অসাফল্য কেবলই গুমরিয়া মরিয়াছে; সকল ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার একটা রূপাবয়ব আবিষ্কারও তাহার ধ্যানে-মনে হয়তো সবসময়ই জাগরূক ছিল। আসরের উৎসাহে সেও যেন নিমজ্জিত হইয়া গেল।

.

২৮.

ডাকিও না ডাকিও না কোকিলা রে
নিশির আন্ধারে
পবন বঁধুয়া তুমি বিলাইও না
ফুলের গন্ধরে ॥
চন্দ্রমা করিওনা উজলরে
কুঞ্জ বন বীথি
চরণে শৃঙ্খল আমাররে
জনম অবধি ॥
নিদ নাই রে নিশীথে কালে
দিনমানে দাস
কানু বলে সৃষ্টি যেন
ধরে উপহাস ॥

সেই আসরে শিকদারের গীত-কথকতা কোনো প্রচলিত ধারা অনুযায়ী হয়তো ছিল না, কিন্তু তাহার অভিনবত্ব এবং বক্তব্য গুঞ্জনের গুঞ্জন বহাইয়া দিয়া যাইতেছিল। এক সময় সে নিজেও অনুভব করিল তাহার হৃদয়াবেগ, দৃষ্টি এবং মনোযোগ যেন ক্রমাগত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে; মূল বিষয়কে অবলম্বন করিয়া সে চতুর্দিকের ওই জীবন এবং নানা রূপ-অরূপের সঙ্গে বর্তমান জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য গাঁথার আকাক্ষাটাই কেবল ব্যক্ত করিতে পারিতেছে। আর একই সঙ্গে সে স্বয়ং যেন একটা নতুন দিশা স্থির করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। জগৎ-সংসার চতুর্দিকের অবস্থা-ব্যবস্থা, তাহার মতো সামান্য সাধারণ জনের জীবৎকালে যে-নতুন শিশু সকলের মধ্যে আসিয়াছে, সে জীবনকেই গীত-কথার মতো অপরূপ করিয়া তুলিবার পথ দেখাইতে পারিবে এই শুভ কামনা জানাইয়া সে শেষ করিল।

সমাদরের অভাব হইল না, স্বয়ং বড়োমিঞাও প্রত্যাশার অতীত ইনামও দিলেন, কিন্তু সে তৃপ্তি বোধ করিল না। এক সময় সকল ভিড় এড়াইয়া সে নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল। মনসব সর্দারের সঙ্গে কিছু অত্যন্ত জরুরি কর্মকর্তার প্রয়োজন ছিল বটে, কিন্তু সে বাস্তবিকই ব্যস্ত। একবার যখন সামনা সামনি হইতে পারিল সে ঠা ঠা হাসিয়া বলিল : এখন বাড়ি গিয়া ভালো করিয়া একটা ঘুম দেও গিয়া মর্দ। কোনো চিন্তার কারণ নাই। সব ব্যবস্থা হইতে আছে।

সে তাহার একজন সহকারীকে নির্দেশও দিয়া দিল : ওই ভাটিতে যারা যাইবে, তাগো বেশ কিছু জন এইখানেও হাজির দেখছিলাম। দেখো দেখি, খুঁজিয়া পাতিয়া আমার কবিয়াল ভাই-এর সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিতে পারো কিনা। এমন কবিয়াল তাগো সঙ্গেও ওইখানের লড়াইয়ের মধ্যে যাইবে শুনিয়া অবধি তারগো উৎসাহের শেষ নাই।

কিন্তু তখনকার মতো অন্য কিছুই যেন আর তাহাকে আকৃষ্ট করিয়া রাখিতে পারিতেছিল না। কেবলই মনে হইতে লাগিল সেই আসরে বাস্তবিকই মনের মতো কিছু বলিতে পারে নাই, তাহার সুর-স্বর-কথা কোনো কিছুরই যেন যথাযথ প্রস্তুতি ছিল না। সে এতদিন শুধু ভাবুকের মতো তন্ময় হইয়া জীবন জগৎ-সংসার লইয়া ভাবিয়াছে বটে; কিন্তু কোনো কিছু ধাপের পরে ধাপ সাজাইয়া নির্মাণ করে নাই। সমস্ত দিক হইতে নানা ভাব, নানা ভাষা-ভাষ্য; কখনও স্বপ্ন স্মৃতিতে সঞ্চিত উক্তি-ব্যক্তিরাই যেন সমস্ত গীত-কথা নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। যদিও সে তাহার শ্রীহীন গৃহাঙ্গনে ফিরিবার জন্য অধীর হইয়া উঠিয়াছিল, তবু মনে হইতে লাগিল সেই ভাটির দেশে জীবনকে যেন সাগরের তলা হইতে গড়িয়া তুলিতে হয়, গভীর গহনে ডুবিয়া শ্রমিক মানুষ যেইভাবে মুক্তা আহরণ করে, আধি-ব্যাধি, ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রভৃতির সহিত যুদ্ধ করিয়া যাহারা জীবন সাজাইবার দুঃসাধ্য প্রয়াস করে, কেবলমাত্র তাহাদের সঙ্গে সাকুল্যেই সে সম্ভবত জীবনকে অন্যতর কোনো দৃষ্টিতে দেখিতে পারিবে, উপলব্ধি করিতে পারিবে। আরও বুঝিতে পারিবে জীবনে কোনটা বড়ো, শ্রম না প্রেম? অথবা দুয়েরই কী উপায় সম্ভব হইতে পারে? এক সময় সে হোসেন-এর বড়ো অভাব বোধ করিতে লাগিল।

অন্ধকার বারান্দায় শুইয়া বারংবার মনে হইল জোবেদার কথা। সেও নিকটে থাকিলে হয়তো সে এমন অতৃপ্ত, এমন অস্থির বোধ করিত না। পারিপাট্যভরা গৃহ-সংসার না সাজাইয়া সমাজভুক্ত না হইয়া কোনো জীবনকথাই হয়তো গড়িয়া তোলা যায় না। মনে হইতে লাগিল ঘাট-মাস্টার ঠিকই বলিয়াছে, সুষ্ঠ গড়ন-গঠনের পথ দেখাইতে না পারিলে কোনো গীত কথা কি আনন্দ যেন সার্থক হইয়া ওঠে না। কেবল দুঃখ নয়, আশা-ভরসা, উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আপন বিশ্বাস শক্তি ও ক্ষমতার বিষয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করিতে না পারিলে তাহার মুখে আর কোনো কাব্যকথাও সাজিবে না।

বাকি রাত্রিটুকু ব্যাপিয়া আরও একটা চিন্তা তাহার মন অধিকার করিয়া রাখিল, কেন সে কেবল মাত্র গীত-কথাকেই জীবনের সর্বস্ব করিয়া তুলিয়াছে? এ কি কেবল সেই শৈশবকাল হইতে অনুসরণ করা একটা অভ্যাস, জীবনের আসল সংগ্রাম হইতে দূরে সরিয়া বিশিষ্ট হইয়া থাকিবার আকাঙ্ক্ষা, না বাস্তবিকই তাহার মধ্যে এমন কোনো গুণ আছে যা অন্য কাহারও নাই। কতটুকু বোধ তাহার নিজস্ব? সেই সব বোধবৃত্তির কথা সে একের পর এক আবৃত্তি করিয়া গিয়াছে, তাহা হইতে কী এমন লাভ হইয়াছে তাহার? এমনও তো হইতে পারে সে কেবল অলীক দিগ-দিগন্তের দিকেই সকলের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করিয়াছে, সত্যকারের জীবন-গঠনের কঠিন কঠোর সংগ্রামের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। বিধি যাহার কপালে লিখিয়াছে গাহিয়া ধূয়া ধরানোর বিষয়টাই যদি সত্য হয় তাহা হইলে মানুষের কোনো চেষ্টা, কোনো সংগ্রামেরই কোনো অর্থ নাই।

ভোর ভোর সময়ে সে হোসেনের বাড়ির দিকটা ঘুরিয়া আসিল। একবার ভাবিল সময় থাকিলে একবার গঞ্জের ঘাটেও তাহার তালাশ লইতে যাইতে পারিত; হয়তো ঘাট-মাস্টারের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলিয়া অনেক বিষয় পরিষ্কার করিয়া লওয়া যাইত। কিন্তু ভাটির দেশে রওয়ানা হইবার সময় ঘনাইয়া আসিতেছিল। মনসব সর্দারের ব্যবস্থার উপর নিজেকে নির্ভর রাখিতে হইল।

দিন গড়াইয়া যাইতে না যাইতেই খালের ঘাটে কিছু নৌকা দেখা গেল। প্রত্যেকটিতে এক একদল জনমুনীষ। একে এক মুলুকের, অন্য আরেকের। অধিকাংশেরই কোনো জমি নাই, জীবিকা আহরণের কোনো বৃত্তি নাই, একমাত্র কৃষি কাজ ব্যতীত; জীবনের অন্য কোনো কর্ম নাই, পেশাতেও তাহার ভুক্ত হইতে পারে নাই। বিধাতা জীবন দিয়াছে, এখন তাহাকে বাঁচাইয়া রাখিবার ফরজ আদায়ের জন্য তাহারা যোদ্ধার সংকল্পে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছিল।

তাহাদের মধ্যকার বয়স্ক একজন শিকদারের কাছে আগাইয়া নিজ পরিচয় দিল, আমি আরও একটা খন্দ কাটাইয়া আসছি সেই চরে। এতদিনে নিশ্চয় আরও মজবুত হইয়া জাগছে। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হইতে পারে; কোনো দিকে কোনো লোকালয় কি বসতি তো এখন হয় নাই। আমাদের সব একেবারে গোড়া হইতে গড়িয়া তুলতে হইবে। সর্দারের হুকুমে একটা নৌকার পুরা একটা দিক আপনাগো জন্য আব্রু করিয়া দেওয়া হইছে। দেখবেন একবার পছন্দ হইল কিনা?

শিকদার একটু সংকোচ বোধ করিল। নৌকাটির দিকে একবার উঁকি দিয়া দেখিল বটে, কিন্তু আরও অনেক বিষয় তখনও সম্পন্ন করা বাকি। যে লোকটি তাহার এবং হোসেনের ঘর-বাড়ি পাহারায় থাকিবে তাহারও কোনো উদ্দেশ্য নাই তখনও অবধি। কাহার ঘরেই এমনি কোনো বিশেষ সম্পদ নাই যা কোনো দস্যু আসিয়া লুটিয়া লইয়া যাইতে পারে। কিন্তু হোসেন একরকম আমানত দিয়া গিয়াছে, এমন দেরি করা তাহারও কথা ছিল না যদিও। তাহা ছাড়া ঘুরিয়া-ফিরিয়া যত দেখে শিকদার, যতবারই দৃষ্টি পড়ে ঘাটে বাঁধা ভূমিহীন, প্রায় ভিটাবাড়িহীন জন-মুনীষদের উপর, ততবারই মনে হইতে লাগিল সেই ভিটা এর গৃহের ভিত প্রাঙ্গণও তো একটা সম্পদ, সম্পত্তি। এত দরদ এত যত্ন করিয়া গড়িয়া ভোলা প্রতিটি ঘর-বারিয়াল, প্রতিটি বৃক্ষ লতাপাতা, প্রতিটি নালা-খাল-জলাশয়ও একটা গভীর ইচ্ছার প্রতীক এক একটা সংগ্রামের কাহিনি। এক কালের মজা গাঙ এখন যা খাল, তাহার পাড় ভাঙিয়া আগাইয়া আসার গতি রোধ করিয়াছে সারির পর সাড়ি বড়ো গাছ। একবার, কয়েক বছর আগে হোসেনের ঘরের একদিকের চাল ঝড়ে উড়িয়া গিয়াছিল, অথচ প্রভাত হইতে না হইতেই এইদিক-সেইদিক হইতে আসা আরও দশজনের বাহুবলে আবারও মজবুতভাবে খাড়া হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবতন্ময় শিকদার আবারও ভাবিতে শুরু করিয়া দিল, এই রকম যৌথসম্পর্ক এবং মনোভাব থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন নিরাশ্রয় নিরাবলম্বন হইয়া পড়ে? আপাতভাবে সে তখনও তাহার কোনো সদুত্তর খুঁজিয়া পাইল না।

ইতিমধ্যে মনসব সর্দার আসিয়া গেল। সঙ্গের লোকজনদের অন্যদিকে পাঠাইয়া সে শিকদারের বারান্দার ধারে বসিল হাতের লাঠিখানাকে একধারে ঠেস দিয়া রাখিয়া। তাহার হাবভাব এবং গম্ভীর মুখচক্ষু লক্ষ করিয়া শিকদার একটু বিচলিত বোধ করিল।

: বুঝতেই তো পারতে আছো, মর্দ, সে আসে নাই। এই যাত্রায় তোমার যাওয়া হইবে না। শিকদার বিস্মিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া হঠাৎ কোনো প্রশ্নও করিয়া উঠিতে পারিল না।

: আমার ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি ঘটে নাই। লোকজন ঠিকমতোই তারে আনতে তার ভাইয়ের বাড়ি গেছিল, গিয়া দেখে সেখানে সেও নাই, আর তার ভাইয়েরও কোনো উদ্দেশ নাই। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর ঘরের পোয়াতি মাইয়া ছেইলাটার কাছে জানা গেল, আগের দিন তার স্বামী আসগরউল্লা স্বয়ং আসিয়া তারে লইয়া গেছে, সঙ্গে কয়েকজন লোকজন নাকি আছিল। অনেক কথা কাটাকাটিও নাকি কিছু হইছে। মাইয়াছেইলাটির তেমন কোনো বোধ তবধ নাকি নাই, কেবল এক সময় দেখছে, সেই কন্যা এক সময় যেন আপনা হইতেই তারগো নৌকায় গিয়া ওঠছে। তার ভাইটার এত তালাশ চালাইলাম কিন্তুক কোনো হদিস করতে পারলাম না। এত্তো বড় এস্টাট চালাইতে আছি আমি, আর এই সামান্য বিষয়টারই কোনো মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারলাম না।

শিকদার দৃষ্টি নত করিয়া সমস্ত বিষয়টার আকস্মিকতা কাটাইয়া উঠিতে চাহিল।

: আমার তো মনে কয় এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো জোর-জবরদস্তির ব্যাপার স্যাপার আছে। লোকবল তো আমারও আছে। তবে মনে হইল, সেইসব হাঙ্গামা আইন-আদালতের হৈ চৈ তোলার আগে বেশ একটু চিন্তা-ভাবন দরকার আছে, তোমার সঙ্গে কিছু কথা পরিষ্কার করিয়া লওনও প্রয়োজন। সমূহ কর্তব্য দেখি এই যে তোমার যাওন হয় না।

শিকদার দৃষ্টি তুলিয়া একবার খালের দিকে তাকাইল, তারপর একটু ইতস্তত করিয়া ঘরের মধ্যে হইতে রুমালে বাঁধা ছোটো একটা পুঁটুলি আনিয়া মনসব সর্দারের হাতে তুলিয়া দিল : সর্দার স্বয়ং বড়োমিঞার হাত হইতে এমন ইনাম আমি কল্পনাও করি নাই। আমার দোস্ত হোসেন এখনও তক। বাড়ি ফিরিয়া আসিল না; তার হাতে এইটা তুলিয়া দিবেন। আর, এই দুই বাড়ি পাহারার লোক না পাইলে আমিও স্বস্তি পাইতে আছি না।

মনসব সর্দার পুঁটুলির মধ্যে টাকাগুলি লক্ষ করিয়া একটু বিমূঢ় মুখভাব দেখাইল : তার অর্থ? যার জন্য অর্ধেক জীবনটা এমন পথ চাইয়া কাটাইয়া দিলা, এখন তার সমস্ত কিছু এই রকম আচুক্কা ছাড়িয়া দিয়া ভাটির দেশে যাওনের কী অর্থ হয়? আমার তো মনে কয় সেও খুবই ছিদ্দতের মধ্যে পড়ছে। এখন তারে উদ্ধার করাই হইবে ঠিকমতো পুরুষকার। তখন দেখিও সমস্ত দিক হইতে তামাম জগৎ-সংসার তোমারে সাবাশ দিয়া উঠবে। আমারে যদি দোস্ত বলিয়া মানো, এই সুখটা আমিও পাইতে চাই।

শিকদার নতমুখ দাঁড়াইয়া রহিল।

মনসব সর্দার লাঠিখানা হাতে লইয়া স্ফীত বুকে ঋজু হইয়া বসিল : তবে কেবল দেহের শক্তিতেই সব কর্ম হয় না, কৌশলে ব্যাপারটা নিস্পন্ন করতে হইবে। এখনও দরকার হয় নাই। তবে বড়োমিঞার সঙ্গে পরামর্শের দরকার হইতে পারে। এত বড়ো এস্টাট চালাই তো, চতুর্দিকে চৌখ রাখতে হয়। ওই আসগরউল্লার নিকট থেকিয়া আইন-মোতাবেক ছাড়াইয়া না লওন পর্যন্ত

তোমার সঙ্গে তারে উঠাইয়া দেওনটাও একটু কাঁচা কাজই হইয়া যাইত। এস্টাটের কেউর কোনো দুর্নাম হইতে দেওনটা কামের কথা না।

শিকদার একসময় ধীরস্বরে বলিল : সর্দার, আমার তো মনে কয় একদিক দিয়া এমন হওনটাই ভালো হইছে। সে স্বেচ্ছায় আসছে গেছে। কেন, কী অবস্থায় এখন আবারও গেল আমি জানি না, বুঝি না। বাকি জীবনটাও যে এই বিষয় লইয়া কাটাইতেও আমার কোনো সুখ হইবে না। পৌরুষকারের কথা না, আর এই বিষয় লইয়া কোনো হৈ চৈ হাঙ্গামাও আমার পছন্দ না। আমারও রুজি-রোজগার দরকার, অন্য সকলেও তৈরি হইয়া আমার অপেক্ষায় আছে, আমি এখন না গেলে নিজেরেও আর মাপ করতে পারমু না। আপনারা রইলেন, রইল ঘর-বাড়ি-ভিটা। একটা খন্দের তো কাল, ইতিমধ্যে রহস্যটারও একটা সঙ্গত মীমাংসা হইয়া যাইবে। সর্দার, কেবল এ কন্যার কথা না, আমার আরও কিছু ইচ্ছা আছে। আমি অন্য মানুষেরও ভালোবাসার পাত্র হইতে চাই। আপনেও তো চায়েন আমি কবি হই। এখন, আপনে দয়া করিয়া হুকুম দেন, নৌকা খুলুক, আমরা রওয়ানা দেই।

মনসব সর্দার মাথা নিচু করিয়া বেশ কিছুক্ষণ ভাবিয়া দেখিল সব দিকগুলি। তারপর দাড়ির উপর হাত বুলাইয়া হাসিত চাহিল : বেশ, তবে তাই হউক কবিয়াল, আর এই এস্টাটেই তো রইলা, সুযোগ মতো তোমারে আনতেও আমার চেষ্টার কোনো কসুর থাকবে না। মুখে যা-ই বলি কবিয়াল, আমিও বুঝি, ওই মাইয়া-মানুষ এমনই একটা বস্তু যার উপর জোর জবরদস্তি করার মধ্যে সুখ নাই। দেহ পাই তো মন পাই না, তখন জানো এই এত্ত বড়ো এস্টাটের কামকার্যও যেন আমার কাছে মিছা হইয়া যায়। মন পাইলে তখন দেহের সুখেরও আর সীম-পরিসীমা থাকে না। এই বিষয়টা বুঝি বলিয়াই তো আমি চাই তোমার আরও সম্মান হউক, গৌরব হউক, যে যা-ই বলুক, এই পিরকীতি এই পৃথিবীও যেন একটা মাইয়া মানুষের লাহান। ওই সমুদুর যতই কোরখো লইয়া তার কাছে আছড়াইয়া পড়ুক সে যেন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে, কিন্তু অন্তরে প্রবেশ করুক, নদীনালা হইয়া ভরিয়া তুলুক বীজ-বীর্যে চতুর্দিক, সোহাগ করিয়া সেই পুরুষের গর্বে-ঝলমল করিয়া সেই উঠবে। আমরা অপেক্ষায় থাকুম কবিয়াল, এই সমস্তর গীত-কথার মর্মে আমার তোমার সমস্ত জগৎ-সংসারের এস্টাটকে নতুন করিয়া সাজাইয়া তুলতে হইবে।

শিকদার খালের দিকে পা বাড়াইয়াও থামিয়া পড়িল : সর্দার, এইবার যাইতে হয়।

মনসব সর্দার স্মিতমুখে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। বেলাশেষের রৌদ্রে তখন বন-বনানী, খালপাড়ের নল-খাগড়া কাশবন দুলিয়া চলিতেছে, খালের স্রোতে দুমুড়ির সময় শেষ হইয়া অন্য স্রোতের সূচনা দেখা দিয়াছে।

*

2 Comments
Collapse Comments

অসাধারণ

আমি উপন্যাসটি পড়ার আগেই পড়ার জন্য আগ্রহ পোষণ করেছিলাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *