০৬. জোছনা ও জননীর গল্প-র প্রকাশনা উৎসব

জোছনা ও জননীর গল্প-র প্রকাশনা উৎসব হবে।

হুমায়ূন ভাই সাধারণত প্রকাশনা উৎসব ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। এ বইটি নিয়ে তাঁর একটু বিশেষ মায়া আছে। মাজহারের প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন।

২০০৪ সালের কথা।

ফেব্রুয়ারি বইমেলা চলছে। মেলার মধ্যেই আয়োজন করা হলো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক বিকেলে অনুষ্ঠান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি এলেন। কোনো বিশেষ অতিথি বা সভাপতি—এসব নেই। পাঁচজন বড়মাপের মানুষ বইটি নিয়ে কথা বলবেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবেন আসাদুজ্জামান নূর।

এক দিন আগে হঠাৎ করে মত বদলালেন হুমায়ূন ভাই। মাজহারকে বললেন, উপন্যাস নিয়ে অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হবেন একজন লেখক। দায়িত্বটা তিনি আমাকে দিলেন। আলোচনা শেষে মোহিনী চৌধুরী রচিত সেই বিখ্যাত গান—

মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্ৰাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজালে…

খালি গলায় গেয়ে শোনালেন শাওন। হুমায়ূন ভাইকে দেখি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদছেন। কান্নার কারণ সেই মুহুর্তে তিনি চলে গিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। সেই ভয়ংকর সময়ের কথা ভেবে তিনি কাঁদছিলেন।

এই আবেগপ্রবণ শিশুর মতো মানুষটিই আবার খোঁচাখুঁচির ওস্তাদ, মজা করার ওস্তাদ। প্রিয় মানুষজনকে খুঁচিয়ে আনন্দ পান।

তাঁর মুখ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বলি। পিএইচডি করে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের চাকরিতে ঢুকেছেন। হুমায়ূন আজাদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব। তিনি খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। ইংরেজি সাহিত্যের এক সেমিনারে নিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তিতুল্য ইংরেজির অধ্যাপক, আমি তাঁর নামটা বলছি না, তিনি বক্তৃতা করছেন। হুমায়ূন আহমেদ ভদ্রলোককে চেনেন এবং তাঁর সম্পর্কে জানেন সবই। তবু তাঁর বক্তৃতা শুনে একটু মজা করতে চাইলেন। ভদ্রলোক বক্তৃতা শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে আসার পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, স্যার, আপনার চিবিয়ে চিবিয়ে বলা ইংরেজি আমার ভালো লেগেছে।

সেই ভদ্রলোক ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এতই পস, জীবনে এ ধরনের কথা বোধ হয় শোনেনই নি। হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি একটা কাজ করুন, আমার বক্তৃতার দু-একটি বাক্য না চিবিয়ে উচ্চারণ করুন তো।

হুমায়ুন আজাদ গিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। সেখান থেকে এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। ইংরেজির অধ্যাপককে বললেন, স্যার, ও তো আমাদের হুমায়ূন আহমেদ।

ভদ্রলোক হুমায়ূন ভাইকে চিনতে পারেন নি। নাম শুনে রাগ-বিরক্তি ভুলে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, আরে, আমি তো আপনার লেখার ভক্ত।

এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গেছেন। বন্ধুপত্নী অতিযত্নে রান্নাবান্না করেছেন। বহু আইটেম। সঙ্গে আমি এবং আমাদের আরও দু-একজন বন্ধু আছেন। হুমায়ূন ভাই যা যা পছন্দ করেন, ওসবেরই আয়োজন করেছেন তিনি। বন্ধুপত্নীর রান্না তেমন সুবিধার না। তবু ভদ্রমহিলা তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে হুমায়ূন ভাই নির্বিকার গলায় বললেন, এত বাজে রান্না জীবনে খাই নি।

আমাকে একবার বললেন, তোমাদের মাওয়ার ওদিককার পদ্মায় ভালো রিঠা মাছ পাওয়া যায়। তোমার বউকে বলে আমাকে রান্না করে পাঠাতে।

মাওয়া থেকে রিঠা মাছ আনালাম। আমার স্ত্রী রান্না করে পাঠালেন। হুমায়ূন ভাই খেলেন, আমার স্ত্রীকে নিজের উপন্যাস সংকলন অটোগ্রাফ দিয়ে পাঠালেন। পরদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, রিঠা মাছটা মরা ছিল।

আমি বিস্মিত। রিঠা মাছ মরা ছিল না জ্যান্ত, এটা বোঝা বেশ কঠিন। কারণ মাছটা আনার পর আমি একপলক দেখেছিলাম। একদম তাজা এবং জ্যান্ত মনে হয়েছে। রিঠা খুবই শক্ত প্ৰাণের মাছ, দু-চার ঘণ্টায় মরে না, ভালো রকম তাজা থাকে।

আমার খটকা লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, রিঠা মাছটা জ্যান্ত ছিল না?

সে বলল, না, আনতে আনতে মরে গিয়েছিল। তবে তাজা ছিল, ফ্রেশ ছিল।

আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম। একজন মানুষ কতটা খাদ্যসচেতন হলে এটা বোঝা সম্ভব!

আমাদের যেবার তিনি কুতুবপুরে নিয়ে গেলেন, ৮৫/৮৬ সালের কথা। তাঁর বাবার নামে করা পাঠাগার উদ্বোধন। ওই যেবার হুমায়ুন আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণ রাতভর ঝগড়া করলেন, সেবারের কথা। হুমায়ূন ভাইয়ের চাচা খুবই সমাদর করেছিলেন আমাদের, চমৎকার খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল। আমরা ফিরছিলাম ট্রেনে করে। ট্রেনের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন ভাই, আমি তাঁর পাশে। মুগ্ধ গলায় বললাম, চাচা খুবই সমাদর করলেন আমাদের। ভালো খাইয়েছেন।

হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ, দেড় হাজার টাকার একটা বিলও ধরিয়ে দিয়েছেন।

তখনকার দিনে দেড় হাজার টাকা অনেক টাকা।

রাতের বেলা তাঁর অতিপ্রিয় একজনের ভাইয়ের বিয়েতে যেতে হবে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। আমরা সবাই রেডি। কিন্তু হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ইচ্ছা নেই যাওয়ার। তাঁর ইচ্ছা নিজের ফ্ল্যাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন।

সেটা সম্ভব না। যেতেই হবে।

আমরা রওনা দিলাম। অনেক রাতে। বিয়েশাদির খাওয়াদাওয়া শেষ। আমরা যাওয়ার পর নতুন করে অ্যারেঞ্জ করা হলো। খেতে শুরু করেছি। হুমায়ূন ভাই একবার মাত্র সামান্য বিরানি মুখে দিয়েই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের ধাক্কায় প্লেট সরিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বললেন, তুমি জানো না, আমি ঠান্ডা খাবার খাই না?

খাবার তেমন ঠান্ডা ছিল না, তবু তিনি রাগলেন। এই রাগটা আসলে ওই রাগ, যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না; প্ৰকাশ করলেন অন্যভাবে। আর খেলেনই না। উঠে চলে এলেন। তার সঙ্গে আমাদেরও খাওয়া হলো না।

গেণ্ডারিয়ায় আমাদের বন্ধু আলমগীর রহমানের বাড়িতে বহু বছর আগে আমরা খুব আডা দিতাম। আলমগীর ভাইয়ের স্ত্রী ঝরনা ভাবির রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আলমগীর ভাই নিজেও খুব ভালো রান্না করেন। আমরা বিকেলবেলা আড্ডা দিতে বসি! রাতের বেলা তার ওখানে খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরি। ও রকম এক বিকেলবেলা হুমায়ূন ভাই এসে বললেন, আমি একটা সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলাম, ন্যাকের লোম কাটার কথা বলে নাপিত আমার নাকে কাঁচি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। চুল না। কাটিয়েই চলে আসছি। আলমগীর, একজন নাপিত ডেকে আনান, আমি আপনার এই বারান্দায় বসে চুল কাটাবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *