৩.১৬-২০ উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেন

৩.১৬

উদ্বাস্তুদের নিয়ে স্পেশাল ট্রেনটা একটানা ছুটতে পারছে না। মাঝে মাঝেই সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এইভাবে থেমে থেমে যখন শিয়ালদায় পৌঁছল, সন্ধে পার হয়ে গেছে।

গোটা স্টেশন জুড়ে প্রচুর আলো জ্বলছে। রয়েছে বন্দুক হাতে বিরাট এক পুলিশ বাহিনী। প্যান্ট শার্ট পরা কিছু লোকজনও রয়েছে। তাদের ব্যস্ততা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে, ওঁরা সরকারি কর্মচারী। দু’চারজন নিশ্চয়ই অফিসার, বাদবাকি তাদের সহকারী।

মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল, যে সব উদ্বাস্তু এই ট্রেনে এসেছে, তাদের আশ্রয় দেবার মতো কোনও আত্মীয়স্বজন যদি কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে না থাকে, তারা যেন আপাতত শিয়ালদা স্টেশনেই থেকে যায়। গভর্নমেন্ট থেকে পরে তাদের ব্যবস্থা করা হবে।

ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনু। যাতায়াতের জন্য প্ল্যাটফর্মের সিকিভাগ ছেড়ে বাকি অংশটায় কত যে মানুষ বসে আছে তার লেখাজোখা নেই। সাত আট ফুটের মতো জায়গা ইট পেতে সীমানা ঠিক করে নিয়েছে এক একটা ফ্যামিলি। তার ভেতর গাদাগাদি করে আছে বাচ্চাকাচ্চা, স্বামী-স্ত্রী এবং ডাই-করা লটবহর। এইরকম অসংখ্য খোপ, অগুনতি পরিবার। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, ওরাও ভিটেমাটি খুইয়ে বিনুদের আগেই এখানে চলে এসেছে। শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মই এখন তাদের ঠিকানা।

বিনুর চকিতে মনে হল, আজ যারা তার সঙ্গে এই ট্রেনে এসেছে তাদের নিরানব্বই ভাগই এই স্টেশনে থেকে যাবে। কালও ট্রেন বোঝাই হয়ে আসবে, আসবে পরশুও। আসতে থাকবে দিনের পর দিন। হাজারে হাজারে। এই স্টেশনের চত্বরে কত মানুষের জায়গা হবে?

কিন্তু এসব ভাবনা ছাপিয়ে যে প্রশ্নগুলো মাথার ওপর পাষাণভারের মতো চেপে আছে তা হল, অবনীমোহন আর সুধা সুনীতিরা কি তাকে নিয়ে যাবার জন্য স্টেশনে এসেছে? তার চেয়েও দুশ্চিন্তার ব্যাপার, রামরতনের ভাইপো বিমল এসেছে কিনা।

মাইকে অনবরত একই ঘোষণা চলছিল। এই ট্রেনে যে উদ্বাস্তুরা এসেছে, তাদের যদি

পাশ থেকে হরিন্দ উদ্বেগের সুরে বলল, ছুটোবাবু, শুনলেন নি, কী কইতে আছে? আপনের দুই বইন আর বাবায় কইলকাতায় আছে। আপনের চিন্তা নাই। আমাগো এই ইস্টিশান পইড়া থাকতে হইব।

ভুবন দাসও এই কামরায় ছিল। সে বলল, কপালে কী যে আছে! তার অটুট বিশ্বাস ছিল, ইন্ডিয়ায় সবাই তাদের জন্য হাত বাড়িয়ে রেখেছে। সেখানে জমিজমা, ডোল-ভরা ধান, বাড়িঘর, ফলবাগিচা, সমস্ত সাজানো রয়েছে। তারা ভারতে এলে তাদের হাতে সেসব তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার আগেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে গেল। চরম হতাশাগ্রস্ত ভুবন দাস জোরে জোরে মাথা নাড়তে থাকে।

এখন হা-হুতাশ শোনার সময় নেই। আগে যা দরকার তা হল বিমলের খোঁজ নেওয়া, নইলে অলোকপ্রসাদ সেনের সঙ্গে দেখা করা। একবার বাঁ দিকে তাকাল বিনু। রামরতনের মৃতদেহ ঘিরে একইভাবে বসে আছেন তার স্ত্রী এবং মেয়েরা। কেউ আর কাঁদছে না। যেন চার পাথরপ্রতিমা। তাদের পাশে ঠায় বসে আছে ঝিনুক। নীরব, বিহ্বল।

বিনু উঠে দাঁড়ায়। রামরতনের স্ত্রীকে বলে, বিমলবাবু এলেন কিনা, খোঁজখবর নিয়ে আসি। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।

বৃদ্ধা উত্তর দিলেন না। আচ্ছন্নের মতো স্বামীর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন।

বিনু কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে পড়ে। চারদিকে তুমুল শোরগোল চলছে। আগে যে উদ্বাস্তুরা এসে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে বসে ছিল তারা হইচই বাধিয়ে দিয়েছে। যারা নতুন এল, তাদের কেউ ট্রেন থেকে নামেনি। কী করবে বুঝতে না পেরে অধীর হয়ে উঠেছে। প্ল্যাটফর্মে যাকেই দেখছে, পুলিশ কনস্টেবল থেকে অফিসার এবং সাধারণ স্তরের সরকারি কর্মচারী, সবাইকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছে, বাবুরা, অহন আমরা কী করুম? আর কতক্ষণ গাড়ির ভিতরে বইসা থাকুম? শরীলে আর দিতে আছে না।

অফিসাররা যেখানে রয়েছেন সেদিকে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি লোক, চল্লিশ বেয়াল্লিশের মতো বয়স, পরনে ধুতি শার্ট, প্রতিটি কামরার জানালায় মুখ বাড়িয়ে ডাকাডাকি করতে করতে আসছে।

প্রথমটা বোঝা যাচ্ছিল না, কাছাকাছি আসতে পরিষ্কার শোনা গেল, জেঠু জেঠু, বাসন্তীদিদি, মায়া–ছায়া।

বাসন্তী রামরতনের বিধবা মেয়ে। তার নাম বিনু আগেই জেনেছে। নিঃসন্দেহে এই লোকটা বিমল। রামরতনের চিঠি পেয়ে সে তাদের নিতে এসেছে।

বিনু একরকম দৌড়েই লোকটার কাছে চলে আসে। যদিও সংশয় নেই, তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করে, আপনি কি বিমলবাবু?

লোকটা অবাক দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, শ্যা। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।

চেনার কথা নয়। আমি ইস্ট পাকিস্তান থেকে এই ট্রেনটায় এসেছি। রামরতন গাঙ্গুলি নিশ্চয়ই আপনার জেঠামশাই?

আপনি জানলেন কী করে?

কিভাবে রামরতনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে এবং তাঁর মুখেই বিমলের কথা শুনেছে, ইত্যাদি জানিয়ে বিনু বলল, আপনাকে একটা খবর দেবার আছে, কিন্তু কেমন করে দেব বুঝতে পারছি না।

বিমল অধীরভাবে বলল, পরে আপনার খবর শোনা যাবে। জেঠামশাইরা যে কম্পার্টমেন্টে আছেন, আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন।

না।

মানে?

আগে আমার খরবটা আপনার শোনা দরকার।

বিমূঢ়র মতো অচেনা যুবকটির দিকে তাকিয়ে থাকে বিমল।

বিনু বিমলের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। নতমুখে বলল, খুব দুঃসংবাদ। ট্রেনে আসতে আসতে আপনার জেঠামশাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। ডেডবডি কম্পার্টমেন্টে রয়েছে। আপনি ওঁদের নিতে আসতে পারেন, তাই ট্রেন থেকে নেমে আপনার খোঁজ করছিলাম। বাসন্তীদেবীর নাম করে ডাকতেই বুঝতে পারলাম, আপনি বিমলবাবু।

বিনুর শেষ কথাগুলো যেন শুনতে পাচ্ছিল না বিমল। আকস্মিক আঘাতে শিয়ালদা স্টেশনের অজস্র আলো, অসংখ্য মানুষের শোরগোল মুহূর্তে ঝাঁপসা হয়ে যায়। টলতে টলতে পড়েই যেত, বিনু তাকে ধরে ফেলল। বলল, বিমলবাবু, ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে শক্ত রাখুন। আপনার জেঠাইমা আর বোনেরা ডেডবডি নিয়ে বসে আছে। আপনি বিচলিত হয়ে পড়লে ওদের কে সান্ত্বনা দেবে?

বিমল জবাব দিল না। বালকের মতো আকুল হয়ে কিছুক্ষণ কাদল। তারপর চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, চলুন–

যে চারটি নারী নিপ্রাণ মূর্তি হয়ে বসে ছিল, বিমলকে দেখে তারা ফের উতরোল কান্নায় ভেঙে পড়ে। সবার চোখ থেকে অবিরল জল ঝরে যায়।

কেঁদে কেঁদে গলা ভেঙে গিয়েছিল রামরতনের স্ত্রীর। বিকৃত স্বরে বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, সব শ্যাষ হইয়া গেল রে বিমল। তর জ্যাঠার শরীলটাই আইল, পরানটা রাইখা আইল উই পারে।

তিন বোন কেঁদেই চলেছে। দুর্বোধ্য, জড়ানো গলায় যা বলছে সেই হাহাকারের একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।

বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ বসে থাকে বিমল। সমানে বলতে থাকে, তুমি যদি এত অস্থির হও, আমাদের কে দেখবে? শান্ত হও জেঠিমা, শান্ত হও–

এদিকে মাইকে মুহুর্মুহু ঘোষণা হচ্ছিল, যে ছিন্নমূল মানুষদের এপারে আত্মীয়পরিজন নেই তারা ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খলভাবে যেন ট্রেন থেকে নেমে আসে।

অধর ভুইমালী আর হরিন্দ বিনুকে বলল, আমাগো ডাক আইছে ছুটোবাবু। এই জনমে আর বুঝিন আপনের লগে দেখা হইব না।

বিনু বলল, নিশ্চয়ই হবে। তোমরা তো এখন শিয়ালদা স্টেশনেই থাক। দু’চারদিন পর এসে তোমাদের দেখে যাব।

লটবহর এবং বউ-বাচ্চা নিয়ে লোকজন নেমে যেতে থাকে। ক্রমশ কামরা ফাঁকা হয়ে যায়।

হঠাৎ বিনুর খেয়াল হল, তাদের নিয়ে যাবার জন্য কেউ আসেনি। না সুধা, না সুনীতি, না অবনীমোহন। ওঁরা এলে নিশ্চয়ই কামরায় কামরায় হাঁক দিয়ে যেতেন। রাত বাড়ছে। এই বিশাল মহানগর বিনুর প্রায় অচেনা। সেই কতকাল আগে, ছেলেবেলার কয়েকটা বছর এখানে কাটিয়েছে সে। তারপর এই আসা। সেদিনের সেই শহর এতকাল বাদে কি আর তেমনটাই আছে? ঝিনুককে নিয়ে এই রাত্রিবেলা তাকে বাবা কি বোনেদের কারোর ঠিকানা খুঁজে বার করতে হবে।

বিমল স্টেশনে আসায় একটা বিরাট দুর্ভাবনা মাথা থেকে নেমে গেছে। রামরতনদের সব দায়িত্ব এখন বিমলের। এবার বিনুর মুক্তি। যা করার বিমলই করবে। তবু এই শোকাবিহূল মানুষগুলোকে ফেলে রেখে চট করে কামরা থেকে নেমে যাওয়া সম্ভব হল না।

বিনু বিমলের পিঠে হাত রাখল। সে ঘুরে তাকাতেই নিচু গলায় বলল, আমার সঙ্গে একটু আসুন। দরকার আছে। চোখের ইশারায় ঝিনুককে তারপাশায় কেনা নতুন চাদর দুটো নিয়ে উঠে আসতে বলল।

প্ল্যাটফর্মে নেমে বিমল বলল, বলুন কী দরকার?

বিনু জানায়, গত দু’তিনটে দিন চরম আতঙ্কের মধ্যে কেটে গেছে তাদের। স্নান নেই, ঘুম নেই, ভাল করে খাওয়া নেই। তার ওপর রামরতনদের দায়। শরীর ভেঙেচুরে আসছে। কলকাতায় পৌঁছেও তার উৎকণ্ঠা শেষ হয়নি। চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও কেউ তাদের নিতে আসেনি। এই রাত্রিবেলা তাকে একটা আশ্রয় খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু রামরতনের মৃতদেহের ব্যবস্থা করা এখনই প্রয়োজন। চলে যাবার আগে অলোকপ্রসাদ সেনের সঙ্গে সে বিমলের পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। অফিসারটি নিশ্চয়ই বিমলকে সাহায্য করবেন।

বিমল বলল, তা হলে তো খুব ভাল হয়। এই অবস্থায় কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।

সরকারি কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে করে অলোকপ্রসাদের খোঁজ পাওয়া গেল। তিনি প্ল্যাটফর্মেই ছিলেন। মাঝবয়সী, মাঝারি হাইট, সৌম্য চেহারা। বিনু সীমান্তের সেই অফিসারটির চিঠি তাকে দিয়ে নিজের এবং বিমলের পরিচয় দিল।

চিঠিটা পড়ার পর ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অলোকপ্রসাদ। জিজ্ঞেস করলেন, ডেডবডি কি এখনও কম্পার্টমেন্টে রয়েছে?

বিনু এবং বিমল জানায়, হ্যাঁ।

আমি এখনই সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করছি।

বিনু কুণ্ঠিত মুখে বিমলকে বলল, এ সময় আপনার পাশে থাকতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আমার সমস্যার কথা তো শুনেছেন।

বিমল আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। আপনাকে আর আটকে রাখব না।

আপনার ঠিকানা আমি জানি। জেঠাইমা আর বোনেদের বলবেন, পরে একদিন গিয়ে ওঁদের সঙ্গে দেখা করে আসব।

নিশ্চয়ই আসবেন। আমাদের যা উপকার আপনি করেছেন–

তাকে থামিয়ে দিয়ে বিনু বলল, একসঙ্গে দেশ ছেড়ে এসেছি। এটুকু তো করতেই হয়। আচ্ছা চলি। বলে আর দাঁড়াল না। ঝিনুক সঙ্গে এসেছিল। তাকে নিয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। অন্যমনস্কের মতো একবার ভাবল, রামরতনের মৃতদেহ দাহ করে কখন ওরা বাড়ি ফিরবে, কে জানে।

.

৩.১৭

প্ল্যাটফর্মের বাইরে আসতে দেখা গেল, একই দৃশ্য। বিশাল চত্বর জুড়ে থিকথিকে ভিড়। ইটের সীমানা ঘেরা আট-দশ ফুট জায়গায় এক একটা পরিবার। অগুনতি ফেস্টুন চারদিকে টাঙানো। সেগুলোতে নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের নাম। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শরণার্থীদের জন্য যে সরকারি ত্রাণব্যবস্থা করা হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। বেসরকারি অর্গানাইজেশনগুলোকেও তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে।

যেদিকে তাকানো যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। এত মানুষ ঠাসাঠাসি করে থাকলে যা হয়, তুমুল হট্টগোল, ঝগড়াঝাটি, কুৎসিত খিস্তিখেউড়।

সমস্ত এলাকাটা নরককুণ্ড। যত্রযত্র গু মুত, দলা দলা কফ, ডাঁই-করা এঁটো শালপাতা। এখানকার বাতাসে থম-ধরা স্থায়ী দুর্গন্ধ। পেট একেবারে গুলিয়ে ওঠে।

দম-আটকানো আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে পথ করে করে এগিয়ে যাচ্ছিল বিনু আর ঝিনুক। পশ্চিম দিকের শেষ মাথায় কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিকশা আর ঘোড়ার গাড়ি। বিনু ঠিক করে ফেলেছে, একটা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ভবানীপুরে অবনীমোহনের কাছে যাবে।

হঠাৎ দেখা গেল, খানিক দূরে তিন চারটে লোক এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, পাকিস্থানি টাকা পালটাবেন, পাকিস্থানি টাকা পালটাবেন–

বিনুর মনে পড়ল, তার কাছে ভারতীয় টাকা নেই। যা আছে তা হল শ’আটেক টাকার মতো পাকিস্তানি নোট আর কিছু খুচররা। এখানে সেগুলো অচল। রাজদিয়ায় থাকতেই সে শুনেছিল, শিয়ালদায় কিছু দালাল চড়া বাট্টা দিলে পাকিস্তানি টাকার বদলে ইন্ডিয়ান টাকা দেয়। ভাগ্য ভাল, দালালগুলোর চেঁচানি কানে এসেছিল। নইলে পরে ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া মেটাতে মুশকিল হত।

আটশ’ টাকা বদলে সাড়ে ছ’শ ভারতীয় টাকা পাওয়া গেল। পাকিস্তানি টাকার দাম কম। কত কম, বিনুর ধারণা নেই। দালালটা যে ঠকাল, মোটামুটি টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

টাকা পকেটে পুরে ক’পা এগিয়েছে, কে যেন নাম ধরে ব্যগ্রভাবে ডেকে উঠল, বিনু—বিনু– এই যে, এই দিকে–

এই প্রায়-অচেনা শহরের রেল স্টেশনে কে তাকে ডাকতে পারে? চমকে এধারে ওধারে তাকাতে চোখে পড়ল, ইটের বাউন্ডারি দেওয়া চৌকো একটা খোপের ভেতর থেকে একজন হাত নাড়ছে।

দেখামাত্র চিনতে পারল বিনু। পতিতপাবন। ওদের বাড়ি ছিল রাজদিয়ার লাগোয়া গ্রাম। তাজহাটিতে। রাজদিয়া স্কুলে তার সঙ্গে পড়ত। বয়সে কম করে দশ বছরের বড়। একবারে সে কখনও প্রমোশন পায়নি। দু’তিন বছর ফেল করে তবে পরের ক্লাসে উঠত। স্কুলে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মনে আছে, প্রথম যেদিন বিনু রাজদিয়া হাইস্কুলে ক্লাস করতে যায়, টিফিনের সময় পতিতপাবন বলেছিল, তাকে চালাক বানিয়ে দেবে। অর্থাৎ পাকিয়ে ছাড়বে। অবশ্য কড়া অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার আশু দত্তর জন্য তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়নি।

সেই পতিতপাবনের সঙ্গে শিয়ালদায় দেখা হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল! বিনু পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে পতিতপাবনও উঠে দাঁড়িয়েছে। বিনু লক্ষ করল, তিনটে নানা বয়সের বাচ্চা, একটি সদ্য যুবতী আর আধ ঘোমটা দেওয়া একটি বউ বসে আছে। নিশ্চয়ই পতিতপাবনের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে।

পতিতপাবন জিজ্ঞেস করল, আইজের ট্রেনে আইলা বুঝিন?

মাথা সামান্য কাত করে বিনু, হ্যাঁ। তোমরা কবে এসেছ?

মাস দুই।

সেই থেকে এখানেই আছ?

হ। আর কই যামু? এই দ্যাশের কিছুই তো চিনি না। মাঝে মইদ্যে অপিসাররা আইসা কয়, রিফুজি কেম্পে নিয়া যাইব।

কবে নেবে?

হেরাই (তারাই) জানে।

ষাট কানি দোফসলা সরেস ধানজমি ছিল পতিতপাবনদের। ছিল ঢেউ টিনের ছাউনি দেওয়া সাতাশের বন্দের বড় বড় ঘর, সাত আটটা দুধেল গাই, বাগবাগিচা, তিন চারটে দীঘির মতো পুকুর। অজস্র ধান, প্রচুর মাছ, অঢেল দুধ। তারা কিনা এই স্টেশন চত্বরে নরকের মধ্যে বসে আছে!

কথা বলতে বলতে দু’একবার ঝিনুকের দিকে তাকাচ্ছিল পতিতপাবন। কৌতূহল থাকলেও কোনও প্রশ্ন করল না।

পতিতপাবন বলল, আমাগো তাজহাটি ছাড়াও চাইর পাশের গেরামগুলা থিকা মেলা মানুষ এই পারে আইছে। তাগো অনেকেই শিয়ালদা ইস্টিশানে আছে।

বিনু বলল, তাই নাকি?

হ। টেরেনে হয়রান হইয়া আসছ। তোমারে আর আটকামু না। তোমার বাবায় আর বইনেরা তো কইলকাতায় থাকে। কার কাছে উঠবা?

রাজদিয়া এবং তার চারপাশের গ্রামগুলোর সবাই সবার নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখত। পতিতপাবনও বিনুদের কথা জানে। দেশভাগের পর ওই অঞ্চলের মানুষজন ভিটেমাটি ফেলে শত দিকে ছিটকে পড়ছে। কেউ যাচ্ছে আগরতলায়, কেউ আসামে, বেশির ভাগই অবশ্য পশ্চিম বাংলায়। একজনের সঙ্গে অন্যজনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন বাদে কেউ কাউকে মনেও রাখবে না। যারা পাশাপাশি পুরুষানুক্রমে বাস করে এসেছে তাদের মুখগুলি বিস্মৃতির আঁধারে ক্রমশ লিীন, হয়ে যাবে।

বিনু বলল, বাবার কাছে উঠব।

পতিতপাবন বলে, তভু তো তোমার এইখানে একখান জাগা (জায়গা) আছে। পোলামাইয়া বউ লইয়া আমি এক্কেরে সমুন্দুরে পড়ছি। শিয়ালদার ইস্টিশানে কুত্তা বিলাইর (বেড়াল) লাখান বাকি জনম কাইটা যাইব কিনা, ক্যাঠা জানে। কুনো আশা-ভরসা দেখি না।

একই আক্ষেপ, একই রকম শঙ্কা ভুবন দাস আর হরিন্দর। ওদের দুজনেরই বা কেন, যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সর্বস্ব খুইয়ে এপারে চলে এসেছে, ইন্ডিয়ায় যাদের আপনজন কেউ নেই, তাদের সবার একই সমস্যা।

পতিতপাবন ফের বলল, রাইত হইছে মেলা (অনেক)। যাও গা। বাবারে কইও যদিন আমার লেইগা কিছু কইরা দিতে পারেন। যাতে মাইনষের লাখান বাচতে পারি।

বিনু বলল, নিশ্চয়ই বলব। সে আর দাঁড়াল না। ঝিনুককে সঙ্গে করে যেখানে ঘোড়ার গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে চলে এল। তারা যাবে ভবানীপুরে, পূর্ণ সিনেমার কাছে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। একটা কোচোয়ানকে সে কথা জানাতে ভাড়া হাঁকল বিশ টাকা।

বিনু বুঝতে পারছে, লোকটা অনেক বেশি চাইছে। কিন্তু খিদেয়, তেষ্টায়, রাস্তার ধকলে জীবনীশক্তি ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে এসেছে। স্নায়ুগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। মাথার ভেতর হাজার ঝিঁঝি ডাকছে। লক্ষ করল, ঝিনুকও দাঁড়ািয় থাকতে পারছে না। সব কিছুর ওপর রামরতনের মৃত্যু দু’জনকে প্রচণ্ড ঝকানি দিয়ে গেছে। একটি শ্রদ্ধেয় মানুষের জীবনের অবসান কী মর্মান্তিকভাবেই না ঘটল!

ভাড়া কমানোর জন্য দর কষাকষি করল না বিনু। ঝিনুককে আগে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে উঠতে উঠতে কোচোয়ানকে বলল, চালাও। যত তাড়াতাড়ি পার পৌঁছে দেবে।

অবাঙালি মুসলমান কোচোয়ান বলল, জি, সাব– বলেই চাবুক হাঁকিয়ে গাড়ি ছোটাল।

মুহূর্তে স্টেশন চত্বর পেরিয়ে বাইরের ট্রাম রাস্তায় এল বিনুরা। ঘোড়া দুরন্ত গতিতে দৌড়চ্ছে। শক্ত পিচের রাস্তা থেকে উঠে আসছে অশ্বক্ষুরের একটানা ধ্বনি।

রাস্তার দু’ধারে উঁচু উঁচু সব বাড়ি। সারি সারি দোকানপাট। আলোয় ঝলমল করছে শহর। মাঝে মাঝে গ্যাসবাতিও চোখে পড়ছে।

এই হেমন্তে কলকাতাতেও হিম পড়ছে। নামছে কুয়াশাও। তবে পূর্ব বাংলার মতো অত ঘন হয়ে নয়। পাতলা ধবধবে রেশমের মতো। রাস্তার আলোগুলো ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে শামাপোকা পাক খাচ্ছে। বৃত্তাকারে। ঠাণ্ডাটাও এখানে অনেক কম। সামান্য শীত শীত লাগছে।

দূরে একটা বড় টাওয়ার ক্লকে আটটা বেজে চল্লিশ। এত রাতেও রাস্তায় জনারণ্য। গাড়ির স্রোত। নানারকম শব্দ। ধাবমান ট্রাম বাসের, রিকশার, ঘোড়ার গাড়ির, প্রাইভেট কারের। তা ছাড়া রয়েছে। মানুষের কোলাহল। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক চালচিত্র।

জানালার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনু। তাদের ঘোড়াটা জোর কদমে ছুটছে। গাড়ির মাথায় বসে কোচোয়ানটা মাঝে মাঝে টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে টর-র-র-র, টর-র-র-র আওয়াজ করে হাওয়ায় সাঁই সাঁই চাবুক চালিয়ে ঘোড়াটাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। দৌড়টা একই তালে চালিয়ে যেতে হবে। গতি কমালেই চাবুক।

হঠাৎ কান্নার সরু শব্দ কানে আসে বিনুর। চকিতে বাইরে থেকে মুখ ফেরাতেই সে দেখতে পায়, জানালায় মাথা রেখে ঝিনুক কাঁদছে। কান্নার হেতুটা বুঝতে না পেরে প্রথমটা হতভম্ব হয়ে যায় সে। তারপর ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উলটো দিকে মুখোমুখি বসে ছিল, দ্রুত উঠে এসে পাশে বসল। ঝিনুকের পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

ঝিনুক ধীরে ধীরে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। শিথিল গলায় বলে, আমার খুব ভয় করছে।

কিসের ভয়?

ঝিনুক উত্তর দেয় না।

বিনু নরম গলায় বলে, কোনও ভয় নেই। আমরা তো কলকাতায় চলে এসেছি। সে জানাতে চায়, নিরাপদ দূরত্বে আসার পর ভীতি বা শঙ্কার কোনও কারণই থাকতে পারে না।

অনেকক্ষণ বোঝানোর পর কান্না থামে ঝিনুকের। কিন্তু ভয়টা কেটেছে কিনা, বোঝা যায় না। উদাস মুখে, নীরবে বসে থাকে সে।

.

ট্রাম রাস্তা থেকে ডাইনে বাঁয়ে নানা অলিগলি, ফের অন্য একটা ট্রাম রাস্তা, এইভাবে পাক খেতে খেতে ঘোড়ার গাড়ি একসময় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে পৌঁছে গেল।

খুব ছেলেবেলার কটা বছর এখানেই কেটেছে বিনুর। রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বলছে। দু’ধারে বাড়িগুলোতেও প্রচুর আলো। পাড়াটা যতখানি চেনা লাগছে, তার চেয়ে ঢের বেশি অচেনা। মনে পড়ছে, অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল এখানে। এখন শুধুই বাড়ি। পাঁচ ফুট খোলা জায়গাও কোথাও পড়ে নেই।

জাতিস্মরের মতো খুঁজে খুঁজে তাদের তেতলা বাড়িটা বার করে ফেলল বিনু। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা ছাঁত করে উঠল।

পুরো বাড়িটা অন্ধকার, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই। দরজা জানালা বন্ধ। সদর দরজায় তিনটে প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে। অর্থাৎ আজ এ বাড়ির অধিবাসীটির সঙ্গে দেখা হওয়ার আদৌ কোনও সম্ভাবনা নেই।

হতশ্রান্ত বিনুর মাথা ঝিমঝিম করছিল। তবু শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু জড়ো করে পাশের বাড়িতে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, অবনীমোহন সপ্তাহ তিনেক আগে হরিদ্বার না উত্তরকাশী কোথায় যেন গেছেন। ফিরবেন তিন চার সপ্তাহ পর।

সুধারা থাকে টালিগঞ্জে। সুনীতিরা বিডন স্ট্রিটে। টালিগঞ্জে আগে কখনও যায় নি বিনু। অচেনা জায়গা। তুলনায় বিডন স্ট্রিট পরিচিত। একবার সেখানে গেছে। এলাকাটা তার মোটামুটি মনে আছে।

বিধ্বস্ত বিনু কোচোয়ানকে বিডন স্ট্রিট যাবার কথা বলতে সে জানালো, শিয়ালদা থেকে এতটা রাস্তা দৌড়ে এসে ঘোড়াটা বহুত থকে গেছে। তাকে খানিকক্ষণ জিরোতে দিতে হবে। তারপর দানাপানি খেয়ে চাঙ্গা হলে ফের সওয়ারি নিয়ে ছুটবার মতো তাকত পাবে। এত রাতে নিরীহ জানোয়ারটাকে কষ্ট দেবার ইচ্ছা ছিল না তার। নেহাত বাবুসাহেব আর বিবিজি মুশকিলে পড়েছেন, তাই তখলিফ হলেও নিয়ে যাবে। তবে এবার কেরায়া দিতে হবে তিরিশ টাকা। অর্থাৎ বিশ আর তিরিশ মিলিয়ে পঞ্চাশটা টাকা কোচোয়ানকে গুনে দিতে হবে।

না দিয়ে উপায়ই বা কী। আধ ঘন্টা বিশ্রামের পর ঘোড়াকে শুকনো ছোলা, ভেলিগুড় আর প্রচুর জল খাইয়ে আবার দৌড় শুরু হল।

.

বিডন স্ট্রিটে বিনুরা যখন সুনীতিদের বাড়ি পৌঁছল, এগারটা বেজে গেছে।

গাড়ি-বারান্দাওলা বেশ বড় বাড়ি সুনীতিদের। সামনে পেছনে বাগান। রাস্তার দিকে নিচু লোহার গেট। ঘরে ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। বাইরেও জোরালো আলো জ্বলছে। নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, রাত হলেও এখনও সবাই জেগে আছে, ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে তুলতে হত।

এ বাড়িতে আগে একবারই এসেছে বিনু। বিয়ের পর হেমনাথ আর অবনীমোহনের সঙ্গে এসে সুনীতিদের এখানে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন থেকেও গেছে।

ভাড়া মিটিয়ে ঝিনুককে নিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল বিনু। বাগানের পাশ দিয়ে সুরকির রাস্তা ধরে গাড়িবারান্দার তলায় চলে এল। এখানে শ্বেত পাথরের সাতটা সিঁড়ি। ওপরে উঠলে থামওলা চৌকোমতো বিরাট চত্বর। সেটার ডান পাশে কারুকাজ করা মস্ত দরজা।

দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। বিনু কড়া নাড়তে পাল্লা খুলে একটা বছর তিরিশের কাজের লোক, যুবকই বলা যায়, কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থাকে। প্রায় মধ্যরাতের এই আগন্তুকদের

সে নিশ্চয়ই আশা করেনি। জিজ্ঞেস করে, কাকে চাইছেন বাবু?

বিনু বলল, আনন্দময়বাবু আর ওঁর স্ত্রী আছেন?

লোকটা ঘাড় কাত করে, আছেন।

অনেকখানি স্বস্তি। আনন্দদের না পাওয়া গেলে এত রাতে হয়তো টালিগঞ্জে সুধাদের বাড়ি ছুটতে হত। বিনু বলল, ওঁদের খবর দাও। বলবে, রাজদিয়া থেকে বিনুবাবুরা এসেছে।

লোকটা কী ভেবে বলল, আপনারা ভেতরে এসে বসুন–

পুরু গদিওলা ভারী ভারী, পুরনো ডিজাইনের সোফা দিয়ে সাজানো একটা বড় বসার ঘরে বিনুদের নিয়ে এল লোকটা। তাদের বসিয়ে ওধারের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।

খানিক পরে সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। চোখের পলক পড়তে না পড়তেই ঘরে এসে ঢুকল সুনীতি, আনন্দ, আনন্দর ভাই দীপক, কমবয়সী একটা বউ এবং দুতিনটে বাচ্চা। বিনু জানে, আনন্দর দুই দাদা সরকারি অফিসার। তাদের একজন থাকেন দিল্লিতে, অন্যজন মিরাটে। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা যে যার শশুরবাড়িতে।

দীপককে চেনে বিনু। সুনীতির বিয়ের সময় বরযাত্রী হয়ে আনন্দর সঙ্গে রাজদিয়া গিয়েছিল সে। এ বাড়িতে সুনীতির বউ-ভাতেও দেখা হয়েছে। তখনও তার বিয়ে হয়নি। পরে যখন হল, নেমন্তন্নের চিঠি পাঠানো হয়েছিল। হেমনাথ ঠিক করেছিলেন, বিনুকে নিয়ে কলকাতায় আসবেন। কিন্তু হঠাৎ স্নেহলতা ধুম জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। অগত্যা কলকাতা যাত্রা বন্ধ করে দিতে হল। বউটিকে আগে না দেখলেও বিনু আন্দাজ করল, নিশ্চয়ই দীপকের স্ত্রী। সে জানে, সুনীতির একটাই ছেলে। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে রাজদিয়ায় সুখবরটা দিয়েছিল আনন্দ। বাকি বাচ্চা দুটো দীপকেরই হবে।

সবাই বিনু আর ঝিনুককে ঘিরে বসল। প্রত্যেকের চোখে মুখে অপার বিস্ময়। সুনীতি জিজ্ঞেস করল, এত রাত্তিরে তোরা কোত্থেকে এলি!

বিনু বলল, রাজদিয়া থেকে। আগে ভবনীপুরে গিয়েছিলাম। বাবা নেই। পাশের বাড়ির লোকেরা বলল, হরিদ্বার না কোথায় যেন গেছে।

বাবা আজকাল বছরের সাত আট মাস হয় হরিদ্বার, নইলে হৃষিকেশ, কি কনখল বা কন্যাকুমারী করে কাটাচ্ছে।

কেন রে?

কোনও এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছে। কলকাতায় মন বসে না। শুধু তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ায়।

বিনু স্তম্ভিত। তার বাবা এক অদ্ভুত মানুষ। পৃথিবীর অন্য সবার থেকে আলাদা। তার স্বভাবে কোনও দিনই স্থিত হয়ে বসার লক্ষণ নেই। সারা জীবন শুধু ছুটছেনই। এটা ধরছেন, সেটা ছাড়ছেন। একসময় কলেজে পড়াতেন, হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে স্টক মার্কেটে যাতায়াত শুরু করলেন। তারপর ঝোঁকের মাথায় চলে গেলেন রাজদিয়ায়। প্রচুর জমিজমা কিনে চাষবাসে মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর হঠাৎ কী খেয়াল হল, সব ফেলে কনট্রাক্টরি করতে ছুটলেন আসামে। তখন যুদ্ধের আমল। মিলিটারিদের জন্য ব্রিজ, সড়ক, হাসপাতাল বানিয়ে দেদার পয়সা করলেন। যুদ্ধ থামলে সোজা কলকাতায়।

সুধা সুনীতি দু’জনেই চিঠি লিখে বছরখানেক আগে জানিয়েছিল, অবনীমোহনের ধর্মের দিকে খুব ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। তাই বলে তিনি দীক্ষা নেবেন, তীর্থে তীর্থে পর্যটন করে বেড়াবেন, এতটা ভাবা যায়নি।

আনন্দ বলল, তোমরা আসবে, আগে জানাওনি কেন?

বিনু বলল, আপনাকে, হিরণদাকে আর বাবাকে দু’টো করে চিঠি দিয়েছি। শিয়ালদায় আপনাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

আজকাল পাকিস্তানের চিঠি পেতে তিন চার সপ্তাহ লেগে যায়। অনেক সময় পাওয়াও যায় না।

বিনু কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, কোনও বয়স্ক মহিলার ভারী গলা শোনা গেল, কথাবার্তা পরে হবে। ওরা ক্লান্ত হয়ে এসেছে। আগে হাতমুখ ধুক, খেয়ে দেয়ে সুস্থ হোক

বিনু দেখতে পেল, দরজার কাছে হেমনলিনী দাঁড়িয়ে আছেন। আনন্দর মা। বিধবা মহিলাটির চেহারায়, কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিত্ব এবং বনেদিআনার ছাপ। সুনীতির বিয়ের সময় আনন্দর বাবা বেঁচে ছিলেন। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে তিনি মারা যান।

হেমনলিনীকে আগে দু’বার দেখেছে বিনু। আনন্দর বিয়ের সময় তিনিও রাজদিয়া গিয়েছিলেন। পরে সুনীতির বউ-ভাতে কলকাতায়। সে উঠে দাঁড়াল। বললে, দুটো দিন স্নান হয়নি মাউইমা। সারা শরীর কাঠ হয়ে আছে। গায়ে মাথায় জল ঢালতে না পারলে ঘুমোতে পারব না। বলতে বলতে সে হেমনলিনীর দিকে এগিয়ে যায়। নিচু হয়ে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

হেমনলিনী আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে সস্নেহে বলেন, বেঁচে থাক বাবা, একশ’ বছর পরমায়ু হোক।

ঝিনুকও সোফা থেকে উঠে এসেছিল। রাজদিয়ায় সে হেমনলিনীকে দেখেছে। কলকাতায় সুনীতির বউভাতের সময়ও বিনুদের সঙ্গে এসেছিল। তাকে পরিষ্কার মনে আছে। তার পায়ের দিকে ঝিনুক ঝুঁকতে যাবে, হেমনলিনী দু’পা পিছিয়ে গেলেন। বললেন, থাক থাক, তুমি সোফায় গিয়ে বসো–

ঝিনুক ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকে। বিমূঢ়, বিহ্বল। ঘরের অন্য সবাই কম হতভম্ব হয়নি। বিনুর প্রণাম নিলেও ঝিনুকেরটা কেন নিলেন না, বরং দৃষ্টিকটুভাবে কেন পিছিয়ে গেলেন, বোঝা যাচ্ছে না।

মুখটা করুণ হয়ে গিয়েছিল ঝিনুকের। কয়েক পলক দাঁড়িয়ে থেকে নতচোখে ফিরে এসে বসে পড়ে।

এদিকে হেমনলিনী গলা উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগলেন, অনাথ, যতীন–শিগগির বাইরের ঘরে আয়।

একজন চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছরের বেঁটেখাটো, গোলগাল প্রৌঢ় এবং একটি লম্বা, পাতলা চেহারার যুবক বাড়ির ভেতর দিক থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে এল। হেমনলিনী মাঝবয়সীকে বললেন, অনাথ, পাকিস্তান থেকে বড় বৌমার ভাই আর ওদের ওই আত্মীয় মেয়েটি এসেছে। উনুন আর কেরাসিনের স্টোভ জ্বেলে দুটোতেই রান্না চড়িয়ে দে। এক ঘন্টার ভেতর যেন সব হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি খেয়ে ওরা শুয়ে পড়বে। দই মিষ্টি আছে?

প্রৌঢ়টি অর্থাৎ অনাথ বলল, আছে মা—

যা–

অনাথকে আগে না দেখলেও যতীনকে দেখেছে বিনুরা। সদর দরজা সেই খুলে দিয়েছিল।

অনাথ চলে গেলে হেমনলিনী যুবকটিকে বললেন, যতীন, ওরা চান করবে। কিন্তু কার্তিক মাসের হিম পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা জল রাত্তিরে মাথায় ঢাললে অসুখ করবে। রান্না চাপাবার আগে অনাথকে দিয়ে দু’বালতি গরম জল করিয়ে নিচের চান-ঘর দুটোয় দিবি।

আচ্ছা মা– যতীন আর দাঁড়াল না।

বিনু টের পাচ্ছে, এ বাড়ির বল্গা শক্ত মুঠোয় ধরে রেখেছেন হেমনলিনী, এবং প্রবল প্রতাপে সংসারটিকে তিনি চালিয়ে থাকেন। নিমেষে সুচারুভাবে তাদের জন্য সব ব্যবস্থা তিনি করে দিলেন। তবু মাথার ভেতরে কোথায় যেন একটা কাঁটা ফুটছে বিনুর। ঝিনুকের প্রণাম কেন নিলেন না তিনি? অসুস্থ, রোগা মেয়েটাকে কেন ওভাবে কষ্ট দিলেন? কিন্তু এখন এত সব ভাবাভাবির মতো মনের অবস্থা নয়। স্নায়ু ছিঁড়ে পড়ছে। স্নান খাওয়া সেরে শুয়ে পড়তে পারলে তারা বেঁচে যায়।

বিনুর হঠাৎ খেয়াল হল, একেবারে খালি হাত-পায়ে তারা চলে এসেছে। পরনের জামাকাপড় এবং তারপাশায় কেনা সেই চাদর দু’টো ছাড়া আর কিছুই নেই। সুনীতিকে বলল, বড়দি, আসার সময় পথে আমাদের সব লুট হয়ে গেছে। গায়ে তিনদিনের বাসি নোংরা জামাকাপড়। সারা শরীর ঘিনঘিন করছে। ঝিনুকের জন্যে শাড়িটাড়ি আর আমার জন্যে আনন্দদার ধুতি কি পাজামা নিয়ে আয়। স্নান করার পর পরব।

এক্ষুনি নিয়ে আসছি– সুনীতি উঠে পড়ল।

.

৩.১৮

সুনীতির শ্বশুরবাড়িতে ডাইনিং টেবল নেই। খাওয়াদাওয়া পুরোপুরি সাবেক চালে, সুতোর নকশা করা বড় বড় আসন পেতে, কাঁসার থালায়।

বসার ঘরের লাগোয়া একটা ঘরে বিনু আর ঝিনুককে খেতে বসানো হয়েছিল। পরিবেশন করছিল সুনীতি আর দীপকের বউ মাধুরী। একটা মোড়ায় বসে তদারক করেছিলেন হেমনলিনী। আনন্দ আর দীপক কাছাকাছি মেঝেতে বসে আছে। বাচ্চাগুলো অবশ্য নেই, তাদের শুতে পাঠানো হয়েছে।

সবারই পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন, তীব্র কৌতূহল এবং প্রবল উৎকণ্ঠা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেখানকার হালচাল জেনে নিচ্ছিল আনন্দরা। তাদের প্রশ্নেরই শুধু জবাব দিল না বিনু, ঝিনুককে নিয়ে কোন পরিস্থিতিতে তাকে রাজদিয়া থেকে চলে আসতে হয়েছে, পথে দু’আড়াই দিন কী কী মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে আসার জন্য স্টিমারঘাটগুলোয় আর গোয়ালন্দে স্টিমার কি ট্রেনের আশায় কিভাবে অসীম আতঙ্ক নিয়ে পড়ে আছে, তার যাবতীয় বিবরণও দিতে লাগল।

শুনতে শুনতে কখনও শিউরে উঠছে আনন্দরা, কখনও তাদের চোখেমুখে গভীর শঙ্কা ফুটে বেরুচ্ছে, কখনও বা গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অস্ফুট, কাতর শব্দ।

আনন্দ বিষাদের সুরে বলল, পার্টিশান সমস্ত কিছু শেষ করে দিল। মনে হচ্ছে, ওপার থেকে উদ্বাস্তু আসা থামবে না, দিনকে দিন বেড়েই যাবে।

বিনু বলল, আমার সেই রকমই ধারণা। যা দেখে এলাম, অল্প দিনের মধ্যে ইস্ট পাকিস্তান ফাঁকা হয়ে যাবে।

হেমনলিনী জিজ্ঞেস করলেন, ওখানকার অবস্থা যখন এইরকম, হেমনাথবাবু থেকে গেলেন কেন?

বিনু বলল, অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু কোনও কথাই শোনেননি। বলেছেন, জন্মভূমি ছেড়ে তিনি ইন্ডিয়ায় আসবেন না। এতে যা হবার তোক।

খাওয়া হয়ে গেলে বিনু আর ঝিনুককে নিয়ে ফের বসার ঘরে এলেন হেমনলিনী। আনন্দরাও সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল।

হেমনলিনী দীপক আর মাধুরীকে বললেন, দীপু, ছোট বৌমা, তোমরা যতীনকে দিয়ে একতলার পুব দিকের ঘরে ঝিনুকের জন্যে বিছানা করে দেবে। আর বিনুর বিছানা হবে দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরে। নতুন চাদর পেতে দিতে বলবে। কার্তিক মাস পড়তেই মশা আসতে শুরু করেছে। মশারি যেন টাঙানো হয়। বিনুদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তোমরা এখন আর এখানে এস না।

মাধুরী আর দীপক চলে যায়।

বিনু হেমনলিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন। মহিলার আদর আপ্যায়ন এবং যত্নে কোনও রকম ত্রুটি নেই। কিন্তু ঝিনুকের ব্যাপারে কোথায় যেন খিচ থেকে যাচ্ছে। এত বড় বাড়িতে দোতলায় নিশ্চয়ই ঘরের অভাব নেই। তবু ঝিনুকের বিছানা নিচে করা হবে কেন?

হেমনলিনী বিনুকে বললেন, অবনীমোহনবাবু যতদিন তীর্থ সেরে ফিরে না আসছেন, তোমরা আমাদের এখানেই থাকো। তবে–

বিনু জিজ্ঞেস করল, তবে কী?

তার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পাননি হেমনলিনী। ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ মা, তোমাকে আমি এমন একটা কথা বলব যাতে দুঃখ পাবে, কিন্তু না বলেও পারছি না। শুনেছি ঢাকায় গিয়ে তুমি রায়টের মধ্যে পড়েছিলে, গুণ্ডারা কদিন তোমাকে আটকে রেখেছিল। খবরটা শোনার পর খুব কষ্ট হয়েছিল। জানি তোমার কোনও অপরাধ নেই, তুমি নির্দোষ। কিন্তু আমি পুরনো দিনের মানুষ। নানা সংস্কারে আটকে আছি। এই বয়েসে সে সব কাটানো সম্ভব নয়। একটু থেমে বললেন, যে কদিন আছ, একতলাতেই থাকবে। দোতলায় আমাদের ঠাকুর ঘর। তুমি ওপরে না উঠলেই ভাল হয়।

লাঞ্ছিত ঝিনুকের ধর্ষণের খবর তা হলে কলকাতাতেও পৌঁছে গেছে? হতচকিত বিনু গলার শিরা ছিঁড়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু কেউ যেন লোহার আঙুল দিয়ে তার কণ্ঠনালী টিপে ধরেছে। গোঙানির মতো একটা ক্ষীণ আওয়াজ বেরিয়ে এল শুধু।

বিনুর মাথার ভেতর হঠাৎ অবিরাম একটা আগুনের চাকা ঘুরে যেতে লাগল। কেন হেমনলিনী ঝিনুককে পা ছুঁতে দেননি, কেন তার নিচে থাকার ব্যবস্থা, এবার স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তে নিদারুণ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কী আতঙ্কের মধ্যে ঝিনুককে সঙ্গে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের এপারে এসেছে, শুধু সে-ই জানে। ভেবেছিল, সব উৎকণ্ঠা সব ত্রাসের অবসান ঘটে গেছে। ভেবেছিল, এখানে এলেই অফুরান সহানুভূতিতে ঝিনুককে সবাই কাছে টেনে নেবে, ভুলিয়ে দেবে তার জীবনের চরম দুর্ঘটনার স্মৃতি। কিন্তু কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিজনের কাছ থেকে মর্মান্তিক আঘাতটা এল। হয়তো অবনীমোহনও ঝিনুককে গ্রহণ করবেন না, সুধারাও মুখ ফিরিয়ে থাকবে। অন্য আত্মীয়স্বজনেরাও ধারে কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু কে কী করল, কে কী করবে, তা নিয়ে ভাববে বিনু। শত হাতে ঝিনুককে আগলে রাখবে। আজ থেকেই তার অন্য এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি।

কখন হেমনলিনী ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, খেয়াল করেনি বিনু। সে দেখল, ডান পাশের বড় সোফায় নতমুখে বসে আছে সুনীতি আর আনন্দ। ছাইবর্ণ মুখ। বিনুর চোখ বাঁ দিকে ঘুরে গেল। সেখানে প্রিয় নারীটি অঝোরে কেঁদে চলেছে।

ঝিনুককে দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা উথলপিথল হয়ে যায়। বড় মায়ায় বিনু তার কাঁধে একটা হাত রাখে।

.

৩.১৯

হেমনলিনী যে অত্যন্ত কড়া ধাতের মহিলা, প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সুনীতিদের সংসারের লাগামটি শক্ত মুঠোয় ধরে আছেন, তা আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল। তার কথাই এ বাড়িতে শেষ কথা। তার মুখের ওপর টু শব্দটি করার দুঃসাহস এই প্রাচীন, বনেদি পরিবারের কারোর নেই। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, মুখ বুজে সবাইকে তা মেনে নিতে হয়।

হেমনলিনী বলেছেন, বিনু রাতে দোতলায় শোবে, কিন্তু ঝিনুক থাকবে একতলার এক কোণে, যতটা সম্ভব এখানকার সমস্ত কিছুর স্পর্শ বাঁচিয়ে। বিনু পুরুষমানুষ, তার ওপর ঘনিষ্ঠ কুটুম। তার কথা আলাদা। কিন্তু অনাত্মীয়, ধর্ষিতা একটি তরুণীকে কোনওভাবেই দোতলায় নিয়ে যাওয়া যায় না, কেননা সেখানে রয়েছে ঠাকুর ঘর। ঝিনুক গেলে ওখানকার পবিত্রতা নষ্ট হবে, এই বংশের মুখে চুনকালি লাগবে।

হেমনলিনীর হুকুমমতো যতীনকে দিয়ে বিছানা পাতিয়ে মাধুরী বাইরের ঘরে এল। নিচু, বিষাদমাখা গলায় বলল, অনেক রাত হল। মা সবাইকে শুয়ে পড়তে বলেছেন। বলতে বলতে তার চোখ ঝিনুকের দিকে চলে যাচ্ছিল। মেয়েটাকে অচ্ছুতদের মতো আলাদা করে দুরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। সে জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল মাধুরীর।

অনেকক্ষণ অঝোরে কান্নার পর চুপ করে গিয়েছিল ঝিনুক। বসে আছে নতচোখে। অসাড় এবং নিস্পন্দ। রক্তিম দুই চোখ টস টস করছে। শুধু গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে যাচ্ছে অবিরল।

সুনীতি বিনু আর আনন্দ, সকলেই স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। বিনুর একটা হাত আলগাভাবে ঝিনুকের কাঁধের ওপর পড়ে আছে। তার ছোঁয়ায় ঝিনুক কতটা ভরসা পেয়েছে, পেয়েছে নতুন করে নিদারুণ আঘাত সইবার মতো কতখানি শক্তি, সে জানে না। এ বাড়িতে আদর যত্নের তিলমাত্র ত্রুটি হয় নি। হেমনলিনী কাছে বসে কোমল সুরে কথা বলতে বলতে ঝিনুককে খাইয়েছেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল অপার সহানুভূতিতে আর্দ্র। কিন্তু স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, ঝিনুকের মতো মেয়েদের জন্য দুঃখ বা সমবেদনা প্রকাশ করা যায়, কিন্তু সবই দূর থেকে। হেমনলিনী তার আর এ বাড়ির মাঝখানে তুলে দিয়েছেন অদৃশ্য একটা দেওয়াল–অনেক উঁচু, প্রায় আকাশস্পর্শী। সেটা ভেদ করে আনন্দ সুনীতি বা অন্য কেউ গভীর মমতায় ঝিনুককে কাছে টেনে নেবে, সাধ্য কী। নেহাত কুটুমের সঙ্গে মেয়েটা চলে এসেছে, তাই খাতির করা হচ্ছে, নইলে ঝিনুক এখানে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।

আস্তে আস্তে, ক্লান্তভাবে সোফা থেকে নিজেদের টেনে তোলে আনন্দরা। খানিক আগে যা ঘটে গেছে, যেভাবে চাঁছাছোলা ভাষায় হেমনলিনী ঝিনুককে এখানে থাকার মূল শর্তগুলো জানিয়ে দিয়েছেন, তাতে লজ্জায় সবার মাথা কাটা যাচ্ছিল। আনন্দর মনে হয়েছে, ওভাবে দুঃখী মেয়েটাকে আঘাত দেওয়া চরম নিষ্ঠুরতা।

সুনীতি ভয়ে ভয়ে মাধুরীকে জিজ্ঞেস করে, নতুন জায়গা। ঝিনুক কি একা শোবে? মা কী বললেন?

অর্থাৎ এ বাড়িতে কে কী করবে, কে কিভাবে চলবে, সব ঠিক করে দেবেন হেমনলিনী। পরিবারের সকলের জন্য তিনি যে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার বেড়াজাল তৈরি করে দিয়েছেন, তার বাইরে পা বাড়াবার কথা কেউ ভাবতে পারে না। রাতে ঝিনুকের কাছে কেউ থাকবে কিনা, সেটাও তার বিবেচনার ওপর নির্ভর করছে।

মাধুরী বলল, একা থাকবে কেন? মা দুলালীকে ঝিনুকের ঘরে থাকতে বলেছেন।

হেমনলিনীর সব দিকে নজর। ঝিনুক যখন এসেই পড়েছে, তার যাতে এতটুকু অযত্ন না হয়, কেউ যেন মনে না করে তাকে হেলাফেলা করে একধারে ফেলে রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি খুবই সচেতন। ঝিনুক যাতে অচেনা জায়গায় একা একা শুতে ভয় পায়, তাই একজনকে তার কাছে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

আনন্দ বলল, চল–

বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে একতলার কোণের দিকের ঘরটিতে ঝিনুককে নিয়ে চলে এল সবাই। দু’টো বিছানা পাতা রয়েছে এখানে। একটা মেহগনি কাঠের মকরমুখি খাটে, অন্যটা মেঝেতে। খাটের বিছানাটা ধবধবে, নিভাজ। ছত্রিতে নেটের নীলচে মশারি খাঁটিয়ে বিছানার চারধারে পরিপাটি করে গুঁজে দেওয়া রয়েছে। শিয়রের কাছে নিচু সাইড টেবলে ঢাকা-দেওয়া কাঁচের গেলাসভর্তি জল।

নিচের সাদামাঠা বিছানায় একটি মেয়েমানুষ বসে ছিল। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। শক্তপোক্ত, নিরেট চেহারা। পরনে লাল তাঁতের খাপী ডুরে শাড়ি আর ক্যাটকেটে নীল ব্লাউজ। নাকে সবুজ পাথর বসানো নাকফুল আর হাতে রুপোর মোটা রুলি, গলায় রুপোরই বিছে হার। বোঝা যায়, সে দুলালী এবং এ বাড়ির কাজের মেয়ে।

আনন্দদের দেখে শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় দুলালী। ঝিনুককে দেখিয়ে সুনীতি তাকে বলে, এই দিদি রইল। মড়ার মতো ঘুমিয়ে থেকো না। ওর কখন কী দরকার হয়, একটু খেয়াল রেখো।

রাখব বৌদিদি। মা আমারে সমস্ত বলে দেছে। দুলালী বলতে লাগল, আপনি নিশ্চিন্তি থাকুন।

এ বাড়ির কাজের লোকেরা হেমনলিনীকে মা’ বলে। সুনীতি দুলালীকে আর কিছু বলল না। ঝিনুকের একটা হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এসে, মশারির সামনের দিকটা একটুখানি তুলে বলল, ওঠ–

ঝিনুক উত্তর দেয় না। একদৃষ্টে কয়েক পলক বিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দু’চোখে কী যে কষ্ট, কত যে যাতনা, লজ্জা আর সুতীব্র অভিমান! বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে সেসব যেন উঠে এসেছে।

ঝিনুকের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না বিনু। বোনের শ্বশুর বাড়িতে এসে মেয়েটার যে চূড়ান্ত অসম্মান আর লাঞ্ছনা হল তার সবটুকু দায় যেন বিনুর। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি, আদরযত্নের আড়ালে এ বাড়িতে ঝিনুকের জন্য অপেক্ষা করছে কী নিদারুণ নির্যাতন। অসহ্য এবং বেদনাময়। কত প্রত্যাশা আর ব্যাকুলতা নিয়ে এখানে ছুটে এসেছিল! তার বিশ্বাস ছিল, ঘনিষ্ঠ পরিজনেরা দু’হাত বাড়িয়ে ঝিনুককে বুকে জড়িয়ে নেবে, জীবনের দগদগে ক্ষতে স্নিগ্ধ প্রলেপ লাগিয়ে জুড়িয়ে দেবে যাবতীয় যন্ত্রণা, ভুলিয়ে দেবে এই সেদিনের যত মর্মান্তিক স্মৃতি। কিন্তু কী ভেবেছিল বিনু আর কী ঘটে গেল! কলকাতায় পা দিয়ে অভ্যর্থনাটা ভালই হল ঝিনুকের। এর জন্য শতভাগের একভাগও দায়ী নয় বিনু, তবু সীমাহীন অপরাধবোধ তার সর্বাঙ্গে অবিরত শেল বিঁধিয়ে চলেছে।

সুনীতি মশারি তুলে ধরায় যে ফোকরটুকু হয়েছিল, তার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে বিছানায় ঢুকে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ঝিনুক। এদিক থেকে তার মুখ আর দেখা যায় না।

মশারিটা ফের সযত্নে তোষকের তলায় গুঁজে দিয়ে, দুলালীকে ঝিনুক সম্পর্কে আরও একবার সতর্ক করে সুনীতি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে মাধুরী বিনু আর আনন্দ।

টানা বারান্দার শেষ মাথায় এসে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল সবাই। এখানেও নিচের তলার মতোই লম্বা বারান্দা, উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। সেটার একপাশে পর পর শোবার ঘর। মোট ছ’খানা। আরেক দিকে কোমর-সমান উঁচু নকশা করা লোহার রেলিং, যার মাথায় পাঁচ ইঞ্চি পুরু বর্মা টিকের ছাউনি। ব্রহ্মদেশের এই দামী কাঠ এতই চকচকে যেন আলো ঠিকরে পড়ছে।

এ বাড়ির লোকজনদের শোবার ঘরগুলো দোতলাতেই। মাধুরীকে তার ঘরে পাঠিয়ে আনন্দ এবং বিনুকে নিয়ে দক্ষিণ দিকের শেষ বেডরুমটায় এল সুনীতি।

দেওয়ালে ল্যাম্প শেডের ভেতর আলো জ্বলছিল। স্নিগ্ধ ছটা ছড়িয়ে পড়েছে বিশাল ঘরখানায়। শ্বেত পাথরের ধবধবে মেঝে। দুই দেওয়ালে বিরাট জোড়া জানালায় খড়খড়ি আর রনি কাঁচ বসানো পাল্লা।

ঘরের মাঝখানে কারুকাজ করা প্রকান্ড খাটে বিছানা পেতে মশারি খটিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সেকেলে দামী দামী আসবাব। আলমারি, দেরাজওলা চেয়ার টেবল, কুশন, ড্রেসিং টেবল। একধারে উঁচু স্ট্যান্ডের মাথায় জি ই সি কোম্পানির মস্ত রেডিও।

আনন্দ ভারী গলায় ডাকল, বিনু–

বিনু অন্যমনস্ক ছিল। ঝিনুকের মুখটা বার বার তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে। এ বাড়িতেই মাত্র কয়েক ফুট নিচে সে আছে। তবু মনে হয়, ধরাছোঁয়ার বাইরে সহস্র যোজন দূরে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন হেমনলিনী।

আনন্দর ডাকে চমকে উঠে বিনু সাড়া দিল, কিছু বলবেন?

পৃথিবীর সব অপরাধের গুরুভার নিজের মাথায় চাপিয়ে কুণ্ঠিতভাবে আনন্দ বলে, মায়ের ওপর রাগ করে থেকো না। সেকেলে মানুষ–

বিনু চুপ করে রইল।

আনন্দ কুণ্ঠিতভাবে এবার বলে, ঝিনুকের ওপর ভীষণ অন্যায় হল। কিন্তু মাকে–কথা অসমাপ্ত রেখে থেমে গেল সে।

হঠাৎ মাথায় আগুন ধরে যায় বিনুর। বিষবাষ্পে-ভরা এক নিদারুণ ভুখন্ড পেরিয়ে কী নিদারুণ আতঙ্কে আর উৎকণ্ঠায় ঝিনুককে আগলে আগলে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছে, শুধু সে-ই জানে। সবই বলেছে বিনু, কিছুই গোপন করে নি। সেই মর্মান্তিক বিবরণ শোনার পরও হেমনলিনী যা করলেন তার বিরুদ্ধে কেউ একটা আঙুল পর্যন্ত তুলল না। বিনুর যাবায় ক্ষোভ আনন্দর ওপর। পুতুলের মতো সে বসে রইল। একবারও বলল না, মা, তুমি যা করছ সেটা ঠিক নয়। একেবারে মেরুদন্ডহীন। ভীরু। কাপুরুষ।

অসহ্য রাগ শিরাস্নায়ু চুরমার করে ফেটে পড়তে চাইছিল। সেকেলে মানুষ’ বলে মার সম্বন্ধে সাফাই গাইছে আনন্দ। ছিঃ! মনে মনে হাজার বার আনন্দকে ধিক্কার দিয়ে, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখল বিনু। চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল তার। ঠাণ্ডা গলায় শুধু বলল, ঠিক আছে।

বিনুর একটা হাত ধরে বিমর্ষ মুখে সুনীতি বলে, ভেবেছিলাম, রাত্তিরে ঝিনুকের কাছে শোব। কিন্তু–

সুনীতি যা বলল না তা খুবই স্পষ্ট। হেমনলিনীর জন্য স্বাধীনভাবে, নিজের বিবেকের নির্দেশে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এ বাড়িতে। একটি ধর্ষিতা মেয়ের পাশে এক বিছানায় বনেদি পরিবারের কুলবধু রাত কাটাবে, হেমনলিনী প্রাণ থাকতে তা হতে দেবেন না।

দিদির ওপরও কম রাগ হচ্ছিল না বিনুর। পরক্ষণে খেয়াল হল, ছেলেই যেখানে মায়ের সামনে কুঁকড়ে থাকে, পুত্রবধু কতটুকু আর কী করতে পারে? দিদির কথার সে উত্তর ছিল না।

সুনীতি বলল, নে, এবার শুয়ে পড়—

বিনু বলল, তোরা যা, আমি একটু পরে শুচ্ছি–

ক’দিন রাস্তায় খুব ধকল গেছে। বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকিস না। সুনীতিরা ঘরের দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে চলে গেল।

কপালের দু’পাশের রগগুলো সমানে দপ দপ করছে। ঝিনুকের কথা যত ভাবছিল, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীরে তীব্র অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছিল।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে বিনু। তারপর পায়ে পায়ে দক্ষিণ দিকের জোড়া জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। খড়খড়ি এবং কাঁচের পাল্লা, দুটোই খোলা রয়েছে।

এখন প্রায় মাঝরাত। চারদিক নিঝুম হয়ে গেছে। রাস্তায় লোক চোখে পড়ে না বললেই হয়। কচিৎ দু’একটা রিকশা ঠন ঠন আওয়াজ তুলে ঢিমে চালে চলে যাচ্ছে। সিটে সাওয়ারিরা হেলে, ত্রিভঙ্গ হয়ে বসে আছে। ওরা সবাই নেশায় চুর। তাদের জড়ানো কণ্ঠস্বর থেকে অস্পষ্ট প্রলাপ, কিংবা দু’চার কলি অশ্লীল গান ভেসে আসছে। তিনটে ঘোড়ার গাড়িও পিচের রাস্তায় খট খট আওয়াজ তুলে চলে গেল। এই তিন যানের আরোহীরাও কেউ স্বাভাবিক নয়। কলকাতা যে মধ্যরাতে মাতালদের দখলে চলে যায়, বিনু জানত না।

রাস্তায় অনেকখানি দূরে দূরে গ্যাসের বাতিগুলো এক পায়ে দাঁড়িয়ে ম্যাড়মেড়ে, ঘোলাটে আলো বিতরণ করে চলেছে। সেগুলোকে ঘিরে কঁক বেঁধে ঘুরছে শামা পোকারা। চক্রাকারে, ক্লান্তিহীন।

কাল পরশু, দু’দিন পারাপারহীন নদীতে ভাসতে ভাসতে মাথার ওপর দিগদিগন্ত জুড়ে যে বিশাল আকাশ ব্যাপ্ত হয়ে ছিল, কলকাতার এক প্রাচীন বাড়ির জানালা দিয়ে সেটা এখন কত ছোট দেখাচ্ছে। ছোট এবং চৌকো। ওপার বাংলায় গভীর কুয়াশা মহাবিশ্বকে মুড়ে রেখেছিল। এখানেও কুয়াশা আছে, কিন্তু অত গাঢ় নয়। ফলে আবছাভাবে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চাঁদটিকে দেখা যাচ্ছে। আকাশময় ছড়িয়ে আছে নিষ্প্রভ তারার মেলা।

চোখের সামনে এত কিছু-চওড়া রাস্তা, চারদিকের বাগানঘেরা বড় বড় বাড়ি, সেগুলোর জমকালো স্থাপত্য, আকাশ, চাঁদ, গ্যাসলাইটের রহস্যময় আলো, কিন্তু সমস্ত আড়াল করে বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে একটি করুণ, কাতর মুখ স্থির হয়ে আছে। ঝিনুক।

হেমনলিনী যখন খাওয়াদাওয়ার পর ঝিনুকের ব্যাপারে হুকুমনামা জারি করলেন, মনে মনে বিনু প্রতিজ্ঞা করেছিল, ঝিনুককে দু’হাতে আগলে রাখবে। যতক্ষণ শ্বাসবায়ু বইছে, চিরদুঃখী এই মেয়েটার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু হেমন্তের এই বিজন মধ্যরাতে, চারদিক যখন অপার নৈঃশব্দে ছেয়ে আছে, তার শপথের ভিত ক্রমশ টলে যেতে থাকে।

দিদির শ্বশুরবাড়িতে, দম-আটকানো আবহাওয়ায় বিনুর আর একটি মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করছে না। সে নিশ্চিত, ঝিনুকও এত অসম্মান আর গ্লানি মাথায় নিয়ে এখানে থাকতে চাইবে না। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবে তাকে? অবনীমোহন কলকাতায় থাকলেও না হয় কথা ছিল। ঝিনুককে দেখলে তিনি কী করতেন, কী বলতেন, অসীম মমতায় তাকে কাছে টেনে নিতেন, নাকি তীব্র ঘৃণায় আবর্জনার মতো দূরে ছুঁড়ে ফেলতেন, কিছুই অনুমান করতে পারে না বিনু। তবে তার ধারণা, হেমনলিনীর মতো এতটা নির্দয় তিনি কোনওভাবেই হতেন না।

রাজদিয়ায় থাকার সময় ক’টা বছর অবনীমোহন ঝিনুককে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তিনি জানেন, জন্মের পর থেকেই জগৎ সংসারের শত কোটি দুঃখ এই মেয়েটার পায়ে পায়ে ঘুরছে। অসহায় ঝিনুকের প্রতি তার আর সুরমার ছিল কত যে মায়া!

অবনীমোহন কলকাতায় থাকলে ঝিনুকের ব্যাপারে হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। কিন্তু তীর্থস্থানে গুরুর সান্নিধ্যে আরও কতদিন থাকবেন তার ঠিক নেই। কবে ফিরবেন, কে জানে।

বিনু আর ভাবতে পারছিল না। নিবিড় হতাশা চারপাশ থেকে তাকে গ্রাস করে ফেলছিল।

জানালা দিয়ে হেমন্তের হিমবাতাস ঘরে ঢুকছিল হু হু করে। দুশ্চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল বিনু, টের পায় নি। আসলে শরীরের অনুভূতিগুলো কেমন অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এখন মনে হল, ঠান্ডায় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। জানালার পাল্লা টেনে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে এল। গাঢ় ঘুম অঝোরে তার শিরায় স্নায়ুতে ঝরে পড়তে লাগল।

.

৩.২০

অনেকক্ষণ ধরে আবছাভাবে রিকশার ঠুন ঠুন এবং অন্যান্য গাড়িঘোড়ার ছোটাছুটির আওয়াজ কানে আসছিল। তারই ভেতর কে যেন তার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে, বিনু-বিনুবিনু’

ঘুমঘোরে প্রথমটা বুঝতে পারছিল না বিনু। পরে কণ্ঠস্বরটি আরেকটু স্পষ্ট হলে ধড়মড় করে উঠে বসল। চোখে পড়ল, খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সুনীতি।

মশারি তুলে বাইরে বেরিয়ে এল বিনু। সুনীতি বলল, অনেক বেলা হয়ে গেছে। মুখ টুখ ধুয়ে নে–

কাল রাতে একদিকের জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল বিনু। অন্যটার পাল্লা আটকাবার কথা খেয়াল ছিল না। খোলা জানালাটা দিয়ে হেমন্তের টলটলে মায়াবী রোদ এসে পড়েছে ঘরে। রাস্তায় এখন। প্রচুর লোকজন। হুস হাস ছুটে যাচ্ছে বাস, প্রাইভেট কার, খবরের কাগজের ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি। কর্পোরেশনের লোকেরা কখন এসে হোস পাইপ দিয়ে জল ছিটিয়ে রাস্তা ধুয়ে দিয়ে গেছে, কখন। নিবিয়েছে গ্যাসের আলো, জানতে পারে নি বিনু।

সুনীতি বলল, চানঘরে তোর আনন্দদার কাচানো পাজামা পাঞ্জাবি, তোয়ালে, দাঁতের মাজন, নতুন ব্লেড, সব রেখে এসেছি। তাড়াতাড়ি দাড়ি কামিয়ে, মুখ ধুয়ে আয়। বাসি জামাকাপড় ওখানেই একধারে রেখে দিস।

কাল রাতেও সুনীতি আনন্দর এক প্রস্থ পাজামা পাঞ্জাবি দিয়েছিল। সেগুলোই এখন বিনুর পরনে। পরশু রাতে আদিঅন্তহীন নদীর ওপর দিয়ে রাজেকের নৌকোয় আসার সময় হানাদারেরা তাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। এক জামাকাপড়ে তারা কলকাতায় চলে এসেছে। আনন্দ আর সুনীতির পাজামা শাড়ি টাড়ি দিয়ে আপাতত তাদের কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে।

সুনীতি ফের বলল, তোর আনন্দদা আজ আর অফিসে যাবে না। বেলায় দোকান খুললে তোকে নিয়ে তোর আর ঝিনুকের শাড়ি ধুতিটুতি কিনতে বেরুবে।

আনন্দর বাবার অ্যাডভোকেট হিসেবে ছিল প্রচুর নামডাক, বিপুল পশার। তার ইচ্ছা ছিল, বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাবেন। তার বড় বড় ক্লায়েন্টগুলো আনন্দ পাবে। কিন্তু ওকালতি করতে হলে যে পাচোয়া বুদ্ধি দরকার তা আনন্দর নেই। কালো কোট পরে বাবার পেছন পেছন কিছুদিন সে কোর্টে যাতায়াত করেছে। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওকালতির ইতি। কালো কোট খুলে রেখে একটা বিরাট ব্রিটিশ মার্কেন্টাইল ফার্মে ভাল চাকরি নিয়েছে। বিনুদের জন্য আজ তাকে অফিস কামাই করতে হবে।

মালপত্র খোয়া গেলেও বেশ কিছু টাকা এখনও বিনুর কাছে আছে। কাল শিয়ালদায় পাকিস্তানি নোটগুলো পালটে সে ভারতীয় টাকা করে নিয়েছিল। ক’টা জামাকাপড় সে অবশ্যই কিনে নিতে পারে, কিন্তু তা বললে আনন্দরা খুবই অসন্তুষ্ট হবে। বিনু আপত্তি করল না। নতুন পোশাক আশাকের ভাবনা নয়, তার মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরি থেকে হঠাৎ ঝিনুকের চিন্তাটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কেন যে তার কথা মনে পড়ে নি! সে নিজে তো গাঢ় ঘুমে কালকের রাতটা কাবার করে দিয়েছে, কিন্তু ঝিনুকের কেমন কেটেছে? কাল নিঃশব্দে বিছানায় ওঠার আগে যেভাবে সে তার দিকে তাকিয়েছিল তার মধ্যে ছিল যাবতীয় ক্ষোভ, দুঃখ আর অসম্মানের গ্লানি। বুকের ভেতরটা নতুন করে দুলে ওঠে বিনুর। একরাশ উদ্বেগ মাথায় নিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ঝিনুক উঠেছে?

সুনীতি মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

ও এখন কোথায়?

নিচের সেই ঘরেই আছে। আর দেরি করিস না। যা– ভাইকে তাড়া দিয়ে ডান পাশের দেওয়ালে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা দেখিয়ে দেয় সুনীতি।

মিনিট পনের কুড়ি বাদে চানঘর থেকে বেরিয়ে বিনু দেখতে পেল, সুনীতি চলে যায় নি। বিছানা এখন ফিটফাট, মশারির চারধার ছত্রির মাথায় চাঁদোয়ার ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে। মনে হল, কাজের লোকদের দিয়ে নয়, নিজের হাতেই সব গুছিয়ে গাছিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে সুনীতি।

বিনু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই এখনও যাস নি?

এক পলক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় সুনীতি। ফের তাকায়। খুবই কুণ্ঠিত। কেমন একটা ইতস্তত ভাব। দ্বিধা কাটিয়ে, থেমে থেমে একসময় বলল, তোর সঙ্গে কথা আছে।

সুনীতির বলার ধরনে কিসের যেন অনুরণন। চাপা ভয়ের কী? নাকি দুশ্চিন্তার? সতর্ক হল বিনু, কী কথা?

হাত তুলে ইশারায় বিনুকে চুপ থাকতে বলে সুনীতি। চট করে ভোলা দরজা অব্দি গিয়ে মুখ বাড়িয়ে ভেতর দিকে ঢালা বারান্দার এপাশ ওপাশ খুঁটিয়ে দেখে ফিরে আসে। গলা নামিয়ে বলে, আমার শাশুড়ি কেমন মানুষ, কাল নিশ্চয়ই টের পেয়েছিস। নেহাত তোর সঙ্গে এসেছে, তাই ঝিনুককে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিল। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে সমানে গজ গজ করে চলেছে।

বুকের ভেতরটা আচমকা হিম হয়ে যায় বিনুর। জিজ্ঞেস করে, কী বলছেন উনি?

সোজাসুজি ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায় সুনীতি, বুঝতে পারছিস না?

না বোঝার কারণ নেই। বিনু বলে, উনিই তো কাল বললেন, যতদিন বাবা না ফিরে আসছে, আমরা যেন এ বাড়িতে থেকে যাই।

ওটা না বললে খারাপ দেখায় তাই বলেছে। আসলে মোটেও চাইছে না, ঝিনুক এখানে থাকুক। কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা, ওর ওপর এতটুকু করুণা নেই।

কিন্তু—

কী?

বাবা না ফেরা পর্যন্ত ঝিনুককে নিয়ে আমি কোথায় যাব?

সেটা ভেবেছি। তোর আনন্দদার সঙ্গে এই নিয়ে কাল রাত্তিরে কথাও হয়েছে। আজই তুই সুধা আর হিরণের সঙ্গে দেখা করবি। হিরণ জন্ম থেকে ঝিনুককে দেখে আসছে। নিশ্চয়ই ওরা তোকে ফেরাবে না।

রাজদিয়ায় থাকতে হিরণকে দাদা বলত সুনীতি। সুধার সঙ্গে বিয়ের পর নাম ধরে ডাকে। সম্পর্কে সে বড় শালী, গুরুজন। নাম ধরে ডাকার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। সেটা প্রতিষ্ঠাও সে করেছে। হিরণ নতমস্তকে তা মেনেও নিয়েছে।

বিনু বলল, শুনেছিলাম হিরণদা পাকিস্তান থেকে তার ঠাকুরদা আর জেঠিমাকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছে। ছোটদির দাদাশ্বশুর দ্বারিক দত্ত আর জেঠি শাশুড়ি যদি তোর শাশুড়ির মতো করে?

একটু খতিয়ে গেল সুনীতি। তারপর বলল, সবাই কি একরকম হয়? তা ছাড়া, এঁরা এখন কলকাতায় নেই। কদিন আগে সুধা আর হিরণ এসেছিল। তারা বলল, হিরণের এক দূর সম্পর্কের কাকা পাটনা থেকে এসে দুই বুড়োবুড়িকে নিয়ে গেছেন। মাসখানেক ওঁরা তাঁর কাছে থাকবেন।

সবাই এক ধাঁচের হয় না বলেও খানিক সংশয় থেকেই গেছে সুনীতির। বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষের উদারতা কম। সেকেলে হাজারটা পচা-গলা সংস্কারের ঘেরাটোপে তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখে। সে সব ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসতে পারে না, এমনই অদৃশ্য শেকলে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। হিরণের ঠাকুরদা আর জেঠিমা নেই, সুনীতির কাছে সেটা বড় রকমের স্বস্তি। ওঁরা থাকলে হয়তো এমন কান্ড বাধিয়ে বসতেন যাতে নতুন করে ঝিনুকের লাঞ্ছনার সীমা-পরিসীমা থাকত না। সুনীতির বিশ্বাস, অন্তত একটা মাস মেয়েটাকে তার এই শ্বশুরবাড়ির মতো কুঁকড়ে এক কোণে পড়ে থাকতে হবে না। অনেক সহজভাবে সে শ্বাস নিতে পারবে।

সুনীতি এবার বলে, যে ক’দিন বুড়োবুড়ি পাটনা থেকে ফিরে না আসছে তোরা সুধাদের কাছে। গিয়ে থাক। তার ভেতর বাবা নিশ্চয়ই চলে আসবে।

মাত্রাছাড়া রাগে ব্রহ্মর জ্বলে যায় বিনুর। হঠাৎ তার মনে হয়, হেমনলিনী শুধু একাই নন, সুনীতি আর আনন্দও হয়তো চায়, ঘাড় থেকে তারা নেমে যাক, আর এক মুহূর্তও এখানে না থাক। ওপরে সহানুভূতির ভান, তলে তলে সুনীতিরা কৌশলে তাদের সুধা আর হিরণের কাছে পাঠাবার ফন্দি এঁটেছে।

আগে থেকে না জানিয়ে (যদিও বিনু রাজদিয়া থেকে চিঠি লিখেছিল) হুট করে চলে আসায় এখানে উটকো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিনুদের বিদায় করতে পারলে এ বাড়ির সবাই ভাল করে নিশ্বাস ফেলতে পারবে। তখন পরিপূর্ণ মুক্তি।

রাগ হলে মানুষ স্বাভাবিক থাকে না। তার বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। তপ্ত মস্তিষ্ক একটু ঠাণ্ডা হলে পরিতাপে নিজের গালে চড় কষাতে ইচ্ছা হল বিনুর। কী আবোল তাবোল ভাবছে সে? নিমেষে পুরনো চিন্তা ফিরে এল মাথায়। কী করতে পারে সুনীতি আর আনন্দ? এ বাড়িতে হেমনলিনী যতদিন মাথার ওপর অধিষ্ঠান করছেন, কারোর কিছু করার নেই।

বিনু বলল, বুঝেছি। বাবা যতদিন না ফিরছে, এর বাড়ি ওর বাড়ি ঝিনুককে নিয়ে চোরের মতো থাকতে হবে।

ক্রোধ না থাকলেও ক্ষোভ এবং অভিমান যথেষ্টই থেকে গেছে। তার বলার ভঙ্গিতে যে শ্লেষ রয়েছে তা যথাস্থানেই বিধল। মুখটা সঙ্গে সঙ্গে চুন হয়ে গেল সুনীতির। ভাইয়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে সে বলে, আমাকে ভুল বুঝিস না। আমার কি ইচ্ছে তোদের তাড়িয়ে দিই? একটু থেমে হাঁফ-ধরা গলায় বলল, আমার ইচ্ছের কোনও দামই এখানে নেই।

বিনু চোখ তুলে সুনীতিকে দেখে। ম্লান মুখচ্ছবি। দিদির ওপর হঠাৎ বড় মায়া হয় তার। ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে নরম গলায় বলে, চল, নিচে যাই–

একতলায় আসতে চোখে পড়ল, কোণের দিকের ঘরটার খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হেমনলিনী। পাশে আনন্দ। ওরা ছাড়া বাড়ির অন্য কাউকে দেখা গেল না।

পায়ের আওয়াজে হেমনলিনী মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। বললেন, তোমরা এসে গেছ? ওই দেখ ঝিনুক এখনও বিছানা থেকে নামে নি। এত করে বলছি, মুখ ধুচ্ছে না, বাসি কাপড়ে বসে আছে। কত বেলা হয়ে গেল

দরজার কাছে চলে এল বিনুরা। ঘরের ভেতর শুধু ঝিনুক আর দুলালী। মশারির চারপাশ ছত্রির ওপর তোলা। উলটো দিকে মুখ করে খাটের মাঝখানে বসে রয়েছে ঝিনুক। নিশ্চল। দুলালী ঝুঁকে নিচু গলায় তাকে কী বোঝাচ্ছে। ঝিনুক চুপ। দুলালীর কোনও কথার উত্তর দিচ্ছে না।

হেমনলিনী বললেন, বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমরা ওকে বাথরুমে পাঠাও। ওদিকে লুচি জুড়িয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।

বিনু বলল, মাউইমা, আপনারা যান। আমি ওর সঙ্গে কথা বলি। ঘরে ঢুকে দুলালীকেও যেতে বলল।

সবাই চলে যায়, কিন্তু সুনীতি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

খাটের পাশ দিয়ে ঘুরে ঝিনুকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় বিনু। ঝিনুকের তেলহীন রুখু চুল উড়ে উড়ে পড়ছে সারা মুখে। চোখ দুটো রক্তের ডেলা, চোখের তলায় পুরু কালির পোঁচ। গাল বসে গেছে। ঠেলে-ওঠা কন্ঠার হাড় বড় বেশি প্রকট। সর্বাঙ্গে রাত জাগার অবসাদ।

কোমল স্বরে বিনু বলে, কাল রাতে ঘুম হয় নি? সব বুঝেও প্রশ্নটা করল।

এক পলক বিনুকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয় ঝিনুক।

বিনু ফের বলে, চেহারার কী হাল হয়েছে! একবার গিয়ে আয়নায় দেখ—

ঝিনুক বোবা হয়ে বসে থাকে।

বিনু বলে, রাতের পর রাত না ঘুমোলে শক্ত অসুখে পড়ে যাবে।

ঝিনুক জবাব দেয় না। একদৃষ্টে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিনু থামে নি, এভাবে নিজেকে শেষ করতে নেই। বাথরুমে যাও—

দরজার ওধার থেকে সুনীতি বলল, কাল দুলালীকে ঝিনুকের জন্যে পাট ভাঙা শাড়ি আর ব্লাউজ দিয়েছিলাম। ও চানঘরে রেখে দিয়েছে।

ঝিনুক সুনীতির দিকে ফিরেও তাকায় না। আচমকা দু’হাতে মুখ ঢেকে প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাতে থাকে। গলার শিরা ছিঁড়ে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, না না না, চানঘরে যাব না। কিছুতেই না। কেন। তুমি আমাকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে? কেন-কেন-কেন?

রায়টের সময় ঢাকা থেকে উদ্ধার করে যেদিন ঝিনুককে আনা হল, তখন সে প্রায় বদ্ধ পাগল। স্নেহলতা আর শিবানী সারাক্ষণ ঘিরে থেকে অনেক যত্নে, দিবারাত্রি শুশ্রূষায় তাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছিলেন। মেয়েটা সেই সেদিনের মতো ফের উথলপিথল হয়ে যাচ্ছে। তেমনই অস্থির, তেমনই উন্মত্ত। বিনু ভয় পেয়ে গেল। ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে, মিনতির সুরে বলতে লাগল, এমন করে না ঝিনুক। থামো–থামো—

ঝিনুক থামে না। চিৎকার করতে করতে গলা চিরে যায়। সেই সঙ্গে উতরোল কান্না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে হঠাৎ সে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিনুর ওপর। বিনুর গলাটা খামচে ধরে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে যায়, আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকব না।

রাজদিয়া থেকে তারপাশা, তারপাশা থেকে গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা। সারা পথে পদে পদে ছিল বিপদ, আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়। ঝিনুককে বুকের ভেতর সাপটে নিয়ে সে সব পেরিয়ে আসার পর আজ আরেক মহা সংকট সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিপর্যস্ত, দিশেহারা বিনু বলে, এমন করে না। শান্ত হও ঝিনুক, শান্ত হও–

ঝিনুক কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। একেবারে বধির। আমি এখানে থাকব না, থাকব না, থাকব না– গলার স্বর আরও উঁচুতে তুলে হিস্টিরিয়ার ঘোরে সে বলে যায়। একটানা, বিরতিহীন।

বিনু টের পায়, তার বুক ঝিনুকের চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে, চামড়ায় নখ বসে যাওয়ায় গলার কাছটা জ্বালা জ্বালা করছে। আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলে, এখানে তোমাকে থাকতে হবে না।

এবার কথাগুলো ঝিনুকের কানে প্রবেশ করে। কান্নার বেগ কমে আসে। জলে ভরা দুই চোখ বিনুর দিকে মেলে ধরে বলে, সত্যি বলছ?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যি।

এখানে থাকলে আমি মরে যাব।

হেমনলিনীর আচরণে ঝিনুক কতটা আঘাত পেয়েছে, কী নিদারুণ কষ্ট, অবিরাম তীক্ষ্ণ শূল বিধিয়ে বিধিয়ে তার বুকের ভেতরটা কতখানি রক্তাক্ত করে দিয়েছে, কালই টের পেয়েছিল বিনু। এ বাড়ির শুচিতা বজায় রাখতে যেভাবে তাকে এক কোণে ফেলে রাখা হয়েছে তাতে মেয়েটা বাঁচবে না, দম আটকে শেষ হয়ে যাবে। বা এমন কিছু করে বসবে যা খুবই মর্মান্তিক। আত্মহত্যার চিন্তাটা পলকের জন্য বিনুর মাথায় ঝিলিক দিয়ে যায়।

ভারী গলায় বিনু বলে, যাও, চানঘরে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে এস। চোখের যা অবস্থা, ভাল করে। জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে থোবে।

ঝিনুক বলল, আগে বল, কবে আমাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছ?

আজই। এখন বাথরুমে যাও।

ঝিনুকের রাতজাগা শীর্ণ মলিন মুখ সামান্য উজ্জ্বল হল। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো বিছানা থেকে নেমে স্নানঘরে ঢুকে যায়।

দরজার কাছে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সুনীতি। পাংশু মুখ।

খাটের কোণে বসতে বসতে বিনু সুনীতিকে বলে, বড়দি, তুই ঝিনুকের আর আমার খাবার এখানে দিয়ে যা। আনন্দদাকে বলবি খাওয়া চুকিয়ে যেন তৈরি হয়ে নেয়। ন’টা বাজতে চলল। জামাকাপড়ের

দোকানগুলো নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যে খুলে যাবে।

মাথাটা একটুখানি হেলিয়ে সুনীতি বলে, হ্যাঁ—

বিনু বলল, আমি যতক্ষণ না ফিরে আসি, তুই ঝিনুকের দিকে নজর রাখিস।

আরেক বার মাথা হেলায় সুনীতি। তারপর চলে যায়।

অনেকক্ষণ বাদে, প্রায় আধ ঘন্টা হবে, চানঘর থেকে বেরিয়ে আসে ঝিনুক। দুপুরের আগে কোনও দিনই স্নান করে না সে, কিন্তু আজ এর মধ্যেই সেটা সেরে ফেলেছে। শাড়ি পালটে চুলটুল আঁচড়েছে। চোখ আর আগের মতো টকটকে লাল নেই। স্বাভাবিক রং কিছুটা ফিরে এসেছে। জলের একটা জাদুস্পর্শ আছে। স্নান করার ফলে রাতজাগার ক্লান্তি, মলিনতা, চোখের তলার কালির ছোপ এখন অনেকটাই উধাও। খ্যাপা খ্যাপা, উদভ্রান্ত ভাবটা প্রায় কেটে এসেছে। ঝিনুককে বেশ স্নিগ্ধ আর তাজা লাগছে। এ বাড়িতে থাকতে হবে না, তাই কি এই পরিবর্তন?

সুনীতি এর ভেতর একবার এসে খাটের পাশের দুটো সাইড টেবলে প্রচুর লুচি, বেগুনভাজা, আলুর তরকারি আর মিষ্টি খুঞ্চিপোষে ঢাকা দিয়ে রেখে গিয়েছিল। কাঁচের প্লেট চাপা দিয়ে দু’গেলাস জলও। বলে গেছে, পরে চা নিয়ে আসবে।

ঝিনুক খাটের আরেক কোনায় বসল। জিজ্ঞেস করল, তখন থেকে বসে আছ?

বিনু বলল, হ্যাঁ, তোমার জন্যে। ঢের বেলা হয়েছে। খেয়ে নাও– ঢাকনা তুলে সাইড টেবল থেকে লুচির প্লেট তুলে ঝিনুকের হাতে দিয়ে নিজের জন্য অন্য প্লেটটা তুলে নিল।

ঝিনুক কপাল কুঁচকে বলল, এখানকার কিছু ছুঁতে ইচ্ছে করে না। আমি খাব না।

বিনু বলল, খুব বেশি হলে বিকেল পর্যন্ত আমরা থাকছি। তারপর তো চলেই যাব। না খেলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। খাও- হিরণদের বাড়িতে অভ্যর্থনা কেমন হবে, জানা নেই। হয়তো ভালই হবে। নইলে ঝিনুককে নিয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে হবে। পথ ছাড়া তখন গতি নেই। অবশ্য কাল সীমান্ত পেরিয়ে আসার সময় বর্ডার স্লিপ দিয়েছিল। তারা যে বোনাফাইড রিফিউজি’ অর্থাৎ খাঁটি শরণার্থী, তার নিশানা। সেটা সঙ্গেই আছে। হিরণরা ফিরিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম তো আছেই। ওই পরিচয়পত্রের জোরে যতদিন অবনীমোহন ফিরে না আসছেন, হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের পাশে কয়েক ফুট জায়গা নিশ্চয়ই তারা পেয়ে যাবে।

পেটে খিদে ছিল। ঝিনুক আর আপত্তি করল না। লুচির কোনা ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবুতে লাগল। বিনুও খাচ্ছে। খেতে খেতে বলল, আমি আনন্দদার সঙ্গে একটু বেরুব।

ঝিনুকের কপালে ভাঁজ পড়ে, কখন ফিরবে?

সুধারা থাকে টালিগঞ্জে। আগে কখনও ওখানে যায় নি বিনু। সুধার বিয়ের পর যখন একবার কলকাতায় এসেছিল তখন ওরা অন্য একটা বাড়িতে থাকত।

সুধাদের নতুন বাড়ির ঠিকানা বিনু জানে। জামাকাপড় কেনাকাটার পর টালিগঞ্জে গিয়ে সুধাদের বাড়িটা খুঁজে বার করতে হবে। তারপর ওদের সঙ্গে কথাবার্তা সারতে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে।

সুধাদের সঙ্গে দেখা করার কথাটা এখনই জানাতে চায় না বিনু। হিরণদাদের মতিগতি বুঝে পরে বলবে। মোটামুটি কতটা সময় লাগতে পারে, আন্দাজ করে নিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, দেড়টা দুটো বেজে যাবে।

রায়টের সময় ঢাকা থেকে ফেরার পর অনন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ঝিনুক। এক লহমাও সে বিনুকে চোখের আড়াল করতে চায় না। বিশেষ করে রাজদিয়ায় রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর থেকে। বিশ্বব্রহ্মান্ড জোড়া বিপুল এক আতঙ্ক সর্বক্ষণ তাকে যেন হা হা করে তাড়া করে চলেছে। বিনুই তার একমাত্র অবলম্বন। এখনও যে বেঁচে আছে, শ্বাসবায়ু সচল রয়েছে, সবই নুির জন্য। বিনু পাশে না থাকলে কবেই সে মরে ঝরে শেষ হয়ে যেত।

ঝিনুকের খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এত দেরি হবে কেন?

কাপড়চোপড় কেনার কথা বলল বিনু।

ক’টা শাড়ি ধুতি কিনতে চার পাঁচ ঘন্টা লাগবে? সন্ধিগ্ধ সুরে জানতে চায় ঝিনুক।

বিনু বলল, তারপর এক জায়গায় যেতে হবে।

সুনীতি চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকছিল। ঝিনুকদের কথা সে শুনতে পেয়েছে। বিনু কোথায় যেতে পারে, আঁচ করে নিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল, চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল বিনু।

ঝিনুক বিনুর দিক থেকে চোখ সরায় নি। বলল, কোথায় যাবে তুমি?

বিনু বলল, বেশি দূরে না। ফিরে এসে বলব। তোমার কিছু দরকার হলে বড়দিকে বলল।

বিনুর ভয় ছিল, সে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য জেদ ধরবে ঝিনুক, কিন্তু তেমন কিছুই করল না। বলল, আমার কিছু দরকার নেই। এই ঘর থেকে আমি বেরুবও না। শুধু

শুধু কী?

কাল রাত্তিরে যে মেয়েমানুষটা মেঝেতে শুয়েছিল সে যেন এ ঘরে না আসে।

দুলালীর কথা বলছে ঝিনুক। উদ্বেগের সুরে বিনু জিজ্ঞেস করল, কী করেছে সে?

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তীব্র গলায় ঝিনুক বলল, খুব পাজি। শয়তান– রাগে তার মুখ গন গন করতে থাকে।

বিনু চমকে ওঠে। এভাবে বলে, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু কী করেছে বলবে তো?

কিছুতেই মুখ খুলতে চায় না ঝিনুক। অনেক করে বলার পর সে জানায়, রায়টের সময় ঢাকায় যে সশস্ত্র হননকারীর দলটা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা কোথায় কতদিন তাকে আটকে রেখেছে, ওদের সঙ্গে ঝিনুকের সময় কিভাবে কেটেছে, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিল দুলালী। মেয়েমানুষটার মন ভীষণ নোংরা, জঘন্য রুচি।

ধর্ষণের খবরটা এ বাড়ির নিচের মহলেও কিভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত দুলালী তা জেনে ফেলেছে। ঝিনুক স্পষ্ট করে বলল না, আভাসে বুঝিয়ে দিল, তার সম্ভ্রমহানির অর্থাৎ ধর্ষণের অনুপুঙ্খ বিবরণ শুনতে চাইছিল মেয়েমানুষটা। কোনও ঘটনা বাদ না দিয়ে, বিশদভাবে।

শুনতে শুনতে অসহ্য ক্রোধে কাঁপছিল সুনীতি। মুখ রক্তবর্ণ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বজ্জাত মেয়েছেলে! এত বড় সাহস! মাকে বলে আজই এ বাড়ি থেকে ওকে তাড়াব।

সুনীতি দুলালীর ধড়মুভু আলাদা করার জন্য ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিল বিনু। আজই তারা এখান থেকে চলে যাবে। কাজের মেয়ের সঙ্গে ঝিনুকের ব্যাপারটা নিয়ে নোংরা ঘাঁটাঘাঁটির পরিণতি ভাল হবে না। দুলালীকে তাড়িয়ে দিলে এখনও যা চাপাচুপি আছে তা আর থাকবে না। ঢাকে কাঠি দিয়ে মেয়েমানুষটা চারদিকে চাউর করে বেড়াবে।

বিনু বলল, মাথা গরম করিস না বড়দি। আমরা তো এখানে থাকছি না। অশান্তি করে লাভ নেই।

সুনীতি কী বুঝল, সে-ই জানে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

একসময় খাওয়া চুকিয়ে সুনীতির হাতে ঝিনুককে সঁপে দিয়ে আনন্দর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বিনু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *