৩.০৬-১০ ভোরে সূর্যোদয়ের আগে

৩.০৬

মোটামুটি ভাবা গিয়েছিল, ভোরে সূর্যোদয়ের আগে আগে তারপাশা পৌঁছনো যাবে। কিন্তু মামুদপুর থেকে নৌকো ছাড়ার পর খ্যাপা বাতাস আর নদীর উদ্দাম ঢেউয়ের বাধায় প্রথম দিকে গতি বাড়ানো যাচ্ছিল না। পরে অবশ্য হাওয়া এবং নদীর দাপট কমলে হামিদরা নৌকোটাকে নদীর ওপর দিয়ে প্রায় উড়িয়েই নিয়ে এসেছে। তবু তারপাশায় পৌঁছতে একটু বেলাই হয়ে গেল।

দিগন্তের তলা থেকে সূর্য এখন অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। হেমন্তের এই সকালে কুয়াশার লেশমাত্র নেই। মাথার ওপর মস্ত বড় নীলাকাশ। স্বচ্ছ। পরিষ্কার। কেউ যেন কাল রাতের সব কুয়াশা আর অন্ধকার ধুয়ে মুছে তকতকে করে রেখেছে। যতদূর চোখ যায়, নদীর জলে সোনালি রোদ টলমল করছে। মনে হয়, দিগন্ত জুড়ে অপার্থিব কোনও কলসি উপুড় করে স্বর্ণরেণু ঢেলে দেওয়া হয়েছে। কাল রাতের মতো না হলেও এই সকালবেলায় বাতাস বেশ ঠাণ্ডা; অদৃশ্য হালকা ঢেউ তুলে তুলে সামনের অন্তহীন জলধারার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদী থেকে পঞ্চাশ ষাট হাত উঁচুতে ঝাকে ঝাকে চিল উড়ছে। ওদের পেটে রাহুর খিদে, সারাক্ষণ শুধু খাই খাই। পাখিগুলোর ধ্যানজ্ঞান জলের দিকে। মাছ নজরে পড়লেই নদীতে ছোঁ দিয়ে পড়ছে। ধারাল ঠোঁটে টাটকিনি কি গোলসা ট্যাংরা বা টাকি মাছ গেঁথে নিয়ে বাতাসে ডানার ঝাঁপটা মেরে ফের উঁচুতে উঠে যাচ্ছে।

নদীর কিনার ঘেঁষে স্টিমারঘাট। সেখানে মস্ত জেটি। গোয়ালন্দ কি নারায়ণগঞ্জের দিক থেকে যত স্টিমার আসে, সব জেটিটার গায়ে ভেড়ে। স্টিমারঘাট থেকে কিছুটা তফাতে নৌকোঘাট। একমাল্লাই, দুমাল্লাই, চারমাল্লাই, ছইওলা, ছইছাড়া কত যে নৌকো কাতার দিয়ে লগি গেঁথে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার হিসেব নেই। তা ছাড়া আছে অগুনতি কোষ, ভাউলে, মহাজনী ভড়।

যেমন নৌকোর ভিড়, তেমনি মানুষের। হামিদরা নৌকোঘাটের গায়ে ফাঁকামতো একটু জায়গায় নৌকো ভিড়িয়ে, লগি পুঁতে, কাছি দিয়ে বেঁধে ফেলল।

দূর থেকে নৌকোঘাটের কলরব শোনা গিয়েছিল। এখানে আসার পর তুমুল হইচই কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দিচ্ছে। সারা রাত চার মাঝি সমানে বৈঠা টেনেছে। ঘুম তো দূরের কথা, কেউ এতটুকু জিরোবারও ফুরসত পায়নি। পরিশ্রমে হাত-পায়ের জোড় যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্তিতে ঘুমে শরীর ভেঙে পড়ছে। চোখ আপনা থেকে বুজে আর্সছে। বৈঠা না টানলেও বাকি সকলের একইভাবে। রাত কেটেছে। বিনিদ্র। আতঙ্কিত।

বিনুরা তারপাশায় পৌঁছবার পর একের পর এক নৌকো নদী পাড়ি দিয়ে নৌকোঘাটে এসে ভিড়তে লাগল। সেগুলো থেকে যারা নামছে তাদের শঙ্কাতুর মুখচোখ দেখে বোঝা যায়, দেশের ভিটেমাটি ফেলে চিরকালের মতো সীমান্তের ওপারে চলে যাবার জন্য ওরা স্টিমার ধরতে এসেছে।

আফজল হোসেন বলল, যাউক, উপুরআলার দোয়ায় শ্যাষ তরি (পর্যন্ত) তারপাশায় পৌঁছান গেল।

কাল হানাদারদের নৌকোটা চলে যাবার পর তেমন আর কিছু ঘটেনি। নির্বিঘ্নে বাকি নদীটুকু পেরিয়ে তারা এখানে আসতে পেরেছে।

আস্তে মাথা নাড়ে বিনু। ঈশ্বরের অপার করুণা ছাড়া যে তারপাশায় পৌঁছনো যেত না, সে ব্যাপারে আফজল হোসেনের সঙ্গে সে একমত।

আফজল বলল, এহানে কুনো ডর নাই। পুলিশ আছে। একটু থেমে জানালো, দ্যাশ ছইড়া যারা যাইতে আছে তাগো উপুর পাকিস্থানে জুলুম হইতে আছে, এই লইয়া ইন্ডিয়ায় জবর শোরগোল উঠছে। হের (তার) লেইগা এখানকার গরমেন (গভর্নমেন্ট) কুমো কুনো জাগায় (জায়গায়) পুলিশ বসাইছে।

এই খবরটা আগেও কানে এসেছে বিনুর। যারা জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে ওপারে যাচ্ছে, রাস্তায় তাদের ওপর যে হামলা চালানো হচ্ছে, সেটা আর চাপা নেই। যারা বর্ডারের ওপারে যেতে পেরেছে, এ ধারের খুনখারাপি, লুটপাট, আগুন লাগানোর খবর সবিস্তার সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ইন্ডিয়ায় সেই কারণে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মানুষজন এটা ভাল চোখে দেখছে না। তাই পাকিস্তান সরকার মুখরক্ষা করতে রেল স্টেশন আর স্টিমারঘাটগুলোতে উদ্বাস্তুদের পাহারাদারির জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছে। এই জায়গাগুলো মোটামুটি সুরক্ষিত।

আফজল হোসেন ফের বলল, বিবিসাবরে কন, অহন আর বুরখা পইরা থাকনের দরকার নাই। আপনেও লুঙ্গি ছাইড়া ধুতিখান পইরা লন (নিন)। হের পর নাও থিকা লাইমা (নেমে) উপুরে চলেন। তমস্ত রাইত কেওর প্যাটে ভাত-পানি পড়ে নাই। আগে খাইয়া শরীলে জোর-বল আনেন। পরে আপনেগো ইস্টিমারঘাটায় পৌঁছাইয়া দিমু।

লোকটার সব দিকে নজর। সময় যখন বেজায় উত্তপ্ত, বিষবাষ্পে আবহাওয়া আচ্ছন্ন, তখন আফজল হোসেন কিন্তু সম্পূর্ণ অবিচলিত। ক’বছর ধরে অবিশ্বাস, ঘৃণা আর বর্বরতায় বহুকালের স্থিতি, শান্তি ভেঙেচুরে শতখান হয়ে গেছে। কিন্তু মামুদপুর গ্রামের এই অখ্যাত মানুষটিকে সে সব কোনও ভাবেই টলাতে পারেনি। বুকের ভেতর ভালবাসা, মমতার এমন এক চেরাগ সে জ্বেলে রেখেছে যা কখনও, কোনও কারণেই নেবে না।

পোশাক পালটে বোরখা লুঙ্গি ভাজ করে ছইয়ের ভেতর একধারে রেখে দিল বিনু। তারপর ঝিনুককে নিয়ে আফজল হোসেনের সঙ্গে পাড়ের মাটিতে নামল। তাদের পিছু পিছু নৌকোর চার মাঝি এবং রাজেক আর তমিজও নেমে এসেছে।

সবাই নদীর জলে মুখ ধুয়ে নিল। ঢালু পাড় বেয়ে কয়েক হাত ওপরে উঠলে চওড়া মেটে সড়ক। সেটা একদিকে স্টিমারঘাটে গিয়ে ঠেকেছে। আরেক দিকে বাঁক ঘুরে ঘুরে দূরের গ্রামগুলোতে চলে গেছে।

একটু পর সড়কে উঠে আসতেই চোখে পড়ল, গ্রামের দিক থেকে কাতারে কাতারে মানুষ আসছে। পুরুষদের মাথায় টিনের বাক্স, পাটি কি শতরঞ্চি-জড়ানো বিছানা, হাতে গাঁটরি বোঁচকা। সধবা বৌদের এক কাকালে বাচ্চা, কাঁধে পোঁটলা পুঁটলি। যে বাচ্চাগুলো একটু বড়, তারাও ছোটখাট কিছু না কিছু হাতে ঝুলিয়ে আসছে।

মানুষের যে মহাযাত্রা স্টিমারঘাটের দিকে চলেছে তারা কারা, কী তাদের পরিচয়, বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই সব নানা বয়সের মানুষ-বুড়ো আধবুড়ো কিশোর কিশোরী যুবক যুবতী বাচ্চাকাচ্চাদের চোখেমুখে অসীম ক্লান্তি আর আতঙ্কের ছাপ। মনে হয়, অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে তারা আসছে।

আফজল হোসেন আক্ষেপের সুরে বলল, দ্যাশ ছাইড়া যাইতে আছে গিয়া। আমাগো ঢাকার জিলা পেরায় শূইন্য হইয়া গেল।

পাশাপাশি হাঁটছিল বিনু আর ঝিনুক। বিনু জানে শুধু ঢাকা জেলাই নয়, সারা পূর্ব বাংলাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সে উত্তর দিল না।

রাস্তার একধারে টিনের চাল এবং কাঁচা বাঁশের বেড়ায় সারিবদ্ধ দোকান। তার অনেকগুলোই মিঠাইয়ের। বড় বড় পেতলের গামলায় রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন, পান্তুয়া, কাঠের পরাতে মাখা সন্দেশ, পাতক্ষীর। এ ছাড়া রয়েছে বেশ ক’টা চিড়ে মুড়ি বাতাসা তিলা কদমা এবং চিনির মঠের দোকান। চার পাঁচটা কলার দোকানও চোখে পড়ছে। কত রকমের কলা–সবরি, মোহনবাঁশি, চাপা, কবরি, অমর্তসাগর। এ ছাড়া আছে কাপড়ের দোকান, মনিহারি দোকান, বাসনকোসনের দোকান, চাল ডাল তেল নুন মশলাপাতির দোকান। দোকানের লেখাজোখা নেই। কয়েকটা ভাতের হোটেলও আছে।

মিঠাই আর চিড়ে মুড়ির দোকানগুলো হিন্দুদের। তারা এখনও দেশ ছেড়ে চলে যায় নি।

চিড়ে আর কলা কিনে সবাইকে নিয়ে একটা মিঠাইয়ের দোকানে ঢুকল আফজল হোসেন। দোকানদারের কাছ থেকে সবার জন্য একটা করে কঁধা-উঁচু কাঁসার বগি থালা চেয়ে নিল সে। তারপর দই চিড়ে মেখে খাওয়া শুরু করল। চিড়ে দুই কলার পর দু’টো করে ক্ষীরমোহন।

চিড়ে এবং কলার দাম দিতে চেয়েছিল বিনু। আফজল হোসেনের প্রবল আপত্তিতে দিতে পারেনি। লোকটা দই মিষ্টির দামও দিতে দিল না। বলল, দামের কথা মুখে আইনেন না। নিজের বাড়ি নিয়া ভাল কইরা দু’গা (দুটি) খাওয়াইতে পারি নাই। বড় আপসোস। দিনকাল যে কী খারাপ হইয়া গ্যাছে!

মামুদপুর গ্রামে নিয়ে যাবার পর বিনুদের লুকিয়ে রাখতে হয়েছে, অত কাছে গিয়েও নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যত্ন করতে পারে নি, এই কথা আরও কয়েক বার শুনিয়েছে আফজল হোসেন। তারপাশায় দই চিড়ের ফলার খাইয়ে তার আক্ষেপ হয়তো কিছুটা মেটাতে চাইছে।

একটু নীরবতা।

তারপর আফজল হোসেন হামিদদের বলল, তোমরা নাওয়ে গিয়া বসো, আমি এনাগো (এঁদের) জেটিঘাটায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসি। তোমাগো লগেই আমি গেরামে ফিরুম। বলে বিনুদের দেখিয়ে দিল।

হামিদরা চলে গেল।

বিনু ব্যস্তভাবে বলল, ওদের নৌকো ভাড়াটা কিন্তু আমি দেব।

আফজল হোসেন হাসল। বলল, ঠিক আছে, দিবেন।

কত দিতে হবে?

তিরিশ ট্যাকা–

কোমরের থলি থেকে টাকা বার করে আফজল হোসেনকে দিল বিনু, ওদের দিয়ে দেবেন। তারপর রাজেককে পঁচিশটা টাকা দিয়ে বলল, তোমাদের তো রাজদিয়া ফিরে যেতে হবে। কিভাবে যাবে?

রাজেক বলল, এখান থিকা গয়নার নাও পামু। হেই ধইরা চইলা যামু।

বিনু বলল, রাজদিয়ায় গিয়েই দাদুর সঙ্গে দেখা করে সব বলো।

হে তো কমুই।

আফজল হোসেন বিনুকে বলল, চলেন—

বিনুরা জেটিঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। তাদের সঙ্গে রাজেক আর তমিজও চলেছে। সামনে পেছনে এবং পাশে চলেছে শিকড় উপড়ে আসা মানুষের স্রোত। ম্রিয়মাণ, ভীত, সন্ত্রস্ত অসংখ্য মুখের মিছিল।

বিনু রাজেককে বলল, তোমরা আবার কষ্ট করে আসছ কেন? আফজল সাহেবই তো যাচ্ছেন।

রাজেক জানায়, বিনুদের স্টিমারে ওঠার কী বন্দোবস্ত হয় তা না জেনে তারা ফিরবে না। রাজদিয়ায় গিয়ে হেমনাথকে সব জানাতে তো হবে।

এরপর আর বলার কিছু থাকে না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল বিনু।

.

৩.০৭

জেটির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে আগুনতি মানুষ। ছেলেমেয়ে, বউ, বুড়ো মা-বাপ নিয়ে তারা বসে আছে। পাশে নানা লটবহর। টিনের বাক্স, পোঁটলাপুঁটলি, বেতের সাজি বা ধামা। পার্থিব সম্পত্তি বলতে যে যেটুকু পেরেছে নিয়ে এসেছে। নৌকোয় করে বা সড়ক ধরে হেঁটে, ধুকতে ধুকতে যারা আসছে তারাও আগে আসা লোকগুলোর পাশে বসে পড়ছে।

জেটির ভেতর ঢোকা প্রায় অসম্ভব। সেখানে এমন ঠাসা ভিড় যে পা ফেলার মতো ফাঁক নেই। আন্দাজ করা যায়, অনেক আগে থেকেই তোকজন এসে স্টিমার ধরার জন্য জেটিতে বসে আছে। এধারে ওধারে আট দশটা কনস্টেবলকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের হাতে বন্দুক।

একসঙ্গে বহু মানুষ জড়ো হলে যা হয়, চারদিকে হইচই চলছে।

আফজল হোসেন এধারে ওধারে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করল। তারপর বিনুকে বলল, আপনেরা এখানে ইট্র খাড়ন। আমি ইস্টিমারের খবর লইয়া আসি। মুহূর্তে জনারণ্যে মিশে গেল সে।

তারপাশায় মোটামুটি নিরাপদে পৌঁছনো গেছে। সেদিক থেকে একটা মারাত্মক চিন্তা কেটেছে। কিন্তু জেটিঘাটের জনসমুদ্র দেখে নতুন একটা দুর্ভাবনা বিনুকে হতচকিত করে তোলে। যত মানুষ আগেই জমা হয়েছে এবং স্রোতের মতো আরও যারা আসছে, দিনে দশটা স্টিমার দিলেও তাদের জায়গা হবে না। রুণ, দুর্বল ঝিনুককে নিয়ে ভিড় ঠেলে কবে সে গোয়ালন্দের স্টিমারে উঠতে পারবে, কে জানে।

একই সমস্যার কথা ভাবছিল ঝিনুক। পাশ থেকে সে বলল, এত মানুষ! আমরা কী করে কলকাতায় যাব?

বিনু ঝিনুকের দিকে ফিরে ভরসা দেবার সুরে বলে, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তারপশায় যখন আসতে পেরেছি, কলকাতাতেও ঠিক চলে যাব।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসে আফজল হোসেন। বলে, গতিক ভালা না তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।

বিনুর বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে, কী হয়েছে মিঞাসাহেব?

কাইল তরি (পর্যন্ত) রোজ দুইখান ইস্টিমার দিত। আইজ থিকা একখান কইরা দিছে। ক্যামনে যে অ্যাত মানুষ গাঙ পারাইয়া (পার হয়ে) গোয়ালন্দ যাইব, খোদা জানে।

বিনুর কাছে এটা পরিষ্কার, আজ আর ঝিনুককে নিয়ে স্টিমারে ওঠা হচ্ছে না। কবে যে উঠতে পারবে, তার ঠিক নেই। হয়তো দু’দিন, চারদিন, কি তারও বেশি তারপাশার স্টিমারঘাটে অপেক্ষা করতে হবে।

আফজল হোসেন এবার বলল, জেটিঘাটার ভিতরে একখান সুই (উঁচ) ফালানের জাগা (জায়গা) নাই–অ্যাত মানুষ। বিবিসাবরে লইয়া আপনেরে বাইরে খুলা (খোলা) আশমানের তলে থাকতে হইব। একটু থেমে ফেরে বলে, জবর কষ্ট হইব আপনেগো।

স্টিমারের সমস্যা তো আছেই, অদূর ভবিষ্যতের আরও একটা দুশ্চিন্তা বিনুকে ভেতরে ভেতরে চঞ্চল করে তোলে। দু’চারদিন পর না হয় তারা গোয়ালন্দ পৌঁছল, কিন্তু সেখানে গিয়েই যে শিয়ালদার ট্রেন ধরতে পারবে, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? সেখানেও কি হাজার হাজার মানুষ আকণ্ঠ উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করছে না। গোয়ালন্দ থেকে দিনে শিয়ালদার কটা ট্রেন ছাড়ে, বিনুর জানা নেই। হয়তো ওখানেও দিনকয়েক ট্রেনের আশায় বসে থাকতে হবে। দুশ্চিন্তাটা ঝাঁকি মেরে মাথা থেকে তাড়াতে চাইল বিনু। যতক্ষণ শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে, আশা তো রাখতেই হয়। সে বলল, এত মানুষ। কলকাতায় চলেছে। তাদের যা হবে, আমাদেরও তাই হবে। সারারাত ঘুমোতে পারেননি, নৌকোর পাটাতনে বসে হিমে ভিজেছেন। আমাদের জন্যে আপনি আর কষ্ট করে এখানে থাকেবন না। মামুদপুরে ফিরে যান।

একটানা পুরো একটি রাত এবং একটি দিনের ধকলে শরীর ভেঙে আসছিল আফজল হোসেনের। রাত জাগার কারণে চোখ টকটকে লাল, কপালের দু’পাশের শিরা দপ দপ করছে। বয়স তো কম হয়নি।

আফজল হোসেন বিনুর দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আপনেগো ইস্টিমারে তুইলা দিয়া যাইতে পারলে শান্তি পাইতাম। কিন্তুক–

সে কী বলতে চায়, বুঝতে পারছিল বিনু। তাদের স্টিমার ধরাতে হলে দু’চারদিন হয়তো তারপাশায় থেকে যেতে হবে আফজল হোসেনকে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

বিনু বলল, চিন্তা করবেন না, আমরা ঠিক স্টিমার ধরতে পারব। আপনি বাড়ি গিয়ে ভাল করে বিশ্রাম করুন।

বিমর্ষ মুখে আফজল হোসেন বলল, কী আর করন, যাই তাইলে (তা হলে)। ধীরে ধীরে মুঠো খুলে বিনুর হাত ছেড়ে দেয় সে। বলতে থাকে, যদিন পারেন কইলকাতায় গিয়া চিঠি লেইখা পৌঁছ সম্বাদটা দিয়েন। তাইলে নিচ্চিন্ত হমু। আমাগো গেরামের নাম তো জানেনই। মামুদপুর, বিক্রমপুর। জিলা ঢাকা। এই লেইখা দিলেই হইব। একটু ভেবে ফের বলে, জানি না, বডারের (বর্ডারের) উই পার থিকা চিঠিপত্তর এই ধারে আসে কিনা–

কে বলবে, আফজল হোসেন নামে এই লোকটার সঙ্গে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগে এক সংকটের মুহূর্তে তার আলাপ। আপ্লুত, অভিভূত বিনু বলে, নিশ্চয়ই লিখব।

আফজল হোসেন আর দাঁড়ায় না, ভিড়ের ভেতর দিয়ে নৌকোঘাটের ওধারে যেখানে হামিদদের নৌকোটা বাঁধা আছে, ক্লান্ত পা ফেলে ফেলে সেদিকে চলে যায়।

আমরাও যাই ছুটোবাবু–রাজেক আর তমিজও চলে যায়। তারা ‘গয়নার নাও’ ধরে রাজদিয়া ফিরে যাবে। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে ফিরে আসে রাজেক। বলে, মামুদপুরের এই মিঞাছাবের লাখান মানুষ আমি আর দেখি নাই ছুটোবাবু। ফেরেশতা (দেবদূত), ফেরশতা– বলেই ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়।

ঠিক একই কথা ভাবছিল বিনু। রাজদিয়ার লারমোর সাহেবকে বাদ দিলে আফজল হোসেনের মতো আর কাউকে কখনও দেখেনি। আমৃত্যু এই মানুষটাকে মনে করে রাখবে সে।

জনসমুদ্রে যতক্ষণ না আফজল হোসেন বিলীন হয়ে যায়, তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিনু।

.

৩.০

পাশেই ছিল ঝিনুক। বলল, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। কোমর থেকে পা পর্যন্ত ছিঁড়ে পড়ছে।

দুর্বল শরীরে এতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ঝিনুকের পক্ষে ভীষণ কষ্টকর। ব্যস্তভাবে এধারে ওধারে তাকায় বিনু। একটু ফাঁকা জায়গা পেলে ঝিনুককে বসাবে, নিজেও বসবে।

হঠাৎ একটা গলা কানে এল, ছুটোবাবু না?

কণ্ঠস্বর চেনা চেনা, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না বিনু।

ফের শোনা গেল, এই যে, এইখানে–

এবার চোখে পড়ল। সড়কের ডান পাশে ঘাসে-ভরা নাবাল জায়গায় আরও অনেকের সঙ্গে বসে আছে হরিন্দ। তার গা ঘেঁষে একটি পনের ষোল বছরের সদ্য যুবতী এবং দু’টো ছেলে। এক ছেলের বয়স এগার বার, অন্যটার সাত আট। আর রয়েছে কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা আধবয়সী সধবা একটি মেয়েমানুষ–খুব সম্ভব হরিন্দর স্ত্রী। ওদের সঙ্গে কিছু লটবহরও রয়েছে। একটা ঢাক, পুরনো টিনের। বাক্স, আধছেঁড়া পাটি দিয়ে জড়ানো বালিশ, কাঁথা, বিছানার চাদর আর ছোটখাটো দু’চারটে পুঁটলি।

হরিন্দকে বিনু প্রথম দেখেছিল সুজনগঞ্জের হাটে। কোন এক জমিদার সম্বন্ধে নাকি রটে গিয়েছিল, সে আপাদমস্তক স্ত্রৈণ, স্ত্রীর এমনই বশীভূত যে স্ত্রী যদি বলে সুর্য পশ্চিম দিকে উঠে পুবে অস্ত যায়, লোকটা নাকি ঘাড় কাত করে তক্ষুনি তাতে সায় দেয়। রটনাটা যে আগাগোড়া মিথ্যে, তা প্রমাণ করার জন্য জমিদার হরিন্দকে সুজনগঞ্জে পাঠিয়েছিল। হরিন্দ ওখানকার বিষহরিতলার পাশের মাঠে ঢেঁড়া পিটিয়ে হাটের লোকজন জড়ো করে জানিয়ে দিয়েছিল, সেই জমিদারবাবুটি স্ত্রৈণ নয়।

এতদিন পর, অসীম উৎকণ্ঠায় যখন তার মন ভরে আছে, সুজনগঞ্জের হাটের সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে হাসি পেল।

দ্বিতীয় বার হরিন্দকে ওই সুজনগঞ্জের হাটেই দেখা গিয়েছিল। তখন যুদ্ধ চলছে। কয়েকজন হোমরা চোমরা অফিসারকে নিয়ে এস ডি ও সাহেব, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওয়ারের জন্য সোলজার রিক্রুট করতে এসেছিলেন। সেবারও তোক জোটাবার কাজে হরিন্দকে লাগানো হয়েছিল। ঢেঁড়া পিটিয়ে সারা হাটটা বিষহরিতলার পাশের মাঠে টেনে এনেছিল সে।

এরপর বারকয়েক হরিন্দর সঙ্গে দেখা হয়েছে। দু’চারবার তাদের রাজদিয়ার বাড়িতেও এসেছে সে। ভাটির দেশে না কোথায় তার বাড়ি, মনে পড়ছে না বিনুর। পালা পার্বণে ঢাক বাজানো ছাড়া, হাটে হাটে ঘুরে চেঁড়া দিয়ে বেড়াত সে।

বিনু লক্ষ করল, হরিন্দর চোখের নিচে কালি, গাল ভাঙা, একমুখ খাড়া খাড়া দাড়ি, কণ্ঠার হাড় চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। ছেলেমেয়েগুলোর চেহারা শীর্ণ, চাউনি ভয়কাতর। একটা অদৃশ্য আতঙ্ক যেন তাদের তাড়া করছে।

চেনা লোক দেখে একটু ভরসা পায় বিনু। ঝিনুককে সঙ্গে করে হরিন্দদের কাছে চলে আসে।

হরি বলে, কইলকাতায় চলছেন?

হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে বিনু। প্রশ্নটা অনাব্যশক, তবু জিজ্ঞেস করে, তোমরাও যাচ্ছ?

হ– বুক তোলপাড় করে দীর্ঘশ্বাস পড়ে হরিন্দর। সে বলে, দ্যাশের আর আশা নাই ছুটোবাবু। কইলকাতায় গ্যালে পরানটা যদিন  বাঁচান যায়– ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, লগে কেঠা (কে)? বৌঠাইন নিকি?

আফজল হোসেনও ঝিনুককে তার স্ত্রী ভেবেছিল। ঝিনুক তার জীবনের সর্বস্ব, শ্বাসবায়ুর মতো অপরিহার্য। কিন্তু এটা তো ঠিক, তাদের বিয়ে হয়নি। একটি অনাত্মীয়, অবিবাহিত তরুণীকে এক যুবক সঙ্গে নিয়ে চলেছে, দেশজোড়া সন্ত্রাসের আবাহাওয়াতেও তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব আগে মাথায় আসে নি বিনুর।

বিনু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, অস্পষ্টভাবে কিছু বলে। এতে যা বোঝার বুঝে নিক হরিন্দ। হরিন্দ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। বলে, খাড়ইয়া ক্যান? আপনেরা এইখানে আইসা বসেন। তারপর কী খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করে, লগে মালপত্তর কই?

তাদের সমস্ত কিছু যে খোয়া গেছে, তা জানালে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বিনু বলল, কিছু আনিনি।

হরিন্দ তাদের পাটির মোড়ক খুলে একটা পুরনো রং-জ্বলা সুজনি পেতে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিনু আর ঝিনুক বসে পড়ে। সমস্ত রাত না ঘুমিয়ে চোখ জ্বালা করছিল ঝিনুকের। সে বলে, আমি বসে থাকতে পারব না। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

বিনু বলল, শুয়ে পড়।

তক্ষুনি সুজনির ওপর শরীর ছেড়ে দেয় ঝিনুক। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বুজে আসে।

কিছুক্ষণ কৃশ, রুণ সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে বিনু। বুকের ভেতরটা আবেগে মায়ায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। পলকা, দুর্বল শরীর ঝিনুকের। পথের যাবতীয় ক্লেশ সয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় পৌঁছতে পারবে কি সে?

একসময় মুখ ফিরিয়ে হরিন্দর দিকে তাকায় বিনু। হরিন্দ জিজ্ঞেস করে, তারপাশায় কবে আসছেন ছুটোবাবু?

বিনু বলে, এই খানিকক্ষণ আগে। তোমরা কবে এসেছ?

দুই দিন পার হইয়া গ্যাছে–

দু’দিনে স্টিমারে উঠতে পার নি?

ক্যামনে উঠুম! এক ইস্টিমারে চাইর পাঁচ শ’ মানুষ ধরে। সুমখের দিকে তাকাইয়া দ্যাখেন, হাজারে হাজারে বইসা রইছে। তাগো ঠেইলা ইস্টিমারে ওঠন যায়!

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিনু। তারপাশায় পা রাখার পর থেকে এই চিন্তাটাই তার মাথাতেও ভর করে আছে।

হঠাৎ বিনুর মনে পড়ল, হরিন্দদের বাড়ি ফরিদপুরে। সে এতদুরে তারপাশায় এল কী করে? তার তো অন্য দিক দিয়ে কলকাতায় চলে যাবার কথা। এসব জিজ্ঞেস করায় হরি বলল, তাদের ফরিদপুরে ভীষণ রায়ট চলছে। ভয়ে কদিন আগে রাজদিয়ার কাছাকাছি সিরাজদীঘায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র বাড়ি চলে এসেছিল। সেখানেও থাকা গেল না।

একটু চুপচাপ।

তারপর হরিন্দ ফের বলে, আপনেরা দুইজনে যাইতে আছেন। হ্যামকত্তা কইলকাতায় যাইব না?

বিনু বলে, না। দেশ ছেড়ে দাদু কোথাও যাবেন না।

হরিন্দ বলে, আইজ কইতে আছে দ্যাশ ছাড়ব না। তয় একখান কথা কই, পাকিস্থানে কেও থাকতে পারব না। বেবাকরে আসামে, নাইলে কইলকাতায় চইলা যাইতে হইব। একটু থেমে বিষণ্ণ মুখে ফের বলে, আমাগোও কি বাপ-ঠাউরদার ভিটা ছাইড়া যাওনের ইচ্ছা আছিল? ফরিদপুরে, আমাগো উইখানে কী যে চলতে আছে, ভাবতে পারবেন না। আমার কথাই ধরেন, সাত কানি ধানী জমিন আছিল। দুই বচ্ছর ধইরা ধান পাকলে কাইটা লইয়া যাইতে আছে। নিজেগো গাছের ফলপাকড়ে হাত ঠেকানের উপায় নাই। চৌখের সুমুখ দিয়া পাইড়া লইয়া যায়। ঘরে একদানা ধান নাই, তভু ভিটার টানে মুখ গুইজা পইড়া আছিলাম। গলার স্বর নামিয়ে, অদূরে বসে থাকা যুবতীটিকে দেখিয়ে ভয়ার্ত সুরে বলে যায়, কয়দিন আগে দুফার বেইলে আমার উই মাইয়াটার হাত ধইরা যহন টান দিল, ঠিক কইরা ফেলাইলাম, আর এই দ্যাশে না। কপালে যা হয় হউক, দ্যাশ ছাড়ুম। নাইলে মাইয়াটারে কুন দিন কাইড়া লইয়া যাইব। হেরপর আইলাম সিরাজদীঘায়। অহন কইলকাতায় পাড়ি দিমু।

বিনু লক্ষ করল, ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে হরিন্দকে। মনে হয়, দুঃস্বপ্নের ঘোরে রয়েছে লোকটা। তাকে কী বলবে, ভেবে পায় না সে।

হরিন্দ ফের বলে, আমাগো উইদিকে কত মানুষ যে খুন হইছে, কত যুবুতী মাইয়ারে যে জোর কইরা টাইনা লাইয়া গ্যাছে হের ল্যাখাজোখা নাই। এই অবোস্তায় কি থাকন যায়? কাগা বগারে মনে আছে ছুটোবাবু?

হরিন্দর সঙ্গে হাটে হাটে ঢেঁড়া দিয়ে বেড়াত তার দুই সঙ্গী, অর্থাৎ কাগা আর বগা। কত বার তাদের দেখেছে বিনু। রাজদিয়ায় হেমনাথের বাড়িতে হরিন্দর সঙ্গে দু’একবার ওরাও এসেছে। এই তো সেদিনের কথা। বিনুর স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল নয় যে ওদের ভুলে যাবে। বলল, নিশ্চয়ই আছে। কী হয়েছে তাদের?

হরি জানায়, কাগা বাগা আপন মায়ের পেটের ভাই। ফরিদপুরে হরিন্দর বাড়ির প্রায় লাগোয়া ওদের বাড়ি। দুই ভাইয়ের কিছু জমিজমা ছিল। হরিন্দর মতো ওদেরও পাকা ধান জোর করে কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দু’বছর ধরে। এবার ওরা রুখে দাঁড়িয়েছিল। কোনও মতেই ধান দেবে না। তার ফলে ওদের কুপিয়ে মারা হয়।

বলতে বলতে অবরুদ্ধ কান্না বুকের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকে হরিন্দর। ঝাঁপসা গলায় সে বলে, কত কাল আমরা একলগে আছিলাম!

হরিন্দর কষ্টটা বিনুর মধ্যেও যেন চারিয়ে যায়। কাগা বগা ছিল সরল, ভালমানুষ, কারোর সাতে পাঁচে থাকত না। এমন দু’জনের শোচনীয় মৃত্যু তাকে আমূল নাড়া দিয়ে যায়। বিনু বলে, ওদের স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা?

হরি বলে হগলে জাওনার (জানোয়ার) হইয়া যায় নাই। আমাগো গেরামের শায়েদ মিঞা এট্টা সত্যকারের মানুষ। হে (সে) পরানের ঝুঁকি লইয়া কাগা বগার বউ আর পোলামাইয়াগো রাইতের আন্ধারে কয়দিন আগে তিপুরার (ত্রিপুরার) বডারে পৌঁছাইয়া দিয়া আইছে।

বেলা আরেকটু চড়েছে। সূর্য আরও খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। যতদূর চোখ যায়, পরিষ্কার নীলাকাশ। একোণে ওকোণে দু’এক টুকরো সাদা মেঘ হেমন্তের বাতাসে দোল খেতে খেতে ভেসে চলেছে–মন্থর, লক্ষ্যহীন। অনেক উঁচুতে আকাশের নীল ছুঁয়ে ডানা মেলে স্থির হয়ে আছে আগুনতি শঙ্খচিল। তাদের কোথাও যাবার যেন তাড়া নেই, এমনই গা-এলানো ভঙ্গি। নিচে নদীর জলে রোদ সোনা ঢেলে দিচ্ছে।

বিনু জিজ্ঞেস করল, কলকাতায় তো যাচ্ছ। সেখানে তোমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ আছে?

কাগা বগার ভয়াবহ মৃত্যুর খবর দিতে গিয়ে শোকাতুর হয়ে পড়েছিল হরিন্দ। সেই ভাবটা খানিক কাটিয়ে বলল, না, কেও নাই।

সেখানে গিয়ে কোথায় উঠবে ঠিক করেছ?

না। আগে কি কুনোদিন কইলকাতায় গ্যাছি যে হেইখানের হগল জাগা (জায়গা) চিনুম? ফরিদপুর আর ঢাকার জিলার বাইরে দুই চাইর বার খালি ঢেড়া দেওন আর পূজার ঢাক বাজানের বায়না লইয়া কুমিল্লা আর শিলটে গেছিলাম।

ফরিদপুর জেলার চৌহদ্দি পেরিয়ে কচিৎ কখনও যার দৌড় জল-বাংলার কয়েকটা জেলা পর্যন্ত, সে ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে কলকাতায় কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজবে, কী করে পেটের ভাত জোটাবে, ভাবতেও দিশেহারা বোধ করল বিনু।

হরিন্দ ফের বলে, লাখে লাখে মানুষ দ্যাশ ছাইড়া ইন্ডিয়ায় যাইতে আছে গিয়া। হেগো (তাদের) হগলের কি বডারের উই পারে ভাই বন্দু আত্মজন আছে? খবর লইয়া দ্যাখেন, লাখে দশজনেরও নাই।

হরিন্দ ঠিক কী বোঝাতে চাইছে, বিনু ধরতে পারে না। সে তাকিয়ে থাকে।

হরিন্দ বলে, উই মানুষগুলানের যা হইব, আমাগোও হেয়াই (তাই) হইব। ভিটা ছাইড়া যহন আসছি, পিছের দিকে আর তাকামু না। দ্যাশের লগে সম্পক্ক চুইকা (চুকে) গ্যাছে ছুটোবাবু। একটু থেমে ফের বলল, ইন্ডিয়ায় একবার যাইতে পারলে বাইচা থাকনের এট্টা না এট্টা বন্দবস্ত ঠিক হইয়া যাইব।

লোকটা চূড়ান্ত আশাবাদী। তার ধারণা, সীমান্তের ওপারে একবার পৌঁছতে পারলে সব সমস্যার যাবতীয় সুরাহা হয়ে যাবে। সেখানে রোজগারের একটা ফিকির, মাথা গোঁজার একটুকরো জায়গা নিশ্চয়ই মিলবে। কিন্তু লোকটা পালা-পার্বণে ঢাক বাজানো আর হাটেগঞ্জে ঢেঁড়া দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ শিখেছে বলে জানা নেই বিনুর। অবশ্য তার কয়েক কানি ধানী জমি ছিল।

ভারত এক বিশাল দেশ। দু’চার শ’ কি পাঁচ দশ হাজার মানুষ যদি পাকিস্তান থেকে সেখানে চলে যায় তাদের কোনও রকম একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল যেখানে নেমেছে তাদের সবার জন্য কিছু করা, ভারতের মতো একটা বড় দেশের পক্ষেও কতটা সম্ভব, সে সম্বন্ধে বিনু যথেষ্ট সন্দিহান। বিশেষ করে হরিন্দর মতো লেখাপড়া না-জানা মানুষ, পুরুষানুক্রমে যে শুধু ঢাক বাজিয়ে আসছে, ইন্ডিয়ায় গিয়ে সে কী করবে, ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে কোথায় থাকবে, কী খাবে, কে জানে। অবশ্য একটা কথা সে ঠিকই বলেছে, সীমান্তের ওপারে গিয়ে অগুনতি ছিন্নমূল মানুষের যা হবে, সেটাই মেনে নেবে সে।

হরিন্দ এবার বলে, ইন্ডিয়ায় গিয়া যদিন মরতেও হয়, তাও সই। দিন রাইত বুকের ভিতরে ডর লইয়া এইখানে থাকন যায় না।

বিনু উত্তর দেয় না।

হরিন্দ কী ভেবে এবার বলে, কইলকাতায় গিয়া আপনেরা কই উঠবেন ছুটোবাবু? কিছু ঠিক করছেন?

বিনু জানায়, ওই শহরে তার বাবা এবং দিদিরা আছে। ওদের সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জবাব অবশ্য পাওয়া যায়নি। এমনও হতে পারে, চিঠিগুলো ওদের কাছে পৌঁছয়নি। না-ও যদি পৌঁছয়, ঠিকানা জানা আছে। শিয়ালদায় নেমে ঠিক চলে যেতে পারবে।

হরিন্দ বলে, আপনের তাইলে কুনো চিন্তা নাই। খালি বডারখান পার হইলেই নিচ্চিন্তি। .

তারপাশা পর্যন্ত আসা গেছে। তার মধ্যে কত কী-ই তো ঘটে গেল। তারপাশা থেকে ইন্ডিয়ার বর্ডার পর্যন্ত কতখানি নিরাপদ, জানা নেই। হয়তো নির্বিঘ্নেই তারা সীমান্তে পৌঁছে যাবে, কিংবা অঘটনও কিছু ঘটতে পারে। যতক্ষণ না বর্ডার পেরিয়ে ওপারে পা রাখছে, উৎকণ্ঠা কাটবে না। তবে একটা আশার কথা, আফজল হোসেনদের মতো মানুষ এখনও রয়েছে। যদি খারাপ কিছু ঘটে, ত্রাণকর্তা হিসেবে তেমন কাউকে কি পাওয়া যাবে না?

অনেকক্ষণ ধরে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ কানে আসছিল। একটানা খানিকটা চলার পর সেটা থামে, আবার নতুন করে শুরু হয়।

হরিন্দর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আগে ততটা খেয়াল করেনি বিনু। এবার শব্দের উৎসটা খুঁজতে লাগল সে। নদীপাড়ের নাবাল জমিতে, খানিকটা দূরে, মধ্যবয়সী একটা লোক স্ত্রী এবং চার পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে আছে। শুষ্ক, দড়ি-পাকানো চেহারা লোকটার। পরনে খাটো ময়লা ধুতি আর আধছেঁড়া নিমা। মেয়েগুলোর গায়ে শস্তা, রং-জুলা নোংরা ফ্রক বা শাড়ি। ছেলেরা পরেছে পুরনো ইজের আর জামা। এই স্টিমারঘাটে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সকলেই ভয়ার্ত, উৎকণ্ঠিত। কিন্তু ওই পরিবারটার আতঙ্কের যেন সীমাপরিসীমা নেই।

আধবুড়ো লোকটার স্ত্রীর কপাল পর্যন্ত ঘোমটায় ঢাকা। মুখে শাড়ির আঁচল গোঁজা, শীর্ণ গাল বেয়ে অবিরল জল ঝরছে। সমানে কাঁদছে সে। মুখে কাপড় ঠেসে ধরে রাখায় শব্দটা ক্ষীণ হয়ে বেরিয়ে আসছে।

বিনু একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হরিন্দর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? অত কাঁদছে কেন?

হরিন্দ বিনুর কানের কাছে মুখ এনে বিমর্ষ সুরে বলে, অগো (ওদের) সব্বনাশ হইয়া গ্যাছে।

বিনু চমকে ওঠে, কিরকম?

আমরা ইস্টিমারঘাটায় আসনের আগে অরা এইখানে আসছে। তহন থিকাই মাইয়ামানুষটা কাতে আছে (কাঁদছে)।

তুমি ওদের চেনো নাকি?

না। এইখানেই পেরথম দেখলাম। শুনাশুন যা কানে আইছে, আপনেরে কই।

খুব নিচু গলায় হরিন্দ বলে যায়। যে মেয়েমানুষটি কাঁদছে তার স্বামীর নাম হরিদাস সাহা। ওদের বাড়ি নয়া চিকন্দি গ্রামে। দেশভাগের আগে এবং পরেও ওদের ওই এলাকাটা ছিল বেশ শান্ত। আবহমান কাল যেভাবে চলছিল, হুবহু সেইভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কোনও রকম বিঘ্ন দেখা দেয়নি। পাকিস্তানের আর যেখানে যাই ঘটুক, নয়া চিকন্দি ছিল শান্তির দ্বীপ। বাইরের আঁচ সেখানে এসে লাগেনি।

কিন্তু কিছুদিন হল, হরিদাসদের এলাকাটা হঠাৎ তেতে উঠতে শুরু করেছে। উস্কানিটা কারা দিচ্ছিল, টের পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় মানুষজনের একটা অংশের মুখচোখের চেহারা যাচ্ছিল বদলে। কুমোরদের কামারদের যুগীদের বামুনদের কায়েতদের জমিজেরাত, হালহালুটি, বাড়িঘর, বাগানপুকুরের দিকে তাদের নজর এসে পড়তে লাগল। আরম্ভ হল শাসানি- দেশ ছেড়ে চলে যাও।

হরিদাস সাহা হরিন্দর মতোই ইন্ডিয়ায় কখনও যায়নি। সেখানে গিয়ে কী খাবে, কিভাবে তাদের দিন চলবে, ভেবে পাচ্ছিল না। হুমকি সত্ত্বেও ঘাড় গুঁজে তারা গ্রামে পড়ে ছিল। কিন্তু পরশু মাঝরাতে মারাত্মক ঘটনা ঘটে যায়। মুখে কাপড় বেঁধে পাঁচ সাতজনের একটা দল ঘরের দরজা ভেঙে হরিদাসের যুবতী মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। সশস্ত্র হানাদারদের ঠেকাতে পারেনি সে। তারপর ভোর হতে না হতে গ্রামের মাতব্বরদের বাড়ি গিয়ে সবার হাতে পায়ে ধরেছে। কিন্তু সুরাহা হয়নি। মাতব্বরদের অনেকেই তাকে সহানুভূতি জানিয়েছে, কেউ কেউ যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে আন্তরিকভাবে মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাকে উদ্ধার করা যায়নি।

ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল হরিদাস। সেই অবস্থাতেই স্থির করে ফেলেছে, এদেশে আর নয়। যা হবার হবে, সীমান্তের ওপারেই চলে যাবে তারা। বাক্সপেটরা, হাঁড়িকুড়ি, জামাকাপড়, যেটুকু পেরেছে কাঁখে আর মাথায় করে ছেলেমেয়ে বউয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে তারপাশায় চলে এসেছে।

বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট অনুভব করছিল বিনু। মনে হচ্ছিল, হৃৎপিণ্ড ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

ফের চারপাশ দেখে নিয়ে শ্বাস-চাপা গলায় হরিন্দ বলে, ছুটোবাবু, ইস্টিমারঘাটায় এত মানুষ যে দেখতে আছেন, তাগো কেওর কেওর (কারোর কারোর) যুবতী বউ কি মাইয়া উঠাইয়া লইয়া গ্যাছে। হরিদাস সাহার বউয়ের লাখান দুই চাইরজন মুখে আচল গুইজা কান্দে, বাদবাকি হগলে এক্কেরে পাথর। বউ-মাইয়া খুয়াইয়া কী যন্তণা নিয়া যে দ্যাশ ছাইড়া যাইতে আছে! মরণকাল তরি (পর্যন্ত) এই দুঃখু অগো ঘুচব না।

কী উত্তর দেবে বিনু? সে চুপ করে থাকে।

হরিন্দ কিছু ভেবে আবার শুরু করে, ছুটোবাবু, আর কয়দিন যদিন গেরামে থাকতাম, আমার কপালেও অ্যামনটা যে ঘটত না, ক্যাঠা (কে) জানে। ঠিক সোময়ে রাধাগোবিন্দ আমারে দ্যাশ ছাড়নের সুবুদ্ধি দিছে।

বেলা ক্রমশ চড়ছিল। সকালে হাওয়ায় যে ভেজা, ঠাণ্ডা ভাবটা ছিল, এখন আর তা নেই। রোদের তাপ বাড়ায় বাতাস বেশ শুকনো, ঝরঝরে।

নৌকোঘাটে ভিটেছাড়া মানুষ বোঝাই করে একের পর এক নৌকো আসছিলই। বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকোর সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নদীর মাঝখান দিয়ে রংবেরঙের পাল তুলে বড় বড় মহাজনী ভড় মন্থর গতিতে ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একটা লঞ্চ কি গয়নার নাও’ হেমন্তের শান্ত জলস্রোতে তুফান তুলে কোথায় চলেছে, কে জানে।

নদীতে সেই একই একঘেয়ে ছবি। অফুরান জলরাশি, নৌকো, দু’চারটে লঞ্চ। মাথার ওপর পাখির ঋক, স্বচ্ছ নীলাকাশ, কয়েক টুকরো ধবধবে ভবঘুরে মেঘ।

ডাঙাতেও সেই একই দৃশ্য, সকালে তারপশায় এসে ঠিক যেমনটি দেখেছিল। উঁচু মাটির রাস্তা ধরে মানুষ আসছেই, আসছেই। বিরামহীন।

কিন্তু কাল নারায়ণগঞ্জ থেকে যে স্টিমার ছাড়ার কথা ছিল, আজ এখনও সেটার দেখা নেই। কখন আসবে, কবে আসবে, কেউ জানে না।

সূর্য যখন সোজাসুজি মাথার ওপর চলে এসেছে, বিনু উঠে পড়ল। ডান পাশে খানিক দূরে, কাতার দিয়ে ভাতের হোটেল। আফজল হোসেন সকালে দই চিড়ে টিড়ে খাইয়ে গিয়েছিল। তারপরও অনেকটা সময় কেটে গেছে। এ অঞ্চলের মানুষের ভাতের নাড়ি। দুপুরে পেটে দুটি ভাত না পড়লেই নয়। আফজল হোসেন ঠিকই বলেছিল, ভরপেট ভাত না খেলে রাস্তার ধকল সইবার মতো শক্তি থাকবে না।

হরিন্দর পেতে-দেওয়া সুজনির ওপর কখন ঝিনুক ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিনু লক্ষ করেনি। সে হরিন্দকে বলল, তুমি এর দিকে নজর রেখো। আমি একটু ঘুরে আসছি। বলে ঝিনুককে দেখিয়ে দিল।

হরিন্দ বলে, আপনে নিচ্চিন্ত মনে যান ছুটোবাবু। বৌঠাইনরে আমি দেখুম।

ঢালু ঘাসের জমি থেকে উঁচু রাস্তায় উঠেই ফের নিচে নেমে আসে বিনু। হরিন্দদের খাওয়ার কী ব্যবস্থা হয়েছে তার জানা নেই। তারা পাশে বসে হোটেলের ভাত-তরকারি খাবে, আর ওরা খালি পেটে মুখ শুকনো করে থাকবে, তা হয় না।

বিনু জিজ্ঞেস করে, দুপুরে তোমরা কী খাবে?

হরিন্দ জানায়, আমাগো লগে দুই দিনের মতো চিড়ামুড়ি, মুছি গুড় আর কদমা আছে। হেয়াই খামু।

চিঁড়ে গুড় থাক। আমি হোটেলে ভাত আনতে যাচ্ছি। তোমরা আমাদের সঙ্গে ভাত খাবে।

আমাগো লেইগা আবার এতগুলা পয়সা খরচা করবেন!

বিনু একটু হাসল।

হরিন্দ কী ভেবে এবার বলে, আইচ্ছা, খাওয়াইতে যহন মন অইছে তহন খাওয়ান। কবে আবার প্যাটে দু’গা ভাত পড়ব হের (তার) তো দিশা নাই। আপনে অ্যাত মাইনষের ভাত ক্যামনে আনবেন? লন (চলুন), আমিও লগে যাই–

ঝিনুকের দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের ওপর দিয়ে বিনুর সঙ্গে রাস্তায় উঠে আসে হরিন্দ।

চারপাশে ভয়কাতর মানুষের জটলা। তার ভেতর দিয়ে দু’জনে এগিয়ে চলে। যেখানে হোটেলগুলো সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে, কঁচা সড়কটা সেই জায়গায় বাঁক নিয়ে ডান পাশে ঘুরে অনেক দূর চলে গেছে।

বেশ কিছু হিন্দু হোটেল এখনও টিকে আছে এখানে। সেগুলোর কাছাকাছি মুসলমানদের কটা হোটেলও চোখে পড়ল।

বিনুরা একটা হোটেলে ঢুকতে যাবে, হঠাৎ ডান দিকের সড়কে হইচই শোনা গেল। বহু মানুষের মিশ্র কণ্ঠস্বর। আওয়াজটা স্টিমারঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে।

যদিও এখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে, গভর্নমেন্ট থেকে মোটামুটি সুরক্ষার একটা বন্দোবস্তও করেছে, তবু আবহাওয়া এমনই বিষময়, যে কোনও দিন, যে কোনও সময় চরম কিছু ঘটে যেতে পারে। হয়তো স্টিমারঘাটের পাহারাদারি ফুৎকারে উড়ে যাবে। এতগুলো নির্ভূম মানুষের ওপর যদি হানাদারেরা ঝাঁপিয়েই পড়ে, পুলিশ তাদের কতটা ঠেকাতে চেষ্টা করবে, সে সম্বন্ধে সংশয় আছে।

হোটেলে ঢোকা হল না, উৎকণ্ঠিত বিনু এবং হরিন্দ ডান পাশের সড়কের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখা গেল, অনেকগুলো লোক লম্বা লম্বা পা ফেলে এদিকে আসছে। তাদের কারোর হাতে লাঠি, কারোর হাতের সড়কির ফলায় দুপুরের রোদ ঝলকাচ্ছে।

ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল হরিন্দ। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, এই লোকগুলার কী মতলব ছুটোবাবু? কিছু বিপদ হইব?

রুদ্ধশ্বাসে বিনু বলল, কী জানি, বুঝতে পারছি না।

আমরা শ্যাষ। আর বুঝিন ইন্ডিয়ায় যাওন হইল না!

হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বিনুরা। ভেতরে কাঁচা মেঝেতে কাঠের পিঁড়িতে বসে অনেকে খাচ্ছে। একধারে নিচু তক্তপোষে টিনের ক্যাশবাক্স কোলের কাছে নিয়ে বসে আছে মাঝবয়সী থলথলে চেহারার একটা লোক। খুব সম্ভব হোটেলের মালিক। বিনুদের কথাগুলো তার কানে গিয়েছিল। সে বলল, ডরের কিছু নাই। গরমেন (গভর্নমেন্ট) ইস্টিমারঘাটায় ঝঞ্ঝাট করতে দিব না। পুলিশ আছে।

হরিন্দ বলল, মেলা (অনেক) মানুষ লাঠি সড়কি লইয়া এই দিকে আইতে আছে।

হোটেলের মালিক বাইরে বেরিয়ে আসে। দূরের সশস্ত্র লোকগুলোকে দেখতে দেখতে তার কপালে ভাঁজ পড়ে। বলে, দ্যাশভাগের আগে বড় দাঙ্গার সোময় এইখানে কিছু হয় নাই, পরেও না। অরা সড়কি উড়কি লইয়া আইতে আছে ক্যান, গতিক বুইঝা লই। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে থাকে।

ডান ধারের যে সড়কটা ধরে বাহিনীটা আসছে, তার দু’ধারেও ভিটেমাটি খোয়ানো প্রচুর মানুষ স্টিমার ধরার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সড়কের অনেকটা নিচে এখানে ধানখেত। অস্ত্রধারীদের দেখে ভয়ে আতঙ্কে তাদের অনেকে উধ্বশ্বাসে ধানখেতের দিকে দৌড়ে যায়। কেউ কেউ দিশেহারার মতো এধারে ওধারে ছোটাছুটি করতে থাকে।

সশস্ত্র দলটা অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখন তাদের আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সড়কের এক পাশে দশ বারটি মুসলমান যুবকের একটা সারি, আরেক পাশেও তা-ই। এদের তিন চারজনের হাতে অস্ত্র তো আছেই, তা ছাড়া কাঁধে এবং মাথায় রয়েছে প্রচুর লটবহর।

যুবকদের দুই সারির মাঝখানে সত্তর বাহাত্তর বছরের একজন বৃদ্ধ। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি। তার সঙ্গে একজন বৃদ্ধা। মহিলার একটা চুলও কাঁচা নেই, সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর লেপা, হাতে শাঁখা এবং রুপো-বাঁধানো লোহা। এঁরা ছাড়াও রয়েছে একটি মাঝবয়সী থান-পরা বিধবা এবং দুটি অবিবাহিত তরুণী। সবারই হাতে-পায়ে-মুখে-মাথায় পুরু ধুলোর স্তর। বোঝা যায়, বহু দূর থেকে তারা হেঁটে আসছে।

এত বড় দলটার একেবারে সামনে একজন প্রৌঢ় মুসলমান। তার দিকে তাকালে রীতিমতো সম্ভ্রম হয়। টকটকে ফর্সা রং, ধারাল নাক, একজোড়া উজ্জ্বল চোখ, চওড়া কপাল, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। অভয় দেবার ভঙ্গিতে হাত তুলে যে সন্ত্রস্ত মানুষগুলো এদিকে সেদিকে ছোটাছুটি করছিল তাদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সমানে বলে যাচ্ছেন, ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না। আমরা খুনখারাপি লুটপাট করতে আসি নাই। যে যেইখানে আছিলেন সেইখানে ফিরা আসেন। পলাইয়েন না।

যারা পালাচ্ছিল তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ প্রৌঢ় মুসলমান এবং তার সঙ্গীদের লক্ষ করে যখন বুঝতে পারে ওঁদের দিক থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, পায়ে পায়ে ফিরে আসতে থাকে।

সশস্ত্র দলটাকে দেখে বিনুর চোখেমুখে যে আতঙ্ক ফুটে বেরিয়েছিল, এখন সেটা বদলে গিয়ে শুধুই অপার বিস্ময়। সে আন্দাজ করে নিল, প্রৌঢ়টি কয়েকজন যুবককে নিয়ে পাহারা দিয়ে দিয়ে একটি হিন্দু পরিবারকে তারপশায় নিয়ে এসেছে।

পাশ থেকে হোটেলের মালিক বলে ওঠে, কইছিলাম না, তরাসের কিছু নাই। আমাগো তারপাশায় কুনো গণ্ডগোল হয় না। বলে ব্যস্তভাবে হোটলের ভেতর ঢুকে গেল। লোকজন খেতে বসে গেছে। এখন তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই।

প্রৌঢ় মুসলমানটি চারদিক লক্ষ করতে লাগলেন। কোথাও এতটুকু কাঁক নেই। সর্বত্র ঠাসা মানুষ। তিনি সঙ্গীদের নিয়ে বাঁ পাশে ঘুরে নৌকোঘাটের দিকে চলে গেলেন।

হরিন্দও কম অবাক হয়নি। সে কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করল, আমরা ডরে মরতে আছিলাম। কী ভাবছিলাম, আর কী দেখলাম! হগল মানুষ মোন্দ হইয়া যায় নাই।

বিনু উত্তর দিল না। হোটেলে ঢুকে ভাত ডাল তরকারি মাছের পাতুরি কিনে হরিন্দ আর সে নৌকোঘাটের কাছাকাছি তাদের সেই জায়গাটায় ফিরে এল। হোটেলের লোকেরা সিলভারের নানা পাত্রে খাদ্যবস্তুগুলো গুছিয়ে গাছিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে দিয়েছে কলাপাতা আর মাটির গেলাস, একটা খাবার জলের কলসিও। খাওয়াদাওয়া চুকলে পাত্রগুলো নদীর জলে ধুয়ে পাখলে হোটেলে ফেরত দিয়ে যেতে হবে।

ফিরে এসে বিনু দেখতে পেল, ঝিনুক হরিন্দদের সুজনির ওপর বসে উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে চতুর্দিকে কী খুঁজছে। ওর মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যায়, সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে। জেগে উঠে বিনুকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।

ঝিনুক দম-আটকানো গলায় বলল, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কোথায়? বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।

হাতের পাত্রগুলো নামিয়ে রেখে বিনু ঝিনুকের পাশে বসে পড়ে। বলে, হোটেলে। দুপুরে খেতে হবে তো–

সেই ঢাকা থেকে ফেরার পর সারাক্ষণ ত্রস্ত হয়ে থাকে ঝিনুক। কী এক আতঙ্ক যেন তাকে দিনরাত তাড়া করে চলেছে।

ঝিনুকের চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে যাচ্ছে। কান্না-জড়ানো ঝাঁপসা গলায় সে বলে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওনি কেন?

তুমি ঘুমোচ্ছিলে।

ডাকতে পার নি?

ঘুম ভাঙালে তোমার শরীর খারাপ হত। তাই–

হলে হত। অবুঝ বালিকার মতো মাথা ঝাঁকাতে থাকে ঝিনুক, তুমি আমাকে ফেলে কক্ষনো আর কোথাও যাবে না।

ঝিনুকের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে করতে বিনু বলে, ঠিক আছে, যাব না।

কান্নার বেগ কমে আসে ঝিনুকের। হাতের পিঠে চোখ মুছে সে বলে, কী ভয় যে পেয়েছিলাম! ওই দেখ– বলে ডান ধারে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।

বিনু আগে লক্ষ করেনি। এবার চোখে পড়ল, খানিক দূরে সেই প্রৌঢ় মুসলমানটি এবং তার সঙ্গীরা বসে আছে। বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, দুই তরুণী আর বিধবাটিকেও দেখা গেল। ওদের পাশে স্থূপাকার মালপত্র। অর্থাৎ অন্য কোথাও ফাঁকা জায়গা না পেয়ে ওরা এখানে চলে এসেছে।

প্রৌঢ় মুসলমানটি অবশ্য চুপচাপ বসে নেই। আশেপাশে যারা আগে থেকে এসে বসে ছিল তাদের কী সব জিজ্ঞেস করছে। খানিকটা দূরে থাকায় বিনুরা অবশ্য কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে না।

ঝিনুকের ভীতির কারণটা এবার স্পষ্ট হয়ে যায়। লাঠি সড়কি দেখে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছে সে। ঢাকার অভিজ্ঞতা তার স্মৃতি থেকে কোনও দিনই মুছে যাবার নয়। বিনু বলল, ভয় পেও না, ওরা লোক ভাল।

ঝিনুক বলে, তুমি কেমন করে জানলে?

লোকগুলো সম্পর্কে কেন তার এমন ধারণা হয়েছে, বুঝিয়ে দেয় বিনু।

ঝিনুক আর কোনও প্রশ্ন করে না।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রৌঢ় মুসলমানটির নজর এসে পড়ে বিনুর ওপর। কী ভেবে তিনি উঠে আসেন। বলেন, আদাব। আমার নাম নাসের আলি।

বিনু টের পেল, ঝিনুক তার কোমরের কাছটা প্রাণপণে খামচে ধরেছে। সে যতই নাসের আলিকে ভালমানুষ বলে তাঁর গুণগান করুক, ঝিনুকের সংশয় কাটছে না। লোকটা তাদের কাছে চলে আসায় সে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে।

বিনু হাতজোড় করে নিজের নাম জানিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে।

নাসের আলি বলেন, আমি জামতলি হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার। আপনেগো বাড়ি আছিল কই?

বিনু বলল। জামতলি নামটা তার জানা, তবে সেটা কোথায় সে সম্বন্ধে তার পরিষ্কার ধারণা নেই।

নাসের আলি বলেন, দ্যাশ ছাইড়া চইলা যাইতে আছেন?

হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে বিনু।

দেইখা মনে হয়, আপনে একজন এডুকেটেড ইয়ং ম্যান। দয়া কইরা একটা উপকার করবেন?

কী উপকার?

দূরে বৃদ্ধকে দেখিয়ে নাসের আলি বলেন, ওনার নাম রামরতন গাঙ্গুলি। এক কালে জামতলি হাই স্কুলের হেডমাস্টার আছিলেন। আমি ওনার ছাত্র। ঢাকা ইউনিভার্সিটির এম. এ’তে ফার্স্ট ক্লাস। হেই ব্রিটিশ আমলে ইচ্ছা করলে বড় অফিসার হইতে পারতেন। হন নাই।

নাসের আলি বিস্তারিতভাবে আরও জানান, পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা পাওয়ার পর গ্রামে এসে থিতু হয়ে বসলেন রামরতন। জামতলি অঞ্চলে সে আমলে লেখাপড়া নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। জায়গাটা ছিল অশিক্ষা আর কুশিক্ষার বিশাল আড়ত। রামরতন বিপুল উদ্যমে মানুষ গড়ার কাজে নামলেন। জামতলি এবং তার চারপাশের দশ বারটা গ্রামের প্রতিটি হিন্দু আর মুসলমানের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তিনি ছাত্র যোগাড় করতে লাগলেন। রামরতনের তুলনা নেই। মানুষ এবং শিক্ষক হিসেবে তিনি সৎ, নির্লোভ, নিষ্ঠাবান। জামতলি এলাকায় তার হাত ধরেই শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এখন ওখানকার প্রতি দশটা পরিবারে কম করে একজন গ্র্যাজুয়েট, প্রতি বিশটা পরিবারে একজন এম. এ।

শুনতে শুনতে রাজদিয়ার আশু দত্তর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বিনুর। হুবহু তারই মতো একই ছাঁচে গড়া। নিজের কেরিয়ার, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সব কিছু বিসর্জন দিয়ে জাতি গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আশু দত্ত। সেই সময় এই ধরনের আদর্শবাদীদের পূর্ব বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যেত।

নাসের আলি থামেননি, এই মানুষটারে আমাগো মাথায় কইরা রাখনের কথা। কিন্তুক দিনকাল আর আগের মতো নাই। কিছু মানুষ জানোয়ার হইয়া গ্যাছে। যারে বাপের মতো সম্মান দেওনের কথা, তারই সর্বনাশ করতে চায়। চাশভাগের আগে থিকাই আমাগো জামতলি এরিয়াটা গরম হইয়া আছে। তবু আমরা অনেকেই রামরতন স্যারের ফ্যামিলি আগলইয়া রাখছিলাম। কিন্তু আর পারা যাইব না। ওনার ঘরে দুই অবিয়াত (অবিবাহিত) জুয়ান (যুবতী) মাইয়া। কুন দিন কী অঘটন ঘইটা যাইব। হেই লেইগা কয়জন ভাল সাহসী পোলা জুটাইয়া পাহারা দিয়া দিয়া তারপাশায় লইয়া আইছি। পথেও তো ভরসা নাই। কার মনে কী কুমতলব আছে, কে জানে। জুয়ান মাইয়া দেইখা কে কী কইরা বসব, হেইর লেইগা পাহারাদারির বন্দোবস্ত।

বিনু জিজ্ঞেস করল, আমাকে কী করতে হবে বলুন–

নাসের আলি জানালেন, তারপাশার স্টিমারঘাটে দেশ ছাড়ার জন্য যারা জড়ো হয়েছে তারা খুবই সামান্য মানুষ। অক্ষরপরিচয়হীন, অসীম ত্রাসে সবাই কুঁকড়ে আছে। নিজেদের নিয়ে তারা এতই উৎকণ্ঠিত যে অন্য কোনও দিকে তাকাবার সময় নেই। এদের কেউ কখনও কলকাতায় যায়নি। তাদের কারোর ভরসায় রামরতনকে সীমান্তের ওপারে পাঠাতে সাহস হয় না। বিনুকে দেখে মনে হয়েছে–শিক্ষিত, ভদ্র যুবক। সে তো কলকাতায় যাচ্ছেই, কষ্ট করে পথে যদি রামরতনদের একটু দেখাশোনা করে, নাসের আলি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। তারই উচিত ছিল শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই এবং তার পরিবারকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসা। ওই মানুষটার প্রতি তার ঋণের শেষ নেই। কিন্তু দিনকাল খারাপ, বিষবাষ্পে আবহাওয়া ছেয়ে গেছে। সীমান্তের ওপারে কী ঘটছে, তার জানা নেই। কলকাতায় গেলে ফিরে আসা সম্ভব হবে কিনা, কে জানে। প্রতিহিংসা নেবার জন্য সেখানেও মানুষ হয়তো অস্ত্র শানিয়ে অপেক্ষা করছে।

নাসের আলি বিনুর হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, না কইবেন না। তার গলার স্বরে অনুনয়।

বিনু একবার ঝিনুককে দেখে নিল। এই রুগণ, লাঞ্ছিত, সদাত্রস্ত তরুণীটি তো রয়েছেই, তার ওপর রামরতনদের দায়িত্ব। ওঁদের সঙ্গে আবার দুটি পূর্ণ যুবতী। এই দুঃসময়ে, ওই বয়সের মেয়েদের নিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পাওয়া যে কতখানি বিপজ্জনক, সে জানে। কিন্তু নাসের আলির মুখের ওপর সোজাসুজি না বলা গেল না।

বিনু বলল, রাস্তায় বিপদ ঘটতে পারে, তাই বুঝে আপনি নিজেই তোকজন সঙ্গে করে পাহারা দিতে দিতে স্টিমারঘাটে এসেছেন। আমাকে ওঁদের নিয়ে যেতে হবে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে কলকাতা। বুড়ো মানুষদের নিয়ে ততটা ভয় নেই। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের কম বয়েসের দুই মেয়ে রয়েছে। ঝিনুককে দেখিয়ে বলে, আমার সঙ্গে এও চলেছে। পথে যদি হামলা হয়, আমি কী করে ঠেকাব?

নাসের আলি বলেন, হ, ঠিকই কইছেন।

দেশ ছেড়ে যে হাজার হাজার মানুষ চলেছে তারাও সঙ্গে থাকবে। কিন্তু তাদের কেউ বাধা দেওয়া দূরের কথা, একটা আঙুলও তুলবে না।

জানি। মানুষের মনে এখন বড় ডর।

অনেকক্ষণ ম্রিয়মাণ বসে থাকেন নাসের আলি। রামরতনের দুই যুবতী মেয়ের সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে হয়তো ভেতরে ভেতরে বিচলিত হয়ে পড়েন। তারপর খানিকটা হতাশার সুরে বলেন, কিছু যদি হয়ই, হেইটা ওনাগো বরাত। তারপাশা পর্যন্ত তিনি ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন। এরপর ভাগ্যের হাতে রামরতনদের সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

বিনু বলে, আরেকটা কথা—

কন–

ধরুন, কলকাতা পর্যন্ত আমরা পৌঁছতে পারলাম। তারপর মাস্টারমশাইদের কী হবে?

নাসের আলি বলেন, ওনার এক ভাইস্তা (ভাইপো) বিমল গাঙ্গুলি কইলকাতায় থাকে। হেরে চিঠি লেইখা জানান হইছে, মাস্টারমশাইরা যাইতে আছেন।

বিনুর মনে পড়ে যায়, সেও তার দুই দিদি এবং বাবাকে চিঠি লিখে তাদের কলকাতায় যাবার কথা জানিয়েছে। কিন্তু উত্তর আসেনি। জিজ্ঞেস করল, মাস্টারমশাই কি তার ভাইপোর জবাব পেয়েছেন?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়েন নাসের আলি, না। আইজ কাইল পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে গণ্ডগোল চলতে আছে। ইত্মাি থিকা ঠিকমতো চিঠি আসে না। এইপার থিকা উই পারে যায় কিনা, হেও জানি না।

রামরতন গাঙ্গুলির ব্যাপারটা অনেকখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তার ভাইপো চিঠি না পেলে কী হবে? ওঁদের কি তার ঠিকানায় বিকেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে? সে বলে, মাস্টারমশাইয়ের ভাইপো চিঠি না পেয়ে থাকলে তো শিয়ালদা স্টেশনে আসবে না।

কী কইরা আসব? জ্যাঠার যাওনের খবর জানব ক্যামনে?

মাস্টারমশাই কি কলকাতার রাস্তাঘাট চেনেন? ভাইপো না এলে শিয়ালদা থেকে তার বাড়ি চলে যেতে পারবেন?

কইলকাতা তেনার এক্কেবারে অচিনা না। যদূর জানি, অনেক কাল আগে বার দুই ওইখানে গেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যেইবার মারা যান হেইবার। আরেক বার গেছিলেন ওনার বন্ধু জামতলির সেকেন্দর আলি সাহেবরে লইয়া ডাক্তার বিধান রায়েরে দেখাইতে। সেকেন্দর সাহেব রোগে রোগে মরতে বসছিলেন। বিধান ডাক্তার তেনারে  বাঁচাইয়া দিছিলেন।

একটা দুশ্চিন্তা মোটামুটি লাঘব হল বিনুর। শিয়ালদায় পৌঁছতে পারলে রামরতনরা ভাইপোর বাড়ি চলে যেতে পারবেন।

নাসের আলি বলল, আমি এখন যাই। যে পোলাগুলা মাস্টারমশাইগো পাহারা দিয়া আনছে তাগো হোটেলে খাওয়াইয়া বাড়িতে পাঠাইতে হইব।

কী ভেবে বিনু জিজ্ঞেস করল, আপনি ফিরে যাবেন না?

না। যতক্ষণ না মাস্টারমশাইরা স্টিমারে উঠতে আছেন, আমি এইখানেই থাইকা যামু।

গোয়ালন্দের স্টিমার আজ আসবে কিনা, কারোর জানা নাই। রামরতনদের স্টিমারে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত তারপাশা ছেড়ে যাবেন না নাসের আলি। দু’চার দিন এখানে যদি থেকেও যেতে হয়, থাকবেন।

বিনু আর কোনও প্রশ্ন করল না। নাসের আলিও আর বসলেন না, রামরতনদের কাছে ফিরে গেলেন।

.

৩.০৯

জামাকাপড়া, বিছানাপত্র, সবই খোয়া গেছে। হরিন্দ একখানা সুজনি পেতে দিয়েছিল, তাই তারা বসতে পেরেছে। কিন্তু সামনে লম্বা পাড়ি। ঠাণ্ডাটা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। সূর্য ডোবার আগেই কুয়াশায় চরাচর ঢেকে যায়। সীমান্তের ওপারে পৌঁছবার জন্য আকণ্ঠ উদ্বেগ তো রয়েছেই, শীতের সঙ্গেও যোঝযুঝিটা কম নয়।

দুপুরে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে কাপড়ের দোকান থেকে দু’খানা মোটা সুতির চাদর কিনে এনেছিল বিনু। তারই একটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে ঝিনুক।

এখন বিকেল। সূর্য আকাশের গা বেয়ে পশ্চিমে অনেকখানি ঢলে পড়েছে। গাঢ় হয়ে ছায়া নামছে চারদিকে। রুপোর মিহি রেণুর মতো দিগন্তে কুয়াশা জমছে। শান্ত নদীর ভঙ্গুর ঢেউয়ে ঢেউয়ে হেমন্তের শেষ বেলা সোনা ঢেলে দিচ্ছে।

ঝিনুকের পাশে বসে ছিল বিনু। তার মুখ নদীর দিকে ফেরানো। সেখানে একই চলমান দৃশ্য। নৌকো আসছেই, আসছেই। ঝাকে ঝাকে, বিরতিহীন।

মাঝে মাঝে উঁচু সড়কের দিকে চোখ চলে যায় তার। সেখানেও একই চিত্র। পায়ে হেঁটে মানুষ আসছে ক্লান্ত, ধূলিধূসর, ভয়ার্ত। বেশির ভাগই আসছে নিজের নিজের ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে আলাদা আলাদা, ছন্নছাড়া। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে একসঙ্গে জমাট-বাঁধা বহু মানুষ। বোঝা যায়, এক একটা গ্রাম দলবদ্ধ হয়ে চলে এসেছে। পুরুষদের অনেকের হাতেই লাঠি রামদা বা চোখা ফলাওলা বর্শা বা টেটা। অর্থাৎ এরা ভয়ঙ্কর রকমের মরিয়া। ঘরবাড়ি ভিটেমাটি খুইয়ে যখন চলেই যেতে, হচ্ছে, তখন কিসের আর মৃত্যুভয়? হামলা হলে তারা ছাড়বে না, পালটা মার দেবে।

যার শক্তসমর্থ, মেয়ে কি পুরুষ, তাদের সবারই মাথায় বা কাঁধে বাক্সপেটরা। সকাল থেকেই একই দৃশ্য দেখে আসছে বিনু। হঠাৎ নজরে পড়ল, অনেকে থুথুড়ে বুড়োবুড়ি বা অথর্ব পঙ্গুদের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই এই বুড়োবুড়িরা ওদের মা-বাপ, ঠাকুমা-ঠাকুরদা, কিংবা প্রিয় কোনও পরিজন। এদের কোথায় ফেলে রেখে যাবে?

অনন্ত প্রতীক্ষা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে? পরশু সন্ধেবেলায় হেমনাথের বাড়ির পুকুরঘাট থেকে রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর অনিবার্য মৃত্যু যে কতবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার লেখাজোখা নেই। আতঙ্কে স্নায়ুমণ্ডলী সারাক্ষণ ছিঁড়ে পড়েছে। প্রচণ্ড চাপ সামাল দেবার পর যা হয়, এখন শুধুই অবসাদ। শারীরিক বা মানসিক অনুভূতিগুলো কেমন যেন অসাড় লাগছে।

হয়তো অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বিনু, হঠাৎ চারপাশ থেকে তুমুল শোরগোল উঠল।

ইস্টিমার আসতে আছে, ইস্টিমার আসতে আছে—

লৌড়াও লৌড়াও (দৌড়াও দৌড়াও)—

বইসা থাকলে আর জাগা (জায়গা) পামু না।

সচকিত বিনু দেখতে পেল, অনেক দূরে আকাশ যেখানে পিঠ ঝুঁকিয়ে নদীতে নেমে গেছে, একটা জলযানের চেহারা ফুটে উঠেছে। উঁচু চোঙা দেখে অনুমান করা যায়, ওটা সত্যিই স্টিমার।

প্রথমে ছিল হাত চারেক লম্বা কালচে একটা রেখা। ক্রমশ স্টিমারটা স্পষ্ট হতে লাগল। প্রকাণ্ড জলপোকার মতো জলযানটা ঢেউ কেটে কেটে তারপাশার দিকে এগিয়ে আসছে। সেটার চোঙা দিয়ে গল গল করে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে হেমন্তের বাতাসে মিশে যাচ্ছে।

এদিকে স্টিমারঘাটের সুবিশাল চত্বর জুড়ে হুলস্থুল বেধে গেছে। চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি, কুৎসিত গালিগালাজের আদানপ্রদান। সবাই আগে গিয়ে স্টিমারে জায়গা দখল করতে চায়। এই হননপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি পালানো যায়।

বিনুর চারপাশে যারা বসে ছিল তাদের মধ্যে প্রচণ্ড চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। হরিন্দ মালপত্র গোছগাছ করতে করতে তাড়া লাগায়, উইঠা পড়েন ছুটোবাবু, তরাতরি করেন।

ওধার থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নাসের আলি বিনুকে বলতে থাকেন, আর বইসা থাইকেন না। জেটির দিকে আউগাইয়া (এগিয়ে) যাইতে হইব।

হরিন্দ বা নাসের আলির তাড়া দেবার কারণটা বুঝতে পারে বিনু। কিন্তু তাদের সঙ্গে দুটো সুতি চাদর ছাড়া আর কোনও রকম লটবহর নেই। চাদর দু’টো দ্রুত ভাজ করে ঝিনুককে নিয়ে উঠে পড়ে সে। হরিন্দরাও তাদের বোঁচকাবুচকি, বাক্স বিছানা মাথায় তুলে নিয়েছে।

নাসের আলি যে জোয়ান ছেলেদের পাহারাদার নিয়ে এসেছিলেন, দুপুরে খাইয়ে তাদের গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। হয়তো ভাবেননি, স্টিমার এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বে। তিনি নিজে যতটা পেরেছেন রামরতনদের মালপত্র হাতে এবং কাঁধে চাপিয়েছেন, বাকিগুলো নিয়েছে রামরতনের মেয়েরা। শুধু তারাই নয়, চারপাশের সবাই যে যার লটবহর মাথায় চাপিয়ে বা হাতে ঝুলিয়ে জেটিঘাটের দিকে দৌড়বার চেষ্টা করছে। সেই দৌড়ের ভেতর ঢুকে গেল বিরা।

কিন্তু সামনের দিকে মানুষের নিরেট দেওয়াল। ঠাসবুনট ভিড় ঠেলে এগোয় কার সাধ্য।

ওদিকে স্টিমারটা কোনাকুনি নদী পেরিয়ে জেটিঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছিল। সেটার বিরাট বিরাট চাকার ঘা লেগে জল তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এক ঝাঁক শঙ্খচিল তক্কে তক্কে ছিল; কোত্থেকে বেরিয়ে এসে এখন জাহাজের মোটা গোলাকার চোঙাটার চারপাশে চক্কর দিতে শুরু করেছে।

সামনে অগুনতি মানুষ। পেছনেও তাই। দুদিকের চাপে মাঝখানের লোকজনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বিশেষ করে ঝিনুকের। বিনু সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রাণপণে তাকে আগলে রাখতে চাইছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। মনে হচ্ছে, তার হাত-পা ঘাড়-মাথা ছিঁড়ে পড়বে। ওদিকে গলার শির ফুলে উঠেছে ঝিনুকের; দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

ঝিনুক গোঙানির মতো আওয়াজ করে বলে, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ভিড় থেকে বাইরে নিয়ে যাও।

বিনু বলল, একটু কষ্ট কর ঝিনুক।

হরিন্দ এবং নাসের আলিরা কাছাকাছিই আছেন।

হরিন্দ বলে, অহন বাইর হইয়া গ্যালে ইস্টিমারে ওঠন যাইব না বৌঠাইন।

নাসের আলিও তা-ই বললেন।

ঝিনুক জোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, আমি আর পারছি না, পারছি না, পারছি না।

তাকে এই মুহূর্তে বাইরে বার করে নিয়ে যাওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কেননা, শুধু সামনে আর পেছনেই না, দু’পাশেও অসংখ্য মানুষ।

বিনু বলল, এই স্টিমারটা ধরতে না পারলে এখানেই পড়ে থাকতে হবে। আবার কবে স্টিমার আসবে তার ঠিক নেই। ঝিনুককে নিজের গায়ের সঙ্গে লেপটে দু’হাতে জড়িয়ে রেখে চারদিকের ধাক্কা সামলাতে থাকে সে।

ঝিনুক আর কিছু বলে না। তার নির্জীব রোগা শরীর নেতিয়ে পড়েছে। ঘাড় ভেঙে মাথাটা বিনুর বুকের ওপর যেন ঝুলছে।

গম্ভীর ভোঁ বাজিয়ে ওদিকে স্টিমারটা জেটির গায়ে এসে ভিড়েছে। নোয়াখালি কি সিলেট জেলার খালাসিরা স্টিমার থেকে মোটা মোটা লোহার শেকল জেটির দিকে ছুঁড়ে দিল। জেটিঘাটে আর একদল খালাসি তৈরিই ছিল। তারা শেকলগুলো লুফে মোটা মোটা লোহার থামে বেঁধে ফেলল।

বিনু জানে, স্টিমারটা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছে। জলযানটাতে ঠাসা ভিড়। অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জ থেকেই মানুষ তুলতে তুলতে সেটা এখানে এসে পৌঁছেছে।

স্টিমারটা তেতলা। নিচের ডেক থেকে ওপর পর্যন্ত সর্বত্র ছন্নছাড়া উদ্বাস্তুরা দলা পাকিয়ে রয়েছে। কোথাও একটা কুটো ফেলার মতো ফঁক আছে বলে মনে হয় না। এধারে তারপাশা স্টিমারঘাটে হাজার কয়েক লোক ওটায় ওঠার জন্য সমানে ধস্তাধস্তি করছে।

পোক্ত শেকল দিয়ে বাঁধার পর খালাসিরা গ্যাংওয়ে পেতে জেটির সঙ্গে স্টিমারকে জুড়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে গ্যাংওয়ের সরু পথ ধরে পাড়ের লোকজন স্টিমারে ঢুকে পড়তে থাকে।

স্টিমার কানায় কানায় বোঝাই ছিল। তারপরও কী প্রক্রিয়ায় যে আরও দু’আড়াই শ’ মানুষ ঠেসে ঠেসে ঢুকে পড়ল, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না বিনুর।

হুড়োহুড়ির কারণে জমাটবাঁধা ভিড়টা একদিকে একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল। সেই ফাঁক দিয়ে জেটির কাছাকাছি চলে এসেছে বিনুরা, কিন্তু স্টিমার পর্যন্ত পৌঁছোনা গেল না। তার আগেই গ্যাংওয়ে তুলে ফেলেছে খালাসিরা; জেটির মোটা লোহার থামগুলো থেকে শেকল খুলে দিয়েছে। তবু মরিয়া হয়ে অনেকেই স্টিমারে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল। খালাসিরা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তাদের বাপান্ত করতে করতে চেঁচাচ্ছে, পুঙ্গির পুতেরা, গাঙ্গের পানিতে পইড়া মরতে চাও?

জানের মায়া নাই?

যা শালারা, জেটির ভিতরে সান্দ্‌ (ঢোক) গিয়া–

ঠেলে, ধাক্কা মেরে জলের কিনার থেকে খালাসিরা উদ্ভ্রান্ত মানুষগুলোকে জেটির মাঝখানে ঢুকিয়ে দেয়।

সন্ধে নেমে গিয়েছিল বেশ খানিকক্ষণ আগে। জেটিঘাটে অসংখ্য আলো জ্বলে উঠেছে। গোয়ালন্দগামী স্টিমারটার একতলা থেকে তেতলা পর্যন্ত শুধু আলো আর আলো।

আকাশপাতাল কাপিয়ে বিকট শব্দ করে একসময় স্টিমারের ইঞ্জিন চালু হল। বিরাট বিরাট চাকাগুলো পাহাড়প্রমাণ ঢেউ তুলে দুরন্ত বেগে ঘুরতে শুরু করেছে। নদীতীরের বাঁধন ছিন্ন করে স্টিমারটা গুরুগম্ভীর ভো দিতে দিতে ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল।

এদিকে সমস্ত জেটিঘাট জুড়ে কান্নার রোল উঠেছে। যারা স্টিমারে উঠতে পারেনি, প্রবল হতাশায় তারা ভেঙে পড়েছে। কেউ কাঁদছে চাপা গলায়, কেউ হাউ হাউ করে। তাদের হয়তো ধারণা, গোয়ালন্দের এটাই শেষ স্টিমার। সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় যাওয়া বুঝি তাদের হল না।

বিনু আগেই বুঝে গিয়েছিল, আজকের স্টিমারে তাদের পক্ষে ওঠা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। জেটির মুখ পর্যন্ত চলে আসতে পেরেছে। আশা করা যায়, এরপর যে স্টিমার আসবে সেটায় হয়তো জায়গা পেয়ে যাবে। তাও যদি না পারে, তার পরের স্টিমারে।

হরিন্দর গলা কানে এল, ছুটোবাবু, এইখানে আসেন। এই যে, এই দিকে—

বিনুর চোখে পড়ল, জেটিঘাটের ভেতরে এক কোণে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে আছে হরিন্দ। চোখাচোখি হতে সে হাত নাড়তে লাগল।

বিনুদের সামনে এখনও পঞ্চাশ ষাট জনের নিরেট পাঁচিল। সেটা ভেদ করে ঝিনুককে নিয়ে আর এগুনো যাচ্ছে না। কেউ এক বিঘত জায়গাও ছাড়তে রাজি নয়। জেটির ওধারের গেটের দিকে যতটা এগিয়ে থাকা যাবে, স্টিমার এলে আগে উঠে পড়ার তত বেশি সুযোগ।

বিনু আর পেরে উঠছিল না। পা এবং মাথা টলছে। টের পাচ্ছিল, শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু ক্ষয়ে আসছে। যত পলকা আর রোগাই হোক, একটি তরুণীর দেহের ভারে তার শিরদাঁড়া বেঁকে দুমড়ে যাচ্ছে।

হরিন্দ বিনুদের লক্ষ করছিল। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সে। সামনের লোকগুলোকে ঠেলে সরাতে সরাতে চেঁচাতে থাকে, উনাগো (ওঁদের) আসতে দ্যাও–সরো সরো—

লোকগুলো রুখে ওঠে, ক্যান, পিছের মানুষ আগে যাইব ক্যান? কেওরে সুমখে যাইতে দিমু না।

আমরা এক লগে আইছি। গুতাগুতিতে ওনারা পিছাইয়া পড়ছিল। আটকাইও না, পথ ছাড়–

ক্যান ছাড়ুম? পিছাইয়া যহন পড়ছে, পিছাইয়াই থাকব।

হরিন্দ আর কিছু বলে না। লোকটার অলৌকিক ক্ষমতা। হাতে পায়ে তার বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। গায়ের জোরে ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে করে বিনু এবং ঝিনুককে তার বউ ছেলেমেয়েরা যেখানে বসে ছিল সেখানে নিয়ে আসে। সেই পুরনো সুজনিটা ক্ষিপ্র হাতে পেতে দিয়ে বলে, বৌঠাইনরে তরাতরি শোয়াইয়া দ্যান। বড় কাহিল হইয়া পড়ছে।

নির্জীব, মৃতপ্রায় ঝিনুককে শুইয়ে দেয় বিনু। বাইরে আকাশ থেকে হিম নামছে, নদীর ওপর দিয়ে হেমন্তের ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জেটির ভেতরটা বেশ গরম। চারদিকে থিকথিকে ভিড়। এত মানুষ এক জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থাকলে যা হয়, তাদের গায়ের তাপে এবং উষ্ণ নিঃশ্বাসে এখানকার বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে আছে।

অনেকক্ষণ ঝিনুককে জড়িয়ে ধরে রাখার কারণে বুক এবং ডান হাতটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে বিনুর। বাঁ হাত দিয়ে বুকটা ডলতে থাকে সে। চোখেমুখে তীব্র ক্লেশের ছাপ।

হরিন্দ সহৃদয় সুরে বলে, বৌঠাইনেরে অতখানি সোময় ধইরা রাখছিলেন। বুক আর ড্যানা (হাত) নি বিষাইতে (কষ্ট) আছে?

আস্তে মাথা নাড়ে বিনু।

হরিন্দ নিরাশার সুরে এবার বলে, এক ইস্টিমার গেল, উঠতে পারলাম না। কবে যে পরেরটা আসব ক্যাঠা জানে। দুগগতির আর শ্যাষ নাই। তার হা-হুঁতাশ চলতেই থাকে।

হঠাৎ বাঁ দিক থেকে পরিচিত গলা ভেসে আসে, বাবুসাহেব–বাবুসাহেব–

মুখ ঘোরাতেই বিনু নাসের আলিকে দেখতে পায়। খানিক দূরে রামরতন গাঙ্গুলিদের আগলে তিনি বসে আছেন।

আপনেগো জেটিতে না দেইখা চিন্তা হইতে আছিল। যাউক, ভিতরে আইতে পারছেন। বলতে বলতে উঠে এলেন নাসের আলি, আর কিছুক্ষণ দেইখা আপনেগো খোঁজ করতে বাইরে যাইতাম।

স্টিমারে ওঠার জন্য যখন মরণপণ ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছিল, ঝিনুককে নিয়ে বিনু তখন এতই ব্যতিব্যস্ত, এতই শঙ্কিত যে নাসের বা রামরতনদের কথা খেয়াল ছিল না। লক্ষ করেনি, কখন প্রাক্তন মাস্টারমশাই এবং তার পরিবারকে নিয়ে নাসের আলি জেটিতে চলে এসেছেন।

বিনু বলল, বসুন—

নাসের আলি কাছাকাছি বসে পড়েন।

বিনু বলে, তা হলে আজ আর আপনার গ্রামে ফেরা হল না?

কী কইরা ফিরুম? মাস্টারমশাইগো স্টিমারে না তোলন তরি জেটিঘাটেই থাইকা যামু–

এই কথাটা বুঝিবা আগেও একবার বলেছিলেন নাসের আলি। বিনু একটু ভেবে জিজ্ঞেস করল, আবার কবে স্টিমার আসবে, বলতে পারেন?

নাসের আলি বললেন, ক্যামনে কই? সরকারের মতিগতি বুঝি না। যারা দ্যাশ ছাইড়া যাইতে চায় তাগো তরাতরি যাওনের ব্যবস্থা কইরা দিলেই তো হয়। দিনে তিন চাইটা কইরা স্টিমার দিলে মানুষের এত কষ্ট হইত না।

বিনু ভাবে, এ দেশের সরকার যারা চালায়, তাদের কারোর যদি নাসের আলির মতো সহানুভূতি থাকত! মুখ ফুটে অবশ্য কিছু বলে না।

নাসের আলি থামেননি, এইটুক কইতে পারি, হগলই বড় সাহেবগো মর্জি। স্টিমার যতক্ষণ না আইতে আছে, আশায় আশায় বইসা থাকতে হইব।

মাথাটা সামান্য হেলিয়ে দেয় বিনু, হ্যাঁ।

কথা বলতে বলতে নাসের আলির নজর এসে পড়ে ঝিনুকের ওপর। কয়েক পলক তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, বিবিসাহেব খুব কাহিল হইয়া পড়ছেন।

হ্যাঁ।

রোগা মাইয়া, সাবধানে রাখবেন।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নাসের আলি চলে যান।

এদিকে বেহুঁশের মতো শুয়ে আছে ঝিনুক। তার মুখের ওপর এক গোছা চুল এসে পড়েছে। সেগুলো সরিয়ে দিতে গিয়ে কপালে হাত ঠেকে যায় বিনুর। বেশ গরম। নিশ্চিত হবার জন্য ওর একটা হাত তুলে নেয়। সন্দেহ নেই, জ্বর। দু’দিন একটানা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, আঙ্ক, হেমন্তের হিম, মৃত্যুভয়, উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি, এ সবের চাপ ঝিনুকের দুর্বল শরীর সহ্য করতে পারেনি।

বিনু বিচলিত হয়ে পড়ে। রুগণ, ভয়কাতর মেয়েটাকে আগলে আগলে দেশজোড়া বিষাক্ত আবহাওয়ায় রাস্তায় বেরুনোই মস্ত সমস্যা। তার ওপর এই জ্বর। সবে তারপাশা পর্যন্ত আসা গেছে। কলকাতা অনেক দুরের পথ। কিভাবে সেখানে পৌঁছনো যাবে? সমস্যাটা ক্রমাগত জটিল হয়ে যাচ্ছে।

বিনুর মুখ দেখে হরিন্দ কিছু আন্দাজ করে নিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, ছুটোবাবু, বৌঠাইনের শরীল কি খারাপ?

বিনু বলে, হ্যাঁ। জ্বর হয়েছে। ডাক্তার দেখাতে পারলে ভাল হত। এখানে কি ডাক্তার পাওয়া যাবে?

হরিন্দ সাত ঘাটের জল খাওয়া মানুষ। পূর্ব বাংলার নানা অঞ্চলে কত বছর চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু সেও কোনও হদিস দিতে পারল না। খানিক চিন্তা করে বলল, উই মিঞাসাব কইতে পারে। নাসের আলিকে দেখিয়ে দিল সে।

সঠিক পরামর্শ দিয়েছে হরিন্দ। নাসের আলি জামতলির বাসিন্দা। তারপাশা থেকে জামতলির দূরত্ব যদিও অনেকটাই, তবু তিনি জানলেও জানতে পারেন।

নাসের আলিকে ডেকে সব বলল বিনু।

নাসের আলি বললেন, শুনছি, এইখানে একজন ডাক্তারের চেম্বার আছে। তরাতরি ওষুধ পড়লে ভাল। নাইলে পথে বিপদে পড়বেন। চলেন দেখি কী করা যায়–

দেশভাগের আগে বেশ কয়েক বার হেমনাথের সঙ্গে তারপশায় এসেছে বিনু। স্টিমার আসার সময় এখানকার গোটা এলাকা জুড়ে চাঞ্চল্য দেখা দিত। সেটা চলে যাবার পর মনে হত, সমস্ত নিঝুম হয়ে গেছে। কিন্তু যেদিন পূর্ব বাংলা পাকিস্তান হল তখন থেকেই এই স্টিমারঘাটের চেহারা আগাগোড়া বদলে গেছে। এখন দিনরাত, অষ্টপ্রহর থিকথিকে ভিড়। আগে দিনে একবার কি দু’বারও স্টিমার আসত। ইদানীং আসাটা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। কদিন পর তার দেখা পাওয়া যাবে, বলা মুশকিল। যখনই আসুক, কয়েক শ উদ্বাস্তু তুলে নিয়ে গোয়ালন্দ যায়। এদিকে ভিটেমাটি ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ আসছেই, আসছেই। ভিড় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

এত মানুষ থাকলে যা হয়, দোকান বাজার অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। চারদিকে হেরিকেন, ত্যাজাক এবং ডেলাইটের আলো জ্বলছে।

বিনুকে নিয়ে জেটির বাইরে চলে এলেন নাসের আলি। এখানে ডাক্তারখানা আছে কিনা, তারও স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা ওষুধের দোকান পাওয়া গেল। একজন ডাক্তার সেখানে বসেন, কিন্তু সূর্য ডোবার আগেই সাইকেলে চেপে পাঁচ মাইল দূরে তাঁর গ্রামে ফিরে যান।

অগত্যা দোকানদারের কাছ থেকে সাধারণ জ্বরজারি কমানোর কিছু বড়ি কিনল বিনু। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা গা ব্যথা করে জ্বরটর হলে ডাক্তাররা এ সবই দেয়। খুব চেনা ওষুধ।

নাসের আলি বললেন, আর এক কাম করেন। কাইল হউক, পরশু হউক, স্টিমার আসবই। পথে খাওনের লেইগা কিছু শুকনা জিনিস কিনা লন (নিন)।

আগে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে ভাত আর মুরগির মাংস পাওয়া যেত। বিনু শুনেছে, দেশভাগের পর সে সব বন্ধ হয়ে গেছে। নাসের আলি মানুষটা খুবই দুরদশী। সকল দিকে তার নজর।

বিনু কিছু চিড়ে, মুড়ি, মুছি গুড় আর এক ফানা মোহনবাঁশি কলা কিনল। নাসের আলিও রামরতনদের জন্য চিড়ে টিড়ে কিনে নিলেন।

জেটিতে ফিরে ঝিনুকের ঘুম ভাঙিয়ে একটা বড়ি খাইয়ে দেওয়া হল, কিন্তু চিড়ে টিড়ে কিছুই খাওয়ানো গেল না।

ওষুধ খেয়ে ফের শুয়ে পড়েছিল ঝিনুক। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।

বিনুরও খেতে ইচ্ছা করছিল না। সে চুপচাপ ঝিনুকের শিয়রের কাছে বসে থাকে।

রাত বাড়ছিল। স্টিমারঘাটের কলরোল ক্রমশ ঝিমিয়ে আসে। স্টিমারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আরও একটা রাত কেটে যাবে বিনুদের।

.

৩.১০

পরদিন সকালে যা ঘটল তা প্রায় অভাবনীয়। অবিশ্বাস্যও বলা যায়।

সবে রোদ উঠেছে। কাল বিকেল থেকে সমস্ত চরাচরের ওপর পুরু হয়ে যে কুয়াশা জমে ছিল, তা দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। খানিক বাদে তার চিহ্নটুকুও থাকবে না। হেমন্তের কুয়াশামুক্ত নীলাকাশ এখন পরিষ্কার, তকতকে। নদীর অগুনতি পলকা ঢেউয়ের মাথায় রোদ সোনার কলস উপুড় করে দিয়েছে।

আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ছে শঙ্খচিল। সারা রাত তারা কোথায় থাকে, কে জানে। জল বাংলার যেখানেই যাওয়া যাক, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে পড়ে।

ঠিক এই সময় দেখা গেল, দূর দিগন্ত পেরিয়ে স্টিমার আসছে। জেটিঘাটে বা বাইরে যারা দলা পাকিয়ে পড়ে ছিল, এখনও তাদের অনেকেরই ঘুম ভাঙেনি। যারা জেগে গিয়েছিল তাদের চোখেও রয়েছে দুলুনি।

হঠাৎ কারা যেন চেঁচিয়ে ওঠে, ইস্টিমার আসে, ইস্টিমার আসে–

কালকের মতোই স্টিমারঘাটে তীব্র ঝাঁকানি লাগে। যারা ঘুমোচ্ছিল, ধড়মড় করে উঠে বসে। যারা ঢুলছিল তাদের চটকা ভেঙে যায়। সবার শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলতে থাকে।

কালকের মতোই ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। স্টিমারে ওঠার জন্য মরণপণ প্রতিযোগিতা। জেটিঘাটার ভেতরেও তুমুল শোরগোল চলছে। সকলেই নদীর দিকের গেটে পৌঁছতে চায়।

দেখতে দেখতে কালো ধোঁয়া ছেড়ে, গম্ভীর ভোঁ বাজিয়ে স্টিমার জেটিঘাটে এসে ভিড়ল। কাল যেটা গোয়ালন্দে গিয়েছিল এটা সেই স্টিমার নয়। সেটার পক্ষে রাতারাতি গোয়ালন্দে লোক নামিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে গিয়ে আবার তারপাশায় আসা অসম্ভব। সরকারের সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তারা হয়তো ভেবেছে, যারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের কষ্টটা যাতে লাঘব হয়, সেজন্য গোয়ালন্দ রুটে বেশি করে স্টিমার চালানো উচিত।

কাল বিনুরা যে যার মতো আলাদা আলাদা স্টিমারে ওঠার চেষ্টা করেছিল। আজ নাসের আলি পুরো দায়িত্বটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। বিনুকে বললেন, আসেন আমার লগে–

রামরতন এবং বিনুদের নিয়ে এগুতে লাগলেন নাসের আলি। হরিন্দরাও তাদের গায়ে লেপটে রয়েছে। সামনে চাপ-বাঁধা মানুষ। গলা চড়িয়ে কর্তৃত্বের সুরে নাসের আলি বললেন, অ্যাই, পথ দাও। দ্যাখো না, আমার লগে বুড়া মানুষ, রুগী মানুষরা রইছে।

একজন মাঝবয়সী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুসলমানকে দেখে কেউ আর বাধা দিতে বা হইচই করতে সাহস পায় না। সামনের ভিড়টা ভয়ে ভয়ে পথ করে দেয়।

গ্যাংওয়ে পেতে দেওয়া হয়েছিল। নাসের আলি সঙ্গীদের নিয়ে স্টিমারে চলে এলেন।

কালকের স্টিমারটার মতোই এটাও কানায় কানায় ঠাসা। একতলায় পা ফেলার জায়গা নেই। নাসের আলি বললেন, এইখানে হইব না, উপুরে চলেন–

দোতলার ডেকেও যথেষ্ট ভিড়। তবু সামান্য কিছু ফাঁকফোকর বার করে রামরতনদের সঙ্গে বিনু এবং হরিন্দদেরও বসিয়ে দিলেন নাসের আলি।

অবাক বিস্ময়ে লোকটাকে দেখছিল বিনু। নাসের আলি প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি না থাকলে আজও স্টিমারে ওঠা যেত না।

নাসের আলি রামরতনকে বলছিলেন, স্টিমার এইখানে বেশিক্ষণ খাড়ইব না। বিশ পঁচিশ মিনিটের মইদ্যে ছাইড়া দিব। সাবধানে যাইয়েন। বিনুকে দেখিয়ে বললেন, বাবুসাহেব আছেন, যা দরকার ওনারে কইয়েন। কইলকাতায় গিয়া পৌঁছ সম্বাদটা দিয়েন। খুব চিন্তায় থাকুম।

রামরতন বললেন, হ, দিমু। তবে উইপারের চিঠি এইখানে আসব কিনা, জানি না। একটু চুপ করে থেকে ভাঙা ভাঙা, ঝাঁপসা গলায় বলতে লাগলেন, তুই যা করলি, নিজের পোলাও তা করে না।

এই কথা কইয়েন না স্যার। এইটা আমার কর্তব্য।

কর্তব্য তো অনেকেরই থাকে। পালন করে কয়জন?

একটু নীরবতা।

তারপর রামরতন বললেন, দ্যাশের লগে সম্পর্ক চুইকা গেল। এই জীবনে তগো লগে আর দেখা হইব না। তার ভারী কণ্ঠস্বর হাহাকারের মতো শোনায়।

নাসের আলি কিছু বলতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। তার গলার কাছে কী যেন ক্রমাগত ডেলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিলে গিলে প্রবল আবেগকে তিনি সামলাতে চেষ্টা করছেন।

রামরতন বললেন, জমিজমা বাড়িঘরের দলিলপত্র তর কাছেই রইল। যত তরাতরি পারস, ব্যাচনের (বিক্রির ব্যবস্থা করিস। খালি হাতে দ্যাশ ছাড়তে আছি। অর্থবল একটা বড় শক্তি। টাকা থাকলে মনের জোর বাড়ে।

নাসের আলি তার কণ্ঠস্বর ফিরে পেলেন। ধরা গলায় বললেন, হ, ঠিকই কইছেন স্যার। তবে এখনই কিছু করতে গ্যালে হিতে বিপরীত হইয়া যাইব। সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন, মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র তুমুল উত্তেজনা। রামরতনদের জমিজমা বিক্রি করতে গেলে নাসের আলি বিপদে পড়বেন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হোক, মানুষের মাথায় যে খ্যাপামি ভর করে আছে সেটা কাটুক, তারপর ধীরেসুস্থে সুযোগ বুঝে ঠিকই বন্দোবস্ত করা যাবে।

নাসের আলির কথায় আরও জানা যায়, প্রায় তিরিশ কানির মতো দোফসলা উত্তম জমি রামরতনদের। তা ছাড়া পঁচিশের বন্দের পাঁচখানা ঘরওলা বাড়ি, পুকুর, গোটা তিরিশেক ফলন্ত নারকেল গাছ, সুপারি বাগিচা, আম জাম বাতাবি কাউ আর উয়া ফলের বাগান।

রামরতনদের বাড়িঘরের দিকে অনেকেরই নজর। কেনার জন্য তারা মুখিয়ে আছে। কিন্তু বেশ কিছু লোকের ধারণা, উদ্বাস্তুদের সম্পত্তি কেনার দরকার নেই। এমনিই দখল করে নেওয়া যাবে। : কেউ যদি নগদ টাকা বার করে কিনতে যায়, তাকে ঝামেলায় পড়তে হবে। এখন বুদ্ধিমানের কাজ হল, অপেক্ষা করে থাকা এবং সময় সুযোগ এলে কাজে লাগানো।

রামরতন উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, বাড়ি জমিন বেদখল হইয়া যাইব না তো?

নাসের আলি বললেন, যতদিন বাইচা আছি, আপনের এক টুকরা জমিন কেও কাইড়া নিতে পারব না। তবে মইরা গেলে কী হইব, জানি না।

এই কি তর মরণের বয়স! আশীর্বাদ করি দীর্ঘায়ু হ। তুই যে জমিজমা অন্যেরে দখল করতে দিবি না, এইতেই আমি নিশ্চিন্ত।

যদি খরিদ্দার পাই, রেজিস্ট্রি কইরা দেওনের লেইগা আপনেরে কিন্তুক জামতলিতে আইতে লাগব।

বাইচা থাকলে আসুম। যা করনের তরাতরি করিস।

স্টিমার ঘন ঘন ভোঁ দিচ্ছিল। চমকে নাসের আলি দেখলেন, জেটির মোটা মোটা থাম থেকে লোহার শেকল খুলে ফেলা হচ্ছে। বন্ধন মুক্তির পরই গ্যাংওয়ে তুলে নেওয়া হবে। তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, স্যার, এহনই স্টিমার ছাইড়া দিব। আর থাকন যাইব না।

রামরতন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, হ হ, নাইমা যা–

প্রাক্তন মাস্টারমশাইকে প্রণাম করে দ্রুত বিনুর দিকে তাকিয়ে নাসের আলি বললেন, পথে স্যারেগো দেইখেন–

এই অনুরোধটা আগেও করেছেন। ফের বিনুকে মনে করিয়ে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলেন নাসের আলি। একটু পর চোখে পড়ল, একতলায় নেমে গ্যাংওয়ে পেরিয়ে জেটির এধারের গেটের মুখে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, যতক্ষণ না স্টিমার তারপাশা ছেড়ে চলে যায়, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন।

শেকল ভোলা হয়ে গিয়েছিল। সিলেট জেলার খালাসিরা অদ্ভুত সুর করে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে বলতে গ্যাংওয়ে তুলে ফেলল। ভোঁ বাজছিলই। হঠাৎ সেটার জোর দশগুণ বেড়ে যায়। সমস্ত চরাচরে কাঁপন তুলে স্টিমার শেষ ভোঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ করে জলযানের ইঞ্জিনও চালু হয়ে গেল।

নাসের আলি নেমে যাবার পর বিনু খোলা ডেকের রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পাশে রামরতন।

হেমন্তের নদীতে বিশাল বিশাল ঢেউ তুলে স্টিমারের দু’ধারের চাকা ঘুরে চলেছে। ধীরে ধীরে তারপাশা দূরে সরে যাচ্ছে।

নাসের আলি জেটির মুখে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিলেন। তার পাশে এবং পেছনে বাস্তুহারা, বিষণ্ণ, হতাশ মানুষদের ভিড়। পরের বা তার পরের কিংবা তারও পরের স্টিমারে ওঠার জন্য তাদের কতদিন তারপাশায় পড়ে থাকতে হবে, কে জানে।

বিনু এবং রামরতনও হাত নাড়ছিলেন। বিনু লক্ষ করল, চশমার পুরু কাঁচের ভেতর রামরতনের ঘোলাটে চোখ ক্রমশ জলে ভরে যাচ্ছে।

রাজদিয়া থেকে বেরুবার পর দুটি মানুষকে দেখেছে বিনু–আফজল হোসেন এবং নাসের আলি। এদের সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না। বিনু ভাবে, যদি সে বেঁচে থাকে, শেষ পর্যন্ত কলকাতায় পৌঁছতে পারে, সময়ের পলি পড়ে পড়ে একদিন এই চরম দুঃসময়ের অনেক কিছুই ঢেকে যাবে, কিন্তু এই দুটো মানুষকে কোনও দিনই ভোলা যাবে না।

স্টিমারের গতি বেড়ে যাচ্ছে। তারপাশার স্টিমারঘাট ছোট হতে হতে একসময় বিন্দুবৎ মিলিয়ে গেল।

এক ঝাঁক নাছোড়বান্দা শঙ্খচিল মাথার ওপর চক্কর দিতে দিতে আসছিল। স্টিমারটাকে গোয়ালন্দর দিকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে এখন তারা ফিরে যাচ্ছে। বিনু জানে, এই জল-বাংলায় যেখানে যে স্টিমারই আসুক, আর যেদিকেই যাক, শঙ্খচিলেরা সেগুলোকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দেয়।

কার্যকারণ নেই, অসংলগ্নভাবে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল বিনুর। মুন্সিগঞ্জ, ভাগ্যকুল কি তারপাশা, আগে যেখানেই সে গেছে, দেখেছে স্টিমার এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মিঠাইয়ের নৌকো সেটাকে ঘেঁকে ধরত। কত রকমের মিষ্টি-রসগোল্লা, রাজভোগ, পান্তুয়া, ক্ষীরমোহন। এসব ছাড়াও মাঠা, কলপাতায় চিনি ছড়ানো ধবধবে মাখনের দলা, পাতক্ষীর। কিন্তু এখন এসব খাওয়ার লোক নেই। যারা সর্বস্ব খুইয়ে চলে যাচ্ছে, তাদের পয়সা কোথায় যে কিনবে। কাজেই মিঠাইয়ের নৌকোও আসে না।

সূর্য অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। রোদের তাপ বাড়ছে। চাকার অবিরত ঘূর্ণনের শব্দ আর ইঞ্জিনের একটানা গজরানি ছাড়া তেমন কোনও আওয়াজ নেই। নদীর জল উথলপাথল করে, সফেন ঢেউ তুলে স্টিমার ছুটে চলেছে।

বিনুরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। রামরতন বললেন, বহুক্ষণ খাড়ইয়া আছি, পা ধইরা গ্যাছে। চল, বসি গিয়া। তুমি কইরা কইলাম কিন্তুক। তুমি আমার নাতির বয়সী।

বিনু বলল, তুমি করেই তো বলবেন। চলুন—

জোরে ছোটার জন্য স্টিমার বেশ দুলছিল। টাল সামলে রামরতনের পক্ষে ডেকের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে অসুবিধা হচ্ছিল। বৃদ্ধ মানুষটির হাত ধরে নিজেদের জায়গায় ফিরে এল বিনু। রামরতনকে তার স্ত্রী এবং মেয়েদের কাছে বসিয়ে ঝিনুকের কাছে চলে এল।

ঝিনুক বসে ছিল। তাকে অনেকটা সুস্থ মনে হচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে বিনু বুঝতে পারল, জ্বর নেই। ওষুধে কাজ হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, এখন ভাল লাগছে?

হ্যাঁ– আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল ঝিনুক।

যাক, একটা ব্যাপারে দুশ্চিন্তা কাটল বিনুর। এমনিতেই মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত ঝিনুক সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে। তার ওপর জ্বরটা বাড়লে কলকাতা পর্যন্ত তাকে টেনে নিয়ে যেতে কী সমস্যা যে হত, ভাবা যায় না।

ঝিনুক বলল, স্টিমারে জল পাওয়া যাবে? মুখটুখ ধোয়া হয়নি—

সকালে স্টিমার আসতে দেখে এমন হইচই আর ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গিয়েছিল যে অন্য কোনও দিকে লক্ষ্য ছিল না। বিনু নিজেও চোখেমুখে জল দিয়ে আসতে পারেনি।

দোতলার ডেকে ওঠার পর খানিক দূরে যে জায়গাটা থেকে স্টিমারের মোটা চোঙা ওপরে উঠে গেছে তার গা ঘেঁষে পর পর তিনটে স্নানের ঘর। বিনু ঝিনুককে নিয়ে সেখানে গেল।

গামছা বা তোয়ালে কি দাঁতের মাজন কিছুই সঙ্গে নেই। তারপাশার স্টিমারঘাটে বাজার থেকে কাল যখন একজোড়া চাদর কিনেছিল বিনু, তখন খেয়াল করে গামছা টামছাও কেনা উচিত ছিল। এখন কী আর করা। গোয়ালন্দেও বাজার আছে। সেখান থেকে দরকারী জিনিসগুলো কিনে নেবে।

আঙুলে দাঁত ঘষে মুখ ধুয়ে ঝিনুক তার শাড়ির আঁচলে আর বিনু তার কেঁচার খুঁটে জল মুছতে মুছতে ফিরে এল। ঝিনুক বলল, আমার খিদে পেয়েছে।

পরশু হেমনাথের বাড়ির পুকুরঘাটে রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর এই প্রথম নিজের থেকে খেতে চাইল ঝিনুক। তাকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। বিনুর খুব ভাল লাগল।

নাসের আলির পরামর্শে ভাগ্যিস কিছু চিড়ে মুড়ি কিনেছিল। দোকানদার কাগজের ঠোঙায় ভরে পাটের সুতো দিয়ে ভাল করে বেঁধে দিয়েছে। বাঁধন খুলে মুড়ি আর মুছি গুড় বার করে ঝিনুককে দিল বিনু, নিজেও খানিকটা নিল।

খেতে খেতে ঝিনুক বলল, আর ভয় নেই, কী বল? মনে হচ্ছে, এবার শান্তিতে আমরা কলকাতায় যেতে পারব।

মেয়েটা ত্ৰাস কাটিয়ে উঠছে, সাহস ফিরে পাচ্ছে। বিনুও আশা করছে, এবার হয়তো নির্বিঘ্নে সীমান্তের ওপারে যাওয়া যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *