২৫-২৮. কদম শিকারি

কদম শিকারি পকেট ঘড়িটা বুঝিয়ে দেয় ফজলের হাতে। সে দেখে পৌনে পাঁচটা বাজে। বেলা ডুবতে দেরি আছে এখনো।

পাহারারত চল্লিশজন ছাড়া আর সবাই জড় হয় ফজলের চারপাশে। তারা মাটিতে গামছা বিছিয়ে বসে। সবার মনে খুশির প্লাবন। হাসিতে ঝলমল করছে সবার চোখ-মুখ।

কই চাচা লস্করের পো? আমাগ পোলাপাইন্যা কাণ্ড-কারখানা কেমুন দ্যাখলেন? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে ফজল।

হ মিয়া, একখান খেইল দেহাইছ। জাবেদ লশকর বলে।

আমাগ শরীলে একটা আঁচড়ও লাগে নাই। বিপক্ষের কোনো মানুষও খুন-জখম অয় নাই।

রক্তারক্তি ছাড়া এমুন মারামারি আমার জীবনে কোনোদিন দেহি নাই। রজিম মিরধা বলে।

শোনেন, আঁউকড়াগুলা বেবাক টোকাইয়া রাখেন। চোত্‌রাগাছ গুলারে লাগাইয়া দ্যান এক জায়গায়। ভবিষ্যতে এগুলা কামে লাগব।

আমাগ নায়ের মইদ্যে ওগ বিস্তর গুলি পইড়া রইছে। কদম শিকারি বলে।

হ, ওগুলা টোকাইয়া একখানে করেন। আরো কিছু গুলি যোগাড় করতে অইব। ওরা কিন্তু দখলে আসার চেষ্টা করব। চাকইর‍্যা লইয়া হামলা করব। ওগ নাও দ্যাখলেই আমাগ নৌকার দল গুলাইল লইয়া ওগ এক পাশে গিয়া গুলি মারতে শুরু করব। আমরাও চরেরতন গুলি ছাড়মু। দুই দিগের গুলি ওরা ঢাল দিয়া ফিরাইতে পারব না। চাকইর‍্যারা কিন্তু বেশির ভাগ বইস্যা বইস্যা আউগ্‌গায়, হাতিয়ার চালায়। ওগ কাবু করণের লেইগ্যা আঁকড়ার ঝাঁপটা মারতে অইব ওগ মাথায় আর পিঠে।

আমাগ কিছু চাকইর‍্যা আইন্যা রাখন দরকার। রমিজ মিরধা বলে। ট্যাহাতো আছেই।

না। আর চাকইর‍্যা আননের দরকার নাই। ফজল বলে খামাখা টাকা খরচ করতে যাইমু কোন দুকখে? আমরা নিজেরাই ওগ হটাইয়া দিতে পারমু। কি কও জুয়ানরা পারবা না?

হ, পারমু। সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে কিশোর ও জোয়ানরা। জয়ের জোশে তারা উদ্দীপ্ত।

আপনারা আগে চাকইর‍্যার পিছে বেশুমার টাকা ঢালছেন। আর আমরা? আমরা অল্প খরচে কাম ফতে করছি।

কত ট্যাহা খরচ অইছে? জাবেদ লশকর জিজ্ঞেস করে।

খুব অল্প। রামদাও, ঢাল, টর্চলাইট আর এইডা ওইডা কিনতেই যা খরচ অইছে। কাইলই জগু পোদ্দারের দোকানে যাইবেন। গয়নাগুলা বেবাক ছাড়াইয়া লইয়া আইবেন।

হ, এইডা একটা কামের কাম অইব। মেহের মুনশি বলে।

হ, সুদ বড় জোর এক মাসের নিতে পারে। রমিজ মিরধা বলে।

এক মাসের সুদ আর আসল দিয়া গয়নাগুলা ফর্দের লগে মিলাইয়া ওজন কইর‍্যা লইয়্যা আইবেন। ফজল বলে।

হ, কাইলই গিয়া লইয়া আইমু। মেহের মুনশি বলে। বউ-ঝিগ দায়-দাবির তলে আর থাকন লাগব না।

কিন্তু মিয়া, এই চরে থাকতে গেলে খরচ লাগব না? ট্যাহা পাইবা কই? রমিজ মিরধা বলে।

টাকার লেইগ্যা ভাবনা নাই। ফজল বলে। আমাগ বানাগুলাতো আছেই। সবাইরে লাগাইয়া দ্যান মাছ ধরতে। বেড়ের মাছ বেইচ্যা খরচ চালাইতে অইব। আমাগ চাই, দোয়াইর, খাদইন, পারন, ঝাঁকিজাল, ধর্মজাল, ইলশাজাল, মইজাল–মাছ ধরনের যত সরঞ্জাম ঐবার থুইয়া গেছিলাম, ওগুলা ওরা এই চরেই থুইয়া গেছে। বেবাক বিচরাইয়া বাইর করেন। এগুলা দিয়া মাছ ধরনের ব্যবস্থা করেন?

তুমি কি আমাগ বেবাকটিরে জাউল্যা বানাইয়া দিতে চাওনি? শ্লেষ-মেশানো কণ্ঠে জাবেদ লশকর বলে।

কি যে কথা কন! পা-না-ধোয়ার কোলশরিকরা মাছ বেচে নাই? ওরাও তো বেড়ের মাছ বেইচ্যা সংসার চালাইছে। জঙ্গুরুল্লাও তো ঐ টাকার ভাগ নিছে। জাইত যাওনের ভয় খালি আপনাগ!

ফজলের সমর্থনে প্রায় সবাই গুঞ্জন করে ওঠে।

ফজল আবার বলে, আর শোনেন, ওরা কি কি জিনিস থুইয়া গেছে তার লিস্টি করেন। ঐগুলার মধ্যে আমাগ জিনিস, আমাগ হাতিয়ারও পাওয়া যাইব–যেগুলা আমরা ঐবার ফালাইয়া গেছিলাম। ঐগুলা আর ওগ তামাম হাতিয়ার আমরা রাইখ্যা দিমু। থালা-বাসন, লোটা-বদনা যা কিছু থুইয়া গেছে, সেগুলা কিন্তু রাখন যাইব না।

ক্যান্? ওরাতো আমাগ জিনিস ফিরত দেয় নাই। কোলশরিকদের কয়েকজন প্রতিবাদ করে।

ঐগুলার মালিকতো আপনাগ মতন গরিব কোলশরিকরা। ঐগুলা যদি জঙ্গুরুল্লার অইত, তয় ফিরত দেওনের কথা কইতাম না। আমরা খুদ খাইয়া পেট নষ্ট করতে যাইমু ক্যান? ঐগুলা একখানে কইর‍্যা রাইতের আন্ধারে ওগ চরে ফালাইয়া দিয়া আইবেন। আপনারা কয়েকজন চইল্যা যান। আন্ধার হওয়ার আগে সবগুলা ভাওর ঘর তালাশ কইর‍্যা দেখেন, কোন ঘরে কি আছে। পোলাপানরা তালাশ করুক ধানখেতে। ওগ হাতিয়ার, আমাগ আঁউকড়া–বেবাক বিচরাইয়া লইয়া আসুক। মারামারির সময় ধানের গাছ কিছু নষ্ট অইছে। আর যেন নষ্ট না হয়।

.

মাগরেবের নামাজের পর আবার সবাই জড় হয় ফজলের ভাওর ঘরের সামনে। তারা বিপক্ষ দলের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে আসে।

হারিকেনের আলোয় ফজল ও আরো কয়েকজন মিলে ফেরতযোগ্য জিনিসগুলো বেছে বেছে আলাদা করে। চাল-ডাল ইত্যাদি খাবার জিনিস ফেরত দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না তারা। কারণ তারাও পুলিসের ভয়ে পালাবার সময় অনেক খাবার জিনিস ফেলে গিয়েছিল এ চরে। চাল-ডাল-মশলাদি–যা ওরা রেখে গেছে তাতে বেশ কয়েকদিন চলে যাবে সকলের।

চর দখলের আনন্দে সবাই মেতে ছিল এতক্ষণ। খাবার কথা কারো মনেই হয়নি। চাল ডাল দেখে হঠাৎ খিদের তাড়না অনুভব করে সবাই। এক সাথে এত লোকের রান্না করার মতো বড় ডেগ নেই এখানে। ফজল দশটা চুলোয় দশ পাতিল খিচুড়ি রান্নার ব্যবস্থা করে। দিয়ে আবার এসে আলোচনায় বসে।

জাবেদ লশকর বলে, জঙ্গুরুল্লার মতন খুঁটগাড়ি আদায় করণ লাগব।

হ, ঘোঁজায় নানা মুলুকের নাও আইস্যা পাড়া গাড়ে। ধলাই সরদার বলে। খুঁটগাড়ি আদায় করতে পারলে অনেক ট্যাহা আমদানি অইব।

উঁহু। আমরা খুঁটগাড়ি আদায় করমু না। ফজল বলে।

ক্যান। এত বড় একখান আয়ের সুযোগ—

ঘোঁজায় নৌকা রাখে আশ্রয়ের লেইগ্যা। আশ্রয়ের বদলে কিছু আদায় করা ঠিক অইব না। আমরা যদি খুঁটগাড়ি আদায় করতে শুরু করি, তয় নৌকা আর একটাও এই ঘোঁজায় আসব না। মাঝিরা অন্য চরের কোনা-কাঞ্ছিতে গিয়া নাও রাখব। আপনাগ কাছেই তো শুনছি। রউজ্যার কাণ্ড। যদি ওর মতন ডাকাতি করতে পারেন, তবে ডাকাতির ভয়ে কিছু নৌকা আসতে পারে এই ঘোঁজায়।

হঠাৎ একটা শোরগোল শোনা যায়।

সবাই সচকিত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তারা দেখতে পায়, চরমান্দ্রার অনেক পুবে, কোনো একটা চরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের লেলিহান জিভ লকলক করে উঠছে আকাশে।

তোমরা বোঝতে পারছনি, ব্যাপারখান কি? জাবেদ লশকর বলে। কী মনে অয় তোমাগ?

এইডা জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। রমিজ মিরধা বলে। নিজেগ ঘরে আগুন লাগাইয়া আমাগ বিরুদ্ধে থানায় ইজাহার দিব।

তুমি ঠিকই ধরছ। জাবেদ লশকর বলে। জঙ্গুরুল্লা ঐবার নাহক ডাকাতি মামলায় আমাগ আসামি দিয়া চর দখল করছিল। এইবার আবার ঘর পোড়নের মামলা দিয়া পুলিস সুলাইয়া দিব আমাগ ধরতে।

জাবেদ লশকর নিচু গলায় বলে, একটা কাম করলে অয়। কিন্তু বেবাকের সামনে কওন যাইব না।

চলেন ঘরে গিয়া বসি।

ও মিয়ারা তোমরা গিয়া পাত পাইত্যা বস। মনে অয় খিচুড়ি এতক্ষণে রান্দা অইয়া গেছে।

হ, তোমরা যাও। আমরা আইতে আছি।

ফজল একটা হারিকেন হাতে করে পুলকি মাতব্বরদের নিয়ে তাদের ভাওর ঘরে গিয়ে বসে।

বলেন, কি বলতে চাইছিলেন? ফজর উৎসুক হয়ে তাকায় জাবেদ লশকরের দিকে।

সে চাপা গলায় বলে, আমরাও একটা ঘরে আগুন লাগাইয়া ওগ নামে ইজাহার দিমু।

উঁহু, এইডা ঠিক অইব না।

কী যে কও তুমি! জানো না, বিষ দিয়া বিষ মারতে অয়? কাডা দিয়া কাডা খুলতে অয়?

তা তো জানি। কিন্তু ডাহা মিথ্যারে সত্য বইল্যা প্রমাণ করতে পারবেন?

ক্যান্ পারমু না? ওগ পিঠে আমাগ গুলির দাগ আছে না?

হ, কিছু লোকের শরীরে গুলিতো লাগছিলই।

হোন, আমরা এই বুইল্যা ইজাহার দিমু-অমুক, অমুক, অমুক, আরো দশ বারোজন আমাগ ঘরে আগুন লাগায়। আমরা টের পাইয়া যখন গুলাইল মারতে শুরু করি তখন ওরা দুইডা শড়কি ফালাইয়া ভাইগ্যা যায়। আমাগ গুলির দাগ আছে ওগ শরীলে।

ওরা দিব ঘর পোড়ার ইজাহার, আমরাও যদি ঘর পোড়ার পাল্টা ইজাহার দেই তা দারোগা বিশ্বেস করব না। রমিজ মিরধা বলে। তার চাইয়া ডাকাতির মামলা সাজাও। জঙ্গুরুল্লার দুই পোলা ও আরো দশ বারোজন রামদাও শড়কি লইয়া ডাকাতি করতে আইছিল। আমাগ গুলাইলের গুলি খাইয়া একটা রামদাও আর দুইডা শড়কি ফালাইয়া ওরা ভাইগ্যা যায়। ওগ শরীলে আমাগ গুলির দাগ আছে।

ইজাহার দেওয়া সোজা। ফজল বলে। সাক্ষী-সাবুদ দিয়া প্রমাণ করা বড় কঠিন। জোরে কচ্লান দিলে কোন্‌টা সত্য, কোটা মিথ্যা বাইর অইয়া পড়ে। মাইনষে কইতেই কয়–সাচ্চা গুড় আন্ধার রাইতেও মিডা।

তা অইলে কী করতে চাও? আমাগই খালি পুলিস দিয়া অয়রান করব আর আমরা চুপ কইর‍্যা সইজ্য করমু।

আমাগ হয়রান করতে ওরাও হয়রান অইয়া যাইব, ওগ টাকার শেরাদ্দ অইব। আমরা এত টাকা খরচও করমু না, আর মাইনষের নাহক হয়রানির মইদ্যেও ফেলমু না। শোনেন, আমাগ কোলশরিক যারা পাতনা দিয়া আছে অন্যের জাগায়, তারা এই রাইতের মইদ্যে বউ পোলাপান, হাঁস-মুরগি, গিরস্থালির বেবাক মাল-সামান লইয়া আইব এই চরে। ভাওর ঘরে গিরস্তালি শুরু করব। যার যার গরু-বাছুর কাইল সকালের মইদ্যে আইন্যা বাইন্ধা থুইব ঐ বাথানে। দারোগা-পুলিস আইলে যেন বুঝাইয়া দিতে পারি, এই চর আমাগ। আমরা ধান। লাগাইছি, কলাগাছ লাগাইছি। বাপ-দাদার আমলতন এই জা’গার চর আমাগ। এইখানে কতবার চর জাগছে, কতবার ভাঙছে। কিন্তু আমরা সব সময় খাজনা চালাইয়া আইছি। আমাগ পর্চা-দাখিলা আছে। জঙ্গুরুল্লার কি আছে? পারব কোনো কাগজ দেখাইতে?

না, ওরা কাগজ দেহাইব কইতন? মেহের মুনশি বলে। হুনছি বিশুগাঁয়ের রায়চদরীগ তিন বচ্ছরের খাজনা দিয়া আমলদারি নিছে জঙ্গুরুল্লা। দেহাইলে ঐ আমলদারি আর খাজনার দাখিল দেহাইতে পারে। কিন্তু আগের আমলের কোনো কাগজ দেহাইতে পারব না।

রায়চৌধুরীগ কান্দার চর তো আছিল অনেক দক্ষিণ-পশ্চিমে। সেই চর তো ভাইঙ্গা গেছে ছয়-সাত বছর আগে। জমিদারগ শয়তানি দ্যাখেন না। নিজেগ চরের নাম-নিশানা নাই। তবু তারা আমলদারি দিছে জঙ্গুরুল্লারে। সে এখন আমাগ চর খাবলা দিয়া নিতে চায়।

হ, জমিদাররা এম্বায়ই যত আউল-ঝাউল লাগায় আর আমরা মারামারি কইর‍্যা মরি।

শোনেন, দারোগা-পুলিস কাইল পরশুর মইদ্যে আইসা পড়ব মনে হয়। খবরদার কেও যেন চর ছাইড়া না পালায়। কয়জনরে আর ধরব! ফজল বলে।

কিন্তু মিয়া, পুলিস আইলে তুমি এট্টু সইর‍্যা থাকবা। কদম শিকারি বলে। তোমারে ধইর‍্যা নিলে এই চর রাখন যাইব না। তুমি পরে আদালতে আজির অইয়া জামিন লইয়া আইতে পারবা।

কদম শিকারির প্রস্তাবে সায় দেয় সবাই। কিন্তু ফজল আমতা আমতা করে। সে বলে, আপনাগ পুলিসে ধইর‍্যা লইয়া যাইব আর আমি পলাইয়া থাকমু?

হ, পুলিস আইলে তুমি সইর‍্যা থাকবা। জাবেদ লশকর বলে।

লড়াইয়ের সময় সেনাপতি থাকে বেবাকের পিছনে। তারে রক্ষা করে সিপাই লশকররা। তুমি আমাগ সেনাপতি। তোমারে রক্ষা করণ আমাগ ফরজ।

হ, তুমি রক্ষা পাইলে আমরাও রক্ষা পাইমু। মেহের মুনশি বলে।

দারোগার পানসি দূরের তন দ্যাখলেই চিনা যায়। চাইরদিগে আমাগ পাহারাদার থাকব। তারা নজর রাখব সব সময়।

হ দারোগার নাও দ্যাখলেই চিক্কইর দিব। রমিজ মিরধা বলে। ষাড়েরে যেমুন কইর‍্যা মাইনষে ডাক দেয় তেমুন কইর‍্যা ডাক দিব–মোল্লাকে ডাক্ কুরুত্। আবার গামছা উড়াইয়া ইশারাও দিব।

হ, ইশারা ধরনের লেইগ্যা পালা কইর‍্যা এক জনের পর আরেক জন ভাওর ঘরের কাছে বইয়া চউখ রাখব চাইরদিগে।

হ, এইডাই ঠিক। জাবেদ লশকর বলে। জমিরদ্দির দাঁড়াইশ্যা ডিঙিখান তৈয়ার থাকব সব সময়। পাঁচজন বাইছাও ঠিক কইর‍্যা রাখন লাগব।

আচ্ছা, আপনাগ রায় মাইন্যা নিলাম। ফজল বলে। আর শোনেন, ভাটিকান্দি ছাইড়্যা আমি চইল্যা আসমু এই চরে। তিন-চারদিনের মইদ্যে ঘর-দরজা ভাইঙ্গা মাল-সামান লইয়া এই চরে আইস্যা বসত করমু। আর কেও যদি এই চরে আইতে চান, আইতে পারেন। দারোগা-পুলিস আসার ইশারা পাইলেই হাতিয়ারগুলা ধানখেতের ভিতর গুঁজাইয়া রাখতে অইব।

অন্য চরে যাদের জমাজমি নেই তারা সবাই এই চরে এসে বসত করাই উচিত কাজ মনে করে। তারাও কয়েক দিনের মধ্যেই ঘর-দরজা ভেঙে বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে আসবে।

.

২৬.

আগুন দেখে ফজলের দল ঠিকই অনুমান করেছিল–ওটা জঙ্গুরুল্লার কারসাজি। খুনের চর থেকে বিতাড়িত হয়ে কোলশরিকরা জঙ্গুরুল্লার বাড়ি গিয়ে হাজির হয় সন্ধ্যার পর। ওদের দেখে কিছু বলার আগেই সে বুঝতে পারে, খুনের চর বেদখল হয়ে গেছে। রাগের তীব্রতায় তার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। তার ক্রুদ্ধ ঘূর্ণায়মান চোখ দুটোয় আগুন জ্বলছে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে মিইয়ে যায় সবাই। তাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে খেঁকিয়ে ওঠে জঙ্গুরুল্লা, হারামজাদা শুয়রের বাচ্চারা, চরের দখল ছাইড়া দিয়া আইছস? খুন কই? জখম কই? একটা হারামজাদার গায়েও তো একটা কোপের দাগ নাই। কিরে লাশ ফালাইয়া থুইয়া আইছস?

দবির গোরাপি ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলে, না হুজুর, কেও খুন অয় নাই।

খুন অয় নাই! তয় তোরা মাইর করস নাই? ওগ দেইখ্যা ডরে চর ছাইড়্যা পলাইয়া আইছস?

না, হুজুর, মাইর করছি।

মাইর করলে খুন-জখমতো অইত? তার আলামত কই? দুই চাইডারে খুন কইর‍্যা, লাশ লইয়া থানায় গিয়া ইজাহার দেই।

সাহস সঞ্চয় করে দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি মারামারির বিস্তারিত বিবরণ দেয়। জঙ্গুরুল্লা প্রথমে শুনতে চায়না তাদের কথা। প্রতিপক্ষের অভিনব কায়দা-কৌশলের কথা শুনেই সে মনোযোগ দেয়। তাদের বিবরণ শেষ হলে জঙ্গুরুল্লা বলে, হুনছি রামদাওয়ালা চাকইর‍্যা আছে দক্ষিণে, ভাটির মুলুকে। কিন্তু আঁউকড়া আর চোরাপাতা দিয়া এম্বায় লবজান করার কথা তো শুনি নাই কোনো কালে। চাকইর‍্যাগ চিনতে পারছনি?

না, ক্যামনে চিনমু। মজিদ খালাসি বলে। কাইলামতো, চাকইর‍্যারা আর দলের অনেকেই মোখা লাগাইয়া আইছিল।

ফউজ্যারে দ্যাখছ নি? ওকি জেলের তন ছাড়া পাইয়া আইছে?

তারে দেহি নাই। দবির গোরাপি বলে।

তোমরা কেও দ্যাখছ নি মিয়ারা? কোলশরিকদের দিকে চেয়ে বলে মজিদ খালাসি।

ফজলকে কেউ দেখেনি। তবে দু’-তিন জন নাকি তার গলার আওয়াজ শুনেছে।

তোমরা খোঁজ খবর নেও। জঙ্গুরুল্লা বলে। গোরাপি আর খালাসি এইখানে থাইক্য, কথা আছে। তোমরা কয়েকজনরে পাড়াইয়া দ্যাও খবর আনতে–ফউজ্যা জেলেরতন আইছে, না আহে নাই? রাইত দুফরের আগে পাক্কা খবর চাই। আর বাকি সবাই বাড়িত যাও। চর দখলের ব্যবস্থা কইর‍্যা তোমাগ খবর দিমু।

দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি ফজলের খবর সংগ্রহের জন্য দুখানা নৌকায় ছ’জনকে পাঠিয়ে দেয় দুদিকে। তারা বুঝতে পারে প্রতিপক্ষের জোয়ান পুরুষরা আজ বাড়িতে নেই কেউ। সবাই গেছে খুনের চরে। একদল ঘটক সেজে ফজলের বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে সোজা চলে যাবে ভাটিকান্দি–ফজলদের বাড়ি। কথায় বের করে আনবে ফজলের খবর। অন্য দলটি যাবে জাবেদ লশকরের বাড়ি। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কোনো অছিলায় ফজলের খবর বের করে আনবার চেষ্টা করবে।

দবির গোরাপি ও মজিদ খালাসি ফিরে এসে দেখে জঙ্গুরুল্লা হুঁকোর নল মুখে দিয়ে চোখ বুজে কি যেন ভাবছে। তার পা টিপছে চাকর। তার থমথমে গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস হয় না তাদের।

জঙ্গুরুল্লা হুঁকোয় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। চোখ মেলে গোরাপি আর খালাসিকে দেখতে পেয়ে বলে, ফউজ্যার খবর আনতে মানুষ পাডাইছ?

হ, দুইদল দুইখানে পাডাইছি। দবির গোরাপি বলে।

শোন, তোমরা আমার ইজ্জতটা এক্কেরে গরবাদ কইর‍্যা দিছ। চর দখলের মাইরে আমার দল কোনোদিন হারে নাই। আমার দখল করা চরে কোনো ব্যাডা আইতে সাহস করে নাই। আর এইবার কি কারবারডা অইয়া গেল!

এহন কি করতে চান হুজুর? মজিদ খালাসি বলে ।

ওরা মনে অয় বাছাবাছা চাকইর‍্যা আনছে ভাটি মুলুকতন। আমরা আর মাইর দাঙ্গার মইদ্যে যাইমু না। কলে কলে চাবি দিয়া কল ঘুরাইতে অইব। শোন, ওগ বিরুদ্ধে ঘর পোড়নের মামলা দিমু।

ঘর পোড়নের মামলা!

হ, ঘর পোড়নের মামলা। দশ-বারো জনরে দিমু আসামি। ফউজ্যা জেলেতন আইলে ওরে দিমু এক লম্বর আসামি। তোমরা একটা ঘর ঠিক কর। ঐ ঘরে আগুন দিয়া ঘরের মালিক ডাকচিক্কইর দিব। ঐ ডাক-চিক্কইর শুইন্যা তোমরা এই চর ওই চরের কয়েকজন দেখবা– ঘরে আগুন দিয়া নাও বাইয়া পলাইয়া যাইতেছে ওগ দশ-বারো জন। ইজাহারে আরো কইতে

অইব, ঘরে পাট আছিল।

জঙ্গুরুল্লার পরামর্শে তারই কুমিরডাঙার কোলশরিক তালেবালী নিজের কুড়েঘরে আগুন দেয়।

ফজল জেল থেকে খালাস পেয়ে এসেছে, খবরটা পেলেই জঙ্গরুল্লা রাত দুপুরের পর তালেবালীর সাথে তার বড় ছেলে জাফর ও দবির গোরাপিকে পাঠিয়ে দেয় থানায়।

তারা থানায় পৌঁছে বেলা নটারও পরে। থানার বড় দারোগা জাফরকে দেখেই চিনতে পারেন। বলেন, কি মিয়া নতুন চর জেগেছে বুঝি? কারা দখল করেছে? নাম বলো। সব ক’টার মাজায় রশি বেঁধে নিয়ে আসি।

না হুজুর, চর দখলের ঘটনা না।

তবে ঘটনাটা কি?

হুজুর, এই তালেবালীর ঘরে আগুন লাগাইছে।

আগুন লাগিয়েছে! কারা লাগিয়েছে, দেখেছ তোমরা?

হ, হুজুর।

আচ্ছা।

বড় দারোগা দু’জন সেপাই ডাকেন। দবির গোরাপি ও জাফরকে দেখিয়ে বলেন, তোমরা দুজন এদের নিয়ে যাও। একজন যাও পুকুরের উত্তর পাড় আর একজন যাও দক্ষিণ দিকে পুলের ওপর। এদের সাথে গপগপ করো গিয়ে। আমি একজন একজন করে ডাকব।

বড় দারোগা ঘটনার বিবরণ শোনেন তালেবালীর কাছ থেকে। তাকে জেরা করেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর জাফর ও দবির গোরাপিকে এক এক করে জেরা করেন। জেরা শেষ হলে তিনি বলেন, কি মিয়ারা, মামলাটা ঠিকমত সাজিয়ে আনতে পারোনি? বাদী বলছে তার পশ্চিম-ভিটি ঘরে বগি পাট ছিল পাঁচমন। ঘর আর সব পাট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে ফজল ও আরো চারজন আসামির নাম বলেছে। আরো চার-পাঁচ জন ছিল, তাদের চিনতে পারেনি। সে দুটো নৌকায় আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেছে। তার কাছে টর্চলাইট ছিল না। রাতের অন্ধকারে সে আসামিদের চিনল কেমন করে? দবির গোরাপি বলছে–তালেবালীর ঘরে দশমন নালতে পাট ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ডাক চিৎকার শুনে সে টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিল। সে একটা নৌকায় আসামিদের পালিয়ে যেতে দেখেছে। সে ফজল ও আরো চারজন আসামির নাম বলেছে। কি তাজ্জবের কথা! তালেবালী যাদের দেখেছে দবির গোরাপিও ঠিক তাদেরই দেখেছে। আর কাউকে চিনতে পারেনি। দুজনের চোখ যেন পরামর্শ করেই ঐ কয়জন আসামিদের ওপর দৃষ্টি ফেলেছিল। তালেবালী বলছে–নয়-দশ জন আসামির মধ্যে দু’জনের দাড়ি ছিল। অথচ দবির গোরাপি বলছে–চারজনের দাড়ি ছিল। তালেবালী যে আউশ ধান পেয়েছিল তা ভাদ্র মাসেই খেয়ে শেষ করেছে। ভাদ্রমাস থেকেই সে চাল কিনে খাচ্ছে। আর দবির গোরাপি যে আউশ ধান পেয়েছিল তা এখনও খেয়ে শেষ করতে পারেনি। অথচ দবির গোরাপি পাট বেচে দিয়েছে ভাদ্র মাসেই। তার ঘরে পাট নেই। অন্য দিকে তালেবালীর টানাটানির সংসার। সে পাট মজুদ রেখেছে বেশি দাম পাওয়ার জন্য। ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারপর জাফর বলছে ঘটনার বিবরণ ও সাতজন আসামির নাম সে তালেবালীর কাছে শুনেছে। বাড়তি দু’জনের নাম জাফর পেল কোথায়? তালেবালী তত কুল্লে চিনেছে পাঁচজনকে। কী মিয়া জাফর, দু’জনের নাম পেলে কোথায়?

হুজুর, তালেবালী আমার কাছে সাতজনের নামই কইছিল। ভয়ে জাফরের গলা কাঁপছে। তার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে।

বড় দারোগা হক দেন, অ্যাই কে আছ?

দু’জন সেপাই এসে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ায়।

বড় দারোগা নির্দেশ দেন, এই তিনজনকে হাজতে ঢুকাও। মিথ্যা এজাহার দিতে আসার মজাটা দেখাচ্ছি।

জাফর হাতজোড় করে, হুজুর, কী কইতে কী কইয়া ফালাইছি–

আমিও কী করতে কী করে ফেলি, টের পাবে এবার। মিথ্যাকে খোলস পরিয়ে সত্য বানানো যায় না। অ্যাই, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? নিয়ে যাও এদের হাজতে।

জাফর ও দবির গোরাপি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা ভয়ে কাঁপছে থরথর করে।

তালেবালী বড় দারোগার পা জড়িয়ে ধরে বলে, হুজুর মাপ কইরা দ্যান। মাইনষের কথায় আর কান দিমু না, আর কোনো দিন থানায় আইমু না।

পা ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য বড় দারোগা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, আরে ছাড়ো, ছাড়ো, পা ছাড়ো। এই সেপাইরা, দাঁড়িয়ে দেখছ কি?

সেপাই দু’জন তালেবালীর হাত ধরে টেনে তোলে।

যাও, এই শয়তানের বাচ্চা তিনটাকে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও থানা থেকে।

গলাধাক্কা দেয়ার আর প্রয়োজন হয় না। তিনজনই দ্রুত থানা থেকে বেরিয়ে যায়।

.

২৭.

চর অঞ্চলের লোক যা কোনোদিন করেনি, করতে সাহস পায়নি, তাই করছে জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। সে চৌধুরীর চরে নিজের বাড়ি থেকে অল্প দূরে দক্ষিণ দিকে তার পীরবাবার জন্য দেয়াল ঘেরা তিন কামরার পাকা বাড়ি তৈরি করছে। দেয়ালের বাইরে তৈরি করছে খানকাশরিফ।

প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য সে কোনো দিনই ইটের বাড়ি বানাতে সাহস করেনি। সে প্রায়ই বলত, ইট মানেই মাটি। এই মাটির ঘরেরতন টিনের ঘর অনেক ভালো। রাইস্যা গাঙ থাবা দিলে টিনের ঘর ভাইঙ্গা-চুইর‍্যা আরেক খানে গিয়া আবার বসত করণ যায়। আর ইটের ঘর? ইটের ঘর ভাঙলেই বেবাক মাটি। ভাঙ্গন শুরু অইলে এই মাটির ঘর চিৎ-কাইত অইয়া রসাতল অইয়া যাইব।

পীরবাবা বুজুর্গ আদমি, আল্লার খাস বান্দা, পিয়ারা দোস্ত। তার খানকাশরিফ, তার মহল খোদ আল্লাই হেফাজত করবেন–এই দৃঢ় বিশ্বাসই জঙ্গুরুল্লার বুকে হিম্মত দিয়েছে ইটের বাড়ি তৈরি করবার। পীরবাবাকে তো আর তাদের মতো টিনের ঘরে মাটির মেঝেতে বাস করার কথা বলা যায় না।

তার আরো বিশ্বাস-পীরবাবা এ চরে বসত করলে রাক্ষুসে নদী এ চরের ওপর তার সর্বনাশ থাবা দিতে সাহস করবে না।

বিকেল বেলা সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে জলচৌকির ওপর বসে জঙ্গুরুল্লা রাজমিস্ত্রিদের কাজ দেখাশুনা করছিল আর হুঁকো টানতে টানতে ভাবছিল অনেক কিছু।

খুনের চর হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই কার্তিক মাসের পরেই অগ্রহায়ণ মাসের শেষ নাগাদ এই চরের ধান পাকবে। তার আগেই কলে-কৌশলে চরটা আবার দখল করতে হবে। যুদ্ধের দরুন ধান-চালের দাম লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে। গোলার ধান আরো কয়েক মাস রেখে দিলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। আমনের মরশুমে দুই-তিন হাজার মণ চাল কিনে রাখলে অনেক মুনাফা হবে। চাল রাখার জন্য একটা গুদামঘর বানানো দরকার। কিন্তু টিন পাওয়া যাচ্ছে না। টাটা কোম্পানী এখন নাকি যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি করতে ব্যস্ত। টিন আর তৈরি করছে না। অনেকে অভাবে পড়ে ঘর বিক্রি করছে। দু-চারটে ঘর কিনতে পারলে গুদামের জন্য প্রয়োজনীয় টিন পাওয়া যাবে। পীরবাবা আর মাসখানেক পরেই এসে পড়বেন। তাই বাড়ি তৈরির কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। আরশেদ মোল্লার মেয়ের সাথে পীরবাবার শাদিমোবারক সহি-সালামতে সম্পন্ন করতে পারলেই তার মনে লালিত অনেক দিনের আরজু পুরো হয়। কিন্তু তার আগে ফজলকে আবার জেলে ঢোকাতে হবে। গুলি-খাওয়া বাঘ খাঁচায়। ঢুকাতে না পারলে স্বস্তি নেই। ও বাইরে থাকলে চর দখল করা কঠিন হবে। আর শুভ কাজের সময় সে কী যে করে বসে বলা যায় না।

হঠাৎ আরশেদ মোল্লা ও তার মেয়ের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে জঙ্গুরুল্লা। মোল্লাকে সে দেখেনি অনেকদিন। খুনের চর থেকে বিতাড়িত কোলশরিকদের মাঝেও তাকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না তার। কোরবান ঢালী তার সামনেই বসে ছিল। তাকেই জিজ্ঞেস করে সে, মাইরের দিন আরশেদ মোল্লা কি চরে আছিল?

হ আছিল। ভ্যাদাডা পলাইতে পারছিল না? ওরে চুবাইয়া এক্কেরে আধামরা কইর‍্যা ফালাইছিল।

অ্যাঁ, কও কি! এই কথাডাতো আমারে কয় নাই কেও।

আমি ও জানতাম না হুজুর, আইজই হুনছি।

কে চুবাইল? জামাই বুঝিন হউরের লাগুড় পাইয়া শোধ নিছে? চুবাইয়া হ্যাঁ-দফা ঘড়াইয়া দিছে?

কে চুবাইছে, হুনি নাই।

ভ্যাবলাডা কই এহন? বাইন্দা রাখে নাই তো?

না ওগ আতে পায়ে ধইর্যা, মাইয়া দিয়া আহনের ওয়াদা কইর‍্যা ছাড়া পাইছে।

অ্যাঁ, কও কি! ওয়াদা কইর‍্যা আইছে?

হ, আমার কানে কানে কইছে। আপনের কাছে কইতে মানা করছে।

ক্যান্? মানা করছে কিয়ের লেইগ্যা? মাইয়া কি দিয়া আইব নি?

হেইডা কয় নাই। তয় ওয়াদা যহন করছে–

ওয়াদা করছে তো জান বাঁচানের লেইগ্যা। তালাক দেওয়া মাইয়ারে দিয়া আইব ক্যামনে? তুমি শিগগির যাও। আরো পাঁজ-ছয়জন লইয়া যাও। মোল্লারে ধইর‍্যা উঁচুকাইয়া লইয়া আইবা আমার কাছে। আর শোন, ওর মাইয়াডারেও লইয়া আহো।

কোরবান ঢালী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মজিদ খালাসি আসে।

কি ও খালাসি, কি খবর লইয়া আইছ?

হুজুর, থানায় ইজাহার নেয় নাই।

ইজাহার নেয় নাই! জঙ্গুরুল্লা রাগে ও উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়।

তুমি খবর পাইলা কই? তোমারে তো থানায় পাই নাই।

ওনারা ডরে আপনের কাছে আহে নাই। আমারে খবর দিয়া পাডাইছে।

ইজাহার নেয় নাই ক্যান?

বড় দারোগা বিশ্বেস করে নাই।

ক্যান বিশ্বেস করে নাই?

তাতো কিছু ভাইঙ্গা কয় নাই। মনে অয় ঠিকমত মিল দিয়া কইতে পারে নাই।

রাগান্বিত জঞ্জুরুল্লা দাঁতে দাঁত ঘষে। বলে, এই হারামজাদারা কোনো কামের না। এই সামান্য কামডা ঠিক মতন কইর‍্যা আইতে পারল না। ইচ্ছা করে ওগ ভরতা বানাইয়া খাই। হারামজাদারা–

মাগরেবের আজান শোনা যায়।

জঙ্গুরুল্লা রাগে গরগর করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।

রাতের খাওয়া সেরে জঙ্গুরুল্লা যখন শোয়ার আয়োজন করছিল তখন বাইরে কোরবান ঢালীর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। হুজুর, ঘুমাইয়া পড়ছেন নি? আমরা আইছি।

জঙ্গুরুল্লা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, মোল্লারে লইয়া আইছ?

না হুজুর, আরশেদ মোল্লা বাড়ি নাই। কোথায় গেছে বাড়ির কেও কইতে পারে না।

কবে আইব?

তাও কেও কইতে পারে না।

তার মাইয়া লইয়া আইছ?

না হুজুর। আরশেদ মোল্লা নাই, এমুন অবস্থায় তার মাইয়া আনি ক্যামনে?

আইচ্ছা বাড়ি যাও। কাইল সকাল বেলা আমার লগে দেখা কইর‍্য।

জঙ্গুরুল্লা পালঙ্কের বিছানায় শুয়ে পড়ে।

আরশেদ মোল্লার মাইয়ারে আনতে কইছিল কিয়ের লেইগ্যা? পাশে শোয়া দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শরিফন জিজ্ঞেস করে।

তুমি ওই সব বোঝবা না।

বুঝমু না ক্যান্? সুখের গাঙ্গে বুঝিন রসের জোয়ার লাগছে, রঙ্গের ঢেউ উথালপাথাল করতে আছে?

উঁহু, নাগো, দুখের গাঙ্গে এখন বড় তুফান। ঐ সব কথা বাদ দ্যাও। তুমি আমার রান দুইডারে টিপ্যা দ্যাও জোরে জোরে। রানের মইদ্যে বড় চাবাইতে শুরু করছে।

শরিফন ওঠে। স্বামীর পা টিপতে টিপতে বলে, মাইয়াডা বোলে পরীর মতন খবসুরত?

শরিফনের কথা কানে যায় না জঙ্গুরুল্লার। তার মনে তখন নানা দুশ্চিন্তার ভিড় জমতে শুরু করেছে।

আরশেদ মোল্লা কি সত্যি ওয়াদা পালন করবে? ফজলের ঘরে দিয়ে আসবে তার মেয়েকে? তা কি করে হয়! তালাক দেয়া মেয়ে আগের স্বামীর ঘর করবে কেমন করে? এটা যে শরিয়তের বরখেলাপ।

পীরবাবার জাদু-টোনার কি কোনো আছর পড়েনি মেয়েটার ওপর? ফজলকে জেলে ঢুকাবার একটা বড় সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল। ওকে কি ভাবে আবার জেলে ঢোকানো যায় ।

.

২৮.

সে দিনের সে গানটি ফজলের মনে গেঁথে রয়েছে। সে একাকী বসে থাকলে বা শুয়ে জেগে থাকলে সমস্ত ভাবনা-চিন্তা ছাপিয়ে গানটির গুঞ্জরণ শুরু হয় তার মনের মধ্যে। দেহের সমস্ত তন্ত্রী নেচে ওঠে সুরের ঝঙ্কারে। সে নিজেও গুনগুন করে গায় গানের কয়েকটা কলি। কখনো কলাগাছের ফাঁক দিয়ে রূপজানের বিষণ্ণ মুখ, কখনো কাশবনের ফাঁক দিয়ে জরিনার অশ্রুসজল চোখ ধরা পড়ে তার মনের চোখে। দুজনই তাকে ভালোবাসে। দুজনই তার চোখে এক ও অভিন্ন, যেন এক দেহে লীন হয়ে গেছে দুটি নারী।

ভাওর ঘরে শুয়ে আছে ফজল। তার পাশে ঘুমিয়ে আছে নূরু। পাশের আরেকটা ভাওর ঘরে বরুবিবি ও আমিনা ঘুমিয়ে আছে।

সারাটা দিন খুবই খাটুনি গেছে। ভাটিকান্দি থেকে ঘর-দরজা ভেঙে সে নিয়ে এসেছে খুনের চর। কাল ভোরেই আবার শুরু হবে ঘর তৈরির কাজ। এক দিনের মধ্যে ঘরগুলো খাড়া করতে হবে। এজন্য তিনজন মিস্ত্রি ঠিক করেছে সে। জন চল্লিশেক কোলশরিকও কাজ করবে মিস্ত্রিদের সাথে।

রাত অনেক হয়েছে। গতদিনের খাটা-খাটুনিতে ফজল ক্লান্ত, অবসন্ন। ঘুমে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কিন্তু তবুও তার মনের ভেতর চলছে গানের গুঞ্জরন,–সেথায় বধূ থাকে।

এক সময়ে গানের গুঞ্জরণ থেমে যায়। ফজল ঘুমিয়ে পড়ে।

…কাশবনের ভেতর দিয়ে কলসি কাঁখে এক যুবতী নারী ললিতগতিতে এগিয়ে আসছে নদীর পাড়ে। তার পরিধানে কমলা রঙের শাড়ি। কে এ নারী? রূপজান, না জরিনা? দূর থেকে চিনতে পারছে না ফজল। সে ডিঙির মাথিতে বসে বৈঠা টানছে। কলসিটা পাড়ে রেখে যুবতীটি কোমরে জড়িয়ে নেয় শাড়ির আঁচল। কলসিটা বাঁহাতে তুলে সে পানিতে নামে। কলসিটায় বুকের ভর দিয়ে সে এবার পা ছড়িয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করে। হঠাৎ তার চিৎকার শুনতে পায় ফজল। সে দেখতে পায়, যুবতীটি কলসির গলা জড়িয়ে ধরে ভেসে থাকবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিসে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। নিশ্চয়ই কুমির টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফজল জোরে জোরে বেঠা টেনে এগিয়ে যায়। কলসিটা একদিকে কাত হয়ে ছুটছে মাঝনদীর দিকে। মাঝে মাঝে ওটা ডুবে যাচ্ছে। যখন ভেসে উঠছে তখন ওটার গলা জড়িয়ে ধরা কনুই ও একগোছা চুল শুধু দেখতে পায় ফজল। সে বৈঠাটা দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে কুমিরের সম্ভাব্য অবস্থানের দিকে তাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি লাগে ফজলের সারা দেহে। তার মাথাটা ধপ করে পড়ে বালিশের ওপর।

আল্লাহু আল্লাহ! কী দ্যাখলাম!ঘাড়টা ব্যথা করছে ফজলের। বালিশের ওপর ঘাড়টা এ-কাত ও-কাত করে সে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়। পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ফজল বিছানা ছেড়ে ওঠে। অন্ধকারে হাতড়ে সে খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রাখা টর্চলাইটটা হাতে নেয়। ওটা জ্বালিয়ে ঘরের এক কোণে রাখা মাটির কলসি থেকে ঢেলে পুরো এক গ্লাস পানি খায়।

রাত আর কতক্ষণ আছে, কে জানে? বেড়ায় সাথে ঝোলানো আছে ঘড়িটা। ফজল টর্চের আলো ফেলে ঘড়ি দেখে। বারোটা বেজে ওটা বন্ধ হয়ে আছে। গত পরশুর পর নানা ঝামেলার জন্য ওটায় আর দম দেয়ার কথা মনে হয়নি।

ফজল ঝাঁপ সরিয়ে খালি পায়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়ের নিচে ভিজে মাটি। মাথার ওপর খোলা আকাশ। লক্ষ কোটি তারা মিটিমিটি জ্বলছে। সন্ধ্যায় দেখা শুক্লপক্ষের আধখানা চাঁদ আর আকাশে নেই। সে আদমসুরত খুঁজে বের করে। আদমসুরতের অবস্থান দেখে সে বুঝতে পারে, রাত পোহাতে ঘণ্টা তিনেক বাকি আছে।

কী একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম! ফজল মনে মনে বলে। রূপজানের কোনো বিপদ হয় নাই তো! জরিনা কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে নাই তো!

ওরা কেমন আছে, জানতে প্রবল ইচ্ছে জাগে তার মনে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খবরাখবর সে পায়নি। চোখ দুটো তার আপনা থেকেই একবার উত্তর পুবমুখি নলতার দিকে আর একবার দক্ষিণ-পুব বরাবর নয়াকান্দির দিকে দৃষ্টি ফেলে। ঘন কালো অন্ধকার। কয়েকটা বাতি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। জেলেরা মাছ ধরছে নদীতে। বাতি জ্বলছে তাদের নৌকায়।

ফজল দুদিকেই টর্চের আলো ফেলে। সে আলো চরের সীমানা ছাড়িয়ে খুব বেশি দূর এগোয় না। সে জানে টর্চের আলো নলতা বা নয়াকান্দির অর্ধেকের অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে না। তবুও অযথাই সে ঐ দুদিকে টর্চের আলো ফেলে বারবার। ফজলের দিকে টর্চের আলো আসছে পুবদিকে থেকে। চরের পাহারায়রত তারই লোক তার আলোর জবাবে আলো ফেলছে।

ফজল চরের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকেও টর্চের আলো ফেলে। সেদিক থেকেও টর্চ মেরে জবাব দেয় পাহারাদাররা।

ফজল ধানখেতের আল ধরে এগিয়ে যায় পুবদিকে। পায়ের নিচে প্যাঁচপেচে কাদা। কিছুদূর কাদা মাড়িয়ে, তারপর তিরতিরে পানি ভেঙে সে পুব কিনারায় চলে যায়। অনেকক্ষণ নদীতে ভাটা শুরু হয়েছে। কিন্তু জোয়ারের পানি এখনো পুরোপুরি নেমে যায়নি।

এখানে কারা আছে পাহারায়? ফজল জিজ্ঞেস করে।

আমি লালু আর সাবু। উত্তর দেয় একজন পাহারাদার। অনেক লটাঘাস বিছিয়ে একটা ঢিবির মতো করা হয়েছে। তারই ওপর দাঁড়িয়ে আছে দু’জন পাহারাদার।

তোরা সাবধানে থাকিস। গাঙ্গে কিন্তু কুমির আছে।

আমাগ কাছে কুমির আইব কি মরতে? ট্যাটা দিয়া এক্কেরে গাঁইথ্যা ফালাইমু।

টিপির উপরে তোগ টঙ বানাইয়া দিতে অইবরে। শীতকাল আইসা পড়তেছে। ছই না থাকলে মাথায় ওস পড়ব। আমাগ বেড়য়ালারা কই? ফাঁকগুলা বানা দিয়া বন্ধ করছে?

হ, ভাটার টান লাগনের আগেই জাগাইয়া দিছিলাম। সাবু বলে। তারা ফাঁক বুজাইয়া ঘুমাইয়া রইছে ডিঙির মইদ্যে।

জোয়ারের সময় মাছ যাতে কিনারায় আসতে পারে সেজন্য বেড়ের কিছু বানা তুলে দেয়া হয়। ভাটার টান শুরু হওয়ার আগেই সে ফাঁক গুলো আবার বানা দিয়ে বন্ধ করতে হয়। যাতে পানি কমার সাথে সাথে মাছ বেরিয়ে যেতে না পারে।

মোরগের বাকের আগে পানি নামব না। ফজল বলে। পানি বেবাক সইর‍্যা যাওনের আগেই ওগ জাগাইয়া দিস আবার।

আইচ্ছা।

আর শোন, মাছ বেচতে যারা তারপাশা যাইব, তাগো মনে করাইয়া দিস, তারা যেন খবরের কাগজ আনতে ভোলে না।

ফজল টর্চের আলো ফেলে কিনারা ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়। কোথাও পায়ের পাতা সমান, কোথাও আধহাঁটু পানি। সে পুরোটা চরে ঘোরে। পাহারাদাররা সবাই সজাগ, সতর্ক।

সে তাদের সাবধান করে দেয়, কুমির আছে কিন্তু গাঙ্গে। সাবধান!

ফজল ভাওর ঘরে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর শোনা যায় ভোরের আজান।

.

বসত ভিটা উঁচু করা প্রয়োজন। উঁচু না করলে ভরা বর্ষার সময় জোয়ারের পানি ঢুকবে ঘরের মধ্যে। তাই চল্লিশ জন কোলশরিক অন্ধকার থাকতেই ওড়া-কোদাল নিয়ে কাজে লেগে গেছে। ফজলের বাড়ির জন্য নির্ধারিত চৌহদ্দির দক্ষিণ পাশে পুকুর কেটে তারা বসত ভিটায় মাটি ফেলছে। কিন্তু পুকুরটা বেশি গভীর করা যাচ্ছে না। পানি উঠছে নিচে থেকে।

আকু মিস্ত্রি ভোরেই এসে কাজ করতে শুরু করেছে। তার তদারকিতে কাজ করছে। আরো দু’জন মিস্ত্রি।

দক্ষিণ ভিটিতে উঠবে তিরিশের বন্দের কাছারি ঘর। উত্তর ভিটিতে সাতাশের বন্দের ও পশ্চিম ভিটিতে পঁচিশের বন্দের দুটো থাকবার ঘর উঠবে। ঘরগুলোর ঢেউটিনের চালা, পাতটিনের বেড়া আর খুঁটি-খাম্বা সবই তৈরি। এখন মাপ-জোখ নিয়ে, বন্দ ঠিক করে, খুঁটি খাম্বা পুঁততে হবে। খুঁটির ওপর চালা বসিয়ে বেড়াগুলো গজাল মেরে আটকে দিতে হবে। পুবের ভিটিতে চাড়ার দো-চালা ঘর উঠবে। ওটার একদিকে চেঁকিঘর আর একদিকে রসুইঘর হবে।

ফজল বসে বসে মিস্ত্রিদের কাজ দেখছে আর নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে পুলকি মাতব্বরদের সাথে।

ওরা কি থানায় গেছে? জিজ্ঞেস করে ফজল।

গেছে, এডুক খবর পাইছি। মেহের মুনশি বলে। কারে কারে আসামি দিছে, খবর পাই নাই।

আপনারা খবর নেন। যাদের এই চরে আসার কথা, তারা কি সবাই আইস্যা পড়ছে?

হ, সবাই বউ-পোলাপান লইয়া আইছে। বলে জাবেদ লশকর। গরু-বাছুর, হাঁস মুরগি সব লইয়া আইছে।

ফুঁত-ফুঁত।

চাটগাঁ মেল আসছে। সকলেই সেদিকে তাকায়। স্টিমারটা এ চরের উত্তর দিক দিয়ে চলে যায়। তারপাশা, ভাগ্যকুল টেপাখোলা ধরে যায় গোয়ালন্দ।

জাহাজটা অনেক দেরিতে যাইতে আছে আইজ। কদম শিকারি বলে।

চর মাথাভাঙ্গার উত্তর চর পড়তে আছে। জাবেদ লশকর বলে। তার লেইগ্যা ঘুইর‍্যা আইতে জাহাজের দেরি অইয়া যায়।

শোনেন, একট প্রাইমারি ইস্কুল খুলতে অইব। ফজল বলে। শুরুতে নিজেগই মাস্টারি করণ লাগব।

তা করণ যাইব। মেহের মুনশি বলে।

বাজারের বেইল অইয়া গেছে। রমিজ মিরধা বলে। ট্যাহা লইয়া আহো। আমি আর মুনশি হাশাইল যাইমু। গয়নাগুলা বেবাক ছাড়াইয়া লইয়া আইমু।

লাগবতো আসল দেড় হাজার আর এক মাসের সুদ পঁচাত্তর টাকা। তাই না? ফজল বলে।

হ। এই কয়দিনের লেইগ্যা পুরা এক মাসের সুদ চাইতে পারে।

ফজল উঠে ভাওর ঘরে যায়। লোহার সিন্দুক এনে সেখানেই রাখা হয়েছে। সিন্দুক খুলে টাকা নিয়ে সে কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে। মেহের মুনশি টাকা গুণে নিয়ে রমিজ মিরধার সাথে হাশাইল রওনা হয়।

.

রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে। ফজল সবাইকে নিয়ে তাদের ভাওর ঘরের ছায়ায় গিয়ে বসে।

ঘোঁজার দিক থেকে চারজন লোক আসছে। তাদের সাথে করে নিয়ে আসছে উত্তর দিকের একজন পাহারাদার।

এই লোকগুলা আইছে আপনের লগে দ্যাহা করতে। ফজলকে বলে পাহারাদার বাচ্চু।

হ, মাতবরের পো, আপনের কাছে একটা আরজু লইয়া আইছি। আমরা আছিলাম ধানকুনিয়ার চরে। আমাগ চর ভাইঙ্গা গেছে। আমার নাম তোবারক। অনেকদিন ধইর‍্যা পাতনা দিয়া আছি ডাইনগায়। আর ওনারা চর ভাঙনের পর আসাম মুলুকে চইল্যা গেছিল। আবার ফিরত আইছে। আমাগ কিছু জমি দ্যান।

জমি দিব কইত্যন? কদম শিকারি বলে। জমিতে বেবাক ভাগ-বণ্টন অইয়া গেছে।

এই মিয়া মাতবরের পো ইচ্ছা করলে দিতে পারে। আমাগ বাঁচনের একটা রাস্তা কইর‍্যা দিলে আমরা না খাইয়া মইরা যাইমু।

না মিয়ারা, জমি দেওনের কোনো উপায় নাই।

দয়া কইর‍্যা আমাগ বাচনের একটা পথ কইরা দ্যান। তোবারকের সাথের একজন বলে। আমরা এই তিনজন চর ভাঙ্গনের পর গেছিলাম আসাম মুলুক।

আসামে তো অনেক মানুষ যায়। ফজল বলে। গেলেই কি জমি পাওয়া যায়।?

পাওয়া যাইব কইতন? জমিতো কেও দ্যায় না। বন-জঙ্গল সাফ কইরা জমি বানাইতে অয়। আমরাও জমি আবাদ করছিলাম। কিন্তু কালাজ্বরে থাকতে দিল না। কালাজ্বরে আমার মা, দুইডা লায়েক পোলা মরছে। ওনাগ পোলাপানও মরছে। হেষে মরণের মোখেরতন আমরা পলাইয়া আইছি। হঠাৎ লোকটির গলা ধরে যায়। তার চোখ ছলছল করে।

ফজলের মনে সহানুভূতি জাগে। সে জাবেদ লশকর ও কদম শিকারির দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা কি কন?

কী আর কইমু। জাবেদ লশকর বলে। এতে কষ্ট কইর‍্যা আমরা চর দখল করলাম। আর ওনারা আসমানতন আইয়া কয়, জমি দ্যান।

না মিয়ারা, জমি দেওন যাইব না। কদম শিকারি দৃঢ় কণ্ঠে বলে।

আমাগ বাঁচনের একটা রাস্তা কইর‍্যা না দিলে বউ-পোলাপান লইয়া দপাইয়া মইর‍্যা যাইমু। তোবারক বলে। সাড়ে তিন ট্যাহা মনের চাউল দশ ট্যাহা অইয়া গেছে।

আকু মিস্ত্রি হুঁকো টানতে টানতে এসে দাঁড়িয়ে শুনছিল এদের কথা। সে বলে, হ, কাইল ট্যাহায় চাইর সের ভাও গেছে দিঘিরপাড়। হোন মাতবরের পো, আমাগ কিন্তু এহন আষ্ট আনা রোজ দিয়া পারবা না। আমাগ এহন অ্যাক ট্যাহা কইর‍্যা দিতে অইব।

ওরে আমার আল্লারে, আষ্ট আনারতন এই লাফে অ্যাক টাকা!

চাউলের দামও তো লাফ দিয়া তিন দুনা অইছে, কি কও, দিবা, না দিবা না? না দিলে থাকুক পইড়া তোমার কাম। আমরা বাড়ি চলোম।

না, না, কাম করতে থাকেন। বিবেচনা কইরা দিমু আপনাগ।

আকু মিস্ত্রি গিয়ে আবার কাজে লেগে যায়।

লোকগুলো আবার অনুনয় করে।

জমি দিতে পারমু না। ফজল বলে। তয় তোমাগ বাচনের একটা পথ কইর‍্যা দিতে পারি।

হ, একটা পথ কইরা দ্যান। তোবারক বলে। আল্লায় আপনের ভালো করব।

শোন, বাড়ির কাছে এত বড় গাঙ থাকতে তোমরা না খাইয়া মরবা ক্যান? এই গাঙ আমাগ যেমন ভোগায়, তার চেয়ে বেশি খাওন যোগায়। আমাগ কোলশরিকরা বেড় দিয়া মাছ। ধরে। সেই মাছ বেইচ্যা তারা সংসার চালায়। পারবা তোমরা মাছ ধরতে?

পারমু, মাতবরের পো। তোমরা কি কও, পারবা?

হ, পারমু। আসাম-ফেরত তিনজন বলে।

যদি পার, চইল্যা আসো এই চরে। থাকনের লেইগ্যা ঘর উঠানের জায়গা আমি দিমু। তোমরা বাঁশ, বেত, নারকেলের কাতা কিন্যা আনো। চাই বানাও, দোয়াইর বানাও, চালি বুনাও। দাউন বড়শি বাইন্দা লও। অবসর সময়ে জাল বোন ইলশা জাল, মই জাল, টানা জাল, ধর্মজাল, ঝাঁকি জাল। আমাগ কোলশরিকরা পুব-দক্ষিণ আর পশ্চিমের ঢালে বেড় পাতছে। বেড় পাতনের আর জায়গা নাই। উত্তর দিকটা ঢালু না, খাই বেশি। ঐ দিগে তোমরা চাই পাতো, দোয়াইর পাতো, দাউন বড়শি পাতো। থাকলে মানুষ পারে না কোন কাম? না খাইয়া মরে কারা? যারা আত-পাও থাকতে হায়-হুঁতাশ করে। বাঁশ, বেত, সূতা কিনতে টাকা লাগলে কর্জ নিও আমারতন।

ফজলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তারা চলে যায়।

জাবেদ লশকর বলে, বড় খারাপ দিন আইতে আছে। মানুষ চেষ্টা করলেও কি বাইচ্যা থাকতে পারব?

চেষ্টাতো করতে অইব। ইতিহাসে পড়ছি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে এই দেশের তিনভাগের এক ভাগ মানুষ মইর‍্যা গেছিল। সেই সময়েও ব্রিটিশ আছিল। দেশের ফসল মাইর গেছিল। মানুষের টাকা থাকলেও চাউল পাওয়া যায় নাই। সেই সময় তো জাহাজ আছিল না, রেলগাড়ি আছিল না। অন্য দেশের সাথে যোগাযোগ আছিল না। এখন তো একখানের ফসল মাইর গেলে আরেকখানতন আনতে পারা যায়। সরকার কী করতে আছে? এক জেলারতন আরেক জেলায় ধান-চাউল আনতে দেয় না। জাপানিরা বর্মা দখল করছে। ওই খানের পেণ্ড চাউল আর আসব না। আবার মিলিটারির লেইগ্যা ধান-চাউল গুদামে ভরতে আছে। সরকার যদি দেশের মানইনষের দিগে না চায় তয় সেই সরকার থাকন না থাকন সমান। শোনেন, এই বিদেশী সরকার খেদান লাগব। ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু অইছে। ব্রিটিশ আর বেশিদিন এই দেশে থাকতে পারব না। শোনেন বিদেশী সরকারের উপর ভরসা কইর‍্যা থাকন যাইব না। এই চরের ধানে কিন্তু বেবাকের সাত-আট মাসের বেশি চলব না। আপনারা চীনা আর কাউনের বীজ যোগাড় করেন। উঁচা জায়গায় ঐ লতা লাগাইয়া দিবেন। যার যার বাড়িত লপ্তে।

গুড়গুড় আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। সবাই মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। পাঁচটা উড়োজাহাজ আসছে দূর থেকে। তার পেছনে আসছে আরো পাঁচটা।

যুদ্ধ এইবার লাগছে জবর। জাবেদ লশকর বলে। ওগুলা কই যাইতাছে?

ওগুলা যাইব আসামের কোনো ঘাঁটিতে। ফজল বলে। সেইখানতন পেট্টল ভইর‍্যা যাইব বর্মা মুলুকে, জাপানিগ উপরে বোমা মারতে।

ভয়ঙ্কর বিদঘুঁটে শব্দ করে উড়োজাহাজগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উত্তর পুবদিকে।

ফজল তার অসমাপ্ত কথার জের টেনে বলে, আপনারা যার যার বাড়ির লপ্তে কদু, কুমড়া, বেগুন, মরিচ, নানান জাতের তরিতরকারির গাছ লাগাইতে শুরু করেন। বাড়ির চুতর্দিগে বেশি কইর‍্যা, ঘন কইর‍্যা কলাগাছ লাগান। এতে বাড়ির পর্দাও অইব, কলাও খাওয়ন যাইব। যদি আকাল লাগে, তয় চীনা-কাউনের ভাত, মিষ্টি আলু, কলার বারালি পেটের জামিন দিয়াও বাঁচন যাইব।

ও মিয়া মাতবরের পো। আকু মিস্ত্রি ডাকে ফজলকে। দ্যাহো দেহি ভালো কইর‍্যা। ব্যাকাত্যাড়া অইয়া গেলনি আবার।

জাবেদ লশকর, কদম শিকারি ও আহাদালীকে নিয়ে ফজল ঘরের কাজ দেখে। খুঁটি খাম্বা ঠিকমত বসানো হয়েছে। মিস্ত্রিদের কাজে কোনো খুঁত পাওয়া যায় না। বসত ভিটায় ও ঘরের ভিটির মাটি ফেলা শেষ হয়েছে। তক্তা দিয়ে পিটিয়ে দুরমুশ করে সমতল ও মজবুত করে মাটি বসাচ্ছে কয়েকজন কোলশরিক।

মিস্ত্রি চাচা, সব ঠিক আছে। এইবার চালগুলা উড়াইয়া খিলাইয়া ফেলেন। বেড়াগুলা লাগাইয়া ফেলেন। চাল উড়াইতে আমাগ ধরন লাগব?

না, বহুত মানুষ আছে। তোমাগ ধরন লাগব না।

পুলকি-মাতব্বরদের নিয়ে ফজল আবার এসে বসে ভাওর ঘরের ছায়ায়।

গতকাল দারোগা-পুলিস আসার কথা ছিল। আসে নাই ক্যান্, কে জানে! আজ কিন্তু আসতে পারে। পাহারাদাররা সতর্ক আছে তো?

হ আছে। আহাদালী বলে।

যারা মাছ নিয়ে তারপাশা গিয়েছিল তারা ফিরে আসে। ফজলের জন্য খবরের কাগজ নিয়ে এসেছে তারা।

আনন্দবাজার পত্রিকাটা হাতে নিতে নিতে ফজল বলে, আজাদ পাইলা না?

না, এইডাই শুধু পাওয়া গেল। কোলশরিক জমিরদ্দি জবাব দেয়।

কত পাওয়া গেছে আইজ?

বড় মাছে আঠারো ট্যাকা। আর গুড়া মাছে আট টাকা।

ভালোইতো পাইছ।

হ, মাছের দাম কিছু বাড়ছে।

কিন্তু চাউলের দামের মতন তো বাড়ে নাই।

তারপাশায় চাউলের দামের খোঁজ নিছিলা?

হ, ট্যাহায় চাইর সের। মাইনষে কওয়া-কওয়ি করছিল–দর আরো বাড়ব। হেষে পাওয়াই যাইব না।

জেল থেকে খালাস পেয়ে আসার পর ফজল খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ পায়নি। আর খবরের কাগজ হাতে পেয়েই তার পিপাসার্ত চোখ খবরের শিরোনামগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ে।

কি লেখছে মিয়া? জাবেদ লশকর উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করে। জোরে জোরে পড়লে আমরাও কিছু জানতে পারি।

উত্তর আফ্রিকায় মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশী আক্রমণ। রোমেলের দুর্ধর্ষ বাহিনীর পশ্চাদপসরণ। ব্রিটিশ বিমান হামলায় আকিয়াবের জাপানি ঘাটি বিধ্বস্ত। স্তালিনগ্রাডে প্রচণ্ড যুদ্ধ।

ফজল জোরে জোরে শিরোনামগুলো পড়তে থাকে।

দুপুরের কিছু পরে রমিজ মিরধা ও মেহের মুনশি হাশাইল থেকে ফিরে আসে। তারা গয়নাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।

একটা কামের মতো কাম অইছে। জাবেদ লশকর বলে। এহন ছাড়াইয়া না আনলে গয়নাগুলা আর কোনোদিন ছাড়ান যাইত না।

এই গয়নাগুলা নেওনের সময় কত বউ-ঝিরে কান্দাইছি। রমিজ মিরধা বলে। আইজ তাগ মোখে আবার হাসি ঝলমল করব।

ফর্দের সঙ্গে মিলাইয়া গয়নাগুলা আলাদা আলাদা সাজাইয়া নেন। ফজল বলে। তারপর একজন একজন কইর‍্যা বোলাইয়া যার যার গয়না ফিরত দিয়া দ্যান। পয়লা আমারে দিয়াই শুরু করেন।

রূপজানের গয়নাগুলো বুঝে নিয়ে ফজল সেগুলোকে রুমালে বাঁধে। রুমালের পুটলিটা বুকের সাথে চেপে ধরে সে ভাওর ঘরে যায়। তার মা সেখানে আলগা চুলোয় রান্না করছে।

মা এই নেও গয়না। আইজই মহাজনের ঘরতন টাকা দিয়া ছাড়াইয়া লইয়া আইছি।

গয়নাতো আনছস। কিন্তু গয়নার মানুষটারে তো আনতে পারলি না। গয়নার পুটলিটা হাতে নিয়ে বলে বরুবিবি।

ফজল মাথা নিচু করে সরে যায় সেখান থেকে।

.

দুপুরের খাওয়া সেরে ফজল মিস্ত্রিদের কাজ দেখতে চলে আসে। পুলকি-মাতব্বররা বাড়ি চলে গেছে যার যার। শেষ বিকেলের আগে তারা আর আসবে না।

ফজল খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে যায়।

ফজল।

ফজল মুখ তুলে তাকায়। আরে জাহিদ ভাই! তুমি কইতন আইলা?

আইলাম বাড়িত্‌ন। গেছিলাম ভাটিকান্দি। শোনলাম, তোমরা ঘর-দরজা ভাইঙ্গা এই নতুন চরে আইসা পড়ছ।

বাড়ির সব কেমন আছে? চাচি, শহিদ-ভাই, তওহিদ, সেতারা?

সব্বাই ভালো আছে। আমিই খালি ভালো নাই।

ক্যান্, কি অইছে?

এই নানান ঝামেলা। চাচি কই?

ঐ খানে ভাওর ঘরে। চলো যাই। তোমার তো খাওয়া হয় নাই।

না।

জাহিদকে ভাওর ঘরে নিয়ে যায় ফজল। তাকে দেখে খুশি হয় বরুবিবি। তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে তাদের বাড়ির সকলের কথা।

এরফান মাতব্বরের বড় ভাই এমরান মাতব্বর। সে-ই ছিল এ এলাকার বড় মাতব্বর। বাংলা ১৩২৬ সনের বন্যার পরের বছর যখন লটাবুনিয়া ভেঙে যায় তখন সে তার সব কিছু নিয়ে চলে যায় তার শ্বশুরবাড়ি–দক্ষিণপাড়ের পাইকপাড়া গ্রামে। তার স্ত্রী শরিফ ঘরের মেয়ে। সে বেঁকে বসেছিল, সে আর কোনো দিন চর অঞ্চলে যাবে না। উপায়ান্তর না দেখে সেখানেই সে জমাজমি কিনে বাড়ি-ঘর করে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। তারপর লটাবুনিয়া কয়েকবারই জেগেছে, আবার ভেঙেছে। নাম বদলে হয়েছে খুনের চর। কিন্তু এমরান মাতব্বর আর চরে ফিরে আসেনি কোনো দিন। স্ত্রীর জেদের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। বছর সাতেক আগে সে কলেরায় মারা যায়। জাহিদ তারই মেজো ছেলে।

জাহিদকে নিয়ে ফজল আবার চলে আসে মিস্ত্রিদের কাজের জায়গায়।

জাহিদ ভাই, তুমি না মিলিটারিতে গেছিলা?

হ, না জাইন্যা ঢুকছিলাম পায়োনিয়ার ফোর্সে। আমাগ নিয়া গেছিল চাটগাঁর অনেক দক্ষিণে জঙ্গল সাফ কইর‍্যা রাস্তা বানাইতে। এমুন সব কাম করতে হুকুম দেয় যা গুষ্ঠীর কেউ কোনোদিন করে নাই। অইসব জাগায় জাপানিরা বোমা মারতে পারে। আমি আইয়া পড়ছি, আর যাইমু না।

পলাইয়া আইছ?

না পলাইমু ক্যান্। ছুটি লইয়া আইছিলাম। আর যাইমু না।

আমাগ কোলশরিক কিতাবালীর পোলা বোরহান পড়ত ক্লাস এইটে। মিলিটারিতে ‘টপ্যাস’ অইয়া ঢুকছিল। সে মনে করছিল রাইফেল-বন্দুক হাতে লইয়া লড়াই করব। আমরা যেমন লড়াই করি ঢাল-শড়কি লইয়া। ও গিয়া দেখে, টপ্যাসের কাজ ঝাড়ু দেওয়া। সে-ও পলাইয়া আইছে। তারে নাকি পলাতক ঘোষণা করছে। তার নামে ওয়ারেন্ট বাইর অইছে।

জাহিদ গলা খাদে নামিয়ে বলে, শোন ফজল, আমার নামেও ওয়ারেন্ট অইছে। সেই জন্যই আইছি তোমায় বাড়ি। এইখানে তো আমারে কেও চিনে না। আমি এইখানেই থাকমু কিছুদিন।

থাকো, যদ্দিন তোমার মনে লয়। কিন্তু পুলিস আমাগ ধরতে আইব। আইজও আইতে পারে, কাইলও আইতে পারে। আমাগ বিরুদ্ধে ঘর পোড়ানের মামলা আছে।

তয় তো বড় মুসিবত। আমি তাইলে এখনি চইল্যা যাই।

না, যাইবা ক্যান্। পুলিস আইলে আগেই খবর পাইমু। আমি ধরা দিমু না। সইর‍্যা যাইমু। নাও-বাইছা সব তৈয়ার। তুমিও আমার লগে সইর‍্যা পড়বা।

জাহিদ আশ্বস্ত হয়। কিছুক্ষণ পরে সে বলে, আইচ্ছা, এই চরের অর্ধেক মালিকানা তো আমার বাজানের আছিল। তার অবর্তমানে এখন আমরা মালিক। দূরে আছিলাম বুইল্লা দাবি করি নাই। এহন দাবি করলে আমাগ অংশের জমি দিবা?

নেও না। আমার ভাগের অর্ধেক জমি দিমু তোমারে। চাচিরে, ভাবিসাবরে লইয়া আহো গিয়া।

মা তো আইব না। তোমার ভাবিসাবরে লইয়া আইমু। একটু থেমে সে আবার বলে, আইজ হাঁটতে হাঁটতে জান সারা। আমি ভাওর ঘরে গিয়া একটু বিশ্রাম নেই।

.

সবগুলো ঘর উঠে গেছে। কাজ আর বেশি বাকি নেই। দিনের শেষে কাজেরও শেষ হবে বলে মনে হয় ফজলের।

আজও পুলিস আসেনি। ফজল মনে মনে ভাবে, খুবই ভালো হলো। কাল এসে পুলিস প্রমাণ পাবে, এ চরের সত্যিকার মালিক কে?

আকু মিস্ত্রি চালার ওপর উঠে চালার জোড়ায় টুয়া লাগাচ্ছে। এক সময়ে সে গানে টান দেয়:

যেই ঘর আমি বানাইলাম
মনের মতন সাজাইলাম
সেই ঘরেতে হবে না মোর ঠাই রে,
হবে না মোর ঠাই।
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে
থাকতে হবে চিরতরে
সেই ঘরেতে আলো বাতাস নাই রে,
আলো বাতাস নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *