২১-২৪. জেল থেকে খালাস

জেল থেকে খালাস পেয়ে ফজল বাড়ি আসে। তাকে নিয়ে এক মাল্লাই কেরায়া নৌকা যখন বাড়ির ঘাটে পৌঁছে তখন সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই।

নৌকা থেকে নেমেই সে পিতার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নূরু ও আমিনা তাকে নৌকা থেকে নামতে দেখে ছুটে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়। খবর পেয়ে বরুবিবি বিলাপ করতে শুরু করে। ফজল বাপের মরণ দেখতে পায়নি আবার বাপও মরণকালে ছেলেকে দেখতে পায়নি–এ দুঃখ এখনো তার বুকের ভেতর আছাড়ি-পিছাড়ি খায়।

ফজল কবর জিয়ারত শেষ করে মৃত পিতার উদ্দেশে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, বাজান, আপনের অকালে মরার জন্য জঙ্গুরুল্লা আর আরশেদ মোল্লা দায়ী। আমাগ চর, আমাগ হক-হালালের জমি জঙ্গুরুল্লা অন্যায়ভাবে দখল করছে। এই চর আমি দখল করমুই করমু। আপনে দোয়া কইরেন। আরশেদ মোল্লা মিথ্যা মামলায় আমারে পুলিস দিয়া ধরাইয়া দিছে। এর উপযুক্ত শাস্তি তারে দিমুই দিমু। আপনে দোয়া কইরেন।

নূরুর দিকে তাকিয়ে ফজল বলে, নূরু, তুই মেহের মুনশির কানে কানে কইয়া আয়–আমি আইছি। সে যেন রমিজ মিরধা ও কোলশরিকগ লইয়া মাগরেবের পর চুপচাপ আইসা পড়ে।

সন্ধ্যার পর পুলকি-মাতব্বর মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা, কদম শিকারি ও কোলশরিক আহাদালী, ধনু শিকদার ও আরো কয়েকজন আসে ফজলের সাথে দেখা করতে। তারা চরের অনেক খবর দেয় ফজলকে : জঙ্গুরুল্লার কোলশরিক আর বর্গাদাররা নতুন ভাওর ঘর তৈরি করেনি একটাও। তাদের তৈরি উনষাটটা ভাওর ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বসত করছে ওরা। হালের গরু নিয়ে গেছে চরে। সেগুলোর জন্য একচালা বানিয়েছে ষোলটা। তাদের রোপা ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছিল। ধানের অর্ধেকটা নিয়েছে জঙ্গুরুল্লা। বাকিটা ভাগ করে দিয়েছে কোলশরিকদের মধ্যে। জমি ভাগ করে এরফান মাতব্বরের কোলশরিকরা যেভাবে আল বেঁধেছিল সে সব আল ঠিক রেখে কোলশরিকদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিয়েছে জঙ্গুরুল্লা। প্রতি নল জমির জন্য সেলামি নিয়েছে চল্লিশ টাকা করে। শ্রাবণ মাসে রোপা আমন লাগিয়েছে সারাটা চর জুড়ে। ফসলের খুব জোর দেখা যায়।

চাকরিয়া প্রথমদিকে ছিল পঞ্চাশজন। ফজলকে পুলিস দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার পরও ছিল জনতিরিশেক। এরফান মাতব্বরের মৃত্যুর পর সব চাকরিয়া বিদায় করে দিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। ফজল জেল থেকে পালিয়ে আসার পর তিরিশ জনকে এনে রেখেছিল কিছুদিন। ফজলের। জেল হওয়ার পর আবার তাদের বিদায় দিয়েছে। ফজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে শুনলে আবার চাকরিয়াদের ডাক পড়বে।

ফজলদের তৈরি বানার বেড় দিয়ে মাছ ধরছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিকরা। অনেক মাছ। সেগুলো নিকারির সেঁকে নিয়ে বিক্রি করে রোজ কমসে কম কুড়ি টাকা পায়। ঐ টাকার চার আনা ভাগ দিতে হয় জহরুল্লাকে।

টাকা আয়ের একটা নতুন পথ বার করেছে জঙ্গুরুল্লা। খুনের চরের উত্তর-পূর্ব কোণে। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে যে ঘোঁজাটা, সেখানে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন জায়গার ছোট, বড়, খালি, মালবোঝাই নৌকা এসে পাড়া গাড়ে বিশ্রাম ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। জঙ্গুরুল্লা খুঁটিগাড়ি আদায়ের জন্য সে ঘোঁজা বন্দোবস্ত দিয়েছে রউজ্যা ডাকাতের কাছে। সে একশ থেকে দুশ মনি নৌকার জন্য আটআনা, দুশ থেকে চারশ-মনি নৌকার জন্য এক টাকা, চারশ-মনির ওপর হলে দুটাকা করে খুঁটিগাড়ি আদায় করে। জঙ্গুরুল্লাকে সে প্রতিমাসে দেয় তিনশ টাকা।

এত পয়সার আমদানি! এত নৌকা আসে কইতন? নৌকাতো বেশিভাগ আটক করছে সরকার। ফজল অবাক হয়ে বলে।

কিছু কিছু নৌকা লম্বর দিয়া ছাইড়া দিছে। রমিজ মিরধা বলে।

সে আর কয়ডা? ধান-চাউলের নৌকাও তো চলে না। নতুন আইন অইছে–এক জেলার ধান-চাউল অন্য জেলায় যাইতে পারব না।

ধান-চাউলের নৌকা ছাড়া আরো তো নৌকা আছে। মেহের মুনশি বলে। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস ভইর‍্যা চলছে আমের নাও আর কাঁডালের নাও। বাজে মালের নাও চলে বারোমাস। মওসুমের কতকত জিনিসরশুন, পেঁয়াজ, হলদি, মরিচ, তেজপাতা, নারকেল, সুপারি, হাজারো মাল এক জেলারতন আরেক জেলায় যায় এই নদী দিয়া।

আগের দিন অইলেতো টাকা দিয়া সিন্দুক বোঝাই কইর‍্যা ফেলাইত জঙ্গুরুল্লা।

হ ঠিক কথাই কইছ। রমিজ মিরধা বলে। আগের দিন অইলে রোজ আদায় অইত কমসে কম একশ ট্যাহা।

কিন্তু নৌকাওয়ালারা ঐ ঘোঁজায় নৌকা বান্দে ক্যান্। আরো তো কত ঘেঁজা আছে। সেখানে বিনে পয়সায় নৌকা রাখতে পারে।

অন্য ঘোঁজায় গেলে ডাকাতি অইতে পারে।কদম শিকারি বলে। এই আট-নয় মাসের মইদ্যে ছয়-সাতটা নৌকায় ডাকাতি অইছে! তারা পয়সা বাঁচাইতে গিয়া নাও রাখছিল অন্য ঘোঁজায়।

আসলে রউজ্যাই ডাকাতি করায় ওর লোকজন দিয়া। রমিজ মিরধা বলে। ডাকাতির ভয়ে বেবাক নৌকা খুনের চরের ঘোঁজায় আইস্যা খুঁটগাড়ি দিয়া খুঁডা গাড়ে।

ধান-চাউলের দাম কি বাজারে?

দাম অনেক বাইড়া গেছে। সোয়া দুই ট্যাহা মনের ধানের দাম চাইর ট্যাহা আর তিন ট্যাহা মনের চাউল ছয় ট্যাহা।

এই বছর বাচন কষ্ট আছে। কদম শিকারি বলে।

ধান বেশি অয় ভাটি অঞ্চল খুলনা বরিশালে আর উজান দেশ সিলেট ময়মনসিংয়ে। উত্তর বঙ্গের দিনাজপুরেও ধান বেশি অয়। ঐ সব জেলারতন ধান-চাউল আইতে দেয় না বুইল্যাইতো দাম এত বাড়তে আছে।

ধান-চাউল আইতে দেয় না ক্যান?

কি জানি, ব্রিটিশ সরকারের কি মতলব। জাপান বর্মা মুলুক দখল করছে। আসামের দিগে আগাইয়া যাইতেছে। ব্রিটিশ এইবার যুদ্ধের ঘাঁটি বানাইব এই দেশে। তারা সৈন্য আর যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়া আসছে। আরো অনেক আসব । এই সব লক্ষ লক্ষ সৈন্যদের খাওয়ান লাগব তো! তাই মিলিটারির জন্য ধান-চাউল মজুত করতেছে ব্রিটিশ সরকার।

হ আমিও হুনছি। মেহের মুনশি বলে। দিঘিরপাড়ের কেরাসিন তেলের পাইকার বলাই কুণ্ডু মাল আনতে গেছিল নারায়ণগঞ্জ। মাল পায় নাই। কেরাসিন তেল বোলে আর পাওয়া যাইব না। সে দেইখ্যা আইছে–শীতলক্ষাপড়ের আর চারগোপের পাটের গুদাম–ডেভিড কোম্পানীর ঐ সব বড় বড় পাটের গুদাম মিলিটারি দখল করছে। গাধাবোট, সুলুপ, ফেলাট, মাডুয়া নাও বোঝাই অইয়া ধান-চাউল আইতে আছে বিভিন্ন জেলারতন। মালগাড়ি ভইরা চাউল আহে দিনাজপুরতন। ওইগুলা জমা করতে আছে ঐ সব গুদামে।

বিদেশতন গমও নাকি আসতেছে জাহাজ বোঝাই কইরা। ফজল বলে। এইবার যে মাইনষের কপালে কি আছে, বলা যায় না। বর্মা মুলুকতন আগে চাউল আসত। মোটা পেশু চাউল। বর্মা এখন জাপানের দখলে। তাই ওইখানতন আর চাউল আসব না। সাংঘাতিক মুসিবত সামনে।

একটা কতা জিগাই মাতবরের পো। ধনু শিকদার বলে। আমরা হগল বচ্ছর ভাটি মুলুকে না অয় উজান দ্যাশে যাই ধান দাইতে। এইবারও মহাজন ঠিক করছি। কাতি মাসের এই কয়দিন পর ভাটি মুলুকে যাত্রা করতে চাই। দাওয়ালি নাও যাইতে দিব তো?

খালি নাও লইয়া যাইতে পারবেন। কিন্তু আসার সময় ধান লইয়া আইতে পারবেন না।

কষ্ট কইর‍্যা ধান কাটমু, মাড়াই করমু। হেই মিন্নতের ধানের ভাগ যদি না আনতে পারি, তয় মিন্নত কইর‍্যা লাভ কি? ক্ষোভ ও হতাশা ধনু শিকদারের কণ্ঠে।

আমরা ঢাকা-ফরিদপুরের দাওয়ালরা যদি না যাই তয়তো ভাটি আর উজান মুলুকের খেতের ধান খেতেই নষ্ট অইব। বলে আহাদালী।

তাতে অইবই। ব্রিটিশ সরকারের কি এখন এই দিগে খেয়াল আছে? তারা এখন যুদ্ধ লইয়া পেরেশান। ক্যামনে জাপানরে হটাইয়া নিজেগ রাজ্য উদ্ধার করব। ভারত ছাড় আন্দোলনের অনেক নেতা এখন জেলে। তারা আলোচনা করতে আছিল : আমাগ প্রধানমন্ত্রী হক সায়েবরে না জিগাইয়া ছোট লাট মিলিটারিগ লগে যুক্তি কইর‍্যা কয়েকটা জেলার ধান চাউল সরাইয়া দিছে বাংলার বাইরে, জাপান আইয়া পড়লে খাদ্যের অভাবে যাতে মুশকিলে পড়ে, লড়াই করতে না পারে। এই নিয়া হক সায়েবের সাথে ছোট লাটের বিরোধ চলতে আছে। রাজবন্দিরা আরো কইতেছিল–গুদামে গুদামে মিলিটারিরা ধান-চাউল জমা করতে আছে খালি তাগ খাওয়ার লেইগ্যা না। জাপান আইয়া পড়লে ওনারা বেবাক পোড়াইয়া দিয়া ভাইগ্যা যাইব। জাপানিরা খাদ্যের অভাবে আর লড়াই করতে পারব না।

কিন্তু হেই লগে আমরাও তো খাওন না পাইয়া মইরা যাইমু। আমাগ তিন-চাইর মাসের খোরাক আছে ভাটি না অয় উজান মুলুকতন। আমাগো তো বাঁচনের কোনো পথ দ্যাখতে আছি না।

হ, বড় খারাপ দিন আইতে আছে। এখন যদি আমন ধান পাকার আগে চরটা দখল করা যায়, তয় কিছুটা বাঁচার আশা আছে।

হ ঠিকই কইছ। রমিজ মিরধা বলে। কিন্তু জঙ্গুরুল্লার দলরে ক্যামনে হটান যায়? আপনেরাই বুদ্ধি দ্যান, কেমন কইর‍্যা—

আমরা তো কোনো কূলকিনারা পাইতেছি না। বলে মেহের মুনশি।

শোনেন, আমারে মুনশিগঞ্জ জেলেরতন পাঠাইছিল ঢাকা জেলে। আমি ঢাকা জেলেরতন খালাস পাইয়া আইছি। জঙ্গুরুল্লার দল আমার ছাড়া পাওয়ার কথা তাড়াতাড়ি জানতে পারব না। সেই জন্যই আপনেগ চুপে-চাপে আইতে কইছি। তারা তো তিনমাস হিসাব কইর‍্যা রাখছে। তাগ হিসাব মতন অগ্রাণ মাসের পাঁচ-ছয় তারিখে আমি ছাড়া পাইমু। কিন্তু আমি চব্বিশদিন আগেই ছাড়া পাইয়া আইছি। জেলখানায় ভালো মতন চললে, হুকুম মতন কাম করলে জেল মাফ পাওয়া যায়। জঙ্গুরুল্লারা তো এই খবর রাখে না। তাই চাকইর‍্যা এখন একটাও নাই চরে।

হ, তোমার ছাড়া পাওয়ার খবর পাইলে আবার চাকইরা আইন্যা রাখব চরে।

তখন কিন্তু চর দখল করা মুশকিল অইয়া পড়ব। আমি কাইল একটা দিন বাড়িতে আছি। পরশু দূরে একখানে চইল্যা যাইমু। জেলখানায় পালং থানার একজনের কাছে ভালো চাকইর‍্যার সন্ধান পাইছি। মেঘু আর আলেফের মতো চাকইর‍্যা দিয়া কাম ফতে অইব না। আমি দুই-তিন দিনের মইদ্য ঐ চাকইর‍্যা লইয়া আইমু। আমি যে ছাড়া পাইয়া আইছি এই কথা যেন একটা কাউয়ায়ও জানতে না পারে।

ও মিয়ারা হোনলা নি? খবরদার! এই কথা জানাজানি অইলে কিন্তু কোনো কাম অইব না।

বোঝলা তো মিয়ারা? রমিজ মিরধা বলে। নিজের কপালের লগে বেবাকের কপাল পোড়াইও না। যার মোখ দিয়া এই কতা বাইর অইব সে তার বাপের জর্মের না। সে একটা জারুয়া। এই কইয়া দিলাম।

শোনেন, অনেক টাকার দরকার। ফজল বলে। আমি আমাগ বেবাক গয়না বন্ধক দিমু। আপনারা নিজেগ সাধ্যমত টাকা জোগাড় কইর‍্যা কাইলই নিয়া আসেন। নগদ টাকা

থাকলে গয়না বন্ধক দেওন লাগব। চর ফতে অইলে সব আবার ফিরত পাইবেন।

হ, চরের জমি খাইতে অইলে টাকা খরচ করন লাগব। মেহের মুনশি বলে। আপনারা সবাই রাজি তো?

ফজল তার কাজে-কর্মে, ব্যবহারে এদের আস্থা অর্জন করেছে। সকলের অগাধ বিশ্বাস তার ওপর। মাছ ধরার ব্যবস্থা করে গরিব কোলশরিকদের যেভাবে সে সাহায্য করেছিল তা কেউ ভোলেনি। তাই তার প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়।

ফজল বলে, আপনারা বাড়ি যান। মুনশি ভাই, আর মির ভাই এই রাত্রের মইদ্যে টাকা অথবা গয়না যোগাড় করেন। ঐগুলা লইয়া কাইল ভোরে আমার এইখানে চইল্যা আসবেন।

একে একে সবাই নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওনা হয়।

.

পরের দিন। ভোরবেলা বরুবিবি রসুইঘরে চালের গুঁড়োয় পানি মিশিয়ে চিতই পিঠার গোলা তৈরি করছিল।

ফজল দরজার মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কি করতে আছ, মা।

কয়ডা চিতই পিডা বানাইমু। তুই আবার বাইরে চইল্যা যাইস না।

না, যাইমু না। তুমি আত ধুইয়া গয়নার পোটলাডা নামাইয়া দ্যাও তো মা।

গয়নার পোটলা! বউর গয়নার?

হ।

ঐ পোটলা দিয়া তুই কি করবি?

কাম আছে। অনেক টাকার দরকার।

উঁহু! এই গয়নাতে রূপজানের। উনি মরার সময় কইয়া গেছেন–ঐ গয়না রূপজানের মহরানার হক।

শোন মা, আমারতন জবরদস্তি কইর‍্যা তালাক নিছে। ঐ সময় আরশেদ মোল্লা মহরানার দাবি ছাইড়্যা দিছে।

আরশেদ মোল্লা দাবি ছাইড়া দেউক। কিন্তু উনি তো কইয়া গেছেন–গয়নাগুলা রূপজানের মহরানার হক।

ঠিক আছে, ঐগুলো রূপজানেরই থাকব। এখন টাকার বড় দরকার। ঐগুলা বন্ধক দিয়া কিছু টাকা আনতে অইব।

না রে বাজান, হেষে যদি ছাড়াইতে পারস?

ছাড়াইতে পারমু না ক্যান্? তোমারে কথা দিলাম, চাইর মাসের মইদ্যে ওগুলা ছাড়াইয়া আইন্যা যারডা তারে ফিরাইয়া দিমু।

অনেক পীড়াপীড়ির পর বরুবিবি রাজি হয়। সে হাত ধুয়ে ঘরে যায়। সিন্দুক খুলে গয়নার পুটলি বের করে। ফজলের হাতে ওটা দিয়ে সে বলে, দ্যাখরে বাজান, এইগুলা খুয়াইয়া ফেলাইলে কিন্তুক দায়িকের তলে থাকবি। মহরানার দেনা আর শোধ করতে পারবি না।

গয়নার পুটলি নিয়ে ফজল নিজের ঘরে যায়। চৌকির ওপর বসে সে পুটলি খোলে, একটা-একটা করে দেখে গয়নাগুলো। ওগুলো নাড়াচাড়া করার সময় গয়না পরিহিতা রূপজানের ছবি বারবার ভেসে ওঠে তার মনে।

ফজলের মনে প্রশ্ন জাগে, রূপজান গয়নাগুলো কেন ফেরত দিয়েছিল। তবে কি সে জোর-জবরদস্তির তালাক মেনে নিয়েছে? না, অসম্ভব। এ তালাক সে মেনে নিতে পারে না। গয়না বিক্রি করে তার মামলার তদবির করার জন্য সে কাদিরকে দিয়ে ওগুলো ফেরত পাঠিয়েছিল। কাদির তো তাই বলেছিল ওগুলো ফেরত দেয়ার সময়। সে তো বানিয়ে বলেনি কিছু। রূপজান যা বলে দিয়েছিল তা-ই সে বলেছে।

গয়নাগুলোয় হাত বুলাতে বুলাতে সে মনে মনে বলে, হায় রে অভাব! এই অভাবের তাড়নায় রূপজানের শরীল খালি কইর‍্যা একবার বন্ধক দিতে অইছিল এই গয়নাগুলা। এখন আবার বন্ধক দিতে অইব।

কেমনে যেন সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কায় ব্যথিয়ে ওঠে তার বুকের ভেতরটা।

মিয়া ভাই।

আমিনার ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল, কে রে আমিনা? আয়।

একটা থালায় করে চিতই পিঠা, নারকেল কোরা ও ঝোলা গুড় নিয়ে আসে আমিনা।

কিরে, তাল নাই? তালের মওসুম কি শেষ?

এইডাতো কাতি মাস। এহন কি আর তাল পাওয়া যাইব? হাশাইলের হাটে পাওয়া যাইতে পারে দুই একটা।

এই বচ্ছর তাল চোখে দেখি নাই। গুড় ও নারকেল সহযোগে চিতই পিঠায় এক কামড় দিয়ে ফজল বলে, চিতই পিঠার লগে তালের পায়েস! ওহ্ যা মজা!

ভাবি তো নাই। তাল গোলাইব কে?

ক্যান্ তুই? পারবিনা গোলাইতে?

উঁহু। তাল গোলান কি যেমুন-তেমুন কষ্ট। আমিনা গান গাইত গাইতে রসুইঘরের দিকে চলে যায়–

তাল গোলাগোল যেমুন তেমুন,
আঁইট্যা দ্যাখলে ভয় করে,  
তার চুল-দাড়িরে ভয় করে,
অ ভাইজান, আমি তাল খাইনা ডরে।

ফজলের মনের চোখে ভেসে ওঠে, রূপজান সবল সুডৌল হাত দিয়ে তালের আঁটি দলাইমলাই করে ঘন গোলা বের করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে–

তাল গোলাগোল যেমুন তেমুন,
আঁইট্যা দ্যাখলে ভয় করে,
তার চুল-দাড়িরে ভয় করে,
অ বু’জান, আমি তাল খাইনা ডরে গো,
তাল খাইনা ডরে।

তালের আঁইটায় চুল-দাড়ি
খামচা দ্যাও আর দ্যাও বাড়ি
ডলা দিয়া বাইর করগো রস
 অ বউ, বেতাইল্লারে এমনে করো বশ গো,
এমনে করো বশ।

হাতে-ধরা চিতই পিঠা মুখে দিতে ভুলে যায় ফজল। তার কল্পনা রূপজানকে নিয়ে আসে তার চোখের সামনে। তাল গোলাতে গোলাতে রূপজান তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে আর গান গাইছে–

তালের গোলা বেতাল করে,
জ্বাল দিলে যে উতরে পড়ে,
অ বু’জান, হইল কি কারবার গো,
হইল কি কারবার।
তাল পড়লে উত্‌রাইয়া,
পড়িস না গো চিত্‌তরাইয়া,
অ বউ, নিভু জ্বালে তালে তালে
নাড়া দে বারবার গো,
নাড়া দে বারবার।

অ দুদু।

নূরুর ডাকে কল্পনার ছবি মুছে যায় হঠাৎ।

কি রে নূরু, ডাক দিলি ক্যান্?

রমিজ মিরধা আর মেহের মুনশি আইছে।

কাছারি ঘরে বইতে দে। পান-তামুক দে। আমি আইতে আছি।

পিঠা খাওয়া শেষ করে গয়নার পুঁটলি নিয়ে ফজল কাছারি ঘরে যায়।

সালাম বিনিময়ের পর মেহের মুনশি বলে নগদ টাকা অনেকেই দিতে পারে নাই। বারোজনের কাছে পাইছি দুইশ’ পঞ্চাশ টাকা। পনেরো জন দিছে গয়না। বাকি কোলশরিকরা কিছু দিতে পারে নাই।

দিব কইতন? রমিজ মিরধা বলে। বউ-পোলাপান লইয়া ওরা বড় কষ্টে আছে।

তাতো বুঝলাম। ফজল বলে, কিন্তু অনেক টাকার দরকার। গয়না বন্ধক দিয়া কি অত, টাকা জোগাড় করন যাইব?

কত টাকা লাগব, আন্দাজ করছনি? মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে।

তা প্রায় দুই হাজার টাকা লাগব।

তা বেবাক গয়না বন্দুক দিলে অইয়া যাইব মনে অয়। বলে রমিজ মিরধা।

কি কি গয়না আনছেন, দেখি? কারন কোন কোন গয়না আনছেন, তার ফর্দ বানাইছেন তো?

হ বানাইছি। মেহের মুনশি বলে।

মেহের মুনশি নগদ দুশ’ পঞ্চাশ টাকা দেয় ফজলের হাতে। তারপর পুটলিবাঁধা গয়না ও ফর্দ রাখে ফজলের সামনে।

ফজল পুটলি খুলে গয়নাগুলো ফর্দের সাথে মিলিয়ে নেয়। গয়নার মধ্যে রয়েছে করণফুল, কানপাশা, মাকড়ি, মুড়কি, চুড়ি, বাজু, দানাকবচ। সবগুলো গয়না ও রূপজানের গয়নার পুটলি মেহের মুনশির হাতে তুলে দিয়ে ফজল বলে, এইগুলা লইয়া আপনারা দুইজন হাশাইল বাজারে চইল্যা যান। জগু পোদ্দারের দোকানে বন্ধক রাইখ্যা টাকা লইয়া আসেন। আমিই যাইতাম, কিন্তু জঙ্গুরুল্লার কোনো লোক দেইখ্যা ফালাইলে বেবাক গোলমাল অইয়া যাইব।

ঠিক আছে। তোমার যাওনের দরকার নাই। রমিজ মিরধা বলে। আমরাই ঠিকঠাক মত ওজন করাইয়া ট্যাহা লইয়া আইতে আছি।

হ, ঠিক মতন আলাদা আলাদা ওজন করাইয়া কার গয়নার কত ওজন তা ফর্দে লেইখ্যা রাইখেন। দেড় হাজার টাকা কমে রাজি অইবেন না।

গয়না অইব চল্লিশ ভরির কাছাকাছি। মেহের মুনশি বলে। দেড় হাজার টাকা দিব না ক্যান?

না দিলে বিষ্ণু পাল আছে, ছিদাম কুণ্ডু আছে। ওনাদের কাছে যাইবেন।

ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কইর‍্য না।

আইজ সন্ধ্যার পর আপনাগ দুইজনরে লইয়া একটু বসতে অইব। মাইরটা কেমনে কি ভাবে চালাইতে অইব তা আপনাগ সাথে পরামিশ কইর‍্যা ঠিক করণ লাগব।

সের দশেক মরিচের গুড়া লইয়া আইমু, কি কও? রমিজ মিরধা বলে। ছাইয়ের লগে মিশাইয়া–

এখনতো কার্তিক মাস। বাতাসের জোর নাই। এখন ছাই উড়াইয়া কাম অইব না।

হ, ঠিকই। মেহের মুনশি বলে। মরিচের গুঁড়ায় পয়সা নষ্ট করণের দরকার নাই।

তাদের বিদায় দিয়ে ফজল নিজের ঘরে যায়। নূরুর হাতের-লেখার খাতা থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে সে খুনের চরের নক্সা আঁকে। কোন দিক থেকে কখন কিভাবে আক্রমণ করলে জঞ্জুরুল্লার দলকে তাড়িয়ে দেয়া যাবে তার পরিকল্পনা ঘুরতে থাকে তার মগজের মধ্যে।

.

২২.

জোর যার মুলুক তার–সর্বজনবিদিত এ প্রবচনটি পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে চর অঞ্চলে যে রূপ নিয়েছে তা হচ্ছে–

জোর যার চর তার।
জোর কার, চর কার?
হাতিয়ার সাথী যার।

ঢাল, কাতরা, লাঠি, শড়কি, লেজা, চ্যাঙ্গা, গুলের বাঁশ ইত্যাদি হাতিয়ারগুলো চরবাসীদের সাথী। পুলিসের ভয়ে চর ছেড়ে পালাবার সময় ফজলদের দলের অনেকেই তাদের সাথী হারিয়ে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। হাতিয়ার ছাড়া চরে বসত করা যায় না। তাই কয়েক মাসের মধ্যে কষ্টেসৃষ্টে তারা তাদের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে আবার।

ফজলও জানে দলের সবাই হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে ছিল ফেরার, তারপর আবার জেলে। তাই হাতিয়ারগুলো দেখার সুযোগ পায়নি সে এতদিন। প্রত্যেকের হাতিয়ার ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তার নির্দেশ মতো বিকেল বেলা নৌকার উওরায় লুকিয়ে সবাই নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে আসে ফজলের কাছে। হাতিয়ারগুলো মোটামুটি ভালোই বানিয়েছে বলে মনে হয় ফজলের। তবে কয়েকটা শড়কি ও লেজার হাতলে এর মধ্যেই ঘুণ লেগে গেছে। বাবাত্তি বাঁশ দিয়ে বানিয়েছে বলেই এ অবস্থা। হাতলগুলো বদলাতে হবে। দুটো গুলেল বাঁশের টঙ্কার কানে বাজে না তেমন। এগুলো বাতিল করে তিন দিনের মধ্যে নতুন বানিয়ে নিতে হবে। ঢাল অতি আবশ্যকীয় বস্তু। আস্ত বেত দিয়ে প্রত্যেকেই তৈরি করেছে নিজ নিজ ঢাল। ছোট বড় মিলিয়ে সংখ্যায় একশ’ চৌত্রিশটা। বারোটা বাদে সবগুলোয় কষ-কুঁড়োর মাজন লাগানো হয়েছে ঠিক মত। গাব বা উইর্যাম গোটার কষের সাথে পরিমাণ মতো চালের কুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি হয় এ মাজন। এ মাজন কয়েক পোচ দিতে পারলে ঢাল খুব শক্ত-পোক্ত হয়, ঘুণ বাসা বাঁধতে পারে না। মাজন লাগাবার জন্য বারোটা ঢালের মালিকদের তিনদিনের সময় দেয় ফজল। ঘন গিঠযুক্ত চিকন পাকাঁপোক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি করতে হয় যার যার নিজের হাতের পাঁচ-হাতি লাঠি। ফজল এক একটা লাঠির দু’দিক ধরে হাঁটুর সাথে চাপ দিয়ে পরীক্ষা করে। চারটে লাঠি মটমটাৎ করে ভেঙেই গেল পরীক্ষার সময়। এ লাঠিয়ালদের নতুন লাঠি বানাবার জন্য সময় দেয়া হয় দুদিন। রামদা পাওয়া গেল মাত্র ছয়খানা। রামদা নিয়ে ডাকাতি করে ডাকাতরা। তাই পরিচিত লোহারু ছাড়া কেউ এ অস্ত্র বানিয়ে দিতে রাজি হয় না। ফজল বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে ধার পরীক্ষা করে রামদাগুলোর। সবগুলোতেই পাইন দেয়া দরকার। কিন্তু দিঘিরপাড় বা হাশাইলের লোহারুর দোকানে এগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না। গেলেই সাথে সাথে রটে যাবে তাদের প্রস্তুতির খবর। এগুলো বালিগচার ওপর ‘করাইত্যা’ বালিতে ঘষে ধার উঠাবার চেষ্টা করতে হবে। ধার না উঠলেও চিন্তা নেই। কারণ রামদা দিয়ে তো মানুষ কাটতে যাচ্ছে না তারা। দাগুলোকে ঘষে চকচকে ঝকঝকে বানাতে হবে। দেখলেই যেন বিপক্ষীয় লড়িয়েদের পিলে চমকে যায়। রামদা কম থাকলেও ফজলের ভাবনার কিছু নেই। সে তো রামদাওয়ালা চাকরিয়া আনতেই যাচ্ছে দক্ষিণপাড়।

গুলেল বাঁশের জন্য প্রচুর গুলির প্রয়োজন। হিসেব করে দেখা যায় পয়তাল্লিশটা গুলেল বাঁশের জন্য মাত্র আটশ’ মাটির গুলি তৈরি আছে। রোদে শুকানো গুলিগুলো পুড়িয়ে নিতে হবে। আরো অন্ততঃ দেড় হাজার গুলির দরকার। দশসের টাডি সুপারি আর দশসের ঝাঁকিজালের কাঠি কিনে নিলেই দেড় হাজার গুলির অভাব পূরণ হবে।

ফজল এবার কাগজ-কলম নিয়ে লড়াইয়ের লায়েক মানুষের হিসেব করতে শুরু করে। কোলশরিকের সংখ্যা ছাপ্পান্ন। এদের মধ্যে দু’জন বুড়োকে বাদ দিলে থাকে চুয়ান্ন জন। তাদের জোয়ান মরদ ছেলের সংখ্যা বিয়াল্লিশ। উঠতি বয়সের কিশোরের সংখ্যা ছত্রিশ। চাকরিয়া অন্তত পঁচিশ জন। মোট একশ’ সাতান্ন জন।

এবার নৌকার হিসেব। এগারো-হাতি ডিঙি আঠারোটা। প্রত্যেকটায় চারজন করে চার আঠারং বাহাত্তর জনের জায়গা হবে। তেরোহাতি ডিঙি পাঁচখানা। প্রত্যেকটায় পাঁচজন করে পাঁচ-পাঁচে পঁচিশ। দু’খানা বড় ঢুশা নৌকা। কুড়ি জন করে কুড়ি দ্বিগুণে চল্লিশ। একটা ধূরী। এতে জায়গা হবে পনেরো জনের। ফজলের ঘাসি নৌকায় ধরবে কমপক্ষে তিরশি জন।

ছোট বড় মিলিয়ে মোট নৌকার সংখ্যা সাতাশ। তাতে তোক ধরবে কমপক্ষে একশ’ বিরাশি জন।

যথেষ্ট! যথেষ্ট! ফজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মাথা তুলে তাকায় তার লোকজনের দিকে।

কি মিয়া, কি যথেষ্ট? জিজ্ঞেস করে কদম শিকারি।

নাও যা আছে, যথেষ্ট। সাতাশটা নাও আছে। আমাগ বেবাক মানুষ ফারাগত মতন। বসতে পারব নায়। শোনেন শিকারির পো। সামনের ভোর রাত্রে ঘাসিটা লইয়া রওনা দিমু দক্ষিণপাড়া। চাকইর‍্যা আনতে যাইমু পালং থানার বাসুদেবপুর। ঘাসি বাইতে পাঁচজন বাইছা ঠিক করেন।

কদম শিকারি জোয়ান দেখে পাঁচ জনকে যাচাই করে। অনেকেই ফজলের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরে। কিন্তু ফেয়ার সময় চাকরিয়া বোঝাই করে আনতে হবে বলে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিরস্ত করতে হয়।

বেলা ডোবার আর বেশি দেরি নেই। সবাইকে চুপেচাপে হাতিয়ার ঠিকঠাক করতে হবে, তাদের প্রস্তুতির ব্যাপারটা কাকপক্ষীও জানতে পারবে না। ফজলের এসব নির্দেশ নিয়ে কদম শিকারি ও জাবেদ লশকর ছাড়া সবাই যার যার বাড়ি চলে যায়।

কদম শিকারি ও জাবেদ লশকরকে কাছারি ঘরে বসিয়ে ফজল ভেতর বাড়ি যায়। উঠানে পা দিয়েই দেখে তার মা উত্তরভিটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ থমথমে, মেঘাচ্ছন্ন।

অ্যাই ফজু, এই দিগে আয়। বরুবিবি ডাকে।

কি মা?

কি হুনতে আছি আঁ? তোরা আবার কাইজ্যা করণের লেইগ্যা হাজাহাজি করতে আছস?

আমাগ হকের চর অন্যে দখল কইর‍্যা লইয়া গেছে। সেই চর রাহেলিল্লাহ ছাইড়া দিমু?

ছাইড়া দে বাজান। চর বড়, না জান বড়? জানে বাঁইচ্যা থাকলে–

মা তুমি চুপ করো দেহি। বাজান মনে এত কষ্ট লইয়া মরছে। আমারে ওরা জেলের ভাত খাওয়াইছে। ওগ এমনে এমনে ছাইড়্যা দিমু।

কি করবি বাজান? অদিষ্টে যা আছিল তা অইছে। আর মারামারি কাড়াকাডির মইদ্যে যাইস না।

মা এতগুলা মানুষ, এতগুলা কোলশরিক আমারে মাতবর বানাইছে। আমার মুখের দিকে চাইয়া আছে। হকের জমি যদি এমনে এমনে ছাইড়া দেই তয়তো চরে আর বসত করণ যাইব না।

চরে আর বসত করণের কাম নাই, বাজান। তোর বাজানের আগে তোর বড় চাচা আছিল মাতবর। আমাগ ঘর-বাড়ি আছিল লটাবইন্যায়। এই খুনের চরেরই নাম আছিল লটাবইন্যা। এই লটাবইন্যা ভাঙ্গনের পর বউ-পোলা-মাইয়া লইয়া হেই যে ছাব্বিশ সনের বন্যার পরের বচ্ছর আসুলিতে চইল্যা গেল, হউর বাড়িতে গিয়া ওঠল, আর চরের মাড়িতে ফির‍্যা আইল না। উনিতো কত শান্তির মইদ্যে দিয়া গুঁজাইরা গেছে। তুই জেলে থাকতে তোর চাচি আইছিল তার ছোড পোলা লইয়া। তাগো কাছে হুনছি, তাগো ঐ জাগায় মারামারি নাই, কাড়াকাডি নাই। কত শান্তি! বাজান ফজু, চল আমরাও আসুলিতে চইল্যা যাই।

আসুলিতে কই যাইমু? সেইখানে কি আমাগ মামুর বাড়ি আছে নি? তোমার বাপের বাড়িতে আছিল ভূকৈলাশ। সেই চরও ভাইঙ্গা গেছে। মামুরা এখন পাতনা দিয়া আছে মিত্রের চরে। যাইবা সেইখানে?

বেবাক বেইচ্যা কিন্যা চল পাইকপাড়া যাই। তোর চাচাতো ভাইরা তো আছে।

বা’জান বাঁইচ্যা থাকতে চাচায়ই কোনো দিন জিগায় নাই। এহন চাচাতো ভাইরা কি আর জিগাইব? শোন মা, এই চর ছাইড়্যা আর যাওনের কোনো জায়গা নাই আমাগো।

বরুবিবির চোখের কোলে পানি চকচক করছিল এতক্ষণ। এবার দু’গাল বেয়ে দরদর ধারায় শুরু হয় অশ্রুর প্লাবন।

ফজল শঙ্কিত হয়। মা হয়তো এখনি বিলাপ করতে শুরু করবে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সে বলে, মা তুমি চিন্তা কইর‍্য না। আমিতো মাতবর। আমিতো মারামারি করতে যাইতে আছি না। চাকইর‍্যা আনতে যাইতে আছি। চাকইর‍্যারাই মাইর করব। তুমি একটুও চিন্তা কইর‍্য না।

বরুবিবি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চলে যায়। ফজল ফিরে আসে কাছারি ঘরে।

.

সন্ধ্যার পর মেহের মুনশি ও রমিজ মিরধা আসে।

মেহের মুনশি তার কোমরে পেঁচিয়ে বাঁধা খুতি বের করে। ফজলের সামনে সেটা উপুড় করে ঢালতে ঢালতে বলে, অনেক কইয়া-বুইল্লা দেড় হাজার টাকাই আনছি। পোদ্দারের পো কি রাজি অইতে চায়!

সুদ কি হারে নিব। ফজর জিজ্ঞেস করে।

শ’ তে মাসিক পাঁচটাকা।

তার মানে পনেরোশ’ টাকার সুদ এক মাসে পঁচাত্তর টাকা! ওরে আল্লারে!

সুদের হার তো বড় বেশি! কদম শিকারি বলে।

হ সুদের হার বেশিই। রজিম মিরধা বলে। শোন ফজল মিয়া, ত্বরাত্বরিই ট্যাহা শোধ দিতে অইব। সুদের পোলা-মাইয়া নাতি-পুতি বিয়ানের সময় দেওন যাইব না। ওগুলা বিয়াইতে শুরু করলে কিন্তুক উফায় নাই। তহন গয়নাগুলা বেবাক খুয়াইতে অইব।

হ তাড়াতাড়িই টাকা শোধ দিয়া গয়না ছাড়াইয়া আনতে অইব। দেরি করণ যাইব না।

মেহের মুনশির কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা গুনে নিয়ে ফজল অন্দরে যায়। সিন্দুকে টাকাগুলো রেখে আবার কাছারি ঘরে ফিরে আসে।

অনেকক্ষণ ধরে তারা সলা-পরামর্শ করে। মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা ও কদম শিকারি হামলা করার যে সব কায়দা-কৌশলের কথা বলে তা সবই পুরানো, বহুল ব্যবহৃত দাদা-পরদাদার আমলের পদ্ধতি। ওতে খুন-জখম এড়ানো সম্ভব নয়। খুন-জখম না করে বিপক্ষ। দলকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করে চর থেকে হটিয়ে দেয়া যায় তার ফন্দি-ফিকিরের জন্য ফজল অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছে। জেলে থাকতে অনেকের সাথে আলোচনা করেছে। অনেক ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা একটা করে রেখেছে সে, গেঁথে রেখেছে মনের মধ্যে। কিন্তু এখনি, এত আগে তা প্রকাশ করা সমীচীন নয়। কারণ সে মনে করে, এদের কানাকানি থেকে বাইরে জানাজানি হবে আর জানাজানি হলেই সব আয়োজন হবে বিলকুল বরবাদ। সে শুধু বলে দুইজন বুড়া বাদে সবাইকে হাতিয়ার হাতে নিতে অইব। আমাগ মোট মানুষের সংখ্যা উঠন্তি চ্যাংড়া লইয়া একশ বত্রিশ জন। এই সব মানুষের লিস্টি তৈরি করতে অইব। পয়লা পরথম বাছাই করেন ল্যাগবেগা হ্যাংম্যাইঙ্গা গুলারে। তারপর বাছাই করেন চ্যাংড়া লেদুফেদু গুলারে। ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি লইয়া ওরা মুখামুখি লড়তে পারব না। ওগ হাতে দিতে অইব গুলাইল বাশ। দূরের তন ওরা গুলাইল মারব। যারা গুলাইল মারতে জানে না, এই কয় দিনের মইদ্যে তাগগা শিখাইয়া লইতে অইব। কলাগাছের মাজায় চান্দের মতো গোল দাগ দিয়া চানমারির ব্যবস্থা করবেন। মাটির গুলি মাইরা মাইর‍্যা ওরা মারতে শিখব।

একটু থেমে ফজল আবার বলে, তুরফানের কাছে যারা লাঠি খেলা শিখছিল, আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ানের কাছে যারা শড়কি চালান শিখছিল, তারা এই কয়দিন খুব কইর‍্যা অভ্যাস করব। চাকইর‍্যা আইলে চাকইর‍্যাগ লগে পরামিশ কইর‍্যা ঠিক করণ লাগব। কোন ভাবে হামলা করলে কাম ফতে অইব। আপনারা

ক্যাডারে? বাইরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পেয়ে হাঁক দেয় মেহের মুনশি।

আমরা।

আমরা ক্যাডা?

চান্দু, বক্কর–আমরা ঘাসি লইয়া ফজল ভাইর লগে যাইমু।

তোমরা এই রাইতে আইয়া পড়ছ? ফজল জিজ্ঞেস করে।

হ, ঘুমাইয়া গেলে যদি জাগন না পাই।

ভালো করছ। দাঁড়, বাদাম, গুন, লগি সব ঠিকঠাক মতো নায়ে উডাও। তোমরাও নায়ের মইদ্যে ঘুমাইয়া থাক গিয়া। পোয়াত্যা তারা ওডনের আগে রওনা দিতে অইব। আর তিনজন কই?

তারা এহনই আইয়া পড়ব।

আইচ্ছা যাও।

ফজল তার আগের কথার জের টেনে বলে, আপনারা লিস্টিগুলা কইর‍্যা রাইখেন। আইজ আর আলোচনার দরকার নাই। চাকইর‍্যারা আইলেই ফাইনাল’ আলোচনা অইব।

সবাইকে বিদায় দিয়ে ফজল অন্দরে গিয়ে দেখে তার মা বারান্দায় তার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে বসে তসবি গুনছে।

.

২৩.

ভোর রাত্রেই পাঁচজন বাইছা নিয়ে নৌকায় চড়ে রওনা হয়েছিল ফজল। বাদাম উড়িয়ে, দাঁড় মেরে, গুন টেনে, পদ্মা উজিয়ে, কীর্তিনাশা ভাটিয়ে তারা যখন পালং পৌঁছে তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। লোকের কাছ থেকে বাসুদেবপুরের পথের খবর নিয়ে তারা নৌকাটাকে একটা বড় খালের ভেতর দিয়ে বেয়ে নিয়ে যায়। মাইল দুয়েক গিয়ে একটা শুকনো সরু খালের মুখে নৌকাটাকে বাধে।

চলতি নৌকায় রান্নার ঝামেলা অনেক। তাই গুড় আর কলা দিয়ে মুড়ি খেয়ে কোনো রকমে পেটকে বুঝ দিয়ে এতদূর এসেছে তারা। এসব চাকুমচুকুম আর গছানো যাবে না পেটকে। চাল, ডাল, মুরগি আলু, তেল, নুন, পেঁয়াজ, মরিচ ইত্যাদি বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল ফজল। তিনজনের ওপর রান্নার ভার দিয়ে বক্কর আর টিটুকে নিয়ে ফজল নৌকা থেকে নামে। ফজলের হাতে রশির ঝুলনায় একটা সন্দেশের হাঁড়ি।

ফজল জেল থেকেই শুনে এসেছিল রামদয়াল সরদার খুব মেজাজি লোক। তাই তাকে খুশি করার জন্য পথে নৌকা থামিয়ে সে নড়িয়ার সুপ্রসিদ্ধ সন্দেশ কিনে নিয়ে এসেছে।

লোকের কাছ জিজ্ঞেস করে খাল পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা রামদয়াল সরদারের বাড়ি পৌঁছে।

লুঙ্গি-পরা অপরিচিত লোক এসেছে শুনে বিরক্তির সাথে রামদয়াল ঘর থেকে উঠানে নামে। আগন্তুকদের দিকে তাকিয়ে তার বিরক্তিভরা গম্ভীর দৃষ্টি হঠাৎ প্রসন্ন হয়ে ওঠে। ফজলের হাত থেকে সন্দেশের হাঁড়িটা নিতে নিতে সে বলে, এগুলা আবার ক্যান্ আনছ, বাবা? হাঁড়িটা পর্শ করো নাই তো?

না, না দড়ির ঝুলনা ধইর‍্যা আনছি।

উঠানে মাদুর বিছিয়ে তাদের বসতে দেয়া হয়।

রামদয়াল সরদারের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। তার দোহারা পেশিবহুল মজবুত শরীরে ভাটার টান লাগলেও গায়ের কুচকুচে কষ্টিকালো রংয়ের জন্যই বোধ হয় তা চোখে পড়ে না।

রামদয়াল সরদার তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম পাঁচকড়ি মণ্ডল। জমি দখলের ‘কাইজ্যায়’ তার দল রামদা নিয়ে লড়াই করত। রামদাওয়ালা সরদারই লোকের মুখে মুখে বিবর্তিত হয়ে রামদয়াল সরদার হয়েছে। এই নামেই সে পরিচিত আজকাল। আসল নামে আর কেউ চিনে না তাকে। সে নিজেও বোধ হয় ভুলে গেছে তার আসল নাম।

খুনের চরের বৃত্তান্ত শেষ করে ফজল তার এখানে আসার উদ্দেশ্য রামদয়ালকে জানায়। রামদয়ালের মুখ সমবেদনায় বিষণ্ণ। আফসোসসূচক শ-শ্চ শব্দ করে সে বলে, বড় অদিনে আইছ বাবা। আমার দল তো আর নাই। দল তো কবে ভাইঙ্গা গেছে।

ফজলের মাথায় যেন হঠাৎ বাজ পড়ে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে রামদয়ালের মুখের দিকে।

ফজলের অসহায় বিহ্বল দৃষ্টি লক্ষ্য করে রামদয়াল আবার বলে, আমাগ আর কেও জিগায় না আইজকাইল। আগে বরিশাল, ভোলা, চানপুর, মেন্দীগঞ্জে, হিজলা আরো কত জায়গা থিকা লইয়া যাইত আমাগ। আড়িয়াল খাঁ আর মেঘনার কত কত চর দখল কইর‍্যা দিয়া আইছি। তোমাগ পদ্মার চরে যাই নাই কোনোদিন। এহন চরুয়ারা নিজেরা নিজেরাই লড়াই করে, দশ-পাঁচটা খুন-জখম অয়, হাজতে যায়, জেল খাডে। আমাগ আতে খুন-জখম বড় একটা অইত না।

একটু থেমে আবার বলে, আগে আশ্বিন-কাতি মাসে বাড়ির ভাত খাইতে পারতাম না। আইজ এই চর, কাইল অই চর দখলের লেইগ্যা মাইনষে আতে-পায়ে ধরত। গেল কয়েক বচ্ছর ধইর‍্যা আর কেও নিতে আহে না। দুই একটা যা আইত, উচিত পয়সা দিত না। এমনে কি আর সংসার চলে? আমাগ অনেকেরই জমাজমি নাই। দলের মানুষ প্যাডের ধান্দায় নানান জা’গায়, নানান কাজে চইল্যা গেছে। বারো-তেরো জন তো বউ-পোলা-মাইয়া লইয়া গেছে। আসাম মুলুকে। ওরা আর ফিরা আইব না কোনো দিন। চার-পাঁচ জন গেছে করাত কামে। তিনজন সইন কইর‍্যা যুদ্ধে গেছে। কয়েকজন হাটে হাটে তরি-তরকারি বেচে। দুইজন এক মাল্লাই বায়। কয়েকজন করে কুড়ালের কাম। তারা গাছ কাডে, চলা ফাড়ে। কয়েকজন ওড়া কোদাল লইয়া কই যে গেছে ভগমান জানে।

দশ-বারো জন তো পাওয়া যাইব? হতাশার ধকল কাটিয়ে ফজল বলে।

নারে বাপু, তাও নাই। দুই-তিনজন যারাও আছে, তারা কেও জ্বরে কাহিল, কেও বদনা লইয়া দৌড়াদৌড়ি করে।

ফজল হেসে ওঠে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সে হাসি। সে বলে, দলের মানুষ তো নাই, কিন্তু রামদাওগুলাতো আছে?

রামদাও দিয়া কি করবা?

আমাগ রামদাও নাই। আপনাগ রামদাওগুলা বেইচ্যা ফালান আমার কাছে।

রামদাও লইয়া পারবা না বাপু তোমরা লাড়াই করতে। খামাখা—

আপনে যদি দেখাইয়া দ্যান, এট্টু শিখাইয়া দ্যান তয় পারমু আপনের আশীর্বাদে।

রামদয়াল বিস্মিত চোখে তাকায় ফজলের দিকে। তার চোখ খুঁটে খুঁটে দেখে ফজলের সিনা, বাহু, আঙুল। সে ফজলের সাথী দুজনকেও দেখে খুঁটে খুঁটে। তারাও হাতে-পায়ে গায়ে-গতরে প্রায় ফজলের মতই বলিষ্ঠ।

রামদয়াল হঠাৎ খপ করে ফজলের ডান হাত ধরে ফেলে বলে, আসো দেখি পাঞ্জা লড়ি। দেখি কেমুন জোর আছে শরীলে।

দু’জনে দু’জনের কজী ধরে মাটিতে কবজি রেখে পাঞ্জার লড়াই শুরু করে। যদিও শেষ পর্যন্ত রামদয়ালই জিতে, তবুও ফজলের হাত মাটিতে নোয়াতে তাকে গায়েব সব কুয়ত ঢালতে হয়।

আপনেরে ওস্তাদ মানলাম, গুরু মানলাম। ফজল অনুনয় করে বলে। শিখাইয়া দ্যান আমাগো।

গুরু মানলে দক্ষিণা দিতে অয়। দক্ষিণা কই?

ফজল জামার পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দেয় রামদয়ালের দিকে।

দশ টাকা! দেড় মণ চালের দাম! যুদ্ধের জন্য হঠাৎ দাম না বাড়লে তো তিন মণই পাওয়া যেত।

রামদয়াল নোটটা ট্র্যাকে খুঁজে উঠে দাঁড়ায়। উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে সে একটা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পরে রামদয়াল জঙ্গল থেকে ফিরে আসে। তার একহাতে একটা লম্বা রামদা, অন্যহাতে সদ্য-কাটা একটা তল্লা বাঁশ।

এই জুয়ান, কি যেন নাম তোমার? রামদয়াল জিজ্ঞেস করে।

ফজল।

রামদয়াল রামদাটা ফজলের হাতে দিয়ে বলে, এই বাঁশটা এক কোপে দুইখণ্ড করতে অইব।

ফজল রামদাটা নিয়ে ওটার ধার পরীক্ষা করে বলে, ধার তো তেমন নাই।

ঠিক আছে, তুমি কোপ মারো। আমি ঠিকই বোঝতে পারব।

রামদয়াল বাঁশটার গোড়ার দিক এগিয়ে দেয় ফজলের দিকে।

সে লাফ মেরে ‘ইয়া আলী’ হুঙ্কার দিয়ে কোপ মারে। বাঁশটা দু’টুকরো হয়ে যায়। রামদয়ালের চোখে-মুখে বিস্ময়। সে বলে, সাবাস, তুমি পারবা হে। গুরুর নাম রাখতে পারবা।

রামদয়াল ফজলের সাথী বকর আর টিটুরও পরীক্ষা নেয়। তারা এক কোপে বাঁশটার বারো আনারও বেশি কাটতে সক্ষম হয়।

রামদয়াল বলে, তোমরাও চেষ্টা করলে পারবা।

সে ঘরে গিয়ে দুটো ঢাল ও একটা শড়কি নামিয়ে নিয়ে আসে।

একটা ঢাল ও শড়কি ফজলের হাতে দিয়ে বলে, তুমি ঢাল ও শড়কি লইয়া আমারে আক্রমণ করবা। আমি ঢাল আর রামদা দিয়া তোমারে ফিরাইমু।

রামদয়াল ও ফজল যার যার হাতিয়ার নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়।

রামদয়াল ইশারা দিতেই ফজল শড়কি নিয়ে আক্রমণ করে। রামদয়াল ঢাল দিয়ে শড়কির আঘাত প্রতিহত করেই ডান দিকে সরে বাঁদিকে সামান্য ঘুরে লাফ দিয়ে জয় মা কালী’ বলে কোপ মারে শড়কির হাতলে। বাঁশের শুকনো হাতল পুরোপুরি দু’টুকরো হয় না। কোপ খাওয়া হাতলের নিচের অংশের সাথে শড়কির ফলাটা লল্লুড় করে। এতেই বেশি অসুবিধেয় পড়ে ফজল। তার হাতের অস্ত্রটা এখন না-শড়কি, না-লাঠি। কোনো ভাবেই সে ওটাকে চালাতে পারে না। ওদিকে রামদয়াল রামদা উঁচিয়ে মার মার করে তেড়ে আসে। ফজল পিছু হটে দৌড় দিয়ে পালাতে বাধ্য হয়।

রামদয়াল হাসতে হাসতে বলে, এইডা অইল রামদার লাড়াই। শড়কির আতল পুরাপুরি না কাটলেই বেশি ভালো। শড়কিডা দিয়া তহন শড়কির কাম তো না-ই, লাডির কামও চলব না।

এবার রামদয়াল ঢাল আর শড়কি এবং ফজল ঢাল আর রামদা নিয়ে মহড়া শুরু করে।

ফজলের সাহস শক্তি ও ক্ষিপ্রতায় মুগ্ধ হয় রামদয়াল। এমন ভালো শাগরেদ সে কখনো পায়নি। সে মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে সে বুড়ো হয়ে গেছে। মরে যাবে আর কদিন পর। ফজল তার গুরুর নাম রাখতে পারবে।

ফজলের সাথী দু’জন–বক্কর আর টিটুও একে একে যোগ দেয় মহড়ায়। তারাও মোটামুটি ভালোই দেখিয়েছে রামদা’র লড়াই। রামদয়াল লড়াইয়ের আরো কিছু কায়দা কৌশল সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে বলে, তোমরা মাংস বেশি খাও, তাই শক্তি আছে তোমাগ গায়ে, পেঁয়াজ-রশুন খাও, তার তেজ আছে শরীলে। তোমরা অভ্যাস করলে আমাগতন ভালো লাড়াই করতে পারবা।

কয়টা রামদাও দিতে পারবেন? জিজ্ঞেস করে ফজল। ঢালও লাগব ঐ কয়টা। আপনাগ ঢালগুলা বড় আর মজবুত।

রামদাও কুড়ি খানেকের বেশি দেওয়ন যাইব না। ঢালও কুড়িডা দেওয়ন যাইব। কিন্তু কত টাকা দিবা?

আপনে কইয়া দ্যান?

কুড়িখান রামদা’র দাম চাইর টাকা কইর‍্যা আশি টাকা আর কুড়িখান ঢাল তিন টাকা কইর‍্যা ষাট টাকা।

গুরুজি, এট্টু কমাইয়া ধরেন। একটা রামদাও দুই টাকায় বানান যায়।

হেই জিনিস আর এই জিনিসে তফাত আছে। এই জিনিস চাইর টাকার কমে বানাইতে পারবা না।

ঠিক আছে, আপনার কথাই রাখলাম। তয় সব মিলাইয়া একশ কুড়ি টাকা দিমু।

রামদয়ালের দল ভেঙে গেছে। রামদা’র প্রয়োজন তাই শেষ হয়ে গেছে। তার বিশেষ প্রয়োজন এখন টাকার। সে একশ কুড়ি টাকায় জিনিসগুলো দিতে রাজি হয়ে যায়। এ টাকায় মহাজনের কাছে বন্ধক দেয়া দেড় বিঘা জমি ছাড়িয়ে নেয়া যাবে।

ফজল আর তার সাথী দুজনকে নিয়ে রামদয়াল উত্তর দিকের জঙ্গলে ঢোকে। একটা বাঁশঝাড়ের পাশে এলোমেলো করে রাখা কঞ্চির স্তূপ। রামদয়াল কঞ্চিগুলোকে সরিয়ে একটা আয়তাকার গর্ত থেকে কাঠের একটা বাক্স উঠিয়ে আনে। বাক্সের ডালা খুলতে খুলতে সে বলে, এগুলা ঘরে রাখলে বিপদ। পুলিস খানাতল্লাশি কইর‍্যা এগুলা পাইলে কি আর বাঁচনের উপায় আছে? মাজায় দড়ি লাগাইয়া হান্দাইয়া দিব জেলে। ঐ ডরে কব্বরের মইদ্যে গুঁজাইয়া রাখছি। নেও, গইন্যা দ্যাহো কয়ডা আছে।

ফজল গুনে দেখে কুড়িটা আছে রামদা।

বাক্সডা শুদ্দা লইয়া যাও। বাক্সডা দিয়া আর কি করমু? বাক্সের দাম দশটাকা দিও।

ঠিক আছে। দিমু দশ টাকা।

দাওগুলায় পাইন দেওয়া আছে। বালিগচার উপরে বালি দিয়া ধারাইয়া লইও।

সন্ধ্যার পর বাক্সটা নিয়ে নৌকায় ওঠে ফজল ও তার সাথীরা।

রামদয়াল এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে কুড়িটা ঢাল যোগাড় করে নৌকায় দিয়ে যায়। ফজল একশ’ তিরিশ টাকা তার হাতে দিয়ে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।

রামদয়াল তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে, ভগবান তোমার মঙ্গল করুক, তোমার জয় হোক।

রামদয়াল চলে যাওয়ার পর বাক্সটা ও ঢালগুলো তারা ধানখেতের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আসে। চৌকিদার-দফাদার বা পুলিস খবর পেয়ে বা বিদেশী নৌকা দেখে সন্দেহ করে নৌকায় তল্লাশি চালালে মুসিবতে পড়তে হবে। সুতরাং সাবধান হওয়া ভালো।

রান্না অনেক আগেই শেষ হয়েছিল। সবাই খেতে শুয়ে পড়ে। ভোর হওয়ার আগে রওনা দিলেই চলবে।

শুয়ে শুয়ে ফজর চিন্তার জাল বুনতে শুরু করে। যাদের জন্য এত পরিশ্রম করে তারা এই দূর দেশে এসেছিল তাদের পাওয়া গেল না। তাদের হাতিয়ার নিয়ে কাম ফতে করা কি সম্ভব হবে? কেন হবে না? নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।

সন্দেহের দোলায় নুয়ে পড়া সংকল্প তার আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ডে ভর দিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

খুনের চর বেদখল হওয়ার পর থেকে, বিশেষ করে জেলে থাকতে ফজল শুধু ভেবেছে আর ভেবেছে। চর দখলের নতুন কায়দা-কৌশল ফন্দি-ফিকির মনে আসতেই তার চোখে ভাসে দুই দলের মারামারির দৃশ্য। অনেকগুলোর মধ্যে তিনটা কৌশল তার মনে সাফল্যের আশা জাগায়। এগুলো নিয়ে সে বাদল আর আক্লাসের সাথে আলোচনাও করেছিল। তারাও কৌশলগুলোর প্রশংসা করে বলেছিল, ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে জয় নিশ্চিত।

চাকরিয়া যোগাড়ের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তার উদ্ভাবিত কায়দা-কৌশলগুলো এবার তার মাথার ভেতর জটলা পাকাতে শুরু করে। শুয়ে শুয়ে সে স্থির করে, ফিরে যাওয়ার পথে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো অবশ্যই সগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে।

ফজলের মনের ভাবনা ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে। সে ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়ে।

একদল লোক লাঠি-শড়কি নিয়ে তাড়া করছে রূপজানকে। সে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে নদীর পাড় ধরে। এক পাশ থেকে সে নিজেও দৌড়াচ্ছে শড়কি হাতে। কিন্তু এগুতে পারছে না। হঠাৎ পাড় ভেঙে রূপজান নদীতে পড়ে গেল আর অমনি ঘুমটা ভেঙে গেল তার। সে কাঁপতে থাকে থরথর করে।

একটু পরেই মোরগ বাক দিয়ে ওঠে, কুউ-ক্কুরু-উ-উ–ৎ-কু-উ-উ।

ফজল উঠে সবাইকে জাগিয়ে দেয়। তারা তাড়াতাড়ি ধানখেত থেকে রামদা’র বাক্স ও ঢালগুলো নিয়ে আসে, রেখে দেয় উওরায় পাটাতনের নিচে।

আর একটুও দেরি না করে তারা পাড়া উঠিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।

খাল উজিয়ে কীর্তিনাশায় পৌঁছতে ভোর হয়ে যায়। উজান পানি। বাতাসও নেই যে পাল তুলে দেবে। দু’জন গুন নিয়ে নেমে যায় ডাঙায়। কাঁধে বেরুয়া ঠেকিয়ে তারা গুন টেনে এগিয়ে যায় নদীর পাড় ধরে।

একটা বাঁক ঘুরতেই ফজল উত্তর দিকে তাকায়। একটা ছোট স্টিমার আসছে উত্তর দিক থেকে। ওটার পেছনে চাক্কি। পানি কমে গেছে, তাই পেছনে চাক্কিওয়ালা জাহাজ চালু হয়েছে।

অনেক দূরে দেখা যায় একটা উঁচু তালগাছ। আশপাশের উঁচু গাছগুলোর মাথা তালগাছটার হাঁটু-বরাবর।

এই বক্কর, এই টিটু, ঐ চাইয়া দ্যাখ ভোজেশ্বরের আসমাইন্যা তালগাছটা। এমুন উঁচা তালগাছ আর দেখি নাই কোনো মুলুকে। দুফরের আগে কিন্তু ঐখানে যাওন লাগব। আইজ সোমবার, ভোজেশ্বরের হাট।

হাটেরতন কিছু কিনবেন নি? জিজ্ঞেস করে বক্কর।

হ, অনেক কিছু কিনতে অইব।

পথে চান্দনী গ্রাম বরাবর নদীর ঢোনে নৌকা বাধে তারা। তিনজনকে নিয়ে ফজল নৌকা থেকে নামে। একটা কাটারি, একটা চাঙারি ও কিছু রশি নেয় সাথে ।

গ্রামের সরু পথ ধরে তারা হাঁটে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ফজল বলে, তোরা চোত্‌রা গাছ চিনস? গুঁড়িচোত্‌রা? রামচোত্‌রা?

তিনজনের কেউ চেনে না চোত্‌রা গাছ।

চিনবি কইতন? চরে এই গাছ অয়না। তোরা নামও শোনস নাই কোনো দিন?

হ, হুনছি। টিটু বলে। ঐ পাতা গায়ে লাগলে চুটমুট করে, জ্বালা করে, খাউজ্যায়।

হ, বইয়ের ভাষায় এগুলার নাম বিছুটি।

গ্রামের দুটো বেতঝোপ থেকে গুনে গুনে দুইশ আঁকড়ি যোগাড় করে ফজল। বেতঝোঁপের মালিককে আঁকড়ি পিছু এক পয়সা করে দিতে হয়। ওগুলোকে একখানে সাজিয়ে তারা রশি দিয়ে শক্ত করে বাধে।

খুঁজতে খুঁজতে রাস্তার পাশের এক জঙ্গলে রামচোত্‌রাও পাওয়া যায়। হাতে রুমাল বেঁধে ফজল অনেকগুলো গাছ উপড়ে তোলে শিকড়ের মাটিসহ। চাঙারির ভেতর ওগুলো খাড়া করে সাজিয়ে চাঙাড়িটা তুলে দেয় একজনের মাথায়।

নদীর ঢোনে ফিরে এসেই তারা নৌকা ছেড়ে দেয়। ভোজেশ্বর পৌঁছে তারা নদীর পাড়ের বাঁশহাটা থেকে সরু লম্বা ও শুকনো দেখে পঁচিশটা তল্লা বাঁশ কেনে। বাঁশগুলোকে নৌকার দুধারে পানিতরাশ বরাবর তারা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়। তারপর টিটুকে নৌকায় রেখে ফজল বাকি চারজনকে নিয়ে হাটের বিভিন্ন পট্টিতে ঘোরে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য। তিন ব্যাটারীর চারটে টর্চলাইট; দশসের টাডি সুপারি; দশসের ঝাঁকিজালের কাঠি; তিনসের মাথা তামাক, কুড়ি প্যাকেট বিড়ি ও একসের সুতলি কিনে হাটের ভিড় ঠেলে তারা তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে আসে। টিটুকে নৌকায় না দেখে ফজল হাঁক দেয়, টিটু গেলি কইরে?”

টিটুর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

চান্দু থলে-ভরা জালের কাঠি নিয়ে নৌকায় ওঠে সকলের আগে।

ও মাগো!

থলে ফেলে লাফ দিয়ে নেমে যায় চান্দু।

ফ্যাঁক-ফ্যাঁক করে হাসতে হাসতে দৈত্যের মুখোশ-পরা টিটু ছই-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।

সবাই এবার জোরে হেসে ওঠে–কেউ খলখলিয়ে কেউ ফাঁককেঁকিয়ে। ভয়ঙ্কর বিকট চেহারার দৈত্য ভেঙচি দিয়ে রয়েছে। দাঁতাল শুয়োরের দাঁতের মতো দুটো বড় দাঁত বেরিয়ে আছে। রক্ত লেগে আছে সে দাঁতে। নওল ষাড়ের শিংএয়ের মতো দুটো খাড়া শিং-এও রক্তের দাগ।

মুখোশটা দেখেই ফজলের মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি খেলে যায়। সে বলে, মোখাড়া পালি কই, এই টিটু?

টিটু মুখ থেকে শক্ত কাগজে তৈরি মুখোশটা খুলে বলে, অ্যাক ব্যাডা বেচতে আনছিল। অ্যাক আনা দিয়া কিনছি।

ও ব্যাডা গেল কই?

হাটের কোন দিয়ে গেছে কে জানে?

অ্যাই, তোরা পাঁচজনে পাঁচ দিকে যা ব্যাডারে হাঁটের তন বিচরাইয়া আনন চাই। ওরে কইস, পঞ্চাশটা কিনমু।

ফজল ভাবে, মুখোশটা খুবই কাজের জিনিস। হঠাৎ দেখলে ভয় পাওয়ার কথা। মুখোশ দেখে ভয় না পেলেও মুখোশের আড়ালের মানুষকে নিশ্চয়ই ভয় পাবে। চিনতে না পেরে মনে। করবে ওস্তাদ লাঠিয়ালরাই মুখোশ পরেছে তাদের পরিচয় গোপন করার জন্য। মুখোশ না থাকলে বিপক্ষদল দেখবে পাকা লাঠিয়াল একজনও নেই। সব হাঙাল-বাঙাল আর চ্যাংড়ার দল। ওদের মনের জোর বেড়ে যাবে। তখন লড়াই জেতা মুশকিল হয়ে যেতে পারে।

কিছুক্ষণ পর মুখোশ-পরা ফেরিওয়ালাকে ওরা নিয়ে আসে। দর কষাকষি করে ফজল পাইকারী দরে ভয়াল চেহারার দৈত্য-দানবের পঞ্চাশটা মুখোশ কেনে আড়াই টাকায়।

আর কোনো কাজ বাকি নেই পথে। তারা পাল তুলে নৌকা ছেড়ে দেয়। হাল ধরে বসে থাকে বক্কর।

দূর থেকে একটা গানের সুর ভেসে আসে ফজলের কানে। গানের কথা কিছুই বোঝা যায় না। তবুও সুরের স্পর্শে বিহ্বল হয় তার মন।

তাদের সামনে অনেক দূরে একটা দো-মাল্লাই নৌকা। নৌকাটা ভাটিয়ে তাদের দিকে আসছে। মনে হয়, ওটাতেই বাজছে কলের গান। দুটো নৌকার মাঝের দূরত্ব কমে আসতেই গানের কথা স্পষ্ট শোনা যায় ।

‘ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে,
কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে,
দেখা যায় যে ঘরখানি।
সেথায় বধূ থাকে গো,
সেথায় বধূ থাকে।‘

গানের কথা ও সুর গুঞ্জরণ তোলে তার মনে। তার চোখ বুজে আসে। কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে তার মন উড়ে চলে যায় ভরা নদীর বাঁকে। মনের চোখ খুঁজে বেড়ায় তার প্রিয় মুখ।

নৌকাটা তাদের পাশ দিয়ে ভাটির টানে অনেক দূর চলে গেছে। গান আর শোনা যায় না  এখন। কিন্তু ফজলের মনে গানটা তখনো বেজে চলেছে। তার মনের চোখ তখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে–কখনো রূপজানের, কখনো জরিনার মুখ।

ও মিয়াভাই, বড় গাঙ্গে আইয়া পড়ছি।

বক্করের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল। সে চোখ খোলে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে সে বলে, আল্লার নাম লইয়া পাড়ি দে।

সন্ধ্যার মৃতপ্রায় আলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, খুব ভালো সময়েই পৌঁছেছে তারা। রাতের অন্ধকারে কেউ দেখতে পাবে না, আর দেখলেও চিনতে পারবে না তাদের।

আল্লা-রসুল বলে ভাইরে মোমিন। আল্লা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। বক্কর ও অন্যান্য বাইছারা জাকইর দেয়।

অনুকূল স্রোত। ভাটির টানে নৌকাটা যাতে পুবদিকে জঙ্গুরুল্লার এলাকায় চলে না যায় সেজন্য পালটাকে একই অবস্থায় রেখে তারা উত্তরমুখি পাড়ি ধরে।

পাল আর দাঁড়ের টানে উত্তর দিকে চলতে চলতে, ভাটির টানে পুবদিকে সরতে সরতে নৌকাটা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফজলদের বাড়ির ঘাটে পৌঁছে যায়।

.

২৪.

পরের দিন ভোরে ফজল ঘুম থেকে উঠেই ঘাসিতে ঘুমিয়ে থাকা বক্কর ও চান্দুকে ডেকে তুলে পাঠিয়ে দেয় পুলকি মাতব্বরদের ডেকে আনতে। সে নিজে চাঙারিসহ রামচোত্রা গাছগুলো কলাগাছের ঝোঁপের মধ্যে ছায়ায় রেখে আসে। মাঝে মাঝে পানির ছিটে দিলে গাছগুলো তাজা থাকবে।

ফজল এবার হাট থেকে কিনে আনা তল্লা বাঁশগুলোর আইক্কা ছাড়ায় দা দিয়ে, গিঠগুলো চেঁচে পরিষ্কার করে। ফজলের বাঁশ চাচা শেষ না হতেই মেহের মুনশি, রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর ও কদম শিকারি চলে আসে।

খবরিয়াদের কাছেই তারা শুনেছিল, চাকরিয়া একজনও আসেনি, ই তারা বিষণ্ণ মুখে জানতে চায় চাকরিয়া না আসার কারণ।

দলটা ভাইঙ্গা গেছে। ফজল বলে। দলের সরদার আছে। সে-ও বুড়া। দলের লোকজন এদিগে ওদিগে নানান কাজে চইল্যা গেছে।

এহন কি করতে চাও? মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে। মেঘু আর আলেফ সরদারের লেইগ্যা খবরিয়া পাঠান দরকার।

কোনো দরকার নাই। আমরাই পারমু কাম ফতে করতে।

চারজন পুলকি-মাতব্বর হাঁ করে চেয়ে থাকে ফজলের দিকে।

আপনারা ঘাবড়াইয়েন না। ওগ খবর নিছেন? ওরা আমাগ সাজাসাজির খবর পায় নাই তো?

না। ওরা চাকইর‍্যা আনে নাই তো?

না। ওরা জানেই না, তুমি জেলেরতন খালাস পাইয়া আইছ। রমিজ মিরধা বলে। তোমার অবর্তমানে আমরা চরদখলের হামতাম করতে যাইমু না, ওরা জানে। তার লেইগ্যা, ওরা খুব নির্ভাবনায় আছে। চাকইর‍্যা অ্যাকটাও নাই ওগ দলে।

শোনেন। কাইলই হামলা করণ লাগব। আর বেশি দেরি করলে ওরা সব জাইন্যা ফালাইব। লিস্টি করছেন?

হ। মেহের মুনশি নিমার পকেট থেকে কাগজ বের করে ফজলের হাতে দেয়।

উত্তম, ভালো, মধ্যম, ল্যাগবেগা, চ্যাংড়া–এই পাঁচ শ্রেণীর ভাগ করা হয়েছে দলের একশ বত্রিশ জনকে।

‘উত্তম’ শ্রেণীতে আছে আঠারো জন। ফজলের সাথে ঘাসি বেয়ে গিয়েছিল যে পাঁচজন তারাও আছে এ তালিকায়।

ফজল ‘ভালো’দের তালিকা থেকে বেছে দু’জনকে তুলে নেয় ‘উত্তম’দের তালিকায়। এই কুড়ি জনকে সে ডাকতে পাঠিয়ে দেয়।

ভালো তেইশ জন আর মধ্যম চৌত্রিশ জন যাবে মেহের মুনশির বাড়ি। সেখানে তারা শড়কি আর লাঠি চালাবার কসরত করবে মেহের মুনশি আর জাবেদ লস্করের পরিচালনায়। গুলেল বাঁশের চাঁদমারির জন্য যাবে কদম শিকারির বাড়ি।

পুলকি-মাতব্বরদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিয়ে ফজল বলে, কাইল ভোরে সবাই একশ বত্রিশ জন যার যার হাতিয়ার লইয়া এইখানে হাজির অইব। দ্যাখবেন কেও যে ভয়ে না পলায়। আমাগ লাল বড় দামড়াডা জবাই করমু। বেলা এগারোটার মইদ্যে এইখানে খাওয়া-দাওয়া সইর‍্যা তৈরি অইব। ঘড়ি লাগব দুইটা। একটা তো আছে বাজানের পকেট ঘড়ি। আর একটা পাই কই?

আমার পোলার আছে একটা টেবিল ঘড়ি। রমিজ মিরধা বলে।

ঠিক আছে। এইটা দিয়াই কাম চালান যাইব।

এই চিক্কন লম্বা বাঁশগুলান দিয়া কি করবা? মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে।

এখন আর কইমু না। কাইলই দ্যাখতে পাইবেন।

পুলকি মাতব্বররা চলে যাওয়ার পর ফজল নাশতা খেয়ে বাঁশের গিঠ চাচতে লেগে যায় আবার। তার হাতের কাজ শেষ হওয়ার আগেই উত্তম কুড়ি জন এসে হাজির হয়।

ভালো লেচালাবার কসরত করুন শিকারির বাড়ি।

ফজলের নির্দেশে নৌকার ডওরা থেকে রামদার বাক্স আর ঢাল নিয়ে আসে চান্দু, বক্কর আর টিটু। ফজল কয়েকটা পুরানো লগি যোগাড় করে। চান্দুর হাতে লগি আর ঢাল দিয়ে বলে, মনে কর এই লগিটা একটা শড়কি। আমি ইশারা দিলেই এইটা লইয়া তুই আমারে আক্রমণ করবি। আর সব্বাই তোরা মনোযোগ দিয়া দেখবি। তোগ সব্বাইর কিন্তু শিখতে অইব রামদার লড়াই।

ফজল বাঁ হাতে ঢাল আর ডান হাতে রামদা নিয়ে চান্দুকে ইশারা করে আক্রমণের জন্য। চান্দু আক্রমণ করে। ফজল লগিটাকে ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে রামদয়ালের কায়দায় লাফ দিয়ে ‘ইয়া আলী’ বলে কোপ মারে লগির ওপর। লগিটা দুটুকরো হয়ে যায়।

ফজল বলে, এইডা অইল রামদার লড়াই। শড়কির হাতল দুই টুকরো না অইলেও ক্ষতি নাই। বারো আনা কাটলেই বরং ভালো। কোপ খাওয়া শড়কির হাতল দিয়া তখন শড়কির কামও চলব না, লাঠির কামও চলব না।

দুপুর পর্যন্ত কুড়ি জনকে তালিম দেয় ফজল। তারা ঢাল দিয়ে কল্পিত শড়কির কোপ ফিরিয়ে রামদা দিয়ে হাওয়ায় কোপ মেরে মেরে অভ্যাস করে।

দুপুরের খাওয়া খেয়ে কিছুক্ষণ জিরোবার পর আবার শুরু হয় মহড়া। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ফজল পরীক্ষা নেয় সকলের। তার মূল্যায়ন অনুসারে ছয়জন প্রথম বিভাগে, দশ জন দ্বিতীয় বিভাগে, আর চারজন তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। তাদের প্রত্যেককে একটা করে রামদা বুঝিয়ে দেয় সে। সেই সাথে ঢালও দেয় একটা করে। রামদা বালিগচার ওপর কিভাবে ধার করে নিতে হবে, তাও সে বুঝিয়ে দেয়।

কাইল বেলা ওঠার আগে তোমরা সবাই চইল্যা আসবা। ফজল নির্দেশ দেয়। বড় দামড়াটা জবাই কইর‍্যা, কুইট্যা-কাইট্যা তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করতে অইব।

.

পরের দিন ভোর বেলা। রোদ ওঠার আগেই তোকজন নৌকা আর হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয় মাতব্বর বাড়ি। ফজলের নির্দেশে তারা বিভিন্ন কাজে লেগে যায়।

বাড়ির পুব পাশে গরু জবাই করে দশ-বারো জন গোশত কাটাকুটি করে। তিন জন পেঁয়াজ-রশুনের চোকলা ছাড়ায়। দু’জন পালা করে মসলা বাটে। কয়েকজন মাটিতে গর্ত করে চুলো বানায়।

কাছারি ঘরের সামনে একজন একজন করে বালিগচার ওপর বালি ছড়িয়ে যার যার রামদা ঘষছে ধার তোলার জন্য। একসাথে তিনজন একটা বড় পাথরের ওপর শড়কি, লেজা, কাতরা ঘষে চৰ্চকে ঝকমকে করে নিচ্ছে।

নূরু ও হাশমত লগির মাথায় কাস্তে বেঁধে কলার ডাউগ্গা কাটে। থালা বাসনের অভাবে আর বোয়া-পাখলার ঝকমারি এড়াতে বড়-ছোট সবাইকে কলার পাতে খাবার পরিবেশন করতে হবে। পশ্চিম পাশে তিনজন হাতে গামছা জড়িয়ে লম্বা ও সরু তল্লা বাঁশের আগায় রামচোরা গাছ বাঁধছে সুতলি দিয়ে। ফজল দাঁড়িয়ে তদারক করছে।

এগুলা বড়শি গিট্টু দিয়া শক্ত কইর‍্যা বাইন্দা ফ্যাল। ফজল নির্দেশ দেয়। এগুলার উপরে আবার গইন্যা গইন্যা পাঁচটা কইর‍্যা আঁউকড়া বানতে অইব একেকটা বাঁশের লগে। আঁউকড়াগুলা কিন্তু একটু আলগা কইর‍্যা বানতে অইব। টান লাগলেই যেন খুইল্যা যায়।

আঁকড়ির মসৃণ গোড়ার দিক বাঁশের আগায় রামচোত্রার ওপর আলগা করে বেঁধে দেয়া হয়।

রমিজ মিরধা ও জাবেদ লশকর দাঁড়িয়ে দেখছিল। জাবেদ লশকর হাসতে হাসতে বলে, যত সব পোলাপাইন্যা কাণ্ড-কারখানা! তোমাগ এই চ্যাংড়ামি বুদ্ধিতে কি কাম অইব?

আপনারা ঠাট্টা করেন আর যাই করেন, আপনাগ দাদার আমলের গোঁয়ারকিতে, সামনা-সামনি লড়াইয়ে বিপক্ষ দলেরে কাহিল করণ যাইব না। খুন-জখম অইয়া যাইতে পারে। দেখি, আমাগ চ্যাংড়ামি কায়দা-কৌশলে ওগ কাবু করতে পারি কিনা। বইতে পড়ছি–মারি অরি পারি যে কৌশলে। অরি মানে শত্রু। শত্রুরে যে কোনো কৌশলে নাস্তানাবুদ করা দরকার।

একটু থেমে ফজল আবার বলে, পঁয়তাল্লিশটা গুলাইল বাঁশ আছে। আপনারা মাটির গুলি, টাডি সুপারি আর জালের কাঠি গুলারে পঁয়তাল্লিশটা ভাগ কইর‍্যা ফেলেন। একেক ভাগ বুঝাইয়া দিতে অইব একেক জন গুলাইলওলার হাতে।

.

সকলের খাওয়া শেষ হয়েছে। ফজল জামার পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখে, সোয়া এগারোটা বাজে। সে সবাইকে বলে, তোমরা পান-বিড়ি-তামুক খাইয়া জিরাইয়া লও কতক্ষণ।

সাড়ে বারোটার সময় ফজলের ডাকে নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে লাইন করে দাঁড়ায় সবাই। ফজল তালিকা অনুযায়ী পাঁচ দলে ভাগ করে সবাইকে।

ল্যাগবো উনিশজন আর চ্যাংড়া কিশোর ছত্রিশ জনের সবারই ঢাল আছে। ল্যাগবেগা সবার হাতে লেজা বা শড়কি আর চ্যাংড়াদের হাতে কোচের কুতু।

ফজলের নির্দেশে রমিজ মিরধা ও কদম শিকারি ওদের ভেতর থেকে কুড়িজনকে বাছাই করে কুড়িটা গুলেল বাঁশ ওদের হাতে দিয়ে দেয়। একেক জনের জন্য ভাগ করে রাখা গুলি ঢেলে দেয় প্রত্যেকের কোঁচড়ে।

এগারো-হাতি ডিঙি বারোখানা আর তেরো-হাতি ডিঙি দু’খানায় ওদের পঞ্চান্ন জনকে ভালো-মন্দয় মিলিয়ে চারজন পাঁচজন করে তুলে দেয়া হয়। ওদের পরিচালনার জন্য ঢাল শড়কি নিয়ে কদম শিকারি, আহাদালী ও ধলাই সরদার ওঠে ভিন্ন ভিন্ন নৌকায়।

কদম শিকারির হাতে পকেট ঘড়িটা দিয়ে ফজল নৌকার লোকদের উদ্দেশ্যে বলে, তোমরা মনোযোগ দিয়া শোন। পুবদিক তন তোমরা উজাইয়া যাইবা চরের দিকে। দূরে থাকতেই ঠিক দুইটার সময় মাইর ডাক দিবা। ওরা তখন চরের পুব কিনারে গিয়া গুলাইল মারব। তোমরাও গুলাইল মারবা। একবার উজাইয়া কিছু দূর আউগ্‌গাইবা, ঢাল দিয়া ওগ গুলি ফিরাইবা। আবার ভাইটুটাইয়া পাউছ্‌ছাইবা। এম্বায় আউগ্‌গাইবা আর পাউছ্‌ছাইবা–এই তোমাগ কাম। তোমরা বেশি গুলি খরচ করবা না। কিন্তু ওগ গুলি খরচ করাইবা। আমরা ঠিক তিনটার সময় পশ্চিম দিক দিয়া চরে নাইম্যা পড়মু। আমাগ মাইর ডাক হামাহামি শুইন্যা ওরা পশ্চিম দিগে ঘুরতেই ওগ পিঠে আর পাছার উপরে ফটাফট গুলি মারবা। ওরা যখন আমাগ মুখামুখি আউগ্‌গাইতে থাকব তখন তোমরা নাও লইয়া চরের উত্তর দিকে গিয়া নাইম্যা পড়বা। কিছু দূর আউগ্‌গাইয়া দূরেরতন ওগ সই কইর‍্যা গুলাইল মারবা। যা কইলাম মনে থাকে যেন। আর শোন, তোমাগ সব্বাইরে স্মরণ করাইয়া দিতেছি–বাজান কি কইত, মনে আছে তো? এইডা কিন্তু রাজা-বাদশাগ লড়াই না যে যারে পাইলাম তারে খতম করলাম। এই লড়াই অইল বিপক্ষেরে খেদানের লেইগ্যা। নিজেরে বাঁচাইয়া চলবা। সুযোগ পাইলে আতে পায়ে বাড়ি দিবা, খোঁচা দিবা। প্যাট, বুক, আর মাথায় কিন্তু মারবা না, খবরদার! ব্যস এই কথা! যাও, বিছমিল্লা বুইল্যা, আল্লা-রাসুলের নাম লইয়া নাও ছাড়।

চোদ্দখানা ডিঙি পাড়া উঠিয়ে রওনা হয়ে যায়।

উত্তম, ভালো ও মধ্যমদের নিয়ে ফজল ঘাসি, ঢুশা ও বাকি ডিঙিগুলোতে ওঠে। অনেক ঘুরে তারা নাগরার চর আর আটং-এর দক্ষিণ দিক দিয়ে বেশ কিছু দূর উজিয়ে খুনের চরের দিকে নৌকার মাথি ঘোরায়। ঘাসির হালমাচার সাথে বাধা টেবিল ঘড়িটা বারবার দেখছে ফজল।

ঠিক দুটোর সময় মাইর ডাক শোনা যায়—

ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা।

বিপক্ষের শোরগোলও শোনা যায়—

আউগ্‌গারে, আউগ্‌গা। আইয়া পড়ছে। আউগ্‌গা, আউগ্‌গা।  

কিছুক্ষণ পর বিপক্ষ দলের মাইর ডাক শোনা যায়।

ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা–

কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় ফজল দলবল ও হাতিয়ার-সরঞ্জাম নিয়ে চরের পশ্চিম কিনারায় নামে। নামার আগে বাঁশের আগায় বাধা বিছুটি পাতা পানিতে ভিজিয়ে নেয়। কোনো শব্দ না করে ধানখেতের ভেতর দিয়ে পা চালিয়ে তারা পুবদিকে এগিয়ে যায় অনেক দূর।

প্রচণ্ড রোদ। আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। বিপক্ষের লোকজন সবাই পুব কিনারায় । তারা গুলেল বাঁশ থেকে হরদম গুলি ছুঁড়ছে পুব দিকে। পশ্চিম দিকে ওদের একটা লোকও নেই।

ফজল দশ-বারো জনকে অর্ধেক করে কাটা কতকগুলো আঁকড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় গরুর বাথানে। তারা গরুর লেজের আগায় পশমের সাথে দুতিনটে করে আঁকড়ি আটকে দিয়ে গরুগুলোকে ছেড়ে দেয়। তাড়া খেয়ে সেগুলো পুবদিকে দৌড়াতে থাকে। পেছনের দু’পায়ে আঁকড়ির খোঁচা আর ফজলদের দাবড় খেয়ে সন্ত্রস্ত গরুগুলো লেজ উঁচিয়ে ‘ওম্‌বা—ওম্‌বা’ রব তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।

ফজলের লোকজন তিন-চার হাত পরপর পাশাপাশি দাঁড়ায় এক সারিতে। তারা সবাই মাটির দিকে মুখ করে মুখের ওপর ডান হাত নেড়ে ডাক দেয়– ওয়া-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা-হ্বা–,

ফজলের নির্দেশে এবার সবাই মুখোশ পরে নেয়।

এরফান মাতব্বর মারা গেছে, আর জঙ্গুরুল্লার দল জানে ফজল জেলে আছে। তাই তারা বেশ নিশ্চিন্ত আরামে দিন গুনছিল। আচম্বিতে এরকম হামলা করবে, তারা কল্পনাও করতে পারে নি। আজ তারা সংখ্যায় মাত্র উনসত্তর জন। পশ্চিম দিকের মাইর ডাক শুনে তাদের বুক ভয়ে কেঁপে ওঠে। শিউরে ওঠে শরীর, কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ের রোম।

তারা পশ্চিম দিকে ঘোরে। চোখ-ধাঁধানো রোদ। কপালে হাত রেখে সূর্য আড়াল করে তারা দেখে তাদের গরুগুলো লেজ উঁচিয়ে ছুটে আসছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। উহ, উহ! করে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে কয়েক জন। তাদের অনেকের পিঠে, পাছায়, পায়ে এসে লাগছে গুলেল বাশের গুলি। ধাবমান মত্ত গরুগুলোর পদদলন থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে তারা দৌড়ে গুলির পাল্লা পেরিয়ে এক জায়গায় থামে। দাঁড়িয়ে দম নেয় কিছুক্ষণ। তারপর ঢাল, কাতলা, লাঠি, শড়কি নিয়ে মাইর ডাক দিয়ে তারা এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে।

সূর্যের কড়া আলো পড়ছে তাদের চোখে, কপালে। ভালো করে তারা দেখতে পায়না হামলাকারীদের। তবুও তারা ধানখেতের ভেতর দিয়ে পাশাপাশি এক সারিতে এগিয়ে যায়।

বাঁশগুলা আউগ্‌গাইয়া রাখ। ফজল হুকুম দেয়। জঙ্গুরুল্লার দল আরো এগিয়ে আসে। নাগালের মধ্যে এসে পড়ার সাথে সাথে ফজল হুকুম দেয়, মা-র আঁউক্‌ড়া।

বিপক্ষীয় লোকদের দু’পায়ের ফাঁকে রামচোত্‌রা আর আঁকড়ি বাঁধা বাঁশের আগা ঢুকিয়ে টান মারে ফজলের দল। আলগা করে বাঁধা আঁকড়ি ওদের কয়েকজনের কাছামারা লুঙ্গির সাথে আটকে যায়, কারো কাছা খুলেও যায়। ফজলের দল বিছুটিপাতা সমেত বাঁশের আগা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওদের রানে, হাতে, শরীরে ঝাঁপটা মারে। দু-একটা বাঁশের আগায় আঁকড়ি শক্ত করে বাঁধা ছিল বলেই বোধ হয় আঁকড়ির টানে দু’জনের লুঙ্গি কোমর থেকে খসে যায়। তারা শড়কি-ধরা হাত দিয়ে লুঙ্গি সামলায়, দিশে না পেয়ে পিছু হটে। শেষে হাতিয়ার ফেলে আঁকড়ি জড়ানো লুঙ্গি ধরে দৌড় দেয়।

যাদের লুঙ্গিতে আঁকড়ি আটকে গেছে তারা এগুবার চেষ্টা করে। কিন্তু আঁকড়ির আঁচড়ে ছড়ে যাচ্ছে দু’দিকের রান। ভীষণ জ্বলুনি শুরু হয়ে গেছে বিছুটিপাতার ঘষায়। এ সব অসুবিধে সত্ত্বেও কয়েকজন ঢাল-শড়কি নিয়ে এগিয়ে যায়। ফজলের রামদাওয়ালারা তাদের মুখোমুখি হয়। ওরা শড়কির কোপ মারতেই ফজলের দল ঢাল দিয়ে সে কোপ ফিরিয়ে রামদা দিয়ে কোপ মারে শড়কির হাতলে। দু’একটা হাতল দুটুকরো হয়ে যায়। বেশির ভাগ হাতল বারো আনা চৌদ্দ আনা কেটে গেছে। ওসব শড়কি দিয়ে আবার কোপ মারতেই ঢালের সাথে লেগে ফলাসহ হাতলের নিচের অংশ ভেঙে ওপরের অংশের সাথে দুলতে থাকে ললুড় করে। ফজলের দল এবার সারিবদ্ধভাবে কেউ রামদা উঁচিয়ে, কেউ শড়কি বাগিয়ে ধরে, কেউ গুলেল মারতে মারতে ‘মা-র–মা-র’ করে এগিয়ে যায়। বিপক্ষ দলের সবাই এবার পিছু হটে দৌড় দেয়। কারো কারো কাছামারা লুঙ্গিতে জড়ান আঁকড়ি লেজের মতো দুলছে, যেন লেজ নিচু করে তারা পালাচ্ছে। ফজলের পূর্বদিকের দল উত্তর দিক দিয়ে এসে গেছে। তারা জঙ্গুরুল্লার পলায়মান লোকদের লক্ষ্য করে গুলি মারে গুলেল বাঁশ থেকে।

জঙ্গুরুল্লার দল ছত্রভঙ্গ হয়ে কেউ ঢাল ফেলে, কেউ শড়কি ফেলে, কেউ-বা সব হাতিয়ার ফেলে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। ছুটতে ছুটতে কেউ লুঙ্গি থেকে আঁকড়ি ছাড়াবার চেষ্টা করছে, কেউ আঁকড়ির সামনের মাথা এক হাত দিয়ে, পেছনের মাথা আর এক হাত দিয়ে ধরে পাল্লাচ্ছে। ফজলের দল ‘মা-র–মা-র’ ছুটছে তাদের পিছু পিছু। জঙ্গুরুল্লার অধিকাংশ লোক দৌড়ে যাচ্ছে ঘোঁজার দিকে। তাদের নৌকাগুলো সেখানেই বাধা আছে। ফজলের দল ওদের পালাবার সুযোগ দেয়ার জন্য নিজেদের গতি কমিয়ে দেয়।

জঙ্গুরুল্লার লোক হুড়মুড় করে নৌকায় ওঠে–যে যেটা সামনে পায়। কয়েকজনের হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলির চোটে একটা ডিঙি ডুবেই যায়। সেটা ছেড়ে পানি ভেঙে তারা উঠে পড়ে আরেকটায়। একেকটায় চার-পাঁচজন করে উঠে আর কারো জন্য দেরি না করে নৌকা ছেড়ে দেয়। লগির খোঁচ মেরে, বৈটা টেনে তারা চলে যায় নিরাপদ দূরত্বে। যারা ঘোঁজার দিকে যেতে পারেনি তারা পুবদিকে নদীর ধারে দৌড়ে চলে যায়। সেখানে তাদের গরুগুলো ছটফট করছে, কোনোটা লাফালাফি করছে। তারা পশ্চিমদিকে চেয়ে দেখে হামলাকারীরা অনেক পেছনে। কেউ কেউ নিজেদের লুঙ্গিতে আটকানো আঁকড়ি খোলে। কেউ গরুর লেজে জড়ানো আঁকড়ি ছাড়িয়ে নেয়।

‘মা-র মা-র’ করে এগিয়ে আসছে ফজলের দল। জঙ্গুরুল্লার পলায়মান কিছু লোক গরুগুলোকে তাড়া দিয়ে নদীতে নামায়। গরুগুলো সাঁতার দিলে ওগুলোর লেজ ধরে একেক জন ভাটির টানে ভেসে যায় চরমান্দ্রার দিকে।

ফজলের একটা দল ঘোঁজার কিনারায় এসে বিপক্ষ দলের নৌকা লক্ষ্য করে গুলের বাঁশ থেকে কয়েকটা গুলি মারে। আর একদল পুব কিনারায় গিয়ে দুয়েকটা গুলি মারে গরুর লেজ ধরা লোকগুলোর দিকে।

গুলি মারার উদ্দেশ্য ভয় দেখানো। তারা বোঝে, পরাজিত পলায়মান শত্রুর পেছনে বেশি গুলি খরচ করা নিরর্থক।

ফজলের দলের সবাই ঘোঁজার কাছে এসে জমায়েত হয়। ফজল হাঁক দেয়, আল্লাহু আকবর।

দলের সবাই গলা ফাটিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার দেয়, আল্লাহু আকবর।

ফজল দলের চল্লিশ জনকে পাহারার জন্য চরের চার কিনারায় পাঠিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ শোনা যায়, ঐ গেল–গেল–গেল, ধর্‌–ধর্‌—ধর্‌‌।

সবাই তাকিয়ে দেখে দক্ষিণ দিকে যারা পাহারা দিতে যাচ্ছিল তারা ধাওয়া করছে দুটো লোকের পেছনে। প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে লোক দুটো পুবদিকে।

জাবেদ লশকর প্রকৃতির তাগিদ সেরে ঐ দিক থেকেই আসছিল। সে দেখে, দু’জনের একজন আরশেদ মোল্লা। সে মোল্লাকে তাড়া করে দৌড়ে যায় তার পিছু পিছু। নদীতে নেমে কিছুটা পানি ভেঙে মোল্লা সাঁতার দেয়। লশকরও সাঁতার দিয়ে গলা পানিতে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। সে মোল্লাকে চুব দিয়ে আবার টেনে তোলে।

আরশেদ মোল্লা কাঁপছে থরথর করে। অন্য লোকটা সাঁতার কেটে ভাটি পানিতে ভেসে যাচ্ছে চরমান্দ্রার দিকে।

হালা, আমাগ বউ আটকাইছস। তোরে চুবাইয়া মাইরা ফালাইমু। জাবেদ লশকর আবার চুব দেয় আরশেদ মোল্লাকে। তাকে টেনে তুলে সে আবার বলে, ফজলরে পুলিস দিয়ে ধরাইয়া দিছিলি, হা-লা। এহন দ্যাখ কেমুন মজা।

ও চাচা। ফজলের গলা। সে তাকায় ফজলের দিকে। ফজল দূর থেকে হাত নেড়ে মানা করছে আর চুব দিতে, ছেড়ে দিতে বলছে হাতের ইশারায়।

ফজল ধরতে গেলে তার ছেলের বয়সী। সে তাকে চাচা বলে ডাকে। তবুও ফজল মাতব্বর। সে তার আদেশ অমান্য করতে সাহস করে না। সে বিরক্তির সাথে মনে মনে বলে, যেই না হালার বউর বাপ! তার লেইগ্যা দরদ এক্করে বাইয়া পড়ে। এমুন হউররে একশ একটা চুব দেওন দরকার।

আরশেদ মোল্লাকে টেনে তুলে সে বলে, অ্যাই হালার ভাই হালা। দিমুনি আরেকটা চুব?

অনেকক্ষণ চুব দিয়ে ঠেসে ধরায় দম ফাপড় হয়ে আসছে আরশেদ মোল্লার হাঁসফাস করতে করতে সে বলে, আপনের আতে ধরি। আর চুব দিয়েন না?

তোর মাইয়াখান কানে আঁইট্যা দিয়া যাইতে পারবি? ক, শিগগির। নাইলে আবার চুব দিলাম।

আরশেদ মোল্লা কাঁদো-কাঁদো স্বরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, হ, দিয়া যাইমু।

ওয়াদা করলি তো?

হ, ওয়াদা করলাম।

দ্যাখ ওয়াদা যদি খেলাপ করসরে, তয় তোর পেডের ঝুলি বাইর কইরা দিমু যেইখানে পাই।

ওয়াদা ঠিক থাকব বিয়াইসাব।

ওরে আমার বিয়াইরে! হালা কমজাত কমিন। তোরে বিয়াই কইতেও ঘিন্না লাগে।

আপনের দুইডা আতে ধরি। আমারে ছাইড়া দ্যান।

ছাইড়া দিলে হাঁতরাইয়া যাইতে পারবি?

ফজলের লোকজন নদীর কিনারায় এসে জড় হয়।

কদম শিকারি বলে, হালারে লইয়া আহহ। গর্দানডার উপরে দুইডা চটকানা দিয়া জিগাই, হালায় এমুন আকামের কাম ক্যান্ করছিল? ক্যান্ মাইয়া আটকাইছিল? ক্যান্ পা না ধোয়ার লগে দোস্তালি পাতাইছিল? ক্যান্ ফজলরে পুলিস দিয়া ধরাইয়া দিছিল?

জাবেদ লশকর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় আরশেদ মোল্লাকে।

হালার লুঙ্গিতে বুঝিন আঁউকড়া লাগে নাই। বলে কদম শিকারি। মনে অয় চোত্রার ঘষাও লাগে নাই। এই বক্কর, দ্যাখতো চোরা পাতা আছেনি। হালার লুঙ্গি উড়াইয়া পাছায় আর কুচকিতে ঘইষ্যা দেই।

একজন বলে, মনে অয় এই দুই ব্যাডা আঁউকড়া লাগনে দৌড় দিয়া পলাইতে পারে নাই। ধানখেতের মইদ্যে হুতি দিয়া পলাইয়া আঁউকড়া ছাড়াইতে আছিল।

হ, ওরা যেইখানে পলাইছিল, হেইখানে ধানখেতের মইদ্যে তিন-চাইড্‌ডা আঁউকড়া দেখছি আমি। আর একজন বলে।

আরশেদ মোল্লার রান পরীক্ষা করে দেখে কদম শিকারি ও জাবেদ লশকর। সত্যি রানটা আঁকড়ির আঁচড়ে সাংঘাতিকভাবে ছড়ে গেছে।

ফজল ছেড়ে দিতে বলেছে। সুতরাং আরশেদ মোল্লাকে আর আটকে রাখা ঠিক নয়। ওদের দলের যে নৌকাটা ডুবে গিয়েছিল সেটাকে পানি থেকে তুলে তাতে উঠিয়ে দেয়া হয় আরশেদ মোল্লাকে। নৌকার মাথি ধরে ধাক্কা দিতে দিতে জাবেদ লশকর বলে, মাইয়া দিয়া যাবি, ওয়াদা করছস। ওয়াদা যেন ঠিক থাকে। নাইলে কিন্তু চউখ দুইডা ঘুইট্যা দিমু যেইহানে পাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *