১৭-২০. মহকুমার জেলখানা

মহকুমার জেলখানা। পাশাপাশি দুটো মাত্র ব্যারাক। একটায় রাখা হয় বিচারধীন আসামি, অন্যটায় স্বল্প মেয়াদের দণ্ডিত অপরাধী। ব্যারাক দুটোর শিকের দরজা একই দিকে অবস্থিত। দরজার সামনে খোলা লম্বা বারান্দা। একজন রাইফেলধারী সেপাই বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত টহল দিয়ে ফেরে।

আলো-বাতাসের জন্য কয়েদিরা দরজার কাছ ঘেঁষে জটলা করে সব সময়। অনন্ত আকাশ আর সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে ক্লান্তি আসে না তাদের চোখে। মনের আনন্দে উড়ে যাওয়া মুক্ত পাখির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অনেকে।

রাত আটটার ঘন্টা পিটিয়ে এক পাহারাদার তার চার ঘণ্টার কাজের পালা শেষ করে। নতুন পাহারাদার আসে তার জায়গায়।

ষড়যন্ত্র মামলার আসামিরা দরজার কাছে বসে গল্পগুজব করে। শুধু মতি জানালার গরাদের ওপর দুই কনুই রেখে চুপচাপ বসে আছে। তার দৃষ্টি পাঁচিলের বাইরের একটা আমগাছের ওপর। ঘন অন্ধকারে গা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। এক লহমার জন্য হঠাৎ গাছের টিকির কয়েকটা পাতা চিকমিকিয়ে ওঠে যেমন চিকমিক করে শেষ বিকেলের রোদে। কিছুক্ষণ পর পর আরো দু’বার দেখা যায় সে ক্ষীণ আলোর চিকিমিকি।

মতি উঠে দাঁড়ায়। দলের লোকদের বলে, কিরে তোরা চুপচাপ বসে আছিস কেন? একটু গান-টান কর।

দ্বিতীয়বার আর বলতে হয় না। একজন গানে টান দিতেই দলের সবাই গাইতে শুরু করে দেয়–

ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক–
সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ,
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে–
আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি।

ফজল ও বাকি সাত-আটজন আসামি দূরে বসেছিল। গানের আকর্ষণে ফজল গিয়ে বাদলের পাশে বসে। গানের কথা ও সুর গুনগুন করে তার মনের ভেতর।

গান শেষ হয়। ফজলকে দেখে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে সকলে। বাদল মতির দিকে চেয়ে বলে, ঠিক আছে, কোনো অসুবিধে হবে না।

কী ঠিক আছে, বুঝতে পারে না ফজল। কিছুক্ষণ পরই সে দেখে আল্লাস বিঘত দেড়েক লম্বা কালোমত কি একটা জিনিস তার জামার ভেতর থেকে বার করে রানের নিচে রাখল।

মতি বলে, মোহন, এবার তোর সেই গানটা ধর। আর তোরা সবাই কবির সাথে সাথে দোহার ধরিস আর তালে তালে তালি দিস।

মোহন : ও ভাই কোথা থেকে উড়ে এল লালমুখো বাদুড়, ও ভাই কোথা থেকে ………

একজন : কোথা থেকে?

মোহন : পার হয়ে তেরো নদী সাত সমুদ্র,

সকলে : ও ভাই জাগো…জাগোরে ভাই জাগো,
ও ভাই ওঠো…ওঠোরে ভাই ওঠো,
করো তারে দূর।

তালির তালে তাল মিলিয়ে লোহা-কাটা করাত চলে দরজার শিকের ওপর। গান আর হাততালির শব্দে ঢাকা পড়ে করাতের আওয়াজ। পাহারাদার টহল দিয়ে এদিকে মুখ ঘোরাবার আগেই কারো রানের নিচে চলে যায় করাতটা।

মোহন : ও ভাই উড়ে এসে জুড়ে বসে বড় সে চতুর,
ও ভাই উড়ে এসে…এ…এ…

একজন : তারপর?

মোহন : তার সাথে যোগ দি’ছে–(প্রহরীর দিকে তাকিয়ে) কে বলো তো?

প্রহরী : কে?

মোহন : তার সাথে যোগ দিছে ছুঁচো আর ইঁদুর,

সকলে : ও ভাই মারো–মারো রে ভাই মারো,
ও ভাই কাটো–কাটোরে ভাই কাটো,
করো তারে দূর।

বারবার গাওয়া হচ্ছে একই চরণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গানের কথা আর সুর রপ্ত হয়ে যায়। ফজলের। সে-ও তালি বাজিয়ে গান গায় সকলের সাথে।

মোহন : ও তোর বুকে বসে খুন চুষে পেট করে সে পুর,
ও তোর বুকে বসে…এ..এ…

একজন : তারপর?

মোহন : লুটে নেয় নিজ দেশে সাত-সমুদ্দূর।

সকলে : ও ভাই ধরো, ধরোরে ভাই ধরো,
ও ভাই লড়ো, লড়োরে ভাই লড়ো
করো তারে দূর।

দুটো শিকের বেশ কিছুটা কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু করাতের আওয়াজ যেন বেশি হচ্ছে এখন। গান আর তালির শব্দ ছাপিয়ে রাখতে পারছে না করাতের কুড়ুৎ-কুড়ুৎ আওয়াজ। মতি শঙ্কিত হয়। সে করাত চালানো বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে মোহনকে বলে, ওরে কবি, তোর গানের জারিজুরি আর চলবে না এখন। নতুন গান তৈরি কর।

কিছুক্ষণ পর মোহন আবার নতুন গানে টান দেয় :

আমার দেশের কৃষাণ-মজুর,
মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমোর,
ওরাই যে খাঁটি মানুষরে–
ঐ যে দেখ মাঝি ভাই,
বাড়িতে তার খাবার নাই,
তবু তার বৈঠা চরে কুডুৎ-কুড়ুৎ

সকলে : কুড়ুৎ-কুড়ুৎ-কুড়ুৎ-কুড়ুৎ

হাততালি আর কুড়ুৎ-কুড়ুৎ শব্দ এবার করাতের আওয়াজকে বেমালুম ঢেকে দেয়।

মোহন : ঐ যে দেখ কারিগর,
নাইক তার চালে খড়,
তার কুঁদ-বাটালি চলে তবু খুড়ুৎ-খুড়ুৎ

সকলে : খুড়ৎ-খুড়ৎ-ঋড়ৎ-খুড়ুৎ

মোহন: গোয়াল ভাইরে দেখ চেয়ে,
দেখছে কি সে ঘি খেয়ে?
তবু সে মাখন টানে ঘুড়ুৎ-ঘুড়ুৎ।

সকলে : ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ-ঘুড়ৎ

মোহন : তাঁতি ভাইয়া কাপড় বোনে,
ছেঁড়া কাপড় তার পরনে,
তবু সে মাকু চালায় ঠুড়ুৎ-ফুড়ুৎ

সকলে : টুডুৎ-ঠুড়ুৎ-ঠুড়ৎ-ফুড়ুৎ

মোহন : আমরা যে ভাই খাঁচার পাখি,
চোখের জলে ভাসে আঁখি,
খাঁচা ভেঙে কেমনে পালাই ফুড়ুৎ-ফুড়ৎ

সকলে : ফুড়ৎ-ফুড়ৎ-ফুড়ৎ-ফুড়ৎ

রাত বারোটায় নতুন পাহারাদার আসার আগেই দুটো শিক কাটা হয়ে গেছে। এক একটার দু’জায়াগায় করাত চালানো হয়েছে দু’হাত অন্তর। অল্প আঁশের ওপর যথাস্থানে রেখে দেয়া হয়েছে ওগুলোকে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না।

মতি, বাদল ও আরো একজন দরজার কাছে বিছানা পেতে শুয়ে আছে।

পেটাঘড়ি রাত একটা ঘোষণা করে।

মতি শুয়ে শুয়েই দৃষ্টি ফেলে আমগাছটার টিকিতে। পাতার ওপর আলোর চিকিমিকি দেখে সে টোকা দেয় বাদলের গায়ে। বাদল কাশি দিয়ে সঙ্কেত জানায় আর সবাইকে!

ঠক-ঠক আওয়াজ তুলে টহল দিচ্ছে প্রহরী। এ দরজা থেকে ঘুরে সে এগিয়ে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। তার বুটের আওয়াজ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। বাদল আলগোছে মোড় দিয়ে শিকের টুকরো দুটো খসিয়ে ফেলে। সে আর আল্লাস চুপিসারে বেরিয়ে বারান্দার থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকে।

প্রহরী এগিয়ে আসছে অন্য প্রান্ত থেকে। দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই পেছন থেকে বাদল শক্ত হাতে তার মুখ চেপে ধরে রুমাল দিয়ে। আর আল্লাস তাকে জাপটে ধরে রাইফেলটা সরিয়ে নেয়।

দু’জনে তাকে মাটিতে পেড়ে তার মুখের ভেতর রুমাল গুঁজে দেয়। মুখ থেকে সামান্য আওয়াজ বের করবারও সুযোগ পায় না প্রহরী। তার লাল পাগড়িটাকে তারা দুটুকরো করে তার হাতে পায়ে বেঁধে উপুড় করে চেপে ধরে রাখে।

মতি দলের আর সবাইকে নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে ছুটে যায় পেছনের পাঁচিলের দিকে। বাইরে থেকে একটা দড়ির মই নেমে আসে। মই বেয়ে চটপট তারা পাঁচিলের বাইরে চলে যায়। বাদল আর আলাস এসে দেখে, ফজলও উঠছে মই বেয়ে।

বাদল ফিস ফিস করে বলে, এই ফজল, তুমি কেন পালাচ্ছ? কেন নিজের বিপদ বাড়াচ্ছ?

আলাস বলে, আরে যেতে দাও। জলদি করো।

বাইরে বেরিয়ে সটকে পড়ে যে যেদিকে পারে, মিশে যায় কালো রাত্রির অন্ধকারে।

অল্পক্ষণ পরেই বেজে ওঠে পাগলা ঘণ্টা। রাত্রির নিস্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে ঘন্টা বাজতে থাকে অবিরাম।

ফজল ছুটছে। অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে, কাঁটার আঁচড় খেয়ে সে ছুটছে। একটা শুকনো খাল পেরিয়ে সে পাটখেতের ভেতর ঢোকে। চুপটি মেরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়া দরকার।

খালের ভেতর কিছু একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ হলো।

ফজল দাঁড়ায়। অন্ধকারে সাদামতো কিছু একটা নড়ছে, কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়।

মানুষ! দলের কেউ নয় তো?

ফজল ভয়ে ভয়ে নামে খালের ভেতর। কাছে গিয়ে টেনে তোলে মানুষটিকে।

কে? কেরে তুই? উহ্–উহ্।

এ যে মতিভাই! গলার স্বরে চিনতে পারে ফজল। সে বলে, আমি ফজল। শিগ্‌গির ওঠেন।

মতিকে কাঁধে তুলে সে পাটখেতে নিয়ে বসিয়ে দেয়। হাঁপাতে থাকে তারা দুজনেই। ব্যথা পাইছেননি মতিভাই?

হ্যাঁ, পায়ে চোট লেগেছে। ছাল উঠে গেছে অনেক জায়গায়। হাঁটতে পারবেন? দেখি পারি কিনা। টলতে টলতে দাঁড়ায় মতি। কয়েক কদম ফেলে বলে, পারব।

তবে জলদি চলেন। কিন্তু কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। চশমাটা পড়ে গেছে পাঁচিল ডিঙোবার সময়। আমার হাতে ধরেন। চলেন শিগগির। কোন দিগে যাইবেন? নিয়ে চলো তোমার যেদিকে ইচ্ছে। তুমিতো দক্ষিণ দিকে যাবে?

হ।

তাই চলো। রাস্তা দিয়ে যেয়ো না কিন্তু।

না। ধানখেতের আইল দিয়া, পাটখেতের আড়ালে আড়ালে যাইতে পারমু। আন্ধার রাইতে কেও-দেখতে পাইব না।

মানুষের আনাগোনার শব্দ পেলে পাটখেত ঢুকে চুপটি মেরে থাকতে হবে, বুঝলে?

ফজল একটা ধঞ্চে গাছ টেনে তোলে। ওটা ভেঙে হাত দু’য়েক লম্বা একটা লাঠি বানিয়ে নেয়। লাঠিটার এক মাথা মতির হাতে দিয়ে অন্য মাথা ধরে ফজল নিয়ে চলে তাকে অন্ধের মতো। তাড়াতাড়ি হাঁটলে তার অসুবিধা হবে ভেবে ফজল আস্তে ধীরে পা চালাচ্ছিল। মতি তাড়া দেয়, আরো জোরে হাঁটো, নইলে ধরা পড়ে যাব।

ফজল এবার জোরে পা চালায়। মতি লাঠি ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার পিছু পিছু। পথে কোনো অসুবিধা থাকলে, উঁচু-নিচু থাকলে তাকে আগেই সাবধান করে দেয় ফজল।

.

পূর্ব দিগন্তে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি সরু চাঁদ। চাঁদের আকার দেখে ফজল বুঝতে পারে, বড়জোর দু’তিন দিন বাকি আছে অমাবস্যার। সে আরো বুঝতে পারে, ধলপহরের সময় হয়ে আসছে। সে বলে, মতি ভাই, রাইত কিন্তু আর বেশি নাই।

আস্তে কথা বলো। ফিসফিসিয়ে বলে মতি। কোথায় এসেছ?

সেরাজাবাদের খালের কিনারে আসছি। এখন কোনমুখি যাইবেন?

খালে পানি আছে?

না।

খালের ভেতর দিয়ে পুব দিকে নদীর পাড়ে চলে যাও। নদীর কিনারা ধরে চলতে চলতে দেখো নৌকা পাওয়া যায় কিনা। নৌকা একটা চুরি না করে উপায় নেই।

খালের ভেতর দিয়ে কিছুক্ষণ চলার পর তারা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছে।

ছোট শাখানদী। নাম রজতরেখা। ক্ষীণ ঘোলাটে জোছনায় নদীটাকে রুপালি চাঁদরের মতো মনে হয়।

তারা চলতে থাকে নদীর কিনারা ধরে। কিছুদূর গিয়েই একটা ছইওলা এক-মাল্লাই নৌকা দেখতে পায় ফজল। একটা বাড়ির নিচে নদীর ঘাটে বাঁধা নৌকাটা।

মতিভাই, একটা নৌকা পাইছি। কিন্তু নৌকার মাঝির বাড়ি বোধ করি নদীর পাড়েই। টের পাইয়া গেলে

না টের পাইব না। রাতের এ সময়ে কেউ জেগে নেই। চলো, উঠে পড়ি নৌকায়।

দু’জনেই নৌকায় ওঠে। ফজল রশি খুলে পাড়া উঠিয়ে নৌকা ছেড়ে দেয়।

পুব পাড়ে লোকজনের বসতি কম। ওপাড়ে চলে যাও। আমাকেও একটা বৈঠা দাও। চোখে ভালো না দেখলেও টানতে পারব।

দু’জনে বৈঠা টেনে যখন দিঘিরপাড় বরাবর পৌঁছে তখন সূর্য উঠে গেছে। দিঘিরপাড় ডানে রেখে আরো কিছুক্ষণ বৈঠা টানার পর তারা বড় নদীতে গিয়ে পড়ে।

এইবার কোনমুখি যাইবেন, মতিভাই?

চলো দক্ষিণপাড় চলে যাই। পাড়ি দিয়ে যেতে পারবে তো?

তা পারব। কিন্তু অনেকদূর উজাইয়া পাড়ি দিতে অইব।

কেন?

পানির তেজ খুব বেশি। সোজা পাড়ি দিলে দক্ষিণপাড় যাওয়া যাইব না। নৌকা ঠেইল্যা লইয়া যাইব মেঘনায়।

প্রাণপণ বৈঠা টানে দু’জনে। বাঁ-দিকে একের পর এক বাহেরক, সাতকচর আর চাকমখোলা পেছনে ফেলে ধীর গতিতে উজিয়ে চলছে নৌকা। আরো কিছুদূর গিয়ে ফজর দাত্রার খাড়ির মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দেয়।

এইবার আপনে বৈঠা রাখেন, মতিভাই। আমি একলাই বাইয়া যাইতে পারমু।

অনভ্যস্ত মতি বৈঠা টেনে খুবই ক্লান্ত। সে বৈঠা রেখে সটান শুয়ে পড়ে ছই-এর নিচে পাটাতনের ওপর।

দক্ষিণ দিকে নৌকা চলছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ফজল বলে, মতিভাই আমি তো প্রায় বাড়ির কাছে আইসা পড়লাম।

উঁহু, এখন বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না তোমার।

কিন্তু পেটে কিছু না দিলে এতটা পথ

তা ঠিকই বলেছ। তবে চলো। বাড়ি গিয়ে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। দেরি হলে বিপদ হবে।

বৈঠা টানতে টানতে ফজলের হঠাৎ মনে হয়, বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা, বোন, আত্মীয়-স্বজন শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে। তাকে দেখে কান্নার রোল পড়ে যাবে বাড়িতে। মা বিলাপ করতে শুরু করবে। তার নিজের বুকের কান্নাও বাঁধ মানবে না তখন।

ফজলের চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে।

ভোরের রোদের ছোঁয়া লাগছে পিঠে। ফজল সুমুখে ডানে বাঁয়ে তাকায়। পরিচিত পরিবেশ তার চোখ জুড়িয়ে দেয়।

অসংখ্য ডিঙি। ডিঙির মালিকেরা ইলিশ মাছের জাল ফেলে খোট ধরে বসে আছে। সাথের লোক গলুইয়ে বসে আছে হাল ধরে। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে ডিঙি একটার পর একটা। যেন ডিঙির মিছিল। দ্রুত ধাবমান ইলিশ মাছ জালে ধাক্কা খেলে খোট-ধরা হাত টের পায়, ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে সারা শরীর। আর অমনি টান মেরে জালের ছড়িয়ে থাকা প্রান্ত দুটি একসাথে মিলিয়ে বন্ধ করে দেয়। মাছ আটকা পড়ে যায় জালের ভেতর। ফজল জানে, এ এক অদ্ভুত শিহরণ, অদম্য নেশা। কোনো এক ইলিশ শিকারি নাকি স্বপ্নে খোট পেয়ে জোরে মেরেছিল এক টান। তার আঙুল ঢুকে গিয়েছিল বউর নাকের চাঁদবালির মধ্যে। টানের চোটে আঙুলে আটকানো চাঁদবালি নাক কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল।

কয়েকটা সরু লম্বা জেলে নৌকা নিকারির টেকের দিকে যাচ্ছে। সারা রাত জেগে মইজাল, টানাজাল, জগৎবেড় জাল দিয়ে জেলেরা ধরেছে যে মাছ তা বিক্রি করবে দাদনদার মাছের ব্যবসায়ীদের কাছে।

বাঁদিকে একটা সোতা জুড়ে ভ্যাশাল পেতেছে এক জেলে। বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সাথে আড়াআড়ি লম্বালম্বি কোনাকুনি বাঁশ বেঁধে সাঁকোর মতো বানানো হয়েছে। এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে জাল। সকোর সাথে ঠেকিয়ে ওটার এক কোণে শরীরের ভার চাপিয়ে পাড় দিলে পানি থেকে মাছ নিয়ে ওপরে উঠে যায় জাল। অদ্ভুত এক ফাঁদ। ফাঁদের মালিক ফাঁদ পেতে মাকড়শার মতো চুপচাপ বসে আছে সাঁকোর ওপর।

বড় বড় নৌকা গুনের টানে উজিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে। কাঁধে বেরুয়া ঠেকিয়ে গুন টানছে মাল্লারা। বছরের এ সময়ে ওদিকে কোথায় যাচ্ছে নৌকাগুলো–জানে ফজল। এগুলো ফজলি আম কিনতে যাচ্ছে মালদহ জেলায়। হালমাচার ওপর দাঁড়িয়ে তোতাশলা আর মুইন্যাশলা ধরে মাঝি হালে গুঁড়ি দিচ্ছে কেডোৎ-কোড়োৎ।

পশ্চিমদিক থেকেও আসছে বড় বড় নৌকা। প্রায় পানিতরাস পর্যন্ত বোঝাই করা হয়েছে নৌকাগুলো। এগুলোতে গুটি আম আসছে রাজশাহী ও মালদহ জেলা থেকে। যাবে বড় বড় বন্দরে। তাড়াতাড়ি বন্দরে পৌঁছতে না পারলে আম পচে যাওয়ার ভয় আছে। তাই অনুকূল স্রোত থাকা সত্ত্বেও মাল্লারা প্রাণপণ দাঁড় টেনে চলেছে।

অনেকদিন পর ফজল ফিরে এসেছে পদ্মায়। পদ্মার পানি, পদ্মার তরঙ্গ তার অন্তরঙ্গ। পদ্মার পলিমাটি তার আশ্রয়। সে আঁজলা ভরে পানি খায়। বুকভরে টানে মুক্ত বাতাস।

ফজল ডানদিকে তাকায়। দূরে পশ্চিম দিকে একটা বাড়ি। কলাগাছের ঘন ঝাড় আড়াল করে রেখেছে ঘরগুলো। এতদূর থেকে একটা শাড়ির আঁচলও দেখা যাচ্ছে না। রূপজান কি তার কথা ভাবছে এখন?

ফজল।

জী।

বাদলের কাছে শুনেছি, তোমাকে মিথ্যে ডাকাতি মামলায় জড়িয়েছে। ব্যাপারটা কি বলো তো?

ফজলের মুখে সব ঘটনা শুনে শক্ত হয়ে ওঠে তার চোয়াল। সে রাগে ঠোঁট কামড়ায়।

ঐ যে দ্যাখেন মতিভাই, ডানদিকে দূরে ধু ধু দেখা যায় সেই খুনের চর।

মতি ডান দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ঝাঁপসা দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজদের চাই জমিদারগুলো হচ্ছে এই সব ঝগড়া-ফ্যাসাদের মূল। ওদের খতম করা দরকার সকলের আগে।

কিছুক্ষণ পর আবার সে বলে, জানো ফজল, আগে এখানে নদী ছিল না। এখানে ছিল একটা খাল। লোকে বলতো ওটাকে রথখোলার খাল। চাঁদরায়-কেদার রায়দের রথটানা হতো ওখান দিয়ে। আগের দিনে পদ্মা ফরিদপুরের মাঝ দিয়ে বরিশালের কন্দর্পপুরের কাছে মেঘনায় মিশেছিল। এখন যেটা আড়িয়াল খাঁ টোই ছিল তখন আসল পদ্মা।

আইচ্ছা! আমরা তা হইলে চরুয়া ছিলাম না, আসুলি ছিলাম!

হয়তো ছিলে। আগে বাঙলার মাটিতে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছিল এক সাথে। ব্রহ্মপুত্র গতি বদলে পশ্চিম দিকে গিয়ে যমুনার সাথে মিশে। এই দুটি নদীর স্রোত গোয়ালন্দের কাছে পদ্মার সাথে মিলে যায়। তার পরেই রথখোলার খাল ভাঙতে ভাঙতে নদী হয়ে যায়। চাঁদ রায় কেদার রায়ের কীর্তি, রাজ রাজবল্লভের কীর্তি ধ্বংস করে। তাই পদ্মার আর এক নাম কীর্তিনাশা।

ভালো একটা ইতিহাসের কথা শুনাইলেন মতিভাই। আমরা তো কিছুই জানি না। জানলে কি আর আসুলিরা আমাগো নিন্দা করতে পারে? কথায় কথায় চরুয়া ভূত কইয়া ঠেশ দিতে পারে?

এই যে নদী, এই যে তোমাদের চর–এখানে বিক্রমপুরের অনেক গ্রাম ছিল। পদ্মা বিক্রমপুরকে দু’ভাগ করে গিয়েছে। আগে বিক্রমপুরের দক্ষিণ সীমা ছিল ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর। নদীর ভাঙনের ফলে আমার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীদের কেউ উত্তরপাড় রয়ে গেছে। কেউ চলে গেছে দক্ষিণপাড়।

আমরাও তা হইলে বিক্রমপুরের লোক। এইবার আসুলিরা কেউ টিটকারি দিলেই শুনাইয়া দিমু।

তুমি চরের লোক বলে নিজেকে ছোট মনে করো নাকি ফজল?

আসুলিরা যে তাই কয়।

একদম বাজে কথা। দেশ, কুল, জাতি, ধর্ম দিয়ে কি ছোট-বড় বিচার হয়? মানুষের বিচার হয় তার কাজ দিয়ে–একথা মনে রেখো। তোমার বড় পরিচয় তুমি মানুষ–পৃথিবীর আর সবার মতো মানুষ। তোমার কাজে, কথায়, অবহেলায়, উদাসীনতায় কোনো লোকের সামান্য ক্ষতিও না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে সব সময়। যারা মানুষকে ভালোবাসে, মানুষের ভালো করে তারাই বড়, তারাই মহৎ। যারা মানুষকে ভালোবাসে না, মানুষের ভালো চায় না। তারাই ছোট, তারাই অধার্মিক।

ফজল কথাগুলোর কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। বলে, আপনারাও তো মানুষরে ভালোবাসেন না। শুনছি, আপনারা ডাকাতি করেন, মানুষ খুন করেন।

হ্যাঁ, ডাকাতি করি, দরকার হলে খুনও করি। যারা অমানুষ, যারা দিনের পর দিন মানুষের রক্ত শোষণ করে, অত্যাচার করে, যারা বিদেশী শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে, বার বার সতর্ক করার পরেও যারা পথে আসে না, তুমি কি মনে করো তাদের বাঁচবার অধিকার আছে? বেঁচে থাকার চেয়ে তারা পচে গলে দেশের মাটির উর্বরতা বাড়াক। এদের অন্যায়-অত্যাচার আর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিকার না করে উদাসীন হয়ে বসে থাকা অন্যায়। এদের ক্ষমা করা মহাপাপ।

কিন্তু অন্যান্য-অত্যাচারের বিচারের জন্য তো আইন-আদালত আছে।

আইন-আদলাত! মতির মুখে বিদ্রুপের হাসি। একটা কাটারি যেন চিকমিকিয়ে ওঠে তার ঠোঁটের ফাঁকে। আইন-আদালত তো পয়সার গোলাম। পয়সাওলা শোষক গোষ্ঠীর কথায় ওঠে বসে।

আইচ্ছা, এই যে গরিব মাঝির নৌকাটা চুরি করলাম। এইটা কি অন্যায় হয় নাই, আমাদের?

নিশ্চয়ই অন্যায় হয়েছে। এর প্রতিকার অবিশ্যি করতে হবে।

কিভাবে করবেন?

সেটা পরে দেখা যাবে। আগে তো পালিয়ে বাঁচি। কতদূর এলে ফজল?

উল্টা বাতাস। নাওটা জোরে চলতেছে না। যতদূর আসছি আরো দুই এতখানি গেলে পাড়ি শেষ হইব। আমি কিন্তু বাড়ি যাইতেছি না।

কোথায় যাচ্ছ তাহলে?

সোজা দক্ষিণ পাড়, আপনে যেইখানে যাইতে চান।

না খেয়ে বৈঠা বাইতে পারবে তো?

তা পারব। কিন্তু আপনার বোধ হয় খিদা লাগব।

না, লাগবে না। তুমি বুঝেশুনে যাও। দেখো কেউ যেন চিনতে না পারে।

না, দাড়ি-মোচে যা একখান চেহারা হইছে, সহজে কেউ চিনতে পারব না।

একটা ছেঁড়া গামছা পড়ে আছে পাটাতনের ওপর।বোধ হয় মাঝি ওটা পা মোছর জন্য রেখেছে। ফজল ওটাই মাথায় বেঁধে নেয়। এবার আর তাকে চেনার সাধ্যি নেই কারো।

একটা ছোট লঞ্চ আসছে পুব দিক থেকে।

কিসের আওয়াজ? জিজ্ঞেস করে মতি। লঞ্চ বোধ হয়?

হ্যাঁ, ছোট্ট একটা লঞ্চ। কিন্তু চলতি বড় জবর।

কিছুদূর দিয়ে লঞ্চটা চলে যায়।

ফজল বলে, কয়েকটা ধলা সাহেব যাইতেছে।

আচ্ছা! লঞ্চটার গায়ে কিছু লেখা আছে?

হ্যাঁ, ইংরেজীতে লেখা আছে, আর্মি বোট নম্বর পি-২৬৮। একটা সাহেব চোখে দূরবিন লাগাইয়া দেখতে আছে।

হুঁ, নদীতে টহল দিতে শুরু করেছে। আমাদের নৌকার নম্বর আছে তো?

মাথির একপাশে আলকাতরা দিয়ে লেখা নম্বর পড়ে ফজল বলে, হ্যাঁ আছে, ১৭৩৫ নম্বর।

নম্বর আছে বলেই বোধ হয় কিছু বলল না। নম্বর না থাকলে কি জানি হয় তো এখনই বিপদ ঘটত।

ভোর থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছিল। বেলা এক প্রহরের কিছু পরেই সারা আকাশ ছেয়ে যায় কালো মেঘে। যেন ছানি পড়েছে পৃথিবীর চোখে। ফজল বলে, দিনের অবস্থা বড় ভালো না। মেঘ করছে খুব।

ঝড় উঠবে না তো?

মনে হয় না। এখন তো জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ। ঝড়-তুফান না-ও আসতে পারে। উত্তরের আসমানে খাড়াঝিকি মারতে আছে খুব।

বৈঠাটা আমার হাতে দাও। তুমি জিরিয়ে নাও কিছুক্ষণ।

আরো কয়েকবার বৈঠা চেয়েছিল মতি। কিন্তু ফজল দেয়নি। এবার আর সে মানা করে না। খিদেয় চেঁ-চোঁ করছে পেট। শ্রান্ত হাত দুটো বিদ্রোহ করতে চাইছে।

মতির হাতে বৈঠা দিয়ে বলে ফজল, ডাইন কোনাকুনি রাইখেন নৌকার মাথা। তা না হইলে কিন্তু ভাটির টানে জঙ্গুরুল্লার চরের দিগে লইয়া যাইব।

মতির হাতে বৈঠা দেয়ার আর এক উদ্দেশ্য ছিল ফজলের। সে মাঝির কাঁথার গাঁটরি তন্নতন্ন করে খোঁজে। চোঙা-চুঙি উপুড় করে ঢেলে দেখে, হাতিয়ে দেখে নৌকার উত্তরা। কিন্তু একটা আধলাও খুঁজে পায় না সে। তার আশা ছিল দু-চার আনার পয়সা পেলে চরের কোনো ছুটকো দোকান থেকে চিড়েমুড়ি কিনে নেবে। শান্ত করবে উদরের ভোক্ষসটাকে। ওটা বড় বেশি খাই-খাই শুরু করে দিয়েছে।

ফজল আবার বৈঠা হাতে নেয়। একটা খাড়ি উজিয়ে দক্ষিণের প্রধান স্রোতে পৌঁছবার আগেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে।

কি করি মতিভাই এখন? বিষ্টি তো শুরু হইল।

কোনো চরের কিনারায় নিয়ে যাও।

ফজল একটা ঘোঁজার ভেতর চলে যায়। পুরো নৌকাটা ঢুকিয়ে দেয় কাশবনের ভেতর। দুটো লগি পুঁতে শক্ত করে বাঁধে দুই মাথি। তারপর সে ছই-এর ভেতর ঢুকে দু’দিকের ঝাঁপ নামিয়ে দেয়।

বৃষ্টি পড়ছে ঝরঝর। ছই-এর ওপর যেন দাপাদাপি করছে দূরন্ত ছেলেরা। ঝড়ো বাতাসে নৌকাটা দুলছে এদিক-ওদিক। ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির ঝাঁপটা আসছে।

কাঁথার ওপর মতি শুয়ে পড়েছিল। মাঝির তেলচিটে বালিশটা তার মাথার নিচে খুঁজে দেয় ফজল।

বালিশের অর্ধেকটা ছেড়ে দিয়ে মতিভাই বলে, তুমিও শুয়ে পড় ফজল, জিরিয়ে নাও। বিষ্টি যেন কখন থামে ঠিক নেই।

মতিভাই মাথার পাশে মাথা রেখে ফজল বলে, খিদা লাগছে না মতিভাই?

খিদে তো লেগেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই তো আমি করিনি। কাজ না করে বসে বসে খাওয়ার কথা চিন্তা করাও অন্যায়। কাজ করেছ তুমি, খিদে পাওয়া উচিত তোমার।

আমার তো দারুণ খিদা লাগছে।

চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করো। যে পরিশ্রম করেছ—

দু’জনেই চোখ বুজে পড়ে থাকে।

খাবার সময় পেরিয়ে খিদে যখন ধীরে ধীরে মরে যায় তখন ক্লান্ত অবসন্ন শরীর ঘুমে ঢলে পড়ে।

তারা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, কিছু খেয়াল নেই তাদের। ঝম্‌ঝম্ বৃষ্টি পড়ছে এখনো। এখনো ঢাকা পৃথিবীর চোখ। তাই সময়ের আন্দাজ করতে পারে না তারা। তবে পেটের ভোক্ষসটা নাড়ি-ভুঁড়িগুলোকে যে রকম খুবলাতে শুরু করেছে তাতে সহজেই বোঝা যায়– খাবার সময় হয়েছে আবার। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।

বৃষ্টির পানিতে প্রায় টুবুটুবু হয়েছে নৌকার ডওরা। ফজল তাড়াতাড়ি কয়েকটা পাটাতন সরায়, সেঁউতি বের করে পানি সেচে।

গলুইয়ের ঝাঁপ ফাঁক করে আকাশের দিকে তাকায় ফজল। বলে, বিষ্টি ছেক দেয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, মতিভাই।

কিন্তু সন্ধ্যার আগে বিষ্টি না থামলে সারা রাত এখানেই পড়ে থাকতে হবে।

কেন? রাত্রেই পাড়ি দিয়া ওপার যাইতে পারব।

কিন্তু রাতের বেলা ওপার গিয়ে কোনো লাভ নেই। পথ চিনে যেতে পারব না।

ওপারে কোনে গ্রামে যাইবেন? কার বাড়ি?

নয়নপুরে–আমার বোনের বাড়ি।

নয়নপুর আবার কোনখানে?

পণ্ডিতসার যেতে পথে পড়ে। বছর দশেক আগে এসেছিলাম একবার। বোমার মামলায় পড়ে লুকিয়ে ছিলাম অনেক দিন। এত বছর পরে পথ চিনে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।

কোনো চিন্তা কইরেন না মতিভাই। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে বিলাত যাওয়া যায়।

আজ যদি যেতে পারতাম, গিয়েই বোনকে বলতাম—শিগগির খিচুড়ি রান্না কর, ডিম ভেজে দে। আর যদি ইলিশ মাছ ভাজা থাকে তো কথাই নেই।

আর কইয়েন না মতিভাই। জিহ্বায় পানি আইসা গেল। এই ঘন ডাওরে গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা আর নয়তো আণ্ডা বিরান–ওরে মাবুদের পেটের মধ্যে খাম খাম শুরু হইয়া গেছে।

ফজল ঢোক গিলে। তার চোখের সামনেই যেন সে দেখতে পায় গামলা ভরা খিচুড়ি। গরম গরম খিচুড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভাজা ইলিশ মাছের খিদে-চেতানো গন্ধ এসে লাগছে নাকে।

নাহ, আজ খিচুড়ি না পেলে পেটের ভোক্ষসটা কিছুতেই শান্ত হবে না।–ভাবে ফজল। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? কার বাড়ি গেলে এখন খিচুড়ি খাওয়া যায়? নিজেদের বাড়ি সে বহুদুর পেছনে ফেলে এসেছে। সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার ভাইয়ের দোস্ত রফি শিকদারের বাড়ি ধুলচর। পশ্চিম দিকে মাইল খানেক উজান ঠেলে যাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু বৃষ্টি মাথায় করে অতটা পানি ভাঙবার শক্তি নেই শরীরে। আর এ অবস্থায় সেখানে গিয়ে বেশরমের মতো খিচুড়ির ফরমাশইবা দেবে সে কেমন করে? এ খাড়িটা ধরে বেশ কিছুদূর পিছিয়ে গেলে তাদের কোলশরিক কেরামতের বাড়ি। সেখানে গিয়েও খিচুড়ির ফরমাশ দেয়া যাবে না। আর কোথায় যাওয়া যায়?

হ্যাঁ, অল্প কিছুদূরেই আর একটা বাড়ি আছে। বাড়িটার কথা মনে পড়তেই কেমন একটা আনন্দ তার বিধ্বস্ত মনের ধ্বংস স্থূপ সরিয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এ যেন ঠিক আনন্দ নয়, আনন্দের কালো বিষণ্ণ ছায়া।

জরিনা তার কেউ নয়। কোনো সম্পর্ক নেই আর তার সাথে। কোনো দাবি নেই তার ওপর।

রূপজানও আর কেউ নয় তার।

জীবনের ভিত ধসে গেছে। ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে সব। ভগ্নস্তূপের নিচে মৃতপ্রায় মনটা তার কিছু একটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়াতে চায়।

অধিকার ও অনধিকারের সীমান্তে এসে দাঁড়ায় ফজলের অভিলাষ। মমতা মাখানো এক পলক চাহনি, সমবেদনার দুটি কথা, স্নেহের একটুখানি পরশের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে তার বিপর্যস্ত মন। মনের এই আকুতিই তাকে তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে প্ররোচিত করে। এ মুহূর্তে পেটের খিদেকে ছাপিয়ে উঠেছে মনের পিপাসা।

বৃষ্টির তোড় আর নেই। শুধু টিপটিপানি আছে এখন। তাড়াতাড়ি নৌকার বাধন খুলে লগি দুটো তুলে ফেলে ফজল। তারপর কাশবন থেকে বের করে নৌকাটাকে সে স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্য সে ছই-এর ভেতর গিয়ে বসে।

কি করছ ফজল? নৌকা ছেড়ে দিলে কেন?

কাছেই একটা বাড়ি আছে জানাশোনা।

আচ্ছা, তবে এতক্ষণ যাওনি কেন?

মনে ছিল না।

হালবিহীন নৌকা ভাটির টানে ভেসে যায় ঘুরপাক খেয়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর নৌকাটাকে ফজল আর একটা খাড়ির ভেতর বেয়ে নিয়ে যায়। কিনারায় ভিড়িয়ে বাঁধে লগি পুঁতে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখনো বৃষ্টি পড়ছে টিপিরটিপির।

ফজল নেমে যায় নৌকা থেকে।

মতিভাই বলে, বেশি করে খাবার নিয়ে এসো। দেরি কোরো না কিন্তু।

ফজল কোনো জবাব না দিয়ে এগিয়ে যায়। কাশ আর লটাবনের ভেতর দিয়ে পথ। অন্ধকারে পথ চলতে চলতে সে ভাবে–জরিনার বুড়ি শাশুড়ি আছে বাড়িতে। তার চোখ এড়িয়ে কেমন করে দেখা করবে সে জরিনার সাথে? ধারে কাছে আর কোনো বাড়ি নেই–এই যা রক্ষে।

এ তল্লাটে কোথাও চুরি হলেই হেকমতকে ধরার জন্য পুলিস আসে। জ্ঞাতিদের ঘরেও খানাতল্লাশি হয়। এজন্য বিরক্ত হয়ে তার জ্ঞাতিরা তাকে তাদের পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারাই তার ঘরদোর তুলে এনে চরের এক কোণে আলাদা বাড়ি করে দিয়েছে।

ফজল ডাক দিয়ে উঠে, টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্‌। না, হট্টিটির ডাক এখানো ভোলেনি সে। কিন্তু এত বছর পরে জরিনা যদি বুঝতে না পারে এ সঙ্কেত? হেকমত আজ বাড়ি আছে। কি না, তাই-বা কে জানে?

ফজল নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়ায় ঘরের পেছনে।

ঘরে কুপি জ্বলছে তরজার বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পায়, জরিনা ছেঁড়া কাপড় সেলাই করছে, তার শাশুড়ি শুয়ে আছে মেঝের একপাশে হোগলার বিছানায়।

ফজল সরে যায় কিছুদূরে কাশবনের কাছে। ডেকে ওঠে, টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট্‌।

জরিনা কান খাড়া করে। বড় মধুর হট্টিটির ডাক। তার দুআঙুলে ধরা সুইটি পড়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সুইটাকে কুড়িয়ে নিয়ে আবার ফেঁড় তোলে সে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হটু….

আবার সেই ডাক। কিছুক্ষণ পরে আবার, তারপর আরো কয়েক বার।

জরিনা দাঁড়ায়। দরজার কাছ থেকে বদনা নিয়ে সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট….

ডাকটা আসছে কাশবনের দিক থেকে। জরিনা বদনাটা উঠানে রেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। ওদিক থেকে ফজলও এগিয়ে আসে। কিন্তু অন্ধকারে একটা মানুষের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই ঠাওর করতে পারে না জরিনা। মূর্তিটার মুখোমুখি এসে দাঁড়াতেই সে নিঃশঙ্ক বিশ্বাসে মাথা নোয়ায় কদমবুসি করার জন্য।

ফজল তার দুই বাহু ধরে টেনে তোলে। ফিসফিসিয়ে বলে, নানা জরু, আমার পায়ে হাত দিও না। আমি–আমি পাপী, আমি ডাকাইত। তার কণ্ঠে কান্নার রেশ কেঁপে কেঁপে ওঠে।

না–না, মিছা কথা–মিছা কথা।

জরিনা তার হাত ধরে কাশবনের দিকে যেতে যেতে বলে, আমার হাউড়ি আছে ঘরে। টের পাইয়া যাইব।

জরু, তুমি তো কইলা মিছা কথা। কিন্তু মাইনষে কয় আমারে ডাকাইত। রূপজান– সেও কয় আমারে ডাকাইত। ফজলের কথায় কান্না ঝরে পড়ে।

জরিনার চোখে পানি আসে। ধরা গরায় সে বলে, আমি বেবাক হুনছি। আরশেদ মোল্লা যোগ দিছে জঙ্গু শয়তানডার লগে। ওরাই তোমারে ধরাইয়া দিছে।

হ, এর শোধ নিয়া ছাইড়া দিমু। শোধ নেওনের লেইগ্যাই পলাইয়া আইছি জেলেরতন। জেলেরতন! কবে পলাইছ?

কাইল রাইতে। পলাইয়া যাইতে আছিলাম দক্ষিণপাড়। বিষ্টির লেইগ্যা পাড়ি দিতে পারি নাই।

বাড়ি গেছিলা?

না।

খাইছ কনুখানে?

খাই নাই। কোথায় খাইমু? সাথে একটা পয়সাও নাই।

এতক্ষণ কও নাই ক্যান্। জলদি বাড়িত্ লও।

তুমি কি ভাত রাইন্দা থুইছ নি?

না, দুইডা চাউল ফুডাইতে বেশি দেরি লাগব না। কিন্তু খাইবা কি দিয়া? মাছ-তরকারি কিছু নাই।

ডাইল আছে?

আছে।

তবে খিচুড়ি পাকাইতে পারবা?

তা পারমু।

বেশি কইর‍্যা খিচুড়ি পাকাও। সাথে নৌকায় মানুষ আছে আর একজন। আর আণ্ডা থাকলে ভাইজ্যা দিও।

কে আছে নায়?

তুমি চিনবা না তারে। মস্ত বড় একজন বিদ্বান মানুষ।

ফজলের হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যায় জরিনা। তাকে রান্নাঘরে বসিয়ে সে ঘরে যায়। মাটির ঘড়া থেকে চলে বের করে, শিকেয় তোলা ডিবা থেকে বের করে ডাল।

কি ঘুডুঘুডু করতে আছস বউ? পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করে শাশুড়ি।

এই ডাওরের মইদ্যে খিচুড়ি খাইতে মন চাইতে আছে। অল্প দুগা ভাত আছে। পানি দিয়া থুই। পান্তা খাইমু।

শাশুড়ি বলে, হ, বিষ্টি-বাদলের দিনে গরম গরম খিচুড়ি ভালোই লাগে। আমি উঠমু?

না, আপনি আন্ধারে হুইয়া থাকেন। রাইন্দা বাইড়া আপনেরে ডাক দিমু।

জরিনা এক হাতে কুপি অন্য হাতে হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে যায়।

কুপির মৃদু আলোয় এতক্ষণ পরে সে প্রথম দেখতে পায় ফজলের মুখ। দাড়ি-গোঁফে বদলে গেছে চেহারা। খিদেয় শুকিয়ে গেছে মুখ। চোখ বসে গেছে। গায়ের উজ্জ্বল রঙ গেছে ফ্যাকাশে হয়ে। মাথায় এলোথেলো চুল। বহুদিন তেল-পানি না পড়ায় জট পাকিয়ে গেছে।

জরিনা নির্বাক চেয়ে থাকে ফজলের মুখের দিকে। পলকহীন দৃষ্টি মেলে ফজলও তাকায়। গোধূলির বিষণ্ণ ছায়া জরিনার মুখে। মমতা-মাখা দুটি চোখের কোণে চিকচিক করে পানি।

জরিনা চোখ নামায়। চাল-ডাল ধুয়ে বাটনা বেটে সে তাড়াতাড়ি রান্না চড়িয়ে দেয়।

জরিনা চুলোর মুখে লাকড়ি গোঁজে। তার পাশে পিড়েতে বসে চাল চিবোয় ফজল।

অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙে জরিনা। সে নিচু গলায় বলে, মিয়াজির মরণের পর গেছিলাম তোমাগ বাড়ি। আম্মার কান্দন দেইখ্যা কইলজা ফাঁইট্যা যায়। মরণের দিন মিয়াজি তোমারে দ্যাখতে চাইছিল। মরার আগক্ষণে দুই-তিন বার তোমার নাম ধইর‍্যা বোলাইছিল।

ফজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

জরিনা এক সময়ে ঘরে গিয়ে নারকেল তেল আর চিরুনি নিয়ে আসে। চিরুনি চালিয়ে সে ফজলের চুলের জট ছাড়ায়, তারপর তেল মাখিয়ে আঁচড়ে দেয়, সিঁথি কেটে দেয় পরিপাটি করে।

হেকমত কই? জিজ্ঞেস করে ফজল।

কোনো খবর নাই। মাসখানেক আগে আইছিল একদিন রাইতে। আবার রাইতের আন্ধারেই চইল্যা গেছে।

মোল্লাবাড়ি গেছিলা?

গেছিলাম একদিন। তোমারে যেদিন ধরাইয়া দেয় তার কয়েকদিন আগে।

কাইল-পরশু একবার যাইতে পারবা?

উঁহু।

ক্যান?

জরিনা কোনো উত্তর দেয় না।

আগে রূপজান তাকে বড় গলায় বু’জান বলে ডাকত, হাসি-মশকরা করত কথায় কথায়। সে তার চুল আঁচড়ে খোঁপা বেঁধে দিত। রূপজানকে সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরতে শিখিয়েছিল সে-ই। রূপজানের বিয়ের পর জরিনা ধান ভানতে গিয়েছিল মোল্লাবাড়ি। রূপজান তার কানে কানে বলেছিল, বু’জান লো, তোমার ছোডকালের পুরুষটা জ্বালাইয়া মারে আমারে। রাইতে এট্টুও ঘুমাইতে দেয় না। সেই রূপজান বদলে গেছে এখন। সেদিন কাজের খোঁজে গিয়ে কাজ তো জোটেইনি, ভালো ব্যবহারও পায়নি সে। রূপজান তাকে সোজা বলে দিয়েছে, আমাগ ধান ভান লাগব না। আর কোনোদিন আইও না আমায় বাড়ি। তারপর জরিনা আর যায়নি সে বাড়ি, আর যেতেও চায় না। তার বিশ্বাস, রূপজান কিছু টের পেয়েছিল।

কইলা না, ক্যান যাইতে পারবা না? ফজল আবার জিজ্ঞেস করে।

কি করতে যাইমু?

গিয়া রূপজানরে খালি জিগাইবাসে ডাকাইতের ঘর করব না–এমুন কথা ক্যান্ কইল? সত্য সত্যই কি সে বিশ্বাস করে আমি ডাকাইত?

এহন আর এই কথা জিগাইয়া লাভ কি?

লাভ নাই। খালি মনরে বুঝ দিতে চাই। রূপজান আমারে ডাকাইত মনে করে, ঘিন্না করে–এই কথা ভাবলেই মনে অয় কে যেন অন্তরডারে টাটা দিয়া খোঁচায়।

আইচ্ছা যাইমু একদিন। উড়কি দিয়ে খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বলে জরিনা।

কিছুক্ষণ পরে খিচুড়ি নামিয়ে সে ডিম ভাজে। খাবার পরিবেশন করার আয়োজন দেখে ফজল বলে, নায়ের মইদ্যে আমার মতো ভুখা আছে আর একজন। তারে থুইয়া খাইতে একটুও মজা লাগব না।

তোমার কাছে বইয়া তোমারে কোনো দিন খাওয়াইতে পারি নাই। আশা করছিলাম–

জরিনার কথা শেষ না হতেই মুচকি হেসে ফজল বলে, হ, শেষে কইতে পারবা, আর এক বাড়ির ছ্যামড়াডা বেশি বেশি খাইয়া ফালাইল।

হাসি ফোটে জরিনার মেঘাচ্ছন্ন মুখে। ফজল বলে, সামনে বহুত দিন পইড়া রইছে। খাওয়ানের অনেক সুযোগ পাইবা। সত্য কও তো? আইবা তো আবার?

হ, আইমু।

কবে আইবা?

আইমু একদিন।

না, কইয়া যাইতে অইব।

তিন-চার দিন পর।

আমার মাথা ছুঁইয়া কও।

মাথা ছুঁয়ে ফজল বলে, এই কইলাম। এইবার বিদায় দ্যাও। মতিভাই খিদায় মরতে আছে।

জরিনা কিছুটা খিচুড়ি রেখে বাকিটা হাঁড়িশুদ্ধ তুলে দেয় ফজলের হাতে। ডিম ভাজা রাখে শরার ওপর। তারপর বলে, পাতিলডা গাঙের পাড়ে কাশঝোঁপের মইদ্যে থুইয়া যাইও। কাইল বিচরাইয়া লইয়া আইমু।

ফজল রওনা হয়। জরিনা তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, হাত রাখে তার পায়ে। ফজল তার মাথায় হাত বুলায়।

.

রাত্রে জোর বৃষ্টি হয়েছিল আর এক ঢলক। ভোররাত্রে নৌকার পানি সেচে পাড়ি দেয় ফজল। ভোর হওয়ার আগেই তারা দক্ষিণপাড় পৌঁছে যায়। ফজল তীরে নামে। তার হাত ধরে নামে মতি।

নৌকাটা বাঁধবার দরকার নেই। মতি বলে।

ভাসাইয়া লইয়া যাইব তো!

যাকগে। নৌকার দামটা দূরের কোনো পোস্টাপিস থেকে বেনামিতে মানি অর্ডার করে দিলেই হবে।

কার নামে মানি অর্ডার করবেন? মাঝির নামতো জানি না?

থানার দারোগার কাছে পাঠালেই মাঝি পেয়ে যাবে টাকাটা। নৌকার নম্বরটা লিখে দেব। নৌকা চুরির পর মাঝি নিশ্চয়ই থানায় গিয়ে এজাহার দিয়েছে।

আইচ্ছা! এখন কোন দিগে যাইবেন?

গাঁয়ের পথ ধরে সোজা দক্ষিণ দিকে চলতে থাকো। কিছুদূর গেলেই একটা চক পড়বে।

মতির হাত ধরে এগিয়ে যায় ফজল। চকে পৌঁছতে পৌঁছতে ফরসা হয়ে যায়।

চকের জায়গায় জায়গায় জমে আছে বৃষ্টির পানি। তারা ধান আর পাটখেতের আল ধরে পা চালায়। ধান আর পাট গাছের ঝরা পানিতে ভিজে যায় তাদের জামা-কাপড়।

ছড়ছড় আওয়াজ শুনে পাশের দিকে তাকায় ফজল।

আরে কই মাছ! বিষ্টিতে কই মাছ উজাইছে মতিভাই!

ধরো।

ফজল তিনটে কইমাছ পায় ধানখেতের মাঝে। মাছের কানকোর ভেতর পাটের কোষ্টা ঢুকিয়ে সে ঝুলিয়ে নেয় হাতে। চকের শেষ মাথায় পৌঁছতে পৌঁছতে গোটা পনেরো কইমাছ কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এক হালটের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পাওয়া যায় আরো সাতটা। সবগুলোকে সে কোষ্টায় গেঁথে নেয় মালার মতো করে।

মতি বলে, আজ খাওয়াটা খুব জমবেরে ফজল।

হ, আল্লা খুব মেহেরবান।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। মতি হাসে। কিন্তু এই মেহেরবানিটা গতকাল জাহির করলেই ভালো করত আল্লা। কাল খিদের জ্বালায় যখন কষ্ট পাচ্ছিলাম তখন অত বিষ্টি না ছিটিয়ে আমাদের নৌকায় কিছু চিড়ে-মুড়ি ছিটিয়ে দিলে বুঝতাম আল্লা খুব মেহেরবান। তাহলে কি আর খিচুড়ি মেগে খেতে হতো কাল?

পথের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা গন্তব্যস্থানে গিয়ে পৌঁছে।

বহু বছর পরে ভাইকে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলে বোন।

.

১৮.

মতির বোনের বাড়ির তিনদিন ছিল ফজল। এমন একটি স্নেহের আশ্রয় ছেড়ে আসবার সময় চোখ তার ছলছল করে উঠেছিল। তার নিজের বড় বোন নেই। সে অভাব পূরণের জন্যই বোধ হয় মতিভাইয়ের সাথে এমন করে দেখা হয়েছিল তার।

চণ্ডীপুর থেকে নৌকা কেরায়া করে সে বাড়ি রওনা হয়। বাড়ির ঘাটে পৌঁছতে রাত হয়ে যায় বেশ। জেল থেকে পালাবার পর রাতের অন্ধকারে চলাফেরা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।

ফজল ছই-এর ভেতর থেকে বেরোয়।

বাড়িটা অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু অন্ধকারটা যেন বড় বেশি মনে হয় তার কাছে। বাড়ির সূর্য ডুবে গেছে, তাই বুঝি এত অন্ধকার।

ফজলের দুচোখ অশ্রুতে ভরে যায়। সে নৌকার ভাড়া মিটিয়ে ঘাটে নামে। দুঃসহ বেদনায় ভরাক্রান্ত দেহটা বয়ে নিয়ে চলে পা দুটো। কিন্তু পায়ের নিচের মাটিতে যে আশ্বাস নেই, ভরসা নেই।

চলতে চলতে তার মনে আবার সেই ভয় জাগে; তাকে দেখেই বাড়ির সবাই কান্না জুড়ে দেবে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাপ করতে শুরু করবে। তা শুনে তার বাড়ি আসার কথা জেনে ফেলবে আশপাশের লোকজন। জেনে ফেলবে জঙ্গুরুল্লা আর আইনের মানুষ চৌকিদার আর দফাদারও।

ফজল দাঁড়ায়। ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে সে ডানে বায়ে দৃষ্টি ফেলে। কিছু দূরেই দেখতে পায় তার পিতার কবর।

সে হাঁটু গেড়ে বসে কবরের পাশে। তার বুকের কান্না রুদ্ধ কণ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চায়। বেরিয়েও যায় দু-একবার। কান্নার বেগ রোধ করা যখন কঠিন হয়ে পড়ে তখন সে মুখটাকে শক্তহাতে চেপে ধরে নদীর কিনারায় ফিরে আসে। সেখানে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলে অনেকক্ষণ। কিছুটা শান্ত হলে চরের কিনারা ধরে সে এগিয়ে যায় পশ্চিম দিকে মেহের মুনশির বাড়ি।

দু-তিনবার দরজায় খটখট দেয়ার পর মেহের মুনশির ঘুম ভাঙে। আচমকা ঘুম ভেঙে সে চেঁচিয়ে ওঠে, কে? কেডা ও?

আমি। আমি ফজল।

ফজল, আহারে ভাই, আইছ তুমি! কান্নাঝরা কণ্ঠে বলে মেহের মুনশি। থিতিয়ে আসা শোক আলোড়ন তোলে তার বুকের ভেতর। নিজেকে সামলে নিয়ে সে কুপি জ্বালায়। ঘর থেকে বেরিয়ে ফজলকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, তোমার লেইগ্যা চিন্তায় জারাজারা অইয়া গেছি আমরা। চাচিজি কাইন্দা চউখ অন্ধ কইর‍্যা ফালাইছে।

উদগত শোকাবেগ অনেক কষ্টে সংবরণ করে ফজল বলে, মা-র কান্দাকাডির ডরে বাড়িতে যাই নাই। কান্দাকাডি শুনলে সব মানুষ টের পাইয়া যাইব।

মেহের মুনশি তার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। চৌকির ওপর বসিয়ে বলে, বাড়িত না। গিয়া ভালোই করছ। গেল রাইতের আগের রাইতে পুলিস ঘেরাও করছিল তোমায় বাড়ি। কিন্তুক।

আমি জিগাই, তোমারে এই অলক্ষ্মীতে পাইল ক্যান? জেলেরতন ক্যান্ পলাইয়া আইছ?

পলাইয়া আইছি শোধ নিতে। জঙ্গুরুল্লার লগে দোস্তালি পাতাইছে আরশেদ মোল্লা। হ, পা-না-ধোয়ার পাও ধইর‍্যা আরশেদ মোল্লা বিশ নল জমি পাইছে খুনের চরে।

জমিডা ভালো কইর‍্যা খাওয়াইয়া দিমু। সবুর করেন মিয়াভাই। এই দুইডারে জবাই করতে না পারলে আমার রক্ত ঠাণ্ডা অইব না।

কিন্তুক খুনাখুনি কইর‍্যা কি ফয়দা অইব?

এই দুই জানোয়ারের লাশ পচাইয়া সার বানাইমু চরের মাডির। ওগ হারামিহয়রানির লেইগ্যাই বাজান মারা গেছে, না অইলে বাজান এত তাড়াতাড়ি মরত না।

হ ঠিক কথাই কইছ। কিন্তুক–

আপনে আর কিন্তু কিন্তুক’ কইরেন না তো মিয়াভাই। আপনে বুড়া অইয়া গেছেন। আপনের রক্তে তেজ নাই। আমার রক্ত যে টগবগ করতে আছে রাইতদিন।

আমার কথা হোন ফজল। খুন-জখমি কইর‍্যা আরো বিপদ অইব। মামলামকদ্দমা। জেল-ফাঁসি–

জেল-ফাঁসিরে আর ডরাই না, মিয়াভাই। জাহান্নামি দুইডারে খুন না করতে পারলে আমার পরান ঠাণ্ডা অইব না। ওরা জাহান্নামি। ওগ মাপ করলে জাহান্নামে যাইতে অইব।

চর দখলের কি করবা?

চর দখল করতে অইব। আপনেরা একজন মাতবর ঠিক করেন। তারপর—

মাতবর ত তুমি।

আপনে একলা কইলে তো অইব না। সব্বাই যদি না মানে তবে আর কিসের মাতবর।

মানব না ক্যান। বেবাকে মানব।

কিন্তু আমি তো এখন ফেরার। ডুব দিয়া রইছি। যদি কোনোদিন ভাসতে পারি তখন না হয় আমারে মাতবর বানাইবেন। এখন কারোরে মাতবর ঠিক করেন। পলাইয়া পলাইয়া যতখানি পারি ততখানি সাহায্য আমি করমু। কিন্তু আমি চরে আইছি এই খবর যেন কেও না জানে।

না, একটা কাউয়ার কানেও যাইব না এই কথা। কিন্তু একবার চাচির লগে দেহা করণ তোমার দরকার।

মা যেই রহম কান্দাকাডি করে। বেবাক মানুষ টের পাইয়া যাইব। চৌকিদার-দফাদার টের পাইয়া খবর দিব পুলিসের কাছে।

হোন, আমি ভোরে গিয়া চাচিজিরে বুঝাইমু। কান্দাকাডি করতে মানা করমু। আর যদি কান্দতে চায় তয় যে কাইল দিনের বেলায়ই কাইন্দা লয় কতক্ষণ। তারপর রাইতের বেলা তোমারে লইয়া যাইমু।

হ তাই করেন।

আরে খালি কথা আর কথাই কইতাছি। তোমার খাওনের কথা জিগাইতে মনে নাই।

উঁহু, আমার খাওয়া লাগব না। নতুন বইন পাইছি একজন। পথে খাওনের লেইগ্যা মুড়ি, নারকেলের লাড়ু আর ফজলি আম দিছিল।

কে এমুন বইনডা।

আপনে চিনবেন না। মায়ের পেডের বইনের মতন।

আইচ্ছা, আমি বিছান কইর‍্যা দিতাছি। ঘুমাইয়া পড় জলদি। রাইত দুফর কাবার অইয়া গেছে।

মেহের মুনশির ভেঁকিঘরের এক পাশে শুকনো লটাঘাসের স্থূপ। বর্ষার সময় এগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্কুপের আড়ালে হোগলার বিছানায় একটা পুরো দিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয় ফজল। তার মনের ভেতর পদ্মার স্রোতের মতো আঁকা-বাঁকা চিন্তা বয়ে চলে। বাবা, মা, আমিনা, নূরু, স্বার্থপর রূপজান, দুঃখিনী জরিনা সবাই এসে বারবার নোঙর। ফেলে সেই স্রোতে। কখনো সে স্রোত ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি করে। তার মাঝে ঘুরপাক খায়। আরশেদ মোল্লা আর জঙ্গুরুল্লা। ফজলের মনের বিক্ষুব্ধ ঢেউ আছড়ে পড়ে তাদের ওপর।

সন্ধ্যার অনেক পরে মেহের মুনশির সাথে সে বেরোয়। বাড়ির উঠানে পৌঁছতেই নূরু ছুটে এসে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। বরুবিবি শব্দ পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেহের মুনশি ধমক দিয়ে তাকে বিপদের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে থামে। ফজলও অনেক কষ্টে সংবরণ করে নিজেকে।

সে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। তাদের রুদ্ধ কান্না বুক ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। কখনো সে কান্না ফুঁপিয়ে বেরোয়। তাদের গাল বেয়ে নামে অশ্রুর প্রপাত।

বরুবিবি ফজলের মুখে মাথায় হাত বুলায়। মা ও ছেলে দুজনেই বড় বেশি অভিভূত হয়ে পড়েছে। কারো মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোয় না।

মেহের মুনশির তাড়া দেয়, ও চাচি, বেশি দেরি করণ যাইব না। কিছু খাওয়াইতে মন চাইলে জলদি কইর‍্যা খাওয়াইয়া দ্যাও।

ফজল বাড়ি আসবে খবর পেয়ে অনেক পদ রান্না করেছিল বরু বিবি। আমিনা খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু ফজলের গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। সে শুধু চিবোয়। কয়েক গ্রাস মুখে তুলে এক গ্লাস পানি খেয়ে সে উঠে পড়ে।

বরুবিবি ঝাঁপসা চোখ মেলে চেয়ে থাকে ছেলের দিকে, ধরা গলায় বলে, কিছুই তো খাইলি না বাজান?

না মা, খিদা নাই একদম! এইখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। আমি যাই।

বরুবিবি আবার ফোঁপাতে শুরু করে।

তুমি কাইন্দ না মা। আমি ধারে কাছেই কোনো জায়গায় থাকমু। কারো কাছে কইওনা কিন্তুক। ও আমিনা, ও নূরু খবরদার!

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে মেহের মুনশির সাথে বেরিয়ে পড়ে ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে।

.

জরিনাকে যখন কথা দিয়ে গেছে ফজল, তখন নিশ্চয়ই সে আসবে। সে জেল থেকে পালিয়েছে। তার এখন আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু ঘরে রয়েছে শাশুড়ি। তাকে দূরে কোথাও পাঠাতে না পারলে কেমন করে তার ঘরে ফজলকে সে জায়গা দেবে? তাই সে একদিন একটা বাহানা তৈরি করে, আম্মা আপনের শরীলডা খুব কাবু অইয়া গেছে।

বুড়া মানুষ। কাবু অইলে আর কি করমু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাজুবিবি।

আমিতো আপনেরে প্যাড ভইরা দুইডা খাইতেও দিতে পারি না। আর যেই দিনকাল পড়ছে। ধান ভানতে বড় বেশি ডাক দেয় না কেও। চাউলের কল অওনে এই দশা। ঘর লেপন আর চিড়া কোডনের কামে আয় নাই।

হগো মা। দিন-কাল বড় খারাপ পড়ছে। তুই আমার প্যাডের মাইয়ার তনও বেশি। যারে পেডে রাখছিলাম, হেই লক্ষ্মীছাড়াডা একটা পয়সাও দেয় না। তুই না থাকলে এতদিনে মইর‍্যা যাইতাম।

আম্মাগো, এহন বুঝি না খাইয়া মরতেই অইব। আপনে এক কাম করেন–আপনের বইনের বাড়ি বেড়াইতে যান কয়ডা দিনের লেইগ্যা। ভাল-ভালাই খাইয়া আহেন। আপনের শরীলডাও ভালো অইব আর এদিগে ঘরে কিছু চাউল-ডাইলও জমা অইব।

বেড়াতে যাওয়ার নামে নাজুবিবির ঠ্যাঙ দুটো ডিলিক দিয়ে ওঠে সব সময়। বউ একা ঘরে থাকবে বলে বেড়াবার শখ চেপে রাখতে হয় তাকে। এখন বউয়ের কাছ থেকেই যখন প্রস্তাব এসেছে বেড়াতে যাওয়ার তখন সে মনে মনে খুশি হয়। মুখে বলে, কিন্তু আমি গেলে তুই ঘরে একলা থাকবি ক্যামনে?

আমার লেইগ্যা চিন্তা কইরেন না। যেই বাড়ি কাম করতে যাইমু, হেইখানেই থাকতে পারমু আমি।

নাজুবিবি পরের দিনই তার বোনের বাড়ি চর-কানকাটা চলে যায়।

জেল-পালানো আসামি রাতের আঁধারেই আসবে–বুঝতে পারে জরিনা। তাই দিনের বেলা যেখানেই থাকুক, যে কাজেই থাকুক, বেলা ডোবার আগেই সে বাড়ি ফিরে আসে।

ফজল কাজির ভাত খুব শখ করে খায়। জরিনা তাই কাজি পেতে রেখেছে। পানিভরা। মাটির হাঁড়িতে ফেলে রাখা হয় যে চাল তারই নাম কাজি। কাজির ভাত খেতে যে সব অনুপান উপকরণের দরকার তারও কিছু কিছু সে যোগাড় করে রেখেছে। লশকর বাড়ি থেকে চেয়ে এনেছে মুঠো খানের মেথি আর কালিজিরা। এগুলো খোলায় টেলে বাটা হবে। নদীতে গোসল করার সময় শাড়ির আঁচল দিয়ে ধরেছে ছোট ছোট মাছ–চেলা আর খরচান্দা। অল্প কয়েকটা মাছ এক দিনেই যা পেয়েছিল। পরের দিন এ মাছ ধরবার সময় ভটভট আওয়াজ তুলে যাচ্ছিল একটা কলের নৌকা। যাচ্ছিল বেশ কিছু দূর দিয়েই। হঠাৎ ওটা মোড় নেয় কিনারার দিকে। জরিনা জাবড়ি দেয় পানির ভেতর। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয় শরীর। আঁচল ঠিক করে গায়ে জড়ায়, ঘোমটা টানে। দুটো ধলা মানুষ শিষ দিচ্ছিল। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে দেখে পাঁচ কি দশ টাকার কয়েকটা নোট দেখিয়ে কুৎসিত ইশারা করছে একটা বাঁদরমুখো।

জরিনা পাড়ে উঠে একদৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। তারপর থেকে নদীর ঘাটে যাওয়ার আগে চারদিক ভালো করে দেখে নেয় সে।

সেই চেলা আর খরচান্দা মাছ কয়টা শুঁটকি দিয়ে রেখেছে জরিনা। শুঁটকি মাছের ভরতা কব্জির ভাতের এক বিশেষ অনুপূরক।

পুরানো দুটো চাই ছিল ঘরের বেড়ায় টাঙানো। সে দুটোর পেটে সুতোয় গাঁথা ফড়িংয়ের টোপ ভরে সে লটা ঝোঁপের আড়ালে পেতে রাখে রোজ বিকেল বেলা। ভোরে উঠিয়ে তার ভেতর পায় পাঁচ-সাতটা করে ছোট আণ্ডালু চিংড়ি। তিন-চার দিনে অনেকগুলো হয়েছে। সবগুলোই সে জিইয়ে রেখেছে একটা পানিভরা বৌকার ভেতর। রান্নাঘরের চালে বিছিয়ে রয়েছে ফনফনে পুঁই লতা। পুঁই-চিংড়ির চচ্চড়ি ফজলের খুব প্রিয়।

খালাসিবাড়িতে ধান ভেনে সেদ্ধ চালের বদলে আতপ চাল চেয়ে এনেছে জরিনা। এ চাল পাটায় বেটে আর কিছু না হোক কয়েকটা চিতই পিঠা বানিয়ে ফজলের সামনে দিতে পারবে সে। ঘরে গুড় আছে। এখন একটা নারকেল যোগাড় করতে হবে যেভাবে হোক।

তিন-চার দিন পরে আসবে বলেছিল ফজল। কিন্তু সাত দিন পার হয়ে গেছে সে এল না। জরিনার একবার মনে হয়, সে আর আসবে না। পরক্ষণেই আবার মনে হয়–পুলিসের ভয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে হয়তো। সেখান থেকে বেরুতে পারছে না।

জরিনা চাঁই দুটো নিয়ে নদীর পাড়ে যায়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্যের গায়ে এক ফালি মেঘ বিধে রয়েছে বর্শার ফলার মত। সে আঘাতে সূর্যের রক্ত যেন ছড়িয়ে পড়েছে টুকরো টুকরো মেঘের ওপর।

শাড়িটাকে কোমরে গুঁজে হাঁটুর ওপর তুলে নেয় জরিনা। তারপর পানিতে নেমে চাইদুটো লটা ঝোঁপের ভেতর পেতে রাখে।

ডাঙায় উঠেই তার চোখে পড়ে একজোড়া বক। বকদুটো পাখা ঝাড়ছে, ঠোঁট দিয়ে একে অন্যের পালকে বিলি দিচ্ছে। আজকের মতো শেষ হয়েছে ওদের মাছ শিকার। এখন রাতের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বগা উড়ে এসে তাড়া করে জোড়ের বগাটাকে। ওটাকে অনেক দূর হটিয়ে দিয়ে সে বগির দিকে আসে এবং গলা বাড়িয়ে ঠোঁট নেড়ে সোহাগ জানায়। বগিটা উড়াল দিয়ে ওর ভীরু দুর্বল সঙ্গীর কাছে চলে যায়। শক্তিশালী বগাটা আবার আক্রমণ করার আগেই বগা আর বগি সোজা দক্ষিণ দিকে উড়ে চলে যায়।

পলকহীন চোখ মেলে জরিনা চেয়ে থাকে উড়ন্ত বক-জোড়ার দিকে। ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে সে ঘরের দিকে রওনা হয়।

আবার ফজলের চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় তার মন। তাকে পুলিস ধরে নিয়ে যায়নি তো?

জরিনার বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। চোখের কোণে চকচক করে পানি।

হঠাৎ তার মনে হয়, বেগানা পুরুষের জন্য এমন করে চিন্তা করা তার অন্যায়। ঘোর অন্যায়। নিজের স্বামীর জন্য সে-তো এমন করে ভাবে না। তার স্বামী ফেরার। পুলিসের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কি খায়, কোথায় থাকে, ঠিক-ঠিকানা নেই। তার জন্য তো একফোঁটা পানিও ঝরে না তার চোখ থেকে।

হঠাৎ দরদর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার দু’গাল বেয়ে।

এ অশ্রু কার উদ্দেশে তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন বোধ করে না জরিনা। তার মনের অপরাধবোধটাই এখন সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে।

আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে পাশের চর থেকে। শিথিল আঁচল টেনে মাথায় দেয় জরিনা। ঘরে গিয়ে কুপি জ্বালে। নামাজ সে কদাচিৎ পড়ে। কিন্তু আজ হঠাৎ নামাজ পড়ার তাগিদ অনুভব করে সে তার মনের ভেতর।

সে অজু করে নামাজের জন্য দাঁড়ায়। অজু করা সত্ত্বেও কেমন না-পাক মনে হয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সারা শরীর ছেয়ে রয়েছে কেমন এক অশুচিতা।

একটা মাত্র ভালো শাড়ি আছে তার। গোলাপী রঙের সেই শাড়িটাই তার পরনে। আজই ওটা বাক্স থেকে নামিয়ে ধোয়া হয়েছিল। এ পরিষ্কার শাড়িটাই তার কাছে নাপাক মনে হয়।

জরিনা শাড়িটা খুলে তালিমারা একটা শাড়ি পরে। আবার অজু করতে বসে প্রথমেই সে চোখের কাজল পানি দিয়ে ঘষে মুছে ফেলে। নখ দিয়ে আঁচড়ে তোলে কপালের টিপ। যত্ন করে বাঁধা খোঁপাটাও খুলে ফেলে সে।

নামাজের শেষে সে মোনাজাত করে, আল্লাহ তুমি রহিম, তুমি রহমান। আমার গুনা তুমি মাপ কাইর‍্যা দ্যাও আল্লা। আমার শরীলের গুনা, মনের গুনা, চউখের গুনা মাপ কইর‍্যা দিও আল্লাহ্। রাববানা আতেনা ফিদুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখেরাতে হাসানাতাও

ওয়াকেনা আজাব আন্-নার। আমিন।

অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে চরের বুকে। জরিনা বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। চলন্ত নৌকার পালগুলো অস্পষ্ট হতে হতে দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। চাঁদহীন আকাশে তারার মহোৎসব।

আজ আর রান্না-বান্নার প্রয়োজন নেই। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সে ধান ভেনেছে। গাজিবাড়ি। দুপুরে সেখানেই খেয়েছে। আজ রাতে তার না খেলেও চলবে।

জরিনা ঘরে গিয়ে কুপি নিবিয়ে শুয়ে পড়ে। গত তিনচার দিন কুপি জ্বালিয়ে সে অনেক রাত পর্যন্ত বসে কাটিয়েছে। নষ্ট করেছে যুদ্ধের বাজারের দুষ্প্রাপ্য কেরোসিন। সে কয়দিনের উনা ঘুমের জন্য এখন দুনা ঘুমের প্রয়োজন। আজ আবার সারাদিন খুব খাটুনি গেছে। এ অবস্থায় শুতে না শুতেই চোখ বুজে আসার কথা। কিন্তু চোখ বুজেও ঘুম আনতে পারছে না জরিনা। সে নামাজে বসে মনের যেসব গুনা, অবাঞ্ছিত ভাবনা-চিন্তা, কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে এসেছিল, তাড়িয়ে দিয়েছিল উড়তে সক্ষম পাখির ছানার মতো, সেগুলো এখন ফিরে আসতে চাইছে মনের নীড়ে।

এশার নামাজের আজান শুনে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে জরিনা। কুপি জ্বালে। অজু করে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ শেষ করে মোনাজাতের জন্য হাত উঠায়, আল্লা সব গুনা মাপ করো।

আল্লা। শরীলের গুনা মনের গুনা, চউখের গুনা–সব গুনা–’

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট।

জরিনার প্রার্থনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। সে তাড়াতাড়ি কুপিটা নিবিয়ে আবার শুরু করে, আল্লা আমার সব গুনা মাপ করো। রাব্বানা আতেনা ফিদদুনিয়া

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট….

রাব্বানা আতেনা ফিদ্দুনিয়া-মোনাজাতের পরেরটুকু আর মনে আসছে না তার। কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকমে সে ‘আমিন’ বলে মোনাজাতের হাত বুলায় চোখে ও কপালে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ-হট।

জরিনা কানে আঙুল দেয়। কিন্তু তবুও সে স্পষ্ট শুনছে, বারবার শুনছে হট্টিটির ডাক। তার মনের তারে ঝঙ্কার দিয়ে উঠছে যে টি-টি ডাক, তাই বুঝি শুনছে সে।

জরিনা ঘর থেকে বেরোয়। ডাকটা অনেক কাছে শোনা যাচ্ছে এখন। সে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরের পেছনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

টিঁ-টিঁ-টিঁ আর শোনা যাচ্ছে না এখন। তবে কি ফজল চলে গেল? ভাবে জরিনা। যাক চলে যাক। আল্লায় যেন তার মুখ আর না দেখায়।

অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শোনা যায়। জরিনা রান্নাঘরের কোণের দিকে গিয়ে উঁকি মারে। একটা মূর্তি উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ঠায়।

কিছুক্ষণ পরে মূর্তিটা নড়েচড়ে ওঠে। এগিয়ে গিয়ে দরজার ওপর টোকা দেয় কয়েকবার। কোনো সাড়া না পেয়ে ভেজানো দরজাটা খোলে। ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই। মেঝেতে বিছানা পাতা। বালিশের পাশে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়ে রয়েছে।

সে দরজাটা ভেজিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিড়ি ধরায়। সে সময়ে দেশলাইর আলোয় এক লহমার জন্য ফজলের মুখ দেখতে পায় জরিনা। তার অন্তরের। স্নেহ-মমতা শাসন-শৃঙ্খলা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফজল রওনা হয়। জরিনার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে বুকটা যেন তার রিক্ত হয়ে যায়।

কিছুদূর গিয়েই ফজল ফিরে আসে। তার পায়ের মৃদু শব্দে জরিনার বুকের হাহাকার থামে।

ফজল ঘরে গিয়ে ম্যাচবাতি জ্বালিয়ে কুপি ধরায়। ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে সে বুঝতে পারে, খাবার হাঁড়ি-পাতিল এ ঘরে রাখা হয় না।

কুপি হাতে সে রান্নাঘরে যায়। সব হাঁড়ি-পাতিল চুলোর পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এক কোণে একটা পানির কলসি। তার পাশে একটা মাটির বৌকা বাঁশের চালুনি দিয়ে ঢাকা। ওটাও বোধহয় পানিভরা।

ফজল চালুনিটা সরিয়ে হাত দেয় বৌকার ভেতর। সাথে সাথেই ভয়ে সরিয়ে আনে হাতটা।

ব্যথায় উৎপীড়িত মুখেও হঠাৎ হাসি ফোটে জরিনার। রান্নাঘরের পেছন থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে সব কিছুই দেখছিল।

ফজল কুপিটি বৌকার মুখের কাছে নিয়ে দেখতে পায় চিংড়ি মাছ গিজগিজ করছে পানির ভেতর। সে বোকার মত হেসে ওঠে। ভাগ্যিস পান্তাবুড়ির মতো শিং মাছ জিইয়ে রাখেনি জরিনা।

কুপিটা নিবিয়ে সে বেড়া হেলান দিয়ে বসে থাকে। আহাদালীর ছোট্ট ডিঙি বেয়ে সে এসেছে। কেউ না দেখে সেজন্য ধানখেতের ভেতর ওটাকে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। এখন ওটা তুলে এত রাত্রে কার বাড়ি গিয়ে সে আশ্রয় নেবে?

খিদেয় চোঁ-চোঁ করছে পেট। ফজল কুপিটা জ্বালায় আবার। সে বৌকার ভেতর থেকে কয়েকটা চিংড়ি মাছ তোলে। জীবন্ত মাছগুলো ছট্‌কা মেরে ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। সে ওগুলোর খোসা ছাড়ায়। চিত্রা একটা হাঁড়ির ভেতর পানি ঢেলে মাছগুলোকে ভালো করে ধুয়ে নেয়। খুঁজেপেতে একটা চিমটা পাওয়া যায় বেড়ার সাথে গোঁজা। সেটার সাহায্যে একটা মাছ পাটখড়ির আগুনে ঝলসিয়ে সে মুখে দেয়। চিবোতে চিবোতে লবণের খোঁজ করে।

জরিনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তার বুকের ঝড় ছিন্নভিন্ন করে দেয় সব বাধা-বন্ধন। চোখের প্লাবনে ভেসে যায় সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সে চোখ মুছে ঘোমটা টেনে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের দরজায়।

ফজল চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তার মুখে মলিন হাসি ফুটতে ফুটতে মিলিয়ে যায় জরিনার চোখে পানি দেখে।

দু’জনেই দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরোয় না। নিজেকে সামলে নিয়ে ফজল বলে, ঘরে অতিথি আইলে মানুষ খুশি অয়। তোমার চউখে পানি দেইখ্যা মনে অয় তুমি খুশি অও নাই।

জরিনা নিরুত্তর। তার চোখের পানির উৎস কোথায় ফজল জানে। তাই পরিবেশটা স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে সে আবার বলে, তুমি খুশি অও নাই, কেমন?

না।

ফজল জানে এটা তার অন্তরের কথা নয়। সে খুশি হয়েছে এ কথা তার মুখ থেকে শুনবার জন্য সে আবার বলে, সত্য কইর‍্যা কও, তুমি খুশি আছ?

না।

তবে আমি চইল্যা যাই।

জরিনা কোনো উত্তর দেয় না। চুলোর পাশ থেকে সে ভাতের হাঁড়িটা তুলে নেয়। ঘর থেকে চাল এনে ধুয়ে বসিয়ে দেয় চুলোর উপর।

জানো জরিনা, চাউল বড় মাংগা অইয়া গেছে।

হ, আমিও হুনছি। তিন ট্যাহা মনের চাউল পাঁচ ট্যাহা অইয়া গেছে। চুলো ধরাতে ধরাতে বলে জরিনা।

দাম আরো বাড়ছে। আইজ দর উঠছে সাড়ে পাঁচ টাকায়।

মানুষ এইবার না খাইয়া দপাইয়া মইরা যাইব।

হ, এইবার কী যে উপায় অইব মানুষের, কওন যায় না। দুনিয়াজোড়া লড়াই চলতে আছে। চিনি পাওয়া যায় না। কেরোসিন পাওয়া যায় না–

জরিনা বৌকার ভেতর থেকে আরো কয়েকটা চিংড়ি মাছ তোলে। মাছ কুটতে কুটতে সে বলে, খুব খিদা লাগছে, না?

হ সাংঘাতিক–

খিদার চোডে মাছ পোড়াইয়া খাইতে শুরু করছিলা। পোড়া মাছ তো ভূতের ভোগ লাগে।

হ ভূতই অইয়া গেছি। আইজ পুলিস আইছিল। খুব তালাশ করছে। সারা দিন আছিলাম একটা পাটখেতের মইদ্যে।

ভাত ফুটতে বেশি দেরি লাগব না। তুমি চালের উপরতন কয়েকটা পুঁই এর আগা কাইট্যা আনো।

ফজল পুঁই-এর ডগা কেটে এনে দেয়।

রান্না শেষ হয়। চুলোর পাশে পিড়ি বিছিয়ে ফজলকে খেতে দেয় জরিনা। মাটির বাসনে ভাত বাড়তেই ফজল বলে, আমি আসছি বুইল্যা তুমি তো খুশি অও নাই। নিজের মোখেই তখন না করছ। বেখুশি মাইনষের ভাত তো মোখে দিতে ইচ্ছা করে না।

বেখুশি মাইনষেরে দিয়া ভাত তো রান্দাইয়া ছাড়ছ। এহন মোখে দিতে ইচ্ছা করব না। ক্যান? জরিনা মাছের সালুন দিতে দিতে বলে।

সত্য কইর‍্যা কও জরিনা, তুমি খুশি অইছ? না কইলে এই উইঠ্যা গেলাম আমি। ফজল সত্যি সত্যি উঠবার উদ্যোগ করে।

হ, খুশি অইছি। এইবার বিছমিল্লাহ করো।

তুমি খাইবা না?

আমি খাইছি। মিছে কথা বলে জরিনা।

আবার অল্প কইর‍্যা খাও আমার লগে।

যহন দিন আছিল, তহনই একসাথে খাওয়ার সযোগ পাই না। এহন আর–

পেটে খিদে নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করতে ভালো লাগে না ফজলের। সে গোগ্রাসে খেয়ে চলে আর জরিনা বেশি বেশি করে ভাত তরকারি তুলে দিতে থাকে তার পাতে।

মেঝেতে পাতা হোগলার ওপর একটা নকশি কাঁথা বিছিয়ে দেয় জরিনা। তেলচিটে বালিশের ওপর বিছিয়ে দেয় নিজের হাতের তৈরি গেলাপ। তারপর মশারি খাটাতে খাটাতে বলে, এইবার শুইয়া পড়। রাইত দুফর পার অইয়া গেছে।

তোমার বালিশ কই? তুমি শুইবা না?

উঁহু, আমি বইয়া পাহারা দিমু। জানোই তো চোরের বাড়ি। চৌকিদার-পুলিস আইতে পারে যে কোনো সময়।

পুলিস আইতে পারে! আঁতকে ওঠে ফজল। তবে তো এইখানে থাকন ঠিক না!

আগে আইতো ঘন ঘন চোরবক্সরে ধরতে। এহন কৃচিৎ কোনোদিন আহে।

কিন্তু আমি ঘুমাইমু আর তুমি সারা রাইত জাইগ্যা থাকবা? তার চাইতে দুই জনই জাইগ্যা থাকি না ক্যান্। কথা কইতে কইতে রাইত পোয়াইয়া যাইব।

অতীতের গর্ভে ডুবে যাওয়া নানা কথা, নানা স্মৃতি ভেসে উঠছে জরিনার মনেও। কিন্তু জরিনা এদের বেরুবার সুযোগ না দিয়ে বলে, উঁহু কথা কইও না আর। নিসাড় রাইতের কথা অনেক দূর থিকা হুনা যায়।

ফজল আর কথা বলে না।

জরিনা আবার বলে, হোন, পুলিস আইলে যদি পলাইতে না পার, তবে ঐ কোনায় খাড়াইয়া থাকবা। আমি তোমারে হোগলা দিয়া প্যাচাইয়া দিমু। কেও বুঝতেই পারব না।

হেষে দম ফাপর অইয়া মইরা যাইমু না তো!

উঁহু। মরবা না। চোরা ভাদামারে এই রহম কইর‍্যা বাঁচাইয়া দিছিলাম একদিন।

জরিনা দরজায় খিল লাগিয়ে নিজের জন্য নামাজের মাদুরটা বিছিয়ে নেয়। তারপর কুপটি ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে বসে পড়ে তার ওপর।

ফজল বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। রূপজানের কোনো খবর এখনো দেয়নি জরিনা। আর দিবে বলেও মনে হয় না। জরিনার বোধ হয় ভালো লাগে না রূপজানের নাম শুনতে। ফজলেরও তাই কেমন বাধোবাধো ঠেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। শেষে দ্বিধা কাটিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, মোল্লাবাড়ি গেছিলা?

না।

কোনো খবর আছে?

হোনলাম, রূপজানের নিকার কথা পাকা অইয়া গেছে।

নিকা! কার লগে?

ফুলপুরী মওলানার লগে।

অ্যাঁ! উত্তেজনায় চিড়বিড়িয়ে উঠে বসে ফজল। ঐ বুইড়ার লগে! ঐ পাকনা দাড়িওয়ালার লগে। রূপজান রাজি অইছে?

মাইয়ালোক রাজি অইলেই বা কি, না অইলেই বা কি।

বোঝলাম জঙ্গুরুল্লা আছে এর মইদ্যে। নিজের পীররে খুশি করণের কারসাজি।

ফজল দাঁতে দাঁত ঘষে। তীব্র ক্রোধে ফুলে ওঠে তার সারা শরীর। পেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে।

জরিনা চেয়ে আছে মশরির দিকে। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। শুধু শোনা যায় ফজলের ফুঁসে ওঠা শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ।

জরিনা তিনবার আয়াতুলকুরসি পড়ে আঙুল দিয়ে কুণ্ডলী দেয় তার চারদিকে আর মনে মনে প্রার্থনা করে, এই কুণ্ডলী ডিঙিয়ে দাগাবাজ শয়তান যেন তার কাছে আসতে না পারে।

ফজল বিড়ি টানছে বসে বসে। বিড়ির আগুন আলেয়ার মতো জ্বলছে আর নিভছে। জরিনার মনে হয়, আলৈয়াদানা যেন দাগা দেয়ার চক্রান্ত করছে। আলোয় আকৃষ্ট পোকার মতো তাকে টানছে আর টানছে।

সে চোখ বন্ধ করে। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বিছানো মাদুরটা।

অনেকক্ষণ পর চোখ খোলে জরিনা। নিঃসীম অন্ধকারে সে ডুবে আছে। সাদা মশারির অস্পষ্ট আভাস চোখে পড়ে কি পড়ে না। কিন্তু তার অন্তরালের মানুষটিকে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, শুনতে পায় তার নিশ্বাস-প্রশ্বাস।

জরিনার মনের কোটরে ঘুমিয়ে থাকা চামচিকেটা জেগে ওঠে। নিশির ডাকে নিশাচরী বেরিয়ে যেতে চায়। তার ডানার ঝাঁপটায় জরিনার আঁকা আয়তুল কুরসীর কুণ্ডলী দূরে সরে যাচ্ছে, ফিকে হয়ে যাচ্ছে বুঝি।

জরিনা উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখা তসবি ছড়া সে নামিয়ে আনে। মুসল্লি বাপের স্মৃতিচিহ্ন এ হাজার দানার তসবি। লক্ষ লক্ষ বার জপিত আল্লার নাম ওর প্রতিটি গুটিকায়।

মাথা ও শরীর গলিয়ে সে তসবির মালা নামিয়ে দেয় মাদুরের ওপর। তসবির নিরাপদ আবেষ্টনীর মাঝে সে এবার শক্ত হয়ে বসে।

ফজলও বসে আছে। রূপজানের নিকের খবর শুনে তার রক্ত টগবগ করে উঠেছিল। সে রক্তে এখন উত্তাল তরঙ্গ। সে কোথায় কোন পরিবেশে আছে সে দিকে এতটুকু খেয়াল নেই। প্রতিহিংসার পরিকল্পনায় নিবিষ্ট তার মন।

আরশেদ মোল্লা আর জঙ্গুরুল্লা মানুষ নয়। মানুষের সুরত ধরে পয়দা হয়েছে দুটো জানোয়ার। ওদের চেহারা বিকৃত বীভৎস হয়ে দেখা দেয় তার মনের চোখে। ওদের চুল দাড়ি যেন জড়াজড়ি করে ঝুলছে সুতানালি সাপের মতো।

জাহাজের ফুৎ-ফুৎ সিটি শুনে সংবিৎ ফিরে পায় ফজল। ঝপড় ঝপড় আওয়াজ তুলে জাহাজ চলছে। কাশি দিয়ে গলা সাফ করে সে ডাকে, জরিনা ঘুমাইছ?

না। তোমার কি ঘুম ভাইঙ্গা গেল?

না, ঘুমাই নাই এহনো।

ঘুমাও, রাইত দুফর কুন্তু পার অইয়া গেছে।

ঘুম আর আইব না। তোমার ঘরে কেরোসিন তেল আছে?

কেরোসিন দিয়া এত রাইতে কি করবা?

আছে কোনো দরকার।

কি দরকার?

সাপের খোন্দলে আগুন লাগাইমু।

এত রাইতে সাপের কথা মনে অইল ক্যান? সাপের ব্যথা দ্যাও নাই তো?

সাপের জাত। ব্যথা না দিলেও তো কামড়াইতে পারে।

আইচ্ছা, রাইত পোয়াইলে যোগাড় কইরা দিমু। তুমি ঘুমাও এইবার।

জরিনা উঠে গিয়ে মশারির চারপাশ গুঁজে দেয় হোগলার তলা দিয়ে। তারপর বলে, ভালো কইর‍্যা গুঁইজ্যা দিছি মশারি। সাপ-খোপ আর ঢুকতে পারব না। তুমি নির্ভাবনায় ঘুমাও এইবার।

ফজল বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। জরিনা গিয়ে বসে তসবির নিরাপদ বেষ্টনীর মাঝে।

.

১৯.

জরিনার বাড়িতে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। তার শাশুড়ি বা স্বামী যে কোনো সময়ে এসে যেতে পারে। চৌকিদার-দফাদার বা পুলিসও হঠাৎ হানা দিতে পারে হেকমতকে ধরবার জন্য।

নিরাপদ আশ্রয় আছে অনেক। কিন্তু এখানকার বাতাসে যে স্নেহ-প্রীতি, পরিবেশে যে অন্তরঙ্গতা, তা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে? হয়তো পাওয়া যাবে কোথাও–ফজল ভাবে। কিন্তু সকলের স্নেহ-প্রীতিতে কি আন্তরিকতা আছে? অন্তরঙ্গ পরিবেশও হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু সব অন্তরঙ্গতার অন্তকরণ নাও থাকতে পারে।

ফজলের হাতে অনেক কাজ। দূরের কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর ধারেকাছের কোনো বাড়িতে থাকতেও সাহস পায় না সে। কখন কে পুলিসের কাছে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেবে তার কি কোনো ঠিক আছে? নিজের বউয়ের বাপই যখন এমন কাজটা করতে পারল, তখন আর সে কাকে বিশ্বাস করতে পারে?

জরিনাদের বাড়ির পুবদিকে একটা ধানখেত। সেটা পেরিয়ে আরো পুবদিকে বহুদূর বিস্তৃত পাটখেত। এই পাটের অরণ্যে আস্তানা গাড়ে ফজল, লুকোবার একটা জায়গা করে নেয়। একটা ছোট চৌকির আয়তনের সমান জায়গার পাট সে উপড়ে ফেলে, বিছিয়ে দেয় সেগুলো মাটির ওপর। পাটগুলোর কয়েকটা নখ দিয়ে চিকিয়ে সে কোষ্টা বের করে! এ কোষ্টা দিয়ে দুপাশের পাটগুলোকে ধনুকের মতো বাঁকা করে জোড়ায় জোড়ায় বাঁধে। এভাবে ছই এর একটা কাঠামো তৈরি করে ফেলে সে। এবার কাঠামোর ওপর কয়েকটা আস্ত কলার ডাউগ্গা বিছিয়ে কোষ্টা দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। ছইটা মুষলধার বৃষ্টি ঠেকাতে না পারলেও দুপুরের রোদ আর গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি ঠেকাতে পারবে বলেই মনে হয় ফজলের। সে বিছানার জন্য একটা ছেঁড়া মাদুর, শিথানের জন্য তুষভরা ছোট্ট একটা থলে আর একটা মাথাল নিয়ে এসেছিল জরিনার কাছ থেকে। প্রবর বর্ষণের সময় মাথালটা দরকার হবে। তখন মাদুরটা গুটিয়ে থলেটা বগলে নিয়ে, মাথালটা মাথায় চড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসলে ভিজতে হবে না তেমন, আর বিছানাটাও জবজবে হবে না ভিজে।

তুষের বালিশে মাথা রেখে মাদুরের ওপর শোয় ফজল। খুব একটা খারাপ লাগছে না। ছেঁড়া কলাপাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সাদা মেঘ, কালো মেঘ উড়ে যাচ্ছে। মেঘ সরে গেলে উঁকি দেয় রোদ। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাঁপটায় ফেটে যাচ্ছে ছই-এর কলাপাতা।

দক্ষিণ দিক থেকে চিট-চিট-চিট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ফজল মাথা উঁচু করে। পাটগাছের ভেতর দিয়ে দৃষ্টি চলে তার। সে দেখতে পায়–কিছু দূরে পাটগাছের সাথে বাসা বুনছে বাবুই পাখি। এ পাটখেতের পরেই ধানখেত। আউশ ধান পাকার সময় হয়েছে– বুঝতে পারে ফজল।

আউশ ধান পাকার সময় হলে আসুলি এলাকার তাল-বাবলা গাছের বাসা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে এগুলো আসে। দূর থেকে আসা-যাওয়ার সময় নষ্ট হয়, ডানায় ব্যথা ধরে, পেটের দানাও যায় হজম হয়ে। তাই ধানখেতের কাছাকাছি কোনো পাটখেতে এরা অস্থায়ী বাসা তৈরি করে। শুধু চর অঞ্চলেই নয়, আসুলির বিল অঞ্চলেও এরা ধান পাকার সময় এ রকম অস্থায়ী বাসা তৈরি করে।

ফজল ভাবে, সময়ের মূল্য এ ছোট পাখিগুলোও বোঝে। তাই ওরা তাদের মতোই তৈরি করছে ভাওর ঘর।

শুক্লা সপ্তমীর চাঁদ ডুবে গেছে। ফজল পাটখেত থেকে বেরোয়। এগিয়ে যায় নদীর দিকে। নদীর পাড়ের ধানখেতে ডুবিয়ে রাখা ডিঙিটা তুলে সে চরাটের ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। চারদিকটা ভালো করে দেখে নেয়। টহলদার কলের নৌকার সন্ধানী আলো দেখা যায় না কোথাও। এ কলের নৌকার ভয়ে রাতে নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ। জেলেরাও সন্ধ্যার আগেই জাল গুটিয়ে কোনো নিরাপদ ঘেঁজায় পাড়া গেড়ে বিশ্রাম নেয়।

ফজল নলতার খাড়ি ধরে বেয়ে নিয়ে যায় ডিঙিটাকে।

টুকরো টুকরো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। যেন ধোপার কাপড় শুকোবার মাঠ। মেঘের ফাঁক দিয়ে তারা উঁকি মারছে। দিনের দুপুর থেকে রাতের দুপুর পর্যন্ত দাপাদাপি করে বাতাসের ডানা এখন ক্লান্ত। ক্রান্তি নেই শুধু পানির। গা দুলিয়ে নেচে নেচে কুলকুল গান গেয়ে অবিরাম বয়ে যাচ্ছে পানি। রুপালি পানির আভাস পাওয়া যাচ্ছে অন্ধকারেও।

উজান ঠেলে ধীরগতিতে চলছে ডিঙি। নিজের বৈঠার শব্দের সাথে তাল রেখে চলছে ফজলের হৃদস্পন্দন।

যে কাজের জন্য সে বেরিয়েছে, তার পরিকল্পনা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। এখন ডিঙিটাকে পেছনে ফেলে তার মন পৌঁছে গেছে ঘটনাস্থলে ।…উত্তর ভিটির এ ঘরে থাকে আরশেদ মোল্লা। ব্যাটা জানোয়ার! কোনো দয়ামায়া নেই তোর জন্য। বাইরে থেকে দে শিকল এঁটে দুটো দরজায়। জানোয়ারটা বেরুতে পারবে না আর। চারদিকের বেড়ায় দে কেরোসিন ছিটিয়ে। ভয় কিসের? ম্যাচবাতির কাঠি জ্বালিয়ে দে আগুন!

ফজলের মনে দাউদাউ করে জ্বলছে ক্রোধের আগুন।

আগুন! আগুন! বাঁচাও! বাঁচাও!!

হঠাৎ অনেক মানুষের আর্ত চিৎকার ফজল শুনতে পায় তার নিজের মনে।

বাঁচাও! বাঁচাও!!

এ চিৎকার শুধু আরশেদ মোল্লার নয়। রূপজানের চিৎকারও যে শোনা যাচ্ছে। আগুন কি ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমভিটি ঘরেও? হ্যাঁ তাইতো! ঘরের লাগোয়া ঘর। শ-শ করে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন।

রূপজান!

একটা অস্ফুট চিৎকার দিয়ে চেতনা ফিরে পায় ফজল। তার বৈঠা টানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাল ছেড়ে দেয়ায় ঘুরে যাচ্ছিল ডিঙিটা।

ফজল ডিঙিটাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে নেয়। কিছুদূর গিয়ে আরেকটা খাড়ির মধ্যে ঢোকে। ভাটির টানে এবার দ্রুত এগিয়ে যায় ডিঙি।

সব চক্রান্তের মূলে আছে পা-না-ধোয়া জানোয়ারটা। ওকেই খতম করতে হবে আগে। ওর সাথে পুড়ে মরবে ওর বউ-ছেলে-মেয়ে সব। যাক, পুড়ে ছাই হয়ে যাক, কালসাপের বংশ নির্বংশ হোক।

ডিঙিটাকে লটাঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রেখে সে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়। চার ভিটিতে চারখানা ঘর। ঢেউটিনের চালা, পাতটিনের বেড়া। এ ঘরে আগুন লাগানো সহজ নয়। কপাট, চৌকাঠ, রুয়া-বাগা কাঠের। দরজা আর জানালার কপাটে লাগাতে হবে আগুন। গত বছর পাটের দাম কম ছিল। পাট নিশ্চয়ই বেচেনি জঙ্গুরুল্লা। ঘরে পাট থাকলে তো কথাই নেই। ফরফর করে জ্বলে উঠবে আগুন।

জঙ্গুরুল্লা কোন ঘরে থাকে–ফজলের জানা নেই। ঘরগুলোর সবকটা দরজা বাইরে থেকে শিকল এঁটে বন্ধ করে দেয় সে। বোতল থেকে হাতের তেলোয় কেরোসিন ঢেলে ছিটিয়ে দেয় কপাট-চৌকাঠগুলোয়। তারপর ম্যাচবাতির কাঠি জ্বালায় সে। জ্বলন্ত কাঠি-ধরা হাতটা তার এগিয়ে যায় কপাটের দিকে।

ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।

শিশুর কান্না। ফজলের হাতটা থেমে যায়। বুকটা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এসে নিবিয়ে দেয় কাঠির আগুন।

ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।

অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুর কান্না প্রতিধ্বনি তোলে তার বুকের ভেতর। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই একটা জানালা।

ঘরের ভেতর হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে। সে কুপির আলোয় দেখতে পায় একটি তরুণী মা শিশুর ভিজে কাঁথা বদলে দিচ্ছে।

ওয়াঁ-আঁ–ওঁয়া-আঁ-আঁ।

আবার সেই কান্না। ফজলের অভিভূত দৃষ্টির সামনে মা ও শিশু। মা কোলে তুলে নিয়েছে শিশুকে। বুকের কাপড় সরিয়ে স্তনের বোঁটা শিশুর মুখে দিতেই তার কান্না থেমে যায়। নিষ্পাপ শিশু নিশ্চিন্ত আরামে স্তন চুষছে আর হাত-পা নাড়ছে।

ফজল আর দেরি করে না। সে সব কটা দরজার শিকল খুলে দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে যায় নদীর ধারে। তারপর লটা ঝোঁপের আড়াল থেকে ডিঙিটা বের করে সে বৈঠায় টান মারে।

আক্রোশের আগুন নিবে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এবার সে আগুন দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে তার মনে। প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু কাপুষের মতো নয়।

জোরে বৈঠায় টান মারে ফজল। তাকে অনেক উজান পানি ভাঙতে হবে। সময়টা পূর্ণিমা-অমাবস্যার মাঝামাঝি। তাই স্রোতের বেগ এখন অনেক কম। তবুও উজান ঠেলে যেতে ফজলের কষ্ট হচ্ছে খুব। স্রোত কেটে ছলচ্ছল আওয়াজ তুলে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলছে ডিঙি।

নিঃসীম অন্ধকার। ইচাণ্ডা খাড়ির মুখে পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে।

ক্ষীণ ভটভট শব্দ আসছে পশ্চিম দিক থেকে। দুরের ফুলে ছাওয়া কাশবন আর নদীর রুপালি পানি মাঝে মাঝেই ঝলমলিয়ে উঠছে সার্চ লাইটের ফোয়ারায়।

ফজল বুঝতে পারে টহলরত গোরা সৈন্যের লঞ্চ আসছে। সে প্রাণপণ বৈঠা টেনে চর বগাদিয়ার কিনারায় চলে যায়, লটা বনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ডিঙিটা। ওটাকে লটাবনের আঁড়ালে বেঁধে সে নেমে পড়ে ডাঙায়।

তিন বছর আগের পয়স্তি চর এই বগাদিয়া। জঙ্গুরুল্লার বড় ছেলে জাফর ও তাদের কয়েক ঘর কোলশরিক ও বর্গাদারের বসত এ চরে। তারা টের পেলে জান-পরান হারিয়ে ভেসে যেতে হবে গাঙের স্রোতে।

ফজল চুইন্যা ঘাসের ঝোঁপের ভেতর গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকে।

ভটভট আওয়াজ এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সার্চলাইটের আলোও এসে পড়ছে তার ডিঙি বরাবর নদীর মাঝখানে।

কিন্তু হঠাৎ ভটভট আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। সার্চলাইটের আলোও আর দেখা যায় না। ফজলের মনে বিস্ময় জাগে–বিকল হয়ে গেল নাকি কলের নৌকা!

ফজল চুপচাপ বসে থাকে ঝোঁপের ভেতর। অনেকক্ষণ পরে সে দেখতে পায় লঞ্চটা স্রোতের টানে ভেসে আসছে। বন্ধ কেবিনের জানালার খড়খড়ি গলে আলোর রশ্মি এসে পড়ছে বাইরে। সেই আবছা আলোয় দেখা যায় দু’জন গোরা সৈন্য বৈঠার খেচ মেরে লঞ্চটা পাড়ের দিকে ঠেলছে। তাদের একজন লঞ্চের ডানপাশে এসে বৈঠা দিয়ে পানির গভীরতা মেপে চলে যায় কেবিনের ভেতর। অল্পক্ষণ পরেই একটা মেয়েলোককে পাঁজাকোলা করে এনে সে নামিয়ে দেয় কোমর পানিতে। মেয়েলোকটি হুমড়ি খেয়ে পানির ওপর পড়তে পড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পানি ভেঙে কোনো মতে পা টেনে টেনে তীরে উঠে সে বসে পড়ে মাটিতে।

ফজল ফেরারি আসামি। আর এলাকাটাও শত্রু পক্ষের। তাই রাগে ঠোঁট কামড়ানো ছাড়া ঐ বর্বরদের বিরুদ্ধে আর কিছুই করার কথা চিন্তা করতে পারে না সে।

লঞ্চটা বৈঠার ঠেলায় ও ভাটির টানে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ চালু হয়ে যায়। ভটভট আওয়াজ তুলে সার্চলাইট জ্বেলে দ্রুতগতিতে চলে যায় পুব দিকে।

ফজল ঠায় বসে থাকে। ভয়ে তার বুক দুরু দুরু করে। মেয়েলোকটা হয়তো কেঁদে চিৎকার। দিয়ে উঠবে। আর সাথে সাথে বগাদিয়ার সব মানুষ হৈ-চৈ করে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু অন্ধকারে তার নড়াচড়ার কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। সে বোধ হয় বসেই আছে মাটির ওপর।

ফজল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে ডিঙিটা লটা ঝোঁপ থেকে বের করে সে জোরে টান মারে বৈঠায়।

পাটখেতে যখন ফজল ফিরে আসে তখন রাত প্রায় শেষ।

আক্রোশের আগুনে যেন ঝলসে গেছে তার শরীর ও মন। সে মাদুরের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে। শরীরটা ঢেলে দেয়। নিধুম ক্লান্ত চোখ দুটো ঘুমের আক্রমণ রোধ করতে পারে না বেশিক্ষণ।

রাতের বেলা কেন এল না ফজল বুঝতে পারে না জরিনা। তার জন্য রান্না করে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল সে। একবার চেষ্টাও করেছিল তাকে খুঁজে বের করবার। বাড়ির পুবদিকে ধানখেত। ধান পাতার আঁচড় খেয়ে কিছুদূর গিয়েছিল সে। ফজলের অনুকরণে অপটু কণ্ঠে টিঁ-টিঁ-টিঁ–টিঁ-টিঁ-টিঁ হট্‌ ডাকও দিয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে সে আর এগুতে সাহস করেনি অন্ধকারে।

ফজরের নামাজ পড়েই জরিনা রান্নাধরে যায়। গত রাতের রান্না বেলেমাছের চচ্চড়ি গরম করে। হলুদ-লবণ দিয়ে সাঁতলানো আণ্ডালু চিংড়ি ভর্তা করে পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা ও সরষের তেল সহযোগে। তারপর একটা মেটে বাসনে পান্তা বাড়ে। তার ওপর চচ্চড়ি ও ভরতা বসিয়ে দিয়ে বাসনটাকে গামছায় বেঁধে নেয়।

ধানখেত পেরিয়ে পাটখেতের আলে গিয়ে দাঁড়ায় জরিনা।

গতকাল আকাশে ছিল টুকরো টুকরো মেঘের উড়ন্ত মিছিল। কখনো চোখ বুজে, কখনো চোখ মেলে সারাদিন কর্তব্য পালন করছিল সূর্য। রাতেও বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ ভোর থেকেই আকাশে জমতে শুরু করছে কালো মেঘ। উত্তর-পশ্চিম দিগন্তে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার অস্পষ্ট গর্জন শোনা যায় কি যায় না। আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে সে এদিক ওদিক তাকায়। আলের পাশে খুঁজে পায় সে একটা মাথাভাঙা পাটগাছ। ওটায় বসান রয়েছে একটা ম্যাচবাতির খোসা–ফজলের রাখা নিশানা। নিশানা ধরে সোজা পুব দিকে এগিয়ে যায় সে। মাথা নুইয়ে যেতে হয়, কারণ পাটগাছ এখনো মাথাসমান লম্বা হয়নি। নল চারেক যেতেই পাটগাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ফজলের তৈরি ছই-টা।

জরিনা কাছে গিয়ে দেখে ছই-এর নিচে মাদুরের ওপর খালি গায়ে পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে ঘুমুচ্ছে ফজল।

দিনের আলোয় জোয়ারে ভরা ফজলের জোয়ান শরীর দেখাবার সুযোগ পায় জরিনা এই প্রথম। গামছায় বাধা খাবার নামিয়ে রেখে সে নিঃশব্দে বসে পড়ে ফজলের পাশে।

ঈষৎ ফাঁক ঠোঁট দুটির আড়ালে ওপরের পাটির দুটি দাঁত দেখা যায়। আলুথালু চুলের এক গোছা কপালের ওপর এসে পড়েছে। দাড়ি-গোঁফ চাচা হয়নি অনেক দিন। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি বিষণ্ণ মুখকে বিষণ্ণতর করে তুলেছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জরিনা।

গভীর ঘুমে অচেতন ফজল। তার প্রশস্ত রোমশ বুক ওঠা-নামা করছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে। লুঙ্গির গেরো শিথিল হয়ে নেমে গেছে নাভির নিচে। দুটি উরুর অনেকটা উদলা লুঙ্গি ওপরে উঠে যাওয়ায়। জরিনা লক্ষ্য করে মুখের রঙের চেয়ে অনেক ফরসা উরুর রঙ। সর্বক্ষণ কাপড়ে ঢাকা থাকার ফলে রোদে পুড়ে উরুর রঙ তামাটে হতে পারেনি। টেকির কাতলার মতো মোটা মজবুত দুই উরু।

কপালের চুলের গোছাটি ঘুরিয়ে মাথার ওপর তুলবার জন্য জরিনার আঙুল নিশপিশ করে। কিন্তু সে সংযত করে নিজেকে।

জরিনা একটা কাঁপুনি অনুভব করে তার বুকের মধ্যে। কাঁপুনিটা ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। তার মনের বন্য বাসনা পলিমাটির বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে যেতে চায়।

জরিনা চোখ বোজে, মনে মনে কি যেন আওড়ায়। সে বুকে ফুঁ দেয়, ডানে বায়ে ফুঁ দেয়।

ঢেউ থামে। দিশেহারা বাসনা ধীরে ধীরে উৎসে ফিরে যায়।

কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে জরিনা। ফজল একই অবস্থায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

পাটগাছের আগায় আঁশ বাঁধিয়ে ঝুলছে একটা শুয়াপোকা। নিজের শরীর থেকে নির্গত আঁশের সাথে ওটা ঝুলছে, দুলছে বাতাসে আর নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

কি বিশ্রী কদাকার জীব। জরিনার শরীরের রোম খাড়া হয়ে ওঠে। হলদে বিছাটা মাটিতে পড়েই শুয়াভরা শরীর দুলিয়ে চলতে শুরু করে ফজলের দিকে।

ইস্! খুশির আর সীমা নাই! জরিনা মনে মনে বলে। অমন সোন্দর শরীলে উঠতে দিমু তোমারে!

তারই দেয়া কেরোসিন তেলের বোতলটা হাতের কাছেই রয়েছে। ওটার তলা দিয়ে সে পোকটাকে পিষে দেয় মাটির সাথে।

পাটগাছের পাতায় পাতায় অসংখ্য গুঁয়াপোকা। প্রজাপতি ডিম পাড়ে পাটপাতার ওপর। ডিম থেকে ফুটে বেরোয় শুয়াপোকা। পাটের কচিপাতা খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে ওরা। কয়েকটা পোকা নিজের শরীর থেকে নিঃসৃত আঁশ দিয়ে পাটপাতা মুড়িয়ে গুটি তৈরি করছে।

স্বেচ্ছাবন্দি বয়োজ্যেষ্ঠ য়াপোকারা মুক্তির সাধনায় ধ্যানমগ্ন গুটির ভেতর। একটার মুক্তিলাভ ঘটে জরিনার চোখের সামনেই। গুটি ভেঙে একটা হলদে প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। পাতা আঁকড়ে ধরে ওটা পাখা দোলাচ্ছে। জরিনা চেয়ে থাকে ওটার দিকে।

আহা কি সুন্দর!

এমনি হলদে রঙের একটা শাড়ি দেখেছিল সে রূপজানের পরনে। শাড়ির আঁচলটা বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছিল প্রজাপতির পাখার মতোই। তার মনে হয় এই হলদে প্রজাপতিটার মতোই সুন্দরী রূপজান।

ফজলের দিকে আবার চোখ নেমে আসে জরিনার। ঘুম তার এত গভীর যে একবারও পাশ ফিরে শোয়নি সে এতক্ষণের মধ্যে।

তার মাথার কাছেই পিড়াপিড়িয়ে হাঁটছে একটা কদাকার শুঁয়াপোকা।

জরিনা বোতলের তলা দিয়ে এটাকেও পিষে ফেলে।

এ পোকার শুয়ায় নাকি বিষ আছে। শুয়া শরীরের কোথাও লেগে গেলে ফুলে যায়, শেষে পেকে পুঁজ হয়।

জরিনা একটা পাটগাছের আগা ভাঙে। মাথার পাতাগুলো রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এবার এটাকে বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। কেরোসিন-ভেজা পাতাগুলো সে এবার বুলিয়ে দেয় মাদুরের কিনারায়। বারবার কেরোসিনে ডুবিয়ে সে মাদুরের চারপাশটা ভিজিয়ে। দেয়। কেরোসিনের দুর্গন্ধে ফজলের কাছে এগুতে পারবে না কদাকার পোকাগুলো।

স্বস্তি বোধ করে জরিনা। কিন্তু নবজাত প্রজাপতির একটা উড়ে এসে বসে ফজলের ঊরুর ওপর। ওটাকে তাড়াবার জন্য সে হাত বাড়ায়। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হয়, রূপজানই বুঝি প্রজাপতির রূপধরে এসে বসেছে ফজলের গায়ে। সে হাত টেনে নেয়, পলকহীন চোখ মেলে চেয়ে থাকে প্রজাপতিটার দিকে। কি সুন্দর! ওটার তুলনায় নিজেকে মনে হয় একটা শুয়াপোকা। ফজলের গায়ে বসবার অধিকার নেই শুয়াপোকার।

কদাকার ওয়াপোকা গুটির কবরে গিয়ে সুন্দর প্রজাপতির রূপ লাভ করে। সে যদি কবরে যায় তার কি দশা হবে? সে কি এমন সুন্দর রূপ নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে? আসতে পারবে এ সুন্দর পৃথিবীতে যেখানে চাঁদ আছে, সূর্য আছে, বাতাস আছে, পানি আছে, আর আছে ফজল?

অসম্ভব। কবর থেকে কোনো মানুষই ফিরে আসে না এ মাটির পৃথিবীতে। কবরে মাটিচাপা দেয়ার পরেই আসবে দুই ফেরেশতা মনকির আর নকির। গুনাগারের আজাব চলতে থাকবে কবরের ভেতর। তারপর আল্লার বিচার। বিচারের পর গুনাগারকে ফেলবে হাবিয়া দোজখে, জাহান্নামে।

জরিনা আরো ভাবে, সে সবচেয়ে বড় গুনাগার। শরীরের গুনা, মনের গুনা, চোখের গুনা সে করেছে। অন্য সব গুনা মাফ হলেও হতে পারে, কিন্তু শরীরের গুনা কবিরা গুনা। এ গুনার মাফ নেই। সে শুনেছে, সারা জীবনভর আল্লার নাম জপ করলেও শরীরের গুনার শাস্তি থেকে কেউ রেহাই পাবে না। আর কি সাংঘাতিক সে শাস্তি। দুই সাপ এসে কামড়ে ধরবে দুই স্তন। ফেরেশতারা গুজু মারবে কুচকির ওপর।

জরিনা আর ভাবতে পারে না। সে ফজলের দিকে তাকায়। শরীরের গুনা করেছে। ফজলও। তারও নিস্তার নেই। একই হাবিয়া দোজখে যেতে হবে দু’জনকে।

হঠাৎ জরিনার বেদনাভারাক্রান্ত মনটা হালকা মনে হয়। ফজল হবে তার দোজখের সাথী। রূপজান সতী-সাধ্বী, নিষ্পাপ। সে যাবে বেহেশতে। আখেরাতে সে সাথী হবে পারবে

ফজলের। এ দুনিয়াতেও ফজলকে আর সাথী হিসেবে পাবে না সে। তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।

প্রজাপতিটা এখনো বসে আছে ফজলের ঊরুর ওপর।

নাহ, ওটার বসবার অধিকার নেই ফজলের গায়ে।

জরিনা আঙুলের টোকা দিতেই প্রজাপতিটা নরম অপটু পাখা নেড়ে টলতে টলতে উড়ে চলে যায়।

জরিনার মনের মেঘে উষার অরুণিমা। ফজল হবে তার দোজখের সাথী। কিন্তু এ দুনিয়ায়?

এ দুনিয়ায় ফজল একা। তার সাথী নেই। তার নিজেরও কি সাথী আছে?

ফজলের জন্য তার মনে রয়েছে মমতার এক গভীর সরোবর। তাতে এবার জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। মমতা-সরোবর থেকে নির্গত হচ্ছে মেহগঙ্গা। সমস্ত বাঁধ-বাধা ভেঙে, ডিঙিয়ে দুর্বার স্রোতের অধঃপতন ঘটছে এক অন্ধকার কুহরে।

জরিনা চেয়ে থাকে ফজলের মুখের দিকে। সে মুখমণ্ডল জুড়ে থমথমে বিষাদের ছায়া। জরিনার চোখ ছলছল করে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ফজলের আরো কাছে গিয়ে বসে। তার কপালের ওপর থেকে সে চুলের গোছাটি আঙুল দিয়ে তুলে দেয় মাথার ওপর। কপালে হাত বুলায়।

ফজলের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ মেলে। জরিনার মাথা ঈষৎ ঝুঁকে আছে তার মুখের ওপর। চেয়ে আছে নির্নিমেষ। মমতামাখা দুটি চোখ। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

ফজলের চোখও ছলছল করে ওঠে। তার পিপাসাজর্জর মন মরীচিৎকার পেছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। হঠাৎ সে দেখতে পায় স্নেহ-ভালোবাসার এক বিশাল সরোবর। তার পানি স্বচ্ছ কি পঙ্কিল যাচিয়ে দেখে না সে। দেখবার প্রয়োজনও বোধ করে না। সে হাত বাড়িয়ে জরিনাকে কাছে টেনে নেয়। জরিনা বাধা দেয় না।

.

২০.

বগাদিয়ার কোলশরিক কোরবান ঢালীর পুতের বউ সবুরন মোরগের বাকেরও আগে নদীর ঘাটে গিয়েছিল ফরজ গোসল করতে। অনেকক্ষণ পরে ঘুম ভেঙে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে তার স্বামী সোরমানও যায় গোসল করতে। এত সময়ের মধ্যেও সবুরন ঘরে ফিরে আসেনি আর নদীর ঘাটেও তাকে দেখতে পায় না সোরমান। গোসলের পর পরবার জন্য যে শাড়িটা সে নিয়ে গিয়েছিল সেটা পড়ে রয়েছে পাড়ে তুলে রাখা একটা ওচার ওপর। সোরমানের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। সবুরনকে কুমিরে নিয়ে যায়নি তো!

তার ডাক-চিৎকারে বাড়ির ও আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। কয়েকজন লগি মেরে মেরে নদীর কিনারায় খোঁজ করে। কয়েকটা নৌকা নিয়ে কয়েকজন খোঁজ করে এ-চর ও চর। কিন্তু সবুরনের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। সে কোথাও কারো সাথে পালিয়ে যায়নি–এ ব্যাপারে সবাই একমত। বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছে। হেসে-খেলে দিব্যি ঘর-সংসার করছিল মেয়েটি।

পালিয়ে যাওয়ার কোনো কারণও ঘটেনি। আর পালিয়ে গেলে শাড়িটা নিশ্চয়ই নিয়ে যেত। সে সাঁতার জানে। সুতরাং পানিতে ডুবে মরার কথাও নয়। তবে কি সত্যি সত্যি কুমিরেই নিয়ে গেছে?

কিন্তু একদিন এক রাত পর ভোরবেলা যখন তাকে নদীর সেই একই ঘাটে পাওয়া গেল তখন সবাই বিস্ময়ে হতবাক। সবুরন কেমন যেন সম্মোহিত, বাহ্যজ্ঞানশূন্য। তার মুখে কথা নেই। অনেক সময় ধরে ঘোমটা টেনে সে বসে থাকে এক জায়গায়। কারো প্রশ্নের উত্তর সে দেয় না। সকলের দৃঢ় বিশ্বাস মেয়েটির ওপর জিনের দৃষ্টি পড়েছে এবং জিনই তাকে নিয়ে গিয়েছিল?

খবরটা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সারা চর অঞ্চলে। লোকের মুখে এ-ও শোনা যায়–সবুরনের শরীরে, শাড়ি-ব্লাউজে মন-মাতানো খোশবু। সে নাকি জিন-পরীর দেশ কোহকাফ-এর খোশবুর নহরে ডুব দিয়ে এসেছে।

জরিনার কাছে খবরটা পায় ফজলও। সে মনে মনে হাসে আর এই ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে নিশ্চিত বিপর্যয়ের হাত থেকে বউটির ভবিষ্যৎ দাম্পত্য জীবন রক্ষা পেয়ে গেল।

ফজলের মনে পড়ে যায় একদিনের কথা। মাস ছয়েক আগে সে মাছ বিক্রি করতে গিয়েছিল তারপাশা, মাছের চালানদারদের কাছে। তারপাশা স্টেশনে অপেক্ষমান কয়েকজন স্টিমার-যাত্রীর মধ্যে তর্ক হচ্ছিল। ফজল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল পাশে দাঁড়িয়ে। একজন বলছিল, জিনের কথা কোরানশরিফে লেখা আছে। আর একজন বলছিল, হ্যাঁ লেখা আছে ঠিকই। কিন্তু জিন কী, কেমন, কোথায় থাকে তার কোনো স্পষ্ট বর্ণনা নেই। কোরানশরিফের একজন অনুবাদক তার টীকায় লিখেছেন-’কোরান শরিফের কোনো কোনো আয়াতে জিনের উল্লেখে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয়, সুচতুর বিদেশী বোঝাবার জন্য জিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

ফজল মনে মনে বলে, ঠিকই, বউটারে জিনেই ধইর‍্যা লইয়া গেছিল।

ফজল আরো খবর পায়–ফুলপুরী পীরবাবাকে নিয়ে জঙ্গুরুল্লা আগামী শনিবার বগাদিয়া যাচ্ছে। জিন চালান দিয়ে জিনের দৃষ্টি থেকে পীরবাবা সবুরনকে উদ্ধার করবেন।

.

কোনো সাক্ষী-সাবুদ পায়নি বলে ডাকাতি মামলাটা দাঁড় করাতে পারেনি পুলিস। তাই খারিজ হয়ে গেছে মামলা। কিন্তু জেলভাঙার অভিযোগ আছে ফজলের বিরুদ্ধে। তাকে ধরবার জন্য মাঝে মাঝে হানা দেয় পুলিস।

পালিয়ে পালিয়ে আর কতদিন থাকা যায়? পালাবার আর জায়গাও নেই। জরিনার শাশুড়ি ফিরে এসেছে। সে বাড়িতে যাওয়া যায় না আর। তাকে ধরবার জন্য আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চালিয়েছিল পুলিস। এভাবে বেইজ্জত হওয়ায় অনেকেই বিরক্ত হয়ে গেছে তার ওপর। তাদের বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য আর যাওয়া যায় না। বর্ষার পানিতে ডুবে গেছে মাঠ-ঘাট। ঝপাঝপ বৃষ্টি নামে যখন তখন। এ দিনে পাটখেতে বা বনবাদাড়ে লুকিয়ে থাকবার উপায় নেই। শিকারির ভয়ে ভীত এ পশুর জীবন আর ভালো লাগে না ফজলের। জেল থেকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে পালিয়েছিল তার একটাও সফল হয়নি। না পারল সে প্রতিশোধ নিতে, না পারল চরটা আবার দখলে আনতে। এভাবে পালিয়ে বেড়ালে কোনো কাজই সমাধা হবে না–সে বুঝতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে মেহের মুনশির সাথে পরামর্শ করে সে মহকুমার আদালতে আত্মসমর্পণ করাই সমীচীন মনে করে।

উকিল ধরে শেষে আদালতে আত্মসমর্পণই করে ফজল।

আবার হাজতবাস। তবে কিছু দিনের মধ্যে তার বিচার শুরু হয়। ডাকাতি মামলায় অনর্থক গ্রেফতার, বিনা অপরাধে দীর্ঘদিন হাজতবাস, স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ ইত্যাদি কারণগুলো তার জেলভাঙার অপরাধের গুরুত্ব অনেকখানি কমিয়ে দেয়। এটাও প্রমাণিত হয়–সে জেল ভাঙেনি। জেল ভেঙেছিল বিপ্লবী রাজনৈতিক দল। সে শুধু সুযোগ বুঝে পালিয়েছিল। বিচারক এসব বিবেচনা করে তার রায় দেন। মাত্র তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাকে।

ফজলের সাজা হয়েছে শুনে আরশেদ মোল্লা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে তার।

ফজল জেল থেকে পালিয়ে এসেছে শুনে সে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। রূপজানকে সে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই ছিল তার ভয়। মেয়ের মতিগতিও ভালো মনে হয়নি। পানি আনার নাম করে সে নদীর ঘাটে গিয়ে প্রায়ই চুপচাপ বসে থাকত। তাকে চোখে-চোখে রাখতে হতো সব সময়। ঐদিন পুলিস দিয়ে ধরিয়ে না দিলে ফজল তাকে নিশ্চিয় ভাগিয়ে নিয়ে যেত। রূপজানও তৈরি ছিল, ঘর থেকে বেরুবার চেষ্টাও করেছিল। ভাগ্যিস উঠানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল সে, আর ঠিক সময়ে পুলিস এসে পড়েছিল।

রূপজান এখনো প্রায়ই নদীর ঘাটে গিয়ে বসে থাকে। তবে পালিয়ে যাওয়ার ভয় আর নেই। এবার দিন-তারিখ ঠিক করে শুভ কাজটা সমাধা করতে পারলেই সব ঝঞ্ঝাট চুকে যায়।

ফুলপুরী পীরবাবা আরো কিছুদিন থাকবেন এ অঞ্চলে। জঙ্গুরুল্লাও তাগিদ দিচ্ছে। বারবার। কিন্তু রূপজানকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। সে তার মা-কে সোজা বলে দিয়েছে, আমারে বিয়া দিতে পারবা না। পারবা আমার লাশটারে বিয়া দিতে। বেশি জোরাজুরি করলে গলায় দড়ি দিমু।

মহাভাবনায় পড়ে যায় আরশেদ মোল্লা। নিরুপায় হয়ে সে জঙ্গুরুল্লার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে। জঙ্গুরুল্লা শুনে হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে, তুমিও যেমুন! মাইয়া রাজি অয়না ক্যান্? পীরবাবার পাকনা দাড়ি দেইখ্যা বুঝিন পছন্দ অয়না মাইয়ার?

হ ঠিকই ধরছেন।

আরে মিয়া, তুমি তো একটা জাহিল। রসুলে করিমের বয়স যখন পঞ্চাশের উপরে তখন তিনি হজরত আয়েশাকে বিয়া করেন। তুমি জানো, বিবি আয়েশার বয়স তখন কত?

তেনারাতো আল্লার পিয়ারা। তেনাগো লগে আমাগো লগে তুলনা অয়?

আরে রসুলে করিম যা কইর‍্যা গেছেন সেই মতন কাম করা তো সুন্নত–অনেক সওয়াবের কাম। পীরবাবা আল্লার পিয়ারা দোস্ত। তার লগে মাইয়া বিয়া দিলে গুষ্টিশুদ্ধ বেহেশতে যাইতে পারবা।

কিন্তুক মাইয়ারে যে রাজি করাইতে পারলাম না। সে কয়–আমার লাশটারে বিয়া দিতে পারবা।

সবুর করা। এট্টু বসো তুমি। আমি জিগাইয়া আসি পীরবাবারে। তিনার কাছে এই ব্যারামেরও ওষুধ আছে।

কিছুক্ষণ পরে জঙ্গুরুল্লা ফিরে আসে। বলে, শোন, মোল্লা, তুমি বাজারে যাও। এক মূলের সোয়াসের জিলাফি আর এক শিশি সুবাসিত তেল নিয়া আসো। দরাদরি কইর‍্য না কিন্তুক। যা দাম চাইব তাই দিয়া কিনবা। তেলের নামডা যে কি কইল বাবা? হ হ মনে পড়ছে, রওগনে আম্বর। ঐ ডা না পাইলে যে কোনো সুবাসিত তেল আনলেই চলব।

পরের দিনই আরশেদ মোল্লা জিলাপি আর একশিশি কামিনীকুসুম কেশ তৈল নিয়ে আসে জঙ্গুরুল্লার বাড়ি।

জঙ্গুরুল্লা ওগুলো নিয়ে যায় পীরবাবার বজরায়। তিনি মন্ত্রতন্ত্র পড়ে ওগুলোতে ফুঁ দিয়ে ফেরত দেন। উপদেশও দেন কিছু।

জঙ্গুরুল্লা জিনিসগুলো আরশেদ মোল্লার হাতে দিয়ে বলে, এই জিলাফি খাওয়াইবা মাইয়ারে। আর এই তেল সে মাথায় দিব। তারপর দ্যাখবা মিয়া, ক্যামনে নাচতে নাচতে তোমার মাইয়া আইয়া পড়ে পীরবাবার ঘরে।

এতগুলা জিলাফি একলা মাইয়ারে দিলেতো সন্দ করব।

না মিয়া, খালি মাইয়ারে দিবা ক্যান্? তোমার বউ-পোলা-মাইয়া বেবাকগুলারে খাওয়াইবা।

এইডা কি কতা কইলেন চদরীসাব? হেষে আমার কবিলার উপরেও যদি টোনার আছর অয়?

জঙ্গুরুল্লা খিকখিক করে হেসে ওঠে। কোনো রকমে হাসি চেপে সে বলে, ও তোমার বুঝিন ডর লাগছে? তুমি মনে করছ তোমার কবিলা নাচতে নাচতে আইয়া পড়ব মন্তরের ঠেলায়। উঁহু, হেইডা চিন্তা কইর‍্য না। তোমার মাইয়ার নাম লইয়া মন্তর পড়া অইছে এই জিলাফি আর তেলের উপরে। আর কোনো মাইনষের উপরে আচর অইব না।

ঠিক কইলেন তো?

আরে হ হ হুগনা ওলানের তন দুধ দোয়ানের কারো এমুন আহেঙ্কাত নাই। এইবার যাও। বিছমিল্লাহ বুইল্লাথুরি না-না, বিছমিল্লাহ কওনের দরকার নাই। বিছমিল্লাহ কইয়া মোখে দিলে বেবাক বিষ পানি অইয়া যায়। জাদু-টোনার মন্তর-তন্তর ফুক্কা অইয়া যাইতে পারে, বোলা মিয়া?

আরশেদ মোল্লা জিলিপির পুটলি ও তেলের শিশি হাতে নেয়।

আর শোন, পীরবাবা আর একটা কথা কইয়া দিছেন। জিলাফি খাওনের তিনদিন পর যখন জিলাফির মন্তর গিয়া ঢুকব শরীলের মইদ্যে তখন মাইয়ারে টোনার কথা জানাইতে অইব। তোমার বিবিরে তালিম দিয়া দিও। এমুন কইরা কইতে অইব ‘পীরবাবা তোরে টোনা করছে, রাইতে খোয়বে পীরবাবার কাছে চইল্যা যাবি। তুই ঘুমাইলে তোর রুহু চইল্যা যাইব পীরবাবার কাছে। এই কথাগুলা দিনে তিনবার–ফজর, জহুর আর এশার নামাজের পর। কওন লাগব। মনে থাকব তো?

হ থাকব। এহন যাই।

জঙ্গুরুল্লাকে ‘আসলামালেকুম’ দিয়ে আরশেদ মোল্লা বাড়ির দিকে রওনা হয়।

জঙ্গুরুল্লার নির্দেশমত জিলিপি খাওয়ানো হয়েছে রূপজানকে। সুবাসিত তেল মাখিয়ে রোজ চুল বেঁধে দিচ্ছে তার মা। দিনে তিনবার টোনার কথা বেশ জোর গলায় বলা হচ্ছে তার কাছে। কিন্তু তার মনের কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সে আগের মতোই অচল অটল।

রাতে বিছানায় শুয়ে রূপজান ঘুমের ভান করে থাকে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে উঠে বসে থাকে। ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্ন দেখার ভয় আছে। আত্মাটা দেহ ছেড়ে চলে যাবে পীরের কাছে।

সে সারারাত জেগে থাকে। রাতের ঘুম সে পুষিয়ে নেয় দিনের বেলা ঘুমিয়ে।

রাতের নিঃসীম অন্ধকারে রূপজানের ব্যাকুল মন খুঁজে বেড়ায় ফজলকে। জেলের ভেতর সে এখন নিশ্চয় ঘুমিয়ে আছে। সে কি তাকে স্বপ্নে দেখে এখন। টোনা করে সে যদি আনতে পারত ফজলের আত্মাটাকে। আত্মাটা পাহারা দিতে পারত তার নিজের আত্মাটাকে।

বাড়ির সবাই তাকে বুঝিয়েছিল, ফজল ডাকাত। ডাকাতির মামলায় তার চৌদ্দ বছর জেল হবে। কেন সে তার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করবে?

রূপজান তাদের কথা বিশ্বাস করেনি। ফজল ডাকাতি করতে পারে না–সে জানত। সেটাই এখন প্রমাণিত হয়েছে। সে ওভাবে জেল থেকে না পালালেই ভালো করত। জেল পালানোর অপরাধে সাজা খাটতে হতো না। যাক, মাত্র তিন মাসেরই তো ব্যাপার। দেখতে দেখতে জেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ফিরে আসবে ফজল।

কিন্তু ফিরে এলে তার কি লাভ? সে-তো তাকে তালাক দিয়ে গেছে। আর তো সে তাকে ঘরে নিতে পারবে না।

তবুও ফজল জেল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক মনে মনে সে এ প্রার্থনা করে দিনরাত।

আরশেদ মোল্লার প্রার্থনা কিন্তু তা নয়। ফজলের জেলের ভাত যত দেরিতে ফুরোয় এই তার কামনা। মাত্র কয়েক দিন হলো রূপজানকে জিলিপি খাওয়ানো হয়েছে। এর আছর হতে সময় লাগবে। কিন্তু বেশি সময় নিলে তো মহামুশকিল হয়ে যাবে। ফজল ফিরে এলে একটা কিছু গোলমাল বাঁধিয়ে দিতে পারে–এই তার ভয়।

পদ্মার স্রোতের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে। একমাস পার হয়ে গেছে এর মধ্যে। কিন্তু একটুকুও পরিবর্তন হয়নি রূপজানের। তার মা টোনার প্ররোচন-বাক্য উচ্চারণ করলেই সে কানে আঙুল দেয়, পা উঁচিয়ে মেঝের ওপর লাথি মারে আর বলে, টোনার কপালে লাথি, টোনার মুখে লাখি।

ছি মা, অমুন করিস না। আল্লাহ্ গুনা লেখব, চুপ কর। তোর বাজান হুনলে কাইট্যা ফালাইব। সোনাইবিবির কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।

রূপজান চুপ করে না। সে এবার বাঁ পা দিয়ে বারবার লাথি মারে মেঝের ওপর। আর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, টোনার মাজায় বাইয়া ঠ্যাঙ্গের লাথি। একশো একটা লাথি।

সোনাইবিবিও চায়না জাদু-টোনার আছর পড়ুক রূপজানের ওপর। কিন্তু স্বামীর আদেশ অমান্য করার সাহস নেই তার। তাই দিনে তিনবার সে টোনার কথা শোনায় রূপজানকে। প্রত্যেক বারই কানে আঙুল দেয় রূপজান। থুক ফেলে, লাথি মারে মেঝেতে। সোনাইবিবির চোখ থেকে ধারা নামে। বুক ভেঙে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।

পীরবাবার তুকতাকে কাজ হচ্ছে না কেন বুঝতে পারে না আরশেদ মোল্লা। এদিকে দিন যে আর বেশি বাকি নেই। কার্তিক মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন পরেই বেরিয়ে যাবে ষণ্ডাটা। এখন উপায়?

আরশেদ মোল্লা পরামর্শের জন্য ছোটে জঙ্গুরুল্লার বাড়ি।

পীরবাবার তুকতাকে রূপজানের মন টলেনি শুনে ভাবনায় পড়ে জঙ্গুরুল্লাও। আরো কড়া, আরো তেজালো বশীকরণমন্ত্র নিশ্চয়ই জানা আছে পীরবাবার। কিন্তু আর যে বেশি সময় নেই। ফজল জেল থেকে বেরিয়ে এসে গোলমাল বাঁধাবে, তার জন্য মোটেও ভাবে না সে। ফজলতো একটা পিঁপড়ে তার কাছে। খালি একটু চোখের ইশারা ব্যস এক ডলায় খতম। তার ভাবনা শুধু পীরবাবার জন্য। এই চান্দের মাসের পনেরো তারিখে তার মেয়ের শাদি-মোবারক। আর মাত্র তেরো দিন বাকি আছে। পাঁচ দিন পরে তিনি নিজের ‘ওয়াতন’ ফুলপুর চলে যাবেন। সুতরাং তিন-চার দিনের মধ্যেই শুভ কাজটা সমাধা করা দরকার।

শোন মোল্লা, মাইয়ার মনের দিগে চাইয়া থাকলে কোনো কাম অইব না। জঙ্গুরুল্লা বলে। বিয়ার কলমা পড়লে আর পুরুষ মাইনষের হাত লাগলে সব ঠিক অইয়া যাইব।

আমার মনে অয় চদরী সাব, মাইয়ারে কবুল করান যাইব না। আপনে জুয়ান দেইখ্যা একটা পোলা ঠিক করেন।

দ্যাখো মোল্লা, আমার যেমুন কথা তেমুন কাম। পীরবাবারে তোমার মাইয়া দিমু বুইল্লা নিয়াত কইর‍্যা রাখছি। এই নিয়াত ভাঙতে পারমু না।

কিন্তু চদরীসাব, মাইয়া কবুল না করলে কি করবেন?

কবুল করাইতে অইব। যদি এই শাদি না অয় তবে আর জমির ধারে কাছে যাইতে পারবা না। কইয়া দিলাম।

আরশেদ মোল্লা কুঁকড়ে যায়। সে হাতজোড় করে বলে, এট্টু রহম করেন, চদরীসাব। বেকচরের অর্ধেক জমি গাঙে খাইয়া ফালাইছে। আপনের জমিই এখন ভরসা। জমি লইয়া গেলে খাইমু কী?

কী খাইবা, আমি কী জানি। জমি খাইতে অইলে আমার কথা মতন কাম করণ লাগব।

হ, আপনে যা শুকুম দিবেন সেই মতন কাম করমু।

জঙ্গুরুল্লা হেসে বলে, তুমি হুকুমরে শুর্দু কইর‍্যা শুকুম কইলা বুঝিন? আসলে হুকুম কথাড়াই শুর্দু, বোঝলা মিয়া? ভর্দ লোকেরা শুকুম কয় না, হুকুম কয়। আমার এই হুকুমের কথা মনে রাইখ্য সব সময়।

একটু থেমে আবার বলে জঞ্জুরুল্লা, পীরবাবার গায়ের রং দ্যাখছো? এক্কেরে হবরী ক্যালার মতন। তিনার লগে কি আন্দুরা-বানদুরা কালাকষ্টি মাইয়ার শাদি দেওন যায়? তিনার রঙের লগে মিশ খাইব তোমার মাইয়ার রং। এহন বোঝতে পারছ–কিয়ের লেইগ্যা আমি এত তেলামাখি করতে লাগছি তোমারে?

পীর বাবাতো বুড়া মানুষ। ওনার আবার শাদি করণের খায়েশ অইল ক্যান্?

আরে পীরবাবার খায়েশ থাকুক আর না থাকুক, আসলে খায়েশটা অইছে আমার। পীরবাবা বুজুর্গ মানুষ। আল্লার পিয়ারা দোস্ত। তিনারে যদি আমাগ চরে রাখন যায়, তয় বালা-মসিবত আইতে পারব না। দ্যাখো না ক্যান্, রাইস্যা গাঙ ক্যামনে ভাইঙ্গা রসাতল কইরা লইয়া যায় আমাগ চরগুলা। উনি যদি আমাগ লগে আমাগ চরে বসত করেন তয় কোনোদিন চর ভাঙতে পারব না। আমাগ চরডা অনেক পুরান আর বড়। দক্ষিণ-পশ্চিম দিগ দিয়া এট্টু-এট্টু ভাঙতে শুরু করছে। পীরবাবারে আইন্যা এই ভাঙন ঠেকাইতে অইব। তারপর তোমার কানে কানে কই একটা কথা। কারো কাছ ভাঙবা না কিন্তুক। জঙ্গুরুল্লা আরশেদ মোল্লার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, পীরবাবা যখন ইন্তিকাল করবেন তখন ওনারে কবর দিমু আমাগ চরে। তারপর আল্লায় মকসুদ পুরা করলে কবরডারে পোস্তা কইর‍্যা দিমু। তখন আল্লায়ই হেফাজত করব তার পিয়ারা দোস্তের কবর। এর পর গাঙ ক্যান্, গাঙ্গের বাপেরও পাওর’থাকব না এই চর ভাঙনের।

একটু দম নিয়ে আবার বলে সে, যেই মতন মনে মনে ঠিক কইর‍্যা রাখছি, হেই মতন ঠিক ঠিক যদি কামডা অইয়া যায়, তা অইলে আরো ফয়দা অইব। তোমার মাইয়ারও কপাল খুইল্যা যাইব তখন, হুঁহ্ হুঁহ!

মাইয়ার কপাল খুলব! আরশেদ মোল্লার কণ্ঠে বিস্ময়। ক্যামনে খুলব?

হেইডাও এহনই জানতে চাও? কইবা না তো কাওর কাছে?

না–না, কইমু না। আপনি কইয়া ফেলেন।

তুমি পীর-দরবেশের মাজার দ্যাখছো?

দেখছি।

কত দ্যাশ-বিদ্যাশের মানুষ যায় মাজারশরিফে। কত সৰ্মান! কত পয়সার আমদানি! পীরবাবারে আমাগ চরে কবর দিতে পারলে আমারও মাজারশরিফ বানাইতে পারমু। তখন মিয়া তোমার মাইয়া ছালা ভইরা ফালাইব টাকা দিয়া।

আরশেদ মোল্লার চোখে-মুখে খুশি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

এখন তুমি কও, পীরবাবারে ক্যামনে ভুলাইয়া রাখন যায়? ক্যামনে আটকাইয়া রাখন। যায় আমাগ চরে?

সোন্দর দেইখ্যা একটা শাদি করাইয়া দিলে–

এইতো এইবার বুইঝ্যা ফালাইছ। যেমুন-তেমুন আনদুরা-বানদুরা মাইয়ার লগে শাদি দিলে কাম অইব না। তার লেইগ্যা মাইয়া চাই বেহেশতের হুরির মতন সোন্দর, খুবসুরত। এইডা চিন্তা কইর‍্যা আমি তোমার মাইয়া ঠিক করছি। তোমার মাইয়ার মতন সোন্দর ঢক চেহারার মাইয়া আমাগ এই চরে-চঞ্চালে আর একটাও নাই। তোমার মাইয়ারে দ্যাখছে পীরবাবা, বজরা দিয়া যাইতে আছিল, হেই সময় একদিন আমারে কয়, অ্যায়ছা খুবসুরত লারকি হামি কোনোদিন দেখে নাই। হামার মুলুকেও এমুন চুন্দর লাড়কি নাই। এহন বোঝতে পারছ তো? তোমারে বুঝানের লেইগ্যা অনেক কথা খরচ করলাম।

আমিতো বেবাক বোঝলাম। মাইয়াতো বোঝতে চায় না।

বোঝতে চাইব একশবার। ছালা-ছালা টাকার কথা শোনলে এক কথায় কবুল কইরা ফালাইব। তুমি তোমার বিবিরে বুঝাইয়া কইও বেবাক কথা। সে যে মাইয়ার কানে কানে কয় সব।

আইচ্ছা কইমু।

এইবার তা অইলে তুমি শাদির ইন্তিজাম করো।

কবে, দিন-তারিখ কইয়্যা দ্যান।

আইজ রবিবার। তারপর সোম, মঙ্গল, বুধ। হ্যাঁ বুধবারই বিয়ার তারিখ ধার্য করলাম। আরে দ্যাখো তো কি কারবার। যার বিয়া তার দ্যাখতে মানা। আরে আসল কথাডাই ভুইল্যা গেছিলাম। যার শাদি তারে না জিগাইয়া তারিখ ধার্য করণ ঠিক না। আমি পীরবাবার লগে কথা কইয়া দেখি।

বাড়ির ঘাটে বাঁধ আছে ফুলপুরী পীরের বজরা। জঙ্গুরুল্লা বজরার কক্ষে ঢুকে দেখা করে তাঁর সাথে। অনেকক্ষণ পরে সে বেরিয়ে আসে। চোখে-মুখে উৎসাহের যে দীপ্তি নিয়ে সে গিয়েছিল, তা আর নেই এখন। আরশেদ মোল্লা তার অন্ধকার মুখের দিকে চেয়ে থাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

জঙ্গুরুল্লা তার কাঁঠাল কাঠের খাস চেয়ারটায় বসে বলে, জবর একটা ভুল কইর‍্যা ফালাইছি। মাইয়ার মন এহনো নরম অয় নাই, এইডা কওনে সব্বনাশ অইয়া গেছে। পীরবাবা কয়–তব শাদি নেহি হোগা। তারে অনেক বুঝাইলাম–সব ঠিক অইয়া যাইব। কিন্তু কিছুতেই সে রাজি অইতে চায় না। হেষে অনেক কষ্টে রাজি করাইছি। কিন্তুক শাদি এহন অইব না। উনি যহন শীতকালে আবার তশরিফ নিব, তহন তোমার মাইয়ারে উড়াইয়া দিমু তিনার আতে।

কিন্তু মাইয়া যদি ঐ সময়েও রাজি না অয়?

রাজি করান লাগব। রাজি করানের দাওয়াই দিব পীরবাবা। ওনার ছিনার মধ্যে অনেক এলেম, বেশুমার মারফতি-কেরামতি, মন্তর-তন্তর। অনেক জিন তিনার হুকুমের গোলাম। তোমার মাইয়া বশ করতে জিন চালান দিব এইবার।

ওরে ডাক্‌কুসরে। না চদরীসাব, জিন-পেরেতের দরকার নাই।

আরে ওনারাতো পীরবাবার পোষা জিন। কোনো লোসকান করব না। এইবার মাইয়া ঠিক অইয়া যাইব। তুমি কোনো চিন্তা কইর‍্য না। কোনো ডর নাই তোমার। বাজারের বেইল অইয়া গেছে। এইবার বাড়িত যাও।

আরশেদ মোল্লা তার ডিঙি বেয়ে বাড়ি রওনা হয়।

কোনো ডর নাই, কোনো চিন্তা নাই। কিন্তু যার ডরে সে অস্থির সে জেল থেকে বেরিয়ে আসছে কিছুদিনের মধ্যেই। ফজল বেরিয়ে যদি শুনতে পায়–রূপজান তার জন্য সব সময়ে কাঁদে, জাদু-টোনা করেও তাকে ভোলানো যায়নি তার কথা, তবে তো সে তুফান ছুটিয়ে দেবে। লোক-লশকর নিয়ে হাজির হবে তার বাড়ি। ধরে নিয়ে যাবে রূপজানকে।

আরশেদ মোল্লার মাথার মধ্যে কেমন একটা দপদপানি শুরু হয়।

ফজল নিশ্চয়ই খবর পেয়ে যাবে। রূপজান নিজেও গোপনে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতে পারে।

আরশেদ মোল্লা ভেবে কূল পায় না কেমন করে এ তুফান থেকে রক্ষা পাবে সে। রক্ষা করবে মান-ইজ্জত।

ঘর-দোর, গরু-বাছুর নিয়ে খুনের চরে গেলে কেমন হয়? সেখানে অনেক মানুষ আছে চরের পাহারায়। কিন্তু ফজলের দল যদি চর দখলের জন্য হামলা করে? না, অত হিম্মত হবে না। কিন্তু খুনের চরে সবাই থাকে ভাওর ঘরে। এখনো বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে কেউ যায়নি সেখানে।

রূপজানকে কোথাও লুকিয়ে রাখলে কেমন হয়? উঁহু, তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। রূপজান নিজেই হয়তো পালিয়ে যাবে কোনো ব্যবস্থা করে। এক কাজ করা যায়–জঙ্গুরুল্লার বাড়ি রেখে দিলে আর কোনো ভয় থাকে না। জঙ্গুরুল্লার বাড়িতে অনেক মানুষজন। তারাই চোখে চোখে রাখবে আর ফজলেরও সাহস হবে না সে বাড়িতে হামলা করার।

আরশেদ মোল্লা স্বস্তি বোধ করে। এতক্ষণ সে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। হাতদুটো বৈঠা টানছিল যন্ত্রচালিতের মতো। আকাশের মেঘ, নদীর ঢেউ, ইলিশ ধরার ডিঙি, নানা রঙের বাদাম, সবুজ ধানখেত, লটা আর কাশবন–কিছুই তার নজরে পড়েনি। হালবৈঠার কেড়োত-কোড়োত দাঁড়ের ঝপ্‌পতঝপ, জেলেদের হাঁক-ডাক, কিছুই কানে যায়নি তার। এবার চারদিকে তাকায় আরশেদ মোল্লা। দূরে, ডিঙির মাথি বরাবর দেখা যাচ্ছে খুনের চর। নদীতে এখন ভাটা। চরের ঢালু তট জেগে উঠেছে অনেক দূর পর্যন্ত। ফজলদের ফেলে যাওয়া বানার বেড় থেকে মাছ ধরছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিকেরা। চরের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক সারি ভাওর ঘর–কোলশরিক আর বর্গাদারদের থাকবার ঝুপড়ি।

পীরবাবাকে চর পাঙাশিয়ায় কবর দেয়া হবে। মাজার হবে তার।

আরশেদ মোল্লা নূরপুর আহসান ফকিরের মাজারে গিয়েছিল কয়েকবার। প্রতি বছর মাঘ মাসে ‘উরস’ হয় সেখানে। সেই দৃশ্য এবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার মনের চোখে।

বিরাট মেলা। হাজার হাজার মানুষের ভিড়। দূর-দূরান্তরের মানুষের সমাগম। দোকানপাট, ম্যাজিক, সার্কাস, ঘোড়াচক্কর, রাধাচক্কর। বিপুল বিশাল ডেগের মধ্যে রাতদিন। রান্না হচ্ছে। পাশেই চালাঘরের নিচে কয়েকটা ডিঙি। রান্না করা ডাল-ভাত-তরকারি ঢেলে দিচ্ছে ডিঙির উওরায়। মানুষ তুলে নিয়ে খেয়ে যাচ্ছে যার যার ইচ্ছে মতো।

ফকিরের রওজা। লাল মখমলের গেলাপে ঢাকা কবর। রওজার চারপাশে কয়েকটা তালা দেয়া বাক্স। দর্শনার্থীরা বাক্সের ওপরের কাটা ছিদ্রপথে ফেলছে টাকা, আধুলি, সিকি।

এ ছাড়া আরো টাকা আমদানি হয় নিশ্চয়। দোকানপাটের খাজনা আদায় হয়। চাল, ডাল, নগদ টাকা আসে মুরিদানের কাছ থেকে। মানতের গরু, খাসি, মুরগি আসে।

জাহাজের সিটি যবনিকা টেনে দেয় তার মনে-জাত চলচ্ছবির।

দুটো গাধাবোট টেনে নিয়ে ভাটির দিকে যাচ্ছে একটা লঞ্চ। কিছুক্ষণ পরেই গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যায়। শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। পশ্চিম থেকে উড়ে আসছে সাতটা উড়োজাহাজ। পুব দিকে যাচ্ছে।

বাড়ির কাছে এসে পড়েছে আরশেদ মোল্লা ডিঙিটাকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে সে নলতার খাড়ির মধ্যে ঢোকে।

ভাটির টান খুব জোর। সে শুধু হাল ধরে থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে বাড়ির ঘাটে পৌঁছে যায়।

ঘরে গিয়েই সে সোনাইবিবিকে বলে, রূপজানরে বাড়ি রাখন ঠিক না। ষণ্ডাডা জেলেরতন আইলে কোন কাণ্ড কইর‍্যা ফালায় ঠিক নাই। ওরে জঙ্গুরুল্লার বাড়ি পাড়াইয়া দিতে চাই। হেইখা থাকব কয়ডা মাস।

‘ওনারে কি শয়তানে পাইছে নি? এমুন জুয়ান মাইয়াডা মাইনষের বাড়ি রাখনের কথা ক্যামনে কইতে পারল? আর জঙ্গুরুল্লার স্বভাবও হুনছি ভালো না। পোলা জহিরডাও হুনছি লুচ্চা।

আরশেদ মোল্লা চুপ করে থাকে।

সোনাইবিবি আবার বলে, এমুন কথা আর কোনোদিন যেন মোখ দিয়া বাইর না করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *