০৩. বিয়ের কথা

আমি তোর বিয়ের কথা ভাবছি।

গভীর মনোযোগ দিয়ে মেনু দেখছিল শারমিন। বাবার কথা শুনে চমকে চোখ তুলে তাকাল। যেন কথাটা সে শুনতে পায়নি এমন গলায় বলল, কী বললে?

জাহিদ সাহেব হাসলেন। তুই বড় হয়ে গেছিস!

এতে হাসির কী হলো?

না হাসছি অন্য কথা ভেবে।

কী কথা?

আগের দিনের লোকের নামের শেষে শিক্ষাগত যোগ্যতাটা লাগিয়ে দিত। অমুক রহমান, বি এ। অনার্স থাকলে ব্রাকেটে আবার অনার্সটা লাগাত। কয়েক মাস পর তুই হচ্ছিস শারমিন হক, এম এ।

এবার শারমিনও হাসল। ব্রাকেটে অনার্সটা লাগাও। অনার্সে এত ভাল রেজাল্ট আমার আর সেটা তুমি লাগবে না!

আচ্ছা লাগালাম।

এবার ঝেরে কাশে। মানে পরিষ্কার করে বলো কী বলছিলে!

আগে খাবারের অর্ডার দে।

কাউন্টারের দিকে স্লিপপ্যাড হাতে দাড়িয়ে আছে একজন ওয়েটার। আড়চোখে শারামিনের দিকে তাকাচ্ছে। আচরণে বোঝা যায় শারমিনের অর্ডার নেয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে বেশ উদগ্রিব সে।

হাত ইসারায় লোকটিকে ডাকল শারমিন। মুহূর্তে ছুটে এল সে। খাবারের অর্ডার দিল শারমিন। কিন্তু আইটেম যেন কম মনে হলো জাহিদ সাহেবের। বললেন, এত কম অর্ডার দিলি কেন?

কম কোথায়? চারটা আইটেম।

সবই তো মনে হলো ফিস।

হ্যাঁ। প্রণ, পসফ্রেটস আর মেন্ডারিন ফিস। তুমি বলেছ আমার যা পছন্দ তাই খাবে। ভেজিটেবল রাইসের সঙ্গে এই তিনটে ফিসই খুব ভাল লাগবে।

তা বুঝলাম। দু-একটা মাংসের আইটেম দিলেও পারতি।

শারমিন গম্ভীর গলায় বলল, বাবা, তুমিই আমাকে শিখিয়েছ মাছ এবং মাংস একসঙ্গে খেতে হয় না। আমাদের বাড়িতে কোনও দিনও মাছ আর মাংস একদিনে রান্না হয় না। যেদিন মাছ হবে, শুধু মাছ। আর যেদিন মাংস শুধুই মাংস। সঙ্গে কমন আইটেম সবজি আর ডাল।

আজ একটু অনিয়ম হলেও অসুবিধা।

তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু দুজন মানুষ কত খাব! আর অপচয় আমি পছন্দ করি না।

ঠিক আছে। সফট ড্রিংকস দিতে বল। খাবারের আগে গলাটা একটু ভেজাই।

নিজের জন্য কোক আর বাবার জন্য ম্প্রাইট দিতে বলল। শারমিন। তারপর বাবার দিকে তাকাল। এবার বলো।

মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব। আবার বললেন, আমি তোর বিয়ের কথা ভাবছি।

বাবার মুখে সরাসরি নিজের বিয়ের কথা, শারমিন যেন একটু লজ্জা পেল। যদিও বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো, বাপ মেয়ে সাধারণত বলে না। এমন কথাও তারা দুজন কখনও কখনও বলে। তবু এই মুহূর্তে শারমিন যেন একটু লজ্জা পেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুখটা সে নিচু করে রাখল, লজ্জাটা কাটাল, তারপর মুখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। অতি সহজ সরল গলায় বলল, যেন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, মেয়ে বড় হলে সব বাবা-মাই তার বিয়ের কথা ভাবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি কি শুধুই ভেবেছ না এগিয়েছ?

কিছুটা এগিয়েছি।

মানে ঘটক লাগিয়েছ?

ঠিক ঘটক না। প্রফেশনাল ঘটক আমার পছন্দ না। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক, মানে একজন প্রকাশক, তুই তাকে দেখেছিস কিন্তু মনে আছে কি না। আমি জানি না, খান সাহেব, সে একটা সম্বন্ধ এনেছে।

সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটার কথা মনে পড়ল। শারমিনের। কেন, সে একদমই বুঝতে পারল না। একটু আনমনা হল।

শারামিনের আনমনা ভাবটা খেয়াল করলেন জাহিদ সাহেব। বললেন, তোর মা বেঁচে থাকলে আমার অনেক সুবিধা হতো।

শারমিন অবাক হল। কেমন?

যেসব কথা আমার বলতে হচ্ছে এসব তোর মা বলতেন।

তুমিও বলতে পার। কোনও অসুবিধা নেই।

অবশ্য নীলুকে দিয়েও বলাতে পারতাম।

কোনও দরকার নেই বাবা। আমি তেমন পুতুপুতু স্বভাবের মেয়ে নই, তুমিও পুরনো দিনের বাবা নও। সবকিছু আমাকে সহজ করে বলো। আমারও যদি তোমাকে কিছু বলার থাকে বলব।

গুড, ভেরি গুড। ছেলেটি সম্পর্কে আমি পরে বলি তার আগে তোর কাছ থেকে দুএকটি কথা আমার জানা দরকার।

শারমিন হাসল। আমি জানি তুমি কী জানতে চাইবে। প্রশ্ন করবার দরকার নেই, উত্তরটা আমিই দিয়ে দিচ্ছি। আমার নিজের কাউকে পছন্দ নেই, কোনও ভাল লাগা, এফেয়ার টেফেয়ার কিছু নেই। তুমি নিজেও বেশ ভাল করেই জানো তোমার পছন্দেই আমি বিয়ে করব। তোমার কথার বাইরে আমি যাব না।

মেয়ের কথা শুনে এতটাই মুগ্ধ হলেন জাহিদ সাহেব, হাত বাড়িয়ে মেয়ের গালটা একটু ছুঁয়ে দিলেন। শিশুকে আদর করার গলায় বললেন, ওরে আমার মেয়েটা! আমি খুব খুশি হয়েছি মা। খুব খুশি হয়েছি।

এ সময় কোক স্প্রাইট এল, দুজনে প্রায় একসঙ্গে গ্লাসে চুমুক দিল।

জাহিদ সাহেব বললেন, এবার তাহলে ছেলেটার কথা বলি।

শারমিন কথা বলল না।

জাহিদ সাহেব বললেন, তার আগে তোর পারমিশন নিয়ে একটা সিগারেট খেতে পারি?

শারমিন চোখ পাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। না।

আমি তো রেগুলার খাচ্ছি না। একদিন খেলে কী হবে?

না। বদ অভ্যোস একটু একটু করেই হয়। আজ একটা খেলে কাল দুটো খেতে ইচ্ছা করবে। এভাবে অভ্যাস হয়ে যাবে।

আরে না। তুই পছন্দ করিস না এমন কাজ আমি কখনই করব না।

মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস বদলানো খুব কঠিন। যা ছেড়েছ তা আর ধরা ঠিক হবে। না। আবার যদি ধরো, দেখা গেল। আগের চেয়ে বেশি খেতে শুরু করেছ। আমার ভয়ে বাইরে গিয়ে খাচ্ছ। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছ। মোবারককে দিয়ে একটা দুটো করে আনোচ্ছ।

না তেমন আর হবে না।

হতে পারে।

আচ্ছা ঠিক আছে। খেলাম না।

সবচে বড় কথা সিগ্রেটের গন্ধ আমার ভাল লাগে না।

অথচ ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলোতে মেয়েরা আজকাল বেশি সিগ্রেট খাচ্ছে।

খাক গিয়ে।

দুজনেই একটু থামল।

শারামিনের তখন ভেতরে ভেতরে বেশ একটা অস্থিরতা চলছে। কথাটা পরিষ্কার করে বলছে না কেন বাবা! কেমন সমন্ধ এনেছেন খান সাহেব। ছেলেটা করে কী? পড়াশুনা কতদূর, দেখতে কেমন, ফ্যামিলি কেমন, এসব জানার জন্য শারমিন যে উদ্‌গ্ৰীব হয়েছে। বাবা কি তা বুঝতে পারছে না! এরকম একটি কথা বেশিক্ষণ না বলে সে থাকছেই বা কেমন করে!

বাবা অবশ্য শারমিনের মতো অস্থির ধরনের মানুষ নয়। ধীর-স্থির শান্ত স্বভাবের। যে কোনও কাজ দশবার ভেবেচিন্তে করে।

তা করুক গে। কিন্তু এখন শারমিনকে এমন সাসপেনসের মধ্যে রেখেছে কেন? বলছে না কেন কথাগুলো!

মেয়ের মনের অবস্থাটা যেন এসময় বুঝতে পারলেন জাহিদ সাহেব। হাসিমুখে বললেন, তোর খুব অস্থির লাগছে, না?

শারমিন হাসল। তোমার কি মনে হয়? লাগাবার কথা না?

হ্যাঁ। তোর জায়গায় আমি হলে আমারও লাগতো।

তাহলে বলে ফেল।

ছেলেটির নাম গালিব। গালিব আহসান চৌধুরী। গুলশানে নিজেদের বাড়ি। ব্যাঙ্গালোর থেকে এমবিএ করেছে। বাবার শিপিং বিজনেস। অয়েলট্যাঙ্কার কারগো, বরিশাল পটুয়াখালী যাওয়ার দোতলা বিশাল বিশাল লঞ্চ আছে চার পাঁচটা। তিনভাই দুবোন। দুবোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। গালিব সবার ছোট। বাবা এখন বিজনেস দেখে না। দুই বোনজামাই, বড় দুইভাই এবং গালিব এই পাঁচজনেই দেখাশোনা করে। মতিঝিলে অফিস আছে। গালিব সেই অফিসে বসে।

হাইট কেমন? বেঁটে ফেটে না তো?

জাহিদ সাহেব হাসলেন। আমি জানতাম এই প্রশ্নটাই তুই প্রথমে করবি। খান সাহেবকে আমিও প্রথমেই বলেছিলাম ছেলের হাইট কেমন? কালো ফর্সা কিংবা শ্যামলা গায়ের রং নিয়ে আমার কোনও কথা নেই, কথা ওই হাইট নিয়ে। বেঁটে মানুষ দুই চোখে দেখতে পারে না আমার মেয়ে।

খান আংকেল কী বললেন?

আমার কথা শুনে হাসলেন। আমি জানি আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেঁটে পছন্দ করে না। গালিবের হাইট খুব ভাল। পাঁচ ফিট দশ।

শুনে স্বস্থির একটা শ্বাস ফেলল শারমিন। কথা বলল না।

জাহিদ সাহেব বললেন, হাইট ঠিক আছে না?

খুব যে ঠিক আছে তা নয়। আজকালকার ছেলেরা ছয় দুই তিন এমনকি চার সোয়া চারও হচ্ছে। অনেক লম্বা মেয়েও দেখা যায় এখন।

তা যায়। কিন্তু তোর সঙ্গে মানানসই তো হতে হবে। অমিতাভ বচ্চন আর জয়া ভাদুড়ির মতো হলে তো হবে না।

শারমিন চোখ পাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। এই, আমি কি জয়া ভাদুড়ির মতো অত বেঁটে?

জাহিদ সাহেব হাসলেন। আরে না। তোর হাইট যথেষ্ট ভাল। বাঙালি মেয়ে হিসেবে পাঁচ পাঁচ ভাল হাইট।

জাহিদ সাহেব স্প্রাইটে চুমুক দিলেন।

শারমিন অস্থির গলায় বলল, কিন্তু খাবার দিচ্ছে না কেন? এত দেরি করছে কেন?

এক্ষুণি দেব মা। কোক খা।

আমার কোক তো শেষ।

কখন শেষ করলি?

শারমিন হাসল। কথার তালে ছিলাম। নিজেও বুঝতে পারিনি।

আর একটা দিতে বলব?

না। কোকে খুব ফ্যাট।

কিন্তু আমি জানি তুই খুব পছন্দ করিস।

তা করি।

তাহলে খা আর একটা। একদিন দুটো কোক খেলে কিছু হবে না। কাল না খেলেই হবে।

তোমার কি ধারণা আমি রোজ কোক খাই?

ধারণা না, তুই যে খাস তা আমি জানি।

কেমন করে জানো?

যাকে দিয়ে আনাস সেই বলেছে।

মোবারক। দাঁড়াও, বাড়ি গিয়ে আজ ওকে একটা গুতা দেব।

এসময় খাবার নিয়ে এল ওয়েটার। জাহিদ সাহেব বললেন, আর একটা কোক দেবেন।

শারমিন তখন বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে।

জাহিদ সাহেব বললেন, ছেলেটির ছবি টবি কিছু আমি দেখিনি। তবে সব শুনে আমার ভাল লেগেছে। শিক্ষিত, টাকা পয়সাআলা ভাল ঘরের ছেলে। ভাইবোনগুলো, দুই বোন জামাই সবাই লেখাপড়া জানা। এক বোন ডাক্তার আরেক বোন ভিকারুননিসা নুনের ইংরেজির টিচার। বড় ভাই মাস্টার্স করেছে ম্যানেজম্যান্টে। মেজোটা একাউনটিংয়ে। খান সাহেব বললেন, ওরা কেউ তেমন ফর্সা না, শ্যামলা ধরনের রং সবার। তবে চেহারা টেহারা ভাল।

শুনে শারমিন মনে মনে বলল, ফর্সা রংয়ের পুরুষ আমার একদম পছন্দ না। কেমন আলু মুলার মতো লাগে। আমি পছন্দ করি ডার্ক, ম্যানলি পুরুষ।

সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষটির কথা মনে পড়ল। শারমিনের সেও বেশ লম্বা, গায়ের রং কালোর দিকেই বলা যায়, আর বেশ ম্যানলি। চালচলন একেবারেই কেয়ারলেস টাইপের।

মানুষটির উদ্দেশ্যে শারমিন মনে মনে বলল, তোমার আর কোনও চান্স নেই গো! মির্জা গালিব আমাকে বোধহয় নিয়েই যাচ্ছে।

জাহিদ সাহেব খেতে খেতে বললেন, কী ভাবছিস?

মুখের খাবার শেষ করে শারমিন বলল, না কিছু না।

গালিবকে কেমন লাগল?

আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন, শারমিন চমকাল। কেমন লাগল মানে? আমি দেখেছি নাকি?

না মানে আমার কাছ থেকে শুনে!

আমার কিছু বলার নেই। তুমি যা ভাল বুঝবে তাই।

আমার কিন্তু পছন্দ।

তা আমি বুঝেছি।

আমি কি তাহলে আগাবো?

তোমার ইচ্ছা।

তবে তোকে যে তাদের পছন্দ হবে এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

কী করে বুঝলে।

আমি জানি, আমার মেয়ে খুব সুন্দর।

নিজের মেয়েকে সব বাবারই সুন্দর মনে হয়।

এটা ঠিক না।

কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে জানিস?

কী?

তোর দুটো ছবি আর বায়োডাটা চেয়েছিল ওরা। খান সাহেবকে দিয়েও ছিলাম। আজ সকালে ফোন করে খান সাহেব বললেন, খামটা নাকি সে খুঁজে পাচ্ছে না।

বলো কী? হারিয়ে ফেলেছে?

তাই তো বলল।

খুবই ইরেসপনসেবল লোক দেখছি।

এভাবে বলিস না। সে তো আর ইচ্ছে করে হারায়নি।

কিন্তু ব্যাপারটা খুব ভাল হয়নি বাবা। আজকাল কত ধরনের ধান্দাবাজ লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। তেমন কারও হাতে যদি আমার ছবি আর বায়োডাটা যায়, আমাকে যদি কেউ ব্লাকমেইল করে!

আরে না। কী ব্লাকমেইল করবে?

তুমি জানো না, করতে পারে।

মেয়ের প্লেটে দুটো চিংড়ি তুলে দিলেন জাহিদ সাহেব। ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না তো।

আচ্ছা ঠিক আছে ভাবব না। কিন্তু তুমি আমার ছবি পেলে কোথায়?

তোর এ্যালবাম থেকে নিয়েছি।

কই আমাকে তো কিছুই বলনি।

বলিনি ইচ্ছে করেই। ভেবেছি আগে ওদের সঙ্গে কথাটথা হোক তারপর বলব।

এখনও তো কথা হয়নি, আজ তাহলে বললে কেন?

জাহিদ সাহেব হাসলেন। ছবির জন্য।

মানে?

তোর আরও দুটো ছবি আমার লাগবে। আমার অফিসের কম্পিউটারে তোর বায়োডাটা আছে। সেখান থেকে একটা প্রিন্ট বের করে নেব। এখন তোর দুটো ছবি হলে দু-একদিনের মধ্যে খান সাহেবকে আবার পাঠাতে পারি।

আমাকে না বলেও তো ছবি নিয়ে নিতে পারতে।

তা পারতাম। আগেরবার ছবি বের করে দিয়েছিল নীলু। সেই ছবি হারিয়ে গেছে শুনে সেও কেমন একটু ভয় পেয়েছে। বললাম শারমিনের এ্যালবাম থেকে আরও দুটো ছবি এনে দে। শুনে বলল, আমি আর পারব না। পরে যখন তোমার মেয়ে সব শুনবে, আমাকে একদম খেয়ে ফেলবে। তখনই ডিসিশান নিলাম তোকে সব বলে দেব। তারপর তোর কাছ থেকেই ছবি চেয়ে নেব।

শারমিন এক চুমুক কোক খেল। তারপর মিষ্টি করে হাসল। এজন্যই আজ এখানে খাওয়াতে নিয়ে এসেছি।

জাহিদ সাহেবও হাসলেন। আরো না।

আমি ঠিকই বুঝেছি। আচ্ছা যাও, ঠিক আছে। ছবি তোমাকে আমি দেব। থ্রিাআর সাইজ, পাসপোর্ট সাইজ, যা চাও। আর যদি আমার আগের হারিয়ে যাওয়া ছবি নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়। সেই ঝামেলার জন্য কিন্তু তুমি আর খান আংকেল দায়ী থাকবে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

আবার কিছুটা সময় কাটে চুপচাপ। জাহিদ সাহেব খেতে খেতে কেমন উদাস হয়ে যান।

ব্যাপারটা খেয়াল করল শারমিন। বলল, কী ভাবছ বাবা?

অন্য একটা ঘটনার কথা ভাবছি।

কী বলো তো?

সকালবেলা তোকে আজ বলেছিলাম না, দুটো ঘটনার কথা বলব! একটা তো বলে ফেললাম। তোর বিয়ে, ছবি ইত্যাদি। অন্যটাও বলে ফেলি। কেন যে কাল থেকে ঘটনাটা থেকে থেকে মনে পড়ছে। তোর মায়ের মৃত্যুদিন ছিল বলেই হয়তো মনে পড়ছে। তোর মায়ের মৃত্যুদিনের ভোরবেলাই ঘটেছিল। ঘটনাটা। সাত বছর আগে। ঠিক ভোরবেলা না, ভোর রাত বলতে পারিস। তখনও ফজরের আজান হয়নি। চারটা পাঁচ দশ মিনিট হবে। উত্তরায় আমাদের বাড়ির সামনেই ঘটেছিল।

ইস বাবা, তুমি মাঝে মাঝে এত রহস্য করে কথা বলো। এত সময় নিচ্ছ কেন বলতে। সহজ ভাষায় চট করে বলে। ফেললেই তো হয়।

হ্যাঁ বলছি। ভোররাতে হাসপাতাল থেকে ফোন এল, তোর মার অবস্থা বেশ খারাপ। নীলু ছিল তোর মায়ের কাছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করল। ভাইজান, তুমি এক্ষুণি আস। ভাবীর শরীর খুবই খারাপ। ফোন পেয়ে আমি দিশেহারার মতো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আমাদের তখন গাড়ি নেই। বাড়ি একতলা হয়েছে। দোতলার কাজ চলছে। তোর মার কথায়ই একতলা কমপ্লিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে এসে উঠেছিলাম। আমরা। তাতে সুবিধাই হয়েছিল। বাড়িতে থেকেই বাড়ির কাজ তদারক করতে পারছিলাম। কিন্তু ভোেররাতে উত্তরা থেকে ঢাকা মেডিকেলে কেমন করে যাব। তবু দিশেহারার মতো বেরিয়েছি। মেইনরোডে। গিয়ে রিকশা স্কুটার যা পাই নিয়ে নেব। ভাড়া যা নেয় নেবে। উত্তরা তখন বেশ ফ্যাকা এলাকা। এত বাড়ি টারি তৈরি হয়নি। তবে হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকালেই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়ি দেখা যায় প্রচুর। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। আমি। কোনওদিকে খেয়াল নেই। দিশেহারার মতো ছুটছি। হঠাৎ দেখি আমাদের বাড়ি বরাবর লেকের পাড়ের আবছা অন্ধকারে দুজন মানুষ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে টালমাটাল পায়ে হাঁটছে। খানিকদূর গিয়ে লেকের ভাঙনের দিকে নেমে গেল তারা। শুধু এটুকুই আমি দেখলাম। তারপর আমার আর কিছু চোখে পড়েনি বা খেয়াল করিনি। স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়, হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে, রিকশা স্কুটার পাব কী পাব না জানি না, এই অবস্থায় অন্যকিছু কি আর খেয়াল থাকে! সেদিনই সকালবেলা তোর মা মারা গেলেন। লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম দশটার দিকে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই এসেছে। কান্নাকাটি বিলাপ চলছে বাড়িতে। ওই দৃশ্যটির কথা আমার আর মানেই নেই। তোর মাকে মাটি দিয়ে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে দেখি লেকের ওদিকটায় লোকজনের জটলা। পুলিশ এসেছে। কী ব্যাপার? লেকের ওদিকটায় একজন আধাবুড়ো লোকের লাশ ভাসছে। তার হাত-পা শক্ত দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বাধা।

শুনে চমকে উঠল। শারমিন। বলো কী!

হ্যাঁ। দড়ি দিয়ে বেঁধে লেকে ফেলে দেয়া হয়েছিল তাকে। যাতে নড়তে চড়তে না পারে। একবারেই ডুবে যায়।

তার মানে ভোররাতে তুমি যে দুজনকে আবছা মতন দেখেছিলে তাদের একজন আরেকজনকে এইভাবে মেরেছে?

হ্যাঁ।

পরে তুমি পুলিশকে ঘটনাটা জানাওনি?

না। কে যায়। ওসব ঝামেলায়। পুলিশকে তো নয়ই, কখনই কাউকে ঘটনাটা আমি বলিনি। আজই প্ৰথম তোকে বললাম।

কেন বললে?

জানি না। বলতে ভাল লাগল।  অনেকদিন বুকের ভেতর চেপে ছিল ঘটনাটা। আজ তোকে বলে বুকটা কেমন হালকা লাগছে।

পরে কি লোকটা পরিচয় টরিচয় জানা গিয়েছিল?

তেমন কিছু জানা যায়নি। পাড়ার লোকরা নাকি শুনেছিল লোকটা পুরনো ঢাকার। একসময় মাঝারি ধরনের গুন্ডা ছিল।

গুন্ডা কথাটা শুনে শারমিন কেমন যেন স্বস্তি পেল। ও গুন্ডা ছিল! তাহলে ঠিকই আছে। গুন্ডারা তো এইভাবেই মরে।

কিন্তু তখন লোকটা প্রায় বৃদ্ধ। গুন্ডামি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিল।

তাহলে হয়তো কেউ পুরনো শত্রুতার প্ৰতিশোধ নিয়েছে।

হয়তো তাই হবে।

দুজনেরই খাওয়া শেষ। টিসু পেপারে আলতো করে ঠোঁট মুছল শারমিন। আমি কিন্তু ঘটনাটা শুনে খুব একটা অবাক হইনি বাবা।

কেন?

আমার কাছে এমন কিছু ঘটনা মনে হয়নি। এরকম ঘটনা অনেক ঘটে।

কিন্তু আমার কাছে ঘটনাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে প্রায় মৃত্যুর কাছে চলে যাচ্ছে আমার স্ত্রী, তাকে শেষ দেখার জন্য ছুটছি, আর ঠিক সেই মুহূর্ত চোখের সামনে দেখছি একজন মানুষ নিঃশব্দে মেরে ফেলছে আরেকজনকে। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারছি না।

বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে শারমিন বলল, তোমার মনোভাবটা আমি বুঝেছি বাবা। চলো উঠি।

বিল মিটিয়ে ওরা যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুচ্ছে, তখন সেই মানুষটার কথা আবার মনে পড়ল শারমিনের। আর মাঝখান থেকে মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন। গোপনে তোমারে সখা…। কেন যে, শারমিন নিজেও তা জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *