৩৬-৪০. আরজান ফকিরের বাড়ি

৩৬.

আরজান ফকিরের বাড়ি আসিয়া বছির স্কুলে যাওয়া আসা করিতে লাগিল। ভাসান চর হইতে আরও তিন চারজন ছাত্র স্কুলে যায়। তাহারা সকলে আসিয়া বছিরের আস্তানায় জড় হয়। তারপর দল বাধিয়া স্কুলের পথে রওয়ানা হয়। স্কুলে যাইবার সময় তাহারা খুব আনন্দেই যায় কিন্তু ফিরিবার পথে সকলেরই পেট ক্ষুধায় জ্বলিতে থাকে। পথের দুইধারে গাছে গাছে যে দিনের যে ফল তাহা তাহাদের নখদর্পণে। ফিরিবার পথে তাহারা। গাছের ডাঁসা কাঁচা যত ফল খাইয়া দারুণ ক্ষুধার কিঞ্চিত নিবৃত্তি করে। এত পথ আসা যাওয়া করিয়া যখন তাহারা বাড়ি ফেরে তখন অতিরিক্ত আহারের ফলে ঘুমে তাহারা জড়াইয়া পড়ে। তবু পাঠ্যবইগুলি সামনে মেলিয়া ধরিয়া কিছুক্ষণ পড়িতে চেষ্টা করে। তারপর সাতরাজার ঘুম আসিয়া তাহাদিগকে পাইয়া বসে। তাই স্কুলের পরীক্ষায় তাহারা ভাল করিতে পারে না। কেহ কেহ একাদিক্রমে দুই তিনবার ফেল করে।

প্রথমে এখানে আসিয়া বছিরেরও সেই দশা হইল। সে বাড়ি আসিয়া খাইয়াই ঘুমাইয়া পড়ে। এই ভাবে সাত আটদিন যাওয়ার পরে সে ভাবিতে বসিল, এমন করিয়া ঘুমাইলে ত। তাহার চলিবে না! তার যে বড় হইতে হইবে। বড় হইয়া সে যে নিজ সমাজের অনেক। অনাচার দূর করিবে। বড়ুর কবরে বসিয়া সে যে নিজে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, বার বার সেই কথা সে মনে মনে আওড়ায়। নানা কিছুতেই তাহার ঘুমাইলে চলিবে না। সে একখণ্ড কাগজ লইয়া বড় বড় অক্ষরে লিখিল, “ঘুম শক্র”।

তারপর সেই কাগজখানা ঘরের বেড়ায় টানাইয়া রাখিল। তারই সামনে বসিয়া বইপত্র লইয়া বছির জোরে জোরে পড়ে। পড়িতে পড়িতে যখন চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয় তখন সে উঠিয়া চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়। ঘরের বাহিরে যাইয়া খানিকটা দৌড়াইয়া আসে। ঘুম কাটিয়া গেলে সে আবার পড়িতে বসে। ঘুমের সময় অঙ্ক কষিলে ঘুম পায় না। পড়িতে পড়িতে সে ঘুম তাড়ানোর এই অভিজ্ঞতা আবিষ্কার করিয়াছে। সে যতক্ষণ পড়ে ফকিরনী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া জাগিয়া থাকে। বছিরের সঙ্গে সেও যেন পরীক্ষার পড়া তৈরী করিতেছে। বছির পরীক্ষায় পাশ করিবে। ফকিরনীর পরীক্ষা কোন দিনই শেষ হইবে না। যাহারা মমতার বন্ধনে জড়াইয়া পড়ে, সর্বস্ব দিয়াও তাহাদের মনের অতৃপ্তি মেটে না।

ফকিরনীর পাশেই বছিরের শুইবার স্থান। পড়াশুনা করিয়া বছির ঘুমাইয়া পড়ে। পার্শ্বে বসিয়া ফকিরনী তাহাকে বাতাস করে। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়া চাঁদের আলো আসিয়া বছিরের শ্যামল লাবণ্যভরা মুখোনির উপর পড়ে। ফকিরনী যেন বিছানার কাঁথার গায়ে এই কিশোর-দেবতাটিকে তুলি দিয়া আঁকিয়া লইতেছে। সে পাখার বাতাস করিতে করিতে স্বপ্ন দেখে, সন্ধ্যার রঙিন মেঘগুলি আসিয়া তাহাকে বলিল, “আমরা তোমার তুলিতে ভর করিব। আমাদের রঙ দিয়া তোমার কিশোর-দেবতাটিকে গড়িয়া লও।” ফকিরনী বলিল, “না, তোমরা ওইখানে দাঁড়াইয়া দেখ।” সাতনরি হার গলায় পরিয়া রামধনু আসিয়া তাহার সামনে আসিয়া বলিল, “কৌটা খুলিয়া আমি ডালায় জড়াইয়া আনিয়াছি সাতটি রঙ। আমাকে তুমি লও।”

ফকিরনী বলিল, “না, তোমাকেও আমি চাহি না। তুমি ওইখানে দাঁড়াইয়া দেখ।” চাঁদের কলসী কাখে লইয়া জোছনা ছড়াইতে ছড়াইতে কে একটি মেয়ে আসিয়া বলিল, “আমি দিব সোনালী স্বপনের ঝিকিমিকি। আমাকে তুমি লও।”

ফকিরনী বলিল, “না–না, তুমিও লও। তোমাকে আমি চাই না! তুমি ওখানে দাঁড়াইয়া থাক।” আকাশের আঙিনায় নাচের নক্সা আঁকিতে আঁকিতে বিজলী আসিয়া বলিল, “আমি দিব রঙ আর গতি। তুমি আমাকে লও।” ফকিরনী বলিল, “না-না, তোমাকেও আমি চাহি না।”

তখন প্রথম আষাঢ়ের মেঘ তার কালো কাজল অঙ্গ বকের পাখা দিয়া মাজিতে মাজিতে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। ফকিরনী বলিল, “তোমাকে আমি চাই। তোমার কালো কাজল রঙ আমাকে দাও। আমি এই কিশোর দেবতার অঙ্গে মাখিয়া দিব।” নানা বরনের সবুজ অঙ্গে পরিয়া কচি ধান খেত আসিয়া সামনে খাড়া হইল। ফকিরনী বলিল, “তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করিতেছি। তুমি কৃষাণের স্বপ্ন হইয়া সারা মাঠ ভরিয়া তোমার শ্যামল অঞ্চল বিছাইয়াছ। তুমি দাও তোমার সজীবতা আর নানা ছাদের সবুজ সুষমা! এইসব লইয়া নিপুণ তুলি ধরিয়া মনের মতন করিয়া ফকিরনী যেন তার কিশোর-দেবতাটিকে অঙ্কন করিল। তখন জগতের যত স্নেহাতুর মাতা তারা দল বাঁধিয়া আসিয়া তাহাদের নিজ নিজ বাছনীদিগকে আদর করিতে যে চুম্বন দেয়, সেই চুম্বন যেন তারা একে একে সেই কিশোর বালকের গায়ে মুখে মাখিয়া দিয়া গেল। পাশে দাঁড়াইয়া সন্ধ্যার মেঘ, আকাশের রামধনু আর চাঁদ আর বিদ্যুৎ সমবেত কণ্ঠে গাহিল–সুন্দর–ওহে শ্যামল সুন্দর।

অশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে ফকিরনী অত শত ভাবিতে পারে কিনা জানি না। হয়ত পারে! গ্রাম্যরচনাকারীদের ভাবে এবং রসে যে কথাকলি ফুটিয়া আছে হয়ত এর চাইতেও সুন্দর কথা তার মনে উদয় হয়।

কত কথাই ফকিরনী ভাবে। ভাবিতে ভাবিতে রাত প্রায় শেষ হইয়া আসে। কোথাকার এক শূন্যতা আসিয়া যেন ফকিরনীর সমস্ত মনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাহাকার করে। তার কেবলই ইচ্ছা করে ওই ঘুমন্ত শ্যামল মুখোনি যদি সে চুমায় চুমায় ভরিয়া দিতে পারিত তবে বুঝি তার মনের সকল হাহাকার মিটিত। বাছা আমার ঘুমাইয়া আছে! আহা! সে ঘুমাইয়া থাক!

শেষ রাত্রে বছির জাগিয়া উঠিয়া দেখে, ফকিরনী তখনও তার শিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছে। সে বলে, “একি ফকির-মা! তুমি ঘুমাও নাই?” এই মা ডাক শুনিয়া তার বুভুক্ষু অন্তর যেন জুড়াইয়া যায়।

সে তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালাইয়া দেয়। তারই আলোকে বছির পড়িতে বসে।

ভাসানচরের ইয়াসীন, শামসু আর নবী ভালমত পড়াশুনা করিত না। নবী আর শামসু পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ইয়াসীন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। বছির তাহাদিগকে বলিয়া দিল, “ভাই! তোমরা রোজ সকালে আমার এহানে আইসা পড়াশুনা করবা আমি যতটা পারি, তোমাগো সাহায্য করব।”

দিনে দিনে ফকিরের বাড়িখানি যেন পড়ুয়াদের আড্ডায় পরিণত হইল।

দেখিতে দেখিতে বর্ষা আসিয়া পড়িল। সমস্ত চর পানিতে ডুবু ডুবু। এ-বাড়ি হইতে ও বাড়ি যাইতে নৌকা লাগে। বর্ষার জলধারায় পদ্মা নদী ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। আগে যে খেয়া-নৌকা দিয়া পার হইয়া বছির তাহার সঙ্গী-সাথীদের লইয়া স্কুলে যাইত তাহা উঠিয়া গিয়াছে। এখন তাহারা স্কুলে যাইবে কেমন করিয়া? ইয়াসীনের বাপ গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক। বছির তার ছেলেকে পড়াইতেছে দেখিয়া বছিরের প্রতি তাহার মনে খুব স্নেহ। ইয়াসীনের বাড়িতে দুই তিনখানা নৌকা। ইয়াসীনের বাপ তাহার একখানা ডিঙ্গি নৌকা তাহাদের পারাপারের জন্য ছাড়িয়া দিল। তিনজনের বই পুস্তক নৌকার পাটাতনের উপর। রাখিয়া তাহারা রোজ নৌকা বাহিয়া স্কুলে যায়। আলীপুরের মোড়ে নৌকা বাধিয়া রাখে। স্কুলের ছুটি হইলে আবার নৌকা বাহিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসে। আগে হাঁটাপথে স্কুলে যাতায়াত করিতে হইত। তাহাতে স্কুলে পৌঁছিতে তাহাদের এত ঘন্টা লাগিল। এখন ধান খেতের পাশ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাও দাঁড়া দিয়া নৌকা চালাইতে হয়। তাই দেড় ঘন্টার। আগে তাহারা স্কুলে পৌঁছিতে পারে না। যেদিন বৃষ্টি হয় একজন বসিয়া বুকের তলায় বই-পত্রগুলিকে কোন রকমে বৃষ্টির হাত হইতে রক্ষা করে। কিন্তু তিনজনেই ভিজিয়া কাকের ছাও হইয়া যায়। সেই ভিজা জামা কাপড় শুদ্ধই তাহারা স্কুলে যায়। স্কুলে যাইয়া গায়ের জামা খুলিয়া শুখাইতে দেয়। পরনের ভিজা কাপড় পরনেই থাকে।

ফিরিবার পথে নৌকায় উঠিয়া তাহাদের কতই যে ক্ষুধা লাগে। ইয়াসীন বছিরকে বলে, “বছির ভাই! আমাগো বাড়ি যদি শহরে থাকত তয় কত মজাই ঐত! এতক্ষণে বাড়ি যায় খায়া লয়া খেলাইতি যাইতাম।”

বছির বলে, “ভাই! একজন লোক কইছে, বড় হওয়া মানে অনেক অসুবিধার ভিতর দিয়া নিজেরে চালায়া নেওয়া–অভাবের আগুনের মদ্দি জ্বইলা পুইড়া নিজেরে সোনা করা। ভাই ইয়াসীন! দুঃখ আর অভাব একটা বড় রকমের পরীক্ষা হয়া আমাগো সামনে আইছে। এই পরীক্ষায় পাশ করতি অবি।”

ইয়াসীন বলে, “কিন্তুক বাই। এ পরীক্ষায় পাশের নম্বর আমাগো কেউ দিবি না।”

উত্তরে বছির বলে, “দিবি ভাই–একদিন দিবি, যদি আমরা বালমত পাশ করবার পারি, এই যে কত দুঃখ কষ্ট সইবার অভ্যাস আমাগো ঐল, এই অভ্যাস আমাগো কামে দিবি। জানস, আমাগো নবীজীরে কত দুস্কের মদ্দী দ্যা চলতি ঐছিল। সেই জন্যি ইত। তানি দুঃখী জনের বন্ধু।”

নৌকা বাহিতে বাহিতে তাহারা পদ্মানদী পার হইয়া আসিল। সামনে কলিমদ্দীর ধানের খেতের পাশ দিয়া নাও দাঁড়া। বামধারে মেছের সেখ ডুবিয়া পাট কাটিতেছে। এক এক ডুব দেয় আর পাট গাছের আগাগুলি নড়িয়া ওঠে। ধারালো কচির আঘাতে গুচ্ছ গুচ্ছ পাট কাটিয়া সে আঁটি বাধিতে থাকে। এক আঁটিগুলি পরে এক জায়গায় জড় করিয়া তবে জাগ দিবে। জাগের উপর কচুরিপানার ভারা দিবে; যাহাতে পাটের জাগ ভাসিয়া অন্যত্র চলিয়া না যায়। সেই পাটখেত ছাড়াইয়া তাহারা মিঞাজানের ধান খেতের পাশ দিয়া চলিল। কি সুন্দর গুচ্ছ গুচ্ছ পক্ষিরাজ ধান পাকিয়া আছে। কালো রঙের ধানগুলি। প্রত্যেক ধানের মুখে সাদা রেখা যেন পাখা মেলিয়া আছে। ধানের পাতাগুলি রৌদ্রে সোনালী রাঙালি রঙ ধরিয়াছে। বর্ষার পানির উপরে যেন একখানা পটে আঁকা ছবি। হাজার হাজার পাখি কোথায় যেন উড়িয়া চলিয়াছে। বাতাসের মৃদু ঢেউএ ধান গাছগুলি দুলিতেছে। যেন পাখিগুলির পাখা নড়িতেছে। এই ধান সকল মানুষের আশা ভরসা। চাষীর মনের স্বপ্ন জীবন্ত হইয়া পানির উপর ভাসিতেছে। বছির বলে, “ভাই ইয়াসীন!–ভাই আজিম। তোমরা পরাণ ভইরা দেইখা লও। এই সুন্দর ছবি শহরের লোকেরা কুনু দিন দেহে নাই। আর শোন ভাই! এত পানি ঠেইলা এই ধান গাছগুলি উপরে মাথা উঠাইয়া ধানের ভরে হাসত্যাছে। আমরাও একদিন এমনি দুস্কের সঁতার পানি ঠেইলা জীবনের সুফল লয়া হাসপ।”

ইয়াসীন বলে, “কিন্তু ক ভাই! আমরা কি এই পানি ঠেইলা উঠতি পারব?”

বছির উত্তর করে, “আলবৎ পারব ভাই! আমার যা বিদ্যা বুদ্ধি আছে তাই দিয় তোমাগো পড়াব। আমরা সগলেই পইড়া বড় অব। দুঃখ দেইখা আমাগো ভয় পাইলি চলবি না।”

বছিরের কথা শুনিয়া তাহার সাথীদের মনে আশায় সঞ্চার হয়। তাহারা আরও জোরে। জোরে নৌকা চালায়।

.

৩৭.

মাঠের কাজ করিতে করিতে আজাহের ছেলের কথা ভাবে। ছেলে তাহার কি পড়িতেছে তাহা সে বুঝিতে পারে না। হয়ত আকাশে যত তারা আছে–পাতালে যত বালু আছে সব সে গণিয়া কালি করিতে পারে। আরও কত কত বিষয় সে জানে! কিন্তু এ তার ভাবনার প্রধান লক্ষ্য নয়। সে যেমন খেতের একদিক হইতে লাঙলের ফোড় দিয়া অপর দিকে যাইতেছে তেমনি তার ছেলে বড়লোক হওয়ার পথে আওগাইয়া যাইতেছে–ভদ্রলোক হইবার রাস্তায় হাঁটিয়া যাইতেছে। যে ভদ্রলোকেরা তাহাকে ঘৃণা করে–যে ভদ্রলোকেরা তাহাকে অবহেলা করে, তাহার ছেলে তাদেরই সামিল হইতে চলিয়াছে। গর্বে আজাহেরে বুক ফুলিয়া ওঠে। সে যেন মানসলোকে স্বপ্ন দেখিতেছে।

বাড়ি ফিরিয়া দুপুরের ভাত খাইতে খাইতে আজাহের বউ-এর সঙ্গে ছেলের বিষয়ে আলাপ করে। সে যেন গাজীর গানের দলের কোন অপরূপ কথাকার বনিয়াছে।

আজাহের বলে, “ছেলে আমার লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ হইয়া আসিবে। আজ যাহারা আমাদিগকে গরীব বলিয়া অবহেলা করে, একদিন তাহারা আমাদিগকে মান্য করিবে-সম্মান দেখাইবে। বউ! তুমি আরও মনোযোগ দিয়া সংসারের কাজ কর। ছেলের বউ আসিবে ঘরে। নাতি নাতকুর হইবে। বাড়ির ওইধারে পেয়ারার গাছ লাগাও–এধারে মিঠা আমের গাছ। আমার নাতিরা গাছে উঠিয়া পাড়িয়া খাইবে। আমরা চাহিয়া চাহিয়া দেখিব। আর শোন কথা; এবারের পাট বেচিব না। ঘরে বসিয়া রশি পাকাইব। তুমি সুতলী পাকাইও। পাটের দামের চাইতে রশির দাম বেশী–সুতলীর দাম বেশী।”

রাত্রে সামান্য কিছু আহার করিয়া আজাহের ঝুড়ি বুনাইতে বসে। বউ পাশে সুতলী বুনায়। এই বুননীর পাকে পাকে ওরা যেন ছেলের ভবিষ্যৎ বুনাইয়া চলিয়াছে।

কোন কোনদিন গরীবুল্লা মাতবর আসে। পাড়ার তাহের আসে–ছমির আসে-কুতুবদী আসে। উঠানে বসিয়া তারা আজাহেরের কাছে তার ছেলের কাহিনী শোনে। সেই উকিল সাবের বাড়ি হইতে কি করিয়া বছির মসজিদে যাইয়া আস্তানা লইল, তারপর সেখান হইতে চরকেষ্টপুর আরজান ফকিরের বাড়ি–এ-কাহিনী যেন রূপকথার কাহিনীর চাইতেও মধুর। কারণ এ যে তাহাদের নিজেদের কাহিনী। একই গল্প তাই শুনিবার জন্য তাহারা বার বার আসে। যে বিদ্বান হইয়া আসিতেছে সে ত শুধু আজাহেরের ছেলে নয়, সে যে তাহাদের সকল গ্রামবাসীর ছেলে। সে বড় হইয়া আসিলে তাহাদের গ্রামের সুনাম হইবে। গ্রামবাসীদের গৌরব বাড়িবে। তাহাদের দুঃখ-কষ্ট দূর হইবে।

গরীবুল্লা মাতবর বলে, ”আজাহের! তোমার ছাওয়ালের বই-পুস্তক কিনার জন্যি আমি দিব পাঁচ টাহা। কও তো মিঞারা তুমরা কে কি দিবা?” ছমরুদ্দী দিবে দুই টাকা, তাহের দিবে তিন টাকা, তমু টাকা দিতে পারিবে না। সে ছেলের নাস্তা করিবার জন্য দশ সের চিড়া কুটিয়া দিবে। মিঞাজান দিবে এক হাঁড়ি খেজুরে-গুড়।

রবিবারে হাটের দিন এই সব লইয়া আজাহের ছেলের সঙ্গে দেখা করে। সমস্ত জিনিস নামাইয়া টাকাগুলি গণিয়া আজাহের তার গামছার খোট খুলিয়া কতকটা কাউনের ছাতু বাহির করে। “এ গুলান তোর মা পাঠাইছে। আমার সামনে বইসা খা। আর এক কথা,” গামছার আর এক কোণা খুলিয়া আজাহের দুইগাছি ডুমকুরের মালা বাহির করে। “আসপার সময় ফুলী দিয়া গ্যাছে। আর কইছে, বছির বাই যিনি এই ডুমকুরির মালা দুইগাছ গলায় পইরা একটা একটা কইরা ছিড়া খায়।”

আরজান ফকিরের ঘরের মেঝের বসিয়া আজাহের ছেলের সঙ্গে কথা কয়। তাম্বুলখানায় সমস্ত গ্রামের মায়া-মমতা সে যেন ছেলের কাছে লইয়া আসিয়াছে। “বাজান! তুমি কুনু চিন্তা কইর না। তুমার লেহনের বই-কাগজের জন্যি বাইব না। সগল গিরাম তোমার পাছে খাড়ায়া আছে। আমি যেডা না দিতি পারব ওরা সেডা আইনা দিবি। বাজান! তুমি আরও মন দিয়া লেহাপড়া কর।”

বাপের কথা শুনিয়া বছিরের দুই চোখে পানি আসিতে চাহে। বছির শুধু একাই শত সহস্র অভাব অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে না। তাহার গ্রামবাসীরাও তাহার পিছনে থাকিয়া তাহার জন্য ছোট-খাট কত আত্মত্যাগ করিতেছে। এই সব

ছোট-খাট উপহার সামগ্রীর মধ্যে তাহাদের সকলের শুভ কামনা তাহার অন্তরকে আরও আশান্বিত করিয়া তোলে।

.

৩৮.

সেদিন কি একটা কারণে স্কুলের ছুটি ছিল। বছির চলিল তাহার সেই মসজিদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করিতে। তারই মত ওরাও নানা অভাব-অভিযোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে। ওদের কথা ভাবিতে ভাবিতে বছিরের মনে সাহসের সঞ্চার হয়। মনের বল বাড়িয়া যায়।

বছিরকে দেখিয়া মজিদ দৌড়াইয়া আসিল, ইয়াসীন দৌড়াইয়া আসিল। তারপর তাহাকে ঘরে লইয়া গিয়া বসাইয়া কত রকমের কথা। সে সব কথা সুখের কথা নয়। অভাব অনটনের কথা। অসুখ-বিসুখের কথা। মজিদের মায়ের খুব অসুখ। মজিদকে দেখিতে চাহিতেছে। কিন্তু সে যাইবে কেমন করিয়া? তাহার বাড়ি সেই মাদারীপুর ছাড়িয়া ত্রিশ মাইল দূরের এক গ্রামে। সেখানে যাইতে আসিতে অন্ততঃ দশ টাকার প্রয়োজন। মজিদ কোথায় পাইবে এত টাকা? মাকে দেখিতে যাইতে পারিতেছে না। খোদা না করুন, মা যদি মরিয়া যায় তবে ত জন্মের মত আর তার সঙ্গে দেখা হইবে না। রাত্রে শুইতে গেলে কান্নায় বালিশ ভিজিয়া যায়। অভাব অনটন শুধু তাহাকে অনাহারেই রাখে নাই। কঠিন শৃখলে বাধিয়া তাহার স্নেহ-মমতার পাত্রগুলি হইতে তাহাকে দূরে সরাইয়া রাখিয়াছে। ইয়াসীনের দিকে চাহিয়া বছির জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কি করতাছাও বাই?” ইয়াসীন বলে, সে হাফেজে-কোরান হইয়া কারী হইবে তখন তাহাকে কোরান শরীফের অর্থ জানিতে হইবে।

এরূপ অনেক কথার পর বছির জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা ভাই! করিম কোথায় গ্যাল? তারে ত দেখতি পাইত্যাছি না।”

মজিদ বলিল, “করিমের একটু একটু জ্বর ঐছিল। ডাক্তার দেইখ্যা কইল, ওর যক্ষা! ঐছে। তহন উকিল সাহেব খবর পায়া ওরে এহান হাইনে তাড়ায়া দিল। যাইবার সময় করিম কানল! আমরা কি করব বাই? আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে কানলাম।”

বছির জিজ্ঞাসা করিল, “উকিল সাহেব ত ইচ্ছা করলি তারে হাসপাতালে বর্তি কইরা দিতি পারতেন। আইজ কাল যক্ষ্মা রোগের কত বাল বাল চিকিৎসা ঐছে।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মজিদ বলিল, “কেডা কার জন্যি বাবেরে বাই? মানুষের জন্যি যদি মানুষ কানত, তয় কি দুইনায় এত দুষ্ণু থাকত?”

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বছির জিজ্ঞাসা করিল, “করিম এহন কোথায় আছে। তোমরা কবার পার?”

মজিদ বলিল, “তা ত জানি না বাই। তার সঙ্গে দেখা করতি উকিল সাব আমাগো বারণ কইরা দিছেন। তয় হুনছি সে দিগম্বর সান্যালের ঘাটলার ফকির মিছকিনগো লগে থাহে। সে চইলা যাওয়ায় এহন আর আমরা কোথায় কার বাড়ি খাওয়া লওয়া ঐত্যাছে। তার খবর পাই না। কতদিন না খায়াই কাটাই। ও আমাগো কত উপকারে লাগত। আমরা উয়ার কোন উপকারেই আইলাম না।”

বছির বলিল, “বাই। একদিন আমাগো দিন আইব। গরীবের দিন, না খাওয়া ভুখাকা মানষির দিন আইব। তোমরা এখানে থাইকা ইসলামী শিক্ষা লও। আমি ইংরাজী শিহি। তারপর উপযুক্ত হয়া আমরা এমন সমাজ গঠন করব সেহানে দুঃখিত লোক থাকপি না। একজন ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং দিয়া খাবি আর হাজার হাজার লোক না খায়া মরবি এ সমাজ ব্যবস্থা আমরা বাঙব। এই সমাজরে ভাইঙ্গা চূর্ণ বিচূর্ণ কইরা নতুন মানুষের সমাজ গড়ব। তার জন্যি আমাগো তৈরী ঐতি অবি। আরও দুঃখ কষ্ট সহ্য কইরা লেহাপড়া শিখতি অবি।”

মসজিদের বন্ধুদের কাছে বিদায় লইয়া বছির চলিল দিগম্বর সান্যালের ঘাটলায়। চকবাজারের মধ্য দিয়া পথ চলিয়া গিয়াছে ঘাটলায়। ঘাটলার দুইপাশে কত দেশ বিদেশের নৌকা আসিয়া ভিড়িয়াছে। ঘাটলার স্বল্প পরিসর ঘরে নোংরা কাপড় পরা পাঁচ সাত জন ভিখারী পড়িয়া আছে। ও ধারে একজন সন্ন্যাসী তার কয়েক জন ভক্তকে লইয়া গাঁজায়। দম দিতেছে আর নিজের বুজুরকির কাহিনী বলিতেছে। কিন্তু কোনখানেই ত করিমের দেখা মিলিল না। অনেক খোঁজাখুজির পর এক কোণে একটি লোককে দেখিতে পাইল। মানুষ না কয়খানা হাড়গোড় চিনিবার উপায় নাই!

সামনে যাইতেই লোকটি বলিয়া উঠিল, “ও কেডা বছির বাই নাহি? আমার একটা কথা হুইনা যাও।” বছির বিস্ময়ে লোকটির দিকে চাহিয়া রহিল।

“আমারে চিনবার পারলা না বছির বাই! আর চিনবা কেমন কইরা? আমার শরীলে কি আর বস্তু আছে? আমি করিম”।

“করিম! আইজ তুমার এমন অবস্থা ঐছে?” বছির কাছে যাইয়া বসিয়া দুইহাতে করিমের মুখ সাপটাইয়া দিল। সমবেদনার এই স্পর্শে করিমের দু’চোখ বহিয়া ফোঁটায়। ফোঁটায় জলধারা বহিতে লাগিল।

করিম বলিল, “তুমার সঙ্গে যে দেখা অবে তা কুনুদিনই বাবি নাই বছির বাই। দেখা যহন ঐল, তোমার কাছে কয়ডা কথা কব।”

বছির বলিল, “কথা পরে অবি বাই। তুমি বইস। তুমার জন্যি কিছু খাবার আনি।” এই বলিয়া বছির নিজের পকেট হাতড়াইয়া চারিটি পয়সা বাহির করিয়া সামনের দোকান হইতে একখানা রুটি কিনিয়া আনিল।

সেই রুটিখানা করিম এমনই গোগ্রাসে খাইতে লাগিল যে বছিরের ভয় হইতে লাগিল, পাছে সে গলায় ঠেকিয়া মারা যায়। সে তাড়াতাড়ি তার টিনের কৌটার গ্লাসটায় পানি লইয়া সামনে বসিয়া রহিল। রুটিখানার শেষ অংশটুকু খাইয়া করিম ঢক ঢক করিয়া টিনের গ্লাসের সবটুকু পানি খাইয়া ফেলিল।

“কতদিন খাই না বছির বাই। রুটিখানা খায়া শরীলে একটু বল পাইলাম। যহন চলতি পারতাম এহানে ওখানে মাইঙ্গা আইনা খাইতাম। আইজ কয়দিন সারা রাইত এমনি কাশি ওঠে যে দিনে আর চলবার পারি না।”

যে জায়গাটায় করিম শুইয়াছিল সেখানে আখের ছুবড়া,ছোবড়া কাগজ প্রভৃতির আবর্জনা জমিয়াছিল। বছির সে সব পরিষ্কার করিয়া তাহার ময়লা চাঁদরের বিছানাটি ঝাড়িয়া ঝুড়িয়া সমান করিয়া দিল।

করিম জিজ্ঞাসা করিল, “বছির বাই! তুমি কি আমার মসজিদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করছিলা? কতদিন তাগো খবর পাই না। তারাও আমার খোঁজ লয় না। আর কি কইরাই বা খবর নিবি? উকিল সাব হুনলি তাগো ত আর মসজিদে রাখপি না।”

বছির আচ্ছা করিম! তুমি এখানে রইছ কেন? হুনছি তোমার মা আছে, দুইডা ভাই-বোন আছে। তাগো কাছে চইলা যাওনা কেন?

করিম উত্তর করিল, “তাগো কাছেই যাবার চাইছিলাম। কিন্তু উকিল সাব কইলেন আমার এ ব্যারাম ছোঁয়াইচা। আমি যদি বাড়ি যাই, আমার মার–আমার ভাই-বোনগো এই ব্যারাম ঐব। হেই জন্যিই বাড়ি যাই না। আমি ত বাঁচপই না। আমার মা, ভাই-বোনগো এই ব্যারাম দিয়া গেলি কে তাগো দেখাপ? আর হোন বাই! তুমি যে আমারে চুইলা, বাড়ি যায়া সাবান পানি দ্যা গাও গতর পরিষ্কার কইরা নিও। বড় বুল। করছি বাই। কেন আমারে ‘বার সময় তোমারে বারণ করলাম না?”

“আমার জন্যি তুমি বাইব না করিম! আমি তোমারে ডাক্তার খানায় নিয়া বর্তী করায়া দিব।”

“ডাক্তারখানায় আমি গেছিলাম বছির ভাই। তারা এই ব্যারামের রোগীগো বর্তী করে না। হুনছি ডাহার শহরে এই ব্যারামের হাসপাতাল আছে। সেহানে বর্তী ঐতে অনেক টাহা পয়সা দিয়া ফটোক উঠায়া পাঠাইতি অয়। তা আমি হেই টাহা পয়সা কোথায় পাব? আমার জন্যি বাইব না বছির বাই। কালে যারে দরছে তারে কে উদ্ধার করবি।”

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া করিম বলিল, “আচ্ছা বছির বাই! আমার মসজিদের দোস্তগো লগে তোমার দেখা অয়?”

“আইজ তাগো ওহানে গেছিলাম। তারাই ত তোমার খবর কইল।”

“তারা সব বাল আছে? মজিদ, আরফান, আজিম, ওরা বাল আছে?”

“তারা সগলেই তোমার কথা মনে করে।”

“দেহ বাই! আমি এখানে পইড়া আছি। কোথায় কোথায় মেজবানী হয় তাগো খবর। দিবার পারি না। হয়ত ওরা কতদিন না খাইয়া থাহে। মজিদরে তুমি কইও বাই! ওরা যেন রোজ মাছের বাজারে আর দুধির বাজারে যায়। এ সগল জায়গায় একজন না একজন অনেক মাছ কেনে–অনেক দুধ কেনে। তাগো বাড়িই মেজবানী হয়। বাজারের মদ্দিই তাগো ঠিক ঠিকানা জাইনা নিয়া তাগো বাড়ি গেলিই ঐল। ফুরকানিয়া মাদ্রাসার তালেম-এলেমগো কেউ না খাওয়ায়া ফিরায়া দিবি না। মজিদের সঙ্গে দেখা কইরা এই খবরডা তারে কইও।”

“তা কব বাই। করিম! তুমি এহন ঘুমাও। আমি বাড়ি যাই।”

“হ যাও বাই! যদি বাইচা থাহি আর একবার আইসা আমারে দেইখা যাইও! তোমারে কওনের আমার একটা কথা আছে।”

বাড়িতে ফিরিয়া ফকির-মার কাছে বছির করিমের সকল ঘটনা বলিল।

ফকির-মা বলিল, “বাবা! আমি একদিন যায়া ওরে দেইখা আসপ।”

সত্য সত্যই বছিরকে সঙ্গে লইয়া ফকির-মা একদিন করিমকে দেখিতে আসিল। সেদিন করিমের অবস্থা খুবই খারাপ। জ্ঞান আছে কি নাই। ফকির-মা তার আঁচল দিয়া অনেকক্ষণ করিমকে বাতাস করিল। মাথার চুলে হাত বুলাইয়া দিল। কিছুক্ষণ পরে করিমের জ্ঞান ফিরিয়া আসিল। চক্ষু মেলিয়া করিম ডাকিল, “মা! মাগো!”

ফকির-মা বলিল, “এই যে গোপাল। আমি তোমার সামনে বইসা আছি।”

চক্ষু মেলিয়া করিম দেখিল, শিয়রে বসিয়া যে মেয়েটি তার চোখে মুখে হাত বুলাইতেছে সে তার নিজের মা নয়। কতই যেন নিরাশার একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সে আবার চক্ষু মুদ্রিত করিল। ফকির-মা সবই বুঝিতে পারিল। সে তাহার চুলের মধ্যে নখ বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “বাজান! মায়ের কোন জাতি নাই। সকল মায়ের মধ্যে তোমার সেই একই মা বিরাজ করত্যাছে। আমার ফকির কইছে,

নানান বরণ গাভীরে একই বরণ দুধ,
আমি জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।

গোপাল! একবার চক্ষু মেলন কইরা চাও।”

করিম চক্ষু মেলিয়া চাহিল। ফকির-মা গ্রাম হইতে একটু দুধ লইয়া আসিয়াছিল। তারা ধীরে ধীরে করিমের মুখে ঢালিয়া দিল। দুধটুকু পান করিয়া করিমের একটু আরাম বোধ। হইল। ফকির-মার হাতখানা বুকের উপর লইয়া করিম বলিল, “ফকির-মা! আমার ত দিন শেষ হয়া আইছে। কিন্তুক আমার ভড়ই ভয় করতাছে।”

ফকির-মা তাহাকে আদর করিতে করিতে বলিল, “বাজানরে! আমার ফকির কইছে কোন কিছুতেই ভয় করতি নাই। মরণ যদিই বা আসে তারে গলার মালা কইরা নিবি। মরণ তো একদ্যাশ থইনে আর এক দ্যাশে যাওয়া। সে দ্যাশে হয়ত এমুন দুস্কু কষ্ট নাই। হয়ত সে দ্যাশে তোমার মায়ের চায়াও দরদী মা আছে–বন্ধুর চায়াও দরদী বন্ধু আছে। নতুন দ্যাশে যাইতি মানুষ কত আনন্দ করে। যদি সে দ্যাশে তোমার যাইতিই হয়, মুখ কালা কইরা যাইও না বাজান! খুশী মনে যাইও ।”

ফকির মায়ের হাতখানা আরও বুকের মধ্যে জড়াইয়া করিম বলিল, “ফকির-মা! তোমার কথা শুইনা বুকির মদ্দি বল পাইলাম। আমার মনে অনেক সাহস আইল।”

ফকির-মা বলিল, “বাজানরে! আমার ফকির যে আনন্দ ধামে বিরাজ করে। তাই যেহানে যাই, সেহানেই আমার ফকির আনন্দ আইনা দেয়। আমার ফকিরের দরবারে নিরাশা নাই বাজান!” এই বলিয়া ফকির-মা একটি গান ধরিল–

ধীরে ধীরে বাওরে নৌকা
আমারে নিও তোমার নায়।
পদ্মা নদীর তুফান দেইখ্যা
প্রাণ করে হায় হায়,
ও মাঝি শক্ত কইরা হাইল ধরিও
আজকা আমার ভাঙা নায়।
আমি অফর বেলায় নাও ভাসাইলাম
অকুল দরিয়ায়;
কূলের কলঙ্ক হবে
যদি তরী ডুইবা যায়।
তুফানের বানাইছি বাদাম
মেঘের বানছি ছয়া,
ঢেউ-এর বৈঠা বায়া মাঝি
আমারে যাও লয়া।
ডুবুক ডুবুক ভাঙা তরী
ডুবুক বহু দূর,
ডুইবা দেখব কোথায় আছে
ডবুনিয়ারপুর।

গান গাহিতে গাহিতে ফকির-মার দুইচোখ জলে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। গান শেষ হইলে করিম বছিরকে কাছে ডাকিয়া বলিল, “বছিরবাই! তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। সেদিন কইবার পারি নাই। আজ তোমারে কয়া যাই।”

আরও নিকটে আসিয়া বছির বলিল, “কও ত বাই! কি কথা?”

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া করিম বলিল, “বছিরবাই! আমার দিন ত ফুরায়াই আইছে। মা বাপের লগে আর দেখা অবি না। তারা যদি হোনে আমি পথে পইড়া মরছি সে শোগ তারা পাশরতি পারবি না। তুমি তাগো কাছে কইও, আমি হাসপাতালে যায় মরছি। অনেক বড় বড় ডাক্তার কবিরাজ আমার চিকিচ্ছা করছে। আমার কোরান শরীফখানা আমার মা জননীরে দিও। এই কেতাবের মদ্দি অনেক সান্ত্বনার কথা আছে। কাউরে দিয়া পড়ায়া মা যেন তা শোনে। তাতে সে আমার যোগ কতকটা পাশরতি পারবি।” এই বলিয়া করিম হাঁপাইতে লাগিল।

বছির করিমের মুখে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “ভাই করিম! তুমি অত কথা কইও না। দেখছাও না তুমি কেমন হাঁপায়া উঠছাও। একটু চুপ কইরা থাহ।”

করিম বলিল, “না বাই! আমারে চুপ করতি কইও না। আমার বেশী সময় নাই! আর একটা মাত্র কথা। আমার ঝুলির মদ্দি একগাছা রাঙা সূতা আছে। আমার ছোট বোনটিরে নিয়া দিও। তারে কইও, তার গরীব ভাইজানের ইয়ার চাইতে বাল কিছু দিবার শক্তি ছিল না।” বলিতে বলিতে করিমের কাশি উঠিল। সেই কাশিতে তার বুকখানা যেন ফাটিয়া যাইবে । তারপর আস্তে আস্তে সে চিরনিদ্রায় ঘুমাইয়া পড়িল। তার মুখখানা কাপড় দিয়া ঢাকিয়া ফকির-মা আবার গান ধরিল–

চল যাইরে,
আমার দরদীর তালাশেরে
মন চল যাইরে।

.

৩৯.

দিনে দিনে হায়রে ভাল দিন চইলা যায়। বিহানের শিশির ধারা দুপুরে শুখায়। বারো জঙ্গ করে মদ্দ কিতাবে খবর, তের জঙ্গ লেখা যায়রে টঙ্গির শহর। জেলা স্কুল হইতে পাশ করিয়া বছির ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হইতে জলপানি পাইয়া আই, এস, সি, পাশ করিয়া বিলাত চলিল জীবাণু বিদ্যার উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করিতে। এত পথ সে কি করিয়া পার হইবে? কোন-জাহাজের খালাসী হইয়া যাইবে। বিলাতে যাইয়া সে প্রথমে সিলেটিদের হোটেলে কাজ করিবে? তারপর সুযোগ মত পড়াশুনা করিবে।

তার জীবনের সুদীর্ঘ কাহিনীর সঙ্গে কতক তার নিজের অক্লান্ত তপস্যা, কতক তার অভাব অনটনকে জয় করার অপরিসীম ক্ষমতা মিশিয়া রহিয়াছে। তাহার সঙ্গে আরও রহিয়াছে তাহার অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের শুভকামনা। তাই তাহার এই সাফল্যে সমস্ত গ্রাম গৌরবান্বিত।

রাত্রে গ্রামের সকল লোক আসিয়া জড় হইল তাহাদের উঠানে। গরীবুল্লা মাতবর, তাহের লেংড়া, মাকিম, তমু সকলের আগে আসিল।

গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “তা বাবা বছির! তুমি আমাগো গিরামের নামডা আসমানে। উঠাইলা। বিদ্যাশে বিভূঁইয়ে চলছাও। আমাগো কথা মনে রাইখ।”

বছির উত্তর করিল, “চাচা! আমার জীবনের যত সুখ্যাতি তার পিছে রইছে আপনাগো দোয়া আর সাহায্য। আপনারা যদি আমারে সাহায্য না করতেন তয় আমি এতদূর যাইতি পারতাম না। ফইরাতপুরির ইস্কুলে পড়নের সময় যহন বাজান গামছায় বাইন্দা পাটালী গুড় নিয়া গ্যাছে আর আমারে কইছে, মাতবরের বউ দিছে তোরে খাইবার জন্যি; তহন আমার মনে যে কত কথার উদয় হইতে তা আপনাগো বুজাবার পারব না। গিরামের সবাই আমারে কিছু না কিছু সাহায্য করছে। আপনারা সগলে চান্দা তুইলা আমার পড়ার খরচ দিছেন। আপনাগো উপকারের পরিশোধ আমি কুনুদিন দিতি পারব না।”

গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাজান! তোমার কুনু পরিশোধ দিতি অবি না। তুমি সগল। বিদ্যা শিখা বড় হয়া আইস, তাতেই আমাগো পরিশোধ হবি।”

আজাহের আওগাইয়া আসিয়া বলিল, “ওসব পরিশোধের কথা আমি বুজি না। আমাগো গিরামের লোক অর্ধেক হয়া গ্যাল ম্যালোয়ারী জ্বরে। তুই বিলাত গুণা ম্যালোয়ারী জ্বরের ওষুধ শিহা আসতি পারবি কিনা তাই সগলরে ক? এমুন দাওয়াই শিহা আসপি যা খাইলি কাউরও ম্যালোয়ারী অবি না।”

বছির উত্তর করিল, “আমি ত ম্যালোয়ারী জ্বরের উপর গবেষণা করতিই বিলাত যাইতাছি। আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন সগল কাম হাছিল কইরা আসতি পারি। দ্যাশে আইসা অনেক কাম করতি হবি। এই গিরামে একটা ইস্কুল অবি। একটা হাসপাতাল অবি। আর অবি একটা কৃষি বিদ্যালয়। আরো অনেক কিছু করতি অবি। তার। আগে আমার বড় ঐতি অবি। অনেক টাহা উপার্জন কইরা তবে এই সব কামে হাত দিতি। অবি।”

গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাবা বছির! আমরা সগলে দোয়া করি তোমার মনের ইচ্ছা যেন হাসেল হয়।”

গ্রামের সকলে একে একে বিদায় হইয়া চলিয়া গেল। হুঁকো টানিতে টানিতে আজাহের ছেলেকে বলিল, “বাজান! আর কয়দিন পরে তোমার বিলাত যাইতি অবি?”

বছির উত্তর করিল, “আরও পনর দিন পরে আমাকে রওয়ানা ঐতি অবি।”

“বাজান! একটা কতা আমাগো মনের মদ্দি অনেকদিন দইরা আনাগোনা করতাছে। আইজ তোমারে কইবার চাই। মাতবরের ম্যায়া ফুলীরে ত তুমি জানই। আমাগো দুইজনের ইচ্ছা, ফুলীরে বউ কইরা গরে আনি। মাতবরেরও মনে বড় আশা।”

বছিরের মা সামনে বসিয়া বসিয়া সুতলী পাকাইতেছিল। সে কান পাতিয়া রহিল বছির কি উত্তর করে।

বছির বলিল, “বাজান! আমার জীবনডারে আগে গইড়া নিতি দ্যান। এহন আমি কাটার উপর দিয়া পথ চলতাছি। আপনারা জানেন না এই লেহাপড়া শিখতি আমারে কত দুস্কু কষ্ট সইতি ঐছে। আইজ আমার কাছে বিয়া করার কথা একটা হাসি-তামাসার মত মনে হয়।”

বছিরের মা বলিল, “বাবা বছির! তুই না করিস না। ফুলুরে গরে আইনা আমি .. আমার বড়র শোগ পাশরি। বড়র বড় আদরের সাথী ছিল ফুলু।”

বছির নত হইয়া উত্তর করিল, “মা! আমি যাইত্যাছি সাত সমুদ্র তের নদীর উপারে। বাজান যা কামাই করে তাতে তোমাগো দুইজনের খাওনই জোটে না। এর উপর আমার একটা বউ আইলে তারে তোমরা কেমন কইরা খাওন দিবা?”

আজাহের বলিল, “আমাগো কি খাওন দিবার শক্তি আছেরে বাজান? খাওন আল্লায় দিব।”

বছির উত্তর করিল, “না বাজান! আল্লায় খাওন দেয় না। মানুষের খাওন মানুষের জোগাড় কইরা নিতি অয়। তোমাগো পায়ে ধরি, তোমরা আর আমারে এ সগল কথা কইও না।”

আজাহের বুঝিল ছেলের এখন বিবাহ করিবার ইচ্ছা নাই। ছেলে লেখাপড়া শিখিয়াছে। বই পুস্তক পড়িয়া তার অনেক বুদ্ধি হইয়াছে। সে যাহা বুঝিয়াছে হয়ত তাহাই তাহার পক্ষে ভাল। তাই বউকে বলিল, “বছিরের মা! তুমি ওরে আর পীড়াপীড়ি কইর না। ও লেহাপড়া শিখ্যা মানুষ হয়া আসুক। তখন ওর বউ ও নিজেই বাইছা নিতি পারবি।”

রাত অনেক হইয়াছে। বছির শুইয়া পড়িল। মা বছিরের পাশে শুইয়া পাখার বাতাস করিতে লাগিল। ছেলে আর মাত্র পনরটা দিন তাহার কাছে থাকিবে। তারপর চলিয়া যাইবে সেই কত দূরের দেশে। সেখান হইতে কবে ফিরিতে পারিবে কে জানে? ছেলের ফেরার আগে যদি মায়ের মরণ হয়, তবে ত মরিবার আগে ছেলের মুখ দেখিতে পাইবে না! তবুও যাক–ওর জীবনের উদ্দেশ্য সফল করিয়া দেশে ফিরিয়া আসুক। ছেলেকে বাতাস করিতে করিতে মায়ের কত কথাই মনে পড়ে। ও যখন এতটুকু ছিল। শেষ রাত্রে জাগিয়া উঠিয়া খেলা করিত। তারা স্বামী স্ত্রী দুইজন ছেলের দুই পাশে বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত। ভাঙা ঘরের ফাঁক দিয়া চাঁদের আলো আসিয়া ছেলের মুখে পড়িত। ভাবিতে ভাবিতে মা স্বপ্ন দেখে বছির যেন আবার এতটুক হইয়া গিয়াছে। পাঠশালা হইতে ফিরিয়া আসিয়াই তাহার ঘরের মেঝেয় বসিয়া পিঠা খাইতেছে। তারপর সে বড় হইয়া শহরে গেল লেহাপড়া করিতে। কে যেন যাদুকর বছিরের বিগত জীবনের সমস্ত কাহিনী পুতুল নাচের ছবিতে ধরিয়া মায়ের চোখের সামনে মেলিয়া ধরিয়াছে।

পরদিন সকালে ভোরের পাখির কলকাকলীতে বছিরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। উঠিয়া মুখ হাত ধুইয়া বেড়াইতে বাহির হইবে এমন সময় ফুলী আসিয়া উপস্থিত। এতদিন সে ফুলীর চেহারার দিকে লক্ষ্য করে নাই। তার মৃত বোন বড়ুরই প্রতীক হইয়া সে তাহার মনের স্নেহধারায় সিঞ্চিত হইত। তাহা ছাড়া নানা অভাব-অভিযোগ, দৈন্য-অবহেলার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াই তাহার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়া গিয়াছে। কোন মেয়েকে সুন্দর বলিয়া দেখিবার সময় তাহার কখনো হয় নাই। সেই ছোটবেলা হইতে ফুলীকে যেমনটি দেখিত, তাহার মনে হইত সে যেন তেমনটিই রহিয়াছে। কাল পিতার নিকট ফুলীর সঙ্গে তাহার বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখান করিয়া আজ ফুলীকে সে নতুন দৃষ্টি লইয়া দেখিল।

মরি! মরি! কি লাবণ্যই না ফুলীর সারা দেহে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কে যেন দীঘির কলমী ফুলটি আনিয়া তাহার সুন্দর হাসিভরা মুখে ভরিয়া দিয়াছে। হলুদে আর লালে মেশান অল্প দামের শাড়ীখানা সে পরিয়া আসিয়াছে। সেই শাড়ীর আড়াল হইতে তার হলুদ রঙের বাহু দুইখানা যেন আকর্ষণের যুগল দুইখানা ধনু তাহার দিকে উদ্যত হইয়া রহিয়াছে। মুগ্ধ হইয়া বছির অনেকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। এই চাঁদ হয়ত আকাশ ছাড়িয়া আজ তাহার আঙিনায় আসিয়া খেলা করিতেছে। হাত বাড়াইলেই তাহাকে ধরা যায়; তাহাকে বুকের অন্ধকার ঘরের প্রদীপ করা যায়; কিন্তু বিলম্ব করিলে এই চাঁদ যখন আকাশে চলিয়া যাইবে, তখন শত ডাকিলেও আর ফিরিয়া আসিবে না। কিন্তু বছির এ কি ভাবিতেছে! তার জীবনের সম্মুখে যে সুদীর্ঘ পথ এখনও পড়িয়া রহিয়াছে। সে পথে কত বিপদ, কত অভাব-অনটন, তার গতিধারা সে ত এখনও জানে না। সে জীবন পথের যোদ্ধা। সংগ্রাম শেষ না হইলে ত তাহার বিশ্রাম লইবার ফুরসত হইবে না।

এই সরলা গ্রাম্য-বালিকার মনে সে যদি আজ তার প্রতি এতটুকুও আকর্ষণের ফুল ফুটিবার সুযোগ দেয় তবে যে জাহান্নামেও তার স্থান হইবে না।

ফুলী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, “কি বছিরবাই! কথা কও না ক্যান? কাল । রাইতিই আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবার আসত্যাছিলাম।”

বছির বলিল, “মা ওইখানে পাকের ঘরে আছে। যাও ফুলী। মার কাছে যাও।”

“তা তো যাবই বছিরবাই। কিন্তুক কাইল রাইতি আইলাম না ক্যান হেই কথাডা আগে কই। তোমার জন্যি আইজ ছয়মাস ধইরা একখানা কাঁথা সিলাই করত্যাছিলাম। আইজ সারা রাইত জাইগা এডারে শেষ করলাম। দেখত বছির বাই কেমন ঐছে?”

এই বলিয়া ফুলী তার আঁচলের তলা হইতে কাঁথাখানা মেলন করিয়া ধরিল। দেখিয়া বছির বড়ই মুগ্ধ হইল। কোন শিল্প বিদ্যালয়ের শিক্ষা পাইয়া এই গ্রাম্য মেয়েটি অঙ্কন পদ্ধতির সীমা-পরিসীমার (Proportion) জ্ঞান লাভ করে নাই। নানা রঙ সামনে লইয়া এ-রঙের সঙ্গে ওরঙ মিশাইয়া রঙের কোন নতুনত্বও সে দেখাইতে পারে নাই। ছেঁড়া কাপড়ের পাড় হইতে লাল, নীল, হলুদ ও সাদা–মাত্র এই কয়টি রঙের সূতা উঠাইয়া সে এই নক্সাগুলি করিয়াছে। শিল্প-বিদ্যালয়ের সমালোচকেরা হয়ত ইহার মধ্যে অনেক ভুলত্রুটি ধরিতে পারিবেন কিন্তু তাহার সাধারণ সৌন্দর্য অনুভূতি লইয়াই সে বুঝিল এমন শিল্পকার্য সে আর কোথাও দেখে নাই। কাঁথার মধ্যে অনেক কিছু ফুলী আঁকে নাই। শুধু মাত্র একটি কিশোর-রাখাল বাঁশী বাজাইয়া পথে চলিয়াছে। আর একটি গ্রাম্য-মেয়ে কাঁখে কলসী লইয়া সেই বাঁশী মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছে। পুকুরে কয়েকটি পদ্মফুল ভাসিতেছে। তাহাদের দলগুলির রঙে বংশীওয়ালার প্রতি সেই মেয়েটির অনুরাগই প্রকাশ পাইতেছে। বছির বুঝিল, তার জীবনের সুদীর্ঘ পথের কাহিনী বাঁশীর সুরে ভাসিয়া বহুকাল ধরিয়া ওই জল-ভরণ-উদ্যতা মেয়েটির অন্তরে প্রবেশ করিতেছে। তারই মনের আকুতি রূপ পাইয়াছে ওই চলন্ত মাছগুলির মধ্যে, ওই উড়ন্ত পাখিগুলির মধ্যে এই ক্ষুদ্র কাঁথার উপরে ফুলী এতগুলি নক্সা এবড়ো থেবড়ো ভাবে বুনোট করে নাই। যেখানে যে নকসাটি মানায়—যে রঙটি যে নকসায় শোভা করে সেই ভাবেই ফুলী কাঁথাখানি তৈরী করিয়াছে। আর সবগুলি নকসই বাঙালীর যুগ যুগান্তরের রস-সৃষ্টির সঙ্গে যোগ–সংযোগ করিয়া হাসিতেছে। বছির অনেক বড় বড় কেতাবে সূচিকার্য রূপান্তরিত রাফেলের ভুবন বিখ্যাত ছবিগুলির প্রতিচ্ছবি দেখিয়াছে। এখানে যাহারা সূচিকার্য করিয়াছে তাহারা বহু বৎসর সুদক্ষ শিক্ষকের অধীনে থাকিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছে। তাহাদের শিল্প কার্যে নিজস্ব কোন দান নাই। রাফেল যেমনটি আঁকিয়াছেন তাহারই অনুকৃতি করিয়াছে। কিন্তু এই অশিক্ষিতা পল্লী বালিকার নকসায় যে অপটু হাতের ভুলত্রুটি রহিয়াছে তাহারই গবাক্ষ পথ দিয়া মনকে শিল্পীর সৃজিত রসলোকে লইয়া যায়। সৃষ্টিকার্য মেয়েটি করিয়াছে শুধুমাত্র তাহারই জন্য। কতদিনের কত সুদীর্ঘ সকাল দুপুরে সূক্ষ শুই ধরিয়া একখানা মূক-কাপড়ের উপর সে তাহার অনুরাগের রঙ মাখাইয়া দিয়াছে। জীবনে বহু ভাগ্যের অধিকারী না হইলে এই। অপূর্ব দানের উপযুক্ত হওয়া যায় না। তবু এই দানকে তাহার প্রত্যাখান করিতে হইবে। এই সরলা পল্লী-বালিকার মনে তাহার প্রতি যে অনুরাগের রঙ লাগিয়াছে তাহা নিষ্ঠুর হাতে মুছিয়া যাইতে হইবে। নতুবা পরবর্তী জীবনে এই ভোরের কুসুমটি যে দুঃখের অগ্নিদাহনে জ্বলিবে, তাহার হাত হইতে কেহই তাহাকে নিস্তার করিতে পারিবে না।

ফুলী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল,”বছির বাই! আমার কাঁথাখানা কেমন ঐছে কইলা না ত?”

বছির বলিল, “মন্দ হয় নাই। এখানা তুমি যত্তন কইরা রাইখ। একদিন কামে দিবি।”

এ কথা শুনিয়া ফুলীর মনটা কেমন করিয়া উঠিল। সে আশা করিয়াছিল বছির তাহার এত যত্নে তৈরী করা কথাখানা পাইয়া কতই না উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহা গ্রহণ করিবে। সেবার একখানা রুমালের উপর মাত্র একটা ফুল তুলিয়া ফুলী তাহাকে দিয়াছিল। তাই পাইয়া বছিরের কত আনন্দ। সে শহরে যাইয়াও বন্ধু-বান্ধবদের তাহা দেখাইয়া বলিয়াছে, আমার বোন এই ফুলটি করিয়া দিয়াছে। সেই খবর আবার বছির বাড়ি আসিয়া তাহাকে শুনাইয়াছে। কিন্তু এতদিন ভরিয়া যে কথাখানা সে এত সুন্দর করিয়া তৈরী করিয়াছে, যাহা দেখিয়া পাড়ার সকলেই তাহাকে কত প্রশংসা করিয়াছে–সেই কথাখানা দেখিয়া বছির ভাই কিনা বলিল–মন্দ হয় নাই।

ম্লান হাসিয়া ফুলী বলিল, “আমি কেন তোমার কথাখানা যত্তন কইরা রাখতি যাব? তোমার জন্যি বানাইছি। তোমার যদি মনে দরে যা খুশী তাই কর এটা নিয়া।” বলিতে। বলিতে ফুলী প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল।

কিন্তু বছিরকে আজ নিষ্ঠুর হইতেই হইবে। কিছুতেই সে তার মনের দৃঢ়তা হারাইবে না।

সে বলিল, “আমি ত কয়দিন পরে বিলাত চইলা যাব। তোমার কথা দিয়া করব কি? সে দ্যাশের লোক এটা দেখলি হাসপি ঠাট্টা করবি।”

ম্লান মুখে ফুলী কাঁথাখানা গোটাইয়া ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। বছিরের মা বলিল, “ও ফুলী! এহনই আইলি আর চইলা গেলি। আয়-আয় হুইনা যা।” ফুলী ফিরিয়াও চাহিল না।

ফুলীর চলিয়া-যাওয়া পথের দিকে বছির চাহিয়া রহিল। তাহার প্রতিটি পদাঘাতে সে যেন বছিরের মনে কোন অসহনীয় বিষাদের কাহিনী লিখিতে লিখিতে তাহার দৃষ্টির আড়ালে চলিয়া গেল। কিন্তু ইহা ছাড়া বছির আর কিইবা করিতে পারিত। তবু ফুলীর সুন্দর মুখোনি কে যেন রঙিন তুলি দিয়া তার মনের পটে আঁকিয়া দেয়। সেই ছবি সে জোর করিয়া মুছিয়া ফেলে কিন্তু আরও উজ্জ্বল হইয়া–আরও জীবন্ত হইয়া সেই ছবি আবার তাহার মনের-পটে আঁকিয়া ওঠে। এ যেন কোন চিত্রকর জোর করিয়া তাহার মনের-পটে নানা চিত্র আঁকিতেছে। তাহাকে থামাইতে গেলেও থামে না।

কলমী ফুলের মত সুন্দর মেয়েটি ফুলী! গ্রামের গাছপালা লতা-পাতা তাদের গায়ের যত মায়া-মমতা সব দিয়া যেন তাহার সুন্দর দেহটিকে আরও পেলব করিয়া দিয়াছে। বনের পাখিরা দিনের পর দিন এ-ডালে ও-ডালে গান গাহিয়া তার কণ্ঠস্বরটিকে আরও মিষ্ট করিবার শিক্ষা দিয়াছে। তার সারা গায়ে রঙ মাখাইয়াছে সোনালতা। রঙিন শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে সেই রঙ যেন ঈষৎ বাহির হইয়া আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া যায়। যে পথে দিয়া সে চলে সে পথে সেই রঙ ঝুমঝুমি হইয়া বাজিতে থাকে।

এই ফুলীকে সে যেন কোনদিনই দেখে নাই। ও যেন গাজীর গানের কোন মধুরতর সুরে রূপ পাইয়া তাহার সামনে আসিয়া উদয় হইয়াছিল। রহিমদ্দী চাচার সেই গানটি আজ বার বার বছিরের কণ্ঠ হইতে কোন সাত সাগরের কান্না হইয়া বাজিয়া উঠিয়াছিল।

‘ও আমি স্বপ্নে দেখলাম
মধুমালার মুখহে।’

এই মধুমালাকে পাইবার জন্য সে সপ্তডিঙা মধুকোষ সাজাইয়া সাত সাগরে পাড়ি দিবে–কত পাহাড়-পর্বত ডিঙাইবে–কত বন-জঙ্গল পার হইবে। মধুমালা! মধুমালা! মধুমালা! যেমন করিয়াই হোক এই মধুমালাকে সে লাভ করিবেই করিবে। কিন্তু তার জীবনের যে সুদীর্ঘ পথ এখনও পড়িয়া রহিয়াছে। দেবলোক হইতে অমৃত আনিয়া যে তাহার দেশবাসীকে অমর করিয়া তুলিতে হইবে। শত শত মূঢ় ম্লান মুক মুখে ভাষা ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। যুগে যুগে যাহারা বঞ্চিত হইয়াছে–নিপীড়িত হইয়াছে–শোষিত হইয়াছে, তাহারাই আজ মূর্ত হইয়া আছে তার পিতার মধ্যে, তার মায়ের মধ্যে, তার শত শত গ্রামবাসীদের মধ্যে। স্বর্গ হইতে বিদ্যার অমৃত আনিয়া যে তাহাদিগকে মৃত্যুর হাত হইতে–পীড়নের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইবে। তবু ফুলী! ফুলী! আমার সোনার ফুলী! তোমাকে বছির ভূলিতে পারে না। সরলা কিশোরী বালিকা। যৌবনের ইন্দ্রপুরী আজ তার সম্মুখে তোরণদ্বার সাজাইয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। মরি! মরি! কি সুন্দর রূপ! তার সুন্দর দেহের সারিন্দা হইতে কোন অশরীরী সুরকার দিন রজনীর দু’খানা পাত্র ভরিয়া কোন অনাহুত সুরের মদিরা চারিদিকে ছড়াইয়া দিতেছে। ফুলী! ফুলী–আমার সুন্দর ফুলী! সরষে খেত রচনা করিব আমি তোমার গায়ের বর্ণ ফুটাইতে। পাকা পুই-এর রঙে তোমার অধরের লালিমা ধরিয়া রাখিব। কলমী ফুলের রঙিন পাত্রে তোমার হাসিখানি ভরিয়া দেখিব। ফুলী! ফুলী! তুমি আমার! তুমি আমার! আকাশের চঁদ তুমি মাটির আঙিনায় নামিয়া আসিয়াছ। হাত বাড়াইলেই তোমাকে ধরিতে পারি। আর তোমাকে আকাশে ফিরিয়া যাইতে দিব না।

না–না–না, এ কি ভাবিতেছে বছির? জীবনের পথ যে আরও–আরও দুর-দুরান্তরে বাঁকাইয়া গিয়াছে? এ পথের শেষ অবধি যে তাহার্কে যাইতে হইবে? একটা মেয়ের মোহে ভুলিয়া সে তার জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিবে? তাই যদি হয় তবে এতদিন কষ্ট করিয়া অনাহারে থাকিয়া আধপেটা খাইয়া সে কেন এত তপস্যা করিয়াছে? বড়র কবরে বসিয়া সে যে তার দেশবাসীর কাছে নিজেকে উৎসর্গীকৃত করিয়াছে। সে কে? তার নিজস্ব বলিতে ত সে নিজের কিছুই রাখে নাই। আনন্দ বিশ্রামের সুখ, নিদ্রার স্বপ্ন সবকিছু যে তার আদর্শবাদের কাছে উৎসর্গীত। তার সেই বিপদসঙ্কুল দুঃখ-দৈন্য অভাবময় জীবনের সঙ্গে এই সরলা গ্রাম্য বালাকে সে কিছুতেই যুক্ত করিয়া লইবে না।

তবু ফুলু-ফুলের মত ফুলুর মুখখানা বছিরের মনে ভাসিয়া ওঠে। না-না এ কখনো হইতে পারিবে না। যেমন করিয়া বছির অনাহার জয় করিয়াছে, নানা লোকের অপমান অত্যাচার সহ্য করিয়াছে, তেমনি করিয়া সে আজ ফুলর চিন্তা তাহার মন হইতে মুছিয়া ফেলিবে। বার বার বছির তার বিগত দিনগুলির কথা চিন্তা করে। তারা যেন শক্তি-উদ্দীপক মন্ত্র। সেই মন্ত্রের জোরে সে সম্মুখের ঘোর কূজাটি পথ অতিক্রম করিয়া। যাইবে।

পরদিন সকালে বছির বড়ুর কবরে আসিয়া দেখিল, কোন্ সময় আসিয়া ফুলু তাহার রঙিন কাঁথাখানা ঘরের উপর মেলিয়া দিয়া গিয়াছে। সে যেন তার মনের সকল কথা এই কথার উপর অঙ্কিত করিয়া গিয়াছে। এই পল্লী-বালার যে অনুরাগের নিদর্শন বছির গ্রহণ করে নাই তাই যেন সে কবরের তলায় তার ঘুমন্ত বোনটির কাছে জানাইয়া দিয়া গিয়াছে। সেই মেয়েটির কাছে জানাইয়া গিয়াছে হাসি খেলায় যে তার সব সময়ের সঙ্গিনী ছিল, যার কাছে সে তার মনের সকল কথা বলিতে পারিত।

কাঁথাখানির দিকে চাহিয়া আবার ফুলুর সুন্দর মুখোনির কথা বছিরের মনে পড়িল। কিন্তু কিই বা সে করিতে পারে? তাহার জীবন-তরী যে কোন গাঙে যাইয়া কোথায়। ভিড়িবে সেই অনিশ্চিতের খবর সে নিজেও জানে না। সেঁতের শেহলার মত সে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। সেই সুদূর লণ্ডন শহরে যাইয়া সে নিজে উপার্জন করিয়া পড়াশুনার খরচ চালাইবে। সেখানে কত অভাব, কত দৈন্য, কত অনাহার তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এই জীবন সংগ্রামে সে টিকিয়া থাকিবেনা পথের মধ্যেই কোথাও শেষ হইয়া যাইবে তাহাই বা কে বলিতে পারে? আহা! এই সরলা গ্রাম বালিকা! একে সে তার সংগ্রাম-বহুল জীবনের সঙ্গে কিছুতেই জড়াইবে না। ফুল–আমার সোনার ফুল? তুমি আমাকে ক্ষমা করিও। হয়ত তোমাকে ব্যথা দিয়া গেলাম, কিন্তু তোমার ব্যথার চাইতেও অনেক ব্যথা আমি আমার অন্তরে ভরিয়া লইয়া গেলাম।

ভাবিতে ভাবিতে বছিরের মনে ছবির পর ছবি উদয় হয়। কোন গ্রাম্য-কৃষাণের ঘরে যেন ফুলুর বিবাহ হইয়াছে। কলা পাতায় ঘেরা ছোট্ট বাড়িখানি। খড়ের দু’খানা ঘর। তাহার উপরে চালকুমড়ার লতা আঁকিয়া বাকিয়া তাহারই মনের খুশীর প্রতীক হইয়া যেন এদিক ওদিক বাহিয়া চলিতেছে! দুপুরে সুগন্ধি আউস ধানের আঁটি মাথায় করিয়া তাহার কৃষাণ স্বামী বাড়ি ফিরিবে। লেপা-পোছা আঙিনায় তাহার মাথার বোঝা নামাইয়া হাতে বোনা রঙিন পাখা দিয়া সে তাহাকে বাতাস করিবে। মরাই-ভরা ধান-গোয়াল-ভরা গরু। বারো মাসের বারো ফসল আসিয়া তাহার উঠানে গড়াগড়ি করিবে। সন্ধ্যাবেলা আঁকা বাঁকা গেঁয়ো পথ দিয়া কাখে কলস লইয়া সে নদীতে জল আনিতে যাইবে। ধানের ক্ষেতের ওধার দিয়া কোড়াকুড়ী ডাকিয়া দিগদিগন্ত মুখর করিবে। পাট ক্ষেতের মাঝখান দিয়া যাইতে সে ক্ষণেক পঁড়াইয়া একগুচ্ছ বৌটুনী ফুল তুলিয়া খোঁপায় গুজিবে। তারপর গাঙের ঘাটে যাইয়া ও-পাড়ার সম-বয়সিনী বউটির সঙ্গে দেখা হইবে। দুইজনের কারো কথা যেন ফুরাইতে চাহিবে না। হয়ত বিগত রাতের কোন সুখ স্বপ্নের কথাযা ভাষায় প্রকাশ করা। যায় না; আকারে ইঙ্গিতে একের কথা অপরে বুঝিতে পারে। তারপর ভরা কলস কাঁখে করিয়া ঘরে ফিরিতে পথের মধ্যে কোথাও কার্যরত তাহার কৃষাণ স্বামীর সঙ্গে দেখা হইবে। চকিতে তাহাকে একটি চাহনী কুস উপহার দিয়া সে ত্বরিতে ঘরে ফিরিবে! আহা! এই স্বপ্ন যেন ফুলুর জীবনে নামিয়া আসে! এই সুখ-স্বর্গ হইতে বছির কিছুতেই এই মেয়েটিকে নামাইয়া আনিয়া তাহার দুঃখময় জীবনের সঙ্গে গ্রথিত করিবে না। নানা-না, কিছুতেই না।

.

৪০.

আজ তিন চার দিন বছির বাড়ি আসিয়াছে। সেই যে সেদিন নিজের বোনা কথাখানা গোটাইয়া লইয়া ফুলী চলিয়া গিয়াছে আর সে ফিরিয়া আসিয়া বছিরের সঙ্গে দেখা করে নাই।

সেদিন বিকালে বছির কি একখানা বই খুলিয়া বসিয়া আছে। এমন সময় ফুলী আসিয়া ঘরের দরজা ধরিয়া দাঁড়াইল। বই-এর মধ্যে বছির এমনই মশগুল, সে চাহিয়াও দেখিল না কে আসিয়াছে। বৃথাই ফুলী দুই হাতের কাঁচের চুড়িগুলি নাড়িল চাড়িল। পরনের আঁচলখানা মাথা হইতে খুলিয়া আবার যথাস্থানে বিন্যস্ত করিল। বছির ফিরিয়াও চাহিল না। তখন যেন নিরুপায় হইয়াই ফুলী ডাকিল, “বছিরবাই!”

বছির বই-এর মধ্যেই মুখ লইয়া বলিল, “ফুলী! তুমি মার সঙ্গে যায়া কথা কও। আমি এহন খুব দরকারি একখানা বই পড়ত্যাছি।”

ফুলীর ইচ্ছা করিতেছিল বলে, “বছিরবাই! তুমি এমন নিষ্ঠুর ঐলা ক্যান? এবার বাড়ি আইসা আমার সঙ্গে একটাও কথা কইলা না। কও ত আমি তোমার কাছে কি অপরাধ করছি?” ভাবিতে ভাবিতে দুই চোখ পানিতে ভরিয়া আসে। তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছিয়া ফুলী যেন মরিয়া হইয়াই বলিল, “বছিরবাই! চল তোমারে সঙ্গে কইরা বড়ুর কবরে যাই। তার কবরের উপর আমি যে কুলের গাছে সোনালী লতা দিছিলাম না? সমস্ত গাছ বাইয়া গ্যাছে সেই লতায়?”

বই-এর মধ্যে মুখ লুকাইয়া বছির উত্তর করিল, “নারে! আমার সময় নাই। তুই এখন যা। আমার একটা খুব জরুরী বই পড়তি ঐত্যাছে।”

ফুলী আবার বলিল, “মা তোমারে যাইবার কইছে। তুমি না ঢ্যাপের খই-এর মোয়া পছন্দ কর। তোমার জন্যি মা খাজুইর‍্যা মিঠাই দিয়া ঢ্যাপের মোয়া বাইন্দা রাখছে!”

বছির তেমনি বই-এর মধ্যে মুখ লইয়াই বলিল, “চাচীরে কইস, আমার সময় নাই। কাল-পরশু আমারে চইলা যাইতি অবি। আমার কত কাম পইড়া রইছে।”

বছিরের কথাগুলি যেন কঠিন ঢেলার মত ফুলীর হৃদয়ে আসিয়া আঘাতের পর আঘাত হানিল।

বহু কষ্টে কান্না থামাইয়া সে ধীরে ধীরে সেখান হইতে সামনের বনে যাইয়া প্রবেশ করিল। পাকা ডুমকুর খাইতে বছির খুব ভালবাসে। সেই ডুমকুর দিয়া একছড়া মালা গাথিয়া সে বছিরের জন্য আনিয়াছিল। তাহা সে ছিঁড়িয়া কুটি কুটি করিয়া বনের মধ্যে ইতস্তত : ফেলিয়া দিল। আঁচলে বাধিয়া কয়েকটি পাকা পেয়ারা আনিয়াছিল। তাহা সে পা দিয়া চটকাইয়া ফেলিল।

আজ কত পরিপাটী করিয়া সে চুল বাধিয়া খোঁপায় একটি কুমড়ার ফুল খুঁজি। দিয়াছিল। তাহা সে খোঁপা হইতে খুলিয়া দূরে ছুঁডিয়া ফেলিয়া দিল। বাড়ি হইতে আসিবার সময় সে পাকা পুঁই দিয়া দুটি হাত রাঙা করিয়াছিল। এখন সেই হাতে চোখের পানি মুছিতে মুছিতে সে রঙ ধুইয়া গেল।

বার বার তার বালিকা-মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হইল!–কেন এমন হইল! কি করিয়াছে ফুলী যার জন্য তার এত আপনার বছিরভাই পাষাণ হইয়া গেল? কি অপরাধ করিয়াছে সে? কে তাহাকে এ কথার জবাব দিবে?

গ্রাম্য চাষী-মোড়লের ঘরের আদুরে মেয়েটি সে। ছোটকাল হইতেই অনাদর কাকে বলে জানে না। বছিরের এই অবহেলায় তার বালিকা-হৃদয়খানিকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দিল। তবু বছিরের কথা ভাবিতে কেন যেন লজ্জায় ফুলুর মুখোনি রাঙা হইয়া ওঠে। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি জাগে। অলক্ষিতে সে যে বছিরকে ভালবাসিয়াছে এ কথা পোড়া মুখী নিজেও জানে না। তাহাদের পাড়ায় তারই সমবয়সিনী কত মেয়েকে সে দেখিয়াছে। বাপ মা যাহার সঙ্গে বিবাহ দিয়াছে, শাড়ী গহনা পরিয়া সে তাহারই ঘর করিতে গিয়াছে। ভালবাসা কাহাকে বলে তাহাদের গ্রামে কোন মেয়ে ইহা জানে না। কোন বিবাহিতা মেয়ের কাছেও সে ভালবাসার কথা শোনে নাই। এ-গায়ে ও-গায়ে কৃচিৎ দুএকটি মেয়ে স্বামীর ঘর ছাড়িয়া অপরের সঙ্গে বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহাদিগকে সকলেই কুলটা বলিয়া গালি দিয়াছে। ভালবাসার কথা সে কোনদিন কাহারো মুখে শোনে নাই।

বছিরভাই তাহাকে অবহেলা করিয়াছে। তাহাতে তাহার কি আসে যায়? সেও আর বছিরভাইর নাম মুখে আনিবে না। কিন্তু এ কথা ভাবিতে কোথাকার সাত সাগরের কান্নায় তার বুক ভাসিয়া যায়। কি যেন তাহার সর্বনাশ হইয়াছে! কোথায় যেন তার কত বড় একটা ক্ষতি হইয়াছে! সে ক্ষতি হয়ত সারা জীবনেও আর পূরণ হইবে না! কিন্তু কিসের ক্ষতি হইয়াছে, কে সেই ক্ষতি করিয়াছে কিছুই সে বুঝে না। বন-হরিণীর মত বনের এ পথে সে পথে সে ঘুরিয়া বেড়াইল। তারপর বড়র কবরের পাশে আসিয়া কান্দিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। এই কবরের মাটির মতই সে মূক। তাহার বেদনার কথা পৃথিবীর কেহই কোনদিন জানিবে না। তাই এই কবরের মূক-মাটির উপর বসিয়া সে অঝোরে কাঁদিতে লাগিল।

কিন্তু মূক-মাটি কথা কহে না। মাটির তলায় যে ঘুমাইয়া আছে সেও কথা কহে না।

বড়ু! তুই আর কত কাল ঘুমাইবি? তুই–শুধু তুই আমার কথা বুঝিতে পারিবি। মাটিতে মাথা ঘসিয়া ঘসিয়া ফুলী সমস্ত কপাল ক্ষত-বিক্ষত করিয়া ফেলিল। এ মাটি কথা বলে না। তবু এই মাটির কবরের উপর বসিয়া কাদিতে তাহার ভাল লাগে। মাটি যেন তাহাকে চেনে। বড় শীতল এই মাটি। তার বুকে বুক মিশাইলে বুক জুড়াইতে চাহে।

“মাটি! তুই আমারে জায়গা দে। যেখানে বড় ঘুমাইয়া আছে তারই পাশে আমাকে স্থান দে। আমরা দুই বন্ধুতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া বছিরভাইর স্বপ্ন দেখিব। হয়ত মাঝে মাঝে বছিরভাই এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে। আমার কথা মনে করিয়া আসিবে না। কিন্তু বড়ু! তোকে সে কোনদিন ভুলিবে না। তোর কথা মনে করিয়া সে যখন এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে, কবরের ঘুমে বসিয়া আমি তার চাঁদ মুখখানা দেখিতে পাইব। বড়–আমার পরানের সখি বড়–তুই আমারে সঙ্গে নে।”

.

৪১.

বছির এখনই লণ্ডনের পথে রওয়ানা হইবে! আজাহেরের উঠানে ভর্তী লোক। ভাসান চর হইতে আরজান ফকির আর তার স্ত্রী আসিয়াছে। আলীপুর হইতে রহিমুদ্দীন কারিকর আসিয়াছে। গরীবুল্লা মাতবর, মিঞাজান, তাহের, গ্রামের সকল লোক আসিয়া আজাহেরের উঠানখানা ভর্তী করিয়া ফেলিয়াছে। বছির সকলকে সালাম জানাইয়া বলিল, “আমি আইজ নিরুদ্দেশের পথে রওয়ানা ঐলাম। আপনারা দোয়া করবেন, ফিরা আইসা যেন আপনাগো খেদমত করতি পারি।”

গণশা আওগাইয়া আসিয়া বলিল, “ভাই-বছির! হেই কথা যিনি মনে থাহে। তুমি আইসা এমুন একটা স্কুল বানাইবা যেহানে মাষ্টারের মাইর থাকপি না।”

বছির বলিল, “গণেশভাই! তোমার কথা আমার মনে আছে। তুমি আমার পরথম গুরু। তুমি আমার মনে বড় হওয়ার আশা জাগাইয়া দিছিলা। আল্লায় যদি আমারে দ্যাশে ফিরাইয়া আনে, তোমার মনের মত একটা ইস্কুল আমি গইড়া তুলব।”

তারপর বছির আরজান ফকিরের পদধুলি লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ফকির সাহেব। তুমি ত আইজ আমারে কুনু কথা কইলা না?”

আরজান ফকির তাহাকে দোয়া করিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, “বাজানরে! মনের কথা কি মুহে কওন যায়? বুকের কথা বুকের মদ্দি ভইরা দিতি

অয়। এতদিন তোমারে আমার ঘরে রাইখা আমার যত কথা সারিন্দার সুরি সুরি তোমার বুকের মদ্দি ভইরা দিছি। সে কথার ফুল ফোটে–সে কথার ফল ধরে। সেই ফলের আশায়ই আমি বইসা থাকপ যতদিন তুমি ফিরা না আস।”

বছির বলিল, “বুঝতি পারলাম ফকিরসাব! এতদিন তোমার বাজনা আর গান শুইনা তোমার গায়ালী সব কিছুর উপর আমার মনের ভালবাসা জাগায়া দিছাও। আমি যদি শক্তিবান হয়া ফিরতি পারি, তখন এমন দিন ডাইকা আনব, যহন তোমার হাতের সারিন্দা আর কেউ ভাঙতি পারবি না। তোমার গায়ালী গান, নকসা যা কিছু গাওগেরামের বাল সেগুলাকে উপরে তুইলা ধরব।”

ফকির উত্তর করিল, “বাজান! গল্পে শুনছি অসুর কুলির এক ছেলে দেবতাগো দ্যাশে যায়া অমরত লয়া আইছিল। তেমনি তোমারে পাঠাইলাম সেই দূরদেশে। আমরা সব মইরা গেছি। সেইহানগুনা অমরত আইনা আমাগো সগলরে তুমি বাঁচাইবা। তুমি একা বড় ঐলে ত চলবি না বাজান! আমাগো সগলরে তোমার মত বড় বানাইতি অবি।”

গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাবা বছির! তুমি যতদিন ফিরা না আইবা আমরা তোমার পথের দিগে চায়া থাকপ। আর মনে করব, তুমি ফিরা আইসা আমাগো সগল দুষ্ণু দূর করবা। বাজানরে! আমরা বোবা। দুস্কের কথা কয়া বুঝাইতি পারি না। তাই আমাগো জন্যি কেউ কান্দে না। তোমারে আমরা আমাগো কান্দার কান্দুইনা বানাবার চাই। এই গিরাম ঐল কাটার শয্যা। এই হানে আইসা তোমারে বেগুম রাইত কাটাইতি অবি। আমরা মরা। আমাগো বাঁচাইতি ঐলি তোমারে এহানে আইসা মরার আগে মরতি অবি। মান সম্মান ইজ্জত সব কিছু ছাইড়া আমাগো সাথে মাটির উপর আইসা বসতি অবি।”

সামনে ফকির-মা বসিয়াছিল। তাহার কাছে যাইয়া সালাম করিতে ফকির মার দুইটি চোখ অশ্রুতে ভরিয়া গেল। বছির সকলকে দেখাইয়া বলিল, “এই আমার ফকির মা। পশ্চিমা যেমন ঠোঁটের আধার দিয়া বাচ্চাগো পালন করে তেমন কইরা নিজে না খায়া এই মা আমারে খাওয়াইছে।”

ফকির মা বলিল, “আমার গোপাল! আমার যাদুমণি! তুমি স্বর্গপুরী থইনা আমার ভাঙা ঘরে আইসা উদয় হৈছিলা। আজ মায়ের কোল ছাইড়া তুমি গোচারণ চইলা যাও। আমি পথের দিকে চায়া থাকপ কতক্ষণে আমার গোপাল ফিরা আসে।”

একে একে সকলেই বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। বছিরের কেবলই ইচ্ছা করিতেছিল যাইবার আগে একবার ফুলুর রাঙা মুখোনি দেখিয়া যায়। সেই যে সেদিন ফুল চলিয়া গিয়াছে, অভিমানী মেয়ে আর ফিরিয়া আসে নাই। তাহার অবহেলা না জানি তাকে কতইনা আঘাত করিয়াছে। যাইবার আগে তাহাকে দুইটি মিষ্টি কথা বলিয়া গেলে হয় না? কাছে ডাকিয়া আগের মত বোনটি বলিয়া একটু আদর করিয়া গেলে চলে না? কিন্তু তা করিতে গেলে হয়ত তাহার বালিকা-মনে বছির যে আশঙ্কা করিতেছে, সেই ভালবাসার অঙ্কুর রোপণ করিয়া যাইতে হইবে। অভাগিনী ফুলুর সারাটি জীবন হয়ত তাহাতে ব্যর্থ হইয়া যাইবে।

বছির কি শুধু ইহাই ভাবিতেছিল? নিজের মনের দুর্বলতার কথা কি তাহার মনে পড়িতেছিল না? কলমী ফুলের মত লাল টুকটুকে মুখ ফুলীর! আবার যদি সে দেখে তার জীবনের সকল সঙ্কল্পের কথা সে ভুলিয়া যাইবে। না-না ইহা কখনো হইতে পারিবে না। কঠোর হইতে কঠোরতর তাহাকে হইতে হইবে।

কিন্তু এমন হইতে পারে না? তাহা দেশে আসিয়া ফুলুকে সঙ্গে করিয়া সে নতুন সংসার পাতিবে।….উঠানের উপর ফুল এ-কাজে ওকাজে ঘুরিবে; উঠান ভরিয়া কলমী ফুল ছড়াইয়া যাইবে। রান্নাঘরে পাটাপুতা লইয়া সে হলুদ বাটিবে। তাহার গায়ের রঙের সঙ্গে আড়াআড়ি করিয়া পাটা ভরিয়া হলুদের রঙ ছড়াইবে। না–না–না। একি ভাবিতেছে। বছির? আজ সে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াইতেছে। তাহার জীবনের বড় হওয়ার ক্ষুধা এখনো মেটে নাই। এখনও তার অথই গাঙের তরী পাড়ের ঘাটে আসিয়া ভেড়ে নাই। এসব সুখের কথা তাহার ভাবিতে নাই। তবুও একবার যদি ফুলুর সঙ্গে দেখা হইত! সেই লাল নটে পাতার মত ডুগুডুগু মেয়েটিকে যদি আর একবার সে চোক্ষের দেখা দেখিয়া যাইতে পারিত; সেই স্বপ্ন চক্ষে পুরিয়া বছির তার ভবিষ্যতের অনিশ্চিত দিনগুলিকে রঙিন করিয়া লইতে পারিত। কিন্তু তাহা যে হইবার নয়।

যাইবার আগে বছির বড়ুর কবরের পাশে আসিয়া বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। ফুলু কবরের মাটিতে মাথা খুড়িয়া ফেঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে।

ধীরে ধীরে যাইয়া বছির ফুলুর হাত দুইখানা ধরিয়া তাহাকে উঠাইল। তারপর তাহার মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “ফুল! আমার সোনা বইন! আমি জানি সেদিন তোমারে অবহেলা কইরা তোমার মনে আমি বড় ব্যথা দিছি। কিন্তুক একথা জাইন বইন। তোমার ভালর জন্যিই আমারে অমন করতি ঐছে। আমি দোয়া করি। তোমার জীবন যেন সুখের হয়। এই কথা মনে রাইখ, তোমারে যে দুস্ক, আমি দিয়া গেলাম তার চাইতে অনেক দুস্ক আমি আমার মনের মদ্দি ভইরা লয়া গেলাম।”

কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলু বলিল, “বছিরবাই! তোমার পায়ে পড়ি। আমার ভালর কথা তুমি আর কইও না। তুমি এহন যাও। আমারে মনের মত কইরা কানতি দাও। কবরে যে ঘুমায়া আছে সেই একজন ক্যাবল আমার কান্দন শুনতি পায়।”

এই বলিয়া ফুলী কাঁদিয়া ভাঙিয়া পড়িল।

অনেক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বছির সেখান হইতে চলিয়া গেল।

আহা! এই বনের হরিণী! ওকে কাঁদিতে দাও। বুকের বোবা কাহিনী যাহার কহিবার ভাষা নাই, সে যদি কাঁদিয়া কিছুটা সান্ত্বনা পায় তাহাকে কাঁদিতে দাও!

–সমাপ্ত–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *